২. গ্রীষ্মকালে ছুটি নিয়ে

টাকা বাঁচাবার জন্য সেবার গ্রীষ্মকালে ছুটি নিয়ে তিনি সস্ত্রীক শালার মফঃস্বলের বাড়িতে চলে যান।

এই গ্রামাঞ্চলে কর্মহীনতার মধ্যেই তিনি প্রথম অবসাদের লক্ষণ টের পান। শুধু অবসাদ নয়, দুর্বহ এক বিষণ্ণতা যেন তাকে পেয়ে বসে। মনে হল, এভাবে। বসবাস করা চলে না…. জোরাল একটা কিছু করা আবশ্যক।

একদিন গোটা রাত তিনি বারান্দায় পায়চারি করে কাটিয়ে দেন। ঠিক করলেন, পেতরবুর্গ গিয়ে তদবির-তদারক করে ভিন্ন মন্ত্রীদপ্তরে বদলির ব্যবস্থা করবেন। যারা তার কদর বোঝেনি এতে তাদের গালেও ভালভাবে চড় মারা হবে।

গৃহিণী এবং শালার নিষেধ সত্ত্বেও পরদিনই তিনি পেতরবুর্গ রওনা হলেন। রাজধানী যাত্রার একমাত্র লক্ষ্য বছরে পাঁচ হাজার রুবল মাইনের একটি চাকরি আদায় করা। বিশেষ কোন দপ্তর, কাজ বা দৃষ্টিভঙ্গীর প্রতি তার আকর্ষণ ছিল না। তার চাই পাঁচ হাজার রুবল মাইনের এক চাকরি। সে চাকরি শাসন বিভাগে হোক, ব্যাঙ্কে হোক, রেল বিভাগে হোক, সাম্রাজ্ঞী মারিয়ার কোন প্রতিষ্ঠানে হোক, এমনকি শুল্ক-বিভাগে হলেও তার আপত্তি ছিল না। পাঁচ হাজার রুবল মাইনের চাকরি পেলেই হল। যে মন্ত্রীদপ্তর তার যোগ্যতার কদর করেনি সেখানে ছাড়া অপর যে কোন দপ্তরে হোক তাতেই তিনি খুশী।

ইভান ইলিচের এই তল্লাস অপ্রত্যাশিত এবং বিস্ময়কর সাফল্য লাভ করে। এফ, আই. ইলিন নামে তার এক পরিচিত তুরস্কে প্রথম শ্রেণীর কামরায় ওঠেন। ইভান ইলিচের পাশাপাশি বসে তিনি জানান, কুরস্কের গভর্নর সদ্য এক তার পেয়েছেন, তাতে জানান হয়েছে যে মন্ত্রী-দপ্তরে পরিবর্তন আসন্ন এবং ইভান সেমিনভিচ তার ফলে পেতর ইভানভিচকে অতিক্রম করে যাবেন।

রাশিয়ার পক্ষে এ পরিবর্তনের তাৎপর্য ছাড়াও ইভান ইলিচের পক্ষে এর গুরুত্ব অসীম! পেতর ইভানভিচের মত নতুন লোক যদি পুরোধায় আসে তাহলে তার বন্ধু জাকার ইভানভিচেরও পদোন্নতি অনিবার্য। ইভান ইলিচের পক্ষে এই সম্ভাবনা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। জাকার ইভানভিচ শুধু তার সহকর্মীই নয়, বন্ধুও বটে।

মস্কোতে সংবাদটি পাকাপাকিভাবে জানা গেল। পেতরবুর্গে পৌঁছে জাকার ইভানভিচের সঙ্গে দেখা করেন ইভান ইলিচ। জাকার তাকে সুনিশ্চিত প্রতিশ্রুতি দেন যে সাবেক বিচার বিভাগেই তিনি অভীষ্ট পদ পাবেন।

সপ্তাহখানেক পরে স্ত্রীর কাছে তার করেন ইভান ইলিচ : জাকার এখন মিলারের স্থলাধিষ্ঠিত। রিপোর্ট দাখিল করলেই পদ পেয়ে যাব।

উপরতলার লোক বদলির ফলে বিচার বিভাগেই নতুন পদ পেয়ে গেলেন ইভান ইলিচ। এতে তিনি বছরে পাঁচ হাজার রুবল মাইনে আর বাড়ি বদলের খরচ বাবদ এককালীন সাড়ে তিন হাজার রুবল তো পেলেনই, তাছাড়াও নতুন পদ– তাকে সাবেক সহকর্মীদের চাইতে দুই ধাপ উপরে তুলে দেয়। গোটা বিভাগ আর সাবেক শক্রদের সম্পর্কে তার সমস্ত বিদ্বেষ লোপ পেল। ইভান ইলিচ এখন পুরোপুরি সুখী।

সন্তুষ্টচিত্তে আর প্রসন্নমনে তিনি মফঃস্বলের বাড়িতে ফিরে এলেন। এতটা প্রসন্ন তিনি বহুদিন হতে পারেননি। প্রাসকভিয়া ফেদরভনাও কতকটা প্রসন্না হলেন। স্বামী-স্ত্রীতে আবার কিছুদিনের মত আপস-রফা হল। পেতরবুর্গে সবারই কাছ থেকে কত যে আদর আপ্যায়ন পাওয়া গেছে, শত্রুরা মুখ ভোঁতা করে কেমন করে তার তোয়াজ করেছে, তার নতুন পদলাভে কতটা ঈর্ষান্বিত তারা হয়েছে আর রাজধানীর সবাই তাকে কি পছন্দই যে করেছে, সবিস্তারে স্ত্রীকে তার গল্প শোনালেন ইভান ইলিচ।

প্রাসকভিয়া ফেদরভনা সব কিছু মন দিয়ে শুনলেন। মনে হল বিশ্বাসও করলেন। কোন প্রতিবাদ তিনি করলেন না; শুধু নতুন শহরে গিয়ে কেমন করে সংসার পাতবেন তার পরিকল্পনা শোনালেন। ইভান ইলিচ যখন দেখলেন যে স্ত্রীর পরিকল্পনা তার পরিকল্পনার সামিল, স্বামী-স্ত্রীতে তখন মতের মিল হল। খানিকটা হোঁচট খেয়ে এতদিন পরে আবার তার জীবন স্বাভাবিক লঘুচিত্ততা আর ভব্যতার রূপ ফিরে পেল।

ফিরে এসে বেশিদিন বিশ্রাম নেবার সুযোগ ছিল না। দশই সেপ্টেম্বর তার নতুন কার্যভার গ্রহণের তারিখ। তাছাড়া নতুন জায়গায় গৃহস্থালী সাজানো, সংসারের যাবতীয় লট-বহর বদলি করা আর বহু জিনিস কেনা-কাটা কি ফরমাস দেবার জন্যও কিছু সময় দরকার। এক কথায়, তিনি যে সব বন্দোবস্ত করবেন বলে স্থির করেছিলেন, প্রাসকভিয়া ফেদরভনার সিদ্ধান্তের সঙ্গেও তা হুবহু মিলে গেল।

ইভান ইলিচের দাম্পত্য জীবন এই সময় এত শান্তিময় হয়ে ওঠে যে বিয়ের প্রথম বছরও এত মিল, এমন শান্তিতে কাটেনি। কারণ সব কিছুই সৌভাগ্যবশত আশানুরূপ ঘটে গেল। স্বামী-স্ত্রীর মতের মিল হল। তাই পরস্পরের দোষ-ত্রুটিও নজরে পড়ত খুব সামান্য। ইভান ইলিচ সপরিবারে নতুন কর্মস্থলে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত করেন। কিন্তু শালা আর শালা বৌর বিশেষ অনুরোধে তাকে একলাই রওনা হতে হয়। তার এবং তার পরিবারের প্রতি এরা যেন হঠাৎ একটু বেশি দরদী হয়ে ওঠে।

একলাই তাকে যেতে হয়। কিন্তু কর্মজীবনের সাফল্য আর স্ত্রীর সঙ্গে মতের মিল হওয়ায় মানসিক প্রসন্নতা ক্ষুণ্ণ হল না। একটা অপরটাকে সতেজ ও সজীব করে রাখত। বসবাসের বাড়িখানি চমৎকার লাগল। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই এমন একখানি বাড়ির স্বপ্ন দেখেছেন। ঘরগুলি প্রশস্ত, সাবেক কায়দার অভ্যর্থনা কক্ষটি মনোরম, পড়ার ঘরটিও যেমন আরামপ্রদ তেমনি সাজানো-গোছানো। তাছাড়া স্বামী-স্ত্রীর জন্য আলাদা কামরা আর ছেলের পড়ার ঘরও ছিল। মনে হত, বিশেষ করে তার পরিবারের জন্যই বুঝি বাড়িটি তৈরি করা হয়েছিল। সব বন্দোবস্তের তদারকি ইভান ইলিচ নিজেই করেন। নিজেই দেয়ালে লাগাবার কাগজ পছন্দ করে দেন, অতিরিক্ত আসবাবপত্র সাজাবার তদারকি করেন এবং কি করে পর্দা ঝুলাতে হবে তা-ও দেখিয়ে দেন। সব কিছুই ঠিকঠাকমত এগিয়ে যায়। নিজে যেমনটি চেয়েছিলেন সমস্ত ব্যবস্থাই সেই লক্ষ্যের দিকে এগোয়। এমনকি, আধাআধি বন্দোবস্ত হতে না হতেই তার আশা পেরিয়ে যায়। বেশ বুঝতে পারলেন, সাজানো গোছানো সম্পূর্ণ হয়ে গেলে বাড়িখানি স্কুল রুচির ছোঁয়াচ মুক্ত হয়ে কি মার্জিত পরিপাটির চেহারাই যে পাবে। ঘুমিয়ে ঘুমিয়েও তিনি অভ্যর্থনা কক্ষের ছবি চোখের সামনে দেখতে পেতেন। অসমাপ্ত বৈঠকখানার দিকে চেয়েও তার চোখের সামনে অগ্নিকুণ্ড, পর্দা, ওয়াট-নট, এখানে-সেখানে সাজানো ছোট ছোট চেয়ার, দেয়ালে ঝুলানো পিরিচ আর ব্রোঞ্জের বাসনপত্রের ছবি ভেসে উঠত। এ ব্যাপারে স্ত্রী ও কন্যার রুচিও তারই মত। তাদের খুশীর কথা ভেবেও তিনি পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। এতটা অবিশ্যি তারাও আশা করতে পারেনি। খুঁজে-পেতে সস্তায় দুষ্প্রাপ্য জিনিস কিনতেও তার কষ্ট হল না। এই দুষ্প্রাপ্য জিনিস-পত্তর গোটা বাড়িতে একটা আভিজাত্যের সৃষ্টি করে। কিন্তু পরিবারের লোকজনকে তাক লাগিয়ে দেবার আশায় চিঠিপত্রে ইচ্ছে করেই সব কিছু তিনি কম করে লিখতেন। সরকারি কাজ তার ভাল লাগত, তবু এই সব জিনিসে তার মন এত মগ্ন হয়ে থাকত যে নতুন কাজে তিনি আশানুরূপ আগ্রহ বোধ করতেন না। মাঝে মাঝে এজলাসে বসেও আনমনা হয়ে পড়তেন। ভাবতেন, পর্দার কানিসটা সোজা করা ভাল হবে না বাঁকা করলে ভাল দেখাবে। ঘর সাজাবার কাজ তার এত ভাল লেগে যায় যে নিজেই মাঝে মাঝে হাত লাগিয়ে নতুন করে আসবাবপত্র সাজাতেন কি নতুন কায়দায় পর্দা ঝুলিয়ে দিতেন। মই-এর উপর চড়ে গৃহসজ্জাকারকে পর্দা ঝুলাবার কায়দা দেখিয়ে দিতে গিয়ে একবার তার পা ফসকে যায়। কিন্তু শক্তিমান চটপটে লোক বলে মই আঁকড়ে থাকেন। তবু জানালার ফ্রেমে কেকে চোট লাগে। থেঁতলানো জায়গাটিতে বেশ বেদনা হয়। কিন্তু ব্যথা তাকে কাতর করতে পারল না। একটু বাদেই বেশ সুস্থ বোধ করলেন। স্ত্রীকে লিখলেন : মনে হচ্ছে যেন আমার বয়স বছর পনর কমে গেছে। ভেবেছিলেন, সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব ঠিকঠাক করে ফেলবেন। কিন্তু অক্টোবরের মাঝামাঝির আগে হল না। শেষ অবধি অবস্থা যা দাঁড়াল তা শুধু তার নিজের চোখেই মনোরম নয়, যারা দেখল তারাও সবাই অকুণ্ঠ প্রশংসা করল।

মধ্যবিত্তদের মধ্যে যারা বড়লোকী চালে ঘর সাজায় এবং কেবলমাত্র স্বশ্রেণীর অন্যান্যদের সামিল হতে সমর্থ হয়, এই বাড়িখানিতেও অবিকল সেই সব সংসারের জিনিসপত্তরের দেখা মিলত। ফুল তোলা চাদর, কাল কাঠ, টবে সাজানো চারাগাছ, রাগ আর পালিশ করা ময়লাটে ব্রোঞ্জের মূর্তি–সবই ছিল এখানে। সম-শ্রেণীর অন্যান্যদের সামিল হবার জন্য এক শ্রেণীর লোক এই সব জিনিস যোগাড় করে। সম-শ্রেণীর অন্যান্য লোকের বাড়ির সঙ্গে এই বাড়ির এতটা মিল ছিল যে কেউ এদিকে নজর দিত না। কিন্তু ইভান ইলিচের দৃষ্টিতে বাড়িখানি অতুলনীয়। সানন্দে তিনি পরিবারের লোকজনকে অভ্যর্থনা করার জন্য স্টেশনে যান এবং তাদের নিয়ে আলোকোজ্জ্বল সদ্য আসবাবপত্রে সাজানো বাড়িতে ফিরে আসেন। সাদা টাই-পরা এক আরদালি তাদের চারাগাছ-দিয়ে-সাজানো অভ্যর্থনা-কক্ষের দরজা খুলে দেয়। বৈঠকখানা আর পড়ার ঘরে ঢুকে তারা সানন্দ বিস্ময়ে প্রশংসাবাদ করে। ঘুরে ঘুরে ইভান ইলিচ তাদের সব কখানা ঘর দেখান আর তাদের প্রশংসাবাদে উল্লসিত হয়ে ওঠেন। সেদিন সন্ধ্যাবেলা চা খাবার সময় প্রাসকভিয়া ফেদরভনা প্রসঙ্গক্রমে তার পড়ে যাবার কথা তোলেন। হো হো করে হেসে ওঠেন ইভান ইলিচ এবং কি করে পা ফসকে গৃহসজ্জাকারীকে ঘাবড়ে দিয়েছিলেন তাই দেখিয়ে দেন।

–ব্যায়াম চর্চা করতাম বলে কিছুই হয়নি। অপর কেউ হলে মারা পড়ত। আমার শুধু একটা ঠোক্কর লেগেছিল… ঠিক এই জায়গায়। এখনও টিপি দিলে ব্যথা লাগে, তবে ক্রমেই কমে আসছে। সামান্য তেলে গিয়েছিল মাত্র।

এইভাবেই নতুন বাড়িতে তাদের বসবাস আরম্ভ হয়। কিন্তু কিছুদিন থাকবার পরেই মনে হল যেন আর একখানা কামরা থাকলে ভাল হত। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শ এমনি ঘটে থাকে। আয় বাড়লেও মনে হয় যেন আরও পাঁচশ রুবল হলে ভাল হত। এই দুটি খুঁত ছাড়া আর সব কিছুই ঠিকঠাক মত চলতে থাকে।

প্রথমদিকে সব কিছু সাজানো-গোছানো না হওয়া অবধি, অর্থাৎ কিছু কাজ বাকি থাকা পর্যন্ত কোন গোলমাল ছিল না। আজ এ জিনিসটা কেনা হচ্ছে, কাল ওটার জন্য ফরমাস দেওয়া হচ্ছে, পরশু আর একটা জিনিস সরিয়ে নতুন করে সাজানো হচ্ছে–এইভাবেই চলল। মাঝেমাঝে স্বামী-স্ত্রীর মতভেদ ঘটলেও উভয়েই বড় সন্তুষ্ট ছিলেন এবং উভয়েরই এত কাজ ছিল যে গুরুতর ঝগড়া-ঝাটি হবার সুযোগ জোটেনি। কিন্তু কাজকর্ম ফুরিয়ে যাবার কিছুদিন বাদেই কেমন একঘেয়ে লাগতে শুরু করে। মনে হল কিসের যেন অভাব রয়েছে। কিন্তু তখন এরা নতুন পরিচয়, নতুন অভ্যাস গড়ে তুলছেন। ক্রমেই পরিপূর্ণ হয়ে উঠছে নতুন জীবন।

ইভান ইলিচের সকালবেলা কাটত আদালতে। দুপুরে তিনি খেতে আসতেন। সাধারণত এই সময় তার মেজাজ ভাল থাকত। আবার ঘর-দোরের কোথাও ত্রুটি দেখলে মাঝে মাঝে চটেও যেতেন। টেবিলের ঢাকনা কি গৃহসজ্জার কোথাও কোন দাগ কিংবা জানালার কাঁচ ভাঙা দেখলে তার মেজাজ বিগড়ে যেত। এই সব সাজাবার জন্য তিনি এত খেটেছেন যে সেই বন্দোবস্তের কোথাও কোন অদলবদল দেখলে মনমরা হয়ে পড়তেন। মোটামুটি ভাবে তার জীবন অভীষ্ট পথে স্বচ্ছন্দ আরামে আর ভদ্রভাবেই চলতে থাকে।

নটার সময় উঠে কফি খেতে খেতে তিনি কাগজ পড়তেন; তারপর সরকারি পোশাক পরে আদালতে চলে যেতেন। সেখানকার দৈনিক কাজকর্ম ইতিমধ্যেই তার উপযোগী করে বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই সেগুলো তিনি অনায়াসে করে যেতেন। আবেদনকারীদের জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দেওয়া, সর্বোচ্চ বিচারালয়ে খোঁজ-খবর নেওয়া কি সেখানকার কাজকর্ম করা আর প্রকাশ্য কি শাসনতান্ত্রিক অধিবেশনে যোগদান করা–এই তো তার কাজ। গুরুত্বপূর্ণ নতুন কিছুর প্রবর্তনও এখানকার রীতি বিরোধী। তাতে নাকি আমলাতান্ত্রিক কাজকর্মের স্বাভাবিক ধারায় ব্যাঘাত জন্মায়। সরকারি কাজকর্মের ভিত্তিতে এখানকার লোকজনের সঙ্গে শুধু কর্মসংক্রান্ত সম্পর্ক স্থাপন করা চলে। ধরা যাক একটি নোক কোন সংবাদপ্রার্থী হয়ে এল। বিষয়টি যদি ইভান ইলিচের এখতিয়ারের না হয় তো লোকটির প্রতি তার কোন কর্তব্য নেই। কিন্তু তার নির্দিষ্ট সরকারি কর্তব্যসংক্রান্ত কোন কাজে যদি লোকটি এসে থাকে আর সেই-কাজ যদি এমন হয় যে ছাপমারা সরকারি দলিলে প্রকাশ করা যায়, তাহলে এই সম্পর্কের চৌহদ্দির মধ্যে থেকে তার জন্য ইভান ইলিচ অবশ্যই যথাসম্ভব করবেন। এবং এই কাজ করতে গিয়ে বন্ধুজনোচিত মানবীয় সম্পর্কের আদল বজায় রাখতেও ভুল করবেন না। তার মানে, শিষ্টাচার ও ভব্যতার রীতি পুরোপুরি মেনে চলবেন। কিন্তু এই সরকারি কর্তব্য চুকে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আর সব কিছুও খতম হয়ে যাবে।

আসল জীবনকে সরকারি কর্তব্য থেকে আলাদা রাখা আর দুটোকে না মিশিয়ে ফেলার নিখুঁত যোগ্যতা তার ছিল। দীর্ঘদিনের অভ্যাস আর স্বাভাবিক প্রবৃত্তির বলে এই ক্ষমতাকে তিনি এমন এক চরম পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন যে বিচক্ষণ কলাবিদের মত মাঝে মাঝে এই মানবীয় ও সরকারি সম্পর্ক ইচ্ছে করে মিশিয়ে দিতেন। কারণ ইচ্ছে করলেই তো আবার যে কোন মুহূর্তে মানবীয় সম্পর্ক দূরে ঠেলে ফেলে নিছক সরকারি মনোভাব অবলম্বন করতে পারবেন।

এই সব কিছুই তিনি অনায়াসে নিখুঁতভাবে এমনকি বিস্ময়কর মুন্সিয়ানার সঙ্গে করে যেতেন। আদালতের বিরতির সময় তিনি ধূমপান করতেন, কফি খেতেন, সামান্য রাজনীতি চর্চা করতেন কিংবা সাধারণ কোন প্রসঙ্গে কিঞ্চিং আলোচনা করতেন। কখনও বা তাসের প্রসঙ্গ উঠত। কিন্তু সব চাইতে বেশি আলোচনা হত সরকারি নিয়োগ-বদলি নিয়ে। বাড়ি ফিরতেন ক্লান্ত হয়ে। তবু যন্ত্রশিল্পীর মত মনে একটা আত্মপ্রসাদ থাকত। নিখুঁতভাবে বাজাবার পর অরকোর প্রথম বেহালা বাজিয়ের মনে যে আত্মপ্রসাদ থাকে অনেকটা সেই ধরনের। বাড়ি ফিরে দেখতেন; স্ত্রী ও কন্যা কারও সঙ্গে দেখা করতে গেছে কি কোন দর্শনার্থী বসে আছে… ছেলে গেছে স্কুলে কিংবা গৃহশিক্ষকের পড়ানো হয়ে গেছে আর হাই স্কুলে যা শেখানো হয় যথারীতি তাই শিখছে ছেলেটি। যা যেমনটি হওয়া উচিত সব কিছুই সেইভাবে চলছে। মধ্যাহ্ন ভোজনের পর কোন দর্শনার্থী যদি না থাকত তো ইভান ইলিচ সমসাময়িক কোন বহুআলোচিত বই খুলে বসতেন। সন্ধ্যাবেলা বসতেন কাজ নিয়ে। তার মানে, সরকারি নথিপত্র পড়তেন, সাক্ষীদের জবানবন্দী তুলনা করে দেখতেন এবং তার সঙ্গে আইনের কোন ধারা বা উপধারা প্রযোজ্য তাই টুকে রাখতেন। এই কাজ তেমন বিরক্তিকরও নয়, আবার এমন আরামের কাজও নয়। ব্রিজ খেলার সময় কাজটা অবশ্যই বিরক্তিকর লাগত। কিন্তু ব্রিজ না খেললে কোন কিছু না-করা, কি স্ত্রীর সঙ্গে বসে থাকার চাইতে একাজ বরং ভাল। ছোট খাটো ভোজ-সভার আয়োজন করে খুবই আনন্দ পেতেন ইভান ইলিচ। এই সব ভোজসভায় তিনি সমাজের উপরতলার ভদ্রলোক ও মহিলাদের নেমতন্ন করতেন। কিন্তু তার বৈঠকখানার সঙ্গে আর সব বৈঠকখানার সৌসাদৃশ্য ছিল বলে এই সব সখের পার্টিও আর দশটা পার্টির মতই হত।

একবার তারা এক নাচের আসরের আয়োজন করেন। আসরটি ইভান ইলিচের খুবই ভাল লাগে। সব কিছুই চমৎকার ভাবে নিষ্পন্ন হয়। শুধু কেক ও মিঠাই নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে তার একচোট বচসা হয়ে যায়। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা মনে মনে একটা ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ইভান ইলিচ সব কিছু একটা ভাল কনফেকশনারের দোকান থেকে আনাবার জন্য জিদ ধরে বসেন। প্রচুর কেকের ফরমাস দেওয়া হয়। কিন্তু কেক থেকে যায় আর মিঠাইওয়ালা পঁয়তাল্লিশ রুবলের বিল পাঠায় বলে স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া বাঁধে। শেষ অবধি একটা নিতান্ত বিচ্ছিরি অবস্থা দেখা দেয়। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা তাকে মূর্খ ও ক্লীব বলে ভৎর্সনা করেন; আর ইভান ইলিচও দু হাতে মাথা চেপে ধরে ক্রুদ্ধভাবে বিবাহ-বিচ্ছেদের ইঙ্গিত করেন। তবু নাচের আসর ভালই জমেছিল। সমাজের সেরা সেরা লোক এই আসরে উপস্থিত ছিলেন। রাজকুমারী এফনভনার সঙ্গে নাচেন ইভান ইলিচ। আমার বোঝা বহন কর নামে যে প্রতিষ্ঠানটি আছে, রাজকুমারী তার প্রখ্যাত প্রতিষ্ঠাতার ভগিনী।

সরকারি কাজকর্মের মধ্যে যে আনন্দ তিনি পেতেন তার সঙ্গে উচ্চাভিলাষের আত্মপ্রসাদের যোগাযোগ ছিল। সামাজিক আনন্দের মূলে ছিল অহমিকাবোধ। তবে ব্রিজ খেলার মধ্যেই তিনি সেরা আনন্দ পেতেন! নিজের মুখেই স্বীকার করতেন, জীবনে যত অপ্রীতিকর ঘটনাই ঘটুক না কেন, ভাল জুটি নিয়ে ব্রিজ খেলতে বসতে পারলে যে আনন্দ পেতেন আলোর ঝলকের মত সব কিছু ছাপিয়ে উঠত। ঝগড়াটে জুটি তিনি পছন্দ করতেন না। আর চারজনে খেলাই ভাল লাগত। পাঁচজন খেলোয়াড় হলে একজনকে পাশে অপেক্ষা করতে হত আর ব্যাপারটা বিরক্তিকর হলেও কিছু মনে না করার ভান দেখাতে হত। তারপর খেলা যদি জমে উঠত তো কথাই নেই। সে অবশ্য তাস পাওয়া না-পাওয়ার উপর অনেকটা নির্ভর করত। খেলা শেষে খাওয়া-দাওয়া আর পাত্র খানেক মদ। ব্যস! ব্রিজ খেলায় যদি সামান্য জিত হত (বেশি জিতলে ভাল লাগত না) তো বিশেষ খোস মেজাজেই বিছানায় যেতেন ইভান ইলিচ।

এই ভাবেই তাদের জীবন কাটে। সেরা লোকের একটি দল গড়ে ওঠে। এই পরিচিতদের নিয়েই তাদের আড্ডা জমত। গণ্যমান্য কিছু লোক এবং কিছু যুবকও। আসত। পরিচিতদের সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী ও কন্যার মতামত অভিন্ন। যত সব অভদ্র বন্ধু-বান্ধব ভালবাসার ভান দেখিয়ে দেয়ালে জাপানি পিরিচ সাজানো বৈঠকখানায় এসে ভিড় করত, নীরবে একজোটে তারা তাদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকতেন। অনতিবিলম্বেই এই অনাহূত বান্ধবেরা আনাগোনা বন্ধ করে দেয়। গলভিনদের আসরে তখন বাছাই করা সেরা লোককটিই থাকে।

যুবকেরা লিসার দিকে নজর দেয়। দিমিত্রি ইভানভিচ পেত্রিশচেভের পুত্র এবং তার একমাত্র উত্তরাধিকারী তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট পেত্রিশচেভ লিসার প্রতি এত মনযোগী হয়ে ওঠে যে ইভান ইলিচ ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা স্ত্রীকে জানিয়ে দেন এবং মনে মনে চিন্তা করেন, ওদের জন্য একটা পার্টির আয়োজন করা উচিত হবে, না প্রাইভেট কোন নাটকের ব্যবস্থা করলে ঠিক হবে।

এইভাবেই দিন কাটে গলভিনদের। কোন পরিবর্তন না ঘটে বেশ ভালভাবেই কাটে–পরম আনন্দে বয়ে যায় জীবন প্রবাহ।

.

সবারই স্বাস্থ্য ভাল ছিল। ইভান ইলিচ যদি কখনও মুখে একটা বিচ্ছিরি স্বাদ কিংবা বা কোঁকে কোন অস্বস্তি বোধ করতেন তো তাকে স্বাস্থ্যহীনতা বলা যায় না।

এই অস্বস্তি কিন্তু বেড়ে যায়। ঠিক ব্যথা অনুভব না করলেও ইভান ইলিচ কোকে একটা চাপা চাপা ভাব অনুভব করতেন, আর মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে উঠল। এই খিটখিটে ভাবটা ক্রমেই এত বেড়ে যায় যে গলভিন পরিবারের শিষ্টাচার সম্মত সহজ শান্তিময় জীবনধারা পর্যন্ত ব্যহত হতে শুরু করে। স্বামী-স্ত্রীতে প্রায়শ কলহ হতে থাকে। সুখ-শান্তি অনতিবিলম্বে লোপ পায়। এমনকি শিষ্টাচারও সব সময় বজায় থাকত না। চটাচটির মাত্রা বেড়ে যায়। বিস্ফোরণ ছাড়া স্বামী-স্ত্রী যে কটি দ্বীপে মিলিত হতে পারতেন তারও সামান্য কটিই অবশিষ্ট থাকে। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা তখন যদি বলতেন, স্বামীর মেজাজ অসহ্য তাহলে অন্যায় হত না। তবে অদ্ভুত অতিরঞ্জন করেই তিনি অবিশ্যি বলতেন যে ইভান ইলিচের মেজাজ বরাবর দুঃসহ এবং তার নিজের মেজাজ এত ভাল বলেই এই বিশ বছর একসঙ্গে ঘর করতে পেরেছেন।

একথা ঠিক যে আজকালকার ঝগড়ার সূত্রপাত ইভান ইলিচই করতেন। দুপুরের খাবার সময়েই তার মেজাজ ফেটে পড়ত আর তাও প্রায়শ আবার ঝোল খাবার আগে। মাঝে মাঝে তার খেয়াল হত যে একখানা পিরিচ কি একখানা ডিস ভেঙ্গে গেছে, কি রান্না ভাল হয়নি, কিংবা ছেলে টেবিলের উপর কনুই ভর দিয়ে বসে আছে অথবা মেয়ের চুল তার পছন্দসই আঁচড়ানো হয়নি। এই সব কিছুর জন্যই তিনি প্রাসকভিয়া ফেদরভনাকে দায়ী করতেন! প্রথম প্রথম প্রাসকভিয়া জবাব করতেন এবং তাকে কড়া কথা শোনাতেন। কিন্তু একদিন কি দুদিন খাওয়া শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে ইভান ইলিচ এমন চটে ওঠেন সে প্রাসকভিয়া ফেদরভনার মনে হয় যেন খাবার খেয়ে তার কোন শারীরিক অসুস্থতা ঘটেছে। কাজেই নিজেকে তিনি সংযত করেন এবং চটপট যাতে খাওয়া হয়ে যায় তার দিকে নজর দেন। নিজের এই সংযমকে তিনি বিশেষ প্রশংসার মনে করতেন। মনে মনে তিনি স্থির করে ফেলেছেন যে স্বামীর মেজাজটি দুঃসহ আর এই মেজাজ তার জীবনটা দুর্বহ। করে তুলেছে! নিজের জন্য তখন তার দুঃখ হত। আর যতই নিজের জন্য দুঃখবোধ করতেন ততই স্বামীর প্রতি ঘৃণা বাড়ত। মনে হত, মরে গেলেই রক্ষা পাওয়া যায়; তবু তার মৃত্যুকামনা তখন তিনি করতেন না, কারণ তাতে মাইনেটাও বন্ধ হয়ে যাবে। এতে তিনি মনে মনে স্বামীর উপর চটে যেতেন। নিজেকে তখন চরম অসুখী বলে মনে হত; কেননা স্বামী মারা গেলেও তার রক্ষা পাবার উপায় ছিল না। প্রাসকভিয়া এই ক্ষোভ চাপা দিয়ে রাখতেন, তবু এই লুকানো ক্ষোভ ইভান ইলিচের খিটখিটি আরও বাড়িয়ে দিত।

একদিন ঝগড়ার পর (সেদিন অবিশ্যি ইভান ইলিচই বিশেষ অন্যায় করেছিলেন) তিনি স্বীকার করেন যে তার মেজাজটা সত্যিই খিটখিটে হয়ে গেছে এবং তার কারণ অসুখ। স্ত্রী তখন বলেন, তিনি যদি অসুস্থই হয়ে থাকেন তো অসুখের চিকিৎসা করা দরকার এবং ইভান ইলিচ যাতে প্রসিদ্ধ এক ডাক্তারের কাছে যান তার জন্য তিনি পীড়াপীড়ি করেন।

ডাক্তারের কাছে গেলেন ইভান। যা ভেবেছিলেন সবকিছুই সেইমত হল। সব সময়েই হয়ে থাকে। প্রথমত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হল। তার উপর ডাক্তারের ভারিক্কি চাল। এ মেজাজ তার পরিচিত। আদালতে তিনি নিজে যে মেজাজ দেখান অনেকটা সেই ধরনের। তারপর নানাবিধ শব্দ করে ডাক্তার পরীক্ষা করলেন। এরপর যে সব জিজ্ঞাসা বাদ শুরু হল তার জবাব পূর্বনির্ধারিত একটি সিদ্ধান্তই সমর্থন করে। স্পষ্টই বোঝা যায় যে এর কোন প্রয়োজন ছিল না। তাছাড়া ডাক্তারের চোখ-মুখের ভঙ্গী এই কথাই বলছে : আমাদের উপর যদি নির্ভর করেন তো সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। কি কি করা দরকার তার সব আমাদের জানা সকলের সম্পর্কে এক ব্যবস্থা।

এখানকার অবস্থাও ঠিক আদালতের মত। আসামীদের প্রতি তিনি নিজে যে মনোভাব অবলম্বন করেন, ডাক্তারও আজ তার সম্পর্কে অবিকল সেই মনোভাব দেখাচ্ছিলেন।

ডাক্তার বললেন, এই এই লক্ষণ রোগীর মধ্যে এই এই অবস্থার সূচক। আর এই সব বিষয়ের পরীক্ষায় যদি তা প্রতিপন্ন না হয় তো চিকিৎসককে সেই সেই জিনিস ধরে নিতে হবে। আর তিনি যদি সেই সেই জিনিস ধরে নেন তাহলে…।

ইভান ইলিচের কাছে একটি প্রশ্নই গুরুত্বপূর্ণ : গুরুতর কিছু হয়েছে কি? ডাক্তার এই অবান্তর প্রশ্ন উপেক্ষা করে যান। তার দৃষ্টিতে এটা বিবেচ্য বিষয় নয়। আসল সমস্যা হচ্ছে : পুরনো সর্দি জমেছে, না এপেনডিসাইটিস হয়েছে, না মূত্রাশয় ফুলেছে। ইভান ইলিচের জীবন-মৃত্যুর সমস্যা আসল প্রশ্ন নয়; প্রশ্নটা হচ্ছে। এপেনডিসাইটিস বা মূত্রাশয় ফোলার। ইভান ইলিচের মনে হল যেন এই সমস্যার চমৎকার সমাধান করে দিলেন ডাক্তার। এপেনডিসাইটিসের স্বপক্ষেই তিনি মত প্রকাশ করলেন। তবে, মূত্র পরীক্ষায় যদি নতুন কিছু ধরা পড়ে তো বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে।

রোগী নিজেও হাজারো বার আসামীদের সম্পর্কে এমনি অপূর্ব রায় দিয়াছেন। ডাক্তারও তেমনি অপূর্বভাবেই বিজয়ীর মত সগর্বে চশমার ফাঁক দিয়ে অভিযুক্তের প্রতি উৎফুল্ল দৃষ্টিতে চেয়ে তার মন্তব্য শেষ করলেন। ডাক্তারের রায় থেকে ইভান ইলিচ বুঝতে পারলেন যে অবস্থা সুবিধার নয়। কিন্তু ডাক্তার কিংবা অপর সকলের কাছেই ব্যাপারটি উপেক্ষণীয়, তবে তার নিজের পক্ষে খারাপ। এই সিদ্ধান্ত তাকে বেজায় ভড়কে দেয়। নিজের জন্য বড়ড মায়া হয় এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডাক্তারের উদাসীনতায় তার উপর বিষম বিরক্ত হন।

এর কোন মনোভাবই তিনি প্রকাশ করলেন না। উঠে দাঁড়িয়ে টেবিলের উপর ডাক্তারের ফি রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন : আমরা রোগীরা হয়তো অনেক সময় অসমীচীন প্রশ্ন করে বসি। মোটামুটি বলুন তো, অসুখটা কি গুরুতর?

চশমার উপর দিয়ে কঠোর দৃষ্টিতে এক চোখে তার দিকে চাইলেন ডাক্তার। যেন বলতে চান : বন্দী, তোমাকে যে সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তার সঠিক জবাব যদি না দাও তো আদালত থেকে জোর করে সরিয়ে দিতে বাধ্য হব।

যা বলবার তাতো আগেই বলে দিয়েছি। পরীক্ষা করলে আরও কিছু বেরুতে পারে। কথা শেষ করেই ডাক্তার বিদায় অভিবাদন জানালেন।

ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসেন ইভান ইলিচ এবং বিষণ্ণমনে শ্লেগায় চড়ে বাড়ি ফেরেন। পথে পথে সারাক্ষণ আপনমনে ডাক্তারের কথাগুলো আলোচনা করলেন। চেষ্টা করলেন সেইসব জটিল দুর্বোধ্য বৈজ্ঞানিক পরিভাষা সহজ কথায় বুঝতে; এবং তা থেকে এই প্রশ্নের জবাব বার করতে চেষ্টা করলেন; অবস্থা কি খারাপ? খুবই খারাপ কি? না এখনও তেমন বেশি কিছু হয়নি?

তবু ডাক্তারের মন্তব্য থেকে তার এই কথাই মনে হয়েছে যে অবস্থা বেশ খারাপ। রাস্তার সব কিছু বিচ্ছিরি লাগে। কোচোয়ান, ঘর-বাড়ি, পথচারি আর দোকানপাট–সব কিছুই বিষণ্ণ বলে মনে হয়। ডাক্তারের অনিশ্চিত মন্তব্যে তার বিরামহীন ভোতা খামচে ধরার মত ব্যথাবোধটা যেন গুরুতর এক নতুন বৈশিষ্ট্য পায়। নতুন ক্লিষ্ট মনোভাব নিয়ে তিনি ব্যথার প্রকৃতি লক্ষ্য করতে লাগলেন।

বাড়ি ফিরে স্ত্রীর কাছে সব কথা তিনি খুলে বলতে আরম্ভ করেন। মন দিয়ে তিনি শুনে যান। কিন্তু বিবরণের মাঝামাঝি সময়ে মায়ের সঙ্গে বেরুবার জন্য টুপি পরে মেয়ে ঘরে ঢোকে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই বিরক্তিকর কাহিনী শুনবার জন্য তাকে বসতে হয়। কিন্তু বেশিক্ষণ সে সহ্য করতে পারল না। তার মাও শেষ অবধি শুনলেন না।

স্ত্রী বললেন, বেশ তো, শুনে খুশি হলাম। এখন থেকে নিয়মিত ওষুধ খেতে শুরু কর। ব্যবস্থাপত্রটা আমাকে দাও, গেরাসিমকে আমি ওষুধের দোকানে পাঠিয়ে দেবখন।

স্ত্রী ঘরে থাকতে শ্বাস ফেলার ফুরসত পাননি ইভান ইলিচ। সে চলে যাবার পরেই টেনে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। ভাবলেন, তাহলে খারাপ কিছু হয়নি নিশ্চয়ই।

ওষুধ খেতে আরম্ভ করেন ইভান ইলিচ এবং ডাক্তারের নির্দেশ মত চলতে থাকেন। প্রস্রাব পরীক্ষার পর নির্দেশ খানিকটা বদলে যায়। কিছুদিন বাদে প্রস্রাব পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত আর রোগীর উপসর্গে পার্থক্য দেখা দেয়। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই : ডাক্তার তাকে যা বলেছে তার সঙ্গে তার লক্ষণ মিলল না। মনে হত, হয় সে ভুলে গেছে, ভুল করেছে কিংবা কিছু লুকিয়েছে। যাই হোক, এ জন্য ডাক্তারকে দোষ দেওয়া যায় না। ইভান ইলিচ তথাপি তার নির্দেশ পালন করে চলতে থাকেন। এবং প্রথম দিকে এই নিয়ম পালনে খানিকটা আরামও পান।

ডাক্তারের কাছে যাবার পর থেকে স্বাস্থ্যরক্ষা সম্পর্কে তার নির্দেশ পালন করা, নিয়মিত ওষুধ খাওয়া আর ব্যথা ও মল-মূত্রের প্রতি লক্ষ্য করা ইভান ইলিচের প্রধান কাজ হয়ে ওঠে। লোকের অসুখ-বিসুখ আর স্বাস্থ্য সম্পর্কে তিনি সবিশেষ কৌতূহলী হয়ে পড়েন। তার সামনে কখনও অসুখ, মৃত্যু কি রোগমুক্তির কথা বলা হলে নিজের মানসিক উত্তেজনা চাপা দিয়ে সেই সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করতেন। আর রোগটা যদি তার নিজের রোগের মত হত তো শোনা-কথা নিজের রোগ সম্পর্কে প্রয়োগ করতেন।

ব্যথা কমলো না। তবু ইভান ইলিচ জোর করে ভাববার চেষ্টা করতেন যে তিনি ভালই আছেন। কোন উত্তেজনা দেখা না দেওয়া অবধি এ কথা ভাবতে অসুবিধা হত না। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে কখনও কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলে, সরকারি কাজে কোন অসাফল্য দেখা দিলে কিংবা ব্রিজ খেলায় খারাপ তাস পেলেই সঙ্গে সঙ্গে তিনি নিজের অসুখ সম্পর্কে বিশেষ সচেতন হয়ে পড়তেন। আগেকার দিনে এই সব দুর্দৈব অনায়াসে সয়ে গেছেন। ভেবেছেন, ত্রুটি সংশোধন করে কিংবা দুর্বলতা দমন করে অচিরেই সাফল্য অর্জন করবেন, কিংবা গ্রান্ড স্লাম করে বসবেন। কিন্তু এখন সামান্য দুর্দৈবও বিচলিত করে ফেলে–হতাশায় ডুবিয়ে দিয়ে যায়। মনে মনে বলতেন : এই দ্যাখ, যখনই ভাল হয়ে উঠছি আর ওষুধটা ফল দিতে শুরু করেছে, তখনই এই অভিশপ্ত দুর্দৈব আর অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে সব ভেস্তে দিয়ে গেল। ফলে দুর্দৈবের প্রতি কিংবা যে লোক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটিয়েছে তার উপর বিষম চটে যেতেন। তাকে খুন করার ইচ্ছে হত। নিজে তিনি অনুভব করতেন, এই ক্রোধ তাকে মেরে ফেলবার উপক্রম করছে অথচ তা সামলাবার ক্ষমতা নেই। কেউ কেউ হয়তো বলবেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও মানুষের প্রতি এই ক্রোধ যে তার অসুখ বৃদ্ধি করছে এটুকু অন্তত তার মত লোকের বোঝা উচিত ছিল। কিন্তু নিজে তিনি বিপরীত সিদ্ধান্ত করতেন। বলতেন, তিনি শান্তি চান এবং যত কিছু তার ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে তার সবই তিনি লক্ষ্য করতেন আর শান্তির সামান্য ব্যাঘাতের সম্ভাবনায় চটে উঠতেন। নিজে তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের বই পড়েছেন এবং ডাক্তারদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন বলে তার অবস্থা আরও খারাপ হয়ে পড়ল। রোগের অগ্রগতি এমন সুনিশ্চিত ছিল যে একদিনের সঙ্গে অপরদিনের সামান্য পার্থক্যের তুলনা করেই তিনি নিজেকে প্রবঞ্চনা করতে পারতেন। কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলেই মনে হত যেন অবস্থা ক্রমেই খারাপ হচ্ছে এবং বোজই অতি খারাপ হয়ে চলেছে। এ সত্ত্বেও প্রতিনিয়ত তিনি তাদের কাছে যেতেন।

সে মাসে তিনি আর একজন নামকরা ডাক্তারের কাছে যান। তিনিও প্রায় আগেকার ডাক্তারের মত অভিমত প্রকাশ করেন। তবে তার জিজ্ঞাসাবাদের ধরনটা কিছু আলাদা। এই নামকরা ডাক্তারকে দেখিয়ে এসে ইভান ইলিচের শংকা-সন্দেহ আরও বেড়ে যায়। তার এক বন্ধুর বন্ধু ভাল ডাক্তার! তিনি আর সকলের চাইতে ভিন্নমত প্রকাশ করেন। ডাক্তারটি রোগমুক্তির আশ্বাস দিলেও তার প্রশ্ন ও অনুমান ইলিচকে বিস্ময়াবিষ্ট করে এবং তার শংকা আরও বাড়িয়ে দেয়। হোমিওপ্যাথিক এক চিকিৎসক সম্পূর্ণ আলাদাভাবে রোগ নির্ণয় করেন। গোপনে গোপনে ইভান ইলিচ তার ব্যবস্থামত ওষুধ খান। কিন্তু সপ্তাহকাল পরে কোন উন্নতি লক্ষ না করে আগেকার ডাক্তার আর এই নতুন ডাক্তারের উপর আস্থা হারিয়ে আরও হতাশ হয়ে পড়েন।

একদনি এক পরিচিত মহিলা তাকে অলৌকিক এক ইকনের দৈব-শক্তির কথা বলেন। ইকনটি দৈববলে নাকি রোগ সারিয়ে দিয়েছিল। ইভান ইলিচ মন দিয়ে মহিলাটির গল্প শোনেন। একবার তার মনে হল, ঘটনাটি বুঝি সত্যি। এই মানসিক দুর্বলতা তাকে সচকিত করে তোলে। আপন মনে জিজ্ঞাসা করেন : আমি কি এতই দুর্বলচিত্ত হয়ে পড়েছি? দুত্তোর ছাই, সব বাজে! ভয়ে এত চঞ্চল হলে চলবে না। একবার এক ডাক্তার যখন ঠিক করেছি তখন তার নির্দেশ মতই চলব। তা-ই করব। আর নড়চড় করা হবে না। এ সম্পর্কে আর ভাববও না- গ্রীষ্মকাল পর্যন্ত যথারীতি তার ব্যবস্থামত চলব। তারপর দেখা যাবে। এখন থেকে আর দোমনা হওয়া চলবে না।

এ কথা বলা সহজ, কিন্তু কার্যকরী করা কঠিন। কেকের ব্যথাটা অনবরত পীড়া দিচ্ছে। ক্রমেই যেন খারাপ ও জারালো হয়ে উঠেছে বলে মনে হয়। মুখের স্বাদটাও ক্রমেই অদ্ভুত লাগছে। মনে হত যেন শ্বাস-প্রশ্বাসেও একটা বিচ্ছিরি গন্ধ আসে। খিদের অভাব এবং দুর্বলতাও যেন টের পেতেন। আর আত্ম প্রবঞ্চনা করা যায় না। তার দেহের মধ্যে নিশ্চয়ই মারাত্মক নতুন কিছু ঘটছে। জীবনের সমস্ত ঘটনার চাইতে ব্যাপারটি গুরুত্বপূর্ণ। অথচ এ সম্পর্কে একমাত্র তিনিই সচেতন। তার চারপাশে যারা আছে, তাদের কেউ বোঝে না কিংবা বুঝবেও না। ভাবছে, সংসারের সব কিছুই যথারীতি চলছে। এই চিন্তা ইভান ইলিচকে আরও বেশি মনস্তাপ দেয়। চোখের উপর দেখছেন, সংসারের সবাই, বিশেষত এ-বাড়ি ও-বাড়ি ঘুরে বেড়াবার নেশায় মত্ত তার স্ত্রী ও কন্যা তার রোগের কিছুই বোঝে না। বরং তার মনমরা ভাব দেখলে কিংবা ফাই-ফরমাস খাটতে হলে বিরক্তবোধ করে। যেন এ জন্য তিনিই দোষী। কথাটা তারা লুকোবার চেষ্টা করলেও তিনি বুঝতে পারতেন, তিনি এখন ওদের পথের কাঁটা। স্ত্রী তার রোগ সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা সুনির্দিষ্ট মনোভাব অবলম্বন করেছেন। ইভান ইলিচ যা-ই বলুন বা করুন না কেন তার এই মনোভাব বদলায় না। তার মনোভাবটা এই রকম : বন্ধু বান্ধবদের কাছে তিনি বলতেন, জানেন, ইভান ইলিচ ঠিক আর দশজনের মত নয়! ডাক্তারের নির্দেশমত চলতে পারে না। একদিন হয়তো ঠিক মত ওষুধ খেল, পথ্য খেল আবার সকাল সকাল শুতেও গেল। কিন্তু পরদিন যদি আমি খেয়াল না রাখি তো হঠাৎ হয়তো ওষুধ খাবে না, কুপথ্য করবে আর এক নাগাড়ে রাত একটা অবধি তাস পিটবে।

–সেকি, কবে করেছি বলতো! বিরক্তভাবে বলতেন ইভান ইলিচ।

–একবারমাত্র পেতর ইভানভিচের বাড়িতে হয়েছিল।

–কালকে শেবেকের বাড়িতে রাত জাগনি?

–জেগে না থাকলেও ব্যথার জন্য ঘুম হত না।

–সে যা-ই হোক, অমন করলে অসুখ সারবে না…আমাদের জ্বালাবে শুধু।

ইভান ইলিচের অসুখ সম্পর্কে প্রাসকভিয়া ফেদরভনা স্বামীর কাছে এবং আর পাঁচজনের কাছেও বলতেন : অসুখের জন্য ইভান নিজেই দায়ী, আর এ হয়েছে তার নতুন এক জ্বালা। ইভান ইলিচ ভাবতেন, এই অভিমত তার এড়িয়ে চলার চেষ্টা; কিন্তু তাতে তার অবস্থার কোন তারতম্য হত না।

আদালতে বসেও ইভান ইলিচ লক্ষ করেছেন, অন্তত মনে হত যেন লক্ষ করছেন যে লোকজন তার সম্পর্কে এক অদ্ভুত মনোভাব অবলম্বন করছে। মাঝে মাঝে মনে হত যেন উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছে, তার আসন অচিরেই শূন্য হবে। তাছাড়া বন্ধু-বান্ধবও মাঝে মাঝে মনমরা বিষণভাবের জন্য বন্ধুভাবে তাকে ঠাট্টা করত। তার মধ্যে যে বিভীষিকাময় অপরিজ্ঞাত পরিবর্তন ঘটেছে–সর্বক্ষণ খামচে ধরার মত যে বেদনাটা তাকে ক্লিষ্ট করছে আর দুর্নিবারভাবে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে, তা যেন উপহাসের বস্তু। সোয়ার্জের হাসিখুশি সজীব প্রফুল্লতাই তাকে বিশেষভাবে উত্যক্ত করত। কেননা এই প্রফুল্লতা তাকে স্মরণ করিয়ে দিত যে দশ বছর আগে তিনি নিজে কি ছিলেন।

বন্ধুরা দল বেঁধে তাস খেলতে বসত। নতুন তাস বাকিয়ে তারা ভাঁজত। নিজের হাতের রুহিতন এক জায়গায় এনে তিনি দেখতেন যে সাতখানা পেয়েছেন। জুটি নো-ট্রাম ডাকত। দুটো রুহিতন ডেকে তিনি সমর্থন জানাতেন। আর কি চাই? এতে দুজনেরই খুশি এবং চাঙ্গা হয়ে ওঠবার কথা। তারা হয়তো একটা গ্রান্ড স্লাম করে বসবেন। কিন্তু ইভান ইলিচ অকস্মাৎ বেদনার টাটানি আর মুখের স্বাদটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে পড়তেন। মনে হত, এই অবস্থায় গ্রান্ড স্লাম করার আনন্দে উল্লাস বোধ করা হাস্যকর।

মিখাইল মিখাইললোভিচ তার জুটি। তার দিকে তাকাতেন ইভান ইলিচ। সবল হাতে টেবিলের উপর সশব্দে তাস ফেলে ছোঁ-মেরে বাজিটা তুলে না নিয়ে সে আস্তে ইভান ইলিচের দিকে ঠেলে দিত যাতে হাত না বাড়িয়েই তিনি তুলে নিতে পারেন। ইভান ইলিচ ভাবতেন, ও কি মনে করে আমি এতই দুর্বল যে হাত বাড়াতেও পারি না? খেলার দিকে তখন আর নজর থাকত না। জুটি যে বাজি পাচ্ছে তাতেও তিনি তুরুপ করে বসতেন। ফলে গ্রান্ড স্লামের বদলে তিনটে শট যেত। এর চাইতেও বিচ্ছিরি ব্যাপার হত যখন দেখতেন যে মিখাইল মিখাইলোভিচ এতে বড় বিচলিত হয়ে পড়েছে। কিন্তু নিজে তিনি গ্রাহ্য করতেন না। কেন যে গ্রাহ্য করতেন না সে চিন্তাও মর্মান্তিক।

সবাই বুঝতে পারত যে তিনি কষ্ট পাচ্ছেন। বলত, আপনার ক্লান্তি লাগলে খেলা বন্ধ করতে পারি। খানিকটা বিশ্রাম করুন না। শুয়ে পড়বেন? না, বিন্দুমাত্র ক্লান্তি তার হয়নি। রাবার হওয়া অবধি তিনি খেলতেন। সবাই নীরব ও বিষণ্ণ। ইভান ইলিচের মনে হত যেন নিজের বিষণ্ণতা তিনি এদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন; কিন্তু সে-বিমর্ষতা দূর করার সাধ্য তার নেই। খাওয়া-দাওয়া সেরে তারা চলে যেত। একাকী বসে ইভান ইলিচ তখন ভাবতেন, তার নিজের জীবন বিষে জর্জরিত, আর অন্যের জীবনও তিনি বিষিয়ে তুলছেন। নিজের দেহের এই বিষ কিছুতেই কমছে না, বরং ক্রমান্বয় আরও গভীরে প্রবেশ করে তার সমস্ত সত্তা জর্জরিত করে তুলেছে।

এই অনুভূতি, বেদনার সঙ্গে এই ভীতি নিয়ে তাকে বিছানায় যেতে হত। প্রায়ই জেগে জেগে অনেক রাত কেটে যেত। পরদিন সকালে উঠতে হবে–পোশাক আশাক পরে আদালতে গিয়ে লিখতে হবে কথা বলতে হবে। আর যদি না বেরোন তো চব্বিশ ঘণ্টা ঘরে বসে থাকতে হবে। অথচ তার প্রতিটি ঘণ্টা যন্ত্রণাদায়ক। এইভাবে গভীর গহ্বরের মুখে দাঁড়িয়ে নিঃসঙ্গভাবে তাকে বাঁচতে হয়েছে। কেউ তার ব্যথা বোঝে নি…সমবেদনাও প্রকাশ করেনি কেউ।

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *