০৩. স্বদেশী আন্দোলন

তৃতীয় অধ্যায় – স্বদেশী আন্দোলন

প্রশাসনিক সুবিধার অজুহাতে লর্ড কার্জন বঙ্গদেশকে দুই ভাগ করার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ যে তীব্র আন্দোলনের সৃষ্টি হয় তাহা পূর্ব অধ্যায়ে বিবৃত হইয়াছে। এই আন্দোলনের ফলে কিভাবে বিলাতী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার–এই বিষয় দুইটিতে লোকের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় তাহাও বর্ণিত হইয়াছে। কিন্তু, ক্রমে ক্রমে এই দুইটি আন্দোলনের সঙ্গে বঙ্গভঙ্গের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ কমিয়া গেলেও অর্থনীতির দিক দিয়া যে ইহার গুরুতর মূল্য আছে লোকে তাহা বুঝিতে আরম্ভ করিল। তাহা ছাড়া জাতীয়তার দিক দিয়াও যে ব্যাপক অর্থে ইহার বিশেষ মূল্য আছে তাহারও উপলব্ধি হইল। কেবল বিলাতী দ্রব্য নহে, বিদেশী পোষাক পরিচ্ছদ, ভাব ও চিন্তার ধারা–কেবল স্বদেশী দ্রব্য নহে, সর্বপ্রকারে বিদেশী আদর্শের পরিবর্তে জাতীয় ভাষা, সাহিত্য, শিক্ষাপদ্ধতি এবং রাজনীতিক আদর্শ, লক্ষ্য ও পন্থা জনগণের মনে প্রভাব বিস্তার করিতে লাগিল। দেশব্যাপী আন্দোলনের নিষ্ফলতা কংগ্রেসের প্রচলিত পন্থার অসারতা প্রতিপাদন করিয়া নূতন উপায় ও পথের দিকে লোকের দৃষ্টি প্রসারিত করিল।

এস্থলে বলা আবশ্যক, এই নূতন ধারাগুলি যে বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের পূর্বে কখনও ভারতে ছিল না তাহা নহে। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যাইতে পারে যে বিলাতের জনসাধারণের চাপে ইংরেজ গভর্নমেন্টকে মত পরিবর্তন করিতে বাধ্য করার যন্ত্রহিসাবে এবং দেশীয় শিল্পের উন্নতির জন্য বিলাতী দ্রব্য বর্জনের কথা ইহার পূর্বেও কেহ কেহ বলিয়াছিলেন। ১৮৭৫, ১৮৭৬, এবং ১৮৭৮ খৃষ্টাব্দে যখন বিলাতে ম্যাঞ্চেষ্টারের বস্ত্রবয়ন কলের মালিকেরা স্বার্থের জন্য ভারতে নবনির্মিত বস্ত্রবয়ন কলওয়ালাদের বিরুদ্ধাচরণ করিতেছিল তখন কেহ কেহ প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে, ম্যাঞ্চেষ্টারের কাপড় বর্জন করা হউক। ১৮৮৩ খৃষ্টাব্দে যখন ভারতে ইংরেজরা ইলবার্ট বিলের বিরুদ্ধে তুমুল আন্দোলন আরম্ভ করিল এবং ১৮৮৪ খৃষ্টাব্দে যখন সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইলেন, তখনও এইরূপ প্রস্তাব হইয়াছিল। ১৮৯১ সনে যখন গোঁড়া হিন্দুসম্প্রদায় সহবাস সম্মতি আইনের প্রস্তাবে বিষম ক্ষুব্ধ হইয়াছিলেন তখন কেবল বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব নহে, ইহা কিয়ৎ পরিমাণে কার্যেও পরিণত হইয়াছিল। কিন্তু ইহার কোনটিই বিশেষ কার্যকর বা দীর্ঘকালস্থায়ী হয় নাই। ১৯০৫ সনে যখন বিলাতী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাব হয় তখনও চীনদেশের দৃষ্টান্ত বাঙ্গালী আন্দোলনকারীদের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছিল। প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, ১৯০৫ সনের ১৯শে জুলাই তারিখের ‘বরিশাল হিতৈষী’ পত্রিকায় উনিশ শতকে চীনদেশ যে বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে বিলাতী দ্রব্য বর্জনরূপ অস্ত্র ব্যবহার করিয়াছিল তাহা উদ্ধত করিয়া বাঙ্গালীকে তাহার অনুকরণ করিতে উপদেশ দিয়াছিল।

ইংরেজ গভর্নমেন্টের উপর চাপ সৃষ্টি করা ছাড়া ভারতে শিল্পোন্নতির অন্যতম প্রকৃষ্ট উপায়স্বরূপ বিদেশী দ্রব্য বর্জনের প্রস্তাবও পূর্বে করা হইয়াছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বোম্বাইএর গোপালহরি দেশমুখ (লোকহিতবাদী নামে সুপরিচিত) স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহার সম্বন্ধে দেশের লোককে সচেতন করার জন্য বিধিবদ্ধভাবে আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তার কথা লিখিয়াছিলেন। ১৮৭৩ সনে। ভোলানাথ চন্দ লিখিয়াছিলেন, “এ-দেশীয় সংবাদপত্রে দেশীয় ব্যাঙ্ক, দেশীয় বণিক কোম্পানি ও দেশীয় কলকারখানার প্রতিষ্ঠা যে কত আবশ্যক তাহা বিশদৃভাবে প্রচার করা প্রয়োজন। দেশীয় জিনিসের পরিবর্তে বিদেশীয় জিনিস কেনা দেশের পক্ষে যে কত অনিষ্টকর তাহার উজ্জ্বল চিত্র দেশবাসীর সম্মুখে সর্বদা উপস্থিত রাখিতে হইবে। ইংরেজের অধীনতার ফলে আমরা কেবল রাজনীতিক দাসত্ব নহে, অর্থনীতিক দাসত্বও যে মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিয়াছি তাহা আঙ্গুল দিয়া দেখাইতে হইবে। যে-সকল দ্রব্য দেশে উৎপন্ন করা যায় সে-সকল দ্রব্য বিদেশ হইতে আমদানি বন্ধ করিতে হইবে।”

আর্যসমাজের প্রতিষ্ঠাতা স্বামী দয়ানন্দ এবং আরও কেহ কেহ স্বদেশী দ্রব্যের ব্যবহারের উপর বিশেষ জোর দিয়াছিলেন। কলিকাতানিবাসী যোগেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ যাহাতে এই নির্দেশ ও উপদেশ কার্যকর হয় তাহার জন্য শিল্পশিক্ষার উদ্দেশ্যে বৃত্তি দিয়া প্রতি বৎসর বহু যুবককে বিদেশে পাঠাইবার ব্যবস্থা করেন। চারি শতেরও অধিক যুবক এই উপায়ে বিদেশী কলকারখানায় হাতেকলমে শিক্ষালাভ করেন এবং দেশে ফিরিয়া তাহাদের অনেকেই ছোটখাট শিল্পের পত্তন করেন; অন্ততঃ কুড়িটি নূতন শিল্পের কারখানা এইভাবে বাংলায় গড়িয়া ওঠে।

কিন্তু, উদ্দেশ্য ও আদর্শ মহৎ হইলেও এইসব চেষ্টার স্থায়ী কোন ফল হয় নাই। বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনে, বিশেষতঃ তাহা দমনের জন্য সরকারের কঠোর নিপীড়ন-নীতি অবলম্বনের ফলে, বিলাতীবর্জন ও স্বদেশীগ্রহণ যেমন ক্রমেই ব্যাপক অর্থ লাভ করিয়া কেবল ব্যবহৃত দ্রব্যাদি এবং আর্থিক উন্নতির ক্ষুদ্র ও সংকীর্ণ সীমানা লঙ্ঘনপূর্বক সমগ্র জাতীয় জীবন ও চিন্তাধারা প্রভাবিত করিল, তেমনি, ১৯০৫ সনে যে উত্তেজনা, কর্মপ্রবাহ ও ভাবধারা পর্বতগাত্র হইতে প্রসূত ক্ষীণ তটিনীর ন্যায় বঙ্গদেশে দেখা দিয়াছিল ক্রমে ক্রমে তাহার অবিচ্ছিন্ন কলেবর ও স্রোতোবেগ বর্ধিত হইতে হইতে সমগ্র ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের বিশাল স্রোতস্বিনীতে পরিণত হইয়া মুক্তি ও স্বাধীনতার সমুদ্রে বিলীন হইল। ১৯০৫ হইতে ১৯৪৭ সনের মধ্যে নূতন নূতন ধারা ইহার সহিত মিশিয়াছে, কিন্তু গিরিগাত্র হইতে যে ক্ষুদ্র জলধারা বঙ্গভঙ্গের আন্দোলনের প্রবল বেগে পর্বতবন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছিল তাহার গতি কখনও ব্যাহত হয় নাই। এইজন্যই একজন বিদেশী ঐতিহাসিক উইলিয়াম ডুরান্ট মন্তব্য করিয়াছেন যে, ১৯০৫ সন হইতেই ভারতের স্বাধীনতা-সগ্রামের সূত্রপাত গণনা করিতে হইবে।

অসীম সাহস, দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও নিষ্ঠুর পীড়নে অবিচলিত ধৈর্যের সহিত দূর লক্ষ্যের প্রতি স্থিরদৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া বঙ্গের অখণ্ড ঐক্য রক্ষার নিমিত্ত বাঙ্গালী যে আন্দোলন আরম্ভ করিল তাহা ক্রমশঃ এই সঙ্কীর্ণ পরিধি লঙ্ঘন করিয়া সমগ্র ভারতে জাতীয়তা-সংগঠন ও বিদেশীর দাসত্বশৃঙ্খল হইতে মুক্তিলাভের সংগ্রামে পরিণত হইল।

বঙ্গভঙ্গের সঙ্গে সঙ্গেই ভারতে ব্রিটিশরাজ্যের শান্তিময় যুগের (Pax Britannica) অবসান হইয়া খর্বাকৃতি বামনের সহিত বিশালকায় দৈত্যের সংগ্রাম আরম্ভ হইল। ভারতে ও বিশ্বে অভাবিত ঘটনাপরম্পরার ফলে এই অসম যুদ্ধে দৈত্যকে পরাজয় স্বীকার করিতে হইল।

১. স্বদেশী দ্রব্যের উৎপাদন

পূর্বেই বলিয়াছি, বিদেশী দ্রব্য বর্জন বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের প্রধান অঙ্গ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। এ-বিষয়ে প্রধান সমস্যা হইল, যাহা বর্জন করা হইল তাহার অভাব পূরণ। বিলাতী লবণের বদলে করকচ এবং চিনির বদলে গুড় ব্যবহার করিয়া এই দুই দ্রব্যের অভাব অনেকটা মিটিল। কিন্তু প্রধান সমস্যা হইল পরিধেয় বস্ত্র। একমাত্র ভরসা ছিল দেশী তাঁতীর হাতেবোনা মোটা কাপড় এবং বোম্বাই ও আহম্মদাবাদের কলে তৈরী কাপড়। সুযোগ বুঝিয়া কলওয়ালারা ধুতি ও শাড়ীর দাম চড়াইয়া দিল। তাহাদের সরবরাহও পর্যাপ্ত ছিল না। সাধারণ গ্রামবাসীদের প্রধান অবলম্বন হইল দেশী তাঁতের মোটা কাপড়। কিন্তু বিলাতী কলের কৃপায় তাঁতীয় দল প্রায় নির্মূল হইয়াছিল। আট দশ খানা গ্রামের মধ্যে হয়তো কয়েক ঘর তাঁতী কাপড় বুনিত। সুতরাং বিলাতী কাপড় বর্জন একটি প্রধান সমস্যা হইয়া দাঁড়াইল। দায়ে ঠেকিয়া অনেককে সস্তা বিলাতী কাপড় কিনিতে হইত। ইহার প্রতিকারকল্পে বাংলার গ্রামের ভদ্রঘরের শিক্ষিত যুবকেরা আট-দশ মাইল হাঁটিয়া সুদূর পল্লীগ্রামের তাঁতীদের নিকট হইতে মোটা কাপড়ের বস্তা কিনিয়া নিজেরা মাথায় করিয়া আসিয়া নিজেদের ও চারিপাশের গ্রামের লোককে কেনা দামে দিত।

এই উপলক্ষে তাহারা মোটা কাপড়ের বস্তা-মাথায় গলা ছাড়িয়া আনন্দে গান গাহিত, “মায়ের দেওয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে নে রে ভাই। দীন দুঃখিনী মা যে তোদের তার বেশী আর সাধ্য নাই”। বর্তমান লেখক তখন সদ্য প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছেন। গ্রামের অন্যান্য পাঁচ-ছয়জন যুবকের সহিত এই কার্যে লিপ্ত হইয়া একবার পথে বাঁশের সাঁকো দিয়া পার হইবার সময় খালের জলের মধ্যে পড়িয়া গিয়াছিলেন তাহা সত্তর বছর পরে এখনও মনে আছে। অবশ্য কাপড়ের কল খোলার অনেক চেষ্টাও হইল। কিন্তু ইহার জন্য যে অর্থ ও অভিজ্ঞতার প্রয়োজন, সে-দুইয়েরই যথেষ্ট অভাব ছিল। ফলে যদিও দুই-একটি কাপড়ের কল প্রস্তুত হইল ও কোনমতে টিকিয়া রহিল, তাহা অভাবের পক্ষে পর্যাপ্ত নহে। তবে এই চেষ্টার ফলে প্রায় বিশ বৎসর পরে বঙ্গদেশে কয়েকটি কাপড়ের কল বেশ ভালভাবে দাঁড়াইয়া গেল।

স্বদেশী দ্রব্য বিক্রয়ের জন্য যুবকেরা নানা স্থানে দোকান খুলিয়া যথাসম্ভব সস্তা দামে বিক্রয় করিত। বিদেশী দ্রব্য বর্জনের পক্ষে যে নানারূপ প্রচারকার্য ও বিদেশী দ্রব্য ব্যবহারের জন্য সামাজিক দণ্ডের ব্যবস্থা গড়িয়া উঠিয়াছিল পূর্বেই তাহার আভাস দেওয়া হইয়াছে। এগুলি আরও প্রসারিত করা হইল।

এইসব ঘটনার ফলে গভর্নমেন্ট ও জনসাধারণের মধ্যে সংঘর্ষ বাধিল। পুলিশের জুলুম বাড়িল। বহু যুবককে কারাদণ্ড ও বেত্রাঘাত সহ্য করিতে হইল। ইহার অনিবার্য ফলস্বরূপ একদিকে গভর্নমেন্ট দমননীতির কঠোরতা বাড়াইতে লাগিল, অপরদিকে একদল যুবকের বিশ্বাস হইল যে, গভর্নমেন্টের বলপ্রয়োগের প্রত্যুত্তরে তাহারাও হিংসাত্মক পথ অবলম্বন করিবে। এ সম্বন্ধে পরে সবিস্তারে আলোচনা করা হইবে।

২. বিদেশী দ্রব্যবর্জনের প্রত্যক্ষ ফল

বিদেশীবর্জন আন্দোলনের ফলে বিদেশী দ্রব্যের আমদানি কতটা হ্রাস পাইয়াছিল তাহা নির্ণয় করা কঠিন, কারণ বিদেশী সুতার কাপড়, জুতা ও সিগারেট প্রভৃতি যে সকল দ্রব্য বিদেশীবর্জনের প্রধান লক্ষ্য ছিল, এই আন্দোলনের পূর্বে ও অব্যবহিত পরে তাহাদের তুলনামূলক আমদানির বিবরণ পাওয়া যায় নাই। সমসাময়িক পত্রিকায় যে-সকল বিবরণ বাহির হইত তাহাও সম্পূর্ণ নির্ভরযোগ্য নহে। কারণ, কাগজে এই আন্দোলনের সার্থকতা প্রতিপন্ন করিবার জন্য যেমন আমদানির পরিমাণ কম করিয়া বর্ণনার প্রবণতা খুবই স্বাভাবিক ছিল, ইংরেজের কাগজে ইহার বিফলতা প্রদর্শনের জন্য বিপরীত মনোভাবেরও যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কলিকাতার ‘Englishman’ পত্রিকা প্রথমে বঙ্গভঙ্গের তীব্র নিন্দা করিত। কিন্তু, বিদেশীবর্জনে ইংরেজ বণিকের সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনায় শুধু ইহার মত পরিবর্তনই হইল না, স্বদেশী আন্দোলনের নিন্দা ও বিদ্রুপেও ইহা মূর্খর হইয়া উঠিল। এই আন্দোলন যে হাস্যকর ও শীঘ্রই বুদবুদের মত মিলাইয়া যাইবে, অথবা গিয়াছে– এইরূপ বিদ্রুপের সঙ্গে গভর্নমেন্টের নিকট ইহা কঠোরহস্তে দমন করিবার পুনঃ পুনঃ আবেদন–এ দুইয়ের সামঞ্জস্য করা কঠিন। Indian Daily News’ পত্রিকা Statesman’ পত্রিকার ন্যায় ভারতবিদ্বেষী ছিল না, কিন্তু তথাপি এই কাগজের সুর ছিল–”স্বদেশী আন্দোলন দ্রুতবেগে হ্রাস পাইতেছে, প্রায় মুছিয়া গিয়াছে বলিলেও চলে”। ইংরেজী পত্রিকার মধ্যে ‘Statesman and Friend of India’ নামক পত্রিকাকে এ-বিষয়ে সার্থকনামা বলা যাইতে পারে। কারণ ইহার মন্তব্যগুলিই পক্ষপাতশূন্যতা অবলম্বন করিয়া ইহার ‘ভারতবন্ধু’ নাম সার্থক করিয়াছিল।

এই পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য এবং ইহাতে প্রকাশিত ঘটনাবলীর বিবরণ মোটামুটি যথার্থ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে। সুতরাং ইহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“একজন খুব বড় ব্যবসায়ী আমাদের প্রতিনিধিকে বলিলেন যে, তিনি যেসব বিদেশী দ্রব্য আমদানি করিয়াছেন তাহা কেনা দামে বিনা লাভে সমস্ত তাঁহার নিকট বিক্রয় করিতে প্রস্তুত আছেন। কারণ বিক্রয় প্রায় নাই বলিলেও চলে। তিনি পূর্ব চুক্তিমত আগামী কয়েক মাসের আমদানি মালের ক্ষতির সম্ভাবনায় যে গভীর উদ্বেগের ও দুঃখের পরিচয় দিলেন আমাদের প্রতিনিধিও তাহার সহিত সমবেদনা প্রকাশ না করিয়া পারিলেন না। তিনি বলিলেন, বিলিতি ধুতি কেনা দামের চেয়েও কম মূল্যে বিক্রয় করিতে হইতেছে এবং ইহাতেও খুব বেশী পরিমাণে বিক্রয় হইতেছে না। কারণ ম্যাঞ্চেস্টারের ধুতির খরিদ্দার নাই বলিলেও চলে। তিনি একজোড়া বিলিতি মোটা ধুতি দেখাইয়া বলিলেন যে, ইহার ন্যায্য মূল্য এক টাকা পাঁচ আনা–ইহা কেহ কিনিতে চায় না। ঠিক একই রকম দেশী ধুতি দেখাইয়া বলিলেন–অথচ এক টাকা চৌদ্দ আনায় আমি এরকম যত ধুতি যোগাড় করিতে পারি সব বিক্রয় করিতে পারি। হিসাবের খাতা খুলিয়া বলিলেন যে, গতবৎসর দুর্গাপূজার সময় দেড়লাখ টাকার কাপড় বিক্রয় করিয়াছি, এ-বৎসর তাহার অর্ধেক বিক্রীরও সম্ভাবনা নাই”।

‘Statesman’ পত্রিকার প্রতিনিধি আর একজন বস্ত্রব্যবসায়ীর সম্বন্ধে লিখিয়াছেন :

“তিনি বলিলেন, বিলিতী কাপড়ের বাজার বড় মন্দা। কেহই কিনিতে চায় না। গত বছর (১৯০৪) সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে (অর্থাৎ পূজার মরসুমে)। পাঁচ হাজার গাঁট বিলাতী কাপড় বিক্রয় করিয়াছিলাম–কিন্তু এ বছর ঐ মাসের প্রথম দুই সপ্তাহে দাম অনেক কমাইয়াও ১২৫ গাঁটের বেশী বিক্রয় করিতে পারি নাই। তৃতীয় একজন ব্যবসায়ী ‘ Statesman’ পত্রিকার প্রতিনিধিকে মফঃস্বলের ব্যবসায়ীদের ছয়-সাত খানা টেলিগ্রাম দেখাইলেন। এগুলির মর্ম এই ছিল যে, বিদেশী কাপড়ের জন্য তাহারা যে বায়না দিয়াছিল তাহা বরবাদ করা হইল। ঢাকার এক ব্যাপারী বলিল যে, শহরে একটি সমিতি বিলাতী কাপড় বিক্রেতাদিগকে জানাইয়াছে যে বিলাতী কাপড় বিক্রয় করিলে তাহাদের সমূহ বিপদ ঘটিবে। এই ব্যাপারী প্রতি বছর ৪০,০০০ টাকার কাপড় আমদানি করিত-এ-বছর ভয়ে ভয়ে মাত্র দশ হাজার টাকার মাল আনাইয়াছে।”

কলিকাতার ‘ Statesman’ পত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বিলাতী বস্ত্র বিক্রয়ের যে তুলনামূলক পরিমাণ নির্দেশ করিয়াছিল তাহা নিম্নে উদ্ধৃত হইল।

স্থান১৯-০৪ সেপ্টেম্বরে ক্রীত বস্ত্রের মূল্য১৯০৫ সেপ্টেম্বরে ক্রীত বস্ত্রের মূল্য যশোহর
যশোহর৩০,০০০ টাকা২,০০০ টাকা
বগুড়া১,৭০০ টাকা২০০ টাকা
ঢাকা৫,০০০ টাকা২, ০০০ টাকা
নদীয়া১৫,০০০ টাকা২, ৫০০ টাকা
মালদহ৮, ০০০ টাকা১, ৩০০ টাকা
বর্ধমান৬, ০০০ টাকা১, ০০০ টাকা
আরা১, ৫০০ টাকা২০০ টাকা
হাজারিবাগ১০, ০০০ টাকা৫০০ টাকা

Statesman পত্রিকার প্রতিনিধি বিলাতী লবণ, সিগারেট, সাবান, সুগন্ধি, বোতাম ও অন্যান্য দ্রব্যের যে তুলনামূলক বিবরণ দিয়াছেন তাহাতে দেখা যায় যে, বস্ত্র অপেক্ষা এইসব বিলাতী দ্রব্যের চাহিদা কম ছিল। আগে যেসব দোকানে বড় বড় অক্ষরে বিলাতী দ্রব্য বিক্রয়ের সাইনবোর্ড থাকিত সেগুলির বদলে “এখানে স্বদেশী। দ্রব্য পাওয়া যায়”, এইরূপ সাইনবোর্ড দেখা যাইত। বিলাতী ব্যবসায়ীদের মুখপত্র ‘Capital’ পত্রিকাতেও বিলাতী দ্রব্যের বিক্রয়সম্বন্ধে হতাশা প্রকাশ করা হইয়াছে।

১৯০৫ সনের ১লা সেপ্টেম্বর কলিকাতার মাড়ওয়ারী চেম্বার অব কমার্স (Chamber of Commerce) ম্যানচেস্টারের চেম্বার অব কমার্সের নিকট এই সুদীর্ঘ টেলিগ্রাম করিয়া জানাইল, বিলাতী কাপড়ের বিক্রয় বন্ধ হইয়া গিয়াছে। দুই-চারি দিনের মধ্যে বঙ্গভঙ্গ রহিত না হইলে পূজায় বিলাতী কাপড় বিক্রী হইবে না–সুতরাং তাহারা যেন ভারতবর্ষসংক্রান্ত মন্ত্রীর উপর চাপ দিয়া বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাব বাতিল করিয়া দেন।

কলিকাতার Collector of Customs ১৯০৬ সনের সেপ্টেম্বর মাসে বিগত এক বৎসরের যে গোপনীয় রিপোর্ট পাঠান তাহা হইতে দেখা যায় :

(১) বিলাতী লবণের আমদানি একলক্ষ চল্লিশ হাজার মণ হ্রাস এবং এডেন হইতে আনীত লবণের আমদানি ৪৮, ০০০ হইতে ৭৭, ৭০০ মণ বৃদ্ধি।

(২) সুতার কাপড়ের আমদানি হ্রাস তিন কোটি গজ এবং নানাপ্রকার সুতার আমদানির মূল্য এক কোটি টাকা কম।

(৩) বিদেশী জুতার আমদানি শতকরা ৭৫ অংশ কম।

(৪) সিগারেটের আমদানি অর্ধেক পরিমাণ।

বিলাতী দ্রব্যের আমদানির পরিমাণ যে তিন-চারি বৎসর পর্যন্ত খুবই হ্রাস পাইয়াছিল, নানাবিধ সরকারী বিবরণ ও ইংরেজ ব্যবসায়ীগণের লিখিত চিঠিপত্র হইতে তাহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হয়। ভারত গভর্নমেন্টের নিকট বঙ্গদেশ হইতে মাসিক রিপোর্ট পাঠান হইত। তাহা হইতে অনুমান করা যাইতে পারে যে ১৯০৮ ০৯ পর্যন্ত বিদেশী দ্রব্য বর্জন আন্দোলনের ফলে বিলাতী কাপড়ের আমদানি খুবই কমিয়া গিয়াছিল, কিন্তু ১৯১০ সন হইতে এই আমদানি ক্রমশঃই বাড়িতে থাকে। কিন্তু আন্দোলন হ্রাস পাইলেও ইহার কয়েকটি চিরস্থায়ী ফল বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিদেশী দ্রব্যের আমদানি যে এদেশের আর্থিক দুরবস্থার একটি প্রধান কারণ, সাধারণ লোকও সে-বিষয়ে সচেতন হইয়া উঠিল। দাদাভাই নৌরজী, ডিগবী, রমেশচন্দ্র দত্ত প্রভৃতি মনীষিগণ বড় বড় গ্রন্থ লিখিয়াও জনসাধারণের মধ্যে যে ধারণা গঠিত করিতে পারেন নাই, বঙ্গদেশের বিদেশীবর্জন আন্দোলনের ফলে তাহা অনেক পরিমাণে সাধিত হইয়াছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ ১৯০৫ সনের ডিসেম্বর মাসে বারাণসীর ‘Indian Industrial Conference’ বা নিখিল ভারতীয় শিল্প সম্মেলনের উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই সম্মেলনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে সংগৃহীত এদেশে প্রস্তুত নানাবিধ শিল্পজাত দ্রব্যের প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হইয়াছিল। এই সমুদয় দ্রব্যের এবং তাহার মূল্য ও নির্মাতাগণের নাম, ঠিকানা প্রভৃতির তালিকা প্রস্তুত করা হয়। সম্মেলনের সভাপতি স্বনামখ্যাত রমেশচন্দ্র দত্ত তাঁহার ভাষণে ভারতে শিল্পোন্নতির উপায়সম্বন্ধে অনেক মূল্যবান নির্দেশ দেন। এই জাতীয় সম্মেলন ইহার পূর্বে আর কখনও হয় নাই, এবং ইহা যে ভারতের শিল্পোন্নতির দিকে লোকের মনোযোগ বিশেষভাবে আকৃষ্ট করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। মোটের উপর বঙ্গ-ভঙ্গ উপলক্ষে যে বিদেশীবর্জন আন্দোলন আরম্ভ হয় তাহা যে ভারতের শিল্পোন্নতির পথ নানাভাবে প্রশস্ত ও সুগম করিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই।

বিদেশীবর্জন আন্দোলন বিলাতী দ্রব্যবৰ্জন দিয়া আরম্ভ হইলেও ক্রমশঃ ইহার উদ্দেশ্য আরও গভীর ও ব্যাপক হইয়া উঠিল। কেবল বিলাতী দ্রব্য নহে, বিদেশীয় শিক্ষা, রীতি-নীতি, আচার-ব্যবহার এবং সর্বোপরি বিদেশীয় শাসন হইতে মুক্তিলাভই ইহার প্রধান লক্ষ্য হইয়া দাঁড়াইল। এই নবলব্ধ জাতীয়তা-চেতনার প্রথম বলিষ্ঠ পদক্ষেপ হইল প্রচলিত ইংরেজী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে জাতীয় শিক্ষালয়ের প্রতিষ্ঠা।

৩. জাতীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান

জাতীয় জীবনে শিক্ষার প্রভাব যে খুবই বেশী, সর্বদেশে সর্বকালেই নানাভাবে তাহার স্বীকৃতির পরিচয় পাওয়া যায়। বর্তমান যুগে কমিউনিস্ট বা ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের নেতারা এই কারণেই নূতন রাজনীতিক প্রণালী প্রবর্তনের সঙ্গেই শিক্ষার পদ্ধতি ও প্রণালী এবং শিক্ষণীয় বিষয়ের পরিবর্তন করিয়া তাহা নূতন ছাঁচে ঢালাই করিবার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। বঙ্গদেশে বিলাতী দ্রব্য বর্জনের আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যেই প্রথমে খুব গভীর ও ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। ছাত্রগণই যে এই আন্দোলনের মেরুদণ্ডস্বরূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছিল ইহা অস্বীকার করা কঠিন। ইংরেজ সরকার এই প্রভাবের গুরুত্ব সম্পূর্ণ অনুধাবন করিলেন এবং ছাত্রদিগকে ইহা হইতে নিবৃত্ত করার দিকে বিশেষ দৃষ্টি দিলেন। যাহাতে ছাত্রেরা এই আন্দোলনে কোন সক্রিয় অংশগ্রহণ না করে, স্কুল ও কলেজের কর্তৃপক্ষকে সে-বিষয়ে উপদেশ বা আদেশ দিয়াও বিশেষ ফল হইল না। কারণ, তরুণ ছাত্রসমপ্রদায়ের মনে স্বাদেশিকতার ভাব গভীরভাবে অঙ্কিত হইয়াছিল এবং শিক্ষকেরাও অনেকেই গোপনে, কেহ কেহ প্রকাশ্যেই, এই আন্দোলনের সমর্থন করিতেন। আদেশ-নির্দেশে যখন ফল হইল না, তখন সরকার দমননীতি অবলম্বন করিলেন।

অনেক ছাত্রের জরিমানা হইল, অনেকে স্কুল হইতে বিতাড়িত হইল। শিক্ষকদের মধ্যেও কেহ কেহ পদচ্যুত বা অন্য উপায়ে দণ্ডিত হইলেন। সরকার এ-বিষয়ে প্রত্যেক জিলার ম্যাজিষ্ট্রেট ও কলেক্টারের নিকট একটি গোপনীয় সার্কুলার জারি করিলেন।

এই সার্কুলারে স্বাক্ষরকারী চীফ সেক্রেটারি R. W. Carlyle সাহেবের নাম অনুসারে এই কুখ্যাত কার্লাইল সার্কুলার সে-যুগে যথেষ্ট বিক্ষোভের কারণ হইয়াছিল। সার্কুলারটির সারমর্ম এই : “সম্প্রতি স্কুল কলেজের ছাত্রগণ যেভাবে রাজনীতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করিতেছে তাহা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়ম ও শৃঙ্খলার বিরোধী এবং ছাত্রদের পক্ষে অনিষ্টকর। যে-সকল প্রতিষ্ঠান সরকার হইতে কোনরূপ সাহায্য পায় তাহাদের ছাত্রদের এইরূপ আচরণ কোন মতেই সহ্য করা যাইবে না। অতএব আপনার জিলার কোন ছাত্র যদি তথাকথিত স্বদেশী আন্দোলনে পিকেটিং বা অন্য কোন রকমে অংশ গ্রহণ করে তাহা হইলে এই সমুদয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষদিগকে জানাইবেন যে, যদি তাঁহারা ছাত্রদিগের এই সব কার্য বন্ধ করিতে না পারেন তবে গভর্নমেন্ট এই সব প্রতিষ্ঠানে যে অর্থ সাহায্য করে তাহা বন্ধ করা হইবে। এই সকল বিদ্যালয়ের ছাত্রেরা ভবিষ্যতে বৃত্তি পাইবে না এবং যাহারা বৃত্তি পাইতেছে তাহাদের বৃত্তি বন্ধ করা হইবে। আর, এই সকল স্কুল কলেজের ছাত্রেরা যাহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা দিবার অধিকারে বঞ্চিত হয় সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে অনুরোধ করা হইবে। অবশ্য যদি স্কুল কলেজের কর্তৃপক্ষ যথাসাধ্য চেষ্টা করিয়াও ছাত্রদিগকে স্বদেশী আন্দোলন হইতে প্রতিনিবৃত্ত করিতে না পারেন, তবে যে সকল ছাত্রেরা তাঁহাদের আদেশ অমান্য করে তাহাদের নামের তালিকা পাঠাইবেন এবং আপনারাই এই তালিকাভুক্ত ছাত্রদের উপযুক্ত দণ্ডবিধানের ব্যবস্থা করিবেন। আপনারা স্কুল কলেজের অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদিগকে ইহাও জানাইবেন যে, শান্তিরক্ষার জন্য প্রয়োজন হইলে তাঁহাদিগকে ‘বিশেষ কনষ্টেবল’ (special constable) নিযুক্ত করা হইবে। ছাত্রদের দ্বারা শান্তিভঙ্গের সম্ভাবনা থাকিলে বিনা দ্বিধায় এইরূপ কনষ্টেবল নিযুক্ত করিবেন। কারণ, ছাত্রেরা তাহাদিগকে ভক্তি করে এবং তাঁহারা দুষ্কৃতকারী ও অবাধ্য ছাত্রদের নামধাম দিতে পারিবেন।”

১৯০৫ সনের ১০ই অক্টোবর এই সার্কুলার গোপনে জারি হয় এবং ইহা সাধারণের কর্ণগোচর হইলে সমগ্র বঙ্গদেশে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও ইহার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ দেখা দেয়। আর একটি কারণে এই বিক্ষোভ ও বিদ্রোহ শতগুণে বর্ধিত হইল। ২১শে অক্টোবর (১৯০৫) শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর পেডলার সাহেব কলিকাতার কয়েকটি কলেজের অধ্যক্ষদিগকে এক পত্র লেখেন। ৩রা অক্টোবর হ্যারিসন রোডে যেসব ছাত্রেরা পিকেটিং করে (এবং পরে এই উপলক্ষে হাঙ্গামা বাদে) তাহাদিগকে কেন কলেজ হইতে বিতাড়িত করা হইবে না, অধ্যক্ষদিগকে তাহার কারণ দেখাইতে বলা হয়।

‘কার্লাইল সার্কুলার’ ও পেডলারের চিঠিতে গভর্নমেন্টের যে মনোভাব স্পষ্ট প্রকাশ পাইল তাহার বিরুদ্ধে কেবল বিক্ষোভ প্রকাশ নহে, বিদ্রোহাত্মক প্রতিক্রিয়াও দেখা দিল। ২৪শে অক্টোবর আব্দুল রসুলের নেতৃত্বে এক জনসভায় বিপিনচন্দ্র পাল কার্লাইল সার্কুলারের তীব্র নিন্দা করিয়াই ক্ষান্ত হইলেন না, তিনি প্রস্তাব করিলেন যে, সরকারী প্রভাববর্জিত স্বাধীনভাবে পরিচালিত জাতীয় শিক্ষা প্রবর্তনের ব্যবস্থা করা হউক। এইভাবে ভবিষ্যতের জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সূত্রপাত হইল। ঐদিনই অর্থাৎ ২৪শে অক্টোবর গোলদিঘিতে আর একটি জনসভা হয়। প্রায় দুই হাজার মুসলমান এই সভায় স্বদেশী আন্দোলনের পালন-ব্রতে দীক্ষা গ্রহণ করেন।

ইহার তিনদিন পরে পটলডাঙ্গায় শ্রীচারুচন্দ্র মল্লিকের বাড়ীতে একটি জনসভা হয়, ইহার সভাপতি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভূপেন্দ্রনাথ বসু, কৃষ্ণকুমার মিত্র, সতীশচন্দ্র মুখার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, মনোরঞ্জন গুহ ঠাকুরতা এবং অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাগণ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। কলিকাতার বিভিন্ন কলেজের সহস্রাধিক ছাত্র এই সভায় যোগদান করিয়া প্রতিজ্ঞা করিল যে, তাহারা কার্লাইল সাকুলার মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিবে না। সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ছাত্রদের সমর্থন করিয়া দৃঢ়কণ্ঠে ‘কার্লাইল সার্কুলারের তীব্র নিন্দা করিলেন।

১৬ই অক্টোবর নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের চীফ সেক্রেটারি পি. সি. লায়ন (P. C. Lyon) সাহেবও কার্লাইল সার্কুলারে’র অনুরূপ এক সার্কুলার জারি করিলেন। ইহাতে আরও বলা হইল, যেসব ছাত্র বিলাতী দ্রব্য বর্জনের সমর্থনে পিকেটিং করিবে তাহারা সরকারী চাকুরী পাইবে না। এই সার্কুলার প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে দমনীতি প্রচণ্ড আকার ধারণ করিল। ইহার দুই একটি দৃষ্টান্ত দিতেছি।

রংপুর : রংপুরের ম্যাজিষ্ট্রেট T. Emerson সাহেবের নির্দেশমত রংপুরের জিলা স্কুলের হেডমাস্টার ৩১শে অক্টোবর (১৯০৫) এক বিজ্ঞপ্তি দিলেন যে, স্বদেশী আন্দোলনে পিকেটিং প্রভৃতি কোনরূপ সক্রিয় অংশগ্রহণ করিলে ছাত্রগণকে কঠিন শাস্তি দেওয়া হইবে। ছাত্রেরা ইহা অগ্রাহ্য করিয়া ঐদিনই এক স্বদেশী সভায় যোগদান করিল, স্বদেশী গীত গাহিল এবং বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে সারাপথ মুখরিত করিয়া গৃহে ফিরিল। পরদিন রংপুরের জিলা স্কুল ও টেকনিক্যাল স্কুলের ছাত্রেরা মিলিয়া আরও একটি বড় জনসভায় যে কোন উপায়েই হউক বঙ্গভঙ্গের পরিবর্তন করিব”–এই মর্মে একটি জাতীয় ঘোষণা পাঠ করিল।

কর্তৃপক্ষ বিচলিত হইলেন। জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট প্রতি ছাত্রের পাঁচ টাকা জরিমানা করিলেন; আরও আদেশ দিলেন, জরিমানা না-দেওয়া পর্যন্ত তাহারা স্কুলে যোগদান করিতে পারিবে না এবং পুনরায় এই অপরাধ করিলে স্কুলটি তুলিয়া দেওয়া হইতে পারে–এই আদেশের নকল ছাত্রদের অভিভাবকদের কাছে পাঠানো হইল। অভিভাবকেরা বলিলেন, ছেলেরা কোন অপরাধ করে নাই, সুতরাং তাহারা জরিমানা দিবে না। ৭ই নভেম্বর রংপুরের অধিবাসীরা সভায় মিলিয়া স্থির করিলেন, তাঁহারা একটি জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন করিবেন। ৮ই নভেম্বর রংপুরে জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। রংপুরের জিলা স্কুলের হেডমাস্টার ৩১শে অক্টোবর শিক্ষকদের নিকট যে বিজ্ঞপ্তি দেন তাহাতে সমস্ত শিক্ষককে নির্দেশ দেওয়া হয় যে তাঁহারা যেন বিদ্যালয়ে এবং তাহার বাহিরে ছাত্রদের গতিবিধি সম্বন্ধে তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখেন এবং স্বদেশী আন্দোলনের অনিষ্টকারিতা বুঝাইয়া দেওয়া সত্ত্বেও যাহারা ইহাতে যোগদান করে তাহাদের নাম হেডমাস্টারকে জানান। অর্থাৎ শিক্ষকদিগকে গোয়েন্দাগিরির কার্যে নিযুক্ত করা হইল। ইহার প্রতিবাদস্বরূপ ছাত্রেরা বিদ্যালয় ত্যাগ করিল। শ্রীকালীপ্রসন্ন দাসগুপ্ত ও ব্রজসুন্দর রায়ের নেতৃত্বে রংপুরে প্রথম জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হইল। কার্লাইল সার্কুলারে’র বিরোধিতা করিবার জন্য একটি সমিতি গঠিত হইল (Anti-circular Society)। শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু নামক বি. এ. ক্লাসের একজন ছাত্র ইহার সম্পাদক হইল। তাহার বাগ্মিতা ও কর্মপরায়ণতায় এই ‘সার্কুলার বিরোধী সমিতি’ স্বদেশী আন্দোলনে যুবশক্তির কর্মানুষ্ঠানের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল। রংপুরের ঘটনার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়াস আরও বাড়িয়া গেল।

মাদারিপুর : রংপুরের ঘটনার অনুরূপ অনেক ঘটনায় পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের নবনিযুক্ত শাসনকর্তা ফুলার সাহেব সম্বন্ধে লোকের ধারণা হইল যে, তিনি ঢাকায় নবাবী আমলের স্বেচ্ছাচারিতার পুনঃপ্রবর্তন করিয়াছেন। এই সময় মাদারিপুরের একটি ঘটনায় এই ধারণা আরও বদ্ধমূল হইল।

ফরিদপুর জিলার মহকুমা শহর মাদারিপুর স্কুলের একটি ছাত্র ছাতা মাথায় দিয়া স্কুল হইতে ফিরিতেছিল। পাটের ব্যবসায়ী এক সাহেব ইহাতে অপমানিত বোধ করিয়া জোর করিয়া ছাতাটি মাটিতে ফেলিয়া দিবার চেষ্টা করিলে ছাত্রটি জোরে ছাতাটি হাতের মুঠায় চাপিয়া ধরে। সাহেব তখন ছাত্রটিকে মাটিতে ফেলিয়া দেন এবং সাহেবের সঙ্গী তিনজন চাপরাশী তাহার হুকুমমত ছাত্রটিকে প্রহার করে। তারপর বাসায় ফিরিয়া তিনি স্কুলের হেডমাষ্টার শ্রীকালীপ্রসন্ন দাসগুপ্তকে চিঠি লেখেন যে ঐ ছাত্রটি তাঁহার অপমান করিয়াছে। তাহাকে যেন গুরুতর দণ্ড দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আলোচনার জন্য হেডমাষ্টারকে তাঁহার সঙ্গে দেখা করিতে আদেশ করেন। হেডমাস্টার উত্তর দিলেন যে, এই ঘটনা সম্বন্ধে তিনি যাহা শুনিয়াছেন তাহা সম্পূর্ণ ভিন্নরকমের এবং সাহেব যদি স্কুলে আসেন তাহা হইলেও এ-বিষয়ে আলোচনা করিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। সাহেবের ইহা মনঃপূত হইল না। ইতিমধ্যে তাঁহার চাপরাশি আসিয়া জানাইল যে, কেহ তাহাকে প্রহার করিয়াছে। সাহেব তৎক্ষণাৎ বিষয়টি গভর্নমেন্টের গোচরে আনিলেন। বিভাগীয় স্কুল ইনসপেক্টর মি. ষ্টেপলটন (Stapleton) সরেজমিনে তদন্ত করিবার জন্য স্বয়ং মাদারিপুর আসিয়া হেডমাস্টারকে হুকুম দিলেন, অপরাধীদের খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে এবং সাহেব নিজে তাহাদিগের শাস্তি বিধান করিবেন। হেডমাস্টার জবাব দিলেন, যদি তাহার উপর বিচারের ভার দেওয়া হয় তবে তিনি উপযুক্ত দণ্ড দিতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু ছাত্রদিগকে শাস্তি দিবার জন্য ইনসপেক্টরের নিকট পাঠাইতে প্রস্তুত নহেন। ষ্টেপলটন বলিলেন, ইহা নিশ্চয়ই বয়স্ক ছাত্রদের কাজ, সুতরাং উপরের ক্লাসের ছাত্রদের নিকট হইতে দুইশত টাকা জরিমানা আদায় করিয়া তাহা চাপরাশিকে দেওয়া হউক। অনেক বাদানুবাদের পর ইনসপেক্টর জরিমানার পরিমাণ কমাইয়া পঁচিশ টাকা ধার্য করিলেন। এই সময় ছোটলাট ফুলার সাহেব হুকুম দিলেন যে, প্রথম তিনটি উচ্চশ্রেণীর ছাত্রদের ১৫০ টাকা জরিমানা দিতে হইবে এবং মহকুমা ম্যাজিষ্ট্রেটের উপস্থিতিতে হেডমাস্টার নিজে ছাত্রদিগকে বেত্রাঘাত করিবেন।

হেডমাস্টার এই আদেশ মানিতে অস্বীকার করায় ইনসপেক্টর স্কুলের সেক্রেটারীকে আদেশ দিলেন যে, তিনি যেন হেডমাষ্টারকে অবিলম্বে পদত্যাগ করিতে আদেশ দেন নচেৎ ঐ স্কুলের ছাত্রেরা ভবিষ্যতে সরকারী চাকুরী পাইবে না এবং স্কুলটিও বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার জন্য ছাত্র মনোনয়ন করার অধিকার হইতে বঞ্চিত হইবে (desaffiliated)। এই সংবাদ শুনিয়া মাদারিপুর মহকুমার এগারোটি হাইস্কুলের প্রতিনিধিরা মাদারিপুরে একটি কনফারেন্সে মিলিত হইয়া মাদারিপুর স্কুলের হেডমাষ্টার কালীপ্রসন্নবাবুর আচরণ সম্পূর্ণভাবে সমর্থন করিয়া একটি স্থায়ী সমিতি (Standing Committee) গঠিত করিলেন। শিক্ষাবিভাগের ডিরেক্টর ঐ এগারোটি স্কুলের কর্তৃপক্ষকে আদেশ দিলেন যে, উক্ত সমিতির সদস্য শিক্ষকদের পদত্যাগ করিতে বলা হউক এবং না করিলে তাহাদিগকে বরখাস্ত করা হউক।

সরকারের এইরূপ জোরজবরদস্তি সমগ্র বঙ্গদেশেই ঘটিয়াছিল। এ বিষয়ে ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, বানরিপাড়া, জলপাইগুড়ি, বর্ধমান, হুগলী, রাণীগঞ্জ, আসানসোল প্রভৃতি স্থানের চাঞ্চল্যকর বিবরণ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়া শিক্ষাজগতে যে অসন্তোষের আগুন জ্বালাইয়াছিল তাহার স্বরূপ বর্ণনা করা সম্ভব নহে।

১৯০৫ সনের ৮ই নভেম্বর পূর্ববঙ্গের ছাত্র ও শিক্ষক দমনের জন্য চীফ সেক্রেটারী P. C. Lyon ঢাকা বিভাগের কমিশনারের নিকট দুইটি সার্কুলার পাঠাইলেন। তাহাতে এই দমননীতি আরও প্রকট হইয়া উঠিল। প্রথমটিতে ছাত্রদিগকে স্বদেশী আন্দোলন হইতে দূরে রাখিবার জন্য নানাপ্রকার নির্দেশ দেওয়া হইল; এবং ইহা অমান্য করিলে ছাত্র, শিক্ষক ও স্কুলের সম্বন্ধে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে তাহা বিস্তৃতভাবে বর্ণিত হইল। কমিশনারকে নির্দেশ দেওয়া হইল যে, নিম্নলিখিত নিষেধাজ্ঞাগুলি যথাযথভাবে পালিত হইতেছে কিনা সে সম্বন্ধে যেন তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখা হয়।

নিষিদ্ধ আচরণগুলি এই :

(১) রাস্তায় বা প্রকাশ্য স্থানে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করা;

(২) প্রকাশ্যে কোন স্থানে রাজনীতি বা তাহার সহিত সম্পর্কিত কোন বিষয় আলোচনার জন্য সভা-সমিতি করা;

(৩) রাস্তায় দলবদ্ধভাবে সঙ্গীত বা (বন্দে মাতরম্ প্রভৃতির ন্যায়) কোন ধ্বনি করা। রাস্তায় সংকীর্তনও এই নিষেধাজ্ঞার অন্তর্ভুক্ত।

(৪) মেমসাহেবরা গাড়ী হাঁকাইয়া যাওয়ার সময় তাহাদের প্রতি অশিষ্ট ইঙ্গিত বা তাহাদের বিরক্তির কারণ হইতে পারে এবম্বিধ আচরণ। আরও আদেশ হইল যে, রাস্তায় কোন সাহেব বা মুসলমানের প্রতি অশিষ্ট ব্যবহারের জন্য পুলিশ অপরাধীর নাম ধাম জিজ্ঞাসা করিবে এবং তাহা দিতে অস্বীকার করিলে পুলিশ তাহাকে তৎক্ষণাৎ থানায় লইয়া যাইবে।

সরকারের এই ছাত্রদমন-নীতির সম্বন্ধে আর বেশীকিছু বলিবার প্রয়োজন নাই। কিন্তু বাঙ্গালী ছাত্রেরা ইহা মাথা পাতিয়া নীরবে সহ্য করে নাই। তাহারা সগর্বে মাথা তুলিয়া দাঁড়াইয়া এই অন্যায় ও অপমানের যে বলিষ্ঠ প্রতিবাদ জানাইয়াছে তাহা সত্যই অভিনব, অদৃষ্টপূর্ব এবং মনুষ্যত্বের পরিচায়ক। এ বিষয়ে দুইটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :

(ক) অ্যান্টি-সার্কুলার সোসাইটি

শচীন্দ্রপ্রসাদ বসু নামে একটি বি. এ. ক্লাসের ছাত্রের চেষ্টায় ছাত্রদের এই সোসাইটির প্রতিষ্ঠার কথা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে। প্রথম প্রথম কলিকাতার রাস্তায় জাতীয় সঙ্গীতসহ দৈনন্দিন শোভাযাত্রা এবং বিলাতী পণ্যদ্রব্যের দোকানে পিকেটিং করাই ছিল এই সমিতির প্রধান কার্য। কিন্তু ক্রমে ক্রমে ইহার কার্যসীমা বর্ধিত হইল। ইহার কার্যক্রম নিম্নলিখিত কয়েকটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়

(১) যে-সকল ছাত্র স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য স্কুল হইতে বিতাড়িত হইয়াছে তাহাদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা। ইহাদের এ-বিষয়ে সামান্য প্রচেষ্টা হইতেই পরিশেষে কিরূপে জাতীয় শিক্ষা পরিষদ স্থাপিত হয় তাহা পরে বিবৃত হইবে।

(২) সঙ্গীত ও শোভাযাত্রার সাহায্যে জনসাধারণের মধ্যে স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্য, লক্ষ্য, প্রয়োজনীয়তা এবং কী উপায়ে ইহা সফলতা লাভ করিতে পারে সে-সম্বন্ধে তথ্য প্রচার করা।

(৩) বিলাতী দ্রব্যের ক্রেতা এবং বিক্রেতাকে নানাভাবে ইহা হইতে প্রতিনিবৃত্ত করা।

(৪) শহরে ও গ্রামে গৃহে গৃহে স্বদেশী বস্ত্রের সরবরাহ করার ব্যবস্থা করা।

(৫) সভাসমিতিতে বক্তৃতাদ্বারা স্বদেশী আন্দোলনকে জনপ্রিয় করা।

(খ) ডন সোসাইটি (Dawn Society)

শ্রীসতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় নামে একজন অতিশয় ধর্মশীল ও সাধুপুরুষ ১৯০২ সনে এই সমিতি স্থাপন করেন। শিক্ষার প্রকৃত আদর্শ ও লক্ষ্য সম্মুখে রাখিয়া যাহাতে বঙ্গদেশীয় যুবকগণ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধন করিয়া মনুষ্যত্ব লাভ করিতে পারে, ঋষিতুল্য সতীশচন্দ্রের তাহাই ছিল আদর্শ। বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিপূরক হিসাবে এখানে ধর্ম ও নীতিশিক্ষার মাধ্যমে ছাত্রদের চরিত্রগঠনে বিশেষ যত্ন লওয়া হইত। ছাত্রেরা যাহা পড়িত বা শুনিত তাহার তাৎপর্য হৃদয়ঙ্গম করিয়া সে-বিষয়ে লেখা বা আলোচনা দ্বারা মানসিক শক্তি বর্ধন ও চরিত্রগঠনের দিকে খুব জোর দেওয়া হইত। ইহা ছাড়াও এখানকার শিক্ষার আরও দুইটি বৈশিষ্ট্য ছিল।

প্রথমতঃ, জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও দেশপ্রেমের উদ্বোধন এখানকার সকল শিক্ষাদীক্ষার প্রধান লক্ষ্য ছিল। দেশের জন্য সর্বস্বত্যাগ এই মন্ত্রেই সকলে দীক্ষা লইত।

দ্বিতীয়তঃ, হাতে-কলমে কারিগরী শিক্ষা ও স্বদেশী শিল্পের সর্ববিধ উন্নতি সাধন এই প্রতিষ্ঠানের অন্যতম আদর্শ বলিয়া পরিগণিত হইত। ১৯০৩ সনে শুধু ছাত্রদের তত্ত্বাবধানে একটি স্বদেশী ভাণ্ডার পরিচালিত হইত। ছাত্রেরা নানাস্থান হইতে নানাপ্রকার গৃহপ্রস্তুত দ্রব্য সংগ্রহ করিয়া আনিত এবং প্রত্যহ বৈকালে তাহা বিক্রয় করিত। ১৯০৩ সনের জুন হইতে পর বৎসরের জুনের মধ্যে প্রায় দশ হাজার টাকা মূল্যের দ্রব্য এই স্বদেশী ভাণ্ডার হইতে বিক্রয় করা হইয়াছিল। স্মরণ রাখিতে হইবে যে, স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইবার পূর্ব হইতেই এইরূপে এবং বক্তৃতা ও Dawn পত্রিকায় প্রবন্ধ দ্বারা দেশে শিল্পের পুনরুজ্জীবনের জন্য একদল যুবক-ছাত্র এই প্রতিষ্ঠানে দীক্ষা ও শিক্ষা লাভ করিয়াছিল। অতএব সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় স্বদেশী আন্দোলনের কেবল সূত্রপাত নহে, ইহার সফলতার পথও প্রশস্ত করিয়াছিলেন। সুতরাং ডন সোসাইটিও স্বদেশী আন্দোলনের একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হইয়াছিল।

(গ) জাতীয় শিক্ষা

শিক্ষাবিষয়ে স্বাদেশিকতার প্রবর্তনে ডন সোসাইটির দান অপরিসীম বলা যাইতে পারে। ১৯০৫ সনের ৫ই নভেম্বর ডন সোসাইটির আহ্বানে জাতীয় শিক্ষা উদ্বোধনের জন্য এক বিরাট জনসভার অধিবেশন হয়। ইহাতে প্রায় দুই হাজার ছাত্র উপস্থিত ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সতীশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং হীরেন্দ্রনাথ দত্ত এই সভায় ভাষণ দেন। সতীশচন্দ্র যুবক-ছাত্রগণকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলামখানা ত্যাগ ও সেখানকার পরীক্ষা বর্জনের জন্য আহ্বান করিলেন।

এইভাবে জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সূত্রপাত হইল। চারি দিন পরে (৯ই নভেম্বর) পান্তির মাঠে আবার এক বিরাট সভা হইল। এই সভায় সুবোধচন্দ্র মল্লিক জাতীয় শিক্ষার জন্য এক লক্ষ টাকা দানের প্রতিশ্রুতি দিলেন। কৃতজ্ঞ দেশবাসী তাঁহাকে ‘রাজা’ উপাধি দিয়া সম্মান জানাইল। পরদিন সতীশচন্দ্রের বন্ধু (ময়মনসিংহ জিলার অন্তর্গত গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী) জাতীয় শিক্ষার জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন, এই বার্তা চতুর্দিকে বিঘোষিত হইল।

১১ই নভেম্বর গোলদীঘির তীরে প্রায় পাঁচ হাজারের বেশী ছাত্রের এক সভা হইল। ইহার সভাপতি ব্যারিস্টার আশুতোষ চৌধুরী সভার তিন দিন পরে বঙ্গদেশের প্রধান প্রধান নেতাদের এক কনফারেন্সে উপস্থিত হইয়া জাতীয় শিক্ষা পরিষদের বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবার জন্য আহ্বান করিলেন।

তিনি ঐ সভার উল্লেখ করিয়া বলিলেন, “ইহার পূর্বে আমার ধারণা ছিল না যে যুবক-ছাত্রগণ কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করিয়া জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের জন্য এত দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাহারা স্থির করিয়াছে, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা বর্জন করিবে এবং জানিতে চাহিয়াছে আমরা তাহাদের জন্য জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করিতে পরিব কি না।”

১৬ই নভেম্বর এই কনফারেন্সের অধিবেশন হইল। বঙ্গদেশের নেতৃবৃন্দের মধ্যে যাঁহারা এই কনফারেন্সে যোগ দেন তাহাদের মধ্যে ছিলেন–গুরুদাস ব্যানার্জী, সতীশচন্দ্র মুখার্জী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আশুতোষ চৌধুরী, রাসবিহারী ঘোষ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তারকনাথ পালিত, ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, চিত্তরঞ্জন দাশ, আবদুল রসুল, নীলরতন সরকার, ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, লালমোহন ঘোষ, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, বিপিনচন্দ্র পাল, মতিলাল ঘোষ এবং সুবোধচন্দ্র মল্লিক। এই কনফারেন্সে নিম্নলিখিত দুইটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হইল।

(১) সর্বপ্রকার সাধারণ বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থার জন্য একটি জাতীয় শিক্ষা পরিষদ অবিলম্বে প্রতিষ্ঠিত করা আবশ্যক।

(২) ছাত্রদের পরীক্ষাবর্জনের প্রস্তাব তাহাদের স্বার্থত্যাগের প্রকৃষ্ট প্রমাণ হিসাবে প্রশংসনীয় মনে করিলেও এই কনফারেন্সের বিবেচনায় দেশের স্বার্থের বিষয় বিবেচনা করিয়া তাহাদের পরীক্ষা দেওয়াই কর্তব্য।

এই কনফারেন্সে ঘোষিত হইল যে পূর্বোল্লিখিত রাজা সুবোধ মল্লিক ও ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছাড়া তৃতীয় এক ব্যক্তি নগদ দুই লক্ষ টাকা ও প্রকাণ্ড হাতাওয়ালা একটি বড় বাড়ী জাতীয় শিক্ষা পরিষদের জন্য দান করিয়াছেন। চতুর্থ এক ব্যক্তি বার্ষিক ত্রিশ হাজার টাকা দান করিবেন এইরূপ সম্ভাবনা আছে। জাতীয় শিক্ষা পরিষদ গঠনের ভার শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র মুখার্জীর উপর ন্যস্ত হইল। তাঁহার অক্লান্ত চেষ্টায় ১৯০৬ সনের ১৪ই আগষ্ট জাতীয় শিক্ষা পরিষদ (National Council of Education) প্রতিষ্ঠিত হইল। ইহাতে যে নূতন শিক্ষার প্রবর্তন হইবে তাহা নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলির দ্বারা সূচিত হইল :

(১) সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক ও টেকনিক্যাল প্রভৃতি সর্বপ্রকার শিক্ষা সাধারণতঃ বাংলাভাষার মাধ্যমে দিতে হইবে–তবে ইংরেজী অবশ্যপাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হইবে।’বাংলাভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন করিতে হইবে।

(২) শারীরিক ও নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ের ধর্মশিক্ষা দিবার ব্যবস্থা থাকিবে, শিক্ষার্থীর মনে অকৃত্রিম দেশপ্রেম ও দেশসেবার প্রতি অনুরক্তিসৃষ্টি শিক্ষার বিশেষ লক্ষ্য হইবে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান ধর্মশিক্ষার অঙ্গ হইবে না।

(৩) দেশের ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন সম্বন্ধে জ্ঞান এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্ত্য আদর্শের সমন্বয় সাধনের উপর জোর দিতে হইবে।

(৪) দেশের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের দিকে দৃষ্টি রাখিয়া, বৈজ্ঞানিক, টেকনিক্যাল ও শ্রমশিল্প শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে হইবে। প্রাচ্য জ্ঞানের ভাণ্ডারে যে সকল বৈজ্ঞানিক তথ্য নিহিত আছে, বিশেষতঃ আয়ুর্বেদ ও হেকিমিচিকিৎসায় যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি আছে তাহার অনুশীলন করিতে হইবে।

যদিও প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতির দোষত্রুটি সম্বন্ধে নেতৃবৃন্দ সকলেই সচেতন ছিলেন, তথাপি কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে বর্জন করা সম্বন্ধে তাঁহাদের মধ্যে গুরুতর মতভেদ উপস্থিত হইল। একদলের মতে একমাত্র জাতীয় শিক্ষা পরিষদই সর্বপ্রকার শিক্ষার ভার গ্রহণ করিবে। অপর দলের মতে প্রচলিত শিক্ষার পরিপূরক হিসাবে কেবলমাত্র টেকনিক্যাল শিক্ষার ব্যবস্থাই জাতীয় শিক্ষা পরিষদের প্রধান লক্ষ্য হইবে। এই মতবিরোধের ফলে দুইটি বিভিন্ন দলের সৃষ্টি হইল। তৎকালে সুপরিচিত রাজনীতির দলের সংজ্ঞা অনুসারে উপরোক্ত দুই দলকে যথাক্রমে চরমপন্থী (Extremist) ও নরমপন্থী (Moderate) বলা যাইতে পারে। প্রথম দলে ছিলেন গুরুদাস ব্যানার্জী, সতীশচন্দ্র মুখার্জী, হীরেন্দ্রনাথ দত্ত, আশুতোষ চৌধুরী, সুবোধচন্দ্র মল্লিক, ব্রজেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রভৃতি। দ্বিতীয় দলে ছিলেন তারকনাথ পালিত, ভূপেন্দ্রনাথ বসু, নগেন্দ্রনাথ ঘোষ, নীলরতন সরকার, মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রভৃতি। ফলে একই দিনে (১লা জুন, ১৯০৬ খ্রী.) National Coucil of Education (N.C.E.) বা জাতীয় শিক্ষা পরিষদ এবং Society for the Promotion of Technical Education (S. P. T. E.) at coafata fara spate উন্নতি বিধায়ক সমিতি-এই দুইটি প্রতিষ্ঠান পৃথক পৃথক ভাবে রেজিস্ট্রী করা হইল। প্রথমটি ১৯০৬ সনের ১৪ই আগষ্ট “Bengal National College and School” এবং দ্বিতীয়টি ১৯০৬ সনের ২৫শে জুলাই “Bengal Technical Institute” প্রতিষ্ঠিত করিল। মতভেদ থাকিলেও যে, উভয় দলের মধ্যে বিরোধ বা বিদ্বেষ ছিল না তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে উভয়েরই সভাপতি ছিলেন রাসবিহারী ঘোষ। সুতরাং, ১৯১০ সনে যে পূর্বোক্ত দুই প্রতিষ্ঠান (N. C. E. এবং S. P. T. E.) মিলিত হইল তাহাতে আশ্চর্যবোধ করিবার কিছু নাই। মিলিত হইবার পর সাহিত্য ও বিশুদ্ধ বিজ্ঞান বিভাগের নাম হইল Bengal National College, ব্যবহারিক বিজ্ঞান এবং টেকনিক্যাল বিভাগের নাম হইল Bengal Technical Institute। স্বাধীনতা লাভের পর এই সমস্তই বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত হইয়াছে।

১৯১০ সনে মিলিত হইবার পূর্বে দুইটি প্রতিষ্ঠানই প্রথমে বিশেষ উন্নতি লাভ করিয়াছিল। শ্রীঅরবিন্দ ঘোষ ৭৫০ টাকা বেতনে বরোদা কলেজের অধ্যাপক ছিলেন। তাহা ছাড়িয়া সামান্য বেতনে (প্রথমে ৭৫ পরে ১৫০ টাকা) National College-এর প্রিন্সিপ্যাল হইয়া আসিলেন এবং ইহাতে নবীন জীবনের সঞ্চার করিলেন। পরে রাজনীতিক আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং বন্দে মাতরম্’ নামক বিখ্যাত ইংরেজী দৈনিক পত্রিকার সম্পাদনায় ব্যস্ত থাকায় তিনি ১৯০৭ সনে ন্যাশনাল কলেজের অধ্যক্ষের পদ ত্যাগ করিলেন। তাঁহার স্থানে সতীশচন্দ্র মুখার্জী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হইলেন। তিনিও অসুস্থতার জন্য ১৯০৮ সনে পদত্যাগ করিতে বাধ্য হইলেন। ১৯১০ সনের পর এই কলেজের জনপ্রিয়তা কমিয়া যায়। ইহার অনেক কারণ ছিল। প্রথমতঃ, স্বদেশী আন্দোলন ক্রমশঃ মুক্তিসংগ্রামে পর্যবসিত হইল, ফলে তখন রাজনীতিক স্বাধীনতাই প্রধান আদর্শ ও কাম্য হইল এবং সমস্ত আগ্রহ ও প্রচেষ্টা সেইদিকেই ধাবিত হইল। দ্বিতীয়তঃ, মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর উচ্চশিক্ষালাভের প্রধান উদ্দেশ্য চাকুরী। জাতীয় বিদ্যালয়ে শিক্ষা ইহার প্রচণ্ড বাধা হইয়া দাঁড়াইল। সুতরাং পূর্বোক্ত কারণগুলি সমভাবে প্রযোজ্য হইলেও Technical Institute ক্রমশঃ উন্নতি লাভ করিতে লাগিল। কারণ এখানকার কারিগরী শিক্ষা লাভ করিয়া চাকুরী ছাড়াও স্বাধীনভাবে জীবিকা নির্বাহের যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল। স্বদেশী আন্দোলনের বেগ হ্রাস পাওয়ায় স্কুল কলেজ হইতে বিতাড়িত ছাত্রের সংখ্যা খুবই কমিয়া গেল। এইসব ছাত্রের শিক্ষার জন্যই প্রথমে এবং প্রধানতঃ জাতীয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা হয়। সুতরাং স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে এইসব স্কুলের প্রয়োজনীয়তাও কমিয়া যায়।

এই প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ যাহা লিখিয়াছিলেন (১৩১২, ২৬শে অগ্রহায়ণ) তাহা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : “মফঃস্বলে বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষদের প্রতি কর্তৃপক্ষ এক ন্যায়বিগর্হিত সুবুদ্ধিবিবর্জিত সার্কুলার জারি করিলেন। তখন ছাত্রমণ্ডলী হঠাৎ উত্তেজিত হইয়া পণ করিয়া বসিলেন যে আমরা বর্তমান য়ুনিভার্সিটিকে বয়কট করিব। আমরা এ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিব না। আমাদের জন্য অন্য বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হউক…। প্রবল ক্ষমতাশালী পক্ষের প্রতি রাগ করিয়া যখন মনে জেদ জন্মে তখন অতি সত্বর যে অসাধ্য সাধন করিবার ইচ্ছা হয়, তাহা ইন্দ্রজালের দ্বারাই সম্ভব।…কিন্তু মায়ার ভরসা ছাড়িয়া দিয়া যদি যথার্থ কাজের প্রত্যাশা করা যায় তবে ধৈর্য ধরিতেই হইবে…ছোট আরম্ভের প্রতি ধৈর্য রক্ষা করা যথার্থ প্রীতির লক্ষণ। কিন্তু বিপক্ষ পক্ষের প্রতি স্পর্ধা করিয়া যখন আমরা কোন উদ্যোগে প্রবৃত্ত হই তখন আমাদের বিলম্ব সয় না।…দেশীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে প্রথম হইতেই আমাদের এই যে আঘাতকর অধৈর্যের লক্ষণ দেখা যাইতেছে, ইহাই আমাদের আশঙ্কার কারণ।”২

৪. বঙ্গের বাহিরে স্বদেশী আন্দোলনের প্রসার

স্বদেশী আন্দোলন শীঘ্রই সমগ্র ভারতবর্ষে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। বঙ্গদেশের গোপনীয় সরকারী রিপোর্টে এ-বিষয়ে যে-বিবরণ পাওয়া যায় তাহার সারমর্ম এই : “বিলাতীবর্জন ও স্বদেশী আন্দোলন ১৯০৫ সন শেষ হইবার পূর্বেই ভারতীয়। আন্দোলনে পরিণত হয়। যুক্তপ্রদেশের ২৩টি জিলা, মধ্যপ্রদেশের ১৫টি শহর, বম্বে প্রদেশের ২৪টি নগরী, পাঞ্জাবের ২০টি জিলা এবং মাদ্রাজের ১৩টি জিলায় এই আন্দোলন ছড়াইয়া পড়ে। বোম্বাই প্রদেশে ইহার নেতা ছিলেন বালগঙ্গাধর তিলক, তাহার কন্যা শ্রীযুক্তা কেটকার এবং শ্রীযুক্তা যোশী (অন্যান্য প্রদেশের নেতাদের নামও আছে)। মাদ্রাজে সুব্রহ্মনিয়া আয়ার, পি, আনন্দ চালু এবং টি. এম. নায়ার এই আন্দোলনের প্রবল সমর্থন করেন। ১৯০৫ সনের ২রা ডিসেম্বর আনন্দ চালুর সভাপতিত্বে এক জনসভার অধিবেশন হয় তাহাতে নায়ার বাংলায় বিদেশীবর্জনের সমর্থনে একটি প্রস্তাব করেন এবং বলেন, ‘প্রবল জাতির বিরুদ্ধে দুর্বল জাতির ইহাই অস্ত্র এবং আয়ার্ল্যাণ্ড ও আমেরিকায় যে বিলাতীবর্জন আন্দোলন (Boycott) হইয়াছিল তিনি তাহারও উল্লেখ করেন।

বম্বে ও আহমদাবাদে এই আন্দোলনের ফলে কলের কাপড়ের বিক্রয় অসম্ভব রকম বৃদ্ধি পায়। বঙ্গদেশের ন্যায় লাহোরে ও হরিদ্বারে পাণ্ডারা বিলাতী চিনিতে তৈরী মিঠাই ব্যবহার করিতে অস্বীকার করে। পুণাতে ধর্মের দোহাই দিয়া বিদেশীবর্জনের নেটিশ নানা প্রকাশ্য স্থানে টাঙাইয়া দেওয়া হয়। পুরীতে এক সভায় একশত সাধু শপথ করেন যে, তাঁহারা সারা ভারতবর্ষে স্বদেশী আন্দোলনের আদর্শ প্রচার করিবেন। পুরীতে জগন্নাথের মন্দিরের পাণ্ডারাও মন্দিরপ্রাঙ্গণে সভা করিয়া বিলাতী দ্রব্য বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।

জাতীয় শিক্ষার আন্দোলনও সারা ভারতে ছড়াইয়া পড়ে। বালগঙ্গাধর তিলক ও লালা লাজপৎ রায়ের মত নেতারা ইহা প্রচার করেন। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে জনসভা, জিলা কনফারেন্স-এ ইহার সমর্থক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। তিলক পুণার জিলা কনফারেন্সে ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা করেন। তিনি বলেন, জাতীয় শিক্ষাই নবযুগে সর্ববিধ উন্নতির ও প্রকৃত দেশাত্মবোধ জাগাইবার একমাত্র উপায় এবং আশা প্রকাশ করেন যে অচিরেই ভারতের সর্বত্র ও সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতীয় শিক্ষার প্রবর্তন হইবে। তিলকের প্রস্তাব সমর্থন করিয়া ফার্গুসন কলেজের অধ্যাপক লিমায়ে বলেন, “দেশের নবজাগরণই শিক্ষার একমাত্র উদ্দেশ্য।” কলিকাতার জাতীয় শিক্ষা পরিষদের পাঠ্যসূচী ও প্রণালী অবলম্বন করিয়া পুণায় কয়েকটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কলিকাতার আদর্শে মসলিপত্তনে “অন্ধ্র জাতীয় শিক্ষা পরিষদ” এবং একটি জাতীয় কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯০৮)। রাজমীতেও একটি জাতীয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় (১৯০৮)। কলিকাতার প্রসিদ্ধ নেতা রাসবিহারী ঘোষ যখন কংগ্রেস অধিবেশনে যোগ দিবার জন্য মাদ্রাজ যাইতেছিলেন তখন রাজমন্ত্রী রেলওয়ে স্টেশনে দুইশত নাগরিক তাঁহাকে এক অভিনন্দনপত্র দিয়া সম্মানিত করে। এই পত্রের নিম্নলিখিত উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য : “বন্দে মাতরম দেশলাইয়ের কারখানা স্থাপন এবং কলিকাতার জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সভাপতিরূপে জাতীয় শিক্ষার উন্নয়ন বিশেষ প্রশংসার যোগ্য–মাতৃভূমির উন্নতির জন্য আপনি যাহা করিয়াছেন আমরা তাহা অতিশয় মূল্যবান মনে করি।”

যুক্তপ্রদেশেও জাতীয় শিক্ষার আন্দোলন আরম্ভ হয়। ১৯০৮ সনে এলাহাবাদে প্রতিষ্ঠিত “অযযাধ্যানাথ ন্যাশনাল হাই স্কুল” কলিকাতা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অধীনস্থ (affiliated) করা হয়। ধুলিয়া নগরে বম্বে প্রাদেশিক সম্মেলনের অধিবেশনে জাতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। এই প্রদেশের অধিবাসীদের জাতীয় শিক্ষার প্রচারসম্বন্ধে কিরূপ আগ্রহ ও উৎসাহ ছিল তাহার একটি বিশিষ্ট উদাহরণ উল্লেখ করা যাইতে পারে। মহারাষ্ট্র নাটক-মণ্ডলী এবং পতঙ্কর সঙ্গীত-মণ্ডলী কলিকাতা জাতীয় শিক্ষা পরিষদের সাহায্যের জন্য একটি বিশেষ অভিনয়ের ব্যবস্থা করেন এবং লব্ধ অর্থ ৩৭৮ টাকা অরবিন্দ ঘোষের মারফৎ দান করেন। এইরূপে জাতীয় শিক্ষার আদর্শ ও উদ্দীপনা সমগ্র ভারতের ঐক্যবন্ধনের একটি সূক্ষ্ম সূত্ররূপে পরিণত হয়।

৫. সরকারের দমননীতি

বাংলা দেশের একটি প্রশাসনমূলক ঘটনার ফলে যে আন্দোলনের সূত্রপাত হয় তাহা যে ইহার সঙ্কীর্ণ লক্ষ্য ও গণ্ডী অতিক্রম করিয়া দ্রুতগতিতে একটি বিশাল ভারতীয় অর্থনীতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতিক বিপ্লবের সূচনার পরিণত হইয়াছে ভারত-সরকার অবিলম্বে তাহা উপলব্ধি করিলেন। নবগঠিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের লেফটেনান্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলারের অদ্ভুত মনোবৃত্তি ও উচ্ছঙ্খল আচরণ অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিল। উত্তেজিত হিন্দুদের সন্তোষ বা সান্ত্বনা বিধান তো দূরের কথা, প্রকাশ্যে হিন্দুদিগের নিগ্রহ ও মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট বিশেষ অনুগ্রহ তাঁহার শাসননীতির মূলমন্ত্র হইয়া দাঁড়াইল। একটি লৌকিক কাহিনীর সুষ্ঠু উপমার সাহায্যে তিনি তাঁহার হৃদয়ের দ্বার উদ্ঘাটিত করিয়াছিলেন। তিনি ঘোষণা করিলেন যে তাঁহার দুই রানী-মুসলমানেরা সুয়ো আর হিন্দুরা দুয়োরানী। পরবর্তীকালে তিনি ইহা একটি বিদ্রূপ বা পরিহাসমাত্র বলিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিলেন, কিন্তু ইহা যে তাহার অন্তরের অকপট অভিব্যক্তি, তাঁহার আচরণ ও শাসনকালের ঘটনাবলী আলোচনা করিলে সে-বিষয়ে সন্দেহমাত্র থাকে না। অতি অল্পকালের মধ্যেই তিনি যে কুখ্যাতি অর্জন করিয়াছিলেন, এবং ফুলারী রাজত্ব যে স্বৈরতন্ত্রের নিদর্শনরূপে প্রবাদবাক্যে পরিণত হইয়াছিল ইহাই তাহার বিশিষ্ট প্রমাণ।

ফুলারের স্বল্পকালস্থায়ী রাজত্বের বিশদ ও বিস্তৃত বর্ণনা দেওয়া সম্ভব নহে। রজনীর দুঃস্বপ্নের ন্যায় প্রভাতে তাহার স্মৃতি রোমন্থন করার বিশেষ প্রয়োজনীয়তাও নাই। কেবলমাত্র পূর্ববঙ্গের বরিশাল শহরের কাহিনী বিবৃত করিলেই এ সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যাইবে।

তখন বরিশালের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন অশ্বিনীকুমার দত্ত। তাঁহার পিতার নামে তিনি যে ব্রজমোহন কলেজের প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন, বর্তমান লেখক ১৯০৫ সনের তাহার আবাসিক ছাত্র হিসাবে তাঁহার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আসার সৌভাগ্য লাভ করিয়াছিল। তখন রাজনীতিক নেতাদের মধ্যে একমাত্র অরবিন্দ ঘোষ ব্যতীত এরূপ সাধুতা ও আদর্শ চরিত্রের ঋষিতুল্য নেতা বঙ্গদেশে আর কেহ ছিলেন না বলিলে অত্যুক্তি করা হইবে না। সমগ্র বরিশাল জেলার আপামর জনসাধারণ তাঁহাকে দেবতার ন্যায় ভক্তি করিত। গাছের নূতন ফল, তরী-তরকারী জন্মিলে গৃহস্বামী প্রথমে অশ্বিনীবাবুর চরণে নিবেদন করিত-ইহা কেবল কাহিনীমাত্র নহে, বর্তমান লেখক ইহা প্রত্যক্ষ দর্শন করিয়াছে। সত্তর বৎসর পরেও তাঁহার সৌম্যমূর্তি আজও লেখকের সম্মুখে দেদীপ্যমান রহিয়াছে।

স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ হইবার সঙ্গে সঙ্গেই অশ্বিনীবাবু ইহা তাহার জীবনের ব্রত বলিয়া গ্রহণ করেন। তাঁহার অদ্ভুত জনপ্রিয়তার ফলে এই আন্দোলন বরিশাল জিলায় যেরূপ সফলতা অর্জন করিয়াছিল, মফঃস্বলের আর কোথাও সেরূপ হয় নাই। সুতরাং, ফুলার সাহেবের কুদৃষ্টি বরিশাল ও তাহার নেতা অশ্বিনীবাবুর উপর পড়িল। ইহার অর্ধশতাব্দী পরে বর্তমান লেখক দিল্লীর মহাফেজখানায় (National Archives) অশ্বিনীবাবুর ব্যক্তিত্ব ও স্বদেশী আন্দোলনের নেতৃত্বসম্বন্ধে যেসব গোপনীয় সরকারী রিপোর্ট দেখিবার সুযোগ পাইয়াছিল তাহা হইতে ফুলার সাহেবের বরিশাল ও অশ্বিনীবাবুর সম্বন্ধে মনোভাব ও আচরণের প্রকৃত ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। অতঃপর ইহাই বিবৃত করিতেছি।

স্বদেশী আন্দোলনের প্রারম্ভেই অশ্বিনীবাবু ইহাকে জাতীয় আন্দোলনে পরিণত করিতে চেষ্টা করেন। তাঁহার চেষ্টা ও অধ্যবসায়ের ফলে সমগ্র বরিশাল জিলায় স্বদেশী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করিল। কলিকাতার ‘Statesman’ পত্রিকায় রিপোর্ট বাহির হইল–”সারা অক্টোবর মাসে (১৯০৫), বিশেষতঃ পূজার সময়, সমগ্র বরিশাল জিলায় ‘বিলাতী-বর্জন’ আন্দোলন অভূতপূর্ব সাফল্য লাভ করিয়াছে, বিলাতী দ্রব্যের ক্রেতারা দুশ্চিন্তায় ও দুর্ভাবনায় দিন কাটাইতেছে। তাহাদের মনে শান্তি নাই। বরিশাল শহরে এবং জিলার সর্বত্র সভা সমিতির অধিবেশন হইতেছে এবং বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে আকাশ বাতাস পরিপূর্ণ করিতেছে। কোন কোন স্থানে শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা অসম্ভব হইয়াছে।”

কিন্তু একদিকে যেমন অশ্বিনীবাবু স্বদেশী আন্দোলনের সাফল্যের জন্য দিবারাত্রি পরিশ্রম ও পরিভ্রমণ করিতে লাগিলেন, অন্যদিকে ফুলার সাহেবও অশ্বিনীবাবুকে শায়েস্তা করিয়া স্বদেশী আন্দোলনের এই দুর্ভেদ্য দুর্গটি ধূলিসাৎ করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন।

১৯০৫ সনের ৭ই নভেম্বর অশ্বিনীবাবু ও অন্য কয়েকজন নেতার স্বাক্ষরিত একটি আবেদনপত্র সমস্ত জিলায় বিলি করা হয়। ইহাতে বর্তমানে এদেশের সুতা বিলাতে নিয়া সেখানকার কলে কাপড় প্রস্তুত করিয়া পুনরায় তাহা এদেশে পাঠানোর ফলে এই আনা-নেওয়ায় অধিক অর্থব্যয়ের জন্য কাপড়ের দাম বৃদ্ধি হয় এবং লাভের টাকা বিলাতের শ্রমিক ও কলওয়ালারাই পায়–দেশে কাপড় তৈরী হইলে কাপড়ের দাম কম পড়িবে, শ্রমিকের অর্থোপার্জন বাড়িবে এবং লাভের টাকা দেশেই থাকিবে–এই তথ্যগুলি এমন সরল ভাষায় বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা হয়, যাহাতে সর্বসাধারণ সহজেই তাহা বুঝিতে পারে। আবেদনপত্রে আরও বলা হয়, বিদেশী দ্রব্যের বদলে দেশী দ্রব্য কিনিব-এই ন্যায়সঙ্গত প্রস্তাব কার্যে পরিণত করিবার জন্য সকলেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিবে। যদিও ইহা বেআইনী নহে, তবু ইহার জন্য কাহারও প্রতি কোন জোরজুলুম করিলে আইন ভঙ্গ করা হইবে বলিয়া তাহা সর্বৰ্থা পরিহার করিবে। অনুরোধ ও উপরোধ করিয়াই সকলকে বিদেশী দ্রব্য কেনা হইতে নিবৃত্ত করিবার চেষ্টা করিবে।

তথাপি যদি কেহ বিদেশী দ্রব্য ক্রয় করে তাহাকে একঘরে করা অর্থাৎ তাহার সহিত সমস্ত সামাজিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক রহিত করায় কোন আপত্তি হইতে পারে না। এই বর্জননীতি সফল করিতে ও অন্যান্য উপায়ে আমাদের মাতৃভূমির মঙ্গলসাধনের জন্য প্রতি গ্রামে একটি জনসমিতি গঠিত করিতে হইবে।

ফুলার সাহেব এই আবেদনপত্রখানির সংবাদ পাইয়া ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিলেন। তাঁহার মতে কেবলমাত্র রাজা বা তাঁহার প্রতিনিধিরাই এরূপ ঘোষণা (Proclamation) করার অধিকারী; সুতরাং এই আবেদনপত্র ‘বিদ্রোহসূচক’ (Seditious) এবং গ্রাম্য সমিতি’ গঠনের প্রস্তাব অন্যায়, অসঙ্গত ও স্পর্ধার পরিচায়ক (Impertinent)। বরিশালের পাঁচজন বিশিষ্ট নাগরিক আবেদনপত্রের উদ্দেশ্য ও প্রকৃতি ব্যাখ্যা করিয়া বুঝাইবার জন্য ফুলারের সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনি কোন কথা শুনিতে চাহিলেন না, বরং হুকুম দিলেন, ঐ আবেদনপত্র এখনই প্রত্যাহার করিতে হইবে। বরিশালের নাগরিকগণ ফিরিয়া আসিয়া একখানি পত্রে লিখিলেন, “যেহেতু লেফটেন্যান্ট গভর্নর মনে করেন যে আবেদনপত্রখানির কোন কোন অংশে এমন কথা আছে যাহার ফলে লোকেরা উত্তেজিত হইয়া শান্তিভঙ্গ করিতে পারে, সেইজন্য আমরা আবেদনপত্রের ঐ অংশ প্রত্যাহার করিলাম।” এই চিঠি পাওয়ামাত্র জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট মি. জ্যাক একটি বিজ্ঞপ্তি দিলেন, “বাবু অশ্বিনীকুমার দত্ত এবং তাঁহার সহযোগীরা আবেদনপত্রখানি প্রত্যাহার করিয়াছেন, কারণ তাঁহারা বুঝিতে পারিয়াছেন যে আবেদনপত্রখানি বিদ্রোহাত্মক এবং ইহা শান্তিভঙ্গের উদ্রেক করিতে পারে।” অশ্বিনীবাবু তৎক্ষণাৎ জ্যাক সাহেবকে লিখিলেন, “লাটসাহেবের সম্মানরক্ষার্থে আমরা আবেদনপত্র হইতে কয়েকটি শব্দমাত্র বাদ দিয়াছি, কিন্তু তাহা প্রত্যাহার করি নাই। সুতরাং, আপনার বিজ্ঞপ্তিটি যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করিয়াছে তাহা সংশোধন করুন।” উত্তর না পাইয়া অশ্বিনীবাবু জ্যাক সাহেবের বিরুদ্ধে আদালতে মানহানির নালিশ করিলেন। জ্যাক সাহেব হারিয়া গেলেন এবং তাঁহার ১২০ টাকা জরিমানা হইল। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, কলিকাতার Statesman পত্রিকাও জ্যাক সাহেবের বিজ্ঞপ্তি ভ্রমাত্মক বলিয়া নিন্দা করিয়াছিল।

ইতিমধ্যে বরিশালের পরিস্থিতি ক্রমশঃই খারাপ হইতে লাগিল। পুলিশ রিপোর্ট করিল, হিন্দুরা মুসলমানদের বলপূর্বক বিলাতী দ্রব্য কিনিতে বাধা দিতেছে এবং সাহেবদের প্রতি অসৎ ব্যবহার করিতেছে। জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট বানরীপাড়া গ্রামে গেলে রাত্রে গোলমাল হয় এবং ম্যাজিষ্ট্রেট একটি স্কুলের তিনটি ছাত্র ও একজন শিক্ষককে স্কুল হইতে বিতাড়িত করেন। অনেকগুলি ছাত্র মিলিয়া এই দণ্ডাদেশের পুনর্বিচারের জন্য ম্যাজিষ্ট্রেটের সহিত সাক্ষাৎ করে এবং ম্যাজিষ্ট্রেট তাহাদের কথায় কর্ণপাত না করায় কেহ কেহ ম্যাজিষ্ট্রেটের দিকে মাটির ঢিল নিক্ষেপ করে। অমনি লাটসাহেব ফুলারের কাছে টেলিগ্রাম গেল এবং তিনি স্বয়ং একদল গুর্খা সৈন্য লইয়া বানরীপাড়ায় উপস্থিত হইলেন (২৫শে নভেম্বর ১৯০৫)। সঙ্গে সঙ্গে পিউনিটিভ পুলিশ নানা স্থানে প্রেরিত হইল।

বরিশালে গুর্খা ও পুলিশ উভয়ে যে অত্যাচার করিয়াছিল তাহার মর্মন্তুদ বিবরণ দিনের পর দিন সংবাদপত্রে বাহির হইত। মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করিতেছি।

(১) একটি বাড়ীর গায়ে ‘বন্দে মাতরম্’ লেখা ছিল বলিয়া বাড়ীটি ভাঙ্গিয়া ধ্বংস করা হইল।

(২) বাড়ীর রান্নাঘরে বসিয়া বন্দে মাতরম্’ উচ্চারণ করার অপরাধে একটি ১০/১১ বছরের বালককে টানিয়া কাছারিতে লইয়া ত্রিভুজাকৃতি কাঠের ফ্রেমে হাত পা বাঁধিয়া বেত্রাঘাত করা হইল।

(৩) দোকান হইতে দাম না দিয়া গুখারা ইচ্ছামত দ্রব্যাদি লইয়া যাইত।

(৪) দুইটি মিঠাইয়ের দোকানে স্বদেশী দ্রব্যের বিজ্ঞাপন ছিল। দোকানদার তাহা সরাইতে রাজি না হওয়ায় তাহাদিগকে গুরুতররূপে জখম করা হয়।

ইতিমধ্যে পূর্বোক্ত জ্যাক সাহেব বরিশালের ম্যাজিষ্ট্রেট হইয়া আসিলে গুর্খাদের অত্যাচার শতগুণ বাড়িয়া গেল; ফলে বরিশালের হিন্দুরা যে সন্ত্রাস ও বিভীষিকার মধ্যে জীবনযাপন করিত তাহা অবর্ণনীয়। গুর্খারা লোকের বাড়ীতে ঢুকিয়া যাহাকে সম্মুখে পাইত নির্বিচারে প্রহার করিত, দোকানে ঢুকিয়া দোকানীদের মারিত, সারারাত্রি টহল দিয়া ফিরিয়া অকথ্য অত্যাচার করিত। Statesman পত্রিকার রিপোর্টার এইসব বর্ণনা করিয়া লিখিয়াছেন যে, হিন্দুরা রাত্রে তো সব দরজা বন্ধ করিয়া রাখিতই, দিনেও বড় একটা বাহির হইত না।

এই সময় লণ্ডনের প্রসিদ্ধ Daily News পত্রিকার বিশেষ সংবাদদাতা হিসাবে নেভিস নামে একজন সাহেব বাংলা দেশের নানা স্থানে ভ্রমণ করিয়া যে বিবরণী পাঠাইয়াছিলেন তাহা গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হইয়াছে। অশ্বিনীবাবু ও অন্য কয়েকজন নেতাদের প্রতি পূর্বোক্ত ফুলারের আচরণ বিবৃত করিয়া তিনি। লিখিয়াছেন :

“কিন্তু বরিশালের দুর্ভোগ ইহাতেই শেষ হয় নাই। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অপরাধে বহুসংখ্যক পদস্থ ব্যক্তিকে ১৫ দিনের মধ্যে বরিশাল শহর ছাড়িয়া যাইতে আদেশ করা হইয়াছে। গুর্খা সৈন্যদল শহরের নানা স্থানে ঘাঁটি বসাইয়াছে এবং সর্বত্র লোকের বাড়ীতে ঢুকিয়া যে অত্যাচার করিতেছে ভারতের অন্য কোন প্রদেশে তাহা হইলে গুরুতর মারামারি (rioting) ঘটিত।”

এইরূপ অত্যাচার বরিশালে চরমে উঠিলেও অন্যান্য জিলাও একেবারে রেহাই পায় নাই। অন্যান্য জিলার ম্যাজিষ্ট্রেটরা প্রকাশ্যে বলিতেন যে, স্বদেশী জিনিসের বিক্রয় বন্ধ করিয়া বিলাতী জিনিস বিক্রয় আরম্ভ না করিলে তাহারাও গুর্খা সৈন্যের ঘাঁটি বসাইবেন।

একজন জিলা ম্যাজিষ্ট্রেট বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে এত উত্তেজিত হইয়াছিলেন যে বহু গণমান্য বৃদ্ধ ভদ্রলোককে অপমান করিবার জন্য বিশেষ কনষ্টেবল (Special Constable) নিযুক্ত করেন। বিলাতীদ্রব্য বর্জন প্রচারের জন্য বহুলোকের নামে আদালতে অভিযোগ করা হয়। স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দিবার অপরাধে বা অজুহাতে বহু সরকারী কর্মচারীকে বরখাস্ত করা হয়। এক বরিশাল শহরেই ৬০ জন কেরানীকে স্বদেশী আন্দোলনের সংস্পর্শে থাকার জন্য পদচ্যুত করা হইয়াছিল। নিরস্ত্র লোকের উপর পুলিশের লাঠির আঘাত তো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হইয়া দাঁড়াইয়াছিল। ব্রিটিশ-শাসনে যে অপক্ষপাত ন্যায়বিচারের খ্যাতি ছিল তাহা লোপ পাইল এবং ফুলারের শাসন মধ্যযুগের বর্বরতার পুনরাবির্ভাব বলিয়া সর্বসাধারণ মনে করিত।

পূর্ববঙ্গে ফুলারের শাসন সম্বন্ধে নেভিন্স সাহেব নিম্নলিখিত যে-চিত্রটি অঙ্কিত করিয়াছেন, নিরপেক্ষ বিবরণ হিসাবে তাহা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

“হুকুমের পর হুকুম জারি করিয়া ফুলার সাহেব প্রকাশ্য স্থানে সভা সমিতি বন্ধ করিয়াছেন, কোন ছাত্র বা অন্য কেহ রাস্তায় বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করিলেই পুলিশ তাহাকে ফৌজদারী কয়েদীর মত গ্রেপ্তার করে। শান্তিভঙ্গের কোন সম্ভাবনা

থাকিলেও সেই অজুহাতে রংপুরের যে সকল ভদ্রলোক ফুলারের অভিনন্দনে যযাগদান করেন নাই তাহাদিগকে ‘বিশেষ কনষ্টেবল’ নিযুক্ত করিয়াছেন। কোমরে কোমরবন্ধ পরিয়া হাতে ব্যাটন’ লইয়া তাঁহাদিগকে সাধারণ কনষ্টেবলদের মত ড্রিল করিতে হয় এবং শহরে সরকারের বিরুদ্ধে কে কী ষড়যন্ত্র করিতেছে রোজ তাহা রিপোর্ট করিতে হয়। আইনের কোন ধারায়ই এই অপমানজনক আচরণের সমর্থন নাই।”

লাটসাহেব সিরাজগঞ্জে গেলেও সেখানে আসামদেশীয় পুলিশ রাস্তায় যাহাকে পাইত তাহাকেই ব্যাটন দিয়া মারিত। স্থানীয় পুলিশ স্বদেশী আন্দোলনের বড় বড় নেতাদের দূর হইতে দেখাইয়া দিত এবং আসামদেশীয় পুলিশ তাহাদিগকে প্রহারে জর্জরিত করিত। একজন প্রত্যক্ষদর্শী অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান এই দৃশ্য বর্ণনা করিয়া মন্ত ব্য করিয়াছেন : “এই সব দেখিয়া মনে হইত আমরা কি ইংরেজ-রাজ্যে আছি না রাশিয়ার জারের রাজ্যে আছি?”।

নেভিন্সন্ লিখিয়াছেন, মফঃস্বলের এই সকল অত্যাচারের কাহিনী টেলিগ্রাফ অফিস গ্রহণ করিত না, বাধ্য হইয়া পত্রিকার অধ্যক্ষগণকে মফঃস্বলের সংবাদ সংগ্রহের জন্য লোক পাঠাইতে হইত। এই সংবাদ বিলাতে পৌঁছিলে সেখানকার প্রসিদ্ধ পত্রিকা Manchester Guardian মন্তব্য করে : “রাশিয়াতেও এইরূপ উৎপীড়ন (Pettifogging tyranny) আছে কিনা সন্দেহ।”

কিন্তু ফুলারের দৌরাত্ম চরমে পৌঁছিল ১৯০৬ সনে বরিশালে প্রাদেশিক সম্মেলনের বার্ষিক অধিবেশনের সময়ে। কলিকাতা ও ঢাকা হইতে প্রতিনিধিবর্গের দুইটি বৃহৎ দল ১৩ই এপ্রিল সন্ধ্যাকালে স্টীমারে বরিশালে পৌঁছিয়া শুনিলেন, বরিশালে পূর্ববঙ্গের অন্যান্য শহরের ন্যায় রাস্তায় ‘বন্দে মাতরম্‌’ ধ্বনি নিষিদ্ধ করা হইয়াছে। কিন্তু নেতৃবর্গ স্থির করিলেন, তাঁহারা এই বেআইনী নিষেধাজ্ঞা মানিবেন না। পরদিন দুপুরবেলা দেড়টার সময় নেতৃবর্গ শোভাযাত্রা করিয়া সভাস্থলের দিকে যাত্রা করিলেন। সভাপতি এ. রসুল ও তাঁহার বিলাতী মেম গাড়ীতে এবং সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, মতিলাল ঘোষ এবং ভূপেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ নেতৃবৃন্দ পদব্রজে চলিলেন। তাঁহাদের কেহ বাধা দিল না, কিন্তু তাঁহাদের পশ্চাতে ‘বন্দে মাতরম্‌ ব্যাজ ধারণ করিয়া যুবকের দল যেই রাস্তায় আসিল অমনি ছয় ফুট লম্বা মোটা লাঠি দিয়া পুলিশ তাহাদিগকে গুরুতর প্রহার করিতে লাগিল এবং বন্দে মাতরম্ ব্যাজ জোর করিয়া ছিনাইয়া লইল। মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতার পুত্র চিত্তরঞ্জনকে মারিতে মারিতে পার্শ্বের পুকুরে ফেলিয়া দিল, কিন্তু এই অবস্থাতেও সে বন্দে মাতম’ ধ্বনি করিতে বিরত হইল না। কয়েকজন পুকুরে নামিয়া কোনমতে গুরুতররূপে আহত চিত্তরঞ্জনকে পারে তুলিল। সুরেন্দ্রনাথ প্রমুখ কয়েকজন এই সংবাদ শুনিয়া ফিরিয়া আসিলেন। পুলিশ সুপারিন্টেন্টে কেম্প সাহেবকে দেখিয়া তিনি তাঁহাকে বলিলেন, তোমরা আমাদের লোককে মারিতেছ কেন? যদি কোন দোষ হইয়া থাকে, আমি ইহাদের নেতা–সুতরাং সব অপরাধই আমার, তুমি আমাকে গ্রেপ্তার করিতে পার’। পুলিশ সাহেব অমনি সুরেন্দ্রনাথকে কয়েদ করিলেন। মতিলাল ঘোষ বলিলেন, “আমাকেও গ্রেপ্তার কর’। সাহেব বলিলেন, ‘কেবল সুরেন্দ্রনাথকে আটক করারই হুকুম আছে আর কাহাকেও গ্রেপ্তার করিব না। সুরেন্দ্রনাথ তখন পার্শ্ববর্তী ভূপেন্দ্রনাথ বসুকে বলিলেন, আপনারা যাইয়া যথারীতি কনফারেন্সের কার্য আরম্ভ করুন। চতুর্দিকের গোলমালের মধ্যেও সুরেন্দ্রনাথের আদেশ পালিত হইল–সভার কার্য আরম্ভ হইল ও যথারীতি চলিতে লাগিল।

পুলিশ এদিকে সুরেন্দ্রনাথকে ম্যাজিষ্ট্রেট ইমার্সন (Emerson) সাহেবের বাড়ীতে লইয়া গেল। তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে দুইজন নেতাও ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া দুই চেয়ারে বসিলেন, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ যেই চেয়ারে বসিতে গেলেন অমনি ম্যাজিষ্ট্রেট বলিলেন, তুমি কয়েদী, তোমাকে দাঁড়াইয়া থাকিতে হইবে। তারপর সরাসরি বিচার করিয়া বিনা লাইসেন্সে শোভাযাত্রা এবং নিষিদ্ধ বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করার অপরাধে সুরেন্দ্রনাথকে দুইশত টাকা জরিমানা করিলেন। বরিশাল কোর্টের সুপ্রসিদ্ধ উকিল দীনবন্ধু সেন ঐ টাকা দিয়া তৎক্ষণাৎ সুরেন্দ্রনাথকে মুক্ত করিয়া সভাগৃহে যাত্রা করিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ কনফারেন্সে প্রবেশমাত্র সকলে দাঁড়াইয়া উঠিয়া তুমুল রবে বন্দে মাতরম’ ধ্বনি করিতে লাগিল। হর্ষধ্বনি থামিলে মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা গুরুতররূপে আহত ও মাথায় ব্যাণ্ডেজ-বাঁধা পুত্র চিত্তরঞ্জনকে লইয়া সভামঞ্চে উঠিয়া পুলিশের নিষ্ঠুর প্রহার-কাহিনী বর্ণনা করিতে লাগিলেন। পুলিশের লাঠির প্রতিটি আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে কিরূপে চিত্তরঞ্জন বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করিতেছিল এবং পুকুরের জলের মধ্যেও এই পৈশাচিক প্রহার ও বীরত্বব্যঞ্জক বন্দে মাতরম’ ধ্বনিতে যে অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা বর্ণনা করা অসম্ভব। এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, এই হৃদয়বিদারক দৃশ্যের একখানি চিত্র কিছুকাল পরেই কলিকাতা প্রদর্শনীতে রাখা হইয়াছিল এবং বড়লাট লর্ড মিন্টো ইহার উদ্বোধন করিয়াছিলেন।

সন্ধ্যাকালে কনফারেন্স শেষ হইলে প্রতিনিধির দল উচ্চৈঃস্বরে বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করিতে করিতে রাস্তা দিয়া অগ্রসর হইল, পুলিশ কিছুই করিল না। কিন্তু পরদিন সভা আরম্ভ হইবার পরে পুলিশ সাহেব সভামধ্যে প্রবেশ করিয়া সভাপতিকে বলিলেন, সভাভঙ্গের পর কেহ ফিরিবার পথে ‘বন্দে মাতরম’ ধ্বনি করিবে না, এইরূপ অঙ্গীকার যদি তিনি না করেন তবে তিনি এই সভা বন্ধ করিয়া দিবেন। সভাপতি নেতৃবৃন্দের সহিত পরামর্শ করিয়া এইরূপ অঙ্গীকারদানে অসম্মত হইলে পুলিশ সাহেব ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেবের আদেশপত্র পাঠ করিয়া ফৌজদারি দণ্ডবিধি আইনের ১৪৪ ধারা অনুযায়ী এই কনফারেন্সের অধিবেশন বন্ধ করা হইল’ বলিয়া আদেশ দিলেন। সভায় ক্রোধের প্রবাহ বহিতে লাগিল এবং প্রতিনিধিরা অনেকেই এই নিষেধাজ্ঞা পালন করার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করিলেন। কিন্তু প্রধান নেতৃবৃন্দ খোলাখুলিভাবে সরকারী হুকুম অমান্য করার বিরুদ্ধে অনেক যুক্তি দেখাইয়া সকলকেই ইহা মানিতে রাজী করাইলেন। সকলে সভাত্যাগ করিয়া বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি করিতে করিতে রাস্তা দিয়া মূর্তিমান বিদ্রোহের ন্যায় চলিতে লাগিলেন। কেবলমাত্র কৃষ্ণকুমার মিত্র বহুক্ষণ বসিয়া রহিলেন, অবশেষে অনেকের অনুরোধে তিনিও সভা ত্যাগ করিলেন।

সুরেন্দ্রনাথ তাঁহার আত্মজীবনীতে বরিশালে এই সরকারী জুলুমের তীব্র নিন্দা করিয়াছেন। তিনি লিখিয়াছেন, শোভাযাত্রা করাটাকে কোনমতেই আইনবিরুদ্ধ বলা যায় না-হইলেও তাহারা ইহা বন্ধ করিবার আদেশ দিতে পারিত, কিন্তু নির্বিচারে প্রহার করিবার কোন অধিকারই গভর্নমেন্টের ছিল না, বিশেষতঃ, যখন প্রহার আরম্ভ হইবার পূর্বে বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি উচ্চারিত হয় নাই। ইহা নিছক সরকারী সন্ত্রাসবাদের পরিচয়, লোকের মনে ভীতিসঞ্চার করিয়া তাহাদিগকে স্বদেশী আন্দোলন হইতে নিবৃত্ত করিবার জন্য পূর্বকল্পিত অমোঘ অস্ত্ররূপে ব্যবহৃত হইয়াছিল।

কিন্তু, এ অস্ত্র কতদূর সফল হইয়াছিল অতিশীঘ্রই তাহার প্রমাণ পাওয়া গেল। বরিশাল হইতে ফিরিবার পথে প্রতি স্টেশনে স্টীমার থামিবামাত্র বিরাট জনতা সুরেন্দ্রনাথকে যে সংবর্ধনা জানাইল তাহা রাজা বা সম্রাটেরও হিংসার উদ্রেক করিতে পারে। সকলেই তাঁহার পদধূলি মাথার দিবায় জন্য ব্যগ্র হইয়া ছুটিয়া আসিয়া এক অভাবনীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করিল। ১৮ই এপ্রিল প্রত্যূষে কলিকাতায় পৌঁছিলে প্রায় দশ হাজার লোক শিয়ালদহ স্টেশনে তাঁহাকে সংবর্ধনা জানাইল এবং গাড়ীর ঘোড়া খুলিয়া নিজেরা গাড়ী টানিয়া গোলদীঘি পৌঁছিল। সেখানে সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতা শুনিতে অতি প্রত্যুষ হইলেও সহস্র সহস্র লোক সমবেত হইল।

তাহার পর প্রত্যহই নানা স্থানে জনাকীর্ণ সভায় বরিশালের কাহিনী আলোচিত হইতে লাগিল। যে শ্রেণীর লোক সাধারণতঃ কোন রাজনীতিক বিষয়ে যোগদান করেন না, এমনকি যেসব গ্রন্থকীট অথবা ধর্মপিপাসু ব্যক্তি নিরালায় ঘরে বসিয়া থাকিতেই অভ্যস্ত তাঁহারাও স্বদেশী আন্দোলন ও বঙ্গবিভাগ ব্যাপারে উৎসাহী হইয়া উঠিলেন এবং শোভাযাত্রা, জনসভা প্রভৃতিতে যোগ দিতে লাগিলেন। বাগবাজারে রায় পশুপতিনাথ বসুর বাড়ীর অঙ্গনে মুক্তাকাশের নীচে যে মহতী জনসভার অনুষ্ঠান হয়, পূর্বোক্ত ১৬ই অক্টোবরের টাউন হল সভা ছাড়া সেরূপ সভা আর ইহার পূর্বে কখনও অনুষ্ঠিত হয় নাই।

এই সভায় সভাপতি নরেন্দ্রনাথ সেন বলিলেন, বরিশালে যাহা ঘটিয়াছে ভারতে ইংরেজশাসনে সেরূপ আর কখনও ঘটে নাই। জনগণের অসন্তোষ প্রধানতঃ সংবাদপত্র ও প্রকাশ্য সভার মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে এবং তাহার স্বাভাবিক পরিণতি ইহাই। জোর করিয়া বন্ধ করিলে তাহা বিদ্রোহ ও অরাজকতার সৃষ্টি করে। সভাপতির এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছিল।

বরিশালে ফুলার সাহেবের অত্যাচারের প্রতিক্রিয়া কেবল বঙ্গদেশেই সীমাবদ্ধ রহিল না। প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষের শিক্ষিত সম্প্রদায় এই ব্যাপারে বিচলিত এবং ক্রোধে উত্তেজিত হইয়া উঠিল। লাহোর, মাদ্রাজ, পুণা প্রভৃতি দূরদূরান্তর হইতে বিক্ষোভ প্রকাশ ও সহানুভূতিসূচক তারবার্তা আসিতে লাগিল। মাদ্রাজে একটি জনসভায় প্রায় দশ হাজার লোক সভার নির্দিষ্ট সময়ের বহু পূর্ব হইতে ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনিতে আকাশ পরিপূর্ণ করিতে করিতে সভায় উপস্থিত হইল। বরিশালের কর্তৃপক্ষ, বৃটিশের রাজনীতি ও গণতন্ত্রমূলক শাসনবিধি অগ্রাহ্য করিয়া ও প্রজাদের ন্যায্য অধিকার লঙ্ঘন করিয়া যে অত্যাচারের পদ্ধতি গ্রহণ করিয়াছে তাহার তীব্র নিন্দাসূচক প্রস্তাব গ্রহণ করিল। যে দুষ্কৃতকারী কর্মচারীদের আচরণে ভারতের প্রজাগণ বৃটিশশাসনের উদার নীতির প্রতি আস্থা হারাইতে বসিয়াছে তাহাদের যথোচিত শাস্তিবিধানের প্রার্থনা করিয়া লণ্ডনে ভারত-সচিবের নিকট তারযোগে আবেদন করা হইল।

রাজনীতিক্ষেত্রে অনেক সময় কুশাসনও সুফল প্রসব করে। কারণ অত্যাচারের ফলে ঘুমন্ত জাতির নিদ্রাভঙ্গ হয় এবং জাতীয় জীবনে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগায়। বরিশাল কনফারেন্সে ফুলারের অত্যাচার এবং স্বদেশী আন্দোলন কেবল যে বাঙ্গালীর সুপ্ত জাতীয়তাবোধ জাগরণে সাহায্য করিয়াছিল তাহা নহে, সমগ্র ভারতে এই আন্দোলন একটি জাতীয় ঐক্যের সূত্ৰবন্ধনে সহায়ক হইল। তিলক, অরবিন্দ, লাজপৎ রায় প্রভৃতি যে কংগ্রেসের চিরাচরিত আবেদন-নিবেদনের পরিবর্তে বৃটিশের সহিত নিরস্ত্র সংগ্রামের কল্পনা করিতেছিলেন, নিখিল ভারতে স্বদেশী আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি এবং বৃটিশশাসনের অত্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ তাহার একটি প্রত্যক্ষ নিদর্শন হইয়া দাঁড়াইল। ইহাকে উপলক্ষ করিয়া বঙ্গদেশে যে সংগ্রামী মনোভাবের সৃষ্টি হইয়াছিল তাহা সমগ্র ভারতে ছড়াইয়া পড়িল, কংগ্রেসের প্রচলিত আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির পরিবর্তে এক নূতন সংগ্রামমূলক প্রবৃত্তি জাগিয়া উঠিল এবং তাহাকে কেন্দ্র করিয়া কংগ্রেস-নেতাদের মধ্যে দুই দলের সৃষ্টি হইল–পুরাতন নরমপন্থী, আর নবীন চরমপন্থী। এই নিরস্ত্র সংগ্রামের আদর্শ পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর প্রবর্তিত ১৯২১ সনের অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের পূর্বাভাস বলা যাইতে পারে। কিন্তু এই নিরস্ত্র সংগ্রাম ক্রমে ক্রমে সহিংস বিপ্লবের পথ প্রশস্ত করিয়া দিল। বাংলায় যে গুপ্ত বিপ্লবী সমিতি স্থাপনের চেষ্টা এতদিন সফল হয় নাই, এইবার তাহা দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হইল এবং ক্রমে ইহা ভারতের সর্বত্র বিস্তৃত হইয়া কিরূপে আমাদের স্বাধীনতালাভের পথ প্রশস্ত করিয়াছিল তাহা পরে বিবৃত হইবে। সুতরাং বঙ্গভঙ্গরূপ একটি প্রদেশিক শাসন-সমস্যা হইতে যাহার উদ্ভব, সেই স্বদেশী আন্দোলন ও বিলাতীবৰ্জন ক্রমে ক্রমে ভারতের বিপ্লবাত্মক মুক্তিসংগ্রামে পরিণত হইল।

বরিশালে ফুলার সাহেবের অপকীর্তির আর একটি অবধারিত ফল সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর অপূর্ব জনপ্রিয়তা। বরিশালের ম্যাজিষ্ট্রেট ইমার্সন সাহেব তাঁহার মাথায় যে কণ্টকের মুকুট পরাইয়াছিলেন তাহার ফলে সুরেন্দ্রনাথ বাংলার মুকুটবিহীন সম্রাট বলিয়া সমগ্র ভারতে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছিলেন। বস্তুতঃ, বরিশালে দণ্ডভোগের ফলে তিনি যে অদ্বিতীয় ও অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতার পদে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন, ভারতে তাহার পূর্বে আর কেহ সেরূপ হন নাই এবং ইহাই ইংরেজ সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রহিত করিতে বাধ্য করিয়াছিল। অদৃষ্টের এমনই পরিহাস যে, যে ইমার্সন সাহেব সুরেন্দ্রনাথকে তাঁহার ঘরে বসিতে বাধা দিয়াছিলেন, পনেরো বছর পরে সেই সাহেবই বাংলা দেশের মন্ত্রী সুরেন্দ্রনাথের সেক্রেটারি হিসাবে তাঁহার ঘরে গিয়া দাঁড়াইয়া থাকিতেন।

স্বীয় শাসনের কুকীর্তির তীব্র সমালোচনা ও নিন্দা প্রতিদিনই সংবাদপত্রে ও সভাসমিতির মারফৎ প্রচারিত হওয়ায় ফুলার সাহেব প্রায় ক্ষেপিয়া উঠিলেন। চরমপন্থী জাতীয়তাবাদীর মুখপত্র ‘বন্দে মাতরম্’ পত্রিকায় জ্বালাময়ী ও অনন্যসাধারণ ভাষায় তাঁহার বিরুদ্ধে যে-সকল লেখা প্রকাশিত হইত তাহার জন্য সম্পাদক হিসাবে অরবিন্দ ঘোষ বিদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হইলেন (১৯০৭, অগষ্ট)। অরবিন্দ যে এই দৈনিক পত্রিকার সম্পাদক তাহা প্রমাণ করিবার জন্য গভর্নমেন্ট বিপিনচন্দ্র পালকে সাক্ষী মানিলেন; বিপিনচন্দ্র সাক্ষ্য দিতে অস্বীকার করায় তাঁহাকে ছয়মাসের জন্য বিনাশ্রম কারাদণ্ড ভোগ করিতে হইল; কিন্তু অরবিন্দ মুক্তি পাইলেন।

সাধারণের সহজবোধ্য অপূর্ব ভাষায় দৈনিক ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় ইহার সম্পাদক ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায় যেসব তীব্র মন্তব্য করিতেন তাহার জন্য তিনিও ‘বিদ্রোহের অপরাধে অভিযুক্ত হইলেন। পরবর্তীকালের গান্ধিযুগের ন্যায় তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করিলেন না-বলিলেন, “দেশের শত্রু ইংরেজের কাছে দেশের জন্য আমি যা করেছি তার জন্য জবাবদিহি করব না। আর ইংরেজের সাধ্য নাই আমাকে কারাদণ্ড দেয়। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁহার এই দম্ভ বজায় রহিল-মামলা শেষ হইবার পূর্বেই ব্রহ্মবান্ধবের মৃত্যু হইল।

বিপ্লবীদের অপর মুখপত্র যুগান্তর পত্রিকার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইহার সম্পাদক ও মুদ্রাকর একাধিকবার কারাদণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন।

৬. মুসলমানদের বিরোধিতা

এই সকল উৎপীড়ন কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনকে দমিত করিতে পারিল না। বঙ্গভঙ্গের প্রথম বার্ষিকী উপলক্ষে বিপুল উৎসাহে নানা স্থানে সভা সমিতির অধিবেশন হইল (১৬ই অক্টোবর ১৯০৬)। ঢাকা নগরীতে ছয়টি শোভাযাত্রা বাহির হইয়াছিল, হিন্দু ও মুসলমানদের দোকান বন্ধ ছিল। নবাব পরিবারস্থ একজন জনসভায় সভাপতিত্ব করিয়াছিলেন। মৈমনসিংহ, চট্টগ্রাম, নোয়াখালি, পাবনা, ফরিদপুর প্রভৃতি অনেক শহরেও অনুরূপ অনুষ্ঠান হইয়াছিল এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই ইহাতে যোগ দিয়াছিল। সকল স্থানেই শোভাযাত্রা, সংকীর্তন, রাখিবন্ধন ও স্বদেশী দ্রব্য ব্যবহারের শপথ গ্রহণ, বাজী পোড়ান ও বন্দে মাতরম্’ ধ্বনির মধ্যে এই বার্ষিক অনুষ্ঠান পালিত হইত।

তিলক, খাপার্দে, লাজপৎ রায় এবং অন্যান্য সর্বভারতীয় সুপ্রসিদ্ধ নেতৃবৃন্দ বাংলায় আসিয়া এবং বিপিনচন্দ্র পাল প্রভৃতি পূর্ববঙ্গের নানাস্থানে ঘুরিয়া বক্তৃতা প্রদান করিতেন। ইহা ছাড়া, বন্দে মাতরম্’, সন্ধ্যা’, ‘যুগান্তর প্রভৃতি সংবাদপত্রে উদ্দীপনাময় রচনা, স্বদেশী কবিতা, সঙ্গীত, যাত্রাগান প্রভৃতি স্বদেশী আন্দোলনের সংকীর্ণ আদর্শ ছাড়াইয়া ভারতের মুক্তিসংগ্রামের দিকে লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করিল। ম্যাজিষ্ট্রেটদেরও কেহ কেহ তাঁহাদের রিপোর্টে ইহা স্বীকার করিয়াছেন। বিপিনচন্দ্র পাল তাঁহার পত্রিকায় লিখিলেন, ভারত-সরকার যদি রাশিয়ার জারের পন্থা অবলম্বন করেন তবে ভারতীয়েরা রাশিয়ার অনুকরণ করিবে।

প্রথম কয়েক বৎসর মুসলমানসম্প্রদায়ও হিন্দুদের সঙ্গে যোগ দিত। বঙ্গভঙ্গের সমর্থনে যাহাতে মুসলমানেরা সভা-সমিতির অধিবেশন করে, গভর্নমেন্ট তাহার যে চেষ্টা করিয়াছিলেন তাহাতে বিশেষ কোন ফল হয় নাই। কিন্তু ক্রমে ক্রমে এই আন্দোলনের প্রতি মুসলমানদের উৎসাহ ও সমর্থন হ্রাস পাইল। তবে একদল মুসলমান গোড়া হইতেই গভর্নমেন্টকে সমর্থন করিতেন। ঢাকার নবাবকে খুব অল্প সুদে চৌদ্দ লক্ষ টাকা ধার দিয়া লর্ড কার্জন তাঁহাকে বশীভূত করিলেন এবং তাঁহার নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলনের বিরোধী এবং বঙ্গভঙ্গের সমর্থক মুসলমানের সংখ্যা ক্রমশঃই বাড়িতে লাগিল। এই সময়ে হিন্দু ও কংগ্রেস-বিদ্বেষী আলিগড়ের সুপ্রসিদ্ধ নেতা সৈয়দ আহমদ মুসলমান সম্প্রদায়কে হিন্দুর বিরোধী এবং ভিন্নজাতিরূপে পরিচিত করিয়া সরকারী সাহায্যে স্বীয় সম্প্রদায়ের উন্নতির জন্য নানাভাবে সচেষ্ট ছিলেন এবং ইহাই ছিল তাঁহার শেষজীবনের ব্রত। এই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকা নগরীতে মুসলমান নেতৃবৃন্দের এক সভা আহ্বান করেন। ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ্ ইহার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন এবং এই সভার মাধ্যমেই ‘মুসলিম লীগ নামে কংগ্রেসের ন্যায়–কিন্তু, কেবল মুসলমান সদস্য লইয়া–একটি রাজনীতিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা শহরে ১৯০৬ খ্রীষ্টাব্দের ৩১শে ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠিত হইল। এইভাবেই হিন্দু ও মুসলমান, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ ও হিংসার বীজ রোপিত হইল কালক্রমে তাহাই ৪০ বৎসর পরে মহামহীরূহে পরিণত হইয়া পাকিস্তান সৃষ্টি করিল।

এই বিরোধাত্মক মনোবৃত্তি গভর্নমেন্টের স্বার্থসিদ্ধির অনুকূল হওয়ায় অচিরাৎ ইহার ফলে সাম্প্রদায়িক কলহ ও মারামারি আরম্ভ হইল এবং সরকারের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদন ও সহানুভূতি লাভ করিল। হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ তীব্র হইয়া উঠিল, নানাস্থানে মুসলমানেরা হিন্দুদের উপর অকথ্য অত্যাচার আরম্ভ করিল। জামালপুরে ও কুমিল্লায় যেভাবে হিন্দুর ধন-সম্পত্তি লুণ্ঠিত ও হিন্দু নরনারীর প্রতি অত্যাচার অবাধে কয়েকদিন যাবৎ চলিয়াছিল তাহা যে-কোন গভর্নমেন্টের পক্ষে চরম কলঙ্কের কাহিনী। ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহ কুমিল্লায় গেলেন। ইহার ফলে মুসলমানেরা চারিদিন যাবৎ হিন্দু-সম্প্রদায়ের দোকান লুঠ, বাড়ীঘর পোড়াইয়া দেওয়া, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রহার ও নানাবিধ অত্যাচার চালাইতে লাগিল, পুলিশ কিছুমাত্র বাধা দিল না। জামালপুরে এবং পার্শ্ববর্তী অনেক গ্রামেও এইরূপ বীভৎস অত্যাচার অনুষ্ঠিত হইল। হিন্দু যুবকেরা প্রাণ তুচ্ছ করিয়া হিন্দুদিগকে রক্ষার জন্য অগ্রসর হইল, কিন্তু গভর্নমেন্ট বিন্দুমাত্র বিচলিত হইল না। হিন্দুর বিরুদ্ধে মুসলমানদের উত্তেজিত করিবার জন্য মূদ্রিত ইস্তাহার বিলি করা হইল। ইহাতেই প্রকাশ্যে প্রচার করা হইল যে হিন্দুদের মারিলে সরকার কোনরূপ শাস্তি দিবেন না ঢাকার নবাবেরও এই হুকুম। ইহা কেবল অলীক গুজব নহে, গোপনীয় পুলিশ রিপোর্টে ইহার সমর্থন পাওয়া যায়।

গভর্নমেন্ট যে এই অত্যাচার বন্ধ করার কোন চেষ্টা করেন নাই এবং প্রত্যক্ষভাবে ইহার অনুপ্রেরণা না দিলেও, পরোক্ষে ইহার সমর্থন করিয়াছিলেন– এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। গোপনীয় পুলিশ রিপোর্ট এবং আদালতের সাক্ষীদিগের উক্তি হইতে ইহার যথেষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। কোন সভ্যদেশের গভর্নমেন্ট যে এইভাবে এক সম্প্রদায়ের প্রজাকে অন্য সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিতে পারেন, ইহা কল্পনা করা কঠিন হইলেও এ-বিষয়ে চূড়ান্ত প্রমাণ সংগৃহীত হইয়াছে। ইহার সমর্থনে পূর্বোক্ত H. W. Nevenson সাহেবের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি : “আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এই যে, যেখানেই হিন্দু মুসলমানের বিরোধ ঘটে সেখানেই সরকারী কর্মচারীরা মুসলমানদের পক্ষ অবলম্বন করে। যে-কোন উপায়ে হউক বঙ্গভঙ্গ ব্যাপারে মুসলমানদের সমর্থন লাভ করিবার জন্য পূর্ববঙ্গে এই মনোবৃত্তি আরও বৃদ্ধি পাইয়াছে। কেবল হিন্দুর বিরুদ্ধেই ছোটখাট অভিযোগ আনিয়া তাহাদিগকে অপদস্থ করিবার জন্য সরকারী কর্মচারীরা উদগ্রীব হইয়া আছেন। কেবল হিন্দুরাই সরকারী চাকুরী হইতে বঞ্চিত, কেবল হিন্দুদের স্কুলে সরকারী সাহায্য বন্ধ করা হইয়াছে। যখন মুসলমানেরা হিন্দুদের মারপিট করে তখন পিটুনি পুলিশ (Punitive Police) হিন্দুদের বাড়ীতে ঢুকিয়া জিনিসপত্র তছনছ করে এবং কেবল হিন্দুদের পাড়ায়ই গুর্খা সৈন্যদল বসান হয়। কোন স্থানে নদীর তীরে হিন্দুদের বসিবার অধিকার ছিল না।

“মুসলমান মোল্লারা সর্বত্র বলিয়া বেড়ায় যে গভর্নমেন্ট মুসলমানদের পক্ষে, আদালত তিন মাসের জন্য বন্ধ করা হইয়াছে, হিন্দুকে মারিলে বা হিন্দুর দোকান লুট করিলে অথবা হিন্দু বিধবাকে জোর করিয়া অপহরণ করিলে কেহ কোনরূপ শাস্তি পাইবে না। সরকারী চাকুরীর অধিকাংশই মুসলমানদের দেওয়া হয়। কোন পদের জন্য উপযুক্ত মুসলমান প্রার্থী না পাওয়া গেলে ঐ পদগুলিতে কাহাকেও নিযুক্ত করা হয় না। ছোটলাট ফুলার সাহেব রহস্যচ্ছলে বলিয়াছিলেন, মুসলমান প্রজারা তাঁহার সুয়োরাণী, আর হিন্দু প্রজারা দুয়োরাণী। মুসলমানেরা এই নীতি সত্য বলিয়া গ্রহণ করিয়াছে এবং মনে করে, যে-কোন হিন্দুর প্রতি অত্যাচার করিলে তাহার জন্য শাস্তি হইবে না।”

বিলাতে পার্লিয়ামেন্টের সভ্য ওডোনেল সাহেব (C.J. O’Donnell) একখানি গ্রন্থে অনুরূপ বর্ণনা করিয়াছেন। তিনি আরও লিখিয়াছেন, আদালতে অনেক উচ্চপদস্থ ইংরেজ বিচারক মকদ্দমার সাক্ষ্য গ্রহণ করার সময় মুসলমান সাক্ষীদের উক্তি সত্য বলিয়া গ্রহণ করেন এবং হিন্দুদের সাক্ষ্য মিথ্যা বলিয়া অগ্রাহ্য করেন। হইকোর্ট এইরূপ কার্যের তীব্র নিন্দা করিয়াছেন। হিন্দুদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের উত্তেজিত করিবার জন্য যেসব ‘ইস্তাহার’ বিলি করা হয় তাহার মধ্যে ইব্রাহিম খানের ‘লাল ইস্তাহার’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। হিন্দুদের ‘স্বদেশী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া বা প্রতিবাদ ও মুসলমানদের মধ্যে স্বজাতি আন্দোলন প্রচারের ভূমিকাস্বরূপ এই ইস্তাহার পূর্ববঙ্গের বহু স্থানে বহুদিন ধরিয়া নির্বিবাদে বিলি করা হইত। মুসলমানদের উদ্দেশ্যে লেখক যাহা বলেন তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি :

“হে মুসলমানগণ! জাগরিত হও। তহবিল সংগ্রহ কর। জাতীয় বিদ্যালয় স্থাপন কর, পাৰ্যমানে হিন্দুর সঙ্গে পাঠ করিও না, জাতীয় কারবার খোল, হিন্দুর দোকান হইতে কোন বস্তু ক্রয় করিও না। শিল্প শিক্ষা কর, হিন্দুর শিল্পজাত দ্রব্য স্পর্শ করিও না। হিন্দুকে চাকুরী দিও না, হিন্দুর বাড়ীতে নিকৃষ্ট চাকুরী করিও না। হিন্দুর কুসংস্কারে আবদ্ধ হইয়া জাতিগত ব্যবসা (গোয়ালা প্রভৃতি ব্যবসা) ছাড়িও না। তোমাদের জ্ঞান নাই, যদি জ্ঞানলাভ করিতে পার, তবে একদিনেই হিন্দুকে জাহান্নামে পাঠাইতে পারি। দেখ, বঙ্গদেশে তোমাদের সংখ্যা অধিক, তোমরা কৃষক, কৃষিকাজই ধন উৎপত্তির বীজ। হিন্দু ধন কোথায় পাইল, হিন্দুর ধন বিন্দুমাত্রও নাই। হিন্দু কৌশলে তোমাদের ধন নিয়া ধনী হইয়াছে। তোমরা যদি সেই কৌশল শিক্ষা করিতে পার ও জ্ঞানলাভ করিতে পার তবে একদিনেই হিন্দু অন্নাভাবে মরিয়া যাইবে বা মুসলমান হইবে।

“মুসলমান মাত্রেই হিন্দুর বিকৃত স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করিবেন না। হিন্দুরা মুসলমানদিগকে স্বদেশী আন্দোলনে যোগদান করার জন্য সাদরে আহ্বান করিতেছে ও অত্যাচার করিতেছে, তাহা মুসলমানদের মঙ্গলের জন্য নহে। মুসলমানগণ চিরকাল তাহাদের পদানত থাকে, ইহাই তাহাদের মূল উদ্দেশ্য। …’হিন্দুর স্বার্থপরতা, মুসলমানদের অজ্ঞানতা’ সর্বনাশের মূল–এই দুই শত্রুই মুসলমানকে অবনত করিয়াছে।”

এই লাল ইস্তাহার ঢাকায় মুসলমানগণের পূর্বোক্ত সম্মেলনের (১৯০৬, ডিসেম্বর) অব্যবহিত পরেই অর্থাৎ ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দের প্রারম্ভেই বিলি করা আরম্ভ হয়। পুলিশের অনুসন্ধানে জানা গেল, মৈমনসিংহ শহরের অধিবাসী ইব্রাহিম খাঁ ইহা বহুসংখ্যায় পূর্ববঙ্গের নানা স্থানে বিলি করিতেছে। কিন্তু ছয়মাসের মধ্যে গভর্নমেন্ট এ-বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করিলেন না। ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘Bengalee’ এ-বিষয়ে গভর্নমেন্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করিলে মৈমনসিংহের ম্যাজিষ্ট্রেট ইব্রাহিম খাঁকে ডাকিয়া পাঠান এবং তাহার বিরুদ্ধে কেন ১০৮ ধারা অনুসারে মামলা করা হইবে না তাহার কারণ দর্শাইতে আদেশ দেন। কিভাবে এই ইস্তাহার বিলি হইত তাহার বিবরণ শুনিয়া এবং ভবিষ্যতে আর সে ইহা বিলি করিবে না, এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় ম্যাজিষ্ট্রেট তাহাকে মুক্তি দেন। তিনি এই আদেশপত্রে লেখেন যে, “উপরওয়ালার আদেশ অনুসারে আমি এক হাজার টাকা জামিন মুচলিকা লইয়া ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করিয়া তাহার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা তুলিয়া লইয়াছি।” এই উপরওয়ালা কে, তাহা কিছু জানা যায় নাই। যখন ইহা নিঃসন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে এইসকল উত্তেজক ইস্তাহারই হিন্দুর উপর মুসলমানদের অকথ্য অত্যাচারের প্রধান কারণ, তখন এই বহুবিলম্বিত বিচারের প্রহসন দেখিয়া কেবল ভারতীয় হিন্দুগণ নহে, অনেক উচ্চপদস্থ ইংরেজ, এমনকি, বড়লাট লর্ড মিন্টোও ম্যাজিষ্ট্রেটের কার্যের তীব্র নিন্দা করিয়াছেন এবং কেহ কেহ স্পষ্টই বলিয়াছেন, ইহা ইংরেজ গভর্নমেন্টের মুসলমানদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অকাট্য প্রমাণ বলিয়া গৃহীত হইবে।

পূর্ববঙ্গ ও আসামের ছোটলাট সাহেবের অবিমৃষ্যকারিতা, খামখেয়ালি ও মুসলমানের প্রতি পক্ষপাতিত্বই যে এইসব দাঙ্গা-হাঙ্গামার জন্য প্রধানতঃ দায়ী সে-সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। বড়লাট মিন্টো ও ভারত-সচিব উভয়েই ইহা অবগত ছিলেন, কিন্তু ব্রিটিশশাসনের সম্মান লাঘবের ভয়ে ফুলারের বিরুদ্ধে খোলাখুলিভাবে কিছু করিতে পারে নাই। কিন্তু এই সময়ে এমন একটি ঘটনা ঘটিল যাহার ফলে ফুলার নিজেই নিজের পায়ে কুড়ল মারিলেন। ঘটনাটি সংক্ষেপে বলিতেছি।

পূর্ববাংলার দুইটি স্কুলের ছাত্রদের ব্যবহারে ফুলার বিরক্ত হইয়া কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে লিখিলেন, এই দুইটি বিদ্যালয়ের নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত বিদ্যালয়ের তালিকা হইতে কাটিয়া দিতে (disaffiliate)। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য (Vice-Chancellor) স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বড়লাট লর্ড মিন্টোকে বুঝাইলেন যে এই কার্য অত্যন্ত অসঙ্গত হইবে। মিন্টো তাঁহার যুক্তির সারবত্তা বুঝিয়া ফুলারকে অনুরোধ করিলেন তিনি যেন কলিকাতা। বিশ্ববিদ্যালয়কে যে নির্দেশ দিয়াছেন তাহা প্রত্যাহার করেন। ফুলার রাজী হইলেন না বরং দাম্ভিকতার সহিত জবাব দিলেন যে, তিনি পদত্যাগ করিবেন কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট যে প্রস্তাব করিয়াছেন তাহা প্রত্যাহার করিবেন না। মিন্টো বলিলেন, “তথাস্তু, তোমার পদত্যাগের প্রস্তাব গ্রহণ করিলাম।” ফুলার অবশ্য মনে করিয়াছিলেন যে, মিন্টো কখনই তাঁহার পদত্যাগপত্র গ্রহণ করিয়া ব্রিটিশ শাসনের চিরাচরিত প্রথা লঙ্ঘন করিবেন না। মিন্টো কিন্তু ফুলারের হাত হইতে মুক্তিলাভ করিবার এই অপূর্ব সুযোগ ছাড়িলেন না। ভারত-সচিব মর্লিও তাঁহাকে সমর্থন করিলেন। ১৯০৬ সনের ৩রা অগষ্ট ফুলার পদত্যাগপত্র প্রেরণ করিলেন। এইভাবে ফুলার সাহেবের তাণ্ডবলীলার অবসান হইল। পূর্ববঙ্গ নিঃশ্বাস ছাড়িয়া বাঁচিল।

৭. বঙ্গভঙ্গের প্রকৃত উদ্দেশ্য

বিদেশী দ্রব্য বর্জন ও স্বদেশী আন্দোলন প্রসঙ্গটি বিস্তৃতভাবে আলোচনা করিয়াছি। তাহার কারণ, প্রকৃত প্রস্তাবে এই আন্দোলনই ভারতের মুক্তিসংগ্রামের অগ্রদূত এবং যে-সকল উপায়ে এবং যে ভারতীয় ঐক্য ও জাতীয়তাবোধের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রাম সফলতা অর্জন করিয়াছিল–এই আন্দোলনই তাহার বীজ রোপণ করিয়াছিল। সেই বীজ হইতেই যে অঙ্কুরের উৎপত্তি, তাহাই ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতে পাইতে স্বাধীনতার মহামহীরূপে পরিণত হইয়াছিল। এই নিগূঢ় সত্য উপলব্ধি করিয়াই একজন প্রবীণ বিদেশী ঐতিহাসিক লিখিয়াছিলেন, “বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনই ভারতের মুক্তিসংগ্রামের আরম্ভ বলা যাইতে পারে।”

অনেকে মনে করেন, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন ও স্বদেশী বয়কট আন্দোলন বাঙ্গালীর ভাবপ্রবণতার পরিচায়ক। ইহা যে কতকটা সত্য সে-বিষয়ে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহা স্মরণ রাখা উচিত, আন্দোলনমাত্রই কতক পরিমাণে ভাবপ্রবণতার উপর প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু কোন কারণে অসন্তোষ জন্মিলে অথবা গুরুতর ক্ষতির সম্ভাবনা থাকিলেই বিপ্লবী মনোবৃত্তির সৃষ্টি হয় এবং ভাবপ্রবণতা কেবল তাহার গতি ও বেগ নির্ধারিত করে। এই অসন্তোষ বা ক্ষতির সম্ভাবনাবোধের ন্যায্য ও সঙ্গত কারণ আছে কিনা, তাহাই প্রধান বিবেচ্য বিষয়। সুতরাং, বঙ্গভঙ্গ যে অসন্তোষ ও বিপ্লবের উন্মাদনা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহার পশ্চাতে কোন ন্যায়সঙ্গত কারণ বা যুক্তি ছিল না, অতঃপর তাহাই আলোচনা করিব।

প্রথমতঃ, মনে রাখিতে হইবে, বঙ্গভঙ্গের অনেক পূর্ব হইতেই সরকারের নিকট আবেদন-নিবেদনই যে আমাদের দুঃখ-দুর্দশা দূরীকরণের ও অভাবমোচনের একমাত্র উপায়-বঙ্গদেশে (তথা ভারতে) এই প্রচলিত রাজনীতির প্রতি লোকের আস্থা কমিয়া যাইতেছিল এবং আমাদিগকে যে সাহস করিয়া নিজের পায়ে দাঁড়াইতে হইবে এই বিশ্বাস ধীরে ধীরে জাগিয়া উঠিতেছিল। অন্যান্য প্রদেশ অপেক্ষা বঙ্গদেশে ইহা তীব্র আকার ধারণ করিয়াছিল। দ্বিতীয়তঃ, বাঙ্গালীরা বুঝিতে পারিয়াছিল যে, বঙ্গভঙ্গের কারণ শাসনকার্যের অসুবিধা দূর করা নহে–ইহার প্রকৃত উদ্দেশ্য রাজনীতিক ক্ষেত্রে বাঙ্গালীর অগ্রগতি ও প্রাধান্য খর্ব করিয়া ইংরেজশাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় চেতনাবোধের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা। সরকার ইহা পুনঃপুনঃ অস্বীকার করিলেও ইহাই যে প্রকৃত কারণ, গোপনীয় সরকারী দলিলপত্রের সাহায্যে এখন তাহা সম্পূর্ণরূপে প্রমাণিত করা যায়। খুব সংক্ষেপে ইহার আলোচনা করিব।

শিক্ষাদীক্ষায় অধিকতর অগ্রসর প্রায় আট কোটি বাঙ্গালীকে একত্র রাখা যে সমীচীন নহে, ১৮৯৬ সনে চট্টগ্রাম বিভাগের কমিশনার W. B. Oldham তাহা উপলব্ধি করিয়া প্রস্তাব করিয়াছিলেন যে পূর্ববঙ্গকে একটি আলাদা প্রদেশরূপে গঠন করা হউক; তাহা হইলে রাজনীতিক দিক দিয়া ভয়ের কারণ (Politically threatening) হিন্দু বাঙ্গালীরা এই নূতন প্রদেশে মুসলমানদের অপেক্ষা সংখ্যালঘু হইবে এবং তাহাদিগের শক্তি ও প্রভাব হ্রাস পাইবে। কয়েক বৎসর পরে বাংলার ছোটলাট Sir Andrew Fraser বড়লাট লর্ড কার্জনকে লিখিলেন, বাংলার রাজনীতিক মতগঠনে পূর্ববাংলার প্রভাব অত্যন্ত বেশি, এজন্যই ইহা একটি পৃথক প্রদেশ করিয়া বাঙ্গালীর প্রভাব খর্ব করা রাজনীতিক কারণে বিশেষ প্রয়োজনীয়। ১৯০৩ সনের ১০ই নভেম্বর লর্ড কার্জন এ-সম্বন্ধে তাঁহার নিজের মত লিপিবদ্ধ করেন : “এই মতটি খুবই সমীচীন। পূর্ববঙ্গ ইংরেজশাসনের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন বাঙ্গালীর প্রধান কেন্দ্র। অন্য অনেক অসুবিধাসত্ত্বেও এই একটি কারণেই পূর্ববঙ্গকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ করাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু এই যুক্তিটি খুব গোপন রাখিতে হইবে। প্রকাশ্যভাবে ইহা যেন কোন নথিপত্রে উল্লিখিত না হয়, কারণ তাহা হইলে একটি ভীষণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হইবে।”

বঙ্গব্যবচ্ছেদ প্রস্তাবটি আলোচনার সময় আর একটি প্রস্তাব হইয়াছিল যে, বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যা লইয়া একটি বিশাল প্রদেশ শাসন করা কঠিন; সুতরাং বিহারকে একটি স্বতন্ত্র প্রদেশ এবং উড়িষ্যাকে মধ্যপ্রদেশের অন্তর্ভুক্ত করা হউক। তাহার উত্তরে কার্জন লিখিলেন, “ইহাতে বাঙ্গালীর সংহতি ও প্রভাব আরও বাড়িয়া যাইবে”। ১৯০৪ সনের ১৭ই ফেব্রুআরি বড়লাট লর্ড কার্জন বিলাতে ভারতীয় বিভাগের মন্ত্রী Brodrick-কে লিখিলেন, “বাঙ্গালীরা মনে করে তাহারা একটি স্বতন্ত্র জাতি এবং তাহারা অদূর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখে যেন ইংরেজ বিতাড়িত হইয়াছে, আর একজন বাঙ্গালী বাবু কলিকাতায় বড়লাটের ভবনে বাস করিতেছে। বঙ্গভঙ্গের ফলে এই সম্ভাবনা দূর হইবে, এইজন্যই তাহারা ইহার প্রবল বিরোধিতা করিতেছে। আমরা যদি আজ দুর্বল মুহূর্তে তাহাদের চীকারে কর্ণপাত করি তবে ভবিষ্যতে আর কোনদিন বঙ্গদেশের কোন অংশ পৃথক করিতে পারিব না এবং সমগ্র বাঙ্গালী জাতির সংহত শক্তি আমাদের রাজ্যের সমূহ বিপদের কারণ হইয়া দাঁড়াইবে।”

যখন বেরার প্রদেশ বোম্বের সহিত যোগ করার প্রস্তাব হইল তখনও কার্জন অনুরূপ যুক্তি দেখাইলেন, “ইহাতে মারাঠা জাতির সংহতি ও শক্তি বৃদ্ধি হইবে–এবং ইহার ফল যে কত অনিষ্টকর হইবে তাহা ভাবিলে আমার আতঙ্ক হয়”। ফ্রেজার ইহাতে সায় দিয়া বলিলেন, “পুণার অধীনে সমগ্র মারাঠা জাতিকে সংহত করা রাজনীতিক দিক দিয়া গুরুতর ভ্রম হইবে। শিবাজীর স্মৃতিই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট বিপদ, তাহাকে পুনরুজ্জীবিত করার কোন প্রয়োজন নাই।”

অন্যান্য অনেক উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীরাও এইরূপ মত প্রকাশ করিয়াছেন। পরবর্তী বড়লাট লর্ড মিন্টো কার্জনের বঙ্গভঙ্গ অনুমোদন করেন নাই। কিন্তু তিনিও স্বীকার করিয়াছেন যে, বাঙ্গালীর রাজনীতিক প্রভাব খর্ব করাই ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য এবং ইহার সমর্থনে প্রবলতম যুক্তি।

বিদেশীবর্জন ও স্বদেশী আন্দোলনের দুইটি বিশিষ্ট অবদান জাতীয়তার জাগরণ ও বঙ্গসাহিত্যে তাহার প্রতিক্রিয়া। এই দুইটিই পরস্পর পরস্পরের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। স্বদেশী আন্দোলনে বাঙ্গালীর চিত্তে যে নূতন জাতীয় জীবনের স্পন্দন জাগাইয়াছিল তাহার অপরূপ প্রকাশ পাইয়াছিল বাংলা কবিতা, সঙ্গীত, নাটক ও যাত্রাগানে-আবার এগুলি জাতীয় জীবনে দেশবোধাত্মক ভাবের প্রবল বন্যাও আনিয়াছিল। একথা বলিলে অত্যুক্তি হইবে না যে, উনিশ বা বিশ শতকের ভারতে আর কোন জনআন্দোলনই সাহিত্যের মধ্যদিয়া এরূপভাবে ফুটিয়া উঠে নাই–এমনকি, মহাত্মা গান্ধীর সর্বভারতীয় আন্দোলনও কোন প্রাদেশিক সাহিত্যকে এরূপ প্রভাবান্বিত করিতে পারে নাই, ইহা অনস্বীকার্য। ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁহার অপূর্ব সঙ্গীত ও কবিতায় স্বদেশী আন্দোলনকে যে মর্যাদা দিয়াছেন ও উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন বিশ্বসাহিত্যে তাহার কোন তুলনা আমার জানা নাই। আরও অনেক কবি এই আন্দোলনকে সঙ্গীত ও কবিতার অর্ঘ্য দান করিয়া মহিমান্বিত করিয়াছেন। এ-যুগের বঙ্গসাহিত্য আলোচনাপ্রসঙ্গে এ-বিষয় বিস্তারিত বর্ণনা করিব। এখানে কয়েকটি সঙ্গীত উদ্ধৃত করিতেছি। এখনও মনে পড়ে, ৬০। ৭০ বৎসর পূর্বে এই সঙ্গীতসমূহ বাংলার আপামর সাধারণের মনে কী উন্মাদনার সৃষ্টি করিত!

বঙ্গদেশ কেবল জন্মভূমি নহে, আমাদের জননী-সুতরাং বঙ্গব্যবচ্ছেদ আমাদের জননীর অঙ্গচ্ছেদের তুল্য-স্বদেশী আন্দোলনের এই মূল মনোবৃত্তিটি রবীন্দ্রনাথ কিভাবে ভাষায় রূপায়িত করিয়াছেন তাহার কয়েকটি দৃষ্টান্ত দিতেছি :

স্বদেশী আন্দোলনের সময় রচিত রবীন্দ্রনাথের যে সুদীর্ঘ সঙ্গীতটি সম্প্রতি “বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বলিয়া গৃহীত হইয়াছে তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিতেছি।

(১) আমার সোনার বাংলা আমি তোমার ভালবাসি।
চিরদিন তোমার আকশ, তোমার বাতাস, আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।
ও মা, ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে,
মরি হায়, হায় রে–
ওমা, অঘ্রাণে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি৷

… … …

ধেনু চরা তোমার মাঠে, পারে যাবার খেয়া-ঘাটে,
সারাদিন পাখি-ঢাকা ছায়ায় ঢাকা তোমার পল্লী-বাটে
তোমার ধানে-ভরা আঙিনাতে জীবনের দিক কাটে
মরি হায়, হায় রে–
ও মা, আমার যে ভাই তারা সবাই, ওমা, তোমার রাখাল তোমার চাষি ॥

(২) আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী।
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে ॥
ডান হাতে তোর খড়গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কা হরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
তোমার মুক্ত কেশের পুঞ্জ মেঘে লুকায় অশনি,
তোমার আঁচল ঝলে আকাশতলে রৌদ্রবসনী ॥

(৩) ও আমার দেশের মাটি, তোমার ‘পরে ঠেকাই মাথা।
তোমাতে বিশ্বময়ীর, তোমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা ॥
তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে,
তুমি মিলেছ মোর প্রাণে মনে,
তোমার ওই শ্যামল বরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা ॥
ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার, মরণ তোমার বুকে,
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখ সুখে।
তুমি অন্ন মুখে তুলে দিলে,
তুমি শীতল জলে জুড়াইলে,
তুমি যে সকল-সহা, সকল-বহা মাতার মাতা ॥

স্বদেশী আন্দোলনে জাতীয় জীবন যে দেশপ্রেমের প্রবল স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছিল তাহার বর্ণনা :

(৪) এবার তোর মরা গাঙ্গে বান এসেছে ‘জয় মা’ বলে ভাসা তরী।
ও রে রে, ও রে মাঝি, কোথায় মাঝি, প্রাণপণে, ভাই, ডাক দে আজি–
তোরা সবাই মিলে বৈঠা নে রে খুলে ফেল্ সব দড়াদড়ি।
ঘাটে বাঁধা দিন গেল রে, মুখ দেখাবি কেমন করে–
ওরে, দে খুলে দে, পাল তুলে দে, যা হয় হবে বাঁচি মরি ॥

স্বদেশী আন্দোলনে বাঙ্গালী যে অভূতপূর্ব ঐক্যের বন্ধনে মিলিত হইয়াছিল তাহার বর্ণনা:

(৫) আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে,
ঘরের হয়ে পরের মতন ভাই ছেড়ে ভাই কদিন থাকে?
প্রাণের মাঝে থেকে থেকে ‘আয়’ বলে ওই ডেকেছে কে,
সেই গভীর স্বরে উদাস করে আর কে কারে ধরে রাখে?

… … … …

কত দিনের সাধন ফলে, মিলেছি আজ দলে দলে–
আজ ঘরের ছেলে সবাই মিলে, দেখা দিয়ে আয়রে মাকে।

সীম সাহসে প্রবল রাজশক্তির বিরুদ্ধে যাহারা স্বদেশী আন্দোলন আরম্ভ করিল তাহাদের মনে সাহস-সঞ্চারের জন্য রাজপুত জাতির যুদ্ধযাত্রার প্রাক্কালে চারণদের ন্যায় বাঙ্গালী কবির উদ্দীপনাময় প্রার্থনা :

(৬) আমাদের যাত্রা হল শুরু, এখন ওগো কর্ণধার,
তোমারে করি নমস্কার।
এখন বাতাস ছুটুক, তুফান উঠুক, ফিরব না গো আর–
তোমারে করি নমস্কার।

আমরা নিয়েছি দাঁড়, তুলেছি পাল, তুমি এখন ধরো গো হাল, ওগো কর্ণধার।
মোদের মরণ বচন, ঢেউয়ের নাচন, ভাবনা কী বা তার–
তোমারে করি নমস্কার।।

‘বাঙ্গালী ভীরু’, এই অপবাদ মিথ্যা প্রমাণ করিয়া স্বদেশী আন্দোলনে বাঙ্গালী যে দুর্জয় সাহস ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞার পরিচয় দিয়াছিল রবীন্দ্রনাথ নিম্নলিখিত সঙ্গীতে তাহা মূর্ত করিয়া তুলিয়াছেন :

(৭) আমি ভয় করব না, ভয় করব না।
দু’বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।
তরীখানা বাইতে গেলে,
মাঝে মাঝে তুফান মেলে,
তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে কান্নাকাটি ধরব না।
শক্ত যা তাই সাধতে হবে;
মাথা তুলে রইব ভবে;
সহজ পথে চলব ভেবে, পাঁকের পরে পড়ব না।
ধর্ম আমার মাথায় রেখে,
চলব সিধে রাস্তা দেখে
বিপদ যদি এসে পড়ে ঘরের কোণে মরব না।

জগতের ইতিহাসে দেখা যায়, প্রত্যেক জাতির জীবনেই এমন একটা ঘটনা ঘটে। যাহাতে তাহার মনুষ্যত্বের যেমন শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়, তাহার পূর্বে বা পরে তেমনটি আর দেখা যায় না। মোটামুটিভাবে বলা যায় যে ১৮২০ হইতে ১৯২০ খ্রীষ্টাব্দ–এই শতাব্দীতে বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ আসিয়াছিল। এ-যুগে বাঙ্গালী যে গৌরব ও মহিমার উচ্চশিখরে উঠিয়াছিল, জগতে সেরূপ দৃষ্টান্ত সচরাচর দেখা যায় না। তাহার পরই বাঙ্গালীর জাতীয় জীবনে যে অন্ধকার নামিয়াছে আর কোনও দিন তাহা দূর হইবে কিনা, ইহা ভগবানই জানেন, ঐতিহাসিকদের পক্ষে তাহা বলা দুঃসাধ্য।

তথ্যনির্দেশ

১. কর্নওয়ালিস ষ্ট্ৰীটে এই মাঠে এখন বিদ্যাসাগর কলেজের হোস্টেল হইয়াছে।

২. প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়-রবীন্দ্রনাথের জীবনচরিত প্রথম খণ্ড, ১০২ পৃষ্ঠা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *