2 of 4

৩.০৮ খলিফা ও জেলের কাহিনী

খলিফা ও জেলের কাহিনী

শাহরাজাদ বলতে শুরু করে :

কোনও এক সময়ে বাগদাদে খলিফা নামে এক জেলে বাস করতো। এমনই তার দীন-হীন অবস্থা যে, সারাদিন হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করেও শুধুমাত্র নিজের উদরান্নের সংস্থান করতে পারতো না। এই কারণে সে ভয়ে শাদী নিকা কিছুই করার দুঃসাহস করেনি। একজনেরই রুটি জোগাড় হয় না, সেখানে বিবি বাল-বাচ্চাদের মুখে সে খাবার দেবে কোথা থেকে! তার মতো দুঃস্থ অসহায় অবস্থা তার পড়শীদের কারুরই ছিলো না।

ফিদিন সাত-সকালে সকলের আগে জাল কাঁধে করে সে নদীতে যায়। সকলের চেয়ে বেশিবার জাল ফেলে। কিন্তু এমনই বরাত, সকলের চেয়ে কম মাছ সে তুলতে পারে।

এই রকম একদিন, নদীতে দশ দশবার জাল ফেলেও একটা চুনো-পুঁটি তুলতে পারলো না। রাগে দুঃখে হতাশায় নদীর উপকূলে বসে পড়ে মাথার চুল ছিড়তে থাকলো সে।

হায় আল্লাহ, একবার অভাগার দিকে মুখ তুলে তাকাও। তুমি ছাড়া যে এ-জগতে আর কোনও ভরসাই নাই আমার। তুমি তো তোমার সৃষ্ট সব প্রাণীকে আহার যোগাও। তবে আমার ওপর এতো নির্দয় হবে কেন?

এইভাবে অনেকক্ষণ হা হুতাশ করার পর আবার সে বুকে ভরসা নিয়ে জাল ফেললো। একটুক্ষণ পরে জাল গোটাতে গিয়ে অবাক হয়ে গেলো। দারুণ ভার বোধ হচ্ছিল। ভাবলো, এতোদিনে আল্লাহ বোধহয় মুখ তুলে তাকিয়েছেন! বেশ তাগদ খাটিয়েই জালখানা ওপরে তুলতে পারলো সে।

খলিফা অবাক হয়ে দেখলো, না কোনও মাছ নয়, একটা কানা খোঁড়া বাঁদর উঠে এসেছে। মাত্র।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো পঞ্চান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে?

খলিফা কপাল চাপড়াতে থাকে, এই কী তোমার বিচার হলো মালিক! মাছের বদলে একটা কানা-খোড়া বাঁদর বরাদ্দ করে পাঠালে আমার জন্য?

একখানা রশি দিয়ে বাঁদরটাকে একটা গাছের গুঁড়িতে বেঁধে বেধড়ক প্রহার করতে লাগলো সে। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে সে বলে ওঠে, আমাকে মেরো না জেলের পো, আমাকে এমন করে মেরো না। তুমি আমার কথা শোনো, আর একবার জাল ফেলো। দেখবে, আল্লাহ তোমার আজকের রুটির ব্যবস্থা করে দেবেন।

এক চক্ষু খঞ্জ সেই বাঁদরের কথায় জেলে আবার জাল ফেলে জলে।

এবারে জালটা আরও বেশি ভারি বোধ হয়। অনেক কষ্টে সেবারও জালখানা ওপরে তোলে সে। আর কী আশ্চর্য, এবারও আর একটা বাঁদর। কিন্তু এ বাঁদরটা খোঁড়াও না, কানাও না। দেখতে খুবই সুন্দর। কাজল কালো টানাটানা চোখ, সুন্দর থ্যাবড়া নাক, দাঁতগুলো ঝকঝকে, সাদা মুক্তোর মতো। ওর গায়ে ছিলো লাল সাদা ডুরি কাটা একটা কুর্তা। হাতে ছিলো সোনার বালা। কানে ছিলো দুল। এবং পায়ে ছিলো সোনার ঘুঙুর। বেশ সুন্দর করে। হাসছিলো সে। এবং আড়চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিলো জেলেকে।

খলিফা দাঁতে দাঁত চেপে স্বগতভাবে বলে, আজ দেখছি বাঁদরেরই দিন।

আল্লাহ কী পানির সব মাছকেই এই রকম সব বাঁদর বানিয়ে রেখেছেন?

এ বাঁদরটাকেও সে আগের মতো রশি দিয়ে গাছের গুড়িতে বেঁধে প্রথম বাঁদরটাকে তেড়ে বললো, ওরে শয়তান, তোর কথাতেই আমি আবার জাল ফেললাম। তা মাছের বদলে আর

একটা বাঁদর? এবার তোকে মারতে মারতে মেরেই ফেলবো।

প্রথম বাঁদরটা বলে, আচ্ছা আমি তো আর পালিয়ে যাচ্ছি না। তুমি ঐ বাঁদরটার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে দেখ না, ও কী বলে? আমার মনে হয়, আমাকে পেটালে তোমার পেট ভরবে না, কিন্তু ওর সঙ্গে কথা বললে আখেরে তোমার ভালোই হবে।

প্রথমটাকে ছেড়ে দিয়ে সে দ্বিতীয়টার কাছে এসে দাঁড়ায়।

দ্বিতীয় বাঁদরটা সহাস্যে স্বাগত জানায় জেলেকে।

খলিফা ওকে ধমক দেয়, এতো হি হি করে হাসার কী আছে? থামো। বলো, কী বলতে চাও?

দ্বিতীয় বাঁদর বলে, আমাকে তুমি চেন, খলিফা?

-না, জানি না। কিন্তু আমার কথার যদি জবাব না দাও, এই চাবুক তোমাকে সব জানিয়ে দেবে।

বাঁদর বলে, আহা অত গোসা করছো কেন? অমন কড়া কড়া কথা বলে কী ফয়দা? তার চেয়ে এসো আমার কাছে। আমার কথা মন দিয়ে শোনো, অনেক লাভবান হতে পারবে।

খলিফা চাবুকটা ফেলে দিয়ে বলে, বেশ বলল। আমি তোমার সব কথাই শুনতে চাই।

বাঁদরটা বলে, এর আগে আমি এক ইহুদীর কাছে ছিলাম। এখনও সে-ই আমার মনিব। লোকটা সুদে টাকা খাটায়। তার কাছে থাকার সময়ে তার ব্যবসার খুব বাড়-বাড়ন্ত হয়েছিলো। প্রতিদিন সে আমার মুখ দেখে দোকান খুলতো। এবং আমার মুখ দেখেই আবার দোকান বন্ধ করতো। লোকে বলে, বাঁদরের মুখ দেখলে নাকি অযাত্রা অশুভ হয়। কিন্তু আমার মনিবের তো ব্যবসা-বাণিজ্য খুব ভালোভাবেই চলছে। যাই হোক, তোমার নসীবটা একবার পরীক্ষা করে দেখ, আমাকে দিয়ে তোমার বরাত কিছু খোলে কিনা।

এক কাজ করো, বাঁদরটা বলতে থাকে। আমাকে জালে জড়িয়ে তুমি আর একবার জাল ফেল জলে। দেখ কী ওঠে।

জেলে বললো, বেশ তাই করছি। ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো ছাপান্নতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে? ‘

বাঁদরটা যেভাবে বলল, খলিফা সেইভাবে জাল ফেলে।

এবার তার ভাগ্যে একটা বিরাট মাছ ওঠে। তার গায়ের রং রূপোলী। চোখ দুটো ঠিক। যেন দুটো সোনার মোহর।

বাঁদরটা বলে, দেখলে তো আমি কেমন পয়া? যাই হোক, একটা বড়সড় ঝুড়ি নিয়ে এসো। নিচে কিছু পাতা বিছিয়ে মাছটা ভরে নিয়ে বাগদাদ শহরে যাও। আমার কথা যদি বিশ্বাস না করো তবে যাওয়ার আগে আমাদের দু’জনকে বেঁধে রেখে যাও এই গাছের গুড়িতে। পথে যেতে যেতে যদি কোনও লোক জিজ্ঞেস করে কী মাছ পেয়েছ আজ, কোনও জবাব দেবে না।

সোজা চলে যাবে স্যাকরা বাজারে। সেখানে জহুরী সাদার দোকান আছে। লোকটা ইহুদী–সুদখোর। স্যাকরা বণিকসভার শাহবানদার সে। তাকে বলবে, আপনার নাম করে জাল ফেলেছিলাম। আল্লাহ আমাকে এই মাছটা দিয়েছেন। তুমি যখন ঝুড়ি থেকে বের করে মাছটা তাকে দেখাবে, সে জিজ্ঞেস করবে আমাকে ছাড়া আর কাউকে দেখিয়েছ এ মাছ? তুমি বলবে, খোদা কসম, কাউকেই দেখাইনি। তখন সে দাম হিসাবে তোমাকে একটা দিনার দিতে যাবে। তাও নেবে না। এইভাবে সে দাম বাড়াতে বাড়াতে যদি বলে, মাছটাকে সোনা দিয়ে ওজন করে দিচ্ছি তাও নেবে না তুমি। তখন সে জিজ্ঞেস করবে তাহলে কী নেবে?’ তখন তুমি বলবে, পয়সা-কড়ি কিছুই চাই না, মালিক। কয়েকটা কথার বিনিময়ে আপনাকে দিতে পারি এই মাছটা। সে বলবে, কী কথা? তখন তুমি বলবে আপনি উঠে দাঁড়িয়ে বলুন, আপনারা সবাই সাক্ষী, আমি আমার বাঁদরটা এই জেলে খলিফার বাঁদরের সঙ্গে বদল করে নিলাম।

ব্যস, এই তোমার মাছের উপযুক্ত দাম হবে। এরপর আমি তোমার সম্পত্তি হয়ে যাবো। এবং আমার কপালেই তোমার কপাল ফিরে যাবে। প্রতিদিন তুমি জাল ফেলে যা মাছ পাবে, বিক্রি করে একশো দিনার সংগ্রহ করতে পারবে। এবং দেখবে, দিনে দিনে তুমি ধনী হবে এবং ঐ ইহুদী গরীব হয়ে যাচ্ছে। এইভাবে এমন একদিন আসবে, তখন তুমি হবে বাজারের সেরা বণিক, আর সে কপর্দকহীন হয়ে পথে পথে ভিক্ষে করে বেড়াবে।

বাঁদরটা বললো, যা বললাম, ভালো করে খেয়াল রেখ, তাহলে তোমার সৌভাগ্য কেউ নিতে পারবে না।

জেলে বললো, ঠিক আছে, তোমার কথামতোই কাজ করবো। কিন্তু এখন এই কানা-খোঁড়া বাঁদরটাকে কী করবো? ছেড়ে দেব?

দ্বিতীয় বাঁদর বলে ঠিক আছে, আমাদের দুজনকেই তুমি ছেড়ে দিয়ে যাও। আমরা এই জলেই থাকবো।

খলিফা ওদের দুজনকে খুলে দিতেই ওরা জলে লাফিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

মাছটাকে ভালো করে ধুয়ে ঝুড়িতে ভরে মাথায় তুলে বাজারের পথে গান গাইতে গাইতে চলে সে।

পথে অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। সবাই চেনা জানা। তারা সকলেই জানে, লোকটা একেবারে অপয়া। সারাদিনে একটা ভালো মাছ ধরতে পারে না। কেউ কেউ রসিকতা করে জিজ্ঞেস করে, কী গো, জেলের পো, আজ দেখি প্রাণে বসন্ত জেগেছে! তা রুই-টুই কিছু তুলেছ বলে মনে হচ্ছে?

কিন্তু খলিফা কোনও জবাব দেয় না। গান গাইতে গাইতে সে সোজা A চলে আসে ইহুদী জহুরীর দোকানে।

জহুরী বসেছিলো নফর চাকর পরিবৃত হয়ে বাদশাহী কেতায়। পরনে তার মহামূল্যবান সাজ-পোশাক। যে আসনটায় বসেছিলো তা দেখতে প্রায় তখত-এর মতো—অত্যন্ত দামী, বাহারী। দেখে মনে হয় যেন কোথাকার নবাব বাদশাহ।

ভোর হয়ে আসছে দেখে গল্প থামিয়ে শাহরাজাদ চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সাতান্নতম রজনী :

আবার সে বলতে শুরু করে :

খলিফাঁকে দেখে স্বাগত জানালো ইহুদী, আরে এসো এসো, কী ব্যাপার! কী মাছ পেয়েছ। আজ? রাতে স্বপন দেখেছি, বিরাট একটা মাছ ধরে আনা হয়েছে বাড়িতে।

খলিফা বলে, আজ সকালে আপনার নাম করে জাল ফেলেছিলাম। তা জালে আল্লাহর দোয়ায় উঠেছে একটা পেল্লাই মাছ। এই দেখুন।

ইহুদী দেখে খুশি হয়ে বলে, বাঃ তোফা। এই নাও, দামটা রাখ।

একটা দিনার দিতে যায় সে।

কিন্তু খলিফা বলে, না মালিক ওতে হবে না।

–আচ্ছা এই নাও দু দিনার।

—না ওতে হবে না?

-তিন দিনার?

-না।

-দশ?

-না, ওতেও দিতে পারবো না।

—আচ্ছা, বাবা তুমি কী চাও? সোনা দিয়ে মেপে দেব?

জেলে বলে, মাফ করবেন জনাব, টাকা-পয়সার বিনিময়ে এ মাছ আমি বিক্রি করতে পারবো না।

ইহুদী জহুরী অবাক হয়ে বলে, তবে? কী চাও তুমি?

-জী, আমাকে একটা কথা দিতে হবে?

—কী কথা বলো?

জেলে বলে, আপনার যে বাঁদরটা আছে, ঐ বাঁদরটা আমি নেব। তার বদলে অবশ্য আমার একটা বাঁদর আপনাকে দেব। আপনি রাজি থাকেন তো বলুন?

—বড় অদ্ভুত প্রস্তাব! ঠিক আছে তাই হবে।

খলিফা বলে, না, ওভাবে বললে হবে না। আপনার দোকানের এইসব খদ্দের কর্মচারী এদের সামনে হলফ করে বলুন যে, আমার বাঁদরটার সঙ্গে আপনার বাঁদরটা বদলা-বদলী করে নেবেন।

ইহুদী উঠে দাঁড়িয়ে বলে, এই যে, শোনো ভাইসব, আমি এই জেলে খলিফাঁকে কথা দিচ্ছি, আজ থেকে ওর বাঁদরের সঙ্গে আমার বাঁদরটা বদল করে নেব।

জেলে সঙ্গে সঙ্গে মাছটা ইহুদীর দোকানে নামিয়ে দিয়ে খালি ঝুড়িটা মাথায় নিয়ে আবার নদীর ধারে ফিরে আসে। মনে মনে ভাবে বাঁদরটাকে সব কথা বলা দরকার। জাল ফেলে সে। ভাবে নিশ্চয় সে উঠে আসবে। জালটা ভারিও বোধ হতে থাকে। টেনে তুলতে বেশ কষ্ট হয়। কিন্তু অবাক কাণ্ড, জালে বাঁদরটা উঠে আসেনি, তার বদলে উঠেছে অজস্র ভালো ভালো মাছ।

সারা জালটা রূপোর মতো ঝকঝক করতে থাকে।

নদীর ধার দিয়ে যাচ্ছিল একটা মেয়ে। জেলের কাছে এগিয়ে এসে একটা মাছ দরদাম করে এক দিনার দিয়ে কিনে নেয়। একটু পরে আরও কয়েকজন পথচারী দাঁড়িয়ে পড়ে। তারাও কিনে নেয় খানিকটা। এইভাবে কিছুক্ষণের মধ্যে বেজায় ভিড় জমে যায় সেখানে। সবাই তাজা মাছের সন্ধানে এসেছিলো। ভালো দামেই সব মাছগুলো অল্পক্ষণের মধ্যে বিকিয়ে যায়। খলিফা গুণে দেখলো, ঠিক একশো দিনার হয়েছে।

মনের আনন্দে বাড়ি ফিরে আসে খলিফা। বহুকাল পরে আজ তার খুশির সীমা নাই। একটা নয় দু’টো নয় একশোটা সোনার দিনারের মালিক সে। এইভাবে প্রতিদিন জাল ফেলে সে একশো দিনার পাবে। ওরে বাপ! সে কত টাকা হয়ে যাবে? অত টাকা সে রাখবে কোথায়?

খলিফা আকাশ-কুসুম কল্পনা করতে থাকে : এইভাবে আমি অনেক বড় লোক হয়ে যাবো একদিন। বিরাট ইমারত, দাস-দাসী খ্যাতি মান সব হবে আমার। কত লোক আমার কাছে আসবে সাহায্যের জন্য! আমি অবশ্য কাউকেই ফেরাবো না। আহা, লোকে অভাবে পড়েই না হাত পাতে। যার যা দরকার সবাইকে খুশি করে দেব।

সবচেয়ে মজার হবে, স্বয়ং খলিফা হারুন অল রসিদ আসবেন আমার কাছে টাকা ধার করতে। তিনি এসে বলবেন, খলিফা সাহেব, খলিফা সাহেব, বাড়ি আছ?

—আমি উত্তর দেব, কে?

তিনি আমার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বলবেন, আমি খলিফা হারুন অল রসিদ। বড় টানাটানির মধ্যে চলছে, তা আমাকে একশোটা দিনার ধার দিতে পার, খলিফা সাহেব?

আমি তখন গম্ভীর চালে বলবো, একশো দিনার? অত টাকা কোথায় পাবো জাঁহাপনা? আমি গরীব-সরীব মানুষ, দিন আনি, দিন খাই। একসঙ্গে একশো দিনার চোখেই দেখিনি। আপনাকে কে বলেছে, আমার কাছে টাকা আছে?

খলিফা বিশ্বাস করবেন না আমার কথা। তিনি সব খোঁজখবর নিয়েই আমার কাছে আসবেন। কত টাকা আমার জমেছে এবং কোন্ জায়গায় লুকিয়ে রেখেছি, সবই তার জানা, সুতরাং হাবিলদার আহমেদকে বলবেন, গ্রেপ্তার করো একে। আহমেদ আমাকে ন্যাংটো করে পেটাতে শুরু করবে। যতক্ষণ না একশো দিনার বের করে দিই ততক্ষণ সে আমাকে মারতেই থাকবে। অবশেষে টাকা বের করে দিতেই হবে।

এই রকম ঝুট ঝামেলা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় বের করতে হবে। জেলে শুয়ে শুয়ে ভাবে। শেষে সে ঠিক করে, না, পাড়াপড়শী কাউকে সে জানাবে না কী তার রোজগার হচ্ছে। জামাকাপড় সাজ-পোশাক এবং খানাপিনা কিছুই পালটাবে না সে। যেমন আগে ছিলো ঠিক তেমনি থাকবে। না, অন্যের দুঃখে বিগলিত হয়ে দয়া সে দেখাবে না কাউকে। দেবে না একটা পয়সাও। তাতে লোকে সন্দেহ করবে। ভাববে, অনেক পয়সা না থাকলে কেউ দানখয়রাত করতে পারে? পরের উপকার করতে গিয়ে নিজের বাঁশ হয়ে যাবে। কী দরকার অমন উটকো দরদ দেখিয়ে? লোকে হাতে পেয়ে উপকারটুকুও নেবে, আবার চোখও টাটাবে। এইভাবে পাঁচ কান হতে হতে একদিন সুলতানের কানে যেতে আর কতক্ষণ। আর খলিফার রোষে পড়লে কারো রক্ষে আছে? সর্বস্বান্ত হয়ে যেতে হবে। সুতরাং একটিও কথা না। নিজেকে ঠিক তেমনি দীন-ভিখারী সাজিয়েই রাখবে সে।

এই সময়ে রাত্রি শেষ হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ঊনষাটতম রজনী–

আবার সে বলতে শুরু করে–

অনেক বুদ্ধি খরচ করে সে একটা অভিনব উপায় উদ্ভাবন করলো। গাঁজাখোরদের মতো আজগুবি এক ফিকির বলা যায়।

রাত যখন গভীর হয়ে এলো, খলিফা নিজেকে বিবস্ত্র করে দেওয়ালে টাঙানো চাবুকখানা পেড়ে নিলো। সপাং সপাং করে নিজের শরীরে বসাতে থাকলো চাবুকের ঘা। যন্ত্রণায় আর্তনাদ করে ওঠে সে, ওরে বাবা রে, গেলাম রে, ম’লাম রে। দোহাই হুজুর আর মারবেন না, মরে যাবো।

এরপর সে নিজেই নিজেকে তড়পে ওঠে। বলো শীগগির, বল, কোথায় টাকা রেখেছিস?

আবার সপাং সপাং করে আঘাত করে নিজেকে। আবার সে আর্তনাদ করে, দোহাই জাঁহাপনা আমাকে ছেড়ে দিন, বলছি, বলছি আমি।

-বল, কোথায় রেখেছিস্ টাকা?

আবার নিজেই বলে, দিচ্ছি, হুজুর দিচ্ছি বের করে।

নিস্তব্ধ নিশুতি রাতে খলিফার আর্ত চিৎকারে পড়শীদের ঘুম ভেঙ্গে যায়। হুড়পাড় করে সবাই বাইরে বেরিয়ে আসে।

-কী ব্যাপার! খলিফার ঘরে ডাকাত পড়লো নাকি?

আর একজন বলে, ঘরে ওর দুটো পয়সা নাই, চোর ডাকাতে নেবে কী?

অন্য একজন বলে, কিন্তু সে হুঁশ কী ওদের আছে? লোকটা দু’বেলা দু’খানা রুটি জোগাড় করতে পারে না। তাকে মারধোর করলেই কী টাকা বের করে দিতে পারবে।

ওদিকে আরও জোরে আর্তনাদ ওঠে। ও বাবা গো, ম’লাম। আমায় ছেড়ে দিন, হুজুর আমি সব বলছি।

পড়শীরা আললাচনা করলো! আর তো চুপ করে থাকা উচিত হবে না। চলো সকলে মিলে দেখি।

কেউ লাঠি, কেউ বর্শা, কেউ সড়কী নিয়ে এসে দাঁড়ালো খলিফার দরজায়। কিন্তু দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তখন ওরা দেওয়াল বেয়ে ছাদের ওপরে ওঠে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে।

তাজ্জব কাণ্ড! সবাই দেখে অবাক হয়। ঘরে দ্বিতীয় কোনও মানুষ নাই। খলিফা একা—এবং সম্পূর্ণ উলঙ্গ। একখানা চাবুক দিয়ে নিজেই পেটাচ্ছে নিজের শরীর।

-কী ব্যাপার? তোমার কান্নাকাটি চিৎকারে পাড়ার লোক সব জেগে ওঠে। আমরা তো মনে করেছিলাম, তোমার ঘরে ডাকাত পড়েছে। সেই থেকে ভয়ে আমরা কাঁপছি। কিন্তু এসব কী কাণ্ড?

ওদের কথার জবাব না দিয়ে খলিফা উল্টো তম্বি করে, তোমরা কী চাও? এই রাত দুপুরে কেন এসেছ আমাকে বিরক্ত করতে? না হয় আমি নিঃস্ব, তা বলে নিজের দেহটারও কি আমি মালিক নই? দু চারটে গোত্তা মেরে এই বেয়াড়া শরীরটা শায়েস্তা করারও কী কোনও অধিকার নাই আমার? আমাকে একটু নিশ্চিন্তে থাকতে দাও। তোমরা এখন ভালো ছেলের মতো বিদেয় হও তো! তোমাদেরও উচিত মাঝে মাঝে আমার মতো এই রকম দেহচর্চা করা, বুঝলে?

এরপর আর পড়শীদের দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে আবার সে যথারীতি চাবুক চালিয়ে যেতে লাগলো নিজের শরীরে।

খলিফার এইসব কাণ্ডকারখানা দেখে পড়শীরা তো সবাই হেসে খুন। আর কিছু না বলে তারা বিদায় নিলো।

খলিফা চিন্তা করতে থাকে, ব্যাটারা এর মধ্যে সন্ধান পেয়ে গেছে, আমার কাছে একশো দিনার আছে। সেইটেই হাতাতে ওরা এসেছিলো। হুঁ হুঁ বাবা, আমিও কম সেয়ানা নই। সেটি হচ্ছে না। এই বসে রইলাম গ্যাট হয়ে। সারারাত ঘুমাবো না। দেখি কে চুরি করে নিয়ে যায়।

সারাটা রাত বিনিদ্রভাবে কাটালো খলিফা। সকালে নদীতে যাবে। কিন্তু সমস্যা হলো দিনারগুলো কোথায় রেখে যাবে। ভাবলো, যদি ঘরে রেখে যাই ব্যাটারা নির্ঘাৎ লোপাট করে দেবে। সুতরাং ঘরে রেখে যাবে না সে। কিন্তু কোমরে পেটিতে বেঁধে চলাও নিরাপদ নয়। সবাই জানে পেটিতে টাকাপয়সা ছাড়া কিছু থাকে না। আর এই বাগদাদ শহরে ছিনতাই দলের অভাব নাই। পথে পা বাড়ালেই গাঁটকাটারা পিছনে লাগবে। অনেক ভেবে-চিন্তে অবশেষে সে একটা অভিনব উপায় আবিষ্কার করলো। পুরানো কুর্তা ছিড়ে একটা থলে বানালো। দিনারগুলো থলেয় ভরে গলায় ঝুলিয়ে জাল কাঁধে করে সে নদীর দিকে রওনা হলো।

আগের দিনের সেই জায়গায় এসে জালটাকে মাথার ওপর দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ছত্রাকার করে জলের মধ্যে ফেললো সে। আর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিপর্যয় ঘটে গেলো। জাল ফেলার সময় সারা দেহে প্রচণ্ড ঝকানি লাগে। এবং সেই ঝকানির দোলায় ছিটকে বেরিয়ে যায়। থলেটা। একবারে মাঝ নদীতে পড়ে তলিয়ে যায়।

খলিফাও ক্ষিপ্রহাতে জামাকাপড় খুলে ফেলে বাজপাখির মতো ঝাপিয়ে পড়ে জলে। অনেকক্ষণ ধরে আঁতিপাতি করে খোঁজে। কিন্তু জলের কোন্ অতলতলে স্রোতের টানে ভেসে চলে যায় তা কিছুই হদিশ করতে পারে না। অবশেষে হতাশ অবসন্ন দেহে ওপরে উঠে আসে। কিন্তু অদৃষ্টের কী নির্মম পরিহাস, জামাকাপড়গুলো কে চুরি করে পালিয়েছে।

ইয়া আল্লাহ! এই কী তোমার বিচার? শয়তান চোর আমার এই ছেড়া সাজপোশাকের লোভও সামলাতে পারলো না?

খলিফা একটি প্রচলিত প্রবাদ আওড়ায় : মক্কায় পৌঁছলে কি হবে, উটের সহিসরা কখনও হাজী হতে পারে না।

সেই সময়ে রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ষাটতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

বেচারা খলিফা আর কী করে ; জালখানা জড়িয়ে নিলো সারা শরীরে। ঝুড়িটা তুলে নিলো মাথায়, ছড়িটা নিলো হাতে—তারপর ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে নদীর ধার দিয়ে চলতে থাকলো।

খলিফা জেলের কথা এখন থাক। এবার খলিফা হারুন অল রসিদের কথা শুনুন। বর্তমান কাহিনীর সঙ্গে তাঁর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ যোগাযোেগ আছে।

এই সময়ে বাদদাদ শহরে ইবন অল কিরনাস নামে এক জহুরী ছিলো। সুলতানের দরবারে তার গতিবিধি ছিলো অবাধ। এক কথায় শহরের সম্রান্তদের সে অন্যতম,-সুলতানের নেক-নজর ছিলো তার ওপর। শহরের যে-কোনও বড় কেনা বেচা—তা সে সাজপোশাক, অলঙ্কার বা বাঁদী গোলামের কেনা-বেচাই হোক না কেন, ইবন অল-কিরনাসকে বাদ দিয়ে কিছুই হতে পারতো না।

একদা ইবন অল কিরনাস সাহেব তার দোকানে বসেছিলো। এমন সময় একটা দালাল নিয়ে এলো একটি বাঁদীকে। মেয়েটি এ শহরে নবাগতা। পরমাসুন্দরী বললেও তার রূপের মাধুর্যকে খাটো করা হয়। মোটকথা, তার মতো নিখুঁত নিভাঁজ কুমারী কন্যা এতাবৎ কালে তামাম আরবে কোথাও কেউ দেখেনি।

দালাল বললো, শুধু রূপই নয় মালিক, গুণগুলোও পরখ করে নিন। গান, বাজনা, নাচ-এ সে পটীয়সী। সাহিত্য, দর্শন, বিজ্ঞানেও সে সুপণ্ডিত।

অল কিরনাস আর কোন দ্বিধা না করে তৎক্ষণাৎ পাঁচ হাজার দিনার দামে মেয়েটিকে সওদা করে নিলো। ওর জমকালো বাহারী সাজপোশাক বাবদ খরচ করলে আরও এক হাজার দিনার।

সাজিয়ে গুজিয়ে নিয়ে গেলো সে খলিফার দরবারে। সে রাতটা খলিফার সঙ্গেই কাটালো মেয়েটি। এর ফলে অল রসিদ মেয়েটির অনন্য-সাধারণ গুণাবলীর পরিচয় জানতে পারলেন। মুগ্ধ হলেন তিনি। মেয়েটির নাম মেরিজান। খাস আরবের কন্যা। কোনও দোআঁশলা নয়। সকালবেলায় খুশি হয়ে তিনি অল-কিরনাসকে দশ হাজার দিনার পাঠিয়ে দিলেন।

এই নতুন বাঁদীটির রুপেগুণে মুগ্ধ হয়ে খলিফা অন্য সব বাঁদীদের ভুলে গিয়ে ওকে নিয়েই মেতে রইলেন বেশ কিছুদিন। আপনারা শুনে অবাক হবেন, মেয়েটার মোহে অন্ধ হয়ে খলিফা তার প্রিয়তমা বেগম জুবেদাকে স্মরণ করেন না অনেকদিন। জুবেদা তো শুধু তার বেগম নয়, চাচার মেয়ে নিজের বোন। তাকেও ভুলে রইলেন তিনি। দরবারের কাজ ডকে উঠলো। সারাটা মাসে একমাত্র জুম্মাবারে নামাজের সময়টুকু ছাড়া আর তাকে কেউ অন্য কোথাও দেখতে পেত না। সারা দিনরাত মেরিজানকে নিয়ে পড়ে থাকেন।

সারা সলতানিয়তের আমির ওমরাহরা চিন্তিত হলো। সুলতান যদি দরবারের কাজ দূরে ঠেলে এইভাবে দিনের পর দিন সামান্য একটি নারীকে নিয়ে বিলাস-ব্যসনে দিন কাটাতে থাকেন তবে তো দেশ জাহান্নামে যাবে। সকলে মিলে উজির জাফর অল বারমাকীর কাছে দরবার করলো তারা, আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, এর একটা ব্যবস্থা করুন। আমাদের তো মনে হয় সুলতানকে ঐ মেয়েটা গুণ করেছে। এখন তিনি ব্যাধিগ্রস্ত। আপনাকেই এর প্রতিকার করতে হবে।

জাফর বলে, আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, উপযুক্ত দাওয়াই দিয়ে তার এ রোগ আমি সারাবো।

এই জন্যে জাফর শুক্রবার-এর প্রতীক্ষায় বসে রইলো। যথাসময়ে জুম্মাবারে সে আগে থেকেই হাজির থাকলো বড় মসজিদে। সেখানে সুলতান নামাজ পড়তে আসবেন। সেই সময় সে তার সঙ্গে বাক্যালাপ করতে পারবে।

যথাসময়ে সুলতান এলেন। নামাজাদির পর উজির জাফর কথা পাড়লো। নানা বিষয়ের কথা। প্রথমে দেশের হালচাল। তার পরে ভালোবাসার মোহ এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম নিয়ে গভীর তত্ত্বকথার অবতারণা করলো উজির জাফর।

সুলতান বললেন, জাফর আমি নেহাত ছেলেমানুষ বা নিরেট নই। সব আমি বুঝি। এর পরিণাম যে সুখাবহ হতে পারে না, তা আমি জানি, কিন্তু কি করবো জাফর, হাত-পা আমার বাঁধা, কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছি না। সব দোষ আমার আমি সবই বুঝতে পারি। কিন্তু ভালোবাসার মোহের জালে জড়িয়ে পড়েছি।

জাফর বলে, ধর্মাবতার, মেরিজান এখন আপনার দখলে। আপনার হুকুমের বাঁদী সে। অন্যান্য আর পাঁচটা বাঁদীর মতো সেও আপনার একটি কেনা বাঁদী মাত্র। আমি আপনাকে এই মোহমুগরের একটা উপায় বাতলে দিতে পারি। ওকে ছেড়ে আপনি মাঝে মাঝে বাইরে বেরিয়ে পড়ুন। শিকার করুন, মাছ ধরুন। ফাঁদ ছাড়াও আরও অনেক রকম ফাদ আছে। সেই ফাঁদে আপনি পা বাড়ান। এতে আপনার ভালো হবে। আপনার সলনিয়ত রক্ষা পাবে। আপনার প্রজারা আপনার জন্য দারুণ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে।

-তুমি ঠিক বলেছ, জাফর। বাইরেই কোথাও যাওয়া যাক। তুমি ব্যবস্থা করো। আমি ১ আজই যাবো। এবং এক্ষুনি।

জাফর এবং খলিফা খচ্চরে চেপে সোজা শহর-সীমায় এসে পৌঁছলো। সারা দিন ধরে ওঁরা। দু’জনে প্রচণ্ড খরতাপের মধ্যে এদিক ওদিক বিচরণ করতে থাকেন। এইভাবে পেয়াদা প্রহরীদের পিছনে ফেলে এক সময় তারা দৃষ্টি পথের অগোচরে উধাও হয়ে যান।

চলতে চলতে খলিফা পিপাসার্ত বোধ করেন।

—জাফর, তেষ্টা পেয়েছে যে—

ধারে কাছে কোনও জনবসতি নাই। জাফর লক্ষ্য করলো অনেক দূরে একটা ছোট্ট পাহাড়ের টিলায় কী যেন একটি বস্তু নড়াচড়া করছে।

সুলতান জিজ্ঞেস করেন, ওখানে কী আছে জাফর? ·

—আসলে, আমার মনে হচ্ছে, ওগুলো মানুষজন কিছু না। ওখানে শশার ক্ষেত কিংবা ফলের বাগান আছে। অর্থাৎ ধারে কাছে পানিও আছে। আপনি এখানে অপেক্ষা করুন, আমি দেখে আসছি।

সুলতান বললেন, তোমার খচ্চরের চেয়ে আমারটা অনেক তাগড়াই আর দ্রুতগামী। তুমি বরঞ্চ এখানে দাঁড়াও, আমি ঘুরে আসছি।

সুলতান আর কোনও জবাবের প্রত্যাশা না করে উধ্বশ্বাসে ছুটে চললেন। এবং নিমেষের মধ্যে পৌঁছে গেলেন সেই পাহাড়ের পাদদেশে। সেই উলঙ্গ জেলে সারা অঙ্গ জালে আবৃত করে ধুলোকাদা মেখে কিম্ভুত কিমাকার সেজে পাগলের মত ধেই ধেই করে নাচছিলো সেখানে। সে এক বীভৎস দৃশ্য। মনে হয় কোনও এক দৈত্যদানব সে।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো একষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

অল রসিদ জেলের সামনে দাঁড়িয়ে স্মিত হেসে স্বাগত জানালো।

—আচ্ছা ভাইসাব, আমাকে একটু খাবার পানি দিতে পারো?

খলিফা জেলে বাজখাই গলায় খেকিয়ে ওঠে, তুমি কী উন্মাদ না অন্ধ? পাহাড়ের নিচ দিয়ে নদী বয়ে চলেছে, দেখতে পাচ্ছো না?

হারুন অল নদীর ঘাটে নেমে আঁজলা ভরে টাইগ্রিসের জল পান করে। খচ্চরটাকে খাওয়ায়। তারপর খলিফা জেলের কাছে ফিরে গিয়ে বললো, এখানে কী করছো? এবং কী করো তুমি? পেশা কী?

খলিফা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, তোমার আগেরটার চেয়ে এটা আরও আহাম্মকের মতো প্রশ্ন। তাই নয় কী? আমার কাঁধের মালপত্র দেখে কী বুঝতে পারছে না, আমার কী পেশা?

এম, দেখে তো সবাই বলবে তুমি জেলে। মাছ ধরাই তোমার কাজ। কিন্তু তোমার কুর্তা কামিজ পাতলুন গেলো কোথায়?

এই কথা শুনে জেলের প্রত্যয় হয়, আর কেউ নয়, এই ব্যাটাই সেই চোর। তার জামাকাপড় চুরি করে এখন মজা দেখতে এসেছে। ভাবামাত্র সে ছুটে এসে সুলতানের খচ্চরের লাগাম চেপে ধরে, আমার জামাকাপড় কোথায়, শীগ্নির বের করো। আমাকে ন্যাংটো করে তামাশা দেখতে এসেছ? শিগগির ফেরত দাও আমার সাজপোশাক। তা না হলে তোমার খুপরী খুলে নেব, শয়তান কাঁহিকা।

-খোদা কসম, হারুন বলেন, আমি তোমার জামাকাপড়ের বিন্দুবিসর্গ জানি না। বুঝতেই পারছি না, কী তুমি বলতে চাইছো, কী করেই বা পরনের বাস চুরি যেতে পারে। আমার মগজে ঢুকছে না, জেলের পো!

সুলতান হারুন অল রসিদের গাল দুটো বেলুনের মতো ফোলানো। মুখের হাঁ-খানা খুব ছোট্ট—ঠিক সানাইবাদকদের মতো। জেলে খলিফা সুলতানের মুখের দিকে ভালো করে লক্ষ্য করে ভাবলো, নির্ঘাৎ লোকটা সানাইবাজিয়ে।

-ওহে সানাইবাদক, সুবোধ ছেলের মতো আমার জামাকাপড়গুলো বের করে দাও দেখি। তা না হলে এই যে দেখছো ডাণ্ডা, এটা তোমার পিঠে ভাঙ্গবো।

হারুন আঁৎকে ওঠার ভান করেন, হায় বাপস, ওর একটা বাড়ি খেলে আমার দফা-রফা হয়ে যাবে। দোহাই বাবা রক্ষা করো, আমি তোমাকে আমার সাজ-পোশাক দু-একটা খুলে দিচ্ছি, পররা। কিন্তু তোমার ঐ ডাণ্ডাটা নিচে নামাও। ওটা দেখলেই আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে।

সুলতান তার বাহারী সাটিনের পোশাকটা খুলে খলিফা জেলের হাতে দিলেন।

—এইটে নিয়ে আমাকে রেহাই দাও বাবা। সত্যি বলছি, আমি তোমার জিনিস চুরি করিনি। জেলে বিজ্ঞের হাসি হাসে, আমাকে তুমি অতই বোকা হাঁদা পেয়েছ নাকি। আমার পোশাকের দাম তোমার এটার দশগুণ হবে। ভুজুংভাজুং দিয়ে যা তা একটা গছিয়ে দিলেই অমনি আমি গলে যাবো, ভেবেছ? তোমার এই বিদঘুটে আঁকি-বুকি-কাটা কুর্তার ক’-পয়সা দাম হবে, শুনি? আমারটার কী দাম ছিলো জান?

—তোমার কথা একশোবার সত্যি, ভাইসাব। কিন্তু আপাততঃ এটা পরে তোমার অঙ্গ-শোভা একটু ঢাক। তোমার মহামূল্যবান পোশাকটার সন্ধান করে দেখছি।

খলিফা জেলে সেই সুলতানের আজানুলম্বিত শেরোয়ানীটা গায়ে চাপায়। কিন্তু বেঁটে খাটো, মানুষটার পক্ষে পোশাকটা বেশিমাত্রায় বড় হয়ে যায়। মাটিতে ঘষা লেগে ছিড়ে যাবে আশঙ্কায় মাছের ঝুড়ি থেকে ছুরিখানা বের করে নিচের অংশটুকু কেটে ফেলে। সেই কাটা অংশটুকু পাকিয়ে সে পাগড়ী বানিয়ে মাথায় পরে। এবার শেরোয়ানীটা ওর হাঁটু অবধি নেমে থাকে। তা থাক ওর বেশি নিচে নামাতে সে চায় না।

জেলে বলে, আচ্ছা সানাইবাদক, সানাই বাজিয়ে মাসে কত টাকা রোজগার করো?

খলিফা হারুন বিন্দুমাত্র হাসি মজাক না করে বেশ গম্ভীর ভারিক্কি চালে বলেন, তা ধর, দশ দিনার।

জেলে সমবেদনা জানায়, আহা গরীব বেচারা, তা কী করবে বলো। তিনি যার ভাগ্যে যা লিখেছেন তার বেশি তো কেউ পাবে না। আমার কথাই বলি, দশটা দিনার আমি তুড়ি মেরে এক পলকে রোজগার করতে পারি। একবার মাত্র জাল ফেলবো ব্যস্ আর দেখতে হবে না, মাছে মাছে ছয়লাপ হয়ে যাবে আমার জাল।

হারুন বলেন, জাল ফেললেই মাছ উঠবে জানলে কী করে? কোনও কোনও বার নাও তো উঠতে পারে?

-না তা হতে পারে না। এই জলের তলায় আমার একটা বাঁদর আছে। সেই আমার হয়ে দেখা শুনা করে। জাল ফেলামাত্র ভালো ভালো মাছদের তাড়িয়ে এনে সে জালের মধ্যে ঢোকায়।

জেলে খলিফা একবার সুলতানের চোখের দিকে তাকায়, কী খুব লোভ হচ্ছে তো? তা করবে এই ব্যবসা? ভাবনার কিছু নাই। সব আমি হাতে কলমে শিখিয়ে দেব তোমায়। সারাদিন তুমি আমার সাগরেদ হয়ে কাজ করে যাবে। আমি তোমাকে পাঁচ দিনার দিনরোজ দেবো, কী, রাজি? না, না ঘাবড়াবার কিছু নাই। ভেবো না, ঐ পাঁচ দিনারের চাকাতেই বাঁধা হয়ে গেলো জীবন। যখন ধীরে ধীরে ভালো কাজ শিখতে পারবে মাইনে আরও বাড়িয়ে দেবো। তুমি হয়তো ভয় পাচ্ছো তোমার সানাই-দলের সর্দার যদি বাধ সাধে। তাহলে আমার এই ডাণ্ডা দিয়ে পিটিয়ে তাকে ঠাণ্ডা করে দেব। তা ছাড়া আমার বিরাশী সিল্কা ওজনের একটা ঘুষি যখন খাবে, বুঝবে বাছাধন কেমন মজা।

সুলতান বলেন, ঠিক, আমি তোমার শর্তে রাজি।

—তা হলে খচ্চর থেকে নামো। এখুনি তালিম নিতে শুরু করো। করবেই যখন ঠিক করেছ, দেরি করে লাভ কী?

সুলতান আমতা আমতা করে নেমে পড়ে, না, হ্যাঁ, মানে, তাতো বটেই।

জেলে বলে, এই যে জালখানা দেখছো, ঠিক এর গোড়াটা শক্ত মুঠিতে পাকড়াও করে ধরো। তারপর জালটাকে মাথার ওপর দিয়ে এইভাবে ঘুরিয়ে ছুঁড়ে দেবে পানিতে। গোল হয়ে ছড়িয়ে পড়বে।

সুলতান যথাসাধ্য চেষ্টা করে জালখানা জলে ফেলতে পারেন। একটু পরে ধীরে ধীরে টেনে তোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু দারুন ভারি। টেনে আর পারেন না। তখন দুজনে মিলে ওপরে তুলে আনলো জালখানা। এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জেলে খলিফা চিৎকার করে গালিগালাজ দিতে থাকে, ওহে ক্যাওড়ার সানাই-এর পো, ইটপাটকেল ঢুকে যদি জাল আমার ছেড়ে তাহলে তোমাকে আস্ত রাখবো না। খেসারত হিসাবে তোমার খচ্চরটাকে বাজেয়াপ্ত করে নেব।

ভাগ্য ভাল হারুনের জালে ইটপাটকেলের বদলে সুন্দর সুন্দর মাছ উঠলো অনেকগুলো। কিন্তু তাতে জেলের মুখে হাসি দেখা গেলো না। আবার খিস্তি খেউড় করে সুলতানকে তামিল দিতে লাগলো। নাও অত আহ্লাদে আটখানা হতে হবে না। এখন মন দিয়ে কাজ কাম করো—তা না হলে মেরে তোমার ঐ বাঁদরের মতো হত কুৎসিত মুখখানার আদলই পাল্টে দেব।

ভোর হয়ে আসছে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো বাষট্টিতম রজনী : আবার গল্প শুরু হয় :

—শোনো জেলে খলিফা হুকুম করে, তোমার খচ্চরটায় চেপে সোজা বাজারে চলে যাও। সেখান থেকে বেশ ভালো দেখে দুখানা বড়সড় ঝুড়ি কিনে আনবে। তা না হলে এতো মাছ একটা ঝুড়িতে ধরবে না। তুমি যাও, আমি মাছগুলো পাহারা দিই। অন্য কোন দিকে তাকাবে না, ঝুড়ি কিনেই চলে আসবে। দাঁড়িপাল্লা বাটখারা সব আমার কাছে আছে। বাজারে যাবো, মাছ দাঁড়িতে তুলবো আর পয়সা গুনে থলেয় ভরবো। ব্যস, অন্য কাজ নাই। খুব সাবধান, দেরি করো না, তাহলে মেরে হাড় ভেঙ্গে দেব।

-ঠিক আছে মালিক, যা বললেন তাই হবে।

এই বলে খচ্চরের পিঠে চেপে ঊধ্বশ্বাসে ছুটে যেতে যেতে হো হো করে হাসতে থাকেন সুলতান।

সুলতানকে খোশ মেজাতে আসতে দেখে উজির জাফর বলে, মনে হচ্ছে ওখানে খুব চমৎকার একখানা বাগান পেয়ে অনেকটা সময় জিরিয়ে এলেন, জাঁহাপনা?

খলিফা হারুন অল রসিদ তখনও প্রাণখোলা হাসি হেসেই চলেছেন। জাফর বলে, মনে হচ্ছে, আপনি নতুন ভাবে খুশি হবার পথ খুঁজে পেয়েছেন। কী ব্যাপার, পানি খেতে আপনার এতো দেরি হলো কেন?

খলিফা হেসে বলেন, সে বড় মজার ব্যাপার। এমন নির্মল আনন্দ বহুদিন আমি পাইনি, জাফর। বড় ভালো কেটেছে সময়টুকু।

তিনি জেলের সঙ্গে তার দেখা হওয়া ইত্যাদির কাহিনী রসিয়ে রসিয়ে বলতে লাগলেন।

সব শুনে জাফর বললো, যাক শুনে আসবস্ত হলাম। আপনার গায়ের লাল শেরোয়ানী না দেখে আমার তো আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হয়ে গিয়েছিলো আর কী? এতক্ষণে বুঝলাম, না মারাত্মক কিছু না। আপনি যদি অনুমতি করেন তবে জেলের কাছ থেকে আপনার মহামূল্যবান কুর্তাটা আমি কিনে নিয়ে আসতে পারি।

সুলতান আরও উচ্চস্বরে হো হো করে হেসে ওঠেন।

তুমি কী ভাবছো এখনও সেটা আগের মতো মূল্যবানই আছে? ওটার তিন ভাগের একভাগ কেটে সে তার পাগড়ী বানিয়ে দফা শেষ করে দিয়েছে। তবে হ্যাঁ, মাছ ধরার শখ আমি যোলআনা মিটিয়ে নিয়েছি। ঐ রকম আসুরিক ব্যায়াম-চর্চার আর দরকার নাই আমার। এবং প্রথম বারে যা তুলতে পেরেছি, কে জানে, সারাজীবন ধরে জাল ফেললেও হয়তো আর তেমনটি হবে না। এক খেপেই বাজিমাত করে দিয়েছি। এতো মাছ উঠেছে, রাখবার মতো পাত্র নাই। তাই আমার সদাশয় মনিব বাজার থেকে দুটো বড় গোছের ঝুড়ি কেনার জন্য পাঠিয়েছে।

জাফর বলে, জাঁহাপনা কী মনে করেন, তার মহামান্য মালিককে একটু মার দিয়ে শিক্ষা দেওয়া দরকার?

– না না, মোটেই না। বরং আমাকে পাহারা দেবার জন্য তোমার সাঙ্গপাঙ্গরা যারা আশে-পাশেই ঘুর ঘুর করছে তাদের সব্বাইকে বলে দাও। এক একটা মাছ, এক এক দিনার দামে জেলের কাছ থেকে কিনে আনুক তারা।

জাফর তখন সমস্ত সিপাই পেয়াদাদের ডেকে বললো, তোমরা সবাই এক এক করে নদীর ধারে যাও। এবং সুলতানের জন্য মাছ নিয়ে এসো।

তক্ষুনি সকলে জাফরের নির্দেশ মতো পাহাড়ের পাদদেশে টাইগ্রিস নদীর উপকূলের দিকে ধাবিত হলো। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা চড়ুই-এর আঁকের মতো ঘিরে ধরলো সেই জেলেকে।

-এ্যাঁই ব্যাটা জেলে, কী মাছ ধরেছিস দেখি, দে?

জেলে বলে, ফেল কড়ি মাখ তেল, তুমি কি আমার পর? মাছ নেবে-পয়সা এনেছ?

—চোপ বাঁদর, সুলতান মাছ খাবে, এই তোর বাপের ভাগ্যি, আবার পয়সা কী র‍্যা?

এই বলে সবাই মিলে কেড়ে কুড়ে নিলো ওর মাছগুলো। জেলে প্রাণপণে বাধা দেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না। একটু পরেই দু’চার ঘা খাওয়ার পর মালুম হতে লাগলো, নাঃ, লোকগুলো নেহাত ফালতু আদমি নয়। লড়াইএর কায়দা করত ওরা খুব ভালো করেই জানে। তা না হলে, তার মতো পালোয়ানের হাত থেকে মাছ কেড়ে কেউ পার পেয়ে যেত?

কোন রকম দু’হাতে দুটো মাছ শক্ত করে ধরে সে নদীর জলে ঝাপ দিলো। এক ডুবে অনেকটা ভেতরে চলে গিয়ে ভেসে উঠে মাছ দুটো ওপরের দিক করে দেখাতে দেখাতে সাফাই গাইতে থাকে, এই দেখো, সব নিতে পারনি তোমরা। আমি দুটো নিয়ে এসেছি। দাঁড়াও, সবুর করো, আমার সানাই-এর পোঁ ফিরে আসুক, তারপর সে তোমাদের মজাটা টের পাইয়ে দেবে খন।

সবাই জেলের এই অদ্ভুত কাণ্ড দেখছিলো। সেই ফাঁকে সব মাছ লাফিয়ে লাফিয়ে নদীর জলে পড়ে পালিয়ে গেলো। প্রহরীরা দেখলো, একটা মাছও নাই। তখন এক নিগ্রো নফর চিৎকার করে জেলেকে ওপরে উঠে আসতে বলে। তার আশা ঐ মাছ দু’টোও অন্তত সে নিয়ে যাবে সুলতানের কাছে।

–ও জেলের পো, ওপরে উঠে এসো ভাই।

জেলে ক্ষেপে ওঠে, বিদেয় হ, বানচোৎরা।

এই গালাগালে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে নিগ্রোটা। হাতের বর্শা উঁচিয়ে ধরে, এখনও বলছি, উঠে আসবে তো এসো, নইলে এই বর্শার ফলা তোমার দাবনায় গেঁথে যাবে।

জেলে খলিফা আঁৎকে উঠে, ওরে হতভাগা পাজি ছুঁচো, এটা ছুঁড়িস্ নে বাবা, তাহলে আর বাঁচবো না। এই নে, দিচ্ছি তোকে এই মাছ দুটো। মাছের চেয়ে আমার জানের দাম অনেক বেশি।

সাঁতার কেটে সে উপকূলের দিকে এগিয়ে এসে মাছ দুটো নিগ্রোটার পায়ের কাছে ছুঁড়ে দেয়।

নিগ্রোটা মাছ দুটোকে একখানা বাহারী রুমালে বেঁধে কুর্তার জেবে হাত ঢোকায়।

—নাঃ, তোমার নসীবই খারাপ জেলের পো, একটা দিরহামও নাই। যাই হোক কাল সকালে যদি প্রাসাদে গিয়ে আমাকে, মানে নিগ্রো খোজা সাঁদালকে খোঁজ করো, ভালো ইনাম পাবে।

জেলে খলিফা আর একটি বাক্যও উচ্চারণ করে না। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে থাকে নিগ্রোটাকে। আর মনে মনে মুণ্ডপাত করে তার।

নিগ্রোটা চলে গেলে জল থেকে উঠে বাজারের পথ ধরে চলতে থাকে সে।

এই সময় ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো তেষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

খলিফা জেলেকে দেখে রাস্তার লোক ঘিরে ধরে। তার দেহে অন্ততঃ হাজার দিনারের মহামূল্যবান এক জলসিক্ত শেরোয়ানী। সবাই অবাক হয়ে দেখে আর ভাবে, এই গরীব জেলেটা এ পোশাক পেলো কোথায়?

সুলতানের দর্জির দোকানের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় দর্জি হতবুদ্ধি হয়ে তাকায় খলিফার দিকে। হারুন অল রসিদের এ পোশাক তার নিজের হাতের তৈরি। কিন্তু এই জেলেটা তা পেলে কী করে?

–হ্যাঁ গো, এই পোশাকটা তুমি পেলে কোথায়?

খলিফা খিস্তি করে ওঠে, তাতে তোমার কী হে শালা? তুমি কে নটবর, জবাবদিহি করতে হবে? তা যদি জানার ইচ্ছে হয় তো শুনে রাখ, এটা নজরানা দিয়েছে আমার সাগরেদ। তাকে আমি মাছ ধরার ব্যবসায় তালিম দিয়েছি। আমার জামা-কাপড় সে ব্যাটা চুরি করেছিলো। যদি না দিত এটা, আমি তার হাত কেটে-ফেলে দিতাম।

দর্জি বুঝলো কোনও ভাবে সুলতানের সঙ্গে এই জেলের যোগাযোগ হয়েছিলো। এবং তিনি তার সহজাত মজা তামাশার ঝেকেই এই কাণ্ড করেছেন। তাই সে বলে, ও, বুঝেছি। ঠিক আছে, তোমার কাজে যাও।

এরপর নিজের ঘরে ফিরে আসে জেলে।

আমরা জানি, সুলতান কিছু মুক্ত বায়ু সেবনের উদ্দেশ্যে জাফরকে সঙ্গে নিয়ে শহর ছেড়ে বেশ কিছুটা দূরে বেড়াতে বেরিয়েছিলো। এবং জেলে খলিফার সাহচর্যে এসে প্রচুর নির্মল আনন্দ উপভোগ করতে পেরেছিলেন। এতোদিনের মনের জড়তা কাটিয়ে আবার সজীব কর্মমুখর হওয়ার উৎসাহ প্রেরণা সঞ্চয় করে এসেছিলেন। এর ফলে মেরিজানের মোহ অনেকটা স্তিমিত হয়ে এসেছিলো। এই বাঁদীটা একটা দুষ্ট গ্রহের মতো তার জীবনটাকে গ্রাস। করে বসেছিলো এই একটা মাস। দরবারের কাজকর্ম যেমন সিকেয় উঠেছিলো, তেমনি চাচার মেয়ে বেগম জুবেদাও বিষাদে বিষণ্ণ হয়ে উঠেছিলো। নাওয়া-খাওয়া সে প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলো বলা যায়। এর অবশ্য একটাই কারণ, মেয়েদের স্বভাবসুলভ হিংসা। তার স্বামীকে নিয়ে অন্য মেয়ে ফস্টিনস্টি করবে, গুণ-তুক করে বশে রাখবে, তা কোনও বেগম-বিবিই সহ্য করতে পারে না।

বেগমসাহেবা মওকা খুঁজছিলো এতোদিন। এই শয়তানী বাঁদীটাকে একবার কজায় পেলে ওর জন্মের সাধ শেষ করে দেবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে সেই সুযোেগ গতকাল সে পেয়েছিলো। এবং তার সদ্ব্যবহার করতেও কসুর করেনি জুবেদা বেগম।

যখন সে শুনলো, সুলতান জাফরকে সঙ্গে নিয়ে ভ্রমণ বিহারে বেরিয়েছেন তখন বাঁদীটাকে নিমন্ত্রণের নাম করে তার কামরায় ডেকে পাঠালো। খোজাকে বললো, যা তাকে গিয়ে বল, অনেকদিন সে প্রাসাদে এসেছে, অথচ আমি সুলতানের খাস বেগম, আমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি। তাই আজ দুপুরে তার সম্মানে আমি একটা ভোজসভার আয়োজন করেছি। সে যেন অতি অবশ্য এক্ষুনি চলে আসে আমার কামরায়। শুনেছি সে নাচে-গানে বাজনায় চৌকস। সুলতান তো তার প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সে যদি এসে আমাকে দু-একটা গান বাজনা শোনায়, খুব খুশি হবো।

খোজা বেগমের দূত হয়ে গেলো মেরিজানের কামরায়। আদাব-কুর্নিশ জানিয়ে বললো, মালকিন, গোস্তাকি মাফ করবেন। আমি এসেছি খলিফা হারুন অল রসিদের চাচা কাসিমের কন্যা এবং সুলতানের একমাত্র খাস বেগম জুবেদা সাহেবার কাছ থেকে। আপনি হারেমে এসেছেন এক মাস হলো। এ যাবত তার সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ আলাপ-পরিচয় হয়নি। সুলতানের মুখে আপনার নানা গুণ-কীর্তন শুনে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। তাই আপনার সঙ্গে আলাপ করতে ব্যর্থ হয়ে উঠেছেন। আজ দুপুরে শুধুমাত্র আপনারই সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেছেন তিনি। তার একান্ত অনুরোধ, আপনি যদি আমার সঙ্গে তার কামরায় গিয়ে খানাপিনায় সঙ্গ দেন এবং আপনার দু-একটা মধুর সঙ্গীত শোনান তবে কৃতার্থ হবেন তিনি।

মেরিজান বলে, এ তো আমার পরম সৌভাগ্যের কথা। তিনি পাঠিয়েছেন, যাবো না? চলো, আমি তৈরি।

বীণ হাতে করে সে উঠে দাঁড়ায়। খোজাটা এগিয়ে এসে হাত পেতে বলে, মেহেরবানী করে যন্ত্রটা আমার হাতে দিন মালকিন।

জুবেদা, তার নিজস্ব দরবার-মহলে এই ভোজসভার ব্যবস্থা করেছিলো। মেরিজান প্রবেশ করে প্রথমে সোনার তখতে আসীন বেগম জুবেদাকে আভূমি আনত হয়ে দীর্ঘ কুর্নিশ জানালো। তারপর উপস্থিত অন্যান্য মেয়েদের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে থাকলো।

অনেকটা দূরে স্বর্ণসিংহাসনে বসে ফিনফিনে পাতলা রেশমী। বোরখার জাফরীকাটা নাকাবের মধ্য দিয়ে এক দৃষ্টে মেরিজানকে। নিরীক্ষণ করতে থাকলো বেগম জুবেদা।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চৌষট্টিতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

সত্যিই মেয়েটি অসাধারণ রূপসী বটে। যেমন টানাটানা চোখ, তেমনি, তেমনি ছোট ললাট। গায়ের রং দুধে-আলতায়। কী সুন্দর অধর—একেবারে পাকা আঙ্গুরের মতো টসটসে। গালে গুলাবী আভা। ছোট অথচ উন্নত নাকের একপাশে কালো একটা তিল সারা মুখটাকে আরও বেশি সুন্দর করে তুলেছে। জুবেদা মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে। মেয়েটির মরালের মত গ্রীবা। কচি ডালিমের মতো সুডৌল সুগঠিত দুটি স্তন, ক্ষীণ কটি, ভারি নিতম্ব—যতই দেখে জুবেদার বুকে হিংসার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। কিন্তু মুখে মধু ঢেলে বলে, আহা, অত শরম কীসের ভাই। এখানে আমরা সবাই সুলতানের পেয়ারের বাঁদী বেগম। সহজ হয়ে দিলখোলা মেজাজে হাসি মজাক করো সকলের সঙ্গে, তবে তো আসর জমবে!

মেরিজান মাথা নুইয়ে বলে, তাই হবে, বেগমসাহেবা।

—অত কায়দা কেতা দেখাচ্ছো কেন, ভাই। বললাম না সবাই আমরা এক। তুমি বাঁদী আমি না হয় বেগম। নাম আলাদা হলেও সুলতানের চোখে সকলেই আমরা সমান। সবাই আমরা একই বৃন্তের ফুল। আজ অনেক দিন বাদে সকলে যখন এক জায়গায় মিলিত হয়েছি, তখন আজ আর কারো মনে কোন জড়তা সঙ্কোচ রেখ না, ভাই. খাও, পিও, নাচো, হাসো, গাও।

একটু থামলো জুবেদা বেগম, তারপর জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা মেরিজান, সুলতানের মুখে শুনেছি—তোমার নাকি ভারি সুন্দর মিষ্টি গলা। কী ভাই, শোনাবে দু একটা গান?

মেরিজান জুবেদার এই রকম সুন্দর সহজ-সাধারণ আচরণ প্রত্যাশা করেনি। সে ভেবেছিলো, সুলতানের পেয়ারের খাস বেগম—দেমাকেই মাটিতে পা পড়বে না। কিন্তু সে-সব ধারণা সব ভুল হয়ে গেলো তার। কত সুন্দর সহজ ভাবে নিমেষে মানুষকে আপন করে নিতে পারে সে। উৎফুল্ল হয়ে জবাব দেয়, নিশ্চয়ই শোনাবো। আপনি শুনতে চাইছেন, শোনাবো না? ভালো মন্দ জানি না—শুনে ভালো লাগে বাহবা দেবেন। আর যদি ভালো না লাগাতে পারি—সে তো আমার দোষ।

মেরিজান গান ধরে। সুললিত মধুর কণ্ঠ। সুরের মূর্ঘনায় মোহিত হয়ে যায় সকলে। এক সে এক করে চৌদ্দখানা গান গায় সে। জুবেদা ভাবে, নাঃ, যা শুনেছিলো তার চেয়ে অনেক বেশি গুণবতী সে। তার গলায় কী এক যাদু আছে, গান শুনতে শুনতে অন্য জগতে উধাও হয়ে যেত হয়।

গান শেষ হলে, অপূর্ব ছন্দ-তালে নাচতে থাকে মেরিজান। এমন মনোহর নাচ অনেক দিন দেখেনি জুবেদা। ঈর্ষায় অন্তর জ্বলে ওঠে। এই সময় ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পঁয়ষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে থাকে।

নাচ শেষ হতে হাততালি দিয়ে প্রশংসা জানায় জুবেদা।

—চমৎকার! বড় সুন্দর তোমার নাচগান, মেরিজান। খুব আনন্দ পেলাম, ভাই। আচ্ছা এবার এসো, আমরা খানাপিনায় বসি।

বিরাট টেবিলে নানা রকমের সুগন্ধী মুখরোচক শাহী খানাপিনার এলাহী ব্যবস্থা করা হয়েছিলো।

জুবেদা নিজের হাতে মেরিজানের সামনে খাবারের রেকাবীগুলো সাজিয়ে দেয়। বলে, নাও ভাই, শরম করো না। পেটভরে খেয়ে নাও।

মেরিজান বলে, আপনারা?

—আমরাও তোমার সঙ্গেই বসছি। আমাদের দিচ্ছে দাসী বাঁদীরা। তুমি আমার ঘরে আজ প্রথম এলে, তাই নিজের হাতেই তোমাকে দিলাম—তা না হলে নিন্দে হবে যে, ভাই।

সবেমাত্র একগ্রাস মুখে পুরেছে, হঠাৎ মাথাটা কেমন ঝিম ঝিম করে ওঠে মেরিজানের। জলের গেলাসের দিকে হাত বাড়ায়। কিন্তু গেলাস আর হাতে ওঠাতে পারে না। মাথাটা ঢলে পড়ে ঘাড়ের ওপর।

বুঝতে নিশ্চয়ই অসুবিধে হচ্ছে না আপনাদের যে, ঈর্ষান্বিতা জুবেদা মেরিজানের খাবারে মারাত্মক আফিং-এর ডেলা মিশিয়ে রেখেছিলো। এবং এ তারই অবশ্যম্ভাবী এই ফল।

পলকের মধ্যে মেরিজানের দেহ লুটিয়ে পড়লো মেঝের ওপর। কপট উৎকণ্ঠা দেখিয়ে ছুটে আসে, জুবেদা।

—এ কি! কী হলো? মেরিজান? মেরিজান? কী হলো ভাই? কথা বলো?

কিন্তু কে কথা বলবে? তখন সে আফিঙের আরকে জারিত হয়ে গেছে। জুবেদা খোজাকে বললো, আর দেরি করিস নে। শীগগির নিয়ে যা আমার ঘরে। আমি যাচ্ছি এক্ষুনি।

জুবেদা তার মহলের একটি গুপ্ত প্রকোষ্ঠে আবদ্ধ করে রাখলো—মেরিজানকে। কিছুক্ষণ পরে ঘোষণা করে দিলো,খাবার টেবিলে গলায় মাংসের টুকরো আটকে দম বন্ধ হয়ে মেরিজান মারা গেছে।

অল্প সময়ের মধ্যে জুবেদার অনুচররা প্রাসাদ-সংলগ্ন বাগিচায় একটা শ্বেতপাথরের তাজিয়া বানিয়ে ফেললো।

খলিফা বাইরের ভ্রমণ-সফর শেষ করে প্রাসাদে ফিরে এসে প্রথমে খোজার কাছে তাঁর প্রাণাধিক প্রিয়া বাঁদীর কুশল জিজ্ঞাসা করলেন, জুবেদা পূর্বাহ্নেই খোজাকে ভয় দেখিয়ে রেখেছিলো, খবরদার, সুলতান যদি এর বিন্দু বিসর্গ জানতে পারেন, তোর ধরে মুণ্ডু আর রাখবো না। খোজা চোখের জল মুছতে মুছতে বলে, ধর্মাবতার, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনি চলে যাওয়ার পর তিনি খেতে বসেছিলেন। কিন্তু কপালের লেখা, মুখের মাংস গলায় আটকে দম বন্ধ হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই মারা গেলেন। হাকিম বদ্যি ডাকবার পর্যন্ত ফুরসত দিলেন না তিনি। শোকের সমুদ্রে আমাদের ভাসিয়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন। পরম ভাগ্যবতী নারী। না হলে এমন মৃত্যু কারো হয় না, জাঁহাপনা।

জাঁহাপনার তখন ঐ সব তত্ত্বকথা শোনার মতো অবস্থা নয়। সে পাগলের মতো ছুটে গেলো প্রাসাদে। মেরিজানের কামরায়। সেখানে তার সাজপোশাক, সেতার বেহালা সরোদ, ঘুঙুর, নূপুর মল সবই যেমন ছিলো ঠিক আছে। শুধু সে নাই। প্রায় উন্মাদের মতো সারা প্রাসাদ দাপিয়ে বেড়াতে লাগলেন তিনি। এক সময় বাগিচার অভ্যন্তরে নকল তাজিয়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। চোখের জল আর কিছুতেই বাঁধ মানে না। এক অসহায় শিশুর মতো কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন তিনি।

ঘণ্টাখানেক এইভাবে কাটানোর পর নিজের ঘরে এসে দরজা বন্ধ করলেন সুলতান। বাদী বেগম ইয়ার দোস্ত উজির আমির সকলের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ বন্ধ করে দিলেন।

জুবেদা দেখলো, তার সব ফিকিরই খেটে গেছে। তখন সে একটা বড় গোছের সাজপোশাকের বাক্সে মেরিজানের হতচৈতন্য দেহটা ভরে ডালা বন্ধ করে দু’জন একান্ত অনুরক্ত খোজার মাথায় চাপিয়ে দিয়ে বললো, যা বাজারে নিয়ে যা। যাকে প্রথম খদ্দের পাবি, যে দামে হোক, বেচে দিবি। বলবি, ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। এই অবস্থাতেই নিতে হবে।

এবার আমরা অন্য প্রসঙ্গে যাই।

পরদিন সকালে জেলে খলিফার ঘুম ভাঙ্গে। প্রথমেই মনে পড়ে, সেই আবলুস কালো, নিগ্রোটার কথা। সে বলেছিলো, মাছ দু’টোর দাম দেবে। সুলতানের প্রাসাদে গিয়ে তার নাম সাঁদাল বলে খোঁজ করলেই হবে। কিন্তু সে যদি তার কথা না রাখে, খলিফা উত্তেজিত হয়ে ওঠে, তা হলে ঐ গঙ্গামুখোর থ্যাবড়া নাক আমি ঘুষি মেরে ফাটিয়ে দিয়ে আসবো।

প্রাসাদের সদর ফটকের সামনে এসে এদিক ওদিক উঁকি ঝুঁকি মেরে সাঁদালকে খুঁজতে চেষ্টা করে জেলে খলিফা। ফটকের পাহারায় ছিলো যে প্রহরী তড়পে তেড়ে আসে সে, এ্যাঁই—কুত্তাকা বাচ্চা, ইধার কেয়া কাম, ভাগো হিয়াসে।

ফটকের ওপাশে সঙ্গী সাথী পরিবৃত হয়ে কাছেই বসেছিলো সাঁদাল। প্রহরীর তর্জনে সে মুখ বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করে, কী ব্যাপার। হঠাৎ খলিফাঁকে দেখতে পেয়ে একগাল হেসে বলে, আরে এসো, এসো ভাইসাব, তোমার জন্যেই বসে আছি।

জেলে গম্ভীরভাবে বলে, তা তো থাকতেই হবে। আমার মাছের দামটা

সাঁদাল ব্যস্ত হয়ে ওঠে, আরে কী আশ্চর্য, দাম তত নিশ্চয়ই পাবে। সঙ্গে আরও কিছু বকশিশও পাবে। দাঁড়াও দাঁড়াও, এক্ষুনি দিয়ে দিচ্ছি তোমার দামটা।

এই বলে খোজাটা কুর্তার জেবে হাত ঢোকায়। ঠিক তক্ষুনি উজির জাফর, সাঁদাল-সাঁদাল বলে চিৎকার করে ডেকে ওঠে।

সাঁদাল জেলের দিকে তাকায়, এক পলক, ঐ-উজির ডাকছেন। শুনে আসি আগে। যাবো আর আসবো। এসেই তোমার দাম মিটিয়ে দিচ্ছি আমি। ততক্ষণে—এই টুলটায় বসো তুমি।

সাঁদাল ছুটতে ছুটতে দরবারে ঢুকে যায়। জেলে খলিফা হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকে সেখানে। রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহারাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ছেষট্টিতম রজনী : আবার সে বলতে থাকে।

খোজা নফর চাকর প্রহরীরা ঘিরে থাকে জেলে খলিফাঁকে। তারা জানে সুলতানের পছন্দ মতো এই জেলের মাছই এসেছে তার প্রাসাদে। সুতরাং সে তো আর যে-সে মেকদারের মানুষ হতে পারে না। তাই খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে তার সান্নিধ্যে থাকতে পেরে প্রাসাদপুত্ররা আত্মপ্রসাদ লাভ করতে থাকে।

অনেকক্ষণ কেটে যায়। সাঁদাল সেই চলে গেছে—আর ফেরার নাম নাই। খলিফা জেলে প্রথমে অধৈর্য, পরে সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। লোকটা ধাপ্পাবাজ নয় তো? হয়তো এই হুট করে কেটে পড়া—এও তার একটা বাহানা। কিন্তু সে-ও জেলের পো, খলিফা। তার সঙ্গে ঐ সব গাঁড়চালাকী চলবে না। মেরে লাস নামিয়ে রেখে যাবে। খলিফা হাঁক ছাড়লো—হেই, সাঁদাল—

কিন্তু কোনও জবাব পেলো না। সাঁদাল তখন জাফরের সঙ্গে জরুরী কথা বলতে ব্যস্ত ব্যাপৃত ছিলো। জেলে খলিফা আবার একটু গলা চড়া গলায় ডাকে, এই যে—কদম্বপিয়ারী, কই, কোথায় গেলে, একবার এদিকে এসো তো নটবর। আমার যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পা ব্যথা হয়ে গেলো, বাপজান! আমার পাওনাগণ্ডা মিটিয়ে দিয়ে যাও, আমি বিদেয় হই।

জাফরের সামনে দাঁড়িয়ে সাঁদাল জেলের ঐ সুমধুর সম্ভাষণ শুনে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু সাড়া না দিয়ে বরং আরও তৎপর হয়ে ওঠে কথাবার্তায়। ভাবখানা এই—কিছুই তার কানে যায়নি।

কিন্তু জেলের পো খলিফা তো ছাড়বার পাত্র নয়। এবার সে দরবার-মহলের আরও কাছে সরে আসে। খ্যানখ্যানে গলায় সাদর সম্ভাষণ জানাতে থাকে, ওহে মিথুক জাসু, একবার দয়া করে গতরটা বাইরে বের করে আনো। বলি, লোক ঠকানোর এই ধান্দা কতকাল ধরে চালাচ্ছো। তাঁকে নাই ফুটো পয়সা, বাদশাহী চাল আছে যোল আনা। বলে কিনা-যাওয়া। মাত্র পেয়ে যাবে দাম। ওরে আমার দেনেওলা আমির রে! এখনও বলছি, এই গরীবের পয়সা কটা মেরে তুমি সুলতান বনবে না। মেহেরবানী করে আমার ন্যায্য পাওনাটা দিয়ে দাও।

এইবার উজির জাফর কথাগুলো পরিষ্কার শুনতে পায়। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। খোজাকে জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার, লোকটা কে? কী সব বলছে সে? কে তাকে ঠকিয়েছে?

নিগ্রো খোজাটা বলে, ঐ লোকটাকে আপনি চেনেন না, হুজুর?

জাফর বলে, যাকে জীবনে কখনও দেখিনি, তাকে চিনবো কী করে?

খোজা বলে, কিন্তু মালিক, এই জেলের কাছ থেকেই তো আপনি আমাদের মাছ আনতে বলেছিলেন! শেষ পর্যন্ত দুটো মাছ নিয়েও এসেছিলাম। তবে তার দাম দেওয়া যায়নি। কারণ আমার কাছে পয়সা-কড়ি কিছুই ছিলো না তখন। আমি ওকে এখানে এসে দাম নিয়ে যেতে বলেছিলাম। তাই সে এসেছে। দামও মিটিয়ে দিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় আপনি তলব করলেন, তাই আর দেওয়া হয়নি। বলে এলাম, ফিরে এসে দিচ্ছি। তা, লোকটা এতো ইতর, ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে যা তা বলে গালমন্দ দিয়ে যাচ্ছে।

জাফর মুচকি হেসে বলে, আহা-হা ধীরে। খলিফা হারুন অল রসিদের মহামান্য গুরু—ওস্তাদ সে। তার নামে ঐ ধরনের অশালীন মন্তব্য করছো? তোমার তো বড় কম দুঃ সাহস নয় খোজা সর্দার! স্বয়ং সুলতান যাকে সেলাম করে কথা বলেন, তার সঙ্গে এই ব্যবহার? না-না-না, এ কিছুতেই বরদাস্ত করা যায় না। মুখ সামলে, খুব সমীহ করে কথা বলবে তার সঙ্গে।

–ওকে কিছুতেই যেতে দিও না, জাফর নির্দেশ দেয়, আমাদের কী পরম সৌভাগ্য এই দুঃসময়ে সে নিজেই এসে হাজির হয়েছে। তুমি তো জান, গতকাল প্রিয়তমা বাঁদী মেরিজান মারা যাওয়ার খবর শোনার পর থেকে সুলতান:ঘরে দোর দিয়েছেন। ইয়ার বন্ধু, বিবি বাঁদী, আমির আমলা কারো সঙ্গেই দেখা করছেন না। শোকে তিনি বড়ই কাতর হয়ে পড়েছেন, এই অবস্থায় আমাদের কোনও কথাই তিনি কানে তুলবেন না। একমাত্র এই জেলের পো-ই অসাধ্য সাধন করতে পারবে। ওর সঙ্গে সুলতানের অন্য একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। ওকে দেখামাত্র তিনি চাঙ্গা হয়ে উঠতে পারেন। তুমি যাও, ওকে একটু ভুলিয়ে ভালিয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করো। আমি খলিফার ঘরের সামনে যাই। দেখি, হাওয়া কী রকম!

সাঁদাল বললো, একাজ আপনার পক্ষেই সম্ভব, হুজুর।

উজির গেলো প্রাসাদের অন্দরে খলিফা হারুনের ঘরের সামনে আর সাঁদাল এলো প্রাসাদ-প্রাঙ্গণে খলিফা জেলের কাছে।

—হুম্ এতক্ষণে তা হলে ফিরে এলে চাঁদু।

সাঁদাল দ্বাররক্ষীকে ইশারা করে বলে, লোকটাকে আটক করো।

খলিফা খেকিয়ে ওঠে, উ, আটক করো! যেন ওর লাখ পঞ্চাশ চুরি করেছি আমি! আটক করো! আগে আমার কড়ি ফেলো, তারপর ওসব আটক করো- ফাটক করো, শোনাবে। কারো গাঁটকাটা পয়সা নয়—এ হকের পাওনা। সিধে ফেলে তারপর কথা বলো। ওসব বুজরুকি আমি শুনতে চাই না।

খলিফা জেলেকে দ্বাররক্ষী যে কী সমাদরে রাখলো, সে কথা পরে বলবো। এখন চলুন। যাই, প্রাসাদের অন্দরমহলে।

 

জাফর পা টিপে টিপে সুলতানের ঘরের সামনে এসে জানলার পর্দার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্য ১ করে, শোকে মুহ্যমান খলিফা পালঙ্ক-শয্যায় এলিয়ে পড়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন।

জাফর খুব মৃদু গলায় বলে, খোদা হাফেজ! সবই তার অপার লীলা ধর্মাবতার। তার ওপরে আর কারো কিছু জারিজুরি খাটে না। নসীবে যা লিখে রেখেছেন তিনি, মেনে তা নিতেই হবে। খোদা—আপনার মঙ্গল করুন, জাঁহাপনা।

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো সাতষট্টিতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো সুলতান। চোখে তার বিষদৃষ্টি।

-খোদা তোমার মঙ্গল করুন, জাফর। কিন্তু বেয়াদপ, কে তোমাকে এখানে আসতে বলেছে। কেন আমার হুকুম অমান্য করে বিরক্ত করতে এসেছ? সুলতানের ফরমান কী তোমার জানা নাই? কেন এসেছ এখানে?

জাফর বলে, ধর্মাবতার আপনার হুকুম না মেনে এখানে আসা আমার অন্যায় হয়েছে, আমি জানি। এবং সে জন্য যে আপনি আমাকে সমুচিত সাজা দিতেও কসুর করবেন না—তাও জানি। এ সত্ত্বেও কিন্তু আমি এলাম। কারণ, না এসে পারলাম না। আপনার গতকালের শিক্ষাগুরু—সেই জেলে খলিফা আজ সকালে প্রাসাদে এসেছে। আপনার সম্বন্ধে তার অনেক নালিশ আছে। আমি তার খানিকটা নিজের কানে শুনে এসেছি। সে বলছিলো,-খোদা মেহেরবান আমি একটা কথা কিছুতেই বুঝতে পারছি না, মানুষ এতো অধম এবং অকৃতজ্ঞ হয় কী করে। সে আমার কাছে নাড়া বাঁধলো। ওস্তাদ বলে স্বীকার করে নিলো। আমি তাকে আমার মাছ ধরা বিদ্যা শেখালাম। প্রথম খেপেই সে কামাল করে দিলো। কিন্তু হলে হবে কী, সব রসাতলে গেলো। গোচোনা হয়ে গেলো। শিক্ষাগুরুর ইজ্জৎ করতে শেখে না যে, সে যত গুণবানই হোক ওস্তাদের অভিশম্পাতে আখেরে কোনও আয় উন্নতি করতে পারে না। আগে গুরু খুশি রাখতে হবে। গুরু রুষ্ট হলে সব ভ্রষ্ট হয়। আমি ওকে বললাম যাও দু’খানা ঝুড়ি কিনে নিয়ে এসো। তা সেই যে হাওয়া হলো, আর ফিরলো না? এইভাবেই কী গুরুদক্ষিণা দিতে হয়?

জেলের এই কথা শুনে আমারও বেশ খারাপ লেগেছে। সত্যিই, ওস্তাদ বলে কথাও নিয়ে এমন ঠাট্টা রসিকতা আদৌ করা উচিত নয় আপনার। সত্যিই যদি আপনি তার কাছে শিক্ষানবীশি করতে চান করুন। আমাদের কিছু বলার নাই। আর যদি মনে করেন না, আর ওসব শিখে-টিখে কোনও লাভ নাই। তাও তাকে সাফ সাফ জানিয়ে দিন ও না ওস্তাদ কাল পর্যন্ত যা হয়ে গেছে তা হয়েছে। তারপর আর আমাদের কোন শর্ত চুক্তি রইলো না। এখন তুমি অন্য সাগরেদ তলাশ করতে পার।

কালকের পরে এই প্রথম খলিফার চোখে জল থাকা সত্বেও মুখে হাসি ফুটলো। একটু পরে তিনি অনেক পিছনের কথা স্মরণ করে হো হো করে উচ্চ স্বরে হেসে উঠলেন। হঠাৎ তার বুক থেকে ভারি পাথরের বোঝা সরে গেলো। নিজেকে মনে হতে লাগলো, উজ্জ্বল প্রাণবন্ত ডানামেলা এক পায়রা। বললেন, একটা সত্যি কথা বলতো জাফর, সত্যিই কী সে এখন প্রাসাদে?

-খোদার কসম, জাফর দিব্যি করে বলে, সে এখন সশরীরে এই প্রাসাদেই হাজির আছে।

-খোদা হাফেজ, আজ আমি তাকে সব পাওনা গণ্ডা মিটিয়ে দেব। আল্লাহ যদি তাকে এইভাবে পাঠিয়ে থাকেন যে, তার আচার-আচরণের দণ্ড-সাজা আমাকে দিয়ে দেওয়াবেন তিনি তবে তাই হোক। আর যদি তিনি ভেবে থাকেন সে আমার ইনাম এবং মর্যাদা পাবার অধিকারী, সে ভী আচ্ছা। জাফর একখানা কাগজ দাও আমাকে।

তৎক্ষণাৎ কাগজ এলো। কাগজখানা চল্লিশটা টুকরো করলেন তিনি। প্রথম কুড়িখানা জাফরের হাতে দিয়ে বললেন, এক থেকে একহাজার দিনারের যে কোনও অঙ্ক এই কুড়িখানা কাগজের যে কোনওটায় লেখা এবং সেই সঙ্গে আমার দরবার বা দপ্তরের যে কোনও পদ, তা সে খলিফা আমির উজিরই হোক বা নফর চাকরই হোক—উল্লেখ করো।

উজির আজ্ঞা মতো কুড়িখানা কাগজে কুড়িটা পদের নাম এবং নিজের ইচ্ছে মত এক থেকে এক হাজারের নানারকম সংখ্যা লিখে রাখে। এরপর বাকী কুড়ি খানা কাগজ দিয়ে সুলতান বলেন, এই কুড়িখানা কাগজে সাধারণ প্রহার থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত কুড়িটা সাজার উল্লেখ করো।

জাফর তাও লেখে। এবং সুলতানের নির্দেশমতো কাগজের টুকরোগুলো একই রকমের ভঁজ করে একখানা গামলার মধ্যে রেখে গামলাটা খলিফার দিকে এগিয়ে দেয়।

খলিফা ইস্টনাম জপ করতে থাকেন।

—আমি আমার চৌদ্দ পুরুষের হলফ করেছি, এই গামলা থেকে ঐ জেলে খলিফা যে কাগজখানা প্রথমে টানবে, তার বিধান আমি অক্ষরে অক্ষরে মানবব। তা সে যদি খলিফার’ কাগজটাই তুলতে পারে, আমি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দেবো তখ। আর যদি সে শূল, ফাসী বা ঐ রকম কোনও নিষ্করুণ সাজার কাগজ একখানা তুলে ধরে, তবে সে রেহাই পাবে না। সে সাজা তাকে নিতেই হবে—মৃত্যুদণ্ড হলেও। মুকুবের কোনও প্রশ্ন নাই। কারণ আমি পিতৃপুরুষের নামে হলফ করেছি। এ সাজা বা পুরস্কার রদ করার ক্ষমতা আমার হাতে রইলো না।

জাফরকে বললেন তিনি, নিয়ে এসে তাকে এখানে।

উজির শঙ্কিত হলো, সাধারণতঃ দেখা গেছে, গরীব দুঃখীদের নসীবে ভালো কিছু ওঠে না। হয়ত নিরীহ বেচারা মৃত্যুদণ্ডের কাগজই একখানা টেনে বসবে। তখন তার এই অকারণ মৃত্যুর জন্য সে নিজেকে ছাড়া আর কাউকেই দোষী মনে করতে পারবে না। খলিফা হলফ করেছেন। সুতরাং তখন তাঁর কাছে আর্জি জানিয়ে কোনও সুরাহা হবে না। ইয়া আল্লাহ, একি সঙ্কটে ফেললে আমাকে। এখন কী করে সেই ভাগ্যহত মানুষটাকে এখানে হাজির করবো আমি।

জাফর প্রাসাদের বাইরে এসে জেলেকে দেখতে পেয়ে প্রাসাদের অন্দরে নিয়ে আসতে চায় তাকে। কিন্তু জেলে কিছুতেই রাজি নয়। সে চেঁচামেচি চিৎকার জুড়ে দেয় হায় খোদা, এই ভোঁদড় নিগ্রোটার কথায় ভুলে কেন আমি এসেছিলাম এখানে। একি দশা হলো আমার।

মাটিতে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়ে তার-স্বরে চিকার এবং খিস্তি খেউর করতে থাকে। কিন্তু সুলতানের হুকুম, নিয়ে যেতেই হবে, জাফর খোঁজা সাঁদালকে হুকুম করে, টেনে হিচড়ে যে ভাবে হোক, নিয়ে যেতে হবে খলিফার সামনে।

সাঁদাল হিড় হিড় করে টানতে টানতে এনে হাজির করে প্রাসাদের বাইরের ঘরে। সাঁদাল বলে, খুব হুঁশিয়ার খলিফা, এখনও বলছি, ভালো মানুষের মতো গিয়ে সুলতানের সামনে দাঁড়াও। তা না হলে হয়তো এক্ষুনি তোমার গর্দান নেবার হুকুম আসবে।

ভয় পেয়ে খলিফা উঠে দাঁড়ায়। সামনে দরজায় ভারি পর্দা সরিয়ে সাঁদাল তাকে খলিফার ঘরের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়। হারুন অল তখন তখ-এ বসেছিলেন। তার দুইপাশে দাঁড়িয়েছিলো কয়েকজন সম্ভ্রান্ত আমির ওমরাহ।

খলিফা ঘরে ঢুকেই থমকে যায়। এ সে কী দেখছে? খুব ভালো করে সুলতানের চেহারাখানা নিরীক্ষণ করে হি হি করে হেসে উঠলো সে।

—অ, সানাই-এর পো তুমি এখান বাদশাহ সেজে! বহুত আচ্ছা। তুমি কী ভেবেছিলে . গতকাল নদীর ধারে ঐ ভাবে আমাকে একা ফেলে রেখে, ধোঁকা দিয়ে কেটে পড়ে খুব বাহাদুরের কাজ করেছিলে? আমি তোমাকে আমার বিদ্যা শিখিয়ে দিলাম। তার পুরস্কার কী এই বেইমানী? তোমাকে দুটো ঝুড়ি আনতে পাঠালাম, তুমি আর ফিরলে না? আমাকে না তুমি ওস্তাদ বলে মেনে নিয়েছিলে? এই কী তোমার গুরুদক্ষিণা? একপাল খোজা শকুনের মতো ঝাপিয়ে পড়ে আমাকে নাজেহাল করে ছাড়লো। তোমার ধরা সব মাছগুলো খোয়ালাম। অন্ততঃ একশোটা দিনার পাওয়া যেত বিক্রি করে। এখন তো দেখছি, এ সবই তোমার কারসাজী! কাল যাদের ওখানে দেখেছিলাম, যারা আমার মাছগুলো সব কেড়ে-কুড়ে নিয়েছিলো, মনে হচ্ছে, তারা সবাই এখানে তোমার আশেপাশে আছে! সে যাক, এখন বলো দেখি সানাই-এর পো, তোমার এই বন্দীদশাটা কী করে হলো? এইভাবে তোমাকে কয়েদ করে রেখেছে কে?

ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো আটষট্টিতম রজনী ও আবার সে বলতে শুরু করে :

সুলতান হাসলেন। সোনার গামলাটা সামনে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা ধর খলিফা। এর থেকে একটিমাত্র কাগজের মোড়ক তুলে নাও।

কিন্তু খলিফা সুলতানের কথায় আমল না দিয়ে চিৎকার করে উঠলো, হায় বাপ, এ কি কাণ্ড! সানাই ছেড়ে কী জ্যোতিষ ধরলে নাকি? গতকাল তো জেলে হতে চেয়েছিলে, আজ হয়েছ জ্যোতিষী! বাঃ বেড়ে! তবে একটা কথা জেনে রাখ সানাই-এর পো, যত বেশি রকমের ব্যবসা ধরবে, লাভের অঙ্ক কিন্তু ততই কমতে থাকবে। ধর যদি

বাধা দিয়ে জাফর বলে, থাক আর জ্ঞান দিতে হবে না। এবার একখানা মোড়ক তোলো দেখি।

জাফর ওকে তখএর দিকে ঠেলে এগিয়ে দিলো। গামলার কাছে দাঁড় করিয়ে একটা হাত টেনে নিয়ে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো তার মধ্যে।

জেলে খলিফা মুঠি করে একগাদা কাগজের মোড়ক তুলে ধরলো।

জাফর প্রায় ধমকের সুরে বললো, তোমাকে না বলা হলো, মাত্র একখানা মোড়ক তুলবে। রাখ, রেখে দাও আবার, মাত্র একখানা তোল।

এবার সে একখানা মোড়কই উঠিয়ে আনলো। মোড়কটা খুলে সে সুলতানের হাতে দেয়, এই নাও সানাই-এর পো, দ্যাখ, কী উঠেছে আমার নসীবে। ঠিক ঠিক বাতাবে, কিছু লুকাবে না কিন্তু।

সুলতান কাগজখানা দেখে গম্ভীর মুখে জাফরের হাতে দেয়। জাফরের মুখখানা আরও কালো হয়ে যায়। লেখা ছিলো : একশোটা চাবুকের ঘা।

তৎক্ষণাৎ মাসরুরকে ডাকা হলো। এবং সপাং সপাং করে একশো চাবুকের আঘাত পড়লো খলিফার পিঠে। কিন্তু ওর তাতে ভাব-বৈলক্ষণ্য দেখা গেলো না। যেন তেমন কিছুই হয় নি।

জাফর এবার আর্জি জানায়, আমার মনে হয়, এই গরীব বেচারাকে আর একটা সুযোগ দেওয়া দরকার। ধর্মাবতার যদি আজ্ঞা করেন, তবে খলিফা আর একবার মোড়ক তুলে ভাগ্য চাই করতে পারে। আহা, অনেক মার খেয়েছে সে।

—তুমি তো বড় বেহুদা হে জাফর, সুলতান কী তার কথার খেলাপ করবে? হয়তো এবার সে ফাঁসীর কাগজখানাই তুলে বসতে পারে, ওর মৃত্যু দেখবারই কী বাসনা হয়েছে তোমার?

জাফর বলে, শোভান আল্লাহ, এর চাইতে ফাঁসীর কাগজ ভোলাই বুঝি ভালো ছিলো ধর্মাবতার।

-তাই নাকি? ঠিক আছে, তোমার কথাই থাক। তোলো দেখি হে আর একবার। কিন্তু খলিফা বেঁকে বসলো, খোদা তোমাদের দুধে-ভাতে রাখুন। অত ভালোয় আমার কাজ নাই। চাই না আমি আমির বাদশাহ হতে, মাথায় থাক তোমার এই জ্যোতিষ খেলা। শোনো সানাই-এর পো আর ও কাজটি হচ্ছে না আমাকে দিয়ে।

জাফর বলে, আমি বলছি, তোমার বরাত খুলবে। ভালো করে নেড়ে-চেড়ে আর একখানি তোলো।

খলিফা নিমরাজি হয়ে গামলার মধ্যে হাত ঢাকায়। একখানা মোড়ক তুলে জাফরের হাতে এগিয়ে দেয়। জাফর খুলে দেখে চুপ করে যায়।

-কী, কী হলো? চুপ করে গেলে কেন, উজির? বলো, কী লেখা আছে? কাগজখানা সুলতানের হাতে তুলে দিতে দিতে সে বলে, কিছুই লেখা নাই, জাঁহাপনা, একেবারে সাদা।

তোমাকে বলেছিলাম না, ওর কপালে ভালো কিছু নাই। যাক, এবার বিদায় করে দাও।

জাফর বললো, এটা তো ঠিক যাচাই হলো না, ধর্মাবতার।

–ঠিক আছে, আর একবার তুলতে বলো, কিন্তু মনে থাকে যেন, এই-ই শেষ বার। সে-বারে সে যে কাগজখানা তুললো তাতে লেখাছিলো-এক দিনার।

খলিফা জেলে শাপ-শাপান্ত করে, নিপাত যাও, সানাই-এর পো। একশো ঘা চাবুকের বদলে দিচ্ছ মাত্র একটা দিনার! এর প্রতিফল তুমি পাবে আল্লাহর দরবারে—শেষ বিচারের দিন।

সুলতান অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। জাফর আর এই না-দায়ক পরিহাস সহ্য করতে পারছিলো না। খলিফাঁকে সে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে চলে গেলো।

ভোর হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে রইলো।

 

পাঁচশো উনসত্তরতম রজনী : আবার সে বলতে থাকে–

সেই হতভাগ্য জেলে যখন মনের দুঃখে প্রাসাদের সদর ফটক দিয়ে নিষ্ক্রান্ত হয়ে যাচ্ছিল, তখন দূর থেকে ছুটে এসে নিগ্রো খোজা সাঁদাল ও পথরোধ করে দাঁড়ালো, ভাগ না দিয়ে পালাচ্ছো যে বড়!

কীসের ভাগ?

-বাঃ, সুলতানের ঘরে দিয়ে এলাম। ইনাম বকশিশ যা পেয়েছ হিসা মতো তার আদ্দেক ভাগ দেবে না আমাকে? এটা তো আমার হক মতো ন্যায্য পাওনা।

খলিফা দাঁত মুখ খিচিয়ে বলে, হকের পাওনা? তা নেবে, নাও। আমি যে একশো ঘা চাবুক খেয়েছি—তার আদ্দেক নেবে? নিতে পারবে? আর এই নাও একটা দিনার নগদ পেয়েছি। এটার আর আদ্দেক না, পুরোটাই তুমি নাও।

এই বলে দিনারটা খোজা সাঁদালের মুখে ছুঁড়ে মারলো সে। তারপর হন হন করে ছুটতে থাকলো। মুদ্রাটা কুড়িয়ে নিয়ে খোজা সাঁদাল দৌড়ে এসে খলিফার হাতে একটা থলে গুঁজে দেয়।

আরে, পালাচ্ছো কোথায়? তোমার মাছের দাম নেবে না? এই নাও, একশো দিনার আছে। আর এই নাও তোমার সেই এক দিনার।

এতক্ষণে খলিফার মুখে হাসি ফোটে। লোকটাকে যত খারাপ সে ভেবেছিলো আসলে . ততটা খারাপ নয়। তা না হলে মাত্র দুটো মাছের দাম একশো দিনার কেউ দেয়?

বুকের মধ্যে দিনারের থলেটা লুকিয়ে সে দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে চলতে থাকে।

বাঁদী-বাজারের পাশ কাটিয়ে বাড়ি পৌঁছতে হয়। খলিফা দেখলো, দুটি লোক একটা লম্বা বাক্স সামনে করে বিচিত্র ভঙ্গীতে হাঁক ডাক করছে, এই যে বণিক সওদাগর সাহেবরা—দেখে যান, কম দামে ভালো সওদা ঘরে নিয়ে যান।

খলিফা থমকে দাঁড়ায়। কম দামে ভালো সওদা। পায়ে পায়ে সে ওদের কাছে আসে। জিজ্ঞেস করে, কী গো, কী আছে তোমাদের বাক্সে?

একজন বলে, বেগম জুবেদা নিলামে পাঠিয়েছেন। যা আছে তা বাক্সেই আছে। আগে থেকে কিছু দেখা যাবে না, বলা যাবে না। যদি ইচ্ছা করেন নিলাম ডাকতে পারেন। হারেমের মালবহুত সস্তায় বিকিয়ে যাবে। কে নেবেন আসুন।

অনেকেই ভিড় করে আসে। একজন দর দেয়—কুড়ি দিনার। সঙ্গে সঙ্গে আর একজন বলে—পঞ্চাশ। অন্য এক ব্যক্তি হাঁকে—একশো দিনার।

লোক দু’টো তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে—এই যে মাত্র একশো দিনারে হারেমের মাল নিলাম হয়ে যাচ্ছে—মাত্র একশো দিনার। আর কেউ আছেন? একশো একশো

—একশো এক দিনার।

খলিফা দর দেয়। এরপর আর কেউ মুখ খোলে না। সুতরাং একশো এক দিনারেই ডাক শেষ হয়। খলিফা একশো এক দিনার গুণে দিয়ে বাক্সটা কাধে তুলে বাড়ির পথে রওনা হয়।

মনে মনে ভাবে স্বয়ং জুবেদার হারেমের সম্পত্তি। নিশ্চয়ই ভালো ভালো সাজ-পোশাক আছে। সুলতানের হারেমে সামান, পুরোনো হলেও অনেক দাম হবে। মনে মনে আকাশ-কুসুম রচনা করতে করতে এক সময় বাড়ির দরজায় এসে পৌঁছয়।

মাছের বাজারের পিছনে তার বাস। এক বিরাট পড়ো বাড়ি। অসংখ্য ঘর। এক একটা অধিকার করে আছে এক একটি জেলে পরিবার। সরকারী সম্পত্তি। কেউই ভাড়া দিয়ে থাকে না সেখানে। অবশ্য দেবার সঙ্গতিও কারো নাই। সবাই দিন আনে দিন খায়। তবে খলিফার মতো দৈন্যদশা কারো নয়। লোকটা নেশা ভাঙ্গ কিছু করে না, শাদী নিকাও করেনি। সুতরাং বিবি বাল-বাচ্চা বা অন্য কোনও ঘাড়ে বসে খানেওলা লোকও কেউ নাই। তার পরিবার বলতে সে মাত্র একা। তবু তার রোজ দিন খাবার জোটে না। ঘরে একটা দানা বা ফুটো পয়সা সে জমিয়ে রাখতে পারে না কখনও। যেদিন বরাতে জোটে সেদিন সে খায়, অন্যদিন নিরঙ্কু উপবাস।

দরজার সামনে বিরাট দশাসই একটা বাক্স নামাতেই পড়শীদের অনেকেই এসে ভিড় জমায়।

-কি গো খলিফা, এ জিনিস কোথেকে নিয়ে এলে?

খলিফা বলে, কিনে এনেছি।

এ ওর মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। চোখে মুখে দুর্বোধ্য আতঙ্ক বিস্ময় ফুটে ওঠে। এতো বড় একটা বাহারী বাক্স—ভিতরে কী আছে কে জানে? এই বাক্সটারই তো অনেক দাম হবে? এক দিরহাম যার ঘরে থাকে না, দিন ভিখিরির হাল যার, সে কি করে এ মাল কিনে আনবে? ধীরে ধীরে সকলের চোখে মুখে অবিশ্বাসের প্রশ্ন জেগে ওঠে, তা হা গো খলিফা, কত দামে কিনলে? পয়সা পেলে কোথায়?

—দাম? তা দাম নেহাত মন্দ না—একশো এক দিনার।

-একশো-এ-ক—দিনার? বলো কি? এতো টাকা কোথায় পেলে তুমি?

তখন খলিফা গতকালের এবং সে দিনের সমস্ত ঘটনা টিকা-টিপ্পনি সহকারে নিজের ভাষায় ব্যক্ত করলো তাদের কাছে।

—জানো তোমরা, সেই সানাই-এর পোটা এমন অকৃতজ্ঞ, নরাধম আমাকে বাগে পেয়ে একশোটা চাবুক মারিয়ে একটা মাত্র দিনার ছাড়লো? আবার ওর সাঙ্গ-পাঙ্গরা বলে কিনা, লোকটা স্বয়ং নাকি খলিফা হারুন অল রসিদ, যতো সব গাঁজা। তবে হ্যাঁ, জাতেহাবশী হলে কী হবে, নিগ্রোটা লোক ভালো। মাত্র দু’টো মাছ সে নিয়েছিলো। তার দাম হিসাবে পুরো একশোটা দিনার আমার হাতে দিলো! আরে, সেই টাকার গরমেই তো মাথাটা বিগড়ে গেলো। তা না হলে বাক্সের ভিতরে কী মাল আছে জানি না শুনি না—অমনি দুম করে পুরো পয়সাটাই বাজী ধরে বসলাম?

পড়শীরা তার এই অসম্ভব গাঁজাখুরী বানানো গপ্পো কেউই বিশ্বাস করে না। তাদের দৃঢ় প্রত্যয় হয়—এ নির্ঘাৎ চুরির মাল। প্রাসাদের হারেম থেকে চুরি করে আনা হয়েছে। দারুণ আতঙ্কে ভয়ে তারা কেঁপে ওঠে। এখুনি সারা মহল্লাটা খানাতল্লাসী করতে আসবে সুলতানের সিপাই সামন্তরা। পাড়া সুষ্ঠু সবাইকে বেঁধে নিয়ে যাবে দরবারে। তারপর একের অপরাধে অন্যের ফাঁসী—এ আর নতুন কথা কী?

-ওরে বাবা রে, কী হবে রে, বলে সকলে যে যার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো।

খলিফা বোকার মতো ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ওদের ভীত-চকিত ত্রস্ত পায়ে ছুটে চলার দিকে।

-যাঃ বাবা! এ কী হলো? সব যে কেটে পড়লো? এখন এই পেল্লাই বাক্সটা আমি ঘরে ঢোকাই কী করে?

যাই হোক, অনেক কায়দা কসরত করে অপরিসর দরজার চৌকাঠ গলিয়ে কোনও ক্রমে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসতে পারলো সে।

এতক্ষণে খলিফা বুঝতে পারে, বাক্সটা বিরাট বড়। কারণ তার ছোট্ট ঘরটার আধখানাই সে জুড়ে নিয়েছে। খলিফার মুখে হাসি ফোটে, তা মন্দ হলো না। খাট পালঙ্কের কাজ দেবে। সটান টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে সে বাক্সটার ওপর। দেখে নেয়, আরামসে শোয়া যাবে কিনা। নাঃ, একেবারে মানুষের মাপের প্রমাণ আকারের বাক্স। আনন্দে নেচে ওঠে সে। সত্যি সত্যিই সে শুয়ে পড়ে বাক্সটার ওপর।

শুয়ে শুয়ে ভাবে, না জানি ভিতরে কী আছে। নবাব বাদশাহের খেয়াল খুশির কারবার। হয়তো এমন কোনও চিজ রয়ে গেছে, যা দিয়ে তার মতো একজন গরীব জেলের সারা জিন্দগীই মহা সুখে কেটে যেতে পারে।

এই সব ভাবতে ভাবতে কখন এক সময় সে ঘুমিয়ে পড়ে। যখন ঘুম ভাঙ্গলো, রাত্রি অনেক হয়ে গেছে। সারা ঘর ঘুটঘুটে অন্ধকার। হঠাৎ তার কানে আসে একটা কঁকানীর আওয়াজ। চমকে ওঠে খলিফা। কী রে বাবা, ভূত প্রেত নাকি! ধড়মড় করে উঠে দাঁড়ায়। হাতড়াতে হাড়তাতে চিরাগটা খুঁজে পায়। জ্বালায়।

নাঃ, ঘরে তো কেউ নাই। কিন্তু আবার সেই অদ্ভুত আওয়াজ। এবার সে বুঝতে পারে শব্দটা ঐ বাক্সের ভিতর থেকেই আসছে। ডালাটা খুলতে যায়। কিন্তু তালা দিয়ে বন্ধ করা।

একটুক্ষণ কী যেন ভাবে সে। তারপর একখানা ডাণ্ডা এনে ডালাটার ভিতর ঢুকিয়ে মোচড় দিতেই মট করে খুলে যায়।

ডালাখানা তুলতেই চমকে ওঠে সে। এ কী? কী যেন নড়াচড়া করছে? মূল্যবান সাজ-পোশাক পরা পরমাসুন্দরী একটি নারী-মূর্তি। খলিফা ভয়ে শিউরে উঠে। এ নির্ঘাৎ কোন হুর-পরী বা জিন!

ছুটে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তারস্বরে চিৎকার করতে থাকে, কই গো, কে আছ, তোমরা বেরিয়ে এসো, আমার ঘরে জিন ঢুকেছে।

তার চেঁচামেচিতে পড়শীদের নিদ্রার ব্যাঘাত ঘটে। বিরক্ত হয়ে কেউ কেউ জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খিচিয়ে ওঠে, কী, এতো রাতে আরম্ভ করেছ কী? একটু ঘুমাতে দেবে না?

আল্লাহ কসম, তোমরা একবারটি আমার ঘরে এসে দ্যাখো, জিন এসেছে।

এবার তারা ক্রোধে ফেটে পড়ে, গাঁজা-ভাঙ্গ চড়িয়েছ বুঝি? যাও, ঘরে যাও। যতো সব ঝুট ঝামেলা

খলিফা হতাশ হয়ে ফিরে আসে। ততক্ষণে বাক্সের মধ্যে উঠে বসেছে মেরিজান। খলিফাঁকে দেখে সে আতঙ্কিত কণ্ঠে প্রশ্ন করে, এ আমি কোথায়?

খলিফা অবাক চোখে দেখতে থাকে, একেবারে ডানাকাটা পরী। এমন রূপ সে জীবনে কখনও দেখেনি। ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে, কে তুমি, মালকিন?

এই সময়ে ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো বাহাত্তরতম রজনী : আবার সে বলতে শুরু করে :

তখনও মেরিজানের নেশার ঘোর সবটা কাটেনি। জোর করে চোখের পাতা খোলার চেষ্টা করে বলে, আমার যুঁই চামেলীরা কোথায়?

এরা দু’জন মেরিজানের নিত্য সহচরী দাসী।

খলিফা বিস্মিত হয়ে তাকায়, এখানে যুঁই চামেলী কোথায় পাবো? অনেক দিন আগে কয়েকটা হেনা এনেছিলাম। তা এতোদিনে শুকিয়ে আমসী হয়ে গেছে বোধ হয়।

খলিফার এতম্বিধ বাক্য কানে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই সব ঘোর কেটে যায় মেরিজানের। বড় বড় চোখ মেলে সে তাকায়। খলিফার আবির্ভাব সে আন্দাজ করতে পারে না। ঘরের দৈন্যদশা অবলোকন করে বেশ বুঝতে পারে, এ তার সেই প্রাসাদ-হারেম কক্ষ নয়। যে ভাবেই হোক, অন্য কোথাও, অন্য কোনওখানে এসে পড়েছে সে।

—আমি কোথায়? তুমি কে?

খলিফার কানে যেন মধু ঢেলে দিলো কেউ। কী মিষ্টি গলার আওয়াজ। একেবারে গানের মতো। সুলতানের উদ্যানে একটা ঝরনা যা আছে। খলিফা একদিন ঐ ঝরনার পানি খেতে গিয়েছিলো। এখনও সে ঐ কলকল শব্দ শুনতে পায় মাঝে মাঝে। ভারি মিঠে লেগেছিলো সেই ঝরনার আওয়াজ। আজ, অনেকদিন পরে, আবার সেই ঝরনার গান শুনতে পেলো সে এই রূপসীর কণ্ঠে। সামান্য দুটি কথা–আমি কোথায়, কে তুমি। কিন্তু এই সামান্য প্রশ্নই অসামান্য সঙ্গীত হয়ে, ভেসে আসে তার কানে। বড় মধুর মনে হয়। ভালো লাগে।

-আমি এক অতি সাধারণ জেলে—নাম খলিফা। এই আমার দৌলতখানা। এখানেই আমি অবস্থান করি। আর ঐশ্বর্য বলতে আমার যা যা আছে তা তুমি নিজের চোখেই দেখতে পাচ্ছ। সব। এ ছাড়া অন্য কোনও কিছু বৈভব আমার নাই। সংসারে আমি একা। আমার খানাপিনায় ভাগ বসাবার দ্বিতীয় ছিলো না কেউ-আজ তুমি এলে।

–তা হলে আমি আর প্রাসাদে নাই?

—বিলকূল না। তুমি এখন আমার প্রাসাদে এসে গেছ। এবং একান্ত ভাবেই আমার, তবে—

—অর্থাৎ

—অর্থাৎ তোমাকে আমি বাঁদী-বাজার থেকে নিলামে কিনে এনেছি, আমার শেষ সম্বল নগদ একশো এক দিনারে। এখন তুমিই আমার একমাত্র ব্যক্তিগত সম্পত্তি। তবে সত্যি কথা বলছি শোনোর কেনার সময়, বাক্সের ডালা খোলার আগে পর্যন্ত আমি জানতাম না, ভিতরে তুমি আছ! নিলামের শর্ত ছিলো—‘যো হ্যাঁয়-সো হ্যাঁয়’ তাই—সওদা দেখার প্রশ্ন ওঠে না।

মেরিজান হাসে, সে হাসিতে মুক্তো ঝরে। কাজল-কালো টানা টানা আয়ত চোখ মেলে তাকায়, তুমি আমাকে না দেখেই কিনে নিয়ে এলে?

-তুমি যে আছো, তা তো জানতাম না। আসলে আদৌ কিছু আছে কি না—তাও ভাবিনি তখন। শুধু মনে করেছিলাম, বেগম জুবেদার হারেমের মাল যখন, তখন খুঁজে পেতে দেখলে, এবং বরাতে থাকলে হয়তো মণি-মুক্তো কিছু মিললেও মিলতে পারে।

এবার মেরিজান সব কিছু ইয়াদ করতে পারে। সব স্বচ্ছ মনে পড়ে ওর। জুবেদার মহলে সে নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করতে গিয়েছিলো। সেই গান, সেই নাচ, সেই খানা খেতে বসা—

ব্যস্! তারপর তো আর কিছু মনে করতে পারে না সে। কিন্তু বুঝতে কষ্ট হয় না, বয়সের ভারে প্রায় বিগত-যৌবনা, এক কালের পরমাসুন্দরী, বেগম জুবেদা তার রূপগুণের ঈর্ষায় কাতর হয়ে খাবারে ঘুমের দাওয়াই মিশিয়ে দিয়ে এইভাবে পার করে দিয়েছে তাকে।

খলিফার কথায় সব পর্দা সরে গেলো মন থেকে। কি হেসে সে জানতে চাইলো, তা পেলে কিছু তেমন মণিরত্ন?

খলিফা হঠাৎ উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে। কাব্য করে বলে ফেলে, হয়তো তারও বেশি পেয়েছি–

এই ভাবে টুকিটাকি কথাবার্তা, হাল্কা কিছু রসিকতার মধ্য দিয়ে রাত্রিটা কাটিয়ে দেয় ওরা। ভোরে মেরিজান বলে, বড্ড খিদে পেয়ে গেছে খলিফা। তোমার ঘরে তো কিছু নাই। কি করা যায়, বলো তো?

-তুমি কিছু ভেবো না, একটু অপেক্ষা করো, আমি আসছি।

বাইরে এসে হাঁক পাড়তে থাকে, এই যে শুনছে, জিনের খিদে পেয়েছে, একটু খাবার কিছু দেবে, ভাই?

একটা জানলা খুলে যায়। আধখানা আধপোড়া রুটি, আর একটা শশা ছুঁড়ে দিয়ে আবার জানলাটা দড়াম আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে যায়।

রুটির টুকরো আর শশাটা কুড়িয়ে নিয়ে ঘরে ফিরে আসে সে। বলে, এই নাও খাও।

মেরিজান বলে, কিন্তু শুকনো রুটি গলায় আটকে যাবে যে। একটু পানি নিয়ে এসো।

খালি কুঁজোটা তুলে নিয়ে আবার সে বাইরে চলে যায়। এবং একই ভাবে ডেকে হেঁকে লোক জাগিয়ে একজনের কাছ থেকে নিয়ে আসে খানিকটা পানীয় জল।

মেরিজান খুব পরিতৃপ্তি সহকারে সেই পোড়া রুটি আর শশাটা উদরস্থ করলো।

—আর কিছু চাই, মালকিন?

খলিফা ওকে তুষ্ট করার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।

কিন্তু মেরিজান বলে, বহুৎ সুক্রিয়া। আমার জন্য অনেক তকলি তোমাকে পোয়াতে হলো। এখন আর কিছু চাই না।

খলিফা বললো, তা হলে, মালকিন এবার আপনার কাহিনীটা একটু শোনান। কেন এবং কীভাবে আপনি এই বাক্সের মধ্যে বন্দী হয়ে বাঁদী-বাজারে বিক্রী হতে এলেন?

মেরিজান মধুর করে হাসতে জানে। সে হাসির বানে অনেক পাখি বিদ্ধ হয়ে লুটিয়ে পড়তে পারে। খলিফাও কেমন চঞ্চল হয়ে ওঠে।

–জুবেদা, মেরিজান বলতে থাকে, সুলতানের চাচার মেয়ে, পেয়ারের বেগম, বিকেল-বয়েসী জুবেদাই আমার এই দশা বানিয়েছে। হিংসায় সে উন্মত্ত হয়ে উঠেছিলো। নেহাত বরাত জোর আমার, বুকে ছুরিফুরি বসিয়ে একেবারে খতম করে দেয়নি!

আমার মনে হয়, সে-ই আমাকে বাক্সে ভরে বাজারে বিক্রী করতে পাঠিয়েছিলো। এবার এর আসল কারণ শোনো। সুলতান যে-কোন কারণেই হোক, আমাকে ভীষণ পেয়ার করেন। একদণ্ড চোখের আড়াল করতে চান না—এই ছিলো তার আক্রোশ। তবে খোদা মেহেরবান, তাঁর ইচ্ছাতেই আজ তোমার কাছে এসেছি আমি। তুমি আমার সঙ্গে আচার ব্যবহারও খুব ভালো করছে। এসব কথা ধর্মাবতার অবশ্যই জানবেন। এবং তার যোগ্য পুরস্কার তুমি পাবে।

খলিফা বললো, কিন্তু এই কী সেই হারুন অল রসিদ যাকে আমি মাছ-ধরা শিখিয়েছিলাম? প্রাসাদের ভিতরে সে একটা ইয়া বিরাট বড় পিরা পোলের মতো কুর্শিতে বসে থাকে?

মেরিজান বলে, ঠিক। ঠিক বলেছ।

খলিফা বলে, তা—যাই বলো না কেন, লোকটা মোটেই সুবিধের না। সানাই-এর পোঁ ধরে ধরে গাল দুখানা টোপাকুলের মতো ফুলিয়ে ফেলেছে। একেবারে ডাহা মিথুক, ঠগবাজ পাজি শয়তান। এতো বড় বদমাইশ, আমার পরণের কাপড় চুরি করলো, তারপর একশোটা চাবুক মেরে একটা দিনার ধরিয়ে দিলো হাতে! এরপর একদিন যদি পথে-ঘাটে পাই বাছাধনকে—

মেরিজান ঠোঁটে তর্জনী রেখে চোখের ইশারায় চুপ করতে বলে, ওসব কথা থাক, জানতো দেওয়ালেরও কান আছে। অন্যে কী খারাপ আচরণ করলো, না ভালো ব্যবহার করলো, সে সব নিয়ে দুঃখ করতে নাই। নিজে ভালো হও। লোকের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করো, দিল্টাকে সাফা রাখো৷ তোমার আচার ব্যবহারেই তোমার পরিচয়। শিক্ষা-দীক্ষা সবই পণ্ড হয়ে যায়, যদি তুমি নম্র বিনয়ী এবং মধুরভাষী হতে পার। সমাজের ওপর তলায় আসন পেতে গেলে আগে তোমাকে কথা বলতে শিখতে হবে। তা না হলে তোমার কোন জ্ঞান বা বিদ্যাবুদ্ধি কোনও কাজে আসবে না।

ভোর হতে থাকে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো তিয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে আরম্ভ করে?

মেরিজানের কথাগুলো খলিফার মরগে গিয়ে বিধে। এতোকাল পরে তার চোখের সামনে থেকে অজ্ঞতার এক কালো পর্দা সরে যায়। অভ্যাস-লব্ধ কটু-ভাষা, এবং সহজলভ্য নির আচার আচরণ পরিহার করে সদা মধুরভাষী হওয়ার এবং সহজাত সুকুমার বৃত্তিগুলো জাগ্রত করার প্রবৃত্তি জেগে ওঠে।

খলিফাঁকে আদর্শ মানুষ হতে গেলে কী কী আচার আচরণ প্রদর্শন করতে হবে এবং কী কী বিধি নিয়ম মেনে চলতে হবে তার বিস্তারিত উপদেশবাণী শোনায় মেরিজান।

খলিফা বলে, এতোদিন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিলাম। আজ তুমি আমার জ্ঞান চক্ষু খুলে দিলে। কী বলে যে তোমাকে ধন্যবাদ জানাবো, জানি না। তোমার প্রতিটি উপদেশ আমি যথাসাধ্য মেনে চলবো। এখন বলো, কী আমাকে করতে হবে।

মেরিজান বলে, কিচ্ছু করতে হবে না, শুধু একটুকরো কাগজ আর দোয়াত কলম নিয়ে এসো।

খলিফা প্রতিবেশিদের একজনের কাছ থেকে কাগজ ও কলম এনে দেয় মেরিজানকে।

মেরিজান ছোট্ট একখানা চিঠি লিখলো জহুরী ইবন কিরনাসের নামে। অতি সংক্ষেপে জানালো তার ভাগ্য বিপর্যয়ের কাহিনী। পরিশেষে লিখলো, এখন সে এই জেলে খলিফার ঘরে আছে। বাঁদী-বাজার থেকে একশো এক দিনার দিয়ে তাকে কিনে এনেছে সে।

চিঠিখানা ভাঁজ করে খলিফার হাতে দিয়ে সে বললো, সোজা চলে যাও স্যাকরা পট্টিতে—জহুরী ইবন কিরনাসের দোকানে। চিঠিখানা তার হাতে দেবে। সে যা বলে শুনবে। কিন্তু একটা কথা, আচার ব্যবহার কথায় বার্তায় কোনও রকম অসভ্যতা যেন প্রকাশ না পায়।

খলিফা বললো, আপনার উপদেশ আমার মনে আছে, মালকিন।

দ্রুত পায়ে চলে যায় সে স্যাকরা পট্টিতে কিরনাসের দোকানে। মাথা নুইয়ে তাকে আদাব জানিয়ে চিঠিটা তার হাতে তুলে দেয়। কিরনাস মাতা নত করে না। ঠোঁট নেড়ে আদাব জানায়। ভঁজ করা চিঠিখানা না খুলে আলতোভাবে দু’আঙ্গুল ধরে একপাশে রেখে দেয়। ভাবে, কারো কাছ থেকে কোনও প্রশংসাপত্র লিখিয়ে এনেছে। এও এক জাতের ভিখিরিদের ভিক্ষে আদায় করার ফিকির। কর্মচারীদের উদ্দেশ্য করে বলে, একটা আধলা দিরহাম দিয়ে দে একে।

খলিফা সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করে আরও বিনয় বিগলিত হয়ে বলে, কিছু গোস্তাকি নেবেন জনাব, আপনার কাছে কোনও দান ভিক্ষের জন্যে আসিনি আমি। মেহেরবানী করে ঐ চিঠিখানা যদি একবার পড়েন, আমি ধন্য হবো। তারপর আপনি যা বলবেন এ বান্দা তাই করতে প্রস্তুত আছে, মালিক।

কিরনাস একটু অবাক হয়। চিঠিখানা খুলে পড়তে শুরু করে। এবং একটু পরেই আনন্দে নেচে ওঠে ওর চোখ। চিঠিখানা বার বার ঠোঁটে ঠেকিয়ে চুমু খেতে থাকে সে। খলিফাঁকে আদর করে পাশে বসায়, কোথায় থাকো, তুমি ভাই, বাসা কোথায়?

খলিফা মৃদুকণ্ঠে তার বাসগৃহের ঠিকানা জানায়। কিরনাসের আনন্দ আর ধরে না। উত্তেজনায় থর থর করে কাঁপতে থাকে। দোকানের দু’জন কর্মচারীকে বলে, একে এক্ষুনি মোসেসের কাছে নিয়ে যাও। বলল, আমি বলছি, তহবিল থেকে যেন এক হাজার দিনার এর হাতে দেয় সে। তারপর আবার আমার কাছে ফিরিয়ে নিয়ে এসো এই মেহেমানকে।

একটুক্ষণ পরে নগদ এক হাজার দিনার সঙ্গে করে আবার সে ফিরে এলো কিরনাসের দোকানে। কিন্তু এ কী এলাহি কাণ্ড! দুটি সুসজ্জিত খচ্চর-সোনার জিন লাগাম লাগানো। তার একটায় চেপে বসেছে জহুরী কিরনাস। আর একটা সওয়ারের অপেক্ষা করছে। এ পাশে দাঁড়িয়ে সারিবদ্ধ ভাবে শ’খানেক নফর চাকর দাসদাসী। খলিফা ফিরে আসতেই খুব ঘরোয়া সুরে আদর করে কিরনাস বলে, চটপট, জলদি চেপে বসতো, দোস্ত।

খলিফা বলে, কিন্তু আমি তো কখনও খচ্চরে চাপিনি জনাব। ও আমি পারবো না। আমি বরং হেঁটেই যাচ্ছি।

-আরে না, না, সে হয় নাকি? এতোকাল চাপপানি তো কী হয়েছে? আজ চাপবে। আচ্ছা দাঁড়াও। কী করে চাপতে হবে, আমি তোমাকে তালিম দিয়ে দিচ্ছি।

কিরনাস নেমে এসে খলিফাঁকে দু’হাতে তুলে খচ্চরটার পিঠে বসিয়ে দেয়।

কিন্তু অনভ্যাসের কপাল চচ্চড় করে, খচ্চরটা বেগড় বাই করতেই লাগাম ছেড়ে দিয়ে সে লেজে মোচড় দেয়। আর যাবে কোথায়, এমন ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে থাকে, টাল সামলাতে পারে না খলিফা। এবং তার অবশ্যম্ভাবী ফল যা হতে পারে, তাই ঘটলো। খলিফা ছিটকে পড়ে গেলো রাস্তায়। খচ্চরটা ছুটেই চললো।

কিন্তু এই সঙ্গেই সব দুর্ভাগ্যের ইতি হয়ে গেলো খলিফার জীবনে। এর পরের অধ্যায়গুলো খুবই সুন্দর, সুখকর এবং আনন্দদায়ক।

এই সময়ে ভোর হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো চুয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

কিরনাস তার নফরদের বলে, সাহেবকে উঠিয়ে হামামে নিয়ে যাও। খুব ভালো করে ঘষেমেজে গোসল করাবে। তারপর আমার বাড়িতে নিয়ে আসবে। আমি সেখানে অপেক্ষা করছি।

চাকররা খলিফাঁকে নিয়ে শহরের এক সম্ভ্রান্ত হামামে গেলো। আর কিরনাস চললো খলিফার বাসায়—মেরিজানকে নিয়ে আসতে।

চাকর দু’টো হামামের ইজারাদারকে বুঝিয়ে বললো, একেবারে শাহজাদার মতো বানিয়ে দিতে হবে। আপনি সাহেবকে গোসল করান, আমরা ওঁর জন্য সাজপোশাক সওদা করে নিয়ে আসি ততক্ষণ।

গোসলাদি শেষ করে হামাম থেকে বেরিয়ে যখন রাস্তায় নামলো খলিফা, তখন কে বলবে সে শাহজাদা নয়। ওকে দেখার জন্য পথচারীরা দাঁড়িয়ে পড়তে থাকলো। এমন বাহারী বাদশাহী সাজ-পোশাকে সেজেছে, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যে কিরনাসের ইমারতে এসে পৌঁছয় ওরা। মেরিজানকে নিয়ে কিরনাস অবশ্য তার আগেই এসে গিয়েছিলো সেখানে।

বিরাট একটা প্রশস্ত কামরা। তার মাঝখানে একটা দিবানে’ বসেছিলো মেরিজান। ওর চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়েছিলো শতাধিক দাসী বাঁদীরা।

খলিফা প্রবেশ করতেই সকলে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো। অতি সহজেই খলিফাও প্রত্যাভিবাদন জানায়। একেবারে বাদশাহী কেতায়।

খলিফার অন্য কোনও দিকে লক্ষ্য নাই। সোজা সে মেরিজানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মৃদু হেসে আভূমি আনত হয়ে অভিবাদন জানায় তাকে। মেরিজান উঠে দাঁড়িয়ে হাতে ধরে তাকে নিজের পাশে বসায়। শরবতের দুটি পেয়ালা তুলে নিয়ে খলিফার হাতে দেয় একটা, এবং নিজে একটা নেয়। দু’জনে খুব ধীরে ধীরে পেয়ালায় চুমুক দিতে থাকে।

খলিফা বিনম্র কণ্ঠে বলে, এই গৃহের আতিথেয়তা আমার বহুকাল স্মরণে থাকবে।

মেরিজান বলে, তোমার এই সংযত আচরণও এ বাড়ির কেউ ভুলতে পারবে না, খলিফা। এবার তোমাকে সুলতানের সামনে দাঁড়াতে হবে। তার আগে আমি তোমাকে দু-একটা উপদেশ দিতে চাই। যখন তুমি সুলতানের দর্শন প্রার্থনা করবে এবং তা মঞ্জুর হবে, তখন দরবারে প্রবেশ করে যথাবিহিত কুর্নিশাদি জানিয়ে তাকে সবিনয়ে বলবে, ধর্মাবতার, আপনার কী স্মরণে আছে, এই বান্দা একদিন আপনাকে জাল ফেলার কৌশল শিখিয়েছিলো? ‘ তিনি তৎক্ষণাৎ তা স্বীকার করবেন। তখন তুমি বলবে, আপনি কী আজ রাতে এই অধমের পর্ণকুটীরে একবার মহামান্য মেহমান রূপে পায়ের ধূলো দিতে পারেন না?’ ব্যস্ আর কিছু করতে হবে না তোমাকে। দেখবে, তিনি অবশ্য আসবেন তোমার ঘরে।

খলিফা প্রায় শতাধিক নফর-চাকর পরিবেষ্টিত হয়ে তখুনি সুলতানের প্রাসাদে এসে উপস্থিত হয়। খোজা সর্দার সাঁদাল তাকে চিনতে পেরে এগিয়ে আসে, কী ব্যাপার?

—সাঁদালজী, সুলতানের সঙ্গে মোলাকাত করতে চাই। এই তার ভেট সহস্র মুদ্রা। তাকে গিয়ে মেহেরবানী করে বলল, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।

সাঁদাল কিছুই বুঝতে পারে না। অবাক হয়ে সে খলিফার জমকালো বাদশাহী সাজপোশোকের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে দেখে কিছুক্ষণ। তারপর দরবারে ঢুকে সুলতানকে বলতে থাকে, ধর্মাবতার, ব্যাপার কী হয়েছে, আমি বলতে পারবো না। তবে দেখে মনে হলো, সেই জেলে খলিফা হয়তো বা হালে সুলতান হয়েছে। তার সাজপোশাক এবং সঙ্গের নফর-চাকর পেয়াদা পাহারা দেখে অন্ততঃ তাই মনে হয়। আর এই নিন আপনাকে তিনি সহস্র দিনার ভেট পাঠিয়েছেন।

সুলতান গম্ভীর ভাবে বললেন, নিয়ে এসো তাকে।

খলিফা দরবারে ঢুকেই আভূমি আনত হয়ে কুর্নিশ জানালো।

-খোদা আপনার মঙ্গল করুন, জাঁহাপনা। আপনি ত্রিভুবনের পিতা ইসলামীদের রক্ষক। আল্লাহ আপনাকে দীর্ঘায়ু করুন। আপনার সলতানিয়ৎ-এর প্রজারা সসম্মানে বসবাস করতে থাকুন। দুনিয়ার মহামতিদের নামের ওপরে আপনার নাম উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে থাক চিরকাল।

সুলতান সবিস্ময়ে লক্ষ্য করলেন খলিফার এই আশ্চর্য পরিবর্তন।

একটা কথার জবাব দেবে খলিফা, এই চমৎকার পোশাকটা তুমি পেলে কোথায়?

—আমার প্রাসাদেই ছিলো, জাঁহাপনা।

—আচ্ছা—তা হলে এখন তুমি প্রাসাদের মালিক?

—হ্যাঁ হুজুর। এখনও পর্ণকুটীরই বলতে পারেন। তবে আজ রাতে যদি মেহেরবানী করে আপনি পায়ের ধুলো দেন, তবে তা প্রাসাদই হয়ে যেতে পারে। আপনাকে আমি নিমন্ত্রণ জানাতেই এসেছি, জাঁহাপনা। আজ আপনি আমার মহামান্য মেহমান হবেন, এই আশা করবো!

—মেহমান? তোমার?

হারুন অল রসিদ মৃদু হাসলেন, তুমি কি শুধু একা আমাকেই চাইছো? না-আমার সঙ্গে যারা যেতে চায় তারাও যাবে?

খলিফা বলে, সক্কলকেই আমি সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, জাঁহাপনা। আপনার প্রাসাদ এবং দরবারের সকলেই যদি যান, আমি আরও খুশি হবো।

এই সময় রাত্রি শেষ হয়ে আসছে দেখে শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো পঁচাত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে।

হারুন জাফরকে ইশারা করতে সে খলিফার সামনে এগিয়ে এসে বললো, আজ রাতে আমরা তোমার অতিথি হলাম—ধর্মাবতারের এই অভিপ্রায়।

এরপর আবার যথাবিহিত কুর্নিশাদি সেরে খলিফা জাফরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে দরবার থেকে বেরিয়ে গেলো। সুলতান অনেকক্ষণ ধরেই ব্যাপারটা অনুধাবন করার জন্য চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কিছুই ঠাওর করতে পারলেন না। পরিশেষে জাফরকে প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা জাফর, বলতে পার, এই খলিফা জেলেটা গতকাল কী রকম সব হাঁদা বোকার মতো কাণ্ডকারখানা দেখিয়ে আমাদের হাসিয়ে মাতিয়ে গেলো, সেই লোকটাই একটা রাতে এতো আমূল বদলে গেলো কী করে? তুমি দেখলে তো ওর আদব-কায়দা কেতা। কেমন মোলায়েম মার্জিত ভাষা! হঠাৎ রাতারাতি এ-সব সে রপ্ত করলো কী করে! মানব-চরিত্র সম্বন্ধে আমার যতটুকু জানা আছে, তাতে তো এতো তাড়াতাড়ি এসব গুণের অধিকারী হওয়া যায় না। এরজন্য আজন্মের না হলেও বহুকালের শিক্ষাদীক্ষা অভ্যাস দরকার হয়। তাছাড়া এতো অর্থই বা সে পেলো কোথায়? বড় তাজ্জব কাণ্ড!

জাফর বলে, সবই তার ইচ্ছা। কখন যে তিনি কাকে কী ভাবে চালান—তার মহিমা বোঝা বড় ভার!

সন্ধ্যার অব্যবহিত পরে জাফর, মাসরুর এবং প্রাসাদের আরও দু’জন প্রিয়-পাত্রকে সঙ্গে নিয়ে খচ্চরে চেপে বসলেন সুলতান। জেলে-খলিফার বাড়ির ঠিকানা ধরে যেতে যেতে বিশাল এক প্রাসাদোপম ইমারতের ফটকের সামনে এসে দাঁড়ালেন ওঁরা। ফটক থেকে প্রাসাদের দরজা অবধি বেশ কিছুটা পথ গালিচা ঢাকা। ঘরের সারা মেঝেটা নানা কারুকাজ করা অতি মূল্যবান পারস্য-গালিচায় মোড়া। দরজা জানলায় বাহারী অথচ নয়নাভিরাম পর্দা খাটানো।

সুলতান দেখলেন, দরজার সামনে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছে খলিফা জেলে।

—আসতে আজ্ঞা হোক, জাঁহাপনা।

ঘরের ভিতরটায় প্রবেশ করে চোখ জুড়িয়ে যায়। তোক দেখানো জাঁকজমকের চেয়ে সারা ঘরময় ছড়িয়েছিলো এক রুচিরা হাতের যাদুস্পর্শ, খুব যে একটা অসম্ভব দামী দুষ্প্রাপ্য আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো গোছানো তা নয়। পরন্তু বলা যায়, অতি নগণ্য একটা সাধারণ খেলনাও জায়গা মতো রাখার গুণে ঘরের আদলই গেছে বদলে।

মোট কথা মনোহর নয়—মনোরম পরিবেশ। মার্জিত রুচি সর্বত্র। সব মিলে এক ছন্দবদ্ধ কাব্যের রূপ ধারণ করে আছে ঘরখানা।

ঠিক মাঝখানে সোনা দিয়ে মোড়া হাতীর দাঁতের চৌকো একখানা তখ। সুলতানকে সসম্মানে সেই মসনদে বসালো খলিফা জেলে। জাফর বসলো ওর এক পাশে। মাসরুর এবং অন্য দু’জন দাঁড়িয়ে রইলো অদূরে।

নফর চাকররা খানাপিনা এনে থরে থরে সাজিয়ে দিলো। মুরগী, হাঁস, ভেড়া এবং নানারকম পাখীর মাংসের হরেক রকম পদ। সুগন্ধে আমোদিত হয়ে উঠলো সারা ঘর। সুসজ্জিতা বাঁদীরা শরাবের পাত্র পূর্ণ করে দিতে থাকলো।

সুলতান বিস্ময়ে হতবাক। তিনি তখনও ভাবতে পারছিলেন না, এ কী সত্য? জাফরকে জিজ্ঞেস করলেন, জাফর, আমার আল্লার কসম খেয়ে বলছি, এতো সুন্দর ব্যবস্থা আগে কখনও দেখিনি। এতোটুকু উকট বাড়াবাড়ি নাই, সব যেন নিখুঁত, পরিচ্ছন্ন-মন-প্রাণ ভরে গেছে আমার। আমি যা কল্পনা করেছিলাম, এ দেখছি তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি সুন্দর।

জাফর বলে, ধর্মাবতার, কে বলতে পারে এখন পর্যন্ত যা দেখলাম, তা আসলে কিছুই দেখা নয়। এরপরে যা দেখাবে, তা হয়তো আরও সুন্দর, আরও চমৎকার

এই সময় জেলে খলিফা এসে কুর্ণিশ জানিয়ে বললে, মহামান্য ধর্মাবতার যদি আজ্ঞা করেন, তবে তার এক বাঁদীকে এখানে গান গাইবার জন্য হাজির করতে পারি। তামাম বাগদাদের সেরা গাইয়ে সে—

—আর্জি মঞ্জুর।

সুলতান সম্মতি জানালেন। মেরিজান বোরখায় সারা অঙ্গ জড়িয়ে সামনের মঞ্চে এসে বসলো। খলিফা হারুন অল রসিদ তেমন নজর করলেন না-করলেও অবশ্য ধরতে পারতেন না। কিন্তু গানের সুললিত কণ্ঠ যখন সারা ঘরে অনুরণন তুলতে থাকলো তখন সুলতাম ছটফট করে উঠলেন।

—এ কি? এ কার কণ্ঠ? না না না, সে কী করে হয়? তবে কী হুবহু একই। কণ্ঠ দু’জনের হতে পারে?

সুলতানের সারা মুখ বিবর্ণ পাংশু বর্ণ হয়ে যায়। কপালে জমে ওঠে বিন্দু বিন্দু ঘাম। মাথা ঝিম ঝিম করতে থাকে। তারপর—তারপর আর কিছুই তিনি মনে করতে পারেন না। ঢলে পড়ে যান।

এই সময় রাত্রি প্রভাত হয়ে আসে। শাহরাজাদ গল্প থামিয়ে চুপ করে বসে থাকে।

 

পাঁচশো ছিয়াত্তরতম রজনীতে আবার সে বলতে শুরু করে :

হঠাৎ সুলতান মূৰ্ছিত হয়ে পড়ায় ঘর সুষ্ঠু সকলে তাকে ঘিরে ধরে। সকলের মুখে চোখে দারুণ আতঙ্ক ভয়। কিন্তু মেরিজান নির্বিকার। সে জানে, এর আসল কারণ কী? খলিফাঁকে বলে, সবাইকে বাইরে যেতে বলো তো। কোন ভয় নাই। সব ঠিক হয়ে যাবে এখুনি।

সকলে ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। শুধু রইলো মেরিজান, জেলে খলিফা আর অচৈতন্য সুলতান। ক্ষিপ্র হাতে বোরখা এবং ইজার টেনে খুলে দেয় মেরিজান। শুধু পরনে থাকে এক নয়ন-সুখকর সাজ-পোশাক। এই পোশাকটা সুলতানের বড় প্রিয় ছিলো। প্রাসাদে

সে বেশির ভাগ সময়ই পরে থাকতো।

অল রসিদের গা-ঘেঁষে বসে পড়ে সে। চোখে মুখে গোলাপ জলের ঝাপটা দেয়। এবং হাতপাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে।

একটু পরে চোখ মেলে তাকালেন খলিফা। সামনে মেরিজানকে দেখামাত্র আবার মূৰ্ছা গেলেন। মেরিজান এবার অল রসিদকে জড়িয়ে ধরে আদর সোহাগ চুম্বন করতে করতে যুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।

সুলতানের আচ্ছন্ন ভাব’তখনও কাটে না। তিনি কঁকিয়ে ওঠেন, তবে কী এই শেষ বিচারের দিন? মৃতেরা কী সবাই উঠে এসেছে আজ? না আমি খোয়াব দেখছি?

মেরিজান আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, না না না, ও কথা আপনি কী বলছেন জাঁহাপনা! এই তো আমি বেঁচে আছি, রক্ত-মাংসের দেহ নিয়েই বেঁচে আছি, ধর্মাবতার। শেষ বিচারের দিনও না, খোয়াবও না। আমি আপনার পেয়ারের মেরিজান-তাকিয়ে দেখুন, হুজুর, আমি সশরীরে বেঁচে আছি। আমাকে কেউ কবর দেয়নি, মরিনি আমি। আমি মারা গেছি—আমাকে কবর দেওয়া হয়েছে সবই মিথ্যা। আপনাকে ওরা ধোঁকা দিয়েছিলো, ধর্মাবতার। আজ আমি জানে বেঁচে আবার আপনাকে ফিরে পেয়েছি, তার জন্য একমাত্র দায়ী এই খলিফা, আর কেউ নয়।

অল রসিদ হাসলেন, কাদলেন, চোখের জল মুছলেন এবং সব শেষে আবার হাসতে থাকলেন। তারপর সব কথা ফুরিয়ে গেলে গভীর আশ্লেষে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। মেরিজানকে। চুম্বনে চুম্বনে সিক্ত করে দিলেন অধর কপোল রক্ষ।

এইভাবে অনেক অনেকক্ষণ একে অন্যের মধ্যে হারিয়ে রইলো। এক সময় জেলে খলিফা উঠে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারী দিয়ে বলে ধর্মাবতার, রাত অনেক গভীর হয়ে আসছে। এবার বোধহয় আর এভাবে এখানে পড়ে থাকা সঙ্গত হবে না।

সুলতান সহাস্যে মুখ তুলে বললেন, তোমরা অধৈর্য হয়ে পড়লে নাকি। ঠিক আছে, ওদের ডাকো। শোনো খলিফা, আমার জন্য যা তুমি করেছ, সে ঋণ শোধ করা যায় না। আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি, তুমি আমার একটা অঞ্চলের সুবাদার হয়ে চিরকাল আমার পাশে পাশে বন্ধুর মতো শুভানুধ্যায়ী হয়ে থাক—এই আমার ইচ্ছা।

-বান্দা কী কখনও মনিবের আজ্ঞা অমান্য করতে পারে, ধর্মাবতার! আমি রাজি।

শুধু তুমি আমার সুবাদারই হবে না খলিফা, তুমি হবে আমার প্রাণাধিকা মেরিজানের ১. মালঞ্চের নতুন মালাকর। আমি তোমার হাতেই সঁপে দিতে চাই একে। আমি বিশ্বাস করি, তোমরা দুজনেই সুখী হবে। চিন্তার কোন কারণ নাই, মেরিজানের ভরণ-পোষণের জন্য মাসে দশহাজার দিনার বরাদ্দ করে দেব আমি। এ ছাড়া তার সাজ-পোশাক, অলঙ্কার বাসস্থান দাস দাসী এবং নানা বিলাসের সামগ্রী যৌতুক দেব তাকে। প্রতিদিনই তোমাদের সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হবে। এবং প্রাসাদের উৎসব অনুষ্ঠানে সাদরে ডেকে নিয়ে যাবো। এক সঙ্গে খানাপিনা গান-বাজনা আমোদ আহ্লাদ করবো।

খলিফা আভূমি আনত হয়ে সুলতানকে কুর্নিশ জানায়। এরপর বহুকাল সে মেরিজানকে জীবন-সঙ্গিনী করে সুখে স্বচ্ছন্দে ঘর সংসার করেছিলো।

শাহরাজাদ ক্ষণকালের জন্য থামে। এ গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু, জাঁহাপনা, তাই বলে ভাববেন না, এর চেয়ে ভালো গল্প আপনাকে শোনাতে পারবো না।

শাহরিয়ার বলে, সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র আমার সংশয় নাই, শাহরাজাদ। এর পর তুমি কী কি বলতে চাও? নাম বল। নিশ্চয়ই সেটা এই জেলে খলিফার কাহিনীর চেয়েও মজাদার হবে।

শাহরাজাদ বলে, আমার পরের গল্পের নাম…..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *