০৮. যদিদং হৃদয়ং

যদিদং হৃদয়ং

দেবাদৃতার বিয়ের খবর পেয়ে, বিয়ে হচ্ছে বলে বন্ধুরা বিস্মিত নয়। এদেশে একটি মেয়ে পঁচিশেও বিয়ে না করলে, তাকে ঘিরে যে সমাজ, তার একটি বিপুল মস্তক তৈরি হয় যা সারাক্ষণ, কেন বিবাহ হচ্ছে না ভেবে স্বেদক্ষরণ করে এবং সেই বিপুল মস্তক বেদনায় নানাবিধ বেদনাহর বড়ির সন্ধান করে!

তাই দেবাদৃতার পরিবার, যা সম্পর্কে অনেকেই বলে অভিজাত বা বনেদি, তারা রাজর্ষি দাশগুপ্তর সঙ্গে বিবাহের আয়োজন করেছে, যে নিজেও এমন পরিবারের, যাকে কেউ কেউ সম্ভ্রম প্রদর্শন করে বলে বনেদি বা অভিজাত, এ খুবই স্বাভাবিক, যাকে বলে পালটি ঘর। তফাতের মধ্যে রায় পরিবারের গায়ের রং সব দুধে-আলতায়, দাশগুপ্তরা শ্যামলাভ!

তবে বন্ধুদের পক্ষে বিস্ময় হয়ে উঠেছে রাজর্ষি দাশগুপ্ত নামে লম্বা চুল, গালভর্তি দাড়ি, ‘আঁতেল’ অধ্যাপক যে, তাদের মতে, “ভাত খেতে খেতে বইটাও চিবিয়ে খাচ্ছিল, আর দেবু কিনা তারই প্রেমে পড়ল!”

শুভায়ন বলল, “আমি ভাবিনি ফাইনাল পাশ না করে তুই বিয়ে করবি!”

দেবু বলল, “করতে তো হতই। আজ নয় কাল। পাশ কবে করব, কেউ কি জানে? বাড়িতে সবাই চাইছিল।”

“এখন তো দেখছি তুই-ও চাইছিলি! সত্যি দেবু, তোর মধ্যেও যে প্রেম-ট্রেম আছে, আমি ভাবিনি।”

“অডিট, অ্যাকাউন্টেন্সি, ল, ব্যালেন্স শিট, কোম্পানি এথিকস অ্যান্ড মডার্ন অডিট ম্যানেজমেন্ট– সব প্রেমে পরিপূর্ণ। হেপাটাইটিস ভাইরাসের মতো ঢুকে পড়েছে মনে!”

শুভ: তোর বিয়ে, আমার কেন মনখারাপ করছে দেবু? সায়ন-রূপমদের মতো আমি খুশি হতে পারছি না কেন?

দেবু: খুশি হওয়ার কী-ই বা আছে? বিয়ে নিয়ে খুশি, আনন্দ, হইচই একরকম সংস্কার! প্রকৃতির নিয়মে পাখি, মৌমাছি, পিঁপড়ে, আরশোলা– সবাই জোট বাঁধে, ঘরদোর, সংসার-পরিবার বানায়। কে আর ঢাকঢোল পিটিয়ে নেত্য করছে?

শুভ: সেই ইলেভেনে তোকে প্রথম দেখলাম। কারও ত্বকস্তর এত পাতলা ও মসৃণ হয়, আমি জানতাম না! আমি তোর শিরা-ধমনি দেখতে পাচ্ছিলাম! মনে হচ্ছিল তুই যেন আলো দিয়ে তৈরি! যেন আলোর সরস্বতী!

দেবু: দুর, ওই ষোলো-সতেরোয় সবারই অমন থাকে। তোদের দাড়ি গজায় তাই বুঝিস না।

শুভ: কতদিন একসঙ্গে আমরা বল তো! কত বছর!

দেবু: আরও কত বছর থাকব! তারপর পাশ করে তুই একটা ফার্ম খুলবি, আমি একটা। আমরা পরস্পর শত্রু হয়ে যাব। প্রতিযোগী সংস্থা। এ ওর ক্লায়েন্ট ভাঙাব। রটনা করব, ওরা তো টাকা খেয়ে ক্লায়েন্টের চাহিদামতো অডিট রিপোর্ট বানায়!

শুভ: পাগলাস্যার বলেন সব কল্পনার চোখে দেখবে। তুই ভাল শিখেছিস! ভাবছি, তোর বিয়েতে যাব না!

দেবু: জেউ দারুণ ক্যাটারার বলছে! শুনলেই জিভে জল!

শুভ: ওই অদ্ভুত লোকটাকে তোর এত ভাল লাগল! আমাকে একবার বললি না পর্যন্ত!

দেবু: হ্যাঁ। লাগল! তো? আমি কি তোর পছন্দমতো লোক বাছব?

শুভ: প্লিজ়! রাগ করিস না! আমি তো তোর ইয়ারদোস্ত, নাকি? কত সুন্দর দিন কেটেছে আমাদের ভাব! একসঙ্গে ভুটান গেলাম! পারো থেকে থিম্পু যাবার পথ! ওঃ! অপূর্ব! যেন স্বর্গ! সাংগ্রিলা! একটু স্বর্গ! একসঙ্গে মাইসোর প্যালেসে সেই অসাধারণ মিউজ়িয়াম! কোচিনে নৌকায় বসে সেই সূর্যাস্ত! দেবু, তুই ছিলি বলেই সব আরও বেশি সুন্দর লেগেছিল! ওয়েল, অভিনন্দন! আমার নিকন ক্যামেরা নিয়ে তোর বিয়েতে আসব। ছবি তুলে অ্যালবাম করে তোকে উপহার দেব।

দেবু: থ্যাঙ্কস। তোর ক্যামেরাটা দারুণ। ভুটান যাওয়ার সময় কিনলি না?

শুভায়নের বিস্ময় ও মনখারাপ নিয়ে বিশেষ ভাবতেই চায়নি দেবু। তারা খুবই ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সহপাঠী, সহকর্মী। পরীক্ষায় দারুণ ফল– সেই আনন্দের বন্ধু, বিভিন্ন সংস্থায় ধুলোমাখা ফাইল ঘেঁটে হিসেব মেলানো, একত্র মধ্যপান, একসঙ্গে পড়া ও ফাজলামি, পরীক্ষায় বারংবার ফেল– সেই দুঃখের বন্ধু। হতাশায় অলি পাবে পানীয়ে চুমুক! জন্মদিনে। দুর্গাপুজোয়। সরস্বতী পুজোয়। এবং পাগলাস্যারের খপ্পরে।

কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, মনের প্রতিটি আলোড়ন বন্ধুদের কাছে উজাড় করে দিতে হবে! বিবাহের দিন এত দ্রুত স্থির না হলে হয়তো বলত পারত, কিন্তু কাউকে তারা এই ব্যাখ্যা দিতে যায়নি, আসলে তাদের দেখা হওয়া এক আকস্মিকতা!

এমনকী, পাগলাস্যারও ধরে নিলেন, তাঁর গৃহ থেকেই এই বিবাহের সূত্রপাত! একদিক থেকে তা সত্য, অন্যদিকে, একটি ছবি, একটু তথ্য, খানিক অনুমানজনিত কৌতূহল সেই সত্যকে বহুতর মাত্রায় সংস্থাপিত করেছে!

অসীমচন্দ্র চৌধুরী পাগলাস্যারের প্রতিক্রিয়া হল খুবই অপ্রত্যাশিত! যদিও, রাজর্ষির বক্তব্য, স্যারের এটাই স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া।

দেবাদৃতার জন্য কেনা, কলহংসের মতো ধবধবে মসৃণ গাড়ি চেপে তারা একসঙ্গে গিয়েছিল পাগলাস্যারের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, বিবাহে আমন্ত্রণ জানাতে।

গাড়িটি আপাতত চালাচ্ছে রফিকুল। দেবুর গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ আছে, ছাড়পত্র আছে, অভ্যাস নেই। যতদিন সেইটি আয়ত্ত না হয়, রফিকুল থাকবে। এ নিয়ে তাদের কথা হয়েছে! “ও থেকে গেলেই বা আপত্তি কী! তোমার কষ্ট করার দরকার নেই। ইচ্ছে হলে চালাবে, নইলে নয়। বরং কলকাতা থেকে স্যারের বাড়ি যাওয়া পর্যন্ত তোমরা গাড়িতে পড়াশোনা করতে পার,” রাজর্ষি বলেছিল।

দেবু তখন বলে, “হ্যাঁ, রফিকুল থাকলে তোমার মা-ও গাড়ি ব্যবহার করতে পারবেন।”

“মায়ের নিজস্ব ফিয়াট আছে। নিজেই চালায়। এ গাড়ি তোমার। মাঝে-মধ্যে আমার বাইক বিগড়োলে ধার দিয়ো।”

“ধার আবার কী? জিনিসে ভাগাভাগির কী দরকার?”

“ঠিক! আচ্ছা, একটা কথা বলো তো, তোমার মা-বাবাকে কী বলে ডাকি? ‘মা’ বলতে তবু তেমন অসুবিধে হয় না, নারীজাতি মানেই মাতৃরূপিণী! কিন্তু ‘বাবা’ সম্বোধন, আমার পক্ষে, তুমি কি বুঝতে পারছ সোনা?”

“সোনা!” দেবাদৃতা খুব হেসেছিল সেদিন। “তুমি আমায় সোনা বললে?”

“তো? কী করব? ডার্লিং, হানি, সুইট হার্ট– দুদ্দুর! উত্তরপাড়ার গঙ্গামাটি মাখা ছেলে! ওসব আসে না! আর বাংলায়, আদরের সুন্দরতম সম্বোধন সোনা।”

“বুঝলাম। শোনো, মন না চাইলে ‘বাবা’, ‘মা’ কিছুই ডেকো না। কাকা, মেসোমশাই, যা খুশি বলতে পার।”

“তুমিও একই সিদ্ধান্ত নিতে পার।”

“আমি ওঁকে মাসিমা ডাকব ঠিক করেছি।”

“বেশ।”

তাদের দু’জনের একত্রিত উপস্থিতিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল তাদের সম্পর্ক। ভালবাসার নিজস্ব আলো থাকে। অপরের চোখে তার রশ্মি পৌঁছয়! স্যার তাদের দেখলেন। বললেন, “মঙ্গলঘট, মঙ্গলশঙ্খ এবং পবিত্র আগুন সাক্ষী রেখে যে-অঙ্গীকার করবে, তাকে মর্যাদা দিয়ো। পুরোহিত নির্বাচনে যেন ত্রুটি না হয়। বিবাহের মন্ত্র হবে সবিস্তার, বিশুদ্ধ এবং শ্রবণযোগ্য। দু’জনেই তা মনোযোগ দিয়ে শুনবে। বিয়ে কখন সম্পন্ন হবে, এই ভেবে অধীর হবে না। বি-বাহ অর্থ বিশেষরূপে বহন। দু’জনের মন ও শরীরের যাবতীয় সুন্দর ও অসুন্দর, জীবনের যাবতীয় আঘাত ও পুরস্কার, সমস্ত সুখাসুখে পরস্পর সঙ্গী হও। কিন্তু মা দেবাদৃতা, আমি চিন্তিত! তোমার পড়ায় ছেদ পড়বে। জীবনের এত বড় পরিবর্তন, মনঃসংযোগে বিঘ্ন ঘটাবে বুঝি-বা।”

রাজর্ষি: ও তো আপনার হাতে তৈরি হচ্ছে স্যার। এমনিতেও ও খুব একনিষ্ঠ। আপনি বলুন, ন্যূনতম ক’দিন আপনি ওকে দিতে চান। আপনি যেমন বলবেন, তেমনই হবে।

স্যার: চারদিন? চারদিনে হবে? আচ্ছা, দাঁড়াও, বিয়ে পড়ছে বুধবার। বুধ-বৃহস্পতি-শুক্র! বেশ। বিবাহের পূর্বে সোম-মঙ্গল তুমি আর এসো না মা! তুমি আসবে পরবর্তী সোমবার তোমার শ্বশুরালয়ের মঙ্গলানুষ্ঠান সুসম্পন্ন হলে পর। কিন্তু মা, পরীক্ষার আগে আর হনিমুন-টুন…

দেবু: না না স্যার! ওই এক সপ্তাহ! তারপরেই আমি চলে আসব।

স্যার: বেশ। ওই সপ্তাহটিতে আমি পড়ানো বন্ধ রাখব। বরং আমার নিজস্ব পাঠপ্রক্রিয়া চলুক। যে-শিক্ষক, সেই সবচেয়ে… সবচেয়ে জিজ্ঞাসু শিক্ষার্থী! হিসাবশাস্ত্র আমার বুড়ো বয়সের অর্জন মা গো। অধ্যয়ন না করলে আয়ত্তে থাকবে না।

তাঁর চোখে জল এল। তিনি তা গোপন করার চেষ্টামাত্র করলেন না! রুদ্ধকণ্ঠে বললেন, “রাজা, এই মেয়েকে কখনও দুঃখ দিয়ো না। সর্বদা নিরাপদে রেখো। সর্বদা পাশে থেকো। আমাদের মেয়েরা সব মা জগদ্ধাত্রী। কিন্তু বড় দুঃখিনী তারা! বাপ-মা ছেড়ে পরের ঘরে যায়। তারপর? অনাদর, অবহেলা, অপমান, অত্যাচার! কী না সয়!”

রাজর্ষি: আশীর্বাদ করুন স্যার, আমি যেন যোগ্য হতে পারি!

তিনি মৌনভাবে আশীর্বাদক হাতখানি প্রসারিত করলেন। তাঁর অশ্রুবিন্দু ভিজিয়ে দিচ্ছে পরিহিত পাঞ্জাবির ঘন সুতোর বুনোট।

রাজর্ষি ইশারা করল। চলো।

তারা বেরিয়ে এল। অসীমচন্দ্রকে অমন ভাবাপ্লুত দেখে ভারী বিষণ্ণ হয়ে উঠল দেবাদৃতা। সে কোনও প্রশ্ন করেনি, মন্তব্য করেনি, কিন্তু মুখচোখে লেগে থাকা মনখারাপের রেখাগুলি রাজর্ষি পড়তে পারছিল। কারণ, ক্রমশ, দু’টি হৃদয় আরও আরও আরও বেশি কাছে আসছিল চাঁদের গায়ে চাঁদ লাগার মতো, পুষ্প ও প্রজাপতির মতো, মিলিত হবে বলে!

রাজর্ষি বলল, “দেবু, চলো, তোমায় জয়নাথের নির্জন সরস্বতী দেখিয়ে আনি। যাবে?”

দেবু: চলো। তুমি চেনো?

রাজর্ষি: চিনে নেব।

দেবু: উনি কাঁদছিলেন, আমার জেউয়ের কথা মনে পড়ছিল! আমার জিতুদিদি যখন বিয়ে করে ঘর ছেড়ে গেল, জেউ ওইরকম– চোখ দিয়ে জল পড়ছে, তবু সব কর্তব্য সারছে।

রাজর্ষি: আমি বুঝি তোমার মনখারাপ, সোনা! সব প্রিয়জন ছেড়ে তুমি আমার কাছে আসছ। পূর্ণ বিশ্বাসে, গভীর ভালবাসায়। আমি তোমায় কখনও কষ্ট দেব না!

দেবু: আমিও দেব না। দেখে নিয়ো।

তারা হাসল। যেমন হাসলেন জয়নাথের দেবী সরস্বতী! যেমন হাসলেন জয়নাথ ও তাঁর স্ত্রী। টিনের চালি দেওয়া ছোট বাড়িটি। ইটের গাঁথনি করা দেওয়াল। উঠোনের এক কোণে মাচায় ঝিঙেলতায় হলুদ ফুলের মেলা। অপর কোণে নির্জন সরস্বতীর মাটির মন্দির। মাটির মেঝে। তিন হাত মাটির প্রাচীর তুলে আধচেরা বাঁশ ঘন করে বোনা দেওয়াল। খড়ের নিচু চালা। অন্দরে সরস্বতী। অদ্ভুত তাঁর গড়ন। কাদামাটি ও কলিচুন মিশিয়ে থুপে-থুপে– ঘরের দেওয়ালে যেভাবে ঘুঁটে দেয় মেয়েরা, গোময় মিশ্রণে লেগে থাকে আঙুলের দাগ, তেমন করে গড়া ফুট তিনেক মূর্তি। কুমোরপাড়ার প্রতিমাশিল্পীর মতো নিটোল নিখুঁত নারীযৌবন নয়। এই মূর্তির দেহাবয়ব এক আদল মাত্র। মুখে অপূর্ব হাসির আভাস, আর কিছু স্পষ্ট নয়। দণ্ডায়মান দেবীর দুই হাত ধরে আছে একতারা যন্ত্রখানা। সত্যিকারের একতারা।

আরও দু’টি হাত এমনভাবে উপরে তোলা যেন দেবী দুই হাতে দুই কর্ণ স্পর্শ করছেন!

সরস্বতীর চার হাত তারা আগে কখনও দেখেনি। ভাস্করের নিজস্ব কল্পনা। এই দেবী বীণাবাদিনীও নন, একতারাবাদিনী। তাঁর বাহন হংসরাজও অনুপস্থিত! যদি বলে না দেওয়া হয়, ইনি সরস্বতী, তবে অনুমান করা মুশকিল!

অদ্ভুত ভাস্কর্য! চোখ ফেরানো যায় না। রং নেই, রূপ নেই, তবু ব্যাখ্যাতীত মহিমা তার।

চালভাজা আর বাতাসা দিয়ে আপ্যায়ন সেরে জয়নাথ বললেন, “একতারাটি এক সাধুর দান। বাজিয়ে, গান গেয়ে ভিক্ষে করছিলেন। বলি, বা’ঠাকুর বসো দি’নি! এট্টু জল-বাতাসা খাও, দুটো গান গাও। বসলেন এই আঙিনেতে! গানও গাইলেন! আমিও বসে গেইলাম সারেঙ্গি বাজাতে। শুনে বলে, আজ হতে একতারা তোমার। সন্ন্যাস নিয়ে সব ছেড়েছি, কেবল একে পারিনি। আজ তোমার হাতে দিলাম। নির্জনে সরস্বতী সাধনা আর করে ক’জনা! সাধু তো গেল। হঠাৎ কী মনে এল, ছেলেকে বলি, তা খোকা, আয় তবে মায়ের মন্দির বানাই। আনকা লোক, আনাড়ি হাতের মূর্তি, মা যেমন হতে চান, তেমনি হলেন। ছেলে মাঝে-মধ্যে একতারাটি নামিয়ে বাজায়, আবার রেখ্যে দেয়।”

জয়নাথ সারেঙ্গি বাজাতে লাগল, তার করুণ মোচড়ে রাজর্ষি আর দেবাদৃতার ভেতরে কষ্ট পাকিয়ে উঠতে লাগল ধূপের ধোঁয়ার মতো! তারা কেউ তেমন সংগীতরসিক নয়। কিন্তু গভীর অনুভূতি তাদের প্রেমে দ্রব মনকে বেদন-মধুর স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে চলল। কখন সন্ধ্যা নেমেছে, কখন উঠোনে সামান্য আলোর ছটা লেগেছে সরস্বতীর পায়ের কাছে জ্বালানো প্রদীপ থেকে!

একসময় বাদন থামল। জয়নাথ মাটিতে উপুড় হয়ে সরস্বতী প্রণাম করে বলল, “তা বেশ। সে-ও তো এক সরস্বতীর ক্ষেত্র। লোকে বলে পাগলা জমিদারের টোল! তা চৌধুরীদের জমিজমা এখনও অনেক। কিন্তু খাবে কে? বংশ শেষ!”

তারা উঠে পড়ল। ফেরার পথে দেবু বলল, “কারও ব্যক্তিগত বিষয়ে কৌতূহল দেখানো ঠিক নয়। কিন্তু স্যার সত্যি অদ্ভূত।”

“স্যারের বোন সুমা, আমি তাঁকে পিসি বলি, বোবা ও বধির! স্যার তাঁর বিয়ে দিয়েছিলেন। তখন স্যার খুব নাম-করা কলেজে অঙ্ক পড়াতেন। যিনি পাত্র ছিলেন, তাঁর কথা বিশেষ জানি না। এক রাতে পিসিকে রক্তাক্ত অবস্থায় সুভাষগ্রাম স্টেশনে কারা ফেলে রেখে গিয়েছিল। কেন, কীভাবে, আর কিছু জানি না। তিনি অত্যাচারিত হয়েছিলেন!”

“বুঝতে পারছি। ওঁকে বিয়ে না দিলেই স্যার ভাল করতেন।”

“তিনি উলটোটাই ভেবেছিলেন। হয়তো সদাশয়ের ছদ্মবেশে কোন লোভী ও খল এসে জুটেছিল। ভেবেছিল সম্পত্তি, সম্পদ পেয়ে যাবে!”

“তাই হবে।”

“সুমাপিসিকে ফেলে স্যার কোথাও যান না।”

“বুঝেছি।”

“স্যারের একটাই চিন্তা, তিনি যদি আগে চলে যান, সুমার কী হবে!”

‘‘আত্মীয় পরিজন কেউ নেই?’’

“আছে নিশ্চয়ই, সব ছাড়া ছাড়া।’’

‘‘আমার তো মনে হয় সবাই একসঙ্গে বেশ জমজমাট– এটাই ভাল।”

“না দেবু, সবসময় নয়। যৌথ পরিবার অনেক পক্ষেই যন্ত্রণার।”

জাঁকজমকের সঙ্গে বিয়ে চুকে যাওয়ার পর, রাজর্ষির মায়ের ইচ্ছায় উত্তরপাড়ার সাবেকি বাড়িতে এল রাজর্ষি ও দেবাদৃতা। স্বামী-শ্বশুরের ভিটে বলে কথা।

এই ব্যবস্থা রাজর্ষির মনঃপূত ছিল না। অবশেষে সে মায়ের সঙ্গে সন্ধি করে, শুক্রবারের আনন্দানুষ্ঠান শেষে তারা নিজস্ব ফ্ল্যাটে ফিরে আসবে।

অনেক রাতে, শেষ অতিথিও বিদায় নিয়ে গেলে রাজর্ষি পাজামা-পাঞ্জাবি পরে, স্নান করা ভিজে চুল আঁচড়ে ঘরে এল।

একটি প্রাচীন জাবদা খাট ফুলে ফুলে সাজানো! সেই সব বাজারি ফুলের ক্লান্ত সৌরভ, রঙে চোবানো সবজেটে ও শুকোতে থাকার ছোপ-ফেলা পাপড়ি সমেত নেতিয়ে পড়া ফুলের ঘেরাটোপে বসে, বেনারসি ও গা ভর্তি গয়না পরা পরিশ্রান্ত দেবু ঘুমে ঢুলছিল! রাজর্ষিকে দেখে বলল, “ইস! স্নান করে কী ভাল লাগছে, না?”

“তুমিও যাও। স্নান করে এসো। এতক্ষণ, এই গরমে এসব পরে বসে আছ!”

“এই গয়নাগাটি খুলি আগে। একটু সাহায্য করবে?”

“নিশ্চয়ই! কী কী খুলতে হবে বলো।”

“গলায় ঝোলানো গয়নাগুলো দেখছ তো, সব ঘাড়ের কাছে হুক লাগানো। খুলে দাও।”

“বেশ।”

যতখানি সম্ভব স্পর্শ বাঁচিয়ে একটি একটি করে হার খুলল রাজর্ষি।

“এবার?”

“হাতের গয়না খোলো।”

“ভারী লাগে না এসব?”

“পরে দ্যাখো।”

“পরলেই হয়। আজ থাক। আজ ক্লান্ত। … তোমার হাত খুব নরম তো দেবু।”

“হুঁ! যাই এবার! এগুলো সব আমার ওই লাল ব্যাগে রেখে দেবে?”

“নিশ্চয়ই।”

“মাসিমা, মানে তোমার মা বলেছেন, কাল এখান থেকে বেরনো পর্যন্ত যেন শাড়ি পরি।”

“কেন? আচ্ছা, পোশাক-আসাক নিয়ে সবাই এত মাথা ঘামায় কেন? তোমার যা খুশি, তাই পরবে। তুমি কী পরবে, মা ঠিক করে দেবে নাকি?”

দেবু: রাগ কোরো না। তুমিও পরিশ্রান্ত।

রাজর্ষি: অন্যায় চাপের কাছে নতিস্বীকার করতে নেই দেবু। চাপ ক্রমশ বাড়তে বাড়তে মেরুদাঁড়া বাঁকিয়ে দেবে। অনেক তো নিয়ম মানা হল! আর কত? জানো, কনে সাজ পরে তোমাকে অপরূপ সুন্দর লাগছিল। কিন্তু তোমার কোনও বিশেষত্ব ছিল না! ওই শাড়ি-গয়না-মুকুটে তোমার ব্যক্তিত্ব বদলে গিয়েছিল! তার চেয়ে এখন, এই যে গায়ে গয়না নেই, সাজ আছে, কিন্তু তুমি সাজ সম্পর্কে সচেতন নও, এতে তোমার ‘তুমিত্ব’ আবার ফিরে আসছে।

দেবু: হুঁ! আমি আসছি।

রাজর্ষি: এসো। তোমায় আমার ছোটবেলার কয়েকটা ছবি দেখাব। বাবার ছবি। এই ঘরটা বাবার প্রিয় ছিল। এ ঘরেই… মানে, বাবার জীবনের শেষ রাত্রি এ ঘরেই!

এ ঘরের জানালা থেকে গঙ্গা দেখা যায়। স্পষ্ট, বহমান গঙ্গা। রাজর্ষি জানালায় দাঁড়াল। দেবু তার স্যুটকেস থেকে সুতির সালোয়ার-কামিজ নিয়ে স্নানে গেল। এ বাড়িতে শোওয়ার ঘরের সংলগ্ন শৌচালয় নেই। এমন ব্যবস্থায় দেবু অভ্যস্ত নয়। এ বাড়িতে যাঁরা থাকেন, কেমন জীর্ণ, ঘোলাটে চোখ, ম্রিয়মাণ ভঙ্গি। যেন জীবিত নয়, বাড়ি জুড়ে জীবন রহিত কিছু অবয়ব! এ জন্য শুধু বয়সের ভার দায়ী নয়। জরা মানুষকে অশক্ত করে দেয়, দুঃখমিশ্রিত জরা করে নিষ্প্রাণ!

সাদা সালোয়ার, গাঢ় লাল কামিজ, পিঠে লম্বা ভিজে চুলের ঝাঁক নিয়ে যখন ফিরে এল দেবু, রাজর্ষি তাকে দেখে হাসল। দু’হাত প্রসারিত করে বলল, “আমার কাছে আসবে?”

“জানালা খোলা।”

“এত রাতে কে দেখবে? আচ্ছা, আলো নিভিয়ে দিই।”

ঘরে রইল বাইরে থেকে ঠিকরানো আবছা আলো। দেবু, আস্তে আস্তে রাজর্ষির কাছে গিয়ে দাঁড়াল। পরস্পরকে জড়িয়ে নিল তারা। আবেগময়। প্রেমাচ্ছন্ন। পরম আকাঙ্ক্ষিত এই মিলনের আলিঙ্গন! বহুক্ষণ এভাবেই রইল!

রাজর্ষি দু’হাত দিয়ে দেবুকে আগলে রইল এমন, যেন তার সবচেয়ে প্রিয়, সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণীটিকে জগতের কোনও অশুভ, অমঙ্গল, অকল্যাণ কেড়ে নিতে না পারে!

বহুক্ষণ পরস্পরের ঘ্রাণ ও স্পর্শ নিয়ে, অল্প অস্থির দেবু বলল, “ঘুমোবে না?”

রাজর্ষি বলল, “আজ আমাদের প্রথম রাত্রি দেবু। চলো জেগে থাকি আরও কিছুক্ষণ! জানো, এক অসামান্য অনুভূতি হচ্ছে আমার! বুঝিয়ে বলতে পারব না! মনে হচ্ছে, বাবা চলে যাবার পর থেকে যে একাকিত্বর শুরু, তুমি এসে তাকে ভরে দিলে। তুমি আমার, একেবারে আমার নিজস্ব মানুষ! আমি বোধ হয় বেশি আবেগবিহ্বল হয়ে যাচ্ছি!

দেবু: জিতুদিদি বলে, আবেগ খুব সৎ ও সুন্দর! আবার আবেগ আমাদের ভুল দিকেও নিয়ে যায়। চূড়ান্ত ক্ষতি করে।

রাজ: তুমিও মনস্তাত্ত্বিক হয়ে উঠেছ! এসো এদিকে, ওই যে ঘাট দেখছ, ওখানে বসে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বই পড়তাম। জলের এক নিজস্ব ভাষা আছে। নিজস্ব গন্ধ! দিনের নানা সময় নানা রঙের আলো পড়ে গঙ্গার যে কত বিচিত্র সুন্দর রূপ তৈরি হয়! আমার ফ্ল্যাটবাড়িতে এই নদীর অভাব বোধ করি! অবশ্য পূর্ব দিকে সূর্যোদয় খুব সুন্দর! তুমি তো ফ্ল্যাট দেখতে এলে না।

দেবু: দেখব তো! ওখানেই তো এই পাখি দুটো নীড় বাঁধবে! আচ্ছা, ওখানে ঝুলবারান্দা আছে?

রাজ: দুটো। আমাদের শোওয়ার ঘরের সঙ্গে একটা, আর-একটা ড্রয়িংরুমের সঙ্গে, পুবমুখী। বেশ বড়।

দেবু: আচ্ছা। আমরা কাল এখান থেকে কখন যাব?

রাজ: সকালেই দেবু। তুমি গিয়ে একটা হতচ্ছাড়া লক্ষ্মীছাড়া সংসারে উঠবে। তোমাদের বাড়ির সম্পূর্ণ বিপরীত। অগোছাল, ময়লাটে, শ্রীহীন!

দেবু: আমি গুছিয়ে নেব।

রাজ: অনেক বই। শুধু বই।

দেবু: তুমি আমাকে সাহায্য করবে।

রাজ: অবশ্যই। রফিকুলকেও ডেকে নেব।

দেবু: আমার পড়ার টেবিল?

রাজ: আমি খুব সুন্দর সব আসবাবপত্রের দোকান দেখে এসেছি। কথা বলা আছে। রেডিমেড পছন্দ করলে ওরা একদিনের মধ্যে সব পৌঁছে দেবে। কাল আমরা দু’জনেই যাব। তোমার যা যা লাগে, নিয়ে নেবে। কোনও কার্পণ্য নয়। এই গোছগাছের জন্য আমি দু’দিন ধার্য্য করেছি। এর মধ্যে সব করে ফেলতে হবে।

দেবু: আমাদের সংসার?

রাজ: হুঁ তো!

দেবু: কীরকম স্বপ্নের মতো লাগছে!

রাজ: আমারও। আমার মন ভরে আছে। শোনো দেবু, আজ আর কাল আমরা ঘরদোর গুছিয়ে নেব। পরশু থেকে লেখাপড়া শুরু।

দেবু: হ্যাঁ, এখন তো শনিবার আরম্ভ হয়ে গড়িয়ে গিয়েছে। সোমবার আমার পড়তে যাওয়া।

রাজ: আমার কলেজ।

দেবু: দু’দিনের মধ্যে সব গুছিয়ে উঠতে পারব?

রাজ: আমার কোনও ধারণাই নেই গো সোনা।

দেবু: জিতুদিদি আর শানু বলেছে প্রয়োজন হলে জানাতে।

রাজ: অবশ্যই জানাবে। ওরা থাকলে তো জমজমাট।

দেবু: আচ্ছা, আমাদের সব একসঙ্গেই তো? মানে খাওয়া-দাওয়া এসব মাসিমার সঙ্গেই তো?

রাজ: এতদিন তাই ছিল। আমি মাকে বলেছি, আমরা আলাদা ব্যবস্থা করে নেব। আগেই বলে রেখেছি যাতে তোমাকে দোষ না দেওয়া হয়। আমাদের রফিকুল ভাল রান্না জানে। ও নিজেই আমাদের বাবুর্চি হতে চেয়েছে। ছেলেটার টাকার দরকার। ফার্স্ট ইয়ার পর্যন্ত পড়েছে, জানো! বাড়িতে দুর্দশা! গাড়ি চালানো শিখে রোজগার করছে! আমি ওকে বলেছি, ওকে রাতের কলেজে ভর্তি করিয়ে আবার পড়াব।

দেবু: খুব ভদ্র, ভাল ছেলে। ঘর-দোর ধোয়া-মোছার জন্য একজন লাগবে তো।

রাজ: আসে তো! সবিতামাসি!

আরও কিছুক্ষণ বকম বকম করে দু’জনে জড়িয়ে-মড়িয়ে ঘুম দিল যেন কতকালের চেনা!

প্রথম রাতেই যে রাজর্ষি কামার্ত হয়ে উঠল না, এই সৌজন্য দেবাদৃতাকে তৃপ্ত ও নিশ্চিন্ত করল! এমনকী, পরবর্তী দু’রাত তারা এভাবেই কাটিয়ে দিল। রাজর্ষির ফ্ল্যাট বেশ বড়, সুন্দর, খোলামেলা। কিন্তু অত্যন্ত বিশৃঙ্খল। দেবু হেসে গড়িয়ে পড়ল এই দেখে যে, স্নানাগারের বাইরে পাপোশ হিসেবে রাজর্ষি ব্যবহার করেছে তার ছেঁড়া জাঙিয়া!

শনিবারেই তারা পছন্দ করল নতুন খাট, ওয়ার্ডরোব, আলমারি, খাওয়ার টেবিল, দু’খানি প্রশস্ত বইয়ের তাক। দেবুর লেখাপড়ার টেবিল-চেয়ার, কাঠের সুন্দর সোফা সেট। সাজগোজের বড় আয়না, চায়ের নিচু টেবিলও বাদ গেল না। পাকশালের ভার নিল রফিকুল নিজে। যা লাগবে, সে কিনে নেবে।

দেবুর বাড়ি থেকে এল প্রচুর উপহার। সংসার গোছানোর যাবতীয় সামগ্রী! শানুকে নিয়ে জিতুদিদি এল দেবু-রাজর্ষির সংসার সজ্জায় হাত লাগানোর জন্য। সারা দিন মিস্ত্রিরা ঠকাস-ঠাঁই শব্দে আসবাবের অংশগুলি জুড়ে জুড়ে পূর্ণাঙ্গ করতে লাগল। তারা হাসি-গল্প-ইয়ার্কি করতে করতে একটি আস্তানাকে গৃহ গড়ে তুলল। জিতুদিদি জিজ্ঞেস করল, “মাসিমা কোথায়?”

“মা উত্তরপাড়ায়।”

“তাঁর ঘর নিশ্চয়ই তোমার মতো এমন এলোমেলো গ্রন্থাগার নয়।”

“আমার অনেক বইপত্র ওই ফ্ল্যাটেও আছে। মা গুছিয়ে রাখে। এ ঘরে মাকে আসতেই দিই না।”

“দেবু তো খুবই গোছালো আর পিটপিটে।”

“আমি বুঝেছি। ওর পছন্দমতোই থাকার চেষ্টা করব।”

“মাসিমা কবে আসবেন?”

“জানি না। রাগ করেছে। শনিবার, মানে কাল আমাদের ওখানে থেকে যেতে বলেছিল। আমি দেবুকে নিয়ে চলে এলাম।”

“এ বাবা!”

“ও নিয়ে ভাববেন না। আমি পুবে তো মা পশ্চিমে। বরাবর এমন।”

রাত্রি প্রায় দশটায় যখন সকলে বিদায় নিয়ে গেল, তাদের নতুন নীড় ঝকঝকে, সুন্দর। তবু আরও অনেক গুছোন বাকি রইল। অনেক বই। অনেক উপহার। একটি ঘরে সব জমিয়ে রাখা। আস্তে আস্তে গুছিয়ে নেবে!

রাজর্ষি দেবাদৃতার কপালে চুমু খেয়ে বলল, “কী সুন্দর তোমাদের সম্পর্ক! কী টান! খুব ভাল লাগে দেখে। তুমি ভাগ্যবান যে, এমন পরিবারে জন্মেছ। আর আমি ভাগ্যবান যে, তোমায় পেয়েছি।”

“তুমিও এখন আমাদেরই একজন রাজর্ষি।”

রাতের আহার শেষে আলো নিভিয়ে, আসবাবপত্র, অন্য ব্যবহার্য নতুন বস্তু সামগ্রীর ঝাঁজালো গন্ধে ভরে, নতুন শয্যার পেলবতায় শয়ন করল তারা। রাজর্ষি বলল, “এবার আমার কী যে ভাল লাগছে। আমার নিজের ঘর। আমার বউ। আমার সারা জীবনের সঙ্গী!”

“হুঁ!”

“তুমি আসার আগে দুটো বড় কাজ করেছি আমি, তুমি না বলতেই।”

“গাড়ি কিনেছ। আর?”

“ঘর রং করিয়েছি!”

“ঠিক!”

“কাল থেকে লেখাপড়ার কাজ শুরু। আর কোনও দিকে মন নয়।”

“নিশ্চয়ই। তোমারও তো বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে হবে। আচ্ছা, তখন আমি কোথায় থাকব?”

“তোমার যেখানে মন চাইবে।”

“মা-বাবা এখানে একা থাকতে দিতে চাইবে না। তোমাকে ছাড়া আমারও কি ভাল লাগবে এই ফ্ল্যাটে?”

“তোমাকে ছেড়ে আমারও ওদেশে ভাল লাগবে না দেবু। আমার যেতেই ইচ্ছে করছে না। কিন্তু কাজ যে দু’জনকেই করতে হবে! তোমাকে মনপ্রাণ দিয়ে পড়তে হবে।”

“কে জানে এবার পাশ করতে পারব কি না।”

“নিশ্চয়ই পারবে। আচ্ছা দেবু…”

“বলো।”

“দু’জন মানুষের মধ্যে সম্পূর্ণ হৃদয় বিনিময় সম্ভব?”

“জিতুদিদি বলে ভালবাসা একটা প্রক্রিয়া। দীর্ঘ সময় নানা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে তাকে যেতে হয়। মুগ্ধতা, প্রেম, শ্রদ্ধা, কামাতুরতা সব ছাপিয়ে মন এমন স্তরে পৌঁছয়, যখন হয়তো পরস্পরকে বুঝতে পারার চূড়ান্ত দশা!”

“আমারও সেইসব পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাব?”

“আর পরীক্ষার দরকার কী রাজর্ষি? এক পরীক্ষার জুজুবুড়ি আমাকে পাগল করে দিচ্ছে!”

“এবার পাশ করে যাবে।”

রাজর্ষি এক হাতে জড়িয়ে নিল বউকে। সারা দিনের এত পরিশ্রম দু’জনকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। যৌথ জীবনের প্রথম তিন রজনী তারা শরীরী সম্পর্কটি কামবোধ ব্যতিরেকী আদরে ভরে রাখল। চতুর্থ রাত্রিতে তারা হয়ে উঠল নিবিড় ও আশ্লেষী। ধীরে ধীরে যৌন সম্পর্কসুখের অভ্যন্তরে যেতে লাগল তারা। কেউই অভিজ্ঞ নয়, কিন্তু পরিণতবুদ্ধি! ধৈর্য এবং পরস্পরের প্রতি যত্ন জারি রেখে দীর্ঘ সুন্দর প্রয়াসে একে অপরে লীন হতে পারল! প্রথম যৌনক্রিয়ার যন্ত্রণা ও সুখমিশ্রিত কাতরতায় পরস্পরকে ভিজিয়ে যখন তারা থামল, পূর্ব কলকাতার জলাভূমি থেকে আসা স্নিগ্ধ বায়ু পরদা উড়িয়ে তাদের পুলকস্বেদ শুকিয়ে তুলতে লাগল।

রাজর্ষি এলিয়ে পড়ে আছে। তার নগ্ন শরীর ভারী মোহময়! কপালে চুমু দিয়ে রাতপোশাক কোনওক্রমে গায়ে জড়িয়ে স্নানঘরে ঢুকে পড়ল দেবাদৃতা। ভাল করে স্নান করল। তার রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তলপেট জুড়ে যন্ত্রণা। সে জানে, এমন হয়। যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে স্নানঘরের দরজা খুলে দেখল রাজর্ষি অস্থিরভাবে পায়চারি করছে! হাত দু’টি পেছনে দৃঢ়বদ্ধ। লম্বা হতে থাকা চুল এলোমেলো। বিস্ফারিত রক্তাভ চোখে সে দেবাদৃতাকে দেখছে! সেই দৃষ্টিতে উন্মাদের ক্রোধ। এ যেন তার চেনা রাজর্ষি নয়। অন্য কেউ! কী হল! এই তো মিনিট পনেরো সে স্নানঘরে ছিল। এর মধ্যে কী হল?

দেবাদৃতা চেঁচিয়ে উঠল, “কী হয়েছে তোমার? রাজর্ষি! তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?”

“চুপ! একদম চুপ!” চাপা তর্জন করে উঠল শান্ত, প্রেমবান রাজর্ষি যুবক, “একটা আওয়াজও করবে না। কেন ঢুকেছ এই ঘরে? কেন? কী দেখছিলে তুমি?”

দেবুর সারা শরীর কাঁপছে! এ কী প্রলাপ! সে বলে উঠল আবার, “রাজর্ষি, হঠাৎ কী হল তোমার?”

“যাও! যাও! কান ধরো! কানে হাত দাও! দাও! দেবে না?”

সে নতুন ওয়ার্ডরোব খুলে বের করে আনল চামড়ার বেল্ট! চাবুকের মতো আছড়াতে লাগল মেঝেয়, “কান ধরো। ধরো। না হলে চাবুক-পেটা করব।”

দেবাদৃতা বিমূঢ় দশায়, অসহায়, বিস্মিত, ভীত, সে দু’হাত কানে তুলে নিল। গায়ের রাতপোশাক– কাঁধে ফিতে দেওয়া টুকরো কাপড়। তখনও গিঁট পড়েনি ফিতেয়। হাতের অবলম্বন আলগা হতেই শূন্য বস্তার মতো খসে পড়ল শরীর থেকে। প্রায় উদোম হয়ে গেল সে। ঘরে আলো জ্বলছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। এতটুকু প্যান্টির আবরণ! সে আলোর যন্ত্রণায়, অপ্রত্যাশিত ঘটনার আঘাতে, অসহায় অপমানবোধে, বিবাহ অনুষ্ঠানের পর, এই প্রথম, কেঁদে উঠল।

“একদম কাঁদবে না! ওঠ-বোস করো, কান ধরে ওঠ-বোস করো। বলো, অন্যায় করেছি, আমি অন্যায় করেছি, আর কোনওদিন করব না! বলো!”

দেবাদৃতা বিড়বিড় করে উঠল। আর করব না। অন্যায় করেছি।

ওঠ-বোস করতে লাগল সে। করতেই লাগল। ভেঙে পড়া কান্নায়, অসহায় কষ্টে, চূড়ান্ত বিপন্নতা ও অসহনীয় আঘাতে ভাঙতে ভাঙতে, প্রায়-নগ্ন, বিহ্বল সে, তলপেটে ব্যথা নিয়ে উঠছে-বসছে অজ্ঞাত শাস্তিতে, যা অদ্যাবধি সে কখনও পায়নি।

তাকে কিছুক্ষণ দেখে, হাতের বেল্ট ছুড়ে ফেলে, আলো নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল রাজর্ষি!

সব কিছু এত আকস্মিক, এমন অভাবিত যে মেঝেয় পড়ে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল দেবু! কাঁদতে লাগল নিঃশব্দে! ভয়ে, পাছে আবার রাজর্ষি অস্বাভাবিক হয়ে যায়!

অস্বাভাবিক!

শব্দটি মনে আসতে সে রোদন সমেত উঠে বসল। রাজর্ষির পাশে শুতে তার ইচ্ছে করল না। ধীর পায়ে বৈঠকঘরের নতুন সোফায় শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগল পূর্বাপর। যত ভাবল, ততই কান্না পেল তার। একদিনও, এক মুহূর্তের জন্যও সে রাজর্ষির মধ্যে কোনও অস্বাভাবিকতা দেখেনি! আজ কী হল! এমন কী হল! এই কি প্রথম, নাকি এমন বিকার তার বহু আগে থেকে? তাই কি মা আর ছেলে আলাদা বসবাস করে? রাজর্ষি কি তার অসুখ বিষয়ে ওয়াকিবহাল? জেনেশুনে প্রতারণা করল?

রাজর্ষি!

প্রতারণা!

তা হলে এই ভালবাসা! অঙ্গীকার! তার শিক্ষা! তার গাড়ি ক্রয়! প্রতিটি বিষয়ে দেবাদৃতার সুবিধে ও সুখের দিকে খেয়াল রাখা! এমনকী, যৌনসম্পর্কের সময়ও সে কত শালীন, কত মাধুর্যময়! রাজর্ষি তাকে প্রতারণা করতে পারে না। তারা যে-চোখ দিয়ে পরস্পরকে হৃদয়ে টেনে নিয়েছিল, সেই তো প্রেম, সেই তো বিশ্বাস।

যৌনতা! যৌনসম্পর্ক! এখানেই রাজর্ষির গভীর অসুখ!

এখন সে কী করে? কী করা উচিত? সে সারা রাত ধরে ভাবতে লাগল। রাজর্ষি তার বেদনাময় শৈশবের কথা তাকে বলেছিল। পিতার অস্বাভাবিক মৃত্যু। মায়ের সঙ্গে দ্বন্দ্ব। নিজের আত্মীয়দের প্রতি অশ্রদ্ধা ভাব! নাকের ফুলখানি অস্থির হাতে ঘোরাতে ঘোরাতে, রাজর্ষির জন্যই এক ব্যাখ্যাতীত কষ্টে সে কাঁদতে লাগল আকুল!

জিতুদিদির কথা তার মনে পড়ল। রাজর্ষি সম্পর্কে ঠিক এই জায়গায় সন্দিহান ছিল জিতু। প্রেমে অন্ধ দেবু ভেবেছিল জিতুদিদি পেশাগত বাঁধা গতে ঢুকে পড়েছে। হায়! এতকাল জিতুদিদির সান্নিধ্য ও উপদেশ পেয়েও সে কী করে ভুলে গেল মানবমনের চেয়ে জটিল ও দুর্বোধ্য আর কিছুই হতে পারে না!

সে এখন কী করে?

বাড়ি ফিরে যাবে?

অসম্ভব!

তার ব্যর্থতার পুনরাবৃত্তি এক বিষম ভার। আবার এক অসহনীয় দুঃসংবাদ নিয়ে সে কী করে গিয়ে দাঁড়াবে? দুঃসহ কষ্টে ভেঙে পড়বে রায় পরিবার!

আর রাজর্ষির কী হবে?

না। রাজর্ষি অসৎ হতে পারে না। প্রতারক নয় সে। সে তো দেবাদৃতাকে পেয়ে কতখানি খুশি!

বিশ্বাস, বিশ্বাস! এত সহজে হার মেনে নেবে না সে। সে কাল জিতুদিদির কাছে যাবে। তার পরম বন্ধু। এই মুহূর্তে জিতুদিদির চেয়ে বড় আশ্রয় তার আর কেউ নয়!

ভাবতে ভাবতে সে দেখল ভোর হচ্ছে। পুবমুখী জানালায় আকাশ রাঙা হয়ে উঠছে। দুঃখে-অপমানে-নিরাশায় তার বুকের মধ্যে অমনই রাঙা দগদগে ক্ষত! এমন এক দুর্বিষহ ভোর তার জীবনে আসবে, সে ভাবেনি! সূর্য ওঠার মহাজাগতিক আলোকরশ্মির পরম সৌন্দর্য দেখতে দেখতে তার মনেও হল না সে সুন্দর অবলোকন করছে! ক্লান্তিতে তার চোখ জুড়িয়ে এল। ঘুমিয়ে পড়ল সে। কাঠের নতুন সোফায়, তার নতুন সংসারে!

সকালবেলায় তাকে ঠেলে তুলল রাজর্ষি, “এ কি সোনা! তুমি এখানে শুয়ে আছ কেন? শরীর খারাপ? আমাকে ডাকোনি কেন?”

সে ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। “ওঃ! ক’টা বাজে? পড়তে যেতে হবে!”

“তুমি এখানে কেন আগে বলো।”

“এমনি।”

“আমার নাক ডাকছিল?”

“বললাম তো এমনি। সরো, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

“তুমি কেমন একটা ব্যবহার করছ! কেমন দূরের! আমি কোনও ভুল করেছি?”

“নিজেকে জিজ্ঞেস করো।”

“কী ভুল করেছি সোনা? বলো আমায়! উই হ্যাড সেক্স লাস্ট নাইট অ্যান্ড ফর দ্য ফার্স্ট টাইম। এটা তো খুবই স্বাভাবিক!”

“সরো না! বলছি দেরি হয়ে যাচ্ছে!”

দ্রুত বেরনোর জন্য তৈরি হয়ে নিল দেবু। দেখল, দু’চোখে হাত চাপা দিয়ে সোফায় শুয়ে আছে রাজর্ষি। দেবুর বুকের মধ্যে কষ্ট উথলে উঠল। তার মনে হল, এ তো অসুস্থ! যে অসুস্থ সে যে আরও অসহায়। আর যার মনের অসুখ, তার কেউ নেই! পৃথিবী মন বিষয়ে নির্দয়!

সে পায়ে চটি গলিয়ে দাঁড়াল এক মুহূর্ত। বলল, “তুমি আজ কখন ফিরবে?”

“আজ আর বেরোব না।”

“কলেজ নেই?”

“যাব না।”

“কেন?”

“ভাল লাগছে না। তুমি যাও। তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। রফিকুল এসে গিয়েছে। জানতে চাইছিল আজ থেকেই রান্নাঘর চালু করবে কি না! মা’র ঘরে মলিনামাসি আজও রান্না করছে বলে গেল।”

“হ্যাঁ, যা ভাল মনে হয়। রফিকুল কাল থেকে শুরু করতে পারে। আসছি। আমার আজ ফিরতে দেরি হবে।”

“ঠিক আছে। কিছু খেয়েছ?”

“না। বেরোলাম।”

তার যাত্রাপথে, অধ্যয়নের সময়, বন্ধুদের সঙ্গে বিচিত্র কথোপকথনে– একটিবারের তরেও সে রাজর্ষির জন্য নির্ধারিত মনঃপ্রকোষ্ঠ বন্ধ রাখতে পারল না। বরং, তার মন মায়াময় হয়ে উঠল, উদ্বিগ্ন বোধ করল সে। সারা দিন হয়তো বই পড়ে কাটিয়েছে! খায়নি! স্নান করেনি!

তার কি গতরাতের কথা কিছুই মনে নেই!

জিতুদিদি বলল, “দু’রকম সম্ভাবনাই আছে। মনে থাকার সম্ভাবনা বেশি, কারণ এই অস্বাভাবিক আচরণ সে করেছে জাগ্রত অবস্থায়! শুনে যা বুঝছি, দৃঢ়বদ্ধ ভীতিজনিত মনোবিকার। কবে, কী থেকে, কেন এর উৎপত্তি সেটা জানা খুব জরুরি।”

দেবু: আমি কি জানতে চাইব।

জিতু: চাইতে পারিস, তবে তার আগে তাকে স্বীকার করতে হবে, বা মানতে হবে, এই আচরণ সে করে।

দেবু: যদি না মানে?

জিতু: তখন মনোবিদ ভরসা। আমি তো আছি। তার আগে তুই বল, তুই কী চাস।

দেবু: কাল থেকে ক্রমাগত ভাবছি। সহজে হার মেনে নেব জিতুদিদি? সিএ ফাইনালে বার-বার ফেল করেছি। হার মানিনি তো! সবই তো যুদ্ধ, বলো? তোমার কাছে মনোরোগের এত গল্প শুনেছি, আমারও একরকম ধারণা হয়ে গেছে। আমি বুঝেছি এটা অসুখ!

জিতু: কোনও সন্দেহ নেই। বুঝতে হবে এর ক্ষতি কতদূর! ও কতখানি হিংস্র ছিল? শুধু কি তোর সঙ্গেই এমন? নাকি অন্যদের প্রতিও এমন উন্মত্ত শাস্তির স্পৃহা? ওর মা কি জানেন? আগে কি মনের কোনও চিকিৎসা করানো হয়েছে? দেবু, যে কোনও মনোরোগই ধৈর্য চায়। সহানুভূতি এবং মনোযোগ দাবি করে। মাত্র বিয়ে হয়েছে। এতখানি করার ইচ্ছে হবে তোর?

দেবু: অসুখ করেছে বলে ছেড়ে যাব? ও তো সবচেয়ে অসহায় বলো! দেখা হওয়ার পর থেকেই ও আমাকে বিশ্বাস করেছিল। ও ফিরে পাচ্ছিল ওর শান্তি, ওর আনন্দ। আমিও, জিতুদিদি, আমার ওই ফেল, ফেল, ফেল ল্যাপচ্যাপানো, একঘেয়ে, যান্ত্রিক জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে আনন্দ পাচ্ছিলাম, অসীমচন্দ্রস্যার এবং ওর সান্নিধ্য আমাকে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে দিয়েছে। সিএ ফাইনাল দিয়ে বেরনোর যুদ্ধটা আর তত কঠিন নয় আমার কাছে! সব দিক দিয়ে, সারাক্ষণ আমাকে আগলে রেখেছে! ওর আত্মীয়েরা যেদিন এলেন আমাদের বাড়ি, কাম্মার উপর রাগ করে আমি স্কার্ট পরেছিলাম। ওঁরা আমাকে বাতিল করতে চেয়েছিলেন, একথা উত্তরপাড়ার বাড়িতে পা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে ওর মা আমায় জানিয়েছেন, “ছেলের গোঁ, হয় একে বিয়ে করব, নয় বিয়েই করব না,” তাই আমাকে মেনে নেওয়া! একটা যুদ্ধ আমার চলছিলই। আমার সিএ পার হওয়া। রাজর্ষির এই দিকটা আমি আরও একটা যুদ্ধ হিসেবে নিতে চাই। তুমি বলবে দুটো যুদ্ধ, আমি বলব, দুটো যুদ্ধ আর আলাদা নয়। সবচেয়ে সোজা রাস্তা যুদ্ধ ছেড়ে পলায়ন, কিন্তু আমি এত সহজে হার মেনে নেব জিতুদিদি? ও হয়তো এই সাময়িক বিকার থেকে পুরোই পাগল হয়ে যাবে যদি আমি ওকে ছেড়ে যাই। কত প্রতিভা ওর বলো! একজন বিজ্ঞান গবেষক! কত মেধাবী! এমন একটা মানুষকে ফেলে পালাতে পারব না জিতুদিদি। তুমি শুধু আমাকে বলো, আমি কী করব।

জিতু: লম্বা এবং কঠিন ধৈর্যের কাজ দেবু।

দেবু: প্রেম মানুষকে অদৃশ্য শক্তি দেয় না জিতুদিদি? শক্ত করে বেঁধে ফেলে না? প্রেমের জন্য, স্নেহ-ভালবাসার জন্য, কী না করে লোকে! আমারও তো এমন হতে পারে? তুমি আমার চিকিৎসা করবে না? সারাবে না আমায়?

জিতু: তুই ওর সঙ্গে যতখানি সম্ভব স্বাভাবিক ব্যবহার কর। কাজটা কঠিন। তোর ভয় করবে। অপমানিত লাগবে। রাগ-অভিমান হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তুই একজন রোগীর সঙ্গে আছিস। কাল তোদের প্রথম দিন ছিল। এর আগে একসঙ্গে ঘুমিয়েছিস কিন্তু যৌন সম্পর্ক তৈরি হয়নি, তখন সে স্বাভাবিক ছিল। তুই যা অনুমান করছিস, এই বিকার যেখান থেকে আসছে, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে গেলে তোকে আবার সেই সম্পর্কে যেতে হবে। তোর পক্ষে প্রায় অসম্ভব একটা কাজ। কিন্তু তুই ছাড়া আর এ ভূমিকা কেউ নিতে পারে না। হতে পারে, দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার, প্রত্যেকবার সে এমন করল। আবার কখনও স্বাভাবিক, কখনও বিকারগ্রস্ত, এমনও সম্ভব। ওর বিকারগ্রস্ত অবস্থায় তোকে যেমন বলবে, তেমনটাই করবি। লক্ষ কর, সে বেল্ট আছড়ে ভয় দেখিয়েছে, তোকে মারেনি। তার মানে কোথাও একটা সচেতনতাও ছিল। কিন্তু ও নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল। সকালে জিজ্ঞেস করেছে কোনও ভুল করেছে কি না। মনখারাপ করে শুয়ে ছিল। অর্থাৎ, বিকার সম্বন্ধে সামান্য হলেও সে অবগত এবং তোকে আঘাত করতে চায় না!

দেবু: কী অদ্ভূত আমার ভূমিকা ভাব। প্রথমে রমণ, চুম্বন, তুঙ্গ সুখের শীৎকার! এবং তখন আমি জানছি, আমাকে কান ধরে ওঠ-বোস করতে হবে, প্রায় ন্যাংটো হয়ে, খোলা আলোর তলায়!

জিতু: কঠিন! অত্যন্ত কঠিন! কিন্তু যদি মনে করিস এটাই ওষুধ, এটাই চিকিৎসার পথ, দেখবি, অত কঠিন মনে হবে না। প্রথমে তোকে বিশ্বাস করতে হবে, তুই ওকে ভালবাসিস, ও তোকে ভালবাসে এবং তুই ওকে সুস্থ করে তুলতে চাস।

দেবু: বলো, আর কী করতে হবে!

জিতু: এর পুনরাবৃত্তি হলে, যখন ও সুস্থ থাকবে, ওকে বলতে হবে, স্বীকার করাতে হবে। যদি স্বীকার না করে, ওকে মনোবিদের কাছে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে হবে।

দেবু: ও সেরে উঠবে তো জিতুদিদি?

জিতু: দেবু, তুই আমার কতখানি, তুই জানিস না? এসব শুনে আমার যে বুক ফেটে যাচ্ছে রে! কিন্তু আমি মনের চিকিৎসক। মনস্তত্ত্বের গবেষক। আমিও হাল ছাড়ব না। মা সরস্বতীর যতটুকু কৃপা আছে, তার সর্বস্ব দিয়ে রাজর্ষিকে সারিয়ে তুলব দেখিস। রাজর্ষি বুদ্ধিমান, হৃদয়বান, শিক্ষিত। আমার ধারণা ও সহযোগিতা করবে। ভেঙে পড়িস না। সাবধানে থাকিস। আমাকে যে-কোনও সময় ফোন করবি। দরকার হলেই।

ঘরে ফিরে এল দেবু। রাজর্ষি দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। সারা বাড়ি অন্ধকার। দেবু কণ্ঠস্বর সাধ্যমতো স্বাভাবিক করে বলল, “এ কী! আলো জ্বালোনি কেন?”

রাজ: এমনি।

দেবু: খেয়েছ কিছু, দুপুরে?

রাজ: না।

দেবু: কিছু খাওনি?

রাজ: না।

দেবু: কেন?

রাজ: আমার কিছু ভাল লাগছে না।

দেবু: কেন?

রাজ: আমার ভীষণ ভয় করছে।

দেবু: কেন?

রাজ: তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে! অ্যাঁ? দেবাদৃতা? চলে যাবে?

দেবু: কেন যাব বলে তোমার মনে হয়?

রাজ: আমি জানি না!

মাটিতে বসে দেবাদৃতার পা দু’টি জড়িয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে হাউহাউ করে কাঁদছে রাজর্ষি দাশগুপ্ত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক গবেষক, “তুমি আমায় ছেড়ে গেলে আমি পাগল হয়ে যাব! বিশ্বাস করো, আমার এমন কখনও হয়নি! আমি তোমাকে প্রতারণা করিনি দেবু!”

দেবু: কী কখনও হয়নি? কিসের প্রতারণা?

রাজ: আমি সারা দিনে এক পাতা পড়তে পারিনি!

দেবু: কী করলে সারা দিন? না পড়তে পারার সঙ্গে প্রতারণার সম্পর্ক কী?

রাজ: শুধু তোমাকে ভেবেছি। শুধু ভাবছি তুমি চলে গেলে আমি সহ্য করতে পারব না। পাগল হয়ে যাব। নয়তো বাবার মতো আমিও…

দেবু: ওঠো রাজর্ষি। আমার দিকে তাকাও। কেন তোমার মনে হচ্ছে আমি তোমাকে ছেড়ে যাব? কাল পর্যন্ত মনে হয়নি তো?

রাজ: আমি জানি না। আমার ভয় করছে।

দেবু: আমাকে ভালবাস তুমি?

রাজ: খুব সোনা। সোনা বিশ্বাস করো, তুমি আসার পর আমার জীবনের আকাঙ্ক্ষা সঞ্জীবিত হয়েছে। আমি সত্যি তোমাকে ছাড়া পাগল হয়ে যাব।

দেবু: আমিও তোমাকে ভালবাসি যে রাজর্ষি। আমি কখনও তোমায় ছেড়ে যাব না।

রাজ: যাবে না তো? আমি ভুল করলে মাপ করে দেবে?

দেবু: তা হলে আমার কথা শুনতে হবে তোমাকে।

রাজ: সব, সব শুনব। বলো কী বলবে!

দেবু: চলো, আগে স্নান করি, খাই, তারপর আমরা কথা বলব, কেমন?

বাধ্য শিশুর মতো মাথা নাড়ল রাজর্ষি। শিশু যেমন মায়ের শাসনের কাছে নত হয়, ঠিক তেমনই!

ঘরের বাতি জ্বালা রইল। হু হু হাওয়ায় উড়তে থাকা পরদা ভেদ করে কোন সুদূর থেকে ফুলের গন্ধ ভেসে আসতে লাগল। দেবাদৃতা দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসল। রাজর্ষি বালিশ টেনে তার পিঠে গুঁজে দিল। নিজে অপর বালিশ নিয়ে দেবুর কোল ঘেঁষে শুয়ে বলল, “এবার বলো।”

দেবু: হুঁ!

রাজ: বলো সোনা!

দেবু: কাল প্রথম আমরা শারীরিক সম্পর্কে প্রবেশ করেছি। এ আমার প্রথম অভিজ্ঞতা।

রাজ: আমারও সোনা।

দেবু: সব হয়ে যাওয়ার পর তুমি কী করেছ?

রাজ: ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। সকালে দেখি তুমি পাশে নেই। সোফায় শুয়ে আছ।

দেবু: তুমি ঘুমিয়ে পড়োনি। মনে করো রাজর্ষি!

রাজ: ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।

দেবু: তাই? আচ্ছা, দ্যাখো তো, আমি একটা কাজ করছি, তোমার কিছু মনে পড়ে কি না!

সে শয্যা থেকে নেমে স্নানঘরের সামনে, ঠিক কাল যেখানে ছিল, সেখানে দাঁড়িয়ে কান ধরে ওঠ-বোস করতে লাগল!

রাজর্ষি চিৎকার করে উঠল, “এসব কী করছ? দেবু! বন্ধ করো! বন্ধ করো!”

দেবু: তুমি কাল আমায় এভাবে শাস্তি দিয়েছ রাজর্ষি।

রাজ: অসম্ভব!

দেবু: এই দ্যাখো তোমার বেল্ট! এটা দিয়ে আমায় চাবুক-পেটা করেছ।

রাজ: না, না, আমি মারিনি। তোমাকে মারিনি। তোমাকে মারতে পারি না। আমাকে মারত। মেরে পিঠ ফাটিয়ে দিত! আমার সোনা। ও সোনা, ও সোনা, আমাকে এটা দুঃস্বপ্ন দেখায়। ভেতরটা কুড়ে খায়! আমার কী ভীষণ কষ্ট সোনা!

রাজর্ষি কাঁদছে। আগলভাঙা কান্না! কিন্তু দেবু ওই কান্নায় আশ্বস্ত হচ্ছে! সে যে এত তাড়াতাড়ি রাজর্ষিকে স্বীকার করিয়ে নিতে পারবে, ভাবেনি। এবারে তারা চিকিৎসা শুরু করতে পারবে। দেবাদৃতা তার কাছে গেল। মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগল, “তোমার মনে পড়ছে তো? কী হয়েছিল আমায় বলো।”

“সে খুব নোংরা! জঘন্য!”

“তবু বলো।”

“আমাকে ঘেন্না করবে!”

“ঘেন্না করব না। বলো তুমি। সোনা, সোনা আমার, যাই হোক না কেন, সেটা তোমার মনে একটা অসুখ বাধিয়েছে। তুমি সেটা মানছ?”

“আমি ইচ্ছে করে করিনি। আমার হয়ে গেল। আগে এরকম হয়নি। আমি যে তোমাকেই প্রথম আদর করলাম। তুমিই যে আমার জীবনে একমাত্র নারী। তুমিই যে একমাত্র বন্ধু। আমি তোমাকে রোগ লুকিয়ে বিয়ে করিনি।”

“আমি তোমাকে বিশ্বাস করি। তোমাকে সারিয়ে তুলতে চাই। তার জন্য তোমার সহযোগিতা চাই। তুমি মনোবিদের কাছে যাবে বলো?”

“জিতুদিদির কাছে?”

“আমি তাই বলব।”

“তোমার বাড়িতে সবাই জেনে যাবে!”

“কেউ জানবে না। এমনকী, শানু বা মনোময়দাও নয়।”

“আমি জিতুদিদির কাছে যাব। তা হলে আমায় ছেড়ে যাবে না তো?”

“যাব না। এবার বলো তো সোনা, আমার সোনাবাবু, কী হয়েছিল! কী সেই ঘটনা?”

প্রথমবার যখন রাজর্ষি দেবাদৃতাকে ‘সোনা’ বলেছিল, সে শুনে হেসে উঠেছিল, “তুমি আমায় সোনা বললে!” জিজ্ঞেস করেছিল সে! সেই আদরবিগলিত সোনা কখন তারও সম্বোধন হয়ে উঠেছে!

এক নর ও এক নারী পরস্পর ঘন হলে, সেই সম্পর্ক জীবনের স্নেহ-প্রেম-ভালবাসার আধার হয়ে যায়। সময় এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে স্ত্রী মায়ের মতোই পরম আদর দিতে পারে। দিতে পারে বান্ধবীর আশ্রয়, বোনের সহানুভূতি। কখনও পুরুষ নেয় পিতার ভূমিকা, কখনও সে প্রিয়সখাও বটে!

অন্তরতম প্রকোষ্ঠে থাকে যে-আদরপিপাসু শিশু, প্রেমের নিবিড় কোলে, সে-ও পূর্ণ সমর্পণ চায়। অহং সেই পথে অন্তরায়। তা অতিক্রম করতে না পারলে বুভুক্ষু ইচ্ছের বিকার হয় ক্রমশ জটিল ও কঠিন!

এই মুহূর্তে দেবাদৃতা মাতৃত্বময়ী। যে-স্নেহে সন্তানকে স্তন্য দিতে বুকে টেনে নেয় মা, তেমনই রাজর্ষিকে আকর্ষণ করল সে। এসো, আমার কাছে এসো। আমাকে বলো। বলো সোনা। বলো, বলো, মন উজাড় করে দাও। কিছু লুকিয়ো না। আমি ছেড়ে যাব না। আমি যাব না।

মাতৃত্ব এক বোধ। প্রেম এক বোধ। ভালবাসা এক উপলব্ধি। প্রিয় হওয়ার জন্য যেমন প্রসাধন মূল্যহীন, তেমনই স্নেহপ্রেমের জন্য রক্তনিবিড় সম্পর্ক অপরিহার্য নয়।

দেবুর কোলে মাথা রেখে, মুখ গুঁজে সর্বস্ব উজাড় করে কেঁদে নিচ্ছে রাজর্ষি। কান্না এক উপশম। কোন অবৈজ্ঞানিক সংস্কারে পুরুষেরা তাকে অপ্রকাশ রাখতে চায়?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *