প্রথম পর্ব : সাহিত্য 
দ্বিতীয় পর্ব : সংস্কৃতি 
তৃতীয় পর্ব : সমাজ, শিক্ষা ও রাষ্ট্র 

সাহিত্য ও সাহিত্য-পুরস্কার 

সাহিত্য ও সাহিত্য-পুরস্কার 

॥ ১ ॥

সত্য ও বিবেকের সাধনা আর অকুতোভয়ে তার উপলব্ধিকে ভাষাদান–মোটামুটি সাহিত্যের এ স্বভাব ও ধর্ম। সৌন্দর্য এসব থেকে বহির্ভূত নয়। এ পথ অত্যন্ত দুরূহ আর এর হা এমন বিরাট যে এ ব্যক্তির সর্ব-সত্তাকে গ্রাস করে নেয়। কিন্তু ভাগ্যের অমোঘ বিধান, এ পথের পথিক আর সাধকরাও স্কুল তথা ব্যবহারিক জীবনের শর্তাধীন। অমরতার সাধনায় আত্মনিমগ্ন থাকলেও এর জীবনের সব দাবির শেকলে তারাও আষ্টেপিষ্টে বাঁধা। চরম সত্যটি অতি প্রাচীনকাল থেকেই, পথের পথিকদের যেমন জানা ছিল তেমনি জানা ছিল দেশ, সমাজ আর রাষ্ট্র আর শাসকদেরও। শেষোক্তদের দেশ-কাল ভেদে নানা পরিচয়; যেমন, নবাব-আমির,রাজা-বাদশাহ, আমির-সালতান, জমিদার-ভূস্বামী ইত্যাদি। এরা ব্যক্তিগত আর বংশগত স্বার্থে কিংবা নিজেদের খেয়াল-খুশিতে নানা আমোদে-প্রমোদে বিচিত্র বিলাস-ব্যসনে প্রজার রক্তজল করা অজস্র অর্থ যে ব্যয় করতো না তা নয়। কিন্তু প্রশংসার কথা, এরাও সত্য ও বিবেকের চর্চার তথা সাহিত্য ও শিল্পের মূল্য দিতো। বিজ্ঞাপন যুগের বহু আগে, দূর অতীতেও এদের অনেকে এসবের কদর করেছে, দিয়েছে যথাযোগ্য মর্যাদা। অধিকন্তু এসবের অবিনশ্বর মূল্যবোধে তারা ন্যস্ত করেছে অসীম বিশ্বাস ও আস্থা। তাই এসব সাধকদের অর্থাৎ কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, গায়ক ও গুণীদের আশ্রয় দিতে, পৃষ্ঠপোষকতা করতে এদের অনেকে সাগ্রহে এসেছে এগিয়ে। সব দেশে, সব যুগে এ দেখা গেছে। ফলে প্রাত্যহিক জীবনেও আবিশ্যক দাবি-দাওয়ার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে এসব গুণী আর সাধক সর্ব-সত্তা দিয়ে নিজ নিজ প্রতিভার দায়-শোধ আর দায়িত্ব পালনে আত্মনিয়োগ করতে পেরেছেন। এবং অনেকটা ঐ কারণেই তেমন আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা তারা যে শুধু মেনে নিয়েছেন তা নয়, অনেক সময় যেচেও নিয়েছেন। আর তা যে অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে দেদার নজির সাহিত্য-শিল্পের ইতিহাসে ছড়িয়ে আছে। বিক্রমাদিত্যের ‘নবরত্ন’ আর আকবরের নওরতন সভার কথা সর্বজনবিদিত। আমার বিশ্বাস, তেমন পৃষ্ঠপোষকতা না পেলে ‘মেঘদূত’ আর ‘শকুন্তলার’ মতো অমর কাব্য আদৌ রচিত হতো কি না সন্দেহ। সে কথা ‘শাহনামা’ সম্বন্ধেও বলা যায়। আমার বিশ্বাস, বহুনিন্দিত সোলতান মাহমুদের নির্দেশ আর পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া ‘শাহনামা’র মতো অত বড় মহাকাব্য আদৌ রচিত হতো এ কথা জোর করে বলা যায় না। পরে সোলতানের সঙ্গে কবির যে বিরোধ তথা ষাট হাজার স্বর্ণমুদ্রা প্রত্যাখ্যানের যে কাহিনী তার কারণ তো সোলতানের সত্যভঙ্গ। এ সত্যভঙ্গ কথাটি সাহিত্য শিল্পের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আর মূল্যবান। সত্য আর বিবেকের সাধক যারা তারা সবকিছু সহ্য করতে রাজি কিন্তু সত্যভঙ্গ বরদাস্ত করতে রাজি নন কিছুতেই। এমন কি বিরাট অঙ্কের অর্থ আর পৃষ্ঠপোষকতার বিনিময়েও না। 

য়ুরোপের বিবেক নামে অভিহিত মহাকবি গ্যেটে ভাইমার সামন্তরাজের অনুগ্রহভাজন ছিলেন। জীবনের শেষ কাল পর্যন্ত মন্ত্রীত্ব করেছেন ঐ সামন্তের অধীনে। কিন্তু বিবেক বিক্রয় করেন নি বরং আজো বিশ্বের বুদ্ধজীবীদের সামনে বিবেকের এক অনির্বাণ দীপশিখা হয়েই বিরাজ করছেন তিনি। নদীয়ার কৃষ্ণচন্দ্রও ছিলেন এক সামন্তরাজ, তার সভাকবি ভারতচন্দ্রের কাব্যসাধনায় তা কোনো বাধার সৃষ্টি করেছিল বলে জানা যায়। নি। আলাওলের সুবিখ্যাত ‘পদ্মাবতী’ও রচিত হয়েছে আরাকান-রাজের অমাত্যের আশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায়। বলা বাহুল্য, আরাকান রাজসভার সব কবিই ছিলেন ‘আশ্রিত’ ও ‘পোষিত’। বাংলা সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস ড. দীনেশচন্দ্র সেনের ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ যে ত্রিপুরার মহারাজার অর্থানুকূল্যেই প্রকাশিত হয়েছিল সে কথা তো দীনেশ চন্দ্র নিজে বলে গেছেন। ঐ গ্রন্থের জন্যই লর্ড কার্জনের মতো ভারত বিরোধী জাদরেল বড়লাটও দীনেশচন্দ্র সেনের কথা সকৃতজ্ঞ চিত্তে উল্লেখ করেছেন তাঁর উক্ত গ্রন্থের ভূমিকায়। তাঁর রায়বাহাদুর খেতাবও তার সাহিত্য সাধনারই পুরস্কার। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও ত্রিপুরার মহারাজার কাছ থেকে নানা উপলক্ষে একাধিকবার অর্থ সাহায্য নিয়েছেন। এমন কি ইংরেজের বশংবদ আর সে যুগের সেরা সামন্ত হায়দ্রাবাদের নিজামের কাছ থেকেও টাকা নিতে দ্বিধা করেন নি এ মহাকবি। বলা বাহুল্য, সে টাকার পরিমাণ বেশ মোটা। রবীন্দ্র-জীবনীর পাঠকদের কাছে এ সব অজানা নয়। লালগোলার মহারাজ ও অন্যান্য বহু ধনাট্যের অর্থেই গড়ে উঠেছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ–যে সাহিত্য পরিষদের উদ্যোগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বহু মূল্যবান গ্রন্থ শুধু প্রকাশিত হয় নি, সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গবেষণার সুযোগও দিয়েছে অনেক গবেষককে। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি বহু নিবেদিতপ্রাণ সাহিত্য কর্মরি কথা এ প্রসঙ্গে স্মরণীয়। এমন কী বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের আনুকূল্য ছাড়া আমাদের সাহিত্যবিশারদ আবদুল করিমের ‘গোরক্ষ বিজয়’, প্রাচীন পুঁথির বিবরণ’ প্রভৃতি মূল্যবান গ্রন্থও প্রকাশিত হতো কি না সন্দেহ। মাত্র সেদিন মহাকবি গালিবের মৃত্যুবার্ষিকী পাকিস্তানেও পালিত হয়েছে–গালিব শুধু যে শেষ মোগল সম্রাট আর রামপুরের নবাবের কাছ থেকে বৃত্তি পেতেন ও নিতেন তা নয়, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছেও পৈত্রিক জায়গির আর নিজের জন্য একটা পেনশনের দাবি জানিয়ে তিনি আর্জি পেশ করেছিলেন একাধিকবার। দুঃখের বিষয় তার আর্জি মঞ্জুর হয় নি। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রথম মহাকবি মধুসূদন, পাইকপাড়ার জমিদারের থেকে অর্থ নিয়ে নাটক লিখে দিয়েছেন–মধুসূদনের জীবনী আর বাংলা সাহিত্যের পাঠকদের কাছে এ সব তথ্য অজানা থাকার কথা নয়। মোট কথা, সাহিত্য-পুরস্কার সাহিত্য-বৃত্তি বা কবি-সাহিত্যকদের সাহায্য দেওয়া নেওয়া সব সভ্য সমাজে এক পুরোনো রেওয়াজ, নতুন কিছু নয় মোটেও। লেখকদের জন্য সবচেয়ে বড় কথা বিবেক ও মনের স্বাধীনতা। এ দুই বজায় রেখে মহাপ্রতিভারাও বিত্তশালীদের কাছ থেকে সাহায্য নিতে কখনো দ্বিধা করেন নি। 

কালের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজ আর সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ইত্যাদি সব কিছুই দ্রুত বদলে যাচ্ছে, বদলে গেছে। বহু দেশ থেকে রাজা-বাদশাহ, নবাব-আমির, জমিদার-ভূস্বামী এখন নিশ্চিহ্ন। পাকিস্তানও তার ব্যতিক্রম নয়। এখন রাজ-রাজড়া কিংবা ধনী ও বিত্তশালীদের স্থান দিয়েছে শিল্প আর পুঁজিপতিরাই, ইতিহাসের এ এক স্বাভাবিক ধারা। এ ধারা অনুসরণ না করলে সাহিত্য-পুরস্কার সম্বন্ধেও বিভ্রান্তি ঘটার সম্ভাবনা। সম্প্রতি আমাদের কোনো কোনো সহকর্মী তেমন বিভ্রান্তির শিকার হয়েছেন বলেই এ লেখার সূত্রপাত। আমাদের সমাজ যে পুরোপুরি পুঁজিবাদী তাতে বোধ করি দ্বিমত নেই। পুঁজিবাদের একটা স্বাভাবিক অনুষঙ্গ, পুঁজি সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় পুঁজিপতিরাও কিছু কিছু সৎ কর্ম ও জনহিতকর কাজ করতে বাধ্য হন। অনেক সময় অবস্থা এ করতে তাদের বাধ্য করে। যেমন, স্কুল-কলেজ ও হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা, বিভিন্ন বিষয়ে চাদা আর বৃত্তি দেওয়া ইত্যাদি। সাহিত্য-পুরস্কারও এ কর্মসূচির অন্তর্গত। পৃথিবীর তাবৎ পুঁজিবাদী দেশে এর বিস্তর নজির–যার থেকে আমাদের দেশের অনেক গবেষক শিক্ষার্থী, জ্ঞানী-গুণীও উপকৃত হয়েছেন। তার ফলে কেউই ফোর্ড কোম্পানি বা ফোর্ড পরিবারের ‘চরণাশ্রিত হয়েছেন কিংবা ‘আত্মবিক্রয় করেছেন তেমন কথা শোনা যায় নি। দুনিয়ার সবচেয়ে সেরা সাহিত্য-পুরস্কার বোধ করি ‘নোবেল প্রাইজ’। এ কি কোন নিঃস্ব বা পুঁজিহীনের দান? আলফ্রেড নোবেলের পরিচয় প্রসঙ্গে, হাতের কাছে যে বিশ্বকোষটা আছে তাতে লেখা হয়েছে–The inventor of dynamite was a Swedish engineer and chemist who amassed a large fortune from the manufacture of explosives (Pears Encyclopaedia) অর্থাৎ সর্বধ্বংসী ডিনামাইট থেকে নানা বিস্ফোরণ তৈরি করে পৃথিবীর বড় বড় যুদ্ধবাজ দেশগুলোর কাছে তা চড়া দামে বিক্রি করে নোবেল প্রভূত ধনের মালিক হয়েছিলেন। সে সঞ্চিত অর্থের একটা মাত্র অংশ থেকেই সব কটা নোবেল প্রাইজের জন্ম। ডিনামাইটের ভূমিকা কারো অজানা নয়। তার থেকে প্রস্তত বিস্ফোরক দু দুটো প্রলয়ঙ্করী মহাযুদ্ধে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা বোধ করি বলার প্রয়োজন নেই। ডিনামাইট থেকে তৈরি নানা বিস্ফোরণ এখনো কি ভিয়েৎনাম আর মধ্যপ্রাচ্যে ব্যবহার করা হচ্ছে না? আর তার ধ্বংসের চিত্র প্রতিনিয়তই তো প্রকাশিত হচ্ছে সংবাদপত্রে। তবুও চিরযুদ্ধ-বিরোধী রোমা রোলা, রাসেল, টমাস মান, রবীন্দ্রনাথ এমন কি শান্তির শহিদ মার্টিন কিং পর্যন্ত ঐ প্রাইজ গ্রহণকে অপমানজনক মনে করেন নি। কিংবা ঐ প্রাইজ থেকে নোবেলের নামের চিহ্ন মুছে ফেলার অদ্ভুত দাবিও জানান নি। পুঁজিবাদের পরম শত্রু আর শ্রেণীহীন সমাজতন্ত্র যে দেশে পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত, সে দেশের সাহিত্যিক আর বৈজ্ঞানিকরাও নোবেল প্রাইজ নিতে অস্বীকার করেন নি। বরিস পাস্তেরনাকও নিতে রাজি ছিলেন, এমন কি নোবেল প্রাইজ কমিটিকে তিনি ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। পরে যে নিতে পরেন নি সে তো তার দেশের সরকারের আপত্তির জন্যই। আর সবাই জানেন, সে আপত্তি ছিল রাজনৈতিক। আলফ্রেড নোবেলের ‘নাম-চিহ্নিত’ বলে মোটেও নয়। যারা ঐ পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছেন তারাও করেছেন ভিন্নতর কারণে–নোবেলের ‘নাম-চিহ্ন’ অজুহাতে নয়। সাহিত্য আর পুরস্কার সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার। যারা বিভিন্ন সাহিত্যে পুরস্কার পেয়েছেন, দুনিয়ার কোনো রকম সাহিত্য-পুরস্কার না থাকলেও তারা সাহিত্য করতেন–পুরস্কার পাওয়ার পরেও সাহিত্য করেছেন ও করে চলেছেন নিজেদের বিবেক আর সত্যকে বজায় রেখে। পুরস্কার পাওয়ার পর কারো মতাদর্শের রাতারাতি রদবদল ঘটেছে তেমন ঘটনা আমার জানা নেই। গোড়াতেই বলেছি, সাহিত্য মানে সত্য ও বিবেকের চর্চা–কোন সাহিত্য-পুরস্কারই খাঁটি সাহিত্যিককে সাহিত্যের চিরকালীন ভূমিকা থেকে বিচ্যুত করতে পারে না। অতীতে যারা রাজা-বাদশাহ কিংবা জমিদার ভূস্বামীদের আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতায় থেকে সাহিত্য করেছেন তাদের বেলায় যেমন এ কথা সত্য, এ যুগের সাহিত্যিকদের বেলায়ও এ বিন্দুমাত্র মিথ্যে নয়। সীমিত অর্থে আমাদের দেশের খাঁটি কবি আর সাহিত্যিকরাও এ পূর্বসূরীদেরই উত্তর-সাধক।

যত ভয় মেকিদের আর মেকিদের নিয়েই। তাঁরাই রজ্জুকে সর্প মনে করে আঁতকে ওঠেন! 

॥ ২ ॥

অতীতকালে যা ছিল আশ্রয় ও পৃষ্ঠপোষকতা বা মাশোয়ারা, বলা বাহুল্য, এখন তা নাম নিয়েছে সাহিত্য-পুরস্কার, সাহিত্য-ভাতা, সাহিত্য-বৃত্তি ইত্যাদি। সে যুগে কোনো কোনো ক্ষেত্রে পৃষ্ঠপোষক ও সাহায্যদাতার প্রশস্তি গাইতে হতো, (এমন কি দিওয়ানে গালিবেও তার নিদর্শনের অভাব নেই) এখন একটা সালাম ঠোকারও প্রয়োজন হয় না, পুরস্কারের অর্থ-দাতাদের মন যুগিয়ে চলা বা কথা বলা তো দূরের কথা। ক্রমবর্ধমান গণতান্ত্রিক চেতনা আর সমাজ বিবর্তনেরই যে এ অনিবার্য পরিণতি তাতে বোধ করি সন্দেহ নেই। আমাদের দেশে যে কটা পুঁজিপতি নামাঙ্কিত সাহিত্য-পুরস্কার চালু হয়েছে, প্রশংসার কথা, তাতেও কোন শর্ত আরোপিত হয় নি। এসব পুরস্কার গ্রহণে যাদের আপত্তি তারা কী রকম সমাজ বা সমাজ ব্যবস্থা চান জানি না, পুঁজিবাদহীন সমাজতন্ত্র যে তারা চান তার অস্পষ্ট চেহারাও তাদের রচনায় দুর্নিরীক্ষ। তবে তাদের সাম্প্রতিক বিবৃতি আর পত্র-পত্রিকায় চিঠিপত্র থেকে জানা যায় যে, তারা পুঁজিপতিদের ওপর খাপ্পা! বিস্ময়ের বিষয় এটুকু যে, খাপ্পা হলেও প্রয়োজনের সময় পুঁজিপতিদের কাছ থেকে এটা-ওটার অজুহাতে টাকা নিতে বা তাদের অধীনে নৌকরি করতে এঁদের বিবেকে মোটেও বাধে না। কিছুদিন আগে এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে চট্টগ্রামে যে সাহিত্য-সভা হয়েছিল, শুনেছি তার জন্য টাকা তোলা হয়েছে পুঁজিপতি আর ব্যাঙ্ক ইত্যাদি পুঁজিপতি চালিত সংস্থা থেকেই। যিনি সর্বপ্রথম পুঁজিপতি নামাঙ্কিত সাহিত্য-পুরস্কারের বিরুদ্ধে আপত্তি তুলেছেন, শুনলাম তারই স্বাক্ষরিত আবেদনপত্র নিয়েই তাঁর প্রতিনিধিরা পুঁজিপতি আর ব্যাঙ্ক ম্যানেজারদের কাছে অর্থের জন্য হাত পেতেছিলেন। বিজ্ঞাপনের জন্য পুঁজিপতিদের কাছে ধর্না দিতে হয়, বিজ্ঞাপনে পুঁজিপতিদের কলকারখানা বা ব্যাঙ্কের গুণপনা (সত্য-মিথ্যা যাই হোক) প্রচার করতে হয়। কিন্তু সাহিত্য-পুরস্কারের বেলায় তেমন কোনো বালাই নেই। এমন কি পুরস্কারের অর্থদাতা কিংবা তার ম্যানেজারের মুখ দেখারও হয় না প্রয়োজন। কোনো রকম প্রচারণা তো দূরের কথা। বরং এ যাবৎ যে সব বই পুঁজিপতি নাম-চিহ্নিত পুরস্কার পেয়েছে তার কোনো কোনোটায় পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে অনেক কথাই বলা হয়েছে, আঁকা হয়েছে বিরুদ্ধ চিত্রও। বলা বাহুল্য, ব্যাঙ্ক কিংবা পুঁজিপতিদের কাছ থেকে বিজ্ঞাপন নেওয়া অথবা চাদা কি সাহায্য গ্রহণের আমি বিরোধী নই। আমি শুধু যারা বিজ্ঞাপনের সাহায্যে পুঁজিপতিদের প্রচারণা করে টাকা নেওয়াকে হালাল আর এঁদের দেয়া সাহিত্য-পুরস্কার গ্রহণ করাকে হারাম মনে করেন তাদের স্ববিরোধিতার প্রতিই পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাচ্ছি। প্রসঙ্গত স্মরণীয়, পুরস্কারের জন্য বই দাখিল করা মোটেও বাধ্যতামূলক নয়। বই দাখিল করা না করা সম্পূর্ণভাবে লেখকের ইচ্ছাধীন। যারা এসব পুরস্কার নেওয়াকে অপমানজনক মনে করেন তাঁরা বই দাখিল না করলেই তো পারেন। তা না করার সম্পূর্ণ স্বাধীনতা তাদের রয়েছে। যদিও বা কারো অজ্ঞাতে তার বই গায়ে পড়ে কোন হিতৈষী সাবমিট করে বসেন, সে খবর দীর্ঘকাল লেখকের অজানা থাকার কথা নয়। কারণ সাবমিট করা সব বইয়ের তালিকা ‘বই’ পত্রিকায় নিয়মিতই প্রকাশিত হয়ে থাকে। তার ওপর প্রকাশকের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগ থাকে হরহামেশাই। আর পুরস্কার ঘোষিত হয় বই সামিটের অন্তত ছ মাস পরে। কাজেই প্রাইজের জন্য সাবৃমিট করা বইয়ের তালিকা থেকে নিজের বই তুলে নেওয়া তথা উইথড্র করার যথেষ্ট সময় লেখক পেয়ে থাকেন। সে সময়ের সদ্ব্যবহার যদি তিনি নাও করে থাকেন অন্তত পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের সময় লেখক সে কথাটা স্বচ্ছন্দে উল্লেখ করতে পারেন এবং সেটা করাই অধিকতর শোভন ও যুক্তিসঙ্গত। 

বই দাখিল করে পুরস্কার পান নি এমন কেউ কেউ কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে এ মর্মে বিবৃতি দিয়েছেন যে, ‘সাহিত্য-পুরস্কার গ্রহণ আমাদের কবি-সাহিত্যিকদের পক্ষে কোনো সম্মান ও শ্লাঘার বিষয় নয়।’ কেন সম্মান ও শ্লাঘার বিষয় নয় তা তারা দয়া করে ব্যাখ্যা করেন নি। তারা নিজেরাও স্বীকার করেছেন এসব পুরস্কারের সঙ্গে কোনো শর্ত নেই। কোনো মতবাদ প্রচার বা সমর্থনের দায় নেই লেখকদের বিন্দুমাত্রও। যারা এসব পুরস্কারের অর্থ জোগাচ্ছেন তাদের মতাদর্শের বিরুদ্ধ বইয়েরও এসব পুরস্কার পেতে কোন বাধা নেই, বাধা হয় নি এ যাবৎ। লেখার ব্যাপারে লেখকরা সম্পূর্ণ স্বাধীন। মতাদর্শ নির্বিশেষে যে কোনো সুলিখিত বই এসব পুরস্কার পেয়ে থাকে। এ যাবৎ পেয়েও এসেছে। আমাদের মধ্যে যারা পুঁজিবাদবিরোধী, যেমন–শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, শামসুর রাহমান, সরদার জয়েন উদ্দীন প্রমুখ, তাঁরা যেমন এসব পুরস্কার পেয়েছেন, তেমনি যারা ইসলামি ভাবধারা অনুসারী, যেমন, বরকতউল্লাহ, আকবর উদ্দীন, ফররুখ আহমদ প্রমুখ, তাঁরাও পেয়েছেন। এসব পুরস্কার পাওয়ার আগে বা পরে এঁদের কেউই পুঁজিবাদ বা পুঁজিপতিদের কোন রকম প্রচারণায় লিপ্ত হয়েছেন, তেমন কথা আমি অন্তত শুনি নি।

বলা বাহুল্য, ছোট বড় কোনো সাহিত্য-পুরস্কারই সহজলভ্য মোয়া নয়। এক একটা বই লিখতে কত বিনিদ্র রজনী কাটাতে হয়, খরচ করতে হয় কতখানি মেদ মগজ তা খাঁটি লেখক মাত্রেরই জানা। তেমন করে লেখার জন্য যে পুরস্কার, আমার মতে তা লেখকের ‘অর্জিত ধন’–তা পড়ে পাওয়া কিম্বা অনুগ্রহের দান নয়। তা চাইতে হয় না অনুগ্রহ প্রার্থীর মতো বা লিখতে হয় না ঐসব পুরস্কারের জন্য বই নেহাত বশংবদের মতো। শওকত ওসমানের কাঁকরমণি, তস্কর ও লস্কর, এতিমখানা ইত্যাদি তো দারুণ পুঁজিবাদবিরোধী বই। তার পুরস্কার প্রাপ্ত ক্রীতদাসের হাসিকে তো আইউব শাসনামলের রূপক হিসেবেও নেওয়া যায়। অর্থাৎ নির্যাতনের সাহায্যে কারো মুখে হাসি ফোঁটানো যায় না এ কথাই তো তিনি বলতে চেয়েছেন রূপকের মারফত। ইচ্ছা করলে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রায় সব বইয়েরই মূল বক্তব্যের সাহায্যে এর কোনোটাই যে পুঁজিবাদের সমর্থনে রচিত নয় তা প্রমাণ করা যায়। বরং অনেক বইতে পুঁজিবাদবিরোধিতা পেয়েছে প্রকাশ। প্রাগুক্ত বিবৃতিতে এমন কথাও লেখা  “আমাদের কবি সাহিত্যিকগণ দরিদ্র হতে পারেন, কিন্তু ‘আদমজী’, ‘দাউদ’ পুরস্কারের অর্থে তারা জীবন ধারণ করবেন বা এই সমস্ত নামকে কবিদের নামের সঙ্গে যুক্ত করে গর্ববোধ করবেন, আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের এরূপ করুণ ও ধিক্কারজনক অবস্থার যত শীঘ্র পরিসমাপ্তি ঘটে, ততই মঙ্গল।” নিঃসন্দেহে অত্যন্ত মহৎ ও উচ্চাঙ্গের আবেগ। তবে সবিনয়ে জিজ্ঞাসা করা যায়, ‘আমাদের সাহিত্যক্ষেত্রের এরূপ করুণ ও ধিক্কারজনক অবস্থা’ দেখে শুনে, মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেও এঁদের কেউ কেউ কেন সে ‘ধিকৃত’ অবস্থার শরিক হতে ঐ পুরস্কারের আশায় নিজেরা বই সাবমিট করেছিলেন? আমাদের পুরস্কার প্রাপ্ত কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কেউ আদমজী, দাউদ পুরস্কারের অর্থে জীবন ধারণ করেন বা করছেন এ অপূর্ব তথ্য আমার জানা ছিল না, শুনি নি কোনোদিন–আর এ সম্ভব বলেও আমার বিশ্বাস নয়। এ যুগে পাঁচ হাজার টাকায় জীবন ধারণ করা সম্ভব–এ এক বা দুই বাতুল ছাড়া কেউ বোধ করি বিশ্বাস করবে না। প্রবীণ শওকত ওসমান থেকে তরুণ শামসুর রাহমান, হাসান আজিজুল হক পর্যন্ত সবাই কোনো না কোনো চাকরি করেই জীবিকা অর্জন করে থাকেন–এ তথ্য এ বিবৃতিকারদের জানা না থাকার কথা নয়। এ বিষয়ে প্রবীণ-নবীন সবাই সমান, অর্থাৎ সকলকেই লেখার বাইরে অন্য কিছু একটা করে নিজের ও পরিবারের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করতে হয়। নোবেল প্রাইজের পরিমাণ লক্ষাধিক টাকা। সে টাকা নিয়েও রবীন্দ্রনাথ জীবন ধারণ করতেন বা করেছেন তেমন কথা শোনা যায় নি। পাঁচ হাজার টাকায় কোনো চাওয়া পূরণ হতে পারে, জীবন ধারণে স্বপ্নাতীত। 

সমাজের অন্য সব স্তরের মতো পুঁজিপতিদের মধ্যেও শ্রেণীভেদ আছে–বড় ছোট, মাঝারি, ক্ষুদ্র-বৃহৎ ইত্যাদি। সাধারণভাবে রবীন্দ্রনাথ যাকে ‘ছোট টাকা’ আর ‘বড় টাকা’ বলে বিঘোষিত করেছেন। পুঁজির পরিমাণ আর শিল্প ও ব্যবসার আকার আয়তন অনুসারে কেউ হয়তো কয়েক হাজার, কেউ বা কয়েক শ লোক খাটান। কিন্তু উভয়ের চরিত্র একই–পুঁজিবাদের যা চরিত্র তা ছোট আর বড়তে তেমন তারতম্য সৃষ্টি করে না। তারতম্য সৃষ্টি করে স্রেফ মুনাফার বেলায়। পবিত্র কোরান-হাদিসের ব্যবসা যারা করেন তারাও মুনাফাটা কর্মচারী আর শ্রমিকদের মধ্যে বেঁটে দেন না। আমাদের দেশে এখনো লর্ড বিভারব্রুক (Beaverbrook) জন্মান নি সত্য কিন্তু ইতিমধ্যে তার ক্ষুদ্র সংস্করণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বেশ কয়টা গড়ে উঠেছে, অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানায় যারা তিন-চারটা পত্রিকার মালিক হয়ে কয়েক শ লোককে খাটান, বহু প্রগতিশীল কবি সাহিত্যিক ঐসব প্রতিষ্ঠানে খেটে জীবিকা অর্জন করে থাকেন। কিন্তু বই লেখার খাটুনি, বিশেষ করে সৃষ্টিধর্মী লেখার শ্রম কি প্রুফ দেখা কি সাংবাদিকী লেখার চেয়ে কম? বলা বাহুল্য, খেটে জীবিকা অর্জন যেমন, তেমনি খেটে বই লিখে সাহিত্য-পুরস্কার গ্রহণও কিছুমাত্র অসম্মানের নয়। মাস মাইনের যে কোনো চাকরির চেয়ে মোটামুটি উচ্চমানের একটা বই লেখার খাটুনি অনেক অনেক বেশি। এ সত্য প্রতিটি লেখকেরই জানা। 

আমি ওপরের কথাগুলি নিন্দাচ্ছলে বলছি না। আমি বলতে চাচ্ছি, আমাদের গোটা সমাজই যেখানে পুঁজিবাদী, সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো যেখানে পুরোপুরি পুঁজিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত, সেখানে ব্যক্তিগতভাবে আমরা চাই না চাই, পুঁজিবাদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে চলা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। পুঁজিপতিদের নামাঙ্কিত পুরস্কার গ্রহণ করলে পুঁজিপতিদের ‘চরণাশ্রিত’ হয়ে লেখকদের আত্মবিক্রয়ের সম্ভাবনা আছে মনে করে এমন কাজকে ধিক্কারজনক যাঁরা বলছেন তারাও যে কীভাবে পুঁজিপতিদের দ্বারস্থ হচ্ছেন বা হতে বাধ্য হচ্ছেন, তার প্রতিই মাত্র আমি ইঙ্গিত করতে চেয়েছি ওপরে। না হয়, অন্তত জীবিকার ব্যাপারে কারো নিন্দা করা আমার উদ্দেশ্য নয়। কুমির নির্বংশ হওয়ার আগে জলে বাস করে কুমিরের অস্তিত্ব অস্বীকার করা স্রেফ ইচ্ছা করে উট পাখি সাজা। 

সাম্যবাদী কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি-পুরস্কার পেয়েছিলেন, তখন ‘স্টেটসম্যান’ মক্তব্য করেছিল—’জ্যাঁ পল সাত্রের পক্ষে যা সহজ, ভারতের বর্তমান সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরম শত্রু হয়েও সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের পক্ষে তা (অর্থাৎ রাষ্ট্রপতি-পুরস্কার প্রত্যাখ্যান) সম্ভব হয় নি।’ ওদের রাষ্ট্রপতি-পুরস্কারেরও অর্থমান পাঁচ হাজার। বলা বাহুল্য, আমাদের অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। 

প্রচলিত সাহিত্য-পুরস্কার বিরোধী তাদের বিবৃতিতে এমন দাবিও করেছেন : ‘সাহিত্য-পুরস্কারগুলিকে শিল্পগোষ্ঠী বা ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠানের নামাঙ্কিত না করে বায়ান্ন সালের মহান ভাষা আন্দোলন এবং ঊনসত্তরের উত্তাল গণসংগ্রামের বীর শহিদদের মধ্যে থেকে নির্বাচিত নামে ঘোষণা করার প্রস্তাব করুন।’ অতি উত্তম প্রস্তাব, এমন প্রস্তাবে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু টাকা? সেতো আর প্রস্তাবের সঙ্গে সঙ্গে আলাউদ্দিনের দৈত্য এসে দিয়ে যাবে না কারো হাতে। জনসাধারণ থেকে চাদা তুলে তা দিয়ে শহিদদের নামে সাহিত্য পুরস্কার ঘোষণার তেমন প্রস্তাব কেন যে তারা দিলেন না বুঝতে পারছি না, দিলে তাই হতো সমুচিত ও যুক্তিসঙ্গত। এঁদের মতে পুরস্কারের টাকাটা আদমজী, দাউদ কিম্বা ব্যাঙ্ক-প্রতিষ্ঠানগুলোই আগের মতো দিতে থাকুক কিন্তু ওদের নাম নেওয়া চলবে না মুখে! টাকাদাতার নাম ভুলে থাকা কি মুছে ফেলা সঙ্গত কিনা সেটা বিবেক আর নৈতিকতার প্রশ্ন। কিন্তু আদৌ বাস্তবে কিনা তাও বিচার করে দেখা প্রয়োজন। ধরা যাক, অর্থ-প্রদানকারী শিল্পপতি কি শিল্পগোষ্ঠীর নাম উহ্য রেখে শহিদ বরকত’ কিংবা ‘শহীদ আসাদুজ্জামান সাহিত্য-পুরস্কার না হয় ঘোষণা করা হলো। এতে কি পুরস্কারের চরিত্র বদলে যাবে? আর ব্যাপারটি তো ওখানেই চুকে খতম হয়ে যাবে না। টাকার উৎস কিছু লোকের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা সম্ভব হলেও সকলের কাছ থেকে তা সম্ভব হবে না কিছুতেই। বিশেষত যে সংস্থার মারফত এ পুরস্কারগুলি বিতরিত হবে তা তো শূন্য মার্গে বিচরণশীল হওয়ার কথা নয়। তেমন সংস্থার নিশ্চয়ই খাতাপত্র, হিসাব-নিকাশ আর তা লেখা-জোকার ব্যবস্থা থাকবেই। টাকা দাতা শিল্পপতি বা শিল্পগোষ্ঠীর নাম-ধাম অন্তত সেখানে তো লিখে রাখতেই হবে। তা হলে কি বুঝতে হবে ঐ অনুচাষীদের নাম খাতা-পত্রে লেখা থাক তাতে ক্ষতি নেই, কিন্তু বাইরে জাহির করা চলবে না! বলতে পারা যাবে না ‘আদমজী শহিদ বরকত কিংবা ‘দাউদ শহিদ আসাদুজ্জামান সাহিত্য-পুরস্কার! কারণ এ করা হলে পুঁজিপতিদের নামাঙ্কিত হওয়ার অপরাধ আর পাপ তো পুরোপুরিই থেকে যাবে। মনে হচ্ছে, আমাদের এ বন্ধুদের আদম চৌধুরী আর দাউদ মিয়ার পুকুরের রুই কাতলার প্রতি তেমন অরুচি নেই, কিন্তু পুকুর দুটির মালিকের নাম উচ্চারণেই তাদের যত আপত্তি! একেই বলে ভাবের ঘরে চুরি। শহিদদের নামে সাহিত্য পুরস্কার প্রবর্তনে আমার ষোল আনা সায় আছে, এ ব্যাপারে বিবৃতিকারীরা। উদ্যোগ গ্রহণ করলে আমি যথাসাধ্য সাহায্য করতেও প্রস্তত। তবে যেখানে শর্তহীন ভাবেও কৃতজ্ঞতা স্বীকৃতির উহ্য, লেখ্য, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কোন দায় নেই, তেমন অবস্থায়ও আমি অকৃতজ্ঞ হতে রাজি নই। অকৃতজ্ঞতা আমাদের সেকেলে’ নৈতিক বোধের বিরোধী। কৃতজ্ঞতা মহৎ চরিত্রের একটি লক্ষণ–সে কথা না হয় নাই উল্লেখ করলাম। মরহুম ডক্টর শহীদুল্লাহ সাহেব একবার এক পত্রে আমাকে লিখেছিলেন–যে মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞ নয় সে আল্লাহর প্রতিও কৃতজ্ঞ নয়। 

॥ ৩ ॥

সাহিত্য-শিল্প যেমন দীর্ঘ মেয়াদি ব্যাপার তেমনি সে সবের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানাদির গড়ে ওঠা একটা জন-স্বীকৃত ঐতিহ্যে রূপ নিতেও বেশ সময় লাগে। তাই এ সব প্রতিষ্ঠানকে গড়ে ও বেড়ে ওঠার সময়-সুযোগ দিতে হয়। কালে কালে সব কিছুরই সূচনার ইতিহাস মানুষ ভুলে যায়, প্রতিষ্ঠান আর তার ঐতিহ্যই থাকে বেঁচে। এবং কালক্রমে রূপ নেয় জাতীয় প্রতিষ্ঠানে। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, এশিয়াটিক সোসাইটি, রাজশাহীর বরেন্দ্র সমিতি, বলদা মিউজিয়াম সবই বিত্তশালীদের অর্থে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান। এমন কি বিশ্বকবির বিশ্বভারতীও এর ব্যতিক্রম নয়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ বিভাগীয় ‘চেয়ার’, ‘মেডেল বৃত্তি’ ও ‘লেকচার’ বিত্তবান পুঁজিপতিদেরই দান! দ্বারভাঙা বিল্ডিং এর দ্বারভাঙা নাম বিনা কারণে হয় নি। এ সব বিত্তশালীদের অনেকেই হয়তো অত্যাচারী ও প্রজাপীড়ক ছিল, কিন্তু সে কথা কে আজ স্মরণে রেখেছে? পীড়ন-শোষণ কখনো কায়েমি হয়ে থাকে না, কায়েমি হয়ে থাকে সকর্ম আর তার স্মৃতি। হাজী মুহসিনও এক জমিদার বংশেরই ওয়ারিশ–আর জমিদার কোনো কালেই নিষ্কলঙ্ক ছিল ইতিহাসে তেমন প্রমাণ নেই। গোড়াতে যদি এঁদের নাম চিহ্নিত করার ধুয়া উঠতো তাহলে অনেক প্রতিষ্ঠানই গড়ে ওঠারই সুযোগ পেত না। পূর্ব পাকিস্তানে দানশীল বিত্তবানের সংখ্যা অতি নগণ্য,তাই অনেক ব্যাপারে সরকারের ওপর নির্ভর না করে পারা যায় না। ভাষা-আন্দোলনের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। কিন্তু তার যাবতীয় ব্যয়ভার সরকারকেই করতে হয় বহন। অথচ সরকার ছিল একদিন ভাষা-আন্দোলনের পরম শত্রু। বাংলা উন্নয়ন বোর্ডও সরকারি অর্থেই পরিচালিত। আমাদের অন্যতম সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ‘বুলবুল ললিতকলা একাডেমী’ শুধু যে সরকারি সাহায্য পেয়ে থাকে তা নয়, অনেক শিল্পীপতি আর ব্যাঙ্কের কাছ থেকেও অর্থ-সাহায্য পায় ও নিয়ে থাকে। এ তথ্যও বোধ করি অনেকেরই জানা। এ সব সাহায্য ছাড়া ‘বুলবুল একাডেমী’ টিকে থাকতে পারতো কিনা সন্দেহ। বিত্তবান আর শিল্প প্রতিষ্ঠানের আর্থিক সাহায্য ছাড়া আজো আমাদের কোনো বড় রকমের সাহিত্য কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করা যায় না–’সোভেনিয়র’ বা ‘স্মারক পুস্তিকা’র তাৎপর্য ও ভূমিকা যারা কখনো এ ধরনের অনুষ্ঠান করেছেন তাদের কাছে অজানা নয়। ওপরে যে এক সাহিত্য সম্মেলনের উল্লেখ করেছি তাও এ পরিপ্রেক্ষিতেই বিচার্য। যারা পুঁজিপতি ‘নামাঙ্কিত’ সাহিত্য পুরস্কার গ্রহণে অসম্মত তারাও কী করে যে পুঁজিপতিদের কৃপাপ্রার্থী তা দেখাতেই শুধু তথ্যটার উল্লেখ করা হয়েছে এ লেখায়। পাকিস্তান লেখক সংঘও সরকারি উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত, গোড়ার দিকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ যে তার ওপর ছিল না তা নয়। কিন্তু লেখকরা আজব চরিত্রের মানুষ। যারা খাঁটি ও আন্তরিক শিল্পী তাদের অন্তরে সব সময় একটা ‘বিদ্রোহী সত্তা’ প্রচ্ছন্ন থাকে। তাই দীর্ঘদিন এদের নিয়ন্ত্রণে রাখা কারো পক্ষে সম্ভব হয় না। লেখক সংঘের ব্যাপারেও এ দেখা গেছে। লেখক সংঘের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্যরা বহুবার সরকারি কোনো নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আর বিবৃতি যে দিয়েছে তা ওয়াকিফহালদের ভাল করেই জানা। আমাদের ভাষা আর সাহিত্যের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধেও, বহু প্রবীণ ও তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা যখন চুপ মেরে থেকেছেন অথবা ঝোঁপ বুঝে কোপ মেরেছেন, তখনও লেখক সংঘের সদস্যরা সোচ্চার হতে দ্বিধা করেন নি এতটুকু। সরকারের রবীন্দ্র-বিরোধিতা একটি সুপরিচিত ব্যাপার। লেখক সংঘের সদস্যরা সাহস আর ধৈর্যের সাথে তারও মোকাবিলা করতে কসুর করেন নি। ঐ বিরুদ্ধতার সবচেয়ে মূল্যবান জবাব দিয়েছেন লেখক সংঘের অন্যতম সদস্য, ‘দাউদ’ পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. আনিসুজ্জামান, রবীন্দ্রনাথ সম্বন্ধে একটি সুপরিকল্পিত বই সম্পাদনা করে।

শহীদুল্লাহ কায়সার দীর্ঘকাল ধরে একটি সুবিদিত সরকারবিরোধী দৈনিক পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। আর তার পুঁজিবাদ বিরোধিতাও সরকার বা অন্য কারো অজানা নয়, তবুও তার পক্ষে ‘আদমজী সাহিত্য-পুরস্কার পেতে কোনো বাধা হয় নি। সরকার প্রবর্তিত ট্রাস্ট পত্রিকায় চাকরি করেও শামসুর রাহমানইতো আমাদের বর্ণমালার বিরুদ্ধে আক্রমণের সবচেয়ে জোরালো উত্তর দিয়েছেন কবিতার মাধ্যমে। যে সব প্রবীণ আর তরুণ কবি ‘দাউদ’ বা ‘আদমজী’ সাহিত্য-পুরস্কার গ্রহণ করলে ‘পুঁজিপতিদের চরণাশ্রিত হয়ে পড়ার কাল্পনিক ভয়ে এমন যত সব বেসামাল উক্তি করেছেন তারা আমাদের এ সব তরুণদের দিকে তাকিয়ে দেখলে বুকে সাহস আর মনে বল পাবেন। আর বুঝতে পারবেন, খাঁটি লেখকদের চরিত্র এমন হালকা নয় যে, মাত্র পাঁচ হাজার তংকার বিনিময়ে তাঁরা পুঁজিপতিদের চরণাশ্রিত হয়ে পড়বেন। আমাদের সাহিত্যের খবরাখবর যারা রাখেন তারা জানেন, এখনকার লেখক সংঘ ঠিক সূচনার যুগের লেখক সংঘ নয়। নয় বলেই ‘মহাকবি সম্মেলন’, স্বদেশী গানের আসর ‘আফ্রো-এশীয় সাহিত্য সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠান প্রভৃতির আয়োজন করা লেখক সংঘের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। লেখক সংঘের মুখপত্র ‘পরিক্রমে আমি এ যাবত সরকার কিংবা পুঁজিপতিদের প্রচারণামূলক কোনো লেখা দেখি নি। কালের দীর্ঘ ব্যবধানে নোবেল প্রাইজের আজ এমন একটা বিশ্বব্যাপী ঐতিহ্য সৃষ্টি হয়েছে যে, আলফ্রেড নোবেলের ডিনামাইট আবিষ্কার আর তার সর্বাত্মক ধ্বংসর ভূমিকার কথা লোকে ভুলেই গেছে–তার দান ও অবদানের মূল্যটাই রয়ে গেছে চিরজীবী হয়ে। আমার বিশ্বাস, অনুরূপভাবে ‘আদমজী’ বা ‘দাউদ শিল্পগোষ্ঠীর যদি কোন অশুভ ভূমিকা থেকেও থাকে, কালক্রমে সমাজ বিবর্তনের সাথে সাথে তা মানুষের স্মৃতি থেকে মুছে যাবে, টিকে থাকবে তাদের অবদান আর তার থেকে সৃষ্ট ঐতিহ্যটুকু। অবশ্য ক্ষেত্র আর পরিমাণ অনুসারে তা হবে ক্ষুদ্রায়তন।

তবে সব কিছুই কালের ওপর, সমাজ বিবর্তন আর তার মূল্যবোধের ওপরই নির্ভরশীল। যা কিছুতে শুভের সম্ভাবনা আছে, তাকে বিনষ্ট করার আমি বিরোধী। আর এও আমার বিশ্বাস, মানুষের মতো কোন প্রতিষ্ঠানও অশোধনীয় নয়। 

[‘সাহিত্য ও সাহিত্য-পুরস্কার’ প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৯৭৪-এ সাহিত্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ গ্রন্থে।]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *