প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি 

ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি 

এক

রাষ্ট্র থাকলে রাজনীতিও থাকবে এ বিষয়ে দ্বিমত নেই। কিন্তু ছাত্রজীবন শিক্ষানবিশির জীবন, ভবিষ্যৎ জীবনের প্রস্তুতি আর দেহ-মন ও চরিত্র গড়ে ওঠার কাল। রাজনীতি এসবের অন্তরায়। তাই ছাত্ররা কোন রকম প্রত্যক্ষ রাজীনতিতে অংশ নিক, এ আমি চাই না–এর বিরুদ্ধে বার বার আমি আওয়াজ তুলেছি। ছাত্র আর অছাত্র কেউই আমার কথায় কর্ণপাত করে নি। রাজনীতির আগে ছাত্র শব্দ যোগ করলেই রাজনীতির চরিত্র বদলে যায় না। আমাদের দেশে যে রাজনীতি, বিশেষ করে আজাদির পর গড়ে উঠেছে, মোড় নিয়েছে আর রূপ নিয়েছে ও নিচ্ছে তার অনিবার্য পরিণতি দলাদলি, হিংসা-বিদ্বেষ চরম অসহিষ্ণুতা, আর বিপক্ষের বা ভিন্ন দলের সম্মানুষকেও নিজের শুধু নয় দেশেরও শত্রু মনে করা। এসব কিশোর মনের জন্য, বেড়ে ওঠা চরিত্রের জন্য বিষের চেয়েও মারাত্মক। শিক্ষক আর একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে এ বিষক্রিয়া আমি দেখেছি। তাই ছাত্র রাজীনতির আমি ঘোর-বিরোধী। তবে যে কোন ছাত্রদল যখন আমাকে কিছু বলার জন্য আহ্বান করে তখন আমি তাদের ডাকে সাগ্রহে এ কারণে সাড়া দিয়ে থাকি যে, ওখানে গিয়ে বৃহত্তর ছাত্রসমাজকে কিছু ভালো কথা বলার সুযোগ হয়তো আমি পাবো। আমি যে-মঞ্চ থেকেই কথা বলি না কেন কারো মুখপাত্র হয়ে কথা বলি নি আজ পর্যন্ত। সব সময় আমার নিজের বক্তব্যই আমি বলেছি। ছাত্রদের বহু অপ্রিয় কথা আমি ছাত্রদের সভায় দাঁড়িয়ে তাদের সামনে বলতেও দ্বিধা করি নি। আমার বক্তব্যে আর আমার ভাষায় আমার বিশ্বাস আমার মতামতই প্রকাশিত হয়েছে। যাদের আহ্বানে আমি সভায় গিয়েছি তাদের মতামত তাতে কখনো প্রতিফলিত হয় নি। তিন চার বছর আগে এক ছাত্রসভায় ছাত্রদের সামনে পাঁচটি ‘না’ নীতিমালা আমি তুলে ধরেছিলাম। ছাত্র আর অছাত্র উভয়ের সামনে সেগুলি আবারও এখানে উদ্ধৃত করছি : 

১. তোমাদের স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় বাইরের রাজনীতিকে ঢুকতে দিও না।

২. জেলা কিংবা এলাকা প্রীতিকে দিও না প্রশ্রয়।

৩. প্রশ্ন কঠিন হয়েছে কিংবা পরীক্ষা পেছানোর দাবিতে ধর্মঘট করে বসো না। কারণ এসব ছাত্রজীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ, এতে তোমাদের ক্ষতি হয় সব চেয়ে বেশি।

৪. নৈতিক কারণে ছাড়া শিক্ষকের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ো না।

৫. কোন ব্যাপারেই করো না বাড়াবাড়ি। পরিমিতিবোধ আত্মমর্যাদার লক্ষণ। ছাত্র সমাজের প্রতি এ পাঁচটি অনুরোধ আমার রইল। 

(দেশ ও দেশের ছাত্র সমাজ : সমাজ সাহিত্য : রাষ্ট্র, পৃ. ২৯৫) 

এ অনুরোধগুলির প্রতি বিশেষ করে প্রথমটির প্রতি আবারও নতুন করে আমার কণ্ঠের সমস্ত জোর দিয়ে ছাত্র, শিক্ষক, অভিভাবক আর শিক্ষানুরাগীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। 

দুই

এখন রাষ্ট্র সব ক্ষমতার মালিক আর সব ক্ষমতার উৎস। এ ক্ষমতা পরিচালিত হয়। প্রশাসকদের হাত দিয়ে। প্রশাসনকে যন্ত্র বলা হলেও তা কিন্তু যান্ত্রিক নয়, তার পেছনে রয়েছে মানুষ। তারাই চালান আর নিয়ন্ত্রণ করেন ক্ষমতা। এ মানুষ যদি ন্যায়নিষ্ঠ আর নিরপেক্ষ না হন, দলমত-নির্বিশেষে সকলের প্রতি তারা যদি সমদৃষ্টিসম্পন্ন আর সম দায়িত্বশীল না হন তাহলে অরাজকতা অবশ্যম্ভাবী। আর অরাজকতার শিকার কখনো এক পক্ষ হয় না। ইতিহাস তা বলে। ছোরাছুরির ধর্মই বুমেরাং হওয়া। অবাধ ক্ষমতা যাদের হাতে থাকে অনেক সময় এ সত্যটা তারা বুঝতে পারেন না, বুঝতে চান না। আজকের দিনই একমাত্র দিন নয়, তার পরও মাস আছে, বছর আছে, যুগ আছে; বুমেরাং হওয়ার অনন্ত অবসর কালের হাতে। ক্ষমতা জিনিসটা চিরকালই অন্ধ ও হ্রস্বদৃষ্টি–-পরিণতি বুঝতে চায় না আদৌ। 

অন্ধ ক্ষমতা আজ ছাত্র রাজনীতির এক অংশকে নাকি প্রশ্রয় দিচ্ছে, প্রশ্রয় দিয়ে বেপরোয়া করে তুলেছে ওদের। এ প্রশ্রয়ের ফলে আজ ছাত্রদের হাতে দেখা দিয়েছে। ছোরাছুরি, লোহার ডাণ্ডা আর হকি স্টিক। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ অধ্যাপককে লাঠি-পেটা করা হয়েছে, বিভিন্ন হল আক্রান্ত। মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার আর নার্সরা পর্যন্ত আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পান নি। বিভিন্ন স্থানে বহু ছাত্র আহত হয়েছে। এ সব ব্যাপারে দেশের প্রশাসনযন্ত্র যথাযথভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে শোনা যায় নি। সরকার-সমর্থক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সম্মানিত বিভাগীয় অধ্যক্ষ একবার অত্যন্ত বেদনার সাথে আমাকে বলেছিলেন, ‘যেদিন ছাত্ররা ডক্টর মাহমুদের ওপর লাঠি তুলেছে সেদিনই আমাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির ভরাডুবি হয়েছে।’ তিনি এও বলেছিলেন, ‘জীবিকার খাতিরে আমি ওখানে আজ চাকরি করছি বটে কিন্তু আমার ছেলেমেয়েকে কখনো ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি ভর্তি করাবো না।’ আমার বিশ্বাস, ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ অধ্যাপকের আজ এই মনোভাব। এ যেন তাদের জন্য দিনগত পাপক্ষয়। 

অন্যায় বা পাপকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করে প্রশ্রয় দিলে তা সহস্রফণা হয়ে দেখা দেয়। এ ফণার দংশনেই সেদিন অকালে এক তরুণ জীবনের অবসান হল। এ শোচনীয়তম ট্র্যাজিক ঘটনার কার্যকারণ আর তার অঙ্কুর কখন কীভাবে বপন করা হয়েছে, কর্তৃপক্ষ তা অনুধাবন করে দেখবেন কিনা জানি না। সমস্ত ঘটনা-পরম্পরা মানস-চক্ষে নিরীক্ষণ করে সূচনা থেকে এসবে পরোক্ষভাবে তাদের কোন দায়িত্ব আছে কিনা, থাকলে সে দায়িত্ব তারা পুরোপুরি পালন করেছেন কিনা, সরকার আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তা বিবেচনা করে দেখলে ভবিষ্যতের জন্য ফল ভালই হতো। তাদের মনোভাব আর দৃষ্টিভঙ্গিতে যদি ভুল ধরা পড়ে, আমাদের শিক্ষাজীবন আর সভ্যতার খাতিরে তা সংশোধিত হওয়া উচিত। সংশোধনে কিংবা ভুল স্বীকারে কিছুমাত্র লজ্জা নেই। বিশেষত, যেখানে গোটা সমাজ আর জাতির স্বার্থ বিপন্ন। এ দল আর ও দল জাতি নয়, সব দল মিলেই জাতি। সে জাতির স্বার্থ রক্ষা করতে হবে নির্ভীক আর নিরপেক্ষ হাতে। নিরপেক্ষতাই সবচেয়ে বড় কথা। সব মূল্যের বিনিময়ে হলেও এ নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হয়। সরকার বা প্রশাসকরা কোন দলের নয়। দলের হতে গেলেই দেশের সর্বনাশ। এখন সে সর্বনাশের আলামত ক্ষেত্র বিশেষে দেখা যাচ্ছে বলেই আমাদের আশঙ্কা।

নির্বাচনের আগে মানুষ দুলের থাকে–পরে শাসনকর্তত্ব যারা লাভ করেন তারা আর দলের থাকেন না, থাকা উচিত নয়। তারা তখন সমস্ত দেশের, সমস্ত নাগরিকের প্রতিভূ। বলা বাহুল্য, নির্বাচনে পরাজিত দলের স্বার্থেরও তারা তখন জামিন। শাসকরা যদি দলীয় হয়ে পড়েন, সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করেন, তাহলে তাদের হাতে শাসন। আর শাসন থাকে না–নির্যাতন আর শোষণ হয়ে দাঁড়ায়। ছাত্র রাজনীতির বেলায় প্রাদেশিক শাসন-যন্ত্র নিরপেক্ষ নন বরং দলীয় পক্ষপাতিত্বের পরিচয় দিচ্ছেন বলে এমন একটা গুজব যেখানে সেখানে এখন শোনা যায়; এ গুজব সত্য হলে এ যে বুমেরাং-এর পথ রচনা তাতে সন্দেহ নেই। এখন ছাত্র রাজনীতি যে-শোচনীয় দশায় পৌঁছেছে তাতে সরকারি দায়িত্ব কতখানি তা সরকার পরিচালকদের ভেবে দেখা উচিত।

তাঁরা যদি সম্পূর্ণভাবে নিরপেক্ষ না হন তাহলে আমাদের শিক্ষা আর সাংস্কৃতিক জীবন দ্রুতযানে না চড়েও দ্রুত রসাতলে যাবে। 

তিন 

সরকারের ক্ষমতার উৎস যেখানেই থাকুক, যেখান থেকেই পরিচালিত হোক– সরজমিনে যারা আছেন তারাই সরকারি ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে থাকেন, করে থাকেন বাস্তবায়িত। বিশেষত, যারা প্রশাসনিক বিভাগে রয়েছেন আর যারা জেলায় জেলায় শাসন-শৃঙ্খলাকে বজায় রাখেন তাদের ওপর দেশের মঙ্গলামঙ্গল অনেকখানিই নির্ভর করে। তারা যদি দায়িত্বশীল আর নিরপেক্ষ হন তাহলে শাসন-শৃঙ্খলা সহজে ভেঙে পড়তে পারে না। তখন মানুষ নিরাপদ মনে করে নিজেকে। তেমন অবস্থায় সরকার যে-দলেরই হোক, শাসন ব্যবস্থার প্রতি মানুষ একটা আনুগত্য বোধ না করে পারে না। তারা দলীয় বা দলীয় মনোভাবের হয়ে পড়লেই দেশের জন্য বিপদ, তখনই দেখা দেয় আনুগত্যহীনতা। এভাবে রোপিত হয় আরাজকতার বীজ। শাসকদের ওপর জনসাধারণের আস্থা না থাকলে কোনো শাসন-ব্যবস্থাই সুষ্ঠুভাবে চলতে পারে না। গায়ের জোরে কতটুকুই বা চালানো যায়? চালাতে গেলে অনেক ঝুঁকি নিয়েই চালাতে হয়। ফলে একদিন ডুবতে হয় স্বখাত সলিলে। 

ঢাকায় যে শোচনীয় ঘটনা ঘটে গেল শুধু নিন্দায় তার কোন প্রতিকার হবে না, যদি না সরকার আর ছাত্র সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আমূল পরিবর্তন ঘটে। ছাত্ররা এখন যে রাজনীতি করছে, এ রাজনীতি তাদের ছাড়তে হবে। কোনো রকম রাজনীতিকেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আঙিনায় ঢুকতে দেওয়া উচিত নয়। গোড়াতেই আমি সে কথা বলেছি। সরকারকে ছাত্র-ছাত্র সকলের ব্যাপারেই হতে হবে নিরপেক্ষ। সরকার নিরপেক্ষ হলে অনেক অশান্তির মূল উৎপাটিত হবে। ছাত্রদের মধ্যেও একটা সরকারি দল খাড়া করা শুধু যে চরম অপরিণামদর্শিতা তা নয়, এ এক চরম নির্বুদ্ধিতাও। এর ফলে শাসন শৃখলার দিক থেকে ক্ষতি হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। হঠাৎ বিভিন্ন দলে গণ্ডগোল কি সংঘর্ষ দেখা দিলে, ইচ্ছা থাকলেও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষরা যেমন, তেমনি প্রশাসকরাও এ অবস্থায় পুরোপুরি নিরপেক্ষ হতে পারবেন না। ফলে অবস্থার সার্বিক অবনতি অনিবার্য। তখন অধ্যক্ষরা হন নিন্দিত। প্রশাসকরা হারান আস্থা।

অথচ সূত্র টানা হচ্ছে বহু দূর থেকে, যা অধ্যক্ষ কিংবা প্রশাসকদের নাগালের বাইরে। নিমিত্তের ভাগী করে এভাবে তাঁদের প্রতি করা হয় অবিচার। আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থা আজ এ এক অদ্ভুত অবস্থার সম্মুখীন। 

ঢাকার যে-শোচনীয় ঘটনার ইঙ্গিত আমি ওপরে করেছি, অনেক জায়গায় তার নাকি অশুভ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। চট্টগ্রামও নাকি বাদ যায় নি, এখানেও নাকি অনেক নিরীহ ছাত্র আক্রান্ত আর প্রহৃত হয়েছে। সংবাদপত্রকে দেওয়া হয়েছে হুমকি। প্রশাসন যন্ত্র নাকি এসব দমনের জন্য আশানুরূপ সক্রিয় হয়ে ওঠে নি। সত্য হলে এসব খুবই দুঃখের আর লজ্জার কথা। দলমত-নির্বিশেষে সব ছাত্র যাতে নিরাপদ বোধ করে আর নির্বিঘ্নে লেখাপড়া করে যেতে পারে তার পরিবেশ রক্ষা আর সৃষ্টির দায়িত্ব প্রশাসকদের। আমার বিশ্বাস জেলায় জেলায় আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যাঁদের ওপর ন্যস্ত তারা সবাই উচ্চশিক্ষিত। আমাদের মতো তাঁরাও দেশের শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ভালোবাসেন। কাজেই এ সব বিঘ্নিত হোক এ তারা চান–এ কথা ভাবা যায় না। চাকুরির বাইরে তাদেরও একটা ব্যক্তিসত্তা আছে। সেখানে সত্য, ন্যায় আর বিবেকের আহ্বানে তারাও সাড়া দেন। এ দুয়ের সমন্বয় হলেই গভর্নমেন্ট সার্ভান্ট সহজে পাবলিক সার্ভ্যান্ট তথা জনসেবক হয়ে ওঠেন। বলা বাহুল্য, শেষোক্ত পরিচয়ই অধিকতর গৌরবের। আমরাও আমাদের প্রশাসকদের কাছে এটুকুই আশা করছি। আর ছাত্রদের কাছে আশা করছি, প্রথম অনুচ্ছেদে আমি আমার যে-পঞ্চ নির্দেশের উল্লেখ করেছি তার প্রথমটি অন্তত তারা যেন মেনে চলতে চেষ্টা করে। তাহলে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ ফিরে না এসে পারে না। রাজনীতি করতে হয় শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের বাইরে গিয়ে করো গে–তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। ছাত্র রাজনীতির যে ভয়াবহ পরিণতি এখন দেখতে পাচ্ছি তাতে আমি বিচলিত বোধ না করে থাকতে পারছি না। 

[‘ছাত্র রাজনীতির ভয়াবহ পরিণতি’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭০-এ সমকালীন চিন্তা গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *