৩০. দরজায় তালা মারা

অধ্যায় ৩০

পেছনের দরজায় তালা মারা ছিল। পাপোশের নিচ থেকে চাবি বের করে ঢুকে পড়লাম। এসে দেখি রান্নাঘরটা খালি, নিঃশব্দ এবং মৃত্যুর মতো পরিস্কার। সুইচ টিপে দেওয়ার পর সিঙ্কের উপরের ফুরোসেন্ট বাতিগুলোর মৃদু গুঞ্জন স্পষ্ট শুনতে পেলাম। আক্ষরিক অর্থেই অনেক বছর পরে, এত সকালে আম্মুর আগে জেগে আছি। শেষ কবে এরকম হয়েছে, সেটা ঠিক করে মনেও করতে পারছি না।

শার্ট খুলে, ওয়াশিং মেশিনের পেছনে কাপড়ের বালতিতে রেখে দিলাম। সিঙ্কের নিচ থেকে একটা পরিস্কার লুফা খুঁজে বের করে, ওটা দিয়ে মুখ, ঘাড়, পেট–সবকিছু ডলে পরিস্কার করতে শুরু করলাম। তারপর, প্যান্টের জিপার খুলে নিচের সব কিছু ডলোম–বিশেষ করে অণ্ডকোষ; চামড়া ব্যথা হয়ে যাওয়ার আগে থামতেই পারিনি সেদিন। তারপরও মনে হচ্ছিল যেন ঠিক করে পরিচ্ছন্ন হতে পারিনি। জোঁকের কামড়ের লাল ছোপ ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখনো ওখানে অর্ধচন্দ্রাকৃতির একটা দাগ রয়ে গেছে।

আমার স্ত্রী একবার আমাকে এ নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল। সচেতনভাবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই টের পেয়েছিলাম, ওকে মিথ্যে বলে দিয়েছি।

ডলা শেষ করে লুফাটা ফেলে দিলাম। নোংরা হয়ে গেছে।

গোসল শেষে এক ডজন ডিম বের করে, ছয়টা একসাথে ভুনা করে ফেললাম। কড়াইতে প্রায় শক্ত হয়ে উঠেছে, এমন অবস্থায় কুঁচি কুঁচি করা আনারস আর এক পোয় দুধ ঢেলে দিলাম ওর সাথে। খেতে বসেছি, এমন সময় আম্মু এসে পাকঘরে ঢুকল, মাথার পেছনে ধূসর চুল খোঁপা করে রেখেছে।

কোথায় ছিলে তুমি, গর্ডন?

বললাম, ক্যাম্প করছিলাম। শুরুর দিকে ভার্নদের মাঠেই ছিলাম, পরে ব্রিকয়ার্ড পাহাড়ের ওদিকে চলে গিয়েছিলাম। ভার্নের আম্মু তো বলল তোমার সাথে কথা বলবে। বলেনি?

হয়তো তোমার বাবার সাথে কথা বলেছে, বলতে বলতে আম্মু সিঙ্কের দিকে এগিয়ে গেল। গোলাপি ভূতের মতো লাগছিল আম্মুকে। কিন্তু ফ্লুরোসেন্ট আলোয় মুখটা কেমন হলদেটে দেখাল, ভালো লাগছিল না। হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি ড্যানিসকে সকালের দিকে সবচেয়ে বেশি মিস করি। ওর রুমের দিকে তাকালে প্রত্যেকদিন দেখি, রুমটা খালি পড়ে আছে।

হ্যাঁ, খারাপ লাগার মতোই।

ও প্রতিটাদিন জানালার পর্দা খুলেই ঘুমিয়ে পড়ত। আর কম্বল…গর্ডন? কিছু বললে?

জরুরি কিছু না, আম্মু।

..আর, কম্বলটা ওর চিবুক পর্যন্ত টানা থাকত। আম্মু কথা শেষ করে শূন্য চোখে জানালা দিয়ে তাকিয়ে রইল, আমার দিকে পেছন ফিরে আছে। আমি চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছিলাম। সারা শরীর থরথর করে কাঁপছে, টের পাচ্ছি।

অধ্যায় ৩১

গল্পটা শেষ পর্যন্ত বাইরের কেউ আর জানতে পারেনি।

রে ব্রাওয়ারের লাশ পাওয়া যায়নি, তা নয়। পাওয়া গেছে। কিন্তু আমাদের বা ওদের দলের কারোই আর নায়ক হওয়া হয়নি শেষ পর্যন্ত। এইস নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিল, বেনামি কলই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কারণ, রিপোর্টের হিসেবে, পুলিশ ওভাবেই এর কথা জানতে পেরেছিল। আমি আসলে বলতে চেয়েছি, শ্রমিক দিবসের ওই সাপ্তাহিক ছুটিতে আমরা কী করেছি, এ ব্যাপারে আমাদের বাবা-মায়েরা কিছুই জানতে পারেনি।

ক্রিস যে কোথাও গিয়েছিল, সেটা ওর বাবা খেয়াল করার মতো অবস্থায়ই ছিল না। মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়েছিল পুরোটা সময়। ওর মা গিয়েছিল বোনের বাসায়, লুইস্টনে। ওর বাবা মাতাল থাকাবস্থায় ওর মা সবসময় এই কাজই করত। যাওয়ার সময় বাসার ছোটদের দায়িত্ব দিয়ে যেত আইবলের কাছে। আইবল সেই দায়িত্ব পালনের জন্যে এইস আর বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়ত। আর নয় বছরের শেলডন, পাঁচ বছরের এমেরি এবং বছর দুইয়ের ডেবোরাহের সময় কাটত নিজেদের খেলাধুলায়, সাঁতার কেটে, কখনোবা ডুবতে বসে।

টেডির মা দ্বিতীয় রাতে একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ভার্নের আম্মুকে ফোন দিয়েছিলেন। ভার্নের আম্মু বলেছেন, আমরা তাঁর বাসার পেছনের মাঠেই আছি। ব্যাপারটা তিনি জানেন, কারণ তাঁবুতে আলো জ্বলতে দেখেছেন তিনি। টেডির মা প্রত্যুত্তরে বলেছিলেন, তিনি আশা করছেন, ছেলেদের কেউ যেন ধূমপান না করে। শুনে ভার্নের মা বলেছেন, ভার্ন বা বিলির কোনো বন্ধুবান্ধব যে ধূমপান করে না, এ ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত।

বাবা আমাকে কিছু অনিশ্চিত গোছের প্রশ্ন করেছিলেন। মনে হচ্ছিল, আমার অস্পষ্ট ধরনের উত্তর শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেছেন। পরে বললেন, মাঝে সাঝে আমাদের একসাথে মাছ ধরতে যাওয়া উচিত। ব্যাস, প্রশ্নোত্তর পর্বের ওখানেই সমাপ্তি। সপ্তাহ বা দুই সপ্তাহ পরে আমাদের বাবা মায়েরা যদি একসাথে হতেন, তাহলে এগুলো আর ধোপে টিকত না। আমাদের, যাকে বলে, একেবারে খবর হয়ে যেত। কিন্তু তাঁদের আর দেখা সাক্ষাৎ হয়নি।

মাইলো প্রেসম্যানও শেষ পর্যন্ত কাউকে কিছু বলেনি। আমার ধারণা, ওর বিপরীতে আমাদের বক্তব্য এবং চপারকে আমার পেছনে লেলিয়ে দেওয়া নিয়ে আমরা যেভাবে কসম খেয়ে স্বীকারোক্তি দেব–এসব ভেবে সে নিশ্চয়ই পিছিয়ে গিয়েছিল। তো, গল্পটা কখনো বাইরের কেউ জানতে পারেনি ঠিকই–কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি।

অধ্যায় ৩২

মাসের প্রায় শেষ, একদিন স্কুল থেকে হেঁটে ফিরছিলাম। একটা কালো ১৯৫২ ফোর্ড গাড়ি সোজা এগিয়ে এসে, আমার সামনে এসে থামল। এই গাড়ি চিনতে ভুল করার কোনো উপায় ছিল না। গ্যাংস্টার সাদা-দেয়াল, স্পিনারের মতো দেখতে চাকা, উঁচু ক্রোম বাম্পার এবং স্টিয়ারিং হুইলে গোলাপ খোদাই করা। সেই সাথে পেছনের ডিকিতে একটা তাসের দুই আর এক-চোখা জ্যাক পেইন্ট করা। একটুখানি নিচে, রোমান গথিক অক্ষরে লেখা, ওয়াইল্ড কার্ড।

দরজাগুলো হাট করে খুলে গেল। বেরিয়ে এল এইস মেরিল ও ফাজি ব্র্যাকোভিচ।

সস্তা রবিনহুড, না? এইস হাসছে, মৃদু, ভদ্র হাসি। আমি যেভাবে করি, ওটা আমার মা খুব পছন্দ করে, তাই না?

তাল মিলিয়ে ফাজি বলল, আমরা আজকে তোকে একেবারে বানিয়ে ছেড়ে দেব, বাবু!

স্কুলের বইগুলো হাত থেকে ফুটপাথে ফেলে দিয়েই দিলাম দৌড়। প্রাণ হাতে করে ছুটেছিলাম, কিন্তু ব্লক পেরুনোর আগেই ওরা আমাকে ধরে ফেলল। একরকম উড়ে এসে আমার গায়ে আছড়ে পড়ল এইস। চিৎপটাং হয়ে পড়ে গেলাম, টের পেলাম থুতনি গিয়ে নিচের সিমেন্টের সাথে বাড়ি খেয়েছে। শুধু তারা না, পুরো নক্ষত্রমণ্ডলী থেকে নীহারিকা-সব দেখতে পাচ্ছিলাম চোখে। ওরা যখন আমাকে তুলে দাঁড় করাল, ততক্ষণে কেঁদে ফেলেছি। হাত-পা ছিলে গেছে, কনুই দুটো থেকে রক্ত পড়ছে; কিন্তু ওসব কিছু বা ভয় থেকে না, প্রচণ্ড অসহায় রাগ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছিল চোখ দিয়ে। ক্রিস ঠিকই বলেছিল। ও আমাদের ছিল।

গা মুচড়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম, এ সময় ফাজি ওর কনুই দিয়ে আমার তলপেটের নিচে পুঁতো মারল। ভয়ংকর ব্যথায় আমার সমস্ত জগত ভরে গেল। মনে হচ্ছিল, পুরনো দিনের টেলিভিশন স্ক্রিনের জায়গা দখল করে নিয়েছে নতুন ভিস্তাভিশন। চিৎকার করছিলাম। এরচেয়ে ভালো কোনো উপায় ছিল না আমার তখন।

দুই-দুইবার মুগুড়ের মতো ঘুষি বসিয়ে দিল এইস আমার মুখে। প্রথমটা বাম চোখের কাছাকাছি; এই চোখ দিয়ে ঠিক করে দেখতে আমার আরো চারদিন লেগে যাবে। দ্বিতীয়টা মট করে আমার নাক ভেঙে দিল, মচমচে সিরিয়াল চিবুনোর সময় মাথার মাঝে যেরকম শব্দ হয়, সেরকম। ঠিক সেই সময় বৃদ্ধা মিসেস কামার ওনার উঠোনে বেরিয়ে এলেন, আর্থাইটিসে কিছুটা বেঁকে যাওয়া এক হাতে হাত ব্যাগ ধরা, মুখের কোণে কিছু একটা চিবুচ্ছেন। আমাদের দেখেই চিৎকার জুড়ে দিলেন তিনিঃ

এই! এই যে, ছেলেরা! থামো তোমরা, থামো! ওকে ছেড়ে দাও! বুলির দল! মাস্তান! দুইজন মিলে একজনকে মারছ! পুলিশ! পুলি-ই-ই-ই-শ!

আমাদের চোখে আর ভুলেও পড়িস না, হারামজাদা! এইস তখনো হাসছে। ওভাবেই, আমাকে ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল ওরা। উঠে বসলাম, একহাতে তলপেটের নিচে চেপে ধরে আছি। প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল বুঝি বমি করতে করতে মরেই যাব। তখনো কাঁদছিলাম। তারপর যখন দেখলাম, ফাজি আমার পাশ দিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছে, ওর জিন্সের পা-টা নেমে গিয়ে ঢেকে দিয়েছে ওর মোটর-সাইকেল বুট; সবটুকু রাগ প্রবলভাবে ফিরে এল, আচ্ছন্ন করে ফেলল আমাকে। খপ করে ওর পা ধরে ফেললাম, জিন্সের ওপর দিয়েই কামড় বসিয়ে দিলাম ওর কাফ মাসলে (পায়ের পেছনের মাংসপেশিতে)। যতটা জোরে সম্ভব কামড়ে দিলাম। ফাজি নিজেও চিৎকার করে উঠল, এক পায়ে লাফাচ্ছে। মজার বিষয় হলো, সে তখন আমাকে নোংরা বলে গাল দিচ্ছিল। ওকে দেখছিলাম, তখনো লাফাচ্ছে; এ সময় এইস আমার বাম হাতে পা দিয়ে প্রচণ্ডভাবে পিষে দিল। দুটো আঙুল ভেঙে গেল আমার। নিজের কানে ভেঙে যাওয়ার শব্দটাও স্পষ্ট শুনতে পেয়েছিলাম, মনে আছে। মচমচে সিরিয়াল না, প্রেৎজেলের মতো শব্দ হয়েছিল। এইস আর ফাজি এইসের ৫২ ফোর্ডের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। ফাজি তখন ওভাবেই একপায়ে লাফাতে লাফাতে, গাল বকতে বকতে যাচ্ছে। আর এইস পেছনের পকেটে হাত দিয়ে অলস ভঙ্গিতে এগোচ্ছিল। শরীরের সবটা গুটিয়ে, কুণ্ডলী পাকিয়ে ওখানেই পড়েছিলাম, কাঁদছি। এভি কামারস আন্টি এগিয়ে এলেন, রাগী ভঙ্গিতে হাত ব্যাগ জোরে জোরে ঝাঁকাচ্ছেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবেন কি না। অনেক কষ্টে, জোর করে উঠে বসলাম। কীভাবে যেন কান্নার গমক অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছি। বললাম, লাগবে না।

বুলশিট! উনি চিৎকার করে উঠলেন। আন্টি আসলে ঠিক করে কানে শুনতেন না, এবং সব কিছু নিয়েই চ্যাঁচাতেন। তোমাকে ওরা কোথায় মেরেছে, আমি দেখেছি তো। ডাক্তারের কাছে না গেলে ওটা ফুলে ঢোল হয়ে যাবে, বুঝলে?

ধরে ওনার বাসায় নিয়ে গেলেন আমাকে। একটা ভেজা কাপড় দিলেন নাকের জন্য–ততক্ষণে ওটা আসলেই অনেকটা ফুলে গেছে। সেই সাথে এক কাপ কফি ধরিয়ে দিলেন মনে হলো যেন, কফি না, ওষুধ খাচ্ছি। কিন্তু কেন যেন ওটা খাওয়ার পরে একটু ভালো লাগল। পুরো সময়টা ধরে উনি বারবার চেঁচিয়ে ডাক্তারের কথা বলছিলেন, আর আমি বারবার না করছিলাম। শেষ পর্যন্ত বেচারি হাল ছেড়ে দিলেন। আমি বাসার পথ ধরলাম। খুব ধীরে ধীরে পা ফেলছিলাম। যদিও তখন অণ্ডকোষ ফুলে ঢোল হয়ে যায়নি, কিন্তু ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, সেই পথেই আগাচ্ছে।

বাবা-মা আমার দিকে একবার তাকিয়েই ছুটে এলেন–সত্যি বলতে কী, ওনারা যে আদৌ কিছু লক্ষ্য করেছেন, সেটা দেখে আমি বেশ অবাক হয়েছিলাম। বাবার মুখে প্রশ্নের তুবড়ি ছুটল, ছেলেগুলি কারা ছিল? আমি কি ওদের দেখলে এখন শনাক্ত করতে পারব? ভদ্রলোক জীবনে নেকেড সিটি এবং দি আনটাচেবলস-এর এক পর্বও মিস দেননি। বললাম, এখন সম্ভব না। আর, আমি খুবই ক্লান্ত। আসলে, আমার মনে হয় আমি শকে চলে গিয়েছিলাম–শকের সাথে সাথে এভি আন্টির কফি খেয়ে সম্ভবত কিছুটা মাতালও ছিলাম। আমি নিশ্চিত, ওর মাঝে ষাট শতাংশেরও বেশি ব্র্যান্ডি ছিল। বললাম, ওই ছেলেগুলো সম্ভবত অন্য কোনো শহর থেকে এসেছিল, সম্ভবত আপ দ্য সিটি থেকে। সে সময় সবাই এই বাক্যাংশটা বুঝত। আসলে, এটা দিয়ে সবাই লুইস্টন-অবার্নকে বোঝাত।

ওরা আমাকে স্টেশন ওয়াগনে করে ডক্টর ক্লার্কসনের কাছে নিয়ে গেল। ভদ্রলোক আজো জীবিত আছেন। কিন্তু সে সময়ই তিনি ছিলেন অতিবৃদ্ধ। আর্মচেয়ারে করে চলাফেরার মতো বয়স হয়ে গিয়েছিল তাঁর। নাক আর আঙুল দুটোর চিকিৎসা করলেন তিনি, আম্মুকে পেইনকিলারের একটা প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিলেন। তারপর ওদের দুজনকে কিছু একটা বুঝিয়ে এক্সামিন রুম থেকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। মাথা সোজা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, জানতে চাইলেন,

কে করেছে এই কাজ, গর্ডন?

আমি জানি না, ডক্টর ক্লা–

তুমি মিথ্যে বলছ।

উঁহু-না, স্যার।

ওনার গাল-টাল রাগে লাল হয়ে গেল। যারা এরকম করেছে, ওই কীটদেরকে তুমি বাঁচাতে চাচ্ছ কেন? ভাবছ, ওরা তোমাকে সম্মান দেবে? ওরা হাসবে তোমাকে নিয়ে। ভাববে, তুমি একটা গাধা! তোমাকে রাস্তায় দেখলেও বলবে, ওহ! ওই যে দেখ, মজা করার জন্য ওই গাধাটাকে সেদিন যা প্যাঁদানি দিয়েছিলাম না! হা-হা! হু-উ-হুঁ!

আমি আসলেই ওদেরকে চিনি না। আসলেই।

বুঝতে পারছিলাম, ধরে আমাকে ঝাঁকি দেওয়ার জন্য ওনার হাত দুটো উশখুশ করছে। কিন্তু উনি চাইলেও সেটা করতে পারতেন না। তো, শেষ পর্যন্ত আমাকে বাবা-মায়ের কাছেই পাঠিয়ে দিলেন, যদিও তখনো মাথা ঝাঁকিয়ে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন তিনি। আমি নিশ্চিত, রাতে সিগার আর শেরি নিয়ে বসে, পুরনো বন্ধু ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানিয়েছিলেন ভদ্রলোক।

এইস, ফাজি কিংবা ওদের বাকিরা আমাকে সম্মান করবে নাকি বোকা ভাববে, নাকি এ নিয়ে আর কিছু ভাববেই না–তা নিয়ে আমার আসলে কোনো মাথাব্যথা ছিল না। আমার চিন্তা ছিল ক্রিসকে নিয়ে। ওর ভাই ওর হাতের দুই জায়গায় ভেঙে ফেলেছিল। এখানেই শেষ হয়নি, পিটিয়ে ওর মূর্খ সূর্যাস্তের মতো রক্তস্নাত করে তবেই ক্ষান্ত দিয়েছিল আইবল। ভাঙা কনুই ঠিক করতে ডাক্তারদের ইস্পাতের পিন ব্যবহার করতে হয়েছিল সেবার। ওদিকের রাস্তায় থাকতেন মিসেস ম্যাকগিন। উনিই প্রথম ক্রিসকে ভাঙা কাঁধ নিয়ে বসে থাকতে দেখেছিলেন। দুই কান থেকে রক্ত গড়াচ্ছিল, টলছিল মাতালের মতো। সেই অবস্থাতেও ক্রিস রিচি রিক কমিক বই পড়ছিল বসে বসে। উনি ক্রিসকে ধরে সিএমজি ইমার্জেন্সিতে নিয়ে গেলেন। ডাক্তারকে ও বলেছিল, অন্ধকারে সেলারের সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে এরকম হয়েছে।

তাই, না? ডক্টর ক্লার্কসন আমার উপরে যেমন বিরক্ত হয়েছিলেন, ভদ্রলোকও ক্রিসের উপরে সেরকম বিরক্ত হয়েছিলেন। শেরিফ ব্যানারম্যানকে ফোন দিয়েছিলেন তিনি।

উনি যখন অফিস থেকে শেরিফকে ফোন দিচ্ছেন, ক্রিস তখন ধীরে ধীরে নিচে নেমে পড়ল; অস্থায়ী স্লিংটাকে বুকের সাথে চেপে ধরে রেখেছে, যেন ওটা নাড়া খেয়ে ছুটে না যায়। তারপর, পয়সা দিয়ে পে ফোন থেকে কল দিয়েছিল সে। পরে আমাকে বলেছিল, এটা ছিল ওর প্রথম এরকম ফোন দেওয়া। মিসেস ম্যাকগিন আদৌ ওর কথা শুনবেন কি না, সেটা নিয়ে খুব ভয়ে ছিল সে। কিন্তু উনি ওর কথা মেনে নিয়েছিলেন।

ফোন ধরেই বলেছিলেন, তুমি ঠিক আছ, ক্রিস?

হ্যাঁ, ঠিক আছি। ধন্যবাদ।

আমি দুঃখিত যে, থাকতে পারলাম না। কিন্তু আমার পাইগুলো–

সমস্যা নেই, মিসেস ম্যাকগিন। কিন্তু আপনি কি আমাদের দরজায় বুইক গাড়িটা দেখতে পাচ্ছেন? ওটা ছিল ক্রিসের মায়ের গাড়ি। দশ বছরের পুরনো এই গাড়ির ইঞ্জিন গরম হয়ে গেলে পোড়া হাশ-পাপির মতো গন্ধ বেরুতে।

ভদ্রমহিলা সতর্ক গলায় বললেন, হ্যাঁ, ওখানেই আছে। আসলে, চেম্বার্সদের সাথে খুব বেশি মেশার ভয়ে আতঙ্কিত ছিলেন তিনি। একে তো গরিব হোয়াইট ট্র্যাশ, তার ওপর আইরিশ!

আম্মুকে গিয়ে একটু বলবেন, নিচে সেলারে গিয়ে লাইটবাল্বগুলো একটু খুলে আনতে হবে?

ক্রিস, আমি আসলেই, মানে পাইগুলো–

ক্রিস জোর দিয়ে বলল, গিয়ে বলুন। পরের কথাটা বলার আগে ওর গলায় ইঙ্গিত ফুটল, মানে, যদি আমার ভাইকে জেলে পাঠাতে না চান আরকি।

আমার বা ক্রিসের মতো ভয়ংকর না হলেও, টেডি আর ভানও মার খেয়েছিল। ঘরে গিয়ে ভার্ন দেখল, বিলি ওর জন্য অপেক্ষা করছে। লাকড়ির কাঠ দিয়ে ওকে পেটাচ্ছিল বিলি। চার-পাঁচ বাড়িতেই ভার্ন যখন অজ্ঞান হয়ে গেল, তখন বিলি পেল ভয়! ভাবল, মেরে-টেরে ফেলেছে কি না। আসলে শুধু অজ্ঞান হয়েছিল, এর বেশি কিছুই হয়নি ভার্নের।

এক বিকেলে ট্রি হাউস থেকে ঘরে ফেরার পথে ওদের তিনজন মিলে ধরেছিল টেডিকে। ঘুষি মেরে ওর চশমা ভেঙে ফেলেছিল ওরা। টেডিও ওদের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। কিন্তু ওরা যখন টের পেল, বেচারা অন্ধের মতো ওদেরকে ধরতে চাইছে, তখন ওকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেল।

কোরিয়ান কোনো সেনাদলের অবশিষ্টদের মতো স্কুলে একসাথে থাকতাম আমরা। ঠিক কী হয়েছে, সেটা কেউই জানত না। কিন্তু সবাই বুঝেছিল, বড়দের সাথে ভালোরকমের সংঘর্ষ হয়েছে আমাদের। ফলে, সবাই আমাদেরকে কিশোর না ভেবে বড় ভাবতে শুরু করেছিল, সম্মান দিতে শুরু করেছিল। বিচিত্র সব গল্প ঘুরে বেড়িয়েছে স্কুলের সবার মুখে মুখে, কিন্তু প্রত্যেকটা গল্পের মাঝে এত উদ্ভটসব জিনিস ছিল, যা বলার মতো না।

ধীরে ধীরে এক সময় ক্ষত শুকিয়ে গেল, সেই সাথে ভার্ন আর টেডিও আমাদের রেখে চলে গেল অন্যদিকে। আমাদের বয়সি এমন একদল ছেলেকে ওরা পেয়ে গিয়েছিল, যারা ওদের কথায় ওঠবস করত। এদের বেশিরভাগই ছিল এক্কেবারে গোবেচারা ধরনের। ভার্ন আর টেডি কথায় কথায় ওদেরকে নাজি জেনারেলের মতো হুকুম দিত।

ওরা এই ছেলেদেরকে নিয়ে নিয়মিত ট্রি হাউজে আসতে শুরু করলে আমার আর ক্রিসের ওখানে যাওয়াও কমে যেতে থাকে। যথাসম্ভব ৬১-এর বসন্তেই ওখানে শেষ গিয়েছিলাম, তারপর আর যাওয়া হয়নি কখনো। টেডি আর ভার্ন আস্তে আস্তে স্কুলের অন্যান্য পরিচিত মুখগুলোর মতোই হয়ে গেল। কখনো দেখা হলে মাথা ঝাঁকিয়ে হাই বলে পাশ কেটে চলে যাওয়া, এই তো৷ হয়, এমনটাই হয়। কখনো খেয়াল করেছেন যে, হোটেল বা রেস্তোরাঁয় যেমন ওয়েটার আসা-যাওয়া করতে থাকে, তেমনই জীবনের বাঁকে বাঁকে বন্ধু-বান্ধবরাও আসে, আবার চলেও যায়। কিন্তু যখন আমি সেই স্বপ্নের কথা ভাবি, ফুলে ওঠা লাশেরা পানির নিচ থেকে আমার পা ধরে টেনে ডুবিয়ে দিতে চাইছে; তখন মনে হয়, বন্ধুদের এই আসা আর চলে যাওয়াটা হয়তো ঠিকই আছে। কিছু মানুষ ডুবে যায়। এই ব্যাপারটা মোটেও ঠিক না, ফেয়ার না; কিন্তু এটাই সত্যি। কিছু মানুষ ডুবেই যায়।

অধ্যায় ৩৩

১৯৬৬ সালে ব্রুকলিনের এক বাড়িতে আগুন ধরে যায়। সে আগুনে মারা যায় ভার্ন টেসিও। যদুর জানি, এ ধরনের বাড়িকে ওরা ঘিঞ্জি খুপরি বলে ডাকে। ফায়ার ডিপার্টমেন্টের ভাষ্যমতে, আগুনটা লেগেছে রাত দুইটার দিকে। ভোর হতে হতে পুরো বাড়ি পুড়ে সিন্ডারে পরিণত হয়েছে; অবশিষ্টাংশগুলো তখন পড়ে ছিল গর্তের মতোন সেলারে। আগের রাতে একটা বিশাল পার্টি ছিল ওখানে। কেউ একজন সিগারেট জ্বালিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল, হয়তো ভার্ন নিজেই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে হয়তো বাড়ির সামনে পুঁতে রাখা ওর পয়সাগুলো স্বপ্নে দেখছিল। ও-সহ আরো চারজনকে দাঁতের ছাপ থেকে শনাক্ত করেছিল ওরা।

টেডি গেল গাড়ি দুর্ঘটনায়। আমরা যখন বেড়ে উঠেছি, তখন একটা কথা প্রচলিত ছিল। তুমি যদি একা মরো, তাহলে তুমি নায়ক। আর যদি কাউকে সাথে নিয়ে মরো, তাহলে তুমি একটা আস্ত হারামজাদা! টেডি, যে কি না বোঝার বয়স হওয়ার পর থেকে সবসময় শুধু সেনাবাহিনীতেই যোগ দিতে চাইত, বিমান বাহিনীতে যোগ দিতে গিয়ে অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছিল। সবাই জানত তাই হবে। ওর কান আর চোখের যে অবস্থা, সেনাবাহিনীতে সুযোগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই ছিল না ওর। সবাই সেটা জানত, শুধু ও বুঝত না। হাইস্কুলে থাকতে একবার গাইডেন্স কাউন্সিলরকে ময়লার বস্তা বলায় স্কুল থেকে তিনদিনের ছুটি দেওয়া হয়েছিল ওকে। ভদ্রলোক ওকে দীর্ঘদিন পর্যবেক্ষণের পরে বলেছিলেন, ওর হয়তো অন্য কোনো পেশার কথা ভাবা উচিত। সে কথা শুনেই ক্ষেপে গিয়ে টেডি ওই গালি দিয়েছিল।

নিয়মিত অনুপস্থিতি, বিভিন্ন সময় ক্লাসে অনেক দেরি করে আসা, কোর্স ঠিক করে না নেওয়া–এসব করে করে এক বছর পিছিয়ে গিয়েছিল সে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ও গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছিল। ওর একটা মান্ধাতা আমলের শেভ্রোলে বেল এয়ার গাড়ি ছিল। আগে এইস আর ফাজিরা যেসব জায়গায় যেত, ওসব জায়গায় যাওয়া শুরু করল সে : পুল হল, ড্যান্স হল, সাকির বার–এখন বন্ধ হয়ে গেছে, আর মেলো টাইগার–এটা অবশ্য এখনো আছে। এক সময় একটা চাকরিও জুটে গেল ক্যাসল রক পাবলিক সার্ভিসে। রাস্তার খানাখন্দ ভরাট করার কাজ। দুর্ঘটনাটা ঘটে হারলোতে। পুরো গাড়ি ভর্তি মাতাল বন্ধু-বান্ধবকে (এদের দুজন আবার সেই ১৯৬০-এ টেডি আর ভার্নের চামচা দলে ছিল) নিয়ে গাড়ি চালাতে গিয়ে একটা গাছের গায়ে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছিল, তারপর চেষ্টা করেছিল সরে আসতে। ছয়বার উল্টেপাল্টে ডিগবাজি মতোন খেয়েছে গাড়িটা। সেই গাড়ি থেকে কেবল একজন মেয়ে জীবিত বেরিয়ে আসতে পেরেছিল। সেই মেয়ে সেন্ট্রাল মেরিন জেনারেল হসপিটালের নার্স আর আর্দালিরা যাকে বলে, সি-এন্ড-টি ওয়ার্ড বাঁধাকপি ও শালগম রাখার জায়গা–সেখানে ছয় মাস সবজি হয়ে পড়েছিল। পরে, একজন দয়া করে ওর লাইফ সাপোর্ট খুলে দেয়। এর মাধ্যমে টেডি ডুশ্যাঁ বর্ষসেরা হারামজাদার পুরষ্কার জিতে গেল।

ক্রিসও এক বছর পরে কলেজ কোর্সে যোগ দিয়েছিল। আমি আর ও, দুজনেই জানতাম, আর দেরি করলে বেশি দেরি হয়ে যাবে। সে আর কুলিয়ে উঠতে পারবে না। ওর বাবা-মা ভেবেছিল, ছেলে বুঝি পাগল হয়ে গেছে; বন্ধুবান্ধব ভেবেছিল গাধার গাধা এবারে জাতে উঠতে চাচ্ছে। ওরা ওকে কাপুরুষ, ফার্মের মুরগি ভেবে এড়িয়ে যাওয়া শুরু করল। গাইডেন্স কাউন্সেলরের কথা যদি বলি, উনি কখনোই ভাবেননি ক্রিসের পক্ষে কলেজের পড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব। সবচেয়ে বড় কথা, শিক্ষকরাও চামড়ার জুতো-জ্যাকেট পরা, উড়ে এসে জুড়ে বসা ছেলেটির অস্তিত্বটাকে নিজেদের ক্লাসে মেনে নিতে পারেননি কোনোভাবেই। ওসব সস্তা জুতো আর বহু-জিপার লাগানো জ্যাকেট পরে একটা ছেলে বীজগণিত, লাতিন ভাষা কিংবা ভূবিজ্ঞানের মতো উচ্চমার্গীয় জিনিসপত্র শিখতে চাচ্ছে–এটা ওদের অহমিকায় আঘাত দিয়েছিল। এরকম কাপড়-চোপড় পরা কারো বড়জোড় দোকানি হওয়ার জন্য শপ কোর্স করার কথা। ক্যাসল ভিউ ও ব্রিকইয়ার্ড হিলের মধ্যবিত্ত পরিবারের ভালো জামা-কাপড় পরা ছেলে মেয়েদের মাঝে ক্রিস এক গম্ভীর জেনারেলের মতো বসে থাকত। মনে হতো, যে কোনো সময় সে বুঝি উন্মত্তের মতো চিৎকার করে উঠবে; গিলে নেবে ওদেরকে।

সে বছর প্রায় এক ডজন বার ক্রিস পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চেয়েছিল। বিশেষ করে ওর বাবা ওকে খুব কষ্ট দিত। তার অভিযোগ ছিল, ক্রিস নিজেকে ওনার চেয়ে ভালো মনে করে। বড়লোকদের কলেজে গিয়ে সে ওনাকে পথে বসাতে চাইছে। একবার তো রাইনগোল্ডের বোতল ভাঙলেন ওর মাথায়। সেবার ওকে আবারো সিএমজি ইমার্জেন্সি রুমে যেতে হয়েছিল। চার-চারটা স্টিচ লেগেছিল ওর মাথার খুলি জোড়া দিতে। ওর পুরনো বন্ধুরা ততদিনে সিগারেট আর গাঁজায় পিএইচডি করে ফেলেছে। পথে-ঘাটে ওকে দেখলেই ওরা বিভিন্ন নামে ডাকত, খেপাতে চেষ্টা করত। গাইডেন্স কাউন্সেলর ভুদ্রলোক ওকে বেশ কয়েকবার বলেছিলেন, অন্তত কিছু শপ কোর্স নিতে। যাতে পরে পড়াশোনা ছেড়ে দিলেও এতদিনের সব পরিশ্রম একেবারে বৃথা না যায়। আর সবচেয়ে বড় সমস্যাটা ছিল, সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত সে নিজে কিছুই পড়েনি। ক্লাস ফাঁকি দিয়েছে, টেনে-টুনে পেরিয়ে এসেছে প্রতিটা শ্রেণি। এখন সেই মূল্য সুদে-আসলে চুকানোর সময় চলে এসেছিল।

ও আর আমি প্রায় প্রতিরাতেই একসাথে বসে পড়াশোনা করতাম। কখনো কখনো টানা ছয় ঘন্টা পড়েছি, এমনও হয়েছে। পড়া শেষে প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে পড়তাম, কখনো কখনো ভয়ও পেয়ে যেতাম অনেক। এতদিনের মূল্য সুদে-আসলে চুকাতে গিয়ে নিজের ওপরেই প্রচণ্ড রাগ হত ওর ওটা আসলে ভয় পাওয়ার মতোই ছিল। দেখা গেল, বেসিক বীজগণিত শেখার আগে টেডি আর ভার্নের সাথে পকেট পুল খেলে ফাঁকি মারা পঞ্চম শ্রেণির ভগ্নাংশের গণিত করতে হচ্ছে ওকে। Pater noster qui est in caelis (লাতিন; অর্থ, আমাদের স্বর্গীয় পিতা)-এর মতো সহজ বাক্য শেখার আগে ওকে আবারো নাম, সর্বনাম, অব্যয় ইত্যাদি শিখতে হলো। একদিন ওর ইংরেজি ব্যকরণ বই খুলে দেখি, ওতে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, ফাঁক জেরান্ডস! রচনা বা প্রবন্ধ লেখার আইডিয়াগুলো বেশ ভালো ছিল ওর, কিন্তু ব্যাকরণের অবস্থা ছিল জঘন্য। আর, বিভিন্ন যতিচিহ্নের ব্যবহার দেখে মনে হতো, বাক্যের ওপর শটগান চালাচ্ছে। ওয়ারিনারের ব্যাকরণ বইয়ের এক কপি পুরো ছিঁড়ে-টিড়ে ভয়াবহ অবস্থা করেছিল ক্রিস। পরে পোর্টল্যান্ডের এক দোকান থেকে কিনে নিয়েছিল আরেক কপি–এটাই ছিল ওর প্রথম কেনা হার্ডকভার বই। সম্ভবত সে কারণে পরবর্তীতে এটা ওর কাছে বাইবেলের মতো হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তৃতীয় বছরের আগেই সবাই ক্রিসকে মেনে নিল। আমাদের দুজনের কেউই সেরাদের সেরা হতে পারিনি। কিন্তু আমি সপ্তম আর ক্রিস উনিশতম হয়েছিল। পরবর্তীতে আমাদের দুজনেই মেরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। কিন্তু আমি যোগ দিলাম অরনো ক্যাম্পাসে, আর ক্রিস চলে গেল পোর্টল্যান্ড ক্যাম্পাসে। ওর বিষয় ছিল প্রি-ল, অর্থাৎ আরো বেশি লাতিন। বিশ্বাস হয়?

হাইস্কুলে থাকতে আমরা দুজনেই প্রেম করেছি, কিন্তু কোনো মেয়েই আমাদের মাঝে চলে আসেনি। শুনে সমকামী মনে হয়, না? আমাদের পুরনো বন্ধু-বান্ধবরা শুনলেও তা-ই ভাবত, ভার্ন আর টেডির জন্যেও একই কথা খাটে। কিন্তু আসলে এর পেছনে মূল কারণটা ছিল সার্ভাইবাল, টিকে থাকা। গভীর পানিতে আমরা একে অন্যকে আঁকড়ে ধরে ছিলাম। ক্রিস আমাকে কেন আঁকড়েছিল, সেটা নিয়ে সম্ভবত আগেই বলেছি। কিন্তু আমি ওকে কেন আঁকড়েছিলাম, সেটা ঠিক ব্যাখ্যা করার মতো না। ক্যাসল রক ছেড়ে ওর বেরিয়ে যেতে চাওয়া এবং মিলের ছায়া থেকে সরে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা ছিল এর মধ্যে সবচেয়ে বড় কারণ। ওকে নিজে নিজে সাঁতরানো বা ডুবে যাওয়ার জন্য ছেড়ে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। ও যদি ডুবে যেত, ওর সাথে আমার একটা অংশও ডুবে যেত বলে আমার ধারণা।

১৯৬৮ সালের বসন্তের শেষ দিকের কথা। মানে, যে বছর আমরা সবাই চুল বড় রেখেছিলাম এবং ক্লাস বাদ দিয়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন সেমিনার বা লেকচারে চলে যেতাম সুযোগ পেলেই। সে সময় ক্রিস একদিন চিকেন ডিলাইটের একটা শাখায় গিয়েছিল থ্রি-পিস স্ন্যাকস বাকেট নেওয়ার জন্য। ওর সামনে দাঁড়ানো দুজন হঠাৎ কে আগে এসেছে, এই নিয়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়া শুরু করে দেয়। ওদের একজন হুট করে ছুরি বের করে ফেলল। পরে জেনেছিলাম, এই লোকটা চারটা ভিন্ন ভিন্ন কারেকশন ইন্সটিটিউটে সময় কাটিয়েছে। কেবল আগের সপ্তাহেই শশাঙ্ক পেনিটেনশিয়ারি থেকে বেরিয়ে এসেছে সে। আমাদের যে কোনো ঝগড়া হলে যে ক্রিস সবাইকে শান্ত করত, কোনো এক জাদুবলে যে মানুষটা যেকোনো ঝগড়া থামিয়ে ফেলতে পারত মুহূর্তের মাঝে, ওদেরকে থামাতে গিয়ে সেই ক্রিস গলায় ছুরি খেল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই মারা গিয়েছিল সে।

যখন পত্রিকায় এই খবর পড়ি, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম না। ক্রিস তখনো গ্র্যাজুয়েট স্কুলে ছিল। এদিকে, আমি ততদিনে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিয়ে করেছি, একটা হাইস্কুলে ইংরেজি পড়াচ্ছি দেড় বছর ধরে। আমার স্ত্রী তখন সন্তানসম্ভবা, আর আমি একটা বই লেখার চেষ্টায় ব্যস্ত। কাগজে ওই খবরটা যখন পড়লাম–পোর্টল্যান্ড রেস্তোরাঁয় ছুরিকাঘাতে শিক্ষার্থীর মৃত্যু স্ত্রীকে বলেছিলাম, একটু ড্রিঙ্ক করার জন্য বাইরে যাচ্ছি। গাড়ি চালিয়ে শহর থেকে বেরিয়ে এসে পার্ক করেছিলাম, তারপর কেঁদেছিলাম ওর জন্যে। সেদিন আমি প্রায় আধাঘন্টা একটানা কান্না করেছিলাম। যতই আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি না কেন, ওর সামনে এভাবে কাঁদতে পারতাম বলে মনে হয় না। ব্যাপারটার মধ্যে কেমন যেন একটা কাপুরুষতার ছোঁয়া আছে।

অধ্যায় ৩৪

আমি?

ওই যে বললাম, আমি এখন লেখক, লেখালেখি করি। অনেক সমালোচকই মনে করেন, আমি যা লেখি, সবই ফালতু জিনিস। অনেক সময় নিজের কাছেও মনে হয়, ওরা ঠিকই বলে…কিন্তু এখনো ক্রেডিট কার্ড বা ডাক্তারের অফিসের ফর্মে পেশার জায়গায় ফ্রিল্যান্স লেখক কথাটা ব্যবহার করতে আমার ভয় করে, বুক কাঁপে। নিজের গল্পটা নিজের কাছেই এত বেশি রূপকথার মতো শোনায় যে, মনে হয়, পুরো ব্যাপারটাই কেমন উদ্ভট।

সেই বইটা আমি বাজারে ছাড়ার পরে, ওটা থেকে চলচ্চিত্রও নির্মিত হয়েছে। সেটা আবার বেশ ভালো রিভিউ পেয়েছে এবং সুপারহিট হয়েছে। এই সব কিছু যখন হয়, তখন আমার বয়স মাত্র ছাব্বিশ। আমার দ্বিতীয় বইটা নিয়েও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে, হয়েছে তৃতীয়টা নিয়েও। বলেছি না, এক্কেবারে উদ্ভট। এদিকে, আমার স্ত্রীও দেখি আমাকে খুব একটা অপছন্দ করে না। ওর সাথে এখন আমার তিন সন্তান হয়েছে। ওদেরকে আমার কাছে একদম পারফেক্ট লাগে। আর, বেশিরভাগ সময়ই মনে হয়, আমি আসলেই সুখি।

কিন্তু লেখালেখি আগে যেমন সহজ ছিল, আনন্দদায়ক ছিল; এখন আর সেরকম নেই। ফোনটা প্রায়ই বেজে ওঠে। অনেক সময় আমার আবার প্রচণ্ড মাথাব্যথা হয়। তখন খুব স্বল্প আলোকিত কোনো ঘরে গিয়ে ব্যথা না। কমা পর্যন্ত শুয়ে থাকতে হয় আমাকে। ডাক্তার বলে, এটা আসলে মাইগ্রেন না, স্ট্রেসেক চাপের কারণে হয়। ওর হিসেবে, আমার একটু স্থির হওয়া উচিত। মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে খুব চিন্তা হয় আমার। কী যে বাজে একটা স্বভাব…কিন্তু কোনোভাবেই না, থামাতে পারি না এই চিন্তাগুলোকে। মনে হয়, আমি যা করছি, এগুলোর আদৌ কোনো মানে আছে? মানে, ধরে নিন ধরনের ফালতু মনস্তাত্বিক খেলা খেলে যে পৃথিবীতে একটা মানুষ বড়লোক হয়ে যেতে পারে, সেটাকে ঠিক কী ভাবা উচিত আমার?

কিন্তু সেবার এইস মেরিলকে দেখে আমার কেমন হাসি পেয়ে গেল। আমার বন্ধুরা সব মৃত, কিন্তু সে দিব্যি বেঁচে আছে। শেষবার যখন বাচ্চাদেরকে নিয়ে আব্বাকে দেখতে গেলাম, তখন তিনটার হুইসেলের ঠিক পরপরই দেখলাম, মিলের পার্কিং লটে সে গাড়ি পার্ক করছে।

৫২ ফোর্ড গাড়িটা এখন ৭৭ ফোর্ড স্টেশন ওয়াগনে পরিণত হয়েছে। বাম্পারে ঝাপসা হয়ে যাওয়া একটা স্টিকারে লেখা রিগান/বুশ ১৯৮০। মাথায় কু-কাট চুল, আর কিছুটা মুটিয়ে গেছে। সুদর্শন, তীক্ষ্ণ যে মানুষটাকে আমি চিনতাম, সে এখন মাংসের গভীরে ঢাকা পড়ে গেছে। আব্বার কাছে বাচ্চাদেরকে অনেকটা সময়ের জন্য রেখে এসেছিলাম। এই সময়ের মধ্যে সেই ডাউনটাউনে গিয়ে পত্রিকা নিয়ে আসা সম্ভব। মেইন আর কার্বাইনের কোণায় গিয়ে দাঁড়ালাম। রাস্তা পেরুনোর জন্য অপেক্ষা করছি, এমন সময় ও আমার দিকে তাকিয়েছিল। বত্রিশ বছর বয়সি মানুষটার চোখে আমাকে চেনার কোনো চিহ্নই ছিল না। অথচ এই মানুষটা সময়ের অন্য কোনো মাত্রায় আমার হাত ভেঙে দিয়েছিল।

দেখলাম, মেলো টাইগারের পাশের নোংরা পার্কিং লটে গাড়িটা রেখে বেরিয়ে এল সে। প্যান্টটা একটু ঠিকঠাক করে নিয়ে ঢুকে গেল ভেতরে। কল্পনায় দেখতে পেলাম, দরজা খোলার সাথে সাথে ভেতর থেকে কান্ট্রি ওয়েস্টার্ন গান ভেসে এল, সাথে নিয়ে এল নিক আর গ্যানসেট মদের গন্ধ। দরজা বন্ধ করার সাথে সাথেই নিয়মিত সদস্যরা চিৎকার করে ওকে স্বাগত জানাল। তারপর, হেঁটে গিয়ে হোঁৎকা দেহটার ভার চাপিয়ে দিল একটা টুলের ওপর। সম্ভবত রবিবার ছাড়া, একুশ বছর বয়স থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিদিন এই টুলই তিন ঘন্টা করে ওর ভার বহণ করেছে।

মনে মনে ভাবলাম, এই তাহলে এখনকার এইস।

বামে তাকালাম। মিলের পেছনে, অনেকটা দূরে দেখা যাচ্ছে ক্যাসল নদী। আগের মতো চওড়া না হলেও, এখন অনেক পরিস্কার। এখনো ক্যাসল রক আর হারলোর মাঝের ব্রিজের নিচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে নদীটা। আগের সেই তীব্রতা আর নেই, নেই ব্রিজের গায়ে উন্মত্ত আছড়ে পড়া। কিন্তু নদীটা আজো রয়ে গেছে, রয়ে গেছি আমিও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *