ফাউস্ট (কাব্য-নাটক) ২

ট্রাজ্যেডির দ্বিতীয় অংশ

পঞ্চ অঙ্কে সমাপ্ত 

প্রথম অঙ্ক

একটি সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য 

গোধূলি বেলা

ফুলছড়ানো ঘাসের উপর ক্লান্ত ও অশান্ত অবস্থায় শুয়ে ছিল ফাউস্ট। তার চারদিকে বৃত্তাকারে সুন্দর ও ছোট আকারের প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। 

(বীণাযোগে গান)

এরিয়েল : যখন দিকে দিকে ফুল ফুটিয়ে ফুল ঝরিয়ে বসন্ত আসে, মুক্ত মাঠ সবুজের সম্ভার নিয়ে সবুজ শিশুদের আহ্বান জানায়, তখন আমাদের মতো মায়াবী পরীরাও অসহায় মানুষদের সাহায্য করার জন্য বেরিয়ে পড়ে। ভালো-মন্দ নির্বিশেষে সকলের উপর করুণা করে বেড়ায় তারা। 

তোমরা যারা ওর মাথার চারপাশে অদৃশ্য অবস্থায় বৃত্তাকারে ঘুরে চলেছ, তারা অবশ্যই যে দুঃখের আবেগে আলোড়িত হচ্ছে ওর বুক তার কারণ আবিষ্কার করবে। তাই অনুশোচনার আগুন নিবিয়ে দেবে। সমস্ত রকমের দুঃখের বোঝা হতে মুক্ত করো। ওর অন্তর। সারারাত্রির মধ্যে চারটি প্রহর আছে। এখন আর দেরি করো না। প্রথমে ওকে ঠাণ্ডা বালিশের উপর ঘুম পাড়াও। তারপর ওর উপর লেথি নদীর জল ছড়াও। তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আর তাহলে কোনও ব্যথা থাকবে না। ওর ঘুম পরিপূর্ণ হয়ে তোমরা তোমাদের ক্রিয়াকর্ম সম্পন্ন করবে। তারপর ওকে জাড়িয়ে দেবে। 

কোরাস : যে সবুজ প্রান্তরের বিশালতায় মন্থর বাতাস খেলা করে যায়, যেখানে কুয়াশাচ্ছন্ন গোধূলির সুবাসিত ছায়া ঘন হয়ে উঠে সোনালী আলোর শেষ দরজাটা বন্ধ করে দেয় সেখানে নীরব শান্তি যেন চুপিসারে কথা কয় বাতাসের সাথে, সেখানে এক শিশুসুলভ চপল খেলায় সকলেরই মন মেতে ওঠে। 

এখন রাত্রি ঘন হয়ে উঠেছে। একের পর এক করে তারা ফুটে উঠেছে মেঘহীন মুক্ত আকাশে। পাশের হ্রদের শান্ত জলে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই সব তারার চকিত আলো। রাজকীয় ঐশ্বর্যে বিরাজমান পূর্ণায়ত চাঁদ অতন্দ্র দৃষ্টিতে রেখে চলেছে চারদিকে সর্বব্যাপী শান্তি আর নীরবতা। 

এখন তুমি কালের সীমাবন্ধন থেকে যেন মুক্ত। তোমার আনন্দ-বেদনার সব পালিয়ে গেছে ওই শান্তির রাজ্য থেকে। এখন তুমি তোমার পূর্ণ অখণ্ড সত্তায় বিরাজিত। যে বিশ্বাস তুমি হারিয়ে ফেলেছিলে তা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত তোমার হৃদয়ে। আলোকোজ্জ্বল নূতন প্রভাতের জন্য প্রতীক্ষা করো। চেয়ে দেখো ভোরের কুহেলী-ঘেরা আরামশয্যা থেকে পাহাড়গুলো জেগে উঠছে, উপত্যকাগুলোকে কেমন সবুজ দেখাচ্ছে। মাঠে মাঠে প্রভাতী আলোর রূপালি ঢেউ তুলে তাদের পরিণতি ঘোষণা করছে সবুজ শস্যের দল। 

যদি অন্তরের অসীম অসংযত কামনাদের জয় করতে পার তাহলেই অতদূরে দেখতে পাবে এক উজ্জ্বল গৌরবের রাজ্য। যে মহানিদ্রার হালকা আবরণে আবৃত তোমার জীবন, ছিন্ন করে ফেল সে আবরণ। অবিশ্বাসী অপরিণাশদশী সাধারণ মানুষ শুধু কামনায় উত্তপ্ত হয়ে উঠতে জানে, কিন্তু কামনা পূরণের পথ জানে না। যে সব কিছু দেখে ভাবনা-চিন্তা করে কাজ করে যায় সেই তার আকাঙ্ক্ষিত বস্তুকে লাভ করে জীবনে। 

(একটি জোর শব্দ সূর্যের আগমন ঘোষণা করল) 

এরিয়েল : ঐ শোনো, আকাশে নবজাত দিনের আবির্ভাব ঘোষিত হচ্ছে প্রচণ্ড শব্দে। সূর্যদেবতা ফিবাসের রথচক্রনিনাদের সঙ্গে সঙ্গে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। স্বর্গমর্তব্যাপী সে আলোর উজ্জ্বলতায় চোখ দিয়ে উঠছে। ঐ শোনো। পাহাড়ে অরণ্যে প্রতিটি কুসুমকোরকের গভীরে অনুপ্রবিষ্ঠ সে আলোর আশ্চর্য অশ্রুত ধ্বনি। 

ফাউস্ট : হে পৃথিবী, যদিও এখন রাত্রির অন্ধকার অবিচলভাবে ঘন হয়ে রয়েছে তোমার বুকে তথাপি এক নূতন প্রাণস্পন্দনে সজীব হয়ে জেগে উঠেছি আমি। নূতন আশার আনন্দ জাগছে আমার হৃদয়ে, আমার বহু-আকাঙ্ক্ষিত বৃহত্তর জীবনলাভের জন্য এক বলিষ্ঠ সংকল্প অটল হয়ে উঠছে আমার মধ্যে। উপত্যকার বুক থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে ভোরের আকাশ। অসংখ্য কণ্ঠ গুঞ্জরিত হয়ে উঠছে কুঞ্জবনে। নানাবিধ বৃক্ষের পত্রপুষ্পশোভিত শাখাপ্রশাখাগুলোর প্রত্যূষের আলোর মুখ তুলে তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন স্বর্গ নেমে এসেছে পৃথিবীতে। সূর্যকিরণ প্রথমে পৰ্বত-শৃঙ্গের মুকুটগুলোকে চুম্বন করে সানুদেশের ঢাল প্রান্তরভূমি পার হয়ে ধীরে ধীরে নেমে আসছে সমতলভূমিতে। সে কিরণে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে আমার। এইভাবে আমাদের সব ইচ্ছা যদি পূরণ হয়, যদি আমাদের সর্বোচ্চ আশার আলোর পূর্ণতার প্রান্তরভূমিতে প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে সার্থক হই আমরা। কিন্তু যদি সে আশার আলোর পরিবর্তে নেমে আসে জ্বলন্ত 

অগ্নিপ্রবাহ, আসে ঘৃণা অথবা প্রেমের আগুন, আনন্দ-বেদনার দ্বৈত উত্তাপে পীড়িত হই। আমরা, তখন অনিবারণীয় কামনার আবেগে সংসারের দিকে ছুটে যাই আমরা, ছদ্ম যৌবনের মিথ্যা রঙে-রূপে অলঙ্কৃত করে তুলি নিজেদের। 

এইভাবে আমি ছুটে যাই সামনের দিকে আর আমার পিছনে পড়ে থাকে উজ্জ্বল সূর্যের আলোকমালা, ঝর্নারা ছুটে যাক পাহাড়ের গা বেয়ে। উপত্যকার বুকের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাক নদীরা। রামধনু ফুটে উঠুক দিগন্তে। মানুষের জীবন সংগ্রামের প্রকৃত কোনও প্রতীক কিন্তু প্রকৃতি জগতে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। এটা বেশ বোঝ যায় জীবনে আসলে আলো নয়, অস্বচ্ছ বস্তুতে প্রতিরুদ্ধ প্রতিসৃত আলোকতরঙ্গ হতে বিচ্ছুরত বর্ণমালামাত্র। 

দ্বিতীয় দৃশ্য 

সম্রাটের সৌধ

দরবারগৃহ : ম্রাটের জন্য প্রতীক্ষারত রাজ্য পরিষদের সদস্যরা। 

বাদ্য : সুসজ্জিত সভাসদবর্গের পিছু পিছু সম্রাট সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। তাঁর ডান দিকে ছিল জনৈক জ্যোতিষী। 

সম্রাট : হে আমার প্রিয় বিশ্বস্ত পরিষদবর্গ, আপনারা বহু দূর-দূরান্ত হতে এসেছেন। আমার পাশে এক বিজ্ঞজনকে দেখছি, কিন্তু তার প্রতিদ্বন্দ্বী সেই ভাঁড় কোথায়? 

ভূম্যাধিকারী : আপনার পোশাকের আঁচলে আটকে গিয়ে হঠাৎ সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়। সে প্রচুর মদ্যপান করেছে কি না কেউ জানে না। তবে তার মোটা দেহটাকে লোকে ধরাধরি করে বয়ে নিয়ে গেছে। এখন সে মৃত কি অচৈতন্য কেউ তা জানে না। 

দ্বিতীয় ভূম্যাধিকারী : সেই ভাঁড়ের স্থান অধিকার করার জন্য অদ্ভুত পোশাক পরে আর একজন ভাঁড় সকলকে ঠেলে এসে হাজির হয়। তার অদ্ভুত চেহারা দেখে চমকে ওঠে সকলে। প্রহরীরা তাকে আটক করলেও সে জোর করে ঢুকে পড়ে। ঐ এসে গেছে সে। 

সিংহাসনের সামনে নতজানু হয়ে

মেফিস্টোফেলিস : মানুষ কোনো জিনিস অভিশপ্ত হলেও তা আগ্রহের সঙ্গে প্রত্যাশা করে? মানুষ কোনো জিনিস কামনা করে তা পেয়ে সারা জীবন ছুটে চলে তার পিছনে? কোন জিনিস যত্নের সঙ্গে রক্ষা করে চলে মানুষ কে সবচেয়ে ধিকৃত ও অপমানিত? কার কথা আপনারা শুনতে চান না? আবার কার কথা মানুষ স্বেচ্ছায় শুনতে চায়? কে আপনার সিংহাসনের কাছে আসতে চায়? আবার কে আপনার সিংহাসনের হতে দূরে থাকতে চায়? 

সম্রাট : এখন এ সব কথা থাক। এখন সময়র বড় অভাব। এখন ধাঁধার সমাধানের উপযুক্ত স্থান এটা নয়। এই ভদ্রমহোদয়গণ একসময় এই সব ধাঁধার উত্তর দেবেন। তুমি নিজেই এর সমাধান করো। আমি তা শুনতে চাই। আমার পুরনো ভাঁড় এখন চলে গেলে সীমাহীন দূরত্বের দেশে। তার স্থান অধিকার করে আমার সাহায্য করো। আমাকে এসে বস। 

মেফিস্টোফেলিসের সম্রাটের বাঁ পাশে গিয়ে বসল 
জনতারা গুঞ্জনধ্বনি করে বলতে লাগল

আবার এক ভাড় এল–চিন্তার কথা। কোথা থেকে এল? কেমন করে ঢুকল এখানে? পুরনোটা মারা গেল। সে ছিল পিপের মতো মোটা। লাঠির মতো সরু। 

সম্রাট : হে আমার প্রিয়, অনুরক্ত ও দূরাগত পরিষদবর্গ! আপনাদের স্বাগত জানাই। এখন আমাদের রাজ্যে সুসময় এবং সৌভাগ্য বিরাজ করছে। কিন্তু এই আনন্দের দিনে যখন সুন্দর সুন্দর পোশাক পরে উৎসব করা উচিত তখন আপনারা কেন কোনও এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় যোগদান করতে চান? 

প্রধান প্রশাসক : আমরা যাকে মানুষের মহৎ গুণ বলে থাকি তা একমাত্র সম্রাটের মাথাতেই আছে এবং একমাত্র সম্রাটই তার প্রয়োগ করতে পারেন। এই রাজ্যে এখন একের পর এক করে অন্যায় এমনভাবে বেড়ে চলেছে যে প্রতিটি মানুষ হতবুদ্ধি হয়ে আপনার কাছে ন্যায়বিচার প্রত্যাশা করছে। চারদিকে অসত্য আর অরাজকতা বিরাজ করছে। অশুভ দুঃস্বপ্নের মতো আইনশঙ্খলার অভাবজনিত ভয়ে পীড়িত হয়ে উঠছে। মানুষের মন। 

এ রাজ্যে কেউ মানুষের গবাদি পশু চুরি করেছে, কেউ মেয়ে চুরি করছে। চোরেরা বড়াই করে বেড়াচ্ছে : অভিযোগকারীদের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে এইভাবে বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছে। এমন কি ধর্মস্থানের বেদী থেকে কাপ, ক্রশ ও বাতি চুরি হচ্ছে। নির্দোষ নিরীহ লোকদের ধনপ্রাণ নষ্ট করছে দুর্বত্তরা। এই ব্যাপক অন্যায় আর অরাজকতায় রাজত্বে কোনও মানুষের মধ্যে শুভবুদ্ধি অবশিষ্ট থাকতে পারে। ফলে ভালোরাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। এমন কি বিচারকরাও দোষীর শাস্তি বিধান করতে পারছেন না। আমি দেশের বর্তমান দূরবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছি তা কালো হলেও তা প্রকৃত অবস্থার অংশমাত্র। (কিছুটা থেমে) যেখানে সকলেই অপরাধ করে এবং কেউ সুবিচার পায় না সেখানেও স্বয়ং সম্রাটকে দোষী সাজতে হয়। 

প্রধান সেনাপতি : এই অরাজকতার দিনে ঝগড়া-বিবাদের সংখ্যা ও গোলমাল বেড়েই চলেছে। একে অন্যকে আঘাত করে চলেছে। কেউ কোনও আইনের নির্দেশ মানছে না। চোর চুরি করেও নিরাপদ আড্ডায় রয়ে গেছে। নাইটরা মিথ্যা শপথ করছে আর ভঙ্গ করছে। ভাড়াটে সৈন্যরা মাইনে চাইছে। না দিলে তারা একযোগে পালিয়ে। যাবে। যে রাজ্য তারা একদিন পাহারা দিয়ে রক্ষা করতে এসেছিল আজ তা তারা বিধ্বস্ত করে দিতে চায়। আমাদের রাজ্যের সীমান্তের বাইরে যে সব রাজা আছে তারা মাথা ঘামাতে চায় এ সব সমস্যায়। 

কোষাধ্যক্ষ : আর মিত্রশক্তিকে বিশ্বাস করলে আমাদের ঠকতে হবে। তারা আমাদের অসময়ে টাকা দেবার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা পূরণ করেনি। তাদের প্রতিশ্রুত সাহায্য এসে পৌঁছায়নি। বলুন মহারাজ, আপনার এই বিশাল রাজ্যের শাসনভার কার হাতে ন্যস্ত এখন। এখন দেখা যাচ্ছে ঘরে ঘরে সবাই রাজা। সবাই স্বাধীন, আপন আপন মতে চলছে। আমাদের ভৃত্যরাও স্বাধিকারে মত্ত হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক দলগুলোকেও আর বিশ্বাস করা যায় না। তারা শুধু ঝগড়া করে পরস্পরের সঙ্গে, দেশের কোনও ভালো করে না। কেউ প্রতিবেশীর মঙ্গল চায় না। চায় ব্যক্তিগত স্বার্থপূরণ। সকলেই ব্যক্তিগতভাবে অর্থ অর্থসঞ্চয় করছে। এদিকে আমাদের রাজকোষ শূন্য। 

প্রধান তত্ত্বাবধায়ক : এমন কি আমি নিজে যা কিছু পাচ্ছি সব সঞ্চয় করছি শুধু। তবু প্রয়োজন মিটছে না। মাংসের জন্য বনের পশু নির্বিচারে শিকার করা হচ্ছে, কিন্তু রাজ্যে ভালো মদ নেই। রাজকোষে টাকা না থাকলেও নাচ-গানের খরচ মেটাতে হয়। ইহুদীদের দেনা কয়েক বছরেও শোধ হবে না। শূকরদের গায়ে চর্বি না জমতেই তাদের বধ করতে হয়। অনেককে মাথার বালিশ বাধা দিতে হয়। রুটিগুলো সেঁকতে সেঁকতেই পেটে চলে যায়। 

সম্রাট : (কিছু চিন্তার পর মেফিস্টোফেলিসকে) বলো ভাঁড়, এত সব অভাবের সঙ্গে তুমি কোনও অভাবের কথা জুড়ে দিতে পার কি না। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি? মোটেই না। আমি শুধু দেখছি আপনাকে আর আপনার মস্তকোপরি বৃত্তাকারে বিরাজিত সৌভাগ্যের জ্যোতিঃপুঞ্জকে। রাজা যেখানে সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, যেখানে রাজশক্তি শক্রশক্তিতে ছত্রভঙ্গ ও দেশ থেকে বিতাড়িত করতে পারে, যেখানে রাজার পিছনে অনুরক্ত প্রজাদের সংগঠিত আনুগত্য এখনও অটুট, সেখাসে অবিশ্বাস ও হতাশার কি থাকতে পারে? যেখানে এত সব উজ্জ্বল নক্ষত্র বিরাজমান সেখানে কোনও অশুভ শক্তি খারাপ কিছু করতে পারে? 

জনতা : লোকটা ভবঘুরে। কে জানে কি আছে ওর মনের মধ্যে। এ আবার জ্যোতিষ নয় তো? 

মেফিস্টোফেলিস : জগতে অভাব কোথায় নেই? হয় এখানে, নয় ওখানে, টাকার অভাব সর্বত্র। এটা ঠিক যে এই মুহূর্তে আপনি অর্থ সংগ্রহ করতে পারছেন না। পর্বতকন্দরে বা বহু গুপ্তস্থানে বহু সোনা ও টাকা গুপ্ত অবস্থায় আছে। তা খুঁজে বার করতে হবে। আপনি হুকুম দিন, কে তার সন্ধান দিতে পারে। যার মন এবং প্রকৃতি শক্তিসম্পন্ন সেই তা পারে। 

প্রধান প্রশাসক : মন আর প্রকৃতি-খ্রিস্টানদের কাছে এ কথা বলি না আমরা। এসব নাস্তিকদের কথা এবং তাদের আমরা পুড়িয়ে মারতে চাই। এসব কথা বিপজ্জনক। প্রকৃতি মানেই পাপ আর মন হচ্ছে শয়তান। তারা শুধু নির্লজ্জভাবে সংশয় উৎপন্ন করে যায়। আমরা এ সব মানি না। দুই শ্রেণীর মানুষ আমাদের রাজ্য চালাচ্ছে। তারা হলো সাধু-সন্ন্যাসী আর বীর নাইট। তারাই যত গির্জা আর রাষ্ট্র চালায়। আর যে সব কুৎসিত মনের মানুষ সংশয় সৃষ্টি করে চলে তারা মায়াবী নাস্তিক। তারা বিভ্রান্তির দ্বারা রাজ্য ধ্বংস করে ফেলে। তাদের আমরা শত্রু হিসাবে দেখি এবং ধ্বংস করে থাকি। তুমি কি দুর্নীতি আমদানি করতে চাও বিদেশ থেকে? 

মেফিস্টোফেলিস : বাঃ, আমি দেখছি আপনি এক বিজ্ঞ সভাসদ। আপনি যেটা ছুঁতে পারছেন না তা কিন্তু আপনার অদূরেই আছে। আপনি যা ধরতে পারছেন না ভাবছেন তার অস্তিত্ব নেই। আপনি যা বুঝতে পারছেন তা ভাবছেন তা সত্য নয়। আপনি যা ওজন করতে পারছেন না ভাবছেন তার ওজন নেই। যে মুদ্রা ভাঙাতে পারছেন না ভাবছেন তা অচল। 

সম্রাট : এখন ভেবে দেখো আমাদের এই প্রয়োজনে কিভাবে সাহায্য করতে পার তুমি। উপদেশ দিয়ে কোনও লাভ নেই। এখন চাই টাকা। দেখো, কোথায় কিভাবে সে টাকা পাওয়া যায়। 

মেফিস্টোফেলিস : আপনি যা চাইছেন আমি তার থেকে আরও বেশি দেব আপনাকে। এটা খুবই হালকা কাজ। তবে হালকা কাজই করা কঠিন। আসল কথা সোনা তো আপনার হাতের কাছেই রয়েছে। শুধু কৌশলে তা হস্তগত করতে হবে। মনে ভাবুন, অতীতে কত সম্রাট কত রাজ্য জয় করেছেন। সেই সব রাজ্যের কত ধনরত্ন তারা মাটির তলায় পুঁতে রেখেছেন। সেই মাটি যখন আপনার তখন তার গর্ভনিহিত ধনরত্নও আপনার। 

কোষাধ্যক্ষ : বোকা ভাড় হলেও ওর কথাগুলো বুদ্ধিদীপ্ত। হ্যাঁ, এ অধিকার সম্রাটের আছে। 

প্রধান প্রশাসক : শয়তান আমাদের ধরার জন্য স্বর্ণজাল বিস্তার করছে। এসব কাজ কোনওমতেই ন্যায়সঙ্গত নয়। 

প্রধান তত্ত্বাবধায়ক : ওকে আগে সেইসব ধনরত্ন রাজসভায় আনতে দাও। ও নিজেও তার অংশ নিক। আর যদি তাতে অন্যায় হয় তাহলেও আমি তা সব নিয়ে যাব। 

প্রধান সেনাপতি : ভাঁড় অত্যন্ত কূটনীতিজ্ঞ। সে সকলের মনে লোভ জাগিয়ে তুলছে। আমরা ধনরত্ন চাই, তা কোথা থেকে আসছে তা দেখব না। 

মেফিস্টোফেলিস : আপনারা হয়ত ভাববেন আমি বাজে কথায় মন ভোলাচ্ছি। এই তো জ্যোতিষী রয়েছেন। ওঁকে জিজ্ঞাসা করুন। কালের গতি তো ওঁর নখদর্পণে। উনি বলুন এখন গ্রহনক্ষের অবস্থান কি। 

জনতার গুঞ্জন : ওরা দুজনেই দুবৃত্ত। ওরা দুজনেই এখন মিলেছে। দুজনেই রাজার সিংহাসনের পাশে জড়ো হয়েছে। লোকটা ভাঁড় হলেও বিজ্ঞের মতো কথা বলছে। 

(মেফিস্টোফেলিস যা বলার তাই বলে)

জ্যোতিষী : রবি এখন খাঁটি সোনার মতো উজ্জ্বল। রবি সিংহাসনে, বুধ প্রহরী, স্নেহ আর বেতনের জন্য সেবা করে। মোহময়ী নারীরূপিনী শুক্র আমাদের সকলেরই পানে স্নেহভরে তাকাচ্ছেন। সতী চন্দ্র বড় খেয়ালী ভাবাপন্ন। মঙ্গল আপনাদের ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু আঘাত করবে না। ভয় নেই, বৃহস্পতি এখনও চমৎকার ঐশ্বর্যময় নক্ষত্ররূপে বিরাজ করছে। শনি খুব দূরবর্তী এবং আকারে ছোট দেখালেও আসলে কিন্তু গ্রহ হিসাবে অনেক বড়। আমরা এমন কোনও ধাতুকে গুরুত্ব দিই না যা ওজনে ভারী কিন্তু মূল্যবান নয়। যেখানে সোনা আর রূপা দুই ধাতু এক জায়গায় হয় তখন মানুষের অপ্রাপ্য কিছু থাকে না। তখন প্রাসাদ বাগান সম্পত্তি সব কিছু হয়। সেই সোনা এবং রূপাকে কোথা থেকে সংগ্রহ করবে তা কেউ জানে না। 

সম্রাট : আমি তার কথার মধ্যে দুটো অর্থ খুঁজে পাচ্ছি। কিন্তু কিছু বুঝতে পারছি na। 

জনতা : তাহলে সে কথা বলার অর্থ কি? আমরা শুনেও কিছু বুঝতে পারিনি। 

মেফিস্টোফেলিস : তারা হতবুদ্ধি ও হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চারদিকে। তারা কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না আমার যাদুতে। কিন্তু কেন তারা অবিশ্বাস করবে, কেন তারা ঠাট্টা-বিদ্রূপ করবে? তারা নিজেরা তাদের পায়ের মধ্যেই এর প্রভাব বুঝতে পারছে। তারা হাঁটতে গেলেই তা বুঝতে পারবে। এইভাবে প্রকৃতি যে গোপন শক্তি বিশ্ব সৃষ্টির সর্বত্র কাজ করে যায় তার প্রভাব যে কোনও জায়গায় যেতে পারে মানুষ। তার আপন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অনুভব করতে পারে সে শক্তি। সুতরাং যে কোনও জায়গাতেই মাটি খুঁড়লেই সোনা পাওয়া যাবে না কেন? সোনা তো প্রকৃতিরই দান। 

জনতা : আমার পাটা সীসের মতো ভারী হয়ে উঠেছে। আমার হাতে বাতের মতো ব্যথা করছে। আমার পিঠেতেও ব্যথা করছে। মনে হচ্ছে এই জায়গাতেই গুপ্তধন। আছে প্রচুর। 

সম্রাট : তাড়াতাড়ি করো। তোমার কথার পরীক্ষা হয়ে যাক। কোথায় কোন জায়গায় সোনা যাওয়া যাবে দেখিয়ে দাও। আমি আমার রাজমুকুট আর রাজদণ্ড ছুঁয়ে শপথ করছি, আমি আমার যথাসর্বস্ব তোমাকে দান করব যদি তোমার কথা সত্য হয়। তোমার সঙ্গে আমার চিরদিনের অক্ষয় বন্ধুত্ব গড়ে উঠবে। আর তোমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত হলে তোমাকে নরকে পাঠাব। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি পথটা দেখিয়ে দেব। কিন্তু ঠিক জায়গাটা বলব না। তা খুঁজে নিতে হবে। যে কোনও জায়গাতেই সোনা পাওয়া যেতে পারে। একটা গরিব চাষিও মাটির কোনও দেওয়ালের ভিতর সোনার হাঁড়ি পেয়ে যেতে পারে। তবে সোনার অনুসন্ধানকারীদের রাত্রির অন্ধকারে বার হতে হয়। যারা এ বিষয়ে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তাদের বিশ্বাস করবে। শুধু সোনা নয়, ভালো মদও নিহিতও আছে মাটির গর্তে। যে রহস্য দিনের বেলায় হাসির উদ্রেক করে, রাত্রিতেই তাই জীবন্ত হয়ে উঠবে। ১৩৪ গ্যেটে বচনাসমগ 

সম্রাট : তুমি আসলে তাদের পথ দেখিয়ে দাও। এসব হেঁয়ালির দরকার কি? সত্যিকারের মূল্যবান বস্তু যদি কোথাও থাকে তাহলে তা দিনের বেলাও পাওয়া যাবে। রাত্রিবেলায় তো সব কিছুই কালো দেখায়। গরু-বেড়াল সব। তখন কোনটা সোনা কোনটা কি বোঝাই যায় না। সুতরাং এখন মাটি কর্ষণ করে সোনা বার করো। 

মেফিস্টোফেলিস : আপনি নিজে কোদাল দিয়ে চাষির মতো মাটি কর্ষণ করুন। তাহলে তার পুরস্কারস্বরূপ আপনি একপাত্র সোনার মোহর পাবেন। তার সঙ্গে অনেক মণিমুক্তাও পাবেন। সেই সব জিনিস আপনার ও রানিমার রাজকীয় ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্য বুদ্ধি পাবে। 

সম্রাট : তাহলে তাড়াতাড়ি করো। কতক্ষণ লাগবে? 

জ্যোতিষী : (মেফিস্টোফেলিসের কথামতো বলতে লাগল) মহারাজ, আপনার কামনার এই ব্যাকুলতাকে সংযত করতে হবে প্রথমে। প্রথমে এইসব উৎসব-আনন্দ বন্ধ করতে হবে। এর দ্বারা কোনও বড় কাজ হয় না। প্রথমে আত্মস্থ হতে হবে আমাদের। উচ্চ বস্তু নিচু জায়গা থেকেই পাওয়া যাবে। কিন্তু ভালো পেতে হলে ভালো হতে হবে। আনন্দ লাভ করতে হলে প্রথমে রক্তের উদ্দামতাকে সংযত করতে হবে। মদ পেতে হলে আঙ্গুর পিষতে হবে। অলৌকিক কোনও ফল পেতে হলে আগে বিশ্বাসকে অটল করতে হবে। 

সম্রাট : ঠিক আছে, উৎসব শেষ হয়ে আসছে বুধবার। ঐদিন সব আনন্দ উৎসবের শেষ। তবে তার আগে আমরা বিজয় উৎসব পালন করব। 

(বাদ্যও সকলের প্রস্থান)

মেফিস্টোফেলিস : ভাগ্যের সঙ্গে সদগুণের সম্পর্ক কত নিবিড়। এই বোকাগুলোর মাথায় এ কথাটা কিছুতেই ঢোকে না। 

তৃতীয় দৃশ্য

কতকগুলি কক্ষসমন্বিত এক প্রশস্ত হলঘর 

(উৎসব ও মুখোশনৃত্যের জন্য সাজানো)

প্রহরী : ডোব না, আমাদের এই জার্মান দেশে এসে তোমাদের মতো ভড়দের মৃত্যু হবে। আমাদের সম্রাট আল্পস পর্বত অতিক্রম করে রোমে অভিযান করে যে বিজয়গৌরব লাভ করেছেন, এ উৎসব তারই জন্য। আজ আমরা সকলে নবজাত শিশুর মতো চঞ্চল, নিরুদ্বেগ। আজ হাজার হাজার নরনারী মত্ত হয়ে উঠেছে এ উৎসবে। সমস্ত পৃথিবীটাই মনে হচ্ছে যেন নির্বোধদের আড্ডাখানা। 

উদ্যানবালিকারা 

(ম্যান্ডেলিনসহযোগে গান)

আজ আমরা এই উৎসবের সাজে সজ্জিত হয়ে
অর্জন করেছি তোমাদের মুগ্ধ দৃষ্টির প্রশংসা।
জার্মানদেশের রাজদরবারে আমাদের দেখে মনে হচ্ছে
আমরা যেন ফ্লোরেন্সের বালিকা।
আমাদের বাদামী চুলের উপর ফুলের গয়না
পরি আমরা আর বাঁধি রেশমী ফিতে।
বসন্তের বিচিত্র ফুল দিয়ে যে মালা আমরা গাঁথি
সেই মালাগাথার কারুকার্য দেখেই বুঝতে পারবে আমাদের গুণ।
প্রতিটি রঙের ফুল ঠিক ঠিক জায়গায় বসেছে।
সব মিলিয়ে তোমাদের আনন্দ দান করবে।
আমরা সুন্দরী উদ্ভিন্নযৌবনা উদ্যানবালিকা,
হালকা খুশির হাওয়ায় ভরা আমাদের বুক
নারী হয়েও আমরা কলাকুশলিনী।

প্রহরী : হে উদ্যানবালিকারা, হাতে ও গলায় ফুলের গয়না পরে যে সব ফুলের ঝুড়ি মাথায় বয়ে নিয়ে চলেছ তা একবার দেখতে দাও।

উদ্যানবালিকারা : এ ফুল বিক্রির জন্য নয়। যারা শুধু ফুল দেখে আনন্দ পায় তারাই ফুলের প্রকৃত মান কি তা জানে। 

ফলবতী অলিভশাখা : আমি ফুলে লোভ করি না। যে কোনও ধরনের বিরোধ আমি এড়িয়ে চলতে চাই। সব দেশে আমি শান্তির প্রতীক। আজ এই উৎসবের দিনে যোগ্য ব্যক্তির মাথাকে শোভিত করতে চাই আমি। 

অন্যান্য ফুলেরা : আমরা প্রকৃতির কন্যা। আমাদের উজ্জ্বল রূপ দেখে মুক্ত হয়ে ওঠে অজস্র মানুষের চক্ষু। 

গোলাপের কুঁড়ি : যারা আমাদের প্রথম দেখতে পায় তারাই ভাগ্যবান। বসন্ত আসার সঙ্গে সঙ্গে গোলাপের কুঁড়িরা ফুটে ওঠে দিকে দিকে। কে এমন মনোহর দৃশ্য উপভোগ করতে না চায়? এইসব ফুলেদের দেশে এসে কে তার ইন্দ্রিয়ের দ্বারকে রুদ্ধ। ও সংযত করে রেখে দিতে পারে? 

(সবুজ পাতা আর ঘাসের উপর ঝুড়ি নামিয়ে উদ্যানবালিকারা । 

তাদের দেখাতে লাগল) 

মালীরা 

(বাদ্যসহ গান)

ফুলের কুড়িগুলো কেমন ফুটে উঠেছ আপনা হতে;
সেই সব ফুল শোভা পাচ্ছে তোমাদের মাথায়
তাদের দেখে ফলের কথাও মনে পড়ে যাচ্ছে।
গোলাপ জাম, পীচ কত সব উজ্জ্বল ফলের মুখ
গোলাপ ফুল নিয়ে কবিতা লেখা যায়,
কিন্তু পাকা সুস্বাদু ফল খাওয়ার আনন্দ কম নয়।
ফুলের সঙ্গে পাকা ফল যেমন ভালো লাগে
তেমনি তোমাদের ফুল্লকুসুমিত যৌবনসৌন্দর্যের
সঙ্গে আমাদের মিলিত হতে দাও।
ফুল, পাতা, ফল, কুড়ি সব মিলিত 
হোক একসঙ্গে।

(গান করতে করতে সকলে আপন ফুল-ফলের পশরা দেখাতে লাগল দর্শকদের)

মাতা ও কন্যা মাতা : হে কুমারী, তুমি যখন প্রথম ভূমিষ্ট হয়েছিলে তখনর তোমার দেহটা কত নরম আর তুলতুলে ছিল। তোমার গায়ের রংটা ছিল সাদা ধবধবে। আমি তোমাকে কত আদরের সঙ্গে পালন করতাম। ভাবতাম বড় হয়ে তুমি কোনও ধনী লোকের ছেলের প্রেমে পড়বে, তার স্ত্রী হবে। কিন্তু হায়, কত বছর বৃথাই কেটে গেল। কেউ তোমার প্রেমে পড়ল না। মাঝে মাঝে এক-একজন এসে নাচতে চায় তোমার সঙ্গে, আবার কেউ চকিত দৃষ্টি হানে তোমার দিকে। কিন্তু তোমার আপন প্রেমিক আজও খুঁজে পাওনি তুমি। কত উৎসবে ও নাচগানের আসরে নিয়ে গিয়েছি তোমার তোমার প্রেমিকের আশায়, কিন্তু কোনো ফল হয়নি। হে সুন্দরী, দেখো কোনও মনের মানুষ পাও কি না। 

(অন্যান্য সুন্দরী কুমারীরা সমবেত হলো খেলার ছলে)

কাঠুরিয়াগণ : তোমাদের আনন্দোৎসবে আমাদের যোগদান করতে দাও। আমরা গাছ কাটি। আমরা কষ্ট করে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে গাছ না কাটলে তোমরা শীতে জমে যেতে। 

অলস ব্যক্তিরা : তোমরা হচ্ছ নির্বোধ। আমরা সুখী, কারণ আমাদের কোনও বোঝা বইতে হয় না। আমরা বাজার দিয়ে বেড়াতে যাই। সব সময় আনন্দ করে ঘুরে বেড়াই। 

মাতাল : আজ আর কোনও বিষাদের কথা নয়। আজ শুধু গান আর আনন্দ। আজ আমি প্রাণ খুলে বলব মনের কথা। আমি গ্লাসের পর গ্লাস মদ খেয়ে যাই। গ্লাসের ইং ঠাং বাজনা শুনি। আমার স্ত্রী মদ খেতে কত নিষেধ করে। কত বকে আমায় তবু আমি মদ খেয়ে যাই। হোটেলের মালিক আমাদের মদ না দিলে মালিকপত্নী দেবে আর মালিকপত্নী না দিলে তার ঝি দেবে। আমরা সব সময় খুঁজে বেড়াই শুধু আনন্দ আর তামাশা। এখানেই আমায় এখন শুয়ে পড়তে দাও, কারণ আর আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না। 

কোরাস : সবাই আপন আপন আসনে বসে যত পার মদ খেয়ে যাও। 

(প্রহরী প্রতিযোগী কবিদের আহ্বান জানাতেই গ্রামকবি, সভাকবি ও 

চারণকবির দল এসে কয়েক ছত্র করে কবিতা বলেই চলে গেল) হাস্যরসের কবি : তোমরা জান কি, কি ধরনের কবিতা আমি ভালোবাসি? আমি যদি কবিতা পাঠ করি অথবা গান হিসাবে গাই তাহলে কেউ তা শুনতে চাইবে না। 

(প্রহরী এবার গ্রীক পুরাণের চরিত্রদের ডাকল যারা আধুনিক কালেও তাদের মূল প্রকৃতি ও মনোহারিণী ক্ষমতা হারায়নি)

অ্যাগ্লাতা : বিবিধ গুণাবলিসহ বেঁচে থাকাই প্রকৃত বেঁচে থাকা। যারা তা পারে আমরা তাদের আশীর্বাদ করি। সুতরাং দানশীলতা প্রভৃতি গুণে ভূষিত করো নিজেদের। 

হেজিমনিঃ গ্রহণকালেও উদার হবে।

ইউফোসিনে : তোমাদের চিন্তাও হবে মুক্ত এবং উদার। 

অ্যাট্রপস : আমি সবচেয়ে বয়সে বড়। আমাকে সুতো কাটতে ডাকা হয়েছে। ডাকা হয়েছে জীবনের সুতো যেদিন থেকে শুরু হয়েছে সেইদিন থেকে। সেইদিন থেকে প্রয়োজন হয়েছে চিন্তার আর ধ্যান-ধারণার। আমার হাত থেকে সুতোগুলো নিয়ে আরও সরু করো। যদি তোমরা শুধু আনন্দের পিছনে মত্ত হয়ে ছুটে চলো তাহলে বুঝে রাখবে, এই জীবনের সুতো অনন্তকাল ধরে প্রসারিত থাকবে না। তা একদিন ছিঁড়ে যাবেই। 

ক্লোদো : মানুষ আমাদের আদিম পিতার কথা ঠিকমতো শোনেনি বলে আমাকে আগে কত আলগা পশম পরতে হয়েছে। কত সুখের স্বপ্ন ও আশার জাল বুনে বাতাসে ভাসিয়ে দিয়েছে মানুষ। প্রথম প্রথম আমিও অনেক ভুলে করেছি। কিন্তু আজ আমি আত্মস্থ ও সংযত হয়ে এই স্থানটিকে বেছে নিয়েছি। 

ল্যাচেনিস : আমার কাছে দক্ষতা ও কৌশলটাই বড় কথা। তাড়াতাড়ি করে কোনও কাজ খারাপ করতে চাই না আমি। কত সুতো আসছে। আমি সেগুলোকে ঠিকমতো জায়গায় স্থাপিত করি। এইভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বছরের পর বছর চলে যাচ্ছে আর আমি কালের সুতো দিয়ে এক অন্তহীন শৃঙখল বুনে চলেছি। 

প্রহরী : এবার যারা আসছে তোমরা তাদের চিনতে পারবে না। তাদের নাম কোথাও শোনোনি ও পড়নি। তাদের দেখতে আপাতদৃষ্টিতে এমন ভালো যে দেখার সঙ্গে সঙ্গে সাদর অভ্যর্থনা না জানিয়ে পারবে না। তারা হচ্ছে রিপুর দল। সুন্দরী তরুণী। কিন্তু আলাপ-পরিচয় করলেই বুঝতে পারবে তাদের চরিত্র কেমন সাপের মতো কুটিল। তবে তারা ঘৃণ্য হলেও একটা গুণ আছে। আজ এই আনন্দের দিনেও অন্যান্যদের মতো তারা কোনও আনন্দ-উল্লাস বা যশ-মান চায় না। তারা শুধু দুঃখ চায়। 

অ্যালেকটো : আমাদের বিশ্বাস করতে পারো তোমরা। আমরা সুন্দরী তরুণী। তোমাদের মধ্যে যদি কেউ প্রেম করে আঘাত পাও তাহলে তার কানে আমরা এমন মন্ত্র দেব যাতে যে বলতে বাধ্য হবে তার প্রেমিকা একটা বাজে মেয়ে। আমার প্রেমিকাদের মনকেও আমরা বিষিয়ে দিতে পারি। এই তো এক হপ্তা আগে একজন প্রেমিক স্পষ্ট বলল, তার প্রেমিকা একটা ঘৃণ্য জীব। এইভাবে তাদের মধ্যে এনে দিই বিচ্ছেদ আর বিতৃষ্ণা। জোড়াতালি দিয়ে মিলন হলেও ঝগড়া লেগেই আছে। 

থেগ্নেরা : বিবাহের বন্ধনে প্রেমিকারা একবার আবদ্ধ হলেই আমি চলে যাই সেখানে। খেয়ালী মানুষের মনকে করে তুলি আরও খামখেয়ালী। সে তখন ভালোকে ছেড়ে আরও ভালো চায়। সূর্যের আলো আর তাপ ছেড়ে তুষারকে কামনা করে। এইভাবে সুখ ছেড়ে দুঃখকে ডেকে আনে জীবনে। এইভাবে আমি ক্ষতি ও ধ্বংসসাধন করে চলি মানুষের মধ্যে।

টিসফোনে : বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি বিধান করাই হলো আমার কাজ। আমার একমাত্র কথা হলো প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসা। আমার হাতে কোনও ক্ষমা নেই। আমি তাদের পানপত্রে বিষ ঢেলে মৃত্যু ও ধ্বংস ঘটাই। 

প্রহরী : এখন দয়া করে সরে দাঁড়াও। এখন যারা আসছে তাদের সঙ্গে তোমাদের কোনও মিল নেই। একটা পাহাড়ের মতো জন্তু এগিয়ে আসছে জনতার মধ্যে। জন্তুটার মুখে সাপের মতো একটা গঁড়। তার পিঠের উপর একটা শীর্ণকায় মেয়ে বসে আছে। সেই মেয়েটার পিছনে এক সুদর্শন যুবাপুরুষ দাঁড়িয়ে আছে আর দুদিকে আছে দুটি মেয়ে। একটা বিমুখ আর একটা হর্ষোফুল্ল। একজন স্বাধীনতা চায় আর অন্যজন নিজেকে স্বাধীন মনে করে। 

ভয় : যদিও এই উৎসব-রজনীতে চারদিকে ধূমায়িত মশাল আর বাতি জ্বলছে, যদিও উল্লাসে মত্ত দেখছি প্রতিটি মুখ তথাপি আজ এক অচ্ছেদ্য কঠিন বন্ধনে আবদ্ধ। তোমরা সবাই এখন হাস্যস্পদভাবে আনন্দোন্মত্ত। কিন্তু বুঝছ না, তোমাদের প্রত্যেকেরই শত্রু আছে, নির্মম শত্রু ওৎ পেতে বসে আছে প্রত্যেকের জন্য। এখানে আমরা শত্রু-মিত্র সবাই সমান। সবাই আমার ক্ষতি করার জন্য ব্যস্ত। তবু আমি মুখোশের অন্তরালে প্রত্যেকের আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারি। একজন আমায় হত্যা করতে চেয়েছিল। আমি বুঝতে পারায় সে এখন পালিয়ে গেছে। আমি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত যেদিকে পাই ঘুরে বেড়াই। তবে আমার মন থেকে ভয় আর যায় না। 

আশা : হে আমার প্রিয় ভগিনীগণ, আমার অভিবাদন গ্রহণ করো। তোমরা এই নৃত্যানুষ্ঠানে যোগদান করলেও জানি তোমরা শুধু ভাবছ ভবিষ্যতের কথা। আমরা কিন্তু আজকের এই আলোকোজ্জ্বল উৎসব রাত্রিতে আমাদের আকাক্ষিত আনন্দ না পেলেও আশা ছাড়ি না। ভবিষ্যতে একদিন সে আনন্দ পাবই। জীবনে কোনও দুঃখই আমাদের হত্যোদ্যম করতে পারে না। আমরা শুধু আরো কিছু ভালোর জন্য সংগ্রাম করি, চেষ্টা করি। শ্রম আর বিশ্রামের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছে আমাদের কর্মব্যস্ত জীবন। আমাদের কাম্য ধন আজ না পেলেও জীবনের একদিন পাবই। 

বিজ্ঞতা : এই ভয় আর আশা হলো মানবজীবনের দুটি সবচেয়ে বড় শত্রু। আমি হচ্ছি তাদের প্রভু এবং তাদের একসূত্রে বেঁধে রাখি। আমি অনেকের জীবন চালনা করি। তাদের ধাপে ধাপে সৌভাগ্যের উচ্চ শিখরে নিয়ে যাই। সেখানে উজ্জ্বল এক জ্যোতির্মণ্ডলে পরিবৃত হয়ে জয়ের দেবী বসে আছেন। 

শয়তান : তোমরা সবাই খারাপ। কোথায় জয়ের দেবী? সে ভেবেছে তার তুষারশুভ্র পাখা দিয়ে সারা পৃথিবী উড়ে বেড়াবে। ভেবেছে সব লোক তার দাস। কিন্তু যেখানে যে কোনও লোক লাভ করে খ্যাতি বা জয়ের গৌরব, আমি সেখানে ছুটে যাই। ছোটকে নিচু থেকে তোলা ও বড়কে উঁচু থেকে নামানোই আমার কাজ। বাঁকাকে সোজা ও সোজাকে বাঁকা করেই আনন্দ পাই আমি। 

প্রহরী : হীন পথকুকুর কোথাকার! তোমাকে শায়েস্তা করছি দাঁড়াও। এই যে ডিমের মতো যে জিনিস গড়িয়ে যাচ্ছে টেবিল-এর থেকে, দুটো বাঁদরের মতো জীব বার হয়ে তোমাকে ঘায়েল করবে। 

জনতা : চলে এস, এ নাচের আসরে থেকে আর লাভ নেই। যত ভূত এসে মাটি করে দিলে উৎসবটাকে। কি যেন আমার চুলের পাশ দিয়ে চলে গেল। কি যেন আমার পায়ের পাশ দিয়ে চলে গেল। আমি তাতে আঘাত না পেলেও দারুণ ভয় পেয়ে গেছি। 

প্রহরী : যেহেতু আমি প্রহরী, এই আসরের শাস্তি অক্ষুণ্ণ রাখাই কাজ, আমি তাই অতন্দ্র দৃষ্টিতে লক্ষ্য রাখছি যাতে কোনও শয়তান এই আনন্দানুষ্ঠানে প্রবেশ করে তোমাদের সব উল্লাস নষ্ট করে না দেয়। যদিও আমি ভয় করি না কোনও কিছুতেই, তবু আমার মনে হয় কোনও ভূতুড়ে বস্তু প্রবেশ করেছে আমার তীক্ষ্ণদৃষ্টির সতর্কতা সত্ত্বেও। প্রথমে বামনের মতো এক জীব ঢোকে। পরে একটা বিরাট দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তোমরা দেখো কিছু বুঝতে পার কি না। চার-ঘোড়ায়। টানা এক আশ্চর্য রথে চেপে বালক আসছে। সে-রথের চারদিকে বিচিত্র বর্ণের নক্ষত্র কিরণ দিচ্ছে। সেগুলো ঠিক ম্যাজিক লণ্ঠনের মতো দেখাচ্ছে। এত শব্দ হচ্ছে সে রথের, অথচ জনতারা কেউ তা শুনতে পাচ্ছে না।

বালক সারথি : হে অশ্বগণ, থামো। আমার আদেশ, তোমাদের গতিবেগ সংযত করো। বল্পার নির্দেশ মেনে চলো। আমি নির্দেশ দিলেই আবার যাত্রা শুরু করবে। শোনো প্রহরী, তুমি এসে বলে দাও, এখানে খ্যাতিমান গৌরবময় কে কে আছে। 

আমি তাদের নিয়ে যেতে এসেছি। 

প্রহরী : না, তা পারি না; কারণ তোমার নাম আমি জানি না।

বালক সারথি : তবু চেষ্টা করে দেখো।

প্রহরী : আপাতদৃষ্টিতে তোমাকে দেখে সুন্দর এক তরুণ যুবক বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু আসলে অর্ধপরিণত এক যুবক, এখনও নারীসুলভ স্বভাব ঘোচেনি তোমার। মনে হচ্ছে চপলমতি এক চটুল প্রেমিক যে তার পুরনো প্রেমিকার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে নূতন একজনের সন্ধান করছে। 

বালক : বলে যাও, খুব ভালো লাগছে। এ রহস্যের সমাধান তুমিই করবে। 

প্রহরী : তোমার ভ্রমরকৃষ্ণ চোখে বিদ্যুতের ঝলক। মাথায় নারীসুলভ কেশপাশে কুষ্ণাভ দীপ্তি। তোমার আজানুলম্বিত পোশাকে বিচিত্র ফুলের কারুকার্য। তোমাকে দেখে কোনও কুমারী মেয়ের মতো মনে হয়। যদিও অবশ্য কোনও মেয়ের পাল্লায় পড়লে সে তোমাকে সমুচিত শিক্ষা দেবে। 

বালক সারথি : আর যে জ্যোতির্ময় পুরুষ রথোপরি সিংহাসনে উপবিষ্ট আছেন? 

প্রহরী : ওকে দেখে মেনে হবে স্বর্গলোকের রাজা। ওঁর কৃপা যারা লাভ করতে পেরেছে তারা সত্যই ভাগ্যবান। তাঁর যেন পাবার বা চাইবার কিছুই নেই। তিনি পরম পূর্ণ পুরুষ। তাদের চোখ সামান্য পলকপাতে সব অভাব সব অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে যায়। এক পরম পাওয়ার উল্লাস সব চাওয়ার আর্তিকে ভুলিয়ে দেয়। 

বালক সারথি : সব কথা বলতে সাহস করছ না। আমি বলছি পরিপূর্ণভাবে তাঁর রূপ বর্ণনা করো। 

প্রহরী : আমি শুধু তার মর্যাদা ও মহিমার কথা বলিনি। মাথায় পাগড়ির নিচে উজ্জ্বল দুটি গণ্ডসমন্বিত মুখে পূর্ণচন্দ্রের প্রভা বিরাজ করছে। তার উপর তার পোশাকের ঔজ্জ্বল্য। কি বর্ণনা করব। নিশ্চয় তিনি কোনও রাজাধিরাজ। 

বালক সারথি : উনি হচ্ছেন স্বর্ণ ও সম্পদের দেবতা প্লুটাস। সম্রাটের অনুরোধক্রমে উনি এসেছেন আপন মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়ে। 

প্রহরী : এ বিষয়ে যা জান বলো আমায়। 

বালক সারথি : আমি হচ্ছি আবেগ, আমি হচ্ছি কাব্য। আমি হচ্ছি কবি যে পার্থিব কোনও সম্পদ গ্রাহ্য করে না। অথচ যার অন্তর সব সময় আপন অপরিমেয় সম্পদে পরিপূর্ণ। পুটাসের মতো আমিও সমমর্যাদাসম্পন্ন। আমি আমার কাব্যকলার দ্বারা তাঁর ভোজসভাকে অলঙ্কৃত করি। তাঁর সব অভাব পূরণ করি। 

প্রহরী : মুখে শুধু বড়াই করলে হবে না। তোমার কাব্যকলার প্রত্যক্ষ পরিচয় দাও। 

বালক সারথি : (হাতের আঙুল নেড়ে) এই দেখো, আমি আমার আঙুলগুলো নাড়ছি, আর কত রকমের রঙিন আলো বেরিয়ে আসছে। কত মণিমুক্তাখচিত অঙ্গুরীয় আর অবতংস ঝরে পড়ছে আমার আঙুল থেকে। এইভাবে আলোকপাত ছড়িয়ে দিতে পারি প্রয়োজন হলে। 

প্রহরী : জনতা কত ব্যাকুলভাবে এই সব মনিমুক্তো পাবার জন্য চেষ্টা করছে। তারা দাতার চারদিকে ভিড় করে ব্যথভাবে প্রতীক্ষা করছে। স্বপ্নদৃষ্ট অলীক বস্তুর মতো তারা ঐ সব ধরার চেষ্টা করছে। কিন্তু পারছে না। এই সব মণিমুক্তো ধরতে না ধরতে তাদের হাত থেকে উড়ে যাচ্ছে মণিমুক্তে যেন রঙিন প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াচ্ছে তাদের চারপাশে। 

বালক সারথি : তুমি তোমার কাজ করো। দেখে মনে হচ্ছে তুমি মোগ্য ব্যক্তি। কিন্তু আমি ঝগড়া করতে চাই না। আমার প্রধানের কাছে যা বলার বলো। (পুটাসের প্রতি) বলো সে স্বর্গদেবতা, তুমি কি আমার উপর বিশ্বাস রেখে এই রথচালনা ও রথাশ্বের গতিবেগ নিয়ন্ত্রিত করার ভার দাওনি? তোমার কথামতোই আমি থেমেছি। আমি যে যুদ্ধে তোমাকে সাহায্য করেছি সে যুদ্ধে সহজ হয়েছে তোমার জয়। আমি অলঙ্কৃত করে তুলেছি তোমার জয়ের মালাকে। 

প্লুটাস : সাক্ষ্য প্রদানের প্রয়োজন হলে আমি সানন্দে বলব তুমি হচ্ছ আমার আত্মার আত্মীয়। তোমার কলানৈপূণ্য সত্যিই বড় অদ্ভুত। তোমার কাব্যকলার। খাতিরেই আমি আমার স্বর্ণমুকুটের থেকে সবুজ বৃক্ষশাখাকে বড় মনে করি। সকলের কাছে আমি জোর গলায় শুধু একটা কথাই বলতে চাই, আমি তোমার সাহচর্যে বিশেষ আনন্দ পাই। 

বালক সারথি : মণিমুক্তাসদৃশ যে সম্পদ আমি আমার চারদিকে ছড়িয়ে দিয়েছি তা হচ্ছে আমার শুধু উজ্জ্বল কথার ফুলঝুরি। কিন্তু তার উজ্জ্বলতা কত ক্ষণস্থায়ী। সে আলো অনেকের চোখে ধরা পড়তে না পড়তেই আঁধারে পরিণত হয়। 

নারীদের কথাবার্তা

রথের উপর যে লোকটাকে দেখা যাচ্ছে তার পিছনে ভাঁড়ের মতো যে লোকটা রয়েছে তাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় সে কৃশকায় হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে তার গায়ে হাড়ের উপর শুধু চামড়া ঢাকা আছে, মাংস নেই। 

অর্থলোভ : হে নারীগণ, তোরা বড় বিতৃষ্ণাজনক। আমি যেখানেই যাই তোমরাও সেখানেও যাও। আমি যে মিতব্যয়িতাকে ভালোবাসি তোমরা সেটাকে দোষ ভাবো। টাকার থেকে তোমাদের কামনা-বাসনার পরিমাণ বেশি। তোমরা তোমাদের দেহ ও প্রেমিকদের পিছনে অযথা টাকা খরচ করে তোমাদের স্বামীদের ঋণগ্রস্ত করে তোলে। খাদ্য ও পানীয় তোমাদের কাছে বিলাসিতা।

নারীদের নেত্রী : ড্রাগনের মতোই ভয়ঙ্কর। জনতাকে অনুপ্রাণিত করতে এসে যত গোলমাল বাধাচ্ছে। 

নারী জনতা : ওরে রথের উপর থেকে নামিয়ে দাও। ও ভেবেছে ওর কুৎসিত মুখ দেখে আমরা ভয় পাব। ওর লম্বা লম্বা কথার জন্য ওকে দুঃখভোগ করতে হবে।

প্রহরী : আমি আমার এই যাদুকাঠি ছুঁয়ে বলছি, সব স্থির হয়ে থাকো। কেউ নড়বে না। আমার সাহায্যের অবশ্য কোনও দরকার নেই। দেখো দেখো কেমন করে। সর্পাকৃতি ড্রাগনগুলো গলায় জ্বলন্ত আগুন নিয়ে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে। ওদের জন্য জনতার অনেকেই চলে গেছে। এখন ঘর ফাঁকা। 

(প্লুটাস রথ থেকে নেমে এলেন)।

প্রহরী : যেমন রাজার মতো উনি রথ হতে নেমে আসছেন। ওঁর সামান্য অঙ্গুলি হেলনে ড্রাগনগুলো সরে যাচ্ছে। এবার ওঁর পায়ের কাছে যে সোনাভর্তি সিন্দুকটা রয়েছে সেটা নিয়ে এস। সোনার সঙ্গে সঙ্গে অর্থলোভও বেড়ে যাবে। 

প্লুটাস : (সারথিকে) তুমি এবার তোমার উপর একান্তভাবে ন্যস্ত বোঝাভার হতে মুক্ত। এখন তুমি তোমার আপন জগতে ফিরে যাও। এখানে যতসব বিকৃত জীবনের ছবি ভিড় করে আসছে চারদিকে। এমন কোনও নির্জন স্থানে চলে যাও তুমি যেখানে সৌন্দর্য এবং সততা অবাধে কাজ করে যায়। সেখানে গিয়ে তুমি তোমার নূতন জগৎ গড়ে তোলো। নূতন জীবন শুরু করো। 

বালক সারথি : তাহলে আমার দৌত্যকার্যে আমি সফল হয়েছি। আমি আপনাকে আপন আত্মীয় ভাবতে ভালোবাসি। আপনি যেখানেই যান চারদিকে সম্পদের প্রাচুর্যে। ভরে যায়। আর আমি যেখানে যাই সেখানে আমাদের দুজনের মধ্যে মানুষ কাকে বেছে নেবে তাই নিয়ে সংশয়ের দোলায় দুলতে থাকে। আপনার না আমার কার কৃপা লাভ করবে তা ঠিক করতে না পারায় অসঙ্গতিতে ভরে ওঠে তাদের জীবন। আপনার অনুসরণকারীরা সাধারণত অলস হয় আর আমার অনুসরণকারী কর্মঠ হয়। আমি যা করি প্রকাশ্যেই করি। আমার কিছু গোপন থাকে না, কোনও কথা অব্যক্ত থাকে না। আপনি আমার যথেষ্ট সুখ ও সম্পদ দান করেছেন। আবার ডাকলেই আসব। এখন চলি। (প্রস্থান) 

প্লুটাস : এবার সিন্দুকটা থেকে মূল্যবান ধাতুটাকে বার করতে হবে। প্রহরীর যাদুকাঠি দিয়ে সিন্দুকের তলায় আঘাত করলেই মুখটা খুলে যাবে। দেখো, দেখো, একটা লোহার কেটলিতে যেন গলন্ত সোনা জলের মতো ফুটছে, আর মুকুট আংটি প্রভৃতি যত সব অলঙ্কার ও মণি-মাণিক্য তাতে সব গলে যাচ্ছে। 

জনতার চিৎকার : দেখো দেখো, সোনাগুলো সব গলে গিয়ে সিন্দুকটা উপরে পড়ছে। সব ফুটছে। সোনা-টাকা সব। আমাদের অন্তর লাফাচ্ছে। আমাদের কামনা বাসনাগুলো সব যেন ঘুরপাক খেতে খেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে ধুলোয়। একটু থামো, ঠাণ্ডা হোক। সবাই পাবে। ধনী হয়ে যাবে। সিন্দুক খালি করে আমরা সব নিয়ে নেব। 

প্রহরী : যতসব বোকা কোথাকার! কি ভাবছ তোমরা? তোমাদের কামনা বাসনাকে আজ সংযত করো। এ হচ্ছে উৎসবের মজা, এক বিভ্রান্তিকর মায়ার ছলনা। ভেবেছ এই সব সোনা তোমাদের দেব? এ হচ্ছে এক মজার ঠাট্টা। একটু পরে বুঝবে নগ্ন সত্য কাকে বলে। তোমাদের কাছে সত্যের কীই বা দাম আছে? যত সব মায়া চারদিকে ঘিরে আছে তোমাদের। হে মুখোশধারী স্বর্ণদেবতা প্লুটাস, আত্মপ্রকাশ করে এই জনতাকে অপসারিত করো। 

প্লুটাস : তোমার যাদুকাঠিটাই এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি সক্ষম। একবার দাও জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়ে নিই। দেখছ তোমরা। কাঠিটা কেমন গরম আগুন হয়ে উঠেছে। যে আমার কাছে আসছে তাকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে মারব। এবার আমি এই যাদুকাঠি নিয়ে চারদিকে ঘুরে বেড়াব।

জনতার চিৎকার : হায়, হায়! আমরা গেলাম। কোনও পরিত্রাণ নেই। পালাও পালাও। সরে যাও, পথ করে দাও। আমার চোখে আগুনের স্ফুলিঙ্গ লাগছে জ্বলন্ত যাদুকাঠিটা আমার ঘাড়ের ওপর পড়েছে। নির্বোধ জনতা পালাও। আমার পাখা থাকলে আমি উড়ে যেতাম। 

প্লুটাস : আগুনের ভয়ে সব পালিয়ে গেছে। কেউ অবশ্য পোড়েনি। আর শান্তি শৃঙ্খলার জন্য একটি অদৃশ্য অংশ আমি বার করছি। 

প্রহরী : আজ রাত্রিতে আপনি খুব একটা বড় কাজ করেছেন। আপনার জ্ঞান ও শক্তিমত্তার জন্য ধন্যবাদ। 

প্লুটাস :ধৈর্য ধারণ করো বন্ধু। এখনও অনেক গোলমাল বাকি আছে। 

অর্থলোভ : জনতার সামনে আছে নারীরা। আমার ইন্দ্রিয়চেতনা এখনও মরচেপড়া লোহার মতো ভোতা হয়ে যায়নি। সুন্দরী নারী আজও মোহ জাগায় আমার মনে। যেহেতু আজ কোনও টাকা-পয়সা লাগবে না, আজ আমি যে কোন নারীকে প্রেম নিবেদন করতে পারি। কিন্তু এই ভিড়ের মাঝে কেউ কারও কথা শুনতে পাবে না। তাই আমাকে মূকাভিনয়ের মাধ্যমে আমার কথা ব্যক্ত করতে হবে। শুধু অঙ্গভঙ্গির দ্বারা কাজ হবে না। আমাকে আর এক কৌশল অবলম্বন করতে হবে। কাদার মতো একতাল গলা। সোনা আমি নিয়ে নেব, পরে ইচ্ছামতো সেটাকে যে কোনও রূপ দান করব। 

প্রহরী : ঐ নির্বোধ অনশনক্লিষ্ট শীর্ণকায় লোকটা আবার কি মজা করছে? সে একতাল নরম সোনা দিয়ে সেটাকে ঘাঁটতে ঘাঁটতে মেয়েদের দিকে যাচ্ছে। আর মেয়েরা চিৎকার করতে করতে ছুটে পালাচ্ছে। মেয়েরা ঘৃণায় মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে তবু বোকাটা থামছে না। সকলের শালীনতা নষ্ট করেই যেন ও আনন্দ পাচ্ছে। আমি আর চুপ করে থাকতে পারছি না। আমার যাদুকাঠিটাও দাও, এর প্রতিবিধান করতে হবে। 

প্লুটাস : ওকে এখন একা থাকতে দাও, বহিরাগত বিপদের আভাস এখনও পায়নি ওর নির্বুদ্ধিতার কাল শেষ হয়ে আসছে। আইনের অমোঘ বিধান ওকে মানতেই হবে। 

গোলমাল ও গান : হে তুষারঝড়, দূর পর্বতশৃঙ্গ ও অরণ্যাচ্ছাদিত উপত্যকাপ্রদেশ হতে দুর্বার বেগে ছুটে এসে প্রমত্ত গর্জনে। ছুটে এসে নির্মম নিয়তির মতো। অবাধে প্রদর্শন করো তোমাদের অতিপ্রাকৃত শক্তির লীলা। তোমাদের গতিপথ কেউ নির্ণয় করতে পারে না আগে হতে। 

প্লুটাস : আমি তোমাদের ও তোমাদের অতিপ্রাকৃত দেবতা পানকে চিনি। তোমাদের যথাকর্তব্য পালন করেছ। এখানে আরও অনেক বিস্ময়কর জিনিস ঘটার আছে। কিন্তু জনতা যে যেদিকে পেরেছে পালিয়ে গেছে। কারণ তাদের দূরদৃষ্টি নেই। সামনে কি আছে দেখতে জানে না। 

গান

জনতা এমনিই হয়। এমন অপরিণামদর্শিতার সঙ্গে তারা আসে আর যায়। ঝড়ের বেগে আসে। ঝড়ের বেগে চলে যায়। 

গ্রাম্য দেবদেবী : হে গ্রাম্য দেবদেবীরা, তোমরা মাথায় ওক পাতার মুকুট পরে জোড়ায় জোড়ায় নাচতে এস। তোমাদের মোটা নাক, চওড়া ও থ্যাবড়া মুখ মেয়েদের খুব একটা অপছন্দ হবে না। 

হাস্যরস : এই দেখো হাস্যরসের পিছনে ছাগলের মতো সরু সরু পা নিয়ে কারা আসছে। তারা পাহাড়ের উপরে একা একা থাকতে ভালোবাসে। ঘরসংসার বা ছেলে পরিবার ভালোবাসে না। তারা বলে তারাই একমাত্র পূতচরিত্র ঊধ্বজগতের মানুষ, সবকিছু থেকে মুক্ত। 

মাটির দেবতা : জোনাকির ঝাঁকের মতো লণ্ঠন হাতে ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ আসছে। চারদিকে এখানে-সেখানে ভিড় করছে তারা কিন্তু জোড়া জোড়া নেই। সব একা একা আপন স্বার্থের তাড়নায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমরা কিন্তু একমাত্র ভালো বা সৎ মানুষের বন্ধু। পাহাড়ের পাথর থেকে আমরা মূল্যবান ধাতু বার করি। আমাদের ভাণ্ডারেই আছে সেই সোনার খনি যার জন্য লুণ্ঠন মারামারি ও কাড়াকাড়ি করে যে লোহার দ্বারা নির্মিত অস্ত্র নিয়ে পৃথিবীর মানুষ খুনোখুনি করে সেই লোহাও আমাদের ভাণ্ডারেই আছে। আমাদের ধৈর্য অসাধারণ। মানুষের অসদাচরণে আমরা কখনও ধৈর্য হারাই না। 

দৈত্যগণ : ওরা হচ্ছে অরণ্যচারী দৈত্যাকার মানুষ। হাতে ফারগাছের গুঁড়ি নিয়ে আসছে। পরণে শুধু গাছের পাতা। 

জলপরীদের কোরাস : (প্যানের চারদিকে ভিড় করে) আমরা জানি পৃথিবীর যে অংশ প্রকৃতির দেবতা শক্তিশালী প্যানের অধীনে তার পরিমাণ বিশাল। তোমাদের মধ্যে যারা নৃত্যপটু তারা তাঁর কাছে গিয়ে সর্বশ্রেষ্ঠ নৃত্যকলা প্রদর্শন করো। তিনি দয়ালু, তিনি চান আমরা সকলে মিলে হাসিখুশির সঙ্গে বাস করি মুক্ত আকাশের তলে। তিনি সব সময় অতন্দ্র দৃষ্টিতে জেগে থাকেন স্থির হয়ে। অথচ তাঁরই নির্দেশে নদী অন্তহীন কলতানে তাকে গান শোনায়। গাছে গাছে পাতার মর্মরধ্বনি ওঠে, বাতাসে ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়ায়। পরীরা তাঁর কাছে যেতে সাহস পায় না। কিন্তু তিনি মাঝে মাঝে যখন বজ্রগর্জনে চিৎকার করে ওঠেন তখন চারদিকে সবাই ভয়ে পালিয়ে যায়। বীরপুরুষেরাও ভয়ে কাঁপতে থাকে। 

মাটির দেবতাদের প্রতিনিধিবৃন্দ : (প্যানের কাছে) যখন তুমি যত সব উজ্জ্বল রত্নসম্ভার ও সম্পদরাশি মানুষের মধ্যে ভাগ করে দাও, কিন্তু তখন অন্ধকার গুহার মধ্যে সকলের অলক্ষে অগোচরে বাস করি। কিন্তু আমাদের কথা বিশ্বাস করো, এখানে এক আশ্চর্য ঝর্নাধারা বয়ে চলেছে। এই ঝর্নাই আমাদের দেবে আমাদের আকাক্ষিত বস্তু। কিন্তু তাতে চাই তোমার সক্রিয় সাহায্য। মায়ার আবরণ স্থির করে সে সম্পদ করায়ত্ত করো ও বিশ্বের সকলের উপকার সাধন করো। 

প্লুটাস (প্রহরীকে) : সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। অপ্রত্যাশিত হলেও যা ঘটার ঘটুক। তোমার সাহস আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে যে ভয়াবহ বস্তু দেখবে তা বিশ্বে কেউ কখনও দেখেনি এর আগে। এর বিবরণ ঠিকমতো লিখে রাখবে।

প্রহরী : (প্লুটাসধৃত যাদুকাঠিটি ধরে) বামনাকৃতি মাটির দেবতারা প্রকৃতিদেবতা প্যানকে সঙ্গে করে এই মায়াময় ঝর্নার ধারে নিয়ে যাচ্ছে। তার উপরটা অন্ধকার দেখাচ্ছে। কানায় কানায় ঝরা ঝর্নার জলটা ফুটছে। তার থেকে বুদ্বুদ উঠছে। ফেনা ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। প্যান প্রফুল্লচিত্তে সেই ঝর্নার ধারে দাঁড়িয়ে সেটা ভালো করে দেখার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তিনি যেমন ঝুঁকে পড়ে ঝর্নার জলধারা দেখতে গেলেন। অমনি হঠাৎ তাঁর দাড়িটা থুতনি থেকে খসে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তার মাথা বুক ও গলার মাথায় আগুন ধরে। এইভাবে আনন্দানুষ্ঠান মাটি হয়ে গেল। সবাই তখন সে আগুন নেভাবার জন্য চেষ্টা করতে লাগল। কিন্তু কেউ তা পারল না। মুখোশধারী সব। লোকের মুখে আগুন ধরে গেল। এইভাবে আগুন ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। কিন্তু শোনো। শোনো, কি এক দুঃসংবাদ লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের দুঃখবৃদ্ধিকারী সেই ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা আগামীকাল জানতে পারবে। সর্বত্র শুনছি এক কথা, আমাদের সম্রাট নিদারুণ যন্ত্রণায় ভুগছেন। তাঁরা মাথা ও বুক অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। ঈশ্বর করুক এ সংবাদ যেন মিথ্যা হয়। যারা তাঁকে ভুল পথে নিয়ে গিয়েছে তারা জাহান্নামে যাক। হে উদ্দাম উদ্ধত যৌবন, তুমি কি এই দুঃখের দিনেও তোমার আনন্দের উচ্ছলতা বন্ধ করবে না, সীমায়িত করবে না? আমাদের প্রিয় সর্বশক্তিমান সম্রাট, তুমি কি আমার স্বভাবসিদ্ধ বিজ্ঞতা সহকারে আমাদের পরিচালিত করবে না? এক সর্বগ্রাসী দাবানলে দগ্ধ হচ্ছে সমস্ত বনভূমি। আগুনের লেলিহান শিখাগুলো তাদের লোহজিহ্বা ঊর্ধ্বে তুলে দিয়ে দাহ্য বস্তুর সন্ধান করেছে। আমাদের দুঃখের পাত্র পরিপ্লাবিত, কে জানে কে আমাদের উদ্ধার করবে? আজকের এই রাজকীয় ঐশ্বর্যের পুঞ্জীভূত অহঙ্কার রাত্রি রেশে একরাশ ভস্মতূপে পরিণত হয়ে পড়ে থাকবে। 

প্লুটাস : যথেষ্ট সন্ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছে। এবার সাহায্য দাও ওদের। তোমার জ্যোতির্ময় যাদুকাঠিটি দিয়ে আঘাত করে তোমার পদতলের মাটি কম্পিত করো। হে বাতাস, শীতল কুয়াশার জাল বিস্তার করে এই ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড নির্বাপিত করো। মেঘ হলে জল বর্ষণ করো অগ্নিকাণ্ডের উপর। হে আর্দ্রতা, অগ্নি লেলিহান শিখাকে প্রশমিত করে গ্রীষ্মের ক্ষয়-ক্ষতিহীন নির্দোষ বিদ্যুতালোকে পরিণত করো। মনে মনে সব মানুষ যখন জব্দ তখন এবার আসল যাদুর খেলা দেখাও। আগুনের খেলা শেষ করো। 

চতুর্থ দৃশ্য

প্রমোদ উদ্যান 

প্রভাত সূর্য

সম্রাটের দরবার। সভাসদগণ পরিবৃত্ত সিংহাসনে উপবিষ্ট সম্রাটের সম্মুখে ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিস নতজানু অবস্থায় উপবিষ্ট। 

ফাউস্ট : হে মহারাজ, আগুন নিয়ে এই খেলার মারাত্মক অপরাধ মার্জনা করুন। 

সম্রাট : (ফাউস্টকে উঠে দাঁড়াবার আদেশ দিয়ে) আমি এই খেলা আরও দেখতে চাই। আমি তার মাঝে হঠাৎ গিয়ে পড়েছিলাম। মনে হচ্ছিল আমি যেন পুটোর মতো জলন্ত নরকাগ্নির মাঝে দাঁড়িয়ে আছি। চারদিকে আগুন। আগুনের লেলিহান শিখাগুলো আকাশকে লেহন করতে চাইছিল। সেই আগুনের আলোয় দেখলাম অন্ধকারে অসংখ্য মানুষ প্রতিকারের আশায় আমার কাছে এসে ভিড় করছে। আমাকে প্রথামতো অভিবাদন করছে। তাদের মধ্যে অনেক রাজকুমার ছিলেন। আমি তাদের চিনতে পেরেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : আপনি প্রকৃতির সকল বস্তুরই রাজা। প্রকৃতির প্রতিটি প্রধান উপাদানও আপনার ইচ্ছ ও বিধান মেনে চলে। অগ্নির আনুগত্যের প্রমাণ এইমাত্র পাওয়া গেছে। এবার দেখবেন বিক্ষুব্ধ সমুদ্রের আনুগত্য। আপনি সমুদ্রের জলরাশির উপর পা রাখতেই দেখবেন জলের এক বিশাল গোলাকৃতি প্রাসাদ গড়ে উঠবে আপনার মাথার উপর। জলের স্তম্ভ ও প্রাচীর দ্বারা নির্মিত এই প্রাসাদের মধ্যে সুবর্ণ অস্ত্র ধারণ করে ড্রাগন ও হাঙরেরা ভেসে বেড়াচ্ছে। আপনি এই রাজদরবার যতই ভালোবাসুন সেই সামুদ্রিক রাজপ্রাসাদ দেখে বিস্মিত হয়ে যাবেন। সেখানে কত সুন্দরী জলপরী আপনার অন্তরকে প্রীত করার জন্য আসছে। আসবে তাদের প্রাধানা জলদেবী থেটিস। সে আপনাকে দ্বিতীয় পেলেউস হিসাবে বরণ করে নেবে। একদিন এইভাবে আপনি অলিম্পাসের সিংহাসনে বসতে পারেন। 

সম্রাট : আমি আপনার শূন্য বায়ুমণ্ডল তোমাকে দান করলাম। তুমি হবে তার অধিপতি। 

মেফিস্টোফেলিস : সমগ্র পৃথিবী তো আগেই আপনার অধিকারে এসেছে। 

সম্রাট : আমাদের পরম সৌভাগ্য বলে তুমি এখানে এসেছ। এই একটি রাত্রির আনন্দ হাজার রাত্রির আনন্দের সমান। তুমি যদি স্কেহেরাজাদের মতো কাহিনী বর্ণনায় ওস্তাদ হও তাহলে আমি ও তোমাকে অনেক বড় পুরস্কার ও সম্মানে ভূষিত করব। যত সব দৈনন্দিন জীবনের কথা আমার আর ভালো লাগে না। 

প্ৰধার কর্মচারী : (তাড়াতাড়ি প্রবেশ করল) হে মহারাজ, এক অপ্রত্যাশিত সুসংবাদ সানন্দে ঘোষণা করছি আপনার নিকট। আমাদের রাজা এখন সকল অর্থকষ্ট হতে মুক্ত। এখন এখানে স্বর্গসুখ বিরাজ করবে। 

প্রধান সেনাপতি : সৈন্যদের বেতন মিটিয়ে দেওয়া হয়েছে। নূতন সৈন্য নিয়োগ। করা হয়েছে। 

সম্রাট : কি ব্যাপার! তোমাদের সকলের বুক স্ফীত হয়ে উঠেছে আনন্দে। সকলেরই মুখ উজ্জ্বল। সকলেরই পায়ের গতিতে দেখছি এক প্রাণোচ্ছলতা। 

কোষাধ্যক্ষ : (প্রবেশ করে) ওঁদের জিজ্ঞাসা করুন, ওঁরাই এই সব কিছুর জন্য দায়ী। ওঁরাই এসব করেছেন। 

ফাউস্ট : প্রধান প্রশাসককে একথা জানতে হবে।

প্রধান প্রশাসক : (ব্যস্তভাবে প্রবেশ করে) অতীতে দেখেছি হঠাৎ কার ভাগ্যের পাতাটা উল্টে গিয়ে গত দুঃখ সুখে পরিণত হয়েছে। এখন দেখছি উল্টো হলো। (পড়তে লাগলো। আমার হাতে যে পত্রটি দেখছেন তার দাম হাজার স্বর্ণমুকুটের সমান। এতে আছে সম্রাটের স্বাক্ষর। সম্রাট তাঁর সাম্রাজ্যের সমস্ত গুপ্তধন উদ্ধার করার ভার একটি লোকের হাতে দিয়ে নিজে সই করেছেন। 

সম্রাট : এক বিরাট প্রতারণা। অপরাধ। কে সম্রাটের স্বাক্ষর জাল করেছে? এর কোনও শাস্তি এখনও দেওয়া হয়নি?

কোষাধক্ষ : স্মরণ করে দেখুন, আপনি গতরাত্রে আনার এই স্বাক্ষরযুক্ত পত্র দান করেন। তখন আপনি শক্তিমান প্রকৃতিদেবতারূপে দাঁড়িয়ে ছিলেন আর প্রধান প্রশাসক আপনার কাছে আবেদন জানাচ্ছিলেন। তিনি বলছিলেন, হে মহারাজ, শুধু কলমের ডগা দিয়ে কয়েকটি অক্ষর লিখে জনগণের মঙ্গল করুন। তাদের আনন্দ দান করুন। আপনি তাই একটি পত্রে স্বাক্ষর করেছিলেন আর সঙ্গে সঙ্গে সে সব চতুর যাদুকর ছিল আপনার কাছে সেই সব জাল করে হাজার হাজার কাগজের নোট ছাপিয়ে ফেলে। সেই সব নোট এখন বাজারে সর্বত্র চলছে। 

সম্রাট : টাকা বা সোনার পরিবর্তে সেই নোট এখন চলছে? যদি চলে তাহলে ব্যাপারটা বিস্ময়কর হলেও আমাকে তা মেনে নিতে হবে। 

প্রধান কর্মচারী : দাবানলের মতো সেই নোট সব জায়গায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে এবং সোনা ও রূপোর পরিবর্তে মূল্যমান হিসাবে কাজ করছে। যে কোনও দোকানে এই নোট ভাঙিয়ে টাকা বা যে কোনও জিনিস কেনা যাচ্ছে। অনেক লোক আমোদ প্রমোদ করতে শুরু করে দিয়েছেন পান ও ভোজনের মাধ্যমে।

মেফিস্টোফেলিস : নির্জন প্রাসাদশীর্ষে যদি কোনও সম্ভ্রান্ত সুন্দরী মহিলাকে প্রীত করার প্রয়োজন হয় তাহরে সেখানে আর কাউকে থলেতে করে টাকা বয়ে নিতে যেতে হবে না। এই হালকা কাগজের নোট তার হাতে ধরে দিলেই সে মেয়ে প্রীত হবে। কোনও যাজক বা সৈনিককে দূরে কোথাও যেতে হলে কোমরে বলে ভর্তি সোনারূপো বয়ে নিয়ে যেত হবে না। এই হালকা কাগজের নোট নিয়ে গেলেই যথেষ্ট। এইবার তাহলে মহারাজ বিচার করবেন আমি ভালো করেছি না মন্দ করেছি। 

ফাউস্ট : আপনার রাজ্যে এই ভুল মুদ্রাপদ্ধতির ফলে যত সব ধনরত্ন মানুষ মাটিতে গুপ্তস্থানে পুঁতে রাখত। কেউ বলতে পারত না কার কত সম্পত্তি আছে। অনেক সময় সে সম্পত্তির মালিক নিজেই তা জানত না। কিন্তু কল্পনাপ্রবণ যে মন প্রকৃতির রহস্য উদ্মাটনে ও সত্য সন্ধানে সক্ষম সে মন একদিন সব গুপ্তধনের পরিমাণও নির্ণয় করবেই। 

মেফিস্টোফেলিস : এই কাজ কাগজের নোট এত হালকা এবং বহন করা এত সহজ যে মানুষ যে কোনও জায়গায় তা বহন করে নিয়ে গিয়ে যে কোনো বস্তু ক্রয় করতে পারবে। সে তার নিজের সম্পত্তির পরিমাণ বা মূল্য সহজেই নিরূপণ করতে পারবে। তাকে আর কোনও পণ্যবস্তু কেনার সময় পণ্য বিনিময়ের ব্যাপারে দরকষাকষি করতে হবে না। এবার থেকে আপনার রাজ্যের দূর প্রান্তেও আপনি যে কোনও বস্তু বা অর্থ বা গয়নাপত্র পাঠাতে পারবেন অতি সহজে। 

সম্রাট : তুমি আমাদের রাজ্যকে অনেক সমৃদ্ধি দান করেছ। তার উপযুক্ত পুরস্কার তোমাকে দান করা উচিত। রাজ্যের সমস্ত জমির রক্ষণাবেক্ষণের ভার তোমার উপর দিলাম। তুমি তা পরীক্ষা করে যেখানে বুঝবে কোনও গুপ্তধানে আছে সেখানেই সে জায়গা খননের আদেশ দিবে। এইভাবে সব গুপ্তধন মাটির অন্ধকার থেকে প্রকাশের আলোয় নিয়ে আসবে। 

কোষাধ্যক্ষ : আমি এই যাদুকরকে আমার সঙ্গে নিলাম। আমাদের মধ্যে কোনওদিন কোনও বিবাদ দেখা দেবে না। (ফাউস্টের সঙ্গে প্রস্থান) 

সম্রাট : এই রাজসভায় উপস্থিত প্রত্যেককেই আমি কিছু করে টাকা দেব। কিন্তু প্রত্যেককেই একে এক স্বীকার করতে হবে সে কি করবে সেই টাকা দিয়ে। 

জনৈক ভৃত্য : (টাকা নিয়ে) আমি টাকা নিয়ে ভালো খাওয়া-দাওয়া করব। আনন্দ উপভোগ করব। 

দ্বিতীয় ভৃত্য : আমি আমার প্রণয়িণীর জন্য কিছু উপহার কিনব। প্রধান ভৃত্য : আরও বেশি মদ কিনে গলাধঃকরণ করব আমি। অন্য ভৃত্য : আমার মনে হচ্ছে আমার পকেটে জুয়ার পাশা নড়াচড়া করছে। নাইট ব্যানিরেট : আমার বাড়ি ও জমি ঋণবন্ধক হতে মুক্ত হবে। 

অন্য নাইট : আমার যা সম্পত্তি আছে তার উপর আরও কিছু বাড়াব। 

সম্রাট : আমি আশা করেছিলাম টাকা পেয়ে তোমরা সবাই সৎ কাজে, বড় কাজে সে টাকা ব্যয় করবে। কিন্তু এখন দেখছি এতে তোমাদের কোনও উন্নতি হবে না। যে যেখানে ছিলে সেখানেই থাকবে। 

ভাঁড় : (এগিয়ে এসে) সবাইকে টাকা দিচ্ছেন, আমাকে কিছু দিন।

সম্রাট : তুমি তো টাকা পেলেই মদ খাবে।

ভাঁড় : সবাই যাতে টাকা ঢালে আমি তাতে ঢালব না।

সম্রাট : এই নাও টাকা, কুড়িয়ে নাও। (প্রস্থান)

ভাঁড় : পাঁচ হাজার সোনার টাকা। কী অপ্রত্যাশিত।

মেফিস্টোফেলিস : আবার নূতন করে প্রাণ ফিরে পেলে।

ভাঁড় : আমার অবশ্য টাকা আছে, কিন্তু এত টাকা কখনও পাইনি এর আগে।

মেফিস্টোফেলিস : তুমি এত আনন্দ পেয়েছ যে তোমার দেহে ঘাম দিচ্ছে। 

ভাঁড় : কিন্তু দেখ তো, এই নোট দিয়ে টাকার কাজ হবে তো? জায়গা-জমি, গবাদি পশু কেনা যাবে তো? 

মেফিস্টোফেলিস : সব কিনতে পারবে। 

ভাঁড় : আজই আমি কিছু জায়গা-জমি কিনব। আমি জমিদার হয়ে বসব। (প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিস : বোকা ভাড়ের যে বুদ্ধি আছে কে তাতে সন্দেহ করবে। 

পঞ্চম দৃশ্য

কোনও এক অন্ধকার অলিন্দ 

ফাউস্ট ও মেফিস্টোফেলিস

মেফিস্টোফেলিস : এই অন্ধকার অলিন্দে আমার কাছ থেকে কি চাও তুমি? সেই জনবহুল রাজসভায় অনেক কৌতুক করে আনন্দ লাভ করেছ। 

ফাউস্ট : ওসব কথা বলো না, ওসব আনন্দ আমি চাই না। এখানে-সেখানে বৃথা ঘুরে বেড়িয়ে তুমি শুধু আমার দাবিটাকে এড়িয়ে গেছ। কিন্তু আমার মনে একটা জিনিসের জন্য শান্তি নেই। সম্রাট আদেশ দিয়েছেন হেলেন আর প্যারিসকে তাদের সেই প্রাচীন পোশাকে সজ্জিত করে এখানে হাজির করতে হবে। আমি কথা দিয়েছি আর সে শপথ ভাঙতে পারি না। 

মেফিস্টোফেলিস : ভাবনা-চিন্তা না করে এই প্রতিশ্রুতি দেওয়া তোমার উচিত হয়নি।

ফাউস্ট : তুমি তোমার ঐন্দ্রজালিক অতিপ্রাকৃত ক্ষমতা যখন প্রয়োগ করেছিলে তার পরিণামের কথা তুমি ভাবনি বন্ধু। তুমি তাদের ধনী করে তুলে সস্তায়। এখন সেই সব অলস ধনীদের আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করতে হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি ভেবেছ যেন প্রস্তুত হয়ে আছ। বলেছিলাম, তুমি খাড়াই পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছ। অনেক পাপকাজের সঙ্গে জড়িয়ে যাবে। তুমি কি ভাবছ হেলেন তোমার ডাকে ঐ সব ভূতুড়ে কাগজের নোটের মতো সাড়া দেবে? আমি কোনও নির্দেশ এ বিষয়ে দেব না। তুমি তাদের দেখতে পারে না। 

ফাউস্ট : ও সব পুরনো কথা ছেড়ে দাও। তুমি বড় হেঁয়ালি করা কথা বলো। তাতে কিছু বোঝা যায় না। পদে পদে সব কাজে তুমি বাধা দাও। তুমি বিড় বিড় করে একটি কথা বলমাত্র এই মুহূর্তে আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে হেলেন। 

মেফিস্টোফেলিস : এই সব অখ্রিস্টীয় নাস্তিকদের সঙ্গে আমারও কোনও সম্পর্ক নেই। তারা এখন নরকে বাস করছে। তবে একটা উপায় আছে। 

ফাউস্ট : দেরি না করে বলে ফেল তাড়াতাড়ি। 

মেফিস্টোফেলিস : অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি বড় রকমের একটা রহস্য উঘাটন করব। নির্জনতার নিভৃত কন্দরে দেবীরা বিরাজ করেন। তাঁদের চারদিকে স্থানকাল বলে কোনও জিনিস নেই। তাঁদের কাছে গিয়ে তোমার দুঃখের কথা বলবে। তাঁরা হলেন আদি মাতৃদেবতা। 

ফাউস্ট : (ভীত হয়ে) আদি মাতৃদেবতা।

মেফিস্টোফেলিস : তুমি ভয় পাচ্ছ? 

ফাউস্ট : মাতৃদেবতা–অদ্ভুত কথা তো! 

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ অদ্ভুত কথাই বটে। তোমার মতো মরণশীল মানুষদের কাছে এইসব দেবদেবীর অপরিচিত ও অজানিত। তাঁদের কাছে পৌঁছতে হলে অনেক গভীর ডুব দিতে হবে। তোমার দোষের জন্য তাদের কাছে গিয়ে অনুনয়-বিনয় করতে হবে। 

ফাউস্ট : তাদের কাছে যাবার পথ কোথায়? 

মেফিস্টোফেলিস : পথ নেই। তারা অগম্য, আবেদন-নিবেদনের অতীত। তুমি প্রস্তুত তো? সেখানে যাবার কোনও সহজ পথ বা অর্গল নেই। শুধু সীমাহীন নির্জনতায় তোমাকে ভাসতে হবে। জীবনে কখনও কোনও নির্জন মরুভূমিতে গিয়ে পড়েছ? 

ফাউস্ট : আমার মনে হয় এসব কথা না বলাই ভালো। এতে ঐন্দ্রজালিক প্রতারণার গন্ধ পাচ্ছি। জীবনে অনেক পার্থিব জ্ঞানের অহঙ্কারে ভুগেছি পাগলের মতো। ঘৃণা ও ছলনার দ্বারা প্রতারিত হয়ে জনমানবহীন নির্জনতার অনেক দূরে বেড়িয়েছি। একা থাকা ঠিক নয়, একাকীত্বের দুঃসহ অবকাশে আমি শয়তানের কবলে পড়ে গিয়েছি। 

মেফিস্টোফেলিস : সীমাহীন দূর সমুদ্রে কোনোদিন সাঁতার কেটেছ? আসন্ন মৃত্যুভয়ে ভীত হয়ে একের পর এক করে তরঙ্গমালার আঘাত সহ্য করেছ? সেই প্রশান্ত সমুদ্রবক্ষে অনেক মৎস্যকন্যাকে হয়ত সাঁতার কাটতে দেখেছ। ঊধ্ব আকাশে দেখেছ সূর্য চন্দ্র নক্ষত্র ও মেঘেদের আনাগোনা। কিন্তু এবার যখন শূন্যতার সাগরে সাঁতার কাটবে তখন কোনও কিছুই দেখবে না, কোনও কিছুই শুনতে পারে না, এমন কি তোমার পদশব্দও না। পা রাখার কোনও জায়গাও পাবে না। 

ফাউস্ট : তুমি এমন সব রহস্যময় দুবৃত্তের মতো কথা বলছ যারা মানুষের সকল সততার সুযোগ নিয়ে তাকে দুঃখের ফাঁদে ফেলে। আমি আমার শক্তিবৃদ্ধির জন্য শূন্যতায় পাড়ি দেব। তুমি তাই চাও। তুমি চাও আগুনের ভিতর থেকে বাদাম এনে তোমাকে খাওয়াই। ঠিক আছে। আমি তাই করব যাই ঘটুক না কেন। এতে আমার আকাঙ্ক্ষিত সব বস্তু পাব। তুমি কিছু পাও বা নাও পাও। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমাকে বিদায় জানাবার আগে তোমার প্রশংসা না করে পারছি না। আমি দেখছি তুমি শয়তানকে চিনে ফেলেছ। এই নাও চাবিকাঠি। 

ফাউস্ট : এই ছোট্ট জিনিসটা?

মেফিস্টোফেলিস : তুচ্ছ জ্ঞান না করে নিয়ে নাও।

ফাউস্ট : এটা চকচক করছে, আমার হাতে এসে যেন বড় হয়ে উঠছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এই জিনিসটার দাম কত শীঘ্রই তা বুঝতে পারবে। এই চাবিই তোমাকে আসল জায়গায় নিয়ে যাবে। একে অনুসরণ করে যাবে। এই তোমাকে মাতৃদেবতার কাছে নিয়ে যাবে। 

ফাউস্ট : কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে এখনও কেন হিমশীতল এক ভয়ের শিহরণ অনুভব করছি আমি? 

মেফিস্টোফেলিস : নূতন কথায়, কেন ভয় পাও তুমি? অনেক ঘটনার সঙ্গে আগেই তো পরিচিত হয়েছ তুমি। 

ফাউস্ট : ভয়ের এই শিহরণ মানুষের একটি বড় গুণ। আঘাতের মধ্যে দিয়ে অনেক বড় জিনিসের গভীরে নিয়ে যায় এ শিহরণ। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে নেমে পড়। উঠে পড়ও বলতে পারি। নামা-ওঠা একই ব্যাপার। বিশ্বসৃষ্টির রূপবৈচিত্র্য হতে রূপহীন চিরমুক্ত শূন্যের রাজ্যে চলে যাও যেখানে শুধু মেঘমালা ছাড়া আর কিছু নেই। তবে এই চাবিকাঠিটা ধরে রাখতে হবে।

ফাউস্ট : এটাকে ধরে আরও শক্তি পাচ্ছি দেহ-মনে। আমার বুক ফুলে উঠছে। এবার শুরু হোক আমার যাত্রা। 

মেফিস্টোফেলিস : অবশেষে এক জলন্ত তিনপায়া পদার্থ তোমাকে আলো দেখিয়ে আদি মাতৃদেবতার কাছে নিয়ে যাবে। সেখানে দেখবে রূপ, রূপান্তর, শাশ্বত মনের শাশ্বত আনন্দ। বিভিন্ন প্রাণীর অবয়ব ভেসে বেড়াচ্ছে অবাধে। কিন্তু তারা তোমার দেখতে পাবে না। তারা শুধু মৃত ব্যক্তিদের প্রেতকেই দেখতে পায়। সাহস অবলম্বন করো। তুমি এই চাবিকাঠি দিয়ে সেই তিনপায়া পদার্থটাকে স্পর্শ করবে। (ফাউস্ট চাবিটা শক্ত করে ধরে মুখের উপর দৃঢ় সংকল্প ফুটিতে তুলতে তা দেখে মেফিস্টোফেলিস খুশি হলো) ঠিক আছে। এই চাবিই তোমাকে আলোর কাছে নিয়ে যাবে। কাজ সেরে আবার ফিরে আসবে। সেই তিনপায়া পদার্থটি তোমাকে বয়ে এনে এখানে নামিয়ে দেবে। তারপর তুমি অতীতের অন্ধকার থেকে হেলেন ও প্যারিসের আত্মাকে আহ্বান করবে। এই কাজ তুইি প্রথম করবে এবং এর জন্য নির্বাচিত হয়েছ। তুমি। ঐন্দ্রজালিকভাবে শূন্যের কুয়াশা থেকে দেবদেবীর মূর্তি আবির্ভূত হবে। 

ফাউস্ট : এখন আর কি করতে হবে? 

মেফিস্টোফেলিস : এবার নিচের নিকে নামো। তারপর উপরে উঠবে। (ফাউস্ট অদৃশ্য হয়ে গেল) চাবিকাঠিটার নির্দেশ যদি মেনে চলে তাহলে আমার মনে হয় ঠিক ফিরে আসবে। 

ষষ্ঠ দৃশ্য

উজ্জ্বলভাবে আলোকিত দরবার কক্ষ 

সম্রাট ও যুবরাজ। রাজসভা চলছিল।

প্রধান ভৃত্য : (মেফিস্টোফেলিসকে) তুমি বলেছিলে প্রেতদের দৃশ্য দেখাবে। এখনও দেখাওনি। আমাদের সভাসদরা অধৈর্য হয়ে পড়েছেন। 

প্রধান কর্মচারী : সম্রাট আমাকে একটু আগে এর কথা জিজ্ঞাসা করছিলেন। আর বিলম্ব করবেন না। উনি রুষ্ট হবেন। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার সহকর্মী এই কাজের জন্য গেছে। কিভাবে কাজটা শুরু করতে হবে সে তা জানে। অতীতের বিস্মৃতির গর্ভ হতে সুন্দরকে বার করার জন্য বিরাট কলাকৌশল দরকার। মুনি-ঋষিদের কাজ।

প্রধান কর্মচারী : তোমার কি দরকার তা জানি না। সম্রাটের আদেশ, তুমি প্রস্তুত হও। 

কোনও এক সুন্দরী : (মেফিস্টোফেলিসের প্রতি) একটা কথা মশাই! আমার দেহটা সুন্দর দেখছেন তো। কিন্তু প্রতিবার গ্রীষ্মকালে আমার চেহারাটা পাল্টে যায়। লাল লাল অসংখ্য ফোঁড়া হয়ে আমার চামড়াকে নষ্ট করে দেয়। 

মেফিস্টোফেলিস : দেহের উজ্জ্বল ত্বকে দাগ–এটা সত্যি দুঃখের কথা। একটা কাজ করতে পারো। কোলাব্যাঙের বাচ্চা আর বিষাক্ত ব্যাঙের জিব সেদ্ধ করবে। পূর্ণিমার দিনে। তারপর সেই মিক্সচার গায়ে লাগাবে। পরের বসন্তকালে দেখবে গায়ে আর দাগ থাকবে না।

জনৈক সুন্দর যুবক : তোমাকে বিরক্ত করতে কতো লোক এদিকে আসছে। আমার পায়ের পাতাটা ব্যথায় তুলতে পারছি না। আমি হাঁটতে বা নাচতে পারছি না। এর একটা বিহিত করতে হবে তোমায়। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি আস্তে করে একটা লাথি মারব তোমার পায়ে। তাহলেই ঠিক হয়ে যাবে। 

যুবক : একমাত্র প্রেমিকই তার প্রেমাস্পদকে লাথি মারতে পারে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার এ লাথির দাম আছে, কারণ রোগ সারাবার জন্য এ লাথি মারছি। পা দিয়ে আঘাত করছি পায়ে। প্রতিটি অঙ্গ তার সমজাতীয় অঙ্গের আঘাত সহ্য করতে পারে। তুমি কিছু মনে করো না। 

যুবক : তোমার লাথিটা তো সাংঘাতিক। ঠিক যেন ঘোড়ার ক্ষুর। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু এতে তাড়াতাড়ি সেরে যাবে তুমি। এবার ঠিকভাবে নাচতে পারবে। টেবিলের তলা দিয়ে তোমার প্রেমিকার পায়ের উপর পা দিয়ে চাপ দিতে পারবে। 

জনৈক তরুণী : (এগিয়ে এসে আমাকে একটু যেতে দাও ওখানে। আমার বড় দুঃখ। গতকাল পর্যন্তও আমার সামান্য চোখের দৃষ্টির মধ্যে আমার প্রেমিক জগতের। সব সুখ খুঁজে পেত। কিন্তু আজ সে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয় আমার উপর থেকে। আজ সে একটি মেয়ে নিতে ফুর্তি করছে, উড়ে বেড়াচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : ব্যাপার সত্যিই গুরুতর। তবে আমার কথা শোনো। এই কয়লাটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে তার কাছে যাবে। গিয়ে শান্ত দৃষ্টিতে তার পোশাক, ঘাড় আর দস্তানার দিকে তাকাবে। সঙ্গে সঙ্গে তার অন্তর হবে অনুতপ্ত। তারপর কয়লাটা গিলে ফেলবে কোনও মদ বা জল না মিশিয়ে। দেখবে আজকের রাত্রিতেই সে তোমার দরজার সামনে এসে কাতরভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলবে। 

তরুণী : এটা বিষ নয় তো? 

মেফিস্টোফেলিস : এসব জিনিসকে শ্রদ্ধা করতে হয়, মান্য করতে হয়। এসব কয়লা সস্তায় পাওয়া যায় না। এর জন্য তোমাকে মাইলের পর মাইল হাঁটতে হবে। এ কয়লা জ্বলন্ত চিতার নেবানো আগুন থেকে বার করা। 

ভৃত্য : আমি একজনকে ভালোবাসি। কিন্তু লোকে বলে আমি অর্বাচীন। 

মেফিস্টোফেলিস : (স্বগত) জানি না, কার কথা শুনব, কার কথা না শুনব। (ভৃত্যকে) অল্প বয়সের মেয়েদের কখনও ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধতে চেষ্টা করবে না। একমাত্র প্রাপ্তবয়স্করাই তোমার মূল্য বুঝতে পারবে। (আরও লোককে আসতে দেখে) আবার লোক? মহাবিপদে পড়লাম তো। এবার আমাকে অন্য উপায় অবলম্বন করতে হবে। নগ্ন সত্যের পথ ধরতে হবে। হে আদি মাতৃদেবতারা, ফাউস্টকে অবাধে তার কাজ করতে দাও। (চারদিকে তাকিয়ে) দরকার কক্ষে মিটমিট করে আলো জ্বলছে। রাজসভায় লোকরা একে একে সমবেত হচ্ছে। বীর নাইটরা যেখানে বসে আছে। সেখানে কত রকমের উজ্জ্বল অস্ত্রশস্ত্র চকচক করছে। এখানে যাদুর আর দরকার হবে। না। আপনা হতেই প্রেতরা আসবে। 

সপ্তম দৃশ্য

স্বল্পালোকিত দরবার কক্ষ 

সম্রাট ও সভাসদবর্গের

প্রবেশ প্রহরী : আমার কাজ হচ্ছে ঘোষণা করা। কিন্তু প্রেতদের প্রভাবে আমি বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। সে প্রভাব ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলা যায় না। এখন আবার অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এ সভা। সম্রাট সামনেই বসেছেন। তারপর সভাসদ ও রাজকুমারেরা বসেছে। প্রেমিক-প্রেমিকারা বসেছে পাশাপাশি। এবার আমরা প্রস্তুত। 

(বাদ্য)

জ্যোতিষী : নাট্যানুষ্ঠান শুরু করো। সম্রাটের আদেশ। হে দেওয়ালগণ, তোমরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রসারিত হও। এবার আমরা যাদু প্রদর্শন করব। অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহ এক রহস্যময় স্বল্প আলোর দ্বারা আলোকিত হচ্ছে। এবার নাটক শুরু হবে। আমি এবার মচ্ছে যাচ্ছি। 

মেফিস্টোফেলিস : (প্রম্পটারের সামনে উঠে) আমি এই কাজেই নাম করব। শয়তানের এটাই হলো কাজ। (জ্যোতিষীকে) তুমি শুধু নক্ষত্রদের গতিপ্রকৃতির কথা জার্নো। আমার প্রতিটি কথা শিষ্যের মতো মন দিয়ে শুনে যাবে। 

জ্যোতিষী : এক ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে যে অ্যাটলাস একদিন ত্রিভুবন ধারণ করেছিল সেই অ্যাটলাসের মন্দিরে মতো এক বিশাল প্রাচীর মন্দির দেখতে পাচ্ছি। আর বড় বড় স্তম্ভগুলো পাথরের ছাদটাকে ধারণ করে আছে। 

স্থপতি : ও মন্দিরটা বড় প্রাচীন। এ সব আজকাল কেউ ভালো বলে না। আজ লোকে চায় সূক্ষ্ম কারুকার্য। 

জ্যোতিষী : গ্রহ-নক্ষত্রদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সময়-অসময়ের কথা ছেড়ে দাও এখন। এখন আর কোনও যুক্তির কথা নয়। এখন যুক্তির সব শক্তি যাদুর দ্বারা আবদ্ধ। সঙ্গে সঙ্গে অবাধ উদ্ধত কল্পনার রঙিন ও উজ্জ্বল পাখাগুলো উন্মুক্ত করে দাও। তোমাদের উদ্ধত উচ্চাশাগুলো আজ পূরণ হবে। শুধু অসম্ভবকে বিশ্বাস করে যাবে। (মঞ্চের একধারে ফাউস্টের প্রবেশ) যাজকের পোশাক পরে এক আশ্চর্য মানুষ তার আরদ্ধ কাজ করে সম্পন্ন করে এসেছে। তার সঙ্গে শূন্যে ভেসে এসেছে এক তিনপায়া পদার্থ। ধূপের গন্ধ পাচ্ছি। 

ফাউস্ট : হে আদিমাতাগণ, অনন্ত মহাশূন্যে চিরন্তন নির্জনতার রাজ্যে অধিষ্ঠিত আছ তোমরা। তোমাদের চারদিকে মৃতদের উজ্জ্বল আত্মারা ঘুরে বেড়ায়। আজকের এই রাত্রিতে এই প্রেক্ষাগৃহে কিছু আত্মার মধ্যে প্রাণ সঞ্চার করে পাঠাও। ঐন্দ্রজালিক শক্তির প্রভাবে তাদের প্রদর্শন করে দর্শকদের মনোরঞ্জন করব আমরা।

জ্যোতিষী : উজ্জ্বল চাবিকাঠিটা কাপে ঠেকাবার সঙ্গে সঙ্গে ধোয়ার মতো একটা বস্তু উঠে মেঘ হয়ে আচ্ছন্ন করে ফেলল চারদিক। ঐ দেখো, তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে এক প্রেতমূর্তি। সঙ্গে সঙ্গে বাতাসে ভেসে আসছে এক মধুর সঙ্গীতের ধ্বনি। সে ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠছে সমগ্র মন্দির-চত্বরটি। সেই কুয়াশাচ্ছন্ন মেঘমালা কেটে গেল সেই অস্পষ্ট প্রেতমূর্তিটি এক সুন্দর যুবার বেশ ধারণ করল। এখানেই আমার কাছের শেষ। তার নাম বলার প্রয়োজন নেই। প্যারিসের নাম কে না জানে? 

জনৈক মহিলা : যৌবনের কি অমিত শক্তি আর উজ্জ্বলতা তার দেহে।

দ্বিতীয় মহিলা : সজীব ও সুপক্ক ফলের রসে পরিপূর্ণ যেন সে।

তৃতীয় মহিলা : তার ঠোঁটগুলো কী চমৎকার।

চতুর্থ মহিলা : এই ওষ্ঠাধরের মাধুর্য কে না উপভোগ করতে চায়।

পঞ্চম মহিলা : সে খুব সুন্দর, তবে কিছুটা অমার্জিত।

ষষ্ঠ মহিলা : আমার মতে আর একটু মার্জিত হলে ভালো হতো। 

নাইট : তাকে দেখে মনে হচ্ছে এক রাখাল। রাজকীয় কোনও নিদর্শন নেই তার দেহে। 

অন্য নাইট : অবশ্য যুবকের অর্ধনগ্ন দেহ খারাপ নয়। তবে তাকে যোদ্ধাবেশে দেখতে চাই আমরা। 

মহিলা : কত শান্তভাবে সে আসন গ্রহণ করল।

নাইট : তার কোলটা তোমাদের কাছে এক পরম রমণীয় স্থান। 

অন্য নাইট : তার মাথার উপর হাত তুলল সে। 

প্রধান ভৃত্য : এটা ঠিক নয়। রাজকীয় আদব-কায়দা কিছু জানে না। সম্রাটের সামনে হাই তুলছে। 

মহিলা : তোমরা শুধু সবেতেই দোষ ধরো। ও ভাবছে ও একা।

জনৈক লর্ড : এটা নাটক হলেও নাটকটা যথাযথভাবে দেখানো উচিত।

মহিলা : ধীরে ধীরে নিদ্রা এসে আচ্ছন্ন করছে সুন্দর যুবককে।

লর্ড : এবার হয়ত তার নাক ডাকবে। 

জনৈক তরুণী : ধূপের ধোঁয়ার সঙ্গে কি এক মিষ্টি গন্ধ এসে আমার বুকের ভিতরটা আলোড়িত করে তুলছে। 

জনৈকা বৃদ্ধা : এটা তার যৌবনের গন্ধ, আমাদের অনুভূতিকে উত্তপ্ত করে তুলছে। 

অন্য বৃদ্ধা : তার অম্লান যৌবনুকুসুমের সৌন্দর্য ও অমৃতরস সমস্ত পরিবেশটাকে মধুরভাবে আচ্ছন্ন করে তুলেছে। (হেলেন এগিয়ে এল)। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে উনি এলেন। কিন্তু আমার ঘুমের এতে কোনও আঘাত ঘটবে না। সে সুন্দরী হলেও তার সৌন্দর্য আমার কাম্য বা রুচিসম্মত নয়। 

জ্যোতিষী : সত্যি কথা বলতে কি, আমার আর কিছু করার নেই। তার সৌন্দর্যদর্শনে গানের অফুরন্ত সুরে সুরে ভরে উঠেছে আমার অন্তর। আমি আমার জিব। দিয়ে সে সুরের আগুন যদি ছড়িয়ে দিতে পারতাম। তাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে বুদ্ধি হারিয়ে ফেলবে কোনও মানুষ। তাকে যে লাভ করেছে সে সত্যিই ভাগ্যবান। 

ফাউস্ট : আমি কি চোখে এখনও দেখতে পাচ্ছি? আমার অস্তিত্ত্বের গভীরে সৌন্দর্যের এক প্রস্রবণ বয়ে যাচ্ছে প্রবল ধারায়। অনেক ভয়াবহ শূন্যতা পার হয়ে অনেক কষ্ট সহ্য করে আমি এই স্বর্গীয় বস্তুকে বয়ে এনেছি। আমাদের কল্পিত সেই সৌন্দর্যমূর্তি এখন যাদুর দ্বারা সঞ্চীবিত হয়ে উঠেছে। সে সুন্দরী, আমি আমার জীবনের সমস্ত শক্তি, আবেগ, কল্পনা, প্রমত্ত প্রেম, প্রীতি সব উৎসর্গ করলাম। 

মেফিস্টোফেলিস : শান্ত হও,–তা না হলে তুমি তোমার ভূমিকায় ঠিকমতো অভিনয় করতে পারবে না। 

বৃদ্ধা : বেশ লম্বা আর সুগঠিত চেহারা। তবে মাথাটা ছোট দেহের তুলনায়।

তরুণী : তার পায়ের পাতাটা কেমন ভারী দেখো। 

কূটনীতিজ্ঞ : এমন রাজকন্যা আমি অনেক দেখেছি। তবে ও সত্যিই সর্বাঙ্গসুন্দরী। 

সভাসদ : ঘুমন্ত যুবকের কাছে ও কেমন কৌশলে ও ধীরে গতিতে যাচ্ছে।

মহিলা : যুবকের পবিত্র যৌবনসৌন্দর্যের পাশে ওকে কত কুৎসিত দেখাচ্ছে। 

কবি : ওর সৌন্দর্যের জ্যোতি ঘুমন্ত যুবকের সামনে উজ্জ্বল উষালোকরূপে প্রতিভাত হবে। 

মহিলা : ওদের দেখে মনে হচ্ছে ওরা যেন এন্ডিমিয়ন আর চন্দ্রাদেবী। 

কবি : ঠিক। মনে হচ্ছে দেবী যেন যুবকের উপর ঝুঁকে পড়ে তার সুগন্ধি নিশ্বাস ছাড়ছে। তাকে চুম্বন করছে। 

ফাউস্ট : যুবকের প্রতি এতখানি আসক্তি তার ভালো নয়।

মেফিস্টোফেলিস : শান্ত হও। ওরা যা করে করতে দাও নীরবে।

সভাসদ : মেয়েটি হালকা পায়ে নিঃশব্দে সরে যেত। যুবকটি জেগে উঠল।

মহিলা : মেয়েটির চোখের সামনে তো কেউ নেই।

সভাসদ : মেয়েটি যুবকের কাছে যথোচিত আত্মসমর্পণ সহকারে আসছে। 

মহিলা : ও যুবকটিকে ওঠাতে চাইছে। এমন অবস্থায় সব যুবকই হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। এখানে যুবকটি ধরে নিয়েছে সেই মেয়েটর প্রেম সে লাভ করেছে। 

ভৃত্য : আমি যদি যুবকটির অবস্থায় পড়তাম।

সভাসদ: এ অবস্থায় কে পড়তে না চায়? 

মহিলা : ঐ মূল্যবান নারীরত্ব কত হাত যে ফিরে এসেছে। তার জৌলুসও অনেকটা ক্ষয় হয়ে গেছে। 

অন্য মহিলা : মেয়েটা দশ বছর বয়স থেকেই খারাপ হয়ে গেছে।

নাইট : যে যা বলুক, আমি যুবতীর সৌন্দর্যে বিমোহিত। 

জনৈক পণ্ডিত : যদিও আমি চোখের সামনে স্পষ্ট করে তাকে দেখছি তথাপি সে সত্যিই হেলেন কি না তাতে সন্দেহ আছে। তবে সর্বত্র যা পড়েছি তা সত্যিই মনে হচ্ছে। ওর সৌন্দর্য ট্রয়বাসীদের একদিন মুক্ত করে এবং আমার দেহে যৌবন না থাকলেও আমাকে মুগ্ধ করছে। 

জ্যোতিষী : এখন মনে হচ্ছে তরুণ বালক নয়, এক বলিষ্ঠ বীরপুরুষ তাকে ছড়িয়ে ধরছে। তাকে তুলে ফেলছে। তাকে বয়ে নিয়ে হয়ত পালাবে। তা দেখে কে আবেগ সংযত করতে পারে? 

ফাউস্ট : হে হঠকারী নির্বোধ, তুমি সত্যিই পালিয়ে যাবে? তোমার সাহস হচ্ছে?

মেফিস্টোফেলিস : এই ভৌতিক নাটকের তুমিই অবতারণা করেছ। 

জ্যোতিষী : আমরা আজ যা দেখেছি তাতে নাটকের নাম দেওয়া উচিত হেলেনার ধর্ষণ। 

ফাউস্ট : ধর্ষণ? আমি এখানে রয়েছি না। আমার হাতে এই চাবিকাঠি এখনও জ্বলজ্বল করছে। এই চাবিকাঠি আমার জনহীন শূন্যতার মধ্য দিয়ে পথ দেখিয়ে এই অমূল্য সম্পদকে আনতে সাহায্য করেছে। কল্পনা আজ এখানে বাস্তবে পরিণত। অবশ্য দর্শকদের মনে কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। তবু বলব একদিন ওরা কত দূরে ছিল। আজ ওরা কত কাছে, কত সুন্দর। আমি এই সুন্দরী হেলেনাকে উদ্ধার করে চিরদিন আমার করে রাখব। হে আদি মাতৃদেবতারা! আমার চেষ্টাকে ফলবতী করে তোলো। 

জ্যোতিষী : কি করছ ফাউস্ট দেখো দেখো। ও তাকে ধরেছে। ও মিলিয়ে যাচ্ছে ধোঁয়ার মতো। চাবি নিয়ে প্যারিসকে ছুঁচ্ছে। হায় হায়! (বিস্ফোরণ। ফাউস্ট মাটিতে পড়ে গেল, প্রেতরা শূন্যে মিলিয়ে গেল।) 

মেফিস্টোফেলিস : (ফাউস্টকে কাঁধে তুলে) তোমার নির্বুদ্ধিতার প্রতিফল তুমি পেলে। (অন্ধকার ও হট্টগোল)। 

দ্বিতীয় অঙ্ক 

প্রথম দৃশ্য

উঁচুতলায় একটি সংকীর্ণ প্রকোষ্ঠ। তাতে অপরিবর্তিত অবস্থায় ফাউস্ট শায়িত। 

মেফিস্টোফেলিস : (শায়িত ফাউস্টকে পর্দার আড়াল থেকে দেখতে দেখতে) ওইখানে শুয়ে থাকো, সে নির্বোধ হতভাগ্য। প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ থাকো। হেলেনা তোমার যে যুক্তিবোধকে বিকল করে দিয়েছে তা সহজে শক্তি ফিরে পাবে না। (পর্দা সরিয়ে ভিতরে এসে চারদিকে তাকিয়ে) দেখে মনে হচ্ছে এ ঘরের সবকিছু যা যেখানে সব ঠিক আছে। জানালার কাঁচের শার্সিটা কিছুটা ম্লান দেখাচ্ছে। মাকড়শার জালগুলো বড় হয়েছে, দীর্ঘ হয়েছে কয়েক বছর ধরে। লেখার কালি শুকিয়ে গেছে। কাগজগুলো বাদামী রঙের হয়ে গেছে কিন্তু প্রতিটি জিনিস তার আগের জায়গাতেই আছে। এমনকি যে পালকের কলমটা দিয়ে শয়তানের সঙ্গে চুক্তিতে স্বাক্ষর করে সেই কলমটাও ঠিক আছে। সে পোশাকটা পরিয়ে আমি তাকে জাদুবিদ্যা শিখিয়েছিরাম সেটা এখনও হুকেতে ঝুলছে। সে কর্কশ ছদ্মবেশ, তোমার সাহায্যেই আমি কলেজ শিক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করে তাকে সেই বিদ্যা শিখিয়েছিলাম যা যুবকদের মুগ্ধ করে সহজে। (পোশাকটা ধরে নাড়া দিতে কতকগুলো পোকামাকড় উড়ে বেড়াতে লাগল।) 

পতঙ্গদের কোরাস : হে পিতা, আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করো। তুমিই আমাদের এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিয়েছ। আমরা হাজারে হাজারে ওখানে বাস করি। তবে বুকের ভিতর দাগ থাকলে ধরা পড়ে না, কেউ তা দেখতে পায় না, কিন্তু জামায় পোকা বা উকুন থাকলেই তা দেখতে পাওয়া যায়। 

মেফিস্টোফেলিস : এই সব কচি প্রাণের উচ্ছলতা দেখে আমার বড় বিস্ময় ও আনন্দ জাগছে। হে পতঙ্গদল, তোমরা পুরনো কাগজে, বই-এর ভিতরে এখানে-ওখানে জারে লুকিয়ে থাকগে (পোশাকটা পরে) হে পোশাক, আমার এস আমার দেহে। তবে। আমি কলেজে পড়াব না। কে আমার দাবি সমর্থন করবে? (একটা ঘণ্টা বাজাতেই ভীষণ জোর শব্দ হলো) 

(ফেমুলাস টলতে টলতে অন্ধকার বারান্দা থেকে এল)

কী ভীষণ শব্দ। বাড়ির সিঁড়িগুলো সব ভয়ঙ্করভাবে কাঁপছে। জানালার রঙিন কাঁচের ফাঁক দিয়ে বিদ্যুৎ দেখতে পাচ্ছি আমি। ছাদটা মনে হচ্ছে ফেটে যাচ্ছে। অর্গলবদ্ধ দরজা খুলে যাচ্ছে কোনো যাদুমন্ত্র বলে। ফাউস্টের ঘরে তার কোট পরে একটা বিরাট দৈত্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে আমার পানে তাকিয়ে ইশারায় ডাকছে। আমি কি পালাব? না কি অপেক্ষা করব? কে জানে আমার ভাগ্যে কি আছে? 

মেফিস্টোফেলিস : এখানে এস বন্ধু? তোমার নাম নিকোডমাস নয়?

ফেমুলাস : হে সম্মান্বিত মহাশয়, আমার নাম ওরেমাস।

মেফিস্টোফেলিস : ও নাম রেখে দাও।

ফেমুলাস : কী আনন্দের কথা! আপনি আমাকে এখনও চিনতে পারছেন না। 

মেফিস্টোফেলিস : এক পুরনো ছাত্র। আমি ভুলিনি। পণ্ডিত লোকের পড়াশুনো শেষ হয় না। তারা ছাত্র রয়ে যায় চিরকাল। তোমার প্রভু এক জ্ঞানী ও পণ্ডিত লোক। মহান ডাক্তার ওয়াগাবারকে সকলেই চেনে। আজও দিনে দিনে তার জ্ঞানের সঞ্চয় বেড়ে যাচ্ছে। জ্ঞানের তৃষ্ণাও তাঁর সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে। তার চারদিকে আজ কত লোক ভিড় করছে। জ্ঞানের যে চাবিকাঠি তাঁর হাতে আছে তা দিয়ে তিনি স্বর্গ-মর্ত্য পাতালের সব রহস্যেরই সন্ধান করতে পারেন। সব জ্ঞানের আলো আজ তাঁর করায়ত্ত। সকলের যশকে তিনি ছাড়িয়ে গেছেন, এমনকি তার পূর্ণ জীবনের ডাক্তার ফাউস্টও ম্লান তাঁর কাছে। 

ফেমুলাস : ক্ষমা করবেন মশাই, আপনার কথার প্রতিবাদ করলে কিছু মনে করবেন না। আপনি যা যা বলবেন তা আমি শুনে চাইনি। সেই মহান পুরুষের হঠাৎ অন্তর্ধানের অর্থ আজও বুঝতে পারিনি আমি। তাঁর এই রূপান্তরও দুর্বোধ্য, দুঃখজনক। ডাক্তার ফাউস্টরূপে তাঁর পুনরাবির্ভাবের প্রত্যাশা করি আমরা। তাঁর ঘরের জিনিসপত্র সব অপরিবর্তিত রয়ে গেছে। সব তাঁর আগমন প্রত্যাশা করছে। তার কাছে আমি যেতে সাহস পাচ্ছি না। জানি না এখন আকাশে কোন নক্ষত্র কিরণ দিচ্ছে। অকস্মাৎ ভয়ঙ্কর এক শব্দে গোটা বাড়িটার ভিত্তিমূলটা কেঁপে উঠল। দরজাগুলো প্রবলভাবে কেঁপে উঠতে খিল খুলে গেল আর সেই ফাঁকে প্রবেশ করলেন আপনি। 

মেফিস্টোফেলিস : বর্তমানে তিনি যেখানে থাকেন আমাকে একবার সেখানে নিয়ে যাবে? অথবা তাকে আমার কাছে নিয়ে এস। 

ফেমুলাস : তাঁর নিষেধ আছে। আমি সাহস পাচ্ছি না। মাসের পর মাস তিনি এক নির্জন নিভৃতে বড় রকমের এক কাজ করতে চলেছেন। কিসের যেন গবেষণা করে চলেছেন গভীরভাবে। তার বুকের ভিতর যেন আগুন জ্বলছে। তার মুখখানা হয়ে উঠেছে কয়লার উনোনের মতো কালো, চোখ দুটো অঙ্গারের মতো লাল। তিনি সব সময় হাঁপাচ্ছেন। 

মেফিস্টোফেলিস : আমাকে কেন তিনি ঢুকতে দেবেন না? তিনি আমাকে একবার ঢুকতে দিলে আমার থেকে তার ভাগান্নতি ত্বরান্বিত হবে। (ফেমুলাস চলে গেলে মেফিস্টোফেলিস গম্ভীরভাবে বসে পড়ল) আমি এখানে বসতে না বসতেই একটা প্রেত এসে হাজির হলো। আমি তাকে চিনি। সে পুরনো পাপী আর তাই তার দুঃসাহসটা হবে অপরিসীম। 

বেকলেরেউস : (বারান্দা দিয়ে এসে) সব দ্বার এখন উন্মুক্ত। এখন আশা হচ্ছে আর তিনি দীর্ঘ ঘুমে আচ্ছন্ন থাকবেন না। মনে হচ্ছে আর তিনি জীবন্ত মারা যাবেন না। কিন্তু এই গোটা প্রাসাদটা কাঁপছে কেন? মনে হচ্ছে বসে যাচ্ছে, ধসে যাচ্ছে। যদি বেরিয়ে না যাই তাহলে নিষ্পেষিত হতে হবে। কিন্তু আমার চোখের সামনে কি দেখছি? আমি সরল প্রকৃতির মানুষ, কিন্তু যত সব পাকা মাথা বৃদ্ধদের দ্বারা চালিত হতে হয় আমাকে। ঐ সব পুরনো বইগুলো পড়ে তারা যা জানত বা লিখত তা তারা ঠিকমতো বোঝাতে পারত না, তারা ভুল শেখাত মানুষকে। আবার তারা যা জানত বা শিখত তাতে তারা নিজেরাই বিশ্বাস করত না। এইভাবে তারা জীবনটাকে ক্ষয় করে। সে ক্ষয় কোনকালেও পূরণ হয়নি। কি ব্যাপার! অদূরে ঐ অন্ধকার ঘরে কে বসে রয়েছে? তার কাছে যেয়ে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি আমি। মোটা পশম আর লোম দিয়ে তৈরি কোট পরে বসে রয়েছে লোকটা। তাকে কেতাদুরস্ত দেখালেও তাকে চিনতে পারছি না। তবে তাকে আমি ভয়ও করি না। কই হে বৃদ্ধ মহাশয়, আপনি এখনও যমের বাড়ি যাননি? আমি আগে আপনাকে ছেলেবেলায় দেখেছি মনে হচ্ছে। অবশ্য আমি এখন আর সে। মানুষ নেই। 

মেফিস্টোফেলিস : আমার ঘণ্টধ্বনি শুনে তুমি যে এসেছ এতে আমি খুশি হয়েছি। আগে তোমার বুদ্ধির প্রশংসা করতাম আমি। একটি ছেলের প্রথম থেকেই বুঝতে পারি ভবিষ্যতে সে কেমন হবে তোমার মাথায় লম্বা লম্বা চুল ছিল। তোমার মুখে ছিল শিশুসুলভ হাসিখুশি ভাব। তুমি প্রেম করতে। কিন্তু এখন তোমার মাথা কামানো। তোমার চোখে-মুখে এখন কঠিন সংকল্পের ছাপ। এখন থেকে একেবারে বাড়ি চলে যেও না। 

বেকালেরেউস : একজন বয়োবৃদ্ধ শিক্ষক হিসাবে আপনি এই পুরাতন শিক্ষাদানের স্থানে বসে জীবনের পরিবর্তনের কথা ভাবছেন। আপনি আপনাদের দ্ব্যর্থবোধক কথা আর বলবেন না। ও সব কথার এখন ভিন্ন অর্থ বার করি আমরা। ওসব কথা বলে আপনি আমাদের যৌবনকে অহেতুক বিব্রত করে তুলতেন। অথচ আপনারা জানতেন আসলে সত্য কত সহজ। 

মেফিস্টোফেলিস : আমরা যদি ছোট ছোট ছেলেদের সহজ সত্য সরলভাবে বলি, তাহলে তারা আর খেলাধুলা করবে না। আমরা চাই বড় হয়ে তারা সত্যকে আর মিথ্যা মায়ার গোপন গহ্বর থেকে আবিষ্কার করুক, বাইরে টেনে আনুক। তারপর তারা নিজের মতো করে সত্যকে জানুক, গ্রহণ করুক। তখন তারা বলবে, তাদের শিক্ষকরা ছিল নির্বোধ। তারা যা পড়িয়েছে, ভুল পড়িয়েছে। 

বেকালেরেউস : শুধু নির্বোধ নয়, বদমাশ। এমন কোনও শিক্ষক আছে সে সত্যকে যথাযথভাবে উপস্থাপিত করতে পারে ছাত্রদের কাছে। তারা সত্যকে হয় কম করে না হয় বেশি করে জানে এবং সেইভাবে প্রকাশ করে। ছেলেদের প্রয়োজন অনুসারে তাদের শিক্ষা দেয়।

মেফিস্টোফেলিস : নিঃসন্দেহে মানুষের শিক্ষার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে। সেই সময় তোমার পার হয়ে গেছে। এখন তুমি শিক্ষা দিতে চাও, বহু বছরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় এখন তুমি সমৃদ্ধ।

বেকালেরেউস : অভিজ্ঞতা! এটা তো কুয়াশা ছাড়া আর কিছুই নয়। এক অভিজ্ঞতা বিভিন্ন মতে বিভিন্ন রূপ লাভ করে। এখন স্বীকার করুন, মানুষ আজ পর্যন্ত যা শিখেছে তার মধ্যে কিছুই শিক্ষণীয় নয়। 

মেফিস্টোফেলিস : এখন বিলম্বে বুঝেছি। আমি সত্যিই একদিন নির্বোধ ছিলাম। আমার জ্ঞানের অগভীরতাকে আমার নিজেরই উপহাস করতে ইচ্ছা করছে। 

বেকালেরেউস : কথাটা শুনে খুশি হলাম। আপনিই প্রথম বয়োপ্রবীণ ব্যক্তি যার মুখে যুক্তির কথা শুনলাম। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি খনির ভিতরে কত গুপ্তধন ও মণিমাণিক্যের সন্ধান করেছিলাম। কিন্তু পরিণামে আমি লাভ করেছি কয়লা আর ভস্মরাশি। 

বেকালেরেউস : আপনি তাহলে স্বীকার করুন আপনার এই টাকপড়া পক্ককেশ মাথাটা শূন্য। তাতে কিছু নেই। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি কিন্তু আমার প্রতি বড় কঠোর আচরণ করছ। বেকালেরেউস : সৌজন্য কথাটাই মিথ্যা। 

মেফিস্টোফেলিস : (চেয়ারটা দর্শকদের সামনে ঘুরিয়ে নিয়ে) এখানে আলো বাতাস নেই। আমি কি তোমাদের কাছে গিয়ে বসতে পারি? 

বেকালেরেউস : বৃদ্ধ বয়সে যুবক হবার সাধ এক অর্থহীন ঔদ্ধত্য ছাড়া আর কিছুই নয়। মানুষের জীবন রক্তের জোরের উপর নির্ভর করে। যৌবনে রক্তের তেজ সবচেয়ে বেশি থাকে এবং সেই সময় সেই রক্ত থেকে এক জীবন থেকে উদ্ভব হয় আর এক জীবনের। তারপর যারা দুর্বল তারা শুধু ঝগড়া-বিবাদ করে, কাজের কাজ কিছু করে না, যারা শক্তিমান তারা সবেতেই সাফল্য লাভ করে। আপনি সারা জীবন ধরে কি করেছেন?–শুধু চিন্তা আর পরিকল্পনা? বার্ধক্য হচ্ছে ঠিক দূষিত জ্বরের মতো। আর তিরিশ বছর পার হলেই মানুষ তার আসল প্রাণশক্তি হারিয়ে ফেলে। 

মেফিস্টোফেলিস : শয়তানরা এর থেকে ভালো কথা বলতে পারে না।

বেকালেরেউস : শয়তান কোথাও থাকে তা তো একমাত্র মানুষের মনে।

মেফিস্টোফেলিস : শয়তান শীঘ্রই তোমার ঘাড়ে চাপবে। 

বেকালেরেউস : ওটা হচ্ছে যৌবনের ডাকে সাড়া দেওয়া যথাযোগ্য অতিথি। আমার আগে এ পৃথিবীর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। এ পৃথিবী আমিই সৃষ্টি করেছি, আমিই পূর্বাচলের মহাসমূদ্র হতে সূর্যকে উঠিয়ে নিয়ে এসেছি। স্পষ্ট দিবালোকের উজ্জ্বল পোশাক পরে অভ্যর্থনা জানায় আমাকে। চাঁদ আমারই সঙ্গে গতি পরিবর্তন করতে শুরু করে। পৃথিবী সবুজ পত্র ও পুষ্পশোভিত হয়ে আমাকে প্রীত করতে থাকে। আমারই ইশারা পাবার সঙ্গে সঙ্গে রাত্রির অন্ধকার আকাশ হতে তাদের অবগুণ্ঠন সরিয়ে অনন্ত আলোকের ঐশ্বর্য উঘাটিত করে আমার চোখের সামনে। আমি ছাড়া কে তোমাকে চিরাচরিত চিন্তার বন্ধন থেকে মুক্ত করত? আমি স্বাধীন, আমি গর্বিত। আমি নিজের মনের আলোয় সব চিনে আমারই আপন আনন্দের বেগে এগিয়ে চলি। যত সব অন্ধকার মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে আমার পিছনে। অন্তহীন চির অম্লান এক গৌরবের আলো পথ দেখিয়ে নিয়ে চলে আমায়। (প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিস : যাও, চলে যাও হে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যসমৃদ্ধ মহান পুরুষ। এমন কি নূতন ও বিজ্ঞজনোচিত চিন্তা আছে যা অতীতে কখনও চিন্তিত হয়নি? এখন তোমরা যতই মৌলিক চিন্তার বড়াই করো না, শীঘ্রই কোনও না কোনও মতের কবলে ধরা দেবে। আর ধরবে মদ। (তরুণ দর্শকের উদ্দেশ্যে) আমার কথা এখন তোমাদের নীরস লাগছে। তবে মনে রাখবে আমি শয়তান হলেও বয়োপ্রবীণ এবং আমার কথা বুঝতে পারবে তোমাদের বয়স হলে। 

দ্বিতীয় দৃশ্য 

গবেষণাগার

মধ্যযুগীয় ধরনের কিছু অদ্ভুত যন্ত্রপাতি ঘরময় ছড়ানো। ওয়াগনার এক জ্বলন্ত চুল্লীর সামনে উপবিষ্ট। 

ওয়াগনার : ঘণ্টার প্রচণ্ড শব্দে বাড়ির দেওয়ালগুলো কাঁপছে। তবে শীঘ্রই সব আগ্রহ ও প্রত্যাশার অবসান ঘটবে। বড় নলটার মধ্যে জ্বলন্ত কাঠের মতো কি একটা জিনিস চকচক করছে। এই পেয়ে গেছি। কিন্তু দরজায় কিসের শব্দ? 

মেফিস্টোফেলিস : (প্রবেশ করে) স্বাগত বন্ধু! 

ওয়াগনার : (উদ্বেগের সঙ্গে) ঠিক সময়েই এসে গেছ। বর্তমান গ্রহের প্রভাবেই তুমি এসে গেছ। (চুপি চুপি) কিন্তু এখন কোনও কথা নয়। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করো। একটা বড় রকমের কাজ এখনি সম্পন্ন হবে। কাজটা বিরাট আর চমৎকার। 

মেফিস্টোফেলিস : কাজটা কি?

ওয়াগনার : এক কৃত্রিম মানুষ জন্ম নিচ্ছে।

মেফিস্টোফেলিস : মানুষ? কোনও প্রেমিকযুগলকে চিমনির মধ্যে লুকিয়ে রেখেছ? 

ওয়াগনার : না, লুকিয়ে রাখার কথা নয়। এই কৃত্রিম প্রজনন এক বিরল ঘটনা। অতীতের অর্থহীন প্রজননপদ্ধতি হতে আমরা আজ মুক্ত হলাম। বিশ্বে জীবনের প্রথম উদ্ভবের কথা একবার ভাব। বাইরের শক্তি ও প্রকৃতির অন্তর্নিহিত শক্তির মিলনে যে মানবজীবনের উদ্ভব হয় তা বড় পাশবিক, তা বড় স্কুল। মানবজাতির উচিত তার প্রজন্মকে উন্নত করা। (চিমনির ভিতরে তাকিয়ে) শত শত বিচিত্র উপাদানের সঙ্গে মানবিক উপাদান কিছু মিলিয়ে সেটাকে পরিশ্রুত করে কেমন চমৎকার ফল পাওয়া যাচ্ছে। আমার আশাটা অবশ্যই ক্রমশই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। বিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে। মানুষের যে সৃষ্টি রহস্য একদিন প্রকৃতির মধ্যে ঢাকা ছিল আজ আমরা জ্ঞানের দ্বারা তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার দ্বারা সহজভাবে উঘাটিত করে তুলছি। 

মেফিস্টোফেলিস : মানুষ বেঁচে থাকলে অনেক রহস্য উঘাটিত করতে শেখে। জগতের সব নূতন নূতন জিনিস কালক্রমে পুরনো হয়ে যায় তার কাছে। আমার ভ্রমণকালে আমি নিজেই অনেক উন্নতমানের মানুষ দেখেছি। 

ওয়াগনার : (নলের দিকে তাকিয়ে) দেখো দেখো মানুষটা হাঁ করছে। কি রকম চঞ্চল দেখাচ্ছে। ওর মাথাটায় এবার থেকে বিশুদ্ধ চিন্তার সৃষ্টি হবে। ও আবার কত চিন্তাশীল ব্যক্তির জন্মদান করবে। কাঁচের নলটা নড়ছে। তার ভিতরে ছোট আকারের এক সুন্দর মানুষ নড়াচড়া করছে। দেখো এক জীবন্ত পদার্থ সৃষ্ট হলো। আর কি আশা করতে পার? সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার একই রহস্য এবার থেকে সব মানুষই জানতে পারবে। ঘণ্টাধ্বনির মতো একটা এলোমেলো শব্দ এসে মানুষের এক সুস্পষ্ট কণ্ঠস্বরের রূপ নিচ্ছে। 

কৃত্রিম মানুষ হোমুনোলাস : কেমন আছ বাবা? আমাকে বুকের উপর চেপে ধরো। তবে খুব জোরে নয়, কারণ তাহলে কাঁচটা ভেঙে যাবে। জগতে শুধু প্রকৃতির বস্তুরই অবাধ স্থান। কৃত্রিম বস্তুর স্থান বড় সংকীর্ণ। (মেফিস্টোফেলিসের প্রতি) হে দুবৃত্ত খুল্লতাত মহাশয়, তোমাকেও দেখছি। ঠিক সময়েই দেখছি। ধন্যবাদ, সৌভাগ্যবশত আমার কাছে এসে পড়েছ। আমি যখন সঞ্জাত হয়েছি তখন কাজও শুরু করব অবিলম্বে। কৌশলে তুমি আমার কাজকে ত্বরান্বিত করবে। 

ওয়াগনার : কিন্তু একটা কথা। এর আত্মাকে খুঁজে পাচ্ছি না আমি। একটা কথা আগে ভাবিনি।, কেমন করে দেহের আত্মাকে এক করা যাবে। তাদের পারস্পরিক বিরোধিতা সত্ত্বেও তারা বিচ্ছিন্ন হয় না। 

মেফিস্টোফেলিস : থামো, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করব স্বামী-স্ত্রী তাদের তিক্ততা সত্ত্বেও কেমন মিলেমিশে থাকে। তুমি এখন বুঝবে না বন্ধু, এখনও কাজের অনেক বাকি আছে। 

হোমুনোলাস : কি করতে হবে? 

মেফিস্টোফেলিস : (একটা দরজার দিকে হাত বাড়িয়ে) তোমার কলাকৌশল যা আছে এখানে প্রয়োগ করতে পার। 

ওয়াগনার : (ফাইলের ভিতর তাকিয়ে) তুমি দেখতে খুবই সুন্দর হে বালক। (পাশের দরজাটা খুলে যেতেই দেখা গেল ফাউস্ট একটা সোফার উপর বসে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে রয়েছে) 

হোমুনোলাস : (বিস্মিত হয়ে) চমৎকার! (বড় শিশিটা ওয়াগনারের হাত হতে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে ফাউস্টের উপর ঝুলতে লাগল) কী সুন্দর দৃশ্য। ছায়াছন্ন বনভুমির ভিতর দিয়ে ঝর্না বয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা স্নান করছে সে ঝর্নার জলে। কী সুন্দর তাদের দেহসৌষ্ঠব। মেয়েরা যখন স্নান করছিল ঝর্নার জলে হঠাৎ এক অনিন্দ্যসুন্দরী দেবী অথবা রাজকনা এসে পা ভেজাল সেই স্বচ্ছ জলে। এমন সময় পাখার ঝটপট শব্দ করে এক বড় রাজহাঁস এসে তার গায়ের পালক ঘষতে লাগল সেই রানির হাঁটুর উপর। তাই দেখে কুমারী মেয়েরা ভয়ে পালিয়ে গেল। কিন্তু রানি পালাল না। রাজহাঁসটার সঙ্গে মিতালি পাতাল রানি। কিন্তু হাঁসটা হঠাৎ কোথায় জলের উপর ভেসে গেল আর এক ঘন কুয়াশার ছবিটা ঢাকা পড়ে গেল। এত সুন্দর ছবি কেউ কখনও আঁকেনি বা স্বপ্নেও দেখেনি। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি দেখতে আকারে কত ছোট। অথচ কত কথা বললে, কত গল্প! নিশ্চয় তুমি উত্তরদেশীয় লোক এবং কুয়াশাচ্ছন্ন দিনে ভূমিষ্ঠ হয়েছে। নিশ্চয়ই তুমি কোনও নাইট অথবা যাজকের ঘরে জন্মেছ। তোমার দৃষ্টি স্বচ্ছ হবে কোথা হতে? অন্ধকারেই তুমি ভালো থাকো। (চারদিতে তাকিয়ে) বাদামী রঙের বাড়িটা ক্রমশ ভেঙে যাচ্ছে। এখনও যদি জেগে ওঠে লোকটা, আর একটা বিপদ আসছে ওর। তখন ঘটনাস্থলেই ও মারা যাবে। সেই বনভূমি, ঝর্ণা, নারীদের নগ্ন সৌন্দর্য, রাজহংসরূপী রাজপুত্রও এইসব স্বপ্ন দেখছিল। এই প্রায়ান্ধকার পরিবেশ ওর কামনা-বাসনার সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না। আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ওকে সরিয়ে নিয়ে যাও। নবজাতকের সৌভাগ্য কামনা করি আমি। 

হোমুনোলাস : বীরকে যুদ্ধে পাঠিয়ে দাও। কুমারী মেয়েদের নাচে যোগদান করতে বলল। আমি চোখে একটা উজ্জ্বল আলো দেখতে পাচ্ছি। এ আলো হচ্ছে প্রাচীন ওয়ালপার্গিস উৎসবরাত্রির আলো। যাই ঘটুক না কেন, এ হচ্ছে সবচেয়ে উপভোগ্য ঘটনা। সুতরাং ওকে জাগাও। 

মেফিস্টোফেলিস : একথা কখনও শুনিনি কারো কাছে।

হোমুনোলাস : একথা তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে কি করে? শুধু রোমান্টিক ভূত দেখতেই তুমি অভ্যস্ত। খাঁটি ক্ল্যাসিক্যাল ভূতও যে ভালো তা জান না। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু কোন দিকে যাব আমি বলতে পার? তোমার কথা শুনে আগে হতেই বিরক্তিতে ভরে উঠছে আমার মন। 

হোমুনোলাস : উত্তর দিকে যাও শয়তান। আমরা যাব দক্ষিণ দিকে। সেখানে আছে পেলেউস, এক তৃণাচ্ছাদিত বিশাল সমভূমি বনের পাশ দিয়ে চলে গেছে পাহাড়ের দিকে। সে পাহাড়ের উপর আছে নূতন-পুরনো কত ফার্সানাস দৈত্য। 

মেফিস্টোফেলিস : হায়! একান্তই যাবে তাহলে। অত্যাচারী মালিক আর। ক্রীতদাসের সেই পুরনো যুদ্ধ-বিবাদের ছবিটা আর আমার সামনে তুলে ধরো না। আমার বিরক্তি লাগছে। আসলে ওরা সবাই অন্ধ, সবাই পরাধীন। ক্রীতদাসগুলো স্বাধীনতার জন্য লড়াই করে। কিন্তু জানে না আসলে ওদের মালিকরাও ক্রীতদাস, পরাধীন, অজ্ঞতার অন্ধকারে আচ্ছন্ন। 

হোমুনোলাস : ও সব ঝগড়া-বিবাদের ব্যাপারটা আমি বুঝব। ছোট থেকে প্রত্যেকেই নিজেকে রক্ষা করে চলবে। এখন বলো, মানুষ কি করে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠতে পারে আর কোনও পদ্ধতি জানা আছে তোমার? 

মেফিস্টোফেলিস : গোপন পদ্ধতি ভালো নয়। গ্রীসীয় পদ্ধতি কিছুটা ভালো। যে পাপকাজে মানুষ আনন্দ পায় তা সবাইকে আকৃষ্ট করে। কিন্তু আমাদের পাপকাজে কোনও আনন্দ নেই বলে লোকে খারাপ বলে আমাদের। 

ওয়াগনার : (উদ্বেগের সঙ্গে) আমি এখন কি করব?

হোমুনোলাস : হ্যাঁ, তোমাকে এখন ঘরে বসে একটা ভারী কাজ করতে হবে। জীবনের সব উপাদানগুলো মিশিয়ে এক মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করতে হবে। এমন জীবন সৃষ্টি করতে হবে যার মধ্যে স্বর্ণ সম্পদ, গৌরব, জ্ঞানবিজ্ঞান, স্বাস্থ্য, গুণরাজি সব সমন্বিত হবে। বিদায়। 

ওয়াগনার : বিদায়! আমার খারাপ লাগছে। আমার মনে হচ্ছে আমাদের আর দেখা হবে না। 

মেফিস্টোফেলিস : তার সহায়তায় আমি পেলেউস যাব। (দর্শকদের প্রতি) আমাদের সৃষ্ট জীবের উপর আমাদেরই নির্ভর করতে হয়। 

তৃতীয় দৃশ্য

সুপ্রাচীন ওয়ালপার্গিস উৎসবরাত্রি (প্রথম) 

ফার্সানীয় প্রান্তর। অন্ধকার।

এরিখথো : এই ভয়ঙ্কর রাত্রির উৎসবে আগের মতোই এসেছি আমি। আমি বিষাদগ্রস্থ এরিখথো। আমাকে যতটা নিষ্ঠুর হিসাবে চিহ্নিত করে বদ কবিরা আমি ততটা নিষ্ঠুর নই। আমি শুধু বিহ্বল হলে দেখছি সামনে ধূসর রঙের তাঁবুর পর তাঁবুর ঢেউ। সেই ভয়ঙ্কর রাত্রির স্মৃতি বার বার আনাগোনা করছে আমার মনে। কোথাও অযোগ্য শাসক কখনও তার রাজ্যকে অপর কোনও যোগ্যতার শাসকের হাতে ছেড়ে দেয় না। এই জন্যই হয়ত দেখা যায় বৃহত্তর শক্তির সঙ্গে ক্ষুদ্রতর শক্তির দ্বন্দ্ব লেগেই আছে। আসলে আত্মা জয় করতে না পারলে বাইরের কোনও শক্তিকে জয় করা যায় না। স্বাধীনতার সাজানো মালা ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। অত্যাচারী শাসকের শক্ত মাথাও নত হয়। ইতিহাস জানে সীজারের লুব্ধ দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় পম্পের প্রথম জীবনের সব বিজয়গৌরব ম্লান হয়ে যায়। শক্তিমানের লালসার লেলিহান শিখা চারদিকে বিস্তার লাভ করে। সবলের অনিবারণীয় আঘাতে ঝরে পড়া দুর্বলের বহু রক্ত শোষণ করে নেয় পৃথিবীর মাটি। আজকের এই উৎসব রাত্রির আলোকোজ্জ্বল ঐশ্বর্য অতীত কালের বহু বিজয়োৎসবের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। অসম্পূর্ণ চন্দ্রকলার স্নিগ্ধোজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। সেইসব ভূতুড়ে তাঁবুগুলো কোথায় অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অকস্মাৎ আমার মাথার উপরে উল্কার আলো দেখছি। সেই আলোর ছটায় আমি এক জীবন্ত প্রাণীর আগমন প্রত্যক্ষ করছি। কিন্তু আমার উপস্থিতি তার পক্ষে ক্ষতিকর হতে পারে তাই আমার এখানে থাকা উচিত হবে না। (প্রস্থান) 

ঊর্ধ্বে এক বায়বীয় অতিথির আবির্ভাব।

হোমুনোলাস : আমার মাথার উপরে ভয়ঙ্কর এক চক্রাকার জ্বলন্ত আলোর শিখা দেখছি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি যখন উত্তরাঞ্চলে থাকতাম, আমার ঘরের জানালায় অনেক ভয়ঙ্কর প্রেতমূর্তি দেখতাম। এখানেও তাই দেখছি। এ জায়গাটাকেও আমার বাড়ির মতো মনে হচ্ছে। 

হোমুনোলাস : দেখো দেখো, একটা লম্বা লোক আমাদের সাথে লম্বা লম্বা পা ফেলে আসছে। 

মেফিস্টোফেলিস : ওকে বাতাসে ভর করে আসতে দাও। মনে হচ্ছে ও ভয় পেয়ে গেছে। 

হোমুনোলাস : ও আবার কোনও রূপকথার রাজ্যে পুনর্জন্মের চেষ্টা করছে। আবার ও জীবন লাভ করবে। 

ফাউস্ট : (পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে) কোথায় সে নারী? 

হোমুনোলাস : আমরা তা বলতে পারি না। তবে তুমি তাকে শূন্য বাতাসে ভর করে জ্বলন্ত অগ্নিশিখার মাঝে খুঁজে বেড়াতে পার। যে একবার আদি মাতৃদেবীর সন্ধান পেয়েছে তাকে আর কোনও কষ্টই ভোগ করতে হয় না। 

মেফিস্টোফেলিস : আমিও এইভাবে বেড়াতে চাই। কিন্তু কোনও ভালো পথ পাচ্ছি না। এই সব জ্বলন্ত আগুনের মাঝে বাঞ্ছিত মনের মানুষকে খুঁজে বেড়ানো ছাড়া আর কোনও উপায় দেখি না। এখন এই ছোট্ট মানবপিণ্ডটাই আলোর দ্বারা পথ দেখাতে পারে। 

হোমুনোলাস : (একটা কাঁচ দিয়ে) এই কাঁচের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠবে তোমাদের প্রচেষ্টা! যাও, অনেক আশ্চর্য বস্তুর সন্ধান পাবে। 

ফাউস্ট : (একা) কোথায় সে? তবে আর কোনও প্রশ্ন নয়। যদি এ মাটিতে কোনওদিন সে পা না দেয়, যদি এখানকার কোনও তরঙ্গ তার আগমনে উত্তাল হয়ে না ওঠে তাহলে এ বাতাসে অন্তত তার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়েছে। কি আশ্চর্য, মনে হচ্ছে। আমি গ্রীসদেশে এসে পড়েছি। আমি তার মাটিতে দাঁড়িয়েছি, মনে হচ্ছে আমি ঘুম থেকে জেগে উঠেছি; আমার শিরায় শিরায় বয়ে যাচ্ছে এক নূতন প্রাণচঞ্চলতা। আমার অনুভূতির মধ্যে আত্রেউস জেগে উঠেছে। এখন আমাকে ঐ চক্রকার আলোক–শিকার ব্যাপারটা খোঁজ করে দেখতে হবে। (প্রস্থান)। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি উদ্দেশ্যহীনভাবে এই সব জ্বলন্ত আগুনের মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছি এবং আমি কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি। উলঙ্গ অবস্থায় গ্রিফিন ও স্ফিংক্স জাতীয় একদল নির্লজ্জ নারী তার মধ্যে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাদের মধ্যে কারও কাছে দেহে জামা বা কিছু আবরণ আছে। তাদের আলুলায়িত কেশপাশ মাথার উপর ছড়ানো। বড় দৃষ্টিকটু। অবশ্য অশালীনতাই আজ আমাদের আদর্শ। আমরা বর্তমানের মন আর প্রচলিত রীতি দিয়ে সব জিনিসকেই যাচাই করে দেখলেও অতীতের এই সব প্রাচীন নিদর্শন লুপ্ত হলেও তারা জীবন্ত এবং অতিবাস্তব। ওদের সঙ্গে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেখা করতে হবে। অতিথিসুলভ সৌজনসহকারে আমি তাদের অভ্যর্থনা জানাব। হে সুন্দরী ধূসরবদনা বায়োপ্রবীণারা, কেমন আছ? 

গ্রিফিনরা : বয়োপ্ৰবীণা? ধূসর, প্রবীণ এসব কথা কেউ শুনতে চায় না। এসব কথা শুনে বিষাদ জাগে মনে। আমাদের লোকে গাল দেয়, সমালোচনা করে। আবার প্রশংসাও করে। কামিনী-কাঞ্চন আর রাজমুকুট কে না চায়?

মেফিস্টোফেলিস : (স্ফিংক্সদের কাছে বসে) তোমাদের মাঝে বসে ভালো লাগছে। সহজ মনে হচ্ছে নিজেকে। আমি তোমাদের সকলকে চিনি। 

স্ফিংক্স : আমাদের প্রেতসুলভ অপ্রাকৃত কণ্ঠস্বর তোমার সংস্পর্শে এসে স্বাভাবিক হলো। এখন নাম ও পরিচয় দাও। 

মেফিস্টোফেলিস : মানুষ আমাকে অনেক নামে ডাকে। এখানে ব্রিটিশ জাতির লোক আছে কি? তারা তো সারা পৃথিবী জুড়ে কত রণক্ষেত্রে ঘুরে বেড়িয়েছে, কত ঐতিহাসিক জায়গায় গেছে। তাদের লেখা অনেক ভালো ভালো পুরনো নাটকে আমার নাম লেখা আছে। 

স্ফিংক্স : কিভাবে তারা তোমাকে জানল?

মেফিস্টোফেলিস : আমি তা জানি না। 

স্ফিংক্স : তোমার কি জ্যোতিষবিদ্যা জানা আছে? কালের প্রকৃতি সম্বন্ধে তোমার কোনও জ্ঞান আছে? 

মেফিস্টোফেলিস : নক্ষত্রপুঞ্জের উপর নক্ষত্রপুঞ্জ কিরণ দান করছে। তার উপর উজ্জ্বল চাঁদ উঠেছে। আমাদের পাথুরে সিংহের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু গরম করে নিচ্ছি। এখন এখান থেকে চলে যাওয়া ঠিক হবে না। এবার কিছু ধাঁধা বলো। 

স্ফিংক্স : নিজের কথা বলল। সেটাই ধাঁধা হয়ে দাঁড়াবে। এখন বলো দেখি এমন কে আছে যে একই সঙ্গে পুণ্যাত্মা ও পাপাত্মার কাছে সমানভাবে দরকারী। 

গ্রিফিনরা : আমরা তাকে পছন্দ করি না। ঐ নোংরা লোকটা আমাদের কেউ নয়। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমরা ভাবছ তোমাদের এই অতিথির নখ আছে, আর তাই দিয়ে আঁচড়ে দেবে। তোমাদের ঠোঁটগুলো তো খুব তীক্ষ্ণ। তাহলে মিল খাবে না? দেখো না পরখ করে একবার?

স্ফিংক্স : যদি ভাল লাগে এখানে থাকতে পার। তবে এখানে তোমার এমনই খারাপ লাগবে যে তুমি চলে যাবে নিজের দেশে। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমাদের উপরের দিকটা খুব একটা সুন্দর না হলেও তার একটা আবেদন আছে। কিন্তু নিচের দিকটা পশুর মতো এবং ভয়ের সঞ্চার করছে আমার মনে। 

স্ফিংক্স : তুমি এক তিক্ত অভিজ্ঞতা লাভ করবে। আমাদের পায়ের থাবাগুলো। যেমন তীক্ষ্ণ, তোমার পায়ের পাতাগুলো তেমনি ঘোড়র ক্ষুরের মতো শক্ত। তবু তুমি অস্বস্তি অনুভব করছ আমাদের মাঝে। (উপরে সাইরেন নামক একজাতীয় পাখির আবির্ভাব)। 

মেফিস্টোফেলিস : অদূরবর্তী ঐ নদীর ধারে পপলার গাছের মাথার উপর যে পাখির দল উড়ে বেড়াচ্ছে ওরা কী পাখি? 

স্ফিংক্স : ওরা সবচেয়ে ভালো জীব। ওরা প্রেম জাগায় মানুষের মনে। 

সাইরেনরা : কুৎসিত লোকদের গায়ের কালো রং দেখলেই বিহ্বল বিমৃঢ় হয়ে। যাও কেন? আমরা ঝাঁকে ঝাকে এসেছি তোমাদের গান শোনাতে। আমাদের মিষ্টি গান প্রেমের গান শোনো। 

স্ফিংক্স : (সাইরেনের সুরে সুর মিলিয়ে) ওই গাছের শাখায় ওদের নামতে বলল। ওরা ওই শাখার আড়ালে ওদের পায়ের তীক্ষ্ণ নখগুলোকে লুকিয়ে রেখেছে। কেউ ওদের গান শুনলেই তাকে ওরা সে নখ দিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে দেবে। 

সাইরেনরা : ঘৃণা ও হিংসা দুটোই দূর করে দাও। আমরা দূর স্বর্গলোক থেকে বিশুদ্ধ পরমাণু নিয়ে আসি। আমরা মধ্যভূমির সর্বত্র জলে স্থলে প্রান্তরে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াই। সে অচেনা পথিক, তোমাদের স্বাগত জানাই। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমাদের গানে কিন্তু নূতনত্ব আছে। তোমাদের কণ্ঠ ও বীণার তারের ঝঙ্কার এক হয়ে অপূর্ব সুর সঙ্গতির সৃষ্টি করেছে। কিন্তু আমার কানে ঢাকের। আওয়াজ শুনছি আমি। অন্য আওয়াজ আমার অন্তরে প্রবেশ করছে না। 

স্ফিংক্স : অন্তর বলো না। বলো চামড়ার এক কুঞ্চিত থলে। অন্তর কথাটা তোমার মুখের সঙ্গে খাপ খায় না। 

ফাউস্ট : কি আশ্চর্য! এই ঘৃণ্য অতিবাস্তব জীবগুলোকে দেখতে আমার ভালো লাগছে। তবে এটাও বুঝছি ভবিষ্যৎ দুর্ভাগ্যের আভাস রয়েছে ওদের মধ্যে। ওদের ঐ। বিষাদগম্ভীরতা আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে। (স্ফিংক্সের দিকে তাকিয়ে) একদিন ঈডিপাসও ওদের কাছে গিয়েছিল। ওদের শরণ নিয়েছিল। (সাইরেনদের দিকে আঙুল বাড়িয়ে) একদিন ওরা ইউলিসেসকে বিভ্রান্ত করেছিল। (গ্রিফিনদের দেখিয়ে) এদের দেখলে মনের নূতন শক্তি পাই। এদের সুন্দর রূপের পানে তাকালে অনেক ভালো ভালো স্মৃতি জেগে ওঠে। 

মেফিস্টোফেলিস : একদিন তুমি এই সব প্রাচীন জীবদের অভিশাপ দিতে। কিন্তু আজ তুমি ওদের দেখে আনন্দ পাচ্ছ। কোনও মানুষ তার প্রিয়তমার খোঁজ করার সময় দৈত্যদানবদেরও খাতির করে। 

ফাউস্ট : (স্ফিংক্সদের সম্বোধন করে) হে নারীমূতি ধারণকারিণীরা, আমার কথা শোনো। তোমাদের কেউ হেলেনাকে দেখেছ? 

স্ফিংক্স : হেলেনার আগেই গ্রীসদেশে আমাদের বংশ ধ্বংস হয়। আমাদের শেষ বংশীয় নিহত হয় হার্কিউলেসের হাতে। তুমি শিরণকে জিজ্ঞাসা করতে পার। এই ভূতুড়ে রাত্রিতে আশা পূরণের সম্ভাবনা উজ্জ্বল। 

সাইরেনরা : ব্যর্থতা তোমার ভাগ্যে নেই। ইউলিসেস আমাদের পাশ দিয়ে সমুদ্র যাবার সময় আমাদের অস্বীকার করেছিল। আমাদের কথা অনেক জেনে পরে সে বর্ণনা করে। সমুদ্রের নীল জলে ছড়ানো আমাদের রূপে মালার সন্ধান করো। সব জানতে পারবে। 

স্ফিংক্স : ইউলিসেসের মতো ওদের কথার ছলনায় এভাবে প্রতারিত হয়ো না। সুপরামর্শের দ্বারা আমরা তোমাকে বরণ করে যাব। শিরণের দেখা যদি না পাও তাহলে। কি করতে হবে আমরা বলে দেব। (ফাউস্টের প্রস্থান)। 

মেফিস্টোফেলিস : (রাগের সঙ্গে) ডানা ঝাঁপটাতে ঝাঁপটাতে সারবন্দিভাবে ওরা কত দ্রুতবেগে উড়ে চলে গেল। কোনও শিকারি ওদের গান শেষ করতে পারবে না। 

স্ফিংক্স : শীতের ঝড়ো হাওয়ার মতো স্টিমফালিরের মতো এবং দ্রুতগামী, অ্যালসিদের শব ওদের নাগাল পায় না। ওদের পাগুলো রাজহাঁস আর ঠোঁটগুলো শকুনির মতো। ওরা কখনও আমাদের কাছে আপন হয়ে আসতে চায় না। 

মেফিস্টোফেলিস : আর একটা জার্নোয়ার কোথায় ফোঁস ফোঁস করছে। 

স্ফিংক্স : ভয় পেও না। বলো তোমার দুঃখের কারণ কি? কেন তুমি অশান্ত চঞ্চল হয়ে উঠেছ? সামনে দেখবে লামিয়ার একদল সুন্দরী বারবণিতা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে। আছে। তাদের অভিবাদন জানাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু তোমরা থাকো এখানে যাতে দরকারের সময় পেতে পারি। 

স্ফিংক্স : হ্যাঁ, তোমার পিছনে ওদের কাছে চলে যাও। হাজার বছর ধরে আমরা মিশর দেশে বাস করে আসছি। আমাদের প্রতি তোমার যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে তোমার ভাগ্য আমরা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রিত করে যাব গ্রহ-নক্ষত্রের বৈরিতা সত্ত্বেও। যুগ-যুগান্তর ধরে অক্ষয় হয়ে পিরামিডের সামনে বসে মানবজাতির সকল কর্মাকর্মের সনাতন সাক্ষীরূপে তাদের বিচার করে চলি। কোনও যুদ্ধ, বন্যা বা বিপর্যয় কোনও ক্ষয়ক্ষতি করতে পারে না আমাদের। 

দ্বিতীয় রাত্রি

(উপনদীবাসিনী জলপরীদের দ্বারা পরিবৃত)

পেলেউস : হে নলখাগড়াগণ, আন্দোলিত হও। মৃদু মর্মরধ্বনিতে তীরবর্তী পপলার গাছগুলোর সঙ্গে কথা বলো চুপিসারে। তাদের স্বপ্নের ব্যাঘাত ঘটাও। ভয়ঙ্কর এক বিপদের আভাস পেয়ে জেগে উঠেছি আমি। এক গোপন ভয়ের শিহরণে কেঁপে কেঁপে উঠছে আমার বুকের শান্ত জল। 

ফাউস্ট : (এগিয়ে এসে) আঙ্গুর ক্ষেত্রের ধারে বনের মধ্যে মানুষের মতো কার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম। মনে হলো নদীর ঢেউগুলো খেলাচ্ছলে কথা বলছে বাতাসের সঙ্গে। 

জলপরীরা : নিরন্তন সন্ধানকার্যে অতিশয় ক্লান্ত হয়ে পড়েছ তুমি। তোমার বিশ্রাম দরকার। এখানে শুয়ে পড়ে তোমার তপ্তক্লান্ত দেহকে শীতল করো। তুমি যখন মধুর বিশ্রামের আস্বাদন গ্রহণ করবে আমরা তখন মৃদুমর্মরধ্বনির মতো কথা বলব তোমার সঙ্গে।

ফাউস্ট : আমি এখন জেগে উঠেছি। আমার দেরি হয় তোক। ওরা কি স্বপ্নের মূর্তি? ঐ সব অনিন্দ্যসুন্দরী মূর্তিরা আমাকে যেখানে খুশি নিয়ে যাক। নদীবিধৌত ঐ শান্তশীতল ঝোঁপের ধারে আমি একটু আগে সত্যিই খুব শান্তিতে ছিলাম। চারদিক হতে অসংখ্য ঝর্না গান গেয়ে বয়ে যাচ্ছিল। ঐ সব সুন্দরীরা নগ্নদেহে যখন সাঁতার কাটছে নদীর স্বচ্ছ জলে, তখন তাদের দেহগুলো প্রতিফলিত হচ্ছে নদীর জলে। তাদের জলকেলির এই দৃশ্যটি মধুর হলেও অদৃশ্য কামনার বস্তুটিকেও আমি ভুলিনি। পত্রাচ্ছন্ন এই বনভূমি ভেদ করে আমার সন্ধানী দৃষ্টি দূরে প্রসারিত হচ্ছে সেই সৌন্দর্যের পরীর সন্ধানে। নদীর বুকে শুভ্র তরঙ্গের মতো বনহংসরা সাঁতার কাটছে। তারা মাঝে মাঝে পালক ছাড়ছে আর কপট দ্বন্দ্বে মেতে উঠছে নিজেদের মধ্যে। পুরুষ হাঁসরা তেড়ে নিয়ে যাচ্ছে মেয়ে হাঁসদের। 

জলপরীরা : হে ভগিনীগণ, নদীর ধারে ঘাসের উপর কান পেতে শোনো, ঘোড়ার ক্ষুরের একটা চলমান শব্দ এগিয়ে আসছে। ভয়ে কাঁপুনি আসছে আমার। এই রাত্রিতে কে কার বার্তা বয়ে নিয়ে আসছে কে জানে! 

ফাউস্ট : দেখো দেখো, শক্তি ও তেজের দ্যোতকরূপী এক অশ্বারোহীর পদভরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে পৃথিবীর মাটি। ওরই কাছে আছে আমার সৌভাগ্য। আমি কি লাভ করব আমার বাঞ্ছিত বস্তু? আমি তাকে না চিনলেও ফিলাইবার ঐ সুদর্শন পুত্রকে অভিবাদন জানাই। থামো শিরণ, আমার কথা শোনেনা। 

শিরণ : কি কথা?

ফাউস্ট : তোমার গতিবেগ স্মরণ করো।

শিরণ : আমার যাবার সময় নেই।

ফাউস্ট : তাহলে আমাকেও তোমার সঙ্গে নাও। আমার অনুরোধ রাখো। 

শিরণ : তাহলে উঠে পড়। কোথায় যাবে? নদীর ধারে দাঁড়িয়ে রয়েছ তুমি। আমি তোমাকে নদী পার করে দেব। 

ফাউস্ট : (ঘোড়ায় উঠে) তুমি কোনদিকে যাবে? হে শক্তিমান পুরুষ, তুমি একটি বীর জাতিকে শিক্ষা দান করতে। গ্রীকজাতির মধ্যে প্রসিদ্ধ হয়ে আছে তোমার নাম। তোমার কার্যাবলি কবিদের মধ্যে ভাবের উদ্রেক করে। 

শিরণ : এসব কথা আর বলতে চাই না। এখন নেস্টর ও প্যালাসকে কেউ শ্রদ্ধা করে না, যেন তারা লেখাপড়া শেখেনি। 

ফাউস্ট : যিনি আতঁকে উদ্ধার করেন, মানুষের দেহমনের ক্ষত সারিয়ে দেন, যার কথা মানুষের অন্তরের মর্মমূলকে আলোকিত করে আমি তাকেই বরণ করে নিতে চাই। 

শিরণ : যখন বীরেরা আমার কাছে আসত, পরামর্শ চাইত, আমি আমার জ্ঞান ও নীতি উপদেশের দ্বারা তাদের সাহায্য করতাম। কিন্তু আজকাল সে কাজ আমি যাজক আর বাঁচাল বুড়িদের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। 

ফাউস্ট : তোমর কথা শুনে বেশ বোঝা যায় তুমি একজন প্রকৃত মহৎ লোক। যিনি নিজের প্রশংসার কথা শুনতে চান না, যিনি মনে করেন তাঁর চারপাশে আজও তার সমকক্ষ ব্যক্তি অনেক আছে। 

শিরণ : মনে হচ্ছে তুমি সাধারণ মানুষ ও রাজা-রাজড়া সবাইকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করতে পার। 

ফাউস্ট : তবে আশা করি একটা কথা তুমি আমায় বলবে। অতীত গৌরবের অনেক কিছু তুমি দেখেছ। এখন বলো, সেকালের সব বীরদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ কে? 

শিরণ : গ্রীকদের মধ্যে এক-একজন বীর এক-একদিকে খ্যাতি লাভ করেন। যেমন ক্যাস্টর ও পোলাক্স দেহগত শক্তি ও বীরত্বে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন এবং বিজ্ঞ ও চিন্তাশীল শাসকরূপে জেসন খ্যাতি লাভ করেন। সর্বশ্রেষ্ঠ বীণাবাদকরূপে মানুষের মন জয় করেন অর্ফিয়াস। আবার বিক্ষুব্ধ সমুদ্রবক্ষে দিনরাত জাহাজচলনায় সর্বাপেক্ষা। পারদর্শী ছিল লাইনেউস। 

ফাউস্ট : কিন্তু হার্কিউলেসের নাম না করে তার প্রতি অন্যায় করেছ তুমি। 

শিরণ : স্বর্গলোকে ফীবাস, অ্যারেস, হার্মিসের লীলা আমি দেখিনি। তবে মর্ত্যভূমিতে দেখেছি এক দেবতার লীলা। কী অপূর্ব তাঁর যৌবনসমৃদ্ধ রাজকীয় রূপ! অবশ্য তিনি তাঁর অগ্রজ ও সুন্দরী রমণীদের কিছুটা বশীভূত ছিলেন। কোনও গাথা তাঁর গুণগান ঠিকমতো করতে পারে না, কোনও মর্মরপ্রস্তর ঠিকমতো তাঁর প্রতিরূপ নির্মাণ করতে পারে না। 

ফাউস্ট : সবচেয়ে সুন্দর পুরুষের কথা বললে। এবার সবচেয়ে সুন্দরী এক নারীর কথা বলো। 

শিরণ : নারীর সৌন্দর্যে কোনও বস্তু আছে বলে আমি মনে করি না। আমি হচ্ছি গুণের উপাসক। দেহগত রূপলাবণ্য যখন গুণাবলির সঙ্গে মিলিত হয় তখনি তা। আকর্ষণ করে মুগ্ধ করে আমাদের। এ বিষয়ে আমি হেলেনাকে শ্রদ্ধা করি, যাকে আমি একদিন আমার পিঠে বহন করেছিলাম। 

ফাউস্ট : তাকে বহন করেছিলে?

শিরণ : আমার এই পিঠে? 

ফাউস্ট : আমি আমার কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না। এ বিষয়ে আরও কিছু বলো। এই হেলেনা হচ্ছে আমার কামনার ধন। একমাত্র উচ্চাশার বস্তু। কোথায় তাকে নিয়ে গিয়েছিলে? 

শিরণ : ব্যাপারটা এমন কিছু কঠিন নয়। দস্যুদের হাত থেকে হেলেনার ভাই ডিসকুরী যখন তাকে উদ্ধার করতে এসেছিল তখন আমি সেখানে ছিলাম। ডাকাতদের ভয়ে ভাই-বোনে যখন পালাচ্ছিল তখন জলাভূমি তাদের গতিরোধ করে। তখন হেলেনা ডুবে যেতে যেতে আমার মাথার চুল ধরে। আমি তাকে আমার পিঠে করে বহন করে উদ্ধার করি। সে আমার মিষ্ট কথায় ধন্যবাদ দেয়। কী অপূর্ব তার যৌবনসৌন্দর্য। 

ফাউস্ট : তার বয়স কত? 

শিরণ : ভাষাতাত্ত্বিকরা নিজেদের যেমন প্রতারণা করে তেমনি তোমাকেও প্রতারিত করেছে। পৌরাণিক সুন্দরীদের কোনও বয়স নেই। তাদের রূপ চিরন্তন। সকল যুগের কবিরা তাদের প্রয়োজন অনুসারে স্মরণ করে। তাদের বয়স বাড়ে না। লাবণ্য ম্লান হয় না। 

ফাউস্ট : তাহলে কালের বন্ধনে তাকে আবদ্ধ করো না। একদিন ফেবার দ্বীপপুঞ্জে একিলিস তাকে যেমন দেখেছিল, আরও সে কালের সব বন্ধনকে অস্বীকার করে ঠিক তেমনিই আছে। অনন্ত রূপযৌবনা এই নারীর প্রেম লাভ করা এক পরম সৌভাগ্যের কথা। আমি কি আমার সারা জীবনের কামনার নিবিড়তার দ্বারা তাকে লাভ করতে পারব না? সেই অক্ষয় দেবীপ্রতিমাসম মূর্তিকে তুমি দেখেছ স্বচক্ষে। আমি দেখেছি। স্বপ্নে। আমার সমগ্র অন্তরাত্মা বাঁধা পড়ে গেছে তার রূপের বাঁধনে। তাকে না পেলে আমি বাঁচব না। 

শিরণ : হে অতিথি, তুমি মরণশীল মানুষ বলেই এত আবেগ অনুভব করছ। আমাদের মনে হচ্ছে তুমি উন্মাদ। তবু মনে হচ্ছে তোমার আশা পূরণ হতে পারে, বছরে একবার করে আমি ম্যান্টোর বাড়ি যাই তার বাবার চিকিৎসার জন্য। তুমি যদি ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করতে পার তাহলে মনে হয় সে তার শক্তি দিয়ে তোমার মনের রোগ সারাতে পারবে। তার সে ক্ষমতা আছে। 

ফাউস্ট : কিন্তু আমার এ রোগ সারবে না। আমার লক্ষ্য হচ্ছে বিরাট। আমি লক্ষ্যভ্রষ্ট হব না কখনও। 

শিরণ : কিন্তু তার রোগনিরাময় ক্ষমতাকে অবহেলা করতে পার না। তাড়াতাড়ি নামো, এসে গেছি। 

ফাউস্ট : উপলখণ্ডে আকীর্ণ এই নদীবক্ষের উপর দিয়ে এই রাত্রিতে কোথায় নিয়ে এলে? 

শিরণ : এই সেই স্থান যেখানে একদিন গ্রীস আর রোম তাদের শক্তি পরীক্ষা করে। এখানে অলিম্পাস প্রাসাদের পদতল বিধৌত করে পেলেউস নদী বয়ে গেছে। ধীরে ধীরে বালুকাবেলায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় এ দেশ। রাজা-রাজড়ারা সব কোথায় পালিয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে আছে শুধু একটি মন্দির, চাঁদের আলোর চূড়াটি যার চকচক করছে। 

ম্যান্টো : অশ্বক্ষুরধ্বনিতে কাঁপছে মন্দিরের সিঁড়িগুলো। নিশ্চয় কোনও উপদেবতা আসছে। 

শিরণ : ঠিক তাই। তোমার চোখ খুলে দেখো কে এসেছে।

ম্যান্টো : এস! তোমার কথা কখনও মিথ্যা হয় না।

শিরণ : তোমার মন্দির আজও তোমাকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ম্যান্টো : এখনও সমান গতিতে ছুটে চলেছ তুমি? 

শিরণ : তুমি যখন শান্ত হয়ে বসে থাকো, আমি তখন চঞ্চল গতিতে ছুটে চলার মধ্যে আনন্দ পাই। 

ম্যান্টো : আমি বসে বসে প্রতীক্ষা করি আর আমার চারদিকে অশান্ত কালের ঢাকা আবর্তিত হয়। কিন্তু এ কে? 

শিরণ : আজকের রাত্রির ঘূর্ণাবর্তে ও তোমার কাছে এসে পড়েছে। ও হেলেনার জন্য পাগল হয়ে উঠেছে। তাকে ও লাভ করবেই। কিন্তু কোথায় কিভাবে তাকে পাবে তা জানে না। তবে ও তার সত্যিই যোগ্য। 

ম্যান্টো : সে অসম্ভবকে কামনা করে আমি তাকে ভালোবাসি। 

শিরণ : হে হঠকারী এগিয়ে এস। ভবিষ্যতের এক সুখসম্ভার প্রতীক্ষায় আছে তোমার জন্য। এই অন্ধকার পথ তোমাকে নিয়ে যাবে পার্সিফোনোতে। অলিম্পাস পাহাড়ের সানুদেশে সে প্রতীক্ষায় থাকবে। একবার অতীতে আমি অর্ফিয়াসকে লুকিয়ে নিয়ে গিয়েছিলাম সেখানে। সাহসের সঙ্গে ভাগ্য পরীক্ষা করো। (অন্ধকার সুড়ঙ্গপথে নামল) 

তৃতীয় রাত্রি 

পেলেউসের উত্তরাঞ্চল (আগের মতো)

সাইরেনরা : পেলেউস নদীর শীতল তরঙ্গমালায় অবগাহন করো। জলকেলি করো। স্তোত্রগান হচ্ছে। কত হতভাগ্যদের উদ্ধার করি আমরা। জল ছাড়া জীবনের কোনও অর্থ হয় না। নীল ঈজিয়াস সাগরের ঢেউ-এর আরও আনন্দ আছে। আছে আরও উজ্জ্বলতা। (ভূমিকম্প) একি, নদীর ঢেউগুলো উল্টোদিকে বইছে। নদীর বুক কাঁপছে প্রবলভাবে। পাথুরে কূলগুলো ফেটে যাচ্ছে, ভেঙে যাচ্ছে। চলো, পালিয়ে যাই আমরা, এখানে থাকা নিরাপদ নয়। ভূমিকম্প ভয় দেখাচ্ছে আমাদের। আমরা সমুদ্রে গিয়ে অবাধে জলকেলি করব, সমুদ্রে স্নান করে রাত্রির স্নিগ্ধ শিশিরে সজীব হয়ে উঠব আমরা। আমরা যথাশক্তি প্রয়োগ করে উপরে ওঠার চেষ্টা করছি। 

স্ফিংক্স : এ কী ভীষণ কম্পন! এক ভয়ঙ্কর কম্পনের প্রবলতায় সব কিছু কাঁপছে দুলছে। চারদিকে ভীতিবিহ্বল জীবরা ছোটাছুটি করছে। কিন্তু আমরা কোনও স্থান পরিবর্তন করব না। আমরা এখানেই অধিষ্ঠিত থাকব। কি আশ্চর্য, একটা বিরাট প্রাসাদের চূড়া উপরে উঠছে। সেই প্রাচীন বৃদ্ধ যিনি এক গর্ভবতী নারীর জন্য সমুদ্রের মাঝখানে ডেলস দ্বীপের সৃষ্টি করেন তিনিই এ ভূমিকম্প সংঘটিত করেন। অসহিষ্ণু আটলাসের মতো তিনি পৃথিবীর সবুজ আঁচলটাকে ওলটপালট করে দিচ্ছেন। নদীর কূল, জল সব এক হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সম্মুখস্থ উপত্যকাও ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে। যেন এক দৈত্য কাঁধে এক বিরাট বোঝা নিয়ে টলতে টলতে আসছে। কিন্তু আমাদের কাছে আর এগোতে পারবে না।

সীসমস : এ কাজ আমার একার। এর জন্য যা কিছু প্রশংসা সব আমার প্রাপ্য। আমি যদি মাঝে মাঝে এভাবে পৃথিবীকে না কাঁপিয়ে তুলি তাহলে পৃথিবী কখনও এত সুন্দর থাকতে পারে না। আমি যদি অত চেষ্টা করে একইভাবে না কাঁপাতাম তাহলে পাহাড়গুলো উঁচু মাথায় ছবির মতো ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকত না। আমি অনেক সহ্য করে সমুদ্রের গম্ভীর হতে পাহাড়গুলোকে টেনে তুলেছি। 

স্ফিংক্স : আমরা তার সাক্ষী আছি। এইভাবে টেনে না তুললে পাহাড়গুলোকে পাহাড় বলে মনেই হতো না। এক ঘন বন চারদিকে প্রসারিত করে এই সব পাহাড়ের মুখগুলোকে ঢেকে রেখেছে। তার মাঝখানে আমরা স্ফিংক্সবেশে নিরাপদেই বাস করছি। আমাদের আসন কেউ টলাতে পারবে না। 

গ্রিফিনরা : চারদিকে সোনা ছড়িয়ে পড়ে রয়েছে অন্ধকারে। এমেটরা, তাড়াতাড়ি যাও। তা না হলে অন্যেরা দেখে ফেলবে। 

এমেটদের কোরাস : থাক পাহাড়। পাহাড় ডিঙিয়ে ঝর্ণার ধারে গিয়ে চকচকে সোনাগুলোকে কুড়িয়ে আনন। একটু কষ্ট করো। 

গ্রিফিনরা : নাও নাও, তাড়াতাড়ি সোনা কুড়িয়ে জড়ো করো। যারা সবচেয়ে বেশি কর্মক্ষম তারাই সবচেয়ে বেশি সম্পদ লাভ করে সঞ্চয় করে। 

পিগমিরা : আমরা কোথা হতে কেমন করে এসেছি তা বলতে পারব না। তবে আমরা এখানে ভালোভাবেই প্রতিষ্ঠিত। আমাদের মতো খর্বকায় নরনারীদের ধরিত্রীমাতা পুবে-পশ্চিমে সৃষ্টি করে আমাদের জীবনকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। আমাদের সুখ ও সৌভাগ্য দান করেছেন। 

পিগমিদের প্রধান : এখন আমাদের একমাত্র শত্রু হলো ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা ঐ সব বক ও সারস পাখিগুলো। তাড়াতাড়ি শক্তি সঞ্চয় করে তীর-ধনুকসহ ঐ সব শত্রুদের সম্মুখীন হও। ওরা সংখ্যা অগণ্য। ওদের তীরবিদ্ধ করো। ওদের পালক আমাদের শিরস্ত্রাণে শোভা পাবে।

সারস পাখিরা : কে আমাদের বাঁচাবে? কে আমাদের মুক্ত করবে পরাধীনতার বন্ধন থেকে নিষ্ঠুর পিগমিরা আমাদের সকলকে হত্যা করছে। আর্তের ভয়ার্ত চিৎকারে আকাশ-বাতাস মুখরিত। তাদের প্রতি অপরিসীম ঘৃণা নিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমরা সহজেই উত্তরে ডাইনিদের দমন করেছি। কিন্তু এই বিদেশে আমার কোনও শক্তি নেই। জায়গাটার নাম ব্লকর্সবার্গ। জায়গাটা মন্দ নয়। এখানে এক সমতলবর্তী বনপথের উপর দিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ একটা পাহাড় পেয়ে গেলাম। পাহাড়টা ওদিকের স্ফিংক্সটাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। পাহাড়ের সানুদেশে চারদিকে আগুন জ্বলছে আর ল্যামি নামে অদ্ভুত ধরনের মেয়েরা নাচগান ও হৈ-হুঁল্লোড় করছে। ডাইনিদের রাজা হেনরি আর রানি ইলস পাহাড়ের উপর পাথরের সিংহাসনে বসে আমাকে লক্ষ করছে। কোথাও কোনওভাবে পালাবার উপায় নেই। আমি লুকিয়ে আড়াল থেকে ওদের নাচগান দেখে এক গোপন আস্বাদ পাচ্ছি। 

ল্যামিরা : তাড়াতাড়ি ধরো ওকে। কই হে পাপাত্মা যাদুকর, আমাদের পিছু পিছু এস। পা টেনে টেনে চলছে। আমাদের সঙ্গ নিতে পারছে না। আমাদের ধরতে পারছে না।

মেফিস্টোফেলিস : কী অভিশপ্ত আমাদের ভাগ্য। সেই আদি পিতা আজকের আমল থেকে এই নারীজাতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আসছি আমরা। আমাদের যথেষ্ট বয়স বাড়লেও সে পরিমাণে জ্ঞান বাড়ে না। আমরা জানি ওদের মধ্যে কোনও বস্তু নেই। তবু বারবার ঠকে যাই ওদের কাছে। ওদের অর্ধনগ্ন দেহজ আর রংমাখা মুখ দেখে ভুলে যাই। ওরা স্বভাবতই দুর্বল, কোনও অঙ্গের উপর নির্ভর করা যায় না। সব জেনেও ওদের প্রতিটি কণ্ঠধ্বনিতে শুনি বাঁশির সুর আর তাতে নেচে উঠি আমরা। 

ল্যামিরা : থামো থামো, ও ভাবছে। ওরা গতি শ্লথ হয়েছে। পিছন ফিরে দেখো, তা না হলে পালিয়ে যাবে। 

মেফিস্টোফেলিস : (লম্বা লম্বা পা ফেলে) এগিয়ে চলো। যে সংশয় আমার শক্তিকে বিকল করে দিচ্ছে আমি তাকে প্রশ্রয় দেব না। শয়তান ডাইনিদের সহ্য করবে না তো করবে কাদের! 

ল্যামিরা : আমাদের মধ্যে কাউকে ও ভালোবাসার জন্য বেছে নিতে পারে।

মেফিস্টোফেলিস : ধিক, কৃত্রিম সাজগোজের মধ্যেও সুন্দরী দেখাচ্ছে তোমাদের।

এমুলুসা : (ল্যামিদের কাছে এগিয়ে এসে আমাকেও তোমাদের দলে নাও। আমি তোমাদের সঙ্গে মিশবার যোগ্য। 

ল্যামিরা : ও আমাদরে খেলার আনন্দ সব নষ্ট করে দেয়। 

এমুলুসা (মেফিস্টোফেলিসকে) তোমার পায়ে ঘোড়ার ক্ষুর আর আমার পায়ে গাধার ক্ষুর। তবু তোমাকে ভালোই দেখাচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : হে বিদেশিনী, আমি এটাই ভেবেছিলাম। আমি আমার আপনজন পেয়ে গেছি। হাংস থেকে হেলাস দ্বীপ পর্যন্ত ঘুরে এরকম অনেক আপনার লোক পেয়ে গেছি। 

এমুলুসা : আমি অনেক রূপ পরিগ্রহ করতে পারি। তবু তোমার সম্মানার্থে বর্তমানে গাধার মাথা গ্রহণ করেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি এখানে অনেক বড় ঘটনা আশা করছি। তবে যাই ঘটুক কেন, আমি এই গাধার মাথাওয়ালা মেয়েটিকে ছাড়ব না।

ল্যামিরা : ওকে ছেড়ে দাও, মেয়েটা কুৎসিত। ওর মধ্যে কোনও লালিত্য নেই। ও যেখানেই যায় সেখানকার সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু তোমাদেরও আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। মনে হচ্ছে তোমাদের গোলাপী গালের সৌন্দর্যের অন্তরালে কোনও অসৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। 

ল্যামিরা : কিন্তু খুঁজে দেখো, আমরা সংখ্যায় অনেক আছি। তোমার পকেটে পয়সা থাকলে ভালো জিনিসই পাবে। আমরা এক অদ্ভুত প্রেমিক চাই যে বিজ্ঞের মতো বড় বড় কথা বলবে এবং আমাদের মধ্যে একজনকে বেছে নেবে। পরে ধীরে ধীরে তার মুখোশ খুলে যাব আর স্বরূপটা বেরিয়ে পড়বে। 

মেফিস্টোফেলিস : (একজনকে ধরে) সবচেয়ে সুন্দরী পেয়ে গেছি। …কী অপ্রত্যাশিতভাবে ঝাঁটা খেলাম। (অন্য একজনকে ধরে) কিন্তু এই মেয়েটা… না। কি কুৎসিত মুখ। 

ল্যামিরা : নিজেকে এর থেকে সৌভাগের উপযুক্ত বলে ভেবো না কখনও। 

মেফিস্টোফেলিস : ওই বেঁটে মেয়েটা আমার মনে ক্ষুধা জাগালেও টিকটিকির মতো আমার হাতের ফাঁক গলে গেল। ও এত ছোট। ওর এই মাথার চুলগুলো সাপের মতো কিলবিল করছিল। আবার ঐ লম্বা মেয়েটাও দেখতে খারাপ। এরপর? ঐ মোটা মেয়েটাকে ধরব। হয়ত ওর মাঝেই আমি পাব আকাক্ষিত আনন্দ। তুর্কীরা ঐ রকম মোটা মেয়ে চায়। কিন্তু হায়, ফাপা বলের মতো মেয়েটা ফেটে যাচ্ছে। 

ল্যামিরা : চারদিকে ছড়িয়ে পড়, চক্রাকারে ঐ ডাইনির বেটাকে ঘিরে ধরো। ও আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছে। নিঃশব্দে উড়ে বেড়িয়ে ডানার ঝাঁপটা দাও। ও পালিয়ে যাচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি এখানে এসে বোকা বনে গেছি। উত্তরের থেকে এ জায়গাটা আরও খারাপ। আমি চেয়েছিলাম মুখোশ নৃত্যের এক সুন্দর নিটোল অনুষ্ঠান। কিন্তু তার বদলে দেখছি যত ভয়ঙ্কর ভূতুড়ে কাণ্ড। (পাহাড়ের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলল) আমি কোথায় আছি? কোথায় যাচ্ছি? সমতল পথের উপর দিয়ে আমি হাটছিলুম, হঠাৎ দেখি, সামনে পর্বতপুঞ্জ। বৃথাই আমি তাতে ওঠানামা করছি। পথ খুঁজে পাচ্ছি না। সেই স্ফিংক্সই বা কোথায়? এই রাত্রিটা কাটে কি করে? 

পার্বত্য দেবতা ওরিয়াজ : এস আমার কাছে। আমার এই পাহাড় বহু প্রাচীন। আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে একদিন পম্পে মৃত্যুবরণ করে। সকাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এ পাহাড় অদৃশ্য হয়ে যাবে কোথায়, কোন গহ্বরে নেমে যাবে, খুঁজেই পাবে না। 

মেফিস্টোফেলিস : ওক গাছের মালা গলায় দেওয়া হে প্রধান, তোমাকে শ্রদ্ধা জানাই। স্বচ্ছ চাঁদের আলো পত্রাচ্ছন্ন অন্ধকারকে বিদীর্ণ করতে পারে না। হঠাৎ আমি ঝোঁপের মধ্যে এক উজ্জ্বল আলো দেখছি। মনে হয় নিশ্চয় ও হচ্ছে হোমুনোলাস। কোথা হতে আসছ হে স্বপ্নালু প্রেমিকমশাই? 

হোমুনোলাস : এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় অনেক দূরে বেড়িয়েছি আমি অশান্ত চিত্তে। কিন্তু এতদিন ধরে কি পেলাম, কি দেখলাম! বস্তুর মধ্যে কোনও সত্যকে খুঁজে পাচ্ছি না। এই পথে আমি ছজন দার্শনিকের দেখা পাই। তারা প্রকৃতি প্রকৃতি বলে চিৎকার করছিল। আমি তাদের আঁকড়ে ধরে থাকব। তারা নিশ্চয় পার্থিব প্রকৃতির মধ্যে সত্যকে খুঁজে পেয়েছে। সেই সত্যকে আমিও জেনে আমি আমার পথ খুঁজে নেব, উপযুক্ত যুক্তির সঙ্গে নীতি খাড়া করব। 

মেফিস্টোফেলিস : তা যদি করতে চাও নিজের চেষ্টায় তা করো। এখানে নরক থেকে যে ভূতের দল আসে তার মধ্যে দার্শনিকদেরও পাবে। কিন্তু কোনও ফল হবে না তাতে। নিজের চেষ্টায় সত্যকে খুঁজে পাবার জন্য কাজ শুরু করে দাও। 

হোমুনোলাস : সৎ পরামর্শ প্রত্যাখ্যান করতে নেই। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে তোমার পথে তুমি চলে যাও। পরে দেখা হবে। (উভয়ের প্রস্থান) 

অ্যানাকজাগোরাস (থেলস্‌কে) : তোমার অনমনীয় মনকে নরম করা গেল না। তুমি বোঝার চেষ্টা করো। 

থেলস্ : যে কোনও বাতাসের কাছে বড় বড় ঢেউরা আত্মসমর্পণ করে। কিন্তু পাহাড় থেকে তারা দূরে থাকে। পাহাড়ের কাছে নত হয় না তারা। 

অ্যানাকজাগোরাস : উষ্ণ উত্তপ্ত বাষ্পরাশি থেকেই ঐ সব পাহাড়ের উৎপত্তি হয়।

থেলস্ : আর্দ্রতা বা জল থেকেই জৈব জীবনের উৎপত্তি হয়।

হোমুনোলাস : আমি কি তোমাদের সঙ্গে যেতে পারি? আমি মানুষ হতে চাই। 

অ্যানাকজাগোরাস : বলো থেলস্, তুমি কি একরাতের মধ্যেই কর্দমাক্ত জল থেকে ঐ সব পাহাড়গুলো তুলে এনেছ? 

থেলস্ : প্রকৃতি ও তার চিরপ্রবহমান শক্তি কখনও দিনরাতি প্রভৃতি কোনও কালখণ্ডের সীমা বা শাসন মেনে চলে না। প্রকৃতি আপন নিয়মে সব বস্তুকে সৃষ্টি করে চলে। 

অ্যানাকজাগোরাস : কিন্তু পৃথিবীর গর্ভনিহিত বিরাট আগ্নেয় শক্তি বিস্ফোরণে ফেটে পড়ে পৃথিবীর বুক ফাটিয়ে অগ্নদগারের সময় ঐ পাহাড়গুলোকে তুলে দেয়। 

থেলস্ : কিনতু তার ফলে কি হবে? পাহাড়গুলো তো দাঁড়িয়েই থাকবে। এ বিবাদে শুধূ অনর্থক সময় নষ্ট হয়। 

অ্যানাকজাগোরাস : এই সব পার্বত্য অঞ্চলে মার্মিডন, পিগমি, এন্মেটেস, অঙ্গুলিপ্রমাণ ক্ষুদ্রাকার প্রভৃতি কর্মঠ প্রাণীরা বাস করে। তারা সব সময় কর্মব্যস্ত থাকে। (হোমুনোলাসকে) তুমি কখনও বড় হতে চাওনি। আত্মপ্রসাদের মধ্য দিয়ে দিন কাটিয়েছ। তুমি তোমার মনকে সংযত করতে পারলে আমি তোমাকে ঐ সব ক্ষুদ্রকায় কর্মঠ মানুষদের রাজা করে দেব। 

হোমুনোলাস : কিন্তু থেলস্ কি বলেন? 

থেলস্ : আমি এ পরামর্শ দেব না। কারণ ছোট পথে ঘোট কাজই হয়। বড় পথ ছোট মানুষকেও বড় করে তোলে। কারণ ওখানে গোলমাল লেগেই আছে। প্রথমে বড় বড় সারস পাখিরা ঠোঁট দিয়ে ছোট ছোট পিগমিদের ঠোকরাত, পা দিয়ে মাড়াত। তখন পিগমিরা প্রতিশোধ বাসনায় উন্মত্ত হয়ে তীর-ধনুক দিয়ে সারস পাখিদের নির্বিচারে হত্যা করে থাকে। তাদের পালক দিয়ে মাথার শিরস্ত্ৰণ সাজায়। তখন সারস পাখিরা পালিয়ে যায়। 

অ্যানাকজাগোরাস : (একটু থেমে) আমি পাতালবাসী কোনও দেবতার শক্তিতে বিশ্বাসী নই। আমি চাই উধ্বতম কোনও দৈবশক্তির সাহায্য। ডায়েনা, লুপ ও হিকেট এই ত্রিনামধারিণী হে চন্দ্রদেবী, তুমি যেমন তোমার স্নিগ্ধ কিরণ-জাল ছড়িয়ে দাও, যেমনি সমস্ত মায়ার আবরণ ত্যাগ করে তোমার প্রাচীন শক্তির স্বরূপ উদ্মঘাটিত করো। (একটু থেমে) আমার কথা কি দেবী শুনতে পেয়েছেন তাঁর কক্ষপথে? আমার আকুল আবেদন কি আকাশে গিয়ে পৌঁছেছে? ঐ দেখো চন্দ্রদেবীর গোলাকার সিংহাসনটা ক্রমশই বড় হয়ে এগিয়ে আসছে, কাছে আসছে। যেন এক বিশাল রক্তবর্ণ অগ্নিগোলক। কিন্তু আর এগিয়ে এসো না। তাহলে এ পৃথিবীর জলভাগ স্থলভাগ সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। থেসালীয় পাইথেলেসদের মতো ধ্বংস হয়ে যাব আমরা। কিসের গর্জন শুনতে পাচ্ছি? বক্স না মত্ত প্রভঞ্জন? তবে কি কোনও অন্যায় কথা বলে ফেলেছি? ক্ষমা করো দেবী। 

থেলস : এই লোকটি কত কি যে দেখতে পায় ও শুনতে পায়। কিন্তু কি ঘটল আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না। সময়টা দুর্যোগঘন হলেও চাঁদ মেঘমুক্ত অবস্থায় শান্তভাবে কিরণ দিচ্ছে আগের মতো। 

হোমুনোলাস : ঐ দেখো, অদূরবর্তী ঐ গোলাকার সূচল মাথা পাহাড়টায় পলাতক পিগমিরা আশ্রয় নিয়েছে। আমি অবাক হয়ে দেখলাম চাঁদ থেকে ঐ পাহাড়টা হঠাৎ পড়ে গেল। ঐ পাহাড়টার মধ্যে যারা ছিল সব নিষ্পেষিত হয়ে গেল। 

থেলস্ : চুপ করো। যাও, তুমি সমুদ্রে যাও, এখানে তোমার স্থান হবে না। তুমি পিগমিদের রাজা বা প্রশাসক হওনি ভালোই হয়েছে। (সকলের প্রস্থান)। 

মেফিস্টোফেলিস : (পাহাড়ের উল্টোদিকে উঠে) ওক গাছে ঘেরা এই খাড়াই পাহাড়টায় আমাকে কি উঠতে হবে? 

ড্রায়েদ : শান্ত হও। এখানেই ভালো থাকবে। অন্য কোথাও তুমি আর কোনও চাতুর্য দেখাতে পারবে না। আর বাড়ি যেতে চেয়ো না। এখানে এই সব সুপ্রাচীন ওক গাছের মাঝে থেকে যাও। তাদের শ্রদ্ধা করো। 

মেফিস্টোফেলিস : প্রয়োজনই কোনও স্থানকে স্বর্গ করে তোলে। কিন্তু অদূরে ঐ গুহার মধ্যে কি এক অদ্ভুত আকারের বস্তু রয়েছে বোঝা যাচ্ছে না। 

ড্রায়েদ : ওরা হচ্ছে ফোর্কিয়ারা। সাহস থাকে তো যাও তাদের কাছে। কথা বলো ওদের সঙ্গে। 

মেফিস্টোফেলিস : কেন যাব না? অবশ্য স্বীকার করছি ওদের দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি। এখন কুৎসিত জীব আমি কখনও দেখিনি। নরকেও আশা করা যায় না। এই সুন্দর গ্রীসদেশে এমন জীব বেমানান। আমাকে দেখে বাদুড়ের মতো ওরা কিচমিচ করছে। প্রাচীনতার জন্য তাদের খ্যাতি আছে এখনও। 

ফোর্কিয়াদরা : কই আমাকে একটা চোখ দাও তো। দেখি কে আমাদরে মন্দিরে এল। 

মেফিস্টোফেলিস : হে ত্রিমূর্তিধারিণী দেবীরা, তোমরা তিনমুখে আমার আশীর্বাদ করো। আমি দূর অজানা দেশ থেকে আসছি। আমি বহু দেবদেবী দেখেছি ওপসরীয়া প্রভৃতি বহু জায়গায়। তোমাদের মতো কোনও দেবী কোথাও দেখিনি। 

ফোর্কিয়াদরা : এই প্রেতটার বুদ্ধি আছে। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি কোনো কবি তোমাদের গুণগান করেনি। করবেই বা কি করে? তোমাদের রূপের কোনও ছবি নেই, কোনও প্রতিমূর্তি নির্মিত হয়নি অন্যান্য দেবদেবীদের মতো। 

ফোর্কিয়াদরা : স্তব্ধনিবিড় নির্জনতায় ঢাকা এই অন্ধকার গুহায় যুগ যুগ ধরে পড়ে আছি আমরা। ওসব কিছু ভাবতেই পারি না। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে কি করে কি হবে? এখানে তোমরা কাউকে দেখতে পাবে না। কেউ তোমাদের দেখতে পাবে না। তোমরা এমন কোথাও উঠে যাও যেখানে আছে শিল্প আর সমৃদ্ধি। সেখানে তোমাদের মূর্তি নির্মিত হবে। 

ফোর্কিয়াদরা : থামো থামো। স্বপ্ন জাগিও না। আমদের মনে। কি লাভ তাতে? আমরা অন্ধকারের জীব অন্ধকারেই থাকতে চাই চিরকাল। আমরা নিজেদের ভালো করে চিনি না। অপরকেও চিনতে চাই না।

মেফিস্টোফেলিস : তোমাদের আমি একটা চোখ আর একটা দাঁত দিতে পারি। তোমাদের তিনটে মাথা তা ভাগ করে নেবে। 

ফোর্কিয়াদরা : তুমি একটা চোখ বন্ধ করো।

মেফিস্টোফেলিস : তাই করলাম। এবার আমাকে দেখো। ঝগড়া বিশৃঙ্খলার অধিষ্ঠাত্রী দেবীর একচক্ষু পুত্র আমি। 

ফোর্কিয়াদরা : আর আমরা তার কন্যা। আমাদের তিনজনের একটামাত্র চোখ ছিল, এখন হয়েছে দুটো। দুটো দাঁত। কি সুন্দর লাগছে সব কিছু। 

মেফিস্টোফেলিস : এ রূপ আর কাউকে দেখাব না। একেবারে নরকে গিয়ে শয়তানদের ভয় দেখাব। (প্রস্থান)। 

চতুর্থ রাত্রি

ঈজিয়ান সাগরের তীরবর্তী পার্বত্য গুহা 

আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছিল

সাইরেনরা : এর আগে তাদের কৃষ্ণকুটিল যাদুবিদ্যাদ্বারা বদমাশ থেসালীয় বুড়ির অসৎ উদ্দেশ্যে তোমাকে নিচের দিকে টানতে থাকে। তার জন্য তুমি বেঁকে গেছ ধনুকের মতো। তোমার বুকে কত কুঞ্চনরেখা দেখা দিয়েছে। কিন্তু সুন্দরী চাঁদ, আর ভয় নেই। এবার অবাধে বিচ্ছুরিত করো তোমার কিরণমালা। 

নেরেইদরা ও ট্রিটনরা : আরও উচ্চরবে গান গেয়ে সমুদ্রের গভীরতম প্রদেশের জীবদের ডাক। যখন প্রবলবেগে ঝড় বইতে থাকে তখন আমরা সমুদ্রের গভীরে চলে যাই। আমরা সেখানে গান গাই, মণি-মাণিক্য ও রত্নরাজির দ্বারা ভূষিত কবি নিজেদের। এই রত্নরাজি হলো জলমগ্ন জাহাজের ভেসে যাওয়া সম্পদ। 

সাইরেনরা : সমুদ্রের শান্তশীতল জলতলে কত রকমের মাছ খেলা করে। কিন্তু তোমরা মাছের থেকে ভিন্ন এক প্রাণী। 

নেরেইদরা ও ট্রিটনরা : এখানে আসার আগে আমরা এ ব্যাপারটা অনেক চিন্তা করেছি। ভেবেছি আমরা কারা? হে আমাদের প্রিয় ভাই ও বোনেরা, আরও দুরে চলো। দেখিয়ে দাও তোমরা মাছের থেকে ভিন্ন কোনও জীব। (প্রস্থান) 

সাইরেনরা : ওরা পালিয়ে গেছে এখান থেকে সামোগ্রেসে। অনুকূল বাতাস ওদের সাহায্য করেছে। ওরা সেখানে কি করবে কে জানে? আশ্চর্য দেবতা ওরা। ওরা নিজেদের বার বার নূতন করে গড়ে তোলে। কিন্তু নিজেদের দেহ ওরা দেখতে পায় না। হে চাঁদ, মধ্য আকাশে তুমি স্থির হয়ে কিরণ দিতে থাকো। যেন এ রাত্রি এখন শেষ না হয়, যেন দিনের আলোর তীক্ষ্ণ তাড়না অনুভব না করি। 

থেলস (হোমুনোলাসকে) : আমার ইচ্ছা আমি তোমাকে প্রাচীন নেরেউসের কাছে নিয়ে যাই। তার আস্তানা থেকে আমরা খুব দূরে নেই। সে বড় একগুয়ে। বদমেজাজই তার একমাত্র ঘৃণ্য রোগ। এই ধরনের লোকদের কেউ সন্তুষ্ট করতে পারে না। ভবিষ্যতের কথা বলতে পারে বলে লোকে শ্রদ্ধা করে এবং অনেকে অনেক উপকারও পেয়েছে তার কাছ থেকে। 

হোমুনোলাস : তাহলে আর দেরি বা দ্বিধা না করে তার কাছে চলো। কাঁচের জারে আমার আগুন এখনও নিভে যায়নি। 

নেরেউস : আমি আমার কানে মানুষের কণ্ঠস্বর শুনছি না? সঙ্গে সঙ্গে ক্রোধ জাগছে আমার মধ্যে। ঐ সব মানুষগুলো ছোট হয়ে দেবতার মতো আকাশচুম্বী উচ্চাশায় মত্ত হয়ে ওঠে। প্রাচীনকালে আমি সৎ ব্যক্তিদের কিছু উপকার করার চেষ্টা করতাম। কিন্তু পরে দেখলাম আমার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। 

থেলস্ : হে সমুদ্রসংলগ্ন প্রবীণতম ব্যক্তি, আমরা তোমাকে শ্রদ্ধা করি। তুমি বিজ্ঞ, আমাদের নিরাশ করে তাড়িয়ে দিও না। মানুষের আকার ধারণকারী এই অগ্নিপুঞ্জকে দেখো। এ তোমার কাছে কিছু পরামর্শ চায়। 

নেরেউস : কি পরামর্শ? মানুষ সৎ পরামর্শকে শ্রদ্ধা করেছে? অমনোযোগীর কানে জ্ঞানের কথা বৃথাই ঝরে পড়ে। মানুষ আগের মতোই স্বেচ্ছাধীন রয়ে গেছে। তারা যা খুশি তাই করে চলে এক বিদেশী নারীর কামনায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে প্যারিসকে আমি সাবধান করে দিয়েছিলাম। সে যখন গ্রীসদেশে পা দিয়েছিল তখন তাকে খুব উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। আমি তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, অশেষ দুঃখের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম অসংখ্য নরহত্যা, অগ্নিকাণ্ড ও ট্রয়নগরীর ধ্বংসের কথা যা শুনে হাজার বছর ভয়ে শিউরে উঠবে পৃথিবীর মানুষ। আমার কথা খেলাচ্ছলে উড়িয়ে দেয় সে। স্বাধিকার প্রমত্ত প্যারিস নিজের কামনার দাস হয়ে ছুটে চলে তার পিছনে; ফলে পতন ঘটে ইলিয়াম নগরীর। পিন্ডারাসের ঈগলরা উল্লসিত হয়ে ওঠে নরমাংসের ভূরিভোজে ইউলিসিসকেও আমি যাদুকরী ও ক্যালিপসোর কথা বলে সাবধান করে দিয়েছিলাম। কিন্তু তাতেও কোনও ফল হয়নি তার। অবশ্য পরে সে দেশে অতি কষ্টে প্রত্যাবর্তন করে। 

থেলস্ : এই ধরনের হঠকারী আচরণ বিজ্ঞ লোকের সত্যই বেদনার কারণ হয়ে ওঠে। তবু যারা সদাশয় ব্যক্তি তারা পরোপকার করে থাকেন। অমিত অকৃতজ্ঞতার মাঝে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতাও তাঁদের সব শ্রমকে সার্থক করে তোলে। আমরা যা জানতে চাইছি তা তুচ্ছ ব্যাপার নয়। এই বালকটি পৃথিবীর মাটিতে জন্মলাভ করতে চায়। 

নেরেউস : আমার মেজাজ খারাপ করে দিও না। আমার হাতে এখন অনেক কাজ। আমি সমুদ্রদেবতা ডোরিয়েদদের অনুরোধে অনুকূল তরঙ্গ ও বাতাসে ভর করে এখানে এসেছি। এখানে যে সব সুন্দরী জলদেবী অলিম্পাসে আছে তাদের দেখতে পাবে না। তাদের দেহগুলো এত হালকা আর সুন্দর যে তারা ঢেউ-এর ঘোড়ায় চেপে খেলা করে। শুভ্র ফেনপুঞ্জের উপর শোভা পায়। এদের রানি গ্লেটিয়া হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দরী। এখন তোমরা প্রোতিয়াসে চলে যাও। এখানে এক আশ্চর্য ভবিষ্যদ্বক্তা আছেন তার কাছে যাও। (সমুদ্রের মাঝে চলে গেল )। 

থেলস্ : এখানে কিছু পেলাম না আমরা। প্রোতিয়াসে যিনি আছেন তিনি এমন সব কথা বলেন যা অর্থ কিছু বোঝা যায় না। যাই হোক, তোমার যখন পরামর্শ একান্তই দরকার তখন সেখানেই চলো। (উভয়ের প্রস্থান) 

পাহাড়ের উপর থেকে সাইরেনরা।

সমুদ্রেরর ঢেউএর উপর কারা নাচছে? তাদের দেশে মনে হচ্ছে অনূকূল বাতাসে সাদা পাল তুলে ভেসে যাওয়া জাহাজ। ওরা হচ্ছে সমুদ্রকন্যা। আমরা ওদের কাছে যাব। ওদের রূপ দেখব, ওদের কথা শুনব। 

নেরেউসরা ট্রিটানরা : আমরা হাতে করে যে দৈত্যাকার জীবদের নিয়ে আসছি তারা হচ্ছে এক ধরনের দেবতা। তোমরা গান গেয়ে তাদের তুষ্ট করো। অনেক ভালো। ফল পাবে। 

সাইরেনরা : দেখতে আকারে ছোট, শক্তিতে বিরাট এই প্রাচীন দেবতারা সমুদ্ৰাঞ্চলে মানুষের উদ্ধারকর্তা।

নেরেউসরা : এদের বলে কাবিরি। আনন্দ করো। এদের কুপা লাভ করলে বিক্ষুব্ধ সমুদ্র শান্ত ও অনুকূল হয়। 

সাইরেনরা : আমরা মেনে নিলাম তোমার কথা। কোনও জাহাজডুবি হলে তোমরা নাবিকদের উদ্ধার করো। 

নেরেউসরা : তিনজন দেবতাকে আমরা এখানে এনেছি। আর একজন আসতে চাননি। অনেকে বলে তিনিই নাকি খাঁটি। 

সাইরেনরা : দেবতায় দেবতায় ঝগড়া-মারামারি চলে। আমরা কিন্তু সব দেবতাকেই সম্মান করে চলব। কারণ তারা সব অশুভ শক্তির বিনাশ সাধন করেন। 

নেরেউসরা : তাঁরা হলেন সংখ্যায় সাত।

সাইরেনরা : আর তিনজন কোথায়? 

নেরেউসরা : একথা আমরা বলতে পারব না। অলিম্পাসে গিয়ে জিজ্ঞাসা করো। এই সব অতুলনীয় অদম্য দেবতারাও ক্ষুধায় জ্বলছেন। তারা আরও অনেক কিছু চান। 

সাইরেনরা : আমাদের কাজ হলো সেই দেবতার উপাসনা করা যিনি সূর্য ও চন্দ্রকে নিয়ন্ত্রিত করেন। 

নেরেউস : এঁদের নিয়ে উৎসব করার মধ্যে আছে এক বিরাট গৌরব। 

সাইরেনরা : অতীতের যত সব বীরেরা অনেক গৌরব যশ ও স্বর্ণসম্পদ লাভ করেছে। কিন্তু তারা কাবিরির মতো লক্ষ্মীদেবীকে লাভ করতে পারেনি। 

হোমুনোলাস : এই সব বিকৃত চেহারার মেয়েগুলোর প্রত্যেকের হাতে একটা করে মাটির পাত্র আছে। এদের পিছনে বৃথা ছুটে চলে কত বিজ্ঞ লোক মাথা ফাটিয়েছে। 

থেলস্ : এটাই জগতের রীতি। টাকা যত পুরনো হয় ততই তার দাম বাড়ে। এইভাবেই মানুষ অভিজ্ঞতা লাভ করে। 

প্রোতিয়াস : (দুর্নিরীক্ষা অবস্থায়) অজানিত বস্তুই বেশি সম্মান পায়।

থেলস্ : কোথায় তুমি প্রোতিয়াস?

প্রোতিয়াস : (কখনও কাছে কখনও দূরে) এই যে এখানে। এখানে। 

থেলস্ : তুমি কোন মায়াময় স্থান থেকে কথা বলছ? এইভাবে বিভ্রান্তিকর কথা শুনে তোমার বন্ধুর সঙ্গে রসিকতা ও প্রতারণা করো না। 

পোতিয়াস : (দূর থেকে) বিদায়। 

থেলস্ : (হোমুনোলাসকে) উনি কাছে এসে গেছেন। এবার তুমি উজ্জ্বলভাবে জ্বলে ওঠ। উনি মাছের মতো পিচ্ছিল । যে কোনও আকারেই থাকুন আগুনের শিখা দেখলে এখানে এসে হাজির হবেন।

হোমুনোলাস : আলোর প্লাবন বইয়ে দেব। কিন্তু খুব ধীরে। তা না হলে কাঁচ ফেটে যাবে। 

প্রোতিয়াস : (বিরাটকায় কচ্ছপের বেশে) কিসের এত আলো জ্বলছে? 

থেলস্ : (হোমুনোলাসকে ঢেকে রেখে) দয়া করে একটু কাছে এস। দেখো। দয়া করে মানুষের আকার ধারণ করে আমাদের কথা শোনো। 

প্রোতিয়াস : (ভালো মূর্তি ধারণ করে) তুমি কি ভালো কথা, জ্ঞানের কথা বলতে ভুলে গেছ? 

থেলস্ : এখনও তুমি মানুষের আকার ধারণ করনি। (হোমুনোলাসকে বার করে) প্রোতিয়াস : এক উজ্জ্বল বামন! এ মূর্তি কখনও দেখিনি। 

থেলস্ : সে তোমার পরামর্শ চায়। সে মানুষ হয়ে জন্মাতে চায়। সে এখন অর্ধজাত মাত্র। মানসিক সব গুণ ও উপাদান তার আছে। কিন্তু সে গুণ সে উপাদান বাস্তরে রূপ পাচ্ছে না। একমাত্র কাঁচের জারে ও আশ্রয় পেয়েছে। ওই তার আধার। 

প্রোতিয়াস : তুমি হচ্ছ আসল কুমারীর পুত্রসন্তান। জন্মের আগেই তোমার মৃত্যু ঘটবে। 

থেলস্ : (চুপি চুপি) আর একটি দিক দিয়ে বিপদ আছে। মনে হয় ও উভয়লিঙ্গ। 

প্রোতিয়াস : তাহলে অচিরেই সাফল্য লাভ করবে। এখানে ওর জন্ম নিয়ে জল্পনা কল্পনা না করে ওকে এখনি মাঝ সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে কাজ শুরু করতে বলল। ধীরে ধীরে ও উন্নতির উচ্চ শিখরে আরোহণ করবে। 

হোমুনোলাস : এখানকার বাতাসটা বড় স্নিগ্ধ আর সুগন্ধি। আমার বড় ভালো লাগছে। 

প্রোতিয়াস : যত দূরে যাবে ততই ভালো লাগবে আরও। ভাসতে ভাসতে আমার সঙ্গে এস দূর সমুদ্রে। ঢেউগুলো তোমার চারদিকে বয়ে যাবে। কিন্তু তোমার অগ্নিশিখা বা জ্যোতিকে ধ্বংস করতে পারবে না তারা। 

থেলস্ : আমিও যাব।

হোমুনোলাস : কোনও অপদেবতার সহায়তায় তিনগুণ শক্তিশালী। 

পঞ্চম রাত্রি

রোডসনিবাসী টেলশিনেরা 

জল-অশ্ব ও ড্রাগনজাতীয় জলজন্তুদের কোরাস

প্রাচীন সমুদ্রদেবতার জন্য আমরা এক ত্রিশূল এনেছি যা দিয়ে জোভপ্রেরিত মেঘমালা বিদীর্ণকারী প্রমত্ত ঝঞ্ঝার প্রহারে উৎক্ষিপ্ত তরঙ্গরাশিকে শান্ত করব। এখন সমুদ্রদেবতা বজ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। সমুদ্রের গর্ভ থেকে ঢেউ-এর পর ঢেউ উঠছে। আমরা তবু স্বচ্ছন্দে ভেসে চলেছি। এই দ্বন্দ্বে সমুদ্রদেবতারই জয় হবে। 

সাইরেন : তোমাদের এখন হেলিয়ম যেতে হবে। উজ্জ্বল দিন আসবে। চাঁদের উপাসনা সার্থক হবে।

টেলশিনেরা : হে সুন্দরী চন্দ্রদেবী, তোমার ভাই আকাশে উদিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর সর্বত্র। গ্রাম, নগর, পাহাড়, প্রান্তর, নদী সমুদ্র সব আলোকিত হয়ে ওঠে সে আলোয়। সব দ্বীপপুঞ্জগুলি কুয়াশামুক্ত হয়। তখন ফীবাসের যৌবনোজ্জ্বলমূর্তি পরিদৃশ্য হয়। আমরাই প্রথম স্বর্গস্থ দেবতাদের মানুষের আকারে দেখার জন্য সাধনা শুরু করি। 

প্রাতিয়াস : ওদের বড়াই করতে দাও, দেবতাদের গুণগান করতে দাও। সূর্যালোক থেকে সব প্রাণের উদ্ভব হয় স্বীকার করি। কিন্তু সারা জীবন ধরে মানুষ যা কিছু সৃষ্টি করে তা সব ক্ষণস্থায়ী। তা সব তুচ্ছতায় বিগলিত হয়ে যায়। এমনকি কঠিন ব্রোঞ্জনির্মিত মূর্তিও ভূমিকম্পে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। মানুষের সব শ্রমই পণ্ড হয় একদিন। একমাত্র এই সমুদ্রই তোমাকে দান করতে পারে এক উন্নত জীবন। (প্রোতিয়াস নিজেকে এক বিরাট রঙিন মাছে রূপান্তরিত করল) আমার পিঠের ওপর চাপো। আমি তোমাকে প্রাচীন সমুদ্রদেবতার কাছে নিয়ে যাব। 

থেলস্ : ওঁর কথা শোনো। সেখানে যাও। অসংখ্য রূপের মধ্য দিয়ে বিবর্তিত হয়ে তুমি একদিন মানুষের আকার ধারণ করবে। প্রথম মানুষ হিসাবে সৃষ্ট হবে। 

হোমুনোলাস প্রোতিয়াসের পিঠের উপর চাপল

প্রোতিয়াস : বিদেহী আত্মারূপে তুমি অনন্ত জলরাশির সঙ্গে ছড়িয়ে থাকবে। তুমি হবে স্বাধীন, অবাধ এবং চিরমুক্ত। এর বেশি কিছু চেও না। মানুষের আকার একবার পেলেই অসংখ্য বাধা আর অপরিপূর্ণতায় আবদ্ধ হয়ে পড়বে তুমি। 

থেলস্ : তবু সবাই তাই চায়। মানুষ প্রকৃত মানুষ হয়ে মহত্ত্ব লাভ করতে চায়। 

প্রোতিয়াস : তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ দীর্ঘদিন বাঁচে। যেমন তোমাকে দেখছি। কয়েক শত বছর ধরে বাঁচতে। 

সাইরেনরা : (পাহাড়ের উপর থেকে) দেখো দেখো। চাঁদকে ঘিরে কেমন ছোট ছোট মেঘখণ্ডগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। ওরা যেন প্রেমের তাড়নায় উড়ে বেড়ানো লঘুপক্ষ কপোত। আমাদের উৎসবটা মুখর হয়ে উঠবে আনন্দে। 

নেবেউস : তোমরা যাই ভাব, ওরা আসলে বনকপোতের দল। এক আশ্চর্য আবেশে ওরা আমার কন্যার রথের চারপাশে ভিড় জমায়। 

শিল্পী ও মার্সি (জলজ জন্তুর দল) : সাইপ্রাসের উপকূলের কাছে গভীর সমুদ্রগর্ভে আমরা জলদেবী সাইপ্রিসের রথটিকে সযত্নে রক্ষা করে চলেছি। এবং রাত্রিকালে সেটিকে ঢেউ-এর উপর দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যাই। ঈগল অথবা পাখাওলা উড়ন্ত সিংহ অথবা কোনও প্রলয়ঙ্কর প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ভয় করি না আমরা। 

সাইরেনরা : হে নেরেউস পরীরা, চক্রাকারে নাচতে নাচতে এসে আমাদের ঘিরে ফেলল। ডোরাইদরাও এস, আদিমাতা গ্লেটিয়াসকে নিয়ে এস। তিনি হচ্ছেন মানবিক মাতার মতোই স্নেহময়ী। 

ডোরাইদরা : হে চন্দ্রদেবী, আমাদের আলো দাও, ছায়া দাও। আমাদের যৌবনসৌন্দর্যকে কুসুমিত করো। আমাদের প্রিয়তম সাথীদের আমরা নিয়ে এসেছি পিতৃপুরুষের কাছে প্রার্থনা করার জন্য। (নেরেউসের প্রতি) এই সব যুবকদের আমরা সমুদ্রতরঙ্গের ভয়ঙ্কর কবল হতে রক্ষা করেছি। যত সব জলজ আগাছা আর শ্যাওলার উপর তারা শুয়েছিল। আজ তারা জীবন ফিরে পেয়েছে। নিবিড় চুম্বনের দ্বারা তারা কৃতজ্ঞতা জানাবে আমাদের। সে দেবী, তুমি তাদেরও দয়া করো। 

নেরেউস : তোমরা দুদিক থেকে লাভবান হলে। তোমাদের উপকারের প্রতিদান হিসাবে কৃতজ্ঞতা ও আনন্দ দুই-ই পেলে। 

নেরেউস : যা পেয়েছ তা দিয়ে আনন্দ করো। কিন্তু আমি তোমাদের কোনও বর দিতে পারব না। তা সে বর একমাত্র দিতে পারেন জিয়াস। এই তরঙ্গায়িত সমুদ্রে কোনও প্রেম কখনও দাঁড়াতে পারে না। ওদের প্রতি তোমাদের আসক্তি কমে গেলে ওদের স্থলভাগে পাঠিয়ে দাও।

ডোরাইরা : হে সুন্দর যুবকগণ, তোমাদের ছেড়ে দিতে হবে। তবু শপথ করে বলছি তোমাদের আমরা ভালোবাসি। আমরা চিরন্তন সত্যকে চাই। কিন্তু দেবতারা আমাদের তা দেবেন না। 

যুবকরা : আমরা এই মৎস্যজীবী যুবকরা তোমাদের প্রেমের প্রতিদানস্বরূপ চিরদিন তোমাদের ভালোবেসে যাব। আমরা নূতন জীবনের আস্বাদ পেয়েছি যা আগে কখনও পাইনি। (রথের উপর গ্নেটিয়ার আবির্ভাব) 

নেরেউস : হে আমার প্রিয় কন্যা, এসেছ?

গ্লেটিয়া : হে পিতা, আজ কী আনন্দ! হে বর্ণালী মৎস্যকনারা থামো। নাচো। 

নেরেউস : তারা এইমাত্র চক্রাকারে নাচতে নাচতে চলে গেল। অন্তরের গভীরতম অনুভূতির কোনও খবর রাখে না তারা। তারা একবার যদি আমাকে সেখানে নিয়ে যেত। আনন্দের বস্তু একবার দেখে আমি সারাজীবনের নীরস নিরানন্দ দিনগুলো ভুলতে পারতাম। 

থেলস্ : আমি বড় আনন্দ অনুভব করছি অন্তরে। আজ আমি সত্য ও সৌন্দর্যের পূর্ণ মিলন দেখছি স্বচক্ষে। জল থেকেই হয় এ বিশ্বের সৃষ্টি। জলই সবকিছু বাঁচিয়ে রাখে। হে সমুদ্রমাতা, যদি তুমি মেঘাকর্ষণ না করো তাহলে নদীগুলো জলপূর্ণ হবে না, তাহলে কোনও কিছুই বাঁচবে না। 

নেরেউস : এখনও ঘুরে ঘুরে নাচছে তারা। তবে তার মুখোমুখি নেই তারা প্রেমিকদের সঙ্গে। গ্লেটিয়ার রথটা এখন দূরে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল করছে। প্রকৃত ভক্তি ও ভালোবাসা এমনি করে উজ্জ্বল তারকার মতো দূরে ও নিকটে জ্বলজ্বল করতে থাকে। 

হোমুনোলাস : এই জলজগতে যা কিছু দেখছি তাই সুন্দর দেখাচ্ছে। 

প্রোতিয়াস : এই আর্দ্র জলজগতেই তোমার জীবনদীপ থেকে সুন্দর ধ্বনি উত্থিত হচ্ছে। 

নেরেউস : নৃত্যরত এই জনতার মধ্য হতে কি এক রহস্য উঘাটিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনে? রানির পায়ের কাছে কি এক অগ্নিশিখা জ্বলছে আর নিবছে। মনে হচ্ছে প্রেমের চপলমতি আবেগের দ্বারা দীপ্ত ঐ অগ্নিশিখা। 

থেলস্ : ও হচ্ছে হোমুনোলাস। প্রোতিয়াস ওকে ভুল পথে নিয়ে গেছে। ঐ প্রজ্বলিত অগ্নিশিখা হলো ওর অন্তরের জ্বলন্ত কামনার ব্যাকুলতা। রানির সিংহাসনের কাছে অধৈর্য হয়ে আবেদন জানাচ্ছে। কিন্তু ও চলে যাচ্ছে বলে আলোটা নিভে যাচ্ছে। 

সাইরেনরা : নৈশ সমুদ্রতরঙ্গের মাঝে আলোর কি চমৎকার খেলা! হে অনন্ত সমুদ্রের আলোক-পরিবৃত্ত অগণ্য তরঙ্গমালা, হে অনন্ত জলরাশি, তোমরা আমাদের অভিবাদন গ্রহণ করো। হে ক্ষিতি, অফ, মরুৎ, তেজ নামধারী শক্তি-চতুষ্টয়, তোমাদের প্রণাম। 

তৃতীয় অঙ্ক

স্পার্টা। মেনেলাসের রাজপ্রাসাদ 

বন্দিনী ট্রয়রমণীদের কোরাসসহ হেলেনার প্রবেশ ।

হেলেনা : বহু প্রশংসিত ও বহু নিন্দিত আমি হেলেনা দূর বিদেশ হতে পসেডনের কৃপায় অসংখ্য সমুদ্রতরঙ্গে প্রবলভাবে দোলায়িত হবার পর অবশেষে স্বদেশের উপকূলে এসে উঠেছি। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিচে দাঁড়িয়ে আছেন বীর যোদ্ধা মেনেলাস। সে উন্নত প্রাসাদ, তোমাকে একদিন আমার পিতা টিন্ডারাস প্যালাস পর্বত হতে ফিরে এসে নির্মাণ করেন এবং তোমার মাঝেই আমি একদিন ভগিনীসম ক্লাইতেমেস্ত্রে, ক্যাস্টর ও পোলাক্সের সঙ্গে খেলাধুলা করে দিন দিনে বেড়ে উঠি। আজ আমাকে গ্রহণ করো। একদিন মেনেলাস এই প্রাসাদেই আমাকে বধূরূপে বেছে নেন। তারপর এক দস্যু সুদূর ফার্জিয়ায় অপহরণ করে নিয়ে যায় আমাকে। তারপর হতে সে অভিশপ্ত দুর্ঘটনা ঘটে যায় তা নিয়ে এক বিরাট রূপকথা গড়ে ওঠে। 

কোরাস : হে সুন্দরী, যে অতুলনীয় সৌন্দর্যরূপসম্পদ তুমি লাভ করেছ তা অবহেলা করো না। কারণ সবচেয়ে বলদর্পিত বীরও এই সৌন্দর্যের কাছে নত হয়ে আত্মসমর্পণ করে। 

হেলেনা : যাক। এখন আমার স্বামী তাঁর নগরে নিয়ে যাবার আগে জাহাজে করে এখানে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তার আসল উদ্দেশ্য কি তা এখনও বুঝতে পারিনি আমি। আমি কি শুধু তাঁর স্ত্রী হয়েই থাকব না রানি হব আবার? অথবা সমগ্র গ্রীকদেশে আবার সুদীর্ঘকাল ধরে যে দুঃখ-বিপর্যয় ভোগ করে তার জন্য আমাকে বলি দেবেন? আমার জগৎজোড়া সৌন্দর্যের খ্যতি ও আমার নিয়তিকে এক করে তার ভুল অর্থ করে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকেন আমার স্বামী। স্বদেশে ফেরার পথে জাহাজে আমার সামনে বসে থেকেও একটা কথাও বলেননি আমার সঙ্গে। অবশেষে ইউরোতাসের উপকূলে জাহাজ থামলে তিনি আমাকে বললেন, আমি আমার যোদ্ধাদের নিয়ে এখানেই নেমে পড়ছি। এই জাহাজে করে তুমি ল্যাসিডিমনের সমভূমিতে অবস্থিত প্রাসাদে গিয়ে ওঠ। পরে আমি সেখানে যাব। সেখানে দাস-দাসীরা আমার ও তোমার পিতার দেওয়া সঞ্চিত ধনসম্পদ রক্ষা করে রেখেছে। সেখানে সব কিছুই ভোগ করতে পাবে। 

কোরাস : সেই সব সঞ্চিত ধনরাশি ভোগ করো এখন। তুমি প্রাসাদের অভ্যন্তরে গিয়ে দাসদাসীদের কাছে গিয়ে বলো। অমূল্য রত্নরাজিতে মণ্ডিত হয়ে উঠুক তোমার দেহসৌন্দর্য। 

হেলেনা : আমার স্বামী তারপর গম্ভীরভাবে নীরসভাবে আরও বলেন, সব ধনরত্ন দাসীদের কাছ থেকে বুঝে নিয়ে দেবপূজার জন্য নির্দিষ্ট পাত্রগুলো নিয়ে ঝর্না থেকে পবিত্র জল নিয়ে আসবে। শুকনো জ্বালানি কাঠ ও তীক্ষ্ণ একটি ছুরি ঠিক করে রাখবে। কিন্তু তিনি পূজার বলির জন্য কোনও পশুর কথা বললেন না। আমি কিছু বুঝতে পারছি না। সব দেবতার বিধানের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। দৈব বিধানে যা হবার হবে। আমাদের তা সহ্য করতেই হবে। অনেক সময় বলির উপর উদ্যত খড়গ কোনও শত্রু বা দেবতার হস্তক্ষেপে ব্যর্থ হয়ে যায়। 

কোরাস : হে রানি, কে হবে না হবে তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করবেন না। সাহস অবলম্বন করুন। আশীর্বাদ ও অভিশাপ অপ্রত্যাশিতভাবেই আসে মানুষের জীবনে। যুদ্ধ, ট্রয়নগরীর ধ্বংস, মৃত্যুর বিভীষিকা প্রভৃতির কথা কিছুই জানতে চাই না আমরা। আপনার মতো একজন জগতের শ্রেষ্ঠ রূপবতী ও দয়াবতী রমণীর সাহচর্যে আমরা ধন্য। মুক্ত আকাশের তলে প্রদীপ্ত সূর্যালোক উদ্দীপিত আপনার দেহসৌন্দর্য অবলোকন করে আমরা তৃপ্ত। 

হেলেনা : যা ঘটে ঘটুক। অবিলম্বে আমি প্রাসাদে যাব। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় কেন ভয় হচ্ছে আমার? শৈশবে যে সহজ নির্ভীকতার সঙ্গে আমি এখানে ওঠানামা করতাম আজ তা খুঁজে পাচ্ছি না কেন? 

কোরাস : হে আমার প্রিয় বোনেরা, দুঃখিনী বন্দিনী, সব দুঃখ ঝেড়ে ফেলো। তোমাদের যে রানি হেলেনা দীর্ঘকাল পরে তাঁর পিতৃগৃহে প্রবেশ করছে, তার আনন্দে অংশগ্রহণ করো। তোমাদের মুক্তিদাতা দেবতাদের ধন্যবাদ দাও। নিজেদের দুর্গপ্রাকারে যে বন্দিনী একদিন উদ্বাহু হয়ে মুক্তি কামনা করতেন আজ তিনি মুক্তপক্ষ বিহঙ্গের মতো উড়ে এসেছেন আনন্দে। আসলে এক দেবতাই তাকে ছিন্নমূল করে ধরে নিয়ে যায় এবং আজ তাঁকে এই প্রাচীন অথচ অধুনা অলঙ্কৃত পিতৃগৃহে এনে দিয়েছে। তাঁর যৌবনদিনের অকথ্য অশেষ দুঃখবেদনার অবসান ঘটেছে। 

প্যাসথালিস (কোরাসনেত্রী) : আনন্দপরিবৃত গানের পথ ত্যাগ করে দরজার দিকে তাকাও। কি দেখছ বোনেরা? আমাদের রানি নয়? কিন্তু হে রানি, কেন কম্পিত পায়ে। প্রবেশ করছেন এ গৃহে? আপনার মুখচোখের উপর স্পষ্ট ফুটে উঠেছে এক প্রবল বিতৃষ্ণা আর ঘৃণামিশ্রিত ক্রোধ। 

হেলেনা : সাধারণ ভয় নয়, সুদূর অতীত রাত্রির ভয়ঙ্কর গর্ত হতে যেন এক বিভীষিকা বাধা দিচ্ছে আমাকে প্রবেশপথে। তবু আমি পালিয়ে যাব না। হে অজানিত অতিপ্রাকৃত দৈবশক্তি, তুমি যেই হও, উপযুক্ত পূজার অঞ্চলিদানে তুষ্ট করব তোমায়। তারপর গৃহ শুদ্ধ করে গৃহিণীরূপে কর্তৃত্বভার গ্রহণ করব। 

কোরাসনেত্রী : হে রানি, তোমার দাসদাসীদের চিনে নাও। 

হেলেনা : আমি যা দেখছি তোমরাও চোখ দিয়ে তাই দেখতে পাচ্ছ। আমি যখন নীরবে বারান্দা দিয়ে যাচ্ছিলাম তখন কোনও কর্মব্যস্ত দাসদাসী চোখে পড়েনি। কোনও দাসীকে দেখিনি। স্থূলাঙ্গী প্রধানা দাসীকে পরে দেখতে পেয়ে আমি এক কাজের আদেশ দিলে সে হাত দিয়ে আমাকে চলে যেতে বলল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখি একরাশ ছাই জমে রয়েছে। আমি প্রধানা দাসীর কাছ থেকে ধনাগারে গিয়ে দেখি রক্তচক্ষু ভয়ঙ্কর চেহারার এক জীব আমাকে তেড়ে এল। আমার স্বামী ফিরে না আসা পর্যন্ত এ বাড়ির কর্তৃত্বভার গ্রহণ করতে পারব না। (দরজার কাছে ফোর্কিয়াদের আবির্ভাব) 

কোরাস : আমার অভিজ্ঞতা অনেক। আমি দেখেছি অনেক বীরের শোক, ইলিয়ামনগরীর পতন। সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের মাঝে আমি শুনেছি দেবতাদের কণ্ঠস্বর। বীর যোদ্ধাদের সেই ভয়ঙ্কর যুদ্ধের সঙ্গে দেখেছি ব্যাপক অগ্নিকাণ্ড। কিন্তু তোমাদের অদ্ভুত আকৃতি দেখে ভয় হচ্ছে আমার। তোমরা কারা, কে তোমাদের জন্মদাতা? তোমরা চলে যাও এখান থেকে। ফীবাস, যিনি কোনও ছায়া বা অন্ধকার সহ্য করেন না, তিনি তোমাদের কুৎসিত রূপ সহ্য করবেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সৌন্দর্যের উপাসক হয়েও তোমাদের মতো ঘৃণ্য জীবদের দেখে চক্ষুকে পীড়া দিতে হচ্ছে। শোনো, যদি তোমরা না যাও, নিয়তির অভিশাপ তোমাদের ভোগ করতে হবে। 

ফোর্কিয়ারা : ‘লজ্জা আর সৌন্দর্য পাশাপশি চলতে পারে না’–এই প্রবাদবাক্যটা প্রাচীন হলেও সত্য। একে অন্যকে পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় দেখলেই মুখ ফিরিয়ে নেয়। লজ্জা সব সময় গভীর বিষাদে মগ্ন আর বার্ধক্যজর্জরিত না হওয়া পর্যন্ত সৌন্দর্য মত্ত হয়ে থাকে অহঙ্কারে। আজ দেখছি তোমরাও নির্লজ্জ অন্ধকারে মত্ত হয়ে একদল কলমুখর দুষ্ট সারস পাখির মতো উড়ে এসেছ এখানে। কেন তোমরা ভয়ঙ্কর মিলাদদের মতো এ প্রাসাদে এসে উঠলে? এখানকার প্রধানা দাসীকে আক্রমণ করলে? আমার মনে হয় তোমাদের দেখে একদল পঙ্গপাল আমাদের দেশের মাঠের সব শস্য খেয়ে ফেলেছে। মানুষের সব শ্রম পণ্ড করে দিচ্ছে। 

হেলেনা : কোন অধিকারে দাসী হয়ে গৃহিণীর কর্তৃত্ব ও প্রভৃত্বকে আক্রমণ করতে এসেছ? স্বীকার করছি আমরা যখন ছিলাম না, যখন যুদ্ধক্ষেত্রে বা জলপথে ব্যস্ত ছিলাম তখন তোমরা এ প্রাসাদ ভালোভাবেই রক্ষণাবেক্ষণ করেছ। কিন্তু এ বাড়ির গৃহিণী যখন ফিরে এসেছে তখন তোমাদের আত্মসমর্পণ করা উচিত। একথা না শুনলে শাস্তি পেতে হবে তোমাকে। 

ফোর্কিয়ারা : বুঝেছি, বহুকাল পরে রানিরূপে এ গৃহের কর্তৃত্বভার গ্রহণ করতে চাও। রাজার কাছে সে অধিকার লাভ করেছ। ঠিক আছে তাই করো। ধনরত্ন যা আছে সব নাও। কিন্তু আমাকে রক্ষা করো। আমি এদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তোমার রূপের কাছে এদের সবাইকে হাঁসের মতো মনে হচ্ছে। 

কোরাসনেত্রী : সুন্দরের পাশে কুৎসিতকে বেশি কুৎসিত মনে হয়। 

ফোর্কিয়ারা : বুদ্ধির পাশে নির্বুদ্ধিতাকে আরও বেশি খারাপ লাগে।

(কোরাসদল ও ফোর্কিয়াদের মধ্যে ঝগড়া ও কথাকাটাকাটি চলতে লাগল)

কোরাসদল: ভয়ঙ্কর নরমাংসভোজী জীব তোমরা।

ফোর্কিয়ারা : তোমরা হচ্ছ রক্তচোষা ভূত।

হেলেনা : আমি ক্রুদ্ধ হইনি। দুঃখের সঙ্গেই তোমাদের এই সব ঝগড়া-বিবাদ বন্ধ করতে বলছি। কোনও গৃহকর্তা ঘরে ফিরে বিশ্বস্ত ভৃত্যদের ঝগড়াঝাটি শুনতে চান না। তার উপর তোমাদের মালিক এমনিতেই বিব্রত। আমি দেখছি দাসীরা কাঁপছে। কিন্তু তুমি তাদের থেকে সবচেয়ে বড়। ভদ্রভাবে কথা বলল। 

ফোর্কিয়ারা : আজ তুমি দেবতাদের কৃপায় সৌভাগ্যের শিখরে আবার উন্নীত হয়েছ। কিন্তু অতীত জীবনে বহু কামনাবিধুর প্রেমার্থীর সঙ্গলাভ করতে হয়েছে। একবার কামনার উত্তপ্ত হার্কিউলিসের মতো শক্তিধর থিসিয়াস তোমাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। 

হেলেনা : তার ঔরসে আমার গর্ভে এক সন্তানের জন্ম হয়। যে থিসিয়াস আমাকে অ্যাট্রিকায় আমাকে বন্দি করে রাখে। 

ফোর্কিয়ারা : তারপর ক্যাস্টর পোলাক্স তোমাকে মুক্ত করে প্রেম নিবেদন করে তোমায়। 

হেলেনা : তবু স্বীকার করছি আমার গোপন আসক্তি ছিল প্যাট্রোক্লাসের প্রতি।

ফোর্কিয়ারা : পিতার ইচ্ছায় নৌযুদ্ধবিশারদ মেনেলাসকে বিবাহ করো।

হেলেনা : আমাদের এই বিবাহ থেকে হার্মিওনের জন্ম হয়। 

ফোর্কিয়ারা : তবু মেনেলাস যখন ক্রীটদেশে যান দাবি জানাতে, তুমি যখন একা ছিলে প্রাসাদে তখন এক সুদর্শন অতিথি আসেন। 

হেলেনা : আমার অতীত জীবনের এই প্রায়বৈধব্যদশা ও তার আনুষঙ্গিক ধ্বংসাবলীর কথা কেন মনে পড়িয়ে দিচ্ছ? 

ফোর্কিয়ারা : সেখানে গিয়ে বন্দিনীরূপে দীর্ঘকাল দাসত্ব ভোগ করতে হয় তোমায়? অথবা অফুরন্ত প্রেমের আনন্দ ভোগ করো? 

হেলেনা : সে আনন্দের কথা আর বলো না। অফুরন্ত দুঃখ এসে জমা হয় আমার বুকে। 

ফোর্কিয়ারা : তবু লোকে বলে তোমাকে একই সঙ্গে ইলিয়াম ও ঈজিপ্টে দেখা যায়। 

হেলেনা : আমার অভিভূত চেতনাকে আর বিব্রত করে তুলো না। এখন আমি বলতে পারব না আমি কে। 

ফোর্কিয়ারা : আবার লোকে বলে একিলিসও তোমার প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। ভাগ্যের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সে তোমাকে ভালোবাসে। 

হেলেনা : মনে মনে স্বপ্নের মাঝে তার সঙ্গে হয়েছিল আমার বিবাহ। আমি আর পারছি না। (মূৰ্ছিত হয়ে ঢলে পড়ল) 

কোরাস : থামো থামো। ভেড়ার চামড়াঢাকা নেকড়ে কোথাকার। একটিমাত্র দন্তবিশিষ্ট ভয়ঙ্কর মুখগহ্বর থেকে এর থেকে ভালো কথা আর কি আশা করা যায়? আবার কখন কোথায় হিংসার বিষ ছড়াবে? অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের গর্ভ থেকে সব খারাপ কথা তুলে নিয়ে এসো। থামো থামো, রানি নড়ে উঠেছেন। (হেলেনা চেতনা ফিরে পেয়ে উঠে দাঁড়াল।) 

ফোর্কিয়ারা : ক্ষণকালের জন্য অচৈতন্যের অন্ধকার মেঘমালায় দিবালোকের মতো তোমার যে উজ্জ্বল দেহসৌন্দর্য আচ্ছন্ন হয়েছিল এতক্ষণ এখন তা আবার প্রকটিত হয়ে আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। সে সৌন্দর্য আমাদের কুৎসিত রূপকে নীরব ভাষায় ধিক্কার দিলেও আমি সৌন্দর্যের মর্ম বুঝি। 

হেলেনা : মূৰ্ছা হতে চেতনা ফিরে পেলেও আমি বড় ক্লান্ত। ঠিকমতো পা ফেলে চলতে পারছি না। তথাপি রানি হিসাবে আমাকে সাহস অবলম্বন করতেই হবে। 

ফোর্কিয়ারা : রাজকীয় গৌরবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তুমি এবার আমাদের আদেশ করো কি করতে হবে। 

হেলেনা : এতক্ষণ ঝগড়া করতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে। রাজার আদেশ, দেবতাদের কাছে পূজার বলি দেবার ব্যবস্থা যথাশীঘ্র করো। 

ফোর্কিয়ারা : সব কিছু প্রস্তুত–জল, পাত্র, ছুরি। কিন্তু বলির পশুর নাম বলো।

হেলেনা : রাজা সে কথা কিছু বলেননি।

ফোর্কিয়ারা : বলনেনি? কী দুঃখের কথা!

হেলেনা : কিসের দুঃখ বোধ করছ তুমি?

ফোর্কিয়ারা : হে রানি, বলির বস্তু হচ্ছ তুমি।

হেলেনা : আমি?

ফোর্কিয়ারা : আরে তোমার এই সব দাসীরা।

হেলেনা : হায়! কী ভয়ঙ্কর! অথচ এটা আমি আগেই আশঙ্কা করেছিলাম।

ফোর্কিয়ারা : কোনও পরিত্রাণ নেই।

কোরাস : আমাদের কি হবে? 

ফোর্কিয়ারা : হে প্রেমূর্তিগণ, পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছ। মানুষদের মতো তোমরাও আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী ছেড়ে যেতে ভয় পাও। (দরজার কাছে বামনাকৃতির কতকগুলি জীব দেখা দিল) এস তোমরা, এখানে যা পার ক্ষয়ক্ষতি করো। মুল্যবান কার্পেট পেতে দাও। তার উপর রানি নতজানু হয়ে পূজার বলি হিসাবে নিজেকে উৎসর্গ করবেন। পাত্রগুলো জলপূর্ণ করো। কারণ বলির পর কারো রক্ত ধুয়ে ফেলতে হবে। তারপর রানির মৃতদেহকে উপযুক্ত মর্যাদাসহকারে সমাহিত করতে হবে। 

কোরাসনেত্রী : চিন্তামগ্ন অবস্থায় রানি দাঁড়িয়ে আছেন। তার দাসীরা উৎপাটিত তৃণগুলের মতো ম্লান। এখন প্রধানা দাসীরূপে আমার কিছু কর্তব্য আছে। তুমি বয়োপ্রবীণা অভিজ্ঞতাসম্পন্না। তোমাকে না চিনে ওরা আক্রমণ করেছিল। এখন বলো সত্যই পরিত্রণের কোনও উপায় আছে কি না। 

ফোর্কিয়ারা : সেটা কিন্তু নির্ভর করছে একমাত্র রানির উপর। একমাত্র তিনিই নিজেকে ও তাঁর সহচরীদের রক্ষা করতে পারেন। কিন্তু যা কিছু করবে খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। 

হেলেনা : আমার দুঃখ হচ্ছে ঠিক, কিন্তু ভয় নেই আমার। তবু যদি উদ্ধারের কোনও উপায় থাকে তো বলো। আমি তা গ্রহণ করবো। তোমার মতো বিজ্ঞ প্রবীণা অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলতে পার। 

কোরাস : গলায় ফাঁসের নাম শুনেই আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে। তুমি দয়া না করলে আমরা মরব। 

ফোর্কিয়া : এত কথা শোনার ধৈর্য হবে কি তোমাদের?

কোরাস : শুনে যদি আমরা বেঁচে যাই তাহলে কেন শোনার ধৈর্য হবে না? 

ফোর্কিয়া : যারা বাড়িতে থেকে ধনসম্পত্তি রক্ষা করে তারা সব সময়ই ভালো থাকে। কিন্তু যারা বাড়ি থেকে চলে যায় দীর্ঘকালের জন্য তারা ফিরে এসে দেখে সব ওলটপালট হয়ে গেছে। 

হেলেনা : ও সব প্রচলিত কথা বলে লাভ নেই। তোমার কি গল্প বলার আছে তা। বলো। 

ফোর্কিয়া : এটা হচ্ছে ঐতিহাসিক সত্য, আমার তিরস্কারের কথা নয়। জলদুস্য মেনেলাস বিভিন্ন উপকূলভাগ হতে কত ধনরত্ন লুণ্ঠন করে আনে তার ইয়ত্তা নেই। দশ বছর ট্রয়যুদ্ধে কাটাবার পর দেশে ফেরার পথে আবার কত ধনরত্ন লুণ্ঠন করে আনবে তা জানি না। 

হেলেনা : মানুষের নিন্দা ছাড়া কিছু মুখ খুলতে পারে না তুমি? পাগলমি করাটা স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। 

ফোর্কিয়া : স্পার্টার উত্তরদিকে ইউরোতাস নদীবিধৌত পার্বত্য উপত্যকাগুলো দীর্ঘকাল জনবসতিহীন ছিল। এখন সেখানে এক দুর্ধর্ষ জাতি বাস করে। তারা এক দুর্গম অঞ্চলে দুর্গ নির্মাণ করেছে। ইচ্ছামতো অত্যাচার চালায় তারা পার্শ্ববর্তী জনগণের উপর। 

হেলেনা : এটা অসম্ভব মনে হচ্ছে।

ফোর্কিয়া : তারা কুড়ি বছর সময় পায়। এই অবসরে এই সব কাজ করে।

হেলেনা : তারা কি দস্যু এবং তাদের একজন সর্দার আছে? 

ফোর্কিয়া : দস্যু তারা নয়। তবে তাদের একজন সর্দার আছে। সে একবার আমাকেও আক্রমণ করে। সে সব নিয়ে যেতে পারত লুণ্ঠন করে। কিন্তু আমি যা তাকে। হাতে তুলে দিয়েছিলাম তাই নিয়ে সে সন্তুষ্ট চলে চলে যায়। 

হেলেনা : লোকটাকে দেখতে কেমন? 

ফোর্কিয়া : কোনও দিক দিয়েই খারাপ নয়। আমার তো ভালোই লেগেছিল। সাহসী বীর সম্ভ্রান্ত বংশের ছেলের মতো চেহারা। এমন ভদ্রজনোচিত ব্যবহার গ্রীকদের মধ্যে পাওয়া যায়। ওদের যদি বর্বর বলা হয় তাহলে নরহত্যাকারী রক্তলোলুপ গ্রীক ও ট্রয়বীরেরা কী? তাছাড়া ওদের দুর্গ তুমি যদি দেখো আশ্চর্য হয়ে যাবে। কী সুন্দরভাবে চারকোণা পাথরগুলো সাজানো। যেমন খাড়াই ও উচ্চতায় আকাশচুম্বী, তেমনি মসৃণ। সেই দূর্গের মধ্যে স্তম্ভ, অলিন্দ, প্রেক্ষাগৃহ সব আছে। 

কোরাস : তারা কোন জাতি? 

ফোর্কিয়া : দুর্গের মধ্যে প্রশস্ত বড় বড় হলঘরগুলোতে কতরকম পশুপাখি, দেবদেবীর চিত্র ও মূল্যবান ধাতু আছে তার ঠিক নেই। তাতে মাঝে মাঝে নাচের অনুষ্ঠানও হয়। 

কোরাস : সেখানে নাচিয়ে আছে।

ফোর্কিয়া : সোনালী চুলওয়ালা অনেক সুন্দর যুবক আছে।

হেলেনা : তোমার মূল বক্তব্য কি তা বলো। 

ফোর্কিয়া : তুমিই বলো। একবার শুধু স্পষ্ট করে হ্যাঁ বলো। আমি তাহলে তোমাকে সেই দুর্গের মাঝে নিয়ে যাব। 

কোরাস : একটামাত্র ছোট কথা বলে নিজেকে ও আমাকে রক্ষা করো। 

হেলেনা : আমি কি একথা মনে করতে পারি যে মেনেলাস এমন অমানবিক নিষ্ঠুরতার সঙ্গে আমাকে আঘাত করবে? 

ফোর্কিয়া : তোমার মনে নেই? প্যারিসের মৃত্যুর পর তার ভাই দিফোবাস যখন তোমাকে গ্রহণ করে তখন মেনেলাস তার নাক-কান কেটে দিয়েছিল? 

হেলেনা : সেটা তিনি আমার জন্যই করেছিলেন। 

ফোর্কিয়া : তোমাকেও তাই করবেন প্রতিহিংসার বশে। এটা জানবে রূপসৌন্দর্য অবধ্য। যার রূপ আছে সে হত্যা করায়, তার জন্য মানুষ মানুষকে হত্যা করে, কিন্তু সে নিজে হত হয় না। (জয়ঢাকের শব্দ শোনা গেল) ঐ জয়ঢাকের শব্দ যেমন কর্ণ বিদীর্ণ করে দেয় তেমনি প্রতিহিংসাও প্রতিহত মানুষের বক্ষকে বিদীর্ণ করে দেয়। 

কোরাস : শুনতে পাচ্ছ না রানি ঢাকের শব্দ, দেখতে পাচ্ছ না সুতীক্ষ্ণ তরবারির উজ্জ্বলতা? 

ফোর্কিয়া : আমাদের রাজা ও প্রভুকে স্বাগত জানাব আমরা। স্বেচ্ছায় বরণ করে নেব তাকে। 

কোরাস : আমাদের কি হবে?

ফোর্কিয়া : তোমরা ভালোই তা জান। রানির মৃত্যু নিজের চোখে দেখবে। কোনও উপায় নেই। 

হেলেনা : আমি কি করব ঠিক করে ফেলেছি। বুঝেছি তুমি এক শয়তানী বুড়ি সব ভালোকে খারাপ করে তোলো যাদুবলে। যাই হোক, প্রথমে আমি দুর্গে যাব তোমার। সঙ্গে। পরে কি করব তা কাউকে বলব না। মনের মধ্যেই থাকবে আমার। 

কোরাস : আমরা কত আনন্দে যাব সেখানে। মৃত্যু আমাদের পিছনে তাড়া করেও কিছু করতে পারবে না। দুর্গের বিরাট প্রাচীর চারদিক থেকে রক্ষা করে রাখবে আমাদের, ঠিক যেমন করে ট্রয়ে রেখেছিল। (হঠাৎ ঘন কুয়াশা এসে পিছনের দিকটা ঢেকে দিল) একি! দেখো দেখো, বোনেরা। একটু আগে দিনটা কত উজ্জ্বল ছিল। কিন্তু হঠাৎ ইউরোতাস নদীর বুক থেকে উত্থিত বাষ্পরাশির দ্বারা নলখাগড়া গাছের মালা গলায় তটভূমি আচ্ছন্ন ও অবলুপ্ত হয়ে গেল কোথায়। জোড়ায় জোড়ায় ভেসে যাওয়া কলকণ্ঠমুখর হাঁসদের দেখছি না আর। তবে তাদের দূরাগত ভীতিবিহ্বল চিৎকার শুনতে পাচ্ছি। সে কণ্ঠে আছে ধ্বংস আর মৃত্যুর আভাস। মেঘ আর কুয়াশা আমাদের চারদিকে এমনভাবে ঢেকে দিয়েছে যে পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের সামনে কি হার্মিসকে দেখছি? কিন্তু হাতে তার উজ্জ্বল দৈব দণ্ডটি নেই তো? হার্মিস কি আমাদের প্রেতপরিপূর্ণ অন্ধকার নিরানন্দ নরকে নিয়ে যাচ্ছে? একি! হঠাৎ কুয়াশা কেটে যেতেই দেখি এক বিশাল কারাগার। চারদিকে প্রাচীর। আমরা কি সবাই বন্দি হয়ে গেলাম? 

কোরাসদলের নেত্রী : হে নির্বোধ নারীর দল। তোমরা বড় অস্থিরমতি। চঞ্চল বাতাসের গতি পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের মতির পরিবর্তন হয়। সৌভাগ্যে দুর্ভাগ্যে, আনন্দে-বেদনায় বড় বিচলিত হয়ে ওঠ। প্রত্যেকের কথায় ও প্রতিবাদে নত হয়ে যাও। এখন চুপ করে রানির কথা শোনো। দেখে তিনি তাঁর ও আমাদের জন্য কি পন্থা অবলম্বন করেন। 

হেলেনা : কোথায় তুমি পাইথোনস? এই অন্ধকার কারাগার হতে তুমি এসে সেই বীর সর্দারের কাছে আমাকে নিয়ে যাও। 

কোরাসনেত্রী : বৃথাই আবেদন-নিবেদন জানাচ্ছ রানি। কোনও দিকে কোনও পথ নেই। সেই বিকৃত চেহারার বুড়িটাও নেই। একটা পা না ফেলেও কিভাবে আমরা এখানে এলাম তা বুঝতে পারছি না। গোলোকধাঁধার মতো পথগুলো। কিন্তু ঐ দেখো কত লোক! গ্যালারি ও জানালায় কত লোক এখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনে হয় অতিথিদের স্বাগত জানাচ্ছে। 

কোরাস : আমার অন্তরটা হালকা হলো। ঐ দেখো, কার আদেশে একদল সুদর্শন যুবক ছন্দায়িত পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে এইদিকে। তারা সর্বাঙ্গসুন্দর। তাদের মাথায় কুঞ্চিত কেশ, সুন্দর গণ্ডদেশ, রেশমী পোশাক। কিসের প্রশংসা করব? কার্পেটের উপর দিয়ে তারা ধীর পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে সিংহাসনের দিকে। সে সিংহাসনে উপবিষ্ট আমাদের রানির মাথার উপর অসংখ্য পুষ্পমালা সাজিয়ে রেখেছে। (সিংহাসনের দুধারে যুবকরা ও অমাত্যরা আসন গ্রহণ করলে মধ্যযুগীয় নাইটের পোশাক পরে ফাউস্ট ধীরে ধীরে আবির্ভূত হলো)। 

কোরাসনেত্রী : (ফাউস্টকে মনোযোগসহ দেখে) জানি না এই আদর্শ মানুষটাকে ঈশ্বর পাঠিয়েছেন কি না। তবে বীরত্ব ও মর্যাদায় ইনি যেন ঊর্ধ্বলোকের মানুষ। এই ধরনের মানুষ সর্বত্র জয়লাভ করেন। ধীর সংযত পদক্ষেপে ও উদার গাম্ভীর্যে উনি সিংহাসন অভিমুখে এগিয়ে চলেছেন। হে রানি, মুখ ফিরিয়ে তাকাও। 

ফাউস্ট : (অগ্রসর হলো; আর পাশে ছিল শৃঙ্খলাবদ্ধ একটি লোক) সাদর ও সশ্রদ্ধ অভ্যর্থনার পরিবর্তে আমি এনেছি এক শৃঙ্খলাবদ্ধ লোক যে কর্তব্যকর্মে অবহেলা করে আমাকে প্রতারিত করেছে। নতজানু হয়ে এই শ্রদ্ধেয়া নারীর কাছে তোমার অপরাধের কথা ব্যক্ত করো। হে রাজরাজেশ্বরী, এই লোকটি প্রাসাদশীর্ষের প্রহরীরূপে নিযুক্ত হয়েছিল। এর কাজ ছিল প্রাসাদশীর্ষ হতে স্থলপথে, জলপথে ও আকাশপথে দৃষ্টি প্রসারিত করে দেখা যাতে অকস্মাৎ কোনও সমুদ্ৰাগত জলোচ্ছ্বাস অথবা মানুষের জনতা এই দুর্গমধ্যে এসে না পড়ে। কিন্তু সে কর্তব্যে অবহেলা করে সে যার ফলে আপনারা এখানে অরক্ষিত অবস্থায় এসে পড়েন এবং এর জন্য আমরা উপযুক্ত অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করতে পারিনি। এখন এই ব্যক্তিকে ক্ষমা করবেন না শাস্তি দান করবেন সেটা আপনার উপরেই নির্ভর করছে।

হেলেনা : রানি ও বিচারকত্রী হিসাবে আমাকে এক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতাদান করেছেন আপনি। এটা এক পরীক্ষাও বলা যেতে পারে। যাই হোক, এখন আমি বিচারকের কর্তব্য ও অধিকার অনুযায়ী আসামীর বক্তব্য শুনতে চাই। বলল, তোমার কথা। 

দুর্গপ্রহরী লিনসেউস : ঈশ্বরপ্রেরিত এই দৈব মানবীর ক্রীতদাসরূপে নতজানু হয়ে আমি তাকে অবলোকন করতে চাই। তাতে আমি বাঁচি বা মরি। যা হয় হোক। আমি যখন স্বাভাবিকভাবে পূর্ব দিকে সূর্যোদয়ের প্রতীক্ষায় ছিলাম তখন আমায় হতচকিত করে সহসা দক্ষিণ দিকে আবির্ভাব হলো সূর্যের। আকাশে বা দিগন্তে কোনও আলো নেই, অথচ সূর্য উঠল। কেমন যেন স্বপ্নবিষ্ট হয়ে পড়লাম আমি। চারদিক বাষ্পরাশিতে আচ্ছন্ন করে তার মাঝে এক দেবী আবির্ভূত হলেন। তাঁর অসামান্য অপ্রাকৃত সৌন্দর্যের উন্মাদনায় অন্ধ হয়ে গেলাম আমি। আমার দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা ও অন্তরের আনুগত্য সব কিছু বিলিয়ে দিলাম তাঁর পায়ে। আমি আমার প্রহরীর সব কর্তব্য ভুলে গেলাম। আমাকে মৃত্যুর ভয় দেখাচ্ছেন। রূপসৌন্দর্য সকলের সব ক্রোধকে মোহপাশে আবদ্ধ করে, সব ভয়কে মুক্ত করে। 

হেলেনা : যে বিপত্তি আমি নিজে এনেছি তার জন্য কাউকে তিরস্কার করব না। ধিক আমাকে। কী দুর্ভাগ্য আমার। আমি যেখানেই যাই সেখানে নরপশুরা সব গুণ ভুলে গিয়ে আমার পিছু পিছু ছুটে চলে। দেবতা-অপদেবতা, দানব-মানব সবাই। মারামারি করে আমার জন্য। আমি শুধু মানুষের দুঃখ তিন-চার গুণ বাড়িয়ে চলি। এই নির্দোষ ব্যক্তিকে ছেড়ে দাও। যাও, ঈশ্বরদত্ত কোনও গুণের অপচয় করো না। 

ফাউস্ট : সত্যিই আমি বিস্মিত হে রানি। সুদক্ষ তীরন্দাজের মতো তুমি যে ধনুকে। অব্যর্থ শর সংযোজন করে তাকে ও আমাকে বিদ্ধ করলে তা দেখলাম। তার মতো আমিও আহত। এই রাজদরবারে অনেকেরই এই অবস্থা। এখন আমি আর আমি নেই। আমার বিশ্বস্ত অন্তরের সব আনুগত্যকে বিদ্রোহে পরিণত করেছ তুমি। এখন আমার যা কিছু আছে তা সব অর্পণ করছি তোমার চরণে। হে রানি, তুমি যেমন আসার সঙ্গে সঙ্গে অপরাজেয় শক্তিবলে এই পার্থিব সিংহাসন অধিকার করেছ তেমনি আমার অন্তরের সিংহাসনও অধিকার করো।

লিনসেউল : (সিন্দুক নিয়ে) হে রানি, আমি মুক্ত হয়ে ফিরে এসেছি। আমি রাজ ঐশ্বর্যে সমৃদ্ধ হয়েও ভিক্ষুকের মতো তোমার কৃপাদৃষ্টি ভিক্ষা চাইছি। আমি কি ছিলাম, এখন আমি কি? কি আমি চাই? আমি সব গুলিয়ে ফেলছি। পূর্ব থেকে আমরা পশ্চিমে এসেছি। অসংখ্য মানুষ আনাগোনা করছে। তার শেষ নেই সীমা নেই। প্রচুর ধনরত্ন। একদিন অকাতরে লুণ্ঠন করেছি আমি। আমার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি কারও কোনও পকেটে বা সিন্দুকের উপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বলে দিতে পারতাম আমি তার মধ্যে কি আছে। স্তূপীকৃত সোনা ও মণিমাণিক্য করায়ত্ত করি আমি। কিন্তু আমার রত্ন তোমাকে উপহার দিতে চাই। সবুজ পান্নার হার তোমার গলে ও বক্ষে শোভা পাক। কর্ণ-কপোল ভূষিত হোক বিবিধ রত্নালঙ্কারে। শুধু কর্ণদেশ হতে ওষ্ঠাধর পর্যন্ত তোমার গোলাপী গণ্ডদ্বয় মুক্ত থাক কোনও অলঙ্কারের লাঞ্ছনা থেকে। তাই আমি সব এনেছি তোমার পায়ে। অপর্ণ করতে। তুমি সিংহাসনে বসার সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার সব জ্ঞান শক্তি সম্পদ সমর্পণ করেছি তোমায়। এতদিন ধরে যে ধনসম্পদ অর্জন করেছি আমি তা তুচ্ছ তৃণবৎ ত্যাগ করতে চাই। তার বিনিময়ে শুধু চাই তোমার সুন্দর মুখের এক আয়ত উজ্জ্বল দৃষ্টি। 

ফাউস্ট : শীঘ্রই সব সরিয়ে নাও। শাস্তি না পেলেও পরস্কারও কিছু পাবে না। এই দুর্গমধ্যে যা কিছু আছে সব ধনরত্নই তাঁর। সুতরাং বিশেষভাবে দান করার কিছু নেই। যেখানে যত ধনরত্ন আছে সব স্থূপীকৃত করে দাও তা প্রতিটি কক্ষে। অমিত ধনৈশ্বর্যের নিষ্প্রাণ সমারোহে এক নূতন স্বর্গ রচিত হোক। স্বর্গসুলভ বিভায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠুক এই প্রাসাদদুর্গ। কুসুমাস্তাৰ্ণ কার্পেট বিস্তৃত হোক তার চলার পথে। রত্নমণ্ডিত এই সকল ঐশ্বর্যের অহঙ্কার লাঞ্ছিত হোক তার পদ্মকোষতুল্য সুমেদুর পদাঘাতে। 

লিনসেউস : একথা যথেষ্ট হলো না। এই গর্বোদ্ধত সৌন্দর্যের দ্বারা মানুষের জীবন সম্পদ অনুশাসিত হয়। এই সৌন্দর্যের উজ্জ্বলতার কাছে সূর্যালোকও ম্লান হয়ে যায়। তাঁর মুখের পাশে সব মূল্যবান বস্তু তাদের সব মহিমা হারিয়ে ফেলে। 

হেলেনা : (ফাউস্টকে) আমি তোমার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। আমার পাশে এসে এই শূন্য আসন অধিকার করো। আমাকেও গ্রহণ করো। 

ফাউস্ট : হে রানি, নতজানু হয়ে অবনত মস্তকে তোমার এ দান গ্রহণ করতে দাও আমায়। তোমার যে হাত আমায় তোমার পাশে তুলে নিতে চায় সে হাতকে প্রথমে চুম্বন করতে দাও। এই অনন্ত ভুখণ্ডসমন্বিত তোমার রাজ্যের রাজপ্রতিনিধি নিযুক্ত করো আমাকে। আমি একাধারে তোমার রক্ষক, উপাসক ও দাস রয়ে যাব চিরদিন।

হেলেনা : অনেক আশ্চর্য জিনিস দেখলাম ও শুনলাম। বিস্ময়ে আচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে আমার সমগ্র অন্তরাত্মা। অনেক কিছু জানতে ইচ্ছা করছে। তবে এখন একটা কথা বলো, ঐ লোকটি এমন অদ্ভুতভাবে এত সুন্দর সুন্দর কথা কি করে বলল? 

ফাউস্ট : আমাদের এখানকার লোকদের কথা যদি তোমার ভালো লেগে থাকে তাহলে আমাদের গান শুনে অভিভূত হয়ে যাবে তুমি। সে গান এখনই শুরু উচিত। 

হেলেনা : তুমিও ঐভাবে ঐ সব কথা বলত পার? 

ফাউস্ট : এটা তো সহজ কথা। অন্তর কামনার ব্যাকুলতায় পূর্ণ হয়ে উঠলেই মানুষ চারদিকে তাকিয়ে দেখে 

হেলেনা : কে তার সে আবেগের অংশ নেবে। 

ফাউস্ট : সেই আবেগের মুহূর্তে অতীত বা ভবিষ্যৎ কিছুই থাকে না। থাকে শুধু একমাত্র বর্তমান। 

হেলেনা : বর্তমানেই থাকে তখন একমাত্র পরম সুখ। 

ফাউস্ট : এই বর্তমানেই আছে আমার সকল সম্পদ ও সৌভাগ্য। আর আমি কি চাই? 

হেলেনা : আমার হাত। 

কোরাস : অবশেষে আমাদের রানি এই দুর্গাধিপতির সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে প্রকাশ্যে আবদ্ধ হলেও আমরা অবশ্য ইলিয়ামের পতনের পর থেকেই যৌথভাবে বন্দিনী রয়ে গেছি। নারীরা চিরকালই পুরুষের প্রেম অভ্যস্ত। এ ব্যাপারে তারা ঠিকমতো বাছাই। করতে পারে না। গ্রাম্য দেবী ফনও কোনও এক সোনালী চুলওয়ালা রাখালের প্রেমে ধরা দিতে পারেন। ওঁরা খুব কাছাকাছি বসে রয়েছে দুজনে। ওদের পরস্পরের কাঁধে। কাঁধ ঠেকছে, হাঁটুতে হাঁটু, হাতে হাত। নরম সিংহাসনের উপর আন্দোলিত হচ্ছে ওঁদের দেহ। সিংহাসনের রাজকীয় মহিমা ওঁদের অন্তরের আবেগকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। 

হেলেনা : আমার মনে হচ্ছে আমার কাছ থেকে দূরে চলে এসেছি আমি। আবার মনে হচ্ছে খুব নিকটে এসেছি। তবু আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমি এখানেই আছি। আমি এখানে। 

ফাউস্ট : আমি নিশ্বাস নিতে পারছি না। বিকম্পিত হচ্ছে আমার দেহ। কথা বলতে পারছি না। স্থানকালহীন এক স্বপ্নের জগতে যেন আমি বাস করছি। 

হেলেনা : আমার মনে হচ্ছে আমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। তোমার সঙ্গে মিলেমিশে এক নবজীবন লাভ করেছি আমি যেন। এই মিলনের ফলে আমারই এক অজানিত সত্তা পরম সত্য হয়ে উঠেছে আমার কাছে। 

ফাউস্ট : কোথা হতে কি করে হলো তা জানতে চেও না। জীবন মানেই কর্তব্য হলেও এখন সে কর্তব্য দূরে থাক। 

ফোর্কিয়া : (অকস্মাৎ প্রবেশ করে) প্রেমের মধুর আবেগ তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেল। বিপদের আভাস পাওনি? জয়ঢাকের শব্দ শোননি? মৃত্যু এগিয়ে আসছে। মেনেলাস তার দলবল নিয়ে এ দুর্গ আক্রমণ করেছে। তোমাদের লোকজনদের যুদ্ধে ডাকো। (ফাউস্টকে) আর তোমার অবস্থা হবে দিফোবাসের মতো, কারণ, তুমি এই নারীর শালীনতা নষ্ট করেছ। একে একে সব বধ হবে।

ফাউস্ট : হঠাকারী বিপদ এইভাবেই আসে। দুঃসংবাদ সংবাদদাতাকে কুৎসিত করে ফেলে। আর তুমি দুঃসংবাদ দান করেই আনন্দ পাও বেশি। কিন্তু এখন তা হবে না। এখানে কোনও বিপদ প্রবেশ করতে পারবে না। (বিস্ফোরণ, সশস্ত্র সৈন্যদলের প্রবেশ) এইমাত্র সেই নারীর প্রসন্নতা লাভ করে যে বীরত্বের সঙ্গে বীরদের প্রতিহত করে।

শক্রদলের নেতা : (এগিয়ে এসে) কখনও উত্তর থেকে দক্ষিণে, কখনও পূর্ব থেকে পশ্চিমে আমরা অবিরাম এগিয়ে চলেছি। পাইলসে আমরা সমুদ্রপথ ছেড়েছি। আমাদের সৈন্যদল ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে গ্রীসের উপকূলে। এই দূর্গে আমাদের নেতা মেনেলাস বিলম্ব করবেন না। তিনি আবার সমুদ্রে ফিরে গিয়ে জলদুস্যরূপে লুণ্ঠনকার্য চালাবেন। স্পার্টার রানির রাজত্বের অধীনে থেকে তোমরা এ রাজ্যের সব সম্পদ উপভোগ করবে। (ফাউস্ট সিংহাসন থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজন্যবর্গ তাকে ঘিরে ধরল।) 

কোরাস : যে লোক কোনও সুন্দরীকে একান্তভাবে করায়ত্ত করতে চায় তাকে আগে দৃঢ়হাতে অস্ত্র ধরতে হবে। তোষামোদের দ্বারা কোনো নারীকে কেউ লাভ করলেও রক্ষা করতে পারবে না। দস্যুরা অপহরণ করে নিয়ে যাবে। এ জন্য আমাদের এই রাজাকে সকলের থেকে বড় মনে না করে পারছি না। কারণ উনি শক্তি ও ত্যাগের সমন্বয় ঘটিয়ে শত্রুসৈন্যদের বশীভূত করে রেখেছেন। আজ এমন ক্ষমতা কার আছে। যে তাঁর কাছ থেকে রানিকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়? বাইরের শক্তিশালী শত্রুকে উপেক্ষা করে তিনি এই সুরক্ষিত দুর্গপ্রাচীরের মধ্যে তাঁকে রক্ষা করবেন।

ফাউস্ট : ওদের প্রত্যেকের হাতে কিছু কিছু ধনরত্ন দিয়ে দাও। আমরা যেমন আছি তেমনই থাকব। ওরা তাহলে অন্যান্য শত্রুদের হাত থেকে তোমাদের সমুদ্র পাহাড়বেষ্টিত রাজ্যটিকে রক্ষা করবে। এ রাজ্যের প্রভূত সম্পদের কিছু কিছু অংশ প্রতিটি জাতিই পেতে পারে। এখানকার পর্বতমালা ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছে তোমাদের। অতুলনীয় সম্পদে সমৃদ্ধ এই দেশের মাটিতে লেডার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন তোমাদের এই রানি। এদেশের তুষারাবৃত পর্বতমালার মাঝে মাঝে গড়ে উঠেছে কত ঝর্নাবিধৌত অরণ্যসমাচ্ছন্ন জনপদ, কত পশুচারণক্ষেত্র। এখানকার মানুষরা জন্মসুখী। এখানে দেবতারাও মাঝে মাঝে নেমে আসেন মানুষের জন্য। জিয়াসপুত্র অ্যাপোলোও এখানে একদিন নেমে এসেছিলেন রাখালের বেশে। (রানির পাশে বসে) ভূস্বর্গ আর্কিডিয়ার মতো এদেশে চিরসুখ বিরাজ করে। অনন্ত যৌবন ও সুখ-সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে তোমাদের জীবন। (রাজসভায় দৃশ্যটি রূপান্তরিত হলো পার্বত্যপ্রদেশে। চারদিকে পাহাড় আর বন দেখা গেল। ফাউস্ট ও হেলেনা অন্তহিত। কোরাসদলের মেয়েরা ঘুমন্ত ও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে এখানে-সেখানে। 

ফোর্কিয়া : এই সব মেয়েরা কতক্ষণ ধরে ঘুমোচ্ছে তা আমি জানি না। তারা কি স্বপ্ন দেখছে তাও জানি না। ওরা জেগে ওঠে আশ্চর্য হয়ে যাবে। তবু ওদের জাগাতে হবে। কই জেগে ওঠ তোমরা। সব ঘুম ঝেড়ে ফেলো। 

কোরাস : বলো আমাদের, কি করে কি ঘটল। অবিশ্বাস্য হলেও আমরা সব শুনব। এই সব পাহাড় দেখতে আমাদের ভালো লাগছে না। 

ফোর্কিয়া : চোখ খুলতে না খুলতেই ক্লান্ত হয়ে পড়ছ তোমরা। তবে শোনো! এই সব পাহাড় আর গুহার মধ্যেই দুই প্রেমিক-প্রেমিকা আমাদের রাজা-রানি আশ্রয় নিয়েছে। 

কোরাস : সেকি! এর মধ্যে? 

ফোর্কিয়া : বাইরের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে তারা এখানে আছে। আমাকে তারা ডেকেছে সেবা করার জন্য। আমি তাদের জন্য ফলমূল, গাছের ছালের সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। তারা এখন একা আছে। 

কোরাস : এর মাঝে কি ঘরবাড়ি, নদী, প্রান্তর আছে? 

ফোর্কিয়া : তোমরা একেবারে অনভিজ্ঞা। এ হচ্ছে এক অনাবিষ্কৃত জগৎ। আমি যখন এর মাঝে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তখন সহসা হাসির শব্দে সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখলাম প্রকৃতি দেবতার মতো সরল সুদর্শন এক তরুণ বালক তার মার কোল থেকে পিতার কোলে আবার পিতার কোল থেকে মার কোলে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। তার মা তাকে এক সময় বলল, তুমি লাফাতে পার যত খুশি, কিন্তু উপরে উঠবে না। তার পিতা বলল, পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে পৃথিবীর মাটিটা ছুঁয়ে থাকবে, শক্তি পাবে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল লাফাতে লাফাতে বালকটি পাহাড়ের মাঝে কোথায় হারিয়ে গেল। তার মাতা-পিতা শোকে অধীর হয়ে উঠল। পিতা মাতাকে সান্ত্বনা দিতে লাগল। তারপর আমাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে নিয়ে অকস্মাৎ সে হাতে একটি সোনার বীণা নিয়ে হাজির হলো আমাদের সামনে। মাথায় তার অপূর্ব জ্যোতি। অপূর্ব সুর তার কণ্ঠে। একদিন যে ছিল পৃথিবী মাতার সন্তান, আজ সে হয়ে উঠেছে যেন সকল সৌন্দর্য ও চিরন্তন সূরমাধুর্যের অধিষ্ঠাতা দেবতা। অননুভূতপূর্ব বিস্ময়ের সঙ্গে তাকে দেখবে তোমরা। 

কোরাস : একে তুমি আশ্চর্যজনক বলছ ক্রেটাকন্যা? এর থেকে কত বিস্ময়কর ঘটনা ঘটে গেছে অতীতে। আওনিয়ার গান শোননি? হেলাসের রূপকথা শোননি? মাইয়ার পুত্রের গান শোননি? বর্তমানে যা ঘটে তা অতীত ঘটনারই প্রতিরূপ মাত্র। সেই সূক্ষ্ম দেবীর পরম শক্তিশালী পুত্র যখন দানস্বরূপ পরিগ্রহ করে সমুদ্রদেবতার কাছ থেকে ত্রিশূল, রণদেবতা অ্যারেসের কোষ থেকে তরবারি, ফীবাসের কাছ থেকে তীরধনুক, অগ্নিদেবতা হিফাস্টারের কাছ থেকে চিমটে, এমনকি পরম পিতা জিয়াসের কাছ থেকে বজ্রও চুরি করে নেয়, কামদেবতা ইরসকে মল্লযুদ্ধে হারায় এবং দেবী। সাইপ্রিস যখন তাকে আদর করে তখন তার বুক থেকে বেল্ট বা রক্ষবন্ধনীটিও চুরি করে নেয়। (নিকটবর্তী একটি গুহা থেকে গানের সুর শোনা গেল)। 

ফোর্কিয়া : এবার শোনো, বিশুদ্ধ গান কাকে বলে। রূপকথার কথা ভুলে যাও। অতীতে কখনও কোনও দেবতা এ গান গায়নি। সে সব দিন চলে গেছে। এ গান অন্তর থেকে বেরিয়ে এসে অন্তরকে স্পর্শ করে। (পাহাড়ের ভিতর চলে গেল) 

কোরাস : হে কিতাকৃতি, সত্যই এ গান শুনে অন্তর আমাদের বিগলিত হয়ে যাচ্ছে। চোখে জল আসছে। প্রভাতসূর্যের বিশুদ্ধ উজ্জ্বলতায় পরিপ্লাবিত হয়ে উঠছে আমাদের অন্তরাত্মা। এতদিন জগতে যা আমরা পাইনি তা সব আমরা পেয়েছি আমাদের অন্তরে। 

বল্কল ও বৃক্ষপত্রপরিহিত অবস্থায় ফাউস্ট, হেলেনা ও ইউফোরিয়ন 

ইউফোরিয়ন : গান শুনে তোমাদের অন্তরে জাগছে শিশুসুলভ উচ্ছলতা, এবার আমার নাচ দেখে তোমাদের অন্তর লাফিয়ে উঠুক। 

হেলেনা : প্রেমের মাধুর্য সাধারণত দুজনেই ভোগ করে। তবে তৃতীয় জন কাছে থাকলে আনন্দ বেশি হয়।

ফাউস্ট : তারা যা চেয়েছিলাম তা পেয়ে গেছি। এখন আমি সর্বতোভাবে তোমার, তুমি আমার । জগতের আর কোনও সম্পদ চাই না আমরা। 

কোরাস : এখন দীর্ঘকাল ধরে ওরা মিলনের আনন্দ লাভ করবে। এ সঙ্গীত ওদের সে আনন্দ আরও বাড়িয়ে দেবে। 

ইউফোরিয়ন : এখন আমি বৃত্তাকারে লাফাব, ঝপাব। আনন্দের আবেগে নাচব। 

ফাউস্ট : কিন্তু ধীরে চলো। শান্তভাবে যা করার করো বৎস! তা না হলে হঠকারিতার ফলে ধ্বংস হয়ে যেতে পার। 

ইউফোরিয়ন : আমি আর এখানে চুপ করে স্থির হয়ে থাকব না। 

হেলেনা : ভেবে দেখো বৎস। তোমার উপর আমাদের ও তোমার ভবিষ্যতের সব সুখ নির্ভর করছে। 

কোরাস : শীঘ্রই হয়ত ওদের মধুর বন্ধন ছিন্ন হয়ে যাবে। আমার ভয় হচ্ছে। 

হেলেনা ও ফাউস্ট : সংযত হও হে হতভাগ্য। আমার ইচ্ছার খাতিরে অন্তত উপরে উঠতে চেও না। সমতলভূমিতেই থাকো। নাচে-গানে উজ্জ্বল করে তোলো, মাতিয়ে তোলো এই সমভূমি। 

ইউফোরিয়ন : তোমরা যখন চাইছ তখন আমি সংযত হব। (কোরাসদের টেনে নিয়ে নাচতে লাগল। সবাই আনন্দে নাচো। একেই কি বলে গান আর নাচ?। 

হেলেনা : হ্যাঁ, ওদের সঙ্গে নিয়ে নাচতে থাকো।

ফাউস্ট : শীঘ্রই এ নাচ বন্ধ করতে হবে। চুরির ঘটনা দেখে কষ্ট হচ্ছে আমার। 

কোরাস : হে সুন্দর বালক, তুমি যখন তোমার হাতগুলো তুলছ তখন তোমার সোনালী কুঞ্চিত কেশরাশি উত্তাল হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। তোমার লঘুচপল পদভরে লাঞ্ছিত হচ্ছে পৃথিবীর মাটি। আমাদের সমস্ত মনপ্রাণ কেন্দ্রীভূত হয়েছে তোমার কাছে। 

ইউফোরিয়ন : এখন থামবে না। কোনও বিরতি নয়। আমি এখন শিকারি আর তোমরা লঘুপদ হরিণীর মতো খেলা করো আমার চারদিকে।

কোরাস : এত তাড়াতাড়ি করো না। তোমার সুন্দর দেহটা জড়িয়ে ধরে চুম্বন করতে ইচ্ছা করছে। 

ইউফোরিয়ন : পাহাড়ে-পর্বতে ঘুরে এতদিন যা পেয়েছি, যা করেছি তাতে মন ভরে না আমার। আমি জোর করে যে কাজ করি তাতে আনন্দ পাই না। 

হেলেনা ও ফাউস্ট : ও বড় বেয়াদব ও অসভ্য হয়ে উঠেছে। ওকে সংযত করার কোনও উপায় নেই। হঠাৎ শিঙার শব্দ শুনছি। কিসের গোলমাল? 

কোরাসদলের একজন : আমাদের মধ্য থেকে একটি উদ্দামস্বভাব তরুণীকে নিয়ে হঠাৎ সে চলে গেল। 

ইউফোরিয়ন (তরুণীসহ) : আমি একটি তরুণীকে এনেছি। জোর করে তাকে আলিঙ্গন করল। সে বাধা দিলেও তার দেহ পীড়ন এবং বক্ষমর্দন করব। তার মুখ চুম্বন করব। তবু বাধা দিলে আমার দুর্বার শক্তি ও কামনার পরিচয় দেব। 

কুমারী তরুণী : আমাকে ছেড়ে দাও। আমার এ দেহে সাহস ও শক্তি দুই আছে। তোমার বাহুতে কত শক্তি আছে নির্বোধ? তুমি আগুন দিয়ে খেলা করছ তা জান না। আমি তোমাকে পুড়িয়ে দেব। (এক অগ্নিশিখায় পরিণত হয়ে বাতাসে উড়ে গেল) এবার আমাকে অনুসরণ করো। তোমার লক্ষ্যবস্তুকে করায়ত্ত করো। 

ইউফোরিয়ন : চারদিকে শুধু বন আর পাহাড়। এখানে কেন আমি বন্দি হলাম? ঝড় উঠছে। সমুদ্রের ঢেউগুলো আছাড় খেয়ে পড়ছে পাহাড়ে। (পাহাড়ের উপর উঠতে লাগল।)। 

হেলেনা : শ্যাময়ের মতো তোমার উচ্চাশা বেড়ে উঠেছে। আমরা তোমার পতনের ভয়ে ভীত হয়ে উঠেছি। 

ইউফোরিয়ন : আমাকে আরও উপরে উঠতে হবে। এখন আমি কোথায়? আমি দ্বীপপুঞ্জে চলে এসেছি। এসেছি পেলোপদের দেশে। 

কোরাস : এই পাহাড় ঘেরা কুঞ্জবনে শান্তিতে বাস করো। তোমার জন্য আমরা আঙ্গুর এনে দেব। শুকনো আঙ্গুর। ডুমুর ও আপেল এনে দেব সোনালী রঙের। দেখো কত সুন্দর এই জায়গাটা। 

ইউফোরিয়ন : শান্তির শব্দে মশগুল হয়ে থাকো তুমি। যুদ্ধ আর জয়ের মধ্যেই। আছে স্বর্গীয় গৌরব। 

কোরাস : যুদ্ধের জন্য যারা শান্তি ও ঐক্যকে ঘৃণার চোখে দেখে তাদের সুদিন কখনও আসে না। 

ইউফোরিন : যারা একদিন প্রভূত রক্ত দান করে বীরত্ব সহকারে এদেশ রক্ষা করেন তারাই আমাকে জয়ের পথ আজ দেখিয়ে দিন। 

কোরাস : দেখো দেখো ও যুদ্ধ চায়। তবু যুদ্ধ ও শান্তিতে ও আমাদের সমান প্রিয়। 

ইউফোরিয়ন : বীরদের সামনে দুর্গপ্রাচীর কিছুই নয়। বীর যোদ্ধার বুক লোহার মতো শক্ত। তার কাছে পাথরের গড়া দুর্গ কিছুই নয়। শান্ত গৃহকোণে বাস না করে। অস্ত্র ধারণ করো তোমরা। তোমাদের স্বামী-সন্তানরাও সকলে যোদ্ধা হয়ে উঠুক। 

কোরাস : দেখো দেখো, উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতো ও কেমন আকাশে উঠছে। কত দূরে চলে যাচ্ছে ও। তবু বড় ভালো লাগছে। . ইউফোরিয়ন : আমি আর শিশু নেই। অস্ত্রধারী এক উদ্ধত যুবক। সে সাহসী, বলবান। প্রতিজ্ঞায় অটল তার আত্মা। আমি যাচ্ছি, জয়ের দিগন্ত উন্মুক্ত আমার সামনে। 

হেলেনা ও ফাউস্ট : তুমি এখনও সূর্যের আঁচ পাচ্ছ না। তুমি বুঝছ না তুমি যাচ্ছ অনন্ত যন্ত্রণার রাজ্যে। আমরা তোমার কেউ নই? তোমার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কী স্বপ্নমাত্র? 

ইউফোরিয়ন : স্থলে-জলে বজ্রের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছ? ধুলিজালে সমাচ্ছন্ন হয়ে উঠেছে বনভূমি। যুদ্ধের আহ্বান আসছে, অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড় যুদ্ধে। 

হেলেনা, ফাউস্ট ও কোরাস : কি ভয়ের কথা! বড় পরিতাপের বিষয়। তুমি কি মৃত্যুর আহ্বান শুনতে পাচ্ছ? 

ইউফোরিয়ন : আমি কি দূর থেকে দেখব ঐ সব বীরদের মৃত্যু? না তাতে অংশগ্রহণ করব? এই দেখো, এক জোড়া পাখা বার করে উড়ে যাচ্ছি আমি সেখানে। আমাকে উড়তে দাও। (উড়ে গেল)। 

কোরাস : আইকারাসের মতো ও উড়ে গেল। কি দুঃখজনক দৃশ্য। (একটি সুন্দর যুবকের মৃতদেহ হেলেনা ও ফাউস্টের সামনে পড়ল। কিন্তু সে দেহ সহসা ধূমকেতুর মতো আকাশে উড়ে গেল, শুধু পোশাক আর বীণাটা পড়ে রইল।)। 

হেলেনা ও ফাউস্ট : উপভোগ করতে না করতেই সব আনন্দ পরিণত হলো নিরানন্দ শোকে। 

ইউফোরিয়ন (ভিতর থেকে) : হে মাতা, আমাকে এই অন্ধকার শূন্যতার মাঝে একা রেখো না। 

কোরাস : না, একা থাকতে হবে না তোমায়। আমাদের সকলের অন্তরাত্মা তোমার কাছে গিয়ে গুণগান করবে তোমার। যে কোনো বিপর্যয়ের ঝড় ও অগ্নিতাপের মাঝে অটুট ছিল তোমার সাহস আর শক্তি। প্রভূত পার্থিব ধনসম্পদ লাভ করেও তোমার উদ্দাম যৌবন সব প্রথার বন্ধন ছিন্ন করে উচ্চাশার অজানা আকাশে পাড়ি দেয়। তুমি এক অভূতপূর্ব কৃতিত্ব ও বিজয়গৌরব লাভ করতে। কিন্তু তোমাকে তা দেওয়া হয়নি। নিয়তি দেয়নি। তাহলে কাকে দেবে নিয়তি? দুঃখ করো না। মানুষের গানের মধ্যে অমর আত্মার মধ্যে, বেঁচে থাকবে তুমি। যুগে যুগে নবজন্ম ঘটবে তোমার। 

হেলেনা (ফাউস্টকে) : একটা প্রাচীন প্রবাদবাক্য মনে পড়ল, সুখ আর সৌন্দর্য দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকে না। জীবন ও প্রেমের বন্ধন শীঘ্র ছিঁড়ে যায়। সুতরাং বিদায়। হে পার্সিফোনে, আমাকে ও আমার সন্তানকে গ্রহণ করো তুমি। (ফাউস্টের কোলে হেলে পড়তেই হেলেনার দেহটা অদৃশ্য হয়ে গেল। শুধু তার পোশাক আর ওড়নাটা ফাউস্টের হাতে রয়ে গেল।)। 

ফোর্কিয়া : ঐগুলো ভালো করে ধরে থাকো। ছেড়ো না। দৈত্যরা এগুলো নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। ওগুলো তোমাকে পৃথিবীর মাটি হতে অনেক দূরে ধরে নিয়ে যাবে। তবে বাতাসে বেশি দিন ভাসতে পারবে না। পরে আমার সঙ্গে দেখা হবে। (হেলেনার পোশাক সহসা মেঘ হয়ে ফাউস্টকে ঘিরে তাকে বাতাসে তুলে নিয়ে গেল এবং ভাসতে ভাসতে চলে গেল।) 

ফোর্কিয়া : সেই সুন্দর উজ্জ্বল প্রাণের অগ্নিশিখা উড়ে গেছে। পড়ে আছে শুধু এই পোশাক। কবিরা এই নিয়েই বেঁচে থাকবে। তাদের আমি প্রতিভা দান করতে না পারলেও অন্তত পোশাকটা দিতে পারব। 

প্যানথালিন : তাড়াতাড়ি করো। হে রানির সহচরীরা, এখন আমরা সমস্ত ইন্দ্রজালের প্রভাব থেকে মুক্ত। তোমাদের রানি এখন ধীর পায়ে ধাপে ধাপে নরকে নেমে চলেছেন বিষণ্ণ রাজার পাশে। তার বিশ্বস্ত সহচরীরাও চলো সেখানে। 

কোরাস : রানিরা সব জায়গাতেই সুখে থাকে। সব জায়গাতেই সম্মান পায়। নরকে গিয়েও নরকের দেবী পার্সিফোনের সঙ্গে সম্মানের সাথে থাকবে রানি। আর আমরা পড়ে থাকব ফলহীন গাছেঘেরা এক প্রান্তরে। বাদুড়ের মতো শুধু কিচমিচ করব আমরা। 

কোরাসনেত্রী : যারা নাম-যশ চাও না, বড় কাজ করতে চাও না তারা নিষ্প্রাণ জড়বস্তুর মতো। তারা চলে যাও। আমি রানির কাছে যাব। সেবা ও বিশস্ততার পরিচয় দেব। (প্রস্থান) 

সকলে : উজ্জ্বল লিলাকে মানুষের মতো বেড়াতে না পারলেও আমরা নরকে কখনও যাব না। প্রকৃতি আমাদের বিদেহী প্রেত করেছে। 

কোরাসদলের এক অংশ : আমরা বাতাসের মতো এই সব গাছের শাখাদের সঙ্গে কথা বলব। দেখব তারা কেমন ফুলে-ফলে ভরে ওঠে। গাছ থেকে ফল পড়লে কত লোক আসবে তা কুড়োতে। আমাদের পায়ের তলায় নত হবে। 

দ্বিতীয় অংশ : আমার এই সব পাহাড়ের ধারে থেকে পাখির গান শুনব। 

তৃতীয় : আমার এই সব নদীর সঙ্গে বন ও প্রান্তরের মধ্য দিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে চলে যাব। 

চতুর্থ অংশ : আমরা এইসব আঙ্গুরক্ষেতের চারদিকে থাকব। আঙ্গুরক্ষেত্রের মালিকরা কত কষ্ট করে আঙ্গুর চাষ করে আঙ্গুল ফলিয়ে তার থেকে মদ তৈরি করে তা দেখব আমরা। (যবনিকাপাতের সঙ্গে সঙ্গে ফোর্কিয়া মুখোশ খুলে ফেফিস্টোফেলিসে পরিণত হলো) ভালো জায়গাতেই অবস্থান করছেন সম্রাট। 

চতুর্থ অঙ্ক 

প্রথম দৃশ্য 

উচ্চ পর্বতমালা

একটি পর্বতশৃঙ্গের উপর মেঘ এসে জমল 

ধীরে ধীরে ফাউস্টের প্রবেশ

ফাউস্ট : উপর থেকে এখানে এক গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করতে দেখে আমি এই পর্বতশৃঙ্গে নেমে পড়েছি। যে মেঘমালা আমাকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছিল তা এখন আমার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পূর্বদিকে চলে গেছে। সেই ভাসমান তরঙ্গায়িত মেঘমালা সহসা জুনো, লেডা বা হেলেনার মতো এক পরমা সুন্দরী নারীর আকার লাভ করল। কিন্তু পরক্ষণেই মিলিয়ে গেল বাষ্পরাশির মধ্যে। পরে তা এক ধূসর পাহাড়ের মতো দিকচক্রবাল আচ্ছন্ন করে দাঁড়িয়ে রইল। অতীতের অনপনেয় স্মৃতিপুঞ্জ মূর্ত হয়ে উঠল যেন বুকে। পার্থিব দেহসৌন্দর্য প্রহেলিকায় পরিণত হয়ে গেলেও আত্মিক সৌন্দর্যের একটি জ্যোতি আজ আমার মনে জেগে আছে এবং তা আমাকে ঊর্ধ্বে আকর্ষণ করছে। আমার সত্তার শ্রেষ্ঠ অংশটিকে নিয়ে যাচ্ছে দূরে। (মেফিস্টোফেলিস এগিয়ে এল)। 

মেফিস্টোফেলিস : এই নরকের রাজ্যে কেন তুমি লম্বা লম্বা পা ফেলে পায়চারি করছ তা তুমি নিজেই জান। এই নরকের ভিত্তিভূমিতে আমি তাদের দেখতে চাইনি। 

ফাউস্ট : মিথ্যা মনগড়া রূপকথার কখনও অভাব হয় না তোমার। এই ধরনের এক রূপকথা হয়ত আবার বলতে চাও।

মেফিস্টোফেলিস : যখন ঈশ্বর আমাদের পাতালে পাঠিয়ে দেয় তখন আমরা সেখানে গিয়ে এক অনির্বাণ আগুনের শিখায় তপ্ত হয়ে উঠছি। তার উপর এক জায়গায় অনেক লোক থাকায় সেই গরমে সর্দি-কাশি প্রভৃতি নানারকম রোগ হতে লাগল। তখন পৃথিবীর সীমাটা বাড়াবার প্রয়োজন হলো। আর তা করতে গিয়ে সব ওলট-পালট হয়ে গেল। নিচেকার লোক উপরে চলে এল আর উপরকার তোক নিচে চলে গেল। পৃথিবীতে যে সব আইন প্রণীত হয়েছে তার উদ্দেশ্যও হলো সমাজের উপরতলার লোককে নিচে আর নিচের তলার লোককে উপরে আনা। এ রহস্য পরে সবাই জানতে পারবে। 

ফাউস্ট : আমি যখন পাহাড় দেখি তখন জানতে চাই না কোথা হতে কেমন করে এসব হলো। তবে আমার মনে হয় প্রকৃতি যখন নিজের মধ্যে নিজে পূর্ণতা অর্জন করেছে তখন সে পৃথিবীকে গোলাকাররূপে সৃষ্টি করে। তারপর তার মধ্যে থরে থরে কত পাহাড় সাজিয়ে দেয়। পাহাড়ের তলায় উপত্যকা, গিরিপথ, তারপর সবুজ প্রান্তর ও বনভূমি–কত কি সাজিয়ে দেয়। প্রকৃতি পৃথিবীর যেখানে যা রেখেছে তাই যথেষ্ট। তার উপর কোনও পরিবর্তনের প্রয়োজন নেই। সেটা হবে উন্মাদ ও হঠকারীর কাজ। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি তা বলবে। তুমি ভাবছ এই দিবালোকের মতো সহজ। কিন্তু যারা তা নিজের চোখে দেখেছে তারা বলবে অন্য কথা। আমি তখন সেখানে ছিলাম, যখন পৃথিবীর তলায় এই রকম ওলট-পালট চলছিল, যখন গরম আগুনের স্রোত বয়ে যাচ্ছিল আর মনকন হাতুড়ি দিয়ে পাহাড়গুলোকে পিটিয়ে পিটিয়ে স্থাপন করছিল পৃথিবীর বুকের উপর। শিক্ষিত লোকদের সব পাণ্ডিত্য ব্যর্থ ও রহস্য উঘাটনে। সরলপ্রাণ বিশ্বাসসর্ব সাধারণ মানুষ সহজভাবে নেমে নিয়েছে এ সত্যকে। আমার মতো শয়তানের কৃতিত্ব এই যে আমি এক আশ্চর্য খঞ্জ পথিকের মতো ক্রাচে ভর দিয়ে অনেক পাহাড় উপত্যকা পার হয়ে চলেছি অজানা রহস্যের সন্ধানে। 

ফাউস্ট : শয়তানের প্রকৃতিটা কেমন তা এখন দেখা দরকার।

মেফিস্টোফেলিস : প্রকৃতির মধ্যে শয়তান আছে। আমাদের মতো শয়তানের কাজ হলো বড় বড় পরিকল্পনা করা। অনেক হৈ-চৈ গোলমাল ও শক্তি অপচয় করেও অবশ্য কিছু হয় না পরিশেষে। তবু আমরা অনেক উপরে উঠেছি। আমার বাইরের আকার ও লক্ষণ দেখে কিছু বুঝতে পার না? এই অনতিক্রম্য বিরাট উচ্চতা থেকে যে রাজকীয় গৌরব ও শক্তির জৌলুস বিচ্ছুরিত করি তা দেখে তোমার শক্তির দম্ভলাভের জন্য লালসা জাগে না? 

ফাউস্ট : হ্যাঁ জাগে। আমার মনে এক বিরাট পরিকল্পনা গড়ে ওঠে। কিছু অনুমান করতে পারছ? 

মেফিস্টোফেলিস : তা বুঝেছি। আমি আর একটা বড় নগর বা রাজধানী অধিকার করব। তাতে থাকতে একটা বিরাট বাজার। কত তরিকরকারি ও মালপত্রে ভরা সে বাজারে অনবরত থাকবে মানুষের ভিড়। তার কাছাকাছি বড় রাস্তার ধারে আমি আরামে ও অফুরন্ত অবসরে বাস করব। সামনে থাকবে প্রসারিত গ্রাম্য প্রান্তর। আমার বাড়ি থেকে পিঁপড়ের মতো সারবন্দি কর্মব্যস্ত মানুষের আনাগোনা দেখতে বড় ভালো লাগবে আমার। অসংখ্য মানুষ আমাকে সম্মান করবে, শ্রদ্ধা করবে। 

ফাউস্ট : না, আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। কি হবে তাতে? কোনও জনপদের মানুষ ভালো খেল, মাখল, লেখাপড়া শিখল, সংখ্যা বৃদ্ধি করল। কিন্তু শেষে দেখবে ক্ষোভ বাড়তে থাকতে দিনে দিনে। তাতের সন্তুষ্ট করতে পারবে না কিছুতে। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে আমি আমার সচেতন শক্তি ও সুরুচির সাহায্যে কোনও এক মনোরম স্থানে প্রাসাদোপম এক প্রমোদভবন নির্মাণ করব। পাহাড়, সবুজ। মখমলের মতো ঘাসে ঢাকা প্রান্তর, সাজানো বাগান, ঝর্না সব থাকবে তার সীমানার মধ্যে। চিত্তবিনোদনের জন্য থাকবে অনেক সুন্দরী নারী। নারী শব্দটা আমি সব সময় বহুবচনে প্রয়োগ করতে চাই। এইভাব এই নিভৃত নির্জন ভবনে অনন্ত উজ্জ্বল আরামঘন অবকাশ যাপন করব আমি। 

ফাউস্ট : এও ভালো নয়। 

মেফিস্টোফেলিস : তাহলে বুঝেছি তুমি কি চাও। সেটা কিন্তু খুবই সাহসের ব্যাপার। চাঁদের কাছাকাছি চলে গেছে তোমার উচ্চাভিলাষ। তোমার বাতিকগ্রস্ত মন কি চাঁদের রাজ্যটাকেও দখল করতে চায়? 

ফাউস্ট : না ঠিক তা নয়। এই পৃথিবীর মাটিতেই এখনও অনেক কিছু করার আছে। কত বিস্ময়কর পরিকল্পনা মাথায় আসছে। নূতন শক্তিও কর্মোদ্যম অনুভব করছি আমি। 

মেফিস্টোফেলিস : তুমি তাহলে বীরের মতো গৌরব অর্জন করবেই? মনে হচ্ছে বীরাঙ্গনারা সঙ্গিনী হয়েছে তোমার। 

ফাউস্ট : শক্তি ও সম্পদলাভের অভিলাষ পেয়ে বসেছে আমায়। তার জন্য কাজ করতে হবে। কাজই আসল কথা, গৌরব নয়। 

মেফিস্টোফেলিস : কবিরা তার বিচার করবে। তোমার নির্বুদ্ধিতা থেকে নিবুদ্ধিতাই বাড়বে। ভবিষ্যৎ প্রমাণ করবে তোমার গৌরব।

ফাউস্ট : তোমার যা নাগালের বাইরে তার বিষয় জানবে কি করে? হিংসাগ্রস্ত কণ্টকিত তোমার অন্তর মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা জানতে পারে না। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমার ইচ্ছা-অভিলাষ তোমার থাক। তবে তার কথা বিশ্বাস করে আমায় বলতে পার। 

ফাউস্ট : উন্মুক্ত সমুদ্রের উপর চোখ পড়ে গেল আমার। দেখলাম অসংখ্য তরঙ্গমালা আপনার থেকে উত্তাল হয়ে উপকূলভাগকে আক্রমণ করার জন্য উদ্দাম বেগে ছুটে চলেছে। মনে হলো, ও তরঙ্গ আমাদেরই উত্তেজিত রক্তের উদ্ধত তুফান সকলের সব অধিকারবোধকে গ্রাস করার করার ছুটে চলেছে স্বাধিকার প্রমত্ত অবস্থায়। কিন্তু পরক্ষণেই দেখলাম সে তরঙ্গমালা গর্জন করতে করতে ফিরে আসছে। করায়ত্ত। লক্ষ্যবস্তুকে ছেড়ে দিয়ে চলে আসছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এটা এমন কিছু নূতন ব্যাপার নয়। শত সহস্র বছর ধরে এ। ঘটনা দেখে আসছি আমি।

ফাউস্ট আবেগের সঙ্গে) : যে সমুদ্রতরঙ্গ কূল পাবিত করে ছুটে চলে তার জলরাশি কিন্তু সৃজনীশক্তিবিহীন। তা কোনও উষর ভূমিকে উর্বর করতে পারে না। এই উদ্দেশ্যহীন প্রকৃতির নিষ্ফল সমারোহ আমাকে হতাশ করে তোলে মাঝে মাঝে। তবু আমি প্রতিনিবৃত্ত হই না। আমি দেখছি একমাত্র পাহাড়ই সমুদ্রকে দমন করতে পারে। উদ্ধত উদ্বেল তরঙ্গমালা অটল পাহাড়ের পদতলে শান্ত হরিণশিশুর মতো খেলা করতে থাকে। আমিও তেমনি ঐ উত্তুঙ্গ পাহাড়ের মতোই মাথা তুলে উঠতে চাই। সমস্ত প্রতিকূলতার তরঙ্গমালাকে প্রতিহত করে ফিরিয়ে দিতে চাই। 

(দূর হতে সামরিক সঙ্গীতের শব্দ আসছিল)।

মেফিস্টোফেলিস : কত সহজে কথাটা বললে! ঢাকের শব্দ শুনতে পাচ্ছ?

ফাউস্ট : জ্ঞানী ব্যক্তিরা আসন্ন যুদ্ধের কথা শুনতে চায় না। 

মেফিস্টোফেলিস : যুদ্ধ বা শান্তির কালে সুযোগ গ্রহণ করাই হলো জ্ঞানীর কাজ। বিজ্ঞ ব্যক্তিরা যে কোনও অবস্থা থেকেই কিছু না কিছু লাভ করার চেষ্টা করেন। তাঁরা লক্ষ্য করে যান। এখন সুযোগ উপস্থিত। সে সুযোগ গ্রহণ করো ফাউস্ট। 

ফাউস্ট : তোমার ওসব ঐন্দ্রজালিক ধনরত্নের মধ্যে আমি নেই। কি বলতে চাও ভালো করে বলল। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি এটা বেশ বুঝতে পেরেছি সম্রাটের এখন বিরাট দুর্দিন সমাগত। তুমি জান আমরা সেখানে থাকাকালে অনেক মায়াময় ধনসম্পদ তাঁকে দান করি। তার ফলে তার লোভলালসা বেড়ে যায়। তার উপর বয়সে যুবক বলে সহজেই উচ্ছলতায় গা ঢেলে দেন। সততা এবং কামনা, সুশাসন এবং ভোগবাসনা এই দুটো জিনিস কখনও পাশাপাশি চলতে পারে না। 

ফাউস্ট : এক বিরাট ভুল করেছেন তিনি। সুশাসক হতে হলে নিজের ইচ্ছা ও কামনা-বাসনাকে বিশ্বস্ত প্রজাকূলের স্বার্থের সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে চলতে হবে। 

মেফিস্টোফেলিস : সে সুশাসন তিনি করতে পারেন নি। তিনি ভোগবাসনায় গা ঢেলে দেন। ফলে সারা রাজ্যে দেখা দেয় নিদারুণ অরাজকতা। উচ্চ-নীচ সকলে মারামারি করতে থাকে পরস্পরের সঙ্গে। ভাই ভাইকে হত্যা করে। এমনকি ধর্মস্থানেও নরহত্যা চলতে থাকে। ব্যবসায়ীরা অসহায় বোধ করতে থাকে। চারদিকে বইতে থাকে প্রতিহিংসার স্রোত। শাসনের অভাবে সকলেই উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে আত্মরক্ষার জন্য। 

ফাউস্ট : তারা উঠছে আর পড়ছে। পড়ছে আর উঠছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এই ধরনের অবস্থা যখন চলছিল, যখন ভয়ে কেউ কোনও কথা বলতে পারছিল না, তখন একজন সমর্থ ব্যক্তি সাহস সঞ্চয় করে বলল, এই অশান্তির মাঝে যিনি আমাদের শান্তি দান করতে পারবেন তিনিই হবেন আমাদের সম্রাট। এখন তুমিই সম্রাট নির্বাচিত হও। দেশকে নূতন করে গড়ে তোলো, শান্তি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করো। 

ফাউস্ট : পুরোহিতের মতো কথা বলছ।

মেফিস্টোফেলিস : সম্রাট এখন শেষ যুদ্ধের জন্য এইদিকেই আসছেন। 

ফাউস্ট : তাঁর জন্য আমার কষ্ট হয়। লোক হিসাবে তিনি বড় সরল প্রকৃতির ও ক্ষমাশীল ছিলেন।

মেফিস্টোফেলিস : চলে এস। যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। ঐ সংকীর্ণ উপত্যকা হতে তাঁকে মুক্ত করতে হবে। দেখা যাক পাশার চাল কোনদিকে পড়ে। এখনও তাঁর হাতে সম্পদ আছে। চলে এস। (পাহাড়ের মাঝামাঝি উঠে সম্রাটের সেনাদল প্রত্যক্ষ করতে লাগল। আমরা তাঁর সঙ্গে যোগদান করব। জয় তাঁর অনিবার্য। 

ফাউস্ট : তার পরে কি হবে জানতে চাই। প্রতারণা, বিভ্রান্তিকর মায়া! ইন্দ্রজাল! 

মেফিস্টোফেলিস : না, প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে যুদ্ধজয়ের জন্য। তোমার মহান লক্ষ্যের কথা একেবার ভেবে দেখো। যদি রাজার এ রাজ্য রক্ষা করতে পার। শত্রুর কবল থেকে তাহলে সে রাজ্য একদিন শ্রমের পারিতোষিক হিসাবে দাবি করতে পারবে। 

ফাউস্ট : অনেক বিদ্যাতেই পারদর্শিতা দেখিয়েছ। এবার এক যুদ্ধ জয় করো।

মেফিস্টোফেলিস : না, তুমি জয় করবে। তোমাকে প্রধান সেনাপতি করা হবে।

ফাউস্ট : এক বিরাট মর্যাদা দান করছ। কিন্তু সেনাপতিত্বের আমি কিছু বুঝি না। 

মেফিস্টোফেলিস : কাজের যা কিছু দোষ বা ত্রুটি তোমার অধীনস্থ লোকদের উপর চাপিয়ে দিয়ে শুধু যশটুকু গ্রহণ করবে। আমি যুদ্ধের সময় অর্থেক মানুষের শক্তি আর অর্ধেক পাহাড়ের বা প্রাকৃতিক শক্তির উপর নির্ভর করলাম। 

ফাউস্ট : তুমি কি পার্বত্য জাতির লোকদেরও উত্তেজিত করেছ? ওরা অস্ত্র হাতে নিয়ে আসছে দেখছি।

মেফিস্টোফেলিস : না, তবে ওদের মধ্য থেকে সবচেয়ে ভালো দেখে কয়জনকে বেছে এনেছি। 

তিনজন শক্তিশালী বীরের আবির্ভাব

মেফিস্টোফেলিস : আমার লোকরা এসে গেছে। তারা বিচিত্র পোশাক ও অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তোমাকে সাহায্য করবে। তারা বীরত্ব দেখিয়ে শিশুদের আনন্দ দান করবে, শয়তানরূপে বিশ্বাসঘাতকরূপে পালাতে পারবে। 

বুল্লী (বিচিতক্রবর্ণের পোশাকপরা হালকা অস্ত্রসহ এক তরুণ) : আমার সামনে কেউ এলেই আমি ঘুষির পর ঘুষি মেরে তার চুলের মুঠি ধরে তাকে চিৎ করে ফেলে দেব। 

হ্যাভকুইক (মধ্যবয়সী ভালো পোশাক ও অস্ত্রে সজ্জিত) : এই যুদ্ধের কোনো অর্থ হয় না। এই সব বিবাদ নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক।

হোল্পপার্ট (বয়োপ্রবীণ ও অস্ত্র সজ্জিত) : যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে লাভ আমরা করি তা হাতের ফাঁক দিয়ে গলে যায়। জীবনের জোয়ার মানুষকে নিচের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বৃদ্ধলোকের কথা শুনে চললে ঠকতে হবে না। (তারা পাহাড় থেকে নামতে লাগল) 

দ্বিতীয় দৃশ্য

সম্রাটের শিবির সন্নিবেশ। নিচের থেকে রণবাদ্য শোনা যাচ্ছিল। 

সম্রাট, প্রধান সেনাপতি ও দেহরক্ষীবৃন্দ

প্রধান সেনাপতি : এই উপত্যকার মাঝে অবস্থান করাই এখন আমাদের বিধেয়। এখানে সরে এসে আমরা ভালোভাবেই সৈন্য সমাবেশ করেছি। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমাদের পরাজয় ঘটবে না। 

সম্রাট : কি হবে শীঘ্রই তা বোঝা যাবে। তবে এই অর্ধ-আত্মসমর্পণ ও অধাপসরণ নীতি আমি পছন্দ করি না। 

প্রধান সেনাপতি : নিচে তাকিয়ে দেখুন মহারাজ, কোথায় আমরা পতাকা উত্তোলন করেছি। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় ভূমি আমাদের দখলে। পাহাড়টা ঠিক খাড়াই না হলেও শত্রুদের অশ্বারোহী সেনাদল এগোতে পারছে না। আমাদের অর্ধেক শক্তি পাহাড়ে লুকোনো আছে। 

সম্রাট : আমার বলার শুধু একটা কথাই আছে, সাহস আর অস্ত্রের পরীক্ষার মাধ্যমেই গুণ বোঝা যায়। 

প্রধান সেনাপতি : ঐ দেখুন, ঐ প্রান্তরের মাঝখানে আপনার পদাতিক সৈন্যদল যুদ্ধে ব্যাপৃত। তাদের বিক্ষিপ্ত বর্শার ফলকগুলো কুহেলীঘেরা সূর্যের আলোয় চকচক করছে। আপনার সেনাদল সংখ্যায় শত্রুদের থেকে অনেক বেশি। 

সম্রাট : প্রথমে দৃশ্যটা আমার দেখতে দাও। শক্তিতে দ্বিগুণ মনে হচ্ছে সেনাদলটাকে। 

প্রধান সেনাপতি : বাঁ দিকের কথা বলার কিছু নেই। বীর যোদ্ধারা সৈন্যাব্যাস ও অস্ত্রগার পাহারা দিচ্ছে। বিনা রক্তক্ষয়ে কোনও শত্রুসৈন্য প্রবেশ করতে পারবে না সেখানে। 

সম্রাট : ওদিকে আমার প্রভুত্বকে অস্বীকার করে, সিংহাসনের মর্যাদাকে লজ্জন করে আমার বিদ্রোহী প্রজাগণ এগিয়ে আসছে আমারই বিরুদ্ধে। নিজের রাজ্য নিজেরাই বিধ্বস্ত করছে। ওদের মতির কোনো স্থিরতা নেই। 

প্রধান সেনাপতি : কোনও এক বিশ্বস্ত সৈনিক কোনও খবর নিয়ে আসছে। হয়ত সুসংবাদ আছে। 

প্রধান গুপ্তচর : সৌভাগ্যক্রমে আমরা জয়লাভ করেছি। আমাদের পক্ষের সাহস ও সমর কৌশল ফলবতী হয়েছে। তবে এখন অনেক প্রজা শ্রদ্ধাঞ্জলি দান করেছে। রাজাকে। 

সম্রাট : জনগণ স্বার্থপর, তারা শুধু আত্মরক্ষার কথাটাই ভালো করে বোঝে। কর্তব্যপরায়ণতা, কৃতজ্ঞতা কোনও কিছুই বোঝে না। তারা এটা বোঝে না যে প্রতিবেশীর ঘরে আগুন লাগালে তাদের নিজেদের ঘরও পুড়বে। 

প্রধান সেনাপতি : আর একজন ক্লান্ত চর আসছে। 

দ্বিতীয় গুপ্তচর : শত্রুপক্ষ যখন হতবুদ্ধি হয়ে ভাবছিল এবং আমরাও কি করব তাই। ভাবছিলাম তখন হঠাৎ আর একজন সম্রাটের আবির্ভাব হয়। আমাদের শত্রুরা তখন। পালিয়ে যায়। অনেকেই সেই সম্রাটের পতাকাতলে সমবেত হয়। তারা হচ্ছে ভেড়া। 

সম্রাট : প্রতিদ্বন্দ্বী এক সম্রাটের দ্বারা লাভবান হব আমি। তবে আমি তরবারি নিয়ে একা সম্মুখীন হব তার। এতদিন যুদ্ধ ও বিপদকে ভয় পেতাম আমি। তার মুখোমুখি হতে চাইতাম না। আজ আগুনের মাঝে পড়ে আমি নিজেকে বুঝতে পেরেছি। ফাঁকি দিয়ে একদিন যে যশ ও বিজয়গৌরব লাভ করতে চেয়েছিলাম তার জন্য আমি প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই আজ। (জনৈক দূত গিয়ে বিদেশাগত সম্রাটকে একক সম্মুখ যুদ্ধে আহ্বান করল) 

তিনজন শক্তিশালী লোকসহ ফাউস্টের প্রবেশ

ফাউস্ট : অশা করি আমাদের এই আগমন তিরস্কৃত হবে না আপনার দ্বারা। আপনি জানেন এই পার্বত্য জাতির লোকেরা অন্ধকার গিরিগুহার মধ্যে এক অতিপ্রাকৃত শক্তির প্রভাবে নীরবে গোপনে কাজ করে যাচ্ছে। তারা কিছু একটা আবিষ্কার করতে চায়। তারা নিরন্তন এক স্বচ্ছ সুতো কেটে চলেছে। 

সম্রাট : আমি তা জানি। কিন্তু বলো বীর, এতে আমার কি উপকার হবে? 

ফাউস্ট : আপনার বিশ্বস্ত ও অনুগত ভৃত্য সেই যাদুকর এর উত্তর দান করেছে। সে একবার এমন অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে পড়ে যায় যেখান থেকে কোনও দেবতা, মানব বা শয়তান তাকে উদ্ধার করতে পারত না। রোমের সম্রাট তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। সে এখন দূরে থাকলেও আপনার কথা ভাবে এবং আপনার গ্রহনক্ষত্রের কথা বিচার করে সে আমাকে আপনার সাহায্যার্থে পাঠিয়েছে। এই পার্বত্য জাতির লোকদের ক্ষমতা অপরিসীম। প্রকৃতির শক্তিতে এরা বলীয়ান। 

সম্রাট : এই সংকটজনক মুহূর্তে সাহায্যের জন্য তুমি যে এগিয়ে এসেছ এজন্য হে বীর তোমাকে স্বাগত জানাই। ধন্যবাদ দিই। কিন্তু হে বীর, তুমি অস্ত্রধারণ করবে না। আমার মুকুট ও সিংহাসন যে অবৈধভাবে দাবি করে সম্রাট সাজতে চাইছে, আমি ব্যক্তিগতভাবে তার সম্মুখীন হতে চাই। 

ফাউস্ট : আপনার মাথা যেমন করে তোক রক্ষা করতে হবে। কারণ সম্রাটের মাথাই শৃঙ্খলা বজায় রাখে সৈন্যদল ও প্রজাদের মধ্যে। আপনার সেই মাথায় যাতে কোনও আঘাত না লাগে তার জন্য আমি বীরত্ব সহকারে ঢাল দিয়ে রক্ষা করব এবং প্রয়োজনবোধে আমার প্রতিদ্বন্দ্বীকে আঘাত করে আপনার জয়ের অংশগ্রহণ করব। 

সম্রাট : আমার এত রাগ হচ্ছে যে, আমি তার সঙ্গে যুদ্ধ করে তার দর্পিত মাথাটা আমার পায়ের তলায় রেখে তার উপর দাঁড়াব। 

প্রহরী : (ফিরে এসে) আমরা কাছে গেলে তারা উপহাসের সঙ্গে বলল, তোমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী সম্রাট হচ্ছে অলীক স্বপ্নের লোক। 

ফাউস্ট : আমরা যা ভেবেছিলাম তাই ঘটেছে। ভালোই হয়েছে। এখন আপনার প্রতি যারা অনুগত তারা আপনার পাশে এসে দাঁড়াবে। এখন শত্রুসৈন্যরা এগিয়ে আসছে। আপনার সেনাদল আক্রমণের জন্য আপনার আদেশের অপেক্ষা করছে।

সম্রাট : তবু সে আদেশ আমি দেব। (প্রধান সেনাপতিকে) এটা তোমার কর্তব্য। সে কর্তব্য পালন করো বিশ্বস্ততার সঙ্গে। 

প্রধান সেনাপতি : বদিক থেকে শত্রুরা পাহাড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। আমাদের ডানদিকের সেনাদলরা তাদের আক্রমণ করুক। 

ফাউস্ট : আমি যে বীরদের সঙ্গে এনেছি তাদের মধ্যে এই কজন আপনার দলকে সাহায্য করুক। আপনি আদশে করুন। (তিনজনের মধ্যে বুল্লীকে ইশারা করল)। 

বুল্লী : (এগিয়ে এসে) আমার সামনে কেউ এগিয়ে এলেই তার গায়ের হাড় ভেঙে দেব। কারও পিঠে গেলে এক ঘুষিতে তা ভেঙে দেব। শত্রুরা নিজেদের রক্তের গভীরে নিজেরাই ডুবে যাবে। (প্রস্থান) 

প্রধান সেনাপতি : আমার প্রধান পদাতিক দল যারা কেন্দ্রস্থলে দাঁড়িয়ে আছে তারা ধীরে কাজ করবে। এখন ডানদিকের সেনাদলই সকলের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে শত্রুদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দিচ্ছে। 

ফাউস্ট : (মধ্যবয়সী হ্যাভকুইককে ডাকল) আপনি আদেশ করুন এখন এই লোকটিও কাজ শুরু করুক। 

হ্যাভকুইক : সম্রাটের সেনাদলের সঙ্গে এবার যুক্ত হবে আমার বীরত্ব। বিপক্ষ সেনাদলের রাজার শিবির হতে আমাদের লক্ষ্য। তাকে আর সিংহাসনে বেশিদিন বসে থাকতে হবে না। (প্রস্থান) 

প্রধান সেনাপতি : বাঁদিকের গিরিবন্ত্রের মুখে তুমুল যুদ্ধ হচ্ছে। আমাদের সেনারা প্রচণ্ডভাবে বাধা দিচ্ছে শত্রুসৈন্যদের। তাদের ঢুকতে দিচ্ছে না গিরিপথে।

ফাউস্ট : (হোল্ডপাস্টকে ডাকল) আমার এই তৃতীয় লোকটিকেও যুদ্ধে যোগদানের আদেশ দিন মহারাজ। আপনার শক্তির আরও বৃদ্ধি হোক। 

হোল্ডপাস্ট : আমি একবার যুদ্ধ নামলে জয় অনিবার্য। আমি একবার যা দখল করি বিদ্যুৎ বা বজ্রও তা ভাঙতে পারে না। (প্রস্থান) 

মেফিস্টোফেলিস : (উপর থেকে নেমে এসে) এখন দেখো, বিভিন্ন দিক থেকে কত শত্রুসৈন্য তরবারি ও বর্শা নিয়ে এগিয়ে আসছে। কিন্তু আমি চুপ করে বসে নেই। জানতে চেও না আমি কোথা থেকে এসেছি। তবে আমি শত্রুদের অস্ত্রাগার থেকে সব অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছি। ঐ দেখো, ওরা কেমন ক্ষিপ্ত হয়ে চিৎকার করতে করতে যুদ্ধ করছে। (জোর গোলমাল, শত্রুসৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল) 

ফাউস্ট : সামনের দিগন্তটা অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু তীক্ষ্ণ তরবারির উজ্জ্বলতায় পাহাড়, বন সব উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। 

মেফিস্টোফেলিস : ডানদিকের সেনাদল জোর যুদ্ধ করছে। কিন্তু তাদের সবার মাঝে বুল্লী একা দৈত্যের মতো লড়াই করে শত্রুসেনাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। 

সম্রাট : আচ্ছা আমি প্রথমে যেখানে দেখেছিলাম একটা হাত এখন সেখানে দেখছি এক ডজন হাত। এটা কেমন অস্বাভাবিক নয়? 

ফাউস্ট : সিসিলির উপকূলে একধরনের বাষ্পরাশির কথা শুনেছেন? স্পষ্ট দিবালোকে দেখলে বাষ্পের মধ্য থেকে এক মূর্তির আবির্ভাব হয় যা শহরের সব বাড়ি বাগান ওলট-পালট করে দেয়। 

সম্রাট : আমাদের পদাতিক দলের বর্শাগুলোর উপরে আমি একটা লোহার ফলক লাগানো বর্শাকে চকচক করতে দেখলাম। সঙ্গে দেখলাম সেই একটা বর্শা যেন। অনেকগুলো হয়ে উঠল। 

ফাউস্ট : ক্ষমা করুন মহারাজ, ওগুলো হচ্ছে পোলাস ও ক্যাস্টরের উজ্জ্বল প্রেতাত্মা। বিপদাপন্ন নাবিকরা ওদের স্মরণ করে। ওরা এসেছে আপনাকে সাহায্য করতে। 

সম্রাট : তাহলে বলো আমরা কার কাছে ঋণী। প্রকৃতিই কি ঐন্দ্রজালিক শক্তির সহায়তায় আমাদের পরিকল্পনাকে সাফল্যের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে? 

মেফিস্টোফেলিস : কার কাছে আবার? এক বৃদ্ধ রোমকের প্রেতাত্মাই নিজেকে বিপন্ন করে প্রবল শত্রুস্টৈদের ভয়ঙ্কর বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে আপনাকে। 

সম্রাট : আমার অভিযানকালে যাজকরা আমাকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল। কিন্তু আমি তাদের পানে তাকাইনি। আমার এই নবলব্ধ শক্তির উৎস কি তারাই? 

ফাউস্ট : এবার তাকিয়ে দেখুন, শত্রুরা আর নেই। আমার মনে হয় সেই আত্মা এক সুলক্ষণ পাঠাবে। 

সম্রাট : আকাশে একটা ঈগল ডিগবাজি খাচ্ছে। তারপর একটা গ্রিফিন পাখি আসছে।

ফাউস্ট : ভালো করে দেখুন। অনুকূল লক্ষণ মনে হচ্ছে। গ্রিফিন রূপকথার পাখি। সাহস করে এক ঈগলের সঙ্গে দ্বন্দ্বে নেমেছে। 

সম্রাট : একবার একটা পাক খেয়ে ওরা পরস্পরকে আক্রমণ করল। মনে হচ্ছে ওদের ঘাড়-দেহ দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাবে। 

ফাউস্ট : দেখুন গ্রিফিনরা এবার শান্ত হলো। নিজে ক্ষতবিক্ষত হয়ে শত্রুকে জয় করল ও। তারপর সিংগের মতো ওর দেহটাকে নত করে অদৃশ্য হয়ে গেল কোথায়। 

সম্রাট : এবার আমি লক্ষণটার অর্থ বুঝতে পেরেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : শত্রুসৈন্যরা বাঁদিক থেকে ডান দিকে সরে যাচ্ছে। সেখানেও প্রবল বাধা পাচ্ছে আমাদের সেনাদলের কাছ থেকে। এ যুদ্ধে আমরা একরকম জয়লাভ করে ফেলেছি। 

সম্রাট : দেখো দেখো, আমাদের জয়ে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। নিয়তি যেন হঠাৎ মত পরিবর্তন করেছে। শত্রুরা যখন অপ্রতিহত গতিতে এগিয়ে এসে গিরিপথ দখল করে ফেলছে তখন তাদের উপর একটা ঢেলাও ছুঁড়ছে না। পরিশেষে আমাদের সব স্বপ্ন ব্যর্থ হলো। তোমার সব কৌশল মিথ্যা মায়ায় পর্যবসিত হলো। 

মেফিস্টোফেলিস : দাঁড়কাকের মতো কুলক্ষণের আভাস পাচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে আমাদের অবস্থা খারাপ। 

সম্রাট : এই সব ভয়ঙ্কর পাখিগুলো কালো পাখা বিস্তার করে এখানে এসে বসল কেন? 

ফাউস্ট : আপনি পায়রাদের ডাকবহনের কথা শুনেছেন। দূর-দূরান্ত থেকে তারা খবরাখবর আনত। কিন্তু শান্তির সময়ে সেটা সম্ভব হতো। যুদ্ধের সময় দাঁড়কাকের দৌত্য? 

মেফিস্টোফেলিস : পাখিরা আমাদের বিপদের কথা ঘোষণা করছে। অদূরে শত্রুসৈন্যরা পর্বতপ্রাচীরের দিকে এগিয়ে আসছে। গিরিপথ একবার দখল করে নিলে আমাদের অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠবে। 

সম্রাট : আমার ভাগ্যে আছে পরাজয় আর প্রতারণা। তোমরাই আমাকে এই অবস্থার মধ্যে টেনে আনলে। তারা আমাকে শৃংখলিত করবে একথা ভাবলেও কম্পন আসছে আমার। 

মেফিস্টোফেলিস : সাহস অবলম্বন করুন। এখনও জয়-পরাজয়ের পাশা চূড়ান্তভাবে পড়েনি। ধৈর্য ধারণ করুন। আমাকে সৈন্য পরিচালনা করার আদেশ দিন।

প্রধান সেনাপতি : আপনি যখন যেচে এদের নেতৃত্ব মেনে চলার আদেশ দিয়েছেন তখন থেকেই আমাদের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। বাহুর দ্বারা কোনও সৌভাগ্য লাভ করা যায় না। যুদ্ধে পরাজিত আমরা। যুদ্ধ ওরা শুরু করেছে, ওরাই শেষ করুক। আমার পদ আমি ত্যাগ করছি। এতে আমার আর করার কিছু নেই। 

সম্রাট : কার্যভার ত্যাগ করো না এখন। সুদিনের অপেক্ষা করো। (মেফিস্টোফেলিসকে) তুমি এই কার্যভার গ্রহণ করো না। যদিও তুমি এ কাজের যোগ্য নও, তবু দেখো যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে আনতে পার কি না। যা হবার হোক। 

(প্রধান সেনাপতিসহ সম্রাটের প্রস্থান)

মেফিস্টোফেলিস : আমাদের এ পক্ষে কোনও সুবিধা হবে না।

ফাউস্ট : এখন কি করতে হবে? 

মেফিস্টোফেলিস : যা হবার হয়ে গেছে। এখন হে আমার দাঁড়কাক ভাইরা, তোমরা পাহাড়ে উড়ে যাও। সেখানে পার্বত্য হ্রদের ধারে বসে জলে নিজের দেহের ছায়া দেখে সত্য-মিথ্যার ব্যবধান বুঝতে দেখো। আসল থেকে নকলকে পৃথক করতে শেখো। 

ফাউস্ট : আমাদের দাঁড়কাক বন্ধুরা পাহাড়ে গিয়ে দেখবে অসংখ্য জলপ্রপাত আর ঝর্না পাহাড়ের উপর থেকে গড়িয়ে পড়ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এ দৃশ্য দেখতে ওরা অভ্যস্ত নয়। সবচেয়ে সাহসী পর্বতারোহণকারীরাও এতে ভয় পায়। 

ফাউস্ট : জলস্রোতের পর জলস্রোত গড়িয়ে পড়ছে সুউচ্চ পাহাড় থেকে। তারপর সে জলস্রোত ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকের উপত্যকা ও মালভূমিতে। ফেনায়িত সেই পতনশীল ও প্রসারণশীল জলতরঙ্গের গতিরোধ করার সাধ্য আমাদের নেই। 

মেফিস্টোফেলিস : আমি কিন্তু জলের দৃশ্যে কোনও ভয় পাই না; বরং আনন্দ পাই। ঐ দাঁড়কাকগুলো ঐ জলের উপর উড়ছে, স্নান করছে। (দাঁড়কাকগুলো ফিরে এলে) উপরকার মালিকের কাছে তোমাদের কাজের প্রশংসা করব। তোমরা এখন বাতাসে ভাসতে ভাসতে এক বামনের দেশে যাবে। সেখানে বামনরা হাঁপরে লোহা পিটছে মেরনে। সেখানে তাদের আগুন আছে। সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাতে পারে, কক্ষচট্যুত উল্কা পড়তে পারে। কিন্তু জানবে অরণ্যবৃক্ষের কঠিন শাখাপ্রশাখায় বিদ্যুৎ বা বজ্রের আগুন আটকে যায়। উল্কাও কোনও ক্ষতি করতে পারে না। অনুনয়ের কথা না শুনলে তাদের কড়া আদেশ দেবে। (দাঁড়কাকের প্রস্থান) এবার শত্রুদের উপর পড়ছে। রাত্রির কালো যবনিকা। তারা আর এগোতে পারছে না। মাঝে মাঝে হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে তাদের চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। তারা চিৎকার করছে ভয়ে। 

ফাউস্ট : যেখানে-সেখানে এলোমেলোভাবে তারা গোলাবর্ষণ করছে। 

মেফিস্টোফেলিস : অতীতে ইতালিতে শুয়েলফ ও গিবেলাইন দলের মধ্যে এইভাবে দীর্ঘকাল ধরে চলছিল যুদ্ধবিবাদ। তেমনি শয়তানসুলভ পারস্পরিক আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণে পার্বত্য উপত্যাকাগুলো ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। (সামরিক সঙ্গীত শোনা গেল) 

তৃতীয় দৃশ্য

প্রতিদ্বন্দ্বী সমাটের শিবির

সিংহাসন : রাজকীয় পরিবেশ 

হ্যাভকুইক ও স্পিডবুটি

স্পিডবুটি : আমরাই তাহলে প্রথম এখানে এসে উপস্থিত হলাম। 

হ্যাভকুইক : আমাদের মতো এত তাড়াতাড়ি কোনও দাঁড়কাকও উড়তে পারে পারে না।

স্পিডবুটি : কত ধনরত্ন ছড়িয়ে রয়েছে স্থূপীকৃত হয়ে। কোথা থেকে শুরু করে কোথায় শেষ করব? 

হ্যাভকুইক : গোটা জায়গাটাই ধনরত্নে পরিপূর্ণ। কত কি নেব বুঝতে পারছি না। 

স্পিডবুটি : এই নরম গালিচাটা আমার দরকার। আমার শোবার বিছানাটা শক্ত লাগে বড়। 

হ্যাভকুইক : (একটা অস্ত্র নিয়ে) এই অস্ত্রের একটা ঘায়েই একটা লোককে মারা যায়। এসব থাক। ঐ বাক্সটা নাও। ওতে খাঁটি সোনা ভরা আছে। এর থেকে সৈন্যদের সব বেতন দেওয়া হবে। 

স্পিডবুটি : বাক্সটা কী ভারী। তুলতে পারছি না।

হ্যাভকুইক : নাও তাড়াতাড়ি। ওটা তোমার শক্ত পিঠে চাপিয়ে দেব। 

স্পিডবুটি : হায় হায়, ওটা পড়ে গেল, আমার পিঠ ভেঙে গেল। (বাক্সটা খুলে গেল) সব সোনা ছড়িয়ে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি যত পার কুড়িয়ে নাও। 

স্পিডবুটি : আমার আঁচল ভরে যাক সোনায়। ‘ 

হ্যাভকুইক : নাও, যাও। একি তোমার আঁচল ফুটো! যেখানে যাচ্ছ সেখানেই পড়ে যাচ্ছ। 

সম্রাটের রক্ষীদল : কি খুঁজছ তোমরা এখানে? 

হ্যাভকুইক : আমরা আমাদের বেতন পাইনি। তাই বিরোধী পক্ষের শিবিরে এসেছি। আমরা সৈনিক। 

রক্ষীদল : সৈনিক হয়ে চুরি করতে এসেছ? সম্রাটের সেবা করতে হলে সৎ হতে হয়।

হ্যাভকুইক : সে সেবা পেতে হলে কিছু দিতে হয়। আমাদের মতো অবস্থায় পড়লে তোমরাও তাই করতে। চলো কেটে পড়ি। এখানে সুবিধে হবে না। (উভয়ের প্রস্থান) 

প্রথম রক্ষী : লোকটার মুখে প্রথমে একটা ঘুষি মারতে পারলে না?

দ্বিতীয় রক্ষী : এদের দেখতে ভূতের মতো মনে হচ্ছিল যার ফলে মারার মতো শক্তি খুঁজে পেলাম না। 

তৃতীয় রক্ষী : আমার চোখের সামনে হঠাৎ আলোর একটা ঝলকানি খেলে গেল। চোখ ধাঁধিয়ে গেল। 

চতুর্থ রক্ষী : আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না। সারাদিন গুমোট গরম গেছে। তার উপর কুয়াশায় চারদিক ঢাকা। তারই মাঝে যুদ্ধ করেছি। 

রাজনবর্গসহ সম্রাটের প্রবেশ

সম্রাট : আমরা যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। শত্রুরা গরুর পালের মতো যেন পালিয়ে। গেছে সমভূমির উপর দিয়ে। এই শূন্য সিংহাসনের উপর আজ আমি প্রতিষ্ঠিত। রক্ষীরা পাহারা দিচ্ছে। চারদিক হতে অনুগত প্রজারা দ্রুত আসছে। যদিও প্রথম দিকে যাদুবিদ্যার সাহায্য নিই। শেষের দিকে আমরা নিজেদের শক্তিতে যুদ্ধ করেছি। যুদ্ধকালে অবশ্য অলৌকিক ঘটনা মাঝে মাঝে ঘটলে ভালোই হয়। যেমন আকাশ থেকে পড়া পাথরখণ্ড, শত্রুদের মাথার রক্তবৃষ্টি, পর্বতগুহা হতে আগত অদ্ভুত ধ্বনি। যাই হোক; বিজেতারা স্বভাবতই ঈশ্বরে বেশি বিশ্বাস করে। তাই শেষের দিকে আমরা ঈশ্বরকে বলছিলাম, হে ঈশ্বর, আমরা তোমার গুণগান করি। এখন রাজন্য চতুষ্টয় সমর্থনের প্রত্যাশায় তোমাদের এখানে আমন্ত্রণ করেছি আমি। এখন তোমাদের সহযোগিতা একান্ত আবশ্যক। (প্রথম রাজন্যকে) তোমাকে প্রধান সেনানী নিযুক্ত করলাম। এই নাও তরবারি। যুদ্ধোত্তর কালের সমগ্র পরিস্থিতি পরিদর্শন করে যথাকর্তব্য নির্ধারণ করে কাজ শুরু করো। 

প্রধান সেনানী : আপনার সিংহাসন এখন সুরক্ষিত। এখন রাজ্যের সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে হবে। আপনার সমর্থনে আমার এই তরবারি চিরদিন নিয়োজিত হবে। আপনাকে সতত রক্ষা করে যাবে। 

সম্রাট : (দ্বিতীয় রাজকন্যাকে) তোমার উপর ভর দিলাম প্রাসাদের দাসদাসীদের পরিচালনা করার। অনেক সময় ওরা নিজেদের মধ্যে কলহ-বিবাদ করে অনেক কাজ পণ্ড করে দেয়। তুমি লক্ষ্য রাখবে ওরা যাতে রাজন্যবর্গের যথাযথভাবে সেবা করে এবং প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ করে চলে। 

প্রধান ভৃত্যপরিচালক : আপনার প্রীতি বর্ধনের জন্য আমি নিরন্তর কাজ করে যাব। এখন আমাদের একমাত্র কর্তব্য আপনার অভিষেক ও বিজয় উৎসবের আয়োজন করা। আপনি চলুন, আমি সোনার গামলা ও আপনার আংটি নিয়ে যাচ্ছি। 

সম্রাট : (তৃতীয় রাজন্যকে) তোমাকে নিযুক্ত করছি প্রধান পরিচারক। তুমি রন্ধনগৃহ ও পাঁচকদের তদারক করে আমার ভোজনের ব্যবস্থা করবে। 

প্রধান পরিচারক : প্রতিদিন আপনাকে সুখাদ্য পরিবেশন না করা পর্যন্ত আমি জলস্পর্শ করব না। নিত্যনূতন সুখাদ্যের ব্যবস্থা করার জন্য তৎপর থাকব আমি। কারণ প্রতিদিন এক খাদ্য ভাল হলেও তার আস্বাদ পাওয় যায় না। 

সম্রাট (চতুর্থকে) যেহেতু আমরা এক উৎসবের আয়োজন করেছি তোমার কাজ হবে উত্তম পানের ব্যবস্থা করা। তুমি দেখবে যেন মদের পাত্র সব সময় পূর্ণ থাকে। উৎসবের উন্মাদনায় নিজে যেন বেশি পান করে বসো না। 

মদ্য অধিকর্তা : হে মহারাজ, আমি বয়সে নবীন হলেও এ বিষয়ে অভিজ্ঞ। আমি মদ পরিবেশনের জন্য সোনা-রূপা প্রভৃতি বিভিন্ন ধাতুর পানপাত্রের ব্যবস্থা করব। আপনার হাতে তুলে দেব সবচেয়ে ভালো ও সুদৃশ্য পানপাত্রটি। সবচেয়ে ভালো মদ আপনাকে দেব যে মদে নেশা হবে না। 

সম্রাট : তোমাদের যা বলার বলেছি। সম্রাটের মুখের কথাই যথেস্ট। যাকে যা দেবার তাও একবার বলা হলে অবশ্যই দেওয়া হবে। স্বাক্ষর দরকার। উপযুক্ত স্বাক্ষরের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে ঠিকমতো তার প্রয়োগ হয় তা দেখতে হবে। 

প্রধান যাজক ও প্রধান প্রশাসকের প্রবেশ

সম্রাট : তোমরা চারজন রাজন্যকে দেখলে। আমি তাদের বুঝিয়ে দিয়েছি কিভাবে রাজপ্রাসাদ ও রাজদরবার পরিচালিত করতে হবে। তোমরা সকলে যেমন বিশ্বস্ততার সঙ্গে আমার সেবা করে যাবে তেমনি তার প্রতিদানস্বরূপ তোমাদের এক একটি রাজ্য দান করব। পরে সে রাজ্য তোমরা বাড়াতেও পারবে বিভিন্নভাবে। সেখানে তোমাদের বিচারের উপর কোনও আদালতে আবেদন চলবে না। সব করের টাকা তোমরা পাবে। শুধু খনিজদ্রব্য আর মুদ্রা থাকবে আমার অধিকারে। কৃতজ্ঞতার বশবর্তী হয়ে এইভাবে তোমাদের পদোন্নতি করলাম। 

প্রধান যাজক : আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গভীর ধন্যবাদ জানাচ্ছি আপনাকে। আপনি আমাদের নিরাপত্তা দান করে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন। 

সম্রাট : আমি আপনাদের উচ্চতর মর্যাদা দান করব। আপনারা আমাকে এই সিংহাসনের উত্তরাধিকারীরূপে অধিষ্ঠিত করুন। এতদিনের যুদ্ধ-বিবাদ সব অনাবিল শান্তিতে পরিণত হোক। 

প্রধান প্রশাসক : আপনিই হচ্ছেন প্রথম নরপতি যার সামনে বিনয়ের সঙ্গে মাথা নত করলাম আমরা। যতদিন আমাদের শিরায় শিরায় বিশ্বস্ততার রক্ত প্রবাহিত হবে ততদিন কখনও অবাধ্য হব না আপনার। 

সম্রাট : কয়েকটি শর্তে যে অধিকার ও সম্পত্তি তোমাদের দান করলাম তা দলিলে লিপিবদ্ধ হোক। এই সব সম্পত্তির আয় উপসত্ত স্বাধীনভাবে ভোগ করবে। তোমরা।

প্রধান প্রশাসক : আমি কাগজে তা লিপিবদ্ধ করব। পরে স্বাক্ষর সংযুক্ত হবে তাতে। 

সম্রাট : এখনকার মতো সভা ভঙ্গ করলাম। উৎসবের বিষয় নিয়ে আলোচনা করো নিজেদের মধ্যে। 

প্রধান যাজক : প্রশাসক চলে গেলেও যাজক রয়ে গেল একটা বিষয়ে আপনাকে সতর্ক করে দেবার জন্য। আমার পিতৃসুলভ হৃদয়টা আপনার জন্য ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে। 

সম্রাট : এই সুখের সময়ে কিসের ভয় অনুভব করছ তুমি? 

যাজক : এই সুখের সময়ে এই কথা ভেবে দুঃখ পাচ্ছি যে আপনি সিংহাসনে এখন সুপ্রতিষ্ঠিত হলেও আপনার মাথায় শয়তান বাস করছে। আমাদের ধর্মগুরু জানতে পারবেন আপনি সেই পুরুষ ডাইনটাকে হাতে পেয়ে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি আপনাকে শাস্তি দান করবেন। 

সম্রাট : এই পাপের জন্য আমি গভীর ভয় অনুভব করছি। তোমার শক্তিতে তুমি এই পাটা অনেক লঘু করে দেবার চেষ্টা করবে। 

প্রধান যাজক : যে রাজ্যে পাপ প্রবেশ করেছিল সে রাজ্যকে পাপমুক্ত করতে হলে ব্যাপকভাবে ধর্মাচরণ করতে হবে। সকালে উঠেই ঈশ্বরের স্তোত্রগান করতে হবে। দিকে দিকে ধর্ম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। ঈশ্বরে বিশ্বাস বাড়াতে হবে জনগণের মধ্যে। রাজ্য থেকে নাচগানের উৎসব উচ্ছেদ করতে হবে। পাপীর হৃদয়কে অনুতাপে ভরিয়ে তুলতে হবে। 

সম্রাট : আমার অনুপাতবোধ এবং ঈশ্বরের গুণগানের ব্যবস্থাই হবে আমার প্রথম কাজ। 

যাজক : এবার চার্চের সঙ্গে রাজার সন্ধি স্থাপন করতে হবে।

সম্রাট : আগের নথিপত্রে দেখছি চার্চ রাজকীয় প্রভাব থেকে মুক্তি চাইছিল। তোমাদের আবেদন আনো। আমি স্বাক্ষর করে দেব। 

প্রধান যাজক : (যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়িয়ে) এই মুহূর্তে কাজ শুরু করে দিন। চার্চের উন্নতির জন্য রাজ্যের সমস্ত আদায় করা কর ব্যয় করুন। আমাদের ব্যয়ভার বহনের জন্য অনেক কিছু দরকার। আপনার কোষাগার হতে কিছু সোনাও দান করবেন। এছাড়া যে সব নিত্য ব্যবহার্য বস্তু আমাদের দরকার, জনগণ আমাদের নীতি উপদেশ সম্বলিত বক্তৃতা শুনে তা দান করবে। যে ব্যক্তি চার্চের জন্য ব্যয় করবে তাকে চার্চ অবশ্যই আশীর্বাদ করবে। (প্রস্থান) 

সম্রাট : পাপের পরিমাণ সত্যিই বিরাট। যাদুকরেরা অনেক ক্ষতি করে গেছে। অনুতাপে ভারাক্রান্ত আমার হৃদয়। 

প্রধান যাজক : (ঘুরে এসে) ক্ষমা করবেন মহারাজ, উপকূলভাগের যে রাজ্যটা সেই কুখ্যাত যাদুকরকে দান করেছেন, আপনার পাপ স্খলন না হওয়া পর্যন্ত তারও কর ও রাজস্ব আমরা পাব। সেও বাদ যাবে না। 

সম্রাট : সে রাজ্যের অস্তিত্ব এখন আর নেই। তা এখন সমুদ্রে ঢুকে গেছে। প্রধান যাজক : যে ব্যক্তি ন্যায়পরায়ণ ও ধৈর্যশীল তার সুদিন আসবেই। (প্রস্থান) সম্রাট : আমার গোটা সাম্রাজ্যটা তোমাদের দান করলে ভালো হতো। 

পঞ্চম অঙ্ক

প্রথম দৃশ্য 

উন্মুক্ত গ্রামাঞ্চল

পথিক : হ্যাঁ, এখানেই আছে সেই বৃদ্ধ দম্পতি। দীর্ঘ তীর্থযাত্রার পর তাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে আবার। বিক্ষুব্ধ সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে এখানে এই কুঁড়েঘরে আশ্রয় লাভ করেছি আমি। বৃদ্ধ হলেও তারা ধার্মিক। দীর্ঘ বিচ্ছেদের পর আবার দেখতে পাব তাদের। 

রসিস (জনৈক বৃদ্ধা) : ধীরে পথিক। আমার স্বামীর ঘুম ভেঙে যাবে। দীর্ঘ নিদ্রার দ্বারা তিনি ক্লান্ত ও অবসন্ন দেহে শক্তি ফিরে পেতে চান। 

পথিক : বলো মাতা, তুমিই কি রসিস যিনি আমাকে একদিন সেবা-শুশ্রষার দ্বারা নবজীবন দান করেন, যাকে ধন্যবাদ দেবার জন্য এখানে এসেছি। আমি। (স্বামী এগিয়ে এসে) তুমিই তো ফিলোমন, আগ্রাসী সমুদ্রতরঙ্গের কবল থেকে আমার ধনরত্ন। রক্ষা করেছিলে। আমার দুর্ভাগ্য তোমারই জন্য পরিণত হয়েছিল সৌভাগ্যে। একবার সেই অনন্ত সমুদ্রকে দেখতে পাও। 

ফিলোম্যান : (রসিসকে) নাও, তাড়াতাড়ি করে ঐ বাগানে গাছের ছায়ায় আমাদের খাবার দাও। (পথিককে) সমুদ্রের যেখানে বিক্ষুব্ধ তরঙ্গমালার কবলে পড়েছিলে তুমি সেইখানে বহুদিন আগে বাঁধে ঘেরা স্বর্গোদ্যানের মতোই এক বাগান। এখন হয়ত দেখতে পাচ্ছ না না সেখানে গড়ে উঠেছিল এক সবুজ জনপদ। যাই হোক, চলে এস, খাবার প্রস্তুত। জাহাজগুলো বন্দরের অভিমুখে চলেছে রাত্রির আশ্রয় নেবার 

জন্য। 

দ্বিতীয় দৃশ্য 

ছোট বাগানবাড়ি 

খাবারের টেবিলে তিনজন

রসিস : (পথিককে) তুমি যাচ্ছ না কেন? কত জিনিস এনেছি তোমার জন্য। 

ফিলোমন : সে অনেক আশ্চর্যজনক ঘটনার কথা জানতে পারবে। ওকে সব। বলো। 

রসিস : সত্যিই ব্যাপারটা অলৌকিক। ভাবতেও কেমন যেন লাগে। মনে হয় এটা যেন কোনও অশুভ ভুতুড়ে শক্তির কাজ। 

ফিলোমন : এখানকার এই রাজ্যটা তাকে দান করে সম্রাট কি দুঃখ-অনুতাপে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছেন? এই নিম্ন উপকূলভাগে সেই লোকটা হঠাৎ এসে তাঁবু খাঁটিয়ে সবুজ মাঠের উপরে এসে প্রাসাদ গড়ে তোলার জন্য কাজ শুরু করে দিল। 

রসিস : দিনরাত কাজ হতে লাগল। রাতেও আগুন জ্বেলে অনেক লোক কাজ করত। অনেক খাল কেটে সেগুলো সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত করে দিল। আমাদের চাষের জমিগুলো সে দখল করে নেবে। সে আমাদের রাজা আর আমরা তার প্রজা। 

ফিলোমন : ক্ষতিপূরণস্বরূপ চাইছে আরও ভালো জমি। 

রসিস : সে জমি জলে ভেসে যাবে, তার চেয়ে পাহাড়ের উপর বসতি স্থাপনের চেষ্টা করো। 

ফিলোমন : এখন চলল গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করি। স্তোত্রগান গাই। সূর্যের শেষ রশ্মিও মুছে গেছে। চলো নতজানু হয়ে ঈশ্বরের প্রতি আমাদের প্রাচীন বিশ্বাসকে। মুখরিত করে তুলি স্তোত্রগানে। 

তৃতীয় দৃশ্য

প্রশস্ত প্রমোদ উদ্যান। পাশ দিয়ে চওড়া খাল, রাস্তা চলে গেছে। 

বৃদ্ধ ফাউস্ট চিন্তান্বিত অবস্থায় পায়চারি করছিল।

লিনসেউস (প্রহরী) : এখন সূর্য অস্ত যাচ্ছে। জাহাজগুলো পোতাশ্রয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। এর পরে এই খালে প্রবেশ করবে জাহাজগুলো। সমুদ্র নাবিকরা আশীর্বাদ করবে তোমায়। (ছোট এক ঘণ্টার ধ্বনি শোনা গেল নিচের থেকে) 

ফাউস্ট : ঐ অভিশপ্ত ঘণ্টার ধ্বনি যেন আমাকে উপহাস করছে। আমার রাজ্য সামনের দিকে অনন্ত প্রসারিত। শুধু পিছনে দুস্ট বাধার জন্য আমার সুন্দর পরিকল্পনাটা সার্থক হতে পারছে না। বাদামী রঙের ঐ কুঁড়েটা তার ভগ্নপায় গির্জাটা আমার দখলে নেই। ঐ ঘণ্টাধ্বনি এই কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাকে। পূর্ণ আনন্দ লাভ করতে পারছি না আমি। বিরক্তিকর পুরণো কাঁটার মতো এই চিন্তাটা বিঁধছে আমার মনে। মনে হচ্ছে দূরে চলে যাই। 

প্রহরী : একটা একতলা জাহাজ মালপত্র নিয়ে এখানে ভিড়ল। তাতে সিন্দুক, বাক্স, বস্তা কত কি রয়েছে। 

মেফিস্টোফেলিস ও তিনজন শক্তিশালী লোক

কোরাস : পাল নামাও। এখানেই আমরা নামব। আমাদের মালিককে নমস্কার। (তারা নেমে মালপত্র নামাল)। 

মেফিস্টোফেলিস : আমরা বিভিন্নভাবে আমাদের যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছি। আমাদের প্রভু আমাদের কাজের প্রশংসা করলে আমরা খুশি হব। আমরা মাত্র দুটি জাহাজ নিয়ে গিয়েছিলাম সমুদ্রে। ফিরে এসেছি বিশটা জাহাজ নিয়ে। তার সঙ্গে এনেছি প্রচুর মালপত্র। অনন্ত সমুদ্রে মানুষের মন থাকে উদার উন্মুক্ত। কোনও দুশ্চিন্তা থাকে না। সেখানে শক্তি মানেই অধিকার। তাই দিয়ে সহজেই সেখানে তুমি মাছ ও জাহাজ ধরতে পার। আমি মনে করি যুদ্ধ ব্যবস্থা আর জলদস্যুতা–দুটোই এক। একে অন্য থেকে আলদা করা যায় না। 

তিনজন শক্তিশালী ব্যক্তি : কোনও ধন্যবাদ পেতে পারি না আমরা? তার মুখে দেখছি বিরক্তির চিহ্ন। আমাদের মনে হচ্ছে রাজার ধন দেখে উনি বিরক্তি বোধ করছেন। 

মেফিস্টোফেলিস : তোমরা তোমাদের অংশ তো নিয়ে গেছ। আর বেতন হিসাবে কিছু চেও না।

শক্তিশালী ব্যক্তিরা : আমরা স্মৃতি করার জন্য সামান্য কিছু নিয়েছিলাম। আমরা সমান অংশ দাবি করি। 

মেফিস্টোফেলিস : প্রথমে মালপত্রগুলো সাজিয়ে দাও পরপর। এত ধনরত্ন লাভ করার পর তিনি কখনোই কার্পণ্য করতে পারেন না। তিনি নিশ্চয়ই আমাদের প্রাপ্য দিয়ে দেবেন এবং ভোজও দান করবেন। কাল এস, আমিও থাকব। (তারা চলে যেতে ফাউস্টের প্রতি) মুখ ভার করে কুঞ্চিত ড্র নিয়ে বসে আছ। তোমার এই সৌভাগ্যের কথা শুনেও শুনছ না। আজ দেখো সমুদ্রকে তোমার এই কূলে নিয়ে এসেছি। আজ তুমি হাত বাড়িয়ে বলতে পার সারা পৃথিবীটাকে তুমি হাতের মুঠোর মধ্যে ধরবে। একদিন তোমার এইখানেই যে পরিকল্পনাটা খাড়া করা হয়েছিল সেই পরিকল্পনা আমরা কিভাবে সার্থক করেছি তা দেখ। তোমার সেবকরা জলভাগ ও স্থলভাগ থেকে কত সম্পদ এনেছে তা দেখ। 

ফাউস্ট : এখনও ঐ অভিশপ্ত ঘরটা রয়েছে ওখানে। অন্তরে যেন যেন হুল ফোঁটাচ্ছে। সহ্য করতে পারছি না আর। একথা বলতে লজ্জা হচ্ছে আমার। চুন সুরকির ঐ কুঁড়েটার নিশ্বাস যেন ঐ ঘণ্টাধ্বনিও সমস্ত বাতাসটাকে দূষিত করে দিচ্ছে। 

মেফিস্টোফেলিস : এই ঘৃণাটা তোমার জীবনটাকে স্বাভাবিকভাবেই তিক্ত করে তুলছে। এই অভিশপ্ত ঘণ্টাধ্বনি এই সন্ধ্যার আকাশকে যেন আরও অন্ধকার করে দিয়ে বলছে জীবনটা স্বপ্নমাত্র। 

ফাউস্ট : ঐ অভিশপ্ত ঘণ্টার একটানা একঘেয়ে শব্দটা আমার পাওয়া সব ধনরত্নের উজ্জ্বলতা ম্লান করে দিচ্ছে। আমি বিরক্তি অনুভব করছি। 

মেফিস্টোফেলিস : এখন স্ফুর্তি করো। তুমি তো আগেই ওগুলোকে তোমার উপনিবেশের অন্তর্ভুক্ত করে নিতে পারতে। 

ফাউস্ট : এখন তাহলে ওগুলো সরাবার ব্যবস্থা করো। তবে ঐ বৃদ্ধদের থাকার জায়গা আমি বেছে রেখেছি। 

মেফিস্টোফেলিস : ওদের অন্য জায়গায় পুনর্বাসন দান করব। চোখের পলক ফেলতে না ফেলতেই দেখবে আবার তারা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তবে জোর দেখাতে এসে কিছুই পাবে না। (বাঁশি বাজাল এবং তিনজন শক্তিশালী লোক এল) তোমাদের প্রভু যা বলে শোনো। আগামীকাল ভোজসভা বসবে জাহাজে। 

তিনজন : আমাদের মালিক আমাদের ভালো করে অভ্যর্থনা জানাননি। আমাদের ভোজটা যেন আনন্দের হয়। 

মেফিস্টোফেলিস : (দর্শকদের পানে তাকিয়ে) অতীতে যেমন হয়েছে এবারও তাই হবে। 

চতুর্থ দৃশ্য 

নিশীথ রাত্রি 

প্রহরী লিসেউস (প্রাসাদশীর্ষে গান গাইতে গাইতে)

এই প্রাসাদশীর্ষেই আমার বাসস্থান। এখান থেকে চারদিকে দেখাই আমার কাজ। এখান থেকে সারা পৃথিবীর পানে তাকিয়ে দেখি আমি। দূরে নিকটে আকাশে মাটিতে বনে প্রান্তরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিয়ে সব কিছু দেখি। সব কিছুই সুন্দর মনে হয়। সব কিছুতেই দেখি ঈশ্বরের মহিমা। (একটু থেমে) তবে শুধু আনন্দজনক বস্তুই দেখি না। অনেক সময় অনেক বিভীষিকাময় বস্তুও দেখি। নিচের পানে তাকিয়ে অন্ধকারে কি দেখছি আমি। লিন্ডেল গাছের ফাঁকে ফাঁকে আগুন জ্বলছে। বাতাসে যে আগুন বেড়ে যাচ্ছে। এখানে যে কুঁড়েঘরে বুড়ো-বুড়ি থাকে সেটা পুড়ে যাচ্ছে। ওধানে গির্জাটাও ভেঙে যাচ্ছে। ওদের কি উদ্ধার করা হয়েছে জ্বলন্ত ঘর থেকে এ ধরনের বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করার থেকে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলা ভালো। ভোরের লাল মেঘের মতো দিগন্তটাকে আচ্ছন্ন করে আছে এ আগুনটা। 

ফাউস্ট : উপরে কার বিলাপের ধ্বনি শুনছি? আমার প্রহরী কাঁদছে। এ হঠকারী কাজের জন্য এখন বিরক্তিবোধ করছি অন্তরে। তবে ঐ কুঁড়েগুলো উচ্ছেদ করার ফলে এবার চারদিক উন্মুক্ত হলো। আর কিছুর দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হবে না আমার অনন্ত প্রসারিত দৃষ্টি। ঐ বৃদ্ধ দম্পতির জন্য আমি অবশ্য বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দেব যাতে জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো ওরা উপভোগ করতে পারে ভালোভাবে। 

মেফিস্টোফেলিস ও তিনজন শক্তিশালী লোক : ব্যাপারটা খুব সুখের হলো না। আমরা ওদের বন্ধ কুঁড়েতে গিয়ে কড়া নাড়ালাম। কত ডাকাডাকি করলাম। কেউ খুলল না। তখন দরজা ভেঙ্গে আমরা ঢুকলাম। বুড়ো-বুড়ি ছাড়া একজন অপরিচিত ব্যক্তি ছিল। ওরা বাধা দিল। জ্বলন্ত অঙ্গার দিয়ে আমাদের মারতে গিয়ে সে অঙ্গর খড়ের উপর পড়ায় আগুন ধরে গেল। ওরা তিনজনেই মারা গেল। ঐ আগুনের চিতায় তিনজনেই ভস্মীভূত হয়েছে। 

ফাউস্ট : আমার কথা তোমরা শোেনননি। আমি বলেছিলাম ঘরের বদলে ঘর দেবে, দুস্যতা করবে না। বর্বরের মতো আঘাত হেনেছে ওদের ওপর। এ পাপ তোমাদের বহন করতে হবে। 

কোরাস : প্রাচীন প্রবাদবাক্যে বলে বলবানের কাছে যদি মাথা নত না করো তাহলে বাড়ি-ঘর ও তোমার জীবন সব যাবে। (প্রস্থান) 

ফাউস্ট : আকাশের তারাগুলো যেন মুখ লুকিয়েছে। ওদিকে আগুনটাও স্তিমিত হয়ে এসেছে। স্যাঁতসেঁতে হাওয়ার মাঝে মাঝে জ্বলে উঠছে আগুনটা। ধোয়াটা এদিকে আসছে। আমার আদেশটা খুব তাড়াতাড়ি পালিত হয়েছে। কিন্তু ছায়ার মতো কি একটা আসছে এদিকে। 

পঞ্চম দৃশ্য 

নিশীথ রাত্রি 

চারজন ছায়ামূর্তির (নারী) আবির্ভাব

অভাব : আমার নাম হচ্ছে অভাব।

পাপ : আমার নাম হচ্ছে পাপ।

নিষ্ঠা : আমার নাম নিষ্ঠা। 

প্রয়োজন : আমার নাম প্রয়োজন। 

তিনজন একত্রে : দরজায় খিল দেওয়া রয়েছে। আমরা প্রবেশ করতে পারছি না। বাড়ির মালিক ধনী। 

অভাব : আমি ছায়ায় পরিণত হয়ে যাচ্ছি।

পাপ : আমি কিন্তু ছায়া হবে না।

প্রয়োজন : আমার কাছে যারা প্রশ্রয় পায় তারা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। 

নিষ্ঠা : তোমরা ঢুকতে পারবে না বা সাহস করবে না। কিন্তু দরজায় যে ছিদ্র আছে তাতে আমি ঢুকে পড়েছি। (প্রস্থান) 

অভাব : তোমরা চলে যাও এখান থেকে।

পাপ : আমি তোমার পাশে পাশেই থাকব।

প্রয়োজন : প্রয়োজন তপ্ত নিশ্বাসে অভাবের কাছে কাছেই থাকে। 

তিনজন একত্রে : ভাসমান মেঘমালায় চাঁদ ঢেকে যাচ্ছে। দূরে আমাদের পিছনে আমাদের ভাই মৃত্যু ধেয়ে আসছে। 

ফাউস্ট : (প্রাসাদে) আমি চারটি ছায়ামূর্তিকে আসতে দেখলাম। কিন্তু তিনজনকে যেতে দেখলাম। তারা কি বলল তা বুঝতে পারলাম না। তবে দুটো কথা বুঝতে পারলাম, প্রয়োজন আর মৃত্যু। কথাটা শুনে ভয় পেয়ে গেলাম আমি। এখনও সেই ভয় থেকে মুক্ত করতে পারিনি নিজেকে। প্রাচ্যের সেই জ্ঞানী লোক অর্থাৎ মাজীদের গুপ্তবিদ্যা যদি আমি শিখে নিতে পারতাম তাহলে হে প্রকৃতি আমি একা মানুষের মতো মানুষ হয়ে দাঁড়াতে পারতাম তোমার মাঝে। জীবনের মানে বুঝতে না পেরে জগৎকে কত অভিশাপ দিয়েছি আমি। এখন বাতাসে এত প্রেতের আনাগোনা হচ্ছে যে পরিত্রাণের পথ দেখতে পাচ্ছি না। অতীতে একদিন যখন যৌবন ছিল তখন এই রাত্রিতে কত স্বপ্নজাল রচনা করেছি। কিন্তু তারপর দুর্ভাগ্য শুরু হলো। সঙ্গে সঙ্গে কুসংস্কারের জালে আবদ্ধ হয়ে গেলাম আমি। ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে একটা দাঁড়িয়ে আছি। আমি। দরজাটা খুলে গেল, অথচ কেউ প্রবেশ করল না। বাইরে কে? 

নিষ্ঠা : আমি আছি।

ফাউস্ট : কে তুমি?

নিষ্ঠা : আমি আছি।

ফাউস্ট : দূর হয়ে যাও।

নিষ্ঠা : আমি যেখানে আছি সেখানেই থাকব। 

ফাউস্ট : সাবধান, কোনও যাদুর কথা বলবে না। 

নিষ্ঠা : একমাত্র বিপন্ন ব্যক্তি ছাড়া কেউ আমার কথা শুনতে চায় না। জলে-স্থলে সর্বত্রই সব সময় আমাকে পাওয়া গেলেও কেউ আমাকে চায় না। কোনও মানুষ আমাকে মূর্ত দেখতে চায় না। তুমি নিষ্ঠাকে চেন না? 

ফাউস্ট : ক্ষুধা আর কামনার তাড়নায় সারা জগৎ ঘুরে বেড়িয়েছি আমি। যা আমার ভালো লাগেনি আমি তা ছেড়ে দিয়েছি। একটি কামনা তৃপ্ত একটি ক্ষুধা নিবৃত্ত হলে আর এক কাম্যবস্তুর জন্য ছুটে চলেছি। জগতের আসল রূপটা আমার দেখা হয়ে গেছে। এই জগতের পরপারে কি আছে তা আমি দেখতে চাই না। অমরত্বের কোনও প্রয়োজন নেই। এই জীবনের অর্থ ও চূড়ান্ত মূল্য এই জগতের মাঝেই খুঁজে পেতে হবে। সুখদুঃখের ফুল ও কাঁটা ছড়ানো পথে নিরন্তর এগিয়ে যেতে হবে মানুষকে চির অতৃপ্ত মন নিয়ে। 

নিষ্ঠা : আমি যাকে একবার ধরি সে জীবনে কোনওদিন সুখ পায় না। সব পেয়েও কিছুই পায় না সে। 

ফাউস্ট : থামো। তুমি আমাকে কোনওদিন ধরতে পারবে না। চলে যাও। তোমার কথা শোনার কোনও প্রবৃত্তি নেই আমার। তুমি জ্ঞানী লোকদেরও বোকা বানিয়ে দাও। 

নিষ্ঠা : সে যাবে না আসবে? সে কি করবে? নিষ্ঠা ছাড়া সে কিছুই করতে পারবে না। মাঝপথে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। না শুরু, না শেষ, না বন্ধন, না মুক্তি তন্দ্রাচ্ছন্ন মানুষের মতো সে শুধু ঝিমোবে। নরকই তার একমাত্র উপযুক্ত স্থান। 

ফাউস্ট : হে ছায়ামূর্তি, তুমি আমার মধ্যে যতই ভয়ের সঞ্চার করো না, আমি তোমাকে স্বীকার করব না। আমি দানব বা অপদেবতাদের ভয় করলেও তোমাকে করব না। 

নিষ্ঠা : এইবার আমার অভিশাপ ভোগ করো। আমি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সমগ্র সত্তা, সমগ্র অস্তিত্ব অন্ধকার হয়ে যায়। তোমারও তাই হবে ফাউস্ট। 

ফাউস্ট : রাত্রির অন্ধকার আমার চারদিকে বেশি করে ঘন হয়ে উঠছে। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রচুর আলো রয়েছে। আমার পরিকল্পনার সবটুকু সার্থক না হওয়া পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছি না আমি। নাও, সবাই এই মুহূর্তে যন্ত্রপাতি হাতে নিয়ে কাজে লেগে পড়। এ কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। এর জন্য সবচেয়ে ভালো পুরস্কার পাবে। এই বিরাট কাজ শেষ হলে সবাই বুঝবে একটা মন হাজারটা হাতের সমান। 

ষষ্ঠ অধ্যায় 

প্রাসাদসংলগ্ন রাজসভা। মশাল।

মেফিস্টোফেলিস : (তদারক হিসাবে) কই এদিকে এস, লিমিওর। 

লিমিওর : অবিলম্বে আমরা কাজে লেগে গেছি। জায়গা মাপের ফিতেও এনেছি। কিন্তু আমাদের সাহায্য কেন চাওয়া হলো বুঝলাম না। 

মেফিস্টোফেলিস : কোনও কারুকার্যের প্রয়োজন নেই। আগেকার কালের মতো কোনওরকমে কাজটা শেষ করলেই হবে। এক বিরাট আয়তক্ষেত্রাকার জায়গা খুঁজতে হবে। 

লিমিওর : যৌবনে কত আশা করে প্রেম করেছিলাম। কিন্তু এখন বার্ধক্যে জর্জরিত আমি। আসতে আসতে এক কবরে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। 

ফাউস্ট : তোমাদের যন্ত্রপাতির শব্দ শুনে বড় আনন্দ হচ্ছে আমার। আমার জন্য জনগণ কঠোর পরিশ্রম করছে। উদ্ধত সমুদ্রতরঙ্গমালাকে প্রতিহত করার জন্য, সমুদ্রকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করার জন্য কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে রাত্রির পৃথিবী। শ্রম ও সাধনার মধ্য দিয়ে মানুষ পৃথিবীকে নতুন রূপ দান করবে। 

মেফিস্টোফেলিস : বাঁধ নির্মাণ করার জন্য তুমি আমাদের বৃথাই খাটাচ্ছ। সমুদ্র দেবতার সঙ্গে তুমি লড়াই করছ। সমুদ্রের শয়তানরা তোমাকে ঘিরে ফেলবে। তোমার ধ্বংস অনিবার্য। 

ফাউস্ট : তুমি একজন কর্মপরিদর্শক মাত্র।

মেফিস্টোফেলিস : হ্যাঁ আমি তাই। 

ফাউস্ট : শক্তিশালী বহু লোক সংগ্রহ করো যে কোনও ভাবে। পুরস্কারের লোভ দেখাও। অথবা আসতে বাধ্য করো পীড়ন দ্বারা। এই পরিখা খননের কাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিদিন আমাকে খবর দেবে কতটা কাজ হলো। 

মেফিস্টোফেলিস : এ কাজ শেষ হলে পরিখা হবে না, হবে তোমার কবর।

ফাউস্ট : ঐ পাহাড়টার পাদদেশে একটা বদ্ধ জলাশয় আছে। ওটা আমার এক দুশ্চিন্তার কারণ। খাল কেটে এই জলটাকে প্রবহমান করে দিতে চাই আমি। সেই জলে লক্ষ লক্ষ লোক চাষ-আবাদের সুযোগ পাবে। কত জমি উর্বরতা প্রাপ্ত হয়ে সবুজ ফসলে ভরে উঠবে। চারদিকে পাহাড়ঘেরা এক সুরক্ষিত জায়গায় এক নূতন সুজলা সুফলা পৃথিবী গড়ে উঠবে। সেই ভূ-স্বর্গের পাশে অসংখ্য সমুদ্রতরঙ্গ কূল অতিক্রম করার জন্য গর্জন করবে। কিন্তু অসংখ্য মানুষের সমবেত চেষ্টায় তা পারবে না। আমি এটা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি নিত্য নূতন বাধা জয় করার মধ্যে দিয়েই মানুষ তার সত্তার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে। এখানেই থাকবে আমার সারা জীবনের সঞ্চিত জ্ঞানের স্বাক্ষর আর সার্থকতা। এইখানেই অতিবাহিত হবে আমার জীবনের শেষ দিন। এক স্বাধীন চিরসমৃদ্ধ ও চিরসুন্দর দেশের উপর গড়ে উঠবে এক স্বাধীন জাতি। আমি বেশ বুঝতে পারছি আমার এই পার্থিব দেহ ক্ষয় হয়ে যাবে একদিন। তবু এই মুহূর্তে এক চরম সার্থকতায় সমৃদ্ধ এক পরম সুখের ভাবসমুন্নতি অনুভব করছি আমি। (ফাউস্ট পড়ে গেল মাটিতে) লিমিওর তাকে শুইয়ে দিল)

মেফিস্টোফেলিস : সুখ কোনও আনন্দ বা তৃপ্তি দান করতে পারত না তার মাকে। ক্ষণবিলীন কতকগুলো অলীক ছায়ামূর্তিকে সুখ ভেবে জড়িয়ে ধরত তাদের। এই নিঃস্ব রিক্ত মুহূর্তটাকে এক পরম প্রাপ্তি হিসাবে চিরকালের মতো জড়িয়ে ধরেছিল। কিন্তু যে কাল সব কিছু গ্রাস করে সেই অমোঘ অপরিহার্য কালগ্রাসে পতিত হয়ে মাটিতে ঢলে পড়ল ও। বন্ধু হয়ে গেল ঘড়ির কাটা। আমাকে ও সব সময় বাধা দিয়ে চলত। 

কোরাস : বন্ধ হয়ে গেল। নেমে এল নিশীত রাত্রির স্তব্ধতা।

মেফিস্টোফেলিস : এখন সব শেষ।

কোরাস : সব কিছুর শেষ হয়ে গেল। 

মেফিস্টোফেলিস : কিন্তু কেন? যা কিছু আমরা সৃষ্টি করি তা যদি ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে এ সৃষ্টির মূল্য কোথায়? ‘শেষ হয়ে গেল’ কথাটা এমনভাবে বলল যাতে মনে হলো কোনওদিন এর আগে। তা তো নয়। সত্তার একটা চিরন্তন অবিনশ্বর অংশ থেকে যায়, মৃত্যু বা সর্বগ্রাসী কাল যাকে শূন্যতায় পর্যবসিত করতে পারে না। 

সমাধি

লিমিওর ও কোরাস : হে হতভাগ্য অতিথি, এই ঘরটা খোন্তা কোদাল দিয়ে কোনওরকমে তৈরি করা হয়েছে তোমার জন্য। 

মেফিস্টোফেলিস : দেহটা ওর এখন শায়িত, আত্মাটা উড়ে গেছে। আমি ভালোভাবে লক্ষ্য রেখে চলেছি ওর আত্মা এখনও ওর দেহরূপ আবাস ছেড়ে চলে যায়নি। মৃত্যু এখনও সুপ্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এ দেহে। (অদ্ভুত মন্ত্র পাঠ করতে করতে) এস, এস হে নারকীয় জীবরা। এস তোমাদের উন্মুক্ত করাল মুখগহ্বর প্রসারিত করে। হ্যাঁ ঠিক আছে। নরকের দ্বার উন্মুক্ত দেখছি আর সেই দ্বারপথে দেখছি প্রজ্বলিত নারকীয় অগ্নির শিখা। পাপীর আত্মা পসিডনের ভয়ে পাশ কাটিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে তোমাদের চোখে ধুলো দিয়ে। কিন্তু তাকে ধরে ফেলবে। (স্কুলদেহী শয়তানের প্রতি) আত্মার পাখা আছে। সেই পাখাগুলোকে আগে ছিঁড়ে দাও। তাহলেই সে আত্মা পরিণত হবে অসহায় অন্ধ পোকায়। তোমরা তোমাদের কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করো, দেখো আত্মাটা যেন পালিয়ে না যায়। (কৃষ্ণকায় শয়তানদের প্রতি) নির্বাপিত দীপ জীবনের অন্ধকার পিঞ্জরে ওর আত্মাটা বিষণ্ণ হয়ে এখনও বসে আছে। পালিয়ে গেলেই তোমাদের তীক্ষ্ণ চঞ্চু দিয়ে সেটাকে ধরে ফেলবে। 

দেবদূত : চলে এস আমাদের সঙ্গে। তোমার পাপ ক্ষমা করে দেব। 

মেফিস্টোফেলিস : কিসের গোলমাল শুনছি। এই শুভ্রোজ্জ্বল দেবদূতগুলোই আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়। ওরা জানে মানুষের ধ্বংস ও নরক প্রাপ্তিতে আমরা আনন্দ পাই। আমরা তাই চাই। ওই সব ভণ্ডের দল এসে আমাদের শিকারকে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। এবার কিন্তু তোমরা সজাগ থাক শয়তানের দল। তোমরা কবরে ছুটে যাও। এবার এ শিকার হাতছাড়া হয়ে গেলে লজ্জার পরিসীমা থাকবে না। আসলে ঐ দেবদূতগুলো ছদ্মবেশী শয়তান। আমাদের প্রতারিত করে শুধু। 

দেবদূতদের কোরাস : হে গোলাপ, ধীরে ধীরে কুসুমিত হয়ে ওঠ। বায়ুবিকম্পিত পাপড়ি দিয়ে মধুর গন্ধ ছড়াও। নবজীবনের বসন্ত তোমাদের ডাকছে। স্নিগ্ধ নিদ্রায় অভিভূত ওই আত্মাকে স্বর্গে বহন করে নিয়ে যাব আমরা।

মেফিস্টোফেলিস : (শয়তানদের) তোমরা বিচলিত হচ্ছ কেন? ওরা ভেবেছে বরফ ছড়িয়ে শয়তানদের তপ্ত উদ্যম শীতল করে দেব। তোমাদের জ্বলন্ত নিশ্বাসে ওদের সব গোলাপ শুকিয়ে যাবে। একি! তোমাদের সব শক্তি ফুরিয়ে যাচ্ছে। সাহস হয়ে হয়ে যাচ্ছে! 

দেবদূতরা : কৃতজ্ঞতা, দয়া, মায়া, প্রেম, সত্য, সর্বত্র দেবদূতদের জন্য বাতাসকে মুক্ত রাখে, দিবালোককে উজ্জ্বল করে রাখে। 

মেফিস্টোফেলিস : ওঃ কী লজ্জার কথা! সব শয়তানগুলো ডিগবাজি খেতে খেতে নরকে পালিয়ে গেল। যাক। আমি একা এখানে থাকব। শুকিয়ে দেব, ব্যর্থ করে দেব ওদের নবজীবনের সব গোলাপগুলোকে। চলে যাও হে গোলাপ। তোমরা মিথ্যা মায়া, তোমাদের সৌন্দর্য দেখতে উজ্জ্বল মনে হলেও হাতে ধরার সঙ্গে সঙ্গে কুৎসিত ও ম্লান হয়ে ওঠ। তবে কেন তোমাদের তোষামোদ করব? আলকাতরা আর গন্ধকের মতো আমার ঘাড়ে এসে পড়ছে চুলগুলো। 

দেবদূতরা : কেন এমন করছ? অন্তরে তোমার দুঃখ কিসের? ভালোকে ভালোবাস। অন্ধকার হতে আলোর পথে এগিয়ে যাও। 

মেফিস্টোফেলিস : নরকাগ্নির থেকে তীক্ষ্ণতর অগ্নিশিখায় দীর্ণ-বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছে আমার হৃৎপিণ্ড। আমার মাথাটা কেন ঘুরছে? একদিন তাদের সঙ্গে শত্রুতা করেছি, তাদের দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঘৃণায কুঞ্চিত হয়ে উঠেছে আমার নাসিকা। কিন্তু এখন কোনও শক্তির বশবর্তী হয়ে তাদের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছি আমি। তাদের অভিশাপ দেওয়ার সব শক্তি হারিয়ে ফেলেছি। অথচ মনে হচ্ছে তাদের এই ছলনায় আমি প্রতারিত হলে আমার মতো নির্বোধ পৃথিবীতে আর কেউ থাকবে না। এখন কত ভালো কত মনোমুগ্ধকর মনে হচ্ছে তাদের। এস, কাছে এস হে সৌন্দর্যের সন্তানগণ, বলো, তোমরা কি লুসিফারের বংশধর নও? তোমরা এত সুন্দর যে তোমাদের চুম্বন করতে ইচ্ছা করছে। তোমাদের পানে তাকাবার সঙ্গে সঙ্গে বিড়ালের মতো সুচতুর কামনারা। চুপিসারে প্রবেশ করছে আমার প্রতিটি শিরায়। শিহরণ জাগাচ্ছে দেহে। তবু কাছে এস একবার দেখি তোমাদের। 

দেবদূতরা : আমরা এসেছি। অস্বস্তিতে কুঁচকে উঠছ কেন? (কাছে এল)

মেফিস্টোফেলিস : দেবদূত হলেও তোমরা অভিশপ্ত। তোমরা নর-নারীকে মোহমুগ্ধ করে ভুল পথে নিয়ে যাও। একেই বলে ভালোবাসা? তোমাদের সংস্পর্শে আমি অনুভব করি এক অসহ্য অগ্নি দীপ্তিহীন প্রদাহ। তবু তোমরা একবার হাস। সেই হাসি দেখে আমিও অনুভব করব এক গভীর আনন্দের আবেগ। তোমাদের দেহ। সুসজ্জিত। তোমাদের দেহ উলঙ্গ থাকতে পারত। 

দেবদূতরা : সত্যই সব অভিশাপ দূর করে, প্রেমের আলোই সব কিছুকে পরিষ্কার করে তোলে। আত্মশুদ্ধির পর বুকে তাদের টেনে নাও। 

মেফিস্টোফেলিস : একি হলো? আমার সারা গায়ে ফোঁড়া হচ্ছে কেন? আমার সত্তার শয়তানী অংশটা চলে গেছে। প্রেমের আক্রমণে আমার গা জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। তবু আমি অভিশাপ দিচ্ছি তোমাদের। 

দেবদূতরা : জ্যোতির্ময় গৌরবের আলোয় তুমি গৌরবান্বিত হও। তুমিও তোমার লক্ষ্যে উপনীত হও। এই বিশুদ্ধ বাতাসে প্রাণ ভরে নিশ্বাস নাও। (তারা ফাউস্টের অমর আত্মাটা নিয়ে গেল) 

মেফিস্টোফেলিস : যে আত্মাটা আমার লক্ষ্যবস্তু ছিল, ওরা তা নিয়ে গেল। আমাকে বোকা বানিয়ে আমার প্রাপ্য কেড়ে নিয়ে পালিয়ে গেল স্বর্গে। কার কাছে আমি ন্যায়বিচারের দাবি জানাব? আমার কষ্টার্জিত অধিকারকে আমায় ফিরিয়ে দেবে? এই নারকীয় ঘৃণা ও অপমার আমার প্রাপ্য। আমি অন্যায় করেছি। হীন কামনার দাস হয়ে আমি শয়তানের মতো কুপথে গিয়েছি। কিন্তু কি পেলাম তাতে? 

সপ্তম দৃশ্য 

গিরিগুহা ও বনভূমি

দেবদূতদের কোরাস : চারদিকে পাহাড় আর বন। ওদিকে একের পর এক সমুদ্রতরঙ্গ আঘাত হানছে। কিন্তু আমরা যেখানেই যাই সেখানেই প্রেমের মহিমা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। 

পেটার এসটেটিকাস : অসংখ্য অগ্নিশলাকা আমায় বিদ্ধ করছে। যেন পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে পার্থিব জীবনের যত সব মিথ্যা আর মায়া। 

পেটার প্রেকান্ডিস : আমার চারদিকে গভীর শূন্য খাদ। তাদের গর্জন শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু প্রেমের অনন্ত শক্তিকে উদ্দীপিত হয়ে উঠছে আমার অন্তরাত্মা। হে ঈশ্বর, আমার অন্তরকে আলোকিত করো। 

পেটার সেপারিটিকাস : যেন এক মেঘমালা পাইন গাছগুলোকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। 

স্বর্গীয় বালকদলের কোরাস : হে ঈশ্বর বলো, আমরা কোথায় আছি? আমরা যে সুখে বাস করছি সে সুখ যেন সকলেই পায়। 

পেটার সেপারিটিকাস : হে বালকদল, তোমাদের পিতামাতারা তোমাদের অকালে হারালে দেবদূতরা তোমাদের নিয়ে আসে। এস আমার কাছে। এখানকার এই মনোহর দৃশ্য দেখো। গাছগুলোর তলা দিয়ে কেমন এক সুন্দর নদী বয়ে যাচ্ছে। 

বালকদল : কিন্তু এ দৃশ্য অন্ধকার ও অস্বস্তিকর মনে হচ্ছে আমাদের। হে পরম পিতা, এখান থেকে নিয়ে চলো আমাদের। 

পেটার সেপারিটিকাস : আরও উপরে ওঠ। যত ঈশ্বরের কাছে যাবে ততই অনন্ত শান্তি অনুভব করবে। দেখতে পাবে পরম প্রেমের আলো।

বালকদলের কোরাস : (সর্বোচ্চ শিখরে উঠে) হাত ধরাধরি করে গান করো সকলে চক্রাকারে ঘুরে ঘুরে। এক পবিত্র অনুভূতিতে আচ্ছন্ন হয়ে উঠছে আমাদের অন্তর। 

দেবদূতরা : (ফাউস্টের অমর আত্মাকে নিয়ে এসে) হে মহান আত্মা, এখন তুমি চিরমুক্ত। আর কোনও পাপপ্রবৃত্তি আচ্ছন্ন করতে পারবে না তোমায়। যারা অক্লান্তভাবে উন্নতি চায়, ঊর্ধ্বগতি চায় তারা কখনও ব্যর্থ হয় না। তারা একদিন অবশ্যই পায় ঈশ্বরের আশীর্বাদ। 

কোরাস মিস্টিকাস : এই বিশ্বের প্রতিটি ক্ষণভঙ্গুর প্রতীক হিসাবে কাজ করে। পৃথিবীর অন্তর্নিহিত অপূর্ণতার জন্য অসংখ্য ঘটনা ঘটে সেখানে। হে দেবদূতের আত্মারা, আমাদের বিশ্বাতীত ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে চলো। 

তরুণ দেবদূতগণ : গোলাপরাই আমাদের দ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে আমাদের জয়লাভে সহায়তা করে। আমরা ফাউস্টের মহান আত্মাটাকে লাভ করি। শয়তান ও অশুভ শক্তিগুলো পালিয়ে যায়। এমনকি শয়তানদের গুরুটাও পালায়। সেও প্রেমের বেদনা অনুভব করে। এখন আমাদের কাজ শেষ। আনন্দ করবার সময় এখন। 

বয়স্ক দেবদূতগণ : মানুষের মন কোনও বস্তু একবার লাভ করলে তা ছাড়তে পারে না। কেউ ছাড়াতে পারে না। একমাত্র অনন্ত ঈশ্বরপ্রেম সে মনকে মুক্ত করতে পারে সব আসক্তি থেকে। 

তরুণ দেবদূতগণ : অনেক উঁচুতে মেঘ আর কুয়াশার মতো পার্থিব দুঃখ-বিষাদ থেকে মুক্ত একদল স্বর্গীয় বালক আসছে। তারাই স্বর্গীয় বসন্তের সব সুষমাটুকু উপভোগ করছে। তারা ফাউস্টের আত্মাকে নিয়ে যাক। 

স্বর্গীয় বালকদল : হ্যাঁ, আমরা বরণ করে নিচ্ছি তাকে। তার থেকে পার্থিব সত্তাটা খসে গেছে। এখন সে দিব্যজীবন লাভ করেছে। 

ডাক্তার মিরিয়ানাম : আমার মুক্ত দৃষ্টি নিয়ে আমি দেখতে পাচ্ছি একদল নারীমূর্তি ঊর্ধ্বে উড়ে যাচ্ছে আর তাদের রানি হলেন স্বর্গলোকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। তাঁকে আমি চিনি। (আবেগের সঙ্গে) সে জগদীশ্বরী, আমাকে স্বর্গলোকে নিয়ে চলো। সুমতি ও সুচিন্তা দাও আমার মনে। যাতে তোমার সাক্ষাৎ লাভ করতে পারি তার জন্য সাহসের সঙ্গে তোমার সব আদেশ পালন করে চলি। হে জগন্মাতা, সর্বদেববন্দিতা, তোমার চারদিকে লঘু মেঘমালা ভেসে যাচ্ছে। অনুতপ্ত নারীদের আত্মা নতজানু হয়ে ক্ষমা ভিক্ষা করছে তোমার কাছে। তোমার প্রতি বিশ্বাস যাদের অগাধ তারা তোমার কৃপালাভ করে। কিন্তু মন যাদের হিংসায় ভরা তাদের ক্ষমা করা কঠিন। তাকে কেউ কখনও প্রতারিত করতে পারে না কোনওভাবে।

অনুতাপগ্রস্ত নারীদের কোরাস : হে দয়াবতী কৃপাময়ী দেবী, স্বর্গরাজ্যে ফিরে যাবার পথে আমাদের আকুল আবেদনে সাড়া দাও। 

ম্যাগনা পেকাট্রিক্স : হে দেবী, স্বর্গের অধীশ্বরী, তোমার পুত্রের দেবোপম মূর্তির কাছে নতজানু হয়ে চোখের জলে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। আমাদের নরম কেশরাশির দ্বারা পা ধুইয়ে দেব তার। 

মুলিয়ের সামারিতানা : যে কূপের পাশে আব্রাহাম একদিন মেষ চরাত, যে পাত্র একদিন আমাদের ত্রাণকর্তার ওষ্ঠাধর স্পর্শ করেছিল, পুণ্যতোয়া যে প্রস্রবণের পবিত্র জলরাশির দ্বারা ধরিত্রী সুজলা সুফলা হয় আমরা তার নামে শপথ করছি।

মেরিয়া এজিপটিয়াকা : যে স্থানে ঈশ্বরের অক্ষয় অমর দেহটি স্নাত হয়, ঈশ্বরের যে স্থূল দেহ একদিন আমাকে দ্বারপথ হতে ফিরিয়ে দেয়, জনহীন পরিত্যক্ত দেশে চব্বিশ বছর ধরে যে অনুতাপ আমি ভোগ করে আসছি, শেষ বিদায়ের যে বাণী আমি সেখানে বালুকারাশির উপর লিখে আসি–সেই সব কিছুর নামে শপথ করছি আমরা। 

তিনজন একসঙ্গে : হে দেবী ক্ষমা করো। আমরা পাপাত্মা হলেও অনুতপ্তা, তোমার মহান উপস্থিতি হতে আমাদের বিমুখ করো না। আমরা না বুঝে যে ভুল যে পাপ করে ফেলেছি তা ক্ষমা করো। আমাদের আশীর্বাদ করো। 

উনা পেনিটেনটাম (পূর্বে মার্গারেট নামে অভিহিত) : হে দয়াবতী, তোমার চিরনির্মল হাস্যচ্ছটা বিকীর্ণ করে আমাকে পরম সুখের প্রতিশ্রুতি দান করো। তোমরা কৃপায় যেন আমার প্রেমাস্পদ তার পাপ স্খলন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার সঙ্গে স্বর্গালোকে এসে মিলিত হয়। 

স্বর্গীয় বালকরা : আমাদের জীবন পরিণতি লাভ না করতেই আমরা জীবন হারাই তবু ঈশ্বর আমাদের ভালোবাসেন, তিনিই আমাদের যাবতীয় শিক্ষা দান করেন। তার প্রতি আমাদের ভালোবাসা আমাদের প্রতি তার ভালোবাসাকে বাড়িয়ে দেয়। 

মার্গারেট : (ফাউস্টকে দেখে) এখানে স্তোত্রগান শুনে সে ধীরে ধীরে নবজন্ম লাভ করছে। তার পার্থিব সত্তা অবগত হচ্ছে। অনন্ত যৌবনশক্তি ফিরে পাচ্ছে সে। স্বর্গীয় দিব্যজীবন লাভ করার আগে তাকে কি কি করতে হবে তা শিখিয়ে দেব আমি। 

মেটার গ্লোরিওসা : ওকে আরও ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে যাও পথ দেখিয়ে। ও তোমার কথা শুনবে। তোমার মনের কথা বুঝবে। 

ডাক্তার মেরিয়ানাস : হে অনুতাপিনীর দল, মুখ তুলে তাকাও। উনি ওঁর মুখমণ্ডল হতে এক স্বর্গীয় জ্যোতি বিচ্ছুরিত করে তোমাদের মুক্তি দান করছেন। তাঁর আশীর্বাদে ধন্য হয়ে নবজন্ম লাভ করো। আমাদের সকলের আত্মা আমাদের কুমারী মাতা স্বর্গলোকের অধিশ্বরী মেরীর প্রতি উৎসর্গীকৃত হোক। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *