প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

মানব-কল্যাণ 

মানব-কল্যাণ 

মানব-কল্যাণ–এ শিরোনাম আমার দেওয়া নয়। আমাদের প্রচলিত ধারণা আর চলতি কথায় মানব-কল্যাণ কথাটা অনেকখানি সস্তা আর মামুলি অর্থেই ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

একমুষ্টি ভিক্ষা দেওয়াকেও আমরা মানব-কল্যাণ মনে করে থাকি। মনুষ্যত্ববোধ আর মানব-মর্যাদাকে এতে যে ক্ষুণ্ণ করা হয় তা সাধারণত উপলব্ধি করা হয় না। 

ইসলামের নবী বলেছেন, ওপরের হাত সব সময় নিচের হাত থেকে শ্রেষ্ঠ। নিচের হাত মানে যে মানুষ হাত পেতে গ্রহণ করে, ওপরের হাত মানে দাতা যে হাত তুলে ওপর থেকে অনুগ্রহ বর্ষণ করে। দান বা ভিক্ষা গ্রহণকারীর দীনতা তার সর্ব অবয়বে কীভাবে প্রতিফলিত হয় তার বীভৎস দৃশ্য কার না নজরে পড়েছে?

মনুষ্যত্ব আর মানব-মর্যাদার দিক থেকে অনুগ্রহকারী আর অনুগৃহীতের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। এ ব্যক্তির বেলায় যেমন সত্য, তেমনি দেশ আর রাষ্ট্রের বেলায় বরং অধিকতর সত্য। কারণ রাষ্ট্র জাতির যৌথ জীবন আর যৌথ চেতনারই প্রতীক।

রাষ্ট্রের দায়িত্ব শুধু প্রশাসন চালানোই নয়, জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলাও রাষ্ট্রের এক বৃহত্তর দায়িত্ব। যে রাষ্ট্র হাতপাতা আর চাটুকারিতাকে দেয় প্রশ্রয়, সে রাষ্ট্র কিছুতেই আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিক সৃষ্টি করতে পারে না। 

তাই মানব-কল্যাণ অর্থে আমি দয়া বা করুণার বশবর্তী হয়ে দান-খয়রাতকে মনে করি না। মনুষ্যত্বের অবমাননা যে ক্রিয়াকর্মের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি তাকে কিছুতেই মানব-কল্যাণ নামে অভিহিত করা যায় না। মানব-কল্যাণের উৎস মানুষের মর্যাদাবোধ বৃদ্ধি আর মানবিক চেতনা বিকাশের মধ্যেই নিহিত। একদিন এক ব্যক্তি ইসলামের নবীর কাছে ভিক্ষা চাইতে এসেছিলো। নবী তাকে একখানা কুড়াল কিনে দিয়ে বলেছিলেন, এটি দিয়ে তুমি বন থেকে কাঠ সংগ্রহ করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা রোজগার করো গে। এভাবে তিনি লোকটিকে শুধু স্বাবলম্বনের পথ দেখান নি, সে সঙ্গে দেখিয়ে দিয়েছিলেন মর্যাদাবান হওয়ার, মর্যাদার সাথে জীবযাপনের উপায়ও। 

মানুষকে মানুষ হিসেবে এবং মানবিক-বৃত্তির বিকাশের পথেই বেড়ে উঠতে হবে আর তার যথাযথ ক্ষেত্র রচনাই মানব-কল্যাণের প্রাথমিক সোপান। সে সোপান রচনাই সমাজ আর রাষ্ট্রের দায়িত্ব। সমাজের ক্ষুদ্রতম অঙ্গ বা ইউনিট পরিবার–সে পরিবারকেও পালন করতে হয় এ দায়িত্ব। কারণ, মানুষের ভবিষ্যৎ জীবনের সূচনা সেখান থেকেই। ধীরে ধীরে ব্যাপকতর পরিধিতে যখন মানুষের বিচরণ হয় শুরু, তখন সে পরিধিতে যে সব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার সংযোগ ঘটে–তা শিক্ষা কিংবা জীবিকা সংক্রান্ত যা হোক না তখন সে দায়িত্ব ঐ সব প্রতিষ্ঠানের ওপরও বর্তায়। তবে তা অনেকখানি নির্ভর করে অনুকূল পরিবেশ ও ক্ষেত্র গড়ে তোলার ওপর। যারা আজকের এ আলোচ্য বিষয়টি নির্বাচন করেছেন, মানব-কল্যাণ অর্থে তারা কী মনে করেছেন তা আমি জানি না। আমি যা মনে করি, সেইটুকুই শুধু আপনাদের সামনে উপস্থাপিত করলাম। মানব-কল্যাণ স্বয়ম্ভ, বিচ্ছিন্ন, সম্পর্ক-রহিত হতে পারে না। প্রতিটি মানুষ যেমন সমাজের সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি তার কল্যাণও সামগ্রিকভাবে সমাজের ভালো-মন্দের সঙ্গে সংযুক্ত। উপলব্ধি ছাড়া মানব-কল্যাণ স্রেফ দান-খয়রাত আর কাঙালি ভোজনের মতো মানব-মর্যাদার অবমাননাকর এক পদ্ধতি না হয়ে যায় না, যা আমাদের দেশ আর সমাজে হয়েছে। এ সবকে বাহবা দেওয়ার এবং এ সব করে বাহবা কুড়োবার লোকেরও অভাব নেই দেশে। 

.

আসল কথা, মানুষের মনুষ্যত্বকে বাদ দিয়ে স্রেফ তার জৈব অস্তিত্বের প্রতি সহানুভূতিশীল এ ধরনের মানব-কল্যাণ কিছুমাত্র ফলপ্রসূ হতে পারে না। এ হেন মানব-কল্যাণের কুৎসিত ছবি দেখার জন্য দূরদূরান্তে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, আমাদের আশে পাশে, চারদিকে তাকিয়ে দেখলেই তা দেখা যায়। 

বর্তমানে মানব-কল্যাণ অর্থে আমরা যা বুঝি তার প্রধানতম অন্তরায় রাষ্ট্র, জাতি, সম্প্রদায় ও গোষ্ঠীগত চেতনা–যা মানুষকে মেলায় না, করে বিভক্ত। বিভক্তিকরণের মনোভাব নিয়ে কারো কল্যাণ করা যায় না। করা যায় একমাত্র সমতা আর সহযোগ সহযোগিতার পথে। 

সত্যিকার মানব কল্যাণ মহৎ চিন্তা-ভাবনারই ফসল। বাংলাদেশের মহৎ প্রতিভারা সবাই মানবিক চিন্তা আর আদর্শের উত্তরাধিকার রেখে গেছেন। দুঃখের বিষয়, সে উত্তরাধিকারকে আমরা জীবনে প্রয়োগ করতে পারি নি। 

বিদ্যাপতি চণ্ডীদাস থেকে লালন প্রভৃতি লোক-কবিরা এবং অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে রবীন্দ্রনাথ-নজরুল সবাইতো মানবিক চেতনার উদাত্ত কণ্ঠস্বর। বঙ্কিমচন্দ্রের অবিস্মরণীয় সাহিত্যিক উক্তি : ‘তুমি অধম তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’ এক গভীর মূল্যবোধেরই উৎসারণ। 

এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিম্নলিখিত উক্তিটিও স্মরণীয় : ‘Relationship is the fundamental truth of the world of appearence’ কবি এ উক্তি করেছিলেন তার হিবার্ট বক্তৃতামালায়। অন্তর জগতের বাইরে যে জগৎকে আমরা অহরহ দেখতে পাই তার মৌলিক সত্য পারস্পরিক সংযোগ-সহযোগিতা, কবি যাকে relationshipবলেছেন। সে সংযোগ বা সম্পর্কের অভাব ঘটলে মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ ভিক্ষা দেওয়া নেওয়ার সম্পর্কে পরিণত হয়। অনেকে হয়তো শিল্পী মাইকেল এঞ্জেলোর ‘The creation of Man’ ছবিটির প্রতিলিপি দেখেছেন–অতি সরল স্পষ্ট একখানা ছবি–দু দিক থেকে দুটি মানুষের হাত আঙুল বাড়িয়ে পরস্পরের সঙ্গে মিলিত হতে চাচ্ছে। মানব সৃষ্টির মূল কথাটাই শিল্পী এ ছবির সাহায্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাই ছবিটির নাম দিয়েছেন তিনি The creation of Man। কী এক অদ্ভুত সংকেতবহ ছবি! এ ছবিটিরই প্রতিলিপি ব্যবহার করেছেন রবীন্দ্রনাথ তাঁর The Religion of Man বইটির প্রচ্ছদ হিসেবে।

যেহেতু রাষ্ট্র আজ সর্বাত্মক ক্ষমতার অধিকারী, অধিকন্তু যে ধরনের রাজনীতি রাষ্ট্রের পেছনে সক্রিয় তাও এত সর্বব্যাপক যে তা যদি মানবিক দৃষ্টিসম্পন্ন না হয় তা হলে মানব-কল্যাণ অর্থে আমরা যা বুঝি তা এ পরিস্থিতিতে মোটেও বাধামুক্ত হতে পারে না। এবং তার বাস্তবায়ন একরকম অসম্ভব বললেই চলে। 

.

আমরা আজ এক চরম স্ববিরোধিতার যুগে বাস করছি। একদিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি, যা মানব মনীষা, সাধনা আর প্রতিভারই ফলশ্রুতি। অন্যদিকে মানবতার চরম লাঞ্ছনা আর নির্মম নিষ্ঠুর আচরণ প্রায় প্রাত্যহিক ঘটনা। এবং সামাজিক আর রাষ্ট্রীয় জীবনে এ সব দিন দিনই বেড়ে চলেছে দ্রুত গতিতে। 

বলা বাহুল্য, মানব-কল্যাণ বিচ্ছিন্ন কিংবা খণ্ডিত কোনো ব্যাপার নয়। গুটি কয়েক ভিখিরি বিদায় কিংবা কিছু সংখ্যক অভাবগ্রস্তের অভাবমোচন মানবিক সমস্যার দিক দিয়ে স্রেফ ছেঁড়া কাপড়ে তালি দেওয়া। 

অধিকন্তু আমাদের দেশে, হয়তো অন্যত্রও এ ধরনের মানব-কল্যাণকে পারলৌকিক মুক্তির উপায় হিসেবেও গণ্য করা হয়। মনে করা হয়, পারলৌকিক ফল লাভের এ এক মোক্ষম উপায়। ফলে ভিক্ষুক আর ভিক্ষাদাতার সম্পর্কে দেখা যায় না কিছুমাত্র মানবিকতার লক্ষণ। খুঁজে পাওয়া যায় না মানবিক সম্পর্ক তথা human relationship এর ছোঁয়া। 

বিশ্বাস আর ব্যবহারিক জীবন সম্পূর্ণ আলাদা। মনাব-কল্যাণ অর্থে আমি পুরোপুরি ব্যবহারিক জীবনের কল্যাণকে বোঝাতে চাচ্ছি। জীবন–যে জীবন আমরা প্রতিদিন যাপন করে থাকি তা সম্পূর্ণভাবে ইহলৌকিক। ইহলৌকিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে পারলৌকিকের সংযোগ ঘটালে কোনোটারই অভীষ্ট সিদ্ধ হওয়ার কথা নয়। শেষোক্ত জীবন অজানা ও অদৃশ্য এবং সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাস-নির্ভর। প্রথমটা অর্থাৎ জাগতিক জীবন চক্ষুগ্রাহ্য, আমাদের প্রতি মুহূর্তের জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং আমাদের অভিজ্ঞতার অঙ্গীভূত। মানব-কল্যাণ পুরোপুরি এ জীবনেরই অঙ্গ এবং এ জীবনের সঙ্গেই তার সম্পর্ক। একে পরলোকের সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সংযুক্ত করে বিচার করতে গেলে কল্যাণ কথাটা অর্থহীন হয়ে পড়ে। কারণ, পারলৌকিক কল্যাণ-অকল্যাণ সম্বন্ধে। আমরা সম্পূর্ণ অজ্ঞ এবং তা আমাদের সর্বপ্রকার অভিজ্ঞতা-বহির্ভূত বলে তার মূল্যায়ন। আমাদের পক্ষে অসাধ্য। 

তাই আমাদের সব কল্যাণ-কর্মকে জাগতিক জীবনের ভাল-মন্দের নিরিখে বিচার করতে হবে। যা জীবনের বাইরের ব্যাপার তা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির। তার সাধন ও সাধনার লক্ষ্য সম্পূর্ণ ব্যক্তিক। জাগতিক জীবন ও তার কল্যাণ-অকল্যাণ তেমন ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়। তার ধরন-ধারণ ও করণীয় ভিন্ন। মৃত আর জীবিতের মধ্যে যে তফাত এ অনেকটা তাই। 

কল্যাণ-কর্ম সম্বন্ধে আমাদের একটি ভ্রান্ত ধারণা বা conception রয়েছে যার ফলে আমরা সব রকম কল্যাণ-কর্মকে পারলৌকিক লাভালাভের সঙ্গে সংযুক্ত করে নিই এবং সে লক্ষ্যটা সামনে রেখেই সাধারণ দান-খয়রাত থেকে স্কুল-মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসা-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা ইত্যাদিকে নিয়ে ও দেখে থাকি। ফলে এতে অনেক সময় মানবিক মর্যাদা হয় বিসর্জিত।

মানব-কল্যাণ অলৌকিক কিছু নয়–এ এক জাগতিক মানবধর্ম। তাই এর সাথে মানব-মর্যাদার তথা human dignity-র সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য। আজ পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে দেখলে কী দেখতে পাই? দেখতে পাই দুঃস্থ, অবহেলিত, বাস্তুহারা, স্বদেশ-বিতাড়িত মানুষের সংখ্যা দিন দিনই বেড়ে চলেছে। সে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে রিলিফ, রিহেবিলিটেশন ইত্যাদি শব্দের ব্যাপক প্রয়োগ। রেডক্রস ইত্যাদি সেবাধর্মী সংস্থার সংখ্যাবৃদ্ধিই কি প্রমাণ করে না মানব-কল্যাণ কথাটা স্রেফ মানব-অপমানে পরিণত হয়েছে? মানুষের স্বাভাবিক অধিকার আর মর্যাদার স্বীকৃতি আর প্রতিষ্ঠা ছাড়া মানব-কল্যাণ মানব-অপমানে পরিণত না হয়ে পারে না। এখন যা হয়েছে।

সামগ্রিকভাবে মানুষ আর তার সামাজিক সত্তাকে স্বীকার করে কল্যাণ-কর্মের, সে সঙ্গে সমানুষের নিরাপত্তার ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা না হলে, রেডক্রসই বলুন, রোটারি-লায়ন্সই বলুন, সবই তো ছেঁড়া কাপড়ে তালি দেওয়া মাত্র। এতে সমস্যার যেমন সমাধান হয় না, তেমনি ঘোচে না মানুষের অপমানও। মানুষ সমাজিক জীব, বিচ্ছিন্ন সত্তা নয়, তাই তার কল্যাণও বিচ্ছিন্ন নয়, নয় সমাজ-সম্পর্কহীন। মানুষের স্বাস্থ্য যেমন তার সর্বাঙ্গের স্বাস্থ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত, তেমনি মানব-কল্যাণকেও হতে হবে সামগ্রিক, সর্বমানবিক। তার ভিত্তিভূমি মানুষ। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্র-উক্তি আরো সুস্পষ্ট: We can never go beyond Man to all that we know and feel. 9 Gta 5 অনুভূতির ওপরই নির্ভর করে মানুষের কল্যাণ-অকল্যাণ সাধন। অন্যত্র কবির উক্তি SICT 58 : The God of humanity has arrived at the gates of the ruined temple of the tribe.

কালের বিবর্তনে আমরা এখন আর tribe বা গোষ্ঠীবদ্ধ জীব নই–বৃহত্তর মানবতার অংশ। তাই God of humanity-কে বিচ্ছিন্ন, বিক্ষিপ্ত কিংবা খণ্ডিতভাবে দেখা বা নেওয়া যায় না। তেমনি নেওয়া যায় না তার কল্যাণকর্মকেও খণ্ডিত করে। দেখতে মানুষও অন্য একটা প্রাণী মাত্র, কিন্তু ভেতরে মানুষের মধ্যে রয়েছে এক অসীম ও অনন্ত সম্ভাবনার বীজ। যে সম্ভাবনার ফুরণ-ফুটনের সুযোগ দেওয়া, ক্ষেত্র রচনা আর তাতে সাহায্য করাই শ্রেষ্ঠতম মানব-কল্যাণ। সেটা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য কিংবা কোনো রকম অপমান-অবমাননার পথে হতে পারে না। হালে যে দর্শনকে অস্তিত্ববাদ নামে অভিহিত করা হয়, ইংরেজিতে যাকে বলা হয় existentialism তারও মূল কথা ব্যক্তি মানুষের অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দান। সব রকম অন্যায় আর মনুষ্যত্বের অবমাননার সামনে যে মাথা তুলে বলতে পারে–না, No। এ দর্শনের মূল কথা I can say No; Therefore I exist। কিন্তু একজন ভিখিরি বা অনুগ্রহপ্রার্থী তো তেমন কথা বলতে পারে না। বলতে পারে না আমি নেব না, আমি মানবো না, করবো না মাথা নত। ফলে তেমন মানুষ পারে না নিজের মনুষ্যত্ব আর মানব-মর্যাদাকে সমুন্নত রাখতে। ভিখিরি আর অনুগৃহীতকে সব সময় কিল খেয়ে কিল হজম করতে হয়। চরম অপমানের মুহূর্তেও মুখে ফুটিয়ে তুলতে হয় হাসি। শওকত ওসমান সীমিত সাফল্যের সাথে এ দুঃসহ অবস্থার এক সকরুণ চিত্র তুলে ধরেছেন তার ক্রীতদাসের হাসিতে। 

বল প্রয়োগ কিংবা সামরিক শাসন দিয়ে মানুষকে তাবেদার কিংবা চাটুকার বানাতে পারা যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠা করা যায় না মানব মর্যাদার আসনে। সব কর্মের সাথে শুধু যে ব্যক্তিগত সম্পর্ক থাকে তা নয়, তার সামাজিক পরিণতি তথা social consequence-ও অবিচ্ছিন্ন। যেহেতু সব মানুষই সমাজের অঙ্গ, তাই সব রকম কল্যাণ-কর্মেরও রয়েছে সামাজিক পরিণতি। এ সত্যটা অনেক সময় ভুলে থাকা হয়। বিশেষত যখন দৃষ্টি থাকে ঊর্ধ্ব দিকে তথা পরলোকের পানে। 

স্রেফ সদিচ্ছার দ্বারা মানব-কল্যাণ সাধিত হয় না। সব ধর্ম আর ধর্ম-প্রবর্তকেরা বারংবার নির্দেশ দিয়েছেন মানুষের ভাল করো, মানুষের কল্যাণ করো, সুখ শান্তি দান করো মানুষকে। এমন কি সর্বজীবে হিতের কথাও বলা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে আমরা কী দেখতে পাই? 

ইসলামের শব্দগত অর্থ ‘শান্তি’। ইসলাম প্রচার করে সাম্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃতু। কিন্তু মুসলমান বা ইসলামি রাষ্ট্রগুলির দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই এর বিপরীত দৃশ্য। শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নয়, সামাজিক জীবনেও বৈপরীত্য কম লক্ষগোচর নয়। 

মানব-প্রেম প্রচারে খ্রিস্ট ধর্ম আরো সোচ্চার। খ্রিস্টের এক সুবিখ্যাত নির্দেশ : কেউ তোমার এক গালে চড় দিলে অন্য গাল পেতে দাও। প্রেম ও অহিংসার এ যে এক পরম অভিব্যক্তি তাতে সন্দেহ নেই। অথচ দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ খ্রিস্টানে খ্রিস্টানেই হয়েছে এবং ব্যবহার করেছে সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র একে অপরের বিরুদ্ধে। যা শুধু অসংখ্য মৃত্যুর কারণ হয় নি, ততোধিক মানুষকে করেছে পঙ্গু। যে পঙ্গুতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে রূপ নিয়েছে বংশানুক্রমিক পরিণতিতে। অধিকতর শক্তিশালী মারণাস্ত্র নির্মাণ কি কিছুমাত্র হাস পেয়েছে ঐ সব সর্বাধিক উন্নত দেশে? 

অহিংসার প্রতিমূর্তি মহামানব বুদ্ধের এক স্মরণীয় উক্তি : সকল প্রাণী সুখী হোক। কিন্তু অন্যান্য মহাপুরুষদের শিক্ষা ও নির্দেশের মতো এও তো শুধু এক আশার বাণী, প্রার্থনা বাক্য মাত্র। পরিণামে দেখা যায়, সব ধর্ম উপদেশই যাকে বলে pious wish তাতেই নিঃশেষিত হয়।

এ সবের ফলে মানব জাতির ভাগ্যে সুখ নেমে আসে নি। সব ধর্মগুরু আর মহাপুরুষেরা এ রকম অজস্র প্রার্থনা-বাণী রেখে গেছেন। কিন্তু সুখ, শান্তি, নিরাপত্তা ক্রমাগতই মানুষের জীবন থেকে দূরে সরে গেছে, সরে যাচ্ছে প্রতিদিন। চীন, জাপান ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ ঐতিহাসিকভাবে মহাপুরুষ বুদ্ধের অনুগামী। মানব কল্যাণ সম্বন্ধে আমাদের ধারণায় কোথাও একটা গলদ রয়েছে। তাই এত সব উন্নতি সত্ত্বেও আমরা কল্যাণের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে পারি নি, পারছি না। 

অতএব আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। সমস্যার মোকাবেলা করতে হবে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে। নতুন পদ্ধতিতে–যা হবে বৈজ্ঞানিক, র‍্যাশেনাল ও সুবুদ্ধি-নিয়ন্ত্রিত। সমস্যা যত বড় আর যত ব্যাপকই হোক না তার মোকাবেলা করতে হবে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সাথে। এড়িয়ে গিয়ে কিংবা জোড়াতালি দিয়ে কোনো সমস্যারই সমাধান করা যায় না। 

এ যুগের মানবতাবাদী দার্শনিক বিজ্ঞানী বার্ট্রান্ড রাসেলের কথা দিয়ে আমি আমার বক্তব্যের সমাপ্তি টানছি : We want to stand upon our own feet and look fair and square at the world–its good facts, its bad facts, its beauties and its ugliness, see the world as it is and be not afraid of it. 

**********

It needs a fearless outlook and free intelligence. It needs hope for the future, not looking back all the time toward a past that is dead, which we trust will be far, surpassed by the future that our intelligence can create, দীর্ঘকাল ধরে আমরা মুক্তবুদ্ধির কথা, রাসেল যাকে free intelligence বলেছেন, তা আমাদের সীমিত সুযোগ আর শক্তি দিয়ে বলতে চেষ্টা করেছি–এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে থেকেই। আমাদের বিশ্বাস মুক্তবুদ্ধির সহায়তায় সুপরিকল্পিত পথেই কল্যাণময় পৃথিবী রচনা সম্ভব। একমাত্র মুক্ত বিচারবুদ্ধির সাহায্যেই বিজ্ঞানের অভাবনীয় আবিষ্কারকে ধ্বংসের পরিবর্তে সৃজনশীল মানবিক কর্মে করা যায় নিয়োগ। তা করা হলেই মানব কল্যাণ হয়ে উঠবে মানব-মর্যাদার সহায়ক। 

[‘মানবকল্যাণ’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় মে ১৯৭২ সালে। মানবতন্ত্র গ্রন্থে প্রথম সংকলিত হয়।]

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *