৫০. সময় পলাতক প্রেমিকের মতো

৫০

সময় পলাতক প্রেমিকের মতো। শরীর আর মনে ক্ষতচিহ্ন এঁকে দিয়ে যায়। পারুরও আজকাল তেমনই মনে হয়। এই যে সময়, আড়ালে-আবডালে কখন যে এত চিহ্ন রেখে গেল, যেন টেরই পেল না সে। অনেক চেষ্টা করেও মাকে আর দেশে আনতে পারেনি। তবে চারু মাঝেমধ্যেই আসে। থাকে তার কাছে। এখনো আছে। এতে অবশ্য পারুর খানিক সুবিধাই হয়। ছায়া-কে নিয়ে তার দুশ্চিন্তা খানিক কমে। তবে মাকে অনেক বুঝিয়েও লাভ হয়নি। তার এক কথা, দেশে যদি ফেরেনই, তবে ঢাকায় বা অন্য কোথাও কেন? তিনি যাবেন ভুবনডাঙায়ই। ভুবনডাঙা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোথাও ফিরবেন না তিনি। যদি সম্ভব হয়, মৃত্যুর আগে একবারের জন্য হলেও ভুবনডাঙার ওই উঠোনে দাঁড়াতে চান তিনি। বুক ভরে নিতে চান ফেলে যাওয়া জীবনের ঘ্রাণ। কিন্তু ভুবনডাঙা কী করে ফিরবে পারু? সেই সাধ্য কি তার আছে?

ছায়া বড় হয়ে উঠেছে। স্কুলেও যেতে শুরু করেছে বেশ কয়বছর। কেমন তরতর করে বেড়ে উঠছে সে। মাঝে মাঝে পারুর বিশ্বাসই হয় না, এ সত্যি সত্যিই তার মেয়ে! তবে ছায়া প্রায়ই কিছু প্রশ্ন করে। সেই প্রশ্নের উত্তর পারুর কাছে থাকে না।

‘আমার বাবা কই মা?’

“বাবা?

হুম।

বাবা নেই।’

‘নেই কেন?

‘বাবা কি সবার থাকে?

‘থাকে তো।

‘কে বলল?

‘কেউ বলেনি।

তাহলে?

স্কুলে দেখেছি।

কী দেখেছো?’

“আমার সব বন্ধুদেরই তো বাবা আছে মা।’

এই কথায় চুপ করে যায় পারু। দীর্ঘ সময়। সে জানে না এই প্রশ্নের উত্তরে সে কী বলবে! মাঝে মাঝে মনে হয় ছায়াকে সব বুঝিয়ে বলে। এই লুকোচুরির জীবন আর ভালো লাগে না তার। সবকিছু ভেঙেচুরে এলোমেলো করে দিতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু এইটুকু এক বাচ্চাকে কী বলবে সে? কীভাবে বলবে?

সবারই বাবা থাকে, এই কথা সত্য না মা। পারু বলে।

সত্য না?

উঁহু। কই? আমারও তো বাবা নেই। আছে?

মায়ের কথা শুনে থমকে যায় ছায়া। আসলেই তো, মায়েরও তো বাবা নেই। তাহলে স্কুলের সবাই যে বলে, তার একারই কেবল বাবা নেই! এ কথা তো সত্য নয়। সে মায়ের এই উত্তরটা স্কুলের বন্ধুদের বলে। কিন্তু তার কথা শুনে সবার সে কী হাসি! যেন এমন বোকা বোকা কথা এ জীবনে আর কখনো শোনেনি তারা।

ছায়াকে স্কুলে ভর্তি করাতে কিছু সমস্যাই হয়েছিল। তবে সেই সমস্যা মিটিয়েছে তরু। কিছু ভুলভাল তথ্য, লুকোচুরি গল্প তাদের বানাতে হয়েছিল। পারুর অবশ্য এখন এসবে অভ্যাস হয়ে গেছে। তার তো লুকোচুরিরই জীবন।

তবে আজকাল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে তার! যেন ভুবনডাঙার সেই ফ্রক পরা, বেণি দোলানো মেয়েটি আয়নার সামনে দাঁড়িয়েই টুপ করে অন্য কোথাও চলে গেছে। তার জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে আরেকটি মেয়ে। সেও দেখতে খানিকটা তারই মতো। কিন্তু হুবহু সে নয়। কিন্তু কোথায় গেল সে? কেনই বা গেল? আর গেলেও কিছুই জানিয়ে গেল না কেন?

নিজেকেই যখন নিজের অচেনা লাগে, অন্য মানুষ মনে হয়, তখন তারচেয়ে দুঃখের বোধকরি আর কিছুতেই নেই। পারুরও মাঝে মাঝে তেমনই মনে হয়। আয়নার সামনে দাঁড়ানো ওই মানুষটাকে ভীষণ অচেনা লাগে। একটু মেদ জমেছে শরীরে। চিবুকের কাছটা ভারী হয়েছে। বয়স কত হলো তার? ছাব্বিশ, না সাতাশ? না আরো বেশি? পারু জানে না। সময়ের হিসেব আর করে না সে।

সময়ের হিসেব করবে তারা, যাদের জন্য কেউ অপেক্ষায় থাকে। দিন ফুরালে যাদের ঘরে ফেরার তাড়া থাকে। দরজা-জানলা খোলা থাকে। কেউ এলেই বন্ধ করে আড়াল হবে। আপন হবে গোপন কোথাও। আগলে রাখবে বুকের ভেতর। এমন তো কেউ নেই তার!

ফলে তার সময়ের হিসাব থাকে না। হিসাব থাকে না জীবনেরও। কেবল ওইটুকু এক ছায়া, সে-ই মাঝেমধ্যে তার সামনে জীবনের ধূসর, মলাটবদ্ধ খেরো খাতাটাকে কারণে-অকারণে খুলে রাখে। সেই খাতা থেকে ঘ্রাণ ছড়াতে থাকে। স্মৃতির ঘ্রাণ, প্রীতির ঘ্রাণ। বিভৎস বিস্মৃতির ঘ্রাণ।

‘আমার বাবাও কি তবে মরে গেছে মা?

মরে কেন যাবে?

কারণ, তোমার বাবা তো মরে গেছে বলে নেই। আমার বাবাও কি তবে…?

এই প্রশ্নের কি উত্তর দেবে পারু? সে চুপ করে থাকে। কিন্তু ছায়া চুপ থাকে। না। সে সময়ে-অসময়ে, কারণে-অকারণে জীবনের জং ধরা বিস্মৃত অতীতের গহিন কোটর থেকে খুঁড়ে বের করে নিয়ে আসতে থাকে অসংখ্য অস্তগামী দুঃখ। সেসব আবার সজীব হয়। প্রবল আলোয় উদ্ভাসিত করে চারপাশ। তার দগদগে আগুনে দগ্ধ হতে থাকে পারু। তার তখন খুব কান্না পায়। কিন্তু সে কাঁদতে চায় না। আচ্ছা, সত্যি সত্যিই কেমন আছে ফরিদ? কোথায় আছে সে? আছমা আর তার কী হয়েছে? ছেলে, না মেয়ে? নিশ্চয়ই খুব ভালো আছে তারা? প্রবল জোছনায়। ভুবনডাঙায় নৌকা করে ঘুরতে বেরোয় তারা? বৃষ্টিতে ভেজে? প্রবল কুয়াশায় লীন হয়ে থাকে? কেমন আছে ভুবনডাঙা? তাদের ছোট্ট সেই ঘর? ঘরের কোণে আলো? আলোর ভেতর দিন। দিনের ভেতর রাত্রি। কেমন আছে সব?

ফরিদ কি কখনো কবিতা শোনায় আছমাকে?

‘কিছু কিছু কিনে নেই দামে, কিছু কিছু ঘামে, কিছু কিছু মূল্যবিহীন।

একটা জীবন তবু জানে, কার কাছে রয়ে যায় কতটুকু ঋণ?

ফরিদ কি জানে কার কাছে কতটুকু ঋণ তার? তার কি একটুও মন খারাপ হয় না পারুর জন্য কান্না পায় না? যখন সে তাদের বাড়ির সামনে দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়, যখন ভুবনডাঙা স্টেশন ছেড়ে চলে যায় সন্ধ্যার ট্রেন, যখন দূর কোথাও থেকে ভেসে আসে মন কেমনের সুর। তখনো কি তার পারুর কথা মনে পড়ে না? বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে না? কান্না পায় না? নাকি সব ভুলে সে ডুবে আছে আরেক জীবনের গল্পে। সেই গল্পে কেবল আলো আর আনন্দ। প্রাপ্তি আর পূর্ণতা।

ওই প্রাপ্তি আর পূর্ণতার গল্প রেখে কে আর শূন্যতার হাহাকার শুনতে চায়? কেউ না।

পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কখনো লুকায়। তবে কাঁদে না সে। কখনো কখনো চোখের কোণে অশ্রু জমে। সে আঙুলের ডগায় সেই অশ্রু ফোঁটা টুপ করে মুছে ফেলে। কিন্তু কাঁদে না। এই জীবনে আর কখনো কাঁদবে না সে। কেন কাঁদবে? কাঁদলে কী হয়? জগতে এমন কিছু কী আছে, কান্নায় যা বদলে যায়? নেই।

আর নেই বলেই পারু হয়ে থাকে বুকভার যন্ত্রণার বিষাদিত হাসিমুখ। ওই মুখের আড়ালের গল্পগুলো কখনোই পড়া হয় না কারো। খোলা হয় না সেই সব গল্পের বন্ধ বইয়ের মলাট। সেখানে ক্রমশই ধুলো জমে জমে ধূসর হতে থাকে অনুভবের চোরাগলি। অক্ষর, শব্দ, কথা। কে জানে, কোনো একদিন হয়তো সেই সব অক্ষর মুছে যাবে। শব্দরা হয়ে যাবে নৈঃশব্দ্য। আর পারু হয়ে রইবে অনুভূতিহীন নির্জীব, নিস্তব্ধ এক মানুষ।

তবে তার এই নিস্তরঙ্গ, নির্বাক জীবনে একদিন অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনা হঠাৎই জাগিয়ে তোলে ধূসর সেই পাণ্ডুলিপি। জীবনের আবছায়া গল্প। সরব হয়ে ওঠে মরা নদী।

.

রাত বারোটার দিকে অফিস থেকে খবর এলো এখুনি হাসপাতালে যেতে হবে তাকে। ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনা ঘটেছে। দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা গেছে প্রায় বিশজন। সংকটাপন্ন অবস্থায় রয়েছে তারও প্রায় দ্বিগুণ। কিন্তু এই রাতে এত মানুষকে সেবা দেয়ার মতো ডাক্তার-নার্স হাসপাতালে নেই। ফলে যারা বাড়িতে রয়েছেন তাদেরও জরুরি ভিত্তিতে ডাকা হয়েছে।

হাসপাতালে গিয়ে রীতিমতো দিশেহারা বোধ করতে থাকে সে। এমন বিভৎস দৃশ্য এর আগে খুব কমই দেখেছে। আহত মানুষের যন্ত্রণা আর নিহত মানুষের স্বজনের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে চারপাশ। ডাক্তার, নার্সসহ হাসপাতালের অন্য স্টাফদের ছোটাছুটিতে ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বাকিটা রাত আর এক মুহূর্তের জন্য কোথাও বসতে পারল না সে। ছোটাছুটি করতে হলো এই বেড থেকে ওই বেড অবধি। এই ছোটাছুটি সহসা শেষ হলো না। দিনের পর দিন চলতেই লাগল। পারু অবশ্য তাতে একটুও বিরক্ত হলো না। বরং সকল কষ্ট-ক্লান্তি ভুলে একটানা কাজ করে যেতে লাগল সে। এই কাজ করতে গিয়েই ঘটনাটা ঘটল।

সেদিন কেবল জ্ঞান ফিরেছে সাত নম্বর ওয়ার্ডের রোগীর। প্রাথমিক সেবা শুশ্রূষা শেষে তার সঙ্গে কথা বলতে গেল সে। আর তখুনি বুকটা ধক করে উঠল। রোগীর পরিচয় জিজ্ঞেস করতেই জানা গেল, তার নাম শফি খা। বাবার নাম আশরাফ খাঁ। বাড়ি ভুবনডাঙার পাশের উত্তরপাড়া গ্রামে। পারুর হঠাৎ মনে হলো তার মাথা ঝিমঝিম করছে। শরীর কাঁপছে তিরতির করে। এই লোকটার বাড়ি ভুবনডাঙার পাশে? সে আশরাফ খাঁর ছেলে? বাবার কাছে মানুষটা সম্পর্কে অনেক শুনেছে সে। কিন্তু সেই আশরাফ খাঁর ছেলে এখানে, এই অবস্থায়?

পরের কয়েকটা দিন পারু যেন আর ঘরেই ফিরতে চাইল না। সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে চাইল এই মানুষটার পাশে। একটু ঘ্রাণ নিতে চাইল ভুবনডাঙার। একটু কথা শুনতে চাইল। বুঝতে চাইল, কেমন আছে সব? সেই ফেলে আসা মনভূমি? সেই স্মৃতির মিনার? সেই ফরিদ? তার নতুন ঘর, গৃহ-গৃহস্থালি? কেমন আছে সব?

.

তা সে জানলও। তবে সেই জানা হয়ে উঠল অন্য এক গল্প। তার আগে অবশ্য সুস্থ হয়ে উঠতে হলো শফিকে। পারু তখনো তাকে কিছুই বলেনি। কেবল যতটুকু সম্ভব সেবা করার চেষ্টা করেছে। তবে সেই সেবায় আর দশজনের চেয়ে যেন একটু বেশিই মায়া ছিল। একটু বেশি যত্নও। তা শফি খাঁ একদিন কথাটা বললও, আপনে যা করলেন, এইটা কেউ কারো আপন মায়ের পেটের ভাইয়ের জন্যও করে না আপা।

পারু হাসল, ভাই কি শুধু মায়ের পেটেই হয়? তা ছাড়া হয় না?

‘তা হয় বইন। তাতো হয়ই। না হইলে কি আর জগৎ-সংসার চলত?

হুম। তবে আপনাকে এমন আলাদা যত্ন করার একটা কারণও কিন্তু আছে।

কী কারণ?

‘আপনার যে গাঁয়ে বাড়ি, তার পাশের গায়ে আমার এক পরিচিত ছিলেন।

কী বলেন? নাম কী?

মহিতোষ স্যার। উনি আমার বাবার কলেজের বন্ধু ছিলেন। ইচ্ছে করেই মিথ্যে কথাটা বলল পারু। কিন্তু তার কথা শুনে যেন চমকে উঠল শফি। বলল, ‘কী বলছেন আপা?’

হুম। চেনেন ওনাকে?

জি। চিনি।

‘কেমন আছেন ওনারা? বহুদিন কোনো যোগাযোগ নেই।

এই কথায় চুপ করে রইল শফি। দীর্ঘ সময়। তারপর স্নান গলায় বলল, ‘উনারা তো আর দেশে নাই আপা। প্রায় বছর দশেক আগেই দেশ ছাইড়া চইলা গেছে।’

‘কোথায়?

কলিকাতা। সপরিবারে।

এরপরের ঘটনাও বলল শফি। তার বাবা আশরাফ খ মারা গেছেন প্রায় বছর পাঁচেক হয়েছে। তবে তিনি যে ওই পরিস্থিতিতেও মহিতোষ মাস্টারের প্রতি কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তাঁর সাধ্যমতো ন্যায্য মূল্যে তাঁর জমি কিনেছিলেন, সে কথাও বলল সে। পারু অবশ্য বুঝল না, তার বাবার কাছে ঠিক কী কারণে কৃতজ্ঞ ছিলেন আশরাফ খাঁ। কারণটা সেদিন আর জিজ্ঞেসও করল না সে। তবে সব মিলিয়ে যেন একটা মনখারাপের আবহ তৈরি হলো। পারু অবশ্য ইচ্ছে করেই করল কিছুটা। সে আসলে ভুবনডাঙার কথা জানতে চায়। জানতে চায় আরো অনেক কিছুই।

ফলে রোজই নানা অজুহাতে এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে সে। আর জেনে নিতে থাকে নানা গল্প। সেই সব গল্পে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, কামাল আর এছাহাকের পালাবদলের ঘটনা যেমন থাকে। তেমনি থাকে ঘটনাচক্রে আছমার খুন হয়ে যাওয়া আর ফরিদের অসমাপ্ত জীবনের বিয়োগান্তক অধ্যায়ও। পারু জানে না কেন, আছমার কথা শুনে আচমকা মেঘের মতো ভারী হয়ে যায় বুক। থমথমে কী ব্যথা জমে থাকে। ওই ব্যথাভার বুক আর হালকা হয় না। আসলেই তো, সময়ের চেয়ে নিষ্ঠুর আততায়ী আর কিছু নেই। কী অবলীলায় সে খুন করে যেতে থাকে কত কত জীবন, সম্পর্ক, পরিচয়, পরিণয়।

সময় এমন কেন?

.

শফি সুস্থ হয়ে গেছে পুরোপুরি। সে চলে যাবে পরদিন ভোরে। রাতে শেষবারের মতো তাকে দেখতে এলো পারু। পরদিন ছায়ার স্কুলে বিশেষ অনুষ্ঠান থাকায় ছুটি নিয়েছে সে। কিন্তু একটা প্রশ্ন বেশ কিছুদিন ধরেই খচখচ করছিল তার মনে। কিন্তু করা হয়নি। আজ শেষ মুহূর্তে আচমকা প্রশ্নটি করল সে। বলল, আচ্ছা, একটা কথা বলি?

হুম।

আপনি বলছিলেন, আপনার বাবা মহিতোষ মাস্টারের কাছে কৃতজ্ঞ ছিলেন। কিন্তু কী কারণে কৃতজ্ঞ ছিলেন?

শফি কথাটা বলার জন্য একটু সময় নিল। তারপর বলল, এই কথা আমি তাঁরে জিজ্ঞেস করছি। তিনি অত খোলাসা কইরা কিছু বলেন নাই। তবে বিভিন্ন সময়ে তাঁর কথাবার্তায় যতটুকু শুনছি, আমার আব্বা অল্প বয়সে একবার কলিকাতায় বিরাট বিপদে পড়েছিলেন। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় জীবন-মরণের সমস্যা। তখন তাঁরে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়া একজনে বাঁচাইছিলেন। তিনি হইলেন মহিতোষ মাস্টারের বাবা। আমার আব্বায় লোক ভালো আছিলেন। তাঁর সম্বন্ধে দশগ্রামের লোকে জানে। তারা এক কথায় রায় দেবে, তিনি মানুষ হিসাবে এক শ তে এক শ আছিলেন। তার একটা প্রমাণ বলব?

কী প্রমাণ?

তিনি যে মানুষ হিসেবে এক শ তে এক শ আছিলেন।

‘প্রমাণ দিতে হবে না। আমি বিশ্বাস করেছি।’

না। তারপরও শোনেন। তিনি মরার আগে কী অছিয়ত কইরা গেছে জানেন?

কী?

তিনি অছিয়ত কইরা গেছেন যে, মহিতোষ মাস্টারের বংশধররা যদি কেউ আবার এই দেশে আসে। এই দেশে থাকতে চায়, তাইলে যেন আমরা তার বাড়িঘরসহ জমি-জমা সব ফেরত দিই। তাতে সে যে দাম দেয়, তাই সই। এইটা কোনো কথা বলেন? জমির দাম বাড়ে বছরে নয়গুণ। সোনার চাইতেও জমির দাম বেশি।’

বর্তমান বাজার মূল্যে ওই জমির দাম কত? স্থির, নিষ্কম্প কণ্ঠে প্রশ্নটা করল পারু।

“কেন?’

“এমনি জানতে চাইছি। কৌতূহল।

শফি অবাক হলেও কিছু বলল না। সে হিসাব করে জমির দাম বলল। পারু শান্ত গলায় বলল, মহিতোষ মাস্টারের বড় মেয়ে যদি ওই জমি ন্যায্য দাম দিয়ে কিনতে চায়, আপনি তা বিক্রি করবেন?

শফি কথা বলল না। সে পারুর কথা কিছুই বুঝতে পারছে না। তবে তার এখন কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেয়েটাকে এখানে দেখার আগেও অন্য কোথাও মুহূর্তের জন্য হলেও দেখেছে সে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটা মনে করতে পারছে না। এমনও হতে পারে, এটা তার মনের ভুল। তবে তারপরও সে বলল, আপনার নাম কী? আপনে কি মহিতোষ মাস্টারের বড় মেয়ে পারু?

পারু কথা বলল না। তবে মৃদু হাসল।

৫১

হেমন্তের বিষণ্ণ সন্ধ্যা।

খানিক আগেই ভুবনডাঙা স্টেশন ছেড়ে সাইরেন বাজিয়ে চলে গেছে সন্ধ্যার ট্রেন। তারপর থেকে অদ্ভুত নৈঃশব্দ্য। সুনসান নীরবতা। একটা হলুদ পাতা হঠাৎ উড়ে এসে পায়ের কাছে পড়তেই পারু ম্লান চোখে তাকায়। কী রুক্ষ, প্রাণহীন চারপাশ! যেন ক্রমশই নেমে আসছে মৃত্যু। গাঢ় অন্ধকার। মুখভার থমথমে আকাশও মিশে গেছে দূরে কোথাও। কিন্তু পারুর খুব ইচ্ছে হয়, ওই আকাশটাকে টুপ করে বুকের ভেতর লুকিয়ে ফেলতে। এমন আকাশ কি আর কোথাও আছে? এমন মন কেমনের সন্ধ্যা? ওই যে দূরের গ্রাম, শুকনো খড়ের মাঠ, ভেজা ঘাসের মেঠোপথ? ওই যে ভুবনডাঙা নদী? এই যে সে বসে আছে পুকুরপারে, ওই যে সামনে শান বাঁধানো ঘাট, স্বচ্ছ জলের আয়না, তুলসীতলার মায়া, বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ, এমন কি আর কোথাও কিছু আছে?

পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়েও লুকায়। মানুষ হওয়ার এই এক যন্ত্রণা। জীবনভর কেবল লুকাতে হয়! মিহি কুয়াশার ভেতর থেকে গায়ে এসে বিঁধে সুচের ফলার মতো তীক্ষ্ণ হিমেল হাওয়া। জড়সড় চারু ডাকে, দিদি।

হুম?’ সাড়া দেয় পারু।

‘এত বছর বাদে আবার এখানে এসে বসতে তোর কেমন লাগছে দিদি?

জানি না?

‘তোর মনে হচ্ছে না, এখুনি ঠাকুমা তোকে ডাকবে?

পারু জবাব দেয় না। চারু বলে, ‘ডেকে বলবে, ও পারুল তোর বাপ এহনো আসে না কেন? রাইত-বিরাইত ঘরে ফেরনের অভ্যাসটা আর তার গেল না?’

পারু এবারও কথা বলে না। চারু বলে, বাবা এসে কলতলায় পা ধুতে শুরু করবে। আর মা পিলসুজের ওপর কুপি নিয়ে দাঁড়িয়ে তোর আর আমার নামে নালিশ করতে থাকবে।

হুম।’ পারু অস্ফুটে বলে।

‘ধূপের গন্ধটা তখনো ঘুরে বেড়াতে থাকবে বাড়িজুড়ে। আর কালুটা হঠাৎ গোয়ালঘর থেকে তারস্বরে হাম্বা ডাকতে থাকবে।’

পারু ছোটবোনের দিকে তাকায়। চারুর বয়স কত হলো? তার থেকে বছর চারেকের ছোট সে। কিন্তু মাথাভর্তি চুল। চুপচুপে তেলে বেণি করে নিয়েছে সে। তাকিয়ে আছে ফ্যাকাশে চোখে। পারুর হঠাৎ মনে হলো, আচ্ছা, ঠিক এই দৃশ্যটা সে এর আগে কি কখনো দেখেছে? আজ থেকে বহু বহু বছর আগে? অবিকল এই দৃশ্যটা? সে আলগোছে উঠে দাঁড়ায়। ঘরদোরগুলো ভেঙেচুরে ঝোঁপঝাড় হয়ে গেছে। সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে আবার সব গোছাতে হবে। কিন্তু বাড়ির দিকে যেতে যেতেই তার হঠাৎ মনে হলো, তুলসীগাছের তলায় সন্ধ্যার আরতি দিচ্ছেন মা। তার পাশেই ঠাকুরঘর। ওই যে বাঁশের কঞ্চি কেটে বানানো ঠাকুরমার লাঠিটা ওখানে। তার পাশে কাঠের খড়ম। দরজার কাছে জলচৌকি। ঘরের টিনের চালের ওপর ডালপালা ছড়ানো আমগাছ। গোয়ালঘর থেকে গলগল করে ধূপের গন্ধ। বেরুচ্ছে। সন্ধ্যা হলেই মশা তাড়াতে ধূপ জ্বেলে দেন মা। কালো রঙের বড় গাইটা। কেমন অসহায়ের মতো তাকিয়ে আছে। তার চোখ কি ভেজা?

পারু জানে না। তবে সে দু-পা এগিয়ে গোয়ালঘরটার দিকে যাবে বলে পা বাড়ায়। এই মুহূর্তে তার সামনে এসে দাঁড়ায় ছায়া। তারপর ডাকে, মা?

হুম? যেন বহু বহু দূর কোনো পৃথিবী থেকে উত্তর দেয় পারু।

একটা লোক এসেছে।

‘লোক?

হুম।

কী চায়?

“তোমার সঙ্গে দেখা করতে চায়।

‘কেন?

তাতো জানি না।’

কী নাম?

ফরিদ।

কী?

ফরিদ।

ফরিদ?

হুম।

পারু আর কথা বলল না। ছায়াও না। তবে পারুর পেছনে একজন লোক এসে। দাঁড়াল। খানিক দূরে। ছায়া সেই লোকটার দিকে তাকিয়ে রইল। লোকটাকে সে চেনে না। কিন্তু তার কেন যেন মনে হচ্ছে লোকটার নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই শান্ত জলের পুকুরে হঠাৎ কম্পনের মতো কেঁপে উঠেছে মা। তার চোখের কোলে চকিতে উঁকি দিয়ে গেছে এক অন্তহীন বিষাদের নদী। কিন্তু সেই নদীতে ঢেউ উঠল না। মা বরং ধীরে ধীরে যেন নির্জীব হয়ে গেল। স্থির, অনড়। পেছনের মানুষটাও। ছায়ার হঠাৎ মনে হতে থাকে, কে এই মানুষটা? মা এমন করছে কেন?

তারা দুজনই অযুত বাধার অজস্র পথ পেরিয়ে এসেও যেন হাতছোঁয়া দূরত্বের ওই পথটুকুই আর পেরোতে পারছে না। ডিঙাতে পারছে না অনভ্যাসে অগম্য হয়ে ওঠা অকর্ষিত অভিমানি মনভূমিটুকু। কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তির। প্রাচীরে গন্তব্যহীন অন্ধকার হয়ে সেঁটে রইল তারা। কিন্তু তাদের মন ও শরীর। আলগোছে হাওয়ায় ছড়িয়ে দিতে লাগল স্মৃতির সুবাস। সেই সুবাস কি ডিঙিয়ে যেতে পারবে এই অলঙ্নীয় দ্বিধার দেয়াল?

দূর কোথাও থেকে ভেসে আসছে অদ্ভুত হাহাকারের সুর। বুকের ভেতর আলগোছে নেমে আসছে মেঘ কিংবা কুয়াশা। কিংবা গাঢ় শীতল অন্ধকার। নাম না জানা দুঃখ। সেই দুঃখের ভেতর মন কেমনের হাওয়া। সেই হাওয়ায়–ওই বিষাদ অন্ধকারে যেন স্থির হয়ে আছে প্রাচীন পাথরে খোদাই করা দুটি মূর্তি।

.

কী আশ্চর্য, সেই মূর্তির বুকেও হঠাৎ জলের ঢেউয়ের মতো ছলাৎ ছলাৎ শব্দ হতে থাকে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *