১৫. তিবলিস থেকে প্রতিবেদন

১৫

তিবলিস থেকে প্রতিবেদনটি পাঠানো হয়েছিল ১৮৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর। বারোটি ঘোড়াকে হয়রান করে এবং আরও বারোটিকে রক্তাক্ত না হওয়া পর্যন্ত পিটিয়ে একজন বার্তাবাহক নববর্ষের আগের সন্ধ্যায় সেটা প্রিন্স চেরনিশভের কাছে পৌঁছোয়। তিনি তখন সমর বিভাগের মন্ত্রী। ১ জানুয়ারি ১৮৫২ তারিখে চেরনিশভ অন্যান্য কাগজপত্রের মধ্যে ভরন্তসভের চিঠিটাও সম্রাট নিকোলাসের কাছে নিয়ে গেলেন।

চেরনিশভ ভরন্তসভকে অপছন্দ করতেন। কারণ, সবাই ভরন্তসভকে শ্রদ্ধা করত। আরও কারণ, ভরসভের প্রচুর সম্পত্তি এবং তিনি ছিলেন আসলেই অভিজাত। অন্যদিকে চেরনিশভ দরিদ্র অবস্থা থেকে বড় হয়েছেন। কিন্তু বিশেষ কারণটা ছিল ভরন্তসভের প্রতি সম্রাটের দুর্বলতা। তাই চেরনিশভ যেকোনো সুযোগে ভরসভের ক্ষতি করার চেষ্টা করতেন।

ককেশাস সম্বন্ধে আগের প্রতিবেদনটা দেওয়ার সময় তিনি ভরসভের বিরুদ্ধে সম্রাটের অসন্তোষ জাগাতে সফল হয়েছিলেন। কারণ, সেনাপতিদের বেখেয়ালের জন্য ছোট একটা ককেশীয় সৈন্যদলকে পাহাড়িরা খতম করে দেয়। চেরনিশভ এখন হাজি মুরাদের ব্যাপারে ভরন্তসভ যা করেছে, সেগুলো দিয়ে কান ভারী করতে চাইছেন। তিনি সম্রাটকে বলতে যাচ্ছেন যে ভরসভ সব সময় রুশদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের রক্ষা করে আর সুবিধা দেয়। এবার সে হাজি মুরাদকে ককেশাসে থাকতে দিয়ে অবিজ্ঞের মতো কাজ করেছে। কারণ, সে আমাদের প্রতিরক্ষার বিষয়ে গোয়েন্দাগিরি করতে এসেছে বলে সন্দেহ করা যায়। তাই ভালো হবে তাকে মধ্য রাশিয়ায় পাঠিয়ে দিলে। তার পরিবারকে পাহাড়িদের কাছ থেকে উদ্ধার করে তার বিশ্বস্ততার ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে কাজে লাগানো যাবে।

চেরনিশভের পরিকল্পনা সফল হলো না। একমাত্র কারণ, নববর্ষের দিনে সম্রাট নিকোলাসের মেজাজ বিশেষ খারাপ ছিল। ওই বিকারের সময় কোনো রকম পরামর্শ গ্রহণ করার কথা নয়। চেরনিশভের পরামর্শ তো একদমই না। তাকে বাদ দিতে পারছেন না বলেই এখন তাকে সহ্য করছেন নিকোলাস। তাকে তিনি নীতিহীন লোক মনে করেন। নিকোলাসের সিংহাসনে আরোহণের সময় সংবিধানের জন্য ডিসেম্বর ষড়যন্ত্রীদের বিচারকালে চেরনিশভ যাচারি চেরনিশভের শাস্তি নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন আর তার সম্পত্তি দখলের চেষ্টা চালান। তাই নিকোলাসের বদমেজাজকে সাধুবাদ, হাজি মুরাদ ককেশাসেই রয়ে গেলেন। তার অবস্থাও বদলাল না, চেরনিশভ অন্য কোনো সময় প্রস্তাবটি তুললে যা হতে পারত।

.

তাপমাপকে মাত্রা শূন্যের নিচে, ১৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট। সাড়ে নয়টায় চেরনিশভের দাড়িওয়ালা গাড়োয়ান শীতসকালে কুয়াশার মধ্য দিয়ে ছোট স্লেজটাকে চালিয়ে আনল। ওটা নিকোলাসের স্লেজটার মতোই। ছোট একটা বাক্সে সে বসে ছিল মোটা শরীর নিয়ে। মাথার ওপরে চোখা কুশন আকারের উজ্জ্বল নীল মখমলের টুপি। উইন্টার প্যালেসের ফটক দিয়ে গাড়িটি ঢুকিয়ে তার দোস্ত প্রিন্স দলগরুকির গাড়োয়ানকে ঘাড় নেড়ে শুভেচ্ছা জানায়। সে-ও তার কর্তাকে নিয়ে প্রাসাদে এসেছে। পুরু কাপড় লাগিয়ে প্রায় পিণ্ড বানানো বিশাল কোটের মধ্যে সে বাইরে বসে আছে অনেকক্ষণ। গাড়োয়ানের আসনে বসে জমে যাওয়া হাতগুলো ঘষে ঘষে গরম করছে। চেরনিশভ পরেছিলেন বড় একটা চাদর-রুপালি বিভারের (উদবিড়ালের মতো দেখতে চ্যাপ্টা লেজের লোমশ প্রাণী) পশমি গলাবন্ধ, মাথায় আইনমাফিক মোরগের পালক লাগানো তিন কোনা টুপি। স্লেজে ভালুকের চামড়ার পর্দাটি ওপরের দিকে উঠিয়ে তিনি সাবধানে ঠান্ডা পাগুলো বের করে আনলেন। জুতার ওপরে কোনো গলোশ (জুতাসহ পরার রাবারের পানিরোধক) পরেননি তিনি। কখনোই এই বুটগুলো পরেন না বলে তার অহংকার। তাকে সম্মান দেখিয়ে দারোয়ান দরজা খুলে ধরেছিল। জুতার নালে ঠংঠং আওয়াজ করে তিনি ঢুকলেন। ভারী চাদরটা খুলতেই একজন খানসামা তা নিয়ে নিল। চেরনিশভ আয়নার কাছে গিয়ে কোঁকড়া পরচুলার ওপর থেকে সাবধানে টুপিটা খুললেন। আয়নায় নিজেকে দেখে কপাল ও দুপাশ থেকে চুলের গোছাগুলো সরালেন পাকা হাতে। ঠিক করে নিলেন ক্রস, কাঁধে ঝোলানো সোনালি দরা (শোল্ডার-নট) এবং পদমর্যাদার বিহ্নগুলো। তারপর বয়স্ক নড়বড়ে পায়ের ওপর ভর করে গালিচামোড়া ছোট ছোট সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলেন। দর্শনার্থীদের ঘরের আজ্ঞাবহ খানসামা মাথা নুয়ে অভিবাদন জানাল। চেরনিশভ তাকে পার হয়ে ঢুকলেন ঘরের ভেতর। সম্রাটের এডিসি নতুন। মুখে তার তাজা গোলাপি আভা, চিকন গোঁফ আর জুলফিগুলো চোখের দিকে নামানো। নিকোলাসের কায়দায়। ঝকঝকে নতুন বিহ্ন, দরা ও পোশাক পরা এডিসি তাকে সসম্মানে বরণ করল।

প্রিন্স ভাসিলি দলগোরুকি সহকারী সমরমন্ত্রী। তার নীরস চেহারায় ক্লান্তির ছাপ। চুঁচালো গোঁফ আর নিকোলাসের কায়দায় তার জুলফিও চোখের দিকে টানা। প্রিন্স ভাসিলি তাকে স্বাগত জানালেন।

সম্রাট কি আছেন! মন্ত্রিসভার দরজার দিকে অনুসন্ধানী চোখে তাকিয়ে চেরনিশভ এডিসিকে জিজ্ঞেস করলেন।

মহামহিম কেবলই ফিরে এসেছেন, এডিসি জবাব দিল। তার চলাফেরা এত কোমল যে মাথার ওপর এক গ্লাস পানি রেখে দিলে তার এক ফোঁটাও যেন ছলকে পড়বে না। শরীরের ভঙ্গি গভীর ভক্তি দেখানোর মতো করে সে এগোল নিঃশব্দ দরজার দিকে।

দলগোরুকি ইতিমধ্যে তার ব্যাগ খুলে দেখে নিয়েছে, দরকারি সব কাগজ আনা হয়েছে কি না। আর চেরনিশভ জমে যাওয়া পায়ে রক্তসঞ্চালন ফিরিয়ে আনতে পায়চারি করছেন আর আউড়ে নিচ্ছেন সম্রাটকে কী বলবেন। তিনি যখন মন্ত্রিসভার দরজার কাছে, ঠিক তখন সেটা আবার খুলে গেল। এডিসি আগের চেয়েও বেশি ভক্তিভরে বের হয়ে মন্ত্রী এবং তার সহকারীকে ভেতরে ঢোকার ইশারা করল।

বিগত শতকে এক ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর উইন্টার প্যালেস আবার বানানো হয়েছিল। কিন্তু নিকোলাস ওপরতলার ঘরগুলোই ব্যবহার করতেন। চমৎকারভাবে সাজানো মন্ত্রিসভার একটি ঘরে তিনি মন্ত্রী ও উচ্চপদস্থদের প্রতিবেদন গ্রহণ করতেন। ঘরটিতে চারটি বড় বড় জানালা। সামনের দেয়ালে সম্রাট প্রথম আলেকজান্ডারের একটা বিরাট আবক্ষ তেলচিত্র। জানালাগুলোর মাঝখানে দেরাজওয়ালা দুটো দাপ্তরিক টেবিল। দেয়ালের পাশে কয়েকটি চেয়ার। ঘরের মাঝখানে বিশাল একটা লেখার টেবিল। তার সামনে নিকোলাসের জন্য একটা আরামকেদারা আর অন্য চেয়ারগুলো আগতদের জন্য, যাদের কথা শোনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

নিকোলাস বসেছিলেন কালো কোট পরে। কাঁধের ফিতেগুলো আছে কিন্তু বিহ্নগুলো নেই ওতে। তার বিশাল বপুটি চেয়ারের পেছনে হেলানো। অতিকায় ফুলে ওঠা পেটটা কারুকাজ করা ফিতে দিয়ে শক্ত করা বাধা। দৃষ্টি আগতদের দিকে স্থির নিবদ্ধ–চোখ প্রাণহীন। সামনের দিকে আঁচড়ানো টিকে থাকা চুলের গোছা এবং টাকটাকা পরচুলার মাঝের জায়গাটুকুতে কপাল ক্রমেই পিছিয়ে চলেছে। তার লম্বা, ফ্যাকাশে চেহারা সেদিন বিশেষ শীতল ও নিষ্প্রাণ। তার চিরনিষ্প্রভ চোখ আরও অনুজ্জ্বল! ওপরের দিকে ঘোরানো গোঁফের নিচে ঠোঁট দুটো চাপা। সসেজ আকারের দুটো গোঁফের ডগা রাখা হয়েছে সদ্য কামানো মোটা গালের ওপর। উঁচু কলার সে দুটোকে ঠেকা দিয়ে রেখেছে। মুখের ওপর ঠাসা চিবুকটিও চেহারায় অসন্তোষ ও বিরক্তির ছাপটিকে বাড়িয়ে দিয়েছে। তার বিরক্তির কারণ তিনি ক্লান্ত। ক্লান্তির কারণ আগের রাতে তিনি অভ্যাসমতো অশ্বারোহী সৈন্যের ছদ্মবেশে মুখোশ পরার আসরে (মাসকারেন্ড) গিয়েছিলেন। সবাই তার বিশাল দেহটির জন্য জায়গা করে দিচ্ছিল। আগের আসরে একটি মুখোশ তার গায়ের রং, চমৎকার শরীর আর মধুর কণ্ঠে তার (নি) জরাগ্রস্ত যৌন ক্ষুধাকে জাগিয়ে তুলেছিল। পরের আসরেও আসবে কথা দিয়ে সেবার সে চলে যায়।

গত রাতে সেই মুখোশ তার কাছে এসেছিল। তিনি তাকে আর যেতে দেননি। একা সময় কাটানোর জন্য সাজানো কুঠরির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। চুপিসারে সেখানে গিয়ে সেখানকার পরিচারককে পেলেন না। নিকোলাস নিজ হাতে দরজা খুলে মহিলাকে আগে ঢুকতে দিলেন।

এখানে বোধ হয় কেউ আছে! ঢুকতেই থেমে গিয়ে মুখোশ-মহিলা ফরাসিতে বললেন।

কুঠরিতে আসলেই লোক ছিল। মখমলে মোড়া ছোট সোফাটায় ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে ছিল বর্শাধারী বাহিনীর একজন অফিসার এবং ঘোমটাওয়ালা আলখাল্লা পরা কোঁকড়া চুলের এক সুন্দরী। মেয়েটি মুখোশ খুলে রেখেছিল, ক্রুদ্ধ নিকোলাসকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই সে মুখোশ দিয়ে তাড়াতাড়ি মুখটা ঢেকে ফেলল। ভয়ে পাথর হয়ে অফিসারটি সোফা থেকে উঠতেই পারল না। শুধু কাতর চোখে তাকিয়ে থাকল নিকোলাসের দিকে।

লোকের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করায় অভ্যস্ত নিকোলাস সেটা উপভোগ করতেন এবং কোনো কোনো সময় ভয়ে চুপসে যাওয়া লোকদের দয়া দেখিয়ে তিনি তাদের বিস্ময়ে অভিভূত করে মজা পেতেন। এবারে তিনি তা-ই করলেন।

ভীতবিহ্বল অফিসারটিকে বললেন, বেশ বন্ধু! তুমি আমার চেয়ে ছোট, তাই তোমার জায়গাটা আমাকে ছেড়ে দিতে পারো।

তড়াক করে উঠে দাঁড়াল অফিসারটি। প্রথমে ফ্যাকাশে, তারপর লাল হয়ে প্রায় দ্বিগুণ কুঁজো হয়ে নীরবে সঙ্গিনীর অনুসরণ করল। নিকোলাস মহিলাকে নিয়ে একা হলেন।

বোঝা গেল, সুন্দরী সঙ্গিনী একজন সুইডিশ গৃহশিক্ষিকার বছর বিশেকের কুমারী মেয়ে। সে বলল কেমন করে বাচ্চা থাকতেই নিকোলাসের ছবি দেখে তার প্রেমে পড়ে। কত গভীরভাবে তাকে চেয়েছে এবং যেকোনো উপায়ে তার চোখে পড়বে বলে ঠিক করে। এখন সে সফল, তার আর কিছুই চাই না।

নিকোলাস যেখানে মেয়েদের সঙ্গে মেশেন, মেয়েটিকে প্রাসাদের সেখানে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে নিকোলাস তার সঙ্গে এক ঘণ্টার বেশি সময় কাটালেন।

সে রাতে ঘরে ফিরে নিকোলাস তার শক্ত সরু বিছানায় শুয়ে পড়লেন। বিছানাটি নিয়ে তার অনেক গর্ব এবং গায়ে যে চাদরটি টেনে নিলেন, তিনি মনে করতেন এবং বলতেন), সেটা নেপোলিয়নের টুপির চেয়ে বিখ্যাত। ঘুমিয়ে পরতে তার অনেক সময় লাগল। তার চোখে একবার ভাসছিল মেয়েটির সুন্দর মুখে শঙ্কামেশানো আনন্দের অভিব্যক্তি, আবার তার নিয়মিত রক্ষিতা নেলিদোভার চওড়া কাঁধ। তিনি দুটোর তুলনা করছিলেন। বিবাহিত পুরুষদের লাম্পট্য খারাপ জিনিস, কথাটি একবারও তার মাথায় আসেনি। কেউ এ জন্য অনুযোগ করলে তিনি খুবই বিস্মিত হতেন। তিনি যথার্থ কাজ করেছেন, এ বিষয়ে সন্তুষ্ট হলেও কিন্তু অস্বস্তি একটা রয়েই গেল। এই অনুভূতিটার গলা টিপে মারতে যে জিনিসটা তাকে শান্ত করে, তিনি তা-ই করলেন–নিজ মহিমার কথা ভাবলেন।

অনেক দেরি করে ঘুমালেও তিনি আটটার আগেই উঠে পড়েছিলেন। প্রক্ষালনের কাজ সেরে অভ্যাসমতো তার বিশাল শরীরে বরফ ঘষলেন। প্রার্থনা করলেন (ছোটবেলা থেকে না বুঝে যে প্রার্থনা করে আসছেন তা-ই, প্রথমে যিশুমাতা, পরে যিশু ও সবশেষে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা)। তারপর তার সামরিক চাদর এবং টুপি পরে প্রাসাদের ছোট গাড়িবারান্দাটি দিয়ে বের হয়ে চলে গেলেন বাঁধের কাছে।

বাধে আইনশাস্ত্রের কলেজের পোশাক পরা তার মতোই হোঁতকা এক ছাত্রের দেখা পেলেন। পোশাকটি চিনতে পেরে ভুরু কুঁচকালেন তিনি। মুক্তচিন্তা করে বলে কলেজটি তার অপছন্দ। কিন্তু ছেলেটির স্বাস্থ্য এবং যত কষ্টে ছেলেটি নিজেকে সোজা রেখে দর্পভরে তাকে স্যালুট ঠকল, তাতে নিকোলাস নরম হলেন।

তোমার নাম কী?

পোলসাতভ, মহামহিম।

বেশ!

ছেলেটি তার হাত টুপি পর্যন্ত তুলে রেখে দাঁড়িয়ে থাকল।

নিকোলাস থামলেন।

তুমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে চাও?

মোটেই না, মহামহিম।

বোকা! নিকোলাস ঘুরে নিজের পথে চলতে শুরু করলেন। যে কথাগুলো তার মাথায় আসছিল, তা-ই উচ্চারণ করছিলেন।

কোপারভাইন…কোপারভাইন, বললেন বেশ কয়েকবার, গত রাতের মেয়েটির নাম। জঘন্য…জঘন্য, যা বলছিলেন ভেবে বলেননি। কিন্তু তা শুনে তার অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গেল।

হ্যাঁ, আমাকে ছাড়া রাশিয়া চলবে কী করে? তিনি বললেন, আগের অসন্তোষের অনুভূতিটা ফিরে আসছিল। হ্যাঁ, শুধু রাশিয়া কেন, আমি না থাকলে পুরো ইউরোপের কী হবে? তার ভগ্নিপতি প্রুশিয়ার রাজার দুর্বলতা ও বোকামির কথা ভেবে তিনি মাথা নাড়লেন।

ছোট গাড়িবারান্দাটার দিকে ফিরে আসার পথে তিনি দেখতে পেলেন, হেলেনা পাভলোভনার গাড়িটা প্রাসাদের সাল্টিকভ ফটক দিয়ে ঢুকছে। সঙ্গে একজন লাল উর্দিপরা ভৃত্য।

তার কাছে হেলেনা পাভলোভনা অকর্মা লোকদের প্রতিভূ। এরা শুধু বিজ্ঞান ও কবিতা নিয়েই নয়, মানুষকে কীভাবে শাসন করতে হবে, সেটা নিয়েও আলোচনা করে। যেন নিকোলাস যেভাবে শাসন করছে, তারা তার চেয়ে ভালো শাসন করতে পারবে। তিনি জানতেন, এ ধরনের লোকদের তিনি যতই দমিয়ে রাখেন না কেন, তারা বারবার সে কাজ করতে থাকে। তার ভাই মাইকেল পাভলোভিচের কথা মনে হলো নিকোলাসের। মারা গেছে খুব বেশি দিন হয়নি। বিরক্তি ও ব্যথায় তার মনটা ভরে গেল। ভুরু দুটো গভীরভাবে কুঁচকে তিনি ফিসফিস করে আবার মাথায় যা আসে, সেই শব্দগুলো আওড়াতে থাকলেন। প্রাসাদে ঢাকা পর্যন্ত তিনি তা করতে থাকলেন।

নিজের ঘরে ঢুকে তিনি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গোঁফের মাথা দুটো চোখা করে ঠেলে দিলেন ওপরের দিকে। কপালের দুপাশের চুলের গোছা আর টাকঢাকা পরচুলাটা ঠিক করলেন। তারপর সোজা চলে গেলেন প্রতিবেদন গ্রহণের ঘরটায়।

তিনি প্রথমেই ডাকলেন চেরনিশভকে। ঘরে ঢুকেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, নিকোলাসের মেজাজ আজ খুব খারাপ। গত রাতের ঘটনা জানতেন বলে কারণটা বুঝতে পেরেছিলেন। শীতল অভ্যর্থনা জানিয়ে চেরনিশভকে বসতে বলে নিকোলাস তার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। চেরনিশভ প্রথমে তুললেন রসদ বিভাগের কর্মকর্তাদের তহবিল তছরুপের সর্বশেষ ঘটনা; পরেরটা ছিল প্রুশিয়ায় সেনা মোতায়েনের বিষয়। তার পরেরটা নববর্ষের পুরস্কারের তালিকায় বাদ পড়া লোকদের নাম। তারপর তুললেন হাজি মুরাদের বিষয়ে ভরসভের প্রতিবেদন। সবশেষে একাডেমি অব মেডিসিনের একজন শিক্ষককে এক ছাত্রের হত্যাচেষ্টার কিছু খুঁটিনাটি অপ্রিয় প্রসঙ্গ।

নিকোলাস নিঃশব্দে ঠোঁট দুটো চেপে রেখে তহবিল তছরুপের ঘটনা শুনছিলেন আর বিশাল সাদা হাতের আংটি পরা আঙুলটি দিয়ে কাগজের ওপর টোকা দিচ্ছিলেন। চোখ দুটো আটকে ছিল চেরনিশভের কপাল ও তার ওপরে চুলের গোছাটার দিকে।

নিকোলাস বিশ্বাস করতেন, সবাই চুরি করে। তিনি জানতেন, রসদ বিভাগের কর্মকর্তাদের শাস্তি দিতে হবে। তাই সবাইকে পদাবনতির আদেশ দিলেন। তিনি জানতেন, তাদের জায়গায় যারা উঠে এল, তারাও সে কাজটিতে বিরত থাকবে না। চুরি করা ছিল কর্মকর্তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তার কাজ তাদের শাস্তি দেওয়া। এ কাজে ক্লান্ত হয়ে গেলেও তিনি ভালোভাবেই তা করছিলেন।

মনে হচ্ছে রাশিয়ায় মাত্র একজন লোক সৎ! তিনি বললেন।

চেরনিশভ সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছিলেন সে লোকটি নিকোলাস নিজে, তাই সম্মতি দিতে মৃদু হাসলেন।

তাই মনে হয়, মহামহিম।

এগুলো রেখে দিন, আমি পরে দেখব, বলে টেবিলের বাঁ দিকে কাগজগুলো রাখলেন।

তারপর চেরনিশভ পুরস্কার দেওয়ার আর প্রুশিয়ায় সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর বিষয়টি তুললেন।

নিকোলাস তালিকাটির ওপর চোখ বুলিয়ে কয়েকটি নাম কেটে দিলেন। আর সংক্ষেপে প্রুশিয়ার সীমান্তে দুই ডিভিশন সৈন্য পাঠানোর আদেশ দিলেন। ১৮৪৮ সালের ঘটনার পর দেশের মানুষকে সংবিধান দেওয়ার জন্য নিকোলাস প্রুশিয়ার রাজাকে ক্ষমা করতে পারেননি। চিঠি ও আলোচনায় আত্মীয়ের সঙ্গে (শ্যালক) সহৃদয়ভাব দেখালেও সীমান্তে সৈন্য পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যদি দরকার হয়। প্রুশিয়ার মানুষ বিদ্রোহ করলে তার আত্মীয়ের সিংহাসন রক্ষায় সে সৈন্যদের তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন। (নিকোলাস সবখানেই বিদ্রোহের আশঙ্কা দেখতেন। কয়েক বছর আগে যেমন হাঙ্গেরির বিদ্রোহ দমাতে তিনি সৈন্যদের লাগিয়েছিলেন। প্রুশিয়ার রাজাকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন, তার গুরুত্ব বাড়ানোও সৈন্য পাঠানোর আরেক কারণ।

হ্যাঁ, আমি না থাকলে রাশিয়া এখন কী করত, আবার তিনি ভাবলেন।

বেশ, আর কী আছে?

ককেশাস থেকে পাঠানো একটি বার্তা, বলে চেরনিশভ হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ সম্বন্ধে ভরন্তসভ যা লিখেছিলেন, তা জানালেন।

হায় খোদা! বললেন নিকোলাস। যাক, শুরুটা ভালোই হয়েছে!

মহামহিম যা পরিকল্পনা করেছিলেন, তা কাজে দিচ্ছে বলেই প্রমাণিত হলো, চেরনিশভ বলল।

তার কৌশল ঠিক করার প্রতিভার স্বীকৃতি নিকোলাসের জন্য সুমধুর ছিল। তিনি এই প্রতিভা নিয়ে গর্ব করতেন। কিন্তু মনের গহনে তিনি জানতেন, ওই রকম কোনো পরিকল্পনার অস্তিত্ব নেই এবং এখন তিনি তার প্রতিভার প্রশস্তি আরও শুনতে চাচ্ছেন।

কী বলতে চাচ্ছেন? তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

আমি মনে করছি, মহামহিম, আপনার পরিকল্পনা যদি অনেক আগে থেকে কাজে লাগিয়ে আমরা ধীরস্থিরভাবে বন-জঙ্গল কেটে ফেলতাম আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দিতাম, তাহলে ককেশাস অনেক আগেই। বশ্যতা স্বীকার করত। হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ থেকে আমি মনে করছি, তারা আর টিকতে পারছে না।

ঠিক, বললেন নিকোলাস।

অবশ্য বন কেটে আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে শত্রুর এলাকায় ধীরে ধীরে এগোনোর পরিকল্পনাটি ছিল এরমোনভ আর ভেলিয়ামিনভের। নিকোলাসের পরিকল্পনার ঠিক উল্টো। নিকোলাসের পরিকল্পনা ছিল শামিলের বাড়ি দখল করে ডাকাতদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দেওয়ার। যে পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৮৪৫ সালে দারগো অভিযান চালানো হয়। সে অভিযানে অনেক প্রাণহানি হয়েছিল। তা সত্ত্বেও নিকোলাস পরিকল্পিতভাবে জঙ্গল কেটে এলাকাটা ধ্বংস করে দেওয়ার প্রস্তাব তার নিজের বলে মেনে নিলেন। এতে মনে হতে পারে, বনের গাছ কেটে আর খাবার পৌঁছানোর পথ বন্ধ করে দিয়ে ধীরে ধীরে এগোনোর প্রস্তাব তার নিজের বলে জাহির করার; কারণ, তিনি ১৮৪৫ সালে অভিযানের ঠিক উল্টো যে পরিকল্পনা করেছিলেন, সেটা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা নয়। অভিযানের পরিকল্পনার জন্য তিনি গর্ব করেন, ধীরে এগোনোর পরিকল্পনা নিয়েও গর্ব করেন। যদিও একটা আরেকটার ঠিক উল্টো বলে প্রমাণিত হয়ে গেছে। চারপাশের সবার কাছ থেকে সারাক্ষণ সত্যের বদলে নির্লজ্জ তোষামোদি শুনে শুনে তার অবস্থা এমন হয়েছে যে তিনি আর নিজের অসংগতিগুলো দেখতে পান না। বাস্তবতা, যুক্তি বা আক্কেল-বুদ্ধিতে তিনি কী করছেন, বিচার করে দেখেন না। তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করেন, তার আদেশগুলো যুক্তিযুক্ত এবং ন্যায়সংগত হতে বাধ্য। কারণ, তিনি সেগুলো দিয়েছেন, সেগুলো যতই কাণ্ডজ্ঞানহীন, অন্যায্য বা পরস্পরবিরোধী হোক না কেন। পরের ঘটনাটিতে তার আদেশ তেমনি কাণ্ডজ্ঞানহীন ধরনের ছিল। সেটা ছিল একাডেমি অব মেডিসিনের ছাত্রের ঘটনা।

ঘটনাটি এ রকম : এক তরুণ পরীক্ষায় দুবার ফেল করলে তৃতীয়বার তার পরীক্ষা নেওয়া হচ্ছিল। পরীক্ষক সেবারও তাকে পাস করায়নি। তরুণটি সেটাকে অন্যায় মনে করে আর ধৈর্য রাখতে পারেনি। ক্ষিপ্ত হয়ে সে একটা কাগজকাটা ছুরি নিয়ে শিক্ষককে তাড়া করে তার গায়ে কয়েকটা আঁচড় দেয়।

তার নাম কী? নিকোলাস জিজ্ঞেস করলেন।

বেজভস্কি।

পোলিশ?

পোলিশ বংশোদ্ভূত, রোমান ক্যাথলিক, চেরনিশভ জবাব দিল।

নিকোলাস ভুরু কোঁচকালেন। তিনি পোলিশদের যথেষ্ট সর্বনাশ করেছেন। সেই সর্বনাশকে বৈধতা দিতে তাকে নিশ্চিত হতে হয় যে সব পোলিশই বদমাশ, তিনি তা-ই মনে করেন এবং তিনি যে সর্বনাশ করেছেন, সেই পরিমাণে তাদের ঘৃণা করেন।

একটু থামুন, চোখ মুদে মাথা নিচু করে তিনি বললেন।

চেরনিশভ নিকোলাসকে এ কথা বহুবার বলতে শুনেছেন। তাই জানেন কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সম্রাটকে কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করতে হয়। তিনি চিন্তায় মগ্ন হন, সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্ত তখন আপনাআপনি চলে আসে, যেন অন্তর থেকে কেউ তাকে তা করতে বলেছে। তিনি ভাবছিলেন, এই ঘটনা তার ভেতরে পোলিশদের প্রতি যেটুকু ঘৃণা জাগিয়েছে, কী করলে তা তুষ্ট হবে। ভেতরের কেউ তাকে নিচের সিদ্ধান্তটি দিল। তিনি প্রতিবেদনটির পাশে তার বড় বড় অক্ষরে তিনটি ভুল বানানে লিখলেন :

মিত্রুর যোজ্ঞ, কিন্তু খোদার রহম, আমাদের মিত্রুদন্ড নেই এবং আমি তা শুরু করতে যাচ্ছি না। তাকে বারোবার এক হাজার লোকের মধ্যে দস্তানাদৌড় দেওয়া হোক। নিকোলাস। [ভুল বানানের শব্দগুলো ভুল বানানে দেওয়া হয়েছে। সেগুলো হলো মৃত্যু, যোগ্য আর মৃত্যুদন্ড। দস্তানার মার শাস্তিতে অপরাধীকে দুই সারি সৈন্যের মধ্য দিয়ে দৌড়াতে হয় আর সৈন্যরা তাকে আঘাত করতে থাকে।

তিনি তার অস্বাভাবিক বড় প্যাচানো স্বাক্ষর দিলেন। নিকোলাস জানতেন, বারো হাজার আঘাত শুধু নির্যাতনে নিশ্চিত মৃত্য নয়, প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতাও। সবচেয়ে শক্তিশালী একটি লোককে মেরে ফেলতে পাঁচ হাজার আঘাতই যথেষ্ট। কিন্তু নির্দয়-নিষ্ঠুর হয়ে তিনি আনন্দ পান আবার রাশিয়ায় মৃত্যুদণ্ড না থাকার আনন্দও পাচ্ছেন।

ছাত্রটির ব্যাপারে নিজের সিদ্ধান্ত লিখে তিনি কাগজটি চেরনিশভের দিকে ঠেলে দিলেন।

এই যে, পড়ুন। তিনি বললেন।

চেরনিশভ পড়লেন এবং সিদ্ধান্তের প্রজ্ঞায় মুগ্ধ হয়ে শ্রদ্ধাভরে মাথা নত করলেন।

হ্যাঁ, শাস্তি দেওয়ার সময় কুচকাওয়াজের মাঠে সব ছাত্রকে হাজির থাকতে হবে। নিকোলাস বললেন।

এটা তাদের জন্য ভালো হবে। আমি সব বিপ্লবী চেতনাকে নির্মূল করে ফেলব! তিনি ভাবলেন।

তা-ই করা হবে, চেরনিশভের জবাব; একটু থেমে কপালের চুলের গোছাটি ঠিক করে ককেশাসের প্রতিবেদনটি তুললেন।

প্রিন্স ভরন্তসভের চিঠির কী জবাব দিতে হুকুম করেন?

চেচনিয়ায় বাড়িঘর আর খাদ্য পৌঁছানোর পথ বন্ধ করার আদেশ কঠোরভাবে পালন করতে হবে আর হামলা করে তাদের ব্যতিব্যস্ত করতে হবে, নিকোলাস বললেন।

আর হাজি মুরাদকে নিয়ে কী করতে আদেশ দিচ্ছেন?

কেন? ভরন্তসভ তো লিখেছে, তাকে ককেশাসে ব্যবহার করতে চায়।

এটা কি বিপজ্জনক নয়? চেরনিশভ বললেন। নিকোলাসের দৃষ্টি এড়িয়ে বললেন, আমার মনে হয় প্রিন্স ভরন্তসভ মানুষকে বেশি বিশ্বাস করেন।

তাই, আপনি কী মনে করেন? ভরসভের সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিতে চেরনিশভের অভিসন্ধি বুঝতে পেরে নিকোলাস তীক্ষ্ণভাবে প্রশ্ন করলেন।

আমি ভাবছিলাম, তাকে মধ্য রাশিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়াই নিরাপদ।

আপনি ভাবছিলেন! বিদ্রুপের সুরে বললেন নিকোলাস। কিন্তু আমি তা ভাবছি না। আমি ভরসভের সঙ্গে একমত। তাকে সেভাবেই জবাব দিন।

তা-ই দেব, বলে উঠে মাথা নুয়ে বিদায় নিলেন চেরনিশভ।

দোলগোরুকিও মাথা নুয়ে বিদায় নিল, সারা সময়ে শুধু (নিকোলাসের প্রশ্নের জবাবে) সৈন্য পাঠানোর ব্যাপারে দু-একটি শব্দ উচ্চারণ করে।

চেরনিশভের পর নিকোলাস পাশ্চাত্যের প্রদেশগুলোর জেনারেল-গভর্নর বিবিকভকে দর্শন দিলেন। অর্থোডক্স ধর্মমত মানতে নারাজ বিদ্রোহী কৃষকদের বিরুদ্ধে বিবিকভ যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তা অনুমোদন করলেন। যারা আত্মসমর্পণ করেনি, তাদের সবাইকে সামরিক আদালতে বিচারের আদেশ দিলেন। সেটাও দস্তানাদৌড়ের সমান। তারপর তিনি একটি সংবাদপত্রের সম্পাদককে সৈনিক হিসেবে খাটতে পাঠানোর আদেশ দিলেন। সম্পাদকের অপরাধ, সে কয়েক হাজার রাষ্ট্রীয় চাষিকে সম্রাটের খামারে বদলির খবর ছেপেছিল।

আমি এটা প্রয়োজন মনে করেই করছি, বললেন নিকোলাস। আমি এটা নিয়ে আলোচনা করতে দেব না।

বিবিকভ ইউনিয়েট ইউনিয়েটরা রোমের পোপকে স্বীকার করে। অন্যান্য বিষয়ে রুশো-গ্রিক অর্থোডক্স চার্চের সঙ্গে তাদের বিরোধ নেই) চাষিদের ব্যাপারে দেওয়া আদেশটির নিষ্ঠুরতা বুঝতে পারলেন। বুঝতে পারলেন (তখনকার দিনে একমাত্র স্বাধীন চাষি) রাষ্ট্রীয় চাষিদের রাজার অধীনে নিয়ে আসার অন্যায়টাও। এর ফলে ওই চাষিরা রাজপরিবারের দাসে পরিণত হবে। কিন্তু ভিন্নমত প্রকাশ করা অসম্ভব ছিল। নিকোলাসের সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হওয়ার অর্থ ছিল এখনকার চমৎকার পদমর্যাদাটি হারানো। এটা পেতে বিবিকভের চল্লিশ বছর লেগেছে এবং বেশ লাগছে এবং তাই সে অনুগতভাবে রুপালি ছোপ ধরা কালো মাথাটি নুয়ে তার সম্মতি এবং সম্রাটের নিষ্ঠুর, বিবেকহীন অসৎ ইচ্ছা কার্যকর করতে তার প্রস্তুতি জানাল।

বিবিকভকে বিদায় করে তিনি কর্তব্য সুচারুভাবে শেষ করার অনুভূতি নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন এবং বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বের হয়ে গেলেন। বিহ্ন লাগানো রাজকীয় পোশাক পরে পদকগুলো লাগালেন এবং গলায় রিবন বেঁধে অভ্যর্থনার হলে গেলেন। সেখানে ছিল এক শ জনের বেশি নারী-পুরুষ; পুরুষদের পরনে সামরিক পোশাক আর নিচু গলার অভিজাত পোশাকে মেয়েরা। তারা নিজেদের জায়গায় অস্থিরভাবে তার আগমনের অপেক্ষা করছিলেন।

নিষ্প্রাণ দৃষ্টি নিয়ে তিনি তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। স্ফীত বুক এবং উদর যেন বন্ধনীর নিচ থেকে বের হয়ে আসতে চাইছে। তার ওপর সবার ভীত অনুগত দৃষ্টি তিনি অনুভব করছিলেন। তিনি আরও বিজয়দৃপ্তভাৰ গ্ৰহণ করলেন। কাউকে চিনতে পারলে তাদের কাছে দাঁড়িয়ে দু-একটি শব্দ বিনিময় করলেন, কখনো রুশ, কখনো ফরাসি ভাষায়। তার শীতল কাঁচের মতো দৃষ্টিতে বিধে ফেলে তাদের কথাও শুনলেন।

নববর্ষের সব অভিনন্দন গ্রহণ করে তিনি সেগুলো চার্চে পাঠিয়ে দিলেন। ঈশ্বর তার ভত্য যাজকদের মাধ্যমে মাটির মানুষের মতোই নিকোলাসকে স্বাগত জানায় ও প্রশংসা করে। সেসব প্রশস্তি গ্রহণ করে ক্লান্ত হলেও তিনি তা যথাযথভাবে গ্রহণ করেন। এগুলো সবই ঘটে ঠিক যেভাবে ঘটা উচিত। কারণ, সারা বিশ্বের মঙ্গল ও সুখ তার ওপরই নির্ভর করে। এগুলোতে তিনি ক্লান্ত হলেও বিশ্বকে কখনো সাহায্যবঞ্চিত করেননি।

গির্জার নিম্নমান পাদরি জমকালো পোশাকে সজ্জিত, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। প্রার্থনা শেষ হলে তিনি ভজন শুরু করলেনচমৎকার গায়ক দল দরদভরা গলায় অনেক বছর ভজনটি ধরল। নিকোলাস চারদিকে তাকিয়ে নেলিদোভাকে দেখতে পেলেন। সুন্দর কাঁধটি নিয়ে জানালার পাশে সে দাঁড়ানো। তিনি তাকে গত রাতের মেয়েটির সঙ্গে তুলনা করার সিদ্ধান্ত নিলেন।

প্রার্থনার পর তিনি সম্রাজ্ঞীর কাছে গেলেন। পরিবারের সান্নিধ্যে কিছুটা সময় কাটালেন বাচ্চাদের ও স্ত্রীর সঙ্গে মশকরা করে। তারপর হার্মিটেজের উইন্টার প্যালেসের লাগোয়া জাদুঘর ভেতর দিয়ে রাজদরবারের মন্ত্রী ভনস্কির কার্যালয়ে গেলেন। অন্যান্য কাজের মধ্যে বিশেষ তহবিল থেকে গত রাতের মেয়েটির মাকে বার্ষিক ভাতা দিতে বললেন। সেখান থেকে তার নিয়মিত ভ্রমণে বের হলেন।

রাতের খাবার দেওয়া হয়েছিল পম্পিয়ান হলে। নিকোলাস ও মিখায়েলের ছোট ছেলেদের সঙ্গে আমন্ত্রিত ছিলেন ব্যারন লিভেন, কাউন্ট রেজভস্কি, দোলগোরুকি, প্রুশিয়ার রাজদূত এবং প্রুশিয়ার রাজার এডিসি।

সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর আগমনের জন্য অপেক্ষা করার সময় ব্যারন লিভেন আর প্রুশিয়ার রাজদূতের মধ্যে পোল্যান্ডের খারাপ খবরটি নিয়ে মজার আলাপ হচ্ছিল ফরাসি ভাষায়।

পেপাল্যান্ড আর ককেশাস রাশিয়ার দুই জ্বালা, বললেন লিভেন। দেশ দুটোর জন্য আমাদের এক লাখ করে সৈন্য দরকার।

আপনি কী বললেন, পোল্যান্ড? রাজদূত কপট বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলেন।

হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমাদের এই জ্বালা দিয়ে মেটারনিশ বড় চাল চেলেছেন…

এই সময় সম্রাজ্ঞী হাসি ধরে রেখে মাথা কাঁপাতে কাঁপাতে ঢুকলেন, তার পিছু পিছু নিকোলাস।

খাওয়ার সময় নিকোলাস হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণের কথা বললেন। আরও বললেন, গাছ কেটে আর বেশ কিছু ছোট ছোট দুর্গ বসিয়ে তিনি পাহাড়িদের আটকে ফেলার যে ব্যবস্থা নিয়েছেন, তার ফলে ককেশাসের যুদ্ধ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাওয়া উচিত।

সেদিন সকালেই নিকোলাসের নিজেকে মহাকৌশলবিদ ভাবার দুর্বলতা নিয়ে রাজদূতদের মধ্যে আলাপ হয়েছিল। তাদের মধ্যে দ্রুত চোখের ইশারা বিনিময় হলো। সেই রাজদূতই নিকোলাসের কৌশলের ভূয়সী প্রশংসা করলেন। বললেন, নিকোলাসের কৌশল-মেধা আবার প্রমাণিত হলো।

খাওয়ার পর নিকোলাস গেলেন ব্যালে নাচের আসরে। সেখানে শত শত স্বল্পবসনা মেয়ে কুচকাওয়াজ করে যাচ্ছিল। তাদের মধ্যে একজন তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তিনি জার্মান ব্যালে পরিচালককে ডাকিয়ে আনালেন এবং তাকে একটা হিরের আংটি উপহার দেওয়ার আদেশ দিলেন।

পরদিন চেরনিশভ তার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে এলে নিকোলাস আবার ভরন্তসভকে দেওয়া আদেশ পাকা করলেন। হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছেন, তাই চেচেনদের ওপর হামলা বাড়াতে হবে এবং তাদের বেষ্টনী আরও চেপে ধরতে হবে।

চেরনিশভ সেই কথাই লিখলেন ভরন্তসভকে। আরেকজন বার্তাবাহী আরও ঘোড়ার গায়ে আঁচড় বাড়িয়ে জোর কদমে তিবলিস ছুটে গেল।

১৬

নিকোলাসের আদেশ মানতে সে মাসেই সঙ্গে সঙ্গে চেচনিয়ায় আক্রমণ করা হয়, সময়টা ১৮৫২ সালের জানুয়ারি।

আক্রমণে পাঠানো সেনাদলে ছিল দুই ব্যাটালিয়ন পদাতিক, দুই কোম্পানি কসাক এবং আটটি কামান। হালকা পদাতিক সৈন্যরা উঁচু-নিচু রাস্তার দুপাশ দিয়ে লম্বা সারিতে কুচকাওয়াজ করে যায়। লম্বা বুট, ভেড়ার চামড়ার কোট এবং মাথায় লম্বা টুপি পরা সৈন্যদের কাঁধে রাইফেল, বেল্টভর্তি কার্তুজ।

বৈরী এলাকার মধ্য দিয়ে যত দূর সম্ভব নিঃশব্দে যাওয়াটাই নিয়ম। শুধু মাঝেমধ্যে খাড়িতে নামার সময় নড়াচড়ায় কামানগুলো ঝংকার তুলছে। অথবা কামানটানা ঘোড়াগুলো নিঃশব্দে চলার আদেশ না বুঝে নাক দিয়ে বা চিহি করে ডাক দিয়ে ফেলেছে। কখনো সারি দুটোর দূরত্ব বেশি হয়ে গেলে কমান্ডার রেগে চাপা হেঁড়ে গলায় সৈন্যদের বকেছে। শুধু একবার নৈঃশব্দ্য ভেঙে গেল! হঠাৎ কাঁটাগাছের ঝোঁপের ভেতর থেকে দৌড়ে সৈন্যদের মধ্যে ঢুকে পড়ল বুকের দিকটা সাদা আর পিঠ কালো একটি ছাগল। ওটার পিছু পিছু দৌড়ে এল একই রকম রঙের একটা পাঁঠা, শিং দুটো পেছনের দিকে বাকানো। বড় বড় ঝাপে সুন্দর প্রাণী দুটো গোলন্দাজ বাহিনীর কাছে চলে এলে সৈন্যরা হইহল্লা করে ওগুলোর পেছনে দৌড়াতে শুরু করে। উদ্দেশ্য, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা। কিন্তু ছাগল দুটো পিছিয়ে সৈন্যদের মধ্য দিয়ে বের হয়ে গেল। কয়েকজন ঘোড়সওয়ার পিছু নিলে তাদের কুকুরগুলো পাখির মতো উড়ে পাহাড়ের দিকে ধাওয়া করে।

তখনো শীতকাল। দুপুর হতে চলেছে। খুব ভোরে রওনা করে সেনাদল তিন মাইল হেঁটে এসেছে। সূর্য অনেক ওপরে উঠে তেজি হয়ে যাওয়ায় সৈন্যদের গরম লাগছিল। সূর্যের আলো এত উজ্জ্বল যে বেয়নেটের চকচকে ইস্পাতের ফলার দিকে তাকানো কষ্টকর ছিল। কামানে লাগানো পিতলের ওপর প্রতিফলন ছিল ছোট ছোট সূর্যের মতো। সেদিকে তাকানোও কষ্টকর।

সেনাদলটি টলটলে পানির খরস্রোতা একটি ঝরনা পার হয়ে এসেছে। তাদের সামনে চষা খেত আর ঘাসভর্তি অগভীর খাদ। আরও সামনে অন্ধকার রহস্যময় বনে ঢাকা পাহাড়গুলো। সেগুলোর পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে দুরারোহ পাহাড়। তারও পরে চিরসুন্দর সব সময় রূপ বদলানো সুউচ্চ দিগন্তে আলোর সঙ্গে খেলা করে হিরের মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে বরফঢাকা চুড়া।

কালো কোট, লম্বা টুপি আর কাঁধে তলোয়ার নিয়ে ৫ম কোম্পানির সামনে ছিল বাটলার। দেহরক্ষী বাহিনী থেকে আসা লম্বা সুদর্শন অফিসার। বেঁচে থাকার আনন্দ, সেই সঙ্গে মৃত্যুভয়, কিছু একটা করার আগ্রহ আর একক ইচ্ছায় চালিত বিশাল একটা কিছুর অংশ হতে পারার সচেতনতার কারণে সে প্রাণবন্ত। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে কোনো অভিযানে যাচ্ছে। সে ভাবছিল, কী করে যেকোনো মুহূর্তে তাদের ওপর গুলি চলতে পারে। সে তখন মাথা নিচু করে গুলির শাঁই শাঁই শব্দ শুনবে তো না-ই, বরং তা আগের চেয়ে আরও সোজা রাখবে। চারদিকে তাকিয়ে সহযোদ্ধা আর সৈন্যদের দিকে হাসিমুখে তাকাবে। শান্ত গলায় তাদের সঙ্গে অন্য কোনো বিষয় নিয়ে গল্প করবে।

সেনাদলটি ভালো রাস্তা ছেড়ে কম ব্যবহৃত রাস্তায় ঘুরে গেল। পথটি গেছে যবের গোড়ায় ভরা খেতের মধ্য দিয়ে। সেটা কখন বনের কাছে নিয়ে এসেছিল, তারা খেয়াল করেনি। শাঁই করে অলক্ষুনে শিস দিয়ে একটা গোলা মালগাড়িগুলোর ভেতর দিয়ে উড়ে গিয়ে রাস্তার পাশের জমি ফাটিয়ে ফেলল।

শুরু হচ্ছে, উজ্জ্বল হাসি মুখে তার পাশে চলা এক সহকর্মীকে বলল বাটলার।

এবং তা-ই হলো। গোলাটার পর বনের আড়াল থেকে ঝান্ডা নিয়ে বের হয়ে এল বিশাল একদল অশ্বারোহী চেচেন। সে দলের মাঝখানে বিরাট একটা সবুজ ঝান্ডা। বাটলার বেশি দূরে দেখতে পেত না। দলের বুড়ো সার্জেন্ট-মেজর অনেক দূরে দেখতে পারত, সে জানাল, শামিল অবশ্যই ওই দলে আছে। অশ্বারোহীরা পাহাড় থেকে বের হয়ে ডান দিকে উপত্যকার সবচেয়ে উঁচু এবং সেনাদলের খুব কাছে চলে এসে নামতে শুরু করল। পুরু কালো কোট আর লম্বা টুপি পরা একজন ছোটখাটো জেনারেল তার দুলকি চালের ঘোড়ায় বাটলারের কোম্পানির কাছে এসে তাকে ডান দিকে নেমে আসা অশ্বারোহীদের আক্রমণ করতে বলল। বাটলার দ্রুত তার কোম্পানি নিয়ে সেদিকে চলে গেল। কিন্তু উপত্যকায় পৌঁছার আগেই তার পেছনে কামান দাগার দুটো আওয়াজ। সে ঘুরে দেখল, দুটো কামানের ওপরে ছাইরং ধোঁয়ার কুণ্ডলী ওপরে উঠে উপত্যকায় ছড়িয়ে পড়ছে। বোঝা গেল, পাহাড়ি অশ্বারোহীরা গোলন্দাজ বাহিনী আসবে ভাবতে পারেনি। তাই পিছু হটতে থাকে। বাটলারের কোম্পানি তাদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করে। পুরো গিরিখাদ ভরে গেল বারুদের গন্ধে। খাদের অনেক ওপরে পাহাড়িদের দ্রুত পালাতে দেখা যাচ্ছে। তবু তারা কসাকদের ওপর গুলি চালানো থামায়নি। কোম্পানিটি পাহাড়িদের আরও ধাওয়া করে চলল। দ্বিতীয় উপত্যকাটির ঢালে চোখে পড়ল ছোট্ট একটি গ্রাম।

পাহাড়িদের পিছু ধাওয়া করে বাটলারের কোম্পানি গ্রামটিতে ঢুকে পড়ে। বাসিন্দাদের কেউ সেখানে ছিল না। সৈন্যদের ভুট্টা, খড় ও কুঁড়েগুলো জ্বালিয়ে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট গ্রামটি ভরে গেল ঝাঁজালো ধোঁয়ায়। সৈন্যরা কুঁড়েগুলোর ভেতরে যা পেল, টেনে বের করল। মোরগ-মুরগিগুলো ধরল বা গুলি করল। পাহাড়িরা ওগুলো সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেনি।

ধোঁয়া থেকে কিছুটা দূরে বসে অফিসাররা দুপুরের আহার সেরে মদ ও ধূমপান করছিল। সার্জেন্ট-মেজর একটা কাঠের টুকরায় তাদের জন্য একটা মধুর চাক নিয়ে এসেছে। চেচেনদের কোনো পাত্তাই নেই। বিকেল নেমে এলে তাদের চলে যাওয়ার হুকুম দেওয়া হলো। গ্রামটির পেছনে সৈন্যদের সারি। বাটলারের কোম্পানি সবার পেছনে। তারা চলতে শুরু করামাত্র চেচেনরা তাদের পেছন থেকে গুলি করতে শুরু করল। সেনাদল খোলা জায়গায় চলে এলে চেচেনরা আর ধাওয়া করল না। বাটলারের কোম্পানির একজনও আহত হয়নি। সে সবচেয়ে খুশি আর তেজিভাব নিয়ে ফিরে চলেছে। সকালের ঝরনাটা হেঁটে পার হয়ে সেনাদলটি ভুট্টাখেত আর ঘাসের ভেতর ছড়িয়ে গেল। প্রতিটা কোম্পানির গায়ক দল সামনে এগিয়ে গিয়ে গান ধরল।

বাদ্যের তালে তালে ঘোড়াগুলো চলছে খোশমেজাজে। কোম্পানির লোমশ কুকুর ট্ৰেজোরকা লেজ বাঁকিয়ে সামনে সামনে দৌড়ে চলেছে। একজন কমান্ডারের মতো। যেন কোম্পানির দায়িত্ব তারই। বাটলার উচ্ছ্বসিত, আনন্দিত, শান্ত। যুদ্ধ তার কাছে শুধু সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়ে পুরস্কার এবং এখানকার সহযোদ্ধাদের ও রাশিয়ার বন্ধুদের শ্রদ্ধা আদায়ের উপায়। নিহত বা আহত অফিসার, সৈন্য বা পাহাড়িরা : যুদ্ধের এই অপর দিকটি তার কল্পনায় কখনো আসেনি। এই কাব্যিক ভাবটি ধরে রাখার জন্য সে অচেতনভাবে নিহত বা আহতদের দিকে তাকানো এড়িয়ে চলে। সেদিন তিনজন নিহত হয়েছিল, আহত হয়েছিল বারোজন। সে চিত হয়ে পড়ে থাকা একটি লাশের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় এক চোখে নমনীয় হাতটির অদ্ভুত ভঙ্গি আর কপালে একটি লাল বিন্দু দেখে আর দাঁড়ায়নি। পাহাড়িরা তার কাছে শুধু অশ্বারোহী যোদ্ধা, যাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হয়।

বুঝেছেন, স্যার! দুই গানের ফাঁকে বাটলার তার উধ্বর্তন মেজরকে বলল, এটা পিটার্সবার্গের মতো আইস রাইট, আইস লেফট নয়। এখানে আমরা আমাদের কাজ করে এখন বাড়ি ফিরে যাচ্ছি। মাশা আমাদের পাই আর সুন্দর বাঁধাকপির স্যুপ খেতে দেবে। এটাই জীবন। তাই না স্যার? তাহলে এবার ভোরের সূর্য উঠছে বলে গানটা হোক! পছন্দের গানটি গাইতে বলল বাটলার।

বাতাস তাজা ও পরিষ্কার, কোনো গতি নেই। এতটা স্বচ্ছ যে এক শ মাইল দূরের বরফঢাকা পাহাড়কেও মনে হয় এই কাছেই। দুই গানের ফাঁকে ফাঁকে পায়ে চলার শব্দ আর কামানের ধাতব ঝংকার আবহ সংগীতের মতো মনে হচ্ছিল। বাটলারের কোম্পানিতে যে গানটি গাওয়া হচ্ছিল, সেটি লিখেছিল একজন নবিশ সৈন্য। সবার চেয়ে আলাদা পদাতিক পদাতিক! নাচের ছন্দে সেটার সুর। বাটলার তার ঘোড়া নিয়ে ঠিক তার ওপরের পদের অফিসারটির পাশে চলে এল। মেজর পেত্রভের সঙ্গেই সে থাকত। বাটলারের মনে হলো, দেহরক্ষী বাহিনী থেকে ককেশাসে আসতে পারার জন্য সে যথেষ্ট কৃতজ্ঞ হয়নি। তার বদলি হওয়ার মূল কারণ সে তার সবকিছু তাসের জুয়ায় উড়িয়ে দেয়। তাই সে ভয় করছিল তার আর হারানোর মতো কিছু না থাকলেও সে তাসের নেশা কাটাতে পারবে না। এখন সেগুলো আর নেই, আনন্দ আর সাহসে তার জীবন পুরোপুরি বদলে গেছে! ভুলে গেছে যে সে ধ্বংস হয়ে গেছে, ভুলে গেছে শোধ না করা ঋণের কথা। ককেশাস, যুদ্ধ, সৈন্যরা, অফিসারবৃন্দ, আধা মাতাল-সাহসী-ভদ্রলোকেরা, মেজর পেভ নিজে–সবকিছুই তার ভালো লাগে। কোনো কোনো সময় এত ভালো লাগে যে সে পিটার্সবার্গে নেই, এটা সত্যি মনে হয় না। পিটার্সবার্গের সেই তামাকের ধোয়াভরা ঘর, জুয়ায় তাসের কোনা উঁচিয়ে দেখা, হিসাব রাখার লোকটাকে ঘেন্না করা, মাথায় চাপ ধরা ব্যথা আর নেই। সে আসলেই সাহসী ককেশীয়দের বিখ্যাত এলাকায়।

মেজর ও সার্জনের আরদালির মেয়ে একসঙ্গে স্বামী-স্ত্রীর মতো থাকে। মেয়েটিকে আগে মাশা ডাকা হতো, এখন সম্মান দেখিয়ে মেরি দমিত্রিয়েভনা ডাকতে হয়। মেরি দমিত্রিয়েভনা সুন্দরী, মুখে অনেক হালকা বাদামি তিল, সুন্দর চুল। ত্রিশ বছর বয়সী, নিঃসন্তান। অতীত তার যা-ই হোক, সে এখন মেজরের বিশ্বস্ত সহচরী, তাকে সেবিকার মতো যত্ন করে। এটা খুব দরকার। কারণ, মেজর প্রায়ই পান করে মাতাল হয়ে যায়।

দুর্গে পৌঁছা পর্যন্ত সবকিছু মেজরের পরিকল্পনামতোই ঘটল। মেজর, বাটলার ও সেনাদল থেকে আমন্ত্রিত দুজন অফিসারকে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার খেতে দিল মেরি দমিত্রিয়েভনা। মেজর মাতাল হওয়া পর্যন্ত খেয়ে আর পান করে ঘরে চলে গেল। বাটলার পাল্লা দেওয়ার চেষ্টায় মাত্রার বেশি চিখির মদ খেয়ে শোবার ঘরে। পোশাক ছাড়ার সময় না পেয়ে তার সুন্দর কোকড়া চুলে ভরা মাথার নিচে হাত রেখে স্বপ্নহীন টানা গভীর ঘুমে ডুবে গেল।

১৭

যে গ্রামটি ধ্বংস করা হয়েছিল, রুশদের কাছে আত্মসমর্পণ করার আগের রাতে হাজি মুরাদ ছিল সেখানেই। রুশ সেনাদলের আক্রমণের মুখে সাদো তার পরিবার নিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। ফিরে এসে সে দেখল, তার বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ছাদটি ভেঙে পড়েছে, বারান্দার খুঁটিগুলো পোড়া আর ভেতরে ধ্বংসস্তূপ। তার উজ্জ্বল চোখের সুদর্শন ছেলেটিকে, যে উত্তেজনাভরে হাজি মুরাদের দিকে অপলক তাকিয়েছিল, চাদর দিয়ে ঢেকে ঘোড়ার পিঠে করে মসজিদে আনা হয়েছে। পিঠে বেয়নেটের আঘাতে তাকে মারা হয়েছে। যে সম্মানিতা মহিলা তার বাড়িতে হাজি মুরাদের সেবা করেছিলেন, তিনি তার ছেলের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে। পরনের ঘন কুঁচি দেওয়া জামাটি ছিঁড়ে গেছে। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে বৃদ্ধার শুকনো স্তন। চুল ঝুলে আছে নিচের দিকে। নখের আঁচড়ে মুখ থেকে ঝরছে রক্ত। অবিরাম বিলাপ করে তিনি কাঁদছেন। সাদো খন্তা-কোদাল হাতে আত্মীয়দের নিয়ে ছেলের জন্য কবর খুঁড়তে চলে গেল। বুড়ো দাদা ভাঙা কুঁড়েটির দেয়ালের পাশে বসে আছে। একটি কাঠি কাটছে আর নির্বিকার দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে কেবলই মৌমাছির খামার থেকে এল। সেখানে দুটো খড়ের গোলা পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সে যে খোবানি (এপ্রিকট) আর লাল জামের (চেরি) চারা লাগিয়েছিল, সেগুলো দুমড়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সবচেয়ে খারাপ খবর হলো সব কটি মৌচাক আর মৌমাছি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। মেয়েদের বিলাপ আর মায়েদের সঙ্গে শিশুদের কান্না ক্ষুধার্ত গবাদিপশুর দুর্বল হাম্বার সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। পশুগুলোর জন্য কোথাও কোনো খাবার ছিল না। বড় ছেলেমেয়েগুলো খেলছিল না, ভয়ার্ত চোখে বড়দের পিছু পিছু চলছিল। ঝরনার পানি পরিকল্পিতভাবে দূষিত করে দেওয়া হয়েছে, যাতে ব্যবহার করা না যায়। মসজিদটিও একইভাবে নোংরা করে দেওয়া হয়েছে। ইমাম ও তার সহকারীরা তা পরিষ্কার করছেন। বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ-সব চেচেনের মনোভাব ঘৃণার চেয়ে বেশি। ঘৃণা নয়; কারণ, তারা রুশ কুত্তাগুলোকে মানুষ বলে মনে করে না। বিবেকহীন নিষ্ঠুরতায় চেচেনদের যে বিকার, বিরক্তি আর বিল অবস্থা, তাতে ওই জীবগুলোকে মেরে ফেলতে ইচ্ছা করে। যেমন ইচ্ছা করে ইঁদুর, বিষধর মাকড় আর নেকড়েকে মারতে। এ রকম ইচ্ছা আত্মরক্ষার মতো সহজাত প্রবৃত্তি।

গ্রামের বাসিন্দারা দ্বিধাগ্রস্ত। এত দিন এত পরিশ্রম দিয়ে গড়ে তোলা গ্রামটির ওপর বিবেকহীন ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। যেকোনো মুহূর্তে আবারও এমন হামলা হতে পারে। তা সত্ত্বেও তারা সেখানে থেকেই গ্রামটা মেরামত করবে, নাকি মনের বিকার ও অপমান সয়ে নিয়ে তাদের ধর্মীয় নির্দেশনা না মেনে রুশদের বশ্যতা স্বীকার করবে। বয়স্করা নামাজ পড়ে দোয়া করল। তারপর সবাই একমত হয়ে সাহায্য চেয়ে শামিলের কাছে দূত পাঠাল এবং তারা ধ্বংস করা সবকিছু মেরামত শুরু করল।

১৮

আক্রমণের পরের সকালে, খুব ভোরে নয়, বাটলার পেছনের গাড়িবারান্দা দিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল। নাশতার আগে তাজা বাতাসে একটু হেঁটে আসবে ভেবে। সাধারণত পেত্রভের সঙ্গেই সে যায়। সূর্য ইতিমধ্যে পাহাড়গুলোর ওপরে উঠে গেছে। রাস্তার ডান দিকের আলোয় উজ্জ্বল সাদা দেয়ালগুলোর দিকে তাকালে চোখ ব্যথা করছে। অথচ সব সময়ের মতো চোখ জুড়িয়ে যায় বাঁ পাশের দেয়ালগুলোর দিকে বা পেছনে অন্ধকার কমে আসা বনে ঢাকা উঁচু পাহাড়ের দিকে বা মেঘের ভান করা বরফের চূড়াগুলোর আবছা রেখার দিকে তাকালে। বাটলার পাহাড়গুলোর দিকে তাকাল। নিশ্বাস নিল বুক ভরে আর বেঁচে আছে বলে এবং এই সুন্দর জায়গায় আছে বলে তার আনন্দ হলো।

গতকাল যাওয়া-আসার দুবারই, বিশেষ করে খুব গরমের মধ্যে পিছিয়ে আসার সময়, সে এত ভালো ব্যবহার করেছে ভেবে সে মনে মনে খুশি ছিল। ফিরে আসার পর পেত্রভের রক্ষিতা মাশা (বা মেরি দমিত্রিয়েভনা) যেভাবে প্রত্যেককে যত্ন করে রাতের খাবার দিয়েছে, তাতেও সে খুশি। তার মনে হয়েছে, মাশা তাকে একটু বেশিই যত্ন করেছে।

মেরি দমিত্রিয়েভনার মোটা বেণি, চওড়া কাঁধ, বিশাল বক্ষ এবং গোলাপি তিলে ভরা মুখে উদ্ভাসিত হাসি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাটলারকে আকর্ষণ করে। অবিবাহিত সুঠাম যুবক বাটলারের এমনও মনে হয়েছে যে মাশা তাকে কামনা করে। কিন্তু সে মনে করে, সেটা তার সরল ভালোমানুষ সহকর্মীর প্রতি অন্যায় হবে। তাই সে মাশার প্রতি সম্মান দেখাত এবং সেটা করতে পারায় নিজের ওপর খুশি ছিল।

এই চিন্তায় তার মগ্নতা ভেঙে গেল সামনের ধুলোভরা রাস্তাটায় অনেকগুলো ঘোড়ার খুরের আওয়াজে। মনে হলো বেশ কয়েকজন ঘোড়সওয়ার আসছে। সে চোখ তুলে তাকিয়ে দেখল রাস্তার শেষ মাথায় একটা দল তার দিকে হেঁটে আসছে। জনা বিশেক কসাকের সামনে দুজন অশ্বারোহী। একজনের পরনে একটা সাদা চাপকান, মাথায় লম্বা পাগড়ি। অন্যজন রুশ অফিসার, গাঢ় গায়ের রং। ইগলের ঠোঁটের মতো নাক। তার পোশাক ও অস্ত্রে অনেক রুপার পদক। পাগড়ি পরা লোকটার ঘোড়াটির রং চমৎকার বাদামি, কেশর আর লেজের রং একটু হালকা। ওটার মাথাটা ছোট, সুন্দর চোখ। অফিসারটির ঘোড়া একটা বড় সুদর্শন কারাবাখ। ঘোড়াপ্রেমিক বাটলার তক্ষুনি প্রথম ঘোড়াটার শক্তি বুঝতে পারল। লোকগুলো কারা, দেখার জন্য সে দাঁড়াল।

এটা কমান্ডারের বাসা? জিজ্ঞেস করল অফিসারটি। উচ্চারণ আর শব্দগুলো প্রতারণা করে তার বিদেশি পরিচয় ফাঁস করে দিল।

হ্যাঁ, বলে বাটলার অফিসারটির কাছে এসে পাগড়ি পরা লোকটিকে দেখিয়ে জানতে চাইল, ইনি কে?

ইনি হাজি মুরাদ। কমান্ডারের সঙ্গে থাকবেন বলে এসেছেন। অফিসারটি বলল।

বাটলার হাজি মুরাদ সম্বন্ধে এবং রাশিয়ার কাছে তার আত্মসমর্পণের খবর জানত। কিন্তু তাকে ছোট্ট দুৰ্গটায় দেখার আশা করেনি। হাজি মুরাদ তার দিকে বন্ধুত্বের দৃষ্টিতে তাকালেন।

সুপ্রভাত, কটকিল্ডি। তার শেখা তাতারি ভাষায় স্বাগত জানানোর শব্দটা বলল বাটলার।

সবুল! (ভালো থাকুন!) হাজি মুরাদের জবাব। ঘোড়াটি বাটলারের কাছে নিয়ে তার দিকে হাত বাড়িয়ে। হাতটার দুই আঙুলে তার চাবুকটা ঝুলছিল।

আপনিই কি সেনাপ্রধান? সে জিজ্ঞেস করল।

না, সেনাপ্রধান ভেতরে। আমি তাকে ডেকে আনছি, অফিসারটিকে এই কথা বলে বাটলার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দরজায় ধাক্কা দিল। অতিথিদের দরজাটা বন্ধ ছিল। মেরি দমিত্রিয়েভনা ওটাকে তা-ই বলত। কয়েকবার ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও দরজাটা কেউ না খোলায় বাটলার ঘুরে পেছনের দরজায় গিয়ে নিজের আরদালিকে ডাকল। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নেই। দুই আরদালির কাউকে না পেয়ে সে গেল রান্নাঘরে। সেখানে ছিল মেরি দমিত্রিয়েভনা। তার আস্তিন কনুইয়ের ওপর পর্যন্ত গুটিয়ে মোটা সাদা হাত দিয়ে হাতের মতোই সাদা ময়দা মাখিয়ে ছোট ছোট পিণ্ড করে রাখছে। ওগুলো দিয়ে পাই বানাবে।

আরদালিরা কোথায়? জিজ্ঞেস করল বাটলার।

মদ খেতে গেছে। তুমি কী চাও? জিজ্ঞেস করল মেরি দমিত্রিয়েভনা।

সামনের দরজা খুলতে হবে। তোমার বাড়ির সামনে একদল পাহাড়ি। হাজি মুরাদ এসেছে!

অন্য কিছু বানিয়ে বলো! হেসে বলল মেরি দমিত্রিয়েভনা।

ঠাট্টা না, সে আসলেই গাড়িবারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে!

সত্যি বলছ?

তোমার সঙ্গে শয়তানি করব কেন? গিয়ে দেখে এসো সে গাড়িবারান্দায়!

হায় খোদা, ঝামেলা হলো তো! আস্তিন নামিয়ে তার মোটা বেণিতে কাঁটাগুলো ঠিক আছে কি না দেখল। আর বলল, আমি তাহলে আইভান মাতভিয়েচকে তুলে দিই।

না, আমিই যাই। বন্দারেঙ্কো, দরজাটা খুলে দাও! পেত্রভের আরদালি তখনই এসেছিল। তাকে বলল বাটলার।

সেটাই ভালো হয়! মেরি দমিত্রিয়েভনা আবার কাজে লেগে গেল।

হাজি মুরাদ তার বাড়িতে এসেছে শুনে মেজর আইভান মাতভিয়েচ পেত্ৰভ একটুও অবাক হয়নি। সে জানত হাজি মুরাদ গ্রজনিতে। বিছানায় উঠে বসে সে একটা সিগারেট ধরিয়ে পোশাক পরতে শুরু করল। জোরে গলাখাকারি দিয়ে শয়তানটাকে তার কাছে পাঠানোর জন্য গজগজ করল।

তৈরি হয়ে সে আরদালিকে একটু ওষুধ দিতে বলল। আরদালি জানত ওষুধ মানে ভোদকা, নিয়ে এল সে।

মিশিয়ে মদ খাওয়ার মতো খারাপ কিছু নেই, বিড়বিড় করে সে ভোদকাটা সেঁক দিয়ে এক কামড় রাইয়ের রুটি খেল! কাল চিখির খেয়েই মাথাটা ধরেছে…এখন কাজে যেতে হচ্ছে, বলতে বলতে বসার ঘরে গেল। হাজি মুরাদ আর অফিসারটাকে বাটলার সেখানে এনে বসিয়েছে।

অফিসার লেফট ফ্ল্যাঙ্কের কমান্ডারের আদেশটা মেজরের হাতে দিল। তাতে হাজি মুরাদকে তার কাছে রেখে চরদের মাধ্যমে পাহাড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু কিছুতেই যেন কসাকদের একটা দল সঙ্গে না নিয়ে তাকে দুর্গের বাইরে যেতে দেওয়া না হয়।

কাগজটা পড়ে মেজর হাজি মুরাদের দিকে তাকাল এবং আবার কাগজটা খুঁটিয়ে দেখল। এভাবে কয়েকবার এদিক-ওদিক চোখ ফেলে শেষে হাজি মুরাদের দিকে তাকাল।

ঠিক আছে, স্যার, ঠিক আছে! উনি এখানেই থাকুন। তাকে বলে দেন যে তাকে বাইরে যেতে না দেওয়ার আদেশ আছে। সেটা মানতে হবে! বাটলার, ওনাকে কোথায় থাকতে দেওয়া যায়? অফিস ঘরে?

বাটলার জবাব দেওয়ার আগেই মেরি দমিত্রিয়েভনা রান্নাঘর থেকে এসে দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সে মেজরকে বলল, কেন তাকে এখানে রাখবে! তাকে মেহমানদের ঘর আর ভাড়ার ঘরটা দেব। তাতে তার ওপর চোখ রাখা যাবে, হাজি মুরাদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল মেরি। চোখে চোখ পড়তেই সে চোখ ঘুরিয়ে নিল।

মেরি দমিত্রিয়েভনা ঠিক বলেছে, বলল বাটলার।

ঠিক আছে, ঠিক আছে; যাও! মেয়েদের এখানে কোনো কাজ নেই, ভুরু কুঁচকে বলল মেজর।

কথাবার্তার পুরো সময়টা হাজি মুরাদ ছোরার বাটে হাত রেখে বসে ছিল। ঠোঁটে তার মৃদু অবজ্ঞার হাসি। তিনি বললেন, যেখানেই রাখা হোক, তার কাছে সবই সমান, সরদার যা কিছুর অনুমতি দিয়েছে, তার বেশি তার চাই না। পাহাড়িদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অনুমতি আছে। তাই তাদের যেন এখানে আসতে দেওয়া হয়।

মেজর বলল তা করা হবে। আর বাটলার যেন তাদের কিছু খাবার দিতে এবং ঘরগুলো গুছিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। সে এর মধ্যে অফিসে গিয়ে দরকারি কাজগুলো করবে আর আদেশ দেবে।

নতুন লোকদের সঙ্গে হাজি মুরাদের সম্পর্ক কী হবে, তা সঙ্গে সঙ্গে পরিষ্কার হয়ে গেল। শুরু থেকেই তিনি মেজরের ব্যবহারে বিরক্ত। তাই তিনি ত্যাড়াভাবে কথা বলেছেন। মেরি দমিত্রিয়েভনা রান্না করে খাবার দিয়ে গেল। তাকে তিনি পছন্দ করেছেন। তার সারল্য, বিশেষ করে বিদেশি ধরনের সৌন্দর্য তার ভালো লেগেছে। হাজি মুরাদের প্রতি আকর্ষণ নিজের অজান্তেই সে বুঝিয়ে দেওয়ায় হাজি মুরাদ বশীভূত। হাজি মুরাদ তার দিকে তাকাতে বা তার সঙ্গে কথা না বলার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু অনিচ্ছা সত্ত্বেও চোখ দুটো মেরির চলাফেরার পথেই ঘুরেছে। দেখা হওয়ার মুহূর্ত থেকে বাটলারের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল। তার সঙ্গে অনেক কথা বলেছেন তার জীবন সম্বন্ধে, নিজের জীবন সম্বন্ধে। গুপ্তচরেরা তার পরিবার সম্পর্কে যে খবর এনেছে, সেগুলো বলেছেন। এমনকি নিজের কী করা উচিত, তাই নিয়ে বাটলারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন।

চরদের মাধ্যমে তিনি ভালো খবর পাননি। দুর্গে তার প্রথম চার দিনে। তারা দুবার তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। দুবারই তারা খারাপ খবর আনে।

১৯

হাজি মুরাদ রুশদের কাছে পালিয়ে যাওয়ার পরপর তার পরিবার ভিদেনোয় নিয়ে যাওয়া হয়। শামিল কী ঠিক করে, সে জন্য তাদের পাহারায় রাখা হয়েছে। তার মা ফাতিমা এবং দুই স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান অফিসার ইব্রাহিম রশিদের বাড়িতে পাহারায়। হাজি মুরাদের আঠারো বছর বয়সী ছেলে ইউসুফ কারাগারে বন্দী। কারাগার মানে সাত ফুটের বেশি গভীর একটি গর্ত। ইউসুফ রয়েছে আরও সাতজনের সঙ্গে। তারা সবাই ভাগ্যে কী ঘটে, তার জন্য অপেক্ষা করছে।

সিদ্ধান্ত দিতে দেরির কারণ শামিল গেছেন রুশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে।

যুদ্ধের পর ভিদেনোয় তিনি ফিরে এলেন ১৮৫২ সালের ৬ জানুয়ারি। রুশরা বলছে, যুদ্ধে হেরে তিনি ভিদেনোয় পালিয়ে গেছেন। আর শামিল ও মুরিদরা বলছে, তারাই রুশদের ঠেকিয়ে দিয়ে জয়ী। ওই যুদ্ধে শামিল নিজে রাইফেল চালান। সেটা তিনি করেন খুব কম। তলোয়ার নিয়েও তিনি রুশদের সরাসরি তাড়া করেন। মুরিদরা তাকে বাধা দেয়। শামিলের পাশেই তার দলের দুজন সেখানেই মারা যায়।

শামিল ফিরে আসেন দুপুরের দিকে। মুরিদরা তাকে ঘিরে ধ্বনি দিতে দিতে আসছিল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। শামিলের বাড়ি পৌঁছা পর্যন্ত তারা অনবরত রাইফেল ও পিস্তলের গুলি ফোঁটাতে থাকে।

বড় গ্রামটির সব বাসিন্দা তাদের নেতাকে দেখার জন্য রাস্তায় নেমে এসেছিল। অনেকে নিজেদের রাইফেল ও পিস্তল থেকে গুলি ছুড়ছিল বিজয়ের উত্তেজনায়। শামিল একটা আরবি সাদা ঘোড়ায় আসছিলেন। তার বাড়ির কাছাকাছি আসায় ঘোড়াটা চলছিল নিজের ইচ্ছায়। ঘোড়াটার জিন বা লাগাম ছিল খুব সাধারণ, কোনো সোনা-রুপা লাগানো ছিল না। সূক্ষ্ম কারুকাজ করা লাল চামড়ার চাবুকটার মাঝবরাবর টানা দাগ। ধাতুর পাদানিগুলো কাপের মতো দেখতে। লাল চাদরের নিচ থেকে জিনটার কিছুটা দেখা যাচ্ছিল। ইমাম পরেছিলেন এক পরত কালো পশম লাগানো বাদামি সুতির চাদর। ঘাড় ও হাতের কাছে পশমগুলো দেখা যাচ্ছিল। তার চিকন লম্বা কোমরে একটা কালো ফিতে দিয়ে চাদরটা বাঁধা। তাতে গাথা

একটা ছোরা। তার মাথায় লম্বা টুপিটার ওপরের দিকটা সমান, পাশে কালো ঝালর ঝোলানো। টুপিটার চারপাশে সাদা পাগড়ি। সেটার এক দিক তার কাঁধ ছুঁয়েছে। তিনি পরেছিলেন কিনারে নকশা করা আঁটসাঁট কালো পায়জামা আর সবুজ চপ্পল।

আসলে ইমাম উজ্জ্বল কিছু পরেননি। না সোনা, না রুপা। তার লম্বা খাড়া সুঠাম শরীর, অলংকারহীন পোশাক, সোনা-রুপা লাগানো কাপড় ও অস্ত্রসজ্জিত মুরিদরা তাকে ঘিরে রাখলে মানুষের মনে ঠিক তার কাঙ্ক্ষিত প্রতিক্রিয়া হয়। কীভাবে তা সৃষ্টি করতে হয়, সেটাও তিনি জানতেন। সুন্দর করে ছাঁটা লালচে দাড়ির ডৌলে আঁটা নিষ্প্রভ চেহারায় চোখ দুটো সব সময় কুঞ্চিত, যেন পাথরে খোদাই করা-অনড়। গ্রামের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময় তিনি তার ওপর হাজারখানেক লোকের উৎসুক দৃষ্টি অনুভব করতে পারছিলেন। কিন্তু তিনি নিজে কারও দিকে তাকাননি।

ইমামের আগমন দেখার জন্য হাজি মুরাদের স্ত্রীরা বাড়ির অন্য বাসিন্দাদের সঙ্গে বারান্দায় বের হয়ে এসেছিল। শুধু তার বৃদ্ধা মা ফাতিমা বাইরে যাননি। তার পাকা চুল ঝুলিয়ে ঘরের মেঝেয় বসে ছিলেন। তার হাঁটু দুটোকে বেড় দিয়ে রেখেছিল লম্বা হাত দুটো। আগুনের স্তূপে জ্বলন্ত কয়লাগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকায় তার কালো চোখ দুটো জ্বলছিল। তার ছেলের মতো তিনিও সব সময় শামিলকে ঘৃণা করতেন। এখন আগের চেয়ে বেশি ঘৃণা করছেন এবং তাকে দেখতে চাননি। হাজি মুরাদের ছেলেও এই বিজয়ীর বেশে প্রবেশ দেখেনি। সে তার অন্ধকার তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত গর্তে বসে শুধু গুলি আর ধ্বনির শব্দ শুনেছে। স্বাধীনতাবঞ্চিত প্রায় তরুণেরা যেভাবে যন্ত্রণা অনুভব করে, সে-ও তেমনি করছিল। দুর্ভাগা, অপরিচ্ছন্ন এবং ক্লান্ত অন্য সহবন্দীদের দেখছিল। আর একে অন্যকে ঘেন্না করছিল। যারা তাদের ইমামের চারপাশে ঘোড়ার ওপর বসে মুক্ত বাতাসে বুক ভরে প্রশস্তি গাইছিল লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, তাদের ওপর তার গভীর হিংসা হলো।

গ্রামটি পার হয়ে শামিল তার বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে অন্দরমহলের দিকে গেলেন। দুজন সশস্ত্র শান্ত্রি খোলা ফটকের কাছে তার দিকে এগিয়ে এল। পুরো আঙিনায় মানুষের ভিড়। অনেকেই বহুদূর থেকে নিজেদের কাজে এসেছে। কেউ কেউ দরখাস্ত নিয়ে এসেছে। কাউকে শামিল ডাকিয়ে এনেছেন বিচার করে শাস্তি দেওয়ার জন্য। শামিল ভেতরে ঢুকলে সবাই দাঁড়িয়ে বুকের ওপর হাত রেখে সালাম দিল। তিনি আঙিনা থেকে অন্দরমহলে যাওয়া পর্যন্ত অনেকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকল। তিনি জানতেন, আঙিনায় অপেক্ষাকারীদের অনেককে তিনি পছন্দ করেন না। অনেকে দীর্ঘদিন ধৈর্য ধরে আবেদন করছে। চেহারায় সেই স্থির পাথুরে দৃষ্টি রেখে সবাইকে কাটিয়ে তিনি অন্দরমহলে ঢুকলেন। ফটকের বাঁ দিকে নিজের ঘরের বারান্দার কাছে ঘোড়া থেকে নামলেন। তিনি যুদ্ধের ধকলে ক্লান্ত। যতটা না শারীরিক, তার চেয়ে বেশি মানসিক। কারণ, প্রকাশ্যে বিজয়ী হওয়ার ঘোষণা দিলেও ভালো করেই জানতেন তিনি পরাজিত। তিনি জানতেন, অনেক চেচেন গ্রাম পুড়িয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। অস্থির চঞ্চল চেচেনরা দোমনা ছিল। আর সীমান্তের কাছের চেচেনরা রুশদের সঙ্গে যোগ দিতে তৈরি।

এগুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছিল। এর বিহিত করা দরকার। কিন্তু সে মুহূর্তে শামিল কিছুই ভাবতে চাননি। তার শুধু একটাই চাহিদা-বিশ্রাম। তিনি চাইছিলেন পরিবারের মধ্যে থাকার আনন্দ আর তার প্রিয়তমা স্ত্রীর আদর। সেই আঠারো বছর বয়সী কালো চোখ চঞ্চল হরিণী ঠিক সে মুহূর্তে পুরুষ ও মেয়েদের আলাদা রাখার বেড়ার অপর দিকে ছিল। (শামিল নিশ্চিত ছিলেন, অন্য স্ত্রীদের সঙ্গে সে-ও বেড়ার ফাঁক দিয়ে তাকে ঘোড়া থেকে নামতে দেখছিল। কিন্তু শুধু তার সান্নিধ্যে যাওয়াই অসম্ভব নয়, তিনি পালকের গদিতে শুয়ে পড়তেও পারছিলেন না। আগে তাকে জোহরের নামাজ পড়তে হবে। যার জন্য সেই মুহূর্তে তার কোনো ইচ্ছা না থাকলেও মানুষের ধর্মীয় নেতা হিসেবে বাদ দিতে পারছিলেন না। নিজের জন্যও তা প্রতিদিনের খাদ্যের মতো। তাই তিনি অজু করে নামাজ পড়লেন এবং তার অপেক্ষায় থাকা লোকদের ডাকলেন।

প্রথমে এলেন জামাল উদ্দিন। তার শ্বশুর ও শিক্ষক। লম্বা পাকাচুল সুদর্শন বৃদ্ধ। বরফের মতো সাদা দাড়ি আর গোলাপি লাল চেহারা। দোয়া পড়ে তিনি শামিলের কাছে যুদ্ধের খবর জানতে চাইলেন। তার অনুপস্থিতিতে পাহাড়ে কী কী ঘটেছে, জানালেন।

বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে বংশগত শত্রুতার কারণে খুন, গরু-ভেড়া চুরি এবং তরিকা না মানার (ধূমপান ও মদ্যপান) অভিযোগ করলেন। জামাল উদ্দিন বললেন, হাজি মুরাদ তার পরিবারকে রুশদের কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য কীভাবে নোক পাঠিয়েছিল। কিন্তু তা ফাঁস হয়ে গেলে তাদের ভিদেনোয় আনা হয়েছে। ইমামের সিদ্ধান্তের জন্য তাদের পাহারায় রাখা হয়েছে। জামাল উদ্দিন আরও বললেন, এসব বিষয় আলোচনার জন্য বয়স্করা তিন দিন মেহমানখানায় অপেক্ষা করছেন। তিনি শামিলকে সেগুলো শেষ করার পরামর্শ দিলেন!!

তার ঘরে জাইদা নামের কালো খাড়া-নাক কুশ্রী মহিলা খাবার পরিবেশন করল। শামিল তাকে ভালোবাসেন না কিন্তু সে তার বড় বউ। খেয়েদেয়ে শামিল গেলেন মেহমানখানায়।

ছয় বৃদ্ধ শামিলের পারিষদ। তাদের সাদা, পাকা বা লাল দাড়ি, মাথায় লম্বা টুপি। কারও কারও মাথায় পাগড়ি। সবার পরনে নতুন বেশমেত আর চাপকান। কোমরবন্ধে ছোরা ঝোলানো। শামিল ঘরে ঢুকলে সবাই উঠে দাঁড়ালেন! শামিল তাদের সবার চেয়ে লম্বা। শামিলসহ সবাই হাত উঠিয়ে চোখ বুজে মোনাজাত করে সবাই বসলেন, শামিল বসলেন একটা বড় তাকিয়ায়। তারপর বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে আলোচনা করলেন। অপরাধীদের বিচার হলো শরিয়া অনুযায়ী। চুরির অপরাধে দুজনের হাত কাটার রায় হলো। খুনের জন্য একজনের রায় শিরচ্ছেদ এবং তিনজনকে মাফ করে দেওয়া হলো। তারপর তারা মূল বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন–কী করে চেচেনদের রুশদের সঙ্গে যোগ দেওয়া থামানো যায়। এই প্রবণতা বন্ধ করার জন্য জামাল উদ্দিন নিচের ঘোষণাটি লেখেন :

আপনাদের ওপর সর্বশক্তিমান আল্লাহর শান্তি আসুক!

আমি জেনেছি, রুশরা আপনাদের তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বলছে। তাদের বিশ্বাস করবেন না এবং আত্মসমর্পণ করবেন না। ধৈর্য ধরুন। এই জীবনে এর জন্য পুরস্কার না পেলেও পরজীবনে এর পুরস্কার পাবেন। আগে কী ঘটেছিল, স্মরণ করুন। আপনাদের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার পর তারা কী করেছিল। আল্লাহ তখন ১৮৪০ সালে আপনাদের সুমতি না দিলে আপনাদের এখন তাদের সৈন্য হয়ে থাকতে হতো। আপনাদের স্ত্রীরা পায়জামা পরতে পারতেন না। তাদের বেইজ্জত করা হতো।

অতীত দিয়ে বিচার করুন ভবিষ্যতে কী হবে। নাস্তিকদের সঙ্গে থাকার চেয়ে রুশদের শত্রু হওয়া ভালো। সামান্য ধৈর্য ধরুন। আমি কোরআন আর তলোয়ার নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে আপনাদের নেতৃত্ব দেব। এখন আপনাদের কঠোর নির্দেশ দিচ্ছি সে রকম ইচ্ছা তো দূরের কথা, রুশদের কাছে আত্মসমর্পণের চিন্তাও করবেন না।

ঘোষণাটি অনুমোদন করে শামিল তাতে সই করে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন।

এরপর তারা হাজি মুরাদের ঘটনা তুললেন। শামিলের কাছে এটা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তিনি স্বীকার না করলেও জানতেন হাজি মুরাদ তার ক্ষিপ্রতা, দৃঢ়তা আর সাহস নিয়ে তার (শা) পাশে থাকলে চেচেনদের এখন যা ঘটছে, তা ঘটত না। তাই হাজি মুরাদের সঙ্গে মিটমাট করে ফেলে তাকে আবার কাজে লাগাতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু তা হওয়ার নয়। সে রুশদের সাহায্য করলে কিছুতেই আর পারা যাবে না। তাকে অবশ্যই লোভ দেখিয়ে এনে মেরে ফেলতে হবে। দুভাবে তারা কাজটা করতে পারে। তিবলিসে কাউকে পাঠিয়ে তাকে সেখানেই মেরে ফেলা। না হলে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে এখানে এনে মেরে ফেলা। এখানে আনার একমাত্র উপায় তার পরিবারকে, বিশেষ করে চার ছেলেকে ব্যবহার করা। শামিল জানতেন, ছেলেদের হাজি মুরাদ কত গভীর ভালোবাসেন। তাই তারা ছেলেকে দিয়েই কাজটা করবে।

উপদেষ্টারা আলোচনা শেষ করলে শামিল চোখ বুজে নিঃশব্দে বসে থাকলেন।

উপদেষ্টারা জানতেন, এর অর্থ শামিল এখন আল্লাহর নবীর (সা.) কথা শুনছেন। তিনি তাকে বলে দেন কী করতে হবে। পাঁচ মিনিট পবিত্র নৈঃশব্দ্যে কাটিয়ে শামিল চোখ খুললেন। তারপর তাদের আরও কাছে ঘেঁষে বললেন, হাজি মুরাদের ছেলেকে আমার কাছে আনুন।

ও এখানেই, জামাল উদ্দিন বললেন। আসলে হাজি মুরাদের ছেলে ইউসুফকে ভেতরে ডাকার জন্য আগেই বাহিরবাড়ির ফটকের কাছে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। পাতলা ফ্যাকাশে ছেলেটি, ছেঁড়াফাটা দুর্গন্ধ কাপড় তার পরনে। তা সত্ত্বেও চেহারা ও স্বাস্থ্য সুন্দর। তার চোখ দুটো দাদি ফাতিমার চোখের মতো কালো আর জ্বলছে।

তার বাবা শামিল সম্বন্ধে যা ভাবত, ইউসুফ তেমন ভাবত না। সে অতীতের সব ঘটনা জানত না। জানলেও সেসব দেখেনি বলে বুঝত না শামিলের প্রতি তার বাবার এত শত্রুতা কেন। খুনজাখের নায়েবের ছেলে হিসেবে যেমন সহজ স্বাধীন জীবন কাটিয়েছে, সে শুধু সেটাই চাইত। তার মনে হতো শামিলের সঙ্গে শত্রুতার কোনো প্রয়োজন নেই। বাবার অবাধ্য হয়ে এবং বিরোধিতার তেজে সে শামিলের বিশেষ ভক্ত হয়ে গিয়েছিল। শামিল পাহাড়ি এলাকায় যে শ্রদ্ধা পেত, সে-ও সেভাবেই তাকে শ্রদ্ধা করত। শ্রদ্ধামিশ্রিত ভয়ের অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে কাঁপা পায়ে সে মেহমানখানার দরজার কাছে এল। তার চোখ পড়ল শামিলের আধবোজা চোখে! একটু থামল সে। তারপর শামিলের কাছে গিয়ে তার লম্বা আঙুলওয়ালা হাতে চুমু খেল।

তুমি হাজি মুরাদের ছেলে?

জি, ইমাম।

তুমি জানো সে কী করেছে?

আমি জানি, ইমাম। আমি এর নিন্দা করি।

তুমি লেখাপড়া জানো?

আমি মোল্লা হওয়ার জন্য পড়ছিলাম।

তাহলে তোমার বাবাকে চিঠি লিখে দাও, সে ঈদের আগে আমার কাছে ফিরে আসবে কি না। যদি আসে, তাহলে আমি তাকে মাফ করে দেব এবং সবকিছু আগের মতোই চলবে। যদি না আসে, তাহলে তোমার দাদি, মা এবং অন্যদের ভিন্ন গ্রামে পাঠিয়ে দেব, আর তোমার কল্লা কেটে ফেলব!

ইউসুফের চেহারায় কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। শামিলের কথা বুঝেছে, মাথা নেড়ে সায় দিল।

চিঠিটা লিখে আমার লোকের হাতে দিয়ো।

শামিল কথা শেষ করে অনেকক্ষণ নীরবে ইউসুফের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

লিখে দাও–তোমার ওপর আমার দয়া হচ্ছে। তোমাকে মারব না। তোমার চোখ দুটো তুলে নেব। সব বিশ্বাসঘাতকের আমি তা-ই করি!…যাও!।

শামিলের সামনে ইউসুফ শান্ত ছিল। কিন্তু তাকে মেহমানখানার বাইরে নিয়ে এলে সে তার পাহারাদারের ছোরাটা কেড়ে নিয়ে নিজেকে জখম করার চেষ্টা করে। কিন্তু তাকে ধরে বেঁধে ফেলে গর্তে ফিরিয়ে নেওয়া হলো

সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পরে শামিল একটা পশমের পরত লাগানো চাদর গায়ে তার স্ত্রীদের ঘরগুলোর দিকে গেলেন। সোজা ঢুকলেন আমিনার ঘরে। কিন্তু তাকে সেখানে পেলেন না। সে বড় বউদের সঙ্গে ছিল। শামিল দরজার পেছনে লুকিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু আমিনা তার ওপর খেপে ছিল। তিনি জাইদাকে রেশমি কাপড় দিয়েছেন, তাকে দেননি। সে তাকে তার ঘরে ঢুকে তাকে খুঁজতে দেখেছে। তাই ইচ্ছা করেই দেরি করছিল। জাইদার ঘরের দরজায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল সে। তার ঘরে শামিলের যাওয়া দেখে সে মনে মনে হাসছিল।

তার জন্য অপেক্ষা করে ব্যর্থ হয়ে শামিল যখন নিজের ঘরে ফিরে এলেন, তখন এশার নামাজের ওয়াক্ত হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *