২০. অস্থায়ী কুটিরে

কুড়ি

অস্থায়ী কুটিরে খানিক আরামে থাকতে গেলে যতটুকু প্রয়োজন, এর মধ্যেই তার চেয়ে বেশি কিছুই ব্যবস্থা করেছে দয়ানন্দ আর দ্বারুক। প্রভাসতীর্থে সাধু, যোগী, মুনি যেমন আসে, তেমনি আসে রাজা-রাজড়া। তীর্থে আসা মানেই যে তারা বিলাসিতা ত্যাগ করে একেবারে সাধুর জীবন কাটায় তা তো নয়। তাই প্রভাসে নগর জীবনের অনেক উপকরণই পাওয়া যায়। একেবারে নদীর ধারে বা মোহানার কাছে নয়। সরস্বতী এখানে উত্তর-পূর্ব থেকে এসে দক্ষিণ-পশ্চিমে সমুদ্রে মিশেছে। তাই সরস্বতীর পার থেকে উন্মুক্ত পূর্ব দিগন্তে সূর্যোদয় খুব ভালভাবে দেখতে পাওয়া যায়। মোহানার প্রান্ত থেকে পশ্চিম সীমারেখা ছুঁয়ে উত্তর বরাবর বিস্তৃত বনাঞ্চল। অনেক উঁচু গাছের মগডালে উঠলে দেখা যেতে পারে ধোঁয়া ধোঁয়া রৈবতক পাহাড়, দ্বারকার গা ঘেঁষে। পশ্চিম থেকে উত্তরে বন যেখানে শেষ হয়েছে, মোহানার শান্তি ও সৌন্দর্য এতটুকু ব্যাহত না করে সেইখানে তৈরি হয়েছে বিকিকিনির হাট। শিবির তৈরির সরঞ্জাম থেকে বিছানা বালিশ কাঠের আসন পায়ের জুতো সবই পাওয়া যায়। সোমরস যারা বানায় তারাও থাকে ওইদিকে।

তীর্থে এসে খুব বিলাসিতা অর্জুনের পছন্দ নয় জানে দয়ানন্দ। মাঝখানে তো কৃচ্ছ্রতার এত বাড়াবাড়ি করেছে অর্জুন যে, দয়ানন্দর ভয় হচ্ছিল ছেলেটা না অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রৌঢ় দয়ানন্দর চার ছেলে, তাদের মধ্যে ছোটটিও অর্জুনের চেয়ে বড়। অর্জুনের জন্য তার বাৎসল্য উপচে ওঠে মনের ভিতর। অর্জুন অপছন্দ করবে না এমন পরিমিতির মধ্যেই দয়ানন্দ যথাসম্ভব তাকে যত্ন করার চেষ্টা করে। আজ কৃষ্ণ এসেছে। অর্জুনের পরম বন্ধু এবং আত্মীয় তো বটেই, এই কুটিরে সে অর্জুনের অতিথি। তাই, যেন কৃষ্ণর সুবিধার জন্যই আরামপ্রদ ব্যবস্থা করেছে দয়ানন্দ। কৃষ্ণর ইচ্ছায় একই ঘরে দু’জনের শোওয়ার আয়োজন।

মণিপুর ছেড়ে আসার পর এত আরামে আর শোয়নি অর্জুন। তার ধরনটাই এমন, যা পায় তা পূর্ণভাবে নেয়। যা পায় না, তার জন্য হাহাকার করে না, লোভও নয়। আজকের দিনটি খুব সুন্দর গেল অর্জুনের। কৃষ্ণকে পেয়েছে। চিত্রসেনের মতো বন্ধু পেয়েছে। তবু মনের কোনায় বিষাদ ভাব লেগে রয়েছে তার।

কৃষ্ণ বলল, “কী পার্থ, ঘুমিয়ে পড়লে?”

“না। বলল অর্জুন।”

“চলো, বিছানা-বালিশ নিয়ে বাইরে শুই। কত তারা আকাশে! কী হাওয়া! সাগর থেকে উঠে আসছে বলে এ হাওয়ায় লোনা ভাব।”

“চলো।”

“তোমার কী ইচ্ছে?”

“তুমি যেমনটি বলবে কৃষ্ণ।”

“এই তোমার দোষ অর্জুন। নিজের ইচ্ছের কথা ভাবোই না তুমি। এত বিলিয়ে দেবে না সব কিছু।”

“না না। তা কেন? আমার কত ইচ্ছের কথাই তো তোমায় বলছি কৃষ্ণ। সব বলতেও তো হচ্ছে না। কত কথা তুমি আপনি বুঝে নাও।”

“যেমন এখন বুঝতে পারছি, এই সামান্য আরাম কতদিন পর তুমি পেলে!”

“ঠিকই বলেছ তুমি কৃষ্ণ। উলূপী আর চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে থাকার সময়টুকু বাদ দিলে, যতখানি সাধ্য কঠোর সংযম মেনে চলেছি আমি। কিন্তু তুমি তা বুঝলে কী করে?”

“সকালে যখন এ ঘরে এসেছিলাম, এসব কিছুই ছিল না। তাতেই বোঝা যায় তুমি এসব ব্যবহার করো না। এ আমার জন্য। কিন্তু তোমার কি ভাল লাগছে না?”

“লাগছে।”

“তবু তুমি বাইরে যেতে চাও শুধু আমার ভাল লাগবে বলে।”

“কৃষ্ণ, তোমার সুখে সুখ মেলাতে পারলেই যে আমার আনন্দ।”

“কচুপোড়া। সবসময় তা হয় নাকি? ওইরকম ভক্তি ভক্তি ভাব নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বোলো না তো। দেখো, সাত্যকি আমার পরম বন্ধু। কিন্তু সেও আমার অনুগত। তুমিও তেমনি হয়ে যেয়ো না। তুমি আর আমি আলাদা নই অর্জুন। একথা তুমি বিশ্বাস করো না? সমপ্রাণতার আশ্রয় সবাই চায় অর্জুন। আমিও চাই। যখন ছোট ছিলাম, এমনকী সেই কংসকে মারার সময় পর্যন্ত বলরাম আমার কত কাছের ছিল। সে অবশ্য চিরকাল আমি যা বলি তাই করে। নিজে খুব একটা ভাবতে চায় না। কিছু লোক থাকে দেখবে, চিন্তায় অলস। বলরামও তাই। কিন্তু আমার কথা মেনে চলতে চলতে তার এমন হল যে, সে আমার গলা জড়িয়ে ধরতেই ভুলে গেল। এখন আমাকে সে যত ভালবাসে, তার চেয়ে বেশি মান্য করে। এই দূরত্ব অতি সূক্ষ্ম কিন্তু আমি কষ্ট পাই। তোমার সঙ্গে এমন কিছু হোক আমি চাই না। তুমি আমার আশ্রয় অর্জুন, একথা তুমি বিশ্বাস করো না?”

“করি কৃষ্ণ। তাই তো তোমায় অকপটে সব বলতে পারি।”

“তাই বলে সত্যভামার ভাগ চেয়ো না। সেবেলা আমরা এক্কেবারে আলাদা।” হেসে ফেলল অর্জুন। কৃষ্ণ বলল, “আজ তোমার এই শয্যাটি ভাল লাগছে, আমি বুঝেছি অর্জুন। উদার আকাশ, বন, পাহাড় যেমন স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে টানে, তেমনি টানে ঘরের কোণ। আসলে কী জানো অর্জুন, এই যে তোমাকে বিনা দোষে এমন শাস্তি পেতে হল, তার জন্য মনে মনে কষ্ট পাচ্ছি আমি। আমি যদি একটুও জানতাম, সোজা তোমাকে নিয়ে আসতাম আমার কাছে। আর তুমি অর্জুন, তুমিই বা কী? ইন্দ্রপ্রস্থ থেকে বেরিয়ে সোজা দ্বারকায় এই কৃষ্ণর কাছে চলে আসতে পারলে না তুমি? জানো না, প্রিয়কে যেখানে পাওয়া যায়, সেখানেই তীর্থ? কত লোক ছিল তোমার সঙ্গে। কাউকে দিয়ে আমায় খবর দিতে পারতে। তুমি না যাও দ্বারকায়, আমি তোমার কাছে চলে আসতাম। দু’জনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়াতাম। কবে কৃষ্ণ তোমার ডাক শুনবে, কবে অন্তর্যামী কৃষ্ণ তোমার মনের কথা বুঝবে— এই ভরসায় থেকে দশ বছর পার করে দিলে অর্জুন! অথচ দশ বছর কত দীর্ঘ সময়। দু’জনে একসঙ্গে থাকলে জগতের যেখানে যত ভাল ভাল অস্ত্র আছে, আমরা সব সংগ্রহ করে ফেলতাম। কত শত্রু নিকেশ করতাম! একবারও তোমার ইচ্ছে করল না, যাই কৃষ্ণর কাছে?”

“কত যে ইচ্ছে করেছে, কী বলব তোমাকে কৃষ্ণ। কিন্তু সংকোচ হল। হয়তো ব্যস্ত আছ তুমি। হয়তো দ্বারকাতেই নেই। ব্রহ্মচর্য পালন করতে বেরিয়ে সোজা দ্বারকানগরীতে যাবার সাহসও হয়নি। তীর্থগুলোয় ঘুরছিলাম। অথচ কৃষ্ণ, উলূপী আমাকে বলেছে, সে নাকি বুঝেছে, আমি সবকিছুর আগে, সবার আগে, তোমাকেই ভালবাসি।”

“বাঃ। ওই উলূপীর কথা যত শুনছি, তত তার প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে আমার। একদিকে ভালই হয়েছে অর্জুন তুমি আমার কাছে আসোনি। তা হলে অবশ্য উলূপী ও চিত্রাঙ্গদার থেকে তোমায় বঞ্চিত করা হত। কিন্তু অন্যতর কিছু পেতে তুমি। আমিও পেতাম। হয়তো তোমাকে পাশে পেলে শত কষ্টেও ভাল থাকতাম আমি অর্জুন। বছরের পর বছর ধরে আমি যে কী অশান্তিতে আছি আর কী বলব। এক শত্রু নিকেশ করতে গিয়ে দশটা শত্রু হয়েছে আমার। ভীষ্মক আর তার ছেলে রুক্মী আমার পরমাত্মীয় হলে কী হবে, তারা আমাকে দু’চক্ষে দেখতে পারে না। জরাসন্ধর তো বোধহয় আমাকে বধ না করে শান্তি নেই। আমাকে ভেবে বোধহয় ওর স্ত্রীগমনের ইচ্ছাও চলে গেছে। আর শিশুপাল? তার কথা ভাবো একবার। এই যেমন যুধিষ্ঠির, ভীম তেমনি শিশুপালও তো আমার আপন পিসতুতো ভাই। যেমনি কুন্তী আমার কাছে, তেমনি শিশুপালের মা শ্রুতশ্রবা। অথচ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক দেখো, আর ওই শিশুপালের সঙ্গে। রুক্মিণীকে সে চেয়েছিল। পায়নি বলে আমার চিরশত্রু হয়ে গেল। সুযোগ পেলেই এদের মধ্যে কেউ না কেউ আক্রমণ করে। মথুরা থেকে দ্বারকায় চলে এলাম। তবু সমস্যার সমাধান হয়নি। তার মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব তো আছেই। ভোজ, বৃষ্ণি, যদু, অন্ধক— সব কুল এককাট্টা করে রাখা কি চাট্টিখানি কথা? বুঝলে অর্জুন, যে-দেশে রাজা নেই সে দেশে সবাই রাজা। আমাদের কেউ একটু প্রতিপত্তি পেলেই হল। বুঝুক না বুঝুক সব ব্যাপারে লম্বা-চওড়া মতামত দেবে। কিছু বললেই তাদের গোঁসা। ধনসম্পত্তি হলেই তো মূর্খামি দূর হয় না। সব্বার মন রেখে যুক্তি সাজাতে গিয়ে প্রাণান্ত অবস্থা হয় আমার। একটা সহজ কথা ওরা যতবার ভুলে যায় আমি ততবার ওদের মনে করিয়ে দিই। নিজেদের মধ্যে লড়াই-ঝগড়া করলে ধ্বংস অনিবার্য। বাইরের শত্রু যদি নাও পারে, নিজেরাই নিজেদের মারবে। আমার কী বলো তো অর্জুন? আমি বড় হয়েছি বৃন্দাবনে। সেখানে মহাসুখেই আমি ছিলাম। যশোদা মা যত স্নেহ আমাকে করেছে, কোনও গর্ভধারিণী মা তার চেয়ে বেশি কিছু পারবে না। নন্দ ঘোষের দু’নয়নের মণি ছিলাম আমি আর বলরাম। সাধ্যের বাইরে গিয়েও নন্দ আমাদের সবরকম শিক্ষার ব্যবস্থা করেছে। এইসব কুলসংঘর্ষে না এসে, একক জীবন কাটাতেই পারতাম আমি। কংসকে বধ করে সিংহাসনে বসতে পারতাম আমিই। কুলসন্ধি না করে এককভাবে রাজত্ব চালাতে পারতাম। কিন্তু আমি তা করিনি। কেন করিনি জানো? কর্তব্যবোধে। তিতিবিরক্ত হয়ে গেলেও আমি এই দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারব না। বিভিন্ন কুলের মধ্যে সদ্ভাব ধরে রাখার চেষ্টা করতে পারি আমিই একমাত্র। সেই আমি কী করে হাত গুটিয়ে নিই? স্বার্থচিন্তাকে আমি প্রাধান্য দিই না অর্জুন। এই জরাসন্ধর কথাই ধরো, তাকে প্রতিহত করতে গিয়ে কী পরিমাণ সতর্ক থাকতে হয় আমায়! কত পরিশ্রম করতে হয়। চাইলে কি জরাসন্ধর সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারতাম না? কিন্তু কুলের জন্য যেমন ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়তে হয়, তেমনি ধর্মরক্ষায় কুলস্বার্থও গৌণ হয়ে যায়। জরাসন্ধ একশোজন রাজাকে বন্দি করে রেখেছে বলি দেবে। এ কী! এ কি ক্ষত্রিয়ের আচার? জরাসন্ধ ক্ষাত্রধর্মের কলঙ্ক। রাজাকে বন্দি করার নীচ মনোবৃত্তি দেখিয়ে সে ধর্মচ্যুত হয়েছে। তাই তাকে শাস্তি পেতেই হবে। সমস্ত বন্দি রাজার মুক্তি চাই আমি। আর কেউ যাতে এমন অধর্ম না করে তা নিশ্চিত করতে হবে আমাদের। আমি আর তুমি তা করব। প্রয়োজন হলে কারও সাহায্য নেব। আমিও রাজা নই, তুমিও নও। কেউ কেউ নিজেকে বিলিয়ে দেবার জন্য জন্মায় অর্জুন। আমিও তাই, তুমিও তাই। তাই আমাদের এত টান, এমন বোঝাপড়া।”

অর্জুন বলল, “ঠিক বলেছ তুমি কৃষ্ণ। কর্তব্যবোধ। এ জিনিসটা যার মধ্যে সূক্ষ্মভাবে আছে, তার আর মুক্তি নেই। আমি তোমার সব কাজে থাকব কৃষ্ণ। জানো, মণিপুররাজ চিত্রবাহন আমাকে তার সিংহাসনটাই দিয়ে দিতে চেয়েছিল। অনেক যুক্তি দিয়ে তাকে নিরস্ত করেছি আমি। শেষ পর্যন্ত হয়তো যুক্তির চেয়ে আবেগটাই বড় হয়ে উঠেছে কারণ, যুধিষ্ঠিরের মূল যে-দুর্বলতা, তা ধরে ফেলেছিল চিত্রবাহন। আমাকে তা এড়িয়ে যেতে হয়েছে। আমি বলতে পারিনি, আমি যদি যুধিষ্ঠিরকে ছেড়ে চলে যাই, তার ডান হাতখানাই কেটে নেওয়া হবে। দুর্বলকে ছেড়ে আমি কেমন করে যাব? একলা পঞ্চাশটা সৈন্য মারতেও যে পারে না, সে তো ক্ষত্রিয়নির্ভর বামুনদের চেয়েও অসহায়। অসহায়কে ত্যাগ করাই তো সবচেয়ে বড় অধর্ম কৃষ্ণ। কোনও কিছুরই জন্য আমি তা ছাড়তে পারব না। রাজত্ব, দ্রৌপদী— কিছু নয়। ধর্ম যদি নাও বলি, খুব সাধারণ লোকের মতো করে দেখলে, যুধিষ্ঠির আমার সহোদর, এমন কিছুই আমি করতে পারব না যাতে আমার চিরদুঃখিনী মা কুন্তী কষ্ট পায়। সেই যুধিষ্ঠির আমাকে ঈর্ষা করল কৃষ্ণ? সেই যুধিষ্ঠির ভাবল দ্রৌপদীর দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অন্যদের বঞ্চিত করব আমি? কৃষ্ণ, পাঞ্চালে আমি আর ভীম পাঞ্চালীকে নিয়ে বাড়ি গেলাম। কুন্তী না দেখেই বলল, যা এনেছ, পাঁচজনে ভাগ করে নাও। সেই মুহূর্তে তুমি যদি মুখগুলো দেখতে! ধার্মিক যুধিষ্ঠির একবারও বলল না, যে-কথা অজানিতে বলা, তা না মানলে দোষ নেই। বলল না, কারণ ওই ব্যাসদেবের কথা কুন্তী যেমন বুঝেছিল, যুধিষ্ঠিরও বুঝেছিল। সেইসঙ্গে কৃষ্ণার প্রতি কামনা। কৃষ্ণ, কুন্তী যদি আদেশ করত, পাঞ্চালী শুধু যুধিষ্ঠিরের মহিষী হোক, আমি মেনে নিতাম।”

কৃষ্ণ হাসতে হাসতে বলল, “ভাগ্যিস কুন্তী তা বলেনি। যুধিষ্ঠির একলা যেমন রাজ্য চালাতে পারবে না, তেমনি দ্রৌপদীকেও সামলাতে পারত না। পাঞ্চালী কৃষ্ণার যে পাঁচ স্বামী, তা বিধিনির্দেশিত এমনটাই ধরে নাও। ক্ষত্রিয়ের জীবনে শ্বাস-প্রশ্বাসেও রাজনীতি। কিন্তু একথাও ঠিক, কৃষ্ণা তীব্রস্বরূপিণী। এমন নারী একজনে তৃপ্ত হয় না। আমার বিষয়ে তুমি যা ভেবেছ, তা একেবারে ঠিক। যাজ্ঞসেনী সম্পর্কে আমি যা জেনেছিলাম তাতে বুঝেছি যে, ওই নারী যার হবে, সেই পুরুষকে সে সর্বাংশে অধিকার করবে, চালনা করবে, একেবারে হাতের মুঠোয় রাখবে। সে আমার বউ হলে কী হত জানো অর্জুন?” কৃষ্ণ কৌতুকমাখানো স্বরে বলে চলল, “হয় আমি তাকে সংহার করতাম, নয় সে আমাকে। কারণ সে আমাকে বশ করতে চাইত, আর আমি তার ইচ্ছাকে ভেঙে দিতাম। যে-কর্তব্যবোধে তুমি পাঞ্চালীকে ভাগ করে নিয়েছ, যে-আত্মসম্মানবোধে তুমি শর্ত মানতে বেরিয়ে পড়েছ, আমি তা সম্মান করি। সমর্থন করি। তোমাকে জানাই, ধন্য তোমার পুরুষকার। তা হলে কেন সেই স্বয়ম্বর সভায় আমি গিয়েছিলাম? নিমন্ত্রণ রাখতে? না অর্জুন, আমি তোমাদের খুঁজতে গিয়েছিলাম। ওরকম একটা পরীক্ষায় তোমার থাকার সম্ভাবনা ছিলই। ব্যাস যেভাবে ভেবেছে, আমিও ঠিক তেমনি করে ভেবেছি। এবারে আমি যুধিষ্ঠিরের কথায় আসি। যুধিষ্ঠির ভীম সবাই আমার প্রিয়। যুধিষ্ঠিরও আমাকে অত্যন্ত ভালবাসে। তার যাতে মঙ্গল হয়, আমি সবসময় তাই দেখব। কিন্তু যুধিষ্ঠির আমার কাছে তোমার চেয়ে বেশি নয়। আচ্ছা অর্জুন, একটা প্রশ্ন করি তোমাকে, আমি জানি তোমার উত্তর সৎ হবে।”

“বলো।”

“তুমি কী কী ছাড়তে পারবে না?”

“কর্তব্যধর্ম।”

“আর?”

“অস্ত্র।”

“আর?”

“তোমাকে কৃষ্ণ। তোমাকে ছাড়তে পারব না। তুমি আমার হৃদয়ের রাজা হয়ে উঠেছ। কথাটা একটু মেয়েলি শোনাল। কিন্তু এটাই আমার সৎ প্রকাশ।”

“আমি জানি। অর্জুন। তোমার উত্তর আমি জানি। এবার শোনো, আমি কী কী ছাড়তে পারব না। কর্তব্য। তাকে তুমি আদর্শস্বরূপ বলতে পারো, লক্ষ্যস্বরূপ বুঝতে পারো। আমি তা ছাড়ব না। আর ছাড়ব না তোমাকে অর্জুন। যদি বলো কেন? আমি বলব তুমি আত্মরূপ আমার। এ আমার অনুভব অর্জুন। আমি অবিনাশী আত্মার অস্তিত্ব বিশ্বাস করি। আমি আর তুমি শুধু এ জন্মের নয়, আরও শত শত জন্ম ধরে কৃষ্ণ আর অর্জুনই ছিলাম। যুধিষ্ঠিরের আচরণে তুমি দুঃখ রেখো না মনে। ভেবে দেখো, কতখানি হারানোর ভয় নিয়ে সে বেঁচে আছে। তোমাকে হারানোর ভয়, তোমাকে হারালে বলহীন হওয়ার ভয়, বলহীন হলে রাজত্ব হারানোর ভয়, মান-মর্যাদা এমনকী দ্রৌপদীর প্রেম— তা সে যতটুকুই পাক। এই ভয় থেকে সে চাইবে কাকে? যার শক্তিতে সে শক্তিমান। ঈর্ষাও করবে সেই শক্তিকেই তো। তুমি তাকে কখনও অমান্য করোনি বলেই তার ভয় তোমাকে নিয়েই বেশি। কী ভয়? যদি অমান্য করো, সে জানে না কেমন করে সামাল দেবে। ভীমও প্রবল শক্তিমান। কিন্তু ভীমও অর্জুনকে ছাড়া সম্পূর্ণ নয়। তাই যখন রেগে গিয়ে যুধিষ্ঠিরকে সে তিরস্কার করে, যুধিষ্ঠির বিচলিত হয় না। পাঞ্চালী যদি কখনও একটু বেশি করে ভীম ভীম করে, তবু যুধিষ্ঠিরের সমস্যা নেই। তার সমস্যা তুমি অর্জুন। তুমি তার হীনতা উপেক্ষা করো। তুমি জেনো অর্জুন, যুধিষ্ঠির তোমার বলে বলীয়ান, এরপর সে তোমার ধনে ধনী হবে। তোমার সম্পর্কিত আত্মীয়বন্ধুকেই সে সহায় হিসেবে পাবে। তুমি জানো, সমগ্র ভারতে মহত্তম শক্তি হিসেবে আমি নিজেকে প্রমাণ করে চলেছি। এই আমিও তাকে চিরকাল বোঝাব, তোমার প্রাণসখা বলেই আমি যুধিষ্ঠিরের শুভাকাঙ্ক্ষী। এই হবে তার শাস্তি অর্জুন। এই তার প্রাপ্য। আর ত্যাগের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা? বিশ্বাস? অর্জুন, তুমি জানো, কংসকে বধ করে যে-আমি জ্ঞাতিবধের কলঙ্ক মাথায় নিয়েছি শুধুমাত্র যদু-বৃষ্ণিদের কল্যাণের জন্য, তাদের একত্রিত করার জন্য, রক্ষা করার জন্য প্রাণপাত করেছি, তারাই আমাকে চোর অপবাদ দিতে এতটুকু দ্বিধা করেনি। শুধু চোরও নয় আবার। হত্যা ও অপহরণ। জানো তুমি? সত্যভামার বাবা সত্রাজিৎ সূর্যর বন্ধু। সূর্য তাকে দিল স্যমন্তক মণি। এই মণি কাছে থাকলে ধরিত্রী শস্যশ্যামলা হয়, লোকের শরীর স্বাস্থ্য ভাল থাকে। আমাদের গণভিত্তিক দেশ। আমি বলেছিলাম, সত্রাজিৎ ওই মণি জনকল্যাণে দান করুক। সবাই তার সুফল পাবে। কিন্তু সত্রাজিৎ রাজি হল না। সে দিল ভাই প্রসেনজিৎকে। মণির জন্য মারা পড়ল সে। সবাই ভাবল আমিই মণির লোভে তাকে মেরেছি। সেই মণি আমি উদ্ধার করেছিলাম। ফিরিয়ে দিয়েছিলাম সত্রাজিৎকে। কিন্তু অর্জুন, সেই মণি আবার চুরি গিয়েছে। অনেক চেষ্টা করেছি ফিরে পাবার। আজও খুঁজে চলেছি তা। কিন্তু এখনও অনেকে ভাবে, আমিই আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছি ওই মণি। এমনকী বলরামও তাই মনে করে। ভেবে দেখো অর্জুন। যে-বলরাম কোন শৈশব থেকে আমাকে প্রাণের চেয়ে বেশি ভালবাসে, সেও একটা মণির জন্য ভাবল আমি চোর? আরে, সত্যভামার বাবার জিনিস তো সত্যভামারই প্রাপ্য। সত্রাজিৎ বেঁচে নেই। আমার মণি রাখার ইচ্ছে হলে ন্যায়সঙ্গতভাবেই তা পারতাম। চুরি করতে যাব কেন? বলরাম বলল, মণি কাছে রাখলে আমার সুখ-সমৃদ্ধি উপচে পড়বে, আমি নাকি তার ভাগ বলরামকেও দিতে চাই না। যেন এমনিতে আমার ধনৈশ্বর্য কিছু কম আছে আর আমি যেন তেমন স্বার্থপর। এরপরও আমি ওদের সঙ্গে আছি। ভালবেসেই আছি। অর্জুন, মানুষ মহান হয় দু’টি কারণে। এক, যারা মহত্ত্ব অবলম্বন করে খ্যাতির উপায় হিসেবে। তারা প্রবঞ্চক নয়। প্রতারক নয়। মহতের আচরণ মন থেকেই তারা করে। কিন্তু খ্যাতি লক্ষ্য হওয়ায় তারা আত্মপর। দুই, চরিত্রগতভাবেই যারা মহান। তাদের সব মহদাচরণ নীরব। মহান না হয়ে তাদের উপায় নেই বলেই তারা মহান। যেমন তুমি।”

“কৃষ্ণ, তুমি যেমন বলছ, আমি সত্যিই অতখানি বড়?”

“আমি যদি বাড়িয়ে বলি, তুমি আমাকে একটু বেশি ভালবাসবে নাকি পার্থ?”

“যতখানি সম্ভব আমি ততখানিই ভালবাসি তোমাকে কৃষ্ণ।”

“তবে কেন আমি বাড়িয়ে বলব তোমাকে? নিজের দোষ যেমন জানা দরকার তেমনি গুণও। কী? চুপ করে রইলে কেন? কৃষ্ণ, তুমিও মহান, তুমিও ভাল, আমিও ভাল তুমিও ভাল— বলো এসব। জানো না, পরস্পরের পিঠ চুলকুনিকেই লোকে বন্ধুত্ব বলে? তুমি সেই একইরকম মুখচোরা রয়ে গেলে অর্জুন?”

অর্জুন হাসতে হাসতে বলল, “দু’জনেই বাবদূক হলে শুনবে কে?”

“তবে রে?” অর্জুনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল কৃষ্ণ। ছেলেমানুষের মতো মারামারি করল দু’জনে কিছুক্ষণ। তারপর পাশাপাশি শুয়ে হাসতে লাগল। কৌতুক রঙ্গের অবকাশ তাদের জীবনে খুব বেশি আসে না।

উল্লাস প্রশমিত হলে অর্জুন বলল, “জানো কৃষ্ণ, আজ ভোরে ওই চিত্রসেন যখন সরস্বতীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যপ্রণাম করছিল, আমার হঠাৎ কর্ণকে মনে পড়ল। তুমি তো জানো, কর্ণ প্রথম থেকে আমার বিষয়ে কীরকম ঈর্ষাপরায়ণ। শ্রেষ্ঠ হওয়ার নেশা তাকে আমার বিরুদ্ধে একেবারে খেপিয়ে তুলেছে। আমার কিন্তু তার প্রতি কোনও ঈর্ষা জন্মায় না। তার অনেক কিছুই আমার ভাল লাগে না, যেমন পরশুরামকে প্রতারণা করেছিল সে। জানো কৃষ্ণ, কর্ণ অসামান্য ধনুর্ধর। কিন্তু তোমাকে বলেই বলছি, আমি জানি, কর্ণ কখনও আমার সঙ্গে পেরে উঠবে না। কারণ সে ধনুর্বিদ্যার চেয়ে বেশি ভালবাসে তার অহং। দেখো, আমি তো কোনও দিন তার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাইনি। অন্যরাই তার বংশ, কুল এইসব প্রশ্ন তুলে তাকে অপদস্থ করেছে। এতে সেও যেমন শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পায়নি, আমিও তো পাইনি। যতক্ষণ আমি কোনও সুস্থ, ন্যায় ও ধর্মের অনুসারী প্রতিযোগিতায় অথবা যুদ্ধে, তাকে হারিয়ে দিতে না পারছি ততক্ষণ এই প্রশ্নের মীমাংসাও তো হল না ধনুর্বিদ্যায় অর্জুন শ্রেষ্ঠ, নাকি কর্ণ? আমিও তো চাই অবিসম্বাদিত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ। কর্ণ তা বোঝে না। অন্যরা তাকে যে-অপমান করে, সেই অপমান সে অর্জুনকৃত বলেই ধরে নেয়। তার চোখে আমার প্রতি প্রতিযোগী সুলভ ঈর্ষা বা দ্বেষই শুধু দেখি না আমি, তার চেয়ে বেশি কিছু আছে। সে কি রাগ? সে কি ঘেন্না? আমাকে কি ঘেন্না করে কর্ণ? কেন করে? শুধু এজন্য যে, আমি তার চেয়ে ভাল তির চালাই! লোকে বলাবলি করে, ওই কর্ণর মুখোমুখি হতে হয়নি এই অর্জুনের সৌভাগ্য। না হলে শ্রেষ্ঠত্বর শিরোপা কর্ণই পেত। আমার দুঃখ হয় শুনে, কিন্তু রাগ বা দ্বেষ জন্মায় না। কৃষ্ণ, আমি যে শুধু তির চালাতেই পারি তা নয়, আমি বিষয়টা বুঝি। আমি বুঝি কে কত বড় তিরন্দাজ। বুঝি যে, আচার্য দ্রোণ অসাধারণ তিরন্দাজ এবং গুরু হিসেবে তুলনাহীন। কিন্তু ভীষ্ম আরও বড়, আরও নিপুণ, অনেক বেশি শিল্পসম্মত তার শরসন্ধান, জ্যারোপ। কৃষ্ণ, ভীষ্মর মতো ধনুর্ধর আমি আর কাউকে দেখিনি। তাই কর্ণকে ঈর্ষা করি না আমি। জীবনে একবারই মাত্র একজনকে ঈর্ষা করেছিলাম, সেই ছোটবেলায় একলব্যকে। তার কথা জানো তো তুমি কৃষ্ণ।”

“জানি। সেই জ্বালা তার এখনও মেটেনি। সুযোগ পেলেই তোমার নিন্দা রটিয়ে বেড়ায়। সেই তো সবচেয়ে বেশি করে বলে কর্ণই শ্রেষ্ঠ, অর্জুন নয়।”

“আমি আজও তার জন্য অনুতপ্ত। তখন না বুঝে অন্যায় করেছিলাম। পরে, দুর্যোধনের ঈর্ষা আর অহং দেখতে দেখতে এত বিতৃষ্ণা হল যে, নিজের মধ্যেকার অহং ও ঈর্ষাকে আমি আর প্রশ্রয় দিইনি। এ তো মুছে ফেলার জিনিস নয়। কিন্তু আমি এ বিষয়ে সচেতন থাকতে চাই। এই কর্ণর সঙ্গে দুর্যোধনের খুব মিল। জানো, কর্ণ লোককে বলে বেড়ায় দ্রোণ তাকে অস্ত্র শেখাতেই চায়নি। এ কথা ঠিক নয়। ছোটবেলায় সেও আমাদের সঙ্গেই দ্রোণের কাছে শিক্ষা নিত। কত দেশ-বিদেশের ছেলে ছিল আমাদের সতীর্থ! সেও ছিল। তখন থেকেই সে দুর্যোধনের বন্ধু। পরে সে কোনও কারণে পরশুরামের শিষ্যত্ব নিয়ে চলে যায়। দেখো, একাধিক গুরুর শিষ্যত্ব নেওয়ার মধ্যে কোনও অন্যায় তো নেই। আচার্য দ্রোণ নিজেই বিদ্যাশিক্ষা করেছেন ঋষি অগ্নিবেশ এবং পরশুরামের কাছে। সে কথা কখনও তিনি গোপন করেননি। কর্ণ সবসময়ই অসরল, কোপন, অসুখী এবং হিংসুক। ঠিক যেন দুর্যোধন। দু’জনেই লোভী, পরশ্রীকাতর, পৈশুন্যস্বভাব।”

“চলো অর্জুন, তুমি ভুলে যাও তুমি পাণ্ডব। একেবারে নির্মোহ চোখে তুমি দুর্যোধনকে দেখার চেষ্টা করো। কর্ণর কথায় পরে আসছি। ভেবে দেখো, এই যে দুর্যোধনের রাজ্যলোভ, এ কি খুব অন্যায়? মহত্ত্বের কথা বলো না। মহত্ত্ব ব্যতিক্রম। সাধারণ মানুষের ভাবনা দেখো। ধৃতরাষ্ট্র আর পাণ্ডু। ধৃতরাষ্ট্র অন্ধ বলে রাজা হতে পারল না। ভীষ্ম সিংহাসনে বসাল পাণ্ডুকে। বেশ। পাণ্ডু সুযোগ্য রাজা। সে নিয়ে আমি কিছু বলছি না। কিন্তু পাণ্ডু যখন রাজত্ব ছেড়ে বনে গেল— তা সে যে কারণেই হোক— ওই অন্ধই তো রাজা হয়ে উঠল তখন। তা যে-লোক পাণ্ডুর পরিত্যক্ত জায়গায় বসতে পারে, সে প্রথমেই সিংহাসন পেল না কেন? ধৃতরাষ্ট্র বুদ্ধিমান, শাস্ত্রজ্ঞ, তখনও পর্যন্ত যথেষ্ট ন্যায়পরায়ণ ছিল। অর্জুন, আজ যদি যুধিষ্ঠির তোমার ভরসায় রাজত্ব চালাতে পারে, তোমার ভরসায় রাজসূয় যজ্ঞের পরিকল্পনা করতে পারে, তবে অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র পাণ্ডুর ওপর নির্ভর করে রাজত্ব চালালে কী ক্ষতি হত বলতে পারো? ভীষ্ম তো সবসময়ই তাদের সঙ্গে আছে। বিদুর আছে। কিন্তু হল কী, ধৃতরাষ্ট্র রাজা হয়েও রাজা হল না। পাণ্ডুর বকলম হয়ে রইল। পাণ্ডু সিংহাসনে না বসে ধৃতরাষ্ট্র যদি প্রথমেই রাজা হত তবে আজ ন্যায়সঙ্গতভাবেই দুর্যোধন হত সিংহাসনের দাবিদার। আর রাজা হওয়ার যে যে যোগ্যতা দরকার, তার সবই আছে। কিন্তু যুধিষ্ঠির আসল রাজা পাণ্ডুর বড় ছেলে, দুর্যোধনের চেয়েও বড়, তাই ধৃতরাষ্ট্রর সঙ্গে যে-অন্যায় হয়েছিল তার দায় পড়ল দুর্যোধনের ওপর। যে যুদ্ধ করে জয়ী হতে পারবে সেই রাজা হওয়ার যোগ্য এই যদি নীতি হয়, তবে ইন্দ্রপ্রস্থর সিংহাসনের জন্য তুমি যোগ্যতম। চিত্রবাহন তোমাকে ভুল কিছু বলেনি। তুমি লোভ করবে না, সে অন্য কথা। দেখো, দুর্যোধন জন্ম থেকে ধৃতরাষ্ট্রকেই রাজা দেখেছে, পাণ্ডুকে চোখেই দেখেনি। তার সিংহাসনের প্রতি লোভ জন্মানো অস্বাভাবিক?”

“ঠিকই বলেছ তুমি কৃষ্ণ। কিন্তু পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্রর ঘটনা পরম্পরার জন্য যুধিষ্ঠির তো দায়ী নয়। ন্যায়সঙ্গতভাবে সেই তো হস্তিনাপুরের যুবরাজ।”

“দুর্যোধন অত্যন্ত সাধারণ প্রবৃত্তির লোক অর্জুন। তার মধ্যে সে খলচিত্ত। তাকে তার মাপে বিচার করো। যে কোনও ব্যক্তিকেই যদি তার পরিস্থিতির বিচারে দেখো পার্থ, তবে অনেক বেশি নির্মোহ হতে পারবে। এবার আসি কর্ণর কথায়। কিন্তু অর্জুন, তুমি আর আমি অভিন্ন বলেই একথা তোমায় বলতে যাচ্ছি। প্রতিজ্ঞা করো, আর কাউকে কোনও দিন তুমি তা বলতে পারবে না।”

“কথা দিলাম কৃষ্ণ।”

“তবে বলি শোনো। আচ্ছা, তুমি বলো তো কর্ণর মধ্যে কী কী বিস্ময়কর? কী কী লক্ষণীয়?”

“প্রথম তার রূপ এবং কবচ-কুণ্ডল। কবচ-কুণ্ডল ক্ষত্রিয়ের প্রতীক। বিশেষ— ওই কবচ। সূত অধিরথ আর রাধা নিশ্চয়ই বহু পুণ্য করেছিল তাই এমন ছেলে হয়েছে।”

“বেশ। তারপর?”

“দেখো, অস্ত্রবিদ্যার প্রতি আকর্ষণ অনেক ব্রাহ্মণের আছে, অন্যান্য অক্ষত্রিয়েরও আছে। কর্ণর বৈশিষ্ট্য তার তেজোদ্দীপনা, তার লড়াকু মনোভাব।”

“আর?”

“শুনেছি কর্ণ মহান দাতা। সূর্যের একনিষ্ঠ উপাসক। কিন্তু পাপমতি। ধৃতরাষ্ট্রর ব্রাহ্মণ মন্ত্রী কর্ণিক যেমন সবসময় পাণ্ডবদের বিরুদ্ধে তাকে প্ররোচিত করে, তেমনি কর্ণ করে দুর্যোধনকে। কর্ণ একই সঙ্গে নীচ ও সদাশয়। তার মধ্যে পরস্পরবিরোধী লক্ষণ প্রকট।”

“এবারে শোনো অর্জুন, কেউ যদি জানতে পারে, জন্মানো মাত্র, পাপবিদায়ের মতো মা তাকে জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল, যদি জানতে পারে সেই মা এমন একজন যার স্বীকৃতি পেলে সে হতে পারত ভুবনেশ্বর, যদি জানে যে, সূর্যের ঔরসে ক্ষত্রিয়কুলেই জন্ম তার, অথচ সে বড় হয়েছে সাধারণ একজন সারথির ঘরে, নীচজাতীয় বলে গুণ এবং ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও বিশ্বসংসারে কেউ তাকে ক্ষমা করেনি, জায়গা দেয়নি এতটুকু, অন্যায়ভাবে কুলপ্রসঙ্গ তুলে অপমান করা হয়েছে তাকে, দ্রোণাচার্য্য তাকে আপন করে নেয়নি, প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে মিথ্যা বলেছে পরশুরামকে, বিনিময়ে পেয়েছে অভিশাপ। রূপ গুণ রাজ্য বিদ্যা সমস্ত থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে যাকে প্রকাশ্য সভায় অপমান করেছে কৃষ্ণা সুন্দরী— সে ক্ষুব্ধ হবে না? ঈর্ষাপরায়ণ হবে না? অপ্রাপ্তি এবং অপমানে বিষিয়ে উঠবে না তার মন, অর্জুন? সে যে সব পাবারই অধিকারী ছিল, যোগ্য ছিল, যা যা পেয়েছ তোমরা— কৌরব আর পাণ্ডব। যুধিষ্ঠির থেকে সহদেব, দুর্যোধন থেকে যুযুৎসু!”

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর কাঁপা এবং ধরা গলায় অর্জুন বলল, “এ কি তুমি বসুষেণ কর্ণর কথা বলছ কৃষ্ণ? এ কি তার জীবনের কাহিনি?”

“আবার কার?”

“কী বলছ তুমি কৃষ্ণ? এ যে অবিশ্বাস্য! এত কষ্ট কর্ণর মনে? এত জ্বালা? কিন্তু আমি কেন? কেন আমাকেই সে ঈর্ষার পাত্র ভাবে?”

“কারণ, কুন্তীর গর্ভে তুমিই সবচেয়ে প্রতিভাবান। তুমিই শ্রেষ্ঠ।”

“তাতে কী? কৃষ্ণ! কে কর্ণর সেই মা? কে কৃষ্ণ?”

“কর্ণ তোমার সহোদর অর্জুন। সেই মা কুন্তী।”

“কৃষ্ণ!” বিছানায় উঠে বসেছে অর্জুন। দম আটকে আসছে তার। মাথার কাছে রাখা কুঁজো থেকে জল গড়িয়ে খেল সে। ধরা গলায় বলল, “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে কৃষ্ণ!”

“আমারও হয়, অর্জুন। কর্ণর কপালটা ভাবো তুমি। এত দুর্ভাগা কেউ আছে? বলো? বঞ্চনায় বিকৃত হয়ে উঠেছে তার মন। সে ভাবছে— ওই কুন্তীর তিনটে ছেলে। তা তিন ছেলেতেই যদি তার তৃপ্তি তবে আজকে কর্ণ যদি ভেসে না যেত তবে কর্ণ, যুধিষ্ঠির, ভীম এই তিনজনই হত কৌন্তেয়। অর্জুনের জন্মের কোনও দরকারই ছিল না! আর অর্জুন না জন্মালে কর্ণই পেত অর্জুনের মতো খ্যাতি, অবিসংবাদিত শ্রেষ্ঠত্ব! কষ্টে ঈর্ষায় অপমানে যন্ত্রণায় পুড়ে পুড়ে কর্ণর মনের আধখানাই এখন দগ্ধ দেহের মতোই গলিত, দুর্গন্ধযুক্ত। তাই দিয়েই তোমাকে সে দেখে। বাকি অর্ধেক কর্ণ দানশীল, সুহৃদ, প্রজাপালক রাজা! সূর্যের একনিষ্ঠ পূজক!”

“কর্ণ সূর্যর ছেলে?”

সূর্য কীসের ইঙ্গিত দিতে চায় বুঝল অর্জুন। কৃষ্ণকে সে বলল এই অনুভূতির কথা। কৃষ্ণ বলল, “আমার কর্ণর জন্য কষ্ট হয়, কুন্তীর জন্যও। দুর্বাসার সঙ্গে সূর্য এসেছিল কুন্তীভোজের বাড়িতে অতিথি হয়ে। দুর্বাসার কামনা সিদ্ধ করেছিল সূর্য। প্রায় বালিকা কুন্তীকে ভয় দেখিয়ে সঙ্গম করেছিল। কর্ণ তারই ফল। সেই কুন্তী পরে আরও তিন দেবতার সঙ্গে সঙ্গত হল। তিন ছেলে পেল। সব জেনেও সমাজ তাদের পাণ্ডুর ছেলে বলে স্বীকৃতি দিল। কিন্তু কর্ণ সেই ভেসে যাওয়া ছেলেই রয়ে গেল না অর্জুন? এমন তো নয়, কুমারী গর্ভের সন্তানকে সমাজ মেনে নেয় না? পরাশর মুনির বীজসম্ভূত সত্যবতীর ছেলে কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস সম্মান পায়নি? শুধু কি তাই? পাণ্ডু আর ধৃতরাষ্ট্র তো ব্যাসেরই ছেলে। এমনকী বিদুর। বিচিত্রবীর্যর দুই বউ বৈধব্য দশাতেই ব্যাসের সন্তান ধারণ করেনি? ব্যাসের জন্মের সময় সত্যবতীর সঙ্গে ভরতবংশের কোনও যোগই তো ছিল না। কিন্তু সত্যবতী নিজের কানীন সন্তানের পরিচয় দিয়ে যে-সাহস দেখিয়েছিল, কুন্তী তা পারেনি। যে-ভুল ভীষ্ম করেছিল ধৃতরাষ্ট্র বিষয়ে, সেই একই ভুল কুন্তী করেছে কর্ণ বিষয়ে। কুন্তীর কানীন ছেলেকে স্বীকৃতি দেবার ঔদার্য পাণ্ডুর ছিল বলেই আমি শুনেছি অর্জুন।”

গভীর বিষণ্ণ স্বরে অর্জুন বলল, “চলো কৃষ্ণ, আমার সমস্ত অস্ত্র আমি কর্ণর পায়ের কাছে রেখে আসি।”

“কোন দুঃখে?”

“কী করে তার মুখোমুখি হব আমি?”

“অর্জুন, তুমি বীর। শুধু দেহবলে বীর হওয়া যায় না, মনোবলেও অধিকার লাগে। যতক্ষণ কুন্তী স্বীকার না করছে, ততক্ষণ তোমার কোনও অধিকার নেই ভাই বলে কর্ণর গলা জড়িয়ে ধরবার। ধরলেও, ইতিহাস পাল্টে যাবে না অর্জুন। ঘটনার গতি হল নদীর স্রোতের মতো। তাকে উৎসের দিকে ঠেলে দেওয়া যায় না।”

“কুন্তী মা? সে জানে?”

“জানবে না? কর্ণকে লুকোন যায়? ওই সহজাত কবচ-কুণ্ডল! কেউ কি সোনার কবচ-কুণ্ডল নিয়ে জন্মায় অর্জুন? ওই চিহ্ন তো কুন্তীরই দেওয়া! ক্ষত্রিয়কুলে জন্মের স্বীকৃতি পাবার আশায় কর্ণ তা ধারণ করে আসছে। যেমন যেমন তার শরীর বড় হয়েছে, তেমনি বাড়ানো হয়েছে প্রতীক দুটি। ভাসিয়ে দিয়েও কুন্তী সন্তানকে চেনার পথ রেখেছিল। মাতৃত্ব এমনই আশ্চর্য অর্জুন। অর্জুন, সহোদর হলেই ভাই হওয়া যায় না। ভ্রাতৃত্ব একরকম মানসিকতা। অনাত্মীয়র সঙ্গেও তা হতে পারে। তোমাদের প্রতি ভাই ভাই মন যদি থাকত কর্ণর, সে এরকম করতে পারত না। তোমাদের অস্ত্রপরীক্ষার দিন— কত ছোট তুমি তখন, তুমি যত কৌশল দেখালে, যেচে এসে কর্ণও সেসব দেখাল। কেউ তাকে বারণ করেনি। কিন্তু সে বয়সে তোমার চেয়ে অন্তত পাঁচ বছরের বড় হওয়া সত্ত্বেও অকারণে তোমাকে দ্বন্দ্বে আহ্বান করে বসল। সে ক্ষত্রিয় হয়ে ওঠার জন্য ব্যাকুল কিন্তু যা করল তা ক্ষত্রিয়োচিত হল না। কেন দ্রোণ অনীহ ছিল কর্ণর প্রতি, তুমি কি জানো অর্জুন? গুরু হিসেবে দ্রোণ যথাসম্ভব নিরপেক্ষ তুমি জানো। তোমার শ্রেষ্ঠত্ব তুমি অর্জন করেছ প্রতিভা এবং অধ্যবসায়ে। যুধিষ্ঠির যে অস্ত্র পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে তিরস্কৃত হয়েছিল তার কারণ এই নয় দ্রোণ তাকে কম শিখিয়েছে। সে পারে না। তা হলে কর্ণ কেন দ্রোণ সম্পর্কে ক্ষোভ প্রকাশ করে? কারণ, সে দ্রোণের কাছে গিয়েছিল তোমার প্রতিপক্ষ হতে, সতীর্থ হতে নয়। দ্রোণের কাছে সে ব্রহ্মশির অস্ত্র চেয়েছিল ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হতে নয়, তোমাকে সংহার করতে। জানো তুমি? জানো না। দ্রোণ দেয়নি তাকে তাই তার রাগ। অর্জুন, কর্ণ তোমাদের প্রতি, বিশেষত তোমার প্রতি এতটুকু ভ্রাতৃভাব বোধ করে না। সে তোমাকে জাতশত্রু মনে করে। সে দুর্ভাগা কিন্তু পরিস্থিতি অতিক্রম করতে পারে না। সূতের ঘরে মানুষ হয়েও সে রথ চালানো ভাল করে শেখেনি। কারণ সে সূতের পেশা নেবে না। অথচ রথে চেপে যারা যুদ্ধ করবে, তাদের রথগতি জানা আবশ্যিক। না হলে অতিরথ, মহারথী হবে কী করে? কর্ণ পুরো সূত হল না, ক্ষত্রিয়ের সংস্কারও সে লাভ করল না। কর্ণ রাজা হয়েও দুর্যোধনের পদলেহী। সে ভৃত্যও নয় বন্ধুও নয়। অর্জুন কর্ণ দুর্ভাগ্যের শিকার। তোমায় তা মেনে নিতে হবে। অর্জুন, তুমি বীর ক্ষত্রিয়। তোমার কাছে বাপ-ঠাকুরদা ভাই-ছেলে বলে কিছু নেই। আজ যদি যুধিষ্ঠির তোমার বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরে, তোমাকে লড়তে হবে। ভীষ্ম, দ্রোণ, ভীমসেন বা সহদেব হলেও।”

“ভাবতেই পারছি না কৃষ্ণ।”

“এখন থেকে ভাবো। যুদ্ধক্ষেত্রে কেউ কিছু নয় অর্জুন, শুধু আত্মপক্ষ আর প্রতিপক্ষ।”

“শুধু তোমার বিরুদ্ধে আমাকে অস্ত্র ধরতে বোলো না কৃষ্ণ।”

“যদি বলি, তা হবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করা। সেটাই পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।”

একুশ

কৃষ্ণ আর অর্জুনের অনুরোধে আরও তিনমাস প্রভাসে থেকে গেল চিত্রসেন। কৃষ্ণ আর অর্জুনের সঙ্গ এত সমৃদ্ধ করে, এত আনন্দ দেয় যে, তারও ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করছিল না। সেই সঙ্গে তাদের মুগ্ধ করেছে কৃষ্ণর বাঁশি। কতদিন পরে বাঁশি ধরল কৃষ্ণ। তবু সে এতটুকু কিছু ভোলেনি। কিন্তু সব দুঃখেরই যেমন শেষ আছে, সব আনন্দেরও পরিসমাপ্তি আছে। চিত্রসেনকে তাই বিদায় নিতে হল।

প্রায় চার মাস অর্জুনকে গান শিখিয়েছে চিত্রসেন। মধুর গম্ভীর সুরঋদ্ধ কণ্ঠ তার ছিলই। তালিম পেয়ে অর্জুনের গান এখন সুরসিকের কাছেও প্রশংসনীয় হয়ে উঠেছে। নাচ শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করেছিল অর্জুন। কিন্তু অতি অল্প সময়ে তা পারা গেল না। চিত্রসেন বলল, “স্বর্গে যখন আসবে, সময় নিয়ে এসো অর্জুন। তখন তোমাকে নাচ শেখাব আমি।”

চিত্রসেনকে বিদায় দেবার আগে কৃষ্ণ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “বন্ধু, আমাদের একটি উপকার করতে হবে তোমায়।”

চিত্রসেন বলল, “তোমাদের জন্য আমি সাধ্যাতীত কাজ করতেও রাজি কৃষ্ণ। বলো কী করতে হবে।”

“তুমি জানো খাণ্ডববন দহন করা নিয়ে ইন্দ্র ও অগ্নির বিবাদ অনেকদিনের। এই অর্জুন ওই বন পুড়িয়ে অগ্নিকে তুষ্ট করতে পারে। তা হলে সে পেতে পারে ব্রহ্মার গাণ্ডীব ধনুক। কিন্তু অগ্নি যদি সাহায্য চায়, তবেই অর্জুন একাজ করতে পারে। আমিও তার সঙ্গে থাকব। আমরা যখন খাণ্ডব বনে যাব, জানাব তোমাকে, তুমি অগ্নিকে আমাদের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করবে। তার সঙ্গে অর্জুন যাতে পুরস্কার হিসেবে গাণ্ডীব পায়, তাও নিশ্চিত করবে।”

চিত্রসেন বলল, “তাই হবে কৃষ্ণ। শুধু গাণ্ডীব কেন, ওই বন পোড়াতে পারলে আরও অনেক কিছু পাবে তোমরা।”

চিত্রসেন চলে গেল।

এই ক’মাস অপূর্ব আনন্দে ছিল তিনজন। একজন চলে যাওয়ায় ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। কৃষ্ণরও এবার দ্বারকায় ফেরা দরকার। সে বলল, “অনেক তীর্থ হল অর্জুন। এবার দ্বারকায় চলো। থাকবে আমার কাছে।”

অর্জুন বলল, “ব্রহ্মচর্যের কাল এখনও তো পেরোয়নি কৃষ্ণ। দ্বারকায় গিয়ে তোমাদের আদরে যদি বিলাসব্যসনে ডুবে যাই?”

কৃষ্ণ বলল, “বেশ। তা হলে চলো দ্বারকার কাছে রৈবতক পাহাড়ে। অতি মনোরম সে জায়গা। তোমার বনে থাকাও হল। আমিও রোজ তোমার কাছে আসতে পারব।”

সেইরকমই ঠিক হল। অর্জুনের জন্য রৈবতকে আবাস তৈরির নির্দেশ গেল।

অর্জুন আশাই করেনি, অস্থায়ী আবাসও এমন সুসজ্জিত থাকবে। সে একটু বিচলিত হয়ে বলতে লাগল, “এতসব কীসের জন্য কৃষ্ণ? এ যে এলাহি ব্যাপার। বিলাসে যাতে অভ্যস্ত হয়ে না যাই, তাই আমি দ্বারকা গেলাম না। আর তুমি এসব কী করেছ?”

সুমধুর হেসে কৃষ্ণ বলল, “আমিও তো রোজ আসব অর্জুন। শোনো। এতটুকু দ্বিধা কোরো না। অনেক কষ্ট পেয়েছ এতগুলো বছর। এখন এই দু’বছর আমার হাতে নিজেকে ছেড়ে দাও। সব ভার দিয়ে দাও আমাকে অর্জুন। এখানে তেরাত্রি বাস করবে তুমি। তারপর আমি যেখানে নিয়ে যাব, সেখানে যাবে। এই তিন রাত্রি, তোমার যদি কৃচ্ছ্রসাধনার আরও বাসনা থাকে, সেরে নাও। আমি ঠিক তিনদিন পরে আসব।”

অর্জুন বলল, “মাত্র তিনদিনের জন্য এত আয়োজন?”

“না অর্জুন। কিছুদিন পরেই আমাদের বাৎসরিক উৎসব। তখন আমরা আবার এখানে এসে থাকব।”

কৃষ্ণ বিদায় নিয়ে গেল। তিনদিন, নিত্যকর্ম সেরে, রৈবতক পাহাড়ের বনপথে ঘুরে বেড়াল অর্জুন। একটি মন্দির পেয়ে তার চাতালে কিছুক্ষণ বসে থাকল। উলূপীকে ভাবল, চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে যাপিত মধুর সময়গুলো ভাবল। সেই ফুটফুটে শিশুটি, বভ্রূবাহন, ভাবল তার কথাও। আর ইরাবান, যাকে সে দেখেনি— তার কথাও মনে পড়ল অর্জুনের। আর মনে পড়ল পাঞ্চালীকে। তাকে ভাবলেই চিবুকাস্থি শক্ত হয়ে ওঠে তার। কী এক যন্ত্রণা ছড়িয়ে যায় দেহময়।

না। পাঞ্চালীকে ভাবতে চায় না অর্জুন। ভাবতে চায় না কারণ… কারণ… কুন্তী যখন বলল, “ভাগ করে নাও”, যুধিষ্ঠির যখন মাতৃবাক্য মিথ্যা না যায় বলে ঝাঁপিয়ে পড়ল, পাঞ্চালী কেন আপত্তি করল না? কেন বলল না, যে-মালা অর্জুনকে পরিয়েছে সে, তা ফিরে আর কাউকে পরাতে পারবে না? সে তো নীরবে মেনে নেবার মেয়ে নয়। যথেষ্ট প্রতিবাদী সে। যথেষ্ট বেপরোয়া। স্বয়ম্বর সভায় সারা পৃথিবীর রাজা-রাজড়ার সামনে, নিজেদেরই দেওয়া শর্তকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে, কর্ণকে প্রত্যাখ্যান করেনি সে? অপমান করেনি? শুধু ভীম আর যুধিষ্ঠিরের চোখই দেখেছিল সেদিন অর্জুন? দ্রৌপদীর চোখ দেখেনি? একা অর্জুনের চেয়ে, যুবরাজ যুধিষ্ঠির সহ পাঁচ-পাঁচজন রূপবান গুণবান পুরুষ অনেক বেশি লোভনীয় মনে হয়নি কি তার? কেন ভাববে পাঞ্চালীকে অর্জুন? চায় না। অর্জুন চায় না তাকে। পাঞ্চালীকে তার কোনও প্রয়োজন নেই।

চোখ জ্বালা করে উঠল অর্জুনের। সেদিন অর্জুন যা পারেনি, পাঞ্চালী তা পারত। নিজেকে পাঁচ খণ্ড করে দেওয়া সে-ই ঠেকাতে পারত।

সারা শরীর কাঁপতে লাগল অর্জুনের। একটি পাথরে বসে পড়ল সে। এই পাহাড়, বন, সরু শীর্ণ জলধারা, বনের পশু-পাখি, সবকিছুতেই পাঞ্চালীকে দেখতে লাগল সে। পাঞ্চালী তাকে এত ঘিরে আছে! পাঁচজনকে বরণ করে একা অর্জুনকে কি তুমি প্রত্যাখ্যানই করলে না ওই কর্ণের মতো? একজনে তুষ্ট নও কৃষ্ণা তুমি? নাকি কোনও মেয়েই নয়? সবারই মধ্যে লুকিয়ে থাকা পাঁচ পুরুষের আকাঙ্ক্ষাই বুঝিয়ে দিলে তুমি? একক পুরুষ অর্জুন একক পুরুষ কর্ণ— অর্জুন আর কর্ণকে ছুড়ে ফেললে এক জায়গায়?

কর্ণর অপমানিত ব্যথিত মুখ মনে পড়ে প্রবল বেগে কাঁদতে লাগল অর্জুন। কী কষ্ট ওই মানুষটার! কী কষ্ট! কেন কুন্তী বুকে টেনে নিল না তাকে? এ কোন সর্বনাশী লজ্জা? কেন নিল না দ্রৌপদী? এ কোন বিধ্বংসী অহং?

অস্থির হয়ে উঠল অর্জুন। তার পাগল পাগল লাগছে। নিজের চুলগুলি দু’হাতে টানতে লাগল সে। আজ এই একাকী সময় অসহনীয় লাগছে তার। কৃষ্ণকে তার দরকার। কেন কৃষ্ণ তিনদিন তাকে একলা রেখে গেল? নিজেকে শান্ত করার জন্য পাহাড়ি পথ বেয়ে ছুটতে লাগল অর্জুন। ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। পেশি ফুলে উঠছে। শক্ত হয়ে উঠছে গলার শিরা ধমনী। পাহাড়ের গায়ে সে ছুটতে লাগল এই ভেবে যে, কৃষ্ণ ঠিক বলেছে। সে কৃষ্ণর হাতেই নিজেকে সঁপে দেবে। দিনান্তের রাঙা আলোয় তাকে দেখাতে লাগল ধাবমান কালো ক্রুদ্ধ চিতার মতো।

বাইশ

সকালবেলায় আনন্দে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেল অর্জুন। তাকে নিয়ে যাবার জন্য সোনার রথ এনেছে কৃষ্ণ। স্বাস্থ্যবান ঘোড়াগুলোয় সোনার ঝালর পরানো। কৃষ্ণ আজ অপরূপ হয়ে সেজেছে। নীল বসন আর সোনার গয়না পরা কৃষ্ণকে দেখাচ্ছে যেন বর্ষামেঘের গায়ে চমকিত সৌদামিনী।

অর্জুনের জন্যও কৃষ্ণ এনেছে নরম রেশমের সুনীল বসন। বহুমূল্য অলঙ্কার। অর্জুনের সঙ্গীদের জন্যও এসেছে উপযুক্ত সাজ, উপযুক্ত শকট। দ্বারুকও আজ সাজসজ্জায় ত্রুটি রাখেনি। অর্জুন অভিভূত। এই সব তারই জন্য? অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণর ভালবাসা?

সোনার রথে চেপে কৃষ্ণর পাশে বসে দ্বারকার দিকে যেতে লাগল অর্জুন। কী বিরাট এই সম্মান! অর্জুন অভিভূত। নন্দিত। গণকেন্দ্রিক দেশ বলে রাজোচিত সম্মান পেতে রাজা হওয়ার প্রয়োজন নেই এখানে। এ হল বাসুদেব কৃষ্ণর দেশ। কৃষ্ণর আত্মীয়দের দেশ।

নগরে পৌঁছে সে দেখল সে আসবে বলে সারা দ্বারকা সেজে উঠেছে। পথের দু’পাশে লোকারণ্য। তারা ফুল আর মালা নিয়ে অর্জুনকে দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছে। সেই অর্জুন। মহাবীর অর্জুন। যারা তাদের দেখছে তারা আনন্দে বিস্ময়ে হর্ষধ্বনি করছে। এত ফুল ছুড়ছে যেন ফুলের বৃষ্টি হচ্ছে আকাশ থেকে। সব্বাই আজ খুশি, সব্বাই আজ পুলক জাগিয়ে পথের উপর এসে দাঁড়িয়েছে উৎসবের সাজপোশাকে। ভুবন আলো করা কালো রূপে, ভুবনজয়ী হাসি নিয়ে, ওই আসছে ভুবনমনোমোহন দুই বীরশ্রেষ্ঠ। লোকে কৃষ্ণকে চেনে। না হলে অপরিচিত জনের পক্ষে কৃষ্ণ আর অর্জুনকে আলাদা করে চেনা মুশকিল।

আনন্দে কৃষ্ণর হাত চেপে ধরল অর্জুন। তার সব দুঃখ চলে গেছে। সব কষ্ট মুছে গেছে। সে বলল, “জরাসন্ধকে বধ করব, শিশুপালকে মারব, ভীষ্মক আর রুক্মীকে ধরে আনব তোমার পায়ের কাছে, তোমার যত শত্রু সব শাতন করব আমি কৃষ্ণ।”

কৃষ্ণ হেসে বলল, “ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে তেমনি অর্জুনও শোভাযাত্রায় শত্রুশাতন করছে। ওসব এখন ভুলে যাও অর্জুন। আনন্দ নাও। আনন্দ নিতে শেখো। যুদ্ধ, শত্রুতা, প্রতিশোধ, নিধন— আমাদের জীবনটাই তো এই।”

“অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে যে কৃষ্ণ।”

“সে তো বুঝতেই পারছি। এখন ক’দিন তোমার শুধুই আনন্দ অর্জুন। তুমি তোমার কৃষ্ণর কাছে আছ।”

অর্জুনকে নিয়ে কৃষ্ণ নিজের বাড়িতে চলে গেল। কৃষ্ণর বউরা যেমন অর্জুনকে নিয়ে আনন্দ করতে লাগল, তেমনি অতিথি সমাগমে বাড়ি সরগরম হয়ে রইল। বলরাম, সাত্যকি, সারণ, গদ সব কৃষ্ণর ভাই বন্ধু দেখা করে গেল অর্জুনের সঙ্গে। কৃষ্ণও অর্জুনকে নিয়ে গেল উগ্রসেন, উদ্ধব, অক্রূর প্রমুখ বর্ষীয়ান কুলপ্রধানদের সঙ্গে দেখা করতে।

দেখতে দেখতে উৎসবের দিন চলে এল। দলে দলে লোক যেতে লাগল রৈবতক পাহাড়ে। বড়মানুষেরা যেমন গেল, তেমনি গেল সাধারণ লোকজন। পুরুষরা যেমন গেল, তেমনি গেল মেয়েরা। রঙে রঙে সেজে উঠেছে রৈবতক। বিকিকিনি, নাচগান চলছে। নানারকম খেলা, নাটক, পানভোজনের ব্যবস্থাও অঢেল। সারা দেশ একসঙ্গে ফুর্তি করতে এসেছে। বলরাম এমনিতেই মদ খেতে ভালবাসে। আজ উৎসবের দিনে ভালরকম মাধ্বী সেবন করে বউ রেবতীর গলা জড়িয়ে সে ক্রমাগত বলছে, “রেবতী, তুমি আমাকে ছাড়া কাউ-উ-উ-কে ভালবেসো না। কেমন?” মাতালের কাণ্ড দেখে রেবতী হাসছে। বলরামের মতো অনেকেই মাতলামি করছে। কিন্তু কেউই মাত্রাজ্ঞান হারায়নি।

এমন পরিবেশ আগে দেখেনি অর্জুন। তার খুব ভাল লাগছে। কৃষ্ণ তাকে একটুও কাছছাড়া করেনি। সে কৃষ্ণর সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখছে। একদল রূপসী মেয়ে এসে কৃষ্ণ আর অর্জুনকে ঘিরে দাঁড়াল। কথা বলল অবশ্য একজন। বলল, “কৃষ্ণ, এবার সেই জাদুকর আসেনি কেন, সেই যে তোমার রথ মায়াজালে অদৃশ্য করে দিয়েছিল। আর চোখ বেঁধে ভল্ল ছুড়ে লক্ষ্যভেদ করে, সেই লোকটাও আসেনি।”

কৃষ্ণ বলল, “প্রতিবার একই মজা এলে একঘেয়ে হয়ে যাবে না?”

“সামনের বার তুমি তাদের ডেকে আনবে তো কৃষ্ণ?”

“আনব ভদ্রা।”

অর্জুন অনিমেষ দেখছিল সেই মেয়েকে। কী অপার্থিব সৌন্দর্য মেয়েটার। চোখ ঝলসানো রোদ্দুরে, গ্রীষ্মের গা দগ্ধানো তাপে ওই মেয়ে যেন একগুচ্ছ প্রস্ফুটিত গন্ধরাজ।

কৃষ্ণর সঙ্গে কথা বলে নিজেদের মধ্যে কলকল করতে করতে তারা চলে যাচ্ছে, অর্জুন চোখ ফেরাতে পারছে না। কৃষ্ণ তাকে লক্ষ করছে, সে খেয়াল নেই। সে কোনওমতে বলে উঠল, “কী সুন্দর মেয়েটি। পাকা চিনিচম্পা কলার মতো গায়ের রং, পটলচেরা চোখ, পাকা ডালিম দু’টি গাল…”

কৃষ্ণ তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল, “পাকা করমচার মতো ঠোঁট, বুনো তেঁতুলের মতো কান, যজ্ঞ ডুমুরের মতো কানের লতি— এক কথায় বললেই হয় মেয়েটি একঝুড়ি পাকা ফল। কী হয়েছে তোমার অর্জুন? খিদে পেয়েছে নাকি?”

অর্জুন তাড়াতাড়ি লজ্জিত মুখে দৃষ্টি সরিয়ে বলল, “না কৃষ্ণ। মেয়েটি অসামান্য রূপসী। তাই বলছিলাম। চোখ যেন ফেরানো যায় না। মেয়েটি কে কৃষ্ণ?”

কৃষ্ণ হেসে হেসে বলল, “কথাগুলো ঠিক ব্রহ্মচারীর বলে মনে হচ্ছে না তো।”

“না না। আমি এমনি বলছিলাম। মেয়েটির স্বর এবং বাচনভঙ্গি দুইই অতি মধুর।”

“বুঝেছি। মন মজেছে।”

“না না, কৃষ্ণ।”

“ওকে বিয়ে করবে অর্জুন? ও আমার বোন ভদ্রা। সুভদ্রা। ওর কথা প্রভাসে থাকতে তোমাকে বলেছি আমি।”

“এক পরমাসুন্দরী বোনের কথা বলেছিলে ঠিকই কৃষ্ণ। তবে নাম বলেছিলে চিত্রা।”

“হুঁ! রমণীর নাম তো খুব মনে থাকে। শোনো চিত্রাই সুভদ্রা। যেমন শান্ত-স্নিগ্ধ দেখতে তেমনি তার স্বভাব। ওকে বিয়ে করলে তুমি সুখী হবে অর্জুন।”

“কৃষ্ণ, ও তোমার বোন। সেই সম্পর্কে আমারও বোন। ওকে আমি কীভাবে বিয়ে করতে পারি? থাক কৃষ্ণ। এ নিয়ে আর কথা বলে লাভ কী!”

“ব্যস! ওমনি অর্জুনকুমারের উত্সাহ দমে গেল। তুমি আগে বলো ওকে তোমার পছন্দ কিনা।”

“অত্যন্ত পছন্দ কৃষ্ণ। নিজে সে অনিন্দ্যকান্তিময়ী। তার ওপর সে তোমার বোন।”

“ব্যস! চলো, আমরা সেই ভবনে যাই। ওখানে গিয়ে বাকি কথা হবে।”

সেই সুসজ্জিত বাড়িতে, যেখানে তিনরাত্রি ছিল আর ভাবনায় পাগল হয়ে উঠেছিল অর্জুন, সেখানে এল তারা। কাদম্বরী আর খাবার নিয়ে বেশ আরাম করে বসে কৃষ্ণ বলল, “দেখো অর্জুন, ভদ্রা আমার বোন আর তাকে আমি খুব ভালবাসি। কিন্তু সে আমার সহোদরা নয়। সুভদ্রা সারণের সহোদরা। তা ছাড়া মামাতো-পিসতুতো ভাইবোনের বিয়ে আমাদের কুলে প্রচলিত। কুলসম্বন্ধ ধরলে রুক্মিণী ও সত্যভামা দু’জনেই কম-বেশি আমার আত্মীয়। আর তাই যদি বলো অর্জুন, ভাই-বোন সম্পর্ক খুঁজলে ভারতজোড়া ক্ষত্রিয়কুলে সবাই সবার ভাই বোন। যদুবংশ আর কুরুবংশই দেখো। দুইয়েরই উৎপত্তি যযাতি থেকে। কিন্তু সেসব ভাবলে চলে না। কে জানে, হয়তো কুলের আদি সম্বন্ধেই তুমি আর আমি প্রায় অভিন্নরূপ। দেখো অর্জুন, আমি চাই সুভদ্রাকে তুমি বিয়ে করো। এর একটা রাজনৈতিক দিক আছে। বলরামের ইচ্ছা, দুর্যোধনের সঙ্গে সুভদ্রার বিয়ে দেয়। বুঝতেই পারছ, বলরাম দুর্যোধনকে খুবই ভালবাসে, নিজের হাতে গদা চালনা শিখিয়েছে। তার ওপর বলরাম আমাদের রাজার মতো। সে আমার মতামত গুরুত্ব দেয়, এমনকী লঙ্ঘনও করে না। তবু, তার ইচ্ছেকে কখনও কখনও মান দিতেই হয় আমায়। সে সব ঠিক আছে। কিন্তু ভাবো অর্জুন, সুভদ্রা আমাদের অতি আদরের বোন। তার মাধ্যমে দুর্যোধন ও ধৃতরাষ্ট্রর সঙ্গে যদি যাদবদের বৈবাহিক সম্বন্ধ হয়, ইচ্ছে না থাকলেও কৌরবদের অনুকূল হতে হবে আমায়।”

“বুঝেছি কৃষ্ণ। আর বলতে হবে না। আমি রাজি। কিন্তু বলরাম কি মেনে নেবে?”

“সে নিয়ে তুমি ভেবো না। তুমি বরং দয়ানন্দকে ইন্দ্রপ্রস্থে পাঠিয়ে দাও। যুধিষ্ঠিরকে জানাও সুভদ্রাকে বিয়ে করতে চাও তুমি। যুধিষ্ঠির আপত্তি করবে না কারণ সে রাজনীতি বোঝে। তবু আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে যখন, জানানো দরকার।”

“তাই হবে কৃষ্ণ।”

“তা হলে সুভদ্রাকে তুমি কীভাবে বিয়ে করবে? সরাসরি যদি বসুদেবকে বলি বা বলরামকে বললে, সে কীরকম গোঁয়ার জানো তো, গোলমাল পাকিয়ে তুলবে। পাঁচজন পাঁচরকম মত দেবে। তার চেয়ে রাক্ষস বিবাহ করো তুমি। সুভদ্রাকে হরণ করো। স্বয়ম্বর সভার ব্যবস্থা করা যায়। কিন্তু তাতেও নিশ্চয়তা থাকে না তুমিই সুভদ্রাকে পাবে।”

“কৃষ্ণ, সুভদ্রাকে অর্জুন ছাড়া আর কেউ পাবে না।”

“এই তো, বীরের মতো কথা। এবারে যা যা বলছি মন দিয়ে শোনো।”

অর্জুনকে ছবি এঁকে বোঝাতে বসল কৃষ্ণ।

“প্রতি সোমবারে রৈবতক পাহাড়ের এই মন্দিরে পুজো দিতে যায় চিত্রা। সঙ্গে বন্ধুরা থাকে, ওই যাদের আজ দেখলে। রক্ষীও থাকে। এই মন্দির তুমি চেনো। এর চাতালে গিয়ে তুমি বসেছ।”

অর্জুন সবিস্ময়ে বলল, “সে খবর জানো তুমি?”

কৃষ্ণ হেসে বলল, “আর তো আমার চোখের বাইরে তোমায় যেতে দেব না অর্জুন। তা হলে অন্ধ হয়ে যাব। পাহাড়ের পথে কী পাগলের মতো ছুটছিলে তুমি? যদি দুর্ঘটনা হত? কী তোমায় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে আমি জানি অর্জুন।”

“তুমি যা বলছিলে, বলো।”

“বলবই তো। তার আগে শোনো অর্জুন, যে-নারী কাম্য এবং দুষ্প্রাপ্য নয়, তাকে নিয়ে বেশি ভেবো না। যে অল্পে সুখী তাকে অতিরিক্ত দিয়ো না। যে স্বামী পরিচয়ের বেশি আত্মপরিচয়ে সচেতন, তাতে নির্ভর করতে নেই, আর যে জ্বালায় বা জ্বলে— তার কাছে আত্মহারা হওয়ার অর্থ নিজের সর্বনাশ।”

অর্জুন কৃষ্ণর ডান হাতখানি নিজের হাতে নিয়ে বলল, “কৃষ্ণ, তোমার কথা আমি বুঝেছি। তুমি নিশ্চিন্ত হও। আমি বিচলিত হতে পারি কিন্তু এ ভুবনে কৃষ্ণ ছাড়া আর কারও হাতে আমি রথের রশি ছাড়ব না।”

কৃষ্ণ খুশি আর ভালবাসায় চক্ষু ভরিয়ে বলল, “অর্জুন, এমন কিছু কোরো না যাতে আমার তোমাকে হারাতে হয়। না দেহে, না মনে। আমি নিজেকে বাঁচাতে চাই বলেই তোমার জীবন চাই। তোমাকে চাই। আমার অভিন্ন তোমাকে। অর্জুন, আমার প্রিয় অর্জুন, ভুলো না, তুমি আমার অবলম্বন।”

“আর তুমি আমার। তুমি এখন প্রশান্ত মনে তোমার পরিকল্পনা আমায় বলো।”

“বেশ। আমি তোমাকে খুব ভাল দু’ঘোড়ার রথ দেব। চিত্রা যখন পুজো দিয়ে নেমে আসবে, তুমি তাকে তুলে নিয়ে পালাবে। রক্ষীরা তোমার কোনও সমস্যা নয়। তুমি সশস্ত্র যাবে। এবার আমাদের ছেলেরা খবর পেলে ধর ধর মার মার করে তোমার পিছু নেবে। তাদের তুমি সামলাবে। আর আমি সামলাব কুলপতিদের। কোন যুক্তিতে তাদের অনুকূলে আনা যায়, সব ভেবে রাখব আমি। তাদের বোঝাব, অর্জুনের সঙ্গে শত্রুতার অর্থ পাণ্ডবদের সঙ্গে বৈরিতা ডেকে আনা। তাতে যাদব-বৃষ্ণিদের কোনও লাভ নেই। আর শোনো, তোমাকে যদি কেউ তাড়া না করে, যদি তোমাকে যুদ্ধ করতে না হয়, তুমি কিন্তু রথ নিয়ে দূরে চলে যেয়ো না। কোনও ছায়া-টায়া দেখে দাঁড়িয়ে থেকো। সুভদ্রার সঙ্গে আলাপচারী কোরো। আমি তোমাদের সাদরে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।”

তেইশ

স্বপ্নের মতো একটি বছর কেটে গেল দ্বারকায়। কৃষ্ণকে বড় কাছে পেল অর্জুন। প্রাণ ভরে পেল। আর পেল চিত্রা নামের কন্যাকে। সোনার বরণ মেয়ে সুভদ্রা মন প্রাণ সঁপে দিয়েছে অর্জুনে। আর, একজন সুগৃহিণী পুরুষকে যে সুখ-শান্তি দেয়, সুভদ্রার কাছে তাই পেয়েছে অর্জুন।

আলতা-লাল শাড়ি খুব পছন্দ সুভদ্রার। গ্রীষ্মের দারুণ দাহনকালেও প্রভাতী ঊষার রাঙারূপ যেমন স্নিগ্ধ, তেমনি রাঙা শাড়িতে সুভদ্রা। অর্জুনের মনে হয়, সুভদ্রা গাঁয়ের শান্ত দিঘির জল। গভীর কিন্তু স্বচ্ছ। হাওয়া তার বুকে ঢেউ তোলে, কিন্তু সে ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ে না। আপনাতে আপনি মিলিয়ে যায়। সুভদ্রা এক পরিমিত মেয়ে। তার কথা, তার হাসি, তার প্রকাশ, এমনকী সে যখন কামরূপী— তখনও, সে তীব্র হয়ে ওঠে না। সুভদ্রার উপস্থিতি নিঃশব্দ, কিন্তু সর্বব্যাপী, অর্জুনের সারাটি দিনের সবখানে তার হাতের পরশ থাকে। চোখ দু’টিতে, কৃষ্ণর মতোই, খুশির মায়া। ছোট ছেলে যখন কেঁদেকেটে দুঃখ-শোক ভুলে চুপ করে, মা যেমন পরম মমতায় আঁচল দিয়ে মুছে দেয় তার গালে জলের দাগ, সুভদ্রা অর্জুনের সেই নরম আটপৌরে আঁচলখানি।

শুধু সুভদ্রাকেই নয়, এই এক বছরে অর্জুন যেমন কৃষ্ণকেও প্রাণভরে কাছে পেয়েছে তেমনি ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে সত্যভামা, জাম্ববতী, রুক্মিণী এবং সাত্যকি ও প্রদ্যুম্নর সঙ্গে। অর্জুন এখন কৃষ্ণর সখা মাত্র নয়। তার ঘরের ছেলে। উগ্রসেন, বসুদেবের মতো বয়স্করা এবং দেবকী, রোহিণীর মতো জননী স্থানীয় নারীও অর্জুনকে স্নেহে ভরিয়ে দিয়েছে। এত ভালবাসায়, নিরুদ্বেগে, আনন্দে আর কখনও দিন যায়নি অর্জুনের। কৃষ্ণ সাহচর্যে মস্ত পাওয়া, সে সহজে উদ্বেগ মুছে দেয়, দুঃখ ভুলিয়ে দেয়, যে কোনও কঠিন কাজকেই সহজ করে তোলে। কিন্তু আমোদ প্রমোদ বিলাস আনন্দ— কোনও কিছুর মধ্যেই সে লক্ষ্যচ্যুত হয় না। বিস্মৃত হয় না করণীয়।

এরই মধ্যে পরশুরাম এসেছিল প্রভাসে। পরম সম্মানে কৃষ্ণ তাকে দ্বারকায় নিয়ে এসেছিল। শুধু তাই নয়, তার সেবাযত্ন করেছে এমন যে, প্রবীণ পরশুরাম খুশি হয়ে বলেছে, “বলো কৃষ্ণ, কী চাও তুমি।”

কৃষ্ণ বলেছে, “আমি চাই, তুমি অর্জুনকে শিক্ষা দাও কিছুদিন। দাও তোমার বিদ্যা। সে যেন অপ্রতিরোধ্য, অপরাজেয় হয়।”

পরশুরাম আনন্দের সঙ্গে রাজি হয়েছিল। ছ’মাস নিয়মিত পরশুরামের কাছে পাঠ নিয়েছে অর্জুন। এসবই হয়েছে কৃষ্ণর উদ্যোগে। অর্জুনের কতদিনের বাসনা ছিল পরশুরামের কাছে শিক্ষা নেয়। কৃষ্ণ তা পূর্ণ করেছে।

কৃষ্ণর শত্রুদের নিয়েও আলোচনা হয়েছে তার সঙ্গে। সেই যেদিন সে সোনার রথে চেপে কৃষ্ণর পাশে বসে দ্বারকা এসেছিল, কৃষ্ণর প্রতি ভালবাসায় প্রথমেই তার মনে হয়েছিল কৃষ্ণর শত্রু নাশ করে। সে কেবল ভাসমান ভাবনামাত্র ছিল না। সুভদ্রার সঙ্গে বিয়ের উৎসব মিটে যাবার পর যখন সব কিছু শান্ত, জরাসন্ধ শিশুপাল এদের মারার কথা বলেছিল অর্জুন। কৃষ্ণ বলে, “হ্যাঁ, তোমার সহায়তা তো চাই-ই আমার। কিন্তু এখন নয়। দেখো, জরাসন্ধ অত্যন্ত ক্ষমতাশীল রাজা। তাকে বেশ ক’বার যুদ্ধে হারিয়েছি বলেই লোকে আমার এমন গুণকীর্তন করে। আমাকে মানে। কংসকে মেরেছি বলেও নয়। আবার ওই জরাসন্ধর উত্পাতেই মথুরা থেকে বাস উঠিয়ে আমাদের এই কুশস্থলীতে আসতে হয়েছে। কুশস্থলী কী ছিল ভাবতে পারবে না অর্জুন। একেবারে জঙ্গল। তাকে কেটে পরিষ্কার করে ঘর-বাড়ি বানিয়ে এই দ্বারকার রূপ দেওয়া কি সহজ কাজ? তা ছাড়া এক জায়গার বসবাস, যেখানে সকলের কত স্মৃতি কত ভালবাসা, পূর্বজনের ছোঁয়া লাগা মাটি— সেইসব ছেড়ে আসার কষ্ট আছে না? সেই কষ্টই আমরা করেছি ওই জরাসন্ধর জন্য। সে আমাদের দেশ-ছাড়া করেছে। জরাসন্ধকে মারলে তার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে ভারত জুড়ে। কে আমাদের পক্ষে, কে নয়, তার স্পষ্ট কোনও ধারণা এখনও আমাদের নেই। তুমি ফিরে গেলে ইন্দ্রপ্রস্থে রাজসূয় যজ্ঞ করবে আমাদের রাজা যুধিষ্ঠির। তখন আমরা আমাদের পক্ষে-বিপক্ষে দেশগুলি সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারব। সেই বুঝে জরাসন্ধ বধের পরিকল্পনা করব আমরা। আর একটা কথা কী জানো অর্জুন, জরাসন্ধের মধ্যে একটা দানবীয় ব্যাপার আছে। ক্ষমতার অহংকার, বলদর্প, হিংসা আর চণ্ডকৌশিক ঋষির আশীর্বাদে সে আসুরিক। তার জামাই কংসকে মেরেছি বলে আমার নাম মনে পড়লেই সে ক্ষ্যাপা ষাঁড়ের মতো মথুরা আক্রমণ করেছে। দেখো, যজ্ঞের আগেও আমরা তাকে মারতে পারি, পরেও। কিন্তু জরাসন্ধকে মারতে যে-ধরনটা দরকার, তা তোমার ধরন নয় অর্জুন। তা হল ভীমের কাজ। শোনো অর্জুন, তুমি হলে মনে-প্রাণে শিল্পী। ভাল গান গাও বলে নয়। তোমার সুরুচি, তোমার মনের সূক্ষ্ম গতি শিল্পীর লক্ষণ। আর শিল্পী তুমি ধনুর্বাণে। চিত্রকর যেমন তুলিতে আঁকে জগৎ, তেমনি তোমার তির ছবি ফুটিয়ে তোলে শূন্যে। যুদ্ধেও নাকি তুমি অতি রুচিশীল, সবরকম বীভত্সতা পরিহার করে চলো। লোকে তাই তোমার নাম দিয়েছে বীভত্সু। তাই জরাসন্ধকে মারতে তোমার সাহায্য তো নেবই, কিন্তু ভীমই হবে এ কাজের যোগ্য লোক। শিশুপালের কথা বলছ? তার দিন ঘনিয়ে এসেছে অর্জুন। ভীষ্মক আর রুক্মী জরাসন্ধর বলে বলীয়ান। তাদের কথা আপাতত ভাবারই দরকার নেই।”

অর্জুন বুঝেছে, সে অনেক দূর ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। কৃষ্ণ দেখে দূরতর। তবু একটি কথা সে না বলে পারেনি। বলেছে, “দেখো কৃষ্ণ, রাজসূয় যজ্ঞের আগেই জরাসন্ধকে মারা অনেক বেশি যুক্তিযুক্ত। যুধিষ্ঠিরের যজ্ঞ সে কিছুতেই ভালভাবে হতে দেবে না। রাজাদের মধ্যে আমাদের শত্রু মিত্রর অনুপাত যাই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত জরাসন্ধকে আমাদের শায়েস্তা করতেই হবে। তাকে বাঁচিয়ে রেখে কার্যসিদ্ধি হবে না। তাকে মরতে হবে। আর তা রাজসূয়র আগেই।”

কৃষ্ণ হেসে বলেছে, “বন্ধু, তুমি তো রীতিমতো বিচক্ষণ হয়ে উঠেছ দেখছি। বুঝেছি, পুরুষের বুদ্ধি খোলে বিয়ের পর।”

অর্জুন বলে, “যত বিয়ে তত বুদ্ধি। তাই তো পুরুষোত্তম কৃষ্ণর তুলনীয় বুদ্ধিমান ত্রিভুবনে নেই।”

হা হা করে হেসে উঠেছিল কৃষ্ণ। তার আটটি বউ। নিন্দুকে বলে কয়েক হাজার।

বারো বছরের নির্বাসন শেষ হতে আর মাত্র তিনমাস বাকি। পাঁচ প্রধান তীর্থের মধ্যে পুষ্কর যাওয়া বাকি ছিল অর্জুনের। সুভদ্রাকে নিয়ে পুষ্কর যাত্রা করল সে। পুষ্কর থেকে সোজা চলে যাবে ইন্দ্রপ্রস্থ। উলূপী বা চিত্রাঙ্গদার মতো সুভদ্রাকেও বাপের বাড়িতে ফেলে যাবার কথা অর্জুন ভাবতেও পারল না। তার ব্রহ্মচর্যকাল প্রায় শেষ। আর সুভদ্রা কোনও পার্বত্য উপজাতির মেয়েও নয়। সে কৃষ্ণ-বলরামের বোন, পাণ্ডবদের সমান কুলগৌরব তাদের। অর্জুন তাই একেবারে নিজের বউকে সঙ্গে নিয়ে চলল। কতদিন পর মা-ভাইয়ের কাছে ফিরছে, তার মনে ভারী আনন্দ। তার ওপর কৃষ্ণ বলেছে, “তুমি সুভদ্রাকে নিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে পৌঁছলেই আমরা সব যাব সেখানে। খুশি মনে অর্জুন পুষ্করে উপস্থিত হল।”

মরু অঞ্চলের মধ্যে পুষ্করতীর্থ। সাধারণত তীর্থগুলি হয় নদীর পাশে। পুষ্করে নদী নেই। ছোট ছোট পাহাড়, বালি, কাঁটাগাছ। কিম্ভূত চেহারা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে উটের দল। একটি বিরাট দিঘির পাশে রয়েছে ব্রহ্মার মন্দির। অর্জুন আর সুভদ্রা মন্দিরে পুজো দিয়ে এল।

এক বিকেলবেলা লাল শাড়ি পরে অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছে সুভদ্রা। গয়া, গঙ্গাদ্বার বা প্রভাসের মতো জনসামাগম এখানে নেই। তাই মনের আনন্দে যেখানে সেখানে তারা ঘুরে বেড়ায়। কখনও বালির ওপর বসে পড়ে। কখনও টিলায় উঠে দূর মরুদেশের রুক্ষ রূপে বিমোহিত হয়ে যায়। কখনও উটের গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে সুভদ্রা, আরও আদর পাবার জন্য তারা সুভদ্রার হাতের কাছে গলা নামিয়ে আনে। সন্ধ্যাবেলা খোলা আকাশতলে বসে সুভদ্রাকে গান শোনায় অর্জুন। এখানে বৃষ্টি বিরল। কিন্তু কী যে হল, লাল শাড়ি পরে অর্জুনের সঙ্গে বেড়াচ্ছে সুভদ্রা, আর কালো একটি মেঘখণ্ড সূর্য ঢেকে দিল। হিরের দ্যুতির মতো সূর্যের আলোকছটা মেঘের চারপাশে ফুটে রইল। সেইদিকে তাকিয়ে একটু আনমনা হয়ে উঠল অর্জুন। বলে উঠল, “দেখো ভদ্রা, ওই যে মেঘ দেখছ, আমাদের পাঞ্চালী ঠিক ওইরকম। ওমনি কালো সে। আর ওইরকম রূপের ছটা তার।” সুভদ্রা তাকাল অর্জুনের দিকে। দেখল তার চোখে-মুখে মুগ্ধতা। অর্জুন যখন উলূপীর কথা তাকে বলেছে, চিত্রাঙ্গদার কথা বলেছে, এমন পরিপ্লুত হতে তাকে দেখেনি সুভদ্রা। সে বুঝল, যত ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার দিন ঘনিয়ে আসছে, তত পাঞ্চালীর জন্য আকুলতা বেড়ে উঠছে অর্জুনের।

সুভদ্রা ভয় পেল না, ঈর্ষাও করল না। অর্জুন তার ভালবাসার মানুষ। অর্জুন আছে তার মনের মধ্যে, যেমন কৌটোর মধ্যে, স্বর্ণসম্পুটের গোপনীয়তায় ধরা থাকে রূপকথার রাক্ষসীটির প্রাণভ্রমর। সুভদ্রা না চাইলে কেউ তা মেরে ফেলতে পারবে না। উড়িয়ে দিতেও নয়। অর্জুনের জন্য মায়ায় ভরে উঠল তার মন। কী তার করা উচিত, ভাবতে লাগল সে। কৃষ্ণকে মনে পড়ল তার। সে বলেছিল, “চিত্রা, অর্জুনের প্রিয়সাধন কোরো। তাকে সেই শান্তি দিয়ো যা তোমার মনের মধ্যে অশেষ হয়ে আছে। আমি তোমায় যেমন ভালবাসি, তেমনি অর্জুনকে।”

সুভদ্রা মনে মনে বলল— তাই হবে কৃষ্ণ, তাই হবে।

ইন্দ্রপ্রস্থে রওনা হওয়ার আগের রাতে সুভদ্রাকে বুকের কাছে নিয়ে অর্জুন বলল, “তুমি ভারী শান্ত মেয়ে ভদ্রা, ভারী নরম তুমি। শুনেছি অন্তঃপুরে মেয়েদের যে-জগৎ, সেখানেও পুরুষের রুক্ষ জগতের মতো অহং, দর্প, ক্ষমতা ও ঈর্ষার লড়াই চলে। অবহেলা, অপমান, অত্যাচারও চলে দুর্বলের ওপর। ভদ্রা, তুমি খুব আদরে পালিত হয়েছ। দুর্ব্যবহারের বিপ্রতীপে কর্কশ হওয়ার মেয়েও তুমি নও। আমার মা কুন্তী খুব ভাল। সে তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালবাসবে। কিন্তু আরও তো মেয়েরা আছে সেখানে ভদ্রা। তোমাকে নিয়ে তাই ভাবছি আমি।”

সুভদ্রা একটু উঠে অর্জুনের কপালে চুমু খেল। অর্জুনের বাঁশির মতো নাকে নিজের তিলফুলের মতো নাকটি ঘষে দিয়ে বলল, “অর্জুন। আমাকে কেউ খাটো করবে কেন? জানো, আমাদের মথুরায় কুন্তীর মধুর ব্যবহারের কথা এখনও সবাই বলে। দ্বারকার যারা পুরনো মানুষ তারা বলে, কুন্তীর মতো লক্ষ্মী মেয়ে খুব কম হয়। সে যেমন সুন্দরী, তেমনি তার মায়া-দয়া আর আন্তরিক ব্যবহার। তুমি অর্জুন, কুন্তী মা-র গুণ পেয়েছ বলেই না লোকে তোমায় এত ভালবাসে! সেই কুন্তী মা-র সংসারে আমার কিছু ভয় নেই।”

“সবাই কুন্তী মা-র মতো নাও হতে পারে ভদ্রা।”

সুভদ্রা বুঝতে পারছে, কার কথা বলছে অর্জুন। কাকে নিয়ে তার দুর্ভাবনা। ধনে, মানে, ক্ষমতায়, কুলগৌরবে সুভদ্রার বংশ দ্রুপদের চেয়ে বেশি বই কম নয়। অহংকার করবার মতো রূপ সুভদ্রারও আছে। যে-মেয়ে অন্তঃপুরের একেশ্বরী হয়ে আছে এতদিন, সুভদ্রার উপস্থিতি তার পছন্দ না হওয়ারই কথা। তার ওপর, আগের দুই বউকে অর্জুন সঙ্গে আনেনি। এনেছে সুভদ্রাকে। অর্থাৎ সে অর্জুনের চিরসঙ্গিনী। পাঞ্চালীর পক্ষে ঈর্ষার কারণ এর চেয়ে বড় কিছু হয় না। তার পরেও, সুভদ্রা জানে, অর্জুনের জন্য, কত-শত উপহারের আয়োজন করছে কৃষ্ণ-বলরাম। অনেক অনেক সোনা-গয়না ধনরত্ন তো আছেই, আরও আছে বহুমূল্য বস্ত্র, এমন সব বসন যা হাতের মুঠোয় লুকিয়ে ফেলা যায়, আবার তাকেই একশোবার ফেরতা দিয়ে মুড়ে ফেলা যায় শরীর— এ হল জাম্ববতীর বাপের বাড়ির জিনিস, আছে সুন্দর সব ঘর সাজাবার সামগ্রী, সোনারুপোর বাসন, অস্ত্র-শস্ত্র, রথ, এক হাজার গোরু, পাঁচশো হাতি, দু’হাজার ঘোড়া আর দাস-দাসী। যুধিষ্ঠিরের সম্পদ একেবারে দ্বিগুণ করে দিতে আসছে কৃষ্ণ।

সুভদ্রা জানে, বাপের বাড়ির কেউ ক্ষমতাবান হলে, বাপের বাড়ি থেকে প্রচুর দিলে-থুলে শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের গৌরব বেড়ে যায়। ঐশ্বর্যে মোড়া আত্মীয়তার মূল্য সবসময়ই বেশি। পাঞ্চালীও এ কথা জানে। তাই, সুভদ্রার আগমনে পাঞ্চালীর উল্লসিত হবার একটি কারণও নেই।

কিন্তু সুভদ্রা কৃষ্ণর বোন। কৃষ্ণর আদর শুধু নয়, তার আদর্শ ও বুদ্ধির প্রভাবে প্রভাবিত। সে জানে, মানীকে তুষ্ট করতে হয় বিনয়ে, দানীকে তুষ্টি করতে হয় প্রার্থনা করে, বিদ্বান তুষ্ট স্বীকৃতি দ্বারা, ধনী আর রূপগর্বী তুষ্ট প্রশংসায়। আর আত্মাভিমানীকে তুষ্ট করতে হয় আত্মনিবেদনে। বলতে হয়, আমি তোমার দাসানুদাস।

সুভদ্রা অর্জুনকে আশ্বস্ত করে বলল, “তুমি ভেবো না অর্জুন। আমি তো কৃষ্ণর বোন। সে আমাকে শক্তি দেবে।”

চব্বিশ

ইন্দ্রপ্রস্থ আজ খুশি। নিশ্চিন্ত। বারো বছর পর আজ অর্জুন ফিরে এসেছে।

যদিও, কৃষ্ণর মতো করে কেউ তার জন্য সোনার রথ আনেনি, উৎসবমুখরতায় ভরে তোলেনি সারা নগরী। দ্বারকার মতো, পুষ্পবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে, শোভাযাত্রা করে ইন্দ্রপ্রস্থে প্রবেশ করেনি ঘরের ছেলে অর্জুন। যুধিষ্ঠিরও ছুটে এসে, ভাই আমার, কতদিন পর তোমাকে দেখলাম, বলে আবেগ দেখায়নি। বরং, অর্জুনই প্রথমে গেল যুধিষ্ঠিরের কাছে। সভাস্থ ব্রাহ্মণ ও অমাত্যদের সঙ্গে দেখা করে আর অপেক্ষা করতে পারল না অর্জুন। কুন্তী মা-র কাছে যাবার আগেই সে পাঞ্চালীর কাছে ছুটে গেল ঠিক যেভাবে আতপ্ত হরিণ হরিণীর কাছে ছুটে যায়।

রাগে দপদপ করতে করতে অর্জুনের দিকে খর চোখে তাকিয়ে পাঞ্চালী বলল, “এখানে হঠাৎ? তোমার যাদবসুন্দরী ঘর থেকে তাড়িয়ে দিল নাকি?”

যে-তীব্র আকর্ষণে ছুটে এসেছিল অর্জুন, তা একেবারে মুছে গেল। অপমানে কান দু’টি জ্বালা করে উঠল তার। পাঞ্চালীর ব্যবহারের কাঠিন্য এবং ভাষার হীনতা তাকে বিদ্ধ করল। সে কাতর স্বরে বলল, “কৃষ্ণা, আমার ওপর ক্ষুব্ধ তুমি?”

ফুঁসে উঠল পাঞ্চালী। বলল, “ক্ষুব্ধ? কেন? ক্ষোভের কী আছে? কী করেছ তুমি অর্জুন যে, ক্ষোভ হবে আমার?”

মাথা নিচু করে চুপ রইল অর্জুন। তার প্রাণ কেঁদে উঠল। পাঞ্চালীর এই তেতো বাঁকা ব্যঙ্গের আড়ালে যে-কান্না তা দেখতে পাচ্ছিল সে। এই মুহূর্তে দ্রৌপদীকে তার দেবার ছিল গভীর চুম্বন, পরম আদর, অমোঘ সঙ্গম। এই বারো বছরে দ্রৌপদী আরও সুন্দর আরও আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। কিন্তু সে দ্রৌপদী কৃষ্ণাকে স্পর্শমাত্র করার চেষ্টা করল না। হিসেব মতো, পাঞ্চালী এখন ভীমের বউ।

অর্জুনের নীরবতায় আরও রেগে উঠে পাঞ্চালী বলল, “আরও দু-চারটে বিয়ে করে আসতে পারতে তো অর্জুন। তা হলে যে-সাত পাকে আমাকে বেঁধেছ তা খুলে পড়ত। তুমি খুব ভালই জানো, এক বাঁধনের ওপর নতুন করে প্যাঁচ দিলে প্রথম প্যাঁচ আলগা হয়ে যায়।”

অর্জুন আর পারল না। অন্তর্মুখী, মিতবাক অর্জুন বলে ফেলল, “কৃষ্ণা, আমি তো তোমারই।”

“চুপ করো। প্রতারকের মতো কথা বানিয়ো না ফাল্গুনী।”

পাঞ্চালী কেঁদে উঠল। দু’হাতে মুখ ঢেকে রোদনোচ্ছাসে সে বলল, “যাও, যাও অর্জুন। চলে যাও। তোমাকে সহ্য করতে পারছি না আমি।”

অর্জুন চলে গেল। হতমান। বেদনাবিধুর। অভিমানী। দ্রৌপদী তাকে বুঝল না! গত বারো বছরে পাঞ্চালীকে সে ভাবতে পর্যন্ত চায়নি পাছে তার টানে সব নিষেধ ভেঙেচুরে দেয় সে। কী করা উচিত ছিল তার? আর কোনও নারীকে স্পর্শমাত্র না করে পাঞ্চালীর জন্য জীবন উৎসর্গ দেওয়া? পায়ে পায়ে নিজের ঘরে এল সে। অর্জুনের বিবর্ণ বিষণ্ণ মুখ আর সজল সুন্দর চোখ দু’টির দিকে তাকিয়ে ইন্দ্রপ্রস্থে সদ্য আগত বধূ সুভদ্রা বলল, “সবার সঙ্গে দেখা করে এলে?”

সুভদ্রার মাথায় হাত ছুঁইয়ে অর্জুন জানালার কাছে বসল। উদাসভাবে চেয়ে রইল বাইরের দিকে। সুভদ্রা একটি একটি করে খুলতে লাগল তার গয়নাগাঁটি। লাল টকটকে বহুমূল্য রেশমি শাড়িটি খুলে পরে নিল লাল পেড়ে সাদা আটপৌরে শাড়ি। অতি সাধারণ এই শাড়িতেও তার রূপের স্নিগ্ধ বিভা লুকোন রইল না। অর্জুনের জানু ছুঁয়ে সে বলল, “যাই। প্রণাম করে আসি।” স্পর্শটুকু ভারী ভাল লাগল অর্জুনের। সে মনে মনে চাইছিল সুভদ্রা আর কিছুক্ষণ থাকুক। কিন্তু বলতে পারল না।

সুভদ্রা প্রথমেই গেল কুন্তীর কাছে। কুন্তী তাকে বুকে জড়িয়ে অনেক আদর করল। প্রাণ খুলে তাকে আশীর্বাদ করল। মথুরা-দ্বারকার প্রবীণদের কুশল জানল। কিন্তু একটিবারও জিজ্ঞেস করল না কেন এমন আটপৌরে শাড়ি পরে গয়লানির মতো হয়ে আছে সুভদ্রা। বুদ্ধিমতী বহুদর্শী কুন্তী তার বাপের কুলের মেয়েটির মন বুঝে যেমন মায়া অনুভব করল, তেমনি গর্ব বোধ হল তার। এক অনুচরীকে ডেকে সে বলল, “সুভদ্রাকে দ্রৌপদীর কাছে নিয়ে যাও।”

ঠিক যেমন বসে ছিল অর্জুন, তেমনি দ্রৌপদীও বসে ছিল জানালার কাছে। তার চুল এলোমেলো। চোখের কোণ লাল। ভারী। কেঁদে কেঁদে মুখখানা ফুলে আছে। সুভদ্রার মনে হল, আগুনের শিখা যদি কালো রঙের হত, যেমন দেখাত, কিংবা মেঘ যদি হত লাল টকটকে আর বিদ্যুৎ হত কালো— দ্রৌপদী সেই আগুন, সেই বিদ্যুল্লেখা। রূপবতী অনেক দেখেছে সুভদ্রা, প্রতিবিম্বে নিজেকে দেখেছে। কিন্তু দ্রৌপদীকে দেখে তার মনে হল এ শুধু রূপ নয়, তার সঙ্গে তেজ। শুধু তেজও নয়, তার সঙ্গে অহংকার, শুধু অহংকারও নয়, তার সঙ্গে জ্ঞানবুদ্ধির দীপ্ত বেপরোয়া শিখাটি দ্রৌপদীতে ছেয়ে আছে। পূর্ণতেজ মধ্যাহ্নসূর্য দেখলে যেমন চোখ ঝলসে যায়, দ্রৌপদীর তেমনি নয়ন অন্ধ করা রূপ। সুভদ্রা নতজানু হয়ে বসল তার পায়ের কাছে। পা ছুঁয়ে বলল, “আমি ত্রিভুবনখ্যাত সুন্দরী দ্রৌপদীর নতুন দাসী। আমি সুভদ্রা। যদুবংশীয় বসুদেবের মেয়ে আমি। কৃষ্ণ বলরামের বোন।”

দ্রৌপদী দেখতে লাগল সুভদ্রাকে। কী সরল নরম অপাপবিদ্ধ মুখ। ধনে মানে বিখ্যাত যাদবদের এই মেয়েটা তার বহুমূল্য পোশাক অলংকার সাজসজ্জার সঙ্গে অহংকারও সরিয়ে রেখে দীনভাবে তার পায়ে পড়েছে দাসীর পরিচয়ে। কেন? যাতে দ্রৌপদী তুষ্ট হয়। যাতে দ্রৌপদী বুঝতে পারে, সুভদ্রা দ্রৌপদীর অর্জুনকে কেড়ে নেয়নি, নেবে না। কেন বোঝাতে চায় সে দ্রৌপদীকে? কারণ দ্রৌপদী ভাল থাকলে, ভাল থাকবে অর্জুন। সুভদ্রা আজ সব বিসর্জন দিয়েছে শুধু অর্জুনকে ভাল রাখার জন্য। কত ভালবাসে মেয়েটা অর্জুনকে! কী গভীর করে ভালবাসে! জানে না, মেয়েটা জানে না, যে-অর্জুনকে কাছের লাগে, সে-ই কত লক্ষ যোজন দূরের।

কষ্ট টাটিয়ে উঠল দ্রৌপদীর বুকের ভেতর। সুভদ্রাকে বুকে তুলে নিল সে। বলল, “তুমি আমার ছোট বোনটি হয়ে থাকবে আমার সঙ্গে। আমি তোমাকে আশীর্বাদ করছি, তোমার স্বামীর যেন কোনও শত্রু না থাকে।”

রাতে, অর্জুনের পাশে শুয়ে সুভদ্রা বুঝল, অর্জুন এখনও কষ্ট আর বিষাদে আছে। সে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “আমায় বলো অর্জুন, কীসের জন্য এত কষ্ট পাচ্ছ? আজ বারো বছর পর তুমি ঘরে ফিরেছ, কেন সেই আনন্দ নেই তোমার?”

অর্জুন বলল, “ভদ্রা, কুন্তী মায়ের কাছে না গিয়ে আমি তার কাছে আগে ছুটে গেলাম। আর সে আমাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করে তাড়িয়ে দিল!”

সুভদ্রা খানিকক্ষণ নীরব থেকে বলল, “তোমার কষ্ট পাওয়া সঙ্গত অর্জুন। তবু আমি বলব তার দিক থেকে ভাবো একবার। বারো বছর ধরে তোমার জন্য অপেক্ষা করে আছে সে। তোমার গলায় মালা দিয়েছে বলে পাঁচটি স্বামীর ভার তাকে নিতে হয়েছে। এ কী সহজ কাজ, অর্জুন? পাঁচজন পুরুষের শরীর, মন, তাদের যত্ন, তাদের শোক-সন্তাপ সামলাবার প্রধান দায় তার। পাঁচজন পুরুষের সন্তানকেও সে লালন করবে। একটুও পক্ষপাত প্রকাশ পেলে কেউ ছেড়ে কথা কইবে না। অর্জুন, পুরুষ যেমন বহু নারীতে আকৃষ্ট হয়, তেমনি মেয়েরাও হতে পারে। কিন্তু সেই আকর্ষণে তার স্বাধীনতা থাকে। দ্রৌপদী যদি তেমনই তীব্রকাম তবু তার কষ্ট। কারণ পাঁচজনের জন্যই প্রেম কাম এবং দুঃখভাগের সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তার এ কথা বলার উপায় নেই— এ বছর অমুককে ভাল লাগছে না আমার। সে যখন মনে মনে তোমাকে কামনা করেছে অর্জুন, তখন তার শরীর অধিকার করেছে তোমার অন্য কোনও ভাই। দ্রৌপদীর মনে কত যে শক্তি, তোমরা পুরুষ হয়ে তা বুঝবে না। আমি জানি না, পাঁচ-পাঁচজন স্বামী পেয়েও তার প্রাণের বন্ধুটি সে পাবে কি না। সে তোমাকে কথার বাণে বিদ্ধ করেছে, কারণ তোমার জন্য তার কষ্ট আছে। প্রেম আছে অর্জুন।”

অর্জুন সুভদ্রাকে নিজের সুগঠিত শক্তিমান হাতের ওপর শুইয়ে নিয়ে বলল, “সে খুব রাগ করে ছিল। তুমি কষ্ট পাওনি তো তার কাছে?”

“না অর্জুন। আমি দীনভাবে গেলাম তার কাছে। বললাম, আমি তোমার দাসী। তারপর নাম বললাম, যাতে তার মনে না হয় তার চেয়ে নিজেকে বড় করছি আমি। নামের পর বললাম বংশ পরিচয়, যাতে তার মনে না হয় আমি কুলগৌরব জাহির করতে এসেছি। তারপর কৃষ্ণর নাম করলাম আমি, যাতে সে বোঝে আমি কৃষ্ণর বিনয় ও সৌজন্যবোধে দীক্ষিত। তোমার নাম আমি একবারও করিনি তার কাছে, যাতে, যে-জ্বালায় সে জ্বলছে তাতে নুনের ছিটে না পড়ে। অর্জুন, সে আমাকে বোন বলে বুকে টেনে নিল। আশীর্বাদ করে বলল, তোমার স্বামীর যেন কোনও শত্রু না থাকে। অর্জুন, তুমি তাকে সপ্রেমে ডেকো। একবার রাগ করলে বার বার ডেকো। দেখো, সেও তোমাকে তেমনি ভালবাসবে।”

সুভদ্রার প্রতি শ্রদ্ধায় কৃতজ্ঞতায় মন ভরে উঠল অর্জুনের। কিন্তু তার মন পড়ে রইল সেইখানে, যেখানে দু’টি কালো হরিণচোখে জল আর আগুন নিয়ে ঘুমিয়ে আছে কালো ভ্রমর কৃষ্ণা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *