৪০. বাইরে পায়ের শব্দে

৪০

বাইরে পায়ের শব্দে অকস্মাৎ চুপ হয়ে গেল ফরিদ। এত রাতে কে ওখানে? সন্ত্রস্ত আছমা এই মাঝরাতে হঠাৎ আবির্ভূত হওয়া এই অস্বস্তি ও আশঙ্কা থেকে যেন দু হাতে আড়াল করে রাখতে চাইল ফরিদকে। সে গলা নিচু করে বলল, ‘বাবা, এত রাইতে বাড়িতে কে?

ওহাব ডাক্তার জবাব দিলেন না। তবে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলেন শব্দটা। খানিক আগেই মনে হচ্ছিল সামনের উঠানের দিক থেকে আসছে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ধীরে ধীরে পেছনের দরজার দিকে সরে যাচ্ছে পাগুলো। আছমা প্রায় ফিসফিস করে বলল, মানুষ মনে হয় একজন না আব্বা। দুজন হইতে পারে। বা আরো বেশি। তার গলা কাঁপছে।

ওহাব ডাক্তার গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন, হুম।’

তার চোখে মুখে চিন্তার রেখা। আতঙ্কিত দেখাচ্ছে নুরুন্নাহারকেও। তিনি ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, “এরা কারা?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার লোক না তো বাবা?’ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলল আছমা।

‘চুপ।’ মুখে আঙুল চেপে ইশারা দিলেন ওহাব ডাক্তার। তারপর ফরিদকে। বললেন, তুই নিশ্চিত যে ওরা কেউ ওই দিন তোরে দেখে নাই?

হুম। অন্ধকার হয়ে আসছিল। আর আমি উল্টোদিক ফিরে দৌড়াচ্ছিলাম। তা ছাড়া তাদের কথাও শুনেছি। আমাকে তারা চিনতে পারেনি।’

‘তাহলে?

তাহলে কী মামা?

তাহলে এতরাতে এরা কারা? তুই অন্য কাউকে কিছু বলিস নাই তো?

ফরিদ মাথা নাড়াল। সে বলেনি। কিন্তু ওহাব ডাক্তার বুঝতে পারছেন না, যদি এই সংক্রান্ত কিছু না-ই হয়ে থাকে, তাহলে এত রাতে কারা এভাবে সন্তর্পণে, লুকিয়ে তার বাড়িতে এসেছে? বিষয়টা তাকে বুঝতে হবে। নাহলে এভাবে চুপচাপ। বসে থেকে তিনি বিপদ এড়াতে পারবেন না।

ওহাব ডাক্তার ইশারায় সবাইকে শান্ত থাকার নির্দেশ দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। তারপর দরজার কাছে গিয়ে বললেন, বাইরে ওইখানে কে? কারা ওইখানে?

সঙ্গে সঙ্গেই পায়ের শব্দ থেমে গেল। ওহাব ডাক্তার গলা উঁচু করলেন এবার, সত্যিকারের বাপের ব্যাটা হইলে দিনের বেলা বীরের মতো কারো বাড়িতে যাইতে হয়। রাইতের বেলা অন্ধকারে চোরের মতো লুকাই লুকাই না। এবার পায়ের শব্দগুলো যেন দ্রুতপায়ে দরজার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। ওহাব ডাক্তার সতর্কভঙ্গিতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নুরুন্নাহার আচমকা ছুটে গিয়ে দা আর বটি নিয়ে এলেন। তার চোখে এখন ভয়ের পরিবর্তে আক্রোশ, উত্তেজনা। যেন যেকোনো পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত তিনি। ওহাব ডাক্তার তাকে শান্ত হওয়ার ইশারা দিলেও তিনি তা শুনলেন না। এগিয়ে এলেন। তারপর একখানা দা তুলে দিলেন আছমার হাতে। আর নিজে এসে দাঁড়ালেন ফরিদকে আড়াল করে সামনে। যেন যেকোনো মূল্যে ফরিদকে তিনি রক্ষা করবেনই। ফরিদ অবশ্য মৃদু হেসে বলল, “কেউ যদি আমারে মারতেই আসে, এইগুলা দিয়া কি আমারে বাঁচাইতে পারবেন মামি?

নুরুন্নাহার কথা বললেন না। তবে তার বুক ওঠানামা করছে। চোখে-মুখে রাজ্যের উত্তেজনা। পায়ের শব্দটা দরজার কাছে এসে থামল। তারপর বেশ খানিকটা সময় নীরব হয়ে রইল। ওহাব ডাক্তার কিছু জিজ্ঞেস করবেন, এই সময়ে ও পাশের লোকটা কথা বলে উঠল। কণ্ঠটা প্রায় ফিসফিস করে বলল, আমি শফি ডাক্তার চাচা। দরজাটা একটু খোলেন।

শফি!’ যেন আকাশ থেকে পড়লেন ওহাব ডাক্তার। কোন শফি?

‘উত্তরপাড়ার খাঁ বাড়ির শফি। আশরাফ খাঁ-র ছেলে।

ওহাব ডাক্তারের হঠাৎ মনে হলো তিনি ভুল কিছু শুনছেন। কিংবা কেউ তাকে মিথ্যে বলছে। না হলে এতরাতে শফি কী করে এখানে আসবে? তাও এভাবে লুকিয়ে তার বাড়িতে! তিনি যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখে বললেন, ‘এত রাতে তুমি এইখানে কী করো শফি? আসলে দিনের বেলা আসবা। ভালো-মন্দ কথা হইব। এত রাইতে আমার বাড়িতে কী?

‘আপনে দুয়ারডা একটু খোলেন চাচা। আমি বিপদে না পড়লে তো এইভাবে এত রাইতে আসতাম না।

কী বিপদ?

‘সেইটা শুনতে হইলেও তো দরজা খুলতে হইব। আর আমার এইভাবে বাইরে দাঁড়াই থাকাটাও নিরাপদ না চাচা। আমার পেছনে সবসময় ফেউ লাইগা

আছে। কখন কোন জায়গা থেকে কে দেইখা ফালায়। তখন বিপদে পড়বেন আপনেও। দরজাটা একটু খোলেন।

শফির কথা মিথ্যে নয়। এখন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বা তার কোনো লোক যদি শফিকে এইখানে এভাবে দেখে, তবে দুজনের জন্যই তা বিপদ। সে তখন ভাববে এরা দুজন মিলে নিশ্চয়ই তার বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্র করছে। কিন্তু একদম বিনা বাক্যে এত রাতে এভাবে বাইরের কাউকে দরজা খুলে দিতেও ঠিক ভরসা পাচ্ছেন

ওহাব ডাক্তার। তবে তাকে আশ্বস্ত করল ফরিদ। সে উঠে এসে মামার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর বলল, মামা, আমার মনে হয় না তারা আমাদের কোনো সমস্যা করবে। এমনিতেই তারা আছে নানা বিপদ-আপদে। আপনি দরজা খুলেন। তাদের ঘটনা বলতে দেন।

ফরিদ থামলেও ওহাব ডাক্তার কথা বললেন না। শফি বলল, চাচা, আপনে আমারে চেনেন না? আমার আব্বারে চেনেন না? তার এই অবস্থায় আমি আপনেদের কাছে একটু আশ্রয় পাবো না? আমারে দরজা খুইলা ঘরে ঢুকতে দেয়ার মতো বিশ্বাসটুকু আপনে করতে পারলেন না? শফির গলা ধরে এলো। অথচ আমার আব্বা, আমরা কেমন লোক সেইটা আপনেরা সবাই জানেন। কিন্তু আমাগো এই এত বড় বিপদে আপনেরা কেউ আমাগো পাশে এসে দাঁড়াইলেন না। একটা কথা পর্যন্ত বললেন না আপনারা।’

শফির কথায় ওহাব ডাক্তারের হঠাৎ কেমন লজ্জা লাগতে লাগল। কথা তো আসলেই সত্যি। আশরাফ খাঁর মতো এত বড় একজন মানুষ, যিনি পরোপকারী, ভালো, অথচ তার এমন দুর্দিনে কেউ তার পাশে এসে দাঁড়াল না! বরং সকলেই নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। পুরোপুরি নিঃসংশয় হতে না পারলেও তিনি দরজা খুলে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকে পড়ল শফি। তবে একটা বিষয় ফরিদকে অবাক করল। শফির সঙ্গে আরো একজন মানুষ রয়েছে। মানুষটার নাম ঝন্টু। সে কলার ব্যবসা করে। বাজারে ফরিদদের ফার্মেসির বাইরেই কলা নিয়ে বসে। কিন্ত সে এখানে শফির সঙ্গে কেন এসেছে?

শফি ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। তারপর বলল, চাচা, আমার কথায় কিছু মনে কইরেন না। বিপদে মাথা ঠিক নাই আমার। আমি আসলে একটা সাহায্যের জন্য এইখানে আসছি।’

‘এইখানে সাহায্যের জন্য? কপাল কুঁচকে তাকালেন ওহাব ডাক্তার। বললেন, ‘আমার কাছে কী সাহায্য?

‘ঠিক আপনের কাছে না। ফরিদের কাছে।

সঙ্গে সঙ্গেই যেন বুক ধক করে উঠল সবার। ফরিদের কাছে আবার কী সাহায্য চায় সে? ফরিদ অবশ্য অত বিচলিত হলো না। সে শান্ত গলায় বলল, কী সাহায্য শফি ভাই?

এবার কথা বলল ঝন্টু। সে বলল, আপনের একটা কথা মনে আছে ফরিদ ভাই?

কী কথা?

‘একদিন সন্ধ্যার দিকে আপনের ফার্মেসিতে মতি মিয়া আসছিল?

হুম। মনে আছে।

‘সে আপনের কাছে মাথা ফাটা জোড়া লাগা আর রক্ত বন্ধ হওনের ওষুধ চাইছিল?

ফরিদ আনমনে প্রমাদ গুনল। এতক্ষণে সে ঘটনা আঁচ করতে পেরেছে। ঝন্টু বলল, “ওই দিন কিন্তু আমিও আপনের দোকানেই বসা ছিলাম। তো আপনি যখন তারে জিজ্ঞেস করলেন যে মাথা ফাটছে কার, সে কিন্তু প্রথমে বলতে চায় নাই। আপনে বললেন যে মাথা বেশি ফাটলে আগে ব্যান্ডেজ করতে হবে। সেইটা মতি পারবে না। আপনের যাওন লাগব। সে কিন্তু তাতেও রাজি হয় নাই। আপনেরে সঙ্গে নিতে চায় নাই। মনে আছে?

হুম। গম্ভীর কণ্ঠে কথাটা বলল ফরিদ।

তারপর আমি তারে জিজ্ঞাস করলাম যে কার মাথা ফাটছে? সে বলল তার জেঠুসের ছেলের। কিন্তু তাদের বাড়ি আমার পাশের বাড়ি। সেই বাড়িতে কারো মাথা ফাটে নাই। আমি তার কথা শুইনা বাড়ি ফিরাও পোলাডারে দেখতে গেছিলাম। এত বড় দুর্ঘটনা ঘটল। আমার প্রতিবেশী। দেখতে যাওয়া উচিত না?’

‘হুম।

কিন্তু গিয়া দেখলাম, ওই ছেলে তো একদম সুস্থ। খেলাধুলা করতেছে। মাথায় ফাটা কেন, একটা আঁচড়ের দাগও নাই। একফোঁটা রক্তও নাই কোনোখানে। তাইলে সেই দিন মিথ্যা কথা বইলা ওই ব্যান্ডেজ আর ওষুধ কার জন্য নিছিল মতি মিয়া?

ফরিদ ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি ঝন্টু আর মতি মিয়ার সেই দিনের ওই সামান্য কথোপকথন এই এতদিন বাদে এত বড় একটা বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। তবে এখন তো এই ঘরের সকলেই কম-বেশি ঘটনা জানে বা আঁচ করতে পেরেছে। ফরিদ কিছু বলতে যাওয়ার আগেই ওহাব ডাক্তার বললেন, ‘এইটা ফরিদ কেমনে বলব বলো শফি? ফরিদ তো আর গোয়েন্দা না যে এইগুলাও খুঁইজা বের করব।’

‘তা না ওহাব চাচা।’ কথা বলল শফি। তবে আমরা চেষ্টা করতেছি নানা তথ্য প্রমাণ জোগাড় করার, যাতে কোর্ট অন্তত এইটা বোঝে যে আমার বাপ রুস্তমরে খুন করে নাই। এই সবই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ষড়যন্ত্র। আর এই কারণেই ফরিদের এই ঘটনাটা আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। তারে একদিন কোর্টে সাক্ষী দিতে যাইতে হইবো চাচা। বেশি কিছু না। সে শুধু এই ঘটনাটুকুই বলবে।

নুরুন্নাহার এবার সামনে এগিয়ে এলেন। তারপর বললেন, ফরিদ কোথাও যাবে না শফি। এমনিতেই তার ওপর দিয়া কত বড় বিপদ গেল। এরপর এখন তারে আর কোনো বিপদে ফেইলো না তোমরা। তোমাদের কাছে আল্লাহর দোহাই লাগে।

‘তার কোনো ক্ষতি হইব না চাচি। আমি আপনারে কথা দিতেছি। আর পুলিশ সবসময়ই মামলার সাক্ষীর সিকিউরিটি দেয় চাচি। তার কোনো ভয় নাই।’ বলে একটু থামল শফি। তারপর বলল, কিন্তু সামান্য এই সাক্ষীর জন্য মামলার গতিটাই অন্যদিকে ঘুরে যাইতে পারে। মতি মিয়ারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হইতে পারে। কে জানে, তখন হয়তো নতুন কোনো সত্য বাইর হইয়া আসব।’ বলে হঠাৎ নুরুন্নাহারের হাত দু খানা জড়িয়ে ধরল সে। তারপর বলল, চাচি, এইটুকু অন্তত আমার বাপের জন্য করেন। সে তো কোনোদিন কারো উপকার ছাড়া ক্ষতি করে নাই। আপনেরা সব জাইনা-শুইনাও এইভাবে চুপ কইরা থাকবেন? ওহাব ডাক্তারের দিকে ফিরল শফি। তার গলা ভার। চোখ ছলছল। সে হাত জোড় করে বলল, “এইটুকু যদি না করেন, তাইলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সঙ্গে আপনেগো আর পার্থক্য কী থাকল? তার এত বড় অন্যায়টাই তো আপনেরা সাপোর্ট করলেন? একটা নিরীহ মানুষরে ফাঁসিতে ঝুলাইলেন…। যে কি না জীবনে কোনোদিন কোনো অপরাধ করে নাই।’

শফি থামলেও ঘরের কেউ কথা বলল না। যেন এক অদ্ভুত অস্বস্তিকর নীরবতা শীতের কুয়াশার মতো নেমে আসতে লাগল এই ঘরে। ফরিদ অবশ্য সেই নীরবতা ভেঙে কথা বলতে যাচ্ছিল। ভেতরে ভেতরে মনস্থির করে ফেলেছে সে, জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এই ভয়ানক অনাচারের বিরুদ্ধে এবার মুখ খুলবে। তাতে যা হবার হবে।

সে নিজেও তো কম ভোগান্তি পোহায়নি। পারুদের পুরো পরিবারটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল শুধু তার কারণেই। তার কারণেই ওহাব ডাক্তারের মতো নিরীহ, নির্দোষ একজন মানুষকেও চূড়ান্ত অপমান-অপদস্থ হতে হয়েছে। এর একটা বিহিত করা জরুরি। ভেতরে ভেতরে দুর্দমনীয় এক আক্রোশ অনুভব করতে লাগল ফরিদ। প্রয়োজনে আদালতেই সব সাক্ষ্য দেবে সে। এখন অবধি যা যা জেনেছে, যা যা দেখেছে তার সব। কিন্তু ওহাব ডাক্তার যেন তার মনের কথা বুঝতে পারলেন। ফলে ফরিদ কিছু বলার আগেই তিনি তাকে আড়াল করে শফির মুখোমুখি দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, আমি তোমার অবস্থাটা বুঝতে পারছি বাবা। কিন্তু তুমিও তো আমাদেরটা বুঝতে পারতেছো। পানিতে বসে কুমিরের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য যেই শক্তি দরকার, তা আমাদের নাই। তারপরও তুমি আমাদের একটু সময় দাও। আমরা নিজেরা একটু কথা বলে নিই। তারপর তোমারে আমরা জানাব।’

শফি আরো কিছু বলত হয়তো। কিন্তু ওহাব ডাক্তার তাকে সে সুযোগ দিলেন। না। দিলেন না ফরিদকেও। কারণ, তিনি জানেন, এই কাজের পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে! এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, বিপদসংকুল পথ পাড়ি দিয়ে আছমা যখন খানিক থিতু হয়েছে। যখন একটু একটু করে তার বিবর্ণ, অশান্ত জীবনে রং ফিরে আসতে শুরু করেছে, তখন তিনি আর নতুন করে কোনো ঝামেলায় জড়াতে চান না। তার নিজেরও বয়স হয়েছে। কখন না কখন টুপ করে মরে যাবেন, তার ঠিক নেই। তখন ফরিদ ছাড়া তো মেয়েটার আর কেউ থাকবে না। সেই ফরিদকে তিনি কিছুতেই আর নতুন কোনো বিপদে জড়াতে দেবেন না। জীবন তাকে একটা বড় সুযোগ দিয়েছে। এই সুযোগ তিনি হেলায় হারাতে চান না।

শফি নিরুপায় হয়ে অসহায়ের মতো ফিরে গেল। কিন্তু তাকে ফিরিয়ে দিয়েও এই ঘরের মানুষগুলো যেন স্বস্তি পেল না। বরং আশরাফ খাঁর জন্য প্রচণ্ড মন খারাপ হতে লাগল। অপরাধবোধও। কিন্তু কী করবেন ওহাব ডাক্তার? আছমার ভবিষ্যৎ তার কাছে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। নিজের মেয়ের জন্য এইটুকু অন্যায় তিনি করতেই পারেন। নুরুন্নাহারেরও একই মত। তাদের এই মত নিয়ে যতটুকুও বা সংশয়, দ্বিধা ছিল, তা কেটে গেল এর দিন কয়েক বাদে এক ঘটনায়। ওহাব ডাক্তার দুপুরে খেয়ে সামান্য ঘুমিয়েছিলেন। এই সময়ে নুরুন্নাহার প্রায় পাখির মতো উড়ে চলে এলেন। তারপর পাগলের মতো তাকে জড়িয়ে ধরলেন। হতভম্ব ওহাব ডাক্তার বললেন, কী হইছে তোমার? এমন করতেছো কেন?

নুরুন্নাহার হড়বড় করে বললেন, আমার কিছু হয় নাই। হইছে আছমার। তোমার মাইয়ার।

‘তার আবার কী হইছে?

নুরুন্নাহার প্রায় জলের কলোরোলের মতো গলায়, আলোর মতো ঝলমলে মুখে বলল, “সে পোয়াতি। তার বাচ্চা হইব।’

কী!’

শোয়া থেকে উঠে বসলেন ওহাব ডাক্তার। এত আনন্দ বোধহয় এই জীবনে আর কখনো হয়নি তার। তিনি একই কথা বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলেন। নুরুন্নাহারও একই কথা বারবার বলে যেতে লাগলেন। যেন তাদের আরো কোনো ক্লান্তি নেই। কান্না নেই। শঙ্কা, সংশয় নেই। চারপাশে কেবল আনন্দ আর আলো। সেই আলোয় ভেসে যেতে লাগলেন তারা। তবে তা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। কিছুদিন পর ওহাব ডাক্তার ফুরফুরে মেজাজে বাজারে গেলেন। নতুন পোস্ট অফিসের পিওন আব্দুল মজিদের সঙ্গে তার সেখানেই দেখা। আব্দুল মজিদ তার কাছে একটা চিঠি দিয়ে গেল। সেই চিঠি হাতে নিয়েই ওহাব ডাক্তারের কপাল কুঁচকে গেল। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠল। তিনি সেই চিঠি খুললেন গভীর রাতে একা। তাকে চিঠি লিখেছেন মহিতোষ ডাক্তার। সেই চিঠিতে কটা মাত্র লাইন। কিন্তু ওই লাইনগুলো দেখে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল ওহাব ডাক্তারের। তিনি জানেন না এখন কী করবেন? কী করলে এই সমাধান অযোগ্য সমস্যা থেকে তিনি বের হতে পারবেন। ফলে ভয়াবহ এক মানসিক অবস্থা নিয়ে তিনি দিন যাপন করতে লাগলেন। প্রতিটি মুহূর্ত ওই চিঠিখানা তাকে খোঁচাতে লাগল। বলতে লাগল, ফরিদকে সব জানানো দরকার। এখুনি জানানো দরকার সব। কিন্তু তিনি কাউকে কিছু জানালেন না। এমনকি নুরুন্নাহারকেও না।

নিজের সঙ্গে অস্বাভাবিক এক যুদ্ধে শামিল হলেন তিনি। কিন্তু এই যুদ্ধে তার কোনো জয় নেই। তিনি যেদিকেই যান না কেন, সেখানেই তার পরাজয় নির্ধারিত। এই অনিবার্য পরাজয় থেকে তার আর কোনো নিস্তার নেই। তিনি রাতের পর রাত, দিনের পর দিন বুকের ওপর বহন অযোগ্য এক পাথর বয়ে বেড়াতে লাগলেন। সেই পাথরখানা ক্রমশই আরো ভারী হতে লাগল। কিন্তু ওহাব ডাক্তার তার থেকে মুক্তি পেলেন না। এতদিন পর মহিতোষ মাস্টার তাকে যে চিঠিখানা লিখেছেন, এই চিঠির কথা তিনি কিছুতেই ফরিদকে বলতে পারবেন না। কাজটা ভীষণ অন্যায় ওহাব ডাক্তার জানেন। এত বড় অন্যায় কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না। কিন্তু সন্তানসম্ভবা আছমার পৃথিবী যে অপার্থিব আনন্দে ঝলমল করছে, ওই আনন্দ-আলো কেড়ে নেয়ার সাধ্য স্রষ্টা কোনো বাবাকে দেননি। সন্তানের ওই আনন্দটুকুর জন্য ক্ষমার অযোগ্য এই অপরাধটা তিনি করলেন। মহিতোষ মাস্টারের চিঠির কথা তিনি ফরিদকে জানালেন না। জানালেন না পারুর ফিরে আসার কথা। তার সন্তানের কথাও। তিনি চিঠি আগুনে পুড়ে ফেললেন।

কিন্তু চিঠি আসতেই লাগল। একের পর এক। আর সেই চিঠি তার বুকটা চিরে ফালাফালা করে দিতে লাগল। একজন অসহায়, অক্ষম বাবা ওহাব ডাক্তার কিছুই করতে পারলেন না। তিনি জানেন, এখন এই কথা যদি ফরিদ বা আছমাকে তিনি জানান, তাহলে তাদের ক্রমশই গুছিয়ে ওঠা পৃথিবীটা আবার এলোমেলো হয়ে যাবে। ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে সবকিছু। যে আছমাকে তিনি চেনেন, সেই আছমা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর এক জীবনের মুখোমুখি হবে। চোখের সামনে ওই দৃশ্য দেখার ক্ষমতা তার নেই। এ কারণেই আশরাফ খাঁ, শফি থেকে শুরু করে মহিতোষ, পারু সবার কথাই বেমালুম ভুলে যেতে চাইলেন তিনি। কিন্তু মহিতোষ তাকে ভুলতে দিলেন না। তিনি একের পর এক চিঠি পাঠাতেই লাগলেন। আর ওহাব ডাক্তার চিঠি পাওয়া মাত্রই তা পুড়ে ফেলতে লাগলেন। তবে তিনি এও ভাবলেন, এই চিঠি পাঠানো বন্ধ করতে হবে। নাহলে কখনো যদি এসব চিঠির কোনো একটি পিয়ন ভুল করে হলেও ফরিদের কাছে দিয়ে দেয়, কী হবে তখন? এই ভয়েই অবশেষে তিনি মহিতোষ মাস্টারকে একখানা চিঠি লিখলেন।

‘ভাই সাহেব।

আপনার চিঠি আমি পাইয়াছি। কিন্তু কখনো কখনো জীবন আমাদের এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করায় যে আমাদের কোথাও আর যাওয়ার জায়গা থাকে না। পারুকে পাওয়া গিয়াছে এই কথা শুনিয়া আমি যারপরনাই আনন্দিত হইয়াছি। কিন্তু ভাই সাহেব, এই দিকে অনেক কিছু ঘটিয়া গিয়াছে। আমাদের কপালেই হয়তো এমন নির্মম ভাগ্য লেখা ছিল। না হইলে সবকিছুই কেন এমন জটিল ধাঁধায় পরিণত হইবে? আপনি জানিয়া যারপরনাই মর্মাহত, বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত হইবেন যে, মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ ফরিদের সুস্থতার জন্যই তাহাকে একভাবে জোর করিয়া তাহার অমতেই আছমার সঙ্গে বিবাহ দেওয়া হইয়াছে। এবং খোদাতালার অশেষ রহমতে আছমা এখন সন্তানসম্ভবা। এমতাবস্থায় পারু ও তার সন্তানের এরূপ ফিরিয়া আসার ঘটনা কীরূপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করিয়াছে বলিয়া আপনার মনে হয়? আমি অনেক ভাবিয়াও এই প্রশ্নের কোনো কূল-কিনারা পাইলাম না। তাই আপনার চিঠির জবাব পাঠাইতে বিলম্ব হইল। এখন এই প্রশ্নখানা আপনার কাছেই রহিল।

আরেকটি ব্যাপার হইল, ফরিদ আর পারুর বিবাহ হয় নাই। তাহারা এখনো ভিন্ন ধর্মাবলম্বী। সুতরাং তাহাদের এই সন্তানকে সমাজে কী পরিচয়েই বা পরিচিত করাইবেন? পারু আর ফরিদের সম্পর্কই বা কী হইবে? আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, সমাজের নিকট তাহাদের আগামীর জীবন কীরূপে প্রতিষ্ঠিত বা গৃহীত হইবে, একটিবার তাহা ভাবিয়া দেখিয়াছেন?

এইদিকে, আমার কন্যা আছমার কথাও আপনাকে একটিবার ভাবিয়া দেখিবার অনুরোধ করি। পিতা হইয়া আমি তাহার এহেন যন্ত্রণার জীবনের কথা আর ভাবিতে পারি না। ফরিদ আর পারুর কারণে সে যে অসহনীয় জীবন কাটাইয়াছে, তাহা ভাবিলে এখনো আমার অশ্রু সংবরণ করিতে পারি না। বুকে ব্যথা টের পাই। এই সব নানা বিষয় বিবেচনা করিয়াই আমি এই চিঠির কথা ফরিদের কাছে গোপন রাখিয়াছি। ভাইজান, আমি জানি আমি একটি অত্যন্ত ঘৃণ্য, জঘন্য, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করিতেছি। কিন্তু ইহাও তো সত্য যে নিজের কন্যার জীবনের কথা চিন্তা করিলে আমার ইহার বিকল্প আর কোনো উপায় জানা নাই। আমি আমার কন্যার জীবনের বিনিময়ে এই অপরাধের দায় বিনা শর্তে মাথা পাতিয়া লইতে রাজি আছি। এর জন্য আপনি বা আল্লাহপাক আমাকে যেই শাস্তি দেবেন, আমি তাহা মানিয়া লইব।

মাস্টার সাহেব, আপনি প্রকৃতই একজন ভালো মানুষ। ইহা আমি জানি ও মানি। আপনার প্রতি আমার শ্রদ্ধা ও সমীহও সীমাহীন। একজন পিতা হিসেবে আপনার অবস্থাও আমি অনুধাবন করিতে পারি। কিন্তু আপনিই বলুন, এমতাবস্থায় অন্য কী উপায় আর অবশিষ্ট রহিয়াছে? আপনি বরং পারুকে লইয়া কলিকাতা চলিয়া যান। এইখানে এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়াইয়াছে, তাহাতে আমার মনে হয় যে সে ওইখানেই বরং ভালো থাকিবে। ইহা ছাড়া আমার মাথায় বিকল্প আর কোনো ভাবনা আসিতেছে না। আপনার কাছে ক্ষমা চাইবার মুখ বা যোগ্যতা কিছুই আর আমার নাই। তাই সেই চেষ্টাও করিতেছি না। তবে কেবল এইটুকু বলি যে, সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে আমাদের এমন অসহায় করিয়া তোলেন যে আমরা নিরুপায় হইয়া যাই। তখন মৃত্যু ব্যতীত আর কোনো উপায় থাকে না। এই মুহূর্তে আমারও তেমন মনে হইতেছে। কিন্তু আমি জানি, আজ যদি আমি এই কাজটি না করি, তাহা হইলে হয়তো আমার কন্যাটি নিজের মৃত্যু নিজেই বাছিয়া লইবে। কারণ, তাহাকে আমি চিনি। কিন্তু বাবা হইয়া তাহাকে অমন পরিস্থিতির দিকে ঠেলিয়া দেওয়ার সাহস আমার নাই। আল্লাহপাক আপনার মঙ্গল করুন। তাহার নিকট এই আমার করজোড়ে প্রার্থনা। আপনার কাছে সত্য সত্যই ক্ষমা চাইবার মুখ আমার নাই।

৪১

চিঠিখানা হাতে স্তব্ধ বসে আছেন মহিতোষ। বারান্দার ওপাশে একটা চড়ই এসে বসেছে মাটিতে। তারপর টুকটুক করে ঠুকরে খেতে শুরু করল কিছু একটা। সেখানে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে। সেই রোদে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার হঠাৎ মনে হলো চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। না রোদ। না মাটি কিংবা পাখি। কেবলই জলের আবডালে ঢাকা পড়ে যাওয়া দৃশ্যের মতো অস্পষ্ট, আবছায়া অবয়ব। পারু তাকে ডাকতে এলো, বাবা?

মহিতোষ আলগোছে ফিরে তাকালেন।

‘খেতে এসো।

‘আসছি।’ বললেও মহিতোষ নড়লেন না। চুপচাপ বসে রইলেন। চিঠিটা পাওয়ার পর থেকে কতবার যে পড়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এরপর আর কিছুই ভাবতে পারছেন না। বুকের বাঁ পাশে একটা তীব্র ব্যথা। থমথমে অনুভব। কেমন কাটার মতো বিঁধে আছে কিছু একটা। সামান্য নড়লেই কিংবা কিছু ভাবতে গেলেই তাতে প্রচণ্ড টান লাগে। মনে হয় কিছু একটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। টুপটাপ ঝরে যাচ্ছে রক্তের ফোঁটা। এত ক্ষত আর যন্ত্রণা নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?

কিন্তু না বেঁচেই বা কী করবেন তিনি? মরে যাবেন? সম্ভবত এটাই এখন সবচেয়ে সহজ সমাধান। এই বিভৎস, কুৎসিত, কদর্য জীবন থেকে মুক্তি মিলবে তার। আরো কোনো দুশ্চিন্তা, দুর্ভোগ নেই। ক্লেদ, কষ্ট নেই। কিন্তু তারপর ওই শিশুটিকে নিয়ে কোথায় যাবে পারু? এই প্রশ্নের উত্তর মহিতোষ জানেন না। ওহাব ডাক্তারের চিঠিটা পাওয়ার পর মানুষটার প্রতি এত ঘৃণা হচ্ছিল তার! এত নোংরা লাগছিল যে মনে হচ্ছিল ওই ঘৃণাটা যদি সরাসরি তার ওপর উগড়ে দিতে না পারেন, তাহলে অসুস্থ হয়ে যাবেন তিনি।

কিন্তু সময় যত গড়িয়েছে, ততই চিঠিটি বারবার পড়েছেন তিনি। আর প্রতিবার পড়ার পরই মনে হয়েছে, খানিক আগের রাগ ক্রমশই অসহায়ত্বে রূপ নিয়েছে। ওহাব ডাক্তার তো ভুল কিছু বলেননি। বরং তার জায়গায় নিজেকে বসিয়ে চিন্তা করলে তিনি নিজেও কি এর অন্যথা কিছু ভাবতে পারতেন? তা ছাড়া, পারু আর ফরিদের সম্পর্ক, তাদের সন্তান, ভবিষ্যতের সংসার, সামাজিক পরিচয়, প্রতিষ্ঠা সবমিলিয়ে যে পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে, সেগুলো কীভাবে সামলাবে তারা?

এই প্রশ্নগুলো অসংখ্যবার উচ্চকিত হতে লাগল মনে। আর ওহাব ডাক্তারের প্রতি খানিক আগেই অনুভব করা ওই প্রবল জিঘাংসা রূপান্তরিত হতে লাগল আগামী দিনের অনিশ্চয়তা আর শঙ্কায়। এখন তাহলে কী করবেন তিনি? কোথায় যাবেন পারুকে নিয়ে?

তিনি নিজেও কি আসলে চাইতেন, পারু ফরিদের সঙ্গেই বাকিটা জীবন কাটাক? প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গিয়ে মহিতোষের মনে হলো, তিনি আসলে এতদিন একটি মাত্র কথাই ভেবেছেন, আর তাহলো–পারু। যেকোনো মূল্যে পারুকে ফিরে পেতে চেয়েছেন তিনি। সেই ভাবনায় পারুকে ফিরে পাওয়ার পর তাকে নিয়ে কী করবেন, এই চিন্তা ছিল না। কিংবা খুব স্বাভাবিকভাবেই হয়তো অবচেতন ভাবনায় এটিই ছিল যে তাকে নিয়ে কলকাতায় চলে যাবেন। কিন্তু তখনকার দৃশ্যপটে নতুন এই বাস্তবতা তো ছিল না। পারুর কোলের ওই শিশু সন্তানটিকে নিয়ে এখন কী করবেন তিনি? কোথায় যাবেন?

দুপুরে খেতে বসেও যেন মুখে কোনো স্বাদ পেলেন না মহিতোষ। পারুর সঙ্গে তেমন কোনো কথাও হলো না। একটা অস্বস্তিকর নীরবতা ঘরজুড়ে। তরু আবার ফিরে গেছে তার কাজে। তবে আজকাল কিছুদিন পর পরই আসার সুযোগ হয় তার। কিন্তু মহিতোষ যেন আর কারো সঙ্গেই কোনো যুক্ততা অনুভব করেন না। বরং আশ্চর্য এক বিচ্ছিন্নতা তাকে ক্রমাগত এই জগৎ-সংসার থেকে দূরে নিয়ে যেতে থাকে। ধূসর, বিবর্ণ করে দিতে থাকে। সেখানে তিনি আদ্যোপান্ত একা। নিঃসঙ্গ। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত ও সর্বৈব অর্থে পরাজিত এক মানুষ।

দিনভর একা একা চুপচাপ বসে থাকেন তিনি। পারু আড়াল থেকে তাকে দেখে। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করতে কিংবা বলতে সাহস হয় না তার। বাবাকে আজকাল ভয়ই পায় সে। কারণ, পারু জানে তার আর সকল অপরাধ হয়তো ক্ষমা করে দেয়া যায়। বাবা তা দিতেনও। কিন্তু তার কোলজুড়ে আসা ওই সন্তানটির জন্ম, পরিচয়, আগামীর দিন বাবাকে লজ্জিত, শঙ্কিত, বিচলিত করে রাখে। ওই মুখখানা তার বুকে শেল হয়ে বেধে। যদিও এই নিয়ে এখনো অবধি পারুকে কিছু বলেননি তিনি। তবে পারু জানে, গত এক বছরেরও বেশি সময়টাতে সে আসলে বড় হয়েছে কয়েক যুগ। মানুষ বয়সের চেয়েও বেশি বাড়ে অভিজ্ঞতায়–এই সত্য তার চেয়ে বেশি এখন আর কে জানে!

জীবন তার রুঢ় বাস্তবতার বিষের পেয়ালা উপুড় করে তাকে যা দিয়েছে, তাতে তার বড় না হয়ে উপায় কী! সে তাই বাবার খুব কাছে না গিয়েও, তার কোনো আক্ষেপ-অভিযোগ না শুনেও যেন সবই বুঝতে পারে। বুঝতে পারে, বাবা মূলত এক জীবন্ত মানুষ। আর তার এই জীবন্ত সমাধির একমাত্র কারণ সে। হয়তো সবকিছুর পরও বাবা আবার উঠে দাঁড়াতেন। আবার আগের মতো তাকে আগলে রাখার চেষ্টা করতেন। বুক পেতে দিতেন নিজের সর্বস্ব দিয়ে। কিন্তু সে টের পায়, ওই শক্তিটুকুও আর অবশিষ্ট নেই বাবার। তিনি হয়তো এখনো চেষ্টা করেন, কিন্তু পারুর কোলজুড়ে প্রতিভাত হওয়া ওই শিশুসন্তানটির অস্তিত্ব তাকে মুহূর্মুহূ মৃত্যবাণে বিদ্ধ করতে থাকে। তার উঠে দাঁড়াবার, আবার যুদ্ধ করবার যে চেষ্টাটুকু ছিল, তাতে শেষ পেরেকটা ঠুকে দিল। স্তব্ধ করে দিল চিরতরে।

.

ওহাব ডাক্তারের চিঠি প্রাপ্তির দিন পনের পর পারুকে ডাকলেন মহিতোষ। তিনি টের পান, পারু তাকে আড়ালে-আবডালে সারাক্ষণ দেখে। কিন্তু কাছে আসতে ভয় পায় সে। দ্বিধায় ভোগে। নিজের মধ্যে প্রচণ্ড এক অপরাধবোধ কাজ করে তার। তাদের সম্পর্কের সুরটা কেটে গেছে। মহিতোষ চেষ্টা করেও সহজ হতে পারেন না। দীর্ঘ দিনের রোগ-শোক, দুর্ভোগের পর জীবন তাকে নতুন এক দুশ্চিন্তার দুয়ারে এনে দাঁড় করিয়েছে। শারীরিক-মানসিকভাবেও ফুরিয়ে দিয়েছে। বুড়িয়ে দিয়েছে। পারুর সন্তানটির কথা ভাবলেই তার মন ও মস্তিষ্ক তীব্র অস্বস্তিকর এক অনুভবে তাকে আড়ষ্ট করে রাখে। পারু এটা বোঝে বলেই সারাক্ষণ ভীত-সন্ত্রস্ত। পাখির মতো জড়সড় হয়ে থাকে। আর কিছুতেই কাউকে কষ্ট দিতে চায় না সে। এমনকি ফরিদের কথা জিজ্ঞেস করতেও সাহস হয় না তার। অথচ সারাক্ষণই মনে হয়, বাবা কি ফরিদের কোনো খোঁজ পেল?

.

মহিতোষ অবশ্য ফরিদের প্রসঙ্গ আর তুললেন না। তিনি বললেন, তোর মেয়ের একটা নাম রাখা দরকার না?

পারু কথা বলল না। তবে বাবার এই প্রশ্নে সে অবাক হয়েছে। এমন কিছু যে মহিতোষ বলবেন এটা সে আশা করেনি। বরং ভেবেছিল, এরপর কী হবে, কোথায়। যাবে তারা, সেসব নিয়ে কথা বলবেন বাবা। কিংবা ফরিদকে নিয়ে কিছু। মহিতোষ বললেন, কী নাম রাখবি কিছু ভেবেছিস?’

পারু এবারও কথা বলল না। তবে তার কেন যেন মনে হচ্ছে, ভেতরে ভেতরে কিছু ঘটে চলেছে। সেটা বাবা তাকে বলতে চান না। আচ্ছা, ফরিদের কোনো খবর কি বাবার কাছে এসেছে? যদি এসে থাকে তাহলে বাবা তাকে সেটি কেন বলছেন না?

মহিতোষ বললেন, যদি কোনো কারণে ফরিদের খোঁজ না পাওয়া যায়, তাহলে কী করবি কিছু ভেবেছিস?

এই কথায় পারু একটা ঝাঁকুনির মতো খেল। ফরিদের খোঁজ কেন পাওয়া যাবে না? ফরিদ ভুবনডাঙা ফিরে গেছে, এ কথা সে তরুর কাছেই শুনেছে। তাহলে?

পৃথিবীতে আর যত যা-ই হোক, তার প্রতি ফরিদের নিবেদন নিয়ে পারুর সংশয় নেই। সে জানে ওই মানুষটা তাকে কতটুকু ভালোবাসে। পৃথিবীর সবকিছুর বিনিময়েও সে তাকে চায়। চেয়েছে। এমনকি তাকে হারিয়ে ফেলার পর ফরিদের কী অবস্থা হয়েছিল, দিনের পর দিন সে কী করেছিল, তাও তরুর কাছে শুনেছে। সে। কিন্তু বাবা হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন করলেন? ফরিদ কি তবে ভুবনডাঙা যায়নি?

প্রশ্নটা করল পারু, উনি ভুবনডাঙা যাননি?

মহিতোষ সরাসরি এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন না। বললেন, ‘জীবন কেমন, সে তো দেখলিই। এইজন্য সব সময়ই বিকল্প ভেবে রাখা ভালো। কখন কী পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়, তাতো আগেভাগে বোঝা যায় না। যায়?

পারু কথা বলল না। মহিতোষ বললেন, তুইতো বুঝতেই পারছিস সবকিছুরই হয়তো কোনো না কোনো একটা ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু…।’ বলে সামান্য থামলেন মহিতোষ। যেন কথাটা বলতে দ্বিধা অনুভব করছেন তিনি। তারপরও গলায় জমে থাকা শ্লেষ্ম পরিষ্কার করতে করতে বললেন, কিন্তু তোর মেয়েটার কারণে কোনো কিছুই আর আগের মতো নাই। আর এদিকে এতদিনতো সব ভুলেই ছিলাম। এখন এতবার কলকাতায় চিঠি লিখলাম। কিন্তু কারো কোনো উত্তর নাই।’

ফরিদের? প্রশ্নটা এবার সরাসরিই করল পারু।

মহিতোষ দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘দেখি। এখনো তো এলো না।

‘বাবা?

ডাকটা শুনে চলে যেতে উদ্যত মহিতোষ থমকে দাঁড়ালেন। পারু কিছু একটা বলতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল। মহিতোষ খানিক চুপ থেকে বললেন, তুই কি ফরিদের খোঁজে ভুবনডাঙা যেতে চাইছিস?

‘চিঠি দিয়ে যদি ওনার কোনো খোঁজ না পাওয়া যায়, তাহলে…।’ বিড়বিড় করে বলল পারু। তবে বাবার মুখের দিকে তাকাল না সে। কথাটা শেষও করল না। তার আগেই মৃদু গলায় ডাকল, বাবা।

হুম?

‘আমায় তুমি আর কোনোদিন আগের মতো ভালোবাসতে পারবে না, তাই না বাবা? পারু জানে না কথাটা সে কীভাবে বলল। তবে তার চোখের কোল গড়িয়ে টুপটাপ ঝরে পড়তে লাগল অশ্রুবিন্দু। সে তবু মুখ তুলে তাকাল না। ঘরের কনক্রিটের মেঝেতে সেই অশ্রুবিন্দু পাশাপশি জমা হতে লাগল। একে অপরকে ছুঁয়ে দিতে লাগল। মিশে গিয়ে আরো টইটম্বুর হয়ে উঠল। পারু সেদিকে তাকিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল।

মহিতোষ অপলক চোখে পারুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। কত রোগা হয়ে গেছে মেয়েটা। একটা বয়সের ছাপও যেন চোখ, মুখ, শরীরজুড়ে। যে অন্য, অচেনা এক মানুষ। কথায়, আচরণে, অবয়বে। কী অদ্ভুতভাবেই জীবন তাকে আদ্যোপান্ত পাল্টে দিয়েছে। মাত্র অল্পকিছু সময়। অথচ সেই সময়ের আঁচড় কী তীব্র, সর্বগ্রাসী। এই পারুই কি তার সেই ভুবনডাঙার পারু? যাকে তিনি এতটুকু এক পাখির ছানার মতো মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখলে সারারাত আর ঘুমাতে পারত না। বাবার বুকের ওপর শুয়ে থাকত। বাবা তখন তাকে রাত জেগে গল্প শোনাত। কিংবা কোলে নিয়ে উঠোনে হাঁটত রাতভর। পারু তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ হঠাৎ বলত, “ওই তারাটি কী তারা বাবা?”

মহিতোষ বলতেন, “ওটা ধ্রুবতারা। ধ্রুবতারা কী বাবা?

‘এটা সবসময় এক জায়গায় স্থির থাকে। কোথাও যায় না। নড়ে না।

‘আর অন্য তারারা?

‘অন্যরা কখনো কখনো নড়ে। জায়গা বদল করে।

কই? সব তারাই তো একই জায়গায় আছে বাবা। কাউকেই তো নড়তে দেখছি না।’

‘খালি চোখে সব দেখা যায় না মা।

‘তাহলে তুমি কী করে দেখলে?

আমিও দেখিনি।

‘তাহলে?

‘বইতে পড়েছি।

বই পড়লে সব জানা যায় বাবা?

হুম যায়।

কিন্তু আমার যে বই পড়তে ভালো লাগে না বাবা।

‘তাহলে কী ভালো লাগে?

‘তোমার কাছে গল্প শুনতে বাবা। তুমি আমাকে সবসময় বই পড়ে পড়ে শোনাবে, হ্যাঁ?’

মহিতোষ হাসতেন, কিন্তু বড় হলে তো তোকে স্কুল, কলেজে যেতে হবে। তখন একা একা পড়তে হবে।

‘উঁহু। তুমিও তখন আমার সঙ্গে যাবে। তারপর আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে রেখে বই পড়ে শোনাবে।’

কত বয়স হবে তখন পারুর? ছয় কি সাত? কিন্তু কী মিষ্টি করে কথা বলত সে!

বাবাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে তার ভালো লাগত। কোথাও গেলে বাবার কোল থেকে নামতেই চাইত না। মহিতোষ হাঁটতে হাঁটতে হাঁপিয়ে যেতেন। তারপরও নামবে না সে। অঞ্জলি বলতেন, মারে, এইবার একটু নাম। বাবার কষ্ট হচ্ছে।

পারু বলত, “আমারও তো কষ্ট হয়।

‘তোর আবার কী কষ্ট হয়?

‘এই যে বাবা আমাকে এভাবে বুকের মধ্যে ধরে না রাখলে…।

কী সহজ, অথচ সুন্দর এক কথা। বাবা তাকে বুকের মধ্যে ধরে না রাখলে তার কষ্ট হয়। মহিতোষের চোখে হঠাৎ জল চলে এলো। তিনি চকিতে চোখ আড়াল করলেন। আচ্ছা, পারুর কি সেসব কথা মনে পড়ে? পড়ার কথা নয়। কিংবা পড়লেও তাদের জীবন এখন অন্য এক নদীর মোহনায় এসে দাঁড়িয়েছে। এখানে প্রবল ঝড়-ঝঞ্ঝা। পাড়ভাঙা ঢেউ-জলোচ্ছ্বাস। এই জলোচ্ছ্বাস থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা ছাড়া বড় আর কিছু নেই। সেখানে পুরনো দিন, পুরনো স্মৃতি-অনুভব ক্রমশই ফ্যাকাশে, বিবর্ণ হতে থাকে। সময় কতকিছু কেড়ে নেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি যা কাড়ে তার নাম স্মৃতি। কিন্তু মহিতোষ কেন যেন বিস্মৃত হতে পারেন না। সেই সব দিন, সেই সব অনুভব, স্পর্শ তাকে অহর্নিশ তাড়িয়ে বেড়াতে থাকে। তার খুব ইচ্ছে হয় পারুকে একটু জড়িয়ে ধরতে। তারও খুব কাঁদতে ইচ্ছে। হয়। কিন্তু কেন যেন তা পারলেন না তিনি। কোথায় যেন তীব্র এক বাধার পাহাড় অদৃশ্য দেয়াল তুলে দাঁড়ায়। সম্ভবত পারুর ওই শিশু সন্তানটিই। সেখানে ধর্ম, বিশ্বাস, বোধ, সমাজ, সংস্কার ক্রমশই মাথা তুলে দাঁড়াতে থাকে।

মহিতোষ অনেক চেষ্টা করেও সেই দেয়ালটা অতিক্রম করতে পারেন না।

.

মহিতোষকে তার এই জীবনের যন্ত্রণা কিংবা ফেলে আসা জীবনের স্মৃতির সুবাস নিস্তার দিল সেদিনই। তিনি মারা গেলেন সন্ধ্যাবেলা। এক স্মৃতিগন্ধা জীবন শেষ হলো যন্ত্রণার কথকতা হয়ে। সেই জীবনে তার শেষ আক্ষেপ বুঝি পারুকে পেয়েও হারিয়ে ফেলার। জীবন এমনই অদ্ভুত, এখানে মানুষ তার সবটুকু দিয়ে যা চায়, তার কিছুই শেষ অবধি আর তার আরাধ্য অনুভব হয়ে ধরা দেয় না। বরং পাওয়া হয়ে গেলেও কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তি দুটোই হয়ে রয় আজন্মের আক্ষেপ।

৪২

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, কিন্তু মনটা কিছুতেই শান্তি পাইতেছে না কামাল।

কামাল গম্ভীর মুখে বলল, বুঝি দুলাভাই। কিন্তু জিনিসটা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না। মালগুলা গেল কই?

‘চোখের সামনে অতগুলা সোনাদানা রাইখা আসলাম। আমরা কয়জন ছাড়া কেউ দেখে নাই। মাত্র কয়দিন পর গিয়া দেখি সেই জিনিস নাই। এইটা কোনো কথা?

আজ মতি, দেলু, এছাহাক সবাইকে নিয়ে বসেছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। সবকিছু নিজেদের মতো গুছিয়ে আনলেও ওই একটা বিষয় তাকে কিছুতেই স্বস্তি দিচ্ছে না। যদি তিনি জানতেন যে ওগুলো কারো কাছে আছে, তাহলেও একভাবে নিজেকে প্রবোধ দিতে পারতেন যে জিনিসগুলোর একটা হদিস আছে। কিন্তু পরিস্থিতি এখন যা দাঁড়িয়েছে তাতে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। সেদিন কি তবে মিথ্যে দেখেছিলেন তিনি? আলেয়ার মতো কিছু? কিংবা মতি, দেলু সবাই? নাকি ভৌতিক কোনো কাণ্ড ঘটে গেছে। সাপের মাথার মণি নিয়ে এমন নানা কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। সাত রাজার ধনের সমান মূল্যের সেই মণির নাকি হঠাৎ হঠাৎ দেখা মেলে। কিন্তু যোগ্য লোক না হলে মিলিয়ে যায়। তখন অনেক খুঁজেও আর তা পাওয়া যায় না। সেদিনও কি তবে এমন কিছুই ঘটেছিল? তিনিও কি তবে ওই ধন-সম্পদ পাওয়ার যোগ্য মানুষ নন? কিন্তু তা কী করে হয়? সেখান থেকে নিয়ে আসা দুখানা বালার একখানা এখনো তার কাছে সযত্নে গচ্ছিত রয়েছে। আরেকখানা দিয়ে আশরাফ খাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তাহলে এটা তো স্পষ্টই যে ঘটনা মিথ্যে নয়।

এছাহাক বলল, মতি আর দেলু তোরা ভুলেও কারো কাছে কিছু বলস নাই তো?

এছাহাকের প্রশ্নে তারা দুজনই রীতিমতো আঁতকে উঠল। জিভ কেটে প্রায় সমস্বরে বলল, নাউজুবিল্লাহ, আস্তাগফিরুল্লাহ। এতদিন পর এইটা কী কথা কন। এছাহাক ভাই?

আরে না না। এছাহাক অত কিছু ভেবে বলে নাই রে।’ তাদের আশ্বস্ত করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আসলে আমরা সবাই-ই তো এখন এই বিষয়ের একটা কূল-কিনারা খুঁইজা পাওয়ার চেষ্টা করতেছি। সেইটা পাইতেছি না বইলাই তো সবার মনে নানা প্রশ্ন আসে। এই ঘটনার একটা সমাধান সবাই চায়।’

কামাল এতক্ষণে আবার কথা বলল, ‘দুলাভাই?

হুম।

‘একটা কথা হঠাৎ মাথায় এলো।’

‘কী কথা?

‘ধরেন, ওইখানে যে পরিমাণ জিনিসপত্র ছিল, তা কি একজনের পক্ষে ওই গর্ত থেকে তুলে গোপনে অল্প সময়ে দূরে কোথাও নিয়া যাওয়া সম্ভব ছিল?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সামান্য ভাবলেন। তারপর বললেন, ‘একটু কঠিন। জিনিস হয়তো অত বেশি না। কিন্তু ওই গর্ত থেকে কলসির মতো পাত্রটা তো আগে তুলতে হবে। তারপর সেইগুলা ওইখান থিকা সরাইতে হবে। অন্ধকারে সবার চোখ এড়িয়ে গোপনে ওইটা একা একা করা একটু কঠিনই।’

তা ছাড়া, সময়ের কথাও খেয়াল রাখতে হইছে। তাই না? সে কিন্তু সময় বেশি পায় নাই। তারওপর ওই কলস বেশিদূর নিয়ে গেলে, বা কারো কাছে রাখলে মানুষের চোখে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও কিন্তু অনেক বেশি থাকবে।’

হুম।’

‘তাহলে… যদি কেউ একা, অন্য কাউকে না জানিয়ে জিনিসগুলো সরাতে চায়, তাহলে সে যেটা করবে, আপাতত ওই মন্দিরের আশপাশেই নিরাপদ কোথাও চট করে মালটা লুকিয়ে রাখতে চাইবে। আমি হলে তাই করতাম। পরে সুযোগ বুঝে অন্য কোথাও সরাইতাম।’

‘কেন? ওইখানের আশপাশেই কেন?’

কারণ সে জানে, ওই জিনিস নিয়ে আপনি কুত্তা পাগল হয়ে যাবেন। চারদিকে খোঁজখবর করবেন। ফলে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে, ওই জায়গারই খুব কাছে কোনো গোপন জায়গায় জিনিসটা লুকিয়ে রাখা। এটা কেউ চিন্তাই করতে পারবে না।’

কামাল কথা শেষ করলেও কেউ কোনো কথা বলল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বেশ খানিকক্ষণ পর নীরবতা ভাঙলেন। বললেন, ‘কথা খারাপ বলস নাই। এমনো তো হতে পারে যে সে মহিতোষের বাড়িতেই কোথাও, বা ওই মন্দিরের ভেতরে-বাইরে, আশপাশেই কোথাও জিনিসটা রাখছে। আর অপেক্ষা করতেছে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হওনের।

‘একদমই তাই। একটা কাজ করলে কেমন হয় দুলাভাই?

‘ওইখানেই আশপাশে একটু নজর কইরা খোঁজ লাগাব?’

হুম। একদম কাছ থেকে শুরু করতে হবে। প্রতিটা ইঞ্চি জায়গা। আমার ধারণা, জিনিসগুলা ওইখানেই কোথাও আছে।

এই কথায় যেন নড়েচড়ে বসল সবাই। উপস্থিত সকলের কাছেই কামালের চিন্তাটি যৌক্তিক মনে হলো। অন্তত পুরোপুরি অন্ধকারে উদ্দেশ্যবিহীন পথ চলার চেয়ে একটি স্পষ্ট নির্দেশনাতো পাওয়া গেল। এছাহাক বলল, কাল থিকাই তাইলে মতি আর দেলুরে নিয়া কাজে লাইগা যাব ভূঁইয়া সাব?

হুম। কিন্তু সাবধান। পুলিশ যখন তখন আসতে পারে। তাদের মনে সন্দেহ তৈরি করা যাইব না।

‘জি। ওইটা মাথায় আছে।

বাইরে তখন গভীর রাত। কিন্তু এই ঘরের সকলের চোখে মুখেই যেন এবার নতুন আশার সঞ্চার হলো। তবে সেই আশায় অকস্মাৎ অন্ধকারেরও আঁচ পড়ল। কামালের ঘরের মেঝে রোজ দুবার ঝকঝকে তকতকে করে মুছে রাখে কাজের মেয়েটা। কিন্তু আলাপ শেষে সকলে ঘর থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বিষয়টা হঠাৎই লক্ষ করল কামাল। মতি মিয়া তার ধুলোবালি মাখা স্যান্ডেল জোড়া ঘরের ভেতরে এনে দরজার কাছে রেখেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সে যখন তা পায়ে গলাতে যাবে, তখন খানিক বিরক্তই হলো কামাল। বলল, তুমি স্যান্ডেল নিয়ে ঘরে ঢুকছ কেন মতি মিয়া? তোমার স্যান্ডেল কি সোনা দিয়া বান্ধানো নাকি? এই ঘরে আর কেউ জুতা নিয়া ঢুকছে?

মতি থতমত খাওয়া গলায় বলল, নয়া স্যান্ডেল তো কামাল ভাই। বাইরে রাখতে ক্যামন লাগতেছিল!’

নয়া স্যান্ডেল নিয়া এত আহ্লাদ থাকলে দড়ি বাইন্ধা গলায় ঝুলাই রাখো, যাও।’

মতি এবার তার বিব্রত ভাব কাটানোর জন্য ফে ফে করে হাসতে লাগল। বলল, অনেক শখ কইরা কিনছি। সেই কবে ফরিদ মিয়ার পায় দেখছিলাম। তখনই পছন্দ হইছিল। কিন্তু দোকানে গিয়া দেখি, এইটা আর নাই। শেষ হইয়া গেছে। এই এতদিন পর আবার গঞ্জের থিকা আইনা দিল।

হুম। তোমরা না… এই সব মেয়ে মানুষের ভাব বাদ দাও। পুরুষ মানুষের কাজ না এইগুলা। বুঝলা? বিরক্ত গলায় বলল কামাল।

মতি মিয়া নিচু হয়ে স্যান্ডেলের পেছনের ফিতা বাঁধছিল। কিন্তু কামালের চোখ আটকে রইল তার পায়ে। হঠাৎই তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। মতি ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে সে তাকে ডাকল, মতি মিয়া।

‘জে?

‘এইদিকে আসো।’ কামালের কণ্ঠ গম্ভীর।

মতি একটু অবাকই হলো। সঙ্গে খানিক ভয়ও। বলল, ‘আবার স্যান্ডেল খুলব? ওইখানে বইসাই বলেন ভাই।’

‘যেইটা বলছি সেইটা করো।’ কামালের চোখে শীতল দৃষ্টি। গলায় কেমন গা হিম করা স্বর।

কী হইছে কামাল?’ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

কামাল তার প্রশ্নের জবাব দিল না। উপস্থিত সকলেই কামালের হঠাৎ এমন আচরণে অবাক হয়েছে। মতি মিয়া ভীত গলায় সামনে এসে বলল, ‘জে কামাল ভাই?

‘এই স্যান্ডেল তুমি কবে কিনছ?

‘এই সপ্তাহখানেক হয়।

এর আগে কার পায়ে দেখছিলা বললা?

মতি এবার খানিক বিভ্রান্ত বোধ করল। চিন্তিতও। বলল, ‘কেন কামাল ভাই?

“যেইটা বলছি, সেইটার জবাব দাও।

ফরিদের। ওহাব ডাক্তারের ভাইগ্না ফরিদের পায়।’

‘ঘটনা খুলে বলো আমারে।’

“ওই যে… মানে যেই দিন আপনের লাঠির আঘাতে রুস্তমের মাথা ফাইটা রক্ত বাইর হইল, ওই দিন সন্ধ্যায় আমি গেছিলাম ফরিদের দোকানে ব্যান্ডেজ আর ওষুধ আনতে। গিয়া দেখি ফরিদ দোকানে নাই। সে এলো কিছুক্ষণ পর। তখন দেখি সে গেছিল সামনের দোকানে স্যান্ডেল কিনতে। স্যান্ডেল জোড়া দেইখা আমার খুব পছন্দ হইল। দাম জিগাইলাম। দামটা একটু বেশি। কিন্তু অরিজিনাল চামড়ার জুতা। তারপর ওই দোকানে গিয়া দেখি এই স্যান্ডেল আর নাই তাদের কাছে। শেষ হইয়া গেছে। পরে আমি বললাম, আবার আনলে আমারে যেন খবর দেয়। তো এতদিন পর আনছে।

কামাল সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলল না। চুপ করে বসে রইল। তার চারপাশে কয়েকজোড়া চোখ অসংখ্য জিজ্ঞাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছে না। তবে সকলেই বুঝতে পারছে এই স্যান্ডেলের সঙ্গে গভীর কোনো সমস্যা জড়িয়ে আছে। কিন্তু কী সেটা?

কামাল আচমকা নীরবতা ভাঙল। তারপর দেলুকে বলল, তুই যে ওইদিন আনছিলি সেই স্যান্ডেলটা আমার খাটের নিচে আছে। বের কর।’

দেলু তার খাটের নিচ থেকে সেই ঘেঁড়া একপাটি স্যান্ডেল বের করল। উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে লক্ষ করল যে মতি মিয়ার পায়ের স্যান্ডেল আর এই স্যান্ডেলখানা একইরকম। ঘটনা স্পষ্ট বুঝতে না পারলেও সকলেই আঁচ করতে পারছে যে এই স্যান্ডেলের সঙ্গে নিশ্চয়ই গুরুতর কোনো ব্যাপার যুক্ত আছে। চিন্তিত, দ্বিধাগ্রস্ত এছাহাক, অবশেষে প্রশ্নটা করল, স্যান্ডেলের ঘটনা কী কামাল ভাই?

কামাল দেলুর হাত থেকে ছেঁড়া স্যান্ডেলখানা নিল। তারপর সেটি উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতে বলল, এই স্যান্ডেলটা দেলু কই পাইছে জানেন?

কই?

রুস্তমরে সেইদিন সন্ধ্যায় যেইখানে আমরা পানিতে ডুবাইছিলাম, সেইখানে।

মানে? হতভম্ব গলায় বলল এছাহাক।

হুম। আমাদের তাড়া খেয়ে যেই লোক অন্ধকারে পালাইছিল। তার পায়ে ছিল এই স্যান্ডেল।

‘কী বলেন!’

হুম।

তার মানে সেইদিন ওইখানে তোদের যে দেখছে, সে ফরিদ? প্রায় কাঁপা গলায় কথাটা বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

কামাল অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। বেশ খানিকটা সময় চুপচাপ বসে রইল সে। তারপর বলল, “একদম নিশ্চিত করে বলা না গেলেও এই সম্ভাবনাই বেশি। সেই দিন ওই খানে ফরিদই ছিল। এইটা তার পায়েরই ছেঁড়া স্যান্ডেল। এই স্যান্ডেলই সেই দিন ফার্মেসিতে ফরিদের কাছে মতি মিয়া দেখছিল। আর সে তো বললই, দাম বেশি বলে এই স্যান্ডেল দোকানদার এক-দুই জোড়ার বেশি আনত না। কারণ বিক্রিই হইত কম। তাইলে ফরিদ না হলে আর কে হবে?

এই কথায় অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতা নেমে এলো ঘরজুড়ে। যেন খানিক আগে জ্বলে ওঠা আশার প্রদীপটা আবার দমকা ঝোড়ো হাওয়ায় নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, কিন্তু সে হইলে তো এতদিনে কারো না কারো কাছে বল তোই? কিন্তু কারো কাছে তো কিছু বলে নাই সে।

‘এখনো না বললেও, বলবে। আজ হোক, কাল হোক সে এই কথা বলবেই।

‘তুই এত নিশ্চিত কেমনে?

নিশ্চিত কারণ, সে আপনের ওপর নানা কারণেই ক্ষিপ্ত। ওহাব ডাক্তারও ক্ষিপ্ত। সুতরাং সুযোগ পেলে তারা যে আপনার ওপর পুরনো হিসেবটা মিটাই নিতে। চাইবে, এইটা তো না বোঝার কিছু নাই।

তাহলে এখন?’ ভীত ও চিন্তিত গলায় প্রশ্নটা করল এছাহাক।

সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না কামাল। বেশ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘এক কাজ করেন এছাহাক ভাই।’

কী কাজ?

মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতে ওই জিনিস খোঁজ করার পাশাপাশি ফরিদের দিকেও খেয়াল রাখেন। মতি আর দেলুরে কাজে লাগান। দেখেন, তার গতিবিধি কী? সে যদি উল্টাপাল্টা কিছু না করে, আমি এই পরিস্থিতিতে আরেকটা খুন করার ঝামেলায় যেতে চাই না। কিন্তু বিষয়টা সিরিয়াস। সে সামান্য উল্টাপাল্টা কিছু করলেও আমার আর উপায় থাকব না।’

.

ফরিদ সিদ্ধান্তটা যে হুট করে নিয়েছে তা নয়। গত বেশ কিছুদিন ধরেই নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে সে। নানাভাবে বোঝানোরও চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তি মেলেনি। বরং সেদিন শফি চলে যাওয়ার পর থেকে সময় যত গড়িয়েছে, ততই নিজেকে অপরাধী মনে হয়েছে। মনে হয়েছে, আশরাফ খাঁর এই পরণতির জন্য সে নিজেকে কখনোই ক্ষমা করতে পারবে না। তার সাক্ষ্য দেয়ার কারণে যদি এই মামলার অবস্থা পাল্টে যায়, মুক্তি মেলে আশরাফ খাঁর, তবে সেটি তার অবশ্যই করা উচিত। অন্যথায়, এই ঘটনায় সে নিজেও সমান অপরাধী হয়ে থাকবে আজীবন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরো কিছু বিষয়। সেই বিষয়গুলোও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার প্রতি তার পুরনো ক্রোধ, ক্ষোভকেও যেন জাগিয়ে তুলেছে।

তবে সিদ্ধান্তের কথা বাড়িতে কাউকে কিছু জানায়নি সে। কারণ, এমনিতেই তাকে নিয়ে সকলে তটস্থ থাকে। এরমধ্যে এক ঘটনা ঘটেছে। আজকাল প্রায়ই রাতে হুটহাট ঘুম ভেঙে যায়। তখন চুপচাপ বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে সে। কত শত শব্দ, ছবি মন ও মগজজুড়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। সেখানে পারু যেমন থাকে, তেমনি থাকে তার ফেলে আসা জীবনের অসংখ্য দিনযাপনের প্রতিচ্ছবিও। ফরিদ অবশ্য আজকাল তার ভাগ্য মেনেই নিয়েছে। তার এখন মনে হয়, জীবনের এই সব দুঃখ-কষ্ট, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সবই অর্থহীন। কারণ মানুষ এখানে মূলত পূর্বনির্ধারিত পাণ্ডুলিপিতেই অভিনয় করে যায়। সে যত চেষ্টাই করুক না কেন, তার পক্ষে কখনোই ওই পাণ্ডুলিপির বাইরে যাওয়া সম্ভব নয়। সে অনেকটা পুতুলনাচের পুতুলের মতো। তার সকলকিছুই নির্ধারিত হয় অন্য কারো দ্বারা।

এই যে তার জীবন, এই যে এত এত যুদ্ধ-যাতনা এসবই হয়তো আগে লেখা ছিল। কিন্তু সে জানত না বলে অযথাই লড়াই করে গেছে। পারুকে পাওয়ার জন্য রুদ্ধশ্বাসে ছুটেছে। হারিয়ে কেঁদেছে। আবার আছমাকে সর্বস্ব দিয়ে উপেক্ষা, অবহেলা করেও কী এক অদ্ভুত বৃত্তে বন্দি হয়ে তার কাছেই ফিরে এসেছে। অর্থাৎ জীবনে যা যা চেয়েছে, তার প্রতিটিই হারিয়েছে সে। আর যা চায়নি, তা-ই যেন বহুদূর বহুক্রোশ ঝঞ্ঝার পথ হেঁটে এসে আলগোছে ধরা দিয়েছে।

সেদিন রাতের ঘুমটা অবশ্য ভেঙে গিয়েছিল অন্য কারণে। ফরিদ হঠাই আবিষ্কার করল আছমা খুব সাবধানে তার হাতখানা ধরল। তারপর আলতো করে সেই হাতটা নিয়ে তার পেটে চেপে ধরে রাখল দীর্ঘসময়। ফরিদ কিছু বলল না। সে ঘুমের ভান ধরেই শুয়ে রইল। কিন্তু আছমার এমন আচরণের কারণ সে চট করে ধরতে পারল না। তবে এই একই ঘটনা ঘটতে লাগল পরের রাতগুলোতেও। আছমা যখন ভাবে যে ফরিদ ঘুমিয়ে পড়েছে তখন সে আলগোছে তার হাতখানা নিজের কাছে টেনে নেয়। তারপর আলতো করে পেটের সঙ্গে চেপে ধরে রাখে। এমন কেন করে আছমা?

প্রথম যেদিন বিষয়টা মাথায় এলো, ফরিদ ঝট করে উঠে বসল। তার শরীর কাঁপছে। দরদর করে ঘামছে সে। আছমা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হইছে আপনের? আপনে এমন করেন কেন?

ফরিদ আছমার কথার জবাব দিল না। সে জগৎসংসার স্তব্ধ করে দেয়া এক চিৎকারে সবকিছু স্তব্ধ করে দিতে চাইছে। কিন্তু পারছে না। তার মাথা কাজ করছে না। মনে হচ্ছে এখুনি তার মাথার শিরা-উপশিরা ছিঁড়ে যাবে। আছমা বিচলিত ভঙ্গিতে বলল, ‘পানি দেব? পানি?

ফরিদ ফ্যাকাশে কণ্ঠে বলল, না।’

‘তাইলে?

‘তাইলে…।’ বলে চুপ করে রইল ফরিদ। তারপর হঠাৎ বলল, তোর পেটে কি আমার বাচ্চা আসছে?

আছমা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তবে খানিক চুপ করে থেকে অবশেষে আলতো করে ওপর নিচ মাথা নাড়ল সে। মৃদু করে রাখা হারিকেনের আবছা আলোয় সেই লজ্জাবনত কিন্তু পরিতৃপ্ত আছমাকে দেখে ফরিদের বুকের ভেতরটা শূন্য হয়ে যেতে লাগল। সে আচমকা ফিসফিস করে বলতে লাগল, আল্লাহগো, ও আল্লাহ, আল্লাহ।’

আছমা চকিতে ফরিদের দিকে মুখ তুলে তাকাল। কী হয়েছে মানুষটার? সে এমন কেন করছে? আছমার সন্তান হবে শুনে সে খুশি হয়নি? ব্যাপারটাতে আছমার মন খারাপ করার কথা। হয়তো হয়েছেও। কিন্তু তারপরও সে তা প্রকাশ করল না। এই মানুষটার জন্য নিজের জীবনের সকল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির হিসেব সে জলাঞ্জলি দিতে জানে। দু হাতে ফরিদকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, কী হইছে আপনার? কী হইছে?

ফরিদ অবশ্য আর কথা বলল না। সেই পুরোটা রাত সে অন্ধকারে চোখ মেলে শুয়ে রইল। তার পেছনে আছমা। দুজন মানুষ একই বিছানায় হয়ে রইল আলাদা। তাদের ভাবনা ও অনুভবের জগৎ হয়ে রইল বিচ্ছিন্ন। কিন্তু তারা কেউ কারো ভাবনা জানল না। পড়তে পারল না। তবে ফরিদের বুকের ভেতর বয়ে যাওয়া তীব্র এক বেদনার নদী ক্রমশই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে লাগল সমগ্র চরাচর। ডুবিয়ে দিতে লাগল ঘর-দোর, উঠোন, বসতি। পারুও কি তবে সন্তানসম্ভবা ছিল?

এই প্রশ্ন তার সমগ্র অস্তিত্ব নাড়িয়ে দিতে লাগল। যাত্রাপালার ওই প্যান্ডেলে আগুন লাগার ঠিক আগ মুহূর্তে পারু হঠাৎ কী বলতে চেয়েছিল তাকে? কেন তার হাতখানা ঠিক এভাবেই পেটে চেপে ধরে রেখেছিল? তার আগে কেন বলছিল যে খুব জরুরি একখানা কথা বলতে চায় সে? কিন্তু সেই কথাটি বলার জন্য সময়ের অপেক্ষায় ছিল সে। অপেক্ষায় ছিল পারস্পরিক অনুভবেরও। কিন্তু কী সেই অনুভব? ফরিদের প্রায়ই মনে হয়, আছমা আর পারুর সঙ্গে কোথায় যেন আশ্চর্য এক মিল রয়েছে। যেন তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হয়েও কোথাও না কোথাও এক। তাদের কথায়, ভাবনায়, আচরণে কী অদৃশ্য কোনো সংযোগ রয়েছে?

সেই সারাটা রাত আর ঘুমাতে পারল না ফরিদ। পরদিনও না। আছমার খবরটা বাড়িতে ছড়িয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে ফুরফুরে হাওয়ায় স্পন্দিত হয়ে উঠতে লাগল বাড়ির ধুলিকণা অবধি, ফরিদ যেন তাতে অংশ নিতে পারল না। বরং জড়সড় হয়ে রইল নিজের ভাবনার জগতে।

এই ভাবনাই নানা ডালপালা ছড়িয়ে শেষ অবধি একটি নির্দিষ্ট জায়গায় এনে তাকে অস্থির করে তুলতে লাগল। জীবন আজ যেখানে এনে তাকে দাঁড় করিয়েছে তাতে বড় দায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারই। দিনের পর দিন তিনি সম্ভাব্য সকল উপায়ে মহিতোষ মাস্টারকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছেন। যার পরিণতি আজ ভোগ করছে এতগুলো মানুষ। পারু। সে। এমনকি যদি সত্যি সত্যিই পারু সন্তানসম্ভবা হয়ে থাকত, তবে সেই সন্তানটিও। বিষয়টা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারল না ফরিদ। বরং তীব্র এক আক্রোশ অনুভব করতে লাগল সে।

সেদিন প্রায় ভোর রাতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো ফরিদ। তারপর পায়চারি করতে লাগল উঠানজুড়ে। তারপর হঠাৎই সে সিদ্ধান্তটা নিল। জীবন যদি তার সকল পাণ্ডুলিপি আগেই লিখে রাখে, নির্ধারিত করে রাখে ভাগ্য, তাহলে এত ভয় আর সংশয় করে কী লাভ? সে কাজটা করবে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেবে সে। তারপর যা হবার হবে।

.

তখন ভর দুপুর। গোরস্থানের মতো নীরব খাঁ বাড়ির পুকুর ধারে বসেছিল শফি খাঁ। এই সময়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এলো ঝন্টু। শফি বলল, কী হইছে?

ফরিদ আপনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। ফরিদ?’

ঝট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল শফি। কী কথা?

‘সেইটা সে আপনেরেই সরাসরি বলবে। বলছে খুব আর্জেন্ট।

কবে? কোথায়?

‘আপনেরে একটা জায়গা ঠিক করতে বলছে। তবে তার বা আপনের বাড়ি না। অন্য কোথাও। কারণ, সে ভয় পাইতেছে যে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আপনার ওপর নজর রাখতেছে।

আচ্ছা। তুই যা। গিয়া বলবি, আমি পান্ন বা তৈয়বরে দিয়া খবর পাঠাব।’

.

শফি খাঁ তৈয়ব আর পান্নুকে পাঠাল রাতে। তারা এলো অন্ধকারে গাঢাকা দিয়ে। ফরিদের ঘরের দরজায় এসে যখন তৈয়ব দাঁড়াল তখন আড়াল থেকে চারদিকে সতর্ক নজর রাখছিল পানু। কিন্তু তখনো তার ধারণাই নেই যে আড়াল থেকে আরো দু জোড়া চোখ তাদের লক্ষ্য করছে। আর সেই চোখে ততক্ষণে লেখা হয়ে গেছে ফরিদের মৃত্যু পরোয়ানা।

৪৩

পারু একদমই কাঁদেনি। এত অবিশ্বাস্য শান্তও এর আগে কখনো লাগেনি তাকে। যেন কোথাও কিছু হয়নি। কেউ মারা যায়নি। যা যেমন ছিল সব তেমনই আছে। এমনকি মায়ের কথাও একবার মনে পড়ল না তার। চারু বা ঠাকুমার কথাও না। খুব শান্তভঙ্গিতে বাবার শেষকৃত্য করাল সে। বাবার যা যা ছিল তা যত্ন করে গুছিয়ে রাখল আলমারিতে। তারপর এক সন্ধ্যায় তরু তার কাছে এসে দাঁড়াল। বলল, ‘কী করবে এখন?

পারু মুখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, আমাকে আর দুটো দিন একটু ভাবতে সময় দেবেন?

‘আমি তোমায় তাড়িয়ে দিচ্ছি না পারু। কিন্তু তোমাকে দেখে আমার ভয় হচ্ছে।’

‘কেন? আমি কি কিছু করেছি?

‘কিছু করলে তো ভয় হতো না।

‘তাহলে?

‘এই যে তুমি হঠাৎ একদম শান্ত, চুপচাপ হয়ে গেছো।

‘তাহলে কী করব?

কাঁদবে।

পারু ম্লান হাসল। যেন সে কুটি করল অদৃশ্য কাউকে। তারপর বলল, আর কত কাঁদব?’

এই প্রশ্নে থমকে গেল তরু। জবাব দিল না। পারু বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কাঁদব না। মানুষের জীবনে সবকিছুরই কোটা থাকে। আনন্দ, দুঃখ। কান্না-হাসি। আমার ধারণা আমি আমার কান্নার কোটা শেষ করে ফেলেছি। এখন থেকে আমি কেবল হাসব।’

বলেই হাসির মতো কিছু একটা করল পারু। তবে সেটি আদতেই হাসি কি না তা নিশ্চিত করে বুঝতে পারল না তরু। সে বলল, তুমি এত শান্ত, এত চুপচাপ হয়ে গেছো যে আমি ভয় পাচ্ছি। এমন কখন হয় জানো?

কখন?

প্রকৃতি ভয়ংকর দুর্যোগের আগে এমন শান্ত হয়ে যায়। কোথাও কোনো শব্দ নেই। স্পন্দন নেই। যেন সবকিছু স্বাভাবিক, স্থির, চুপচাপ।’

‘আমার তো দুর্যোগ নামিয়ে আনার ক্ষমতা নেই। আমার যা আছে তাহলো দুর্যোগ সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।’ বলে আবারও হাসল পারু। মৃদু। তার সেই হাসি ম্লান, প্রাণহীন।

‘তুমি ভুবনডাঙা যাবে?

পারু ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, না।

যাবে না?

উঁহু।

‘কেন?

পারু এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। তরু বলল, কী হয়েছে তোমার? তুমি এমন করে কথা বলছ কেন?

‘কেমন করে কথা বলছি?

আমি জানি না। তোমাকে এত অদ্ভুত লাগছে। ভয়ও হচ্ছে আমার।’

পারু উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, আমি আর কোথাও যাব না তরুদি। আমাকে আপনি একটা কাজটাজের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি এখানেই থাকব।’

‘এখানেই থাকবে মানে?

‘এখানেই মানে একটা কাজটাজ জুটিয়ে নিতে পারলে নিজের মতো করে থাকব। আপনাকেও আর যন্ত্রণা দেব না। আর কত?

তরু পারুর কথার জবাব দিল না। সে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। পারু ধীর পায়ে হেঁটে তার ঘরে চলে গেল। তারপর ফিরে এলো আরো ধীরে। তরু বলল, কী হয়েছে তোমার? তুমি এমন কেন করছ?

পারু বসতে বসতে বলল, এটা দেখুন।

তরু পারুর হাত থেকে কাগজটা নিল। একটা চিঠি। সে অবাক চোখে চিঠিটা পড়ল। তারপর হতভম্ব ভঙ্গিতে তাকাল পারুর দিকে, এই চিঠি তোমাকে কে দিয়েছে?

‘কেউ দেয়নি।

‘তাহলে?

‘বাবার বিছানার নিচে পেয়েছি।

কবে?

বাবা যেদিন মারা গেলেন, ওই দিনই।’

তরু রাজ্যের অবিশ্বাস নিয়ে পারুর দিকে তাকিয়ে রইল। এতবড় একটা ঘটনা জেনেও সে কাউকে কিছু বলেনি। পারু বলল, বাবা এই চিঠির ধকলটা নিতে পারেননি। আর কতই বা নেবেন? মানুষের সহ্য করার ক্ষমতা তো আর অসীম নয়।

‘উনি তোমাকে এই চিঠির কথা বলেননি?

“উঁহু।

সন্ধ্যার বিষণ্ণ অন্ধকারে ঘরজুড়ে আশ্চর্য এক বিষাদ নেমে এলো। সেই বিষাদ অসহ্য নীরবতা ছড়িয়ে দিতে লাগল চারদিকে। তরু বলল, তুমি সত্যি ফরিদের কাছে যাবে না?

পারু সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। বাইরে সোডিয়াম লাইটের হলদে আলোয় ফাঁকা রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। তবে দূরে আঁকা ছবির মতো একটা কুকুর বসে আছে। নিঃসঙ্গ। একা। সে সেই কুকুরটার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি হলে কী করতেন?

‘আমি?

হুম।

উত্তর দিতে গিয়েও থমকে গেল তরু। আসলেই তো, এমন হলে কী করত সে! পারু বলল, আমি আর কোথাও যাব না। মায়ের কাছেও না।

কেন?

কারণ বাবার মতো মাকেও আমি মেরে ফেলতে চাই না। যতটা কষ্ট মানুষ পেতে পারে, তারচেয়ে বেশিই তারা পেয়েছে। আর নিশ্চয়ই এতদিনে খানিক থিতুও হয়েছে। এখন আমি নতুন করে আর ঝড় তুলতে চাই না।’

তরু বুঝতে পারছে না সে কী করবে! তার থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে জানালার চৌকাঠের পটভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকা পারুকে এত দূরের মানুষ মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে এই পৃথিবীর সঙ্গে তার অযুত-নিযুত আলোকবর্ষ দূরত্ব। সে আসলে কোথাও নেই। কিংবা তার সঙ্গে কেউ নেই। এই সত্যিটা সে জেনে গেছে। তরু উঠে পারুর কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, তোমাকে কিছু বলার সাহস আমার নেই। তারপরও আরেকবার সবকিছু ভেবে দেখবে?

‘আমি ভেবেছি দিদি। আর কটা দিন যাক। মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করব আমি। কিন্তু আমি আর দেশ ছেড়ে কোথাও যাব না দিদি। এই দেশ ছাড়তে গিয়ে কিংবা থাকতে গিয়েই তো এত কিছু হলো। তাহলে কেন আর ছেড়ে যাব! যা হবার এখানেই থোক। আমি এখানেই থাকব।’

তরু চুপচাপ পারুর দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটিকে হঠাৎ কেমন অচেনা লাগছে তার। মানুষ আসলে এমনই, সময় তাকে কখন কীভাবে আদ্যোপান্ত বদলে দেয়, তা সে নিজেই জানে না।

পারু বলল, আমায় একটা কাজ জুটিয়ে দেবেন দিদি?

তরু এবারও কথা বলল না। তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ।

পারু বলল, আমি আর ওইটুকু এক মেয়েই তো। দেখি ওকে নিয়ে কতটুকু বাঁচা যায়। না পারলে আপনি তো আছেনই।

‘পারু? হঠাৎ ডাকল তরু।

হুম?

‘তুমি একটু আমার কাছে আসবে?

পারু কথা বলল না। তবে সে এগিয়ে এলো তরুর খুব কাছে। তারপর তরুকে জড়িয়ে ধরল শক্ত করে। যেন এই জগতে এইটুকু মায়ার আশ্রয় ছাড়া আর কিছু নেই তার। কিচ্ছু না।

৪৪

খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্থির হয়ে গেল কামাল। এই আশঙ্কাটাই করছিল সে। রাত তখন কত কেউ জানে না। কিন্তু সেই রাতেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হলো। সদ্য ঘুম ভাঙা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ‘এখন উপায়?

‘উপায় তো একটাই।’

‘কী?’

‘খুন।

‘খুন! যেন আঁতকে উঠলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

হুম।

কী বলছিস তুই?

আর কোনো উপায় আছে?”

এই কথায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চুপ করে গেলেন। কামাল বলল, ফরিদের সাক্ষ্য দেয়া মানে আমাদের সবার ফাঁসি।

কিন্তু তার কথা যে সত্য তার প্রমাণ কী? সে যে সত্যিই তোদের দেখছে, এই প্রমাণ আছে তার কাছে?

‘প্রমাণ বের হবে দুলাভাই। যখন সে নিজে প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করে পুঙ্খানুপুঙ্খ সাক্ষ্য দেবে, তখন খুব স্বাভাবিকভাবেই মামলার তদন্তে নতুন মোড় নেবে। তার কাছে অকাট্য কোনো প্রমাণ না থাকলেও নিবে। আপনাদের জিজ্ঞাসাবাদ, নজরদারি শুরু হবে। আর তখন কোনদিক দিয়ে কী বের হবে আপনে সেটা বলতে পারেন? তা ছাড়া ফরিদের দোকান থেকে মতি মিয়া যে ব্যান্ডেজ আর ওষুধ কিনছিল, এই ঘটনাও কিন্তু দু-একজন দেখছে। দেখে নাই মতি?

হুম। উত্তরপাড়ার ঝন্টু একটু ঝামেলাও করছিল।

কী ঝামেলা?

মতি মিয়া ঘটনা খুলে বলল। সব শুনে কামাল বলল, এখন ফরিদ আর ঝন্টু যদি পুলিশরে ওই ঘটনাও জানায়, তখন পুলিশ কিন্তু মতির জেঠুস বা তার ছেলেরেও জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তখন কী দাঁড়াবে? তারা যদি তখন বলে যে সেই দিন ব্যান্ডেজ লাগানোর মতো কোনো ঘটনা তাদের বাড়ি ঘটে নাই। কারো মাথা ফাটে নাই। মানে আপনি তো প্রত্যেকটা মানুষরে পুলিশের প্রশ্নের উত্তর আগেভাগে শিখাই দিতে পারবেন না। আর এই সব তিল থেকেই তাল হয় বুঝলেন? এত এত অপরাধী তো আর পুলিশের হাতে এমনি এমনি ধরা পড়ে না!

কামালের কথা শুনে ঘরের আবহাওয়া মুহূর্তেই থমথমে হয়ে গেল।

এছাহাক বলল, ফরিদরে অন্য কিছু করা যায় না ভাই?

‘অন্য কী?

‘ধরেন তারে ভয়টয় দেখানো যায় না?

‘সে যদি ভয়ই পাইত, তাহলে তো আর শফির সঙ্গেই যোগাযোগ করত না। কিন্তু সে যেহেতু যোগাযোগই করছে, তার মানে ভেতরে ভেতরে কিছু একটা চলতেছে। আর আমার ধারণা, সে সাক্ষ্য দিতে যাবেই। না গেলে অতরাতে ওদের সঙ্গে তার কী কাজ?

‘তাও ঠিক। ম্রিয়মাণ কণ্ঠে বলল এছাহাক।

‘খুন ছাড়া অন্য কিছুই করা যায় কি না একটু ভাবেন? না হইলে এইটা না আবার নতুন বিপদ নিয়া আসে!’ এবার প্রায় কাতর কণ্ঠে কথাটা বলল মতি মিয়া। কিন্তু এতে সঙ্গে সঙ্গেই ধমকে উঠল কামাল। বলল, মাথাভর্তি গোবর নিয়ে আসছ এই কাজ করতে। আজ তোমাদের জন্যই এত এত ঝামেলা। একটার পর একটা সমস্যা। তোমরা কোনখানে কী কইরা আসো কে জানে!

মতি মিয়া মিনমিনে স্বরে বলে, আমরা কী করছি কামাল ভাই? আমাগো সবাইর মতের বিরুদ্ধে গিয়া আপনেই না রুস্তমরে খুন করলেন। আর এখন দোষ…।’

এবার তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল কামাল। সে বিশ্রি ভাষায় গাল বকে বলল, সাবধান মতি মিয়া। আমার মাথা গরম করবা না। আমার মাথা গরম করলে কিন্তু আমি নিজের ভাইরেও ছাড়ি না।

কামালকে শান্ত করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি বললেন, এখন নিজেরা ঝামেলা না কইরা আগে ঠাণ্ডা মাথায় ভাব, কী করা যায়?

কামাল সেদিন আর কথা বলল না। সে জানে এমন উত্তপ্ত মস্তিষ্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেই সিদ্ধান্ত ফলপ্রসূ হয় না। বরং তাকে এখন ঠাণ্ডা মাথায় পুরো বিষয়টা নিয়ে ভাবতে হবে। তবে তাকে আসল বুদ্ধিটা দিল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া স্বয়ং। পরদিন ভোরেই আবার সবাই মিলে বসল তারা। কথা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ‘একটা কাজ করলে কেমন হয় কামাল?

কী কাজ?

ফরিদরে খুন করলেও ঘটনা সরাসরি ঘটবে না। ঘটনা ঘটবে অন্যভাবে। পরোক্ষে।

মানে?’ কৌতূহলী চোখে তাকাল কামাল।

মানে…। ধর ওরে শারীরিক কোনো আঘাত না করেই মারা হলো।

‘তা কীভাবে?

‘ধর বিষ-টিশ খাইয়ে। তাইলে যেইটা হবে, ধর অসুস্থ হয়ে, পেট ব্যথা, বমি টমি করে মরে গেল। লোকে ভাবল হঠাৎ কোনো অসুখ বিসুখ হইছে। বা কোনো হাই ডোজের ঘুমের ওষুধ। খেয়ে ঘুমের মধ্যেই মইরা গেল? তাইলে কারো সন্দেহও থাকবে না।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া থামলেও চট করে কেউ কথা বলল না। তবে বুদ্ধি পছন্দ হয়েছে কামালের। এতে অনেকগুলো সুবিধাও আছে। এই গাঁও গ্রামে এমন মৃত্যুকে কেউ অস্বাভাবিক মনে করবে না। ভাববে স্বাভাবিক কোনো রোগেই মৃত্যু। ফলে ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই হিসেব মিটিয়ে ফেলা যাবে। তাদের চিন্তাও দূর হবে। কিন্তু সরাসরি খুন করার বিপদ অনেক। এই নিয়েও পুলিশের মধ্যে আবার সন্দেহ তৈরি হবে। শফি খাঁ বিষয়টিকে আরো জটিল করে তুলবে। ফলে শেষ অবধি অভিযোগের তীর ঘুরে ফিরে আবার তাদের দিকেই আসবে। তারপরও আর কয়েকটা দিন ভাবার সময় নিল কামাল। তারপর বসল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। দীর্ঘ ভূমিকার পর কামাল বলল, ‘কাজটা কে করবে?

কী কাজ? দেলু জিজ্ঞেস করল। সেদিনের ঘটনার পর থেকে মতি মিয়া অনেকটাই চুপ মেরে গেছে।

তাকে বিষ খাওয়ানোর কাজ?

এই কথায় আবার থমথমে হয়ে গেল ঘরের পরিবেশ। তারা এতদিন ভেবেছিল কামাল নিজেই কাজটা করবে। যেহেতু এই দলে খুনখারাবির কাজে সে-ই সবচেয়ে দক্ষ। কিন্তু বিষয়টা খোলাসা করল কামাল। বলল, ‘অস্ত্রপাতির বিষয় হলে আমিই দায়িত্ব নিতাম। কিন্তু এই কাজটা করতে হবে কৌশলে। আর সেজন্য এমন একজনকে দায়িত্বটা নিতে হবে যার ওই বাড়িতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা আছে। যে ওই বাড়ির ভেতর-বাহির খুব ভালো চেনে। এখনো যখন-তখন যেতে পারবে।

কামাল থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। যেন উপস্থিত সকলেই এই দায়িত্বটা নিজের কাঁধ থেকে এড়াতে চাইছে। কামাল বলল, ‘প্রথমে দু-একদিন নানা অজুহাতে যেতে হবে। গিয়ে বুঝতে হবে কোন ফাঁকে কীভাবে কাজটা করা যায়। হতে পারে তার খাবারে, বা বিছানার পাশের টেবিলে রাখা পানির জগে। বা এইরকম যেকোনো কিছুতে। কিন্তু খবরদার, মিস করা যাবে না কিছুতেই।

এইটা একমাত্র এছাহাকই পারব। সে ছাড়া আর কারো ওই বাড়িতে যাওয়ার তেমন সুযোগও হয় নাই। তা ছাড়া, ওর সঙ্গে ওহাব ডাক্তারেরও ভালো কথাবার্তা হয়। তার বাড়িতে নানা সময়ে ওষুধপত্র, চিকিৎসা ব্যবস্থার কাজে তো ও যাইতই। এবারও না হয় গেল?’ বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

‘এইটা কিন্তু ভালো বলছেন দুলাভাই।’ ভূঁইয়ার কথায় সায় দিল কামাল। ‘এছাহাক ভাই, এইটাই সবচেয়ে ভালো প্ল্যান। আপনি নরমালি যেমন যান ওই বাড়িতে, কোনো একটা ওষুধপত্রের অজুহাতে সেভাবেই যাবেন। তারপর সুযোগ বুঝে কাজটা করে ফেলবেন।

এছাহাক কিছুতেই এই ভয়ানক কাজের দায়িত্ব নিতে চাইছিল না। কিন্তু সে এও বুঝতে পারছে যে এখন এখান থেকে পিছু হটারও সুযোগ তার নেই। এতে পরিস্থিতি বরং আরো ঘোলাটে হবে। সে বলল, কিন্তু কাজ যদি না হয়?

এই কথায় আবার রেগে গেল কামাল। বলল, কাজ হবে না মানে কী? হবে না কেন? আর কাজ করার আগেই যদি নেগেটিভ চিন্তা থাকে মাথায়, তাইলে হবে কেমনে?

এছাহাক বিড়বিড় করে বলল, ভাইজান। আপনে শুধু শুধু রাগতেছেন। যেকোনো কাজেই তো ফেল থাকতে পারে, পারে না? আমি বলতেছি তাইলে অন্য প্ল্যান কী?

কামাল যেন এবার চিৎকারই করে উঠল। সে উত্তেজিত গলায় বলল, তাইলে আর কী! আমারই খুন করতে হবে।

এই কথায় যেন আশ্বস্ত হলো এছাহাক। সেদিন সন্ধ্যাবেলাতেই সে ওহাব ডাক্তারের বাড়ি গেল। যেহেতু বেশ কিছুদিন ধরে ফার্মেসি বন্ধ কিংবা অনিয়মিত, সেহেতু সে বাড়িতে যাওয়ায় চট করে কেউ কিছু ভাবতে পারল না। এছাহাক কাতর কণ্ঠে বলল, কোমর আর হাঁটুর বেদনায় বসলে দাঁড়াইতে পারি না। দাঁড়াইলে বসতে পারি না। মনে হয় জয়েন্টে জয়েন্টে জং ধরছে। এমন ব্যথা।

ওহাব ডাক্তার তাকে এটা-সেটা করতে বললেন। আর বললেন ফার্মেসি খুললে একদিন দোকানে আসতে। বাড়িতে এই মুহূর্তে কোনো ওষুধ নেই। এতে অবশ্য এছাহাকের খানিক সুবিধাই হলো। সে চাইলে পর পর বেশ কদিনই আসতে পারবে। তবে এদিক-সেদিক তাকিয়েও ফরিদকে কোথাও দেখতে পেল না সে। তার ঘর কিংবা খাবার অবধি পৌঁছাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। এর মধ্যে। তাকে কেউ কিছু সন্দেহ না করলেই হয়।

কথাটা সে কামালকেও বলল। মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না কামাল। সে সময়ক্ষেপণে মোটেই রাজি নয়। কিন্তু এই মুহূর্তে ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কিছু করারও নেই। এছাহাক বিরতি দিয়ে দিয়ে আরো কদিন গেল। কিন্তু ফরিদের সঙ্গে কথা বলার বা তার ঘর অবধি যাওয়ার সুযোগ সেভাবে হলো না। এর অবশ্য কারণও আছে। আছমা সন্তানসম্ভবা। সে বেশির ভাগ সময়ই তার ঘরে থাকে। ফলে বাইরের পুরুষ মানুষের ঘরে প্রবেশ সংগত নয়।

এর মধ্যে ওহাব ডাক্তার সেদিন প্রশ্নটা করেই বসলেন, আমি তো এখন দোকানেই যাই এছাহাক। তুমি তারপরও এত ঘনঘন বাড়িতে আসো কেন? নাকি

অন্য কোনো দরকার?

ওহাব ডাক্তারের কথায় থতমত খেয়ে গেল এছাহাক। সে বলল, কই? আমি তো জানি না।’

‘এখন থেকে জানো। আর আমার মেয়ের বাচ্চা হবে। পাঁচ মাস চলে। এই সময়ে বাইরের লোকের এত ঘনঘন এই বাড়িতে না আসাই ভালো। বুঝলা?

‘আচ্ছা আচ্ছা।’ তটস্থ ভঙ্গিতে বলল এছাহাক।

আরেকটা কথা।

‘জে।

‘তোমার এই রোগের চিকিৎসা আমার কাছে নাই। এগুলার জন্য তোমারে জেলা সদর হাসপাতালে যাইতে হবে। এক্সরে-টে-ক্সরে করতে হইব। শুধু শুধু আমার বাড়িতে ঘোরাঘুরির দরকার নাই।

এছাহাক স্পষ্ট বুঝতে পারছে ওহাব ডাক্তার তার ওপর বিরক্ত। তিনি চাইছেন না সে আর এভাবে তার বাড়িতে আসুক। সম্ভবত বিষয়টা তার কাছে সুবিধারও মনে হচ্ছে না। তা মনে হওয়ার কথাও না। সে ফিরে গিয়ে কামালকে ঘটনা খুলে বলল। শুনে কামাল একটু থম মেরে গেল। এছাহাককে দিয়ে আর কাজ হবে না। অন্য উপায় খুঁজতে হবে। উপায় খুঁজে দিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি বললেন, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

ফরিদ মিয়ারে তো কয়েকদিন দোকানে যাইতে দেখলাম। কাজটা দোকানেও তো করন যায়।

‘সে কি দোকানে খাবার খায়?’ জিজ্ঞেস করল কামাল।

আরেহ! পানি তো খায়। আর পানির জগটা তার টেবিলেই থাকে। এইটা বরং সহজ।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এই বুদ্ধিও পছন্দ হলো কামালের। সে এই দায়িত্ব আর এছাহাককে দিল না। দিল মতি মিয়া আর দেলুকে। তারা দুজনের যেকোনো একজন সুযোগ বুঝে কাজটা করবে। তার আগে দূর থেকে ফরিদকে খেয়াল রাখবে। এমনও হতে পারে সে বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে গেল। কিংবা কল থেকে জগে করে পানি নিয়ে গেল। মাঝেমধ্যে দোকান খোলা রেখে এখানে-সেখানে যেতেও হয় তাকে। সুযোগ বুঝে তখন কাজটা করা যেতে পারে। এটাই বরং অধিক নিরাপদ।

মতি আর দেলু কাজটা করতে না চাইলেও কামালের ভয়ে কিছু বলার সাহস পেল না। তবে তাদের জীবনের সবচেয়ে বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটল সেই রাতেই।

এতটা বিস্মিত বোধ করি তারা এই জীবনে আর কখনো হয়নি। সেদিন রাতে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির পেছনে গুপ্তধনের খোঁজে বের হয়েছে তারা। এই কাজটি নিয়ম করে প্রায় প্রতিদিনই করতে হয়। কামালের স্পষ্ট নির্দেশ, অন্য যত কাজই থাকুক না কেন, এই কাজে কিছুতেই শৈথল্য দেখানো যাবে না। মাঝে কয়েক রাত সে নিজেও এসেছিল। কিন্তু আশান্বিত হওয়ার মতো কোনো ঘটনা এখনো ঘটেনি। তারপরও তার দৃঢ় বিশ্বাস, জিনিসগুলো এখানেই আশপাশে কোথাও আছে।

ঘুটঘুঁটে অন্ধকারে কাজটা করতে হয় খুব সাবধানে। যেন বাইরের কারো চোখে সামান্যও সন্দেহ তৈরি না হয়। আজ অবশ্য একটা জিনিস চোখে পড়েছে। মহিতোষ মাস্টারের ঘরের পেছন দিকের আমগাছটার গোড়ায় হাঁস-মুরগির খোপ ছিল। বর্ষার সময় চারপাশের মাটি ধুয়ে গিয়ে ছাউনির নিচে থাকা জায়গাটা উঁচু হয়ে গেছে। কিন্তু টর্চের আলোতে সেই উঁচু ঢিবিটাকেই কেন যেন সন্দেহ হতে লাগল মতি মিয়ার। সে বলল, ‘এছাহাক ভাই, এইটা খুঁইড়া দেখব?

‘এতটা খুঁড়তে পারবি? আমার গায়ে কিন্তু অত শক্তি নাই।’ বলল এছাহাক।

‘আপনে যে পারবেন না তাতো জানিই। করলে আমাগো দুইজনেরই করতে হইব।’

‘শুরু কর তাইলে।

শীত পড়েছে আঁকিয়ে। কিন্তু শাবল দিয়ে শক্ত মাটির ওই ঢিবি খুঁড়তে খুঁড়তে প্রায় ঘেমে-নেয়ে গেল মতি আর দেলু। এছাহাকও দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হয়রান হয়ে গেছে। সে গিয়ে বসল পুকুরের পেছন দিকের জংলা মতো জায়গাটিতে। ব্যবহার না করতে করতে লোক চলাচলের অগম্য হয়ে গেছে জায়গাটা। বর্ষাকালে তো কোমর সমান ঘাস হয়ে যায়। সে সেখানে বসে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিল। এই সময়ে মতি মিয়া হাঁক দিল, ‘এছাহাক ভাই। এছাহাক ভাই।’

এছাহাক দূর থেকেই বলল, কী হইছে?

“আরে এইদিকে আসেন। তাড়াতাড়ি আসেন।

কী হইছে? জিনিস পাইছসনি?

‘আরে আসেন আপনে। দেইখা যান ঘটনা।

এছাহাক এলো। মতি আর দেলু ভীষণ উত্তেজিত। সে বলল, কী হইছে? কিছুই তো দেখতেছি না। এত চিল্লাইলি কেন তাইলে?

মতি হঠাৎ তার হাতের মুঠো থেকে একটা সোনালি রঙের মলিন নাকের নোলক বের করে এছাহাকের সামনে ধরল। তারপর রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে বলল, এইটা দেখেন।

এছাহাক নোলকটা হাতে নিতে নিতে বলল, কী এইটা?

বুঝতেছেন না, এই সব জিনিসই আছিল সেই কলসিতে। আমি তো নিজ চোখে দেখছি। এইখানে এই আন্ধারে মাটি ফালাইতে গিয়া এইটা পাইছি।’

এছাহাক উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলল, তাই নাকি?

হুম।’ সে একবার ভালো করে আশপাশে দেখল। কিন্তু আর কিছু থাকার সম্ভাবনা আছে বলে তার মনে হলো না। সে কথাটা মতি মিয়াকেও বলল। মতি মিয়া অবশ্য তাতে দমল না। সে এখুনি আরো খনন করতে চায়। এছাহাক তখন বলল, তার আগে এক কাজ কর মতি।

কী কাজ?

মাটি যা খুঁইড়া ফালাইছস। তা সব আবার এইখানে আইনা রাখ। গর্ত বুজাইয়া ফালা।’

‘কেন? চমকে ওঠা গলায় বলল মতি।

‘আমি বলছি এইজন্য।’

আপনে বলছেন সেই জন্য এখন আমি আবার এই সব মাটি এইখানে আইনা রাখব? এতখানি খুঁইড়া আবার গর্ত মাটি দিয়া ঢাইকা রাখব?

হুম।

‘কেন? ফুঁসে ওঠা গলায় বলল মতি মিয়া।

এছাহাক অবশ্য উত্তেজিত হলো না। গলাও উঁচু করল না। সে খুব ঠাণ্ডা গলায় বলল, কারণ… যারা বলদ, তারা এমনেই জীবনভর অন্যের কথায় খাইটা যায়। এদের দিয়া অন্যরা এইখানের মাটি ওইখানে নেয়, আবার ওইখানের মাটি এইখানে আনায়। গর্ত করায়, বুজায়। করায়… বুজায়। কিন্তু এদের ভাগ্যে কী থাকে জানস?’

কী?

লবডঙ্কা।

মতি এছাহাকের কথা কিছুই বুঝতে পারল না। এছাহাক অবশ্য আর কিছু বললও না। সে আবার পুকুর পাড়ে গিয়ে বসল। বিভ্রান্ত মতি আর দেলু আরো খানিক মাটি খুঁড়ল। কিন্তু আর কিছুই পেল না তারা। শেষমেশ ক্লান্ত, ঘর্মাক্ত দেহে তারা এছাহাকের পাশে গিয়ে বসল। এছাহাক বলল, ‘কিছু পাইছস?

মতি মাথা নাড়াল, না ভাই।’

‘জিনিস যদি থাকে একজায়গায়, আর তুই যদি তা সারাজীবন আরেক জায়গায় খোঁজস, তাইলে পাবি?

মতি বিভ্রান্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, না।

সে এছাহাকের আচরণে খুবই অবাক হয়েছে। এছাহাক বলল, হাত পাত।

মতি সম্মোহিত মানুষের মতো এছাহাকের দিকে হাত পাতল। এছাহাক তার সেই হাতে একখানা সোনার বালা রাখল। তারপর আরো একখানা। তারপর একখানা বাজু। তারপর দেলুকে বলল, তুইও হাত পাত।’

দেলু বিনাবাক্যব্যয়ে হাত পাতল। এছাহাক তার হাতেও এটা-সেটা রাখল। দেলু আর মতি সোনার সেই অলংকারগুলো হাতের তালুতে নিয়ে পাথরের মূর্তির মতো বসে রইল। স্থির, অনড়। যেন হাত মুঠো করতেও ভুলে গেছে তারা।

এছাহাক বলল, হাত মুঠ কর। সোনা-দানা, টাকা-পয়সা হইল পাখির মতোন। এদের হাত মুঠ কইরা ধইরা রাখতে হয়। না হইলে উইড়া চইলা যায়।

মতি আর দেলু তবুও হাত মুঠো করল না। তারা যেমন বসে ছিল, তেমনই বসে রইল। বিস্মিত, হতভম্ব, বাকরুদ্ধ।

এছাহাক বলল, ‘এত অবাক হওনের কিছু হয় নাই। তোর ওইখানে একটু আগে আন্ধারের মধ্যে আমিই ওই নোলকটা রাখছি। যাতে তুই পাইয়া চমকাইয়া যাস। হা হা হা। কী ভাবছিলি? মাল পাইয়া গেছস? এইবার ড্যাংড্যাং করতে করতে গিয়া কামাল মিয়ার পায়ের তলায় ঝাপাইয়া পইরা চুমা খাবি? আর বলবি, এই নেন সঁহাপনা, আপনের মণি-মাণিক্য নিয়া আসছি। আপনের পদতলে রাখলম? হা হা হা।

এছাহাকের কথা শুনে ভড়কে গেছে মতি আর দেলু। তারা বিভ্রান্ত গলায় বলল, আপনে এই জিনিস কই পাইলেন?

‘কই পাইলাম?’ ধীর-স্থির গলায় বলল এছাহাক।

‘হ।’

‘এক্কেবারে প্রথম যেইদিন ভূঁইয়া সাব ওই জিনিসের কথা আমারে জানাইছিল, তার পরদিন রাইতেই আমি একলা একলা আইসা জিনিস সরাইছি। কামাল মিয়ার কথা সত্য, জিনিস আমি এই বাড়ির বাইরে নিতে পারি নাই। নিতে চাইও নাই। কারণ ওই জিনিস ভোগ করতে হইলে আমার আরো অনেক কিছুই সরান লাগব।

মতি মিয়া ঘোরগ্রস্ত গলায় বলল, “আর কী সরান লাগব?’

‘জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারে সরান লাগব।

ভূঁইয়া সাবরে!’ আঁতকে ওঠা গলায় বলল দেলু।

হুম। ভূঁইয়া সাবরে।

কী বলতেছেন আপনে!

এছাহাক অন্ধকারেই স্মিত হাসল। তারপর বলল, “ঠিকই বলতেছি। এই জীবনে খালি সুযোগেরই অপেক্ষায় আছিলাম। এই এতবছর বয়সে আইসা জীবন আমারে সেই সুযোগ দিছে। কত লাথি-গুঁতা যে আমি তার খাইছি। রক্ত পানি কইরা দিছি তার জইন্য। কিন্তু কোনোদিন এতটুক সম্মান পাই নাই। খালি অপমান আর অপমান। কেন জান?

‘কেন?

কারণ আমি তার সৎভাই।

সৎভাই মানে!’ হতভম্ব গলায় বলল মতি মিয়া।

‘ঠিক সৎভাই না। কারণ, তার বাপে আমার মায়রে বিয়া করে নাই। এইজন্য আমি হইলাম তার বাপের যারজ সন্তান। আমার কোনো পরিচয় নাই।

শীতের এই গভীর রাতেও যেন বজ্রাহত হয়ে বসে রইল মতি আর দেলু। এছাহাক বলল, আমার মায় ওই বাড়িতে কাম করত। গরিব ঘরের মাইয়া, পেটে ভাতে কাম করত। কিন্তু এইজন্য গতরখানও দিতে হইত। আর সেই গতরের ফল হইলাম আমি…।’ বলেই ঝরঝর করে কাঁদতে লাগল এছাহাক। মতি আর দেলু কী করবে কিছুই বুঝতে পারছিল না। তবে এছাহাক থামল না। সে বলল, এই কথা খালি সে আর আমি জানি। আর কেউ জানে না। আমার মায়রে ভূঁইয়া বাড়িরই এক কামের লোকের লগে বিয়া দেয়া হইল। লোক দেখানো নামে মাত্র বিয়া। কারণ সেই লোক আছিল পাগল। আমার মায় মারা গেছে কেমনে শুনবি?

মতি মিয়া কিংবা দেলু কেউ কোনো কথা বলল না। এছাহাক বলল, আমার পরে আরেক বাচ্চা নষ্ট করতে গিয়া আমার মায় মারা গেছে…।

এছাহাক আরো কীসব বলতে লাগল। কিন্তু তার প্রবল কান্নার তোড়ে সেই সব কথার কিছুই বোঝা গেল না। এই শেষ রাতের নির্জন প্রান্তর, কুয়াশার গা বেয়ে ধেয়ে আসা হিম, এই নিস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে যেন এছাহাকের সেই কান্না লিন হয়ে যেতে লাগল। সে থামল দীর্ঘ সময় পর। তারপর বলল, সময় আমারে একটা সুযোগ দিছে। আমি এছাহাক সুযোগটা কাজে লাগাইছি। বাকিটুকু তোদের ওপরে।

‘আমাগোর ওপরে? অবাক কণ্ঠে বলল দেলু।

হুম। যদি তোরা রাজি থাকস। না থাকলেও ক্ষতি নাই। আমার কিছু করার সাধ্য জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আর নাই।’

এছাহাক থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। সে নিজেই বলল, কামালের ঘটনা জানস?

না।’

‘সে মার্ডার কেসের ফেরারি আসামি। পুলিশ তারে খুঁজতেছে। ধরলেই ফাঁসি। সুতরাং আমি চাইলেই তারে ধরাইয়া দিতে পারি। কিন্তু ধরাই নাই অন্য কারণে।

কী কারণে?

‘আমার আসল হিসাব জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সঙ্গে। আরেকটা সমস্যাও আছে…।

কী?

‘রুস্তমের খুনের ব্যপারটায় আমাগো নামও আসতে পারে। কিছু না কইরা কেন ফসব আমরা? তার আগে কামাল মিয়া আর জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ারে ভালোমতো জালে ঢুকাইতে হইব। তাইলেই খালি আমরা নিরাপদ। কথা বোঝা গেছে?

এতক্ষণে কথা বলল মতি মিয়া, ভাই, আপনে যা বলতেছেন সব সত্য তো?

‘সত্য না হইলে তোর হাতে এইগুলান কী? এইগুলা কি আমি আসমান থিকা পাইছি?

মতি নিজের হাতের দিকে আবারও তাকাল। তারপর বলল, “জিনিস কই রাখছেন ভাই?

এছাহাক হাসল। তবে জবাব দিল না।

‘এই বাড়িতেই রাখছেন?

‘কই রাখছি, সেইটাও যদি তোরে বইলা দিই, তাইলে আর তোদের আমারে কেন দরকার হইব?

না ভাই, খোদার কসম। আমাগো আপনে অবিশ্বাস কইরেন না।

করব না?

না।

‘তাইলে কী করব, বিশ্বাস?

‘হ ভাই। যেমনেই হোক, এই জাল থিকা আমরাও বাইর হইতে চাই। খুন করছে ওই শুয়ারের বাচ্চা কামাল। আমাগো কারো কোনো কথা শোনে নাই। আর এখন তার সব জের টানা লাগতেছে আমাগো। কতদিন যে একটু নিশ্চিন্তে ঘুমাইতে পারি নাই ভাই। আর এই গুপ্তধনের লোভ দেখাইয়া দেখাইয়াই সব করাইছে…’।

এইবার ঘুমাইতে পারবি। আর জিনিসের ভাগও পাবি। কিন্তু খুব সাবধান, কথা না শুনলে কিন্তু…।’

এছাহাক কথা শেষ করল না। মতি আর দেলু তার পায়ের কাছে এস বসে পড়ল। বলল, ‘খালি মাথার ওপর থিকা এই বিপদটা সরানোর ব্যবস্থা করেন ভাই।

এছাহাক বলল, সব হবে। তবে… প্রথমত, ফরিদের কোনো ক্ষতি করন যাইব না। আমিও ইচ্ছা কইরাই কিছু করি নাই। শুধু শুধু ভান ধরছি যে অনেক চেষ্টা করছি। আসলে কিছু করি নাই। তোরাও করবি না।’

কী বলেন ভাই! কেন? সে সাক্ষ্য দিলে তো আমাগো বিপদ।

“সে তো সাক্ষ্য দেবে না।

মানে? মানে তারে আমরা কিছু করব না। কিন্তু সে খুন হইব।

‘কেমনে?’ চক্ষু বড় বড় হয়ে গেল দেলুর।

কামাল নিজে খুন করব। আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করব, যাতে সে রেগে মেগে গিয়া নিজেই তারে খুন করে।

‘তাইলে কী হইব?’

“তাইলেই সে আমার পাতা ফাঁদে পা দিয়া দিল।

কীভাবে?

‘খুব স্বাভাবিকভাবেই শফি খাঁ তখন পুলিশরে গিয়া বলবে যে ফরিদ সাক্ষী হইতে চাইছে বলে তারে খুন করছে। ওহাব ডাক্তারও একই কথা বলবে। তখন সব সন্দেহ যাবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দিকে।

তাইলে আমরাও তো ঝামেলায় পড়ব।’

না পড়ব না। পড়লেও সেইটা কাটাই ওঠন যাইব।’

কীভাবে?

কামালের মতো একজন খুনি যে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার শালা, সে যে তার কাছেই আত্মগোপনে আছে, এই খবর যখন আমরা পুলিশে জানাই দেব, তখন পুলিশ কী করবে?

খুব সহজেই বুঝে নেবে যে খুনগুলো কামালই করছে।’ বলল মতি।

‘একদম। আর আমরা তো পুলিশরে সব তথ্যই দিয়া দেব। শুধু এইটাই না, আরো যা যা পুলিশ জানতে চায়, আমরা বলব। খালি আমাদের গা বাঁচাইয়া বলব। বিশেষ কইরা খুনের কোনো কিছুর সঙ্গেই আমরা যুক্ত আছিলাম, এইটা বলা যাইব না। আর আমরা তো আছিলামও না। আছিলাম?

না। সে আমাগো অমতে গিয়াই খুন করছে।

‘সেইটাই। পুলিশরে বলতে হইব যে সে পিস্তলের মুখে ভয় দেখাইয়া আমাগোর মুখ বন্ধ রাখছে। কিন্তু দিনে দিনে সে এতই বেপরোয়া হইয়া গেছে যে শেষে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়াই তার বিরুদ্ধে মুখ খুললাম। এখন পুলিশের দায়িত্ব আমাগো বাঁচানো।

মতি আর দেলু কথা বলল না। চোখের সামনে বসা এই এছাহাকা তাদের কল্পনারও অতীত।

এছাহাক বলল, আশরাফ খাঁরে ফাঁসানোর জন্য রুস্তমের খুনের ঘটনায় সে যা যা করছে, তাতো সত্যই। আমরা তিনজন একসঙ্গে সব খুইলা বললে, খুব স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের কাছে একটু হইলেও আমরা ভালো অবস্থানে থাকব। আর যা-ই হোক না কেন, আসল বিপদে আমরা পড়ব না। পড়বে তারা দুইজনেই। আর কামালের নামে তো আগে থিকাই মার্ডার কেস আছে। এখন আবার দুইটা। ফরিদ আর রুস্তম। কই যাবে সে?

এছাহাক একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামল। তবে সে থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। যেন চোখের সামনে এই ঘন কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারেও নতুন এক মানুষকে আবিষ্কার করছে তারা। এ কোন এছাহাক এতদিন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে ছিল তাদের গা ঘেঁষে! ভাবতেই একটা ভয়ের তীব্র শিহরণ বয়ে গেল মতি আর দেলুর শরীর বেয়ে। কিন্তু এখন এছাহাকের কথা শোনা ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই তাদের। এই বিপদ থেকে একমাত্র সে-ই তাদের রক্ষা করতে পারে। সঙ্গে গুপ্তধনের ভাগের ব্যাপারও আছে।

.

মতি আর দেলু চুপ করে বসে রইল। যেন নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে তারা। এই জীবনে এত বিস্মিত তারা আর কখনোই হয়নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *