৪. গৃহিণী অধিক রাত্রে বাড়ি ফেরেন

গৃহিণী অধিক রাত্রে বাড়ি ফেরেন। পা টিপে তিনি স্বামীর ঘরে ঢুকলেন; কিন্তু সে শব্দও ইভান ইলিচ টের পান। একবার চোখ মেলে আবারও তিনি চোখ বুজে থাকেন। গৃহিণীর ইচ্ছা, গেরাসিমকে সরিয়ে দিয়ে কিছুক্ষণ স্বামীর কাছে একলা থাকেন। কিন্তু ইভান ইলিচ চোখ মেলে বলেন, না, চলে যাও।

–ব্যথা কি বেড়েছে?

— একরকমই আছে সব সময়।

–খানিকটা আফিম খাও না।

রাজি হয়ে খানিকটা খেলেন ইভান ইলিচ। গৃহিণী তখন বেরিয়ে যান।

রাত তিনটে অবধি তিনি আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকেন। মনে হয় একটু একটু করে তাকে যেন তিমিরাবৃত সংকীর্ণ গভীর এক গহ্বরের মধ্যে ঠেলে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু ঠেলেও যেন তলদেশে পাঠানো যাচ্ছে না। এই বিভীষিকার সঙ্গে আছে ব্যথা। ভয়-ভয় করছে, তবু তিনি যেন গহ্বরের মধ্যে ঢুকতে চাইছেন! সংগ্রাম করছেন তবু যেন সহযোগিতাও করছেন। আচমকা তিনি যেন পড়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে তার সংজ্ঞা ফিরে আসে। গেরাসিম বিছানায় পায়ের দিকে বসে নীরবে ঝিমোচ্ছিল। আর গেরাসিমের কাঁধে মোজাপরা শীর্ণ পা রেখে তিনি শুয়েছিলেন। সেই ঢাকা মোমের বাতি আর একই ধরনের ব্যথা তখনও আগের মতই ছিল।

–তুমি যাও গেরাসিম। ফিসফিস করে বললেন।

-–ঠিক আছে স্যার, আর কিছুক্ষণ থাকছি।

–না, চলে যাও।

গেরাসিমের কাধ থেকে পা সরিয়ে তিনি কাত হন। নিজের জন্য দুঃখ হয়। গেরাসিম পাশের ঘরে না যাওয়া অবধি তিনি অপেক্ষা করেন। তারপর আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। কাঁদতে শুরু করেন শিশুর মত। নিজের অসহায়তা আর বিভীষিকাময় নিঃসঙ্গতা, মানুষের নিষ্ঠুরতা আর ভগবানের নির্মমতা এবং তার অস্তিত্বহীনতার জন্য অশ্রু বিসর্জন করেন ইভান ইলিচ।

–কেন এমন করলে ভগবান? কেন এই অবস্থায় ফেললে? কেন এমন মর্মান্তিক যন্ত্রণা দিচ্ছ?

জবাবের প্রত্যাশা তিনি করেননি। তবু কাঁদলেন, জবাব পেলেন না আর পাওয়া যায় না বলে। বেদনা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। তথাপি তিনি নড়াচড়া করলেন না কিংবা ডাকলেন না কাকেও। আপন মনে বললেন : চলুক! আঘাত করে যাও! কিন্তু কেন এত সব? কি অপরাধ করেছি তোমার কাছে? কেন, কেন এসব?

এরপর তিনি শান্ত হলেন। শুধু কান্নাই থামালেন না, স্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করে স্থির হয়ে রইলেন। মনে হল যেন কর্ণগোচর কোন কথা শুনছিলেন না, শুনছিলেন নিজের অন্তরের বাণী। অনুভব করছিলেন অন্তরের জাগ্রত চিন্তাধারা।

–কি চাই তোমার? ভাষায় প্রকাশযোগ্য এই স্পষ্ট জিজ্ঞাসাই যেন তিনি শুনতে পান।

–কি চাই তোমার? কি চাই বলল! আপন মনে বারংবার তিনি আবৃত্তি করেন।

–কি চাই আমার? চাই বাঁচতে … চাই কষ্ট না পেতে।

আবারও এমন নিবিষ্ট মনে কান পেতে থাকেন যে ব্যথার সুতীব্র অনুভূতিও তার একাগ্রতা বিক্ষিপ্ত করতে পারল না।

–বাঁচতে চাও? কি ভাবে? মর্মবাণী জিজ্ঞাসা করে।

— কেমন করে? কেন, যেমন করে বাচছিলাম সেইভাবে — তেমনি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে!

— যেমন করে আগে বেঁচ্ছে সেই ভাবে? মর্মবাণী আবারও জিজ্ঞাসা করে।

কল্পনায় তখন তিনি জীবনের আনন্দময় মুহূর্তগুলি স্মরণ করবার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার নিশ্চিন্ত জীবনের পরম আনন্দময় মুহূর্তগুলোও এখন আর আগেকার মত মধুর লাগল না। শৈশবের গুটিকয়েক স্মৃতি ছাড়া আর কোনটাই না। এই শৈশবের মধ্যে সত্যই আনন্দময় এমন কিছু ছিল যা আজকে আবার যদি ফিরে পাওয়া যেত তো সেই পুঁজি সম্বল করে হয়তো বাঁচা চলত। কিন্তু যে শিশু সেই সুখ অনুভব করেছে আজকে তার কোন অস্তিত্ব নেই। এ যেন অপর কারও জীবন-স্মৃতির মত।

জীবনের যে অধ্যায় আজকের ইভান ইলিচকে জন্ম দিয়েছে তার যাবতীয় সুখ শান্তির অনুভূতি যেন চোখের সামনে মিলিয়ে যাচ্ছে। অতি তুচ্ছ, এমনকি কুৎসিত বলে মনে হচ্ছে সেদিনকার সব আনন্দ।

বাল্যকাল থেকে যতই তিনি দূরে সরে যাচ্ছেন, যতই এগোচ্ছেন নিজের বর্তমানের কাছাকাছি, আনন্দ বলে সেদিন যা অকুণ্ঠভাবে গ্রহণ করেছেন আজকে তার সবই অলীক অর্থহীন বলে মনে হচ্ছে। এই পর্যায়ের শুরু কলেজ থেকে। আজকে যা সাচ্চা বলে মনে হয় তাও এই কালের সম্পদ। মনটা তখন দিলদরিয়া ছিল–ছিল বন্ধুত্ব আর আশা। কিন্তু অভিজাত সমাজের জীবনে এমন শুভ মুহূর্তের খোঁজ মেলে না। তারপর কর্মজীবনের প্রথম কয়েক বছর যখন সরকারি চাকরি করেছেন জীবনে তখনও আবার গুটিকতক আনন্দময় মুহূর্ত দেখা দিয়েছিল। একালের জীবন নারীর প্রতি ভালবাসার স্মৃতিতে মধুর। তারপর সব এলোমেলো হয়ে গেছে। জীবন যতই এগিয়ে চলেছে স্মরণীয় সাচ্চা শুভমুহূর্তেরও ততই অভাব ঘটেছে। প্রথমে আরও খানিকটা হ্রাস পেয়েছে…. তারপর আরও… তারপর…।

তার বিবাহ একটা আকস্মিক ঘটনা। বিয়ের কিছুদিন পরেই এল মোহমুক্তি। তারপর স্ত্রীর খিটখিটে মেজাজ, বিলাস-ব্যসন আর কপটতা। এ ছাড়া মর্মান্তিক চাকরি-জীবন আর অর্থচিন্তাও ছিল সঙ্গে। বছর খানেক কেটেছে এইভাবে। শুধু এক বছর কেন, দুই দশ বিশ বছরই তো কাটল এই একই ভাবে। যতদিন এই জীবন চলেছে ততই দুর্বিসহ হয়ে ওঠেছে।–এ যেন পাহাড়ের চূড়া থেকে নিচে নামার মত। অথচ আমি ভেবেছি উপরে উঠছি। আসল অবস্থা তো তাই ছিল। জনসাধারণের দৃষ্টিতে আমার উন্নতি হচ্ছিল, কিন্তু আসলে ক্রমান্বয় ভাটা পড়েছে। জীবনে। এখন সব শেষ হয়ে গেছে–বাকি আছে শুধু মৃত্যু!

–ব্যাপারটা তাহলে দাঁড়াল কি? জীবন এমন অর্থহীন এত বিভীষিকাময় হতেই পারে না। আর যদি তা-ই হয় তাহলেই বা আমায় মরতে হবে কেন? কেন মরতে হবে দুঃসহ যন্ত্রণা ভুগে? নিশ্চয়ই কোথাও কোন ত্রুটি আছে।

সহসা তার মনে হয়, হয়তো যেভাবে বাঁচা উচিত ছিল আমিই সেইভাবে জীবন যাপন করিনি। কিন্তু আর সব কিছু যখন যথারীতি করেছি তখন তা-ই বা কি করে হয়? নিজেই নিজের জিজ্ঞাসার জবাব করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে সম্পূর্ণ অসম্ভব বলে এই চিন্তা মন থেকে বাতিল করে দেন। অথচ এই সমস্যার সমাধানের মধ্যেই জীবন-মৃত্যুর রহস্য নিহিত।

তাহলে এখন কি চাই তোমার? বাঁচতে চাও? কেমন করে বাঁচবে? প্রতিহারী যখন ঘোষণা করত বিচারক আসছেন, সেই সময় আদালতে যে ভাবে জীবনযাপন করেছ সেইভাবে বাঁচতে চাও?

–বিচারক আসছেন … বিচারক আসছেন। কথাটা তিনি বারকয়েক আবৃত্তি করেন।

–এই যে, তিনি এসেছেন। কিন্তু তার জন্য আমি দোষী নই! ক্রুদ্ধভাবে তিনি চড়াগলায় বলে ওঠেন।

–তাহলে, তাহলে কেন এই দুর্ভোগ?

তার কান্না থেমে যায়। দেয়ালের দিকে মুখ ঘুরিয়ে বারবার তিনি একই প্রশ্ন ভাবতে থাকেন : কেন, কিসের জন্য এই দুর্ভাগ্য? কিন্তু যতই চিন্তা করুন না কেন, কোন জবাবই পাওয়া গেল না। যখনই মনে হয়েছে যথাযথভাবে জীবন যাপন করা হয়নি (বারে বারেই এ কথা মনে জেগেছে), অমনিই নিজের গোটা জীবন নির্ভুল বলে সাব্যস্ত করে এই অদ্ভুত চিন্তা মন থেকে বাতিল করে দিয়েছেন।

আর এক পক্ষও কাটে। ইভান ইলিচ এখন আর সোফা ছেড়ে ওঠেন না। বিছানায় আর শুতে চান না। দেয়ালের দিকে মুখ করে প্রায় সারাক্ষণ সোফার উপরে পড়ে থাকেন। কিন্তু ব্যথার নিবৃত্তি নেই। একাকী এইভাবে পড়ে-পড়ে একই ধরনের সমাধানাতীত প্রশ্নের কথা ভাবেন; এর নাম কি? এ-ই কি মৃত্যু? মর্মবাণী জবাব দেয়, হ্যাঁ, এই-ই মৃত্যু।

–তাহলে কেন এই যন্ত্রণা?

অন্তর্যামী বলে ওঠে, কোন কারণ নেই–তবে এই তার প্রস্তুতি। এছাড়া এবং এর বাইরে আর কোন কিছু ছিল না।

অসুখের প্রারম্ভ থেকে, অর্থাৎ ডাক্তার দেখাবার দিন থেকে ইভান ইলিচের জীবন দুটি পরস্পর বিরোধী মনোভাবের মধ্যে দোল খেয়ে চলেছে। একবার তিনি হতাশ হয়ে পড়তেন। অজ্ঞেয় বিভীষিকাময় মৃত্যুর শংকা তাকে অভিভূত করে ফেলত। আবার আশা জেগে উঠত। একাগ্রমনে তিনি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্রিয়া-প্রক্রিয়া অনুধাবন করবার চেষ্টা করতেন। এক একবার তার মানস চক্ষে বিকল মূত্রাশয় বা অন্ত্রের ছবি ভেসে উঠত। আবার মনে পড়ত দুয়ে রহস্যময় করাল মৃত্যুর কথা– কোন ভাবেই তার গ্রাস থেকে ত্রাণ পাবার উপায় নেই। অসুখের প্রথম অবস্থা থেকেই মনের এই দ্বৈতভাব চলেছে। কিন্তু রোগ যতই বেড়েছে নিজের মূত্রাশয় সম্পর্কে ধারণা ততই শংকাকুল আর উদ্ভট হয়ে উঠেছে। আসন্ন মৃত্যুর শঙ্কাও ততই বাস্তব হয়ে দেখা দিয়েছে।

এই সময় তার মাস তিনেক আগেকার অবস্থা মনে পড়ত। বর্তমানের সঙ্গে তুলনা করে স্পষ্টই বুঝতে পারতেন যে ক্রমান্বয় এমন সুনিশ্চিত ভাবে তিনি অধোমুখে নেমে চলেছেন যে নিরাময় হবার সব আশা ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

সোফার উপর কাত হয়ে পড়ে তার মনে হত যেন চরম নিঃসঙ্গতা তাকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। জনবহুল শহরে অগুনতি আত্মীয় বন্ধু-বান্ধব পরিবৃত হয়ে

এমন নিঃসঙ্গতা বোধহয় সমুদ্রের অতলে কিংবা বসুন্ধরার গর্ভেও মেলে না। এই বিভীষিকাময় নিঃসঙ্গতার মধ্যে একমাত্র অতীতের স্মৃতি সম্বল করে বাঁচতে হয়েছে ইভান ইলিচকে। একের পর এক অতীতের স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠেছে। তারপর ক্রমান্বয় সরে গেছে সুদূর অতীতে থেমে দাঁড়িয়েছে শৈশবে গিয়ে।

সেদিন তাকে গ্রামের কাথ খেতে দেওয়া হয়। প্লামের কথা মনে হলেই ছেলেবেলার কাঁচা শুটকো ফরাসি প্লামের কথা মনে পড়ে! মনে পড়ে তার অদ্ভুত গল্প আর আঁটি চুষবার সময় লালা ঝরার কথা। সেই স্বাদ স্মরণ হতেই সেকালের এক দঙ্গল স্মৃতি মনে পড়ে যায়। মনে পড়ে ধাত্রী, তার ভাই আর তাদের খেলনার কথা।

–না না, ওর কথা আর ভাবব না…বড় মর্মান্তিক। মনে মনে ভাবেন ইভান ইলিচ এবং চিন্তার রাশ টেনে সাম্প্রতিক কালে ফিরে আসেন। ভাবেন সোফার বোম আর তার মরক্কো চামড়ার ভাজের কথা।

–মরক্কোর দাম বেশি, তবে জিনিসটা তেমন ভাল দেখায় না। এ নিয়ে ঝগড়াও হয়েছিল। সে ঝগড়ার ধরন আলাদা; আর বাবার পোর্টফোলিও ব্যাগ আমরা যখন ছিঁড়েছিলাম তার মরক্কো চামড়াও ছিল অন্য ধরনের। সেজন্য আমাদের শাস্তি পেতে হয়েছিল…আর মা আমাদের কিছু মিঠাই এনে দিয়েছিলেন।

আবারও তার চিন্তা শৈশবে ফিরে যায়, আর সে স্মৃতি মর্মান্তিক লাগে। জোর করে তিনি এই ভাবনা দূর করে দিতে চান। মন নিবদ্ধ করতে চান অপর কিছুর উপর।

আবার সেই চিন্তাধারার সঙ্গে আরও কতগুলো জোটবাধা চিন্তা মানসপট অতিক্রম করে যায় : কেমন করে ক্রমান্বয় তার অসুখ বেড়েছে আর কেমন করেই বা তা ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানেও যতই পেছনের দিকে তাকান, ততই জীবনের সন্ধান পান। পেছনেই যেন জীবনের যত কিছু ভাল ছিল। এমনকি সত্যিকারের জীবনও যেন ছিল তখন। দুটো একসঙ্গে জড়িয়ে যায়। ভাবেন, ব্যথাটা যত উগ্র হচ্ছে জীবনও যেন ততই দুর্বিসহ হয়ে উঠছে। জীবনের সূচনায় একটুখানি ভাস্বর দীপ্তি আছে, তারপর যত এগিয়ে গেছি জীবনপট ততই যেন দ্রুততর মসীলিপ্ত হয়ে উঠেছে। মৃত্যুর যত কাছে এগিয়েছি ততই ভাস্বর দীপ্তি লোপ পেয়ে জীবনপটে বেশি করে কালির দাগ পড়েছে। উঁচু থেকে প্রস্তরখণ্ড যত নিচে গড়িয়ে পড়ে ততই তার গতিবেগ বেড়ে যায়। উপমাটি সহসা তার মনে পড়ে যায়। ঠিক এমনি ক্রমবর্ধমান নিরবচ্ছিন্ন দুঃখভরা জীবন দুর্ণিবার বেগে ধেয়ে যায় তার শেষ পরিণতির দিকে। এই মর্মান্তিক দাহ তুলনাহীন।

–আমিও কি উড়ে চলেছি সুদূরে…।

সহসা তিনি শিউরে ওঠেন। একটু উঁচু হয়ে চিন্তাস্রোতে বাধা দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই টের পান যে প্রতিরোধের চেষ্টা নিষ্ফল। চেয়ে-চেয়ে চোখদুটো ক্লান্ত হয়ে গেছে, তবু চোখের সামনের জিনিস না দেখেও উপায় নেই। তাই একদৃষ্টে সোফার পিছনের দিকে চেয়ে সেই বিভীষিকাময় পতন, আঘাত আর ধ্বংসের প্রতীক্ষা করেন।

আপনমনে বলেন : প্রতিরোধ করা অসম্ভব। কিন্তু এ সবের অর্থও যদি অন্তত বুঝতে পারতাম! কিন্তু তাও অসম্ভব। এই কথা যদি বলা যেত যে আমি যথাযথভাবে জীবনযাপন করিনি, তাহলেও একটা সাফাই দেওয়া চলত। কিন্তু সে দোষ দেওয়া চলবে না।

সঙ্গে সঙ্গে নিজের জীবনের যাবতীয় আইনসিদ্ধ নিখুঁত শিষ্টাচার-সম্মত আচার আচরণের কথা মনে পড়ে। ভাবেন, সে কথা কোনক্রমেই স্বীকার করা যায় না। ব্যঙ্গ-ভরা হাসির আবেগে তার ঠোঁট ফাঁক হয়। যেন সামনে বসে কেউ তার কথা শুনছে আর একথা বিশ্বাস করবে।–না, কোন ব্যাখ্যা নেই! মনস্তাপ…মৃত্যু… কেন…কিসের জন্য?

* * *

আরও সপ্তাহ দুয়েক কাটে এইভাবে? এই পক্ষে এমন একটি ঘটনা ঘটে যা ইভান ইলিচ আর প্রাসকভিয়া উভয়েরই ইঙ্গিত। পেত্রিশচেভ সামাজিক রীতি অনুসারে বিয়ের প্রস্তাব করে। ঘটনাটি ঘটে সন্ধ্যাবেলা। কথাটা স্বামীকে জানাবার উদ্দেশ্যে পরদিন প্রাসকভিয়া ফেরতনা তার ঘরে এলেন। কিন্তু আগের রাত্রে ইভান ইলিচের অবস্থা বদলে গিয়ে আরও খারাপ হয়ে পড়েছে। প্রাসকভিয়া ঘরে ঢুকে দেখেন যে স্বামী তখন সোফায় শুয়ে আছেন, কিন্তু এবারকার শোয়ার ধরন আলাদা। চিৎ হয়ে শুয়ে তিনি কঁকাচ্ছেন আর স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সামনের দিকে।

প্রাসকভিয়া তাকে ওষুধের কথা স্মরণ করিয়ে দেন। কিন্তু তার দিকে চোখ ঘুরিয়ে ইভান ইলিচ এমন দৃষ্টিতে তাকান আর সেই চাহনির মধ্যে বিশেষ করে তার প্রতি এমন বিদ্বেষ-ভরা ছিল যে প্রাসকভিয়া কথাটা শেষ করতে পারলেন না।

ইভান বলে ওঠেন, দোহাই খ্রিস্টের, আমায় একলা থাকতে দাও।

প্রাসকভিয়া হয়তো চলেই যেতেন, কিন্তু এই সময় কন্যা ঘরে ঢুকে বাপকে প্রাতঃসম্ভাষণ জানাবার জন্য এগিয়ে যায়। স্ত্রীর দিকে যে ভাবে চেয়েছিলেন তেমনি কঠোর দৃষ্টিতে কন্যার দিকেও তাকান ইভান ইলিচ। আর তার স্বাস্থ্য সম্পর্কে কন্যার জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে রুক্ষভাবে জানিয়ে দেন যে শিগগিরই তিনি তাদের সবাইকে মুক্তি দিয়ে যাবেন। উভয়েই চুপ করে যায় এবং খানিকক্ষণ বসে উঠে পড়ে।

লিসা মাকে বলে, আমাদের দোষ কি? এমনভাবে বললেন যেন যত দোষ আমাদেরই। বাবার জন্য মায়া হয়, কিন্তু আমাদের তিনি যন্ত্রণা দেবেন কেন।

যথাসময়ে ডাক্তার আসে। ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে ইভান ইলিচ সংক্ষেপে হ্যাঁ না জবাব দেন। পরিশেষে বলেন : আপনি বেশ বুঝতে পারছেন যে রোগ সারাবার ক্ষমতা আপনার নেই, কাজেই আমায় একলা থাকতে দিন।

–আমরা আপনার কষ্টের লাঘব করতে পারি।

–তাও পারেন না। যেমন আছি সেইভাবেই থাকতে দিন। ডাক্তার তখন বৈঠকখানায় গিয়ে প্রাসকভিয়া ফেদরভনাকে জানায় যে রোগীর অবস্থা খারাপ এবং একমাত্র আফিমেই তার মর্মান্তিক ক্লেশ লাঘব হতে পারে।

তিনি আরও জানান যে ইভান ইলিচের দৈহিক ক্লেশ সাংঘাতিক হলেও তার মনস্তাপ দৈহিক ক্লেশের চাইতেও মর্মান্তিক আর সেইটেই ওর প্রধান মর্মপীড়ার কারণ।

সে-রাত্রে তার মনস্তাপের আর একটি কারণ ঘটে। তন্দ্রালু সরল গেরাসিমের গাল-চোয়াড়ে মুখের দিকে চেয়ে সহসা এই প্রশ্ন তার মনে জাগে : গোটা জীবনে সত্যই যদি ভুল করে থাকি?

আগে বরাবর তার মনে হয়েছে যে জীবনে কোন অনাচার তিনি করেন নি। কিন্তু সেইরাত্রে এই দৃঢ়-বিশ্বাস শিথিল হয়ে যায়। তার মনে হয় : অভিজাত সমাজ যাকে ভাল বলে গণ্য করে সেই শ্রেয় লাভ করতে গিয়ে তিনি এমন কতগুলো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বাভাবিক বৃত্তি দমন করেছেন, জীবনে হয়তো সেই বৃত্তিগুলোই একমাত্র সাচ্চা জিনিস আর সব কিছু ভুয়ো। তার সরকারি কর্তব্য, নিজের ও পরিবার পরিজনের গোটা জীবনে-বিধি আর তার সামাজিক ও চাকরি-জীবনের সমস্ত আগ্রহই হয়তো মিথ্যা। মনে মনে জীবনের এই সব কিছু তিনি সমর্থন করবার চেষ্টা করেন। অমনিই সমর্থিত বস্তুর দুর্বলতা ধরা পড়ে যায়।-না, সমর্থনযোগ্য কিছুই নেই।

আপনমনে তখন বলেন, তাই যদি হয়, আমি যখন এই উপলব্ধি নিয়ে প্রাণ ত্যাগ করছি যে প্রকৃতির সমস্ত দান আমি হেলায় হারিয়েছি এবং আর তা সংশোধন করার উপায় নেই, তারপর–তারপর কি হবে?

চিৎ হয়ে শুয়ে নতুন দৃষ্টিভঙ্গী দিয়ে তিনি গোটা জীবন পর্যালোচনা করেন। সকালবেলা প্রথমে বেয়ারা, তারপর স্ত্রী-কন্যা, তারও পরে ডাক্তারের সঙ্গে যখন তার দেখা হয়, তাদের প্রতিটি ভাবভঙ্গী ও কথা প্রমাণিত করে যে গত রাত্রে সত্যের নিষ্ঠুর রূপ তার সম্মুখে উঘাটিত হয়েছে। তার মধ্যেই তিনি নিজের আসল রূপ দেখতে পান–বুঝতে পারেন আদতে কিসের মোহে তিনি বেঁচেছেন। স্পষ্টই তিনি বুঝতে পারেন, এর কোনটাই সাচ্চা নয়। সব কিছু বিরাট এক ধাপ্পা আর প্রহসন। আর এই ধাপ্পাই জীবন-মৃত্যুর আসল রূপ আচ্ছন্ন করে রাখে।

এই অনুভূতি তার দৈহিক ক্লেশ দশগুণ বৃদ্ধি করে। যন্ত্রণায় ছটফট করে তিনি। এপাশ-ওপাশ করেন। বেশবাস শ্বাসরোধ করেছে বলে মাঝে মাঝে তাই ধরে টানাটানি করেন। এ জন্য সব কিছুর উপর ঘৃণা হয়।

তাকে একটু বেশি মাত্রায় আফিম দেওয়া হল। ফলে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন, কিন্তু দুপুরবেলা আবার যন্ত্রণা শুরু হয়। সবাইকে ভাগিয়ে দিয়ে তিনি ছটফট করেন।

স্ত্রী কাছে এসে বলেন, জঁা, আমার জন্য এটুকু কর ডিয়ার। এতে কোন ক্ষতি হবে না, বরং আরামই পাবে। সুস্থ লোক প্রায়ই এ করে থাকে।

বিস্ফারিত চোখে তিনি তাকান।

–কি বললে? ধর্মালাপ করব? কেন? কোন দরকার নেই! তবে… সকভিয়া কাঁদতে শুরু করেন।

–দোহাই তোমার! আমি পুরুতকে ডেকে পাঠাচ্ছি। লোকটি বড় ভাল।

–বেশ! ভাল! বিড় বিড় করে বলেন ইভান ইলিচ।

পুরোহিতের কাছে পাপ স্বীকার করে ইভান ইলিচের মনটা হালকা হয়ে যায়। শংকা-সন্দেহও কিছুটা কমে গেছে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বেদনারও লাখব হল। পলকের জন্য আশার আলো ঝলমল করে ওঠে। আবারও এপেনডিসের কথা মনে পড়ে। ভাবেন, হয়তো সেরেও যেতে পারে। জলভরা চোখে তিনি পুরোহিতের আশীর্বাদ গ্রহণ করেন।

আবার তাকে শুইয়ে দিলে ইভান ইলিচ খানিকটা স্বস্তি বোধ করেন। বাঁচার ক্ষীণ আশাও সঞ্চারিত হয়। তখন অস্ত্রোপচারের কথা ভাবতে শুরু করেন। সে প্রস্তাব আগেই করা হয়েছে। আপনমনে বলে ওঠেন, বাঁচব! বাঁচতে চাই।

পুরোহিতের সঙ্গে কথোপকথনের পর স্ত্রী এসে তাকে অভিনন্দন জানান। তারপর স্বাভাবিক ভব্যতার রীতি অনুযায়ী বলেন, এখন ভাল লাগছে, তাই না?

তার দিকে না চেয়েই তিনি জবাব দেন, কতকটা।

প্রাসকভিয়ার বেশবাস, দেহ ভঙ্গিমা, তার মুখের ব্যঞ্জনা আর গলার স্বর একই ভাব ব্যক্ত করছে; এ অন্যায়-যা হওয়া উচিত, হচ্ছে না। যার জন্য বেঁচ্ছে কি এখনও বেঁচে আছ তার সবই মিথ্যা–শুধু জীবন-মৃত্যুর আসল রূপ আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

আবার এই চিন্তা দেখা দেবার পরেই তার ঘৃণা আর মর্মান্তিক যন্ত্রণাবোধ ফিরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে আসে দুর্ণিবার আসন্ন পরিণামের ভীতি। এর সঙ্গে আর একটা নতুন অনুভূতিও যুক্ত হয়। বেদনাটা সুতীব্র হয়ে ওঠে–ভেতরটা পিষে যাচ্ছে মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে দমও যেন আটকে আসে।

কতকটা বলবার সময় তার মুখের ব্যঞ্জনা বিভীষিকাময় দেখাচ্ছিল। কথাটা বলেই সরাসরি তিনি স্ত্রীর মুখের দিকে তাকান; তারপর তার মত দুর্বল লোকের পক্ষে অস্বাভাবিক দ্রুতভাবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠেন, চলে যাও! চলে। যাও–আমায় একলা থাকতে দাও!

* * *

আর্তনাদ শুরু হবার পর একটানা তিনদিন ধরে কঁকানি কাতরানি চলে। এই আর্তনাদ এত মর্মান্তিক যে বদ্ধ কপাটের ওপাশ থেকে শুনলেও আঁতকে উঠতে হয়। যে মুহূর্তে স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন তখনই তিনি বুঝতে পারলেন যে সব শেষ হয়ে এসেছে–আর ফিরবার উপায় নেই। বুঝতে পারলেন শেষের দিন আসন্ন অথচ তার শংকা-সন্দেহের কোন সমাধান হল না। সন্দেহ সন্দেহই রয়ে গেল।

–ও—হো–হো! বিভিন্ন স্বরে তিনি খেদোক্তি করে ওঠেন। না–না বলে তিনি আর্তনাদ শুরু করেন কিন্তু শেষ অবধি আ-আ ধ্বনিই শোনা যায়।

অদৃশ্য দুর্নিবার এক শক্তি তাকে যেন অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে সবলে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে। সেই অন্ধকারের গর্তে পুরো তিনটি দিন অসহায়ের মত তিনি সংগ্রাম করেন। এই তিনদিন তার কাছে সময়ের কোন অস্তিত্ব ছিল না। মৃত্যুদণ্ডিত মানুষ পরিত্রাণের আশা ত্যাগ করে জল্লাদের সঙ্গে যেমন লড়াই করে, তিনিও এই তিনটি দিন তেমনিভাবে সংগ্রাম করেছেন। আর প্রতি মুহূর্তে অনুভব করেছেন যে আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও ক্রমাগত বিভীষিকাময় সুনিশ্চিত পরিণামের দিকে এগিয়ে চলেছেন। অন্ধকার গহ্বরে নিক্ষিপ্ত হবার জন্যই তিনি সবচাইতে বেশি মনস্তাপ ভোগ করেন। আর তার চাইতেও বেশি করেন প্রতিকারহীনতার জন্য। সদ্ভাবে জীবন যাপন করেছেন এই আত্মপ্রসাদ নিয়ে তিনি এই গহ্বরে প্রবেশ করতে পারছেন না। জীবনের এই যৌক্তিকতার অভাবের জন্যই দৃঢ়ভাবে প্রাণ আঁকড়ে থাকতে চাইছেন–একপাও অগ্রসর হতে চাইছেন না। আর এইটেই তার চরম অন্তর্দাহের প্রধান কারণ।

সহসা কোন একটা শক্তি যেন তার বুকে ও কোঁকে সবলে আঘাত হানে। দম নিতে আরও কষ্ট হয়। দ্রুত তিনি অন্ধকারের অতলে নেমে যান। গহ্বরের শেষ প্রান্তে অবশ্য জ্যোতিরেখা ছিল। রেলে চড়ে যাবার সময় অগ্রগতি সত্ত্বেও কেউ যদি মনে করে যে পেছনে চলেছে এবং অকস্মাৎ গতির আসল প্রকৃতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে তাহলে তখন তার মনে যে আলোড়ন দেখা দেয়, ইভান ইলিচের মানসিক অবস্থাও কতকটা তার সঙ্গে তুলনীয়।

আপন মনে তিনি বলে ওঠেন, সত্যি, জীবনে সবকিছুই সাচ্চা ছিল না। কিন্তু এ তেমন গুরুতর কিছু নয়। এ ত্রুটি সংশোধন করা যেতে পারে। কিন্তু আসল সাচ্চা জিনিস কি? সহসা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে তিনি চুপ করে যান।

তৃতীয় দিনের শেষের দিকে এই ব্যাপার ঘটে। তার মৃত্যুর মাত্র দুঘণ্টা আগে! ছেলেটি চুপি চুপি ঘরে ঢুকে তখন তার বিছানার কাছে যায়। মুমূর্ষ লোকটি তখন হাত-পা ছুঁড়ে আর্তনাদ করছে। তার হাতখানা ছেলের মাথার উপর পড়ে। বালক পুত্র সেই হাতখানি ধরে ঠোঁটের উপর চেপে কাঁদতে শুরু করে।

ঠিক সেই মুহূর্তে ধপ করে তিনি গহ্বরের অতলে পড়ে যান এবং জ্যোতি শিখাঁটি তার চোখে পড়ে। তখন উপলব্ধি করেন যে নিজের জীবনযাত্রা যথাযথ না হলেও ত্রুটি-বিচ্যুতি যা ছিল তা সংশোধনাতীত নয়। আবারও নিজেকে প্রশ্ন করেন : আসল সাচ্চা জিনিস কি? তারপর নিরবে কান পেতে থাকেন।

এই সময় তিনি অনুভব করেন, কে যেন তার হাতে চুমু খাচ্ছে। চোখ খুলে পুত্রের দিকে তাকান। বড় মায়া হয় তার জন্য। স্ত্রীও তখন কাছে এগিয়ে আসেন। পলকের জন্য তার দিকে চোখ ফেরান। মুখ হাঁ করে তিনি চেয়ে আছেন স্বামীর দিকে। তার গালে নাকে অশ্রুধারা আর চোখে হতাশ দৃষ্টি। তার জন্যও দুঃখ হয় ইভান ইলিচের।

ভাবেন : সত্যি, আমিই এদের জীবন দুর্বহ করে তুলেছি। ওরা দুঃখ করছে কিন্তু আমি মরে যাওয়া ওদের পক্ষে ভাল। কথাটা তার বলবার ইচ্ছা হয়, কিন্তু সে সামর্থ্য ছিল না।–তাছাড়া, বলবই বা কেন? আমায় কাজে দেখাতে হবে। স্ত্রীর দিকে চেয়ে ইশারায় ছেলের কথা বুঝিয়ে বলেন, ওকে অন্যত্র নিয়ে যাও…ওর জন্য দুঃখিত…দুঃখিত তোমার জন্যও। ক্ষমা করো কথাটা বলবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু জড়িয়ে গেল। হাতের ইশারায় তিনি বিদায় দেন। মনে মনে ভাবেন, অন্তর্যামী তো বুঝবেন, তাহলেই হল।

সহসা তিনি উপলব্ধি করেন যে এতকাল যারা তাকে যন্ত্রণা দিয়েছে এবং কিছুতেই ছেড়ে যেতে চায়নি, এখন যেন একদিক নয়, দুইদিক নয়–দশদিক থেকে, সব দিক থেকে তারা একে একে বিদায় নিচ্ছে। তাদের জন্য দুঃখ হয়। এরা যাতে ব্যথা না পায় সেইভাবেই কাজ করতে হবে। এদের মুক্তি দিতে হবে আর নিজেকেও মুক্ত করতে হবে বেদনা থেকে।

ভাবেন, কত ভাল–কি সহজ! কিন্তু যন্ত্রণাটা? তার কি হল? কোথায় তুমি–যন্ত্রণা!

তখন সেই দিকেই মনঃসংযোগ করেন।

–হ্যাঁ, এই সে রয়েছে! কিন্তু এর কি হবে? বেশতো, থাকুক না।

–কিন্তু মৃত্যু…কোথায় মৃত্যু?

এরপর তিনি অন্তরের মৃত্যুভীতি পাতি পাতি করে খোঁজেন! তার সন্ধান পাওয়া গেল না।

–কোথায় লুকলো? কোথায় মৃত্যু?

মৃত্যু বলে কিছু নেই তাই কোনও ভয়ও তার ছিল না।

মৃত্যুর পরিবর্তে ছিল জ্যোতি।

–ওঃ, তাহলে এই-ই সেই! কি আনন্দ! সহসা তিনি চিৎকার করে বলে ওঠেন।

পলকের মধ্যে এইসব কিছু ঘটে যায়। কিন্তু তার কাছে এই পলকের তাৎপর্য বদলাল না। উপস্থিত লোকজনের কাছে তার যন্ত্রণা আরও ঘণ্টা দুয়েক চলে। গলায় একটা ঘড়ঘড় আওয়াজ শুরু হয়। শীর্ণ দেহ মোচড় দিতে থাকে। তারপর মহাশ্বাস। গলার ঘড়ঘড়ানিও ক্রমেই কমে আসে। শ্বাসও বিলম্বিত হয়।

পাশের একটি লোক বলে ওঠে, নিভে এসেছে।

কথাটা তার কানে যায়। নিজের অন্তরেও তার পুনরাবৃত্তি করেন।

আপন মনে বলেন, মৃত্যু শেষ হয়ে গেছে। আর তার অস্তিত্ব নেই।

সহসা তিনি একটা শ্বাস টানেন। দীর্ঘশ্বাসের মধ্যে শ্বাসটা থেমে যায়। অমনিই সারা দেহ টান হয়ে যায়…তারপর সব শেষ!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *