১১৪. পাণ্ডবগণের বৈতরণী প্রভৃতি তীৰ্থগমন

১১৪তম অধ্যায়

পাণ্ডবগণের বৈতরণী প্রভৃতি তীৰ্থগমন

বৈশম্পায়ন কহিলেন, হে জনমেজয়! অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির কৌশিকীতীর্থে উপনীত হইয়া অনুক্রমে সমস্ত আয়তনে ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। তৎপরে গঙ্গাসাগরসঙ্গমে উপস্থিত হইয়া পঞ্চ-শত নদীমধ্যে স্নান করিলেন; অনন্তর ভ্রাতৃগণ-সমভিব্যাহারে সমুদ্রতীর দিয়া কলিঙ্গদেশে উত্তীর্ণ হইলেন। তখন লোমশ কহিলেন, মহারাজ! এই সমস্ত প্রদেশকেই লোকে কলিঙ্গ বলিয়া নির্দেশ করে; এই স্থানে স্রোতস্বতী বৈতরণী প্রবাহিত হইতেছে। এই স্থানে ভগবান ধর্ম্ম দেবগণের আশ্রয় গ্রহণপূর্ব্বক যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। এই বৈতরণীর উত্তরতীর নিরবচ্ছিন্ন দ্বিজাতিগণসেবিত মহর্ষি-সার্থসঙ্কুল যজ্ঞীয়োপকরণসংযুক্ত ও গিরিপথশোভিত। ইহা স্বৰ্গপ্রাপ্তির সুগম পথ বলিয়াই বৰ্ণিত হইয়াছে। পূর্ব্বে এই স্থানে অন্যান্য মহর্ষিগণ বহুবিধ যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন। এই স্থানে ভগবান রুদ্র যজ্ঞকালে পশুগ্রহণপূর্ব্বক ‘ইহা আমারই অংশ’ বলিয়া নির্দেশ করিলে দেবগণ রুদ্রকে কহিলেন, “হে ভগবান! পরস্ব গ্রহণ করা আপনার নিতান্ত অন্যায় হইতেছে; আপনি ধর্ম্মসাধন যজ্ঞভাগ সমস্ত আত্মসাৎ করিবেন। না।” এই বলিয়া তাঁহারা উত্তমরূপে রুদ্রের স্তুতিবাদ করিতে লাগিলেন। অনন্তর ইষ্টিকর্ম্ম দ্বারা তুষ্টিসাধনপূর্ব্বক তাঁহার সম্মানবৰ্দ্ধন করিলে তিনি পশু পরিত্যাগপূর্ব্বক দেবযানে আরোহণ করিয়া স্বস্থানে প্ৰস্থান করিলেন। হে যুধিষ্ঠির! এ বিষয়ে এক কিংবদন্তী আছে যে, “দেবগণ রুদ্রের ভয়ে ভীত হইয়া সর্ব্বভাগাপেক্ষা উৎকৃষ্ট রসপূর্ণ একভাগ তাঁহাকে প্রদান করিলেন, এই গাথা কীর্ত্তনপূর্ব্বক এই স্থানে স্নান করিলে স্বৰ্গপথ প্রত্যক্ষ হইয়া থাকে।

অনন্তর পাণ্ডবেরা দ্রৌপদীর সহিত বৈতরণীতে অবতীর্ণ হইয়া পিতৃগণের তর্পণ করিলেন। তখন যুধিষ্ঠির লোমশকে কহিলেন, “হে তপোধন! আমি তপঃপ্রভাবে বৈতরণী—তীর্থে স্নান করিয়া অলৌকিক আকৃতি লাভ করিয়াছি; আপনার প্রসাদে সকল লোকই প্ৰত্যক্ষ করিতেছি, মহাত্মা বৈখানসাগণের জপশব্দও আমার কর্ণকুহরে প্রবিষ্ট হইতেছে।”

লোমশ কহিলেন, “মহারাজ! আপনি তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বনপূর্ব্বক যে জপশব্দ শ্রবণ করিতেছেন, উহা এ স্থান হইতে ত্ৰিশত সহস্ৰ যোজনান্তরে সমুদ্ভূত হইতেছে। ঐ স্বয়ম্ভূ ব্ৰহ্মার দিব্যাকানন লক্ষিত হইতেছে; এই স্থানে তিনি যজ্ঞানুষ্ঠান করিয়াছিলেন; ঐ যজ্ঞে দক্ষিণাদানার্থ মহর্ষি কশ্যপকে পর্ব্বতবনশালিনী ভূমি প্রদান করেন। তখন ভূমি অবসন্নপ্রায় হইয়া রোষাভরে কহিলেন, “ভগবন! আপনি আমাকে মনুষ্যহস্তে প্ৰদান করিবেন না; আপনার এই দক্ষিণাদান নিষ্ফল হইবে; আমি এক্ষণে রসাতলে চলিলাম।” অনন্তর মহর্ষি কশ্যপ ভূমিকে বিষণ্না অবলোকন করিয়া প্রসন্ন করিলেন। পৃথিবী তদীয় তপঃপ্রভাবে প্ৰসন্ন ও পুনরায় সলিল মধ্য হইতে উত্থিত হইয়া বেদীরূপে বিরাজমান হইলেন। হে মহারাজ! ঐ সেই বেদী লক্ষিত হইতেছে; ইহাতে আরোহণ করিলে আপনি বীৰ্য্যবান হইবেন। বেদী সাগরকে আশ্রয় করিয়া আছে, আপনি ইহাতে আরোহণ করিয়া একাকীই সাগরপারে গমন করিতে পরিবেন। আমি স্বস্ত্যয়ন করিতেছি, আপনি অবিলম্বে ইহাতে আরোহণ করুন। বেদী মানুষম্পর্শমাত্রই সাগর-প্রবেশ করিবে, ইহাতে শঙ্কা করিবেন না। “হে দেবেশ! তুমি বিশ্বের পিতা, বিশ্বের ঈশ্বর, তোমাকে নমস্কার, তুমি লবণ-সাগরের সন্নিহিত হও, তুমি অগ্নি, তুমি মিত্র, তুমি সলিলের আধার; তুমি দেবীস্বরূপ ও অমৃতের আকর’, এইরূপে স্তব করিয়া আপনি সত্বর বেদীতে আরোহণ করুন। পরে ‘অগ্নি তোমার উৎপত্তিস্থান; ইড়া তোমার দেহ, তুমি বিষ্ণুর রেতোধারী ও অমৃতের আকর’, এইরূপ জপ করিয়া সাগরে অবগাহন করিতে হইবে। হে মহারাজ! এইরূপ না করিলে দেবযোনি সমুদ্রকে কুশাগ্ৰদ্বারাও স্পর্শ করিবেন না।” তখন রাজা কৃতস্বস্ত্যয়ন হইয়া সাগর-সন্নিধানে উপনীত হইলেন এবং লোমশের আদেশ প্রতিপালনপূর্ব্বক মহেন্দ্ৰ-পর্ব্বতে নিশাযাপন করিলেন।