০৫. কুচকাওয়াজ করে ছয় মাইল

খুব সকালে অন্ধকার থাকতে থাকতেই পোলতোরাৎস্কির অধীনে দুটো কোম্পানি শাহগিরনস্কি ফটক দিয়ে বের হয়ে কুচকাওয়াজ করে ছয় মাইল পার হয়ে এল। এক সারি অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী বসিয়ে দিনের আলো ফোঁটামাত্র তারা গাছ কাটতে শুরু করল। আটটার দিকে আগুনের কুণ্ডলীতে হিসহিস পটপট করে ফুটতে থাকে ভেজা কাঁচা ডালগুলো। ওগুলো থেকে ওঠা সুগন্ধি ধোয়ার সঙ্গে মিশে যাচ্ছে কুয়াশা। গাছ কাটিয়েরা এতক্ষণ পাঁচ হাত দূরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছিল না; শুধু একজন আরেকজনের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। এখন তারা আগুনের কুণ্ড এবং কাটা গাছে বন্ধ বনের রাস্তাটি দেখতে পাচ্ছিল। কুয়াশার মধ্যে সূর্যকে একবার উজ্জ্বল একটা ফোঁটার মতো দেখাচ্ছিল, আবার তা চলে যাচ্ছিল।

রাস্তা থেকে একটু দূরে বনের ফাঁকা জায়গাটায় তৃতীয় কোম্পানির দুই অফিসার পোলতোরাৎস্কি এবং তার অধস্তন তিখোনভ এবং মারামারি করার জন্য পদাবনতি পাওয়া অশ্বারোহী গার্ড বাহিনীর সাবেক অফিসার ব্যারন ফ্রিজ ঢাকগুলোর ওপর বসে ছিল। ফ্রিজ ছিল ক্যাডেট কলেজে পোলতোরাৎস্কির সহপাঠী। খাবার মোড়ানো কাগজের টুকরা, সিগারেটের গোড়া এবং কিছু খালি বোতল ঢাকগুলোর চারপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল। অফিসাররা আগে ভোদকা পান করেছে, এখন চলছিল খাওয়া আর পোর্টার বিয়ার পান। একজন ঢাকবাদক তাদের তৃতীয় দফায় বোতলের ছিপি খুলে দিচ্ছিল।

পোলতোরাৎস্কি রাতে যথেষ্ট ঘুমাতে পারেনি। কিন্তু বিপদের আশঙ্কার মধ্যে এবং অধীন সৈন্য ও সহকর্মীদের সঙ্গে থাকলে সে বিশেষ উল্লাস ও বেখেয়ালি আনন্দ অনুভব করে। সে তখনো ঠিক তেমন বোধ করছিল।

অফিসাররা কথাবার্তা বলছিল প্রফুল্ল মনে, তার বিষয় ছিল পাওয়া সর্বশেষ খবর : জেনারেল স্লেপ্তসভের মৃত্যু। তাদের কেউ এই মৃত্যুকে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, জীবনের সমাপ্তি এবং যেখানে উৎপত্তি, সেখানেই ফিরে যাওয়ার মুহূর্ত হিসেবে দেখছিল না। বরং তারা এটাকে কেবল একজন সাহসী যোদ্ধার বীরত্ব হিসেবে দেখছিল, যে তলোয়ার হাতে নিয়ে পাহাড়িদের দিকে ছুটে গিয়ে তাদের কচুকাটা করছিল।

তাদের সবাই যদিও জানত, বিশেষ করে যারা যুদ্ধ করেছে এবং না জেনে উপায় ছিল না যে তখনকার দিনে ককেশাসে কখনো, সত্যি বলতে কি, কোনোখানেই কখনো মুখোমুখি তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করা হয় না। কারণ, সব সময় মনে করা হয় এবং বলা হয় যে তলোয়ার বা বেয়নেট দিয়ে শুধু পালাতে থাকা যোদ্ধাদের কোপানো যায়। মুখোমুখি যুদ্ধের সেই গল্পে পাওয়া অহংকার ও উৎফুল্লতা নিয়ে তারা ঢাকের ওপর বসে (কেউ হালকা মেজাজে, অন্যরা তার উল্টো খুব বিনয়ীভাবে) পান আর হাসিঠাট্টা করছিল। যে মৃত্যু স্লেপ্তসভকে নিয়ে গেছে, তেমনি তাদেরও যেকোনো সময় নিয়ে যেতে পারে, এই দুশ্চিন্তা তাদের ছিল না এবং তাদের কথার মাঝখানে, যেন তাদের আশঙ্কার প্রমাণ হিসেবে তারা রাস্তার বাঁ দিকে রাইফেলের গুলির শব্দ শুনতে পেল। একটা বুলেট শিসস শব্দ করে বাতাসের মধ্য দিয়ে তাদের কাটিয়ে গিয়ে একটা গাছে লাগল।

হে হো আনন্দে চিৎকার করে উঠল পোলতারাৎস্কি, এটা তো আমাদের লাইনেই এসেছে…কস্টিয়া, তারপর ফ্রিজের দিকে ফিরে বলল, তোমার ভাগ্য ভালো। কোম্পানির কাছে ফিরে যাও। আমরা অল্পক্ষণের মধ্যেই যুদ্ধে নামব, খুব মজা হবে। আমরা দেখিয়ে দেব।

ফ্রিজ লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে দ্রুত ধোয়ায় ঢাকা জায়গাটার দিকে কোম্পানির কাছে চলে গেল।

পোলতোরাৎস্কির কালো লেজ ও কেশরওয়ালা তামাটে রঙের ছোট কাবার্ডা ঘোড়াটাকে তার কাছে আনা হলো। সে ওটায় চড়ে গিয়ে কোম্পানিকে নিয়ে যেদিক থেকে গুলি এসেছিল, সেদিকে রওনা হলো। পাহারাচৌকি বসানো হয়েছিল বনের কিনার ঘেঁষে, খাদের ভোলা ঢালের পাশে। বাতাস বইছিল বনের দিকে, শুধু খাদের ঢালটাই না, অপর দিকটাও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। পোলতোরাৎস্কি সীমার কাছে পৌঁছালে কুয়াশার পেছন থেকে সূর্য বের হয়ে এল এবং গিরিখাদের অন্য পারে একটা নতুন বনের কিনারে, প্রায় সিকি মাইল দূরে, কয়েকজন ঘোড়সওয়ার চোখে পড়ল। তারা ছিল হাজি মুরাদকে ধাওয়া করা চেচেন এবং তারা দেখতে চাচ্ছিল যে হাজি মুরাদ রুশদের সঙ্গে দেখা করেছে। তাদের একজন সৈন্যদলের দিকে গুলি ছুড়ল। কয়েকজন সৈন্য পাল্টা গুলি ছুড়ল। চেচেনরা পিছু হটে গেলে গোলাগুলি বন্ধ হলো।

কিন্তু তা সত্ত্বেও পোলতোরাৎস্কি কোম্পানি নিয়ে হাজির হয়ে গুলি চালানোর আদেশ দিল। তার আদেশ মুখ দিয়ে বের হতে না-হতেই অব্যর্থ লক্ষ্যভেদীদের সারি থেকে সবাই আনন্দে-উত্তেজনায় রাইফেলের খটাখট শব্দে সুন্দর করে মিলিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ধোঁয়ার কুণ্ডলী তুলে অবিরাম গুলি চালাতে শুরু করল। একঘেয়েমি কাটানোর কিছু পেয়ে খুশি সৈন্যরা, দ্রুত রাইফেল ভরে একের পর এক গুলি চালায়। চেচেনরাও উত্তেজনায় একের পর এক লাফিয়ে সামনে এসে সৈন্যদের দিকে কিছু গুলি চালায়। তার একটা গুলিতে একজন সৈন্য আহত হয়। এ হলো সেই আভদিয়েভ, যে আগের রাতে ওত পাতার জায়গায় শুয়ে ছিল। সহযোদ্ধারা তার কাছে এসে দেখে সে উপুড় হয়ে দুহাতে আহত পেট চেপে ধরে মাথা নিচু করে পড়ে আছে এবং এদিক-ওদিক দুলছে আর আস্তে আস্তে গোঙাচ্ছে। সে পোলতোরাৎস্কির কোম্পানির। পোলতোরাৎস্কি কয়েকজন সৈন্যকে জড়ো হতে দেখে তাদের কাছে গেল।

কী হয়েছে, বাবা? গুলি লেগেছে? জিজ্ঞেস করল পোলতোরাৎস্কি। কোথায়?

আভদিয়েভ জবাব দিল না।

স্যার, আমি গুলি ভরতে যাচ্ছিলাম, তখন খট করে শব্দ শুনি, আভদিয়েভের পাশে থাকা একজন সৈন্য বলল। আমি তাকিয়ে দেখলাম সে বন্দুক ফেলে দিয়েছে।

টুক টুক টুক! জিব দিয়ে আওয়াজ করল পোলতোরাৎস্কি। খুব ব্যথা লাগছে, আভদিয়ে?

খুব ব্যথা না, কিন্তু দাঁড়াতে পারছি না। স্যার, এক ফোঁটা ভোদকা।

একটু ভোদকা (বা ককেশাসে সৈন্যরা যে মদ পান করে আনা হলো এবং পানভ গম্ভীরভাবে ভুরু কুঁচকে বোতলের মুখ ভর্তি করে আভদিয়েভকে দিল। আভদিয়েভ পান করার চেষ্টা করে সঙ্গে সঙ্গে মুখটা ফিরিয়ে দিল।

আমার পেট উগরে আসছে, সে বলল। তুমি খেয়ে ফেললো।

পানভ মদটুকু পান করল।

আভদিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই আবার পড়ে গেল। তারা একটা চাদর বিছিয়ে তাতে আভদিয়েভকে শুইয়ে দিল।

স্যার, কর্নেল সাহেব আসছেন, পোলতোরাৎস্কিকে জানাল সার্জেন্ট মেজর।

ঠিক আছে, তোমরা একে দেখো? বলে পোলতোরাৎস্কি চাবুক মেরে জোরে দুলকি চালে ভরসভের সঙ্গে দেখা করতে গেল।

ভরন্তসভ তার উন্নত জাতের বিলাতি বাদামি রঙের খোঁজা ঘোড়ায় চড়ে এসেছিলেন, তার সঙ্গে ছিল একজন কসাক অ্যাডজুট্যান্ট এবং একজন চেচেন দোভাষী।

এখানে কী হয়েছে? ভরন্তসভ জিজ্ঞেস করলেন।

একদল চেচেন আমাদের বাইরের লাইনে আক্রমণ করেছিল, পোলতোরাৎস্কি জবাব দিল।

রাখো, রাখো; তুমি নিজেই এগুলো সাজিয়েছ!

না না, প্রিন্স, আমি না, একটু হেসে বলল পোলতোরাৎস্কি, তারা নিজেরাই এগিয়ে গেছে।

শুনলাম একজন সৈন্য আহত হয়েছে?

হ্যাঁ, দুঃখজনক, সে খুব ভালো সৈন্য।

গুরুতর?

গুরুতর, মনে হয় পেটে লেগেছে।

তুমি জানো আমি কোথায় যাচ্ছি? ভরন্তসভ জিজ্ঞেস করলেন।

আমি জানি না।

আন্দাজ করতে পারো?

না। হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছে, আমরা এখন তাকে দেখতে যাচ্ছি।

আপনি সত্যি বলছেন?

গতকাল তার দূত এসেছিল আমার কাছে, তার আনন্দের হাসি কষ্ট করে চেপে রেখে বললেন ভরসভ। কয়েক মিনিটের মধ্যে শালিন ফাঁকা জায়গাটায় সে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। ভোলা জায়গাটা পর্যন্ত লক্ষ্যভেদীদের বসিয়ে দিয়ে আমার সঙ্গে এসো।

বুঝতে পারছি, বলে টুপি ছুঁয়ে অভিবাদন জানিয়ে পোলতোরাৎস্কি চলে গেল তার কোম্পানির কাছে। পাকা লক্ষ্যভেদীদের ডান দিকে বসানোর জন্য নিজে তাদের নিয়ে গেল আর সার্জেন্ট-মেজরকে বাঁ দিকের সারি বসিয়ে দিতে বলল।

কয়েকজন সৈন্য ইতিমধ্যে আহত আভদিয়েভকে দুর্গে নিয়ে যায়।

ভরসভের কাছে ফেরার পথে পোলতোরাৎস্কি দেখতে পেল কয়েকজন ঘোড়সওয়ার তার পিছু পিছু এসে তাকে পার হয়ে যাচ্ছে। সামনে সাদা কেশরের একটি ঘোড়ায় যাচ্ছে জমকালো পোশাকে একজন লোক। তার মাথায় পাগড়ি এবং অস্ত্রগুলোয় সোনা দিয়ে কাজ করা। এই লোকটি হাজি মুরাদ। তিনি পোলতোরাৎস্কির কাছে এসে তাতার ভাষায় কিছু বললেন। ভুরু কুঁচকে, হাত নেড়ে ও মুচকি হেসে পোলতোরাৎস্কি ইশারা করল সে বুঝতে পারেনি। তার স্মিত হাসির জবাবে হাজি মুরাদও স্মিত হাসি হাসলেন এবং সেই শিশুসুলভ হাসিতেই পোলতোরাৎস্কি গলে গেল। পোলতোরাৎস্কি কখনো কল্পনা করেনি পাহাড়িদের ত্রাস সৃষ্টিকারী নেতাটি দেখতে এমন হবে। ভেবেছিল সে দেখতে রুক্ষ এবং শক্তপোক্ত গড়নের হবে; আর তার সামনে এই প্রাণময় লোকটি, তার হাসি এত সরল যে পোলতোরাৎস্কির মনে হয়েছে কতকালের চেনা। তার অবশ্য একটা বৈশিষ্ট্য ছিল, প্রশস্ত চোখ দুটো কালো ভুরুর নিচ থেকে অন্যদের দিকে মনোযোগ দিয়ে শান্ত অথচ অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকায়।

হাজি মুরাদের দলে ছিল পাঁচজন। তাদের একজন খান মাহোমা, গত রাতে যে প্রিন্স ভরন্তসভের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। গোলাপি আভার গায়ের রং, গোল মুখ এবং পাপড়িহীন চোখে প্রফুল্ল দৃষ্টি, যেন জীবনের আনন্দে পূর্ণ। আর ছিল আভার খানেফি, রোমশ মোটাসোটা মানুষ, জোড়া ভুরু। হাজি মুরাদের সব সম্পত্তির দায়িত্ব ছিল তার ওপর, সে একটা খোঁজা। ঘোড়ায় জিনের সঙ্গে লাগানো বস্তাবোঝাই জিনিসপত্র নিয়ে আসছিল। দলের দুজন লোক ছিল বিশেষ লক্ষণীয়। প্রথমজন দাগেস্তানের পাহাড়ি এলাকার এক তরুণ, চওড়া কাধ, কিন্তু কোমর মেয়েদের মতো সরু, মুখে বাদামি দাড়ি কেবল গজাতে শুরু করেছে, চোখ ভেড়ার চোখের মতো সুন্দর। এ হলো এলডার। অন্যজন গামজালো, একজন চেচেন, এক চোখ কানা, ভুরু বা পাপড়ি নেই, ছোট লাল দাড়ি এবং তার মুখ ও নাকের ওপর আড়াআড়ি কাটা দাগ। পোলতোরাৎস্কি হাজি মুরাদকে দেখাল ভরন্তসভ রাস্তায় উঠে এসেছেন। ঘোড়া চালিয়ে হাজি মুরাদ তার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, তার ডান হাত বুকের ওপর রেখে তার ভাষায় কিছু বলে থামলেন। চেচেন দোভাষী তা বুঝিয়ে দিল।

সে বলছে, আমি রুশ জারের ইচ্ছার কাছে আত্মসমর্পণ করলাম। আমি তার সেবা করতে চাই, সে বলছে, আমি অনেক আগে থেকেই তা করতে চেয়েছি কিন্তু শামিল করতে দেয়নি।

দোভাষীর কথা শুনে ভরন্তসভ তার শ্যাময় চামড়ার দস্তানায় ভরা হাত হাজি মুরাদের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। হাজি মুরাদ ক্ষণিকের জন্য হতভম্ব হয়ে পরক্ষণে তা দৃঢ়ভাবে চাপ দিয়ে ধরলেন, আবার কিছু বললেন প্রথমে দোভাষীর দিকে তাকিয়ে, তারপর তাকালেন ভরসভের দিকে।

তিনি বলছেন, আপনাকে ছাড়া আর কারও কাছে তিনি আত্মসমর্পণ করতে চাননি। কারণ, আপনি একজন সরদারের ছেলে এবং তিনি আপনাকে খুব শ্রদ্ধা করেন।

ভরন্তসভ ধন্যবাদ জানানোর জন্য মাথা নাড়লেন। হাজি মুরাদ তার দলের দিকে দেখিয়ে আবার কিছু বললেন।

তিনি বলছেন, এই লোকগুলো তার বিশ্বাসী সমর্থক এবং তার মতো এরাও রুশদের জন্য কাজ করতে চায়।

ভরন্তসভ তাদের দিকে ফিরে মাথা নাড়লেন। প্রফুল্ল, পাপড়িহীন কালো চোখ, চেচেন খান মাহোমাও মাথা নাড়ল এবং এমন কিছু বলল যা হয়তো মজার ছিল, রোমশ আভার ঠোঁট মুচকি হাসল, যাতে তার হাতির দাঁতের মতো চকচকে দাঁত বের হয়ে এল। কিন্তু লালচুলো গামজালোর একমাত্র লাল চোখটি ভরসভের দিকে একনজর দিয়েই তার ঘোড়ার কানের দিকে স্থির হয়ে গেল।

ভরন্তসভ ও হাজি মুরাদ তাদের দলবল নিয়ে দুর্গে ফিরে যাওয়ার পর সৈন্যরা কাজ থেকে ছাড়া পেয়ে এক জায়গায় জড়ো হয়ে নিজেদের মন্তব্য বলাবলি করছিল।

এই শয়তানটা কতগুলো লোক মেরেছে! এখন দেখো তাকে নিয়ে এরা কী অযথা হইচই করে!

স্বাভাবিক, সে ছিল শামিলের ডান হাত, আর এখন কোনো ভয় নেই।

কিন্তু অস্বীকার করতে পারবে না সে একজন চমৎকার লোক। একজন পাকা জিগিত (ককেশীয় অঞ্চলের দক্ষ ঘোড়সওয়ার)।

আর ওই লালটা? লালটা মানুষের দিকে জানোয়ারের মতো পিটপিট করে তাকায়!

হুম, ওইটা নিশ্চয়ই শিকারি কুত্তা!

তারা সবাই লাল লোকটাকে বিশেষভাবে লক্ষ করেছে। গাছ কাটার জায়গায় রাস্তার সবচেয়ে কাছের সৈন্যরা দৌড়ে দেখতে এসেছিল। তাদের অফিসার আগতদের ধমক দিয়েছিল কিন্তু ভরন্তসভ তাকে থামিয়ে দেন।

তাদের পুরোনো বন্ধুদের একবার দেখতে দাও।

তুমি জানো লোকটা কে? সবচেয়ে কাছের সৈন্যটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে তার ইংরেজি উচ্চারণে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলেন ভরন্তসভ।

না, জনাব।

হাজি মুরাদ–তার নাম শুনেছ?

আমরা না জানি কী করে, জনাব? আমরা বহুবার তাকে হারিয়েছি!

হ্যাঁ, আমরাও তার কাছ থেকে মার খেয়েছি।

ঠিক বলেছেন, জনাব, তাদের অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে পারায় খুশি হয়ে সৈন্যটি জবাব দিল।

হাজি মুরাদ বুঝতে পারলেন তারা তার সম্বন্ধেই কথা বলছে, তিনি তার উজ্জ্বল চোখে হাসলেন।

দারুণ উৎফুল্ল মনে ভরন্তসভ দুর্গে ফিরে এলেন।

তরুণ ভরন্তসভ খুব খোশমেজাজে ছিলেন। কারণ, আর কেউ নয়, স্বয়ং তিনি রাশিয়ার সবচেয়ে বড় এবং সক্রিয় শত্রু শামিলের পরের লোকটিকে জয় করতে এবং ঘরে আনতে সফল হয়েছেন। শুধু একটা জিনিস খচখচ করছিল, ভজভিঝেনস্কে সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেলার-জাকোমেলস্কি। আসলে পুরো ঘটনাটাই তার মাধ্যমে হওয়া উচিত ছিল। ভরন্তসভ কোনো খবর না দিয়ে নিজেই পুরো কাজটি করায় অপ্রিয় কিছু হতে পারে। এই চিন্তা তার প্রফুল্লতায় কাঁটার মতো খচখচ করছিল। দুর্গে পৌঁছে তিনি হাজি মুরাদের সহকারীদের দায়িত্ব রেজিমেন্টের অ্যাডজুট্যান্টের হাতে দিয়ে নিজে হাজি মুরাদকে বাড়িতে নিয়ে গেলেন।

অভিজাত পোশাক পরা প্রিন্সেস মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার ছয় বছর বয়সী কোকড়া চুলের সুন্দর ছেলেটিকে নিয়ে বসার ঘরে হাজি মুরাদের সঙ্গে দেখা করতে এলেন। হাজি মুরাদ হাত বুকের ওপর রেখে, তার সঙ্গে ঘরে আসা দোভাষীর মাধ্যমে অতি বিনয়ে বললেন, প্রিন্স তাকে বাড়িতে নিয়ে আসায় তিনি নিজেকে প্রিন্সের বন্ধু বলে মনে করেন এবং একজন বন্ধুর পরিবারের সবাই তার কাছে বন্ধুর মতোই পবিত্র।

হাজি মুরাদের চেহারা ও ব্যবহারে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা খুশি হলেন এবং নিজের বড় সাদা হাতটি বাড়িয়ে দেওয়ায় তার রক্তিমাভ হয়ে যাওয়াতেও হাজি মুরাদের ভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন মারিয়া। তাঁকে বসার জন্য বলে জিজ্ঞেস করলেন, তিনি কি কফি পান করবেন। কফি পরিবেশন করা হলো। কিন্তু পরিবেশনের পর হাজি মুরাদ তা খেলেন না। হাজি মুরাদ রুশ ভাষা একটু একটু বুঝতেন কিন্তু বলতে পারতেন না। রুশ ভাষার কথা কিছু বুঝতে না পারলে তিনি হাসেন এবং তার হাসিতে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা খুশি হলেন, যেমন তা খুশি করেছিল পালতোরাৎস্কিকেও। কোঁকড়া চুল উৎসুক চোখের ছোট ছেলেটি (তার মা যাকে বুক্কা নামে ডাকে) মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে হাজি মুরাদের ওপর থেকে চোখ একটুও সরায়নি, বড় যোদ্ধা হিসেবে যার সুনাম সে শুনেছে।

স্ত্রীর কাছে হাজি মুরাদকে রেখে, তার রাশিয়ার পক্ষে চলে আসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রতিবেদন লিখতে ভরন্তসভ তার অফিসে গেলেন। প্রতিবেদন লেখা শেষে গ্রজনিতে লেফট ফ্ল্যাঙ্কের অধিনায়ক-জেনারেল, জেনারেল কজলভস্কি এবং তার বাবার কাছে চিঠি লেখা শেষ হওয়ার পর ভরন্তসভ জলদি বাড়িতে রওনা হলেন, মনে ভয়, একজন ভয়াবহ অপরিচিত লোকের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়ার জন্য তার স্ত্রী হয়তো তেতে থাকবে। তার ওপর

লোকটির সঙ্গে এমন আচরণ করতে হবে, যাতে সে ক্ষুব্ধ না হয় আবার বেশি বিনয়ীও না হয়। কিন্তু তার শঙ্কার কোনো কারণ ছিল না। হাজি মুরাদ ভরসভের সৎছেলে ছোট্ট বুল্কাকে হাঁটুর ওপর নিয়ে একটা হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে ছিলেন; আর মাথা নিচু করে দোভাষীর মাধ্যমে হাস্যোজ্জ্বল মারিয়া ভাসিলিয়েভনার কথা শুনছিলেন। মারিয়া ভাসিলিয়েভনা বলছিলেন কোনো বন্ধু ভরসভের কোনো কিছুর প্রশংসা করলে ভরন্তসভ তা উপহার হিসেবে দিয়ে দেন, অবস্থা এমন যে, তাকে শিগগিরই এড়ামের মতো জিনিস খুঁজতে নামতে হবে।

বলতে বলতে প্রিন্স ঘরে ঢুকলেন। বুক্কাকে অবাক ও অসন্তুষ্ট করে হাঁটু থেকে নামিয়ে দিয়ে হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখের হালকাভাব কঠিন ও গম্ভীর হয়ে যায় এবং ভরন্তসভ বসার পরই কেবল তিনি আবার বসেন।

আলাপের খেই ধরে হাজি মুরাদ মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে জবাব দেন যে তাদের সমাজেও বন্ধু কোনো কিছুর প্রশংসা করলে তাকে তা দিয়ে দেওয়াই নিয়ম।

আপনার ছেলে! ছোট ছেলেটির কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ছেলেটি আবার তার হাঁটুতে উঠে বসেছিল।

তোমার দস্যু খুব মজার! মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তার স্বামীকে ফরাসিতে বলল। বুক্কা তার ছোরাটা পছন্দ করেছে আর উনি সেটা ওকে দিয়ে দিয়েছেন।

বুল্কা তার বাবাকে ছোরাটা দেখাল।

এটা তো খুব দামি জিনিস! তার মা বলল।

আমাদেরও কোনো সুযোগে তাকে উপহার দিতে হবে, ভরন্তসভের জবাব।

হাজি মুরাদ চোখ বন্ধ করে ছেলেটির কোঁকড়া চুলে হাত বুলিয়ে বলছিলেন, জিগিত, জিগিত! (তাতার ভাষায় অর্থ দক্ষ সাহসী ঘোড়সওয়ার)।

সুন্দর, খুব সুন্দর ছোরা, ছোরাটার ধারালো ফলা খাপ থেকে অর্ধেক বের করে রুশ ভাষায় বললেন ভরন্তসভ। ফলাটার মাঝখানে একটা শিরা। আপনাকে ধন্যবাদ!

দোভাষীকে বললেন, জিজ্ঞেস করো আমি তার জন্য কী করতে পারি।

দোভাষী তার অর্থ বললে হাজি মুরাদ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, তার কিছু দরকার নেই, শুধু নামাজ পড়ার জায়গা দেখিয়ে দিলেই হবে।

ভরন্তসভ খানসামাকে ডেকে হাজি মুরাদ যা চেয়েছে, তা-ই করতে বললেন।

তাকে দেওয়া কামরায় ঢুকে একা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজি মুরাদের চেহারা। পাল্টে গেল। কখনো বিনয়ী, কখনো গুরুগম্ভীর এবং প্রসন্নতার ছাপ উবে গিয়ে দুশ্চিন্তার ছাপ পড়ল। হাজি মুরাদ যা ভেবেছিলেন, ভরন্তসভ তাকে তার চেয়ে ভালোভাবে বরণ করেছেন। কিন্তু ভরন্তসভ ও তার কর্মকর্তারা যত ভালো ব্যবহার করছিল হাজি মুরাদ তাদের তত কম বিশ্বাস করছিলেন। সবকিছুতেই তার শঙ্কা, তাকে গ্রেপ্তার করে শিকল বেঁধে সাইবেরিয়ায় পাঠিয়ে দেওয়া হতে পারে বা খুন করা হতে পারে এবং তাই সে হুঁশিয়ার ছিল। এলডার তার ঘরে ঢুকলে তাকে জিজ্ঞেস করলেন অন্য মুরিদদের কোথায় রাখা হয়েছে, তাদের অস্ত্র নিয়ে নিয়েছে কি না, ঘোড়াগুলোই-বা কোথায়। এলড়ার খবর দিল ঘোড়াগুলো প্রিন্সের আস্তাবলে রাখা হয়েছে, মুরিদদের একটা খামার ঘরে রাখা হয়েছে, তবে অস্ত্রগুলো তাদের কাছেই আছে, একজন দোভাষী খাবার এবং চা দিচ্ছে।

হাজি মুরাদ সন্দেহে মাথা নাড়লেন। কাপড় ছেড়ে নামাজ পড়লেন এবং এলডারকে তার রুপার ছুরিটা এনে দিতে বললেন। তারপর পোশাক পরে বেল্ট বেঁধে সোফার ওপর পা তুলে বসে ভাগ্যে কী আছে তার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন।

বিকেল চারটায় দোভাষী তাকে প্রিন্সের সঙ্গে খানা খেতে ডেকে নিয়ে গেল।

রাতের খাবারে তিনি প্রায় কিছুই খেলেন না, শুধু মারিয়া ভাসিলিয়েভনা নিজে থালার যে দিকটা থেকে পোলাও নিয়েছিলেন, ঠিক সেই দিক থেকে একটু পোলাও নিলেন।

সে ভয় করছে আমরা তাকে বিষ খাওয়াব, স্বামীর দিকে মন্তব্য মারিয়া। ভাসিলিয়েভনার। আমি যে-ই দিক থেকে নিয়েছি, সে-ও ঠিক সেই দিক থেকে নিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে দোভাষীর মাধ্যমে হাজি মুরাদকে জিজ্ঞেস করল তিনি আবার কখন নামাজ পড়বেন। হাজি মুরাদ পাঁচটা আঙুল তুলে সূর্যের দিকে ইশারা করে দেখালেন। তাহলে খুব তাড়াতাড়ি সময় হয়ে যাবে, ভরন্তসভ তার ঘড়ি বের করলে একটা স্প্রিংয়ে চাপ দিলেন। ঘড়িতে সোয়া চারটার ঘণ্টা বাজল। বোঝা গেল, হাজি মুরাদ ওটায় খুব অবাক হয়েছেন, তিনি ঘণ্টাটা আবার শোনার এবং ঘড়িটা দেখতে দেওয়ার অনুরোধ করলেন।

প্রিন্সেস তার স্বামীকে ফরাসিতে বলল, এটাই সুযোগ! তাকে ঘড়িটা দিয়ে দাও।

ভরন্তসভ সঙ্গে সঙ্গে ঘড়িটা হাজি মুরাদকে দিয়ে দিলেন।

তিনি বুকে হাত রাখলেন এবং ঘড়িটা নিলেন। কয়েকবার স্পিংটায় চাপ দিয়ে ঘণ্টার আওয়াজটা শুনলেন এবং প্রশংসা করে মাথা নাড়লেন।

খাওয়া শেষ হলে কেউ একজন জানাল, মেলার-জাকোমেলস্কির এডিসি এসেছে।

এডিসি প্রিন্সকে জানাল হাজি মুরাদের আসার খবর পেয়ে জেনারেল খুব অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কারণ, তাকে এ বিষয়ে আগে জানানো হয়নি এবং হাজি মুরাদকে কোনো দেরি না করে তার কাছে পাঠাতে বলেছেন। ভরন্তসভ জেনারেলের আদেশ মানার কথা বললেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে হাজি মুরাদকে এই আদেশের কথা জানিয়ে তাকে মেলারের কাছে যেতে বললেন।

এডিসি কী জন্য এসেছে, শুনে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা তক্ষুনি বুঝতে পারলেন তার স্বামী ও জেনারেলের মধ্যে এটা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে, তাই তার স্বামীর কোনো বারণ না শুনে সে এডিসি ও হাজি মুরাদের সঙ্গে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।

(ফরাসিতে তাদের দুজনের আলাপ।)

তুমি বাড়িতে থাকলেই বেশি ভালো হবে। এটা আমার ব্যাপার, তোমার নয়।

জেনারেলের বেগম সাহেবার সঙ্গে দেখা করতে তুমি আমাকে কিছুতেই বাধা দিতে পারবে না!

(রুশ ভাষায় তাদের দুজনের কথা।)

তুমি অন্য সময় যেয়ো।

আমি এখনই যেতে চাই।

কিছুতেই ঠেকাতে না পেরে রাজি হলেন ভরন্তসভ; শেষ পর্যন্ত তারা তিনজনই গেলেন।

তারা ঘরে ঢুকলে মেলার গম্ভীর অথচ ভদ্রভাবে মারিয়া ভাসিলিয়েভনাকে তার স্ত্রীর কাছে নিয়ে গেলেন এবং এডিসিকে বললেন হাজি মুরাদকে অপেক্ষা করার ঘরে বসাতে এবং আবার আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত তাকে যেন বাইরে যেতে না দেয়।

তার পড়ার ঘরের দরজা খুলে প্রিন্স ভরন্তসভকে ভেতরে ঢোকার অনুরোধ করলেন এবং প্রিন্সকে তার আগে যেতে দিলেন।

পড়ার ঘরে ঢুকে তিনি প্রিন্সের সামনে থেমে তাকে বসতে না দিয়েই বললেন, এখানে আমি অধিনায়ক, তাই শত্রুর সঙ্গে কোনো রকম আলোচনা অবশ্যই আমার মাধ্যমে করতে হবে! তুমি কেন আমাকে হাজি মুরাদের আসার কথা জানাওনি?

একজন দূত এসে আমাকে বলেছিল, হাজি মুরাদ কেবল আমার কাছে ধরা দিতে চায়, উত্তেজনায় ফ্যাকাশে হয়ে রাগত জেনারেলের কাছ থেকে রূঢ় জবাব আসবে ভেবে নিজেও রেগে জবাব দিলেন ভরসভ।

আমি জিজ্ঞেস করছি আমাকে কেন জানানো হয়নি?

আমি তা করতে চেয়েছিলাম, ব্যারন, কিন্তু…।

তুমি আমাকে ব্যারন বলবে না, স্যার বলবে! সেই মুহূর্তে ব্যারনের রাগ হঠাৎ ফেটে পড়ল এবং দীর্ঘদিন ধরে তার মনে যত রাগ জমা হয়ে ফুটছিল, তা সব বের হতে থাকল।

আমি সাতাশ বছর জারের চাকরি এই জন্য করিনি যে পরিবারের সুপারিশে গতকাল চাকরিতে যোগ দিয়ে কেউ আমার নাকের নিচে এমন সব আদেশ দিতে থাকবে, যেগুলো তাদের কোনো কাজ নয়!

বাধা দিয়ে ভরন্তসভ বললেন, স্যার, আমি আপনাকে অসত্য কিছু না বলার অনুরোধ করছি।

আমি সত্য কথাই বলছি, আমি সহ্য করব না… জেনারেল আরও রেগে বললেন।

সেই মুহূর্তে স্কার্টে খসখস শব্দ তুলে মারিয়া ভাসিলিয়েভনা ঘরে ঢুকল, তার পেছনে পেছনে একজন ছোটখাটো ভদ্র মহিলা, মেলার-জাকোমেলস্কির স্ত্রী।

শোনো, শোনো ব্যারন! সাইমন তোমাকে অসন্তুষ্ট করতে চায়নি, মারিয়া ভাসিলিয়েভনা বলতে শুরু করলেন।

আমি সে কথা বলছি না, প্রিন্সেস…।

ঠিক আছে, এগুলো সব বাদ দাও! তুমি জানো, খারাপ শান্তি ভালো ঝগড়ার চেয়ে ভালো!…হায় খোদা, আমি কী বলছি? এবং সে হাসতে শুরু করল।

ক্রুদ্ধ জেনারেল সুন্দরীর হাসিতে ধরা পড়লেন। তার গোঁফের নিচে ভেসে উঠল মুচকি হাসি।

স্বীকার করি আমি ভুল করেছি, বললেন ভরন্তসভ, কিন্তু…

আমিও একটু খেপে গিয়েছিলাম, বললেন মেলার এবং প্রিন্সের দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন।

শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত। ঠিক হলো হাজি মুরাদকে তখনকার মতো মেলারের কাছেই রাখা হবে এবং পরে তাকে লেফট-ফ্ল্যাঙ্কের অধিনায়কের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।

হাজি মুরাদ বসে ছিলেন পাশের ঘরে এবং কী বলা হচ্ছিল, বুঝতে না পারলেও যা বোঝা দরকার, তা ঠিকই বুঝে নিয়েছিলেন। যেমন ঝগড়া হচ্ছিল তাকে নিয়েই এবং তার শামিলকে ছেড়ে আসাটা রুশদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং তাই তারা তাকে মারবে না বা নির্বাসনে পাঠাবে না, বরং সে তাদের কাছ থেকে অনেক কিছু আদায় করে নিতে পারবে। তিনি আরও বুঝেছিলেন, মেলার-জাকোমেলস্কি অধিনায়ক হলেও অধীনস্থ ভরন্তসভের মতো প্রভাব তার নেই। ভরন্তসভ গুরুত্বপূর্ণ আর মেলার-জাকোমেলস্কি গুরুত্বহীন এবং তাই মেলার-জাকোমেলস্কি তাকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে হাজি মুরাদ দৃপ্ত ও জমকালো ভাষায় বললেন, তিনি শ্বেতাঙ্গ জারের সেবা করতে এসেছেন এবং কেবল তার সরদারের কাছেই জবাব দেবেন। তার সরদার বলতে তিনি তিবলিসে প্রধান সেনাপতি প্রিন্স ভরন্তসভকেই বুঝিয়েছিলেন।

আহত আভদিয়েভকে হাসপাতালে নিয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে একটা খালি বিছানা দেওয়া হলো। হাসপাতালটা দুর্গে ঢোকার পথে একটা কাঠের বাড়ি, ছাদটাও তক্তা দিয়ে বানানো। ওয়ার্ডে চারজন রোগী–একজনের টাইফাস, তার প্রচণ্ড জ্বর। আরেকজন দেখতে ফ্যাকাশে এবং চোখের নিচে কালি। তার ম্যালেরিয়ার মতো পালা জ্বর। সে অবিরাম গোঙাচ্ছিল, মনে হচ্ছিল আবার জ্বর আসবে। বাকি দুজন তিন সপ্তাহ আগের এক হামলায় আহত একজনের হাতে লেগেছিল, সে দাঁড়িয়েছিল। অন্যজনের লেগেছিল কাঁধে। সে ছিল বিছানায় বসা! টাইফাসের রোগীটা ছাড়া সবাই কাছে গিয়ে আভদিয়েভ এবং যারা তাকে নিয়ে এসেছিল, তাদের ঘিরে ধরে নানা প্রশ্ন করতে শুরু করল।

কোনো কোনো সময় তারা এত গুলি করে যে মনে হবে তোমার ওপর মটরশুটি ছিটাচ্ছে, কিন্তু তাতেও কিছুই হয় না আর এবারমাত্র গোটা পাঁচেক গুলি করেছে, যারা নিয়ে এসছিল, তাদের একজন বলল।

ভাগ্যে যা আছে, প্রত্যেকের তা হবে!

আহ! বিছানায় নামানোর সময় ব্যথা সহ্য করার চেষ্টায় জোরে ককিয়ে উঠল আভদিয়েভ। নামানো হলে সে কোঁকানি থামাল এবং ভুরু কুঁচকে তার পা অনবরত নাড়াচ্ছিল। তার ক্ষতের ওপর হাত রেখে সে সোজা সামনে তাকিয়ে থাকল।

ডাক্তার এসে তাকে উপুড় করে শোয়াতে বলল, যাতে দেখতে পারে গুলি পেছন দিয়ে বের হয়ে গেছে কি না।

এটা কী? ডাক্তার জিজ্ঞেস করল। রোগীর পিঠ থেকে পাছা পর্যন্ত দুটো লম্বা সাদা দাগ, কাটা চিহ্নের মতো একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গেছে।

এটা অনেক আগে হয়েছিল, স্যার! ককিয়ে জবাব দিল আভদিয়েভ।

আভদিয়েভ মদের পেছনে সব টাকা উড়িয়ে দেওয়ায় যে চাবুক খেয়েছিল, তারই দাগ ওগুলো। ডাক্তার অনেকক্ষণ তার পেটে পরীক্ষা করে গুলিটি পেল কিন্তু বের করতে পারল না। সে ক্ষতের ওপর ব্যান্ডেজ বেঁধে প্লাস্টার করে দিয়ে চলে গেল। ডাক্তারের পরীক্ষা ও ব্যান্ডেজ বাধার পুরো সময়টা আভদিয়েভ দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে ছিল। ডাক্তার চলে যাওয়ার পর সে চোখ খুলে অবাক হয়ে চারদিক দেখল। সে অন্য রোগীদের এবং শল্যবিদের আরদালির দিকে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে, কিন্তু অন্য কী একটা তাকে অবাক করে দিল।

তার বন্ধু পানভ ও সেরোগিন এসেছে। কিন্তু আভদিয়ে শুয়ে থাকল একইভাবে, সামনের দিকে তাকিয়ে। তার বন্ধুদের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থাকার অনেকক্ষণ পর সে সহকর্মীদের চিনতে পারল।

পিটার, তোমার বাড়িতে কি খবর দেওয়া দরকার? পানভ জিজ্ঞেস করল।

আভদিয়েভ পানভের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেও জবাব দিল না।

তোমার বাড়িতে কি কিছু বলে পাঠাতে হবে? আভদিয়েভের মোটা হাড়ের ঠান্ডা হাত ছুঁয়ে আবার জিজ্ঞেস করল পানভ।

আভদিয়েভের যেন হুঁশ ফিরে এল।

ও! পানভ!

হ্যাঁ, দেখো, আমি এসেছি! তোমার বাড়িতে খবর পাঠাতে হবে না? সেরোগিন একটা চিঠি লিখে দেবে।

সেরোগিন… কষ্ট করে সেরোগিনের দিকে চোখ ফিরিয়ে আভদিয়েভ বলল, তুমি কি লিখে দেবে?…তাহলে লিখো, তোমার ছেলে পিটার তোমাদের অনেক দিন বেঁচে থাকতে বলেছে (প্রচলিত এই কথার অর্থ চিঠির লেখক মারা গেছে)। সে তার ভাইকে হিংসা করে…আমি আজকেই তোমাদের এ কথা বলেছি…সে এখন খুশি হবে। তাকে বিরক্ত কোরো না। তাকে বাঁচতে দাও। ঈশ্বর তাকে বাঁচিয়ে রাখুক। আমি খুশি! এই লিখে দাও।

এ কথা বলে পানভের দিকে তাকিয়ে সে অনেকক্ষণ চুপ করে থাকল।

হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি তোমার পাইপটা পেয়েছ? পানভ জবাব দিল না।

তোমার পাইপ…তোমার পাইপ! জিজ্ঞেস করছি ওটা পেয়েছ? আভদিয়েভ আবার বলল।

ওটা আমার ব্যাগে ছিল।

ঠিক আছে!…বেশ, এখন আমাকে একটা মোমবাতি এনে দাও…আমি মরতে যাচ্ছি, বলল আভদিয়েভ।

ঠিক তখনই পোলতোরাৎস্কি তার সৈন্যকে দেখার জন্য ভেতরে ঢুকল।

কেমন আছ, ব্যাটা! খারাপ? সে জিজ্ঞেস করল।

না, আভদিয়ে চোখ বুজে মাথা নেড়ে জানাল। তার চোয়াল মোটা মুখটা ছিল ফ্যাকাশে আর কঠোর। সে জবাব দিল না কিন্তু আবার পানভকে বলল, একটা মোমবাতি আনো,..আমি মারা যাচ্ছি।

একটা মোমবাতি এনে তার হাতে দেওয়া হলো কিন্তু তার আঙুলগুলো বাঁকানো যাচ্ছে না বলে বাতিটাকে আঙুলের মধ্যেই গুঁজে দিয়ে তার জন্য উঁচু করে ধরা হলো।

পোলতোরাৎস্কি চলে যাওয়ার মিনিট পাঁচেক পর আরদালি আভদিয়েভের হৃৎস্পন্দন শোনার চেষ্টা করল বুকে কান পেতে, বলল, সব শেষ।

আভদিয়েভের মৃত্যুর বিবরণ যেভাবে তিবলিসে পাঠানো হয়, তা নিচে দেওয়া হলো।

২৩ নভ। কুরিল রেজিমেন্টের দুটো কোম্পানি দুর্গ থেকে বের হয়ে গাছ কাটার অভিযানে যায়। দুপুরের দিকে অনেক পাহাড়ি গাছ কাটিয়েদের ওপর হঠাৎ হামলা করে। অব্যর্থ লক্ষ্যভেদীরা পিছু হটতে শুরু করে কিন্তু দ্বিতীয় কোম্পানি বেয়নেট দিয়ে আক্রমণ করে পাহাড়িদের হটিয়ে দেয়। এই ঘটনায় দুজন সৈন্য সামান্য আহত হয় এবং একজন নিহত হয়। পাহাড়িদের প্রায় ১০০ জন হতাহত হয়েছে।

ভজভিঝেনস্কের হাসপাতালে পিটার আভদিয়েভ মারা যাওয়ার দিন তার বৃদ্ধ বাবা, যে ভাইয়ের বদলে সে সামরিক বাহিনীতে তালিকাভুক্ত হয়েছিল, তার স্ত্রী এবং সেই ভাইয়ের মেয়ে শক্ত বরফশীতল মাড়াইয়ের জায়গায় যব মাড়াই করছিল। ভাইয়ের মেয়েটা ঋতুমতী এবং বিয়ের যোগ্য হয়েছে।

তার আগের দিন ভারী তুষার পড়েছে এবং সকালের দিকে তা জমে বরফ হয়ে যায়। মোরগগুলো তৃতীয়বার ডাকলে বুড়ো জেগে যায় এবং বরফঢাকা জানালা দিয়ে উজ্জ্বল চাঁদের আলো দেখে চুল্লির ওপর থেকে নেমে আসে, তার জায়গায় যায়। ঘণ্টা দুয়েক সেখানে কাজ করার পর সে কুঁড়ের মধ্যে ফিরে এসে তার ছেলে ও মহিলাদের জাগায়। ছেলের বউ ও মেয়েটা মাড়াইয়ের জায়গায় গিয়ে দেখে তা ঝেড়ে পরিষ্কার করা এবং একটা কাঠের কোদালে সাদা শুকনা বরফে আটকে আছে, তার পাশে কাঠির আঁটাগুলোর শলা ওপরের দিক করে দাঁড়ানো। দুই সারি যবের আটি শিষগুলো মুখোমুখি করে পরিষ্কার করা মাড়াইয়ের জায়গাজুড়ে রাখা। তারা তাদের মাড়াইয়ের লাঠি বেছে নিয়ে তিনজন তালে তালে মাড়াই শুরু করে দিল। বুড়ো তার ভারী লাঠিটি দিয়ে খড়গুলো ভেঙে ফেলছিল; মেয়েটা শিষগুলোকে মাপা হাতে পেটাচ্ছিল আর ছেলের বউ তার লাঠি দিয়ে যুবগুলো উল্টে দিচ্ছিল।

চাঁদ ডুবে গিয়ে ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছিল এবং তারা তাদের সারি প্রায় শেষ করে আনার সময় মাড়াইকারীদের সঙ্গে যোগ দিল বুড়োর বড় ছেলে আকিম।

তাকে দেখে কাজ থামিয়ে বুড়ো তার মাড়াইয়ের লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, তুই অলসের মতো কী করছিলি?

ঘোড়াগুলোকেও দেখতে হয়েছে।

ঘোড়াগুলো দেখতে হয়েছে! ছেলেকে ভেঙিয়ে বলল বাবা। ওগুলো বুড়ি দেখবে। তোর মাড়াইয়ের লাঠি নে! ভোটকা হয়েছিস, ব্যাটা মাতাল!

তুমি আমাকে মদ দিয়েছিলে? বিড়বিড় করে বলল ছেলে। কী? একটা বাড়ি বন্ধ করে কড়া দৃষ্টিতে বলল বুড়ো। ছেলে নীরবে একটা লাঠি তুলে নিলে তারা চারটা লাঠি দিয়ে মাড়ানো শুরু করল।

ত্রাক, টপটম…ত্রাক, টপটম ব্রাক… বুড়োর ভারী লাঠির বাড়ি পড়ছে বাকি তিনজনের ওপরে।

তোর গর্দান এ রকম ভদ্রলোকের মতো হয়েছে কেন! এই দেখ আমার ট্রাউজার ঝুলে থাকার জন্য কিছু কোমরে কিছু নেই! বাড়ি না দিয়ে শুধু তাল রাখার জন্য শূন্যে লাঠিটা ঘুরিয়ে বলল বুড়ো।

তাদের সারি শেষ হয়ে গেলে মেয়েরা আঁচড়া দিয়ে খড়গুলো সরাতে শুরু করল।

তোর বদলে পিটার গিয়ে বোকামি করেছে। সেনাবাহিনী তোর বলদামি ছুটিয়ে দিত; বাড়িতে সে তোর পাঁচটার সমান হতো!

অনেক হয়েছে, বাবা, আঁটি বাঁধার খড়গুলো সরাতে সরাতে বলল ছেলের বউ।

হ্যাঁ, তোমাদের ছয়টাকে খাওয়াই আর একজনের কাজও পাই না! পিটার দুজনের সমান কাজ করত। সে এ রকম ছিল না।  

পায়ে চলা পথ ধরে বাড়ি থেকে এল বুড়োর স্ত্রী। তার শক্ত করে পশমি ফিতে জড়ানো পায়ে নতুন গাছের বাকলের জুতা। তার নিচে জমাট বরফ মচমচ করে ভাঙছিল। পুরুষেরা কাঠের কোদাল দিয়ে আঝাড়া যুবগুলো এক জায়গায় জড়ো করছিল। যেগুলো পড়েছিল, ছেলের বউ আর মেয়ে তা ঝাড়ু দিচ্ছিল।

গ্রামের মুরব্বিদের পাঠিয়েছিল, সবাইকে ইট টানতে মালিকের বাড়িতে যেতে বলেছে, বুড়ি বলল। আমি নাশতা বানিয়ে রেখেছি…তোমরা খেতে আসবে না?

ঠিক আছে। যা, পাতলা গদিটা লাগিয়ে যা। আকিমকে বলল বুড়ো, দেখিস, আমাকে আবার সেদিনের মতো বিপদে ফেলিস না! পিটারের জন্য দুঃখ না করে পারা যায় না!

সে যখন বাড়িতে ছিল, তখন তুমি তাকে বকাবকি করতে, পাল্টা জবাব দিল আকিম। এখন সে নাই আর তুমি আমার সঙ্গে ঘ্যান ঘ্যান করো।

এতেই বোঝা যায় এটা তোর পাওনা, তার মা একই রকম রাগত সুরে বলল। তুই কখনো পিটারের সমান হবি না।

আচ্ছা, ঠিক আছে, ছেলে বলল।

ঠিক আছে, আসলেই! গম বেচে মদ গিলেছ, এখন তুমি বলছ ঠিক আছে!

যা গেছে যেতে দিন না! ছেলের বউ বলল।

বাবা ও ছেলের এই ঝগড়া বহুদিনের, প্রায় পিটার সেনাবাহিনীতে যাওয়ার পর থেকে। তখন থেকেই বুড়ো মনে করত সে নাকের বদলে নরুন পেয়েছে। বুড়ো বুঝত একজন পিতার চেয়ে একজন সন্তানহীনের যাওয়াই ঠিক। আকিমের চার সন্তান ছিল, পিটারের একজনও না; কিন্তু পিটার তার বাবার মতো দক্ষ, বিচক্ষণ, সবল, ধৈর্যবান এবং সর্বোপরি পরিশ্রমী ছিল। সে সব সময় কাজ করত। কোথাও যাওয়ার সময় সে যদি দেখত লোকে কাজ করছে, তবে সে থেমে তাদের সাহায্য করত, যেমন তার বাবাও করত, হয় দু-এক বোঝা খড় কেটে দিত বা গাড়ি বোঝাই করে দিত বা গাছ কেটে দিত বা কাঠ ফেড়ে দিত। সে চলে যাওয়ায় বুড়ো খুব দুঃখ করত, কিন্তু তার কোনো প্রতিকার ছিল না। সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নাম লেখানো তখনকার দিনে মরে যাওয়ার মতো ছিল। একজন সৈন্য যেন গাছের কাটা ডাল; বাড়িতে তার জন্য দুঃখ করা ছিল কারও বুক অকারণে ছিঁড়ে ফেলার মতো। শুধু মাঝেমধ্যে বড় ছেলেকে খোঁচানোর জন্য বাবা এই কথা বলত, সেদিন সে যেমন বলেছিল। কিন্তু তার মা প্রায়ই ছোট ছেলের কথা মনে করত এবং সে অনেক দিন ধরে, প্রায় এক বছর ধরে তার স্বামীকে বলছিল পিটারকে কিছু টাকা পাঠাতে, বুড়ো তার কোনো জবাব দেয়নি।

আভদিয়েভদের পরিবার সচ্ছল ছিল এবং বুড়ো কিছু টাকা গোপনে জমিয়ে রেখেছিল কিন্তু সে কিছুতেই সরিয়ে রাখা টাকায় হাত দিত না। এখন সে ছোট ছেলের কথা বলছে শুনে তার বুড়ি স্ত্রী ঠিক করল, তাকে যব বেচে অন্তত এক রুবল পাঠানোর কথা আবার বলবে। সে তা-ই করল। অন্যরা মালিকের কাজ করার জন্য চলে যাওয়ার পরই তারা একা হয়ে গেলে, সে বুড়োকে যব বেচা টাকা থেকে পিটারকে এক রুবল পাঠাতে রাজি করাল।

তাই তিনটি টানা গাড়িতে ছিয়ানব্বই বুশেল (এক বুশেল–আট গ্যালন) বস্তার ঘেরে কাঠের আংটা দিয়ে সাবধানে বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি করা হলে বুড়ি বুড়োর হাতে একটা চিঠি দিল। গির্জার কেরানি বুড়ির কথামতো লিখে দিয়েছে। বুড়ো কথা দিল, শহরে গিয়ে সে এক রুবল ভরে সঠিক ঠিকানায় পাঠিয়ে দেবে।

বুড়ো ভেড়ার চামড়ার একটি নতুন কাপড় পরে তার ওপর বাড়িতে বানানো চাদর পরল এবং পায়ে সাদা পশমি ফিতে পেঁচাল, চিঠিটি নিয়ে তার ছোট ব্যাগে ভরল, তারপর দোয়া পড়ে সামনের গাড়িটিতে উঠে শহরে রওনা হলো। তার নাতি বসল পেছনের গাড়িটায়। শহরে পৌঁছে সে সরাইয়ের লোকটাকে চিঠিটা দিল তাকে পড়ে শোনানোর জন্য। সে খুব মনোযোগ দিয়ে শুনল এবং তাতে সায় দিল।

চিঠিতে পিটারের মা প্রথমে তাকে দোয়া করেছিল, তারপর সবার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা এবং তার দাদার মৃত্যুর খবর লেখা ছিল এবং তারপর লেখা ছিল আকসিনিয়া (পিটারের স্ত্রী) তাদের সঙ্গে থাকতে চায়নি, সে চাকরি করছে এবং তারা শুনেছে যে সে সুন্দর, সৎ জীবন কাটাচ্ছে। তারপর রুবল পাঠানোর কথা। সবশেষে তার নিজের কথাগুলো। সে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে যা বলেছে, গির্জার কেরানি ঠিক সেই শব্দগুলোই হুবহু লিখে দিয়েছে–

আরেকটা কথা, আমার প্রিয় বাছা, আমার মিষ্টি পায়রা, আমার নিজের পিটারকিন! আমি তোমার কথা মনে করে সব সময় চোখের পানি ফেলি, আমার চোখের আলো। তুমি আমাকে কোথায় রেখে গেছ? এই সময় বুড়ি ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল, এতেই চলবে! চিঠিতে শব্দগুলো ঠিক এইভাবে ছিল। কিন্তু ভাগ্যে লেখা ছিল না যে পিটার তার স্ত্রীর বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার কথা বা রুবল পাঠানোর কথা বা মায়ের শেষ কথাগুলো জানতে পারবে। চিঠিটা পাঠানো টাকাসহ ফেরত আসে এবং জানানো হয় পিটার তার জারকে, তার পিতৃভূমিকে এবং অর্থোডক্স ধর্মমতকে রক্ষার যুদ্ধে মারা গেছে। সেনাবাহিনীর কেরানি এভাবেই লিখেছিল।

এই খবর পৌঁছানোর পর বুড়ি যতক্ষণ সময় করতে পারল কাঁদল, তারপর কাজে লেগে গেল। ঠিক পরের রোববার সে গির্জায় গিয়ে একটি প্রার্থনাসংগীত গাইল এবং যাদের জন্য প্রার্থনা করা হয়, তাদের নাম উচ্চারণের জায়গায় সে পিটারের নাম বলল; তারপর সে ঈশ্বরের ভৃত্য পিটারের নামে সব ভালো মানুষের মধ্যে পবিত্র রুটি বিতরণ করল।

পিটারের বিধবা আকসিনিয়া মাত্র এক বছর একসঙ্গে থাকা প্রিয়তম স্বামীর মৃত্যুর খবর পেয়ে হাউমাউ করে বিলাপ করল। স্বামীর জন্য এবং তার নিজের ছারখার হয়ে যাওয়া জীবনের জন্য দুঃখ করল; বিলাপের মধ্যে সে পিটারের কোঁকড়া কালো চুল এবং তার ভালোবাসার কথা, ছোট্ট এতিম আইভানকে নিয়ে তার দুঃখময় জীবনের কথা মনে করছিল; অচেনা পৃথিবীতে ঠেলে দেওয়া হতভাগ্য বউটির দিকে না দেখিয়ে ভাইয়ের প্রতি দয়া দেখানোর জন্য পিটারকে বকল!

আকসিনিয়া অবশ্য মনে মনে স্বামীর মৃত্যুতে খুশি হয়েছিল। সে যে দোকানে কাজ করত, তার মালিকের মাধ্যমে সে আবার গর্ভবতী হয়েছিল; এখন কেউ আর তাকে খোটা দিতে পারবে না, দোকানমালিক তাকে বিয়েও করতে পারে, তাকে পটানোর জন্য দোকানমালিকটি তা-ই বলেছিল।

মিখাইল সেমিয়ানোভিচ ভরন্তসভ রুশ রাষ্ট্রদূতের ছেলে হওয়ায় ইংল্যান্ডে শিক্ষা গ্রহণ করেন এবং তার সমসাময়িক উচ্চপদস্থ রুশ কর্মকর্তাদের থেকে ব্যতিক্রমী ইউরোপীয় শিক্ষা পেয়েছিলেন। তিনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী, ভদ্র, অধস্তনদের প্রতি দয়ালু এবং উচ্চপদস্থদের অনুগ্রহ পেতে আগ্রহী ছিলেন। ক্ষমতা ও বশ্যতা ছাড়া জীবন কী, তা তিনি জানতেন না। সব পদ ও পুরস্কার। পেয়েছিলেন, ক্রাসনির যুদ্ধে নেপোলিয়নকে পরাজিত করায় তাকে একজন মেধাবী অধিনায়ক মনে করা হতো।

১৮৫১ সালে তার বয়স ছিল সত্তরের বেশি কিন্তু তিনি বেশ সতেজ, চটপটে ছিলেন, তার ওপর সাবলীল, পরিশীলিত ও অমায়িক বিচারবুদ্ধি পুরোপুরি ধরে রেখেছিলেন। এসব গুণ তিনি ক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা ধরে রাখার জন্য কাজে লাগাতেন। তার ধন-সম্পদ ছিল প্রচুর, তার নিজের এবং তার স্ত্রীর (জন্মের পর তার নাম ছিল কাউন্টেস ব্রানিস্কি), এবং ভাইসরয় হিসেবে পেতেন বিশাল অঙ্কের বেতন। তিনি সম্পদের একটা বড় অংশ ক্রাইমিয়ার দক্ষিণ কূলে একটা প্রাসাদ এবং বাগান বানাতে খরচ করেন।

৭ ডিসেম্বর ১৮৫১ সাল। সন্ধ্যায় তিবলিসে তার প্রাসাদের সামনে একটা তিন ঘোড়ার গাড়ি এসে থামল। ধুলায় ধূসর ক্লান্ত একজন কর্মকর্তা গাড়ি থেকে নেমে পায়ের জমে যাওয়া পেশিগুলো টান করে সান্ত্রিদের পার হয়ে চওড়া গাড়িবারান্দায় ঢুকল। জেনারেল কজলভস্কি তাকে হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণের খবর দিয়ে পাঠিয়েছেন। তখন সন্ধ্যা ছয়টা এবং ভরসভ রাতের খাবারের জন্য যাচ্ছিলেন, সে সময় তাকে দূত আসার খবর দেওয়া হয়। ভরন্তসভ তার সঙ্গে দেখা করেন আর তাই ডিনারে যেতে কয়েক মিনিট দেরি হয়।

তিনি যখন বসার ঘরে ঢুকলেন, আমন্ত্রিত ৩০ জন অতিথির কেউ কেউ প্রিন্সেস এলিজাবেথ কাসাভিয়েরেভনা ভরসভের পাশে বসে ছিলেন বা ঘোট ছোট দলে জানালাগুলোর পাশে দাঁড়িয়ে গল্প করছিলেন। তারা সবাই প্রিন্সের দিকে তাকালেন। ভরন্তসভ পড়েছিলেন নিয়মিত ব্যবহারের কালো সামরিক কোট, তবে কাঁধে পদমর্যাদার বিহ্ন ছিল না। গলায় ছিল সর্বোচ্চ সামরিক পদক অর্ডার অব সেন্ট জর্জের হোয়াইট ক্রস।

পরিষ্কার করে কামানো লম্বাটে মুখে স্মিত হাসি ধরে তিনি ভুরু কুঁচকে অতিথিদের একবার দেখলেন। দ্রুত হালকা পায়ে ঢুকে দেরি করার জন্য প্রথমেই ক্ষমা চাইলেন মহিলাদের কাছে, পুরুষদের স্বাগত জানালেন। তারপর লম্বা, আনুমানিক ৪৫, প্রাচ্য ধাঁচের সুন্দরী প্রিন্সেস মানানা ওরবেলিয়ানির দিকে এগিয়ে গিয়ে বাহু বাড়িয়ে নৈশভোজে যোগ দেওয়ার অনুরোধ করলেন। প্রিন্সেস কাসাভিয়েরেভনা ভরন্তসভ তার বাহু বাড়িয়ে দিলেন তিবলিস ভ্রমণে আসা একজন লালচুল খোঁচা-গোঁফ জেনারেলের দিকে। একজন জর্জীয় প্রিন্স তার বাহু বাড়ালেন প্রিন্সেস ভরসভের বান্ধবী কাউন্টেস শোয়াসোইয়ের দিকে; এডিসি ড, আন্দ্রিয়েভস্কি এবং অন্যরা মহিলাদের সঙ্গে নিয়ে বা একাই সামনের যুগলদের অনুসরণ করলেন। উর্দি এবং হাঁটু অব্দি আঁটো পায়জামা পরা খানসামারা চেয়ার পিছে টেনে এবং আবার সামনে ঠেলে দিয়ে অতিথিদের বসার ব্যবস্থা করে দিল। প্রধান খানসামা রুপার পাত্র থেকে বড় হাতা দিয়ে নম্রভাবে পেয়ালায় স্যুপ ঢেলে দিল।

লম্বা টেবিলের ঠিক মাঝখানে ভরন্তসভ বসে ছিলেন, তার স্ত্রী বসে ছিলেন উল্টো দিকে, জেনারেলকে ডান দিকে নিয়ে। প্রিন্সের ডান দিকে বসে ছিলেন। সুন্দরী ওরবেলিয়ানি; আর বাঁ দিকে ছিলেন কালোচুল, গোলাপি চাপার মতো রঙের কমনীয় এক জর্জীয় মহিলা। ঝকমকে অলংকারের মধ্য থেকে তিনি হেসেই চলছিলেন।

বার্তাবাহক কী খবর নিয়ে এসেছে, তার স্ত্রীর প্রশ্নে ফরাসিতে জবাব দিলেন ভরন্তসভ, চমৎকার, প্রিয়তমা। সিমমানের সৌভাগ্য! তিনি জোরে বলতে শুরু করলেন, যাতে সবাই শুনতে পায়। দারুণ খবর (যদিও তার জন্য অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ, অনেক দিন ধরেই কথাবার্তা চলছিল) যে শামিলের সেনাপতিদের মধ্যে সবচেয়ে সাহসী এবং বিখ্যাত হাজি মুরাদ রুশদের পক্ষে চলে এসেছেন, দু-এক দিনের মধ্যেই তাকে তিবলিসে আনা হবে।

টেবিলের শেষ দিকে বসে নিজেদের মধ্যে গল্প ও হাসিঠাট্টায় ব্যস্ত তরুণ এডিসি, অফিসাররাসহ প্রত্যেকে চুপ করে শুনতে লাগল।

জেনারেল, আপনি কি কখনো হাজি মুরাদকে দেখেছেন! প্রিন্সের কথা শেষ হলে প্রিন্সেস তার পাশে বসা গাজরবর্ণ গুফো জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলেন।

একাধিকবার, প্রিন্সেস।

এবং জেনারেল বলতে শুরু করলেন, ১৮৪৩ সালে পাহাড়িরা গাৰ্গবিল দখল করে নিলে হাজি মুরাদ জেনারেল পাসেকের বাহিনীর ওপর হামলা করেন এবং প্রায় তাদের চোখের সামনেই কর্নেল জোলোতুখিনকে হত্যা করেন।

তার কথা শুনে জেনারেল আলোচনায় যোগ দেওয়ায় খুশি হয়ে ভরন্তসভ বিনয়ীভাবে মুচকি হাসলেন। কিন্তু হঠাৎ ভরসভের চেহারায় অমনোযোগ ও বিষাদের ছাপ পড়ল।

জেনারেল না থেমে বলতে থাকলেন হাজু মুরাদের সঙ্গে তার দ্বিতীয় সাক্ষাতের কথা।

কেন, আপনার কি মনে নেই, এ হচ্ছে সেই লোক, যে বিস্কিট অভিযানে উদ্ধার দলের ওপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েছিল।

জেনারেল যে উদ্ধার দলের কথা বলছিলেন, সেটা ছিল দারগো অভিযানের দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা, যখন সেনাপতি ভরন্তসভসহ সব সৈন্য অবশ্যই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত যদি সৈন্য বৃদ্ধি করে তাদের উদ্ধার করা না হতো। সবাই জানত ভরন্তসভের অধীনে দারগো অভিযান একটি লজ্জাজনক ঘটনা। কারণ, রাশিয়া তাতে হেরে যায়, অনেক নিহত ও আহত হয় এবং বেশ কিছু কামান খোয়াতে হয়। তাই কেউ ভরসভের উপস্থিতিতে ওই ঘটনার উল্লেখ করলে ভরন্তসভ জারের কাছে সেটাকে রুশ সেনাবাহিনীর চমৎকার সাফল্য উল্লেখ করে যেভাবে প্রতিবেদন দিয়েছিলেন, সেটাই বলেন। কিন্তু উদ্ধার শব্দটি সোজাসুজি বুঝিয়ে দেয় যে ঘটনাটা চমঙ্কার বিজয় ছিল না, বরং বহু জীবননাশী মারাত্মক ভুল ছিল। সবাই তা বুঝেছিল, তাই কেউ কেউ জেনারেলের কথার অর্থ না বোঝার ভান করল, অন্যরা ঘাবড়ে গিয়ে এরপর কী ঘটে দেখার অপেক্ষায় ছিল, কেউ কেউ ইশারা বিনিময় করে মিটিমিটি হাসছিল। কেবল গাজরবর্ণ গুফো জেনারেল কিছুই বুঝতে পারছিলেন না এবং তার বর্ণনা চালিয়ে যেতে থাকলেন, উদ্ধার অভিযানে, মহাত্মন।

তার প্রিয় বিষয়টি শুরু করতে পেরে জেনারেল প্রতিমুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে চললেন হাজি মুরাদ কী করে ধূর্তভাবে রুশ সেনাদলকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেন, যাতে উদ্ধার দল (মনে হচ্ছিল উদ্ধার শব্দটি তার খুব প্রিয়) না গেলে রুশ বাহিনীর একটা লোকও পালাতে পারত না, কারণ…জেনারেল তার কথা শেষ করতে পারলেন না। কারণ, কী ঘটছে বুঝতে পেরে মানান ওরবেলিয়ানি তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি তিবলিসে থাকার ভালো জায়গা পেয়েছেন কি না। বিস্মিত হয়ে জেনারেল চারদিকে সবার দিকে তাকালেন এবং দেখলেন টেবিলের শেষ প্রান্তে তার এডিসি তার দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে স্থির তাকিয়ে আছে। তখনই তিনি বুঝতে পারলেন। প্রিন্সেসের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তিনি ভুরু কুঁচকে থেমে গেলেন। তারপর তার প্লেটে যেসব সুস্বাদু খাবার দেওয়া হয়েছিল, তা না চিবিয়েই গোগ্রাসে গিলতে শুরু করলেন। খাবারগুলোর স্বাদ-গন্ধ-রূপ সৰ তার কাছে রহস্যময় লাগল।

সবাই অস্বস্তিবোধ করছিল, সেই অবস্থা কাটিয়ে দিলেন জর্জীয় প্রিন্স–একটা বেকুব কিন্তু চতুর তোষামুদে। তিনি বসে ছিলেন প্রিন্সেস ভরসভের অন্য পাশে। কী ঘটছে, তা যেন বুঝতে পারেননি, এমনভাবে তিনি বলতে শুরু করলেন হাজি মুরাদ কেমন করে মেহকুলের আহমেদ খানের বিধবাকে নিয়ে গিয়েছিলেন।

সে রাতে গ্রামে এসে যা নিতে চেয়েছিল, নিয়ে পুরো দলসহ ফিরে যায়।

কেন সে এই বিশেষ মহিলাকে নিয়েছিল? প্রিন্সেস জিজ্ঞেস করলেন।

ওহ, সে মহিলার স্বামীর শত্রু ছিল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার পেছনে ধাওয়া করে ধরতে পারেনি, তাই তার স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ নিয়েছিল।

প্রিন্সেস জর্জীয় প্রিন্সের পাশে বসা তার পুরোনো বান্ধবী কাউন্টেস শোয়াসোইকে কথাগুলো ফরাসিতে বুঝিয়ে দিলেন।

কী ভয়ানক! কাউন্টেস ফরাসিতে বললেন।

ওহ, না! মৃদু হেসে বললেন ভরন্তসভ। আমি শুনেছি সে বীরের মতোই তার বন্দীকে সম্মান করেছিল এবং পরে মুক্তি দিয়েছিল।

হ্যাঁ, মুক্তিপণের বিনিময়ে।

হ্যাঁ, অবশ্যই। কিন্তু একই কথা, সে সম্মানজনক ব্যবহার করেছিল।

প্রিন্সের কথাগুলো আলোচনার খেই ধরিয়ে দিয়েছিল। আমন্ত্রিতরা বুঝতে পেরেছিলেন, হাজি মুরাদকে যত গুরুত্ব দেওয়া হবে, প্রিন্স ততই খুশি হবেন।

লোকটির অবাধ্যতা মুগ্ধকর। একজন উল্লেখযোগ্য মানুষ!

কেন, ১৮৪৯ সালে সে তেমির-খান-শুরায় প্রকাশ্য দিনের বেলা যে তাণ্ডব চালিয়েছিল।

তখন তেমির-খান-শুরায় উপস্থিত ছিলেন, টেবিলের শেষ দিকে বসা এমন একজন আর্মেনীয় হাজি মুরাদের সেই লুটের কথা বিস্তারিত বললেন।

আসলে খাওয়ার সময়ের পুরোটা জুড়েই হাজি মুরাদের কথা আলোচনা হচ্ছিল।

প্রত্যেকে একের পর এক হাজি মুরাদের সাহস, যোগ্যতা ও মহানুভবতার কথা বলছিলেন। কেউ একজন তার ২৬ জন বন্দীকে জবাইয়ের আদেশ দেওয়ার কথা বললেন; কিন্তু স্বভাবতই সেটারও বিরোধিতা হলো।

কী করা যেত? যুদ্ধ যুদ্ধই (ফরাসি প্রবাদ)!

সে মহান লোক।

যদি ইউরোপে তার জন্ম হতো, তাহলে সে হয়তো আরেকজন নেপোলিয়ন হতো, বললেন বেকুব তোষামোদের গুণধর জর্জীয় প্রিন্স।

তিনি জানতেন, নেপোলিয়নের নাম উচ্চারণ ভরসভের কাছে মধুর, নেপোলিয়নকে হারিয়েই তিনি পুরস্কার হিসেবে তার গলায় পরা হোয়াইট ক্রসটি পেয়েছেন।

ঠিক নেপোলিয়ন নয়, যদি বলেন, সম্ভবত ঘোড়সওয়ার দলের বীর হতে পারত, বললেন ভরন্তসভ।

নেপোলিয়ন, না হলে মুরাদ।

তার নাম হাজি মুরাদ।

হাজি মুরাদ আত্মসমর্পণ করেছে, এখন শামিলও শেষ হয়ে যাবে, কারও মন্তব্য।

তারা এখন তা মনে করছে, এই এখন মানে ভরসভের অধীনে, তারা আর টিকে থাকতে পারবে না, আরেকজনের মন্তব্য।

সবই হয়েছে আপনার জন্য! ফরাসিতে বললেন মানানা ওরবেলিয়ানি।

প্রিন্স ভরন্তসভ তার দিকে আসা তোষামোদের ঢেউ কমাতে চেষ্টা করলেন। তা সত্ত্বেও সেগুলো ভালো লাগছিল এবং খুব উদ্দীপ্ত হয়ে তাকে আবার বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।

রাতের খাবারের পর বসার ঘরে কফি পরিবেশন করা হলে প্রিন্স সবার প্রতি খুব বিনয়ী ছিলেন এবং গুফো জেনারেলের কাছে গেলে এমন ভাব দেখাতে চেষ্টা করলেন যে জেনারেলের বিরাট ভুলটি গোচরেই আসেনি।

সব অতিথিকে কফি দিয়ে তিনি তাসের টেবিলে বসলেন। তিনি অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে খেলা অম্বে ছাড়া আর কিছু জানতেন না। প্রিন্সের সঙ্গে খেলছিলেন জর্জীয় প্রিন্স, একজন আর্মেনীয় জেনারেল (যিনি প্রিন্স ভরন্তসভের খানসামার কাছ থেকে খেলাটি শিখে নিয়েছেন) এবং চতুর্থজন ছিলেন ড. আন্দ্রিয়েভস্কি, প্রভাবশালী বলে যার অনেক সুনাম।

প্রিন্সের সোনার নস্যির কৌটাটির ঢাকনায় প্রথম আলেকজান্ডারের আবক্ষ প্রতিকৃতি খোদা, তিনি কৌটাটি পাশে রেখে খুব চকচকে একটি তাসের তোড়া খুলে বাটতে শুরু করলেন। ঠিক সেই সময় তার ইতালীয় খানসামা গিওভানি রুপোর ট্রেতে করে আরেকটি চিঠি এনে তাকে দিল।

আরেকজন দূত, মহাত্মন।

ভরন্তসভ তাসগুলো রেখে ক্ষমা চেয়ে চিঠিটি পড়তে শুরু করলেন।

চিঠিটি লিখেছিল তার ছেলে, হাজি মুরাদের আত্মসমর্পণ ও মেলার জাকোমেলস্কির সঙ্গে তার কথোপকথনের বর্ণনা দিয়ে।

প্রিন্সেস এসে জানতে চাইলেন তাদের ছেলে কী লিখেছে।

সেই একই ঘটনা…(ফরাসি ভাষায়) সেখানকার অধিনায়কের সঙ্গে একটু কথা-কাটাকাটি হয়েছে। দোষ সিমোনের। তবে সব ভালো যার শেষ ভালো। চিঠিটি স্ত্রীর হাতে দিয়ে ইংরেজিতে তিনি শেষ করলেন। তারপর তার মেহমানদের দিকে ফিরে তিনি তাদের তাস টানতে বললেন।

প্রথম দফা বাটার পর, খোশমেজাজে থাকলে ভরন্তসভের যেমন অভ্যাস, তার সাদা কুঁচকে যাওয়া হাত দিয়ে ফরাসি নস্যির এক টিপ নাকের কাছে নিয়ে ভেতরে টানলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *