১১১. ঋষ্যশৃঙ্গ আনয়নে বারবনিতার প্রলোভন

১১১তম অধ্যায়

ঋষ্যশৃঙ্গ আনয়নে বারবনিতার প্রলোভন

লোমশ কহিলেন, “হে রাজন! সেই বারাঙ্গনা ভূপতির আদেশক্রমে তাঁহার কার্য্যসম্পাদনের নিমিত্ত স্বীয় বুদ্ধিপ্রভাবে তরীর উপরে একটি মনোহর আশ্রম নির্ম্মাণ করিয়া সুস্বাদুফলনিবহশালী, বহুকুসুমবিভূষিত নানা বিচিত্র কৃত্রিম তরুলতা ও গুল্ম দ্বারা সুশোভিত করিল এবং কাশ্যপাশ্রমের অনতিদূরে ঐ তরণী নিবদ্ধ করিয়া কোন সময়ে বিভাণ্ডক ঋষি আশ্রমের বহির্গত হয়েন, এই সুযোগ অনুচর-পুরুষদ্বারা অনুসন্ধান করিতে লাগিল। একদা সেই বারবনিতা বিভাণ্ডক ঋষির অসন্নিধানরূপ সুযোগসন্দর্শনে ইতিকর্ত্তব্যতাসাধন নিশ্চয় করিয়া সুনিপুণা নিজ পুত্রীকে ঋষ্যশৃঙ্গসমীপে প্রেরণ করিল।

“নিপুণতমা বেশ্যাকুমারী আশ্রমে প্রবেশপূর্ব্বক ঋষিকুমারের সমীপবর্ত্তিনী হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘মুনে! তাপসাগণের ত’ কুশল? ফলমূল ত’ পর্য্যাপ্ত পরিমাণে উৎপন্ন হইয়া থাকে? আপনি ত’ সুখে সময় অতিবাহিত করিয়া থাকে? তাপসাগণের ত’ তপোবৃদ্ধি হইতেছে? আপনার পিতার ত’ তেজোহানি হয় নাই? আপনি বেদপাঠ করিয়া ত’ পরম প্রীতিলাভ করিয়া থাকেন? সম্প্রতি আমি আপনারই দর্শনলালসায় এ স্থানে আগমন করিয়াছি।

“ঋষ্যশৃঙ্গ কহিলেন, “মহাশয়! আপনি তেজঃপুঞ্জের ন্যায় প্রকাশিত হইতেছেন; বোধ হয় আপনি আমার অভিবাদনীয় সন্দেহ নাই; অতএব আপনাকে ধর্ম্মানুসারে পাদ্য ও ফলমূল প্রদান করি। আপনি কৃষ্ণজিনাচ্ছাদিত সুখস্পর্শ কুশময় আসনে উপবেশন করুন। হে ব্ৰহ্মন! আপনার আশ্রম কোথায়? আপনি যে দেবতার ন্যায় এই ব্ৰতানুষ্ঠান করিতেছেন, উহার নাম কি?

“বারবিলাসিনী কহিল, “হে ব্ৰহ্মন! এই ত্ৰিযোজনবিস্তীর্ণ শৈলের অপর দিকে আমার রমণীয় আশ্রম; অভিবাদন গ্রহণ বা পাদ্যোদক স্পর্শ আমার ধর্ম্ম নহে। আমাকে অভিবাদন করিবেন না; আপনি আমার অভিবাদ্য, আমি ভবাদৃশ ব্যক্তিকে আলিঙ্গন করিয়া থাকি; তাহাই আমার ব্রত।” ঋষ্যশৃঙ্গ কহিলেন, “ভল্লাতক, আমলক, করূষক, ইঙ্গুদ, ধন্বন প্রভৃতি সুপক্ক ফলনিচয় প্রদান করিতেছি, যথারুচি উপভোগ করুন।”

অনন্তর বারঙ্গনা ঋষিকুমারপ্রদত্ত ফলনিচয় পরিত্যাগ 
করিয়া তাঁহাকে অমূল্য খাদ্যদ্রব্যসকল প্ৰদান করিল। মুনিকুমার সেই সমস্ত পূর্ণরস ভক্ষ্যদ্রব্য ভক্ষণ করিয়া সাতিশয় পরিতৃপ্ত হইলেন। অনন্তর বারাঙ্গনা পুনরায় সুস্বাদু খাদ্য, সুরভি মাল্য, বিচিত্র উজ্জ্বল বাস ও সুরস পানীয় প্রদানপূ
র্ব্বক আমোদ-প্রমোদ ও হাস্য-পরিহাস-সহকারে কন্দুক লইয়া ফলভারাবনতা লতার ন্যায় হাবভাব প্রকাশ করিয়া আশ্রমোপকেন্ঠ ক্রীড়া করিতে লাগিল; কখন বা গাত্রে গাত্ৰে স্পর্শ, কখন বা গাঢ়তর আলিঙ্গন, কখন বা সর্জ্জ, অশোক ও তিলক প্রভৃতি কুসুমিত তরুসকল অবনত বা ভগ্ন করিয়া মদাভিভূতার ন্যায়, লজ্জামানার ন্যায় হইয়া ঋষিকুমারের মন হরণ করিল; অনন্তর ঋষ্যশৃঙ্গ ঋষিকে বিকৃত চিত্ত অবলোকন করিয়া বারংবার তাঁহাকে আলিঙ্গন করিয়া শনৈঃ শনৈঃ কটাক্ষপাতপূর্ব্বক অগ্নিহোত্রব্যাপদেশে সে স্থান হইতে প্ৰস্থান করিল।

“বেশ্যাকুমারী প্ৰস্থান করিলে ঋষিকুমার মদনমত্ত ও বিচেতন হইয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক তদগতচিত্তে তাহাকে চিন্তা করিয়া সাতিশয় কাতর হইয়া উঠিলেন। এমন সময়ে সিংহের ন্যায় পিঙ্গলক্ষ, আনখাগ্ররোমবেষ্টিতকায় [সর্ব্বগাত্রে বহু লোমযুক্ত—নখের সীমা পৰ্য্যন্ত লোমে আবৃত], স্বাধ্যায়বান বিভাণ্ডক ঋষি তথায় আসিয়া উপস্থিত হইলেন। ঋষ্যশৃঙ্গ একান্তে আসীন হইয়া বিকরচিত্তের ন্যায় মুহুর্মুহুঃ উৰ্দ্ধে দৃষ্টিপাত ও চিন্তা করিয়া দীর্ঘনিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতেছেন। অবলোকন করিয়া তিনি তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বৎস! তুমি কি নিমিত্ত অদ্য সমিধ আহরণ করা নাই? তুমি কি নিমিত্ত অগ্নিহোত্রে আহুতি প্ৰদান কর নাই? তুমি কি নিমিত্ত স্রুক্‌স্রুব নির্ম্মল কর নাই ও কি নিমিত্তই বা হোমধেনুকে পীতবৎসা [যে গরুর বাছুরে দুধ খাইয়া ফেলিয়াছে এইরূপ] করিয়াছ? তোমাকে পূর্ব্বের ন্যায় বোধ হইতেছে না; তোমাকে দীনভাবাপন্ন, চিন্তাপরায়ণ ও বিচেতন্যপ্ৰায় দেখিতেছি; অতএব বল দেখি, আদ্য এই আশ্রমে কোন ব্যক্তি আগমন করিয়াছিলেন?’