দ্য সিটিজেন – ফ্রেডরিক ফোরসাইথ

দ্য সিটিজেন – ফ্রেডরিক ফোরসাইথ

বাড়ি পালানো ছিল তার সবসময়ই প্রিয় বিষয়। ত্রিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে তিনি ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্রকাণ্ড অ্যালুমিনিয়াম টিউবগুলো চালিয়ে আসছেন। দেখেছেন সত্তরটিরও বেশি বড় বড় শহর, এর বেশিরভাগই রাজধানী।

ত্রিশ বছর আগে তিনি ছিলেন উজ্জ্বল চোখের, ঝাঁকড়াচুলো, দুই আস্তি নে সাঁটানো নতুন, ঝকঝকে জুনিয়র ফাস্ট অফিসারের দুটি রিংয়ের এক তরুণ, যিনি দূর দেশে যেতে খুব পছন্দ করতেন। স্টপ-ওভারগুলোতে তিনি উপভোগ করেছেন ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নৈশ জীবন, গিয়েছেন দূর প্রাচ্যের মন্দিরে। এখন তিনি ডকিংয়ে, নিজের বাড়িতে ফেরার জন্য মুখিয়ে থাকেন।

ওই দিনগুলোতে সুন্দরীতমা স্টুয়ার্ডেসদের সঙ্গে তাঁর উষ্ণ সম্পর্ক ছিল তবে সুসান তাকে বিয়ে করার পরে তিনি ওইসব ত্যাগ করেন। পাঁচ হাজার রাত হোটেলের বিছানায় কাটানোর পরে তাঁর একমাত্র আকুলতা ছিল বাড়ি ফিরে সুসানের গায়ের ল্যাভেণ্ডারের গন্ধ নেয়া।

তিনি এখন এক কন্যা এবং এক পুত্রের জনক। ছেলে চার্লসের বয়স তেইশ, পেশায় কম্পিউটার প্রোগ্রামার, মেয়ে জেনিফার, আঠারো, হিস্টোরি অব আর্ট নিয়ে পড়াশোনার জন্য ইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে ঢুকছে। এরা তাকে সুস্থিত একটি অবস্থা এবং বাড়ি ফেরার আরেকটি কারণ দিয়েছে। আর দুবছর পরে তিনি অবসরে যাবেন। ইনি ক্যাপ্টেন আড্রিয়ান ফ্যানন। এ মুহূর্তে একটি ক্রু বাসে রয়েছেন। আর কিছুক্ষণ পরে তিনি একটি বোয়িং ৭৪৭-৪০০ জাম্বো বিমানে ব্যাংকক বিমান বন্দর থেকে ৪০০ যাত্রী নিয়ে উড়াল দেবেন লণ্ডনের হিথ্রো এয়ারপোর্টের উদ্দেশে।

ক্রুবাসটি এ মুহূর্তে ব্যাংকক বিমান বন্দরে যাচ্ছে। বাসে তিনি, দুজন ফার্স্ট অফিসার ছাড়া আরও আছেন কেবিন সার্ভিস ডিরেক্টর বা CSD, পনেরজন স্টুয়ার্ড, এদের চারজন পুরুষ, বাকি এগারজন নারী। দিন দুই আগে তিনি এদেরকে নিয়ে হিথ্রো থেকে উড়ে এসেছেন, জানেন CSD মি.হ্যারি পালফ্রে ফ্লাইট ডেকের দরজা থেকে শুরু করে প্লেনের লেজ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক সামাল দেবেন। কারণ পালফ্রে অতিশয় অভিজ্ঞ একজন বিমান কর্মী।

বাইরে ব্যাংককের আবহাওয়া আর্দ্র এবং গরম, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ক্রু বাসটির ভেতরে তাই আরাম লাগছিল যাত্রীদের। টেক অফের দুই ঘণ্টা আগেই ক্রু বাস ঢুকে পড়ছে এয়ারপোর্ট পেরিমিটারে। বাসটি এগোল BA (ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ) অফিস অভিমুখে। BA অফিস জানিয়েছে সিডনি থেকে যাত্রা করা স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো ব্যাংককের স্থানীয় সময় রাত ৯৯ ৪৮-এ এয়ারপোর্টে অবতরণ করবে। আসলে এটি প্রায় চলেই এসেছে বলা যায়।

ক্রু বাসের এক মাইল পেছনে একটি কালো লিমুজিন। এর একমাত্র যাত্রী উর্দিপরা ড্রাইভারের পেছনে বসে আছেন। তাঁরা আসছেন অভিজাত ওরিয়েন্টাল হোটেল থেকে। ওখানে সিনিয়র এক্সিকিউটিভটি তিনদিন ধরে অবস্থান করছিলেন। গাড়ির বুটে রাখা আছে তার সুটকেস, খাঁটি চামড়ার তৈরি সলিড পিতলের লক, দেখেই বোঝা যায় এর মালিক খুব বেশি ভ্রমণ করেন না বটে তবে সফরকালে সস্তা জিনিসও ব্যবহার করেন না। তার পাশে, সিটের ওপর পড়ে আছে কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেস।

তাঁর চমৎকার ছাঁটাইয়ের ক্রিম সিল্ক সুটের ব্রেস্ট পকেটে শুয়ে আছে একটি ব্রিটিশ পাসপোর্ট যাতে নাম লেখা হিউগো সিমুর এবং রয়েছে ব্যাংকক থেকে লণ্ডন যাত্রার রিটার্ন হাফ টিকেট। অবশ্যই ফার্স্ট ক্লাস। স্পিড়বার্ড ওয়ান জিরো যখন রানওয়ে থেকে ট্যাক্সি রোল করে BA ডিপারচার লাউঞ্জের দিকে যাচ্ছে, ওইসময় লিমোজিনটি মৃদু গরগর শব্দে চেক-ইন হলের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল।

মি. সিমুর তাঁর লাগেজ ট্রলিতে তুললেন না। ম্যানিকিওর করা একটি হাত তুলতেই এক থাই পোর্টার ছুটে এল। ড্রাইভারকে বকশিস দিয়ে ব্যবসায়ীটি ভোলা বুটে রাখা তাঁর সুটকেসটির দিকে তাকিয়ে মৃদু মাথা ঝাঁকালেন, তারপর পোর্টারের পেছন পেছন চেক ইন হলে ঢুকলেন। এগোলেন ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ফার্স্ট ক্লাস ডেস্কে। গাড়ি থেকে নেমে ট্রপিকাল হিটের মধ্যে মাত্র ত্রিশ সেকেণ্ড সময় তাঁকে থাকতে হলো।

ফার্স্ট ক্লাস চেক ইনে এক ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট সময় লাগে না। ডেস্কের পেছনে তরুণ ক্লার্কটি অন্য কারও জন্য ব্যস্তও ছিল না। দশ মিনিটের মধ্যে সুটকেসটি ব্যাগেজ-হ্যাণ্ডলিং এরিয়ায় রওনা হয়ে গেল যেখানে ওটার ট্যাগ দেখিয়ে দেবে যে ওটা BA লণ্ডন ফ্লাইটে যাচ্ছে। মি. সিমুরকে বোর্ডিং কার্ড দেয়া হয়েছে এবং পাসপোর্ট কন্ট্রোলের পেছনে ফাস্ট ক্লাস লাউঞ্জটি তাঁকে দেখিয়ে দেয়া হলো।

ইউনিফর্ম পরা থাই ইমিগ্রেশন অফিসার বার্গাণ্ডি রঙের পাসপোর্ট এবং বোর্ডিং পাসে চোখ বুলিয়ে অবশেষে তাকাল গ্লাস স্ক্রিনের ওপাশে দাঁড়ানো লোকটির দিকে।

দ্রলোক মধ্যবয়সী, হালকা রোদে পোড়া চামড়া, সদ্য কামানো মুখ, লৌহ ধূসর চুল, পরনে নরম, ঘামশূন্য সাদা সিল্ক শার্ট, জিম থম্পসনের দোকান থেকে কেনা সিল্ক টাই এবং ক্রিম সিল্ক সুট যেটি ব্যাংককের সেরা এক দর্জি বানিয়েছে, যারা ত্রিশ ঘণ্টার মধ্যে সেভিল রোর নকল তৈরি করে দিতে পারে। সে আইডেন্টিটি ডকুমেন্ট ঠেলে দিল কাঁচের পর্দার নিচে।

Sawat-di, krab, বিড়বিড় করে বললেন ইংলিশম্যান। থাই অফিসার ভদ্রতা দেখিয়ে হাসল। থাই ভাষায় খুব কম মানুষই ধন্যবাদ জানাতে পারে, বিশেষ করে বিদেশীদের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব একটি কাজ।

ওদিকে সিডনি থেকে ব্যাংকক আসা প্লেনটি থেকে যাত্রীরা নামতে শুরু করেছে। লম্বা করিডর ধরে তারা ইমিগ্রেশনে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে প্লেন খালি হয়ে গেল। এখন ওতে ক্লিনিং স্টাফরা উঠবে আবর্জনা পরিষ্কার করতে। অন্তত চোদ্দটি বিনলাইনার ভরে যাবে আবর্জনায়।

এদিকে মি. সিমুর তাঁর কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেস নিয়ে ফাস্ট ক্লাস লাউঞ্জে পা বাড়ালেন। তাঁকে বসার জায়গা দেখিয়ে দিয়ে এক গ্লাস হোয়াইট ওয়াইন নিয়ে এল। তিনি ফোর্বস ম্যাগাজিনের মধ্যে ডুবে গেলেন। শীতল, বিলাসবহুল, সুপরিসর এ লাউঞ্জে আরও জনাকুড়ি যাত্রী রয়েছে।

তিনি যখন পত্রিকা পড়ছেন ওই সময় বোয়িং ৭৪৭-৪০০র ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা চেক ইন হলে ভিড় জমিয়েছে। এ বিমানটিতে চোদ্দটি প্রথম শ্রেণীর আসন রয়েছে, তেইশটি আছে ক্লাব ক্লাস সিট। এগুলো সবই ভরে যাবে। এর পরের আসনগুলো হলো ইকোনমি ক্লাস বা ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার ক্লাস। এর যাত্রী সংখ্যা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৪০০। চেক ইন হল এর দশটি ডেস্ক এতগুলো যাত্রীকে সামাল দিতে গলদঘর্ম হয়ে গেল। এই যাত্রীদের মধ্যে হিগিন্স পরিবারও আছে। এই যাত্রীরা সবাই নিজেদের লাগেজ বহন করছে। তারা এসেছে কোচে চড়ে। গরমে এবং ঘামে এদের বেসামাল দশা। ডিপারচার লাউঞ্জে পৌঁছাতে হিগিন্স পরিবারের এক ঘণ্টা সময় লেগে গেল।

.

ক্যাপ্টেন এবং তাঁর ক্রুরা অফিসে পনেরো মিনিট সময় কাটালেন প্রয়োজনীয় কাগজপত্রে চোখ বুলানোর জন্য। এখানে ফ্লাইট প্ল্যান রয়েছে যাতে বলা হয়েছে ফ্লাইটে কতটা সময় লাগবে, মিনিমাম কতটুকু জ্বালানি নিতে হবে এবং বেশ কয়েকটি কাগজে রুট সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য রয়েছে যা আজ রাতে অনুসরণ করবেন ক্যাপ্টেন। এ তথ্যগুলো যুগিয়েছে ব্যাংকক এবং লণ্ডনের বিভিন্ন এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল সেন্টার। UK রুটের আবহাওয়া বার্তা বলছে আজ রাতের আবহাওয়া স্বাভাবিক থাকবে।

কাগজপত্রে সইটই করে চার পাইলট প্লেনে ওঠার জন্য প্রস্তুত হলেন। সিডনি থেকে আসা যাত্রীরা অনেক আগেই চলে গেছে। ক্লিনাররা এখনও প্লেনে আছে তবে সেটা CSD র বিষয় এবং মি. হ্যারি পালফ্রে দক্ষতার সঙ্গে যথারীতি ওসব ঝামেলা চোকাবেন।

থাই ক্লিনাররাই CSD র কেবল চিন্তার বিষয় নয়। তাঁকে অন্যান্য সমস্ত দিকেও খেয়াল রাখতে হয়। ল্যাভেটরি ঠিকঠাক পরিষ্কার হলো কিনা দেখতে হবে। ৪০০ যাত্রীর জন্য যথেষ্ট পরিমাণ খাদ্য এবং পানীয় নিয়ে আসা হচ্ছে। এমনকী তিনি লণ্ডনের লেটেস্ট খবরের কাগজের ব্যবস্থাও করেছেন। এগুলো মাত্রই হিথ্রো থেকে আরেকটি জেট বিমান করে এল। মি. পালফ্রে যখন এসব তদারকি করছেন ওইসময় ক্যাপ্টেন এবং তাঁর ক্রুরা প্লেনে উঠে বসলেন।

ক্যাপ্টেন ফ্যালন সিঁড়ি বেয়ে তার এলাকায় চলে এলেন। এন্ট্রি লেভেল থেকে আপার কেবিন এবং সেখান থেকে হেঁটে ফ্লাইট ডেক ডোরে। তাঁর দুই ক্যাপ্টেন এবং একজন ফাস্ট অফিসার যে যার জ্যাকেট খুলে ফেলে রেস্টরুমের দরজার পেছনে ওগুলো ঝুলিয়ে রেখে নিজেদের আসনে বসল।

সামারের সময় ক্যাপ্টেন ফ্যালনকে সাধারণত দুজন ফার্স্ট অফিসার সঙ্গ দেয়। তবে এটা জানুয়ারি শেষ এবং টানা তের ঘণ্টার এ জার্নিতে তাঁর সঙ্গে একজন ফাস্ট অফিসার আছে। অপরজন ছুটিতে।

ক্যাপ্টেন ফ্যালনের বামে বসল একজন পাইলট, ডানে সিনিয়র ফার্স্ট অফিসার। ফ্লাইট ডেকের পেছনে, বাম দিকে, দুইট বাঙ্কসহ ছোট একটি কামরা আছে। ক্যাপ্টেন অটোমেটিক পাইলটে প্লেন চালাতে দিয়ে, তার অপর দুই পাইলটের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে নিশ্চিন্ত মনে চার পাঁচ ঘণ্টা ওখানে নিদ্রা যেতে পারেন। তিনি দুই পাইলটকে কন্ট্রোলে রেখে বাঙ্করুমে ঢুকলেন কাগজে স্টক মার্কেটের খবরে চোখ বুলাতে।

গোটা এয়ারক্রাফ্ট এখন পরিচালিত হচ্ছে Auxiliary Power Unit বা APU দ্বারা। এটি আসলে পঞ্চম জেট ইঞ্জিন যার সম্পর্কে খুব কম যাত্রীই জানে। এই দানব এয়ারক্রাফট যে APU দ্বারা চলছে তার পাওয়ারের সাহায্যে একটি ছোটখাট ফাইটার একাই চলতে সঙ্গম। এই পাওয়ার বিমানটির বাইরের সবকিছু স্বাধীনভাবে কাজ চালানোর সামর্থ দিচ্ছে– আলো, বাতাস, ইঞ্জিন স্টার্টসহ আরও অনেক কিছু।

ওয়ার্ল্ড ট্রাভেলার ডিপারচার লাউঞ্জে মি., মিসেস হিগিন্স এবং তাদের মেয়ে জুলি ইতিমধ্যে ক্লান্ত এবং মেয়েটির মেজাজ খিটখিটে হতে শুরু করেছে। তারা চার ঘন্টা আগে তাদের দুই তারকা হোটেলটি ছেড়ে এসেছে। এখানে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগেছে। কোচে লাগেজ তোলো, কোনোকিছু ফেলে গেলে কিনা তা পরীক্ষা করো, লাইনে দাঁড়াও, ছোট একটি সিটে বসো, ট্রাফিক জ্যাম, দেরি হয়ে যাওয়ার দুশ্চিন্তা, আবার যানজট, কোচ থেকে এয়ারপোর্টে নামমা, লাগেজ খুঁজে বের করো, তারপর ট্রলির সন্ধান, বাচ্চাটা আবার কোথাও ছুটে গেল কিনা সেদিকেও লক্ষ রাখো, চেক ইনের এক মাইল লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকো, কিউতে দাঁড়াও, অপেক্ষা করো, তারপর সিকিউরিটি এক্স-রে মেশিন, বডি সার্চ কারণ বেল্ট বাকলের কারণে বেজে উঠেছে অ্যালার্ম, জুলির চিৎকার কারণ তার পুতুলটা পাঠানো হয়েছে এক্স-রের জন্য, ডিউটি ফ্রি শপে কিছু হাবিজাবি কেনাকাটা, আবার কিউ এবং অপেক্ষা … অবশেষে বোর্ডিংয়ের আগে লাস্ট স্টপে শক্ত প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে থাকো।

জুলি তার পুতুলটি বুকে চেপে ধরে অপেক্ষা করতে করতে অস্থির হয়ে পড়ল। সে এবার হাঁটাহাঁটি করতে লাগল। পুতুলটি তার বাবা তাকে ফুকেট থেকে কিনে দিয়েছে। তাকে দেখে কয়েক গজ দূরে বসা এক লোক ডাক দিল।

এই যে খুকী, খুব সুন্দর পুতুল তো!

দাঁড়িয়ে পড়ল জুলি, চোখ কুঁচকে তাকাল লোকটার দিকে। লোকটার পায়ে কাউবয় বুট, ভেঁড়া, মলিন জিনস, গায়ে ডেনিম শার্ট, গলায় জপমালা। তার চেয়ারের পাশে একটি ছোট হ্যাঁভারস্যাক। চুলগুলো ফ্যাকাশে, গোসল করেনি বোধহয়, মুখে খোঁচাখোঁচা দাড়ি।

আট বছরের জুলির জানার কথা নয় এ একজন হিপ্পি। দূরপ্রাচ্য হিল্পিদের কাছে খুবই আকর্ষণীয় জায়গা। এর কারণ এখানকার জীবনযাত্রা সহজ এবং সস্তা, তাছাড়া এসব দেশে মাদকও মেলে সহজে।

ও আমার নতুন পুতুল, বলল জুলি। ওর নাম পুকি।

বেশ নাম। কিন্তু ওকে পুকি বলো কেন? জিজ্ঞেস করল হিপ্পি।

কারণ ড্যাডি ওকে পুন্ড কেট থেকে কিনে দিয়েছে। আমি চিনি জায়গাটা। চমৎকার সাগর সৈকত আছে। তোমরা ওখান থেকে ছুটি কাটিয়ে এলে বুঝি?

হুম। আমি ড্যাডির সঙ্গে সাঁতার কেটেছি। কত মাছ দেখলাম!

মিসেস হিগিন্স বুড়ো আঙুলের খোঁচা দিল তার স্বামীর পায়ে, ইঙ্গিতে দেখাল তাদের মেয়েকে।

জুলি, এখানে এসো, ডার্লিং, মিসেস হিগিন্স ডাকল তার মেয়েকে। মায়ের এ গলার স্বরটি চেনে জুলি। রাগ করলে বা অসন্তুষ্ট হলে মা এভাবে ডাকে। সে লাফাতে লাফাতে চলে গেল তাদের কাছে। হিগিন্স কটমটে চোখে তাকাল হিপ্পির দিকে। হিপ্লিদের সে মোটেই পছন্দ করে না। এরা বদ, নোংরা এবং মাদকসেবী। এরকম একটা লোকের সঙ্গে তার মেয়েকে কথা বলতে দেয়ার প্রশ্নই নেই। হিপ্পি অগ্নিদৃষ্টির মাজেজা বুঝতে পারল। সে কাঁধ ঝাঁকিয়ে এক প্যাকেট সিগারেট বের করল। তবে মাথার ওপর ধূমপান নিষেধ-এর সাইনবোর্ডে চোখ পড়তে পা বাড়াল স্মোকিং এরিয়ায়। নাক সিটকাল মিসেস হিগিন্স। পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণা করা হলো এখনওই বোর্ডিং শুরু হবে, চেক করা হবে ৩৪ থেকে ৫৭ সারির বোর্ডিং পাস। মি. হিগিন্স তার বোর্ডিং পাস বের করল। ৩৪ নং সারি, সিট D,E এবং F। পরিবারকে সঙ্গে নিয়ে সে চূড়ান্ত লাইনটিতে গিয়ে দাঁড়াল।

.

প্লেন ছাড়ার সময় রাত ১১.৪৫। ১৩ ঘণ্টা ২০ মিনিটের যাত্রা। ক্যাপ্টেন ফ্যালনের বিমান কাল সকাল ৬টা ২০ মিনিটে লণ্ডনের হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছানোর কথা। তখন ওখানকার তাপমাত্রা থাকবে শূন্যের কাছাকাছি, আর ব্যাংককে এ মুহূর্তের তাপমাত্রা দেখাচ্ছে ২৬ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড, হিউমিডিটি ৯০ ডিগ্রির ওপরে।

কেবিন ডোরে নক হলো। CSD ভেতরে ঢুকলেন প্যাসেঞ্জার ম্যানিফেস্ট বা যাত্রী তালিকা নিয়ে।

চারশ পাঁচ জন, স্কিপার, বললেন তিনি।

তালিকায় সই করে ওটা CSD পালফ্রেকে ফিরিয়ে দিলেন ফ্যালন। ইনি এটা তুলে দেবেন BAর গ্রাউণ্ড স্টাফকে। বিশাল ফ্লাই মেশিনটির লোকজন তাদের সার্ভিলেন্সের কাজ শেষ করছে। ব্যাগেজ হোন্ড বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, হোস পাইপগুলো ডিসকানেক্টড, গাড়িগুলো সম্মানজনক দূরত্বে সরে গেছে। দানবটি তার চারটি প্রকাণ্ড রোলসরয়েস ইঞ্জিন চালু করে দৌড় দেয়ার জন্য প্রস্তুত।

প্রথম শ্রেণীর কেবিনে মি. সিমুর তাঁর সিল্ক জ্যাকেটটি খুলে সামনের ওয়ার্ডরোবে রেখেছেন। ঢিলে করে দিয়েছেন টাই। তাঁর কনুইয়ের কাছে বুদ্বুদ তোলা শ্যাম্পেনের গ্লাস, CSD তাঁকে তাজা ফিনান্সিয়াল টাইমস এবং ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা দিয়ে গেছেন।

৩৪ নং সারিতে হিগিন্স পরিবার জাঁকিয়ে বসেছে। তারা ভাগ্যবান। কারণ G নম্বর আসনটি খালি। ফলে চার আসনের এই সারিটি তারা একান্ত ই নিজের করে পাচ্ছে। জন হিগিন্স D নম্বর সিটে বসল। এটি আইলের এক পাশে, তার স্ত্রী দখল করল G নম্বর আসন, আইলের অপর পাশে। তাদের মাঝখানে বসল জুলি। কোলে তার পুকি।

স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো স্টার্ট নিয়েছে। ট্যাক্সিং করে যাচ্ছে টেক অফ পয়েন্টের দিকে। ক্যাপ্টেন ফ্যালন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছেন টাওয়ার কন্ট্রোলের সঙ্গে। মেইন রানওয়ের দূর প্রান্তে পৌঁছে তিনি টেক অফের অনুমতি চাইতেই পেয়ে গেলেন।

রানওয়েতে ঘুরল জাম্বো, নাকটা খাড়া হয়ে আছে সেটার লাইন বরাবর এবং টারমাক থেকে উঁচুতে। ক্যাপ্টেন লিভার ঠেলে দিলেন সামনের দিকে, আঙুল বাঁকা করলেন Toga (Take off/ Go Around) সুইচে চাপ দিতে। চারটে ইঞ্জিনের পাওয়ার স্বয়ংক্রিয়ভাবে উঠে গেছে প্লি সেট ফিগারে।

জাম্বোর গতি দ্রুততর হলে যাত্রীরা গুড়গুড় শব্দ শুনতে পেল। দশ সেকেণ্ড পরে বোয়িংটি ডানা মেলল আকাশে।

প্লেন মাটি ছাড়তেই ফ্যালনের নির্দেশে তার কো-পাইলট সুইচ টিপে গোটা আণ্ডারক্যারেজ তুলে নিল। ঘটাংঘট কয়েকবার শব্দ হলো, তারপর সমস্ত আওয়াজ এবং ভাইব্রেশন বন্ধ হয়ে গেল। বিমানটি প্রতি মিনিটে ১৩০০ ফুট ওপরে উঠছে, তারপর ১৫০০ ফুট, শেষে আরও সহজ হয়ে এল তার শূন্যে উড্ডয়ন।

প্লেন আকাশে ওঠার পরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল জন হিগিন্স। সে প্লেনে চড়তে ভয় পায়, বিশেষ করে টেক অফের সময় তার বুক শুকিয়ে যায় ডরে। এতক্ষণ সে সিটের আর্মরেস্ট চেপে ধরে রেখেছিল। এইমাত্র ছেড়ে দিয়েছে। তবে ভয় পেলেও সে তার পরিবারকে ভয়ার্ত চেহারা দেখাতে চায় না।

আইলের দিকে মাথা তুলে তাকাতেই দেখতে পেল সেই হিপ্পিটা ওদের চার সারি সামনে বসেছে। ৩০৪ তে। তার সামনে দীর্ঘ প্যাসেজ বাল্কহেড পর্যন্ত ঠেকেছে। ওখানে ক্লাব ক্লাস আলাদা করে ফেলেছে ইকোনমি ক্লাসকে। এদিকে কমপ্লিট একটি গ্যালি রয়েছে চারটে ল্যাভেটরিসহ। হিগিন্স দেখতে পাচ্ছে চার-পাঁচজন স্টুয়ার্ডেস রাতের খাবার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সে ছয় ঘন্টা আগে হোটেল রুমে বসে স্ন্যাক খেয়েছে। তারপর আর দানাপানি পড়েনি পেটে। খিদেও পেয়েছে। সে জুলির দিকে তাকাল, ও আরামে বসতে পরেছে কিনা দেখতে। মেয়েকে কার্টুন চ্যানেল ছেড়ে দিল।

.

ব্যাংকক থেকে টেক অফ করে উত্তর অভিমুখে চলেছেন ক্যাপ্টেন ফ্যালন। নিচের দিকে তাকালেন। পরিষ্কার রাত। তাদের পেছনে গালফ অব। থাইল্যান্ড, সামনে দেশটির আয়তন সমান ছড়িয়ে রয়েছে আন্দামান সাগর। চাঁদের আলোয় জলমগ্ন ধানক্ষেতগুলো দেখলে মনে হয় গোটা দেশ জল দিয়ে তৈরি। স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো ৩১০০০ ফুট উচ্চতায় উড়ে চলেছে। লন্ডন যেতে একে একে পার হবে কলকাতা, দিল্লি, কাবুল, তেহরান, পূর্ব তুরষ্ক, বলকান এবং জার্মানি। তিনি স্পিডবার্ড ওয়ান জিরোকে অটো পাইলটে দিলেন, হাত-পা টানটান করলেন। আপার ডেকের এক স্টুয়ার্ডেস তার জন্য কফি নিয়ে এল।

.

৩০সি-র হিপ্পি লেট নাইট ডিনারের মেনুকার্ড দেখছে। খাওয়ার প্রতি তার তেমন আগ্রহ নেই। এ মুহূর্তে একটি সিগারেটে সুখটান দিতে পারলে খুব ভালো হতো। তবে এখনই এ সুযোগ নেই। পরে সুযোগ পেলে সে গাঁজা ভরা একটি সিগারেট খাবে।

গরুর মাংস আনুন, পাশে দাঁড়ানো হাসিমুখের স্টুয়ার্ডেসকে উদ্দেশ্য করে বলল সে। তার উচ্চারণে আমেরিকান টান থাকলেও পাসপোর্ট বলছে সে একজন কানাডিয়ান, নাম ডোনোভান।

.

পশ্চিম লন্ডনে, সশস্ত্র রক্ষী দ্বারা সুরক্ষিত একটি অফিসে ফোন বেজে উঠল। ডেস্কে বসা লোকটি ঘড়ি দেখল। সাড়ে পাঁচটা বাজে কিন্তু এখনই সাঁঝের আঁধার ঘনিয়েছে।

ইয়েস।

বস, BA 0-1-0 ব্যাংকক থেকে উড়াল দিয়েছে।

ধন্যবাদ।

সে ফোন রেখে দিল। উইলিয়াম বিল বাটলার ফোনে কথা বলে সময় নষ্ট করার মানুষ নয়। আসলে সে এমনিতেও খুব কম কথা বলে। সবাই এ কথা জানে। তারা এও জানে যারা ভালো কাজ দেখাতে পারে তাদের প্রতি সে সদয় থাকে আর অকর্মাদের প্রতি তার আচরণ অত্যন্ত বিরূপ।

তবে একটি কথা কেউ জানে না তা হলো তার ফুটফুটে একটি মেয়ে ছিল, তার অহংকার, মেয়েটি স্কলারশিপ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে গিয়েছিল কিন্তু হেরোইনের ওভারডোজ খেয়ে মারা যায়। বিল কাটলার হেরোইন একদমই পছন্দ করে না। সে আরও ঘৃণা করে হেরোইন ব্যবসায়ীদেরকে। এ কারণে হেরোইন ব্যবসায়ীদের যমে পরিণত হয়েছে সে। তার বিভাগ HM কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজের পক্ষে হার্ড ড্রাগসের বিরুদ্ধে নিরন্তর লড়াই করে চলেছে। মাদক ব্যবসায়ীদের ধ্বংস করাই বাটলারের জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।

.

পাঁচ ঘণ্টা পর। স্পিড়বার্ড ওয়ান জিরো এ মুহূর্তে কাবুল এবং কান্দাহার পার হয়ে উত্তরে পানশির পর্বতমালার দিকে চলেছে। ওখানে ধর্মোন্মাদ তালেবানদের বাস।

প্লেনের যাত্রীরা ডিনার সেরে অনেকেই ঘুমিয়ে পড়েছে। সবগুলো জানালার পর্দা ফেলা, বাতির আলো কমানো, গায়ে পাতলা কম্বল। যারা ঘুমায়নি তারা ইন ফ্লাইট মুভি দেখছে, কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে।

34Gতে মিসেস হিগিন্স ঘুমিয়ে পড়েছে, চিবুক পর্যন্ত টেনে দেয়া ব্ল্যাঙ্কেট, মুখ অর্ধেক খোলা, প্রশান্ত নিঃশ্বাস নিচ্ছে। E এর F সিটদুটোর আর্মরেস্ট সরিয়ে, ওটাকে একটি আসনে রূপান্তরিত করে তাতে হাত পা ছড়িয়ে, বুকে পুতুল চেপে আরাম করে ঘুমাচ্ছে জুলি।

তবে ঘুম নেই জন হিগিন্সের চোখে। সে প্লেনে কখনও ঘুমাতেও পারে না। যতই ক্লান্ত লাগুক শরীর, জেগে থাকে। এ মুহূর্তে সে থাইল্যান্ডে তাদের ছুটি কাটানোর কথা ভাবছিল। একটি প্যাকেজ ট্যুরে গিয়েছিল সে ওখানে। নইলে ইনসিওরেন্স কোম্পানির একজন কেরানির পক্ষে সপরিবারে দূরপ্রাচ্য ভ্রমণে যাওয়ার সাধ্য কোথায়?

তারা ফুকেট আইল্যাণ্ডের পানসিয়া হোটেলে উঠেছিল। জুলিকে নিয়ে সৈকতে সাঁতার কেটেছে, কোরাল রিফে রঙিন মাছ দেখে খুশিতে মেয়ের কী চিৎকার! সে হোটেল শপ থেকে জুলিকে ওই পুতুলটি কিনে দিয়েছে।

ফুকেটের কথা ভাবতে ভাবতে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল জন হিগিন্সের। প্লেন একটি ছোট্ট এয়ার টার্বুলেন্সের মধ্যে পড়ে ঝাঁকি খেতে ঘুমঘুম ভাবটা কেটে গেল, সে সভয়ে চেপে ধরল সিটের আর্মরেস্ট।

হিগিন্স দেখল চার সারি সামনে হিপ্পিটা জেগে গেছে। সে ঘড়ি দেখল, কম্বলের মধ্যে নড়েচড়ে বসল। তারপর সিধে হলো।

হিপ্পি চারপাশে একবার চোখ বুলাল কেউ তাকে লক্ষ করছে কিনা দেখার জন্য। তারপর আইল ধরে বাল্কহেডের দিকে এগুলো। এখানে একটি পর্দা আছে তবে আধ গোটানো, গ্যালি এরিয়া থেকে এক ফালি আলো এসে পড়েছে। আলোতে দেখা যাচ্ছে এক টুকরো কার্পেট এবং দুটো ল্যাভেটরি ডোর। হিপ্পি দরজায় পা বাড়াল, দুটির দিকেই একে একে তাকাল তবে খুলবার কোনো লক্ষণ নেই তার মধ্যে। নিশ্চয় ভেতরে লোক আছে, ভাবল হিগিন্স, যদিও সে পায়খানায় কাউকে যেতে দেখেনি। হিপ্পি একটি ল্যাভেটরির দরজায় হেলান দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ত্রিশ সেকেণ্ড পরে তার সঙ্গে যোগ দিলেন আরেকজন। হিগিন্স সতর্ক হয়ে উঠল। এ মানুষটি হিপ্পি থেকে একদমই আলাদা। তার চেহারায়। আভিজাত্য এবং বড়লোকি চালচলন পরিষ্কার ফুটে বেরুচ্ছে। ইনি সামনের ক্লাব কিংবা প্রথম শ্রেণীর আসন থেকে এসেছেন। কিন্তু কেন?

গ্যালির আলোতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় মানুষটির পরনে ক্রিম সুটের ট্রাউজার্স, সিল্ক শার্ট, গলায় ঢিলে করে বাঁধা টাইটিও সিল্কের। এ নিশ্চয় প্রথম শ্রেণীর যাত্রী। তিনি কি এতদূর এসেছেন প্রাতঃকৃত্য সারতে?

তারপর ওরা দুজনে কথা বলতে শুরু করল। মি. বড়লোক এবং হিপ্পি। নিচু গলায়, ভঙ্গিটা জরুরি। বড়লোক মানুষটিই মূলতঃ হিপ্পির দিকে ঝুঁকে কথা বললেন, সে শুধু অসংখ্যবার মাথা দুলিয়ে ভদ্রলোকের কথায় সায় দিয়ে গেল। শরীরী ভাষা বলছে বড়লোকটি হিপ্পিকে কিছু নির্দেশ দিচ্ছেন আর হিপ্পি মাথা ঝাঁকিয়ে রাজি হয়ে যাচ্ছে তাঁর প্রতিটি কথায়।

জন হিগিন্স সেই ধরনের মানুষ যারা সবসময় পড়শীরা কে কী করছে তার সুলুক সন্ধান রাখে এবং সবকিছুর মধ্যেই একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ শোকার চেষ্টা করে। এবারেও তাই ঘটল।

সে ভাবছিল মি. বড়লোকের যদি পায়খানায় যাওয়ার দরকার হতো তাহলে তিনি প্রথম শ্রেণী এবং ক্লাব ক্লাসের পাঁচ/ছটি ল্যাভেটরির যে কোনও একটিতে যেতে পারতেন। এই অসময়ে নিশ্চয় সবগুলো পায়খানা দখল হয়ে থাকবে না। না, ওরা এ জায়গাটি এবং এ সময়টি বেছে নিয়েছে কথা বলার জন্য। এরা স্রেফ আজাইরা প্যাচাল পাড়তে আসেনি, যেমনটি পায়খানা বা অন্য লাইনে দাঁড়ানো মানুষজন করে সময় কাটানোর জন্য।

ওরা বিচ্ছিন্ন হলো। সিল্ক শার্ট অদৃশ্য হয়ে গেলেন দৃশ্যপট থেকে, ফিরে গেলেন সামনে, তাঁর আসনে। হিপ্পি কোনো ল্যাভেটরিতেই ঢুকল না, চলে এল নিজের সিটে। জন হিগিন্সের মাথায় তখন চিন্তার ঝড়। বুঝতে পারছে সে একটি অদ্ভুত তবে গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনার সাক্ষী হয়ে গেছে যদিও জানে না বিষয়টি কী। সে চোখ বুজে ঘুমের ভান ধরল হিপ্পিকে চারপাশের অন্ধকারে নজর বুলাতে দেখে। কেউ তাকে দেখে ফেলেছে কিনা, নিশ্চিত হতে চাইছে বোধহয়।

দশ মিনিট বাদে তার প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেল জন হিগিন্স। এ লোক দুটি পূর্ব পরিকল্পিতভাবে এখানে সাক্ষাত করেছে। হয়তো বড়লোকটি কোনও স্টুয়ার্ডেসের মারফত হিপ্পির কাছে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন এ সময়টায় তিনি ওর সঙ্গে দেখা করবেন। যদিও হিগিন্স কোনও স্টুয়ার্ডেসকে হিপ্পির কাছে কোনও চিরকুট দিতে দেখেনি। তবে?

এমনও হতে পারে ওরা দুজন থাইল্যাণ্ডে বসেই এ বিশেষ মুহূর্তটির কথা ঠিক করে রেখেছিল। কিন্তু কেন? কিছু আলোচনা করার জন্য? কোনও প্রগেস রিপোর্ট দেবে? হিপ্পি কি ব্যবসায়ীটির পিএ? অবশ্যই না। কোনও ধনবান ব্যবসায়ীর প্রাইভেট সেক্রেটারি অমন ফকিরনির মতো পোশাক পরে না। হিগিন্সের মনে সন্দেহ গাঢ়তর হলো।

রাত এগারোটা। লণ্ডন। বিল বাটলার তার ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে একবার তাকিয়ে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে নিভিয়ে দিল ঘরের বাতি। সে ভোর সাড়ে চারটায় অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছে। সোয়া পাঁচটায় সে হিথ্রো বিমান বন্দরে পৌঁছাবে। এ সময়টুকু হাতমুখ ধুয়ে, কাপড় পরে, গাড়ি চড়ে রওয়ানার জন্য যথেষ্ট। তার টাচডাউনের সময় সকাল সোয়া ছয়টা। এরপরে কী ঘটবে না ঘটবে পুরোটাই জানে ভাগ্য।

সারাটা দিন প্রচুর পরিশ্রম গেছে। কোন দিনই বা যায় না? ক্লান্ত হলেও ঘুম আসছিল না বাটলারের। মনে চিন্তার স্রোত।

Us Drug Entarcement Administration 7 DEAs Talicsta এক সহকর্মীর আভাস পাবার পরেই শুরু হয়েছে হান্ট।

ব্রিটিশ আইলের নব্বই ভাগ এবং পশ্চিম ইউরোপের বেশিরভাগ অঞ্চলে হেরোইনের যে চালানটা আসে তা টার্কিশ। এ ব্যবসা নির্দয় ধূর্ততার সঙ্গে পরিচালনা করছে তুর্কি মাফিয়া, এরা খুবই হিংস্র যদিও সবসময় লো প্রোফাইলে থাকে বলে বেশিরভাগ ব্রিটিশ এদের ব্যাপারে কিছু জানে না।

এদের প্রডাক্ট আসে আনাটলিয়ার পপি ফুল থেকে। দেখায় অশোধিত বাদামী রঙের চিনির মতো। মোমবাতির আগুনে টিনফয়েলে এ জিনিস রেখে গরম করে ধোয়া টেনে নেয় মাদকসেবীরা। ব্রিটিশ মাদকাসক্তরা শরীরে খুব কমই ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ করে, আমেরিকানরা করে।

গোল্ডেন ট্রায়ালে এবং ফান ইস্টার্ন ট্রাফিক এই টার্কিশ ডোপ উৎপাদন করে না, এটি থাইল্যাণ্ড হোয়াইট নামে পরিচিত, দেখতে লাগে বেকিং পাউডার। এ জিনিসটি আমেরিকানদের খুব পছন্দ।

DEA বাটলারকে জানিয়েছে তাদের এক আণ্ডারওয়ার্ল্ড সোর্স বলেছে গত ছয় মাসে ব্রিটেনে ছয় কেজি খাঁটি কলম্বিয়ান কোকেন এবং দুই কিলো থাই হোয়াইট পাঠানো হয়েছে এক ক্যারিয়ার বা মিউল-এর মাধ্যমে।

পরিমাণটি বিরাট কিছু না হলেও ফেলে দেয়ার মতো নয়। প্রতি ট্রিপে ব্রিটিশ অর্গানাইজার ২০০,০০০ পাউণ্ড করে পেয়েছে। পরিমাণ শুনে বিল বাটলার বুঝতে পেরেছে এ জিনিস জাহাজ কিংবা ট্রাকে করে আসেনি, এসেছে আকাশ পথে। প্যাসেঞ্জার ব্যাগেজে। সে এবার ঘুরে শুয়ে চার ঘণ্টার ঘুম ঘুমাবার চেষ্টা করল।

.

ঘুমাতে পারছে না জন হিগিন্সও। তাদের বিমান যখন পূর্ব তুরস্কের আনাটলিয়ার পথে, ওইসময় সে সিট ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে মাথার ওপরের র‍্যাক থেকে নিজের অ্যাটাচি কেসটি নামিয়ে আনল। কেউ নড়াচড়া করছে না, এমনকী হিপ্পিও না।

সিটে বসে হিগিন্স কেস খুলে সাদা কাগজের একটি প্যাড এবং কলম বের করল। কাগজের প্যাডটি সে প্যানসিয়া হোটেল থেকে নিয়ে এসেছে। প্যানসিয়া লোগো এবং ঠিকানার অংশটুকু সাবধানে ছিঁড়ে নিয়ে অ্যাটাচি কেসটিকে লেখার ডেস্ক বানিয়ে ক্যাপিটাল লেটারে চিঠি লিখতে শুরু করল হিগিন্স। আধঘন্টা লাগল তার কাজটি করতে।

তার লেখা যখন শেষ, বিমান তখন আংকারার আকাশে। জন হিগিন্স কাগজটি ভাঁজ করে BAর দেয়া ইউনিসেফ চ্যারিটির একটি খামে ঢুকিয়ে তার ওপর বড় বড় হস্তাক্ষরে লিখল: FOR THE CAPTAIN. URGENT।

সিধে হলো হিগিন্স, নিঃশব্দে হেঁটে গেল ল্যাভেটরি দরজার পর্দার ধারে। উঁকি দিল গ্যালিতে। এক তরুণ স্টুয়ার্ড তার দিকে পেছন ফিরে ট্রেতে সকালের নাশতা সাজাতে ব্যস্ত। হিগিন্স সরে এল। বেজে উঠল বাযার। শুনল স্টুয়ার্ড গ্যালি ছেড়ে সামনে কদম বাড়িয়েছে। পর্দার ফাঁক দিয়ে সুড়ৎ করে ভোলা জায়গায় ঢুকে পড়ল হিগিন্স। ট্রের ওপর সাজানো দুটি কফি কাপের মাঝখানে খামটি খাড়া ভাবে বসিয়ে দিয়ে ফিরে এল নিজের আসনে।

আরও আধঘণ্টা বাদে,আরও ব্রেকফাস্ট ট্রে রেডি করতে গিয়ে খামটি নজরে এল স্টুয়ার্ডের। প্রথমে ভাবল ইউনিসিফের কোনও ডোনেশন খাম। পরে লেখাটি চোখে পড়ল তার। কপাশে ভাঁজ পড়ল স্টুয়ার্ডের, একটু ভেবে দেখা করতে চলল কেবিন সার্ভিস ডিরেক্টরের সঙ্গে।

এ জিনিসটি দুটো কফি কাপের মাঝখানে ছিল, হ্যারি। ভাবলাম ফ্লাইট ডেকে না গিয়ে আগে আপনাকে দেখাই।

চোখ পিটপিট করলেন হ্যারি পালফ্রে।

ঠিকই করেছ, সাইমন। হয়তো ভুয়া কোনও চিঠি। এটা আমার কাছে থাক। তুমি বরং ব্রেকফাস্ট ট্রেগুলো…

চলে গেল স্টুয়ার্ড। ইউনিফর্ম ট্রাউজার্সে ঢাকা তার সুঠাম নিতম্বের দিকে তাকিয়ে হ্যারির বুকে আঁচ করে বিধল কামনার ছুরি। তিনি বহু স্টুয়ার্ডকে নিয়ে শুয়েছেন, তবে এ ছেলেটা দারুণ। হয়তো হিথ্রোতে… তিনি খামটির দিকে তাকালেন। এবার ভাবলেন খুলে দেখবেন, শেষে মত বদলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে এলেন। টোকা দিলেন ফ্লাইট ডেকের দরজায়।

এটা স্রেফ ফর্মালিটি। CSD যে কোনও সময় ফ্লাইট ডেকে আসতে পারেন। তিনি ভেতরে ঢুকলেন। বামের আসনে বসে আলোকিত একটি উপকূলের দিকে তাকিয়ে আছে রিলিফ ক্যাপ্টেন। ফ্যালন এখানে নেই। CSD গেলেন বাঙ্ক রুমে। এখানে তাঁকে ত্রিশ সেকেন্ড অপেক্ষা করতে হলো।

ধূসর চুলে হাত বুলাতে বুলাতে দরজা খুলে দিলেন ক্যাপ্টেন ফ্যালন।

হ্যারি?

একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছে, স্কিপার। কেউ এ জিনিসটি মিডসেকশন গ্যালির দুটো কফি কাপের মাঝখানে খুঁজে দিয়ে গেছে। নিজের চেহারা দেখায়নি সে। অচেনা কেউ একজন, অনুমান করি।

তিনি খামটি বাড়িয়ে ধরলেন।

আড্রিয়ান ফ্যালনের পেটে মোচড় দিল। ত্রিশ বছরের ক্যারিয়ারের কখনও তিনি হাইজ্যাকের শিকার হননি। বোমা হামলার ভয়ে তাঁকে ভীত হতে হয়নি। তবে তাঁর অনেক সহকর্মীরই এসব অভিজ্ঞতা হয়েছে। এখন মনে হচ্ছে এ দুঃস্বপ্নের মাঝে তাঁকেও যেতে হবে। তিনি খামটি ছিঁড়ে, চিঠিতে বের করে বাঙ্কের কিনারে বসে পড়তে লাগলেন। চিঠিতে লেখা : ক্যাপ্টেন, আমি নিজের নাম বলতে পারছি না বলে দুঃখিত। কারণ এর মধ্যে আমি নিজেকে কোনোভাবেই জড়াতে চাই না। তবু একজন দায়িত্ববান নাগরিক হিসেবে আমার মনে হলো আমি যা দেখেছি তা আপনাকে অবগত করা দরকার। আপনার দুজন যাত্রী অত্যন্ত অদ্ভুত আচরণ করছে এবং তাদের এহেন আচরণের যৌক্তিক ব্যাখ্যার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।

এরপরে চিঠিতে বিস্তারিত লেখা প্রত্যক্ষদর্শী কী দেখেছে এবং কেন তার কাছে গোটা ব্যাপারটি অদ্ভুত এবং রহস্যময় লেগেছে। শেষে লেখা:

দুই যাত্রীর একজনের চেহারা ও পোশাক আশাক হিপ্পিদের মতো, সে বসেছে 30C আসনে। অপরজনের কথা আমি বলতে পারব না তবে আমার ধারণা তিনি প্রথম শ্রেণী কিংবা ক্লাব ক্লাসের যাত্রী।

বড়লোক যাত্রীটির বর্ণনাও দেয়া হয়েছে চিঠিতে। সবশেষে লেখা:

আশা করি আমি কোনও ঝামেলা সৃষ্টি করছি না তবে দুজন মানুষ যদি কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে একত্রিত হয় এবং তা কারও মনে সন্দেহের উদ্রেক করে, সেক্ষেত্রে বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জ্ঞাত করা দায়িত্ব মনে করেই এ পত্র লেখা।

ক্যাপ্টেন ফ্যালন চিঠিতে হ্যারি পালফ্রেকে দিলেন। তিনি চিঠি পড়া শেষ করে ঠোঁট কামড়ালেন।

মিডনাইট অ্যাসাইনেশন? জিজ্ঞেস করলেন তিনি।

এরা কেন একত্রিত হয়েছিল সে বিষয়ে কোনও ইংগিত নেই। সে যাকগে, হ্যারি, তুমি আমাকে প্যাসেঞ্জার লিস্টটি এনে দেবে?

CSD যাওয়ার পরে চুল টুল আঁচড়ে, শার্ট ঠিকঠাক করে রিলিফ ক্যাপ্টেনকে ফ্যালন জিজ্ঞেস করলেন, বর্তমান পজিশন?

গ্রিক কোস্ট সামনেই। কোনও সমস্যা, আড্রিয়ান?

আরে নাহ।

পালফ্রে ফিরে এলেন যাত্রী তালিকা নিয়ে। 30C আসনের যাত্রীর নাম কেভিন ডোনোভান।

আর অপর যাত্রী? বড়লোকটি?

মনে হয় তাঁকে আমি দেখেছি। বললেন পালফ্রে। ফার্স্ট ক্লাস, সিট 2K, তিনি প্যাসেঞ্জার লিস্টে আঙুল বুলালেন। এঁর নাম মি. হিউগো সিমুর।

লাফ মেরে কোনও উপসংহারে পৌঁছানোর আগে নিশ্চিত হও, বললেন ক্যাপ্টেন। ফার্স্ট ক্লাস এবং ক্লাব ক্লাসে ভালোভাবে খোঁজ নাও! ওয়ারড্রোবে ক্রিম সিল্কের জ্যাকেটের খোঁজ করো।

মাথা ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন পালফ্রে। ফ্যালন স্ট্রং ব্ল্যাক কফির জন্য ঘণ্টা বাজিয়ে ফ্লাইট ডিটেলস চেক করতে বসলেন।

কিছুক্ষণ পরে CSD নিচ থেকে ফিরে এলেন। জানালেন ওটা হিউগো সিমুরই বটে, কোনো সন্দেহ নেই। ক্যাপ্টেন ফ্যালন তাঁর বিমানের দুজন সন্দেহভাজন যাত্রীর বিষয়ে সমস্ত তথ্য দিয়ে সতর্ক করে দিলেন হিথ্রো বিমান বন্দরের কাস্টমস কর্তৃপক্ষকে। এখন তারা যা অ্যাকশন নেয়ার নেবে।

.

সোয়া চারটায় অ্যালার্মের শব্দ শোনা হলো না বিল বাটলারের। তার আগেই চারটা বাজার দশ মিনিট আগে ঘুম ভেঙে গেল ফোনের শব্দে। হিথ্রো এয়ারপোর্টের চার নম্বর টার্মিনাল থেকে তার লোক ফোন করেছে। তার কথা শুনতে শুনতে ঘুমের চটকা পুরোপুরি ভেঙে গেল বাটলারের। কুড়ি মিনিট পরে সে উঠে পড়ল গাড়িতে। গাড়ি চালাতে চালাতে হিসেব নিকেশ কষতে লাগল।

ফাঁদে ফেলার জন্য বা টোপ ফেলতে অচেনা বহু অভিযোগই আসে। বেশিরভাগই বইয়ে লেখা পুরানো সব ট্রিক। এগুলো সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত বিল বাটলার। সাধারণত এ ধরনের ফোন আসে। শহরের কোনও পাবলিক বুথ থেকে, কারও নাম ধরে বলা হয় সে আসছে ফ্লাইটের একজন ক্যারিয়ার।

তবে কাস্টমসের পক্ষে এ ধরনের ফোন কল অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। যদিও ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় বর্ণিত ট্যুরিস্ট একজন নিরপরাধ মানুষ। যে ফোন করেছিল সে নিশ্চয় লণ্ডনের কোনো গ্যাং সদস্য।

বর্ণিত মানুষটিকে যখন জেরা করা হবে আসল অপরাধী হয়তো ততক্ষণে সবার চোখে ধুলো দিয়ে সটকে পড়েছে।

কিন্তু তাই বলে একজন এয়ারক্রাফট ক্যাপ্টেনের কাছ থেকে আসা ওয়ার্নিং? এটি নতুন ঘটনা। তাঁর বিমানের একজন যাত্রী তাঁকে চিঠি লিখেছে? দুজন যাত্রীকে সন্দেহ করা হচ্ছে? এর পেছনে সুসংগঠিত কোনও মস্তিষ্ক কাজ করছে এবং বাটলারের কাজ হবে বুদ্ধির লড়াইয়ে আড়ালের ওই লোকটিকে হারিয়ে দেয়া।

বিল বাটলার চার নম্বর টার্মিনালের সামনে গাড়ি থামাল। প্রায় খালি ভবনের দিকে লম্বা কদমে এগোল। সাড়ে চারটা বাজে, ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের ডজনখানেক প্রকাণ্ড জেট বিমান চার নম্বর টার্মিনালকে প্রায় দখল করে রেখেছে। দুই ঘণ্টার মধ্যে অবশ্য জায়গাটি উন্মদাশ্রমে পরিণত হবে।

.

সকাল ছটা। বিল বাটলার তার নক টিমের দশ জন সদস্যকে টার্মিনাল চারের উদ্দেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। আগামী চল্লিশ মিনিটের মধ্যে নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, বোস্টন এবং মিয়ামি থেকে আসা প্লেনগুলোর সঙ্গে যোগ হবে পূর্ব থেকে আসা বিমান। অফবোর্ড প্যাসেঞ্জারদের ভিড়ে টার্মিনাল পরিণত হবে জনসমুদ্রে। এমবাৰ্কেশন, ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমস সব জায়গাতেই ছদ্মবেশে নিজেদের নোক ঢুকিয়ে দিয়েছে বাটলার। তবে মুশকিল হলো, অনেক সময়ই দেখা যায় ক্যারিয়ার ভয়ের চোটে তার লাগেজই সংগ্রহ করে না। ক্যারুজলে একের পর এক সুটকেস আসতে থাকে, ওগুলো কারা তুলে নিচ্ছে, তার ওপর সতর্ক নজর থাকে কাস্টমসের। কিন্তু বিশেষ একটি কেস হয়তো কেউ তুলতেই এল না।

ওয়েস্ট ড্রেটন জানালো স্পিড়বার্ড ওয়ান জিরো চ্যানেল পার হয়ে সাফোক উপকূলের দিকে আসছে। কোর্স অনুযায়ী সে এয়ারপোর্টের উত্তর দিকে আসবে, তারপর লম্বা একটা চক্কর দিয়ে মেইন রানওয়েতে নেমে পড়বে।

সকাল ছটা পাঁচে স্পিডবার্ড ওয়ান জিরো উপকূল পার হলো। ইতিমধ্যে যাত্রীদের কাছ থেকে খাবারের ট্রে সরিয়ে নেয়া হয়েছে, বন্ধ হয়ে গেছে ভিডিও বিনোদন। কেবিন ক্রুরা ফার্স্ট এবং ক্লাব ক্লাসের যাত্রীদের হাতে তুলে দিতে লাগল যার যার জ্যাকেট। জানালার ধারে বসা যাত্রীরা উঁকি মেরে দেখল তাদের নিচ দিয়ে সাঁ সাঁ করে ছুটে যাচ্ছে আলোকমালা।

মি. হিউগো সিমুর ফার্স্ট ক্লাস ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। ক্লিন শেভড, মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো, গা দিয়ে দামী মিচফিল্ড আফটারশেভের সুঘ্রাণ আসছে। সিটে বসে তিনি টাই ঠিকঠাক করে নিলেন, ওয়েস্টকোটের বোম লাগালেন এবং স্টুয়ার্ডেসের কাছ থেকে ক্রিম সিল্ক জ্যাকেটটি নিয়ে ভাঁজ করে কোলের ওপর রাখলেন। কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেসটি তাঁর দুই পায়ের ফাঁকে বসে রইল।

ইকোনমি ক্লাসে কানাডিয়ান হিপ্পি আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। সিগারেটের জন্য আইঢাই করছে প্রাণ। আইলের ধারে বসেছে বলে পোর্ট হোল দিয়ে কিছু দেখা যাচ্ছে না। অবশ্য সেই চেষ্টা সে করলও না।

চার সারি পরে হিগিন্স পরিবারের ঘুম ভেঙেছে, তারা নিচে নামার জন্য প্রস্তুত। জুলি তার পুকিকে বলছে তার নতুন বাড়িতে সে কী কী মজার জিনিস দেখতে পাবে। মিসেস হিগিন্স তার ক্যারি অন ব্যাগে শেষ টুকিটাকি জিনিসপত্র ভরছে। পরিপাটি মি. হিগিন্স তার প্লাস্টিকের অ্যাটাচি কেসটি হাঁটুর ওপর রেখেছে, হাত জোড়া তার ওপর ভাঁজ করা। সে তার কর্তব্য পালন করেছে। এখন তার ভালো লাগছে।

.

সকাল ছটা আঠারো মিনিটে হিথ্রো বিমান বন্দরে নেমে এল স্পিড়বার্ড ওয়ান জিরো। প্লেন থামতেই এয়ারপোর্টের টেকনিকাল স্টাফের কভারল পরা এক তরুণ এসে সাক্ষাত করল হ্যারি পালফ্রের সঙ্গে। সে CSDর কাছ থেকে হিগিন্সের লেখা চিঠিটি নিয়ে গেল কাস্টমস কর্তৃপক্ষের নির্দেশে। সে চলে যাওয়ার পরে, CSD তার পেছনে দাঁড়ানো প্রথম শ্রেণীর যাত্রীদের দিকে ঘুরলেন।

গুডবাই, স্যার। আশা করি আপনারা ফ্লাইটটি উপভোগ করেছেন।

তারা CSDকে পাশ কাটিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। প্রথম শ্রেণীর যাত্রীরা নেমে যাওয়ার পরে ক্লাব ক্লাসের প্যাসেঞ্জাররা নামল। সবশেষে ইকোনমি ক্লাসের যাত্রীরা।

.

ইমিগ্রেশন হলটি প্রকাণ্ড এবং পাসপোর্ট কন্ট্রোল অফিসাররা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ডেস্কের পেছনে জন সমুদ্র সামাল দিতে। ওপরে এবং এক পাশে, আয়না লাগানো একটি দেয়াল, আসলে এটি টু-ওয়ে মিরর, এর পেছনে একটি ঘর আছে। এ ঘরে বিল বাটলার দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে নিচের দিকে।

তার নিচে দশজন পাসপোর্ট অফিসার, দুজন ইউকে এবং ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন পাসপোর্টের লোক, বাকি আটজন পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোর পাসপোের্ট চেক করবে। বাটলারের একজন সহকারী এদেরকে ব্রিফ করেছে। ইমিগ্রেশন এবং কাস্টমসের মধ্যে সদ্ভাব সর্বদাই বিদ্যমান, তবে এ ব্রিফিং তাদের মাঝে নিস্তেজ সকালে একটু উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। ফার্স্ট ক্লাস যাত্রীদের মধ্যে মাত্র চারজন ব্রিটিশ, বাকিরা থাই অথবা অস্ট্রেলিয়। চার ইউকে নাগরিকের পাসপোর্ট ডেস্ক পার হতে অত্যল্প সময় লাগল। তবে তৃতীয় জন যখন তার পাসপোর্ট হাতে পেল, ইমিগ্রেশন অফিসার সামান্য মাথা কাত করে আয়নাঅলা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝাঁকাল। বিল বাটলারের হাতে সেই চিঠিটি। ক্রিম সিল্ক সুট শুধু একজনই পরেছেন। হিউগো সিমুর। সে তার হাতে বাঁধা খুদে কমিউনিকেটরে দ্রুত কথা বলল।

ও এখন বেরিয়ে আসছে। ক্রিম সিল্ক সুট। হাতে কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেস।

রনজিত গুল সিং একজন শিখ। সে ম্যানচেস্টার ভার্সিটি থেকে এম.এ পাশ করেছে এবং কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজের একজন অফিসার। নকএর সে একজন সদস্যও বটে। সে পাসপোর্ট কন্ট্রোলের পেছনের প্যাসেজে ঝাড়ুদারের ছদ্মবেশে দাঁড়িয়ে ছিল। ডান কানে হিয়ারিং প্লাগের সমান ছোট ইয়ারপিসের মাধ্যমে সে মেসেজটি শুনতে পেল। কয়েক সেকেন্ড পরে ক্রিমসুট পরা এক লোক তার পাশ দিয়ে হেঁটে পুরুষদের ল্যাভেটরিতে ঢুকল। এ তথ্য বাটলারকে দিতে সে হুকুম দিল, ওর পিছু নাও। দ্যাখো কী করে।

কিন্তু হাত মুখ ধোয়া ছাড়া আর কিছুই করলেন না ক্রিম সুট। কারও সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন না তিনি। সিং তথ্যটি দিল তার বসকে।

এদিকে হিপ্পিকে অনুসরণ করছিল ক্যাজুয়াল ড্রেস পরা আরেক তরুণী। আর হিউগো সিমুর তখন ল্যাভেটরি থেকে বেরিয়ে এসে ইকোনমি ক্লাস যাত্রীদের ভিড়ে মিশে গেছেন। তিনি কিছুই করছেন না।

বিল বাটলারের সন্দেহ হলো এ লোকটি ইচ্ছে করে সময় নষ্ট করছেন। তার মনে হচ্ছে হিল্পিটি ডীকয় বা টোপ। ব্যবসায়ী ভদ্রলোকের কাছে বোধ করি কনসাইনমেন্টটি আছে। তবে ব্যাংকক থেকে আসা লাগেজগুলো যখন ছয় নম্বর ক্যারুজেল থেকে প্রথম শ্রেণীর যাত্রীরা একের পর এক তুলে নিতে লাগল তিনি কিন্তু তার সুটকেসটি স্পর্শও করলেন না। কনভেয়র বেল্টটি অন্তত কুড়ি বার চক্কর দিল, তবু ওদিকে এগিয়ে গেলেন না ভদ্রলোক কিংবা একবার তাকিয়েও দেখলেন না। তিনি এ মুহূর্তে রয়েছেন হলরুমের শেষ মাথায় ট্রলি সেকশনে, যেখান থেকে লোকে ট্রলিতে বোঝাই করছে তাদের মালপত্র।

ক্যারুজেল থেকে দশ গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে হিপ্পি ডোনোভান। অপেক্ষা করছে তার ভারী, কালো রঙের হ্যাঁভার স্যাকটির জন্য। আর দুটি ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে এল মি. হিগিন্স, তার স্ত্রী এবং কন্যা জুলিকে নিয়ে। জুলি, জীবনে এই প্রথম বিদেশে গেছে, বায়না ধরেছে সে আলাদা। একটি ট্রলিতে তার ব্যাগ এবং পুকিকে নেবে।

এক এক করে যাত্রীরা যে যার ব্যাগ নিল ক্যারুজেল থেকে। নিজের রঙচঙে ব্যাগটি দেখে খুশিতে লাফিয়ে উঠল জুলি, ওই যে, ড্যাডি!

তার চিৎকার শুনে অনেক যাত্রীই পেছন ফিরে মেয়েটিকে একবার দেখে স্নেহপূর্ণ হাসি দিল। জুলির ব্যাগটি মাঝারী সাইজে স্যামসোনাইট, গায়ে তার প্রিয় সব কার্টুন চরিত্রের অসংখ্য ছবি সটানো : স্কুবিডু, শ্যাগি, উইলি, কয়োটি এবং রোড রানার। প্রায় একই সঙ্গে তার বাবা-মার ব্যাগ দুটিও হাজির হলো। মি. হিগিন্স তাড়াতাড়ি ব্যাগগুলো নামিয়ে নিল।

হিপ্পি তার হ্যাঁভারস্যাক পেয়ে কাঁধে ঝোলাল। পা বাড়াল গ্রীন চ্যানেলের দিকে। ওদিক দিয়েই যাত্রীরা সবাই বেরিয়ে যাচ্ছে। মি. সিমুর অবশেষে তার চামড়ার সুটকেসটি নিয়ে, ট্রলিতে চাপিয়ে গ্রীন চ্যানেল অভিমুখে চললেন। বিল বাটলার ইতিমধ্যে গ্রীন চ্যানেলের সামনে চলে এসেছে এবং আয়নার পেছনে দাঁড়িয়ে লোকজনকে লক্ষ করছে।

তবে হিপ্পি গ্রীন চ্যানেল পর্যন্ত যেতে পারল না। তার আগেই ইউনিফর্মধারী কাস্টমসের দুই লোক তার পথ আটকে দাঁড়াল। এবং অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলল, স্যার, কি দয়া করে আমাদের সঙ্গে একটু আসবেন?

রেগে কাঁই কানাডিয়ান।

এসবের মানে কী?

প্লিজ আসুন, স্যার।

এবারে বিস্ফোরিত হলো কানাডিয়ান।

এই যে এক মিনিট। তেরো ঘন্টা প্লেনে জার্নি করে এখন আমি এসব হাবিজাবি কথা শুনতে চাই না, বুঝতে পেরেছেন?

তার চেঁচামেচিতে তার পেছনে মানুষের সারিটি দাঁড়িয়ে পড়ল যেন গুলি খেয়েছে। তবে পরের মুহূর্তে তারা দেখেও না দেখার ভান করে সামনে এগোল। এদের মধ্যে হিউগো সিমুরও আছেন।

তবে কানাডিয়ানের কোনোই ওজর আপত্তি টিকল না। তাকে জোর করে পাশের একটি ঘরে নিয়ে যাওয়া হলো। আর সিমুর যখন এক্সিট আর্চ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন, তাকেও বাধা দিল দুই অফিসার। তিনি প্রথমে ভান করলেন যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। তবে বুঝতে পেরে তার মুখ ছাইয়ের মতো সাদা হয়ে গেল। তিনি প্রতিবাদ করলেও শেষ পর্যন্ত অফিসারদের সঙ্গে বাধ্য হলেন একটি সার্চ রুমে ঢুকতে।

একটি ওয়ানওয়ে মিরনের পেছনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল বাটলার। রাঘব বোয়ালটাকে ধরা গেছে। চেজিং শেষ। এখন কেস দুটো পরীক্ষা করলেই দেখা যাবে ওগুলোর মধ্যে কী আছে।

দুটি আলাদা কামরায় দুজনকে পরীক্ষা করা হলো। সময় লাগল তিন ঘণ্টা। কিন্তু হ্যাঁভারস্যাক খালি। লাইনিং ফ্রেম ইত্যাদি খুলেও ভেতরে কিছুই পাওয়া গেল না। এতে অবাক হলো না বিল বাটলার। কারণ ডীকয়রা কখনও কিছু বহন করে না।

তবে হিউগো সিমুর তাকে বিমূঢ় করে তুলল। তার চামড়ার সুটকেস ডজনবার এক্সরে করেও ভেতরে কিছু মিলল না। লুকানো কমপার্টমেন্টেও কিছু নেই। কুমিরের চামড়ার অ্যাটাচি কেসেরও একই অবস্থা। অ্যান্টাসিড ট্যাবলেটের একটি টিউব পাওয়া গেল শুধু। সিমুরকে ন্যাংটো করে সার্চ করা হলো, এক্স-রে করা হলো তার জামাকাপড়। কিছু নেই।

সকাল দশটার দিকে মুক্তি পেল দুজনেই। সিমুর তখন চিৎকার করে বলছেন ওদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেবেন। বাটলার এসব হুমকি ধামকি মোটেই পাত্তা দিল না। এরকম সবাই করে। কারণ কাস্টমস অ্যান্ড এক্সাইজের আসল ক্ষমতা সম্পর্কে এদের কোনও ধারণাই নেই।

ওদের পিছনে লোক লাগাব, বস? জিজ্ঞেস করল নক টিমের দুই নম্বর সদস্য। বাটলার একটু ভেবে মাথা নাড়ল।

এরা যদি সত্যি নিরপরাধ হয়ে থাকে খামোকাই পিছু নেয়া হবে। আর যদি নিরপরাধ না হয় তবে ব্যাংকক থেকে কেউ তাদের নিয়ন্ত্রণ করছে কিনা সে বিষয়েও আমার সন্দেহ আছে। বাদ দাও। পরের বারে দেখা যাবে।

.

কানাডিয়ানটি এয়ারপোর্ট কোচে চড়ে লণ্ডন চলে এল, উঠল প্যাডিংটনের কাছে জরাজীর্ণ এক হোটেলে। মি. হিউগো সিমুর ট্যাক্সি নিয়ে দূরের এক দামী হোস্টেলের উদ্দেশে রওনা হলেন।

বেলা দুটোর পরে লণ্ডনের বিভিন্ন রাস্তায় চারজন লোক চারটি ফোন পেল। তারা সবাই ফোন বুথের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। তাদের সবাইকে একটি ঠিকানায় রিপোর্ট করতে বলা হলো। এদের একজন একটি ফোন করে ছুটল তার গন্তব্যে।

বিকেল চারটা। বিল বাটলার কতগুলো সার্ভিসড অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে একটি গাড়িতে বসে আছে একা। এ ধরনের বাসা সাপ্তাহিক, এমনকী দিনের ভিত্তিতেও ভাড়া পাওয়া যায়।

বেলা চারটা পাঁচে নম্বরবিহীন একটি ট্রানজিট ভ্যান এসে থামল তার পেছনে। এটির জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল বাটলার। ভ্যান থেকে তার নক টিমের দশজন সদস্য বেরিয়ে এসে ছড়িয়ে পড়ল। ব্রিফিংয়ের সময় নেই। গ্যাংটির হয়তো কোথাও কোনও লুক আউট লুকিয়ে আছে। যদিও গত আধঘণ্টা ধরে নজর রাখার পরেও সে কোনও জানালার পর্দাও তুলতে দেখেনি। সে তার দলের সদস্যদের উদ্দেশে মাথা ঝাঁকিয়ে ব্লকের দরজা ধরে আগে বাড়ল। ফ্রন্ট ডেস্কে কেউ নেই। সে তার দুই লোককে লিফটের দরজায় নজর রাখতে বলে বাকি আটজনকে নিয়ে উঠতে লাগল সিঁড়ি বেয়ে। তিন তলার ফ্ল্যাট।

নক দল দরজায় নক করার প্রয়োজন অনুভব করল না। প্রচণ্ড এক ধাক্কায় ভেঙে ফেলল দরজা। ওরা সবাই হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়ল ঘরে।

ভাড়া করা ড্রইংরুমে পাঁচ জন লোক। তারা প্রতিরোধের চেষ্টাই করল। বসে থাকল চুপচাপ। আকস্মিক এ হামলায় হতভম্ব। বাটলার ঢুকল সবার শেষে। তার লোকেরা ওই পাঁচজনকে তাদের আইডি দেখিয়ে দিলে তারা আর উচ্চবাচ্য করার সাহস পায়নি। বাটলার সবার আগে ধরল আমেরিকানটাকে।

পরে জানা যায় সে-ই ফোন করে বলেছিল কানাডিয়ান হিপ্পি একটা ডীয় এবং হিথ্রো এয়ারপোর্টের কাস্টমস হটলাইন ব্যবহার করবে। তার ব্যাগে পাওয়া গেল ছয় কিলো খাঁটি কলম্বিয়ান কোকেন।

মি. সালভাতর বোননা, আমি আপনাকে অন্যদের সঙ্গে যোগসাজশে এই দেশে নিষিদ্ধ পদার্থ নিয়ে আসার অভিযোগে গ্রেপ্তার করলাম…

মিয়ামির লোকটিকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরে বাটলার ফিরল হিপ্পির দিকে। খিটখিটে কানাডিয়ানকে নিয়ে যাওয়ার সময় বাটলার পেছন থেকে তার সহকর্মীদেরকে বলল, ওকে আমার গাড়িতে তোললা। ওর সঙ্গে আমার কথা আছে।

মি. হিউগো সিমুর সিল্কের সুট ছেড়ে টুইড এবং স্ন্যাকস পরেছেন। ইনি দ্বিতীয় ডীকয়। তাঁর কাছ থেকে পঞ্চাশ পাউন্ডের নোটে মোট দশ হাজার পাউন্ড উদ্ধার করা হলো। অপারেশনে সহায়তা করার জন্য তাকে এ টাকাটা দেয়া হয়েছিল। বাকি দুজনের দিকে তাকালেন বাটলার।

কনসাইনমেন্টটি ওদের দুজনের মাঝখানে, টেবিলের ওপর রয়েছে। এটি এখনও কেসের মধ্যেই আছে যেটি কাস্টমস ফাঁকি দিয়ে চলে এসেছে। ফলস বটম খুলে নিচে ফাঁকা একটা জায়গা পাওয়া গেছে, ওর মধ্যে সিলথেন ব্যাগে রয়েছে দুই কিলো ওজনের থাই হোয়াইট হিরোইন। তবে কেসটির গায়ে স্কুবিডু এবং শ্যাগির কার্টুন ছবি এখনও লটকে আছে।

মি. জন হিগিন্স, এ জিনিসটি আমাদের দেশে আমদানি এবং আমদানিতে অন্যদের সঙ্গে মিলে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো…

দায়িত্বশীল নাগরিকটিকে বাথরুমে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে সে হড়হড় করে বমি করে দিল। সে চলে যাওয়ার পরে শেষ লোকটির দিকে ফিরল বাটলার। ইনিই ব্যাংকক চালানের মাথা। আড়ালের আসল মানুষ। লণ্ডনের আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। জানেন উন্মুক্ত এ আকাশ আর ভবিষ্যতে দেখার সুযোগ হবে না তার।

আমি আপনাকে অনেক আগে থেকেই সন্দেহ করছিলাম, বন্ধু।

কোনও সাড়া নেই।

দারুণ একটা ফন্দি এঁটেছিলেন। ডীয় একজন নয়, দুজন। গ্রীন চ্যানেলের সুবিধা নিয়ে নিরপরাধ মি. হিগিন্স এবং তার পরিবারকে বুদ্ধ বানিয়ে এ সুযোগটা আপনি নিয়েছেন। আমি আপনাকে গ্রেফতার করছি মি. হ্যারি পালফ্রে…

বাটলার তার দুই লোককে ভাড়া করা বাড়িটিতে রেখে এল যদি তারা আরও কোনও এভিডেন্স খুঁজে পায়। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল রাস্তায়। সামনে অনেক কাজ পড়ে আছে। তবে এ কাজটি সে উপভোগই করবে। তার দলের দুই নম্বর সদস্যটি হুইলে বসেছে। বাটলার পেছনে, নিশ্চুপ কানাডিয়ানের পাশে এসে বসল।

সরাসরি কাজের কথায় আসি, বলল বাটলার। তুমি কবে জানলে এই ডাবল ব্লাফে সিমুর তোমার পার্টনার?

ওই ফ্ল্যাটে বসে। কিছুক্ষণ আগে, জবাব দিল হিপ্পি।

বজ্রাহত দেখাল বাটলারকে।

ল্যাভেটরি ডোরে মাঝরাত্তিরে তোমরা কী কথা বলছিলে?

কীসের কথা? কীসের ল্যাভেটরি? আমি ওই লোককে এর আগে জীবনেও দেখিনি।

হেসে উঠল বাটলার যে কাজটি সে খুব কমই করে।

তাতো বটেই। হিথ্রোর ওই ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। কিন্তু তুমি তো নিয়মকানুনগুলো জানাই। ওখানে বসেও তোমার কাভার ফাঁস করার কোনও উপায় ছিল না। সে যাকগে, ফোন করার জন্য ধন্যবাদ। খুব ভালো দেখিয়েছ, শন। আজ রাতে আমি তোমাকে বিয়ার খাওয়াব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *