৪৫. পর পর বেশ কয়েকদিন

৪৫

পর পর বেশ কয়েকদিন এছাহাকের অমন আকস্মিক আগমনে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন ওহাব ডাক্তার। তবে তিনি সেটি কাউকে বুঝতে দেননি। এমনকি নুরুন্নাহারকেও না। ফরিদ অবশ্য বিষয়টা লক্ষ করেছে। ফলে সতর্ক হয়ে গেছে সেও। শফির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা থাকলেও সেটি আপাতত স্থগিত করে দিল। আগে সার্বিক পরিস্থিতিটা বুঝে নেয়া দরকার। তা ছাড়া আছমার শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। সেদিন মাঝরাতে সে হঠাৎ ফরিদকে ডেকে তুলল ঘুম থেকে। ফরিদ বিরক্ত গলায় বলল, কী হয়েছে?’

‘একটু হারিকেনের আলোটা বাড়াই দেবেন?

‘এত রাতে হারিকেনের আলো বাড়াব কেন?

‘একটু দরকার আছে।

‘কী দরকার?

আপনে হারিকেনের কাছে না যাইতে পারলে বলেন, আমিই যাইতেছি।’ বলে আছমা নিজেই বিছানা থেকে নামতে গেল। সে অন্ধকারে ভয় পায় বলে রাতে ঢিমেতালে জ্বলতে থাকে হারিকেনের আলো। কিন্তু এই রাত দুপুরে সে হারিকেন বাড়িয়ে কী করবে? ফরিদ বিরক্ত ভঙ্গিতে হারিকেনের আলো বাড়িয়ে দিল। আছমা বলল, হারিকেনটা আমার কাছে দেন।

‘তোর কাছে কেন দেব?

কারণ আপনারে আমি দেখব।’

‘আমারে দেখবি মানে! তোর কি মাথাটাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে নাকি আছমা?

না। আমার মাথা ঠিকই আছে। মন ঠিক নাই।

মন ঠিক নাই কেন?

‘জানি না। মনটা কেমন ছটফট করতেছে। আপনের মুখোন খুব নজর কইরা দেখতে ইচ্ছা করতেছে।

‘আছমা!’ এবার গলা শক্ত করে ফরিদ। এত রাতে এইগুলা কী?

‘আমি জানি না। কিন্তু আপনেরে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করতেছে।

‘দেখতে ইচ্ছা করলে সকালে দেখিস। তখন ফকফকা আলো থাকবে।

সকাল পর্যন্ত যদি আমি না থাকি?”

তুই থাকবি না মানে? যাবি কই?’ ফরিদ অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল।

আছমা অবশ্য সেই প্রশ্নের উত্তর দিল না। ফরিদ তাকে হারিকেনটা এগিয়ে দিল। আছমা সেই হারিকেন ফরিদের মুখের কাছে নিয়ে দীর্ঘসময় তার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বিড়বিড় করে বলতে লাগল, আমার তাইলে এমন হইল কেন? এমন হইল কেন আমার?

কী হইছে তোর?

আমি আপনার চেহারা মনে করতে পারতেছিলাম না।

কখন?’ ফরিদ অবাক গলায় বলল।

স্বপ্নে দেখি আমি হারাই গেছি। চাইরদিকে মানুষ আর মানুষ। আপনেরে খুঁইজা পাইতেছি না। একজনে বলল, আপনে নাকি আমার পাশেই আছেন। কিন্তু পাশে তাকাইলে আর আপনেরে আমি দেখি না। সব অচেনা মানুষ দেখি। তখন

সেই লোকটা বলল, ‘ সে-ই নাকি আপনে। কিন্তু আমি আপনের চেহারা চিনতে পারতেছিলাম না। এত চেষ্টা করতেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই চিনতে পারতেছিলাম না। আপনেরে কেন আমি চিনতে পারব না?’

বলেই হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল আছমা। ফরিদের উচিত আছমাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেয়া। সে একটা বিশেষ অবস্থা পার করছে। এই সময়ে মেয়েদের শারীরিক-মানসিক নানা সংকটের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ফলে তার সবচেয়ে কাছের মানুষটির উচিত তাকে সর্বস্ব দিয়ে আগলে রাখা। কিন্তু ফরিদ তার কিছুই করছে না। আসলে পারছে না সে। অনেকবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু যখনই চেষ্টা করেছে, তখনই পারুর মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আর ভেসে ওঠে সেই যাত্রাপালার ভেতরের শেষ মুহূর্তের দৃশ্যটা। পারু তার হাতখানা নিয়ে নিজের পেটের সঙ্গে চেপে ধরছে। আর প্রায় ফিসফিস করে গাঢ় কণ্ঠে বলছে, আপনাকে এখন আমি খুব জরুরি একটা কথা বলব…।’

কিন্তু সেই কথা আর বলতে পারেনি। ফরিদের ধারণা, এখন সে জানে পারুর সেই কথাটি কী ছিল। আর জানে বলেই যতবার সে আছমার দিকে তাকায়, ততবারই তার পারুর কথা মনে পড়ে। যদি সত্যি সত্যিই পারুর পেটেও তার সন্তান থেকে থাকে, তবে সেই সন্তানটি নিয়ে জীবনের শেষ মুহূর্তে ঠিক কী ভেবেছিল পারু? নিশ্চয়ই সে তার সবটুকু দিয়ে বাঁচতে চেয়েছিল। নিজের জন্য না হলেও ওই সন্তানটির জন্য।

ফরিদ এরপর আর ভাবতে পারে না। তার সারা শরীর হিম হয়ে আসে। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এই এখন যেমন হচ্ছে। তার উচিত আছমাকে জড়িয়ে ধরে প্রবোধ দেয়া। একটু আদর করা। বোঝানো। কিন্তু তার কিছুই সে করছে না। কিংবা পারছে না।

আছমা অবশেষে নিজেই কথাটা বলল, আমার কেন জানি খুব ভয় লাগতেছে। খুব ভয়। আপনে কি আমারে একটু জড়াই ধরবেন? একটুখানি? সে তার হাতের তর্জনী এবং বৃদ্ধাঙ্গুলির অগ্রভাগ এক করে তার একটুখানি দেখাল। ফরিদ বলল, ‘আসো। আমার কাছে আসো।’

বললেও সে কোনো আগ্রহ পেল না। কিন্তু এত রাতে একজন সন্তানসম্ভবা স্ত্রীর এমন আকুতি প্রত্যাখ্যান করা যায় না। সেই ভাবনা থেকেই বোধহয় সে আছমাকে জড়িয়ে ধরল। আছমা দীর্ঘসময় তার বুকের সঙ্গে মিশে রইল। কাঁদল। তার সেই কান্নায় কেঁপে ওঠা শরীরের স্পর্শে ফরিদের কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। তার হঠাৎ মনে হলো, বুকের ভেতর ছোট্ট পাখির মতো মিশে থাকা এই মেয়েটি আছমা নয়। এ পারু। সে যদি এখন তার মুখখানা তুলে দেখতে চায়, তাহলেই সে দেখবে যে পারু তার বুকে মাথা রেখে কাঁদছে। কিন্তু সেই সাহস আর তার হলো না।

যদি এই মুখ তুলে সে এখন দেখে যে ওই মুখখানা পারুর নয়, অন্য কারোর। তাহলে ব্যাখ্যাহীন এক ক্রোধ হবে তার। এই ক্রোধ প্রবল অসহায়ত্বের, অক্ষমতার। ওই অনুভূতিটাকে ভয় পায় সে। এক ধরনের অপরাধবোধও হয় তার। এমন কেন হয়ে গেল সে! আছমা তো কোনো অন্যায় করেনি। বরং মাঝে মাঝে তার এও মনে হয়, এ পৃথিবীতে আছমার মতো এমন তীব্র, এমন নিঃস্বার্থ হয়ে কি কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে? এমন নিজেকে নিঃশেষে বিলিয়ে দিয়ে?

আসলেই তো, আছমা যখন জানত যে সে অন্য কারো, যখন জানত যে ফরিদকে সে কখনোই পাবে না, তখনো তাকে এই একইরকম ভালোবাসত। এমনকি যখন ফরিদ পারুকে নিয়ে চলে গেল, তখনো। এ এক আশ্চর্য ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার। আচ্ছা, এমন নিঃশেষে বিসর্জিত হয়ে কেউ কাউকে ভালোবাসতে পারে?

.

পরদিন আছমার শরীরটা ভীষণ খারাপ করল। ফরিদ সকালে দোকানে যাওয়ার। জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। এই সময়ে আছমা তাকে ডাকল। বলল, একটা কথা বলব?’

কী কথা?

‘রাগ করবেন না তো?

‘রাগ কেন করব?

“তাতো জানি না। আমার সারাক্ষণ কেবল মনে হয়, আপনি বুঝি আমার ওপর রেগে যাবেন।

‘এমন কেন মনে হয়? আমি তো তোর ওপর কখনো রাগি না।’

সব রাগ কী আর চোখে দেখা যায়?

“মানে?

মানে সব ভালোবাসা যেমন চোখে দেখা যায় না। তেমনি সব রাগও না।

‘তাহলে?

“ওটা বোঝা যায়। অনুভব করা যায়।

আছমার কথা শুনে ফরিদ চুপ করে রইল। দীর্ঘ সময়। তারপর বলল, ‘কী বলবি বল?

‘আজ দোকানে না গেলে হয় না?

“কেন?’

“আমি বলছি বলে।

আছমার কথা শুনে ভারি অবাক হলো ফরিদ। সে বলল, মানে কী?

মানে কিছু না। হঠাৎ যেন গুটিয়ে যায় আছমা।

বল তুই।

উঁহু। কিছু না।’

ফরিদ আয়নার সামনে থেকে এসে আছমার সামনে বসে। তারপর বলে, ‘আজ কী হয়েছে তোর?

জানি না।’

‘তাহলে এমন করছিস কেন?

‘কেমন?

‘এই যে কীসব কথা বলছিস। পাগলামি করছিস।

আছমা সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। চুপ করে বসে রইল। ফরিদ রেডি হয়ে দোকানের উদ্দেশে রওয়ানা হতে নিল। এই সময়ে আছমা তাকে ডাকল। তারপর বলল, দুনিয়াতে যত মানুষ আছে, যত বড় মানুষ, ছোট মানুষ। ধনী মানুষ, গরিব মানুষ। রাজা মানুষ, প্রজা মানুষ। এই সব মানুষেরই ওই কী সব কথা বলনের জন্য, পাগলামি করনের জন্য একজন মানুষ লাগে। আপনে হইলেন আমার সেই মানুষ। আমি আপনার সঙ্গে ওই সব কথা বলব না তো কার সঙ্গে বলব? আমার কি আপনে ছাড়া আর কেউ আছে? নাই তো কেউ আর।

কথাটুকুতে কী ছিল ফরিদ জানে না। কিন্তু সেই সারাটা দিন আছমার ওই কথাটা তার মাথায় গেঁথে রইল। তারপর ধীরে ধীরে তা সুবাস ছড়াতে লাগল মনেও। কী সুন্দর করেই না কথাটা বলেছে সে। আচ্ছা, এত সুন্দর করে কথা বলা শিখল কই আছমা?

এই প্রশ্নের উত্তরও পেয়ে গেল ফরিদ। তার হঠাৎ মনে হলো, মানুষ যদি কখনো কাউকে তীব্রভাবে ভালোবাসে, তখন সেই ভালোবাসা তার বুকের ভেতরকার সব মায়াময় অনুভূতিকে এক জায়গায় এনে জড়ো করে। তারপর একের পর এক থরেথরে সাজাতে থাকে। এই সাজিয়ে রাখা অনুভূতি সারাক্ষণ ওই মানুষটিকে ছুঁয়ে দিতে চায়। ফলে সে না চাইলেও তার অজান্তেই অদ্ভুত অনুভূতির আখরে লেখা হতে থাকে তার বুকে জমে থাকা ভালোবাসার কথকতা।

.

সেদিন একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরল ফরিদ। কিন্তু সে ঘরে ঢুকলেও আছমা তার সঙ্গে কথা বলল না। মুখ ভার করে চুপচাপ শুয়ে রইল বিছানায়। ফরিদ বলল, কীরে, ঘুমিয়ে পড়লি?’

আছমা জবাব দিল না। ফরিদ হাত-মুখ ধুয়ে এসে তার পাশে বসল। তারপর বলল, এত তাড়াতাড়ি কেউ ঘুমায়? তোর তো একটু হাঁটা-চলাও করা উচিত। সারাদিন এত বিছানায় শুয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে তো।

আছমা তাও কোনো কথা বলল না। ফরিদ বলল, “আজ আকাশে মস্তবড় চাঁদ উঠেছে। কিন্তু বাইরে সাদা চাদরের মতো ঘন কুয়াশা বলে সেই চাঁদ দেখা যাচ্ছে না। তুই কি ওই ঝাপসা চাঁদ দেখতে যাবি?

আছমা এবারও কথা বলল না। ফরিদ বলল, এই চাঁদ কিন্তু অন্যসময়ের চাঁদের চেয়ে সুন্দর। এই চাঁদের আমি কি নাম দিয়েছি জানিস?

‘কী?

‘চন্দ্রবিভ্রম।’

‘এইটার মানে কী? মানে

বুঝতে চাস?

হু।’

‘তাহলে বাইরে চল। এই জিনিস বলে বোঝানো যায় না। দেখে বোঝাতে হয়।

ফরিদ আছমাকে নিয়ে ঘরের বাইরে এলো। সেখানে উঠানজুড়ে ঘন কুয়াশা। একহাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না। সেই কুয়াশায় চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভুত এক দৃশ্য তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে, তাদের সামনেই দুর্ভেদ্য এক দেয়াল। কিংবা

অসীম অন্তহীন শূন্য কোনো দিগন্ত। যেন এর আর কিছু নেই। কিংবা এর কোনো শেষ নেই। এমন অনুভূতি এর আগে কখনো হয়নি আমার। ঘন কুয়াশায় ভরা পূর্ণিমার রূপ যে এমন হতে পারে এ তার ধারণায়ই ছিল না। ফরিদ বলল, ‘দেখেছিস? দেখে মনে হচ্ছে না আমাদের সামনেই একটা সাদা বরফের নিরেট দেয়াল?

হুম।

‘যেন হাত বাড়ালেই দেয়ালটা ধরা যাবে। এমন মনে হচ্ছে না?

হু।

‘আবার খেয়াল কর, অন্যভাবে দেখলে মনে হচ্ছে সামনে অসীম খোলা প্রান্তর। যেন এর কোথাও কোনো শেষ নেই। ঘন কুয়াশার ওপর জোছনা পড়ে এমন হয়েছে। কুয়াশা আর জোছনা মাখামাখি হয়ে চোখের সামনে এক অপার্থিব বিভ্রম তৈরি করেছে। তুই কি এখন চন্দ্রবিভ্রমের মানে বুঝেছিস?”

আছমা জবাব দিল না। তবে সে ফরিদের গা ঘেঁষে এসে দাঁড়াল। তারপর একটা হাত তুলে ফরিদের বাহু আঁকড়ে ধরল। সে কাঁপছে। ফরিদ আলতো গলায় বলল, শীত করছে?

হু।

‘ভেতরে চলে যাবি?

“উঁহু।’

‘তাহলে ভেতর থেকে চাদর এনে দেব?

না।’

‘তাহলে?

আছমা কথা বলল না। ফরিদ বলল, ‘জড়িয়ে ধরব?’

আছমা এবারও কথা বলল না। ফরিদ আছমাকে জড়িয়ে ধরল। আছমার হঠাৎ মনে হলো, সে ওই জোছনা আর ফরিদ ওই কুয়াশা। তারা দুজনই ওই জোছনা আর কুয়াশার মতো মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আর তারপর ওই চন্দ্রবিভ্রমের মতোই তারাও বিভ্রম তৈরি করছে। কিন্তু সে বুঝতে পারছে না, তারা কি ওই জোছনা ও কুয়াশার দেয়ালের মতোই হাত বাড়ানো দূরত্বে দাঁড়ানো সমাপ্তির দেয়াল? নাকি ওই অন্তহীন, অনিঃশেষ প্রান্তর?

৪৬

পারুর চাকরি হয়েছে একটা হাসপাতালে। নার্সের চাকরি। ডিউটি একটু বেশি হলেও বেতন ভালো। তবে সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে প্রায় বছর দেড়েক বয়সের মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে আসতে পারে সে। মেয়ের নাম রাখা হয়েছে ছায়া।

তরু বলেছিল, “ছায়া কেন রাখলে নাম?

‘ও তো ছায়াই। মৃদু হেসে বলল পারু।

‘কেন? বড় হয়ে ও তোমায় ছায়া দেবে তাই?

এই প্রশ্নে চুপ করে রইল পারু। দীর্ঘসময়। তারপর বলল, ‘ও ছাড়া তো আর কেউ নেই আমার। এই পৃথিবীতে আমরা দুজন তো দুজনের ছায়াই। ছায়াসঙ্গীও। সামনের জীবনজুড়ে তো শুধু মরুপথ। সেই পথে আমাদের ছায়া দেয়ার তো কেউ নেই। আমরা দুজনই না হয় দুজনকে ছায়া দেব। আবার একলা চলার পথে একে অন্যের ছায়াসঙ্গীও হয়ে থাকব।’

তরু অবাক চোখে পারুর দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটা খুব দ্রুত বদলে যাচ্ছে। হয়ে যাচ্ছে অচেনা অন্য কেউ। তবে এই অন্য কেউ হওয়াটাই বোধহয় সবচেয়ে বেশি দরকার ছিল তার। জীবন যেখানে যেমন, তেমন হতে না পারলে টিকে থাকাটা কঠিন। পারুর সামনেও কঠিন এক জীবনই। তবে পারু কিন্তু তরুকে একবারও বলল না যে–তার কন্যার ওই নামটির কোথাও খুব চুপিসারে, আলগোছে রয়ে গেছেন বটবৃক্ষের মতো নীরবে নিভৃতে তাদের সকলকে আগলে রাখা ছায়ারাণীও।

.

হাসপাতালের কাছেই এক আয়া থাকে। ডিউটির সময়টাতে তার বাসায় ছায়াকে নিশ্চিন্তে রেখে দেয়া যায়। এই সুবিধাটুকু না হলে বড় ঝামেলা হয়ে যেত। তবে চাকরির এই বুদ্ধিটা তরুর। অনেক ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছে সে। এজন্য অবশ্য বেশ কয়েক মাস ট্রেনিং করতে হয়েছে পারুকে। বাংলাবাজারে একটি ট্রেনিং ইনস্টিটিউটে ক্লাস এইট অবধি পড়া মেয়েরাই ট্রেনিং নিয়ে নার্স হতে পারে। পারুও সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়েছে।

তরু বলেছে সে যখন পাকাপাকিভাবে ঢাকায় ফিরে আসবে, তখন তারা আবার একসঙ্গে থাকবে। একই হাসপাতালে কাজ করবে। সেটা হলে ভালোই হয়। তবে পারুর আজকাল মনে হয়, সে একা থাকতে শিখে গেছে। একা চলতেও। আজকাল আর কোনো কিছুতেই ভয় হয় না তার। আগে যেমন খানিক দূরের অচেনা কিছু, অনাহুত, আগন্তুক কিছু দেখলেই ভয় পেয়ে যেত। মনে হতো, সে কিছুতেই কিছু করতে পারবে না। সব এলোমেলো করে ফেলবে। কিংবা আতঙ্কে জড়সড় হয়ে যেত।

এখন ঠিক তার উল্টোটা। সহসা বিচলিত হয় না সে। যতবড় বিপদই আসুক না কেন, মনে হয় ঠিক সামলে নিতে পারবে। আর না পারলেও ক্ষতি নেই। সবকিছুই যে সবসময় নিজের মনের মতো হতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। এটা আর ভাবেও না সে। কিন্তু নিজের সাধ্যমতো চেষ্টাটা করে। তারপরও যদি না হয়, তখন আর কী করা! বদলে যাওয়া ওই পরিস্থিতির সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিতে শিখে গেছে সে। এই শিখে যাওয়াটাই তার ওই দুঃসহ জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।

মাঝে মাঝে মাঝরাতে যখন ঘুম ভেঙে যায়। তখন বুকের ভেতর সুদূর কোনো অচিনপুরের মন কেমন করা হাহাকারের সুরে চোখের কোল গড়িয়ে দু ফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়তে চায়। পারু তাদের ঝরতেও দেয়। তবে সে ওই অশ্রু ফোঁটাগুলোকে কান্না বলতে নারাজ।

মায়ের সঙ্গে শেষ অবধি চিঠিতেই একটা যোগাযোগ তার হয়েছে। প্রথম দিকে খুব পাগলামি করেছিলেন মা। কিন্তু তারপর দিন যত গিয়েছে, ততই যেন বাস্তবতাটা বুঝতে শিখেছেন। ফলে ধীরে ধীরে তিনিও মেনে নিয়েছেন সবকিছু। না মেনে করবেনই বা কী! তবে পারুকে সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে চারু। প্রায় নিয়মিতোই চিঠি লেখে সে। সেই চিঠির ভাষা এত পরিণত যে পারু অবাক হয়ে যায়। তার মাঝে মাঝে মনে হয়, চারু বুঝি বাবার মতো হয়েছে। আর সে মায়ের মতো। নাকি উল্টোটা? এটা অবশ্য ঠিকঠাক বুঝতে পারে না সে।

চারু আর পারু যে চিঠি লেখালেখি করে, তাতে বাবার কথা থাকেই না বলতে গেলে। থাকে না ছায়ারাণীর কথাও। এমনকি আজকাল মায়ের কথাও খুব কমই থাকে। বরং বেশি থাকে চারুর নতুন স্কুল, বন্ধুদের কথা। নানা ঘটনা, গল্পের কথা। তাদের কলকাতার বাড়ি, ছাদের বাগান, হাস্নাহেনা আর বেলিফুলের কথা। পিলু নামের যে কুকুরটা চারুর সঙ্গে রোজ স্কুলে দৌড়ে দৌড়ে যায়, তারপর গেটের সামনে স্কুল ছুটি না হওয়া অবধি দাঁড়িয়ে থাকে–সেই কুকুরটার কথাও থাকে। কেবল বাবার কথাই থাকে না। আর ছায়ারাণীর কথা।

কেন থাকে না?

এই প্রশ্নও তারা কেউ করে না। তবে কখনো কখনো বিষয়গুলো বড্ড বেশি ছেলেমানুষি হয়ে যায়। এই যেমন সেদিন চারু লিখল, আজ সন্ধ্যায় কী হয়েছে জানিস দিদি? আমাদের ছাদের টবের গাছটায় একটা গোলাপ ফুটল। কিন্তু কী আশ্চর্য, গোলাপটার রংটা কেমন কালচে। অথচ আমার দিব্যি মনে আছে আমি একটা লাল গোলাপের চারা এনে লাগালাম। আচ্ছা, দিদি তুই নিশ্চয়ই কালো গোলাপের কথা শুনেছিস। কিন্তু চোখে দেখেছিস কখনো? আমি না কখনো দেখিনি। কিন্তু বইয়ে পড়েছি। ব্ল্যাক রোজ হলো সিম্বল অব ডেথ। আমাদের বাংলা টিচার কী বলে জানিস? উনি বলেন গোলাপ হলো ফুলের রানি। তা সে কালো হোক কিংবা লাল। তো আমার তখন কী মনে হয়েছে জানিস? আমার মনে হলো– আচ্ছা, অন্য ফুলেরা কি জানে যে গোলাপ তাদের রানি? তারাও কি মানুষের মতো সবাই মিলে ভোট দিয়ে তাকে রানি বানিয়েছে?

মানুষ কী খামখেয়ালি এক প্রাণী দেখ? তারা কী নির্বিঘ্নে ফলের রাজা বানায়, ফুলের রাজা বানায়। অথচ নিজেদের রাজা বানাতে পারে না। সেটা বানাতে গেলেই শুরু হয় সংঘাত। কী অদ্ভুত না? তোর মনে আছে, একবার কী হয়েছিল? বাবা বাজার থেকে দুটা পুতুল কিনে আনলেন। একটা লাল, আরেকটা নীল। তারপর…।

চিঠির এই পর্যন্ত এসে হঠাৎ থমকে গেছে চারু। সে শেষ লাইনটা কলম দিয়ে যত্ন করে কেটে দিয়েছে। তারপর আবার চিঠি লিখেছে। তবে সেখানে ওই কেটে দেয়া প্রসঙ্গটি আর নেই। অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, এই পুরো চিঠির আর কোনো অংশই পড়ার আগ্রহ বোধ করে না পারু। তার কেবল চারুর ওই কেটে দেয়া অংশটুকুই পড়তে ইচ্ছে করে। সে দিনের পর দিন চেষ্টা করে ওই কাটা অংশটুকুর নিচের অক্ষর, শব্দগুলো উদ্ধার করতে। কখনো পারে। কখনো পারে না। কিন্তু তবুও সে জানে, চারু ওখানে কী লিখেছিল। পারু চাইলেই পরের চিঠিতে চারুর কাছে জানতে চাইতে পারে। কিন্তু তাও চায় না সে। তারা দুজনই আশ্চর্য এক লুকোচুরি খেলা খেলতে থাকে পরস্পরের সঙ্গে। সেই খেলায় কখনোই বাবাকে নিয়ে কথা বলতে চায় না তারা। বাবার স্মৃতির দগদগে ঘা-টাকে জাগিয়ে তুলতে চায় না। ওই ঘা জুড়ে যে অসহ্য যন্ত্রণা, সেই যন্ত্রণা সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। কিন্তু তারপরও তারা জানে, ভুবনডাঙার সেই মহিতোষ মাস্টার। সেই আদ্যোপান্ত মায়াময় অনুভব, সেই জলের মতো স্বচ্ছ, গভীর ও সহজ মানুষটাই ধরা ছোঁয়ার আড়াল থেকেও যেন রয়ে গেছেন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। আর কে না জানে, জগতে সে-ই বেশি অস্পর্শ যে সবচেয়ে বেশি গভীর, তীব্র ও বিশাল।

বাবার কথা মনে পড়লে পারুর কেবল ভুবনডাঙার কথাই মনে পড়ে। অনেক চেষ্টা করেও ঢাকায় দেখা শেষ কয়েক মাসের বাবাকে সে সহসা মনে করতে পারে না। অথচ এই বাবাকে এক পলক দেখার জন্য কী ভয়ানক তেষ্টার আগুনেই না সে দগ্ধ হয়েছে। তার চোখের সামনে বাবা এখনো ধুতি-পাঞ্জাবি পরে ভুবনডাঙার ওই স্নিগ্ধ, আদুরে বাড়িটার ঝকঝকে নিকানো উঠোনে হেঁটে বেড়ান। আমগাছটার ডালে একটা কবুতর বসে আছে। কবুতরটা বাবাকে দেখলেই ঝপাৎ করে ডানা ঝাঁপটে উড়ে আসে। তারপর আলগোছে বাবার কাঁধে বসে মাথার চুলে ঠোঁট বুলাতে থাকে। এই নিয়ে পারু আর চারুর কী ভীষণ ঝগড়া! বাবা বুঝি তাদের চেয়ে ওই কবুতরটাকেই বেশি ভালোবাসেন। কিংবা কালুকে। সেই গভীর চোখের গাইটা এখন কোথায়?

পারু অবাক হয়ে আবিষ্কার করে, মফিজুলের নামটা এখনো মনে আছে তার। সেই যে কালুকে নিয়ে গেল মফিজুল, আর এলো না। আসবেই বা কেন! তার তো আর আসার কথা ছিল না। পারুই বরং শেষ মুহূর্তে ছুটে গিয়েছিল রাস্তায়। কী এক না বলা অভিমানে কালু চলে যাচ্ছিল নিঃশব্দে। কারো দিকে তাকাচ্ছিল না অবধি। তারপর পারু যখন ছুটে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরল, তখন আচমকা কী যে হলো তার। সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তার সেই চোখ এই জীবনে আর কখনো ভুলবে না পারু। কী ছিল সেই চোখে? কান্না? ক্লান্তি? কষ্ট? নাকি করুণা?

পারু জানে না। কিন্তু কালুর জন্যও বুকের ভেতরটা কেমন করে তার। তুলসীতলা, পুকুরঘাট, শিউলীফুলের গাছ, বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ। আর সন্ধে হলেই যে বাবা বাইরে থেকে এসে কলতলায় কল চেপে পা ধুতেন। আর মা দাঁড়িয়ে থাকতেন পিলসুজের ওপর কেরোসিনের কুপি নিয়ে। বাবা আর মা তখন টুকুর টুকুর করে কথা বলতেন। মাঝে মধ্যে ঠাকুমা চেঁচিয়ে বলতেন, ও মহি, এতরাত অবধি বাইরে থাকিসনে বাপ। দিনকাল ভালো যাচ্ছে না। ঘরের ছেলে দিনে দিনে ঘরে ফিরে আসবি।

কোথায় সেই ঠাকুমা? সেই কলতলা? জলের শব্দ। রাতের নৈঃশব্দ্য। শিশির কিংবা ভেজা হাওয়ার ঘ্রাণ। কুয়াশার গান। ঝরা পাতার কান্না। কোথায় সেসব?

হয়তো সেসবই আছে। কেবল ওই মানুষগুলোই নেই। আর আসবেও না কখনো। কিন্তু কেন আসবে না? যদি ফি বছর আবার ফুল ধরে শিউলি গাছটায়, যদি রোদ এসে পড়ে চালতাতলায়, যদি বৃষ্টির নুপূর বাজে টিনের চালে, যদি মেঘ ডেকে যায় বুকের ভেতর, চাঁদ উঠে যায় ভুবনডাঙায়, তবে সেই মানুষগুলোই কেন আর আসবে না? কেন তারা কেবল স্মৃতিগন্ধা ফুল হয়ে ফুটে রইবে। আর গন্ধ ছড়াতে থাকবে স্মৃতির। সেই স্মৃতি কেন এত যন্ত্রণাকাতর হবে? কেন?

পারুর মাঝে মাঝে মনে হয়, তার টাকা হলে খুব ছোট্ট করে হলেও একটা বাড়ি কিনবে সে। নিজের বাড়ি। এই শহর থেকে অনেক দূরে। সেখানে ভুবনডাঙার মতো অমন আটপৌরে গন্ধমাখা একখানা টিনের চালের ঘর থাকবে। উঠোন থাকবে। দখিন দিকে বেলিফুলের সুবাস থাকবে। পুকুর পাড়ে হিজল ফুলের গাছ থাকবে। শিউলি ফুলের চাতাল জুড়ে সোনারঙা রোদ থাকবে। হবে এমন?

মাঝে মাঝে নিজেকে নিয়ে হাসেও সে। এই যে রোজ খানিকটা করে টাকা জমায়। তেল, নুন কিংবা মাছ-সবজির বাজার থেকে। রিকশা ভাড়া থেকে। বেতনের একটা অংশ মাসের প্রথমেই আলাদা করে রাখে। সেসব কেন? কার জন্য? পারু জানে না। কিংবা জানলেও সেটি স্বীকার করতে চায় না সে। ভারি সঙ্কোচ হয় তার। আচ্ছা, মানুষ কি নদী পাড়ের মাটির মতো? প্রবল স্রোতে বিলীন হয়েও চরের মতো জেগে ওঠে। ভাঙন শেষে গড়ে আবার। সব হারিয়েও স্বপ্ন দেখে।

এই এত এত ভাবনার মধ্যে ফরিদ কই? সে কি আছে? নাকি নেই? এই প্রশ্নটা অসংগত। তার তো না থাকার কথা নয়। বরং সবটাজুড়েই থাকার কথা। কিন্তু পারু জানে। জীবন আসলে ভাবনা নয়, জীবন হলো যাপন। এখানে প্রতিটা মুহূর্তে তাকে নতুন করে আবিষ্কার করতে হয়। অসংখ্য নুড়ি পাথরের ভেতর থেকে শেষ সম্বল এক মুষ্টি আহার্য চাল যেমন বেছে বেছে আলাদা করে তারপর উদরস্থ করতে হয়। তেমনি জীবনকেও অজস্র মৃত্যু, জরা, যন্ত্রণা থেকে বেছে বেছে আলাদা করে আস্বাদন করতে হয়। ফলে শৈশব-কৈশোরের যে জীবন স্বপ্ন হয়ে ভাবনার আকাশে রং ছড়ায়, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশই যাপনের মধ্য দিয়ে উপলব্ধ হয়।

হয়তো এ কারণেই জীবনের সবচেয়ে তীব্র অনুভব দিয়ে যাওয়া দুজন মানুষের কাছ থেকেই অহর্নিশ পালিয়ে বেড়াতে হয় তাকে। একজন মহিতোষ, তার বাবা। অন্যজন ফরিদ। কিন্তু ফরিদ কী তার? প্রেমিক? স্বামী? কিংবা অন্যকিছু? ভাবতে চাইবে না চাইবে না করেও এসব কথা পারুর বন্ধ ঘরের অন্ধকার কোনো গলিপথ দিয়ে ঢুকে পড়ে। তারপর সারাক্ষণ ঘুরতে থাকে মাথার ভেতর।

সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় ছায়াকে নিয়ে। বাড়ি ভাড়া নেয়ার সময় ছায়ার বাবার প্রশ্ন এলো। চাকরির সময় এলো। এমনকি আয়ার কাছে যখন সে ছায়াকে রাখতে যায়, তখনো এলো। এই এত এত প্রশ্নের মধ্যে ফরিদকে মনে না করে কোনো উপায় থাকে না তার। পারু জানে, জীবন তাকে এমন এক বিভৎস চোরাগলির মধ্যে এনে দাঁড় করিয়েছে যে এই চোরাগলি থেকে তার আর মুক্তি নেই। সারাটা জীবন তাকে এখানেই এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়াতে হবে। এর বাইরে কখনো যেতে পারবে না সে।

হাসপাতালের বাইরে ফুটপাতে প্রায়ই এক পাগলিকে বসে থাকতে দেখে সে। মাথাভর্তি জটা চুল। গায়ে ছেঁড়া, মলিন কাপড়। শীর্ণ শরীর। লোকজন তার পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেই সে হাত বাড়িয়ে ছুটে আসে। আর বলে, দে দে দে। দুইটা ভাত খাওনের টাকা দে। দে দে দে।’

ফুটপাতে পাগলিটার অবিন্যস্ত অস্থায়ী সংসার। তবে সেই সংসারে সে একা নয়। একটা হাড়-জিরজিরে শিশুও আছে। পারু রোজ তাদের দেখে। লোক না। থাকলে পাগলিটা কী মায়া নিয়েই না শিশুটার সঙ্গে খেলে! সেদিন ফেরার পথে সে দেখল পাগলিটা নেই। তবে তার সংসারটা তেমনই পড়ে আছে। কখানা ইট। কালিঝুলি মাখা একখানা দোমড়ানো ছোট্ট পাতিল। প্লাস্টিকের প্লেট। বোতল। রাস্তার দেয়াল থেকে তুলে আনা কয়খানা নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টার। ফেস্টুন। এগুলো মাটিতে বিছিয়ে ঘুমায় সে। কিন্তু কই গেল পাগলিটা?

তার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল হাসপাতালের গেটে। সে কিম্ভুত অঙ্গভঙ্গি, চিৎকার চেঁচামেচি করছে। পারু দারোয়ানকে বলল, কী হয়েছে?

‘দেখেন না সিস্টার, পাগলি ভেতরে ঢুকতে চায়।

“কেন?”

তার পোলার নাকি অসুখ। ডাক্তার দেখাইব।’

পারু তাকাতেই তার দিকেও তেড়ে আসে পাগলি। অশ্রাব্য ভাষায় গালি, চিৎকার শুরু করে। হতভম্ব পারু বলে, কী হয়েছে?

পাগলি তাতে সাড়া দেয় না। সে তারস্বরে চেঁচাতেই থাকে। ভেতরে ঢুকতে দিতে হবে তাকে। এমনকি এক হাতে দারোয়ানকে হঠাৎ আঘাতও করে বসে। রেগে গিয়ে দারোয়ানও পাল্টা আঘাত করতে যাচ্ছিল। কিন্তু তাকে নিবৃত করে পারু। সে পাগলিটির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সেই চেষ্টা খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। চারপাশ থেকে বিরূপ আচরণ পেতে ও দিতে অভ্যস্ত পাগলি আরো উগ্র হয়ে ওঠে। শেষ অবধি অবশ্য ভেতর থেকে লোক এসে তাকে সামলায়। তবে ঘটনাও ততক্ষণে বোঝা যায়। পাগলির কোলের শিশুটি অসুস্থ। প্রচণ্ড জ্বরে প্রায় অচেতন অবস্থা। সেই শিশুর চিকিৎসার জন্যই সে এখানে এসেছিল। কিন্তু সেটি ঠিকঠাক বলার সক্ষমতা তার নেই।

পারু বাচ্চাটিকে দেখল। ওষুধ দিল। সঙ্গে কিছু খাবারও। সেই থেকে তার সঙ্গে যেন খানিক ভাব হয়ে গেল পাগলিটির। আসা-যাওয়ার পথে মাঝেমধ্যেই তাকে এটা-সেটা দেয় পারু। একটা বালিশ, কম্বল। বাচ্চার জন্য খানিক দুধ। একটা বাটি। গ্লাস। পাগলিও যেন রোজ তার জন্য অপেক্ষা করে। সহজ হয়ে কথা বলে। যেন সে বুঝতে পারে, এই মানুষটি অন্যদের মতো নয়। আলাদা। ফলে সেও আলাদা হয়েই থাকে পারুর সঙ্গে।

সেদিন হুট করেই বাচ্চাটির বাবার কথা জানতে চায় পারু। পাগলিটি বেশ খানিকটা সময় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর কাঁদে। হাসে। উঠে চলে যায়। আবার ফিরে আসে। এর অর্থ পারু জানে না। তবে সে এটুকু জানে, জগতে ঈশ্বর যা যা সৃষ্টি করেছেন, তার মধ্যে সবচেয়ে বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে মা। সে নিজেও কি নয়?

এই যে সমাজ-সংস্কার, ধর্ম-বোধ এসবের কাছেই সে দোষী। অপরাধী। কিন্তু কই, তারপরও তো নিজের দায়িত্বটুকু সে এড়াতে পারল না।

আবার অন্যের অপরাধের শাস্তি তাকে ভোগ করতে হলেও ওই অর্ধ কিংবা অবচেতন পাগলিটিও তো তার কাঁধ থেকে দায়িত্বটা ফেলে দিতে পারল না। বাস্তবতা কিংবা প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও তারা দুজনই যেন এখানে কোথাও না কোথাও দাঁড়িয়ে আছে একই পরিচয়ে।

.

ফরিদের ওপর কি পারুর কোনো অভিযোগ নেই? কিংবা রাগ, অভিমান? আর কয়েকটা দিন কি সে তার জন্য অপেক্ষা করতে পারত না? এত ভালোই যদি কেউ বাসে, তবে এত দ্রুত সব ভুলে যেতে পারে? এই প্রশ্নটা যে কত অসংখ্যবার বুকের ভেতর উত্তরে হিম হাওয়ার মতো কাঁটা ফুটিয়েছে, পারু তা জানে না। তবে সে শুধু এটুকু জানে গলার কাছে একটা দলা পাকানো ব্যথা সারাক্ষণ বয়ে বেড়ায় সে। সেই ব্যথাটা কখনো কখনো ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। তারপর বুকভার যন্ত্রণা হয়ে অহর্নিশ সঙ্গ দিতে থাকে। ওই সময়টা থেকে পালিয়ে থাকতে চায় সে। কিন্তু পারে না। ফরিদ তার সামনে এসে দাঁড়ায়। সামনে এসে দাঁড়ায় অজস্র স্মৃতির সন্ধ্যা, মন খারাপের বিকেল, আলিঙ্গনের রাত্রি।

সে জানে, ফরিদ তাকে ভালোবাসততা। হয়তো এখনো বাসে। তা সে তাকে যতই ভুলে যাক। মনে রাখুক। কিংবা সরে যাক দূর থেকে দূরে। তারপরও যে একবার অমন অপার্থিব অনুভব স্পর্শ করেছে, তার পক্ষে এই জীবনে আর কারো স্পর্শে আন্দোলিত হওয়া সম্ভব নয়। ফরিদও কি পারছে?

পারু মাঝেমধ্যেই ওহাব ডাক্তারের চিঠিখানা বের করে পড়ে। তিনি লিখেছেন ফরিদ শারীরিক, মানসিকভাবে এতটাই বিপর্যস্ত-বিধ্বস্ত ছিল যে তার অমতে একভাবে জোর করেই আছমার সঙ্গে তার বিয়ে দেয়া হয়েছে। আসলেই কি তা সম্ভব? যদি ফরিদ সত্যি সত্যিই তা না চাইত? নাকি এই চাওয়া এবং না চাওয়া মানুষ আসলে বুঝতে পারে না। আর পারে না বলেই কি আছমা সন্তানসম্ভবাও!

ভাবতে না চাইলেও খুট খুট করে এই প্রশ্নটা পারুর মাথার ভেতর অনবরত ঘুণপোকা হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে। কিন্তু পারু এর উত্তর খুঁজতে চায় না। জগতে কত প্রশ্নই তো অজানা। তার সব কি আর জানতে আছে?

সবচেয়ে বেশি জানার চেষ্টা করা সত্ত্বেও মানুষের মনই বোধহয় সবচেয়ে বেশি অজানা। সেখানে সে আর ফরিদের কতটুকুই বা জানবে? নিজেকেও কি পুরোপুরি জানে সে? বুঝতে পারে? হলে ফরিদের এই খবর শোনার পর তো তার মরে যাওয়ার কথা।

এই যে জীবন, যে জীবনের শরীরজুড়ে দগদগে ঘা, সেই জীবন তো সে বয়ে বেড়িয়েছে ফরিদেরই জন্য। অথচ অজস্র যন্ত্রণার দুর্বিসহ যাত্রা শেষে যখন সে ঘরে ফিরে এলো, তখন সেই ঘরের দরোজায় কেউ অপেক্ষায় নেই। সেখানে ভেতর থেকে মস্ত বড় খিল আঁটা। ওই খিল কখনো খুলবে না। কিংবা খুলতেও যাবে না সে।

এ কি তবে অভিমান নয়? একবার কি অন্তত বন্ধ দরজাটার সামনে গিয়ে সে দাঁড়াতে পারত না? বলতে পারত না, আমি তো এসেছি। তবে তুমি কেন নেই? ভালোবাসলে এত দ্রুত ভুলে যেতে আছে? প্রিয়তম মানুষের জন্য একটা জনম অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয়া যেত না? এত সহজ ভালোবাসা? খানিক আড়াল হলেই অন্য কোনো ছায়া এসে তাকে ঢেকে দিতে পারে? খানিক ফাঁকা হলেই অন্য কেউ এসে পূরণ করে দিতে পারে জায়গাটা? একটুও কষ্ট হয় না? একলা লাগে না? মনে পড়ে না?

মনে হয় না যে এ জীবনের কোথাও কেউ নেই, কিছু নেই? এসবই অর্থহীন, অনুভূতিহীন, অসাড়?

.

পারু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। লুকায়। কখনো কখনো স্মৃতির কাছে নিজেকে সমর্পণও করে। কিন্তু কাঁদে না। বরং হাসে সে। কারণ সে জানে, হাসির মতো এমন নিখুঁত পোশাক আর পৃথিবীতে নেই। এই পোশাকের আড়ালে যা লুকানো যায়, তা লুকানো যায় না আর কিছুতেই। ফলে তার জীবনের নাম হতে থাকে পলাতক জীবন। এখানে সে হাসিমুখী মানুষের বেশে খেলে যায় লুকোচুরি খেলা।

৪৭

ফরিদ খুন হয়েছে!

তবে তাকে বিষ প্রয়োগে মারা যায়নি। অনেক চেষ্টা করেও কাজটা করতে পারেনি দেলু বা মতি মিয়া। এর মধ্যে কয়েকবার শফি খাঁর লোকজনকে তার দোকানের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখা গেছে। মাঝখানে একদিন পুলিশও কেন যেন এলো! আশরাফ খাঁর মামলায় আবার নতুন কোনো তদন্ত শুরু হয়েছে নাকি? বিষয়টা উত্তেজিত করে তুলল কামালকে। কোনোভাবেই ফরিদকে সাক্ষ্য দিতে দেয়া যাবে না। প্রয়োজনে তাকে নিজ হাতে খুন করবে সে। তারপর পালিয়ে যাবে সেই রাতেই। পুলিশ জানে না যে সে এখানে আছে। ফলে ফরিদ খুন হলে চট করে তারা ধরতেও পারবে না যে খুনটা কে করেছে। হ্যাঁ, শফি খাঁ অভিযোগ করলে হয়তো সন্দেহটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দিকেই ঝুঁকবে। কিন্তু সে থাকলে সেটি যতটা পাকাপোক্ত হবে। সে না থাকলে ততটা হবে না। সুতরাং খুন করে যতদ্রুত সম্ভব পালিয়ে যাবে সে।

কামাল অবশ্য কিছুতেই নিজে খুনটা করতে চায়নি। কিন্তু তাকে একভাবে বাধ্য করেছে মতি আর দেলু। তারা এত চেষ্টা করেও ফরিদকে বিষ প্রয়োগের কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারেনি। বরং একেকদিন একেকরকমের বাহানা দিচ্ছিল। বিষয়টাতে বিরক্ত, ক্ষুব্ধ কামাল শেষ অবধি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠল। সে সেদিন সবার সামনে মতি মিয়াকে থাপ্পড়ই মেরে বসল। এর অবশ্য কারণও আছে। শেষ কিছুদিন ধরে মতি মিয়া কেমন যেন উদ্ধত হয়ে উঠছিল। কামালের মুখে মুখে কয়েকবার তর্কও করল সে। বিষয়টাতে ভারি অবাক হলো কামাল। কিন্তু নানা কারণে উত্তেজিত কিংবা উদ্বিগ্ন থাকায় বিষয়টা তলিয়ে দেখার অবকাশ পেল না সে। বরং প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়ে উঠল। এই থেকেই দ্রুত পরিস্থিতি পাল্টে গেল। সেদিন রাতে এছাহাক আর জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে ডাকল সে। তারপর বলল, সিদ্ধান্ত আমি নিয়া ফালাইছি।’

কী সিদ্ধান্ত? জিজ্ঞেস করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

‘খুনটা আমিই করব।

‘কী বলেন কামাল ভাই?’ প্রায় আঁতকে ওঠা গলায় বলল এছাহাক। কাজটা কি ঠিক হইব?

‘আমার মাথামুথা কিন্তু গরম এছাহাক ভাই। এরমধ্যে আর গরম করবেন না। দিয়েছিলাম তো আপনাদেরই করতে। তো কার কী… ফালাইছেন আপনারা? বিশি গাল বকে কথাগুলো বলল কামাল।

তারপরও আরেকটু ভাইবা দেখ কামাল। পরিস্থিতি কিন্তু এমনেই ভালো না। এর মধ্যে এত বড় একটা কাজ করা কি…।’ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আরো কিছু বলবেন বলে ভাবছিলেন। কিন্তু তার আগে রুদ্রমূর্তি ধারন করল কামাল। বলল, কতগুলা রামছাগল পালতেছেন। এদের ভাত-তরকারির বদলে এখন থেকে ঘাস খেতে দেবেন। এরা ঘাস ছাড়া আর কিছু খাওয়ার যোগ্য না। এরা আমার মাথাটা গরম করে দিছে। আর ওই মতি মিয়ারে আমার থেকে দূরে থাকতে বলবেন। না হলে ওরেও আমি খুন করে ফেলতে পারি। আমার কিন্তু মাথার ঠিক নাই।’

.

এরপর আর কেউ কোনো কথা বলার সাহস পেল না। তবে এছাহাক তারপরও যতটুকু সম্ভব তাকে ইনিয়ে বিনিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল। তাতে অবশ্য লাভ হলো না। সে তার সিদ্ধান্তে অটল। এই সময়টায় আকাশে চাঁদ থাকলেও ঘন কুয়াশা থাকার কারণে হাতখানেক দূরের জিনিসও দেখা যায় না। এটা অবশ্য একদিক থেকে ভালো। রাতে যাতায়াতে সুবিধা হবে। কামালের সঙ্গে থাকবে এছাহাক আর দেলু। তবে তারা বাড়ির ভেতরে ঢুকবে না। বাইরে দাঁড়িয়ে কামালকে ফরিদের বাড়ির নানা কিছুর অবস্থান দেখিয়ে দেবে।

পরিকল্পনার জন্য অবশ্য একটা দিন সময় নিতে হলো। একবার রাতের অন্ধকারে তারা বাড়িটা দেখেও এলো। তবে খুনের চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে হলো এছাহাককেই। এর অবশ্য কারণও আছে। ওই বাড়িতে সবচেয়ে বেশিবার গিয়েছে সে। ফলে সে জানে কোথায় কী আছে। গ্রামের বাড়ির শৌচাগারটা সাধারণত মূল ঘর থেকে দূরে থাকে। সঙ্গে একটা কলতলা। ওহাব ডাক্তারের বাড়িতেও তেমন।

তবে এখানে সুবিধাটা হলো কলতলা আর শৌচাগারটা বাড়ির পেছন দিকে। ওই জায়গাটা একটু অন্ধকার। গাছপালাও বেশি। ফলে বেশ একটা আড়াল রয়েছে। এছাহাকের মতে, রাতে একবার না একবার ফরিদ বাথরুমের জন্য বের হবেই। ঘটনা ঘটাতে হবে তখন।

বুদ্ধিটা পছন্দ হলো কামালের। ফলে আর বেশি দেরি করতে চাইল না সে। তবে খুনের উপায় নিয়ে সে ভাবছে। এমনভাবে করতে হবে, যাতে শেষ পর্যন্তও খুনির বিষয়ে একটা সন্দেহের সুযোগ থাকে। সমস্যা হচ্ছে সেই উপায়টা কিছুতেই মাথায় আসছে না। কথাটা অন্য দুজনের সঙ্গে শেয়ারও করল কামাল। আর বুদ্ধিটা তখুনি দিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বললেন, “একটা কাজ করা যায়।

কী কাজ?

‘গুলি কইরাই মারা যায়।

কী! গুলি করে? আপনার কি মাথা খারাপ দুলাভাই? বিরক্তির স্বরে কথাটা বলল কামাল। এই গ্রামে এখন গুলি করে মানুষ খুন করলে কী হবে সেইটা বুঝতেছেন না আপনি? এই নিয়া হইচই বাইধা যাবে।’

যাবে। তবে সেই হইচই-তে আমরাও ঢাকা পইড়া যাইতে পারি।’

মানে কী? খুলে বলেন।’ কথাটা বললেও কামালের কণ্ঠে সন্দেহের সুর।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড কতগুলা পলিটিক্যাল পার্টির কথা শুনছস না?”

হুম। শুনছি।

‘তারা যে এখন এই সব অঞ্চলেও আসতে শুরু করছে, জানস?

‘ঢাকায় থাকতে পেপার-পত্রিকায় কিছু পড়ছি। আপনাদের এইদিকেও নাকি মাঝেমধ্যে আসে। বড় গৃহস্থের কাছ থেকে ধান-চাল টাকা পয়সা সংগ্রহ করে চরাঞ্চলের গরিবদের মধ্যে বিলায় দেয়?

এইগুলা আগে করত। এখন আর করে না।

‘এখন তাইলে কী করে?

এখন নিজেরা নিজেরাই গ্রুপিংয়ে ব্যস্ত। এক দল ভাইঙা অনেক দল হইছে। তো এই দল চালাইতে টাকা লাগে না? লোক লাগে না?

হুম। লাগে।

‘তো তারা এখন বিভিন্ন গ্রাম থেকে সম্পন্ন গৃহস্থের কাছ থিকা চান্দা তুইলা দল চালায়। যার থেকে যা পারে আর কী! আর কমবয়সী পোলাপানরে দলে ঢুকাইতে চায়। এই নিয়া শুরু হইছে গ্রুপে গ্রুপে কোন্দল। মারামারি। খুনাখুনি পর্যন্ত। তো মাঝেমধ্যে আমাগো বাজারেও আসে চান্দার টাকার জন্য। সব দোকানেই চান্দা চাইছে।

‘আসল কথা কন। অধৈর্য হয়ে বলল কামাল।

আসল কথা হইলো, যেহেতু এইদিকে তারাও আজকাল আসতেছে। তো ফরিদ যদি গুলিতে মারা যায়, তাইলে একটা সুযোগ আছে ঘটনা তাদের দিকে ঘুরাই দেওনের।

‘কেমনে?

‘ধর এমনও তো হইতে পারে যে তারা চান্দা চাইছিল ওহাব ডাক্তারের কাছে।

হুম।

বা ধর ফরিদরে কোনো একটা গ্রুপ তাদের দলে ঢুকাইতে চাইছিল। কী হইতে পারে না এমন?

হুম। পারে।

‘তো ফরিদ ধর রাজি হয় নাই দেইখা তারা ঘটনা ঘটাই দিছে। আবার ধর এমনও তো হইতে পারে যে–সে এক দলে ঢুকছে, তখন অন্যদল আইসা খুন কইরা রাইখা গেল? এখন তো এইরকম ঘটনাই ঘটতেছে। হইতে পারে না এমন? কী এছাহাক, এমন হইতেছে না?

এছাহাক চিন্তিত ভঙ্গিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। ঘটনা সত্য। এই গাঁয়ে এখনো এমন কিছু না ঘটলেও এসব অনেক জায়গায়ই ঘটছে। এই নিয়ে প্রশাসনও চিন্তিত হয়ে পড়েছে।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, জিনিসটা ভাইবা দেখ। এই অজপাড়া গাঁয়ে পিস্তলের গুলিতে কেউ মারা গেলে, বিষয়টা আর সাধারণ থাকবে না। তখন এইটা ওইদিকেই যাইব। আর তুই যে এইখানে আছস, এই কথাতো আর কেউ জানে না। জানলে সেইটা আলাদা ব্যাপার ছিল।

কথাটা ভাবল কামাল। গ্রাম-গঞ্জে যেসব খুনখারাবি হয়, তার বেশির ভাগই মূলত দেশীয় অস্ত্রে। বিশেষ করে বর্শা, দা-বঁটি, ছুরি-চাকুর মাধ্যমে। সেখানে গুলি খেয়ে কেউ মারা গেলে বিষয়টা নিয়ে একটা হইচই হবেই। আর এখন যেহেতু ওই পার্টির অভ্যন্তরীণ গ্রুপগুলোর কোন্দল চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, সেহেতু চাইলে খুব সহজেই বিষয়টাকে ওদিকে প্রবাহিত করা যাবে। বুদ্ধিটা আসলে খারাপ দেননি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। পরিস্থিতি বিবেচনায় বরং এর চেয়ে ভালো আর কিছু হয়-ই না। ফলে আর সময়ক্ষেপণ করল না কামাল। কথাও বাড়াল না। উঠে দাঁড়াল সে। পিস্তলটা অনেকদিন ব্যবহার করা হয় না। ঘটনা ঘটানোর আগে সেটাকে একটু ঘষে-মেজে ঠিকঠাক করে নিতে চায় সে। তারপর অপেক্ষা রাতের।

.

তখন মাঝরাত। আকাশে ভরা চাঁদ। সেই চাঁদের আলো ঘন কুয়াশায় মাখামাখি হয়ে অপার্থিব এক দৃশ্য তৈরি করেছে। সেই দৃশ্য দেখার অবকাশ অবশ্য কারো নেই। ওহাব ডাক্তারের বাড়ির বাইরে গাছের আড়ালে বসে আছে কামাল, এছাহাক আর দেলু। এখান থেকে তারা ফরিদের অপেক্ষা করবে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসার শব্দ শুনলেই কামাল লুকিয়ে একা একা কলতলার কাছটাতে চলে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে ঘটনা ঘটাবে। সমস্যা হচ্ছে ফরিদ বাইরেই বসে আছে। তবে সে যে একা বসে আছে তা না। তার সঙ্গে বসে আছে আছমাও। ফলে প্রায় হাতের নাগালে পেয়েও কিছুই করতে পারছে না তারা। বরং আড়াল থেকে উঠানে বসে থাকা কুয়াশায় আবছা হয়ে থাকা ছায়ামূর্তি দুটিকে দেখছে তারা। আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকতে হবে কে জানে!

এছাহাক ফিসফিস করে বলল, এরা আর কতক্ষণ এইভাবে বইসা থাকব?

‘সেটাই তো বুঝতে পারছি না। আজকেই একদম প্রেম উথলাই উঠছে। বিরক্ত গলায় বলল কামাল।

‘সেইটাই। এই ঠাণ্ডায় কতক্ষণ থাকন যায়।

তাগো তো আর সমস্যা নাই। গায়ে মোটা কথা জড়াইয়া বইসা আছে। বলল দেলু।

হুম। মনে হচ্ছে দুইটারেই শেষ করে দেই। রাগে গজগজ করতে করতে বলল কামাল। ঠাণ্ডায় মনে হয় জমে যাচ্ছি।’

তাদের ভোগান্তি অবশ্য সহসা ফুরাল না। ফরিদ আর আছমা ঘরে গেল প্রায় শেষ রাতের দিকে। কিন্তু তারপর আর ঘর থেকে বের হলো না তারা। বিরক্ত, বিপর্যস্ত কামাল অনেকটা মরিয়া হয়েই উঠান পেরিয়ে ঘরের দিকে গেল। বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে চায় সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘরের দরজাটা নড়ে উঠল। তারপর খানিক আগের সাদা কাঁথায় আপাদমস্তক আবৃত হয়ে ঘর থেকে কেউ বেরিয়ে এলো। কামাল আর এক মুহূর্ত দেরি করল না। হাত দশেক দূর থেকে কুয়াশায় ঢাকা ছায়ামূর্তিটাকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টিপে দিল সে। শেষ রাতের অন্ধকারে, নিঃশব্দ-নিস্তব্ধতায় তীব্র একটা শব্দ তুলে বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেল বুলেট! তারপর বিদ্ধ করল মানুষটাকে। মুহূর্তেরও ভগ্নাংশ সময়ের মধ্যে মানুষটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। তারপর নির্জীব, নিথর হয়ে গেল। একটা শব্দ অবধি বের করতে পারল না মুখ থেকে। তবে ঘরভর্তি মানুষ ততক্ষণে জেগে গেছে। কী হয়েছে। ওখানে? কী হয়েছে?

কামাল অবশ্য সেসব দেখার জন্য অপেক্ষা করল না। সে নিঃশব্দে উঠান পেরিয়ে ছুটতে লাগল রাস্তার দিকে। তাকে এখুনি গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে। এই গ্রামে আপাতত বেশ কিছুদিন আর আসবে না সে। অন্তত সবকিছু ঠাণ্ডা হওয়া অবধি অপেক্ষা করতে হবে। তবে কাজটা যে ঠিকঠাক শেষ করতে পেরেছে, এটিই তার স্বস্তি। এছাহাক আর দেলু ততক্ষণে ছুটতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া দাঁড়িয়ে ছিলেন ঘরের দরজায়। কামালকে দেখে তিনি নিচে নেমে এলেন। বললেন, ‘ঘটনা ক্লিয়ার?

কামাল মৃদু হাসল, ‘ক্লিয়ার।

“আর সাক্ষ্য দিতে চাইব নাতো সে?

তার ভূতে চাইতে পারে। মৃদু হাসল কামাল।

চাদরের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে কামালের কনকনে ঠাণ্ডা হাতখানা ধরলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, তুই তোর পথ ধর। এইদিকটা আমি সামলাইতেছি।

কামাল কথা বলল না। সে হাতের মুঠোয় দুলাভাইয়ের হাতখানা শক্ত করে চেপে ধরল। তারপর বলল, আমি আবার আসব। ওই গুপ্তধনের শেষ না দেখে আমি ছাড়ব না। আপনারে আমি কথা দিচ্ছি।

বলেই হাঁটতে শুরু করল কামাল। এই মানুষটাকে অসম্ভব পছন্দ করে সে। সম্ভবত তাদের মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক কোনো সাদৃশ্য রয়েছে। নাহলে এভাবে তারা বারবার কাছে আসত না। পরস্পরের সান্নিধ্যও এত উপভোগ করত না। এই এতগুলো দিন এক সঙ্গে থাকার পরও এখন মানুষটাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হচ্ছে। কামালের। আবার কবে দেখা হবে কে জানে! তবে মানুষটাকে সারাক্ষণই মনে পড়বে তার। সবকিছু শান্ত হলে আবার ফিরে আসবে সে। গুপ্তধনের বিষয়টার সুরাহা করে ছাড়বে। এমন পরাজয়ের ঘটনা তার জীবনে খুব একটা নেই। ফলে বিষয়টা মন থেকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে। তারপরও আজ রাতের কাজটা অন্তত ঠিকঠাক করতে পেরেছে ভেবে খানিক স্বস্তি পাচ্ছে। ফিরে যাওয়ার সময় এই স্বস্তিটুকুর দরকার ছিল তার। আপাতত তার গন্তব্য জয়পুরহাটের এক গ্রাম। সেখানকার ঠিকানা এছাহাককে দিয়ে গেছে সে। যাতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই তাকে জানাতে পারে। সঙ্গে সঙ্গে চলে আসবে সে।

কামালের অপস্রিয়মাণ ছায়ার দিকে তাকিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মনটাও কেমন বিষাদাচ্ছন্ন হয়ে গেল। ছেলেটা তার জন্য এমন কিছু নেই যে করেনি। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় ছিল না। ফলে গুপ্তধনটার কোনো খোঁজ বের করতে পারেনি। তবে তিনি জানেন, কামাল শিগগির আবার ফিরে আসবে। এবং ওই গুপ্তধনের শেষ না দেখে ছাড়বে না সে। সেই অবধি এছাহাককে নিয়েই বাকি ঝড় সামাল দিতে হবে তাকে। এতদিন কামাল থাকায় বেশ খানিকটা চুপচাপই ছিল এছাহাক। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া জানেন, সময়ে সেও ক্ষুরধার হয়ে উঠতে পারে। এর প্রমাণও সে বিভিন্ন সময়ে দিয়েছে। এবার আবারও তার পালা।

৪৮

এছাহাক অবশ্য তার ক্ষুরধার মস্তিষ্কের খেলাই দেখাল। তবে তার আগে ঘটল আরেক ঘটনা। ওহাব ডাক্তারের বাড়ি থেকে ভেসে আসা গগনবিদারী চিৎকারের শব্দে ফজরের নামাজ পড়তে যাওয়া মুসল্লিরা ছুটে এলেন। তারা এসে দেখলেন। উঠানে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদছেন নুরুন্নাহার। ওহাব ডাক্তার পড়ে আছেন বারান্দার মেঝেতে। সম্ভবত জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে দরজার কাছটাতে ঠায় বসে আছে ফরিদ! কিন্তু তার মুখে কোনো শব্দ নেই। চোখে কান্না নেই। বুকে যন্ত্রণা নেই। যেন সে তার কোলে থাকা মৃতদেহটির মতোই নিথর, নির্জীব, প্রাণহীন। এক জোড়া অশ্রুহীন চোখ তুলে সে তাকিয়ে আছে শূন্যে। তার সেই চোখের দৃষ্টি সহ্য করা কঠিন।

ফরিদের কোলে পড়ে আছে আছমার নিথর দেহ। শেষ রাতে ফরিদ যখন ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন সে একা একাই ঘর থেকে বেরিয়েছিল। মানুষটাকে আর জাগাতে চায়নি সে। কিন্তু দরজা খুলে বাইরে পা দিতেই গুলিটা তার পিঠ এফোড় ওফোঁড় করে দিল। একটা শব্দ পর্যন্ত করতে পারেনি সে। আর কখনো করবেও। ফরিদকে যে কতজন কতকিছু জিজ্ঞেস করল। কিন্তু সেসব যেন শুনতেই পেল সে। এই এত এত মানুষের চিৎকার, হৈ-হট্টগোল, কান্না, ভয়, আতঙ্ক কিছুই না। যেন এই পৃথিবীর কোথাও আর নেই সে। নেই অন্য কোথাও-ও।

যেন অদৃশ্য, অর্থহীন এক অস্তিত্ব সে। যেন আর কোনো দুঃখ, জরা, কান্না ক্লান্তিই আর কখনো তাকে ছুঁতে পারবে না। এই জীবনের সঙ্গে তার সকল লেনদেন ফুরিয়ে গেছে। আর কোনো প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আনন্দ-বেদনার অনুভব তার নেই।

.

পুলিশ এলো দুপুর নাগাদ। শফি খা তাদের খবর দিয়ে নিয়ে এসেছে। সব শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে সেদিনই ডেকে আনা হলো। তবে তাতে লাভ বিশেষ হলো না। তার মতো কাউকে চট করে বিনা প্রমাণে গ্রেপ্তার করা যায় না। ফলে অল্পবিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হলো তাকে।

তবে ঘটনার দিন তিনেক পর এক গভীর রাতে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বাড়িতে তল্লাশি চালাল পুলিশ। অদ্ভুত বিষয় হলো তার বাড়িতে তার বিছানার নিচেই শত বছরের পুরনো সেই সব গহনা পাওয়া গেল। হাতের বালা, বাজু থেকে শুরু করে নাকের নোলক, কোমরের বিছা অবধি। এগুলোই তাহলে সেই গুপ্তধন! অথচ এসবের কারণেই কি না রুস্তমের খুনি সন্দেহে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল আশরাফ খাঁকে!

পরের কয়েকদিনে পুলিশের তদন্তে নতুন নতুন মোড় নিল। জয়পুরহাটের এক প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে গ্রেপ্তার করা হলো কামালকে। তার কাছে একটি পিস্তল পাওয়া গেছে। সেই পিস্তলের গুলি মিলিয়ে দেখা হলো। আছমাকে যে গুলিতে খুন করা হয়েছে তা এই পিস্তলেরই গুলি!

পুলিশকে এসব বিষয়ে মহামূল্যবান তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছে এছাহাক, দেলু ও মতি মিয়া। কিন্তু তার পরও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আর কামালের সঙ্গে আটক করা হয়েছে তাদের তিনজনকেও। যদিও তাদের বিষয়ে পুলিশের বিশেষ পর্যবেক্ষণ আছে। মহিতোষ মাস্টারের গ্রাম ছাড়া হওয়া থেকে শুরু করে তার বাড়ি দখল, মন্দিরের গুপ্তধন, রুস্তম ও আছমার খুন সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য দিয়েছে তারা। সেই সব তথ্য পুলিশ মিলিয়েও দেখেছে। এবং তাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে। যে পুরোপুরি না হলেও এই সব ঘটনায় তারা মোটামুটি নির্দোষ। পুলিশের অবশ্য ধারণা, বাধ্য হয়েই কিছু কাজ তাদের করতে হয়েছে। এমনকি কামালের ভয়ে মুখও বন্ধ রাখতে হয়েছে।

তা ছাড়া, সবকিছু তারা জানতো না। কিন্তু শেষ অবধি জীবন বাজি রেখেই পুলিশের কাছে তারা মুখ খুলেছে। বিষয়টা বিশেষ বিবেচনায় নেয়া হলো। ফলে ঘটনার বছরখানেক পর পুলিশের সন্দেহের তালিকা থেকে পুরোপুরি নিস্তার পেল এছাহাক, দেলু ও মতি মিয়া। তাদের সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি পেলেন আশরাফ খাঁও।

.

তবে আছমার মৃত্যুর ভয়ানক শোক থেকে মুক্তি মেলেনি ওহাব ডাক্তারের। মেয়ের মৃত্যুর সপ্তাহখানেকের মাথায় মারা গেলেন তিনিও। এর আগের যে কটা দিন বেঁচেছিলেন সে সময়টাতেও সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন বিছানায়। নুরুন্নাহার পুরোপুরি চুপ মেরে গেছেন। খানিক মানসিক ভারসাম্যহীনও যেন।

.

তবে ফরিদ খুব স্বাভাবিক। যেন কোথাও কিছু হয়নি এভাবে জীবন কেটে যাচ্ছে তার। সে রোজ দু বেলা আছমার কবরের কাছে গিয়ে বসে থাকে। ভোরের আলো ফোঁটার সময়। সূর্যাস্তের সময়। শুধু ওই সময়টুকুই তার কাছে কেমন ঘোরের মতো লাগে। মনে হয় আমার সঙ্গে সে কথা বলতে পারে। কিন্তু আছমা কি তার কথা শুনতে পায়?

না পেলেও সে বলে।

“কী করছিস তুই?

আছমা জবাব দেয় না।

ফরিদ বলে, আমার কথা শুনতে পাচ্ছিস না?

আছমা তাও জবাব দেয় না। ফরিদের তখন খুব মন খারাপ হয়। আছমা সারাজীবন এমনই রয়ে গেল। সে কেবল শুনেই গেল। কাউকে কখনোই কিছু বলে গেল না।

শীতের কুয়াশায় তার কবরের ঘাসে শিশির জমে। রোদে সেই শিশির মরে যায়। চাঁদের আলোয় জোছনা গড়াগড়ি খায়। বর্ষা নামে। বৃষ্টির টুপটাপ শব্দে তার কবরের মাটি বুক পেতে শুষে নেয় কান্না। ফরিদ সেই কান্নার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হয়, এই যে সে আর কাঁদতে পারে না। তার সেই না বলা কান্নাই বোধহয় শিশিরের শব্দ হয়ে, বৃষ্টির অবিরাম বর্ষণ হয়ে ঝরে পড়ে। তার পর ছুঁয়ে যায় আছমার কবর।

আচ্ছা, আছমা কি সেই স্পর্শ অনুভব করে?

ফরিদ জানে না। মাঝে মাঝে ঠিক মাঝরাতে সে আছমার কবরের কাছে এসে দাঁড়ায়। কবরের ওপর বড় বড় ঘাস। কী এক নাম না জানা ফুল ফুটেছে। সেই ফুলের ঘ্রাণে চারপাশ ম-ম করে। আচ্ছা এই ফুলের ঘ্রাণ কি আছমা সুনভব করে? করার কথা নয়। ফরিদের তার পরও মনে হয় সে করে। বেঁচে থাকতেও তো বুকের ভেতর অজস্র অনুভবের ঘ্রাণ নিয়ে এমন নিঃস্তব্ধ হয়ে থাকত সে। কাউকে কখনো বুঝতে দিত না কী অবর্ণনীয় যন্ত্রণা, কী অথই ব্যথার সমুদ্র সে তার ওইটুকু বুকে পুষে রাখে। কত কত কথা, কত ব্যথা, কত আকুলতা সে আড়াল করে হেসে যেত।

আর বলে যেত বলতে না চাওয়া অজস্র কথা।

.

মানুষ এমন কেন? কেন তার বুকভার না বলা অসুখে? কেন সে মরে যায় জলজ দু চোখে?

ফরিদ এসব কিছুরই উত্তর জানে না। সে কেবল জানে, এইখানে এই ছোট্ট কবরটাতে পৃথিবীর সব না বলা কথা গভীরতম অনুভব হয়ে সমাহিত হয়ে আছে মাটির বুকে। প্রতি বৃষ্টি কিংবা জোছনার রাতে সেই অনুভব নাম না জানা ফুলের সুরভি হয়ে গন্ধ বিলাতে থাকে।

আছমা তো নাম না জানা এক ফুলই। না হলে তার সবটুকু সুবাস নিঃশেষে শুষে নিলেও ফরিদ কেন কখনোই তাকে চিনতে পারেনি?

৪৯

জেল থেকে বের হয়েই অস্থির হয়ে পড়ল মতি আর দেলু। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না যে শেষ অবধি এছাহাকও তাদের ঠকিয়েছে! না হলে যে গুপ্তধনের কথা বলে এছাহাক তাদের দলে ভেড়াল, সেই গুপ্তধনই কি না পাওয়া গেল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বাড়িতে! এ কেমন মিথ্যাচার এছাহাকের? নাকি সে অন্য কোনো ষড়যন্ত্র করেছে? এমন কি হতে পারে যে ওই গুপ্তধন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কাছেই ছিল? তিনি আর এছাহাক মিলে গোপনে তা তুলে নিয়েছিলেন? যাতে মতি আর দেলুকে ভাগ দিতে না হয়? কিন্তু পরবর্তীতে ওই ভাগ-বাটোয়ারা নিয়েই বেআবার এছাহাকের সঙ্গে ঝামেলা বেঁধে গেল তার। আর এ কারণেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে ফাঁদে ফেলে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিল সে? হতে পারে এমন? যদি তা ই না হবে, তা হলে গুপ্তধনগুলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বাড়িতেই পাওয়া গেল কী করে!

বিষয়টা যারপরনাই হতাশ, ক্ষুব্ধ করে তুলল মতি আর দেলুকে। জেলে থাকাকালীন এই নিয়ে অসংখ্যবার প্রশ্নও করেছে তারা। কিন্তু এছাহাক স্পষ্ট করে কোনো জবাব দেয়নি। কয়েকবার কেবল বলেছে, ‘জেলে বইসা এই সব দিয়া কাজ কী? আগে আল্লাহ আল্লাহ কইরা জেল থিকা ছাড়া পা। জেল থিকা ছাড়া না পাইলে দুনিয়ার সব ধন পাইলেও লাভ হইব না।

তা একথা মতি-দেলুও ভেবেছে। তাদের মনে কিঞ্চিৎ ভয়ও ছিল যে এছাহাক না আবার অন্য কোনোভাবে তাদের সারাজীবনের জন্য ফাঁসিয়ে দেয়। তবে তেমন কিছুই হলো না। বরং এছাহাকের সঙ্গে সঙ্গেই ছাড়া পেল তারা। আর ছাড়া পেয়েই বিষয়টা নিয়ে উচ্চকিত হয়ে উঠল দুজন। এছাহাক অবশ্য সাড়াশব্দ করল না। তাড়াহুড়াও না। সে বরং চুপচাপ ভূঁইয়া বাড়ির অভ্যন্তরে আগের মতোই অনুগামী ভৃত্য হিসেবে কাজে নিয়োজিত হয়ে গেল। আর অপেক্ষা করতে লাগল সময়ের। কারণ সে জানে, সময়ের চেয়ে বড় বিচারক আর নেই। নেই সময়ের চেয়ে বড় গুপ্তঘাতকও।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বড় ছেলে লিয়াকত শ্বশুরবাড়ির ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে বাবার সংসারের হাল ধরতে খুব একটা উৎসাহী হলো না। যতটুকু চেষ্টা সে করল, তাতে চিত্ত ছিল না। যা ছিল, তার নাম চাঞ্চল্য। তবে তার সেই লোক দেখানো চাঞ্চল্যে পরিস্থিতির হেরফের হলো না। বরং তার ছোটো ভাই শওকত অনেকটাই সংসারমুখী হয়ে উঠল। কিন্তু বিষয়-আশয় সম্পর্কে তার জ্ঞান খুবই সীমিত। ফলে অল্পদিনেই ভূইয়াবাড়ির নেপথ্যের কারিগর হয়ে উঠল এছাহাক। এর অবশ্য কারণও আছে। সে জানে, চট করে সামনে চলে এলে লোকে তাকে মানবে না। এই গাঁয়ের সকলেই তাকে সেই এতটুকু কাল থেকে চেনে। ফলে এতদিনকার সেই তুচ্ছাতিতুচ্ছ এছাহাক হঠাৎ ভূঁইয়া বাড়ির কর্তাব্যক্তি হয়ে উঠতে চাইলে লোকে তা মানবে কেন?

এছাহাক তাই আবারও ধৈর্য ধরতে শুরু করল। শওকতকে সামনে রেখে সে শাসন করতে লাগল ভুবনডাঙার সাম্রাজ্য। সে জানে, তার সময় আসবেই। আর তখন সুযোগ বুঝে আড়াল থেকে সামনে চলে আসতে হবে তাকে। হয়ে উঠতে হবে সর্বেসর্বা। তবে এই যাত্রায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মতো ভুল করতে চায় না সে। হতে চায় না অত্যাচারী, স্বেচ্ছাচারী শাসক। বরং যতটা সম্ভব নমনীয়, গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে চায় সে। হয়তো এই একটি কারণেই মানুষের কাছে নিজের জায়গা তৈরি করতে পারবে সে।

এসব কারণেই কি না কে জানে, অসন্তুষ্ট মতি আর দেলুকে একদিন ডেকে আনল সে। তারপর বলল, ‘কী রে? আমার ওপর খুব গোস্বা তোদের?

মতি আর দেলু জবাব দিল না। তবে তাদের মুখ থমথমে। এছাহাক বলল, কী হইছে, এইবার খুইলা বল।

কী আর বলব? আপনে যেই লোভ দেখাইয়া এতদিন এত কাজ করাইলেন, জেল খাটাইলেন। সেই জিনিসই তো আপনের কাছে নাই।

‘কোন জিনিস?

এছাহাকের প্রশ্নে ভারি অবাক হলো মতি আর দেলু। দুজন পরস্পরের দিকে চোখ চাওয়াচাওয়ি করে গলা নামিয়ে বলল, “কোন জিনিস মানে? যার জন্য এত কিছু করলাম, সেই গুপ্তধন?

এছাহাক মৃদু হাসল। বলল, ‘গুপ্তধন তো আছে।

‘আছে!”

হুম।

কই আছে? সব তো ভূঁইয়া সাবের বাড়িরতন পুলিশ নিয়া গেছে।

‘পুলিশ নিছে ভূঁইয়ার ভাগেরটা। আমাগো ভাগেরটা তো আর নেয় নাই।’

মানে?

মানে…।’ বলে একটু থমকাল এছাহাক। তারপর বলল, মানে হইল ওই জিনিসে কার কার ভাগ আছিল?

‘আপনে, ভূঁইয়া সাব, আর আমরা দুইজন।

‘তো আমরা তিনজনে কতটুক পাইতাম? ভূঁইয়া সাবের সমান?

এই প্রশ্নে মতি আর দেলু থমকে গেল। এছাহাক বলল, কী? কথা কস না কেন? তার সমান আমরা পাইতাম?

‘জে না।’

তাইলে?

‘আমরা অল্প পাইতাম। ভূঁইয়া সাব বেশি পাইত।

কত বেশি?

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না মতি আর দেলু। এছাহাক বলল, ভূঁইয়া সাবের ভাগেরটা আমি পুলিশরে দিয়া দিছি। তার বাড়িতে তল্লাশি কইরা পুলিশ যেই জিনিস পাইছে, ওই জিনিস তার বাড়িতে আমিই রাখছি। তারে ফাঁসানোর জন্য। ওই জিনিসের কথা ভূঁইয়া সাবও জানত না।’

তাইলে আমাগোটা আছে?’ চোখ চকচক করে উঠল মতি আর দেলুর। • এছাহাক হাত তুলে তাদের সংযত হতে ইশারা করল। তারপর বলল, ‘আছে। কিন্তু এত উত্তেজিত হওয়া যাবে না।

হইলাম না। কিন্তু আমাগো ভাগে আর কত আছে?’ ঠোঁট উল্টে বলল মতি মিয়া। বেশি তো থাকার কথা না। পুলিশ যেই পরিমাণ ভূঁইয়া সাবের ঘরের থিকা নিছে, তারপর তো খুব কমই থাকার কথা।

এবার বিরক্ত হলো এছাহাক। বলল, এইজন্যই কথায় বলে–অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। ওই সব জিনিস যদি আমি তোরে দিয়া দিতাম, তুই তা ভোগ করতে পারতি?

‘পারতাম না কেন?’ বলল মতি মিয়া।

‘পারতি না কারণ, পুলিশ ওই জিনিস পাগলের মতো খুঁজতেছিল। আশপাশে সব জায়গায় তাদের সোর্স লাগানো ছিল। বেচতে গেলেই কাক কইরা ধইরা জেলে ঢুকাই দিত।

এই কথায় চুপ করে গেল মতি মিয়া। কথা খারাপ বলেনি এছাহাক। কিন্তু বিষয়টা মন থেকে মানতে পারছে না সে। এছাহাক বলল, কিন্তু এখন কী হইছে?’

কী?

‘পুলিশ জানে তারা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বাড়ি থিকা সব গুপ্তধন উদ্ধার কইরা ফেলছে। তাই না?

হুম।

‘কিন্তু তারা একটা জিনিস জানে না।

‘কী?

তারা জানে না যে আরো কিছু জিনিস এখনো বাইরে রইয়া গেছে। কারণ তারা তো আর জানত না যে মোট কতগুলা জিনিস ওই মন্দিরের তলায় আছিল! কি, জানত?

না, তা জানত না।

‘এইজন্যই এইটা নিয়া এখন আর তাদের কোনো মাথাব্যথা নাই। কারণ তারা তো এখন নিশ্চিত জানে যে সব জিনিসই তারা পাইয়া গেছে। নাকি?’

হুম।’ যেন এতক্ষণে বিষয়টা বুঝতে পারল মতি মিয়া।

এছাহাক বলল, এখন আর কয়টা বছর ধৈর্য ধর। তারপর পরিস্থিতি একটু ঠাণ্ডা হইলে তখন ধীরে-সুস্থে নিজেগো ভাগেরটা দিয়া যা ইচ্ছা করিস। তখন আরামসে ভোগ করতে পারবি। আমি এই বুদ্ধি না করলে ওই জিনিসের এক কোনাকাঞ্চিও ভোগ করতে পারতি না। নিজের পেটের তুলনায় বড় জিনিস খাইতে গেলে কি হয় জানস তো? ওই খাওনই হয় গলায় আটকাইয়া অথবা বদহজম হইয়া মৃত্যু ঘটে।

এই কথায় মতি মিয়া চুপ করে গেল। তবে এতক্ষণে কথা বলল দেলু, আপনে তাইলে এক কাজে দুই কাজ করলেন এছাহাক ভাই?’

এছাহাক জবাব দিল না। প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল। দেলু বলল, একই সঙ্গে ওই জিনিস দিয়া জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারেও পুলিশের কাছে ধরাইয়া দিলেন প্রমাণসহ। আবার বাকি মালের রাস্তাও পরিষ্কার করলেন?

এছাহাক এবারও কথা বলল না। দেলু সমীহের চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মতি মিয়া অবশ্য তাতে দ্রবীভূত হলো না। সে বলল, কিন্তু জিনিস আপনে কই রাখছেন সেইটা কিন্তু বলেন নাই? এখনো কি মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতেই ওই জিনিস আছে?

এছাহাক আবারও হাসল। রহস্যময় হাসি। সেই হাসির অর্থ তারা কেউ বুঝল না। তবে তার কয়েকদিন বাদে এক রাতে তাদের নিয়ে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির পুকুরের পেছন ঘাটে বসল এছাহাক। জায়গাটা লতাপাতায় ছাওয়া। এদিকটাতে খুব একটা লোকজনের যাতায়াত নেই। ফলে বেশ খানিকটা অগম্যও। এছাহাক হঠাৎ মতি মিয়াকে বলল, জামা-লুঙ্গি খোল।

‘কেন?’ হতভম্ব গলায় বলল মতি।

‘আমি বলছি, এইজন্য। খোল। আর খুইলা এই গামছাখান পর। পইরা পানিতে নাম।’ বলে ধীরে-সুস্থে নিজের সঙ্গে থাকা একখানা গামছা এগিয়ে দিল তার দিকে। মাঘ মাসের শীতে জবুথবু হয়ে আছে চারপাশ। মোটা কাপড় পরেও হাড় কাঁপুনি দশা। সেই হাড় থরথর ঠাণ্ডার মধ্যেই গামছা পরে পানিতে নামল মতি মিয়া। তারপর পানির তলা থেকে মন্দিরের নিচে পাওয়া সেই কলসিখানা তুলল। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না, এছাহাক ওই জিনিস এতদিন এইখানে লুকিয়ে রেখেছিল! সবার চোখের সামনে এইখানে এই পুকুরের তলায়! ঝুঁকি নিয়ে বেশিদূর যেতেও হয়নি তাকে। অথচ পুরোপুরি নিশ্চিন্ত। কিন্তু কলসির তলায় জিনিসের পরিমাণ দেখে সে যারপরনাই হতাশ হলো। সে কথা বললও এছাহাককে। এছাহাক অবশ্য তার কথা শুনে উত্তেজিত হলো না। সে বরং ধীরে সুস্থে বলল, “সেইদিনই বলছি, অতিরিক্ত খাইলে সমস্যা। শরীরে চর্বি জমে। দুর্বল লাগে। এইজন্য আমার মায় কইতেন, উনা ভাতে দুনা বল। অল্প খাইলে শক্তি অধিক। জীবনে সবকিছুই খাইতে হবে। কিন্তু খুব সাবধানে। হিসাব কইরা। যাতে হজম করন যায়। আর হজম করন না গেলে দুনিয়ার সব খাওন দিয়া ঘরভর্তি কইরাও লাভ নাই। আছে?

এই কথায় কেউ কোনো উত্তর দিল না। তবে তাদের সামনে বসে থাকা লোকটা যে ভুল কিছু বলেনি, এই কথা যেন আরো একবার উপলব্ধি করতে পারল মতি আর দেলু।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *