১. মেলভিনস্কি মামলার বিচার

জীবন গোধূলি (ডেথ অব ইভান ইলিচ) / মূল : লিও তলস্তয় / অনুবাদ : আসিফ খান

ভূমিকা

ডেথ অব ইভান ইলিচ তলস্তয়ের পরিণত বয়সের লেখা। প্রকাশ কাল ১৮৮৬ সাল। উপন্যাসখানি তলস্তয়ের শ্রেষ্ঠ লেখার অন্যতম। সাধারণ মানুষের মত সুখ শান্তি আরাম-আয়াসভরা সাংসারিক জীবনের নিশ্চিন্ততা-প্রয়াসী ইভান ইলিচের অন্তিম উপলব্ধি যদি একান্তভাবে তার নিজস্ব অনুভূতি হত, সেই মর্মান্তিক উপলব্ধি যদি সার্বজনীনত্ব না পেত তো রসোত্তীর্ণ সার্থক সাহিত্য হিসাবে উপন্যাসখানি কোন মর্যাদা পেত না। এর অনন্য সাধারণত্বের মূলে আছে সার্বজনীনত্বের আবেদন।

অন্তরঙ্গ প্রিয়-পরিজনের সান্নিধ্যেও মহাযাত্রী মানুষ নিঃসঙ্গ। তার নিগূঢ় বেদনার সমব্যথী নেই। নেই কোন সমমমী। কেউ বোঝে না তিলে তিলে পলে পলে নিভে যাওয়ার, অজানা অন্ধকারের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে যাওয়ার মর্মান্তিক বেদনা। জীবন গোধূলির এই নিঃসঙ্গতা, এই নিগূঢ় বেদনার দুঃসহ করুণ মর্মপীড়া বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে ইভান ইলিচের অন্তিম জীবনচিত্রে। এই বেদনাবিধুর অনুভূতি, অন্তরঙ্গের পরিবেশের মধ্যেও এই একান্তবোধ সার্বজনীন। সবাই আমরা ভাবী ইভান ইলিচ। জীবনকে ভালবেসে, বাঁচার অক্লান্ত আকুতি নিয়ে একদিন না একদিন সবাই মুখোমুখি দাঁড়াবে এই সুনিশ্চিত ভবিতব্যের। পেছনে চেয়ে জীবনের সব পুঁজি হয়তো সেদিন অর্থহীন মনে হবে। আর গোটাজীবন মনে হবে ভুলে-ভরা। আত্মবঞ্চনার সব যুক্তি সেদিন মেকি বলে মনে হবে–দুঃসহ মর্মপীড়া আর সংশোধনের আগ্রহ নিয়ে অসহায়ের মত আত্মসমর্পণ করতে হবে অমোঘ পরিণামের কাছে। তলস্তয়ের কল্পলোকের ইভান ইলিচ তাই সর্বকালের সর্বদেশের সাধারণ মানুষ।

–অনুবাদক

বিশাল আদালত-ভবনে মেলভিনস্কি মামলার বিচার চলছে। আদালতের বিরতির সময় সরকারি উকিল আর বিচারকদের আড্ডা জমে ইভান এগারভিচ শেবেকের গোপন কক্ষে। কথায় কথায় সেখানে প্রখ্যাত ক্ৰাসভস্কি মামলার প্রসঙ্গ ওঠে। ফেদর ভাসিলিভিচ জোর দিয়ে বলেন যে বিষয়টি তাদের এখতিয়ারে নয়। ইভান এগারভিচ ভিন্ন মত প্রকাশ করেন। পেতর ইভানভিচ প্রথম থেকেই এ আলোচনায় যোগ দেয়নি। এখুনি যে গেজেটখানি বিলি করা হয়েছে নীরবে সে তার উপর চোখ বোলাচ্ছিল।

সহসা সে বলে ওঠে, সে কি! ইভান ইলিচ মারা গেছেন?

–বলেন কি?

–এই তো রয়েছে–পড়ে দেখুন না! সদ্য-ছাপা ভেজা কাগজখানা ফেদর ভাসিলিভিচের হাতে বাড়িয়ে দেয় পেতর ইভানভিচ।

কাল রেখার বেষ্টনীর মধ্যে এই কয়টি কথা লেখা ছিল : গভীর শোকাতুরা প্রাসকভিয়া ফেদরভনা গলভিনা এতদ্বারা আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবকে তাহার প্রিয় স্বামী বিচারক ইভান ইলিচ গলভিনের মৃত্যু-সংবাদ জানাইতেছেন। ১৮৭২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তাঁহার মৃত্যু হইয়াছে। শুক্রবার বিকাল একটার সময় তাঁহার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া নিষ্পন্ন হইবে।

উপস্থিত ভদ্রজনের সহকর্মী ছিলেন ইভান ইলিচ। এদের সকলেই তাকে পছন্দও করতেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। এ রোগ নাকি সারে না। চাকরির পদটি এখনও তার জন্য শূন্য রাখা হয়েছে। কথা উঠেছে, তিনি মারা গেলে আলেকসিভ তার শূন্য পদে নিযুক্ত হবে; আর ভিন্নিকভ কিংবা স্তাবেল পাবে আলেকসিভের পদ। কাজেই মৃত্যু সংবাদ শুনে গোপন কক্ষে উপস্থিত ভদ্রজনের মনে প্রথমত নিজেদের কিংবা পরিচিতদের পদ-পরিবর্তন আর পদোন্নতির কথাই জাগ্রত হয়।

ফেদর ভাসিলিভিচ ভাবে, আমি নিশ্চয় স্তাবেল কি ভিন্নিকভের পদ পাব। অনেকদিন আগেই সেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে; আর সেই পদোন্নতির মানে ভাতা বাদে বছরে অতিরিক্ত আরও আটশ রুবল মাইনে বৃদ্ধি।

পেতর ইভানভিচের মনে হয়, এইবারে কালুগা থেকে শালার বদলির জন্য আবেদন করতে হবে। তাতে স্ত্রীও খুশী হবে। তখন আর বলতে পারবে না যে তার আত্মীয়ের জন্য আমি কিছু করিনি।

–আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বিছানা ছেড়ে এবার আর ওকে উঠতে হবে! বড় দুঃখের কথা! জোরে জোরে বলে পেতর ইভানভিচ।

–কিন্তু আসলে ওর হয়েছিল কি?

–ডাক্তার বলতে পারেনি! অন্তত তাদের মতের মিল হয়নি…সবাই আলাদা। মত প্রকাশ করেছে। শেষবার যখন তাকে দেখতে গেলাম তখন তো ভালই দেখেছিলাম।

–প্রায়ই যাব ভেবেছি, কিন্তু ছুটির পর আর যেতে পারিনি।

–সম্পত্তি-টম্পত্তি কিছু আছে কি?

–স্ত্রীর কিছু আছে হয়তো…তবে তেমন কিছু নয়!

–তার সঙ্গে একবার দেখা করে যেতে হবে…কিন্তু বড় বেশি দূরে বাড়ি!

–তার মানে আপনার বাড়ি থেকে দূরে! তা সব জায়গাই তো আপনার বাড়ি থেকে দূরে!

–দেখছেন, নদীর ওপারে থাকি বলে সুযোগ পেলেই উনি বাড়ি নিয়ে খোঁচা দিতে ছাড়েন না। শেবেকের দিকে চেয়ে হেসে বলে পেতর ইভানভিচ। তারপর শহরের বিভিন্ন স্থানের দূরত্ব সম্পর্কে আরও খানিকটা আলোচনা করে আবার তারা আদালতের প্রসঙ্গে ফিরে আসেন।

ইভান ইলিচের মৃত্যুর ফলে সম্ভাব্য পদ-পরিবর্তন ও পদোন্নতি সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ছাড়াও এই নিকট পরিচিতের মৃত্যু-সংবাদ স্বভাবতই এদের সকলের মনে এই আত্ম-প্রসাদের ভাব জাগ্রত করে : মরেছে তো অন্যে…আমি তো মরিনি!

সকলেই মনে মনে ভাবে কি অনুভব করে; যাক গে, মারা গেছে তো সে…আমি তো বেঁচে আছি! কিন্তু ইভান ইলিচের অন্তরঙ্গ পরিচিতেরা, মানে তার তথাকথিত বন্ধু-বান্ধব একথা না ভেবে পারল না যে, এইবারে তাদের শেষকৃত্যে যোগ দেবার মত বিরক্তিকর সামাজিক কর্তব্য পালন করতে হবে, আর বিধবার সঙ্গে দেখা করেও শোকজ্ঞাপন করে আসতে হবে।

ফেদর ভাসিলিভিচ আর পেতর ইভানভিচ তার পরিচিতদের মধ্যে সব চাইতে ঘনিষ্ঠ। আইন পড়ার সময় ইভানভিচ তার সতীর্থ ছিল। তাছাড়াও নিজেকে সে ইভান ইলিচের কাছে ঋণী বলে মনে করে।

ডিনার খাবার সময় স্ত্রীকে ইভান ইলিচের মৃত্যু-সংবাদ জানায় পেতর ইভানভিচ এবং এইবারে তার ভাইকে এই এলাকায় বদলি করা হয়তো সম্ভব হবে বলেও ইংগিত করে। তারপর প্রাত্যহিকের দিবান্দ্রিা বিসর্জন নিয়ে সান্ধ্য বেশবাস পরে গাড়ি করে ইলিচের বাড়ির দিকে রওনা হয়।

ফটকের সামনে একখানি জুড়ি-গাড়ি আর খান দুয়েক ভাড়াগাড়ি ছিল। ক্লোক রাখার আয়নার কাছাকাছি একতলার হল ঘরের দেয়ালে সোনালি চাদর দিয়ে মোড়া শবাধারের একটি ডালা হেলান দেওয়া রয়েছে। চাদরখানি সোনার দড়ি আর সোনার ঝুরি দিয়ে সাজান। আর এই অলংকার আবার ধাতুর গুড়ো দিয়ে পালিশ করা হয়েছে। কাল পোশাক-পরা দুটি মহিলা তখন গা থেকে ফার ক্লোক খুলে ফেলছেন। ইভান ইলিচের ভগিনীকে চিনতে পারে পেতর ইভানভিচ; কিন্তু দ্বিতীয়া অপরিচিতা। ইভানভিচের সহকর্মী সোয়ার্জ এই সময় সবে একতলায় নামছিল। কিন্তু পেতর ইভানভিচকে ঢুকতে দেখেই সে থেমে পড়ে এবং পিট পিট করে চায় তার দিকে। যেন বলতে চায় : ইভান ইলিচ সব ভেস্তে দিয়ে গেছেন, কিন্তু তোমার বা আমার মত নয়!

সোয়ার্জের কেতাদুরস্ত গোঁফওয়ালা মুখ আর সান্ধ্য বেশবাস পরা ছিপছিপে চেহারার মধ্যে এমন এক চোস্ত গাম্ভীর্য ছিল যা তার হাসিখুশি স্বভাবের পক্ষে নেহাৎ বেমানান, আর এখানকার বিশেষ পরিবেশের সঙ্গেও একদম খাপ খাচ্ছিল না। অন্তত পেতর ইভানভিচের তাই মনে হয়েছে।

মহিলাদের আগে আগে যেতে দেয় পেতর ইভানভিচ এবং নিজে সন্তর্পণে উপরতলায় তাদের অনুগমন করে। সোয়ার্জ নিচে নামেনি…যেখানে ছিল সেইখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। পেতর ইভানভিচ বুঝতে পারে যে আজকের ব্রিজ খেলার স্থান নির্ণয় করতে চায় সোয়ার্জ। মহিলারা একে একে বিধবার ঘরে চলে যান! গম্ভীরভাবে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সহাস দৃষ্টিতে ইভানভিচকে ভুরুর ইশারায় ডানদিকের ঘরটি দেখিয়ে দেয় সোয়ার্জ! শবটি সেই ঘরেই শোয়ান রয়েছে।…

ইতি-কর্তব্য সম্পর্কে বিমূঢ় অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করে ইভান ইভানভিচ। এমন পরিস্থিতিতে সকলেরই খানিকটা বিমূঢ়তা দেখা দেয়। এইটুকুমাত্র তার জানা ছিল যে এই সব ক্ষেত্রে ক্রশ করা সব দিক থেকে নিরাপদ। কিন্তু ক্রশ করার সময় অভিবাদন করা সমীচীন হবে কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। কাজেই সে মধ্য পন্থা অবলম্বন করে। ঘরে ঢুকেই সে ক্রশ করতে আরম্ভ করে এবং নমস্কারের ভঙ্গীতে মাথাঁ নোয়ায়। আর সেই সুযোগে হাত ও মাথার ভঙ্গীর ফাঁকে ঘরের অবস্থাটা যথাসম্ভব দেখে নেয়। দুটি যুবক ক্রশ করে বেরিয়ে গেল। স্পষ্টই বোঝা যায়, এরা বোনপো। একজন আবার হাই স্কুলের ছাত্র। এক বৃদ্ধা নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অদ্ভুত ভুরু বাঁকানো এক মহিলা ফিস ফিস করে কি যেন বলছিলেন তার কানে কানে। ফ্রক-কোট-পরা বলবান দৃঢ়চেতা এক পাদরি চড়াগলায় কি যেন পাঠ করছেন। তার পড়ার ভঙ্গী এমনি দৃঢ়তাব্যঞ্জক যে তার মধ্যে প্রতিবাদের সুযোগ নেই। বাটলারের সহকারি গেরাসিম সন্তর্পণে পেতর ইভানভিচের সামনে এসে মেজেয় কি যেন ছড়িয়ে দেয়। ব্যাপারটা লক্ষ্য করে পেতর ইভানভিচ সঙ্গে সঙ্গে পচা-ধরা শবের ক্ষীণ দুর্গন্ধ অনুভব করে।

শেষবার ইভান ইলিচকে দেখতে এসে গেরাসিমকে পড়ার ঘরে দেখেছিল ইভান ইভানভিচ। ইভান ইলিচের খুবই প্রিয় পাত্র ছিল গেরাসিম; আর এই লোকটিই তার নার্সের কাজ করত।

শবাধার, পাদরি আর কক্ষটির এক কোণে টেবিলের উপর সাজান ইকনগুলির মাঝামাঝি একটা স্থান লক্ষ করে ঈষৎ মাথা নুইয়ে বারংবার ক্রশ করতে থাকে পেতর ইভানভিচ। খানিক বাদে হাতের ভঙ্গী অনেকক্ষণ করা হয়েছে মনে করে সে ক্রশ করা বন্ধ করে এবং একদৃষ্টে শবটির দিকে চেয়ে থাকে।

বিশিষ্ট ভঙ্গীতে কাঠের গুঁড়ির মত শুয়ে আছে মৃত লোকটি। সমস্ত মৃত লোকই অবশ্য এমনিভাবে শোয়। তার অসাড় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শবাধারের কুশনের উপর কেটে বসেছে। মাথাটি চিরদিনের মত ভেঙে পড়েছে বালিশের উপর। মোমের মত ফ্যাকাশে হলদে ভুরু আর বিরল-কেশ রগ এমনভাবে উপর দিকে টান হয়ে আছে যা একমাত্র মৃতদের মধ্যেই দেখা যায়। টিকলো নাকের ডগা ঝুলে পড়েছে ওষ্ঠের উপর। পেতর ইভানভিচ শেষবার যখন তাকে দেখে গেছে, তার চাইতে অনেক বদলে গেছে ইভান ইলিচ। আরও শীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু জীবিতাবস্থার চাইতে তার মুখমণ্ডল স্বভাবতই আরও প্রশান্ত সুন্দর আরও মহিমান্বিত দেখাচ্ছে! এই পরিবর্তন সব মৃতের পক্ষেই স্বাভাবিক। মুখের ব্যঞ্জনা যেন বলছে : প্রয়োজন এতদিনে সিদ্ধ হয়েছে, শুধু সিদ্ধ নয়…যথাযথভাবেই সিদ্ধ হয়েছে। এ ছাড়াও সেই ব্যঞ্জনার মধ্যে জীবিতদের প্রতি সুস্পষ্ট একটা তিরস্কার আর হুঁশিয়ারির ভাব ছিল। পেতর ইভানভিচের কাছে এই হুঁশিয়ারি অবান্তর বলে মনে হয়…অন্তত তার সম্পর্কে প্রযোজ্য নয় নিশ্চিত। খানিকটা অস্বস্তি বোধ করে ইভানভিচ। কাজেই আর একবার ক্রশ করে পেছন ফিরে সে বড় চটপট ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। অথচ এই লক্ষ্য পড়বার মত অসৌজন্য সম্পর্কে নিজে সে সম্পূর্ণ অবহিত ছিল।

পা ফাঁক করে লাগোয়া ঘরে তার জন্য অপেক্ষা করছিল সোয়ার্জ…দুই হাত দিয়ে উঁচু টুপির পেছনটা নাড়াচাড়া করছিল। এই হাসিখুশি চোস্ত পোশাক-পরা পরিপাটি-দুরস্ত ছিমছাম চেহারা দেখে পেতর ইভানভিচের মন চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মনে হল যেন সোয়ার্জ এই সব ঘটনার ঊর্ধ্বে…ফুর্তির হানি ঘটাতে পারে এমন কোন প্রভাবের কাছে বুঝি সে নতি স্বীকার করবে না। তার চোখ যেন বলে দিচ্ছে যে ইভান ইলিচের উদ্দেশ্যে এই উপাসনা-কৃত্যের জন্য দৈনন্দিন আসরের নিয়ম লঙ্ঘন করা অর্থহীন। তার মানে, সেদিন সন্ধ্যায় নতুন তাসের প্যাকেট খুলে তাস ভঁজা আর টেবিলের উপর খানসামার চারখানা নতুন মোম জ্বেলে দেবার নিয়মের নিশ্চয়ই কোন বাধা হবে না। অবশ্য এ কথা মনে করবার কোন কারণ নেই যে এই ঘটনা তাদের সান্ধ্য মজলিসের ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে। পেতর ইভানভিচ পাশ কাটিয়ে যাবার বেলা এ কথা সে বলতেও দ্বিধা করল না। সোয়ার্জ প্রস্তাব করল যে ফেদর ভাসিলিভিচের বাড়িতে আজকের খেলার আসর বসান যেতে পারে। কিন্তু স্পষ্টই বোঝা গেল, সেদিন সন্ধ্যায় ব্রিজ খেলা পেতর ইভানভিচের ভাগ্যে ছিল না। পুরোপুরি কাল পোশাক আর মাথায় লেসের ঘোমটাপরা প্রাসকভিয়া ফেদরভনা এই সময় জনকয়েক মহিলাসহ নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং যে ঘরে শবটি রয়েছে মহিলাদের সেই ঘরে নিয়ে গিয়ে বলেন, এখুনি উপাসনা শুরু হবে, ভেতরে আসুন আপনারা।

মোটা-সোটা বেঁটে স্ত্রীলোক প্রাসকভিয়া ফেদরভনা। শত চেষ্টা করেও মহিলাটি কাঁধ থেকে কোমর অবধি ক্রমাগত মুটিয়ে-যাওয়া রোধ করতে পারেননি। শবাধারের পাশে যে মহিলাটি দাঁড়িয়ে ছিলেন ফেদরভনার ভুরুও তার মত অদ্ভুতভাবে বাঁকানো।

অস্পষ্টভাবে অভিনন্দন করে সোয়ার্জ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। স্পষ্টতই সে আমন্ত্রণ গ্রহণও করল না, আবার প্রত্যাখ্যানও করল না। পেতর ইভানভিচকে দেখতে পেয়ে প্রাসকভিয়া ফেদরভনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার দিকে এগিয়ে যান। বলেন : জানতাম, আপনি ইভান ইলিচের প্রকৃত বন্ধু ছিলেন…। ইভানভিচের মুখ থেকে যথোচিত একটি জবাব শোনার আশায় তিনি তার দিকে তাকান। পেতর ইভানভিচ জানত যে শবের কাছে গিয়ে ক্রশ করা যেমন নিরাপদ কাজ, এবারেও তেমনি তাকে মহিলাটির হাতে চাপ দিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলতে হবে : বিশ্বাস করুন …। সুতরাং সামাজিক ভব্যতার রীতি অনুযায়ী এই সব কিছুই সে করে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে অনুভব করে যে সে আর মহিলাটি বিচলিত হয়ে পড়েছেন।

–আমার সঙ্গে আসুন। উপাসনা শুরু হবার আগে আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলে নেব। বিধবা বলেন–আমায় ধরে নিয়ে চলুন!

পেতর ইভানভিচ বাহু বাড়িয়ে দেয়। সোয়ার্জের পাশ কাটিয়ে উভয়েই ভেতরের ঘরের দিকে চলে যায়। সোয়ার্জ পিটপিট করে সহানুভূতির চোখে তাকায় পেতর ইভানভিচের দিকে। তার কৌতুকোচ্ছল দৃষ্টি বলে : ব্রিজ খেলার দফা শেষ হল। আর একজন খেলোয়াড় যোগাড় করলে আপত্তি করতে পারবে না কিন্তু! ছাড় পেলে এসে যাবে নিশ্চয়ই!

আরও গম্ভীর হতাশাভরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পেতর ইভানভিচ। সকৃতজ্ঞ প্রাসকভিয়া ফেদরভনা আরও জোরে তার বাহু চেপে ধরেন। ছাপান চাদর দিয়ে আসবাবপত্র ঢাকা মিটমিটে-আলো-জ্বালানো বৈঠকখানায় ঢুকে তারা একখানা টেবিলের পাশে বসেন। মহিলাটি বসেন একটা সোফার উপর, আর পেতর ইভানভিচ বসল একটা নিচু নরম কৌচে। তার চাপে স্প্রিং সংকুচিত হয়ে নিচু হয়ে যায়। প্রাসকভিয়া ফেদরভনা তাকে আর একটা আসনে বসবার কথা বলতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কথাটা তার বর্তমান অবস্থায় সমীচীন হবে না মনে করে মত পরিবর্তন করেন। কৌচের উপর বসবার সময় পেতর ইভানভিচের মনে পড়ে : ইভান ইলিচ কত পরিপাটি করে ঘরখানি সাজিয়েছিলেন এবং সবজে পাতাওলা এই গোলাপী চাদর কেনা সম্পর্কে তার পরামর্শ চেয়েছিলেন। ঘরময় আসবাবপত্র সাজান। সোফায় বসতে গিয়ে টেবিলের খোদাই করা কোণে বিধবার কাল শালের লেস আটকে যায়। খুলে দেবার জন্য পেতর ইভানভিচ উঠে পড়ে। তার ভারমুক্ত হয়ে কৌচের স্প্রিংও কেঁপে উঠে ঠেলা মারে। বিধবা নিজেই শাল খুলবার চেষ্টা করেন; ফলে বেয়াড়া স্পিংটা চেপে আবারও বসে পড়ে পেতর ইভানভিচ। আটকানি খুলতে বিধবার খানিকটা বিলম্ব হয়; তাই দেখে আবারও উঠে পড়ে পেতর ইভানভিচ। সঙ্গে সঙ্গে কৌচটা আবারও ফেঁপে কচমচ করে ওঠে। এই সব শেষ হয়ে গেলে ক্যামব্রিকের একখানা ধবধবে রুমাল বার করে মহিলাটি কাঁদতে শুরু করেন। শালের প্রসঙ্গ এবং কৌচের সঙ্গে সগ্রামের অভিজ্ঞতা পেতর ইভানভিচের ভাবাবেগ ঠাণ্ডা করে দেয়। বিষঃ গোমড়া মুখে সে চুপ করে বসে থাকে। ইভান ইলিচের বাটলার সকলভ এই বিচ্ছিরি অবস্থায় ব্যাঘাত জন্মায়। সে এসে সংবাদ দেয় : সমাধিক্ষেত্রে প্রাসকাভিয়া ফেদরভনা যে স্থানটি নির্বাচন করেছেন, তার দাম পড়বে দুশো রুবল। মহিলাটি কান্না বন্ধ করেন। অপরাধীর মত অসহায় দৃষ্টিতে ইভানভিচের দিকে চেয়ে ফরাসিতে বলেন, এত দাম দেওয়া তার পক্ষে কষ্টকর। পেতর ইভানভিচ নীরব ভঙ্গীতে পুরোপুরি সায় দেয়।

তখন খানিকটা উদারভাবে ভাঙাগলায় মহিলাটি বলেন : ধূমপান করুন না! তারপর সকলভের দিকে ফিরে কবরের জমির দাম নিয়ে আলোচনা করেন।

সিগারেট ধরিয়ে পেতর ইভানভিচ সমাধিক্ষেত্রের বিভিন্ন জমির দাম সম্পর্কে মহিলাটির ছাড়াছাড়া জিজ্ঞাসাবাদ কান পেতে শোনে। শেষ অবধি তিনি একখণ্ড জমি নির্বাচন করেন। এই সবের পর গায়কদল নিয়োগ করা সম্পর্কেও মহিলাটি নির্দেশ দেন। তারপর সকলভ ঘর থেকে চলে যায়।

–সব কিছুই আমি নিজেই দেখাশোনা করি। টেবিলের উপরকার জিনিসগুলো নাড়াচাড়া করে পেতর ইভানভিচকে বলেন মহিলাটি। ইভানভিচের সিগারেটের ছাই পড়ে টেবিলটা নোংরা হয়ে যাচ্ছে লক্ষ করে ছাই ফেলার পাত্রটি বাড়িয়ে দিতে দিতে বলেন : শোকের জন্য সংসারের কাজকর্ম দেখাশোনা করতে পারছি না একথা বলা আমি কপটতা বলে মনে করি। বরং ওর সব কিছু দেখাশোনা করতে পারলে সান্ত্বনা পাই বলব না, তবে আনমনা হতে পারি নিশ্চয়ই।

কান্নার উদ্যোগ করবার জন্য আবারও তিনি রুমাল বার করেন, কিন্তু সহসা যেন নিজেকে সংযত করে গা ঝাঁকুনি দেন এবং শান্তভাবে বলতে শুরু করেন : যাহোক, একটা বিষয়ে আপনার সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।

কৌচের স্প্রিংটা চেপে রেখে মাথা নোয়ায় পেতর ইভানভিচ। কিন্তু স্প্রিংটি সঙ্গে সঙ্গে তার নিচে মৃদু মৃদু দুলতে থাকে।

–গত দিন কয়েক খুবই কষ্ট পেয়েছেন!

–তাই কি? পেতর ইভানভিচ বলে।

–ওঃ! বেজায় কষ্ট পেয়েছেন। দুচার মিনিট নয়…ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটানা আর্তনাদ করেছেন। গত দিন তিনেক পলকের জন্যও আর্তনাদ থামেনি। সে আর্তনাদ কানে শোনা যায় না! কেমন করে যে সইলাম তা নিজেই বুঝে উঠতে পারি না। তিন চারখানা কামরার ওপাশ থেকেও কঁকানি শোনা যেত। ওঃ! কি কষ্টই যে সইতে হয়েছে!

–সব সময় ওর জ্ঞান ছিল কি? পেতর ইভানভিচ জিজ্ঞাসা করে।

–ছিল…শেষ মুহূর্ত অবধি ছিল। ফিসফিস করে বলেন তিনিঃ মরার মিনিট পনর আগে আমাদের সবারই কাছ থেকে বিদায় নেন এবং ভলদিয়াকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলেন।

ইভান ইলিচের সঙ্গে আবাল্য পরিচয় ইভানভিচের। শৈশবে একসঙ্গে খেলাধূলা করেছে…কৈশোরে একই স্কুলে পড়েছে…তারপর পরিণত বয়সে সহকর্মী হিসাবে কাজ করেছে। অন্তরঙ্গ পরিচিত সেই মানুষটির ক্লেশের কথা শুনে নিজের আর এই মহিলাটির কপটতা সত্ত্বেও সহসা ভয়ে অভিভূত হয়ে পড়ে পেতর ইভানভিচ। আবারও তার চোখের সামনে সেই ভুরু, সেই ওষ্ঠের উপর ঝুলে-পড়া নাক ভেসে ওঠে। নিজের জন্য কেমন ভয় ভয় করে।

মনে মনে ভাবে; পর পর তিনদিন ক্লেশ ভোগের পর মৃত্যু! সহসা যে কোন সময়ে আমারও এ অবস্থা হতে পারে তো!

পলকের জন্য সে ভীতি-বিহ্বল হয়ে পড়ে। কিন্তু অমনই তার মনে এই প্রচলিত চিন্তা জাগে : সে-অবস্থা হয়েছে ইভান ইলিচের…তার নয়! কেমন করে কথাটা যে মনে এল তা সে নিজেও জানে না। মনে হল, এ অবস্থা তার হবে …হতে পারে না। আর এই কথা ভাবার অর্থ : বিমর্ষতার কাছে আত্মসমর্পণ করা। সে কাজ কখনও করা উচিত নয়। সোয়ার্জের ভাব থেকে স্পষ্টই তা বোঝা যায়। এই চিন্তার পর পেতর ইভানভিচ খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করে এবং ইভান ইলিচের মৃত্যু-সংক্রান্ত খুঁটিনাটি খবর জানতে চায়। যেন মৃত্যুটা শুধু ইভান ইলিচের পক্ষেই একটা স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নিশ্চয়ই তার নিজের পক্ষে নয়!

ইভান ইলিচকে সত্যই যে বিভীষিকাময় দৈহিক ক্লেশ ভোগ করতে হয়েছে তার বিস্তারিত বিবরণ শুনিয়ে বিধবাটি আসল কাজের কথা পাড়তে চান। অবশ্য সেই মর্মান্তিক ক্লেশ প্রাসকভিয়া ফেদরভনার স্নায়ুর উপর যে মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করেছে, ইভানভিচ শুধু তারই বর্ণনা শুনতে পায়!

–ওঃ! বড় মর্মান্তিক পেতর ইভানভিচ! কত যে মর্মান্তিক তা বলে বোঝন যায় না।

আবারও কাঁদতে শুরু করেন মহিলাটি। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার নাক-ঝাড়া অবধি অপেক্ষা করে পেতর ইভানভিচ। নাক-ঝাড়ার পর মহিলাটি বলেন : বিশ্বাস করুন…। তারপর ফেদরভনা আবারও কথা বলতে শুরু করেন! এইবারে তিনি পেতর ইভানভিচের সঙ্গে আলোচনার আসল উদ্দেশ্য সম্পর্কে কথা পাড়েন; অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যু উপলক্ষে রাজকোষ থেকে সাহায্য আদায়ের পন্থার কথা জিজ্ঞাসা করেন। কথাটা তিনি এমনভাবে পাড়েন যাতে পেতর ইভানভিচের মনে হয় যেন তিনি তার পেনসন সম্পর্কে পরামর্শ চাইছেন। কিন্তু ইভানভিচ অবিলম্বেই বুঝতে পারে যে পেনসন সম্পর্কে সব কিছুই তার জানা…এমনকি তার নিজের চাইতেও মহিলাটি বেশি খোঁজ-খবর রাখেন। ভালভাবেই তিনি জানেন যে স্বামীর মৃত্যুর জন্য রাজকোষ থেকে কতটা তিনি আদায় করতে পারবেন। কিন্তু তার জিজ্ঞাসার অর্থ হচ্ছে, আরও বেশি কিছু আদায় করা সম্ভব কিনা। পেতর ইভানভিচ মনে মনে একটা উপায় বার করার চেষ্টা করে। খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবে সৌজন্যের খাতিরে সরকারি কৃপণতার নিন্দা করে জানায় যে অতিরিক্ত কিছু আদায় করা সম্ভব নয় বলেই তার ধারণা। মহিলাটি তখন দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন এবং অতিথিকে বিদায় করে দেবার ভব্য পন্থা বার করবার চেষ্টা করেন। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে পেতর ইভানভিচ সিগারেট নিভিয়ে ফেলে এবং উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাটির করতলে চাপ দিয়ে পাশের ঘরে চলে যায়।

খাবার ঘরে মস্ত বড় একটা ক্লক ছিল। ঘড়িটি ইভান ইলিচের শখের জিনিস। পুরনো দোকান থেকে কিনেছিলেন। এখানে ইভানভিচের সঙ্গে একজন পুরোহিত এবং জন কয়েক পরিচিতের দেখা হয়। উপাসনায় যোগ দেবার উদ্দেশ্যে এসেছে এরা। ইভান ইলিচের মেয়েকে চিনতে পারে ইভানভিচ। প্রিয়দর্শিনী তরুণী। কাল পোশাক পরে এসেছে মেয়েটি। এই পোশাকে তন্বীকে আরও ছিপছিপে দেখাচ্ছে। মেয়েটির মুখ ব্যঞ্জনা বিষণ্ণ, দৃঢ়তাব্যঞ্জক…কতকটা ক্ষুব্ধও বলা চলে। এমনভাবে সে পেতর ইভানভিচকে অভিবাদন জানায় যেন সে অপরাধী। তার পেছনে এক বিত্তবান সুদর্শন যুবক–তদন্তকারী ম্যাজিস্ট্রেট। তার মুখভঙ্গীও মেয়েটির মত ক্ষুব্ধ। যুবকটি প্তের ইভানভিচের চেনা…শুনেছে ও নাকি মেয়েটির প্রণয়ী। বিষণ্ণমুখে এদের প্রত্যভিবাদন জানিয়ে শব-গৃহে যাবার মুখে সিঁড়ির তলায় ইভান ইলিচের পুত্রকে দেখতে পায় ইভানভিচ। ছেলেটি স্কুলে পড়ে…দেখতে হুবহু বাপের মত। তাকে দেখে ছোটবেলার ইভান ইলিচের কথা মনে পড়ে। আইন কলেজে একসঙ্গে পড়বার সময় অবিকল এমনি দেখাত তাকে। তের-চৌদ্দ বছরের পাকা ছেলের অশ্রুসিক্ত মুখের মতই দেখাচ্ছে তার চোখের-জলে-ভেজা মুখখানা। পেতর ইভানভিচকে দেখে সসঙ্কোচে বিষণ্ণভাবে ভ্রুকুটি করে ওঠে ছেলেটি! ইভানভিচ তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে শব-গৃহে ঢুকে যায়। উপাসনা শুরু হয়। মোমের আলো, হা হুতাশ, ধুপের গন্ধ, চোখের জল আর ফোঁপানিতে ঘরখানি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। মুখ ভার করে নিজের পায়ের দিকে চেয়ে থাকে পেতর ইভানভিচ। ভুলেও সে মৃতলোকটির দিকে একবার ফিরে তাকায়নি, কিংবা বিষণ্ণতার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি। প্রথমে যারা ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে, সেও তাদের দলেই ছিল। লাগোয়া ঘরে কোন লোক ছিল না, কিন্তু গেরাসিম লম্বা পা ফেলে শব-গৃহ থেকে বেরিয়ে আসে এবং সবল দৃঢ় হাতে ফার কোইগুলো উলটে-পালটে ফেদর ইভানভিচেরটা বার করে তাকে পরিয়ে দেয়।

–বড়ই দুঃখের ব্যাপার, কি বল গেরাসিম, তাই না? একটা কিছু বলা উচিত বলেই বলে পেতর ইভানভিচ।

–ভগবান যা করেন তাই হবে একদিন সবাইকেই তো যেতে হবে! সেঁতো হাসি হেসে বলে গেরাসিম। সুন্দর সাদা ঝকঝকে দাঁতওলা স্বাস্থ্যবান চাষী লোকটি। জরুরি কাজে ব্যস্ত লোকের মত চটপট সে সামনের দরজা খুলে দেয় এবং কোচোয়ানকে ডেকে ইভানভিচকে শ্লেগায় চড়তে সাহায্য করে। পরক্ষণেই এমনভাবে লাফ দিয়ে বারান্দার ওঠে যেন পরবর্তী কাজের জন্য দেরি হচ্ছে।

ধূপ-দীপ, মৃতদেহ আর কার্বলিক এসিডের গন্ধের পর এই খোলা হাওয়া পেতর ইভানভিচের ভালই লাগে।

–কোথায় যাব স্যার? কোচোয়ান জিজ্ঞাসা করে।

-–এখনও খুব দেরি হয়নি…ফেদর ভাসিলিভিচের ওখানেই যাব।

সেইখানেই যায় ইভানভিচ। ওদের তখন প্রথম রাবার শেষ হয়ে এসেছে। কাজেই দলে ভিড়ে পড়তে অসুবিধা হল না।

.

নেহাৎ সরল, নিতান্ত আটপৌরে জীবন ইভান ইলিচের; তাই সে-জীবন বিভীষিকাময়।

ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন তিনি…মারা যান পঁয়তাল্লিশ বছরে। তার বাবাও রাজকর্মচারী ছিলেন। পেতরবুর্গের বিভিন্ন সরকারি বিভাগ আর মন্ত্রীদপ্তরে কাজ করে শেষ অবধি তিনি ফালতু অথচ আরামের একটি পদ যোগাড় করে নেন। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ এই সব কর্মচারী এমন এক কর্ম-জীবনের নজীর সৃষ্টি করেন যে দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের অযোগ্য বলে বিবেচিত হলেও দীর্ঘদিন চাকুরির জন্য এদের বরখাস্ত করা সম্ভব হয় না। সরকারি মহল এদের জন্য তখন বিশেষ পদ সৃষ্টি করে থাকে। সেই পদগুলি অর্থহীন হলেও তার মাইনে থাকে ছয় থেকে দশ হাজার রুবল পর্যন্ত। মাইনেটা কাল্পনিক নয় নিশ্চয়ই! আর এই মোটা মাইনে ভোগ করে এরা দীর্ঘ জীবন লাভ করেন।

এই হল প্রিভি কাউন্সিলের সদস্য আর বিভিন্ন অনাবশ্যক প্রতিষ্ঠানের ফালতু সদস্য ইলিয়া এপিমভিচ গলভিনের আসল পরিচয়।

তিন ছেলে ভদ্রলোকের। ইভান ইলিচ মেজ। বড় ছেলে ভিন্ন বিভাগে বাপের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। বর্তমানে তার চাকুরি যে অবস্থায় পৌঁছেছে তাতে সেও অনতিবিলম্বেই বাপের মত আরামের চাকরি পেয়ে যাবে। শ্রম করতে হবে না কিন্তু পারিশ্রমিক মিলবে মোটা। ছোট ছেলের জীবন ব্যর্থ। বিভিন্ন বিভাগে কাজ করে সে নিজের ভবিষ্যৎ উন্নতির আশা নষ্ট করেছে। এখন আছে রেল বিভাগে। বাপ-ভাইয়েরা তার সঙ্গে দেখা করতেও চায় না। বৌদিদের বিরক্তি আরও বেশি। দেখা na করা তবু ভাল, বাধ্য না হলে তার অস্তিত্বের কথাও এরা ভুলে থাকতে চায়। ভগিনীটি বিয়ে করেছে বাপেরই মত ব্যারন গ্রাফ নামে পেতরবুর্গের এক অফিসারকে। গোটা পরিবারের মধ্যে আলাদা ধাতের মানুষ ছিলেন ইভান ইলিচ। লোকে তাই বলত অবশ্য। বড় ভাইর মত নিষ্প্রাণ কিংবা কপট মিষ্টভাষীও তিনি নন, আবার ছোট ভাইর মত বেয়াড়াও ছিলেন না। বুদ্ধিমান সদালাপী মার্জিত রুচির প্রাণবন্ত অমায়িক লোক ছিলেন তিনি। ছোট ভাইর সঙ্গেই তিনি আইন কলেজে পড়েছেন; কিন্তু সে পাশ করতে পারেনি। পঞ্চম শ্রেণীতে থাকতেই স্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করে দেয়। ইভান ইলিচ অবশ্য ভালভাবেই পড়াশোনা শেষ করেন। আইনের ছাত্রাবস্থায় যা ছিলেন, বাকি জীবনেও ঠিক সেই মানুষটিই রয়ে গেছেন। যেমন যোগ্য তেমনি হাসিখুশি অমায়িক মিশুক লোক। তবে কর্তব্য বলে যা মনে করতেন সে-বিষয়ে বরাবর কঠোর ছিলেন। আর কর্তব্য সম্পর্কে তার ধারণা কর্তৃপক্ষীয়দের ধারণার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যেত। বাল্যে বা পরিণত বয়সে কোনদিন তিনি হীন তোষামুদে ছিলেন না। তবে পতঙ্গ যেমন আগুনের শিখার দিকে আকৃষ্ট হয়, তিনিও আবাল্য তেমনি ভাবে উঁচুতলার মানুষের প্রতি স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করতেন এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপন করে তাদের হালচাল আর দৃষ্টিভঙ্গী রপ্ত করে নিয়েছিলেন। বাল্য বা যৌবনের সমস্ত উৎসাহ আর আগ্রহ উত্তরজীবনে তার উপর বিশেষ কোন প্রভাব রেখে যেতে পারেনি। ভোগ, শিক্ষা আর অহমিকার কাছে আত্মসমর্পণ করেন ইভান ইলিচ। শেষ অবধি সর্বোচ্চ তলার মানুষের কাছে উদারনীতিক সাজতেন। কিন্তু নিজের সহজাত বুদ্ধি যেটুকু এখোন সমীচীন বলে প্রতিবারেই হুঁশিয়ার করে দিয়েছে সেই সীমা তিনি কখনও লংঘন করেননি।

স্কুলে এমন কতগুলো কাজ তিনি করেছেন আগে যা অতি জঘন্য বলে মনে হয়েছে। তখন এজন্য নিজের উপর বিরক্ত হত। কিন্তু পরিণত বয়সে গণ্যমান্য লোকেদের যখন সেই-সব কাজ করতে দেখেছেন, যখন বুঝতে পেরেছেন যে সেই কাজ করা তারা গহিত বলেও মনে করে না, তখন তাদের ঠিক সমর্থন করতে পারেননি। তবে হয় তাদের কথা মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলেছেন, না-হয় স্মরণ করতে চাননি।

আইন কলেজ থেকে স্নাতক উপাধি নিয়ে তিনি সিভিল সার্ভিসের দশম পর্যায়ে চাকরি লাভ করেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্তর কেনার টাকাটা বাবাই দিলেন। শারমারের অভিজাত দরজির দোকানে পোশাকের অর্ডার দিলেন ইভান ইলিচ। ঘড়ির চেনে ঝুলালেন নামাঙ্কিত এক মেডেল।…অধ্যাপক এবং কলেজের পৃষ্ঠপোষক প্রিন্সের কাছ থেকে বিদায় নিলেন। ডোনসের অভিজাত রেস্তোরাঁয় এক ভোজের আয়োজন করে সতীর্থেরা তাকে বিদায় সংবর্ধনা জানায়। তারপর সেরা দোকান থেকে কেনা জামা-পোশাক, বেশবাস, কামাবার আর প্রসাধনের জন্য হরেক রকম জিনিসপত্তর এবং রাগ কিনে তিনি দূরান্তের এক প্রদেশের অভিমুখে রওনা হলেন। বাপের প্রভাবে লাট-দপ্তরে বিশেষ কাজে নিযুক্ত হলেন ইভান ইলিচ।

অনতিবিলম্বেই চাকরিস্থলে ইভান ইলিচ এক সহজ শান্তিময় পরিবেশ সৃষ্টি করে ফেলেন। আইন কলেজে পড়বার সময়েও এই কৃতিত্ব তিনি দেখিয়েছেন। ঐকান্তিক আগ্রহে তিনি সরকারি কর্তব্য করে যান। ফলে কর্মজীবনে উন্নতির পথও পরিষ্কার হয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনেও সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিলাস-ব্যসন থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখেননি। মাঝে মাঝে মফঃস্বল সফরে যেতেন এবং সেখানে উপরওলা আর নিম্নপদস্থদের সঙ্গে নিজের পদোচিত সুষ্ঠু আচরণ করেছেন। যে যে কাজের ভার তার উপর অর্পণ করা হয়েছে, এমন অবিচল সততার সঙ্গে সুষ্ঠুভাবে সেই কর্তব্য তিনি করেছেন যে নিজে তার জন্য গর্ববোধ না করে পারতেন না।

তরুণ বয়স এবং খেলো বিলাস-ব্যসনের প্রতি আকর্ষণ সত্ত্বেও সরকারি কাজে তিনি মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর, নিয়মনিষ্ঠ–এমন কি বেশ খানিকটা কঠোর ছিলেন বলা যায়। কিন্তু সামাজিক ব্যাপারে বেশ সদালাপী সুরসিক এবং অমায়িক ছিলেন। এ ব্যাপারে তার আচার-আচরণ কখনও মার্জিত ভব্যতার সীমা লঙ্ঘন করেনি। স্বয়ং লাট সাহেব এবং লাট-পত্নী পর্যন্ত এজন্য তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতেন। তাকে এরা নিজেদের পরিবারভুক্ত বলেই গণ্য করতেন।

এখানে এক মহিলার সঙ্গে কিছুদিন তার মন-দেওয়া-নেওয়ার ব্যাপার চলে। মহিলাটিই এই মার্জিত তরুণ আইনজীবীর প্রতি আকৃষ্ট হয়। মহিলাদের এক টুপিওলাও জড়িত ছিল এই ব্যাপারে। তাছাড়া লাটসাহেবের পার্শ্বচরদের সঙ্গেও মাঝে মাঝে পান-ভোজনোৎসব চলত। রাত্রির খাওয়া-দাওয়ার পর কখন কখন তাকে সন্দেহজনক পাড়ায় ঘোরাফেরা করতে দেখা গিয়েছে। এ ছাড়া বড় কর্তা, এমন কি তার স্ত্রীর জন্যও দুচারটে হীন কাজ করতে না হয়েছে এমন নয়। তবু এই সব কিছু এমন সুরুচিসম্পন্ন মার্জিতভাবে করা হয়েছে যে কোন কুৎসিত নামেই তাকে অভিহিত করা যায় না। এর সব কিছুই একটা ফরাসি প্রবাদবাক্যের আওতায় পড়ে : বয়সকালে কিছু দোষ ত্রুটি থাকবেই। এর সব কিছু করা হয়েছে পরিচ্ছন্ন মনে, গায়ে বিন্দুমাত্র নোংরা না লাগিয়ে আর ফরাসি বুলি আউড়ে, এবং সর্বোপরি সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের সহযোগে! এ কাজ তাই গণ্যমান্যদের সমর্থনপুষ্ট।

এইভাবেই ইভান ইলিচের পাঁচ বছরের চাকরি-জীবন কেটে যায়। তারপর তার কর্মজীবনে পরিবর্তন আসে। নতুন বিচার-ব্যবস্থা পত্তন হল এ সময়ে। বিচার ব্যবস্থার এই সংস্কার কার্যকরী করার জন্য নতুন লোকের প্রয়োজন। ইভান ইলিচ এই নতুন লোকের একজন মনোনীত হলেন। তাকে বিচারক মাজিস্ট্রেটের পদ দিতে চাওয়া হয়। ভিন্ন প্রদেশে হলেও এই পদ তিনি গ্রহণ করলেন। পুরনো সম্পর্ক ছিন্ন করে তাই তাকে নতুন সম্পর্ক গড়ে তুলতে হয়। যাবার আগে বন্ধু-বান্ধবেরা বিদায় সংবর্ধনা জানাল। সবাই মিলে এক সাথে ফটো তোলা হল একখানা এবং ইভান ইলিচ একটা রূপোর সিগ্রেট-কেস উপহার পেলেন। তারপর তিনি নতুন পদে যোগ দিতে গেলেন।

বিচারক হিসাবে ইভান ইলিচ যেমন উপযুক্ত তেমনি ন্যায়পরায়ণ ছিলেন। তার আচরণও ছিল নেহাৎ জ্ঞ। সবাই তাকে শ্রদ্ধা করত। তাছাড়া সরকারি কর্তব্য থেকে নিজের ব্যক্তিগত জীবন বিচ্ছিন্ন রাখতেও তিনি জানতেন। স্পেশাল অফিসার থাকাকালেও এই বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ণ ছিল। কিন্তু বিচারক হিসাবে তার এখানকার কর্তব্য আগেকার কাজের চাইতে অনেক বেশি আকর্ষণীয়, ঢের উৎসাহজনক। আগেকার চাকরিতে শারমারের তৈরি উর্দি পরে আবেদনকারী আর লাটসাহেবের দর্শনপ্রার্থী অফিসারদের ভিড়ের মধ্য দিয়ে গটমট করে হেঁটে যাবার মধ্যে অবশ্যই আনন্দ ছিল। হাঁ-করে উৎসুক জনতা দেখত যে সহজ সচ্ছলভাবে হেঁটে তিনি কর্তার নিভৃত কক্ষে ঢুকে যেতেন এবং তার সঙ্গে বসে চা কি সিগ্রেট খেতেন। কিন্তু খুব বেশি লোক এই সময়ে তার উপর নির্ভরশীল ছিল না। শুধু পুলিশ অফিসার, আর বিশেষ কাজে সফরে বেরুলে বিশেষ বিশেষ ধর্ম-মতাবলম্বীরাই তার উপর নির্ভর করত। তবে এদের সঙ্গে তিনি ভদ্র ব্যবহার করতেন। প্রায় সাথীর মত আচরণ করতেন বলতে গেলে হয়তো তাদের বুঝিয়ে দিতেন যে দমন করার ক্ষমতা সত্ত্বেও সরল বন্ধুজনোচিত ব্যবহার করছেন। তবে এই রকম খুব সামান্য লোকই ছিল তখন। কিন্তু এখন ইভান ইলিচের মনে হয় : বিচারক হিসাবে পদমর্যাদা নির্বিশেষে সমস্ত লোক তার অধীন। একটা শিরোনামা দিয়ে এক টুকরো কাগজের উপর কয়েকটি ছত্র যদি তিনি লিখে দেন তবে যে কোন মানী কি আত্মতুষ্ট লোককে অভিযুক্ত কি সাক্ষী হিসাবে তার সামনে হাজির করা হবে। তিনি যদি বসতে না দেন তো তাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জবাব দিতে হবে। ক্ষমতার অপব্যবহার কোনদিন তিনি করেননি। বরং ক্ষমতার প্রয়োগ বরাবর মোলায়েম করবার চেষ্টা করেছেন। তবু তিনি যে ক্ষমতার অধিকারী এই অনুভূতি আর সেই ক্ষমতার প্রয়োগ মোলায়েম করার সম্ভাব্যতা তার কর্মজীবনের প্রধানতম আকর্ষণ। নিজের কাজে, বিশেষত জেরা-জবানবন্দীর ব্যাপারে অচিরেই তিনি এমন এক পন্থা অবলম্বন করেন যাতে মামলার আইন সংক্রান্ত বিষয়ের সঙ্গে অসংলগ্ন সমস্ত বিচার-বিবেচনা অবান্তর হয়ে পড়ত। তার ফলে নিতান্ত জটিল মামলাও কাগজে-কলমে শুধু আইনের ছকে-বাঁধা খসড়ার রূপ পেত। তার সঙ্গে কোথাও তিনি নিজের মতামত যুক্ত করতেন না। কিন্তু এই ব্যাপারে কখনও তিনি প্রতিটি আনুষ্ঠানিক রীতি প্রতিপালনে ভুল করেননি। কাজটি সম্পূর্ণ নতুন; আর ১৮৬১ সালের আইন* [*১৮৬১ সালে ভূমিদাস প্রথা লোপ করার পর রাশিয়ায় বিচার-ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন করা] প্রথম যারা কার্যকরী করেন ইভান ইলিচ তাদের অন্যতম।

নতুন শহরে বিচারকের পদ পেয়ে তিনি নতুন সম্পর্ক, নতুনতর পরিচয় গড়ে তোলেন। সম্পূর্ণ আলাদা ভিত্তির উপর গড়ে তোলেন নিজের জীবন। তাছাড়া তার মনোভাবও কতকটা বদলে যায়। প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষের সংস্রব থেকে সম্ভ্রমে নিজেকে কতকটা বিচ্ছিন্ন করে রাখতেন আর মেলামেশা করতেন শহরের বাছাই করা আইনজীবী আর বিত্তবান ভদ্রজনের সঙ্গে। সরকার সম্পর্কে ঈষৎ অসন্তোষের ভাবও প্রকাশ করতেন। কথাবার্তার ধরন ছিল উদারনীতি-গন্ধী আর বিদগ্ধ নাগরিক জীবনের সমর্থক। এই সঙ্গে প্রসাধনের পরিপাটি বিন্দুমাত্র লাঘব না করে তিনি কামানো বন্ধ করেন এবং গালে স্বাভাবিকভাবে দাড়ি গজাতে দেন।

এই নতুন শহরে বেশ সুখে-শান্তিতে বসবাস করেন ইভান ইলিচ। এখানকার উপরতলার মানুষ লাটসাহেবের বিরোধীপক্ষের অনুরাগী। তুব ইভান ইলিচের প্রতি তারা বন্ধুভাবাপন্ন। তার মাইনেও বেশ মোটা। কাজেই তিনি বিন্তি খেলা শুরু করেন। এ খেলায় তিনি কম আনন্দ পেতেন না। তাস খেলায় বেশ ওস্তাদ ছিলেন তিনি। তাছাড়া খেলতেনও খোসমেজাজে; আর ঠিকঠাক হিসাবও করতে পারতেন চটপট। কাজেই প্রায়শই তার জিত হত।

বছর দুয়েক এখানে বসবাস করার পর তিনি ভাবী স্ত্রী প্রাসকভিয়া ফেদরভনা মিখেলের সঙ্গে পরিচিত হন। সমাজের যে মহলে তিনি মেলামেশা করতেন, প্রাসকভিয়া ফেদরভনা সেখানকার মেয়েমহলের সেরা মেয়ে। সব চাইতে প্রিয়দর্শিনী, সুচতুরা আর বুদ্ধিমতী। সরকারি কাজের চাপের মধ্যে আমোদ প্রমোদের যতটুকু ফুরসৎ পাওয়া যেত তারই ফাঁকে প্রাসকভিয়ার সঙ্গে তিনি হালকা মধুর সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

স্পেশাল অফিসারের পদে নিযুক্ত থাকার সময় প্রায়শ তাকে নাচতে হত। কিন্তু এখন বিচারক হিসাবে নাচা না-নাচা তার ইচ্ছাধীন। এখন কোন সময় যদি নাচতেন তো এই কথাই হয়তো প্রতিপন্ন করতে চাইতেন যে তিনি সংস্কৃত নতুন শাসন ব্যবস্থার অধীনে চাকরি করছেন এবং সরকারি পদমর্যাদার দিক থেকে পঞ্চম পর্যায়ে উন্নীত হয়েছেন। তবে নাচের আসরে অধিকাংশ লোকের চাইতে ভাল নাচতে পারতেন ইভান ইলিচ। এইভাবে কোন কোন সান্ধ্য মজলিসের শেষে মাঝে মাঝে তিনি প্রাসকভিয়া ফেদরভনার সঙ্গে নাচতেন। আর এই নাচের সময়েই তরুণীকে তিনি মুগ্ধ করেন।

প্রাসকভিয়া তার প্রেমে পড়ে যায়। প্রথম দিকে বিয়ে করার কোন সুস্পষ্ট অভিপ্রায় ইভান ইলিচের ছিল না। কিন্তু মেয়েটি প্রেমে পড়েছে বুঝে মনে মনে ভাবেন : সত্যিইতো, বিয়ে করবই না বা কেন?

সদ্বংশের মেয়ে প্রাসকভিয়া ফেদরভনা। দেখতেও মন্দ নয়। তাছাড়া কিছু সম্পত্তিও ছিল। ইভান ইলিচ অবিশ্যি এর চাইতে ভাল স্ত্রী-লাভের আশা করতে পারতেন। কিন্তু এই সম্বন্ধও তো মন্দ নয়! নিজে মোটা মাইনে পান। প্রাসকভিয়ার সম্পত্তির আয়ও তার বেতনের সমান হবে বলে মনে হয়। ভাল ভাল ঘরের সঙ্গে কুটুম্বিতাও আছে। এ ছাড়া তরুণীর স্বভাবটি যেমন মধুর তেমনি মিষ্টি আচার আচরণ পুরোপুরি মার্জিত শিষ্টাচার সঙ্গত। কিন্তু প্রেমে পড়ে কিংবা জীবন সম্পর্কে প্রাসকভিয়ার ধারণা তার সমধর্মী বলে ইভান ইলিচ তাকে বিয়ে করেছেন, একথা বলা যায় না। আবার এও বলা যায় না যে বন্ধু-বান্ধব এই সম্বন্ধ অনুমোদন করে বলেই তিনি বিয়ে করেছেন। তবে দুটি জিনিস তার সিদ্ধান্ত বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছে : বিবাহে তিনি ব্যক্তিগত সন্তোষ লাভ করেন আর সেই সঙ্গে তার উপরওলা সহকর্মীরা তার বিয়ে-করা পুরোপুরি সমর্থন করেন।

কাজেই ইভান ইলিচের বিয়ে হয়ে গেল।

বিয়ের উদযোগ-আয়োজন, নতুন আসবাবপত্র, নতুন বাসনপত্তর, নতুন বেশবাস আর অনুরাগ রঞ্জিত যুগল-জীবনের সূচনা প্রথমে মধুময় লাগে। এই শুভ আরম্ভ থেকে ইভান ইলিচের মনে হয়, বিবাহিত জীবন তার আগেকার সহজ স্বচ্ছন্দ সামাজিক শিষ্টাচার-সম্মত আরাম-আয়াসের ভদ্র জীবন-ধারার কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করবে না। বরং হয়তো তার উন্নতিসাধন করবে। তার কাছে সেটাই স্বাভাবিক বলে মনে হয়েছে। স্ত্রী অন্তঃস্বত্ত্বা না হওয়া অবধি এই মনোভাবই ছিল। কিন্তু সে গর্ভবতী হবার প্রথম দু-এক মাসের মধ্যেই নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে নতুন এক অস্বস্তিকর নিরুৎসাহ-ভরা অশোভন পরিস্থিতি দেখা যায়। অথচ এই অবস্থা থেকে অব্যাহতি পাবার কোন উপায় ছিল না।

তখন ইভান ইলিচের মনে হয়েছে, গৃহিণী যেন অকারণে তাদের দাম্পত্য জীবনের আনন্দে ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। মহিলাটি অকারণে কোদুলে ভাব দেখাত, সব কিছুতেই দোষ ধরত আর মাঝে মাঝে চটেমটে অভদ্র অশোভন চেঁচামেচি করে বসত। তাছাড়াও সে আশা করত যে স্বামী অনন্যমনা হয়ে শুধু তার দিকেই নজর দেবে।

উপেক্ষা করে ইলিচ প্রথম এই অস্বস্তিকর অবস্থা এড়াতে চেয়েছেন। ভেবেছেন এতদিনকার সরল শিষ্টাচার সম্মত জীবনধারা বজায় রাখতে পারলে এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে অব্যাহতি পাওয়া যাবে। তাই স্ত্রী খিটখিটে মেজাজের প্রতি উপেক্ষার ভাব দেখিয়ে তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল জীবনযাপন করে গেছেন–তাস খেলার জন্য বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করেছেন নিজের বাড়িতে আবার নিজেও কখন কখন ক্লাবে কি বন্ধু-বান্ধবদের বাসায় গিয়ে সন্ধ্যা কাটিয়ে এসেছেন।

কিন্তু স্ত্রী অশিষ্টভাষায় জোরালোভাবে তাকে বেশ দুকথা শুনিয়ে দিত। এবং সেই থেকে যখনই তিনি তার দাবি-দাওয়া পূরণ না করতেন, তখনই এমন কড়াভাবে ঝগড়া করত যে ইভান ইলিচ হার স্বীকার না করা অবধি কোনমতেই তার জিদ নিরস্ত করা যেত না। তার মানে, তাকে বাড়ি থাকতে হত এবং বাধ্য হয়ে স্ত্রীর মতই বিরক্তিবোধ করতে হত। অবস্থা এমন দাঁড়াল যে ইভান ইলিচ শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। শেষ অবধি তিনি উপলব্ধি করলেন : বিয়ে করে, অন্তত প্রাসকভিয়া ফেদরভনার মত মেয়েকে বিয়ে করে জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের আশা করা বৃথা; এ ধরনের বিবাহ স্বাচ্ছন্দ্যভরা ভুদ্র জীবনে প্রায়শ ব্যাঘাত সৃষ্টি করে। কাজেই অবশ্যই তাকে এই হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে হবে। বস্তুত তার পথ বার করবার চেষ্টাও করলেন। একমাত্র তার সরকারি কর্তব্যের বিরুদ্ধেই প্রাসকভিয়া ফেদরভনা নীরব। তাই সরকারি কর্তব্য আর সেই সংক্রান্ত কাজ-কর্মের সাহায্যে নিজের স্বাধীনতা লাভের জন্য স্ত্রীর বিরোধিতা শুরু করলেন ইভান ইলিচ।

সন্তান জন্মাবার পর নবজাতককে খাওয়াবার চেষ্টা আর তার নানাবিধ অসুবিধা, সন্তান ও জননীর খাঁটি কি মানসিক অসুখ-বিসুখের অনুযোগ নতুন ঝামেলা সৃষ্টি করে। সব ব্যাপারেই ইভান ইলিচের সহানুভূতি দাবি করা হয়, অথচ নিজে তিনি এ বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। এই অবস্থায় পারিবারিক পরিবেশের বাইরে সময় কাটাবার প্রয়োজন আরও জরুরি হয়ে ওঠে।

স্ত্রীর স্বভাব যতই খিটখিটে আর কেঁদুলে হয়ে ওঠে ইভান ইলিচও ততই সরকারি কাজে ডুবে থাকার চেষ্টা করেন। ফলে চাকরির প্রতি টান বেড়ে যায় এবং আগের চাইতেও তিনি উচ্চাভিলাষী হয়ে ওঠেন।

বিয়ের বছর খানেকের মধ্যেই। ইভান ইলিচ উপলব্ধি করলেন যে বিবাহ .প্রকৃতই বড় জটিল এবং কঠিন জিনিস। অবশ্য তার মধ্যে খানিকটা আরাম যে নেই তাও নয়, তবু সামাজিক রীতি-সম্মত ভদ্র জীবনযাপন করতে হলে চাকরি-জীবনের মতই এই সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট একটা মনোভাব অবলম্বন করা আবশ্যক।

বিবাহিত জীবন সম্পর্কে এমনি একটা মনোভাবই অবলম্বন করলেন ইভান ইলিচ। সংসার থেকে মাত্র গুটিকয়েক সুবিধাই তিনি চাইতেন : বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার সুযোগ, গৃহিণী আর শয্যা। এর সব কিছুই তিনি পেতে পারেন। তাছাড়া সর্বোপরি চাই জনমত সমর্থিত শিষ্টাচারের বাহিক্য রূপ। বাকি আর সব কিছুর জন্য তিনি খেলো আমোদ-প্রমোেদ আর ভব্যতার খোঁজ করতেন। এবং তাই পেলে পরম তৃপ্তিবোধ করতেন। কিন্তু কোথাও যদি বিরোধিতা আর ঝগড়াটেপনার সম্মুখীন হতেন তো অমনিই সরকারি কাজের বেড়া-দেওয়া আলাদা জগতের মধ্যে আত্মগোপন করে থাকতেন আর তাতে আত্মতৃপ্তি লাভ করতেন।

সুযোগ্য অফিসার হিসাবে খ্যাতি ছিল ইভান ইলিচের। তিন বছর পরে তাকে সহকারী সরকারি কৌঁসুলির পদ দেওয়া হয়। এই নতুন কর্তব্য, তার গুরুত্ব, খুশিমত যে কোন লোককে সোপর্দ ও কারারুদ্ধ করার সম্ভাব্যতা, তার বক্তৃতার বহুল প্রচার আর এই সব ব্যাপারে কৃতকার্যতা পদটি আরও লোভনীয় করে তোলে।

আরও সন্তান জন্মায়। গৃহিণী ক্রমেই বেশি খিটখিটে, বেশি ঝগড়াটে হয়ে ওঠেন। কিন্তু পারিবারিক জীবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী থাকায় তার অনুযোগ বা গজগজানি ইভান ইলিচকে স্পর্শ করতে পারেনি।

এই শহরে সাত বছর চাকরি করার পর সরকারি কৌসুলি হিসাবে তাকে ভিন্ন। প্রদেশে বদলি করা হয়। সপরিবারে উঠে গেলেন ইভান ইলিচ; কিন্তু টাকার বড় অনটন পড়ে। তাছাড়া নতুন জায়গা স্ত্রীর পছন্দ হল না। মাইনে আরও বাড়ল বটে, কিন্তু জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে গেল তার চাইতেও বেশি। দুটি সন্তান আবার মারা যায়; ফলে পারিবাবিক জীবন আরও অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।

নতুন বাসায় যে কোন অসুবিধা ঘটলেই তার জন্য স্বামীকে দোষ দিতেন প্রাসকভিয়া ফেদরভনা। স্বামী-স্ত্রীর অধিকাংশ আলাপ, বিশেষত সে-আলাপ যদি ছেলে-মেয়ের শিক্ষা-প্রসঙ্গে হত তো তার খেই ধরে অনিবার্যভাবে তাদের পুরনো ঝগড়ার প্রসঙ্গ উঠত; আর সেই কলহ আবারও যে-কোন মুহূর্তে দপ করে জ্বলে উঠতে পারত। বিজলি চমকের মত কদাচিত আগেকার সেই মধুময় যুগলজীবন দেখা দিত বটে, কিন্তু দীর্ঘস্থায়ী হতে পারত না। ক্ষণিকের এই অভিজ্ঞতা যেন ছোট ছোট দ্বীপের মত। পলকের জন্য এখানে নোঙ্গর ফেলে আবার তারা ছদ্ম বিরোধিতার সংসার-সমুদ্রে পৃথকভাবে পাড়ি দিতেন। ইভান ইলিচ যদি ভাবতেন যে এই অবস্থা চলা উচিত নয় তাহলে অবিশ্যি এই নিঃসঙ্গতা তাকে ব্যথা দিত। কিন্তু এই পরিস্থিতি তিনি স্বাভাবিক বলে মেনে নিয়েছেন। এমনকি, তার কাছে এইটেই সাংসারিক জীবনের চরম পরিণতি। এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে নিজেকে যতটা সম্ভব মুক্ত রাখা আর সেগুলোকে একটা ভব্য উপেক্ষণীয় রূপ দেওয়া তার সাংসারিক জীবনের অন্যতম লক্ষ্য হয়ে পড়ে। পরিবারের সঙ্গে যথাসম্ভব কম সময় কাটিয়ে তিনি এই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতেন। বাধ্য হয়ে যদি কোন সময় বাড়ি থাকতে হত তো বাইরের দু-একজনকে সঙ্গে রেখে আত্মরক্ষা করতেন। আসল কথা হচ্ছে, সরকারি কাজ প্রচুর থাকত। এই চাকরি-জীবনকে কেন্দ্র করেই তার ব্যক্তিগত জীবন আবর্তিত হত। আর এই সরকারি কাজের মধ্যে নিজেকে তিনি ডুবিয়ে রাখতে পারতেন। যাকে খুশি ধ্বংস করে দিতে পারি–নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে এই সচেতনতা, পদমর্যাদার গুরুত্ব, এমনকি আদালতে ঢুকবার সময় তার চাল-চলনের কায়দা কিংবা উপরওলা কি অধস্তন কর্মচারিদের সঙ্গে সুগম্ভীর আলাপ আর সর্বোপরি সুষ্ঠুভাবে মামলা পরিচালনের কৃতিত্বে তিনি পরম আত্মপ্রসাদ লাভ করতেন। এর সঙ্গে ব্রিজ খেলা, নেমন্তন্ন আর সহকর্মিদের সঙ্গে খোস-গল্প নিয়েই তো তার জীবন। ইভান ইলিচ যা চেয়েছিলেন, এই সব কিছু মিলিয়ে বেশ আরামে ঠিক সেইভাবেই তার জীবন কেটে যায়।

আরও সাত বছর চলে এইভাবে। বড় মেয়েটির বয়স তখন মোল। আর একটি সন্তানও মারা যায়। একটি মাত্র ছেলে তখন বেঁচে। স্কুলে পড়ে। তাকে নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে বিরোধের অন্ত নেই। ইভান ইলিচ তাকে আইন পড়াতে চান। কিন্তু তার বিরোধিতা করার জন্যই যেন প্রাসকভিয়া ফেদরভনা ছেলেকে হাই স্কুলে পাঠালেন। মেয়েটি ঘরে বসে লেখা-পড়া শেখে। শিক্ষাও ভালই হয়। ছেলের শিক্ষাও মন্দ হল না।

বিয়ের পর এইভাবেই সতের বছর কেটে যায়। ইভান ইলিচ তখন বহুদিনের সরকারি কৌঁসুলি। ভাল একটা পদলাভের আশায় তিনি কয়েকটি বদলির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। এই সময় এক অপ্রত্যাশিত অস্বস্তিকর ঘটনা তার শান্তিময় জীবনধারা ওলট-পালট করে দিয়ে যায়। তিনি আশা করছিলেন যে বিশ্ববিদ্যালয় আছে এমনি কোন শহরে তাকে প্রধান বিচারক করে বদলি করা হবে। কিন্তু যেভাবেই, হোক হ্যাঁপে তাকে ডিঙিয়ে পদটি পায়। ইভান ইলিচ বেদম চটে যান। হ্যাঁপেকে ভর্ৎসনা করেন। এমনকি, হ্যাঁপে এবং তার নিজের উপরওয়ালার সঙ্গে ঝগড়াও করে বসেন। উপরওয়ালা এতে অসন্তুষ্ট হন। নতুন নিয়োগের সময় তার দাবি ফের উপেক্ষিত হল।

এ ১৮৮০ সালের কথা। বছরটি ইভান ইলিচের জীবনের কঠোরতম সময়। এই সময়েই স্পষ্ট ধরা পড়ে যে মাইনেতে সাংসারিক ব্যয় চলে না, আর কর্তৃপক্ষের কাছেও তিনি উপেক্ষিত। শুধু তাই নয়, নিজে যাকে নিষ্ঠুরতম অবিচার বলে মনে করতেন, অপরের দৃষ্টিতে তা অতি সাধারণ ঘটনা বলে গণ্য হত। এমনকি, তার বাবাও এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করা কর্তব্য বলে মনে করেননি। ইভান ইলিচের মনে হত যেন সবাই তাকে পরিত্যাগ করেছে। সবাই যেন তার বাৎসরিক সাড়ে তিন হাজার রুবল মাইনের চাকরিকে নিতান্ত স্বাভাবিক, এমনকি সৌভাগ্যের লক্ষণ বলে জ্ঞান করে। নিজের প্রতি অবিচারের সচেতনতা, স্ত্রীর ক্ষান্তিহীন অনুযোগ আর আয়ের অতিরিক্ত ব্যয়ের দরুন ধার-দেনার ফলে একলা তিনিই জানতেন যে তার সাংসারিক অবস্থা আদৌ স্বাভাবিক নয়।

* * *

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *