বোকা নেকড়ে

বোকা নেকড়ে

একদিন এক নেকড়ে পথে বেরোল চাকরির খোঁজে। পেটে খিদে। চব্বিশ ঘণ্টা হল পেটে কুটোটি পড়েনি। নেকড়ে হাঁটছে তো হাঁটছে, হাঁটছে তো হাঁটছে। পথে দেখা দুটো বলদের সঙ্গে। বলদ দুটো মাঠেই চরছিল। নেকড়ে বললে, ‘বলদভায়া, বলদভায়া আমি তো তোমাদের খাব।’

‘কী আর করব খাবেন তো খাবেন। কিছু তো করবার নেই। তবে আমাদের একটি অনুরোধ আছে। সেটা যদি রাখেন তা হলে বড় ভাল হয়। আমাদের একজনকে আজ খান, আরেকজনকে কাল খাবেন। আপনার ভালর জন্যই বলছি। বদহজম হবে না। আমরা তো আপনার ভাল চাই।’

‘ঠিক আছে’ নেকড়ে রাজি হয়ে গেল। ‘কিন্তু কাকে আগে খাব কেমন করে বুঝব?’ নেকড়ে জিজ্ঞেস করে।

‘সে আমরা ঠিক করে দিচ্ছি। একটু সাহায্য করব বই তো নয়। আপনি এই গুঁড়িটার ওপর উঠে বসুন। আর আমরা আপনাকে মাঝখানে রেখে দু’জনেই শ’খানেক হাত দু’পাশে সরে যাব। একজন বাঁয়ে একজন ডাইনে। তারপর দুজনেই একসঙ্গে তোমার দিকে ছুটে আসব। যে তোমায় আগে ছোঁবে তাকে তুমি কাল খেয়ো আর যে হারবে তাকে তুমি আজই খাবে। কী বলেন, আপনার মত আছে তো?’

নেকড়ে দেখে ভয়ে আপনি-তুমি ঠিক নেই। মনের আনন্দে বলে, ‘ঠিক আছে। তবে তাই ঠিক রইল।’

গাছের গুঁড়িটা যেখানে দু’ভাগ হয়ে গেছে ঠিক সেইখানটিতে নেকড়ে জাঁকিয়ে বসল। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে ধার দিতে লাগল। এক্ষুনি একটা বলদ এফোঁড় ওফোঁড় করতে হবে তো, দাঁতে ধার চাই।

একটা বলদ গেল শ’খানেক হাত বাঁয়ে। অন্যটা শ’খানেক হাত ডাইনে। তারপর একসঙ্গে দৌড়োতে শুরু করল নেকড়েটার দিকে। সোজা দৌড়ে এসে বলদদুটো প্রচণ্ড জোর ঢুঁ মারল নেকড়ের পেটে। তারপর কী হল, না হল, দেখবার জন্য অপেক্ষা না করেই চোঁ চোঁ দৌড়। সোজা এসে উঠল মনিবের দাওয়ায়।

কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে নেকড়ে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে বলল, ‘হায় হায় কী ভুলই করেছি। কালকের জন্য একটা বলদ জিইয়ে রাখার কী বা দরকার ছিল। মাথাটা আমার এক্কেবারে খালি।’

নেকড়ে আবার হাঁটা দিল। মাঠে একটা টাট্টু ঘোড়া চরছিল। নেকড়ে গিয়ে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।

‘ওহে ঘোড়ার পো আমি তো তোমায় এক্ষুনি খাব।’

‘তা ভাই পাঁশুটে নেকড়ে, খাবে বই কী? খালি একটা কথা ভাবছি। তোমার এমন সৌভাগ্য হবে কি না। রাজা আমায় হুকুম করেছেন তাঁর গুপ্তধন আগলাতে। আমাকে খেয়ে নেবে আর ভাই অন্য কেউ রাজার গুপ্তধন হাতিয়ে নেবে, সে তো ভাই হতে দিতে পারি না। যাই বলো রাজার হুকুম।’

‘রাজার হুকুম? তা হুকুমনামা দেখি তো? আগে নিজের চোখে দেখব, তবে ঠিক করব তোকে খাব কি না।’

‘এই তো দেখো না আমার পিঠেই লেখা আছে। পিছনে যাও আমি একটু নিচু হচ্ছি। ঠিক দেখতে পাবে। নিজেই পড়ে দেখো সত্যি না মিথ্যে।’

বোকা নেকড়ে টাট্টু ঘোড়ার কথা বিশ্বাস করে ঘোড়াটার পিছনে দাঁড়িয়ে পিঠের লেখা দেখবার চেষ্টা করতে লাগল। আর টাট্টু ঘোড়া পিছনের পা দুটো জোড়া করে এইস্যা এক চাঁট মারলে যে নেকড়ে শূন্যে উঠে বেশ কয়েক হাত দুরে ছিটকে পড়ল মাটিতে। মরল না বাঁচল বোঝা দায়। আর টাট্টু ঘোড়া টগবগিয়ে বাড়ির দিকে পিটটান।

জ্ঞান ফিরল। বোকা নেকড়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর নিজেই নিজেকে ধিক্কার দিতে লাগল, ‘মাথায় কিচ্ছু নেই; এই বুদ্ধি নিয়ে রাজার হুকুমনামা পড়তে যাওয়া কেন?’ নেকড়ে আবার হাঁটতে শুরু করল। এদিকে খিদের জ্বালায় মাথা ঘোরে বনবন। পা করে টলমল। চোখে সর্ষে ফুল দেখে।

নেকড়ে আবার হাঁটা দেয়। পথে দেখা এক গাধার সঙ্গে। নেকড়ে বলে, ‘ওহে ভায়া আমি তো তোমাকে খাব।’ গাধা বলে, ‘খাবে তো খেয়ো, কী আর করব। কিন্তু ভাই আমাদের বংশে একটা নিয়ম আছে। যে গাধাটিকে খাবে তার উপর তিনবার লাফাতে হবে। তাতে পাপ যাবে কেটে।’

ঠিক আছে নেকড়ে ভাবে। ব্যাটা গাধা তোর আর কতই বা বুদ্ধি হবে? তিনবার কেন, যদি বলিস তো ছ’বার লাফিয়ে দেব।

নেকড়ে লাফ শুরু করল। এক…দুই…মাঠে গ্রামের লোকজন কাজ করছিল। তারা হঠাৎ দেখে কী একটা নেকড়ে লাফালাফি শুরু করেছে। হাতের কাছে যে যা পেল কোদাল, কাস্তে, খুরপি, লাঠি তাই নিয়ে ছুটল নেকড়ে মারতে। ইট-পাটকেল দিয়ে শুরু হল দূর থেকে মারা। তারপর কাস্তে ছুড়ে মারলে। কাস্তে সোজা নেকড়ের গলায় বিঁধে গেল। গাধা ততক্ষণে দে দৌড়। ইট, পাটকেল, কাস্তে, কোদাল, খুরপি, লাঠির চোট লেগে নেকড়ের তো প্রাণ যায় যায়। দৌড়োতে দৌড়োতে এসে উঠল এক বাড়ির দাওয়ায়। গেরস্তের শুয়োরের পাল সেখানে কাছের মাঠেই চরছে। একটা মোটাসোটা নাদুস-নুদুস শুয়োরের কাছে গিয়ে নেকড়ে বলে, ‘তোকে তো আমি খাব।’

‘খাবে তো খাও, কী আর করব? কিন্তু মরবার আগে একটা ইচ্ছাপূরণ করতে দেবে?’

নেকড়ের তখন পেটে আগুন জ্বলছে। গা টনটন করছে। রেগে বলে, ‘কী তোর ইচ্ছে, জলদি বল।’

শুয়োর হাত জোড় করে কাঁচুমাচু মুখে বলে, ‘ভাই আমার একটা শিঙা আছে। বড় ইচ্ছে মরবার আগে একবার প্রাণভরে শিঙাটা বাজিয়ে নিই।’

পাঁশুটে নেকড়ে রাজি হয়ে গেল।

‘ঠিক আছে; কিন্তু চটপট কর। আজ তিনদিন দাঁতে কুটোটি কাটিনি। পেটে একবিন্দুও জলও পড়েনি।’

শুয়োর শিঙাটা তুলে নিল। তারপর জোর শিঙা বাজায় আর হেঁড়ে গলায় চেঁচায়,

‘মেরে ফেললে রে,

খেয়ে ফেললে রে,

কে আছ ভাই জলদি এসো।’

কর্তার গলা প্রথমেই গেল শুয়োর গিন্নির কানে। তক্ষুনি গাঁয়ে যে ক’টা কুকুর ছিল এক হাঁকে সব ক’টাকে জুটিয়ে নিয়ে চলল কর্তাকে উদ্ধার করতে। নেকড়েটাকে দেখেই গাঁয়ের মস্ত মস্ত কুকুরগুলো দিল তার চারপায়ে এমন কামড় যে নেকড়েভায়া হাউমাউ কান্না জুড়ল। নেকড়ে পালাবার পথ পায় না। উত্তর দক্ষিণ পুব পশ্চিম যে দিক দিয়েই পালাতে যায় সেইদিকেই একটা করে কুকুর খাড়া— দেয় খ্যাঁক করে এক কামড়। শেষে অনেক অনুনয় বিনয় করে হলপ করে বলতে হল, ‘নাক মুলছি, কান মুলছি, আর কোনওদিন শুয়োর খাব না। ছেড়ে দাও ভাই, এ যাত্রা রেহাই দাও।’ কর্তা-গিন্নি মেনে নিল। তাদের আগলে নিয়ে কুকুরের দল ফিরে গেল গাঁয়ে। নেকড়ে আবার চলতে শুরু করল। আহা বেচারা, খাওয়া নেই দাওয়া নেই, জল পর্যন্ত পেটে পড়েনি। কুকুরদের কামড়ে কামড়ে পা ক্ষতবিক্ষত। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কোনওরকমে চলছে। একটা শেয়াল ওই দিকেই আসছিল। নেকড়ে শেয়ালকে দেখেই বলে, ‘সাঙাৎ তোমাকে তো আমি খাব।’

শেয়াল তো ভারী চালাক হয়। তাই মিষ্টি মিষ্টি করে বললে, ‘তা সাঙাৎ এতদিন পর দেখা। কত গপ্প, কত কথা জমা রয়েছে, আর তুমি কিনা আমায় খেতে চাইছ? আমি তো তোমাকে খুঁজে খুঁজে হয়রান। যদি জানতে তোমার কপালে কী নাচছে তা হলে আর আমাকে খেতে চাইতে না। উলটে পুরস্কার দিতে।’

‘তা ভাই, খুলে বলো,’ নেকড়ের আর তর সয় না।

‘তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে গো এক পরমাসুন্দরী মেয়ে। বিয়ে যদি করতে চাও, তো জলদি চলো আমার সঙ্গে। এতক্ষণে বোধহয় সভা সাজিয়ে বরের জন্য অপেক্ষা করছে। সত্যি বলছি ভাই কী রূপ, কী গুণ, জগতে কেন, স্বর্গেও মেলে না। আহা হা…হা।’ নেকড়ে একটু ভেবে বলে, ‘তোমার কথা বিশ্বাস করে তোমার সঙ্গে যাচ্ছি। বলদ দুটো, টাট্টু ঘোড়া, শুয়োর ব্যাটা সবাই ঠকিয়েছে। যদি তোমার কথা মিথ্যে হয় তা হলে টেরটি পাবে।’

নাক, কান মলে মস্ত জিভ কেটে শেয়াল বলে, ‘ছিঃ ছিঃ ছিঃ রাম রাম, আমি তোমাকে মিথ্যে বলব? তা হলে আজ তিন দিন, তিন রাত তোমাকে খুঁজছি কেন? মেয়ের বাবা যে তোমাকে ডেকেছে। বলদ দুটো যে তোমাকে ঠকিয়েছে সে খবরও শ্বশুরমশাইয়ের কানে পৌঁছেছে। বলেছে বলদ দুটোকে জবাই করে এমন জায়গায় টাঙিয়ে দেবে যাতে সারা গাঁয়ের লোকে দেখতে পায়।’

বোকা নেকড়ে শেয়ালের সব কথা বিশ্বাস করল। চলল গ্রামের দিকে বিয়ে করতে। নেকড়ে ভাবে

বিয়ে বাড়ি, শ্বশুর বাড়ি,

আসবে খাবার গাড়ি গাড়ি—পেট চুঁই চুঁই করে খিদেয়।

হাঁটতে হাঁটতে নেকড়ে আর শেয়াল এসে পৌঁছোল গ্রামের ধারে। গ্রামের লোক এল ভিড় করে। ওমা শেয়ালের সঙ্গে যে নেকড়ে আসে! আর কোথা যায়, যে যা পেল ঢিলটা, লাঠিটা, কোদালটা, কুড়ুলটা কুড়িয়ে নিল। তারপর নেকড়েটাকে তাক করে সব ছুড়তে লাগল। নেকড়ের সে কী চেহারা। সারা গা ক্ষতবিক্ষত। জামাই আদরই বটে। আর শেয়াল কখন জানি সুড়ুৎ করে পড়ল সরে। খুঁজে পেতে এক গৃহস্থের আটা ভাঙার চাকির তলায় গিয়ে শেয়াল লুকোল। একটু আগেই চাকির পাশে বসে বাড়ির বউ আটা মাখছিল। মাখা ময়দা বারকোশেই রেখে একটু উঠে গেছে উনুনটা ঘরে আনতে আর ইতিমধ্যে শেয়াল এসে হাজির। প্রথমেই তো শেয়াল সব মাখা ময়দা চেটেপুটে খেল। তারপর বারকোশে, মাটিতে যা আটা পড়েছিল গড়াগড়ি দিয়ে তা মাথায় মুখে মেখে নিলে। তারপর গাঁয়ে ঢোকার মুখে নেকড়ে যেখানে পড়ে ছিল সেখানে গেল দিব্যি হেঁটে গটগটিয়ে। যেই নেকড়েকে দেখেছে, অমনি দুষ্টু শেয়াল গোঙাতে লাগল, ‘ওহো… হো…হো…আর তো পারি না। এর চেয়ে মেরে ফেললে ছিল ভাল… কেউ আছ নাকি গো…একটু এসো না গো…এবার বোধহয় জানে প্রাণে মলুম…গো…ও হো…হো…হো…’

শেয়ালের কান্না নেকড়ের কানে পৌঁছোল। চেনা গলা মনে হয়। কোনওরকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে, গড়াতে গড়াতে নেকড়ে গিয়ে শেয়ালের পাশটিতে পৌঁছোল।

‘কী ভায়া, অমন করে কাঁদছ কেন? কী হলটা কী?’

শেয়াল বলে, ‘নিজেই দেখো। আমার মাথাটা মেরে এক্কেবারে বেলফাটা করে দিয়েছে। দেখছ না ঘিলু গড়িয়ে পড়ছে?’

নেকড়ে দেখল সত্যিই সারা মাথা মুখ সাদা ঘিলুতে মাখামাখি। নেকড়ে তো আর জানে না ওগুলো আটা; তাই কাছে এসে বলতে লাগল, ‘কেঁদো না ভাই, কেঁদো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

শেয়াল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আর বলে, ‘ভাই, একটু পিঠে তুলে নাও না ভাই; আমার গর্তে পৌঁছে দাও। নয়তো বেপাড়ায় বেঘোরে প্রাণটা যাবে।’

বোকা নেকড়ে গড়াতে গড়াতে এসে দিল তার পিঠ পেতে। তাগড়া শেয়াল কুঁই কুঁই করতে করতে পিঠে চড়ে বসল। ধীরে ধীরে অতি কষ্টে নেকড়ে বয়ে নিয়ে চলল দুষ্টু শেয়ালকে। শেয়ালকে পৌঁছে দেবে তার গর্তে। শেয়াল এবার নড়ে চড়ে জাঁকিয়ে বসল নেকড়ের পিঠে। নেকড়ে এগোয় আর শিয়াল বিড়বিড় করে কী যেন বলে—

‘তাগড়া শেয়াল জাঁকিয়ে বসে’

মারখাওয়াটার পিঠে।’

নেকড়ে তো মার খেয়েই ছিল, তাই জিজ্ঞেস করে, ‘কার কথা বলছ ভাই?’ শেয়াল বলে, ‘ও কিছু নয়, ও কিছু নয় মন্তর পড়ছি। তোমারও ব্যথা সেরে যাবে, আমারও ব্যথা সেরে যাবে।’ চলতে চলতে নেকড়ে এসে পৌঁছোল শেয়ালের গর্তে। শেয়াল একলাফে নেকড়ের পিঠ থেকে নেমে মুচকি হেসে, চোখ মটকে গর্তে ঢুকে গেল।

নেকড়ে কী আর করে শেয়ালের গর্তের পাশে পড়ে থাকে আর ভাবে—আমার সাধের লেজ গেল কুড়ুলের ঘায়ে। সোনালি লোমে ভরা গা কালসিটে আর কাটার দাগে ভরা। বেচারি নেকড়ে কাঁদতে লাগল।

আর দুষ্টু ফিঙে পাখি একটা উঁচু ডালে বসে বসে সব দেখছিল। সে ফুড়ুৎ ফুড়ুৎ করে ওড়ে আর ছড়া কাটে,

‘মার খাওয়া ব্যাটা

সব দেয় হ্যাটা,

মরি আমি হেসে,

ঠকলি তো শেষে?

মনে ছিল সাধ,

মাংসের স্বাদ

পাবি সহজেই,

শেষে কিনা এই

হাল হল তোর?

ভাঙল কোমর।

বসে জাঁকিয়ে

পিঠ বেঁকিয়ে শেয়াল ভায়া

ধুর বেহায়া,

ঢুকল সে ঘর

তুই ডুবে মর।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *