১০. নয়ীম আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন

দশ

নয়ীম আবার জ্ঞান ফিরে পেলেন, তখন তিনি রয়েছেন খোলা ময়দানের পরিবর্তে এক পাথরের ঘরে। তার আশেপাশে কয়েকটি পুরুষ ও নারী। যে সুন্দরী যুবতীর অস্পষ্ট ছবি তখনো নয়ীমের মগজে রয়ে গেছে, সে এক হাতে দুধের পেয়ালা নিয়ে অপর হাত নয়ীমের মাথার নীচে দিয়ে তাকে উপরে তুলবার চেষ্ট করছে। নয়ীম খানিকটা ইতস্তত করে মুখ লাগালেন পিয়ালায়। কিছুটা দুধ পান করার পর তিনি হাত দিয়ে ইশারা করলে যুবতী তাকে আবার বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর বিছানার একপাশে সরে বসলো সে। কমযোরীর দরুন নয়ীম কখনো চোখ মুদে থাকেন, আবার কখনো আবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেন তরুণী ও আর সবার দিকে। এক নওজোয়ান এসে দাঁড়ালো ঘরের দরযায়। তার এক হাতে নেযাহ, অপর হাতে ধনুক।

তরুণী তার দিকে তাকিয়ে বললো, ভেড়াগুলোকে এনেছ?

হাঁ এনেছি, আর এখই আমি যাচ্ছি।’

‘কোথায়? তরুণী প্রশ্ন করলো।

শিকার খেলতে যাচ্ছি। একটা জায়গায় আমি এক ভালুক দেখে এসেছি। খুব বড়ো ভালুক। উনি এখন আরামে আছেন?’

হাঁ, কিছুটা হুঁশ ফিরেছে।’

যখমের উপর পট্টি বেঁধে দিয়েছো?

না, আমি তোমার জন্য ইনতেহার করছি, ওটা আমি খুলতে পারবো না। তরুণী নয়ীমের বর্মের দিকে ইশারা করলো।

নওজোয়ান এগিয়ে এসে নয়ীমকে কোলের কাছে তুলে নিয়ে তাঁর বর্ম খুলে দিলো। কামিয উপরে তুলে সে তার যখম দেখলো। তার উপর প্রলেপ লাগিয়ে বেঁধে দিয়ে বললো,’ এবার শুয়ে থাকুন। যখম খুবই বিপজ্জনক, কিন্তু এ প্রলেপে শিগগীরই সেরে যাবে। নয়ীম কিছু না বলে শুয়ে পড়লেন এবং নওজোয়ান চলে গেলো বাইরে। আর সব লোকও একে একে চলে গেলো। নয়ীম তখন পুরোপুরি জ্ঞান ফিরে পেয়েছেন এবং তিনি যে জীবনের সফর শেষ করে জান্নাতুল ফিরদাউসে পৌঁছে গেছেন, সে ধারণাও ধীরে ধীরে মিটে গেছে তার মন থেকে।

‘আমি কোথায়? তরুণীর দিকে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন।

‘আপনি এখন আমাদেরই ঘরে।’তরুণী জবাব দিলে, বাইরে আপনি পড়েছিলেন বেহুশ হয়ে। আমি এসে আমার ভাইকে খবর দিয়ে ছিলাম। সে আপনাকে তুলে এনেছে এখানে।’

তুমি কে?’ নয়ীম প্রশ্ন করলেন।

‘আমি ভেড়া চরিয়ে বেড়াই।

‘তোমার নাম কি?

‘আমার নাম নার্গিস।

নার্গিস।

জি হাঁ!’

নয়মের কল্পনায় তারই সাথে সাথে আরো দুটি তরুণীর ছবি ভেসে উঠলো। তার নামের সাথে তার স্বরণ পড়লো আরো দুটি নাম। দীলের মধ্যে উল্লা, জোলায়খা ও নার্গিসের নাম আবৃত্তি করতে করতে তিনি গভীর চিন্তামগ্ন হয়ে তাকিয়ে রইলেন ঘরের ছাদের দিকে।

আপনার ক্ষিধে পেয়েছে নিশ্চয়ই। তরুণী নয়ীমের মনোযোগ আর্কষণ করে বললো। তারপর উঠে সামনের কামরা থেকে কয়েকটি সেব ও শুকনো মেওয়া এনে রাখলো নয়ীমের সামনে। সে নয়ীমের মাথার নীচের হাত দিয়ে উপরে তুললো এবং ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বসবার জন্য একটা পুস্তিকন এনে দিলো তার পেছন দিকে। নয়ীম কয়েকটি সেব খেয়ে নার্গিসকে জিজ্ঞাস করলেন, যে নওযোয়ান এখন এসেছিল, সে কে?

ও আমার ছোট ভাই।’

“কি নাম ওর?’

হুমান। নার্গিস জওয়াব দিলো।

নার্গিসকে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে নয়ীম জানলেন যে তার বাপ-মা আগেই মারা গেছেন। সে তার ভাইয়ের সাথে থাকে এই ছোট্ট বস্তিতে আর হুমান হচ্ছে বস্তির রাখালদের সরদার। বস্তির বাসিন্দাদের সংখ্যা প্রায় ছয়শ।’

সন্ধ্যা বেলায় হুমান ফিরে এসে জানালো যে, তার শিকার মেলেনি।

নার্গিস ও হুমান নয়ীমের শুশ্রূষার কোন কসুর করে না। গভীর রাত পর্যন্ত জেগে বসে থাকে তারা নয়ীমের শয্যার পাশে। নয়ীমের চোখে যখন নেমে আসে ঘুমের মায়া, নার্গিস তখন উঠে যায় অপর কামরায় আর হুমান তার পাশেই শুয়ে পড়ে ঘাসের বিছানায়। রাতভর নয়ীম দেখতে থাকেন কতো মুগ্ধকর স্বপ্ন। আব্দুল্লাহর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসার পর এই প্রথম রাত স্বপ্নের ঘোরে নয়ীমের কল্পনা জংগের ময়দান ছেড়ে উঠে গেছে আর এক নতুন দেশে। কখনো তিনি দেখছেন যেনো তার মরহুম ওয়ালেদা তার যখমের উপর প্রলেপ লাগিয়ে পট্টি বেঁধে দিচ্ছেন আর উযরার মুহব্বত ভরা দৃষ্টি তাঁকে দিচ্ছে শান্তির পয়গাম। আবার তিনি দেখছেন, যেনো জোলায়খা তাঁর আলোক-দীপ্ত মুখের আলোয় উজ্জ্বল করে তুলেছেন কয়েদখানার অন্ধকার কুঠরী।

ভোরের আলোয় খুলে চোখ তিনি দেখলেন, নার্গিস আবার দুধের পিয়ালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার শিয়রে, আর হুমান তাঁকে জাগাচ্ছে ঘুম থেকে।

নার্গিসের পিছনে দাঁড়িয়ে বস্তির আর একটি তরুণী তার দিকে তাকাচ্ছে একাগ্র দৃষ্টিতে। নার্গিস বলনো, বস, যমররুদ! অমনি সে নীরবে বসে পড়লো এক পাশে।

এক হফতা পরে নয়ীমের চলা-ফেরার শক্তি ফিরে এল। তিনি বস্তির নিদোষ আবহাওয়া উপভোগ করতে শুরু করলেন। ভেড়া-বকরী চরিয়ে দিন গুযরান করে বস্তির লোকেরা। আশেপাশে সুন্দর শ্যামল চারণভূমি, তাই তাদের অবস্থা বেশ স্বচ্ছল। কোথাও কোথাও সেব ও আঙ্গুরের বাগিচা। ভেড়া-বকরী পালন ছাড়া সেকানকার লোক আনন্দ পায় জংলী জানোয়ার শিকার করে। বস্তির লোকেরা শিকার করতে চলে যায় দূরের বরফ ঢাকা এলাকায়, আর ভেড়া চরিয়ে বেড়ায় বিশেষ করে বস্তির যুবতী মেয়েরা। দেশের রাজনীতির ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না এরা। তাতারীদের বিদ্রোহের সমর্থন বা বিরোধিতা-কোনোটারই ধার ধারে না এরা। রাতের বেলা বস্তির যুবক-যুবতীরা এসে জমা হয় মস্ত বড়ড়া খিমায়, সেখানে তারা গান গায় আর নাচে। রাত্রির একভাগ কেটে গেলে মেয়েরা চলে যায় নিজ নিজ ঘরে, আর পুরুষরা অনেক রাত জেগে ছোট্ট ছোট্ট দলে ভাগ হয়ে কাটায় গুল্পগুজবে। কেউ শুনায় আগেরকার দিনের বাদশাহদের কাহিনী, কেউ বলে তার নিজের ভালুক, শিকারের মুগ্ধকর ঘটনা, আর কেউ বসে যায়, জিন, ভুত-প্রেমের অসংখ্য মনগড়া কিস্সা নিয়ে। এরা অনেকটা কুসংস্কার পরস্ত, তাই মন দিয়ে শোনে ভুতের কিস্সা। কিছুদিন ধরে তাদের কাহিনীর বিষয়বস্তু হয়ে উঠেছেন এক শাহযাদা। কেউ বলে তার চেহারা ও রূপের কথা, কেউ তারিফ করে তাঁর লেবাসের, কেউ তার যখমী হয়ে বস্তিতে আসায় প্রকাশ করে হয়রাণী, আবার কেউ কেউ বলে, রাখালদের বস্তিতে দেবতারা পাঠিয়েছে এক বাদশাহকে, আর হুমানকে তিনি বানাবেন তার উযির। সোজা কথায়, বস্তির লোকেরা নয়ীমের নাম না নিয়ে তাকে বলতে শাহযাদা।

ওদিকে বস্তির মেয়েদের মধ্যে জল্পনা চললো যে, নবাগত শাহযাদা নার্গিসকে বানাবেন তার বেগম। নার্গিসের সৌভাগ্যে গায়ের মেয়েরা ঈর্ষান্বিতা। শাহযাদা নিরুপায় হয়ে তাদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন বলে কেউ তাঁকে জানায় মোবারকবাদ, আবার কেউ কথায় কথায় তাকে করে বিদ্রূপ। নার্গিস প্রকাশ্যে রাগ করে, কিন্তু সখীদের মুখে এই ধরনের কথা শুনলে তার দীলে জাগে কম্পন। তার সফেদ গায়ের উপর খেলে যায় রক্তিম আভা,। পল্লীর লোকদের মুখ দিয়ে নয়ীমের নতুন নতুন তারিফের কথা শুনবার জন্য তার কানে হয়ে থাকে বেকারার।

নয়ীম এর সব কিছু সম্পর্কে বে-খবর অবস্থায় হুমানদের বাড়ির এক কামরায় কাটিয়ে দিচ্ছে তার যিন্দেগীর নিরুপদ্রব শান্তিপূর্ণ দিনগুলো। গাঁয়ের পুরুষ ও মেয়েরা হররোয এসে দেখে যায় তাকে। তার শুশ্রূষার জন্য নয়ীম তাদেরকে জানান অকুণ্ঠ শোকরিয়া। সবাই তাঁকে শাহযাদা মনে করে আদরের সাথে দাঁড়িয়ে থাকে দূরে এবং তাঁর অবস্থা জানাবার জন্য বড় বেশী প্রশ্ন করে না, কিন্তু নয়ীম শান্ত স্বভাব তাদের সব কুষ্ঠ কাটিয়ে দেয় সহজেই। তাই কয়েকদিনের মধ্যেই আদব ও শ্রদ্ধা ছাড়া নয়ীমকে তারা মহব্বতের পাত্র করে নেয়।

*

একদিন সন্ধ্যাবেলায় নয়ীম নামায পড়ছেন। নার্গিস তার সখীদের সাথে ঘরের দর্যয় দাঁড়িয়ে একাগ্রচিত্তে দেখছে তার কার্যকালাপ।

উনি কি করছেন?’ এক কিশোরী হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলো।

উনি যে শাহযাদা।’ যমররুদ শিশুর মতো জবাব দিলো, “দেখ, কি চমৎকার উঠা বসা করছেন! ….ভাগ্য নার্গিসের, তুমিও অমনি করে থাক, নার্গিস?,

‘চুপ। নার্গিস ঠোঁটের উপর আঙ্গুল রেখে বললো।

নয়ীম নামায শেষ করে দো’আর জন্য হাত বাড়ালেন। তরুণীরা দরযার খানিকটা দূরে সরে কথা বলতে লাগলো।

‘চল, নার্গিস! যমররুদ বললো, ওখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে সবাই।

‘আমি তোমাদের আগেই বলেছি, ওঁকে এখানে একা ফেলে যেতে পারবো না আমি।’

‘চলো ওকেও সাথে নিয়ে যাবো।’

‘তোমার মাথা বিগড়ে গেছে, কমবখৃত? উনি শাহযাদা না খেলনা? আর এক বালিকা বললো।

মেয়েরা যখন এমনি করে কথা বলছে, তখন হুমানকে ঘোড়ায় চড়ে আসতে দেখা গেলো। সে নেমে এলে নার্গিস এগিয়ে ঘোড়ার বাগ ধরলো• হুমান সোজা গিয়ে নয়ীমের কামরায় প্রবেশ করলো।

যমররুদ বললো, চল নার্গিস! এবার তোমার ভাই-ই তো ওঁর কাছে বসবে।

‘চলো নার্গিস। আর একজন বললো।

‘চল, চল।’ বলতে বলতে মেয়েরা নার্গিসকে ঠেলে নিয়ে গেলো একদিকে। হুমান ভিতরে প্রবেশ করলে নয়ীম প্রশ্ন করলেন, বল ভাই, কি খবর নিয়ে এলে?

আমি সবগুলো জায়গা ঘুরে দেখে এসেছি। আপনার ফউজের কোন খবর মিললো না। ইবনে সাদেক যেনো গা ঢাকা দিয়েছে। একটি লোকের কাছ থেকে জানলাম, শিগগিরই আপনাদের ফউজ হামলা করবে সমরকন্দের উপর।

হুমান ও নয়ীমের মধ্যে কথাবার্তা চললো অনেকক্ষণ। নয়ীম এশার নামায পড়লেন। আরাম করবেন বলে তিনি শুয়ে পড়লেন। হুমান উঠে আর এক কামরায় চলে যাচ্ছিলো। ইতিমধ্যে গায়ের লোকদের গানের আওয়ায় ভেসে এলো তাদের কানে।

আপনি আমাদের গাঁয়ের লোকদের গান শোনেন নি, কেমন?’ হুমান বললো।

‘আমি এখানে শুয়ে শুয়ে কয়েকবার শুনেছি।’

চলুন, ওখানে নিয়ে যাব আপনাকে। ওরা আপনাকে দেখলে খুবই খুশী হবে। আপনি জানেন, ওরা আপনাকে শাহযাদা মনে করে?

শাহযাদা?’ নয়ীম হাসিমুখে বললেন, ‘ভাই, আমাদের ভেতরে না আছে কোনও বাদশাহ না আছে শাহযাদা।’

‘আমার কাছে আপনি গোপন করছেন কেন?

‘গোপন করে আমার লাভ?’

তা হলে আপনি কে?

এক মুসলামন।’

হয়তো আপনারা যাকে মুসলমান বলেন, আমরা তাকে বলি শাহযাদা।

গানের আওয়ায় ক্রমাগত জোরদার হতে লাগলো। হুমান শুনলো নিবিষ্টমনে। চলুন। হুমান আর একবার বললো, গায়ের লোক আমায় কতোবার অনুরোধ করেছে আপনাকে ওদের মজলিসে নিয়ে যেতে, কিন্তু আমি আপনার উপর যবরদস্তি করতে সাহস করিনি।’

‘আচ্ছা চলো।’ নয়ীম উঠতে উঠতে জওয়াব দিলেন।

কয়েকটি লোক সানাই আর ঢোল বাজাচ্ছে। এক বুড়ো তাতারী গাইছে গান। নয়ীম ও হুমান খিমায় ঢুকতেই সব শান্ত-নিশ্চুপ।

‘তোমরা চুপ করলে কেন?’ হুমান বললো, “গাও।

আবার গান শুরু হলো।

এক ব্যক্তি একটা পুস্তিন বিছিয়ে দিয়ে নয়ীমকে অনুরোধ করলো বসতে। নয়ীম খানিকটা ইতস্ততঃ করে বসলেন। যন্ত্রীরা যখন সঙ্গীতের সুরের সাথে সাথে তাল বদল করলো, অমনি তামাম পুরুষ ও নারী উঠে একে অপরের হাত ধরে শুরু করলো নৃত্য। হুমানও উঠে যমররুদের হাত ধরে শরীক হলো নৃত্যে।

তামাম নৰ্তক-নর্তকীর দৃষ্টি নয়ীমের দিকে নিবন্ধ। নার্গিস তখনো একা দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে নয়ীমের দিকে। এক বৃদ্ধ মেষ পালক সাহস করে নয়ীমের কাছে এসে বললো, আপনিও উঠুন। আপনার সাথী ইনতেফর করছে আপনার।

নয়ীম নার্গিসের দিকে তাকালেন। অমনি নার্গিস দৃষ্টি অবনত করলো। নয়ীম নীরবে আসন ছেড়ে উঠে খিমার বাইরে গেলেন। নয়ীম বেরিয়ে যাওয়া মাত্র খিমায় ছেয়ে গেলো একটা গভীর নিস্তব্ধতা।

উনি আমাদের নাচ পছন্দ করেন না। আচ্ছা আমি ওকে ঘরে রেখে এখনি ফিরে আসছি।’ এই কথা বলে হুমান খিমা থেকে বেরিয়ে ছুটে গেলো নয়ীমের কাছে।

আপনি খুব ঘাবড়ে গেলেন?’ সে বললো।

‘ওহহো, তুমিও এসে গেলে?

আমি আপনাকে ঘর পর্যন্ত রেখে আসবো?

না যাও। আমি খানিকক্ষণ এদিকে ফিরে ঘরে যাবো।’

হুমান ফিরে চলে গেলে নয়ীম বস্তির এদিক ওদিক ঘুরে থাকার জায়গার কাছে পৌঁছে ঘরের বাইরে এক পাথরের উপর বসে আসমানের সিতারার সাথে ভাব জমালেন। তাঁর দীলের মধ্যে ভেসে আসতে লাগলো নানা রকমের চিন্তা, কি করছি আমি এখানে? এখানে বেশী সময় থাকা ঠিক হবে না। এক হফতার মধ্যে আমি ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারবো। আমি শিগগিরই চলে যাবো এখান থেকে। এ বস্তি মুজাহিদের দুনিয়া থেকে অনেক-অনেক দূর। কিন্তু এ লোকগুলো কতো সাদাসিধা। এদেরকে নেক রাস্তা দেখানো প্রয়োজন।

নয়ীম এমনি করে ভাবছেন আর ভাবছেন, হঠাৎ পিছন থেকে কারুর পদধ্বনি শোনা গেলো, তিনি ফিরে দেখলেন, নার্গিস আসছে। সে কি যেনে চিন্তা করে ধীরে পা ফেলে এলো নয়ীমের কাছে। তারপর ধরা গলায় বললো,

‘আপনি এ ঠান্ডার ভিতরে বাইরে বসে রয়েছেন?

নয়ীম চাঁদের মুগ্ধকর রৌশনীতে তার মুখের দিকে নয়র করলেন। এ যেমন সুন্দর, তেমনি নিষ্পাপ। তিনি বললেন, নার্গিস, তোমার সাথীদের ছেড়ে কেন এলে তুমি?

‘আপনি চলে এলেন। আমি ভাবলাম …..আপনি ……একাই রয়েছেন হয়তো।

এই ভাঙা ভাঙা কথাগুলো নয়ীমের কানে বাজিয়ে গেলো অনন্ত সুরঝংকার। এক লহমার জন্য তিনি নিশ্চল-নিঃসাড় হয়ে চেয়ে রইলেন নার্গিসের দিকে। তারপর অচানক উঠে একটি কথাও না বলে লম্বা লম্বা কদম ফেলে গিয়ে ঢুকলেন তাঁর কামরায়। নার্গিসের কথাগুলো বহু সময় ধরে তার কানের কাছে গুঞ্জর করে ফিরতে লাগলো এবং তিনি শয্যায় আশ্রয় নিয়ে পাশ ফিরতে লাগলেন বারংবার।

তোরে নয়ীম ঘুম থেকে জেগে বাইরে গিয়ে ঝরণার পানিতে ওযু করে কামরায়, ফিরে এসে ফজরের নামায পড়লেন। তারপর বেরিয়ে গেলেন বেড়াতে ফিরে এসে কামরায় ঢুকতে গিয়ে দেখলেন, বেশীর ভাগ সময়ে তিনি যেখানে নামায পড়েন, হমান সেখানে চোখ বন্ধ করে কেবলার দিকে মুখ করে রুকু ও সিজদার অনুকরণ করছে। নয়ীম নীরবে দরযায় দাঁড়িয়ে তার নির্বিকার অনুকরণ দেখে হাসতে লাগলেন। হুমান যখন নয়ীমের মতো:বসে খানিক্ষণ ঠোঁট নাড়াচাড়া করে ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলো, তখন তার নযর পড়লো নয়ীমের উপর। সে ঘাবড়ে গিয়ে উঠে এলো এবং তার পেরেশানি সংযত করতে গিয়ে বললো, আমি আপনার নকল করছিলাম। গাঁয়ের অনেক যুবক-যুবতী এমনি করছে। তারা বলে, এমনি করে থাকে, তাদেরকে খুব ভালো লোক মনে হয়। আমি যখন আপনার কামরায় গেলাম, তখন নার্গিসও এমনি করছিলো। আমি…….।

নয়ীম বললেন, হুমান সব কিছুতেই তুমি কেন আমায় নকল করবার চেষ্টা করছো?

‘কেননা আপনি আমাদের চাইতে ভালো, আর আপনার প্রত্যেক কথাই আমাদের চাইতে ভালো।’

‘আচ্ছা বেশ, আজ গাঁয়ের তামাম লোককে এক জায়গায় জমা করো। আমি তাদের কাছে কিছু কথা বললো।

‘ওরা আপনার কথা শুনে খুব খুশী হবে। আমি এখখুনি তাদেরকে একত্র করছি। হুমান দেরী না করে ছুটে চললো।

দুপুরের আগেই তামাম লোক এক জায়গায় জমা হলো। নয়ীম প্রথম দিন খোদাও তাঁর রসূল (সঃ)-এর তারিফ করলেন। তিনি তাদেরকে বললেন, ‘আগুন পাথর আর সব জিনিসই খোদার সৃষ্টি। এসব সৃষ্টিকর্তাকে ভুলে সৃষ্ট জিনিসের পুজা করা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। আমাদের কওমের অবস্থাও একদিন ছিলো তোমাদের কওমেরই মতো। তারাও পাথরের মূর্তি তৈরী করে তার পুজা করতো। তারপর আমাদের মাঝে পয়দা হলেন খোদার মনোনীত এক রসূল (সঃ)। তিনি আমাদেরকে দেখালেন এক নতুন পথ। নয়ীম রসূলে মাদানী (সঃ)-এর যিন্দেগী কাহিনী শোনালেন তাদেরকে। এমনি করে চললো আরও কয়েকটি বক্তৃতা। বস্তির তামাম লোককে তিনি টেনে আনলেন ইসলামের দিকে। সবার আগে কলেমা পড়লো নার্গিস আর হুমান।

কয়েকদিনে মধ্যে বস্তির আবহাওয়া সম্পূর্ণ বদলে গেলো। মনোমুগ্ধকর শ্যামল চারণভূমি মুখর হয়ে উঠেলো নয়ীমের ধ্বনিতে। নাচ গানের বদলে চালু হলো পাঁচ ওয়াক্তের নামায।

নয়ীম এবার পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠেছেন। তিনি কয়েকবার ফিরে যাবার ইরাদা করছেন, কিন্তু বরফপাতের দরুণ পাহাড়ীপথ বন্ধ থাকায় আরও কিছুকাল দেরী না করে উপায় ছিলো না।

নয়ীম বেকার বসে দিন কাটাতে অভ্যস্ত নন। তাই তিনি কখনও বস্তির লোকদের সাথে যান শিকার করতে। একদিন ভালুক শিকারে নয়ীম দিলেন অসাধারণ সাহসের পরিচয়। এক ভালুক শিকারীর তীরে যখমী হয়ে এমন হিংস্র হামলা শুরু করলো যে, শিকারীরা এদিক ওদিক পালাতে লাগলো। তারা নিজ নিজ জান বাঁচাবার জন্য বড়ো বড়ো পাথরের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে তীর ছুঁড়তে লাগলো ভালুকের দিকে। নয়ীম নেহায়েত স্বস্তির সাথে দাঁড়িয়ে রইলেন নিজের জায়গায়। ক্রুদ্ধ ভালুক তাঁর উপর হামলা করতে এগিয়ে এলো। নয়ীম বাম হাতে ঢাল তুলে আত্মরক্ষা করলেন এবং ডান হাতের নেযাহ্ ঢুকিয়ে দিলেন তার পেটে। ভালুক উল্টে পড়ে গেলো, কিন্তু পরক্ষণেই তীব্র চীৎকার করে উঠে হামলা করলো নয়ীমের উপর। ইতিমধ্যে তিনি তলোয়ার কোষমুক্ত করে হাতে নিয়েছেন। ভালুক থাবা মারবার আগেই নয়ীমের তলোয়ার গিয়ে লাগলো তার মাথায়। ভালুক পড়ে গিয়ে তড়পাতে তড়পাতে ঠান্ডা হয়ে গেলো।

শিকারীরা তাদের আশ্রয়স্থান থেকে বেড়িয়ে এসে হয়রাণ হয়ে তাকাতে লাগলো নয়ীমের দিকে। এক শিকারী বললো, “আজ পর্যন্ত এত বড়ো ভালুক আর কেউ মারতে পারেনি। আপনার জায়গায় আজ আমাদের মধ্যে কেউ থাকলে তার ভালো হতো না। আজ পর্যন্ত কতো ভালুক আপনি মেরেছেন।’

আজই প্রথমবার। নয়ীম তলোয়ার কোষবদ্ধ করতে করতে বললেন।

প্রথমবার? সে হয়রাণ হয়ে বললো, আপনাকে তো নিপুণ শিকারী বলেই মনে হচ্ছে।’

তার জওয়াবে বৃদ্ধ শিকারী বললো, দীলের বাহাদুরী, বায়ুর হিম্মৎ আর তলোয়ারের তেজ যেখানে রয়েছে, সেখানে অভিজ্ঞার প্রয়োজন নেই।

*

গাঁয়ের লোকদের কাছে নয়ীম হয়ে উঠলেন মানবতার সর্বোচ্চ আর্দশ এবং তাঁর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ হলো তাদের কাছে অনুকরণীয়। এ বস্তিতে এসে তাঁর দেড়মাস কেটে গেছে। তার একিন রয়েছে যে, কুতায়বা বসন্ত কালের আগে হামলা করতে এগিয়ে আসবেন না। তাই প্রকাশ্যে তার সেখানে আরও কিছু কাল থাকায় কোনো বাঁধা ছিলো না, কিন্তু এক অনুভূতি নয়ীমকে অনেক খানি অশান্ত চঞ্চল করে তুললো।

নার্গিসের চাল-চলন তাঁর শান্ত-সমাহিত অন্তরে আবার তুললো এক ঝড়। ধারণার দিক দিয়ে তিনি প্রথম যৌবনের রঙিন স্বপ্ন সম্পর্কে নির্বিকার হয়ে গেছেন, কিন্তু প্রকৃতির বর্ণগন্ধময় রূপের প্রভাব আর একবার তার মনে জাগিয়ে তুলতে চাচ্ছে সেই ঘুমন্ত অনুভূতিকে।

বস্তির লোকদের মধ্যে নার্গিস রূপ,গুন,আকৃতি,স্বভাব ও চালচলনের দিক দিয়ে অনেকটা স্বতন্ত্র হয়ে দেখা দিয়েছে তার চোখে। গোড়ার দিকে বস্তির লোকেরা যখন নয়ীমকে ভালো করে জানতো না, তখন নার্গিস অসংকোচে তাঁর সামনে এসেছে। কিন্তু বস্তির লোকেরা যখন তাঁর সাথে অসংকোচে মেলামেশা করতে লাগলো, তখন নার্গিসের অসংকোচ সংকোচে রূপান্তরিত হলো। আকাংক্ষার চরম আকর্ষণ তাকে নিয়ে যায় নয়ীমের কামরায়, কিন্তু চরম সংকোচ-শরম তাকে সেখানে দাঁড়াতে দেয় না। নয়ীমকে অচঞ্চল দষ্টিতে সে দেখবে সারাদিন, মনে করে সে যায় তাঁর কামরায় কিন্তু নয়ীমের সামনে গেলেই তার সব ধারণা ভুল হয়ে যায় অন্তরের আশা আকাংক্ষার কেন্দ্র মানুষটির দিকে তাকালেই তার দৃষ্টি অবনত হয়ে পড়ে এবং কম্পিত দীলের সকল আবেদন, অনুনয় ও প্রেরণা সত্ত্বেও আর একবার নযর তুলবার সাহস সঞ্চয় করতে পরে না সে কিছুতেই। যদি বা কখনো সে সাহস যোগায়, তথাপি নয়ীম ও তার মাঝখানে এসে দাঁড়ায় হায়া-শরমের দুর্ভেদ্য নেকাব। এমনি আবস্থায় নয়ীম তাকে দেখছেন ভেবে সে হয়তো আশ্বাস পায়, কিন্তু যখন সে ভূল করে এক আধবার তাঁর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, তখন দেখে যে, তিনি গদীন নীচু করে পুস্তিনের পশমের উপর হাত বুলাচ্ছেন অথবা হাত দিয়ে একটির পর একটি শুকনো ঘাস ছিঁড়ছেন। এসব দেখে শুনে তার অন্তরের ধুমায়িত অগ্নিশিখা নিভে আসে, তার শিরা-উপশিরায় বয়ে যায় হিমশীতল রক্তপ্রবাহ। তার কানে গুঞ্জরিত সংগীত-ঝংকার নির্বাক হয়ে আসে, তার চিন্তার সূত্র যায় ছিন্নভিন্ন হয়ে। দীলের মধ্যে এক অসহনীয় বোঝা নিয়ে সে উঠে নয়ীমের দিকে হতাশ দৃষ্টি হেনে বেরিয়ে যায় কামরা থেকে।

গোড়ার দিকে যেখানে এক নিষ্পাপ যুবতীর মুহব্বত একটি মানুষের অন্তরে আকাংক্ষার তুফান আর ধারণা-কল্পনা ঝড় পয়দা করে দেয়, সেখানেই কতকগুলো অসাধারণ চিন্তা তাঁকে কর্ম ও সংগ্রামের সাহস থেকে করে বঞ্চিত।

নয়ীম হয়ে উঠেছেন নার্গিসের ধারণা, আকাংক্ষা ও স্বপ্নে ছোট্ট দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু। তার অন্তর আনন্দে উছল। কিন্তু ভবিষ্যতের চিন্তা করতে গেলেই সংখ্যাতীত আশংকা তাকে করে তোলে পেরেশান। সে তাঁর সামনে না গিয়ে চুপি চুপি তাঁকে দেখে। কখনো এক কাল্পনিক সুখের চিন্তা তার দীলকে করে দেয় আনন্দোজ্জ্বল, আবার এক কাল্পনিক বিপদের আশংকা তাকে প্রহরের পর প্রহর করে রাখে অশান্ত-চঞ্চল।

নয়ীমের মত আত্মসচেতন লোকের পক্ষে নার্গিসের দীলের অবস্থা আন্দায করা মোটেই মুশকিল ছিলো না। মানুষের মন জয় করবার.যে শক্তি তার ভিতরে রয়েছে তা তাঁর অজানা নেই, কিন্তু এ বিজয়ে তিনি খুশী হবেন কিনা, তার মীমাংসা করে উঠতে পারে না আপন মনে।

একদিন এশার নামাযের পর নয়ীম হুমানকে তাঁর কামরায় ডেকে ফিরে যাবার ইরাদা জানালেন। হুমান জওয়াবে বললো, ‘আপনার মরযীর খেলাফ আপনাকে বাঁধা দেবার সাহস নেই আমার, কিন্তু আমায় বলতেই হবে যে, বরফ-ঢাকা পাহাড়ী পথ এখনও সাফ হয়নি। কমসেকম আরও একমাস আপনি দেরী করুন। মওসুম বদল হলে সহজ হবে আপনার সফর।’

নয়ীম জওয়াব দিলেন, বরফপাতের মওসুম তো এখন শেষ হয়ে গেছে, আর সফরের ইরাদা আমার কাছে সমতল ও বন্ধুর দুর্গম পথ একই রকম করে দেয়। আমি কাল ভোরেই চলে যাবার ইরাদা করে ফেলেছি।’

‘এত জলদী! কাল তো আমরা যেতে দেবো না!’

‘আচ্ছা, ভোরে দেখা যাবে। বলে নয়ীম বিছানার উপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লেন। হুমানা উঠলো নিজের কামরায় যাবার জন্য। পথে দাঁড়িয়ে রয়েছে নার্গিস। হুমানকে আসতে দেখে সে দাঁড়িয়ে গেলো গাছের আড়ালে। হুমান অপর কামরায় চলে গেলে নার্গিসও এসে তার পিছু পিছু ঢুকলো।

‘নার্গিস, বাইরে ঠান্ডা। এর মধ্যে তুমি কোথায় ঘুরছো?’ হুমান বললো।

‘কোথাও না, এমনি বাইরে ঘুরছিলাম আর কি!’ নার্গিস জওয়াব দিলো। কামরাটি নয়ীমের বিশ্রামের কামরা থেকে একটুখানি দূরে। মেঝের উপর শুকনো ঘাস বিছানো কামরার এক কোণে শুয়ে পড়লো হমান, অপর কোণে নার্গিস।

হুমান বললো, নার্গিস, উনি কাল চলে যাবার ইরদা করছেন।’

নার্গিস আগেই নিজের কানে নয়ীম ও হুমানের কথাবার্তা শুনেছ, কিন্তু ব্যপারটা তার কাছে এমন নয় যে, সে চুপ করে থাকবে।

সে বললো তা তুমি ওঁকে কি বললে?

‘আমি ওকে দেরি করতে বললাম, কিন্তু ওঁকে অনুরোধ করতেও ভয় লাগে আমার। উনি চলে গেলে গাঁয়ের লোকেরও আফসোস হবে খুবই। ওদেরকে আমি বলবো সবাই মিলে ওঁকে বাধ্য করবে থেকে যেতে।

হুমান নার্গিসের সাথে কয়েকটি কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়লো। নার্গিস বারংবার পাশ ফিরে ঘুমোবার ব্যর্থ চেষ্টা করবার পর উঠে বসলো। উনি যদি চলেই যাবেন এমনি করে, তাহলে এলেন কেন?’ এই কথা ভাবতে ভাবতে সে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে কদম ফেলে কামরার বাইরে নয়ীমের কামরার চারদিকে ঘুরে দেখলো। তার পর ভয়ে ভয়ে দরযা খুলালো, কিন্তু সামনে কদম ফেলবার সাহস হলো না। ভিতরে মোমবাতি জ্বলছে আর নয়ীম পুস্তিনে গা ঢেকে ঘুমোচ্ছে। তাঁর মুখ চিবুক পর্যন্ত খোলা। নার্গিস আপন মনে বললো, শাহযাদা আমার, তুমি চলে যাচ্ছো! জানি না, কোথায় যাচ্ছো। তুমি, তুমি কি জানো, তুমি কি ফেলে যাচ্ছো

এখানে, আর কি নিয়ে যাচ্ছে, এই পাহাড়, এই চারণভূমি, বাগ-বাগিচা আর ঝরণার সবটুকু সৌন্দর্য, সবটুকু তুমি নিয়ে যাবে তোমার সাথে, আর এখানে পড়ে থাকবে তোমার স্মৃতি। ……শাহযাদা…….শাহযাদা আমার………. না, না, তুমি আমার নও, আমি তোমার যোগ্য নই।ভাবতে ভাবতে সে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। সে আবার ঢুকলো কামরার ভিতরে এবং নিশ্চল-নিঃসাড় হয়ে তাকিয়ে রইলো। নয়ীমের দিকে।

আচানক নয়ীম পাশ ফিরলেন। নার্গিস ভয় পেয়ে বেরিয়ে নিঃশব্দ পদক্ষেপে নিজের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। ওহ, রাত এত দীঘ!’ কয়েকবার উঠে উঠে সে আবার শুয়ে পড়ে বললো আপন মনে।

ভোরে এক রাখাল আযান দিলো। বিছানা ছেড়ে নয়ীম ওযু করতে গেলেন ঝরণার ধারে। নার্গিস আগে থেকেই রয়েছে সেখানে। তাকে দেখেও নয়ীমের কোন ভাবান্তর হলো না। তিনি বললেন, নার্গিস, আজ তুমি সকালে এসে গেছে এখানে?

রোজ নার্গিস এই গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নয়ীমকে। আজ সে নয়ীমের নির্বিকার ঔদাসীন্যের জন্য অভিযোগ জানাতে তৈরী হয়ে এসেছে, কিন্তু নয়ীম বেপরোয়া হয়ে আলাপ করা তার উৎসাহের আগুন নিভে গেলো। তথাপি সে সংযত হয়ে থাকতে পারলো না। অশ্রুসজল চোখে সে বললো আপনি আজই চলে যাচ্ছেন?

হ্যাঁ নার্গিস, এখানে এসে আমার বহুত দিন কেটে গেলো। আমার জন্য কত খলীফই না করলে তোমরা। হয়তো আমি তার শোকরিয়া জানাতে পারবো না। খোদা তোমাদেরকে এর প্রতিদান দিন।’

কথাটি বলে নয়ীম একটা পাথরের উপর বসে ওযু করতে লাগলেন ঝরণার পানিতে। নার্গিস আরও কিছু বলতে চায়, কিন্তু নয়ীমের কার্যকলাপ তার উৎসাহ নিভিয়ে দেয়। দীলের মধ্যে যে ঝড় বইছিলো তা থেমে আসে। গাঁয়ের বাকী লোকেরা ঝরণার কাছে ওযু করতে এলে নার্গিস সরে পড়ে সেখান থেকে।

ইসলাম কবুল করবার আগে যে বড়ো খিমায় গাঁয়ের লোকেরা নাচ-গানে কাটাতে অবসর সময়, এখন সেখানেই হচ্ছে নামায। নয়ীম ওযু করে খিমায় ঢুকলেন। গায়ের লোকদের নামায পড়ালেন এবং দোয়া শেষ করে তাদেরকে জানালেন চলে যাবার ইরাদা।

নয়ীম হুমানকে সাথে নিয়ে বাইরে এলেন। বাড়িতে পৌঁছে নয়ীম গেলেন তার কামরায়। হুমান নয়ীমের সাথে ঢুকতে গিয়ে পেছনে গাঁয়ের লোকদের আসতে দেখে ফিরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকালো।

সত্যি সত্যি উনি চলে যাচ্ছে তা হলে? এক বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো।

‘হ্যাঁ, উনি থাকবেন না বলে আমার আফসোস হচ্ছে’। হুমান বললো।

‘আমরা অনুরোধ করলেও থাকবেনা না?’

তা হলে হয়তো থাকতে পারেন, কিন্তু ঠিক বলতে পারি না। তবু আপনারা ওঁকে বলে দেখুন। উনি যেদিন এলেন, সেদিন থেকে আমার মনে হচ্ছে যেনো দুনিয়ার বাদশাহী পেয়ে গেছি। আপনারা বয়সে আমার বড়ো, আপনারা অবশ্য চেষ্টা করুন। আপনাদের কথা উনি মানতেও পারেন।

নয়ীম বর্ম-পরিহিত অস্ত্র সজ্জিত হয়ে এলেন। তাঁকে আজ সত্যি মনে হচ্ছে যেনো এক শাহযাদা। গাঁয়ের লোকেরা তাকে দেখেই সমস্বরে কোলাহল শুরু করলো, যেতে দেবো না আমরা, কিছুতেই যেতে দেবো না।’

নয়ীম তাঁর বিশ্বস্ত মেযবানদের দিকে তাকিয়ে হাসলেন এবং খানিক্ষণ নীরব থেকে হাত বাড়িয়ে দিলে তারা সবাই চুপ করলো।

নয়ীম এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা করলেন,’বেরাদারণ! কর্তব্যের আহবানে বাধ্য না হলে আমার আরও কিছু দিন এখানে থাকতে আপত্তি হতো না, কিন্তু আপনাদের জেনে রাখা প্রয়োজন যে, জিহাদ এমন এক ফরয, যাকে কোনো অবস্থায়ই উপেক্ষা করা যায়না। আপনাদের মুহব্বতের জন্য অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আশা করি, খুশী হয়ে আপনারা আমায় এজাযত দেবেন।’

নয়ীম তার কথা শেষ না করতেই একটি ছোট ছেলে চীৎকার উঠলো, “আমরা যেতে দেবো না।’ নয়ীম এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট বাচ্চাটিকে তুলে নিয়ে বুকে চেপে ধরে বললেন, আপনাদের উপকার হামেশা আমার মনে থাকবে। এ বস্তির কল্পনা হামেশা আমার মন আনন্দে ভরপুর করে রাখবে। এ বস্তিতে আমি এসেছি অপরিচিত। আজ এই কয়েক হফতার পর এখান থেকে বিদায় নিতে গিয়ে আমি অনুভব করছি যে, আমি আমার প্রিয়তম ভাইদের কাছ থেকে জুদা হয়ে যাচিছ। আল্লাহ চাহেতো আর একবার আমি এখানে আসবার চেষ্টা করবো।’

এরপর নয়ীম তাদেরকে কিছু উপদেশ দিয়ে দো’আ করে সকলের সাথে মোসাফেহা করতে শুরু করলেন। হুমান ও আর সব লোকদের মতো রাষী হলো তার মরীর বিরুদ্ধে। নয়ীমের জন্য সে নিয়ে এলো তার খুবসুরত সাদা ঘোড়াটি এবং নেহায়েত আন্তরিকতা সহকারে অনুরোধ করলো এ তোহফা কবুল করতে।

নয়ীয় তাকে শোকরিয়া জানালেন। হুমানও গাঁয়ের আরও পনেরো জন নওজোয়ান নয়ীমের সাথে যেতে চাইলো জিহাদে যোগ দিতে। কিন্তু সেনাবাহিনীর ছাউনীতে পোঁছে প্রয়োজন মতো নয়ীম তাদেরকে ডেকে পাঠাবেন, এই ওয়াদা পেয়ে তারা আস্বস্ত হলো। বিদায় নেবার আগে নয়ীম এদিক ওদিক তাকালেন, কিন্তু নার্গিসকে দেখতে পেলেন না। তার কাছ থেকে বিদায় না নিয়ে তিনি যেতে চান না, কিন্তু সেই মুহূর্তে তার কথা কারুর কাছে জিজ্ঞেস করাটাও ভালো দেখায় না।

হুমানের সাথে মোসাফেহা করতে গিয়ে একবার তাকালেন মেয়েদের ভিড়ের দিকে। নার্গিস হয়তো তাঁর মতলব বুঝে ফেলেছে। তাই সে ভিড় থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে দাঁড়ালো নয়ীমের কাছে থেকে কিছুটা দূরে। নয়ীম ঘোড়ার সওয়ার হয়ে নার্গিসের দিকে হানলেন বিদায়ী দৃষ্টি। এই প্রথম বার নয়ীমের চোখের সামনে দৃষ্টি অবনত হলো না। এক পাথরের মূর্তির মতো নিঃসাড় নিশ্চল হয়ে এক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো নয়ীমের মুখের দিকে। তার মুখে ফুটে উঠেছে এক অব্যক্ত বেদনার অভিব্যক্তি, কিন্তু চোখে তার অশ্রু নেই। বেদনার আতিশয্যে চোখের পানি শুকিয়ে যায়, তা জানা আছে নয়ীমের। তিনি যেন সইতে পারেন না এ মর্মদ দৃশ্য। তাঁর দীল ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে, তবু থেকে যাওয়া তার পক্ষে মুশকিল। নয়ীম আর একদিকে মুখ ফিরালেন। হুমান ও গাঁয়ের আরও কতো লোক তার সাথে যেতে চাইলে কিছুদূর, কিন্তু তাদেরকে মানা করে তিনি ঘোড়া ছুটালেন দ্রুত গতিতে।

উঁচু উঁচু টিলায় চড়ে লোকেরা দেখতে লাগলো নয়ীমের চলে যাবার শেষ দৃশ্য; কিন্তু নার্গিস সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। তার পা যেন যমিনে বসে গিয়েছে, নড়বার শক্তিও যেনো নেই তার। কয়েকজন সখী এসে জমা হলো তার পাশে। তার সব চাইতে অন্তরংগ ও ঘনিষ্ঠ যমররুদ বিষণ্ণ মুখে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। গাঁয়ের মেয়েদের জমা হতে দেখে সে বললো তোমার কি দেখছো এখানে? নিজ নিজ কেউ কেউ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলো। যমররুদ নার্গিসের কাঁধে হাত রেখে বললো, চল নার্গিস!’

নার্গিস চমকে উঠে যমররুদের দিকে তাকালো। তারপর কোন কথা না বলে তার সাথে সাথে খিমার ভিতর প্রবেশ করলো। নয়ীম যে পুস্তিনটি ব্যবহার করতেন, তা সেখানেই পড়েছিল নার্গিস বসতে বসতে সেটি হাতে তুলে নিলো। পুস্তিনটি দিয়ে মুখ ঢাকতেই তার দু’চোখ বেয়ে নামলো অশ্রুর বন্যা। যমররুদ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো তার পাশে। অবশেষে নার্গিসের বায়ু ধরে নিজের দিকে টেনে এনে সে বললো, নার্গিস! তুমি হতাশ হলে? উনি কতবার ওয়ায করতে গিয়ে বলেছেন, খোদার রহমত সম্পর্কে কখখনো হতাশ হতে নেই। প্রার্থীকে তিনি সব কিছুই দিতে পারেন। ওঠ নার্গিস, বাইরে যাই। তিনি নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন।

নার্গিস, অশ্রু মুছে ফেলে যমররুদের সাথে বেরিয়ে গেলো। বস্তির সব কিছুই তার চোখে হয়ে এসেছে ম্লান।

*

দুপুরের সূর্য নীল আসমানে পূর্ণ গৌরবে তার কিরণ-জাল বিকিরণ করছে। বস্তির বাইরে এক খেজুর-কুঞ্জের ঘন ছায়ায় কয়েকটি লোক জমা হয়েছে। তাদের মধ্যে কতক লোক বসে কথা বলছে, আর বাকী লোকেরা পড়ে ঘুমুচ্ছে। তাদের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে কুতায়বা, মুহাম্মদ বিন্ কাসিম ও তারিকের বিজয় কাহিনী।

আচ্ছা এ তিন জনের মধ্যে বাহাদুর কে? এক নওজোয়ান প্রশ্ন করলো।

মুহম্মদ বিন কাসিম।’ একজন কিছুক্ষণ চিন্তা করে জওয়াব দিলো। একটি লোক ঘুমের নেশায় ঝিমুচ্ছিল। মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের নাম শুনে সে বসলো হুশিয়ার হয়ে।

মুহাম্মদ বিন কাসিম? আরে, তিনি আবার বাহাদুর? সিন্ধুর ভীতু রাজাদের তাড়িয়েছেন, এইতো! তাতেই হলেন বাহাদুর! লোক যে তাঁকে ভয় করে, তার কারণ তিনি হাজ্জাজ বিন ইউসুফের ভাতিজা। তার চাইতে রিক অনেক বড়ো, লোকটি এই কথা বলে চোখ মুদলো আবার।

তার কথা শুনে মুহম্মদ বিন কাসিমের সমর্থক বিরক্ত হয়ে বললো, চাঁদের দিকে থুথু ফেললে তা পড়ে নিজেরই মুখে। আজকের ইসলামী দুনিয়ায় কেউ নেই। মুহম্মদ বিন কাসিমের মোকাবিলা করবার মতো।

তৃতীয় এক ব্যক্তি বললো, মুহাম্মদ বিন্ কাসিমকে আমরা দেখি ইযযতের দৃষ্টিতে, কিন্তু এ কথা কখনো স্বীকার করবো না যে, ইসলামী দুনিয়ায় তাঁর মোকাবিলার যোগ্য নেই। আমার ধারণা, তারিকের মোকাবিলা করবার যোগ্য নেই আর কোন সিপাহী।’

চতুর্থ ব্যক্তি বললো, এও ভুল। কুতায়বা এঁদের দুজনেরই চাইতে বাহাদুর।’ তারিকের সমর্থক বললো,…..’লা হাওলা ওয়ালা কুওৎ। কোথায় তারিক আর কোথায় কুতায়বা। কুতায়বা মুহম্মদ বিন্ কাসিমের চাইতে বাহাদুর, এ কথা আমি মানি, কিন্তু তারিকের সাথে তার তুলনা চলে না।’

‘তোমার ছোট মুখে মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের নামও শোভা পায় না। মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের সমর্থক আবার বললো বিরক্তি স্বরে।

‘আর তোমার ছোট মুখে আমার সাথে কথা বলাও শোভা পায় না। তারিকের সমর্থন জওয়াব দিলো।

এরপর দুজনেই তলোয়ার টেনে নিয়ে পরস্পরের মোকাবিলায় দাঁড়িয়ে গেলো। তাদের মধ্যে যখন লড়াই শুরু হয়ে যাচ্ছে, তখনই দেখা গেলো, আব্দুল্লাহ আসছেন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে। আব্দুল্লাহ্ দূর থেকে এ দৃশ্য লক্ষ্য করে ঘোড়া হাঁকালেন দ্রুতগতিতে। দেখতে দেখতে তিনি এসে দাঁড়ালেন তাদের মাঝখানে এবং তাদের কাছে জানতে চাইলেন লড়াইয়ের কারণ।

এক ব্যক্তি উঠে বললো, তারিক বড়ো না মুহাম্মদ বিন কাসিম বড়ো, এই প্রশ্নের মীমাংসা করছে এরা।

থাম!’ আব্দুল্লাহ্ হেসে বললেন এবং যুদ্ধরত লোক দুটিও তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলো

‘তোমরা দুজনই ভুল করছে। মুহাম্মদ বিন্ কাসিম ও তারিক তোমাদের নিন্দা-প্রশংসার ধার ধারেন না। তোমরা কেন মুফতে একে অপরের গর্দান কাটতে যাচেছা? শোন, তারিককে কেউ মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের চাইতে বড়ো বললে তিনি তা পছন্দ করবেন না, আর মুহাম্মদ বিন্ কাসিমও শুনে খুশী হবেন না যে, তিনি তারিকের চাইতে বড়ো। যারা জংগের ময়দানে যান আল্লাহর হুকুমের সব কিছু কোরবান করবার আকাংক্ষা নিয়ে, এমনি বাজে কথার ধার ধারেন না তারা। তোমরা তলোয়ার কোষবদ্ধ কর। তাদেরকে নিয়ে মাথা ঘামিও না।’

আব্দুল্লাহর কথায় সবাই চুপ করে গেলো এবং লড়াই করতে উদ্যত লোক দুটি লজ্জায় অপোবদন হয়ে তলোয়ার কোষবদ্ধ করলো। সবাই একে একে আব্দুল্লাহর সাথে মোসাফেহা করতে লাগলো। আব্দুল্লাহ্ এক ব্যক্তির কাছে নিজের বাড়ির খবর জানতে চাইলেন। সে জওয়াব দিলো, আপনার বাড়ির সবাই কুশলে আছেন। কাল আমি আপনার বাচ্চাকে দেখলাম মাশাআল্লাহ্, আপনারই মতে জোয়ান মরদহবে।

‘আমার বাচ্চা!’ আব্দুল্লাহ্ প্রশ্ন করলেন।

“ওহো, এখনও আপনি খবর পাননি। তিন চার মাস হলো, মাশাআল্লাহ আপনি এক সুদর্শন ছেলের বাপ হয়েছেন। কাল আমার বিবি আপনার বাড়ি থেকে তাকে নিয়ে এলো। আমার বাচ্চা তাকে নিয়ে অনেকক্ষণ খেলা করেছে। চমৎকার স্বাস্থ্যবান ছেলে।

আব্দুল্লাহ লজ্জায় চোখ অবনত করলেন এবং সেখান থেকে উঠে বাড়ির পথ ধরলেন। তাঁর মন চায় এক লাফে বাড়িতে পৌঁছে যেতে, কিন্তু এতগুলো লোকের সামনে লজ্জায় তিনি মামুলী গতিতে ঘোড়া ছুটালেন। গাছ-গাছড়ার আড়ালে গিয়েই তিনি ঘোড়া ছুটালেন পূর্ণ গতিতে।

আব্দুল্লাহ্ বাড়িতে ঢুকে দেখলেন, উযরা খেজুরের ছায়ায় চারপায়ীর উপর শুয়ে রয়েছেন। তাঁর ডান পাশে শায়িত এক খুবসুরত বাচ্চা তার হাতের আঙ্গুল চুষছে। আব্দুল্লাহ্ নীরবে এক কুরসী টেনে উযরার বিছানার কাছে বসে পড়লেন। উযরা স্বামীর মুখের উপর লজ্জাভারাবনত দৃষ্টি হেনে উঠে বসলেন। আব্দুল্লাহ হেসে ফেললেন। উযরা দৃষ্টি অবনত করে বাচ্চাকে কোলে তুলে নিয়ে হাত বুলাতে লাগলেন তার মাথায়। আব্দুল্লাহ্ হাত বাড়িয়ে উযরার হাতে চুমো খেলেন। তারপর ধীরে বাচ্চাকে তুলে নিলেন এবং তার পেশানীতে হাত বুলিয়ে তাকে কোলে শুইয়ে দিয়ে তাকিয়ে রইলেন তার মুখের দিকে। বাচ্চা একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো আব্দুল্লাহর কোমরে ঝুলানো খনজরের চমকদার হাতলের দিকে। সে যখন এদিক-ওদিক হাত, চালিয়ে হাতলটি ধরলো, তখন আব্দুল্লাহ নিজে তাঁর খনজরের হাতল তুলে দিলেন তার হাতে। বাচ্চা হাতলটি মুখে নিয়ে চুষতে লাগলো।

উযরা তার হাত থেকে খনজরের হাত ছাড়াবার চেষ্টা করে বললেন, ‘চমৎকার খেলা নিয়ে এসেছেন আপনি।

আব্দুল্লাহ্ হেসে বললেন, ‘মুজাহিদের বাচ্চার জন্য এর চাইতে ভালো খেলনা কি হবে?

‘যখন এ ধরনের খেলনা নিয়ে খেলবার সময় আসবে, তখন দেখবেন, ইনশাঅল্লাহ খারাপ খেলোয়ার হবে না ও।

উযরা, ওর নাম কি?

‘আপনি বলুন।

উযরা, একটি নামই তো আমার ভাল লাগে।’

বলুন!’

নয়ীম!’ আব্দুল্লাহ বিষণ্ণ আওয়াযে জওয়াব দিলেন।

শুনে উমরার চোখ দুটি খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। তিনি বললেন, আমার একিন ছিলো যে, এই নামই আপনি পছন্দ করবেন তাই আগেই আমি ওর এই নাম রেখে দিয়েছি।’

*

নার্গিসদের বস্তি থেকে বিদায় নিয়ে প্রায় পঞ্চাশ ক্রোশ পথ অতিক্রম করে নয়ীম তাতারী পশু-পালকদের এক বস্তিতে গিয়ে রাত কাটালেন। সেখানকার লোকদের চালচলন ও রীতিনীতির সাথে তিনি পরিচিত। তাই আশ্রয়স্থান খুঁজে নিতে অসুবিধা হয়নি তার। বস্তির সরদার তাঁকে ইসলামী ফউজের এক অফিসার মনে করে যথাসম্ভব আদর আপ্যায়ন করলো! সন্ধ্যায় খানা খেয়ে নয়ীম বেরুলেন ঘুরতে। বস্তি থেকে কিছুদুর যেতেই শোনা গেলো ফউজী নাকারার আওয়ায। পিছু ফিরে তিনি দেখলেন, গায়ের লোকেরা ঘর ছেড়ে পালাচ্ছে এদিক ওদিক নয়ীম ছুটে তাদের কাছে গিয়ে জানতে চাইলেন তাদের পেরেশানীর কারণ।

গাঁয়ের সরদার বললো, নাযকারের সেনাবাহিনী মুসলমানদের লশকরের উপর ব্যর্থ হামলা করে পিছু হটে এসে এগিয়ে যাচ্ছে ফারগানার দিকে। আমি খবর পেয়েছি যে, তাদের রাস্তায় যে বস্তিই আসছে, তার উপর তারা চালাচ্ছে লুটপাট। আমার ভয় হচ্ছে, তারা এ পথ দিয়ে গেলে আমাদের ভীষণ ধ্বংসের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। আপনি এখানেই থাকুন। আমি ওই পাহাড়ে চড়ে তাদের খোঁজ নিচ্ছি। নয়ীম বললেন, আমিও যাচ্ছি আপনার সাথে।

নয়ীম ও তাতারী সরদার ছুটে চলে গেলেন পাহাড়ের চূড়ায়। সেখান থেকে দেড়ক্রোশ দূরে তাতারী লশকর আসতে দেখা গেলো। সরদার খানিকক্ষন দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তারপর খুশীতে উছলে উঠে বললো, সত্যি বলছি, ওরাঁ এদিকে আসবে না। ওরা ভিন্ন পথ ধরেছে। খানিকক্ষণ আগেও আমি মনে করেছি যে, আপনার আগমন আমাদের জন্য এক অশুভ ইংগিত, কিন্তু এখন আমার একিন জন্মেছে, আপনি মানুষ নন, এক আসমানী দেবতা। আপনার কারামতেই এই ক্ষুধিত নেকড়ের দল আমাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। এই কথা বলে সে নয়ীমের হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে নেমে গেলো নীচের দিকে। বস্তির লোকদের সে খোশখবর শোনালো। অমনি তারা সবাই চাক্ষুষ দেখবার জন্য উঠে গেলো পাহাড়ের উপর।

গোধূলির স্নান আভা মিশে গেলো রাতের অন্ধকারে। বস্তির খানিকটা দূরে ফারগানা গামী রাস্তায় ফউজের অগ্রগতির অস্পষ্ট দৃশ্য দেখা যায়। ঘোড়ার আওয়ায ও নাকারার ধ্বনি ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে। বস্তির লোকেরা আশ্বস্ত হয়ে হল্লা করে, দাপাদাপি করে, নেচে গেয়ে ফিরে এলো বস্তি দিকে।

এশার নামায শেষ করে শুয়ে পড়তেই নয়ীমের চোখে নামলো গভীর ঘুম। স্বপ্নের আবেশে মুজাহিদ আর একবার দ্রুতগামী ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তীরবৃষ্টি ও তলোয়ারের হামলা উপেক্ষা করে দুশমনের সারি ভেদ করে এগিয়ে চললেন সামনের দিকে। ভোরে উঠে নামায পড়ার পর তিনি রওয়ানা হলেন মনযিলে মকসুওদের দিকে।

আরও কয়েক মনযিল অতিক্রম করে যাবার পর একদিন ইসলামী লশকরের তাঁবু নয়ীমের ন্যরে পড়লো। মরভ থেকে তার লশকর অপ্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে যাওয়ায় তিনি হয়রান হয়েছিলেন। তথাপি তার ধারণা হলো, হয়তো তাতারীদের হামলা তাদেরকে সময়ের আগেই এগিয়ে যেতে বাধ্য করেছে।

কুতায়বা বিন মুসলিম বাহেলী তার প্রিয় সালারকে জানালেন সাদর অভ্যর্থনা। অন্যান্য সালাররাও তাঁর আগমনে অসীম আনন্দ প্রকাশ করলেন।

নয়ীমকে অনেক প্রশ্ন করা হলো। তার জওয়াবে তিনি সংক্ষেপে শোনালেন তার কাহিনী। তারা নয়ীম পর কয়েকটি প্রশ্ন করলেন কুতায়বা বিন মুসলিমের কাছে। জওয়াবে তিনি জানান যে, কুতায়বা তাতারীদের পরাজিত করে নাযযাকের পিছু ধাওয়া করছেন।

রাতের বেলায় কুতায়বা বিন মুসলিম তার সালার ও মন্ত্রণাদাতাদের মজলিসে অগ্রগতির বিভিন্ন পরামর্শ সম্পর্কে আলোচনা করলেন। নয়ীম তাকে বুঝালেন যে, ইবনে সাদেক তার নতুন চক্রান্তের কেন্দ্র করে তুলবে এবার ফারগানাকে। তাই তার অনুসরণ করতে দেরী করা উচিত হবে না।

ভোরবেলা সেনাবাহিনীর অগ্রগতির জন্য কারা বেজে উঠলো। কুতায়বা সেনাদলকে দু’ভাগে বিভক্ত করে এগিয়ে যাবার জন্য দুটি ভিন্ন রাস্তা নির্দেশ করে দিলেন। অর্ধেক ফউজের নেতৃত্ব থাকলো তাঁর নিজের উপর আর বাকী অর্ধেকের নেতৃত্ব সোপর্দ করলেন তাঁর ভাইয়ের উপর। নয়ীম ছিলেন দ্বিতীয় দলের শামিল। পথ-ঘাটের খুঁটিনাটি সব ব্যাপারে নয়ীমের জানা আছে বলেই কুতায়বার ভাই তাঁকে রাখলেন অগ্রগামী সেনাদলে।

*

নার্গিস এক পাথরের উপর বসে ঝরণার স্বচ্ছ পানি নিয়ে খেলছে। ছোট ছোট কাঁকর তুলে সে ছুঁড়ে ফেলছে পানিতে, তারপর কি করে তা ধীরে ধরে পানির তলায়। চলে যাচ্ছে, তাই সে দেখছে আপন মনে। একটি কাঁকর এমনি করে তলায় গিয়ে পৌঁছলে সে আর একটি ছুঁড়ে মারছে পানির উপর। কখনো বা তার মন এ খেলা থেকে সরে গিয়ে নিবিষ্ট হচ্ছে সামনের ময়দানের দিকে। ময়দানের বিস্তীর্ণ প্রসারের শেষে ঘন গাছপালার সবুজ লেবাসে ঢাকা পাহাড়রাজি দন্ডায়মান। এসব পাহড়ের পরেই উঁচু উঁচু পাহাড়ের সফেদ বরফ ঢাকা চুড়াগুলো পড়ে নজরে। বসন্ত মওসুমের সূচনা করে মুগ্ধকর হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ডান দিকে সেব গাছ আর আঙ্গুর লতায় ফল ধরতে শুরু করেছে।

নার্গিস তার আপন চিন্তায় বিভোর, অমনি পেছনে থেকে যমররুদ নিঃশব্দ পদক্ষেপে এসে পাথর তুলে মারলো পানির উপর। উছলে ওঠা পানির ছিটা এসে পড়লো নার্গিসের কাপড়ের উপর। নার্গিস ঘাবড়ে গিয়ে তাকালো পেছন দিকে। যমররুদ অট্টহাস্যে ফেটে পড়লো, কিন্তু নার্গিসের দিকে থেকে কোন সাড়া এলো না। যমররুদ হাসি সংযত করে মুখের উপর নার্গিসেরই মতো গাম্ভীর্য টেনে এনে তার কাছে এসে বসলো।

নার্গিস! আমি তোমায় আজ বহুত খুঁজছি। এখানে কি করছো তুমি?

কিছুই না। নার্গিস একহাতে পানি নিয়ে খেলতে খেলতে জওয়াব দিলো।

তুমি আর কতকাল এমনি করে তিলে তিলে জান দেবে। তোমার দেহ যে আধখানা হয়ে গেছে। কি রকম পাভুর হয়ে গেছে। তুমি।

যমরুরদ! বার বার আমায় বিরক্ত করো না। যাও।’

‘আমি তোমার সাথে ঠাট্টা করতে আসিনি, নার্গিস! তোমায় দেখে আমি কতটা পেরেশান হয়েছি, তা খোদাই জানেন।

যমররুদ নার্গিসের গলায় বাহু বেষ্টন করে তার মাথাটা টেনে নিয়ে বুকে চেপে ধরলো। নার্গিসও এক রুগ্ন বাচ্চার মত তার কাছে নিজকে সমর্পণ করে দিলো।

হায়! আমি যদি তোমার জন্য কিছু করতে পারতাম!’ যমররুদ নার্গিসের পেশানীর উপর হাত বুলাতে বুলাতে বললো। নার্গিসের চোখ অশ্রুভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো। ব্যাথাতুর কণ্ঠে সে বললো, আমার যা হবার, হয়ে গেছে। পাহাড়-চূড়ার মুগ্ধকর দৃশ্য আমি দেখেছি, কিন্তু দুর্গম পথের চিন্তা করিনি। যমররুদ! উনি আমার জন্য নন। আমি তাঁর যোগ্যই নই। তাঁর সম্পর্কে কোনও নালিশও নেই আমার। হয়তো আমার মতো হাজারো মেয়ে তার পায়ের ধূলাকে চোখের সুরমা বানাবার জন্য উদগ্রীব। কিন্তু ….কেন তিনি এলেন এখানে? যদি এলেন তো কেন চলে গেলেন? কেন তাকে দেখেই আমি এমন বেকারার-এমন পেরেশান হলাম? আমি তাঁকে সব কিছুই খুলে বলতাম, কিন্তু তাঁর কোন শক্তি আমার যবানকে এমন করে দাবিয়ে রাখলো? তিনি আমাদের থেকে অনেক খানি স্বতন্ত্র, জেনে-শুনেও কেন আমি নিজকে তার পায়ে সঁপে দিতে চেষ্টা করলাম? এ পরিণামের ভয় আমি করেছি, কিন্তু হায়! ভয় যদি আমায় ফিরিয়ে রাখতো! যমররুদ! ছোটবেলা থেকেই আমি স্বপ্ন দেখেছি আসমান থেকে এক শাহযাদা নেমে আসবেন, আমি তার কাছে দীল-যবান সমর্পন করে দিয়ে আপনার করে নেবো তাঁকে। আমার শাহযাদা এলেন, কিন্তু তাঁকে আমি আপনার করে নিতে পারিনি ভয়ে। যমররুদ! এও কি এক স্বপ্ন? এ স্বপ্নে কি কোন অর্থ আছে? যরূরুদ! যমররুদ!! আমার কি হলো? তুমি কি এখনও বলবে, আমি সবর করিনি? হায়, সবর করবার ক্ষমতা যদি আমার থাকতো।’

নার্গিস! প্রত্যেক স্বপ্নের সাফল্যের সময় ঠিক থাকে। অনন্ত হতাশার মধ্যেও ইনতেযার আর উম্মীদ হবে আমাদের শেষ অবলম্বন। খোদার কাছে দো’আ করো।

এমনি বিলাপ করে কোন ফায়দা নেই। ওঠ, এবার ঘুরে আসিগে’।

নার্গিম উঠে যমররুদের সাথে সাথে চললো। কয়েক কদম চলতেই ডান দিকে এক সওয়ারকে দ্রুত ঘোড়া ছুটিয়ে আসতে দেখা গেলো। সওয়ার তাদের কাছে এসে ঘোড়া থামালেন। তাঁকে দেখে যমররুদ চীৎকার করে বললো, নার্গিস! নার্গিস!! তোমার শাহযাদা এলেন! নার্গিস নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তার দীলের রাজ্যের বাদশাহ্ তার সামনে দাঁড়িয়ে। সে তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না যেনো। অন্তহীন খুশী অথবা অন্তহীন বিষাদের ভিতরে মানুষ যেমন নিশ্চল হয়ে যায়, নার্গিসের অবস্থাও তাই। ঘুমের ঘোরে স্বপ্নবেশে চলবার মত দু’তিন কদম সামনে গিয়েই সে পড়ে গেলো যমিনের উপর। নয়ীম তখখুনি ঘোড়া থেকে নেমে নার্গিসকে ধরে তুললেন।

নার্গিস! কি হলো তোমার?

‘কিছু না।’ নার্গিস চোখ খুলে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে জওয়াব দিলো।

‘আমায় দেখে ভয় পেলে তুমি?’

নার্গিস কোন জওয়াব না দিয়ে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে রইলো একদৃষ্টে। এতো কাছে থেকে তাঁকে দেখা তার প্রত্যাশার অতীত, কিন্তু নয়ীম.তার অবস্থা সম্পর্কে আশ্বস্ত হয়ে দু’তিন কদম দূরে সরে দাঁড়ালেন। নার্গিস তার আঁচলে আসা ফুলের বিচ্ছেদ বরদাশত করতে পারলো না। তার দেহের প্রতি শিরা উপশিরায় জাগলো এক অপূর্ব কম্পন। নারীসূল সংকোচের বাঁধা কাটিয়ে সে এগিয়ে গিয়ে মুজাহিদের পায়ের উপর ঝুকলো।

নয়ীমের সংযম বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। তিনি নার্গিসের বায়ু ধরে তুলে যমরুদের দিকে তাকিয়ে বললেন, যমররুদ! একে ঘরে নিয়ে যাও।’

নার্গিস একবার নয়ীমের দিকে, আবার যমররুদের দিকে তাকাতে লাগলো। তার চোখ থেকে নামলো অশ্রুর বন্যা। সে মুখ ফিরিয়ে নিলো অপর দিকে। তারপর একবার নয়ীমের দিকে ফিরে তাকিয়ে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঘরের দিকে চললো। নয়ীম যমররুদের দিকে তাকালেন। সে দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়।

নয়ীম বিষণ্ণ স্বরে বললেন, যাও যমররুদ, ওকে সান্ত্বনা দাওগে।’

যমররুদ জওয়াব দিলো, “কেমন সান্ত্বনা? আপনি এসে ওর শেষ অবলম্বনটুকুও ভেঙে চুরমার করে দিলেন। এর চাইতে না আসাইতো ছিলো ভালো।’

‘আমি হুমানের সাথে দেখা করতে এসেছি। সে কোথায়?

‘সে গেছে শিকার করতে।’

‘তা হলে ঘর পর্যন্ত যাওয়া আমার পক্ষে নিরর্থক। হুমানকে আমার সালাম দিয়ে বলবে, নিরুপায় বলেই আমি দেরী করতে পারিনি। আমাদের ফউজ এগিয়ে যাচ্ছে ফারগানার দিকে।

কথাটি বলেই নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হলেন, কিন্ত যমররুদ এগিয়ে গিয়ে ঘোড়ার বাগ ধরে বললো, আমি মনে করেছিলাম, আপনার চাইতে নরমদীল মানুষ আর নেই, কিন্তু আমার ধারণা ভুল। আপনি মাটির তৈরী নন, আর কোন জিনিষের তৈরী। এখন বদনসীবের দেহে জানটুকুও বাকী রইলো না।’

যমররুদ! ওদিকে তাকও!’ নয়ীম একদিকে ইশারা করে বললো। যমররুদ তাকিয়ে দেখলো, এক শলকর এগিয়ে আসছে।

হয়তো কোন ফউজ আসছে। সে বললো।

নয়ীম বললেন, এই যে আমাদেরই ফউজ আসছে। আমি হমানের সাথে কয়েকটা কথা বলবার জন্য ফউজের আগে চলে এসেছিলাম।’

যমররুদ বললো, আপনি দেরী করুন। সে আজ রাত্রেই এসে পড়বে হয়তো।

‘এ মুহূর্তে আমার দেরী করা অসম্ভব। আমি আবার আসবো। নার্গিসের দীলে হয়তো কোন ভূল ধারণা পয়দা হয়েছে আমার সম্পর্কে। তুমি গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিও। ওর দীল এতটা কমজোর, তা জানতাম না। ওকে আশ্বাস দিও যে, আমি নিশ্চয়ই আসবো। ওর দীলের খবর আমি জানি।

কথায় যতোটা সম্ভব, আমি ওকে সান্ত্বনা দিয়ে থাকি আগে থেকেই, কিন্তু এখন হয়তো ও আমার কথায় বিশ্বাস করবে না। হায়! আপনি নিজের মুখে যদি ওকে একটি কথা বলেও সান্ত্বনা দিতেন। এখন যদি আপনি ওর জন্য কোন নিশানী দিতে পারেন, তাহলে হয়তো ওকে সান্ত্বনা দিতে পারবো।’

নয়ীম এক লহমা চিন্তা করে জেল থেকে রুমাল বের করে দিলেন যমরুদের হাতে। তারপর বললেন, ‘এটা ওকে দিও।

বস্তির লোকেরা ফউজ আসার খবরে ঘাবড়ে গিয়ে এদিক ওদিক পালতে লাগলো। নয়ীম ঘোড়া ছুটিয়ে তাদের কাছে গিয়ে বললেন, কোন বিপদের কারণ নেই। তারা আশ্বস্ত হয়ে নয়ীমে আশে পাশে জমা হতে লাগলো। তিনি ঘোড়া থেকে নেমে তাদের প্রত্যেকের কাছে গিয়ে আলাপ করতে লাগলেন ঘনিষ্ঠ হয়ে। ইতিমধ্যে ফউজ এসে পৌঁছলো বস্তির কাছে। ইসলামী ভ্রাতৃত্বের বিচিত্র আকর্ষণ! বস্তির লোকেরা নয়ীমের সাথে গেলো ইসলামী ফউজকে অভ্যর্থনা জানতে। নয়ীম সিপাহসালারের সাথে প্রত্যেকের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ফউজের লক্ষ্যের সাথে পরিচিত হবার পর কতক লোক জিহাদের যাবার আকাংক্ষা প্রকাশ করলো। সিপাহসালার তখনি তৈরী হয়ে নেবার হুকুম দিলেন তাদেরকে। এদের মধ্যে সব চাইতে বেশী আগ্রহ নার্গিসের চাচা বারমাকের। যিন্দেগীর পঞ্চাশটি বসন্ত ঋতু অতিক্রম করে আসার পরও তার সুগঠিত দেহ ও অটুট স্বাস্থ্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতো। বস্তির নয়া সিপাহীদের প্রস্তুতির জন্য খানিকক্ষণ দেরী করতে হলো ফউজকে।

খানিকক্ষণ পর বিশজন সিপাহী তৈরী হয়ে এলে ফউজকে এগিয়ে চলবার হুকুম দেওয়া হলো। বস্তির মেয়েরা ফউজের অগ্রগতির দৃশ্য দেখবার জন্য এসে জমা হলো এ পাহাড়ের উপর। নয়ীম সবার অগ্রগামী দলের পথনির্দেশ করে চলেছেন। নার্গিস ও যমররুদ আর সব মেয়েদের দল থেকে আলাদা হয়ে ফউজের আরও কাছে দাঁড়িয়ে পরস্পর কথা বলে যাচ্ছে। নার্গিসের হাতে নয়ীমের রুমাল।

নার্গিস, তোমার শাহযাদা তো সত্যি শাহযাদা হয়েই বেরিয়েছেন। নয়ীমের দিকে ইশারা করে যমররুদ বললো।

নার্গিস জওয়াব দিলো। আহা! তিনি যদি সত্যি আমার হতেন!

‘তোমার এখনও একিন আসছে না’?

‘একিন আসছে, আবার আসছে না। গম্ভীর হতাশার মধ্যে যখন একবার আশার প্রদীপ নিভে যায়, তখন তাকে আর একবার জ্বেলে নেওয়া বড়ই মুশকিল। সত্যি বলতে তোমার কথায়ও পুরোপুরি একিন আসে না আমার। যমররুদ! সত্যি করে বলো তো, তুমি আমার সাথে ঠাট্টা তো করছে না।

না, তোমার একিন না এলে ওঁকেই ডাকো’।. এখনও বেশী দূরে যাননি। কেমন?

না, যমররুদ, কসম খাও।’

‘কোন কসম খেলে তুমি বিশ্বাস করবে?

‘তোমার শাহযাদার কসম খাও।

‘কোন শাহযাদার?

হুমানের।

‘যে সে আমার শাহযাদা, তা তোমায় কে বললো?’

তুমিই বলেছো।

কবে?’

‘যে দিন সে ভালুক শিকার কতে গিয়ে যখমী হয়ে ফিরে এলো, আর তুমি সারা রাত জেগে কাটালে।’

তাতে তুমি কি আন্দায করলে?

যমররুদ! আচ্ছা, আমার কাছ থেকে কি গোপন করবে তুমি? এমন মুহূর্ত আমারও কেটেছে। উনিও যে যখমী হয়ে এসেছিলেন, তা তোমার মনে নেই?

‘আচ্ছা, তা হলে আমি ওর কসম খেলে তুমি বিশ্বাস করবে?’

“হয়তো করবো।’

আচ্ছা, হুমানের কসম করেই বলছি, আমি ঠাট্টা করছি না।’

যমরুরুদ! যমররুদ!! নার্গিস তাকে চেপে ধরে বললো, তুমি আমায় বারংবার সান্ত্বনা না দিলে, হয়তো আমি মরেই যেতাম! উনি কবে আসবেন, কেন জিজ্ঞেস করলে না তুমি?

“উনি খুব শিগগীরই আসবেন।

যদি শিগগীরই না আসেন তাহলে…. তাহলে?’ নার্গিস ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করলো।

যমদ সলজ্জভাবে বললো, তাহলে আমি তোমার ভাইকে পাঠিয়ে দেবো ওঁকে নিয়ে আসতে।

এগারো

ছয় মাস কেটে গেলো, কিন্তু নয়ীম আসেন না। ইতিমধ্যে কুতায়বা নাযককে কতল করে তুর্কিস্তানের বিদ্রোহের ধুমায়িত অগ্নিশিখা অনেকখানি ঠান্ডা করে এনেছেন। নাকের যবরদস্ত সমর্থক শাহে জর্জানও নিহত হয়েছেন। এই অভিযানে শেষ করে কুতায়বা সুগদের বাকী এলাকা জয় করতে গিয়ে পৌঁছলেন সিন্তানে। সেখানে থেকে আবার উত্তর দিকে এগিয়ে গেলেন খারেযম পর্যন্ত। খারেযম-শাহ জিযিয়া দেবর ওয়াদা করে শান্তি স্থাপন করলেন। খারেযম থেকে খবর পাওয়া গেলো যে, সমরকন্দবাসীরা চুক্তিভংগ করে চালিয়ে যাচ্ছে বিদ্রোহের প্রস্তুতি।

কুতায়বা ফউজের কয়েকটি দল সাথে নিয়ে হামলা করলেন সমরকন্দের উপর এবং শহর অবরোধ করলেন। বোখারার মতই সুদৃঢ় প্রাচীর ও মযবুত কেল্লা এ শহরটিকেও নিরাপদ করে রেখেছিলো। কুতায়বা আত্মবিশ্বাস সহকারে অবরোধ জারী রাখলেন। তিন মাস কেটে যাবার পর শাহে-সমরকন্দ পাঠালেন শান্তির আবেদন। জওয়াবে কুতায়বা সন্ধির শর্ত লিখে পাঠালেন। বাদশাহ্ শর্ত মন্যুর করে নিলে শহরের দরজা খুলে দেওয়া হলো।

সমরকন্দের এক মন্দিরে ছিলো এক মহাসম্মানিত প্রস্তরমূর্তি। লোকে বলতো, সে মুর্তির গায়ে কেউ হাত লাগালে তার মৃত্যু সুনিশ্চিত। কুতায়বা মন্দিরে ঢুকে ‘আল্লাহু আকবার’ তীর ধ্বনি করে একই আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিলেন সে ভয়ংকর মূর্তিকে। মূর্তির পেট থেকে বেরুলো পঞ্চাশ হাজার মিসকাল সোনা। কুতায়বা যখন এমনি সাহসের পরিচয় দিয়েও দেবতার রোষ থেকে নিরাপদ রইলেন, তখন সমরকন্দের বেশুমার লোক পড়লো কালেমায়ে তওহীদ।

কুতায়বা বিন্ মুসলিম বিজয় ও খ্যাতির সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেলেন। হিজরী ৯৫ সালে তিনি অভিযান চালালেন ফারগানার দিকে। বহু শহর তিনি জয় করলেন। এরপর তিনি ইসলামী ঝান্ডা উড়িয়ে পৌঁছলেন কাশগড় পর্যন্ত। এর পরেই চীন সীমান্ত।

কাশগড়ে থেকে কুতায়বা শুরু কররেন চীন আক্রমণের প্রস্তুতি। চীনের শাহ্ কুতায়বার উদ্যোগ আয়োজনের খবর পেয়ে এক দূত পাঠিয়ে শান্তি আলোচনার জন্য একদল দূত প্রেরণের আবেদন জানালেন। দূত-দলের কর্তব্য পালনের যোগ্য মনে করে কুতায়বা হুবাযরা ও নয়ীম ছাড়া আরও পাঁচজন অভিজ্ঞ অফিসারকে মনোনীত করলেন চীন যাবার জন্য।

*

চীনের বাদশার দূতাবাসে হুবায়রা, নয়ীম ও তাঁদের সাথীরা এক মনোরম গালিচার উপর বসে আলাপ আলোচনা করছেন।

কুতায়বাকে কি খবর পাঠান যায়? হুবায়রা নয়ীমের কাছে প্রশ্ন করলেন, চীনের বাদশার লশকর আমাদের মোকাবিলায় অনেক বেশি। আপনি লক্ষ্য করেছেন, কতটা গর্ব সহকারে তারা আমাদের সামনে এসেছে!

নয়ীম জওয়াবে বললেন, শাহে ইরানের চাইতে বেশী ক্ষমতা গর্বিত নয় এরা। ক্ষমতার দিক দিয়েও এরা তার চাইতে বড় নয়। এখানকার আরামপিয়াসী ভীতু সিপাহীরা আমাদের ঘোড়ার খুরের দাপটেই ভয় পেয়ে পালাবে। আমাদের শর্ত পেশ করে দিয়েছি আমরা, তার জওয়াবের ইতেযার করুন। আপাততঃ কুতায়বাকে লিখে দিন যে, চীন জয়ের জন্য নতুন ফউজের প্রয়োজন হবে না। লড়াই যদি, করতেই হয়, তাহলে তুর্কিস্তানে যে ফউজ মওজুদ রয়েছে, এদেশ জয় করার জন্য তারাই হবে যথেষ্ট।

এক সভাসদ কামরায় প্রবেশ করে নত মস্তকে হুবায়রা ও তাঁর সাথীদের সালাম জানিয়ে বললেন, ‘জাঁহাপনা আর একবার আপনাদের সাথে আলাপ করতে চাচ্ছেন।

হুবায়রা জওয়াব দিলেন, আপনি গিয়ে বাদশাহকে বলেন, আমাদের শর্তে কোন রদবদল করবো না আমরা। আমাদের শর্ত মনযুর না হলে আমাদের মধ্যে তলোয়ার দিয়েই বিরোধ মীমাংসা হবে।

‘জাঁহাপনা শর্ত ছাড়া আরও কিছু জানতে চান আপনাদের কাছে। আপনাদের মধ্যে একজনকে তাঁর কাছে নিয়ে যাবার হুকুম হয়েছে আমার উপর। অতদূর থেকে ধন-দৌলতের আকাংক্ষায় লুটপাট করতে করতে আপনারা এখানে এসেছেন, তাই আঁহাপনা আমাদেরকে কিছু ধন-দৌলত উপহার দিয়ে বন্ধুর মত বিদায় করতে চান। আরও তিনি কিছু জানতে চান আপনাদের দেশ ও কওম সম্পর্কে। নয়ীম তাঁর তলোয়ার সভাসদকে দিয়ে বললেন, ‘এখানি নিয়ে যান। এ আপনাদের বাদশার যে কোন সওয়ালের জওয়াব দেবে।

‘আপনার তলোয়ার?’ সভাসদ হয়রাণ হয়ে বললেন।

হাঁ, আপনার বাদশাহকে বলবেন, এই তলোয়ারের মুখেই আমাদের কওমের তামাম ইতিহাস লেখা হয়েছে, এবং তাকে আরও বলবেন যে, তাঁর তামাম ধন ভান্ডারকে আমরা মুজাহিদের ঘোড়ার পায়ের ধুলার সমানও মনে করি না।’

সভাসদ লজ্জিত হয়ে বললেন, জাঁহাপনার মকসুদ আপনাদের নারায করা নয়। আপনাদের সাহসের তারিফ করেন তিনি। আপনারা আর একবার মোলাকাত করুন, আমার বিশ্বাস, তার ফল ভালই হবে। হুবায়রা নয়ীমকে আরবী জবানে বললেন, বাদশাহকে আর একবার সুযোগ দেওয়া আমাদের উচিত। আপনি গিয়ে তবলীগ করুন।

নয়ীম জওয়াব দিলেন, আপনি আমার চাইতে বেশি অভিজ্ঞ।’

আমি আপনাকে পাঠাচ্ছি, তার কারণ, আপনার জবান ও তলোয়ার-দুই-ই সমান তীক্ষ্ণধার। আপনার আলাপ আমার চাইতে বেশী কার্যকরী হবে।

শুনে নয়ীম উঠে সভাসদের সাথে চললেন।

দরবারে প্রবেশের আগে এ শাহী গোলাম সোনার পাত্রে একটি বহুমূল্য পোষাক নিয়ে হাযির হলো, কিন্তু নয়ীম তা পরিধান করতে অস্বীকার করলেন। সভাসদ বললেন, আপনার কামিয বড়ই পুরানো। আপনি বাদশার দরবারে যাচ্ছেন।

নয়ীম জওয়াব দিলেন, ‘এ সব দামী লেবাস আপনাদেরকে বাদশার দরবারে মাথা নত করতে বাধ্য করে, কিন্তু আপনি দেখবেন, আমার পুরানো জীর্ণ কামিয আমায় আপনাদের বাদশার সামনে মাথা নীচু করতে দেবে না।’

নয়ীমের মোটা শক্ত চামড়ার জুতোজোড়াও ধুলি-মলিন। এক গোলাম নূয়ে পড়ে রেশমী কাপড় দিয়ে তা সাফ করে দিতে চাইলো। নয়ীম তার বায়ু ধরে তুলে দিয়ে কিছু না বলেই এগিয়ে চললেন।

চীনের বাদশাহ তাঁর পত্নীকে সাথে নিয়ে এক সোনার তখতে সমাসীন। তাঁর পাভুর মুখের উপর বার্ধক্যের রেখা সুস্পষ্ট। তাঁর পত্নী যদিও অর্ধবয়সী তথাপি তার সুডৌল মুখের উপর অতীত যৌবনের বিগত বসন্তের রূপের আভাস এখনো মিলিয়ে যায়নি। তিনি ফারগানার শাহী খান্দানের সাথে সম্পর্কিত। চীনা নারীদের তুলনায় তাঁর মুখশ্রী অধিকতর কমনীয়। রাজ্যের ওলী আহাদের গলায় জওয়াহেরাতের এক বহুমূল্য মালা। বাদশার ডান দিকে একদল সুন্দরী পরিচারিকা শারাবের জাম ও সোরাহী নিয়ে দন্ডায়মান। তাদের মাঝখানে হুসনেআরা নামী এক ইরানী নর্তকী। রূপলাবণ্যে সে অপর পরিচারিকাদের থেকে অসামান্য। তার দীর্ঘ সোনালী কেশদাম ছড়িয়ে আছে কাঁধের উপর দিয়ে। তার মাথায় সবুজ রঙের এক রুমাল। গায়ে কালো রঙের কামি। কোমরের উপর দিকে তা দেহের সাথে এমন আঁটসাট হয়ে আছে যে, তার উন্নত বক্ষযুগল সুস্পষ্টভাবে নযরে পড়ে। নীচে উজ্জ্বল রঙের ঢিলা পাজামা। হুসনেআরা আর সব মেয়েদের তুলনায় উঁচু।

নয়ীম বিজয়ী বেশে দরবারে প্রবেশ করলেন। তিনি বাদশাহ ও দরবারীদের দিকে দৃষ্টি হেনে আসসলামু আলাইকুম’ বললেন।

বাদশাহ দরবারীদের দিকে আর দরবারীরা বাদশার দিকে তাকাতে লাগলেন। সালামের জওয়াব না পেয়ে নয়ীম তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকালেন বাদশাহের দিকে বাদশাহ মুজাহিদের তেজোব্যঞ্জক দৃষ্টির সামনে দৃষ্টি অবনত করলেন। ওলী আহাদ আসন ছেড়ে উঠে নয়ীমের দিকে হাত বাড়ালেন। নয়ীম তাঁর সাথে মোসাফেহা করে তাঁর ইশারা একটি খালি কুরসিতে বসে পড়লেন।

বাদশাহ তাঁর পত্মীর দিকে তাকিয়ে তাতারী যবানে বললেন, ‘এ লোকগুলোকে দেখে আমি কৌতুক অনুভব করি। এঁরাই এসেছেন আমাদের জয় করতে। এঁর লেবাসটা দেখে নাও।’

নয়ীম জওয়াব দিলেন, সিপাহীর শক্তি তার লেবাস দিয়ে আন্দায করা যায়না, তা আদায় করতে হয় তার তলোয়ারের তেজ ও বায়ুর কুওৎ দেখে।’

চীনের বাদশার ধারণা, নয়ীম তাতারী যবান জানেন না, কিন্তু জওয়াব পেয়ে তিনি পেরেশান হলেন। তিনি বললেন, শাবাশ। তুমি তাতারী যবানও জানো দেখছি। নওজোয়ান! তোমার সাহসের প্রশংসা করি আমি, কিন্তু তোমাদের শক্তি পরীক্ষার জন্য আর কোন প্রতিদ্বন্দ্বী বাছাই করে নিলেই হয়তো ভালো হতো তোমাদের জন্য চীন সাম্রাজের উত্তরাধিকারীকে তুর্কিস্তানের ক্ষুদ্র শাসকদের সমকক্ষ মনে করে তোমরা ভুল করছে। আমার বিদ্যুৎ গতি অশ্ব তোমাদের গর্বিত শির ধুলোয় পিষে দিবে। তোমরা যা কিছু হাতে পেয়েছে, তাই নিয়ে খুশী থাক। এমনও তো হতে পারে যে, চীন জয় করতে গিয়ে তুর্কিস্তানও হারিয়ে ফেলবে তোমরা।’

নয়ীম জোশের সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি ডান হাত তলোয়ারের হাতলের উপর রেখে বললেন, ‘গর্বিত বাদশাহ! এ তলোয়ার ইরান ও রুমের শাহানশাহদেরকে মিশিয়ে দিয়েছে মাটিতে। এ আঘাত সহ্য বরবার ক্ষমতা নেই আপনাদের। আপনাদের ঘোড়া ইরানীদের হাতীর চাইতে বেশী শক্তিশালী নয়।

নয়মের কথা শুনে দরবারে স্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। বাদশাহ একটুখানি মাথা নাড়লেন। অমনি হুমনেআরা এগিয়ে এসে শারাবের জাম পেশ করে আবার গিয়ে দাঁড়ালেন নিজের জায়গায়।

এক পরিচারিকা হুসনেআরার কানের কাছে চুপি চুপি বললো, জাঁহাপনার ক্রোধ উদ্দীপ্ত হচ্ছে। এ নওজোয়ান সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।’

হুসনেআরা মনোমুগ্ধকর হাসি সহকারে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললো, এর বাহাদুরী বেঅকুফীর সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এধরনের সাহসের মূল্য কি, তা জানা নেই ওর।’

বাদশাহ কয়েক ঢোক শারাব গিলে নয়ামের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘নওজোয়ান আমি আর একবার তোমার সাহসের তারিফ করছি। আজ পর্যন্ত কেউ সাহস করেনি আমার দরবারে এত বড়ো কথা বলতে। আমরা তোমাদের ধর্মকে ভয় পেয়ে যাব, মনে করা ঠিক হবে না। তোমাদের বাহাদুরীর পরীক্ষাও হবে, কিন্তু আমি জানতে চাই, দুনিয়ার সব শান্তিপূর্ণ সালতানাতে কেন তোমরা পয়দা করছে অশান্তি। হুকুমাতের লোভ থাকলে আগেই তো তোমরা বহুদূর প্রসারিত সালতানাতের মালিক হয়েছে। দৌলতের লালা থাকলে আমরা তোমাদের অনেক কিছুই দেবো খুশী হয়ে। সোনা চাদি দিয়ে ভরে দিলেও আমাদের ধনভান্ডারে দৌলতের কমতি হবে না। যা খুশী, তোমরা চেয়ে নাও’।

নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমরা আমাদের শর্ত পেশ করেছি। আপনি আমাদের সম্পর্কে ভুল ধারণা করছেন। দুনিয়ায় বিশৃংখলা পয়দা করতে আমরা আসিনি, কিন্তু এমন শান্তির সমর্থক আমরা নই, যাতে অসহায় কমযোর মানুষ শক্তিমানের যুলুম নীরবে সয়ে যেতে বাধ্য হয়। সারা দুনিয়ার শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা কায়েম করতে চাই এক.বিশ্বজয়ী কানুন-যাতে শক্তিমানের হাত কমযোরকে আঘাত দিতে পারবে না, মনিব ও গোলামের প্রভেদ থাকবে না, বাদশাহ আর তাঁর প্রজাদের মধ্যে থাকবে না কোন দূরত্ব। এই কানুনই হচ্ছে ইসলাম। দৌতল ও হুকুমাতের লোভ নেই আমাদের, বরং দুনিয়ার পাশব শক্তির হাত থেকে মযলুম মানবতার হারানো অধিকার ফিরিয়ে আনবার জন্যই এসেছি আমরা। আপনি হয়তো জানেন না, দুনিয়ার বিস্তীর্ণতম হুকুমাতের মালিক হয়েও আমাদের নযর নেই দুনিয়ার ঐশ্বর্য-আড়ম্বরের দিকে।’

নয়ীম কথা শেষ করে বসলেন। দরবারে আর একবার স্তব্ধতা ছেয়ে গেলো। হুসনেআরা তার পাশের পরিচারিকাকে বললো, “এই সদুৰ্শন নওজোয়ানকে দেখে আমার মনে জাগে দয়া। যিন্দেগী এর কাছে ভার হয়ে এসেছে, মনে হয়। জাহাঁপনার একটি মাত্র মামুলি ইশারা ওকে নিরব করে দেবে চিরদিনের জন্য, কিন্ত আমি দেখে হয়রাণ হচ্ছি, জাঁহাপনা আজ প্রয়োজনের চাইতে বেশি দয়ার পরিচয় দিচ্ছেন। দেখি, এর পরিণাম কি হয়। এমনি ভরা-যৌবনে মৃত্যুর পথ খোলাসা করা কতো বড়ো নির্বুদ্ধিতা।

নয়মের কথার মধ্যে বাদশাহ দু’একবার চঞ্চল হয়ে উঠে এপাশ-ওপাশ করেছেন এবং কোন জওয়াব না দিয়ে তামাম দরবারীর মুখের দিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করেছেন। তারপর তাঁর পত্নীর কাছে চীনা ভাষায় কি যেনো বলে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এ ব্যাপার নিয়ে আবার আলোচনা করবো। আজ আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কিছু অবাঞ্ছিত আলোচনা হয়েছে। আমার ইচ্ছা, মজলিসে কিছুটা আনন্দ পরিবেশন করা হোক। বলে বাদশাহ হুসনেআরার দিকে হাত দিয়ে ইশারা করলেন। হুসনেআরা এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে গেলো দরবারীদের মাঝখানে। নয়ীমের দিকে তাকিয়ে সে হেসে ফেললো। তার পা দুটি নৃত্য-চঞ্চল হয়ে উঠতেই সে দুটি হাত প্রসারিত করলো দু’দিকে। রেশমী পর্দার পেছন থেকে জেগে উঠলো বিচিত্র বাদ্য-ধ্বনি। স্তিমিত সুরের সাথে সাথে হুসসেআরা ধীরে ধীরে পা ফেলে তখতের কাছে এসে দুই জানুর উপর ভর করে বসে পড়লো। বাদশাহ সামনে হাত বাড়ালে হুসনেআরা সসম্ভ্রমে তাতে চুমু খেলো এবং উঠে ধীরে ধীরে পিছনে সরে যেতে শুরু করলো। বাদ্য-বাজনার আওয়াজ সহসা উঁচু হয়ে উঠলো। হুসনেআরা বিজলী চমকের মতো দ্রুতগতিতে ঘুরে ঘুরে নাচতে লাগলো। তার দেহের প্রতিটি অংগ প্রত্যংগ কেমন যেন নাযুক ও মুগ্ধকর হয়ে দেখা দিলো। কখনও সে মাথা নত করে তার দীর্ঘ কেশদাম ছড়িয়ে দিচ্ছে সুন্দর মুখের উপর, আবার মাথায় নাড়া দিয়ে তা সরিয়ে নিচ্ছে পিঠের উপর এবং মুখখানিকে আবরণমুক্ত করে দর্শকদের মুগ্ধ বিস্ময় লক্ষ্য করে হাসছে। কখনও সে তার সুঢেল সফেদ বাহু মাথার উপর উঁচু করে ধরে আহত ফণিনীর মতো দোলাচ্ছে। নৃত্যের তালে কখনও সে এগুচ্ছে সামনে, আবার পিছেয়ে যাচ্ছে। কখনও কখনও কোমরে হাত রেখে সে সামনে ও পেছনে ঝুঁকছে, যেনো তার চুলগুলো যমিন ছুঁয়ে যায়। তার প্রতিটি অংগভংগী যেনো বিজলীর বিচিত্র খেলা। নেচে নেচে সে এক সোনার ফুলদানীর কাছে গিয়ে একটি গোলাপ তুলে নিয়ে গেলো নয়ীমের কাছে। তারপর তার সামনে বসে পড়লো দুই জানুর উপর। নর্তকীর কার্যকালাপে তখন তাঁর বুক কাঁপছে। তাঁর কান ও গাল অনুভূত হচ্ছে একটা তীব্র জ্বালা। নর্তকী ফুলটি তার ঠোঁটে লাগিয়ে দু’হাতে নিয়ে এগিয়ে ধরলো নয়ীমের সামনে। নয়ীম চোখে তুলছেন না দেখে সে হাত দুটি আরও এগিয়ে দিলো। এবার তার আঙুল দিয়ে তার বুক স্পর্শ করলো। নয়ীম তার হাত থেকে ফুলটি নিয়ে ছুঁড়ে ফেললেন নিচে এবং তখখুনি উঠে দাঁড়ালেন। নর্তকী অস্থিরভাবে ঠোঁট কামড়ে উঠে দাঁড়ালো এবং মুহূর্তের জন্তু নয়ীমের দিকে রোষ দীপ্ত চাউনী হেনে ছুটে অদৃশ্য হয়ে গেলো দরযার রেশমী পর্দার পিছনে। হুসনেআরা চলে যেতেই বাদ্য-বাজনার আওয়ায বন্ধ হয়ে গেলো। দরবারে নেমে এলো গভীর নিস্তব্ধতা।

বাদশাহ্ বললেন, এ নৃত্য-গীত বুঝি আপনার ভালো গাগলো না?

নয়ীম জওয়াবে বললেন, আমাদের কানে কেবল সেই সুরই ভালো লাগে, যা তলোয়ারের ঝংকার থেকে পয়দা হয়ে। আমাদের তাহযীব নারীকে নৃত্য করবার অনুমতি দেয় না। নামাযের সময় হয়ে এলো। আমার এখখুনি যেতে হচ্ছে-’ বলে নয়ীম লম্বা লম্বা পা ফেলে দরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন হুসনেআরা দরযায় দাঁড়িয়ে। নয়ীমকে আসতে দেখে সে মুখ ফিরিয়ে নিলো বিরক্তির সাথে। নয়ীম বেপরোয়া হয়ে, বেরিয়ে গেলেন। হুসনেআরার মনে আর একবার জাগলো পরাজয়ের অনুভুতি।

‘অতি তুচ্ছ তুমি। তোমায় আমি অন্তর দিয়ে ঘুণা করি। নয়ীমের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে সে বললো তাতারী যবানে। কিন্তু নয়ীম একবার পিছু ফিরেও তাকলেন না! সে তখন আপন মনে গর্জাতে লাগলো নিস্কল আক্রোশে। নয়ীম চলে গেলে সে ফিরে গেলো হতাশ হয়ে। যিন্দেগীতে এই প্রথমবার সে মাথা নীচু করে চললো।

রাতের বেলায় নয়ীম বিছানায় পড়ে ঘুমোবার নিষ্ফল চেষ্টা করছেন। তাঁর সাথীরা গভীর নিদ্রামগ্ন। কামরায় জ্বলছে অনেকগুলো মোমবাতি। দিনের ঘটনাগুলো বার বার তার মস্তিস্কে এসে তাকে পেরেশান করে তুলছে। হুসনেআরার কল্পনা বার বার চিন্তার গতি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নার্গিসের দেশে। দু’জনের চেহারায় কতো মিল পাথ্যক শুধু এই যে, হুসনেআরা সুন্দরী এবং সৌন্দর্যের অনুভূতিও রয়েছে তার মনে। কিন্তু সে অনুভুতি এমন বিপজ্জনক রূপ নিয়েছে তার ভিতরে যে, সে তার পুরোপুরি সুযোগ নিতে গিয়ে বঞ্চিত করছে আপনাকে পবিত্রতা ও নিষ্পাপ সৌন্দর্য থেকে। তার রূপে-তার আকৃতিতে আন্তরিকতার পরিবর্তে প্রধান্য লাভ করেছে লালসা চরিতার্থ করবার অদম্য স্পৃহা।

আর নার্গিস? নার্গিস প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে এক সরল, নিষ্পাপ ও অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবি। বার বার নয়ীমের মনে পড়ে নার্গিসের কাছ থেকে তাঁর শেষ বিদায়ের দৃশ্য। নয়ীমের কাছে নার্গিস তার মনের যে পরিচয় দিয়েছে, তা তিনি আজও ভোলেননি। তিনি জানেন, নার্গিসের নিষ্পাপ দীলের গভীরে তিনি পয়দা করেছেন মুহাব্বতের তুফান।

গত কয়েক মাসে কতোবার তাঁর মনে জেগেছে নার্গিসকে আর একবার দেখা দেবার ওয়াদা পূরণ করবার দূরন্ত সাধ, কিন্তু মুজাহিদের উদ্দীপনায় তা চাপা পড়ে গেছে প্রতিবার। প্রত্যেক বিজয় তার সামনে খুলে দিয়েছে নতুন অভিযানের পথ।

নয়ীম প্রত্যেক নয়া অভিযানকে শেষ অভিযান মনে করে নার্গিসের কাছে যাবার ইরাদা মূলতবী রেখেছেন প্রতিবার। কিন্তু তার নির্বিকার ঔদাসিনের কারণ শুধু তাই নয়। নয়ীমের অবস্থা সেই মুসাফিরের মাতো, দীর্ঘ সফরের পথে যে তার মূল্যবান ও জরুরি পাথেয় ডাকাতের হাতে সমর্পণ করে এমন হতাশ হয়ে যায় যে, অবশিষ্ট সামান্য জিনিসগুলোকে নিজের হাতে পথের ধুলোয় ফেলে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে শূন্য হাতে।

জোলায়খার মৃত্য আর উযরার কাছ থেকে চিরদিনের বিচ্ছেদ দুনিয়ার সুখ, শান্তি ও আরাম শব্দগুলোকে করে তুলেছে নয়ীমের কাছে অর্থহীন। যদিও নার্গিসের সাথে তার শেষ মোলাকাত এ শব্দগুলোকে আবার কিছুটা অর্থপূর্ণ করে তুলেছে, কিন্তু সে অর্থের গভীরতা তাতে ডুবে যাবার মতো যথেষ্ট নয়। নার্গিসকে তিনি যেমন করে চান, তাতে তার নৈকট্য ও দূরত্ব একই কথা। তথাপি নার্গিসের কথা ভাবতে ভাবতে কখনও কখনও তাঁর মনে হয়, সেই তাঁর যিন্দেগীর শেষ অবলম্বন। তার কাছ থেকে চিরদিনের জন্য বিচ্ছেদের কল্পনা তাঁর কাছে কতো ভয়ংকর!

বিছানায় শুয়ে তার মনে চিন্তা জাগে, খোদা জানেন, নার্গিস কি অবস্থায় কি ধারণা নিয়ে তার পথ চেয়ে রয়েছে। যদি সে…….জোলায়খা …….অবথা উযরার মতো, না, না, খোদা যেনো তা না করেন। নার্গিসের সম্পর্কে হাজারো চিন্তা নয়ীমকে পেরেশান করে তোলে, আর তিনি সান্ত্বনা দেন নিজের দলকে।

মানুষের স্বভাব, যখন সে গোড়ার দিকে কোনো গৌরবময় সাফল্যের অধিকার লাভ করে, হতাশার ভয়াবহ গভীরতার ভিতরেও সে তখন জ্বালিয়ে রাখে আশার দ্বীপ-শিখা। কিন্তু গোড়াতেই যে লোক ব্যর্থতার চরমে পৌঁছে গেছে, সে তো কোনো কিছুকেই বানাতে পারে না তার আশার কেন্দ্রস্থল, আর যদি তা পারেও তথাপি লক্ষ্য অর্জনের প্রত্যয় সত্ত্বেও সে আশ্বস্ত হয় না। হাজারো বিপদের কল্পনা ছাড়া এক পা’ও সে এগুতে পারে না গন্তব্য লক্ষ্যের পথে, আর লক্ষ্য অর্জনের পরও তার অবস্থা হয় এক দেউলিয়া মানুষেরই মতো-যে পথের মাঝে জওয়াহেরাতের তূপ পেয়েও মালদার হবার খুশির পরিবর্তে পুনরায় সর্বস্ব হারানোর ভয়ে থাকে বিব্রত।

হাজারো চাঞ্চল্যকর চিন্তায় ঘাবড়ে গিয়ে নয়ীম ঘুমোবার চেষ্টা করলেন, কিন্তু দীর্ঘ সময় এপাশ ওপাশ করেও ঘুম এলো না বেকারার হয়ে তিনি পায়চারী করতে লাগলেন কামরার মধ্যে। পায়চারী করতে করতে রাতে তিনি কামরার বাইরে এসে দেখতে লাগলেন চাঁদের মুগ্ধকর স্নিগ্ধরূপ।

*

মহলের অপর দিকে এক সুদৃশ্য কামরায় হুসনেআরা আবলুস কাঠের এক কুরসীতে বসে বসে তার দেবতাদের কাছে অভিযোগ জানাচ্ছেনয়মের কার্যকলাপের। তার পরিচারিকা মারওয়ারিদ সামনে এক গালিচায় বসে তার দিকে তাকিয়ে রায়েছে। হুসনেআরার দীলের মধ্যে এখনও জ্বলছে পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার অদম্য অগ্নিশিখা।

‘একি সম্ভব যে, সে আমার চাইতে বেশি সুন্দরী কোনো নারীকে দেখেছে? ভাবতে ভাবতে কুরসী থেকে উঠে সে প্রাচীরের গায়ে লাগানো একটা বড় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের রূপ দেখে নিলো এবং কামবার মধ্যে পায়চারী করতে লাগলো। মারওয়ারিদ একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে লাগলো তার কার্যকলাপ।

আপনি আজ ঘুমোবেন না,’ মারওয়ারিদ প্রশ্ন করলো।

যতক্ষণ সে আমার পায়ে এসে না পড়বে, ততক্ষণ ঘুম নেই আমার।

বলে হুসনেআরা আরও খানিকটা দ্রুত পায়ে ঘুরতে লাগলো এদিক ওদিক। মারওয়ারিদ উঠে কামরার খিড়কী দিয়ে তাকিয়ে রইলো পাইন বাগিচার দিকে। আচানক তার নযরে পড়লো, একটি লোক বাগিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাতের ইশারায় হুসনেআরাকে কাছে ডেকে সে বাগিচার দিকে ইশারা করে বললো দেখুন! বিলকুল আপনারই মত বেকারার হয়ে কে যেন পায়চারী করছে বাগিচায়।’

হুসনেআরা বিস্ফরিত চোখে তাকিয়ে দেখতে লাগলো। লোকটি গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে এলে চাঁদের পূর্ণরৌশনী যখন তাঁর মুখের উপর পড়লো, তখন হুসনেআরা নয়ীমকে চিনে ফেললো। হুসনেআরা বিষন্দু মুখে খেলে গেলো একটা হাসির রেখা।

মারওয়ারিদ আমি এখখুনি আসছি’ বলে হুসনেআরা কামরার বাইরে চলে গেলো এবং দেখতে দেখতে বাগিচায় গিয়ে নয়ীমকে দেখতে লাগলো এক গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে। নয়ীম তখন ঘুরতে ঘুরতে সেই গাছের কাছে এলেন, অমনি হুসনেআরা এসে তাঁর সামনে দাঁড়ালো গাছের আড়াল থেকে। নয়ীমও চমকে দাঁড়িয়ে গেলেন। তিনি হয়রান হয়ে তাকাতে লাগলেন তার দিকে।

‘আপনি ঘাবড়ে গেলেন? আমি দুঃখিত।

তুমি কি করে এখানে এলে?

‘আমি আপনার কাছে তাই জানতে চাচ্ছি।’ হুসনেআরা আরো এক কদম এগিয়ে এসে বললো।

‘আমার তবিয়ৎ ভালো ছিলো না।’

‘খুব! তাহলে আপনারও তবিয়ৎ বিগয়ে যায়! আমি তো ভেবেছিলাম আপনি বুঝি আমাদের মতো মানুষ থেকে আলাদা ধরনের। তবিয়ৎ বিগড়ে যাবার কারণটা জানতে পারি কি?’

‘তোমার প্রত্যেকটি সওয়ালেরই জওয়াব দিতে হবে, এটা তো আমি জরুরী মনে করছি না।’ বলে নয়ীম চলে যেতে চাইলেন।

তার চোখের যাদুতে আকৃষ্ট হয়ে নয়ীম রাতের বেলা এমনি পায়চারী করে বেড়াচ্ছেন, হুসনেআরা এই ধারণা নিয়ে এসেছে, কিন্তু তার সে ধারণা কেমন যেনো ভূল হয়ে গেলো। এ ঘৃনা, না মুহাব্বত? সে যাই হোক, হুসনেআরা সাহস করে সামনে এগিয়ে এসে নয়ীমের পথ রোধ করে দাঁড়ালো। নয়ীম অপর দিক দিয়ে চলে যেতে চাইলেন, কিন্তু সে তার জামার এক প্রান্ত ধরে ফেললো। নয়ীম ফিরে বললেন, কি চাও তুমি?’

হুসনেআরা মুখে জওয়াব যোগায় না। তার ঠোঁট কাঁপতে থাকে। তার সকল গর্ব সে ঢেলে দিয়েছে মুজাহিদের পায়ে। নয়ীম তার কম্পিত হাত থেকে জামার প্রান্তটি ছাড়িয়ে একটি কথাও না বলে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন তার কামরার দিকে।

হুসনেআরা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। লজ্জায় তার দেহে ঘাম বেরিয়ে এসেছে। ঘাম মুছে ফেলে রাগে কাঁপতে কাঁপতে সে চলে গেলে নিজের কামরায়। আয়নায় আর একবার নিজের মুখ দেখে নিয়ে রাগে শরাবের একটা সোরাহী ছুঁড়ে মারলো আয়নার উপর।

‘জংলী কোথাকার! আমি কেন ওর পায়ে পড়তে গেলাম?’ বলে আর একবার সে কামরার মধ্যে তেমনি পায়চারী করতে লাগলো বেকারার হয়ে। আমি কেন ওর পায়ে পড়লাম! কেন আমি ওর কাছে গেলাম। বলতে বলতে হুসনেআরা ভাঙ্গা আয়নার একটা টুকরা তুলে মুখ দেখে নিজের মুখের উপরে এক চাপড় মারলো। তারপর নয়ীম ছাড়া গোটা দুনিয়াকে গাল দিতে দিতে বিছানায় উপুর হয়ে পড়ে কাঁদতে লাগলো ফুঁপিয়ে।

এ ঘটানার এক মাস পর নয়ীম কাশগড় পৌঁছে কুতায়বার কাছ থেকে ছয় মাসের ছুটি নিলেন। আরব ও ইরানের যেসব মুজাহিদ ছুটি নিয়ে দেশে যাচ্ছে, নয়ীম হলেন তাদের সফরের সাথী। নয়ীমের পুরানো দোস্ত ওয়াকি ছিলেন এই ক্ষুদ্র কাফেলায় শামিল। নয়ীম তাঁর কাছে খুলে বলেছিলেন দীলের কথা। কয়েক মনযিল অতিক্রম করে নয়ীম কাফেলা থেকে আলাদা হয়ে যেতে চাইলে সাথীরা জানালো যে, তারা তাঁকে মনযিলে মসুদে পৌঁছে দিয়ে যাবে।

*

নার্গিস এক পাহাড়-চুড়ায় বসে উঁচু উঁচু পাহাড়ের মুগ্ধকর রূপ দেখছে। যমররুদ তাঁকে দেখে পাহাড়-চুড়ায় ছুটে এলো।

নার্গিস, নার্গিস!!’

নার্গিস উঠে মরুদকে দেখে তার সাড়া দিয়ে বসে পড়লো।

নার্গিস! নার্গিস!! যমরুরুদ কাছে আসতে আসতে আবার ডাকলো।

নার্গিস, উনি এসেছেন! তোমার শাহযাদা এসেছেন!’

পাহাড়ের মাটি আচানক সোনা হয়ে গেলেও নার্গিস হয়তো এতোটা হয়রান হতো না। সে তার কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। যমররুদ আবার একই কথা বললো, তোমার শাহযাদা এসে গেছেন!

নার্গিসের মুখ খুশীর দীপ্তিতে ঝলমল করে উঠলো। সে উঠলো, কিন্তু বুকের ধড়ফড়ানি ও দেহের কম্পন সংযত করতে না পেরে বসে পড়লো আবার। যমররুদ এগিয়ে এসে দু’হাতে তাকে ধরে তুললো। তারা দুজন আলিংগনা বন্ধ হলো।

‘আমার স্বপ্ন সফল হলো।’ নার্গিস লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলে বললো।

নার্গিস! আমি আরও এক খোশখবর এনেছি।’

বলো যমদ, ৰলো। এর চাইতে বড় খোশখবর আর কি হতে পারে?

আজ তোমার শাদী।

‘আজ!….না!’

নার্গিস, এখখুনি।’

নার্গিস দ্রুত এক পা পিছিড়ে দাঁড়ালো। তার আনন্দ-দীপ্ত মুখ আবার পান্ডুর হলো। সে বললো, যমররুদ! এ ধরনের ঠাট্টা ভাল নয়।

না, না, তোমার শাহযাদার কসম, তিনি এসে গেছেন। এসেই তিনি তোমার কথা জানতে চেয়েছেন। আমি সব কিছু বলেছি তাঁকে। তার সাথে এসেছেন এক বৃদ্ধ। তিনি চুপি চুপি তোমার ভাইকে কি যেনো বললেন, আর তোমার ভাই আমায় পাঠালো তোমার খোঁজে। হুমানকে আজ খুব খুশী দেখাচ্ছে। চলো নার্গিস!

নার্গিস যমরুদের সাথে পাহাড় থেকে নীচে নামলো। যমদ খুব দ্রুত গতিতে চলছে, কিন্তু নার্গিসের পা দুটি কাঁপছে। সে বললো, যমররুদ! একটু ধীরে চলো।

অত তাড়াতাড়ি চলতে পারছি না আমি।

গাঁয়ের বহুলোক এসে জমা হয়েছে হুমানের ঘরে। ওয়াকি নয়ীম ও নার্গিসের নিকাহ পড়ালেন। দুলহা-দুলহিনের উপর চারদিক থেকে হলো পুষ্পবৃষ্টি।

যমররুদ এক কোণে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রয়েছে মানের দিকে। হুমানের মুখ খুশির দীপ্তিতে উজ্জ্বল। এক বৃদ্ধ তাতারী কানের কাছে সে কি যেনো বললো। আর বৃদ্ধ তাতারী যমররুদের বাপের কাছে গিয়ে বললো কয়েকটি কথা। যমররুদের বাপ সম্মতি জানালে সে হুমানকে ধরে নিয়ে গেলো খিমার বাইরে।

‘আজই?’ যমররুদের বাপ বললেন।

যদি আপনার আপত্তি না থাকে।

বহুত আচ্ছা! আমি ঘরে গিয়ে পরামর্শ করে আছি।’ যমরুদের বাপ ঘরে চলে গেলেন।

সন্ধ্যার খানিকক্ষণ আগে সব লোক যমরুদের ঘরে এসে জমা হলো। হুমান ও যমরুরুদের নিকাহ্ পড়াবার ভারও পড়লো ওয়াকির উপর।

দুলহিনকে হুমানের ঘরে আনা হলে যখন নার্গিস ও যমররুদ নির্জন আলাপের সুযোগ পেলো, তখন নার্গিস একটি ছোট্ট চামড়ার বাস খুললো।

যমররুদ! তোমার শাদীর দিনে আমি তোমায় একটি উপহার দিতে চাচ্ছি।’ বলে সে নয়ীমের দেওয়া রুমালখানি বের করে তার হাতে দিয়ে বললো, এই মূহুর্তে এর চাইতে দামী আর কিছু নেই আমার কাছে।

যমররুদ বললো, তোমার শাহযাদা না এলে এতটা মহৎ প্রাণের পরিচয় দিতে না তুমি।

নার্গিস যমররুদকে বুকে চেপে ধরে বললো, যমররুদ! এখনো আমার খোশনসীবের কল্পনা করতে ভয় পাই আমি। আজকের সবগুলো ঘটনা যেন একটা স্বপ্ন।’

যমদ হেসে বললো, যদি সত্যি সত্যি এটা একটা স্বপ্ন হয়? তাহলে আমি সে মন-ভোলান স্বপ্ন ভংগের পর বেঁচে থাকতে চাইবো না।’নার্গিস জওয়াব দিলো।

ওয়াকি আর তার সাথীরা সেখানেই রাত কাটালেন। ফজরের নামাযের পর তাঁরা তৈরী হলেন সফরের জন্য। বিদায় বেলায় নয়ীম বললেন, তিনিও শিগগীরই পৌঁছবেন বসরায়।

হমানের ঘরের যে কামরায় কিছুকাল আগে নয়ীম অপরিচিত মেহমান ছিলেন, আজ নার্গিস ও তার থাকার জায়গা হলো সেই কামরায়। নয়ীমের কাছে এ বস্তি আজ জান্নাতের প্রতিরূপ। দুনিয়ার সব কিছুই তার কাছে আজ আগের চাইতে বেশী মুগ্ধকর। ফুলের ঘ্রাণ, হাওয়ার মর্মরধ্বনি, পাখীদের কলগুঞ্জন-সব কিছুই প্রেম মিলনের এক সুর-মুছনায় বিভোর।

বারো

খলিফা ওয়ালিদের হুকুমাতের শেষভাগে ভূমধ্যসাগর থেকে শুরু করে কাশগড় ও সিন্ধু পর্যন্ত মুসলমানদের বিজয় ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছিলো। ইসলামী ইতিহাসের তিনজন সিপাহসালার পৌঁছে গিয়েছিলেন খ্যাতি ও যশের সর্বোচ্চ শিখরে। পূর্বদিকে মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু নদের কিনারে ডেরা ফেলে হিন্দুস্তানের বিস্তীর্ণ ভুখন্ড জয়ের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

কুতায়বা কাশগড়ের এক উঁচু পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে ইনতের করছিলেন দরবারে খিলাফত থেকে চীন সাম্রাজ্যের দিকে এগিয়ে যাবার হুকুমের জন্য।

পশ্চিমে মুসার লশকর চেষ্টা করছিলো ফিরে নিজের পাহাড়শ্রেণী অতিক্রম করে ফ্রান্সের সীমানায় প্রবেশ করবার, কিন্তু হিজরী ৯৪ সালে খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যু ও তাঁর স্থলে খলিফা সুলায়মানের অভিষেকের খবর ইসলামী বিজয়-অভিযানের নকশা বদলে দিলো। বহুদিন ধরে সুলায়মানের দীলের মধ্যে জ্বলছিলো খলিফা ওয়ালিদ ও তাঁর সহকারীদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও প্রতিশোধের আগুন। খলিফার মসনদে বসেই তিনি ডেকে পাঠালেন ওয়ালিদের প্রিয় সিপাহসালারদের। হাজ্জাজ বিন ইউসুফের জন্য তিনি কঠিনতম শাস্তি নির্ধারিত করে রাখলেন, কিন্তু যিন্দেগীর দুঃখময় দিন আসবার আগেই তিনি দুনিয়া ছেড়ে গেলেন। হাজ্জাজের মৃত্যুতেও সুলায়মানের সিনা ঠান্ডা হলো না। চাচার উপর তার প্রতিহিংসার ফল ভাতিজার উপর ফললো। মুহাম্মদ বিন কাসিমকে সিন্ধু থেকে ডেকে এনে কঠিন পীড়ণের পর হত্যা করা হলো। মুসার খেদমতের বদলায় তাঁর সর্বস্ব রাজেয়াফত করা হলো এবং তাঁর নওজোয়ান পুত্রের মস্তক ছেদন করে তার সামনে পেশ করা হলো। এই নৃশংস যুলুমে ইবনে সাদেক ছিলো সুলায়মানের ডান হাত। এই বৃদ্ধ শৃগাল ঝড়-ঝঞ্জার হাজারো আঘাত খেয়েও হিম্মৎ হারায়নি। খলিফা ওয়ালিদের মৃত্যু তার কাছে ছিলো এক আনন্দের বার্তা। হাজ্জাজ আগেই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছিলেন। তাঁর প্রিয়জনদের কাউকে কয়েদ করা হলো, আর কাউকে পাঠানো হলো মৃত্যুর দেশে। দুনিয়ার ইবনে সাদেকের আর কোনো আশংকা রইলো না। সে তার নির্জন আবাস থেকে বেরিয়ে এসে হাজির হলো সুলায়মানের দরবারে। সুলায়মান তার পুরানো দোস্তকে চিনতে পেরে তাকে যথেষ্ট সমাদর করলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই ইবনে সাদেক হলো খলিফার প্রধান মন্ত্রণাদাতাদের অন্যতম।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের সম্পর্কে খলিফার অন্যান্য মন্ত্রণাদাতা যখন মত দিলেন যে, তিনি নিরপরাধ এবং নিরপরাধকে হত্যা করা জায়েয নয়, তখন ইবনে সাদেক এমনি খাঁটি লোকের বেঁচে থাকা তার নিজের পক্ষে বিপজ্জনক মনে করলো। সে মুহাম্মদ বিন কাসিমের হত্যা শুধু জায়েয নয়, জরুরী প্রমাণ করবার জন্য বললো, ‘আমীরুল মুমেনিনের দুশমনের যিন্দাহ্ থাকবার কোনো অধিকার নেই। এ লোক হাজ্জাজের ভাতিজা। সুযোগ পেলেই এ ধরনের লোক বিপজ্জনক হয়ে দেখা দেবে।

মুহাম্মদ বিন কাসিমের ভয়াবহ পরিণামের পর মুসার আহত দীলের উপর নুনের ছিটা দেওয়া হলো। এরপর সুলায়মান কুতায়বাকে জালে ফেলবার চক্রান্ত শুরু করলো। কুতায়বার ব্যক্তিত্ব তামাম ইসলামী সাম্রাজ্যের শ্রদ্ধা অর্জন করেছে। আরবী ও ইরানী ফউজ ছাড়া তুর্কিস্তানের নও মুসলিমরাও তাঁকে ভক্তি করতো মনে প্রাণে। সুলায়মানের মনে আশংকা জাগলো, বিদ্রোহ করে বলে তিনি হয়ে উঠবেন। তাঁর শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বী। তাঁর কার্যকলাপের ফলে যারা তাঁর প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করছে, তারা সবাই হবে বিদ্রোহের সমর্থক। এই মুশকিল থেকে বাঁচাবার কোনো পন্থা তাঁর মাথায় এলো না। তাই তিনি ইবনে সাদেকের কাছে চাইলেন পরামর্শ। ইবনে সাদেক বললো, হুজুর! ওঁকে দরবারে হাযির হবার হুকুম পাঠিয়ে দিন। যদি আসে তো ভালো, নইলে আর কোন তরিকা অবলম্বন করা যাবে।’

‘কেমন তরিকা?’ সুলায়মান প্রশ্ন করলেন।

‘হুজুর! সে কর্তব্য এ বান্দার উপর ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন, ওঁকে তুর্কিস্তানেই কতল করা যাবে।

*

নার্গিসের সাহচর্যে নয়ীমের কয়েক হফতা কেটে গেলো এক সোনালী স্বপ্নের মতো। উপত্যকা ও পাহাড়ের প্রতিটি প্রাকৃতিক দৃশ্য তাঁর মনে জাগায় এক স্বপ্নময় ভাবালুতা। তারই বর্ণচ্ছটায় বিভোর হয়ে নয়ীম ঘরে ফিরে যাবার ইরাদা কিছুদিনের জন্য মুলতবী রাখলেন, কিন্তু তার দীলের এ ভাবাবেগ বেশি দিন থাকলো না। একদিন তিনি ঘুম থেকে জেগে নার্গিসকে বললেন, আমি এতগুলো দিন এখানে কি করে কাটিয়ে দিয়েছি, তা নিজেই ভাবতে পারি না। এখন আমার শিগগীরই চলে যাওয়া দরকার। আমাদের বস্তি এখান থেকে বহু মাইল দুরে। সেখানে গিয়ে তোমার মন কেমন করবে না তো?

মন কেমন করবে? হায়! আমার দীলে আপনার দেশ দেখবার কি যে আগ্রহ, আর সে পবিত্র ধুলি চোখে লাগবার জন্য আমি কতোটা বেকারার, তা যদি আপনি জানতেন! আচ্ছা, পরশু আমরা এখান থেকে রওয়ানা হয়ে যাবো। বলে নয়ীম ফজরের নামায পড়বার জন্য তৈরী হতে লাগলেন। ইতিমধ্যে হুমান ভিতরে প্রবেশ করলো। সে নয়ীমকে বললো যে, বস্তির বারমাক নামে এক সিপাহী কুতায়বা বিন্ মুসলিমের পয়গাম নিয়ে এসেছে।’ নয়ীম পেরেশান হয়ে বাইরে গেলেন। বারমাক ঘোড়ার বাগ ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ভালো খবর নিয়ে আসেনি বলে নয়ীমের মনে, জাগলো সন্দেহ। নয়ীমের প্রশ্নে অপেক্ষ না করেই বারমাক বললো, আমার সাথে যাবার জন্য আপনি এখখুনি তৈরী হয়ে নিন।’

‘খবর ভাল তো? নয়ীম প্রশ্ন করলেন।’

বারমাক কুতায়বার চিঠি পেশ করলো। নয়ীম চিঠি খুলে পড়লেন। তাতে লেখা রয়েছে, তোমায় বিশেষভাবে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে যে চিঠি পাওয়ামাত্র সমরকন্দে পৌঁছে যাবে। আমীরুল মুমেনিনের মৃত্যুতে যে অবস্থার উদ্ভব হয়েছে, তারই জন্য তোমায় এ হুকুম দেওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত বিবরণ বারমাকের কাছে শুনতে পাবে।’

নয়ীম হয়রান হয়ে বারমাকের কাছে প্রশ্ন করলেন, সমরকন্দ থেকে বিদ্রোহের খবর আসেনি তো?

না।’ বারমাক জওয়াব দিলো।

তা হলে আমায় সমরকন্দে যাবার হুকুম কেন দেওয়া হলো?

কুতায়বা তার তামাম সালারকে নিয়ে কি যেনো পরামর্শ করবেন।

‘কিন্তু তিনি তো কাশগড়ে ছিলেন।

না, নানা করণে তিনি সমরকন্দ চলে গেছেন।

কি ধরনের কারণ?

বারমাক বললো, আমিরুল মুমেনিনের ওফাতের পর পরবর্তী খলিফা সুলায়মান হাজ্জাজ বিন ইউসুফের নিযুক্ত বহু অফিসারকে কতল করে ফেলেছেন। মুসা বিন্ নুছায়েরের পুত্রকেও সিন্ধু-বিজয়ী মুহাম্মদ বিন কাসিমকে হত্যা করা হয়েছে। আমাদের সালারকেও হুকুম দেওয়া হয়েছে দরবারে খিলাফতে হাযির হতে। তিনি সেখানে যেতে বিপদের আশংকা করছেন, কেন না খলিফার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা নেই। তাই তিনি তাঁর সালারদের জমা করে পরামর্শ করতে চাচ্ছেন। তাই আপনাকে নিয়ে যাবার জন্য তিনি আমায় পাঠিয়েছেন।’

নয়ীম বারমাকের কথার শেষের দিকটা মন দিয়ে শুনতে পারেন নি। মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের কতলের খবর শোনার পর আর কোনও কথার উপর তিনি গুরুত্ব দেননি মোটেই।

অশ্রুভারাক্রান্ত চোখে তিনি বললেন, বারমাক! তুমি বড়োই দুঃসংবাদ নিয়ে এসেছো। বসো, আমি তৈরী হয়ে আসছি।’

নয়ীম ফিরে গিয়ে নামাযে দাঁড়ালেন। তাঁর বিষণ্ণ মুখ দেখে নার্গিসের মনে হাজারো দুর্ভাবনা জেগে উঠেছে। নামায শেষ হোলে নার্গিস সাহস করে তাকে প্রশ্ন করলেন, আপনি খুবই পেরেশান হয়েছেন, দেখছি। কেমন খবর নিয়ে এলো লোকটি?

‘নার্গিস, আমরা এখনি সমরকন্দ চলে যাচ্ছি। তুমি জলদী তৈরী হয়ে নাও।

নয়ীমের জওয়াবে নার্গিসের বিষণ্ণ মুখ খুশীতে দীপ্ত হয়ে উঠলো। নয়ীমের সাথে থেকে যিন্দেগীর সব রকম বিপদের মোকাবিলা করবার সাহস মওজুদ রয়েছে তাঁর দীলের মধ্যে, কিন্তু যে কোনো মুসীবতে তাঁর কাছ থেকে জুদা হওয়া তাঁর কাছে মৃত্যুর, চাইতেও বেশি ভয়ংকর। নয়ীমের সাথে তিনি যাচ্ছেন, এই তাঁর কাছে যথেষ্ট। কোথায় আর কি অবস্থার ভিতরে, সে সব প্রশ্নে জওয়াব পাবার চেষ্টা তার কাছে অবান্তর।

*

সমরকন্দের কেল্লার এক কামরায় কুতায়বা তার বিশ্বস্ত সালারদের মাঝখানে বসে তাঁদের সাথে আলাপ-আলোচনা করছেন। কামরার চারদিকে প্রাচীরের সাথে ঝুলানো বিভিন্ন দেশের বড় বড় নকশা। কুতায়বা চীনের নকশার দিকে ইশারা করে বললেন, আমরা আর কয়েকমাসের মধ্যে এই বিস্তীর্ণ ভূ-খন্ড জয় করে ফেলতাম, কিন্তু নয়া খলিফা আমায় ডেকে পাঠিয়েছেন বড়ো দুঃসময়ে। তোমারা জানো, ওখানে আমার সাথে কেমন ব্যবহার করা হবে?

এক সালার জওয়াব দিলেন, মুহাম্মদ বিন্ কাসিমের সাথে যে ব্যবহার করা হয়েছে, তা-ই হবে।’

কিন্তু কেন?’ কুতায়বা তেজোদীপ্ত আওয়াযে বললেন, মুসলামানদের এখনো আমার খেদতমের প্রয়োজন রয়েছে। চীন জয় করবার আগে আমি কিছুতেই খলিফার কাছে আত্মসমর্পণ করবো না।

কুতায়বা আবার নকশা দেখতে শুরু করলেন।

আচানক নয়ীম এসে কামরায় প্রবেশ করলেন। কুতায়বা এগিয়ে তাঁর সাথে মোসাফেহা করে বললেন, “আফসোস! তোমায় এ অসময়ে তীফ দেওয়া হয়েছে। একা এসেছ, না-?

বিবিকেও আমি সাথে নিয়ে এসেছি। মনে করলাম, হয়তো আমার দামেস্ক যেতে হবে।’

‘দামেস্ক? না দূত হয়তো তোমায় ভুল খবর দিয়েছে। দামেস্কে তোমায় নয়, আমায় ডেকে পাঠান হয়েছে। নয়া খলিফার কেবল আমারই মস্তকের প্রয়োজন।

তাহলে তো আমিও যাওয়া জরুরী মনে করছি।’

নয়ীম! কুতায়বা সাদরে তার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘আমার বদলে তুমি দামেস্কে যাবে, এজন্য তো আমি তোমায় ডাকিনি। তোমার জান আমার কাছে আমার নিজের জানের চাইতেও প্রিয়। বরং আমি আমার প্রত্যেক সিপাহীর জান আমার নিজের জানের চাইতে মূল্যবান মনে করি। তুমি অনেকখানি বিচক্ষণ বলেই আমি তোমায় ডেকে এনেছি। আমায় কি করতে হবে, তাই আমি তোমার ও অন্যান্য অভিজ্ঞ দোস্তদের কাছে জিজ্ঞেস করতে চাই। আমীরুল মুমেনিন আমার রক্তের পিয়াসী।’

নয়ীম স্থির কণ্ঠে জওয়াব দিলেন, ‘খলিফার হুকুম অমান্য করা কোন মুসলিম সিপাহীর পক্ষে শোভন নয়।

তুমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিণাম জেনেও আমায় দামেস্ক গিয়ে নিজ হাতে নিজের মস্তক খলিফার সামনে পেশ করতে বলছো?

আমার মনে হয়, খলিফাতুল মুসলেমিন আপনার সাথে হয়তো অতোটা খারাপ ব্যবহার করবেন না, কিন্তু যদি কোনো সম্ভাবনা আসে, তথাপি তুর্কিস্তানের সব চাইতে বড়ড়া সিপাহসালারকে প্রমাণ করতে হবে যে, আমীরের আনুগত্যে তিনি কারুর পেছনে নন।’

কুতায়বা বললেন, মওতের ভয়ে আমি ঘাবরাই না, কিন্তু আমি অনুভব করছি যে, ইসলামী দুনিয়ায় আমার প্রয়োজন রয়েছে। চীন জয়ের আগে আমি নিজে মৃত্যুর মুখে সমর্পণ করে দিতে চাই না। আমি বন্দীর মৃত্যু চাই না, চাই মুজাহিদের মৃত্যু।

দরবারে খিলাফতের হয়তো আপনার সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হয়ে থাকবে। খুবই সম্ভব, তা দূর হয়ে যাবে। আপাততঃ আপনি এখানেই থাকুন এবং আমায় দামেস্ক যাবার এজাযত দিন।’

কুতায়বা বললেন, ‘এও কি হতে পারে যে, আমি নিজের জান বাচাঁতে গিয়ে তোমার জান বিপদের মুখে ঠেলে দেবো? তুমি আমায় কি মনে করো?

‘হাঁ’ তাহলে আপনি কি করতে চান?

‘আমি এখানেই থাকবো। আমীরুল মুমেনিন যদি অকারণে আমার সাথে মুহাম্মদ বিন কাসিমের অনুরূপ আচরণ করতে চান, তাহলে আমার তলোয়ারই আমায় হেফাযত করবে।’

‘এ তলোয়ার আপনাকে দরবারে খিলাফত থেকে দেওয়া হয়েছিলো। একে খলিফার বিরুদ্ধে লাগানোর খেয়াল মনেও আনবেন না। আমায় ওখানে যাবার এযত দিন। আমার বিশ্বাস, খলিফা আমার কথা শুনবেন এবং আমি তাঁর ধারণা দূর করতে পারবো। আমার সম্পর্কে কোনো আশংকা মনে আনবেন না। দামেস্কে আমার পরিচিতি লোক কমই রয়েছে। ওখানে কোনো দুশমন নেই আমার। এক মামুলি সিপাহী হিসাবে আমি যাবো ওখানে।’

নয়ীম, আমার জন্য কোন বিপদে পড়বার এযাবত আমি তোমায় দেবো না।’

এ আপনার জন্য নয়। আমি অনুভব করছি, আমীরুল মুমেনিনের কার্যকলাপে ইসলামী জামাআতের ক্ষতির আশংকা রয়েছে। আমার কর্তব্য আমি তাকে এ বিপদ-সম্ভাবনা সম্পর্কে অবহিত করে দিই। আপনি আমায় এযত দিন।’

কুতায়বা অন্যান্য সালারের দিকে তাকিয়ে তাঁদের মত জানতে চাইলেন। হুবায়রা বললেন, তামাম জিন্দেগীর কোরবানীর পর যিন্দেগীর শেষ অধ্যায়ে এসে আমরা বিদ্রোহীর তালিকায় নাম লিখাতে পারি না। নয়ীমের যবান থেকে আমারা সব কিছুই . জেনেছি। আপনি ওঁকে দামেস্ক যাবার এযত দিন।’

কুতায়বা খানিকক্ষণ পেশানীতে হাত রেখে চিন্তা করে বললেন, আচ্ছা নয়ীম, তুমি যাও। দরবারে খিলাফতে আমার তরফ থেকে আরয করবে যে, আমি চীন জয়ের পরেই এসে হাযির হবো।

কাল ভোরেই আমি এখান থেকে রওয়ানা হবে।’

কিন্তু তুমি এই মাত্র বললে, তোমার বিবিকে তুমি সাথে নিয়ে এসেছে। ওঁকে তুমি..।

‘ওঁকে সাথেই নিয়ে যাবো আমি।’ কথার মাঝখানে নয়ীম জওয়াব দিলেন, দামেস্কে আমার কর্তব্য শেষ করে আমি ওঁকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে আপনার খেদমতে হাযির হবো।’

পরদিন নয়ীম ও নার্গিস আরও দশজন সিপাহী সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন দামেস্কের পথে। বিভিন্ন দিক বিবেচনা করে বারমাকেও তারা নিলেন সাথে করে।

দামেস্কে পৌঁছে নয়ীম তার সাথীদের থাকার ব্যবস্থা করলেন এক সারাইখানায়। নিজের জন্য এক বাড়ি ভাড়া নিয়ে নার্গিসের হেফাযত করবার জন্য বারমাককে নিযুক্ত করে খলিফার মহলে গিয়ে মোলাকাতের আবেদন জানালেন। সেখানে তার একদিন ইনতেযার কবরার হুকুম হলো। পরদিন দরবারে খিলাফতে হাযির হবার আগে তিনি বারমারকে বললেন,যদি কোনো কারণে দরবারে খিলাফতে আমার দেরী হয়ে যায় তাহলে ঘরের হেফাযত করবার ও নার্গিসের খেয়াল রাখবার ভার রইলো তোমার উপর। নার্গিসকেও তিনি আশ্বাস দিলেন, যাতে তাঁর অনুপস্থিতিতে তিনি ঘাবড়ে না যান। ওখানে কোনো বিপদের সম্ভাবনা নেই বলে তিনি বিদায় চাইলেন।

নার্গিস স্থিরকণ্ঠে জওয়াব দিলেন, আপনার ফিরে আসা পর্যন্ত আমি ওই উঁচু উঁচু বাড়িগুলো গুণতে থাকবো।’

নয়ীম কিছুক্ষণ খলিফার প্রসাদ দ্বারে প্রতীক্ষা করতে হলো। অবশেষে দারোয়ানের ইসারায় তিনি দরবারে হাযির হয়ে খলিফাঁকে সালাম করে দাঁড়ালেন আদবের সাথে। খলিফার ডানে বাঁয়ে কতিপয় বিশিষ্ট সভাসদ উপবিষ্ট। কিন্তু কারুর দিকেই তিনি লক্ষ্য করে দেখলেন না। খলিফা সুলায়মান বিন্ আব্দুল মালিকের মুখে এমন এক তেজের দীপ্তি ফুটে বেরুতো যে, অতি বড় বাহাদুর লোকও তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলবার সাহস করতেন না।

খলিফা নয়ীমের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি তুর্কিস্তান থেকে এসেছো?

“জি হাঁ, আমীরুল মুমেনিন।’

কুতায়বা তোমায় পাঠিয়েছেন?

এ প্রশ্ন নয়ীমকে হয়রান করে তুললো। আমীরুল মুমেনিন, আমি নিজের মরীতেই এসেছি।’ তিনি জওয়াব দিলেন।

বলো কি বলবার আছে তোমার?

‘আমীরুল মুমেনিন, আমি আপনার কাছে.আরয করতে এসেছি যে, কুতায়বা আপনার এক ওফাদার সিপাহী। হয়তো মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো তাঁর সম্পর্কেও আপনার মনে কোনো ভুল ধারণা হয়ে থাকবে।

সুলায়মান তার কথা শুনে কুরসী থেকে খানিকটা উঁচু হয়ে উঠে ক্রোধে ঠোঁট কামড়ে আবার বসে পড়লেন ‘তুমি জানো? খলিফা আপনার কণ্ঠস্বর বদল করে বললেন, ‘তোমার মতো বেআদবের সাথে আমি কেমন করে থাকি, জানো তুমি?

দরবারে খিলাফত থেকে একটি লোক উঠে বললো, আমীরুল মুমেনিন? এ মুহাম্মদ বিন কাসিমে পুরানো দোস্ত। দরবারে খিলাফতের চাইতে এর বেশী সম্পর্ক সেই অভিশপ্ত খান্দানের সাথে।

নয়ীম বক্তার দিকে তাকিয়ে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। সেই ইবনে সাদেক!

অবজ্ঞা-মিশ্রিত হাসি সহকারে সে তাকালো নয়ীমের দিকে। নয়ীম অনুভব করলেন যে, আজদাহা আবার মুখ খুলে দাঁড়িয়েছে। এবার আজদাহা আরও তীক্ষ্ণ দাঁত বের করে এগিয়ে আসছে। নয়ীম ইবনে সাদেকের দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে সুলায়মানের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি আমার সভ্যভাষণে বিরত করবে না। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো সিপাহী আরব মাতা বারংবার জন্ম দেবে না। হ্যাঁ, তিনি ছিলেন আমার দোস্ত, কিন্তু আমার চাইতে বেশি তিনি ছিলেন আপনার দোস্ত। কিন্তু তাকে ভুল বুঝলেন আপনি। আপনি হাজ্জাজের প্রতিশোধ নিলেন তাঁর নিরপরাধ ভাতিজার উপর। আর এখন আপনি ইবনে সাদেকের মতো জঘন্য শয়তানদের ফাঁদে পড়ে কুতায়বা বিন মুসলিমের সাথেও সেই একই আচরণ করতে চাচ্ছেন। আমিরুল মুমেনিন, আপনি মুসলমানদের ভবিষ্যতকে ঠেলে দিচ্ছেন বিপদের মুখে। শুধু মুসলমানদের ভবিষ্যতই আপনি বিপন্ন করছেন না, আপনি নিজেও এক যবরদস্ত বিপদ ডেকে নিয়ে আসছেন। এ লোকটি ইসলামের পুরানো দুশমন। ওর কবল থেকে বাঁচবার চেষ্টা করুন।

‘খামোশ। খলিফা নয়ীমের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে তালি বাজালেন। এক কোতোয়াল আর কয়েকজন সিপাহী নাংগা তলোয়ার হাতে এসে দেখা দিলো।

নওজোয়ান, আমি কুতায়বার চাইতে বেশী করে সন্ধান করছি মুহাম্মদ বিন কাসিমের দোস্তদের। খুব ভাল হলো যে, তুমি নিজে এসে ধরা দিয়েছে। ওকে নিয়ে যাও আর ভাল করে ওর দেখাশুনা করো গে,।

সিপাহী নাংগা তলোয়রের পাহারায় নয়ীমকে বাইরে নিয়ে গেলো। তখনো দরাজয় তাঁর কয়েকজন সাথী তার ইনতেযার করছে। নয়ীমকে বন্দী হতে দেখে তারা পেরেশান হলো। নয়ীম তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার জলদি ফিরে চলে যাও। বারমাককে বলবে, সে যেনো নার্গিসের কাছেই থাকে, আর কুতায়বাকে আমার তরফ থেকে বলবে তিনি যেনো বিদ্রোহ না করেন।’

কোতয়াল বললো, “আফসোেস, আমরা আপনাদেরকে বেশি সময় কথা বলবার এযাবত দিতে পারছি না।’

বহুত আচ্ছা’ নয়ীম কোতায়ালের দিকে তাকিয়ে হেসে জওয়াব দিয়ে এগিয়ে চললেন।

তের

সুলায়মান খলিফার মসনদে সমাসীন। তাঁর মুখের উপর চিন্তার রেখা সুপরিস্ফুট। তিনি ইবনে সাদেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, এখনো তুর্কিস্তান থেকে কোনো খবর এলো না।’

‘আমীরুল মুমেনিন! নিশ্চিন্ত থাকুন। ইনশাআল্লাহ্ তুর্কিস্তান থেকে প্রথম খবরে সাথেই কুতায়বার শির আপনার সামনে হাযির করা হবে।

‘দেখা যাক।’ সুলায়মান দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন।

খানিক্ষণ পরেই এক দারোয়ান এসে আরয করলো, স্পেনে থেকে আব্দুল্লাহ নামে এক সালার এসে হাযির হয়েছেন।’

“হ্যাঁ তাকে নিয়ে এসো।’ খলিফা বললেন।

দারোয়ান চলে গেলে আব্দুল্লাহ্ এসে হাযির হলেন।

খানিকটা উঁচু হয়ে বসে খলিফা ডান হাতটি বড়িয়ে দিলেন। আব্দুল্লাহ এগিযে এসে খলিফা সাথে মোসাফেহা করে আদব সহকারে দাঁড়িয়ে গেলেন।

‘তোমার নাম আব্দুল্লাহ’?

‘জি হ্যাঁ, আমীরুল মুমেনিন।

‘স্পেন থেকে আমি তোমার বীরত্বের তারিফ শুনেছি। তোমায় অভিজ্ঞ নওজোয়ান বলে মনে হচ্ছে। স্পেনের ফউজে তুমি কবে ভর্তি হয়েছিলে’?

‘আমীরুল মুমেনিন, তারিকের সাথে আমি গিয়েছিলাম স্পেনের উপকূলে। তারপর থেকে আমি ওখানেই ছিলাম এতদিন।’

‘বেশ। তারিক সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?

‘আমীরুল মুমেনিন, তিনি এক সত্যিকার মুজাহিদ।

‘আর মুসা সম্পর্কে তোমার মত?

‘আমীরুল মুমেনিন, এক সিপাহী অপর সিপাহী সম্পর্কে কোনো খারাপ মত পোষণ করতে পারে না। ব্যক্তিগতভাবে আমি মুসার সমর্থক এবং তাঁর সম্পর্কে কোন খারাপ মত মুখ থেকে বের করা আমি গুনাহ্ মনে করি।

ইবনে কাসিম সম্পর্কে তোমার কি ধারণা’?

আমীরুল মুমেনিন, তিনি এক বাহাদুর সিপাহী, এর বেশী আমি কিছু জানি না।’

এদের প্রতি আমি কতোটা বিদ্বেষপরায়ণ, তা তুমি জানো?’ সুলায়মান বললেন।

‘আমীরুল মুমেনিন, আমি আপনাকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু আমি মুনাফেক নই। আপনি আমার ব্যক্তিগত মত জানতে চেয়েছেন। তা আমি প্রকাশ করেছি।’

আমি তোমার কথার কদর করছি। তুমি কখনো আমার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে অংশ নেওনি, তাই আমি তোমায় বিশ্বাস করি।

‘আমিরুল মুমেনিন, আমার বিশ্বাসের যোগ্যই পাবেন।

‘বহুত আচ্ছা! কাস্তাতুনিয়া অভিযানের জন্য একজন অভিজ্ঞ সালারের প্রয়োজন আমাদের ওখানে আমাদের ফউজ কোনো কামিয়াবি হাসিল করতে পারেনি। সেই জন্যই তোমায় ডেকে আনা হয়েছে স্পেন থেকে। তুমি খুব জলদী এখান থেকে পাঁচ হাজার সিপাহী নিয়ে রওয়ানা হয়ে যাও কাস্তানতুনিয়ার পথে।’

সুলমায়ন এক নকশা নিয়ে আব্দুল্লাহকে কাছে ডেকে তাঁর সামনে খুলে ধরে লম্বা-চওড়া আলোচনা শুরু করে দিলেন।

দারোয়ান এসে এক চিঠি পেশ করলো।

সুলায়মান জলদী করে চিঠিটা পড়ে ইবনে সাদেকের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, কুতায়বা কতল হয়ে গেছে। কয়েকদিন মধ্যে তার মস্তক এসে পৌঁছবে এখানে।

‘মোবারক হোক।’ ইবনে সাদেক খলিফার হাত থেকে চিঠি নিয়ে পড়তে পড়তে বললো ‘ওই নওজোয়ান সম্পর্কে আপনি কি ভেবেছেন?

কুতায়বার তরফ থেকে কিছুদিন আগে যে এখানে এসেছিলো। খুব বিপজ্জনক লোক বলে মনে হয় ওকে।’

হ্যাঁ, তাঁর সম্পর্কেও আমি শীগগীরই ফয়সলা করবো।

খলিফা আবার আবদুল্লাহর দিকে মনোযোগ দিলেন।

‘তোমার পরামর্শ আমার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হচ্ছে। তুমি জলদী রওয়ানা হয়ে যাও।

‘আমি কালই রওয়ানা হয়ে যাচ্ছি।’ বলে আবদুল্লাহ সালাম করে বেড়িয়ে পড়লেন। আব্দুল্লাহ্ দরবারে খিলাফত থেকে বেরিয়ে বেশী দূর যান নি। পেছন থেকে একটি লোক তার কাঁধে হাত দিয়ে তাকে দাঁড় করালেন। আবদুল্লাহ্ পেছনে ফিরে দেখলেন, এক সুদর্শন নওজোয়ান তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছেন। আবদুল্লাহ তাঁকে বুকে চেপে ধরলেন।

ইউসুফ, তুমি এখানে কি করে এলে? তুমি স্পেন থেকে এমনি কুরে গায়েব হয়ে গেলে যে, আর তোমার চেহারা দেখা গেল না কোনদিন।

‘এখানে আমায় কোতায়ালের চাকুরী দেওয়া হয়েছে। তোমায় দেখে খুব খুশী হয়েছি। আবদুল্লাহ্ তুমিই প্রথম ব্যক্তি, যার স্পষ্ট কথায় খলিফা রেগে যান নি।

‘কেন না আমাকে তার প্রয়োজন।’ আব্দুল্লাহ্ হাসিমুখে জওয়াব দিলেন, ‘তুমি ওখানেই ছিলে?

আমি এক দিকে দাঁড়িয়েছিলাম। তুমি লক্ষ করোনি।’ ভোরেই তুমি চলে যাচ্ছো?

তুমিতো শুনেছো।’

আজ রাত্রে আমার কাছে থাকবে না’?

‘তোমার কাছে থাকতে পারলে আমি খুশী হতাম, কিন্তু ভোরেই লশকরকে এগিয়ে যাবার হুকুম দিতে হবে। তাই আমার সেনাবাসে থাকাই ভালো হবে।’

‘আবদুল্লাহ্, চলো। তোমার ফউজকে তৈরী থাকার হুকুম দিয়ে আসবে। আমিও তোমার সাথে যাচ্ছি। খানিক্ষণ পরেই আমরা ফিরে আসবো। এতদিন পর দেখা। অনেক কথা বলা যাবে।’

আচ্ছা চলো।’

আব্দুল্লাহ ও ইউসুফ কথা বলতে বলতে সেনাবাসে প্রবেশ করলেন। আব্দুল্লাহ আমীরে লশকরের কাছে খলিফার হুকুমনামা দিয়ে ভোরে পাঁচ হাজার সিপাহী তৈরী রাখবার নিদের্শ দিলেন। তারপর তিনি ইউসুফের সাথে ফিরে চলে এলেন শহরের দিকে।

রাতের বেলায় ইউসুফের গৃহে খানা খেয়ে আব্দুল্লাহ ও ইউসুফ কথাবার্তায় মশগুল হলেন। তারা কুতায়বা বিন বাহেলীর বিজয় অভিযান সম্পর্কে আলোচনা করে মর্মান্তিক পরিণামে আফসোস প্রকাশ করলেন।

আব্দুল্লাহ প্রশ্ন করলেন, কুতায়বার কতলের খবরে আমীরুল মুমেনিনকে মোবারকবাদ জানালো যে লোকটি, সে কে?

ইউসুফ জওয়াব দিলেন, “এ লোকটি তামাম দামেস্কের কাছে এক রহস্য। ওর নাম ইবনে সাদেক, এবং খলিফা ওয়ালিদ ওর মস্তকের মূল্য এক হাজার আশরাফী নির্ধারণ করেছিলেন, ওর সম্পর্কে এর বেশী আর কিছু জানা নেই আমার। খলিফার ওফাতের পর সে কোনো গোপন আবাস থেকে বেরিয়ে এসেছে সুলায়মানের কাছে। নয়া খলিফা ওকে যথেষ্ট খাতির করেন এবং বর্তমান অবস্থায় খলিফা ওর চাইতে বেশী আমল দেন না আর কারুর কথায়। আব্দুল্লাহ্ বললেন, ‘বহুদিন আগে আমি কিছু শুনেছিলাম ওর সম্পর্কে দরবারে খিলাফতে ওর আধিপত্য মুসলমানদের জন্য বিপদের কারণ হবে। বর্তমান অবস্থায় বোঝা যাচ্ছে যে, আমাদের সামনে এক দুঃসময় আসন্ন।

ইউসুফ বললেন, আমি ওর চাইতে কঠিন-হৃদয় নীচ প্রকৃতির লোক এ যাবত দেখিনি। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মর্মান্তিক পরিণতিতে চোখের পানি না ফেলেছে, এমন লোক দেখিনি। সুলায়মান কঠিন-হৃদয় হয়েও কয়েকদিন কারুর সাথে কথা বলেন নি, কিন্তু এই লোকটিই সেদিন ছিলো যার পর নাই খুশী। আমার হাতে ক্ষমতা এলে আমি ওকে কুকুর দিয়ে খাওয়াতাম। এই লোকটি কারুর দিকে আঙ্গুলের ইশারা করলে আমীরুল মুমেনিন তাকে জল্লাদের হাতে সোর্পদ করে দেন। কুতায়বাকে কতল করবার পরামর্শ এই লোকটিই দিয়েছে এবং আজ তুমি শুনেছো সে খলিফাঁকে আর একজন কয়েদীর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে।’..

হ্যাঁ, সে লোকটি কে’?

তিনি হচ্ছেন কুতায়বার এক জোয়ান সালার। তার কথা মনে পড়লে আমার দেহ রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের চাইতে তাঁর পরিণতি আরো মর্মান্তিক হবে বলে আমার ধারণা। আবদুল্লাহ্ আমার মন চায়, এ কাজ ছেড়ে দিয়ে আবার আমি গিয়ে ফউজে শামিল হই। আমার বিবেক আমায় দংশন করছে অনবরত। মুহাম্মদ বিন কাসিকে নিয়ে আরবের তামাম বাচ্চা-বুড়ো গর্ব করেছে, কিন্তু fি অপরাধীর প্রতিও যে আচরণ করা হয় না, তাই করা হয়েছে তার সাথে। তাঁকে যখন ওয়াসতের কয়েদখানায় পাঠানো হলো, তখন তাঁর দেখাশুনা করবার জন্য আমায় হুকুম দেওয়া হলো সেখানে যেতে। আগে থেকেই ওয়াসতের হাকীম সালেহ ছিলো তাঁর রক্তপিয়াসী। সে মুহাম্মদ বিন কাসিমের উপর চালালো কঠিন নির্যাতন। কয়েকদিন পর ইবনে সাদেকও পৌঁছলো সেখানে। মুহাম্মদ বিন কাসিমের দীলে ব্যথা দেবার নিত্যনতুন তরিকা সে উদ্ভাবন করতো। সেই মুহূর্তটি আমি ভুলতে পারি না, কতল হবার একদিন আগে যখন মুহাম্মদ বিন কাসিম কয়েদখানার কুঠরীর ভিতরে পায়চারী করছিলেন আমি লৌহ কপাটের বাইরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছিলাম তাঁর প্রতিটি কার্যকলাপ। তাঁর খুবসুরত মুখের ভাবগাম্ভীর্য দেখে আমার মন চাইতো ভিতরে গিয়ে পায়ে চুমু খেতে। রাতের বেলায় কঠিন পাহারার হুকুম ছিলো আমার উপর। আমি তাঁর অন্ধকার কুঠরীতে মোমবাতি জ্বেলে দিলাম। এশার নামাযের পর তিনি ধীরে ধীরে পায়চারী করতে লাগলেন। এক প্রহার রাত কেটে গেলে এই ঘৃণিত কুকুর ইবনে সাদেক কয়েদখানার ফটকে এসে চীৎকার শুরু করলো। পাহারাদার দর্য খুলে দিলে সাদেক আমার কাছে এসে বললো, আমি মুহাম্মদ বিন কাসিমের সাথে দেখা করবো। আমি জওয়াব দিলাম সালেহ হুকুম দিয়েছেন তার সাথে কারুর মোলকাতের এযাত দেওয়া হবে না।

সে রাগ করে বললো, তুমি জান আমি কে?

আমি ঘাবড়ে গেলাম। সালেহ কিছু বলবে না বলে সে আমায় আশ্বাস দিলো। আমি বাধ্য হয়ে মুহাম্মদ বিন কাসিমের কুঠরীর দিকে ইশারা করলাম। ইবনে সাদেক এগিয়ে গিয়ে দর দিয়ে উঁকি মারতে লাগলো। মুহাম্মদ বিন কাসিম তখন গভীর চিন্তায় মগ্ন। তিনি তার দিকে লক্ষ্য করলেন না। অবজ্ঞার স্বরে ইবনে সাদেক বললো, হাজ্জাজের দুলাল, তোমার অবস্থা কি?

মুহাম্মদ বিন কাসিম চমকে উঠে তাকালেন তার দিকে, কিন্তু মুখে কোনো কথা বললেন না।

‘আমায় চিনতে পারো? ইবনে সাদেক প্রশ্ন করলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম বললেন, আপনি কে, আমার মনে পড়ছে না।

সে বললো, “দেখলে, তুমি আমায় ভুলে গেছে, কিন্তু আমি তোমায় ভুলিনি।’

মুহাম্মদ বিন কাসিম এগিয়ে এসে দরযার লৌহ-শলাকা ধরে ইবনে সাদেকের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বললেন, আপনাকে হয়তো কোথাও দেখেছি, কিন্তু মনে পড়ছে না।

ইবনে সাদেক কোনো কথা না বলে তাঁর হাতের উপর নিজের ছড়ি দিয়ে আঘাত করলো এবং তার মুখের উপর থুথু ফেললো।

কি আশ্চর্য! মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুখে বিন্দুমাত্র বিরক্তির চিহ্ন দেখা গেলো না। তিনি তাঁর কামিজের প্রান্ত দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললেন, বুড়ো! তোমার বয়সের কোনো লোককে কখনো আমি তকলীফ দেইনি। না জেনে যদি আমি তোমায় কোনো দুঃখ দিয়ে থাকি, তাহলে আর একবার থুথু দিতে আমি তোমার খুশী মনে অনুমতি দিচ্ছে।—-’আমি সত্যি বলছি তখন মুহাম্মদ বিন কামিমের সামনে পাথর থাকলেও তা গলে যেতো। আমার মন চাইছিলো, ইবনে সাদেকের দাড়ি উপড়ে ফেলি, কিন্তু দরবারে খিলাফতের ভয় অথবা আমার বুজদীলি আমায় কিছুই করতে দিলো না। তারপর ইবনে সাদেক তাঁকে গাল দিতে দিতে চলে গেলো। মধ্যরাত্রের কাছাকাছি সময়ে আমি কয়েদখানায় ঘুরতে ঘুরতে দেখলাম, মুহাম্মদ বিন কাসিম দুই জানুর উপর বসে হাত তুলে দো’আ করছেন। আমি আর তাকাতে পারলাম না। তালা খুলে আমি ভিতরে গেলাম। দো’আ শেষ করে তিনি আমার দিকে তাকালেন।

‘উঠুন। আমি তাকে বললাম।

‘কেন?’ তিনি হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলেন।

আমি বললাম, এ গুনাহ করবার কাজে আমি হিংসা দিতে চাই না। আমি আপনার জান বাঁচাতে চাই।’

তিনি বসতে বসতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে আমার হাত ধরলেন। আমায় কাছে বসিয়ে তিনি বললেন, একে তো আমার বিশ্বাস হচ্ছে না যে, আমীরুল মুমেনিন, আমায় কতল করবার হুকুম দেবেন। আর যদি তা হয়, তাহলেও কি আমি জান বাঁচাতে তোমায় বিপদের মুখে ঠেলে দেবো’?

আমি বললাম, আমার জানের উপর কোনো বিপদ আসবে না। আমিও আপনার সাথে চলে যাবো। আমার দুটি অত্যন্ত দ্রুতগামী গোড়া রয়েছে। আমরা শিগীরই চলে যাবো বুহুদূরে। আমরা গিয়ে কুফা ও বসরার লোকদের কাছে আশ্রয় নেবো। তারা আপনার জন্য শেষ রক্তবিন্দু দিতেও প্রস্তুত। ইসলামী দুনিয়ার সব বড় বড় শহর আপনার আওয়াজে সাড়া দেবে।’

তিনি হেসে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ধারণা আমি বিদ্রোহের, আগুন জেলে দিয়ে মুসলমানদের ধ্বংসের দৃশ্য দেখতে থাকবো? না, তা হতে পারে না। এ হবে কাপুরুষতা। বাহাদুর লোকদের বাহাদুরের মত্য কামনা করাই উচিত। আমি নিজের জান বাঁচাতে গিয়ে হাজারো মুসলমানের জান বিপদের মুখে ঠেলে। দেবো না। তুমি কি চাও, দুনিয়া মুহাম্মদ বিন কাসিমকে মুজাহিদ হিসাবে স্মরণ না। করে বিদ্রোহী বলে আখ্যায়িত করুক’?

আমি বললাম, কিন্তু মুসলামানদের তো আপনার মতো বাহাদুর সিপাহীর প্রয়োজন রয়েছে।’

তিনি বললেন, মুসলমানদের মধ্যে তোমাদের মতো সিপাহীর অভাব হবে না। ইসলামকে যারা কমবেশী করে বুঝেছে, তাদের ভিতরে শ্রেষ্ঠ সিপাহীর গুণরাজি পয়দা করে তোলা কিছু কঠিন নয়।’

আমার মুখে কথা যোগালো না। আমি উঠতে উঠতে বললাম, মাফ করবেন। আপনি আমার কল্পনার চাইতেও বহু উর্ধ্বে।’ তিনি উঠে আমার সাথে হাত মিলিয়ে বললেন, দরবারে খিলাফত হচ্ছে মুসলমানদের শক্তিকেন্দ্র। তার সাথে বিশ্বাস ভংগের খেয়াল কখনো মনে এনো না।’

ইউসুফের কথা শেষ হলো। আব্দুল্লাহ্ তার ব্যথাতুর দৃষ্টি লক্ষ্য করে বললেন, তিনি ছিলেন এক সত্যিকার মুজাহিদ।

ইউসুফ বললেন, এখন আর একটি ব্যাপার আমার কাছে মর্মপীড়ার কারণ হয়েছে। আমি এখুনি তোমায় বলেছিলাম কুতায়বা বিন্ মুসলিম বাহেলীর এক সালারের কথা। তার আকৃতি ও দেহাবয়ব তোমার সাথে অনেকখানি মেলে। উচ্চতায় সে তোমার চাইতে কিছুটা লম্বা। তাঁর সাথে আমার অনেকটা ভাব জন্মেছে। খোদা

করেন, যদি তারও পরিণতি একই হয়, তাহলে আমি বিদ্রোহ করবো। সে বেচারার একমাত্র কসুর, তিনি কয়েকটি ভালো কথা বলেছিলেন মুহাম্মদ বিন্ কাসিম ও কুতায়বা সম্পর্কে। এখন ইবনে সাদেক হয়রায় কয়েদখানায় গিয়ে তাকে দুঃখ দেয়া। আমি বুঝি যে, ইবনে সাদেকের কথায় তার মনে অশেষ বেদনা লাগে। আমার কাছে কতোবার তিনি প্রশ্ন করেছেন, কবে তাকে আযাদ করা হবে। আমার ভয় হয়, ইবনে সাদেকের কথামতো খলিফা তাকে ছেড়ে দেবার পরিবর্তে কতল করে না ফেলেন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের আরো কয়েকজন দোস্ত রয়েছেন কয়েদখানায় বন্দী। তাঁদের সাতে যে ব্যবহার করা হয়, তা খুবই লজ্জাজনক। সেই নওজোয়ান সালারের তাতারী বিবিও এসেছেন তার সাথে। তিনি তার এক আত্মীয়ের সাথে থাকেন শহরে। কয়েকদিন আগে তিনি আমায় তার বিবির খবর দিয়েছন। তার নাম সম্ভবতঃ নার্গিস। তার বাড়ির কাছেই আমার খালার বাড়ি। তার সাথে আমার খালার খুব ভাব জমেছে। তিনি সারা দিনই ওখানে থাকেন এবং আমায় অনুরোধ করেন তার স্বামীকে বাঁচিয়ে দেবার চেষ্টা করতে। আমি কি করবো আর কি করে তার জান বাঁচাবো, কিছুই ভেবে পাই না।

আব্দুল্লাহ্ গভীর চিন্তামগ্ন অবস্থায় ইউসুফের কথা শুনলেন। তার দীলের মধ্যে পয়দা হচ্ছে নানারকম ধারণা। তিনি ইউসুফকে প্রশ্ন করলেন, তাঁর আকৃতি আমার সাথে মেলে তো’?

‘কিন্তু তিনি তোমার চাইতে কিছুটা লম্বা।’

‘তাঁর নাম নয়ীম তো নয়’? আব্দুল্লাহ্ বিষণ্ণ কণ্ঠে বললেন।

‘হ নয়ীম। তুমি চেনো তাকে?

তিনি আমার ভাই আমার ছোট ভাই।

‘ওহ, আমি তো তা জানতাম না!

আব্দুল্লাহ্ মুহূর্তকাল নীরব থেকে বললেন, যদি তার নাম হয়ে থাকে নয়ীম, তার পেশানী আমার পেশানীর চাইতে চওড়া, তার নাক আমার নাকের চাইতে কিছুটা পাতলা, চোখ আমার চোখের চাইতে বড়, ঠোঁট আমার ঠোঁটের চাইতে পাতলা ও খুবসুরত, উচচতা আমার চাইতে একটু বেশী আর দেহ আমার দেহের চাইতে খানিকটা পাতলা হয়ে থাকে, তাহলে আমি কসম খেতে পারি যে, লোকটি, আমার ভাই ছাড়া আর কেউ নন। তিনি কততদিন বন্দি রয়েছেন?

‘প্রায় দু’মাস হলো তিনি কয়েদ হয়েছেন। আব্দুল্লাহ, এখন ওকে বাঁচাবার পরামর্শ করতে হবে আমাদেরকে।

নিজের জান বিপদের মুখে ঠেলে না দিয়ে তুমি তার জন্য কিছু করতে পারো না।’ আব্দুল্লাহ বললেন।

‘আব্দুল্লাহ, তোমার মনে পড়ে, কডোভা অবরোধ কালে আমি যখমী হয়ে মরতে চলেছিলাম, তখন তুমি নিজের জীবন বিপন্ন করে অ তীর বৃষ্টির মাঝখানে লাশের তূপের ভিতর দিয়ে এনেছিলে আমায়’?

‘সে ছিলো আমার ফরয। তোমার উপকার আমি করিনি।’

‘আমিও একে মনে করছি আমার ফরয। একে তোমার উপকার আমি মনে করছি না।’ আব্দুল্লাহ খানিকক্ষণ ইউসুফের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন। তিনি কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, ইতিমধ্যে ইউসুফের হাবশী গোলাম যেয়াদ এসে খবর দিলো, ইবনে সাদেক তার সাথে দেখা করবার জন্য দাঁড়িয়ে রয়েছে। ইউসুফের মুখ পার হয়ে গেলো। তিনি ঘাবড়ে গিয়ে আব্দুল্লাহকে বললেন, তুমি আর এক কামরায় চলে যাও। ও যেনো সন্দেহ না করে।’

আব্দুল্লাহ জলদী পিছনের কামরায় চলে গেলেন। ইউসুফ কামরার দরযা বন্ধ করে দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। তারপর যেয়াদকে বললেন, ওকে ভিতরে নিয়ে এসো।

যেয়াদ চলে যাবার পরেই ইবনে সাদেক ভিতরে এলো। ইনে সাদেক কোন রকম সৌজন্য না দেখিয়ে এসেই সরাসরি বললো, আপনি আমায় দেখে খুবই হয়রান হয়েছেন, না?

ইউসুফ মুখের উপর অর্থপূর্ণ হাসি টেনে এনে বললো, এখানে কেন, যে কোন জায়গায় আপনাকে দেখে আমি হয়রান হই, আপনি তশরীফ রাখুন।’ ইবনে সাদেক কামরার চারিদিকে দৃষ্টি সঞ্চালন করে পিছনের কামরার দরযার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো, আজ আমি খুবই ব্যস্ত। আচ্ছা, আপনার সে দোস্ত কোথায়?

ইউসুফ পেরেশান হয়ে বললেন, ‘কোন্ দোস্ত?

‘কোন দোস্তের কথা জিজ্ঞেস করছি, আপনি জানেন।’

আপনার মতো এলমে গায়েব তো আমার নেই।’

‘আমার মতলব নয়ীমের ভাই আব্দুল্লাহ কোথায়?

“আপনি কি করে জানেন যে, আব্দুল্লাহ নয়ীমের ভাই?

নয়ীমের সব খবর জানতে আমি কয়েক বছর কাটিয়ে দিয়েছি। ওর সাথে আমার কতোখানি জানাজানি, তা আপনি জানেন?

ইউসুফ তীব্রকণ্ঠে জওয়াব দিলেন, তা আমি জানি, কিন্তু আব্দুল্লার কাছে আপনার কি কাজ আমি জানতে পারি কি?’

ইবনে সাদেক বললো, তাও আপনি জানতে পারেন। আগে বলুন সে কোথায়?

‘আমি কি জানি? কারুর সাথে আপনার জানাজানি থাকলে আমি যে তার গোপন খবর নিয়ে বেড়াবো, এ তো জরুরী নয়।

ইবনে সাদেক বললো, দরবারে খিলাফত থেকে যখন সে বেরিয়ে এলো, তখন আপনি তার সাথে ছিলেন। যখন সে সেনাবাসে গেলো, তখন আপনি তার সাথে। যখন সে ফিরে শহরে এলো, তখনো আপনি তার সাথে। ভেবেছিলাম, এখনো সে আপনাদেরই সাথে রয়েছে।’

‘এখানে খানা খেয়ে তিনি চলে গেলেন।

কখন?’

‘এখখুনি।

‘কোন দিকে?

হয়তো সেনাবাসের দিকে।’

এও তো হতে পারে যে, কয়েদখানা দিকে গেছে অথবা ভাইয়ের বিধবাকে সান্ত্বনা দিতে গেছে।

কভাইয়ের বিধবা? আপনার মতলব….?

ইবনে সাদেক দাঁড়িয়ে হাত বুলিয়ে জওয়াব দিলো, আমার মতলব, কাল পর্যন্ত সে বিধবা হয়ে যাবে। আমি আপনাকে আমীরুল মুমেনিনের হুকুম শুনাতে এসেছি যে, মুহাম্মদ বিন কাসিমের তামাম দোস্তকে ভালো করে দেখা শুনা করবেন। তাদের সম্পর্কে কালই হুকুম জারী করা হবে। আর নিজের তরফ থেকে আমি আপনার খেদমতে আরয করছি, আপনি নিজের জানকে প্রিয় মনে করলে আব্দুল্লাহর সাথে মিলে নয়ীমের মুক্তির ষড়যন্ত করবেন না।’

‘আমি এরূপ ষড়যন্ত্র করতে পারি, তা আপনি কি করে বললেন? ইউসুফ ক্ৰদ্ধ স্বরে বললেন।

আমি তা বিশ্বাস করি না, কিন্তু হয়তো আল্লাহর দোস্তির জন্য আপনি বাধ্য হতে পারেন। আচ্ছা, আপনি কয়েদখানার পাহারায় কতো সিপাহী রেখেছেন?

ইউসুফ জওয়াব দিলেন, ‘চল্লিশজন আর আমি নিজেও যাচ্ছি ওখানে।’

‘সম্ভব হলে আরো কিছু সিপাহী রাখুন, কেননা শেষ মুহূর্তে সে ফেরার হয়ে যেতে পারে।

‘এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন আপনি? এতো একটি সাধারণ লোক। পাঁচ হাজার লোক কয়েদখানার উপর হামলা করেও তাকে ছাড়িয়ে নিতে পারবে না।

‘আমার স্বভাবই আমায় আসন্ন বিপদ সম্পর্কে সচেনত করে দেয়। আচ্ছা, আমি চলে যাচ্ছি। আরো কিছু সিপাহী আমি পাঠিয়ে দেবো। আপনি তাদেরকে নয়ীমের কুঠরীর পাহারায় লাগিয়ে দিন।

ইউসুফ আশ্বাসের স্বরে বললেন, আপনি আশ্বস্ত থাকুন। নতুন পাহারাদারের প্রয়োজন নেই। আমি নিজে পাহারা দেবো। আপনি এত উদ্বিগ্ন কেন?’

ইবনে সাদেক জওয়াব দিলো, আপনি হয়েতো জানেন না, ওর মুক্তির অর্থই হচ্ছে আমার মওত ৷ ওর গদানে যতোক্ষণ জল্লাদের তলোয়ার না পড়ছে, ততোক্ষণ আমি স্থির হতে পারবো না।

ইবনে সাদেকের কথা শেষ হতেই আকস্মাত পিছনের কামরার দরযা খুলে গেলো। আব্দুল্লাহ বেরিয়ে আসতে আসতে বললেন, “আর এও তো হতে পারে যে, নয়ীমের মৃত্যুর আগেই তোমায় কবরের মাটিতে শুইয়ে দেওয়া হবে।’

ইবনে সাদেক চমকে উঠে পিছু হটলো। সে পালিয়ে বাঁচাবার চেষ্টা করলো কিন্তু ইউসুফ এগিয়ে গিয়ে তার পথ রোধ করে খনজর দেখিয়ে বললেন, এখন তুমি যেতে পারছে না।

ইবনে সাদেক বললো, “তোমরা জানো, আমি কে?

তা আমরা ভালো করেই জানি, আর আমরা কে, তাও এখনই তোমার জানতে হবে।’ বলে ইউসুফ তালি বাজালেন। তার গোলাম যেয়াদ ছুটে এসে ঢুকলো কামরায়। তাকে দৈর্ঘ্য প্রস্থে, রূপ ও আকৃতিতে মনে হলো, যেনো এক কালো দৈত্য। তার ভুড়িটি এতো বেড়ে গেছে যে, চলবার সময়ে তার পেট উপরে নীচে থলথল করছে। বিরাট এক মোটা নাক। নীচের ওষ্ট এতো মোটা যে, মাড়িশুদ্ধ দাঁতগুলো দেখা যায়, আর উপরের দাঁত ওষ্ঠের তুলনায় অনেকখানি লম্বা। চোখ দুটো ছোট অথচ উজ্জ্বল। সে ইবনে সাদেকের দিকে তাকিয়ে মনিবের হুকুমের ইনতেযার করতে লাগলো।

ইউসুফ একটা রশি নিয়ে আসতে হুকুম দিলেন। যেয়াদ তেমনি তার পেট উপর-নীচে নাচিয়ে-নাচিয়ে বাইরে গিয়ে রশি ছাড়া একটা চাবুকও নিয়ে এলো।

ইউসুফ বললেন, ‘যেয়াদ, ওকে রশি দিয়ে জড়িয়ে এই খুটির সাথে বেঁধে ফেলো।’

যেয়াদ আগের চাইতেও ভয়ংকর মূর্তি ধরে এগিয়ে গেলো এবং ইবনে সাদেকের বায়ু ধরে ফেললো। ইবনে সাদেক খানিকটা ধস্তাধস্তি করে শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বীর মুঠোর চাপে অসহায় হয়ে পড়লো। যেয়াদ তার বায়ু ধরে এমন করে ঝাঁকুনি দিলো যে, সে বেঁহুশ ও নিঃসাড় হয়ে পড়লো। তারপর বেশ স্বস্তির সাথে সে তার হাতপা এক খুটির সাথে শক্ত করে বেঁধে দিলো। আব্দুল্লাহ্ জিব থেকে রুমাল বের করে তার মুখটা বেঁধে দিলেন মযবুত করে। ইউসুফ আব্দুল্লার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, ‘এখন আমাদের কি করতে হবে?

আব্দুল্লাহ্ জওয়াব দিলেন, সব কিছুই আমি ভেবে রেখেছি। তুমি তৈরী হয়ে আমার সাথে চলো। নয়ীমের বিবি যে বাড়িতে থাকেন, তা তোমার জানা আছে?

‘জি হ্যাঁ, সে বাড়িটা এখান থেকে কাছেই।

বহুত আচ্ছা। ইউসুফ, তুমি এক দীর্ঘ সফরে চলেছে। জলদী তৈরী হয়ে নাও।’

ইউসুফ লেবাস বদলী করতে ব্যস্ত হলেন এবং আব্দুল্লাহ কাগজ-কলম নিয়ে জলদী এক চিঠি লিখে জিবের মধ্যে ফেললেন।

কার কাছে চিঠি লিখছেন?

‘এ ঘৃণিত কুকুরের সামনে তা বলা ঠিক হবে না। বাইরে গিয়ে আমি সব বলবো। তোমার গোলামকে বলে দাও, আমি যা বলি, সে যেন তেমনি করে। আজ ভোরে আমি ওকে সাথে নিয়ে যাবো।’

আর ওর কি হবে? ইউসুফ ইবনে সাদেকের দিকে ইশারা করে বললেন।

আব্দুল্লাহ জওয়াবে বললেন, ‘ওর জন্য তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি যেয়াদকে বলে যাও, আমরা ফিরে আসা পর্যন্ত ওর হেফাযত করবে।…… তোমার এখানে কোনো বড় কাঠের সিন্দুক আছে, যা এই বিপদজ্জনক ইঁদুরের জন্য পিঁজরার কাজে লাগতে পারে?’

ইউসুফ আব্দুল্লাহর মতলব বুঝে হাসলেন। তিনি বললেন, জি হ্যাঁ, পাশের কামরায় একটা বড় সিন্দুক পড়ে রয়েছে। তাতে ওর জন্য চত্মকার পিজরা হবে এসো, তোমায় দেখাচ্ছি।’ ..

ইউসুফ আব্দুল্লাহকে অপর কামরায় নিয়ে এবং কাঠের এক সিন্দুকের দিকে ইশারা করে বললেন, আমার মনে হয়, এটি দিয়ে তোমার প্রয়োজন মিটবে।’

হ্যাঁ এটি চমৎকার। এটিকে শিগগীর খালি করো।’ ইউসুফ ঢাকনা তুলে ফেলে সিন্দুক উলটে দিয়ে জিনিসপত্র মেঝের উপর ঢেলে ফেললেন। আব্দুল্লাহ চাকু দিয়ে সিন্দুকের ঢাকনায় দু’তিনটি ছিদ্র করে বললেন, ব্যস, এবার ঠিক আছে। যেয়াদকে বলে দাও, এটাকে তুলে কামরায় দিয়ে যাক।’

ইউসুফ যেয়াদকে হুকুম দিলে সে সিন্দুকটি অপর কামরায় নিয়ে গেলো।

আব্দুল্লাহ বললেন, এখন তুমি যেয়াদকে বলল, সে ভালো করে ওকে দেখাশুনা করবে, আর যদি সে ছাড়িয়ে যাবার চেষ্টা করে, তাহলে ওর গলা টিপে দেয়’

ইউসুফ যেয়াদের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যেয়াদ তোমায় কি করতে হবে, বুঝে নিয়েছে তো?’

যেয়াদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো।

উনি যা হুকুম করেন, তা আমারই হুকুম মনে করবে।’

যেয়াদ আবার তেমনি ঘাড় নাড়লো।

আব্দুল্লাহ্ বললেন, চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে। ইউসুফ ও আব্দুল্লাহ্ বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ ইউসুফ কি যেনো চিন্তা করে থেমে বললেন, হয়তো এ লোকটার সাথে আমার আর দেখা হবে না। আমার কিছু কথা আছে ওর সাথে।

আব্দুল্লাহ বললেন, এখন কথার সময় নয়।

‘কোনো লম্বা আলাপ নয়। ইউসুফ বললেন, ‘তুমি একটু দাঁড়াও। ইউসুফ ইবনে সাদেককে লক্ষ্য করে বললেন, আমি আপনার কাছে ঋনী। এখন আমি আপনার কার্য কিছুটা আদায় করে যাচ্ছি। দেখুন, আপনি মুহাম্মদ বিন কাসিমের মুখে থুথু দিয়েছিলেন, তাই আমি আপনার মুখে থুথু দিচ্ছি।—-বলে তিনি ইবনে সাদেকের মুখে থুথু দিলেন। আপনি তার হাতের উপর ছড়ি মেরেছিলেন, এই নিন—বলে ইউসুফ তাকে এক কোনো মারলেন। মনে পড়ে, আপনি নয়ীমের মুখে চড় মেরে ছিলেন, এই তার জওয়াব—বলে ইউসুফ জোরে চড় মারলেন তার গালে। আপনি নয়ীমের মাথার চুল উপড়ে দিয়েছিলেন। ইউসুফ তার দাড়ি ধরে জোরে জোরে ঝাঁকুনি দিলেন।..

ইউসুফ, ছেলেমি করো না। আব্দুল্লাহ ফিরে তার বায়ু ধরে টেনে বললেন, বাকীটা পরে হবে। যেয়াদ, ওর দিকে ভালো করে খেয়াল করো।’ যেয়াদ আবার তেমনি মাথা নাড়লো। ইউসুফ আব্দুল্লাহর সাথে বেরিয়ে গেলেন বাইরে।

*

পথে ইউসুফ প্রশ্ন করলেন, কি মতলব করলে তুমি?’

আব্দুল্লাহ বললেন, ‘শোন, তুমি আমায় নয়ীমের বিবির বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে কয়েদখানায় চলে যাও। ওখান থেকে নয়ীমকে বের করে নিজের বাড়িতে নিয়ে যাবে। ওখান থেকে বেরিয়ে আসতে কোনো অসুবিধা হবে না তো?

‘কোন অসুবিধা নেই।’

“আচ্ছা, তুমি বলেছিলে, তোমার কাছে দুটি ভালো ঘোড়া রয়েছে। আমার ঘোড়া রয়েছে ফউজী আস্তাবলে। তুমি আর একটি ঘোড়ার ব্যবস্থা করতে পারবে না?

দশটি ঘোড়ারও ব্যবস্থা করা যাবে, কিন্তু নয়ীমের তিনটা ঘোড়াওততা তার বাড়িতে মওজুদ রয়েছে।’

‘আচ্ছা, তুমি নয়ীমকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে নিজের বাড়িতে এসো। এর মধ্যে তার বিবিকে নিয়ে আমি শহরের পশ্চিম দরযার বাইরে ইনতেযার করতে থাকবো। তোমরা দু’জন ঘর থেকে সওয়ার হয়ে এসো ওখানে।’

আব্দুল্লাহ তার লেখা চিঠিখানা বের করে ইউসুফের হাতে দিয়ে বললেন, তোমরা এখান থেকে সোজা কায়রোয়ান চলে যাবে। ওখানকার সালারেআলা আমার দোস্ত ও নয়ীমের মকতবের সাথী। তিনি তোমাদেরকে স্পেন পর্যন্ত পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করে দেবেন। স্পেনে পৌঁছে তেতলার সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আবু ওবায়েদের। হাতে দেবে এ চিঠি। তিনি তোমাদেরকে ফউজে ভর্তি করে নেবেন। তিনি আমার, বিশ্বস্ত দোস্ত। তিনি তোমাদের পূর্ণ হেফাযত করবেন। নয়ীম আমার ভাই, তা তাকে বলবার প্রয়োজন নেই। আমি লিখেছি যে, তোমরা দু’জনই আমার দোস্ত। তোমাদের অবস্থা বলো না আর কারুর কাছে। কস্তানতুনিয়া থেকে ফিরে আমি আমীরুল মুমেনিনের ভুল ধারণা দূর করবার চেষ্টা করবো।’

ইউসুফ চিঠিখানা জিবের মধ্যে রেখে একটি সুন্দর বাড়ির সামনে এসে বললেন, যে নয়ীমের বিবি এখানে থাকেন।

আব্দুল্লাহ বললেন, আচ্ছা তুমি যাও। হুশিয়ার হয়ে কাজ করা।

বহুত আচ্ছা খোদা হাফিজ।’

‘খোদা হাফিয।’

ইউসুফ কয়েক কদম চলে যাবার পর আদুল্লাহ বাড়ির দরজায় করাঘাত করলেন। বারমাক ভিতর থেকে দরজা খুলে আব্দুল্লাহকে নয়ীম মনে করে খুশীতে উচ্ছল হয়ে তাতারী যবানে বললো, আপনি এসেছেন, আপনি এসেছেন? নার্গিস! নার্গিস! উনি এসেছেন।’

আব্দুল্লাহ প্রথম জীবনে কিছুকাল তুর্কিস্তানে কাটিয়ে এসেছেন। তাতারী যবান তিনি কমবেশী করে জানেন। বারমাকের মতলব বুঝে তিনি বললেন, আমি তার ভাই। এর মধ্যে নার্গিস ছুটে এসেছেন। কে এসেছেন?’ তিনি এসেই প্রশ্ন করলেন।

ইনি নয়ীমের ভাই।’ বারমাক জওয়াব দিলো।

‘আমি ভেবেছিলাম, তিনি। নার্গিস আর্তস্বরে বললেন, আমি মনে করেছিলাম, বুঝি তিনিই…..! নার্গিসের উচ্ছ্বসিত দীল দমে গেলো। তিনি আর কিছু বলতে পারলেন না।

‘বোন। আমি নয়ীমের পয়গাম নিয়ে এসেছি। আব্দুল্লাহ বাড়ির আঙিনায় প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করতে বললেন।

তার পয়গাম? আপনি তার সাথে দেখা করে এসেছেন? বলুন, বলুন। নার্গিস অ-সজল চোখে বললেন।

তুমি আমার সাথে যাবার জন্য জলদী তৈরী হয়ে নাও।

‘কোথায়?

নয়ীমের সাথে দেখা করতে।’

তিনি কোথায়?’

শহরের বাইরে তার সাথে দেখা হবে তোমাদের।’

নার্গিস সন্দেহের দৃষ্টিতে আব্দুল্লাহর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি তো স্পেনে ছিলেন।’

আব্দুল্লাহ বললেন, আমি ওখান থেকেই এসেছি। আজই আমি জানলাম যে, নয়ীম কয়েদখানায় পড়ে রয়েছেন। তাকে বের করে আনবার ইনতেম আমি করেছি। তুমি জলদী করো।’

বারমাক বললো, “চলুন কামরার ভিতরে। এখানে অন্ধকার।

বারমাক, নার্গিস ও আব্দুল্লাহ বাড়ির একটি আলোকোজ্জ্বল কামরায় প্রবেশ করলেন। নার্গিস আব্দুল্লাহকে দীপালোকে ভালো করে দেখলেন। নয়ীমের সাথে তার আকৃতির অসাধারণ সাদৃশ্য তাকে অনেকখানি আশ্বস্ত করলো।

‘আমরা পায়দল যাবো?’ তিনি আব্দুল্লাহকে প্রশ্ন করলেন।

না, ঘোড়ায় চড়ে।’ বলে আব্দুল্লাহ বারমাকের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ‘ঘোড়া কোথায়?

সামনের আস্তাবলে রয়েছে। সে জওয়াব দিলো।

‘চলো আমরা ঘোড়া তৈরী করে নিয়ে আসি।’

আব্দুল্লাহ ও বারমাক আস্তাবলে গিয়ে ঘোড়ার জিন লাগালেন। এর মধ্যে নার্গিস তৈরী হয়ে এসেছেন। তাকে একটি ঘোড়ায় সওয়ার করিয়ে দিয়ে বাকী দুটি ঘোড়ায় সওয়ার হলেন আব্দুল্লাহ্ ও বারমাক। শহরের দরজায় পাহারাদাররা বাধা দিলো। আব্দুল্লাহ তাদেরকে বললেন যে, তিনি কস্তানতুনিয়াগামী ফউজের সাথে শামিল হবার জন্য যাচ্ছেন সেনাবাসের দিকে। প্রমাণস্বরূপ তিনি পেশ করলেন খলিফার হুকুমনামা। পাহারাদাররা আদরের সাথে সালাম করে দরজা খুলে দিলো। দরজা থেকে কয়েক কদম দূরে গিয়ে তারা তিনজন ঘোড়া থেকে নামলেন এবং গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ইনতেযার করতে লাগলেন ইউসুফ ও নয়ীমের জন্য।

উনি কখন আসবেন? নার্গিস বারংবার অস্থির হয়ে প্রশ্ন করেন। আব্দুল্লাহ সস্নেহে জওয়াব দেন, বাস্, এখখুনি এসে যাবেন।

তারা আরো কিছুক্ষণ ইনতেযারে কাটালেন এবং দরযার দিক থেকে ঘাড়ার পদধ্বনি শোনা গেলো।

‘ওরা আসছেন। আব্দুল্লাহ্ আওয়াজ শুনে বললেন। সওয়ারদের আগমনে আব্দুল্লাহ ও নার্গিস গাছের ছায়া থেকে বেরিয়ে দাঁড়ালেন সড়কের উপর।

নয়ীম কাছে এসে ঘোড়া থেকে নেমে ভাইয়ের সাথে আলীংগনাবদ্ধ হলেন। আব্দুল্লাহ বললেন, “আর দেরী করো না ভোর হলো বলে। কায়রোয়ান পৌঁছবার আগে কোথাও দম নেবে না। বারমাক আমার সাথে যাবে।

নয়ীম ঘোড়ায় সওয়ার হলেন। তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন সামনে। আব্দুল্লাহ তার হাতে চুমু খেলেন এবং চোখে স্পর্শ করলেন।

‘ভাই, উযরা কেমন আছে?’ নয়ীম বিষণ্ণ আওয়াযে প্রশ্ন করলেন।

‘সে ভালোই আছে। আল্লার মনযুর হলে আমরা স্পেনে তোমাদের সাথে মিলবো আবার।’

আব্দুল্লাহ এরপর ইউসুফের সাথে মোসাফেহা করলেন এবং নার্গিসের কাছে গিযে হাত বাড়ালেন। নার্গিস তার মতলব বুঝে মাথা নীচু করলেন। আব্দুল্লাহ সস্নেহে তার মস্তকে হাত বুলিয়ে দিলেন।

নার্গিস বললেন, ভাইজান, উযরাকে আমার সালাম বলবেন।

আচ্ছা খোদা হাফিয।’ আব্দুল্লাহ বললেন।

তিনজন সমস্বরে তার জওয়াবে ‘খোদা হাফি’ বলে ঘোড়র বাগ ঢিলা করে দিলেন। আব্দুল্লাহ ও বারমাক খানিক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। নয়ীম আর তার সারা রাতের অন্ধকারে গায়েব হয়ে গেলে তারা ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে গেলেন সেনাবাসে।

পাহারাদারেরা আব্দুল্লাহকে চিনতে পেরে সালাম করলো। আব্দুল্লাহ বারমাকের ঘোড়া এক সিপাহীর হাতে সঁপে দিয়ে তার সওয়ারীর জন্য উটের ইনতেযাম করে আবার ফিরে গেলেন শহরের দিকে।

*

যেয়াদ তার মালিকের হুকুম পেয়েছে ইবনে সাদেকের দিকে পুরোপুরি খেয়াল রাখবার। সে এতটা খেয়াল রেখেছে ইবনে সাদেকের দিকে যে, তার মুখের দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়নি আর কোনোদিক। ঘুম পেলে সে উঠে সেই খুঁটির চারদিকে ঘুরতে থাকে। এ নিঃসঙ্গতা তার আর ভালো লাগে না। আচানক এক খেয়াল এলো তার মাথায়। সে ইবনে সাদেকের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো এবং তাকে ভালো করে দেখতে লাগলো। তার মুখে আচানক এক ভয়ংকর হাসি দেখা দিলো। সে ইবনে সাদেকের চিবুকের নীচে হাত দিয়ে তার মুখ নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে থুথু দিতে লাগলো তার মুখে। তারপর সে পূর্ণ শক্তি দিয়ে কয়েকটা কোড়া মারলো ইবনে সাদেকের পিঠে এবং এমন জোরে তার মুখে মারলো এক চড় যে সে বেহুঁশ হয়ে পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। তার হুশ ফিরে এলে যেয়াদ তার দাঁড়ি ধরে টানতে লাগলো। ইবনে সাদেক যখন অসহায়ভাবে গর্দান ঢিলা করে দিলো, তখন যেয়াদও তাকে ছেড়ে দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য ঘুরতে থাকলো তার আশপাশে।

ইবনে সাদেকের হুঁশ হলে যখন সে চোখ খুললো, যেয়াদ তখন আবার তেমনি উত্তম মাধ্যম লাগালো। কয়েকবার এমনি করে যখন সে বুঝলে যে তার আর কোড়া খাবার মতো তাকৎ নেই, তখন সে বিড়বিড় করে খুঁটির আশপাশে ঘুরেলো এবং মাঝে মাঝে ইবনে সাদেকের দাড়ি ধরে এক আধটা টান মারলো। কখনো কখনো সে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়ে, আবার খানিকক্ষণ পর খানিকটা তামাশা করে।

ভোরের আযানের সময়ে যেয়াদ দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো, আব্দুল্লাহ ও বারমাক আসছেন.। সে শেষবার থুথু দিতে, কোড়া ও চড় মারতে এবং দাড়ি ধরে টানতে চাইলো। তখনো ইবনে সাদেকের দাড়ি ধরে ঝাঁকুনি দেওয়া শেষ হয়নি। এর মধ্যে আব্দুল্লাহ ও বারমাক এসে পৌঁছলেন।

আব্দুল্লাহ বললেন, বেসকুফ, কি করছো তুমি? ওকে জলদী সিন্দুকে ঢুকাও। যেয়াদ তখখুনি তার হুকুম তামিল করে আধামরা আজদাহকে ঢুকালো সিন্দুকের মধ্যে।

য়ের পরক্ষণেই আব্দুল্লাহ ফউজ নিয়ে চললেন কস্তানতুনিয়ার পথে। রসদ বোঝাই উটগুলোর মধ্যে একটির পিঠে চাপানো হয়েছে একটি সিন্দুক। যেয়াদের উটটি তার পাশে। লশকরের মধ্যে আব্দুল্লাহ, বারমাক ও যেয়াদ ছাড়া আর কেউ জানে না, সিন্দুকের মধ্যে কি রয়েছে।

আব্দুল্লাহর হুকুমে বারমাকও ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চললো। সিন্দুকয়াওলা উটের পাশে পাশে।

*

নয়ীম নার্গিস ও ইউসুফকে সাথে নিয়ে কায়রোয়ান পৌঁছলেন। সেখান থেকে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে তারা গেলেন কডোভায়। কর্ডোভা থেকে ধরলেন তেতালার পথ। সেখানে পৌঁছে নার্গিসকে এক সরাইখানায় রেখে তিনি ইউসুফকে সাথে নিয়ে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক আবু ওবায়েদের খেদমতে হাযির হয়ে পেশ করলেন আব্দুল্লাহর চিঠি।

আবু ওবায়েদ চিঠি পড়ে ইউসুফ ও নয়ীমের দিকে ভালো করে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে বললেন, আপনারা আব্দুল্লাহর দোস্ত। আজ থেকে আমাকেও আপনার দোস্ত মনে করবেন। আব্দুল্লাহ নিজের ফিরে আসবেন না?

নয়ীম জওয়াব দিলেন, আমীরুল মুমেনিন তাকে পাঠিয়েছেন কস্তানতুনিয়া অভিযানে।

‘কস্তানতুনিয়ার চাইতে এখানেই তার প্রয়োজন ছিলো বেশী। তারিক ও মুসার স্থান নেবার মতো আর কেউ নেই। আমি বৃদ্ধ হয়ে গেছি এবং পূর্ন উদ্যম সহকারে কর্তব্য পালন করতে পারছি না। আপনারা জানেন, শাম ও আরব থেকে এদেশ অনেক খানি আলাদা। এখনাকার পাহড়ী লোকদের যুদ্ধের তরিকাও আমাদের থেকে স্বতন্ত্র। পরে এখানে আপনাদেরকে ফউজের কোনো উঁচু পদ দেওয়া যাবে। আপাততঃ মামুলী সিপাহী হিসাবে অভিজ্ঞতা হাসিল করতে হবে বেশ কিছুদিন। তারপর আপনাদের হেফাযতের সওয়াল। সে সম্পর্কে আপনারা নিশ্চিন্ত থাকুন। যদি আমীরুল মুমেনিন এখান পর্যন্ত আপনাদের তালাশ করেন, তাহলে আপনাদেরকে পৌঁছে দেওয়া যাবে কোনো নিরাপদ জায়গায়। কিন্তু আমার নীতি হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির যোগ্যতার পরীক্ষা না নিয়ে আমি তার উপর কোনো জিম্মাদারী দেই না।’

নয়ীম সিপাহসালারের দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আমি কুতাবয়া বিন মুসলিম ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের ডান পাশে থেকে যতোটা আনন্দ লাভ করেছি, সিপাহীদের পিছনের কাতারে দাঁড়িয়েও আমি অনুরূপ আনন্দই পাবো।’

আপনার মতলব হচ্ছে যে আপনি….।

আবু ওবায়েদের কথা শেষ হবার আগেই ইউসুফ বলে উঠলেন, ইনি ছিলেন কুতায়বা ও ইবনে কাসিমের নামদা সালার। মাফ করবেন। আমি জানতাম না যে, আমি আমার চাইতে যোগ্যতর ও অধিকতর অভিজ্ঞ সালারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আবু ওয়ায়েদ আর একবার নয়ীমের সাথে মোসাফেহা করলেন।

‘এবার আমি বুঝেছি, কেন আমীরুল মুমেনিনের বিষ নযরে আপনি পড়েছেন। এখানে কোন বিপদ নেই আপনার। তবু সতর্কতার খাতিরে আজ থেকে আপনার নাম যোবায়ের ও আপনার দোস্তের নাম হবে আবদুল আযীয। আপনার সাথে কেউ আছেন?

নয়ীম বললেন, ‘জি হাঁ, আমার বিবিও সাথে আছেন। তাকে আমি রেখে এসেছি এক সরাইখানায়।’

‘ওহো, তার জন্যও আমি একটা বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। আবু ওবায়েদ আওয়ায দিয়ে এক নওকরকে ডেকে হুকুম দিলেন শহরে একটা ভালো বাড়ি খুঁজে দিতে।

*

চারমাস পর একদিন নয়ীম বর্মপরিহিত হয়ে নার্গিসের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, যে রাত্রে ভাই আব্দুল্লাহ ও উমরার শাদী হলো, সেই রাত্রেই তিনি রওয়ানা হয়ে গেলেন জিহাদের ময়দানে। আমি নিজের চোখে দেখেছি, উযরার মুখে চিন্তা ও দুঃখের মামুলী রেখাঁটিও নেই।’

‘আপনার মতলব আমি বুঝেছি।’ নার্গিস হাসবার চেষ্টা করে বললেন, আপনি কতোবার বলেছেন, তাতারী মেয়েরা আরব মেয়েদের মোকাবিলায় বহুত কমোের, কিন্তু আমি আপনার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দেবো।’

নয়ীম বললেন, পর্তুগাল বিজয়ে আমার প্রায় ছয় মাস লেগে যাবে। আমি চেষ্টা করবো। এরই মধ্যে একবার এসে তোমায় দেখে যেতে। আমি না আসতে পারলেও ঘাবড়ে যেয়ো না। আবু ওবায়েদ আজ এক পরিচারিকাকে পাঠাবেন তোমার কাছে।

‘আমি আপনাকে….। নার্গিস দৃষ্টি অবনত করে বললেন, ‘একটা নতুন খবর শোনাতে চাই।’

‘শোনাও।’ নয়ীম নার্গিসের চিবুক স্নেহে উপরে তুলে বললেন।

‘আপনি যখন ফিরে আসবেন।’.

হাঁ হাঁ, বলো।’

‘আপনি জানেন না?’ নার্গিস নয়ীমের হাত ধরে মৃদু চাপ দিতে দিতে বললেন।

আমি জানি। তোমার মতলব, শিগগিরই আমি বাচ্চার বাপ হতে চলেছি। এই তো?’ এর জওয়াবে নার্গিস তার মস্তক নয়ীমের সিনার সাথে লাগালেন।

নার্গিস, আমি তার নাম বলে যাবো? ….তার নাম হবে আব্দুল্লাহ। আমার ভাইয়ের নাম।

‘আর যদি মেয়ে হয়ে, তবে?

না, ছেলেই হবে। আমার চাই এমন বেটা, যে তীরবৃষ্টি ও তলোয়ারের ঝংকারের ভিতরে খেলে বেড়াবে। আমি তাকে তীরন্দাযী, নেহাবাযি, শাহসওয়ারীর শিক্ষা দেবো। পূর্বপুরুষের তলোয়ার দীপ্তি অব্যাহত রাখবার জন্য পয়দা করতে হবে তার বায়ুতে তাকৎ দীলে হিম্মৎ।

*

ওফাতের কিছুকাল আগে খলিফ ওয়ালিদ কস্তানতুনিয়া বিজয়ের জন্য প্রেরণ করেছিলেন জঙ্গী জাহারের এক বহর এবং এক ফউজ পাঠিয়েছিলেন এশিয়া মাইনরের পথে, কিন্তু সে হামলায় মুসলমানরা কঠিন ব্যর্থতার মোকাবিলা করলো। কস্তানতুনিয়ার মজবুত পাঁচিল জয় করবার আগেই মুসলমানদের রসদ গেলো ফুরিয়ে। আর এক মুসীবৎ হলো এই যে, শীতের মওসুম শুরু হতেই লশকরের ভিতর মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়ে হাজারো মুসলমানের প্রাণ বিনষ্ট হলো। এসব মুসীবতের ভিতর দিয়ে এক বছর অবরোধের পর মুসলিম সেবাহিনীকে ফিরে আসতে হলো।

মুহাম্মদ বিন কাসিম ও কুতায়বা বিন মুসলিম বাহেলীর মর্মান্তিক পরিণতির পর সিন্ধু ও তুর্কিস্তানে ইসলামী বিজয় অভিযানের গতি প্রায় শেষ হয়ে এলো। সুলায়মান এ অখ্যাতির কলংক অপসারণের জন্য চাইলেন কস্তানতুনিয়া জয় করতে। তার ধারণা ছিলো যে, কস্তানতুনিয়া জয় করতে পারলে তিনি বিজয় গৌরবে খলিফা ওয়ালিদকে ছাড়িয়ে যাবেন, কিন্তু দুর্ভগ্যবশত এ বিজয় অভিযানের জন্য তিনি বাছাই করলেন এমন সব লোক, সিপাহীর যিন্দেগীর সাথে যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁর সিপাহসালার যখন পায়ে পায়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে লাগলেন তখন তিনি আন্দালুসের ওয়ালীকে হুকুম দিলেন একজন বাহাদুর ও অভিজ্ঞ সালারকে পাঠিয়ে দিতে। সেই হুকুম অনুযায়ী আব্দুল্লাহ হাযির হয়ে দামেস্ক থেকে পাঁচ হাজার সিপাহী নিয়ে রওয়ানা হলেন কাস্তানতুনিয়ার পথে। যাতে কস্তানতুনিয়ার উপর হামলাকারী ফউজের দেখাশুনা করা যায়, তারই জন্য সুলায়মান নিজেও দামেস্ক ছেড়ে রমলায় বানালেন তার দারুল খিলাফত। কয়েকবার তিনি হামলাকারী ফউজ পরিচালন করলেন, কিন্তু কোনো সাফল্যই লাভ হলো না। সুলায়মানের বেশীর ভাগ নির্দেশের সাথে আব্দুল্লাহ একমত হতেন না। তিনি চাইতেন যে, তুর্কিস্তান ও সিন্ধুর যেসব মশহুর সালার কুতায়বা বিন মুসলিম ও মুহম্মদ বিন কাসিমের অনুরক্ত বলে পদচ্যুত হয়েছেন, তাদেরকে আবার ফউজের শামিল করে নেওয়া হোক। কিন্ত খলিফা তাদের বদলে ভর্তি করে দিলেন তার কতিপয় অযোগ্য দোস্তকে।

সুলায়মানের বিরুদ্ধে জনসাধারণের মধ্যে ঘৃণার মনোভাব পয়দা হলো। নিজের কমযোরী কম্পর্কে তিনিও ছিলেন সচেতন। কেবল খলিফার তুষ্টির জন্য খোদার রাহে জান-মাল উৎসাৰ্গকারী সিপাহীরা রক্তপাত পছন্দ করতো না। তাই ইসলামের পথে আত্মোৎসর্গের সে পুরানো মনোভাব ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে এলো। ইবনে সাদেক গায়েব হয়ে যাওয়ায় খলিফার পেরেশানি গেলো বেড়ে। মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে আসন্ন মুসীবৎ সম্পর্কে তাকে বেপরোয়া করে তুলবার মতো আর কেউ নেই তখন। মুহাম্মদ বিন কাসিমের মতো বেগুনাহ মানুষকে হত্যা করার ফলে তার বিবেক তাকে কষাঘাত করতে লাগলো। ইবনে সাদেককে খুঁজে বের করবার সব রকম প্রচেষ্টা করা হলো। গুপ্তচররা ছুটে বেড়াতে লাগলো, পুরস্কার ঘোষনা করা হলো, কিন্তু কোথাও মিললো না কোনো সন্ধান।

চৌদ্দ

আব্দুল্লাহ জানতেন যে, খলিফা ইবনে সাদেকের সন্ধানের জন্য সর্বপ্রকার সম্ভাব্য চেষ্টাই করবেন। তাই তাকে যিন্দাহ রাখা বিপজ্জনক, কিন্তু তিনি তার মতো নীচু মানুষের রক্তে হাত কলংকিত করা বাহাদুর সিপাহীর পক্ষে শোভন মনে করেন নি। কস্তানতুনিয়ার পথে তার ফউজ যখন কৌনিয়া নামক স্থানে এসে থামলো, তখন আব্দুল্লাহ শহরের শাসনকর্তার সাথে দেখা করে তার দামী জিনিসপত্র হেফাযত করবার জন্য একটি বাড়ি পাবার ইচ্ছা জানালেন। শহরের শাসনকর্তা আব্দুল্লাহকে দিলেন একটি পুরানো জনহীন বাড়ি। আব্দুল্লাহ ইবনে সাদেককে বন্ধ করে রাখলেন সেই বাড়ির গোপন কক্ষে। বারমাক ও যেয়াদের উপর হেফাযতের দায়িত্ব অর্পন করে ফউজ নিয়ে তিনি চলেন কস্তানতুনিয়ার পথে।

যেয়াদের কাছে তার যিন্দেগী আগের চাইতে আনন্দদায়ক হয়ে উঠেছে। আগে সে ছিলো নিছক গোলাম। কিন্তু এখন একটা মানুষের দেহ ও জানের উপর তার পুরো এখতিয়ার। সে যখন চায়, ইবনে সাদেককে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করে। ইবনে সাদেক তার কাছে একটা খেলনার শামিল। এ খেলা নিয়ে খেলতে ক্লান্ত অনুভব করে না সে। তার নিরানন্দ জীবনে ইবনে সাদেক প্রথম ও শেষ আর্কষণ। তার প্রতি তার বিদ্বেষ, না প্রীতির আর্কষণ! যে, ভাবেই হোক, সে হরতোয তাকে চড়-চাপড় মারার, দাড়ি ধরে টানার ও মুখে থুথু দেবার না কোনো সুবিধা বের করে নেয়া বারমাক তার সামনে করতে দেয় না এসব, কিন্তু যখন সে খাবার সংগ্রহের জন্য বাজারে যায়, তখন যেয়াদ তার খুশীমতো কাজ করে।

আব্দুল্লাহর হুকুম মোতাবেক ইবনে সাদেককে দেওয়া হতো ভালো ভালো খানা। তার আরো হুকুম ছিলো যেনো সাদেককে কোনো তকলীফ দেওয়া না হয়। কিন্তু যেয়াদ অতো বেশী জরুরী মনে করতো না এ হুকুম। আরবী যবান কিছুটা জানা থাকলেও যেয়াদ ইবনে সাদেকের সাথে কথা বলতো তার মাতৃভাষায়। গোড়ার দিকে ইবনে সাদেকের অসুবিধা হতো, কিন্তু কয়েক মাস পরে সে বুঝতো যেয়াদের কথা।

একদিন বারমাক চলে গেলো বাজার থেকে খানাপিনার জিনিষপত্র আনতে। যেয়াদ বাড়ির এক কামরায় দাঁড়িয়ে খিড়কি ঋেকে উঁকি মেরে দেখলো, এক হাবশী গাধায় সওয়ার হয়ে বেরিয়ে আসছে শহর থেকে। দৈত্যাকৃতি হাবশীর বোঝা বয়ে জীর্ণ গাধার কোমর বেঁকে যাচ্ছে। গাধা চলতে চলতে শুয়ে পড়লো আর হাবশী শুরু করলো কোড়া বর্ষণ। গাধা নিরুপায় হয়ে উঠে দাঁড়ালো। হাবশী আবার চাপলো তার পিঠে। খনিকটা পথ চলে গাধা আবার বসে পড়লো। হাবশী আবার মারতে লাগলো কোড়া। যেয়াদ অট্টহাস্য করে কামরা থেকে একটা কোড়া হাতে নিয়ে নামলো নীচে এবং ইবনে সাদেকের কয়েদখানার দর খুলে ঢুকলো ভিতরে।

ইবনের সাদেক যেয়াদকে দেখেই তৈরী হলো অভ্যাসমতো দাড়ি টানাতে ও কোড়ার ঘা খেতে, কিন্তু তার প্রত্যাশার বিরুদ্ধে যেয়াদ খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো চুপ করে। অবশেষে সে সামনে ঝুঁকে দুহাত যমিনের উপর ভর করে এক চার পেয়ে জানোয়ারর মতো হাত-পা দিয়ে দুতিন গজ চালবার পর ইবনে সাদেককে বললো, ‘এসো।

ইবনে সাদেক তার মতলব বুঝলো না। আজ কোনো নতুন খেলার ভয়ে সে ঘাবড়ে গেলো। ভয়ের আতিশয্যে তার পেশানীতে দেখা দিলো ঘাম।

যেয়াদ বললো, এসো, আমার উপর সওয়ার হও।’

ইবনে সাদেক জানতো, তার ভালো-মন্দ যে কোনো হুকুম মেনে চললেই তার ভালাই। তার হুকুম অমান্য করার শাস্তি হবে তার পক্ষে অসহনীয়। তাই ভয়ে ভয়ে সে সওয়ার হলো যেয়াদের পিঠে। যেয়াদ গোপন কক্ষের দেওয়ালের চারিদিকে দুতিন চক্কর লাগিয়ে ইবনে সাদেককে নীচে নামিয়ে দিলো। যেয়াদকে খুশী করতে গিয়ে সে খোশমুদীর স্বরে বললো, আপনি বেশ শক্তিমান।

কিন্তু যেয়াদ তার কথায় কান না দিয়ে উঠেই হাত ঝেড়ে ইবনে সাদেককে ধরে নীচে ঝুঁকিয়ে বললো, এবার আমার পালা।

ইবনে সাদেক জানতো, এ দৈত্যের বোঝা পিঠে নিয়ে সে পিষে যাবে, কিন্তু নিরুপায় হয়ে সে নিজেকে তকদীরের উপরে ছেড়ে দিলো।

যেয়াদ কোড়া হাতে ইবনে সাদেকের পিঠে সওয়ার হলো। ইবনে সাদেকের কোমর বেঁকে গেলো। এত ভারী বোঝা বয়ে চলা তার পক্ষে অসম্ভব। বহু কষ্টে দুতিন কদম চলে সে পড়ে গেলো। যেয়াদ তার উপর কোড়া বর্ষণ করতে শুরু করলো। কোড়ার ঘা খেয়ে ইবনে সাদেক বেহুশ হয়ে গেলো। যেয়াদ তাকে দেওয়ালে ভর করে বসিয়ে দিয়ে ছুটে গেলো বাইরে। খানিক্ষণ পর আবার কয়েদখানার দর খুলে সে ঢুকলো এক তশতরীতে কয়েকটা সেব ও আঙ্গুর নিয়ে। ইবনে সাদেক জ্ঞান ফিরে পেয়ে চোখ খুললো। যেয়াদ আপন হাতে তার মুখে দিলো কয়েকটা আঙ্গুর। তারপর নিজের খনজর দিয়ে একটা সেব কেটে সে তার অর্ধেকটা দিলো ইবনে সাদেককে। ইবনে সাদেক তার হিসসা শেষ করলে যেয়াদ তাকে কেটে দিলো আর একটি সেব।

ইবনে সাদেক জানে, যেয়াদ কখনো কখনো তার প্রতি প্রয়োজনের চাইতে বেশী মেহেরবান হয়ে ওঠে। তাই সে দ্বিতীয় সেটি শেষ করে নিজেই যেয়াদকে তুলে দিলো তৃতীয় সেবটি। যেয়াদ তার খনজর রেখে দিয়েছে সেব গুলোর মাঝখানে। ইবনে সাদেক বেপরোয়া হয়ে সেটি হাতে তুলে নিয়ে সেবের খোসা ফেলতে শুরু করলো। যেয়াদ সবকিছুই দেখছে মনোযোগ দিয়ে। ইবনে সাদেক খজনর রেখে দিয়ে বললো, এগুলো খোসাশুদ্ধ খেলে ক্ষতি হয়।’

হুঁ।’ যেয়াদ মাথা নেড়ে আওয়ায করলো এবং একটি সেব তুলে নিজেও ইবনে সাদেকের মতো খোসা ফেলতে লাগলো। যেয়াদের হাত কেমন যেনো নিঃসাড় হয়ে আসছে। সে হাত মুখে দিয়ে ভাবতে লাগলোঃ

‘দিন, আমি খোসা তুলে দিচ্ছি।’ ইবনে সাদেক বললো।

যেয়াদ মাথা নেড়ে সেব ও খনজর দিলো তার হাতে। ইবনে সাদেক সেবের খোসা তুলে ফেলে তার হাতে দিয়ে প্রশ্ন করলো, আরো খাবেন আপনি? যেয়াদ মাথা নাড়লো এবং ইবনে সাদেক আর একটি সেব তুলে তার খোসা ফেলতে লাগলো।

ইবনে সাদেকের হাতে খুনজর। তার দীল ধড় ফড় করছে। সে চায়, একবার আবার ভাগ্য পরীক্ষা করে দেখবে, কিন্তু তার ভয়, হামলা করবার আগেই যেয়াদ তাকে ধরে ফেলবে বজ্রমুষ্ঠিতে। খানিকক্ষন চিন্তা করে সে দরযার দিকে ফিরে দেখে পেরেশান হবার ভান করে বললো, কে যেনো আসছে।’ যেয়াদও জলদী ফিরে তাকালো দরবার দিকে। ইবনে সাদেক অমনি অলক্ষ্যে তার সিনায় আমূল বিদ্ধ করে দিলো তার হাতের চকচকে খনজর এবং দ্রুত এক লাফে কয়েক কদম পিছলে গেলো। যেয়াদ রাগে কাঁপতে কাঁপতে উঠে দুহাত প্রসারিত করে এগিয়ে গেলো ইবনে সাদেকের গলা টিপে দিতে। ইবনে সাদেক তার সামনে অনেকখানি হালকা। দ্রুত গতিতে সে চলে গেলো তার নাগালের বাইরে গোপন কক্ষের এক কোণে। যেয়াদ সেদিকে এগুলো সে গেলো আর এক কোণে। যেয়াদ চারদিক দিয়ে তাকে ধরবার চেষ্টা করলো, কিন্তু পারলো না।

যেয়াদের পা ক্রমে নিঃসাড় হয়ে এলো। যখমের রক্তধারা কাপড়-চোপড় ভিজিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জমিনের উপর। তার শক্তি নিঃশেষ হয়ে এসেছে। দুহাতে সিনা চেপে সে গড়িয়ে পড়লো যমিনের উপর। ইবনে সাদেক এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। সে যখন বুঝলো যে, যেয়াদ মরে গেছে অথবা বেহুশ হয়ে গেছে তখন সে এগিয়ে তার জেল থেকে চাবি নিয়ে দরযা খুলে বেরিয়ে গেলো।

বারমাক তখনো বাজার থেকে ফেরেনি। ইবনে সাদেক মুক্তি পেয়ে খানিকটা দৌড়ে ছুটে চললো। তারপর সে ভাবলো, শহরে কোনো বিপদ নেই তার। এবার সে নিশ্চিন্ত হয়ে চলতে লাগলো। শহরের লোকের কাছ থেকে বাইরের দুনিয়ার খবর নিয়ে সে এবার চললো রমলার পথে খলিফাঁকে তার কাহিনী শুনাতে।

ইবনে সাদেকের মুক্তির কয়েকদিন পর শোনা গেলো, খলিফা আব্দুল্লাহকে সরিয়ে দিয়েছেন সিপাহসালারের পদ থেকে এবং তাঁকে শংখলাবদ্ধ করে নেওয়া হচ্ছে রমলার দিকে। ইবনে সাদেক সম্পর্কে খবর রটলো যে, তাকে স্পেনে পাঠানো হয়েছে মুফতিয়ে আযমের পদে নিযুক্ত করে।

*

হিজরী ৯৯ সালে খলিফা সুলায়মান ফউজের নেতৃত্ব নিজের হাতে নিয়ে কস্তানতুনিয়ার উপর হামলা চালালেন, কিন্তু পূর্ণ বিজয় লাভের আগেই তিনি বিদায় নিলেন দুনিয়া থেকে। উমর বিন আবদুল আযীয খিলাফতের তখতে আসীন হলেন। উমর বিন আবুদল আযীয স্বভাব ও চালচলনে ছিলেন বনু উমিয়ার তামাম খলিফা থেকে স্বতন্ত্র। তার খিলাফত আমল ছিলো বনু উম্মিয়া খিলাফতের গৌরবদীপ্ত অধ্যায়। মযলুম মানুষের প্রতি যুলুমের প্রতিকার হলো নয়া খলিফার প্রথম কর্তব্য। যেসব বড় বড় মুজাহিদ সুলায়মান বিন আব্দুল মালিকের রোষের শিকার হয়ে কয়েদ খানার অন্ধকার কুঠরীতে দিন যাপন করছিলেন, তাঁদেরকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হলো। অত্যাচারী বিচারকদের পদচ্যুত করে তাঁদের স্বলাভিষিক্ত করা হলো নেক দীল ও ন্যায়নিষ্ঠ হাকীমদের। রমলার কয়েদখানায় বন্দী আব্দুল্লাহকে মুক্তি দিয়ে ডেকে আনা হলো দরবারে খিলাফতে।

আব্দুল্লাহ দরবারে খিলাফতে হাযির হয়ে তার মুক্তির জন্য জানালেন শোকরিয়া। আমিরুল মুমেনিন প্রশ্ন করলেন, এখন কোথায় যাবে?

‘আমিরুল মুমেনিন! বহুদিন হয় আমি ঘরে ছেড়ে এসেছি। এখন আমি ঘরেই ফিরে যেতে চাই।’

‘তোমার সম্পর্কে আমি এক হুকুম জারী করেছি।’

‘আমি খুশীর সাথে আপনার হুকুম তামিল করবো। দ্বিতীয় উমর এক টুকরা কাগজ আব্দুল্লাহর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমায় খোরাসানের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছি। তুমি একমাস ঘরে থেকে ফিরে এসে খোরাসানে পৌঁছে যাবে।’

আব্দুল্লাহ সালাম করে কয়েক কদম গিয়ে আবার থেমে দাঁড়িয়ে আমীরুল মুমেনিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

‘তুমি আরো কিছু বলবে?’ আমীরুল মুমেনিন প্রশ্ন করলেন।

‘আমীরুল মুমেনিন, আমি আমার ভাইয়ের সম্পর্কে আরয করতে চাচ্ছি। আমি তাঁকে দামেস্কের কয়েদখানা থেকে মুক্ত করবার চক্রান্ত করেছিলাম। তিনি বেকসুর। তাঁর একমাত্র কসুর, তিনি কুতায়বা বিন মুসলিম ও মুহাম্মদ বিন কাসিমের ঘনিষ্ঠ দোস্ত ছিলেন এবং দরবারে খিলাফতে হাযির হয়ে তিনি আমীরুল মুমেনিনকে কুতায়বাকে হত্যার ইরাদা থেকে বিরত করবার চেষ্টা করেছিলেন।

দ্বিতীয় উমর প্রশ্ন করলেন, তুমি নয়ীম বিন আব্দুর রহমানের কথা বলছো?

জি হাঁ, আমিরুল মুমেনিন! তিনি আমার ছোট ভাই।’

‘এখন তিনি কোথায়?

‘স্পেনে। আমি তাঁকে আবু ওবায়দের কাছে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে, আগের খলিফা ইবনে সাদেককে ওখানকার মুফতিয়ে আযম নিযুক্ত করেছেন এবং সে নয়ীমের খুনের পিয়াসী।’

আমীরুল মুমেনিন বললেন, ইবনে সাদেক সম্পর্কে আজই আমি স্পেনের ওয়ালীকে লিখে হুকুম দিচ্ছি, তার পায়ে শিকল বেধে দামেস্কে পাঠাবেন। তোমার ভাইয়ের দিকেও আমার খেয়াল থাকবে।

‘আমীরুল মুমেনিন! নয়ীমের সাথে তার এক দোস্ত রয়েছে। তিনিও আপনার সদয় দৃষ্টি লাভের যোগ্য।’

আমীরুল মুমেনিন স্পেনের ওয়ালীর কাছে চিঠি লিখলেন এবং এক সিপাহীর হাতে দিয়ে বললেন, এবার তুমি খুশী হয়েছে? তোমার ভাইকে আমি দক্ষিণ পর্তুগালের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছি এবং তার দোস্তকে ফউজের উচ্চপদে নিযুক্ত করবার সুপারিশ করেছি। ইবনে সাদেক সম্পর্কেও আমি লিখে দিয়েছি।’

আব্দুল্লাহ আদব সহকারে সালাম করে বিদায় নিলেন।

*

আলুসের ওয়ালী থাকতেন কডোভায়। তিনি দক্ষিণ পর্তুগাল থেকে যোবায়ের নামক এক নয়া সিপাহসালারের বিজয়ের খবর শুনে অত্যন্ত খুশী। তিনি আবু ওবায়েদকে চিঠি লিখলেন এবং যোবায়েরের সাথে মোলাকাত করবার ইচ্ছা জানালেন। নয়ীম কর্ডোভায় পৌঁছে আলুসের ওয়ালীর খেদমতে হাযির হলেন। ওয়ালী তাকে সাদর অভ্যর্থনা করে গ্রহণ করলেন।

ওয়ালী বললেন, আপনার মোলাকাত পেয়ে আমি খুশী হয়েছি। আবু ওবায়েদ তার চিঠিতে আপনার যথেষ্ট তারিফ করেছেন। কয়েকদিন আগে আমি খবর পেয়েছি, উত্তর এলাকার পাহাড়ী লোকেরা বিদ্রোহ করছে। আমি তাদেরকে দমন করার জন্য আপনাকে পাঠাতে চাই। কাল পর্যন্ত আপনি তৈরী হবেন।

বিদ্রোহ হয়ে থাকলে তো আমার আজই যাওয়া দরকার। বিদ্রোহের আগুন ছড়ানোর সুযোগ দেওয়া ঠিক হবে না।’

বহুত আচ্ছা। এখনি আমি সেনাবাহিনীর অধিনায়ককে ডাকাচ্ছি পরামর্শের জন্য।’

নয়ীম ও আলুসের ওয়ালী পরস্পর আলাপ আলোচনা করতে লাগলেন। এক সিপাহী এসে বললো, মুফতিয়ে আযম আপনার সাথে দেখা করতে চান।

ওয়ালী বললেন, তাঁকে তশরীফ আনতে বলো।’

আপনার সাথে হয়তো তার দেখা হয়নি। নয়ীকে লক্ষ্য করে ওয়ালী বললেন, ‘এক মাসের বেশী হয়নি তিনি এখানে এসেছেন। তাঁকে আমীরুল মুমেনিনের প্রিয়পাত্র মনে হচ্ছে। কিন্তু আমার আফসোস, এ পদের যোগ্য নন তিনি।’

তার নাম কি?

ইবনে সাদেক।’ ওয়ালী জওয়াব দিলেন।

নয়ীম চমকে উঠে বললেন, ইবনে সাদেক!

‘আপনি তাঁকে চেনেন?

এরই মধ্যে ইবনে সাদেক ভিতরে প্রবেশ করলো। তাকে দেকে নয়ীমের মনে হলো যেনো এক নতুন মুসীবৎ আসন্ন।

ইবনে সাদেকও তার পুরানো প্রতিদ্বন্দ্বীকে দেখে অন্তজ্বালা অনুভব করলো।

‘আপনি এঁকে জানেন না’? ওয়ালী বললেন ইবনে সাদেককে লক্ষ্য করে, এর নাম যোবায়ের। আমাদের ফউজের সব চাইতে বাহাদুর সালার।

‘বে-শ। বলে ইবনে সাদেক নয়ীমের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো, কিন্তু নয়ীম মোসাফেহা করলেন না।

নয়ীম ইবনে সাদেককে আমল না দিয়ে ওয়ালীকে বললেন, আপনি আমায় এযাযত দিন।’

‘একটু দেরী করুন। আমি সিপাহসালারকে হুকুমনামা লিখে দিচ্ছি। আপনার সাথে যতো ফউজের দরকার, তিনি রওয়ানা করে দেবেন। আর আপনিও তশরীফ রাখুন।’ তিনি ইবনে সাদেককে হাত দিয়ে ইশারা করে বললেন। ইবনে সাদেক তার পাশে বসলে তিনি কাগজ নিয়ে হুকুমনামা লিখে নয়ীমের হাতে দেবার জন্য হাত বাড়ালেন।

‘আমি একবার দেখতে পারি কি?’ ইবনে সাদেক বললেন।

‘খুশীর সাথে।’ বলে ওয়ালী হুকুমনামা ইবনে সাদেকের হাতে দিলেন। ইবনে সাদেক তা পড়ে ওয়ালীর হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বললো, এখন আর এ ব্যক্তির খেদমতের প্রয়োজন নেই। এর জায়গায় আর কোনো লোককে পাঠিয়ে দিন।

ওয়ালী হয়রান হয়ে প্রশ্ন করলেন, এঁর সম্পর্কে আপনার সন্দেহ হলো কি করে? উনি হচ্ছেন আমাদের ফউজের সবচাইতে যোগ্য সালার।’ .

কিন্তু আপনি জানেন না, এ লোকটি আমীরুল মুমেনিনের নিকৃষ্টতম দুশমন, আর এঁর নাম যোবায়ের নয়, নয়ীম। ইনি দামেস্কের কয়েদখানা থেকে ফেরার হয়ে এখানে তাশরীফ এনেছেন।

‘এ কথা সত্যি?’ ওয়ালী পেরেশান হয়ে প্রশ্ন করলেন।

নয়ীম নীরব রইলেন।

ইবনে সাদেক বললো, আপনি এখখুনি গেরেফতার করে আমার অদিলিতে পেশ করুন।’

আমি বিনা সাক্ষ্য প্রমাণে একজন সালারকে গ্রেফতার করতে পারি না। প্রথম মোলাকাতেই আপনারা পরস্পরের সাথে এমন আচরণ করেছেন, যাতে মনে হচ্ছে যে, আপনাদের মধ্যে রয়েছে পুরানো বিদ্বেষ এবং এ অবস্থায় ইনি অপরাধী হলেও এর ভাগ্য নির্ধারণের ভার আমি আপনার উপর সোপার্দ করবো না।

‘আপনার জানা উচিত যে,আপনি স্পেনের মুফতিয়ে আযমের সাথে কথা বলছেন।’

‘আর আপনার জানা উচিত ছিলো যে, আমি স্পেনের শাসনকর্তা।’

“ঠিক, কিন্তু আপনি জানেন না যে, আমি স্পেনের মুফতিয়ে আযমের চাইতে বেশী আরো কিছু।

নয়ীম বললেন, ‘উনি জানেন না। আমি বলে দিচ্ছি। আপনি আমীরুল মুমেনিনের দোস্ত এবং কুতায়বা বিন মুসলিম, মুহাম্মদ বিন কাসিম ও ইবনে আমেরের হত্যাকারী, তুর্কিস্তানের বিদ্রোহের মূলে ছিলো আপনার অনুগ্রহ। আর আপনি সেই নির্মম নিষ্ঠুর লোকটি, যিনি আপন ভাই ও ভাতিজীকে কতল করতে দ্বিধা করেননি। এখন আপনি আমার কাছে অপরাধী। নয়ীম বিজলী চমকের মতো কোষ থেকে তলোয়ার বের করলেন এবং তার অগ্রভাগ ইবনে সাদেকের সিনার উপর রেখে বললেন, ‘আমি বহুত খুঁজেছি তোমায়, কিন্তু পাইনি। আজ কুদরৎ তোমায় এনেছেন এখানে। আমীরুল মুমেনিনের দোস্ত তুমি। তোমার পরিণাম তাঁর খুবই মর্মবেদনার কারণ হবে, কিন্তু আমার কাছে ইসলামের ভবিষ্যৎ খলিফার খুশীর চাইতে অধিকতর প্রিয়।

নয়ীম তলোয়ার উঁচু করলেন। ইবনে সাদেক কাঁপতে লাগলো বেতসের মতো। মৃত্যুকে মাথার উপর দেখে সে চোখ বন্ধ করলো। নয়ীম তার অবস্থা দেখে তলোয়ার নীচু করে কললেন, ‘না, তা হয় না। এ তলোয়ার দিয়ে আমি দিয়ে আমি সিন্ধু ও তুর্কিস্থানের ময়দানে কতো উদ্ধত শাহযাদার গর্দান উড়িয়ে দিয়েছি। তোমার মতো নীচু ভীরু বুদীলের খুনে আমি তলোয়ার রঞ্জিত করবো না কোষবদ্ধ করলেন। কামরায় ছেয়ে গেলো এক গভীর নিস্তব্ধতা।

এক ফউজী অফিসার এসে ভাঙলেন কামরার নিস্তব্ধতা। তিনি এসেই একটা চিঠি দিলেন আন্দলুসের ওয়ালীর হাতে। ওয়ালী চিঠিখানা বিস্ফারিত চোখে দুতিনবার পড়ে নয়ীমের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যদি আপনার নাম যোবায়ের না হয়ে নয়ীম হয়ে থাকে, তাহলে আপনার জন্যও খবর আছে এ চিঠিতে।’ বলতে বলতে তিনি চিঠিখানা বাড়িয়ে দিলেন নয়ীমের দিকে। নয়ীম চিঠি নিয়ে পড়তে শুরু করলেন। আমীরুল মুমেনিন উমর বিন আব্দুল আযীযের তরফ থেকে চিঠি।

আন্দালুসের ওয়ালী তালি বাজালেন। অমনি কয়েকজন সিপাহী এসে দেখা দিলো।

‘ওকে গ্রেফতার করো।’ ইবনে সাদেকের দিকে ইশারা করে তিনি বললেন।

ইবনে সাদেকের ধারণাই হয়নি যে, তার তকদীরের সিতারা উদয়ের সাথে সাথেই ঢেকে যাবে এমনি কালো মেঘে।

একদিকে নয়ীম দক্ষিণ পর্তুগালের দিকে চলে যাচ্ছেন শাসনকর্তার পদ গ্রহণের জন্য, অপর দিকে কয়েকজন সিপাহী ইবনে সাদেকের শিকলে বেঁধে নিয়ে যাচ্ছে দামেস্কের পথে। কয়েকদিন পর নয়ীম জানালেন যে, ইবনে সাদেক দামেস্ক পৌঁছবার আগেই পথে বিষ খেয়ে তার যিন্দেগী শেষ করে দিয়েছে।

আব্দুল্লাহকে চিঠি লিখে নয়ীম ঘরের খবর জানবার চেষ্টা করলেন। বহুদিন সে চিঠির জওয়াব মিললো না। নয়ীম ইনতেহার করতে করতে অধীর হয়ে তিন মাসের ছুটি নিয়ে গেলেন বসরার দিকে। নার্গিস তখনো তার সাথে। তাই সফরে বিলম্ব হলো। ঘরে পৌঁছে তিনি জানলেন, আব্দুল্লাহ খোরাসানে চলে গেছেন। উযরাকেও নিয়ে গেছেন সাথে। নয়ীম খোরাসান যেতে চাইলেন, কিন্তু স্পেনের উত্তর দিকে ইসলামী ফউজের অগ্রগতির কারণে তিনি নিজের ইরাদা মুলতবী রেখে ফিরে গেলেন নিরুপায় হয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *