সোহাগী

সোহাগী

সে আজ বহুকাল আগেকার কথা। এক দেশে এক বুড়ো ছিল। আর তার ছিল এক বুড়ি। তাদের ছিল একটি মেয়ে। ওই সম্বল। বুড়ো-বুড়ি দু’জনাতে মনের মিলে সুখে থাকত। বুড়ো-বুড়ি মেয়েকে প্রাণের চেয়েও ভালবাসত। খাটে শুতে দেয় না, পাছে গায়ে লাগে। সারাক্ষণ কোলে-কাঁখেই রাখে। পাড়ার লোকে নাম দিয়েছে সোহাগী।

সোহাগী নিজে কুটোটি নাড়ে না। যা চায় হুকুম করে। অমনি হাজির। সকাল হয়, সোহাগী খাট থেকে নামে না। মা আসবে অপেক্ষা করে। মা আসে, কোলে করে তোলে, মুখ ধোয়ায়, জামা ছাড়ায়, চুল আঁচড়ে দেয়, ভাল জামা পরায়। তারপর খাট থেকে তোলে। সাজ পাট হল, এবার কোলে। সারা দিন কোলে কাঁখেই থাকে। বুড়ি মা সারাদিন সংসারের যাবতীয় কাজকম্ম করে। ঘর ধোয় মোছে, রাঁধে বাড়ে। সোহাগী কোলে কাঁখেই ঘোরে।

দিন যায়। সোহাগী বড় হচ্ছে। হুকুম করে, ‘নিয়ে চলো।’ মানে শীত করছে আগুনের কাছে নিয়ে চলো। বুড়ো-বুড়ি অমনি চ্যাংদোলা করে সোহাগীকে আগুনের কাছে বসিয়ে দেয়।

বছর ঘুরে যায়। এক বছর, দু’ বছর, তিন বছর। সোহাগী এখন বেশ বড় হয়েছে। কত সম্বন্ধ আসে। সোহাগীকে বিয়ে করতে চায়। পাত্র নিজে এসে দেখে। কিন্তু সবাই ফিরে যায়। পাত্র আর জোটে না। জুটবে কোত্থেকে? পাত্রপক্ষ আসে, বুড়ি বলে ‘সোহাগীর বাপু পায়ে হাঁটা সয় না। আমরা ওকে কোলে কাঁখেই রাখি কিনা। মেয়ের বিয়ে আমরা তেমনি ঘরেই দেব বাছা, যারা আমার মেয়েকে কোলে কাঁখে করে রাখতে রাজি হবে।’

বরপক্ষ সব শোনে। সোজা হাঁটা দেয়। কে আর ওই শর্তে রাজি হবে? একবার তো এক পাত্র এল। বুড়ি তাকেও বললে, ‘আমার মেয়ের অভ্যেস কোলে কাঁখে থাকা। কোলে করেই খাওয়াই। কোলে করেই আগুনের পাশে বসাই। গরম লাগলে কোলে করেই দূরে সরিয়ে নিয়ে যাই। তুমি বাছা এমনি খেজমত যদি করতে পারো তবেই বিয়ে দেব।’

‘কোনও ভাবনা নেই মা। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না মা। আপনার চেয়ে ভাল করে ওর সেবা যত্ন করব। কোনও ত্রুটি হবে না।’

বুড়ো রাজি। বুড়ি রাজি। পাত্র রাজি। আয়োজন হল বিয়ে সাদির। ভাল হল, মন্দ হল, সে একরকম যা হোক হল। বিয়ে হল।

বর তো বাড়ি গিয়ে পরদিন থেকেই লেগে গেল বউয়ের দেখভাল করতে। সকাল হল। আগুনের কাছে বউকে নিয়ে এল কোলে করে। তারপর খুব যত্ন করে বসিয়ে দিয়ে নিজে চলে গেল মাঠে কাজ করতে। কাজ আছে বিস্তর। এদিকে সোহাগীর তো একটু পরেই বেজায় গরম লাগছে। অভ্যাস মতো চেঁচাল, ‘নিয়ে চলো।’ কিন্তু কে শুনবে? সারা বাড়িতে তো জনপ্রাণী নেই। একবার ডাকলে, দু’বার ডাকলে। গলা তুলে আবার হাঁকলে। কিন্তু কেউ এল না। কী আর করে। নিজেই গুটিগুটি আগুনের কাছ থেকে সরে বসল।

আর-একদিনের কথা। বেরোবার আগে বর চমৎকার করে ফরাশ পাতলে দোরগোড়ায়। যত্ন করে বউকে বসাল ফরাশের উপর। তারপর নিজে চলে গেল কাজে। দরজা দিয়ে তো হু হু করে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকছে। একটু পরেই সোহাগী তারস্বরে চেঁচাতে লাগল, ‘নিয়ে চলো, নিয়ে চলো।’ কিন্তু নেবেটা কে? বাড়িতে তো আর দ্বিতীয় প্রাণীটি নেই। কী আর করে, নিজেই উঠল। দোরটা ভেজিয়ে ফরাশটা টেনে নিয়ে বসল আগুনের কাছে। একদম গা ঘেঁষে।

পরদিন সোহাগীর বর সোহাগীকে সাজিয়ে গুজিয়ে বসিয়ে দিল। তারপর বেশ মিষ্টি করেই বললে, ‘শোন গো শোন। আমি মাঠে চললাম। তুই রান্না বান্না করে আমার ভাত মাঠে পৌঁছে দিবি। বুঝলি? দেখিস যেন অন্যথা না হয়।’

দুপুরের খাবার সময় হল। বেলা গড়িয়ে গেল। সোহাগী নড়েও না চড়েও না। ঠায় বসে থাকে। বসে বসে তার এমন খিদে পেল যে শতরঞ্চিটার নাম ধরে তাকেই ধমকাতে লাগল। ‘কানে ঢোকেনি নাকি? মনিব যে বলে গেল সকালে, ভাত নিয়ে মাঠে যেতে। নে নে চটপট কর যা, যা ভাত দিয়ে আয় মাঠে। জলদি কর।’

এই বলে সোহাগী শতরঞ্চিটা টেনে বের করলে ফরাশের তলা থেকে। তারপর দিলে টান মেরে উঠোনে ফেলে।

সন্ধ্যা হল। চাষি ঘরে ফিরল। ঢুকেই দেখে উঠোনে পড়ে রয়েছে শতরঞ্চিটা। আর কোথায় যায় চাষি শুরু করলে ধমকাতে। ‘কী রে ব্যাটা খাবার নিয়ে মাঠে যাসনি কেন? কী বলে গিয়েছিলাম?’ চাষির সঙ্গে সঙ্গে সোহাগীও গলা মেলালে। ‘দেখো না গো, আমিও কতবার বললুম, তা নড়ে বসলে না। চৌকাঠটিও পেরোল না।’

‘ও বুঝেছি এই ব্যাপার! আমার কথাও শোনে না আর তোমার কথাও কানে তোলে না। এত বড় আস্পর্ধা? দেখাচ্ছি মজা। কথা না শোনা বের করছি।’ এই বলে চাষা হিড়হিড় করে শতরঞ্চিখানা টেনে এনে বেশ টান টান করে দিলে সোহাগীর পিঠে পেতে। তারপর ছড়িগাছা তুলে সে কী মার? সোহাগী মিনমিন করে বলে, ‘ওগো চাষার পো, তুমি তো শতরঞ্চিটাকে শিক্ষা দিচ্ছ। এদিকে লাগছে যে আমার।’

‘একটু সহ্য করো বউ, আর একটু। একটু ধৈর্য ধরো। এমন শিক্ষা দেব যে আমার বউয়ের অবাধ্য আর কোনওদিন হবে না।’

পরদিন কাজে যাবার সময় চাষা আবার শতরঞ্চিকে ডেকে ভাল করে বুঝিয়ে বলে গেল। ‘আজ ভাল করে ভাত তরকারি রাঁধবি। আর সময় হলেই, সব গুছিয়ে নিয়ে মাঠে চলে যাবি, বুঝলি?’ এই বলে চাষা গেল মাঠে চলে।

দুপুর হল। বেলা গড়িয়ে গেল। সোহাগীর ভারী খিদে পেল। এবার সে চিৎকার জুড়ল। ‘কী রে শতরঞ্চি ভুলে গেলি নাকি? মনিব কী বলে গিয়েছিল?’ নিজের বসে থাকা ফরাশের তলা থেকে একটানে শতরঞ্চিটা বের করে দিলে সেটাকে একদম চৌকাঠ পেরিয়ে ছুড়ে ফেলে। শতরঞ্চি গিয়ে পড়ল সোজা উঠোনে। শতরঞ্চি আর কী করে সারাদিন ওই জায়গাটিতেই পড়ে রইল। সোহাগী বলে, ‘থাক থাক পড়েই থাক আসবে মনিব সন্ধ্যাবেলা দেবে দু’ঘা বুঝবি ঠ্যালা।’ সোহাগী এবার নড়েচড়ে আগুনের গা ঘেঁষে বসল।

সন্ধ্যা হল। চাষা ঘরে ফিরল। উঠোনে শতরঞ্চিটাকে পড়ে থাকতে দেখেই খেপে উঠল। বললে, ‘কী রে ব্যাটা, এত মার খেলি, তবু কানে কথা গেল না? তবু অবাধ্যতা! দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।’

সোহাগী বলে, ‘কী আর বলব গো? কতবার বললুম। কিছুতেই কথা শুনলে না। ঠায় ওই উঠোনেই পড়ে রইল।’

আর কোথা যায়? চাষা শতরঞ্চিটা টেনে নিয়ে বেশ করে সোহাগীর পিঠে পাতলে। তারপর ছড়িগাছা তুলে সে কী মার! দমাদ্দম দমাদ্দম সপাং সপ, সপাং সপ। সোহাগী বলে, ‘উহু-হু এ কী লাঠি, ওরে বাবা রে মলুম রে। তুমি তো বেশ শতরঞ্চিটাকে শিক্ষা দিচ্ছ, আর এদিকে আমার পিঠ যে গেল!’ চাষা কি ছাড়ে? পিটছে আর বলছে, ‘দাঁড়া বউ দাঁড়া, আর একটু দাঁড়া। আর দু’-চার ঘা পড়লেই কাল থেকে সব কথা শুনবে। কই দেখি তো আর ক’ ঘা লাগাই।’ চাষার বউয়ের সে কী কাকুতি মিনতি। ‘ছেড়ে দাও গো, ছেড়ে দাও। ভগবানের দিব্যি, সত্যি বলছি ও ব্যাটা যদি খাবার নিয়ে না যায়, তো কাল আমি নিজে তোমার ভাত মাঠে নিয়ে যাব। পায়ে পড়ি এবার ক্ষান্ত দাও।’

পরদিন কাজে যাবার সময় আবার চাষা বলে গেল শতরঞ্চিটাকে, ‘রেঁধে বেড়ে ঠিক সময় মতো মাঠে যাবি, নইলে উচিত শিক্ষা পাবি।’

সোহাগী বসে আছে তো আছেই। শতরঞ্চিকে বলে, ‘দেখিস বাপু যা করবার এখনই কর। আজ আবার মনিব এসে মারধর না করে। কাল তো বলে কয়ে অতি কষ্টে ক্ষান্ত করেছিলাম। তাই কাল রেহাই পেলি। তা বলি বাপু এত যে মার খাস তবু নড়ে বসতে ইচ্ছে করে না?’

শতরঞ্চি নড়েও না চড়েও না। দেখে শুনে সোহাগী এবার নিজেই উঠে দাঁড়ালে। পায়ে করে শতরঞ্চিটা সরিয়ে দিয়ে বসল রান্না করতে। রুটি বানাল, তরকারি রাঁধল। তারপর পাড়াপড়শি সক্কলের আগে খাবার নিয়ে চলল মাঠে।

দিন যায়। মাস যায়। বছর ঘুরে যায়। সোহাগী এখন কাজ করতে শিখেছে। পাকা রাঁধুনি। নিজেই সব করে। কে তাকে হাতে হাতে জোগান দেবে? কারও থেকে সে এখন কম যায় না। চাষা ভারী খুশি। তার ইচ্ছে তার বউ পাড়ার মধ্যে হবে সবার সেরা। একদিন সকালে উঠে চাষা শতরঞ্চিকে ডেকে বলল,

শোন রে শতরঞ্চি ব্যাটা,

তুই তো জানি বেজায় ঢ্যাঁটা,

তবুও বলি শোন।

সন্ধ্যা হলেই মাঠে যাবি

বাতি ধরে ঘরে আনবি।

দেখিস যেন অন্যথা না হয়।’ এই বলে চাষা চলে গেল। এদিকে সন্ধ্যা লেগেছে কি লাগেনি সোহাগী বলে, ‘কই যা যা ছুটে যা। আঁধার হল। কর্তাকে ঘরে নিয়ে আয়। চটপট কর বাপু।’ এই বলে, দিলে শতরঞ্চিটাকে এক টান মেরে চৌকাঠ পেরিয়ে ছুড়ে ফেলল। সন্ধ্যা লাগতেই চাষা ঘরে ফিরল। আর কোথা যায়, পড়ল শতরঞ্চি নিয়ে। উঃ সে কী মার। চাষা মারে, আর বউ কেঁদে কেঁদে বলে, ‘ছেড়ে দাও গো, ছেড়ে দাও; পায়ে পড়ি তোমার। গা-খানা তো শতরঞ্চির কিন্তু শিরদাঁড়াটা যে আমার। কাল থেকে আমিই তোমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসব।’ পরদিন সোহাগী চটপট করে রাতের রান্না সেরে রাখল। যেই আঁধার লাগল চলে গেল বাতি নিয়ে কর্তাকে আনতে। ঠিক সেইখানেই গিয়ে দাঁড়াল যেইখানটিতে চাষা বলে দিয়েছিল। মাঠের কাজ সেরে চাষা এল। সোহাগী ঘোড়ার জিনটা তাড়াতাড়ি চাষার হাত থেকে নিয়ে নিল। তারপর দু’জনায় চলল ঘরমুখো। তার পরদিন থেকে সোহাগী রোজ কর্তাকে এগিয়ে দেয়, রোজ বাতি ধরে পথ দেখিয়ে নিয়ে আসে।

বেশ কিছুদিন কেটে গেছে। একদিন সোহাগীর মা ভাবলে যাই মেয়ের বাড়ি ঘুরে আসি। কেমন আছে মেয়েটা কে জানে। কতদিন দেখি না। কে জানে জামাই যত্ন আত্তি করছে কি না। এইসব ভেবে তো বুড়ি একদিন জামাইবাড়ি এসে হাজির। এসে যা দেখলে তাতে তো বুড়ির নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না। সোহাগী নিজে বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছে। নিজেই সব কাজ করছে। বুড়িকে দেখে মেয়ে কী খুশি। বুড়ি জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করল।

‘হ্যাঁরে সোহাগী, জামাই কোলে কাঁখে করে রাখে তো তোকে?’ কথা শুনেই তো সোহাগীর চোখে জল। চোখের জল মুছে উত্তর দেয়, ‘শুধু কি যত্ন আত্তি করে না, কোলে কাঁখে রাখে না, রোজ সন্ধ্যাবেলা আমার পিঠে শতরঞ্চি পেতে শতরঞ্চিকে সে কী মার! কেন শতরঞ্চি ভাত রাঁধেনি, কেন মাঠে ভাত পৌঁছোয়নি?

বেচারা বুড়ি হায় হায় করে ওঠে। ‘তা বাছা তোকে মারে কেন?’ বুড়ি বলে।

‘আরও শুনবে?’ সোহাগী শুধোয়।

‘থাম থাম মজা দেখাচ্ছি। আসুক সে। কথা দিল এক আর করল আর। বাজ পড়ুক হতভাগার মাথায়।’

আঁধার হয়ে এল। সোহাগী চলল কর্তাকে এগিয়ে আনতে। বুড়ি শুধোয়, ‘সোহাগী মা আমার, সারাদিন খেটেখুটে সাঁঝবেলাতে চললি কোথায়?’

‘মাগো তুই এখানে বোস। আমি তেনাকে এগিয়ে নিয়ে আসি। রোজ ভোরে এগিয়ে দিই, রোজ সাঁঝের বেলায় বাতি ধরে বাড়ি ফিরিয়ে আনি।’ সোহাগী কাঁদোকাঁদো গলায় দুঃখ জানায়।

‘কী বলিস মা? সত্যি নাকি? বস এখানে। কোথাও যাবি না। জোয়ান মদ্দ ছেলে ঘরে ফেরার পথ চেনে না? ন্যাকা নাকি?’

চাষা সেদিন একাই ঘরে ফিরল। এবার পড়লে বউকে নিয়ে। ‘কেন রে আজ এগিয়ে আনতে যাসনি?’ হঠাৎ সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বয়ং শাশুড়ি। আর জামাইকে সে কী ধমকানি! বুড়ির মুখে যা আসে তাই বলে। চাষাও দমবার পাত্র নয়। দড়ি দিয়ে বেঁধে এক আঁটি খড় এনে শাশুড়িকে দিলে। বললে, ‘টেবিলে বসে খাবার আদব কায়দা তো শেখোনি, নাও সব চেটেপুটে খাও।’

শাশুড়ি গেল ভারী ঘাবড়ে। জামাইবাড়ি এত অপমান। রেগে গরগর করতে করতে চলল জামাইবাড়ি ছেড়ে নিজের গাঁয়ে। আর তাদের গাঁ তো আর কাছে নয়। সে বহুত দূর। বুড়ি হনহন হাঁটে। শনশন ছোটে। গরগর করে। শেষে সেই সাঁঝবেলাতে বাড়ি পৌঁছোল। সামনেই ছিল বুড়ো বসে। বুড়ি দোরগোড়া থেকেই শুরু করলে, ‘কী আর বলি গো, আমার কপালই মন্দ। সোহাগীর যা হাল করেছে হতভাগা জামাই। মারে, খাটায়, ধমকায় আরও কত কী। আর আমি শাশুড়ি। আমাকে কিনা এক বোঝা খড় দিয়ে বলে ‘খাও।’ এতদূর আস্পর্ধা।’

‘কী বললে, জামাইয়ের তো বড় বাড় বেড়েছে। দাঁড়াও আমি নিজেই যাচ্ছি। একবার দেখে আসি তো ব্যাপারখানা কী? তারপর শায়েস্তা করছি ব্যাটাকে।’ এই বলে বুড়ো রওনা দিলে। জামাইঘর পৌঁছেই বুড়ো ডাকলে, ‘সোহাগী, অ সোহাগী, এই তো এলাম তোকে দেখতে। তা আছিস কেমন? ভাল তো সব?’

‘ভাল আছ বাবা? ঠাকুর তোমায় ভাল রাখুন। তুমি নিজে হেঁটে এলে?’

‘এই তো চলে এলাম। তা জামাই কই?’

‘মাঠে গেছে। চাষ করতে।’ এবার সোহাগী বাবার কাছে মনের দুঃখের কথা বলতে লাগল।

‘এই কর, সেই কর,

সারাদিন খেটে মর।

ভাত রাঁধ, রুটি কর,

কাজ কর কাজ কর,

পথ দেখিয়ে পৌঁছে দে

পথ দেখিয়ে ঘরকে নে।

কী বলব এই আমার দশা।’

বুড়ো ধীরে ধীরে বলে,

‘সোহাগী রে সোহাগী,

জামাই যখন বদরাগী,

যা বলে তাই কর না,

জল আনা ঘর কন্‌না।

(যা) না বলে তাও করবি,

(ফেরার) পথেই বাতি ধরবি।’

আঁধার লাগল। সোহাগী বললে, ‘বাবা গো বাবা তুই বোস, আমি যাই জামাইকে এগিয়ে আনি।’

‘যা, যা এক্ষুনি যা। আর যেখানে তোকে দাঁড়াতে বলেছে তার চেয়েও এগিয়ে যাবি। ভাল ভাল, হাঁটা ভাল।’

সোহাগী আজ বহুদূর এগিয়ে গেল। সেই মাঠে দেখা কর্তার সঙ্গে। চাষা বউকে শুধোয়, ‘তো আজ তোকে এতদূর এগিয়ে আসবার বুদ্ধি দিল কে?’

‘বাবা এসেছেন। বাবাই বললেন এগিয়ে নিয়ে যেতে।’

দু’জনে বাড়ি ফিরল। জামাই শুধোয়, ‘আছেন কেমন? কখন এলেন? সব কুশল তো? পথে কষ্ট হয়নি তো?’ এমন আরও কত ভাল ভাল কথা।

সোহাগী টেবিলের উপর সুন্দর করে সাজালে রাতের খাবার। তাদের ঘরে যা ছিল সব। বাবাকে খাইয়ে দাইয়ে বিছানা করে দিলে। তারপর মেয়ে-জামাই বুড়োর কত গুণগান করলে। সক্কালে উঠেই জামাই শ্বশুরমশাইকে উপহার দিলে চমৎকার একখানা শেয়ালের লোমের ফারকোট। তারপর মেয়ে জামাই চলল শ্বশুরমশাইকে এগিয়ে দিতে।

বুড়ো গাঁয়ে পৌঁছোতে না পৌঁছোতে বুড়ি দেখতে পেল কাঁধে যেন কী একটা রয়েছে। বুড়ি ভাবলে বুড়োর ছালচামড়া খুলে সেটা দিয়েই কোট বানিয়ে দিয়েছে। বুড়ি তো হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ‘হায় হায় আমার কী হল গো। আমাকে দিলে খড় খেতে; আর বুড়োর জ্যান্ত ছালচামড়া ছাড়িয়ে কোট বানিয়ে উপহার দিলে গো… হায়… হায়… হায়… গো।’

বুড়ো বাড়ির পানে গুটিগুটি হাঁটে। মিটিমিটি হাসে আর কয়,

‘থাম না বুড়ি থাম না

প্যানপ্যানানি রাখ না।

অকম্মারই ঢিপি ছিল

ওই আমাদের মেয়ে।

কাজ কম্ম শিখল যত

জামাইবাড়ি গিয়ে।

জামাই বড় ভাল

ঘর করেছে আলো।

দিল আমায় কুরতা

ঘ্যানঘ্যানানি, প্যানপ্যানানি;

বৃথাই তুমি করতা।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *