৩০. ফরিদকে পাওয়া গেল পরদিন

৩০

ফরিদকে পাওয়া গেল পরদিন ভোরে। সে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পড়েছিল মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির উঠানে। তখন প্রায় শেষ রাত। তুমুল বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতেও আশরাফ খাঁর দুজন লোক জেগে ছিল। তারা হলো পানু আর তৈয়ব। রুস্তমের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহচর তারা। গত দুদিন হলো রুস্তমকে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। তবে ঘটনাটা এখনো আশরাফ খাঁকে জানানো হয়নি। এর অবশ্য কারণও আছে। রুস্তম মাধেমধ্যেই কাউকে কিছু না বলে এভাবে উধাও হয়ে যায়। বিশেষ করে তার ওই শারীরিক সমস্যার পর থেকে। অমন বলশালী একজন মানুষ হঠাৎ এমন নির্বল হয়ে গেল, বিষয়টা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারে না। ফলে কারো কাছে সামান্য আশার কথা শুনলেও সে বিনা দ্বিধায় তাৎক্ষণিক সেখানে ছুটে যায়।

একবার দেখা গেল, রোজ ভোরে সূর্য ওঠার ঠিক আগে, সে শিমুল চারার শিকড় মাটি থেকে তুলে খালি পেটে খেতে শুরু করেছে। এই টোটকা নাকি তাকে দিয়েছিল আলীপুরের কবিরাজ ব্রজবিহারী। তবে তাতে তার কাজ হয়েছে বলে মনে হয়নি। কারণ এর কদিন পরই আবার দেখা গেল নিয়ম করে কচি পাঠার মাংস খাচ্ছে রুস্তম। অনেকেই অবশ্য বলাবলি করছিল যে, সে নাকি কয়েকবার এক-আধ। টুকরো কাঁচা মাংসও খেয়ে দেখার চেষ্টা করেছিল। তবে যত যা-ই হোক না কেন, শেষ অবধি রুস্তমের শরীর আর সেই আগের মতো বলশালী হয়নি। ফলে মানসিকভাবেও আর সুস্থির হতে পারেনি সে।

এসব কারণেই দুশ্চিন্তা করলেও তড়িঘড়ি করে আশরাফ খাঁকে কিছু জানানো হয়নি। দেখা গেল দিন দুই বাদে হঠাৎ মাঝরাতে এসে হাজির হলো সে? তখন? তখন কী করবে তারা? তার চেয়ে অপেক্ষা করাই ভালো। তবে এরমধ্যেও কোথায়। যেন একটা অস্বস্তির কাটা খচখচ করতে লাগল। কোনো সমস্যা হয়নিতো তার? ফলে আজকাল একটু বেশিই সতর্ক থাকে এ বাড়ির পাহারায় থাকা লোকগুলো। এই প্রায় শেষ রাতে তুমুল বৃষ্টির মধ্যেও যখন ফরিদ পারুদের বাড়ির আঙিনা পেরিয়ে ঘরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল, তখন ভেতর থেকে তৈয়ব আলী স্পষ্ট উঁচু গলায় বলল, “কে ওইখানে, কেডা?

ফরিদ কথা বলল না। সে যেন একটা ঘোরের মধ্যে হেঁটে এসেছে। তৈয়ব বলল, রুস্তম ভাইনি? ও রুস্তম ভাই। কথা কন না কেন?

ফরিদ এবার সাড়া দিল। সে বলল, আমি ফরিদ। পারু বাড়িতে আছে?

ফরিদের কথায় পানু আর তৈয়ব ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তারা চট করে ঠাহর করতে পারল না কোন ফরিদ। পানু বলল, ফরিদ কেডা?’

‘আমি ফরিদ। ওহাব ডাক্তারের ভাইগ্না ফরিদ। ভেতরে কি মহিতোষ স্যার আছেন? স্যার, আমি পারুর খোঁজে আসছি। শুনছি, পারু এইখানে আছে। আমি যে আছমারে বিয়া করছি, এই কথা কিন্তু সত্য না স্যার। আপনি পারুরে একটু ডাকেন, আমি তারে আসল কথাটা বলতে চাই। সে জানি আমারে ভুল বুঝতে না পারে। দরজাটা খোলেন স্যার।

তৈয়ব আর পানু পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তবে তারা দরজা খুলল না। প্রবল বৃষ্টিতে ফরিদের সব কথা স্পষ্ট শুনতেও পেল না। তবে এটুকু অন্তত বুঝল যে এই গভীর রাতে ফরিদের জন্য দরজা খোলার কোনো কারণ নেই। হতে পারে এটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার নতুন কোনো কৌশল। আশরাফ খাঁ বারবার তাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। ভয়ানক ধুরন্ধর মানুষ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। ফলে কোনোভাবেই এমন কিছু করা যাবে না যাতে তিনি নতুন কোনো সুযোগ পান। ফরিদের বিষয় নিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার নতুন অবস্থানের কথাও সকলে জানে। বিষয়টা চিন্তার উদ্রেকও করেছে। কে জানে, হয়তো এর পেছনেও অন্য কোনো উদ্দেশ্য আছে তাঁর। এসব কারণেই অন্ধকারে সতর্ক ভঙ্গিতে বসে রইল তারা। অন্যদেরও ঘুম থেকে ডেকে তুলল। কিন্তু দরজা খুলল না। হতে পারে ফরিদকে এভাবে এতরাতে এখানে পাঠানো কোনো ফাঁদ। যদি তা-ই হয়, তবে এই ফাঁদে তারা পা দিতে চায় না।

ফরিদের সাড়া-শব্দ অবশ্য বেশিক্ষণ পাওয়া গেল না। হঠাৎ নীরব হয়ে গেল সে। তাকে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির উঠানে পাওয়া গেল ভোরবেলা। ওহাব ডাক্তার তাকে খুঁজতে বেরিয়েছিলেন। তিনি প্রথমে গিয়েছিলেন নদীর ঘাটে। তারপর স্টেশনে। কোথাও না পেয়ে এসেছিলেন মহিতোষ মাস্টারের বাড়ি। তখনো বাড়ির কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। সম্ভবত ভোর রাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল সবাই। ওহাব ডাক্তার ফরিদকে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। পরের দুটো দিন সে মরার মতো ঘুমাল। জেগে উঠল তৃতীয় দিন মাঝরাতে। ঘুম থেকে উঠেই বলল, আছমা, তোমার কপালের রক্ত বন্ধ হয়েছে?

আছমা জেগেই ছিল। সে কেরোসিনের কুপির নিভু নিভু আলোয় ফরিদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। ফরিদ বলল, ‘দেখি দেখি কপালের কী অবস্থা?

আছমার কপালের অবস্থা অবশ্য খুব বেশি খারাপ না। তারপরও সেই রাতে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিল ফরিদ। সে সবাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলল। আছমার কপালের ক্ষত গরম পানিতে পরিষ্কার করে সেখানে ওষুধ দিল। রাতে তারা দুজন এক সঙ্গে বসে খেলো। তারপর বাইরে উঠানে বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। খানিক। এলোমেলো গল্প করল। তারপর বলল, আমার মাথার ঠিক-ঠিকানা নাই। তুমি আমার ওপর রাগ করো না। দেখবা, কদিন যেতেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ওকে?

আছমা মাথা নাড়ল। তার এই ফরিদকে দেখে কেমন ভয় করছে। সঙ্গে একটা সলজ্জ ভালো লাগাও। ফরিদ কি জানে যে সে তাকে তুমি করে বলেছে?

ফরিদ বলল, তুমি আমাকে আপনি আপনি করছ কেন? স্বামী-স্ত্রীদের তুমি করে বলতে হয়। মামা-মামি তো ব্যাকডেইটেড। আমরা তো ব্যাকডেইটেড না। ব্যাকডেইটেড?

আছমা ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়ল।

তাহলে? তুমি এখন থেকে আমাকে তুমি করে বলবে। ঠিক আছে?

‘জি, ঠিক আছে।

বাকি রাতটুকু আছমাকে সযত্নে বুকের ভেতর চেপে ধরে শুয়ে রইল ফরিদ। এটা সেটা নানা কথা বলল। আছমা অবশ্য তার কোনো উত্তর দিতে পারল না। এক অনাস্বাদিত ভালো লাগার অবর্ণনীয় অনুভব যেন মেঘের মতো ছড়িয়ে যেতে থাকল তার শরীর ও মন জুড়ে। এই মুহূর্তটুকুর জন্য কত বছর অপেক্ষা করেছে। সে? সম্ভবত যখন থেকে বুঝতে শিখেছে। যখন থেকে তার ভেতর ফুলের রেণুর মতো নারী সত্তা অঙ্কুরিত হতে শুরু করেছে। সেই প্রতিটি মুহূর্ত যেন একটু একটু করে স্বপ্ন দেখেছে সে। আজ এতবছর পর, এত ঝড়ঝঞ্ঝা, দুর্ভোগ-দুর্বিপাকের পর অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এসে যেন তার কোলে লুটিয়ে পড়েছে সকল আগল ভেঙে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের সবটুকু অনুভব সে শুষে নিতে লাগল। তবে একটা শঙ্কাও যেন ছিল কোথাও না কোথাও। ফরিদকে দেখে মাঝে মধ্যেই স্বাভাবিক মনে হয় না তার। যেন এক অদ্ভুত সম্মোহন বা ঘোরের ভেতর ডুবে আছে সে। আচ্ছা, এই ঘোর যদি আবার কেটে যায়? যদি সে আবারও পারুর জন্য অমন উদগ্রীব হয়ে ওঠে? তার অবদমিত যন্ত্রণা কিংবা তেষ্টার উন্মাতাল ঢেউ যদি আবার আছড়ে পড়তে থাকে তার এই অপার্থিব আনন্দের ভুবনে?

তেমন কিছু অবশ্য হলো না। বরং পরের দিনগুলোতে ফরিদ যেন ক্রমশই অন্যরকম এক মানুষ হয়ে উঠতে থাকল। অস্বাভাবিক রকমের স্বাভাবিক। এই ফরিদ অচেনা, অদেখা। কারো সঙ্গে খুব একটা কথা বলে না সে। চুপচাপ, শান্ত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে আছমার সঙ্গে সকালের নাশতা খায়। তারপর মামার সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে দোকানের উদ্দেশ্যে। দুপুরের ঠিক আগে আগে বাড়ি ফেরে। গোসল, খাওয়া ও খানিক বিশ্রাম শেষে আবার বেরিয়ে পড়ে। তবে এই সময়ে যে সে রোজ দোকানে যায়, এমন নয়। মাঝেমধ্যেই নদীর পাড় ধরে হাঁটতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় বহুদূর। তারপর কোথাও চুপচাপ বসে থাকে। জলের শব্দ শোনে। শব্দ শোনে নৈঃশব্দ্যেরও। একটা পাখি, একটা গাছের পাতা, ঘাসের ডগা হয়তো কম্পন তোলে স্থবির সন্ধ্যায়। সে সেই কম্পন অনুভব করে। মাঝেমধ্যে তার নিখোঁজ হয়ে যেতে ইচ্ছে করে। হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করে অচেনা, অজানা কোনো জগতে। কিন্তু তারপর হঠাৎই যেন আর আগ্রহ পায় না। যেন এখানে এমন স্থির, অবিচল হয়েই বাকি জীবনটুকু কাটিয়ে দিতে চায় সে। ওই যে বকটা যেমন এক পা তুলে নদীর জলে চোখ রেখে ধ্যানমগ্ন হয়ে রয়েছে, ঠিক তেমন।

কী এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা যেন তাকে ক্রমশই অবশ করে দিতে থাকে। এই নির্লিপ্ততা, নির্বিকারত্ব থেকে সে অবশ্য মুক্তিও চায় না। ফরিদ জানে কিছু মুক্তি মানে মৃত্যু। কিছু স্বাধীনতা মানে শৃঙ্খল। ওই শৃঙ্খলিত স্বাধীনতা ও বেঁচে থাকা মৃত্যুকে সে ভয় পায়। ফলে সে বৃক্ষের মতো স্থির, নির্বাক হয়ে রয়। কিংবা বয়ে যেতে থাকে শান্ত, গভীর নদীর মতো। অলখে, নিঃশব্দে।

পারুর কথাও আর বলে না সে। সে কি পারুকে ভুলে গেছে? কে জানে, ফরিদের বুকের অতল গভীর জলের সমুদ্র সেঁচে কে বের করে আনবে সে কথা? সেই সাধ্য কারো নেই। না আছমার, কিংবা অন্য কারোর। ফলে ফরিদ ক্রমশই হয়ে থাকে দুর্বোধ্য জটিল এক ধাঁধা। এই ধাঁধার হিসেব মেলে না। কেবল নিস্তরঙ্গ এক জীবন বয়ে যেতে থাকে। সেই জীবনে আছমা পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকে নিজের আরাধ্য মানুষটাকে পেয়ে। তার মা নুরুন্নাহার বেগম গভীর তৃপ্তি নিয়ে রাতে ঘুমাতে যান। আড়াল থেকে মেয়ে-জামাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে থাকেন। আহা, এতদিন পর তার ঘর আলো করে যেন ফুল ফুটল। এই যুগল ফুলের সৌরভে কখন সুরভিত হয়ে উঠবে চারপাশ? কখন আছমার কোল আলো করে চাঁদের মতো স্নিগ্ধ এক শিশু হেসে উঠবে? একথা ঠারেটুরে কয়েকবার আমাকে বলেছেনও তিনি? আছমা অবশ্য গা করেনি। সে লজ্জায় গুটিয়ে গেছে। মায়ের সঙ্গেও এই নিয়ে কথা বলতে তার আড়ষ্টতা। কিন্তু নুরুন্নাহার বেগম তাতে কুণ্ঠিত হন না। তিনি তার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকেন। তবে একজন মানুষ এই সব কিছুর ভেতরও একটা চাপা অস্বস্তি, অস্থিরতা অনুভব করেন। তিনি ওহাব ডাক্তার। মাঝে মাঝে ফরিদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেন তিনি। বোঝার চেষ্টা করেন তাকে।

কী রে ফরিদ? আজ দোকানের বেচা-কিনা কেমন?

‘একটা লোক লাগবে মামা?’

কীসের লোক?

‘দোকানে। টাকা-পয়সা, ওষুধ-পত্রের হিসাব-নিকাশ রাখার জন্য।

‘কেন, বেচা-কিনা কি খুব বেশি নাকি?

না মামা।

তাইলে?

মাঝেমধ্যে আমার মাথা কাজ করে না। সবকিছু কেমন তালগোল পাকাই যায়। হিসাব-নিকাশও ঠিকঠাক রাখতে পারি না। এক ওষুধের বদলে অন্য ওষুধ দিয়ে দিই।’

‘ওহ।’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন ওহাব ডাক্তার। ভেতরে ভেতরে যে শঙ্কাটা তিনি পুষে রাখেন তা যেন আরো ঘনীভূত হয়। ফরিদ অবশ্য স্বাভাবিকই থাকে। একটু চুপচাপ হয়ে যাওয়া ছাড়া বাইরে থেকে তার আর বিশেষ কোনো পরিবর্তন ধরা পড়ে না। তাও কেবল বুঝতে পারে ওই আছমা কিংবা ঘরের মানুষেরা। বাইরের মানুষের কাছে সে স্বাভাবিকই। অবশ্য আজকাল আর কারো সঙ্গে মেশেও না সে।

মাঝে মাঝে আছমা তাকে জিজ্ঞেস করে, “আপনে ভালো আছেন তো?

হুম।’

‘কোনো অসুবিধা নাই তো?

কী অসুবিধা?

না মানে, কেউ কিছু বলে নাতো?

কী বলবে?

আছমা এই প্রশ্নে চুপ করে থাকে। ফরিদের সঙ্গে কথা বলার সময় খুব সতর্ক থাকে সে। তার ভয়, যদি আলটপকা মুখ ফসকে এমন কিছু সে বলে বসে যাতে ফরিদ আবার অস্থির হয়ে ওঠে। আছমা জানে, সময় মানুষকে অনেক কিছুই ভুলিয়ে রাখে। হয়তো ফরিদকেও ধীরে ধীরে ভুলিয়ে দিচ্ছে তার দুঃসহ যন্ত্রণার স্মৃতি। সে তাকে তাই ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখতে চায়। অন্তত ফরিদের জন্য এই অনুভূতির সীমাহীন ভাণ্ডার রয়েছে তার কাছে। এ কখনো ফুরাবে না। সেদিন রাতে। সে বলল, এই যে আপনারে আমি এখন আপনে করে বলি, কই, এখন তো আর। তুমি করে বলতে বলেন না?

ফরিদ মৃদু হাসে, আমি তোর বড় না? বড়দের আপনিই বলতে হয়।

আছমা মন খারাপ করে বলে, আপনে আবার আমারে তুই কইরা বলতেছেন?

মাঝে মাঝে বলা ভালো। তুই, তুমি, আপনি। দেখবি এতে সম্পর্কে বৈচিত্র্য আসে। বৈচিত্র্য বুঝিস?

‘আমার অত বোঝার দরকার নাই। আপনে বুঝলেই হবে। ফরিদ হাসে, কম বোঝার অবশ্য সুবিধা আছে।

কী সুবিধা?

কম বোঝা মানুষের কষ্ট থাকে কম, আনন্দ থাকে বেশি।’

এই কথায় আছমা চুপ করে যায়। সে কি আসলেই কম বোঝে? হবে হয়তো। কিন্তু কই, তার তো কষ্ট কম না। বরং সে মনে করতে পারে না, শেষ কবে নির্ভেজাল আনন্দে হেসেছে সে।

এই যে পারু আর ফরিদ পরস্পরকে এত গভীরভাবে ভালোবাসত, তার সবই বুঝত সে। কিন্তু বুঝেও না বোঝার ভান ধরে থাকত। কিংবা ফরিদের প্রতি তার যে এই তীব্র ভালোবাসা, এই ভালোবাসার অনুভূতিটাকে আড়াল করে রাখত সে। তারপর হাসিমুখে তাদের সঙ্গে কথা বলত, মিশত। যেন এসবে কিছুই যায় আসে না তার। এমনকি পারুকে নিয়ে ফরিদ চলে যাওয়ার পরও সে তার অনুভূতিটাকে কাউকে বুঝতে দেয়নি। একা একা নিজের ভেতর চেপে রেখেছে। কান্না, কষ্ট, যন্ত্রণা। এমনকি ফরিদ ফিরে আসার পরও এই যে এত কিছু হয়ে গেল, এই এতকিছুর ভিড়ে কি সে কখনোই তার নিজেকে বুঝতে দিয়েছে যে তার এই প্রাপ্তির মধ্যে কতটুকু ফাঁকি রয়ে গেছে? বাইরে থেকে যতটুকু ভরাট, যতটা পরিপূর্ণ দেখা যায় সবকিছু, ভেতর থেকে যে তা নয়, সেটা তার থেকে বেশি আর কে জানে!

সে কি তবে আসলেই কম বোঝে? নাকি তার বোঝার ধরনটাই ভুল? নিজেকে লুকিয়ে রাখতে রাখতে সে হয়তো ভুলেই গেছে যে কারো দায় পড়েনি ওই আড়াল থেকে তার কষ্টের কষ্টিপাথরটাকে খুঁড়ে বের করবার। তারপর প্রবল মমতায় একটু ছুঁয়ে দেবার। অনুভব করবার যে ওই পাথর কঠিন অবয়বের আড়ালেও কী অনায়াসে সে জমা করে রাখে তার দুঃখভার বুক। এমন কেন সে?

আছমার সেই রাতে আর ঘুম হয় না। শেষ রাতের দিকে টিনের চালে টুপটাপ ঝরে পড়তে থাকে জলের ফোঁটা। সেই ফোঁটা যেন লিখে দিতে থাকে নাম না জানা কোনো এক অচিনপুরের গল্প। সেই অচিনপুরের দুঃখী এক রাজকুমারী হয়েই থাকে সে। অথচ তার মুখে ঝলমলে আলো। দুপুর রোদের মতো আনন্দ। কিন্তু সে জানে, তার বুকের ভেতর যে থমথমে মেঘ জমে আছে, সে কখনো তা বৃষ্টি হয়ে ঝরতে। দেয় না বলে কেউ তা দেখতেও না। ফরিদও না।

কিন্তু এভাবেই কি তার জীবন ফুরাবে? কারো দায় থাকবে না তাকে স্পর্শ করার? একটু সত্যিকারের ভালোবাসা নিয়ে আগলে রাখবার? ফরিদেরও না? সেও কি তাকে কখনোই সত্যি সত্যি প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ছুঁয়ে দেখবে না? সে কি কখনোই কারো আরাধ্য নারী হয়ে উঠতে পারবে না? নাকি ফরিদের ঘোরগ্রস্ত জীবনের এক অপাংক্তেয় অনুসঙ্গ হয়েই সে বেঁচে থাকবে! যার অনিবার্যতা কেবল প্রয়োজনের, কিন্তু প্রিয়জনের নয়।

সেদিন মঙ্গলবার। ভুবনডাঙা বাজারে সেদিন হাটবার। এদিন বেচাকেনা ভালো হয়। লোকজনে সরগরম থাকে পুরো বাজার। ফরিদকে তাই আগেভাগে চলে আসতে হয়েছিল বাজারে। দুপুর থেকেই কেনা-বেচা বেশ জমে উঠল। ওহাব ডাক্তারও আজ তার সঙ্গে দোকানে এসে বসেছেন। আকাশ খানিক মেঘলা। একটা কেমন মন উদাস করা হাওয়া। ফরিদ হঠাৎ বলল, আমার কিছু ভালো লাগছে না। মামা।

‘কেন ভালো লাগছে না? শরীর খারাপ লাগছে?

না মামা।

তাহলে?

তাহলে জানি না।’

বলেই ফরিদ দোকান থেকে বের হয়ে গেল। ওহাব ডাক্তার অবাক চোখে ভাগ্নের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। ফরিদের মানসিক অবস্থাটা। তিনি বোঝেন। ছেলেটা যে ভয়াবহ আঘাত পেয়েছে, তা সহসা সেড়ে উঠবার নয়। মানুষ মরে গেলে তার স্মৃতি সহসাই বিস্মৃত হয়। তার প্রয়াণের ক্ষততেও প্রলেপ পড়ে। কিন্তু হারিয়ে গেলে সেই ক্ষত বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। তার অনিশ্চিত অপেক্ষায় কেটে যেতে থাকে অনির্ণনীয় যন্ত্রণার অনির্বচনীয় জীবন। ওহাব ডাক্তার তাই ফরিদকে কিছু বলেন না। তার এই অঘোর অর্ধেক জীবনকে তিনি জোর করে চৈতন্য দান করতে চান না। থাকুক সে তার মতো।

কিন্তু ফরিদের আর নিজের মতো থাকা হয় না। সেই বিষণ্ণ দুপুরে সে নদীর ধার ধরে হাঁটতে হাঁটতে কোথায় যে চলে যায়। কতদূর। তার খবর সে জানে না। সে কেবল জানে, এই নদী যেখানে গিয়েছে, সেও সেখানে যাবে। তার আর কোনো গন্তব্য নেই। ফিরে আসা নেই। সে কেবল এক অচেনা আগন্তুক। ঠিকানাবিহীন। পথিক। ওই নদীর শব্দ, জলের কলরোল আর বয়ে চলা স্রোতের সঙ্গে সেও ছুটে চলতে থাকে নিঃশব্দে। তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে প্রায়। ম্লান হয়ে আসতে থাকা আলো ক্রমশই আরো গাঢ় অন্ধকারে রূপান্তরিত হচ্ছে। চারধারে কেউ নেই। কেবল গা-ছমছমে অদ্ভুত এক নৈঃশব্দ। দূরে কোথাও নাম না জানা এক পাখি ডাকল বিকট শব্দে। পাশের জঙ্গলের মতো জায়গাটা থেকে কেমন গা ছমছমে একটা শব্দ ভেসে এলো। ক্রমশই নিভে আসা আলোয় ফরিদের খুব ভয় হতে লাগল। মনে হতে লাগল, আশপাশে কোথায় যেন অশুভ কিছু ঘটছে। তার এখুনি এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত। কিন্তু ফরিদ গেল না। সে সন্ধ্যার সে চুরি যাওয়া আলোয় আচমকা মানুষগুলোকে দেখল। দুজন লোক একটা বস্তা টেনে নিয়ে এসেছে জঙ্গলের শেষ প্রান্তে। এতক্ষণ তাদের এই চলার শব্দই শুনতে পেয়েছিল সে। কিন্তু এখানে কী করছে তারা? তাদের সঙ্গের ওই বস্তাটিতেই বা কী?

ফরিদ কৌতূহলী ভঙ্গিতে আরো খানিকটা এগিয়ে গেল সামনে। তবে সে সতর্ক। জঙ্গলের শেষে ওখান থেকেই শুরু হয়েছে নদী। সেই নদীর ধারে এসে থামল লোকগুলো। তারপর অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। খুব সতর্ক ভঙ্গিতে আরো দুজন মানুষ এসে যোগ দিল তাদের সঙ্গে। ফরিদের মনে হলো এদের কাউকে কাউকে সে চেনে। কিন্তু এই সন্ধ্যায় এখানে কী করছে তারা? লোকগুলো পরস্পরের সঙ্গে আরো খানিক কথা বলল। তারপর সঙ্গের বস্তাটাকে ঠেলে ফেলে দিল জলে। ফরিদের মনে হলো শেষ মুহূর্তে সে বস্তার ভেতরটা দেখতে পেয়েছে। অনেকটা পথ মাটিতে টেনে আনার ফলে ঘষা খেয়ে বস্তার একপাশটা খুলে গিয়েছিল। সেই খুলে যাওয়া পাশ দিয়ে দু খানা পা বের হয়েছে। তার মানে বস্তার ভেতরে মানুষ!

শরীর আর কিছু ভাবতে পারল না। তার সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল। লোকগুলো বস্তায় ভরে একটা মানুষ ফেলে দিয়েছে জলে? তার মানে মানুষটা মৃত! তার মানে লোকটাকে তারা খুন করেছে! আচমকাই দম বন্ধ লাগতে লাগল ফরিদের। বুকের ভেতর একটা তীব্র আতঙ্কের হিম শীতল অনুভব বয়ে যেতে লাগল। মনে হলো এই নিঃশব্দ সন্ধ্যার নির্জন এক প্রান্তরে সে একা দাঁড়িয়ে আছে কতগুলো খুনি মানুষের সঙ্গে। তারা যদি ঘুণাক্ষরেও জানে যে সে এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাদের দেখেছে, তাহলে আর রক্ষা নেই তার। হয়তো বস্তাবন্দি ওই লাশটার সঙ্গে জলে ভেসে যাবে তার প্রাণহীন শরীরও। ফরিদ আচমকা ঘুরে দাঁড়াল। তারপর ছুটতে শুরু করল বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না তার।

পেছন থেকে কারো চিৎকারের শব্দ ভেসে এলো, কে ওইখানে? কে?

৩১

ফজু তখন সিঁড়িতে পা রেখেছে। ছোট্ট কাঠের সিঁড়িটাতে মাত্র পাঁচটা ধাপ। অন্ধকারে খানিক সতর্ক হয়েই এগোলো সে। কিন্তু দ্বিতীয় ধাপের পরই তার মনে হলো কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। কিন্তু ঝামেলাটা সে সহসাই ধরতে পারল না। খানিক অস্বস্তি নিয়েই তৃতীয় ধাপ পেরোল। এ মুহূর্তে হুড়মুড় করে নেমে আসা পায়ের শব্দটা টের পেল সে। যেন ওপরের ঢাল থেকে ঝড়ের বেগে নেমে আসছে কেউ। ফজু ঝট করে মুখ ফেরাল। কিন্তু অন্ধকারে পুরোপুরি ঠাহর করার আগেই জমাট অন্ধকারটাকে সিঁড়ির ওপর উঠে আসতে দেখল। সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল সিঁড়ির অগ্রভাগ। মুহূর্তের জন্য ভারসাম্য হারাল সে। অন্ধকার হাতড়ে ট্রলারের ছই ধরে নিজের পতন ঠেকানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার আগেই ঘটাং শব্দে কানের কাছে শক্ত কোনো ধাতব পদার্থের আঘাত টের পেল। আঘাতটা তেমন তীব্র না হলেও নিজের শরীরের ভর সামলাতে পারল না ফজু। সে ঝপ করে হাঁটু ভাঁজ করে ছিটকে পড়ে গেল পায়ের গোড়ালি ডোবা পানির মধ্যে। কিন্তু উঠে দাঁড়াতে পারল না। তার আগেই দ্বিতীয় আঘাতটা পড়ল তার চোয়াল বরাবর। পারুর হাতে তখন লোহার বালতিখানা। ওজনে যথেষ্টই ভারী। তার মতো মানুষের পক্ষে অত ভারী বালতি দিয়ে কাউকে আঘাত করে আহত করা কঠিনই। কিন্তু সে জানে না কেন, যেন কিছু একটা ভর করেছে তার শরীর ও মনে। হয়তো অবিশ্বাস্য যন্ত্রণার মৃত্যু কিংবা অনিবার্য ভয়াল পরিণতির শঙ্কা তাকে বেপরোয়া করে তুলেছে। হতবিহ্বল ফজু কিছু বুঝে ওঠার আগেই বালতির তৃতীয় এবং মোক্ষম আঘাতটা পড়ল তার মাথায়। ঠং করে জুতসই একটা শব্দ হলো। বালতির তলার নিরেট লোহার পাতটা ঠুকে গেল তার মাথায়। তারপর আর কিছু মনে নেই ফজুর। সে দুই হাতে মাথা চেপে ধরতে ধরতে পুরোপুরি লুটিয়ে পড়ল জল-কাদার মধ্যে। তারপর জ্ঞান হারাল। পারু তাতেও নিরস্ত রইল না। সে আবারও আঘাত করল। তারপর আবার। যেন সাক্ষাৎ উন্মাদিনী।

তাকে সতর্ক করলেন তাবারন বিবি। তিনি বললেন, ‘খুন কইরা ফালাবি নাকি? অ্যাঁ? খুন করবি? তাড়াতাড়ি নাওয়ে উইঠ্যা আয়। ওর লগে কিন্তু আরো লোক আছে। তাড়াতাড়ি আয়।

পারুর যেন আচমকা সংবিৎ ফিরে এলো। আসলেই তো! ফজু তো এখানে একা নয়। তার সঙ্গে আরো দুজন লোক আছে। একজন ট্রলারে। অন্যজন ওপরের জঙ্গলে। তাকে তারা ধরে ফেলবার আগেই এখান থেকে পালাতে হবে। ফজুর চিৎকার-আর্তনাদ অবশ্য ততক্ষণে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু হঠাৎ নেমে আসা অন্ধকার আর এমন বদলে যাওয়া পরিস্থিতিতে নিজেদের আশু কর্তব্য ঠিক করতে পারল না তারা। মন্টু ওপর থেকে কয়েকবার চিৎকার করে জানতে চাইল, ‘ওইখানে কী হইতেছে? ও ফজু ভাই, কী হইতেছে?

ট্রলারের লোকটাও ততক্ষণে তীরে ভেড়ার চেষ্টা করছে। সে চিৎকার করে বলল, “ওই মন্টু, তাড়াতাড়ি নাইম্যা আয়। ফজু ভাইর কিছু হইছে। তাড়াতাড়ি আয়।

লোকটার হাতে আলো জ্বলে উঠেছে। সে ট্রলার তীরে ভেড়াতে ভেড়াতে আলো জ্বেলে ফজুকে দেখল। ফজুর মাথা, চোয়াল, কান ফেটে রক্ত ঝরছে। সেই রক্তে লাল হয়ে উঠছে পানি। লোকটা এবার পারুকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল দিতে লাগল। সঙ্গে ভয়ানক হুমকিধমকি। পারু অবশ্য তা গ্রাহ্য করল না। সে লোকটার টর্চের আলোতেই সিঁড়ি বেয়ে ট্রলারে উঠে গেল। সালমা ততক্ষণে রবিউলের বাঁধন ছাড়িয়ে দিয়েছে। উঠে দাঁড়িয়েছে সে। পরের কয়েক মুহূর্তে ঘটনা ঘটে গেল দ্রুত। পারুদের সামনে পথ রোধ করে রাখা ট্রলারটি সরে যাওয়ায় তাদের চলে যেতে আর কোনো বাধা রইল না। ফলে দ্রুত গতিতে ট্রলার ছোটাল রবিউল। যদিও তার আশঙ্কা ছিল যে পেছনের ট্রলারখানা সহসাই তাদের তাড়া করে ছুটে আসবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং বেশ খানিকটা চলে আসার পর রবিউলের মনে হলো অন্তত আজ আর তারা এমুখো হবে না। সম্ভবত আহত ফজুর চিকিৎসা নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে লোক দুজন।

তবে বাড়ি ফেরার বাকিটা পথ ট্রলারের পরিবেশ কেমন গুমোট হয়ে রইল। কেউ কারো সঙ্গে কোনো কথা বলল না। যেন খানিক আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা বিশ্বাসই করতে পারছে না তারা। তা ছাড়া পারুর অমন অভাবিত রুদ্রমূর্তি দেখে উপস্থিত সকলেই ভড়কে গেছে। ভড়কে গেছে ফজুর ওই ভয়ানক মুখ আর পাশবিক আচরণ দেখেও। হয়তো ধাতস্ত হতে খানিক সময় লাগছে তাদের।

সমস্যা হচ্ছে, এই গুমোট হাওয়া আর কাটল না। পরদিন ভোরে তাবারন বিবি বেশ খানিকটা গম্ভীর মুখেই পারুর কাছে এলেন। তারপর বললেন, তুই কিছু মনে করিস না, পারুল। তোরে আমি কয়টা কথা বলতে চাই।

কী কথা ঠাকুমা?’

‘তোর ওপর আমার একটা মায়া জন্মাই গেছে, এই কথা যেমন সত্য। তেমনি এই কথাও সত্য যে তোর অনেক বিষয়ই আমার ভালো লাগে না। সন্দেহ হয়। মনে হয়, ভেতরে ভেতরে তোর অনেক গোপন ব্যাপার-স্যাপার আছে। বিষয়টা আমার আর ভালো লাগতেছে না।’

‘আমি কি অন্যায় কিছু করেছি?

পারুর এই প্রশ্নের উত্তরে সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বললেন না তাবারন বিবি। বেশ খানিকটা সময় চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, ‘ফজুর সঙ্গে তোর কী হইছিলো? সে তোর ওপর ওইরম ক্ষ্যাপা জানোয়ার হইয়া গেছিল কেন?

পারু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। তাবারন বিবি বললেন, তুই তার সঙ্গে কী করছিলি? আর তার মুখেরই বা ওই দশা কেমনে হইলো?”

পারু এবারও কথা বলল না। তাবারন বিবি আসন গেড়ে বসলেন। তার মুখে পান। তিনি পিচিক করে পানের পিক ফেললেন দূরে। তারপর বললেন, কাশেম আমার খুব আদরের। সে সেই ছোটবেলা থিকাই আমার সঙ্গে সবসময় উঠতে বসতে থাকত। কত উপকার যে সে আমার করছে তা বলার মতো না। কিন্তু আল্লায় তার ঘরে দিছে ওইরম একটা বউ। তাও আবার কপাল পোড়া। বউর বাচ্চাকাচ্চা হয় না। এই জন্য কাশেম তোরে বিয়া করছে শুইনা, তোর পেটে কাশেমের বাচ্চা আছে শুইনা আমার পরানডা ভইরা গেছিল। এত খুশি মনে হয় আমি আমার নিজের পোলা মাইয়া, নাতি-নাতনির জন্যও হই নাই। কিন্তু তারপর…’।

বলে থমকে গেলেন তাবারন বিবি। বেশ কিছুক্ষণ কথা বললেন না। তারপর বললেন, যা-ই হোক। মানুষ হইলো গিয়া ভাদ্র মাসের আসমানের মতন। এই রোদ, এই বৃষ্টি। সে কখন কী করে তা সে নিজেই জানে না।’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি। তারপর আবার বললেন, ‘তোর সব শোনার পর মায়াটা কমার বদলে আরো বাইড়া গেল। আহারে, এইটুক এক মাইয়া। কী কষ্টটাই না পাইতেছে। কিন্তু পারুল… এহনতো আমার ডর লাগতেছে।

‘কীসের ডর ঠাকুমা?’

কীসের ডর তুই বুঝস না? কিছু বুঝস না?

পারু জবাব দিল না। নিরাসক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল।

‘আমার বয়স হইছে। জীবনে কম কিছু তো আর দেহি নাই। কথা বললেন তাবারন বিবি। গত রাইতে যেই ফজুরে আমি দেখছি, ওই ফজু তো আর মানুষ নাই রে। সে তো পুরাপুরি জানোয়ার হইয়া গেছে। সে তো মরণরেও আর ভয় পায় না। সে কেন এইরম হইয়া গেল। কী তারে এইরম বানাইল?

পারু ধীরে কথা বলল। তার সেই কথায় ফজুর সঙ্গে তার ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রায় পুরোটাই উঠে এলো। সব শুনে থম মেরে রইলেন তাবারন বিবি। বললেন, ‘আল্লাহরে আল্লাহ! সে তো তোরে এই জীবনে কোনোদিন ছাড়ব না। তার ওপরে গতকালের ঘটনা, তুই কি বুঝতেছস না সে এখন কী করব?

এই প্রশ্নে চুপ করে রইল পারু। সে জানে, ফজু এবার আর কিছুতেই তাকে ছাড়বে না। পর পর দুবার সে যেভাবে পর্যুদস্ত হয়েছে, তা যে কারো জন্য ভয়ানক অপমান ও লজ্জার। তার মতো কারো পক্ষে এটা মেনে নেওয়া আরো বেশি অসম্ভব। তা ছাড়া ফজুর জীবনের সবচেয়ে বড়, স্থায়ী ক্ষতিটাও সে করে ফেলেছে। ফলে এর প্রতিশোধ যে কী ভয়াবহ হতে পারে, তা সে ছাড়া আর কেউ জানে না।

তাবারন বিবি বললেন, তুইতো তুই… সে তো তোর পোলারেও ছাড়ব না। ওই পোলারে তুই আর একদিনও এইখানে রাখতে পারবি না। এক মুহূর্তও না।

পারু এসবই অনুমান করতে পারছে। সে জানে, শুধু সে একাই নয়, এর জের হয়তো টানতে হতে পারে তাবারন বিবিকেও। ফজু যেকোনো মূল্যে ক্ষতি করে ছাড়বে। এ থেকে কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবে না। এমনকি থানা পুলিশও না। কারণ, কেউ যদি জীবন-মৃত্যুর পরোয়াই না করে, তবে তাকে ঠেকাবে কে? কোনো ভয়ই আর তাকে রুখতে পারে না। সে সাধ্যও কারো নেই।

কথাটা তাবারন বিবিও বললেন, সামনে কখন কী ঘইটা যায়, আমি জানি না। বেশির ভাগ সময় আমি থাকি আমার মেয়ে-জামাইর বাড়ি। এরমধ্যে আমি তোরে নিয়া কী করব? আর গতকালের ঘটনার পর থেকে আমি একটা ফোঁটা চোখের দুয়ার বন্ধ করতে পারি নাই। সারাটাক্ষণ মনে হইছে, এই বুঝি কেউ আসল। আইসা দরজা ধাক্কাইয়া কইলো, দরজা খোলেন। আমি ফজু। আর আমারও তো মাইয়া-জামাই, নাতি-নাতনি আছে। তাগো লইয়াই তো এখন ভয় পাইতেছি।’

পারু কী বলবে ভেবে পেল না। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এ বাড়ির আশ্রয় তাকে হারাতে হবে। অবশ্য এ ছাড়া আর উপায়ও নেই। নিজের জন্য এই অসাধারণ মানুষগুলোর কাঁধে আর বিপদের বোঝা চাপিয়ে দিতে চায় না সে। কিন্তু কী করবে? কোথায় যাবে?

সেই সারাটা দিন ঝিম ধরে বসে রইল পারু। এমন এক রুদ্ধ পথের মুখে এসে সে দাঁড়িয়েছে যে এখান থেকে তার আর কোনো মুক্তি নেই। যাওয়ার পথ নেই কোথাও। আবার থাকারও উপায় নেই। তাহলে?

সেই রাতে ঘটল আরো এক ভয়াবহ ঘটনা। দিনভর দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতায় ক্লান্ত পারু ঘুমিয়ে পড়েছিল। তার ঘুম ভাঙল অদ্ভুত এক অস্বস্তি নিয়ে। তখন প্রায় শেষ রাত। আচমকা শব্দটা শুনতে পেল সে। একটা শুকনো গাছের ডাল যেন হঠাৎ মড়মড় করে ভেঙে যেতে লাগল। যেন কতগুলো পায়ের শব্দ সন্তর্পণে ঘোরাঘুরি করতে লাগল বাড়ির উঠানে। এলোমেলো ফিসফাস শব্দও। ঠং করে ধাতব কিছুর আঘাত। পারু একবার ভাবল, ভুল শুনছে সে। নিশ্চয়ই অত্যাধিক দুশ্চিন্তা আর ভয় তাকে বিভ্রান্ত করে ফেলেছে। কিন্তু খানিক সময় যেতেই সে বুঝল, ঘটনা আসলে তা নয়। সত্যি সত্যিই বাড়ির উঠোনে কিছু লোক ঘোরাঘুরি করছে। মাঝে মধ্যে দুয়েক সেকেন্ডের জন্য চট করে আলো জ্বালছে তারা। সম্ভবত কিছু দেখার চেষ্টা করছে।

এই মুহূর্তে দরজার কাছে কারো উপস্থিতি টের পেল সে। নিঃস্তব্ধ রাতের অন্ধকারে কেউ একজন চাপ দিয়ে দরজার অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছে। লোকটা হয়তো সাবধানেই কাজটা করতে চেয়েছিল। কিন্তু কাঠের দরজায় চেপে বসা হাতের মৃদু শব্দটা এড়াতে পারল না সে। এবার পায়ের শব্দগুলো ঘুরে এলো বাড়ির পেছন দিকটাও। সুনসান রাত বলে সামান্য নড়াচড়াও বেশ কানে বাজছে। সম্ভবত ঘরের দুর্বল দিকটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে লোকগুলো। তারা কি তবে ঘরে ঢুকতে চাইছে?

পারুর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। সে উঠে বসল। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারল না কী করবে! এত রাতে তাবারন বিবিকে ডাকা কি ঠিক হবে? আর তাকে ডেকেই বা কী করবে? এই রাতে নিশ্চয়ই এমন কিছু শুনতে ভালো লাগবে না তার! তা ছাড়া, বাইরে যদি সত্যি সত্যিই ফজু কিংবা তার লোকেরা হয়, তাহলে তাবারন বিবিই বা কী করবেন? বিচ্ছিন্ন এই বাড়িতে তো তারা তিনজন মেয়ে আর ওই এক রবিউল ছাড়া কেউ নেই! তাবারন বিবির কি ক্ষমতা আছে ওদের হাত থেকে তাকে রক্ষা করার? বরং তার কারণে এই ঘরের মানুষগুলোই উল্টো বিপদে পড়বে।

ভীত, বিচলিত পারু হতবুদ্ধির মতো বসে রইল। তবে তাকে চমকে দিয়ে কথা বলে উঠলেন তাবারন বিবি। তিনি হেঁড়ে গলায় বললেন, কেডা ওইখানে? কেডা? কোন নওয়াবের পুকুর এত্তো রাইতে আমার বাড়ির উঠানে মেহমান হইতে আসছে? কেডা?

তাবারন বিবির অকস্মাৎ কণ্ঠে উঠোনের মানুষগুলো যেন চমকে গেল। হঠাৎ নিস্তব্ধ হয়ে গেল তারা। কোনো জবাব দিল না। এমনকি খানিক আগের হাঁটা-চলা, ফিসফিসানির শব্দও যেন স্তিমিত হয়ে গেল। তাবারন বিবি ঘরের আলো জ্বালালেন। তারপর পায়ে কাঠের খড়ম জোড়া গলাতে গলাতে বললেন, কী হইল? কথা বলে না কেন? মেহমান আইলে তো মেহমানদারিও করতে হইব। কথা না কইলে বুঝব কেমনে যে মেহমান, না চোর?’

আরো কিছুক্ষণ সবকিছু স্থির, স্তব্ধ হয়ে রইল। তবে এই নীরবতা ভাঙল ফজুর কণ্ঠ। সে স্পষ্ট ঠাণ্ডা গলায় বলল, নানিজান, আপনের সঙ্গে আমার কোনো শত্রুতা নাই। আপনে মুরব্বি মানুষ। আপনে খালি আমার লগে কোনো শত্রুতা কইরেন না। আপনের কাছে বেয়াদবি করলে আমারে মাফ কইরা দিয়েন নানিজান।

‘তোর লগে আমার শত্রুতা কীয়ের ফজু?

‘আমিও সেইটাই কই নানিজান। আপন না হন, আপনেরে ছোটোকাল থিকা আপন নানিই মনে করছি। সেই নানির সঙ্গে উল্টাপাল্টা কিছু করতে আমার ভালো লাগবে না।

‘তুই আমার লগে কী উল্টাপাল্টা করবি, হ্যাঁ? কী উল্টাপাল্টা করবি?” যেন খানিক রুক্ষ হলেন তাবারন বিবি।

‘আমি হইমু তা তো কই নাই নানি। কইছি হইতে পারি। আপনে আমারে বাধ্য কইরেন না। আপনে আমার মুখের অবস্থা তো দেখছেন। ওই খানকি মাগি আমার এই অবস্থা করছে। আমি ওরে ছাড়ব না। আমার জেল-ফাস যা হয় হোউক। আমি ওরে ছাড়ব না। আপনে খালি আমারে বাধা দিয়েন না নানিজান।’

তাবারন বিবি সঙ্গে সঙ্গে কথা বললেন না। তিনি তার করণীয় ভাবতে সময় নিলেন খানিক। ফজুর অবশ্য তর সইল না। সে বলল, আমি আপনের আপন? না ও আপনের আপন? আপনে আমার চেহারাটা দেখছেন?

‘দেখছি। কিন্তু ওইটাতো সে বাধ্য হইয়া করছে। তুই তার লগে…।’

তাবারন বিবির কথা শেষ করতে দিল না ফজু। তার আগেই সে বলল, আমি এইখানে আপনের ওকালতি শোনতে আসি নাই। আমি আসছি ওরে জন্মের মতো শিক্ষা দিতে। আপনে এইখানে বেশি কথা বইলেন না। আমার মাথার কিন্তু ঠিক নাই নানি। কখন কারে কী কইরা ফেলি তার হিসাব নাই।’

‘কী করবি তুই? অ্যাঁ? কী করবি? মারবি? খেঁকিয়ে উঠলেন তাবারন বিবি। ‘তোর এত সাহস? আয়, মার…।’

দরকার হইলে তা-ই করব। আমি এহন সব করতে পারি। আর আমার এই অবস্থার জন্য আপনেও দায়ী। আপনে যদি তারে লাই না দিতেন, তাইলে তার এত সাহস হইতো না। ওই দিন রাইতেও সে আপনের বাড়িতে আইসা আশ্রয় পাইত না। সে জানত যে ওইখান থেকে কোনোভাবে ছুঁইটা পালাইতে পারলেই আপনের বাড়িতে সে আশ্রয় পাইব। এইজন্যই তার এত সাহস হইছে। এইজন্যই সে এই কাজ করতে পারছে। আর আপনে তারে আশ্রয় না দিলে, এতদিনে আমি তার মাংস টুকরা টুকরা কইরা গাঙ্গের পানিতে ভাসাই দিতাম। আপনের কারণে কিছু পারি নাই। আপনেরে এতদিন কিছু বলি নাই দেইখা এখনো বলব না, এইটা মনে কইরেন না।

কী করবি তুই আমার?’ তাবারন বিবির কণ্ঠ যেন এবার খানিক নিস্তেজ।

‘আপনে দুয়ার খোলেন। দুয়ার না খুললে আমি এই দুয়ার ভাইঙা ঢুকব।’

তাবারন বিবি এবার আর কথা বললেন না। চুপ করে রইলেন। ততক্ষণে ঘরের সবাই জেগে গেছে। সকলের চোখে মুখেই তীব্র আতঙ্ক। রাতেরও আর বাকি নেই বেশি। হয়তো এই রাতটুকু কোনোভাবে কাটিয়ে দিতে পারলেই মুক্তি মিলত তাদের। কিন্তু দুঃসময় বা বিপদের মুহূর্ত দীর্ঘ হয়। সেই দীর্ঘ বিপদাপন্ন সময়টুকু তারা কীভাবে কাটাবে? ঘরের প্রতিটি মানুষই বুঝতে পারছে ফজু কতটা বেপরোয়া, হিংস্র, প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে আছে! পারুকে নাগালে পেতে সে এখন যেকোনো কিছু করতে পারে। এমনকি তাবারন বিবি, সালমা বা রবিউলেরও বড় কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। কিন্তু পারু এখন কী করবে?

নিজেকে বিনাবাক্যব্যয়ে ফজুর হাতে সমর্পিত করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। সেটি হয়তো করতোও। কারণ, এই মানুষগুলোকে রক্ষা করার আর কোনো উপায় তার জানা নেই। একজন অচেনা, অজানা, অনাত্মীয় মানুষের জন্য তারা এতদিন যা করেছেন, তাতে তাদের রক্ষা করার জন্য পারু অবলীলায় নিজেকে বিলিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে তার সন্তান। এই একটা জায়গাতে এসেই পারু আটকে যাচ্ছে। তার সমস্ত চিন্তা-ভাবনা, অনুভব স্থির হয়ে যাচ্ছে। কিছুতেই কিছু ঠিক করতে পারছে না। তবে কি গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে থাকা ওই নিশ্চিন্ত, নির্ভার অস্তিত্বটুকু নিয়েই সে ফজুর হাতে নিজেকে সমর্পণ করবে? তারপর কী করবে ফজু?

ফজু কী করবে তা অবশ্য আর জানা হলো না। কারণ সে এবার সশব্দে দরজায় ধাক্কা দিতে লাগল। তার শক্ত হাতের আঘাতে কেঁপে উঠতে লাগল দরজার চৌকাঠ, ঘরের বেড়া। তাবারন বিবি কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে রইলেন। রবিউল আর সালমা এসে দুদিক থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। ঘরের মাঝখানে কেরোসিনের কুপিটা জ্বলছে। মাঝে মাঝে তিরতির করে কাঁপছে আলোটা। সেই কম্পনে এই তিনজন ভীত মানুষের ছায়াও কেঁপে যাচ্ছে দেয়ালজুড়ে। যেন তা প্রতীকী অর্থে প্রতিফলিত করে তুলেছে তাদের বুকের গহিন।

তাবারন বিবি বুঝতে পারছেন ফজুকে আর কিছু বলেই লাভ নেই। তার এখন আর হিতাহিত জ্ঞান নেই। তিনি যদি দরজা না খোলেন, তাহলে সে হয়তো দরজা ভেঙেই ঘরে ঢুকবে। লুকোচুরির আর বাকি নেই কিছু। এখন সে যা করবে, তা করবে প্রকাশ্যে, সদম্ভে, সদর্পে। বরং তিনি যদি এখন দরজা না খোলেন, তবে তার পরিণতি হবে সবচেয়ে ভয়াবহ। তারচেয়ে দরজাটা খুলে দেয়াই ভালো। কিন্তু তারপর? তারপর পারুর কী হবে?

তাবারন বিবি আর ভাবতে পারলেন না। এবার দ্রিম দ্রিম শব্দে কিছু একটার আঘাত পড়ছে দরজায়। সম্ভবত ভারী কিছু দিয়ে দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে ফজুর লোকেরা। কতজন তার সঙ্গে? যদি সালমারও কোনো ক্ষতি করে বসে তারা? বা রবিউলের? আশু অশুভ পরিণতির ভাবনায় তাবারন বিবি অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে গেলেন দরজার সামনে। সেখানে মুহূর্মুহূ আঘাতে থরথর করে কাঁপছে ঘরের দেয়াল ও দরজা। তিনি কম্পিত হাতে সেই দরজা খুললেন। ফজু হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকল। তারপর ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে দিল তাবারন বিবিকে। তার সঙ্গে গতকালের সেই দুজন। তাদের হাতে টর্চ লাইট। তারা সেই টর্চের আলো জ্বেলে ছুটে গেল ঘরের ভেতরে। তারপর উঁকি দিয়ে দেখতে লাগল ঘরের প্রতিটি কক্ষ, আনাচ-কানাচ। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো পারু কোথাও নেই। কোথাও না! তার সন্তান আর সে যেন হঠাৎ উধাও হয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে এই শেষ রাতের গহিন অন্ধকারে। কিন্তু এত রাতে তারা যাবে কই?

ফজু রুদ্রমূর্তিতে এসে দাঁড়াল তাবারন বিবির সামনে। কিন্তু তাবারন বিবি নিজেও যারপরনাই অবাক হলেন। তিনি বিস্মিত গলায় বললেন, ‘পারুল নাই? ঘরে নাই সে? কই গেছে সে? কই গেছে? সে তো তার ঘরেই আছিল। রাইতেও ওইখানে ঘুমাইছিল। ও আল্লাহ, সে গেল কই?

ফজু কী বুঝল কে জানে! সে হঠাৎ ঘরের উত্তর দিকের সরু ছোট্ট দরজাটার দিকে গেল। জীবনে অসংখ্যবার সে এই ঘরে এসেছে। ফলে এর প্রতিটি কোণ তার চেনা। সে সেই উত্তর দিকের কোণে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে রইল। সেখানকার ছোট্ট, সরু দরজাটা খোলা! পারু নেই। তার মানে এই দরজা দিয়ে পালিয়েছে সে। কিন্তু এই অন্ধকারে নিজের অতটুকু বাচ্চা নিয়ে সে কোথায় যাবে? কতদূর যাবে?

ফজু বাইরের মাটিতে আলো ফেলল। গত বেশ কিছুদিন ধরেই বৃষ্টি হয়েছে। ফলে মাটি ভেজা। সেই মাটিতে খানিক আগেই হেঁটে যাওয়া পারুর পায়ের স্পষ্ট দাগ পড়ে আছে। এই দাগ ধরে হেঁটে গেলেই তাকে পাওয়া যাবে। এই অন্ধকারে অচেনা অজানা পথে বেশিদূর হেঁটে যেতে পারবে না সে। তাকে ধরে ফেলা এখন জলের মতো সহজ। ফলে তাড়াহুড়ার কিছু নেই। মুখে অদ্ভুত এক প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল ফজুর। তবে সেই হাসি জুড়ে প্রবল নৃশংসতাও। সে সঙ্গেই সঙ্গেই পারুকে অনুসরণ করল না। খানিক সময় নিল। যেন শিকার বধ করার আগে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করতে চায় শিকারের আতঙ্ক, দিশেহারা অবস্থা।

তাবারন বিবির প্রতি ক্ষোভ থাকলেও সে তা প্রকাশ করল না। বরং দরজা খুলে দেয়ার জন্য তার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাল। ক্ষমাও চাইল খানিক আগে করা নিজের দুর্ব্যবহারের জন্য। তবে আজকের ঘটনা যেন কাউকে কিছু না বলা হয়, সেজন্য এক ধরনের প্রচ্ছন্ন হুমকিও দিয়ে রাখল সে। তারপর ধীরে সুস্থে পা বাড়াল বাইরের অন্ধকারে। সেই অন্ধকারে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে ফজুর চোখ। সেই চোখের দৃষ্টি ভয়ংকর।

৩২

রুস্তমকে নিয়ে ভয়াবহ ঝামেলায় পড়েছে কামাল। সে ভেবেছিল সেদিন রাতেই তারা তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে পারবে। খুঁজে পাবে হারানো গুপ্তধন। কিন্তু তাতো হলোই না। বরং নতুন এক ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ল তারা। এছাহাক আর মতি মিয়াকে চিনে ফেলল রুস্তম। ফলে তৈরি হলো নতুন সংকট। সেই সংকট থেকে উত্তরণের জন্যই তাকে তুলে নিয়ে আসা হলো। কারণ কামাল জানে, রুস্তমকে ছেড়ে দেয়া মানে এই ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে পড়া। আর তা হলে, শুরু হবে ভয়াবহ হইচই। বিষয়টা কিছুতেই মেনে নেবেন না আশরাফ খাঁ। মেনে নেবে না এলাকার মানুষও। এমনিতেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ওপর চাপা ক্ষোভ, অসন্তোষ লুকিয়ে আছে গ্রামবাসীর। এই ঘটনা বরং সেই সুপ্ত ক্ষোভের আগুনে দাবানল জ্বালিয়ে দেবে। ফলে তাৎক্ষণিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল কামাল। রুস্তমকে চোখ মুখ বেঁধে নিয়ে আসা হলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার গুদাম ঘরের নিচে।

সমস্যা হচ্ছে, সপ্তাহখানেক পেরিয়ে গেলেও তার কাছ থেকে কোনো তথ্য আদায় করা গেল না। বরং তার কথা শুনে মনে হচ্ছে, গুপ্তধনের বিষয়ে কিছুই জানে না সে। কখনো শোনেনি কিছু। বিষয়টা দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলল কামালকে। একইসঙ্গে রাগান্বিতও। প্রথম দিকে তার ধারণা হলো, রুস্তম নিজে নিজেই গুপ্তধন সরিয়েছে। এ বিষয়ে অন্য কেউ কিছু জানে না। এমনকি আশরাফ খাঁও না। এ কারণেই সে মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে। কিন্তু আবার কয়েকদিন যেতে না যেতেই মনে হলো, বিষয়টা আশরাফ খাঁও জানেন। হয়তো তার ভয়েই মুখ খুলছে না সে। কিংবা এমনো হতে পারে যে আশরাফ খাঁ তাকে বড়সড় কোনো লোভ দেখিয়েছেন। সেই লোভের কারণেই মুখ বন্ধ করে রেখেছে সে।

সমস্যা হচ্ছে, এই ঘটনায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অত্যন্ত বিরক্ত হয়েছেন। এমনিতেই নানাবিধ ঝামেলায় অতিষ্ঠ জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এই মুহূর্তে নতুন করে আর কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাইছিলেন না। কিন্তু ঘটনার দিনকয়েক পরে যখন তিনি। জানলেন, তখন কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারছিলেন না। কামাল বলল, ‘আপনি উত্তেজিত হবেন না দুলাভাই। বিষয়টা আমি দেখছি।’

‘আর কী দেখবি? বুঝতে পারতেছিস যে এখন কী হবে?

কী হবে?’

‘এই ঘটনা জানাজানি হলে দুই গাঁয়ের মানুষই ক্ষেপে যাবে। আশরাফ খাঁ বা থানা-পুলিশের আর কিছু করতে হইব না। যা করনের গ্রামের লোকজনই করব।’

পরিস্থিতি কামালও বুঝতে পারছে। সে এটাও বুঝতে পারছে যে এই ঘটনা থেকে নিরাপদ প্রস্থানের আর কোনো সুযোগও নেই। বরং এখন যতটা সম্ভব সময় নিতে হবে। আর চেষ্টা করতে হবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার। এ কারণেই ফরিদের বিয়ের ঘটনায় সে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে নতুন ভূমিকা নিতে বলল। গাঁয়ের মানুষের কাছে তার পরিবর্তিত অহিংস ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দিল। তা কিছুটা হলোও। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রুস্তমের কাছ থেকে কোনো কথা আদায় করা গেল না।

সময় যত যেতে থাকল, ততই রুস্তমের নিখোঁজ হওয়ার বিষয়টা নিয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠতে লাগল মানুষ। প্রথমে সকলেই ভেবেছিল যে, আর সব সময়ের মতো এবারও বোধহয় নতুন কোনো চিকিৎসার খোঁজে উধাও হয়েছে সে। নিশ্চয়ই কিছুদিনের মধ্যেই আবার ফিরে আসবে। কিন্তু দিন পনেরো কেটে যাওয়ার পর এই নিয়ে ধীরে ধীরে ফিসফাস শুরু হলো। উচ্চকিত হয়ে উঠতে থাকল মানুষ। বিশেষ করে আশরাফ খাঁ। তিনি পুরোপুরি নিশ্চিন্ত না হয়ে কিছু করেন না। তারপরও হঠাত্র একদিন তাকে ভুবনডাঙায় দেখা গেল। তারপর থেকে নিয়মিত। মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতেও তার আনাগোনা বাড়তে লাগল। বিষয়টা নিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চিন্তিত হয়ে পড়লেন। তিনি বললেন, কামাল, অবস্থা কিন্তু ভালো না।

‘কেন?’

‘ধর আশরাফ খাঁ পুলিশরে জানাইল বিষয়টা?

তাতে কী? আমরা কিছু করছি এমন কোনো প্রমাণ আছে?

না থাকুক। যদি এমন হয় যে সে রুস্তমের নিখোঁজ হওনের বিষয়টাই পুলিশে জানায়? আর তারপর পুলিশ আসলো গ্রামে তার খোঁজে। তখন? তখন যদি তোর খোঁজ পাইয়া যায়?

‘আমার খোঁজ কীভাবে পাবে? আমি এইখানে আছি, এই কথা কেউ জানে? আমি তো লোকসম্মুখে যাই না। আর আমারে যে পুলিশ খুঁজতেছে, তাও তো এই গাঁয়ের কেউ জানে না।’

তা জানে না। কিন্তু বিপদের কি আর হাত পাও আছে?

উঁহু। তা নাই। বিড়বিড় করে বলল কামাল। চেষ্টা করেও নিজের দুশ্চিন্তা ঢেকে রাখতে পারছে না সে। কিন্তু দুলাভাইয়ের সামনে সেটি প্রকাশও করতে চায় না। এত আশা নিয়ে তার ওপর নির্ভর করেছিলেন তিনি। এখন এই অবস্থায় কিছুতেই তাকে নিরাশ করা ঠিক হবে না। সেটি করতে চায়ও না কামাল। সে জানে, কেবল ওই গুপ্তধনের খোঁজ মিলে গেলেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সব হতাশা, রাগ, বিরক্তি কর্পূরের মতো উবে যাবে। কিন্তু রুস্তম তো কিছুতেই মুখ খুলছে না।

যতবারই তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, সে বলে, জানি না।’

কামাল বলে, না জানলে অতরাতে তুই কই যাস?

রাইতে হাঁটাহাঁটি করন আমার অভ্যাস।

হাঁটাহাঁটি করতে ব্যাগ লাগে?

লাগে।’

‘কেন?

‘আমার অসুখ সারনের জইন্য নানা লতাপাতা, ফল-পাকড়া টোকাইতে হয়। গাছ থেকে পাড়তে হয়। সেইগুলা ব্যাগে কইরা আনতে হয়।

‘তা সেইটা রাতেই কেন করতে হবে? দিনেও তো করা যায়?

কবিরাজে কইছে রাইতের বেলা করতে। রাইতের জিনিসে উপকার বেশি।

তাইলে হাতে টেডা থাকে কেন? ফল-পাকড়া কি মাছ নাকি যে লাফ দিয়া পালাই যাইব, এইজন্য টেডা দিয়া কোপাইয়া মারতে হয়?’ মতি মিয়া জিজ্ঞেস করে।

এই প্রশ্নে রুস্তম চুপ করে থাকে। শত চেষ্টায়ও তার মুখ থেকে আর জবাব বের করা যায় না। বিষয়টা নিয়ে ভয়াবহ বিরক্ত কামাল। তার সেই বিরক্তি মাঝেমাঝেই প্রবল রাগে পরিণত হয়। সে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে তার এই রাগটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পারে না। মাঝেমাঝেই সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। নিজের অনিয়ন্ত্রিত এই রাগটাকে কামাল নিজেই ভয় পায়। সে জানে তখন কত ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে সে!

মুখ খোলানোর জন্য মাঝেমধ্যে রুস্তমকে অল্পবিস্তর নির্যাতনও করা হয়। তবে সেসব নির্যাতন হঠাৎ হঠাৎ সীমা ছাড়িয়ে যায়। সেদিন যেমন কামাল হঠাৎ রেগে গেল। তার হাতের কাছে মেঝেতে পড়ে ছিল একটুকরো কাঠ। সে আচমকা সেই কাঠ তুলে এলোপাতাড়ি আঘাত করতে লাগল রুস্তমকে। এছাহাক, মতি মিয়া, দেলু অনেক চেষ্টা করেও তাকে থামাতে পারল না। কামালের মাথায় যেন উন্মাদ ভর করেছে। রুস্তম তার আঘাত থেকে রক্ষা পেতে মাথা নিচু করে ফেলল। আর তখুনি আঘাতটা লাগল তার মাথায়। কানের কাছের নরম জায়গাটায়। সেখান দিয়ে দরদর করে রক্ত ছুটতে লাগল। অনেক চেষ্টা করেও সেই রক্ত বন্ধ করা গেল না। শেষ অবধি মতি মিয়া ছুটল ফরিদের ওষুধের দোকানে। গিয়ে দেখল ফরিদ দোকানে নেই। সে তার অপেক্ষায় বসে রইল। বেশ খানিকক্ষণ পর ফরিদ ফিরল। তার হাতে একজোড়া নতুন স্যান্ডেল। মতি বলল, কই গেছিলা ফরিদ?

‘এই তো স্যান্ডেল কিনতে গেছিলাম। পুরান স্যান্ডেল জোড়া ছিঁড়ে গেছে। আর পরার অঅস্থা নাই।

কই, দেখি দেখি? আগ্রহভরে ফরিদের স্যান্ডেল জোড়া দেখল মতি। তারপর বলল, দাম কত নিছে?

ফরিদ দাম বলল। মতির মূলত এই স্যান্ডেল নিয়ে কোনো আগ্রহই নেই। সে এসব এমনি এমনিই জিজ্ঞেস করল। যাতে ফরিদের সঙ্গে পরের কথাটা বলার জন্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে নিতে পারে সে। ফরিদ স্যান্ডেল জোড়া ব্যাগে ভরে রাখতেই মতি বলল, ও ফরিদ, তোমার দোকানে রক্ত বন্ধ করার কোনো ওষুধ আছে?

‘রক্ত বন্ধ করার ওষুধ? খুব অবাক ভঙ্গিতেই জিজ্ঞেস করেছিল ফরিদ।

হুম।

কী হইছে আগে বলেন। না শুনে তো বলা যাবে না।

‘ধরো মাথায়, এই যে এইখানে, কানের কাছে কাঠের বাড়ি লাইগা মাথা ফাইটা রক্ত বাইর হইতেছে, সেইটা বন্ধের উপায় কী?

ফরিদ বলেছিল, মাথায় আঘাত লাগা কিন্তু ভালো না। এইটা খুব খারাপ জায়গা। সামান্য কিছু থেকেও অনেক বড় বিপদ হইতে পারে। চলেন, আমি যাই আপনার সঙ্গে। কার কী হইছে, দেইখা আসি।’

না না। তোমার যাওন লাগত না।’ আঁতকে ওঠা গলায় বলল মতি মিয়া। তুমি আমারে বল কী করন লাগব, আমিই পারব। ওষুধ দাও, তাতেই কাম হইব।

‘এইটা চট করে ওষুধের কাজ না। আগে ব্যান্ডেজ করতে হবে মাথায়। আপনে পারবেন?

“আরে পারব, পারব। দেও, আমারে একটু শিখাই দেও। আমার বড় জেঠুসের ছোট পোলা। অত দূর এখন দোকান বন্ধ কইরা যাইবা তুমি? তার চাইতে আমারেই একটু শিখাই দাও।’

দোকানেই বসা ছিল উত্তর পাড়ার ঝন্টু। সে কলার ব্যবসা করে। ফরিদের ফার্মেসির সামনেই খোলা জায়গায় কলা নিয়ে হাটবারে বসে সে। মাঝেমধ্যে ফরিদের সঙ্গে এটা সেটা গল্পও করে। সে হঠাৎ বলল, কই? তোমার জেঠুসের বাড়ি তো আমার বাড়ির লগেই। তার পোলার মাথা ফাটল কখন? আমি তো কিছুই জানি না। এখন একদম ব্যান্ডেজ লাগব?

মতি মিয়া যেন আচমকা থতমত খেয়ে গেল। সে চট করে কথাটা বলে ফেলেছে। কিন্তু ঝন্টু যে এখানে বসা, তা সে খেয়াল করেনি। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে সে বলল, এই কিছুক্ষণ আগেই ফাটছে। এইজন্য তুমি জানো না।

‘ও।’ বলে থামল ঝন্টু। ফরিদ অবাক হলেও কিছু বলল না। সে যতটা সম্ভব শিখিয়ে দিল। সঙ্গে কিছু ওষুধও দিল। সেই ওষুধ আর ব্যান্ডেজ তাৎক্ষণিক হলেও বিপদ সামলে নিল। কিন্তু দিন যত যেতে লাগল, ততই যেন নেতিয়ে পড়তে লাগল রুস্তম। তার শ্বাসকষ্টটাও বাড়তে লাগল। শেষ অবধি তাকে নিয়ে আলোচনায় বসল সবাই। এলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও। তিনি রুস্তমের অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলেন। বললেন, তুই এইটা কী করছস কামাল?’

কামাল বলল, ‘বেশি কিছু করি নাই। তার কপাল খারাপ। না হইলে ওইটুকু আঘাতে কারো কিছু হয় না।’

‘জায়গা মতো পড়লে আঙুলের টোকায়ও মানুষ মারা যায়।

‘সেইটা কপালের ফের। কেউ দশতলা বিল্ডিং থেকে পড়েও বেঁচে থাকে। আবার কেউ খাট দেখে পড়েও মরে। মরে না দুলাভাই?

তা মরে।’ বিড়বিড় করে বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

‘তাহলে? বাঁচা-মরা হইলো ওপরওয়ালার ব্যাপার। উনি কারে কখন বাঁচান মারেন, সেইটা আমরা কেমনে বলব? নাহলে ওইটুকু একটু আঘাতেই ওর মতো কুস্তিগিরের এমনে নেতাইয়া পড়নের কথা না। কথা?

উপস্থিত কেউ কোনো জবাব দিল না। সকলেই মনে মনে ভয় পেয়ে গেছে। কারণ তারা সকলেই জানে যে রুস্তমের যদি এখন কিছু একটা হয়ে যায়, তবে তাদের অবস্থা হবে ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত উনুনে পড়ার মতো। তারা কেউই সেই পরিস্থিতি চায় না।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া একবার বললেন, ‘একটা কাজ করবি না কি?

কী কাজ?

‘ওহাব ডাক্তাররে একবার এইখানে নিয়াস বো নাকি? সে দেখল? দেইখা যদি ভালো মন্দ কিছু করতে পারে?

‘আপনার কি বোধ-বুদ্ধি সব গেছে দুলাভাই? সত্যি সত্যি এই কাজ করার কথা ভাবতেছেন আপনে?

কামালের এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি নিজেও বুঝতে পারছেন সেটি করা হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির উপায় আসলে কী? এছাহাক বেশ খানিকটা চুপচাপ। সম্ভবত এই পরিস্থিতি সে চায়নি। কিংবা এখন ভয় পেয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি তো কোনো কথাই বলতেছে না। তোমার মাথায় তো অনেক বুদ্ধি এছাহাক। কিছু একটা উপায় বলো। বিপদে পড়লে কিন্তু সবাই এক সঙ্গেই পড়ব।’

এছাহাক বেশ খানিকটা সময় চুপ থেকে শেষে মাথা চুলকে বলল, কী যে বলব ভূঁইয়া সাব। কিছুই মাথায় ঢুকতেছে না। সবকিছু আউলা-ঝাউলা লাগতেছে। মনে হইতেছে বেশি চালাকি করতে গিয়া বেশি বোকামিটা কইরা ফালাইলাম। কথায় আছে না, অতি চালাকের গলায় দড়ি?

শেষের বাক্যটা যেন কামালের উদ্দেশ্যে ফেঁড়ন কেটেই বলা। তা কামাল বিষয়টা বুঝতেও পারল। সঙ্গে সঙ্গে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠল সে। বলল, আপনে আমারে বুদ্ধি শেখান এছাহাক ভাই? আপনে আমারে বুদ্ধি শেখান?’

এছাহাক আর যত যা-ই করুক, কখনোই কামালকে ঘাটাতে চায় না। সে এই মানুষটাকে হাড়ে হাড়ে চেনে। হয়তো তার সঙ্গে কখনোই তেমন উল্টাপাল্টা কিছু করেনি এছাহাক। তারপরও এই মানুষটা যে ঠাণ্ডা মাথার নির্মম এক খুনি, তা বুঝতে তার বাকিও কিছু নেই।

সে বলল, আমি আপনেরে কিছু বলি নাই কামাল ভাই। নিজেদেরই বলছি। চোখের সামনে থিকা অত মূল্যবান জিনিসটা উধাও হইয়া গেল, কিন্তু কেউ কিছু ঠাহর করতে পারলাম না। এইটা কোনো কথা? যদি ওই জিনিসটা আমরা আগলাই রাখতে পারতাম, তাইলে কী আর আজকের এই পরিস্থিতি হইত? হইত না। নিজে গো অতি চালাক মনে কইরাই তো ধরাটা আমরা খাইছি।’

এছাহাকের এই কথায় কামাল যেন খানিক নিবৃত হলো। তবে তার রাগ যে নামছে না, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। সেই সন্ধ্যায় সে রুস্তমের সঙ্গে আবার বসল। রুস্তম বলল, আমারে আপনে ছাইড়া দেন ভাই। আমার শইলডা ভালো লাগতেছে না। দুর্বল লাগতেছে খুব। চোখেও যেন ঠিকঠাক দেখি না। তারওপর শ্বাসকষ্ট।

‘তোমারে তো আমি আটকাই রাখতে চাই না রুস্তম। তুমি যদি এখন বলো ওই জিনিস কই আছে, আমি তোমারে এখন ছাইড়া দেব। এখন। তোমারে ভাগও দেব।’

রুস্তম এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলল, বিশ্বাস করেন, আমি আল্লাহখোদার কসম কইরা বলতেছি, দেখা তো দূরের কথা, ওই জিনিসের কথাও শুনি নাই আমি কখনো। শুধু শুধু আপনেরা আমারে এইখানে আইনা আটকাই রাখছেন। আমারে মাইরা ফালাইলেও এই বিষয়ে একটা কথা আমার মুখ থিকা বাইর হইব না। যেই জিনিস আমি জানি না, সেই জিনিস আমি বলব কেমনে?

বলবি কেমনে মানে? তুই কি আমাদের ভেড়া পাইছিস? ভেড়া? যা বুঝাইবি, তাই বুঝব? ওই, তুই যদি কিছু না-ই জানস, তাইলে অত রাতে ওই টেডা আর ব্যাগ নিয়া তুই কই যাস? বল? বল?

এবার প্রায় কেঁদেই ফেলল রুস্তম। সে ভাঙা গলায় বলল, আমি তো একবার কইছি মিয়া ভাই। আর কী বলব বলেন?

তুই যেইটা কইছস সেইটা তুই নিজেই বিশ্বাস করস? তুই ফল পাকড় পাড়তে যাস রাইতে? তাও আবার টেডা আর ব্যাগ নিয়া? আমারে আষাঢ় মাসের গল্প শোনাস?

চটাস শব্দে চড় বসাল কামাল। রুস্তমের আহত মাথাখানা হেলে পড়ল ডানে। কামাল এবার লাথি বসাল তার বুকে। তারপর হিসহিসে গলায় বলল, “তোরে আমি খুন করব রুস্তম। তাতে আমার যা হবার হবে। কিন্তু তোরে আমি খুন করব। এই এতগুলা দিন তোরে আমি লুতুপুতু করে বুঝাইছি। লাভ হয় নাই। এইবার আর সহ্য করব না। এইবার আমি তোরে মেরে টুকরা টুকরা করে ফেলব। কিন্তু আমার সঙ্গে আর তোরে চোর-পুলিশ খেলতে দেব না। এক মুহূর্তও না।

রুস্তম তার আহত, নেতানো শরীর নিয়েই ছিটকে পড়ল দেয়ালের কাছে। তার মাথাটা ঠক শব্দে ঠুকে গেল সেখানে। মুহূর্তের জন্য চোখে পুরোপুরি অন্ধকার দেখল সে। তারপর মনে হলো ফুসফুস বাতাস শূন্য হয়ে গেছে। সে খানিক ফ্যালফ্যাল করে তাকাল কামালের দিকে। তারপর বলল, আমি সত্যিই…।’

এবার কামাল তার বুক চেপে ধরল পায়ের তলায়। সে আর তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ছুটে এলো এছাহাক, মতি মিয়া আর দেলু। এছাহাক বলল, কী করতেছেন ভাই, কী করতেছেন? তার শইলের অবস্থা দেখছেন? সে তো মইরা যাইব।’

কামাল ধাক্কা দিয়ে এছাহাককে সরিয়ে দিল। তারপর বলল, মরলে মরব। ও যদি আজ সত্যি কথা না কয়, ওরে আমি মাইরাই ফেলব। তা যেমনেই মরুক।’

মতি মিয়া গিয়ে রুস্তমের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল। তারপর নরম গলায় বলল, ‘এখনো সময় আছে তুমি আসল ঘটনা কও। তোমার কোনো ক্ষতি হইব না, আমি কথা দিলাম।

রুস্তমের চোখের কোনায় পানি। অতবড় মানুষটা যে কেবল শরীরেই বড়, মনে নয়, তা যেন তাকে দেখেই এখন বোঝা যাচ্ছে। সে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ‘আমি একটা অন্যায় করতে রাইতে বাইর হইতাম। দিনে বাইর হইলে সবাই দেইখা ফেলব। সন্দেহ করব। এইজন্য রাইতে একলা একলা বাইর হইতাম।’

মুহূর্তের মধ্যে সবাই উত্তর্ণ হয়ে উঠল। এতদিনে অবশেষে মুখ খুলছে রুস্তম। কামাল শীতল গলায় বলল, বল, কাহিনি কী?

‘আমি গেছিলাম উজানপুরের সাধুর মেলায়। ওইখানে এক সাধুর লগে আমার পরিচয়। তার কাছে হিন্দু-মুসলমান সবাই আসে। সে নাকি বহু লোকের বহু রোগ ভালো করছে। কত মানুষ যে তার ওষুধে ভালো হইছে দেইখা হাঁস, মুরগি, কবুতর, ছাগলসহ কত কী উপহার লইয়া আবার তার কাছে আসছে! তো সে আমারে কইল আমি যদি প্রতি রাইতে অল্প ফুটকিওয়ালা হইলদা রঙের কোলা ব্যাঙের মাংস তিন মাস রেগুলার খাইতে পারি, তাইলে আমার হাঁপানির ব্যারাম কমব। হাতের সমস্যাও সারব।’

বলে থামল রুস্তম। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। ক্লান্ত শরীর। সে খানিক ঢোক গিলে বলল, কিন্তু আমাগো ধর্মে তো ব্যাঙ খাওয়া নিষেধ। কেউ যদি জানে ওই জিনিস আমি খাই, তাইলে আর আমারে আস্তা রাখব? এইজন্য আমি রাইতে বাইর হইতাম। যখন কেউ দেখব না। বিশ্বাস করেন, আর কিছু না। এই আল্লাহর কসম কইরা বলতেছি, আর কিছু না।

রুস্তম থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। যেন কেউই তার কথা বিশ্বাস করতে চাইছে না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না। মতি মিয়া বলল, ‘টেডা দিয়া ব্যাঙ ধরতি?

‘হ মতি। অত রাইতে তো আর বোঝা যাইত না কোনটা কী? এইজন্য যা পাইতাম, সব ধরতাম। পরে ব্যাগে কইরা আইনা বাইছা আলাদা করতাম। বিশ্বাস না হইলে রমজানরে জিজ্ঞাস করো। অর হোটেলেই ও গোপনে রান্না কইরা দিত। এইজন্য ওরে ভালো টাকা-পয়সাও দেওন লাগত।

এরপর আর কথা থাকে না। এবার সাক্ষীও জোগাড় করে ফেলেছে রুস্তম। হকিন্তু তারপরও নিঃসন্দেহ হলো না কামাল। সে বলল, তা এই কথা এতদিন বললি না কেন? এতদিন ধইরা এই গল্প বানাইছস?

না না ভাই। বিশ্বাস করেন, এইটাই সত্য। কিন্তু ব্যাঙ খাওনের কথা শুনলে যদি আপনেরা আরো খেইপা যান, এই জন্য বলি নাই। এই জিনিস তো আমাগো খাওন মানা।

সেদিনের মতো রুস্তমকে ছেড়ে দেয়া হলেও কেউ আর রমজানের কাছে বিষয়টা প্রমাণের জন্য গেল না। বরং সকলেই যেন বুঝে গেল, রুস্তম যা বলছে তা ই সত্যি। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাকে সন্দেহ করতে গিয়ে যে ভুলের ফাঁদে তারা পা দিয়ে ফেলেছে, সেই ভুল থেকে নিস্তারের উপায় তাদের জানা নেই। এখন রুস্তমকে নিয়ে কী করবে তারা?

সব শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া থম মেরে রইলেন। এত বড় ঝুঁকি নেয়াটা শেষ অবধি বৃথাই গেল। তার চেয়েও বড় কথা, গুপ্তধন তাহলে কোথায়? কে নিয়েছে ওই মন্দিরের ধ্বংসস্তূপে লুকানো গুপ্তধন? নাকি তিনি সত্যি সত্যিই ভুল কিছু দেখেছিলেন? জাহাঙ্গীর ভূইয়া আর এক মুহূর্তও স্থির হতে পারলেন না। তার চারপাশটা ক্রমশই দুর্বোধ্য রহস্যময় জটিল এক ধাঁধায় পরিণত হচ্ছে। তিনি জানেন না এই ধাঁধার গলিপথ থেকে তার মুক্তি কীসে? কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এখন রুস্তমের কী হবে? কী করবেন তাকে এখন?

প্রশ্নটা করা হলো কামালকে। কামাল খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘খুন!

‘খুন! যেন কানের কাছে বোমা ফুটল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তুই রুস্তমরে খুন করবি?

হুম। ঠাণ্ডা গলায় বলল কামাল। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নাই দুলাভাই। এক, সেও এখন গুপ্তধনের কথা জানে। যদি এখনো আশরাফ খাঁ গুপ্তধনের কথা না জেনে থাকে, তবে রুস্তম বেঁচে ফিরলে সে সবই জানবে। তখন আপনি পড়বেন আরেক ঝামেলায়। দুই, সে বেঁচে ফেরা মানে এই সব ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়া। আপনের কি মনে হয়, আশরাফ খাঁ এই ঘটনা এমনি এমনি ছেড়ে দেবে?

কামালের কথা মিথ্যে নয়। এটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও জানেন। কিন্তু তাই বলে খুন! একজন নির্দোষ, নিরপরাধ মানুষকে খুন? বিষয়টা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হচ্ছে তার। ভয়ও। এর অবশ্য কারণও আছে। এমনিতেও যে দুর্ভাগ্যের দুর্বিপাকের মধ্য দিয়ে তিনি যাচ্ছেন, তাতে স্পষ্টতই এটি একটি ভয়ানক অশনিসংকেত। কিন্তু এর থেকে নিস্তারের কোনো উপায়ও তার জানা নেই।

কামাল বলল, আরেকটা কথা দুলাভাই।’

কী?

তার লাশ কিন্তু কেউ পাইব না। লাশ ডুবাই দেব নদীতে। ফলে সরাসরি আমাদের অভিযোগ করার সুযোগ নাই। কিন্তু এতে একটা ভালো কাজও হবে।

‘ভালো কাজ?

হুম।

কী? উৎসুক চোখে তাকালেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

আশরাফ খাঁর লোকজন ভয় পেয়ে যাবে। তারা বুঝতে পারবে যে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া দুর্বল হইয়া যায় নাই। সে এখনো যেকোনো কিছুর জন্য প্রস্তুত। সে শক্তিশালী আর ভয়ংকর। শোনেন, মানুষ দুর্বলের শাসন বা শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করতে চায় না। তারা শক্তিশালী শাসক চায়। বুঝলেন?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথা বললেন না। কামালই বলল, ‘দুলাভাই…। এত এত টাকার ধন-সম্পদি…আর আপনে সেই সব বিনা বাধায়, বিনা যুদ্ধ-রক্তপাতে সব নিজের পকেটে ভরতে চান? দুনিয়া কি এতই সহজ দুলাভাই? আগের দিনে মানুষ চর দখল করত না? কত খুনাখুনি হইতো, মনে আছে? রক্তপাত ছাড়া এই গ্রামে কোনোদিন কোনো জমি দখল হইছে দুলাভাই? আপনে আগে তো এত ভীতু আছিলেন না! আপনে ভূঁইয়া বাড়ির জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আপনের রক্তেই তো রক্তের নেশা থাকনের কথা। সেই আপনে গেলেন ব্যাঙের রক্ত হইয়া…। আপনেরে মানুষ মানব কেমনে? ভয় পাইব কেমনে? আপনিই তো অন্যের ভয়ে কাঁচুমাচু।’

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এবার চোখ তুলে তাকালেন কামালের দিকে। তার হঠাৎই মনে হলো শরীরের ভেতর কেমন যেন একটা স্পন্দন বইতে শুরু করছে। একটা উষ্ণ অনুভব। ঝড়। যেন সেই ঝড় উথাল-পাথাল করে নাড়িয়ে দিচ্ছে তার বুকের ভেতর। আবারও জেগে উঠতে শুরু করেছেন তিনি। সেই বহুবছর আগের উচ্চাভিলাষী, ভয়-ডরহীন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার চোখ চকচক করতে লাগল। চোয়াল কাঁপতে লাগল। তিনি বললেন, তুই যা ইচ্ছা কর। আমি আছি।

.

রুস্তমের লাশ ফেলা হলো ভুবনডাঙা বাজারের প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে জঙ্গলের গা ঘেঁষে নদীতে। জায়গাটা নির্জন, চুপচাপ। সহসা এদিকে কেউ আসে না। বিশেষ করে সন্ধ্যাবেলায় তো নয়ই। লাশের গায়ে ছয় মণ ওজনের ইট বেঁধে নেয়া হয়েছে। তারপর বস্তাবন্দি সেই লাশ ফেলা হলো নদীতে। এছাহাক, মতি মিয়া, দেলু আর কামাল। তারা সকলেই উত্তেজিত, এরপর শুরু হবে তাদের অন্য খেলা। এতদিন অনেক রয়ে সয়ে ছিল ভূঁইয়ারা। কিন্তু এবার আর তা হবে না। এখন থেকে আগ বাড়িয়ে আঘাত হানতে হবে। ভয় ধরাতে হবে প্রতিপক্ষের মনে। তাহলেই তারা জিতবে। কারণ তারা সকলেই জানে, পৃথিবীটা শক্তের ভক্ত, নরমের জম।

ইটবাঁধা বস্তাবন্দি লাশটা জলে ঠেলে ফেলে দিল দেলু আর মতি। কিন্তু কিছুটা পথ জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টেনে আনতে হয়েছে বলে বস্তাটার এখানে সেখানে চিড় দেখা দিয়েছে। সেই বস্তার একপাশটা ছিঁড়েই গেল নদীতে ফেলে দেয়ার সময়। মুহূর্তের জন্য রুস্তমের পা দু খানা বের হয়ে এলো। তবে জলে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝুপ শব্দে তলিয়ে গেল বস্তাটা। যেন বহুদিন পর অন্তত একটা ঝামেলা থেকে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল সবাই। সমস্যা হচ্ছে, কামালের হঠাৎ মনে হলো তারা ছাড়াও আরো কেউ একজন এখানে আছে। সে লোকটাকে দেখতে পায়নি, কোনো শব্দও হয়তো শোনেনি। কিন্তু তারপরও তার ষষ্ঠইন্দ্রীয় যেন তাকে সতর্ক করে দিল যে এখানে তাদের খুব কাছাকাছিই কেউ একজন আছে। খুব কাছাকাছি। সে তাদের খুব সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখছে। বিষয়টা নিঃসন্দেহে বিপজ্জনক। এমন ভয়ানক এক অনুভূতি নিয়ে চলে যাওয়া যায় না। বিষয়টা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হতে হবে। স্পষ্ট বুঝতে হবে, আসলেই কেউ আছে কি না।

এই মুহূর্তে শব্দটা কানে এলো কামালের। যেন একটা মরা ডাল বা পাতায় কারো সাবধানী পায়ের শব্দ। সে নিঃশব্দে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে রইল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে হাত তিরিশেক দূরে ঝোঁপের আড়ালে একটা সতর্ক কম্পন লক্ষ্য করল কামাল। সে চিৎকার করে ডাকল, ‘কে ওইখানে? কে?

৩৩

দিশেহারা পারু হঠাৎই সিদ্ধান্তটা নিল। তাকে পালাতে হবে। যেকোনো মূল্যে এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে তাকে। কিন্তু পালিয়ে যাবে কোথায়? এই প্রশ্নের উত্তর পারু জানে না। তবে অন্ধকারে ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে তুলে নিল সে। তারপর এগিয়ে গেল উত্তর দিকের দেয়ালের দিকে। সেখানে ছোট্ট সরু একখানা দরজা। সন্তপর্ণে দরজাটা খুলল পারু। ঘরের দক্ষিণ দিকের দরজায় তখনো উচ্চস্বরে তর্ক বিতর্ক হচ্ছে তাবারন বিবি আর ফজুর মধ্যে। ফলে তার দরজা খোলার শব্দ কেউ খেয়াল করল না। পারু যতক্ষণে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো, ততক্ষণে ফজু বিকট শব্দে আঘাত করতে শুরু করেছে সামনের দরজায়। তার মানে আরো কিছুটা সময় তার হাতে আছে। কিন্তু এই সময়টুকুর মধ্যে কী করবে পারু? এই অচেনা-অজানা গায়ে সে কোথায় যাবে? কার কাছে যাবে?

এসব কোনো প্রশ্নের উত্তরই তার জানা নেই। সে কেবল জানে, তাকে যেতে হবে। যতদূর অন্ধকার, তার সবটার ভেতর সেঁধিয়ে যেতে হবে তাকে। যেন কেউ আর তাকে খুঁজে না পায়। আঘাত করতে না পারে। কিন্তু এমন অন্ধকার কি কোথাও আছে? পারুর পায়ের নিচে নরম ভেজা মাটি। শেষ রাতের আকাশে ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ। তবে সেই চাঁদের স্নান আলোই যেন খানিক হলেও তার সহায় হয়ে এলো। সে ধানক্ষেতের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া সরু রাস্তা ধরে এগোলো। সামনে কী আছে কে জানে! তবে দূর থেকে দেখে চোখে খানিক ঘন জমাট অন্ধকার অনুভূত হয়েছে তার। সে ওই জমাট অন্ধকারটুকু লক্ষ্য করেই এগোচ্ছে। কে জানে, হয়তো ওখানে খানিক হলেও আড়াল মিলতে পারে। এই রাতে এভাবে হেঁটে খুব একটা বেশি দূর যেতেও পারবে না সে। ফলে যতটা সম্ভব কাছাকাছিই একটা লুকানোর জায়গা খুঁজে বের করতে হবে। অন্তত ভোরের আলো ফোঁটা অবধি নিজেকে লুকিয়ে রাখতে হবে তার। কিন্তু কোথায় লুকাবে?

পারু ধানক্ষেতটা পেরিয়ে সোজা চলে এলো উঁচু বাঁধের মতো জায়গাটাতে। খোলা মাঠ বলে ধান ক্ষেতজুড়ে যে চাঁদের আলোটুকু ছিল, এখানে তা নেই। বরং তাবারন বিবির বাড়ির মতোই ঘন ঝোঁপ-ঝাড় আর গাছ-গাছালি থাকায় জায়গাটা অন্ধকার। পারুর জন্য অবশ্য জায়গাটা ভালো। কিন্তু ফজু যদি সরাসরি এদিকে চলে আসে তবে সে নিজেকে বেশিক্ষণ আড়াল করে রাখতে পারবে না। সামনে আবারও খানিকটা ফাঁকা জায়গা। তারপরই সরু একটা খাল। খালে প্রচণ্ড স্রোত। এখান থেকেও তার বয়ে যাওয়ার কুলকুল শব্দ শুনতে পাচ্ছে পারু। সম্ভবত সামান্য সামনে বাঁদিকে ঘুরে গিয়েই নদীর সঙ্গে মিশেছে। সমস্যা হচ্ছে, ওই খাল কোনোভাবেই তার আশ্রয়স্থল হতে পারবে না। কিংবা ওই ফাঁকা ঘাসের মাঠও না। বরং এই গাছে ঢাকা উঁচু ঢিবিটা যদি খানিক হলেও তাকে আড়াল করে রাখতে পারে! পায়ে লেগে থাকা আঠার মতো কাদা ছাড়াতে গিয়ে হঠাই দুশ্চিন্তাটা উঁকি দিল পারুর মাথায়। ফজু তো চাইলে খুব সহজেই তাকে ধরে ফেলতে পারবে। কারণ, এই যে এতটুকু পথ সে হেঁটে এসেছে, এর প্রতিটি পদক্ষেপে তার পায়ের চিহ্ন পড়ে আছে। সেই চিহ্ন অনুসরণ করে ফজু ঠিক-ঠিক এখানে চলে আসবে। তাহলে?

ঝট করে উঠে দাঁড়াল সে। কী করবে এখন? কোথায় যাবে? আশপাশে ওই স্রোতস্বিনী প্রস্রবণটুকু ছাড়া আর কোথাও যাওয়ার নেই তার। সে কি তবে খালটা পার হওয়ার চেষ্টা করবে? কিন্তু সেটিতো সম্ভব নয়। তার শরীরের যা অবস্থা, তাতে এরই মধ্যে কাহিল হয়ে পড়েছে সে। কোলের মেয়েকে নিয়ে হাঁটতেও কষ্ট হচ্ছে। তারপরও খানিক মরিয়া হয়েই খালটার দিকে এগিয়ে গেল পারু। খালের দু ধারেই ঘন কাশবন। তবে সেই কাশবনের কাছে এসেই থমকে দাঁড়াতে হলো তাকে। একখানা ছোটো নৌকা বাঁধা ঘাটে। চাঁদের মান আলোতেও নৌকার অবয়বটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। খালের তীব্র স্রোতের টানে তীর থেকে বেশ খানিকটা দূরে সরে হগেছে। তবে গাছে বাধা দড়ি ধরে টানলেই আবার তীরে নিয়ে আসা যায়। ভেজা মাটিতে পায়ের ছাপ এড়িয়ে পালাতে হলে এই নৌকাই হতে পারে একমাত্র উপায়। সমস্যা হচ্ছে পারু নৌকা বাইতে জানে না। এবং এই অবস্থায় সেটি সম্ভবও নয়। তা ছাড়া এমন যদি হয় যে এটি ফজুদেরই নৌকা? তারা এটিতে চড়েই এখানে এসেছিল? তাহলে এখানে তাকে না পেয়ে প্রথমে নৌকাটাই খুঁজবে তারা। আর তাতে তার ধরা পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়ে যাবে সবচেয়ে বেশি। কিন্তু এ ছাড়া আর কী ই বা করবে সে?

ঠিক তখুনি ভাবনাটা মাথায় এলো পারুর। একটা কাজ অন্তত সে করতে পারে। এতে সামান্য হলেও সম্ভাবনা থাকবে বেঁচে থাকার। যদিও কাজটা বিপজ্জনক এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এর চেয়ে ভালো আর কোনো উপায় তার জানা নেই। সে একহাতে গাছের শরীর থেকে নৌকার বাঁধনটা খুলে দিল। তারপর দড়িটা ছুঁড়ে মারল দূরে পানিতে ভেসে থাকা নৌকার ওপর। বাঁধন মুক্ত হতেই স্রোতের টানে নদীর দিকে ছুটতে শুরু করল নৌকাটা। পারু গোড়ালি অবধি খালের পানিতে নেমে গেল। তারপর পানির ভেতর দিয়েই খালের তীর ধরে স্রোতের বিপরীত দিকে হাঁটতে শুরু করল। এভাবেই যতটা সম্ভব দূরে চলে যেতে চায় সে। এতে মাটিতে আর পায়ের ছাপ থাকবে না। ফজুরা আসার আগেই হয়তো কিছুটা দূরে চলেও যেতে পারবে।

নৌকাটাও অবশ্য ততক্ষণে স্রোতের টানে দৃষ্টির আড়ালে চলে যাবে। ফজুরা যদি তার পায়ের ছাপ অনুসরণ করে এখানে এসেও থাকে, তবে দেখবে যে পারু এখানে নেই। নেই নৌকাটাও। এমনকি খালের পাড়ের ভেজা মাটি অবধি এসে আচমকা তার পায়ের ছাপও উধাও হয়ে গেছে। তার মানে পারু ওই নৌকা করেই কোথাও পালিয়েছে! তখন নিশ্চয়ই স্রোত লক্ষ করে নদীর দিকে ছুটে যাবে ফজুরা। কারণ এই স্রোতের বিপরীতে কেউ নৌকা বাইতে চাইবে না। পারুর পক্ষে সেটি সম্ভবও নয়। ফলে তারা খুব সহজেই ছুটে যাবে স্রোতের অনুকূলে নদীর দিকে।

এসব ভেবেই পারু হাঁটতে লাগল স্রোতের উল্টো দিকে। খুব বেশি দূর অবশ্য যেতে পারল না সে। তার আগেই কয়েকজন লোকের চাপা কথাবার্তা আর দ্রুত পদক্ষেপের শব্দ শুনতে পেল সে। সঙ্গে টর্চের আলো। পারু ঝট করে কাশবনের আড়ালে বসে পড়ল। তার পায়ের নিচে পানি। সামনে ঘন কাশবন। কোলে শিশু সন্তান। মেঘলা আকাশে শেষ রাতের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ। সামনে ভয়ানক হিংস্র একদল মানুষ। যারা তাকে পাওয়া মাত্রই ছিঁড়েখুড়ে খাবে। টুকরো টুকরো করে ভাসিয়ে দেবে সামনের ওই নদীর জলে। তারপর তার সন্তানটিকে পিষে মারবে হাতের তালুতে।

এসব থেকে পারুকে কে রক্ষা করবে? তার ওই বুদ্ধি কিংবা কৌশলটা কি আসলেই কাজে লাগবে? কিন্তু এমন যদি হয় যে তার মেয়েটা আচমকা কেঁদে ফেলে? কিংবা কোনোভাবে পারুর কৌশলটা বুঝে যায় তারা? তখন কী করবে সে? পারু প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল। তারপরের সময়টুকু যেতে লাগল খুব ধীরে। রুদ্ধশ্বাস আতঙ্ক আর উত্তেজনায়। তবে শেষ অবধি বিভ্রান্ত হলো লোকগুলো। ফজু আর তার সঙ্গীদের উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল।

মাগি তো দেখি একটা আস্তা হারামজাদি। দেইখ্যাতো এরম মনে হয় না। মনে হয় লতার মতন নরম।

‘একদম ঠিক কইছস। যেন কিচ্ছু বোঝে না। আসলে তো সেয়ানা মাল।

হুম। কিন্তু এহন তো তোরা বুঝছস, আস্ত জাত সাপের বাচ্চা সে! কথায় আছে না, ছোটো সাপের বড় বিষ? এই মাইয়া হইলো সেই কিসিমের।’ সঙ্গীদের কথার উত্তরে বলল ফজু। কত বড় হারামি, নাও লইয়া ভাগছে। কিন্তু কোলে পোলা নিয়াতো নাও বাইতে পারব না। তাইলে আর কী? গাঙ্গের দিকেই গেছে। ওইদিকেই তো স্রোত। তাড়াতাড়ি চল। বেশি দূরে চইলা গেলে কিন্তু আবার ঝামেলা। আজানের সময়ও মনে হয় হইয়া আসছে।

ফজুর কথা শেষ হওয়ার আগেই লোকগুলো ছুটতে শুরু করল। ধীরে ধীরে চলে যেতে থাকল পারুর দৃষ্টি থেকে দূরে। মুহূর্তের জন্য হলেও নিজেকে খানিক নির্ভার, নিশ্চিন্ত মনে হলো পারুর। কিন্তু সে জানে, কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকগুলো আবার ফিরে আসবে। আর তখন তাদের ক্রোধ হবে সবচেয়ে বেশি। জগতে কোনো মানুষই হারতে পছন্দ করে না। আর বেশির ভাগ মানুষই হেরে গেলে সেটি মেনে নেয়ার পরিবর্তে বরং হয়ে ওঠে প্রতিশোধপরায়ণ, জিঘাংসু। পারুও সেটি জানে। ফলে সে উঠে দাঁড়াল। যেকোনো ভাবেই হোক এখান থেকে দূরে সরে যেতে হবে তাকে। কিন্তু তাবারন বিবির বাড়ি তো আর যেতে পারবে না সে। তাহলে কোথায় যাবে?

.

এই মুহূর্তে ফজরের আজান শুরু হলো। কাছেই কোথাও মসজিদ রয়েছে। সেই মসজিদ থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসছে। পারু খানিক কী ভাবল। তারপর ছুটতে শুরু করল আজানের শব্দ লক্ষ করে। সে মসজিদের কাছে পৌঁছে যেতে চায়। অন্তত সেখানে সে কিছুটা হলেও নিরাপদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই মসজিদে নামাজ পড়তে আসতে শুরু করবে মুসল্লিরা। লোকজনে ভরে উঠবে মসজিদের প্রাঙ্গণ। সেখানে সে এক কোণে চুপচাপ বসে থাকবে। নিশ্চয়ই অত মানুষের সামনে থেকে কেউ তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না।

পারু যতক্ষণে মসজিদের সামনে পৌঁছাল, ততক্ষণে ভোরের আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। পূর্বদিগন্তে দেখা দিতে শুরু করেছে আলোর আভা। সেই আভায় শুরু হতে যাচ্ছে নতুন দিন। কিন্তু পারুর জীবনে কি তা সত্যি সত্যি নতুন আসবে?

.

মসজিদের সামনে বড় ফাঁকা জায়গা। সেখানে কয়েকজন ভিখারিকে বসে থাকতে দেখা গেল। মুসল্লিরা নামাজ শেষে বেরিয়ে আসার সময় তাদের খুচরো টাকা পয়সাসহ এটা-সেটা দান করে থাকেন। আজও করবেন। ভিখারিদের মধ্যে ঘোমটায় মুখ ঢাকা কয়েকজন নারীও রয়েছে। পারু তাদের পাশে গিয়ে বসল। যদিও তার বসার জায়গাটা খানিক আড়ালে। গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকা দুটো বড় জারুল গাছের মাঝখানে হেলান দিয়ে বসে পড়ল সে। তারপর কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল তা সে নিজেই জানে না। কিংবা সংজ্ঞাহীনের মতো হয়ে রইল। তবে এর মধ্যেও কয়েকবার মেয়েটাকে স্তন পান করাল সে। তখন কটা বাজে পারু জানে না। বাইরে ঝাঁঝালো রোদ। সেই রোদে তার চোখ জ্বালা করছে। তারপরও যেন চোখ মেলে তাকাতে পারছে না। বরং কী সব আজেবাজে স্বপ্ন দেখছে। পারু অবশ্য জানে না, এটা স্বপ্ন না সত্যি।

মসজিদের সামনে অসংখ্য মানুষ। তাদের সবার পরনেই পাজামা-পাঞ্জাবি। কেবল একজন মানুষের পরনে ধুতি-পাঞ্জাবি। মানুষটাকে দেখে সে চমকে গেল। দূর থেকে কেমন চেনা চেনা লাগছে তাকে। কে লোকটা?

ভিড়ের মধ্যে কাকে যেন খুঁজছেন তিনি! অস্থির ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছেন। একবার কি এদিকে ফিরে তাকাবেন? পারুকে চমকে দিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে তাকালেন মানুষটা। কিন্তু পারু দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও তাকে চিনতে পারল না সে। তাহলে এত চেনা চেনা কেন লাগছে? পারু নিৰ্ণিমেষ ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল। তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা সোজা হেঁটে আসতে লাগলেন তার দিকে। তারপর তার সামনে এসে দাঁড়ালেন। পারুর এখনো কিছুই মনে পড়ছে না। কিন্তু ভীষণ চেনা আর আপন মনে হচ্ছে। যেন এই মানুষটার সঙ্গে তার জনম-জনমের পরিচয়। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে মানুষটা তাকে ডাকলেন, ‘পারুল… পারুল…।’

পারু তার ডাকে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মানুষটা আবার তাকে ডাকলেন, আবার। বারবার। প্রতিবারই পারু উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল। মানুষটার ডাকে সাড়া দেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার কেবল মনে হলো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি তার হাত, পা, মুখ, জিহ্বা বেঁধে রেখেছে। এর থেকে সে মুক্ত হতে পারছে না। এই মুহূর্তে মানুষটা তার কাঁধ ধরে আলতো ধাক্কা দিল। পর পর বেশ কয়েকবার। তারপর বলল, পারুল… ও পারুল। পারুল…।’

পারু চোখ মেলে তাকাল। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাবারন বিবি। তাবারন বিবির সঙ্গে সালমা আর রবিউলও। তবে আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, তাদের পেছনে আরো একজন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটাকে পারু চেনে। কিন্তু চট করে চোখ খুলে কিছুই মনে করতে পারছে না সে। কে মানুষটা? এত চেনা, অথচ কিছুতেই মনে করতে পারছে না!

মানুষটা ধীর পায়ে তার কাছে এগিয়ে এলো। তারপর বলল, পারু, আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি?”

‘আমাকে?’ পারু ঘোরগ্রস্ত মানুষের মতো কথাটা বলল। কোথায়?

‘তোমার বাবার কাছে।

কার কাছে?’ যেন কথাটা ঠিকঠাক শোনেনি পারু। কিংবা বুঝতে পারেনি।

‘তোমার বাবা।

‘আমার বাবা?

হুম।

‘আমার বাবা কে?’ পারুর মনে হলো সে কিছুই বুঝতে পারছে না। একটা কুয়াশা তার চিন্তা ও চোখের সামনে চাদরের মতো ঝুলে আছে। সেই চাদর ডিঙিয়ে সে কিছুই স্পষ্ট দেখতে কিংবা বুঝতে পারছে না।

‘তোমার বাবা কে? মানুষটা উল্টো প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন পারুকে। তবে তার মুখে মৃদু হাসি। এই মানুষটিকে কোথাও দেখেছিল সে। কিন্তু কোথায়, তা মনে করতে পারছে না।

হুম। অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বলল পারু।

‘তোমার বাবা মহিতোষ মাস্টার। মহিতোষ চন্দ্র রায়।

পারুর আচমকা মনে হলো তার শরীর বেয়ে মুহূর্মুহূ বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে। পায়ের তালু থেকে মাথার চুল অবধি ঝিম ধরে গেছে। সে যা শুনছে, তাকি সত্যি? নাকি স্বপ্ন? সে ফ্যালফেলে চোখে চারপাশে তাকাল। মানুষটা তার বাবার নাম জানে! তাকে তার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলছে। কিন্তু কীভাবে!

ওই তো তাবারন বিবি, সালমা, রবিউল। সে আজ খুব ভোরে, প্রায় অন্ধকারে ভয়ানক এক পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে পালিয়ে এসেছিল এখানে। তারপর কী হয়েছিল? খিদেয়, ভয়ে, ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল সে? তাহলে এখন যা হচ্ছে তার সবই স্বপ্ন? কিন্তু যে মানুষটা তার সঙ্গে কথা বলছে, তাকে এত চেনা চেনা লাগছে কেন? কোথায় যেন দেখেছে সে তাকে? কোথায়?

পারুর আচমকা মনে হলো, মানুষটাকে সে চিনতে পেরেছে। মাত্র দুদিন আগেই মানুষটার সঙ্গে তার শেষ দেখা হয়েছিল। এত অল্প সময়ে সে কী করে ভুলে গেল! পারুর খুব লজ্জা লাগতে লাগল। তাকে কী ভয়ানক বিপদ থেকেই না রক্ষা করেছিলেন মানুষটা। অথচ সে কি না দিব্যি ভুলে গেছে? তাও মাত্র কয়েক দিনেই? বিব্রত, বিচলিত পারু লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, আপনি তরু ম্যাডাম। ডাক্তার তরু ম্যাডাম!

তরু কথা বলল না। হাসল। তার সেই হাসিজুড়ে নির্ভরতা, আনন্দ, আশ্রয়, আহ্বান। কিন্তু পারু সেসব লক্ষ করল কি না বোঝা গেল না। তার মাথায় তখন কাজ করছে ওই একটি কথাই। তরু তাকে কীভাবে তার বাবার কাছে নিয়ে যাবে? মহিতোষ মাস্টারের কাছে! তাকে কীভাবে চেনে সে?

তরু বলল, যাবে না বাবার কাছে?

বাবার কাছে?’ পারু ঘোরগ্রস্ত ভঙ্গিতে পুনরাবৃত্তি করল।

হুম। বাবার কাছে। তোমার বাবা… মহিতোষ স্যারের কাছে।

‘আমার বাবার কাছে?

হুম।

বাবা?

হুম। বাবা।

পারু কিছুই বুঝতে পারছে না। তার মাথা কাজ করছে না। সে কি আবারও স্বপ্ন দেখছে? এই স্বপ্ন কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে যাবে? সে জেগে উঠবে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে? পারু বিড়বিড় করে বলল, বাবা কোথায়? আমার বাবা… কোথায়?

‘আমার কাছে। মৃদু কণ্ঠে বলল তরু।

‘আপনার কাছে?

হুম। কই? আপনার কাছে তো বাবা নেই।’

‘আছেন।’

পারু এদিক-সেদিক তাকাল। কিন্তু কোথাও তার বাবাকে দেখতে পেল না। তার ভীতি, দিশেহারা দৃষ্টি। তরু বলল, তুমি আমার সঙ্গে চলো। গেলেই বাবাকে দেখতে পাবে। বাবা তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন।

পারুর কিছুই ভালো লাগছে না। তার চারপাশের জীবন ও জগত সবকিছুই কেমন অশরীরী, বায়বীয় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে, এই যে মানুষ, এই যে আকাশ, বৃক্ষ, পাখি, এমনকি এই যে সে, এর সবই স্বপ্ন। অলীক। খানিক বাদেই সব আবার মিলিয়ে যাবে শূন্যে। সে জেগে দেখবে ভয়ানক কোনো দুঃস্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে সে। এই জীবনে সেই দুঃস্বপ্ন থেকে তার আর মুক্তি নেই।

তরু বলল, কই? চলো?

পারু উঠে দাঁড়াল। সে জানে, এসবই মিথ্যে। এসবই কল্পনা। সে কোনো স্বপ্ন দেখছে। খানিক বাদেই এই স্বপ্ন ভেঙে যাবে। তার সঙ্গে ওই স্বপ্ন ছাড়া আর কোথাও কখনো বাবার দেখা হবে না। দেখা হবে না মা, চারু, ঠাকুমা কিংবা ফরিদের সঙ্গেও না।

তারপরও সে হাঁটতে লাগল। স্বপ্নহীন এক মানুষ হেঁটে যেতে লাগল স্বপ্নের পথে। বাস্তব পৃথিবীতে এক অবাস্তব, অতনু, অনঙ্গ মানুষ।

৩৪

ফরিদ লাফিয়ে কাটা গাছের গুঁড়িটা ডিঙাল। কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ। সেখানে ছোট্ট খাদের মতো জায়গাটাতে বৃষ্টির জল জমে কেমন কুয়োর মতো হয়ে আছে। সে পড়ল গিয়ে সেখানে। ছলাৎ শব্দে জল ছিটকে উঠল চারদিকে। পেছনের কণ্ঠটা ততক্ষণে আরো উচ্চকিত হয়েছে। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে আরো কিছু গলা। তারা সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, কেডা ওইখানে? কেডা?

ফরিদ উঠে আবার ছুটল। তার বুক ধুকপুক করছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে যেকোনো সময় পা জোড়া অসাড় হয়ে যাবে। আর সে আছড়ে পড়বে মাটিতে। তেমন অবশ্য হলো না। তবে ক্রমশই ঘনিভূত হয়ে আসা অন্ধকারে ঘাসে ঢাকা এবড়োখেবড়ো জমিতে সে মুহূর্মুহূ হোঁচট খেতে লাগল। তার পা কেটে রক্তাক্ত হতে লাগল। ফরিদ অবশ্য থামল না। সে ছুটতে লাগল আরো দ্রুত। কিন্তু পেছন থেকে ভেসে আসা চিৎকার ক্রমশই তাকে ভীত, আতঙ্কিত করে তুলল। এমন ঘাসের উঁচু-নিচু জমিতে দৌড়ে তার অভ্যাস নেই। অভ্যাস নেই ধেয়ে আসা মৃত্যুকে পিছু ফেলে এভাবে ছুটে পালানোরও।

ফলে ধীরে ধীরে সে শ্লথ হতে থাকে। তার শরীর ক্লান্ত হতে থাকে। তীব্র ভয় গেড়ে বসতে থাকে মনে। সে বারবার পেছন ফিরে তাকায়। কতগুলো দ্রুত পদক্ষেপের শব্দ তার কানে বাজতে থাকে। মানুষগুলো ছুটে আসছে হাওয়ার বেগে। যেকোনো সময় তারা তাকে ধরে ফেলবে। তারপর জবাই করে লাশ ডুবিয়ে দেবে বর্ষার এই ভরভরন্ত ভুবনডাঙার জলে।

কথাটা ভাবতেই অসাঢ় বোধ করতে থাকে ফরিদ। অনভ্যস্ত শরীর ক্রমশই নিস্তেজ মনে হয়। আর পেছনের পাগুলো ছুটে আসতে থাকে তীব্র গতিতে। যেন একেকটি পদক্ষেপে তারা ফরিদের চেয়ে কয়েকগুন বেশি পথ পেরোয়। ফরিদ। বুঝতে পারে, সে আর কিছুতেই মাঝখানের এই দূরত্বটুকু ধরে রাখতে পারবে না। ভাগ্য কি তবে পারুর মতোই তার মৃত্যুও নির্ধারিত করে রেখেছে অতল জলের গভীরে? তাদের কি তবে সেখানেই আবার দেখা হবে!

কথাটা ভাবতেই ফরিদের বুকের ভেতরটা অকস্মাৎ শূন্য হয়ে গেল। তা ভয়ে ভাবনায়, ফরিদ জানে না। তবে ওই শূন্যতাটুকুই যেন তাকে আরো বিবশ করে ফেলল। পাথরের মতো ভার হয়ে আসতে লাগল শরীর। সে কি তবে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করবে? লোকগুলোর কাছে বলবে যে সে কিছু দেখেনি। কিছু জানে না। কিংবা জানলেও কাউকে কিছু বলবে না? কিন্তু তার কথায় তারা কেন বিশ্বাস করবে?

মানুষগুলোকে চেনে সে। অন্তত এছাহাক আর মতি মিয়াকে তো সে খুব ভালো করেই চেনে। তারা মানুষ হিসেবে কেমন, তাও জানে! সুতরাং সে বললেই যে তারা বিশ্বাস করে ফেলবে, বিষয়টা এমন নয়। বরং যেকোনোভাবেই হোক তাকে এখানে খুন করে চিরতরে বিলীন করে দিয়ে যাবে তারা। এত বড় অপরাধের এমন জ্বলজ্যান্ত প্রমাণ কিছুতেই রাখবে না।

পায়ের শব্দগুলো খুব কাছে চলে এসেছে। মৃত্যু ভয় যে এত ভয়ংকর তা আগে কখনো টের পায়নি সে। কিন্তু এই ভয়ানক মৃত্যুর মুহূর্তেও পারুর কথা মনে হতে থাকে তার। আচ্ছা, মৃত্যুর ঠিক আগের মুহূর্তে কী করেছিল পারু? নিশ্চয়ই তাকে খুঁজেছিল? তার কথা মনে করেছিল?

ফরিদের হঠাৎ মনে হয়, এই বেঁচে থাকার চেষ্টাটা আর করবে না সে। যা হয় হোক, সে লোকগুলোর হাতে ধরা দেবে। যে অর্ধেক জীবন নিয়ে সে বেঁচে আছে, তার চেয়ে মৃত্যু বরং শ্রেয়। অন্ধকারে ছুটন্ত ফরিদ আচমকা থেমে যাওয়ার চেষ্টা করল। পেছনের শব্দগুলো ততক্ষণে আরো কাছে চলে এসেছে। আর ঠিক তখুনি কিছু একটাতে হোঁচট খেলো সে। সম্ভবত উঁচু কোনো মাটির ঢিবি। কিংবা উপড়ে পড়া গাছ। অন্ধকারে ঠিকঠাক ঠাহর করতে পারল না ফরিদ। তবে তার ওই ছুটন্ত পা জোড়া যেন নিমিষেই ছিটকে গেল শূন্যে। তারপর তার শরীরটাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল আরো অন্ধকারে। সেখানে কী ছিল সে জানে না। তবে ঝপাৎ শব্দে যখন ওই অন্ধকারে অতল জলের স্পর্শ পেল, তখন বুঝল তার স্থান হয়েছে নদীতে। আর ঠিক তখুনি পেছনের পায়ের শব্দগুলোও থেমে গেল।

ফরিদ সাঁতার জানে। তলিয়ে যেতে যেতেই আবার জলের ওপর ভেসে উঠল সে। তার পায়ের নিচে মাটির আভাসও পাওয়া যাচ্ছে। সে আঙুলে ভর দিয়ে জলের ওপর মুখ বের করে হা করে বাতাস টেনে নিল। তারপর যেন খানিক ধাতস্থও হলো। এই সময়ে কণ্ঠস্বরটা শুনতে পেল সে। তবে অন্ধকারে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না মানুষটা কে?

’আপনে দেখছেন লোকটা কে?

না। চেহারা তো দেখি নাই। হঠাৎ শব্দ হলো। তারপর ঝোঁপটা নড়ে উঠতেই দেখি কেউ একজন সেখান থেকে সরে যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে আমি ডাক দিলাম। লোকটা দিল দৌড়।

‘কেডা হইতে পারে?

‘কেডা হইতে পারে, সেই চিন্তা বাদ দিয়া এখন চিন্তা করো সে গেল কই? শব্দ শুইনা তো মনে হইল পানির মধ্যে পড়ছে।

‘এটা হলে তো সমস্যা।

‘কেন? কীসের সমস্যা? আমরা চাইরজন। সে পানিতে পইড়াই যাইব কই?

আরে মতি মিয়া। গাধার মতো কথা বললে হবে? এই অন্ধকারে চারজন হও আর দশজন হও, একজন মানুষরে নদী থেকে ধরা অত সহজ না।

কথাটা এতক্ষণে ফরিদও বুঝতে পেরেছে। খানিক আগে যে মৃত্যুকে সে প্রায় মেনেই নিয়েছিল, পরিস্থিতি বদলে যেতেই নতুন করে যেন আবার বাঁচার আশা তাকে উদ্দীপ্ত করে তুলল। সে নিজেও জানে, ডাঙায় বসে তাকে ধরা যত সহজ ছিল, এই অন্ধকারে নদী থেকে ধরা তাকে ততটাই কঠিন। তা ছাড়া লোকগুলোর কথা শুনে সে যতটুকু বুঝেছে, তাদের কাছে আলো নেই। ফলে ফরিদকে খুঁজতে হবে অন্ধকারে অনুমানের ভিত্তিতে। সুতরাং সে যদি শব্দ এড়িয়ে তাদের থেকে দূরে সরে যেতে পারে, তাহলেই আর ভয় নেই। কথাটা ভাবতেই যেন খানিক আগে হারিয়ে ফেলা সাহস ও শক্তিটাকে আবার ফিরে পেল সে। আত্মবিশ্বাসও। কিন্তু বোকার মতো এতটা পথ ছুটবার সময়ও কেন যে একবারের জন্যও নদীতে নেমে পড়ার কথা মনে পড়েনি, ভেবে ভারি অবাক হলো সে। বরং এখন মনে হচ্ছে, ভাগ্য অভাবিতভাবে এসে তাকে সহায়তা করেছে। আচ্ছা, এমনও কি হতে পারে যে পারুকেও ভাগ্য এমন কোনো উপায়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে? হতে পারে এমন?

‘পানিতে কে নামবে?’ কণ্ঠস্বরটা আবার ভেসে এলো।

মতি আর দেলু নামুক। এছাহাকের কণ্ঠটা চিনতে এবার আর ভুল হলো না ফরিদের। কিন্তু খানিক শহুরে ভারি গলাটাও তার কেমন চেনা চেনা লাগতে লাগল। লোকটা বলল, “খালি ওরা দুজন কেন এছাহাক ভাই। আপনেও নামবেন। আমি তো ভালো সাঁতার জানি না। জানলে আমিও নামতাম।’

আমার একটু ঠাণ্ডার সমস্যা আছে ভাই। আমি নামতে পারব না। ওরা নামুক।

এবার রেগে গেল কামাল। বলল, এইটা ফাজলামি করার জায়গা না এছাহাক ভাই। এইটা কতটা মারাত্মক ব্যাপার আপনে বুঝতেছেন না? আপনের ঠাণ্ডা বড়, নাফাঁসির দড়ি বড়? বুঝতেছেন কিছু?

এছাহাক আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই কামালের উত্তেজিত চিৎকার শোনা গেল, একদম চুপ। একদম চুপ।

এছাহাক তারপরও পানিতে নামতে চাইল না। সত্যি সত্যিই তার শরীরটা খারাপ। তা ছাড়া এখানে তারা যে চারজন রয়েছে, তার মধ্যে সে-ই বয়সে সবচেয়ে বড়। তার শরীরটাও বেশ ভঙ্গুর। এই শরীর নিয়ে কোনোভাবেই তাকে এখানে নামতে বলা সমীচীন কিছু নয়। কথাটা সে বলল, আমার বয়স হইছে কামাল ভাই। এই রাইতে এমন ঠাণ্ডা পানিতে আমার নামা ঠিক হইব না। আর নামলে লাভও নাই। আমি তো আর বয়সে জোয়ান না যে লাফাইয়া-ঝাপাইয়া কাউরে ধরতে পারব। তার চাইতে আপনে…।’

কথা শেষ করতে পারল না এছাহাক। তার আগেই সপাটে এছাহাকের গালে চড় বসাল কামাল। শীর্ণ এছাহাক ছিটকে পড়ল মাটিতে। তবে সেদিকে ফিরেও তাকাল না কামাল। সে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে বলল, আমার মাথা কিন্তু গরম আছে এছাহাক মিয়া। যা বলছি, তার ওপরে আর কোনো কথা হবে না। স্ট্রেট নদীতে। যান, এক্ষণ যান। আপনে সবার আগে যাইবেন। যান।’

এরপর আর কোনো উচ্চবাচ্য হলো না। এছাহাক চুপচাপ পানিতে নেমে গেল। তবে ফরিদ বুঝল এই নদী থেকে তাকে ধরে নেয়া আর সহজসাধ্য কোনো কাজ নয়। এমনকি সে বড় ধরনের কোনো ভুল না করলে এই তিনজন কেন, আরো লোকজন এলেও তাকে ধরতে পারবে না। তবে সাবধানে দূরে সরে যেতে হবে তাকে। মুহূর্তের জন্যও অসতর্ক হওয়া যাবে না।

সে টুপ করে ডুব দিল। আর ঠিক তখুনি মনে হলো তার পায়ে খানিক আগের সেই বস্তাবন্দি লাশটা এসে ঠেকল। কিংবা অন্ধকার জলের গভীরে তার পা টেনে ধরল। ভয়ে ফরিদের শরীর আবার জড়সড় হয়ে গেল। একটা তীব্র আতঙ্ক ক্রমশই ঘিরে ধরতে লাগল তাকে। যেন তার খুব কাছে, এই জলে ভেসে কিংবা ডুবে তার সঙ্গে সঙ্গেই চলছে ওই লাশটা। ভাবতেই গা হিম হয়ে এলো ফরিদের। তবে সে হাল ছেড়ে দিল না।

নিঃশব্দে পানির নিচ দিয়ে সাঁতার কেটে চলে গেল বেশ খানিকটা দূরে। ছোটবেলা নদীর ধারে বেড়ে উঠেছে সে। ফলে এমন অসংখ্য অভিজ্ঞতা তার রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার বলেই ধীরে ধীরে ডুব-সাঁতারে এছাহাকদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকল সে। যতক্ষণ না অবধি নিজেকে পুরোপুরি নিরাপদ মনে হলো, ততক্ষণ অবধি চলতেই থাকল ফরিদ। পিছে ফেলে এলো এছাহাকদের। কেবল ওই বস্তাবন্দি লাশের ভয়টাকেই পিছে ফেলতে পারল না।

ফরিদ বাড়ি ফিরল গভীর রাতে। আছমা তখনো জেগে। সে ফরিদকে দেখে আঁতকে উঠল। ফরিদের চোখ লাল। গা ভেজা। হাতে-পায়ে কাদা। ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে পরনের পোশাক। হাঁটু, পায়ের গোড়ালি থেকে রক্ত ঝরছে। চোখে-মুখে কেমন সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। সে ছুটে এসে ফরিদকে ধরল। তারপর বলল, আপনের কী হইছে? কী হইছে আপনের?

ফরিদ জবাব দিল না। সে ঠাণ্ডায় কাঁপছে। তার চোখে ভাসছে বস্তাবন্দি লাশের সেই পা জোড়া। কী বিভৎস সেই দৃশ্য! আচ্ছা, এছাহাক আর মতি মিয়া তো তার চেনা, এ গাঁয়েরই মানুষ। সেই মানুষগুলো কী করে একজন মানুষকে খুন করল? কাকে খুন করেছে তারা? নিশ্চয়ই সে-ও এ গাঁয়েরই মানুষ। তার পরিচিত কেউই। বিষয়টা মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না সে। এতক্ষণ নিজের জীবন বাঁচানোর তাগিদে পাগলের মতো ছুটেছে। কিন্তু এখন যতই নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে, ততই ওই তীব্র ভয়টা যেন আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। আছমা বলল, কী হইছে আপনের? কন না কেন?

ফরিদ বিড়বিড় করে বলল, আমারে একটা কথা দে। আমি ঘুমাব। একটা কাঁথা দে আমারে। আমার শীত লাগে। শীত।

আছমা তার গা মুছিয়ে পোশাক পাল্টে দিল। সেই রাতে কিছুই খেলো না ফরিদ। তাকে মোটা কাঁথায় জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হলো। কিন্তু ঘুমের মধ্যেই বারবার কেঁপে উঠতে লাগল সে। তার ঘুম ভাঙল পরদিন দুপুরে। ওহাব ডাক্তার এসে বললেন, কী হইছে তোর?

ফরিদ জবাব দিল না। তার চোখে ভাসছে বস্তাবন্দি লাশের বের হয়ে আসা পা। সেই পা কিছুতেই সে তার চোখ থেকে আড়াল করতে পারছে না। ওহাব ডাক্তার বললেন, কী হইলো, তুই কথা বলস না কেন?

ফরিদ তাও কথা বলল না। গতকালের ঘটনা সে কাউকে বলতে চায় না। সে চায় না তার কারণে এরা আরো কোনো বিপদে পড়ক। তারচেয়ে যতটা সম্ভব বিষয়টা চেপেই রাখবে সে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, লোকগুলো কি তাকে চিনতে পেরেছে? যদি চিনে থাকে, তাহলে তার সামনে ভয়ানক বিপদ। সে যেখানেই থাকুক না কেন লোকগুলো তাকে খুঁজে বের করবেই। তারপর খুন করবে। এর অন্যথা কখনো হবে না। ফরিদ ঝিম ধরে বসে রইল। বাড়ি থেকে বের হলো না। কোথাও গেল না। তবে তার হঠাৎ মনে হলো, ওই অন্ধকারে তাকে কারো চেনার কথা না। আর চিনলে সেটি তাদের কথা শুনেই বোঝা যেত। কিন্তু সেরকম কিছুই তখন মনে হয়নি। তার মানে সে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। কিন্তু ফরিদ নিশ্চিন্ত থাকতে পারল না। তার চোখের সামনে অবিরাম ভেসে বেড়াতে লাগল ওই নিথর পা জোড়া। আচ্ছা, বস্তার ভেতর যে মানুষটা ছিল, কে সে? নিশ্চয়ই তাকে ফরিদ চেনে। হয়তো এই গাঁয়েরই কোনো মানুষ সে। কিন্তু তাকে কেন খুন করল এছাহাক, মতি মিয়ারা? কার লাশ ছিল ওটা?

.

গাঁয়ে পুলিশ এলো তার দিন কয়েক পরে। রুস্তমের খোঁজে পুলিশ এসেছে শুনে সবার আগে এগিয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। পুলিশ অফিসারের নাম কাইয়ুম হোসেন। তিনি বললেন, আপনি তো এই গাঁয়ের মাথা। সব বিষয়ে আপনার খোঁজখবর আছে। তা একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষ আপনার গ্রাম থেকে উধাও হয়ে গেল। অথচ আপনি থানা-পুলিশ কিছু করলেন না?

সুযোগটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নিলেন। তিনি বললেন, আপনের ঘরের কেউ যদি হারাই যায়, আর সেই সংবাদ যদি আপনে চাপা দিয়া রাখেন। তাইলে কি বাইরের মানুষের সাধ্য আছে তা জানার?

মানে?’

মানে আপনেরে খবর দিছে কে?

‘আশরাফ খাঁ।

তিনি কেন খবর দিছেন?

কারণ রুস্তম তার হয়ে কাজ করত।

 তার মানে সে তার লোক, তাই না?

হুম।

“তাইলে? যার লোক আজ প্রায় মাস দেড়েকের বেশি নিখোঁজ, সে কেন সেই খবর চাইপা রাখল? এই খবর সে আরো আগে জানাইব না? ঘটনা একটু চিন্তা ভাবনা করেন। তার তো সঙ্গে সঙ্গেই থানা পুলিশ করার উচিত ছিল। কি ছিল কি না? আপনেই বলেন ওসি সাব?

ওসি কাইয়ুম হোসেন এই কথায় চুপ করে গেলেন। তারপর বললেন, উনি বিষয়টা বোঝেন নাই। নিজেই খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করছিলেন প্রথমে।

‘এইটাও ডাহা মিথ্যা কথা। উনি কোনো খোঁজখবর নেওয়ার চেষ্টা করেন নাই। সেইটা হইলে আমরা জানতাম। এই যে গাঁয়ের মানুষ আপনের চারপাশে। তাদের একটু জিজ্ঞেস করেন তো, আসলেই উনি এদের কারো কাছে রুস্তমের ব্যাপারে কোনো খোঁজখবর করছেনি? এমনকি আমরা কেউ কিছু জানতাম না। জানছি ঘটনার বহুদিন পর। ততদিনে তো সে পুলিশেই খবর দিছে। এখন আপনেই বিবেচনা কইরা বলেন, ঘটনা সোজা, না বাকা?’

কাইয়ুম হোসেন আশপাশে লোকজনের কাছেও নানা কিছু জিজ্ঞেস করলেন। সকলেই বললেন রুস্তমকে তারা বহুদিন ধরেই দেখেননি। সকলে ভেবেছিল, আশরাফ খ হয়তো তাকে কোথাও পাঠিয়েছেন। কিংবা তার কাছে ডেকে নিয়ে অন্য কোনো কাজ দিয়েছেন। কারণ, এই নিয়ে তার লোকেরা কেউ কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।

বিষয়টা হঠাৎ করেই যেন উল্টোদিকে মোড় নিল। এটি আশরাফ খাঁও আশা করেননি। পুলিশ তার বাড়িতে এলো। নানারকমের তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ করল। শুধু তাকেই না, তার আশপাশের অনেককেই নানা কথা জিজ্ঞেস করল। গায়ের বিভিন্ন বাড়িতেও গেল তারা। তারপর একদিন আশরাফ খাঁকে ডেকে নিয়ে যাওয়া হলো থানায়। কাইয়ুম হোসেন বললেন, কিছু মনে করবেন না খাঁ সাহেব। একটা কথা বলি?

‘জি ওসি সাব।

‘আপনি মান্যগণ্য মানুষ। বুদ্ধিমান লোক। দশগ্রামের লোক আপনেরে মানে। সেই আপনি যদি এইরকম একটা কাজ করেন, সেটা কি খাটে?

‘কী করেছি আমি?’ আশরাফ খাঁ এতদিনে বিষয়টার গুরুত্ব এখন আঁচ করতে পারছেন। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যে এমন একটি জটিল প্যাঁচ খেলবেন এটি তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। ওসি বললেন, ‘রুস্তম নিখোঁজ হওয়ার এতদিন পর কেন আপনি পুলিশের কাছে খবর দিলেন? যত যুক্তিই আপনি দেন না কেন, বিষয়টা স্বাভাবিক না। কিছু মনে করবেন না, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

‘জি।

‘রুস্তমের সঙ্গে কি কোনো কারণে আপনার কোনো ঝামেলা ছিল?

রুস্তমের সঙ্গে আমার কী ঝামেলা? সে দীর্ঘদিন থেকেই আমার সঙ্গে কাজ করে। আমার সবকিছুর দেখাশোনা করে। তার সঙ্গে আমার কি ঝামেলা?

‘ধরেন, আপনার গোপন কোনো বিষয় সে জেনে গেল? যা সে ছাড়া আর কেউ জানত না? আর আপনি তাকেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না?

আশরাফ খাঁ এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, ঘটনা কোন দিকে যাচ্ছে। তিনি বললেন, আপনি কি বোঝাতে চাইছেন ওসি সাহেব?’

ওসি কাইয়ুম হোসেন বললেন, আপনি যে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ি, জমি জমা কিনছেন বলে দাবি করছেন, সেইখানে একটা পুরনো মন্দির আছে, এই কথা সত্যি?

‘জি, সত্য।

‘এই বাড়ি, জমি-জমা, বাগান আপনার দখলে। তাই না?

‘জি।’

‘আপনার লোকজনই সব দেখাশোনা করে? সম্প্রতি আপনি সেখানে দিন-রাত পাহারার ব্যবস্থাও করেছেন, যাতে বাইরের লোকজন প্রবেশ করতে না পারে?

আশরাফ খাঁ মৃদু মাথা নাড়লেন। ওসি কাইয়ুম হোসেন একজন কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় কিছু নিয়ে আসতে বললেন। তারপর বললেন, ‘ঘটনাটা আমাদের আরো আগে জানানো উচিত ছিল আপনার। যাই হোক, আপনার জন্য একটা দুঃসংবাদ আছে খাঁ সাহেব।

কী দুঃসংবাদ? কম্পিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন আশরাফ খাঁ।

‘আপনার কেনা মহিতোষ মাস্টারের বাড়িতেও আমরা তল্লাশি করেছি। বাড়ির পেছনে যে ভাঙা মন্দিরটা রয়েছে, সেখানে একটা গর্ত পেয়েছি আমরা। গর্তটা বেশ কিছুদিন আগে খোঁড়া হলেও বৃষ্টির পানি-কাদাতে প্রায় ভরাট হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু খুব রিসেন্টলি সেটি আবার খোঁড়া হয়েছে। খুঁড়ে সেটির ভেতর এই জিনসগুলো রেখে আবার মাটি চাপা দেয়া হয়েছে।

‘কী জিনিস?”

আশরাফ খাঁ তাকালেন। তার সামনে রুস্তমের গায়ের জামাকাপড়গুলো রাখা। কাইয়ুম হোসেন বললেন, “আমরা কথা বলে জেনেছি, রুস্তম যেদিন হারিয়ে যায়, সেদিন এই জামা কাপড়গুলোই তার গায়ে ছিল।’

আশরাফ খাঁ অবাক চোখে সেই কাপড়গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলেন। হঠাৎ করেই তার প্রচণ্ড গরম লাগতে শুরু করছে। মনে হচ্ছে তার কানের পাশ দিয়ে ঘামের সরু প্রস্রবণ নেমে যাচ্ছে। তিনি আর বসে থাকতে পারছেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *