১৫. ঐকান্তিক সাধনা করল অর্জুন

পনেরো

ছ’মাস আরও ঐকান্তিক সাধনা করল অর্জুন। এখন মেঘবাণমন্ত্র তার করায়ত্ত। শিক্ষা সার্থক হল কিনা পরীক্ষা করতে পারবে না অর্জুন। তা হলেই তা প্রয়োগ করা হবে। যেমন সে ব্রহ্মশির অস্ত্র প্রয়োগ করতেই শুধু পারবে। পরখ করতে পারবে না।

ছ’মাসে চিত্রাঙ্গদার জীবনেও পরিবর্তন এসেছিল কিছু। অর্জুনের সব কাজে সে ছায়ার মতো সঙ্গী হয়ে ছিল। সে কি শুধু ছেলে পাবার আশায়? না। অর্জুন বুঝেছে চিত্রাঙ্গদার উপলব্ধি। চিত্রবাহনের আদরের দুলালী চিত্রাঙ্গদা বুঝতে পেরেছে, তার জীবনে বিচ্ছেদ যন্ত্রণার দিন এগিয়ে আসছে। যে-মুহূর্তে অর্জুনের সঙ্গে তার মিলন হয়েছিল, সে মুহূর্ত থেকেই বিচ্ছেদের দিন গোনাও যে শুরু হয়েছিল তার, প্রথম দিকে তেমন করে সে বোঝেনি।

এক দুপুরে মেঘবাণ মন্ত্রের পাঠ নিচ্ছিল অর্জুন চিত্রবাহনের কাছে যেমন নেয় রোজ। নিজের ঘরে বিশ্রাম নিচ্ছিল চিত্রাঙ্গদা। তার বিছানায়, বালিশে, তার নিজস্ব স্নানাগারে কেবল অর্জুনের দেহসৌগন্ধ। কী সুন্দর সুবাস অর্জুনের শরীরে, মুখবিবরে, চুলে। হঠাৎ তার মনে হল, একদিন আসবে যখন অর্জুন আর এঘরে থাকবে না। তার গন্ধ মুছে যাবে। এই প্রাসাদে, এই নগরের পথে পথে, মাঠে, ঘাটে, শিবমন্দিরে— কোথাও সে অর্জুনকে দেখতে পাবে না। দমবন্ধ হয়ে এল তার। অর্জুনকে ছেড়ে সে কেমন করে থাকবে? পাগলিনীর মতো সে ছুটে গিয়েছিল সেইখানে, যেখানে ছিল অর্জুন ও চিত্রবাহন। এমনটি আর কখনও হয়নি যে, এই সময় সে এসে পড়েছে। অর্জুন সবিস্ময়ে তাকিয়েছিল তার দিকে। চিত্রবাহন ছিল সস্নেহ, বিমূঢ়।

কাঁপা গলায় চিত্রাঙ্গদা বলেছিল, “অর্জুন!”

অর্জুন জিজ্ঞেস করেছিল, “কী হয়েছে চিত্রাঙ্গদা? কোনও শত্রু বা দস্যুর আসার খবর পেলে?”

“তুমি এসেছ একবছর পার হয়ে গেল অর্জুন।”

“হ্যাঁ চিত্রাঙ্গদা।”

“কেমন করে চলে গেল সময়টা? একটা বছর যেন এক পলকে কেটে গেল। এই তো সেদিন বাবা বলল, পাণ্ডব অর্জুন আমাকে বিয়ে করতে চায়। সে মস্ত বীর।”

“সময় তো শুধু বয়েই যায় চিত্রাঙ্গদা। কাউকে সে এতটুকু প্রশ্রয় দেয় না।”

“তাই তো! তাই তো!”

যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ চলে গিয়েছিল চিত্রাঙ্গদা। সেদিন আর কারও কাজে মন লাগেনি। চিত্রবাহন বলেছিল, “মেয়েটা একটা ছেলে পাবার জন্য মনে মনে অস্থির হয়ে উঠেছে অর্জুন। আর তা খুবই স্বাভাবিক। আমি গণত্কার ডেকেছিলাম। সে বলেছে সময় আসন্ন। খুব শিগগির গর্ভ হবে চিত্রাঙ্গদার। বলেছে, খুব সুন্দর ছেলে পাবে সে।”

অর্জুন বুঝেছিল, চিত্রাঙ্গদার চেয়েও, একটা ছেলের জন্য চিত্রবাহনের অধীরতা আরও অনেক বেশি। তার নিজের ভাবনাই সে বড় করে দেখছে বলে চিত্রাঙ্গদার মূল কষ্ট বুঝতে পারেনি।

ছ’মাস কেটে গিয়েছে তারপর। চিত্রাঙ্গদা এখন গর্ভবতী। এক সপ্তাহ আগে এ খবর পেয়েছে অর্জুন। সারা রাজবাড়িতে আনন্দের ভাব। অর্জুনেরও ভাল লাগছে। কিন্তু অনেক বেশি বেদনাবিধুর হয়ে আছে তার মন। যেতে হবে। এইবার ছেড়ে যেতে হবে তাকে। বন্ধন গভীর হয়ে উঠেছে।

মণিপুরে এসে যে-কুটির তারা বেঁধেছিল, তারই দাওয়ায় সে বসে আছে এখন। এরই মধ্যে এই কুটির একটি সংসার হয়ে উঠেছে। কেউ জুঁই লাগিয়েছিল। এখন তা লতিয়ে উঠেছে চালে। একটি পলাশগাছ মাথা তুলেছে আঙিনায়। কুটিরের পিছনে পুঁইলতা, লাউমাচা, একটি ফলন্ত পেঁপেগাছ। তার সঙ্গীরা লাগিয়েছে এইসব। কী আশ্চর্য মায়া কুটিরখানি জুড়ে।

প্রতিদিন রাজপ্রাসাদ ছেড়ে সূর্য ওঠার আগে ওই মাঠটিতে সে আসে যখন, রাত্রির নিবিড় কালো ফিকে হয়ে আসে অনেকখানি। কালোর আলোয় তখন ঢুকে পড়তে থাকে নীলের আভা। পৃথিবী তখন শান্ত, পবিত্র। রাতের ফুল তার সুগন্ধের শেষটুকু বাতাসে ঢেলে দেয়। রাতের তারা সূর্যপ্রণাম করবে বলে ভক্তিনম্র চোখে চেয়ে থাকে কখন সে পুব আকাশে আসবে। দিনের যত ফুল, তাদের কুঁড়িগুলি ফুটে উঠবার আগে সম্পূর্ণ সাজ পরে উন্মুখ হয়ে থাকে কখন প্রথম আলোর কিরণ এসে ফুটিয়ে দেবে পাপড়িগুলি। পাখিরা ঘুমজড়িত গলায় সুর সেধে দিনের ঘোষণা করে। এমনই পবিত্র এ সময়, বিশ্বের সবচেয়ে মন্দ লোকটিও মন্দ ভাবতে পারে না। আর সবাই যখন ঘুমোয়, এই কুটিরে অর্জুনের সঙ্গীরা জেগে উঠে তার পূজার আয়োজন করে। রান্নাঘরে উনুনে আগুন দেয় সূপকার হরিষেণ। একদিনও এর ব্যতিক্রম হয়নি। একদিনও ছন্দে ত্রুটি হয়নি। আঠেরো মাস ধরে এই কুটির অর্জুনকে শান্তি দিয়েছে। তৃপ্তি দিয়েছে।

অর্জুনের মনে পড়ছে, ওই ছোট টিলা পাহাড়ে প্রথম দিন সে ফল পাড়তে গিয়েছিল। চিত্রাঙ্গদা দলবল নিয়ে খেলা করছিল পাহাড়ের ওপারে। চিত্রাঙ্গদাকে বিয়ে করার কথা চিত্রবাহনকে বলে এসেছে তখন অর্জুন। তবু তার মন জুড়ে ছিল উলূপীর চিন্তা। আজও উলূপী আছে। কিন্তু এখন তাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে চিত্রাঙ্গদা চপলকলিকা কৌতুকিনী। তাকে ছেড়ে যেতে হবে ভাবতেই কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে তার।

শুধু কি চিত্রাঙ্গদা? অর্জুনকে মায়ায় জড়িয়েছে ওই প্রাসাদ। ওই প্রৌঢ় রাজা চিত্রবাহন। কী খুশি এখন মানুষটা!

প্রথম দিকে, ধনাঢ্য চিত্রবাহনের ধনগৌরব এবং দেখানেপনা ভাল লাগেনি অর্জুনের। এখন আর কিছুই আলাদা করে চোখে পড়ে না। কানে বাজে না। অর্জুন অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। এই দেড় বছর ওই রাজপ্রাসাদে সে চিত্রবাহনের ছেলের মতোই স্বাধীন ও সহজ ছিল। সে মনেই রাখেনি এ তার নিজের বাড়ি নয়।

বস্তুত, নিজের বাড়ি কাকে বলে, এখানেই তার স্বাদ পেয়েছে অর্জুন। অতি শৈশবে ছিল বনে। তখন বাপ-মায়ের কোলই ছিল ঘরবাড়ি। তারপর বাবা মরে গেল। মরে গেল মাদ্রী মা। বাবা-মায়ের মৃতদেহের সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তারা পৌঁছল হস্তিনাপুরে ধৃতরাষ্ট্রের আশ্রয়ে। অথচ সেই বাড়িটা আগে তার বাবারই ছিল। সেখানে স্নেহ আদর অনেক পেয়েছে অর্জুন। কিন্তু ধৃতরাষ্ট্রর ছেলে দুর্যোধন আর তার ভাইয়েরা একদিনের জন্যও ভুলতে দেয়নি, এ বাড়িটা পাণ্ডবদের নয়। শেষ পর্যন্ত যদিও বা নিজেদের একটা জায়গা পেল তারা, ভাল করে গুছিয়ে বসার আগেই শর্তপালন করতে বেরিয়ে পড়ল অর্জুন। বারণাবত থেকে ফেরার পর দ্রুপদের আতিথ্যে তারা সুখে ছিল। কিন্তু আপন ঘরে ছিল না।

আজ যখন স্নেহের অধিকারে, প্রেমের সৌন্দর্যে সে এ বাড়ির আপনার জন হয়ে উঠল, তখন আবার তাকে ছেড়ে যেতে হবে।

আর শুধু প্রাসাদ, চিত্রবাহন আর চিত্রাঙ্গদাই কি? এই মণিপুর রাজ্য, এই নগরী, সবকিছুই কি তাকে নিজের করে নেয়নি? সে যখন নাগলোকে ছিল, কৌরব্য, উলূপী ও উলূপীর বন্ধুদের মধ্যেই তার দিন কাটত। এখানে অর্জুন সাধারণের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। সময়-সুযোগ পেলেই সে নানা পল্লিতে ঘুরে বেড়াত। অস্ত্র বা অন্য লোহার জিনিস বানায় যেখানে কামাররা, বাসন ও শিল্প সামগ্রী বানায় যত স্বর্ণকার, কাঁসারি, কুমোর, পটশিল্পী। চাকচিক্যবর্জিত সাধারণ বেশে কখনও অনুপ, কখনও সৌমাল্য বা দয়ানন্দ তার সঙ্গী হয়েছে। লোকে এখন অর্জুনকে চেনে। সে রাজার জামাই, সে মস্ত বীর। তার জন্য লোকে তাকে মর্যাদা দেয়। আর এই যে সে ঘরের ছেলেটির মতো সাধারণের মধ্যে নেমে আসে— এতে লোকে তাকে ভালবাসে। সেইসব লোকের কথা মনে পড়ল তার। মনে পড়ল প্রদীপকের কথা। মনে পড়ল, মালতী আর পার্বতীর বিয়ের উৎসবে গিয়েছিল সে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে। গাঁয়ের লোক এত খুশি হয়েছিল, এত আদর করেছিল তাদের যে, অর্জুন আর চিত্রাঙ্গদা তাদের ঘরের মানুষ হয়ে উঠেছিল। সেই স্নেহ, সেই আদর কোনও দিন ভুলতে পারবে না অর্জুন।

আর চিত্রাঙ্গদা? এ দেশে সেই তো মধ্যমণি। তারই জন্য পাখি ডাকে, হাওয়া বয়, ফুল ফোটে। তাকে ছেড়ে যেতে হবে এবার। অর্জুনের মনে হল, কেউ বুঝি তার হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে নিচ্ছে!

তবু, যেতে তাকে হবেই। মায়ায় জড়ানো চলবে না। সে জানে, এখনই চিত্রাঙ্গদা এবং মণিপুরের তাকে সবচেয়ে বেশি জড়িয়ে ধরার কথা। কারণ দস্যুর উত্পাত হলে চিত্রাঙ্গদা যুদ্ধে যেতে পারবে না। চিত্রবাহন অবশ্য এখনও যথেষ্ট ক্ষমতা রাখে। সে এখনও বৃদ্ধ বা অশক্ত হয়ে যায়নি। তবু স্বামী হিসেবে গর্ভবতী স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব বোধ করছে অর্জুন। এবং সে জানে, এই পারিবারিক দায়বদ্ধতাই ব্রহ্মচর্যের সমস্ত ধর্মের পরিপন্থী। অর্জুন নিজের মন শক্ত করে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গীদের ডেকে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে প্রাসাদে চলল সে। প্রথমে গেল চিত্রাঙ্গদার কাছে। তাকে বুকে নিয়ে অনেক আদর করে অর্জুন বলল, “চিত্রাঙ্গদা, এবার আমাকে যেতে হবে।”

চিত্রাঙ্গদা সবলে জড়িয়ে ধরল অর্জুনকে। কান্নার মতো করে বলল, “কোথায় যাবে তুমি অর্জুন এই আমাকে ফেলে, তোমার যে-ছেলে আমার পেটে রয়েছে, তাকে ফেলে?”

“ফেলে যাব কেন চিত্রাঙ্গদা? আমি সবসময় সঙ্গে থাকব তোমাদের। কিন্তু এবার আমায় যেতেই হবে।”

“ছেলের মুখ দেখবে না তুমি অর্জুন? দেখতে ইচ্ছে করবে না তোমার? তোমার প্রথম সন্তান ইরাবানের মুখও তুমি দেখোনি অর্জুন। এর সঙ্গেও তাই করবে?”

“চিত্রাঙ্গদা, ছেলের জন্ম হলেই আমি আসব তাকে দেখতে। আর ইরাবান? সেও তো আমারই হৃদয়ের টুকরো। তার সঙ্গেও আমার দেখা হবে কোনও না কোনও দিন।”

“কোথায় যাবে তুমি অর্জুন? কত দূর?”

“বেশি দূর যাব না আমি চিত্রাঙ্গদা। যেতে পারব না। তোমাকে ছেড়ে দূরে যাবার মন আমি তৈরি করতে পারিনি এখনও। তাই কাছে পিঠের তীর্থক্ষেত্রগুলোই ঘুরে দেখব আমি। চিত্রাঙ্গদা, তোমার থেকে দূরে যাবার জন্য এই স্বল্পকালীন বিচ্ছেদ আমার দরকার।”

অর্জুন যে-কর্তব্য নিয়ে চিন্তিত ছিল, দ্বিধাগ্রস্ত ছিল, সেই কথাই তুলল চিত্রাঙ্গদা। বলল, “আমি গর্ভবতী। যুদ্ধ-টুদ্ধ তো করতেই পারব না। এখনই কি তোমার আমার কাছে থাকা উচিত ছিল না অর্জুন?”

অর্জুন জানত, প্রশ্ন উঠবেই। সে বলল, “চিত্রাঙ্গদা, রাজা চিত্রবাহন তোমার যথাযথ যত্ন নেবেন। দেশ রক্ষা করতেও তিনি যথেষ্ট পারঙ্গম। তোমাকে তিনি যুদ্ধে বা রাজকাজে অভ্যস্ত করিয়ে নিচ্ছিলেন ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তার মানে এই নয় তাঁর ক্ষাত্র তেজ কিছু কম পড়েছে। তবু আমি আমার দুই অনুচর অনুপ আর সৌমাল্যকে রেখে যাচ্ছি। দু’জনেই অত্যন্ত ভাল যোদ্ধা। দু’জনেই অত্যন্ত দ্রুত ঘোড়া চালিয়ে যেতে পারে। দরকার হলে ওরা সব করবে তোমার জন্য।”

“কেন তুমি যাবে অর্জুন?” চিত্রাঙ্গদা কাঁদতে লাগল। অর্জুন বলল, “কেঁদো না। কাঁদলে তোমার ছেলের ক্ষতি হবে। শোনো চিত্রাঙ্গদা, না গেলে অধর্ম হবে আমার।”

“কীসের অধর্ম?”

“সে অনেক কথা চিত্রাঙ্গদা। উলূপী জানে। তার সঙ্গে দেখা হলে সব শুনে নিয়ো।”

“যা উলূপীকে বলতে পারো, তা আমাকে বলতে পারো না কেন অর্জুন?”

“উলূপীকে আমার তেমন করে বলতে হয়নি। তার জানা ছিল। আর সেইসব কথা বলতে আমার ভাল লাগে না চিত্রাঙ্গদা। আমি তোমাকে বলতে চাই না তা নয়। আমি বলতেই চাই না।”

অর্জুনের বুকে মাথা রেখে চিত্রাঙ্গদা বলল, “তুমি আজই চলে যেয়ো না অর্জুন।”

“বেশ। কাল ভোরবেলা যাত্রা করব তা হলে।”

চিত্রাঙ্গদা ভেবেছিল, অর্জুনের সবটুকু সে বুঝেছে। আজ তার মনে হতে লাগল অর্জুন পুরু কঠিন দুর্ভেদ্য পাহাড়ের মতো। চিত্রাঙ্গদা কিছুই চেনেনি তাকে। কিছুই জানেনি। কেন এমন হল কিছুতেই বুঝতে পারল না সে। জানালার ধারে চুপটি করে বসে রইল। অর্জুন গেল চিত্রবাহনের সঙ্গে দেখা করতে।

ষোলো

অর্জুন যেদিন প্রথম চিত্রবাহনের কাছে এসেছিল, সেদিন এই তরুণের প্রতি তার বিস্ময়াহত ঈর্ষাই ছিল একরকম। আর ছিল শ্রদ্ধা। পেশাগত শ্রদ্ধা। ধনুর্বাণে অর্জুনের যে-দক্ষতা, তাকে, অর্জুনের পরম হিতৈষী বীরও শ্রদ্ধা করবে এবং গোপন ঈর্ষা করবে। একবার অন্তত তার মনে হবে, সুযোগ পেলে আমিও প্রমাণ দেব। আর যে-বীর অর্জুনের শত্রু, সে তো শত্রুভাবের জন্যই ঈর্ষা করবে তাকে, সেই সঙ্গে মনে মনে শ্রদ্ধা না করে পারবে না। হৃদয়ে বিদ্বেষ নিয়েও ক্ষত্রিয় প্রতিপক্ষের অস্ত্রকুশলতাকে শ্রদ্ধা করতে পারে।

সেই প্রথম দিন অর্জুনের সঙ্গে চিত্রবাহনের হৃদয়ের কোনও যোগ ছিল না। অর্জুন নাম করা পরিবারের নাম করা ছেলে। তাকে জামাই করে নেবার মধ্যে আপত্তির কিছুই ছিল না। চিত্রবাহনের শর্ত সবই সে মেনে নিয়েছিল। সেইসঙ্গে এ-ও জানিয়েছিল, তিন বছরের বেশি সে এখানে থাকবে না। চিত্রবাহনের রাজবুদ্ধিই তখন কাজ করেছিল বেশি। মনে হয়েছিল, শর্তগুলো সমস্তই তার নিজের অনুকূলে। ভীষ্মর পরিবারের সঙ্গে আত্মীয়তা হচ্ছে, ভরতবংশের বীর ধারা আসছে তার পরিবারে, চিত্রাঙ্গদাকে বাবার বুক খালি করে শ্বশুরবাড়ি যেতে হচ্ছে না, উল্টে সে পাচ্ছে অত্যন্ত সুদর্শন বীরচূড়ামণি স্বামী। অর্জুন কোনওরকম যৌতুক চায়নি বলে ধনরত্ন সোনাদানাও সেরকম কিছু দিতে হবে না। নিজের রাজকীয় মর্যাদা রাখার জন্য উপযুক্ত উপহার দিলেই চলবে। যৌতুক দিতে গেলে শুধু যে ধনরত্নে হত তা-ও নয়। দিতে হত অস্ত্র, দাস-দাসী, হাতি, ঘোড়া। এইসব কিছুই চিত্রবাহনকে খোয়াতে হচ্ছে না মেয়ের বিয়ে দেবার জন্য। সবচেয়ে বড় কথা, অর্জুনের ছেলেকে চিত্রবাহন নিজের করে পাচ্ছে। যে কোনও ধনাঢ্য আত্মপর স্বার্থবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের মতোই শুধু ব্যবহারিক দিক নিয়েই তুষ্ট ছিল সে।

কিন্তু অর্জুনের সঙ্গে দু’দিন থেকেই যখন চিত্রবাহন বুঝল অর্জুন নিজের গুণে তার হৃদয় থেকে স্নেহফল্গুধারা টেনে আনছে, তখন পুত্রস্নেহের অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দানুভবের সঙ্গে সঙ্গে হারাবার কষ্টও তাকে পেয়ে বসল। অর্জুন কখনও আত্মঘোষী নয়। আমাকে দেখো সবাই, আমার কথা শোনো, আমাকে ঘিরে থাকো সারাক্ষণ— এমন ভাব তার এতটুকু নেই। হলেও নিন্দার কিছু ছিল না কারণ সে মনোযোগ আকর্ষণের যোগ্য পাত্র। কিন্তু এমন ভাব তার নেই বলেই তার নিরুচ্চার উপস্থিতিতে অসামান্য মাহাত্ম্য সৃষ্টি হয়। দিনের পর দিন যখন অর্জুনকে মেঘবাণ মন্ত্র শিখিয়েছে চিত্রবাহন, যা আয়ত্ত করতে তার নিজের দশ বছর লেগেছিল, দৌহিত্রকেই যা শেখাবে বলে ভেবেছিল সে, তা-ই অর্জুনকে দেবার এই ইচ্ছাকে দৈব নির্দেশ বলেই মেনে নিয়েছে চিত্রবাহন এবং তা অর্জুনকে শেখাবার সময় অপূর্ব পুলক অনুভব করেছে। কী মেধা ছেলেটির! কী বিনয়! কী বিস্ময়কর মনঃসংযোগ! প্রশংসনীয় তার নিষ্ঠা, আত্মবিশ্বাস এবং অধ্যবসায়। সেইসঙ্গে মধুর তার ব্যবহার। এমন ছেলেকে ভালবাসবে না চিত্রবাহন তেমন পাথর নয়। নয় তেমন ঈর্ষাতুর। আর ঠিক এই বিষয়টিই স্বার্থের অঙ্ক কষার সময় মাথায় রাখেনি সে। ভেবে দেখেনি, অর্জুন চলে গেলে কেমন লাগবে চিত্রাঙ্গদার, কেমন লাগবে তার নিজের। অর্জুনের ছেলেকেই শিশু অর্জুন ভেবে বুকে তুলে নিলেই কি অর্জুনের সান্নিধ্য এবং স্পর্শ পাবার আকাঙ্ক্ষা মিটে যাবে?

তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী?

কিন্তু উপায় কি একেবারেই নেই? রাজা হওয়ার সমস্ত যোগ্যতার যে অধিকারী, তার কি রাজা হওয়ার বাসনা নেই?

রাজনৈতিক বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে অর্জুনকে ধরে রাখার শেষ চেষ্টা করতে চাইছে চিত্রবাহন। ইতিমধ্যে হস্তিনাপুর এবং ইন্দ্রপ্রস্থের রাজনীতি সম্পর্কে অনেক খবর নিয়েছে সে, যা আগে নেবার কোনও আগ্রহই তার ছিল না। এখন সে জানে, কেন সদ্যগঠিত রাজ্য ছেড়ে এমন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্জুন, জানে, ইন্দ্রপ্রস্থের রাজা যুধিষ্ঠির যত বড় ধার্মিক, তত বড় বীর নয়। এমনকী তার ছোট দু’টি ভাই, মাদ্রীর যমজ ছেলে নকুল ও সহদেবের যে-অস্ত্রনৈপুণ্য যে-বীরত্ব আছে, যুধিষ্ঠিরের তা নেই। যুধিষ্ঠির বেদজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ, সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ কিন্তু সে ভাইদের বীরত্বের ওপর নির্ভর করে। সবচেয়ে বেশি, অর্জুনের ওপর। প্রাজ্ঞ রাজা চিত্রবাহন কূট মানসিকতায় ভাবছে, এত বছর ভাইদের ছেড়ে আছে অর্জুন, তার জন্য এতটুকু বিলাপ তাকে করতে দেখা যায়নি, তার রোজকার ক্রিয়াকর্মে এতটুকু ব্যাঘাত ঘটায়নি আত্মীয় বিচ্ছেদজনিত বিষাদ, বেদনা। তা হলে কি ধরে নেওয়া যায় না, অর্জুন আর সেই অর্জুন নেই? যুধিষ্ঠিরের সেই অনুগত ভাইটি? পাঞ্চালীর অধিকার ছেড়ে দেওয়ার বিক্ষোভ কিছুই কি নেই মনে?

চিত্রাঙ্গদা সেসবের কিছুই জানে না। তার মনের স্বাভাবিক স্ফূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করতে চায় না এখন চিত্রবাহন।

অর্জুন এসে যখন বলল, “এ রাজ্যের রক্ষক আপনি, চিত্রাঙ্গদা আপনার কাছে সবদিকে ভাল থাকবে জেনেই কাল আমি আবার ভ্রমণে বেরুব ঠিক করেছি। কয়েকটি তীর্থ ঘুরে আসব। চিত্রাঙ্গদাও আমার ইচ্ছের কথা জানে।”

চিত্রবাহন বলল, “সে তো খুব ভাল কথা। এই যে তীর্থে ঘুরে তুমি পুণ্য অর্জন করছ অর্জুন, এর ফল তুমি নিশ্চয়ই লাভ করবে। প্রত্যেকের তীর্থভ্রমণ কর্তব্য। তবে কী জানো অর্জুন, তীর্থ করার সময় এখনও অনেক আছে তোমার। এখন তোমার জয় করার বয়স। ভোগ করার বয়স। মহাদেবের আশীর্বাদে যেমন তুমি যুদ্ধ জয়ে সক্ষম তেমনি মন জয়ে। সার্থক তোমার জিষ্ণু নাম। তুমি যে আমাদের সবার মন জয় করেছ। তুমি না থাকলে আমাদের ভারী কষ্ট হবে অর্জুন।”

অর্জুন বলল, “আমিও বড় কষ্টে আছি রাজা। কিন্তু আপনি তো জানেন, ধর্মের পথ, কর্তব্যের পথ সুখের নয়।”

“তা তো ঠিকই। আর জগতের নিয়ম কী জানো? কেউ যদি ভার বইতে পারে, সবাই তার ওপরেই বোঝা চাপিয়ে দেয়। তা তুমি তীর্থ সেরে ছেলের মুখ দেখার জন্য ফিরে আসবে তো?”

“নিশ্চয়ই। গর্ভ পূর্ণ হওয়ার সময় হলেই আমি চলে আসব। আমি জানি আপনার ভৃত্য, অনুচর, সেনা সবই অনেক আছে। তবু আমার দুই দক্ষ যোদ্ধা এবং বিশ্বস্ত অনুচর অনুপ এবং সৌমাল্যকে আপনার এবং চিত্রাঙ্গদার সেবার জন্য রেখে যাচ্ছি।”

“খুব খুশি হলাম আমি। তা ফিরে আসার পর তুমি কী করবে ভেবেছ নিশ্চয়ই।”

“হ্যাঁ, আরও কিছু তীর্থ সেরে আমি আমার নিজের দেশে ফিরে যাব।”

“তুমি যদি রাজি থাকো অর্জুন, এই মণিপুরের রাজসিংহাসনে তোমাকে অভিষিক্ত করব আমি।”

“কী বলছেন মহারাজ? আমার মনের গোপনতম অন্ধকারেও সেরকম লোভ নেই।”

“লোভ কেন বলছ? এ তোমার প্রাপ্য। ভেবে দেখো অর্জুন। রাজাধিরাজ হওয়ার সমস্ত যোগ্যতা তোমার আছে। চাইলে এই পৃথিবীর অধীশ্বর হতে পারো তুমি। কে তোমাকে হারাবে? ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে গিয়ে কী পাবে তুমি? ওই পাঞ্চালী, যাকে তুমিই জয় করেছ, পাবে তার পাঁচ ভাগের একভাগ। তুমিই রাজ্য জয় করে ধনসম্পদ আনবে, তুমিই দেশ রক্ষা করবে, একটি সমৃদ্ধ দেশের প্রধান শক্তিই হবে তুমি। অথচ সম্রাট হবে যুধিষ্ঠির। লোকে তাকে ধন্য ধন্য করবে। আর তোমাকেও তার অঙ্গুলি হেলনে চলতে হবে। রাজার ভাই হয়ে, যুধিষ্ঠিরের অধীন হয়ে কী সুখ তুমি পাবে অর্জুন? তার চেয়ে নিজে রাজা হও। ভোগ করো এই ধরিত্রীকে। আমি তোমাকে সিংহাসন দেব অর্জুন। তুমি স্বগৌরবে প্রতিষ্ঠিত হও।”

বেশ কিছুক্ষণ মুখ নিচু করে বসে রইল অর্জুন। অনেক দূর থেকে গান-বাদ্যি ভেসে আসছে। কারা সব আমোদ করছে। সন্ধ্যা নামছে কোনায় কোনায়। ঘরে ঘরে দীপ জ্বেলে দিচ্ছে মেয়েরা। রাজবাড়ির ঝাড়লণ্ঠন জ্বলে উঠছে একটার পর একটা। নাগদেশের মতো এই মণিপুরেও শাঁখ বাজানোর রেওয়াজ নেই। এরা শিঙা বাজায়। গৃহস্থের দুয়োরে দুয়োরে বেজে উঠছে মঙ্গলবিষাণ। একটুক্ষণ কান পেতে শুনে অর্জুনের মনে হল, ওই দূরের সুরে লেগে রয়েছে আনন্দকল্যাণের ভাব। এই সন্ধ্যায় মণিপুরের প্রজারা বেশ সুখে আছে।

এখানকার গোপালক-মেষপালকরা মাটির হাঁড়ি বাজিয়ে বাঁশের যন্ত্রে সুর তুলে তার সঙ্গতে একরকম গান গায়। গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটে গেলে তাদের গানে তার বর্ণনা ধরা থাকে। অর্জুন যে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে গিয়ে দস্যু মেরেছিল, তাই নিয়েও গান বেঁধেছিল গোপালকেরা।

রাজার নতুন ধন নাম অর্জুন।

যত তার রূপ দেখো তত তার গুণ॥

রাজার মেয়ের সনে যায় মহারণে।

দুইয়ে চিরসাথী তারা জীবনে-মরণে॥

বায়ুবেগে রথ চলে ছুটে যায় তির।

অর্জুন সমান আর নাই কোনও বীর॥

চিত্রাঙ্গদা সে যে বীরকুলবতী।

স্ত্রী-রত্ন পেয়ে ধন্য অর্জুনপতি॥

অর্জুনের ভাল লেগেছিল এই গান। সরল কিন্তু জনমনের সহজাত রসবোধ ও অভিব্যক্তিতে চিত্রিত।

কতদিন অর্জুন গিয়ে বসেছে এমন আসরে গান শুনতে। কতদিন চিত্রবাহনের সভায় বসে শুনেছে মণিপুরের নাম-করা গাইয়েদের গান। অর্জুন যা ভালবাসে, যাতে ভাল থাকে, তার সব আয়োজনই করতে চেয়েছে চিত্রবাহন নিজের বোধবুদ্ধি অনুযায়ী।

অনেক কিছু ভাবল অর্জুন। তারপর ধীরে, অনুচ্চ স্বরে বলল, “আমি একে একে আপনার কথার জবাব দিচ্ছি মহারাজ। আপনি নিশ্চয়ই জানেন, রাজা যুদ্ধজয়ের সফলতা গুণে মহান হয় না, হয় সুষ্ঠু রাজ্যপরিচালনার সাফল্যে। প্রজাপালনে রাজা তখনই সফল যখন রাজা হয় ধার্মিক, ন্যায়পরায়ণ, সত্যনিষ্ঠ, প্রজাবত্সল। মহারাজ, যুধিষ্ঠিরকে লোকে বলে ধর্মরাজ। আর তা বানিয়ে বলে না। যুধিষ্ঠিরের ধর্মনিষ্ঠা এবং ন্যায়বোধ এতই সূক্ষ্ম যে, অনেক সময় সেই বিচার অনুধাবন করাও শক্ত হয়ে ওঠে। রাজা হিসেবে যুধিষ্ঠিরের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্নই উঠতে পারে না।”

চিত্রবাহন বলল, “বেশ তো। যুধিষ্ঠির ইন্দ্রপ্রস্থে রাজত্ব করুক। তুমি এখানে রাজা হয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করো। দু’ভাই দু’টি আলাদা রাজ্যের রাজা এমন ঘটনা বিরলও নয়, ধর্মবিরুদ্ধও নয়।”

“আবারও বলছি, সিংহাসনে আমার লোভ নেই। সম্রাট অর্জুন শোনার আকাঙ্ক্ষা এতটুকুও নেই আমার।”

“সেইটাই তো আশ্চর্যের। যোগ্য লোক যদি তার উপযুক্ত জায়গা আর কাউকে দিয়ে দেয় অর্জুন, তার পরিণতি হয় বারণাবত। হয় অকল্যাণ। বারণাবতে চক্রান্ত করে তোমাদের মেরে ফেলতে চেয়েছিল তোমাদের পিতৃসম ধৃতরাষ্ট্র এবং তার ছেলে দুর্যোধন— এই কুকীর্তির কথা এখন কে না জানে? এমন হীন চক্রান্ত যারা করে তারা রাজা হওয়ার যোগ্যই নয়। আমার কথা যে ভুল নয়, ভীষ্মকে দেখেই তোমার তা বোঝা উচিত অর্জুন। হস্তিনাপুরের রাজা যদি তিনি হতেন, আজ ধৃতরাষ্ট্রর অন্যায় এবং দুর্যোধনের দুরাচার কাউকেই সহ্য করতে হত না।”

“রাজা, এ জগৎ শুধু শাসন, ভোগ আর ক্ষমতার লোভ নয়। ত্যাগ ও সংযমের মহিমা আছে বলেই এ জগৎ বাসযোগ্য। আমরা সামান্য মানুষ, ভীষ্মর বিচার আমরা করার কে? শুধু এটুকু বলতে পারি, ভীষ্মর মতো পুরুষ আছে বলেই পৃথিবী এত সুন্দর। এত লোভ, এত ঈর্ষা, স্বার্থপরতা, হীনতা— এত এত নীচ মনোবৃত্তি সত্ত্বেও ভীষ্ম আছে বলেই আমরা ভালবাসতে ভুলে যাইনি। আমরা কর্তব্যবোধে অটল থাকতে পেরেছি। মহারাজ, আপনি যখন আমাকে মেঘবাণ মন্ত্র শেখাতেন, আমি বুঝেছিলাম, কত স্নেহ করেন আপনি আমাকে। আজ এই যে আপনি আপনার সিংহাসনটাই আমাকে দিয়ে দিতে চাইছেন, তাতে বুঝতে পারছি, আপনি আমাকে সত্যিই ছেলে বলে ভেবেছেন। আপনার স্নেহ আমি মাথায় করে রাখব। জগতের সব বাবাই তার ছেলেকে শ্রেষ্ঠ দেখতে চায়। আপনিও চেয়েছেন। এর মধ্যে কিছু অন্যায় নেই। কিন্তু আপনি ভেবে দেখুন, আঠেরো মাস আমি আপনার কাছে আছি, তাইতে আপনি আমাকে এত ভালবেসেছেন। আর যারা আজন্ম আমার সঙ্গী, যাদের সঙ্গে জীবনের সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা ক্লেশ বিপদ অপমান ভাগ করে নিয়েছি আমি, ভাগ করে নিয়েছি মায়ের গর্ভ, মায়ের কোল, কত আনন্দের মুহূর্ত, কত আশা স্বপ্ন ভবিষ্যতের কল্পনা, এমনকী দ্রৌপদী— তারা আমাকে কত ভালবাসে! আমি তাদের ভালবাসি কত! এই ক’দিনেই আপনার মনে হচ্ছে আমাকে না দেখতে পেলে আপনার কষ্ট হবে। আমারও হবে রাজা। কিন্তু ভেবে দেখুন, প্রায় সাত-আট বছর হল আমি ঘরছাড়া, আমাকে না দেখে আমার মা-ভাই কত কষ্টে আছে, আমারই বা কত কষ্ট! মহারাজ, যে-সম্পর্ক দুঃখ-কষ্টের কড়া পাকে শক্ত হয়, তাকে সহজে ভাঙা যায় না। আমার পাঁচ পাণ্ডব ভাই আর মা কুন্তীর সেই সম্পর্ক। আর আপনি বলছিলেন যে, আমাকে যুধিষ্ঠিরের অঙ্গুলি হেলনে চলতে হবে। তাতে আপত্তি কী মহারাজ? ঈশ্বরের অঙ্গুলি হেলনে যদি চলতে পারি আমরা এই বিশ্বাস রেখে যে, ভগবানের কাজে কোনও অন্যায় নেই, তবে ঈশ্বরের সমান ধার্মিক ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের আঙুল কী দোষ করল? একজন লোভী বিচারবুদ্ধিহীন রাজা হওয়ার চাইতে একজন ধার্মিক ন্যায়পরায়ণ রাজার অধীনে থাকা ভাল আমার কাছে।”

চিত্রবাহন বলল, “তোমার সব কথাই আমি মেনে নিচ্ছি। কিন্তু তুমি অধার্মিক, লোভী, বিচারবুদ্ধিহীন রাজা হতেই পারো না, অর্জুন। যুধিষ্ঠিরের অধীনে না থাকলেই তুমি অধার্মিক হও কী করে?”

“আমি সিংহাসন চাই না মহারাজ। যা কিছুতে আমাকে ভাইদের থেকে আলাদা করে দেবে, আমি তার কিছুই চাই না।”

অর্জুনের ডান হাতটি নিজের দুই হাতে নিয়ে বুকে চেপে ধরল চিত্রবাহন। বলল, “অর্জুন, ধন্য সেই মা যে তোমাকে জন্ম দিয়েছে। ধন্য সেই ভাইরা, যারা তোমাকে ভাই হিসেবে পেয়েছে। আমি জানি, যার শক্তি বেশি, তার কষ্টও বেশি, তাকেই হতে হয় সবচেয়ে বেশি সহনশীল।”

“ভেঙে ফেলার চেয়ে সহজ আর কিছু আছে মহারাজ?”

“না অর্জুন, নেই। অর্জুন, আমার প্রিয় পুত্র, তোমাকে হারাতে চাই না বলেই, অতি হীনভাবে তোমাকে নানারকম প্রস্তাব দিয়েছি। যে কোনওভাবে কেবল কাছে রাখতে চেয়েছি তোমাকে। আমার কথায় রাজি না হয়ে আমাকে তুমি গর্বিত করেছ। আমার অপরাধ ক্ষমা কোরো তুমি। তুমি মহান। তুমি পারবে।”

“কিছু অপরাধ নেই মহারাজ। আমি তো আগেই বলেছি, আমি আপনাকে বুঝেছি। এ আপনার স্নেহের বান। বন্যায় আত্মরক্ষা করতে লোকে তো খড়কুটোও আঁকড়ে ধরে। আমি তো আসব মহারাজ। আবার আসব। আবার আমাদের দেখা হবে।”

সমান আসন থেকে নেমে চিত্রবাহনের পায়ের কাছে বসল অর্জুন। চিত্রবাহনের মনে হল, উঁচু মন্দির থেকে নেমে কষ্টিপাথরের শিব স্বয়ং এসে বসল তার কোলের কাছে। অর্জুনের মাথাটি নিজের কোলের ওপর টেনে নিল সে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। স্নেহধারা উথলে উঠল তার। চোখ থেকে টপ টপ করে জল পড়তে লাগল। মনে হল, যতই গুরুগম্ভীর কথা বলুক, যতই বাণ মেরে জল তুলে আনুক পাতাল থেকে, এ তো একটা ছোট ছেলে। স্নেহের কাঙাল। কে জানে, পথে পথে ঘুরে কত কষ্ট হবে ছেলেটার।

সতেরো

দশ মাস অতি যত্নে পেটের ছেলেকে ধারণ করল চিত্রাঙ্গদা। দশ মাস নিজেকেও সে জানল, বুঝল, তৈরি করল একটু একটু করে। আর কোনও দিকে মন দিল না। বাইরের অভ্যস্ত জীবন তাকে ডাকছিল। সে বুঝতে পারছিল এই বদ্ধ জীবন তার জন্য নয়। তবু ছেলের জন্য একাগ্র হয়ে ছিল সে।

দশ মাস কঠোর ব্রতনিয়মের মধ্যে থেকে তীর্থে তীর্থে ঘুরে বেড়াল অর্জুন। যেমনি করে সরাইখানার আস্তানায় আশ্রয় পায় ক্লান্ত পথিক, তেমনি করে, অর্জুনের বড় দুঃখের ব্রহ্মচর্যা এবং পর্যটক জীবনে প্রেম ও শান্তির জলধারা দিয়েছে যে-দুই নারী, তাদের কথা বার বার তার মনে পড়তে লাগল। এমন নয় যে, পাঞ্চালীকে ভুলতে সে উলূপীর কাছে গিয়েছিল এবং উলূপীকে ভুলতে চিত্রাঙ্গদার কাছে গিয়েছে। এমন নয়। এরা প্রত্যেকেই স্বতন্ত্র। এদের সঙ্গে অর্জুনের সম্পর্কও আলাদারকম। আকাশে যেমন সূর্য তারা একসঙ্গে থাকে কিন্তু কেউ কাউকে আচ্ছন্ন করে না, অর্জুনের হৃদ্‌গগনে দ্রৌপদী, উলূপী, চিত্রাঙ্গদাও তেমনি।

যতখানি সম্ভব যজ্ঞে পূজায় শাস্ত্রপাঠে যোগাভ্যাসে নিজেকে ব্যস্ত রাখল অর্জুন, তবু তার প্রেমভিক্ষু মন উদাসী বিষাদে ছেয়ে রইল সারাক্ষণ। ক্রমাগত এই ধারণাই অর্জুনের মনে জন্মাচ্ছে যে, একাকিত্বই তার নিয়তি। কেবল কৃষ্ণর কথা ভাবলে তার মন আপনি আনন্দে ভরে ওঠে। কোনও নারী নয়, ভাই নয়, আত্মীয় নয়, কেবল কৃষ্ণকেই তার চিরসখা বলে মনে হয়। যতদিন অর্জুনের শরীরে প্রাণ থাকবে, ততদিনই কৃষ্ণ থাকবে সেই প্রাণে।

যদি এই লম্বা সময় অর্জুন মা-ভাই ছেড়ে একা একা এভাবে ঘুরে না বেড়াত, সে বুঝতেই পারত না, অত অল্প দিনেই কৃষ্ণ তার কোথায় গিয়ে পৌঁছেছে।

কৃষ্ণ কি তার কথা এমনি করে ভাবে?

দশ মাস পরে অর্জুন আবার মণিপুরের দিকে রওনা হল। প্রথমবার যখন এদেশে আসে, তার জন্য কী অপেক্ষা করে আছে, কিছুই সে জানত না। আজ সে জানে, তার জন্য অপেক্ষা করে আছে একটি শিশু, এক নারী, এক পিতৃতুল্য প্রৌঢ় পুরুষ। অপেক্ষা করে আছে গোটা মণিপুর। এই কথা ভাবতে ভাবতে মন ভাল হয়ে গেল তার। মনে হল, তার জীবনও একজন কৃষক বা কুমোরের মতো সরল হত যদি তো বেশ হত। আকাশ যেমন ঘড়ার জলে নিজের ক্ষুদ্র প্রতিবিম্ব দেখে খুশি হয়, তেমনি সহজ জীবনের কল্পনায় অর্জুনও খুশি হয়ে উঠল।

নগরে পৌঁছনোর সঙ্গে সঙ্গে কত লোক ছুটে ছুটে আসতে লাগল অর্জুনকে দেখতে। অর্জুন, আমাদের অর্জুন! চারিদিকে সাড়া পড়ে গেল। লোকে তাকে ঘিরে জয়ধ্বনি দিতে দিতে প্রাসাদের দিকে নিয়ে চলল। সেই দলে শলক আর প্রদীপকও ছিল।

প্রাসাদের দ্বারে এসে তারা বলল, “অর্জুন, তুমি ছিলে না, সেই কষ্টে আমরা তিন সন্ধ্যা দীপ জ্বালিনি। তিন রাত্রি মদ ছুঁইনি একজনও। আমাদের ঘরের ছেলে চলে গিয়েছিল, আমাদের প্রাণে আর সুখ ছিল না অর্জুন।”

অর্জুন বলল, “তোমাদের এত ভালবাসার কথা আমি কোনওদিন ভুলব না। আমাকে আবার চলে যেতে হবে। কিন্তু আমার অংশ আমার ছেলেকে তোমাদের মধ্যে রেখে যাব। তোমরা তাকে আমার মতোই ভালবেসো।”

অর্জুনের ছেলে মণিপুরে থাকবে শুনে আনন্দ পেল লোকেরা, আবার অর্জুন চলে যাবে শুনে দুঃখ পেল। হরিষে-বিষাদে মন ভরিয়ে তারা ফিরে চলল আপন কাজে। চিত্রাঙ্গদা ছেলে কোলে দাঁড়িয়েছিল জানালার কাছে। মায়ের রূপে সে অসামান্য লাবণ্যময়ী হয়ে উঠেছে। চিত্রবাহন এসে অর্জুনকে জড়িয়ে ঘরে নিয়ে চলল। অর্জুনের এখন মাত্র তিনজন সঙ্গী। তারা তাদের পুরনো কুটিরে অনুপ আর সৌমাল্যর কাছে চলে গেল।

চিত্রবাহনের কুশল নিল অর্জুন। চিত্রবাহন বলল, “আজ আমাদের সমস্ত কুশল। আজ তুমি এসেছ।”

অর্জুনকে ছেলের মুখ দেখাতে নিয়ে চলল চিত্রবাহন। ছেলেকে দেখবে কী, চিত্রাঙ্গদাকে দেখে চোখ ফেরাতে পারছিল না অর্জুন। তার ইচ্ছে করল, এখুনি চিত্রাঙ্গদাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। চিত্রবাহনের জন্য সংযত হয়ে রইল। এবার ফুটফুটে ছেলেটির দিকে মনোযোগ দিল সে। তারই মতো কালো হয়েছে ছেলে। বেশ বড়-সড়, গাবলা-গোবলা। অর্জুনকে দেখে, যেন কত চেনে এমনভাবে, অতুলনীয় হেসে উঠল সে। আনন্দে হাত পা ছুড়ল। সবাই হাসতে লাগল তাকে দেখে। অর্জুনের যেন বিস্ময়ের সীমা নেই। এ তারই ছেলে! একটি রত্নকবচ ছিল তার হাতে। সে যখন খুব ছোট, ভীষ্ম ভালবেসে পরিয়ে দিয়েছিল। অনেকগুলো লহর দেওয়া এই কবচ ইচ্ছেমতো বড়-ছোট করা যায়। অর্জুন নিজের হাত থেকে তা খুলে তার আধখানা ভীষ্মর ভালবাসার চিহ্ন হিসেবে নিজের কাছে রাখল, আধখানা ছেলের হাতে পরিয়ে দিল। তার মনে পড়ল আরও একজনের কথা। উলূপীর কোলে ইরাবানের কথা। তাকে সে দেখতেও যায়নি। কোনও আশীর্বাদের চিহ্নও পরিয়ে দেয়নি তাকে। কেন? সে যেন বড্ডই তাড়াহুড়ো করে উলূপীর কাছ থেকে পালিয়ে এসেছে। আজ বুঝতে পারছে অর্জুন, ব্রহ্মচর্যের কঠোরতা থেকে উলূপীই তাকে যুক্তিসঙ্গতভাবে স্বাভাবিকতায় এনেছিল। কিন্তু অর্জুনের মনের গভীরে ধর্মচ্যুত হওয়ার ভয় এতখানিই প্রবল ছিল যে, সমস্ত ভাললাগা ছিন্ন করে সে পথে বেরিয়ে পড়েছিল। উলূপী আর ইরাবানের জন্য বড় কষ্ট হতে লাগল অর্জুনের। ব্রহ্মচর্যে বেরিয়েছে বলে ধনরত্নও সে সঙ্গে আনেনি, প্রচুর অলঙ্কারও পরে আসেনি। ইরাবানকে সে কী দেবে?

তার ইচ্ছা প্রকাশ করতে চিত্রবাহন বলল, “অর্জুন, এ তোমার নিজের বাড়ি। এখানে তোমার ধনরত্নের অভাব কী? তা ছাড়া তোমার নিজের জিনিসও তো রয়েছে। বিয়ের সময় তোমাকে যে-রত্ন আর গয়নাগুলো দিয়েছিলাম, সেসব তো তোমারই ধন। তার মধ্যে থেকেই তুমি ইরাবানের জন্য কিছু বেছে রাখো। তার আগে শুনে নাও তুমি অর্জুন, তোমার ছেলের নাম আমি রেখেছি বভ্রূ। বভ্রূবাহন। কথা অনুযায়ী সেই তো আমার উত্তরাধিকারী।”

অর্জুন বুঝল, একটি বড় কাজ সে ভুলে যাচ্ছিল। ছেলেকে কোলে নিয়ে সে বলল, “রাজা, আমি কথা দিয়েছিলাম, আমার ছেলেকে দাবিহীনভাবে আপনার কাছে দিয়ে যাব। এই নিন। এ ছেলে আপনার।”

বভ্রূবাহনকে চিত্রবাহনের হাতে দিয়ে প্রতিজ্ঞা রক্ষা করল অর্জুন। আর ইরাবানের জন্য সে বেছে নিল চুনি আর রক্তমুখী নীলায় গাঁথা কণ্ঠহার। উলূপী যখন মণিপুরে আসবে, চিত্রাঙ্গদা ইরাবানের গলায় এই আশীর্বাদী হার পরিয়ে দেবে।

দিনকয়েক থেকে এবার পুরোপুরিভাবে মণিপুর ছেড়ে যাবার উদ্যোগ নিল অর্জুন। সে জানে না আবার কবে সে এখানে আসতে পারবে। এই বিচ্ছেদের জন্য দীর্ঘ দশ মাস ধরে নিজেকে তৈরি করেছে অর্জুন। তৈরি হয়েছে চিত্রাঙ্গদাও। তবু, দু’জনের মন দুঃখে ভরে আছে।

সঙ্গীদের নির্দেশ দেবার জন্য কুটিরে এল অর্জুন। অনুপ আর সৌমাল্য নতমুখে এসে দাঁড়াল অর্জুনের সামনে। প্রদীপকের দুই মেয়েকে পছন্দ করেছে দু’জনে। অর্জুনের অনুমতি পেলে বিয়ে করবে। অনুপ বলল, “বিয়ে করেই আমরা সেইখানে চলে যাব অর্জুন, যেখানে তুমি থাকবে।”

অর্জুন হাসল। বড় দুঃখের সে হাসি। তার মতো আর কেই বা জানে, বিয়ে করে বউ-ছেলে রেখে দূর অনিশ্চয়তায় চলে যাওয়া কত যন্ত্রণার! সে বলল, “অনুপ, সৌমাল্য, তোমরা বিয়ে করে সুখী হও। তোমরা যদি চাও, এই মণিপুরেই থেকে যেতে পারো। চাইলে ইন্দ্রপ্রস্থেও চলে যেতে পারো বউ নিয়ে। যা তোমাদের ইচ্ছা। আমার সঙ্গে আর তোমাদের ঘুরে বেড়াতে হবে না।”

অনুপ দুঃখের গলায় বলল, “তোমাকে ছেড়ে থাকতে আমার কষ্ট হবে অর্জুন। প্রজার মতো নয়। তুমি আমাকে ভাইয়ের মতো দেখেছ। তোমার কাছে আমি শিখেছি অনেক কিছু। সেই শিক্ষা ব্যর্থ হতে দেব না আমি। যেখানেই থাকি, ক্ষাত্রধর্ম রক্ষা করে চলব।”

সৌমাল্য বলল, “অর্জুন, তুমি ছিলে না বলেই আমাদের জীবনে নারী প্রবেশ করল। তুমি যতক্ষণ কাছে ছিলে, আমাদের সব পূর্ণ ছিল, কোনও কিছুর অভাব বোধ হয়নি। যেই তুমি গেলে, সব শূন্য হয়ে গেল। আমরাও গৃহী হওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলাম।”

অর্জুন হেসে বলল, “এ সবই যৌবধর্ম সৌমাল্য। এতে কিছু অপরাধ নেই। এই আমাকেই দেখো, ব্রহ্মচর্য পালন করব বলে বেরিয়েছিলাম, অথচ দু’বার বিয়ে করে বসলাম। শর্তের সূক্ষ্ম বিচারে আমিও অন্যায় করিনি, তোমরাও করোনি। ভেবো না তোমরা।”

সৌমাল্য বলল, “আমি ইন্দ্রপ্রস্থেই ফিরে যাব অর্জুন। সেখানে আমার পরিবার আছে। মা, বাবা, দু’টি ভাই, ভাই-বউ। তাদের বাচ্চারা। বউকে নিয়ে সেখানেই যাব আমি।”

অনুপ বলল, “তুমি তো জানো অর্জুন, আমার সংসার বলে কিছু নেই। একমাত্র বোন কৃষ্ণবেণী, সেও আছে তার শ্বশুরঘরে। তাই আমি ঠিক করেছি এখানে থেকে যাব। রাজা চিত্রবাহনের সেনাদলে যোগ দেব আমি আর এই যে কুটির, আমাদের কত স্মৃতি কত আনন্দঘন মুহূর্ত এই কুটিরের গায়ে, এখানেই আমি বাঁধব আমার নীড়। ওই মাঠ ওই পাহাড়ের দিকে চেয়ে আমি ভাবব তোমার কথা। আমার মনে পড়বে, প্রতিদিন সূর্যোদয়ের আগে কী আনন্দে আমরা তিরচালনা অভ্যাস করতাম! চিত্রাঙ্গদাও এমনকী আপন দেবরের মতো স্নেহ করেছে আমাকে। এই কুটির ছেড়ে অন্য কোথাও বাস করব না অর্জুন।”

“বেশ। তাই হবে।”

কুটিরের চারপাশ ঘুরে দেখে নিল অর্জুন আরও একবার। আঠেরো মাস ওই পাহাড়ের তলায় ঘন সবুজ ঘাসের মাঠে ছিল তার অস্ত্র চালানোর জায়গা। অনুপ ছিল তার সঙ্গী। শেষ ছ’মাস ছিল চিত্রাঙ্গদাও। ওই কুটিরে আঠেরো মাস সে পূজার্চনা করেছে। মায়া কাটানোর তাগিদে প্রয়োজনের চেয়েও বেশি জোরে হনহনিয়ে চলতে লাগল অর্জুন।

মণিপুর রাজপ্রাসাদে চিত্রাঙ্গদার সঙ্গে আজ তার শেষ রাত্রি। ছেলেকে অনেকক্ষণ আদর করল অর্জুন। এত ছোট শিশু সে মণিপুরে আসার আগে কখনও কোলে নেয়নি। কী নরম! কী ছোট্ট ঠোঁট, ছোট নাকের ফুটো, ছোট হাই তোলা। একদিন সে-ও এইরকম ছিল। চিত্রাঙ্গদা ছেলেকে দুধ খাওয়াচ্ছে, এই দৃশ্য সে দেখল পরম মমতায়। কামকলাকুসুমিত মধুভাণ্ড স্তন আজ মাতৃত্বে স্ফীত এবং সুধায় ভরা।

অর্জুন বলল, “চিত্রাঙ্গদা, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে, তবু যেতে আমাকে হবেই। আমাকে তুমি মার্জনা কোরো।”

চিত্রাঙ্গদা বলল, “অর্জুন, আজ থেকে এগারো মাস আগে আমি যখন ছিলাম সদ্য গর্ভবতী, তীর্থে যাবার জন্য বিদায় নিতে এসেছিলে তুমি। যে-তোমাকে আমি পরিপূর্ণ চিনেছি ভেবেছিলাম, সেদিন তাকে সম্পূর্ণ অচেনা লেগেছিল। মনে হয়েছিল দুর্ভেদ্য। সেদিন তার কারণ বুঝতে পারিনি আমি। আজ পারি। সেদিন আমি আর সব কিছু বাদ দিয়ে অর্জুনকে দেখেছিলাম। আজ আর সেই ভুল আমার হবে না। আজ আমি জানি, অর্জুন এক ব্যক্তিমাত্র নয়। বংশপরিচয়, তার সমাজ, তার পারিবারিক ইতিহাস ও বর্তমানের নিরিখে তাকে বুঝতে হবে। জানতে হবে তার সাধনা, তার ধর্ম, উদ্দেশ্য। আজ আমি জেনেছি সেসব অর্জুন। তুমি যাও অর্জুন। তুমি সাধারণ নও। তুচ্ছ মায়ায় আমি তোমাকে বেঁধে রাখব না। একটি বিরাট গাছের কোটরে, ডালে ডালে যেমনি অনেক পাখি, অনেক প্রাণী বাসা বেঁধে সুখে থাকে, তেমনি করে তোমার জীবনে আমরা থেকে যাব। অর্জুন, তুমি যে কাছে নেই, এমনটা বিশ্বাস করতেই আমার দশ মাস কেটে গিয়েছে। তোমার না থাকার শূন্যতা আর কোনও কিছু দিয়েই ভরিয়ে তোলা যায় না। ছেলেকে দিয়েও নয়। তবু এখন সেই আমার অবলম্বন।”

“চিত্রাঙ্গদা, যদি তোমাকে ইন্দ্রপ্রস্থে নিয়ে যেতে চাই, যাবে তুমি?”

“কেন যাব না অর্জুন? তবে পাকাপাকি সেখানে থাকতে আমার প্রাণ চাইবে না। কেন জানো? পুরুষের বেশ আমার পছন্দ হোক আর নাই হোক, এখানে যে-স্বাধীনতায় যে-কাজে আমি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, সেইসব ছেড়ে একেবারে অন্তঃপুরিকার জীবন আমি মেনে নিতে পারব না। আর সেখানে আমার জায়গা কী হবে অর্জুন? এখানে আমার ছোট্ট দেশে আমিই সব। ভবিষ্যতে আমার ছেলে এখানকার রাজা হবে। এখানে আমার যেমন স্বাধীনতা তেমনি সম্মান। তবু যদি এমনটা হত, ওখানে তোমাকে পুরো আমারই করে পাব, আমি চলে যেতাম। তাও তো হওয়ার নয় অর্জুন। ওখানে তোমার ওপর সবচেয়ে বেশি অধিকার থাকবে পাঞ্চালীর, কারণ সে-ই তোমার প্রথমা। তারপর আছে তোমার রাজকর্তব্য। ঘরের কোণে প্রদীপ জ্বেলে রাতের পর রাত তোমার জন্য অপেক্ষা করাই হবে আমার জীবন। না অর্জুন। তেমনটা আমি পারব না। আর আমার ছেলে? সে তো মণিপুরের সম্পদ। তাকে ফেলে আমি কোথায় যাব?”

“তাই হোক তবে চিত্রাঙ্গদা। তুমি এখানেই তোমার অভ্যস্ত জীবনে ভাল থেকো। তবু আমি চাই, আমার দেশ দেখতে আসবে তুমি। সেই দেশের রাজা যুধিষ্ঠির যখন রাজসূয় যজ্ঞ করবে, তখন এসো তুমি। যুধিষ্ঠির ছাড়াও আমার আরও সব ভাইরা আছে সেখানে। ভীম, নকুল, সহদেব। আছে মা কুন্তী। কী যে ভাল আমার মা— তুমি কাছে গেলে বুঝবে। আমি জানি, সম্পদে কল্যাণে বৈভবে পুণ্যে রাজা যুধিষ্ঠির আর সবাইকে ছাপিয়ে যাবে একদিন। তুমি সেই গৌরবের দিনে গৌরবলক্ষ্মী হয়ে এসো।”

পরদিন পূজাপাঠ সেরে যাবার জন্য তৈরি হল অর্জুন। শিবের মন্দিরে প্রণাম সেরে এসেছে। অনুপ কাঁদছিল। অর্জুন তাকে আলিঙ্গন করল। চিত্রাঙ্গদা ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে আছে জানালায়। তার চোখ সারা রাত্রির জাগরণ এবং কান্নায় লাল, খরখরে। চিত্রবাহন আলিঙ্গন করল অর্জুনকে। অর্জুন তাকে প্রণাম করে বলল, “আসি পিতা।”

চিত্রবাহন আবেগাপ্লুত হয়ে বলল, “এই প্রথম তুমি আমাকে পিতা বললে অর্জুন। এই ডাকটুকু শোনার জন্য কত ব্যাকুল ছিলাম আমি। অর্জুন, আশীর্বাদ করি, সর্বজয়ী হও তুমি।”

অর্জুন চলতে লাগল। পথে শত শত লোক। তারা কাঁদছে। কেউ বাড়ির লাউটা এনেছে, কেউ চারটি ফল। অর্জুনকে দেবে। খিদে পেলে খেয়ো অর্জুন, আমার গাছের সেরা ফল। এক থলে মিষ্টি দিল প্রদীপক। কারও উপহার ফেরাল না অর্জুন। একটি মালবহনের রথে ভালবাসার বোঝা চাপিয়ে আর একটি সাধারণ রথে চেপে সাধারণ লোকের মতো সে মণিপুর ছেড়ে গেল।

আঠারো

বহু তীর্থ ঘুরে, প্রায় সমস্ত ভারতভ্রমণ সেরে, অর্জুন এল প্রভাসে। প্রভাস অতি মনোরম এবং পবিত্র জায়গা। যে-পাঁচটি নদীর জলে স্নান করলে পুণ্য হয়, তার এক সরস্বতী নদী। প্রভাসে সরস্বতী সমুদ্রে মিশেছে। প্রভাসের আরেক নাম সোমতীর্থ। লোকে বলে, সোমতীর্থের জলবায়ু যক্ষ্মা সারায়। স্বয়ং চাঁদ এখানে বসবাস করে যক্ষ্মারোগ থেকে মুক্তি পেয়েছিল।

প্রভাসের নির্মল জলবায়ু যক্ষ্মা সারানোর পক্ষে খুবই উপযোগী। তা ছাড়া সোমলতাও এখানে প্রচুর পাওয়া যায়। সোম যজ্ঞে যেমন লাগে, তেমনি লাগে মদ বা ওষুধ তৈরিতে। সোমরস খেতে খুব ভালবাসে অর্জুন। সে শুনেছে সোমরস ইন্দ্রেরও প্রিয় পানীয়।

আর মাত্র দু’বছর। তারপরেই মা-ভাইয়ের কাছে ফিরে যেতে পারবে অর্জুন। তার নির্বাসন ফুরোবে।

অর্জুনের মন এখন অনেক শান্ত। অনেক আত্মবিশ্বাসী।

বরাবর কুন্তী এবং যুধিষ্ঠিরের ছায়ায় থাকা অর্জুন এই একলা ভ্রমণের ফলে এখন অনেক বেশি সপ্রতিভ এবং স্বাবলম্বী। স্বাধীনভাবে দুটো বিয়ে করেছে সে। স্বাধীনভাবে ঘুরেছে। অস্ত্র সংগ্রহ করেছে। সাধারণ অসাধারণ বহু জনের সান্নিধ্যে যেমন লোকাচার দেশাচার সম্পর্কে জ্ঞান বেড়েছে তার, তেমনি তৈরি হয়েছে বিচক্ষণতা। এক তরুণ বীরের জীবনে বিষাদময় একাকী দশটি বছর অনেক অর্থ তৈরি করে।

এই দশ বছরে উলূপী আর চিত্রাঙ্গদা অর্জুনের মনোবনে পদ্ম আর চাঁপা। নিজেদের সবটুকু রূপ রস সৌগন্ধ আর গুণপনা দিয়ে তারা অর্জুনের পুরুষসত্তা ধন্য করেছে। দিয়েছে তাকে রমণের অভিনব স্বর্গসুখ। চিনিয়েছে নারী। অর্জুন তৃপ্ত। অর্জুন শান্ত।

অর্জুনের সঙ্গে এখন তিনজন মাত্র। পুরোহিত, সূপকার হরিষেণ আর দক্ষ যোদ্ধা দয়ানন্দ।

অনুপ এবং সৌমাল্যর তুলনায় দয়ানন্দ একটু বেশি বয়স্ক এবং গম্ভীর। কিন্তু সব কাজেই তার হাত পাকা। প্রভাসে পৌঁছে নদীমোহানার কাছাকাছি খুব সুন্দর নির্জন একটি জায়গা বেছে সে লোক জুটিয়ে কুটির তৈরি করতে লেগে গেল।

পরবর্তী দু’বছর কী করবে, সরস্বতীর পারে দাঁড়িয়ে ভাবছিল অর্জুন। এই প্রভাসে থেকে গেলেই কেমন হয়? বহু সাধুসঙ্গ করতে পারবে সে। সবচেয়ে ভাল হত, যদি এইসময়ে শিখতে পারত প্রতিস্মৃতি বিদ্যা। শিবলোকে এবং ইন্দ্রলোকে তবে যেতে পারত সে। শিবকে তুষ্ট করে পাশুপত অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারত। আরও ভাল হয় যদি পায় কৃষ্ণকে।

অর্জুনের অস্ত্রসম্ভার এখন বেশ বড়। সে ঠিক করল, ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরে নিজের জন্য একটি আলাদা অস্ত্রশালা তৈরি করবে। সাধারণ অস্ত্রাগারে আর কখনও যাবে না অর্জুন। পঞ্চপাণ্ডব অভিন্ন মানে তো এই নয় যে, কারও আলাদা অস্ত্র রাখার ঘর থাকতে পারবে না। বরং তা পৃথক হওয়াই ভাল। যার যেভাবে খুশি ব্যবহার করতে পারে। প্রয়োজনে অত্যন্ত দ্রুত নিজের অস্ত্র খুঁজে নিতে পারে।

কাছেই যে-বন, সেদিকে হাঁটতে লাগল অর্জুন। সরস্বতী নদীর স্নিগ্ধ হাওয়ায় তার শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। এমনই এ জায়গা, অর্জুন এখানে সারাজীবন থাকতেও রাজি আছে।

গত দশ বছরে পুণ্যসলিলা চার নদী দেখেছে অর্জুন। যমুনা তো বয়ে যাচ্ছে ইন্দ্রপ্রস্থের পাশ দিয়েই। কিরণা, ধুতপাপা আর গঙ্গাও দেখা হয়েছে। আজ পেল সরস্বতী। পঞ্চতীর্থের মধ্যে কুরুক্ষেত্র তো কবেই দেখা হয়েছে। গয়া দেখল, গঙ্গাদ্বার দেখল, এল এই প্রভাসে। বাকি রইল পুষ্কর। সে ঠিক করল, ইন্দ্রপ্রস্থে যাবার আগে পুষ্কর দর্শন করে যাবে। তার আগে এই প্রভাসেই কাটিয়ে দেবে দিনগুলো।

একটি ঝাঁকড়া রুদ্রাক্ষ গাছের তলায় এসে বসল অর্জুন। গাছের নীচে বিছিয়ে আছে শুকনো পাতা আর রুদ্রাক্ষ ফল। লোকে এই ফল পবিত্র মনে করে। কাহিনি আছে, তারকাসুরের তিন ছেলে তারকাক্ষ, কমলাক্ষ ও বিদ্যুন্মালীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে মহাদেব তাদের সংহার করেছিল। যে-পাশুপত অস্ত্র পাবার এত ইচ্ছে অর্জুনের, সেই পাশুপত দিয়েই শিব ওই তিন অসুরের বাসভবন ত্রিপুর ধ্বংস করেছিল। সেসময়, কেন কে জানে, মহাদেবের চোখ থেকে নাকি এক বিন্দু জল পড়েছিল এসে মর্ত্যে। সঙ্গে সঙ্গে জন্মায় এক গাছ। সেই গাছের ফলই রুদ্রাক্ষ।

অর্জুন আনমনে ক’টি রুদ্রাক্ষ ফল কুড়িয়ে দূরের একটি ঝোপ লক্ষ্য করে ছুড়তে লাগল। চারদিকে ঝলমল করছে রোদ্দুর। ছোট ছোট পাহাড় আর বনে ঘেরা মণিপুরের সেই কুটিরটি মনে পড়ল তার। এখন যদি চিত্রাঙ্গদা থাকত তার সঙ্গে, কতখানি সুখী হত অর্জুন? তার মনে পড়ল নাগলোকে শ্বেতনাগিনীর বরফগলা জলে উলূপীর সঙ্গে স্নানদৃশ্য। এই প্রভাসের সঙ্গে সেই হিমালয়ের কোলে নাগদেশের কোনও মিল নেই। সেখানে আকাশচুমুক পাহাড়-পর্বত দিগন্ত আড়াল করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠান্ডা হাওয়া আর বরফ-গলা জল পাঠিয়ে শীতল করে দিচ্ছে সমতলের সন্তাপ। সেখানকার বিরাট কঠিন পাথরগুলি আশ্চর্য গাম্ভীর্য নিয়ে চুপচাপ দেখছে মানুষের কীর্তিকলাপ। আর এই প্রভাসতীর্থের পুবে দক্ষিণে যত দূর চোখ যায় কোনও আড়াল নেই, বাধা নেই, যেন মনে হয়, ওই যে সীমারেখা, ওই দূর দিগন্তিকার পরেই পৃথিবীর শেষ মহাশূন্য। ওইখানেই, কোনও রহস্যলোক থেকে সূর্য উঠে আসে। সরস্বতী নদী এখানে সমুদ্রের সঙ্গে মিলনের আনন্দে বিস্তৃত, উদ্ভাসিত। মোহানা ছাড়িয়ে দূর সমুদ্রের অকুল জলরাশি আকাশে লীন হয়েছে দিগন্তরেখায়। মন এখানে আপনি উদাস উদার হয়ে ওঠে। দিগন্তলীন এই প্রভাসে যদি উলূপী আজ সঙ্গে থাকত, তবে কত সুখী হত অর্জুন? মনে পড়ল পাঞ্চালের সেই কুমোরবাড়ির ছোট ঘরখানি। তারা পাঁচভাই জড়োসড়ো হয়ে শুয়েছে গাদাগাদি করে। তাদের মাথার কাছে কুন্তী। পায়ের কাছে দ্রৌপদী। ধর্মতঃ, তখনও দ্রৌপদীর সঙ্গে বিয়ে হয়নি তাদের। একটি অনাত্মীয় অপরিচিত মেয়েকে পায়ের কাছে নিয়ে শুয়েছে পাঁচটি তরুণ। সঙ্কোচে সারা রাত ঘুমোতেই পারেনি। সবচেয়ে ভয়ে ভয়ে ছিল ভীম। যেমন বিশাল তার চেহারা, তেমনি গায়ের জোর। ঘুমের ঘোরে যদি পা দিয়ে পাঞ্চালীকে আঘাত করে বসে, এই দুর্ভাবনায় সারা রাত ভীম হাঁটু মুড়ে রেখেছিল। আজ এই উদার প্রকৃতির মধ্যে, পুণ্য ক্ষেত্রে যদি পাঞ্চালীকে একান্তে পেত অর্জুন?

তার মনে হল, এই মুহূর্তে কোনও নারীর সঙ্গই তার ভাল লাগত না। এমন অনেক সময় আসে জীবনে যখন একটি ছেলে একজন পুরুষকে সঙ্গী চায়, নারী চায় নারীকে। এখন অর্জুনের সবচেয়ে ভাল লাগত যদি কৃষ্ণ থাকত।

সেই যে পাঞ্চালীর সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখে দ্বারকায় চলে গেল কৃষ্ণ, তারপর এই এত বছর আর কোনও যোগাযোগ নেই। অর্জুন ভাবল, একবার দ্বারকায় চলে গেলে কেমন হয়? দ্বারকা এখান থেকে বেশি দূরে নয়। কিন্তু যদি কৃষ্ণ না থাকে সেখানে, খুব খারাপ লাগবে অর্জুনের। তার চেয়ে এই ভাল। এই অপেক্ষা। কৃষ্ণর মনে যখন তার ডাক পৌঁছবে, না এসে থাকতেই পারবে না।

দেখতে দেখতে তিনদিন প্রভাসে কেটে গেল অর্জুনের। চতুর্থদিন নিত্যক্রিয়া সেরে স্নানের জন্য সরস্বতীর পাড়ে এসে দাঁড়াল অর্জুন, দেখল, এক অসামান্য রূপবান যুবক অদূরেই দাঁড়িয়ে উদীয়মান সূর্যকে প্রণাম করছে। অর্জুনের বুক ধক ধক করে উঠল হঠাৎ। এই যুবককে সে আগে কখনও দেখেনি। তবু তার মনে হল, কর্ণ যেন এসে দাঁড়িয়েছে সরস্বতীর পাড়ে আর প্রণাম করছে সূর্যকে। আজও অর্জুনের মনে হল, সূর্য কী এক ইঙ্গিত দিতে চায়। হয়তো কৃষ্ণ জানে এর অর্থ কী। যদি না জানে, স্বর্গলোকে ইন্দ্র ও মহাদেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলে সূর্যর সঙ্গেও সাক্ষাৎ করবে বলে ঠিক করল অর্জুন। জিজ্ঞেস করবে, কেন তার এইরকম মনে হয়। সে সূর্যকে প্রণাম করে, কিন্তু সে তো কর্ণর মতো সূর্যের একনিষ্ঠ উপাসক নয়।

অর্জুনের কাছে কর্ণ এক বিস্ময়। সূত অধিরথের ছেলে কর্ণ যেমন সুন্দর তেমনি বীর। সূতের ছেলে বীর হবে না এমন কোনও কথা নেই। নিজের চেষ্টায় মানুষ কী না করতে পারে, একলব্যকে দেখে বুঝেছে অর্জুন। নিজের চেষ্টায় ক্ষত্রিয় বিশ্বামিত্র ব্রাহ্মণ হয়েছিল। ব্রাহ্মণ পরশুরাম হয়েছিল মহাবীর। ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কর্ণ— তিনজনই পরশুরামের শিষ্য। শিবকে তুষ্ট করে অত্যন্ত শক্তিশালী পরশু অস্ত্র পেয়েছে জমদগ্নির ছেলে ভার্গব পরশুরাম। তাই কর্ণর বীরবত্তায় অর্জুনের বিস্ময় নেই। সে অবাক হয় কর্ণর চেহারা দেখে। সূত অধিরথকে হস্তিনাপুর রাজবাড়িতে দেখেছে অর্জুন। আর পাঁচটা লোকের মতোই সে দেখতে। তার ছেলে এত সুন্দর? তার আরও অবাক লাগে, যে-কর্ণ অর্জুনের সম্পর্কে সবসময় প্রতিযোগী, তার প্রতি অর্জুনের ঈর্ষা জাগে না কেন? দুর্যোধন যখন কর্ণকে অঙ্গরাজ্যের রাজা করে দিল, অর্জুনের ভাল লেগেছিল। রূপে গুণে কর্ণ রাজা হওয়ার যোগ্য। দুর্যোধনকে নিয়েও অর্জুনের পরম বিস্ময়। কত রাজ্যের কত রাজা ও রাজপুত্রদের সঙ্গে যে দুর্যোধনের বন্ধুত্ব! অর্জুনের আশ্চর্য লাগে এই ভেবে যে, যে-ছেলে নিজের জ্ঞাতি ভাইদের দু’চক্ষে দেখতে পারে না, সে কী করে এমন বন্ধুবত্সল হয়! নিজের কাছে স্বীকার করতে অর্জুনের বাধা নেই, যুধিষ্ঠির অনাত্মীয়ের সঙ্গে এমন বন্ধুত্ব করে উঠতে পারে না।

ভাবতে ভাবতে এমনই অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল অর্জুন যে, সেই অনিন্দ্যকান্তি ছেলেটি কখন প্রণাম শেষ করে চলে গিয়েছে লক্ষই করেনি সে। স্নান সেরে সরস্বতীর তীরেই পূজা করল অর্জুন। তারপর গুনগুন স্বরে গান গাইতে গাইতে কুটিরে ফিরে এল। ‘ব্যূহ’ নামে যে বইটি তাকে দিয়েছিল কৌরব্য নাগ, অতি প্রাচীন সেই বই অত্যন্ত দুরূহ। নহুষ, যযাতি, দুষ্যন্ত, ভরত, কুরু, পুরু, পুরূরবা— যত বিখ্যাত রাজা ছিল, তাদের বিভিন্ন ব্যূহগঠন এবং ব্যূহ ভেঙে বেরিয়ে আসার আঙ্কিক কৌশল লেখা আছে এ বইতে। রচনাকারের নাম নেই কোথাও। সম্ভবত নর এবং নারায়ণ ঋষি এই বই লেখা শুরু করেছিল। তারপর ভৃগু, তারপর কশ্যপ ও পরাশর হয়ে এই বই শেষ হয়। এই বইটি নকল। মূল গ্রন্থ ব্যাসদেবের কাছে রাখা আছে। হয়তো ব্যাসদেব আরও কিছু এই পুঁথিতে সংযোজন করছে।

মণিপুরে থাকার সময় অর্জুন এ বই পড়ে আয়ত্ত করার চেষ্টা করেছিল। তারপর মেঘবাণ মন্ত্র শেখার জন্য মনোযোগ দিয়েছিল। আজ থেকে আবার ‘ব্যূহ’ পড়ায় মন দেবে সে।

খেয়ে-দেয়ে কুটিরের নিভৃত ঘরে ‘ব্যূহ’ নিয়ে বসল সে। গভীর মনঃসংযোগে পড়তে লাগল ব্যূহভেদ। বিভিন্ন বিচিত্র সেনাবিন্যাস। দ্রোণাচার্য্যের কাছে কিছু শিখেছিল তারা। সে আর দুর্যোধনই শিখেছিল সবচেয়ে ভাল।

পড়তে পড়তে যখন বইয়ের পাতায় ঢুকে পড়েছে সে, তার মনে হল, কোন দূর থেকে ডাক ভেসে আসছে তার নামে। অর্জুন, অর্জুন, অর্জুন!

সচকিত হল সে। কে ডাকে? কৃষ্ণর গলা না? তবে কি সত্যি কৃষ্ণ এল, না মতিভ্রম? ছুটে বাইরে বেরিয়ে এল সে। দেখল, সত্যিই কুটিরের সামনে রথ এসে দাঁড়িয়েছে। সেই রথ থেকে নেমে আসছে কৃষ্ণ। অর্জুনকে সবলে জড়িয়ে ধরল সে, যেন এক খণ্ড কালো মেঘ মিশে গেল অপর এক কালো মেঘের সঙ্গে। এক মেহগনি গাছ জড়িয়ে ধরল আর এক মেহগনিকে। কৃষ্ণ অর্জুনকে জড়াচ্ছে, ছেড়ে দিয়ে দেখছে কয়েক পল, আবার জড়িয়ে ধরছে। দু’জনেরই চোখ-মুখ থেকে আনন্দ ঝরে পড়ছে। আস্তে আস্তে আনন্দময় চোখগুলি জলে ভরে এল। চোখে জল মুখে হাসি নিয়ে কৃষ্ণ বলল, “তুমি একলা এভাবে প্রভাসতীর্থে কেন অর্জুন? দ্বারকায় না গিয়ে এখানে কেন?”

অর্জুন মুখে হাসি চোখে জল নিয়ে বলল, “তুমি কি কিছুই জানো না কৃষ্ণ? তা হলে যে লোকে বলে তুমি সর্বজ্ঞ!”

“লোকে তো আমাকে চোরও বলে অর্জুন, লোকের কথা ছাড়ো। তোমার কথা বলো। আমি সত্যিই কিছু জানি না।”

“বলব। সব বলব তোমাকে কৃষ্ণ। বলব বলেই তো মনে মনে কত ডেকেছি তোমাকে। কুন্তী বলে, তুমি অন্তরের আহ্বান শুনতে পাও। আমার ডাক শোনোনি তুমি কৃষ্ণ?”

কৃষ্ণ হেসে বলল, “আরে দূরত্ব বেশি হলে অন্তরের আহ্বানও পথ ভুলে যায়। ডাকছ একজনকে, শুনে বসল আরেকজন। তুমি হয়তো বলেছ কৃষ্ণ, ডাক পৌঁছল পাঞ্চালীর কাছে, সে ভাবল অর্জুন কৃষ্ণা কৃষ্ণা বলে ডাকছে। যেই তুমি দ্বারকার কাছাকাছি এলে, ওমনি তোমার ডাক পথ চিনে আমার কাছে চলে এল।”

অর্জুন হেসে উঠল। কতদিন— কতদিন পর এমন নির্মল হাসিতে ভরে উঠছে সে। কৃষ্ণর হাত টেনে সে বলল, “চলো, চলো, ঘরে চলো।”

ভাল করে অর্জুনের কুটির দেখতে দেখতে ঘরে এল কৃষ্ণ। “দিব্যি ব্যবস্থা।” বলল সে। অর্জুন বলল, “সব ব্যবস্থা করেছে আমার অনুচর দয়ানন্দ। তোমার পছন্দ হয়েছে কৃষ্ণ? থাকবে আমার সঙ্গে ক’দিন? পুরোহিত আছেন আমার সঙ্গে। তোমার পূজাপাঠের কোনও অসুবিধা হবে না। আর আমার রান্নার ঠাকুর সূপকার হরিষেণ, সে যে কী ভাল রাঁধে, বলে বোঝাতে পারব না। খেলে বুঝবে তুমি কৃষ্ণ। যেখানে যেখানে আমরা ছিলাম, সব জায়গায় হরিষেণ কিছু না কিছু নতুন পদ রাঁধতে শিখেছে।”

কৃষ্ণ বলল, “ওফ! দু’বন্ধুতে জমিয়ে খাব, কী বলো? প্রভাসের সোমরসও দারুণ খেতে। এমন জায়গায় ক’দিন থাকতে বলছ কী অর্জুন? তোমাকে ফেলে যাবই না আমি এখন।”

এত খুশি বুঝি অর্জুন আগে কখনও হয়নি। কৃষ্ণর রথ এবং সারথি দ্বারুকের ভার দয়ানন্দর উপরে দিয়ে কৃষ্ণকে নিয়ে প্রভাস দেখতে বেরুল অর্জুন। খানিক এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরি করার পর কৃষ্ণ বলল, “চলো, কোথাও গিয়ে বসি।”

অর্জুন বলল, “ওই যে বন দেখছ, চলো ওখানে যাই। খুব মনোরম জায়গাটা।”

“বন তোমার খুব প্রিয় অর্জুন?”

“হ্যাঁ। খুব প্রিয়। খুব শান্তি আসে মনে।”

“এত অশান্তিই বা কী তোমার? বন্ধু? তবে বন আমারও খুব প্রিয় গো। বনে এলে আমার আর লোকালয়ে যেতে ইচ্ছে করে না।”

কৃষ্ণকে নিয়ে অর্জুন বসল গিয়ে সেই রুদ্রাক্ষ গাছের তলায়। গাছের গুঁড়িতে ঠেসান দিয়ে বসতেই কৃষ্ণ বলল, “তোমার কাছে আসব বলে সেই কোন ভোরে উঠেছি, ঘুম ঘুম পাচ্ছে।” অর্জুনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়ল সে। হাসতে হাসতে বলল, “তোমার কোল মোটেই সত্যভামার মতো নরম নয়। ইটের চেয়ে ভাল, এই যা। তবে কাজ চলে যাবে।” অর্জুনের একটি হাত নিজের বুকে চেপে কৃষ্ণ বলল, “এবার বলো তো পার্থ, ব্যাপারটা কী? কেন তুমি এই প্রভাসে এসেছ? কবে বেরিয়েছ, কী করেছ, সব বলো।”

অর্জুন উদাস চোখে দূরের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমাকেই সব বলব কৃষ্ণ। তোমাকে ছাড়া আর কাউকে সব কথা বলতে পারব না আমি। এত কথা জমে আছে আমার কৃষ্ণ, আজ সারা দিন সারা রাত লেগে যাবে বলতে।”

“শুরু করো।”

অর্জুন শুরু করল, “তুমি তো জানো কৃষ্ণ, নারদের সঙ্গে বসে যুধিষ্ঠির কিছু বিধিনিয়ম তৈরি করেছিল যাতে আমাদের পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে দ্রৌপদীর সহবাস নিয়ে কোনও বিশৃঙ্খলা তৈরি না হয়। আমরা সবাই সেই নিয়ম মেনে নিয়েছি। যুধিষ্ঠির একবার বলেছিল, অর্জুন যখন পাঞ্চালীকে জয় করেছে সে প্রথমে অর্জুনেরই ঘরে যাক। কৃষ্ণ, তুমি জানো, লোকে যখন কথা বলে, শুধুমাত্র যা সে উচ্চারণ করল তার বাইরেও অনেক কিছু থাকে, যা দিয়ে সেই কথার ঠিক ঠিক অর্থ তৈরি হয়। বাচনভঙ্গি, স্বরগ্রাম, দৃষ্টি, শরীরী বিভঙ্গ, এমনকী উচ্চারণের স্পষ্টতা! যখন তুমি আমার সঙ্গে কথা বলো কৃষ্ণ, কুন্তী বলে, ভীষ্ম বা ভীম বলে, তখন আমি এসব দেখি না। কিন্তু যখন যুধিষ্ঠির কথা বলে, ধৃতরাষ্ট্র এবং দ্রৌপদী— আমি তখন সব নজর করি। কারণ এরা কথার মধ্যে কথা লুকোয়। যা বলতে চায় তা না বলে, যা বলতে চায় না তা সাজিয়ে তোলে। সেদিন যুধিষ্ঠিরের কথায় আমি বুঝেছিলাম, সে চায় না পাঞ্চালী প্রথমে আমার হোক। তা হলে সে কী চায়? পাঞ্চালী প্রথমে আমার না হলে কার হবে? যুধিষ্ঠির বড়। তারই হবে। আমি বুঝলাম, সে পাঞ্চালীকে পাবার জন্য কত ব্যগ্র। আমি তখন তার কথায় রাজি না হয়ে বললাম, তা হয় না। তুমি বড়, পাঞ্চালী আগে তোমার মহিষী হোন। যুধিষ্ঠির বেশ খুশি হল। কিন্তু পাঞ্চালীর মুখখানা ম্লান হয়ে গেল শুনে। ভীমের কোনও হেলদোল ছিল না। যদিও পাঞ্চালীর জন্য তার অধীরতা সেই স্বয়ম্বর সভাতেই আমি বুঝেছিলাম। কিন্তু আমার কথায় তার ভাববদল হয়নি কারণ সে বুঝেছিল, পাঞ্চালী প্রথমে আমারই হোক, আর যুধিষ্ঠিরের, তার কপালে পাঞ্চালী প্রথমবারেই নেই।”

কৃষ্ণ একমনে অর্জুনের কথা শুনতে লাগল। অর্জুন বলে চলল, “পাঞ্চালীকে আমিই প্রথম নেব, এরকম কিছুই আমি ভাবিনি কৃষ্ণ। কারণ তা ভাল দেখায় না। তবু যে যুধিষ্ঠির ওই ভালমানুষিটুকু করে নিজের মহত্ত্ব প্রমাণ করল, আমার খুব খারাপ লাগল সেটা। কার কাছে করল বলো? সেই আমি, যে নাকি মায়ের একটি কথায় ওইরকম আগুনের মতো রূপসী একটা মেয়েকে জয় করেও পাঁচ ভাইয়ের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছে! সেই যুধিষ্ঠির ছলনা করল অর্জুনের সঙ্গে যে নাকি একটা হরিণ মারলেও যুধিষ্ঠিরের পায়ে প্রণামী দেয়! এবারে তো যুধিষ্ঠির পাঞ্চালীকে নিয়ে থাকতে লাগল। নকুল সহদেবকে নিয়ে আমি আর ভীম সব দেখেশুনে রাখছিলাম যাতে যুধিষ্ঠির আর পাঞ্চালীর মধুর সময়ে কোনও ব্যাঘাত না ঘটে। এমন সময় একদিন এক ব্রাহ্মণ ছুটতে ছুটতে এসে বলল— অর্জুন, এক চোর আমার গোরু নিয়ে গিয়েছে, যাও, অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র নিয়ে এসো তুমি, আর আমার গোরু ফিরিয়ে এনে দাও। আমি তাকে বললাম কৃষ্ণ যে, একটা গোরুচোর ধরতে সহদেবই পারবে, আর তার জন্য অস্ত্রও তার কিছু লাগবে না কারণ ব্রাহ্মণ দেখেছে চোর কোনদিকে গেল। ব্রাহ্মণ খুব রেগে গিয়ে চিত্কার করে আমায় বলতে লাগল— শুনেছিলাম যুধিষ্ঠির প্রজাবত্সল আর তার ভাই অর্জুন বীর। এই তার পরিচয়? একটা গোরুচোর ধরতে পারে না? এই যদি তুমি অস্ত্রশালায় না যাও আর আমার গোরু ধরে না আনো অর্জুন, তবে আমি ব্রাহ্মণটোলায় যাব আর জনে জনে বলব, তুমি কীরকম অবহেলা অপমান করেছ আমাকে। কৃষ্ণ তুমি জানো, ব্রাহ্মণরা অল্পেই কেমন বিরুদ্ধ হয়ে ওঠে। ইন্দ্রপ্রস্থ নতুন রাজ্য, এখনই ব্রাহ্মণদের খেপিয়ে তুলতে আমার ভয় করল। তা ছাড়া ওখানে কারই বা জানতে বাকি আছে, একটি সাধারণ গোরুচোর ধরার জন্য অর্জুন কেন, নকুলেরও অস্ত্র-শস্ত্র লাগে না। তাও যে ব্রাহ্মণ বার বার অস্ত্রশালায় যাও অস্ত্রশালায় যাও বলছিল, তাতে আমার মনে হল, এর মধ্যে কী একটা ইঙ্গিত আছে। আমি অস্ত্রাগারের দিকে যেতে শুরু করলাম। ব্রাহ্মণ আমাকে অনুসরণ করে বলতে লাগল, তোমার মনে হয় ইচ্ছেই নেই যে, আমি গোরু ফেরত পাই। তাড়াতাড়ি অস্ত্রশালায় যাও বলছি। অস্ত্রাগারের সামনে দ্বার রক্ষা করছিল এই দয়ানন্দ। সে কিছু বলার আগেই আমি দেখতে পেলাম দ্রৌপদী ও যুধিষ্ঠিরের জুতো দু’জোড়া। তারা অস্ত্রাগারে। দয়ানন্দ আমাকে ভিতরে যেতে নিষেধ করল। আমি একটু ভাবলাম। অদূরেই ব্রাহ্মণ দেখছে আমি কী করি। সব কিছু আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল কৃষ্ণ। আমি বুঝলাম, এইসময় আমাকে অস্ত্রাগারে ঢোকানোই ব্রাহ্মণের কাজ। বিতৃষ্ণায় মন ভরে গেল। সব জেনেবুঝেও অস্ত্রাগারে ঢুকে পড়লাম আর দ্বিধা না করে। কীরকম জটিল সংকট দেখো কৃষ্ণ। ভেতরে গেলে আমাকে সত্য রক্ষা করতে বারো বছরের শাস্তি নিতে হবে, না গেলে ব্রাহ্মণ লোক খ্যাপাবে, এতে শুধু যুধিষ্ঠিরের নিন্দে হবে না, প্রতিপন্ন হবে, একটি মেয়েকে পাবার লোভে আমি অস্ত্রশালায় যাওয়ার ঝুঁকি নিইনি। নিজেকে অতখানি কাঙাল করে তুলতে পারলাম না আমি কৃষ্ণ। আমাকে দেখে যুধিষ্ঠির বলে উঠল, ভাই অর্জুন, তুমি এসময় এখানে! আমি ওদের দিকে ভাল করে তাকাইনি। শুধু বললাম, গোরুচোর ধরতে যাচ্ছি। এক ব্রাহ্মণের গোরু চুরি গিয়েছে। ফিরে এসে তোমার সঙ্গে কথা বলব। বাইরে এসে দেখি, অস্ত্র নাও অস্ত্র নাও করে যে-ব্রাহ্মণ পাগল হয়েছিল সে চলে যাচ্ছে। বুঝলাম তার কাজ শেষ। চোরকে সে যেদিকে যেতে দেখেছিল সেদিকে গেলাম। খুব সহজেই গোরু পাওয়া গেল। চোরও। মনে হল, আমার হাতে ধরা দেবে বলে চোর আর গোরু যেন অনন্তকাল ধরে অপেক্ষা করে আছে।”

কৃষ্ণ আর অর্জুনের কোলে শুয়ে নেই। নিজের হাতে ভর দিয়ে পাশ ফিরে আধশোয়া হয়ে আছে সে। তার ভ্রূ জোড়া কুটিল হয়ে উঠেছে। দুই চোখে বিস্ময় ও ক্রোধ। অর্জুন বলে চলেছে, “ব্রাহ্মণকে গোরু ফিরিয়ে দিয়ে, সহদেবের হাতে চোরের ভার দিয়ে আমি যুধিষ্ঠিরের সঙ্গে দেখা করে বললাম, আমাকে বিদায় দাও। আমাদের শর্ত জানো তো তুমি কৃষ্ণ। দ্রৌপদীর সঙ্গে অন্য কোনও ভাইকে একান্তে দেখে ফেললে যে-দেখবে তাকে বারো বছরের জন্য ব্রহ্মচর্য নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে। যুধিষ্ঠির অবশ্য এবারও মহৎ রইল। বলল— আমি তোমাকে বলছি, কোনও দোষ হয়নি তোমার। বড়ভাইয়ের ঘরে ছোটভাই আসবে, এতে দোষ কী? দোষ হয় বড় ছোটর ঘরে ঢুকলে। তাই তোমার কিছু দোষ নেই। কোথাও যেতে হবে না তোমায়। কিন্তু আমি শুনব কেন? শর্ত যখন মেনেছি, তা পালন করব না কেন? আমি তো দুর্বল নই। ছোটভাই বড়ভাইয়ের বিচার শর্তের অন্তর্গত ছিল না তো। পাঞ্চালী নামের একটি পরমাসুন্দরী মেয়েকে দু’বছর পরে রমণ করতে পারবে এই লোভে সত্যচ্যুত হবে না অর্জুন, যুধিষ্ঠিরও তা জানে ভালমতো। আমাকে তাড়াতেই তো সে চায়। না হলে, তুমি বলো কৃষ্ণ, অস্ত্রাগার কি একটা প্রেম করার জায়গা? নাকি ওই একটিই ঘর আমাদের? ব্রাহ্মণের গোরুও ঠিক তখনই হারাল আর আমাকেই সশস্ত্র হয়ে চোর পাকড়াতে যেতে হল! অস্ত্রাগারে ঢুকতেই হল আমাকে যেন চোর ধরার চেয়ে অস্ত্র নেওয়াই আমার প্রধান কাজ। কেন কৃষ্ণ, কেন? কেন এমন হীন আয়োজন করতে হল আমাকে বাইরে পাঠাবার জন্য? যুধিষ্ঠির যদি একবার বলত, যাও অর্জুন, বিশ্বভ্রমণ করে এসো— আমি চলে যেতাম। কৃষ্ণ, এই হীনতা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। পাঞ্চালীকে নিয়ে যুধিষ্ঠিরের চোখে আমি ঈর্ষা দেখেছি কৃষ্ণ। হ্যাঁ, হতে পারে, আমি তাকে জয় করেছি বলে, আমার প্রতি তার আকর্ষণ বেশি। তাতে অন্যায় তো কিছু নেই। সে তো মুগ্ধতা। আমাকে তাড়িয়ে যুধিষ্ঠির কি এই আকর্ষণ কমাতে পারবে কৃষ্ণ? নাকি নিজেই দ্রৌপদীকে কিছু বেশি করে পাবে? নাকি সে অনুমান করছে, বারো বছরে দ্রৌপদীও তেমন তীব্র থাকবে না আর। চারজনের ব্যবহারে অনেক ক্ষয়ে যাবে। আর আমিও পালটে যাব অনেকখানি? তাতেই বা কী লাভ হল তার? সে কি ভেবেছিল আমার প্রতি পাঞ্চালীর এই আসক্তি ভাইদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করবে? কোনও মানুষের পক্ষে কি নিক্তি মেপে পাঁচজনকে সমান ভালবাসা দেওয়া সম্ভব? কৃষ্ণ, লোকে অবাক হয়ে আমাকে দেখে। ভাবে, এই ছেলেটা কি মানুষ? যে-মেয়েটা নিজের বউ হতে যাচ্ছে, তাকে আরও চারজনের সঙ্গে ভাগ করে নিল? এর চেয়ে যদি কর্ণর গলায় মালা দিত দ্রৌপদী তো বেশ হত। কৃষ্ণ, সেই সহজ নীতিশিক্ষা কে না জানে। নারী আর ভূমি ঈর্ষার কারণ। ঈর্ষা বিবাদের কারণ। আর বিবাদ ধ্বংসের কারণ। স্বয়ম্বর সভায় ভীম যখন আমায় মনে করিয়ে দিল, ব্যাসদেব কুন্তী মাকে বলে গিয়েছিল, পাঞ্চালী আমাদের পাঁচ ভাইয়ের বউ হবে, তখন যুধিষ্ঠিরকে দেখেছিলাম আমি। নকুল সহদেবকেও দেখেছি। পাঞ্চালীকে প্রত্যেকে কামাতুর চোখে দেখছিল আর সব রাজার মতোই। আর আমি তোমাকে দেখেছিলাম কৃষ্ণ।”

“আমাকে?”

“হ্যাঁ কৃষ্ণ! দেখছিলাম তুমি কী সুন্দর! আর কী বিস্ময়কর তোমার মেধা ও সংযম। সেই মুহূর্তে, পাঞ্চালীকে নয়, আমি ভালবেসেছিলাম তোমাকে কৃষ্ণ। তুমি পাঞ্চালীর বরমাল্য পাবার জন্য আসোনি। তার বরণমালা পাবার কোনও আগ্রহ তোমার ছিল না। তোমার চোখে কোনও কাম ছিল না। বলরাম আলাভোলা মানুষ। তার কথা বাদ দিলে একমাত্র তুমি কৃষ্ণ, যে দ্রৌপদীকে যৌনলালসার সঙ্গে দেখেনি। আমি ভাবতে শুরু করলাম, কেন। এমন নয় কৃষ্ণ যে, তোমার নারীমোহ নেই। লোকে তোমাকে রমণীমোহন বলেই জানে। কৃষ্ণার মতো মেয়েও তুমি খুব একটা পাবে না। লোকে বলে, সে যজ্ঞের আগুন থেকে জন্মেছে। আগুনের মতোই সে রূপবতী। কোথাও এতটুকু আগুন জ্বললেও যেমন দৃষ্টি আপনি সেদিকে যায়, তেমনি দ্রৌপদী। কৃষ্ণার জন্য কৃষ্ণই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত পুরুষ। তবু কেন কৃষ্ণ নিজেকে সংযত রাখল? ভাবতে লাগলাম আমি। কেন ব্যাসদেব অত আগে কুন্তী মাকে অমন একটা কথা বলে গেল? কারণ ব্যাসদেব নিশ্চয়ই জেনেছিল দ্রুপদের শর্ত কী হতে চলেছে। জানত, কে কে ওই শর্তপূরণের ক্ষমতা রাখে। আমি অর্জুন, ভাইদের মধ্যে তৃতীয়, ওইরকম আগুনের মতো একটা মেয়ে আমারই বউ হলে অনর্থ আসবে সংসারে, ঈর্ষা হবে অন্য ভাইদের, মহাবোধি ব্যাসদেব তা অনেক আগে বুঝেছিল। তার জন্য কী করতে হবে, তারই ইঙ্গিত দিয়েছিল কুন্তী মাকে। বুদ্ধিমতী কুন্তী তার সদ্ব্যবহার করেছে কৃষ্ণ। কারণ অত বছর ধরে, ছেলেদের রাজ্যাধিকার পাইয়ে দেবার জন্য এত ধৈর্য ধরেছে যে-কুন্তী, এত কষ্ট অপমান সয়েছে— সে কখনও চায় না, কোনও কারণেই তার ছেলেদের মধ্যে মনোমালিন্য হোক। যা পাবে পাঁচজনে ভাগ করে নেবে— এই শিক্ষাই কুন্তী মা আমাদের ছোটবেলা থেকে দিয়েছে। একটি আতাফল পেলে যা বলত, একটি হরিণ শিকার করলে যা বলত, সেই একই লব্‌জ সে ব্যবহার করেছে পাঞ্চালী সম্পর্কে। কৃষ্ণ, কুন্তী পরে আফশোস করে বলেছিল সে না দেখেই এমন কথা বলে ফেলেছে। কৃষ্ণ, কুন্তী দেখেনি দেখতে চায়নি বলেই। যা বলেছে কুন্তী তা বলেছে বলতে চেয়েছে বলেই। পাঞ্চালীকে আগে দেখলে ওই লব্‌জ ব্যবহার করাই যেত না যে! আর, যেমন ব্যাসদেব জানত, তেমনি তুমিও বুঝেছিলে, দ্রৌপদীর মধ্যে আগুনের মতো সর্বগ্রাসী ভাব আছে। যে তার অধিকারী হবে, তাকে নিরন্তর ব্যাপৃত থাকতে হবে তার প্রেম, সন্তুষ্টি, দাবি এবং তাকে নিয়ে অপরের ঈর্ষা সামলানোর জন্য। তুমি তা চাওনি কৃষ্ণ। রমণীমোহন হয়েও পৃথিবীর সর্বোত্তমার বিষয়ে তুমি সংযম দেখিয়েছিলে। এতে তোমার মহত্ত্ব যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তেমনি তোমার বউরাও সম্মানিত হয়েছে। সেইদিন লক্ষ্যভেদ করার আগেই আমি মনকে শাসন করেছিলাম। পাঞ্চালীর প্রতি একাধিপত্যের এতটুকু আশা আমি রাখিনি। তাই অনায়াসে তাকে ভাগ করে নিয়েছিলাম। এক নারীর চেয়ে তোমার কাছে বেশি গুরুত্বের ছিল তোমার কর্তব্যবোধ, তোমার আর সব স্ত্রীদের প্রতি প্রেম। আমার ছিল ভাইদের মধ্যে বন্ধন অটুট রাখার প্রয়াস। নারীর কারণে ঈর্ষা, ঈর্ষার কারণে বিবাদ, বিবাদের কারণে ধ্বংস আমি আনতে চাইনি। আমার এই নীতিবোধ বুঝল না যুধিষ্ঠির।”

এরপর অর্জুন বলতে লাগল তার তীর্থভ্রমণের ইতিবৃত্ত। একে একে বলতে লাগল উলূপীর কথা। মণিপুরের চিত্রাঙ্গদা এবং চিত্রবাহনের কথা। ইরাবান ও বভ্রূবাহনের কথা। এবারে হা হা করে হেসে উঠল কৃষ্ণ। বলল, “তা হলে, ব্রহ্মচারী অর্জুন, ব্রহ্মচর্যকালে, বেশি নয়, মাত্র দু’টি বিয়ে করেছ তুমি আর মাত্র দু’টি ছেলের বাপ হয়েছ! হা হা হা! এই না হলে তুমি আমার বন্ধু!”

অর্জুন লজ্জিত মুখে বলল, “এ তোমার তিরস্কার, না কৌতুক কৃষ্ণ? আমি কি ধর্মচ্যুত হয়েছি?”

অর্জুনের মুখোমুখি আসনপিঁড়ি হয়ে বসল কৃষ্ণ। তার দু’টি হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “পাগল! কীসের ধর্ম আর কীসের চ্যুতি? উলূপী একেবারে সঠিক যুক্তি দিয়েছে তোমাকে। ওই নারদ ব্যাটা বিটলে বুড়ো। বারো বছরের জন্য ঘরছাড়া হয়ে থাকতে হবে, এই শাস্তিই দরকারের চেয়ে বেশি, তার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য জুড়েছে! পরে আড়ালে গিয়ে ব্যাটা নিজেই খিক খিক করে হেসেছে। অর্জুন, সারা জীবন তো তোমরা পাঁচ ভাই দ্রৌপদীর সঙ্গে থাকবে। আমি জানি, তোমার সঙ্গে যা হল, তা আর কোনও ভাইয়ের সঙ্গেই ঘটবে না। কারণ, আর কারও সঙ্গেই তা ঘটবার প্রয়োজন নেই। তোমার উপলব্ধি অভ্রান্ত। দেখো অর্জুন, মূল শর্ত থেকে তুমি এতটুকুও বিচ্যুত হওনি। শর্তে যদি কোনও অংশ বাহুল্য হয়, তাকে মেনে চলার মধ্যেই অধর্ম আছে। কারণ শর্ত যে তৈরি করছে সে নির্ভুল নয়। আর জগতে কেউ নির্ভুল নয়। যুধিষ্ঠিরের উচিত ছিল ব্রহ্মচর্যের অংশটুকু বাদ দেওয়া। আরে! ভাইয়ের সঙ্গে এক পলক পাঞ্চালীকে দেখে ফেললে এমন দোষ হয়ে গেল যে, একেবারে বারো বছর অণ্ডকোষে বাঁধন দিয়ে রাখতে হবে! ধুত্তোর! তুমি যা করেছ, ঠিক করেছ। আরে নারদের স্বভাবটাই ওমনি। সুযোগ পেলেই হল। পিঁড়িক দিতে ওর জুড়ি নেই। আমার বাড়িতে যখনই আসে, সত্যভামাকে উস্কে দিয়ে যায়। আর সত্যভামা কীরকম জানো? একেবারে মা মনসা। রাগের ছুতো পেলেই হল। রুক্মিণী হল ছিঁচকাঁদুনি আর সত্যভামা রাগুনি। আমার দুঃখের কথা আর তোমাকে কী বলব অর্জুন? তার ওপরে ওই বিটলে নারদ আর শয়তান দুর্বাসার যাওয়া-আসা। নারদকে তবু সহ্য হয় কারণ বুড়োর রসবোধ আছে। লড়িয়ে দিয়ে মজা পায়। কিন্তু দুর্বাসাকে দু’চক্ষে দেখতে পারি না আমি। সে যাক গে। তুমি কিন্তু দারুণ কাজ করেছ অর্জুন! উলূপীর মতো একটা বউ আমার যদি থাকত, মন্দ হত না।”

হেসে ফেলল অর্জুন। বলল, “দেখা হলে সত্যভামাকে বলব নাকি?”

“খবরদার না!” দু’জনে হেসে উঠল একসঙ্গে। অর্জুন হাসতে হাসতে বলল, “চলো কৃষ্ণ। তোমার নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে। এতক্ষণে হরিষেণও ভাল ভাল রান্না করে রেখেছে।”

“হ্যাঁ, চলো, রাতে খাব সেঁকা মাংস আর সোমরস।”

অর্জুনের মনে পড়ল সেই পূর্ণিমা রাত্রির কথা। কৌরব্যের প্রাসাদ উদ্যানে বসে সে আর উলূপী সেঁকা-ভাজা মাংস আর মদ খেয়েছিল। উলূপীর জন্য কষ্ট হতে লাগল তার। সে বলল, “উলূপী এক অসামান্য রমণী, জানো কৃষ্ণ! সে আমাকে শিখিয়েছে নাগপাশ বাণ।”

কৃষ্ণ বলল, “বাঃ! গরুড়াস্ত্র শিখেছ কি?”

“না।”

“নাগপাশ বাণকে অকেজো করে দেবার জন্য গরুড়াস্ত্র। আমি শিখিয়ে দেব তোমাকে। আর কী অস্ত্র পেলে?”

চিত্রবাহনের কাছে পাওয়া মেঘবাণের বর্ণনা দিল অর্জুন। কৃষ্ণ বলল, “বাঃ! এই মন্ত্র তুমি আমায় দিয়ো অর্জুন। কখন কী লাগে।”

“নিশ্চয়ই কৃষ্ণ, তোমাকে আমার অদেয় কিছু নেই। জানো কৃষ্ণ, আমার খুব ইচ্ছা একবার স্বর্গলোকে যাই। ইন্দ্রের কাছে তো যাবই। মহাদেবের কাছ থেকে পাশুপত অস্ত্র পেতেও চাই আমি।”

“হবে হবে। সব হবে। পৃথিবীর অস্ত্রই শুধু নয়, স্বর্গের সেরা অস্ত্রগুলোও অর্জুনের হাতে পড়ে ধন্য হওয়ার অপেক্ষায় আছে। অর্জুন, নিজের শ্রেষ্ঠত্বের কারণ বুঝতে হয়। তুমি কেন সেরা ধনুর্ধর জানো? একনিষ্ঠ এবং শিক্ষণপিপাসু বলে। আমার-তোমার বয়সী অন্যদের দেখো তোমার দেশে। আমার দেশে দেখো। শিক্ষাপর্ব শেষ করে সবাই আখের গুছোচ্ছে। শেখার মনটাই নেই। কিন্তু তুমি অন্যরকমের। তুমি অনেক পারবে। অনেক জানবে। তুমি আমার গর্ব অর্জুন। এখন আমি যা বলি, তা করো। মহাদেবের আগে অগ্নিকে তুষ্ট করো অর্জুন। গাণ্ডীব নামে একটি ধনুক বানিয়েছিল ব্রহ্মা জানো তো? গণ্ডারের মেরুদণ্ডে তৈরি সেটি। অসামান্য জিনিস। তুমিই তার সুযোগ্য অধিকারী। যতদূর শুনেছি, ওই ধনুক এখন অগ্নির প্রাণের বন্ধু বরুণের হেফাজতে। কিন্তু অগ্নিই তার অধিকারী।”

“আর কীভাবে অগ্নিকে তুষ্ট করি বলো তো? পূজা-যজ্ঞ তো রোজ করি।”

“সে দিয়ে হবে না। তোমাকে উপায় বলি শোনো। খাণ্ডবপ্রস্থ মানে তোমাদের ইন্দ্রপ্রস্থের গায়ে যে-খাণ্ডববন— ইন্দ্রের খুব প্রিয় জায়গা সেটি। সেখানে একবার ইন্দ্র আর অগ্নি এসেছিল বেড়াতে। এমনিতে দু’জনের খুব বন্ধুত্ব, কিন্তু পারস্পরিক ঈর্ষাও কম নেই। ইন্দ্র স্বর্গের রাজা। দানব মানব পশু পাখি সবাই তাকে সমীহ করে। তাই দেখে ঈর্ষাকাতর অগ্নি বলল— তোমার চেয়ে আমার শক্তি বেশি, সৃষ্টির মূল শক্তিই আমি, সেই আমাকে ছেড়ে লোকে কিনা তোমাকে সম্মান দিচ্ছে! ইন্দ্র বলল— মোটেই তোমার শক্তি আমার চেয়ে বেশি নয়। এই নিয়ে দু’জনের তুমুল ঝগড়া। মীমাংসার জন্য দু’জনে ব্রহ্মার কাছে গেল। ব্রহ্মা বলল— ঠিক আছে পরীক্ষা করা যাক। যেখানে তোমাদের ঝগড়ার শুরু, সেই বন পুড়িয়ে দেখাক দেখি অগ্নি। আর ইন্দ্রর ক্ষমতা থাকে, সেই বন রক্ষা করুক। যে জিতবে, সেই সেরা। সেই থেকে দু’জনে লেগে আছে। অগ্নি সাতবার ওই বন পোড়াবার চেষ্টা করেছে, পারেনি। ইন্দ্র নিভিয়ে দিয়েছে আগুন। তুমি যখন ইন্দ্রপ্রস্থে যাবে, আমরা ওই খাণ্ডববন পোড়াব। তার আগে অগ্নির কানে কথাটা দেওয়া দরকার। সে হয়ে যাবে।”

অর্জুন বলল, “কিন্তু ইন্দ্র তো আবার আগুন নিভিয়ে দেবে। সাতবার পেরেছে। অষ্টমবারও পারবে নিশ্চয়ই।”

“কেন পারবে না? তবে সে তা করবে না। তোমার গাণ্ডীব লাভের পথ ইন্দ্র আটকাবে না। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। নাগদের এক অংশ তক্ষক নাগেরা ওই বনে বাস করে। তারা ইন্দ্রের বন্ধুলোক। তাদের বিষয়ে সাবধান থাকতে হবে।”

“ওই বনের যত দানব, মানব, পশু, পাখি আছে সবাইকে আগে বনের বাইরে নিয়ে আসব তো আমরা?”

“না অর্জুন। পাখিরা আপনি বেরিয়ে যাবে। পশুরা বেরোলে নগরে গিয়ে অনর্থ করবে। দানব-মানব নিজেরা নিজেদের রক্ষা করতে পারলে করবে, কারণ আমরা তাদের অধিকারের জায়গা ছিনিয়ে নিচ্ছি আমাদের স্বার্থে। এই উদ্দেশ্যে অধিকারীকে জীবিত রাখতে নেই। অর্জুন, তোমাকে কঠোর হতে হবে।”

দুপুরের খাবার খেতে খেতে কৃষ্ণ বলল, “সত্যি খুব ভাল রাঁধে তোমার হরিষেণ। আমার তো খুবই ইচ্ছে করছে রুক্মিণী, সত্যভামা, জাম্ববতী— সবাইকে ডেকে ডেকে এই রান্না খাওয়াই। আর আমার আদরের বোন পরমাসুন্দরী চিত্রা তো এই রান্না খেলে খুব খুশি হবে। জানো তো অর্জুন, রুক্মিণী যখন দুঃখে থাকে তখন খুব ভাল রাঁধে। মাঝে মাঝে ওকে বলি— তুমি আর আমাকে আগের মতো ভালবাস না। ব্যস, ওমনি কাঁদতেও বসে, রাঁধতেও বসে।”

কৃষ্ণর কথায় হাসতে হাসতে চোখে জল এসে যাচ্ছিল অর্জুনের। সে বলল, “বেশ তো। দ্বারকায় ফিরবে যখন, নিয়ে যেয়ো হরিষেণকে।”

“আর তুমি কী খাবে? হরিমটর?”

“দয়ানন্দ আছে। ব্যবস্থা করবে কিছু।”

“দয়ানন্দর দয়া, কী বলো? আচ্ছা সে দেখব এখন। চলো আজ বিকেলে এক জায়গায় যাই। আমার খুব প্রিয় বন্ধু গন্ধর্ব চিত্রসেন এসেছে প্রভাসে। তার সঙ্গে দেখা করে আসি। চিত্রসেনের অনেক গুণ বুঝলে। সোমলতা দিয়ে ভাল ওষুধ বানায়। এ ছাড়া সে অগ্নির অত্যন্ত প্রিয় অনুচর। আমাদের সোমরস পানে যদি সে যোগ দেয় তা হলে দারুণ জমে যাবে। জানো তো, গন্ধর্বরা খুব ভাল গাইয়ে-বাজিয়ে হয়? তাদের মধ্যে চিত্রসেন সেরা।”

অর্জুন বলল, “কৃষ্ণ, তোমার মোহনবাঁশির কথা শুনেছি। সে-বাঁশি আমায় শোনাবে না?”

কৃষ্ণ একটুক্ষণ চুপ থেকে হেসে হেসে বলল, “বৃন্দাবন ছেড়ে আসার পর আর তেমন করে বাঁশি বাজাইনি আমি অর্জুন। তবে তুমি যখন চাইছ, আমি বাজাব। অবশ্য যদি চিত্রসেন একটা বাঁশি আমায় ধার দেয়।”

খাওয়া শেষ করে অর্জুনের ‘ব্যূহ’ গ্রন্থটি খুব আগ্রহের সঙ্গে দেখল কৃষ্ণ। বলল, “পুরো পড়েছ?”

অর্জুন বলল, “চোখ বোলানো গোছের। আজ থেকে মন দিয়ে পড়ছি। বোঝা সহজ নয়।”

“সে তো নয়ই। আবার একবার বুঝে গেলে দেখবে এর চেয়ে সহজ কিছু হয় না। ব্যাসদেবের বদরিকাশ্রমে গিয়ে ছিলাম কিছুদিন। তখন মূল পুঁথিটি ওখানে পড়েছি। শিখতে গিয়েছিলাম অবশ্য অন্য জিনিস।”

“কী শিখলে কৃষ্ণ? তুমি বলেছিলে বটে, ব্যাসের কাছে আয়ুর্বেদ শিখতে চাও।”

“শিশুজন্মের নানারকম উপায় জানেন ব্যাসদেব। তার কিছু শিখছিলাম।”

“তোমার কি ধাত্রীবিদ্যায়ও আগ্রহ আছে কৃষ্ণ?”

“আমার সব কিছুতে আগ্রহ অর্জুন। ভীষণ আগ্রাসী আমার জ্ঞানের স্পৃহা। আচ্ছা, তুমি তো নাগলোকে গিয়েছিলে। তুমি কি জানো ওরা অনেক ওষুধ-বিষুধ জানে?”

“হ্যাঁ, সেই আদি মাতা কদ্রুর সময় থেকে ওরা এসব করে চলেছে।”

“তুমি কি জানো ওরা সঞ্জীবনী মন্ত্র জানে? সেও অবশ্য ওষুধ একরকম। ওরা বলে মণি।”

“সঞ্জীবনী মন্ত্র? না, তা জানি না। তবে এ বোধহয় রটনা কৃষ্ণ। কারণ ওদের ঘরে ঘরে ছেলেরা গরুড়দের হাতে মরে। সঞ্জীবন মন্ত্র জানলে তো সব্বাইকে বাঁচিয়ে তুলতে পারত।”

“না। ব্যাপারটা একটু অন্যরকম অর্জুন। জানো তো, মানুষ যখন মরে, তার হৃৎপিণ্ড স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে মৃত্যু সম্পূর্ণ হয় না। অন্তত আধ প্রহর মস্তিষ্কের কোষ জীবিত থাকে। সেই সময়ের মধ্যে সঞ্জীবনী মণি প্রয়োগ করতে পারলে মৃত শরীর আবার সজীব হয়ে উঠবে। আমার যদি জানা থাকত তুমি ওদেশে যাচ্ছ, আমি বলতাম, শিখে এসো ওই বিদ্যা। কখন কোনটা কাজে লাগে। আর উলূপীর কথা যদি জানতাম, তা হলে তো আমিই যেতাম শিখতে।”

কৃষ্ণ হাসছে। গুরু আলোচনার ভার লাঘব করে তুলতে খুব ভাল পারে কৃষ্ণ। তার সঙ্গে থাকলে সব কাজই সহজ মনে হয়। অর্জুন বলল, “তোমার কাছে ‘ব্যূহ’-র পাঠ নেব আমি কৃষ্ণ।”

“নিশ্চয়ই। ওঃ, কী আনন্দে কাটবে বলো তো এই প্রভাসে। কত কী শিখব, চিত্রসেনের গান শুনব, সোমরস আর হরিষেণের রান্না খাব। সবচেয়ে বড় কথা, প্রাণ খুলে তোমার সঙ্গে কথা বলব অর্জুন।”

অর্জুনের মুখও উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আনন্দ ভাবনায়। আরও এক উপলব্ধিতে পুলকিত হল সে। সে যেমন কৃষ্ণকে পেয়ে আনন্দিত, কৃষ্ণও তেমনি। সে যেমন কৃষ্ণকে চায়, কৃষ্ণও তেমনি চায় অর্জুনকে।

উনিশ

কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে গেল। আজ কৃষ্ণ এসেছে প্রভাসে। আজ অর্জুন খুব খুশি। অনেকদিন তাকে এত খুশি দেখেনি দয়ানন্দ। দুপুরে খেতে বসে পুরোহিত এবং হরিষেণ সূপকারের সঙ্গে সেই কথাই বলছিল দয়ানন্দ। তারাও আজ বড় খুশি। ইন্দ্রপ্রস্থের পাণ্ডব রাজপরিবারের সঙ্গে যারা রোজ দিন কাটায়, যত ঠাকুর চাকর দারোয়ান সারথি মালি রক্ষী— সবাই অর্জুনকে ভালবাসে। এই নয় যে, অর্জুন খুব আড্ডাবাজি করে তাদের সঙ্গে, পাশা খেলে বা হইচই করে মাধ্বী খায় বলেই তারা অর্জুনকে আপনার মনে করে। সে এসবের কিছুই করে না। অর্জুনকে তারা ভালবাসে তার পরিমিত কিন্তু আন্তরিক ব্যবহারের জন্য। ন্যায়পরায়ণ ধার্মিক রাজা যুধিষ্ঠির রাজকাজের বাইরে সাধুসন্ত, মুনিঋষি ও ব্রাহ্মণদের সঙ্গে থাকে। সাধারণ লোক তাকে দূর থেকে সমীহ করে। বলদর্পী ভীমসেন ক্ষত্রিয় যোদ্ধা আর ব্রাহ্মণ ছাড়া কাউকে গণ্য করে না। রাজার ভাই বলে নকুল সহদেবের চালচলনও রাজার মতো। একমাত্র অর্জুন, যে সবচেয়ে বেশি গুণবান ও রূপবান হওয়া সত্ত্বেও সবার নাম মনে রাখে। সবাইকে কুশল জিজ্ঞেস করে। দয়ানন্দ চোখের সামনে দেখল কীভাবে ব্রহ্মচর্য ও নির্বাসনের প্যাঁচে পড়ে গেল অর্জুন। অথচ একথা সে কাউকে বলে বিশ্বাস করাতে পারবে না। সেও যদি নিজে না দেখে আর কারও মুখে শুনত, বিশ্বাস করত না। অর্জুনের এই পরিণতির জন্য নিজেকে ভারী অপরাধী মনে হয় দয়ানন্দর। তাই অর্জুন যখন যাত্রা করল, যুধিষ্ঠির লোকজন দিচ্ছিল তার সঙ্গে, দয়ানন্দও অর্জুনের সঙ্গে সঙ্গে থাকার জন্য আবেদন জানিয়েছিল।

মনের খুশিতে দয়ানন্দ সুন্দর দু’টি সুগন্ধী ফুলের মালা গেঁথে এনেছে অর্জুন ও কৃষ্ণর জন্য। কৃষ্ণ ভারী খুশি হল মালা পেয়ে। চিত্রসেনের জন্যও একখানি চেয়ে নিল সে। গলায় মালা দুলিয়ে বন্ধু চিত্রসেনের সঙ্গে দেখা করতে চলল দু’জনে। অপরাহ্নের নিঝুম বেলায়, অপরূপ সুন্দর দু’টি কালো ছেলে টান টান শরীর আর দৃপ্ত পদক্ষেপে সরস্বতীর তীর ধরে চলতে লাগল দুই কৃষ্ণ সারসের মতো। দু’জনেই দীর্ঘদেহী, নির্মেদ, দৃঢ় কিন্তু মসৃণ পেশিযুক্ত, দু’জনেই উন্নত ললাট, সুকেশ, তীক্ষ্ণ নাসা, বড় বড় টানা টানা মায়াবী চোখ দু’জনের, দু’জনেই হাস্যময়, শুধু কৃষ্ণর হাসিটি মধুরমধুর, অর্জুনের হাসিতে মাধুর্যর সঙ্গে অল্প বিষাদ। এই তফাত্টুকু যদি না থাকত, তা হলে মনে হত দর্পণ থেকে একজনের প্রতিবিম্বই বুঝি দেহ ধারণ করে বেরিয়ে এসেছে। অর্জুন জানে না, সে যখন কৃষ্ণকে বলে সুন্দর, তা নিজেকেও বলা হয়ে যায়।

গুরুর নির্দেশে চিত্রসেন প্রভাসে থাকবে মোট একশো আট দিন। তার মধ্যে আশি দিন পার হয়ে গেছে। প্রথম দিকে কৃষ্ণ এসে তার সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিল। তাই বাসস্থান চিনতে কৃষ্ণর ভুল হল না। তাকে দেখে খুব খুশি হল চিত্রসেন। অর্জুনকে দেখে পূর্বপরিচিতের মতো বলল, “এসো বন্ধু।”

ভাল লাগল অর্জুনের। সে দেখেই চিনেছে। ভোরবেলা এই যুবককেই সে সরস্বতীর পাড়ে সূর্যপ্রণাম করতে দেখেছিল। চিত্রসেনও যে দেখেছিল তা বুঝল অর্জুন যখন চিত্রসেন বলল, “পুণ্যসলিলা সরস্বতীর তীরে সূর্যোদয়ের পুণ্য লগ্নে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিল অর্জুন। তাই তুমি আমার পরম বন্ধু। আর এই কৃষ্ণ আমারও প্রাণের বন্ধু, তোমারও। সেই কারণেও তোমার-আমার বন্ধুত্ব নিঃশর্ত এবং অনিঃশেষ।”

অর্জুন চিত্রসেনের হাত দু’টি ধরে বলল, “আমি ধন্য।”

চিত্রসেন বলল, “কে বেশি কালো কৃষ্ণ না অর্জুন? কে বেশি রূপবান? বলবান কে বেশি?”

কৃষ্ণ বাঁকা হেসে বলল, “কেন? যে বেশি তাকে তুমি পুরস্কার দেবে নাকি? বা তার উল্টো। যে কম তাকে খারিজ করে দিলে। না কী বলো তো? আমার যদি বল একটু কম হয়, আমাকে একটু বল দেবে আর অর্জুনের রূপ কম হলে রূপ দেবে? এই স্বর্গের লোকগুলোকে নিয়ে মহা মুশকিল। সারাক্ষণ দাক্ষিণ্য বিলোতে চায়। বন্ধুকেও বাদ দেয় না।”

“আরে আমি কখন বললাম তোমাদের বল দেব, রূপ দেব? আমি কি পাগল?”

“দেবে না-ই বা কেন? যা চাইব দেবে।”

তিনজনে হেসে উঠল একসঙ্গে। তিনজন বীর, গুণী, মেধাবী, সরস এবং দেবদুর্লভরূপ তরুণের সম্মিলিত হাসিতে সরস্বতী নদী পর্যন্ত সানন্দে উছলিত হল। কৃষ্ণ বলল, “চিত্রসেন, চলো আমাদের আস্তানায়। আজ আমরা একসঙ্গে সোমরস পান করব। নাচব। গাইব। এই যে অর্জুনকে দেখছ, এ মহাধনুর্ধর হলে কী হবে, এ খুব সুন্দর গান গায়। আর এই যে চিত্রসেনকে দেখছ অর্জুন, এ স্বর্গে উর্বশীর নাচের সঙ্গে গানে বাজনায় সঙ্গত করে, নিজেও অত্যন্ত উঁচুদরের নৃত্যশিল্পী, কিন্তু এ মস্ত বীর। লোকে ভাবে নাচগান করলেই বুঝি পুরুষ মেয়েলি হয়ে যায়। সেটা যে একেবারেই ঠিক নয় তার প্রমাণ নটরাজ শিব এবং স্বর্গের গায়ক-নর্তক গন্ধর্ব চিত্রসেন।”

অর্জুন ভাবছিল, সে তো কৃষ্ণকে গান শোনায়নি। তবু কৃষ্ণ জানে তার গানের কথা!

অর্জুনের কুটিরে চিত্রসেনের গান শুনে বিমোহিত হয়ে গেল অর্জুন ও কৃষ্ণ। শুধু তারাই বা কেন, গান শুনছিল পুরোহিত, দয়ানন্দ, দ্বারুক ও হরিষেণ। সকলেই অপার্থিব সুরের মায়ায় মন্ত্রমুগ্ধ।

কৃষ্ণ স্বভাবসুলভ হাসিতে মুখ ভরিয়ে অর্জুনকে বলল, “কি বন্ধু, চিত্রসেনের কাছে গানের তালিম নেবে নাকি ক’দিন?”

কৃতজ্ঞ চোখে কৃষ্ণর দিকে চাইল অর্জুন। কৃষ্ণ একেবারে তার মনের কথা বলেছে। লোকে ঠিকই বলে। কৃষ্ণ অন্তর্যামী। সে চিত্রসেনের হাত দু’টি ধরে বলল, “বন্ধু, আমার শিষ্যত্ব স্বীকার করো।”

কৃষ্ণ বলল, “করবে করবে। তুমি ওকে গুরু-ত্ব দিচ্ছ যে। ত্রিজগতের সেরা ধনুকবাজ অর্জুনের গুরুগিরির সুযোগ কেউ ছাড়ে?”

হাসিতে ফেটে পড়ল সবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *