২০. রাত কাটল জেগে

অধ্যায় ২০

বাকি রাত জুড়ে সবাই বেশ ভালো ঘুমালেও আমার রাত কাটল জেগে, পাহারায়। কখনোবা আধো ঘুমে। রাতটা মোটেও নিঃশব্দ ছিল না। পাখিদের কান্না, ইঁদুর আর অন্যান্য পোকামাকড়ের শব্দ, শিকারী প্রাণির সামনে পড়ে খাদ্য হতে চলা ছোট প্রাণীদের কান্না কিছু একটা চলছেই। সেই সাথে একঘেয়ে সুরে ঝি ঝি পোকারা গান গেয়েই যাচ্ছিল। তবে ওই অদ্ভুত চিৎকারটা আর শুনতে পাইনি। পরে ভেবেছি, যে হারে বারবার পাহারার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ছিলাম, লা ডিও-এর গল্পে যদি এমন কোনো পাহারাদার থাকত, নিশ্চিত তাকে কোর্ট-মার্শাল করে বসতাম।

শেষ পর্যন্ত ঘুমটা ভেঙেই গেল। টের পেলাম, কী যেন একটা ঠিক আগের মতো নেই। এক মুহূর্ত লাগল ব্যাপারটা বুঝতে: চাঁদ ডুবে গেছে, কিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, আমার হাতদুটো প্যান্টের ওপর বিশ্রাম নিচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা বলছে, সোয়া পাঁচটা বাজে। ভোর হয়ে গেছে।

উঠে পড়লাম। দাঁড়াতে গিয়ে টের পেলাম, মেরুদন্ড মট মট করছে। কয়েক গজ হাঁটলাম বনের ভেতর দিয়ে। একটা ঝোঁপের মধ্যে প্রাকৃতিক কর্ম সেরে নিলাম। বুঝতে পারছি, রাতের বেলা চেপে বসা আতঙ্কটা আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। ভালো লাগছিল।

খাড়া ঢাল ধরে উঠে এসে রেললাইনের উপরে বসে পড়লাম। হাতে পাথর নিয়ে ক্যাচ ক্যাচ খেলছি। বাকিদের ডেকে তোলার ব্যাপারে একটুও তাড়া বোধ করছিলাম না। এত চমৎকার একটা নতুন দিন! কারো সাথে ভাগাভাগি করার জন্যে বড় বেশি মূল্যবান মনে হলো অনুভূতিটাকে।

ভোরের হাত ধরে শান্তি শান্তি একটা ভাব নেমে এসেছে চারপাশে। ঝি ঝি পোকার ডাক আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে। গাছপালার নিচের ছায়াটুকু কেটে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, প্রবল বর্ষণের পর রাস্তা থেকে কাদাগুলো যেমন ধুয়ে যায়। প্রচণ্ড গরমের দিনে বাতাস যেমন স্বাদহীন হয়ে যায়, তেমনি বাতাস বইছিল। যে পাখিগুলো হয়তো আমাদের মতোই ভয়ে ভয়ে রাত যাপন করেছে, তারাও ডাকতে শুরু করে দিয়েছে।

কতক্ষণ যে ওখানে বসে ছিলাম, ঠিক মনে নেই। ভোর কেটে গিয়ে পরিপূর্ণ সকাল হচ্ছে, গোলাপি আকাশটা আস্তে আস্তে নীল হয়ে উঠছে। এটুকু মনে আছে, রেললাইনের একপাশে অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে ব্যথা লাগছিল। উঠে পড়ব, এমন সময় ডান পাশে তাকিয়ে দেখি একটা হরিণ রেললাইনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মাঝে তখন দশ গজের চেয়েও কম দূরত্ব।

আমার হৃৎপিন্ডটা একেবারে গলার কাছে উঠে এসেছিল। মনে হচ্ছিল, মুখে হাত দিলেই স্পর্শ করা সম্ভব! সারা শরীরে অদ্ভুত এক উত্তেজনা ঝড় তুলেছিল। সেই মুহূর্তে নড়তে ভুলেই গিয়েছিলাম, চাইলেও পারতাম না। হরিণটার চোখ দুটো বাদামি ছিল না, বরং কেমন গাঢ় ধোঁয়াটে অন্ধকার খেলা করছিল চোখ জুড়ে। গহনার দোকানে গহনাগুলো সাজিয়ে রাখলে পেছনে যে রংটা থাকে, তেমন। আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মাথাটা একটুখানি বেঁকে গেল, যেন কৌতূহলি চোখে ঘুম ভেঙে উঠে আসা জিন্স আর বাদামি খাকি শার্ট পরা এলোচুলের এক ছেলেকে দেখছে। সে সময়ের ফ্যাশন অনুযায়ী কলারটা হুডির মতো করে তুলে দিয়েছে ছেলেটা, রেললাইনের উপরে বসে আছে চুপচাপ। আর আমি যেটা দেখছিলাম, সেটা ছিল আমার নিতান্ত অবহেলায় পাওয়া দারুণ উপহার–অবহেলার জন্যেই জিনিসটা যেন আরো বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

আমরা দুজন একে অন্যের দিকে দীর্ঘ সময় ধরে তাকিয়ে ছিলাম– অন্তত ফিরে তাকালে তাই মনে হয় আমার। তারপর হরিণটা ঘুরে রেললাইনের উল্টোদিকে চলে গেল। ঘাস পেয়ে খেতে শুরু করল দাঁড়িয়ে। নিজের চোখকেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কোনোরকম ইতস্তত বোধ ছাড়াই হরিণটা ঘাস খেয়ে যাচ্ছিল, আমার দিকে আর ফিরেও তাকায়নি–সেটার প্রয়োজনও অবশ্য ছিল না। জমে যাওয়া মূর্তির মতো স্থির নিষ্কম্প বসে ছিলাম আমি।

কিছুক্ষণ পর রেললাইন কাঁপতে শুরু করলে হরিণটা মুখ তুলে তাকাল। ক্যাসল রককে পেছনে রেখে ঘুরে দাঁড়াল কী মনে করে। এক মুহূর্ত ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইল, অসম্ভব সুন্দর কালো নাকটা একটু যেন কাঁপছে, বাতাস কে বুঝতে চাইছে কিছু একটা। একটু পরেই ছুট দিল বনের দিকে এবং তিন লাফে পুরো গায়েব হয়ে গেল। শুধু একবার গুলির মতো শব্দ করে কোনো একটা গাছের শুকনো ডাল ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা গিয়েছিল। ওইটুকুই, আর কোনো সাড়াশব্দ শোনা যায়নি।

যেখানে ছিল, বেশ কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো স্থির বসে ছিলাম আমি। তারপর ট্রেন আসার ধাতব শব্দ ভেসে এল। উঠে ঢাল বেয়ে নিচে নেমে এলাম। সবাই যেখানে ঘুমিয়ে আছে, সেদিকে পা বাড়ালাম।

ট্রেনের শব্দে সবারই ঘুম ভেঙে গেছে। হাই তুলতে তুলতে, গা চুলকাতে চুলকাতে গতরাতের ভৌতিক চিৎকার নিয়ে টুকটাক কথাবার্তা হচ্ছিল। ক্রিস মজা করে নামও দিয়ে দিল, চেঁচিয়ে বন মাথায় তোেলা ভূত। তবে বেশিক্ষণ এই নিয়ে কথাবার্তা চলেনি। দিনের আলোয় পুরো ব্যাপারটাকে আর ইন্টারেস্টিং মনে হচ্ছিল না, বরং বিব্রত বোধ হচ্ছিল। ভাবলে নিজেদেরকেই কেমন বোকা বোকা লাগে। সব ভেবে মনে হলো, এই ব্যাপারটা ভুলে যাওয়াই সবার জন্য ভালো।

হরিণের ব্যাপারটা ওদেরকে প্রায় বলেই ফেলেছিলাম, কিন্তু কী মনে করে যেন শেষ পর্যন্ত আর বলিনি। এই একটা ব্যাপার একেবারে নিজের বুকের ভেতরে রেখে দিয়েছিলাম আমি। একান্ত নিজস্ব সম্পত্তির মতো আগলে রেখেছিলাম। আজকের আগ পর্যন্ত কখনো এই নিয়ে কাউকে কিছু বলিনি, লেখিওনি কোথাও। আর, এখন লিখে ফেলার পরে পুরো ব্যাপারটাকে কেমন নিতান্ত সাধারণ, তুচ্ছ বলে মনে হচ্ছে, তাই না? কিন্তু ওই পুরো যাত্রার মধ্যে এই ব্যাপারটাই ছিল আমার সবচেয়ে পছন্দের। যখনই আমাকে কোনো ভয়াবহ সমস্যায় পড়তে হয়েছে–জীবনের সবচেয়ে চমৎকার এবং পরিস্কার সেই স্মৃতিটার কথা আমি ফিরে ফিরে বারবার ভেবেছি, অসহায়ভাবে ফিরে গেছি ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে।

যেদিন প্রথম ভিয়েতনামের জঙ্গলে গিয়েছিলাম, এক লোককে দেখেছি নাকে হাত দিয়ে হেঁটে আসছে। হাত সরিয়ে সে আমাকে দেখিয়েছে, তার নাকের জায়গাটায় কিছু নেই। একটা বুলেট তার নাকের ওই অংশটুকু নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। যেদিন ডাক্তার বলেছিলেন, আমাদের ছোট ছেলেটা হাইড্রোসেফালিক (মস্তিষ্কের ভেতরে প্রচুর পরিমাণে তরল জমে যাওয়ার ফলে মস্তিষ্ক ফুলে বড় হয়ে যাওয়া, যার ফলে এমনকি ব্রেন ড্যামেজও হতে পারে)–শ্রষ্টাকে ধন্যবাদ যে, পরে জানা গিয়েছিল, ওর মাথার আকার এমনিতেই বড়। কিংবা যে দীর্ঘ ভয়াবহ সপ্তাহে আমার মা মারা গেলেন– প্রত্যেকবার আমি দেখেছি, আমার ভাবনাগুলো ঘুরে ফিরে ঠিক সেই মুহূর্তগুলোতে গিয়ে থেমেছে।

কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারগুলো বলে বোঝানোটাই হলো সবচেয়ে কঠিন কাজ। কারণ, শব্দ যখন নিঃশব্দ ভাবনাগুলোকে প্রকাশের চেষ্টা করে, তখন তার মূল্য কমে যায়। তাই অচেনা কাউকে এসব ব্যাপারে শুধু বলে কিছু অনুভব করানোর চেয়ে কঠিন কাজ আর হয় না।

অধ্যায় ২১

এই জায়গায় এসে রেললাইনটা দক্ষিণ-পশ্চিমে বেঁকে গিয়ে ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। আমরা ঝোঁপঝাড় থেকে কিছু ব্ল্যাকবেরি সংগ্রহ করে নাস্তা সেরে নিলাম। কিন্তু এসব খেয়ে আসলে পেট ভরে না। পাকস্থলী একটু শান্ত হয় আরকি, আধা ঘন্টা মত একটু অবসরও হয়তো দেয় কিন্তু তারপরেই আবার ছুঁচোর নাচ শুরু হয়ে যায়। রেললাইনের দিকে ফিরে চললাম। ততক্ষণে প্রায় আটটার মতো বেজে গেছে এবং ওখানে পৌঁছাতে আরো মিনিট পাঁচেক সময় লাগল। ব্ল্যাকবেরির রস লেগে মুখ গাঢ় বেগুনি হয়ে আছে, এদিকে গালে-গলায় ব্ল্যাকবেরি ঝোঁপের আঁচড়ের দাগ পড়ে গেছে। এ সময় ভার্ন জোর গলায় ওর ইচ্ছে জানান দিল কয়েকটা ডিমসেদ্ধ আর সাথে বেকন হলে মন্দ হতো না!

দিনটা ছিল তীব্র গরমের শেষ দিন, আর আমার হিসেবে সবচেয়ে বাজে। নয়টার মধ্যেই আকাশ একেবারে গাঢ় এবং কেমন ধাতব নীল বর্ণ ধারণ করল। তাকালেই গরম লাগতে থাকে, এমন অবস্থা। গাল, ঘাড় আর পিঠ বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরছে। শরীরে লেগে থাকা বালু ধুয়ে যাচ্ছে ঘামের সাথে। আর পোকামাকড়ের যন্ত্রণা তো আছেই! মশার সাথে ব্ল্যাকফ্রাই প্রজাতির মাছিরাও মাথার উপরে একতাল মেঘের মতো দল বেঁধে গান শোনাচ্ছে, সেই সাথে একটু পরপর হামলা করছে আমাদের ওপর। জানতাম, আরো অন্তত আট থেকে দশ মাইল হাঁটতে হবে। কিন্তু জিনিসটা টানছিল, এই তীব্র রোদের মাঝেও দ্রুত হাঁটতে বাধ্য করছিল আমাদেরকে। আমরা ওর লাশ দেখার জন্য ততক্ষণে, যাকে বলে একেবারে পাগল হয়ে ছিলাম। পুরো ব্যাপারটাকে সরল এবং সভাবে ব্যাখ্যা করার এরচেয়ে ভালো আর কোনো উপায় আসলে নেই। তখনো জানতাম না লাশটা আদৌ অক্ষত আছে, নাকি ক্ষতবিক্ষত হয়ে আগত শত শত রাতের ঘুম হারাম করে দেওয়ার মতো ভয়াবহ কোনো রূপ নিয়েছে। কিন্তু ততক্ষণে সম্ভবত এই বিশ্বাসটা মাথায় বসে গিয়েছিল যে, লাশটা অন্তত একবার দেখার সুযোগ পাওয়াটা আমাদের প্রাপ্য।

প্রায় সাড়ে নয়টার দিকে টেডি আর ক্রিস প্রথমবারের মতো পানির দেখা পেল। ওদের চিৎকার শুনে আমি আর ভার্ন দৌড়ে গেলাম।

দেখ দেখ! ক্রিস আঙুল দিয়ে দেখাচ্ছিল, আনন্দে হাসছে। এটা নিশ্চয়ই বিবররা তৈরি করেছে।

একটা পুকুরের দেখা পাওয়া গেল। যে ঢালটা দিয়ে রেললাইন চলে গেছে, সেটার নিচ দিয়ে ছোট্ট একটা কালভার্টের মধ্যে দিয়ে একটা ধারা থেকে ওটার মাঝে পানি এসে পড়ছে। ক্রিস ঠিকই বলেছে, এই কাজ বিবররাই করেছে, নিশ্চিত। ধারাটার ডান প্রান্তে নিজেদের চিহ্ন রেখে গেছে বিবররা গাছের ডালপালার সাথে পাতা, আগাছা, শুকনো কাদা ইত্যাদি দিয়ে একটা বাঁধ তৈরি করেছে। লোমশ ছোট্ট এই প্রাণীরা সাধারণত এমনটাই করে, দাঁত দিয়ে গাছ কেটে নদী বা স্রোতের মধ্যে ফেলে বাঁধ তৈরি করে। এখানেও তারা তা-ই করেছে, ফলে বাঁধের এপাশে পরিস্কার পানির দারুণ এক পুকুর তৈরি হয়েছে। জায়গায় জায়গায় ঘর বানিয়ে রেখেছে বিবররা, দেখে মনে হয় কাঠের ইগলু। সূর্যের আলো বাধা পাচ্ছে ঘরগুলোতে, পানিতে প্রতিফলন দেখে মনে হচ্ছে, আলো বেঁকে গেছে। পুকুরের একপাশে একটা খাঁড়ির মতো তৈরি হয়েছে, সেখানকার গাছগুলোর গায়ে জায়গায় জায়গায় প্রায় তিনফুটের মতো বিক্ষত-চিবানো গর্তের মতো দেখা যাচ্ছে, বিবরদের কাজ।

ক্রিস বলল, কয়েকদিনের মধ্যেই রেলরোড এগুলি পরিস্কার করে ফেলবে।

কেন?

ভার্নের প্রশ্নের জবাবে ক্রিস জানাল, এখানে কোনো পুকুর রাখতে পারবে না ওরা। তাহলে এটা ওদের আগের রেললাইনটাকে নষ্ট করে ফেলবে। এজন্যই তারা ঢাল বানানোর আগে কালভার্ট বানিয়েছে, যাতে পানি এক জায়গায় জমে যেতে না পারে, প্রবাহিত হয়। দেখবি, কয়দিন পর এসে কিছু বিবর মেরে বাকিগুলোকে ভয় দেখিয়ে তাড়াবে। তারপর এটা আবার কাদা-জলা হয়ে যাবে আগের মতো।

এটা তাহলে মাংসের ঘাটতি তৈরি করবে না? টেডি জিজ্ঞাসা করল।

কাঁধ ঝাঁকাল ক্রিস, বিবরের মাংস নিয়ে কে মাথা ঘামাতে যাচ্ছে? দক্ষিণ বা পশ্চিম মেইন শহরের কেউ যে অন্তত মাথা ঘামায় না, সেটা তো নিশ্চিতভাবেই বলা যায়।

পানির দিকে বেশ কিছুক্ষণ বুভুক্ষের মতো তাকিয়ে থেকে ভার্ন জিজ্ঞাসা করল, কী মনে হয় তোদের? এটা কি সাঁতার কাটার মতো যথেষ্ট গভীর?

বের করার উপায় তো একটাই।

টেডির উত্তর শুনে আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম, কে আগে যাবে?

আমি বলেই ক্রিস ঢাল ধরে দৌড়ে নামা শুরু করল। নামতে নামতেই পা ঝাঁকিয়ে জুতোগুলো ছুঁড়ে দিল দূরে, দুই হাতে ব্যস্ত ভঙ্গিতে কোমরে বাঁধা শার্ট খুলছে। শার্ট খোলা হতেই বুড়ো আঙুলের খেলায় ট্রাউজার খুলে ফেলল। একটু থেমে ভারসাম্য ঠিক করে নিল ক্রিস প্রথমে এক পা, তারপর অন্য পা থেকে একটানে খুলে আনল মোজাদুটো। তারপরেই সামান্য বেঁকে ছোট্ট করে ডাইভ দিল পানিতে। পরক্ষণেই পানি থেকে মাথা তুলে চিৎকার করে জানাল, চমৎকার পানি! মাথা ঝাঁকিয়ে ভেজা চুল সরাতে চাচ্ছে চোখের ওপর থেকে।

টেডির পাল্টা চিৎকার শোনা গেল, গভীরতা কেমন? বেচারা এক জীবনে আর সাঁতার কাটা শিখলই না।

ক্রিস পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াল, ঘাড় বেরিয়ে এল পানি থেকে। ধুসর রঙের কী যেন একটা দেখা যাচ্ছিল ঘাড়ে। আমার কাছে মনে হলো, কাদা মতোন কিছু হবে। এই নিয়ে সে সময় আর ভাবিনি। যদি ভাবতাম, অনেক দুঃস্বপ্নের হাত থেকে বেঁচে যেতাম জীবনের জন্য।

ফার্মের মুরগি নাকি তোরা? নামিস না কেন? ক্রিস আবারো চিৎকার করল।

এ কথা শুনে আমরা সবাই কাপড় চোপড় খুলে রাখলাম। প্রথমে ভার্ন নেমে গেল, তারপর আমি। টেডি নামল সবার পরে। স্বচ্ছ শীতল পানিতে সাঁতার কেটে ক্রিসের পাশে গিয়ে থামলাম। সারা গায়ে পানি ছাড়া আর কিছু নেই, ভাবতেই ভালো লাগছে। চমৎকার অনুভূতি। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালাম, এক অন্যের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠলাম একসাথে।

জোস! ক্রিস আর আমি একই সময়ে বলে উঠলাম।

আসলেই দারুণ! বলেই আমার মুখে পানি ছুঁড়ে দিয়ে উল্টোদিকে সাঁতরে ছুট দিল সে।

প্রায় আধাঘন্টা পানিতে দাপিয়ে বেড়ালাম সবাই। দুষ্টামি করছি, সাঁতার কেটে বেরুচ্ছি একে অন্যের পায়ের ফাঁক দিয়ে। ডাইভ দিচ্ছি ইচ্ছেমতো, সুযোগ পেলেই মাথা চেপে ধরছি পানির নিচে। তারপর হঠাৎ করেই আবিষ্কার করলাম ব্যাপারটা, পুরো পুকুরটা জোঁক দিয়ে একেবারে ভর্তি হয়ে আছে। অথচ এতক্ষণ ধরে আমরা কেউ খেয়ালই করিনি। ভার্ন কী মনে করে যেন পুকুরের অগভীর অংশের দিকে এগিয়ে গিয়েছিল, তারপর দুই হাতে ভর দিয়ে উল্টো হয়ে পা দুটো উপরের দিকে তুলে দিয়েছিল। পা কাঁপছে, কিন্তু বিজয়ীর ভঙ্গিতে ইংরেজি ভি আকৃতি নিয়ে জানান দিচ্ছে নিজেদের অস্তিত্ব। এ সময় আমি অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম, ক্রিসের কাঁধের মতো ওর পুরো পা-ও কেমন কালচে-ধূসর কিছু একটায় ঢাকা পড়ে গেছে। একেবারে গাবদা-গোবদা জোঁক ছিল সেগুলো।

দেখে ক্রিসের মুখ পুরো হাঁ হয়ে গেল। বুঝতে পারলাম, আমার শরীরের সব রক্ত জায়গায় জমে গেছে। টেডির সারা মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। চিৎকার করে উঠল ও, তারপর তিনজন একসাথে যত জোরে সম্ভব পাগলের মতো দৌড় দিলাম, তীরের দিকে ছুটছি। তারপর অনেক দিন গড়িয়েছে, বয়স হয়েছে, পরিস্কার পানির জোঁকের ব্যাপারে ভালো জানাশোনাও হয়েছে আমার। জানি, এরা আসলে তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কিন্তু তারপরও, সেদিন যে ভয়াবহ আতঙ্ক আমাদেরকে ঘেঁকে ধরেছিল, আজও জোঁকের কথা ভাবলে একইরকম তীব্র আতঙ্ক জেঁকে বসতে চায়। এদের লালারসে অবশ করার জন্য এক ধরনের অ্যানেস্থেটিক থাকে, সাথে রক্ত পাতলা আর তরল রাখার জন্য থাকে এন্টিকোয়াগুলেন্ট। অর্থাৎ, এরা যে কখন শরীরে উঠে আসবে, আপনি টেরও পাবেন না। আর যদি দেখতে না পান, এরা আপনার রক্ত খেতেই থাকবে। খেতে খেতে পেট ভর্তি হয়ে পড়ে না গেলে বা বিস্ফোরিত না হলে ছাড়বে না আপনাকে।

আমরা যখন ঢালের উপরে উঠে এসেছি, টেডি নিজের দিকে তাকিয়ে হিস্টিরিয়াগ্রস্থের মতো চিৎকার জুড়ে দিল, শরীরে লেগে থাকা জোঁকগুলোকে ধরে ধরে সরানোর চেষ্টা করছে।

ভার্ন পানি থেকে মাথা তুলে আমাদের দিকে অবাক চোখে তাকাল। কী হয়েছে ও–?

জোঁক! চিৎকার করতে করতে পা থেকে আরো দুটোকে ছাড়িয়ে আনল টেডি, তারপর গায়ের সবটুকু শক্তি দিয়ে ছুঁড়ে দিল, যতদূর যায়।

হায় খোদা! খোদা রে! ভার্নের যাকে বলে, কেঁদে ফেলার মতো অবস্থা। সাঁতরে পুকুরের কিনারায় এসে নিজেকে টেনে তুলল সে।

আমার তখনো শীত শীত লাগছে। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপের কিছুই অনুভূত হচ্ছে না। নিজেকে বারবার বোঝাচ্ছি, নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখ, ভুলেও মেয়ে মানুষের মতো চিৎকার করো না। এরইমাঝে হাত আর বুক থেকে আধ ডজন তুলেছি, কাঁধ থেকেও ছাড়িয়েছি বেশ কয়েকটা।

ক্রিস আমার দিকে পিঠ দিয়ে বলল, দেখ তো গর্ডি, আর আছে কি না? থাকলে একটু তুলে দে, প্লিজ?

ওর পিঠে তখনো আরো পাঁচ-ছয়টা ছিল, বীভৎস কালো বোতামের মতো গড়িয়ে নিচে নামছিল। নরম হাঁড়বিহীন দেহগুলো টেনে তুলে ফেললাম। এরপর নিজের পা থেকে আরো কয়েকটা ছাড়ালাম, ক্রিসকে বললাম, পিঠে লেগে থাকলে তুলে দিতে।

একটু ভালো বোধ করছিলাম আমি। নিজেকে ভালো করে দেখছি, আর কোনোটা রয়ে গেছে কিনা…ঠিক সেই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় জোঁকটার অস্তিত্ব টের পেলাম–অণ্ডকোষে ঝুলে আছে। দেহের মূল আকারের চারগুণ হয়ে গেছে রক্ত খেয়ে। কালচে ধূসর চামড়া ভেতরের রক্তের কারণে লালচে হয়ে গেছে। সেই মুহূর্তে আমি নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাতে শুরু করলাম। যদিও বাইরে থেকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল না, কিন্তু ভেতরে ভেতরে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আর, এই ভেতরের অনুভূতিটাই আসলে গুরুত্বপূর্ণ। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম, লাভ হলো না। পিচ্ছিল, মসৃন এবং আঠালো দেহটা আগের জায়গাতেই রয়ে গেল। আরেকবার ঝাড়া দেওয়ার কথা ভাবলেও জোঁকটাকে ধরার সাহস করে উঠতে পারছিলাম না। ক্রিসের দিকে ফিরে কিছু বলতে চেষ্টা করছিলাম, পারিনি। শেষ পর্যন্ত হাত দিয়ে ইশারা করে দেখালাম। ওর গাল এমনিতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেছে, দেখার পরে ভয়ে সাদা হয়ে গেল। ঠোঁট নাড়াতে পারছিলাম না, অনেক কষ্টে উচ্চারণ করলাম শব্দগুলো, আমি পারছি না। তুই পারবি…একটু সরিয়ে দে, প্লিজ।

কিন্তু ক্রিস পিছিয়ে গেল, মাথা নাড়ছে। মুখ বেঁকে গেছে অদ্ভুতভাবে। বলল, আমি পারব না, গর্ডি। চেষ্টা করেও চোখ সরাতে পারছে না। আমি দুঃখিত। আমার পক্ষে সম্ভব না রে।

মুখ ঘুরিয়ে নিল ক্রিস, মাথা নিচু করে একহাতে বুক চেপে ধরেছে। দেখে মনে হচ্ছে যেন কোনো মিউজিক্যাল কমেডি-তে বাটলার চরিত্রে অভিনয় করছে।

ভাবছিলাম, কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ হারানো যাবে না। বিচিত্র ভঙ্গিতে ঝুলে থাকা জোঁকটার দিকে তাকিয়ে আছি। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, রক্ত খেয়ে ধীরে ধীরে আরো ফুলে উঠছে। যেভাবেই হোক, নিজেকে ধরে রাখতে হবে তোমার। ওটাকে ছাড়াতে হবে। শক্ত হও। এটাই শেষ, এটাকে সরালেই আর কোনো ঝামেলা নেই। কাজ শেষ।

শেষ পর্যন্ত হাত দিয়ে জোরে চেপে ধরে ছাড়ানোর জন্যে যখন টান দিলাম, আমার আঙুলের মধ্যেই বিস্ফোরিত হলো সেটা। রক্ত আমার নিজের রক্ত উষ্ণ ধারার মতো হাতের তালু আর কব্জি বেয়ে গড়িয়ে পড়ছিল। চেষ্টা করেও আর কান্না আটকে রাখতে পারিনি। কাঁদতে কাঁদতেই কাপড় পরলাম। ইচ্ছে থাকলেও কান্না থামাতে পারছিলাম না। মরার ওপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে শরীর কাঁপতে শুরু করল। ভার্ন নগ্ন দেহেই আমার দিকে দৌড়ে এল। সবগুলো গেছে কি না, দেখ তো গর্ডি? গেছে? সার্কাসের পাগলা নাচুড়ের মতো আমার সামনে পাক খেতে লাগল ভার্ন। গেছে সব?

শিশুপার্কের ঘোড়াগুলোর মতো চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।

মাথা নেড়ে বলতে চাচ্ছিলাম, হ্যাঁ, গেছে; কিন্তু কান্না থামাতে পারছিলাম না কিছুতেই। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, কান্নাকাটিকে পেশা হিসেবে নিলে ভবিষ্যতে দারুণ উন্নতি করতে পারব! শার্ট ইন করে গলা পর্যন্ত সবগুলো বোম লাগিয়ে নিলাম। মোজা আর স্নিকার্স পরার পর বুঝতে পারলাম, আস্তে আস্তে কান্নার দমকটুকু কমে আসছে। শেষ পর্যন্ত কান্না থামল! হাতে একগাদা এলম পাতা নিয়ে মুখ মুছছিল ক্রিস, সেভাবেই আমার দিকে এগিয়ে এল, নিঃশব্দ দৃষ্টিতে ক্ষমা চাইছে।

সবার কাপড় চোপড় পরা হলে মুহূর্তখানেকের জন্যে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম আমরা, একে অন্যের দিকে তাকিয়ে আছি। তারপর চুপচাপ পা চালালাম, খাড়া ঢাল ধরে উপরের রেললাইনের দিকে উঠে যাচ্ছি। হাঁটতে হাঁটতেই পেছনে তাকালাম। সমান ঘাসের উপরে বিস্ফোরিত জোঁকগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে, যে ঘাসের উপরে একটু আগেই আমরা বেঁচেকুঁদে চিৎকার করতে করতে ওদেরকে ঝেড়ে ফেলেছি।

১৪ বছর পরে যখন আমার প্রথম বই প্রকাশিত হয়, সে সময় আমি নিউইয়র্ক ভ্রমণে গিয়েছিলাম। আমার নতুন সম্পাদক আমাকে ফোনে বলেছিল, তিনদিনের একটা উৎসব উদযাপন করা হবে। মানুষ যা বকবক করবে, সেসবের একটা সারকথা রেকর্ড করা হবে। তা হোক, কিন্তু টানা তিনদিনের বকবকই তো হবে সেগুলো। যাওয়ার সময় ভাবছিলাম, প্রকাশনী নিশ্চয়ই আমাকে থমাস উলফের পুণর্জন্ম হিসেবে সেখানে চায়, কিন্তু তারা আমাকে অন্যকিছু ভেবে নিয়েছিল–মিলিয়নখানেক পেপারব্যাক বিক্রির খনি হিসেবে হয়তো।

সেখানে থাকাকালীন শহরের বাইরে থেকে ঘুরতে যাওয়া সবাই যা যা করে, আমি সেসবই করতে চেয়েছিলাম। যেমন, রেডিও সিটি মিউজিক হলে একটা স্টেজ-শো দেখা, এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের ছাদে ওঠা (ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার জাহান্নামে যাক! ১৯৩৩ সালে কিংকং যে বিল্ডিংয়ের মাথায় উঠেছিল, সেটাই আমার কাছে সারাজীবন পৃথিবীর সবচেয়ে লম্বা বিল্ডিং হয়ে থাকবে), রাতের বেলা টাইমস স্কয়ারে ঘুরতে যাওয়া। আমার সম্পাদক, কিথ বরং তার শহর ঘুরিয়ে দেখাতে পেরে খুশি হচ্ছে বলেই মনে হলো। পর্যটক হিসেবে আমাদের শেষ কাজ ছিল স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের উদ্দেশ্যে ফেরি ভ্রমণ। ফেরির রেলিং ধরে ঝুঁকে পানির দিকে তাকিয়ে দেখি, প্রচুর ব্যবহৃত কনডম পানিতে ভাসছে, পানি ঢুকে ফুলে উঠেছে। মুহূর্তখানেকের জন্য আমার সেদিনের কথা মনে পড়ে গেল, কিংবা হয়তো সময়-পরিভ্রমণ করে আসলেই ফিরে গিয়েছিলাম ওই মুহূর্তে। যেটাই হোক, এক সেকেন্ডের জন্য আমি আক্ষরিক অর্থেই অতীতে চলে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল, খাড়া ঢাল ধরে কিছুটা উঠে, থেমে, পিছনে ফিরে বিস্ফোরিত হয়ে পড়ে থাকা জোঁকগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। মৃত প্রাণিগুলোকে কেমন যেন অশুভ লাগছে দেখে।

কিথ নিশ্চয়ই আমার চেহারায় কিছু একটা দেখতে পেয়েছিল। কনডমগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বলল, বাজে অবস্থা, তাই না?

আমি কেবল মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। বলতে চাচ্ছিলাম, ক্ষমা চাওয়ার কোনো দরকার নেই। বলতে চাচ্ছিলাম, অযথা কষ্ট করে আমার সাথে এসে ফেরিতে উঠে এসব ব্যবহৃত রবারের টুকরো দেখার কোনো দরকার ছিল না। বলতে চাচ্ছিলাম–গল্প লেখার পেছনে মানুষের একটাই কারণ থাকে। অতীতকে বোঝার চেষ্টা করা এবং ভবিষ্যতের পথে ওঁৎ পেতে থাকা মৃত্যুর জন্য যথাসম্ভব প্রস্তুতি নেওয়া। সেজন্য কিথ, আমার ভালো মানুষ বন্ধু, জেনে রাখো, গল্পগুলোতে ক্রিয়াপদ সবসময় অতীতকালের-ই হয়, এমনকি যেসব পেপারব্যাক গল্প মিলিয়নখানেক বিক্রি হয়, সেগুলোতেও। দরকারি দুটো শিল্পধারার একটি হলো ধর্ম, আরেকটি গল্প বলা।

নিশ্চয়ই আন্দাজ করতে পারছেন, সে রাতে যথেষ্ট গিলে মাতাল হয়ে পড়েছিলাম।

আমি শুধু ওকে বলেছিলাম, এসব কিছু না। আসলে অন্য জিনিস নিয়ে ভাবছিলাম।

হ্যাঁ, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলা আসলেই সবচেয়ে কঠিন কাজ।

অধ্যায় ২২

রেললাইন ধরে আরো কিছুদূর হাঁটলাম আমরা। কতদূর, ঠিক মনে নেই। ভাবতে শুরু করেছিলাম: যাক, কোনো সমস্যা নেই। এবারের মতো সবকিছু নিয়ন্ত্রণেই আছে, আর ঝামেলাও শেষ। কয়েকটা জোঁকই তো ছিল, এ আর এমন কী। ভাবতে ভাবতেই চোখের মাঝে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো সাদার জোয়ার এল। ওভাবেই ঘুরে পড়ে গেলাম।

অনেক জোরেই পড়েছিলাম নিশ্চয়ই, কিন্তু রেললাইনের কাঠের তক্তার ওপর পড়ার সময় মনে হয়েছিল যেন নিচে উষ্ণ কোমল কিছু বিছানো আছে। কেউ একজন আমাকে ঘুরিয়ে শুইয়ে দিল। হাতের ছোঁয়াগুলোকে মনে হচ্ছিল মৃদু, গুরুত্বহীন। চেহারাগুলো যেন যোজন যোজন দূর থেকে ঝাপসা বেলুনের মতো তাকিয়ে আছে।

কোনো মুষ্টিযোদ্ধা বেমক্কা বিরাশি সিক্কার ঘুসি খেয়ে মাঠিতে আছড়ে পড়ে, সেকেন্ড দশেক বিশ্রাম নিতে নিতে চোখ মিট মিট করে তাকালে তার কাছে রেফারির চেহারা দেখে যেরকম লাগে, ওদের মুখ দেখে তখন আমার ঠিক সেরকম লাগছিল। কথার শব্দগুলো ঝাপসা, অস্পষ্ট তরঙ্গের মতো ভাঙা ভাঙাভাবে ভেসে আসছিল, … সে?

…এইটুকুই–

…যদি মনে হয়, রোদে—

গর্ডি, তুই–

এ সময় আমি নিশ্চয়ই উত্তরে অর্থহীন কিছু বলেছিলাম। কারণ, কথা শুনে সবার চেহারায় আরো বেশি উদ্বেগের ছাপ পড়ল।

টেডি বলল, আমাদের ওকে নিয়ে ফিরে যাওয়া উচিত মনে হয়। এর পরেই আবারো সবকিছু সাদা হয়ে গেল।

দৃষ্টি পরিস্কার হয়ে এলে মনে হলো, ঠিকই আছি। আমার পাশে বসে ক্রিস বলেই যাচ্ছে, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস, গর্ডি? তুই ঠিক আছিস? আদৌ আছিস তো, বাপ?

আছি, বলে উঠে বসলাম। একতাল কালো বিন্দু যেন বিস্ফোরিত হলো চোখের সামনে, তারপর চলে গেল। ফিরে আসতে পারে ভেবে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, তারপর উঠে দাঁড়ালাম।

তুই আমাকে আসলেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিলি, গর্ডি। ক্রিস বলল, পানি খাবি?

হ্যাঁ।

নিজের ক্যান্টিনটা আমাকে ধরিয়ে দিল সে। অর্ধেক ভর্তি ছিল, তিন ঢোঁক উষ্ণ তরল চালিয়ে দিলাম।

তুই জ্ঞান হারিয়েছিলি কেন, গর্ডি? ভার্ন খুব অস্থির হয়ে আছে জানার জন্য।

উত্তরে বললাম, ভুলে তোর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম, ব্যাস!

টেডি ইইই-ইইই-ইইইই করে হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসতে হাসতেই বলল, শালা গর্ডির বাচ্চা! মিচকা শয়তান!

তুই ঠিক আছিস আসলেই? ভান আবারো জানতে চাইল।

হ্যাঁ, আছি। ওই রক্তচোষাগুলোর কথা ভেবে…একটু এলোমেলো লাগছিল আরকি।

সবাই মাথা নেড়ে সায় দিল। গাছের ছায়ায় মিনিট পাঁচেক জিরিয়ে নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম। ভান আর আমি আবারো রেললাইনের একপাশে হাঁটছি, ক্রিস আর টেডি অন্যপাশে। মনে হচ্ছিল, কাছাকাছি চলে এসেছি।

অধ্যায় ২৩

যতটা ভেবেছিলাম, আসলে ততটা কাছাকাছি তখনো যাইনি। আমরা যদি একটু ঘিলু খাঁটিয়ে দুটো মিনিট সময় খরচ করে মানচিত্র দেখে নিতাম, তাহলে সহজেই বুঝে যেতাম, এমন হলো কেন? এটুকু জানতাম, যে জায়গায় ব্যাক হারলো রোডটা রয়্যাল নদীতে এসে শেষ হয়েছে, রে ব্রাওয়ারের লাশটা তার কাছাকাছি কোথাও-ই আছে। এরপর, আরেকটা ব্রিজ হয়ে জিএসঅ্যান্ডডব্লিউএম রেললাইনটা নদী পেরিয়েছে। কাজেই আমাদের হিসেবে আমরা যখন রয়্যাল নদীর কাছাকাছি পৌঁছে যাব, তখন ব্যাক হারলো রোডেরও কাছাকাছি পৌঁছে যাব হিসেব অনুযায়ী এখানেই বিলি আর চার্লি গাড়ি পার্ক করে লাশটা দেখতে পেয়েছিল। আর যেহেতু ক্যাসল রক থেকে রয়্যাল নদীর দূরত্ব মাত্র দশ মাইল, কাজেই ছায়া থাকতে থাকতেই গন্তব্যে পৌঁছে যাব আমরা।

কিন্তু এই দশ মাইল আসলে ছিল সরল রৈখিক দূরত্ব। আর আমরা গিয়েছিলাম রেললাইন ধরে। এই রেললাইন আবার দ্য ব্লাফ নামের কিছু পাহাড় আর আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু রাস্তা এড়াতে গিয়ে অনেকটা ঘুরে গেছে, তৈরি করেছে দীর্ঘ এক বক্ররেখা। আমরা যদি আসার আগে কোনো মানচিত্র দেখে নিতাম, তাহলে খুব স্পষ্টভাবেই বক্ররেখাটা দেখতে পেতাম। বুঝতে পারতাম, দশ মাইলের বদলে রেললাইন ধরে হেঁটে এলে আমাদেরকে মোল মাইল হাঁটতে হবে। এছাড়া হেঁটে আসার আর কোনো উপায়ও নেই।

মধ্য দুপুর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও যখন রয়্যাল নদীর দেখা পাওয়া গেল না, ক্রিস প্রথমবারের মতো সত্যটুকু আন্দাজ করতে শুরু করল। আমাদেরকে দাঁড়াতে বলে একটা বেশ উঁচু গাছে উঠে গেল সে, তারপর চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ব্যাপারটা। নেমে এসে আমাদেরকে এক কথায় বলল, অনেক দ্রুত হাঁটলেও রয়্যালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অন্তত বিকেল চারটা পেরোবে।

টেডি চিৎকার করে উঠল কথাটা শুনে, হায় জিশু! কী করব তাহলে আমরা এখন?

একে অন্যের ঘর্মাক্ত চেহারার দিকে তাকালাম। সবাই প্রচন্ড ক্লান্ত, বিরক্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে আছি। রোমাঞ্চকর যাত্রাটা জগদ্দল বোঝা হয়ে চেপে বসেছে কাঁধে। কখনো কখনো নোংরা এবং ভয়ংকরও হয়ে দাঁড়িয়েছে। যথাসম্ভব আমাদের বাবা-মায়েরাও আমরা কোথায় আছি, কী করছি–এসব নিয়ে চিন্তা শুরু করে দিয়েছে। আর মাইলো প্রেসম্যান না বললেও ব্রিজ পেরুনোর সময় আমাদেরকে দেখে ফেলা ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ার হয়তো পুলিশকে আমাদের কথা বলে দিয়েছে। ওরাও নিশ্চয়ই এতক্ষণে আমাদেরকে খোঁজা শুরু করেছে। গন্তব্যে পৌঁছে আবার হিচহাইক করে, মানে কারো গাড়িতে লিফট নিয়ে ক্যাসল রকে ফিরে যাওয়ার কথা ভাবছিলাম। কিন্তু চারটা বেজে গেলে সন্ধ্যা হওয়ার আগে হাতে থাকবে মাত্র ঘন্টাতিনেক, আর সন্ধ্যার পরে কান্ট্রিরোড থেকে চারটা বাচ্চাকে লিফট দিতে কেউ রাজি হবে না। মনে মনে আমার সেই হরিণটার কথা ভাবতে চাচ্ছিলাম, আপনমনে সাত সকালের সবুজ ঘাস চিবুচ্ছে–কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হলো না। শিকারীদের ঘরে যেমন অর্জন হিসেবে স্টাফড করা প্রাণীর মাথা ঝুলিয়ে রাখা হয়, আর চোখগুলোতে একটু রং স্প্রে করে জীবন্ত ভাব আনার চেষ্টা করা হয়, যেটা দেখে মনে কোনো শান্তিই অনুভব হয় না–তেমনই অর্থহীন লাগছিল হরিণটার কথা ভেবে।

শেষ পর্যন্ত ক্রিসই মুখ খুলল, মনে হচ্ছে, সামনে আগালেই আমাদের জন্য ভালো হবে। তুলনামূলকভাবে ওটাই কাছে হওয়ার কথা। চল, আগানো যাক।

ঘুরে, মাথা নিচু করে ধুলি ধূসরিত জুতা পায়ে রেললাইনের পাশ দিয়ে হাঁটা শুরু করল সে। ওর ছায়া তখন খাটো হতে হতে পায়ের কাছে এসে পড়েছে। কয়েকমুহূর্ত, তারপর আমরাও একে একে ওর পিছু পিছু পা বাড়ালাম।

অধ্যায় ২৪

সেই ভ্রমণ থেকে শুরু করে এই স্মৃতিকথা লেখার মধ্যবর্তী সময়ে সেপ্টেম্বরের ওই দুদিনের কথা আমি সচেতনভাবে খুব কমই ভেবেছি। গোলাগুলিতে মারা যাওয়া সপ্তাহ-পুরনো লাশ নদীতে ভেসে উঠলে যেমন দুঃসহ অনুভূতি হয়, স্মৃতিগুলোর সাথেও তেমনি দুঃসহ অনুভূতি জড়িয়ে আছে। ফলে, রেললাইন ধরে আমাদের হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে আমার মনে কখনো কোনো প্রশ্ন তৈরি হয়নি। অন্যভাবে বললে, যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম–এ নিয়ে মাঝে সাঝে ভাবলেও, যেভাবে করতে চেয়েছিলাম, সেটা নিয়ে কেন যেন কখনো ভাবা হয়নি। কিন্তু এখন ভাবলে মাথার ভেতর খুবই সরল একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে। সে সময় যদি এই চিন্তা মাথায় আসততাও, তাহলেও সেটাকে কেউই পাত্তা দিত বলে মনে হয় না। রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়া ছিল বিশাল কাজ, এবং সেসময় আমরা যেমন বলতাম–জটিল, কঠিন, উরাধুরা! কিন্তু সে সময় যদি এই চিন্তা মাথায় আসত এবং ছুঁড়ে ফেলে না দিয়ে একটু ভেবে দেখতাম, তাহলে হয়তো পরবর্তীতে যা ঘটেছে, সেসব এড়ানো যেত। কে জানে, হয়তো ভার্ন, ক্রিস আর টেডি আজও বেঁচে থাকত। না না, ওরা মোটেও বনের ভেতরে বা রেললাইনের ওপর মারা যায়নি। এই গল্পে কিছু জোঁক আর রে ব্রাওয়ার ছাড়া আর কেউই মরেনি। সত্যি বলতে, ব্ৰাওয়ার তো আসলে গল্প শুরু হওয়ার আগেই মারা গিয়েছিল। কিন্তু একটা কথা তো সত্যি, সেই যে কয়েন ঘুরিয়ে দেখেছিলাম, চারজনের মধ্যে খাবার আনতে কে যাবে, যে গিয়েছিল কেবল সে-ই এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে। প্রিয় পাঠক, আপনাদের সাথে গল্পের পথ ধরে প্রধান অতিথির চরিত্রে আছে চৌত্রিশ বছরের প্রাচীন এক নৌ-সেনা। (এই মুহূর্তে আপনার কি একবার পেছনে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে না, আমার দৃষ্টি আপনার পিঠে লেগে আছে কি না কিংবা কোনো অদ্ভুতুড়ে মন্ত্র জপ করছে কি না কেউ পিছে দাঁড়িয়ে?) আপনার যদি মনে হয় আমি চট করে দিক পাল্টে ফেলেছি, ঠিকই ধরেছেন। তবে এর পেছনে কারণও আছে। যে বয়সে আমাদের চারজনকেই খুবই কমবয়সি এবং প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্যও অপরিপক্ক বলে বিবেচনা করার কথা, সে বয়সে তিনজনই মরে গেছে। লোকে বলে, বছর ঘুরতে ঘুরতে যে কোনো ঘটনার প্রতিক্রিয়াও দিন দিন বাড়তে থাকে। যদি এ কথা সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে হ্যাঁ, যদি আমরা সহজ কাজটাই করতাম, হিচহাইক করে হার্লো চলে যেতাম, তাহলে ওরা হয়তো এখনো বেঁচে থাকত। সহজেই একটা গাড়ি ধরে আমরা রুট ৭-এর শিলো চার্চে চলে যেতে পারতাম। ব্যাক হারলো রোড আর হাইওয়ের সংযোগস্থলে ছিল চার্চটা (অন্তত ১৯৬৭ পর্যন্ত। আগুন লেগে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে জায়গাটা। শুনেছি, এই আগুনের কারণ ছিল মিটমিট করে জ্বলতে থাকা সিগারেটের পরিত্যক্ত গোড়া)। আর, ভাগ্যের একটুখানি সাহায্য পেলে আগেরদিন সূর্য ডোবারও আগে আমরা হয়তো বিলি আর চার্লি যেখানে তাদের বান্ধবীদের নিয়ে গাড়ি পার্ক করেছিল, সে জায়গাটা খুঁজে পেয়ে যেতাম।

কিন্তু এই চিন্তা একদমই পাত্তা পেত না। ভাবনা-চিন্তা, তর্ক-বিতর্কের মাধ্যমে যে আইডিয়াটাকে বাতিল করা হতো, তাও না–বরং মধ্যম আঙুলি দেখিয়ে, বিদ্রূপ করে শেষ করে দেওয়া হতো। আর এই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার মূল বক্তব্য হতো জাহান্নামে যাক!, ফালতু, যত্তসব!, ফার্মের মুরগি কোথাকার! কিংবা তোর মায়ের কোনো ছেলে-মেয়ে এক জীবনে আদৌ বাঁচার চেষ্টা করেছে তো?

না বলা কথাটা হলো–কিংবা এটা হয়তো বলার প্রয়োজনই ছিল না যে আমাদের এই অভিযানের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা ছিল একটা বিশাল ব্যাপার। আতশবাজি নিয়ে উল্টাপাল্টা কারসাজি করা কিংবা হ্যারিসন স্টেট পার্কে মেয়েদের ওয়াশরুমের ফুটোয় চোখ রেখে দেখার চেষ্টা করার মতো সস্তা কিছু ছিল না এটা। বরং জীবনে প্রথমবারের মতো কোনো মেয়ের সাথে ঘুমানো, কিংবা সেনাবাহিনীতে যোগদান অথবা প্রথমবারের মতো আইনসম্মতভাবে মদের বোতল কেনা সরাসরি দোকানে ঢুকে একটা ভালো স্কচের বোতল বাছাই করা, তারপর দোকানিকে ডাফট কার্ড আর লাইসেন্স দেখিয়ে বাদামি ব্যাগটা হাতে নিয়ে, একগাল হেসে সোজা বেরিয়ে আসাটা যেমন অনেক বড় ব্যাপার, প্রথমবারের মতো লাশ দেখতে যাওয়াটাও ছিল সেরকম। এক ধাক্কায় অনেক বড় মনে হতে থাকে নিজেকে, যদি আপনার অভিজ্ঞতা থাকে, তাহলে হয়তো বুঝবেন। ছোট্ট ট্রি হাউজ ক্লাবের সদস্য হিসেবে যেসব সুবিধা পাওয়া যেত, তারচেয়েও বেশি সুবিধা পাওয়া যায়–এমন এক ক্লাবের সদস্য মনে হতে থাকে নিজেকে।

জীবনের সব মৌলিক এবং বিশাল মুহূর্তগুলো উদযাপন করার জন্য বিশেষ ধরনের আচার-অনুষ্ঠান আছে আমাদের। সেসব নিয়ম মানাটা হলো এক ধরনের জাদুর সড়ক ধরে হেঁটে যাওয়া, যার মধ্যে দিয়ে আপনার জীবন বদলে যাবে। যেমন, বিয়ের সময় পাদ্রীর সামনে দাঁড়ানো। হাত তুলে শপথ নেওয়া। প্রথম কনডম কেনা। অথবা, আমাদের জন্য, নিজেদের বয়সি একজনের সাথে দেখা করার জন্য রেলরোড ধরে অর্ধেক রাস্তা হেঁটে যাওয়া। ক্রিস আমার বাসায় আসতে চাইলে আমি যেমন গ্র্যান্ড স্ট্রিটের অর্ধেক পথে গিয়ে ওকে নিয়ে আসতাম। কিংবা আমি টেডির ওখানে যেতে চাইলে সে যেমন গেটস স্ট্রিটের মাঝখান থেকে আমাকে নিয়ে যেত। কাজগুলো এভাবে করাটাই ঠিক মনে হতো। কারণ, এই আচারগুলোই ছিল সেই জাদুর সড়ক; এ পথ ধরে আপনি যাতে ঠিকভাবে হেঁটে যেতে পারেন, সেজন্য যথাসম্ভব সাহায্য করবে বাকিরা। এজন্যেই বিয়ের সময় সবার মাঝখান দিয়ে আপনি হেঁটে যান কিংবা মৃত্যুর পর সবাই আপনাকে কাঁধে করে বয়ে নিয়ে যায় কবরে। আমাদের জন্য সেই রাস্তাটা ছিল সেই রেলরোড ট্র্যাক, যার মাঝে দিয়ে আমরা হেঁটে গেছি। তখনো জানতাম না ওমাথায় ঠিক কী অপেক্ষা করছে বা এই পথ আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। তবু, আমরা হেঁটেই গেছি। এমন কিছুর দিকে হিচহাইক করে, গাড়ি করে যাওয়াটা কোনো কাজের কথা না বলেই হয়তো।

জীবনে বড় জিনিসগুলো পাওয়ার পথটুকু কখনোই সহজ হওয়া উচিত না–এই কাঠিন্যটুকুই এদের গুরুত্বটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয়। কাজেই, রেললাইন ধরে হেঁটে যাওয়াটা যদি আমাদের আশা থেকে একটু কঠিনও হয়, সম্ভবত আমাদের হিসেবে অমনটা হওয়াই ঠিক ছিল। ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে আমাদের এই যাত্রাটা যেমন ভেবেছিলাম, তেমনই একটা অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হয়ে উঠেছিল।

কিন্তু একটা ব্যাপার আমরা একদমই জানতাম না। আমরা যখন ক্লাস ধরে হেঁটে এগোচ্ছি, সেসময় বিলি টেসিও, চার্লি হোগান, জ্যাক মাজেট, নরম্যান ফাজি ব্র্যাকোভিচ, ভিন্স দেশ্যাদে, ক্রিসের বড় ভাই আইবল আর এইস মেরিল নিজেরাও লাশ দেখার জন্য রওনা দিয়েছে। উদ্ভট এবং বিচিত্রভাবে রে ব্রাওয়ার বিখ্যাত হয়ে গেছে এবং আমাদের গোপন অভিযান সাধারণ এক রোড শো-তে পরিণত হয়েছে। আমরা যখন অভিযানের শেষ অংশটুকুর দিকে হেঁটে যাচ্ছি, ওরা তখন চড়ে বসেছে এইসের কালো ৫২ ফোর্ড আর ভিন্সের গোলাপি ৫৪ স্টাডবেকারে।

বিলি আর চার্লি তাদের বিশাল গোপন তথ্য মাত্র চব্বিশ ঘন্টার মতো গোপন রাখতে পেরেছিল। তারপর পুল খেলতে গিয়ে চার্লি মুখ ফসকে এইসকে বলে ফেলেছে আর ওদিকে জ্যাক মাজেটের সাথে বুম রোড ব্রিজে মাছ ধরতে গিয়ে সব কিছু স্বীকার করে বসেছে বিলি। এইস আর জ্যাক দুজনেই নিজেদের মায়ের কসম কেটে বলেছিল কাউকে বলবে না। সেই কসমের জোরে দুপুর গড়ানোর আগেই ওদের গ্যাংয়ের সবাই সবকিছু জেনে গেল। হারামজাদারা নিজেদের মাকে কতটুকু গুরুত্ব দিত, সেটা নিশ্চয়ই আপনার এ থেকেই বুঝে যাওয়ার কথা।

পুল হলে গুরুত্বপূর্ণ সভা বসল। ঝাপসা শয়তান নরম্যান ব্র্যাকোভিচ পরামর্শ দিল (যেটা আপনারা এরই মাঝে একদফা শুনে ফেলেছেন), লাশটা খুঁজে বের করে ওরা চাইলে নায়ক হয়ে যেতে পারে। সেই সাথে রেডিও আর টিভি ব্যক্তিতে পরিণত হওয়াটা তো আছেই। এজন্য কেবল ছোট্ট একটা কাজ করতে হবে ওদেরকে: দুটো গাড়ির ট্রাঙ্কে বেশ কিছু মাছ ধরার যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে যেতে হবে আসল জায়গায়। তাহলে লাশ খুঁজে পাওয়ার পরে যে গল্পটা বলবে, সেটা একশ ভাগ খাঁটি শোনাবে–আমরা আসলে সবাই মিলে রয়্যাল নদীতে মাছ ধরতে এসেছিলাম, অফিসার। হেহে! লাশটা আসলে কীভাবে কীভাবে যেন আবিষ্কার করে ফেলেছি আরকি।

আমরা যখন শেষ পর্যন্ত মৃত দেহটার কাছাকাছি চলে এসেছি, ওরা তখন ক্যাসল রক থেকে ব্যাক হারলোর দিকে প্রচন্ড গতিতে গাড়ি টান দিয়েছে।

অধ্যায় ২৫

মোটামুটি দুইটার দিকে আকাশে মেঘ জমতে শুরু করলেও, শুরুতে আমরা কেউই পাত্তা দেইনি। জুলাইয়ের শুরু থেকেই বৃষ্টির নামগন্ধও নেই, এখন কেন বৃষ্টি হবে? কিন্তু দক্ষিণে, আকাশের বুকে মেঘ জমতে জমতে বিশাল আকার ধারণ করল। বজ্রের মাথা দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি আঁচড়ে আকাশের বুক বিক্ষত করে দিয়েছে। ধীরে ধীরে ওটা এগিয়ে আসতে লাগল আমাদের দিকে। ভালো করে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছিলাম ব্যপারটা। আঁচড়ের নিচে একটা হালকা পর্দা মতো কিছু, যেটা দেখে বোঝা যাবে, বিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূরে এর মাঝেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু বৃষ্টির কোনো নিশানা পেলাম না। এখনো মেঘের দল কেবল জড়ো হচ্ছে।

ভার্নের বাম পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে। সবাই থেমে একটু জিরিয়ে নিল। এদিকে ভার্ন পুরনো ওকে গাছের বাকল আর মস একসাথে জুতোর ভেতরে বিছিয়ে দিয়ে জুতো পরে নিল।

টেডি জিজ্ঞাসা করল, বৃষ্টি হবে নাকি, গর্ডি?

তাই তো মনে হয়।

ধুর! একটা ভালো দিনের মাথায় পেশাব করে দিবে, এটা কোনো কথা? বলে হাই তুলছিল টেডি, আমাকে হাসতে দেখে চোখ টিপে দিল। আবারো হাঁটতে শুরু করেছি। ভার্নের পায়ের ব্যথার কথা ভেবে এখন অবশ্য সবাই কিছুটা আস্তে হাঁটছে।

দুইটা থেকে তিনটার মাঝামাঝি কোনো এক সময় ধীরে ধীরে দিনের আলো পাল্টাতে শুরু করল। গরম আগের মতো তীব্ৰই আছে, আর্দ্রতা বরং আরো বেড়ে গেছে। সবাই বুঝতে পারছিলাম ব্যাপারটা বৃষ্টি হবে। পাখিরাও জেনে গিয়েছিল; দেখা গেল মুহূর্তখানেক আগের ফাঁকা আকাশে কোত্থেকে যেন অনেক অনেক পাখি এসে ভরে ফেলেছে। দলবেঁধে একসাথে কান্না জুড়ে দিয়েছে সবগুলো। ক্রমেই অন্ধকারের ভেতর আলো হারিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ছায়ারাও ঝাপসা হয়ে উঠছে ধীরে ধীরে। সূর্য মাঝে মাঝেই মুখ লুকোচ্ছে মেঘের ভারি চাদরে। মাঝে মাঝে মুখ বাড়িয়ে উঁকিও দিচ্ছে, কিন্তু আবারো মুখ লুকিয়ে ফেলছে সাথেসাথেই। দক্ষিণের আকাশ এরইমাঝে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে। বিশাল সব বজ্রমেঘ ছুটে আসছে আমাদের দিকে আসার পথে প্রচণ্ড গর্জনে হুমকি দিচ্ছে মাটির বুকের সবকিছুকে। হুমকি আর এদের বিশাল আকৃতি দেখে আমরা তখন মন্ত্রমুগ্ধ, ঘোরে চলে গেছি। হঠাৎ হঠাৎ বিদ্যৎ চমকে উঠছে মেঘের বুক চিডে, আর মেঘের গোলাপি রং পাল্টে গিয়ে ভীষণ রকম উজ্জ্বল ধুসর বর্ণ ধারণ করছে। তারপর হঠাৎ আমাদের সবচেয়ে কাছের মেঘটা থেকে বজ্রপাত হতে দেখলাম। পেছনে পেছনে এল সর্বস্ব কাঁপিয়ে দেওয়া দীর্ঘ এক বজ্রগর্জন। প্রচণ্ড উজ্জ্বলতা আমার চোখের রেটিনায় নীল ট্যাটু এঁকে দিয়ে গেল।

নিজেদের মধ্যে এক-আধটু অভিযোগ-অনুযোগ চলল ভিজে কী অবস্থা হবে, ঠান্ডা লেগে যাবে কিনা–এসব নিয়ে। বলার জন্য বলা আর কি, আসলে আমরা সবাই তখন মনে মনে বৃষ্টির জন্যই অপেক্ষা করছিলাম। কারণ, এই পানিটুকু হবে প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া শীতল। আর সবচেয়ে বড় কথা, এই পানিতে কোনো জোঁক থাকবে না।

প্রায় সাড়ে তিনটার দিকে হঠাৎ গাছের ফাঁক দিয়ে দেখি, পানি গড়িয়ে পড়ছে।

এই তো! ক্রিসের গলায় চিৎকারের সাথে আনন্দ ঝরে পড়ছে, এটাই হচ্ছে রয়্যাল নদী!

আমরা দ্রুত পা চালানো শুরু করলাম। ঝড় এরই মধ্যে অনেকটুকু কাছিয়ে এসেছে। প্রচন্ড বাতাস দিচ্ছে, কয়েক সেকেন্ডের মাঝে তাপমাত্রা নেমে গেছে দশ ডিগ্রির মতো। হঠাৎ তাকিয়ে আবিষ্কার করলাম, আমার ছায়াটাও পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছে।

আমরা তখন রেললাইনের দুপাশ ধরে জোড়ায় জোড়ায় হাঁটছি। উদ্দেশ্য, দুই পাশের ঢালের নিচের জায়গাগুলোর দিকে ভালমতো লক্ষ্য রাখা। মুখের ভেতরে শুকিয়ে গেছে, বুঝতে পারছি। শেষবারের মতো উঁকি দিয়ে নিয়ে সূর্য আবার মুখ লুকিয়েছে, আর বেরিয়ে আসেনি। এক মুহূর্তের জন্য নদীর তীরবর্তী অংশটুকু সোনালী আভায় ছেয়ে গেল, দেখে মনে হচ্ছিল বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্টে বর্ণিত কোনো স্বর্ণের মেঘ মাটিতে নেমে এসেছে। পরমুহূর্তেই ওয়াইন রঙের প্রবল বজ্রমেঘ তেড়ে এল, সূর্যের শেষ চিহ্নটুকুও শুষে নিল নির্মমভাবে। প্রচণ্ড উজ্জ্বলতায় ডুবে গেল চরাচর ওদিকে আকাশের বুকে মেঘের দল নীলের বাকিটুকুও গ্রাস করে নিচ্ছে। নদীর গন্ধ পাচ্ছিলাম, কিংবা হয়তো বাতাসে বৃষ্টির গন্ধ ভেসে আসছে। এত স্পষ্টভাবে গন্ধ পাচ্ছিলাম যে নিজেদেরকে মানুষের বদলে বরং ঘোড়া মনে হচ্ছিল। মাথার ওপর থেকে ভেসে আসছে সমুদ্রের গর্জন। যেন, আকাশের বুকে পাতলা কোনো থলির উপরে একটা সমুদ্র তৈরি হয়েছে। যেকোনো সময় থলিটা ছিঁড়ে যেতে পারে, তারপর প্রবল স্রোত বন্যার মতো ভাসিয়ে নেবে সবকিছু।

জোর করে ঝোঁপঝাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু চোখ কি আর কথা শোনে? গর্জনরত আকাশের বুকে মেঘেদের ছোটাছুটির দিকে চলে যেতে চায় বারবার। অন্ধকার ঘনিয়ে আসা আকাশের দিকে তাকিয়ে বিভিন্ন ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের সম্ভাবনার কথা মনে হতে থাকে। পানিবাহিত হোক কিংবা আগুন, প্রবল বাতাস অথবা তুষারে ভর করেও নেমে আসতে পারে ধ্বংস। হঠাৎ এক ঝলক বজ্রপাত হানা দিয়ে গেল। মনে হচ্ছিল বুঝি ঠিক মাথার উপরে এসে পড়েছে। কেঁদে ফেলেছিলাম আমি, মুখ ঢেকে ফেলেছিলাম দুই হাতে। খোদা সম্ভবত আমার ছবি তুলে রেখেছেন–ছোট্ট একটা ছেলের কোমরে শার্ট বাঁধা, ভয়ে বুকের পশম দাঁড়িয়ে গেছে, গালে লেগে আছে ধুলোবালি, পাথরচূর্ণ। ৬০ গজের মতো দূরে বিশাল সব গাছের ভেঙে-চুরে মাটিতে পড়ার শব্দ পাওয়া যাচ্ছিল। পেছন পেছন ভেসে এল বজ্রনিনাদ। ভয়ে এক মুহূর্তের জন্যে সিঁটিয়ে গেলাম। সবটুকু দিয়ে শুধু বাড়িতে থাকতে চাইছিলাম আমি। ভূগর্ভস্থ আলু রাখার ঘরে কিংবা নিরাপদ কোনো জায়গায় বসে চাইছিলাম চমৎকার একটা গল্পের বই পড়তে।

জিশু! ভার্নের চিৎকার শোনা গেল, দেখ দেখ!

ভার্নের আঙুল অনুসরণ করে তাকিয়ে দেখি, একটা নীলচে-সাদা আগুনের গোলা রেললাইনের বামপাশের পাত ধরে গড়িয়ে আসছে, শব্দ শুনে মনে হচ্ছে যেন কোনো রাগী বিড়াল গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। গোলাটা যখন প্রচণ্ডবেগে আমাদের পেরিয়ে গেল, অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলাম সবাই। এমন কিছুর যে অস্তিত্ব থাকতে পারে, সে ব্যাপারে কোনো ধারণাই ছিল না আমাদের। আরো বিশ ফিট সামনে গিয়ে হঠাৎ করেই বিস্ফোরিত হলো গোলাটা, তারপর মিলিয়ে গেল বাতাসে।

কী করছি আমি এখানে আসলে? টেডি বলে উঠল।

জটিল না? আজকে যে বষ্টি হবে, আগে কখনো এমন বষ্টি হয়নি, আমি নিশ্চিত! ক্রিস খুশি খুশি গলায় বলল, ওপরে তাকিয়ে আছে। কথা সত্যি আসলেই দারুণ বৃষ্টি হবে, যদি কেউ উপভোগ করতে পারে আরকি। কিন্তু আমি টেডির সাথেই একমত হলাম। আকাশ যাকে বলে, অশনী সংকেত দিচ্ছে। তাকালেই মাথা ঘোরাচ্ছে, এমন অবস্থা। পাহাড়ের ভেতর দিয়ে চলে যাওয়া গভীর এবং রহস্যময় কোনো সুড়ঙ্গের দিকে তাকালে যেমন লাগে, সেরকম লাগছে।

আবারো বজ্রপাত হল, এবং কোনোরকম বিরতি না দিয়ে সাথে সাথেই ছুটে এল বজ্রনিনাদ। মনে হচ্ছে ওজনের গন্ধ যেন প্রচণ্ড উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। কানে তালা লেগে যাওয়ার জোগাড়।

আমার কানে তখনো আকাশের গর্জন বাজছিল, এরই মাঝে ভেসে এল। ভার্নের চিৎকার। ওই যে! ওই যে ওখানে! ওকে দেখতে পেয়েছি আমি!

চাইলে এখনো ভার্নকে দেখতে পাই আমি। মিনিটখানেক চুপচাপ চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেই ওর দেখা পাওয়া যায়, স্পষ্ট। রেললাইনের বামপাশের পাতে পা রেখে দাঁড়িয়ে ছিল ভার্ন, যেন আবিষ্কারের নেশায় অনুসন্ধানী চোখে জাহাজের মাস্তুলে দাঁড়িয়ে আছে। মাত্র যে বজ্রপাতটা হলো, সেটা থেকে চোখ বাঁচিয়ে সামনে দেখার জন্য একহাত চোখের উপরে দিয়ে রাখা। আরেকহাত দিক নির্দেশের জন্য সামনের দিকে বাড়ানো। দেখাচ্ছে, ঠিক কোথায় লাশটাকে দেখতে পাচ্ছে ও!

আমরা সবাই দৌড়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়িয়ে নির্দিষ্ট দিকে তাকালাম। মনে মনে ভাবছিলাম, ভার্ন নিশ্চয়ই কল্পনা করে নিয়েছে লাশটাকে। জোঁকের দল, প্রচণ্ড গরম আর এই ঝড় মিলে মাথা এলোমেলো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। কিন্তু কল্পনা ছিল না ওটা। যদিও এক মুহূর্তের জন্য মাথার মাঝে একটা আকুতি উঁকি দিয়ে গেল কল্পনা হলেই আসলে ভালো হতো। সেই মুহূর্তে প্রথমবারের মতো আমি উপলব্ধি করলাম, এক জীবনে আমি আর কখনো কোনো লাশ দেখতে চাই না। এমনকি ছোট্ট কোনো পশুর লাশ হলেও না।

আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বসন্তের প্রথম বৃষ্টি তার একটু নিচে ঢালের অনেকটুকু মাটি ধুয়ে নিয়ে গেছে। ফলে তৈরি হয়েছে চার ফুটের ভয়ংকর এক গভীর খাদ। হয় রেলরোড রক্ষণাবেক্ষণ কর্তৃপক্ষের কর্মীরা তাদের ডিজেল চালিত হলুদ রিপেয়ার-কার্ট নিয়ে এখনো এসে পৌঁছেনি, নাহয় এটা খুবই সাম্প্রতিক সময়ে তৈরি হয়েছে। হয়তো তাদের কাছে এর খবরই পৌঁছেনি এখনো। খাদের তলার নোংরা জলাবদ্ধ অংশটায় আগাছার একটা ঝোঁপ তৈরি হয়েছে। ভীষণ দুর্গন্ধ আসছে সেখান থেকে। তার মধ্যে থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা হাত সাদা, ফ্যাকাশে।

আমাদের মধ্যে কেউ কি সেই মুহূর্তে নিঃশ্বাস নিচ্ছিল? আমি নেইনি।

প্রচন্ড বাতাস দিচ্ছিল সে সময়। চারপাশ থেকে সমস্ত বাতাস যেন আমাদের দিকেই ছুটে আসছে। ঘর্মাক্ত নগ্ন ত্বকের ওপর হামলে পড়ছে, বাড়ি মারছে ইচ্ছেমতো। কিন্তু সে সময় ওসবের দিকে তেমন খেয়াল ছিল না আসলে। সম্ভবত আমার মস্তিষ্কের একটা অংশ টেডির কেঁদে ফেলার জন্য অপেক্ষা করছিল। যদি আসলেই কাঁদত, আমি হয়তো পাগলই হয়ে যেতাম। একটা হাত আলাদা না দেখে পুরো লাশটা একসাথে দেখতে পেলেই হয়তো ভাল হতো। হাতটা অদ্ভুতভাবে বেরিয়ে আছে, বীভৎস রকম সাদা, আর আঙুলগুলো কেমন উল্টে গিয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে মাটির উপরে। পানিতে ডুবে মরা লাশগুলোর হাত যেমন হয়। পুরো ব্যাপারটার মধ্যে কী যেন একটা ছিল, আমাদের মাথার মধ্যে একটা জিনিস গেঁথে দিয়ে গেছে মৃত্যুর চেয়ে সত্যি আর কিছু নেই। ওই একটা হাত পৃথিবীর সকল কবরের মানে বুঝিয়ে দিয়েছে আমাদেরকে। প্রতিবার যখন কোনো ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা পড়ি বা শুনতে পাই, সেই হাতের স্মৃতি ফিরে ফিরে আসে। কোথাও না কোথাও হাতটার সাথে যুক্ত রে ব্রাওয়ারের বাকি দেহটাও পড়ে আছে।

পরপর অনেকগুলো বিজলী চমকাল। আর প্রতিটা বিজলীর পিছু পিছু ছুটে এল বজ্রনিনাদ, যেন আকাশের বুকে ড্রাগনের দল যুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে।

ফিসফিসানি বেরিয়ে এল ক্রিসের মুখ থেকে, শিইইই!

এটা ঠিক গালিও না, আবার স্থানীয়দের ভাষায়ও শিট কথাটা এভাবে বলে না। বরং জিনিসটা ছিল দীর্ঘ, ছন্দহীন এবং অর্থহীন শব্দাংশ আঁতকে ওঠায় হুট করে গলা দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিল।

ভার্নের জিহ্বা ওর ঠোঁটের উপরে এমনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, যেন সে ঠিক ওই মুহূর্তে নতুন এবং ভিন্ন কিছুর স্বাদ পেয়েছে। তিব্বতী সসেজ রোল কিংবা আন্তঃনাক্ষত্রিক শামুক রান্না–অর্থাৎ এমন কিছু, যেটা ওকে একইসাথে উত্তেজিত এবং ভয়াবহ বিরক্ত করে তুলেছে।

টেডি শুধু চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিল। বাতাস ওর কানের ওপর থেকে নোংরা এলোচুল একেকবার সরিয়ে নিয়ে ফের কানের উপরে আছড়ে ফেলছে। কিন্তু ওর মুখে কোনো অনুভূতির চিহ্ন ছিল না। পুরোপুরি শূন্য।

এখন আমি বলতে পারি, হাতটার কাছে সে সময় কিছু একটা দেখেছিলাম। আসলেই হয়তো দেখেছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারিনি। বুঝেছি পরে। কালো পিঁপড়ার দল সারি বেঁধে হাতের ওপর দিয়ে আসা যাওয়া করছিল।

রেললাইনের দুপাশের বনেই হঠাৎ করে কেমন যেন ফিসফিসানি শুরু হয়ে গেল। যেন পুরো বন এইমাত্র আমাদের অস্তিত্ব টের পেয়ে গিয়ে, এ নিয়ে মন্তব্য করতে শুরু করেছে। তারপর শুরু হলো বৃষ্টি।

কয়েনের মতো বিশালাকৃতির সব বৃষ্টির ফোঁটা হাতে-মাথায় পড়তে লাগল, আছড়ে পড়তে লাগল ঢালের গায়ে। মুহূর্তখানেকের জন্য চারপাশের সবকিছু ভিজে গাঢ় রং ধারণ করল। কিন্তু স্থায়ী হলো না, শুষ্ক মাটি শুষে নিল সবটা পানি, আবার আগের শুকনো রং ফিরে এল সবখানে।

বড় বড় ফোঁটাগুলো সর্বোচ্চ পাঁচ সেকেন্ডের মতো ঝরার পরে থেমে গেল। ক্রিসের দিকে তাকিয়ে দেখি চোখ পিটপিট করছে।

এক মুহূর্তের বিরতি, তারপর শুরু হলো ঝড়–সত্যিকারের ঝড়। যেন একসাথে আকাশের সমস্ত ঝরনার মুখ খুলে দেওয়া হয়েছে। মুহূর্তের মাঝে ভিজে একসা হয়ে গেলাম। ফিসফিসানির শব্দ বদলে গেল, মনে হচ্ছে। চারপাশ থেকে কোটি কোটি হাতুড়ির বাড়ির শব্দ ভেসে আসছে। যেন, এই আবিষ্কারের জন্য পুরো বন আমাদেরকেই দায়ি করছে। প্রচন্ড ভয় চেপে বসছিল। কলেজে ওঠার আগপর্যন্ত কেউ বলেওনি আমাদেরকে যে, এগুলো কুসংস্কার…এমনকি কলেজে উঠেও দেখেছি, একেবারে গাধা বা গোঁয়ার না হলে কেউ এসবকে ঠিক কুসংস্কার বলে উড়িয়ে দেয় না।

খাদের পাশ দিয়ে খাড়া ঢাল ধরে লাফ দিল ক্রিস, চুল ভিজে মাথায় একেবারে বসে গেছে। পিছু পিছু আমিও লাফ দিলাম। ভান আর টেডিও এল আমাদের পেছনে। একেবারে কাছেই ছিল ওরা, কিন্তু আমি আর ক্রিসই প্রথম রে ব্রাওয়ারের লাশের কাছে পৌঁছালাম। বেচারার মুখ নিচের দিকে ফেরানো ছিল। ক্রিস আমার চোখের দিকে তাকাল। মুখ শক্ত হয়ে আছে, দেখে মনে হয় কোনো পূর্ণ বয়স্ক মানুষ বুঝি তাকিয়েছে আমার দিকে। মাথা নেড়ে সায় দিলাম, মনে হচ্ছিল বুঝি শব্দ করেই কথা বলছে।

উপরে রেললাইনে পড়ে থাকলে যে বীভৎস অবস্থা হতো, এখানে নিচে পড়ে থাকার ফলে ওর অবস্থা তুলনামূলক অনেকটা ভালো; কিংবা বলা উচিত, কম ক্ষতিগ্রস্ত। এর কারণটা সম্ভবত এই যে, ট্রেন যখন ধাক্কা দিয়েছিল, তখন সে আসলে রেললাইন থেকে সরে যাবার চেষ্টা করছিল। পড়ার সময় মাথা ছিল রেললাইনের দিকে আর হাত দুটো ছিল মাথার উপরে, ডাইভ দিতে চাইলে যে কারো ঠিক এমনটাই করার কথা। আর, এসে এমন জলাবদ্ধ জায়গায় পড়েছে যে, বৃষ্টির পানিতে জায়গাটা খুব দ্রুত ভরে যাচ্ছে। মাথার চুল কালচে লাল হয়ে আছে, বাতাসের আর্দ্রতা চুলের আগাগুলো কিছুটা বাঁকিয়ে ফেলেছে। রক্ত লেগে আছে চুলে, তবে দেখে নিজেকে অসুস্থ মনে হওয়ার মতো বেশি না। কিন্তু সবচেয়ে ভয়াবহ হচ্ছে পিঁপড়েগুলো। আর, সে পরে আছে একটা কালচে সবুজ টি-শার্ট আর নীল জিন্স। পা দুটো খালি। কয়েক ফিট দূরে ব্ল্যাকবেরির ঝোঁপের মধ্যে দেখলামএকজোড়া ময়লা কেডস ঝুলছে।

এক মুহূর্তের জন্যে বিহ্বলতা ভর করল। সে এখানে থাকলে জুতোগুলো ওখানে কেন? তারপরেই বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। মনে হচ্ছিল কেউ যেন আমার বেল্টের নিচে বেমক্কা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। আমার বউ-বাচ্চা-বন্ধু-বান্ধবরা মনে করে আমার মতো কল্পনাশক্তি থাকাটা বেশ চমৎকার একটা ব্যাপার। এই কল্পনাশক্তি দিয়ে আমি যে শুধু অনেক টাকা আয় করি, তা-ই নয়; বরং একঘেয়ে লাগলে, ইচ্ছে হলে মনের মধ্যেই মুভি দেখতে পারি। বেশিরভাগ সময়ের জন্যে এই কথাটা হয়তো সত্যি। কিন্তু কখনো কখনো আমার এই কল্পনাশক্তি তার তীক্ষ্ণ, ধারালো এবং নির্মম দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে। এমন কিছু দেখা দিয়ে যায়, যেটা আপনি কোনোভাবেই দেখতে চাইবেন না। যে জিনিসগুলো আপনার রাতের ঘুম হারাম করে ফেলবে। সেই মুহূর্তে ওখানে দাঁড়িয়ে ঠিক এমনই একটা জিনিস দেখতে পেয়েছিলাম আমি, অসম্ভব স্পষ্ট এবং এক শ ভাগ নিশ্চয়তা নিয়ে দৃশ্যগুলো ভেসে উঠেছিল আমার চোখে। ধাক্কা খেয়ে বেচারা ওর কেডস থেকে বাইরে ছিটকে পড়েছে। ট্রেন ওকে এত প্রচন্ডভাবে ধাক্কা দিয়েছে যে, রে ব্রাওয়ার ওর জুতোগুলো থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে; সেই সাথে ওর দেহ ছেড়ে জীবনটুকুও বেরিয়ে গেছে।

আমার ভাবনার জগতে শেষ পেরেক ঠুকে দিল এই ব্যাপারটা। বুঝিয়ে দিল, রে বাওয়ার মারা গেছে। অসুস্থ হয়ে শুয়ে নেই কিংবা ঘুমিয়ে নেই। আর কোনো ভোরে ও জেগে উঠবে না, একসাথে অনেক আপেল খেয়ে পেট খারাপ করে ফেলবে না কিংবা দুশ্চিন্তা করবে না স্কুলের পরীক্ষা নিয়ে। মারা গেছে ছেলেটা। মারা গেছে।

আর কখনো নতুন বসন্তে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়তে পারবে না সে। বিদায়ি তুষারের মাঝ থেকে মাথা বেরিয়ে থাকা বাতিল মাল সংগ্রহ করতে পারবে না। হ্যালোইনের সস্তা চকলেট খেয়ে বছরের পহেলা নভেম্বর রাত দুটোয় ঘুম ভেঙে বমি করার জন্য ছুট দিতে পারবে না বাথরুমে। আর কখনো খেলার মাঠে মারামারি করতে পারবে না কিংবা তুলে আনতে পারবে না কোনো মেয়ের চুল। ওর সবকিছুর মাঝে এখন শুধু না-এর ছড়াছড়ি। নেই, পারবে না, করবে না, উচিত না–সবটুকু জুড়ে শুধু না আর না।

ব্যাটারির যে পাশটায় লেখা থাকে নেগেটিভ, রে ব্রাওয়ার এখন সে পাশে পড়ে আছে। কিংবা শিক্ষকের ডেস্কের পাশে যে বাতিল কাগজের ঝুড়ি থাকে পেন্সিল চেঁছে কিংবা নষ্ট কমলার কোষ ফেলে ভর্তি করে ফেলার ফলে বিশ্রী দুর্গন্ধ আসতে থাকে সেটা থেকে। কিংবা শহরের বাইরে যে ভূতুড়ে বাড়িটার জানালার কাঁচ ভেঙে গুঁড়ো-গুড়ো হয়ে পড়ে থাকে, অনুমতি ছাড়া প্রবেশ নিষেধ লেখা সাইনবোর্ডটা অযত্নে পড়ে থাকে বাড়ির পাশের মাঠের ভেতরে; বাঁদুড়ের দল বাসা বাঁধে চিলেকোঠায়, ভূগর্ভস্থ ঘর ভরে যায় পোকাদের বিচরণে–সেই ময়লার ঝুড়ি বা বাড়িটার মতোই অযত্নে পড়ে আছে রে ব্রাওয়ার। সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে ছেলেটা। মারা গেছে।

সারাদিন ধরে বলে গেলেও ওর নগ্ন পা আর বাঁশঝাড়ে ঝুলতে থাকা নোংরা জুতো জোড়ার মাঝের দূরত্বটুকু ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারব না আমি। মাত্র ত্রিশ ইঞ্চি, কিংবা হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরত্ব ওদের মাঝে। যে জুতো জোড়া থেকে ছিটকে পড়েছে, সেই জুতোগুলো আর কোনোদিন পায়ে দিতে পারবে না ছেলেটা। রে ব্রাওয়ার মারা গেছে।

সবাই মিলে মুখ উপরের দিকে ফিরিয়ে শোয়ালাম ওকে। বৃষ্টি আর বজ্রপাতের দিকে ফিরিয়ে শোয়ালাম।

ওর পুরো মুখ আর ঘাড় জুড়ে পোকামাকড় হেঁটে বেড়াচ্ছিল। উপরের দিকে ফিরে শোয়ানোর ফলে ওর টি-শার্টের গোল গলা ধরে সব পোকামাকড় এলোমেলো দৌড়ে বেড়াতে লাগল। চোখ দুটো বীভৎসরকম ভুলভাবে খুলে আছে। এক চোখ এমনভাবে বেঁকে গেছে যে, শুধু সাদা অংশটাই দেখা যাচ্ছে, মনিটাকে দেখাই যাচ্ছে না। আরেক চোখ সোজা তাকিয়ে আছে ঝড়ের দিকে। ঠোঁট আর গলার কাছে শুকিয়ে যাওয়া রক্ত লেগে আছে। মুখের ডানপাশে একটা ক্ষত। তবু আমি ভাবছিলাম, খুব যে খারাপ অবস্থা, তা বলা যাবে না। আমার বড় ভাই ডেনিস একবার ঠেলেঠুলে, জোর করে একটা দরজা খোলার পর ভেতরে ঢুকেছিলাম। এরচেয়ে ভয়াবহ ক্ষত এবং নাকে একদলা রক্ত নিয়ে বেরিয়েছি। তারপরেও সেদিন রাতের খাবার প্রস্তুতিতে সাহায্য করতে হয়েছিল আমাকে।

টেডি আর ভার্ন আমাদের পেছনে দাঁড়িয়েছিল। এই মুহূর্তে উপরের দিকে তাকিয়ে থাকা চোখে যদি দৃষ্টির আদৌ কিছু বাকি থাকে, রে ব্রাওয়ারের কাছে আমাদেরকে মনে হবে কোনো হরর মুভি থেকে উঠে আসা শববহণকারী।

একটা পোকা বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে। গালের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়ে একটা পাতার উপরে উঠে পড়ল, তারপর হারিয়ে গেল মুহূর্তে।

দেখলি তোরা? কেমন অদ্ভুতুড়ে গলায় চিৎকার করে বলল টেডি, আমি নিশ্চিত ওর ভেতরের পুরোটা এখন পোকামাকড় দিয়ে ভরা! আমি নিশ্চিত, ওর বেন–

চুপ কর, টেডি, ক্রিস ধমকে উঠল। চুপ করে গেল টেডি, দেখে মনে হচ্ছিল, ধমক খেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করছে। আকাশে নীলের বুক চিড়ে দিল বজ্রপাত। সে আলোয় ওর সোজা হয়ে থাকা চোখটা আলোকিত হয়ে উঠল। দেখে আপনি হয়তো বিশ্বাস-ই করে ফেলবেন যে, নিজের বয়সি কয়েকটা ছেলেকে দেখে বুঝি খুশি হয়ে গেছে সে। লাশ ফুলে উঠতে শুরু করেছে, তার ওপর কেমন যেন পুরনো, পঁচে যাওয়া গ্যাসের দুর্গন্ধ আসছে। শরীর থেকে।

উল্টো ঘুরে দাঁড়ালাম। নিশ্চিত ছিলাম, অসুস্থ হয়ে পড়ব, কিন্তু পাকস্থলীর ভেতরের সবকিছু কেমন যেন শক্ত, স্থির আর শুষ্ক হয়ে গিয়েছিল। গলায় দুই আঙুল ঢুকিয়ে দিলাম। বমি করতে চাচ্ছিলাম, খুব দরকার ছিল একটু বমি করা। মনে হচ্ছিল, একটুখানি বমি করতে পারলে এই তীব্র অশান্তি থেকে হয়তো কিছুটা হলেও মুক্তি পাব। কিন্তু পারিনি।

বৃষ্টি আর বজ্রপাতের শব্দে কয়েক গজ দূরের ব্যাক হারলো রোড ধরে আসা গাড়িগুলোর আওয়াজ পুরোপুরি ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। একইভাবে, রাস্তার শেষ মাথায় গাড়ি পার্ক করে, গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ওদের এতদূর হেঁটে আসার শব্দও ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এর ফলে।

প্রথমবার ওদের অস্তিত্ব টের পেলাম এইস মেরিলের কথায়। বজ্রপাতের শব্দ ছাপিয়ে ভেসে এল ওর গলা: কী হচ্ছে এখানে?

অধ্যায় ২৬

বিষ্ময়ে লাফিয়ে উঠলাম আমরা সবাই। ভার্ন কেঁদে ফেলল। পরে ও স্বীকার করেছিল কথাটা, এক মুহূর্তের জন্য সে ভেবেছিল, কথাগুলি বুঝি লাশের ভেতর থেকে এসেছে।

জলা জায়গাটার শেষে যেখানে আবার বন শুরু হয়েছে, ছেয়ে রেখেছে। রাস্তার শেষ মাথা, সেখানে এইস মেরিল আর আইবল চেম্বার্স একসাথে দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টির ধুসর পর্দা ভেদ করে দেখা দায়। তারমাঝেই ওদের পরনের নাইলনের লাল হাইস্কুল জ্যাকেটটা চোখে পড়ছে। নিয়মিত ছাত্ররা চাইলে স্কুলের অফিস থেকে এ ধরনের জ্যাকেট কিনতে পারে। আর, বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে যারা খেলে, তাদেরকে এগুলো বিনামূল্যে দেওয়া হয়। মাথার চুল বৃষ্টির তোড়ে খুলির সাথে লেপটে গেছে। গাল বেয়ে অশ্রুর মতো ঝরঝর করে ঝরছে বৃষ্টিজল।

আইবল চেম্বার্স ক্রিসকে দেখে বলল, হেল! ওটা তো আমার ছোেট ভাই!

ক্রিসও আইবলের দিকে তাকিয়ে ছিল, মুখ বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে। ভেজা শার্ট তখনো কোমরের কাছে বাঁধা। আর বৃষ্টিতে ভিজে গিয়ে পিঠে ঝুলতে থাকা ব্যাকপ্যাক কালচে সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।

তুমি চলে যাও, রিচ, কম্পিত কণ্ঠে ক্রিস বলল, ওকে আমরা খুঁজে পেয়েছি, পুরষ্কারও আমাদের।

কিছু যায় আসে না। ওর ব্যাপারটা আমরা রিপোর্ট করব।

না, তোমরা করবে না। কথাটা বলার সময় বুঝতে পারছিলাম, শেষ মুহূর্তে এসে বাগড়া দেওয়ায় ওদের উপরে প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আমার। যদি আগে থেকে একটুও চিন্তা করতাম, তাহলেই বুঝতাম, এরকম একটা কিছু হবেই। কিন্তু এরমাঝেই মনে মনে খুব ভালো ভাবে ঠিক করে নিয়েছিলাম ব্যাপারটা–এই একটাবার ছোটদের কাছ থেকে শুধু বয়সে বড় হওয়ায় কিছু একটা চাইলেই তারা নিয়ে যেতে পারবে না। ভাব দেখে মনে হচ্ছিল যেন বড় হওয়ায় চট করে যে কোনো কিছু চাইলেই পেয়ে যাওয়াটা ওদের অধিকার। তার ওপর, ওরা এসেছিল গাড়িতে চেপে। যতটুকু বুঝি, এই ব্যাপারটা আমাকে আরো বেশি রাগিয়ে দিয়েছিল। আমাদের এত এত কষ্টের পর ওরা আরামে গাড়ি করে এসে আমাদের কষ্টের ফলটুকু নিয়ে যেতে চাচ্ছে।

আমরা চারজন আছি এখানে, আইবল। চেষ্টা করে দেখতে পার কী হয়।

আইবল জবাব দিল, তা আমরা করব, অবশ্যই। চিন্তার কিছু নেই।

এ সময় ওদের পেছনের গাছগুলো নড়ে উঠল। চার্লি হোগান আর ভার্নের বড় ভাই বিলি গাছের আড়াল ছেড়ে বেরিয়ে এসে দাঁড়াল ওদের পেছনে, গাল দিতে দিতে চোখ থেকে পানি মোছার চেষ্টা করছে। আমার কাছে মনে হচ্ছিল, কেউ বুঝি সীসার বল দিয়ে আমার পেটে আঘাত করেছে। পরমুহূর্তেই দলে যোগ দিল জ্যাক মাজেট আর ফাজি ব্র্যাকোভিচ।

আর, আমরা কেবল এই কয়জন? বলতে বলতে হেসে উঠল এইস, কাজেই, তোরা বরং–

ভার্ন! হাত মুঠো পাকিয়ে বিলি টেসিও তীব্র স্বরে ছোট ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, কীটের বাচ্চা কীট! তুই বাসার সামনে লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের কথা শুনেছিস!

ভার্নকে দেখে বোঝা যাচ্ছিল, বেচারা ভয় পাচ্ছে।

বিলির কথার সাথে একমত হলো চার্লি হোগান, গালির তুবড়ি ছুটল মুখে। তারপর বলল, পিটিয়ে তোর পেটের সব গলা দিয়ে বের না করে যদি ছেড়েছি!

তাই? আয় তাহলে, টেডি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। ওর বৃষ্টিভেজা চশমার পেছনে চোখদুটো পাগলের মতো জ্বলজ্বল করছে। আয়, দাদাগিরি ছুটাচ্ছি। লাশের জন্য দরকার হলে যুদ্ধ করব আমরা! আয়!

বিলি আর চার্লির দ্বিতীয় কোনো নিমন্ত্রণের আর দরকার ছিল না। এগিয়ে আসার জন্য পা বাড়াল ওরা, আঁতকে উঠে পিছিয়ে গেল ভার্ন। আমি নিশ্চিত, আগের মার খাওয়ার স্মৃতি আর ভবিষ্যতে কপালে যে আরো দুঃখ আছে, সেসব ভেবেই এমন করেছিল ও। কিন্তু আঁতকে উঠলেও স্থির দাঁড়িয়ে রইল সে। আমার ধারণা, এর পেছনে কয়েকটা জিনিস কাজ করেছে। একে তো সে বন্ধুদের সাথে আছে, তার ওপর, আমরা গাড়ি চেপে এখানে আসিনি। আসার পথে অনেক কিছু পেরিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের।

তবে, কাঁধে হাত দিয়ে ওদেরকে থামাল এইস। শান্ত গলায় বলল, সবাই শোন। কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন কিছুই হয়নি। যেন চারপাশে কোনো ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে না, সবকিছু সম্পূর্ণ শান্ত। তোমাদের চেয়ে আমরা সংখ্যায় বেশি, এবং আমরা বড়। তাই, তোমাদেরকে চলে যাওয়ার আরেকটা শেষ সুযোগ দেব আমরা। যেখানে ইচ্ছে যাও, কিন্তু এখান থেকে চলে যাও। কথা শুনে ক্রিসের ভাই হেসে উঠল, বাহবা দিয়ে এইসের পিঠ চাপড়ে দিল ফাজি।

কারণ, আমরা ওকে নিয়েই যাব। এইস মেরিল শান্তভাবে হাসছে। পুল খেলতে গিয়ে শট নেওয়ার মুহূর্তে উল্টাপাল্টা কথা বলায় উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য এভাবেই হাসতে হাসতে যে কারো মাথায় কিউ, মানে পুল খেলার লাঠি ভাঙতে পারে সে। তোমরা চলে গেলে আমরাও ওকে নিয়ে চলে যাব। আর না গেলে, প্রথমে তোমাদেরকে পিটিয়ে সিধে করতে বাধ্য হব আমরা। তারপর নিয়ে যাব ওকে। কারণ, মাস্তানি করাটাকে ন্যায্য প্রমাণের চেষ্টায় যোগ করল, যত যাই হোক, সবার আগে চার্লি আর বিলিই ওর খোঁজ পেয়েছে। কাজেই, এটা ওদের অধিকার।

ওরা হচ্ছে ভীতুর ডিম! চিৎকার করে উঠল টেডি। ভার্ন ওদের কথা বলেছে আমাদেরকে। কিছু করার আগেই ভয়ে একেকজনের পেচ্ছাব করে দেওয়ার অবস্থা। এটুকু বলেই চার্লি হোগানের গলা নকল করল ও, গাড়ি চুরি করাটা বিশাল ভুল ছিল আমাদের। ব্যাক হারলো রোডে যাওয়াটা আরো বড় ভুল ছিল! কী করব আমরা এখন, বিলি? ইশ, মনে হচ্ছে আমি জুতোর উপরেই বমি করে ফেলব! ওহ বিলি

যথেষ্ট হয়েছে, বলেই চার্লি আবার এগিয়ে আসতে শুরু করল, রাগ আর বিব্রত ভাব ছড়িয়ে পড়েছে মুখে। তোর নাম যাই হোক, নাম না গিলিয়ে ছাড়ব না আমি আজকে। পরেরবার কারো ব্যাপারে নাক গলানোর আগে সেটা বমি করে বের করতে হবে তোকে।

আমি বুনো দৃষ্টিতে রে ব্রাওয়ারের দিকে তাকালাম। শান্ত, একচোখে একইভাবে এই বৃষ্টির মধ্যেও উপরে তাকিয়ে আছে। এখনো বজ্রপাত হচ্ছে, কিন্তু বৃষ্টি হালকা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে।

তোমার কী মনে হয়, গর্ডি? এইস আমাকে জিজ্ঞেস করল। ভয়ংকর কোনো প্রশিক্ষিত কুকুরকে প্রশিক্ষকরা যেভাবে ধরে রাখে, সেভাবে একহাতে আলতো করে চার্লির বাহুতে ধরে রেখেছে।

আশা করি, তোমার ভাইয়ের বুদ্ধি-শুদ্ধির কিছুটা হলেও নিশ্চয়ই তোমার মধ্যে আছে। সবাইকে বলে চলে যেতে। আমি চার্লিকে শুধু চশমাওয়ালাটাকে একটুখানি শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেব, কিন্তু সে আর কাউকে কিছু করবে না। যে যার কাজে চলে যাব তারপর, কী বলে?

এইস মেরিল ভুল করে ফেলেছিল। ড্যানির কথা বলে মোটেও বুদ্ধিমানের কাজ করেনি সে। আমি ওকে বুঝিয়ে বলতে চাচ্ছিলাম সবকিছু। এইস নিজেও ভালো করেই জানত ব্যাপারটা যেহেতু বিলি আর চার্লি সে সময় আগ্রহী ছিল না, এবং ভার্ন ওদেরকে লাশ খোঁজার চেষ্টা করবে না বলতে শুনেছে, কাজেই আমরাই লাশটা প্রথম খুঁজে পেয়েছি। আমি ওকে ব্রিজের ট্রেনের ব্যাপারটাও বলতে চেয়েছিলাম, বলতে চেয়েছিলাম মাইলো প্রেসম্যানের অকুতোভয় কিন্তু বোকা সহযোগী, কিংবদন্তী চপারের কথা। এমনকি জোঁকগুলোর কথাও বলব বলে ভেবেছিলাম। আমার ধারণা, আমি আসলে ওকে এক কথায় বলতে চাচ্ছিলাম, কাম অন, এইস! অন্তত ন্যায্য ভাবে একবার ভেবে দেখ ব্যাপারটা।

কিন্তু আর কাউকে পেল না সে, ড্যানির কথাটাই তুলল। ফলাফল: ন্যায্য আর যৌক্তিক কোনোকিছুর বদলে আমার মুখ থেকে যেটা বেরিয়ে আসতে শুনলাম, নিজেই বুঝতে পারছিলাম, নিজেদের মৃত্যু পরওয়ানা জারি করতে চলেছি আমি।

আমার ইয়ে চোষোগে, যাও! ফালতু কোথাকার!

এইসের মুখ বিস্ময়ে ইংরেজি ও এর মতো পুরো গোল হয়ে গেল। দুই দলের সবাই জলাজমির দুপাশে দাঁড়িয়ে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।

নিরবতা ভাঙল টেডি। খুশির চিৎকার বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে, এক্কেবারে! এভাবেই দেওয়া দরকার ছিল, গর্ডি!

স্থির দাঁড়িয়ে ছিলাম, হজম করতে চেষ্টা করছিলাম, আসলে কী করে বসেছি। পুরো ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে নিজেরই কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল আমি এমন এক অভিনেতা, মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কি না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক দৃশ্যে ভয়াবহ ভুল কিছু শব্দ বলে ফেলেছে। কারো মাকে টেনে গালি দেওয়ার কথা বাদ দিলে, কাউকে বলার জন্য এটাই সবচেয়ে ভয়াবহ কথা। চোখের কোণা দিয়ে খেয়াল করলাম, ক্রিস কাঁধ থেকে নামিয়েছে ব্যাকপ্যাকটা, কী যেন খুঁজছে ভেতরে। কিন্তু তখনো আসলে ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারিনি।

ঠিক আছে তাহলে, শান্ত, কোমল গলায় জবাব দিল এইস, ওদেরকে ধরো। কিন্তু শ্যান্স ছাড়া আর কাউকে কেউ আঘাত করবে না। আমি ওর হাতদুটো ভেঙে গুঁড়োগুড়ো করব।

মড়ার মত জমে গেলাম। কিন্তু ব্রিজে যেভাবে প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছিলাম, তেমন কিছু করিনি। আসলে, ভেতরে সম্ভবত কিছু ছিলই না বেরিয়ে আসার মতো। তবে বুঝতে পারছিলাম, প্রতিটা অক্ষর নিজের সবটা দিয়ে বিশ্বাস করেই বলেছিল এইস। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত অনেক কিছুর ব্যাপারেই আমার ধারণা এবং বিশ্বাস বদলেছে, কিন্তু এই একটা ব্যাপারে আমার ধারণায় কোনো পরিবর্তন আসেনি। এইস যখন বলেছিল, সে আমার হাত দুটো ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো করতে চায়–আসলেই তাই করতে চাচ্ছিল।

ওরা সবাই আমাদের দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। জ্যাকি মাজেট ওর পকেট থেকে একটা সুইচনাইফ বের করে হাতে নিয়ে নিল। সুইচ টিপে দিতেই বেরিয়ে এল ছয় ইঞ্চি ধাতব পাত। বৃষ্টির ফলে আবছায়া বিকেলের আলোয় জিনিসটাকে মনে হলো ধুসর একটা কিছু। ভান আর টেডি যুদ্ধাংদেহী ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে গেল আমার দুপাশে। টেডির মুখে প্রচন্ড কৌতূহল খেলা করছিল। আর ভার্ন মরিয়া হয়ে শেষ দেখতে চাচ্ছিল সবকিছুর।

বড়রা সবাই একসারিতে এগিয়ে আসছিল আমাদের দিকে। জলাভূমিতে আছড়ে পড়ছিল ওদের পা, ঝড়ের কারণে জায়গাটা এখন কাদা কাদা হয়ে গেছে। রে ব্রাওয়ারের লাশটা পানিভর্তি ড্রামের মতো আমাদের পায়ের কাছে পড়েছিল। আমিও মারামারির জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলাম। আর, ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রিস ওর বাবার ডেস্ক থেকে নিয়ে আসা পিস্তলটার সত্যিকার ব্যবহার করল।

কা-বাম!

ঈশ্বর, কী অসম্ভব চমৎকার ছিল শব্দটা! চার্লি হোগান বাতাসের মধ্যেই লাফিয়ে উঠল। এইস মেরিল এতক্ষণ আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল, পাঁই করে ঘুরে ক্রিসের দিকে ফিরে তাকাল সে। ঠোঁট দুটো আবারো বিষ্ময়ে ইংরেজি ও এর মত হয়ে গেছে। আইবলকে হতভম্ব লাগছে।

ক্রিস, এটা তো আব্বুর পিস্তল। সে বলছিল, তোকে এজন্যে যে মারটা দেবে না–

কিন্তু তোমার যা হবে, সে তুলনায় কিছু না সেটা। উত্তর দেওয়ার সময় ক্রিসের পুরো মুখ ফ্যাকাশে প্রাণহীণ হয়ে গিয়েছিল, শুধু চোখ দুটো বাদে। জ্বলজ্বল করছিল ওগুলো।

গর্ডি ঠিকই বলেছে। ফালতু পাড়ার মাস্তান ছাড়া আর কিছু না তোমরা। সবাই খুব ভালো করেই জানো, চার্লি আর বিলি প্রথমে আসতেই চায়নি। ওরা আসতে চাইলে এই পুরো পথটা আমরা অযথা হেঁটে আসতাম না। ওরা শুধু কোনো একজায়গায় গিয়ে পুরো ব্যাপারটা বমি করে উগরে দিয়েছে এইস মেরিলের কাছে। আর, চিন্তার সবটুকুও ওর উপরে ছেড়ে দিয়ে খালাস হয়ে গেছে। গলার স্বর উপরে উঠতে উঠতে চিৎকারে পরিণত হলো, কিন্তু তোমরা ওকে নিয়ে যেতে পারবে না। কানে যাচ্ছে আমার কথা?

শোন, এইস কথা বলে উঠল। নিজের পায়ে গুলি করে বসার আগে পিস্তলটা সরিয়ে রাখলেই মনে হয় ভালো করবে তুমি। কারণ, আমি যেটুকু বুঝি, একটা ইঁদুরকে গুলি করার সাহসও তোমার নেই।

এটুকু বলে আবারো সামনে এগোতে শুরু করল এইস। ঠোঁটে আবারো আগের সেই মৃদু হাসি ফুটে উঠেছে, আমি তোমাকে পিস্তলটা গিলে খাওয়াব, দাঁড়াও।

এইস, তুমি যদি স্থির হয়ে না দাঁড়াও, কসম খোদার, আমি গুলি করব।

সেক্ষেত্রে তোমরা সবগুলো জে-এএএ-লে যাবে, বিদ্রুপের স্বরে পরামর্শ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল এইস, হাসছে। এখনো এগোচ্ছে, একটু ইতস্ততও করছে না। বাকি প্রত্যেকে জায়গায় জমে গেছে, দেখছে, অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। একইভাবে আমি, টেডি আর ভার্নও তাকিয়ে ছিলাম ক্রিসের দিকে। পুরো এলাকায় এইস ছিল সবচেয়ে শক্ত মানুষ। ফাঁপা বুলি আউড়ে ক্রিস ওকে থামাতে পারবে বলে আমার মনে হচ্ছিল না। তাহলে কী দাঁড়াল ব্যাপারটা? একটা বারো বছরের ছেলে ওকে ভুলেও গুলি করবে বলে বিশ্বাস করেনি সে। আমি ভাবছিলাম, এইস ভুল করছে। কেবলই মনে হচ্ছিল, বাবার পিস্তল কেড়ে নেওয়ার আগেই ক্রিস ওকে গুলি করে বসবে। ওই কয়েক সেকেন্ডে আমি মনে মনে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম, খারাপ কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। সবচেয়ে খারাপ যেটা হতে পারে, সেটাই ভাবছিলাম। খুন হয়ে যেতে পারে কেউ। আর এই সব কিছুর কেন্দ্রে আছে একটা লাশ, এবং কে সেটা খুঁজে পেয়েছে বলে আগে রিপোর্ট করবে, তা।

মৃদু হতাশার সুরে কোমল গলায় ক্রিস বলল, কোথায় চাও, এইস? হাতে, নাকি পায়ে? আমি ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। আমার হয়ে তুমিই নাহয় বলো।

এইস থমকে গেল।

অধ্যায় ২৭

ওর মুখ ভয়ে ফ্যাকাশে, সাদা হয়ে গেছে। ক্রিসের কথায় না, আমার ধারণা, বলার ধরন, গলার হতাশার সুর–এসব মিলে ভয় পাইয়ে দিয়েছে। এইসকে। ক্রিস যেন বুঝতে পারছিল, পরিস্থিতি খারাপ থেকে জঘন্য অবস্থায় যেতে চলেছে। যদি ফাঁপা বুলিও হয়, আমার দেখা সবচেয়ে সুচারুভাবে কাজটা করেছে সে। বড়দের বাকিরা সবাই বিশ্বাস করেছে কথাগুলো। চেহারায় ফুটে ওঠা ভয়ের ছাপ দেখে মনে হচ্ছে, কেউ বুঝি ছোট সলতের কোনো বোমায় হঠাৎ করেই আগুন ধরিয়ে দিয়েছে।

এইস ধীরে-সুস্থে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল। মুখের পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেল আবার, ঠোঁট দুটো চেপে বসল দৃঢ় ভাবে। এমনভাবে ক্রিসের দিকে তাকাল যেন এইমাত্র সে প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যবসায়িক প্রস্তাব দিয়েছে। দুটো প্রতিষ্ঠান এক করে ফেলা, কিংবা আপনার প্রতিষ্ঠানের লেনদেনের সবকিছু দেখাশোনা করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেওয়া, কিংবা আপনাকে ধ্বসিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব দিলে আপনি কারো দিকে যে দৃষ্টিতে তাকাবেন, সেরকম। কেমন একটা অপেক্ষা ছিল দৃষ্টিতে, কৌতূহলি একটা কিছু দেখে মনে হবে, হয় ঝামেলা মিটে গেছে, আর নাহয় সেটা তুঙ্গস্পর্শী রুপ নিয়েছে এইমাত্র। গুলি না খাওয়ার সম্ভাবনাটুকু আরেকবার হিসেব করে দেখল এইস। বুঝে গেছে, পরিস্থিতি ঠিক অনুকূলে নেই। কিন্তু এর সাথে সাথে এইস নিজেও আরো বিপদজনক হয়ে উঠেছে। আগুন নিয়ে খেলার এমন স্পর্শকাতর অবস্থা আর কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না। কারণ, ওদের দুজনের কেউই ফাঁপা বুলি আউড়াচ্ছিল না। কাজের কথা বলছিল, বিশ্বাস করছিল প্রতিটা অক্ষর।

ক্রিসের দিকে তাকিয়ে এইস মৃদু গলায় বলল, আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু পরবর্তীতে তোমার কী হবে, সেটা আমি ঠিক করে ফেলেছি।

না, ফেলনি।

কীটের বাচ্চা কীট! আইবল চিৎকার করছে, দেখিস, তোর শেষ ঠিকানা হবে হাসপাতালের বিছানায়।

জাহান্নামে যাও!

প্রচণ্ড রাগে গর্জন করে আইবল যখন সামনে পা বাড়াল, ক্রিস ওর দশফুট সামনের পানিতে পিস্তল তাক করে ট্রিগার টেনে দিল। বুলেট বেরিয়ে আসার শব্দে লাফিয়ে উঠল আইবল, অভিশাপ দিচ্ছে।

আচ্ছা, ঠিক আছে। এইস জিজ্ঞাসা করল, এবার কী করতে হবে?

তোমরা সবাই গাড়িতে উঠে সুবোধ বালকের মতো ক্যাসল রকে ফিরে যাবে। তারপর যা হয় হোক, কিছু যায় আসে না। কিন্তু তোমরা ওকে নিয়ে যেতে পারবে না, এটুকু জানি। এক পায়ে আলতো করে কিছুটা শ্রদ্ধার সাথেই যেন–রে ব্রাওয়ারের দেহ স্পর্শ করল ক্রিস, বোঝা গেছে কথা?

কিন্তু আমরা অবশ্যই তোমাদেরকে ধরব। এইস জবাব দিল। ঠোঁটের কোণে সেই হাসিটা আবারো ফিরে এসেছে। তোমরা জানো না বুঝি সেটা? আমরা ধরে ধরে, দেখে দেখে আঘাত করব তোমাদের প্রত্যেককে। তোমরা এটুকুও জানো না, এটা বিশ্বাস হয় না আমার। হাড়গোড় ভেঙে যত্ন করে তোমাদের সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করে দিয়ে আসব, দেখো!

আহ! তাহলে এখনই বাসায় গিয়ে নিজের মায়ের সাথে একটু ফুর্তি করে নাও না কেন? শুনেছি, তুমি যেভাবে করো, সেটা নাকি ওর বেশ পছন্দ।

হাসিটা জমে গেল এইসের মুখে। তোকে খুন করে ফেলব আমি। আমার মাকে নিয়ে কেউ কোনোদিন কথা বলার সাহস করেনি।

ক্রিস মৃদু গলায় জানানোর ভঙ্গিতে বলল, আমি তো শুনলাম, টাকার জন্যও করে। এইসের মুখ প্রচণ্ড রাগে সাদা হয়ে গেল, কাঁপছে। কিন্তু ক্রিস বলেই যাচ্ছিল, আর, শুনেছি কয়েক পয়সা দিয়ে নাকি মুখেও

ওর কথার পরের অংশটুকু ঝড়ের শব্দে চাপা পড়ে গেল। ঝড়টা আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে এসেছে। শুধু বৃষ্টিই না, সাথে তুষারও ঝরছে আকাশ থেকে। এখন আর ফিসফিস কিংবা বিড়বিড় করছে বলে মনে হচ্ছে না, বরং পুরো বন যেন ড্রাম পেটানোর মতো অলৌকিক কোনো তান্ডব-উৎসবে যোগ দিয়েছে। আসলে, বিশাল তুষারখন্ডগুলো গাছপালার উপরে পড়ার সময় অসম্ভব শব্দ করছিল। পাথর কাঁধে পড়ার ফলে ব্যথা পাচ্ছিলাম। মনে হচ্ছিল, কোনো শয়তান বা দানব বুঝি ইচ্ছে করেই ওভাবে পাথর ছুঁড়ছে। আরো ভয়াবহ ব্যাপার হলো, পাথরগুলো এলোপাথাড়িভাবে রে ব্রাওয়ারের শরীরে পড়ায় বীভৎস শব্দ হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ওগুলো বুঝি ওর শরীরে গেঁথে যাচ্ছে। যেন ভয়াবহ, অফুরন্ত ধৈৰ্য্য নিয়ে পুরো বনের এই তান্ডবলীলায় যোগ দিয়েছে ছেলেটা।

সবার আগে হার মেনে নিল ভার্ন। ভীষণ এক চিৎকার দিয়ে খাড়া ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করে দিল। ভার্নের পরে আরো এক মিনিট সহ্য করার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল টেডি, তারপরেই হাল ছেড়ে দিয়ে দুই হাত মাথার উপরে তুলে দৌড় মারল। ওদিকে ভিন্স দেশার্দে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল, একটু পরেই ওকে অনুসরণ করল ফাজি ব্র্যাকোভিচ। কিন্তু দলের বাকিরা স্থির দাঁড়িয়ে ছিল তখনো। এইস মেরিল ততক্ষণে আবারো হাসতে শুরু করেছে।

আমার সাথে থাক, গর্ডি। কাঁপা-কাঁপা নিচু গলায় বিড় বিড় করল ক্রিস, প্লিজ, আমার সাথে থাক।

আমি আছি।

এখন যাও এখান থেকে, এবারে এইসের দিকে ফিরল ক্রিস, কেমন করে যেন গলা থেকে কম্পনটুকু সরিয়ে ফেলেছে। কথা শুনে মনে হচ্ছিল, কোনো বোকাসোকা বাচ্চাকে বুঝি নির্দেশ দিচ্ছে।

জবাবে এইস বলল, আমরা ধরব তোমাকে। আজকের এই কথাগুলো আমরা ভুলব না। মনে থাকবে আমাদের। বিশাল ঝামেলা পাকিয়ে ফেলেছ তুমি, মনে রেখ।

থাকুক। পরে কখনো হবে নিশ্চয়ই, কিন্তু আজকে না।

তোমাকে অ্যাম্বুশ করব আমি, চেম্বার্স। আমরা

যাও এখান থেকে! হঠাৎ করে কথার মাঝেই ভয়ংকরভাবে চেঁচিয়ে উঠল ক্রিস। শুনে কয়েক পা পিছিয়ে গেল এইস।

প্রচন্ড আক্রোশ নিয়ে এক মুহূর্ত ক্রিসের দিকে তাকিয়ে থাকার পর মাথা ঝাঁকিয়ে নড় করল, তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বলল, চল। ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো তাকাল আমাদের দিকে। ভালো করে ক্রিস আর আমাকে দেখে নিয়ে স্পষ্ট গলায় বলল, আবার দেখা হবে।

জলা জায়গা আর রাস্তাটার মাঝখান দিয়ে গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল ওরা। ক্রিস আর আমি নিশ্চুপ, স্থির দাঁড়িয়ে রইলাম। তখনো বরফের বড় বড় টুকরো ছুটে এসে আঘাত করছে আমাদের গায়ে, জায়গায় জায়গায় ত্বক লাল হয়ে গেছে। এর মাঝেই স্থির দাঁড়িয়ে কান পেতে ছিলাম। তারপর শুনতে পেলাম শব্দটা, দুটো গাড়ির ইঞ্জিন চালু হয়েছে।

এখানেই দাঁড়া, বলে শব্দের দিকে এগিয়ে গেল ক্রিস, নিশ্চিত হতে চাচ্ছে ওরা আসলেই গেছে কি না।

ভীত গলায় ডাক দিলাম, ক্রিস!

একটু দাঁড়া, ভাই। আমাকে নিশ্চিত হতে হবে।

অনেকক্ষণ পেরিয়ে যাওয়ার পর আমার মনে হচ্ছিল, এইস আর আইবল নিশচয়ই গাছের আড়ালে ফাঁদ পেতে লুকিয়ে ছিল। ধরে ফেলেছে। ওকে। একাকী দাঁড়িয়ে রইলাম। সঙ্গী বলতে এক রে ব্রাওয়ার, কিংবা ওর লাশ। আকুল হয়ে অপেক্ষা করছি, কেউ একজন অন্তত আসুক। যে কেউ। শেষ পর্যন্ত ক্রিসকে দেখা গেল, ফিরে আসছে।

আমরা পেরেছি রে! ওরা চলে গেছে।

তুই নিশ্চিত?

হ্যাঁ। গাড়ি দুটো গেছে, আমি নিশ্চিত। মাথার উপরে দুহাত তুলল সে, পিস্তল দেখা যাচ্ছে। বিজয়ীর মতো দুই হাত ঝাঁকিয়ে আনন্দ প্রকাশ করল, তারপর হাত নামিয়ে নিতে নিতে হাসল আমার দিকে চেয়ে। এক জীবনে আমার দেখা সবচেয়ে কষ্টের, সবচেয়ে ভয়ের হাসি ছিল সেটা। নিরবতা ভাঙার জন্য বলল, আমার ইয়ে চোষোগে, না? তোর যে ইয়ে আছে, সেটা তোকে কে বলল রে, শ্যান্স?

আশেপাশের চার কাউন্টির সবচেয়ে বড়! মজা করলেও তখনো আমার সারা গা কাঁপছে।

এক মুহূর্তের জন্য পরম স্বস্তি নিয়ে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। মুহূর্তখানেক পরে চোখ নামিয়ে নিলাম দুজনেই। একটা শীতল ভয় আর রোমাঞ্চের ঢেউ নেমে গেল আমার মেরুদন্ড বেয়ে। ক্রিসের অস্বস্তি ভরে পা নাড়ানোর শব্দ কানে যেতে বুঝলাম, একই অনুভূতি হচ্ছে। রে ব্রাওয়ারের চোখগুলো কেমন ভয়াবহরকম বিশাল আর ফ্যাকাশে সাদা হয়ে গেছে। দেখে মনে হচ্ছে, শূন্য দৃষ্টিতে দেখছে কিছু একটা। এক মুহূর্ত পর বুঝতে পারলাম, আসলে কী হয়েছে। কিন্তু সেটা আমার ভেতরের আদিম আতঙ্কটুকু একটুও কমাতে পারেনি। আসলে ওর চোখ দুটো গোল গোল তুষারখন্ডে ঢাকা পড়ে গেছে। আর এখন, ওগুলো গলে গাল বেয়ে এমনভাবে পানি গড়াচ্ছে যে, দেখে মনে হয়, ছেলেটা কাঁদছে। নিজের অসহায় অবস্থা, দুই দল গাধার মধ্যেকার মারামারির পুরষ্কার হয়ে নিঃসাড় পড়ে থাকা যেন মেনে নিতে পারছে না। গায়ের কাপড়গুলোও তুষার পড়ে সাদা হয়ে গেছে। যেন, কাফনের চাদর গায়ে দিয়ে পড়ে আছে, নিঃস্ব।

ক্রিসের গলা অসহায় শোনাল, ওহ, গর্ডি! কী ভয়াবহ জিনিস দেখতে হলো ছেলেটাকে!

আমার মনে হয় না, সে বুঝতে–

হয়তো সেদিন ওর প্রেতাত্মার চিৎকারই শুনেছিলাম আমরা। হয়তো সে জানত, এমন কিছুই হবে। কী নির্মম জিনিস যে দেখতে হলে ওকে! আমি আসলেই মানতে পারছি না রে।

পেছনে ডাল ভাঙার শব্দ শুনে চরকির মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম, মাথার মাঝে নিশ্চিত একটা ভাবনা উঁকি দিয়ে গেছে। কিন্তু ক্রিস একপলক তাকিয়েই আবার লাশের দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। ঘুরে দেখি, ভার্ন আর টেডি। জিন্স ভিজে কালো হয়ে পায়ের সাথে লেগে গেছে। দুজনেই কেমন কুকুরের মত হাসছে।

আমরা এখন কী করব রে? ক্রিস নিচের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে প্রশ্নটা করল যে, আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, আমার সাথে কথা বলছে, নাকি লাশটার সাথে। শীতল একটা অনুভূতি বয়ে গেল আমার মধ্যে দিয়ে।

আমরা ওকে নিয়ে যাব, তাই না? নাকি? টেডির গলা শুনে বোঝা গেল ক্রিসের কথা শুনে দ্বিধান্বিত হয়ে গেছে। আমরা সবার হিরো হয়ে যাব, তাই না? ক্রিসের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার আমাকে দেখে নিল সে, তারপর আবারো ক্রিসের দিকে তাকাল।

ক্রিস এমনভাবে চোখ তুলে চাইল যেন এইমাত্র ঘুম ভেঙে জেগে উঠেছে। ঠোঁট শক্ত হয়ে চেপে বসল, বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে গেল টেডির দিকে। ওর বুকে এত জোরে ধাক্কা মারল যে, ঝপাস শব্দ করে কাদা মাটিতেই পড়ে গেল বেচারা। কিছু বুঝতে না পেরে চোখ পিটপিট করছে। ভার্ন উদ্বিগ্ন দৃষ্টিতে তাকাল, যেন ভাবছে, পাগল-টাগল হয়ে গেল না তো ক্রিস।

চিৎকার করে উঠল ক্রিস, তুই একদম চুপ করে থাকবি! আর্মি-আর্মি করে এত কথা বলে দরকারের সময় তো লেজ তুলে পালালি, মুরগির বাচ্চা কোথাকার!

আমি ওদেরকে দেখে মোটেও ভয় পাইনি, ক্রিস! কিন্তু তুষারের গোলা দেখে– রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায় গলা ভেঙে এল, কান্নার মতো শোনাচ্ছে, আমি ঝড় ভয় পাই, ক্রিস। কী করব বল, এটা তো আমার হাতে নেই। ওদের সাথে মারামারি করতে কোনো সমস্যা ছিল না আমার আসলেই। আম্মুর কসম! কিন্তু ঝড় আমি খুব ভয় পাই রে! সহ্য করতে পারি না। কাদাপানিতে বসে সত্যি সত্যি কাঁদতে শুরু করেছে টেডি!

ভার্নের দিকে ফিরল ক্রিস, তোর কী হয়েছিল? নাকি তুইও ঝড় ভয় পাস?

ভার্ন মাথা ঝাঁকাল, ক্রিসের রাগ দেখে অবাক হয়ে গেছে, বোঝা যাচ্ছে। না, আমি আসলে ভেবেছিলাম, আমরা সবাই চলে যাচ্ছি।

তাহলে তুই নিশ্চয়ই মনের কথা পড়তে পারিস। কারণ, তুই তো সবার আগেই পালিয়েছিস! তুই কীভাবে জানলি, আমরা সবাই তোর মতো পালাব?

ভার্ন অস্বস্তিতে দুইবার ঢোঁক গিলল। মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বেরুচ্ছে না।

কিছুক্ষণ ভার্নের দিকে উন্মত্ত চোখে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে ফিরল ক্রিস, আমরা ডালপালা দিয়ে একটা স্ট্রেচার বানিয়ে ওকে বয়ে নিয়ে যাব, গর্ডি।

তোর যদি তাই মনে হয়, তাহলে তাই।

অবশ্যই! স্কাউটরা যেমন করে। ওর গলার স্বর উঁচুগ্রামে চড়ছিল, কেমন যেন অদ্ভুত শোনাচ্ছে, শালার স্কাউটদের মতে, বুঝলি? স্ট্রেচারে করে, ডালপালা দিয়ে বইয়ের মধ্যে যেমন হয়, ঠিক আছে?

ঠিক আছে। তুই যদি তাই চাস, তাহলে তাই। কিন্তু ওরা যদি_ _

ওরা যা ইচ্ছে করুক, কিছু যায় আসে না আমার। চিৎকার করতে শুরু করল ক্রিস, তোরা সবগুলো একেকটা মুরগির বাচ্চা ছাড়া আর কিছু না! জাহান্নামে যা, বুঝলি?

ক্রিস, ওরা প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য শেরিফকেও কল করতে পারে।

লাশটা আমরা পেয়েছি এবং আমরাই নিয়ে যাব! আর কিছু শুনতে চাই না আমি।

কিন্তু ওরা আমাদেরকে বিপদে ফেলার জন্য যা যা বলা দরকার, তাই বলবে। বললেও গলায় জোর পাচ্ছি না। তবু আরেকবার চেষ্টা করলাম, যা ইচ্ছে বলবে, দরকারে মিথ্যে বানাবে। তুই তো অন্তত জানিস, মিথ্যা বলে মানুষ কীভাবে ঝামেলা করতে পারে। দুধের সেই টাকাটা

আমার কিছু যায় আসে না!

পাগলের মতো চিৎকার করতে করতে আমার দিকে ছুটে এল ক্রিস। কিন্তু ওর এক পা রে ব্রাওয়ারের শরীরে বেঁধে গেলে, মাটিতে পড়ে গেল সে। আমি ওর উঠে দাঁড়ানোর অপেক্ষা করছিলাম, লাগলে আমার মুখে ঘুসি মারুক এসে, তাও উঠে দাঁড়াক। কিন্তু সে পড়ে রইল সেভাবেই। ঢালের দিকে মাথা, হাত দুটো মাথার উপরে ডাইভ দেওয়ার ভঙ্গিতে পড়ে আছে। যেভাবে রে ব্রাওয়ার পড়েছিল, ঠিক সেভাবে। আমি ক্ষ্যাপাটে চোখে ক্রিসের পায়ের দিকে তাকালাম নিশ্চিত হওয়ার জন্য যে, জুতোগুলো এখনো ওর পায়ে আছে কি না। সেই মুহূর্তে ক্রিস চিৎকার করে কেঁদে উঠল। কান্নার তালে তালে হাত-পা ছুঁড়ে কাদায় আঘাত করছে। টেডি আর ভার্ন অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ, আজ পর্যন্ত কেউ কখনো ক্রিস চেম্বার্সকে কাঁদতে দেখেনি। এক থেকে দুই মুহূর্ত পর, আমি চুপচাপ ঢালের দিকে পা বাড়ালাম। ঢাল ধরে উঠে রেললাইনের একটা পাতের উপরে বসে পড়লাম আস্তে করে। টেডি আর ভার্নও এল আমার পিছু পিছু। ওখানে, ওই বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে আমরা বসে রইলাম, নিশ্চুপ।

অধ্যায় ২৮

প্রায় বিশ মিনিট পর ক্রিস ঢাল ধরে উঠে এসে আমাদের পাশে বসল। ততক্ষণে আকাশে মেঘের ভেলায় ফাটল দেখা দিতে শুরু করেছে। ওর মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে সূর্যের হাসি। শেষ পঁয়তাল্লিশ মিনিটে ঝোঁপঝাড়গুলো আরো তিনগুন গাঢ় সবুজ হয়ে উঠেছে। এদিকে ক্রিসের মাথা থেকে পা পর্যন্ত সবটা কাদায় ছেয়ে গেছে। চুলে কাদা লেগে স্পাইক হয়ে গেছে নিজে-নিজেই। পুরো শরীরের একমাত্র পরিস্কার অংশটা হচ্ছে চোখের সাদা অংশটুকু।

তুই ঠিকই বলেছিস, গর্ডি, ক্রিস বলল, ও কারো দখলের মধ্যে থাকার জিনিস না আসলে। আমি মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম। পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেল, চুপচাপ। কারো মুখে কোনো কথা নেই। এ সময় একটা চিন্তা খেলে গেল মাথায়, ওরা যদি আসলেই পুলিশকে বলে দিয়ে থাকে? ক্রিস যেখানে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল, ঢাল বেয়ে ওখানে নেমে গেলাম। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে ঘাস আর জমে যাওয়া জলের মাঝে আঙুল ঢুকিয়ে খুঁজতে শুরু করলাম।

নেমে আসতে আসতে টেডি প্রশ্ন করল, কী করছিস তুই?

তোর বামদিকে দেখ, বলতে বলতে ক্রিস আঙুল তুলে দেখাল।

খুঁজতে গিয়ে মিনিট দুয়েক না পেরোতেই পেয়ে গেলাম কার্তুজ দুটো। সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। ক্রিসকে দিতেই মাথা ঝাঁকিয়ে পকেটে চালান করে দিল ওগুলো।

তাহলে, চল, যাই।

ক্রিসের কথা শুনে কান্না কান্না গলায় টেডি বলল, না! আমি ওকে নিয়ে যেতে চাই সাথে করে!

গাধার বাচ্চা, ভালো করে শোন। ওকে নিয়ে গেলে আমরা আসলেই বিপদে পড়তে পারি। সংশোধনাগারেও যেতে হতে পারে। গর্ডি ঠিকই বলেছে। ওরা পুলিশকে ইচ্ছেমতো কিছু বানিয়ে বলতেই পারে। হয়তো বলবে, আমরাই ওকে খুন করেছি। তখন? তখন কেমন লাগবে তোর?

কিছু যায় আসে না, টেডি গোঁয়ারের মত বলল। অর্থহীন আশায় বুক বেঁধে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাছাড়া, পাঠালেও কতদিনের জন্যই আর পাঠাবে? সর্বোচ্চ কয়েক মাস? আর, আমাদের বয়স কেবল বারো। ওরা যে আমাদেরকে শশাঙ্ক-এ পাঠাবে না, তা তো নিশ্চিত।

কোমল গলায় ক্রিস জবাব দিল, এরকম রেকর্ড থাকলে তুই সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে পারবি না, টেডি।

আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে, এটা একেবারেই ফালতু কথা। কিন্তু এখন ওসব বলার সময় না। টেডি বেশ কিছুক্ষণ স্থির চোখে ক্রিসের দিকে তাকিয়ে রইল, ঠোঁট কাঁপছে। শেষ পর্যন্ত কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, আসলেই?

গর্ডিকে জিজ্ঞাসা কর।

অসম্ভব আশা নিয়ে আমার দিকে তাকাল টেডি। বললাম, ক্রিস ঠিকই বলেছে রে। নিজেকে ভয়াবহ এক প্রতারক মনে হচ্ছিল। তুই যখন যোগ দিতে যাবি, সবার আগে তোর রেকর্ড চেক করবে ওরা।

আহহা!

আমরা যত দ্রুত সম্ভব, হেঁটে ব্রিজে গিয়ে উঠব। তারপর রেললাইন ছেড়ে অন্য কোনো দিক দিয়ে ঘুরে গিয়ে ঢুকব ক্যাসল রকে। মানুষজন জিজ্ঞাসা করলে বলব, আমরা ব্রিকইয়ার্ড হিলে ক্যাম্প করতে গিয়ে রাস্তা হারিয়ে ফেলেছিলাম।

মাইলো প্রেসম্যান কিন্তু জানে। ফ্লোরিডা মার্কেটের সেই শয়তানটাও জানে। মনে করিয়ে দিলাম।

আমরা বলব, মাইলো আমাদেরকে ভয় পাইয়ে দেওয়ার কারণেই আমরা ব্রিকইয়ার্ডে ক্যাম্প করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।

মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিলাম, মোটামুটি ঠিকই আছে বলতে হবে। যদি টেডি আর ভার্ন মুখ ফসকে কাউকে কিছু বলে না বসে আরকি। আর, আমাদের বাবা-মায়েদের মধ্যে যদি কথাবার্তা হয়ে থাকে? ভার্ন জিজ্ঞাসা করল।

ক্রিস জবাবে বলল, তুই চাইলে ভেবে মরগে। আমার বাবা এখনো মাতাল হয়ে পড়ে আছে, আমি নিশ্চিত।

চল তাহলে, আমাদের আর ব্যাক হারলো রোডের মধ্যেকার গাছগুলোকে চোখের ইশারায় দেখাল ভার্ন। দেখে মনে হচ্ছে, সাথে করে ব্লাডহাউন্ড নিয়ে পুলিশ চলে আসতে পারে–এমন কিছু ভাবছে। আমরা সবাই এরই মাঝে উঠে দাঁড়িয়েছি, ফিরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। পাখিদের দল পাগলের মতো গান গাইছে, বৃষ্টির জন্য আনন্দ প্রকাশ করছে। সূর্য আত্মপ্তকাশ করেছে, সেই সাথে মাটির উপরে বেরিয়ে এসেছে পোকামাকড়ের দল। আমরা সবাই একসাথে রে ব্রাওয়ারের দিকে ফিরে তাকালাম, যেন অদৃশ্য কোনো সুতোয় টান খেয়েছি।

ছেলেটা শুয়ে আছে, একা। আমরা ওকে ঘুরিয়ে শুইয়েছি। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে, কেউ বুঝি শুয়ে শুয়ে সূর্যের তাপ উপভোগ করছে। তারপরই আপনার চোখে পড়বে রক্ত, গালের নিচে, নাকের নিচে, গলায়। চোখে পড়বে ওর লাশ ফুলে উঠেছে। সূর্যের সাথে সাথে মাছিদের দলও ফিরে এসেছে, ইচ্ছেমতো ওর শরীরের যেখানে সেখানে গিয়ে বসছে। আপনার মনে পড়ে যাবে ভেসে বেড়ানো গন্ধটার কথা। বুঝতে পারবেন, আমাদেরই বয়সি কিশোর সে, মারা গেছে। এর কোনো কিছু যে আদৌ প্রাকৃতিক হতে পারে, সেটাই মেনে নিতে পারছিলাম না আমি। প্রচণ্ড ভয়ের সাথে বুকের ভেতর থেকে অস্বীকার করতে চাচ্ছিলাম ব্যাপারটাকে।

আচ্ছা, ক্রিসের গলা শোনা গেল, চল, যাওয়া যাক। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলার চেষ্টা করেও লাভ হলো না। শুনে মনে হচ্ছিল, নষ্ট শলার ঝাড় থেকে বুঝি শলা খুলে পড়ছে। চল, চল, দ্বিগুণ বেগে পা চালাতে হবে।

যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিক দিয়েই ফিরতি পথ ধরলাম। কারো মুখে কোনো কথা নেই। বাকিদের ব্যাপারে জানি না, আমি নিজে চিন্তার ভেতরে এত বিভোর ছিলাম যে, কথা বলার মতো অবস্থাই ছিল না আমার। রে ব্রাওয়ারের লাশের ব্যাপারে কিছু জিনিস আমাকে খুব খোঁচাচ্ছিল আজো বিষয়গুলো আমাকে যন্ত্রণা দেয়। একটা কাটা দাগ পড়ে গেছে গালে। খুলিতে আঘাতের চিহ্ন পড়েছে, আর রক্তাক্ত নাক।

এছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিল না। বারে মদ খেয়ে মারামারি করে লোকজন এরচেয়ে খারাপ অবস্থায় বেরিয়ে আসে। তারপর সোজা অন্য কোথাও গিয়ে আবার বোতলে চুমুক দেয়। কিন্তু ট্রেন নিশ্চয়ই ওকে আঘাত করেছিল, নাহয় অযথা সে পায়ের জুতোগুলো থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে কেন? কিন্তু তাহলে ট্রেনের ইঞ্জিনিয়ারদের কেউ দেখেনি কেন ওকে? ট্রেন কি ওকে এমনভাবে আঘাত করেছিল, যাতে সে খাড়া ঢাল থেকে ছিটকে পড়েছে, কিন্তু মারা যায়নি? মানে, আঘাতটা হয়তো মারা যাওয়ার মতো গুরুতর ছিল না। বেশ কিছু ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটলে এমনটা হতে পারে। যদি এবং কেবল যদি ও ট্রেনটার সামনে থেকে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকে, তাহলে। সেক্ষেত্রে ট্রেনের ধাক্কায় উড়ে এসে পড়েছে সে। হয়তো কাদার ভেতরে শুয়ে ছিল, সজাগ; প্রচন্ড ভয়ে বিবশ, নড়াচড়া করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। অন্ধকারে ঘন্টার পর ঘন্টা, নিঃসঙ্গ। প্রচণ্ড যন্ত্রণা, আর অজানা ভয়–কোথায় আছে, তাও তো জানা ছিল না ওর। একবার একটা আহত পাখি ধরে ছিলাম আমি। পাখিটা ভয়ের চোটে আমার হাতের মধ্যেই মরে গিয়েছিল। রে ব্রাওয়ারও হয়তো সেভাবেই মারা গেছে। প্রচন্ড ভয়, বেঁচে থাকার ভয়েই হয়তো মারা গিয়েছিল বেচারা।

আরেকটা ব্যাপার ছিল, যেটা সবচেয়ে বেশি খোঁচাচ্ছিল আমাকে। বুনো ফল কুড়িয়ে নেওয়ার জন্য এসেছিল সে। মনে আছে, সব খবরে এসেছিল কথাটা: ফল নেওয়ার জন্য আসার সময় একটা বালতি এনেছিল সাথে করে। ক্যাসল রকে ফিরে এসে লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম পত্রিকা চেক করে দেখার জন্য। হ্যাঁ, ফল নেওয়ার জন্য বালতি ছিল ওর সাথে। ওর সাথে জুতোগুলোও পেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু সেই বালতিটা পাইনি। কোথায় ছিল সেটা? রে ব্রাওয়ার নিশ্চয়ই চেম্বারলেইন আর এই জলা জায়গাটার মাঝের কোথাও মরার আগে আগে বালতিটা ছুঁড়ে দিয়েছিল। হয়তো প্রথমে আরো জোরে চেপে ধরতে চেয়েছিল সেটা। বাড়ির সাথে সম্পর্কের একটা চিহ্ন ছিল জিনিসটা। নিরাপত্তার চিহ্ন ছিল। কিন্তু ভয় বাড়ার সাথে সাথে একা হয়ে যাওয়ার ভয়ংকর অনুভূতিটা যখন চেপে ধরেছিল ওকে, উদ্ধার পাওয়ার সব আশা যখন শেষ হয়ে গিয়েছিল; তখন প্রচন্ড ভয়ে দিশেহারা অবস্থায় এমন একটা নিতান্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস বয়ে বেড়ানোর আর কোনো প্রয়োজন নেই ভেবে সে নিশ্চয়ই ফেলে দিয়েছিল বালতিটা। হয়তো খেয়ালই করেনি, কখন পড়ে গেছে।

আমি অনেকবার ফিরে গিয়ে বালতিটা খুঁজে দেখার কথা ভেবেছি। কী ভয়াবহ মানসিক অবস্থায় ভুগছিলাম, সেটা হয়তো কিছুটা বোঝা যাচ্ছে এ থেকে। অনেকবার ভেবেছি, পুরনো এই স্বপ্নটাকে তাড়া করে দরকার হলে আমার প্রায় নতুন ফোর্ড গাড়িটায় চেপে ব্যাক হারলো রোডের শেষ অবধি যাব। একা। আমার স্ত্রী-সন্তানরা থাকবে অনেক দূরের অন্য কোনো জগতে। যেখানে সুইচ টিপে দিলে অন্ধকারের বুকে বাতি জ্বলে ওঠে। ব্যাপারটা কেমন হবে, সেটা নিয়ে অনেক ভেবেছি আমি। ব্যাকপ্যাকটা গাড়ি থেকে বের করে কাঁধে ঝুলিয়ে নেব, শার্ট খুলে বেঁধে নেব কোমরে। পোকামাকড়ের কামড় থেকে বাঁচার জন্য বুকে-ঘাড়ে বিশেষ ধরনের তেল মেখে নেব। তারপর পা বাড়াব সেই জলা জায়গাটার খোঁজে। জায়গাটা খুঁজে পাওয়ার পর দেখব, ওখানকার ঘাস একটা মানুষের আকৃতি নিয়ে হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে কি না। আসলে, ওখানে এখন আর এসবের কোনো চিহ্নও থাকবে না। তারপরও, খুব মনে হয় কথাটা। বুঝতে পারি, বয়স হয়ে যাওয়া লেখকের মুখোেশ পরা এই মানুষটার সাথে বাচ্চাকালের। সেই গর্ডনের খুব বেশি পার্থক্য নেই। তারপর উঠে যাব খাড়া ঢাল বেয়ে। যেখানে এখন পড়ে আছে একটা বিবর্ণ রেললাইন, আর কিছু পঁচা কাঠের টুকরো। সেটা ধরে ধীরে ধীরে হেঁটে যাব চেম্বারলেইন পর্যন্ত।

চৌদ্দ বছরের পুরনো ব্লুবেরি ঝোঁপের খোঁজে অর্থহীন অভিযাত্রা। বোকামোর একশেষ আরকি। ঝোঁপটা নিশ্চয়ই বুলডোজারের চাপে মিশে গেছে মাটির গভীরে। এখন হয়তো সেখানে তৈরি হয়েছে হাফ-একরের কোনো বাড়ি। হয়ে গেছে বা করা হবে। কিংবা গাছপালা-ঝোঁপঝাড় বেড়ে উঠে ঢেকে ফেলেছে সেখানকার সবকিছু। তারপরও, আমার কেন যেন খুব নিশ্চিতভাবে মনে হয়, রেললাইনের পাশে কোনো এক জায়গায় পড়ে থাকা বালতিটাকে খুঁজে পাব আমি। মাঝে মাঝে ওখানে গিয়ে খুঁজে দেখার এই চিন্তাটা একেবারে উন্মত্ত হয়ে ওঠে। মূলত সকালের দিকে আসে ভাবনাটা। যখন আমার স্ত্রী গোসলে আর বাচ্চা-কাচ্চারা চ্যানেল ৩৮-এ ব্যাটম্যান কিংবা স্কুবি-ডু দেখায় ব্যস্ত থাকে, ঠিক সে সময় যৌবনে পা দেওয়ার আগের সেই গর্ডন লুশ্যান্স সবচেয়ে তীব্রভাবে জেগে উঠতে চায়। এক সময় যে আনমনে হেঁটে বেড়াত পৃথিবীর বুকে। হাঁটত, কথা বলত কিংবা মাঝে সাঝে সাপের মতো পেটে ভর দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়াত। মনে হয়, সেই ছেলেটাই বুঝি আমি। ঠিক পরের ভাবনাটাই শীতল জলের মতো আছড়ে পড়ে: কোন ছেলেটার কথা বলছ তুমি?

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে দেখি, পাকঘরের জানালা দিয়ে সূর্যের আলো ভেতরে ঢুকছে। ঘরের এক মাথা থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে, আরেক পাশ থেকে ভেসে আসছে গোসলের আওয়াজ। এসব শুনতে শুনতেই চোখের পেছনে, রক্তের মাঝে স্পন্দন অনুভব করি। বুঝতে পারি, গতকাল রাতে বিয়ারটা একটু বেশিই গেলা হয়ে গেছে। এর মধ্যেই কেমন একটা নিশ্চিত অনুভব আচ্ছন্ন করে ফেলে আমাকে। মনে হয়, আমি চাইলে ওটা খুঁজে পাব। মরিচার মাঝ দিয়ে উঁকি দেওয়া পরিস্কার ধাতুতে প্রতিফলিত হয়ে আমার চোখে এসে পড়বে উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি। জানান দেবে ওটার অস্তিত্ব। ঢাল ধরে নেমে যাব আমি। যেসব ঘাস ওটার চারপাশে এবং হাতলের মাঝে পেঁচিয়ে বেড়ে উঠেছে, ওগুলোকে সরিয়ে দেব হাত দিয়ে। তারপর…আর কী? সময়ের বুক থেকে একটানে তুলে নেব ওটাকে। বারবার উল্টেপাল্টে দেখব, অনুভব করব; শেষ যে মানুষটা এটাকে স্পর্শ করেছে, সেই মানুষটা এখন কবরে শুয়ে আছে ভেবে অবাক হব। হয়তো এর ভেতরে কোনো নোট লেখা থাকবে, কে জানে? হারিয়ে গেছি, আমাকে সাহায্য করো। আসলে থাকবে না ব্লুবেরি খোঁজার জন্য বনে ঢোকার সময় কেউ কাগজ-পেন্সিল নিয়ে ঢোকে না। কিন্তু ধরে নেই, যদি থাকে? যে প্রবল বিস্ময় এবং আতঙ্ক আমি অনুভব করব, সেটা সম্ভবত সূর্যগ্রহণের মতোই অন্ধকারচ্ছন্ন হবে। এই সবকিছুর মূলে আছে কেবল বালতিটা দুই হাতে ধরে রাখার ধারণাটা–ওর মৃত্যু আর আমার বেঁচে থাকার একটা চিহ্ন; আমি যে জানি, কোন ছেলেটা, তার একটা প্রমাণ–আমাদের পাঁচ জনের মাঝের কে সেটা, তার চিহ্ন। ওটা হাতে ধরে, এতগুলো বছর ধরে জমা মরিচার প্রতিটা স্তর পড়ে দেখতে চাই আমি। বালতিটার উজ্জ্বলতা কমে আসার প্রতিটা মুহূর্ত ফিরে দেখব, অনুভবের চেষ্টা করব। যত সূর্যালোক, বৃষ্টি এবং তুষারের আবরণ এতে পড়েছে, তাদের বুঝতে চেষ্টা করব। আর ভেবে দেখব, যে মুহূর্তগুলোতে এটা একাকী পড়ে ছিল, সেই মুহূর্তগুলোতে আমি কী করছিলাম, কোথায় ছিলাম। কার সাথে প্রেম করছিলাম, কাকে আদর করছিলাম, কীভাবে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলাম সময়ের সাথে সাথে। আমি ওটাকে ধরে রাখতাম, পড়ে দেখতাম, অনুভব করতাম…এবং বাকি রয়ে যাওয়া স্মৃতির আয়নার চোখ রেখে নিজেকে দেখার চেষ্টা করতাম, যতটা সম্ভব। কথাগুলো কি আদৌ বোঝা যায়?

অধ্যায় ২৯

ক্যাসল রকে পৌঁছুতে পৌঁছুতে রবিবার ভোর হয়ে গেল। শ্রমিক দিবসের আগের দিন। পাঁচটা বেজে ঘড়ির কাঁটা আরেকটু সামনে এগিয়ে গেছে। সারারাত ধরে হেঁটেছি। হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা হয়ে গেছে। সবাই প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়লেও কেউই কোনো ধরনের অভিযোগ জানায়নি। ব্যথায় আমার মাথা ঝাঁ ঝাঁ করছে। শ্রান্ত পা দুটো যেন পুড়ে যাচ্ছে, বাঁকা হয়ে যেতে চাইছে–এমন অবস্থা। আসার সময় রেললাইনটা নিরাপদেই পেরিয়ে এসেছি আমরা। এরমাঝে, ট্রেনের হাত থেকে বাঁচার জন্য দুইবার ঢাল ধরে নেমে যেতে হয়েছিল। একটা ট্রেন আমাদের গন্তব্যের দিকেই যাচ্ছিল। কিন্তু এত জোরে ছুটছিল যে, ওঠার কোনো উপায় ছিল না। ক্যাসল রকের কাছের ব্রিজটায় যতক্ষণে এসে পৌঁছেছি, তখনই আসলে ভোরের আলো উঁকি দিতে শুরু করেছিল। ক্রিস একবার ওটার দিকে তাকাল, একবার নদীর দিকে; তারপর আমাদের দিকে ফিরে বলল, যা হয় হোক, আমি হেঁটেই পার হব। যাওয়ার সময় ট্রেন ধাক্কা দিলে তো হলোই, জীবনভর এইস মেরিলের দিকে এক চোখ রেখে আর চলতে হবে না।

আমরা সবাই ওটা ধরে পা বাড়ালাম–ঠিক করে বললে বলতে হবে, জোর করে টেনে যাচ্ছিলাম। ব্রিজে থাকা অবস্থায় আর কোনো ট্রেন আসেনাি। ডাম্পে এসে বেড়া টপকে সোজা পাম্পের পথ ধরলাম। (মাইলো প্রেসম্যান বা চপার ছিল না। একে তো সাত সকাল, তার ওপর রবিবার এ সময় ওদের থাকার কথাও না আসলে।) ভার্ন কল চেপে গেল, আর একে একে আমরা সবাই শীতল পানির মাঝে মাথা গুঁজে দিলাম, একই সাথে শরীরের বিভিন্ন জায়গা ভেঁজা হাতে মুছে দিচ্ছি। যদুর সম্ভব পানি গিলে নিলাম সবাই। তারপর, ঠান্ডার জন্য শার্ট গায়ে দিতে একরকম বাধ্যই হলাম। ওভাবেই শেষ পর্যন্ত পা রেখেছিলাম শহরের বুকে। আমাদের ট্রি হাউজটার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ ওটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, যেন একে অন্যের দিকে তাকাতে না হয়।

শেষ পর্যন্ত টেডি বলল, বুধবার স্কুলে দেখা হবে তাহলে। মাঝের পুরো সময়টা এক ঘুমেই কাটিয়ে দেব, মনে হয়।

একমত হলো ভার্ন, আমিও। বের হওয়ার মতো একবিন্দু শক্তিও আর অবশিষ্ট নেই।

দাঁতের ফাঁক দিয়ে বেসুরো শিষ বাজাচ্ছিল ক্রিস, কিছু বলছে না।

অস্বস্তির সাথে টেডি ওকে বলল, ভাইরে! কিছু মনে করিস না, হ্যাঁ?

নাহ। ওর এতক্ষণের গম্ভীর, ক্লান্ত মুখটা হঠাতই উজ্জ্বল হয়ে উঠল, হাসছে, আমরা কাজ করে ফেলেছি, তাই না? ওই বাস্টার্ডগুলোকে একদম ভরে দিয়েছি।

হ্যাঁ, তা তো করেইছিস! কিন্তু এখন তো বিলি ধরবে আমাকে।

ভার্নের কথার জবাবে ক্রিস বলল, তো? রিচিও আমাকে ধরবে, আর এইস যথাসম্ভব গর্ডিকে ধরতে পারলে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। বাকি যারা আছে, তাদের কেউ না কেউ নিশ্চয়ই টেডিকেও ধরবে। কিন্তু আমরা তো কাজের কাজ ঠিকই করে এসেছি।

তা ঠিক, বললেও ভার্নের গলায় অসন্তোষ প্রকাশ পেল।

এবারে আমার দিকে ফিরল ক্রিস। কোমল গলায় বলল, আমরা পেরেছি, তাই না রে? যত যাই হোক, ষোল আনাই উসুল হয়ে গেছে, তাই না?

হ্যাঁ।

জাহান্নামে যা! শুষ্ক গলায় বলে উঠল টেডি, যেন আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তোদর কথা শুনে তো মনে হচ্ছে শালার টিভিতে মিট দ্য প্রেস দেখছি। এখন আমাকে একটু হাই-ফাইভ দে তো, আয়! বাসায় চলে যাব। দেখতে হবে, আম্মু আবার আমার নাম টেন মোস্ট ওয়ান্টেড লিস্ট-এ তুলে ফেলেছে কি না।

সবাই হেসে ফেললাম। টেডি আমাদের দিকে কৃত্রিম হায়-খোদা-এখন-আবার-কী-হবে ভঙ্গিতে তাকালে, সবাই মিলে ওকে হাই-ফাইভ দিলাম। তারপর, ভান আর টেডি ওদের বাসার দিকে পা বাড়াল। আমারও বাসার দিকে এগোনোই উচিত ছিল, কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য কেমন যেন অস্বস্তি বোধ হলো আমার।

ক্রিস বলল, আমি তোর সাথে যাব, আয়।

আচ্ছা।

কিছুটা সময় চুপচাপ হাঁটলাম আমরা। দিনের প্রথম আলোয় ক্যাসল রক অসম্ভবরকম নিরব হয়ে আছে। কেমন একটা স্বর্গীয় ক্লান্তি বোধ হচ্ছিল অন্যরকম, যেন একটু পরেই ঘুমাতে পারব ভেবে মন পুলকিত হয়ে উঠেছে। ভাবছিলাম, এদিকে আমরা জেগে আছি, আর ওদিকে পুরো বিশ্ব ঘুমাচ্ছে। একটা অদ্ভুত আশা উঁকি দিয়ে যাচ্ছিল মনের কোনায়। যেন মোড় ঘুরলেই দেখতে পাব, দূরে, কারবাইন সড়কের শেষ মাথায়, যেখানে মিলের লোডিং ইয়ার্ডের মাঝ দিয়ে রেললাইনটা চলে গেছে, সেখানে আমার হরিণটা দাঁড়িয়ে আছে।

শেষ পর্যন্ত ক্রিস মুখ খুলল। ভার্ন আর টেডি বাকিদেরকে বলে দেবে।

হ্যাঁ, সেটা চোখ বুজে বলে দেওয়া যায়। কিন্তু আজ-কালকের মধ্যে বলবে না। মানে, যদি এ নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তা হয় তোর, তাহলে চিন্তার কিছু নেই মনে হয়। হয়তো অনেক বছর পেরিয়ে যাওয়ার আগে মুখ খোলার কথা ভাববেই না ওরা।

ক্রিস বিস্মিত চোখে ফিরে তাকাল আমার দিকে।

ওরা ভয় পেয়েছে, ক্রিস। বিশেষ করে টেডি। ও ভাবছে, কেউ এসব জেনে ফেললে ওরা ওকে আর্মিতে নেবে না। ভার্নও ভালোই ভয় পেয়েছে। বেশ কিছু বিনিদ্র রাত কাটাবে ওরা। তারপর, বসন্তে বেশ কয়েকবার বলে ফেলতে নেবে, কিন্তু বলবে বলে মনে হয় না। আর তারপর…কী জানিস, শুনে পাগলামো মনে হতে পারে…কিন্তু আমার ধারণা, একসময় পুরো ব্যাপারটা ভুলেই যাবে ওরা।

ধীরে ধীরে মাথা ঝাঁকিয়ে সায় দিল সে। আমি ব্যাপারটা নিয়ে ওভাবে ভাবিনি। তুই মানুষের ভেতরটা পড়তে পারিস, গর্ডি।

আসলেই যদি পারতাম!

কিন্তু তুই পারিস।

আরো কিছুটা সময় চুপচাপ হেঁটে চললাম।

আমি কখনো এই শহর ছেড়ে যাব না রে। ক্রিস বলছিল, তুই যখন গ্রীষ্মের ছুটিতে কলেজ থেকে ফিরবি, সাকির ওখানে আমি, টেডি, ভার্ন–সবাইকেই খুঁজলে পাবি। সাতটা-তিনটার শিফট শেষ হওয়ার পরে আরকি। যদি তুই চাস। কিন্তু আমার মনে হয় না, তুই আদৌ চাইবি। কেমন অস্বস্তি নিয়ে হাসল সে।

ভেবে ভেবে তত ভালোই মাথা খারাপ করছিস রে, বললাম, নিজেকে কঠিন ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেখাতে চেষ্টা করছি। আসলে বনে থাকার সময়ের কথা ভাবছিলাম, ক্রিসের বলা কথাগুলো–হয়তো আমি বুড়ি সিমনসের কাছে টাকাটা নিয়ে গিয়ে ওনার কাছে সব স্বীকার করেছিলাম এবং ওনাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম পুরো টাকাটা। হয়তো তারপরেও স্কুল থেকে তিন দিনের জন্যে বহিষ্কৃত হয়েছিলাম, কারণ, যত যাই করি, ওই টাকাটা আর কখনো স্কুলে ফিরে যায়নি। আর সপ্তাহখানেক পর যখন বুড়ি সিমনস স্কুলে এসেছিলেন, হয়তো ওনার পরনে একটা নতুন ওড়না দেখেছিলাম…ওর দৃষ্টি। ওর চোখে সে সময় ফুটে ওঠা সেই দৃষ্টি!

তোকে নিয়ে ভাবতে আমার বয়েই গেছে! ক্রিস বলল।

তর্জনী দিয়ে বুড়ো আঙুলে ঘষতে ঘষতে মজা করে বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট ভায়োলিনটা বাজছে, শুনতে পাচ্ছিস তো? হৃদয় আমার তোমার তোরে–

ঠিক সেই মুহূর্তে ক্রিস বলে উঠল, ও আমাদের ছিল রে। ভোরের আলোয় ওর চোখ দুটো কেমন অন্ধকারচ্ছন্ন দেখাল।

আমরা ততক্ষণে আমাদের বাসার রাস্তার কোণায় পৌঁছে গেছি। ওখানেই থেমে দাঁড়ালাম। ঘড়িতে তখন সোয়া ছয়টা বাজে।

শহরের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, টেডির চাচার মুদি দোকানের সামনে সানডে টেলিগ্রামের ট্রাক এসে থামছে। নীল জিন্স ও টি-শার্ট পরা এক লোক এক বান্ডেল পত্রিকা ছুঁড়ে দিল। উল্টো হয়ে ফুটপাথে পড়ে রইল বান্ডেলটা, রঙচঙে হাস্যকর জিনিসগুলো দেখা যাচ্ছে (তখন প্রথম পৃষ্ঠায় বরাবরই ডিক ট্রেসি আর স্বর্ণকেশীর ছবি থাকত)। গাড়িটা সামনে ছুটল, প্রতিটা হুইসেলস্টপে বহির্বিশ্বের খবর পৌঁছে দিয়ে দায়িত্ব শেষ করতে চালক লোকটা নিশ্চয়ই উদগ্রীব হয়ে আছে। সামনে ওর গন্তব্য হিসেবে আছে ওটিসফিল্ড, নরওয়ে-সাউথ প্যারিস, ওয়াটারফোর্ড, স্টোনহ্যাম ইত্যাদি। ক্রিসকে আমি আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলাম, কিন্তু কীভাবে বলব, ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

হাই-ফাইভ দে আমাকে, ভাই, কেমন ক্লান্ত শোনাল ওর গলা।

ক্রিস—

হাত দে!

আমরা হাই-ফাইভ করলাম। দেখা হবে।

ক্রিস হেসে ফেলল, উজ্জ্বল, প্রাণখোলা হাসি। যদি আমি তোকে আগে দেখে ফেলি আরকি, শালা!

হাসতে হাসতে হেঁটে চলে গেল ও, দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার মতো এত এত আঘাত পায়নি; যেন আমার মতই একদল পোকামাকড়ের কামড়ে বিক্ষত হয়নি সে। যেন পৃথিবীর কিছুতেই আর কিছু যায় আসে না। ওকে দেখে মনেই হচ্ছিল না যে, ও তিন রুমের নোংরা বাসাটাতেই (কুঁড়েঘর বললে আরো ভালো বোঝা যাবে) আবার ফিরে যাচ্ছে, যেখানে আভ্যন্তরীণ কোনো প্লাম্বিং সিস্টেমও নেই। ভাঙা জানালাগুলো ঢেকে দেওয়া হয়েছে প্লাস্টিকের আবরণে, আর ভাইটা হয়তো উঠোনেই ওকে ধোলাই করার জন্য অপেক্ষা করছে।

যদি বলার মতো ঠিক শব্দগুলো খুঁজে পেতামও, তবু বলতে পারতাম বলে মনে হয় না। কথা বলাটা অনেক সময় ভালোবাসার প্রভাব নষ্ট করে দেয়। লেখকদের হয়তো এমন কিছু বলা উচিত না, মনে হয়, কিন্তু আমি এটাই বিশ্বাস করি। যদি কোনো হরিণকে বলতে চাও, তুমি ওর কোনো ক্ষতি করবে না, দেখবে, মুহূর্তের মাঝে লেজ নাড়িয়ে হাওয়া হয়ে গেছে। ম্যাককুয়েনের মতো কবিরা যেমন বলে, ভালোবাসা অমন কোমল না। ভালোবাসার দাঁত আছে; এই দাঁত দিয়ে সে কামড়ে দেয়, ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে। এই ক্ষত কখনো শুকায় না। পৃথিবীর কোনো শব্দের এই ক্ষত সারিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই। যদি এই ক্ষতগুলো আসলেই শুকিয়ে যেত, তাহলে শব্দেরাও থমকে যেত। পৃথিবীতে বলার মতো এত শব্দ আর থাকত না। আমার কাছ থেকে এটা ভালোভাবে শুনে নিন। আমি তো শব্দ-শ্রমিক, শব্দ বেঁচেই জীবন চালাই। তাই আমি খুব ভালো করেই জানি, এরচেয়ে বড় সত্যি আর নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *