সাত

সাত

সত্যি তো, সেদিন ট্রেনে আমি কাকে দেখেছিলাম? এ প্রশ্নের উত্তর আমি আজ পর্যন্ত পাইনি। তাই প্রশ্নটার কোন সদুত্তর দিতে পারিনি। শুধু জানি সেদিন ট্রেনের কামরায় যিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন তাঁর চেহারা অবিকল মি. ডুয়েরিং হাউসের মতো। অবশ্য নিহত মি. ডুয়েরিং হাউসের মৃতদেহটা তখন পড়েছিল একটা পরিত্যক্ত খড়ির খাদের মধ্যে–গাছের শুকনো ডালপালা আর পচা পাতার তলায়। পড়েছিল দশ সপ্তাহ ধরে। জায়গাটা ব্ল্যাকওয়াটার আর ম্যালিংফোর্ডের মাঝামাঝি। মি. ডুয়েরিং হাউস বেঁচে থাকতে যেভাবে কথাবার্তা বলতেন, যে ভঙ্গীতে চলাফেরা করতেন আমার সহযাত্রী ঠিক তেমনিই করেছিলেন। তাঁর চেহারারও অবিকল মি. ডুয়েরিং হাউসের মতো। সহযাত্রীর কাছ থেকে আমি যেসব কথাবার্তা শুনেছিলাম, তা অন্য কোনভাবে আমার জানার সম্ভাবনা নেই। মনে হয় হত্যাকারীকে যাতে আমি সনাক্ত করতে পারি সেজন্য মি. ডুয়েরিং হাউসের বিদেহী আত্মা আমাকে চালনা করে নামিয়েছিল জংশন স্টেশনের প্লাটফরমে। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার জন্য, হত্যাকারী যাতে আইনের হাত থেকে নিষ্কৃতি না পায় সেজন্য বিদেহী আত্মা দেহ ধারণ করেছিল কিছু সময়ের জন্য, সেই স্টেশনে আমি দেখেছিলাম অতীতের ছায়া, গ্যাস পোস্টের নিচেই রাইকসের সঙ্গে মি. ডুয়েরিং হাউসের দেখা হয়েছিল। ওখানে দাঁড়িয়ে তাঁরা কথা বলেছিলেন কিছুক্ষণ, অপঘাতে মৃত ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা অতীতের সেই দৃশ্যটাই তুলে ধরেছিল আমার চোখের সামনে। যন্ত্ৰী আত্মা যন্ত্রের মতো ব্যবহার করেছে আমাকে। আমাকে দিয়েই সে লোকচক্ষুর সামনে প্রকৃত ব্যাপারটা তুলে ধরতে চেয়েছে এছাড়া আর কী ব্যাখ্যা আছে এই রহস্যময় ব্যাপারের?

সিগারকেসের রহস্যের সমাধান হলো। অনুসন্ধানে জানা গেল আমি যে কামরায় উঠেছিলাম, সে কামরাটি কয়েক সপ্তাহ ধরে ব্যবহার করা হয়নি। আর এই কামরাতেই হতভাগ্য মি. ডুয়েরিং হাউস তাঁর শেষ যাত্রায় বেরিয়েছিলেন। সিগারকেসটাকে তিনিই কামরায় ফেলে গিয়েছিলেন। আমি পাবার আগে কেউ-ই কেসটা লক্ষ করেনি। কামরাতেই পড়ে ছিল ওটা।

এখানে হত্যার বিস্তৃত বিবরণ দেবার কোনো প্রয়োজন নেই। যারা খুঁটিনাটি জানতে চান তারা ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের টাইমস পত্রিকার পুরানো ফাইল এবং ওই পত্রিকায় প্রকাশিত অগাস্টাস রাইকসের স্বীকারোক্তি পড়ে দেখতে পারেন। এখানে এটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে কোম্পানির একজন আন্ডার সেক্রেটারি হিসেবে রাইকস নতুন লাইন পাতা সম্পর্কে সমস্ত খবরাখবরই রাখত। মি. ডুয়েরিং হাউস যে সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে যাবেন এ সংবাদটাও তার অজানা নয়। রাইকস ঠিক করেছিল মি. ডুয়েরিং হাউসকে ভুলিয়ে কোনো নির্জন জায়গায় নিয়ে যাবে। রাইকস কোম্পানির একজন অফিসার, কাজেই তার সম্পর্কে মি. ডুয়েরিং হাউসের মনে কোনো সন্দেহই জাগবে না। নির্জন জায়গায় গিয়ে রাইকস মি. ডুয়েরিং হাউসের কাছ থেকে সত্তর হাজার পাউন্ড জোর করে ছিনিয়ে নেবে। তারপর অপহৃত সম্পদ নিয়ে নিজে পাড়ি দেবে আমেরিকায়। এদেশের পুলিশ কোনদিন ব্যাপারটা আন্দাজ করতে পারলেও তাকে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। সে থাকবে ব্রিটিশ পুলিশের ধরাছোঁয়ার বাইরে।

উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য মি. ডুয়েরিং হাউস টাকা নিয়ে যাবার কদিন আগেই রাইকস ছুটি নেয়। ২৩ তারিখে আমেরিকাগামী একটি জাহাজ ছাড়বার কথা ছিল। সেই জাহাজেই একটা সিট বুক করে সে। জাহাজের একজন খালাসীর কাছ থেকে একটা কার্তুজভরা রিভলবার সংগ্রহ করে ব্ল্যাকওয়াটার জংশনে অপেক্ষা করতে থাকে তার শিকারের জন্য।

নির্দিষ্ট দিনে যথাসময়ে মি. ডুয়েরিং হাউস ট্রেন থেকে নামলেন। রাইকসের সঙ্গে দেখা হলো প্লাটফরমে- একটা গ্যাস পোস্টের কাছাকাছি। রাইকস বলল সে বোর্ডের কাছ থেকে একটা জরুরি বার্তা নিয়ে এসেছে। মি. ডুয়েরিং হাউস তাকে চিনতেন, কিন্তু সে যে ছুটিতে রয়েছে তা বোধহয় তিনি জানতেন না আর জানলেই বা ওকে সন্দেহ করবেন কীভাবে? রাইকস তো রেল কোম্পানিরই একজন পদস্থ কর্মচারী।

রাইকস বলে সে ম্যালিংফোর্ডের মাঠের মধ্য দিয়ে সোজা পথে মি. ডুয়েরিং হাউসকে তার গন্তব্যস্থলে নিয়ে যাবে। ডিরেক্টর সাহেব সরল বিশ্বাসে চললেন আন্ডার সেক্রেটারির সঙ্গে। তাঁকে নির্জন জায়গায় নিয়ে এসে রাইকস অতর্কিতে তার মাথায় রিভলবারের নল দিয়ে আঘাত করে। এরকম আচমকা আঘাতের জন্য তৈরি ছিলেন না মি. ডুয়েরিং হাউস। টু শব্দটি না করে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। রাইকস হয়তো নরহত্যা করতে চায়নি। সে বোধহয় মি. ডুয়েরিং হাউসকে অজ্ঞান করে টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু যখন সে দেখল ডিরেক্টর মারা গেছেন, তখন দারুণ ভয় পেয়ে গেল। সে পোড় খাওয়া অপরাধী নয়। মৃতদেহটাকে সে টেনে নিয়ে গেল একটা খড়ি পাহাড়ের খাদের কাছে। জায়গাটা নির্জন–লোক চলাচলের পথ থেকে অনেক দূরে। দেহটাকে খাদে ফেলে দিয়ে শুকনো ডালাপালা আর পাতা দিয়ে লাশটাকে ঢেকে দিল রাইকস। এসব কথা আজও অনেক লোকের স্মৃতিতে সজীব হয়ে রয়েছে।

আশ্চর্যের বিষয়, অপরাধ করার পরও অপরাধী এদেশ ছেড়ে যেতে সাহস করল না। স্বীকারোক্তিতে সে বলেছিল যে মি. দুয়েরিং হাউসকে খুন করার পরিকল্পনা তার ছিল না। তার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল তাকে অজ্ঞান করে টাকার ব্যাগটা ছিনিয়ে নেয়া। কিন্তু আঘাত করার ফলে মি. ডুয়েরিং হাউসের মৃত্যু হওয়ায় রাইকস ঘাবড়ে গেল। সে ভাবল এখন পালিয়ে গেলে সমস্ত সন্দেহ এসে পড়বে তারই ওপর। নিছক ছিনতাইকারী হলে সে আমেরিকায় নিরাপদেই থাকত! কেন না তাকে নিয়ে দেশে কিছুদিন হৈচৈ হলেও তা ক্রমে ঝিমিয়ে পড়ত। কিন্তু সে যে নরহত্যা করে ফেলেছে। এখন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েও তার নিস্তার নেই। পুলিশ দেশ বিদেশে তার খোঁজ খবর করবে। এক সময় তাকে গ্রেপ্তার করে হাজির করবে আদালতে। বিচারে নরহত্যার দায়ে তার হবে চরমদন্ড।

তাই আমেরিকাগামী জাহাজের টিকিট বাতিল করে দিয়ে ছুটি ফুরালেই রাইকস কাজে যোগ দিল। অন্যায়ভাবে পাওয়া সত্তর হাজার পাউন্ড সে লুকিয়ে রাখল। পরে সুযোগ এলে সে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ ভোগ করবে। ইতিমধ্যে সে শুনল মি. ডুয়েরিং হাউস নাকি রেল কোম্পানির সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। দোষটা ডিরেক্টরের ওপর পড়েছে শুনে রাইকস নিশ্চিন্ত হলো। সে ভাবতেই পারেনি এক অদ্ভুত অলৌকিক উপায়ে তার অপরাধ একদিন প্রকাশ হয়ে যাবে।

আট

রাইকস হত্যা করতে চেয়েছিল কি চায়নি এ প্রশ্নের উত্তর কে দেবে? কিন্তু অপরাধের জন্য পুরো মূল্য দিতে হলো তাকে। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ওল্ড বেইলিতে তার ফাঁসি হলো।

যারা তার সঙ্গে পরিচিত হতে চান তারা তাকে আজও যে কোনদিন দেখতে পারেন। না ঠিক তাকে নয়, তার মোমের তৈরি মূর্তিকে। মূর্তিটা যেন জীবন্ত। বেকার স্ট্রিটে মাদাম তুসোর প্রদর্শনীশালার একটি ঘরে নাম আতঙ্কের ঘর –আজও রাইকসের মোমের তৈরি মূর্তি দেখতে পাওয়া যাবে। সে ঘরে রাইকসের মূর্তি নিঃসঙ্গ নয়। কয়েকজন বাছাই করা হত্যাকারীর সঙ্গে তার মূর্তি রয়েছে সেখানে। রাইকসের মূর্তির পরনে আঁটোসাঁটো টুইড সুট। এরকম একটা সুটই সে হত্যার দিন পড়েছিল। মূর্তির হাতে রিভলবার। এরকম একটা রিভলবার দিয়েই সে নরহত্যার মতো মহা অপরাধ করেছিল।

–লর্ড হ্যালিফ্যাক্স

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *