০১. শেষ কালে আমি হলাম একজন শিক্ষার্থী

শেষ কালে আমি হলাম একজন শিক্ষার্থী। নগরের প্রধান রাস্তার উপরে এক শৌখিন জুতার দোকানের একজন বয়।

আমার মনিব অনেকটা বেঁটেখাটো ধরনের চেহারার লোক। গোলগাল চেহারার মানুষটি। বাদামি রেখায় ভরা মুখ। সবুজ মতো দাঁত। চোখ পানসে ঘোলাটে। মনে হলো লোকটা অন্ধ। আমি

ভেংচি কাটলাম নিশ্চিত হবার জন্যে।

শান্ত কড়া গলায় মনিব বললো, এই মুখ ভেংচাবি না বলে দিচ্ছি। ঐ দুটো ঘোলাটে চোখ আমায় দেখছে, এ-কথা ভাবতেই রাগ হয় আমার।

বেঁটে হয়তো বা আন্দাজেই ধরে নিয়েছে যে আমি ভেংচি কাটছি। বিশ্বাস করতে পারি না। আবার বলে, একবার বলে দিয়েছি না যে মুখ ভেংচাবি না। আরো ধীর শান্ত গলায় মনিব বলে। পুরু পুরু ঠোঁট দুটো যেনো নড়েও না।

আর ঐ হাত চুলকানো বন্ধ করো।

মনে হয় ওর কনো হিসহিসে গলার স্বর যেনো আমার দিকে। গুঁড়ি মেরে এগোচ্ছে, কাজ করছিস শহরের সদর রাস্তায় সেরা জুতার দোকানে, সেটা খেয়াল রাখিস! বয়কে দোরগোড়ায় প্রস্তরমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হবে …

প্রস্তরমূর্তি যে কি বস্তু সে সম্পর্কে আদৌ কোনো ধারণা নেই আমার, তা ছাড়া হাত চুলকানোও বন্ধ করা যায় না। কারণ আমার দুটো হাতই কনুই পর্যন্ত খোস চুলকানিতে ভরা। চুলকানির গোটাগুলো যেনো আমার চামড়ার ভেতরটা নির্মমভাবে কুরে কুরে খেয়ে চলছে।

আমার হাত দুটোর দিকে তাকিয়ে মনিব জিজ্ঞেস করে, বাড়িতে কী কাজ করতি?

কী করতাম তা বলি। শুনে পাকা চুলে ভরা গোল মাথাটা নাড়তে নাড়তে সে খোঁচা দিয়ে বলে, ধাঙ্গড়ের কাজ–ভিক্ষে করার চেয়েও খারাপ, চুরির চেয়েও জঘন্য।

আমি বলি, চুরিও করেছি।

বলার ভেতরে একটু গর্ববোধের ভাব যে ছিলো না তা নয়। শুনে যেনো বিড়াল থাবার উপর ভর দিয়েছে, সে দু হাতের উপর ভর দিয়ে কাউন্টারের উপর ঝুঁকে ঘোলাটে চোখের স্থির শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো, কী বল-লি! চুরি করেছিলি?

কী ব্যাপার, কেমন করে কী চুরি করেছিলাম খুলে বলি। আচ্ছা, ও ব্যাপার না হয় ছেড়ে দিলাম।

কিন্তু আমার দোকানের জুতো বা টাকা-কড়ি যদি চুরি করিস, তবে সাবালক হওয়ার আগেই জেল খাঁটিয়ে ছাড়বো …

খুব শান্ত গলায়ই কথাটা বলে, কিন্তু দারুণ ভয় লাগে আমার। মনটা তাতে আরো যেনো বেশি বিরূপ হয়ে ওঠে ওর উপরে।

মনিব ছাড়া আরো দু জন কর্মচারী আছে দোকানে। আমার মামাতো ভাই সাশা-ইয়াকভের ছেলের আর বড়ো সাগরেদ-ফিটফাট, পা-চাটা, রাঙা-মুখ লোকটা। সাশার গায়ে বাদামি রঙের একটা ফ্রক কোট, কড়া ইস্ত্রি করা শার্ট, গলায় টাই। দেমাগে আমার দিকে ফিরেও তাকায় না।

দাদু প্রথম যেদিন আমাকে নিয়ে আসেন মনিবের কাছে, সাশাকে ডেকে বলেছিলেন আমাকে কাজ-কর্ম একটু শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে। সাশা চাল দেখিয়ে কুঁচকে বলেছিলো, আগে ওকে আমার হুকুম মেনে চলতে শিখতে হবে!

হাত দিয়ে ঠেলে আমার মাথাটা একটু নুইয়ে দিয়ে দাদু বলেছিলেন, ওর কথা শুনে চলিস, তোর চেয়ে বয়সেও বড়ো আর চাকরিতেও উপরে।

ভারিক্কি চালে চোখ পাকিয়ে তাকিয়েছিলো সাশ, দাদা মশাইয়ের কথা মনে থাকে যেনো

প্রথম দিন থেকেই সাশা মর্মান্তিকভাবে আমার উপরে তার পদমর্যাদার সুযোগ নিতে আরম্ভ করে।

তোর চোখ পাকানো থামা, কাশিরিন, সাশাকে ধমকে দিয়েছিলো মনিব।

আমি কই চোখ তো পাকাই নি, প্রত্যুত্তরে মাথা নিচু করে সাশা বলেছিলো।

কিন্তু মনিব ছাড়ে নি, তা ছাড়া অমন করে মুখ গোমড়া করে থাকবি না, খদ্দেররা তোকে ছাগল বলে ভুল করতে পারে …

খোশামুদে হাসি হেসে উঠলো বড়ো সাগরেদ, মনিবের কুৎসিত ঠোঁট দুটো প্রসারিত হলো, আর দারুণ লাল হয়ে ওঠে সাশা কাউন্টারের আড়ালে মুখ লুকালো।

এ ধরনের কথা-বার্তা বিশ্রী লাগতো আমার। ওরা এমন সব অদ্ভুত অদ্ভুত শব্দ ব্যবহার করতো যে মাঝে মাঝে আমার মনে হতো যেনো ওরা বিদেশি ভাষায় কথা বলছে।

যখনই কোনো মহিলা দোকানে ঢুকতেন, মনিব পকেটের ভেতর থেকে হাত বের করে আলতোভাবে গোঁফে তা দিতে আরম্ভ করতো। একটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠতো মুখে আর গাল দুটো ভরে যেতো রেখায়। কিন্তু তার ভাবলেশহীন ঘোলাটে দুটো চোখে কোনো ভাবান্তর ঘটতো না। বড়ো সাগরেদ ওঠে দাঁড়াতো খাড়া হয়ে, দুটো কনুই দু পাশে চেপে ধরে তোষামোদের ভঙ্গীতে হাত কচলাতো। সাশা তার ড্যাব-ড্যাবে চোখ দুটো লুকাবার চেষ্টায় চোখ পিটপিট করতো। আর আমি দোরের সামনে দাঁড়িয়ে গোপনে হাত চুলকাতে চুলকাতে বিক্রির সমারোহ দেখতাম।

কোনো মহিলার সামনে হাটু গেড়ে বসে তার পায়ে জুতা পরিয়ে দেখার সময় বড়ো সাগরেদ অদ্ভুত ভঙ্গিতে হাতের আঙ্গুলগুলো টান টান করে দিত। হাত দুটো কাঁপতে থর থর করে আর এমনভাবে পা ছুঁতো, যেনো ভয় পাছে পা-টা ভেঙ্গে ফেলে। পা-টা অবশ্য সাধারণত বেশ মোটা সোটাই থাকতো, দেখাতো যেনো কাধ ঝোলান উল্টে রাখা বোতল।

একবার এক মহিলা ঝটকা মেরে পা নেড়ে বললেন, উঁহু, ভীষণ সুড়সুড়ি দিচ্ছেন যে! ওটা নিছক শিষ্টতার জন্যেই, সাথে সাথেই উত্তেজিতভাবে জবাব দিলো বড়ো সাগরেদ।

মেয়েদের সামনে এমনভাবে ঘুর ঘুর করতো বড়ো সাগরেদ যে দেখলে হাসি পেতো। হাসি চাপতে গিয়ে পেছন ফিরে দাঁড়াতে হতো আমাকে। কিন্তু মুখ ফিরিয়ে দেখার লোভও সামলাতে পারতাম না। এমনই অদ্ভুত, এমনই হাস্যজনক বড়ো সাগরেদের কলা-কৌশল। মনে হতো অমন আলতোভাবে আঙ্গুল টান টান করার নৈপুণ্য বা অমন দক্ষতার সাথে অন্যের পায়ে জুতা পরাবার কৌশল জীবনে কখনোই আয়ত্ত করতে পারবো না।

খদ্দেরের কাছে বড়ো সাগরেদকে একা রেখে মনিব প্রায়ই পেছনের ঘরে চলে যেতো, সাশাকেও ডেকে নিয়ে যেতে সাথে। মনে আছে, একবার এক লালচুলো মহিলার পায়ের উপরে হাত বুলতে বুলতে হঠাৎ হাতের আঙ্গুলের ডগাগুলো জড়ো করে চুমো খেয়েছিলো বড়ো সাগরেদ।

আপনি কী দুষ্টু! দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন মহিলা। আঃ! গাল ফুলিয়ে চাপা আওয়াজ করলো বড়ো সাগরেদ।

জোরে হেসে উঠে আমি তো পড়েই যাই আর কি। দোরের হাতলটা ধরে ফেলতেই দোরটা খুলে যেতে তার কাছে মাথাটা গেলো ঠুকে। ফলে কঁচটা ভেঙ্গে পড়ে গেলো। বড়ো সাগরেদ লাথি উঁচিয়ে তেড়ে এলো আমাকে, মনিব তার হাতের মোটা সোনার আংটিটা দিয়ে গাট্টা মেরে আমার সমস্ত মাথাটা ফুলিয়ে দিলো, আর সাশা চেষ্টা করলো আমার কান মলতে। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরার পথে সাশা আমায় দারুণ ধমকালো, এমনি করলে তোর জবাব হয়ে যাবে, অতো হাসির কী হয়েছিলো শুনি?

তারপর বুঝিয়ে বললো, যে বড়ো সাগরেদকে দেখে মেয়েরা যতো বেশি আকৃষ্ট হবে ব্যবসায়ের দিক থেকে তো ততোই ভালো।

কোনো মহিলার জুতোর দরকার না থাকলেও স্রেফ ঐ সুন্দর চেহারা আর একবার দেখার জন্যে বাড়তি জুতো কিনতে আসবে, তা বুঝিস না! তোকে কিছু শেখানোই বৃথা।

শুনে রাগ হয়ে গেলো আমার, দোকানের কেউই কোনো দিন আমায় কিছু শেখাবার চেষ্টা করে নি, সাশা তো দূরের কথা।

রুগণ ঝগড়াটে এক মেয়েছেলে রাধুনীর কাজ করে। রোজ ভোরে সে আমার মামাতো ভাইয়ের এক ঘণ্টা আগেই আমাকে ঘুম থেকে ঠেলে তুলতো। আমি সামোভার গরম করতাম, কাঠ বয়ে আনতাম সব কটা চুলার জন্যে, থালা-বাসন মাজতাম। মনিব, বড়ো সাগরেদ আর সাশার জামা কাপড় বুরুশ করতাম, তাদের জুতা সাফ করতাম দোকানের ঝটপাট, ধুলো ঝাড়া, চা তৈরি করা, খদ্দেরদের বাড়িতে প্যাকেট পৌঁছে দেওয়া–আমাকেই করতে হতো। তারপর বাড়ি আসতাম দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে। আমি যখন এ সব কাজ করতাম, তখন সাশাকে গিয়ে দাঁড়াতে হতো আমার জায়গায়, দোরের সামনে। কিন্তু এটা ওর সম্মানে লাগতো, তাই চিৎকার করে গাল দিতো আমাকে, এই উজবুক! আমি তোর কাজ করে দেব না!

ঘোলা পানি ওকা নদীর তীরে মাঠে মাঠে বনে বনে আর কুনাভিনোর কাকরভরা পথে পথে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি স্বাধীনভাবে ঘুরে বেড়ানো ছিলো আমার অভ্যাস। বর্তমান জীবনটা তাই। একঘেয়ে আর বিরক্তিকর লাগতো। দিদিমা নেই, বন্ধুরা নেই, কথা বলার মতো একটি লোকও নেই। এই কৃত্রিম মাপজোখা জীবন যেনো পিষে ক্ষয় করে দিতো আমাকে।

অনেক সময়ে ভদ্র মহিলারা কিছু না কিনেই চলে যেতেন, তখন মনিব আর দুই কর্মচারী চটে যেতো দারুণ।

জুতোগুলো তুলে রাখ কাশিরিন! হুকুম করতো মনিব, মিহি হাসির মুখোশ পড়তো খসে।

দোকানে এসেছে ছোঁক ছোঁক করতে, হারামজাদী! বাড়িতে বসে থেকে থেকে গতরে ঘুণ ধরে গেছে, তাই আহম্মকটা ভাবলো যাই দোকান ঘুরে আসি। ওঃ! ও আমার বউ হতো আচ্ছা করে দেখিয়ে দিতাম!

মনিবের বউয়ের রোগা চেহারা, কালো চোখ, নাকটা লম্বা, এমন তম্বি করতো, তেড়ে আসততা মনিবের উপর যে মনে হতো ও যেনো তার চাকর।

প্রায়ই কোনো পরিচিতা ক্রেতাকে বিনীত নমস্কার আর মিষ্টি কথার আপ্যায়নে বিদায় দেবার পর মনিব আর তার কর্মচারীরা মিলে তার সম্পর্কে এমন সব নোংরা বেহায়া কথা বলতো যে, মনে হতো ছুটে গিয়ে মহিলাকে বলে দিয়ে আসি কী বলছে ওরা তার সম্পর্কে।

জানতাম পেছনে কুৎসা করা মানুষের স্বভাব, কিন্তু এরা তিনজনে মিলে প্রত্যেকের সম্পর্কে এমন সব কথা বলতো যে শুনে গায়ে জ্বালা ধরে যেতো। যেনো দুনিয়ায় ওরাই হচ্ছে একমাত্র সৎলোক, অপরের সম্পর্কে রায় দেবার অধিকার কেবল ওদেরই। সবাইকে ওরা হিংসে করতো, কারুর প্রশংসা করতো না, প্রত্যেকের সম্পর্কে কিছু না কিছু নোংরা গল্প ওদের জানা ছিলো।

একদিন এক তরুণী এলেন দোকানে। উজ্জ্বল দুটি চোখ, গোলাপি গাল, গায়ে ভেলভেটের ওভারকোট। গলা ঘিরে কালো নরম ফারের কলার। কালো ফারের উপরে মুখখানা ফুটে রয়েছে সুন্দর ফুলের মতো। ওভারকোটটা খুলে যখন সাশার হাতে দিলেন, তখন যেনো আরো সুন্দর দেখাচ্ছিলো তাকে, দু কানে হীরের দুটো ফোঁটা ঝিকমিকিয়ে উঠলো। আঁটোসাঁটো ধূসর-নীল পোশাকে তার দৃপ্ত সুকুমার দেহভঙ্গিমা আরো ফুটে উঠেছিলো।

ওকে দেখে আমার মনে পড়লো সুন্দরী ভাসিলিসার কথা। আমার দৃঢ় ধারণা হলো মহিলা নিদেনপক্ষে প্রদেশপালের স্ত্রী হবেনই। ওরা একটু বিশেষভাবেই অভ্যর্থনা করলো তাকে। অগ্নি উপাসকদের মতো নূয়ে পড়ে অভিবাদন করলো, মুখে মিষ্টি মধুর বুলি। তিনজনেই পাগলের মতো দোকানের ভেতরে ছোটাছুটি জুড়ে দিলো। শো-কেসের কাঁচে চমকে উঠতে লাগলো তাদের ছায়া। মনে হলো সব কিছু বুঝিবা জ্বলে-পুড়ে এক্ষুণি নতুন রূপে, নতুন রেখায় রূপান্তরিত হয়ে উঠবে।

খুব তাড়াতাড়ি এক জোড়া দামী জুতো পছন্দ করে মহিলা যখন চলে গেলেন। জিভে চুমকুড়ি কেটে হিসিয়ে উঠলো মনিব, খানকী!

খাঁটি একট্রেস, অবজ্ঞার সুরে বিড় বিড় করে বললো বড়ো সাগরেদ।

তারপর মহিলাটির ক জন মনের মানুষ, তার উচ্ছল জীবনটা কেমন, এসব নিয়ে ওরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে লাগলো।

দুপুরে খাওয়ার পরে মনিব একটু গড়িয়ে নেবার জন্যে দোকানের পেছনের ছোট ঘরটায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। আমি তার সোনার ঘড়িটার পেছনের ডালা খুলে কলকজার ভেতরে খানিকটা ভিনেগার ঢেলে দিলাম। ঘুম থেকে ওঠে ঘড়িটা হাতে নিয়ে বিড় বিড় করতে করতে মনিব যখন দোকানে এসে ঢুকলো তখন কী মজাই না লাগলো, কী ব্যাপার বল দেখি! ঘামছে, দেখ কাঁচটা! বোধ হয় কোনো অমঙ্গলের চিহ্ন, তাই না?

দোকানের হৈ হল্লা, আর বাড়ির যাবতীয় কাজ-কর্ম সত্ত্বেও এতো একঘেয়ে লাগতো যে প্রায়ই ভাবতাম, কী করলে ওরা আমাকে তাড়িয়ে দেবে।

সর্বাঙ্গ তুষার-ছাওয়া পথচারীরা দ্রুত হেঁটে যেতে দোকানের সামনে দিয়ে। মনে হতো যেনো দেরি করে ফেলেছে শাবানুগমনে। তাই কফিনের সঙ্গ ধরতে তাড়াতাড়ি ছুটে চলছে কবরস্থানের দিকে। মাল-টানা গাড়ির ঘোড়াগুলো পরিশ্রমে কাঁপতে কাঁপতে চলছে তুষার-স্তূপের ভেতর দিয়ে। রোজ দোকানের পেছনের গির্জার ঘণ্টায় বাজত করুণ সুর। কারণ এখন লেন্টে পরবের সময়। ঐ অবিশ্রাম ঘণ্টা-ধ্বনির ফলে মনে হতো যেনো মাথার উপরে বালিশ পিটে চলছে, ব্যথা নেই, কিন্তু চেতনা অসাড় করে আনে।

একদিন উঠোনে বসে নতুন আসা একটা মালের প্যাকিং খুলছিলাম। গির্জার চৌকিদার এলো, বুড়ো, কুঁজো হয়ে পড়েছে। ন্যাকড়ার পুতুলের মতো নড়বড়ে, পরনে জীর্ণ পোষাক, এমন ঘেঁড়াখোঁড়া, মনে হয় যেনো কুকুরে আঁচড়ে কামড়ে দিয়েছে। আমায় সে বলে, একজোড়া গামবুট চুরি করে আমাকে এনে দিবি বাছা?

আমি কোনো জবাব দিলাম না। একটা খালি প্যাকিং বাক্সের উপরে ও এসে বসলো, হাই তুললো, ঠোঁটের উপরে ক্রুশ করলো, তারপর আবার অনুরোধ করে বললো, দিবি না?

আমি বললাম, চুরি করা অন্যায়!

কিন্তু তবুও তো চুরি হয়। শোন বাপধন, বুড়ো মানুষের কথাটা মান্য কর!

যাদের ভেতরে বাস করছি তাদের থেকে লোকটা অন্যরকম বলে বেশ লাগলো।

আমি যে চুরি করতে রাজী হয়ে যাবো এ সম্পর্কে সে এতো স্থির নিশ্চিত যে, জানালা গলিয়ে একজোড়া গামবুট ওকে বের করে দিতে রাজী হয়ে গেলাম।

বেশ, বেশ, ধীর গম্ভীর গলায় বললো, মনে হলো না তেমন খুশি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঠকাবি তো? বেশ, বেশ। না, ঠকাবার মতো মানুষ তুই নস্ …

খানিকক্ষণ বসে বসে জুতোর ডগা দিয়ে ভেজা নোংরা বরফের উপরে আঁচড় কাটলো। মাটির পাইপটা ধরালো, তারপর আচমকা আমাকে দারুণ ভয় পাইয়ে দিলো, আর আমি যদি তোকে ঠকাই, তাহলে? যদি সেই গামবুট জোড়া তোর মনিবের কাছে নিয়ে গিয়ে বলি যে আধ রুবলে আমার কাছে বেচেছিস, তখন? ওটার দাম দুই রুবলের উপরে আর তুই বেচেছিস আধ রুবলে। দুটো হাতখরচের পয়সার জন্যে কি?

বোবার মতো ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, যেনো শাসানিটাকে ইতোমধ্যেই সে কাজে পরিণত করেছে। ও কিন্তু তেমনি ধীরভাবে নাকী সুরে পায়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলে চলছে। মাথার চারপাশে ঘিরে উড়ছে নীল ধোয়া, যদি তোর মনিবই আমাকে পাঠিয়ে থাকে, ছোঁড়াটাকে গিয়ে একটু বাজিয়ে দেখ দেখি চোর-ঘঁচোড় কিনা, তাহলে?

আমি দেবো না তোমাকে গামবুট, রেগে বললাম।

একবার কথা যখন দিয়েছিস তখন আর এড়িয়ে যাবার উপায় নেই!

আমার হাতখানা ধরে সে আমাকে কাছে টেনে নিলো। তারপর আমার কপালের উপরে বরফের মতো ঠাণ্ডা আঙ্গুল দিয়ে ধীরে ধীরে খোঁচা দিতে দিতে একটু টেনে বললো, অমন করে রাজী হয়ে গেলি কি করে একেবারে, গামবুট হাতে হাতে দিবি বলে ফেললি, এ্যা!

তুমি নিজেই তো চেয়েছিলে, চাও নি?

আমি তো কতো কিছুই চেয়ে পারি! যদি বলি গির্জা থেকে চুরি করে আন, তবে কি তুই তাই করবি? মানুষকে অতোটা বিশ্বাস করিস কোনো আক্কেলে? বোকা ছেলে …,

আমাকে ঠেলে দিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো।

চোরা গামবুটে আমার কোনো প্রয়োজন নেই। যে করেই হোক গামবুট পরতে হবে এমন দুরস্ত বাবু আমি নই। একটু ঠাট্টা করছিলাম মাত্র … কিন্তু তুই যখন এতো সাদামাটা, তাই বলি, আসছে ইস্টারের সময়ে আমি তোকে ঘণ্টিঘরে চড়তে দেবো। ঘণ্টাও বাজাতে পারবি আর শহরটাও ভালো করে দেখতে পাবি …

শহর আমার দেখা।

ঘণ্টিঘর থেকে আরো সুন্দর দেখায় …

জুতোর ডগা দিয়ে বরফ ঠেলতে ঠেলতে ধীরে ধীরে সে চলতে আরম্ভ করলো। তারপর গির্জা ঘুরে একটা কোণের দিকে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

ওর চলার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটা বেদনাভরা অস্বস্তিতে মন ভারী হয়ে উঠলো। সত্যিই কি বুড়ো আমার সাথে কেবল রসিকতা করলো? নাকি মনিবই ওকে পাঠিয়েছিলো আমায় পরীক্ষা করতে? দোকানে ফিরে যেতে সাহস হচ্ছিলো না আমার।

কী করছিস এখানে এতোক্ষণ ধরে উঠানে দৌড়ে এসে চিৎকার করে উঠলো সাশা। হঠাৎ ভীষণ রেগে গিয়ে প্যাকিংবাক্স ভাঙা হাতুড়িটা নিয়ে তেড়ে উঠলাম।

জানতাম ও আর বড়ো সাগরেদ মনিবের মাল চুরি করে। একেক জোড়া বুট বা জুতো চুরি করে লুকিয়ে রাখে চুলার চিমনিতে। তারপর দোকান বন্ধ করে যাবার সময়ে কোটের হাতার ভেতরে পুরে নিয়ে বেরিয়ে যায়। দারুণ বিশ্রী লাগতো আমার, ভয় হতো কারণ মনিবের সে দিনের সেই শাসানোর কথা আমি ভুলি নি।

সাশাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুই চুরি করিস?

আমি না, বড়ো সাগরেদ করে, একটু চটে গিয়েই জবাব দেয় সাশা, আমি তাকে সাহায্য করি মাত্র। বড়ো সাগরেদ বলে, তোকে যা বলবো তাই করবি। যদি না করি তবে সে আমার পেছনে লাগবে, ক্ষতি করবে। আর মনিবসে নিজেও এক সময়ে দোকানের কর্মচারী ছিলো, এ সব ব্যাপার সেও জানে। তুই কিন্তু মুখ বুজে চুপ করে থাকিস!

কথা বলতে বলতে বার বার সাশা তাকাচ্ছিলো আয়নার দিকে। বড়ো সাগরেদের অনুকরণে আঙ্গুলগুলো অস্বাভাবিক টান টান করে টাই ঠিক করছিলো। বরাবর সে এমন সব ভাবভঙ্গি করতো যেনো আমাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়ো সে আমার চেয়ে বয়সে বড়া। আমার উপরে মাতব্বরি করার অধিকার তার আছে। গম্ভীর ভারী গলায় গাল পাড়তো আমাকে, কর্তৃত্বভরা ভারিক্কি চালে হুকুম করতো। যদিও ওর চেয়ে আমি লম্বা, গায়েও জোর বেশি, তবুও আমাকে কেমন যেনো বিশ্রী বেটপ দেখাতো। আর ওর চেহারা ছিলো নধর, পুরুষ্টু, মসৃণ। ফ্রক কোটে ওকে বেশ কেউকেটা গোছেরই মনে হতো, কিন্তু তবুও কেমন যেনো একটু হাস্যকর। রাধুনীকে আদৌ দেখতে পারতো না সাশা। অবশ্য সে মেয়েলোকটিও ছিলো একটু অদ্ভুত গোছের, ভালো কি মন্দ তা জানি না।

আমার সবচেয়ে ভালো লাগে লড়াই দেখতে, জ্বলন্ত কালো চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলতো সে, তা সে যার লড়াই হোক না কেন–মোরগ হোক, কুকুর হোক বা চাষাদের–আমার কাছে সব সমান!

উঠোনে কখনো যদি মোরগ কিংবা পায়রার লড়াই আরম্ভ হতো, তাহলে হাতের সব কাজ ফেলে রেখে সে তক্ষুণি ছুটে এসে দাঁড়াতে জানালায়। আর যততক্ষণ না লড়াই শেষ হয় ততোক্ষণ কোনো কিছুই আর তার কানে ঢুকতো না। সন্ধ্যা বেলায় সাশাকে আর আমাকে ডেকে বললো, এই ছোঁড়ারা,

এখানে বসে আছিস কেন? বাইরে গিয়ে বেশ করে এক হাত লড়গে না।

সাশা ফুঁসে উঠতো, ছোঁড়া নই আমি, বোকা বুড়ী–আমি দোকানের ছোটো সাগরেদ!

থাক, তাতে কিছু এসে যায় না। বিয়ের দিনটি পর্যন্ত আমার কাছে তুই ছোঁড়াই থাকবি।

বোকা বুড়ী, মাথা হাঁড়ি …

শয়তান খুব চালাক, কিন্তু খোদা তাকে পছন্দ করেন না।

ওর কথা বলার ধরণেই বিশেষ করে খেপে যেতে সাশা। সাশা ওর পেছনে লাগতে গেলে এমন এক চাউনিতে সাশাকে ঠাণ্ডা করে সে বলতো, ফুঃ, খুদে আরশুলা! খোদার অপকর্ম কোথাকার!

অনেক দিন সাশা আমাকে বলেছে ওর বালিশে আলপিন ফুটিয়ে রাখতে, ঘুমন্ত অবস্থায় ওর মুখে চুনকালি লেপে দিতে, নয়তো ঐ ধরণেরই কিছু একটা তামাসা করতে। কিন্তু রাধুনীকে আমি ভীষণ ভয় পেতাম, নিশ্চয় জানতাম ব্রা পড়ে যাবো ওর হাতে, কারণ ওর ঘুম খুব পাতলা। প্রায়ই রাতে জেগে উঠে আলো জ্বলতো, তারপর এক কোণে চেয়ে চুপ করে বসে থাকতো। কখনো বা ওঠে এসে চুলার পেছনে আমার বিছানায় বসততা আর আমাকে ধাক্কা দিয়ে তুলতো, ভাঙা গলায় ফিস্ ফিস্ করে বলতো,

কী জানি কেন ঘুম আসছে না, আলিওশা। অস্থির লাগছে, একটা গল্প বল!

আধ ঘুম আধ জাগা অবস্থায় কোনো একটা গল্প বলে যেতাম। ও চুপ করে বসে বসে দুলতো। মনে হতো যেনো ওর গরম গা থেকে গলানো মোম আর ধুনোর গন্ধ বেরিয়ে আসছে, ও যেনো শীগগিরই মরবে। হয়তো এক্ষুণি, এই মুহূর্তে। ভয়ে গলার আওয়াজ চড়িয়ে দিতাম, কিন্তু তক্ষুণি ও আমাকে থামিয়ে দিতো,

শ! তুই দেখছি ঐ বেজন্মগুলোকে জাগিয়ে দিবি! ওরা ভাববে তুই আমার পিরিতের নাগর ..

প্রত্যেক দিন একই ভঙ্গিতে ও বসে থাকতো, কুঁজো হয়ে ঝুঁকে, হাঁটুর ভেতরে হাত দুটো ঢুকিয়ে, হাড্ডিসার পা দুটো শক্ত করে চেপে। বুক বলতে ওর কিছু ছিলো না, এমন কি হাতে-বোনা মোটা রাত্রিবাসের ভেতর থেকেও ওর পাজরার হাড়গুলো চোপসানো পিপের গাঁয়ের খাজের মতো ঠেলে বেরিয়ে থাকতো। বহুক্ষণ তেমনিভাবে চুপ করে বসে থেকে এক সময়ে হঠাৎ ফিস ফিস করে বলে উঠতো, ইচ্ছে হয় মরে জ্বালা-যন্ত্রণা জুডোই!

অথবা হয়তো অদৃশ্য কারুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলতো, জীনটা তো কাটিয়েই দিলাম কিন্তু কী হলো?

মাঝে মাঝে পরম নির্বিকারভাবে আমার গল্প থামিয়ে দিয়ে বলে উঠতো, নে, এখন ঘুমা! বলে নিঃশব্দে ওঠে রান্নাঘরের অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে যেতো।

সাশা ওকে আড়ালে বলতো, ডাইনি বুড়ী!

একদিন সাশাকে বললাম ওর সামনে বলতে, ভয় পাই ভেবেছিস? সাথে সাথে জবাব দিলো সাশা। কিন্তু পরক্ষণেই কপাল কুঁচকে বললো, না, ওর সামনে বলবো না! ও যদি সত্যি সত্যিই ডাইনি হয় …

রাধুনীটির সব সময়েই অসন্তুষ্টি, সব সময়েই খিটখিটে মেজাজ। আমাকেও অন্যের চেয়ে এতোটুকুও বেশি দয়া-মায়া দেখাতো না। ভোর ছয়টায় এসে আমার ঠ্যাং ধরে টান মেরে চিৎকার করতো, অনেক হয়েছে নাক ডাকান! ওঠে কাঠ নিয়ে আয়! সামোভার গরম কর! আলুর খোসা ছাড়া!

এতে সাশারও ঘুম ভেঙ্গে যেতো।

চ্যাচ্চাচ্ছো কেন? গল্ গজ করে উঠতো সাশা। মনিবকে বলে দেব তুমি আমাকে ঘুমোতে দাও না…।

রাত-জাগা ফোলা ফোলা দুটো চোখে চকিতে একবার সাশার দিকে চেয়ে মেয়েটা তার কঙ্কালসার দেহটা নিয়ে দ্রুত রান্নাঘরের দিকে চলে যেতো।

ফুঃ! খোদার অপকর্ম কোথাকার! তুই যদি আমার সতীনের ব্যাটা হতিস তবে ঠেঙ্গিয়ে ঠিক করে দিতাম না!

সাশা গর্জাতো, জাহান্নামে যা!

তারপর দোকানে যাবার পথে বলতো, দাঁড়া, ওকে তাড়ানোর ব্যবস্থা করছি। ওর অজান্তে তরকারীতে লবণ মিশিয়ে রেখে দেবো। সব তরকারীই যদি দারুণ লবণ কাটা লাগে তবে দেবে ওকে দূর করে। নয়তো কেরোসিন তেল। তুই পারবি করতে?

তুই নিজেই কেন করিস না?”

ভীতু কোথাকার! ঘোৎ ঘোৎ করে উঠতে সাশা।

আমাদের চোখের সামনেই রাধুনীটা মরলো। একদিন নিচু হয়ে সামোর তুলতে গিয়ে হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে গেলো। কাত হয়ে পড়ে রইলো, হাত দুটো পড়লো ছড়িয়ে, মুখ বেয়ে গড়িয়ে নেমে এলো রক্তের ধারা; মনে হলো যেনো কেউ ওর বুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে।

আমরা দু জনে তক্ষুণি বুঝতে পারলাম যে ও মারা গেছে, কিন্তু দারুণ ভয়ে ওর দিকে তাকিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, কথা বলার শক্তিটুকুও ছিলো না। অবশেষে সাশা এক ছুটে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর আমি কি করবো বুঝতে না পেরে রাস্তার আলোর দিকের জানালাটার কাঁচের সাথে মিশে দাঁড়িয়ে রইলাম। মনিব এলো, চিন্তিত মুখে ওর পাশে উবু হয়ে বসে গায়ে হাত দিয়ে দেখলো। তারপর বললো, মরেই গেছে, না?

আইকনের কোণের দিকে রাখা অদ্ভুতকর্মা নিকোলাইয়ের ছোট্ট মূর্তির দিকে ফিরে সে ক্রুশ করতে লাগলো। প্রার্থনা শেষে দোরের দিকে মুখ বাড়িয়ে আদেশ দিলো, কাশিরিন! ছুটে গিয়ে পুলিশে খবর দিয়ে আয়!

পুলিশ এলো একটা। খানিকক্ষণ দাপাদাপি করে বেড়ালো, তারপর একটি মুদ্রা পকেটস্থ করে চলে গেলো। খানিক বাদে ফিরে এলো একটা মাল-টানা গাড়ির কোচম্যানকে নিয়ে। দু জনে মিলে বঁধুনীর মাথা আর পা রাধরি করে বাইরে নিয়ে গেলো। দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখছিলো মনিব গিন্নি।

আমাকে ডেকে বললো, মেঝেটা ভালো করে ঘষে ঘষে ধুয়ে ফেল!

মনিব বললো, ভালোই হলো সন্ধ্যাসন্ধ্যি মারা গেছে …

কিন্তু কেন ভালো হলো, আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।

বাতি নেভাস নে! শুতে গিয়ে অস্বাভাবিক নরম গলায় বললো সাশা। ভয় করছে।

মাথা মুখ ঢেকে কম্বল মুড়ি দিয়ে বহুক্ষণ চুপ করে রইলো সাশা। নিথর নিস্তব্ধ রাত। যেনো কী শুনছে কান পেতে। প্রতীক্ষা করছে কোনো কিছুর। আমার মনে হলো একটু পরেই বুঝিবা ঢঙ ঢঙ করে ঘণ্টা বেজে উঠবে। আর গোটা শহরের সমস্ত মানুষ ভয়ে চিৎকার করে উঠে পাগলের মতো ছোটাছুটি আরম্ভ করে দেবে।

আয় দু জনে একসাথে শুই চুলার উপরে, কম্বলের ভেতর থেকে মুখ বের করে নরম সুরে বললো সাশা।

চুলার উপরটা গরম।

আবার চুপ করে পড়ে রইলো সাশা। অবশেষে বললো, খুবই আচমকা মারা গেলো, তাই না? আর আমি কিনা ভাবতাম ও ডাইনি …না, ঘুম আসছে না আমার …

আমারও না।

সাশা বলতে লাগলো, কেমন করে মরা মানুষ কবরের ভেতর থেকে উঠে আসে, তারপর রাত দুপুর পর্যন্ত শহরময় ঘুরে বেড়ায় তাদের বাড়িঘর আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজে।

মরা মানুষদের কেবল শহরটার কথাই মনে থাকে, কিন্তু রাস্তা-ঘাট বা বাড়ি-ঘরের কথা মনে থাকে না .. ফিস ফিস করে বললো সাশা।

আর নিশুতি হয়ে উঠলো রাত। মনে হলো যেনো অন্ধকার আরো ঘন হয়ে উঠেছে। সাশা মাথা তুলে জিজ্ঞাসা করলো, দেখবি আমার বাক্সে কী আছে।

বহুদিন অবাক হয়ে ভেবেছি, কী এমন বস্তু ও বাক্সে লুকিয়ে রাখে? বাক্সটা সব সময়েই তালাবন্ধ। খুলতো একান্তই সন্তর্পণে। কখনো বা যদি উঁকি মেরে দেখতে গেছি ভেতরে কী আছে, অমনি বেঁকিয়ে উঠেছে, খবর্দার! কী দেখছিস?

কী আছে দেখতে চাইতাম, সে-কথা এবার জানাতে সাশা বিছানার উপরে ওঠে বসলো। তারপর ওর স্বভাবসুলভ কর্তৃত্বত্র সুরে হুকুম করলো বাক্সটা ওর পায়ের কাছে এনে রাখতে। একটা সরু চেনে গলায় ঝোলানো ক্রুশের সাথে রাখতে চাবিটা। প্রথমে রান্নাঘরে অন্ধকারের ভেতরে তাকিয়ে ভারিক্কি চালে ঐ কোচকালো, তারপর তালাটা খুলে ফেললো। বার কয়েক ফুঁ দিলো বাক্সের ডালাটার উপরে, যেনো ওটা খুব গরম, অবশেষে ডালাটা খুলে ফেললো। অনেকগুলো আন্ডারওয়্যার টেনে বের করলো ভেতর থেকে।

ওষুধের বড়ির খালি বাক্স, চায়ের প্যাকেটের উপরের রঙ-বেরঙের কাগজ, মাছের খালি টিন। ইত্যাদিতে আধখানা বাক্স ঠাসা।

কী ওগুলো?

দেখবি, দাঁড়া …

তোরঙ্গটা দু পায়ের ভেতরে চেপে ধরে ঝুঁকে পড়লো সাশা। তারপর রুদ্ধ নিঃশ্বাসে আবৃত্তি– করলো, হে স্বর্গের পিতা …

আশা করেছিলাম দেখবো নানান রকমের খেলনা, আমি কোনো দিনই খেলনার মুখ দেখি নি। প্রকাশ্যে খেলনাপাতিদের সম্বন্ধে আমি তাচ্ছিল্য দেখাতাম, কিন্তু ভেতরে ভেতরে যাদের খেলনা ছিলো তাদের উপর হিংসেও হতো খুব। আমার ভালো লাগতো যে সাশা রুগম্ভীর লোক হলেও খেলনা খেলে; সেগুলো ও লজ্জায় লুকিয়ে রেখেছে। ওর এ সঙ্কোচ আমি বুঝতাম।

প্রথম বাক্সটা খুলে এক জোড়া চশমার ফ্রেম বের করলো সাশা। ফ্রেমটা নাকে এটে গম্ভীর মুখে আমার দিকে তাকালো, বললো, কাঁচ নেই তাতে কী, এগুলোতে কাঁচ থাকে না।

দেখি, আমি একবার পরে দেখি।

তোর চোখে মানাবে না। যাদের চোখ গাঢ়, এগুলো তাদের জন্যে। তোর চোখ কটা কি-না! নেহাৎ তাচ্ছিল্যের সুরে ঘোৎ ঘোৎ করে বলে উঠলো সাশা। কিন্তু এমন অস্বাভাবিকভাবে গলাটা চড়ে গেলো যে পর মুহূর্তেই ভয়ে ভয়ে রান্নাঘরের দিকে তাকালো সে।

জুতোর কালির একটা খালি টিনের ভেতরে রয়েছে কতোগুলো বোতাম।

সবগুলোই রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়েছিসগর্বে বললো সাশা। সব কটা নিজে জোগাড় করেছি, সঁইত্রিশটা।

তৃতীয় বাক্সটায় কতোগুলো বড় পেতলের কাঁটা, সেগুলোও রাস্তায় কুড়িয়ে পাওয়া। কিন্তু জুতার পেরেক, বকলস–কিছু পুরনো, কিছু ভাঙা, কয়েকটা আস্ত একটা পেতলের দোরের হাতল, হাতির দাঁতের ভাঙা হাতল একটা মেয়েদের মাথার চিরুনি একখানা, একখানা বই স্বপ্ন ও ভাগ্য গণনা, তাছাড়া ঐ ধরনের টুকিটাকি আরো অনেক কিছু।

আমিও এক সময় ছেঁড়া ন্যাকড়া আর হাড় কুড়িয়ে বেড়াতাম। তখন ইচ্ছে করলে ঐ সব বাজে জিনিস একমাসে ওর দশগুণ জমাতে পারতাম। সাশার সম্পদ দেখে মনটা দমে গেলো, বিরক্তি লাগলো, করুণাও হলো ওর উপরে। একান্ত নিবিষ্টভাবে প্রত্যেকটি জিনিস দেখছে সাশা, পরম আদরে প্রত্যেকটির গায়ে হাত বুলাচ্ছে; গর্বে ওর পুরু পুরু ঠোঁট দুটো কুঁচকে ওঠেছে, দুটো ড্যাবা চোখের চাউনি বেয়ে যেনো মমতা আর ঔৎসুক্য ঝরে পড়ছে। কিন্তু চশমার জন্যে ওর কচি মুখখানার চেহারা কেমন যেনো অদ্ভুত হয়ে উঠেছে।

কী করবি এগুলো দিয়ে?

চশমার ফ্রেমের ভেতর দিয়ে চকিতে একবার আমার দিকে তাকালে সে, তারপর বয়োসন্ধির ভাঙা গলায় বললো, তোকে দেব কিছু, নিবি?”

না, ধন্যবাদ …।

ওর সম্পদে আমার আগ্রহের অভাব প্রত্যাখানে ক্ষুণ্ণ হয়েই বোধ হয় খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইলো ও, তারপর বললো, একটা তোয়ালে নে, আয় আমরা এগুলোকে ঘসে মেজে চকচকে করে তুলি, ধুলো পড়ে সব ময়লা হয়ে গেছে …

সম্পদগুলো ঝেড়ে মুছে চকচকে করে গুছিয়ে রাখার পর সাশা দেয়ালের দিকে পাশ ফিরে শুলো। ওদিকে বৃষ্টি পড়তে আরম্ভ করেছে, বাতাসের ঝাঁপটা জানালার গায়ে।

দাঁড়া, বাগানের মাটি কাক, তোকে এমন একটা জিনিস দেখাবো যে হাঁ হয়ে যাবি! মুখ না ফিরিয়েই বললো সাশা।

ওর কথার কোনো জবাব না দিয়ে আমি বিছানার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। খানিকক্ষণ পরে হঠাৎ সাশা লাফিয়ে উঠলল, নখ দিয়ে দেয়াল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললো, আমার ভয় করছে … হায় খোদা, ভীষণ ভয় করছে! হে প্রভু, দয়া করো!

ওর গলার স্বরে ওর আতঙ্ক সম্বন্ধে সন্দেহের অবকাশ রইলো না।

যে আমি নিজেও তখন ভয়ে হিম, মনে হলো যেনো রাধুনী আমার দিকে পেছন ফিরে জানালার কাঁচে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, মোরগের লড়াই দেখার সময়ে যেমন করে দাঁড়াতো।

সাশা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না জুড়লো, নখ দিয়ে দেয়াল আঁচড়ালো, ওর পা দুটো কাঁপতে লাগলো ঠক ঠক করে। যেনো জ্বলন্ত কয়লার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, এমনি করে কোনো দিকে না তাকিয়ে কোনো রকমে রান্নাঘরের মেঝে পেরিয়ে আমি ওর পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লাম।

তারপর কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে দু জনেই এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

.

কয়েকদিন পর এক ছুটির দিন, কেবল দুপুর পর্যন্ত কাজ করে ফিরে এলাম খেতে। মনিব আর তার গিন্নি ঘুমোতে গেলে পর রহস্যভরা কণ্ঠে বললো সাশা, চল যাই!

অনুমানে বুঝলাম, ও আমাকে সেই তাজ্জব করা জিনিসটা দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে।

দু জনে বাগানের ভেতরে গেলাম। দুটো বাড়ির মাঝখানে এক ফালি জমি, তাতে গোটা দশ পনেরো লাইম গাছ। বিরাট মোটা সেকেলে গুঁড়িগুলো শেওলা পড়া। কালো কালো রিক্ত ডালপালাগুলো মড়ার মতো আকাশে উঁচু হয়ে উঠেছে। একটা দাঁড়কাকের বাসা পর্যন্ত নেই। অতিকায় সমাধি স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে গাছগুলো কটা লাইম গাছ ছাড়া আর কিছুই নেই এখানে। না কোনো ঝোঁপঝাড়, না একটু ঘাস। হাঁটা পথের মাটিটুকুও পায়ে পায়ে লোহার মতো কালো আর শক্ত হয়ে গেছে। গত বছরের ঝরা পাতার ফাঁকে ফাঁকে যেখানে ফালি ফালি জমি চোখে পড়ে সেখানে তা ভুরভুরে মাটিতে এমন হয়ে আছে যেনো শেওলা পড়া বদ্ধ পানির ডোবা।

বাড়িটার কোনের দিকে মোড় ফিরে রাস্তার বেড়ার সামনে সাশা এগিয়ে গেলো। তারপর একটা লাইম গাছের তলায় দাঁড়ালো। সামনের বাড়ির জানালার দিকে তাকিয়ে মিনিটখানেক চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে উবু হয়ে বসে দু হাত দিয়ে পাতা সরাতে লাগলো। বেরিয়ে এলো একটা গিঁট শিকড়, আর তারই পাশে মাটির ভেতরে গভীর করে পোঁতা দু খানা ইট। ইট দু খানা তুলে ফেললো সাশা। ইটের তলায় চালা বানানোর এক টুকরো টিন, টিনের নিচে চৌকো একটা তক্তা। অবশেষে দেখতে পেলাম একটা বড় গর্ত। শিকড়ের তলা পর্যন্ত বিস্তৃত।

একটা দিয়াশলাই জ্বেলে আধপোড়া এক টুকরো মোমবাতি ধরালো সাশা। তারপর বাতিটা গর্তের ভেতরে নামিয়ে দিয়ে বললো, তাকিয়ে দেখ! কিন্তু ভয় পাস নে যেনো …।

আদতেও ও নিজেই ভয় পেয়েছিলো, হাতের বাতিটা কাঁপছে থর থর করে, মুখখানা পাংশু, বিশ্রীভাবে ঝুলে পড়েছে দুটো ঠোঁট, চোখ ছল ছল করছে, খালি হাতটা পেছনে লুকানো। ওর ভয় আমাতেও সংক্রমিত হলো। একান্ত সন্তর্পণে ক্ষুদে গুহাটার খিলানের মতো ঐ শিকড়টার তলা দিয়ে তাকাই। তিনটা মোমবাতির টুকরো জ্বেলে দিয়েছে সাশা, নীল আলোয় ভরে উঠেছে গর্তটা। একটা সাধারণ বালতির মতো গভীর গর্তটা, কিন্তু অনেকখানি চওড়া, দেয়ালে রঙিন কাঁচ আর চিনে মাটির ভাঙা টুকরো বসান। মাঝখানের উঁচু জায়গায় ছোট্ট একটা কফিন, এক টুকরো রং তা জুড়ে তৈরি। কিংখাপের মতো কী একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে কফিনটার আধখানা ঢাকা। ঐ ঢাকনার ভেতর থেকে চড়ুই পাখির একটা ধূসর পা আর ঠোঁট বেরিয়ে রয়েছে। মাথার দিকে ছোট্ট একটা বেদীর উপরে ছোট একটা পিতলের ক্রুশ। বাকি তিন দিকে সোনালি আর রূপালি প্যাকেটের কাগজে মোড়া দীপদানির ভেতরে জ্বলছে মোমবাতির টুকরো।

সরু দীপশিখাগুলো গর্তের খোলা হাঁসের দিকে মুখ করে কাঁপছে। ভেতরটা নানা বর্ণের আলোর ছটায় স্বল্প উজ্জ্বল। মাটি, মোম আর গরম পচা আবর্জনার গন্ধ থেকে থেকে আমার নাকে মুখে ঝাঁপটা মারছে। আর যেনো ভাঙাচোরা রামধনুর রঙগুলো লাফিয়ে ওঠে আমার চোখের ভেতরে কাঁপতে আরম্ভ করেছে। সব কিছু মিলে একটা দম আটকে আসা চাপা বিস্ময়ে আমার ভয় দূর হয়ে গেলো।

চমৎকার না? সাশা জিজ্ঞেস করলো।

এ কি, কী হবে এটায়?

মন্দির, বললো সাশা, ঠিক সে রকম দেখতে না?

কি জানি।

আর ঐ চড় ইটা হলো শব। হয়তো একদিন ওর দেহটা অলৌকিকভাবে একটা পূণ্য স্মারক হয়ে উঠবে, কেননা ওর মৃত্যু হলো নিষ্পাপ আত্মদান কিনা।

মরা অবস্থায় পেয়েছিলি ওটাকে?

না, গোয়ালের মধ্যে উড়ে এসে পড়েছিলো। আমি টুপি দিয়ে ধরে চেপে মেরেছি।

কেন?

এমনি..?

সাশা আমার চোখের দিকে তাকালো। তারপর আবার জিজ্ঞেস করলো, চমৎকার না?

না।

গর্তটার উপরে ঝুঁকে পড়লো সাশা, তাড়াতাড়ি তক্তাটা টেনে দিলো, তার উপরে ঢাকা দিলো টিন। তারপর ইট দুটো চাপা দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে হাঁটুর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে রুক্ষ স্বরে বললো, কেন

তোর ভালো লাগলো না শুনি?

কারণ, চড় ইটার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে।

শূন্য দৃষ্টি মেলে সাশা খানিকক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, যেননা সে হঠাৎ অন্ধ হয়ে গেছে। তারপর আমার বুকের উপরে একটা ধাক্কা মেরে চিৎকার করে বলে উঠলো, বেকুফ! তোের হিংসে হচ্ছে কিনা, তাই বলছিস ভালো লাগে না। ভাবছিস বুঝি কানাতুনায়া স্ট্রীটের তোর বাগানে যেটা বানিয়েছিলি সেটা আরো সুন্দর, তাই না?

নিশ্চয়ই, সেটা অনেক সুন্দর!

আমি নিজেই একটা মণ্ডপ তৈরি করেছিলাম। সেটার কথা মনে পড়তেই এতোটুকু ইতস্তত না করেই জবাব দিলাম।

সাশা তার ফ্রক কোটটা খুলে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আস্তিন গুটালো। তারপর হাতের চেটোয় থুথু ছিটিয়ে বললো, বেশ, তবে আয়, লড়ে ফয়সালা করি!

লড়বার ইচ্ছে আমার আদৌ ছিলো না। সব মিলে কেমন যেনো একটা ক্লান্তি লাগছিলো, সাশার কুদ্ধ মুখটাও যেনো অসহ্য ঠেকছিলো।

সাশা ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার উপরে। বুকে ঢু মেরে সে চিৎ করে ফেলে দিলো আমাকে। তারপর দু দিকে দু পা দিয়ে আমার ওপর চেপে বসে চিৎকার করে বললো, বাঁচতে চাস, না মরতে চাস?

ওর চেয়ে আমার গায়ে জোর বেশি, রাগও হয়েছিলো খুব। পর মুহূর্তেই মাথার উপরে দু হাত তুলে মটির উপরে মুখ থুবড়ে পড়তে হলো সাশাকে। গোঁ গোঁ করতে আরম্ভ করলো সাশা। ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে তুলতে চেষ্টা করলাম ওকে, কিন্তু হাত পা ছুঁড়ে ও আমাকে দূরে সরিয়ে দিলো। ফলে আরো ঘাবড়ে গেলাম। কী করব বুঝে ওঠতে না পেরে একটু দূরে সরে দাঁড়ালাম। সাশা মাথা তুলে বললো, এবার তোকে বাগে পেয়েছি। যততক্ষণ না মনিব এসে দেখে, ততোক্ষণ একটুও নড়বো না। তারপর তোর নামে নালিশ করবো, তোকে তাড়িয়ে ছাড়বে।

গাল-মন্দ করতে লাগলো সাশা, শাসাতে লাগলো। ফলে খেপে গেলাম আমি। ছুটে গর্তটার কাছে গিয়ে ইট দুটো টান মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম, চড়ুই সমেত কফিনটা তুলে এনে বেড়ার ওপাশে আচড়ে ফেললাম, আর ভেতরের সব কিছু টেনে তুলে দু পা দিয়ে দলে পিষে দিলাম গুঁড়িয়ে।

বটে! বটে! তবে দ্যাখ!

আমার রাগের এক অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া হলো সাশার উপরে। উঠে বসলো ও। মুখটা আধখোলা। ভ্রু কোঁচকানো। চুপ করে সে চেয়ে রইলো আমার দিকে। আমি থামতে ধীরে সুস্থে উঠে দাঁড়ালো, গায়ের ধুলো ঝাড়লো, ফ্রক কোটটা ফেললো কাঁধের ওপর। তারপর চাপা আক্রোশে বললো, এবার দেখে নিস কী হয়! দাঁড়া না কয়েক দিন যাক! তোর জন্যেই তৈরি করেছিলাম, ওটা একটা ডাইনির তুকতাক! এবার দেখবি!

আমি থপ করে বসে পড়লাম। ওর কথাগুলোই যেনো ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো আমাকে গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেলো। আমার দিকে ভ্রূক্ষেপ মাত্র না করেই চলে গেলো সাশা। ওর এই শান্তভাব যেনো আমাকে একেবারে শেষ করে দিলো।

ঠিক করলাম, পরের দিনই শহর ছেড়ে, মনিব ছেড়ে, সাশা, সাশার তুকতাক–এই অর্থহীন বিষণ্ণ জীবন ছেড়ে যাবো পালিয়ে।

পরদিন ভোরে নতুন রাঁধুনী আমাকে ঘুম থেকে তুলতে এসে চেঁচিয়ে উঠলো, হায় খোদা, তোর মুখে কী হয়েছে?

ভয়ে ভয়ে মনে হলো, তুকতাকের ফল ফলছে।

কিন্তু রাধুনীটা এতো জোরে হেসে উঠলো যে তার আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আমিও না হেসে থাকতে পারলাম না। কে যেননা আমার মুখময় পুরু করে ঝুলকালি লেপে রেখেছে।

সাশা করেছে, না? জিজ্ঞেস করলাম।

তা নয়তো কি আমি হাসতে হাসতে বললো রাধুনী।

জুতো পালিশ করতে আরম্ভ করলাম। একটার ভেতরে হাত ঢোকাতেই হাতে একটা পিনের খেচা লাগলো।

বটে, এই তবে তুকতাক! মনে মনে ভাবলাম।

সবগুলো জুতার মধ্যে পিন আর পেরেক এমন চালাকি করে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছে যাতে হাত দিলেই আমার হাতে ফুটে। এক ঘটি ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসে আমি ঘুমন্ত, অথবা ঘুমের ভান করে মটকা মেরে পড়ে থাকা যাদুকরের মাথায় মহা আনন্দে ঢেলে দিলাম।

কিন্তু তবুও মনে শান্তি এলো না, কিছুতেই মন থেকে মুছে ফেলতে পারছিলাম না কফিনটার কথা। কফিনের ভেতরের সেই চড় ইটার কথা, কুঁকড়ে যাওয়া ধূসর দুটো পা, করুণ মোমের মতো ঠোঁট আর ওকে ঘিরে বহু বর্ণের সেই মৃদু আলো, যা নাকি রংধনুতে পরিণত হয়ে ওঠার ব্যর্থ চেষ্টায় মিট মিট করছিলো। মনের মধ্যে কফিনটা যেনো ক্রমেই বড় হয়ে উঠতো, থাবাগুলো বড়ো হতে হতে ক্রমেই উপর দিকে ছড়িয়ে পড়তো, কাঁপতো জীবন্তের মতো।

ঠিক করেছিলাম সে দিন সন্ধ্যাবেলায়ই পালিয়ে যাবো, কিন্তু দুপুরে খাওয়ার আগে কেরোসিনের স্টোভে বাঁধাকপির ঝোল গরম করতে করতে কেমন যেন একটু আনমনা হয়ে যাই। ঝোল উথলে পড়তে আরম্ভ করলো, তাড়াতাড়ি স্টোভ নেভাতে গিয়ে কড়াশুদ্ধ ঝোল উন্টে পড়লো আমার হাতে। ফলে আমাকে পাঠিয়ে দিতে হলো হাসপাতালে।

হাসপাতালের সেই বিভীষিকার কথা আজো ভুলি নি। ধূসর আর সাদা পোশাক-পরা মূর্তির ভিড়, কাঁপা হলুদ শূন্যতার ভেতরে কঁকাচ্ছে, বিড় বিড় করছে। ক্রাচে ভর করা একটা লম্বা লোক, ভ্র দুটো গোঁফের মতো মোটা, লম্বা কালো দাড়ি নাড়তে নাড়তে চিৎকার করছে, মহামান্য বিশপের কাছে আমি নালিশ করবো তোমার নামে!

হাসপাতালের খাটগুলো যেনো কতোগুলো কফিন, সিলিংয়ের দিকে নাক উঁচু করে শুয়ে থাকা রোগীরা যেনো মরা চড়ুই। হলদে দেয়ালগুলো দোলে। জাহাজের পালের মতো ফুলে ফুলে ওঠে সিলিংটা। খাটগুলোকে দোল দিতে দিতে ঢেউয়ের মতো দোলে মেঝেটা। সব কিছু কেমন অবান্তর, আশাহীন। আর বাইরে, জানালার ওপাশে গাছের পাতাঝরা শূন্য ডালপালাগুলো যেনো এক অদৃশ্য হাতের চাবুকের মতো উঁচিয়ে থাকে।

দোরের পথে একটা লাল-চুল কঙ্কালসার শবদেহ যেনো বেঁটে বেঁটে দুটো কঙ্কালময় হাত দিয়ে গায়ে শবাচ্ছাদন জড়াতে জড়াতে নাচছে আর চিৎকার করছে, পাগলদের মধ্যে আমি থাকবো না!

মহামান্য বি-ই-শপের কাছে … তার মাথার ব্রহ্মতালু ভেদ করে চিৎকার করে উঠছে ক্রাচওয়ালা লোকটি।

দিদিমা, দাদামশাই আর অন্যান্য আরো অনেকের মুখে শুনেছি হাসপাতালে লোককে মেরে ফেলে, তাই আমি ধরেই নিয়েছিলাম আমারও দিন ঘনিয়ে এসেছে। চশমা পরা এক মহিলা। তার গায়েও যেনো অমনি মৃতের পোশাক। কাছে এসে আমার শিয়রে ঝোলানো স্লেটে চক দিয়ে কী যেনো লিখলেন। চকটা গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়ছিলো আমার চুলের ভেতরে।

তোমার নাম কী? জিজ্ঞেস করলেন মহিলা।

কোনো নাম নেই।

আরে একটা নাম আছে তো?

নেই।

বাজে কথা বলো না, তাহলে বেত খাবে।

আমার কেমন যেনো নিশ্চিত ধারণা ছিলো যে ওরা বেত মারবে আমাকে। তাই ইচ্ছে করেই জবাব দিই নি। বিড়ালের মতো ফ্যা ফ্যা করে কথা বলছিলেন মহিলা আর বিড়ালের মতো নিঃশব্দ পায়েই চলে গেলেন।

দুটো আলো জ্বললো। তাদের হলদে গোলক দুটো যেনো কার হারানো দুটো চোখ। সিলিংয়ের উপর থেকে স্কুলে মিটমিটিয়ে দুলতে লাগলো। যেনো পরস্পর মিলে যেতে চাইছে।

এসো একটু তাস খেলা যাক! কে যেনো বলে উঠলো কোণের দিক থেকে।

এক হাতে কেমন করে খেলবো?

ওহো, ওরা তবে তোমার একটা হাত কেটে ফেলেছে?

শুনে আমার মনে হলো তাস খেলার জন্যেই ওর একটা হাত কেটে ফেলেছে ওরা। অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম মেরে ফেলার আগে আর কী কী করবে আমাকে

আমার হাত দুটো জুলছিলো। টন টন করছিলো। যেনো কেউ আমার হাতের হাড়গুলো টেনে ছিঁড়ে নিচ্ছে। ভয়ে ব্যথায় চোখ বুজে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করলাম। চোখ বন্ধ করে রইলাম কেউ যাতে আমার চোখের পানি দেখতে না পায়। তবু চোখ ছাপিয়ে দু রগ বেয়ে আমার কানের ভেতরে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

রাত এলো। রোগীরা যে যার খাটে ওঠে ধূসর কম্বলের তলায় গা ঢাকা দিলো। প্রতি মুহূর্তে নিস্তব্ধতা গভীরতর হয়ে উঠতে লাগলো। নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কেবল কোণের দিক থেকে ভেসে আসছিলো কণ্ঠস্বর। বিড় বিড় করে কে বলে চলছে, কিছুই ফল হবে না এতেও একটা জানোয়ার, মেয়েটাও জানোয়ার ..

ইচ্ছে হচ্ছিলো দিদিমাকে চিঠি লিখে বলি সময় থাকতে থাকতে এখনো এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাক এখান থেকে। কিন্তু লেখার উপায় নেই, হাত চলে না, তাছাড়া কাগজও ছিলো না। ভাবলাম এখান থেকে পালানোর চেষ্টা করলে কেমন হয়?

মনে হলো এ রাত বুঝি বা ক্রমেই আরা নিস্তব্ধ, অবিকল যেনো অন্তহীন হয়ে চেপে বসছে। নিঃশব্দে খাটের কিনারা দিয়ে পা গলিয়ে দিলাম। এগিয়ে গেলাম দোরের সামনে। একটা পাট খোলা, আর সেখানে, করিডরে ল্যাম্পের নিচে, কাঠের বেঞ্চের উপরে বসে রয়েছে এক বুড়ো। খাড়া খাড়া পাকা চুলে ভরা মাথাটা ঘিলে ধোঁয়া উড়ছে, কোটরে ঢোকা কালো দুটো চোখের স্থির দৃষ্টি মেলে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকে। লুকাবার মতো সময় আমার ছিলো না।

কে এখানে ঘুর ঘুর করছে? এখানে এসো!

ওর গলার স্বর নরম, আদৌ ভীতিজনক নয়। কাছে এগিয়ে গেলাম। খোঁচা খোঁচা দাড়ি গোঁফে ঢাকা গোল মুখখানার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটার মাথার ঝাকড়া ঝাকড়া পাকা চুল রূপালি জ্যোতিমণ্ডলের মতো চারদিক থেকে খাড়া হয়ে আছে, কোমরবন্ধে ঝুলছে এক থোকা চাবি। চুলদাড়িগুলো যদি আর একটু বড় হতো তবে ঠিক সেন্ট পিটারের মতো দেখাতো।

তোমারই হাত পুড়ে গেছে বুঝি? এতো রাতে ঘুরে বেড়াচ্ছো কেন? ঘোরাঘুরি করার নিয়ম নেই।

আমার মুখের উপরে একমুখ ধোয়া ছেড়ে হাত বাড়িয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাছে টেনে নিলো।

ভয় করছে?

হুঁ।

এখানে এসে প্রথমটা সবাই ভয় পায়, কিন্তু ভয় পাবার মতো কিছুই এখানে নেই। বিশেষ করে আমার কাছে–আমি কারুর এতোটুকু অনিষ্ট হতে দিই না … সিগারেট খাবে? বেশ, বেশ, সিগারেট খাও না তুমি। এখনো বড় ছোট আছ কিনা, আরো বছর দুই যাক … তোমার মা-বাপ কোথায়? মা বাপ নেই? ঠিক আছে নাই বা থাকল, তাদের ছাড়াই চালিয়ে নিতে পারবে, কেবল ঘাবড়াবে না, বুঝেছো?

বহুদিন পরে একজন লোকের দেখা পেলাম, যে সহজ-সরল আন্তরিকতার সাথে সহজবোধ্য ভাষায় কথা বলে। সে কথা শুনতে খুবই ভালো লাগছিলো।

লোকটি আমাকে বিছানায় ফিরিয়ে নিয়ে এলো।

আমার কাছে একটু বসো না!” অনুনয় করে বললাম।

তা বসছি, বললো সে।

তুমি কে?

সৈনিক, খাঁটি সৈনিক। ককেশাসে লড়াই করেছি। সত্যিকারের লড়াই। তা তো হবেই, সৈনিকের জীবন যুদ্ধ করার জন্যেই। যুদ্ধ করেছি হাঙ্গেরিয়দের সাথে, চেরকেশিয়দের সাথে, পোলদের সাথে। যুদ্ধ–বুঝলে ভাই, একটা মস্ত শয়তানি!

এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বুজেছিলাম। যখন খুললাম, দেখি সৈনিকটির জায়গায় বসে আছে, দিদিমা, আর সৈনিকটি তার পাশে দাঁড়িয়ে বলছে,

তাহলে ওরা সবাই মারা গেছে, আহা!

সূর্যের আলো দুষ্টু শিশুর মতো লুকোচুরি খেলছে, সোনালি আলোয় সব কিছু উজ্জ্বল করে তুলে পরক্ষণেই লুকিয়ে পড়ছে, নতুন করে আবার ঝাঁপ দিয়ে বেরিয়ে আসছে।

দিদিমা আমার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বললেন,

কী হয়েছে, সোনা! ওরা মেরেছে তোকে? ঐ লাল-চুল শয়তানটাকে বলে দিয়েছি ..

একটু সবুর করুন, কানুন মাফিক সব বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, চলে যেতে যেতে বললো সৈনিক।

সৈনিকটির দেশ বালাখানায়, সে আমাদের গ্রামবাসী, গাল বেয়ে নেমে আসা চোখের পানি মুছতে মুছতে বললেন দিদিমা।

তখনো আমার মনে হচ্ছিলো স্বপ্ন দেখছি, তাই কথা না বলে চুপ করে রইলাম। ডাক্তার এসে আমার পোড়া জায়গায় ব্যান্ডেজ করে দিলেন। তারপর দিদিমা আর আমি একটা গাড়ি চড়ে চললাম শহরের ভেতর দিয়ে। দিদিমা বলে চললেন, তোর দাদুর মাথাটা একদম বিগড়ে গেছে রে, দারুণ কিপূটে হয়ে উঠেছে, হাড় কিপটে! এইতো সেদিন ওর নতুন বন্ধু ফারকারবারী খলিস্ত ওর প্রার্থনার বইয়ের ভেতর থেকে একশো রুবলের একটা নোট চুরি করে নিয়েছিলো। ওঃ, তা নিয়ে কী হাঙ্গামাই না হলো! বাবা!

ঝলমলে রোদ উঠেছে। সাদা পাখির মতো ডানা মেলে মেঘগুলো ভেসে চলছে আকাশ পাড়ি দিয়ে। বরফ-জমা ভলগার বুকের উপর তক্তা-পাতা পথ বেয়ে নদী পার হলাম। বরফ ভাঙার মুচুড় মুচুড় শব্দ, ঝকমক করছে বাজারে গির্জার চুডোর লাল গম্বুজগুলোর উপরের সোনালি ক্রুশগুলো। পথে একটি স্ত্রীলোকের সাথে দেখা, চওড়া মুখ, এক বোঝা রেশমি কোমল উইলো নিয়ে চলছে পথ বেয়ে বসন্ত আসছে, শীগগিরই ইস্টার উৎসব!

আমার ভেতরটা গান গেয়ে উঠছিলো লার্ক পাখির মতো।

দিদিমা, তোমায় খুব ভালোবাসি আমি!

আমার কথায় একটুকুও আশ্চর্য হন না দিদিমা।

তাতো স্বাভাবিকই–তুই যে আমার আপনার, শান্ত গলায় বললেন দিদিমা অহঙ্কার না করেও বলতে পারি নিতান্ত পর যারা তারাও আমাকে ভালোবাসে, মেরিমাকে ধন্যবাদ!

একটু হেসে আবার বললেন, মেরিমার আর কি–ওঁর ছেলে তো শীগগিরই বেঁচে উঠবেন, কতো আনন্দ করবেন! কিন্তু আমার মেয়ে ভারুশা …

তারপর চুপ করে গেলেন ..

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *