আ সিম্পল মিসটেক – ম্যাক্স ভ্যান ডারভির

আ সিম্পল মিসটেক – ম্যাক্স ভ্যান ডারভির

অনেক সয়েছে সে। হ্যারী লোথারিওর আর ক্ষমা নেই। তাকে এবার অবশ্যই মরতে হবে।

মোনা রোপ দোকান থেকে কম দামী একটা হ্যাট কিনল, লিপস্টিক কিনল আরেক দোকান থেকে, আর বেলচাটা কম দামে পেয়ে গেল এক ডিসকাউন্ট স্টোরে। জিনিসগুলো নিয়ে ভাড়া করা সেডানে উঠল মোনা। চোহারায় নিস্পৃহ ভাব ধরে রাখলেও ভেতরে ভেতরে সে খুবই নার্ভাস।

খুব সাবধানে গাড়ি চালাল মোনা যেন অ্যাক্সিডেন্ট না হয়। দুর্ঘটনায় জড়িয়ে পড়ে পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায় না সে। বাণিজ্যিক এলাকা ছাড়িয়ে রিভারভিউ বুলেভার্দের দিকে মোড় নিল মোনা। তার বা দিকে সবুজ ঘাসের প্রশস্ত লন সামনে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অভিজাত বাড়িগুলো। আর ডানের ঢাল গিয়ে মিশেছে নদীর কিনারায়। এদিকে বড় বড় গাছপালার আড়ালে মাঝে মাঝেই চোখে পড়ে বড় লোকদের দামী বাড়ির ছাদ।

বুলেভার্দ থেকে মোড় ঘুরে বার্নহিল্ট ড্রাইভওয়েতে চলে এল মোনা, পাথুরে, সুদৃশ্য একটি বাড়ির ডাবল গ্যারেজের বন্ধ দরজার সামনে ব্রেক কষল। পার্স থেকে দ্রুত চাবি নিয়ে দরজা খুলল সে, সেডানটাকে ভেতরে ঢোকাল, তারপর আবার ফিরে চলল বুলেভার্দের উদ্দেশে।

এক সেকেন্ডের জন্য ঘাড় ঘুড়িয়ে বাড়িটার দিকে চাইল মোনা, উঁচ করে ঈর্ষার কাঁটা বিঁধল বুকে। স্যালি লাফহার্টি, তার বাল্য বন্ধু, হিউস বার্নহিল্টকে বিয়ে করে কত সুখে আছে! ওরা দুজনেই এখন ইউরোপে, সামার বিজনেস ভ্যাকেশন কাটাতে গেছে। যাবার আগে স্যালি তাঁর বাড়ির একগোছা ডুপ্লিকেট দিয়ে গেছে মোনাকে।

উইকএন্ডে যে কোন সময় চলে আসিস এখানে। বার বার বলেছে স্যালি।

এটা ফ্রান্সের রিভিয়েরা নয় বটে, কিন্তু এখানে এলে তোর মন ভাল হয়ে যাবে। নদীতে ইচ্ছেমত সাঁতার কাটতে পারবি, পার্টি দিতে পারবি।

মোনা বুলেভার্দের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে একটা ট্যাক্সি ডাকল। বিশ মিনিট পরে আবার ডাউন টাউন চলে এল। দুই ব্লক পরে ওর পার্ক করা গাড়িটার দিতে দ্রুত এগুলো সে। এখন পর্যন্ত সব কিছু প্ল্যান মাফিক ঠিকঠাক চলছে। কপালের ঘাম মুছল মোনা, ঘামে ভেজা হাতের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কোঁচকাল, গাড়ির সীটে রাখা বেদিং স্যুট দিয়ে হাতটা পরিষ্কার করল, তারপর স্টার্ট দিল গাড়িতে। বাড়ি ফিরছে মোনা রোপ, যে বাড়িতে হ্যারী রোপের সঙ্গে দীর্ঘ ষোলোটা বছর এক সঙ্গে কাটিয়েছে সে।

তবে আর নয়। আর হ্যারীর সাথে এক সঙ্গে থাকতে রাজি নয় মোনা। নাটকের মঞ্চ তৈরি হয়ে গেছে, এইবার ঘটতে শুরু করবে ঘটনা।

অভিজাত এই এলাকায় পুবদিকে বেটিফেয়ার চাইল্ডদের বাড়ি। মোনা, দেখল হলুদ শর্টস পরা বেটি লম্বা একটা কাঁচি নিয়ে তাদের বাগানে কাজ করছে। বাগান থেকে কয়েক গজ দূরে মোনাদের বাসা। নিজের বাসার সামনে গাড়ি দাঁড় করাল সে। বেটি মুখ তুলে চাইল, বলল, হাই!

মোনা গাড়ি থেকে নামতে নামতে কষ্ট করে হাসি ফোঁটাল ঠোঁটে। হাই!

আজ খুব গরম পড়েছে, না? সাঁতার কেটে এলে?

মোনা মনে মনে খুব খুশি হয়ে উঠল এই কথায়। মাথা ঝাঁকিয়ে বেদিং স্যুটটা বেটির উদ্দেশ্যে নাড়ল। সব কিছু কি চমৎকার খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে। মোনা রোপ যে বুধবার বিকেলটা সুইমিং পুলে কাটিয়েছে তার সাক্ষ্য বেটিই দেবে। বলবে, অফিসার, মোনা ওইদিন যখন বাড়ি ফেরে তখন প্রায় পাঁচটার মত বাজে। ওর হাতে একটা বেদিং স্যুট ছিল। সে ওটা আমার দিকে তাকিয়ে নেড়ে ছিল।

মোনা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গ্যারেজে গেল, গাড়িটা যথাস্থানে রাখল, তারপর বাড়িতে ঢুকল। বেটি ফেয়ারচাইল্ডের চোখের আড়াল হতেই চঞ্চলা হরিণী হয়ে উঠল সে। রান্নাঘরের সিঙ্কে সুইম স্যুটটা ডুবিয়ে কিছুক্ষণ পর ওটাকে ইউলিটি রুমের হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল।

রান্না ঘরের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল মোনা। বেটি ফেয়ারচাইল্ড আবার ঘাস কাটার কাঁচে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। প্রতিবেশীদের ব্যক্তিগত ব্যাপারে নাক গলানোর বদভ্যাস আছে বেটির। বিশেষ করে মোনার ব্যাপারে আগ্রহ তার প্রবল।

একটা হাইবল তৈরি করে সিগারেট ধরাল মোনা। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। পাঁচটা পনেরো। আরও মিনিট পঁয়তাল্লিশ পর বাসায় ফিরবে হ্যারী।

ড্রিঙ্কটা নিয়ে কিচেন টেবিলে বসল মোনা হাঁটু ভাঁজ করে। ওর পা একটু পরপর ঝাঁকি খেলো, জোর করে স্থির হয়ে থাকল মোনা। এয়ারকুলারের থার্মোস্টাটের ক্লিক শব্দে হঠাৎ চমকে উঠল। আবার পা ঝাঁকি খেতে শুরু করেছে। মোনা এবার আর ঝাঁকুনি থামাতে চেষ্টা করল না। গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে ঘড়ির দিকে চোখ তুলল। পাঁচটা ষোলো এখনও চল্লিশ মিনিট। ওর হাতের লোমের গোড়ায় ফুটে উঠেছে স্বেদ বিন্দু। সিঙ্কে গিয়ে মুখ ধুলো মোনা, কলের নিচে হাত মেলে ধরল। গড, এত ঘামছে কেন সে? ঘর তো ঠাণ্ডা। নাকি খুনের আগে সব খুনীরই এ রকম অবস্থা হয়?

আরেকটা হাইবল তৈরি করল মোন প্রচুর সময় নিয়ে, আগেরটার চেয়ে বড়। হ্যারী নিখোঁজ হলে পুলিশ প্রথমেই তার কারণ জানতে চাইবে। ষোলো বছরের দাম্পত্য জীবনে, বিখ্যাত জুতো তৈরির কারখানা পাইপার এ যে মানুষটা সততা এবং নিষ্ঠার সঙ্গে আঠারো বছর কাজ করে গেছে সে কেন হঠাৎ করে হাওয়া হয়ে যাবে?

হ্যারী রোপের কোনও পাওনাদার নেই, যাদের ভয়ে সে বাড়ি ছেড়ে পালাবে। টাকা পয়সারও অভাব নেই তার। ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের অর্থ গচ্ছিত আছে, জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট। আছে চমৎকার একটি বাড়ি, দামী আসবাবপত্র, দুটো গাড়ি। হ্যারী রোপ জুয়া খেলে না, মদ্যপ নয়, অসৎ পথে টাকাও ওড়ায় না। প্রতিবেশীদের সঙ্গে হ্যারীর সম্পর্ক খুবই ভালো। তারা জানে, স্বর্ণকেশী মোনা রোপা চল্লিশোর্ধ্ব বয়সেও যৌবনকে ধরে রেখেছে শক্ত হাতে এবং স্বামীর প্রতি সে খুবই বিশ্বস্ত।

আচ্ছা, এক মিনিট। হ্যারীর স্ত্রীর ব্যাপারে একটা কথা বলা যাক। মোনা রোপ কি তার স্বামীকে কোন কারণে বাড়ি থেকে বের করে দিতে পারে? নাকি এমন কোন কারণ থাকতে পারে যে মোনা হ্যারীকে খুন করে লাশ গুম করে ফেলল, তারপর হ্যারী নিখোঁজ বলে পুলিশকে জানাল?

কিন্তু মোনা তার স্বামীকে খুন করবে কেন? সেফ ডিপোজিটের জয়েন্ট অ্যাকাউন্টে যে টাকা আছে, ওটার জন্য? উঁহু, বিশ্বাস হয় না। জয়েন্ট অ্যাকাউন্টের টাকা দিয়ে মোনা বড়লোক হতে পারবে না। জীবন বীমা? হ্যারী রোপ জীবন বীমা করেনি। তাহলে দেখা যাচ্ছে স্বামী নিখোঁজ হলে কিংবা মারা গেলে মোনা রোপ কোনদিক থেকেই লাভবান হতে পারছে না।

আয়নায় নিজেকে মুখ ভেঙচাল মোনা, তাকাল বাইরে। বেটি ফেয়ারচাইল্ড ঘাস কাটছে না, কিন্তু এখনও বাগানে আছে। ও কেন ওখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করছে বুঝতে কষ্ট হয় না। পঁচিশের কোঠায় বয়স, হালকা পাতলা বেটির মনে রাজ্যের সন্দেহ আর অবিশ্বাস বাসা বেঁধে আছে। মেয়েটাকে দুই চোখে দেখতে পারে না মোনা।

আরও পাঁচ মিনিট পর হ্যারীর কনভার্টিবলটাকে আসতে দেখল মোনা। বেটিদের বাগানের বেড়ার সামনে দিয়ে আসার সময় কি যেন বলল সে। বেটিকে। বেটি হাতের হলদে দড়ির ফাঁসটা দুলিয়ে হাসল। হ্যারী ওর দিকে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত নেড়ে গাড়ি ঢোকাল গ্যারেজে।

হ্যারী যখন কিচেনে ঢুকল মোনা ততক্ষণে তার জন্য একটা নতুন ড্রিঙ্ক নিয়ে তৈরি। হ্যারীর বয়স মোনার সমান হলেও খাটো, রোগা আর মাথায় ছোট চুল বলে ওকে আরও কম বয়েসী দেখায়। কাঁধে কোট, আলগা টাই, জামার বোতাম খুলতে খুলতে হ্যারী মোনার দিকে তাকিয়ে হাসল। হাই, সইটি। আমার জন্যই ড্রিঙ্কটা বানিয়েছ বুঝি?

মাথা দোলাল মোনা।

তুমি বিকেলে সাঁতার কেটেছ?

হ্যাঁ।

রান্না ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে হ্যারী বলল, ড্রিঙ্কটা বাথটাবে দিয়ে যাও। আমি গোসল করব। ঘেমে একেবারে নেয়ে গেছি?

এটা হ্যারীর বহুদিনের অভ্যাস। শীত হোক আর গ্রীষ্মই-ঘরে ফেরার পাঁচ মিনিটের মধ্যে তার গোসল করা চাই।

মোনা হাত মুঠি করল, প্রাণপণে চেষ্টা করল স্বাভাবিক থাকতে। কান পাতল। কোন সাড়াশব্দ নেই। কপালে ভাঁজ পড়ল মোনার, সাবধানে লিভিং রুমে গেল। ওর বিপরীত দিকে বেডরুম, দরজা খোলা। হ্যারী করছেটা কি?

এখনও টাবে ঢুকছে না কেন? এই সময় বাথরুম থেকে জল পড়ার শব্দ শুনতে পেল সে। ঢিল পড়ল পেশীতে কিছুক্ষণ পর থেমে গেল শব্দটা। হ্যারী টাবে ঢুকেছে।

রান্না ঘরে ফিরে এল মোনা, ড্রয়ার খুলে বাঁকানো একটা হাতুড়ি বের করল, জুতো খুলে নিঃশব্দে পায়ে ঢুকল শোবার ঘরে। বাথরুমের দরজা ভেজানো। গলা ছেড়ে গান গাইছে হ্যারী। একটানে দরজা খুলে ফেলল মোনা। শাওয়ারের নিচে দাঁড়িয়ে ভিজছে হ্যারী, মোনার দিকে পিঠ।

সোজা খুলির ওপর প্রথম আঘাতটা করল মোনা। আঘাতের চোটে সামনের দিকে ছিটকে গেল হ্যারী, কোমর ভেঙে পড়ে গেল বাথরুমের মধ্যে। গলা দিয়ে একটা আওয়াজও বেরুল না। উন্মাদিনীর মতো হাতুড়ি চালাতে লাগল মোনা, হ্যারী মারা গেছে বুঝতে পেরে এক সময় থামল।

এই সময় গম্ভীর কণ্ঠটা শুনতে পেল মোনা।

হ্যারী, বাড়ি আছ?

মুখ সাদা হয়ে গেল মোনর, শূন্য দৃষ্টিতে চাইল।

হেই, আমি রয়েস। বাড়িতে আছ নাকি, হ্যারী?

রয়েস ফেয়ারচাইল্ড!

কিভাবে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছে জানে না মোনা, হঠাৎ দেখল। সে চলে এসেছে বেডরুমে। হাতে এখনও হাতুড়িটা। স্রেফ জমে গেল মোনা। এ হাতুড়ির কারণে তো সেও মারা পড়বে!

হ্যারী?

মোনা বিদ্যুৎগতিতে হাতুড়িটা বালিশের নিচে চালনা দিল। রয়েস ফেয়ারচাইল্ড সম্ভবত ইউটিলিটি রুমের কাছে চলে এসেছে। জোর করে শক্তি সঞ্চার করল মোনা, বলল, আসছি, রয়েস। টলতে টলতে সে পা বাড়াল সামনে।

রয়েস ফেয়ারচাইল্ড লম্বা, সুদর্শন তরুণ। ওর এক মাথা ঝাঁকড়া কালো চুলের দিকে চাইলেই বুক কেমন শিরশির করে মোনার। রয়েসের সপ্রতিভ উপস্থিতি সব সময়ই তাকে মুগ্ধ করে। রয়েস এই মুহূর্তে ইউটিলিটি রুমের স্ক্রীন ডোরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। হাসছে। বিশালদেহী রয়েসের সামনে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে হলো মোনর।

হাই, আন্তরিক গলায় ডাকল রয়েস।

আমি বাথরুমে ছিলাম। হাসার চেষ্টা করল মোনা। জল পড়ার শব্দে তোমার গলা প্রথমে শুনতে পাইনি।

আজ রাতে তুমি আর হ্যারী কোথাও যাবার প্ল্যান করেছ? জানতে চাইল রয়েস।

নাহ্, বলল সে। আমার আর প্ল্যান করে কোথাও যাওয়া হয় না। তবে সন্ধ্যাবেলায় ডাউন টাউনে যাব ভাবছি। কিছু কেনাকাটা করতে হবে। তারপর নাইটশোতে আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে ছবি দেখব।

এত ব্যাখ্যার দরকার ছিল না, রয়েসের হাসি আরেকটু প্রসারিত হলো। ভেবেছিলাম রাতে হ্যারীর সঙ্গে কার রেস দেখতে যাব।

কিন্তু, আমি তো…

রয়েস ফেয়ারচাইল্ড চকিতে একবার মোনার দ্বিধান্বিত মুখের দিকে তাকাল, লক্ষ করল মোনা কনভার্টিবলটার দিকে চেয়েই চোখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। হ্যারী তো বাসায় আছে, তাই না? বেটি বলল কিছুক্ষণ আগে নাকি ও বাসায় ফিরেছে। ভাবলাম একবার জিজ্ঞেস করেই যাই ও আমার সঙ্গে যাবে কি-না।

কিন্তু হ্যারী তো ওষুধের দোকানে গেছে, অম্লান বদনে মিথ্যে কথাটা বলল মোনা।

তাই? একটু থেমে রয়েস বলল, কিন্তু ওকে তো বেরুতে দেখলাম না। ঠিক আছে, ও এলে একবার আমার বাসায় নক করতে বোলো।

আ-আচ্ছা বলব। গলাটা হঠাই যেন বসে গেল মোনার। দাঁড়িয়ে পড়ল রয়েস।

এনিথিং রং, মোনা? জ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল সে।

দুর্বলভাবে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল মোনা, উপযুক্ত শব্দ হাতড়াচ্ছে প্রাণপণে। আ-আমি…মানে আমার শরীরটা ঠিক ভাল ঠেকছে না। সুইমিং পুলে সাঁতার কেটে আসার পর থেকে খারাপ লাগছে। যাকগে, এটা এমন কোন ব্যাপার নয়। রয়েস, তুমি…যদি কিছু মনে না করে গ্যারেজের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাবে?

অবশ্যই দেব।

মানে বলছিলাম কি, হ্যারীও নেই, আমি বাসায় একা। দরজাটা বন্ধ থাকলেও একটু কম চিন্তা থাকে।

ঠিক আছে, ঠিক আছে। বলল রয়েস ফেয়ারচাইল্ড।

হ্যারীকে আমার কথা বলতে ভুলো না।

ভুলব না।

গ্যারেজের দরজা বন্ধ হবার শব্দ শুনল মোনা, গা ছেড়ে দিল স্ক্রীন ডোরের কবটে। ওর বুক ধুকধুক শব্দ করছে, পায়ে কোন জোর নেই। গ্যারেজের দরজা বন্ধ করার যুক্তিটা নিতান্তই খেলো ছিল, বুঝতে পারে। মোনা। কিন্তু এই মুহূর্তে নিরাপদে কাজ সারা তার খুবই প্রয়োজন

এখন দ্রুত কাজগুলো করতে হবে মোনাকে। রয়েস আবারও আসতে পারে। ইস্, আজ রাতেই কেন হ্যারীকে নিয়ে রেস দেখার ভূত চাপল ওর মাথায়?

শিউরে উঠল মোনা, ঝোলানো লম্বা কম্বলটার এক প্রান্ত খামচে ধরল। তারপর দৌড়ে গেল বাথরুমে। ছোটখাট হ্যারীর গায়ে এত ওজন! বাথরুম থেকে ওকে টেনে তুলতে জান বেরিয়ে গেল মোনার। ধপাস করে লাশটা মেঝেতে ফেলল ও, দুটো তোয়ালে দিয়ে শরীর মুছল তারপর একটা কম্বলে মৃত হ্যারীকে পেঁচাল। জামাকাপড়গুলো এক জায়গায় জড়ো করল। প্যান্টের পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে টাকা গুনল মোনা। মাত্র তেইশ। ডলার। টাকাগুলো নিয়ে ওয়ালেটটা যথাস্থানে রেখে দিল সে।

আবার ঘামতে শুরু করেছে মোনা। কিন্তু এখন আগের মতো আর দুর্বল লাগছে না। ধীরে ধীরে হারানো শক্তি ফিরে পাচ্ছে সে। কম্বলে মোড়ানো হ্যারীর লাশটা টানতে টানতে গ্যারেজে নিয়ে এল মোনা। গাড়ির পেছনের ট্রাঙ্ক খুলল চাবি দিয়ে। কিন্তু এখন ওকে ভেতরে ঢোকাবে কী করে? গোটা লাশ দুহাতে তোলার শক্তি নেই মোনার। ভয়ানক ভারী হ্যারীর শরীর।

প্রথমে হ্যারীর পা দুটো ধরল মোনা, বাম্পারের ওপর রাখল। লাশটা ডিঙিয়ে ওর পেছন চলে এসে সে ঝুঁকল, দুহাতের বেড়িতে শক্ত করে কোমর ধরে টান দিল। মেঝে ছেড়ে শুন্যে উঠে গেল হ্যারী, কিন্তু নিতম্ব বেঁধে গেল ট্রাঙ্কের কোনায়। থেতলানো মাথাটা বিশ্রীভাবে ঝুলছে। ঘাড়ের পেছনে হাত নিয়ে এল মোনা, মাথাটা সোজা করে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিল ভেতরে। ট্রাঙ্কের এক কোনায় বসার ভঙ্গিতে স্থির হয়ে থাকল নিষ্প্রাণ দেহটা। হড় হড় করে ওকে সামনের দিকে টান দিতেই ভাঁজ হয়ে পড়ে গেল হ্যারী।

ঘন ঘন শ্বাস পড়ছে মোনার, যেন কয়েক মাইল পথ দৌড় এসেছে। ছেঁড়া জামাকাপড়গুলো দিয়ে লাশটাকে ঢাকল সে, বন্ধ করল ট্রাঙ্ক। তারপর কম্বলটা আবার ইউটিলিটি রুমের মেঝেতে বিছাল। জিনিসটা ভিজে গেছে, কিন্তু শুকিয়ে যাবে শিগগিরই। এখন আর কোন কাজ নেই। এখন কাজ শুধু কালক্ষেপণ।

অপেক্ষার মুহূর্তগুলো ভারী কষ্টের, যন্ত্রণাদায়ক। মোনা ভাবতে থাকে ফেঁসে যাবার সম্ভাবনা কতটুকু। কিন্তু জোর করে অশুভ চিন্তাগুলো মন থেকে দূর করে দেয় সে। বেহুদা টেনশনে ভুগছে সে। সাজানো প্ল্যানের মধ্যে সামান্য ছন্দপতন ঘটিয়েছে কেবল রয়েস ফেয়ারচাইল্ডের আকস্মিক আবির্ভাব। কিন্তু তার কারণে পরিকল্পনাটি একেবারে মাঠে মারা যাবে না।

.

সাতটা বাজার মিনিট কয়েক আগে রয়েস ফোন করল। জানতে চাইল মোনা হ্যারীকে তার কথা বলতে ভুলে যায়নি তো।

না, রয়েস। ও এখনও ওষুধের দোকান থেকে ফেরেনি। ও বোধহয় গিনোর বারে গেছে। নইলে এত দেরি হবার তো কথা নয়।

ঠিক আছে, আমি হ্যারীকে ওখানেই খোঁজ করছি, মোনা।

ফোন রেখে দিল মোনা। কাজটা এখন তাকে আরও আধ ঘণ্টা আগে করতে হবে। ভেবেছিল সাড়ে সাতটার আগে বাইরে যাবে না, কিন্তু এখনই বেরুলে রয়েস আবার হুট করে হাজির হলে বিপদে পড়বে মোনা। দ্বিতীয়বার তার মুখোমুখি হতে চায় না সে। সামাল দিতে পারবে না।

.

কনভার্টিবলটাকে নিয়ে বেরুচ্ছে মোনা, দেখল রয়েস জানালা দিয়ে তার দিকে চেয়ে আছে। আতঙ্ক গ্রাস করল ওকে। ইচ্ছে হলো ঝড়ের গতিতে গাড়ি ছোটায়, চোখের পলকে শহর ছেড়ে দূরে চলে যায়।

দাঁতে দাঁত চাপল মোনা। না, আতঙ্কিত হলে চলবে না। আতঙ্ক ওকে ফাঁদে ফেলবে, আর তার নিশ্চিত পরিণাম ডেথ চেম্বার। স্বাভাবিক গতিতে গাড়ি চালিয়ে বার্নহিল্টদের বাড়িতে চলে এল মোনা। এখানে, ডাবল গ্যারেজের ভেতরে সে ভাড়া করা গাড়িটা রেখে গেছে। হ্যারীর লাশ আর জামাকাপড়ের স্তূপ সেখানে ঢোকাল সে, ট্রাঙ্কের মধ্যে বেলচাটা রাখল, আর বিকেলে কেনা অন্যান্য জিনিসপত্রগুলোর স্থান হলো কনভার্টিবলে।

এবার ডাউনটাউনে চলে এল মোনা, বুকের মধ্যে ভয় চেপে দোকানগুলোতে ঘুরে বেড়াল, খামোকা এটা ওটার দাম জানতে চাইল। ঘণ্টাখানেক পর একটা ড্রাগস্টোরে সে যখন ঢুকল, ঘড়িতে তখন সাড়ে আটটা। ওর বন্ধু প্যাট ডডসনের সঙ্গে আরও আধঘণ্টা পর দেখা করার কথা। হয়তো প্যাট ইতোমধ্যে রেডি হয়ে বসে আছে। অপেক্ষা করছে তার জন্য।

একটা বুঁদ থেকে ফোন করল মোনা প্যাটকে। প্যাট যা বলল শুনে হিম হয়ে গেল সে। মোনা আজ রাতের প্রোগ্রামটা ক্যান্সেল করা যায় না? আমি অনেকক্ষণ ধরে তোমার বাসায় ফোন করছি। কেউ ধরে না। আমার খুব মাথা ধরেছে মোনা। আমি ছবি দেখতে যেতে পারব না, তাই।

মোনার পা কাঁপছে থরথর করে। যদি বিশেষ কোন সাক্ষী দরকার হত তাহলে প্যাট ডড়সনই হত তার অন্যতম সাক্ষী। তু-তুমি ওষুধ খাওনি? কথা খুঁজে পাচ্ছে না মোনা। কোনমতে বলল, বাইরে বেরুলে ঠাণ্ডা বাতাসে মাথা ধরাটা নিশ্চয়ই ছেড়ে যেত।

ঘুম, মোনা, এটাই এখন আমার একমাত্র ওষুধ। আরেকদিন না হয় তোমার সঙ্গে ছবি দেখব। সুস্থ হলে কাল রাতে?

না, ইতস্তত করল মোনা, অনুরোধ করে লাভ হবে না বুঝে বলল, আমি আজ রাতেই ছবিটা দেখব, প্যাট, কাল নয়।

ঠিক আছে, দেখো তাহলে। যেতে পারছি না বলে আবারও দুঃখিত।

ড্রাগস্টোর থেকে বেরিয়ে এল মোনা। শরীর ভয়ানক দুর্বল ঠেকছে। উদ্দেশ্যহীনভাবে সে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। চিন্তাভাবনাগুলো সব গিঠই পাকিয়ে গেছে। কিন্তু ধৈর্য হারালে চলবে না, নিজেকে শাসাল ও, ভাবতে হবে। ভেবেচিন্তে প্রতিটি পা ফেলতে হবে। আউল ফাউল না ঘুরে মনস্থির করে ফেলল মোনা। বাঁক ঘুরে সিনেমা হলের দিকে এগোল। হলের সামনে আসতেই চট করে আইডিয়াটা মাথায় খেলে গেল।

দ্রুত পায়ে ফিরে এল পার্ক করা কনভার্টিবলে, বিকালে কেনা জিনিসগুলোর প্যাকেট দুটো নিয়ে সিনেমা হলে ঢুকল। লিপস্টিকের প্যাকেটটা টিকেট কাউন্টারের জানলার পাশে ফেলে সেটের দিকে তাকাল। কাউন্টারের মেয়েটা বুথের দরজা খুলে ডাক দিল, ম্যাম?

ঘুরল মোনা, মেয়েটা ছোট্ট প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরেছে ওর দিকে। হাসল সে, মেয়েটাকে ধন্যবাদ দিয়ে প্যাকেটটা নিয়ে অন্ধকার প্রেক্ষাগ্রহে। প্রবেশ করল। এখন একটু স্বস্তি লাগছে। প্রয়োজনের সময় কাউন্টারের মেয়েটা ওকে অন্তত স্মরণ করতে পারবে।

ছবিটা কমেডি ধাঁচের। অন্যসময় হলে মোনা এই ছবি দেখে হাসতে হাসতে খুন হয়ে যেত, কিন্তু দুই ঘণ্টা পর হল থেকে বেরিয়ে ও আবিষ্কার করল আসলে পর্দার দিকে তাকিয়েছিল শুধু, কিছুই দেখেনি।

সময় কাটানো মোনার জন্য এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা। সে অস্থির হাতে কনভার্টিবলের রেডিওর সুইচ অন করল। রেডিওতে আবহাওয়ার খবর হচ্ছে। আগামী ছয় ঘণ্টার মধ্যে প্রবল ঝড় শুরু হতে পারে, সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন সংবাদ পাঠক। তাই নগরবাসীদের সতর্ক করে দেয়া হচ্ছে। মোনা কপাল কোঁচকাল। আসন্ন ঝড়টা তাকে সাহায্য করবে না বিপদে ফেলবে?

বাড়ি ফেরার সময় মোনা দেখল ফেয়ারচাইল্ডদের বাড়ির আলোকিত জানালা দিয়ে একটা মুখ তাকে লক্ষ করছে। আড়ষ্ট হাসল মোনা। ভালোই হলো বেটি জানল সে কখন ছবি দেখে ফিরেছে।

গ্যারেজে গাড়ি রেখে প্যাকেটগুলো নিয়ে ঘরে ঢুকল মোনা। আধঘণ্টা পর সমস্ত বাতি নিভিয়ে অন্ধকার একটা জানালার সামনে এসে বসল। এখান থেকে ফেয়ারচাইল্ডদের বাড়ি স্পষ্ট দেখা যায়। মাঝে মধ্যে বেটির আকৃতি ফুটে উঠতে দেখল সে জানালার কাঁচে। কিন্তু রয়েসকে দেখা গেল না। এখন রাত একটা। বেটি এখনও ঘুমাতে যাচ্ছে না কেন? হঠাৎ ওর মনে পড়ল বেটি ঝড়বাদল খুব ভয় পায়। ঝড়বৃষ্টি হবে শুনলে সে ঘুমাতে পারে না।

নিয়তি দেখছি আমার সঙ্গে বিরোধিতা শুরু করেছে, ভাবল মোনা। তার বাইরে বেরুবার ব্যাপারটা বেটির চোখে কিছুতেই ধরা পড়া চলবে না। আর ঝড়ঝনঝার রাতে ফেয়ারচাইল্ডরা নিশ্চয়ই আশা করে না মোনার সব বাতি জ্বালিয়ে রাখবে?

সময় হয়েছে বুঝতে পেরে সামনের দরজা দিয়ে বেরুল মোনা। তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল ফেয়ারচাইল্ডদের জানালার দিকে, কেউ উঁকি দিচ্ছে কিনা দেখতে। অন্ধকারে চোখ সইয়ে উঠান পেরোল সে, উঠে এল ফুটপাথে। জলদি পা চালাচ্ছে মোনা। হাঁটতে হাঁটতে মুখ তুলে চাইল আকাশের দিকে। তারা জ্বলছে। ঝড় নাও আসতে পারে।

শপিং সেন্টারের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড, এখানে সারারাত ট্যাক্সি ভাড়া পাওয়া যায়, একটা ক্যাবে ড্রাইভারকে মুখ হাঁ করে ঘুমাতে দেখল মোনা। দরজা। খুলে ব্যাকসীটে বসল সে। আশা করল অন্ধকারে ড্রাইভার তাকে ভালমত লক্ষ করতে পারবে না।

ড্রাইভার মোনার দিকে প্রায় তাকালই না, ঘুম ঘুম চোখে মাত্র একবার ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল। মোনা তাকে রিভারভিউ বুলভার্ডে যেতে বলল। গন্তব্যে পৌঁছে ড্রাইভারকে ভাড়ার সঙ্গে পঞ্চাশ সেন্ট বকশিশ দিল। তারপর হন হন করে হাঁটতে লাগল একটা অন্ধকার বাড়ি লক্ষ করে। খানিকটা এগিয়ে। যখন বুঝল ড্রাইভারের চিহ্নও নেই কোথাও ফিরে এল সে বুলেভার্দে পার হল রাস্তা, এগিয়ে চলল বার্নহিল্টদের বাড়ি অভিমুখে।

হ্যারীকে কবর দেয়ার জায়গাও ঠিক করে রেখেছে মোনা। গত রোববার বিকালে ওদিকটা ভাল মত দেখে যায় সে। হাইওয়ে ছাড়িয়ে একটা সরু মেঠো পথ চলে গেছে গাছপালার মধ্যে দিয়ে, শেষ হয়েছে একটা খাদের মাথায়, ওখানে।

ভাড়া করা সেডানটা নিয়ে মোনা এখন সেদিকেই চলেছে। হেডলাইটের আলো চিরে দিচ্ছে গাঢ় অন্ধকার। মেঠো রাস্তার শেষ মাথায় পৌঁছে গাড়ি থামাল মোনা, লাইটের সুইচ অফ করল। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকল সে বেলচা নিয়ে। গভীর একটা কবর খুঁড়ল ত্রস্ত হাতে, স্বামীর দলা পাকানো লাশ আর পোশাকগুলো ছুঁড়ে ফেলল গর্তে।

দূরে, শহরের সীমানার কালো আকাশে ঝিলিক দিল বিদ্যুৎ, গুরগুর আওয়াজ ভেসে এল কয়েক সেকেন্ড পর। কবরে মাটি ভরাট করার সময় একটা দুশ্চিন্তা মাথায় ভর করল মোনর। বৃষ্টি হলে ভেজা মাটিতে তার গাড়ির চাকার ছাপ থেকে যাবে। সুতরাং বৃষ্টির আগেই হাইওয়েতে ফিরতে হবে তাকে।

এবড়োথেবেড়ো রাস্তা দিয়ে গাড়ি ব্যাক করছে মোনা, যান্ত্রিক বাহনটা তীব্র আর্তনাদ করে উঠল। আস্তে নিজেকে পরামর্শ দিল মোনা, সাবধানে চালাও মেয়ে। এমন বিদঘুঁটে জায়গায় কোন সমস্যায় পড়লে বারোটা বেজে যাবে তোমার।

হাইওয়েতে উঠে আসতেই সশব্দে চেপে রাখা শ্বাস ফেলল মোনা। ঝড় আসছে। একটু বিরতির পরপরই আলো হয়ে যাচ্ছে অন্ধকার আকাশ। নদীর ব্রিজটা সামনেই। ওর সামনে কিংবা পিছনে কোন গাড়ি নেই বলে স্বস্তি পেল মোনা।

ব্রিজে উঠে গাড়ি থামাল সে। চট করে নেমে বেলচাটা রেলিং-এর ওপর দিয়ে নদীতে ফেলে দিল। মাইল দুয়েক দূরে শহরের আলোকমালা, ফ্যান্টাসি ছবির মত জ্বলছে। সন্তুষ্টি বোধ করল মোনা, গাড়ি ছেড়ে দিল আর তক্ষুনি ওর বুকের ভিতর লাফিয়ে উঠল হৃৎপিণ্ড।

সামনে আলো জ্বলছে। অথচ মোনা ভাল করেই জানে এখানে আলো জ্বলার কোন কারণ নেই। সম্ভবত রোড ব্লক, ঘূর্ণায়মান লাল বিকন। বাতিগুলো যেন পিশাচের চোখ।

পুলিশ! যেভাবেই হোক ওরা তার কুকীর্তির কথা জানে গেছে আর এখানে অপেক্ষা করছে কখন সে শহরে ফিরবে তার জন্য।

ব্রেকে আলতো একটা পা রাখল মোনা। চোখ দুটো কোন সাইড রোড, খুঁজছে।

কিন্তু পুলিশ কী করে এত তাড়াতাড়ি টের পেল? দ্রুত মাথা হাতড়াল মোনা। নাহ্, টের পাবার কোন প্রশ্নই নেই। নির্ঘাত সামনে কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সেটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্যই রোড ব্লক।

ধীরগতিতে গাড়ি চালাল। হেড লাইটের আলোতে ইউনিফর্ম পরা এক পুলিশ অফিসারের আকৃতি পরিস্কার হয়ে উঠল। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সে, হাতের লাল আলো দিয়ে সামনে আসতে ইশারা করল মোনাকে, মোনা খেয়াল করল রাস্তার একটা পাশ শুধু বন্ধ-যারা শহর ছেড়ে আসছে শুধু তাদের গাড়ি থামানো হচ্ছে। আরেক পুলিশ অফিসার লাল ফ্ল্যাগলাইটের আলো দিয়ে ইঙ্গিত করল-যেতে পারে মোনা। রোড ব্লক পেরিয়ে শহরের রাস্তায় পড়ল মোনা। চিরিক চিরিক ঝলসে বিদ্যুৎ বিকট শব্দে কাছে কোথাও বাজ পড়ল।

মোনার গাড়ি থামাতে ইচ্ছে করল, মন চাইছে প্রাণভরে শ্বাস নিয়ে একটু সুস্থির হতে। কিন্তু এগিয়ে চলল সে, ডাউনটাউন থিয়েটার পার্কিং লটের দিকে গাড়ি ছোটাল।

দুই ব্লক পরে কার রেন্টাল এজেন্সি, তার পরেই একটা ট্যাক্সি স্ট্যান্ড। পার্কিং লটে গাড়ি দাঁড় করল মোনা। একটা ট্যাক্সিতে উঠে বসল। বলল, শপিং সেন্টার কমপ্লেক্সে যাবে। বাতাসে ঝঅপটায় রাস্তার খড়কুটো উড়তে শুরু করেছে, ভাড়া মিটিয়ে মাত্র ফুটপাথে পা রেখেছে মোনা, বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে লাগল গায়ে।

তাড়া খাওয়া কুকুরের মতো বাড়ির দিকে ছুটল মোনা। তিনটে ব্লক পরেই তার বাড়ি। দরজা গিয়ে ঘরে ঢোকা মাত্র প্রবল বর্ষণ শুরু হলো। ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পড়ল সে। নিজেকে এত দুর্বল লাগল, মনে হলো যে, একটা হপ্তা না ঘুমালে সে আর শক্তি ফিরে পাবে না।

কিন্তু ঘুম এল না। দুশ্চিন্তায় ভার হয়ে থাকল মাথা। অনেক কিছু পিছনে ফেলে এসেছে সে, আরও কত কি সামনে অপেক্ষা করছে কে জানে। অন্ধকারে হাতড়ে রান্না ঘরে ঢুকল মোনা, জানালা দিয়ে তাকাল বাইরে। ফেয়ারচাইল্ডদের বাড়িতে আলো জ্বলছে। বেটি এখনও ঘুমায়নি? নাকি জেগে থাকার ভান করছে?

আলোর সুইচের দিকে হাত বাড়াল মোনা, সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলাল। আরেকটু হলেই মস্ত এক ভুল করতে যাচ্ছিল সে। বেটি জেগে থাকলে আলো জ্বললেই সে দেখতে পেত মোনার গায়ে বাইরের পোশাক…।

মোনা কাপড় পাল্টাল। রাতের পোশাক পরল। হঠাৎ বালিশের নিচে রাখা হাতুড়িটার কথা মনে পড়ে গেল। জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখল ও, হাতুড়িটা নিয়ে রান্না ঘরে গেল, ওটাকে একটা ড্রয়ারে রেখে দিল। তারপর আলো জ্বালল, সিগারেট ধরাল। এখন বেটি ফেয়ারচাইল্ড ওকে ইচ্ছে মতো দেখুক। দেখুক ঝড়ের রাতে তার মতো আরও একজন নির্মম সময় কাটাচ্ছে।

মোনা কফি বানিয়ে নিল। পরবর্তী চারটে ঘন্টা তার কাটল মারিজুয়ানা সেবন করে আর বাইরে ঝড়ো হাওয়ার দাপাদাপি শুনে।

সকাল সাতটার দিকে ঝড়ের তান্ডব থেমে গেল, শুধু বর্ষণধারা অব্যাহত রইল। আটটা বাজার কয়েক মিনিট আগে মোনা শুনল গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে রয়েস ফেয়ারচাইল্ড। আরও মিনিট বিশেক কাটিয়ে দিল সে কাপড় পরতে। তারপর বেরিয়ে পড়ল কনভার্টিবলটা নিয়ে। দেখল জানালার পাশে বসে আছে বেটি, ওকে লক্ষ করছে।

থিয়েটার পার্কিং সেটে চলে এল মোনা, ভাড়া গাড়িটা, এজেন্সির কাছে হস্তান্তর করল। ইচ্ছে করলে কাল রাতেই কাজটা করতে পারত সে। কিন্তু তাতে ধরা পড়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিল। রাত সাড়ে তিনটায় গাড়ি ফেরত দিতে গেলে এজেন্সি সহজেই তাকে চিনে রাখত, কিন্তু সকাল নটা বিশ-এ সেই আশঙ্কাটা নেই।

অ্যাটেনডেন্ট লোকটা লম্বা-চওড়া কিন্তু নোংরা, দেখে মনে হয় গোসল শব্দটার সঙ্গে পরিচিত নয়।

কাজ শেষ, ম্যাম? জিজ্ঞেস করল সে।

শান্ত গলায় জবাব দিল মোনা, হ্যাঁ। ভাড়া চুকিয়ে পা বাড়াল অফিসের বাইরে।

পেছন থেকে ডাক দিল লোকটা, শুনুন, শুনুন! গাড়ির হাবক্যাপটা কোথায় ফেলে এসেছেন, ম্যাম?

মোনা থমকে দাঁড়াল, ঘুরল। লোকটা সেডানের ডান দিকের হুইলের পাশে দাঁড়ানো, কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে মোনার দিকে। হুইলের ওপর কোনও হাবক্যাপ নেই।

মোনা কোন কথা বলতে পারল না। ওর জিভটা যেন আঠা দিয়ে লেগে আছে টাকরায়। হাবক্যাপটা হারাল কিভাবে? কোথায় কবরে? নাকি মেঠো রাস্তাটার কোথাও? অথবা থিয়েটার পার্কিং লটে।

আ-আমাকে কি এ জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে? তোতলাতে তোতলাতে বলল মোনা।

লোকটা মোনার আগাপাশতলা যেন চাটল চোখ দিয়ে। নিজের সঙ্গে বোধ হয় যুদ্ধ করছে। তার পাতলা ঠোঁটজোড়া একদিকে বেঁকে গেল, বিড়বিড় করে বলল, না, আপনাকে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে না। আমাদের বীমা করা আছে।

কাঠ হয়ে এজেন্সি অফিস থেকে বেরুল মোনা, এগোল কনভার্টিবলের দিতে। গাড়ি নিয়ে শপিং সেন্টার সুপার মার্কেটে চলে এল ও, খামোকা বেশ কিছু মুদি সওদা কিনল। তারপর ফিরে এল বাড়িতে। ওর চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাল। কাঁপা হাতে কফি ঢালল কাপে, চুমুক দিল। হাবক্যাপ হারানোর ঘটনাটা ছাড়া আর সবকিছুই এখন পর্যন্ত ঠিক আছে। তবে পুলিশে খবর দেয়ার আগে আরও একটা কাজ বাকি রয়ে গেছে। এখন দশটা চল্লিশ বাজে। পাইপার-এর নম্বরে ফোন করল মোনা।

পাইপারের যে লোক ফোন ধরল, সে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জানাল, না, মি. রোপ এখনও অফিসে পৌঁছেননি। আর এভাবে তিনি কখনোই অনুপস্থিত থাকেন না। অফিসে আগে না জানিয়ে মি. রোপ আজ পর্যন্ত কোথাও যাননি। পাইপার কি এ ব্যাপারে মিসেস রোপকে কোন সাহায্য করতে পারে?

কিন্তু মোনার কোনও সাহায্যের প্রয়োজন নেই।

সে এবার পুলিশ ডিপার্টমেন্টে রিং করে মিসিং পারসনস ব্যুরোর নাম্বারটা চাইল। ও ধারের লোকটা নিরাসক্ত গলায় বলল তার স্বামী হয়তো কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় ফিরে আসবেন, মিসেস মোনা খামোকা দুশ্চিন্তা করছেন। হয়তো গতকালকের ঝড় জলের জন্যে তিনি অতি মাত্রায় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।

ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, অফিসার।

ঠিক আছে, আপনি যদি অন্য কোন আশঙ্কা করে থাকেন তাহলে আমরা কি এখান থেকে লোক পাঠাতে পারি–

সত্যি পাঠাবেন? প্লীজ!

ব্যাঙ্কস নামে এক তরুণ সার্জেন্টকে পাঠাল ওরা। লোকটার বয়স খুব বেশি হলে ত্রিশ। সে মোনাকে যারপরনাই বিস্মিত করল। মনে হলো মোনার কষ্ট সে অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পেরেছে। সার্জেন্টকে পছন্দ হয়ে গেল মোনার তার প্রশ্নের ধরণ শুনে। হ্যারি সম্পর্কে বিস্তারিত নোট নিল সে, বলল মোনা যেন তার স্বামীর জন্যে খুব বেশি চিন্তা না করে। আশা করা যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই তার স্বামীকে খুঁজে পাওয়া যাবে।

মিনিট বিশেক পর বিদায় হলো সার্জেন্ট। বেটি ফেয়ারচাইল্ড এল মোনার সঙ্গে কথা বলতে। রাতে বোধ হয় ঘুমায়নি, চোখ বসে গেছে, কিন্তু তাকে বেশ কৌতূহলী আর উত্তেজিত দেখাল।

একটু আগে যে গাড়িটা দেখলাম, হড়বড় করে বলল বেটি, পুলিশের গাড়ি মনে হলো! কি হয়েছে, মোনা?

মোনা ওকে ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করল।

যেন স্তম্ভিত হয়ে গেছে কথাটা শুনে এমনভাবে, বেটি বলল, হ্যারি কাল রাতে বাসায় ফেরেনি?

অফিস থেকে ফেরার পর আমাকে বলল ওষুধের দোকানে যাচ্ছে। তারপর থেকে ওর আর কোন সংবাদ নেই।

কোথায় যেতে পারে, বলো তো?

আমি জানি না, বেটি।

অফিসে খোঁজ নিয়েছ?

মোনা মনে মনে উল্লাস বোধ করল। সকালেই নিয়েছি। কিন্তু ওরা বলল হ্যারি অফিসে যায়নি…

হা ঈশ্বর। শ্বাস টানল বেটি। সব ঘটনা দেখছি এক সঙ্গে ঘটছে! প্রথমে ঝড় এল, তারপর ব্যাঙ্ক ডাকাতি, আর এখন হ্যারি–

ব্যাঙ্ক ডাকাতি?

রেডিওতে শোনননি? কাল রাতে ডাউনটাউনের একটা ব্যাঙ্কে ডাকাতি হয়েছে। সারা শহরে রোড ব্লক বসানো হয়েছে। আর…

বেটির কথা কানে ঢুকছে না মোনার। কাল রাতে রোড ব্লকে পড়ে কি রকম আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল মনে পড়তেই পেট ফেটে হাসি এল ওর। কিন্তু নিজেকে সংবরণ করল ও। বেটি জিজ্ঞেস করল, মোনা, হ্যারি হঠাৎ করে এভাবে নিখোঁজ হওয়ার কারণ কী, বলো তো?

মোনা কোন জবাব দিল না।

পরদিন আবার এল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস। গৎ বাঁধা প্রশ্নগুলো করল। মোনার যখন সমস্ত জবাব ফুরিয়ে গেল, সার্জেন্ট উদাসীন মুখ করে বলল, আপনি বোধ হয় জানেন, মিসেস রোপ, আপনার স্বামী কি পরনারীতে আসক্ত ছিলেন?

মোনার আঁতকে ওঠার অভিনয়টা নিখুঁত হলো। সবাই যুবতী, বলে চলল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস। ধারণা করা হচ্ছে ওরা প্রত্যেকে পাইপার কোম্পানির সঙ্গে যুক্ত।

মোনার চেহারা করুণ হয়ে উঠল।

এসব কেস-এ আমরা প্রথমেই যে জিনিসগুলো চেক করি তা হচ্ছে আর্থিক অবস্থা, দাম্পত্য সুখ–।

মোনা রাগের ভান করল। আমাদের আর্থিক অবস্থা যথেষ্ট ভালো।

জী?

আর হ্যারী কখনও–

আমি দুঃখিত, মিসেস রোপ, বাধা দিল সার্জেন্ট। আমরা তদন্ত করে দেখেছি আপনার স্বামীর সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে তরুণী আর যুবতী কয়েকটি মেয়ের অবৈধ সম্পর্ক ছিল।

মোনা নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করল। সার্জেন্ট চলে যেতেই সে রান্নাঘরে ঢুকল, কাপে কফি ঢেলে তাতে বুরবন মেশাল, তারপর নীরবে পানীয়টা উৎসর্গ করল তার মৃত স্বামীর উদ্দেশ্যে : চিয়ারস, হ্যারী লোথারিও রোপ!

.

শনিবার, সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস একটা বোমা ফাটাল। পাইপার কোম্পানিতে হ্যারীর কাগজপত্র ঘেঁটে জানা গেছে সে বেশ কিছু অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

ক-কত টাকা পাওয়া যাচ্ছে না? জানতে চাইল মোনা।

দশ হাজার ডলারের মতো।

আপনাদের কি ধারণা হ্যারী টাকাগুলো নিয়ে পালিয়েছে?

তার সঙ্গে যে সব মেয়ের সম্পর্ক ছিল তারা কেউ পালায়নি, শুধু হ্যারী। আর টাকাগুলোর কোন খবর নেই।

আচ্ছা! বলল মোনা। এতদিনে বুঝতে পারল হ্যারী মেয়ে মানুষ নিয়ে ফুর্তি করার টাকা কোত্থেকে জোগাড় করত। এই মেয়ে ঘটিত ব্যাপার নিয়ে অনেক ঝগড়া হয়েছে তার হ্যারীর সঙ্গে। কিন্তু হ্যারী তাকে পাত্তাই দেয়নি। শেষ তক অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে মোনা। তারপর…

সত্যি, এটা খুব হৃদয়বিদারক সংবাদই বটে।

সার্জেন্ট ব্যাঙ্কসের কথায় চমক ভাঙল মোনার। চোখ তুলে চাইতেই দেখল মোনা তার দিকে চেয়ে আছে সার্জেন্ট। আমি ভাবছিলাম… ইতস্তত গলায় বলল মোনা। ভাবছিলাম কয়েকদিনের জন্যে ধরুন, ধরুন হপ্তাখানেকের জন্য যদি বাইরে যাই কেমন হয়। এই ব্যাপারটা নিয়ে কাগজে লেখালেখি হবে। বিশেষ করে যেখানে টাকা পয়সার প্রশ্ন জড়িত… আমার আসলে এখন দিন কয়েক কোথাও একা কাটিয়ে আসা দরকার।

নির্দিষ্ট কোথাও যেতে চাইছেন, মিসেস রোপ? আপনার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের প্রয়োজন হতে পারে।

লেক চার্লসের নাম শুনেছেন?

জ্বী।

ওখানে একটা বাড়ি আছে। ওখানে আমি আর হ্যারী একবার …যাকগে, কিছু ভাববেন না। বাড়িটার নাম শেডি ওকস।

ঠিক আছে, মিসেস রোপ।

তাহলে আমি যেতে পারি?

অবশ্যই পারেন।

শহর ছেড়ে ওইদিন বিকালেই বেরিয়ে পড়ল মোনা। মাইল বিশেক যাবার পর ওর সন্দেহ সত্যি বলে প্রমাণিত হলো। শেডি ওকসের আশপাশে। পুলিশি ছায়া আবিষ্কার করল মোনা। একটি যুবক বয়সের ছেলেকে ওর কাছে পিয়ে প্রায়ই ঘুরঘুর করতে দেখল সে।

মঙ্গলবার সকালে অবশ্য যুবক ভণিতা ছেড়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল মোনাকে নিয়ে তার শহরে ফিরতে হবে।

আপনি নিশ্চয়ই ভাবছেন না হ্যারী তার দশ হাজার ডলারসহ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে? তিক্ত গলায় বলল মোনা।

আপনার স্বামীর খোঁজ পাওয়া গেছে, মিসেস রোপ। আর আমার ধারণা তিনি খুন হয়েছেন। গম্ভীর গলায় বলল সে।

হেডকোয়ার্টারে দুজন পুলিশ অফিসার জেরা করল মোনাকে। সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস লেফটেন্যান্ট পোলিং নামে একজন অমায়িক স্বভাবের অফিসারের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দিল। পোলিং খুব বিনীতভাবে মোনার কাছে জানতে চাইল হ্যারী যেদিন নিখোঁজ হয় সেদিন আসলে কি কি ঘটেছিল। সব বিস্তারিত বর্ণনা দিল মোনা।

সপ্রতিভভাবে সমস্ত প্রশ্নের জবাব দিতে পেরে নিজের ওপর খুশি হয়ে উঠল সে। মোনা জানে ওর গল্প খতিয়ে দেখা হবে, পুলিশ ভেরিফিকেশন হবে। বেটি ফেয়ারচাইল্ড জানাবে ঘটনার দিন বিকালে মোনাকে সে মিউনিসিপ্যাল পুল থেকে পাঁচটার সময় সাঁতার কেটে আসতে দেখেছে, আর মোনা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তার সাক্ষী কেটে আসতে দেখেছে, আর মোনা কখন বাড়ি থেকে বেরিয়েছে তার সাক্ষী দেবে রয়েস ফেয়ারচাইল্ড। আর প্যাট ওডসন বলবে সে কথা দিয়েও বুধবার রাতে মোনার সঙ্গে ছবি দেখতে যেতে পারেনি। সিনেমা হলের টিকেট বিক্রেতা মেয়েটাও মোনাকে স্মরণ করতে পারবে। বলবে হ্যাঁ, এক মহিলা ওইদিন নাইট শোতে ছবি দেখতে এসেছিলেন। ভুলে তার একটা প্যাকেট ফেলে যাচ্ছিলেন কাউন্টারে। আর ছবি দেখে মোনা কখন ফিরেছে সে ব্যাপারেও বেটি সাক্ষী দেবে। জানাবে, যখন ঝড় শুরু হয় ওই সময় সে রোপদের বাড়িতে আলো জ্বলতে দেখেছে।

প্রশ্নপর্ব শেষ হলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল মোনা। লেফটেন্যান্ট পোলিং মোথা ঝাঁকিয়ে নরম গলায় বলল, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, মিসেস রোপ, আপনাকে প্রশ্ন করা আমাদের দরকার ছিল।

অবশ্যই। টাকা পয়সার ব্যাপারটাও যেহেতু এর সঙ্গে জড়িত। তবে আমি কল্পনাও করিনি হ্যারী টাকা চুরি করতে পারে।

আমরা এ জন্যই আপনাকে লেক চার্লসে যেতে দিয়েছি, বলল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস।

আপনারা কি ভেবেছিলেন আমার সঙ্গে হ্যারীর কোথাও সাক্ষাৎ হবে? আমি টাকার কথা কিছুই জানতাম না, সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস। ব্যাপারটা আমার জন্যে খুবই মর্মবেদনার কারণ ছিল।

আমরা ধারণা করতে পারছি টাকাটা বেশিরভাগ কোথায় ব্যয় হয়েছে, বলল লেফটেন্যান্ট পোলিং।

মানে…হ্যারীর সঙ্গে যে সব মেয়ের সম্পর্ক ছিল তাদের কথা বলছেন?

মাথা ঝাঁকাল লেফটেন্যান্ট। আমাদের আরও সন্দেহ ওদেরই কেউ হাতুড়ির বাড়িতে মাথা ফাটিয়ে খুন করেছে হ্যারীকে।

পাথর হয়ে গেল মোনা।

আপনি নৃশংস ঘটনাটা শুনবেন, মিসেস রোপ?

মোনা জানে না সে সায় দিয়েছে কিনা, কিন্তু লেফটেন্যান্ট পোলিং গল্পটা শুরু করল: আমাদের ধারণা বুধবার রাতে আপনার স্বামী ওষুধের দোকানের কথা বললে বেরিয়ে পড়েন। হয়তো আগেই কথা হয়েছিল, কিংবা এও হতে পারে পথে মেয়েটার সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়। তারা সন্ধ্যাটা একত্রে কাটায়। তারপর সন্ধ্যারই কোন এক সময় মেয়েটা আপনার স্বামীকে ভারী এবং ভোঁতা কিছু দিয়ে মাথায় আঘাত করে। সম্ভবত হাতুড়ি জাতীয় কিছু হবে। মেয়েটাকে খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত হতে পারছি না। তারপর সে লাশটাকে শহরের বাইরে নিয়ে গিয়ে কবর দেয়। কবর খুঁড়ে আমরা যখন লাশটা বের করি, মুর্দার পরনে কোন কাপড় ছিল না। কিন্তু তার জামা কাপড়গুলো কবরের মধ্যেই পাওয়া গেছে। আর তার ওয়ালেট। ওটাও খালি ছিল।

লে-লেফটেনান্ট, তোতলাচ্ছে মোনা, আ-আপনি কিন্তু এখনও বলেননি কিভাবে…কিভাবে আপনার হ্যারী খোঁজ পেয়েছেন।

একটা বাচ্চার কৌতূহলের কারণে, মুখ অন্ধকার করে বলল লেফটেন্যান্ট পোলিং। একটা হাবকাপ ছিল তার কৌতূহলের কারণ। ছেলেটা ওখানে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছিল। একটা খাদের পাশে, ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে চকচকে হাবক্যাপটা তার নজর কেড়ে নেয়। খাদটার পাশে স্তূপ করা মাটির দেখে তার নতুন কবর বলে সন্দেহ হয়। হাত দিয়ে কবরটা খুঁড়তে শুরু করে। থামল যখন নগ্ন পা জোড়া চোখে পড়ল, তখন। স্বাভাবিকভাবেই প্রচণ্ড ভয় পেয়েছিল সে।

একটা…হাবক্যাপ? বিড়বিড় করে বলল মোনা।

এখন সেই গাড়িটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে যেটার চাকা থেকে জিনিসটা খুসে পড়েছে, বলল পোলিং।

পা-পারবেন?

সেটাই তো এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা, মিসেস রোপ। এ যেন খড়ের গাদায় সূঁচের সন্ধান করছি আমরা।

যদি…যদি আপনারা খোঁজ পান?

তাহলে বুঝব আমরা খুনী মেয়েটাকে পেয়ে গেছি।

.

অবিশ্বাস্য মন্থর গতিতে কাটতে লাগল দিন। খবরের কাগজে ফলাও করে হ্যারী খুনের রহস্য ছাপা হচ্ছে। পুলিশ হন্যে হয়ে হাবক্যাপবিহীন গাড়ির সন্ধানে ব্যস্ত। তারপর বেটি আর রয়েস ফেয়ারচাইল্ডদের অদম্য কৌতূহল তো আছেই। আর যতদিন যাচ্ছে, টের পাচ্ছে মোনা, ওর চারপাশে পুলিশী প্রহরার সংখ্যাও বাড়ছে। তবে পুলিশ খুনীর কোন সন্ধানই করতে পারছে না। মোনা মাত্র নিজেকে নিরাপদ ভাবতে শুরু করেছে। এই সময় মূর্তিমান আতঙ্কের মতো হাজির হলো নোকটা।

সেদিন সন্ধ্যায় মোনার দোরগোড়ায় চওড়া কাঁধের লম্বা এক লোক উপস্থিত হলো। তার পরনে নোংরা, জীর্ণ পোশাক, মুখে কৃত্রিম হাসি, ঠোঁটে সিগারেট। তার পেছনে একটি গাড়ি, ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা।

মোনা আগন্তুককে না চেনার ভান করল। কী চাই? জিজ্ঞেস করল সে।

ভণিতা রাখুন, ম্যাম, বলল লোকটা। আমি ফ্রেড টেলর। আমাকে আপনি ভাল করেই চেনন। আমার পেছনের গাড়িটাকেও।

নিমিষে মোনার মুখের রক্ত সরে গেল।

দেখুন, আমি পুলিশের কাছে যেতে পারতাম। বলতে পারতাম এক মহিলাকে আমি চিনি, যিনি আমাদের একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে হাবক্যাপ ছাড়া ওটাকে ফিরিয়ে এনেছেন।

মি. টেলর, আমি–

আপনার ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে, মিসেস রোপ। এছাড়াও হাবক্যাপ হারানোর ঘটনাসহ আপনার স্বামীর দশ হাজার ডলার নিয়ে পলায়নের ঘটনাও বেশ রসিয়ে বর্ণনা করেছে ওরা।

ফ্রেড টেলর মোনাকে প্রায় ঠেলে ভেতরে ঢুকল, একটা চেয়ার টেনে বসল। বসে পড়ো, খুকি, ভদ্রতার মুখোশ খুলে ফেলল সে। দাঁত বের করে বলল, বসো। তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।

কিসের কথা? চেঁচিয়ে উঠল মোনা।

হারানো দশ হাজার ডলার সম্পর্কে, হানি। ওখান থেকে আমাকে পাঁচ দিলেই আমি একেবারে বোবা হয়ে যাব। বেশি চাইনি কিন্তু। মাত্র অর্ধেক। সিগারেট টানতে টানতে টেলর বলল, দেখো, আমি খুব ভালো করেই জানি এসব ঘটনা কিভাবে ঘটে। স্ত্রী স্বামীকে প্ররোচনা দেয় তার অফিস থেকে টাকা মারতে। দুজনে মিলে প্ল্যান প্রোগ্রাম করে। তারপর কাজ উদ্ধার হয়ে গেলে স্ত্রী বলে, চলো, দক্ষিণ আমেরিকাটা একবার ঘুরে আসি। কিন্তু স্বামী বেচারার আর দরজার বাইরে পা রাখার সৌভাগ্য হয় না। স্ত্রী তার চোদ্দটা বাজিয়ে দেয়। তারপর সে একাই মজা করতে থাকে।

বাহ্, দারুণ গপপো ফঁদতে জানো দেখছি। বলল মোনা। তাই কি? হাসল ফ্রেড টেলর, তবে চেহারায় কোন ভাব ফুটল না। হঠাৎ তার মুখ কঠোর হয়ে উঠল। হানি, আমি এখানে গপপো মারতে আসিনি। আমি পাঁচ হাজার ডলার চাই নতুবা পুলিশের কাছে যেতে বাধ্য হব।

মি. টেলর, প্লীজ… অন্ধের মতো শব্দ হাতড়াচ্ছে মোনা। কী বলবে বুঝতে পারছে না। শেষ পর্যন্ত এই ছিল তার কপালে। মি. টে-টেলার, ঢোক গিলে বলল সে, তোমাকে…তোমাকে কি একটা ড্রিঙ্ক দেব? টাকাটা…ইয়ে মানে, আমাকে জোগাড় করতে হবে।

ফ্রেড টেলরকে বিস্মিত দেখাল, কিন্তু কথাটা তার মনে ধরেছে বোধ হয়। মোনার সর্বাঙ্গে দ্রুত একবার নজর বোলাল সে, তারপর বলল, ঠিক আছে, মিসেস রোপ, তোমার কথায় ভরসার গন্ধ পাচ্ছি। তুমি বন্ধু হতে চাইছ বুঝতে পারছি। আচ্ছা, আমারও তাতে আপত্তি নেই।

মোনা রান্নাঘরে ঢুকল। তাকে অনুসরণ করল ফ্রেড টেলর। প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে মোনা। কিন্তু একই সঙ্গে ঝড়ের গতিতে মাথা চলছে। এই মূর্তিমান আতঙ্কটার হাত থেকে তাকে রক্ষা পেতেই হবে। সে এক বোতল বুরবন বের করল। ফ্রেড মন্তব্য করল, খাসা মাল।

কাবার্ড থেকে দুটো গ্লাস বের করল মোনা, ফ্রিজ খুলল। আইস কমপার্টমেন্টে বরফের কিউবগুলো ট্রের সঙ্গে শক্তভাবে লেগে আছে। মোনা কিউবগুলো ছোটাতে চেষ্টা করছে, টের পেল ফ্রেড অশ্লীলভাবে তার শরীরের সঙ্গে গা ঠেসে ধরেছে। গলা ফটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে করল মোনার। কিন্তু ফ্রেড বলল, দেখি, আমি কিউবগুলো নিচ্ছে। সিধে হয়ে গেল মোনা, কিন্তু ফ্রেড ওর কাঁধ চেপে ধরল, চোখে চিকচিক করছে কামনা।

ঝুঁকল ফ্রেড, চুমু খাবে। ঝট করে মুখ সরিয়ে নিল মোনা। এক মুহূর্তের জন্যে ফ্রেডের মুখ ছুঁয়ে গিয়েছিল মোনার চিবুক, বোটকা একটা গন্ধ পেল মোনা। বিদ্যুঙ্গতিতে হাতটা ওপর দিকে উঠে এল, ঠাস করে ফ্রেডের গালে চড় কষাল সে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল ফ্রেড, কিন্তু মোনাকে অবাক করে দিয়ে ছেড়ে দিল। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল ফ্রেড মোনার দিকে, ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে।

ঠিক আছে, খুকী। তোমার বন্ধুত্ব তাহলে স্রেফ ভান! যাকগে, টাকাটা আমার এক্ষুণি চাই! বের করো শিগগির।

মোনা হতবুদ্ধির মত দাঁড়িয়ে আছে, এদিক ওদিক মাথা নাড়ল।

আবার কাঁধ চেপে ধরল ফ্রেড ভয়ানক ঝকি দিতে লাগল। মাগী! টাকা কোথায় রেখেছিস শিগগির বল! গর্জে উঠল সে।

গা-গাড়িতে! ফুঁপিয়ে উঠল মোনা।

ঝাঁকুনি বন্ধ করল ফ্রেড, তীক্ষ্ণ চোখে চাইল মোনার দিকে। মোনা যন্ত্রমানুষের মতো হাঁটতে লাগল, ফ্রেড ওর সঙ্গে এগোল। গ্যারেজে চলে এল দুজনে। মোনা সব কাজ যেন করছে একটা ঘোরের মধ্যে। জানে না কিসের জন্যে সে গ্যারেজে এসেছে, আসলে অবচেতনভাবে ও একটা অস্ত্র খুঁজছিল পশুটাকে শায়েস্তা করতে, ওর হাত থেকে রক্ষা পেতে। গ্যারেজে কি সে রকম কিছু নেই?

শূন্য দৃষ্টিতে চারপাশে চোখ বোলাচ্ছে মোনা, পাশে দাঁড়ানো ফ্রেড টেলর বলল, এই গাড়িতেই তো, নাকি?

না ট্রাঙ্কে, পকেট হাতড়ে চাবি বের করল মোনা, ট্রাঙ্ক খুলল। খোলা ট্রাঙ্কটা মুখ ব্যাদান করল মোনর দিকে চেয়ে, ওঠার মধ্যে জ্যাক আর লাগ রেন্টটা পড়ে আছে।

খুকী…

কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেল ফ্রেড। দেখল মোনা ট্রাঙ্কের মধ্যে কি যেন খোঁজাখুঁজি করছে। এবার কি একটা ধরে টানতে লাগল মোনা, ছোটাতে পারছে না।

ফ্রেড মোনার কোমরে হাত রাখল, প্রায় ছুঁড়ে ফেলল গ্যারেজের দরজার ওপরে।

টাকাটা এখানে আছে, খুকী? কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল সে। লাইনিং-এর পেছনে?

আড়ষ্ট ভঙ্গিতে মাথা দোলাল মোনা।

ফাঁদে পা দিল ফ্রেড টেলর। ট্রাঙ্কের মধ্যে উঁকি দিল সে, হামাগুড়ি দিয়ে ভিতরে ঢুকল, লাইনিং ছিঁড়তে শুরু করল। টায়ার রেঞ্চটা মোনার সাহায্যে আসার জন্যেই যেন অদূরে অপেক্ষা করছিল। সামনে বাড়ল মোনা, ঝট করে তুলে নিল লোহার ভারী অস্ত্রটা, শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে মরণ আঘাত হানল ফ্রেডের মেরুদণ্ডে।

আর্তনাদ করে উঠল সে, প্রবল ঝাঁকি খেল শরীর। ট্রাঙ্কের ডালায় প্রচণ্ড জোরে থেতলে গেল মাথা। এবার রেঞ্চটা ঘুরিয়ে ফ্রেডের উরুর পিছনে মারল মোনা। গলা চিরে চিৎকার বেরিয়ে এল ফ্রেডের, মাথাটা ট্রাঙ্ক থেকে বের করেছে মাত্র, তৃতীয় আঘাতটা করল মোনা ওর মুখে। তারপর যেন খুনের নেশা পেয়ে গেল ওকে। একের পর এক বাড়িতে ফ্রেডের মাথাটা চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলল।

রেঞ্চটা লাশের গায়ে ফেলে ট্রাঙ্ক বন্ধ করল মোনা, হেলান দিয়ে হাঁপাতে লাগল। ফোঁপানির মতো শ্বাস বেরিয়ে আসছে মুখ থেকে, শরীরে সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গেছে। তবে কাজটা করতে পেরেছে মোনা। ট্রাঙ্কের ভেতরে লোকটা আর কখনও তাকে বিরক্ত করতে আসবে না।

টলমল পায়ে ঘরে ফিরল মোনা। জট পাকানো চিন্তা-ভাবনাগুলো গোছাতে চেষ্টা করল। ফ্রেড টেলরের লাশটা কোথাও ফেলতে হবে। নদীতে ফেলা যায়। কিন্তু তেমন কোন নির্জন জায়গা মিলবে কি?

হঠাৎ দরজায় কলিংবেলের আওয়াজ! ভয়ানক চমকে উঠল মোনা, দ্রুত ঠান্ডা হয়ে গেল শরীর। ওঠার শক্তি পাচ্ছে না। আবার বেল বাজল। পারব। না, কাঁপতে কাঁপতে ভাবল মোনা, আমি আর পারব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে দাঁড়াল, গভীর শ্বাস টানল একটা, দাঁতে দাঁত চেপে পা বাড়াল সামনের দরজার দিকে। দরজা খুলতেই শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল একটা স্রোত নামতে থাকল। চিৎকার দিতে যাচ্ছিল, শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামাল দিল ও। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস।

সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস চোখ কুঁচকে, বলল, শুভ সন্ধ্যা, মিসেস রোপ। কোন। সমস্যা?

স্বাভাবিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে মোনা। না, জবাব দিল সে। কণ্ঠ ভাঙা শোনাল। মানে– মাঝ পথে থেমে গেল সে। তারপর বলল, মানে আপনাকে এই সময়ে ঠিক আশা করিনি। ভেবেছিলাম ওই লোকটাই আবার এল কিনা!

আচ্ছা? প্রশ্নবোধক চোখে চাইল ব্যাঙ্কস।

ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা গাড়িটাকে আঙুল দিয়ে দেখাল মোনা। একটা লোক এসেছিল কিছুক্ষণ আগে। একজন সেলসম্যান। লোকটা ভালো না। আমি ওকে বের করে দেই। আর আপনি যখন বেল বাজালেন, ভাবলাম…ইয়ে মানে ওই লোকটাই বুঝি আবার এসেছে। ওকে আরও কড়া কিছু কথা শোনাবার ইচ্ছে নিয়েই দরজা খুলেছিলাম আমি।

হয়তো লোকটা কাছে পিঠে কোথাও থাকতে পারে, বলল সার্জেন্ট। তবে ওখানে গাড়ি পার্ক করা তার উচিত হয়নি।

সম্ভবত তাড়াহুড়োয় কাজটা করেছে সে। বলল মোনা। থাকগে, আপনার জন্য কি করতে পারি, বলুন?

তেমন কিছুই না। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি খাওয়ালে কৃতার্থ হব, মিসেস রোপ।

এক্ষুনি দিচ্ছি।

সার্জেন্টকে রান্নাঘরে নিয়ে এল মোনা, তার এহেন অদ্ভুত অনুরোধে খানিকটা হতচকিত সে। গ্লাসে পানি ঢালল মোনা। এক চুমুকে গ্লাসটা শেষ করল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস, মোনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে চলে এল। ড্রাইভওয়েতে গাড়িটার দিকে আবার চাইল সার্জেন্ট। আমি কি ওই সেলসম্যানকে খুঁজে বের করে বলব গাড়িটা এখান থেকে সরিয়ে নিতে?

না, মোনার মনে হলো সে অজ্ঞান হয়ে যাবে। থাক, যার গাড়ি সেই সময়মত নিয়ে যাবে। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না।

ঠিক আছে, মিসেস রোপ। গুড নাইট, সার্জেন্ট।

সার্জেন্ট ব্যাঙ্কসকে চোখ দিয়ে অনুসরণ করল মোনা। সার্জেন্ট গাড়িটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, দরজা খুলল। রেজিস্ট্রেশন বুকের ওপর চোখ বোলাল, তারপর রাস্তায় উঠল। এদিক ওদিক বার দুই তাকাল সবশেষে ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একটা কালো সেডানে চড়ে অদৃশ্য হয়ে গেল।

.

এখন মোনার করণীয় কাজ একটাই। কনভার্টিবল গাড়িটা নিয়ে বেরিয়ে পড়া। সার্জেন্ট যদি মোনার কল্পিত সেলসম্যানের জন্যে কোথাও অপেক্ষা করতে থাকে তাহলে সে মোনাকে অনুসরণ করবে না। সে শুধু ড্রাইভওয়েতে পার্ক করা গাড়িটার দিকে নজর রাখবে। হয়তো সারারাত সে এখানেই থাকবে। ভাড়া করা সেডানও নড়বে না। পরদিন সহজেই মোনার গল্পটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে। এক সেলসম্যান তার ড্রাইভওয়েতে গাড়িটা পার্ক করে তার বাসায় এসেছিল। কিন্তু লোকটাকে পছন্দ হয়নি বলে সে তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে। মোনা ভেবেছে সেলসম্যান হয়তো পড়শীদের কারও বাড়িতে গেছে। না, মোনা জানে না, লোকটা কেন তার গাড়ি নিতে আর ফিরে আসেনি।

মোনা কনভার্টিবলটাকে গ্যারেজ থেকে বের করল, বড় রাস্তায় উঠতে যাচ্ছে, হঠাৎ কালো সেডানটা যেন মাটি খুঁড়ে সামনে এসে দাঁড়াল, মোনা বাধ্য হলো ব্রেক কষতে।

সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস ওর কাছে এল। খোলা জানালায় ঝুঁকে বলল, আপনার বয়ফ্রেন্ডটি কোথায়, মিসেস রোপ? সার্জেন্টের চেহারা পাথরের মতো কঠিন।

মোনা শক্ত মুঠিতে চেপে ধরল স্টিয়ারিং হুইল, সাদা হয়ে গেল আঙুলের গাঁট। আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না, সার্জেন্ট।

আপনাদের এখানে কোন সেলসম্যান আসেনি, মিসেস রোপ। আর আপনার উঠানে ওটা একটা ভাড়া করা গাড়ি। আমার ধারণা আপনার বাড়িতে একটা লোক লুকিয়ে আছে। অবৈধ সম্পর্ক শুধু পুরুষরাই করে না, কথাটা নিশ্চয়ই জানেন। এটা কি সম্ভব নয় যে আপনিও অনেকদিন ধরে কারও সঙ্গে চুটিয়ে প্রেম করে যাচ্ছেন? এটাও কি সম্ভব নয় যে আপনি আর আপনার প্রেমিক দুজনে মিলেই আপনার স্বামীর হত্যা পরিকল্পনা করেছেন? আর এটাও বা অসম্ভব কি যে সেই পরিকল্পনাটির সফল বাস্তবায়ন ঘটিয়েছে আপনার প্রেমিক প্রবর? এই প্রশ্নগুলো আমাকে ভীষণ তাড়া করছে, মিসেস রোপ।

সার্জেন্ট! খাবি খেল মোনা। এসব আপনি কি বলছেন? আমি আজই আপনার বসের সঙ্গে কথা বলব। জানেন আমি তা পারি।

জ্বী, মিসেস রোপ, বলল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস। তা আপনি পারেন। ঠিক আছে, লেফটেন্যান্ট পোলিংকে ফোন করুন আর বলুন–

ওহ্ সার্জেন্ট, দিস ইজ অ্যাবসার্ড! ঝট করে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল মোনা।

আপনার গাড়ির চাবি, প্লীজ।

কি? চিৎকার করে উঠল মোনা।

সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস তীক্ষ্ণ চোখে কিছুক্ষণ কনভার্টিবলটাকে পরীক্ষা করল। মোনার হার্টবিট বেড়েই চলল। ট্রাঙ্ক বেয়ে রক্ত পড়ছে না তো? মোনা মনে করতে পারল না ফ্রেডকে হত্যা করার সময় ওর শরীর রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল কিনা…

চাবি, মিসেস রোপ? হাত বাড়াল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস, অপেক্ষা করছে।

হতবুদ্ধি মোনা এদিক ওদিক মাথা নাড়ল। আপনার কথা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।

হতে পারে আপনি আপনার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে পালিয়ে যাবার প্ল্যান করেছেন, বলল সে। হতে পারে সে ট্রাঙ্কে লুকিয়ে আছে। ট্রাঙ্কটা তাই আমাকে খুলে দেখতে হবে।

গলা চিরে আর্তনাদ বেরিয়ে এল মোনার, ঘুরে দাঁড়াল, দৌড় দেবে। কিন্তু সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস ওর চেয়ে অনেক ক্ষিপ্র। খপ করে সে মোনার কব্জি ধরে ফেলল, গাড়ির সঙ্গে ওকে ঠেসে ধরে সমস্ত ওজন চাপিয়ে দিল গায়ে। খোলা জানালার দিকে হাত বাড়াল সার্জেন্ট, একটানে ইগনিশন সুইচ থেকে খুলে আনল চাবির গোছা, মোনাকে চেপে ধরে নিয়ে এল গাড়ির পেছনে। গোছা থেকে সঠিক চাবিটা বের করে ট্রাঙ্কের তালায় লাগাল ব্যাঙ্কস। তারপর একটানে ডালাটা তুলে ফেলল ওপরে।

ভেতরের দৃশ্যটা দেখে আঁতকে উঠল সার্জেন্ট ব্যাঙ্কস, আর একই সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল মোনা রোপ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *