মুণ্ডহীন প্রেত

মুণ্ডহীন প্রেত

এক

ভৌতিক এ কাহিনির পটভূমি আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগে, আমেরিকার হাডসন নদীর তীরে এক প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামটির নাম স্লিপি হলো। যে সময়ের কথা বলছি তখন উনিশ শতকের মধ্যভাগ, কয়েক বছর আগে আমেরিকায় গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটেছে। যুদ্ধে অংশ নেয়া কয়েকজন সৈনিক প্রাণের দায়ে পালিয়ে এসে স্লিপি হলোতে আশ্রয় নিয়েছিল।

এ গাঁয়ের প্রায় সকলেই কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। ওই সময়ে অবস্থাপন্ন কৃষকরা তাদের বাগানে আপেল চাষও করতেন। গ্রামে একটি স্কুল আছে। আছে চমৎকার একটি গির্জা। এ গির্জাটির একটি ইতিহাস রয়েছে। শোনা যায়, তিনশ বছর আগে গির্জাটি তৈরি করে এক কুখ্যাত ডাচ জলদস্যু গনজালেস। এ গির্জায় প্রতি রোববার গাঁয়ের খ্রিষ্টান সম্প্রদায় প্রার্থনা করতে যায়, সেখানে নবীন গায়কদের ছোট একটি দল নিয়ে প্রার্থনা সংগীত পরিবেশনা করে গাঁয়ের লজিং মাস্টার রাফায়েল হেরন। তবে তার কথা এখন নয়, পরে।

স্লিপিহলোতে শীতকালে যখন বেশ বৃষ্টি-বাদল হতো, ঝড় গোঁ গোঁ করে গোঙাত, এসব রহস্যময় রাতগুলোতে এ গাঁয়ের লোকেরা চুলোর আগুনের সামনে জড়ো হয়ে গল্প করত এক রহস্যময় ব্যক্তিকে নিয়ে। তাকে আশেপাশের অনেকেই নাকি ঘোড়ার পিঠে চড়ে বেড়াতে দেখেছে।

লোকটা এক অশ্বারোহী হোসিয়ান সৈনিক, বলল একজন।

যুদ্ধে মাথা হারিয়েছে সে। কামানের গোলায় উড়ে গেছে মুন্ডু,

লোকটা আসলে ভূত, শিউরে ওঠে আরেকজন। এ গাঁয়ের ভূতেদের রাজা।

লোকটা আসলে কে বা কী জানে না কেউ। যদিও মধ্যরাতে চাষাভুষোদের অনেকেই দেখেছে কালো রঙের মস্ত একটা ঘোড়ার পিঠে চেপে বিশালদেহী ভয়ংকর একটি মূর্তি নিস্তবদ্ধতা ভেঙে খটখটিয়ে চলেছে গাঁয়ের একমাত্র : পাকা রাস্তা দিয়ে।

লোকটার মুন্ডুহীন ধড় কবর দেয়া হয়েছে গির্জায়, জানায় একজন সে এসব খবর ভালোই রাখে। রাতের বেলা বেরিয়ে পড়ে যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। সে ভাবে এখানেই যুদ্ধ হয়েছিল। মাথামোটা আর কাকে বলে। যুদ্ধক্ষেত্রে যায় নিজের কাটা মুণ্ডুর খোঁজে। ভোর রাতে রাস্তায় বেরুলে দেখবে ঘোড়সওয়ার তীরবেগে ছুটে চলেছে। সকাল হওয়ার আগেই তাকে ফিরে যেতে হয় কবরে।

ভুতুড়ে ঘোড়সওয়ার নিয়ে এসব গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনছিল রাফায়েল হেরন। সে এ গাঁয়ের স্কুলে মাষ্টারি করে। ভূত-প্রেতে তার প্রবল আগ্রহ। এ বিষয়ে পড়াশোনাও আছে প্রচুর।

বক পাখির সাথে রাফায়েল হেরনের চেহারার বেশ একটা মিল আছে। এ জন্যেই বোধ করি তার পদবি হেরন। সে খুব লম্বা, রোগা, টিংটিঙে হাতে-পা, হাত জোড়া হাঁটু ছাড়িয়েছে, চওড়া পায়ের পাতা কোদালের মতো। হাড্ডিসার লম্বা ঘাড়টার ওপরে বসানো ছোট একটি মাথা। হেরনের কান দুটো বিরাট, নাকটা এমনই লম্বা এবং খাড়া, খাম্বার কথা মনে করিয়ে দেয়। কেউ কেউ ঠাট্টা করে বলে রাফায়েলকে দেখলে নাকি শস্য ক্ষেতের কাকতাড়ুয়ার কথা মনে পড়ে যায়।

স্লিপিহলোকে বলা হয় এ অঞ্চলের সবচেয়ে শান্তিময় জায়গা। নদীর তীরে এটি একটি ছবির মতো গ্রাম। নদীর ধারে জঙ্গল আছে, এদিক সেদিক ছড়ানো ছিটানো পাহাড়সদৃশ টিলাও রয়েছে। এমন নির্জন, সুনসান আর স্বপ্নময় এলাকা খুব কমই চোখে পড়ে। কারো কারো ধারণা, এক ডাচ ডাক্তার, সে ডাকিনি চর্চা করত, অনেক দিন আগে এখানে নাকি জাদু করে গেছে। আবার কারও মতে, এক রেড ইন্ডিয়ান ওঝা জাদু করেছে এখানে।

এটা একটা ভূতুড়ে জায়গা, এক রাতে রাফায়েল হেরনকে ফিসফিস করে বলল বুড়ো এক চাষা। এ অঞ্চলে অগণিত উল্কাপাতের ঘটনা ঘটে, তারা খসে পড়ে। এদিকে দুঃস্বপ্নকে হার মানানো এমন সব ঘটনা আছে যা রাতের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট।

দিনের বেলা অবশ্য ভূত-প্রেত নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই হেরনের। সে তখন তার স্কুল নিয়ে ব্যস্ত। তার স্কুলে একটি মাত্র ঘর। স্কুল ঘরের পাশ দিয়ে যাবার সময় শোনা যায় ছাত্ররা উঁচু গলায় ABCD পড়ছে। আবার কখনো শপাং শপাং ঘা মারার শব্দ ভেসে আসে। শিক্ষক তার অবাধ্য, ছাত্রকে ধরে পিটাচ্ছে।

তবে হেরন একান্ত বাধ্য না হলে ছাত্র পেটায় না। ছাত্র যদি বেজায় দুর্বল হয় আর শিক্ষকের হাতের বেত দেখে ভয়ে কেঁদে ওঠে ভ্যা করে, মন নরম হয়ে যায় তার। ছাত্রকে চোখ রাঙিয়ে, দুএকটা কড়া কথা শুনিয়ে ছেড়ে দেয়। তবে পাজির পা ঝাড়া দুএকটা ছাত্রকে ধরে পেটাতেই হয়। বেত মারার পরে হেরন যুক্তি দেখায় প্রহার করা হয়েছে ছাত্রের মঙ্গলের জন্যেই।

হেরন তার ছাত্রদেরকে পছন্দ করে। স্কুল ছুটির পর তাকে দেখা যায় ছাত্রদেরকে নিয়ে মেতে উঠেছে খেলায়। ছোটদেরকে সে বাড়িও পৌঁছে দেয়, বিশেষ করে সে ছাত্রদের বড় বোন যদি সুন্দরী হয় কিংবা মা ভালো রান্না করতে পারে।

হেরন তার ছাত্রের পরিবারের সঙ্গে সবসময় সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলে। এছাড়া উপায়ও নেই। কারণ বেতন এত কম পায় যে তা দিয়ে তিন বেলা পেট চালানো কষ্ট।

আজকের ডিনারে কী থাকছে? প্রথমেই এ প্রশ্নটা করবে হেরন। রোগা পটকা হলে কী হবে, অজগর সাপের মতোই পেটুক সে। প্রচুর খেতে পারে।

হেরন একেক সপ্তাহে একেক পরিবারে থাকে। লজিং মাস্টার আর কী! বছরব্যাপী সারা গায়ে প্রতিটি পরিবারে আতিথ্য গ্রহণ করা হয়ে যায় তার। তার সঙ্গে মালপত্তরও বেশি নেই। একটা লাঠির ডগায় বড় একটা গামছার মধ্যে বাঁধা থাকে হেরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।

ওই সব দিনে চাষাভুষোরা ছেলেমেয়েদেরকে স্কুলে পাঠাতে চাইত না। পড়াশোনা কিছু হয় না। মাস্টাররা খালি নাক ডেকে ঘুমায়। তবে হেরন যে অলস প্রকৃতির শিক্ষক নয় তা বোঝাতে সে যেসব বাড়িতে লজিং থাকত, তাদেরকে নানা কাজে সাহায্য করত। চাষীদের সাথে মিলে মাঠ থেকে খড় তুলে আনত হেরন, বেড়া বাঁধতে সাহায্য করত, ঘোড়াগুলোকে দানাপানি খাওয়াত, মাঠে গরু নিয়ে যেত চড়াতে, শীতের জ্বালানির জন্যে বন থেকে কাঠ কেটেও আনত।

বাচ্চা ভেড়াগুলোর দেখাশোনা আমিই করতে পারি, বলত সে ছাত্রদের মায়েদেরকে। সে এক বাচ্চাকে হাঁটুর ওপরে বসিয়ে রেখে একই সঙ্গে আরেক বাচ্চার দোলনায় দোল দিয়ে যেত পা দিয়ে।

হেরন খুব পছন্দ করত শীতের রাতে মালসার সামনে বসে চাষী। বউদের কাছে ভূতের গল্প শুনতে। উল বুনতে বুনতে কিংবা মালসার আগুনে মিষ্টি আলু পোড়াতে পোড়াতে চাষী বউরা ভূত-প্রেতদের গল্প বলত।

ওই মাঠটা কিন্তু ভুতুড়ে, মন্তব্য করত একজন।

ওই সেতুর নিচে একজন ভূত থাকে, বলত আরেকজন। নিজের চোখে ভূতটাকে দেখেছি আমি।

হেরন নিজেও ভূতের গল্প জানত। ডাকিনি চর্চার ওপরে প্রচুর বই পড়েছে সে। মাঝে মাঝে এসব গল্প বলে সে। উল্কাপাত কিংবা আকাশ থেকে তারা ছিটকে পড়া যে অশুভ লক্ষণ, বলে চমকে দিত চাষাদেরকে। পৃথিবী বনবন করে ঘুরছে শুনে তারা সবাই ভয় পায়।

চুলোর ধারে বসে এসব গল্প বলার মজাই আলাদা। চুলোয় আগুন জ্বলছে, মাঝে মাঝে বন্দুকের গুলির আওয়াজ করে ফেটে যাচ্ছে কাঠ, দেয়ালে আলো আঁধারির খেলা। ভূতের গল্প বলার বা শোনার এরকম মোক্ষম পরিবেশ আর হয় না।

তবে ভূতের গল্প শোনার পর বাড়ি ফেরাটা একটু মুশকিলই হয়ে যায় ভীতু স্কুল মাস্টারের জন্যে। তার মাথায় তখন গিজগিজ করছে শত রাজ্যের ভৌতিক কাহিনী। শীতের এক সন্ধ্যায় একা রাস্তা দিয়ে হাঁটার সময় মনে হয় পিছু নিয়েছে ভয়ঙ্কর আকৃতির ছায়ামূর্তি। দূরে কোনো বাড়ির জানালায়

ভাগ, আমার কাছ থেকে দূর হ! চেঁচিয়ে ওঠে হেরন। যেটাকে ভূত ভেবে সে ভয় পাচ্ছিল ওটা আসলে বড় একটি ঝোঁপ ছাড়া কিছু নয়।

কী ওটা? আপন মনে ফিসফিস করে হেরন। রাস্তার ওপর দিয়ে হাঁটছে সে, জুতোর মচমচ শব্দ ছাপিয়ে মনে হয় আরেকটা কিসের যেন আওয়াজ শুনছে।

এমনই ভয় পেয়ে যায়, হেরন পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখার সাহসটুকু পর্যন্ত নেই। ভাবে ঘুরলেই দেখবে কেউ পিছু নিয়েছে তার। অবশ্য হেরনের সবচেয়ে ভয় একজনকে, চাষী বউরা যার নাম দিয়েছে স্লিপিহলোর মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার।

মাঝে মাঝে, যখন অনেক রাত হয়ে যায় বাড়ি ফিরতে, অন্ধকার মাঠ ধরে হাঁটছে হেরন, হঠাৎ শুনতে পায় শোঁ শোঁ আওয়াজ উঠেছে গাছে, দমকা একটা হাওয়া যেন ডালপালা ভেঙেচুরে ছুটে যায়।

ওটা বাতাস ছাড়া কিছু নয়, নিজেকে অভয় দেয় হেরন। কিন্তু মন তাতে মানে না, জানে ওটা বাতাস নয়, ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেছে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার!

দুই

স্কুলে পড়ানো আর যে বাড়িতে লজিং থাকে তাদের গৃহস্থালির কাজে খুঁটিনাটি সাহায্য করার পাশাপাশি রাফায়েল হেরন গানও শেখায়। প্রতিবেশী গ্রামের তরুণ-তরুণীদের গান শিখিয়ে দুপয়সা আয় রোজগার হচ্ছে তার।

প্রতি রোববার অত্যন্ত গর্বের সাথে শিক্ষানবিশ গায়কদের ছোট দলটিকে নিয়ে গির্জায় যায় হেরন। সেখানে প্রার্থনা সঙ্গীত পরিবেশন করে। তার কণ্ঠের জোর ছাপিয়ে যায় সবাইকে। আধ মাইল দূর থেকেও হেরনের গানের গলা শোনা যায়। যদিও কেউ কেউ তার কণ্ঠ নিয়ে ঠাট্টা করে। বলে রাফায়েল হেরনের গলার এমনই জোর পুরানো গির্জাতেও তার গানের সুর প্রতিধ্বনি তোলে।

শিক্ষিত হেরন তার রুচি এবং জ্ঞান নিয়ে গর্বিত, মূর্খ চাষাদের সমালোচনা সে হোড়াই গ্রাহ্য করে। পাশের গ্রামের মেয়ে ও মহিলা মহলে তার রয়েছে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা। ওই গ্রামে গেলে তারা হেরনকে নানান রকম পিঠা আর মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করে।

রোববার গির্জা থেকে সোজা পাশের গায়ে চলে যায় হেরন। যাবার পথে রাস্তার ধারের বৈঁচি গাছে ফুটে থাকা টক-মিষ্টি স্বাদের এই ফলগুলো দিয়ে পকেট বোঝাই করে। মেয়েদেরকে খেতে দেয় ওই বৈঁচি ফল। সমাধি স্তম্ভের কবরে লেখা বিভিন্ন এপিটাফ মুখস্থ শোনায় ওদেরকে। গম্ভীর গলায় বলে, এখানে শুয়ে আছে আমার স্ত্রী। ওকে ঘুমুতে দাও। ও শান্তিতে আছে। আমিও। হেরনের বলার ভঙ্গিতে মেয়েরা হেসে কুটিপাটি।

হেরন মেয়েদেরকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে গাঁয়ের পশ্চিমে দীঘিসম মস্ত পুকুরটার ধারে, দূর থেকে ওদের পেছন নেয় অশিক্ষিত, ভিরু গ্রামবাসী। এসব তরুণ স্বভাবে লাজুক, মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস নেই। তারা ঈর্ষা নিয়ে দেখে পাশের গায়ের হেরন কত সহজে তাদের গ্রামের মেয়েদের সঙ্গে মিশছে, কথা বলছে।

মহিলাদের চোখে হেরন মস্ত শিক্ষিত পুরুষ। সে ওদেরকে পড়ে শোনায় ডাকিনি চর্চার ইতিহাস। তার প্রিয় বিষয় হলো ডাইনি, পিশাচ, কালো ঘোড়া ইত্যাদি। এসবে গভীর বিশ্বাস হেরনের। অতিপ্রাকৃত গল্প পড়তে ভালোবাসে বলে স্লিপিহলোর ভূত-প্রেত নিয়েও তার আগ্রহের কমতি নেই। গল্প যত উদ্ভট এবং গা ছমছমে হবে, উত্তেজনা ততই বাড়বে হেরনের।

স্কুল ছুটির পরে নদীর ধারে আসে হেরন। শুয়ে শুয়ে গোগ্রাসে গিলতে থাকে ভৌতিক গল্প-উপন্যাস। পড়তে পড়তে ঘনিয়ে আসে সন্ধ্যা। প্রকৃতির প্রতিটি শব্দ তার উত্তেজিত মনে রোমাঞ্চ জাগিয়ে তোলে। ভেসে আসা পাখির ডাক, গেছো ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ, পেঁচার তীক্ষ্ণ চিৎকার এমনকি ঝোঁপের মধ্যে পাখির ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজেও ঘাড়ের পেছনের চুল সরসর করে দাঁড়িয়ে যায় হেরনের।

জোনাকি পোকা ভীত করে তোলে তাকে। অন্ধকারে গুবড়ে পোকা গায়ে পড়লে আঁতকে উঠে দশ হাত দূরে ছিটকে যায় হেরন, যেন ডাইনি থাবা বসিয়েছে শরীরে। ভয় তাড়াতে প্রার্থনা সংগীত গাইতে থাকে তার স্বরে। তার বিশ্বাস, ধর্মীয় গান শুনলে ভূত-প্রেত ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে পারে না।

ওই যে রাফায়েল হেরন যায়। রাতের বেলা আগুনের ধারে বসে চাষা বলে তার বউকে, গান গাইছে শুনতে পাচ্ছ?

হেরনের যত ভয় আর আতঙ্ক রাতকে ঘিরে, দিনের বেলা তার মতো সাহসী কেউ হয় না। তবে ভূতুড়ে কল্পনার জগৎ নিয়ে বেশ আছে সে।

তিন

মিস জুলিয়া অগাস্টিন, রাফায়েল হেরন বলল এক সন্ধ্যায়। আজ চমৎকার গান করেছেন আপনি। দারুণ উন্নতি হচ্ছে আপনার।

হেরন তার ছোট গানের দলটির সাপ্তাহিক সংগীত শিক্ষার আসর শেষ করেছে কিছুক্ষণ আগে। যে তরুণীকে উদ্দেশ্য করে সে কথাগুলো বলেছে, সেই মিস জুলিয়া অগাস্টিন গভীর দৃষ্টিতে তাকাল হেরনের দিকে।

ধন্যবাদ, মি. হেরন, বলল মেয়েটি। আপনার খুব দয়া। ভারী মিষ্টি করে হাসল সে। জবাবে হেরনও মধুর হাসল।

আপনার বাবা-মাকে আমার শুভেচ্ছা জানাবেন, মেয়েটি বাড়ির পথ ধরলে তাকে বলল হেরন।

অবশ্যই, বলল তরুণী, আপনি আমাদের বাড়িতে এলে বাবা-মা খুব খুশি হবেন।

একথা শুনে বার কয়েক ঢোক গিলল স্কুল মাস্টার। খুশিতে উদ্ভাসিত চেহারা। জুলিয়াকে যতক্ষণ দেখা গেল রাস্তায়, তাকিয়ে রইল তার দিকে। মেয়েটি মোড় ঘুরে অদৃশ্য হয়ে যেতে হেরন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জুলিয়া।

জুলিয়া অগাস্টিন ওই অঞ্চলের সবচেয়ে ধনী কৃষকের একমাত্র কন্যা। সে তিতির পাখির মতো কমনীয়, তার নরম গোলাপী গাল জোড়া রসালো পীচ ফলের মতো টসটসে। তার রূপের কথা ছড়িয়ে পড়েছে আশপাশের দুদশ গ্রামে। জুলিয়ার বাপের প্রচুর পয়সা। উত্তরাধিকারসূত্রে সে-ই সমস্ত ধন-সম্পত্তির মালিক হবে একদিন।

তবে হেরনের মতো আর কেউ জুলিয়াকে রঙিন গ্লাসের চশমা দিয়ে দেখার সাহস করে না।

জুলিয়াকে গাঁয়ের অনেক চাষী বউ পছন্দ করে না তার কাপড় চোপড়ের ধরনের জন্য। জুলিয়ার পিতামহী নাতনীকে সোনার গহনা বসানো অত্যন্ত দামী একটি জামা কিনে দিয়েছেন। তবে স্কার্টটি বেজায় খাটো। ওই সময় এত খাটো স্কার্ট কোনো মেয়ে পরত না। স্কার্ট জুলিয়ার সুন্দর পা। জোড়া উন্মুক্ত করে রাখে। এটা অনেকের দৃষ্টিতে অশোভন।

প্রতিটি মেয়ের জন্য হৃদয়ের কোণে মমতা জড়িয়ে আছে হেরনের। কাজেই জুলিয়ার মতো সুন্দরী মেয়ের জন্য যে তার অন্তর ব্যাকুল হবে তা অতি স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষ করে জুলিয়া ধনী পরিবারের মেয়ে ও সুন্দরী বলে। তাই সে একদিন গেল ও বাড়িতে।

আসুন, মাস্টার সাহেব, হেরনকে দেখে সাদর আমন্ত্রণ জানালেন বৃদ্ধ রজার অগাস্টিন, জুলিয়া আপনার কথা অনেক বলেছে। জুলিয়ার বাবা আন্তরিকভাবে পিঠ চাপড়ে দিলেন হেরনের।

ও ব-বলেছে? বিড়বিড় করল হেরন। ও তো আমার সবচেয়ে প্রতিভাবান ছাত্রী। ওর কণ্ঠ দোয়েল পাখির মতো।

জুলিয়া বলেছে আপনার মতো স্মার্ট যুবক সে দ্বিতীয়টি দেখে নি, জানালেন রজার অগাস্টিন।

তাই নাকি? শুনে খুব খুশি হেরন।

রজার হেরনকে তার খামারবাড়ি ঘুরে দেখার অনুমতি দিলেন। শ্ৰীমন্ত নদীর আধমাইল দক্ষিণে, চমৎকার একটি জায়গায় খামার বাড়িটি। গোলাঘরটি গির্জার মতোই প্রকাণ্ড, খড়ের গাদা আর শস্য ভর্তি। গোলাঘরের ছাদে বসে মনের সুখে বাকবাকুম করে চলছে অনেকগুলো পায়রা। মোটাসোটা ছাগলগুলো অলস ভঙ্গিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে খোয়াড়ে। সবুজ মাঠে দাঁড়িয়ে ঘাস খাচ্ছে হৃষ্টপুষ্ট একপাল লাল-সাদা এবং মেটে রঙের গরু। পুকুরে সাঁতার কাটছে ধবধবে সাদা রাজহাঁস আর পাতিহাঁসের দল। বড়সড় আকারের মুরগিগুলো মাটিতে পোকা খুঁটে খাচ্ছে। নধরকান্তি একটি ঝুঁটিঅলা মস্ত লাল মোরগ নজর কেড়ে নিল হেরনের। গর্বিত ভঙ্গিতে বার কয়েক ডানা ঝাঁপটাল ওটা। তারপর নখ দিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করল। পোকা খাবে।

কী দারুণ খামার আপনার! হেরন বলল জুলিয়ার বাবাকে।

এখানকার বাসিন্দারাও দারুণ! বোঝাই যায় এদের খুব যত্নআত্তি করেন আপনি।

আসলে খামারের বাসিন্দাদের দেখে জিভে জল এসে গেছে হেরনের। চোখের সামনে ভাসছে গরুর মাংসের ঝোল আর বনমোরগের রোস্ট।

ঠিকই বলেছেন আপনি, বললেন খামারবাড়ির গর্বিত মালিক রজার অগাস্টিন, দেখার চোখ আছে আপনার স্বীকার করতেই হয়। বাড়ি চলুন। আমার স্ত্রী আপনার সাথে সাক্ষাৎ করার জন্যে অপেক্ষা করছেন।

রজার অগাস্টিনের বাড়ির প্রতিটি কোণা থেকে উপচে পড়ছে প্রাচুর্য। বাড়ির বাইরে বড় বড় মাছ ধরার জাল ঝুলছে, বিরাট বস্তাভর্তি উল, সুতা কাটার জন্যে প্রস্তুত।

এটা আমাদের সবচেয়ে ভালো বৈঠকখানা, হেরনকে বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন মিসেস রজার অগাস্টিন। পালিশ করা কাঠের টেবিল আয়নার মতো চকচকে। কোণায় একটি কাঠের আলমারি। ওটার পাল্লা খুললেন ভদ্র মহিলা। ভেতরে রূপার তৈরী প্রচুর তৈজসপত্র। রজার অগাস্টিনের পরিবারের কাছ থেকে যখন বিদায় নিয়ে বাড়ির পথ ধরল হেরন, মনের চোখে দেখতে শুরু করেছে এই দিগন্তবিস্তৃত শস্যের মাঠ, ফলের বাগান ইত্যাদি সবকিছু একদিন তার হবে।

কে জানে, আপন মনে বলছে হেরন। একদিন হয়তো আমি সবকিছু বিক্রি করে টাকাটা নিয়ে আমেরিকা চলে যাব, ওখানে বিনিয়োগ করব । শুনেছি আজকাল ওই দেশে গেলে নাকি ফিরে যায় ভাগ্য।

ভবিষ্যৎ এখনই দেখতে পাচ্ছে হেরন। দেখছে সে আর রূপসী জুলিয়া মাল সামাল বোঝাই ওয়াগন নিয়ে আমেরিকার টেনেসি কিংবা কেনটাকির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। সঙ্গে ঈশ্বর চাহে তো তাদের ছেলেমেয়েরাও থাকবে।

তবে কল্পনায় ধনী, সুন্দরী নারীকে বিয়ে করা এক ব্যাপার আর বাস্তবে তার হৃদয় জয় করা সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস।

চার

হেরন পুরানো দিনের নাইটদের গল্প বইতে পড়েছে তাঁরা তাঁদের ভালোবাসার পাত্রীদেরকে রক্ষা করার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতেন। তাঁরা লড়াই করতেন দানব আর ড্রাগনদের বিরুদ্ধে, বোঝা-পড়া করতে হতো জাদুকরদের সঙ্গে। পাথরের দেয়াল টপকাতেন তাঁরা, লোহার গেট ভেঙে ঢুকে পড়তেন মাটির নিচের ঘরে যেখানে বেচারী মেয়েগুলো বন্দি হয়ে আছে।

আমার কাজটাও ওই নাইটদের মতোই কঠিন, আপন মনে নিজেকে শোনায় স্কুল মাস্টার। সুন্দরী জুলিয়ার হৃদয় জয় করতে হবে আমাকে। তবে মেয়েটি বড় অস্থিরমতি, যখন তখন বদলে ফেলে সিদ্ধান্ত। জানি না। ও সত্যি আমার ব্যাপারে সিরিয়াস নাকি স্রেফ খেলছে আমাকে নিয়ে।

নাইটদের মতো হেরনেরও শত্রুর অভাব নেই। তবে তারা ড্রাগন বা দানব নয়, রক্তমাংসের প্রতিদ্বন্দ্বী। খামারে অনেক তরুণ আছে যারা জুলিয়াকে বিয়ে করার জন্য পাগল। এরা একে অপরকে ঈর্ষা করে, বিশেষ করে রাফায়েল হেরনের মতো বহিরাগতদের প্রতি তাদের হিংসাটা বেশি। হেরন জানে জুলিয়ার মন জয়ের চেষ্টার কথা জানতে পারলে এরা সবাই তার বিরুদ্ধে আদাজল খেয়ে লেগে পড়বে।

আমি সবসময়ই লড়াইর জন্য প্রস্তুত, এই প্রতিদ্বন্দ্বীদের একজন প্রায়ই চেঁচিয়ে বলে এ কথা। তার নাম আব্রাহাম ফার্নান্দেজ। দেখতে বেশ সুদর্শন বলে বন্ধুরা রোমিও বলে ডাকে। ওর গায়ে ষাঁড়ের মতো জোর ।

গাঁয়ের সবাই কালো, কোঁকড়ানো চুলের রোমিওকে চেনে। তার অনেক সাহস, মজাও করতে পারে বেশ। আড্ডা মারতে ভালোবাসে রোমিও, তাকে সবসময় দেখা যায় খড়ের টুপি মাথায়, তাতে শেয়ালের লেজ ঝুলছে পেছন থেকে। রাতের বেলা ঘোড়া ছুটিয়ে চলার সময় সবাই বুঝতে পারে দলবল নিয়ে কোথাও যাচ্ছে রোমিও ফার্নান্দেজ। কোথাও হট্টগোল বা মারামারি বাঁধলে সবাই জানে এর মূল হোতা রোমিও।

বেপরোয়া এই যুবক জানে না একটি মেয়ে তাকে ভালোবাসে। আর মেয়েটি অন্য কেউ নয়, জুলিয়া অগাস্টিন। মেয়েদের মন পাবার মতো গুণ নিজের আছে বলে মনে করে না রোমিও। ভল্লুকের মতোই সে কর্কশ। তবু জুলিয়া তাকে কেন পছন্দ করে, ঈশ্বর জানেন।

রোমিও ফার্নান্দেজকে জুলিয়া ভালোবাসে এরকম একটা কথা চাউর হয়ে যাবার পরে যারা জুলিয়াকে প্রেম নিবেদন করবে ভেবেছিল তারা সভয়ে কেটে পড়ল। দূর থেকেও রোমিওর ঘোড়া দেখলে তারা অন্য রাস্তা ধরে। রোমিওকে সবাই যমের মতো ডরায়।

হেরন জানত রোমিওকে সরাসরি চ্যালেঞ্জ করা মূর্খতা ছাড়া কিছু নয়। তবে সংগীত শিক্ষক হিসেবে জুলিয়ার সঙ্গে দেখা সাক্ষাতের সুযোগ ভালোভাবেই নিচ্ছে সে। আর জুলিয়ার বাবা-মাও খুশি হন হেরন বাড়ি এলে। সন্ধ্যাবেলা জুলিয়াকে নিয়ে হেরন খামার ঘুরতে বেরুলে তাঁরা আপত্তি করেন না।

দুজনে কী কথা বলে কে জানে। তবে হেরনের সবসময়ই চেষ্টা থাকে পাণ্ডিত্য আর বিদ্যার জোরে অস্থিরমতি জুলিয়াকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট করার। তার বিশ্বাস এ ব্যাপারে সে বেশ খানিকটা এগিয়েও গেছে। জুলিয়াকে বিয়ে করে রজার অগাস্টিনের সম্পত্তির মালিক হবার স্বপ্ন সর্বক্ষণ দেখে চলেছে হেরন।

প্রতিবেশীরা একদিন লক্ষ করল আগের মতো আর রজার অগাস্টিনের বাড়ির বেড়ার বাইরে রোমিও ফার্নান্দেজের ঘোড়া বাঁধা থাকে না।

রাফায়েল হেরনের সাবধানে থাকা উচিত, বলাবলি করে তারা। কারণ রোমিও সহজে কাউকে ছেড়ে দেওয়ার পাত্র নয়।

সবাই জানে রোমিও আর হেরন একদিন পরস্পরের মুখোমুখি হবে। রোমিও হাতহাতি লড়াইয়ের মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে চায়।

স্কুল মাস্টারটাকে আমি দুই ভাঁজ করে ওর নিজের স্কুল ঘরের শেলফে রেখে আসব, ঘোঁত ঘোত করে বলে রোমিও ফার্নান্দেজ। তবে দু ভাঁজ হবার কোনো ইচ্ছে নেই হেরনের। রোমিওকে সে সুযোগ কখনোই দেবে না। তার সাথে চ্যালেঞ্জেই যাবে না হেরন। ফার্নান্দেজ স্কুল মাস্টারকে নিয়ে নানা ঠাট্টা মশকরা করে, তাকে রাগিয়ে তুলতে চায়। স্কুলের সামনে দলবল নিয়ে মাটি কাঁপিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে যায় রোমিও। গানের ক্লাস চলছে, দলবল নিয়ে বাইরে এমন চেঁচামেচি করে রোমিও, ক্লাস করাই মুশকিল। রাতের বেলা স্কুল ঘরে ঢুকে সবকিছু তছনছ করে যায়। হেরন ভাবে ডাইনি কিংবা ভূত এসে অমন কাণ্ড করেছে।– জুলিয়ার সঙ্গে হেরনকে দেখলেই তাকে বিব্রত করার মওকা খুঁজতে থাকে রোমিও। একবার সে কোত্থেকে হাড় জিরজিরে, খোস পাঁচড়ায় ভর্তি বুড়ো একটা কুকুর ধরে নিয়ে এলো। যখন হেরনের গানের ক্লাস শুরু হলো, কুকুরটাকে উস্কে দিল রোমিও। কুকুরের ঘেউ ঘেউর চোটে বারটা বেজে গেল ক্লাসের।

দেখতে দেখতে চলে এল গ্রীষ্ম। দুই প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়নি। শরৎ এলো। শরতের এক চমৎকার বিকেলে হেরন তার স্কুল ঘরে, ডেস্কে বসে আছে। ডেস্ক বোঝাই গোপন জিনিসে, প্রায় সবই সে ছাত্রদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে আছে আধ খাওয়া পেয়ারা, পপ গান (ঢিল ছোঁড়ার নল) সহ প্রচুর বল।

ছাত্ররা মনোযোগ দিয়ে পড়ছে। হেরন একটু আগে একজনকে বেত দিয়ে ধুমসে পিটিয়েছে বাঁদরামী করার জন্য। তাই কারো মুখে এখন টু শব্দটি নেই। সবার চোখ বইয়ের পাতায়। নিঃশব্দে পড়ছে। চমৎকার শান্তি পূর্ণ পরিবেশ।

কিন্তু শান্তি বিঘ্নিত হলো কোমরে চাকুর খাপ ঝোলানো এক লোকের আগমনে। সে জুতোয় শব্দ তুলে ক্লাসরুমে ঢুকল।

হেরন মাস্টার সাহেব, উঁচু গলায় বলল আগন্তুক, আপনাকে একটি পার্টিতে যাবার দাওয়াত দিতে এসেছি আমি। আপনার গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতি পার্টিটিকে মহিমান্বিত করে তুলবে, স্যার।

পার্টি? প্রশ্ন করল হেরন, কিন্তু কোথায়?

চমৎকার এক পার্টি, স্যার। পুনরাবৃত্তি করল লোকটা।

সে তো বুঝলাম বলল হেরন, কিন্তু দাওয়াতটা দিচ্ছে কে?

কেন, মাননীয় রজার অগাস্টিন সাহেব, জানাল আগন্তুক, আজ সন্ধ্যায় পার্টি, তার বাড়িতে। মনিবকে গিয়ে কী বলব আমি?

বলবে আমি যাব, চেঁচিয়ে উঠল হেরন। অবশ্যই হাজির থাকব পার্টিতে।

পাঁচ

ঠিক আছে বাচ্চারা, বলল স্কুল মাস্টার। আজকের মতো পড়া এখানেই শেষ। এখন তোমরা বাড়ি যেতে পার। ছুটি।

বাচ্চারা পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগল অবাক দৃষ্টিতে। মাস্টার সাহেব কখনোই তাদেরকে এতো তাড়াতাড়ি ছুটি দেন না। বিরক্তিকর ক্লাসগুলো শেষ না হওয়া পর্যন্ত তারা স্কুলের বাইরে যেতে পারে না।

তবে আজ ব্যতিক্রম হলো। হঠাৎ ছুটি পেয়ে ছেলেমেয়েরা খুব খুশি। তবে মাস্টার সাহেব আজ কারো বই গুছিয়ে দিলেন না। ওরা নিজেদের মতো হুড়োহুড়ি করে বইপত্র কোনোমতে ব্যাগে ঢুকিয়ে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে পড়ল ক্লাস থেকে। মনের আনন্দে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটল বাড়ির দিকে।

হেরন পার্টিতে যাবার জন্য সেজেগুজে তৈরি হলো। আজ সে তার সবচেয়ে ভালো স্যুটটি পরেছে। আসলে স্যুট তার এই একটিই। ভাঙা একটা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে স্যুট পরতে এবং চুল আঁচড়াতেই পাক্কা আধঘণ্টা সময় লেগে গেল। নিজেকে সে নাইট হিসেবে কল্পনা করছে। তাই সেজেগুজে না গেলে চলে?

আমার একটা ঘোড়া লাগবে, যে কৃষকের বাড়িতে লজিং থাকত তাকে বলল হেরন, আর একটা জিন অবশ্যই।

রডরিক রিপার নামের কৃষকটি সরু চোখে তাকাল হেরনের দিকে, আপনি বুলেটকে নিতে পারেন। তবে ওকে শক্ত হাতে সামাল দিতে হবে। কারণ ঘোড়াটা ভয়ানক দুষ্ট। মাথায় সবসময় কুবুদ্ধি গিজগিজ করছে। হেরন রিপারকে আশ্বস্ত করল এই বলে যে সে খুব দক্ষ ঘোড়সওয়ার। যদিও জীবনে খুব কমই ঘোড়ার পিঠে চড়েছে হেরন। সে বুলেটের পিঠে চেপে বসল নতুন অভিযানে যাবার আনন্দ বুকে নিয়ে।

চলো হে, বুলেট, বলল সে। ঘোড়াটা বিষ দৃষ্টিতে, আড়চোখে দেখল স্কুল মাস্টারকে। তারপর ধীর পায়ে এগোল রাস্তা ধরে।

বুলেট প্রায় অচল একটা ঘোড়া। তার ঘাড়টা ছাগলের মতো, মাথাটা হাতুড়ির মতো। তার লেজে গেঁথে আছে অসংখ্য চোর কাটা, একটা চোখ আবার কানা। বুড়ো, অথর্ব দেখালে কী হবে ঘোড়াটা পাজির পা ঝাড়া।

সামনে চলো, তেজী ঘোড়া, বুলেটকে উৎসাহিত করার জন্য বলল হেরন।

ঘোড়া ও তার সওয়ারীকে জুটি হিসেবে মানিয়েছে ভালোই। হেরন ছোট রেকাব নিয়ে চলেছে, ফলে তার হাঁটু জোড়া ঠেকেছে জিনের মাথায়। হাড্ডিসার কনুই জোড়া লাগছে ফড়িংয়ের মতো। চাবুকটা বর্শার ঢঙে মাথার ওপরে উঁচিয়ে ধরা। ঘোড়া চলছে, হেরনের হাত জোড়া সেই সাথে ডানার মতো শরীরের দুপাশে ঝকি খাচ্ছে। ঘোড়া ও ঘোড়সওয়ারকে দেখতে অদ্ভুত লাগছে, সন্দেহ নেই।

শরতের চমৎকার সন্ধ্যা। বুনো হাঁসের ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে মাথার উপর দিয়ে। পথ চলতে চলতে হেরন যথারীতি ভাবছে খাবারের কথা।

এ বছর কী চমৎকার আপেল ফলেছে, আপন মনে বিড়বিড় করছে। হেরন, এবারের কুমড়োগুলো দিয়েও দারুণ পাই বানানো যাবে।

কতগুলো মৌচাকের সামনে দিয়ে যাবার সময় ধোঁয়া ওঠা প্যান কেকের কথা মনে পড়তে জিভে জল এসে গেল তার। কল্পনায় দেখল জুলিয়া তার নরম হাত দিয়ে মধু ঢালছে কেকের উপরে।

রজার অগাস্টিনের খামারে যেতে হয় গাঁয়ের বিপরীত দিকের রাস্তা দিয়ে। হাডসন নদীর শান্ত জলে পাশের জঙ্গলের কালো ছায়া। খামারে পৌঁছুতে পৌঁছুতে পাহাড়ের কোলে ডুব দিল সূর্য আকাশটাকে গোলাপী আর সোনালি রঙে রাঙিয়ে।

আপনার বাড়িতে খুব লোকজন দেখছি আজ, রজার অগাস্টিনকে উদ্দেশ্য করে বলল হেরন, মনে হচ্ছে শহরের সবাই হাজির হয়ে গেছে।

ভিড় তো থাকবেই, বললেন আমন্ত্রণকর্তা, যত ভিড় তত আনন্দ। সময়টাকে নিজের মতো করে উপভোগ করুন, মাস্টার সাহেব। পরে আমরা নাচ শুরু করব।

হেরন চারদিকে তাকাতে লাগল। তেলতেলে মুখের চাষারাও দাওয়াত পেয়েছে। তারা বাড়িতে তৈরি কোট আর বিরাট মাপের জুতো পরে এসেছে। এদের স্ত্রীদের সাজসজ্জা একেবারেই সাধারণ এবং অতি পুরানো ফ্যাশনের। রঙ বেরঙের ফিতে দিয়ে চুল বিনুনি করেছে তরুণীরা, মাথায় চাপিয়েছে খড়ের টুপি। ছেলেরা পনিটেল স্টাইলে মাথার পেছনে ঝুঁটি করে বেঁধেছে চুল। ওই সময় এ ফ্যাশনই চলত।

ওই যে রোমিও ফার্নান্দেজ আসছে! কেউ একজন বলল চেঁচিয়ে। পার্টির অভ্যাগতদের বেশিরভাগের মাথা ঘুরে গেল ঘোড়ার খুরের শব্দ যেদিক থেকে আসছে, সেদিকে। খটখট শব্দ তুলে প্রিয় ঘোড়া ডেয়ার ডেভিলের পিঠে সওয়ার রোমিও ফার্নান্দেজ ঝড়ের বেগে ঢুকে পড়ল খামারবাড়িতে। তার ঘোড়াটা আস্তে চলতেই জানে না। দুরন্তগতি বলেই তাকে পছন্দ করে রোমিও। হেরন অবশ্য তার প্রতিদ্বন্দ্বীর দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাল না। তার নজর তখন অন্য দিকে। না, পার্টির সুন্দরী মেয়েরা দৃষ্টি কাড়েনি হেরনের। সে লোভাতুর চোখে দেখছে টেবিল বোঝাই খাবার।

বড় বড় থালা বোঝাই কেক। আরো রয়েছে ডোনাট, মিষ্টি পিঠা এবং রুটি। আর রোস্ট, চপের অভাব নেই। দারুণ সুগন্ধ ছড়াচ্ছে খাবারগুলো। জিভে আসা জল বারবার গিলে ফেলছে হেরন।

নিন, মাস্টার সাহেব, জুলিয়ার মা এসে দাঁড়ালেন হেরনের পাশে। যত ইচ্ছা নিন। লজ্জা করবেন না।

কীভাবে, কোনটা দিয়ে যে শুরু করব বুঝতে পারছি না, মনে মনে বলল হেরন। সবগুলো খাবারই দারুণ। আপেল পাই নেব, রোস্ট নাকি চপ দিয়ে শুরু করব? শেষে ঠিক করল প্রতিটি খাবারই সে চেখে দেখবে। প্লেট বোঝাই করে ফেলল চপ, গরুর মাংস, মুরগির রোস্ট, আগুনে ঝলসানো মাছ, কেক আর পাই দিয়ে। টেবিলের প্রতিটি প্লেট থেকে কিছু না কিছু খাবার নিজের প্লেটে তুলল সে।

দারুণ সুস্বাদু! বলল সে, আরেক গ্রাস পুরে নিল মুখে। চিবুচ্ছে। খাওয়ার মতো আনন্দ সে অন্য কিছুতে পায় না। খেতে খেতে চোখের মণি ঘোরাতে লাগল সে, খুব মজা পাচ্ছে এ তারই অভিব্যক্তির প্রকাশ।

একদিন, ভাবল হেরন, এসব কিছুই আমার হবে। আমি এ বাড়ির মালিক হব। তখন আর মাস্টারি করতে হবে না।

সবাই খেয়ে নিন, ঘোষণার সুরে বললেন বুড়ো বালটুস রজার অগাস্টিন, এরপরে শুরু হবে আমাদের নৃত্যপর্ব।

নাচের সময় বেহালা বাজাল ধূসর চুলো এক বুড়ো। এ এলাকায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বেহালা বাজিয়ে আসছে সে। পুরানো, জীর্ণ বেহালা বাজানোর সময় বাজনার তালে তার মাথা দুলতে থাকে। নতুন কোনো জুটি নাচ করতে সে পা ঠুকে উৎসাহ দেয়।

আমার সঙ্গে নাচবে? হেরন দুরু দুরু বুকে প্রস্তাব দিল জুলিয়াকে। উত্তেজনায় আপনি থেকে তুমিতে চলে এসেছে। দম বন্ধ করে অপেক্ষা করছে জবাবের জন্য।

অবশ্যই। জবাব দিল জুলিয়া। হেরন আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

হেরনের ধারণা সে গানের মতোই সুন্দর নাচতে পারে। নাচার সময় তার হাত আর পা কাঁপতে লাগল, মাথা আর নিতম্ব দুলতে লাগল বাজনার তালে। হাড্ডিসার শরীরটা ঘরের মধ্যে ঘূর্ণির মতো ঘুরছে, যেন এখনই ফিট হয়ে যাবে হেরন।

আজ রাতে সে তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষটির সঙ্গে নাচার সুযোগ পেয়েছে। এতো আনন্দ কোথায় রাখে হেরন। চোখের মণি ঘোরাচ্ছে সে জুলিয়ার দিকে তাকিয়ে। জুলিয়া জবাবে মিষ্টি হাসল, পিটপিট করল চোখ।

হেরন জুলিয়াকে নিয়ে নাচছে, সে দৃশ্য ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে দেখছে রোমিও ফার্নান্দেজ। হিংসায় বুক জ্বলে যাচ্ছে তার। নৃত্যরত জুটির দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সে। হেরন এবং জুলিয়ার নাচের গতি যত উদ্দাম হয়ে উঠল, বুকের ভেতরে ঈর্ষার আগুনটা ততই ধিকি ধিকি জ্বলতে লাগল রোমিও ফার্নান্দেজের।

ছয়

নাচ শেষ হলে হেরন রজার অগাস্টিনসহ কয়েকজন বুড়োর সঙ্গে মিলিত আড্ডায়। তারা সিপাহী বিদ্রোহ নিয়ে গল্প করছেন। কয়েক বছর আগের সেই যুদ্ধে কে কী করেছেন তা নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন বুড়োরা।

আমি একাই একটা ব্রিটিশ ব্যাটালিয়ন প্রায় উড়িয়ে দিতে যাচ্ছিলাম, ঊট দেখালেন এক বুড়ো। কিন্তু কামানটা হঠাৎ বিগড়ে গেল বলে আর পারলাম না।

আমি আমার তরবারি দিয়ে মাস্কেট বন্দুকের গুলি ফিরিয়ে দিয়েছি, গপ্পো ঝাড়লেন আরেকজন। তার কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠলেন অন্যরা। বুড়ো রেগে মেগে বললেন এর প্রমাণ দেখাবেন। গুলির আঘাতে ছিদ্র হওয়া তরবারিটি তাঁর কাছে আছে।

বুড়োরা সবাই নিজেদের যুদ্ধের হিরো বলে প্রমাণ করতে চাইছেন। তবে এ আড্ডা হঠাৎ করেই মোড় নিল ভূতের গল্পে। পাদ্রিশিবপুরের আশপাশে যারা থাকে মূলত তারাই এ গল্পের বক্তা, অন্যরা শ্রোতা। তবে সবাই জানে ওই এলাকায় অদ্ভুত, রোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে।

সাদা পোশাক পরা এক মহিলাকে আপনারা কখনো কেউ দেখেছেন? জিজ্ঞেস করলেন এক বুড়ো। স্লিপিহলোর কাছে গোরস্তানে ঘুরে বেড়ায় সে। শীতের রাতে তার বিকট গলার চিৎকার শোনা যায় কখনো কখনো। তার মানে খারাপ একটা আবহাওয়া আসছে। তারই পূর্বাভাস ওই চিৎকার। বছর কয়েক আগে ঝড়ের কবলে পড়ে মারা গেছে মহিলা।

আপনার সাদা পোশাক পরা মহিলাকে আমি দেখিনি, পাইপ ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন এক বুড়ো, তবে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ারকে দেখেছি।

আমিও, সায় দিলেন আরেকজন, পুরানো গির্জার পাশ দিয়ে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ারকে ঘোড়া ছুটিয়ে যেতে দেখেছি।

বুড়ো ডি সুজার কী হয়েছিল জানেন? প্রশ্ন করলেন রজার অগাস্টিন।

তাঁর বুড়ো বন্ধুরা ডানে-বামে মাথা নাড়লেন। জানেন না কেউ।

সে এসব ভূত-প্রেতে বিশ্বাস করত না। এক রাতে জলার ধারের রাস্তা ধরে সে ঘোড়ায় চড়ে আসছিল। জলার ধারের গাছপালা এমন ঘন, সূর্যের আলো ঢুকতে পারে না বলে দিনের বেলাতেও অন্ধকার থাকে ওদিকটাতে। মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার তাকে তাড়া করে। ডি সুজা প্রাণভয়ে ছুটতে ছুটতে চলে আসে, ঝর্ণার ওপরের সেতুতে। দেখে ঘোড়সওয়ার একটা কঙ্কাল হয়ে গেছে, বজ্রপাতের মতো প্রচণ্ড শব্দ তুলে সে গাছের ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়। ডি সুজার কাটা মাথাটা গড়িয়ে পড়ে ঝর্ণার জলে। নতুন এ গল্পটি কেউ শোনেনি। সবাই বলাবলি করল ভূত-প্রেতে বিশ্বাস থাকলে ডি সুজাকে এভাবে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হতো না।

বোকা, মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ারের সঙ্গে একবার আমার সাক্ষাৎ হয়েছে, ভেসে এল একটি কণ্ঠ। ফিরে তাকালেন সবাই। রোমিও ফার্নান্দেজ।

সেই রাতে ঘোড়ায় চড়ে বাড়ি ফিরছি আমি, এমন সময় দেখতে পাই তাকে, বলে চলল সে, তাকে ঘোড় দৌড়ের প্রস্তাব দিই, বাজি ধরি আমার সঙ্গে দৌড়ে সে পারবে না। ডেয়ার ডেভিলের ওপরে বিশ্বাস ছিল আমার। ওর সঙ্গে দৌড়ের পাল্লায় জীবিত বা মৃত কোনো ঘোড়াই পারবে না। কিন্তু ওই সেতুর ওপরে যাবার পরে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার হাল ছেড়ে দিল। আগুনের একটা গোল্লা তৈরি করে অদৃশ্য হয়ে গেল।

হেরন গল্প শুনে বেশ মজা পাচ্ছিল। সেও নিজের দুএকটি অভিজ্ঞতার কথা শোনাল। জানাল স্লিপিহলোর রাস্তা ধরে হাঁটার সময় কী রকম অনুভূতি তার হয়েছে।

আরো কিছুক্ষণ পরে শেষ হয়ে গেল পার্টি। এবার বাড়ি ফেরার পালা। চাষারা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে উঠে পড়ল যে যার ঘোড়ার গাড়িতে। রওনা হয়ে গেল বাড়ি অভিমুখে। কয়েকটি মেয়েকে বাড়ি পৌঁছে দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করল তাদের প্রেমিকরা। কৃষকদের গাড়ির চাকার আওয়াজ অস্পষ্ট হয়ে এলো, প্রেমিক-প্রেমিকাদের হাসির উচ্চকিত শব্দও এক সময় ক্ষীণ হয়ে এল। তারপর নেমে এল নৈশব্দ। নিঝুম হয়ে গেল খামারবাড়ি। সবার শেষে বিদায় নিল হেরন। জুলিয়ার সঙ্গে কথা বলার লোভে সে লক্ষ করেনি অনেক রাত হয়ে গেছে। তার ধারণা সে মেয়েটির হৃদয় জয় করে নিয়েছে।

জুলিয়া হেরনকে কী বলেছে কে জানে, তবে দুঃসংবাদই হবে বোধহয়, কারণ খামারবাড়ি থেকে বেরিয়ে এল সে খুবই করুণ চেহারা নিয়ে।

অস্থিরমতি জুলিয়া কি সারাটা সন্ধ্যা তাহলে তার সঙ্গে খেলা করেছে? রোমিও ফার্নান্দেজকে ঈর্ষান্বিত করে তোলার উদ্দেশ্যেই কি সারাক্ষণ হেরনের সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলেছে? ঈশ্বর জানেন এসব প্রশ্নের জবাব।

তবে জুলিয়া হেরনকে যে কোনো আনন্দ সংবাদ দেয়নি তা তার অন্ধকার, শুকনো মুখ দেখলে যে কেউ বলে দিতে পারত। সে ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেল গোলাঘরের দিকে, নিজের ঘোড়ার খোঁজে। বুলেট তখন ঘতর ঘতর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে।

বিমর্ষ, দুঃখী হেরন যখন বাড়ির পথ ধরল, রাত তখন অনেক। সন্ধ্যা বেলায় যে প্রকৃতিকে দেখে বুকে খুশির দোলা লেগেছিল হেরনের, অন্ধকার সেই প্রকৃতি এখন গ্রাস করেছে। স্থির রাত। নদীর ওপার থেকে ভেসে আসা কুকুরের ডাক শোনা গেল পরিষ্কার। আর তক্ষুণি রাজ্যের ভূত-প্রেতের গল্প ভিড় করে এল হেরনের স্মৃতিতে।

সর্বনাশ, এত রাত হয়েছে বুঝতেই পারিনি! আঁতকে উঠল হেরন। ঠিক তখনি প্রকাণ্ড, কালো একখণ্ড মেঘ ঢেকে দিল চাঁদ, গাঢ় করে তুলল আঁধার।

হেরন চলেছে গ্রামের সবচেয়ে অন্ধকার আর সুনসান অংশের দিকে। এক লোককে রাস্তার ধারে বড় একটা গাছে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। লোকটার আত্মা নাকি ওখানে ঘুরে বেড়ায়। সেই গাছের দিকেই এগোচ্ছে হেরন, বুক। শুকিয়ে কাঠ। মনে সাহস আনতে শিস বাজাল সে। তার শিস বাজানো শেষ হওয়া মাত্র কে যেন প্রত্যুত্তরে বাজাল শিস!

না, কেউ শিস বাজায়নি, মনকে প্রবোধ দিল হেরন। ওটা গাছের ডালে বাড়ি খাওয়া বাতাসের শব্দ। গাছের ডালে বাড়ি খেলে বাতাসে শিসের শব্দ ওঠে। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো সেই বড় গাছটার নিচে সাদা কী একটা দাঁড়িয়ে আছে। গাছটার সামনে আসতে দেখল একটা পুঁড়ি পড়ে আছে। বজ্রপাতে দুভাগ হয়ে গিয়েছিল ওটা। চাঁদের আলোয় সাদা দেখাচ্ছে। বুকে। একটু সাহস পেল হেরন।

পরক্ষণে দারুণ চমকে উঠল গোঙানির শব্দে। দাঁতে দাঁত লেগে ঠকাঠক কাঁপুনি শুরু হয়ে গেল হেরনের। নাহ্, খামোকাই ভয় পেয়েছে সে। দুটো ডালে বাতাসের বাড়ি লেগে অমন শব্দ হয়েছে। হেরন বড় গাছটা পার হয়ে গেল ঈশ্বরের নাম জপতে জপতে। ঘটল না কিছুই।

সামনের রাস্তাটা আরো অন্ধকার, আরো গা ছমছমে। ছোট একটা নালা পার হয়ে যেতে হবে তাকে। লোকে বলে নালা বা খালটা ভুতুড়ে। সন্ধ্যার পরে কেউ এদিকে আসার সাহস পায় না। ওদিকে এগোচ্ছে হেরন, পাঁজরের গায়ে দমাদম বাড়ি খেতে লাগল হৃদপিন্ড।

চলো, বুলেট, বলল সে ঘোড়াকে, জলদি চলো।

ঘোড়ার পাঁজরে লাথি কষাল হেরন তাকে জোরে ছুটতে ইঙ্গিত করে । কিন্তু বদমাশ ঘোড়া তার সওয়ারীর কথা মতো কাজ করল না, উল্টো রাস্তার পাশের একটা বেড়ার গায়ে আছড়ে পড়ল। তারপর বৈচি ফলের একটা ঝোঁপের দিকে ছুটল।

ঘোড়াটাকে বহু কষ্টে নালার কাছে নিয়ে এল হেরন। অকুস্থলে পৌঁছামাত্র ঝট করে দাঁড়িয়ে গেল বুলেট। ঝাঁকুনির চোটে আরেকটু হলে ঘোড়ার পিঠ থেকে চিটকে পড়ে যাচ্ছিল হেরন।

কোনো মতে সুস্থির হয়ে জিনে বসেছে সে, কানে ভেসে এল একটা শব্দ। অন্ধকারে উঁকি দিল একটা ঝোঁপের ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা কালো প্রকাণ্ড এক ছায়ামূর্তি। মূর্তিটি কে বা কী ধারণায় কুলালো না হেরনের। তবে এটুকু বুঝতে পারল দানব আকৃতিটা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে যাচ্ছে।

সাত

প্রকাণ্ড এক কালো ছায়ামূর্তি দেখে ভয়ের চোটে হেরনের ঘাড়ের পেছনের সবগুলো চুল দাঁড়িয়ে গেল সরসর করে। এখন আর ছুটে পালাবার উপায় নেই। কী করবে সে?

ক্কে-কে তুমি? তোতলাচ্ছে হেরন।

জবাব দিল না ছায়ামূর্তি।

কে ওখানে? আবার কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল হেরন।

কোনো জবাব এল না। বুলেটের পাঁজরে লাথি কষাল হেরন। কিন্তু একগুঁয়ে ঘোড়াটা নড়ল না একচুল। চোখ বুজল হেরন, কর্কশ গলায় ধরল প্রার্থনা সংগীত।

একটা বিকট শব্দ হতে চোখ মেলে চাইল হেরন। রাস্তার মাঝখানে চলে এসেছে ছায়ামূর্তি। অন্ধকারেও হেরন বুঝতে পারল ঘোড়সওয়ার প্রকাণ্ডদেহী এবং তার বাহনটিও আকারে বিশাল। ছুটে আসতে শুরু করল সে স্কুল মাস্টারের দিকে।

জলদি ভাগ, বুলেট, অনুনয় করল হেরন। এতক্ষণে বুঝি দয়া হয়েছে বুলেটের, কিংবা ভয়ও পেতে পারে। ছুটল সে। পেছন পেছন কালো ঘোড়া।

হেরন ঘোড়ার গতি কমাল অনুসরণকারী তা পাশ কাটিয়ে যাবে সে আশায়। কিন্তু পেছনের জনের কোনো তাড়া নেই। সেও মন্থর করল গতি। হেরন আবার প্রার্থনা সংগীত গাইবার চেষ্টা করল। কিন্তু মুখের ভেতরটা এমন শুকিয়ে গেছে কোনো আওয়াজ বেরুল না গলা থেকে। পেছনের ছায়ামূর্তি কোনো শব্দ করছে না, এটাই সবচেয়ে ভীত করে তুলেছে হেরনকে। ওটা নিঃশব্দে অনুসরণ করে চলেছে হেরনকে। তার চলার মধ্যে রয়েছে রহস্য আর অশুভ ইঙ্গিত।

ওরা ছোট একটা টিলায় উঠে এলো। পেছন ফিরে তাকাল হেরন। অনুসরণকারীকে এবার আগের চেয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আকাশের পটভূমিকায় যেন ফুটে আছে তার আকৃতি। গায়ের রোম খাড়া হয়ে গেল। হেরনের। দেখে ঘোড়সওয়ারের ধড়ের ওপর মুণ্ডু নেই! আরো ভয়ঙ্কর ব্যাপার, কাটা মুভুটা হাতে ঝুলিয়ে রেখেছে সে!

হেরন প্রচণ্ড জোরে লাথি কষাল বুলেটের পেটে। জোরে ছুটতে বলছে। আরোহীর ভয় সংক্রামিত হলো ঘোড়ার মধ্যেও। জানবাজি রেখে ছুটল সে। কিন্তু অশরীরীও তীব্র বেগে ছুটে আসতে লাগল। বাতাসের বেগে ছুটছে দুটি ঘোড়াই, খুরের আঘাতে ছিটকে যাচ্ছে পাথর আর মাটির ঢেলা। খুরের লোহার নলে লেগে জ্বলে উঠছে স্ফুলিঙ্গ।

পাগলের মতো ছুটছিল বলে হেরনের খেয়াল ছিল না কোথায় বা কোনদিকে যাচ্ছে। হঠাৎ দেখতে পেল বুলেট তাকে সেই কুখ্যাত সেতুর কাছে নিয়ে এসেছে যেটা ভূত-প্রেতের রাজ্য বলে জানে সবাই। বড় একটা টিলার ওপরে সেতুটা, এখানেই রয়েছে সেই পুরানো গির্জা। লোকে বলে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ারকে এই গির্জার গোরস্তানে কবর দেয়া হয়েছে!

তীব্র আতঙ্কে ছুটছে বুলেট, ভয়ঙ্কর জিনিসটার কাছ থেকে দূরত্ব বাড়িয়ে নিতে পেরেছে কিছুটা। আর ঠিক তখন হেরন টের পেল তার ঘোড়ার জিন আটকানোর বেল্টটি আলগা হয়ে গেছে!

হেরন চেষ্টা করল বেল্ট ধরতে, কিন্তু খুলে গেল ওটা, খসে পড়ল জিন। ভৌতিক ঘোড়া ওটাকে মাড়িয়ে দিল পা দিয়ে। জিন খুইয়েছি দেখলে রডরিক রিপার আমাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে! হায় হায় করে উঠল হেরন।

তবে জিন হারানোর চেয়েও গুরুতর সমস্যা তার সামনে। কারণ জিন ছাড়া ঘোড়ার পিঠে মোটেই সুস্থির হয়ে বসতে পারছিল না হেরন। একবার ডানে, আরেকবার বামে ঝাঁকুনির চোটে ছিটকে যাচ্ছিল। মাঝে মাঝে এমন জোরে ঝাঁকুনি লাগছিল, হেরনের মনে হচ্ছিল শরীরের হাড়গোড় বুঝি একখানাও আস্ত থাকবে না।

কিন্তু সামনে কী ওটা? নদীর বুকে ঝলমল করছে তারা! টিলার ওপরে একটা গির্জা দেখতে পেল হেরন। তারপর চোখে পড়ল একটা সেতু। হেরনের মনে পড়ল ওই সেতুর কাছে এলেই অদৃশ্য হয়ে যায় মুন্ডুহীন প্রেত।

ওখানে পৌঁছুতে পারলেই আমি বেঁচে যাব প্রাণে, ভাবল হেরন। ঠিক তখন শুনতে পেল তার পেছনে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে মস্ত কালো ঘোড়াটা। মনে হলো ঘোড়াটার গরম নিঃশ্বাস তার গায়ে লাগছে।

যাও, বুলেট, যাও। চেঁচিয়ে উঠল সে। হাড় জিরজিরে ঘোড়াটাকে আবার লাথি মারল।

লাফ মেরে সেতুতে উঠে পড়ল বুলেট। কাঠের তক্তায় ঘোড়ার খুরের প্রবল শব্দ উঠল। বিপরীত দিকে চলে এলো হেরন, তাকাল ঘাড় ঘুরিয়ে। আশা করল এখনই দেখবে অগ্নিঝলক তুলে গায়েব হয়ে গেছে ঘোড়সওয়ার।

কিন্তু দেখল পিশাচটা তার রেকাবে দাঁড়িয়ে পড়েছে, মাথাটা ছুঁড়ে মারল হেরনকে লক্ষ্য করে। হেরন ছুটে আসা মিসাইলটাকে ফাঁকি দিতে চাইল। কিন্তু পারল না। ভয়াবহ গতিতে ছুটে এল ওটা, দড়াম করে আছড়ে পড়ল হেরনের খুলিতে! ঘোড়ার পিঠ থেকে ডিগবাজি খেয়ে মাটিতে পড়ে গেল হেরন। বুলেট, কালো ঘোড়া আর পিশাচ বাতাসে ঘূর্ণি তুলে চলে গেল তার পাশ কাটিয়ে।

আট

পরদিন বুড়ো বুলেটকে দেখা গেল তার মনিবের বাড়ির ফটকের বাইরে ঘাস চিবোচ্ছে। পিঠে জিন নেই। নাস্তার টেবিলে দেখা গেল না হেরনকে। দুপুরের খাওয়ার সময়েও তার খবর নেই। বাচ্চারা স্কুলে এলো। কিন্তু অনুপস্থিত তাদের মাস্টার।

রাফায়েল হেরনের হলোটা কী? অবাক রডরিক রিপার। আর আমার ঘোড়ার জিনই বা কোথায়?

প্রতিবেশীকে নিয়ে হেরনকে খুঁজতে বেরুল রিপার। ময়লা আবর্জনার মধ্যে বুলেটের স্যাডলের দেখা মিলল। ঘোড়ার খুরের ছাপ লক্ষ করে ওরা গির্জার ধারের সেতুতে চলে এল। ঝর্ণা বা জলাধারাটির তীরে পেয়ে গেল হেরনের টুপি। ওটার পাশে ছিটিয়ে আছে কয়েক টুকরো কুমড়ো। জলধারার আশপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজল দুই কৃষক। সন্ধান মিলল না হেরনের।

হেরনের ঘর খুঁজে অল্প কিছু জিনিস পাওয়া গেল। কয়েকটি জামা, একটা জং ধরা রেজার, খান কয়েক বই। একটি বইয়ের পেছনের পাতায় হেরন কবিতা লিখেছে জুলিয়াকে নিয়ে। রডরিক রিপার কবিতাসহ অন্যান্য বইপত্রগুলো পুড়িয়ে ফেলল।

আমি আর জীবনেও আমার বাচ্চাদেরকে স্কুলে পাঠাব না, সিদ্ধান্ত নিল সে, লেখাপড়া শিখে কোনো লাভ নেই।

রোববারে গির্জায় সবাই রাফায়েল হেরনের রহস্যময়ভাবে গায়েব হয়ে যাবার ব্যাপারটি নিয়ে গল্পে মেতে উঠল। অনেকেই গেল সেতুর ধারে যেখানে টুপি আর কুমড়ো দেখে এসেছে রিপার। নানাজনে নানা গল্প ফাঁদল। তবে শেষে সবাই একমত হলো, হেরনকে মুন্ডুহীন ঘোড়সওয়ার ধরে নিয়ে গেছে।

.

এরপরে আর কেউ হেরনের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে কথা বলার সাহস পেল । গ্রামবাসী অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে গেল স্কুল, নিয়োগ করল নতুন শিক্ষক।

অনেক বছর পরে, বুড়ো এক কৃষক এসে বলতে লাগল বেঁচে আছে। রাফায়েল হেরন। সে দেশের দূরের এক অঞ্চলে চলে গেছে, ওখানে আরেকটা স্কুলে মাস্টারি করছে। হেরন নাকি আইন পড়েছিল, পরে সে আইনজীবীর পেশা বেছে নেয়, পত্রিকায় লেখালেখিও করে এক সময়ে, এক পর্যায়ে বিচারপতির পদেও তাকে বসানো হয়েছিল।

রাফায়েল হেরন নিখোঁজ হবার কিছুদিন পরে রোমিও ফার্নান্দেজ বিয়ে করে সুন্দরী জুলিয়াকে। তার হাবভাবে মনে হচ্ছিল হেরনের অদৃশ্য হয়ে যাবার আসল কারণ সম্ভবত সে জানে। কেউ টুকরো হয়ে যাওয়া কুমড়োর কথা বললেই সে হাসিতে ফেটে পড়ত।

তবে বুড়ো চাষাদের স্ত্রীরা দাবি করত তারা নাকি জানে আসল ব্যাপারটা। তারা নিশ্চিত ছিল হেরনকে কোনো মন্দ আত্মা ধরে নিয়ে গেছে। শীতের রাতে ঘরে আগুন জ্বালিয়ে, অগ্নিকুণ্ডের সামনে গোল হয়ে বসে রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলত তারা।

পরিত্যক্ত স্কুল বাড়িতে–বলত তারা, হেরনের আত্মা নাকি ঘুরে বেড়ায়। গ্রীষ্মের রাতে ওই বাড়ির পাশ দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যাবে করুণ সুরের প্রার্থনা সংগীত, গানটা প্রতিধ্বনি তুলে ভেঙে দেয় স্লিপিহলোর সুনসান নীরবতা।

–রাডিয়ার্ড কিপলিং

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *