একদিন ট্রেনে

একদিন ট্রেনে

এক কয়েকদিনের জন্য লন্ডনের বাইরে গিয়েছিলাম আমি। ভোরবেলা ইউস্টন স্টেশন থেকে ট্রেনে চাপলাম। সঙ্গে কিছু দরকারী কাগজপত্র রয়েছে। ঠিক করলাম ট্রেনে যেতে যেতে ডকুমেন্টগুলো পড়ে ফেলব।

ছোট একটি কামরা রিজার্ভ করা যায় কিনা খোঁজ করতেই গার্ড সাহেব একটি খালি কামরার ব্যবস্থা করে দিলেন। এ ব্যবস্থা করতে তেমন অসুবিধাও হলো না, কারণ ট্রেনটি বলতে গেলে একরকম ফাঁকাই যাচ্ছিল।

ট্রেন ছাড়বার সময় হলো। বাঁশি বাজল, ট্রেন নড়েচড়ে উঠল। আর ঠিক সেই সময় একজন বয়স্ক ভদ্রলোক একটি ভারী ব্যাগ নিয়ে ছুটতে ছুটতে আমার কামরার সামনে চলে এলেন; তারপর দরজা খুলে ঢুকে পড়লেন ভেতরে।

একটু বিরক্তই হলাম। একা বসে নিজের কাজ আর করা যাবে না। কিন্তু উপায় কী? এ কামরা তো আর আমার একার নয়।

তবে কিছুক্ষণের মধ্যে আমাদের দুজনের আলাপ-পরিচয় হয়ে গেল। নিজের পরিচয় দিয়ে ভদ্রলোক বললেন, ভাই, আমি রেলওয়ে কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। আমাদের কোম্পানি একটা ব্রাঞ্চ লাইন খুলেছে। তার ডিউটির অনেকটাই আমার ঘাড়ে এসে পড়েছে। এ কাজটা নিয়ে আমি এখন খুবই ব্যস্ত। এই তো সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছি। লোকাল ব্যাংকে জমা দেব। তাতে কাজ চালাতে খুব সুবিধা হবে। কোন খরচের জন্য হেড অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।

কিন্তু এতগুলো টাকা নিয়ে চলাফেরা করছেন, ভয় লাগে না? আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোনো দুর্ঘটনাও তো ঘটতে পারে।

না, না! কে জানছে আমার ব্যাগে এত টাকা রয়েছে। তাছাড়া কে ছিনতাই করবে? আপনাকে বললাম বলে আপনি নিশ্চয়ই করবেন না, বলে ভদ্রলোক হাসলেন।

তবু, এভাবে…

কোন রকম দুর্ঘটনা ঘটবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া আমি খুব একটা ভিতু বা নার্ভাস টাইপের লোক নই। আমার মনোবল যথেষ্ট শক্ত।

কথাবার্তায় অনেকটা সময় কেটে গেল। ট্রেন ছুটে চলেছে। সঙ্গের কাগজগুলো পড়া হলো না। গন্তব্যে পৌঁছেও পড়া যাবে। ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলতেও ভাল লাগছে। আগেকার বিরক্তির ভাবটা কেটে গেছে। কথা প্রসঙ্গে ভদ্রলোক আমার গন্তব্যস্থল কোথায় জেনে বেশ উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, আরে, আপনার বন্ধু তো আমার খুবই পরিচিত।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আপনার বন্ধুর স্ত্রী আমার নিজের ভাগ্নী। ইস, আপনার সঙ্গে যেতে পারলে খুব ভালো হত। কটা দিন একটু বিশ্রাম মিলত। কিন্তু উপায় নেই, ব্রাঞ্চ লাইনের সব দায়দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। লাইনের পরিকল্পনাটা আমিই দিয়েছিলাম। কয়েকজন ডিরেক্টর আপত্তি জানালেও স্কিমটা শেষ পর্যন্ত ডিরেক্টর বোর্ডের মিটিংয়ে পাশ করিয়ে নিতে পেরেছি। এখন যত ঝক্কি-ঝামেলা আমার ওপর। কমাস ধরে যা খাটা-খাটনি যাচ্ছে! ভদ্রলোক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

বন্ধু আর বন্ধুপত্নীকে বলব আপনার কথা।

বলবেন, ম্লান হেসে ভদ্রলোক বললেন।

আপনার যদি কিছু বলার থাকে, তবে আমি তা ওদের বলতে পারি, আমি বললাম।

আমার! ভদ্রলোক যেন চমকে উঠলেন, তারপর নিজেকে একটু সামলে নিয়ে বললেন, হ্যাঁ, একটি কথা ওদের বলতে পারেন যে কয়েকদিনের মধ্যেই আমি সপ্তাহখানেকের ছুটি নিয়ে ওদের ওখানে যাব। ভাগ্নীকে বলবেন ব্লু রুমের ফায়ার প্লেসে যে অত আগুন না জ্বালায় । আমি গেলে ওরা আমাকে ও ঘরটিই ছেড়ে দেয়। উঃ! গতবারে গিয়ে আগুনের তাপে একেবারে ঝলসে যাওয়ার দশা।

গাড়ির গতি মন্থর হয়ে এল। সামনে স্টেশন। আলো দেখা যাচ্ছে। সামনে আর একটি গাড়ি থামার জন্য আমাদের ট্রেন প্লাটফরমে ঢোকার সিগনাল পায়নি।

দুই

একজন টিকিট চেকার ঢুকলেন কামরায়। এ কামরার টিকিট চেক করতে তার বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। মোটে তো দুজন আরোহী। সোজা আমার কাছে এসে তিনি বললেন, টিকিট?

পকেট থেকে টিকিট বের করে দেখালাম।

মনে হলো আমার সহযাত্রীর দিকে একবার তাকালেন চেকার সাহেব। তারপর নেমে গেলেন পাশের কামরার দিকে। ট্রেনও ততক্ষণে সিগনাল পেয়ে চলতে শুরু করেছে।

মি. ডুয়েরিং হাউসের দিকে তাকিয়ে আমি বিস্ময়ের সুরে বললাম, চেকার আপনার টিকিট দেখতে চাইলেন না তো?

বলতে ভুলে গিয়েছি আমার সহযাত্রী ভদ্রলোকের নাম ডি. ডুয়েরিং হাউস।

ওরা সবাই আমাকে চেনে, জানে আমি রেল কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। প্রায়ই এ লাইনে যাতায়াত করি। আমার ফার্স্টক্লাস পাস আছে।

ট্রেন স্টেশনে ঢুকল। ভদ্রলোক চট করে উঠে পড়লেন, ব্যাগটা হাতে নিয়ে বললেন, আমাকে এখানেই নামতে হবে। আপনি তো এ লাইনের শেষ স্টেশনে নামবেন। আপনার সঙ্গে গল্পগুজব করে সময়টা বেশ কাটল। চলি তাহলে।

বিদায় জানিয়ে ভদ্রলোক নেমে পড়লেন প্লাটফরমে। তারপর মিশে গেলেন যাত্রীদের ভিড়ে।

আমি জানালা দিয়ে ঝুঁকে লক্ষ করছিলাম মি. ডুয়েরিং হাউসকে। হঠাৎ কীসের ওপর যেন আমার পা পড়ল। নিচু হয়ে দেখলাম একটা সিগারকেস। হয়তো আমার সহযাত্রী ফেলে গেছেন। ঠিক তাই। দেখলাম কেসটার এক কোনায় মি. ডুয়েরিং হাউসের নাম লেখা রয়েছে।

ট্রেন ছাড়তে এখনও দুমিনিট বাকি। ভাবলাম এক ছুটে ভদ্রলোককে কেসটা দিয়ে আসি। নেমে পড়লাম প্লাটফরমে। গার্ড বোধহয় আমার কামরার দরজা বন্ধ করতে আসছিলেন।

কোথায় যাচ্ছেন? আপনার তো এখানে নামার কথা নয়, বললেন তিনি।

আসছি এক্ষুনি। আমার সহযাত্রী ভদ্রলোকটি তাঁর সিগারকেসটি ফেলে গেছেন। দামী কেস… ভদ্রলোক বোধহয় এখনও স্টেশনের বাইরে যেতে পারেননি। দেখি তাঁকে কেসটা দিয়ে আসা যায় কিনা।

তাড়াতাড়ি আসবেন। আর মিনিট দেড়েকের মধ্যেই ট্রেন ছেড়ে দেবে।

আর কথা না বাড়িয়ে ছুটতে লাগলাম। এটা একটা বড় জংশন। প্লাটফরমটাও বিরাট। ভদ্রলোক বোধহয় এতক্ষণে প্লাটফরমের অর্ধেকটা পেরিয়ে গেছেন।

কিছুটা ছুটে আসবার পরে সহযাত্রী ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম। দেখলাম একজন লোকের সঙ্গে কথা বলতে বলতে তিনি এগিয়ে চলেছেন। তারপর দুজনে ভিড় থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একান্তভাবে আলাপ করতে লাগলেন। ওঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন প্লাটফরমের একটা ল্যাম্প পোস্টের পাশে। ওঁদের ঠিক মাথার উপরে জুলছিল গ্যাস বাতি। সেই আলোয় দুজনকেই আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম।

কুলি আর যাত্রীদের ভিড় ঠেলে যতদূর সম্ভব জোরে ছুটছিলাম। মনে ভয়, এই বুঝি আমাকে না নিয়েই ট্রেন ছেড়ে দিল। এরকম মানসিক অবস্থাতেও মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গীকে ভালভাবেই লক্ষ করছিলাম। ভদ্রলোকের রঙ ফর্সা, মাথার চুল ধূসর, লম্বায় তিনি আমার সহযাত্রীর থেকে ইঞ্চি দুয়েকের ছোটই হবেন। লোকটির মুখে হালকা দাড়ি-গোঁফ।

যাক এসে গেছি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বিপদ! ঘাটে এসে তরী ডুবল । ভিড়ের ধাক্কায় পা পিছলে পড়ে গেলাম। সামলে নিয়ে উঠে পড়তে দুতিন সেকেন্ডের বেশি লাগেনি কিন্তু যখন সিধে হলাম তখন আমার সহযাত্রী বা তার সঙ্গী কাউকেই দেখতে পেলাম না। চারপাশে তাকালাম-নাঃ কোথাও ওঁদের কোন চিহ্ন নেই! ওঁরা দুজনেই কি কর্পূরের মতো উবে গেলেন!

ঢং ঢং ঢং… ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা পড়ল। বেজে উঠল ট্রেনের বাঁশি।

কাছেই স্টেশনের একজন পয়েন্টস ম্যান দাঁড়িয়েছিল। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, এই যে ভাই, একটু আগে গ্যাস পোস্টের তলায় যে দুজন। ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে ছিলেন তারা কোন্ দিকে গেলেন বলতে পার?

আমি লক্ষ করিনি, স্যার।

ট্রেনের বাঁশি আবার বেজে উঠল। দেখলাম হাত নেড়ে গার্ড সাহেব আমাকে গাড়িতে উঠবার ইঙ্গিত করছেন। ছুটলাম নিজের কামরার দিকে। গাড়ি নড়েচড়ে উঠল, চলতে শুরু করল ধীর গতিতে। এক লাফে নিজের কামরার ফুটবোর্ডে উঠে পড়লাম তারপর ঢুকে পড়লাম কামরায়।

আমি তখন হাঁপাচ্ছি। আমার হাতে সহযাত্রীর ফেলে যাওয়া সুদৃশ্য সিগারকেস। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তখনও তাকিয়ে আছি বিরাট প্লাটফরমটার দিকে।

গাড়ির গতি বাড়ল। পিছনে পড়ে রইল জংশন তার বিরাট প্লাটফরম নিয়ে।

বাকি পথটুকু আর সঙ্গে আনা কাগজপত্রে মন বসাতে পারলাম না। সহযাত্রী আর তার সিগারকেসটার কথাই বারবার মনে হানা দিতে লাগল। কেন যে মনে পড়ছিল জানি না। ব্যাপারটা এমন কিছু অসাধারণ নয়… ট্রেন থেকে তাড়াতাড়ি নামতে গিয়ে লোকে কি অনেক সময় টুকটাক জিনিসপত্র ফেলে যায় না?

তিন

গন্তব্যে পৌঁছতে সাঁঝ ঘনাল। স্টেশন থেকে বন্ধুর বাড়ি যেতে কোন অসুবিধা হলো না। কারণ বন্ধুবর স্টেশনে তার মোটরগাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল। স্টেশন থেকে বাড়ি আসতে আধ ঘণ্টার বেশি লাগল না।

গিয়ে দেখলাম আরও কয়েকজন অতিথি এসেছেন। গোসল করে, পোশাক পাল্টে ড্রয়িংরুমে এলাম। বন্ধুবর তার অতিথিদের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিল।

কিছুক্ষণ নানা গল্প-গুজব চলল, তারপর আমরা গিয়ে বসলাম খাবার টেবিলে। আজকের অভিজ্ঞতাটা বলবার জন্য মনটা ছটফট করছিল, কিন্তু এতক্ষণ সে কথা বলার সুযোগ পাইনি। এবার সুযোগ মিলল। বন্ধুপত্নীর দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনার এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয়ের সঙ্গে দেখা হলো ট্রেনে, আমরা এক সঙ্গে অনেকটা পথ এলাম। গল্প-গুজবে সময়টা বেশ কেটে গেল।

তাই বুঝি? কার সঙ্গে দেখা হলো? বিস্মিত হেসে বললেন বন্ধুপত্নী।

আপনার মামা মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে।

বন্ধুপত্নী চমকে উঠলেন, বন্ধুকেও কেমন যেন বিব্রত মনে হলো।

মি. ডুয়েরিং হাউস বলেছেন শীগগিরই হপ্তাখানেকের ছুটি নিয়ে তিনি এখানে আসবেন। তাকে যেন রু রুমটাই ছেড়ে দেয়া হয়। তবে গতবারের মত ফায়ার প্লেসে যেন অত আগুনের ব্যবস্থা করা না হয়। গতবার আগুনের তাপে অনেক কষ্ট পেয়েছেন তিনি।

কথা শেষ করার আগেই বুঝতে পারলাম ঘরের মধ্যে অস্বস্তির কালো একটা ছায়া নেমে এসেছে। ঘরের আনন্দময় পরিবেশটা যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। কেমন একটা থমথমে ভাব। খাবার ঘরে দুঃসহ স্তব্ধতা। আমি হয়তো এমন কোনো কথা বলে ফেলেছি যা না বললেই ভালো হত! অপ্রস্তুত হয়ে পড়লাম। আমার জন্যই বুঝি আনন্দের সুর কেটে গেল। কিন্তু আমি কী এমন কথা বললাম যাতে ডিনার পার্টিটা নিরানন্দময় হয়ে গেল? কিছুই বুঝতে না পেরে চুপ করে রইলাম।

ডিনার পার্টি আর জমল না। বন্ধু, বন্ধুপত্নী এবং অতিথিরা খুশির ভাব আনার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বেশ বোঝা গেল ভাবটা কৃত্রিম। যেটা স্বচ্ছন্দে গতিতে এগিয়ে চলছিল তাও যেন হঠাৎ মন্থর গতি হয়ে উঠল। কোথায় ঘটল ছন্দপতন?

কোন রকমে ভোজন পর্ব চুকল। অতিথিরাও কোন না কোন অজুহাতে চলে গেলেন যে যার বাড়ি। এরা সবাই স্থানীয়। বহিরাগত অতিথি কেবল আমি একা।

খাওয়ার পর ড্রয়িংরুমে বসলাম আমি এবং বন্ধু। বন্ধুপত্নীও শরীর খারাপের কথা বলে শোবার ঘরে চলে গেলেন। দুজনে দুটো সিগারেট ধরিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলাম। তারপর নীরবতা ভেঙে আমিই বললাম, আনন্দের সুরটা হঠাৎ কেটে গেল। আমার কারণেই যে এটা ঘটেছে তা বুঝতে পারছি। কিন্তু বুঝতে পারিনি আমার কোন্ কথায় বা আচরণে এমনটি ঘটল?

সুর কেটে গেল, তাই না? সিগারেটে টান দিয়ে বন্ধু বলল, তুমি আমার স্ত্রীকে যা বলেছ তাতে আমরা সবাই একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়ে গিয়েছি।

ঠিক বুঝলাম না, বিমূঢ়ভাবে বললাম আমি।

তুমি বুঝবে কী করে? ব্যাপারটা তো তুমি জানোই না, এক মুখ ধোয়া ছাড়ল বন্ধু।

দুঃখিত! আনন্দের আসরটা মাটি করে দিলাম।

আরে না না, তোমার কোন দোষ নেই। বিব্রতভাবে বন্ধু বলল। তুমি যা করেছ, সেটাই স্বাভাবিক। যে বাড়িতে যাচ্ছি সে বাড়ির একজন আত্মীয়ের সঙ্গে পথে দেখা হলো, গন্তব্যে পৌঁছে এ কথা বলাই স্বাভাবিক। আমরা হলেও বলতাম।

তাহলে? আমি আরও অবাক হয়ে বললাম।

আসলে আমার মামা শ্বশুর অর্থাৎ মি. ডুয়েরিং হাউসের প্রসঙ্গ উঠবার ফলেই গোটা পরিবেশটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠল।

কেন কি হয়েছে মি. ডুয়েরিং হাউসের?

কী যে হয়েছে তাই তো কেউ জানে না। আচ্ছা তোমার কোন ভুল হয়নি তো, তুমি কি নিশ্চিত যে ট্রেনে যে ভদ্রলোক তোমার সহযাত্রী ছিলেন তিনি মি. ডুয়েরিং হাউস?

দেখ, মি. ডুয়েরিং হাউসকে আমি আগে কখনও দেখিনি। ভদ্রলোক নিজের যে পরিচয় দিলেন তাতে… আচ্ছা দাঁড়াও উনি একটা জিনিস ফেলে গিয়েছিলেন কামরায়, আপাতত আমার কাছে রয়েছে সেটা। দেখ তো এ সিগারকেসটা তোমার মামা শ্বশুরের কিনা..।

পকেট থেকে কেসটা বের করে বন্ধুর হাতে দিলাম।

কেসটা হাতে নিয়ে অবাক বন্ধুবর, বিস্মিত স্বরে বলল, হ্যাঁ, এটাই তো আমার মামা শ্বশুরের সিগার কেস। এটা বহুবার দেখেছি। তাছাড়া এই তো কোনায় তার নাম মনোগ্রাম করা রয়েছে। না, এটা তাঁরই জিনিস। তুমি বলছ এটা উনি ট্রেনের কামরায় ফেলে গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ।

কিন্তু আমার মামা শ্বশুরের সঙ্গে দেখা হওয়াটা, একটু ইতস্তত করে বন্ধু বলল খুবই আশ্চর্যের ব্যাপার!

এর মধ্যে আশ্চর্যের কী আছে? ব্যাপারটা একটু খোলাসা করে বলো তো। তখন থেকে কেবলই রহস্যের জাল বুনে চলেছ।

ব্যাপারটা হলো, কণ্ঠস্বর নিচু করে বন্ধু বলল, আমার মামা শ্বশুর রেল কোম্পানির সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে পালিয়েছিলেন। কেউ জানে না এখন তিনি কোথায়, তিনি একজন ফেরারি। পুলিশ তাঁকে খুঁজে বেড়াচ্ছে।

কী বলছ তুমি!

ঠিকই বলছি, এটা আমাদের জন্যও একটা দারুণ লজ্জার কথা। মি. ডুয়েরিং হাউস আমাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। কাজেই তার প্রসঙ্গ ওঠায় আমরা বেশ বিব্রত হয়ে যাই।

তিনি কতদিন ধরে নিরুদ্দেশ?

তা প্রায় মাস তিনেক।

অথচ আজকেই কয়েকঘণ্টা আগে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, কথা হয়েছে।

তাই তো ভাবছি, এটা কী করে হল সেটাই বুঝতে পারছি না।

তুমি বলছ মি. ডুয়েরিং হাউস সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে ফেরার হয়েছেন। অথচ আমাকে বলেছেন টাকাটা তিনি স্থানীয় ব্যাংকে জমা দেবেন। ব্রাঞ্চ লাইনের কাজের জন্য যাতে সব সময় হেড অফিসের দিকে তাকিয়ে থাকতে না হয়, সেজন্যই এ ব্যবস্থা। তাঁর সঙ্গে যে সত্তর হাজার পাউন্ড রয়েছে একথা তিনি নিজের থেকেই আমাকে বলেছেন। কোন অপরাধী কি এরকম বলে বেড়ায়?

হ্যাঁ, তোমার কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়।

আচ্ছা, মি. ডুয়েরিং হাউস মানুষ হিসেবে কেমন?

তাকে অত্যন্ত সৎ এবং কর্মনিষ্ঠ বলেই জানতাম। সাধারণ একজন কেরানির চাকরি নিয়ে তিনি রেল কোম্পানিতে ঢুকেছিলেন। কোন খুঁটির জোর ছাড়াই। তারপর নিজের সততা, নিষ্ঠা আর কর্মদক্ষতায় ধাপে ধাপে উন্নতি করে তিনি কোম্পানির ডিরেক্টর বোর্ডের একজন সদস্য পর্যন্ত হয়েছিলেন। কর্মজীবনের শেষ প্রান্তে এসে কেন যে তাঁর দুর্মতি হল। সারা জীবনের সুনামটাকে তিনি ধ্বংস করে ফেলেছেন!

বন্ধু দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে আজ কিন্তু আমার সত্যিই দেখা হয়েছিল।

হ্যাঁ, সিগারকেসটা দেখে তো তাই মনে হচ্ছে।

ব্যাপারটার মধ্যে যেন রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি।

হুঁ, চিন্তিতভাবে বন্ধু বলল।

চলো না কাল একবার জংশন স্টেশন থেকে ঘুরে আসি; দেখি নতুন কোন খোঁজ-খবর পাওয়া যায় নাকি।

বেশ।

কিন্তু আমাদের যাবার ব্যাপারটা গোপন রেখো, আমি তাকে সাবধান করে দিলাম।

রাখবো।

তোমার স্ত্রীকেও আপাতত কিছু বলো না।

বেশ বলব না।

চার

পরদিন তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা দুই বন্ধু জংশন স্টেশনে এলাম। এই স্টেশনেই মি. ডুয়েরিং হাউস নেমেছিলেন। আর এখান থেকেই নতুন ব্রাঞ্চ লাইন পাতা হচ্ছে। সুতরাং আমার নিরুদ্দেশ সহযাত্রীর কোন খবর আদৌ মিললে এখান থেকেই পাওয়া যাবে।

ট্রেন থেকে নেমে সোজা স্টেশন মাস্টারের ঘরে গেলাম। দেখলাম স্টেশন মাস্টার আমার বন্ধুকে বেশ ভালোভাবেই চেনেন। মামুলি দুচারটি কথাবার্তার পর বন্ধুবর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা, মি. ডুয়েরিং হাউস কি কাল এই স্টেশনে নেমেছিলেন?

দারুণ অবাক হয়ে স্টেশন মাস্টার তাকালেন আমাদের দিকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, মি. ডুয়েরিং হাউস? কই এরকম খবর তো আমার কানে আসেনি।

আপনি মি. ডুয়েরিং হাউসকে চেনেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

কেন চিনব না? তিনি আমাদের রেল কোম্পানির একজন ডিরেক্টর। ব্রাঞ্চ লাইন পাতবার কাজে তাঁকে বহুবার এপথে যাতায়াত করতে হয়েছে। তিনি আমার এ ঘরে এসে বসতেন, চা খেতেন। ব্রাঞ্চ লাইনের কাজ কতদূর এগিয়েছে বা কাজকর্ম কেমন হয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করতেন। মি. ডুয়েরিং হাউসকে আমি বেশ ভালোভাবেই চিনি।

কাল বিকেলে এই স্টেশনেই তিনি নেমেছিলেন। ইউস্টন স্টেশন। থেকে আমার সঙ্গে একই কামরায় তিনি এসেছিলেন।

আপনি ডুয়েরিং হাউসকে চেনেন তো? স্টেশন মাস্টার এবার আমাকেই পাল্টা প্রশ্ন করলেন।

কালকের আগে তাঁকে কখনও দেখিনি।

তাহলে কী করে বুঝলেন যে আপনার সহযাত্রীই মি. ডুয়েরিং হাউস?

ন্দ্রলোক তো সেই পরিচয়ই দিয়েছিলেন।

তবে তিনি নিশ্চয়ই অন্য কেউ। যেকোন কারণেই হোক তিনি মি. ডুয়েরিং হাউস বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন, স্টেশন মাস্টার গম্ভীরভাবে বললেন।

কিন্তু মি. ডুয়েরিং হাউস এটা ট্রেনের কামরায় ফেলে গেছেন।

ট্রেনের কামরায়?

হা, আগেই বলেছি গতকাল ইউস্টন স্টেশন থেকে এই জংশন পর্যন্ত তিনি আমার সহযাত্রী ছিলেন।

কিন্তু এ অবিশ্বাস্য। স্টেশন মাস্টার বললেন।

কেন? আমি প্রশ্ন করলাম।

মি. ডুয়েরিং হাউস একজন ফেরারী আসামী। রেল কোম্পানির সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে তিনি উধাও হয়েছেন। এ লাইনে তিনি বহুবার যাতায়াত করেছেন। এ লাইনের স্টেশন মাস্টার, গার্ড, টিকিট-চেকার, পয়েন্টস ম্যান, খালাসী, ড্রাইভার, কুলি সবাই তাঁকে চেনে। তাঁর খোঁজ পাওয়া গেলে সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশে খবর চলে যাবে। সুতরাং মি. ডুয়েরিং হাউস এ লাইনে অন্তত যাতায়াত করার সাহস করবেন বলে মনে হয় না।

টিকিট চেকার? আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, গতকাল আমাদের কামরায় একজন টিকিট চেকার এসেছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই আমার সহযাত্রীকে দেখেছেন। তাকে পাওয়া যাবে এখন?

না, সন্ধ্যার আগে তাকে পাবেন না। সে যে ট্রেনে আসবে সে ট্রেন এখানে পনের মিনিট থামবে। তখন তাকে আমার অফিসে তলব করতে পারি। কিন্তু আপনারা কি অতক্ষণ অপেক্ষা করবেন?

না করে উপায় কী, বন্ধু বলল, অবশ্য সময় কাটানো খুব একটা সমস্যা হবে না। ব্রাঞ্চ লাইনের কাজকর্ম দেখব। লাইনের লোক জনের কাছে খোঁজখবর নেব গতকাল তাদের কেউ মি. ডুয়েরিং হাউসকে দেখেছে কিনা। আপনাদের এলাকাটা ঘুরে দেখব। কয়েক ঘণ্টা তো সময় তা দেখতে দেখতে কেটে যাবে।

ব্রাঞ্চ লাইনের কাজকর্ম দেখে আর রেল কর্মচারীদের জিজ্ঞাসাবাদ সেরে সন্ধ্যার একটু আগেই স্টেশনে ফিরে এলাম। আমাদের তদন্তের ফল মোটেই আশাপ্রদ হয়নি। মি. ডুয়েরিং হাউসকে গতকাল কেউ দেখেনি।

এক্সপ্রেস ট্রেন যথাসময়েই জংশন স্টেশনে এল। স্টেশন মাস্টার চেকার সাহেবকে নিজের কামরায় ডেকে পাঠালেন।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চেকার এসে গেলেন। চিনতে পারলাম। কালকের টিকেট চেকারই ইনি।

স্টেশন মাস্টার টিকিট চেকারের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই দুই ভদ্রলোক আপনাকে মি. ডুয়েরিং হাউস সম্পর্কে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চান। আপনার তো তাড়া আছে– এক্ষুনি ট্রেনে ফিরে যেতে হবে…

না, আমার তেমন তাড়া নেই। আজকে আমার ডিউটি এখানেই শেষ । বাকি স্টেশনগুলোর জন্য আর একজন চেকারের উঠবার কথা আছে এই স্টেশন থেকে। বাকি পথটুকু আমি এমনিই চলে যেতাম। সে না হয় পরের লোকাল ট্রেনেই যাব।

বেশ।

এঁরা কি পুলিশের পক্ষ থেকে এসেছেন? চেকার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন।

না না সেসব কিছু নয় দ্রুত বললাম আমি। আমাদের প্রশ্ন শুনলেই বুঝতে পারবেন ব্যাপারটা আসলে কী।

বেশ, বলুন কী প্রশ্ন। চেকার বললেন।

আপনি মি. ডুয়েরিং হাউসকে চেনেন? আমি প্রশ্ন করলাম। চিনি।

তাঁকে দেখলে চিনতে পারবেন?

নিশ্চয়ই পারব।

আচ্ছা, গতকাল যে ট্রেনে আপনি টিকিট চেক করেছিলেন তাতে মি. ডুয়েরিং হাউস ছিলেন?

না।

এ ব্যাপারে আপনি নিশ্চিত?

অবশ্যই। চেকার বেশ জোরের সঙ্গেই বললেন।

কী করে এতটা নিশ্চিত হলেন?

আমি প্রতিটি কামরার প্রতিটি লোকের টিকিট চেক করেছি। আর গতকালকের যাত্রীদের মুখও আমার মোটামুটি মনে আছে। কিন্তু কোন কামরাতেই মি. ডুয়েরিং হাউস ছিলেন না। দেখুন আপনার চেহারা আমার মনে আছে, অথচ আপনাকে আমি কালকের আগে কখনও দেখিনি। কাজেই বুঝতেই পারছেন মি. ডুয়েরিং হাউস কোনো কামরায় থাকলে আমি তাঁকে দেখলেই চিনতে পারতাম।

কিন্তু মি. ডুয়েরিং হাউস তো আমার কামরাতেই ছিলেন।

আপনার কামরায়! বিস্মিতভাবে চেকার বললেন, যতদূর মনে পড়ছে সে কামরায় তো আপনি ছাড়া আর কোনো যাত্রী ছিলেন না।

মোটেই না, আমার কামরাতেই মি. ডুয়েরিং হাউস ছিলেন। তিনি এই স্টেশনে নেমে যান। তাঁর ফেলে যাওয়া সিগার কেসটি তাঁকে পৌঁছে দিতে গিয়ে আমি ট্রেন ফেল করতে বসেছিলাম।

চেকার বিমূঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে।

কালকে যে গার্ড সাহেবকে দেখেছিলাম, তাকে কোথায় পাওয়া যাবে? স্টেশন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

এই ট্রেনেই আছেন তিনি।

ট্রেন ছাড়তে কতক্ষণ দেরি?

আর মিনিট পাঁচেক পরেই ছেড়ে দেবে।

আমি যে মি. ডুয়েরিং হাউসের সিগার কেসটা নিয়ে ছুটেছিলাম তা গার্ড সাহেব দেখেছেন। ইচ্ছে করলে তাকে এখানে ডেকে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে নিতে পারেন, স্টেশন মাস্টারের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি।

স্টেশন মাস্টারের জরুরি ডাকে গার্ড সাহেব ছুটতে ছুটতে এলেন। তিনি স্বীকার করলেন আমাকে প্লাটফরম ধরে ছুটে যেতে দেখেছেন। এটাও বললেন যে আমি যেন কার সিগার কেস ফেরত দেবার জন্য দৌড়ে যাচ্ছিলাম।

ট্রেন ছাড়ার সময় হলো। গার্ড সাহেব দৌড়ালেন ট্রেনের দিকে।

ট্রেন ছেড়ে দিল। আমরা বোকার মতো তাকিয়ে রইলাম চলন্ত ট্রেনের দিকে।

নীরবতা ভেঙে বন্ধু বলল, তুমি বোধহয় স্বপ্ন দেখেছ।

স্বপ্ন? যে কথা কোনদিন শুনিনি তা নিয়ে স্বপ্ন দেখব কী করে? ব্রাঞ্চ লাইনের কথা আমি কোনদিন শুনিনি। মি. ডুয়েরিং হাউস ব্যাগে করে সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছেন, তাও আমি জানতাম না।

হয়তো কোথাও শুনেছিলে বা খবরের কাগজে পড়েছ কিন্তু খেয়াল করনি। তোমার মনের গহনে এসব কথা জমা ছিল। স্বপ্নে মনের অচেতন স্তর থেকে মুক্তি পেয়ে ব্যাপারটা তোমার মনে এসেছিল। জাগ্রত অবস্থায় যে ব্যাপারটাকে কোন গুরুত্ব দাওনি, স্বপ্নাতুর অবস্থায় সেটাই গুরুত্ব পেয়ে গেছে।

বেশ, তর্কের খাতিরে মানলাম তোমার কথা, কিন্তু তোমার বাড়ির ব্লু রুমের কথা আমি কী করে জানব? আমি তোমার এ বাড়িতে আগে কখনও আসিনি। মি. ডুয়েরিং হাউসকে যে রু রুমে থাকতে দেয়া হয়েছিল তা তো আমার জানার কথা নয়।

হুঁ, এটা ঠিকই বলেছ। হয় আমাদের না হয় মি. ডুয়েরিং হাউসের কাছে না শুনলে এটা তোমার জানার কথা নয়।

কিন্তু তোমাদের কাছ থেকে আমি একথা শুনিনি, তাহলে অনিবার্যভাবে এটাই প্রমাণ হচ্ছে যে কথাটা আমি শুনেছি আমার সহযাত্রী মি. ডুয়েরিং হাউসের কাছ থেকে।

ব্যাপারটা তো তা-ই দাঁড়াচ্ছে, বিমূঢ়ভাবে বন্ধুবর বলল।

তাছাড়া এই সিগার কেসটা, এটা আমার কাছে এল কী করে?

তাই তো! ওটা আপনার কাছে এল কী করে? স্টেশন মাস্টার এতক্ষণ আমাদের দুজনের কথা শুনছিলেন। এবার তিনি আমাকেই প্রশ্ন করলেন।

এ এক অদ্ভুত রহস্য, সবাই বলছে মি. ডুয়েরিং হাউস একজন ফেরারী আসামী। অথচ তুমি বলছ কাল এ লাইনে তিনি তোমার সহযাত্রী ছিলেন, বন্ধু বললেন।

হ্যাঁ, শুধু তাই নয় তাঁর মধ্যে কোন লুকোচুরির ভাবও ছিল না। কোন পলাতক আসামী কি এমনভাবে সহযাত্রীর কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে জনবহুল প্লাটফরমের মধ্য দিয়ে যায়? আর তাছাড়া এমন একটা স্টেশন যেখানে কর্মচারীরা সবাই তাঁকে চেনে? মি. ডুয়েরিং হাউসের কথাবার্তায় এবং আচরণে তাঁকে কিন্তু আমার একজন সত্যিকারের ভদ্রলোক বলেই মনে হয়েছে। আমারও ধারণা এর মধ্যে একটা রহস্য রয়েছে।

এ রহস্য ভেদ করা আমাদের কাজ নয়, আমি কালই কর্তৃপক্ষের কাছে সব কিছু জানিয়ে একটা রিপোর্ট পাঠাচ্ছি, স্টেশন মাস্টার বললেন। রিপোর্টে আমি এ ব্যাপারটা গোয়েন্দা দিয়ে তদন্ত করাবার সুপারিশ করব।

পাঁচ

কয়েকদিন পর রেল কোম্পানির কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে চিঠি পেলাম। ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমাকে অনুরোধ করেছেন ডিরেক্টর বোর্ডের এক বিশেষ সভায় উপস্থিত থাকার জন্য। বুঝলাম বোর্ডের সদস্যরা আমাকে মি. ডুয়েরিং হাউস সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতে চান।

সভার আগের দিনই লন্ডনগামী ট্রেনে চেপে বসলাম। কোম্পানির হেড অফিস লন্ডনে। সেখানেই বোর্ডের সভা। সভায় যাতে যথাসময়ে পৌঁছতে পারি সেজন্য কোন রকম ঝুঁকি না দিয়ে একদিন আগেই বন্ধুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম।

যথাসময়ে বোর্ডের অফিসে পৌঁছে গেলাম। কোম্পানির একজন পদস্থ কর্মচারী আমাকে মিটিংরুম-এ নিয়ে গেলেন।

দেখলাম সুন্দর সাজানো গোছানো একটি ঘরে বড় টেবিলের চারপাশে কয়েকজন ভদ্রলোক বসে আছেন। বুঝলাম এঁরাই রেল কোম্পানির ডিরেক্টর। ম্যানেজিং ডিরেক্টর আমাকে স্বাগত জানিয়ে বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন।

পরিচিতির পর শুরু হলো আসল কাজ। কোম্পানির চেয়ারম্যান বললেন, আমরা জংশন স্টেশনের স্টেশন মাস্টারের কাছ থেকে একটা রিপোর্ট পেয়েছি। রিপোর্টটা আমাদের কোম্পানির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। রিপোর্টে বলা হয়েছে কদিন আগে আপনি নাকি আমাদের কোম্পানির নিরুদ্দিষ্ট ডিরেক্টর মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে একই কামরায় গিয়েছিলেন?

হ্যাঁ, ইউস্টন থেকে জংশন পর্যন্ত আমরা একই কামরায় ছিলাম।

আপনি কি মি. ডুয়েরিং হাউসকে চিনতেন?

না, সেদিনই ট্রেনের কামরায় তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ হয়।

তাঁর সঙ্গে আপনার কী ধরনের কথাবার্তা হয়েছিল?

নানা রকমের কথাবার্তা হয়েছিল।

আমাদের কোম্পানি সংক্রান্ত কোন কথা হয়েছিল?

জ্বি।

কী কথা?

মি. ডুয়েরিং হাউস নতুন ব্রাঞ্চ লাইনটা সম্পর্কে আলোচনা করেছিলেন। কাজের জন্য তিনি যে ব্যাগে করে সত্তর হাজার পাউন্ড নিয়ে যাচ্ছেন, সে কথাও বলেছেন।

তাই নাকি! চেয়ারম্যানের কণ্ঠস্বরে বিস্ময়ের সুরটা আর চাপা রইল না।

বোর্ডের অন্য সদস্যরা উৎসুক হয়ে আমাদের কথা শুনছিলেন, এবার তাঁদের মধ্যে একজন জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা, ট্রেনে যার সঙ্গে আপনার আলাপ হয়েছিল তিনিই যে আসল মি. ডুয়েরিং হাউস তা কী করে বুঝলেন? অন্য কোন লোকও তো বিশেষ উদ্দেশ্যে নিজেকে মি. ডুয়েরিং হাউস বলে চালাতে পারেন।

তা পারেন, আমি স্বীকার করলাম, কিন্তু একজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের কাছে ছদ্মপরিচয় দিয়ে কী লাভ? তাছাড়া এমন লোকের নামে পরিচয় দেয়া হলো তিনি একজন ফেরারি আসামী পুলিশ যাকে খুঁজছে।

আপনার সেদিনের সহযাত্রীর চেহারার বর্ণনা দিতে পারবেন? চেয়ারম্যান প্রশ্ন করলেন।

যতদূর মনে ছিল সহযাত্রীর চেহারা এবং ভাবভঙ্গির একটা বর্ণনা দিলাম।

চেয়ারম্যানের মুখ গম্ভীর হলো। বোর্ডের সদস্যদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার বর্ণনা শুনে ভদ্রলোককে তো মি. ডুয়েরিং হাউস বলেই মনে হচ্ছে।

এ দেখছি বড়ই অদ্ভুত রহস্যময় ব্যাপার! একজন প্রবীণ সদস্য মন্তব্য করলেন।

এবার আমি সিগার কেসটি বের করে টেবিলের উপর রেখে বললাম, আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক এটা ফেলে গিয়েছিলেন।

চেয়ারম্যান সিগারকেসটি পরীক্ষা করে সেটা একজন সদস্যের হাতে দিলেন। তারপর বোর্ডের সদস্যদের হাতে হাতে ঘুরতে লাগল সিগারকেসটা।

তাঁদের পরীক্ষা শেষ হলে চেয়ারম্যান গম্ভীরভাবে বললেন, সিগারকেসটা যে মি. ডুয়েরিং হাউসের তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমি নিজে এবং বোর্ডের মাননীয় সদস্যরা সবাই এই সিগারকেসটা তাঁকে বহুবার ব্যবহার করতে দেখেছি।

চেয়ারম্যান কলিংবেল টিপলেন, একজন বেয়ারা ঘরে ঢুকতে তিনি নিচু গলায় কী যেন আদেশ করলেন। একটু পরেই ঘরে ঢুকলেন সেদিনের সেই টিকিট চেকার ।

বসুন, চেয়ারম্যান বললেন। আমার মতো চেকার সাহেবেরও জবানবন্দি নেওয়া হল।

আপনি মি. ডুয়েরিং হাউসকে চেনেন?

হ্যাঁ, বেশ ভালোভাবেই চিনি।

তাঁকে চিনতে ভুল হবার কোন সম্ভাবনা আছে?

মি. ডুয়েরিং হাউসকে এতবার দেখেছি যে তাঁকে দেখলে চিনতে পারব এমনটি হতেই পারে না, চেকার সাহেব বেশ জোর দিয়েই বললেন।

এই ভদ্রলোক বলছেন মি. ডুয়েরিং হাউস ইউস্টন থেকে জংশন স্টেশন পর্যন্ত ওঁর সঙ্গে একই কামরায় এসেছেন। আপনি তো সেদিন ওই ট্রেনের চেকার ছিলেন তাই না?

হ্যাঁ।

আচ্ছা, আপনি কি সেদিন মি. ডুয়েরিং হাউসকে দেখেছেন? চেয়ারম্যান যেন তীরের মতো কথাগুলো ছুঁড়ে দিলেন।

জ্বি না, আমি প্রতিটি যাত্রীর টিকিট পরীক্ষা করেছি। মি. ডুয়েরিং হাউস ট্রেনে থাকলে নিশ্চয়ই তাঁকে দেখতে পেতাম, চিনতে পারতাম।

এই ভদ্রলোককে চেনেন? ওঁকে দেখেছেন কোনদিন?

উনি আমার পূর্ব পরিচিত নন, সেদিন ট্রেনের একটি কামরায় উনি ছিলেন।

আপনি কখন ওঁর কামরায় টিকিট চেক করতে যান?

ট্রেন জংশন স্টেশনে ঢুকবার ঠিক আগে! সিগনাল না পেয়ে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

কিন্তু এ ভদ্রলোক তো বলছেন জংশন স্টেশন পর্যন্ত মি. ডুয়েরিং হাউস ওঁর কামরাতেই ছিলেন।

সেদিন আমি যখন ওঁর কামরায় চেক করতে গিয়েছিলাম তখন সেখানে উনি ছাড়া দ্বিতীয় কেউ ছিলেন না।

আমার দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান বললেন, আপনার কথার সঙ্গে আমাদের চেকারের বক্তব্যের কোন সঙ্গতি নেই। একজন বলছেন মি. ডুয়েরিং হাউস কামরায় ছিলেন আর একজন বলছেন ছিলেন না।

একটু থেমে প্রতিটি শব্দ ধীর এবং স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন তিনি, তাহলে এই সিদ্ধান্তেই আসতে হয় যে আপনাদের দুজনের মধ্যে একজনের উক্তি সঠিক নয়। মাফ করবেন কিন্তু একথা বলতে বাধ্য হচ্ছি যে আপনাদের দুজনের একজন মিথ্যা কথা বলছেন।

আমি সত্যি কথাই বলছি, স্যার, টিকিট চেকারের দিকে একটু সদ্ধি দৃষ্টিতেই তাকালেন চেয়ারম্যান। চেকারের সঙ্গে পলাতক মি. ডুয়েরিং হাউসের একটা গোপন যোগাযোগ আছে–এ রকম একটা সন্দেহই কি চেয়ারম্যান সাহেবের মনে এসেছে?

টিকিট চেকারও বোধহয় এরকম কিছু একটা আশঙ্কা করে ভীরু গলায় বলল, আমি সত্যি কথাই বলছি, স্যার।

চেয়ারম্যান আমার দিকে সপ্রশ্ন চাউনি তুলতেই আমি বললাম, আমার বক্তব্য সম্বন্ধে নিজের মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। আমি আগে যা বলেছি এখনও তা-ই বললাম।

এরপর সেদিনের গার্ডের জবানবন্দি নেয়া হলো। কিন্তু রহস্য সমাধানের কোন ক্ল পাওয়া গেল না। গার্ড জানালেন ট্রেন ছাড়বার একটু আগে তিনি আমাকে প্লাটফরম দিয়ে ছুটতে দেখেছিলেন। আমার সহযাত্রী একটা সিগারকেস ফেলে গিয়েছিলেন। সেটা তাঁকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য আমি ছুটেছিলাম–একথাটাও তিনি বললেন।

বোর্ডের বৈঠকে নেমে এল এক অস্বস্তিকর নীরবতা।

.

নীরবতা ভেঙে চেয়ারম্যান বললেন, ব্যাপারটা মোটেই পরিষ্কার হলো না। আমরা যে তিমিরে তিমিরে ছিলাম সেই তিমিরেই রয়ে গেলাম। এবার তাহলে কাগজগুলো দেখা দরকার। সেদিন ঐ ট্রেনের গার্ড চেকার এদের ডিউটি বুক নিয়ে আসা হোক। ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত করতে চাই।

ডিরেক্টররা সায় দিলেন তাঁর কথায়, সেক্রেটারির দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান বললেন, এ ব্যাপারে ডে বুকটা একবার দেখা দরকার।

সেক্রেটারি কলিং বেল টিপল। বেয়ারা ঢুকল। তার দিকে তাকিয়ে সেক্রেটারি বলল, মি. রাইকস।

একজন ডিরেক্টরের কথা থেকে বুঝলাম যে মি. রাইকস কোম্পানির একজন আন্ডার সেক্রেটারি।

ছয়

মি. রাইকস এলেন। ভদ্রলোক বেঁটে, রোগা, মাথার চুল ধূসর, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ রঙ ফর্সা, মুখে হালকা দাড়ি গোঁফ। লোকটি মিটিং রুমের দোরগোড়ায় আসতে না আসতেই সেক্রেটারি তাঁকে, যেদিন মি. ডুয়েরিং হাউস আমার সহযাত্রী ছিলেন বলে দাবি করেছি, সেই দিনকার ডে বুকটি নিয়ে আসবার জন্য বললেন।

মাথা ঝাঁকিয়ে মি. রাইকস চলে গেলেন।

মি. রাইকস বোধহয় মুহূর্তকাল দোরগোড়ায় ছিলেন। কিন্তু তাঁকে দেখে আমি এমন চমকে উঠলাম যে কিছুক্ষণ কোন কথাই বলতে পারলাম না। তারপর বেয়ারা দরজা ভেজিয়ে দিতেই আমি চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম।

ওই ভদ্রলোক… হ্যাঁ, ওই ভদ্রলোকই সেদিন ব্ল্যাক ওয়াটার জংশনের প্লাটফরমে মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে কথা বলছিলেন। উত্তেজিতভাবে আমি বললাম।

সবাই স্তম্ভিত।

আপনি বোধহয় ভুল করছেন, উনি হেড অফিসের একজন আন্ডার সেক্রেটারি, ওঁর তো ব্ল্যাক ওয়াটার জংশনে যাবার কথা নয়, সেক্রেটারি বললেন।

না, আমি মোটেই ভুল করিনি। আমি জোর দিয়ে বললাম। ওঁরা দুজনে একটি লাইটপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন। আলো পড়ছিল ওদের গায়ে। দুজনকেই আমি স্পষ্ট দেখেছি। না না, আমি মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে এই ভদ্রলোককেই দেখেছিলাম।

চেয়ারম্যান একটু বিব্রতভাবেই বললেন।

মি. ল্যাংফোর্ড (আমার নাম), একটু ভেবেচিন্তে কথা বলবেন। আপনার কথার তাৎপর্যটা কি ঠিক বুঝতে পারছেন?

আমি নিজেকে যেমন চিনি, ওই ভদ্রলোককে ঠিক তেমনি নিশ্চিতভাবে চিনতে পারছি।

আপনার কথার ফলাফল কী হতে পারে তা কি ভেবে দেখেছেন? আপনি কিন্তু কোম্পানির একজন পদস্থ কর্মচারীর বিরুদ্ধে প্রকারান্তরে মারাত্মক অভিযোগ আনছেন?

আমি শপথ করে বলতে পারি একটু আগে যে ভদ্রলোক দোরগোড়ায় এসেছিলন, তাকেই ব্ল্যাকওয়াটার জংশনের প্লাটফরমে মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে কথা বলতে দেখেছি।

চেয়ারম্যান চেকার-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি কি সেদিন ট্রেনে মি. রাইকসকে দেখেছিলেন?

না, মি. রাইকস ট্রেনে ছিলেন না।

প্লাটফরমে? গার্ড সাহেবের দিকে তাকিয়ে চেয়ারম্যান জিজ্ঞেস করলেন।

ওঁকে প্লাটফরমে দেখেছি বলে তো মনে পড়ছে না।

মি. হান্টার, আপনার অফিসে কাজ করেন মি. রাইকস। তিনি কি এ মাসের চার তারিখে অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন?

মনে হয় না। তবে এই মুহূর্তে আমি সঠিকভাবে বলতে পারব না। কেন না ঐ সময়ে কয়েকদিন আমি বেশিক্ষণ হেড অফিসে থাকতে পারিনি, আমাকে বেরোতে হয়েছে নানা তদারকিতে। সেই সুযোগে মি. রাইকস অফিস কামাই করতেও পারেন। অবশ্য ডে বুকটা দেখলে সেটাও বোঝা যাবে।

আর ঠিক তখনই ডে বুক বগলে করে মিটিং রুমে ঢুকলেন মি. রাইকস।

বসুন।

মি. রাইকস বসবার পর চেয়ারম্যান তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, এই গার্ড সাহেব আর চেকার সাহেবকে চেনেন?

চিনি স্যার। ওঁরা আমাদের কোম্পানিতেই কাজ করেন।

অনুগ্রহ করে ডে বুকে এ মাসের চার তারিখের এন্ট্রিগুলো দেখুন। দেখুন ওঁদের দুজনের ডিউটি কোন গাড়িতে কতক্ষণ পর্যন্ত ছিল ।

এক্ষুনি দেখে দিচ্ছি, স্যার। মি. রাইকস ডে বুকটা খুললেন।

পরপর কয়েকটি পাতায় অভ্যস্ত চোখ বুলিয়ে একটি পাতার নিচে আঙুল রেখে মি. রাইকস বললেন,  পেয়েছি, স্যার। ওঁদের দুজনেরই ডিউটি ছিল ভোর চারটে পনেরোর এক্সপ্রেস ট্রেনে। ট্রেন ইউস্টন থেকে ছেড়ে ক্রম্পটন স্টেশন পর্যন্ত গিয়েছিল।

চেয়ারম্যান সামনের দিকে ঝুঁকে পূর্ণ দৃষ্টিতে মি. রাইকসের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ তীক্ষ্ণস্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ঐদিন বিকেলবেলা আপনি কোথায় ছিলেন, মি. রাইকস?

আমি? আমি স্যার?

জ্বি, আপনি, রাইকস। এ মাসের চার তারিখে বিকেলে এবং সন্ধ্যায় আপনি কোথায় ছিলেন?

আমি তো এখানেই ছিলাম, স্যার। মি. হান্টারের অফিসেই ছিলাম আমি। আর কোথায় থাকব?

মি. রাইকসের গলার স্বরে কাঁপুনি থাকলেও তাঁর চোখের দৃষ্টিতে যে অবাক ভাবটা ছিল তার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা ছিল না।

মি. রাইকস, গম্ভীরভাবে চেয়ারম্যান বললেন, আমাদের বিশ্বাস করবার যথেষ্ট কারণ আছে যে গত চার তারিখে বিকেলে আপনি ছুটি না নিয়ে অফিসে অনুপস্থিত ছিলেন, ঠিক?

না, স্যার, তা নয়। মোটেই তা নয়। আমি অফিসেই ছিলাম। গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে আমি একদিনের জন্যও ছুটি নিইনি। আমার বস মি. হান্টার নিশ্চয়ই আমার বক্তব্যকে সমর্থন করবেন।

সেক্রেটারির দিকে প্রশ্নভরা চোখে তাকালেন চেয়ারম্যান।

মি. রাইকস বোধহয় ঠিক কথাই বলেছেন। চার তারিখে ওঁর ছুটি নেবার কোন কথা আমার জানা নেই। এ সম্পর্কে অফিসের কেরানিরা হয়তো সঠিক খবর দিতে পারবে। আমি হেডক্লার্ককে ডাকছি, স্যার।

ডাকুন।

সেক্রেটারি কলিং বেল টিপলেন। বেয়ারা ঘরে ঢুকলে তাকে বললেন, হেড ক্লার্ক সাহেবকে এখানে আসতে বলো।

একটু পরেই হেড ক্লার্ক এলেন। ভদ্রলোক মাঝ বয়সী, চোখে চশমা, মুখের ভাব গম্ভীর। তিনি ঘরে ঢুকতেই কোন ভণিতা না করে চেয়ারম্যান তাঁকে জেরা করতে শুরু করলেন।

আপনি গত চার তারিখে অফিসে এসেছিলেন?

জ্বি।

কতক্ষণ অফিসে ছিলেন?

কাজকর্ম সেরে বেরোতে প্রায় ছটা বেজে গিয়েছিল।

মি. রাইকস সেদিন অফিসে এসেছিলেন?

জ্বি।

বিকেলের দিকে তিনি অফিসে ছিলেন?

ছিলেন।

কী করে এ কথা বলছেন? তাঁকে বিকেলের দিকে দেখেছিলেন? দেখেছিলাম। কিছু কাগজপত্রে সই করবার জন্য আমাকে তার ঘরে যেতে হয়েছিল। আর তাছাড়া…

তাছাড়া? হেড ক্লার্ককে কথা শেষ করতে না দিয়েই চেয়ারম্যান প্রশ্ন করলেন।

আমাদের সেকশনে পদমর্যাদার দিক দিয়ে মি. রাইকসের পরেই আপাতত আমার স্থান। মাঝখানে সুপারিন্টেনডেন্টের একটা পদ আছে বটে কিন্তু সে পদটা কিছুদিন ধরে খালি। অফিসের কাজে মি. রাইকসকে আগে। চলে যেতে হলে তিনি আমাকে সেকশন দেখাশোনার ভার দিয়ে যান। কাজেই ছুটির আগে মি. রাইকস কখনও হেড অফিস থেকে চলে গেলে আমি তা জানতে পারি। গত চার তারিখে এরকম কিছু ঘটেনি। সেদিন। সাড়ে চারটে পর্যন্ত আমি মি. রাইকসের ঘরেই ছিলাম। কাজেই এটা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি যে বিকেল অন্তত সাড়ে চারটে পর্যন্ত মি. রাইকস হেড অফিসেই ছিলেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে তিনি ছুটি নিয়েছিলেন। ছুটির শেষে কাজে যোগ দিয়ে তিনি একদিনও অফিস কামাই করেননি।

হেড ক্লার্কের বক্তব্যে মি. রাইকসের ওপর থেকে সন্দেহটা কেটে গেল। এসব কথা শুনবার পর চেয়ারম্যান এবং ডিরেক্টররা তো তাকে আর সন্দেহ করতে পারেন না। এরপরেও সন্দেহ করলে অন্যায়ই করা হবে।

আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম।

একটু হেসে আমার দিকে তাকালেন চেয়ারম্যান। সেই হাসির আড়ালে বোধ করি একটু বিরক্তিও লুকিয়ে ছিল।

সবই তো শুনলেন, মি. ল্যাংফোর্ড?

শুনলাম। কিন্তু এখনও আমি আমার বিশ্বাসে অবিচল।

কিন্তু আপনার বিশ্বাসের ভিত্তি খুব দুর্বল, একটু কেশে চেয়ারম্যান বললেন, আমার ধারণা আপনি স্বপ্ন দেখেছেন এবং সেই স্বপ্নটাকেই সত্যি বলে ভেবেছেন, এটা মনের একটা বিপজ্জনক অভ্যাস; এর ফল খুব মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে। মি. রাইকসের সন্তোষজনক অ্যালিবাই না থাকলে তাকে অত্যন্ত অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে পড়তে হতো।

আমি জবাব দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু চেয়ারম্যান আমাকে সময় দিলেন না। বোর্ডের অন্যান্য সদস্যদের লক্ষ করে বললেন, এ নিয়ে আর অনুসন্ধান চালানোর অর্থ হচ্ছে সময়ের অপব্যয়। মি. ল্যাংফোর্ডের বক্তব্যে দুটো গুরুত্বপূর্ণ কথা রয়েছে। প্রথমত, মি. ডুয়েরিং হাউস তার সহযাত্রী ছিলেন, দ্বিতীয়ত জংশন স্টেশনে তিনি আমাদের অফিসের একজন আন্ডার সেক্রেটারি মি. রাইকসকে দেখেছিলেন। কিন্তু গার্ড বেঞ্জামিন সোমার্সের সাক্ষ্য প্রমাণ করেছে যে মি. ডুয়েরিং হাউস মি. ল্যাংফোর্ডের সহযাত্রী ছিলেন না। হেড ক্লার্কের সাক্ষ্যের ফলে জানা যাচ্ছে ওই দিন ওই সময় মি. রাইকসের পক্ষে জংশন স্টেশনের প্লাটফরমে থাকা একেবারেই অসম্ভব। তাহলে আমাদের এই সিদ্ধান্তেই আসতে হচ্ছে যে ইউস্টন থেকে ক্লেবরো যাবার সময় মি. ল্যাংফোর্ড ট্রেনে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন। অবশ্য তাঁর স্বপ্নটা যে জীবন্ত এ কথা মানতেই হবে। আর তাঁর স্বপ্নের সঙ্গে আমাদের কোম্পানির একটা ব্যাপার দৈবাৎ এসেও গিয়েছে। তবে এটা নিতান্তই কাকতালীয়। ব্যাপারটাকে এখানেই ছেড়ে দেয়া যেতে পারে।

একজনের দৃঢ় বিশ্বাসকে সবাই যদি অবিশ্বাস করতে শুরু করে তার চেয়ে অস্বস্তিকর এবং বিরক্তিকর আর কিছু হয় না। ব্যাপারটা যে দিকে মোড় নিল তাতে আমার ধৈর্য চ্যুতি ঘটল। চেয়ারম্যানের ভদ্র পরিহাস, গার্ড বেঞ্জামিন সোমার্সের ঠোঁটের কোণে নিঃশব্দ বাঁকা হাসি আর আন্ডার সেক্রেটারি রাইকসের চোখের দৃষ্টিতে আধা বিদ্বেষ এবং আধা বিজয়ের উল্লাস আমার কাছে অসহ্য ঠেকল।

স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে রাইকস লোকটা হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছে- ভয়ও পেয়েছে। ওর চকিত চাহনি যেন আমাকে নীরবে প্রশ্ন করছে- কে তুমি? কী চাও? কেন আমার চাকরির ব্যাপারে নাক গলাতে এসেছ? ছুটি না নিয়ে আমি অফিসে অনুপস্থিত ছিলাম কিনা তা জেনে তোমার কী লাভ?

এসব দেখে এবং ঘটনার গতি লক্ষ করে আমি একটু বিরক্ত হয়ে বললাম, মাননীয় চেয়ারম্যান, মাননীয় সদস্যগণ আমি আর একটু সময় চাইছি আপনাদের কাছে।

ছেড়ে দাও ব্যাপারটা, আমার বন্ধু ফিসফিস করে বলল, চেয়ারম্যান ঠিকই বলেছেন, তুমি স্বপ্নই দেখেছ। এখন যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো।

কিন্তু এভাবে আমাকে চুপ করিয়ে দেয়া গেল না। আমার আরো কিছু বলার আছে এবং তা আমি বলবই।

চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের সদস্যরা আমার দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকালেন।

চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে আমি স্থির গলায় বললাম, মি. চেয়ারম্যান স্যার, আপনি বলছেন আমি স্বপ্ন দেখেছি। বেশ তর্কের খাতিরে মেনে নিলাম আপনার কথা। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।

কী প্রশ্ন?

দেখুন, স্বপ্নের মধ্যে কেউ বাস্তব জিনিসের সংস্পর্শে আসতে পারে না। এই সিগার কেসটা একটা স্কুল বাস্তব জিনিস। বলতে পারেন কী করে স্বপ্নের মধ্যে আমি সিগারকেসটা পেলাম?

সিগারকেসটা, হ্যাঁ, মি. ল্যাংফোর্ড, আমি স্বীকার করছি কেসটা আপনার স্বপক্ষে একটা জোরালো পয়েন্ট। কিন্তু এটাই আপনার একমাত্র জোরালো পয়েন্ট। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে একটা নিছক সাদৃশ্যের দ্বারা আমরা ভুল পথে চালিত হচ্ছি। আপনার পাওয়া সিগারকেসটার সঙ্গে মি. ডুয়েরিং হাউসের সিগারকেসটার গঠনগত মিল থাকবার জন্যই হয়তো আমরা একটু সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছি। আপনি অনুগ্রহ করে সিগারকেসটা আরেকবার দেখাবেন?

সিগারকেসটা চেয়ারম্যানের হাতে দিতে গিয়ে বললাম, তা কী করে সম্ভব? অন্যের সিগারকেসে মি. ডুয়েরিং হাউসের মনোগ্রাম কী করে থাকবে? তাছাড়া অন্য সব দিক দিয়েও বা কী করে এটা তার সিগারকেসের মতো হবে?

চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ নীরবে সিগারকেসটা পরীক্ষা করলেন তারপর সেটা দিলেন সেক্রেটারি মি. হান্টারের হাতে। সেক্রেটারি কেসটা কয়েকবার উল্টেপাল্টে দেখে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, না, এটা কেবল নিছক সাদৃশ্যের ব্যাপার নয়। এটা যে মি. ডুয়েরিং হাউসের সিগারকেস তাতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। আমি বহুবার দেখেছি এটা। কেসটার কথা আমার ভালোভাবেই মনে আছে।

আমিও বোধহয় একই কথা বলব। কিন্তু কীভাবে সিগারকেসটা মি. ল্যাংফোর্ডের হাতে এলো? এ প্রশ্নের উত্তর কী দেবেন? গম্ভীর গলায় চেয়ারম্যান সেক্রেটারিকে প্রশ্ন করলেন।

এ প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, সেক্রেটারি জবাব দিলেন।

উত্তরটা আমিই দিচ্ছি। অবশ্য আমি আগে যা বলেছি সে কথাই আবার বলছি। মি. ডুয়েরিং হাউস নেমে যাবার পর কামরার মেঝেতে আমি ওটা কুড়িয়ে পেয়েছি। তাকে দেখার জন্য আমি জানালা দিয়ে ঝুঁকেছিলাম তখন। আমি কেসটা পা দিয়ে মাড়িয়ে ফেলি। মি. ডুয়েরিং হাউসকে ওটা দেবার জন্য আমি প্লাটফরম দিয়ে ছুটছিলাম আর তখনই দেখি–বলতে পারেন আমার বিশ্বাস আমি দেখেছি যে তিনি গ্যাস লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়িয়ে মি. রাইকসের সঙ্গে নিবিষ্টভাবে কথা বলছেন।

আমার বন্ধু আমার জামার হাতায় টান দিল।

দেখো, মি. রাইকসের মুখের দিকে তাকিয়ে দেখ, ও ফিসফিস করে বলল।

একটু আগে রাইকস যেখানে দাঁড়িয়েছিল সেদিকে তাকালাম। তার মুখ মরার মতো ফ্যাকাসে, ঠোঁট দুটো কাঁপছে, চোখের কোণে আতঙ্ক। চোরের মতো দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে রাইকস।

আমার মনে হঠাৎ একটা অদ্ভুত এবং অস্পষ্ট সন্দেহ জেগে উঠল। এক লাফে এগিয়ে গিয়ে আমি রাইকসের কাঁধ দুটো চেপে ধরলাম। তারপর ওর আতঙ্কে পাণ্ডুর মুখখানা ঘুরিয়ে দিলাম চেয়ারম্যান এবং বোর্ডের সদস্যদের দিকে।

তাকান ওর দিকে, একবার দেখুন ওর চেহারা। আমার কথার সত্যতা প্রমাণ করার জন্য এর থেকে ভালো সাক্ষ্য আর নেই, উত্তেজিতভাবে আমি বললাম।

চেয়ারম্যানের মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। আন্ডার সেক্রেটারির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি কঠোরভাবে বললেন, মি. রাইকস, যদি আপনি কিছু জানেন তবে তা খুলে বললেই ভালো হয়।

আমার হাত থেকে নিজেকে উদ্ধার করার জন্য রাইকস ধস্তাধস্তি করতে লাগল। কিন্তু বৃথা চেষ্টা। আমি ওকে সজোরে চেপে ধরেছি। আর আমার গায়ের জোরটাও কম নয়, দুর্বল রাইকস কী করে পারবে আমার সঙ্গে। হাঁপাতে হাঁপাতে ও অসংলগ্নভাবে বলতে লাগল, আমায় যেতে দিন। আমি জানি না… কিছু জানি না। আমাকে এভাবে আটকে রাখার কোনো অধিকার নেই আপনার… বেআইনি… এটা ঘোরতর বেআইনি… আমাকে ছেড়ে দিন.. যেতে দিন…।

গম্ভীর গলায় চেয়ারম্যান বললেন, মি. রাইকস, ঠিক করে বলুন ব্ল্যাকওয়াটার জংশনে মি. ডুয়েরিং হাউসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল কিনা? আপনার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা হয় সত্য না হয় মিথ্যা। যদি সত্য হয় তবে আপনি পরিচালক মণ্ডলির সভার কাছে সারেন্ডার করুন এবং যা জানেন কোনো কথা গোপন না করে তা স্বীকার করুন।

অসহায় আতঙ্কে –নিদারুণ মানসিক যন্ত্রণায় রাইকস তার দুহাত মোচড়াতে লাগল। এবার সে ভেঙে পড়ার মুখে।

আমি ওখানে ছিলাম না, আর্তস্বরে চিৎকার করে উঠল রাইকস, আমি সে সময় দুশো মাইল দূরে ছিলাম! এ ব্যাপারে কিছু জানি না আমি…আমার স্বীকার করার মতো কিছু নেই। আমি নির্দোষ… ফর গডস শেক, আমি নির্দোষ!

দুশো মাইল দূরে! চেয়ারম্যান প্রতিধ্বনি করলেন, আপনার কথার অর্থ কী?

আমি… আমি ডেভনশায়ারে ছিলাম। তিন সপ্তাহের ছুটি নিয়েছিলাম আমি। মি. হান্টার জানেন সে কথা। বলুন স্যার, আমি সত্যি বলছি কিনা। গোটা ছুটিটাই আমি ডেভনশায়ারে কাটিয়েছি। আমি প্রমাণ করতে পারি, আমি সেখানে ছিলাম!

রাইকসকে ভীত এবং অসংলগ্নভাবে কথা বলতে দেখে বোর্ডের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গম্ভীরভাবে ফিসফিস করতে লাগলেন। একজন নিঃশব্দে উঠে গিয়ে বেয়ারাকে দরজায় পাহারা দেবার জন্য বলে এলেন।

আপনার ডেভনশায়ারে থাকার সঙ্গে এ ঘটনার কী সম্পর্ক? চেয়ারম্যান প্রশ্ন করলেন, আপনি কখন ডেভনশায়ারে ছিলেন?

মি. রাইকস ছুটি নিয়েছিলেন সেপ্টেম্বর মাসে আর সেই সময়েই মি. ডুয়েরিং হাউস নিখোঁজ হন, চেয়ারম্যানের দিকে তাকিয়ে সেক্রেটারি মি. হান্টার বললেন।

মি. ডুয়েরিং হাউস যে নিখোঁজ হয়েছেন এ কথা ছুটির পর অফিসে ফিরে আসার আগে আমি জানতে পারিনি, ভাঙা গলায় রাইকস বলল।

সেটা প্রমাণ সাপেক্ষ, চেয়ারম্যান বললেন, আমি এক্ষুনি এ ব্যাপারটা পুলিশকে জানাব। আমি নিজেই ম্যাজিস্ট্রেটের পদমর্যাদাসম্পন্ন। কাজেই এ মামলা সম্পর্কে বিচার বিবেচনা করার আইনগত ক্ষমতা আমার আছে আর এ ধরনের মামলা নিয়ে নাড়াচাড়া করতে আমি অভ্যস্ত। আমি আপনাকে পরামর্শ দিচ্ছি– কোন বাধা দেবেন না, কোনরকম গোপনীয়তার আশ্রয় না নিয়ে সব কথা অকপটে স্বীকার করুন। স্বীকারোক্তি হয়তো আপনার সহায়ক হবে হয়তো আপনার অপরাধের গুরুত্বটাও কিছু হ্রাস পাবে তাতে। এ কাজে কে বা কারা আপনার সঙ্গী ছিল?

আমার কোনো সঙ্গী ছিল না, নতজানু হয়ে আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল ভীত রাইকস, আমাকে দয়া করুন আমাকে বাঁচান। আমি সব কথা স্বীকার করব। আমি তাঁর কোনো ক্ষতি চাইনি। তাঁকে আঘাত করার ইচ্ছা আমার ছিল না। তার মাথার একগোছা চুলও আমি টানতে চাইনি। দয়া করুন… ছেড়ে দিন আমায়… আমাকে যেতে দিন… আমাকে যেতে দিন…।

চেয়ারম্যান উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর মুখ ফ্যাকাসে। চাপা মানসিক উত্তেজনায় তিনি চঞ্চল হয়ে উঠেছেন। উত্তেজিতভাবে তিনি বললেন, ওহ্ গড! এ কী ভয়ঙ্কর রহস্য! এ সবের অর্থ কী?

অর্থটা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার, আমার বন্ধু জোনাথন জেলফ বলল, এর অর্থ হলো একটা খুন। হ্যাঁ, আমার ধারণা মি, ডুয়েরিং হাউসকে খুন করা হয়েছে।

না! না! না! মার খাওয়া কুকুরের মতো রাইকস আর্তনাদ করে উঠল। না, না, খুন নয়…খুন নয়। কোনো জুরী একে খুন বলবে না। ভেবেছিলাম আমি তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেছি। তার বেশি আমি কিছু করতে চাইনি। খুন? নরহত্যা? না, না, আমি তা করতে চাইনি… করতে চাইনি।

দারুণ আতঙ্কে এবং উত্তেজনায় রাইকসের কণ্ঠ থরথর করে কাঁপতে লাগল।

ঘটনাটা প্রকাশিত হয়ে গেল অপ্রত্যাশিতভাবে। দারুণ আতংকে দুহাতে মুখ ঢেকে চেয়ারম্যান কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি ভাবতেও পারেননি যে মি. ডুয়েরিং হাউসকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে।

মিনিট তিন-চার পরে তিনি বললেন, হতভাগা নিজেই নিজেকে ধরিয়ে দিল! মি. রাইকস আপনি যে অপরাধ করেছেন তার শাস্তি জানেন?

স্যার, আপনি সব কথা স্বীকার করার আদেশ করলেন তাই স্বীকার করলাম। আপনার নির্দেশ মতোই আমি বোর্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করছি, ভাঙা গলায় বলল রাইকস।

আপনি এমন একটা অপরাধ সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করছেন, যা আপনার দ্বারা করা সম্ভব বলে আমরা কেউ ভাবতেই পারিনি, চেয়ারম্যান বললেন, এ অপরাধের শাস্তি দেয়া বা এ অপরাধের ক্ষমা করার ক্ষমতা এই বোর্ডের নেই। আপনাকে কেবল এটুকু উপদেশ দিতে পারি যে আপনি আইনের কাছে সারেন্ডার করুন। কোনো কথা গোপন না করে নিজের অপরাধ স্বীকার করুন। এবার বলুন কবে এ অপকর্মটা করেছিলেন?

অপরাধী উঠল ধীরে ধীরে। থরথর করে কাঁপছে। টেবিলে ভর দিয়ে নিজেকে সামলে নিল একটু। তারপর অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বপ্নের ঘোরে বলল, বাইশে সেপ্টেম্বর।

বাইশে সেপ্টেম্বর! আমি জোনাথনের দিকে তাকালাম, সেও চমকে তাকাল আমার দিকে। আমার মনে একই সঙ্গে বিস্ময় এবং আতঙ্ক।

জোনাথনের মুখখানা মরার মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ওর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল থরথর করে। ফিসফিসিয়ে কাঁপা গলায় বলল ও, তাহলে.. তাহলে সেদিন ট্রেনে তুমি কাকে দেখেছিলে!?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *