কাইন্ডার্ড বাই চয়েস (উপন্যাস)

কাইন্ডার্ড বাই চয়েস (উপন্যাস)

প্রথম খণ্ড

প্রথম পরিচ্ছেদ

এডওয়ার্ড হচ্ছে জনৈক ব্যারন বা সামন্ত যুবকের নাম। এপ্রিলের কোনও এক বিকেলে সে তার ফুলবাগানে কাজ করছিল একা একা। তার কাজ শেষ হয়ে যেতেই বাগানের মালী তার কাছে এল। তাকে দেখে এডওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করল, আমার স্ত্রী এখন কোথায়, তাকে দেখেছ? 

মালী বলল, ওই ওখানে, নতুন বাড়ির মাঠে। প্রাসাদের উল্টোদিকে যে বাড়িটা তিনি করেছিলেন তার কাজ শেষ হয়ে গেছে। বাড়িটা সত্যিই আপনার ভালো লাগবে। কাজেই গাঁ, ওপর থেকে দেখতে পারেন। একটু ডানদিকে চার্চ। উল্টোদিকে এই প্রাসাদ আর বাগান। 

এডওয়ার্ড বলল, হ্যাঁ, আমি লোকজনদের কাজ করতে দেখেছি। 

মালী উৎসাহিত হয়ে বলল, বাড়িটার ডানদিকে একটা ছায়াঘেরা প্রান্তর উপত্যকায় গিয়ে মিশে গেছে। পাহাড়ে যাবার পথটা বড় চমৎকারভাবে নির্মাণ করা। গিন্নীমার সত্যিই বড় সূক্ষ্ম রুচিবোধ আছে। 

এডওয়ার্ড বলল, এখন তাকে গিয়ে বলল, নতুন বাড়িটা আমি নিজে গিয়ে দেখতে চাই। 

মালী ব্যস্ত হয়ে চলে গেল। মালী চলে গেলে এডওয়ার্ড একাই বাগান থেকে পুরনো প্রাসাদটাকে ফেলে রেখে নতুন বাড়িটাতে চলে গেল। তার স্ত্রী শার্লোতে তারই জন্য অপেক্ষা করছিল। শার্লোতে তাকে সঙ্গে করে উপরতলায় এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেল যেখান থেকে চারদিকের দৃশ্য সব দেখা যাবে। 

সেখান থেকে চারদিকে খুঁটিয়ে দেখে সত্যিই খুশি হলো এডওয়ার্ড। বলল, সত্যি চমৎকার। তবে একটি ত্রুটি আছে। বাড়িটার আয়তন ছোট হয়ে গেছে। 

শার্লোতে বলল, কিন্তু আমরা তো মাত্র দুজন প্রাণী। বেশি জায়গার দরকার কি? তাছাড়া এখানে দুজন ছাড়া আরও বেশি কিছু লোক ধরবে। 

এডওয়ার্ড শান্ত কণ্ঠে বলল, দেখো, একটা কথা তোমাকে কদিন থেকে বলব ভাবছি, কিন্তু বলতে পারিনি। কিন্তু আজকের ডাকে একটা চিঠি পেয়ে আর না বলে পারছি না। 

শার্লোতে বলল, আমিও এই রকম একটা কিছু লক্ষ্য করছি। কিন্তু কথাটা কি?

এডওয়ার্ড বলল, কথাটা আমাদের বন্ধু সেই ক্যাপ্টেনকে নিয়ে। তার এখন সত্যি বড় দুরবস্থা। তার মতো প্রতিভাবান কৃতিসম্পন্ন লোকের এইরকম অকর্মণ্য হয়ে পড়াটা 

সত্যিই বড় দুঃখজনক। আমার কথা হলো এই যে ওকে আমরা এই বাড়িতে কিছুদিন রাখতে চাই 

শার্লোতে শান্ত অথচ দৃঢ়কণ্ঠে বলল, এ ব্যাপারটা কিন্তু একাধিক দিক থেকে ভেবে দেখতে হবে। 

এডওয়ার্ড বলল, তার শেষ চিঠিখানিতে একটা চাপা অসন্তোষ ছিল। তবে যে কোনও কিছুর অভাব আছে তা নয়। আমার কাছ থেকে কোনও সাহায্য নিতেও সে অরাজি নয়। তা হবার কথা নয়। কারণ আমাদের দুই বন্ধুর জীবন এমনভাবে গড়ে উঠেছে যে দেনাপাওনার হিসেব করা ভার। কে কার থেকে কত পাবে কেউ বলতে পারবে না। আর আসল কথাটা হলো এই যে, তার করার কিছু নেই। চুপচাপ কোলের উপর হাত গুটিয়ে বসে থাকা আর পড়া। এই কর্মহীন একাকীত্বে তার বেদনাটা তিনগুণ হয়ে যায়। 

শার্লোতে বলল, তার পক্ষ থেকে আমি অনেক বন্ধু-বান্ধবকে চিঠি লিখেছিলাম। তাদের অনেকে তাকে সাহায্য করতে চেয়েছিল। 

এডওয়ার্ড বলল, তা ঠিক। কিন্তু এই সব সাহায্যের প্রতিশ্রুতিই তাকে নূতন করে বেদনা দেয়। তারা যদি কোনও কাজ দেয় তাহলে তা গ্রহণ করলে ক্যাপ্টেনকে নিজের ব্যক্তিত্বকে বিসর্জন দিতে হবে। আত্মবিক্রীত হতে হবে। আমি তার অবস্থাটা বেশ বুঝতে পারছি। 

শার্লোতে বলল, বন্ধুর দুঃখে সমবেদনা জানানো খুবই ভালো কথা। কিন্তু আমাদের নিজের দিকটাও ভেবে দেখতে হবে। 

এডওয়ার্ড বলল, আমি তা দেখেছি। খরচে কথা বলব না কারণ সে এখানে থাকলে অতি সামান্যই খরচ হবে। সে থাকলে আমাদের কোনও অসুবিধাই হবে না। বরং সুবিধা হবে। বাড়িটার ডানদিকে সে থাকতে পারবে। সে আমাদের বিষয় সম্পত্তির কাজ দেখাশোনা করতে পারবে। তার অভিজ্ঞতার মূল্য আছে। গ্রামের লোকের অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু চিন্তাশক্তি নেই। তথ্য পরিবেশনে কোনও যথার্থ্য নেই। আবার শহর থেকে যারা পড়াশুনা করছে তাদের চিন্তাশক্তি থাকলেও তাদের অভিজ্ঞতা নেই জমিজমা সম্বন্ধে। কিন্তু আমার বন্ধুর দুই-ই আছে। প্রাসাদের ব্রিজের সময়টা পার হয়ে গেলে তোমার কাজ আরও বেড়ে যাবে। তখন ও আমাদের অনেক সাহায্য করতে পারবে। 

শার্লোতে বলল, ভালো কথা। মানুষ বর্তমানটাকেই বড় করে দেখে। পুরুষরা কাজের লোক বলে এইরকম দেখাটাই স্বাভাবিক তাদের পক্ষে। কিন্তু মেয়েরা সব সময় সারা জীবনের কথা ভাবে। আমাদের অতীতটা একবার ভেবে দেখো। প্রথম যৌবনে আমরা ভালোবাসতাম পরস্পরকে। কিন্তু তোমার বাবা টাকা চাইলেন বলে একটা মোটা সম্পত্তির লোভে একটা বুড়ো মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ে দেন। আমারও এমন একজনের সঙ্গে বিয়ে হয় তাকে আমি ভালোবাসতে পারিনি। এইভাবে আমাদের বিচ্ছেদ হয়। কিন্তু তোমার স্ত্রী আর আমার স্বামী মারা যাওয়ায় সৌভাগ্যক্রমে আমরা মিলিত হই আবার। আকাঙ্ক্ষিত যে সুখ, অনাবিল অব্যাহত মিলনের যে আনন্দ একদিন আমরা পাইনি, সে সুখ সে আনন্দ আজ আমরা পূর্ণমাত্রায় পেতে চাই। তুমিও জীবনে অনেক ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করেছ; আজ বিশ্রাম চাও। এর জন্য তোমারই কথায় আমার মেয়েকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দিয়েছি। আমার ভাইজিকেও অন্যত্র সরিয়ে দিয়েছি। 

এডওয়ার্ড বলল, আমি তোমার সব কথাই মেনে নিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেনের উপস্থিতি আমাদের এ মিলনকে কোনওভাবে ব্যাহত বা ক্ষতিগ্রস্ত করবে না। 

শার্লোতে তবু তর্কের ভঙ্গিতে বলল, আমি জানি অনেক মানুষের জীবনে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব নানাভাবে বিঘ্ন ঘটিয়েছে। 

এডওয়ার্ড বলল, তা ঘটিয়েছে এমন লোকদের জীবনে যাদের বুদ্ধি বা অভিজ্ঞতা কিছুই নেই। যারা অন্ধের মতো চলে, নিজস্ব বিচারবুদ্ধি নেই, তাদের ক্ষেত্রেই এ কথা খাটে। 

শার্লোতে বলল, তবু আমি বিপদের অশুভ আভাস পাচ্ছি যেন।

এডওয়ার্ড বলল, ও সব অর্থহীন চিন্তা। 

শার্লোতে বলল, এই সব আভাস মানুষের কর্মফল সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাপ্রসূত এক একটা প্রাককল্পনা ছাড়া আর কিছুই নয়। যাই হোক, আমাদের এ বিষয়ে ভাবার জন্য দিনকয়েক সময় দাও। হঠকারিতার সঙ্গে কিছু করো না। 

এডওয়ার্ড বলল, কিন্তু যা কিছু করার এখনি করতে হবে। যা হোক একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি তার চিঠির উত্তর দিতে যাচ্ছি। 

শার্লোতে বলল, এখন তাকে সমবেদনা ও সান্ত্বনা জানিয়ে দুকথা লিখে দাও। 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

শার্লোতের কথায় বন্ধুর প্রতি সহানুভূতির উদ্দাম আবেগটা সত্যিই শান্ত ও প্রশমিত হলো এডওয়ার্ডের। তার কথার গুরুত্বটা ধীরে ধীরে বুঝল এডওয়ার্ড। তাছাড়া মনে তার কতকগুলো স্মৃতি জেগে উঠল শার্লোতের কথায়। সে প্রেম বিচ্ছেদে বিরহে মরে যায়নি, বরং ইন্দ্রিয়সংসর্গ ছাড়াই যা তীব্র হয়ে ওঠে দিনে দিনে, অমর ইন্দ্রিয়াতীত সে প্রেমের আশ্চর্য মধুর এক সুবাস অতীত জীবনের ভাঁজ থেকে তার কাছে যেন উঠে আসে সহসা। 

এডওয়ার্ড ঠিক করে ফেলে শার্লোতের কথামতোই সে এখন চিঠির উত্তর লিখবে তার বন্ধুকে। এখন তাকে আসতে লিখবে না। কিন্তু চিঠি লিখতে গিয়ে ক্যাপ্টেনের খোলা চিঠিটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে বন্ধুর প্রতি সেই সকরুণ সহানুভূতির এক অদম্য প্রবলতা ভাসিয়ে নিয়ে গেল শার্লোতের কথাগুলোকে। 

আজ একটা জিনিস অনুভব করল এডওয়ার্ড। আজ তার জীবনে তার ইচ্ছা এক প্রত্যক্ষ বিরোধিতা লাভ করল। তার স্ত্রী শার্লোতে আজ প্রত্যক্ষভাবে তার ইচ্ছার গতিরোধ করে দাঁড়িয়েছে। জীবনে এর আগে এমনভাবে তার ইচ্ছার গতিবেগ কেউ প্রতিহত করেনি। সে বাবা- মার একমাত্র প্রিয় সন্তানরূপে যা চেয়ে তাই একরকম পেয়েছে বিনা বাধায়। যৌবনে বাবা-মা এরকম তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে দিলেও এই বিরোধিতকার মাসুল সে সুদে-আসলে পেয়ে গেছে। তার প্রথমা স্ত্রী মারা যাবার পর সে অনেক সম্পত্তি লাভ করেছে এবং তার ফলে তার ইচ্ছার স্বাধীনতা আরও অনেক বেড়ে গেছে। সে ইচ্ছামতো ঘুরে বেরিয়েছে অনেক জায়গায়। ইচ্ছামতো তার প্রথম প্রেমের নায়িকা শার্লোতেকে দীর্ঘ দিন পর স্ত্রী হিসাবে ঘরে এনেছে। তবু আজ শার্লোতের কথাটা তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গেলেও সে কথাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না এডওয়ার্ড। 

বন্ধুর চিঠির উত্তর দিতে গিয়ে তাই তাকে আসতে বলতে পারল না। কোনও সিদ্ধান্তে আসতে না পেরে শুধু লিখল অনেক দিন চিঠি দিতে না পারার জন্য সে দুঃখিত। অল্পদিনের মধ্যেই সন্তোষজনক আর একখানি চিঠি সে পাঠাচ্ছে। 

পরদিন সকালেই আবার কথাটা তুলল শার্লোতে। আর এডওয়ার্ডের মনটা খুব ভালো ছিল। তার প্রতিটি কথার ওদার্যে ও মাধুর্যে মুগ্ধ হয়ে গেল শার্লোতে নতুন করে। একসময়ে সে বলল, তুমি আমাকে সত্যিই বাধিত করলে এডওয়ার্ড। গতকাল যা আমি আমার স্বামীকে দিতে পারিনি আজ তা আমার প্রেমিককে না দিয়ে পারছি না। আজ না বলে পারছি না যে তোমার অকৃত্রিম বন্ধুপ্রীতির নিবিড়তা আমাকেও বিচলিত করে তুলেছে। আমার মধ্যেও জাগিয়ে তুলেছে অনুরূপ ভাব। তুমি যেমন ক্যাপ্টেনের কথা ভাবছ আমিও তেমনি ভাবছি ওতিলের কথা। আমি আমার মেয়ে লুসিয়ানের কথা ভাবছি না। সে ভালোই আছে। পড়াশুনো করছে। কিন্তু ওতিলে যে বোর্ডিং-হাউসে থাকে তার অবস্থা মোটেই ভালো নয়। বেচারীর জন্য বড় দুঃখ হয়। তাই বলছিলাম কি তুমি যেমন ক্যাপ্টেনকে এখানে রাখতে চাও, আমিও তেমনি ওতিলকে এখানে এনে রাখতে চাই। এতদিন কিন্তু কথাটা বলতে পারিনি কারণ যে কারণে আমি তোমাকে বাধা দিচ্ছিলাম সেই কারণে আমি নিজের বন্ধুরও বিরোধিতা করেছিলাম। নিজেকে বাধা দিয়েছিলাম নিজে। 

এডওয়ার্ড বলল, এ কিন্তু পুরোপুর স্বার্থপরতা। আমি ক্যাপ্টেনকে আনতে চাই। তুমি চাও ওতিলকে। একে যদি স্বার্থপরতা না বলো তো আর কাকে বলবে। 

শার্লোতে সে কথায় কান না দিয়ে বলল, কিন্তু এ বিষয়ে একটা কথা আছে। তুমি কি মনে করো এক বাড়িতে ক্যাপ্টেনের কাছাকাছি ওতিলেকে রাখা ঠিক হবে? ক্যাপ্টেনের বয়স প্রায় তোমার মতোই আর ওতিলেও সবেমাত্র যৌবনে পা দিয়েছে। তাছাড়া ওতিলে দেখতে ভালো। 

এডওয়ার্ড বলল, আমি কিন্তু বুঝতে পারছি না ওতিলের রূপটাকে কেন তুমি এত বড় করে দেখছ এবং সেটাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছ। তার মাকে তুমি ভালোবাসতে বলে তাকে তুমি স্নেহ করো। তা করো তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু বাড়াবাড়ি করো না। সে সুন্দরী, তার চোখ দুটোও ভালো ঠিক। ক্যাপ্টেন তার প্রিয় একবার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিল দেশভ্রমণ থেকে আমি ফিরে আসার পর। কিন্তু সে আমার মনে মোটেই কোনও রেখাপাত করতে পারেনি। 

শার্লোতে হেসে বলল, এজন্যই তো তোমাকে এত ভালো লাগে। তুমি তার কচি সৌন্দর্য ফেলে আমার মতো পুরনো বান্ধবীর প্রতি আকৃষ্ট হলে। 

কথা বলতে বলতে ওরা যখন নূতন বাড়ির বাগান থেকে পুরনো প্রাসাদে ফিরছিল তখন একটি চাকর এসে খবর দিল ঘোড়ায় চেপে মিস্টার মিটলার এসেছে। চাকর মারফৎ জিজ্ঞাসা করছে তাকে প্রয়োজন আছে কিনা? 

মিটলারের নাম শুনে আনন্দে লাফিয়ে উঠল এডওয়ার্ড। বলল, গিয়ে এখনি তাঁকে আদার-আপ্যায়ন করো। তাকে এনে বসার ঘরে বসাও। জলখাবার খেতে দাও। আমরা যাচ্ছি। 

এডওয়ার্ডকে দেখে মিটলার বলল, আশা করি আমাকে আজ তোমাদের কোনও প্রয়োজন নেই। আমাকে যদি সত্যি সত্যিই কোনও প্রয়োজন থাকে, তাহলে আমি আজ তোমাদের এখানে লাঞ্চ খাবো। তা না হলে চলে যাব। আমার অনেক কাজ আছে। 

শার্লোতে বলল, সত্যিই দরকার আছে। আমাদের বিয়ের পর আজ প্রথম একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে দুজনের মধ্যে। আমরা সেটার সমাধান করতে পারছি না। এ ব্যাপারে তোমার সাহায্য চাই। 

মিটলার বলল, কিন্তু তোমাদের দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। ঠিক আছে, যদি তাই হয় তাহলে পরে দেখা যাবে। আজ আমার কাজ আছে। 

ওরা কথা বলতে বলতে হলের মধ্যে গেল। চাকরে প্রাতরাশ নিয়ে গেল। এই অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ মিটলার আগে ধর্ম দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন। মন্ত্রী হিসাবে প্রচুর নাম করেছিল মিটলার। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা সম্প্রদায়গত যে কোনও ঝগড়া মেটানোর কাজে সিদ্ধহস্ত ছিল মিটলার। সে মন্ত্রী থাকাকালে কোনও বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারত 

কেউ। কারও কোনও দাম্পত্য জীবনে সমস্যা বা মন কষাকষি দেখা দিলে সে তা মিটিয়ে দিত। এমনকি অনেক মামলা-মোকদ্দমাও শুরু হতে না হতেই মিটিয়ে দিত সে। এই সব কাজে আইনজ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা আছে দেখে সে অল্প কালের মধ্যেই আইনবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে ওঠে। তখন তার কর্মক্ষেত্র আরও প্রসারিত হয়। তখন রাজধানীতে ডাক পড়ে তার। বর্তমানে এখন একটা এস্টেট কিনে খামার করেছে। মিটলার অবসর নেবার পর। আর একটা অদ্ভুত কাজ সে করে বেড়ায়। সে মাঝে মাঝে এমনি বিভিন্ন গাঁয়ে ঘুরে বেড়ায়। কিন্তু কারো বাড়িতে বসে না বা খায় না যদি না সে বাড়ির কোনও উপকার সে করে। আজও আগের মতোই ঝগড়া মিটিয়ে বেড়ায় মিটলার। 

খাবারের সঙ্গে মিষ্টি দেওয়া হলো, এদিকে কথায় কথায় তাদের দুজনের দাম্পত্য সমস্যাটার কথাও বরে ফেলল এডওয়ার্ড। কিন্তু সব শুনে মিটলার বলল, আজ এসব কথা বলে কোনও লাভ হবে না। আমার অন্যত্র কাজ আছে। আজ আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারব না। 

মিটলার সত্যি সত্যিই উঠে পড়ল। চাকরকে তার ঘোড়া তৈরি করতে বলল। সে তখন এডওয়ার্ডকে বলল, তোমাদের এটা মোটেই সমস্যা নয়। তোমরা জান প্রথমে আমি কাউকে উপদেশ দেই না। সমস্যা বুঝলে আগে তোমরা নিজেরাই একটা উপদেশ খাড়া করো। তাতে কাজ হলে আনন্দ করো, নিজেদের বুদ্ধিকে বাহবা দাও। আর তাতে কাজ না হলে আমাকে ডাকবে। যে যাকে আনতে চাইছ নিয়ে এস বাড়িতে। রেখে দাও। পরে সমস্যা দেখা দিলে আমাকে ডাকবে। ভয়ের কিছু নেই। তখন অবশ্যই সাহায্য পাবে আমার কাছ থেকে। আজ চলি। বিদায়। 

এই বলে কফি না খেয়েই ঘোড়ার উপর চেপে চলে গেল মিটলার। 

শার্লোতে বলল, এইজন্যেই বলছিলাম দুজন অন্তরঙ্গ মানুষের মধ্যে কোনও বিষয়ে অমিল হলে তৃতীয় পক্ষকে ডাকতে নেই। এখন যেমন একথা ওকে বলে কোনও লাভ তো হলোই না, বরং আগের থেকে কেমন যেন জটিল আর গোলমেলে লাগছে ব্যাপারটা। 

ব্যাপারটার এখানেই শেষ করা ওরা চলে যাচ্ছিল অন্যত্র, এমন সময় চাকর এসে একটি চিঠি দিল এডওয়ার্ডের হাতে। চিঠিখানা ক্যাপ্টেনের। ক্যাপ্টেন লিখছে অবশেষে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটা কাজ সে গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। কাজটা হলো কোনও ধনীর বাড়িতে থেকে তাকে সঙ্গ দান করা ও তাকে খুশি করা। 

এডওয়ার্ড চিঠিখানা শার্লোতকে দেখিয়ে বলল, দেখছ আমার বন্ধু কি রকম দারুণ দুরবস্থায় পড়েছে। এর পরেও তুমি চুপ করে থাকতে পার শার্লোতে? 

শার্লোতে বলল, মিটলার ঠিকই বলেছে, এসব ব্যাপারে আগে থেকে কিছু বলা যায় না। ভালো ব্যবস্থা অনেক খারাপ হয়ে যায়, আর খারাপ ব্যবস্থাও ভালো ফল লাভ করে। সুতরাং অনেক সময় আমাদের অন্ধকারে লাফ দিতেই হবে। আজ তোমাকে বাধা দেবার কোনও শক্তি বা যুক্তি খুঁজে পাচ্ছি না আমি। তুমি ওঁকে আসতে লিখে দাও। তবে এখানে যে খুব বেশিদিন উনি না থাকেন। অবশ্য আমিও ওঁর পক্ষ থেকে একটা সন্তোষজনক ভালো কাজের জন্য চেষ্টা করব।

এ বিষয়ে আনন্দের সঙ্গে একমত হয়ে এডওয়ার্ড চিঠি লিখতে শুরু করল তার বন্ধুকে। তার লেখা শেষ হলে সেই চিঠিতে নিজের দিকে শার্লোতে দু কলম লিখে দিল। সৌজনের খাতিরে আসতে আহ্বান জানাল স্বামীর বন্ধুকে। 

এডওয়ার্ড চিঠিটা বন্ধুকে পাঠিয়ে দিয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। সঙ্গে সঙ্গে শার্লোতকে অনুরোধ করল ওতিলেকে আনার জন্য। সন্ধ্যা হতেই সেদিন ওদের দ্বৈত গান-বাজনার আসর বসল। শার্লোতে পিয়ানো বাজাতে লাগল আর এডওয়ার্ড বাজাতে লাগল বাঁশি। মাঝে মাঝে বাঁশি বাজায় এডওয়ার্ড। কিন্তু তার স্বাভাবিক চঞ্চলতার জন্য ভালোভাবে শিখতে পারেনি। তবু তার সঙ্গে তাল রেখে একমাত্র শার্লোতেই পিয়ানো বাজিয়ে চলে ধৈর্য ধরে। 

তৃতীয় পরিচ্ছেদ

অবশেষে যার জন্য এত কাণ্ড সেই ক্যাপ্টেন এসে গেল। আসার আগে একটা চিঠি দিয়েছিল এডওয়ার্ডকে। চিঠিখানি এমনই চিন্তাপূর্ণ এবং সুলিখিত যে তা দেখে আশ্বস্ত হয় শালোর্তে। সে চিঠিতে একদিকে ক্যাপ্টেন নিজের অবস্থার কথাটা আশ্চর্য স্বচ্ছতার সঙ্গে ব্যক্ত করে তেমনি বন্ধুদের প্রতি তার মনোভাবটাও চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলে। 

দেখা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুই বন্ধুতে প্রচুর কথাবার্তা হলো। বেশ কিছুদিন পর দেখা হলো। সুতরাং কথাবার্তার কিছু উচ্ছ্বাস থাকবেই। সন্ধের দিকে শার্লোতে বেড়াবার ব্যবস্থা করল। নূতন বাড়ির বাগানে বেড়াতে যাবে ওরা। জায়গাটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে খুব পছন্দ হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের। এ বাগানের প্রতিটি গাছ, প্রতিটি জায়গা খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। 

নূতন বাড়িতে পৌঁছে ক্যাপ্টেন দেখল ফুলের মালা দিয়ে বাড়িটাকে চমৎকারভাবে সাজানো হয়েছে। শার্লোতে বলল, আজ একদিকে দুটো উৎসব। এডওয়ার্ডের জন্মদিন আর আমাদের বন্ধুর শুভাগমন। এডওয়ার্ড অবশ্য চায় না ওর জন্মদিন পালিত হোক। নামকরণের দিনটাও পালন করে না ও। 

এডওয়ার্ড বলল, নামকরণের কথা বলতে আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমরা দুই বন্ধুতে ছোট থেকেই একসঙ্গে বেড়ে উঠেছি, খেলা করেছি। 

এডওয়ার্ড একসময় শার্লোতেকে বলল, আমরা এখন তিনজন। আর একজনের অবশ্যই জায়গা হবে প্রাসাদে। 

এবার ওরা পাহাড়ের চূড়াটায় যাবার জন্য রাস্তা ধরল। এডওয়ার্ড বলল, বন্ধুকে পাহাড়টার উপর নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আসি আমাদের সম্পত্তির সীমানা কতদূর, তা না হলে মনে হবে এই ছোট উপত্যাকাটার মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে আমাদের বাড়ির চৌহদ্দি। 

শার্লোতে বলল, তাহলে এই সোজা পথে এস।

ঝোঁপঝাড়ে ভরা বেশ কিছু চড়াই পার হয়ে ওরা পাহাড়ের মাথাটায় গিয়ে উঠল। সেখান থেকে প্রাসাদটাকেও দেখা গেল না। সেখানে ওরা দেখতে পেল শুধু একটা প্রকাণ্ড লেক আর তার ওপরে আর একটা পাহাড় দিগন্তটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড় থেকে একটা নদী বের হয়ে সামনের লেকে এসে পড়েছে। লোকের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে পপলার গাছের সারি। এডওয়ার্ড বলল, ঐ গাছগুলো আমি বসিয়েছি। 

খুশি হয়ে পাহাড় থেকে নেমে এল ওরা। ক্যাপ্টেনের থাকার জায়গা দেখিয়ে দেওয়া হলো। ক্যাপ্টেন থাকবে প্রাসাদের ডানদিকে বারান্দাওয়ালা একটি প্রশস্ত ঘরে। সেখানে তার বইপত্র ও কাগজ সব গুছিয়ে রাখল। কিন্তু এডওয়ার্ড তাকে বেশ কয়েকদিন শান্তিতে থাকতে দিল না। ক্রমাগত চারপাশের জায়গাগুলো ঘোড়ায় চাপিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াতে লাগল। স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকের সঙ্গে পরিচয় দিয়ে দিল সে। 

অবশেষে একদিস তার মনের গোপন কথাটা বলে ফেলল ক্যাপ্টেনকে। বলল, আবার যাবতীয় ভূসম্পত্তি কোথায় কি আছে তা তোমাকে দেখিয়ে দিলাম। এবার এর রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নতি সম্পর্কে তোমার মতামত ও সাহায্য চাই। এটা আমার অনেক দিনের বাসনা। 

ক্যাপ্টেন বলল, এই জেলাতে কোনখানে তোমার কত জমি আছে তা আগে জরিপ করে মেপে দেখতে হবে। 

জমি মাপার সাজসরঞ্জাম তার সঙ্গেই ছিল। বলার সঙ্গে সঙ্গে নিজেই মাপার কাজ শুরু করে দিল ক্যাপ্টেন। তারপর বাড়ি গিয়ে নক্সা করে এক বিরাট কাগজের উপর রং দিয়ে চিহ্নিত করে এডওয়ার্ডের কোথায় কত জমি আছে তা দেখিয়ে দিল। তা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল এডওয়ার্ড। জীবনে আজ সে যেন প্রথম ভালোভাবে তার ভৌম অধিকারের সীমানা যথাযথ বুঝতে পারল। সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমার স্ত্রীকে দেখাই। 

ক্যাপ্টেন বলল, কি দরকার? সবাই সব বিষয়ে একমত নাও হতে পারে। 

এডওয়ার্ড বলল, কিন্তু তার বাগান সাজানোর কাজটা সমর্থন করবে না তুমি? সেটা দেখেছ তো? 

ক্যাপ্টেন বলল, আমি দেখেছি। কিন্তু তারিফ করতে পারছি না। উনি যে পথ নির্মাণ করেছেন তাতে দুজনে পাশাপাশি চলতে পারবে না। আর ঐ পথটাকে সোজা করতে হলে ঐ পাহাড়ের একটা অংশ ভাঙতে হবে। 

এরপর সে তার নিজের পরিকল্পনার কথা বলল। নূতন বাড়ির বাগান থেকে বেরিয়ে পথটা কিভাবে পাহাড়ের উঁচু চূড়াটায় চলে যাবে। আর তাতে পয়সাও তেমন খরচ হবে না। 

ক্যাপ্টেনের সমালোচনা ও পরিকল্পনা দুটোই ভালো লাগল এডওয়ার্ডের। সে। এটাই গ্রহণ করল। তারপর একদিন যখন দেখল শার্লোতে তার আগেকার সেই ভুল পরিকল্পনা অনুসারে কাজ শুরু করে দিয়েছে তখন তাকে কথাটা খুলে বলল। 

শার্লোতে বুদ্ধিমতী। ক্যাপ্টেনের পরিকল্পনাটা যে ঠিক তা সে বুঝতে পারল সহজেই। তবু নিজের পরিকল্পনাটাকে একেবারে উড়িয়ে দিতে পারল না। এ পরিকল্পনা একদিন সে অনেক কষ্ট করে গড়ে তোলে। এ কাজে তার অনেক সময় কেটে যেত। তাই সে সব জেনেও তর্ক করতে লাগল এডওয়ার্ডের সঙ্গে। তারপর হেরে নিজেই চুপ করল। 

ক্যাপ্টেন আসার পর থেকে দিনের মধ্যে বেশিরভাগ সময় এডওয়ার্ড তার বন্ধুর কাছেই থাকে। নানারকমের কথাবার্তা বলে। তার উপর আছে ঘোড়ায় চেপে বেড়াতে যাওয়ার আর শিকার করা। শার্লোতের সঙ্গে আজকাল বিশেষ কোনও কথাই বলে না। এডওয়ার্ড। এর উপর হাতের কাজটা চলে যাওয়ায় খুব বেশি নিঃসঙ্গ বোধ করতে লাগল শার্লোতে। 

এমন সময় শার্লোতে একটা কাজ পেল। বোর্ডিং থেকে ওতিলে সম্পর্কে চিঠি পেল। স্কুলের হেডমিসেট্রেস জানিয়েছে, ওতিলে অন্য সব মেয়েদের মতো ঠিক। পড়াশোনা আয়ত্ত করতে পারছে না। সে ভালো করে তৃপ্তির সঙ্গে খায় না। মাঝে মাঝে মাথা ধরে তার। বাঁ দিকের কপালটায় যন্ত্রণা করে। তবু আমরা আশা ছাড়িনি। বিশেষ আগ্রহ সহকারে ওর অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করে যাচ্ছি। আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে ওর নিরানন্দ জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে পারব।

শার্লোতে আশ্বস্ত হলো। ওতিলের প্রতি প্রধান শিক্ষিকার স্নেহ ও আগ্রহ দেখে খুশি হলো সে। অবহেলা আর ঔদাসিন্যে ভরা এই জগতে কেউ যদি কারও প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখায় ও স্নেহ-প্রীতি দান করে তখন সত্যিই সেটা দেখার বিষয়। 

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

এডওয়ার্ডের যাবতীয় স্থাবর ভূম্পত্তির একটা প্রাথমিক নক্সা তৈরি হয়ে গেল। এবার ক্যাপ্টেন বন্ধুকে বলল, এরপর তোমার ভূসম্পত্তির সব বিবরণ লিপিবদ্ধ করতে হবে। তারপর প্রজাদের ব্যাপারটা ঠিক করা হবে। 

কয়েকদিনের মধ্যেই এডওয়ার্ড বুঝতে পারল ক্যাপ্টেন কত পরিশ্রমী। যে কাজ হাতে নেয় ক্যাপ্টেন তা কত নিখুঁতভাবে করে। শুধু তাই নয়, ক্যাপ্টেন আবার তার বন্ধুকে খানিক উপদেশও দিয়ে দিল। বলল, কাজ নিষ্ঠা আর একাগ্রতা মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু জীবন চায় আনন্দ আর ভোগ-উপভোগ। দুটো একসঙ্গে চলতে পারে না। 

ক্যাপ্টেনের কাজকর্মে সাহায্য করার জন্য একজন কেরানি নিযুক্ত করা হলো। সে। লোকটিও খুব পরিশ্রমী। সারাদিন সমানে কাজ করেও রাত্রিতে অনেকক্ষণ পর্যন্ত থাকত। 

তবে ক্যাপ্টেন সন্ধের দিকে কাজ থেকে নিজেকে কিছুক্ষণ ছিনিয়ে নিত। সন্ধের সময়টা সে বন্ধুর সঙ্গে গল্পগুজব করে কাটাত। যেদিন কোনো প্রতিবেশী বেড়াতে আসত না শার্লোতের কাছে, যেদিন সে একা থাকত, সেদিন সন্ধ্যায় ওরা দুই বন্ধুতেই শার্লোতের কাছে বসে গল্প করত।

ক্যাপ্টেন আসার পর তার স্বামীর মন কিছুটা সরে গেলেও একটা দিকে লাভ হয়েছে শার্লোতের। সংসারের কতকগুলো নূতন জরুরি ব্যবস্থা কিছুতেই দীর্ঘদিন ধরে সম্পন্ন করে উঠতে পারছিল না শার্লোতে। সেগুলো ক্যাপ্টেন এসে সহজেই করে ফেলল। আগে বাড়িতে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের ভাঁড়াটা ছিল নামমাত্র। ক্যাপ্টেন এসে সেটা বাড়াল। অনেক নূতন নূতন ওষুধ আনাল। বিশেষ করে আনাল জলে ডোবার ব্যাপারে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য অনেক ওষুধ। তার দরকারও ছিল। এ অঞ্চলে লেক, নদী আর খাল-বিলের সংখ্যা অনেক। তাছাড়া মাঝে মাঝে বাঁধ প্রকল্পের কাজও হয়। এজন্য জলে ডোবার ঘটনা খুব একটা বিরল নয়। তবে জলের ডোবার একটা ঘটনা ক্যাপ্টেনের জীবনের সঙ্গে আশ্চর্যভাবে জড়িয়ে ছিল। এটা এডওয়ার্ড শার্লোতকে একদিন বলেছিল। তারা দুজনেই জানত। আর জানত বলেই এ কথা নূতন করে তোলেনি ক্যাপ্টেনের কাছে। 

ক্যাপ্টেন একদিন বলল, এত ওষুধপত্র তো আনালাম। কিন্তু এ অঞ্চলে প্রাথমিক চিকিৎসা দেবার ও কাটাছেঁড়ার ব্যাপারে আরোগ্য করার জন্য একজন সার্জেন দরকার। আর এই ধরনের একজন লোকের সঙ্গে আমার জানাশোনাও আছে। তবে তাকে অবশ্য উপযুক্ত পারিশ্রমিক দিতে হবে। 

অবশেষে সেই সার্জেন ভদ্রলোককে ক্যাপ্টেনের কথামতো আসতে লিখে দেওয়া হলো। এডওয়ার্ড সস্ত্রীক টাকাপয়সার হিসেব করে দেখল এই বাড়তি খরচের জন্য টাকার অভাব হবে না। 

এতদিনে ক্যাপ্টেনের আসার ব্যাপারে আগেকার সব ক্ষোভ ও অসন্তোষ দূর হয়ে গেল শার্লোতের মন থেকে। আজকাল ক্যাপ্টেনকে দিয়ে ঘর-সংসারের অনেক কাজ সে করিয়ে নেয়। আজ সে বুঝল ক্যাপ্টেনের মতো একজন অভিজ্ঞ ও শক্ত লোকের আসার দরকার ছিল তাদের সংসারে। 

এক-একদিন সন্ধের সময় এডওয়ার্ড কোনও বই আবৃত্তি করে পড়ে শোনাত ওদের। তার কণ্ঠটা গম্ভীর আর মিষ্টি ছিল। সে একসময় ভালো কবিতা আবৃত্তি করত। তবে তার একটা দোষ ছিল। সে যখন কিছু মন দিয়ে পড়ত বা আবৃত্তি করত, তখন শ্রোতাদের মধ্যে কেউ অন্য কোনও দিকে তাকালে বা অন্যমনস্ক হয়ে উঠলে সে কোনও মতেই সহ্য করতে পারত না। একদিন সন্ধের সময় সে কি একটা বই থেকে পড়ছিল। হঠাৎ তার চোখ পড়ল শার্লোতে তার বুকের দিকে তাকিয়ে আছে। অর্থাৎ তার পড়ার কথা শুনছে না। এডওয়ার্ড তখন রেগে গিয়ে বলল, কথাগুলো ছাপা থাকলেও একথার সঙ্গে আমার অন্তরের আবেগ ও অনুভূমি মিশিয়ে আমি এগুলো তোমাদের অন্তরে সঞ্চার করে দিতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি আমার বুকের মধ্যে যে একটা জানালা আছে তাই দিয়ে সেই কথাগুলো পালিয়ে গেছে। তোমার অন্তরে ঢুকতে পারেনি। 

যে কোনও অপ্রীতিকর প্রশ্নের উত্তর দেবার বা নীরস আলোচনাকে সরস করে তোলার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল শার্লোতের। এডওয়ার্ডের কথায় সে বিমুঢ় না হয়ে সহজভাবে বলল, তোমার পড়ার মধ্যে আত্মীয়তার কথা ছিল। হঠাৎ আমার এক খুড়তুতো ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তাই ক্ষণিকের জন্য আমি অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি ও বই-এর মাঝে তাকিয়ে খুঁজতে থাকি তুমি কোথায় পড়ছ।

এডওয়ার্ড বলল, আসল কথা সব মানুষ নার্সিসাসের মতো সব বস্তুর মাঝে নিজের প্রতিফলন খুঁজে চলেছে। 

শার্লোতে ক্যাপ্টেনের মুখপানে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা, আত্মীয়তা বলতে আপনি কি বোঝেন? 

ক্যাপ্টেন বলল, আমি অবশ্য দশ বছর আগে এ বিষয়ে যা পড়েছিলাম তার কথাই বলব। এখন অবশ্য আপনাদের একথা ভালো লাগবে কিনা জানি না? 

এডওয়ার্ড বলল, এমন কোনও জ্ঞান নেই যা মানুষের সারা জীবনভর প্রযোজ্য হতে পারে। প্রাচীনকালের জ্ঞানী বৃদ্ধরা বলতেন, এটা আমরা যৌবনে শিখেছি। কিন্তু এখন খাটে না একথা। আজ আমরা প্রতি পাঁচ বছরেই নূতন নূতন কথা শিখছি। আজকের জ্ঞান ও সত্য কাল অচল হয়ে যাচ্ছে, জগন্টা এমনই পরিবর্তনশীল হয়ে পড়েছে।

শার্লোতে বলল, আমরা মেয়েরা অল্পতেই সন্তুষ্ট। অতশত চাই না। আমি শুধু জানতে চাই শব্দটা কি অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং এই শব্দের কোনও বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য আছে কিনা। আমি তর্ক করতে চাই না এ নিয়ে। সেটা পণ্ডিতদের উপর ছেড়ে দিলাম। 

ক্যাপ্টেন বলল, প্রথমে আমরা দেখতে পাই সব জীবন্ত প্রাণীই পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়ে বাঁচতে চায়। কিছু না কিছু জানতে চায়। তবে তারা যে কিছু জেনেছে এ বিষয়ে নিশ্চিত না হলে তারা অজ্ঞাত বিষয়কে জানতে যায় না। 

ক্যাপ্টেন একটু থেমে আবার বলল, সব বস্তুরই একটা তরল অবস্থা আছে আর সেই তরল অবস্থাতেই সে অন্য বস্তুর তরল অবস্থার সঙ্গে মিশতে চায়। কিন্তু সেই তরল অবস্থাটা একটু শক্ত হলেই তা গোলাকার রূপ ধারণ করে নিজেকে আর সব থেকে পূথক করে রাখতে চায় একটা বৃত্তসীমার মাঝে। 

এডওয়ার্ড মাঝখানে বলল, কিন্তু সব তরল বস্তু আবার মিশতে চায় না পরস্পরের সঙ্গে, যেমন তেল আর জল। তাদের মেশানো হলে রসায়নবিদের সাহায্য নিতে হয়। অ্যালকালাইন দিলেই ওরা মিশে যায়। আবার অনেক সময় গবেষণাগারে দেখা যায় ভিন্নধর্মীয় বস্তুও পরস্পরে মিলেমিশে তৃতীয় এক বস্তুর সৃষ্টি করছে। 

শার্লোতে বাধা দিয়ে বলল, রসায়নবিদের গবেষণাগারে লাইমস্টোন, সালফুরিক অ্যাসিড, অ্যালকালাইন প্রভৃতি বিভিন্ন উপাদানের মেলামেশার ফলে যে যাদু সৃষ্টি হয়, মানুষের জীবনে তা খাটে না। আমি দেখেছি মানুষ এই সব রাসায়নিক উৎপাদনের অনেক ঊর্ধ্বে। মানুষ অনেক পছন্দ করে যে আত্মীয়তা যে বন্ধুত্ব বেছে নেয়, পরে দেখা যায় তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাবে তাদের সে আত্মীয়তা ও বন্ধুত্বে ফাটল ধরে। 

এডওয়ার্ড রসিকতা করে বলল, সেক্ষেত্রে কেমিস্ট চতুর্থ ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটিয়ে সমস্যার সমাধান ঘটবে। কাউকে শুধূ হাতে ফিরতে হবে না। 

শার্লোতে বলল, এসব কথা আমাদের জীবনে খাটুক বা না খাটুক, একটা বিষয়ে আমি আজ একমত হলাম। 

এডওয়ার্ডের পানে তাকিয়ে শার্লোতে বলল, তুমি এবার থেকে সব জিনিস জোরে পড়বে। আমরা তা শুনে যাব। আমি দাঁড়িয়ে তোমার ঘাড়ের উপর দিয়ে বই-এর কোনখানে পড়ছ তা দেখার চেষ্টা করব না। ওতিলের কথা মনে করে আমি তা সহ্য করব। কারণ তাকেও আনতে হবে। 

এই বলে একটা চিঠি এডওয়ার্তের হাতে দিল শার্লোতে। 

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

হেডমিস্ট্রেসের পত্র মাদামের চিঠি যথাসময়ে পাওয়া সত্ত্বেও উত্তর দিতে দেরি হলো, কারণ অনেক ছাত্রীরই অভিভাবকের পত্রের উত্তর দিতে হয় আমাকে। এজন্য আমি ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। আজ বেশি কথা লিখতেও পারব না, কারণ পরীক্ষার ফলাফল অভিভাবকদের জানাতে হবে। আপনার মেয়ে সব বিষয়েই প্রথম স্থান অধিকার করেছে। অনেক পারিতোষিক লাভ করেছে। এত ভালো মেয়ে এখানে রেখে দেওয়ার কোনও যুক্তিই দেখি না। ওতিলের কথা আমার সহকারিণীর চিঠিতে জানতে পারবেন। 

সহকারিণীর পত্র

আমাদের মাননীয় প্রধান শিক্ষিকা আপনাকে এমন একটা কথা জানাতে দিয়েছেন যা তিনি নিজে জানাতে চান না। অবশ্য ওতিলের মধ্যে কি আছে, তার প্রকৃত অবস্থা কি তা আমিই সবচেয়ে ভালো জানি। আমি তাকে বাৎসরিক পরীক্ষার জন্য মোটেই ভালোভাবে প্রস্তুত করে তুলতে পারিনি শত চেষ্টা সত্ত্বেও। তার পরীক্ষার ফল সম্বন্ধে যে উদ্বেগ পোষণ করতাম মনে মনে তাই সত্য প্রমাণিত হয়েছে। অঙ্কে তার বুদ্ধি নেই তা নয়, তবু প্রায় সব অঙ্কই ভুল করছে। ইতিহাসের সন-তারিখ মনে রাখে না। ভূগোলে রাষ্ট্রীয় বিভাগ দেখাতে পারে না। অঙ্কনকার্যে তার হাত ভালো। কিন্তু এত বড় কাজ ফেঁদে বসেছিল যে সময়ে শেষ করতে পারেনি সে। খাতা দেবার পর পরীক্ষকরা আমাদের অর্থাৎ সে সব শিক্ষিকারা ক্লাসে পড়াই তাদের মতামত জানতে চান। আমি ওতিলের অন্তর্নিহিত যোগ্যতা ও গুণাগুণ সম্পর্কে সব কথা বলি। কিন্তু প্রধান পরীক্ষক তখন বলেন, এর দ্বারা বোঝা যাচ্ছে তার সামর্থ্য আছে, কিন্তু সে সামর্থ্য কর্মসম্পাদনের মধ্যে বাস্তব রূপ পায়নি। 

সব মেয়ে যখন কোনও না কোনও প্রাইজ পেয়ে আনন্দে লাফাচ্ছিল, ওতিলে তখন ঘরের এক কোণে একটা জানালার ধারে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল বাইরে শূন্য মনে তাকিয়ে। আমাদের প্রধান শিক্ষিকা যার প্রতিটি ছাত্রীর প্রতিই অসীম মমতা, তিনি ওতিলের কাছে গিয়ে বললেন, ভগবানের নামে বলল, এতখানি মূর্খতার পরিচয় তুমি কেন দিলে যখন সত্যি সত্যিই তুমি এতটা মূর্খ নও?– ওতিলে তখন ম্লান মুখে উত্তর দিল, ক্ষমা করবেন মা, আমার মাথা ধরেছিল পরীক্ষার সময়, যেমন আজ আবার ধরেছে। অন্য দিনকার মতো বেশি ধরেছে। 

অথচ কি আশ্চয়! পরীক্ষার সময় লক্ষ্য করে দেখেছি ওতিলে একবারও তার কপালে হাত দেয়নি। যন্ত্রণার জন্য একবারও মুখটা বিকৃত করেনি। ওতিলেকে নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আলোচনা হয়। আমি তার সে আলোচনার ফল বা সিদ্ধান্তটুকু শুধু জানিয়ে দিচ্ছি। আমরা চাই ওতিলেকে আপনি আপনার কাছে নিয়ে গিয়ে কিছুদিন রাখুন। আপনারা ওখান থেকে যদি অন্য কোথাও চলে যান তখন আবার ওতিলে ফিরে আসবে সাদরে আমাদের কাছে। আর একটা কথা, ওতিলে কখনও কিছু বলতে চায়। না। কোনও কিছুও দাবি জানায় না। আবার কেউ কিছু তার কাছ থেকে চাইলেও সে প্রত্যাখ্যান করে না। এটাই তার স্বভাব। 

চিঠি দুটো পড়ে সবাইকে শোনাল এডওয়ার্ড। তারপর বলল, ঠিক আছে। ওতিলেকে আনা হোক। সব ব্যবস্থা করে ফেল। ওতিলে এলে আমি প্রাসাদের ডান দিকে ক্যাপ্টেনের ঘরের কাছে একটা ঘরে চলে আসব। রাত পর্যন্ত পড়েও খুব সকালে ওঠে। দুজনে কাজ করা সহজ হবে তাহলে। আর ওতিলে থাকতে তোমার ঘরের পাশে। ওর আবার মাথা ধরার রোগ আছে। আমারও তাই। ওর বাঁদিকের কপালটা ধরে, আমার ডানদিকটা। 

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

একদিন প্রাসাদের সামনে একখানি ঘোড়ার গাড়ি এসে দাঁড়াল। তার থেকে নামল ওতিলে। শার্লোতে গিয়ে দাঁড়াল তার সামনে। সঙ্গে সঙ্গে ওতিলে বসে পড়ে তার হাঁটু দুটো জড়িয়ে ধরল। শার্লোতে ব্যস্তভাবে বলল, একি করছিস, নিজেকে এত ছোট ভাবছিস কেন? 

ওতিলে বলল, না আমি সত্যি তোমার এই হাঁটুর উপরে উঠতে পারিনি। তোমার কাছ থেকে এত স্নেহ-ভালোবাসা পেয়েও আমি কোনও বিষয়ে কোনও উন্নতিই করতে পারিনি। 

ওতিলেকে দেখে খুশি হলো এডওয়ার্ড। ওতিলের চেহারা সত্যিই সুন্দর হয়ে উঠেছে। তার বুদ্ধির উৎকর্ষ তেমন না হলেও তার দেহসৌষ্ঠব্যের মধ্যে কোনও অপূর্ণতা নেই। তাছাড়া সাংসারিক কাজকর্মেও বেশ পটু ওতিলে। বাড়িতে আসার পর থেকেই সব বিষয়ে শার্লোতেকে সাহায্য করতে শুরু করে দিয়েছে। কোনও কাজের কথা তাকে বলতে হয় না। সে নিজে থেকেই যখনকার যে কাজ সব ঠিক করে রাখে। সে যেন সবার সব মনের কথা বুঝতে পারে। 

তার পড়াশুনোর ব্যাপারে শার্লোতে কোনও জোর করত না। সেটা তার উপরে ছেড়ে দিয়েছিল। শার্লোতে দেখল ওতিলের হাতের লেখা ভালো। সে ফরাসি ভাষায় কথা বলত। 

একদিন তার সম্পর্কে স্কুলের কাগজপত্র সব ভালো করে দেখল শার্লোতে। দেখল স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার অফিস থেকে তার সম্বন্ধে যা বলা হয়েছে তা হুবহু সত্যি। খাওয়াপরা সম্বন্ধে ওতিলের সত্যিই কোনো আগ্রহ নেই। তবে শার্লোতে যে মুহূর্তে তাকে ভালো পোশাক পরতে বলল এবং তার ব্যবস্থা করে দিল সেই মুহূর্ত থেকে সে ভালো পোশাক পরতে শুরু করল। উজ্জ্বল পোশাক পরার সঙ্গে সঙ্গে তার দেহসৌন্দর্য আরও বেড়ে গেল। তার দিকে সকলের দৃষ্টি আকৃষ্ট হতে লাগল। বিশেষ করে পুরুষমানুষের দৃষ্টি। তবে মানুষের রূপসৌন্দর্য মানুষের বহিরেন্দ্রিয় ও অন্তরেন্দ্রিয় উভয়ের উপরেই প্রভাব বিস্তার করে। মানুষ যতক্ষণ পর্যন্ত কোনও দেহসৌন্দর্যের পানে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত তার মনে কোনও পাপ বা অশুভচিন্তা প্রবেশ করতে পারে না। 

ওতিলে আসার পর বাড়িতে পুরুষদের দৈনন্দিন আচরণের অনেক উন্নতি হলো। আগে এডওয়ার্ড ও ক্যাপ্টেন দুই বন্ধুতে যখন কাজে বা কথাবার্তায় মত্ত হয়ে উঠত খাওয়া বা বেড়াবার কথা ভুলেই যেত একরকম। ফলে অনেক সময় শার্লোতেকে বসে থাকতে হতো তাদের জন্য। আজকাল সকলে খাবার টেবিলে যথাসময়ে এসে হাজির হয়। খাওয়া শেষ করেও গল্প করে বেড়াতে যাবার সময় বার হতে দেরি করে না। মোটেই। 

শার্লোতের মনে হলো দুটো মানুষই যেন হঠাৎ পাল্টে গেছে একেবারে। শুধু ওতিলের প্রতি নয়, তারা আজকাল শার্লোতের প্রতিও আগের থেকে শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছে। কোনও আলোচনা বা পাঠের সময় তার মতামতের উপরেও গুরুত্ব দেয় তারা। অবশ্য তারা ওতিলের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর সব বিষয়েই বেশি গুরুত্ব দান করত। দিনে দিনে এ গুরুত্ব বেড়ে যেতে লাগল। এবং ওতিলে এটা ভালোভাবেই লক্ষ্য করল। প্রত্যেকের প্রতিটি কথা, প্রতিটি দৃষ্টি, প্রতিটি অঙ্গ সঞ্চালনের অর্থ তার বুঝতে কিছু বাকি থাকল না। অথচ কোনও চপলতা দেখা দিল না তার আচরণের মধ্যে। তার কথাবার্তার মধ্যে কোনও উচ্ছ্বাস নেই। তার কর্মতৎপরতার মধ্যে কোনও চঞ্চলতা নেই। তেমনি তার পদক্ষেপের মধ্যেও কোনো শব্দ নেই। সব মিলিয়ে তার সমগ্র জীবনভঙ্গিমার ও জীবনযাত্রার মধ্যে এক সহজ ও শান্ত নিরুচ্চার সৌন্দর্য ছিল যা দেখে মৃগ্ধ হয়ে যেত সকলে। বিশেষ করে খুব খুশি হতো শার্লোতে। ওতিলের আসার কথা কথা সে-ই তুলেছিল প্রথমে। 

একদিন শার্লোতে একটা শিক্ষা দিল ওতিলেকে। বলল, ছোট-বড় যে কোনও লোকের হাত থেকে কোনও জিনিস মাটিতে পড়ে গেলে তা কুড়িয়ে দিতে হয়। এতে বড়দের প্রতি শ্রদ্ধা ও নম্রতা প্রকাশ পায় আর ছোটদের প্রতি মানবিক মমতা ও সহানুভূতির পরিচয় দেওয়া হয়। 

ওতিলে বলল, এটা কিন্তু আমার ভালো লাগে না। ইতিহাসে কিন্তু এ শিক্ষার কোনও সায় পাই না আমরা। ইতিহাসের একটা ঘটনার কথা মনে আছে আমার। ইংল্যান্ডের পরাজিত রাজা প্রথম চার্লসের যখন বিচার হচ্ছিল, যখন তিনি তাঁর তথাকথিত বিচারকদের সামনে তার রাজদণ্ড দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন তার হাতের দণ্ডটা থেকে সোনার বলটা পড়ে যায়। তিনি ভেবেছিলেন বিচার সভায় উপস্থিত কেউ 

কেউ সেটা তুলে দেবে আগের মতো। কিন্তু সেদিন কেউ এ উপকারটুকু করেনি তার। তখন তিনি নিজেই নত হয়ে সেটা কুড়িয়ে নেন। 

এদিকে এডওয়ার্ড ও ক্যাপ্টেনের কাজ কমার পরিবর্তে বেড়েই যেতে লাগল দিনে দিনে। মাঝে মাঝে দুই বন্ধুকে বাইরে যেতে হয়। এস্টেটের অন্তর্ভুক্ত গ্রামগুলো ঘুরে বেড়িয়ে দেখতে হয়। 

একদিন দুজনে যখন বেড়াচ্ছিল, ক্যাপ্টেন তখন বলল, দেখো, কোনও কোনও গাঁ কত পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, আবার কোনও কোনও গা কত অপরিচ্ছন্ন। এখানকার রাস্তাগুলোও ভালো নয়। বড় আঁকাবাঁকা, খানা-ডোবায় ভর্তি। আমি তোমার এস্টেটের উন্নতির জন্য সুইজারল্যান্ডের কায়দায় একটা পার্কের চারদিকে একটা আদর্শ গ্রাম গড়ে তুলতে চাই। 

এডওয়ার্ড তখন সমর্থনের সুরে বলল, তাহলে তো খুবই ভালো হয়। আমাদের প্রাসাদের কাছে সে গ্রামটা রয়েছে সেটা নদীর ওপারে অর্ধবৃত্তাকারে স্থাপিত। সেখানে যাবার পথটা খুবই খারাপ। সে পথ কোথাও উঁচু, কোথাও নিচু, কোথাও জলের তলা দিয়ে গেছে। তার পর নদীতে যখন বর্ষার বান আসে তখন গাঁয়ের লোকেরা সকলেই স্বার্থপরের মতো নিজের ঘর বাঁচাবার চেষ্টা করে পথের জল আটকাতে চায়। কিন্তু পরের কথা ভাবে না। কিন্তু গাঁয়ের লোকেরা সকলে মিলে যদি চেষ্টা করে, যদি মিলেমিশে সকলেই হাত লাগায় তাহলে এই রাস্তাটাকে অনেক উঁচু করা যায়। তাহলে রাস্তাটাও অনেক উন্নত হবে আর সেটা বাধের মতো কাজ করবে, বানের কবল থেকেও গাটা রক্ষা পাবে। 

ক্যাপ্টেন বলল, জনগণ ও ব্যবসাদরদের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা, কোননা ভালো কাজ পাবে না তুমি। তাদের আশায় থাকলে কোনও কাজই হবে না। তাদের হুকুম করে করাতে হবে। কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব ছাড়া এ সব বিষয়ে কোনও কাজ হবে না। 

এডওয়ার্ড বলল, তার কারণ, সাধারণ মানুষ তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি সম্বন্ধে পূর্ণমাত্রায় সচেতন। কিন্তু ভবিষ্যত্বের কথাও একেবারে ভাবে না। দৈনন্দিন জীবনের উর্ধ্বে কোনও কিছুই তারা দেখতে পায় না। তুমি ঠিকই বলেছ এ সব কাজে অবাধ জোর খাটাতে হবে। 

দুই বন্ধুতে এইভাবে একমত হয়ে গেল। ঠিক হলো, ক্যাপ্টেন একটা নক্সা আঁকবে। দরকারমতো জায়গাগুলো মেপে নেবে। 

নক্সা হয়ে যাবার পর পরিকল্পনাটা দেখল এডওয়ার্ড। রাস্তাটা উঁচু করতে ও নদীর গায়ে ফেলতে অনেক পাথর লাগবে। তার জন্য ক্যাপ্টেন প্রাসাদ থেকে পাহাড়ের চূড়ায় যাবার জন্য একটা পথের পরিকল্পনা করেছে। সেই চূড়ার উপর একটা বিশ্রামাগার হবে। বাইরের লোক এসে থাকতে পারবে। প্রাসাদের ঘরের জানালা থেকে তা দেখা যাবে। এই কাজের জন্য পাহাড় থেকে অনেক পাথর কাটতে হবে আর সেই পাথর দিয়ে রাস্তাটাকে উঁচু করা যাবে, আর নদীর গায়ে তা ফেলে তার ক্ষয়রোধ করা যাবে। 

একটা ভিখিরি জ্বালাতন করছিল এডওয়ার্ডকে। তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে যেতে বললেও সে যাচ্ছিল না। 

ক্যাপ্টেন বলল, এভাবে মানুষের ঘরে ঘরে বা পথে ভিক্ষা চাওয়া বা দেওয়া ঠিক নয়। মানুষের বদান্যতা ও দানশীলতার একটা সুনিয়ন্ত্রিত সীমা থাকবে। একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মানুষ যা কিছু দান করার দান করবে তা ভিখিরিরা সেখান থেকেই পাবে। 

ক্যাপ্টেন আরও বলল, এই গাঁয়ে ঢোকবার দুই প্রান্তে দুই জায়গায় দুটো কেন্দ্র খোলা যেতে পারে ভিখিরিদের দানের জন্য। একদিকে একটা আছে পান্থশালা। আর একদিকে আছে এক বৃদ্ধ দম্পতি। আমাদের পক্ষ থেকে যা দেবার ওখানেই দিয়ে রাখব। সেখান থেকেই ভিখিরিরা একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সাহায্য মাঝে মাঝে পাবে। 

এডওয়ার্ড ক্যাপ্টেনের সঙ্গে গিয়ে জায়গা দুটো দেখে এল এবং তার পছন্দ হলো। আসার পথে এডওয়ার্ড একসময় ক্যাপ্টনকে বলল, মানুষ তার ইচ্ছার দৃঢ়তার দ্বারা ও ব্যক্তিত্বের জোরে কাজ করতে পারে। অনেক পরিকল্পনা রূপায়িত করতে পারে বাস্তবে। যেমন ধরো, নতুন বাড়ির বাগানে যে পথগুলো ভুল করে বানিয়েছিল শার্লোতে সেগুলো আরও অনেক চওড়া ও ভাল করে নির্মাণ করেছি আমরা। 

ক্যাপ্টেন বলল, এতে শার্লোতে ক্ষুণ্ণ হয়েছে। সে এ ব্যাপারে কোনও আলোচনা হলে তাতে যোগদান করে না। এড়িয়ে যায়। ও বেশির ভাগ সময় ওতিলের কাছে থাকে। 

এডওয়ার্ড বলল, আমরা আমাদের কাজ করে যাব সঠিক পথে। তাতে কে কি ভাবল বা কতটা ক্ষুণ্ণ হলো তা আমাদের দেখার দরকার নেই। 

নূতন বাড়ির বাগান থেকে যে পথটা চওড়া হয়ে পাহাড়ের চূড়াটায় উঠে যাবে, নদীর ধার বরাবর গাঁয়ের রাস্তাটা উঁচু করে নির্মিত হয়ে বাঁধ হিসাবে কাজ করবে আর পাহাড়ের চূড়ার উপর একটা বিশ্রামাগার গড়ে উঠবে। কিন্তু এই সব পরিকল্পনা কার্যে রূপায়িত করতে অনেক টাকার দরকার। পাহাড় ভেঙে পাথর এনে রাস্তায় ফেলে রাস্তটা উঁচু করতে হবে। টাকা আছে শার্লোতের কাছে। তাকে শুধু কিসে কোন খাতে কত টাকা লাগবে বুঝিয়ে দিতে হবে। 

ক্যাপ্টেন একদিন শার্লোতেকে নিয়ে পরিকল্পনার খাতাপত্র বুঝিয়ে দিল। অনেক কষ্ট করে সে পুরো পরিকল্পনার প্রয়োজনীয় নক্সা আর খাতাপত্র সব তৈরি করেছে। অবশেষে ওদের তিনজনের মধ্যে ঠিক হলো, এবার হতে শার্লোতে ক্যাপ্টেনের ঘরে বসে পরিকল্পনার বিভিন্ন খাতে ধার্য টাকাকড়ির হিসাব বুঝে নেবে ও দরকার মতো টাকা বরাদ্দ করবে কাজ চালাবার জন্য। 

সেই কথামতোই কাজ করে যেতে লাগলো শার্লোতে। ক্যাপ্টেন মানুষটা আজ অনেকখানি সহজ হয়ে উঠেছে তার কাছে। আজ সে মোটেই অসহনীয় নয় তার কাছে। বরং তার ভালো গুণগুলো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে। অথচ না জেনে এই ক্যাপ্টেনের আসার ব্যাপারে কত বিরোধিতা করেছিল একদিন। এই ক্যাপ্টেন আসার সঙ্গে সঙ্গে কতদিন ধরে গড়ে তোলা কত সাধের এক পরিকল্পনার উপর আপন ইচ্ছার রথচক্র চাপিয়ে নস্যাৎ করে দেওয়া সত্ত্বেও আজ তার কাছে বসে কাজ করতে বা তাকে সহ্য করে যেতে একটুও কষ্ট হয় না শার্লোতের। বরং ভালোভাবেই কেটে যায় তার। 

সপ্তম পরিচ্ছেদ

শার্লোতে আজকাল ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দিনের মধ্যে বেশির ভাগ সময় কাজে ব্যস্ত থাকায় এডওয়ার্ডকে সময় কাটাতে হয় ওতিলের কাছে। আজকাল ওতিলের প্রতি এক বন্ধুত্বপূর্ণ মনোভাব গড়ে ওঠায় তার সাহচর্যে ভালোই থাকে এডওয়ার্ড। আর ওতিলেও যতক্ষণ এডওয়ার্ড তার কাছে থাকে, নানারকমের কথা বলে তাকে প্রীত করার চেষ্টা করে। তাছাড়া এডওয়ার্ড যা যা ভালোবাসে তাই সে করে। সে যা খেতে ভালোবাসে তাই সে করে দেয়। এডওয়ার্ডের প্রতি তার ক্রমবর্ধমান আগ্রহের পরিচয় দিতে থাকে সে এইভাবে। 

এডওয়ার্ডের প্রতি তার এই আগ্রহ বৃদ্ধির একটা কারণও ছিল। এডওয়ার্ডের দেহের বয়সটা আগের থেকে বাড়লেও তার মধ্যে একটা শিশুসুলভ সরলতার ভাব ছিল। সে ভাব তার কথায় ও আচরণে প্রায়ই প্রকাশ পেত। আর তা দেখে মুগ্ধ হয়ে যেত ওতিলে। 

এদিকে দুই বন্ধুতে কয়েকদিন ধরে দেখা না হওয়ায় অনেক কাজকর্ম করা হয়ে ওঠেনি। ক্যাপ্টেনের কেরানিও কাজের অভাবে প্রায় বসে আছে। একদিন এডওয়ার্ড ক্যাপ্টেনের ঘরে গিয়ে আবার কাজকর্ম শুরু করে দিল। কেরানিকেও প্রচুর কাজ দিল। 

সেদিন কাজের ফাঁকে একবার এডওয়ার্ড ক্যাপ্টেনকে সময়ের কথা জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু ক্যাপ্টেন আশ্চর্য হয়ে দেখল ঘড়িতে সময়ে দম দেওয়া না হওয়ায় ঘড়ি বন্ধ হয়ে আছে। ক্যাপ্টেনের এ ধরনের ভুল কখনও হয় না। শার্লোতে কাছে থাকায় কাজের ফাঁকে ফাঁকে কথা বলতে গিয়ে ঘড়িতে দম দিতে ভুলে গিয়েছে ক্যাপ্টেন। তাই হয়। কোনও বিশেষ এক গৃহপরিবেশের মধ্যে পরিচিত কয়েকজন মানুষের কাজকর্ম করতে করতে হঠাৎ যদি নূতন মানুষের আবির্ভাব ঘটে সেখানে তাহলে স্বভাবতই মনের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং সেই নূতন আগন্তুকের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে বেশ কিছুদিন সময় লাগে। ক্যাপ্টেন ও এডওয়ার্ড দুজনেরই তাই হয়েছিল। তাদের সময়টা কোন দিকে কেটে গেল তা খেয়াল থাকল না। 

দুই বন্ধুতে এক গোপন অলিখিত ও অজ্ঞাত চুক্তিতে যেন আবদ্ধ হয়ে পড়েছিল। এডওয়ার্ড যেমন ওতিলেকে পেয়ে খুশি তেমনি শার্লোতেকে কাছে পেয়ে ক্যাপ্টেনও খুশি। অথচ তারা কেউ কারও প্রতি বিন্দুমাত্রও ঈর্ষান্বিত নয়। 

যে যার সঙ্গে সারাদিন কাটায়, বাইরে বেড়াতে যাবার সময়েও সে তারই সঙ্গে যায়। ওরা যখন একসঙ্গে চারজনে বেড়াতে বার হয় তখন এডওয়ার্ড ওতিলেকে নিয়ে এগিয়ে যায় আর ক্যাপ্টেন শালের্ণাতের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ধীর গতিতে চলতে থাকে। 

সেদিন ওরা পুরনো প্রাসাদ থেকে বনের মধ্যে অবস্থিত ওদের মিলের দিকে বেড়াতে গেল। প্রথমে একটা পথ ধরে ওরা সবাই এগিয়ে গেল। এডওয়ার্ড ওতিলের সঙ্গে অনেকটা এগিয়ে পড়েছিল। ক্যাপ্টেন পথের পাশের জায়গাগুলো দেখাচ্ছিল শার্লোতেকে। কিছুদূর যাবার পর দেখা গেল পথটা বনের মধ্যে মিলিয়ে গেছে। সারা বনভূমি জুড়ে বড় বড় ছায়াশীতল গাছ। এখানে নদীটা থেমে এসেছে। নদীটা খুব শীর্ণ এবং অগভীর। পাথরের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে। এখানে কোনও সেতু বা সাঁকো না থাকায় নদীটা পার হতে ওদের কষ্ট হলো। একটা পাথর হতে আর একটা পাথরে পা দিয়ে পরে ওতিলের হাত ধরে তাকে পার করল এডওয়ার্ড। এইভাবে নদীটা পার হয়ে ওরা বনভূমিতে গিয়ে একটু বসল। এডওয়ার্ড ওতিলেকে বলল, তোমার বুকের লকেটে ছোট্ট একটা ফটো দেখছি, ওটা হয়ত তোমার বাবার। এটা ঘরের মধ্যে যত্ন করে রাখবে, সব সময় কাছে নিয়ে এভাবে বেড়াতে নেই। যে কোনও সময়ে কোথাও পড়ে যেতে পারে অথবা কারও লালসাকলুষ স্পর্শে ওটার পবিত্রতা নষ্ট হতে পারে। 

ওতিলে কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতর থেকে ফটোটা বার করে এডওয়ার্ডের হাতে দিয়ে বলল, আপনার এই পরামর্শের জন্য অনেক ধন্যবাদ। এটা এখন আপনি রেখে দিন। বাড়িতে গিয়ে আমি নেব। 

ওরা মিলে গিয়ে আবার চারজনে একসঙ্গে হলো। মিলের পরিচালক ওদের খাতির করে বসিয়ে দুধ এনে দিল। বাড়ি ফেরার একটা ভালো পথ ধরিয়ে দিল। বাড়িতে ফিরে ওরা সবাই স্বীকার করল, মিলে যাওয়ার পথটা খারাপ; মিলের কাছে একটা সেতু করে দিলে এবং পথটা সোজা করলে তিন-চার ঘণ্টার পথটা হয়ে উঠবে এক ঘণ্টার। 

এডওয়ার্ড ও ক্যাপ্টেন দুজনেই এর প্রয়োজনীয়তা একবাক্যে স্বীকার করল। কিন্তু শার্লোতে পাকা গৃহিণীর মতো টাকার কথা তুলল। বলল, তোমরা তো পরিকল্পনা করেই খালাস। কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা হতে? 

এডওয়ার্ড তখন নূতন যুক্তি খাড়া করে বলল, বছরের পর অনেক হিসাবপত্র করে মিলটা থেকে যা পাই তা খুবই সামান্য। তার থেকে মিলটা যদি বিক্রি করে দিই। তাহলে সেই টাকাটা আমরা এই কাজে লাগাতে পারি। তাহলে আমাদের পরিকল্পনা সার্থকভাবে রূপায়িত হবে। 

ওতিলে এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এডওয়ার্ড তার সামনে বড় নক্সাটা ধরে বলল, ওতিলে, তোমার মতামত বলো। কোনও কুণ্ঠা না করে তোমার মত ব্যক্ত করো। 

ওতিলে ভাল করে নক্সাটা দেখে পাহাড়ের উপর যেখানে গ্রীবাস বা বিশ্রামাগার করার কথা ছিল সেখানে হাত দিয়ে বলল, আমার মনে হয় গ্রীষ্মবাস এখানে না করে 

একটু দূরে একেবারে বনের মধ্যে করা উচিত। তাহলে বাইরের জগৎ থেকে ওটা হয়ে পড়বে একেবারে অপরিদৃশ্য। ওখান থেকে আমাদের এই পুরনো প্রাসাদ বা গ্রাম কোনও কিছুই দেখা যাবে না। 

ওতিলের কথায় এডওয়ার্ড মনে মনে কিছুটা ক্ষুণ্ণ হলেও পরে স্বীকার করল, কথাটা মন্দ নয়। 

অষ্টম পরিচ্ছেদ

ক্যাপ্টেন আর একবার সবাইকে জায়গাগুলোতে নিয়ে গিয়ে সকলের মতামত নিল। মাপজোপ করে নক্সা তৈরি করল এবং তার সঙ্গে ব্যয়ের তালিকাও দিল। তারপর একদিন এডওয়ার্ডের কাছে প্রস্তাব করল, শার্লোতের আসন্ন জন্মদিনে এই পরিকল্পনার ভিস্তিপ্রস্তর স্থাপিত হলে ভালো হয়। 

জন্মদিন পালন করার কোনও ইচ্ছা ছিল না এডওয়ার্ডের। সে বলল, এরপর ওতিলের জন্মদিন আসছে। তাহলে সেটাও পালন করতে হবে। 

অবশেষে এডওয়ার্ড মত দিল এবং সেইমতো কাজ শুরু হলো। এই নূতন পরিকল্পনা অনুসারে একটি উন্নত প্রশস্ত পাকা রাস্তা গ্রাম ও প্রাসাদকে যুক্ত করবে এবং এক জায়গায় এই রাস্তাটা আর একটি পথের সঙ্গে মিলিত হবে, যে পথটা প্রাসাদের বাগান থেকে চলে গেছে পাহাড়ের উপর। 

এডওয়ার্ড একটা জিনিস লক্ষ করল ওতিলে ঘরের মধ্যে সাংসারিক কাজকর্ম নিয়ে থাকতে ভালোবাসে। বাইরে বেড়াতে গিয়েও সে বিভিন্ন কাজের অজুহাতে ঘরে ফেরার। চেষ্টা করে। 

তবে সারা দিন যে কাজই করুক না, সন্ধের সময় তারা রোজ এক জায়গায় মিলিত হয়। একসঙ্গে বসে কথা বলে। আপন আপন মনের ভাব প্রকাশ করে। 

অনেক দিন কবিতা ও গান-বাজনার আসর বসেনি। তাই সেদিন সন্ধ্যায় এডওয়ার্ড কতকগুলো প্রেমের কবিতা পড়তে লাগল আবৃত্তি করে। ওতিলে ডার ডান দিকে একটা চেয়ারে বসেছিল। সে চেয়ারটার কাছে টেনে এনে এডওয়ার্ডের ঘাড়ের উপর ঝুঁকে তার কোলের উপর রাখা বইটা অনুসরণ করতে লাগল। এডওয়ার্ডও আস্তে আস্তে পড়তে লাগল যাতে ওতিলে ঠিকমতো অনুসরণ করতে পারে তাকে। ওদের রকমসকম দেখে শার্লোতে ও ক্যাপ্টেন পরস্পরের দিকে তাকাল। মৃদৃ হাসির রেখা ফুটে উঠল তাদের মুখে। 

তারা আরও বিস্মিত হলো আর একটি ঘটনায়। 

একদিন সন্ধের পর এডওয়ার্ড সকলকে বলল, আজ একটু বেশি সময় বসে যাও। আমি বাঁশি বাজাব। ওতিলে, আজ তুমি আমার সঙ্গে পিয়ানো বাজাবে। 

ওতিলে ভালোভাবেই পিয়ানো বাজিয়ে যেতে লাগল। শার্লোতে একটা জিনিস লক্ষ করে আশ্চর্য হয়ে গেল, সে যেমন পিয়ানো বাজাবার সময় এডওয়ার্ডকে তাল রাখার সুযোগ দিত, ওতিলেও ঠিক তাই করল। 

এবার শার্লোতে ও ক্যাপ্টেন নিঃসন্দেহে বুঝতে পারল যে এডওয়ার্ডের প্রতি ওতিলের আগ্রহ দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। ভবিষ্যৎ পরিণামের কথা ভেবে ওতিলের এ আগ্রহ যেমন সমর্থন করতে পারে না শালোতে তেমনি তার জন্য প্রকাশ্যে তিরস্কারও করতে পারে না। 

এদিকে ক্যাপ্টেনও অনুভব করল বাস্তব অবস্থা তাকে ও শার্লোতেকে অনেক কাছে এনে ফেলেছে। অথচ সে এটা চায় না। চায় না বলেই সকালে রোজ শার্লোতে যখন বাগানে যায়, ইচ্ছা করে সেই সময়টা এড়িয়ে যায় ক্যাপ্টেন। পরে তা বুঝতে পেরে শার্লোতেও কিছু বলে না। শুধু ক্যাপ্টেনের প্রতি তার শ্রদ্ধাটা বেড়ে যায়। শার্লোতের সঙ্গে একা থাকতে চায় না ক্যাপ্টেন। কিন্তু তা না চাইলেও কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে শার্লোতের প্রতি তার আগ্রহ বেশ ফুটে উঠতে থাকে। শার্লোতের জন্মদিন উপলক্ষে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কাজের ব্যাপারে উঠেপড়ে লেগে যায় সে। ওদিকে পাহাড়ের ধারে পাথর ভাঙার কাজ শুরু হয়ে গেছে। 

সেদিন সন্ধ্যায় এডওয়ার্ড হঠাৎ হুকুম করল ক্যাপ্টেনকে, তোমার বেহালাটা নিয়ে এস। আর শার্লোতে পিয়ানো বাজাবে।

সত্যিই চমৎকার বাজাল ওরা দুজনে। বিশেষ দরদ দিয়ে বাজাল। ওদের বাজনা শুনে এডওয়ার্ড ঠাট্টা করে ওতিলেকে বলল, আমাদের থেকে ওরা আরও ভালো বাজিয়েছে। তা বাজাক। তবু আমরা যেমন বাজাচ্ছি তেমনি বাজিয়ে যাব দুজনে। 

নবম পরিচ্ছেদ

অবশেষে দীর্ঘ প্রতীক্ষা আর কর্মতৎপরতার পর শার্লোতের জন্মদিন এসে গেল। দুটো রাস্তা আর পাহাড়ের উপর সেই গ্রীষ্মবাসের কাজ অনেক কষ্টে অনেক তাড়াহুড়ো করে শেষ হলো ক্যাপ্টেনের চেষ্টায়। একটি রাস্তা প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে চার্চের পাশ দিয়ে পাহাড়ের মাথায় চলে গেছে। আর একটি পথ নদীর উঁচু বাঁধ হিসাবে গাঁয়ের পাশ দিয়ে চলে গেছে। এই রাস্তা বাঁধের মতোই নদীর জলোস হতে রক্ষা করবে গ্রামবাসীদের। 

জন্মদিনে ওরা প্রথমে চার্চে গেল। সেখান থেকে অতিথিদের সঙ্গে যাবে পাহাড়ের উপর নূতন বাড়িতে। গাঁয়ের আবালবৃদ্ধবনিতা সব লোকই প্রায় ঘর ছেড়ে নূতন পথে নেমে পড়েছিল। তাদের খুশি আর ধরে না। সবাই নূতন পথে হাঁটছিল। কারণে অকারণে হেঁটে চলেছিল। গায়ের লোক ছাড়াও কিছু নিয়ন্ত্রিত অতিথি ছিল। তারা এ অঞ্চলের বিশিষ্ট লোক। 

বাড়ির সকলের মধ্যে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল আজ শার্লোতে। এক সময় সে এই খুশির আবেগে ক্যাপ্টেনের হাতে চাপ দিল। এবার পাহাড়ের চুড়ার উপর বাড়িটা তৈরির জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হবে। একজন রাজমিস্ত্রী এক হাতে একটা হাতুড়ি আর এক হাতে একটা কনিক নিয়ে দাঁড়িয়ে ছন্দোবদ্ধ একটা ছড়া আবৃত্তি করল। তার অর্থ হলো এই : বাড়ি নির্মাণের জন্য তিনটে জিনিস দরকার। প্রথমে চাই ভালো। জায়গা অর্থাৎ যেখানে বাড়িটা দাঁড়িয়ে থাকবে এবং যেখানে তার ভিত্তি গাঁথা হবে সে জায়গাটা শক্ত হওয়া চাই। তারপর তার ভিত্তিটা খুব ভালো করে গাঁথা চাই। তারপর তার নির্মাণকার্য ভালো হওয়া চাই। প্রথমটির জন্য দায়ী হচ্ছেন বাড়ির মালিক কারণ যে জায়গায় বাড়ি নির্মিত হবে সে জায়গাটা তিনিই যোগাড় করবেন। দ্বিতীয়টার জন্য দায়ী স্থপতিরা কারণ কিভাবে ভিত্তি নির্মিত হবে সে নির্দেশ তারাই দেবেন। তবে তৃতীয়টির জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী হলো রাজমিস্ত্রীরা, কারণ বাড়ি নির্মাণের যাবতীয় কাজ তাদের হাতেই। 

প্রধান রাজমিস্ত্রী এই ছড়ার মাধ্যমে উপরোক্ত কথাটি বলার পর বলল, তার কথা না বাড়িয়ে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হোক। যে ইটটি এখন স্থাপন করা হবে, সব ইটগুলো হবে তার মতো একই রকমের। স্বভাবের দিক থেকে অনেক মানুষ এক হলেও আইনের দ্বারা তাদের সম্পর্ক যেমন ঘনীভূত হয় তেমনি ইটগুলো আকার প্রকারে এক হলেও সিমেন্টের শক্তি এদের ঐক্যবদ্ধ করবে এবং এই শক্তির দ্বারা তাদের সম্পর্ক আরও ঘনীভূত হয়ে উঠবে। 

এই বলে রাজমিস্ত্রী প্রথমে কান্নিক ও পরে হাতুড়িটা শার্লোতের হাতে দিল। শার্লোতেই আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবে। শার্লোতে প্রথমে একটি পাথর বসিয়ে দিল সিমেন্ট দেওয়া এক নির্দিষ্ট জায়গায়। তারপর হাতুড়ি দিয়ে তিনবার ঠুকল পাথরটার উপর। 

ভিত্তিপ্রস্তর বাড়িটার এক কোণে স্থাপিত হবার পর রাজমিস্ত্রী আবার বলতে লাগল, আমরা যারা মিস্ত্রী তারা বাড়িটা নির্মাণ করলেও লোকে ইটকাটিয়েদের ও স্থপতিদের কাজটাকেই বড় করে দেখে। বাড়ি তৈরি হবার সময় ইটকাটিয়েরা যখন ইট কাটে তখন তারা সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আর যখন বাড়িটা শেষ হয়ে যায় তখন তার স্থাপত্যমূলক কারুকার্য দৃষ্টি আকর্ষণ করে সকলের। কিন্তু আজকের এই বাড়িটা যাতে অতীতের বহু সাক্ষ্য বহন করতে পারে তার জন্য আজকের দিনের বেশ কিছু নিদর্শনসম্বলিত ঢাকনাঢাকা এক বাক্স এই বাড়ির গর্তে প্রোথিত করব আজ আমরা। এতে আছে এ কালের বহু জ্ঞাতব্য তথ্যলেখা, কিছু প্রস্তরখণ্ড। এর সঙ্গে আছে ভালো বোতলে ভরা কিছু মদ আর আছে এ বছরে ছাপা আরও কিছু মুদ্রা যা বাড়ির মালিক দান করেছেন। এই বাক্সে আরও স্থান আছে। যদি কোনও অতিথি এ যুগের কিছু নিদর্শন ভাবীকালের লোকের জন্য দান করতে চান তাহলে তা দিতে পারেন। 

একথা শুনে অতিথিরা বিস্মিত হয়ে গেল। তারপর একজন যুবক অফিসার এগিয়ে এসে বলল, আমার কোটের কয়েকটি বোম ছিঁড়ে আমি দিতে চাই। 

তার দেখাদেখি মেয়েরাও চিরুনি, স্মোলিং সল্টের শৌখিন শিশি প্রভৃতি অনেক শৌখিন জিনিস বাক্সের মধ্যে ফেলে দিল। ওতিলেও কিছু দেবার কথা ভাবছিল। কিন্তু ঠিক করে উঠতে পারছিল না। এডওয়ার্ড তা বুঝতে পেরে সম্মতি দেওয়ায় সে তার গলা থেকে সোনার চেনটা খুলে বাক্সে ফেলে দিল। এই চেনেই একদিন তার বাবারও ফটোটা ঝোলানো থাকত। 

এবার রাজমিস্ত্রী বলল, আমরা তাহলে বাক্সটি চিরকালের জন্য প্রোথিত করছি এই বাড়ির গর্ভে। আমরা চাই এই বাড়ির বর্তমান ও ভবিষ্যতের মালিকরা এই পাথরের বাক্সের মতোই অক্ষয় সুখের অধিকারী হোক। তবে এটাও ঠিক যে যেহেতু মানব জীবনের সব কিছুই ক্ষণস্থায়ী, এই অক্ষর পাথরের বাক্স একদিন না একদিন এই মাটির গর্ভ থেকে উত্তোলিত হবেই। যে বাড়ির আমরা নির্মাণ করব তা যখন সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হবে তখন এ বাক্সটি তোলা হবেই। 

এরপর বাক্সটি বসানো হলো একটি সুন্দর পানপাত্র হতে মদ খেয়ে রাজমিস্ত্রী গ্লাসটি সামনের দিকে ছুঁড়ে দিল। সেখানে আরও মিস্ত্রী ও শ্রমিক দাঁড়িয়ে অনুষ্ঠানটি দেখছিল। গ্লাসটি মাটিতে পড়ল না। তাদের মধ্যেই একজন লুফে নিয়ে পাশের লোকদের তা দেখাতে লাগল। 

এদিকে ভিত্তিপ্রস্তরের কাজ শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে মিস্ত্রী ও শ্রমিকরা কাজ শুরু করে দিল একযোগে। অতিথিরা তখন পাহাড়ের উপর থেকে চারদিকের দৃশ্য দেখতে লাগল। সামনের দিকে কয়েকটি গ্রাম দেখা যাচ্ছে আর দেখা যাচ্ছে রূপালি সুতোর মতো এক নদী। দূরে রাজধানীর বড় বড় প্রাসাদের চূড়াগুলোও দেখা যাচ্ছিল। বাড়ির পিছনের দিকে ছিল শুধু অরণ্যাচ্ছাদিত পাহাড়। সেই সব পাহাড় আর বনের ভিতর থেকে এক বিশাল পর্বতমালার কয়েকটি নীল শৃঙ্গ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল দিগন্তকে আড়াল করে। 

অতিথিরা অবাক বিস্ময়ে চারদিকের দৃশ্যাবলি দেখতে লাগল আশ মিটিয়ে। তাদের মধ্যে একজন পরামর্শ দিল, সামনে যে তিনটি পৃথক জলাশয় দেখা যাচ্ছে সেগুলি কেটে পরস্পরকে যুক্ত করে দিলে একটি বিরাট হ্রদে পরিণত হবে এই জলাশয়গুলো। 

ক্যাপ্টেন বলল, হ্যাঁ তা করা যায়।

কিন্তু এডওয়ার্ড বলল, করতে পার, তবে মধ্য জলাশয়টির ধারে যে সব গাছ আছে সেগুলোকে বাঁচিয়ে করতে হবে। ঐ গাছগুলো আমি নিজের হাতে একদিন বসিয়েছি। 

এই বলে ওতিলেকে এডওয়ার্ড তা ভালো করে দেখাল। ওতিলে জিজ্ঞাসা করল, গাছগুলো কতদিন আগে বসানো হয়েছে। 

এডওয়ার্ড বলল, তুমি যখন দোলনায় দোল খেতে তখন আমি ঐ গাছ বসাই। 

এবারে সকলে প্রাসাদে ফিরে এল। খাওয়া-দাওয়ার পর বসার ঘরে চারজনে বসল। গাঁয়ের অনেক লোক তাদের বাড়ির উঠোনে জমায়েত হয়েছিল। ক্যাপ্টেন তাদের বুঝিয়ে দিয়েছে গ্রামকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য প্রতি রবিবার ও ছুটির দিন তাদের নিজেদের হাতে কাজ করতে হবে। 

গ্রামের লোকেরা সব চলে গেলে ওরা চারজনে বসে আবার ঘনিষ্ঠতার কথা বলতে লাগল। এমন সময় হঠাৎ চাকরে একখানি চিঠি নিয়ে এল। চিঠি পড়ে এডওয়ার্ড শার্লোতেকে বলল, কাউন্ট আগামীকাল আসছেন। 

শার্লোতে বলল, তাহলে কাউন্টপত্নীও আসছে নিশ্চয়? 

এডওয়ার্ড বলল, হ্যাঁ, উনি আসবেন অন্য দিক থেকে। কাউন্ট আগামীকাল আমাদের এখানে থাকতে চেয়েছেন। ওঁরা এখানে রাতটা কাটিয়ে পরদিন আবার অন্য জায়গায় বেড়াতে যাবেন একসঙ্গে। 

শার্লোতে বলল, তাহলে আমাদের এখন থেকে প্রস্তুত হতে হবে।

ওতিলে সঙ্গে সঙ্গে বলল, কি কি করতে হবে আমাকে বলো।

শার্লোতে ওতিলেকে কি বলায় সে চলে গেল। 

ক্যাপ্টেন জানতে চাইল দাম্পত্য সম্পর্ক বর্তমানে কি অবস্থায় আছে। কেননা ওদের কথা ও আগেই কিছু শুনেছিল। এডওয়ার্ড তখন বলল, কাউন্ট ও কাউন্টপত্নী ওদের বিয়ের পর দুজনেই প্রেমে পড়ে। জড়িয়ে পড়ে এক অবৈধ প্রেমসংসর্গের জালে। বিবাহ-বিচ্ছেদ হয় হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিবাহ-বিচ্ছেদ হলো না। 

কাউন্ট এডওয়ার্ডের থেকে বয়সে কিছু বড় হলেও বন্ধুত্ব অনেক দিনের এবং ওদের সম্পর্ক বরাবর ভালোই আছে। 

শার্লোতের ইচ্ছা ছিল না কাউন্টরা ওদের বাড়িতে আসুক। ওতিলে ওদের কথা জানতে পারুক। এডওয়ার্ড বলল, আর দিনকতক পরে আসতে পারত। কারখানা। বিক্রির ব্যাপারটা চুকে গেলে ভালো হতো। এখনও সব দলিল হয়নি। 

পরদিন সকালে ওরা প্রাসাদের ছাদ থেকে অতিথিদের আসার পথের দিকে তাকিয়ে রইল। এডওয়ার্ড বলল, কে যেন ঘোড়া ছুটিয়ে আসছে। ক্যাপ্টেন বলল, কাউন্ট আসছে। 

এডওয়ার্ড বলল, না মিটলার। 

সত্যি সত্যিই মিটলার এসে হাজির হলো ওদের প্রাসাদে। এডওয়ার্ড বলল, গতকাল এলেন না কেন? উৎসবের দিন ছিল। 

মিটলার বলল, ওসব হৈচৈ ও গোলমাল আমার ভালো লাগে না। আজ শান্ত পরিবেশে আমি আমার বন্ধুর জন্মদিন পালন করতে এসেছি। 

এডওয়ার্ড হাসিমুখে বলল, কিন্তু সময়টা তো আর পিছিয়ে দিতে পারবে না।

মিটলার বলল, আসল কথা আসতে মনে হলো তাই চলে এলাম। গতকাল একটা বাড়িতে অনেক দিন পর রাত কাটাই। তাদের বাড়িতে শান্তি স্থাপন করি। পরে ভাবলাম শুধু ঝগড়ার সময় নয়, শান্তির সময়েও বন্ধুদের বাড়িতে মাঝে মাঝে যাওয়া। উচিত। এই কথা আপন মনে ভেবেই চলে এলাম। 

এডওয়ার্ড বলল, গতকাল বাড়িতে কত লোক ছিল। আজ আর কেউ নেই।

শার্লোতে বলল, আজ আর একটু পরে কাউন্ট ও কাউন্টপত্নীকে দেখতে পাবেন। 

কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্য থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেল মিটলার। তার টুপি, আর ঘোড়ার চাবুকটা খুঁজতে লাগল। বলল, এক অশুভ নক্ষত্র সব সময় আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। যখনই কোথাও গিয়ে একটু বিশ্রাম করতে চাই তখনি একটা একটা বাধা আসবেই।

মিটলারকে ওদের সকলের ভালো লাগত। এই অদ্ভুত লোকটির সঙ্গ ও সংস্পর্শ মাঝে মাঝে কামনা করত ওরা। কিন্তু ওকে কাছে পেত না। পেলেও আবার পরক্ষণেই চলে যেত। 

মিটলার বলল, যারা বিয়ের পবিত্রতা বা দাম্পত্য সম্পর্কের শুচিতা রক্ষা করতে জানে না, বিয়ের গুরুত্বকে স্বীকার করতে চায় না, তাদের সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। আমি তাদের মুখদর্শন করতে চাই না। বিয়ে হচ্ছে মানবতার সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান। এই বিয়ে মানুষের পাশবিক কামপ্রবৃত্তির দুর্বার আবেগকে সামাজিক অনুশাসন ও পবিত্র প্রেমসম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ করে তার সঠিক উত্তরণ ঘটায়। মানুষের বিবাহিত জীবনে দুঃখ নেই তা বলছি না। কিন্তু তার সঙ্গেও আনন্দও কম নেই। স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের কাছ থেকে আনন্দ ও বেদনা দুই-ই পায়। কে কার কাছ থেকে কতখানি ঋণী, কে কার কাছ থেকে কতখানি ভালোবাসার আনন্দ ও বেদনা লাভ করেছে তার পরিমাপ করা সম্ভব নয়। কারণ তা অনন্ত। তাছাড়া আমাদের সবচেয়ে যে আপনার, আমাদের অন্তরশায়ী বিবেক, একদিক দিয়ে আমাদের জ্ঞান হাওয়ার পর থেকে তার সঙ্গে আমরা বিবাহিত। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর মতোই বিবেকের সঙ্গে আমাদের মিলেমিশে চলা দরকার। কিন্তু সেই বিবেকের নির্দেশ আমরা সব সময় মেনে চলতে পারি না। স্বামী-স্ত্রীর মতো সেই বিবেকের সঙ্গে আমাদের ঝগড়া হয় মাঝে মাঝে।

মিটলারের কথা শেষ হতে না হতেই একটা ঘোড়ার গাড়ি হতে কোচম্যান একটা শিঙা বাজিয়ে কাউন্টের আগমন ঘোষণা করল। বাড়ির সকল লোক কাউন্টের অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠল। এদিকে মিটলার তার ঘোড়ায় উঠে মুহূর্তে মদ্যে সরেও পড়ল সবার অলক্ষ্যে। 

দশম পরিচ্ছেদ

অতিথিদের যথাযোগ্য সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরে তোলা হলো। এ বাড়িতে বহুদিন পর আবার পদার্পণ করলেন কাউন্ট। যৌবনে কতবার এ বাড়িতে বন্ধু এডওয়ার্ডের সঙ্গে কাটিয়ে গেছেন তিনি। এ বাড়ির সব কিছুই তার চেনা। আজ কাউন্ট বা কাউন্টপত্নীর দুজনেরই চেহারার কিছু পরিবর্তন ঘটলেও এবং তাঁদের সেই যৌবন না থাকলেও প্রৌঢ়ত্বসুলভ এক গাম্ভীর্য তাদের চেহারাকে দান করেছে এক আকর্ষণীর মর্যাদা। যৌবনসুলভ চঞ্চলতার পরিবর্তে ধৈর্য-স্থৈর্য ও আত্মবিশ্বাসে কেমর যেন প্রগাঢ় হয়ে উঠেছে তাঁদের ব্যক্তিসত্তা। তাদের আচার-আচরণ আগের থেকে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি মার্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত। 

বহুদিন পর তাঁদের কাছে পেয়ে খুব ভালো লাগল এডওয়ার্ড ও শার্লোতের। অতীত দিনের কথা মনে পড়ায় কাউন্টের ভালো লাগছিল ওদের সাহচর্য। ওরা লক্ষ্য করল, কাউন্টের ব্যবহার আগের থেকে হয়ে উঠেছে অনেক বেশি অন্তরঙ্গ ও মমতা-মধুর। 

প্রথমদিকে ওরা দুদলে বিভক্ত হয়ে গেল। মেয়েরা এক জায়গার গিয়ে পোশাক পরিচ্ছদের ফ্যাশান নিয়ে গল্প জুড়ে দিল। কিছু গোপন মেয়েলি কথাবার্তা বলল, অন্যদিকে পুরুষরা অন্য এক জায়গায় বসে ঘোড়া ও ঘোড়া বলদের গল্প করতে লাগল। 

যাই হোক, খাবার সময় ওরা আবার জড়ো হলো সকলে এক জায়গায়। কাউন্ট ফরাসি ভাষায় কথা বলতে লাগলেন যাতে চাকরেরা তাঁদের কোনও কথা বুঝতে না পারে। 

কিন্তু ওদের সমস্ত আলোচনা শুধু একটি বিষয়কে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হতে লাগল বহুক্ষণ ধরে। বিষয়টা এতদূর গড়াবে শার্লোতে প্রথমে তা বুঝতে পারেনি। সে হঠাৎ কাউন্টকে জিজ্ঞাসা করেছিল তার এক পুরনো বান্ধবীর কথা। কাউন্ট উত্তরে বলেছিলেন ভদ্রমহিলা বিবাহবিচ্ছেদ করেছেন। 

শার্লোতে তখন বলেছিল, তার বান্ধবী এভাবে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের পথে পা বাড়িয়ে ভালো করেনি। তার বিবাহবিচ্ছেদ সমর্থন করতে পারেনি শার্লোতে। 

কিন্তু কাউন্ট বললেন অন্য কথা। তিনি বললেন, আমরা সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্কটাকে অক্ষয় ও অচ্ছেদ্য বলে মনে করি। মিলনান্ত নাটক দেখে আমাদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাস আরও বেড়ে যায়। এই সব নাটকে দেখানো হয় বিয়েটাই যেন তাদের প্রেমের একমাত্র উদ্দেশ্য। 

নায়ক-নায়িকার মিলন একমাত্র শুভ পরিণয়ে পরিণত হলেই যবনিকাপাত হয় কিন্তু জীবনটা নাটক নয়। সেখানে বিবাহিত জীবনের যবনিকার অন্তরালে অনেক দৃশ্যই সকলের অলক্ষে অগোচরে অনুষ্ঠিত হয়। পরে যবনিকা উঠলে দেখি সে প্রেমের আর কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই। 

শার্লোতে প্রতিবাদের সুরে বলল, সব ক্ষেত্রেই এটা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় বিবাহের রঙ্গমঞ্চে দ্বৈত ভূমিকায় অভিনয় করতে করতে অনেকে মঞ্চ ছেড়ে চলে। গিয়েও পরে আবার ফিরে এসে সেই একই ভূমিকায় অভিনয় করেছে। 

কাউন্ট বললেন, তা হয়ত করেছে। কিন্তু আপনি দেখবেন জগতে অনেক কিছুই পরিবর্তনশীল তখন সেই ব্যাপক পরিবর্তনশীলতার মাঝে বিয়েটা যদি অক্ষয় অপরিবর্তনীয় একটা কিছু হয়ে যায় তাহলে সেটাকে অবশ্যই আমাদের বেখাপ্পা লাগবে মাঝে মাঝে। 

এবার কাউন্ট এডওয়ার্ডকে লক্ষ করে বললেন, তবে অবশ্য আমি তোমাদের বিয়ের কথা বলছি না। তোমাদের এই পুনর্মিলনে আজ আমি যেমনি খুশি হয়েছি, তেমনি যখন তোমাদের প্রথম প্রেম ব্যর্থ হয়, তোমরা যখন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড় পরস্পর থেকে তখন আমি সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাই মনে। তোমরা যখন নাচের আসরে নাচতে দুজনে তখন তোমাদের খুব ভালো লাগত, তোমাদের জুটি ছিল চমৎকার। এডওয়ার্ডের বাবা যখন জোর করে ওর অন্যত্র বিয়ে দেয় তখন আমি এডওয়ার্ডকেই দোষ দিয়েছিলাম। আমি ওকে আরও শক্ত হতে বলেছিলাম। 

কাউন্টপরী বলল, এ বিষয়ে আমি শার্লোতেকেও দোষ না দিয়ে পারছি না। কারণ আমি বেশ তখন লক্ষ করেছি ও এডওয়ার্ডকে ভালোবাসলেও মাঝে মাঝে ওর নজর অন্যদিকে ঘোরাফেরা করত যার জন্য এডওয়ার্ডকে বেশ কিছুদিন দেশভ্রমণে ঘুরে বেড়াতে হয়। অবশ্য ওর ভালোবাসায় নিষ্ঠার অভাব খুব একটা ছিল না। 

কাউন্ট বললেন, আসল কি জান, মেয়েরা যাকে একবার ভালোবাসে তার প্রতি তাদের আসক্তির অনুভূতিটা বিচ্ছেদের দ্বারা বিকৃত বা বিলপ্ত হয় না। তা দীর্ঘকাল বেঁচে থাকে তাদের মনে। 

কাউন্টপত্নী বলল, এতে তোমারাও কম যাও না। 

কাউন্ট এডওয়ার্ডকে আবার বললেন, শার্লোতে প্রথম স্বামীর মত্যু আর তোমাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের এই বিবাহ তোমাদের অমর প্রেমের বিজয়পতাকাকে উড্ডীন করেছে নূতন করে। তবে অবশ্য সব বিবাহই ভালো নয়। অনেকের বিয়ের পর দেখতে একজন স্বেচ্ছাচারী ওয়ে ওঠে। বিয়েটাকে ব্যভিচারের ছাড়পত্র হিসাবে গণ্য করে। মানুষ তার প্রতিশ্রুতির কথা রাখবার চেষ্টা করে, কিন্তু পরিবর্তনশীল জগৎ, উদাসীন জগৎ মানুষের কোনও কথা রাখতে চায় না। সব ধুয়ে-মুছে ভেঙে-চুরে দিতে চায়। 

শার্লোকে ওতিলের সামনে তাদের বিবাহ সম্পর্কে এই সব কথা আলোচনা করতেও চাইছিল না। এর আগে একবার কৌশলে সে প্রসঙ্গটা পাল্টাবার চেষ্টা করে। ব্যর্থ হয়। কাউন্টও তার ইচ্ছার কথাটা ঠিক করতে পারেননি। শার্লোতে এবার প্রসঙ্গটা পাল্টাবার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে বলল, দেখুন, অতীতের কথা ঘাঁটাঘাঁটি করে আর কোনও লাভ নেই। বিয়ের ব্যাপারে কে কি করে, কে কতটা বিশ্বস্ত তা আমাদের দেখার দরকার নেই। তবে আমরা যতদূর সম্ভব আমাদের দাম্পত্য সম্পর্কের শূচিতা রক্ষা করে চলার চেষ্টা করি। আমাদের কথা রাখার চেষ্টা করে চলি। এইটুকুই শুধু বলতে পারি। অতীতে যে যা করেছি তা আর ফিরবে না। এখন ওকথা বাদ দিন। 

এবার কাউন্ট বুঝতে পেরে চুপ করলেন। এরপর ঠিক হলো ক্যাপ্টেন আসার পর থেকে ওরা যে সব নূতন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে এ অঞ্চলের পথঘাটের উন্নতির জন্য তা অতিথিদের দেখানো হবে। ওদের প্রাসাদের চারদিকের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো অতিথিরা ঘুরে দেখবেন।

ওতিলে ঘরে রইল। তার দোষ নেই। সে এডওয়ার্ডের দেওয়া কাজ একমনে মলে করছিল। কারখানা বিক্রির কাগজপত্র এখনও সব তৈরি হয়নি। ও তাই করছিল। 

ক্যাপ্টেন ওদের সঙ্গে গেল। ওরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে নদীর ধার দিয়ে সোজা পাহাড়ের উপর যে বাড়ি তৈরি হচ্ছিল সেখান পর্যন্ত গেল। সত্যিই জায়গাটা চমৎকার লাগল ওদের। এডওয়ার্ড ওদের চারদিকে আঙুল দিয়ে দেখাতে লাগল। পাথর ভেঙে এগিয়ে যাওয়া শীর্ণ নদী, জলাশয়ের স্বচ্ছ জল, প্রাসাদসংলগ্ন পপলার আর পাইন গাছের সাজানো বাগান আর এদিকে পাহাড়সংলগ্ন ঘন বন, সব মিলিয়ে এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য বড় মনোরম। 

ক্যাপ্টেন নক্সাটা আনতে ভুলে গিয়েছিল বলে প্রাসাদে ফিরে গেল। এতক্ষণ সে মুখেই কাউন্টকে বোঝাচ্ছিল পরিকল্পনাটা। ক্যাপ্টেন চলে যেতে কাউন্ট শার্লোতের সঙ্গে এবং এডওয়ার্ড কাউন্টপত্নীর সঙ্গে কথা বলতে লাগল। 

কথায় কথায় কাউন্ট একসময় শার্লোতেকে বললেন, ক্যাপ্টেন ভদ্রলোক সত্যিই খুব কাজের লোক, গুণী লোক। এখানে বেচারা শুধু পড়ে আছে। আমি ওকে ভালো জায়গায় কাজের ব্যবস্থা করে দেব। এখনি ওর কাজের ব্যবস্থা করে চিঠি লিখে লোক পাঠাব এক জায়গায়। 

কথা নয়, যেন শেল বিধল শার্লোতের কানে। ক্যাপ্টেন এত তাড়াতাড়ি তাদের বাড়ি থেকে চলে যাক এটা সে চায়নি। কোনও বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও ক্যাপ্টেনের প্রতি তার তরল আসক্তিটা এবার শক্ত হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তার প্রতি ভালোলাগার আলতো অস্পষ্ট ভাবটা এবার ঘন হয়ে উঠতে শুরু করেছে। তরুণী ওতিলের অনিবারণীয় আকর্ষণে এডওয়ার্ড ক্রমাগত যেভাবে তার দিকে ঝুঁকে পড়েছে, এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার মনে এডওয়ার্ডের আসনটা শূন্য হয়ে পড়েছে স্বাভাবিকভাবে। কর্মপাগল ভাবভোলা ক্যাপ্টেনের নিরাসক্ত ব্যক্তিত্ব ধীরে ধীরে তার মোহপ্রসারী আবেদনের ছটা বিস্তার করে শার্লোতের মনের সব শূন্যতাকে ভরিয়ে তুলেছিল। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে দুদণ্ড কথা বলে শান্তি পেত শার্লোতে। কিন্তু ক্যাপ্টেন এবার চলে যাবে। বাড়িটা আবার শূন্য হয়ে পড়বে আর সঙ্গে সঙ্গে তার মনের পতিত জমিটাও। 

একাদশ পরিচ্ছেদ

এদিকে সুচতরা কাউন্টপত্নী সরলপ্রকৃতির এডওয়ার্ডের সঙ্গে কথা বলতে বলতে একটা নূতন জিনিস আবিষ্কার করে ফেলল। সে জিনিস হলো ওতিলের প্রতি তার ক্রমবর্ধমান আসক্তি। কাউন্টপত্নী বাড়িতে আসার পর থেকেই লক্ষ করছিল কথায় কথায় এডওয়ার্ড ওতিলের নাম উল্লেখ করছিল এবং তাকে বিভিন্নভাবে গুরুত্ব দান করছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। 

কাউন্টপত্নী কৌশলে এডওয়ার্ডের সঙ্গে এমন সব কথা বলছিল যাতে ওতিলের প্রতি এডওয়ার্ডের দৃষ্টিভঙ্গিটা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। একবার খাবার টেবিলে সবার সামনে ওদের বাড়ির সামনের শরৎকালে বেড়াতে যাবার জন্য নিমন্ত্রণ করল এডওয়ার্ডকে। বলল, শার্লোতেকে নিয়ে বর্ষার সময় অবশ্যই যাবেন। 

এডওয়ার্ড তখন সকলের সামনেই কাউন্টপত্নীকে জিজ্ঞাসা করল, ওতিলে তাদের সঙ্গে যেতে পারবে কি না? কাউন্টপত্নী বলল, সেটা আপনার ইচ্ছা, আপনি আর কাকে সঙ্গে নেবেন না নেবেন আমি তার কি জানি? 

সেদিন রাত্রিতে নৈশভোজনের পর এডওয়ার্ড কাউন্টের ঘরে গিয়ে তাদের যৌবনকালের গল্প করছিল। কাউন্ট একবার বললেন, তোমার মনে আছে, যৌবনে শার্লোতের পা দুটো কত সুন্দর ছিল?

এডওয়ার্ড আবেগের সঙ্গে বলল, অতীত কেন, আজও ওর পাদুটো সত্যিই সুন্দর এবং ওর পা কেন আমি ওর জুতোও চুম্বন করতে পারি। 

কাউন্ট তাচ্ছিল্যভরে ভরে হেসে উঠলেন আনন্দে। 

হাসি থামিয়ে একসময় কাউন্ট একটা অনুরোধ করলেন এডওয়ার্ডকে। বললেন, এখন কাউন্টপত্নী কোথায় আছে? 

এডওয়ার্ড বলল, এখন মেয়েরা সব এক জায়গায় আছে। কিছুক্ষণ পর আপন আপন ঘরে শুতে যাবে। 

কাউন্ট বললেন, কাউন্টপত্নীর ঘরে আমাকে একবার নিয়ে যাবে? সকাল থেকে আমরা নিরিবিলিতে একবারও দুজনে কোনও কথা বলতে পারিনি। 

এডওয়ার্ড একটা জ্বলন্ত বাতি হাতে করে কাউন্টকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে লাগল। বাড়ির মধ্যে কত ঘর। কত গোপন দরজা। যে ঘর-দরজা একমাত্র এডওয়ার্ডের পক্ষেই নির্ভুলভাবে জানা সম্ভব। কাউন্টপত্নীর নির্জন ঘরে কাউন্টকে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজে অন্ধকারে ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল এডওয়ার্ড। 

তারপর তার নিজের ঘরে ফেরার পথে ওতিলের ঘরটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করল। দেখল, ওতিলে তখনও তারই দেওয়া কাজ করে চলেছে। এডওয়ার্ডের প্রথম ইচ্ছা হচ্ছিল, ওতিলে একবার তার ঘর থেকে নির্জন বারান্দার অন্ধকারে এলেই তাকে জড়িয়ে ধরবে নিবিড়ভাবে।

কিন্তু ওতিলে এল না। ওতিলেকে না পেয়ে শার্লোতের ঘরের দিকে এগিয়ে গেল এডওয়ার্ড। দেখল তার ঘরের দরজা বন্ধ। বন্ধ দরজার উপরে মৃদু করাঘাত করল। এদিকে শার্লোতে শুনতে পেয়ে বিশ্বাস করতে পারল না তার স্বামী এসে দাঁড়িয়ে আছে তার ঘরের বাইরে। কারণ আজকাল এডওয়ার্ড তার ঘরে মোটেই আসে না। 

শার্লোতে একবার ভাবল ক্যাপ্টেন গোপনে দেখা করতে এসেছে তার সঙ্গে। কিন্তু ক্যাপ্টেন সে ধরনের মানুষ নয়। তার কথা ভেবে বেদনায় মোচড় দিয়ে উঠল গোটা অন্তরটা। তারপর ভাবল হয়ত কাউন্টপরী ও ওতিলে কোনও দরকারে কিছু চাইতে এসেছে। যাই হোক, এটা-সেটা ভাবার পর দরজা খুলে দিল। এডওয়ার্ডকে অকস্মাৎ তার ঘরের সামনে দেখে আশ্চর্য হলো। পোশাক খুলে শুতে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছিল শার্লোতে। খালি গা, জাঙিয়টা শুধু পরনে ছিল। এডওয়ার্ডকে ঘরে ঢুকতে দেখে খাটের কাছে একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। এডওয়ার্ড হঠাৎ নতজানু হয়ে বলল, আজ আমি বন্ধুর কাছে শপথ করেছি শার্লোতে, তোমার পায়ের জুতো ও পা আমি চুম্বন করব। 

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সত্যি সত্যিই এডওয়ার্ড তা করল। শার্লোতে বাধা দিয়ে তাকে নিবৃত্ত করতে পারল না। শার্লোতে ভেবেছিল সাময়িক আবেগের একটা উচ্ছ্বাসের বশে তার ঘরে এসে পড়েছে এডওয়ার্ড এবং একটু পরেই সে চলে যাবে। কিন্তু এডওয়ার্ড গেল না। উল্টে ঘরের আলোটা নিবিয়ে দিয়ে তার হাত ধরে বিছানার উপর উঠে গেল। দুজনে দুজনকে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ল। পরস্পরকে বাহুবন্ধনে পরস্পরকে নিবিড়ভাবে ধরা দিলেও অন্ধকারে কেমন যেন সব একাকার হয়ে গেল। 

যতক্ষণ ঘরে আলো জ্বালা ছিল ওরা দুজনে বেশ জানত ওদের সামনে কে রয়েছে, ওদের মনের মধ্যে যাই থাকুক। ওদের মনের গোপন কোণে অবৈধ কামনার যে কুটিল সাপটা লুকিয়ে ছিল তা অন্তত বাইরে আসার সাহস পায়নি। কিন্তু আলোটা নিবে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের দাম্পত্য সম্পর্কে সব বন্ধন আর তার জলজ্যান্ত পার্থিবতাটা উবে গেল মুহূর্তে। সঙ্গে সঙ্গে মনের গোপন গর্ত থেকে কামনার সেই কুটিল সাপটা বেরিয়ে এল স্বচ্ছন্দে। জড়িয়ে ধরল দুজনকেই। শার্লোতের মনে হলো তার পাশে এডওয়ার্ড শুয়ে নেই, তার বদলে শুয়ে আছে তারই আকাক্ষিত নায়ক ক্যাপ্টেন আর এডওয়ার্ডের মনে হলো সে শার্লোতের মধ্য দিয়ে ওতিলেকেই আলিঙ্গন করছে, আসলে তার কাম্য নায়িকার দেহকে ভোগ করছে। 

এইভাবে একদিকে বাস্তব ও কল্পনার সঙ্গে তুমুল যুদ্ধ চলতে লাগল ওদের দাম্পত্যশয্যায়। এদিকে রক্তমাংসের বাস্তব মানুষ আর একদিকে আবেগ ও অনুভূতির রসে সমৃদ্ধ ও প্রাণবন্ত এক কল্পনা। 

প্রাতরাশের টেবিলে দেখা গেল কাউন্ট ও কাউন্টপত্নী নববিবাহিত দম্পতির মতোই কেমন যেন হাসিখুশিতে সজীব। অথচ এডওয়ার্ড ও শার্লোতের মুখ দুটো। কেমন যেন শুকনো দেখাচ্ছিল। ওদের দুজনেররই মনে হচিচ্ছল ওরা যেন গতকাল রাতে গোপনে এক অপরাধ করে ফেলেছে। সেই গোপন অপরাধচেতনার নিম্নচাপে মুষড়ে পড়েছিল ওরা অস্বাভাবিকভাবে। বিশেষ করে এডওয়ার্ড যখন ওতিলের দিকে। আর শার্লোতে যখন ক্যাপ্টেনের দিকে তাকাচ্ছিল তখন ওদের অবদমিত সেই অপরাধ চেতনাটা প্রকট হয়ে উঠছিল ওদের শুকনো মুখে। 

অবশেষে অতিথিদের যাবার সময় হলো। ওরা গিয়ে গাড়িতে উঠল। 

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

সেদিন অতিথিরা চলে গেল দুপুরে খাওয়ার সময় তাদের সমালোচনা করতে লাগল এডওয়ার্ড। শার্লোতে তাতে কিন্তু যোগ দিল না। চুপচাপ গম্ভীরভাবে খেয়ে যেতে লাগল। হঠাৎ এডওয়ার্ড বলল, আজ একটা নৌকো ভাড়া করেছি বেশি টাকা দিয়ে। বিকালে লেকে বেড়াতে যাব। তৈরি হয়ে নাও। 

ওরা তিনজনে বেরিয়ে পড়ল যথাসময়ে। ওতিলে কাজ নিয়ে বাড়িতেই রইল। লেকের ধারে গিয়ে পপলার গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে এডওয়ার্ড বলল, এইখানে একটা বসার জায়গা করতে হবে। যারা বেড়াতে আসবে লেকে তারা যাতে ভালোভাবে বসতে বা বিশ্রাম করতে পারে তার জন্য শান বাঁধানো একটা বড় বেদীর মতো জায়গা করে দিতে হবে। 

নৌকোর উপর শার্লোতে ও ক্যাপ্টেন উঠে পড়ল। এডওয়ার্ড সব শেষে উঠে দাঁড় ধরল। কিন্তু হঠাৎ কি মনে সে ব্যস্ত হয়ে ক্যাপ্টেনের হাতে দাঁড়টা দিয়ে নেমে পড়ল। বলল, বাড়িতে একটা জিনিস ভুলে এসেছি। আমি বাড়ি যাচ্ছি। তোমরা যাও। 

বাড়িতে এসে এডওয়ার্ড দেখল ওতিলে তখনও কাজ করছে। ওতিলেকে তার ঘরে খবর দিয়ে বাইরে অপেক্ষা করতে লাগল এডওয়ার্ড। এই হচ্ছে প্রশস্ত সময়। বাড়িতে কেউ নেই। অবশেষে ওতিলে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুহাত বাড়িয়ে জড়িয়ে তরল ওতিলেকে। ওতিলেও যেন এই মুহূর্তটির জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। সেও দুহাতে এডওয়ার্ডের গলাটা জড়িয়ে ধরল। এরপর দুজনে মুখোমুখি বসে নির্বিঘ্নে গল্প। করতে লাগল। 

এদিকে এডওয়ার্ড নৌকো থেকে নেমে গেলে ক্যাপ্টেন নৌকো ছেড়ে দিল। নিজেই দাঁড় বেয়ে নিলে চলল। ক্যাপ্টেনের কাছে বসে ছিল শার্লোতে। কোনও কথা বলছিল না সে। ক্যাপ্টেন তাকে বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা শুধু বোঝাচ্ছিল আর সে তা অন্যমনস্কভাবে শুনে চলেছিল। 

হঠাৎ এক সময় শার্লোতে বলল, নৌকো ফেরান। বাড়ি ফেরা যাক। সন্ধে হয়ে আসছে। 

সত্যিই তখন সূর্য ডুবে গেছে সারবন্দী পপলার আর পাইন গাছের ওপারে। গোধূলির ধূসর ছায়ায় আরও কালো হয়ে উঠেছে লেকের শান্ত জল। ক্যাপ্টেন দেখল ওরা অনেকটা চলে এসেছে। নৌকোটা ঘুরিয়ে কূলের দিকে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ছেড়েছিল সেইখানে ফিরে যাবার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু জায়গাটা ঠিক করতে পারল না। অবশেষে সন্ধে হয়ে যেতে শার্লোতে থামবার কথা বলতে এক জায়গায় থামাল নৌকোটা। কিন্তু সেখানে জল। জলে নেমে তারপর কাদার মধ্যে দিয়ে পাড়ে যেতে হবে। ক্যাপ্টেন বলল, দাঁড়ান, আমি আগে নামি। তারপর আপনাকে তুলে পার করে দেব। 

ক্যাপ্টেন আগে নিজে নামল জলকাদার মধ্যে। তারপর দুহাত বাড়িয়ে শার্লোতেকে তুলে নিল। শার্লোতেও তার গলাটা জড়িয়ে ধরল আবেগের সঙ্গে। শার্লোতের ভালো লাগছিল। ক্যাপ্টেন তাকে এইভাবে অনেকটা নিয়ে গিয়ে তবে খানিকটা শক্ত মাটি পেল। তাদের অব্যক্ত প্রেম এই দেহগত স্পর্শের নিবিড়তার মধ্যে এক ভাষাহীন নীরবতার বাজয় হয়ে উঠল। উত্তাল হয়ে উঠল রোমাঞ্চ ও শিহরণের মধ্যে। 

শার্লোতেকে নামিয়ে দিয়ে ক্যাপ্টেনও সামলাতে পারল না নিজেকে। দুহাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল। তার ঠোঁটে ঠোঁট দিয়ে চুম্বন করল তাকে। এইভাবে আলিঙ্গন ও চুম্বনে অবাধে বেশ কিছুক্ষণ আবদ্ধ হয়ে রইল ওরা দুজনে। তারপর ক্যাপ্টেন হঠাৎ নিজের ভুল বুঝতে পেরে নতজানু হয়ে শার্লোতের একটা হাত টেনে নিয়ে বলল, ক্ষমা করো শার্লোতে। আবেগের বশে ভুল করে ফেলেছি। 

শার্লোতে তখনও দাঁড়িয়ে ছিল স্থির হয়ে। শার্লোতে শান্তভাবে বলল, আমাদের ভালোবাসার ক্ষেত্রে আজকের এই ঘটনার যেন কোনও গুরুত্ব না থাকে। কাউন্ট তোমার কাজের চেষ্টা করছে। শীগগির তুমি এখানে থেকে চলে যাচ্ছ। এতে আমি একই সঙ্গে আনন্দ আর বেদনা অনুভব করছি। তুমি কাছে থাকলে আমার ক্ষতি হতো। নিজেকে সংযত করা কঠিন হতো ক্রমশ। আবার তুমি দূরে চলে গেলেও ব্যথা পাব মনে। যাই হোক, এখানেই সব কিছুর শেষ হোক। এখন বাড়ি চলো। 

বাড়ি ফিরতে দেরি হওয়ার জন্য ক্যাপ্টেন ক্ষমা চাইল এডওয়ার্ডের কাছে। কিন্তু এডওয়ার্ডের মনে হলো ওরা তাড়াতাড়ি ফিরেছে। 

এয়োদশ পরিচ্ছেদ

সেদিন লেক থেকে বেরিয়ে এসে রাতে শুতে যাবার সময় মনে মনে বেশ হাল্কা বোধ করছিল শার্লোতে। তার স্বভাবসিদ্ধ শান্ত সংযত হৃদয়সমুদ্রে ক্যাপ্টেনের সঙ্গে তার সাময়িক সামান্য এই দেহগত স্পর্শের ব্যাপারটা কোনও বিক্ষোভ সৃষ্টি করতে পারল না। তার শোবার ঘরে ঢুকেই তার মনে হলো সে মনেপ্রাণে এডওয়ার্ডের স্ত্রী। গতকাল তার এই ঘরেই তার স্বামী রাত কাটিয়ে গেছে। শান্ত মনে শুয়ে পড়ল শার্লোতে। 

এদিকে এডওয়ার্ডের ঘুম এল না কিছুতেই। আজ বিকালে ওতিলের আলিঙ্গনে ও চুম্বনের মাধ্যমে তার দেহগত স্পর্শের যে মাধুর্য লাভ করেছে তাতে মাতাল হয়ে উঠেছে তার দেহমন। আকাশে চাঁদ উঠতেই সে উপর থেকে নেমে নিচে গেল। ওতিলের ঘরের জানালার নিচে একটা বেঞ্চের উপর বসে বসে ভাবতে লাগল। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল এডওয়ার্ড। 

খুব সকালেই ঘুম ভাঙল তার। ঘুম ভাঙতেই দেখল শ্রমিকরা আসতে শুরু করেছে। লোক আসতেই তাদের কাজে লাগিয়ে দিয়ে বিশেষ ব্যস্ততার সঙ্গে দেখাশোনা করতে লাগল। তখনও বাড়ির কেউ ওঠেনি। 

এডওয়ার্ড ভাবতে লাগল এই পথের কাজ শেষ হলে ওতিলে এই পথ দিয়ে কত যাওয়া-আসা করবে। পথের ধারে সিমেন্টের আসনে বসে বিশ্রাম করবে। পাহাড়ের উপর গ্রীষ্মবাসটার কাজ শেষ হয়ে গেলে সেখানেও মাঝে মাঝে থাকবে ওতিলে। একমাত্র ওতিলেকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হচ্ছে যেন তার সকল কর্মতৎপরতা। ওতিলের জন্যই কাজগুলো যথাশীঘ্র শেষ করার জন্য ব্যগ্র হয়ে উঠল এডওয়ার্ড। শার্লোতে ও ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করে আরও বেশি লোক লাগাল, যদিও সে বুঝতে পারল নিজে বেশি তাড়াতাড়ি করতে গেলে কাজ খারাপ হবে। 

ওতিলের প্রতি এডওয়ার্ডের আসক্তি এবং তাদের পারস্পরিক ঘনিষ্ঠতা ও অন্তরাল তা দিনে দিনে বেড়ে যাওয়ায় মনে মনে চিন্তিত হয়ে উঠল শার্লোতে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে এ নিয়ে কিছু আলোচনাও করল সংযতভাবে। তারপর ওতিলের উপর কড়া বিধিনিষেধ আরোপ করল। এমন ব্যবস্থা করল যাতে সে একা একা না থাকতে পারে, যাতে তাকে নিয়ে মানুষের কাছে থাকতে হয়। 

ওতিলেকে দূরে পাঠাতে হবে। কাছাকাছি দুজনে থাকলে ওরা কিছুতেই সংযত করতে পারবে না নিজেদের। তাই তার জন্য একটা পরিকল্পনাও খাড়া করে ফেলল শার্লোতে। ও ঠিক করল ওর মেয়ে ন্যাসিয়ানেকে বোর্ডিং থেকে নিয়ে আসবে এবং তার জায়গায় পাঠাবে ওতিলেকে। ওদিকে তখন ক্যাপ্টেনও তার নূতন কাজের জায়গায় চলে যাবে। এইভাবে সে আগের মতোই তার স্বামীর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাবে। এই সাময়িক যত সব পারিবারিক অশান্তির অবসান ঘটবে নিঃশেষে। 

এদিকে ওতিলের অদর্শন অসহ্য হয়ে উঠল এডওয়ার্ডের কাছে। সে দেখল কোনও সময়েই ওতিলোকে একা পাওয়া বা তার সঙ্গে কথা বলা একরকম অসম্ভব হয়ে উঠেছে তার পক্ষে। একদিন সে চিঠি লিখে ওতিলেকে কোনওরকমে পৌঁছে দিল। ওতিলেও সে চিঠির জবাব দিল। অসাবধানতাবশত চিঠিটা পড়ে গেল তার হাত থেকে এবং সেটা শার্লোতের হাতে পড়ল। ওতিলের হাতের লেখাটা এডওয়ার্ডের মতো বলে সে সেটা এডওয়ার্ডের চিঠি ভেবে তার হাতেই দিল।

ক্রমশই এডওয়ার্ডের মেজাজটা খিটখিটে হয়ে উঠল। একদিন ওতিলের কাছে স্পষ্ট শার্লোতের উপর তার অযথা ক্রোধ প্রকাশ করল। ওতিলেও অন্যায়ভাবে ক্যাপ্টেনের নিন্দা করতে লাগল। এডওয়ার্ড মিথ্যা করে বলল, শার্লোতে ক্যাপ্টেনের প্রতি আসক্ত এবং সে নিজেই বিবাহবিচ্ছেদ চায়। ওতিলে বলল ক্যাপ্টেনও লোক ভালো হয়। সে এডওয়ার্ডের বাঁশি বাজানোর নিন্দা করে প্রকাশ্যে। ওতিলে চায় শার্লোতের সঙ্গে এডওয়ার্ডের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে গেলেই তার স্ত্রীর শূন্য আসনে বসবে সে। তার। সুখের পথে আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে সব বাধা অপসারিত হয়ে যাবে। 

এডওয়ার্ড যাই ভাবুক, শার্লোতে কিন্তু তার প্রতিজ্ঞায় অটল। ক্যাপ্টেনের প্রতি তার ক্রমবর্ধমান প্রেমাসক্তির কথা ভেবেই ওতিলের প্রতি ক্রমশই কঠোর হয়ে উঠেছিল সে। সে তাই ভেবেছিল। তার মতো আত্মসংযম ওতিলের নেই। সে বয়সে তরুণী। এই প্রেমাসক্তিকে বেশি বাড়তে দিলে তার পরিণাম হবে খুবই ভয়াবহ। সে তাই যথারীতি ওতিলেকে এডওয়ার্ডের কাছ থেকে দূরে দূরে রাখতে লাগল। 

ক্যাপ্টেনের নিয়োগপত্র এসে গেল। দুখানি চিঠি খামের ভিতর ছিল। একটিতে ক্যাপ্টেনকে সব পরিকল্পনা রূপায়িত করতে হবে তার সব ছক লেখা ছিল। তার একখানি চিঠিতে ছিল ক্যাপ্টেনকে যে বেতন ও সুবিধা-সুযোগ দেওয়া হবে তার পূর্ণ বিবরণ। 

ক্যাপ্টেন কিন্তু একথা বাইরে প্রকাশ করল না কারও কাছে। সে আগের মতো কাজকর্ম যথারীতি করে যেতে লাগল। এদিকে ওতিলের জন্মদিন এগিয়ে আসায় তার কাজ অনেক বেড়ে গেছে। এডওয়ার্ডের ইচ্ছা পাহাড়ের উপর যে গ্রীষ্মবাস নির্মিত হচ্ছে তার কাজ ঐ দিনের আগেই শেষ হওয়া চাই। তাতে যত বেশি লোক দরকার নিয়োগ করা হোক। 

ক্যাপ্টেন একটা পরামর্শ দিল এডওয়ার্ডকে। তিনটে জলাশয় এক করে একটা হ্রদে পরিণত করার কোনও পরিকল্পনা যেন গ্রহণ করা না হয়। এর বদলে ছোট জলাশয়টার কিছু উন্নতিবিধান করা উচিত আর মাঝের জলাশয়টা একেবারে বুজিয়ে ফেলা উচিত। তবে এর পরামর্শ মানা নির্ভর করে এডওয়ার্ডের মর্জির উপর। 

এডওয়ার্ড এখন ওতিলের জন্মদিনে তাকে কি কি উপহার দেবে তাই নিয়ে ব্যস্ত। এ বিষয়ে সে শার্লোতের উপর মোটেই নির্ভর করতে পারবে না। কারণ শার্লোতে তাকে যে সব জিনিস কিনতে বলেছে তা খুবই নিম্নমানের। তাই এ ব্যাপারে তার এক বিশ্বস্ত চাকরের উপর ভর দিয়েছে। সেই চাকর শহরের এটা বড় পোশাকের দোকানে। অনেক নূতন ফ্যাশনের পোশাকের অর্ডার দিয়েছে। এই চাকরই আবার এডওয়ার্ডকে পরামর্শ দিয়েছে ঐ দিন জলাশয়ের ধারে সন্ধের সময় বাজি পোড়ানোর ব্যবস্থা করতে। নানা রকমের রং-বেরঙের বাজি ছাড়া হবে জলাশয়ের এধার থেকে আর ওধার থেকে সমবেত দর্শকরা দেখবে আর সেই সব জ্বলন্ত বাজির প্রতিফলন পড়বে জলাশয়ের জলে। 

পরামর্শটা সানন্দে গ্রহণ করল এডওয়ার্ড। সেই মতো ব্যবস্থাও সব হয়ে গেল। 

চতুর্দশ পরিচ্ছেদ

অবশেষে এডওয়ার্ডের সেই বহু প্রতীক্ষিত দিনটি এসে গেল। সকাল থেকে নিমন্ত্রিত অতিথিদের আসা শুরু হয়ে গেল। বিশেষ করে যারা শার্লোতের জন্মদিনে বাড়ির ভিত্তিপ্রস্তর উৎসবে যোগ দিতে পারেনি, তারা সব এল। 

তাছাড়া চারদিকের গ্রামাঞ্চল হতে ঝাঁকে ঝাঁকে আসতে লাগল গ্রামের লোক। অনেক ভিখিরিও আসতে লাগল। এডওয়ার্ড এসব আগেই ভেবে রেখেছিল। যাতে কোনও দিকে কোনও অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে তার জন্য আগেই সে সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। 

সমস্ত প্রাসাদটাতে সবুজ পাতা আর ফুল দিয়ে সাজানো হলো। সারাদিন আনন্দে উৎসবে কেটে গেল। দিনের আলো নিবে যেতেই বাড়ির বিশিষ্ট অতিথিরা সবাই। জলাশয়ের ধারে ঘাসের উপর গাছের তলায় সাদা আসনে গিয়ে বসল। সেখানেই তাদের জলখাবার দেওয়া হলো। সেখানে থেকেই তারা সন্ধের সময় বাজি পোড়ানো দেখবে। 

সব কাজ সুষ্ঠভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ এক দুর্ঘটনা ঘটায় হর্ষের মাঝে বিষাদ নেমে এল। যে নূতন বাধের উপর এক বিরাট জনতা সমবেত হয়েছিল বাজি পোড়ানো দেখার জন্য সেই বাঁধের নরম মাটি মানুষের পায়ের চাপে ধসে গেল। সঙ্গে সঙ্গে জনতার এক অংশ হুড়মুড় করে পড়ে গেল জলাশয়ের জলে। এক প্রবল চিৎকারে সচকিত হয়ে উঠল সকলে। ক্যাপ্টেন একদল সাহসী লোক নিয়ে উদ্ধারের জন্য ছুটে গেল। বাঁধের উপর থেকে অবাঞ্ছিত লোকদের সরিয়ে দিল উদ্ধার কাজের সুবিধার জন্য। জলে যারা পড়ে গিয়েছিল সকলকেই অল্প সময়ের মধ্যে উদ্ধার করে উপরে ভোলা হলো। কিন্তু একটি ছেলে অনেকটা দূরে চলে গিয়েছিল। সে একটা হাত উপরে তুলে ডুবছিল আর এক বার উঠছিল জলের উপর। তাকে দেখে সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন পোশাক খুলে ঝাঁপিয়ে পড়ল জলের উপর। ডুব-সাঁতার দিয়ে তীর বেগে ছেলেটার। কাছে গিয়ে তাকে ধরে ফেলে নৌকোটাকে কাছে আনার জন্য ইশারা করল। কৌতূহলী জনতা তার দিকে তাকিয়ে রইল। ছেলেটাকে এনে মাটির উপর তুলতেই সার্জেন এসে তার চিকিৎসা শুরু করে দিল। ছেলেটা জল খেয়ে অচৈতন্য হয়ে পড়ায় তাকে মরার মতো দেখাচ্ছিল। 

এদিকে শার্লোতে এসে এডওয়ার্ডকে বলল, এই দুর্ঘটনার প্রেক্ষিতে বাজি পোড়ানোর উৎসব বন্ধ করে দেওয়া উচিত। কিন্তু এডওয়ার্ড তাতে রাজি হলো না। বলল, সার্জেন ছেলেটার চিকিৎসার ভার নিয়েছে। আমাদের এ বিষয়ে করার কিছু। নেই। সুতরাং উৎসব বন্ধ করার কোনও যুক্তি নেই। 

শার্লোতে ওতিলেকে ইশারায় বাড়ি ফিরতে বলল। ওতিলে চলে যাচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ড তার হাত ধরে আটকাল। শার্লোতে আর কোনও কথা না বলে চলে গেল। অতিথিরাও সকলে প্রাসাদে চলে গেল। অবশেষে এডওয়ার্ড দেখল জলের ধারে তারা মাত্র দুজনেই বসে আছে। এমন সময় তার সেই বিশ্বস্ত চাকর এসে জিজ্ঞাসা করল বাজি পোড়ানো শুরু হবে কিনা। এডওয়ার্ড বলল, নিশ্চয় হবে। শুরু করে দাও। 

ওতিলে প্রাসাদে ফিরে যাবার জন্য অনুনয়-বিনয় করছিল। কিন্তু এডওয়ার্ড বলল,, তোমার এখন যাওয়া হবে না ওতিলে। তোমার জন্যই এত সব বাজি আমি আনিয়েছি। এ বাড়ির আলোকোজ্জুস তোমাকে দেখতেই হবে। আমি তোমার পাশে বসে থাকব। আজ আমার কত আনন্দ। এইসব গাছ আমি যে বছর বসাই সেই বছরেই তোমার জন্ম হয়। তখনও ছিল এমনি এক দিন আর ঠিক এমনি আবহাওয়া। 

বাজি পোড়ানো শুরু হলো। কোনওটা কামানের গর্জন, কোনওটা বজ্রের গর্জনের সঙ্গে আকাশে চকিত আলোর পশরা মেলে আকাশে উঠতে লাগল বাজিগুলো আর তা দেখে এডওয়ার্ডের গা ঘেঁষে আরও ঘন হয়ে উঠতে লাগল ওতিলে। সঙ্গে এডওয়ার্ড সেই রংমশালের আলোর উত্তাপ অনুভব করতে লাগল তার বুকের ভিতরে। তার চোখ-মুখ এক গোপন আশার অদম্য উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। 

এদিকে প্রাসাদে ফিরে গিয়ে শার্লোতে দেখল সার্জেনের চেষ্টায় ছেলেটির চৈতন্য ফিরে এসেছে। সে খুশি হলো। ক্যাপ্টেন নিরাপদে একটি জীবনকে নিশ্চিত মৃত্যুর কবল থেকে বাঁচিয়েছে। এতে খুশি হয়ে তাকে ধন্যবাদ দিল ক্যাপ্টেনকে। ক্যাপ্টেনও একা পেয়ে তার যাবার কথাটা জানিয়ে দিল। বলল, পরদিন সকালেই সে চলে যাবে। তার উন্নতির সব কথা এবার প্রকাশ করল শার্লোতের কাছে। শার্লোতেও এটা জানত আগে থেকে। তাই কিছুমাত্র বিস্মিত বা ব্যথিত না হয়ে সে সহজভাবে অভিনন্দন জানাল ক্যাপ্টনকে তারে ভাগ্যোন্নতিতে। 

পরে কথাটা এডওয়ার্ডকেও জানানো হলো। কিন্তু এডওয়ার্ডের সমস্ত মন জুড়ে তখনও লেগে ছিল শুধু উৎসবের রং আর ওতিলের চিন্তা। 

পঞ্চদশ পরিচ্ছেদ

পরদিন সকালেই ক্যাপ্টেন চলে গেল বাড়ি থেকে। যাবার সময় একটা চিঠিতে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে গেল এডওয়ার্ডের প্রতি। ক্যাপ্টেনের প্রতি এক গোপন আসক্তির প্রবলতা সত্ত্বেও তার স্বভাবসুলভ আত্মসংযমের দ্বারা অতি সহজেই বিচ্ছেদের সব ব্যথা দমন করে ফেলল শার্লোতে। সে জানত আর কোনওদিন দেখা হবে না তার ক্যাপ্টেনের সঙ্গে। তবুও কোনওরূপ বিচলিত না হয়ে বিদায় দিল আকাঙ্ক্ষিত প্রেমিককে। 

শার্লোতে চাইছিল তার মতো এই আত্মসংযম, এই মানসিক দৃঢ়তার পরিচয় সকল প্রেমিকেরই দেওয়া উচিত। জীবনে যা শ্ৰেয় আর জীবনে যা প্রেয় তার সঙ্গে সামঞ্জস্য সাধন করে চলতে শেখা উচিত। এবার শার্লোতে ঠিক করে এডওয়ার্ডকে খোলাখুলি সব কথা বলে তাকে সাবধান করে দেবে। তাকে পরিষ্কার বুঝিয়ে দিবে তার এই অবৈধ আত্মঘাতী প্রেমের খেলা কোথায় কোণ অশুভ পরিণতির দিকে নিয়ে চলেছে তাকে। 

এডওয়ার্ডকে একা এক জায়গায় বসিয়ে শার্লোতে তাকে বলল, ক্যাপ্টেন চলে গেছে। এবার ওতিলের যাবার ব্যবস্থা করা হোক। আমার মেয়েকে বোডিং হাউস থেকে এনে তার জায়গায় ওতিলেকে পাঠিয়ে দেওয়া হোক। আমরা যেমন ছিলাম তেমনি আবার দুজনে দুজনের খুব কাছে আসতে পারব এডওয়ার্ড। 

এডওয়ার্ড আমতা আমতা করে বলল, ওতিলেকে পাঠাতে চাও, ঠিক আছে। পাঠাবে। কিন্তু এত তাড়াতাড়ি কেন। আরও কিছুদিন পরে পাঠালেই তো চলবে। 

শার্লোতে বুঝতে পারল এডওয়ার্ডের এই কুণ্ঠার পিছনে ওতিলের প্রতি তার আসক্তির তীব্রতাই ফুটে বার হয়ে পড়েছে। প্রকট হয়ে পড়ছে এক নগ্ন নির্লজ্জতায়। শান্তভাবে শার্লোতে বলল, নিজের সঙ্গে প্রতারণা করো না এডওয়ার্ড। এখন তোমার বোঝায় সময় হয়েছে। এখনও অনেক আছে। ওতিলেকে তুমি ভালোবাস কিন্তু এই ভয়ঙ্কর ভালোবাসাকে আর এগোতে দেওয়া উচিত নয়। এবার সাবধান হও। নিজেকে। সংযত করো। 

এডওয়ার্ডকে চুপ করে থাকতে দেখে শার্লোতে বলল, একবার ভেবে দেখো এডওয়ার্ড, একবার তোমাকে হারিয়ে কত কষ্টে তোমাকে ফিরে পেয়েছি। আমার এই বহুকষ্টার্জিত সুখ, আমার স্বামীকে এভাবে আবার হারিয়ে যেতে দিও না। ওতিলে যদি এভাবে আমার স্বামীকে আমার কাছ থেকে অন্যায়ভাবে কেড়ে নেয় তাহলে সে কি জীবসে সুখী হবে ভেবেছ? কখনই নয়। 

এডওয়ার্ড বলল, তুমি এই চরম কথাটা কেন ভাবছ এখন? 

শার্লোতে শান্তভাবে বলল, মানুষের অসংযত উত্তাল প্রেমাবেগ সব সময় তাকে চরম অবস্থা, চরম ঘটনার দিকেই নিয়ে যায় এডওয়ার্ড। কোনও শুভবুদ্ধির কথা সে। শোনে না। তাই তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি আগে হতে। 

এডওয়ার্ড বলল, ঠিক আছে তুমি যা করতে চাও করো, আমি বাধা দেব না।

শার্লোতে দেখল এই সুবর্ণ সুযোগ। এডওয়ার্ডের মত যখন একবার হয়েছে তখন। সব ব্যবস্থা সঙ্গে সঙ্গে পাকা করে নেওয়া উচিত। সেইমত সে ওতিলের যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে ফেলল। 

এডওয়ার্ড তাকে আর কোনও বাধা দিল না। শুধু একটা অনুরোধ করল। বলল, আমাকে দিনকতক বাইরে কোথাও ঘুরে আসতে দাও। তাতে আমার মনটা ভালো হবে।

সঙ্গে সঙ্গে শার্লোতে তাতে রাজি হয়ে তার যাবার ব্যবস্থা করে দিল। ঠিক হলো পরদিন অর্থাৎ একই দিনে দুজনেই বিদায় নেবে ঘর থেকে। এডওয়ার্ডের ঘোড়া ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সব নিজের হাতে গুছিয়ে দিল শার্লোতে। 

যাবার সময় শার্লোতেকে একটা চিঠি লিখে খামের মধ্যে রেখে গেল এডওয়ার্ড। লিখল যে বিপদের কবলে আমরা পড়েছি প্রিয়তমা তার থেকে উদ্ধার পাব কিনা জানি না। তবে আমার মনে হয় একটা কাজ করলে সব দিক রক্ষা পাবে। আমি এখন প্রাসাদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। অবস্থা অনুকূল না হওয়া পর্যন্ত আমি ফিরব না। প্রাসাদের সব ভার এখন তোমার। তবে তোমাকে আর একটা কাজ করতে হবে। আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ বলতে পার। যে কারণে ওতিলেকে দূরে পাঠাতে চাইছিলে তার কারণ যখন দূরীভূত তখন তুমি এবার হতে তাকে নিশ্চিন্তে প্রাসাদের মধ্যেই রাখবে। আমি চাই না। সে অন্য কোনও পরিবেশে গিয়ে থাক। সে বরং তোমার কাছে তোমার স্নেহচ্ছায়ায় থাক। তাতে আমি সুখী হব। আশা করি, তুমি তাকে যথারীতি স্নেহদানে ধন্য করবে। তার প্রতি যত্ন নেবে। আমার প্রেম, আমার ইচ্ছা বা কামনা-বাসনা ও আমার দুঃখের প্রতি তোমার যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে আমার এ অনুরোধ তুমি রক্ষা করবে। বলা যায় না তাহলে হয়ত একদিন আমার মনের সব ক্ষত সেরেও যেতে পারে। 

ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ওতিলে জানালা দিয়ে দেখতে পেল এডওয়ার্ড ঘোড়ায় চেপে চলে যাচ্ছে কোথায়। যেতে পারে, কিন্তু তার বড় বিস্ময় ও বেদানবোধ হচ্ছে এই ভেবে যে আজ সকালে যাবার আগে সে একটা কথাও বলেনি তার সঙ্গে। একথা যতই ভাবতে লাগল ততই অশান্ত হয়ে উছল তার মন। 

শার্লোতে সব বুঝতে পেরে ওতিলেকে ঘর থেকে বাইরে বাগানে নিয়ে গেল বেড়াতে। একথা-সেকথা বলে তার মনটা শান্ত করার চেষ্টা করতে লাগল। দুপুরে খাবার সময় ওতিলে দেখল শার্লোতে নিজেই টেবিল সাজিয়ে দুজনের খাবার আনল। ক্যাপ্টেন ও এডওয়ার্ডের চলে যাবার পর বাড়িতে খাবার টেবিলে তারা মাত্র দুটি প্রাণী। ওতিলে ভাবল শার্লোতে যখন নিজেই এ কাজ করছে তখন তাকে এ বাড়ি থেকে নিশ্চয় অন্যত্র পাঠিয়ে দেবে সে। এ বাড়িতে আর তাকে থাকতে দেবে না। 

খাবার সময় শার্লোতে ক্যাপ্টেনের কথাটা একবার তুলল। বলল, ক্যাপ্টেন অন্য জায়গায় আরও ভালো কাজ পেয়েছে। তার উন্নতি হয়েছে। এবার সে বিয়ে করবে। আপাতত তার সঙ্গে দেখা হওয়ার কোনো উপায় নেই। ওদিকে ওতিলে ভাবতে লাগল এডওয়ার্ডের কথা। কোথায় গেল সে? তার থেকে এডওয়ার্ডকে কৌশলে বিচ্ছিন্ন করে দেবার জন্যই কি শার্লোতে তাকে কোন দূর দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে? এডওয়ার্ড কি এখন মোটেই আসবে না? 

হঠাৎ ওতিলে দেখল এডওয়ার্ডের খাস চাকর তার ঘোড়ার গাড়িটা নিয়ে ফিরে এসেছে। শার্লোতে তার কারণ জানতে চাওয়ায় চাকর বলল, তার মালিকের গোটাকতক ফেলে যাওয়া জিনিস নেবার জন্য সে এসেছে। শার্লোতে বলল যা দেওয়া হয়েছে তাতেই চলে যাবে। অন্য কিছুর দরকার হবে না। আসলে এডওয়ার্ড তার বিশ্বাসী খাস চাকরকে পাঠিয়েছিল ওতিলের সাথে দেখা করে তাকে একটা কথা জানাবার জন্য। কিন্তু সর্বক্ষণ শার্লোতে উপস্থিত থাকায় সে কথা বলার কোনও অবকাশ পেল না এডওয়ার্ডের খাস ভৃত্য।

ওতিলের অবরুদ্ধ দুঃখের আবেগ ক্রমশই বেড়ে যাচ্ছিল। জীবনে আত্মসংযম কাকে বলে তা সে জানে না। আর তা না জানার জন্য সে আবেগ সংযত করা বা অবদমিত করে রাখা সম্ভব হচ্ছিল তা তার পক্ষে। এমন সময় শার্লোতে তাকে এবার এক জায়গায় বসিয়ে কৌশলে নানারকম গল্পের মাধ্যমে ধৈর্য ও সংযম শিক্ষা দিতে লাগল। ওতিলে মাঝখানে একবার বলল, আচ্ছা পিসি, মদ খেলে সব মানুষই কেমন যেন সংযম হারিয়ে ফেলে। যে মানুষ কম কথা বলে, যুক্তিবাদী, সৌজন্যপূর্ণ, সমদর্শী, আমি দেখেছি মদ খাওয়ার পর সে মানুষ কেমন পাল্টে যায় একেবারে। তার স্বাভাবিক বোধ, যুক্তি, নীতি কোথায় উবে যায় সব। 

শার্লোতে এ ব্যাপারে ওতিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত হলো। সেও একবার ক্যাপ্টেনের বিয়ের কথাটা তুলল। তার ধারণা ছিল ক্যাপ্টেন বিয়ে করবে না জীবনে। এডওয়ার্ড একথা একদিন জোর দিয়ে বলেছিল তাকে। শার্লোতে ওতিলেকে এই কথাই বোঝাতে চাইল যে পুরুষমানুষরা সব সময় ধৈর্য ও সংযম সহকারে চলতে পারে না। তারা সব সময় তাদের প্রতিশ্রুতি মেনে চলে না। হয়ত এটা অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলও হতে পারে। 

বাগানে, পথে ও পাহাড়ে যে সব উন্নতিমূলক কাজ হচ্ছিল তা যথারীতি চালিয়ে যেতে লাগল শার্লোতে। বাড়ির সংসার খরচ আগের থেকে অনেক কমিয়ে দিয়ে অর্থ সঞ্চয় বাড়িয়ে দিল। 

শার্লোতে দেখল বেশ কিছু কাজ হয়ে গেছে। যেমন লেকটা চওড়া হয়ে গেছে। তারপর চারপাশের পাড়গুলোও ঘাসে ঢাকা মনোরম বেড়াবার জায়গায় পরিণত হয়েছে। বাগানের পথটাও তৈরি হয়ে গেছে। আগের থেকে বেশ চওড়া হয়েছে। পাহাড়ের উপর গ্রীবাসের কাজও মোটামুটি শেষ। তবে ওতিলে বাড়ির স্থপতির কাজের খুব একটা প্রশংসা করতে পারল না। এবার কাজের গতি শ্লথ করে দিল শার্লোতে ইচ্ছা করে। কারণ সে চায় এডওয়ার্ড বাড়ি ফিরে যেন কিছু কাজ করার সুযোগ পায়। গোড়ার দিকের কঠিন কাজগুলো সম্পন্ন হয়ে গেলে শেষের কাজটুকু সম্পন্ন করা অনেক সহজ ও আনন্দদায়ক হবে তার পক্ষে। 

তবে আর একটা বড় কাজ করল শার্লোতে। গ্রামের ছেলেমেয়েদের উন্নতির জন্য সে নানাভাবে চেষ্টা করতে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জন্য গড়ে তোলা পার্ক ও গ্রাম কি করে পরিচ্ছন্ন রাখতে হয় তাও শেখাল। গ্রামের একদল ছেলেকে এক রঙের পোশাক করিয়ে দিল। তা পরে তারা পার্ক ও গ্রামের পথঘাট সব নিজেরা পরিষ্কার করবে। গাঁয়ের মেয়েদের সেলাই বোনা ও সুতো কাটার কাজ শিখিয়ে তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিল শার্লোতে। তাকে এ ব্যাপারে ওতিলেও সাহায্য করল অনেকখানি। এ কাজ করতে গিয়ে ওতিলে ল্যান্সি নামে গাঁয়ের একটি ছোট্ট মেয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলল। মেয়েটি এরপর থেকে তার কাছে কাছেই থাকত সব সময়। ওতিলে আর একজনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তুলল। সে হলো বাগানের মালী। এর একটা কারণ ছিল, মালী কথায় কথায় শুধু এডওয়ার্ডের নাম করত। সে কখন ফিরবে জিজ্ঞাসা করত ওতিলেকে। ওতিলেরও তো শুধু একই চিন্তা এডওয়ার্ডকে কেন্দ্র করেই দিনরাত আবর্তিত হয়। সব কাজের মধ্যে, সব বস্তুর মধ্যে সে শুধু এডওয়ার্ডকেই দেখে। এডওয়ার্ড কি ভালোবাসত না বাসত, সে কখন ফিরে কোন কাজটাকে পছন্দ করবে না করবে সে শুধু তাই নিয়ে ভাবত। আর তার সেই নারীর নিরুচ্চার ভাবনাটিকেই বাইরে প্রকাশ করে দিত বাগানের মালী। 

ক্যাপ্টেন চলে যাওয়ার পর শার্লোতে যদি ওতিলোকে বাইরে পাঠিয়ে দিতে পারত তাহলে তারা আগের মতোই নির্বিঘ্ন নিরাপদ দাম্পত্য জীবন সুখে-শান্তিতে কাটাতে পারত। অবশ্য তাহলে ওতিলে সব কিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয় যেত। কিন্তু ওতিলে তো আজও নিঃস্ব এবং রিক্ত হয়ে গেছে মনে-প্রাণে। আজ তার মনের বায়বীয় শূন্যতা এতদূর বেড়ে গেছে সে তার চাপ তার স্বাভাবিক সংযমের বাধটাকে কাটিয়ে দিতে চাইছে এক ভয়ঙ্কর প্রবলতায়। সারা দিন এটা-সেটা কাজ করে ভুলে থাকার চেষ্টা ওতিলে। কিন্তু রাত্রিতে শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতেই তীব্রতর হয়ে ওঠে তার শূন্য অন্তরে জ্বালা আর অশান্ত বেদনাবোধ। সে তখন সিন্দুক খুলে তার জন্মদিনে এডওয়ার্ডের দেওয়া উপহারগুলো বার করে দেখে সে জ্বালার কিছুটা মেটাবার চেষ্টা করে। সে উপহারের কিছুই সে ব্যবহার করেনি আজও। 

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

অবশেষে এডওয়ার্ডদের বাড়ির মনকষাকষির কথাটা মিটলাবের কানে গিয়ে উঠল। অবশ্য এই মনাকষাকষির ব্যাপারে নীরব নিঃশব্দ এই দাম্পত্য কলহের অবসানের জন্য কেউ তার সাহায্য চায়নি। তবু মিটলার ভাবল পরিবারের পুরনো বন্ধু হিসেবে তার একটা কর্তব্য আছে। তাই মিটলার একদিন নিজেই এডওয়ার্ডের নূতন ঠিকানা যোগাড় করে সেখানে চলে গেল। 

বর্তমানে এডওয়ার্ড যেখানে থাকে সে জায়গাটা বড় মনোরম। জায়গা মানে প্রাকৃতিক লীলাভূমির মাঝে এক খামারবাড়ি। সাজানো বাগান দিয়ে ঘেরা। ঢালু উপত্যকাসংলগ্ন একটা প্রান্তরের মাঝখানে শান্তভাবে বয়ে চলেছে একটা নদীর স্রোত। কাছেই পাহাড়। গ্রামগুলো ছাড়া ছাড়া, একটু দূরে দূরে। 

মিটলারের কথা মাঝে-মাঝে ভাবত এডওয়ার্ড। তাই তাকে দূর থেকে আসতে দেখে খুশি হলো। মনে মনে ঠিক করে ফেলল যদি তাকে শার্লোতে পাঠায় তাহলে তার কথাগুলো এড়িয়ে যাবে আজেবাজে উত্তর দিয়ে। আর যদি ওতিলে পাঠায় তাহলে সব কথা মন দিয়ে শুনবে। এডওয়ার্ডের ইচ্ছা এই মনোরম পরিবেশে সে একদিন ওতিলেকে নিয়ে একসঙ্গে বাস করবে। আর তা যদি একান্তই সম্ভব না হয় তাহলে সে এই খামারবাড়ি তাকে দান করে যাবে যাতে অন্য কাউকে বিয়ে করে ভবিষ্যতে এখানেই বসবাস করতে পারে ওতিলে।

মিটলার প্রথমে এমন একটা ভাব দেখাল যাতে মনে হবে সে কিছুই জানে না। এডওয়ার্ড যখন জানতে পারল মিটলার নিজের থেকে এসেছে, সে তাদের বাড়ির কোনও খবর জানে না বা কেউ তাকে পাঠায়নি তখন কিছুটা রেগে গেল মনে মনে। মিটলার তাকে এই নিঃসঙ্গ জীবনযাপনের জন্য বন্ধুভাবে তিরস্কার করল। তখন এডওয়ার্ডও কোনও লুকোচুরি না করে মনের আসল ভাব, আসল আবেগের কথা বলে ফেলল অকুণ্ঠভাবে। সে বলল, আমি এখানে একা একা আছি বটে কিন্তু আসলে আমি সব সময় মনে মনে যুক্ত আছি, মিলিত আছি ওতিলের সঙ্গে। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। শার্লোতেকে আমি তার কাছে যাব না। সে প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলতে চাই। তবু আমি চিঠি লিখি তাকে মাঝে মাঝে। কিন্তু সে তার উত্তর দেয় না। তবে কি শার্লোতে নিষ্ঠুরভাবে তার কাছ থেকে কোনও প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছে যার জন্য সে আমাকে কোনও চিঠি লেখে না বা কোনও খবর দেয় না? তবে ওতিলে যদি সত্যি সত্যি আমাকে ভালোবাসে তাহলে কেন তবে সে সব বাঁধন ছিঁড়ে পালিয়ে এসে ধরা দিচ্ছে না আমার বাহুপাশে? আমার মনে হয় সে তা পারে। রাত্রিতে ঘুম ভেঙে গেলে ঘরের স্বল্প আলোয় ওতিলের মূর্তি দেখি আমি। অবশ্য আমার স্বপ্নে দেখা তার মূর্তিই হয়ত ছায়ামূর্তি পরিগ্রহ করে আলো-আঁধারি নৈশ পরিবেশে। আগে যখন আমরা এক বাড়িতে থাকতাম, রোজ দেখা হতো আমাদের সঙ্গে তখন রাত্রিতে স্বপ্ন কখনও দেখতাম না তাকে। কিন্তু আজকাল প্রায়ই তাকে স্বপ্নে দেখি। তার রূপ আরও উজ্জ্বল, আরও সুন্দর হয়ে ওঠে স্বপ্নের মাঝে। স্বপ্ন শেষে তার সেই মূর্তি মিলিয়ে যায়। আমি প্রতারিত হই ঠিক কিন্তু এ প্রতারণা বড় মধুর লাগে। বড় ভালো লাগে। 

এডওয়ার্ডের কথা শুনে মিটলার হাসছিল। তার মুখে মৃদু হাসি দেখে এডওয়ার্ড রেগে গেল, তুমি হাসছ? তুমি আমাকে বোকা ভাবতে পার, কিন্তু আমি আমার এই প্রেমাসক্তিতে মোটেই লজ্জিত নই। আমার কেবলি মনে হচ্ছে জীবনে আজ আমি প্রথম ভালোবাসছি। আগে প্রথম যৌবনে ভালোবাসার ব্যাপারটা আমার কাছে ছিল একটা খেলার মতো। আমোদ-প্রমোদের একটা উপকরণ মাত্র। আগে আমি ভালোবাসা কি তা বুঝিনি। আজ এমন কেউ নেই যে আমাকে এই ভালোবাসার ব্যাপারে হার মানাতে পারে।

জানি আমার এই ভালোবাসা অবৈধ, হয়ত অপরাধ। তবু এটা একটা স্বতঃস্ফূর্ত স্বাভাবিক অনুভূতি যা আমি কোনও কিছুর বিনিময়ে ত্যাগ করতে পারব না। 

এই কথা বলতে বলতে আবেগের প্রবলতাটাকে সংযত করতে না পেরে শিশুর মতো কেঁদে ফেলল এডওয়ার্ড। 

আবেগ বা ভাবালুতাহীন বাস্তববাদী মিটলার এবার তার তীক্ষ্ণ যুক্তির হাতিয়ার প্রয়োগ না করে পারল না। কারণ সে যে জন্য এখানে এসেছে সেই মূল উদ্দেশ্য হতেই বিচ্যুত হয়ে পড়েছে ক্রমশ। এডওয়ার্ড তার ভাবালুতার দ্বারা তার কঠিন যুক্তি ও নীতিবোধকে বিগলিত করে দেবার চেষ্টা করছে। তাই সে গম্ভীরভাবে এডওয়ার্ডকে বলল, যারা মহান ব্যক্তি তারা বিপদে কখনও আত্মমর্যাদাকে বিসর্জন দেয় না। তারা অবিচল, ধৈর্য ও স্থৈর্য সহকারে অটলভাবে দাঁড়িয়ে থাকে সব বিপদের মাঝে। সব বেদনাকে, দুঃখকে তারা বৃত্তের মাঝে কঠোরভাবে চেপে রাখে, বাইরে প্রকাশ করে না।

এডওয়ার্ড কিন্তু মোটেই শান্ত হলো না এ কথায়। বলল, যারা দুঃখে পড়েনি যারা সুখে-শান্তিতে বাস করছে তারা বিপন্ন বিব্রত মানুষকে ধৈর্য ধারণ করার পরামর্শ দেয়। কিন্তু জানে না আসলে তা কত কঠিন। প্রাচীনকালে বড় বড় গ্রীকবীরেরাও দুঃখের সময় কেঁদে ফেলতেন। অশ্রুর মাধ্যমে সহজভাবে প্রকাশ করতেন তাঁদের দুঃখ বা শোকের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। এই জন্যই বলে, যারা সহজে কাঁদে না তারা ভালো মানুষ নয়। সেই সব কঠিনহৃদয় মানুষ দুঃখে-বিপদে ধৈর্য ধারণ করতে পারে, বীর গ্যাভিরেটারের মতো সকলের সামনে বীরত্ব সহকারে মরতে পারে, কিন্তু তারা মানুষ হিসাবে মোটেই ভালো নয়। তাই বলি বন্ধু, আমার বাগানটা বরং ঘুরে দেখে এখন চলে যাও। পরে আমি যখন ধৈর্য ধারণ করতে পারব তখন এ বিষয়ে কথা হবে আবার। 

একথা বলার পর আর থাকা চলে না। মিটলার চলেই যাচ্ছিল। কিন্তু এডওয়ার্ডই তাকে বসাল। তার কথাটা টেনে নিয়ে আবার বলল, কোনও কথা মনে চেপে রেখে অথবা কারও কাছে প্রকাশ করে কোনও লাভ হয় না। কাজের কথা ভাবতে হয়। আমিও আমার করণীয় কি তা ভেবে রেখেছি। আমি ওতিলেকেই পেতে চাই। তুমি আমাদের বিবাহবিচ্ছেদের ব্যবস্থা করো। শার্লোতের কাছে গিয়ে তার সম্মতি আদায় করো এ বিষয়ে। এইভাবে আমাদের সব সমস্যার সমাধান করে প্রকৃত বন্ধুর মতো কাজ করো। আমাদের সুখী করো। 

মিটলার কোনো কথা বলতে পারল না। এডওয়ার্ড বলে চলল, আমার ও ওতিলের ভাগ্য এক হয়ে জড়িয়ে পড়েছে। নিয়তির কোনও বিধান অথবা কোনো প্রতিকূল অবস্থা বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না আমাদের সম্পর্ককে। 

মিটলার আপন মনে চিৎকার করে উঠল, হা ভগবান! এ আমি কি শুনছি! ভাগ্যে বিশ্বাস একটা কুসংস্কার ছাড়া আর কিছুই নয়। এতে বিপদ আরো ঘোরাল হয়ে ওঠে। 

এডওয়ার্ড শান্তভাবে বলল, মানুষের কোনও বিপন্ন অন্তর যখন কোনও পথ খুঁজে পায় না, তাকে পথ দেখাবার কেউ থাকে না তখন তাকে অনুকূল গ্রহনক্ষত্রের প্রত্যাশায় থাকতে দাও। 

মিটলার বলল, নিয়তির উপর বিশ্বাসের মধ্যে যদি একটা সংগতি থাকত তাহলে আমি সে বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করতে পারতাম। কিন্তু মানুষ সাধারণত গ্রহনক্ষত্রের প্রভাব অনুকূল হলেই তাতে বিশ্বাস করে আর প্রতিকূল হলেই তাতে অবিশ্বাস করে, এই জন্যই আমি এসব বিশ্বাস করি না। 

মিটলার দেখল এ অবস্থায় আপাতত কিছু করা সম্ভব নয় তার পক্ষে। তাই সে এডওয়ার্ডের অনুরোধটা রক্ষা করার জন্য শার্লোতের কাছে যেতে সম্মত হলো। বিবাহবিচ্ছেদের কথাটা না তুলুক তার কাছে গেলে অন্তত ওদের মনের ভাবটা বোঝা যাবে। তাতে ওর কাজের সুবিধা হবে। 

শার্লোতের কাছে মিটলার গিয়ে দেখল, আগের মতোই আত্মস্থ আছে শার্লোতে তার স্বভাবসুলভ আত্মসংযম বিন্দুমাত্র ক্ষুণ্ণ বা বিচলিত হয়নি। মিটলারের কাছ থেকে। সব কথা শুনে শার্লোতে বলল, আমি আশা করি ভবিষ্যতে সব ঠিক হয়ে যাবে। এডওয়ার্ড আবার ফিরে আসবে আমার কাছে। 

শার্লোতের এই দুর্মর আশার কথা শুনে খুশি হলো মিটলার। সে বলল, এই দৃঢ় প্রত্যাশা হাজার কথা ও পরামর্শের থেকেও বড়। আমিও তাই বিশ্বাস করি। এই বলিষ্ঠ কিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই জীবন আমি অনেক বিবাহ সংঘটিত করেছি, অনেক ঝগড়া মিটিয়েছি, অনেক বিচ্ছিন্নপ্রায় দাম্পত্য সম্পর্কে জোড়া লাগিয়ে দিয়েছি। 

শার্লোতে মিটলারের হাতে দিয়ে এডওয়ার্ডের একটা চিঠি দিতে চাইল। কিন্তু মিটলার বলল, এ চিঠি অন্য কোনও পত্রবাহককে দিয়ে পাঠাতে পার। এটা আমার কাজ নয়। আমি যাচ্ছি। আবার আসব সুখবর নিয়ে। 

শার্লোতের পত্রবাহক যথাসময়ে এসে এডওয়ার্ডের সঙ্গে দেখা করল। ভয়ে ভয়ে চিঠি খুলে দেখল এডওয়ার্ড। শার্লোতে তাকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে তাদের অতীত মিলনের কথা। সেই সব নিবিড়তম মিলনের কথা যখন এডওয়ার্ড তাকে পরম আগ্রহভরে প্রেমের নায়ক হিসাবে জড়িয়ে ধরত অতীতে। 

এসব অতীতের কথা পড়তে কিছুটা ভালো লাগল এডওয়ার্ডের। দুঃখের সময় অতীতচারণা মনের শূন্যতাকে কিছুটা ভরিয়ে দেয়। এডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, যত কষ্টই হোক তার, সে আর প্রাসাদে যাবে না। তার প্রিয়জনের দুঃখের বা চিন্তার কারণ হবে না। 

দ্বিতীয় খণ্ড 

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

ক্যাপ্টেন যাবার আগে বাড়ি নির্মাণের জন্য একজন স্থপতি নিয়োগ করেছিল। বয়সে যুবক হলেও সুদক্ষ এবং সে ছবি আঁকতে পারে। বলিষ্ঠ লম্বা চেহারা। বলিষ্ঠ অথচ ছিপছিপে। বিভিন্ন জায়গায় যে সব কাজকর্ম চলছিল, স্থপতিই তার দেখাশোনা করত। বিভিন্ন কাজের জন্য প্রায়ই বাড়ির ভিতরে আসতে হতো তাকে। মাঝে মাঝে সে শার্লোতে ও ওতিলের সঙ্গে কথাবার্তায় যোগদান করত। এক-একদিন সন্ধেবেলায় সে তাদের সঙ্গে গল্পগুজবও করত। 

একদিন এক স্থানীয় আইনজীবী এসে দেখা করল শার্লোতের সঙ্গে। জনৈক স্থানীয় জমিদার তাকে পাঠিয়েছে। উকিলটিও বয়সে যুবক, বিশেষ উৎসাহের সঙ্গে তার বক্তব্য তুলে ধরল। তার বক্তব্য হলো চার্চে যাবার পথের দুধারের যেসব পাথরের স্মৃতিস্তম্ভ বা স্মৃতিফলকগুলো ভেঙে চার্চের ভিতরে এক জায়গায় জড়ো করে রাখা হয়েছে সেগুলোর পুনর্বিন্যাস করতে হবে। চার্চে যাবার পথটা খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়ায় সে পথকে চওড়া করার জন্য এ কাজ করতে হয়েছে। 

শার্লোতে উকিলের কথা শুনে বলল, আমি যা করেছি ঠিক করেছি। মৃত্যুর পর সব মানুষ একসঙ্গে উঁচু-নিচু নির্বিশেষে মিশিয়ে যাবে মাটিতে, কারও কোনও নাম সে মাটির উপর স্মারক হিসেবে থাকবে না এটাই স্বাভাবিক। আপনার বক্তব্যের মধ্যে কোনও যুক্তি নেই। আপনি বলতে চান মৃত্যুর পর সে কোথায় শুয়ে আছে, সেটা জানাবার জন্য স্মৃতিফলকের দরকার আছে। এটা কিন্তু নিছক ভাবালুতার কথা। 

স্থপতি বলল, আমরা একটা কাজ করতে পারি। আমরা যাদের স্মৃতিফলক আছে তাদের একটা করে ছবি এঁকে চার্চের একটা ঘরের দেওয়ালে টাঙিয়ে রাখতে পারি। এতে সব দিক বজায় থাকবে। ছবির মতো অল্প জায়গায় আরও ভালোভাবে বেঁচে থাকতে পারবে মৃতেরা। 

শার্লোতের এতে কোনও অমত নেই। পরদিন ওরা চার্চে গিয়ে দেখল চার্চের গায়ে এক জায়গায় খানিকটা জায়গা খালি পড়ে রয়েছে। সেখানে একটা ঘর করা যেতে পারে স্বচ্ছন্দে। সেই ঘরে ছবিগুলো রাখা হবে। কিভাবে ছবিগুলো আঁকা হবে অতীত পরিবেশের সঙ্গে সংগতি রেখে তার নিদর্শন দেখাল স্থপতি। 

এজন্য রোজ সন্ধেবেলায় সে নূতন নূতন ডিজাইন নিয়ে দেখাতে আসততা শার্লোতে ও ওতিলেকে। 

চ্যাপেলের ঘরটার নির্মাণকার্য তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে আসতে লাগল। এই ঘরের চারদিকে চেয়ালে স্থপতি স্বর্গের আকাশনীল পটভূমিকায় দেবদূতের বর্ণাঢ্য ছবি আঁকবে। ঘরখানির সৌন্দর্য তাতে অনেক বেড়ে যাবে। কাজ শেষ করে স্থপতি একদিন শার্লোতে ও ওতিলেকে বলল, আপনারা সাত দিন ওখানে যাবেন না। তারপর যাবেন। 

এর আগে কাজের সময় ওতিলে রোজ গিয়ে স্থপতির ছবি আঁকার কাজ দেখত। তাকে পরামর্শ দিত বিভিন্ন বিষয়ে। ছবির প্রতি ওতিলের আগ্রহ দেখে বিশেষ আশ্বস্ত হলো শার্লোতে। এডওয়ার্ডের চিন্তা থেকে তার মনটা যত মুক্ত হয় ততই ভালো তার পক্ষে। 

ওতিলেকে একা প্রথমে পাঠিয়ে দিত শার্লোতে। বলল, তুমি গিয়ে আগে দেখে এস। তারপর আমি যাব। 

ওতিলে গিয়ে সত্যিই মুগ্ধ হলো স্থপতির কাজ দেখে। 

শার্লোতের চিঠির জবাব যথাসময়েই দিয়েছিল এডওয়ার্ড। কিন্তু তারপর অনেকদিন আর কোনও খবর পায়নি তার। তারপর একদিন খবরের কাগজে শার্লোতে এডওয়ার্ডের নাম দেখল। জানল এডওয়ার্ড যুদ্ধে যোগদান করেছে। 

কথাটা জেনে মোটেই আশ্বস্ত হতে পারল না শার্লোতে। কারণ তার কেবলি মনে হতে লাগল যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে আরও ভোগবাদী ও জেদি হয়ে উঠবে এডওয়ার্ড। তখন সে তার কামনার বস্তুকে ছেড়ে দেবার মতো কোনও উদারতাই দেখাতে পারবে না। 

এদিকে এডওয়ার্ডের যুদ্ধে যোগদানের খবরটা জেনে রীতিমতো দুঃখ পেল ওতিলে। স্থপতির আঁকা চিত্রশিল্পের উপর তার নবজাগ্রত আগ্রহ ও অনুরাগ সত্ত্বেও এডওয়ার্ডের অভাবটা নতুন করে অনুভব করল সে। 

তবু বাড়িতে একা একা থেকে এই বিচ্ছেদের সব ব্যথা-বেদনাকে সহ্য করে যাচ্ছিল ওতিলে। নির্জনতা যেমন কোনও ব্যথাকে লালন করে তেমনি তার ক্ষতের উপর শান্ত প্রলেপের কাজও করে। কিন্তু হঠাৎ একটা ঘটনার আঘাতে ওতিলের সব নির্জনতা ভেঙে খান খান হয়ে গেল। 

শার্লোতের মেয়ে লুসিয়ানে বোর্ডিং স্কুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় অনেক লোকজন আনছে। বেশ কিছু আত্মীয়স্বজন আসছে। একটি ধনী সম্ভ্রান্ত ঘরের ছেলে, যে প্রচুর সম্পত্তির মালিক সে লুসিয়ানেকে বিয়ে করতে চায়। সেও তার আত্মীয়স্বজন নিয়ে একই সঙ্গে আসছে। 

সুতরাং বাড়িতে একসঙ্গে অনেকগুলি অতিথি ও আত্মীয় এসে হাজিল হলো। ওতিলের অস্বস্তি তাতে বেড়ে গেল অনেক। বাড়ির ঝি-চাকরেরা অতিথিদের দেখাশোনার কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠল ভীষণভাবে। 

লুসিয়ানে বড় চঞ্চল প্রকৃতির। সে একবারও চুপ করে বসে থাকতে পারে না। অথচ যে ছেলেটি তাকে বিয়ে করতে চায় সে তার থেকে শান্ত। সে এসেছে শান্ত পরিবেশে তার ভাবি শাশুড়ির সঙ্গে পরিচিত হতে। তাদের সঙ্গে সম্পর্কের দিক থেকে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে বিয়ের আগেই। 

লুসিয়ানে সবচেয়ে আনন্দ পায় ঘোড়ায় চড়ে। তার ভাবি স্বামীর অনেক ভালো ভালো ঘোড়া আছে। সে তাই যখন-তখন যে কোনওদিন ঘোড়ায় চড়ে বেড়াতে যায়। ঝড়-বৃষ্টি, রোদ বা ভালো-মন্দ আবহাওয়ার কোনও বাছবিচার করে না। 

লুসিয়ানে বড় হঠকারী। যখন যেটা চাইবে তা তার চাই। যখন যেখানে যাবে বলবে, যে কোনও মুহাতেই সেখানে চলে যাবে সে। যেখানে ঘোড়ায় চেপে যাওয়া যায় না, সেখানে ঘোড়া থামিয়ে হেঁটে যাবে। অবস্থা বা পোশাক-পরিচ্ছেদের কথা সে মোটেই গ্রাহ্য করে না। তার ফাই-ফরমাশ খাটতে হিমসিম খেয়ে যেতে লাগল বাড়ির ঝিরা। 

লুসিয়ানাকে দেখে মনে হতে লাগল সে যেন বিরাট পুচ্ছবিশিষ্ট জ্বলন্ত ধূমকেতু। সে যেখানে যায় তার দলবল যায় তার সঙ্গে। এদিকে শার্লোতেও এত বড় ঘরে ও ভালো বরে মেয়ের বিয়ে দেবার গৌরবে গৌরববোধ না করে পারল না। সে তাই তার ভাবী কুটুম্বদের যথাসাধ্য আপ্যায়িত করে তাদের মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে লাগল। শিকার, মাছধরা, বাগানের কাজকর্ম দেখাশোনা করা প্রভৃতি বিভিন্নভাবে তাদের প্রীত করার ব্যবস্থা হলো। 

লুসিয়ানে ঘরের ভিতর বসে থাকতে ভালোবাসে না। সে বেড়াতে যেতে ভালোবাসে। শুধু প্রকৃতি ও জীবন্ত মানুষদের সে ভালোবাসে। তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে চায়। তাই স্থানীয় প্রতিবেশীদের বাড়ি শেষ করে দূর অঞ্চলে সে কখনও ঘোড়ায় চেপে, কখনও বা গাড়িতে করে সদলবলে বেড়াতে যেতে শুরু করল। ফলে যাদের বাড়ি যেত লাগল তারাও প্রতিদানে বেড়াতে আসতে লাগল। এইভাবে বাড়িতে অতিথিদের আসা-যাওয়ার ধুম পড়ে গেল। 

ওতিলে কিন্তু কোথাও যায় না। সে সব সময় শার্লোতের পাশে থেকে ঘর সংসারের কাজে তাকে সাহায্য করে যায়।

লুসিয়ানের একটা ঝোঁক ছিল সমাজের অভিজাত লোকদের প্রতি। তার সঙ্গে যারা এসেছিল তারা সকলেই অভিজাত সামন্ত শ্রেণীর। তাদের জন্মদিন পালন করে ও তাদের সম্মানার্থে নানা প্রীতিভোজের ব্যবস্থা করে তাদের প্রীত করার চেষ্টা করছিল সে। কিন্তু জ্ঞান ও বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিদের কোনও পরামর্শ সে গ্রহণ করত না। 

এমন সময় হঠাৎ একদিন স্থপতির উপর চোখ পড়ল খেয়ালী লুসিয়ানের। স্থপতির সুন্দর বলিষ্ঠ চেহারা, কালো চুল, স্বচ্ছ দৃষ্টি, সপ্রতিভ চোখ-মুখ এবং স্বল্পভাষিতা তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। যা কিছু প্রশ্ন করা হয় স্থপতিকে সে চটপট তার চমৎকার উত্তর দেয়। 

লুসিয়ানের অনেক অদ্ভুত খেয়ালের মধ্যে একটা হলো পোশাক বদলানো। দিনের মধ্যে সে চারবার পোশাক বদলায়। সে ভালো অভিনয় করতেও পারে। বিভিন্ন ছদ্মবেশও ধারণ করতে পারে। মাঝে মাঝে কখনও ছেলে বা চাষি মেয়ের পোশাক পরে লোককে অবাক করে দেয়। কখনও বা বৃদ্ধার পোশাক করে। অথচ তাতে তার মুখের উজ্জ্বল তারুণ্য আরও ভালো করে ফুটে ওঠে। 

লুসিয়ানের সাঙ্গপাঙ্গ ও ফাইফরমাশ খাটার লোকের অভাব ছিল না। সে যখন বাড়িতে গান করত বা অভিনয় করে অতিথিদের আনন্দ দিত তখন একটি যুবক তার সঙ্গে পিয়ানো বাজাত; সে ভালোই বাজাতে পারত। কারণ সে লুসিয়ানের নাচ-গান বা অভিনয়ের গতি-প্রকৃতি ভালোই জানত। হঠাৎ একদিন তাদের বাড়ির স্থপতি যে একজন গুণী শিল্পী তা আবিষ্কার করে বসল। 

একদিন তার পিয়ানো বাদককে ডেকে শবযাত্রার করুণ সুর বাজাতে বলল আর নিজে এক বিধবা রানির বেশ ধারণ করে শবযাত্রার আগে আগে ধীর গতিতে যাবার 

ভূমিকাটা সুন্দরভাবে দেখাল। তাকে ঠিক বিধবা রানির মতোই মানাচ্ছিল। 

হঠাৎ লুসিয়ানে তার এক সঙ্গীকে স্থপতিকে ডেকে আনার কথা বলল। বাড়ির সবাই তার অভিনয় দেখার জন্য জড়ো হয়েছিল। শুধু স্থপতি আসেনি। 

স্থপতি আসার সঙ্গে সঙ্গে লুসিয়ানে তার সামনে এক ব্ল্যাকবোর্ডে একটা সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভের ছবি আঁকার জন্য অনুরোধ করল। প্রথমে বেশ কিছুটা কুণ্ঠাবোধ করছিল স্থপতি। পরে তার অনুরোধ আর জেদের বশবর্তী হয়ে সে ঘরের মাঝখানে গিয়ে ব্ল্যাকবোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে কতকগুলো রেখার আঁচড় কাটতে কাটতে একটা সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ এঁকে ফেলল। সবাই তা দেখে প্রশংসা করতে লাগল।

এরপর স্বাভাবিকভাবেই উপস্থিত দর্শকদের সপ্রশংস মুগ্ধ দৃষ্টি দুইভাগে ভাগ হয়ে গেল। একদল দেখতে লাগল বিধবা রানির ভূমিকায় অবতীর্ণা লুসিয়ানাকে আর একদল দেখতে লাগল কৃতি শিল্পী স্থপতিকে। 

অনুষ্ঠান শেষে লুসিয়ানের প্রেমিক ও ভাবী স্বামী ব্যারন যুবকটি আলাপ করল স্থপতির সঙ্গে। বলল, আপনি তাড়াতাড়ি এঁকেছেন, তবু আপনার হাত ভালো। আমি আপনার এই ছবি একটা রেখে দেব। আপনি আমাকে এঁকে দেবেন। 

স্থপতি বলল, আমার আরও ছবি আছে যেগুলো যত্ন করে আঁকা। 

ওতিলেও পাশে দাঁড়িয়েছিল। ওতিলে বলল, হ্যাঁ উনি চার্চের নতুন বাড়িতে সব ছবি ও সাজসজ্জার কাজ করেছেন। 

ওদের কথার মধ্যে হঠাৎ লুসিয়ানে এসে হাজির হলো। 

লুসিয়ানে হুকুম করল স্থপতিকে, তোমার যত ভালো ছবি আছে সব এখনি নিয়ে এসে দেখাও। 

স্থপতি বলল, এখন না, অন্য সময়ে দেখাব।

লুসিয়ানে বলল, কোনও কথা নয়, রানির হুকুম।

ওতিলে ফিসফিস করে স্থপতিকে বলল, ঠিক আছে তাই নিয়ে এস।

অনিচ্ছা সত্ত্বেও চলে গেল স্থপতি। তবে কিছু ছবি আনল না। 

এদিকে লুসিয়ানের মাথায় হঠাৎ একটা খেয়াল এসে জুটল। তার নাকি একটা পোষা বাঁদর আছে। সেটা আর চাকর কুঁড়েমি করে আনেনি। সে তার মায়ের কাছে গিয়ে বলল, একটা লোক পাঠিয়ে বাঁদরটাকে আনাও। ওর একটা ছবি আঁকিয়ে নেব স্থপতিকে দিয়ে। শার্লোতে লাইব্রেরি ঘর থেকে নানারকম বাঁদরের ছবির একটা বই আনিয়ে দিল লুসিয়ানকে। লুসিয়ানে আপাতত শান্ত হয়ে তাই পর পর আনন্দের সঙ্গে দেখতে লাগল। এদিকে নৈশভোজের ডাক পড়তে সব চাপা পড়ে গেল। 

দিনের শেষে ডায়েরি লেখার একটা বাতিক হয়েছে ওতিলের। এ বাতিক আগে ছিল না। এডওয়ার্ড যাবার পর এই বাতিকে তাকে পেয়েছে। এইদিন সে তার ডায়েরিতে লিখল : 

আমরা ভবিষ্যতের পানে তাকাই, কারণ আমরা ভেবে থাকি ইতস্তত প্রবহমান। ঘটনাস্রোতগুলো এদিকে-সেদিকে বইতে বইতে আমাদের হয়ত বা উদ্দেশ্য পূরনের পথে নিয়ে যাবে একদিন। আমরা কোনও সমাবেশে বা অনুষ্ঠানে যেতে ভালোবাসি কারণ আমরা ভাবি এত লোকের মাঝে নিশ্চয় আমরা একজন বন্ধুকে পেয়ে যাব। 

অপরের কাছে অন্তরের দ্বার মুক্ত করে দিতে সবাই পারে। এটা সহজ কাজ। কিন্তু অপরের আস্থা অর্জন করতে হলে শিক্ষাদীক্ষা ও মার্জিত রুচির দরকার হয়। বাস্তব বুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তিবাদীরা প্রায় সবকিছুকেই তুচ্ছ ও হাস্যাস্পদ ভাবে। কিন্তু যারা প্রকৃত জ্ঞানী তারা কোনও কিছুকেই তুচ্ছ ভাবেন না। কোনও এক বয়স্ক লোকের যুবতী মেয়েদের প্রতি বেশ আগ্রহ ছিল। তা দেখে একজন সমালোচনা করে তার এই কাজের। তখন সে বলে, যুবতী মেয়ের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যের মাধ্যমে আমি আবার হারানো যৌবনকে ফিরে পেতে পারি আর এটাই সবাই চায়। কোনও প্রেম কখনও দোষের নয়। কিন্তু সেই প্রেমাবেগ বা প্রেমাসক্তি যখন অতিমাত্রায় বেড়ে ওঠে তখনি তা দোষ বা গুণের ব্যাপার হয়ে ওঠে। আমাদের প্রেম হচ্ছে সেই আশ্চর্য ফেনিক্স পাখির মতো। আমাদের এক প্রেমের বস্তু পুড়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তার ছাই থেকে আর একজন গজিয়ে ওঠে। 

ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ

লুসিয়ানের আসার অল্প কিছুদিনের মধ্যে সারা অঞ্চলে বেশ নাম করে ফেলল। মানুষকে তার প্রতি আকৃষ্ট বা আসক্ত করার অদ্ভুত একটা ক্ষমতা ছিল তার। আভিজাত্যবোধের কোনও সীমারেখার দ্বারা কখনও নিয়ন্ত্রত হতো না লুসিয়ানে। ছোট বড় নির্বিশেষে যে কোনও মানুষের সঙ্গে সে সহজভাবে যেচে কথা বলত। ভালো লেগে গেলে তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করত। আবার কউকে কোনও কারণে খারাপ লাগলে তাও মুখের উপরে বলে দিত। অথবা টিপ্পনি কাটত তার উপর। 

লুসিয়ানের একটা গুণ ছিল। সেটা হলো তার দানশীলতা। আর একজন সহচর বা সহচরীর হাতে সব সময় টাকার একটা থলে থাকত। যে কোনও জায়গায় যে কোনও মানুষকে কিছু দেবার ইচ্ছা জাগলেই তৎক্ষণাৎ হুকুম করত লুসিয়ানে এবং তার হুকুমমতো সেই টাকা তাকে দিতে হতো। কেউ কিছু তার কাছে চাইলে বড় একটা বিমুখ হতো না। একদিন এক জায়গায় এক বৃদ্ধাকে শীতে কষ্ট পেতে দেখে একটা দামী শাল তার গায়ে নিজের হাতে জড়িয়ে দিল। সে এমন আন্তরিকতার সঙ্গে তা দিল যে বৃদ্ধা কোনও প্রতিবাদ করার অবকাশ পেল না। না চাইতে অযাচিতভাবে সে তা দিল।

একটি বাড়িতে এক যুবক যুদ্ধে গিয়ে একটি হাত হারায়। সে বড় ঘরের ছেলে। কিন্তু কোনও জায়গায় বা ভোজসভাতে গেলেই সবাই তার কাটা হাতটির কথা জিজ্ঞাসা করত বলে সে কোথাও যেত না। লজ্জাবোধ করত পাঁচজনের কাছে যেতে। সে তাই বিষণ্ণ হয়ে চুপচাপ বাড়িতে বসে থাকত। জীবন ও জগতের প্রতি একে একে সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিল সে। এমন সময় একদিন ঘটনাক্রমে তার কথা জানতে পেরে তার সঙ্গে আলাপ করল লুসিয়ানে। সে তাকে জোর করে একটি ভোজসভায় নিয়ে গেল। তাকে যত্ন করে পাশে বসাল। নিজের হাতে তার খাবার ঠিক করে দিল যাতে খেতে কোনও অসুবিধা না হয়। ছেলেটি অবাক হয়ে গেল তার প্রতি লুসিয়ানের সদয় ব্যবহার দেখে। যাকে কেউ দেখতে পারে না, যে একরকম সকলের নিকট অবাঞ্ছিত তার প্রতি লুসিয়ানের আগ্রহ দেখে সবাই তার প্রশংসা করতে লাগল। এমনকি তার প্রেমিক ও তার ভাবী স্বামীও এর জন্য কোনওরূপ ঈর্ষাবোধ না করে খুশি হলো। এদিকে যুবকটিও নূতন করে বাঁচার আনন্দ খুঁজে পেল এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে উৎসবে যেতে শুরু করল। 

কিন্তু লুসিয়ানের এত গুণের মাঝে একটা দোষ ছিল। তা হলো ওতিলের প্রতি অহেতুক বিরাগ। ওতিলের প্রতি তার এই মনোভাবের অবশ্য কারণ ছিল। সেটা তার স্বভাবগত। কারণ ওতিলের স্বভাবটা ছিল লুসিয়ানের ঠিক বিপরীত। লুসিয়ানে যতখানি বহির্মুখী ছিল ওতিলে ছিল ঠিক ততখানি অন্তর্মুখী। ওতিলে সব সময় ঘর সংসারের কাজকর্ম নিয়ে থাকত, কোথাও কোনও অনুষ্ঠানে যেতে চাইত না দেখে ভীষণ রেগে যেত লুসিয়ানে। এজন্য সময়ে-অসময়ে কথায় কথায় ওতিলেকে আঘাত দিতে ছাড়ত না লুসিয়ানে। স্থপতির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহের কারণও ছিল ওতিলে। লুসিয়ানে বাড়িতে আসার পর থেকে লক্ষ্য করে স্থপতির প্রতি ওতিলের এক সশ্রদ্ধ আসক্তি আছে। স্থপতির কাজকর্মের প্রশংসার পঞ্চমুখ ওতিলে। তাই ওতিলের কাছ থেকে কৌশলে স্থপতিকে সরিয়ে আনার জন্যই সে স্থাপতির প্রতি বিশেষ আগ্রহ দেখাতে থাকে ওতিলের সামনে। 

কিন্তু লুসিয়ানে জানত ওতিলে স্থপতিকে পছন্দ করলেও ভালোবাসত না। ওতিলে শুধু একজনকেই ভালোবাসত। সে হলো এডওয়ার্ড। তার অন্তরের প্রেমের আসনটিতে তখনও ছিল এডওয়ার্ডের একাধিপত্য। 

এদিকে লুসিয়ানের ভাবী স্বামী স্থপতির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে উঠল। স্থপতি সম্বন্ধে তিলে যা যা জানত তা সব বলল তার কাছে। লুসিয়ানের ভাবী স্বামী ব্যারন যুবকটির সহজাত এক শিল্পানুরাগ ছিল। স্থাপতি নিজে একজন শিল্পী বলে তার সঙ্গে সহজেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠল অল্পদিনের মধ্যে। বিশেষ করে ছবি সংগ্রহের ব্যাপারে। কালানুক্রিমকতা সম্বন্ধে স্থপতির সঙ্গে আলোচনা করে অনেক কিছু জানতে পেরেছিল। ব্যারন। সে একবার লুসিয়ানের কাছে প্রস্তাবও করল যে তাদের বাড়ি সাজাবার জন্য স্থপতিকে একবার নিয়ে যাবে। লুসিয়ানেও খুশি হয়ে মত দিল তাতে। 

ওতিলে একদিন কথায় কথায় ব্যারনকে জানাল তারা এতদিন জানত না স্থপতি চলে যাচ্ছে তাদের বাড়ি ছেড়ে। কারণ এখানে পরিকল্পনার কাজ আপাতত বন্ধ থাকবে। তাই শার্লোতে তার জন্য অন্য জায়গায় কাজের চেষ্টা করছিল। 

দেখতে দেখতে দারুণ শীত পড়ে গেল। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়। পথ-ঘাট কাদায় ভরে যায়। বাইরে বেরোনো মুস্কিল হয়ে পড়ে। এমন সময় এ বাড়ির সবচেয়ে সম্মানিত অতিথি কাউন্টপত্নী এসে হাজির হলেন হঠাৎ একদিন। 

লুসিয়ানে কথায় কথায় জানতে পারল কাউন্ট নাচগান ভালোবাসেন। একথা জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সেদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে এক গানের আসরের অনুষ্ঠান করল লুসিয়ানে। সে গিটার সহযোগে গান করল। গিটারটা অন্য একজন বাজাল। কিন্তু কাউন্টের সে গান ভালো লাগল না। তখন আবৃত্তি করল লুসিয়ানে। কিন্তু তাতেও মুগ্ধ করতে পারল না বিশেষ কাউন্টকে। 

অবশেষে কাউন্ট এক সম্পূর্ণ নূতন ধরনের এক অভিনয়ের জন্য পরামর্শ দিলেন। তাদের। কাউন্ট লুসিয়ানকে ডেকে বললেন, তোমাদের বাড়িতে কত রকমের লোক রয়েছে। তোমার নিজেরও বেশ অভিনয় প্রতিভা রয়েছে। একটা কাজ করো, ভ্যান ডাইকের একটি বিখ্যাত ছবি আছে। সেই ছবিতে যতগুলো চরিত্র আছে সেই চরিত্রগুলো মূক অভিনয়ের দ্বারা জীবন্ত করে তুলতে পার। ছবিতে যে যেভাবে যে ভঙ্গিমায় অবস্থান করছে তোমরাও তাই করবে। ছবিতে চিত্রিত আর ভঙ্গিমাগুলো নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলবে তোমরা। 

ছবিটি ভালোভাবে দেখল ওরা। তারপর যার যা ভুমিকা সব বিতরণ করে দেওয়া হলো। ছবিতে আছে কোনও এক মধ্যবয়সী অন্ধ রাজা সিংহাসনে বসে আছে। তার পিছনে রানি দাঁড়িয়ে আছে। রাজার পাশে বাঁদিকে আছে তার সেনাপতি। এছাড়া আছে রানির কিছু সহচরী। রানি একটা টাকার থলে থেকে কিছু মুদ্রা এক ভিখিরীকে দান করতে যাচ্ছে আর এক বৃদ্ধ সহচরী তাকে তা করতে নিষেধ করছে। বলতে চাইছে অনেক দেওয়া হয়েছে। আর না। আর এক সহচরী রানির দেওয়া ভিক্ষা ভিখারীকে দান করছে। ভিখারীটি আছে কিছু দূরে একধারে। 

একজন মধ্যবয়সী সুদর্শন ব্যক্তি ওদের দলেই ছিল। তাকে দেওয়া হলো রাজার ভূমিকা। লুসিয়ানে হলো রানি। স্থপতি অবতীর্ণ হলো রাজার পাশে দণ্ডায়মান সেনাপতির ভূমিকায়। বাকী ভূমিকাগুলো ভাগ করে দেওয়া হলো অন্যদের। 

স্থপতি কাউন্টের নির্দেশতো মঞ্চসজ্জা আর আলোকসম্পাতের দায়িত্ব নিল। অবশেষে একটি সন্ধ্যায় অনুষ্ঠানটি সুসম্পন্ন হলো। সকলের অভিনয়ই ভালো হলো। লুসিয়নের সাজসজ্জা ও অভিনয় খুব ভাল হলো। তাকে রানি হিসাবে বেশ মানিয়েছিল। স্বভাবত চঞ্চল প্রকৃতির লুসিয়ানে প্রায় সব সময়ই ছটফট করে। এইজন্য গান বা আবৃত্তিতে বিশেষ সার্থকতা অর্জন করতে পারে না। কিন্তু এই মূক অভিনয়ে যে স্থৈর্য ও ধৈর্যের পরিচয় দেয় তা সত্যিই তার আকর্ষণকে বাড়িতে তোলে। অভিনয় মূক হলেও লুসিয়ানের দয়া-মায়া উদারতা ও দানশীলতা প্রভৃতি গুণ ও অন্তরবৃত্তিগুলো যেন এক নীরব ভাষাময়তায় সোচ্চার হয়ে ওঠে একসঙ্গে। তার অন্তরের সব সুষমা মূর্ত হয়ে ওঠে প্রায় তার সুসজ্জিত অঙ্গের মধ্যে। মুখের হাবভাবের মধ্যে।

কাউন্ট খুশি হয় আর এক জায়গায় এই অভিনয়ের অনুষ্ঠান করার কথা বললেন। অভিনয় দেখে শুধু কাউন্ট নয়, উপস্থিত সকলেই খুশি। ছবির নির্জীব মানুষ জীবন্ত হয়ে উঠল অভিনয়ের গুণে। অথচ কারও মুখে কথা নেই। মানুষের নীরব অঙ্গভঙ্গি এমন সুন্দরভাবে বাজয় হয়ে উঠতে পারে না দেখলে তা বোঝা যায় না। 

এবার ব্যারন যাবার জন্য প্রস্তুত হতে লাগল তাদের দলবল নিয়ে। স্থাপতিকে বলে দিল, নতুন বছর শুরু হলেই সে যেন ব্যারনের বাড়িতে চলে যায়। 

ওতিলেকে কোনও ভূমিকা দেওয়া হয়নি। হয়ত লুসিয়ানের কোনও ইচ্ছা ছিল না এতে। অথচ ওতিলের আকর্ষণ তাদের দলের সবার চাইতে বেশি। লুসিয়ানের থেকেও বেশি। স্বভাবতঃই লুসিয়ানের থেকে স্থির ধীর বলে তার শান্ত স্বাভাবিক সৌন্দর্য আরও বেশি দেখায়।

ওদের অভিনয় আর পাঁচজন দর্শকের মতো ওতিলেও দেখেছিল। তার পাঁচজনের মতোই ওদের অভিনয়ের প্রশংসা করেছিল। তারপর রাত্রিতে শোবার আগে অন্য দিনকার মতো ডায়েরি লিখেছিল ওতিলে। আজকাল তিলে তার ডায়েরিতে নিজের কোনও কথা বা দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার কথা কিছু লেখে না। লেখে শুধু সাধারণভাবে মানবজীবন সম্পর্কে তার মনোভাব বা অভিজ্ঞতার কিছু কথা। সেদিন ওতিলে তার ডায়েরিতে লিখল : 

কেউ যখন আমাদের বাড়িতে আসে তখন তার চরিত্র সম্বন্ধে কিছুই জানা যায় না। তাকে বুঝতে হলে জানতে হলে তার কাছে আমাদের যেতে হবে। 

একমাত্র শিল্পের মাধ্যমেই মানুষ যেমন জগত্তাকে এড়িয়ে চলতে পারে তেমনি শিল্পের মাধ্যমেই জগতের সঙ্গে খুব বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবে। খুব বেশি সুখ বা দুঃখের মুহূর্তে এই শিল্পীদের প্রয়োজন হবে আমাদের জীবনে। 

বিংশ পরিচ্ছেদ

অবশেষে ওরা চলে গেল। সারা বাড়িটা জুড়ে কয়েক মাস ধরে যেন একটা ঝড় বয়ে গেল। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত হুল্লোড়, নাচগান, লোকজনের ভিড় লেগেই থাকত, সে ঝড়ের প্রকোপটা সবচেয়ে বেশি সহ্য করতে হয়েছে বাড়ির গৃহিণী শার্লোতেকে। অবশ্য ওতিলোকেও খাটতে কম হয়নি। তবু সে শুধু খেটেই খালাস পেয়েছে, কোনও চিন্তা-ভাবনা করতে হয়নি। এতগুলো সম্মানিত অতিথিদের আদর আপ্যায়নের যথাযথ ব্যবস্থা সব শার্লোতেকেই করতে হয়েছে। 

তবে এই ঝড়ের প্রকোপে কিছুটা কষ্ট পেলেও একটা উপকার এর থেকে পেয়েছে শার্লোতে। সে লুনিয়ানেকে বুঝতে পেরে আগের থেকে আরও অনেক নিবিড়ভাবে। সে এখন বড় হয়েছে। তার পছন্দ অপছন্দ, খেয়াল খুশি, মনের গতিপ্রকৃতি এত কাছে থেকে এমন করে জানার দরকার ছিল তার। 

শুধু লুসিয়ানে নয়, সে যাকে বিয়ে করতে চলেছে, যে হবে তার সারা জীবনের সঙ্গী তাকেও এই সুযোগে খুব ভালো করে জানতে পারল শার্লোতে। লুসিয়ানের বয়স কম। সে যেন তার প্রথম প্রেমের নায়ক নির্বাচনে ভুল করেনি, তার নির্বাচন যে তার জীবনের পক্ষে এমন কিছু অশুভ হবে না। এটা মা হিসাবে তার জানা দরকার ছিল। লুসিয়ানের ভাবী স্বামী ব্যারন যুবকটিতে ভালোই লাগল শার্লোতের। ধনী অভিজাত বংশের ছেলে। প্রচুর বিষয় সম্পত্তির মালিক। পড়াশুনা খুব একটা করেনি। তবু তার রুচিবোধ উন্নত ও মার্জিত। তার আচরণ ভদ্র ও সৌজন্যমূলক। সুতরাং তার উপর। স্বচ্ছন্দে তার মেয়ের সব ভার সারা জীবনের জন্য ছেড়ে দিতে পারে শার্লোতে। 

লুসিয়ানে চলে যাবার পর তার ব্যাপারে মনে একটা আঘাত পেল শার্লোতে। কোনও এক প্রতিবেশীর বাড়িতে পরোপকারের ঝেকে এমন সব বাড়াবাড়ি করে গেছে। যা সত্যিই লজ্জা ও দুঃখের কথা। স্থানীয় কোনও এক অভিজাত পরিবারের একটি অল্পবয়সী মেয়ের মাথাটা কোনও এক ঘটনার পর থেকে খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটি বছর কতক আগে ঘটনাক্রমে তার ছোট ভাই-এর মৃত্যুর কারণ হয়ে পড়ে। সেই থেকে তার একটা ধারণা জন্মায় সমাজের লোক তাকে তার মৃত্যুর জন্য দায়ী করছে। অথচ এটা শুধূ তার মনের ভয় মাত্র। এই কাল্পনিক ভয় তার এত বেড়ে গেছে যে সে কোনও সভা বা অনুষ্ঠানে যেত না। বাড়িতে অতিথিদের সামনেও বার হতো না। একটা আধো অন্ধকার ঘরের মধ্যে চুপচাপ সব সময় বসে থাকত মেয়েটি। 

লুসিয়ানে সব কিছু শুনে বলল মেয়েটিকে সে ভালো করে তুলবে। স্বামী ও বিষাদগ্রস্ত মানুষদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলতে পারার এক বিরল কৃতিত্ব এর আগে দেখাতে পারায় লুসিয়ানের আত্মবিশ্বাস ক্রমে এক উগ্র আকার ধারণ করে। সে জেদ ধরে মেয়েটিকে সে ভালো করে তুলবেই। তার অপ্রকৃস্থিত মন প্রকৃতিস্থ করে তুলবে। এই বলে একদিন লুসিয়ানে মেয়েটির ঘরে গিয়ে নানাভাবে তার মন জয় করে ফেলে। মেয়েটি লুসিয়ানের কথায় ঘর থেকে বাইরে ভোজসভায় এসে হাজির হয়। এতে তাড়াহুড়ো না করে লুসিয়ানে যদি মেয়েটিকে ধীরে ধীরে ভালো করে তোলার চেষ্টা করত, প্রথমেই এত লোকের সঙ্গে বার না করে একে একে কিছু কিছু লোকের সামনে বার করে মেয়েটির মনের ভয় দূর করার চেষ্টা করত তাহলে সে অবশ্যই সফল হতো। তা না করে হঠাৎ সকলের সামনে মেয়েটিকে বার করে ভুল করল লুসিয়ানে। তাছাড়া সেই ভোজসভায় লোকজনদের মেয়েটি সম্বন্ধে সব কথা বুঝিয়ে বলে সাবধান করে দেয়নি। 

ফলে মেয়েটি ভোজসভায় আসার সঙ্গে সঙ্গে সকলে তার পানে চাইতে লাগল কৌতূহলী হয়ে। অনেকে তার পানে সন্দেহজনকভাবে তাকিয়ে নিজেদের মেধ্য ফিসফিস করে কথা বলতে লাগল। ফলে মেয়েটির সেই কাল্পনিক ভয়টি বাস্তবে পরিণত হলো। মেয়েটি হঠাৎ তীব্র চিঙ্কারে ফেটে পড়ল। সে ছুটতে ছুটতে তার ঘরের মধ্যে চলে গেল। এই সময় ওতিলেও সেখানে ছিল। সে লজ্জায় পড়ে যায় লুসিয়ানের কাণ্ড দেখে। ওতিলে অবশ্য তৎক্ষণাৎ মেয়েটিকে ঘরে নিয়ে গিয়ে তার সেবা করতে থাকে। কিন্তু সেই থেকে মেয়েটির অবস্থা খারাপের দিকে যেতে থাকে। তার বাড়ির লোকজন বিব্রত হয়ে তাকে হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করতে থাকে। একথা শোনার পর মেয়ের এই অশোভন আচরণে সত্যিই দুঃখিত হয় শার্লোতে। 

এদিকে ওতিলেও সেদিন স্থপতির ব্যাপারে কিছুটা দুঃখিত হয়। এদিন লুসিয়ানে তার ছবিগুলো দেখতে চাইলে তিলে স্থপতিকে তা আনার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু স্থপতি তা আনেনি। 

ওরা সবাই চলে গেলে কথাটা একদিন তুলল ওতিলে। ও তখন ভেবেছিল ওরা সেই সময় তার ছবি দেখার ব্যাপারে ঠিকমতো মনোযোগ দেবে না। তাই তখন আনেনি। যাই হোক, ওতিলে এতে অসন্তুষ্ট হয়েছে জেনে নিজের দোষ স্বীকার করে ক্ষমা চাইল স্থপতি। 

স্থপতি জানত তার যাবার দিন ঘনিয়ে এসেছে। তবু তার ওতিলেকে ছেড়ে যেতে মন চাইছিল না। স্বল্পভাষিণী ওতিলের বিষাদগম্ভীর মুখ আর অচঞ্চল ব্যক্তিত্বের এমন একটা মোহপ্রসারী আবেদন আছে যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছিল স্থপতি। যাবার আগে সে একটা অনুষ্ঠান করে ওতিলের সঙ্গে তার সম্পর্কে একটি মুহূর্তকে অবিস্মরণীয় করে রাখতে চাইল। 

স্থপতি ঠিক করল সে ক্রিস্টমাস ঈভ বা খ্রিস্টের জন্মোৎসব নিয়ে এক মূক অভিনয়ের অনুষ্ঠান করবে। ওতিলে হবে প্রসূতি মাতা, এক স্বাস্থ্যবান শিশু তার কোলে সদ্যজাত শিশুর মতো শোভা পাবে আর তাদের চারপাশে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকবে কিছু রাখাল বালক। 

যথাসময়ে যবনিকা তুললে দেখা গেল শিশুটি ঘুমিয়ে গেছে আর তাকে কোলে নিয়ে নিথর নিস্পন্দ হয়ে বসে আছে ওতিলে। স্বয়ং ঈশ্বরের মাতারূপে সত্যিই মানিয়েছিল তাকে। স্থপতি আলোকসম্পাতের কাছ করছিল। ওতিলের মুখে ঠিক সেই সময়ে যে স্বর্গীয় সুষমা ফুটে উঠেছিল তা কোনও চিত্রকর ফুটিয়ে তুলতে পারে না। 

ওতিলের অভিনয় দেখে শার্লোতে নিজেও মুগ্ধ হয়ে গেল। এই অভিনয় দেখে তার একটি অতৃপ্ত গোপন বাসান খোঁচা দিতে লাগল তার মনকে। শার্লোতে আশা করেছিল আরও একটি শিশুপুত্র জন্মলাভ করবে। তার কন্যা সন্তান আছে, কিন্তু পুত্র নেই। একটি শিশুপুত্র লাভে তার মাতৃত্ব সার্থক হবে। কিন্তু সে আশা হয়ত পূরণ হবে না তার। 

এদিকে স্মৃতি চলে গেলে তার জায়গায় প্রাসাদের বিভিন্ন কাজকর্ম দেখাশোনা করার জন্য একজন নূতন লোক নিয়োগ করেছে শার্লোতে। লোকটি এক সহকারী বিদ্যালয় শিক্ষক। অনুষ্ঠানের দিনই লোকটি এসে হাজির হলো। 

স্থপতিকে বিদায় দেবার সময় শার্লোতে ও ওতিলে দুজনে মিলে তাকে একটা হাতে বোনা ওয়েস্টকোট উপহার দিল। এছাড়া আরও কিছু উপহার আগেই তারা দিয়েছিল। 

একবিংশ পরিচ্ছেদ

ওতিলে যে বোর্ডিং স্কুলে পড়ত, যেখান থেকে পড়তে পড়তে হঠাৎ চলে এসেছে। তার পড়া শেষ না করেই, সেই স্কুলের একজন সহকারী শিক্ষককে কিছুদিনের জন্য এখানে বেড়াতে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছিল শার্লোতে। সেই আহ্বানে সাড়া দিতে এখানে এসেছেন তিনি। তিনি আসাতে ওতিলে ও শার্লোতে দুজনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে বিশেষভাবে। 

এই সহকারীর বয়স অল্প হলেও শিক্ষণকার্যের দক্ষতায় ও শিক্ষাতত্ত্ব সম্পর্কিত বিজ্ঞতার দিক থেকে খুব নির্ভরযোগ্য। ওতিলে তাকে শ্রদ্ধার চোখে দেখত আগে থেকেই। যে বোর্ডিং স্কুলে সহকারী হিসাবে কাজ করত তার হেডমিস্ট্রেস তার যোগ্যতার জন্য তাকে খুবই ভালোবাসতেন। তাঁর বয়স হয়েছিল। অথচ স্কুলটাকে 

তিনি নিজের হাতে গড়ে অতি যত্নসহকারে তা চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। হেডমিস্ট্রেসের তাই একান্ত ইচ্ছা, তিনি তাঁর এই সুযোগ্য সহকারীর উপর স্কুলের সব ভার অর্পণ করে অবসর গ্রহণ করবেন। তাঁর আরও একটা ইচ্ছা, তিনি ওতিলের মতো রূপবতী মেয়ের সঙ্গে সহকারীর বিয়ে দিয়ে তাকে সংসারী করে তুলবেন। এই বিয়ের ব্যাপারে শার্লোতের সম্পত্তির অভাব হবে না-একথা তিনি একরকম ধরেই নিয়েছিলেন। 

স্থপতি চলে গেলে একদিন শার্লোতে গাঁয়ের সব ছেলেদের সহকারীর সামনে ডাকল। তাদের শৃঙ্খলাবোধ শেখবার জন্য রোজ বাগানবাড়ির অফিস ঘরে তাদের ডাকা হতো। তাদের যে পোশাক বিলি করা হতো তাই পরে তারা সারবন্দিভাবে আসত। তারা গাঁয়ের পথঘাট ও পাক সর্ব পরিচ্ছন্ন রাখত এবং সব সময় গাঁয়ের মধ্যে শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলত। ওতিলে ভার নিয়েছিল গাঁয়ের মেয়েদের সংঘবন্ধ করে তাদের সূচিশিল্প ও কিছু কুটিরশিল্পের কাজ শেখাবার। ওতিলে সহকারীকে বলল, আমি কিন্তু এইসব মেয়ের কোনও পোশাক বিলি করি না। ওদের প্রত্যেকের পোশাক আলাদা।

সহকারী প্রতিটি ছেলেকে অল্প দু-চার কথা বলে বোঝাল। তারপর বলল, আমি তোমার এই কাজকে সমর্থন করি। স্কুলের ছেলেদের একই জাতীয় ও একই রঙের। পোশাক পরার প্রয়োজনীয়তা আছে। এতে তাদের সাম্যবোধ ও ঐক্যভাব জাগে। এক সামরিক শৃঙ্খলাবোধ ও আত্মবিশ্বাস দৃঢ় হয়ে ওঠে তাদের মন। কিন্তু মেয়েদের তা প্রয়োজন হয় না। মেয়েরা সকলে এক কাজ করলেও তাদের স্বাতন্ত্র্যবোধ ও ব্যক্তি চেতনা খুবই প্রখর। তারা কন্যারূপে স্ত্রীরূপে ও মাতারূপে যখন যেভাবেই থাকুক না কেন, যে কাজই করুক না, মনে মনে তারা একক ও স্বতন্ত্র রয়ে যায়। কোনও নারীর সঙ্গে অন্য কোনও নারীর সর্বতোভাবে কখনই মিল হয় না। এই স্বাতন্ত্র্যবোধকে প্রথম। থেকে বিলুপ্ত করে না তার মধ্যে তাদের সার্থক হয়ে ওঠার সুযোগ ও শিক্ষা দিতে হবে। 

সহকারী শার্লোতেকে বলল, ছেলের শিক্ষা দেবার সময় বেশি কথা না বলে তাদের থেকে কাজ আদায় করে নিতে হবে। তারা কিভাবে কতখানি কোনও বিষয় বুঝতে পারল সেটা তীক্ষ্ণভাবে লক্ষ্য করতে হবে। তবে এ বিষয়ে ওতিলের বুদ্ধিমত্তাকে স্বীকার না করে পারল না সে। 

শার্লোতে এটাই চাইছিল। তার বহু দিনের গোপন ইচ্ছাটা অনুকূল ঘটনার ঘাতপ্রতিঘাতে ক্রমশ এগিয়ে চলেছিল পুরণের পথে। এডওয়ার্ডের অনুপস্থিতির সুযোগে ওতিলের মনটাকে এডওয়ার্ডের কাছ থেকে ধীরে ধীরে অনেকখানি সরিয়ে আনতে পেরেছিল স্থপতি তার বিচিত্র শিল্পকর্ম ও শিল্পপ্রতিভার মাধ্যমে। এবার সেই মন স্থপতির অবর্তমানে দুর্বারবেগে আকৃষ্ট হলো সহকারীর দিকে। 

তাই সহকারী একদিন কথায় কথায় ওতিলেকে বলল, তুমি বোর্ডিং স্কুলে ফিরে গিয়ে তোমার পড়াটা শেষ করে ফেলো। তোমার সহজাত বুদ্ধিমত্তা আছে। তার সঙ্গে শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকা চাই। অল্পের জন্য এটাকে অপূর্ণ রেখো না। 

ওতিলে একবারও প্রতিবাদ করল না। শার্লোতে একথায় খুশি হলো। সে এটাই চাইছিল। এতে দুদিকই বজায় থাকবে। সে নিজে যদি ওতিলেকে জোর করে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দিত তাহলে ও এডওয়াড দুহজনেই তার উপর রাগ করত, তাকে ভুল বুঝত। কিন্তু সহকারী নিজে এ প্রস্তাব করায় এবং ওতিলে তা সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেওয়ায় শার্লোতের কোনও দায়িত্ব রইল না এ ব্যাপারে। অথচ শার্লোতের উদ্দেশ্যটাও এতেই সিদ্ধ হবে। অর্থাৎ এতিলে বোর্ডিং স্কুলে গিয়ে সহকারীর আরও ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসবে। তার প্রতি আরও বেশি করে আসক্ত ও শ্রদ্ধাশীল হবে। আর তখন হেডমিস্ট্রেসের চেষ্টায় ওদের বিয়েটা সহজেই হয়ে যাবে। ওতিলে স্বেচ্ছায় কাউকে বিয়ে করলে এডওয়ার্ডের তাতে কিছুই বলার থাকবে না। 

তখন এডওয়ার্ড বাধ্য হয়ে আবার ফিরে আসবে। ঘটনার আঘাতে ওতিলের প্রতি তার যত সব অবৈধ মোহ ও আসক্তি অপগত হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবেই সে ফিরে আসবে শার্লোতের কাছে। সব বাধা বিপত্তির অবসানে তাদের পুরনো প্রেম মেঘমুক্ত চাঁদের মতো আবার উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। সেই দিনটির প্রতীক্ষায় আজও মুহূর্ত গণনা করলে শার্লোতে পরম আগ্রহে। আজো সে এডওয়ার্ডের পথ চেয়ে বসে আসে। তার বিশ্বাস এডওয়ার্ড একদিন তার ভুল বুঝতে পারবেই। সে তার কাছে ফিরে আসবেই। তাদের প্রথম প্রেম যখন একবার প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হয় তখন এবারও নিশ্চয়ই জয়ী হবে। 

অব্যবহিত পূর্বে যে ঘটনা ঘটে যায় তার কথা মনে রাখে না মানুষ। হয় বর্তমান জীবনের স্রোত আর ঘটনার মাঝে দুর্বার বেগে ঠেলে নিয়ে গিয়ে তাকে সে কথা মনে রাখতে দেয় না অথবা অতীতের মধ্যে তার মনটা ডুবে যায়। 

প্রাসাদ থেকে বিদায় নিয়ে স্থপতির চলে যাওয়ার ঘটনা অথবা লুসিয়ানার এত সব দাপাদাপির ঘটনা কোনওটাই বিশেষ করে রেখাপাত করতে পারল না শার্লোতে বা ওতিলের মনে। ওরা সে সব স্বচ্ছন্দে ভুলে গেল। সহজভাবে সহকারী জ্বলোকের উপর নজর দিল। 

তাছাড়া মেয়েদের মনের প্রকৃতিটা অন্যরকম। বড় অদ্ভুত। সে প্রকৃতিতে আছে অদ্ভুত ভাবের লীলা। তাদের মনের গভীরে এক বিশেষ পুরুষের প্রতি গভীরতম আসক্তি এমনভাবে বাসা বেঁধে থাকে যা বাইরের সমাজ সম্পর্কের কোন ঘাতপ্রতিঘাত বা কোনও প্রতিকূল অবস্থা সে আসক্তিকে বিলুপ্ত বা নিশ্চিহ্ন করতে পারে না। কিন্তু আবার সঙ্গে সঙ্গে ঘটনাক্রমে সব পুরুষরা তাদের বহুবার বহু নিবিড় সংস্পর্শে আসে যাদের চিন্তা বা কর্ম এবং জীবনের গতি প্রকৃতি ভালো লাগে তাদের প্রতিও একেবারে উদাসীন বা অনাসক্ত থাকতে পারে না তারা। 

সহকারী ভদ্রলোকটির সঙ্গে কথা বলে শার্লোতে ও ওতিলে দুজনেই প্রীত হলো। তার স্বাধীন ও স্বচ্ছ চিন্তা, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তি ও বিচারবুদ্ধি আকর্ষণ করল তাদের মনকে। 

সেদিন সহকারী প্রসাদের বাগানে সেই সব পুরনো আমলের গাছগুলো দেখছিল যা এডওয়ার্ডের বাবা একদিন রোপণ করেছিল। সেই সব গাছগুলোর পানে আজ আর কেউ তাকায় না। আজকাল প্রাসাদের লোকেরা নূতন নূতন কায়দায় গাছ রোপণে ব্যস্ত।

হঠাৎ ঘুরতে ঘুরতে শার্লোতে সেদিক গিয়ে পড়ায় তার সামনে অতীত ও বর্তমানের অপরিহার্য দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে কথা তুলল সহকারী। এই দ্বন্দ্ব সম্বন্ধেই এতক্ষণ ভাবছিল সে। 

সহকারী বলল, অতীত ও বর্তমানের চিরাচরিত দ্বন্দ্বটা পিতাপুত্রের জীবন ও ভাবধারার মাধ্যমে বোঝা যাবে ভালোভাবে। কোনও পুত্র যদি বর্তমানের সাধারণ জীবনধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে থাকে তাহলে তার পিতার ভাবধারার সঙ্গে দ্বন্দ্ব বাধবেই। কারণ প্রায় পিতাই অতীতের ভাবধারাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে চান। তাদের আত্মকেন্দ্রিকতা, সঞ্চয়প্রবণতা ও রক্ষণশীলতার যত সব আতিশয্য এ কালের ছেলেরা সহ্য করতে পারে না। মানতে পারে না। তারা সেই কুটরিটাতে সব দরজা জানালা বন্ধ করে নিজেদের আবদ্ধ করে রাখতে পারে না যে কুটরিটা আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধকার, রক্ষণশীলতায় শীতল এবং সঞ্চয়প্রবণতায় একান্তভাবে সংকীর্ণ। 

শার্লোতে বলল, ছেলেদেরও দোষ আছে। তারা তাদের পিতামাতার আরদ্ধ কাজকর্মগুলোকে একেবারে নষ্ট না করে সেগুলোকে পূর্ণতার পথে নিয়ে যেতে পারে। সেগুলোকে সার্থক করে তুলতে পারে। 

সহকারী বলল, যুগে যুগে মানুষের রুচি পাল্টে যায়। ভাবধারা বদলে যায়, আপনি যে বাগানবাড়ি ও তার পথঘাট কত যত্ন করে পরিকল্পনা করে নির্মাণ করেছেন আপনার পুত্র হয়ত তা আর ভালোবাসবে না। 

একথা শার্লোতের ভালো না লাগলেও তার পুত্রসন্তান’ এই কথাটা শুনে সত্যিই বড় ভালো লাগল তার। সেদিন খ্রিস্টের জন্মোৎসব’ অভিনয় দেখতে গিয়ে ওতিলের কোলে একটি স্বাস্থ্যবান শিশুপুত্র দেখে ঐ বয়সের এক পুত্রলাভের বাসনা জাগে তার মনে। সে বাসনাটাই যেন আরও তীব্র হয়ে উঠল সহকারীর কথায়। শার্লোতে হঠাৎ দেখল তার প্রসবকাল আসন্ন হয়ে আসছে। তার প্রসব না হলে ওতিলেকে এখন ছাড়া চলবে না। 

শার্লোতে উঠে পড়েছিল। সহকারী বলল, আসল কথা কি জানেন? সব পিতার উচিত পুত্রদের নিয়ে সব ব্যাপারে যৌথ কারবার খুলে বসা। তাহলে কোনও হাঙ্গামাই হবে না। সব ব্যাপারে পুত্রদের ডেকে তাদের মতামত চাইতে হয়। পরিকল্পনা খাড়া করার কথা বলতে নেই। নিজ সব দায়িত্ব নিতে নেই। তাহলে পুত্ররাও খুশি হয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়। পিতার উপর অযথা দোষ দেয় না। 

যথাসময়ে নির্বিঘ্নে একটি পুত্রসন্তান প্রসব করল শার্লোতে। যে সব মেয়েরা প্রসবের সময় শার্লোতের কাছে ছিল তারা বলল, ছেলেটি হয়েছে অবিকল এডওয়ার্ডের মতো। কিন্তু ওতিলে একথা মোটেই মানতে পারল না। অবশ্য সে মুখে কোনও কথা বলল না। শুধু শার্লোতকে অভিনন্দন জানাল। 

খবর পেয়ে মিটলার এল। এসে শিশুপুত্রের নামকরণ অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে লাগল। বৃদ্ধ পুরোহিতকে ডাকা হলো। শার্লোতে এডওয়ার্ডের অভাবটা অনুভব করল। লুসিয়ানের বিয়ের কথাবার্তার সময় এডওয়ার্ড ছিল না আবার পুত্রের জন্মের সময়ও সে নেই। 

বৃদ্ধ পুরোহিত শিশুপুত্রের নাম রাখলেন অট্টো। 

অনুষ্ঠানের দিন শিশুটি ছিল ওতিলের কোলে। মিটলার বৃদ্ধ পুরোহিতের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। মন্ত্র বলতে লাগল। হঠাৎ শিশুটির মুখপানে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল ওতিলে। এমন আশ্চর্য সাদৃশ্য দেখাই যায় না। ওতিলের কোল থেকে মিটলার ছেলেটিকে কোলে নিয়ে মিটলারও অবাক হয়ে গেল বিস্ময়ে। ছেলেটির মুখের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মুখের আশ্চর্য সাদৃশ্য ছিল। 

পুরোহিত অতিশয় বৃদ্ধ হওয়ায় একজনের উপর ভর দিয়ে এসেছিলেন। সমগ্র অনুষ্ঠানটি তিনি অতি সংক্ষেপে সারলেন। মিটলার তাকে সাহায্য করতে লাগল নানাভাবে। মিটলার হলো শিশুর ধর্মপিতা এবং ওতিলে হলো ধর্ম মাতা। ধর্মপিতামাতার কর্তব্য সম্বন্ধে এক আবেগময় বক্তৃতা দিল মিটলার। তারপর শিশুটিকে বৃদ্ধ পুরোহিতের কোলে দিতেই পুরোহিতের মাথাটা টলতে লাগল। তিনি পড়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাকে ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হলো। 

কোনওমতেই বাঁচানো গেল না পুরোহিতকে। সেইখানেই তাঁর মৃত্যু ঘটল সেই মুহূর্তে। 

এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় ওতিলের মনটা বড় ভেঙে পড়েছিল। রাত্রিতে শোবার সময় হঠাৎ এডওয়ার্ডকে মনে পড়ল তার। মনে পড়ল অনেকদিন পর। মনে হলো। এডওয়ার্ড তখনও তার সামনে গিয়ে ঘোড়ার চেপে যাচ্ছে। অথবা সামরিক পোশাকে সজ্জিত হয়ে রয়েছে। অথবা পোশাক খুলে বিছানায় শুতে যাওয়া। এইভাবে একের এক করে বিচিত্ৰবেশী এওয়ার্ডের কাল্পনিক মূর্তিগুলো মনের পর্দায় ফুটে উঠল ওতিলের। আর মনে হলো আজও সে এডওয়ার্ডের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে আছে। এত সব ঘটনা ঘটা সত্ত্বেও তার মর্মমূল হতে এডওয়ার্ডকে সরাতে পারেনি কেউ। 

দ্বাবিংশ পরিচ্ছেদ

সেদিন ঘুরতে ঘুরতে বাগানের মালীর কাছে এল ওতিলে। বসন্তকাল এসেছে, গাছে গাছে কচি পাতা গজিয়ে উঠেছে। ফুলগাছে ফুল ধরেছে রং বেরঙের। মালী কাজ করছিল ফুলবাগানে। সে বুড়ো হয়েছে। প্রচুর বয়স হয়েছে, তবু এর অপত্যস্নেহের নিবিড়তা আর নিষ্ঠা নিয়ে গাছগুলোকে লালন-পালন করে চলেছে সে। গাছগুলোকে যেন সন্তানের মতোই ভালোবাসে। 

মালীকে আর একটা কারণে ভালো লাগে ওতিলের। সে অতিমাত্রায় প্রভুভক্ত। এডওয়ার্ডের প্রত্যাবর্তন সে মনেপ্রাণে কামনা করে প্রতি মুহূর্তে। 

কোনও ধাত্রী না রেখে ওতিলের উপরেই শিশুকে মানুষ করার ভার দিয়েছে শার্লোতে। ওতিলে ছেলেটাকে প্রায়ই কোলে নিয়ে বেড়ায়। সে ঘুমিয়ে গেলেও তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় বয়ে বেড়ায়। 

সেদিন শার্লোতে ছেলেটাকে ওতিলের কোলে দিয়ে পাহাড়ের উপর তাদের নবনির্মিত গ্রীষ্মবাসে বেড়াতে গেল। পাহাড়ের উপর নির্মিত বাড়িটার ছাদে চলে গেল শার্লোতে। সেখান থেকে চারদিকের শোভা বড় মনোরম। পাহাড়ের কোলঘেঁষা বন, সামনের লেক, গ্রামের বাড়ি, খামার, বাগান সবকিছুই বড় চমৎকার ও মনোরম দেখায়। 

ওতিলে একবার তার কোলের শিশুটার দিকে তাকাল। শিশুটার মুখখানা ক্যাপ্টেনের মতো দেখতে মনে হলো। তার প্রতি মমতা হচ্ছিল তার। এই বিশাল বিষয় সম্পত্তির সব তারই। সহসা তার মনে হলো, এডওয়ার্ড এসে শার্লোতের সঙ্গে আগের মতো মিলিত হয়ে পুত্ৰসুখ উপভোগ করুক। সে শেষ জীবনে সুখী হোক। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল ওতিলে সে স্বেচ্ছায় ও সানন্দে এডওয়ার্ডের প্রতি তার সব আসক্তি ও তার উপর তার সব দাবি ছেড়ে দেবে। তার এই কল্পিত ত্যাগের মধ্যে তার প্রেমের এক অনাস্বাদিতপূর্ণ রস আর অকল্পনীয় মহত্ব খুঁজে পেল। 

এদিকে শার্লোতে তখন ভাবছিল ওতিলের বিয়েটা কোথায় কিভাবে দেওয়া যায়। বিয়ে হয়ে গেলে সে প্রাসাদ থেকে চলে যাবে। এডওয়ার্ড এসে তখন বাধ্য হয়ে মনের শূন্যস্থান পূরণ করার জন্য তার সঙ্গে পুনর্মিলিত হবে। তবে ওতিলের বিয়েটা ক্যাপ্টেনের সঙ্গে হলেই সে খুশি হতো বেশি। 

পাহাড়র উপর গোটা বাড়িটার নির্মাণকার্য শেষ। শুধু অলঙ্করণের কাজ বাকী আছে। কোনও এক শিল্পী এসে সে কাজ সম্পন্ন করবে। উপরতলার ঘরগুলো বেশ উঁচু বলে বেশ ঠাণ্ডা। এখান থেকে চারদিকের দৃশ্যবলি সুন্দর দেখা যায়। 

হঠাৎ একদিন এক ইরেজ পথিক দেশভ্রমণ করতে করতে প্রাসাদে এসে আতিথ্য গ্রহণ করল। ভদ্রলোকের বয়স হয়েছিল। সঙ্গে একজন লোক ছিল। সেই আলাপ পরিচয়ের সূত্র ধরেই তিনি এসে হাজির হন। 

শার্লোতে ও ওতিলে তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানায় এবং তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দেয়। তাঁকে দিনকতক থেকে যেতে বলে। ইংরেজ ভদ্রলোক পাহাড়ের উপর বাড়িটা ঘুরে দেখে পাহাড়টার চারপাশও দেখলেন ভালো করে। দেখে তিনি কতকগুলো পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন, এই পাহাড়ের ভিতর ঝোপে ঢাকা একটি ঝর্না আছে। ঝোঁপঝাড়গুলো কেটে ঝর্নাটা বার করে তার আশেপাশে বসার জায়গা করে দিলে জায়গাটা চমৎকার দেখাবে। তিনি আরও বললেন, বনের ভিতর পাহাড়ের গায়ে একটা গুহা আছে। বন কেটে সেখানে যাবার পথ করলে সেখানে একটি সুন্দর বিশ্রামাগার করা যেতে পারে। 

ইংরেজ ভদ্রলোককে পেয়ে খুশি হলো শার্লোতে ও ওতিলে। কথা বলার একজন বিদগ্ধ লোক পেল ওরা। ভদ্রলোক কথায় কথায় একদিন বললেন, এডওয়ার্ডের মতো উনিও দেশভ্রমণ করতে ভালোবাসেন। তবে এডওয়ার্ডের মতো নিশ্চিন্ত নন। ওঁর একটি পুত্র আছে। তার উপর বিষয়সম্পত্তির ভার দিয়ে উনি দেশভ্রমণে বার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা হয়ে উঠেনি কারণ ওর একমাত্র পুত্র ভারতবর্ষে গিয়ে বসবাস করছে। সেখানেই জীবন কাটাবার মনস্থ করেছে। এজন্য তাঁর বিষয়সম্পত্তি দেখাশোনার কোনও লোক নেই। 

প্রসঙ্গক্রমে এডওয়ার্ডের কথা শুনে ওতিলের মনে কষ্ট হলো। তার মনে হলো যুদ্ধে যোগদান করে এডওয়ার্ড এখন কোথায় কত কষ্ট করছে। কতখানি বিপদের ঝুঁকি নিয়েছে কে জানে। 

ইংরেজ ভদ্রলোক একদিন তার দেশভ্রমণের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মেয়েদের বিভিন্ন জায়গায় তোলা ছবি দেখালেন। তিনি সব সময় কোনও ভালো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলেই তার ছবি তুলতেন। এই নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন তিনি। কিন্তু তার সঙ্গী ভদ্রলোকটি সব দিকে নজর ও খেয়াল রাখতেন। তিনি এই কদিনের মধ্যেই এ বাড়ির সব খবরাখবর নিয়ে ফেলেছেন। তিনি রোজ সন্ধ্যার সময় একটা করে গল্প শোনাতেন। মেয়েরা বেশ উপভোগ করত তাঁর বলা গল্প। 

একদিন ভদ্রলোক বললেন, আজ আমি আমার একটা গল্প বলব। কিন্তু কারও কোনও কথা বলা চলবে না। সবাই রুদ্ধশ্বাসে মনোযোগ দিয়ে শুনবেন। 

ভদ্রলোক এবার বলতে শুরু করলেন, কোনও এক শহরের পাশাপাশি দুটি বাড়ির দুটি ছেলেমেয়ে একই ঘরে একই সঙ্গে বেড়ে ওঠে। ছোট থেকে তাদের দুজনের মধ্যে এত ভালোবাসা ছিল যে তাদের বাবারা ঠিক করেছিলেন তারা বড় হলে তাদের বিয়ে দেবেন। 

কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল মেয়েটি ও ছেলেটির মধ্যে আর সেই ভাব ভালোবাসার সম্পর্ক নেই। তার পরিবর্তে কেমন যেন ঘৃণা ও শত্রুতার ভাব গড়ে উঠেছে দুজনের মধ্যে। একদিন তারা আরও কয়েকজন ছেলেমেয়ে মিলে যুদ্ধের খেলা খেলছিল। ছেলেটি যেমন একদল ছেলের নেতৃত্ব করছিল সেনাপতি রূপে মেয়েটিও তেমনি একদল মেয়ের সামনে নেতৃত্ব করতে লাগল। সে কিছুতেই হার মানবে না। যুদ্ধে ছেলেটির জয় হলো। কিন্তু মেয়েটি সে জয় স্বীকার করল না। সে ভয়ঙ্করভাবে আক্রোশভাবাপন্ন হয়ে ছেলেটিকে আক্রমণ করল। তার তখন একমাত্র লক্ষ্য যে কোনও প্রকারে ছেলেটিকে আঘাত করা। সে তখন খেলার কথা ভুলে গেল। ছেলেটির জোর বেশি থাকায় সে অতিকষ্টে মেয়েটির হাত দুটি ধরে বেঁধে ফেলল। 

এই ঘটনার পর মেয়েটির মনে ঘৃণার ভাব আরও বেড়ে গেল আগের থেকে। এটা তাদের অভিভাবকরাও লক্ষ করলেন। তখন তারা বাধ্য হয়ে তারা বিচ্ছিন্ন করে দিলেন। পরস্পরের কাছ থেকে। 

ছেলেটিকে পাঠানো হলো সামরিক স্কুলে। নূতন পরিবেশের মাঝে গিয়ে সব কিছু ভুলে গেল সে। ধীরে ধীরে বড় হবার উচ্চাকাঙ্ক্ষা জাগল তার মনে। সাফল্যের সঙ্গে গড়ে তুলতে লাগল সে তার ছাত্রজীবন। 

এদিকে মেয়েটি একা একা বাড়ির মধ্যে থাকতে থাকতে ক্রমশই নিজের ভুল বুঝতে পারল। ক্রমে সে সব ঘৃণা ত্যাগ করে শান্ত ও সুস্থ মনোভাবাপন্ন হয়ে উঠল। কিন্তু ছেলেটি তার থেকে দূরে চলে যাওয়ায় তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার বা মানসিক পরিবর্তনের কথাটা জানাবার কোনও অবকাশ পেল না। 

এইভাবে কয়েক বছর কেটে গেল। এমন সময় মেয়েটি বাল্যবন্ধুর থেকে বয়সে বড় একটি লোক তাদের বাড়িতে আনাগোনা করতে করতে তার প্রতি আকৃষ্ট হলো। প্রথম প্রথম মেয়েটি তার প্রতি কোনও আগ্রহ দেখাল না। তারপর যখন দেখল তার দেহসৌন্দর্যের প্রতি লোকটি অতিমাত্রায় আসক্ত এবং তার থেকে আরও পরিণত বয়স্ক, শিক্ষিতা ও সুন্দরী মেয়েদের থেকে লোকটি শুধু তার সাহচর্যই কামনা করে তখন বাধ্য হয়ে লোকটিকে সঙ্গদান করতে লাগল। তার সঙ্গে ক্রমে এক প্রেমসম্পর্ক গড়ে উঠল। তখন মেয়েটি বাবা ভাবল তাদের মেয়ে হয়ত ভবিষ্যতে এই লোকটিতেই বিয়ে করবে। 

হয়ত তাই হতো। কিন্তু মাঝখানে হঠাৎ আবার একটা ঘটনা ঘটল। এই সময় হঠাৎ একদিন মেয়েটির সেই বাল্যবন্ধু পড়া শেষ করে বাড়ি ফিরে এল দীর্ঘদিন পরে। বাড়িতে এসেই মেয়েটির বাড়িতে গেল তার সঙ্গে এক সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারের জন্য। 

ছেলেটি কিন্তু তখন মেয়েটির প্রতি তেমন কোনও বিদ্বেষভাব ছিল না, তেমনি প্রেমাসক্তিও ছিল না। তার মনে তখন শুধু একান্তভাবে বিরাজ করছিল বড় হবার কামনা, এক বিরাট উচ্চাশার সমুন্নত আবেগ। 

মেয়েটি কিন্তু ছেলেটিকে দীর্ঘদিন পর কাছে পাবার সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্লেখিতের মতো জেগে উঠল। ভাবল মনের নিভৃতে এতদিন যার স্বপ্ন দেখছিল, এতদিন যাকে কামনা করছিল সে স্বয়ং তার সামনে এসে গেছে। সে আরও স্বীকার করল, আসলে তার এই বাল্যবন্ধুই তার আকাক্ষিত পুরুষ। ছোট থেকে তাকেই সে কামনা করে এসেছে। ছেলেবেলায় তার প্রতি যে ঘৃণা বা বিদ্বেষভাব দেখিয়েছে আসলে তা শুধু তার দৃষ্টি আরও নিবিড়ভাবে আকর্ষণ করার জন্য। একদিন সূদূর বাল্যে তার অপরিণত মনের অবচেতনে এক অন্ধ আবেগে যাকে আঁকড়ে ধরেছিল আজ পরিণত মনের সমস্ত যুক্তিবোধের আলোকে তার উজ্জ্বল ভাবমূর্তিটি দেখে অবাক হয়ে গেল মেয়েটি।

কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মেয়েটির এই নবজাগ্রত প্রেমের ডাকে সাড়া দিতে পারল না। ছেলেটি। বড় জোর সে তাকে বোনের মতো ভালোবাসতে পারে। মেয়েটির প্রতি তার কোনও কামনা ছিল না বলেই তার নতুন প্রেমিক ভদ্রলোকটির সঙ্গেও যেচে আলাপ। করেছিল এবং কোনও ঈর্ষাবোধ করেনি সে। এমন কি সে একদিন তার কার্যক্ষেত্রে চলে যাবার কথাও ঘোষণা করল সবার সামনে। 

মেয়েটি যখন দেখল কোনও রকমেই ছেলেটির মন জয় করতে পারবে না, তখন সে মনে মনে আত্মহত্যা করার জন্য মনস্থির করে ফেলল। এইভাবে ছেলেটির মন পরোক্ষভাবে মৃত্যুর পর জয় করার বাসনা করল। সে মারা গেলে তার মৃত মুখ দেখে ছেলেটি নিশ্চয় আঘাত পাবে এবং তার কথা বেশি করে মনে করবে। এই ধরনের এক আত্মঘাতী বিকৃত জয়ের আকাঙ্ক্ষা পেয়ে বসল মেয়েটি। 

এদিকে যাবার আগে ছেলেটি এক স্টিমার পার্টির আয়োজন করল। একটি বড় নদীতে স্টিমার ভাড়া করে সবাই মিলে বেড়াতে যাবার ব্যবস্থা করল। তাতে তাদের দুজনের বাবা-মা ছাড়াও মেয়েটির সেই নূতন প্রেমিকও ছিল। মেয়েটি এই প্রমোদ ভ্রমণের মধ্যে পেয়ে গেল তার আত্মহত্যার সুবর্ণ সুযোগ। স্টিমার যখন দুটি দ্বীপের মাঝখানে খরস্রোতা এক জায়গা দিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ মেয়েটি ছেলেটির কাছে গিয়ে বলল, আমি তোমার জন্যই মৃত্যুবরণ করছি। আমার কোনও খোঁজ করো না। আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করো না। 

এই বলে ডেকের উপর থেকে জলে ঝাঁপ দিল মেয়েটি। ইতিমধ্যে স্টিমারটি প্রায় একটি দ্বীপের কূলে এসে পড়েছে। ছেলেটি তখন আর দেরি না করে পোশাক খুলে। জলে ঝাঁপ দিয়ে সাঁতার কেটে মেয়েটির কাছে চলে গেল। মেয়েটি তখন জলের মধ্যে ডুবছিল আর উঠছিল। ছেলেটি মেয়েটির অচেতন দেহটি কোনওরকমে জলের উপর ভাসিয়ে স্রোতের টানে ভেসে যেতে লাগল। নদীর মুখটা সেখানে আরও চওড়া। অবশেষে তারা নদীর ওপারে কূলে গিয়ে উঠল। সেখানে ঘন বন। ছেলেটি দেখল তার মাঝে পায়ে চলার একটি পথ আছে। সেই পথে কিছুদূর গিয়ে দেখে কোনও এক চাষির কুঁড়ে রয়েছে তার মধ্যে। মেয়েটির মধ্যে কোনও প্রাণের সাড়া ছিল না। 

ছেলেটির কাছ থেকে সব কথা শুনে চাষি দম্পত্তি আগুন জ্বেলে মেয়েটির হাত পা সেঁকতে লাগল। অবশেষে তার মধ্যে চৈতন্য সঞ্চার হলো। সে চোখ মেলে তাকিয়ে তার প্রার্থিত বহু আকাঙ্ক্ষিত মানুষকে দেখে তার গলাটা জড়িয়ে ধরল। তার চোখ। দিয়ে প্রবল ধারায় আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল। ছেলেটিও এবার সব অনাসক্তি ও উচ্চাশার আবেগ ঝেড়ে ফেলে মেয়েটিকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরল। চাষিরা পরার। জন্য কাপড় দিল তাদের। 

চাষিই ডিঙি বেয়ে ওপরে গিয়ে সেই স্টিমারে খবর দিল। 

ওরা তখন খুব ভাবছিল। খোঁজাখুঁজি শুরু করে দিয়েছিল। ভেবেছিল হয়ত দুজনেই স্রোতে ভেসে গেছে। চাষির কাছে সুখবর পেয়ে ওরা সবাই এসে গেলে ছেলেটি ও মেয়েটি তাদের বাবা-মায়ের কাছে আশীর্বাদ চাইল বরবধূরূপে। 

গল্পশেষ করে ভদ্রলোক থামতেই দেখা গেল শার্লোতে তার বিষাদ-গম্ভীর মুখখানা নিয়ে উঠে গেল। এই ধরনের এক ঘটনা ক্যাপ্টেনের জীবনে ঘটে এবং এ কাহিনীর। সঙ্গে তার আশ্চর্য মিল আছে। 

শার্লোতে উঠে গেলে ইংরেজ লর্ড ভদ্রলোক ওতিলেকে বলল, আমরা বুঝতে পারিনি আমাদের এ কাহিনী শুনে উনি দুঃখ পাবেন মনে। যাঁর আতিথ্যে আমরা পরম সুখে এখানে বাস করছি, কত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করছি তিনি কোনওভাবে মনে দুঃখ পান তা আমরা চাই না। 

কিন্তু দু-একদিনের মধ্যে ওঁরা বিদায় নিলে সত্যিই মনে দুঃখ পেল শার্লোতে। ওঁদের সাহচর্যে দিনগুলো ভালোই কেটে যাচ্ছিল। ওতিলেরও বেশ ভালো লাগত। 

এয়োবিংশ পরিচ্ছেদ

যুদ্ধের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় যুদ্ধ থেকে সসম্মানে ছাড়া পেল এডওয়ার্ড ছাড়া পেয়ে সরাসরি সে তার খামার বাড়িতে চলে গেল। সেখানে গিয়ে তার বাড়ির সব খবরাখবর আগ্রহসহকারে শুনল। অনেক খবর তার জন্যে জমে ছিল অনেকদিন ধরে। 

এডওয়ার্ড তার খামার বাড়িতে আসার পরেই একদিন তার পুরনো বন্ধু ক্যাপ্টেন তার সঙ্গে দেখা করতে এল। ক্যাপ্টেনকে কাছে পেয়ে খুব খুশি হলো এডওয়ার্ড। ক্যাপ্টেনই তাকে খবর দিল তার একটি পুত্র সন্তান হয়েছে। কথাপ্রসঙ্গে এডওয়ার্ড তাকে ঠাট্টা করে বলল, বিয়ে থা করলে? 

ক্যাপ্টেন বলল যে সে তখনও বিয়ে করেনি এবং সে বিষয়ে কিছু ঠিক করেনি। 

এডওয়ার্ড বলল, কথাটা বলার আমার একটা কারণ আছে। তুমি জান আমি ওতিলেকে ভালোবাসি। তাকে না পেলে জীবনে বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই বলেই আমি এ জীবন ত্যাগের জন্য যুদ্ধের যোগদান করি। কিন্তু সম্প্রতি যুদ্ধে থেকে ফিরে এসে ওতিলের প্রতি আমার কামনা আরও তীব্র হয়ে উঠেছে। এ কামনা আমি সংযত বা দমন করতে পারছি না। আমার একান্ত বিশ্বাস আমি ওতিলেকে একদিন লাভ করবই। 

ক্যাপ্টেন বলল, এইভাবে মোহের বশবর্তী হয়ে সব সম্ভাব্য বাধা ভেঙে এগিয়ে যাওয়া উচিত নয়। তার থেকে তোমার দাম্পত্য সম্পর্ক ও কর্তব্যের কথা ভেবে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হওয়া উচিত। তোমাদের নবজাত পুত্রসন্তান তোমাদের মিলনকে আরও দৃঢ় ও আনন্দদায়ক করে তুলবে। তোমাদের দাম্পত্য সম্পর্কে আরও মধুর করে তুলবে। 

এডওয়ার্ড তার পুত্রসন্তানের কথায় কোনওরূপ বিচলিত না করে বলল, দেখো, ছেলের জন্য ভাবি না। আমাদের যা বিষয় সম্পত্তি আছে তাতে ছেলে ভালোভাবে মানুষ হয়ে উঠবে। যাদের বিষয় সম্পত্তি নেই, বাবা-মা নেই সেই সব ছেলেরাও মানুষ হয়। 

এডওয়ার্ডকে তার কামনা পূরণের পথে অবিচল দেখে ক্যাপ্টেন বলল, কেন যে। অতীত যৌবনের উদ্দাম দিনগুলোকে ফিরে পেতে চাইছ তা জানি না। জানবে জীবনের যে কোনও স্তরে যে কোনও বয়সের সীমার মধ্যেই মানুষ তার জীবনকে উপভোগ করতে পারে। প্রকৃতি তার সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই উপভোগের জন্য তাকে অতীত বা ভবিষ্যতের পানে তাকাতে হবে না। 

সে কথায় কান না দিয়ে এডওয়ার্ড বলল, দেখো, যুদ্ধে যেয়ে একটা কথা আমার প্রায়ই মনে হতো। তোমার কথাও মনে হতো। আজ এসেছ ভালোই হয়েছে। আমি যেমন ওতিলেকে ভালোবাসি তুমিও তেমনি শার্লোতেকে ভালোবাস। আমি ওতিলেকে বিয়ে করব। তুমি শার্লোতেকে বিয়ে করো। শার্লোতের শিশুপুত্র তার কাছেই থাকবে। তুমি তাকে মানুষ করবে। আমি ওতিলেকে বিয়ে করেই দেশভ্রমণে বেরিয়ে যাব। বিষয়ে সম্পত্তি ভাগ বাটোয়ারা তোমরা দুজনে মিলে ঠিক করবে। 

ক্যাপ্টেন বলল, তুমি ব্যাপারটা যত সহজ ভাবছ ততটা সহজ নয়। তোমার। আমার দুজনেরই একটা চরিত্রগত সুনাম আছে। এ কাজের দ্বারা সে সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে। তাত সমস্যা আরও জটিল হয়ে উঠবে। 

এডওয়ার্ড বলল, সাধারণ মানুষ প্রথম প্রথম হয়ত নিন্দা করবে। পরে তারা ধীরে ধীরে সব ভুলে যাবে। যেমন যায়। তখন সব ঠিক হয়ে যাবে। 

এডওয়ার্ডের দারুণ পীড়াপীড়িতে অবশেষে আর বাধা দিতে পারল না ক্যাপ্টেন, সে যেমন সমর্থন করতে পারছিল না এডওয়ার্ডকে, তেমনি একেবারেই উড়িয়ে দিতও পারছিল না তার কথাটাকে। 

অবশেষে এডওয়ার্ড ক্যাপ্টেনকে সঙ্গে নিয়ে তার পরিকল্পনাকে কার্যে রূপায়িত করার পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসাবে বাড়ির দিকে রওনা হলো। দুর থেকে পাহাড়ের উপর নির্মিত তাদের নূতন বাড়ির চূড়াটাকে দেখে আনন্দের আবেগে ফেটে পড়ল এডওয়ার্ড। ওতিলোকে মনে পড়ল তার। ভাবল আজই সন্ধ্যার সময় সব কথা পাকা করে ফেলতে হবে। 

এডওয়ার্ড বলল, সে একটা পাশের গায়ে লুকিয়ে থাকবে। ক্যাপ্টেন ঘোড়ায় চেপে প্রাসাদে গিয়ে শার্লোতেকে সব কথা বুঝিয়ে বলবে। তারপর তার মতামত নিয়ে এডওয়ার্ডকে এসে খবর দেবে। এডওয়ার্ডের বিশ্বাস তার এই প্রস্তাবে শার্লোতে রাজী হবেই, কারণ এতে তার স্বার্থ কিছুমাত্র ক্ষুণ্ণ হচ্ছে না। 

ক্যাপ্টেন সোজা প্রাসাদে গিয়ে দেখল শার্লোতে সেখানে নেই। খবর নিয়ে জানল সে এখন পাহাড়ের উপর নূতন বাড়িতে বাস করে। এখন সে কোথায় বেড়াতে গেছে। বিকেলের দিকে আসবে। তাই ক্যাপ্টেন তার পান্থশালায় ফিরে গেল। 

এদিকে এডওয়ার্ড আপন মনে ঘুরতে ঘুরতে এক গোপন পথ দিয়ে তাদের লেকের পার্কের কাছে এসে গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইল। হঠাৎ দেখতে পেল ওতিলে একটা গাছের তলায় ঘাসের উপর বসে রয়েছে একটা ছেলে কোলে নিয়ে। তখন সূর্য অস্ত গেল। কিন্তু অন্ধকার ঘন হয়ে ওঠেনি। এডওয়ার্ড চারদিক নির্জন দেখে সোজা তার কাছে গিয়ে তার পায়ের কাছে নতজানু হয়ে বসে পড়ল। ওতিলেও তাকে জড়িয়ে ধরল। এডওয়ার্ড তার পরিকল্পনার কথা সব জানাল। তার উত্তরে তিলে বলল, শার্লোতের কাছে আমি ঋণী। তিনি যদি মত দেন তাহলেই এ বিয়ে সম্ভব। তা না হলে আমি তোমায় ত্যাগ করব। 

হঠাৎ শিশুটির মুখপানে তাকিয়ে এডওয়ার্ড আশ্চর্য হয়ে বলল, ওর মুখের সঙ্গে ক্যাপ্টেনের মুখের কি আশ্চর্য মিল। শার্লোতের বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে এই শিশুই সবচেয়ে বড় সাক্ষী। 

ওতিলে বলল, অনেকে বলে, ওর চোখদুটো আমার মতো। 

এডওয়ার্ড ওতিলেকে এবার পূর্ণভাবে আলিঙ্গন করল। ওতিলেও তাকে জড়িয়ে ধরে চুম্বন করল। ওতিলে বলল, এবার তুমি ফিরে যাও ক্যাপ্টেনের কাছে। আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে। শার্লোতে শিশুর জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে অপেক্ষা করছে। 

এডওয়ার্ড চলে গেলে দেখল পাহাড়ে যেতে অনেকখানি পথ পার হতে হবে। কিন্তু লোকটা যদি নৌকোয় পার হয় তহলে একেবারে বাড়ির গোড়ায় গিয়ে পৌঁছবে। তখন। মুখ আঁধার হয়ে এসেছে। 

নৌকোয় উঠে ছেলে কোলে চেপে নৌকোটা ছেড়ে দিল। ছেলে কোলে থাকায় দাঁড় বাইতে অসুবিধা হচ্ছিল। নৌকোটা টলমল করছিল। হঠাৎ একসময় বাতাসে। নৌকোটা দুলে উঠতেই ওতিলের হাত থেকে দাঁড় ও ছেলে পড়ে গেল। ওতিলে ছেলেটার জামা ধরে অতিকষ্টে টেনে তুলল। কিন্তু এরই মধ্যে সে অনেক জল খেয়েছিল। আর শ্বাস রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। নৌকোটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল লেকের মাঝখানে। ওতিলে জলে ডোবা ছেলেটিকে বাঁচাবার জন্যে অনেক চেষ্টা করল। নিজের গরম অনাবৃত বুকের উপর বারবার তার ছোট্ট শীতল দেহকে চেপে ধরল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। 

অনুকূল বাতাসে অবশেষে যখন নৌকোটা ঘাটের কাছে এসে গেল তখন রাত অনেক হয়েছে। ছেলেটা কোলে তুলে সার্জেনের কাছে গেল ওতিলে। সার্জেনও অনেক চেষ্টা করল। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। তখন হতাশ হয়ে শোকে মেঝের উপর। অচৈতন্য হয়ে পড়ে গেল ওতিলে। 

এদিকে খবর পেয়ে শার্লোতে ছুটে এল বাড়ি থেকে। কিন্তু কোনও অবস্থাতেই আবেগে অভিভূত হয় না সে। অসাধারণ আত্মসংযমের সঙ্গে যে একবার শিশুটির মুখপানে তাকাল। তারপর ওতিলের মাথাটা নিজের কোলে তুলে নিল। 

এদিকে ভোরের দিক পান্থশালার এই দুর্ঘটনার খবরটা পৌঁছলে ক্যাপ্টেন সোজা। চলে এল ঘটনাস্থলে। শার্লোতে ওঠে দাঁড়িয়ে শান্তভাবে তাকে অভ্যর্থনা জানাল। তার গম্ভীর মুখে শান্ত করুণ একটি হাসির রেখা ফুটে উঠল। পরে বলল, জানতে পারি কি ঠিক ঠিক এই দুর্ঘটনার সময়ে কোথা হতে কেমন করে এলে? 

ক্যাপ্টেন তখন সব কথা খুলে বলল। এডওয়ার্ডের পরিকল্পনা ও প্রস্তাবের কথাও বলল। সব শুনে শার্লোতে বলল, আর আমি বাধা দেব না এডওয়ার্ডকে। আমি যদি আমাদের বিবাহবিচ্ছেদের আগেই মত দিতাম তাহলে আমার ছেলেকে হারাতে হতো না। এডওয়ার্ডকে বলবে সে যে কোনও কাগজে বলবে আমি সই করে দেব। 

ক্যাপ্টেন বলল, তাহলে আমাদের বিয়ের কি হবে? 

ক্যাপ্টেন উঠে পড়ল। মৃত ছেলেটির মুখ খোলা ছিল। সে দেখল সত্যিই ছেলেটির মুখের সঙ্গে তার মুখের সাদৃশ্য আছে। শার্লোতে বলল, নিয়তিই তো আপন উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সব কাজ করিয়ে নেয় মানুষকে দিয়ে। সেখানে মানুষের যুক্তি নীতি বা বুদ্ধির কোনও দাম নেই। 

ক্যাপ্টেন চলে গেলে ওতিলে চোখ মেলে তাকাল। তার জ্ঞান ফিরল। জ্ঞান ফিরলে সে দেখল শার্লোতের কোলের উপর সে শুয়ে আছে। সে উঠে বসে আবেগের সঙ্গে বলল, এই দ্বিতীয়বার আমি তোমার কোলে শুলাম। আর একবার আমার মা মরে গেলে আমি তোমার কোলে শুয়েছিলাম। আমি এক উদার আশ্রয় লাভ করেছিলাম। 

শার্লোতে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ওতিলে বলল, আমি তোমাদের সব কথা শুনেছি। যে আত্মঘাতী আশার খবরটা আমি ক্যাপ্টেন চলে তার বিরুদ্ধে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছা করছিল আমার। আমি এ ব্যবস্থা মানব না। এই দুর্ঘটনার মাধ্যমে ঈশ্বর আমার চোখে আঙুল দিয়ে আমার ভুল ভেঙে দিয়েছে। আমি অন্যায় করেছিলাম, পাপ করেছিলাম এডওয়ার্ডকে ভালোবেসে। আমার সেই পাপের প্রতিফল এইভাবে ভোগ করতে হলো আমার। সে পাপের প্রতিকার আমি নিজেই করব। তুমি এখনি ক্যাপ্টেনকে ডেকে আমার কথা তাকে জানিয়ে দাও। 

চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ

দুর্ঘটনার ফলে দেহ-মন অনেকটা ভেঙে গিয়েছিল ওতিলের। মার্লোতে তার দিকে অনেক বেশি নজর দিয়ে সুস্থ করে তুলল তাকে। সুস্থ হয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলল ওতিলে। শার্লোতের ইচ্ছা ছিল, এখানকার পরিবেশ তাদের শোকাবেগকে জাগিয়ে দেয় সব সময়; তাই তারা দূরে কোথাও বেড়াতে যাবে দুজনে। কিন্তু ওতিলে বলল অন্য কথা। সে বলল, আমরা যদি এমনভাবে বসে থাকি তাহলে যত নির্জন ও শান্তিপূর্ণ জায়গাতেই যাই না কেন, আমরা কোনওমতেই পরিত্রাণ পাব না কোনো শোকাবেগ বা অশুভ অবাঞ্ছিত কোনও স্মৃতির প্রভাব থেকে। এসব থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদের কাজের মুধ্যে ডুব দিতে হবে। বৃহত্তর কর্তব্য সাধনই মানুষকে মুক্ত করতে পারে তার সকল দুঃখ বা অপরাধ চেতনা থেকে। 

শার্লোতে তার মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, তাহলে তুমি কি বোর্ডিং স্কুলে ফিরে যেতে চাও? 

ওতিলে বলল, হ্যাঁ সেখানেই ফিরে যেতে চাই আমি। অবসর সময়ে আমি শিশুদের দেখাশোনা করব। তাদের মাঝে আনন্দ পাব। 

শার্লোতে বলল, কিন্তু সেখানে গেলে সহকারী ভদ্রলোক আরও নিবিড়ভাবে তোমায় চাইতে পারেন। তিনি তোমাকে ভালোবাসেন। 

ওতিলে শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, আমাক যারা ভালোবাসবে তারা ভাগ্যের কাছে কোনও সুখই আশা করতে পারবে না। তাদের জীবনে দুঃখ আর হতাশা নেমে আসতে বাধ্য। এটা আমি ভালোই জানি। সুতরাং এ বিষয়ে কোনও ভয় নেই আমার। 

শার্লোতের মনে কিন্তু এক ব্যাপারে আর একটা ভয় ছিল। সেটা হচ্ছে। এডওয়ার্ডের ভয়। এডওয়ার্ড প্রতিজ্ঞা করেছিল যতদিন ওতিলে শার্লোতের কাছে থাকবে ততদিন সে কিছু করবে না। কিন্তু ওতিলে অন্য কোথাও চলে গেলেই সে তাকে ছিনিয়ে আনবে সেখান থেকে। সে ভয়ঙ্করভাবে দুর্বার হয়ে উঠবে তাই এ বিষয়ে এডওয়ার্ডের মত জানার জন্য তার কাছে মিটলারকে পাঠাবার মনস্থ করল শার্লোতে। 

কিন্তু মিটলার গেল না। না গিয়ে সে শার্লোতেকে পরামর্শ দিল, তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দাও ওতিলেকে। এটা খুব ভালো ব্যবস্থা। 

মিটলার দেখল এই সুযোগ। এডওয়ার্ড ও শার্লোতের সব বাধাগুলো আপনা থেকে অর্থাৎ অনুকূল ঘটনার আঘাতে সরে যাচ্ছে। 

শার্লোতেও তাই মনে করে। তাই ওতিলে প্রাসাদ থেকে চলে গেলে সে ঘরগুলোকে আগেকার মতো সাজাল। যখন ক্যাপ্টেন বা ওতিলে কেউ আসেনি তখন যেখানে যা ছিল তা আবার সেখানে রাখল। অতীত সুখের দিনগুলোকে মাঝে মাঝে আমাদের বর্তমান জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য প্রবল কামনা জাগে আমাদের মনে। শার্লোতের মনেও সেই কামনা জেগেছিল। 

পঞ্চবিংশ অধ্যায়

ওতিলে রওনা হতেই মিটলার সত্যি সত্যিই একদিন এডওয়ার্ডের খামারবাড়িতে গিয়ে হাজির হলো। সে সব কথা এডওয়ার্ডকে বলল, ওতিলের সিদ্ধান্ত, তার বোর্ডিং স্কুলে যাওয়ার খুঁটিনাটি সব বলল এডওয়ার্ডকে।

মিটলার চলে গেলেই এডওয়ার্ড তার ঘোড়া তৈরি করতে বলল চাকরকে। তারপর তার বিশ্বাসী চাকরকে সঙ্গে নিয়ে পথে যে হোটেলে রাত কাটাতে হবে ওতিলেকে, সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। হোটেলের মালিক একজন মহিলা। সে এডওয়ার্ডকে চিনল। এডওয়ার্ড এমন একটি ঘর ভাড়া নিল যার পাশের ঘরে ওতিলে থাকবে। প্রথমে এডওয়ার্ড ভাবল ওতিলের কাছে সে সরাসরি হাজির হবে না। আগে চিঠি দিয়ে তার মন জানবে। 

তাই সে একটি চিঠি লিখে ওতিলের টেবিলে রেখে দিল। তাতে লিখল সে ওতিলের উপর জোর করবে না। তবে সে কাছেই আছে। ওতিলে ইচ্ছা করলেই সে আসবে। 

কিন্তু ঘটনাক্রমে ওতিলে তার ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল এডওয়ার্ড। এডওয়ার্ডকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দুপা পিছিয়ে গেল তিলে। তার মুখ-চোখ গম্ভীর হয়ে উঠল। তাকে স্পর্শ করার কোনও সাহস পেল না এডওয়ার্ড। কোনও কথাও বলতে চায় না ওতিলে। 

ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে বাইরে সারাবাত পায়চারি করতে লাগল এডওয়ার্ড। ভোরে ওতিলের ঘরে গিয়ে দেখল ওতিলে ঘুমোচ্ছে পোশাক পরেই। কিছুক্ষণ পরে সে উঠলে এডওয়ার্ড তাকে নৃতন করে সব কিছু ভেবে দেখতে বলল। কিন্তু ওতিলে কোনও কথার জবাব দিল না। তাকে অসুস্থ মনে হচ্ছিল। অবশেষে এডওয়ার্ড তাকে জিজ্ঞাসা করল, বোর্ডিং স্কুলে যাবে? 

ওতিলে ঘাড় নেড়ে অসম্মতি জানাল। এডওয়ার্ড যখন তাকে বলল, প্রাসাদে শার্লোতের কাছে ফিরে যাবে? 

ওতিলে তখন ঘাড় নেবে সম্মতি জানাল। ওতিলে তাড়াতাড়ি নেমে গিয়ে গাড়িতে বসে গাড়ি ছেড়ে দিল। গাড়ির পিছু পিছু ছোঁড়ায় চেপে যেতে লাগল এডওয়ার্ড। 

ওদের দেখে অবাক হয়ে গেল শার্লোতে। যেতে যেতে ফিরে এল ওতিলে এবং তার সঙ্গে এডওয়ার্ডকে আসতে দেখে কিছুই বুঝতে পারল না সে। ওতিলে কোনও কথা বলল না। শুধু এডওয়ার্ড ও শার্লোতের হাতদুটো ধরে এক এক করে তার উপর চাপ দিয়ে ছুটে তার নিরে ঘরে চলে গেল। 

এডওয়ার্ড তাকে আবেগের সঙ্গে শার্লোতেকে জড়িলে ধরল। বলল, তুমি ওতিলের উপর নজর দাও। ওকে তুমি ভুল বুঝো না। 

ওরা ওতিলের ঘরে গিয়ে দেখল ওতিলে মেঝের উপর শুয়ে আছে। সেই থেকে সম্পূর্ণরূপে মৌব্রত পালন করে যেতে লাগল ওতিলে। সে খুব অল্পাহার করতে লাগল। বেঁচে থাকার জন্য যেটুকু দরকার। এ বিষয়ে কার কথা শুন্যতা না সে। 

এডওয়ার্ড আগের মতো তার ঘরে থাকতে লাগল। শার্লোতের সঙ্গে এখন খুব ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করলেও ওতিলের আশা একেবারে ত্যাগ করতে পারল না। 

মিটলার ও ক্যাপ্টেনের কাছে চিঠি পাঠানো হলো। এডওয়ার্ড শার্লোতের উপর চাপ দিতে লাগল ক্যাপ্টেনকে বিয়ে করার জন্য। শার্লোতে বলল, করতে পারি একটা শর্তে। করতে পারি ওতিলে যদি তোমাকে বিয়ে করতে চায়। 

এমন সময় ওতিলে একদিন চিঠি লিখে তার মনের কথা জানিয়ে দিল। সে লিখল, আমাকে তোমরা কেউ বিরক্ত বা বিব্রত করো না। আমি আমার আত্মাকে খুঁজে পেয়েছি। তার পথে এডওয়ার্ড বাধা সৃষ্টি করছে। আমার এই তপশ্চর্যামূলক আত্মনিগ্রহ ও মৌত যতদিন প্রাণ চাইবে চলবে। এতে তোমরা কেউ বাধা সৃষ্টি করবে না। বন্ধুর মতো সব করে যাবে। 

ওতিলের চিঠি পেয়ে এডওয়ার্ড আর কিছু বলল না। ক্যাপ্টেনের কি একটা জরুরি কাজ ছিল। সে তা সেরে এল। 

আবার ওরা চারজনে আগের মতো দিন কাটাতে লাগল প্রাসাদে। কারও প্রতি কারও ঘৃণা বা বিদ্বেষ নেই। ওতিলে কথাটা বললেও অনেকটা সহজ হয়ে উঠেছে। সন্ধের সময় ওরা চারজনে এক জায়গায় বসে বসে গল্প করে। কোনওদিন বই পড়ে এডওয়ার্ড। কোনওদিন গান বাজনার আসর বসায়। শার্লোতের পিয়ানোর সঙ্গে বেহালা বাজায় ক্যাপ্টেন। ওতিলের পিয়ানোর সঙ্গে বাঁশি বাজায় এডওয়ার্ড। 

সেদিন শার্লোতে আর ক্যাপ্টেন বসে ছিল। মিটলার তার সামনে পায়চারি করছিল। এডওয়ার্ড ঘোড়ায় চেপে বাইরে গেছে। ওতিলে তার ঘরে ছিল। মিটলার আপন মনে ওল্ড সেস্টামেন্টের দশটি উপদেশের এক-একটি বলে যাচ্ছিল ও ব্যাখ্যা করছিল। মিটলার বলতে চাইছিল আমরা ছেলেদের মাতাপিতার প্রতি ভক্তি করতে শেখাই। কিন্তু আমরা নিজেরা আমদের দাম্পত্য সম্পর্কেকে শ্রদ্ধা করে চলি না। যে বৈবাহিক বন্ধন বিধিনির্দিষ্ট ও জীবনের এক পবিত্র সম্পদ তা ছিন্ন করে আমরা ব্যভিচারে মত্ত হয়ে উঠি। সে সম্পর্কের মধ্যে কখনও কোনও কারণে ভুল বোঝাবুঝি বা বিরোধ বাধলে তা অবিলম্বে মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা উচিত এবং এ বিষয়ে অপরকে যথাসম্ভব সাহায্য করা উচিত। 

মিটলার লক্ষ করেনি ওতিলে তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে তার কথা শুনছে। এক বিষাদক্ষিণ আগ্রহে মিটলারের কথা শুনতে শুনতে তন্ময় হয়ে পড়েছিল ওতিলে। শার্লোতের শিশুপুত্রের মৃত্যুর পর থেকে তার মধ্যে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠেছিল সে এডওয়ার্ড ও শার্লোতের দাম্পত্য সম্পর্কের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে সে পাপ করেছে, এক অমার্জনীয় অপরাধে অপরাধিনী হয়ে উঠেছে। তার সেই পাপের জন্য শিশুটির অকাল মৃত্যু ঘটেছে তার হাতে। সেই পাপের প্রায়শ্চিত্তের জন্য অপরিসীম আত্মনিগ্রহের মাধ্যমে দিনে দিনে নিজেকে ক্ষয় করে স্বেচ্ছামৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে চায় সে। 

হঠাৎ ওতিলে তার ঘরে চলে যেতে শার্লোতে বিরক্ত হয়ে মিটলারকে বলল, আপনার ঈশ্বরের নীতি উপদেশ ব্যক্ত করা হলো? 

এই বলে শার্লোতে ওতিলের ঘরে ঢুকতেই ওতিলের সহচরী ন্যানি নামে মেয়েটি চিৎকার করে উঠল, ছুটে আসুন, আমার দিদিমণি মরে যাচ্ছে। 

মিটলার, ক্যাপ্টেন, শার্লোতে সকলেই ব্যস্ত হয়ে ছুটে গিয়ে দেখল, সোফার উপরে শুয়ে পড়েছে ওতিলে। তার অবস্থার সত্যিই বড় ক্ষীণ দেখাচ্ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ডাকা হলো। ডাক্তার এসে বুঝলেন, অনাহারজনিত দুর্বলতা ও কোনও দুশ্চিন্তার প্রবল চাপই এর কারণ। ন্যানি বলে যে বাচ্চা মেয়েটিকে গ্রামের এক গবির পরিবার থেকে এনে ওতিলে তার কাছে রেখেছিল এবং তাকে বড় ভালোবাসত ডাক্তার তাকে পাশের ঘরে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ওতিলে আজ কিছু খেয়েছে কিনা। 

ন্যানি বলল, সে কিছুই খায়নি। সব আমাকে দিয়ে দিয়েছে।

ডাক্তার তাকে আরও চাপ দিলে সে বলল, সে কোনওদিনই কিছু খায় না। 

কথাটা বলেই কাঁদতে লাগল ন্যানি, কারণ তার দিদিমণি একথা বলতে নিষেধ করেছে তাকে। কাঁদতে কাঁদতে কোথায় পালিয়ে গেল সে। তার আর বাড়িতে পাওয়া গেল না। 

এদিকে ওতিলের অবস্থা ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছিল। খবর পেয়ে এডওয়ার্ড ছুটে এসে ওতিলের কাছে গিয়ে বাম্পবেগে আকুল হয়ে বলল, তুমি কি আমার সঙ্গে কোনও কথা বলবে না ওতিলে? তাহলে আমিও তোমার সঙ্গে মরব! মরে একসঙ্গে স্বর্গে গিয়ে দুজনে ভাষাহীন নীরবতায় অনেক কথা বলব যুগ যুগ ধরে। 

ওতিলে একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে অতিকষ্টে ঠোঁট দুটো কাঁপিয়ে ক্ষীণকণ্ঠে বলে উঠল, তুমি বাঁচবে। প্রতিজ্ঞা করো। 

এডওয়ার্ড কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, প্রতিজ্ঞা করছি বাঁচব। 

কিন্তু এডওয়ার্ডের এ প্রতিজ্ঞা, এ শপথ ওতিলে আর শুনতে পেল না তার প্রাণবায়ু তার আগেই বেরিয়ে গেছে। 

ওতিলের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে শোকে উন্মাদের মতো হয়ে গেল এডওয়ার্ড। শার্লোতে আকুলভাবে কাঁদতে লাগল সারারাত ধরে। পরদিন সকালে একটি কফিনে করে ওতিলের মৃতদেহ শোভাযাত্রা সহকারে চ্যাপেলে নিয়ে যাওয়া হলো, চার্চসংলগ্ন সে চ্যাপেলের উন্নতির জন্য স্থপতি তার সাহায্যে অনেক কাজ করেছে। কফিনের উপরে। ছিল কাঁচের ঢাকনা। ফলে ওতিলে সুসজ্জিত মৃতদেহ ও তার সুন্দর মুখখানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। কেমন যেন এক স্বর্গীয় দ্যুতি খেলা করছিল তার মুখে। 

শোভাযাত্রায় গাঁয়ের অনেকেই যোগদান করেছিল। শোভাযাত্রাটি যখন একটি বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিল তখন হঠাৎ তার ছাদ থেকে ন্যানি শোভাযাত্রার সামনে পড়ে যায়। দেখে বোঝা গেল তার দেহের সব হাড় গুঁড়িয়ে গেছে। সবাই ভাবে সে মরে গেছে। ছাদের উপর থেকে তার প্রিয় দিদিমণির মৃত মুখখানি দেখে সে থাকতে পারেনি। বিচলিত হয়ে পড়ে যায়। 

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে ওতিলের কফিনটা ছুঁয়ে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠে ন্যানি নতজানু হয়ে বসে বলে, হা হা, আমার দিদিমণি, আমাকে ক্ষমা করেছে। আমার সব অপরাধ ক্ষমা করেছে। এইমাত্র আমার কানে কানে বলল। 

কবরের কাছে মৃতদেহটি নিয়ে গিয়ে নামিয়ে রাখা হলো। দলে দলে অসংখ্য নরনারী আসছিল। ন্যানির আশ্চর্য জীবনলাভের ঘটনা শুনে সবাই তাদের ছেলেমেয়েদের এনে কফিনটাকে ছোঁয়াচ্ছিল। তাদের ধারণা তাদের সব দুরারোগ্য রোগ ভালো হয়ে যাবে। 

রাত্রিতে একটি জ্বলন্ত বাতির পাশে বসে একা মৃতদেহ পাহারা দিতে লাগল ন্যানি। সে কাউকে সামনে থাকতে দেবে না। কেউ তাকে চটাতে সাহস পেল না। রাতের অন্ধকারে কোথা হতে স্থপতি এসে শেষবারের মতো ওতিলের মুখখানা দেখে গেল। সার্জেন বসে ছিল চার্চের এক কোণে ন্যানির অলক্ষ্যে অগোচরে। 

ওতিলের সমাহিত হবার পর থেকে এডওয়ার্ড সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে উঠল জগৎ ও জীবনের প্রতি। বাঁচার সব আনন্দ যেন সে হারিয়ে ফেলেছে নিঃশেষে। মানুষের সঙ্গে মেলামেলা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে। প্রায় সব সময় একা একা ঘরেই থাকে। খাওয়া দাওয়াতও কোনও রুচি বা আগ্রহ নেই। 

এই সময় এডওয়ার্ডের একমাত্র সান্ত্বনার উৎস ছিল একটি পানপাত্র অর্থাৎ একটি কাঁচের গ্লাস। সেই গ্লাসে তার ও ওতিলের স্বাক্ষর ছিল। এই গ্লাসটি পরম যত্নের সঙ্গে কাছে রেখে দিয়েছিল এডওয়ার্ড। এতেই সে রোজ মদ খেতে ওতিলের মৃত্যুর পর থেকে। 

হঠাৎ একদিন এডওয়ার্ডের মনে হলো এটা ঠিক সেই গ্লাস নয়। দেখতে এক মনে হলেও কোথায় একটা পার্থক্য আছে। চাকরকে ডেকে চাপ দিতেই সে স্বীকার করল সেটা ভেঙে যাওয়ায় অন্য একটা আনা হয়েছে তার জায়গায়। একথা শুনে রাগল না এডওয়ার্ড। শুধু সেই দিন থেকে পানাহার ত্যাগ করল একেবারে। 

অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই তার ঘর দেখা গেল এডওয়ার্ড মরে পড়ে রয়েছে। বিছানায়। মিটলার প্রথমে তা দেখে ডাক্তার ও সকলকে ডাকে। 

শার্লোতে বলল, ওতিলের পাশেই সমাহিত করা হবে এডওয়ার্ডকে এবং ভবিষ্যতে সেখানে আর কোনও মৃতদেহ সমাহিত করা হবে না। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তার প্রিয়তমার সঙ্গে মহামিলনের যে স্বপ্ন দেখেছিল এডওয়ার্ড সে স্বপ্ন যেন তার কোনওভাবে বিঘ্নিত না হয় কোনওদিন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *