আ টাফ টাসল – অ্যামব্রোস বিয়ার্স

আ টাফ টাসল – অ্যামব্রোস বিয়ার্স

১৮৬১ সালের শরতের এক রাত। পশ্চিম ভার্জিনিয়ার কেন্দ্রেস্থলের এক জঙ্গলে বসে আছে লোকটা। ওই সময় তো বটেই, এখনো ওই এলাকা চিট মাউন্টেন এলাকার সবচে দুর্গম অঞ্চল বলে পরিচিত। যেখানে লোকটা একা বসে আছে, তার কাছ থেকে মাইল দুয়েক দূরে ফেডারেল ব্রিগ্রেডের ক্যাম্প। লোকটা শত্রুর হামলার আশঙ্কা করছে। সে ফেডারেল ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের একজন তরুণ অফিসার, নাম ব্রেইনার্ড বাইরিং। পদবি তার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, এ মুহূর্তে সে তার ঘুমন্ত কমরেডদের পাহারার দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত। বিচ্ছিন্ন একটা দলের প্রতিনিধিত্ব করছে সে আসলে।

তার রেজিমেন্টের লোকগুলোকে সাঁঝের আঁধার ঘনিয়ে আসার পরপরই একটা ইরেগুলার লাইনে ক্যাম্প করার ব্যবস্থা করেছে। রাস্তাটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঢুকে, পাহাড় আর ঘন ঝোঁপঝাড়ের ভেতরে গিয়ে মিশেছে। লোকগুলো পনেরো বা বিশ গজ পর-পর অবস্থান নিয়েছে।

আগামী চার-ঘণ্টার ভেতরে যদি অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা না ঘটে তা হলে নতুন আরেকটি দল এসে এদের জায়গায় পাহারায় বসে যাবে। রিজার্ভ দলটি বর্তমানে এক ক্যাপ্টেনের অধীনে খানিক দূরে বিশ্রাম নিচ্ছে। তরুণ অফিসার তার দুজন সার্জেন্টকে বলে রেখেছে অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়লেই সাথে-সাথে যেন তাকে জানিয়ে রাখে।

যে জায়গায় সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পাহারা দিচ্ছে, ওটা বেশ নির্জন। তবে বেইনার্ড বাইরিং-এর ভয়ডর কম। বয়সেও তরুণ হলেও যুদ্ধ করার প্রচুর অভিজ্ঞতা তার হয়েছে। বহু শুঁকে সে নিজের হাতে নিধন করেছে, বুক কাঁপেনি একটুও। কিন্তু লাশকে তার সাংঘাতিক ভয়। কারণটা লেফটেন্যান্টের নিজেরও জানা নেই। লাশের দিকে তাকাতে পারে না সে। বমি আসে। হয়তো মৃত্যুকে ভয় করে বলেই লাশ দেখতে পারে না বাইরিং। তাকে রেজিমেন্টের অত্যন্ত সাহসী একজন সৈনিক বলে জানে সবাই, কিন্তু লাশের প্রতি তার তীব্র ঘৃণা এবং আতঙ্কের কথা জানে না। কেউ।

নিজের লোকদের যথাযথ স্থানে বসিয়ে, সার্জেন্টদের দায়িত্ব ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়ে একটা কাঠের গুঁড়ির ওপর বসল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ব্রেইনার্ড বাইরিং। আরাম পেতে কোমরে আটকানো তরবারির বেল্টটা ঢিলে করে দিল সে, হোলস্টার থেকে ভারী পিস্তলটা খুলে পাশে রাখল। এখন বেশ ভাল লাগছে। তবে কান খাড়া করে আছে বাইরিং। মাটিতে গাছের পাতা পতনের শব্দও তার কান এড়িয়ে যাচ্ছে না।

চাঁদের আলোয় আশপাশের সবকিছু পরিষ্কার দেখা যায়। তবে এত বেশি নির্জন পরিবেশ যেন কেমন কেমন লাগে। মাঝে-মাঝে অবশ্য একটা দুটো পাখি রাতের নৈঃশব্দ্য ভেঙে ডেকে উঠছে। প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যাবার পরে আবার সব চুপ। নিজেকে বিশাল প্রকৃতির মাঝে বড় একা লাগল বাইরিং-এর। সে আনমনা হয়ে কীসব ভাবছিল, হঠাৎ জঙ্গলের ধারে, রাস্তায় জিনিসটার দিকে চোখ পড়তে সতর্ক হয়ে উঠল। বাইরিং শপথ করে বলতে পারে একটু আগেও ওটা ওখানে ছিল না। গাছের ছায়ায় জিনিসটার অর্ধেক অংশ ঢাকা পড়েছে, তবে যেটুকু চাঁদের আলোয় দেখা গেল, বোঝা গেল ওটা আসলে একটা মানুষ। চট করে তরবারির বেল্টে একটা হাত চলে গেল বাইরিং-এর, বাকি হাতটা দিয়ে চেপে ধরল পিস্তল শত্রওর হামলার জন্যে প্রস্তুত।

কিন্তু নড়ল না লোকটা। পিস্তল হাতে তার দিকে পা বাড়াল বাইরিং। লোকটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে, উর্ধ্বাংশ ছায়ায় ঢাকা, তার সামনে গিয়ে ঝুঁকে। দেখল বাইরিং। লাশ একটা।

ভয়ানক কেশে উঠল সে, ঘৃণা এবং ভয়ে দ্রুত পিছিয়ে এল ওখান থেকে, আবার গিয়ে বসে পড়ল গুঁড়িতে। সামরিক সাবধানবাণী ভুলে গিয়ে কাঁপা হাতে দেশলাই জ্বালিয়ে সিগার ধরাল। দেশলাই নিবে যাবার সাথে সাথে অন্ধকারে স্বস্তি অনুভব করল সে; ওটাকে আর দেখতে হবে না। কিন্তু তারপরও চুম্বকের মতো যেন তার দৃষ্টি গিয়ে ঠেকল লাশটার গায়ে। মনে হলো ওটা যেন একটু এগিয়ে এসেছে তার দিকে।

দুত্তেরি! বিড়বিড় করল লেফটেন্যান্ট। লাশটা কী চায় আমার কাছে?

সে ওদিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে গুনগুন করে একটা সুর ভাজতে লাগল। হঠাৎ মাঝপথে গান থামিয়ে আবার তাকাল লাশের দিকে। লাশটার উপস্থিতি একই সাথে তাকে ভীত এবং বিরক্ত করে তুলছে। ছায়া থেকে সরে এসেছে লাশ। চেহারাটাকে এখন স্পষ্ট চেনা যাচ্ছে। চাঁদের আলোয় বিকট সাদা লাগল মরা মুখটাকে। লাশের কোট এবং ওয়েস্ট কোট খোলা, ভেতরে সাদা শার্ট দেখা যাচ্ছে। হাত দুটো শরীরের দুপাশে ছড়ানো, বা হাঁটুটা উঠে আছে ওপর দিকে। গোটা অবয়ব এবং আকৃতি বাইরিং-এর কাছে রোমহর্ষক এবং ভয়াবহ ঠেকল।

সে আবার লাশটা থেকে চোখ সরিয়ে নিল, আগডুম-বাগডুম ভাবছে। মানুষ কেন মরে, মরা লাশকে কেনই বা তারা ভয় পায়, তাদের ভেতরে এত কুসংস্কার কেন কাজ করে, এইসব চিন্তা।

নানা দার্শনিক চিন্তা করেও লাশটার উপস্থিতির কথা কিছুতেই ভুলতে পারছে না বাইরিং। একবার ভাবল এখান থেকে চলে যাবে। এজন্যে উঠেও দাঁড়িয়েছিল, কিন্তু কমরেডদের কাছে গেলে একটা লাশের ভয়ে সে পাহারা বাদ দিয়ে পালিয়ে এসেছে শুনলে সবাই তাকে নিয়ে হাসাহাসি করবে, তার চরিত্রের দুর্বলতম দিকটি প্রকাশিত হয়ে পড়বে, এই চিন্তা করে সে দমে গেল।

সে যে কাপুরুষ নয়, সাহসী এটা প্রমাণ করার জন্যে আবার লাশের দিকে ফিরল বাইরিং। লাশটার ডান হাতটা ছায়ায় পড়ে আছে, এ ছাড়া সব আগের মতোই আছে। মনে-মনে স্বস্তি বোধ করল বাইরিং।

হঠাৎ ডান হাতে তীব্র ব্যথা অনুভব করল সে। লাশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাতের দিকে তাকাল। এত জোরে সে তরবারি চেপে ধরেছে যে ব্যথা হয়ে গেছে হাত। ভঙ্গিটা মারমুখী গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো, যেন এক্ষুনি। ঝাঁপিয়ে পড়বে শত্রুর ওপর। দাঁতে দাঁত চেপে বসেছে ওর, ঘন-ঘন শ্বাস পড়ছে। ধীরে-ধীরে নিজেকে স্বাভাবিক হতে দিল বাইরিং, লম্বা করে দম নিল। ব্যাপারটা হাস্যকর মনে হলো নিজের কাছে। হাস্যকরই তো। একটা লাশ, প্রাণহীন একটা জড় পদার্থকে সে কেন জানের শত্রু ভাবছে? হঠাৎ কে যেন হেসে উঠল খলখল করে। লাফ মেরে উঠে দাঁড়াল বাইরিং, সভয়ে তাকাল চারপাশে, বুঝতে পারল না আসলে সে নিজেই হেসে উঠেছে মনের অজান্তে।

এবার ভয় পেল বাইরিং। তীব্র ভয়ে থরথর করে কেঁপে উঠল। দৌড়ে পালাতে ইচ্ছে করল, কিন্তু বিদ্রোহ ঘোষণা করল পা দুটো, নড়তেই চাইছে না। ঝি ঝি ধরে গেছে। বাধ্য হয়ে ধপ করে আবার বসে পড়ল সে গুঁড়ির ওপর। ঘামে ভিজে গেছে মুখ, সারা শরীরও ভিজে গেছে ঠাণ্ডা ঘামে। দাঁত কপাটি লেগে গেছে ওর, চিৎকার দিতে পারছে না। খরখর আওয়াজ উঠল পেছনে, ঘাড় ফিরে দেখার সাহস হলো না বাইরিং-এর। লাশটার ভৌতিক সঙ্গীরা কি কবর থেকে উঠে এসেছে ওর ওপর চড়াও হতে? নাকি কোনো নিশাচর প্রাণী? কিন্তু সাহসই পেল না সে পেছন ফিরে দেখতে। আঠার। মতো তার চোখ লেগে রয়েছে লাশের দিকে।

এমন সময় নড়ে উঠল লাশ। বাইরিং কি প্রচন্ড ভয়ে দৃষ্টি ভ্রমের শিকার হয়েছে? মরা মানুষ আবার নড়াচড়া করতে পারে নাকি? কিন্তু বাইরিং স্পষ্ট দেখছে নড়ছে লাশটা। ওই তো হাত নাড়ল। ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা মারল বাইরিং-এর মুখে। ভয়ে শিউরে উঠল সে। মাথার ওপর গাছের ডালপালাগুলো বাতাসে আন্দোলিত হলো। বাইরিং-এর মনে হলো ওগুলো মৃত্যু যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছে। কোত্থেকে একটা ছায়া এসে পড়ল লাশের গায়ে। তারপর সরে গেল। ভয়ঙ্কর জিনিসটা উঠে দাঁড়াচ্ছে! ঠিক তখন গুলির আওয়াজ শোনা গেল পিকেট লাইন থেকে অনেক দূরে, কিন্তু জোরে।

গুলির শব্দ বাইরিং-এর দুঃস্বপ্নটাকে ভেঙে দিল খানখান করে। লাফ মেরে সিধে হল সে। আর তখনি বৃষ্টির মতো গুলি হতে লাগল তার সামনে থেকে। চিৎকার চেঁচামেচি, হৈ-হল্লা, আর্তনাদ ইত্যাকার বিচিত্র সব শব্দও ভেসে এল। জঙ্গলের পেছন দিকে, ঘুমন্ত ক্যাম্পে আকস্মিক হামলা করেছে শত্রুপক্ষ। শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধ। জঙ্গলের মধ্য থেকে গুলি করতে-করতে বেরিয়ে এল ফেডারেল সৈন্যরা। একদল সশস্ত্র পাহাড়ি লোক, বাইরিং যেখানে বসে ছিল, সেদিকে গুলি চালাতে-চালাতে অদৃশ্য হয়ে গেল রাস্তার বাঁকে। তার কিছুক্ষণ পরে দেখা গেল রিজার্ভ বাহিনীকে। দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। জঙ্গলের এখানে সেখানে বন্দুকের খালি কার্তুজ, স্যাডেল, গুলিবিদ্ধ ঘোড়া পড়ে আছে দেখতে পেল তারা। ফেডারেল কমান্ডার এলাকায় সংক্ষিপ্ত সফরে এসে অধীনস্তদের দুএকটা হুকুম দিয়ে চলে গেল। সৈনিকরাও ঘণ্টাখানেক পর আর কোনো হামলার আশঙ্কা দেখতে না পেয়ে ফিরে গেল যে যার বিছানায়।

পরদিন সকালে একটা ফ্যাটিগ পার্টি (যুদ্ধের পাশাপাশি রাস্তা নির্মাণ, মালবহনসহ টুকটাক নানা কাজ করে যে সৈন্যদল) জঙ্গলে ঢুকল একজন ক্যাপ্টেন এবং সার্জেন্টের তত্ত্বাবধানে, তারা আহত এবং নিহতদের খোঁজে এসেছে। জঙ্গলের মাথায়, রাস্তার একপাশে দুটো লাশ দেখতে পেল তারা, পড়ে আছে পাশাপাশি। একজন ফেডারেল অফিসার, বাকিজন কনফেডারেট প্রাইভেট। অফিসারের গলার ভেতরে আমুল বিঁধে আছে একটা তরবারি, উপুড় হয়ে আছে সে, রক্তে ভেসে গেছে চারপাশ। পাশের লোকটার বুকে ঢুকে আছে তরবারি, সারা শরীরে কমপক্ষে পাঁচটি মারাত্মক জখমের দাগ।

ক্যাপ্টেন মৃত অফিসারকে চিৎ করে শোয়াল। চমকে উঠল সে। ঈশ্বর! আঁতকে উঠল সে, এ তো বাইরিং। অপর লাশটার দিকে আঙুল তুলে দেখাল সে, মনে হয় মৃত্যুর আগে দুজনে জবর লড়াই করেছে।

সার্জন বাইরিং-এর তরবারিটা পরীক্ষা করল। এটা ফেডারেল ইনফ্যান্ট্রির তরবারি, ক্যাপ্টেনের সাথেও আছে অমন একটা। বাইরিং-এর বেল্টে একটা পিস্তলও গোঁজা আছে। তবে গুলি ছোঁড়া হয়নি।

সার্জন তরবারি রেখে এবার অপর লাশটার দিকে এগোল। এই লোকটাকে নিষ্ঠুরভাবে কুপিয়ে মারা হয়েছে। তবে শরীরে রক্তের চিহ্ন নেই। বাম পা-টা শক্ত হয়ে উঠে আছে আকাশের দিকে। পা-টা সোজা করার ব্যর্থ চেষ্টা করল সার্জন, উল্টো খুলে এল ওটা শরীর থেকে। সাথে-সাথে ভস করে পচা একটা গন্ধ ধাক্কা মারল ওদের নাকে।

দুজনেই এবার মুখ তুলে চাইল, ভয় এবং বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইল পরস্পরের দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *