প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র

রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র

রাষ্ট্র, সমাজ আর ছাত্র–এদের কোনটাই বিচ্ছিন্ন ও সম্পর্ক-রহিত নয়। মানুষের সমস্ত জীবনটাই এখন এত জটিলসূত্রে জড়িয়ে গেছে যে, ছাত্র-অছাত্র কারো অব্যাহতি নেই তার হাত থেকে। বৃহত্তর জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত কোন কিছুকেই বিচ্ছিন্ন করে দেখা বা সে সম্বন্ধে নির্লিপ্ত থাকা আজ কারো পক্ষে সম্ভব নয়।

কালের সঙ্গে সঙ্গে সব কিছুই বদলে যাচ্ছে, জীবন আর জীবনের সমস্যারও রূপ বদল ঘটছে প্রতি মুহূর্তে। এ কালস্রোতকে উপলব্ধির ওপরই নির্ভর করে জীবন আর জীবনের সমস্যারও সমাধান। যখন তপোবন কিংবা তপস্বী মানুষের স্মৃতিতেও অনুপস্থিত তখন অধ্যয়নং তপঃ কথাটা স্রেফ আত্মপ্রবঞ্চনারই নামান্তর। ছাত্ররাও সমাজের অঙ্গ, সমাজের উৎপন্ন; সমাজের সার্বিক অবস্থা আর পরিবেশ এড়িয়ে যাওয়া অন্যের মতো তাদেরও সাধ্যাতীত। যেমন সাধ্যাতীত গা না ভিজিয়ে সাঁতার কাটা। কেউ ইচ্ছে করে উটপাখি সাজতে চাইলেও সাজা সম্ভব নয় আজ কিছুতেই। 

এখন সমাজের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি হয়েছে ক্ষমতা আর দাপটের দৃষ্টিভঙ্গি। ক্ষমতার দর্শনই আজ জাতির সামনে একমাত্র দর্শন–শাসকরা এ দর্শনের এক একজন পির মুরশিদ! ছাত্র-জীবনে তারা কেউই অধ্যয়নকে তপস্যা করে নিয়েছিলেন তার কোন প্রমাণ নেই বরং বিপরীতটাই শোনা যায়। তারা কেউই আমাদের এ পবিত্রভূমিতে আসমান থেকে নাজেল হন নি বা আসেন নি কোন অজ্ঞাত দেশ থেকে। তাদের অতীত ইতিহাস আমাদের অনেকেরই দেখা ও জানা আছে, তবে বলার সাহস নেই। তাদের সম্বন্ধে ভক্তি-ভালোবাসা না থাকলেও ভয়টা সবারই পুরোপুরি আছে। নিজের মাথাটার নিরাপত্তা রক্ষা করে চলাও এক রকম জীব-ধর্ম। তাই অন্যায়-অবিচারের সামনেও আমরা ভয়ে চুপ করে থাকি–এভাবে দিন দিনই আমরা হারিয়ে ফেলছি সত্য বলার সাহস!

এ অবস্থা যদি কোন শাসকগোষ্ঠীর পক্ষে গৌরবের হয়, আমাদের বর্তমান শাসকেরা নিঃসন্দেহে এ গৌরব দাবি করতে পারে। 

তবে এ কথাও সত্য যে, ভয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত শাসন একদিন নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে আনে। দেখা গেছে, ভয় আর আতঙ্ক সব সময় এমন একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্ম দিয়ে থাকে যে, তা কখনো শাসক আর শাসিতের পক্ষে শুভ হয় না। এ প্রসঙ্গে একজন জ্ঞানী ব্যক্তির কথা স্মরণ করা যেতে পারে : ‘A state founded upon interest and cemented by fear is an ignoble and unsafe construction.’ (Amiel’s Journal, p. 178) 

Amiel যে-স্বার্থের কথা বলছেন তার পরিচয় পাওয়া যেত ক্ষমতাসীন আর তাঁদের সন্তানসন্ততিরা, ক্ষমতায় আসার আগে কতখানি সম্পত্তির অধিকারী ছিলেন আর এখন তাঁদের ধনসম্পদের পরিমাণ কত তার একটা তুলনামূলক পরিসংখ্যান পাওয়া গেলে। কিন্তু তা পাওয়ার উপায় নেই। কেউ পেতে চাইলে, সূত্র জানতে চাওয়ার অপরাধে তার কপালে জুটবে বহু দুর্ভোগ! স্রেফ স্বার্থ আর ভয়ের দ্বারা তালি-দেওয়া রাষ্ট্রের অবস্থা যে তালি-দেওয়া জামা কাপড়ের চেয়ে কিছুমাত্র মজবুত নয়, অবাধ ক্ষমতার মাথায় এ সহজ সত্যটা কিছুতেই ঢুকছে না। শোনা ছিল, যুদ্ধের সময় সর্বাগ্রে সত্যই শহীদ হয়ে থাকে, এখন দেখছি আমাদের রাষ্ট্রে পুরোপুরি শান্তির সময় সত্য প্রতিদিন অত্যন্ত নির্মমভাবে কতল হচ্ছে। 

আমাদের ছাত্র-সমাজ প্রতিনিয়ত এ দৃশ্য চোখের সামনে দেখছে আর এর মধ্যেই কাটছে তাদের জীবনের শ্রেষ্ঠ কাল। এর অশুভ প্রভাব তারা এড়াবে কী করে? কোনো কোনো ছাত্র প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-রাজনীতির দিকে তাকালে এর সত্যতা সহজেই বুঝতে পারা যায়। 

ক্ষমতার নিজস্ব একটা দুর্বলতা আছে, তাই ক্ষমতাসীনদের যেমন জনগণ কিছুটা ভয়ের চোখে দেখে তেমনি জনগণ সম্পর্কেও তাদের মনে বেশ বড় রকমের আতঙ্ক রয়েছে। এ কারণে অনেক সময় তারা তাদের কথা আর আচরণে ভারসাম্য হারিয়ে বসেন। ক্ষমতার কাছে ক্ষমতা হারানোর চেয়ে বড় আতঙ্ক আর কিছু হতে পারে না–এ আতঙ্কটাই তাদের মুখে বিরোধী দলের প্রতি নির্বিচার নিন্দা আর ভর্ৎসনা হয়ে প্রকাশ পায়। তাদের কথা শুনলে মনে হয়, ক্ষমতা স্রেফ তাদের জন্যেই হালাল, সুপথ্য আর স্বাস্থ্যপ্রদ; আর বিরোধী দলের জন্য তা বিলকুল হারাম, কুপৃথ্য আর অস্বাস্থ্যকর! 

অতীতে সৎ লোকেরা অন্যকে চিনি খেতে বারণ করার আগে নিজেরা চিনি খাওয়া ছেড়ে দিতেন। আমাদের বুজর্গদের ব্যবহার কিন্তু সম্পূর্ণ অন্য রকম। তারা নিজেরা মুঠোয় মুঠোয় চিনি দেশশুদ্ধ ছেলে-বুড়ো সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে খাচ্ছেন আর উপদেশ দেওয়ার বেলায় বলছেন–তোমরা চিনির লোভ করো না, চিনি খেয়ো না, খেলে ক্রিমি হয়, অসুখ করে, তখন দেশটাই গোল্লায় যাবে ইত্যাদি! তাঁরা নিজেরা গাছের মগ ডালে চড়ে পাকা পাকা ফল ডান হাতে বাঁ হাতে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছেন–যে-গাছ রোপণে তাঁদের অনেকেরই কোনো হাত ছিল না। আর আজ তারা অন্যদের ধমকাচ্ছেন–খবরদার গাছে চড়ো না, চড়লে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙবে আর তখন দেশটাই হয়ে যাবে খণ্ড খণ্ড। ক্ষমতার যুক্তি এমনি অদ্ভুত, গল্পের নেকড়ে বাঘের যুক্তিকেও তা হার মানায়।

আমি অন্য এক প্রবন্ধে বলেছি গণতন্ত্র দুই-পা-বিশিষ্ট জীব–এর এক পা সরকার অন্য পা বিরোধী দল। এর এক পা খোঁড়া বা পঙ্গু হলে বা রাখা হলে পঙ্গু করে, তখন সমস্ত রাষ্ট্র-জীবনটাই খোঁড়া না হয়ে পারে না। এখন দেশে সত্য অর্থে কোনো রাজনৈতিক জীবন নেই, সুস্থ স্বাধীন ও সহিষ্ণু রাজনীতি থাকলে, এখনকার ছাত্রদের মধ্য থেকেই সার্থক ও যোগ্য রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক নেতার আবির্ভাব সম্ভব হতো। এখন রাজনীতি একদিকে খোশামোদ-তোষামোদ অন্যদিকে ভয়-ভীতি আর দমনের বস্তু হয়ে উঠেছে। এ অবস্থায় সুস্থ আর স্বাধীন রাজনীতি আশা করা যায় না। বিরোধী দল ছাড়া গণতান্ত্রিক রাজনীতি চলে না, চলতে পারে না, অথচ আমাদের সরকারি মুখপাত্রদের কাছে বিরোধী দল যেন ষাড়ের সামনে লাল শালু। আধুনিক গণতন্ত্রের জন্মভূমি ইংল্যান্ডে সরকারকে যেমন বলা হয় হিজ বা হার ম্যাজেস্টিস গভর্নমেন্ট তেমনি বিরোধী দলকেও বলা হয় হিজ বা হার ম্যাজেস্টিস অপজিশন। বিরোধী দলের প্রতি এ সসম্মান স্বীকৃতির উপর গণতন্ত্র আর গণতান্ত্রিক রাজনীতির সাফল্য পুরোপুরি নির্ভর করে। এ গণতান্ত্রিক চেতনার অভাবের ফলেই আমাদের দেশে রাজনীতিতে গালাগালি, ধমকানি, হুঁশিয়ারি ইত্যাদির আমদানি আর সেই সঙ্গে বিরোধী দলের মুখপত্র বন্ধ করে দেওয়া আর তার কর্মীদের বিনা বিচারে আটক রাখা।

নিষ্ঠাবান রাজনৈতিক কর্মী আর স্বাধীন সংবাদপত্র ছাড়া সুস্থ রাজনৈতিক পরিবেশ কিছুতেই গড়ে উঠতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা আজ প্রায়। এক বছর ধরে বন্ধ। অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে সরকারি বিজ্ঞাপনের ওপর নির্ভর না করে সংবাদপত্র শিল্পের টিকে থাকা এক রকম অসম্ভব বললেই চলে। এখন বিজ্ঞাপন যেভাবে ও যে-শর্তে বিতরিত হয় তাতে কোন স্বাধীন সংবাদপত্রের পক্ষেই অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব নয় আদৌ। ‘সরকার সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী আর সে সম্বন্ধে পুরোপুরি সচেতন’–বিভিন্ন সময় সরকারি মুখপাত্ররা এ ধরনের কথা যে বলে থাকেন তার সঙ্গে বাস্তব ঘটনার এতটুকু সম্পর্কও নেই। তারা যদি কিছুমাত্র আন্তরিক হতেন তাহলে একটা প্রেস বাজেয়াপ্ত করে এক সঙ্গে তিন তিনটা কাগজ বন্ধ করে দিতেন না আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই নতুন নির্দেশ জারি করে আইনের। হুকুমকে নস্যাৎ করে দিতে বোধ করতেন সংকোচ। 

আইন তো জড়বস্তু–তার কার্যকারিতা সম্পূর্ণ নির্ভর করে প্রয়োগকর্তার ওপর। তার যদি আইনের প্রতি আনুগত্য না থাকে তাহলে ইচ্ছামতো তিনি আইনকে দোমড়াতে মোচড়াতে পারেন, এমন কি করে দিতে পারেন সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয়। অবাধ ক্ষমতার এও এক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। ফলে আইনের শাসন বলতে যা বোঝায় তা আজ এক চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ বিপর্যয় যে কোথায় পৌঁছেছে তার নজির সন্ধানের জন্য দূরে যেতে হয় না। আমাদের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে গত কয় বছরে যেসব ঘটনা ঘটেছে আইন সেখানে যেভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে, ছাত্র আর অধ্যাপকদের বিরুদ্ধে মামলা করে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় যত অর্থ ব্যয় করেছে যার কোন তুলনা নেই, কারো কারো মতে ওটা নাকি world record! এসব দেখে শুনে রীতিমতো শঙ্কিত হতে হয় দেশের ভবিষ্যৎ ভেবে। 

সভ্য মানুষ আর সভ্য সমাজের একমাত্র আশ্রয় তো দেশের আইন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সে আইনের আশ্রয় নিতে গিয়ে একজন যোগ্য ও সম্মানিত অধ্যাপক কীভাবে নাজেহাল হয়েছেন সে করুণ ও দুঃসহ সংবাদ অনেকেরই জানা আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রাবাস আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বার বারে আক্রান্ত হয়েছে। দুঃখের বিষয়, দেশের আইন এসব ব্যাপারে নিজের অস্তিত্বের পরিচয় দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। বরং শোনা যায়, আক্রমণকারীদের পরিবর্তে আক্রান্তদের বিরুদ্ধেই নাকি হয়েছে আইনের প্রয়োগ। আইন যদি এভাবে উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার কৌশলে পরিণত হয় তাহলে সমাজ কোথায় দাঁড়াবে, মজলুম প্রতিকারের আশায় কার মুখের দিকে চাইবে? 

সেদিন মনস্তত্ত্ব সম্মেলনে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী জিজ্ঞাসা করেছেন, দেশের তরুণরা এমন সিনিক হয়ে পড়েছে কেন?’ সমাজের সার্বিক অবস্থার দিকে তাকিয়ে দেখলে তিনি তার এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেন। রাষ্ট্রীয় ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে, শিক্ষায়তন আর বিচারালয়গুলিতে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে মূল্যবোধের যে চরম অবনতি ও দুরবস্থা। তরুণরা, বিশেষ করে সচেতন ছাত্র সমাজ, প্রতিনিয়ত দেখতে পাচ্ছে তাতে সিনিক না হয়ে উপায় কী? এসবের প্রভাব তারা এড়াবে কী করে? সমাজের কোথাও সততা, আন্তরিকতা, মহৎ চিন্তা-ভাবনা বা ন্যায়বিচারের ক্ষীণ রেখাও তারা দেখতে পাচ্ছে কি যা দেখে ছাত্র-সমাজ প্রেরণা পাবে, উৎসাহ বোধ করবে কিংবা আশান্বিত হয়ে উঠবে? Amiel Slug 261694, ‘Society rests upon conscience not upon science. Civilization is first and foremost a moral thing’. (Amiel’s Journal, p. 177) বিবেকের চর্চা আর অনুশীলন কি সমাজে কোথাও আছে এখন, না তার কোন মূল্য দিয়ে থাকে সমাজ ও রাষ্ট্র? বিবেকী মানুষের আজ কোনো স্থান নেই সমাজে আর তেমন। মানুষকে রাষ্ট্র মনে করে তার শত্রু। সরকার চায় Yesman, হা-হুজুর, অথবা ভয়ে কাবু হয়ে থাকা নিবীর্য মানুষ। বিবেকের সাথে আইনের শাসন চালাতে গিয়ে কোনো কোনো সুদক্ষ বিচারপতিকে যে সরকারের বিরাগভাজন হতে হয়েছে, এমন কি পরিণামে পদত্যাগ করতে হয়েছে সে খবরও কারো অজানা নয়। 

গ্রিসকে বলা হয় আধুনিক সভ্যতার সূতিকা গৃহ–সে গ্রিসের অধিবাসীদের সম্বন্ধে হেরোডোটাসের মন্তব্য হচ্ছে, ‘They obey only the law.’ শুধু গ্রিসের নয়, সব সভ্যতারই বুনিয়াদ আইন। আর আইনের প্রতি শাসক আর শাসিতের সার্বিক আনুগত্য। সে আইনের লাঞ্ছনা এখন প্রতিনিয়তই ঘটছে আমাদের দেশে। সভ্য জীবনের প্রথম কারিগর শিক্ষক আর শিক্ষাবিদের যেমন আজ কোন সামাজিক সম্মান ও মর্যাদা নেই, তেমনি সম্মান আর মর্যাদা নেই বিচারক আর বিচারপতিদেরও। শুনেছি মুসলিম শাসনের আমলে বাদশাহের পাশেই থাকতো কাজীউল-কুজ্জাতের আসন। আমাদের বর্তমান। রাষ্ট্রকে ইসলামি তথা মুসলিম রাষ্ট্র বলা হয় তবু এ ইসলামি ঐতিহ্য আজ এখানে। সর্বতোভাবে উপেক্ষিত। এ রাষ্ট্রে এক মহিলার রাজনৈতিক মতামতের জন্য তাঁর স্বামীকে চাকুরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে এক খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল কিছুকাল আগে। ইসলামে স্বামী-স্ত্রীর স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, স্বতন্ত্র পেশা, বৃত্তি ও জীবনযাপন স্বীকৃত! শুধু রাজনৈতিক মতামত নয়, স্বামী-স্ত্রীর ভিন্নতর ধর্মমত পোষণেও ইসলামে আপত্তি নেই। ইসলামি বিয়ের শ্রেষ্ঠত্ব আর স্বাভাবিকতু হচ্ছে এ বিয়ে নর-নারীকে সমান। মানবিক মর্যাদা দিয়ে থাকে। এ বিয়ে স্বামীকে স্ত্রীর আর স্ত্রীকে স্বামীর দাস-দাসীতে পরিণত করে না। আমার বিশ্বাস, স্বামীর ধর্মীয় পাপের জন্য স্ত্রীকে আর স্ত্রীর ধর্মীয় পাপের জন্য স্বামীকে দোজখে পাঠাবার বিধান ইসলামে নেই। স্ত্রীর রাজনৈতিক মতামতের জন্যে স্বামীকেও দণ্ড দেওয়ার বিধান ইসলামি আইনে আছে কিনা সে কথা আমাদের ইসলামি উপদেষ্টা কমিটির সদস্যরাই বলতে পারবেন ভালো। 

চোখ কান মন খোলা রেখে চারদিকে তাকিয়ে দেখলে এমন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাবার বহু দৃষ্টান্তই দেখতে পাওয়া যাবে। আমাদের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বিভাগীয় অধ্যক্ষের পদ খালি হয়েছিল। পরবর্তী নিম্নতর পদের অধিকারী হিসেবে যিনি ঐ শূন্যপদে কাজ করার হকদার তার সঙ্গে কী ব্যাপারে যেন কর্তৃপক্ষের মন কষাকষি ছিল। তাই স্রেফ তাকে জব্দ করার মতলবে অন্য বিভাগের এক অধ্যক্ষকে এনে অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে এ বিভাগেরও ভার তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। এতে কর্তৃপক্ষের প্রতিহিংসা-বৃত্তি চরিতার্থ হলো বটে কিন্তু মানুষের সাধারণ বুদ্ধি বলে, এ ব্যবস্থায় দুই বিভাগের কোন বিভাগই পুরোপুরি যোগ্যতার সাথে পরিচালিত হতে পারে না। কথায় বলে–রাজায় রাজায় যুদ্ধ করে উলুখড় প্রাণে মরে। এ দুই বিভাগের ছাত্ররাই সেই উলুখড়। প্রতিদিন ক্ষতি যা হওয়ার তাদেরই হচ্ছে বা হয়েছে। অবাধ ক্ষমতা অনেক সময় এ ভাবে নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গ করতে পেছপাও হয় না। ছাত্ররা আমাদের সমাজের সবচেয়ে সচেতন অংশ। এসব ঘটনা আর দৃশ্য তাদের মনের ওপর কোনো প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার করে না–একথা ভাবতে হলে মানব-বুদ্ধিকে অস্বীকার করতে হয়। 

যে ভয় ও আতঙ্কের কথা সূচনায় উল্লেখ করেছি তা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, তার অশুভ থাবা প্রদেশের শিক্ষায়তনগুলিতেও হয়েছে সম্প্রসারিত। Academic freedom তথা জ্ঞানগত স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা আজ সর্বত্র অনুপস্থিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরাও এখন আর স্বাধীনভাবে চিন্তার চর্চা করেন না, করলেও প্রকাশ করতে সাহস পান না। এ অবস্থায় দেশে চিন্তাবিদের আর সত্যিকার সংস্কৃতিসেবীর আবির্ভাব সুদূর কল্পনার বাইরে। আমরা প্রায় চল্লিশ বছর আগে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম তখন ঐ বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে বুদ্ধির মুক্তি নামে একটি আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, আর তাতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় আর চারপাশের কলেজ আর স্কুলের অধ্যাপক আর শিক্ষকবৃন্দ। আজ কি তেমন কথা ভাবা যায়? নবতর চিন্তার ক্ষেত্রে, যে চিন্তার সঙ্গে ধর্ম, সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতি ইত্যাদির সম্পর্ক রয়েছে তাতে অংশগ্রহণ কিংবা নেতৃত্বদানের কথা বললে অধিকাংশ অধ্যাপক এখন রীতিমতো আঁতকে ওঠেন। অথচ স্বাধীন চিন্তা আর স্বাধীন চিন্তার প্রকাশ ছাড়া কোনো সমাজ, কোনো রাষ্ট্র এবং কোনো সভ্যতাই সামনের দিকে এগুতে পারে না। গ্রিক, রোম আর আরব-সভ্যতার যুগে যাদেরকে ‘স্বাধীন নাগরিক’ বলা হতো, এ অবস্থা আরো কিছুকাল চললে, তেমন স্বাধীন নাগরিক আমাদের দেশে দুর্লভ হয়ে পড়বে। গ্রিক কবি ইউরিপিডিস গোলাম বা দাসের সংজ্ঞা দিয়েছেন এই বলে, ‘A slave is he who cannot speak his thougt.’ 

আমার আশঙ্কা, দোতলা, চৌতলা কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাড়ি, গাড়ি বা টেলিভিশন ইত্যাদি যাবতীয় আধুনিক সুখ-সম্পদের মালিক হয়েও আমরা দিন দিন মনের দিক দিয়ে দাসে পরিণত হচ্ছি। বলা বাহুল্য, স্বাধীন মনই সব সভ্যতার বাহন আর সবরকম সাংস্কৃতিক উপকরণের নির্মাতা। সে স্বাধীন মনের অধিকার হারানো মানে মনের দিক দিয়ে গোলাম হয়ে যাওয়া। এ দেশে সংস্কৃতিসেবীরা আজ এ দুর্দিনের সম্মুখীন। আরবিতে একটি প্রবাদ আছে, মাছ যখন পচতে আরম্ভ করে পচনটা শুরু হয় মাথা থেকেই। দেশের শাসক-প্রশাসক, উচ্চতম শিক্ষায়তনগুলির কর্মকর্তা, অধ্যাপক, অধ্যক্ষ, আইনজীবী, ডাক্তার, সমাজনেতা, আইন পরিষদের নির্বাচিত সদস্য ইত্যাদিকে নিয়েই তো সমাজের মাথা–এ মাথা যদি সুস্থ না থাকে, এখানে যদি পচন শুরু হয়, তাহলে মাছের মতো এ পচনও কি সমাজের সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়বে না? এ পচনের মুখে নৈতিক চেতনা, সব রকম মূল্যবোধ ও সুরুচি, যা নিয়ে সভ্যতার ভিত রচিত হয় তা আজ দেশ-ছাড়া হওয়ার উপক্রম। এ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের ছাত্র আর তরুণদের কি আশাবাদী হওয়া সম্ভব? 

[‘রাষ্ট্র : সমাজ আর ছাত্র’ প্রবন্ধটি প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *