০৩. পাগলাস্যারের সন্ধানে

পাগলাস্যারের সন্ধানে

শুভায়ন ভুল বলেছিল। পাগলাস্যারের বাড়ি সোনারপুর নয়। সুভাষগ্রাম। পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্য তারা এতই মরিয়া যে, যে-কোনও অজ গাঁয়ে, যে-কোনও পাগল পণ্ডিতের দ্বারস্থ হতেও তাদের আপত্তি নেই। অসীম অন্ধকারে এক চিলতে আলো খোঁজার দশা তাদের।

বালিগঞ্জ স্টেশন থেকে ট্রেনে চেপে সুভাষগ্রাম। স্টেশনে নেমে তারা একটা ভ্যানরিকশায় চাপল। যেতে হবে অসীমচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ি।

তারা যখন অসীমচন্দ্র চৌধুরী ও চৌধুরীবাগানের ঠিকানা বলল, ভ্যানওয়ালা মহা বিরক্ত হয়ে বলল, ‘‘জমিদার বাড়ি যাবেন বললেই হয়!”

পাগলাস্যারের খোঁজে বেরিয়ে পড়া তাদের পক্ষে প্রায় অভিযান একরকম! সিএ পরীক্ষার ফল বেরনোর পর শোকবিহ্বল হয়ে থাকার জন্য বিশেষ সময় বাঁচে না। পরবর্তী পরীক্ষার দিন গোনা শুরু হয়ে যায়। অলি পাবে বসে, ভদকার গ্লাস আর কড়া করে ভাজা চিকেন ও চিনেবাদাম নিয়ে বিশেষ হা-হুতাশ না করে পাগলাস্যারের কাছে পড়বে কি না এই নিয়ে আলোচনা করছিল। সায়ন বলেছিল, “আমি তোদের মধ্যে সবচেয়ে পুরনো পাপী। এই নিয়ে সাড়ে সতেরো বার।”

দীপ: ঢপ মারিস না, ঢপ মারিস না। ভাজা মোরগ ডেকে উঠবে!

সায়ন: এখনও তোদের মজা আসে কী করে রে!

রূপ: ভদকা! ভদকা!

শুভ: সায়নের বাবা বলেছে, আর দুটো টার্ম খরচ জোগাবে। তারপর বইখাতা, কোচিং ফি তো দেবেই না, পুজোয় কাপড়-জামাও দেবে না!

সায়ন: মা আর দিদি মধ্যস্থতা করে গেঞ্জি-জাঙিয়াটা পাইয়ে দেবে বলেছে!

দীপ: ভাগ্যিস আমার বাপের কাপড়ের ব্যাবসা!

রূপ: সে তো শাড়ির!

দীপ: লজ্জা নিবারণ তো হবে! ইন ফ্যাক্ট, বাপ বলল, অনেক পড়েছ, এবার দোকানে বসা শুরু করো। তাঁতির পোলায় আবার ছিএ ফিএ পড়ে কিয়ের লিগা? অহনও তো ছিল্কের রকম শিখলা না। ছিএ-র কী বুঝবা? তাঁইতের মর্ম বুজলা না! পদে পদে ঠকবা! তাঁতিকুলও যাইব, তোমার বৈষ্ণব কুলও যাইব। তাঁইতগড়ে ডুইব্যা মরবা। আর কত অর্থ ধ্বংস করবা? আমি বললাম, এই শেষ। করেঙ্গে ইয়া মরেঙ্গে! আর ভাল্লাগছে না! বুইড়া ভাম হইয়া গ্যালাম! দ্যাখ ভাই, এই মে মাসে বসব, পাশ করলে ভাল, না করলে আরও ভাল, স্রেফ শাড়ি বেচে আর বউয়ের শাড়ি খুলে জীবন কাটিয়ে দেব।

শুভ: আমার বাবা মাকে বলেছে, ও কি সত্যি আমার ছেলে? এতটা গবেট সন্তানের পিতা আমিই?

সব্বাই: হা হা হা! হো হো হো!

দেবু নিঃশব্দে হাসল। বন্ধুরা সহমর্মী, সমব্যথী! সকলেই তারা দুঃখী, বিরক্ত, বিপন্ন। এই মুহূর্তে ভদকায় চুমুক আর পরস্পরের সঙ্গ তাদের উপশম। তারা সকলেই যৎসামান্য রোজগার করে। কিন্তু তাদের বইপত্রের এত দাম, এবং প্রতিবার কিছু কিনতেই হয়! বিশেষ করে কর, মাশুল, আইন, বাণিজ্যিক সংস্থা সংক্রান্ত নিয়মকানুন এতই পরিবর্তনশীল যে, বই না কিনে উপায় নেই। তদুপরি তাদের চাই অধিশিক্ষা, যাকে বলে কোচিং। তাদের ক্ষেত্রটি পুরোপুরি অধিশিক্ষা নির্ভর এবং তা দুর্মূল্য! বাড়ির সহায়তা না পেলে ব্যয় বহন করা যায় না। বারংবার ফেল করে সেই টাকা হাত পেতে নিতে প্রত্যেকেরই গ্লানিবোধ হয়। তারা সকলেই মধ্য বা উচ্চবিত্ত। পরিবার এই আশা নিয়ে খরচ জোগায় যে-অর্থ ব্যয়িত হচ্ছে, একদিন তার অনেক বেশি ফিরে আসবে। সন্তান ভবিষ্যতের আমানত। কেউ সন্তানের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা ভেবেই ব্যয় করে। যেমন দেবু, শুভায়ন বা দীপংকরের পরিবার! দরিদ্রের পক্ষে এত ব্যয়সাধ্য এবং দীর্ঘমেয়াদি বিষয় নিয়ে পড়া খুবই অসুবিধেজনক!

অলি পাবে অধিকাংশ পানবিলাসীই শান্তিপ্রিয়! হয়তো জীবনের বহু অশান্তি ভুলতে তারা একান্ত শান্তিতে পান করতে চায়। চারটি ছেলে ও একটি মেয়ের পানদৃশ্য, নিরন্তর কথা ও হাসির শব্দে অনেকেই বিরক্তভাবে এই টেবিলের দিকে তাকাল। সম্ভবত, তাদের এই আপাত হাসির লহর এবং অবিরাম কথোপকথন তারা ঈর্ষা অথবা ক্ষমাময় তাচ্ছিল্যের সঙ্গে দেখছিল। কথা তারা যা-ই বলুক, চলছিল নিচু স্বরে। কাউকে বিরক্ত করার মতো মানসিক গঠনও তাদের নয়। কিন্তু চার যুবক একযোগে হাসলে শব্দ হবেই। যারা তাদের জানে না তাদের পক্ষে, এই অল্প বয়সের ক্ষতবিক্ষত স্বপ্ন ও বিফলতার গ্লানি যে কী যন্ত্রণার, তা অনুমান করা শক্ত। তাই যারা জীবনযুদ্ধে জর্জরিত, কিংবা বেদনাবিদ্ধ, তাদের কেউ কেউ এই বয়স, স্বাধীন স্বতঃস্ফূর্ত হাসি-কথা এবং মদ্যপানের উপভোগ্যতা জনিত সাহসকে ঈর্ষা ও নিন্দার চোখে দেখল। কেউ ভাবল, আহা, জীবন কত জটিল ও কড়া, এরা টের পায়নি। যখন দম ফুরিয়ে যাবে, স্ফূর্তি ও উল্লাসের পাত্র ওই পানপাত্রের মতোই খালি হয়ে যাবে!

কে কী ভাবছে, তা নিয়ে এই পাঁচজন ভাবিত ছিল না। শুভায়ন বলল, “দেবু, তোর বাড়িতে কী বলল?”

দেবু: বিয়ের প্রস্তাব!

শুভ: সর্বনাশ! পড়া বন্ধ?

দেবু: না। পড়ো। সময়মতো পাশ তো করছ না। বিয়েটা করো। তারপর পড়ো।

সায়ন: তোদের মেয়েদের এই এক সুবিধে। কিছু হচ্ছে না, বিয়ে দিয়ে দাও! আমাদের শালা বউ-বাচ্চা পোষার যোগ্যতা না হলে, বিয়ের নাম করলে পেঁদিয়ে বৃন্দাবন দেখিয়ে দেবে!

দেবু: কী মনে হয়? ব্যবস্থাটা খুব সম্মানজনক? বিয়েটা তো পেশা হতে পারে না! আমি পাশ করছি না! ওহে প্রতিষ্ঠিত শুনুন শুনুন! আমার পাকস্থলী পালুন, পুষুন!

সায়ন: আরে ধুর! মজাও বুঝিস না! তুই যাই বল আর তাই বল, চাকরি-বাকরি, প্রতিষ্ঠা, রোজগার– এসব নিয়ে মেয়েদের এখনও অত দুশ্চিন্তা নেই। তারা সুন্দরভাবে বরনির্ভরশীল হতে পারে!

রূপ: বাজে কথা ছাড় তো। সময় কম। তুই আগে বল, এই পাগলাস্যারের ব্যাপারটা কী!

সায়ন: বেশি কিছু জানি না। আমাকে এক মাসতুতো দাদা বলল। তিনি নাকি বলে বলে পাশ করিয়ে দেবেন! এতদিন কেন নাম শুনিনি, জানতে চাইলাম। বলল, আগে নাকি হায়ার ম্যাথামেটিক্স পড়াতেন। এখন অঙ্কের ছাত্র পান না। পয়সাও নেই। তাই বছর তিনেক হল সিএ ছাত্র পড়াচ্ছেন।

শুভ: এসব তো আগে বলিসনি! এ তো মিক্সড চাউমিন।

সায়ন: দেখ ভাই, আমি তোদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ! আমার কথা হল, সব জ্যোতিষী বারবার, অমৃতলাল একবার! সব কোচিং, সব স্যার চেখে দেখে নিয়েছি! একবার চ’ না! কথা তো বলি! আমরা তো নাদান না! দুটো ক্লাস করলেই বুঝতে পারব মাল কীরকম!

দেবু: আমি রাজি।

রাজি তো সকলেই। এ হল সেই খড়কুটোর গল্প, যা কিনা ডুবন্ত মানুষ আঁকড়ে ধরতে চায়!

আপাতত তারা ভ্যানরিকশার কাঠ আঁকড়ে বসে আছে। জানতে চাইছে কতদূর যেতে হবে। সামনে দু’জন চালকের দু’পাশে। পিছনে দু’জন পা ঝুলিয়ে। মাঝখানে এক অল্পবয়সি বউ, বাচ্চা কোলে, আর দেবু। খুব টেনেটুনে হলেও বউটির বয়স কুড়ির বেশি নয়। ত্বকে কম বয়সের নরম মসৃণতা। চোখ দু’টি ভীরু। বাচ্চা বুকে জড়িয়ে মাঝে-মাঝে কাঠ খামচে ধরে ঝাঁকুনি সামলাচ্ছে। যদি তারা এই পাগলাস্যারের কাছে পড়ে, এভাবেই যেতে হবে। কতদিন? কেউ জানে না!

ভ্যানওয়ালা বকবক করছে, “আগে ছিল জমিদার! এখন সেই রামও নেই, রাজত্বও নেই। সব ভাঙা, বুঝলেন। ভাঙাবাড়ি, ভাঙাহাট, মাথাপাগলা লোক। আম, পেয়ারা, জামরুল বাগান করে আর পড়ায়। আপনারা এই প্রথম? ছাত্র?”

মিনিট কুড়ি চলার পর বাচ্চা কোলে বউটি এক জায়গায় নেমে গেল। ভ্যানচালক তার ভাড়া নিল না। দীপংকর তার নাম জেনে নিয়েছে, জয়নাথ। এবার সে আত্মকাহিনি শুরু করল, “ওই যে নেমে গেল। ও সম্পর্কে আমার লাত-বৌ। আমার আপন দাদার লাতির বউ আর কী। দাদা পঞ্চায়েত করেন। জমিজমা সম্পত্তি অনেক।”

“আপনি পঞ্চায়েত করেন না?”

“না। সকলের দ্বারা সব হয় না। দাদা আমার শক্তিমান, সাহসী, তার কথায় লোকে ওঠে আর বসে। ঝান্ডা তুলে কলকাতায় লোক নে যায়, বলে লম্বা মিছিলে বড় নেতাগণের পাশে পাশে থাকে! সে এক কর্ম। লোক মজলিশ করা। আমি তেমনটি নইকো। মা যদ্দিন বেঁচ্যে ছিল, বলত, তুমি বাবু একলাষেঁড়ে! আমার ধর্মে মতি। আমার ঘরে আমার নিজের হাতে গড়া মা সরস্বতী। মেটে ঘরে মাটির দেবী মা আমার। সকাল হতে সন্ধে ভ্যান চালাই। জমিজমা আমারও আছে। ছেলে দেখে। সন্ধ্যায় বসি গিয়ে মন্দিরে। স্নান সেরে মায়ের আরাধনা! সারেঙ্গি বাজাই। এক শাগরেদ আছে। অই আমারই মতো। বিষয়-আশয়ে মন নাই। তবলা বাজায়। যে-কোনও বাদ্য দাও, বাজিয়ে দেবে। খোল, পাখোয়াজ, ঢাক, ঢোল। আমাদের নাম উঠেছিল তো। কাগজে। বারুইপুরে থাকে, একজনা, কাগজের লোক। সে লিখেছিল। নির্জন সরস্বতী!”

“বাঃ! তা হলে তো বিখ্যাত লোক আপনি। ভ্যান চালান কেন?”

“কেন? রোজগার করি! পুরুষমানুষ, সুস্থ শরীর, বসে খাব কেন? গাঁয়েগঞ্জে লোকে বাদ্যবাজনা বোঝে না। কেউ-কেউ শিখতে আসে। ক’দিন পর ছেড়ে দেয়। সরস্বতীর সাধনা তো সহজ নয়। ঠিক কি না? এই যে আপনেরা শহর থেক্যে এতদূর আসেন! কেন? সরস্বতীর সাধনার জন্যই তো! আর বুঝলেন কিনা, ভ্যান চালানো হল স্বাধীন কাজ। ইচ্ছা হল বের হলাম, ইচ্ছা হল না, ওই দিনভর মায়ের সামনে বসে সরস্বতীর সাধনা করলাম। চাষবাসে তা হবার জো নেই! একদিন মাঠে না গেলেই মাটির অভিমান!”

“আর কত দূর, কাকা?”

“এসে গেছি খোকা। ওই যে বাঁক, তার পরেই। রাস্তা তো দেখছেন। শহরের মতো বাঁধানো তো নয়। কী আর বলব! নিজের দাদাই পঞ্চায়েত!”

প্রশ্নটা করেছিল শুভায়ন। খোকা শুনে সে বোকা হয়ে গেল। বন্ধুরা এবার তাকে খোকা বলেই ডাকবে। এর মধ্যেই সায়ন পিঠে টোকা মেরেছে। সে বলল, “আপনি আমায় খোকা বললেন কাকা? এরা হাসছে!”

“তোমরা তো খোকাই। আমার ছেলের বয়সি সব। তাকেও খোকা বলি! পঞ্চাশ ছুঁতে আর মাত্র ছ’বৎসর।”

দীপংকর বলল, “আমি তো বর্ধমানে আমাদের দেশের বাড়ি যাই, আমি লক্ষ করেছি, গ্রামের পঞ্চাশ আর শহরের পঞ্চাশে তফাত আছে।”

“তা হতি পারে খোকা। শহরে হল গে ঘড়ি মেপে চলা। আমাদের হল সুয্যি দেখে বলা। হিসাব আমরা বুঝিনে।”

সায়ন বলল, “পঞ্চাশ ছুঁতে আমাদেরও বেশি বাকি নেই।”

“না না! কী যে বলো! কচি ছেলে সব। ওই যে বাড়ি। যাও খোকারা। মা যাও। পড়ো গিয়ে। কর্মই সাধনা, কর্মই পরিচয়। মানুষের বিচার কী দিয়ে, না কর্ম দিয়ে। সে তুমি রাঁধো, বাসন মাজো আর বাঁশি বাজাও, কি রেল চালাও। যে কর্মটি করবে, মনপ্রাণ দিয়ে করবে। তবেই সরস্বতীর আশীর্বাদ পাবে। সাধনাই সরস্বতী। মা সন্তানকে বড় করে, সে-ও সাধনা! এই সেদিন তেলিপাড়ার মেয়ে-বউ সব একাট্টা হয়ে ভাটিখানা ভেঙে এল। কী, না বাপ-ভাই-স্বামী সব মদ খেয়ে উৎসন্নে যাচ্ছে, তাদের সুপথে ফেরাবে! এ-ও সাধনা! আমি একটু বেশি কথা বলি। লোকে রাগ করে।”

দেবু বলল, “আপনি অনেক মূল্যবান কথা বললেন। ভাল কথা। একদিন যাব আপনার সাধনপীঠ দেখতে।”

“সারেঙ্গি ভালবাস মা? গান সাধো?”

“শুনতে ভাল লাগে।”

“বেশ বেশ! তাই-বা কম কী!”

“কত দেব?”

“পাঁচ টাকা করে, পঁচিশ টাকা।”

“পঁচিশ টাকা?”

“বেশি না মা। আমি বেশি লিই না।”

প্রায় আধঘণ্টার পথ, পাঁচ টাকা! তাদের মনে হল, খুবই কম! তারা যখন ভ্যানে ওঠে, ভাড়া কত জিজ্ঞেস করেছিল। জয়নাথ গম্ভীর মুখে বলেছিলেন, “উঠে পড়েন। এখন আর অন্য ভ্যান নাই।”

তারা ভাড়া নিয়ে দরদস্তুর করার কথা ভাবেনি। যেহেতু অসীমচন্দ্রের সঙ্গে তাঁদের কোনও কথা হয়নি, কারণ তাঁর কোনও ফোন নম্বর পাওয়া যায়নি, তিনি কেমন, এই উদ্যোগ সফল হবে কি না, এতদূর এসে পড়ার সিদ্ধান্ত যুক্তিসঙ্গত কি না, এমন নানা ভাবনায় ব্যস্ত ছিল। পঁচিশ টাকা দিয়ে তারা পুরনো প্রাসাদের মুখোমুখি হল!

রবিবারের বেলা তিনটে। চারপাশ বড়ই নিঝুম। আশপাশে প্রতিটি বাড়িতেই এত গাছ যে, শ্যামল আঁধার তাদের মনের মধ্যেকার অজানিত উদ্বেগ বাড়িয়ে তুলল। তারা আদ্যন্ত শহুরে। গ্রামজীবনের ভাঙা পথ, নিবিড় সবুজ, নৈঃশব্দ্য, অ্যান্টেনাবিহীন বাসভবন এবং স্বল্পব্যয়ের নৈতিক জীবন সম্বন্ধে কোনও ধারণা নেই। তাদের সামনে আপাতত একটি উঁচু লোহার গেট লাগানো বাড়ি। ভাঙা ভাঙা ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। মূল বাড়িটি, যতদূর দেখা যায়, ভেঙে পড়া ইটের প্রাসাদ। লোহার ফটকটি বেশ নতুন, সেই তুলনায়। ইটের প্রাচীরের গায়ে ঝুলে আছে নানাবিধ লতা। ফটক থেকে বাড়ি পর্যন্ত বেশ দূরপথ। টুকরো টুকরো পাথর বিছানো। তারা গেট খুলে ঢুকে পড়ল। পথের দু’পাশে বাগান। নানাবিধ জবাগাছ। ফুল খুব কম। গাছপালা সম্পর্কে তাদের ধ্যানধারণা নেই। দেবু এটুকু জানে, শীতকালে জবা কম ফোটে।

কেউ কোনও কথা বলছে না। সামনের প্রাচীন ভগ্নপ্রাসাদ তাদের মনের ভগ্নদশার মতো প্রতীকী! এমন ধ্বংসস্তূপ থেকেই উঠে আসবে সাফল্য? নাকি সবই বিভ্রম! এতকাল সমস্ত অধিশিক্ষা-কেন্দ্রগুলি, তারা দেখেছে– ঝকঝকে, শিক্ষকেরা সপ্রতিভ, নিখুঁত ইংলিশ, ব্লেজ়ার, টাই অথবা মূল্যবান ও বিজ্ঞাপনদীপ্ত শার্ট-ট্রাউজ়ার ভূষিত। কারও গালে কখনও একদিনেরও বাসি দাড়ি দেখা যায় না! দুর্ভেদ্য সময়জ্ঞান! মাপা জ্ঞানদান এবং পারিশ্রমিক আদায়ে টইটম্বুর, নিবিড় ব্যালেন্স শিট!

এই প্রাচীন জমিদারি প্রাসাদের ভেঙে পড়া ইটের পাঁজায় এমনটা প্রত্যাশা হয় না। তা হলে কেমন?

পাথরে খুরখুর আওয়াজ তুলে তারা ভাঙাবাড়ির দিকে যেতে লাগল। আশ্চর্য হল এই দেখে যে, একটা ঝকঝকে মোটরবাইক! এই শ্যাওলাময় ইটের পাঁজায় সম্পূর্ণ বেমানান। দীপংকর ফিসফিস করে উঠল, “রয়াল এনফিল্ড। ফোর স্ট্রোক।”

সায়ন: তোরটা তো ইয়ামহা?

দীপ: হুঁ! মা চালাতেই দেয় না!

রূপ: ভালই করে। পেছনে একটা মেয়ে থাকলে বাইক চালিয়ে মস্তি! একা চালিয়ে কী করবি!

দীপ: মেয়ে? দূরদূর! ফেল করা পোঁদঘষা কেরানি সব, তার আবার মেয়ে চাই!

সায়ন: আমার মাঝে-মাঝে মনে হয়, আমি মাইরি মরে গিয়েছি! মেয়ে দেখলে ট্যাক্সের পেপার মনে পড়ে। বেশি সুন্দরী দেখলে কর্পোরেট ল আসে মাথায়! আর কিচ্ছু হয় না, বিশ্বাস কর।

শুভ: কারও হয় না! ব্রহ্মচারী হতে চাও তো সিএ পড়ো।

দেবু: বাজে না বকে ওঁকে ডাক। মেয়ে দেখলে তো হ্যাংলার মতো তাকিয়ে থাকিস।

রূপ: এই! তোর দিকে তাকাই?

শুভ: ও আবার মেয়ে নাকি? ও তো দেবু!

দেবু: তোদের সঙ্গে থাকলে আমারই মনে থাকে না আমি মেয়ে। তবে বাড়ি এবার মনে করিয়ে দিচ্ছে। ডাক না রে! আর ভাল্লাগছে না।

চারটি ছেলের মধ্যে সবচেয়ে সুদর্শন শুভায়ন। কিন্তু সে লাজুক। রূপম গাবলু-গুবলু মতো। মুখে চাপদাড়ি। কাঁধে কাপড়ের ঝোলা নিয়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে হেঁটে গেলে কফি হাউজ়ে ঘোরাঘুরি করা কবি মনে হয়! কিন্তু কবিতার সঙ্গে তার ক্ষীণতম সম্পর্ক নেই। সায়ন রোগা, রূপমের বিপরীত, অনেক কষ্টে নরম গোঁফদাড়ি গজিয়ে তুলতে পেরেছে, যেন মরুদেশে ঘাসের চাষ! মাকুন্দ বলে তাকে বালকোচিত দেখায়। এতবার ফেল করা এবং সর্বজ্যেষ্ঠ বলে মনে হয় না। তবে সে সপ্রতিভ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তরতরে হল দীপংকর! লম্বা-চওড়া, নিয়মিত ব্যায়াম করে, কালো কুচকুচে, বড় বড় চোখ। সৌন্দর্যে অনায়াসে শুভায়নকে টেক্কা দিতে পারত, কিন্তু এখনই তার চন্দ্রলুপ্তি ঘটেছে। দলে তাকে সবচেয়ে বয়স্ক দেখায়। তাদের প্রত্যেকের আদরের নাম আছে। দীপংকরের নাম জেঠুমণি। কণ্ঠস্বরও বাজখাঁই।

সে হঠাৎ হালুম হাঁক পাড়ল, “অসীমচন্দ্র চৌধুরী মহাশয় আছেন নাকি?”

“কে?”

দরজায় এক শ্যামল নির্মেদ যুবক। কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুল। রূপমের মতো দাড়ি। উচ্চতা ছ’ফুট হলেও হতে পারে। নীল জিনসের ওপর গেরুয়া পাঞ্জাবির ঝুল হাঁটু ছাড়িয়ে গিয়েছে। সম্ভবত, আস্তিন গোটানো স্বভাব। সে-কর্মটি করতে করতে সে আগন্তুক দলটির দিকে দৃক্‌পাত করল, কিন্তু প্রথমেই দেবাদৃতাকে দেখল না। একটি ছিপছিপে সুন্দর ধবধবে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির মেয়ে, লম্বা ঝুলের স্কার্ট ও টপ, লম্বা বিনুনি, কাঁধে চামড়ার বড় ফোলা ব্যাগসমেত, চারজন যুবকের সঙ্গে, চোখে না পড়ার কথা নয়। আসলে, চোখে পড়েছে বলেই দেখল না। একটু একটু করে, থেমে থেমে, সায়নের পর রূপম, রূপমের পর দীপংকর, দীপংকরের পর শুভায়ন হয়ে দেবুর দিকে চোখ। একপলকের তরে, এ কেমন দেখা হল অচেনা অজানা ভাঙা প্রাসাদদুয়ারে!

একটি পলক আর চোখ!

দেবু বুঝল না, তার হৃদ্‌যন্ত্র ধকধক করে উঠল কেন! কেন তার করতল এই শীতে স্বেদাপ্লুত হল! গলার ভিতর শুকনো খটখটে! সে দৃষ্টি সরিয়ে নিল। ব্যাগ থেকে জলের বোতল বের করে গলায় ঢালছে। ভাবছে, ইনি কে? অসীমচন্দ্র যেন না হন ঠাকুর! সহ্য হবে না! এত বিশাল, মদির, সুন্দর চক্ষু বাস্তবে হয়?

“স্যারকে খুঁজছেন?” কণ্ঠস্বর পুরুষোচিত, কিন্তু তার ঘন কালো চুল ও শ্মশ্রুগুম্ফের মতো ভারী নয়। এই দীর্ঘ, নির্মেদ অবয়বে সুন্দরতর! যেন কণ্ঠস্বরের লঘুতা তাকে সহজেই অন্তরঙ্গ করবে।

দীপংকর বলছে, “হ্যাঁ, মানে, অসীমচন্দ্র চৌধুরী কি আছেন?”

“তিনি স্নান করতে গিয়েছেন। একটু বসতে হবে।”

“আচ্ছা, আমরা বাইরে অপেক্ষা করছি। কতক্ষণ পরে আসব, বলুন?”

“বাইরে কোথায়?” অল্প হাসল সে। কালোর আড়ালে ঝকঝকে দাঁত! রূপম থুপথাপ মশা মারছিল। মশা তাকে একটু বেশিই কামড়ায়। তারা কিছু বলার আগেই লম্বা চুল ছেলেটি বলল, “খুব মশা। ভিতরে চলে আসুন। স্যার এখনই আসবেন।”

তারা লক্ষ করল বারান্দা। কাঠের লম্বা চেয়ার। দেখল, ছেলেটির খালি পা, বারান্দার একপাশে একজোড়া চটি। তারাও চটি খুলে ফেলল। ছেলেটিকে অনুসরণ করে যে ঘরে এল, এই প্রাক-বৈকালেই সেখানে অফুরন্ত অন্ধকার! তারা চোখ সইয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিল! ঘরখানি বিশাল তার আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। এখানে শীত বেশি। তাদের অল্প অল্প শীতল ভাব লাগছে। মেঝেটা ঠান্ডা। তারা এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। বসবে কোথায়!

“এ বাড়িতে চেয়ার-টেবিল নেই। মানে আছে, ব্যবহার করা হয় না। দক্ষিণ দিক, মানে আপনাদের বাম দিকে এগিয়ে যান, গালিচা পাতা আছে। আমি মোম জ্বেলে আনছি।”

“লোডশেডিং? আই মিন পাওয়ার কাট?”

“পাওয়ার কাট ইন আদার সেন্স! স্যার সম্প্রতি বিদ্যুৎ সংযোগ নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন।”

“কেন?”

“ওঁর দরকার হচ্ছে না, তাই,” সে চলে গেল।

রূপম গালিচায় থপাস করে বসে বলল, “এ জন্যই নাম পাগলাস্যার। সায়ন, এ কোথায় নিয়ে এলি রে!”

সায়ন: দুশশালা! আমি কি জেনেবুঝে এসেছি?

রূপ: মাইরি, আমার খুব সাপের ভয় জানিস, এসব জায়গায় খুব বিষাক্ত সাপ থাকে। তার ওপর বিদ্যুৎ নেই! চ’, পিঠটান দিই। আরও কত পাগলামি দেখব কে জানে!

দেবু: এত দূর এসে এত সহজে হাল ছেড়ে দিবি? এত সহজে হার মানবি রূপম? অন্তত কথা বলি, দেখি, বোঝার চেষ্টা করি! বিদ্যুৎ কেটে দেবার অন্য কারণও থাকতে পারে।

সায়ন: কী কারণ? অর্থাভাব?

দেবু: হতে তো পারে। আমরা তো কিছুই জানি না।

দীপ: চুপ কর। আসছে।

জ্বলন্ত মোম হাতে ঘরে এল যুবক। ঝকমকে মোমদান। অরণ্যদেবের খুলিগুহায় যেমন জ্বলে, সেরকম মোটা বাতি! তার কম্পিত সোনালি আলোয় গেরুয়া পাঞ্জাবি যুবককে অপার্থিব লাগছিল। সে যেন এ যুগের বা এ কালের কেউ নয়। হয়তো-বা অতীতের আলোকিত ধনাঢ্য জমিদারির নিজস্ব সন্তান। সে বলল, “মশার উপদ্রবে জানালা বন্ধ রাখতে হয়। ওঁর স্নান শেষ। উপাসনা করছেন। আসবেন এখনই।”

দীপ: আপনি কি ওঁর ছাত্র?

যুবক: নিশ্চয়ই। আমার নাম রাজর্ষি, রাজর্ষি দাশগুপ্ত।

দীপ: আপনি কি ইয়ে, মানে সিএ পড়েন?

যুবক: সিএ না। আমি ইয়ে পড়ি। (হাসল সে। স্নিগ্ধ মধুর হাসি।)

দীপ: মানে অঙ্ক?

যুবক: কেন, অঙ্ক কেন?

সায়ন: শুনেছিলাম উনি আগে অঙ্ক পড়াতেন।

যুবক: উনি অতিমানব! যে-কোনও বিষয় পড়িয়ে দিতে পারেন। আমি ফিজ়িক্সের। ওঁর কাছে দুই-ই পড়েছি। এখনও আসি মাঝে-মাঝে। স্যারের জ্ঞান ও পাণ্ডিত্য সমুদ্রের মতো। আপনারা যদি পড়তে এসে থাকেন, নিশ্চয়ই বুঝবেন।

মেঝেয় মোমদানি রেখে রাজর্ষি দাশগুপ্ত তাক থেকে একটি বই নিয়ে বসে পড়তে শুরু করে দিল। দেবু তাকিয়ে আছে। চোখ ফেরাতে পারছে না। মোমের আলো এখন স্থির। সে জানে না তার নাকে হিরেফুল চিকচিক করছে। ভারী নয়নাভিরাম। তার মনে হচ্ছে, অলৌকিক কোনও জগতে এসে পড়েছে! সামনের ওই রাজর্ষি হঠাৎ উধাও হয়ে যাবে!

ফিজ়িক্স! ফিজ়িক্স! পড়ায়, নাকি পড়ে!

কোথায় পড়ায়?

দেবাদৃতার মনের ভিতর থেকে প্রশ্নটি তুলে এনে পেশ করল শুভায়ন, “আপনি কি এখানে স্কুলে পড়ান?”

রাজর্ষি: না। আমি কলকাতায় কলেজে পড়াই। প্রায়ই স্যারের কাছে চলে আসি! ওঁর কাছে আমি চিরকালের ছাত্র। ওয়ান্স এ স্টুডেন্ট, ইজ় এ স্টুডেন্ট ফর এভার। আপনারা কি সবাই চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্সির ছাত্র?

শুভ: সবাই।

আবার নীরবতা। রাজর্ষি পড়ায় মন দিয়েছে। দেবাদৃতা কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছে না। জীবনে প্রথম কোনও যুবকের দিকে সে সাগ্রহে তাকাচ্ছে! প্রথম সে কৌতূহলী। বুকের ভিতর এক দ্রব আশঙ্কা কেমন বিহ্বলতা, উদ্বেগ, এমনকী অকারণ অভিমান মিশ্রিত অনুভব সঞ্চার করছে! এখানে সে এসেছে তার পড়ার খোঁজ নিতে। তা হলে এই চিত্তবিকলন কেন? সে নিজের উপর বিরক্ত হয়ে উঠল! ওই রাজর্ষি তো নিজের পড়া করছে ঠিক! কী সহজ ও স্বাভাবিক! যেন এমন মোমের আলোয়, ঠান্ডা মেঝের উপর বসে বসে পড়তেই সে স্বচ্ছন্দ। তার এই স্থিতধী প্রকৃতি যেন ভাল লাগছে না দেবুর। যেন রাজর্ষি বারবার দেবাদৃতা মেয়েটির দিকে দৃকপাত করলে, কৌতূহল প্রকাশ করলে, তার হৃদয় শান্ত হত। অথচ, এ-ও সে জানে, রাজর্ষি দাশগুপ্তর অতিকৌতূহল তাকে বিরক্ত ও বিব্রতই করত। এমনকী, সে বিরূপ হয়েও যেতে পারে। সে নিজেই নিজের মন বিষয়ে অসহায় বোধ করতে লাগল। এক অচেনা যুবকের প্রতি তার মন অধিকার বোধ করতে ইচ্ছুক যেন! এই অভিনব, অনাস্বাদিতপূর্ব বিচলিত দশায় সে নাকের হিরের ফুল নিয়ে খেলতে লাগল। এবার যদি সে সত্যিই কৌতূহলী হয়ে ওঠে? যদি প্রশ্ন করে তারা সিএ পাঠক্রমের ঠিক কোন জায়গায় আছে, কী বলবে সে? একটি বিশাল অতল গহ্বরের মুখে দড়ি কামড়ে ঝুলে আছে? দেখাচ্ছে ধৈর্য ও সংগ্রামের অদ্ভুত ট্রাপিজ়! এ খেলায় একটুও গৌরব নেই। হাততালি নেই। একদা তারা সকলেই ভাল ছাত্র ছিল, সেই বোধ কবেই লাট খাওয়া ঘুড়ির মতো গোঁত্তা খেয়ে গিয়েছে। এক অজানিত দরবারে এসে বসেছে, উদ্ধারের আশায়!

এক ফিজ়িক্স পাণ্ডিত্যের সঙ্গে তার বিবাহের প্রস্তাব এসেছে! তার নাম সে জানে না। তার কোনও কৌতূহল নেই। এই রাজর্ষি দাশগুপ্তকেই-বা সে হঠাৎ ভাবনার বিষয় করে তুলছে কেন? এ যদি জানতে চায়, সে বলবে। হ্যাঁ, নিশ্চয়ই বলে দেবে, সে ফেল করেছে পাঁচবার! লুকনোর কিছু নেই। কে তাকে কী মনে করল, মেধাবী ভাবল, না গবেট, কী এসে যায়?

মনে মনে, জোর করে ফিরিয়ে আনা অহংকারের সঙ্গে, বাহ্যত, সে অপলক তাকিয়ে ছিল রাজর্ষির দিকে। তার হিরের ফুল, আঙুলের তাড়নায় একটি প্যাঁচ-কষা স্ক্রুয়ের মতো ঘুরছিল নাসিকার নিভৃত গহ্বরে। হঠাৎ, বইয়ের পাতা থেকে চোখ তুলল রাজর্ষি। স্পষ্টই তাকাল সে দেবাদৃতার দিকে। কয়েক পল অপলক পরস্পর। গুরুগম্ভীরতায় সে বলল, “আপনাদের নাম জানা হয়নি।”

দীপংকর নাম বলতে যাচ্ছিল, তিনি প্রবেশ করলেন। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা, ভিজে চুল উলটে আঁচড়ানো, চওড়া কপাল, মোমের আলোতেও তাঁর গোলাপি ত্বক থেকে প্রভা ঠিকরোচ্ছে। সুদীর্ঘদেহী। দেবুর মনে হল, পুরনো সাদাকালো বাংলা ছবির পরদা থেকে নেমে এলেন বসন্ত চৌধুরী! সে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। তার সঙ্গে অন্যরাও। তাদের ধাঁধা লেগে গেল। এমন সৌম্যদর্শন, প্রশান্ত, মধুর ব্যক্তিকে কীভাবে পাগলাস্যার বলা যায়?

তিনি বললেন, “বসতে আজ্ঞা হয়।”

তারা বসে পড়ল। তিনি রাজর্ষির দিকে তাকিয়ে বললেন, “রাজা, আরও একখানা মোম জ্বালো। মুখগুলো দেখি। তুমিই ঠিক বলেছ। বিজলি ছাড়া চলে না। সব কোথা থেকে আসা হচ্ছে?”

“আ…আজ্ঞে… কলকাতা!”

“তবে? এই অন্ধকারে কি ভাল লাগে?”

রাজর্ষি: মেন সুইচ অন করে দিই স্যার?

স্যার: দেবে? দাও।

একটু পরে আলো জ্বলে উঠল। ভুতুড়ে ফিল্ম শেষ হয়ে যেন প্রেক্ষাগৃহের আলোকিত পরিসর। রূপম বলে উঠল, “বাবাঃ!”

স্যার: কী বাবা? আমি অসীমচন্দ্র চৌধুরী। কী প্রয়োজনে আসা হয়েছে? ফলের ব্যবসা? ফুলের ব্যবসা? নাকি পড়ার ব্যবসা?

তিনি মেঝেয় বসলেন। ঘরখানি ঝকঝকে। পুরনো পাথরের মেঝে। সাদা পাথরগুলোয় কালের হলদেটে ছোপ। ঘরের দেওয়ালে কাঠের তাক আর অজস্র বই!

দীপংকর বলল, “স্যার, আমরা খবর দিয়ে আসতে পারিনি বলে কিছু মনে করবেন না।”

স্যার: কীভাবে খবর দেবে? আমার ফোন-টোন নেই। রাজা, ওদের জন্য অন্নভোগ নিয়ে এসো। সুমা বাড়ছে।

দীপ: আমরা ভাত খাব না স্যার। বাড়ি থেকে খেয়ে এসেছি।

স্যার: সে তো আসবেই। বাপ-মা না খাইয়ে ছাড়ে? কিন্তু এ হল আমাদের আহারের সময়। আমরা একাহারী। গৃহে মা অন্নপূর্ণার ভোগ। অতিথি এলে, তারা খেলে পরে আমাদের খাওয়া।

এক-একটি কাঁসার থালায় নানাবিধ ফল, সুগন্ধী চালের ভাত, ছোট রেকাবে ঘ্যাঁট তরকারি, ছোট বাটিতে ডাল। একপাশে ঘি ও নিমপাতা ভাজা। মাটির ভাঁড়ে একটু পায়েস। বাকি বাসন সমস্তই কাঁসার।

থালাগুলি এমনই বিশাল যে, এত কিছু দিয়েও যথেষ্ট জায়গা থেকে গিয়েছে।

প্রতিবারে দু’টি করে থালা নিয়ে এল রাজর্ষি। মোট সাতটি থালা। অবশেষে অন্য একটি থালায় সাতখানি কাঁসার গ্লাসভর্তি জল!

তারা কথা না বাড়িয়ে দু’জন সদ্য পরিচিত লোকের সঙ্গে আহারে বসল। যাকে বলে পঙ্‌ক্তিভোজন! দেবুর ভাত স্পর্শ করতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তাদের হাত ময়লা। লোকাল ট্রেন এতই অপরিচ্ছন্ন যে, যারা দৈনন্দিন ব্যবহারে অভ্যস্ত নয়, তাদের পক্ষে উপচানো, দরজায় ঝুলন্ত, দুর্গন্ধ প্যাঁটরা সমেত জনপ্রাণীর গুমোট ও গায়ে গা লাগা ভিড়, ময়লা ও আবর্জনার স্তূপ থেকে উঠে আসা ভ্যাপসা গন্ধ, একরকম শাস্তির মতো। জীবনযাপনের মান এক নিদারুণ অভ্যাস। হঠাৎ তার অবনমন যেমন সয় না, উৎকর্ষও অসহনীয় হতে পারে। তার মনে হল, তারা সকলেই কীরকম ঘোরের মধ্যে রয়েছে। অসীমচন্দ্র এখনও তাদের নাম এবং আগমনের উদ্দেশ্য অবহিত নন। ফলের ব্যবসা, ফুলের ব্যবসা, পড়ার ব্যবসা! মানুষটি অদ্ভুত সন্দেহ নেই!

দেবুর ইতস্তত ভাব দেখে তিনি বলে উঠলেন, “মা, ওই দরজা দিয়ে যাও, সোজা এগিয়ে বাঁ দিকে যাবে। হাতমুখ ধোওয়ার ব্যবস্থা আছে। যাও। আমরা অপেক্ষা করব।”

দেবু উঠল। তার সঙ্গে শুভায়ন ও দীপংকর। প্রায়ান্ধকার অলিন্দ দিয়ে খানিক এগিয়ে বাঁয়ে ঘুরতেই নিঝুম আলোয় স্নানাগারটি দেখতে পেল তারা। বাইরে থেকে ভাঙাচোরা দেখালেও এই অংশটি বাসযোগ্য! স্নানাগারের পাশ দিয়ে দোতলায় যাওয়ার চওড়া সিঁড়ি। সব কিছুই জীর্ণ কিন্তু পরিচ্ছন্ন। দেবু স্নানাগারের দরজা বন্ধ করল! ঘরটি সুবিশাল এবং আধুনিক উপকরণে সাজানো। কোনও কিছুই নতুন নয়। কিন্তু বনেদিয়ানার মধ্যে আধুনিক সুব্যবস্থার মিশেল ঘটে যায়!

দেবু বেরিয়ে এসে বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল। শুভায়ন চাপা গলায় বলল, “কী বুঝলি?”

দীপংকর বলল, “ভাই, আমার বীভৎস লাগছে। যেন বাংলা থ্রিলার। তার মধ্যে লম্বা চুল আঁতেলটা আছে। ওই লম্বা চুল নিয়ে কলেজে পড়ায়, স্টুডেন্টরা আওয়াজ দেয় না? আমি এই পাঠশালায় নেই।”

দেবু অল্প হাসল। বলল, ‘‘ওই রাজর্ষি তো আমাদের সঙ্গে পড়বে না। আর এখনও পড়াটাই শুরু হয়নি। যে-কাজে এসেছি, সেটা আগে দেখি! এতদূর এসে এত সহজে পালিয়ে যাব?”

অসীমচন্দ্র আহারকালীন কথা বলেন না। নিঃশব্দে ও দ্রুততায় দিনের একমাত্র আহারটি সম্পন্ন করে তিনি সকলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন।

রাজর্ষির খেতে বেশ সময় লাগছে। কারণ, সে তার হাতের বইটি পড়তে পড়তে খাচ্ছে। দেবুর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল। ভাত আর ডাল তার খুবই সুস্বাদু মনে হয়েছে। ঘ্যাঁটে নুন ছিল না। তবু সে পরিষ্কার করে খেল। এই তার ধরন। সে সবেতেই বড় পরিষ্কার! সে বলল, “স্যার! এই থালা কোথায় রাখব?”

তিনি ইশারা করলেন, থাক। মুখ না ধুয়ে বাক্যোচ্চারণ করবেন না। দেবুকে স্পষ্টই কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখাল। তাদের বাড়ির নিয়ম অনুযায়ী এঁটো থালা তুলে বাসন মাজার গামলায় রেখে আসতে হয়। যাকে বলে সিঙ্ক। যদি কোনও কারণে গৃহপরিচারিকা অনুপস্থিত থাকে, তবে যে যার এঁটো থালা মেজে রাখে। তাদের অমিয়ামাসিকে কখনও কাজের বোঝা চাপানো হয় না!

রাজর্ষি এবার সরাসরি চাইল দেবুর দিকে। দেবু, আবারও, চোখ ফেরাতে পারল না! কী বিশাল, সুন্দর ও মায়াময়! এবং কী গোপন বেদনায় যেন লুকনো পুকুরের মতো সিক্ত, টলটলে! দুঃখী! তার বুকের মধ্যে সেই ব্যথিত দৃষ্টির জল সংবাহিত হতে লাগল। হয়তো এ সমস্তই বিভ্রম, সমস্ত কল্পনা, কিন্তু তার অনুভূতিসমূহ সত্য, নিজেরই কাছে অনস্বীকার্য!

রাজর্ষি বলল, “থালা স্যার তুলে নেবেন। এমনটাই নিয়ম!”

“এ মা! সে কী! ছি ছি! তা কী করে হয়!”

“অতিথিসেবা! যতদিন অতিথি ততদিন এমন। এ বাড়ির সদস্য হতে পারলে তখন নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে।”

“যেখানে হাত ধুতে গিয়েছিলাম, সেখানেই?”

“একেবারেই।”

রাজর্ষি আবার বইয়ে ডুবে গেল। একটু করে খাচ্ছে, কখনও হাত থালায়, কখনও কোলে আলগা করে রাখা! দেবু লক্ষ করল, খাওয়ার কোনও পারম্পর্য নেই। এই ভাত-ডাল খেল, এই হাতে ফলের টুকরো উঠল, তাই খেল। একবার ভাতের সঙ্গে আপেলের টুকরো মুখে পুরল! যেমন স্যার, তেমন ছাত্র! তারা এক অপরূপ ও মেধাবী পাগলাগারদে ঢুকে পড়েছে! দেবুর গতানুগতিক জীবনে এই সমস্তই কৌতূহলোদ্দীপক এবং একইসঙ্গে বিরক্তিকর ও মজাদার! শানু ও জিতুদিদির জন্য প্রচুর গল্প সে জমিয়ে তুলল মনে মনে।

তারা প্রত্যেকেই, বড় অসহায়ের মতো দেখল, সৌম্যকান্তি পাগলাস্যার সকলের এঁটো থালা তুললেন, রাজর্ষি তখনও খাচ্ছে, স্যার তার মাথায় একটু চাপড় মারলেন, তাগাদা দিলেন সম্ভবত। সে চমকে, ও হ্যাঁ, খাওয়াটা শেষ করি, বলে বই পাশে রেখে সমস্ত খাবার চটকে, দলা পাকিয়ে, গোগ্রাসে মুখে চালান করে চিবোতে চিবোতে এঁটো পাত তুলে স্যারকে অনুসরণ করল! হয়তো বাসন মাজতে সাহায্য করবে। কারণ, সে আভাসে বলেছে, সে এ বাড়িতে সদস্য সমান। দেবু তার সদ্য–আবিষ্কৃত গোপন অনুভব নিয়ে দেখল, রাজর্ষির দাড়িতে, গোঁফে খাদ্যকণা, এত বেশি মুখে পুরেছে যে গাল ফুলে আছে, যেন অনন্তকাল সে চিবিয়েই চলবে কেবল!

দেবু, দেবাদৃতা রায়, নিজেকে আবিষ্কার করতে লাগল প্রতি পলে! তার হৃদয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে ভ্রাতৃপ্রেমের মতো মায়া। যখন শানু তার কাছে আসে, আবদার করে, পিঠটা চুলকে দাও, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও, যখন সে হয়তো ডুবে আছে হিসাবশাস্ত্রের কোনও দুরূহ ধাঁধায় আর শানু তার যন্ত্রবিদ্যার হিমশিম বই নিয়ে এসে বলছে, সব জট পাকিয়ে যাচ্ছে, একটু কোলে শুই, তোমার কোলে শুলে বুদ্ধির জানালাগুলো খোলে– সে একইসঙ্গে তখন বিরক্ত ও নাচার! সে কোল পেতে দেয় বটে, দুরূহ প্রশ্নের পথ দিয়ে যেতে যেতে সুনিবিড় স্নেহে শানুর ঝাঁকড়া চুলে বিলি কাটে। শানু কখনও-বা ঘুমিয়েও পড়ে, বই হাত থেকে খসে পড়ে আদরে, আরামে! তার পায়ে ঝিনঝিন ধরে যায়, সে তবু নড়ে না, গভীর মায়ায় ছোট ভাইটির তৃপ্ত ঘুমন্ত মুখ তাকে অপূর্ব সুখের অনুভূতি দেয়। মায়া বড় সুন্দর। এখন সেই মায়ার অনুভব কেন হয় রাজর্ষিকে দেখে? এভাবে হৃদয় নিয়ে কখনও ভাবেনি সে। কখনও আলোড়িত হয়নি এমন! কখনও বোঝেনি, প্রেম একযোগে সর্বস্ব ধারণ করে। স্নেহ, বাৎসল্য, কাম, প্রেম এবং ভালবাসা পাওয়ার অতুল অপরিসীম যাচ্ঞা!

প্রেম!

এই শব্দটি তার মাথায় এল কেন?

হঠাৎ তার বিষম ক্রোধ জাগল! ক্রোধাগ্নি জ্বেলে বিশ্ব ছারখার করে দিতে চাইল সে! সে ক্রোধ-রিপুর বশ নয়! তবু, তার মনে হল, তার মনোজগতে অনাহুত বিধ্বংসী ঘূর্ণিঝড়ের মতো ঢুকে পড়েছে মা-কাম্মা-জেম্মার আনা বিবাহপ্রস্তাব! তা যদি না হত, রাজর্ষি দাশগুপ্ত ফিজ়িক্স পড়ায় শুনে তার ভেকলম্ফ দেওয়ার কোনও কারণই থাকত না।

কিন্তু ওই চোখ?

হ্যাঁ, অদ্ভুত আকর্ষণীয়, মায়াবী, দেবদুর্লভ দুই চক্ষু তার। রামায়ণের কবি বর্ণিত পদ্মদলনেত্র! যা সুন্দর, তা দেখার আগ্রহ হলে দোষ কী!

নিজেকে ব্যবচ্ছেদ করে সে একটি ব্যাখ্যাতীতের সম্মুখীন হল। এই জাতীয় অনুভূতি ও চিন্তা তার কাছে সদ্যোজাত। এবং একেবারেই অজ্ঞানতাপ্রসূত! কেন? কেন?

শুভায়ন তার হাতে টোকা দিল, ‘‘কী রে! কী ভাবছিস এত? টানাটানি করে নাকের ফুলটাই তো ছিঁড়ে নিবি মনে হচ্ছে।”

“পরে বলব।”

শুভায়ন কথা বাড়াল না। দীপংকর তার কেশবিরল মস্তকে হাত বুলোচ্ছে, সায়ন তার সাধ্যসাধিত গুম্ফরাজি অসফলভাবে পাকানোর চেষ্টায় আছে, রূপম নিজের নধর পেটটি টিপেটুপে দেখছে! বিচিত্র ঘটনা সমাবেশে এবং অজানিত ভবিষ্যৎ চিন্তায় সকলেই বিমূঢ় এবং অস্থিরচিত্ত! শুভায়নের মনে হল, অন্যদের তুলনায় সে-ই কিছুটা স্থির! কারণ, কোনও কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সে দেবাদৃতার উপর নির্ভর করে। একই সংস্থায় কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং সেই ষোলো বছর বয়স থেকে যোগেশচন্দ্র বিদ্যানিধি কলেজে পড়া বন্ধুত্বের কারণে দেবুকে সে নির্ভরযোগ্য ভাবতে শিখেছে! সে দেখেছে, দেবু শান্ত, বুদ্ধিমতী, অত্যন্ত মনোযোগী এবং একনিষ্ঠ। কোনও কাজ, যত কঠিনই হোক, সে হাল ছাড়ে না। আজ, পাগলাস্যার বিষয়ে দেবু যা স্থির করবে, শুভায়ন সেটাই মেনে নেবে। সে বসে বসে দাঁতে নখ কাটতে লাগল।

রাজর্ষিকে সঙ্গে নিয়ে অসীমচন্দ্র পাগলাস্যার পুনঃপ্রবেশ করলেন। তারা শুনল, রাজর্ষি বলছে, “স্যার, আমার এই অনুরোধ রাখুন। মেন অফ করে মোম জ্বালিয়ে থাকবেন না। পুরনো বাড়ি, কতরকম বিপদ হতে পারে! আমার আপনাদের জন্য চিন্তা হয় স্যার।”

স্যার: তুমি আমার সব কথা শোনো?

রাজ: নিশ্চয়ই স্যার! আপনার কথা অমান্য করি না। আপনি তো আমার পরমশ্রদ্ধেয়।

স্যার: এই যে মোটরবাইক হাঁকিয়ে এতদূর আসা হয়, তাতে যে আমি সায় দিতে পারি না! আমার চিন্তা হয়!

রাজ: খুব সাবধানে চালাই স্যার! আপনি নিশ্চিন্ত হোন। এই একটাই শৌখিনতা স্যার। দয়া করে নিষেধ করবেন না। অমান্য করতে পারব না, কিন্তু ভারী কষ্ট হবে!

স্যার: বাইক খুব গোলমেলে, খুব বিপজ্জনক। কত যে দুর্ঘটনা ঘটে!

রাজ: না স্যার! সাবধানে চালালে কোনও সমস্যা নেই। বিপদ আর দুর্ঘটনা তো সবসময়ই অপ্রত্যাশিতভাবে আসে। সবই আকস্মিকের খেলা স্যার! বিজ্ঞানের যত গভীরে যাই, ততই বিস্ময় এবং প্রশ্ন বাড়ে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, এমন নিখুঁত আঙ্কিক ভারসাম্যে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বস্তু থেকে অসীম মহাকাশ কে বানাল স্যার! এ কি আপনা-আপনি তৈরি হওয়া সম্ভব? অঙ্ক বা বিজ্ঞানের নতুন কোনও তত্ত্ব বা সূত্র যখন আবিষ্কৃত হয়, তখন আবিষ্কারক তার জন্য প্রশংসা পায়, কিন্তু সেই সূত্র জগতে ছিলই, কেউ খুঁজে পেল মাত্র! খনি থেকে হিরে পাওয়ার মতো। মানুষ কোনও মৌলিক উদ্ভাবন করে না। যা আছে তাকে বুঝতে পারে। সেটাই আবিষ্কার, না স্যার? আর আবিষ্কারও স্যার শেষপর্যন্ত এক আকস্মিকের খেলা! অনেক কথা বলে ফেললাম স্যার। আমার পেপার আপনার ফাইলে রেখে দিয়েছি। আপনি পড়ে বললে জার্নালে পাঠাব।

স্যার: শীঘ্র পড়ব। অত জটিল বিষয়, বুঝতে চেষ্টা করব। কোথায় যেন পাঠাবে বললে? আজকাল অনেক কিছু ভুলে যাই।

রাজ: আপনার কাছে কিছুই জটিল নয় স্যার। জার্নালটি হল ‘দি ইউনিভার্স অ্যান্ড দি ইনফিনিটি’। আমি এবার আসি স্যার। এঁরা অনেকক্ষণ বসে আছেন। এই বইটির কিছুটা বাকি আছে। নিয়ে যাই স্যার?

স্যার: এসো। আমার বইগুলোর জন্য দাশগুপ্ত পুস্তকালয়ে তাগাদা দেবে।

রাজ: নিশ্চয়ই স্যার!

দেবু ও তার বন্ধুরা প্রস্তরবৎ এই বাক্যালাপ শুনছিল। রাজর্ষি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসল। হাত নাড়ল। এবং একটু বেশিক্ষণ, হয়তো কয়েক ভগ্ন পল, দেবাদৃতার চোখে দৃষ্টি স্থাপন করে রইল। অনিমেষ ও বাঙ্ময়! হয়, হয়, এভাবেও হৃদয়ে হৃদয়ে এক সেতু সমন্বয়!

সে চলে গেল। স্যার বারান্দায় দাঁড়ালেন। মোটরবাইক এনফিল্ড যেন ইচ্ছাহীন বিদায়ের যন্ত্রণাকাতর ধ্বনি তুলে, ছোট ছোট নুড়ি-ফেলা পথ বেয়ে যেতে লাগল! অসীমচন্দ্র চৌধুরী স্যার ফিরে এসে বসলেন তাদের মুখোমুখি। বললেন, “আগমনের হেতু কী?”

দীপ: আমরা সিএ স্টুডেন্ট স্যার। ইন্টার পাশ করেছি।

স্যার: তারপর আটকে যাওয়া হয়েছে?

দীপ: এবারও স্যার ফলাফল খারাপ। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না। একজন আপনার কথা বলল।

স্যার: কে বলল?

সায়ন: আমার এক মাসতুতো দাদা স্যার। সে কার কাছে শুনেছে, জানি না।

স্যার: সে আর কী বলেছে?

সায়ন: এই স্যার, আপনি খুব ভাল পড়ান এবং খুব জোর তিনবারের মধ্যে নিশ্চিতভাবে পাশ করিয়ে দেন।

স্যার: ওসব গপ্পোকথায় বিশ্বাস হয়? কে কে এই গপ্পে আস্থা রাখে, কে কে রাখে না!

দীপ: আমরা সবাই রাখি স্যার। আমাদের সকলেরই প্রফেসর শঙ্কুর মিরাকিউরল বড়ি দরকার!

দেবু: আমি একটু অন্যভাবে বলব স্যার?

স্যার: বলো মা!

দেবু: আস্থা অন্যভাবে তৈরি হয় স্যার। গুজব শুনে হয় না। রটনা বা গুজবে শুধু কৌতূহল বাড়ে। পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছে হয়। তবে আমরা আস্থা রাখব, এই মন নিয়ে এসেছিলাম। ভেবে দেখুন স্যার, আমরা আপনার সম্পর্কে শুধু কয়েকটি কথা শুনেছি। চলে এসেছি। আমি সত্যি কথাই বলি, কেউ কাউকে পাশ করিয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দিতে পারে না। এমনকী, পরীক্ষার প্রশ্ন জানা থাকলেও পারে না, কারণ শেষপর্যন্ত পরীক্ষার্থী কী লিখবে বা আদৌ কিছু লিখবে কি না, তা কেউ জানে না।

স্যার: তবে আসা কী জন্য?

দেবু: হয়তো আমাদের অনুশীলনে কোনও ত্রুটি আছে, যা আমরা ধরতে পারছি না। যেখানেই কোচিং নিয়েছি, শিক্ষকেরা দক্ষতার সঙ্গে পড়িয়েছেন। কেউ ফাঁকি দেননি। আমরাও দিই না। তবু কেন আমরা সফল ছাত্রের তালিকায় পড়ছি না?

স্যার: বেশ। এবার আমি আমার কথা বলি। আমি অর্থলোভে পড়াই না। শিক্ষকতা করতে ভালবাসি বলে পড়াই। কিন্তু বিনা দক্ষিণায় শিক্ষকতা করি না। এ আমার পেশা। তবে আমি পেশার দাসত্ব করি না। ছাত্র যদি আমার কথা না শোনে, যতই দক্ষিণা পেয়ে থাকি না কেন, তাকে আমি বিদেয় করে দিই। আমার কাছে পড়তে গেলে তিনটি মূল বিষয় মনে রাখতে হবে। এক, সময়ানুবর্তিতা, দুই, নিয়মানুগ উপস্থিতি, তিন, আমার নির্দেশ মান্য করা। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, ছাত্রদের একদল, যারা আমায় বেশিদিন সইতে পারে না, ছেড়ে যায়। আর-একদল, সংখ্যায় তারা অল্প, তারা আমার সন্তানের স্থান নেয়। এ আমার বড় আনন্দ যে, আমার কৃতী সন্তানেরা দেশে-বিদেশে আছে। অর্থমূল্যে তো শিক্ষার দান-প্রতিদান হয় না কচিবাবুরা। তাই কৃতী সন্তানদের কাছে আমার একটাই প্রার্থনা। বাবা, মরলে এসে একটু কাঁধ দিস। এবার আমি জানতে চাইব, তোমরা কে কী করো। তোমাদের আর্টিক‌লশিপের ন্যূনতম সময়সীমা অতিক্রম করা কারও বাকি আছে কি না।

রূপম: আমরা সবাই ক্লার্কশিপ সম্পূর্ণ করেছি। কিন্তু এখনও কাজ করছি। আমি রূপম আর ওই সায়ন, আমরা এক সংস্থায়। ওই দীপংকর আলাদা ফার্মে। দেবু মানে দেবাদৃতা আর শুভায়ন এক কোম্পানিতে।

স্যার: সংস্থা, ফার্ম এবং কোম্পানি! বেশ। পরবর্তী পরীক্ষায় কবে বসবে বলে ঠিক করা হয়েছে?

দীপ: মে মাসেই স্যার!

স্যার: সর্ববিষয় একই সঙ্গে পরীক্ষা দেওয়া হবে?

দীপ: আমি তাই দেব স্যার।

স্যার: আমার প্রথম শর্ত, চাকরি ছাড়তে হবে। দ্বিতীয় শর্ত, সোম থেকে শুক্র, পাঁচদিন দশটা থেকে পাঁচটা পড়াব। মাঝে এক ঘণ্টা মধ্যাহ্নভোজনের বিরতি। সাকুল্যে ছয় ঘণ্টার পড়া। তৃতীয় শর্ত, মে মাসে পরীক্ষায় বসা চলবে না। তোমরা আমার হাতে চারাগাছের মতো। রোপণ করব, যত্ন করব, তবে ফল ধরবে। সময় লাগবে। পরীক্ষায় বসতে পারবে নভেম্বরে। আটখানা বিষয়, নয় মাস সময়! চতুর্থ, প্রতি মাসে পরীক্ষা দিতে হবে। ফেল করার শাস্তি, আমার ফলের বাগানের ঝরা পাতা পরিষ্কার করতে হবে। পঞ্চম, প্রতি বিষয়ের জন্য আমার দক্ষিণা দুইশত একান্ন টাকা প্রতি মাসে। যা কিনা মোটের উপর অষ্টোত্তর দুই সহস্র! কারও কোনও প্রশ্ন আছে?

দীপ: আমরা যদি পড়ি, কবে থেকে, অথবা ধরুন, না পড়লে…

স্যার: পয়লা ফেব্রুয়ারি পৌনে দশটা, আমি এই ঘরে অপেক্ষা করব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *