ছায়া কালো কালো

ছায়া কালো কালো

বিকট শব্দ তুলে ঝাঁকি খেয়ে থেমে গেল ট্রেন। আমি কামরার জানালা দিয়ে প্রায় সাঁঝ বেলার আবছা আঁধারে ঢাকা বাইরে উঁকি দিলাম। এটা কোন্ জায়গা?

ওক গ্রোভ, স্টেশনের ছাদে ঝাপসা সাইনবোর্ডটি পড়া গেল। আমি ক্লান্ত শ্বাস ছাড়লাম। তিনদিন ধরে ট্রেন জার্নি করছি। অবিরাম দুলুনি, পোড়া অঙ্গার আর জানালার পাশ দিয়ে ছুটে যাওয়া দৃশ্যাবলি দেখতে দেখতে বেজায় শ্রান্ত আমি। হঠাৎ একটি বুদ্ধি মাথায় এল। আইল ধরে এগোলাম কন্ডাক্টরের দিকে। সে এক বৃদ্ধাকে ট্রেন থেকে নামতে সাহায্য করছে।

এখানে ট্রেন থামবে কতক্ষণ? জিজ্ঞেস করলাম তাকে।

মিনিট দশেক, ম্যাম, বলল সে।

আমি ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম। পা রাখলাম স্টেশনের সামনের নরম বালুতে। আবার শক্ত জমিনে হাঁটতে কী যে ভাল লাগছে! শীতের সুশীতল বাতাস টেনে নিলাম বুক ভরে। পা বাড়ালাম স্টেশনের বাইরে। একটু হাঁটাহাঁটি করব। এক ঝলক হাওয়া এসে আমার স্কার্টে বাড়ি খেল, চুল উড়িয়ে মুখে ফেলল। আমি অলস চোখে ওক গ্রোভের চারপাশে নজর বুলালাম। একেবারেই গতানুগতিক ধরনের ছোট শহর। হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন ছেড়ে খানিকটা দূরে চলে এলাম। ইতিমধ্যে বার দুয়েক চোখ বুলিয়ে নিয়েছি ঘড়িতে। দশমিনিট হুট করে পার না হয়ে যায় সে ভয়ে আছি। এমন সময় দেখি দুটো কুকুর একটা বিড়াল ছানার ওপর হামলা করেছে।

আমি ছুটে গেলাম ওদিকে। ছানাটাকে ওদের কবল থেকে ছাড়িয়ে নিতে কসরত করতে হলো। কামড় এবং আঁচড়ও খেতে হলো। তবে বাচ্চাটাকে উদ্ধার করে একটা দোকানের দরজার ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। আর ঠিক সেই মুহূর্তে কানে ভেসে এল ট্রেনের হুইশলের শব্দ। আমি ছুট দিলাম স্টেশনে। কিন্তু অকুস্থলে পৌঁছে দেখি সাদা ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ঝিকঝিক শব্দে আমার ট্রেন নাগালের বাইরে চলে গেছে। এখন আর ছুটেও ওটাকে ধরতে পারব না।

এখন কী করি? ইস, কেন যে মরতে এই অভিশপ্ত স্টেশনে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিলাম। হাত পায়ে খিল ধরে গিয়েছিল বলেই ট্রেন থেকে অচেনা অজানা জায়গায় নামতে হবে? আমার লাগেজসহ সবকিছু রয়ে গেছে রাতের আঁধারে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া রেলগাড়িতে। সঙ্গে পার্স ছাড়া কিছুই নেই। আর আমি একা পড়ে আছি এই খুদে শহরে যাকে অজ পাড়া গাঁ বললেই মানায়। এ শহরের নামই তো জীবনে শুনিনি।

নাকি শুনেছি? ওক গ্রোভ…. কেমন চেনা চেনা লাগছে নামটি। ওক গ্রোভ… ওহ! মনে পড়েছে! কলেজে আমার যে রুমমেট ছিল তার বাড়ি ছিল ওক গ্রোভ নামে একটি শহরে। আমি স্টেশন মাস্টারের ঘরে পা বাড়ালাম।

এখানে কি মিস মেরি অ্যালিসন থাকেন? জিজ্ঞেস করলাম তাকে। মেরি ডিয়ানে অ্যালিসন?

বুড়ো আমার দিকে কেন অনেকক্ষণ অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল বোধগম্য হলো না। দীর্ঘ বিরতির পরে সে আমার প্রশ্নের জবাব দিল। জি, ম্যাম, ধীরে ধীরে, ইতস্তত গলায় বলল সে। আপনি তার আত্মীয় নাকি?

না, হাসলাম আমি। আমরা একসঙ্গে কলেজে পড়তাম। ভাবছি… আজ রাতটা ওর বাড়িতে গিয়ে থাকব। আমি… এমন বোকা ট্রেনটা মিস করেছি…

আপনি, আবারও দ্বিধা বুড়োর গলায়, এখানে কোনো হোটেলে থাকতে পারেন। এখানে একটাই হোটেল আছে। মে ফেয়ার।

ভুরুতে ভাঁজ পড়ল আমার। বুড়োর কথা শুনে মনে হচ্ছে সে যেন চায় আমার বান্ধবীর বাড়িতে গিয়ে উঠি। অবশ্য মফস্বল শহরে অনাহুত অতিথিদের আকস্মিক আগমন অনেকেই খুব একটা আন্তরিকভাবে মেনে নেয় না শুনেছি। কিন্তু আমি তো যেতে চাইছি আমার বান্ধবীর বাসায়। তাতে এ বুড়োর সমস্যা কী? আমি স্টেশন মাস্টারের দিকে শীতল চোখে তাকালাম।

আপনি পারলে ওর ঠিকানাটা বলে দিন, কঠিন গলায় বললাম আমি।

বুড়ো ঠিকানাটা বলল। তবে অনিচ্ছাসত্ত্বে।

শহরের শেষ প্রান্তে, বড় সাদা বাড়িটাতে মেরি অ্যালিসনের নিবাস, বলা হয়েছে আমাকে। ওর সঙ্গে শেষ যেবার দেখা হয়েছিল সেই স্মৃতি মনে পড়ছে। মেরি ছিল হাসিখুশি, আন্তরিক স্বভাবের মেয়ে। পরিবার অন্তপ্রাণ। ও একবার ওর বাড়ি, বাবামা এবং ভাইয়ের একটা ছবি দেখিয়েছিল। তাদের চেহারা এখন অবশ্য মনে নেই। আমার প্রাক্তন রুমমেট ও বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘদিন পরে দেখা হচ্ছে, সেই আগ্রহে আমার হাঁটার গতি বেড়ে গেল।

.

অবশেষে খুঁজে পেলাম বাড়িটি। লম্বা লম্বা থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন কলোনিয়াল ম্যানসনটি। বিশাল। তবে ঝোঁপঝাড়, আগাছা এবং প্রকান্ড প্রকান্ড সাদা ওক গাছ রাস্তা থেকে প্রায় ঢেকে রেখেছে প্রাসাদোপম বাড়িটি, যেন লুকিয়ে আছে বাকি জগৎ থেকে। বাড়িটির প্রচুর সংস্কার দরকার, সেইসঙ্গে বাগানেরও। দেখে মনে হচ্ছে এক সময় বাগানের চেহারা সুন্দরই ছিল। এখন লম্বা লম্বা ঘাস আর আগাছায় বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা।

আমি শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটির সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম ওপরে। দরজার হাতলে পিতলের ভারী কড়া লাগানো। তিন বার কড়া নাড়ার পরে অতিকায় দরজাটি সামান্য খুলে গেল। আমার কলেজের বান্ধবীটি দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রইল। আমার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে কোনো কথা নাবলে। আমি হেসে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম হাত। সে আস্তে আস্তে আমার হাতখানা ধরল। তার চেহারা আগের মতোই আছে, শুধু সর্বদা চঞ্চল ঝকঝকে নীল চোখজোড়ায় সেই স্বতঃস্ফূর্ততা উধাও, কেমন স্বরাচ্ছন্ন। চাউনি। ওর আচরণেও কেমন একটা পরিবর্তন চলে এসেছে লক্ষ করলাম। ছটফটে মেয়েটা কেমন ঝিম মেরে গেছে। অস্বাভাবিক চুপচাপ। আমার দিকে অনেকক্ষণ কুয়াশাচ্ছন্ন চোখে চেয়ে থাকল নিরবে। তারপর খুব আস্তে আস্তে, অবাক গলায় বলল, লিজ! লিজ! আমার আঙুলগুলো শক্ত মুঠোয় চেপে ধরল যেন ভয় পাচ্ছে আমি অকস্মাৎ উধাও হয়ে যাব। তোমাকে… তোমাকে দেখে খুব ভাল লাগছে। ঈশ্বর! কীভাবে… পথ চিনে এখানে এলে?

আমি আসলে ট্রেন মিস করেছি। মানে হাওয়া খেতে নেমেছিলাম। স্টেশনে ফিরে দেখি চলে গেছে ট্রেন। বললাম আমি। তবে ট্রেন মিস করে ভালোই করেছি… আমার হঠাৎ মনে পড়ল তুমি এখানেই থাকো। তাই চলে এলাম।

আমার দিকে কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল মেরি হাতটা ধরে রেখে। আর কাল সকাল দশটার আগে আটলান্টা যাওয়ার কোনো ট্রেন নেই, একটু ইতস্তত গলায় যোগ করলাম আমি, তারপর হেসে উঠলাম। আমাকে ভেতরে আসতে বলবে না!

ও হ্যাঁ.. অবশ্যই। অস্বাভাবিক গলায় বলল মেরি। যেন আমাকে ঘরে আসতে বলার বিষয়টিই তার মাথায় ছিল না। এসো!

প্রকাণ্ড হলঘরে প্রবেশ করলাম আমি। মেরির উদ্ভট আচরণ আমাকে অবাকই করেছে। কলেজে সে ছিল আমার প্রিয় বান্ধবী, তাহলে কেন এমন আড়ষ্টতা? ওর আচরণ দেখে মনে হয়েছে বাড়িতে ঢুকতে চাওয়ায় সে মহা বিব্রত, যেন আমি একজন অচেনা মানুষ, অন্য গ্রহ থেকে এসেছি! হয়তো আমার অপ্রত্যাশিত আগমন ওকে বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে, নিজেকে বোঝাতে চাইলাম। কিন্তু ব্যাখ্যাটি মেনে নিল না আমার জন্য।

তোমাদের বাড়িটি পুরানো হলেও ভারী সুন্দর! ওকে সহজ করে তুলতে স্বতঃস্ফূর্ততা ফোঁটালাম কণ্ঠে। তবে অস্বাভাবিক নিরব বাড়িটি আমাকে একটু অস্বস্তিতেই ফেলে দিল। মুখ থেকে ফস করে বেরিয়ে এল, এত বড় বাড়িতে তুমি নিশ্চয় একা থাক না?

আমার দিকে এমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকাল মেরি যার অর্থ ঠাহর হলো না। খুবই নিচু গলায়, আমার শুনতে বেশ বেগ পেতেই হলো, বলল, আরে না!

হেসে উঠলাম আমি। তা তো বটেই! বোকার মতো হয়ে গেল প্রশ্নটা। তা অন্যরা সবাই কই?

আমি মাথা থেকে খুলে নিলাম হ্যাট। চারপাশে চোখ বুলালাম। আসবাবগুলো শতাব্দী প্রাচীন, দেয়ালে একটা ঝাড়বাতিদান আছে, তাতে কয়েকটি মোম জ্বলছে। ওই মোমের আলোটুকুই ভরসা। বৈদ্যুতিক কোনো বাতির ব্যবস্থাই নেই। মোমের আলো গাঢ় ছায়া ফেলেছে দেয়ালে- দপদপ করছে, নড়ছে। যেন জ্যান্ত। এসব দৃশ্য দেখে গা ছমছম করার কথা কিন্তু পুরানো বাড়িটির সর্বত্র একটা শান্তি ছড়িয়ে আছে যেন। তবে একই সঙ্গে বড় রহস্যময়ও লাগল। মনে হলো অন্ধকার কোণগুলো থেকে অদৃশ্য চোখ দেখছে আমাদেরকে।

সবাই কোথায়? শুয়ে পড়েছে? আবার করলাম প্রশ্নটি প্রথমবারে ও শুনতে পায়নি ভেবে।

ওরা আছে এখানেই, সেই অদ্ভুত ফিসফিসে গলায় জবাব দিল মেরি যেন জোরে কথা বললে ঘুমন্ত কেউ জেগে যাবে।

ও যেদিকে ইঙ্গিত করেছে সেদিকে তাকালাম। এবং চমকে উঠলাম সামান্য। ঘরে যখন ঢুকি ছোট এ দলটিকে লক্ষই করিনি! ওরা মোমবাতির আলো থেকে খানিকটা দূরে, প্রায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে গাদাগাদি করে । স্থির। নির্নিমেষ চাউনি।

আমি হেসে মেরির দিকে তাকালাম। সে মৃদু বাতাস বয়ে যাওয়ার মতো নরম গলায় বলল, আমার মা… ।

আমি হাত বাড়িয়ে এগিয়ে গেলাম সামনে লম্বা চেহারার ভদ্রমহিলাটির দিকে। তিনি ছায়া থেকে বেরিয়ে এক কদম বাড়লেন। আমার বাড়ানো হাতখানা দেখেও যেন দেখলেন না, তার মুখে ফুটল অপূর্ব হাসি এবং মেরির মতো নিচু গলায় বললেন, আমার মেয়ের বান্ধবী হিসেবে তোমাকে সুস্বাগতম!

আমি চোখের কোন দিয়ে এতক্ষণ লক্ষ করছিলাম মেরিকে। মনে হলো তার মায়ের কথা শুনে সে যেন স্বস্তি পেল, চেহারা থেকে দূর হয়ে গেল আড়ষ্টতা।

আমার বাবা, মেরির কণ্ঠে এবারে আশ্চর্য সুখি সুখি ভাব। বছর চল্লিশের লম্বা-চওড়া, ভারিক্কি চেহারার এক ভদ্রলোক আমার দিকে এগিয়ে এলেন ঠোঁটে ভদ্রতার হাসি নিয়ে। তিনিও আমার বাড়ানো হাতখানা অগ্রাহ্য করলেন তবে অত্যন্ত আন্তরিক গলায় বললেন, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, সোনা। মেরি মাঝেমধ্যেই তোমার কথা বলে।

মেরি এবার বলল, এ হলো ললানি… ওকে ছবিতে দেখেছিলে, মনে আছে?

ছবিতে যে সুদর্শন তরুণটিকে দেখেছিলাম সে হাসিমুখে সামনে বাড়ল।

এই তাহলে লিজ! বলল সে। তোমার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ইচ্ছে ছিল অনেকদিন যে মেয়ে কিনা ইঁদুর ধরতে ভয় পায় না.. মনে পড়ে? মেরি বলেছে তুমি একবার জ্যান্ত ইঁদুর রেখে দিয়েছিলে তোমাদের প্রফেসরের ডেস্কে। হাসি হাসি মুখ করে সে কথা বললেও ফিসফিস করছিল বলে আমার কাছে একটু বেখাপ্লাই লাগছিল। এবং লক্ষ করলাম আমিও ওদের সঙ্গে গলা নামিয়ে কথা বলতে শুরু করেছি। এদের কারও মধ্যেই আন্ত রিকতার অভাব নেই তবু কেন সকলে এমন অস্বাভাবিক চুপচাপ। তবে সবচেয়ে অবাক হলাম মেরির ফিসফাস শুনে অথচ ও কলেজে থাকতে সবসময় উচ্চস্বরে কথা বলত, ঘর ফাটিয়ে হাসত।

ও বেটি, বলল মেরি। অদ্ভুত একটা আনন্দের আভা জ্বলজ্বল করছে। চেহারায়।

বছর বারোর এক বালিকা ছায়া থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে এসে ভদ্রতাসূচক সৌজন্য দেখাল।

আর ও বিল, বলল মেরি। গোলগাল চেহারার একটি বাচ্চা তার বোনের পেছন থেকে উঁকি দিয়ে খিলখিল করে হাসতে লাগল। তবে জোরে নয়, আস্তে।

কী সুন্দর বাচ্চা! বললাম আমি।

বাচ্চাটি বেটির পেছন থেকে বেরিয়ে এসে মাথাটা একদিকে কাত করে বড় বড় নীল চোখ মেলে আমাকে দেখতে লাগল। আমি ওর কোঁকড়া চুলে ভরা মাথাটায় আদর করে হাত বুলাতে যেতেই সে ঝট করে পিছিয়ে গেল। যেন অপরিচিত মানুষের স্পর্শ পেতে অভ্যস্ত নয়। আমি অবশ্য অবাক হলাম না। অচেনা লোকদের দেখলে বাচ্চারা এরকম করেই থাকে। তবে ওকে আর আদর করার চেষ্টা করলাম না।

.

ওদের সঙ্গে খানিক কথা বলেই পরিবারটিকে বেশ ভালো লেগে গেল আমার। মেরি জিজ্ঞেস করল আমি আমার রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে নেব কিনা। তারপর ও রাতের খাবারের জন্য ডাকবে। আমি মেরির পিছু পিছু সিঁড়ি বেয়ে উঠে এলাম দোতলায়। একটা জিনিস লক্ষ করেছি মেরি ছাড়া তার পরিবারের অন্য সকল সদস্যের শরীর স্বাস্থ্য বড্ড খারাপ। ওর বাবা থেকে শুরু করে ছোট ভাই পর্যন্ত সবার গায়ের রঙ ফ্যাকাশে, যেন প্রবল রক্তশূন্যতায় ভুগছে। হয়তো আমার চোখের দেখার ভুলও হতে পারে। মোমের স্বল্প আলোয় ওদের গায়ের ত্বক খড়িমাটির মতো লেগেছে।

আটটায় ডিনার, মেরি হেসে বলল আমাকে। তারপর চলে গেল আমাকে হাত মুখ ধুয়ে তাজা হওয়ার সুযোগ দিয়ে।

তবে আটটার একটু আগেই আমি নেমে এলাম নিচতলায়। দেখি হলঘরে কেউ নেই। নারীসুলভ কৌতূহলে একটি প্রকাণ্ড আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেয়াল জোড়া আয়না। আমার পেছনের হলঘরের পুরো ছবি প্রতিফলিত হচ্ছে। মোমবাতির আলো পড়েছে কাঁচে। আয়নায় নিজেকে একটু ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে নিলাম। তারপর পেছন ফিরে তাকাতেই দেখি বিল দাঁড়িয়ে আছে ওখানে। বড় বড় নিষ্পাপ চোখ জোড়া ঝিকমিক করছে।

হাই, ওর দিকে তাকিয়ে হাসলাম আমি। কেমন লাগছে আমাকে বলো তো? আমি আয়নার দিকে ফিরলাম এবং দারুণ চমকে উঠলাম।

বিরাট কাঁচের আয়নায় নিজেকে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি আমি, হলঘরের অনেকখানি অংশেরও প্রতিফলন ঘটেছে ওখানে। কিন্তু বাচ্চাটাকে দেখা যাচ্ছে না আয়নায়! আমার গা শিরশির করে উঠল। পেছন ফিরে তাকালাম। ওই তো দাঁড়িয়ে আছে ও আগের জায়গায়। এবারে আয়নায় তাকালাম। না, বিল নেই। আয়না জুড়ে শুধু আমি! এটা আয়নার কোনো কারসাজি নয় তো? ভাবলাম আমি। তাই হবে। কারণ পেছন ফিরলেই বাচ্চাটাকে দেখতে পাচ্ছি আর আয়নায় তাকালে সে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এটা আয়নার কারসাজি ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে না। হয়তো এরকম মজা দেখতেই বিশেষভাবে তৈরি করা হয়েছে এ আয়না।

তবে আয়নার কারসাজি নিয়ে বেশিক্ষণ মাথা ঘামানো বা চমকানোর সুযোগ হলো না মেরি ডিনার খেতে ডাক দেয়ার কারণে। আমি বিলের দিকে হাত বাড়ালাম ওকে নিয়ে ডাইনিংরুমে যাব বলে। কিন্তু বিল দুষ্ট হেসে আমার হাত ধরল না। ছুট দিল ডাইনিংরুমে।

.

রান্না চমৎকার হয়েছে। পরিবারটির সঙ্গে গল্পগুজবও হলো বেশ। তবে ওরা সবাই আগের মতোই নিচু গলায় কথা বলে গেল।

খাবার পরিবেশন করল মেরি। রান্না ঘর থেকে ছুটে ছুটে জিনিসপত্র নিয়ে আসতে লাগল। ওদের হয়তো আর্থিক সংকট চলছে তাই কাজের

নোক রাখতে পারেনি, ভাবলাম আমি। আমি বেশিরভাগ কথা বললাম। লোনি এবং মেরির সঙ্গে। বাচ্চাটা এবং বেটি আনন্দচিত্তে আমাদের গল্প শুনতে লাগল। মেরির বাবা-মা মাঝে মধ্যে আমাদের আড্ডায় অংশ নিলেন দুএকটা মন্তব্য করে।

মেরি খাবার দাবার রান্না ঘর থেকে নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গেই বসে পড়েছিল খেতে। তবে খাবার যা খাওয়ার আমি আর সে-ই খেলাম। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা খাবার প্রায় মুখেই তুলল না। বেশ কয়েকবার কাঁটা চামচে খাবার গেঁথে নিয়ে ঠোঁটে তুললেও পরে আবার তা আলগোছে নামিয়ে রাখল প্লেটে। খাওয়ার নামে আসলে তারা ভান করছিল। এমনকী বাচ্চাটা পর্যন্ত থালায় হাত ডুবিয়ে বসে আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল আর মাঝে মধ্যে মজার দুএকটা কথা শুনে খিলখিল হাসল।

খাওয়া শেষে আমরা লাইব্রেরি ঘরে গেলাম। মেরির সঙ্গে চলল কলেজ জীবনের স্মৃতিচারণ। মি. অ্যালিসন এবং তাঁর স্ত্রী বই পড়লেন, মাঝেমধ্যে আমাদের আলোচনায় অংশ নিলেন। হাসলেন। একে অন্যের দিকে তাকিয়ে চোখ টিপলেন। লোনি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়েছে, বেটি বসেছে তার চেয়ারের হাতলের ওপর, আমাদের কলেজের দুএকটা বোকামোর গল্প শুনে হাসিতে কুটিপাটি হলো। তবে জোরে হাসল না, বলাবাহুল্য।

রাত এগারোটার দিকে আমাকে বারবার হাই তুলতে দেখে মেরি তাড়া লাগাল ঘুমাতে যাওয়ার জন্য। আমি বাধ্যগতের মতো শুয়ে পড়লাম বিছানায়। বেডসাইড টেবিলে একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিল মেরি। একটা বই পড়তে লাগলাম। ঘুমানোর আগে বই না পড়লে ঘুম আসে না আমার।

.

বই পড়তে পড়তে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। হঠাৎ ঝাঁকি খেয়ে জেগে গেলাম। দেখি মোমবাতি তখনও জ্বলছে। আমি ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে পড়ার প্রস্তুতি নিতে যাচ্ছিলাম, এমন সময় একটা হালকা শব্দ আমার ঝিমুনিটাকে পুরোপুরি দূর করে দিল।

কেউ আমার দরজার হাতল ধরে ঘোরাচ্ছে। শব্দটা ওখান থেকে এসেছে।

আমি চট করে বিছানায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুমের ভান করলাম। যদিও সামান্য চোখ ফাঁক করে দেখছি কী ঘটছে।

আস্তে খুলে গেল দরজা। মিসেস অ্যালিসন ঢুকলেন ঘরে। কোনোরকম শব্দ না করে চলে এলেন আমার শিয়র পাশে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন আমার দিকে। আমি চোখ বুজে ফেললাম শক্ত করে যাতে চোখ পিটপট না করে। তবে একটু পরে চোখের পর্দা সামান্য ফাঁক করে দেখি তিনি দরজার দিকে এগোচ্ছেন। আমি গভীর ঘুমে বিভোর ভেবে সন্তুষ্ট। ভাবলাম উনি কামরা থেকে বেরিয়ে যাবেন কিন্তু তিনি দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং হলঘরে কাউকে যেন ইশারা করলেন ভেতরে আসতে।

মন্থর গতিতে এবং অবিশ্বাস্য নিঃশব্দে পা টিপে টিপে আমার ঘরে ঢুকলেন মি. অ্যালিসন, লোনি, বেটি এবং বাচ্চা। ওঁরা আমার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে এমন ব্যাকুলভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন যে আমার মায়াই লাগল।

ইচ্ছে করছিল চোখ মেলে তাকাই এবং জিজ্ঞেস করি ওরা এত রাতে কেন আমাকে দেখতে এসেছেন। তবে চুপটি করে থাকাই ভালো মনে করলাম। দেখি ওঁরা কী বলেন। মধ্যরাতের এ অনুপ্রবেশ কিন্তু আমার ভেতরে কোনো ভীতির সঞ্চার করল না। বরং আমি আশ্চর্য শান্তি এবং নিরাপত্তা অনুভব করছিলাম, মনে হচ্ছিল সদাশয় দেবদূতেরা আমাকে পাহারা দিয়ে রাখছেন।

ওঁরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলেন কোনো কথা না বলে। তারপর কিশোরীটি আমার দিকে ঝুঁকে এল, লেপের ওপর রাখা আমরা হাতে হাত বুলিয়ে দিল। সেই স্পর্শে আমি ভয়ানক চমকে গেলেও বহু কষ্টে নিয়ন্ত্রণে রাখলাম নিজেকে।

মেয়েটির হাত ভয়ানক ঠান্ডা- তার হাত শুধু শীতলই নয়, মনে হচ্ছিল তার গোটা অবয়ব থেকে বরফ ঠান্ডা একটা বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে। যেন কেউ আমার গায়ে কনকনে নিঃশ্বাস ফেলছে। তার হাত এক মুহূর্তের জন্য আমার গায়ে ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল কোনো ওজনই নেই ওই ভয়ানক। ঠান্ডা হাতে!

তারপর ওঁরা সবাই, মুখে স্নেহ ও ভালোবাসার হাসি, কোনো কথা না বলে এক লাইনে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন খোলা দরজা দিয়ে। ওঁরা কেন এলেন, কী উদ্দেশ্যে কিছুই বোধগম্য হচ্ছিল না আমার। ওদের রহস্যময় আগমনের কারণ ভাবতে ভাবতে কখন নিদ্রাদেবীর কোলে চলে গিয়েছি। জানি না।

.

পরদিন সকালে আমার রুমেই নাশতা নিয়ে এল মেরি। আমি খাচ্ছি, ও গল্প করতে লাগল। আমি ধীরে সুস্থে পোশাক পরে নিলাম। দশটার ট্রেন ধরব। ট্রেন ছাড়ার সময় কাছিয়ে এলে মেরিকে জিজ্ঞেস করলাম ওর পরিবারের লোকজন কোথায় কারণ গত রাতের পর তাদের কাউকে কাছে পিঠে দেখতে পাইনি। আমার মুখে ওর বাবা-মা-ভাই-বোনের প্রশংসা শুনে আনন্দে উদ্ভাসিত হলো মেরির চেহারা। তবে আমার পরের কথাটি শুনে উজ্জল আভাটুকু ম্লান হয়ে গেল। আমি কিন্তু কিছুই বলিনি। শুধু বলেছি যাওয়ার আগে ওদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।

সেই অদ্ভুত, দুর্বোধ্য ভাবটা আবার ফিরে এল মেরির চেহারায়। ওরা.. চলে গেছে। টেনে টেনে ফিসফিস করে বলল ও। আমি ওর দিকে হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে আছি দেখে যোগ করল, মানে… ওরা নেই। রাতের আগে… আর ফিরছে না। শেষ কথাটা এমন আস্তে উচ্চারণ করল প্রায় শোনাই যায় না।

কী আর করা। মেরিকে বললাম আমার হয়ে সে যেন তার পরিবারের সদস্যদের ধন্যবাদ এবং বিদায় শুভেচ্ছা জানিয়ে দেয়। মেরিকে দেখে মনে হলো না ও আমাকে রেল স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছে দেবে। কাজেই একাই রওনা হতে হলো। স্টেশনে পৌঁছে দেখি ট্রেন লেট। আমি টিকেট কেটে স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে খেজুরে আলাপ জুড়ে দিলাম সময় কাটাতে।

মিস অ্যালিসনের পরিবারটি খুব চমৎকার, তাই না? বললাম আমি। সবাই সবার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ।

স্টেশন মাস্টার আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে রইল যেন আমি পাগল হয়ে গেছি। তার বলিরেখায় ভরা মুখখানা হঠাৎ কাগজের মতো সাদা হয়ে গেল।

আপনি ওখানে কাল রাত্তিরে ছিলেন? ব্যাঙের গলায় বলল সে।

ছিলাম তো! বললাম আমি। বুড়োর আচরণে যারপরনাই বিস্মিত। কেন থাকব না?

এবং…. আপনি… ওদেরকে দেখেছেন? তার গলার স্বর ঝপ করে নেমে এল।

মেরির পরিবারের কথা বলছেন? লোকটার প্রশ্নে এবার বিরক্তই। হলাম। অবশ্যই দেখেছি! এতে অবাক হওয়ার কী আছে? কেন, ওদের কোনো সমস্যা আছে?

আমার আগুয়ান ট্রেনের হুইশল শোনা গেল দূর থেকে। তবে আমি বুড়োর জবাব না শুনে নড়ছি না। স্টেশন মাস্টার অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে গতকালের মতো অনিচ্ছাসত্ত্বে এবং দ্বিধাগ্রস্ত গলায় জবাব দিল।

ওরা সবাই গত বছর মারা গেছে। ফিসফিস করল সে, ঝুঁকে এল আমার সামনে, বিস্ফারিত চোখ। প্রত্যেকে–গুটি বসন্তে ধ্বংস হয়ে গেছে পরিবারটি –শুধু মেরি ছাড়া!

–মেরি এলিজাবেথ কাউন্সেলম্যান

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *