২৫. গত কদিন একটানা বৃষ্টি

২৫

গত কদিন একটানা বৃষ্টি। তরুর আগে ধারণা ছিল, শহরের চেয়ে গ্রামে বৃষ্টি দেখা অধিক আনন্দের। চারদিকে জল থইথই পুকুর, ডোবা, নদী। সবুজ ধানক্ষেত। টিনের চালের ঘর। বৃষ্টি উপভোগের জন্য এর চেয়ে উৎকৃষ্ট আর কী হতে পারে! কিন্তু মাত্র ক মাসের গ্রামবাসই তাকে আলাদা এক অভিজ্ঞতা দিল। অনুভবও। এখন মনে হচ্ছে, শহরে বৃষ্টি যত আনন্দের, গ্রামে তা নয়। এখানে বৃষ্টি মানেই প্যাঁচপেচে কাদা। সাপ, ব্যাঙের ভয়। পোকামাকড়ের উপদ্রব। রাস্তায় বেরোনোও মোটামুটি যুদ্ধ প্রস্তুতির মতো ব্যাপার।

এসব কারণে কাজ শেষে যত দ্রুত সম্ভব ঘরে ফিরে আসতে চায় সে। এরপর আর বেরোতে চায় না। আশ্রমের ছেলে-মেয়েগুলোর সঙ্গেও বেশ কিছুদিন দেখা হচ্ছে না। আজও চটজলদি বাসায় ফিরে এসেছিল। ঘড়ির কাঁটায় তখনো বিকেল চারটা। কিন্তু বাইরের পৃথিবী দেখে সেসব বোঝার উপায় নেই। আকাশে ঘন কালো মেঘ। ঝোড়ো হাওয়া বইছে। সাধারণত এই হাওয়ায় বৃষ্টির তোড় খুব একটা থাকে না। কিন্তু আজ আছে। টিনের চালে যেন খইয়ের মতো বৃষ্টি ফুটছে। শো শো শব্দ হচ্ছে বাতাসের। আবহাওয়াও শীতল। গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে জানালার কাছে শুয়ে বাইরের বৃষ্টি দেখছিল সে। সঙ্গে শব্দ শুনছিল উন্মাতাল হাওয়ার। কিন্তু বেশিক্ষণ আর এসব উপভোগ করা হলো না। তার আগেই ঘুমে চোখ জড়িয়ে এলো তরুর।

বাইরে অবিরাম বর্ষণ। সেই বর্ষণের শব্দ যেন সম্মোহন ছড়াচ্ছে অপার্থিব সুর আর সংগীতে। তরুর ঘুম ভাঙল মাঝরাতে। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। কিন্তু হাওয়ার বেগ কমেনি। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। সে চোখ মেলে প্রথম কিছুই বুঝতে পারল না। যেন অন্য কোনো জগৎ থেকে আচমকা উঠে এসেছে সে। এই মুহূর্তে শব্দটা কানে এলো তার। ঠকঠক শব্দ হচ্ছে কোথাও। পরপর কয়েকবার। সে উঠে বসল। রাত কটা বাজে এখন? কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে?

ঘড়ি দেখে আঁতকে উঠল তরু। বারোটা! তার মানে প্রায় আট ঘন্টা ঘুমিয়েছে? শেষ কবে এমন ঘুম হয়েছে তা মনে করতে পারল না সে। এই মুহূর্তে আবারো হলো শব্দটা। এবার যেন খুব কাছেই মনে হলো। বাইরের তুমুল হাওয়া আর বজ্রপাতকে ছাপিয়েও স্পষ্ট কানে বাজল শব্দটা। তরু এবার সতর্ক হলো। এত রাতে, এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে কেউ কি তার দরজা নক করছে? নাকি ভুল শুনছে সে?

কান খাড়া করে অপেক্ষা করল তরু। আর সঙ্গে সঙ্গেই আবারো শব্দ হলো দরজায়। এবার আর দ্বিধার কোনো সুযোগ নেই। স্পষ্ট শব্দটা শুনতে পেয়েছে সে। তরু উঠে দাঁড়াল। আলো জ্বালল। তারপর দরজার কাছে গিয়ে সতর্ক গলায় বলল, ‘কে?”

‘আমি আনারুল ম্যাডাম।’

‘আনারুল? ভারি অবাক হলো তরু। এত রাতে এখানে কী?

‘বিপদ ম্যাডাম। একটা বড় বিপদ…।

‘কী বিপদ? কপাল কোঁচকাল তরু।

‘এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বহু দূর থেইকা এক রোগী আসছে। রোগীর মরণ বাচন অবস্থা।

তরু সঙ্গে সঙ্গেই কোনো কথা বলল না। ডাক্তার হিসেবে দায়িত্ব পালনে এখুনি তার রেডি হয়ে বের হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু সেটি সে পারছে না। কোথায় যেন একটা প্রবল দ্বিধা তাকে আটকে রাখছে। এই অচেনা-অজানা গায়ে নানারকম লোকজন থাকে। তাদের অভিসন্ধিও বোঝা দুরূহ। এত রাতে এই ঝড়বৃষ্টির মধ্যে সে একা একটা মেয়ে চট করে বের হয়ে যাবে? আনারুল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দারোয়ান। এখানে আসার পর থেকে সে-ই তার ভালো-মন্দ দেখা শোনা করছে। কখনো অনাস্থা তৈরি হওয়ার মতো কিছু করেনি সে। ফলে তাকে চট করে সন্দেহও করা যায় না। তা ছাড়া খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু না হলে এত রাতে তাকে এই বাড়ির ভেতরে ঢুকতে দেওয়ারও কথা না। কিন্তু ঘটনা কী?

আনারুল ডাকল, ম্যাডাম।

হুম। বলো।

‘খুবই খারাপ অবস্থা রুগীর। মনে হয় মারাই যাইব। বাঁচান যাইব না। তারপরও আপনে আছেন বইলা ডাকতে আসছি। মহিলা রুগী তো…।’

মহিলা রোগী শুনে তরু যেন একটু নমনীয় হলো। সে বলল, কী হয়েছে। রোগীর?

বাচ্চা হইব। বাড়িতেই চেষ্টা করছিল। কিন্তু বাচ্চা নাকি উল্টা। রুগীর জ্ঞান। নাই। অনেক রক্ত গেছে। এই অবস্থায় তারে অত দূর থেইকা এই তুফানের মধ্যে নিয়া আসছে।

সঙ্গে কে কে আসছে?

‘এক থুড়থুইড়া বুড়া মহিলা। আর তার মেয়ে। পনেরো ষোলো বছরের এক ছ্যামড়া ট্রলার চালাইয়া আসছে। বুড়ির নাতি মনে হয়।

শুনে একটু অবাকই হলো তরু। বলল, ‘রোগী তাদের কী হয়?

বুড়ি তো বলল তার নাতনি।

‘মেয়ের স্বামী কই? সে আসে নাই? তরু এখনো নিশ্চিত হতে পারছে না সে কী করবে!

না, সে আসে নাই। তার নাকি কী ঝামেলা। রুগীর অবস্থা খুবই খারাপ ম্যাডাম। মনে হয় না বাঁচব।

তরু তারপরও কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারল না। এমন তো নয় যে আনারুল মিথ্যা বলছে? অবশ্য তার কথা শুনে তেমন মনে হয়নি। তা ছাড়া এই এতদিনেও তাকে কখনোই খারাপ মানুষ বলে মনে হয়নি। সে আরো খানিক চিন্তা করল। দুজন মহিলা আর এক কিশোর মিলে মেয়েটাকে এই ঝড়-বৃষ্টির রাতে এতদূর পথ নিয়ে এসেছে। তার মানে আসলেই গুরুতর অবস্থা। সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো সঙ্গে মেয়েটার সঙ্গে তার স্বামীও নেই। অথচ এই সময়ে তার উপস্থিতিই সবচেয়ে জরুরি। বুকের ভেতর কোথাও যেন একটা টান অনুভব করল তরু।

মিনিট দশেকের মধ্যে সে ঘর থেকে বের হলো। আনারুলের এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে টর্চ লাইট। তরুকে দেখেই সে বলল, আমি অনেকবার না বলছি। বলছি যে এই রাইতে ম্যাডাম কিছুতেই আসব না। কিন্তু ধরেন সত্তুর-আশি বছরের বুড়া মহিলা, সে আচুক্কা আইসা আমার পা জড়াইয়া ধরল। তখন কী করব কন? কিছু করার আছে?

তরু কথা বলল না। সে এক মনে হাঁটতে লাগল। আনারুল তার মাথায় ছাতা ধরে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজে পাশে পাশে হাঁটছে।

তরু যখন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঢুকল, তখন আবার বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে। সে দেখল স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মূল দরজার বাইরে টিনের ছাউনির নিচে পাকা মেঝেতে এক বৃদ্ধা বসে আছেন। তার কোলে প্রায় নিথর একটি মেয়ের দেহ। পাশেই আরেকজন মহিলা বসে আছেন। তিনি মেয়েটির হাত ধরে আছেন। তাঁদের পরনের কাপড় ভেজা। সেই ভেজা কাপড় থেকে পানি চুঁইয়ে পড়ছে মেঝেতে। বৃদ্ধার চোখ বন্ধ। তিনি সেই বন্ধ চোখেই দুই হাত মোনাজাতের ভঙ্গি করে বসে আছেন। আর ঠোঁট নাড়িয়ে বিড়বিড় করে কিছু পড়ছেন। মেয়েটির হাতে তসবিহ। সে দ্রুতলয়ে সেই তসবিহ গুনছে। তার ঠোঁটও থরথর করে কাঁপছে। বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মুহূর্মুহূ শব্দে বাজ পড়ছে কোথাও। কিন্তু তাতে ওই মানুষ দুজন মুহূর্তের জন্যও বিচলতি হচ্ছেন না। দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল তরুর। মানুষ তার প্রিয়জনের জন্য কত কিছুই না করে! কী অসীম ভালোবাসায়, কী প্রগাঢ় প্রার্থনায় তারা মেয়েটির জীবন ফিরে পেতে চাইছে। কে জানে, হয়তো এই ভালোবাসা থেকে নিঃসৃত সর্বান্তকরণ প্রার্থনাই স্রষ্টার কাছে পৌঁছায়। আর তিনি তখন তার করুণার হাত প্রসারিত করে ছুঁয়ে দেন এই সব ভাগ্যবান মানুষ।

.

কী নাম রোগীর? তরু জিজ্ঞেস করল।

‘পারুল।’ বললেন তাবারন বিবি।

স্বামীর নাম কী?

এই প্রশ্নে তাবারন বিবি থতমত খেয়ে গেলেন। তিনি এখন জানেন যে পারু কাশেমের স্ত্রী নয়। সেদিন নিজের স্বামীর নামও সে বলেছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছুতেই নামটি মনে পড়ছে না তাবারন বিবির। সালমা অবশ্য তাকে উদ্ধার করল। সে চট করে বলল, কাশেম। তার স্বামীর নাম কাশেম।

বয়স?

‘কার? তার স্বামীর?

না। রোগীর।

এই প্রশ্নের উত্তরে আবারো সালমার দিকে তাকালেন তাবারন বিবি। তারপর নিজ থেকেই বললেন, এই ধরেন উনিশ-কুড়ি।

কী হয় আপনার?

নাতনি।’

‘তার স্বামী কোথায়? স্বামীকে লাগবে। রোগীর যা অবস্থা তাতে যেকোনো কিছু ঘটতে পারে।

‘যেকোনো কিছু কী?

‘তার পেট কেটে বাচ্চা বের করতে হবে। এতে ঝুঁকি আছে। সে মারাও যেতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা রোগীর স্বামীর কাছ থেকে লিখিত অনুমতি নেই। তার স্বামীরও অনুমতি লাগবে। লিখিত অনুমতি।

‘তার স্বামী তো এইখানে নাই।

নাই কেন? কোথায় সে?

‘সে গেছে ট্রলারের খ্যাপ লইয়া। এর মইধ্যে পারুল অসুস্থ হইয়া পড়ছে।

‘তাহলে তার বাবা, মা বা ভাই কেউ?

এবার সালমা আর তাবারন বিবি পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। তরু বলল, কী হলো? তার মা, বাবা কেউ আসেনি?”

না।’ মাথা নাড়ালেন তাবারন বিবি।

আশ্চর্য! মেয়ের এই অবস্থায় তারা কেউ আসেনি?

‘তারা নাই। চট করে কথাটা বলল সালমা। মারা গেছেন। আমার বড় বোনের মেয়ে। আমি তার খালা। আমার মায়ে তার নানি।

‘ওহ!’ দুঃখিত কণ্ঠে বলল তরু। তারপর বলল, আচ্ছা, আপনারা কেউই অনুমতি পত্রে স্বাক্ষর বা টিপসই করুন।’

তাবারন বিবি টিপসই দিলেন। একজন নার্স এসে কাগজটা নিয়ে গেল। তরু চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাবে। এই মুহূর্তে তাবারন বিবি বললেন, “এইডা আপনে রাখেন।

তাবারন বিবির হাতে একটা কাপড়ের পোঁটলা। তিনি সেটি তরুর দিকে এগিয়ে দিলেন। তরু বলল, এটা কী?

‘আমার গাছের ফল। পাকা পেঁপে। চিনির মতন মিষ্টি। একবার খাইলে জিহ্বায় চিরদিনের মতো স্বাদ লাইগা থাকব। আর কোনোদিন ভুলতে পারবেন না মা-জননী।

‘এটা কেন?

আমার কাছে তো এখন নগদ টাকা-পয়সা নাই, আপনেরে কী দেব? এইজন্য নিয়াসছি।

তরু কথা বলল না। তাকিয়ে রইল। তাবারন বিবি বললেন, রাগ হইছেন? রাগ হইয়েন না গো মা। আপনারে আমি একদম ঠকাবো না। আরো জিনিস আছে।’

তরু তাকিয়েই রইল। তাবারন বিবি তার শাড়ির আঁচলের গিট থেকে ছোট্ট একটুকরো অলংকার বের করলেন। তরু ভালো করে তাকিয়ে দেখল। সম্ভবত পুরনো দিনের নাকের নথ। তিনি সেখানা আঙুলের ডগায় চিমটি মতো ধরে দেখিয়ে বললেন, আমার আর কিছু নাই গো মা। এইটুকই যা আছিল। এইটাও আপনের। আমি নিয়ত কইরাই আনছি। নেন। নাকে পইরেন। আপনের বিবাহ হইছে? বিবাহ হইলে পরবেন। স্বামীর আদর-সোহাগ বাড়ব।’

তরু কথা বলল না। তবে হাত বাড়িয়ে নথটা নিল সে।

.

পারুর মেয়ে হলো পরদিন সকালে। তখনো আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি হচ্ছে। তবে ঝোড়ো হাওয়া কমেছে। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত তরু বসে আছে তার ঘরে। প্রচণ্ড যন্ত্রণায় মাথা দপদপ করছে। এই হাসপাতালের অপ্রতুল লোকবল ও সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও সে যা করেছে, তাকে রীতিমতো অসাধ্য সাধন বলা যায়। তবে সন্তান ভালো থাকলেও মায়ের অবস্থা বিশেষ ভালো নয়। অন্তত আরো দুটো দিন তাকে দেখতে হবে। সমস্যা হচ্ছে, তরুর নিজেরই শরীর খারাপ লাগছে। বিশ্রাম দরকার তার। আপাতত একটা অসম্ভব যুদ্ধে জয়ী হয়েছে সে। কিন্তু বাকিটার জন্য সময় যেতে দিতে হবে।

খানিকক্ষণ অপেক্ষা করে বাসায় ফিরল তরু। তারপর গোসল, খাওয়া সেরে লম্বা ঘুম দিল। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। তখনো ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। এই বর্ষণ কবে থামবে কে জানে! সে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হলো। গিয়ে দেখল পারু ঘুমাচ্ছে। তার পাশে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছেন তাবারন বিবি। তরু এটা-সেটা জিজ্ঞেস করল। অন্য রোগীদেরও খানিক ঘুরে ঘুরে দেখল। তারপর বাসায় ফিরল রাতে। সেই রাতেও ভালো ঘুম হলো তার। পরদিন দুপুর নাগাদ পারু যেন খানিক সুস্থ হয়ে উঠল। কথাও বলল সে। তার পাশে শুয়ে থাকা শিশুটির মুখের দিকে তাকিয়ে কেমন যেন আচ্ছন্ন হয়ে রইল। যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না এই মানবশিশুটি তার। তার শরীর নিঙড়ে এই শিশুটির জন্ম। কী আশ্চর্য, এইটুকু এক মানুষ! কী ছোট ছোট হাত, পা, আঙুল, ঠোঁট। তার খুব ধরে দেখতে ইচ্ছে হলো। আবার ভয়ও হলো। এত তুলতুলে তুলোর মতো নরম শরীর! যদি সে ব্যথা পায়?

তরুও টুকটাক কথা বলল পারুর সঙ্গে।

‘এখন কী কী সমস্যা হচ্ছে? পারু মৃদু হাসল, কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’

‘একদম না? অবাক গলায় বলল তরু।

‘উঁহু।’

তাবারন বিবি পাশ থেকে বললেন, ‘হইতেছে। কিন্তু সন্তানের মুখ দেখলে কি আর মায়ের কোনো বেদনার কথা মনে থাকে? সে তার মেয়ের মুখ দেইখা আর সবকিছু ভুইলা গেছে।

তাবারন বিবির কথা সত্যি। পারুরও তেমন মনে হচ্ছে। এই এত এত দুঃখ, দুর্দশা, দুর্বিপাক সকলই যেন কোথায় মিলিয়ে গেছে। সে যেন এখন পাখির পালকের মতো ভেসে বেড়াচ্ছে হাওয়ায়। সেখানে কোথাও কোনো যন্ত্রণা নেই, দুশ্চিন্তা নেই। কেবলই ভেসে যাওয়া অসীম আনন্দে।

তরু বলল, কিন্তু খুব বেশি কথা বলবেন না। নড়াচড়াও যত কম করা যায়। ভালো। আর ঘুমানোর চেষ্টা করুন।

‘ও ভালো আছে তো দিদি?’ মেয়ের দিকে নির্দেশ করে বলল পারু।

হ্যাঁ ভালো আছে। খানিক কুঁচকে বলল তরু।

‘কোনো সমস্যা নেই তো?

‘এখনো না। তবে এই যে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুম। স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। ঠাণ্ডাও। এগুলোতে খুব সাবধানে থাকতে হবে।’

‘আচ্ছা। আপনি ঠাকুমাকে একটু ভালোভাবে বুঝিয়ে দিন।’ বলল পারু।

.

পরদিন সকাল থেকে খুব ব্যস্ততায় সময় গেল তরুর। তবে দুপুরে বাসায় ফিরে খানিক বিশ্রাম নিয়েই আবার সন্ধ্যার পর হাসপাতালে গেল সে। কী যেন একটা খচখচ করছে তার মনে। সম্ভবত পারুর কথা। একটা বিষয় খানিক অবাক করেছে। তরুকে। পারু প্রায় শুদ্ধ উচ্চারণেই কথা বলছে তার সঙ্গে। অথচ তার সঙ্গের অন্য মানুষগুলোর কথায় গ্রাম্য টান স্পষ্ট। আরো একটি বিষয়ে অবাক হয়েছে সে। মেয়েটা তাবারন বিবিকে ঠাকুমা বলে সম্বোধন করছে। এমনকি তাকেও ডেকেছে দিদি বলে। কে জানে, হয়তো এ অঞ্চলে সকলেই এমন বলে। কিংবা মেয়েটা হয়তো অন্য কোথাও বড় হয়েছে। এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতেই সে রাস্তা ধরে হাঁটছিল। আজ আর তার সঙ্গে আনারুল নেই। কিন্তু হাসপাতালের কাছাকাছি আসতেই লোকটাকে দেখল সে। ফজু!

তরুকে দেখেই চট করে একটা গাছের আড়ালে চলে গেল সে। ফজু এই সময়ে এখানে কী করছে? সাধারণত এত এত রোগীর ভিড়ে কাউকে আলাদা করে মনে রাখা সম্ভব হয় না। কিন্তু ফজুকে মনে আছে। আসলে তার চেহারাটা ভোলা অসম্ভবই। ভয়ংকর সেই আঘাতে তার মুখের যে হাল হয়েছে, তাতে একবার তাকে কেউ দেখলে আর ভোলার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু সে তো বেশ অনেকদিন হয় হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তাহলে আজ এখানে কী করছে সে? তা ছাড়া, তরুকে দেখে ওভাবে চট করে গাছের আড়ালেই বা সরে গেল কেন?

.

বিষয়টা কিছুতেই বুঝতে পারল না তরু। হাসপাতালে ঢুকে আরো একবার রোগীদের দেখল সে। পারুকেও। কিছু কথাবার্তাও হলো। তরু তখন হঠাত্ব জিজ্ঞেস করল, “আপনি গ্রামে বেড়ে উঠলেও আপনার কথা শুনে কিন্তু তা বোঝা যায় না?

পারু হাসল, কী মনে হয়?

মনে হয় শহরে বেড়ে উঠেছেন।

আমার বাবার কারণে।

উনি শিখিয়েছেন?

হুম।

কী করতেন উনি?’

স্কুল শিক্ষক ছিলেন।

‘খুব শাসন করতেন?

মা করতেন। তবে বাবা চাইতেন আমরা পড়াশোনায় ভালো হই। শহুরে বাচ্চাদের মতো কথা বলি। ছোটোবেলা থেকেই এটা নিয়ে তার ভীষণ কড়াকড়ি ছিল। ফলে গ্রামে বড় হয়েও আমাদের দুই বোনকে যতটা সম্ভব এভাবেই কথা বলতে হতো।

‘আচ্ছা। তরু ইচ্ছে করেই আর বেশি কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে শুনেছে মেয়েটার বাবা-মা নেই। এমন কাউকে এ বিষয়ে আরো জিজ্ঞেস করাটা অভব্যতাও। তরু আরো কিছুক্ষণ থেকে হাসপাতালে তার রুমে চলে এলো। কিন্তু কিছু একটা তাকে যেন স্বস্তি দিচ্ছিল না। ক্রমাগত অস্থির করে তুলছিল। বাইরে তখন অন্ধকার নেমেছে। আজ বৃষ্টি নেই। তবে আবহাওয়া শীতল। হাওয়ার তোড়জোড় কমেছে। চারপাশটা আশ্চর্য শান্ত। ঠিক সেই মুহূর্তে লোকটাকে চোখে পড়ল তরুর। তার জানালা থেকে বাইরের লম্বা সরু করিডোরটা দেখা যায়। রোগীদের ওয়ার্ডের ঠিক পেছন দিকটা। ওখানে অন্ধকারে একটা লোক দাঁড়িয়ে। জানালায় উঁকি দিয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করছে সে। কিন্তু ভেতরে পর্দা থাকায় ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। তরু ভারী অবাক হলো। কে লোকটা? কী দেখার চেষ্টা করছে সে?

এই মুহূর্তে লোকটা সরে গেল। তবে চলে গেল না। সে আরো দক্ষিণে সরে গিয়ে যে জানালাটার সামনে দাঁড়াল, সেখানে পারুর বিছানা। বেশ খানিকক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে রইল সে। তারপর ঘুরে হাঁটতে লাগল রাস্তার দিকে। তরুর হঠাৎ মনে হলো, লোকটাকে সে চিনতে পেরেছে। ফজু!

কিন্তু ফজু এখানে কী করছে? ওভাবে অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে কী দেখছে সে? সে কি কাউকে খুঁজছে?

২৬

আকাশ মেঘলা। পূর্ণিমার রাত হওয়া সত্ত্বেও চারপাশ ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির সামনে ঝোঁপের আড়ালে ওত পেতে বসে আছে তিনজন মানুষ। কামাল, এছাহাক আর মতি মিয়া। তারা অপেক্ষা করছে রুস্তমের। এই অপেক্ষা গত বেশ কিছুদিন ধরেই করতে হচ্ছে। কারণ তারা জানে না রুস্তম আবার কবে বাড়ি থেকে বের হবে! কবে সে রাতের অন্ধকারে গোপনে ব্যাগ হাতে রমজানের দোকানের পাশের সরু উঁচু রাস্তা ধরে উত্তরপাড়ার পথ ধরবে?

জানে না বলেই রাতের পর রাত অপেক্ষা করতে হচ্ছে তাদের। আজ অবশ্য বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না। তার আগেই রুস্তমকে ঘর থেকে বের হতে দেখা গেল। তার হাতে সেদিন রাতের মতোই টর্চ লাইট, ব্যাগ। সঙ্গে আরো কিছু থাকলেও অন্ধকারে চট করে দেখা গেল না। খুব সাবধানে পা ফেলে সজাগ দৃষ্টি মেলে সে ঘর থেকে বের হলো। তারপর সাবধানে আলো জ্বালল। আরো দু-একবার এদিক সেদিক তাকিয়ে অবশেষে পা বাড়াল রাস্তার দিকে। দৃশ্যটা দেখে একটু অবাকই হলো মতি মিয়া। সে ফিসফিস করে বলল, ‘ঘটনা বুঝলাম না।’

কী ঘটনা?’ বলল কামাল।

“সে তো সরাসরি এই রাস্তার দিকেই আসতেছে।

‘তাহলে কই যাবে?

“সেইদিন তো বাড়ির পেছন দিকের জঙ্গল থেইকা বাইর হইয়া রাস্তার দিকে আসছিল। আর আজ দেখি সরাসরি ঘর থেইকাই?

তাতে সমস্যা কী?

‘জিনিস তো আর সে ঘরে রাখে নাই। রাখার কথাও না। বলল এছাহাক। তাইলে সবার দেখার কথা। সে যেহেতু মাঝরাতে গোপনে ব্যাগে কইরা জিনিস নিয়া বাইর হয়, তার মানে ওই জিনিসের কথা তার সঙ্গের লোকেরা জানে না। কিন্তু আজ তো সে সরাসরি ঘর থেকাই বের হইল।

কামাল অন্ধকারেই মাথা নাড়ল। তারপর বলল, ‘হুম। আগে দেখি সে কী করে?

রুস্তম তাদের প্রায় গা ঘেঁষেই হেঁটে চলে গেল। খুব প্রয়োজন না হলে আলো জ্বালছে না সে। তবে খানিক পরপর এদিক-সেদিক দেখছে। মতি মিয়া বলল, ‘এখন কি আমরা তার পিছ নেব?

হুম।’ বলল কামাল।

একটা নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে তারা রুস্তমকে অনুসরণ করতে লাগল। সে এখন দ্রুত পায়ে হাঁটছে। গুনগুন করে কোনো একটা গানও গাইছে। তবে সেই গানের কথা স্পষ্ট এত দূর থেকে শোনা যাচ্ছে না। এছাহাক বলল, “সে তো নদীর দিকে যাইতেছে।’

হুম।’ চিন্তিত স্বরে বলল কামাল। এইদিকে বিশেষ কী আছে?

‘বিশেষ তো কিছুই নাই।’

উত্তরপাড়ার আশরাফ খাঁর বাড়ি যাওয়ার কোনো পথ আছে এদিকে?

না। উত্তরপাড়া তো উল্টা দিকে।

কামাল কথা বলল না। খানিক চুপ করে কী ভাবল। তারপর বলল, এমন কি হতে পারে যে এদিকে কোনো নৌকা-টৌকা আছে। সে সেই নৌকায় করে যেতে চায়?

উমমম। হইতেও পারে…।’ বললেও এছাহাক নিজেই যেন নিজের কথায় জোর পেল না।

উঁচু রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে নামলেই নিচু জমি। সেই জমি পেরিয়ে খানিক এগোলেই নদী। জায়গাটাতে একটা বিশাল পাকুড় গাছ। গাছের ডাল বেয়ে লতাগুলো ঝুলে আছে নিচে। তার একটাতে ব্যাগ আর ধারালো বেঁটাখানা ঝোলাল রুস্তম। তারপর টর্চ লাইটটা বগলে চেপে লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে শক্ত করে বাঁধল কোমরে। এতক্ষণে যেন দেশীয় অস্ত্রটা চোখে পড়ল কামালের। সে বলল, তার সঙ্গে ওটা কী?

“টেঁটা। দেখেন নাই আগে?

‘টেঁটা?

হুম। নাম শোনেন নাই? গ্রাম দেশের মারাত্মক অস্ত্র। নানা কাজে ব্যবহার হয়।’ বলল এছাহাক।

‘ওহ, হ্যাঁ। গম্ভীর গলায় বলল কামাল। নাম শুনছি অনেক। তবে সরাসরি এই প্রথম দেখলাম।

মাছও ধরন যায়। আবার ওই চেঁটা দিয়ে এক কোপে মানুষও খুন করা যায়। কত জায়গায় চর দখলের মারামারিতে এই বেঁটার কোপ খাইয়াই শত শত মানুষ মরছে! গাঁও-গ্রামের মানুষের বড় মারামারির আসল অস্ত্রই হইল এইটা।’

‘সে সবসময় এই জিনিস নিয়া ঘোরে?’ কামাল চিন্তিত স্বরে বলল।

মতি বলল, আগে ঘুরত না। এখন ঘোরে।

‘কেন?’

‘আগে তো তার একার শইলেই দশজনের শক্তি আছিল। কেউ ডরেও তার সঙ্গে লাগতে যাইত না।’

‘এখন শক্তি নাই?

না। একবার কুস্তি লড়তে গিয়া কাঁধের হাড় সরে গেছিল। পরে ডাক্তার কবিরাজ দেখাইয়া ঠিক করছে। কিন্তু আগের সেই বল আর ফিরা পায় নাই। তা ছাড়া একটা রোগও দেখা দিছে কয়েক বছর ধইরা। এইজন্যও কুস্তি লড়তে পারে না। দুর্বল ঠেকে।

কী রোগ?

হাঁপানি। সময়ে অসময়ে দমে টান পড়ে। তখন একদম ন্যাতাই যায়। এই নিয়া খুব অশান্তিতে আছে। বোঝেন না, ওইরকম চিতা বাঘের মতো একটা মানুষ। দেখলেই সবাই ভয় পাইত। এখন মাইনষে আর আগের সেই দাম দেয়? দেয় না।’

‘এইজন্য তেঁটা নিয়া রাত-বিরাতে ঘোরে?

হইতেও পারে।’ বলল এছাহাক। হয়তো ওইটা থাকলে নিজে একটু মনে মনে শক্তি পায়।

কামাল সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না। তাকে খানিক চিন্তিত মনে হলো। হয়তো এই বিষয়টা তার পরিকল্পনায় ছিল না। সে বিড়বিড় করে বলল, সে এইখানে কী করবে বলে মনে হয়?

‘সেইটাই তো বুঝতেছি না। এছাহাক বলল।

মতি মিয়া বলল এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

‘সে আবার তেঁটা হাতে নেয়ার আগেই তারে ধরলে কেমন হয়?

‘এইখানে? এখনই?’ খানিক ভীত গলায় বলল এছাহাক।

হুম।’ বলল মতি মিয়া। নাইলে তেঁটা থাকলে সে কিন্তু…’

কথাটা শেষ করতে পারল না মতি মিয়া। তার আগেই পিচ্ছিল রাস্তার ঢাল বেয়ে প্রায় হুড়মুড় করে পড়ে যেতে থাকল সে। তবে শেষ মুহূর্তে অন্ধকারে একটা লতাগুল্মের ঝোঁপ ধরে নিজের পতন সামলাল। ততক্ষণে অবশ্য ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে গেছে। রুস্তম টের পেয়ে গেছে এখানে অন্য কেউ আছে। কিন্তু কী আছে, সেটি সে নিশ্চিত হতে পারল না। কামাল ভেবেছিল লুকিয়ে আড়াল থেকে যতটা সম্ভব তার গতিবিধি খেয়াল করবে। কিন্তু এখন আর সেটা সম্ভব না।

রুস্তম শব্দ শোনার সঙ্গে সঙ্গেই টর্চটা হাতে নিল। তারপর শব্দ লক্ষ্য করে আলো ফেলতে লাগল। কামালরা অবশ্য ততক্ষণে বড় শিমুল গাছটার আড়ালে সরে গেছে। কিন্তু তাতেও রুস্তমের সন্দেহ দূর হলো না। সে মুহূর্তে গাছের ডাল থেকে টেটাখানা হাতে তুলে নিল। তারপর বাজখাই গলায় বলল, “কেডা ওইখানে? কেডা?’

কেউ কোনো জবাব দিল না। চারপাশ আবার আগের মতো সুনসান। রুস্তম আবারও ডাকল। পর পর বেশ কয়বার। কিন্তু কোথাও কোনো সাড়াশব্দ নেই। রাতের বেলা এমন নির্জন ঝোঁপঝাড়ের পথে নানা নিশাচর বন্য প্রাণী ঘুরে বেড়ায়। হতে পারে তারাই কেউ শব্দ করছে। কথাটা ভেবে সে ঘুরল। সম্ভবত নদীর দিকে নেমে যেতেই মনঃস্থির করল সে। কিন্তু খানিক গিয়ে আবার ফিরে এলো। যেন মনের দ্বিধাটা পুরোপুরি কাটাতে পারছে না। নিঃসংশয় হতে পারছে না।

এবার সরাসরি আলো ফেলল শিমুল গাছটার ওপর। তারপর আশপাশে। বার দুই মুখে নানা শব্দ করল। একটা ঢিল তুলে ছুঁড়ে মারল ঝোঁপের ওপর। তারপর আচমকা হেঁটে আসতে লাগল সোজা শিমুলগাছ বরাবর। মতি মিয়া ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। এছাহাকও। কারণ রুস্তমের ভাবগতিক সুবিধার মনে হচ্ছে না। এই রাতের অন্ধকারে সে যদি এখানে তাদের খুন করে রেখে যায়, কিংবা টেনে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়ে আসে, কারো সাধ্য নেই খুনিকে খুঁজে বের করার। কী করবে তারা এখন? তিনজন এক যোগে ঝাঁপিয়ে পড়বে রুস্তমের ওপর?

এছাহাক কামালের দিকে তাকাল। সেই অন্ধকারেও সে আচমকা আবিষ্কার করল, কামাল হাসছে। রুস্তমের টর্চের ছিটকে আসা আলোর আভায় শিকারির মতো ওত পেতে থাকা কামালের চোখের চকচকে চাহনি তার দৃষ্টি এড়াল না।

এমন পরিস্থিতিতে লোকটা হাসছে কী করে?

.

রুস্তম প্রায় তাদের সামনে চলে এসেছে। এই মুহূর্তে কামাল আড়াল থেকে বের হয়ে এলো। এছাহাক অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, গামছায় নিজের মুখ ঢেকে নিয়েছে কামাল। রুস্তম যাতে তাকে চিনতে না পারে। কামালকে এভাবে সরাসরি সামনে চলে আসতে দেখে মুহূর্তের জন্য হকচকিয়ে গেল রুস্তম। ঘাবড়েও গেল খানিকটা। সুযোগটা নিল কামাল। চট করে নিজের কোমর থেকে কিছু একটা বের করে আনল সে। জিনিসটা ঠিকভাবে দেখতে সামান্য সময় লাগল এছাহাক ও মতি মিয়ার। কিন্তু যতক্ষণে দেখল, ততক্ষণে তাদের দুজনের চোখই ছানাবড়া হয়ে গেল। রুস্তমেরও। এই সময়ে এখানে এমন কিছু দেখতে পাবে বলে ভাবেনি সে। হতভম্ব চোখে কামালের হাতের যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল সবাই।

কামালের হাতে একটা পিস্তল। পিস্তলটার নল সরাসরি রুস্তমের দিকে তাক করা। যেন এখুনি বিদ্যুৎবেগে গুলি ছুটে এসে তার বুক বিদীর্ণ করে দেবে। আর সে পড়ে রইবে এই কাদা পানির রাস্তায় মৃত লাশ হয়ে। ভয়ে কলিজা শুকিয়ে এলো। রুস্তমের। কিন্তু লোকটা কে? সে তার মুখ ঢেকে রেখেছে কেন গামছায়?

হাতের জিনিসটা নিচে ফেল। শীতল গলায় বলল কামাল। একদম কোনো চালাকি করবি না। এত কাছ থেকে আমার হাতের গুলি ফস্কায় না।’

রুস্তম কী করবে ভেবে পেল না। একবার ভাবল গায়ের জোরে শেষ একটা চেষ্টা করে দেখবে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, তার সামনের উদ্যত ওই অস্ত্রটা হেলাফেলার জিনিস নয়। এটি কুস্তির কোনো কৌশলও নয় যে একবার পরাস্ত হলেও দ্বিতীয়বার আবার সুযোগ পাওয়া যাবে। ওই যন্ত্রের সামনে দ্বিতীয় সুযোগ বলতে কিছু নেই। এক আঘাতেই চিরতরে জীবনের যবনিকাপাত।

কামালের হাতেও ততক্ষণে টর্চ জ্বলছে। সে রুস্তমকে বলল, ‘সোজা ওইদিকে ঘোর। খবরদার, এদিকে তাকালে মাথার খুলি উড়ে যাবে।’

রুস্তম ততক্ষণে হাল ছেড়ে দিয়েছে। সে তার হাত থেকে তেঁটা ফেলে বাধ্য ছেলের মতো উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে রইল। এই ফাঁকে পেছনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো মতি মিয়া ও এছাহাক। কামাল ইশারায় তাদের শব্দ করতে নিষেধ করল। সে চায় না এখানকার কাউকেই রুস্তম চিনে ফেলুক। এছাহাক আর মতির কণ্ঠ শুনেও তাদের চিনে ফেলার সুযোগ আছে। কিন্তু তার ক্ষেত্রে সেই সম্ভাবনা। নেই। রুস্তম তাকে চেনে না। কখনো দেখেনি বা কথাও শোনেনি। ফলে সে কথা বললেও সমস্যা নেই।

.

রুস্তমের ব্যাগটা দেখার জন্য কারোই আর তর সইছে না। ওই ব্যাগের ভেতরই তাদের চুরি যাওয়া গুপ্তধনের জিনিস! এত সহজেই সব মিটে যাবে এটা কেউ ভাবেনি। কিন্তু সকলের মনেই অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে। কামাল তাড়াহুড়া করল না। সে বলল, “তোর নাম রুস্তম?

‘জে।

কী করস তুই?

‘খাঁ সাবের সঙ্গে কাজ করি।

কী কাজ? খুন-খারাবি, মারামারি?

না না। ওই সব কেন করব?

‘ওই সব না করলে এত বড় শরীর দিয়ে কী করস?

‘আগে কুস্তি লড়তাম। এইজন্য।

‘এখন লড়স না?

না।’

‘কেন?

‘বেশ কয়বছর ধরে শইলে বল পাই না। হাঁপানিরও সমস্যা। নানা অসুখ বিসুখে ভুগি।

‘তোর ব্যাগের মধ্যে কী? মুহূর্তেই যেন ভীত হয়ে উঠল রুস্তম। তার চোখে কম্পন দেখা গেল।

‘কিছু না।

‘কিছু না?”

না।’

যদি কিছু থাকে?

এই প্রশ্নের উত্তরে রুস্তম চুপ করে রইল। কামাল বলল, কী? কথা বলস না?

সত্যিই কিছু নাই।’ রুস্তম কম্পিত গলায় বলল।

‘কিছু না থাকলে এত রাতেই এইভাবে গোপনে গোপনে ওই ব্যাগ নিয়া কই যাস?

রুস্তম এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। কামাল মতিকে ইশারায় ব্যাগ নিয়ে নিতে বলল।

মতি ব্যাগ নিয়ে এলো। কিন্তু ব্যাগ হাতে নেওয়া মাত্র তার এতক্ষণে সকল আগ্রহ, উত্তেজনা যেন ভেজা তুলোর মতো মিইয়ে গেল। সে ইশারায় কামালকে জানাল, ব্যাগে কিছু নেই!

‘কিছু নাই মানে? ভারি অবাক হলো কামাল আর এছাহাক। এছাহাক ছো। মেরে মতির হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। তারপর উল্টেপাল্টে দেখল। কিন্তু আসলেও কিছু নেই। পুরোপুরি ফাঁকা ব্যাগটা। হতভম্ব কামাল রুস্তমের দিকে। তাকিয়ে রইল। রুস্তম বলল, কী থাকব?’

‘কী থাকব মানে?’ এবার ধমকে উঠল কামাল। তুই আমারে জিগাস?

কামালের ধমক শুনে রুস্তম গুটিয়ে গেল। সে বিড়বিড় করে কিছু বলার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার চোখ কামালের হাতের পিস্তলটার দিকে। যেন একটা ফণা তোলা গোখরা তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেকোনো সময় ছোবল মারবে।

কামাল ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, “এত রাতে এমন লুকাইয়া লুকাইয়া খালি ব্যাগ নিয়া কই যাস?

রুস্তম এবারও কথা বলল না। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট ভয়। যেন খুব বড় কোনো অপরাধ লুকাতে চাইছে সে। কিন্তু কতক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারবে, তা সে নিশ্চিত না।

কামাল গা হিম করা গলায় বলল, জিনিস কই রাখছস বল? আমার হাতে বেশি সময় নাই। রাতও শেষ হয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি বল?

রুস্তম ভেঙে যাওয়া গলায় বলল, আমি কোথাও কিছু রাখি নাই। আপনে কী বলতেছেন কিছুই বুঝতে পারতেছি না। আপনে কে তাও জানি না।

‘কিছুই বুঝতে পারছিস না?

‘জে না।

তুই জানস না, মন্দিরের ভেতরে থাকা গুপ্তধনের সোনা-দানাগুলা কই?

রুস্তম হঠাৎ হাত জোড় করে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। তারপর বলল, ‘আমি সত্যই জানি না। বিশ্বাস করেন, আমি সত্যই জানি না।

‘তুই না জানলে কে জানে?

তাও জানি না। আমি এই জিনিস দেখা তো দূরের কথা, কোনোদিন শুনিও নাই।’

না শুনলে এত রাতে তুই যাস কই? করস কী?

এই প্রশ্নের উত্তরে আবারও চুপ করে রইল রুস্তম। যেন কথাটা বলবে কি না পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছে না সে। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। একটা ভয়, দ্বিধা তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে আগলে ধরেছে।

কামাল বলল, তুই রাত-বিরাতে ওই ব্যাগ নিয়া কই গেছিলি? এত রাতে সবার চোখ এড়াইয়া তোর কাজ কী? আর তোর সঙ্গে এই টেটাই বা থাকে কেন?

রুস্তম হঠাৎ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, এইখানে কি এছাহাক আছো? বা মতি মিয়া?

উপস্থিত কেউ রুস্তমের কথার জবাব না দিলেও তার এমন প্রশ্নে অবাক হয়ে গেল। চোখ বাঁধা অবস্থায় সে বুঝল কী করে?

রুস্তম বলল, এছাহাক, ও মতি মিয়া। আমারে তোমরা মাইরো না। বিশ্বাস করো, আমি কিছু জানি না। আমি…।

রুস্তম কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই কামাল সজোরে লাথি বসাল তার কাঁধে। সে ছিটকে পড়ল মাটিতে। কামাল অবশ্য তাকে উঠে বসার সুযোগ দিল না। তার আগেই এছাহাককে বলল, ‘এছাহাক ভাই, এরে আর ছাড়া যাবে না। এর ঘটনা কী বুঝতে হবে। মতি মিয়া, এরে বাঁধো। টাইট করে বাঁধে।

২৭

বর্ষায় মানুষের রোগ-বালাই বেড়েছে। ফলে রোগীর চাপ বেশি। এর মধ্যেও তরু চেষ্টা করেছে যতটা সম্ভব পারুকে সময় দেয়ার। তবে তাকে নিয়ে কিছু অস্বস্তিও তার আছে। বিশেষ করে পারুর পরিবার ও স্বামীর ব্যাপারে। সেখানে যেন বড়সড় কোনো অস্বাভাবিকতা আছে। কিছু রহস্যময়তাও। সেই রহস্যময়তার ওপারে কী আছে কে জানে? তরু অবশ্য তা জানতেও চায়নি। সে এখানে এসেছে ডাক্তার হিসেবে। তার কাজ রোগীর চিকিৎসা দেওয়া। কারো ব্যক্তিগত, পারিবারিক বিষয় নিয়ে কৌতূহলী হওয়া তাকে মানায় না। এই অভ্যাসও তার নেই।

কিন্তু পারুদের নানা অস্বাভাবিক কথাবার্তা, আচরণ তাকে খানিক কৌতূহলী করে তুলেছে। আর সেই কৌতূহলের পালে হাওয়া জুগিয়েছে ফজু। সেদিন সন্ধ্যার ঘটনার পর ফজুর সঙ্গে তার কথা হয়েছে। তবে সেই কথাও স্বাভাবিক কিছু নয়। বরং অস্বাভাবিকই। শুধু তা-ই নয়। ফজুর সঙ্গে পরদিন তার দেখা হওয়াটাও অস্বাভাবিক। রাতে পারুকে একবার দেখতে গিয়েছিল তরু। টুকটাক এটা-সেটা কথাবার্তাও হচ্ছিল। এই সময়ে তার চোখ আটকে গেল পারুর ঠিক সোজা উল্টোদিকের জানলায়। সেখানে জানলার বাইরে পর্দার ফাঁকে গা হিম করা বিভৎস এক মুখ তাকিয়ে আছে। ঘরের আলো পর্দার ফাঁক গলে গিয়ে পড়েছে লোকটার চোখে। সেই আলোতে ভয়ংকর ওই মুখে যেন গনগন করে জ্বলে উঠেছে এক জোড়া আগুনে চোখ। আচমকা চোখ পড়ায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল তরু। তবে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলেও নিয়েছিল সে। কারণ সে চায়নি বিষয়টা কেউ জানুক। তবে ততক্ষণে একটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল তরুর কাছে। ফজুর সঙ্গে নিশ্চয়ই কোনো ঘটনা আছে পারুর। কিংবা বিশেষ কোনো সম্পর্ক। না হলে গত কদিন ধরেই কেন আড়াল থেকে পারুকে অনুসরণ করার চেষ্টা করছে সে? বিষয়টা তরুকে কৌতূহলী যেমন করে তুলল, তেমনি শঙ্কিতও।

.

রাতে বাসায় ফেরার ঠিক আগে নার্স ফাতেমা তরুর ঘরে এলো। তার মুখ শুকনো। চোখে ভয়ের ছাপ। তরু বলল, কী হয়েছে?

‘ওই লোকটা আসছে আপা।

‘কোন লোক?

‘ওই যে মুখ কাটা।

‘কোথায় আসছে?

‘আমাদের হাসপাতাল কম্পাউন্ডে।

‘কোনো সমস্যা?

‘সে আমারে তিন নম্বর বেডের রুগীর বিষয়ে এটা সেটা জিজ্ঞাস করে।

‘পারুলের বিষয়ে?

হুম।

‘কী জিজ্ঞেস করে?

হাসপাতাল কার্ডে তার স্বামীর নাম কী? কবে রিলিজ হবে এই সব?

তুমি কী বলছ?

‘আমি কিছু বলি নাই।’

‘গুড। সে এখন কোথায়?

তা তো জানি না। ভূতের মতো অন্ধকারের ভেতর থিকা বের হইল। আবার অন্ধকারেই হারাই গেল। এই দেখেন আপা, এখনো আমার হাত কাঁপতেছে!

তরু কথা বলল না। তবে বিষয়টা তাকে উদ্বিগ্ন করে তুলল। এখন মনে হচ্ছে, পুরো বিষয়টাই তার জানা উচিত। পারুর স্বামীর নাম কার্ডে কী লেখা, তা নিয়ে ফজুর কেন আগ্রহ? তার সঙ্গে কী এমন সম্পর্ক পারুর বা তার স্বামীর? আর পারুর হাসপাতাল ছাড়ার তারিখ জেনেই বা সে কী করবে?

আনারুলকে ডেকে তাকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় ফিরছিল তরু। পথ খুব একটা বেশি না হলেও মনে মনে যেন একটু শঙ্কিতই বোধ করছে সে। ফজু লোকটাও রহস্যজনক। সে এখনো পর্যন্ত বলেনি তার মুখের ওই আঘাতের কারণ। এমনকি নিজের সম্পর্কেও সে বেশিকিছু বলেনি। অথচ তারপরও লোকটার কথা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে মনে আছে তরুর।

রোজ অনেক রোগী দেখতে হয় তাকে। নানারকম রোগী। দূর-দূরান্ত থেকে। আসে তারা। তরু চেষ্টা করে যতটা সম্ভব সহজ হওয়ার। খোঁজ খবর নেয়ার। কিন্তু তারপরও সপ্তাহখানেক আগে আসা রোগীও যখন ফের দেখাতে আসে, তখন তাকে। নতুনই মনে হয়। আগের কথা সহজে মনে থাকে না। এর কারণও রয়েছে। এখানকার বেশির ভাগ মানুষই বিশেষত্বহীন। কিংবা তরুর চোখে আলাদা করে ধরা পড়ে না। তাদের পোশাক-আশাক, ভাব-ভঙ্গি, কথা বলার ধরন থেকে চেহারাও প্রায় একই রকম মনে হয়। ফলে চট করে আলাদা করাটা, নির্দিষ্ট কাউকে মনে রাখাটা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। তবে এতকিছুর মধ্যেও ফজুকে তার মনে আছে।

এর কারণ কি কেবলই ফজুর ওই বিভৎস গাল? তরু ভেবে দেখেছে, শুধু গালই নয়। বরং এছাড়াও আরো অনেক কারণ আছে। তার আচার-আচরণও সন্দেহজনক। সে মুখে কথা বলে কম। কিন্তু তার চোখ তীক্ষ্ণ। সেই চোখে নানা রকম অভিব্যক্তি আছে। যেন অন্ধকারেও জ্বলজ্বল করে।

তরু আনমনে নানা কিছু ভাবছিল। এই মুহূর্তে অন্ধকার সরু রাস্তার ওপার থেকে ছায়ামূর্তিটা বেরিয়ে এলো। মুখ না দেখেও তরুর অনুমান করতে অসুবিধা হলো না যে লোকটা ফজু। সে কি তার কোনো ক্ষতি করতে চায়? সেটা হবার কথা নয়। বরং তরুর প্রতি তার কৃতজ্ঞই থাকার কথা। কারণ যে পরিস্থিতিতে সে তার চিকিৎসা করেছে, সেটা অন্য কেউ হলে হয়তো করতই না। তাহলে? সে কি তাকে কিছু বলতে চায়?

ফজুকে দেখেই সতর্ক হয়ে উঠেছে আনারুল। সে তার পথ আগলে দাঁড়াল। বলল, তুই এই রাইতে এইখানে কেন?

ফজু ফ্যাঁসফেঁসে গলায় বলল, ম্যাডামের লগে কথা আছে।

কী কথা?

‘আছে। কথা আছে।’

কথা থাকলে দিনে আয়। রাইত-বিরাতে কী?

‘এখনো রাইত হয় নাই। কেবল সন্ধ্যা হইল।’

সন্ধ্যা হইলেও বলা যাইব না। তুই দিনে আয়। ফজু অবশ্য দমল না। সে দাঁড়িয়েই রইল। তরু বলল, ওকে আসতে দাও। আমার বাসার নিচে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসাও।

.

ফজু বেঞ্চিতে বসে আছে। তার সামনে একটা কাঠের টেবিল। টেবিলের অন্যপ্রান্তে তরু। আনারুল ছাড়াও এই বাড়ির দারোয়ান বশির তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। তরু বলল, ‘বলুন, কী বলতে চান?

‘আমার মুখ কী এইরকমই থাকব?’

হুম।

আর কোনোদিন ভালো হইব না?

‘সেরকম সুযোগ আসলে নেই।

“কেন?”

‘এখানে এর চাইতে বেশি কিছু করা সম্ভবও ছিল না। ইমার্জেন্সি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তারপরও আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।’

তরু থামলেও ফজু কথা বলল না। খানিক চুপ থেকে তরুই বলল, আপনি এখানে কেন এসেছেন?

মুখ দেখাইতে। ফজুর গলা অস্বাভাবিক শীতল।

‘এতবার তো মুখ দেখানোর কিছু নেই। আপনি ওষুধগুলো খান। যে মলমগুলো মাখতে বলা হয়েছে, সেগুলো মাখুন। তারপর এক মাস পর এসে আমাকে দেখাবেন। কিন্তু আপনাকে আমি গত কয়েক দিন ধরেই হাসপাতালের আশপাশে ঘুরঘুর করতে দেখছি।

হাসপাতালে থাকতে থাকতে অভ্যাস হইয়া গেছে। এইজন্য। ফজু হাসল। তার সেই হাসি ভয়াবহ।

হাসপাতাল অভ্যাসে থাকার জায়গা না। এটা অসুস্থতার জায়গা।

‘তাইলে অসুস্থ হওনের চেষ্টা করব?

কী আশ্চর্য, আপনি ইচ্ছা করে কেন অসুস্থ হবেন?

ফজু এই প্রশ্নের জবাব দিল না। তরু বলল, আর আপনাকে আমি বলেছিলাম, যতটা সম্ভব বাইরে গেলে মুখ ঢেকে রাখবেন। যাতে বাইরের জীবাণু, ময়লা, ধুলা-বালি মুখে না যেতে পারে। এতে করে ইনফেকশন হতে পারে। কিন্তু আপনি তো আমার কথা শুনছেনই না। আপনি সবার সামনে মুখ বের করে হাঁটছেন।’

ফজু এই কথারও কোনো উত্তর করল না। তরু বলল, আর কিছু বলবেন?

হুম।

বলুন।

ফজু সঙ্গে সঙ্গে কোনো কথা বলল না। সময় নিল। তারপর বলল, তিন নম্বর বেডে যে আছে, সে ছাড়া পাইব কবে?

‘কেন? সেটা দিয়ে আপনার কী দরকার?’।

‘সে আমার আত্মীয় হয়। মামাতো ভাইয়ের বউ। ভাবি।’

‘ভাবি হলে আপনি দূরে দূরে আছেন কেন? কাছে যান। কথা বলেন। আপনার ভাই যেহেতু এই মুহূর্তে নেই। এই সময়েতো একজন পুরুষ মানুষ দরকার, তাই না? অথচ আপনি দূর থেকে উঁকিঝুঁকি মারছেন। আমার কাছে এসেছেন খবর জানতে। এটা কী ধরনের কথা? আপনি নিজে গিয়ে কেন জিজ্ঞেস করছেন না?

‘অসুবিধা আছে।’

কী অসুবিধা?’

ফজু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না।

তরু বলল, আপনার মামাতো ভাই কোথায়? সে তার স্ত্রীর এই অবস্থা রেখে কোথায় গেছে?

তারে পুলিশে ধরছে।

‘পুলিশে ধরেছে! ভারি অবাক হলো তরু। তাবারন বিবি তাহলে তাকে মিথ্যে বলেছিলেন! কেন? পুলিশে ধরেছে কেন?

আছে অনেক ঘটনা আছে।

কী ঘটনা?

‘খুন-খারাবির মামলা। এতসব আপনের জানন দরকার নাই। না জাননই ভালো।’

হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেল তরু। তারপর বলল, আপনি নাকি নার্সের কাছে। রোগীর স্বামীর নাম জানতে চেয়েছেন?

ফজু কথা বলল না। তরু বলল, আপনি আপনার নিজের মামাতো ভাইয়ের নাম জানেন না?’

‘তার নাম কাশেম। কাশেম মিয়া।

তাহলে? নার্সের কাছে আপনি কেন আবার তার নাম জানতে চাইলেন?

‘সে কাশেমের দ্বিতীয় বউ। কিন্তু তারা দুজনই বলে তারা নাকি স্বামী-স্ত্রী না। সে বলে কাশেম নাকি তার স্বামী না। তার স্বামী অন্য।

কী বলছেন? অন্য কে?

‘তা তো জানি না। আগে ভাবতাম এইগুলা মিথ্যা। কিন্তু এখন মনে হয় সত্য। এইখানে অন্য কোনো ঘটনা আছে।’ কথাটা বলে গম্ভীর হয়ে রইল ফজু। সে তার গালের আহত অংশে হাত বোলাচ্ছে। তরু বুঝতে পারছে না কী বলবে। সবকিছুই ক্রমশ আরো জটিল এবং ধোঁয়াশাপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে।

আপনি আড়াল থেকে কেন তার দিকে নজর রাখছেন?

‘এই চেহারা নিয়া কারো সামনে যাওন যায়? তা ছাড়া মাইয়া মানুষ। ভয় পাইব?’

আপনি কিন্তু এখনো বলেননি, আপনার মুখের এই অবস্থা কী করে হলো?

বলছি তো। রডের কারণে। ট্রলারে ছিল। নামতে গিয়া হুমড়ি খাইয়া পইড়া গেছি।

উঁহু। আপনি ভুলে যাচ্ছেন আমি ডাক্তার। আপনি মিথ্যা বলছেন। আসল কারণটা বলুন।

ফজু চুপচাপ তার পায়ের আঙুলের দিকে তাকিয়ে রইল। দীর্ঘসময়। এক হাতে সে ক্রমাগত তার আহত গালখানা ঘসে চলেছে। আরেক হাতের নখে আঁচড় কাটছে কাঠের টেবিলে। তারপর আচমকা মুখ তুলে তাকাল সে। বলল, বলব। সময় হলেই বলব।’

তরু কথা বলল না। তার হঠাৎ কেন যেন খুব ভয় করছে। নিজের জন্য না, পারুর জন্য। তার মনে হচ্ছে, ফজু পারুর বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করবে। কিন্তু সেই ক্ষতি থেকে পারুকে রক্ষা করার ক্ষমতা তার নেই। বিষয়টা বুঝতে পেরেও কিছুই করতে পারবে না সে। এখানে অবশ্য আরো কিছু ভাবনা তাকে বিচলিত করে তুলছে। গাছের শিকড়ের মতো মস্তিষ্কের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। কখনো মনে হচ্ছে, পারু, ফজু, তাবারন বিবির মধ্যে যে রহস্যময় ব্যাপারগুলো রয়েছে, সেগুলো তার জানা দরকার। জানা দরকার পারুর স্বামীর ঘটনাও। কিন্তু পরক্ষণেই আবার মনে হচ্ছে, শুধু শুধু কেন এসব নিয়ে বিচলিত হচ্ছে সে? সে একজন ডাক্তার। তার অসংখ্য রোগী। তাদের প্রত্যেকের জীবনেই হয়তো এমন নানা রহস্য, সংকট রয়েছে। সেসব উদ্‌ঘাটন কিংবা সমাধানের দায়িত্ব তার নয়। সে এখানে না এলেও তাদের জীবন চলে যেত। বরং এই অচেনা-অজানা জায়গায়, উপযাচক হয়ে কোনো বিপদে নিজেকে যুক্ত করার কোনো মানে হয় না।

ফজু সরাসরি তার চোখে চোখ তুলে তাকাল। তারপর বলল, তার হাসপাতাল থিকা ছাড়নের তারিখটা বললে আমার সুবিধা হইত। না বললেও অসুবিধা নাই। আমার একটু সময় লাগব আর কী!

বলেই সে উঠে দাঁড়াল। কপালে হাত ঠেকিয়ে সালাম দিল তরুকে। তারপর ধীর পায়ে বের হয়ে গেল বারান্দা থেকে। একবারের জন্যও আর পিছে ফিরে তাকাল না সে।

.

পারুর পুরোপুরি সুস্থ হতে আরো বেশ কিছুদিন সময় লাগবে। কিন্তু তরু চাইছে তাকে খানিক আগেভাগেই ছেড়ে দিতে। এর অবশ্য কারণও আছে। তরুর ধারণা, পারুর বাড়ি ফিরে যাওয়ার পথে কোনো একটা ঝামেলা করার চেষ্টা করবে ফজু। যেহেতু সে বারবার পারুর হাসপাতাল ছাড়ার তারিখ জানতে চাইছিল, সেহেতু এটিই সম্ভবত তার উদ্দেশ্য। নিজেকে এই পুরো বিষয়টি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চাইলেও শেষ অবধি পারল না তরু। তার মনে হলো, ফজুর চোখ এড়িয়ে পারুকে বাড়ি ফিরে যাওয়ার সুযোগ করে দিতে পারলে সেটিই সবচেয়ে ভালো।

এসব ভেবে পরদিনই একটা কাজ করল সে। আনারুলকে ডেকে বলল, ‘একটা কাজ করতে পারবে?

কী কাজ?

ফজু যদি আবার তোমার কাছে আসে, তিন নম্বর ওয়ার্ডের রোগীর রিলিজ ডেট জিজ্ঞেস করে। তাহলে বলবে যে তার কিছু ঝামেলা আছে।’

‘কী ঝামেলা?

‘সেটা তোমার জানার দরকার নেই। তুমি শুধু বলবে বড় ধরনের সমস্যা হয়েছে। রোগীর ছাড়া পেতে কমপক্ষে আরো সপ্তাহ দুয়েক লাগবে। ঠিক আছে?

‘জি, আচ্ছা।

এই একই কথা সে নার্সদেরও শিখিয়ে দিল। তরুর ধারণা, ফজু এত সহজে হাল ছেড়ে দেবে না। সে এর-ওর কাছ থেকে আবারও এই তথ্য পাওয়ার চেষ্টা করবে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সে তা করলও। পরদিন সন্ধ্যাবেলাই আনারুল এসে বলল, ম্যাডাম, একখান কথা।

‘কী?’

‘ফজু আইজ আসছিল, এই একটু আগে।

কী বলে? কিছু জানতে চায়?

হুম। তিন নম্বর ওয়ার্ডের রোগীর কথা। আমি বললাম যে আরো সপ্তাহখাকেন এইখানে থাকা লাগবে।

‘শুনে কী বলল?

জিজ্ঞাস করল, আমি নিশ্চিত কি না?

তারপর?

আমি বললাম এক শ তে এক শ সিওর। শুইনা দেখলাম সে খুশি হইল। তারপর কিছুক্ষণ হাবিজাবি কথা বইলা চইলা গেল।’

হুম।’ বলে মাথা নাড়ল তরু। সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, যত দ্রুত সম্ভব পারুকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।

.

তরু পারুকে ছেড়ে দিল তার তিন দিনের মাথায়। এর মধ্যে সে ফজুর খোঁজখবরও নিয়েছে। সেদিনের পর আর তাকে দেখা যায়নি। হঠাৎ করেই যেন উধাও হয়ে গেছে সে। তার মানে, আনারুলের বলা সময় অনুযায়ী আবার ফিরে আসবে। এই সুযোগটাই তৈরি করতে চেয়েছিল তরু। তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে দেখে মনে মনে খুব তৃপ্ত অনুভব করল। পারুকে রিলিজ দেয়ার আগে সে ওয়ার্ডে গেল। তাবারন বিবিকে খানিক বিচলিত লাগছে। সালমাকেও। তরু বলল, আপনাদের কাগজপত্র যা আছে, সেগুলো নার্স দিয়ে যাবে। আপনারা একজন শুধু সাইন। টিপসই দিলেই হবে।’

তাবারন বিবি মাথা ঝাঁকালেন।

তরু পারুর দিকে ফিরে বলল, আপনাকে আরো কয়েকটা দিন এখানে রাখতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু দেখছেন তো রোগীর কী চাপ! এতটুকু হাসপাতালে এত মানুষকে সেবা দেয়া কিছুতেই সম্ভব না। তারপরও আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’

পারু বলল, না না। কোনো সমস্যা নেই।’

‘উঁহু। সমস্যা আছে। আপনাকে সাবধানে থাকতে হবে। বাড়িতে এখুনি খুব ভারী কাজ-টাজ করা যাবে ন। আর আপনার হাজবেন্ডকে বলবেন, সে যেন আপনার আশপাশে থাকে। এভাবে স্ত্রীকে বিপদে ফেলে রেখে পালিয়ে বেরালে হবে না। সন্তান আপনার একার না, তারও।’ তরু ইচ্ছে করেই কথাটা বলল। যদি এর জবাবে স্বামীর বিষয়ে কিছু বলে পারু! কিন্তু সে কিছু বলল না। বলল না অন্যরাও।

দুপুরের দিকে বেরিয়ে গেল পারুরা। তার আগে তাবারন বিবিকে ডাকল তরু। তারপর তার হাতে ছোট্ট সেই অলংকারটুকু তুলে দিতে দিতে বলল, এটা আপনার।

তাবারন বিবি চট করে জিনিসটা দেখতে পেলেন না। বললেন, ‘আমার? হুম।

রোগী ভর্তির দিন আমাকে দিয়েছিলেন।

‘ওহহ।’ এস্ত ভঙ্গিতে বললেন তাবারন বিবি। এইটা আমি আপনেরে দিছি। চিকিৎসার খরচ। হাসপাতালের খরচ। নগদ টাকা তো আমার কাছে নাই।’

তরু হাসল, আমি তো ডাক্তার। এইখানে ডাক্তারকে কিছু দেয়ার নিয়ম নেই। খরচ সব দিতে হয় হাসপাতালকে।

তাইলে আপনে দিয়া দেন।

‘এই নাকফুল হাসপাতালকে দিয়ে দেব? সেটা কি ঠিক হবে? দেখতে ভালো দেখাবে?

তরুর প্রশ্নে হঠাৎ থতমত খেয়ে গেলেন তাবারন বিবি। আসলেই তো, কোনো মানুষকে না হয় গয়না দেয়া যায়। কিন্তু হাসপাতালকে যায় না। তিনি চট করে বললেন, ‘এইটা বেইচা যেই টেকা পাইবেন, ওইটা হাসপাতালে দিয়া দেবেন।

‘আচ্ছা, দেব। তবে এটা আপাতত আপনি রাখুন। এখানে তো আমি নতুন। এসব বিক্রির লোকজনও চিনি না। খোঁজখবর করি। এর পরের আবার যখন আপনি আসবেন, তখন বিক্রি করে ফেলব।

তাবারন বিবি তরুর কথা কিছুই বুঝলেন না। তরু অবশ্য বুঝতেও দিল না। তার চোখে এখনো গেঁথে আছে সেই ঝড়-বৃষ্টির রাতের দৃশ্যটা। সঙ্গাহীন মৃতপ্রায় এক তরুণীর পাশে দু হাত তুলে মোনাজাতের ভঙ্গিতে বসে আছেন এক থুথুরে বৃদ্ধা। বাইরে প্রবল বজ্রপাত, বিদ্যুৎ চমক। ঝোড়ো হাওয়া আর বৃষ্টির তুমুল ঝাঁপটায় ভিজে জবজবে হয়ে আছেন তারা। ঝাবিক্ষুব্ধ ওই রাতে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে ছুটে এসেছেন তারা! ভেবে অবাক হয়ে গিয়েছিল তরু। তারচেয়েও অবাক হয়ে গিয়েছিল এই বৃদ্ধ রমণীর সেই অপার্থিব প্রার্থনার ভঙ্গি দেখে। ওই দৃশ্যটা কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারেনি সে। হয়তো এ কারণেই এই মানুষগুলোর প্রতি খানিক পক্ষপাত তৈরি হয়েছে তার। খানিক মায়া। ওই মায়াটুকু সে পুষেই রাখতে চায়। দিন-রাত যে রোগ আর জরা, শোক আর যন্ত্রণা সইবার কাজ তাকে নির্বিকার ভঙ্গিতে করে যেতে হয়, সেখানে এই মায়াটুকু থাকুক। থাকুক এই মমতার্ধ মানুষটির খানিক ছায়াও।

.

পারুরা চলে গেল তখনই। দুপুরের দিকে খানিক ফুরসত মিলল তরুর। সে বাসায় চলে এলো। একটু বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আবার হাসপাতালে যেতে হবে। গত কদিন ধরে যে টানা পরিশ্রম যাচ্ছে, তাতে দুপুরের এই বিরামটুকু বেশ উপভোগ করল সে। খানিক গা এলিয়ে নিল বিছানায়। তার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। দ্রুত প্রস্তুত হয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো সে। শেষ বিকেলের আকাশটা কেমন ম্লান। তবে ফুরফুরে একটা হাওয়াও আছে। ওই হাওয়াটুকু খুব ভালো লাগল তরুর। হাসপাতালে ঢুকে নিজের রুমের জানালার কাছে খানিক দাঁড়াল সে। এখান থেকে নদীটা বেশ কাছে। পর্দা সরালেই কোলাহলপূর্ণ ঘাট দেখা যায়। সেখানে কতগুলো নৌকা ভিড়েছে। সম্ভবত নতুন রোগী এসেছে। কিন্তু সেসব দেখতেও বেশিক্ষণ ভালো লাগল না। আলতো হাতে জানালার পর্দা টেনে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল। খুব অল্পতেই আজকাল ক্লান্ত লাগে। মনে হয় একবার ঢাকা ঘুরে না আসা অবধি এই ক্লান্তিটা কাটবে না।

এতবার পরিকল্পনা করেও শেষ অবধি আর যাওয়া হয়নি। কিন্তু এবার যে করেই হোক ঢাকা যাবেই সে। ভেতরে ভেতরে দমবন্ধ হয়ে আসছে। মহিতোষের মুখটা দেখার জন্য ছটফট করছে বুক। কেমন আছেন মানুষটা? সত্যি সত্যিই কি কাউকে চিনতে পারছেন না তিনি? সে যদি যায়, গিয়ে তার সামনে দাঁড়ায়, তাহলে তাকেও কি চিনতে পারবেন না? কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতর কেমন চিনচিন করে সূক্ষ্ম এক ব্যথার অনুরণন টের পেল সে। ঘুরে চেয়ারে এসে বসল। টেবিলে অনেক অগোছালো কাগজপত্র। রোগীদের ফাইল। নানা অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সেগুলো সরাল তরু। খানিক গোছগাছ করে রাখল।

এরপর ফাইলগুলোর কাছে এলো। এগুলোও আলাদা করে রাখতে হবে। আনমনা ভঙ্গিতে ফাইলগুলো গুছিয়ে রাখছিল সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে পারুর ফাইলটা তার চোখে পড়ল। সম্ভবত নার্স ফাতেমা রেখে গেছে। কিছু সই বাকি আছে তার। তরু নিরস ভঙ্গিতে কাগজগুলোতে স্বাক্ষর করতে লাগল। তারপর সরিয়ে রাখল পাশে। আর তখুনি কী কারণে যেন ভ্রু কুঁচকে গেল তার। কিছু একটাতে চোখ আটকে গেছে। তরু ফাইলের ভেতর থেকে কাগজগুলো টেনে নিল। রোগী বা তার আত্মীয়দের পূরণ করতে হয়, এমন একটা কাগজে খানিক কাটাছেঁড়া আছে। সে কৌতূহলী ভঙ্গিতে কাগজটা দেখল। সেখানে রোগীর নামের জায়গায় স্পষ্ট অক্ষরে পারুর নাম লেখা-পারুল। কিন্তু রোগীর স্বামীর নামের জায়গায় কাশেম লেখা নামটা কেউ কলম দিয়ে আড়াআড়ি কেটে দিয়েছে। কে কাটল? কেন কাটল? কাশেম কি তবে তার স্বামী নয়?

তরু ভালো করে কাগজটা দেখল। স্বামীর নামের ঠিক নিচেই রোগীর বিকল্প অভিভাবক হিসেবে বাবার নামের একটা অপশনও রয়েছে। সেই অপশনে টিক চিহ্ন দিয়ে কেউ একজন স্বামীর পরিবর্তে রোগীর বাবার নাম লিখে রেখেছে। সমস্যা হচ্ছে নামটা দেখে তরুর পায়ের নখ থেকে মাথার চুল অবধি কেঁপে উঠল। মনে হলো, সে ভুল কিছু দেখছে। কিংবা এর চেয়ে সুন্দর, এর চেয়ে আরাধ্য কিছু আর এ জগতে নেই। সে উঠে দাঁড়াল। তার চারপাশের পৃথিবীটা যেন বনবন করে ঘুরছে। কী করবে এখন সে? চিৎকার করে লোকজন সব জড় করবে? আনারুল বা নার্সদের ডাকবে? কিংবা নিজে ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে? নাকি চুপচাপ বসে থাকবে?

সে চুপচাপ বসেই রইল। তার সামনে থাকা কাগজটাতে রোগীর বাবার নামটা জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সেখানে স্পষ্ট হস্তাক্ষরে লেখা, রোগীর পিতার নাম-মহিতোষ চন্দ্র রায়!

.

কে লিখেছে নামটা?

তরু নার্স ফাতেমাকে ডাকল। ফাতেমা বলল, ‘ম্যাডাম, আমি যখন সবকিছু চেক করে, বুঝিয়ে দিয়ে চলে আসছিলাম, তখন পেশেন্ট হঠাৎ এই কাগজটা চেয়ে নিল।

তারপর?

তারপর বলল, কলমটা দিন। আমি কলমটা দিলাম। সে তখন তার স্বামীর নাম কেটে সম্ভবত বাবার নাম লিখল।

‘তুমি তখন দেখোনি কী লিখেছে?

না ম্যাডাম। আমার তখন খুব তাড়া ছিল। পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের রোগীর অবস্থা ভালো না।

তরু কথা বলল না। নামটা তবে পারুল নিজেই লিখেছে? পারুল! মানে পারু? সে-ই তবে পারু?

তরুর গা ঝিমঝিম করছে। মাথা কাজ করছে না। চারদিকের পৃথিবী মুহূর্তেই যেন কেমন ধোঁয়াশার মতো আবছা, অস্পষ্ট হয়ে গেল। সে ঝট করে উঠে দাঁড়াল।

২৮

শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে ফরিদ আর আছমার বিয়ের কথা থাকলেও বিয়ে হলো না। এর অবশ্য কারণও আছে। মসজিদের ইমাম সাহেব উপস্থিত জনতার কাছে। ফরিদের ফিরে আসার কথা জানালেন। জানলেন যে সে এখন গ্রামেই আছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে। কিন্তু জনতা তা মানল না। তারা সঙ্গে সঙ্গেই ফুঁসে উঠল। যেন ফরিদকে হাতের কাছে পেলে এখুনি তাকে জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে ফেলবে। ইমাম সাহেব অনেক চেষ্টা করেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেন না। তবে তাকে এই পরিস্থিতি থেকে অভাবিতভাবে রক্ষা করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি সাধারণত এমন কিছু করেন না। আজ যে করলেন তার পেছনেও কারণ আছে। সেই কারণ এখনো কেউ জানে না। বিষয়টা নিয়ে তিনি চিন্তিত। আর সে কারণেই নিজের একটা অহিংস, সহনশীল ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টা করলেন। সেই সঙ্গে তার হৃৎ গৌরব ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও।

ফরিদের ফিরে আসার ঘটনাটি তাকে আগেভাগেই জানিয়েছিলেন ইমাম সাহেব। শুনে বিষয়টা নিয়ে কামালের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেছিলেন তিনি। কামাল বলেছে, এটি তার জন্য একটি সুবর্ণ সুযোগ। এই সুযোগে নিজের অন্যরকম ভাবমূর্তি তৈরি করতে হবে। উদার, ক্ষমাশীল, মহৎ মানুষের ভান ধরতে হবে। বিষয়টা জনগণের প্রচলিত ভাবনা ও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার চিরাচরিত বৈশিষ্ট্যের বিপরীতে হলেও তিনি যদি এটি প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন, তবে তা সকলের কাছে নতুন এক জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকেই প্রতিষ্ঠিত করবে। যিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি বিচক্ষণ, উদার, দয়াশীল।

ফলে লোকজন হইচই করতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘পাপ যে করছে, বিচার তার হবেই। এই বিচার থেকে তার রক্ষা নাই। কী বলেন মিয়ারা?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার এমন কথা শুনে উত্তেজিত জনতা খানিক শান্ত হলো। ভূঁইয়া বললেন, তবে একটা কথা। অশান্তি করা যাবে না। আমাদের ধর্মে কিন্তু অশান্তির কথা বলা নাই। কি আছে?

তার এই প্রশ্নে সবাই দ্বিধান্বিত হয়ে গেল। কী বলতে চাইছেন তিনি? তবে কেউ কোনো জবাব দিল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, আমাদের ধর্ম ইসলাম। ইসলাম মানে কী? শান্তি, তাই না?

এবার যেন কিছু কণ্ঠ উচ্চকিত হয়ে উঠল, ‘জি।

‘তাহলে? আমরা অশান্তি কেন করব? যা করার শান্তিপূর্ণভাবে করব। শাস্তি দিলেও সেই শাস্তি যেন অন্যায় শাস্তি না হয়, সেই দিকেও আমাদের খেয়াল রাখতে হবে। কী? ভুল বললাম নাকি মিয়ারা?’।

উপস্থিত জনতা বুঝতে পারছে না তিনি কী বলতে চাইছেন। তারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেল। তাদের কেউ কেউ সাড়া দিল। বাকিরা চুপ করে রইল। ভূঁইয়া এই সুযোগে বললেন, আমাদের ধর্মে পাপের শাস্তি যেমন আছে, তেমনি ক্ষমার কথাও বলা আছে। এই জন্য বুঝতে হবে কোনটা কখন কোথায় প্রযোজ্য। আমি কি ভুল কিছু বললাম, ইমাম সাহেব?

তিনি ইমাম সাহেবের দিকে তাকালেন। ইমাম সাহেব মাথা নাড়লেন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ফরিদ বড় ধরনের অন্যায় করছে, এই কথা যেমন সত্য। তেমনি এই কথাও সত্য যে সে তার ভুল বুঝতে পারছে। এবং এখন সে তার ভুলের জন্য ক্ষমা চায়। তওবা করতে চায়। এই সুযোগটা কি তারে আমাদের দেওয়া উচিত না?

এই কথায় উপস্থিত জনতা আবার চুপ করে গেল। তারা কেউ কোনো কথা বলল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আজ প্রস্তুতি নিয়েই এসেছিলেন। তিনি ধর্মীয় বিভিন্ন উদাহরণ, যুক্তি, বাণী শোনালেন। তারপর বললেন, ফরিদ তো ধর্ম ত্যাগ করে নাই। সে একটা ভুল করেছিল। ভুল বুঝে আবার ফিরে এসেছে। আর আজ আমাদের সবার সামনেই সে তওবা করবে। তারপর তার সঙ্গে আছমার বিয়া হবে। আছমারে তো আপনারা সবাই চেনেন। খুবই ভালো, নামাজি, পরহেজগার মেয়ে। তার সঙ্গে বিয়া হইলে ফরিদ দেখবেন কয়দিনের মধ্যে অন্যরকম মানুষ হয়ে যাবে। তখন সেইটা দেখতে আপনাদের ভালো লাগবে না? এই ভালো কাজের ছোঁয়াব কিন্তু আপনেরাও পাইবেন। নাকি?

কথাগুলো সহজ সাধারণ হলেও এর একটা প্রভাব সকলের মধ্যেই দেখা গেল। তবে তারপরও পুরো পরিস্থিতি সামলাতে বেশ সময় লাগল। আসরের নামাজের সময় ফরিদকে নিয়ে এসে তওবা পড়ানো হলো। যদিও সেই ফরিদ কেমন অসংলগ্ন, ঘোরগ্রস্ত। যেন সে নিজেই জানে না এখানে কী হচ্ছে, সে কী করছে! রাতে আছমার সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের সময় আকাশ ভেঙে বৃষ্টি হলো। বাসরঘরে ঢুকেই ফরিদ ঘুমিয়ে গেল। সে আমার সঙ্গে কোনো কথা বলল না। পায়ের জুতো, গলার মালা, মাথার পাগড়ি অবধি খুলল না। আছমা তার শিয়রের পাশে বসে রইল মাঝরাতে ঘুম ভাঙল ফরিদের। সে বলল, আছমা, তুই কি একটা কাজ করতে পারবি?

কী কাজ?

‘আমাকে একটা গান শোনাতে পারবি?

‘গান? অবাক গলায় বলল আছমা।

হ্যাঁ, গান।

আছমা গলা নিচু করে বলল, স্বামীকে গান শোনানো অন্যায় না। কিন্তু আমি তো গান জানি না।’

‘জানা লাগবে না। আমি গানের কথা বলব, তুই গুনগুন করে গাইবি। পারবি না?”

‘পারব।’

বল—

পারু নামের পরী মেয়ের ঘর গেল ভাসিয়া,
নয়া গাঙের নয়া পানি সেইখানে আসিয়া।
ভাঙিয়া দিল তাহার আসমান জমিন সব,
সব হারাইয়াও বাচল পারু যেন জ্যান্ত শব…।

আছমা এই গান গাইতে পারল না। সে চুপ করে রইল। ফরিদ বলল, ‘কী হইল? গান গাইবি না?

আছমা এবারও কথা বলল না। ফরিদ বলল, তালেব্য শ, ব– শব। শব মানে জানস?

আছমা ডানে-বায়ে মাথা নাড়ল, না।

শব মানে লাশ। জ্যান্ত শব মানে জীবিত লাশ। আমার ধারণা আমার পারু সব হারাইয়াও বেঁচে আছে। সে জ্যান্ত লাশ হয়ে বেঁচে আছে। আমি আমার পারুরে সেইখানে রেখে এইখানে কী করছি? কী করছি আমি?

আছমা ফরিদের দিকে তাকাল। ফরিদের গায়ে এখনো বিয়ের শেরওয়ানি। গলায় মালা। কিন্তু তাকে দেখতে লাগছে পাগলের মতো। তার চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। সেই দৃষ্টি দেখে আছমা ভয় পেয়ে গেল। সে বলল, আপনের কী হইছে? কী হইছে আপনের?’ এতদিন তুমি করে বললেও আজ কেন যেন ফরিদকে তুমি বলতে তার লজ্জা লাগছে।

ফরিদ কথা বলল না। সে তার পাগড়ি ছুঁড়ে ফেলল। গলার মালা, পরনের শেরওয়ানি ছুঁড়ে ফেলল। তারপর বলল, আমি যাই আছমা। আমাকে বিদায় দে।’

‘আপনে কোথায় যান?’

‘পারুর কাছে। আমার পারুরে খুঁজে আনতে। পারু যদি জানে যে আমি তোরে বিয়া করছি, তাহলে কী হবে বুঝতে পারছিস?’

আছমা কথা বলল না।

কী হলো? পারছিস না?

আছমা এবারও কথা বলল না। ফরিদ বলল, “খবরদার এই কথা কিন্তু ভুলেও পারুরে বলবি না। মনে থাকবে?

আছমা হাত বাড়িয়ে ফরিদকে ধরতে গেল। ফরিদ তাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিল। খাটের পায়ায় লেগে তার কপাল কেটে দরদর করে রক্ত বেরোতে লাগল। কিন্তু ফরিদ সেদিকে ভ্রূক্ষেপও করল না। সে দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। আকাশ ভেঙে বৃষ্টি পড়ছে। তবে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার হওয়ায় সেই বৃষ্টি দেখা যাচ্ছে না। ফরিদ সেই অন্ধকার আর তুমুল বৃষ্টির মধ্যে বড় বড় পা ফেলে অদৃশ্য হয়ে গেল।

২৯

সন্ধ্যা হতে খুব বেশি বাকি নেই। তবে সেটা এখানে বোঝা যাচ্ছে না। বিশাল নদীর বুকে তখনো বেশ আলো। সেই আলোতে দূরে বিন্দুর মতো এগিয়ে আসা ট্রলারখানা দেখল রবিউল। সে সালমার ছেলে। পারুকে ওই ঝড়-বাদলের রাতে সে-ই ট্রলার বেয়ে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। আজ আবার নিয়ে ফিরছে। তবে দীর্ঘ এই যাত্রাপথে ইঞ্জিনের একঘেয়ে শব্দে সকলেই ক্লান্ত। সবচেয়ে বেশি ক্লান্ত তাবারন বিবি। তার বয়স হয়েছে। এই বয়সেও গত কদিন ধরে তিনি যা করেছেন, তা অবিশ্বাস্য। কিন্তু আজ এই মুহূর্তে নিজেকে প্রায় চলৎশক্তিহীন মনে হচ্ছে তার। কোমর আর পা-ও ধরে এসেছে। খানিক হাঁটা-চলা করতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু এই নদীর মাঝখানে সে সুযোগ নেই। সালমা তারপরও তার ছেলেকে ডেকে বলল, “ও রবিউল। ট্রলারখান একটু পাড়ে ভিড়ানো যায় না? আর কতক্ষণ এইভাবে একজায়গায় বইসা থাকন যায়? হাত পায়ে খিল ধইরা গেল রে বাজান।’

রবিউল চেঁচিয়ে বলল, এই জায়গা ভালো না মা। দেখো না আশপাশে মানুষজন, বাড়িঘর কিছু নাই? ট্রলার থামানো মানেই বিপদ।

সালমা ছেলের কথা শুনে ভালো করে একবার চারপাশটা দেখে নিল। তারপর বলল, কথা ভুল কস নাই। দূরে ওই যে একটা ট্রলার আসতেছে। ওইটার জইন্য কি একটু দাঁড়াবি নাকি? লোকজন বেশি থাকলে ভয়-ডর কম। ওই দিন রাইতে তো ঝড়-বৃষ্টি ছিল, চোর ডাকাইতেরও ডর আছিল না। কিন্তু আইজ একটু কেমন জানি লাগতেছে!’

মায়ের কথায় দ্বিমত করতে পারল না রবিউল। সে বলল, ‘কথা ঠিকই বলছ মা। কিন্তু ওই ট্রলারের লোকজনই বা কেমন, সেইটা কীভাবে বুঝব? খারাপ লোকও তো হইতে পারে? শোনো নাই, এইদিকে মানুষ ট্রলার নিয়াই ডাকাতি করে? খুনখারাবি পর্যন্ত?

রবিউলের কথা শুনে সালমা আবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। তবে সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তাবারন বিবি আর পারু। পারু জানে, সে তার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়ে এসে উপনীত হয়েছে। এতদিন যা-ই ঘটুক না কেন, তাতে কখনো কখনো সে কেবল নিজের কথাই ভাবতে পেরেছে। অন্য কারো কথা না ভাবলেও চলেছে। কিন্তু এখন আর সেটি সম্ভব নয়। তার সঙ্গে যে ফুটফুটে শিশুটি রয়েছে, সে তার মা। যে করেই হোক তার নিরাপত্তা তাকে নিশ্চিত করতেই হবে। আগলে রাখতে হবে পরম মমতায়, নির্ভরতায়। কিন্তু সেই শক্তি কিংবা সামর্থ্য কি তার আছে?

এখন এই সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবে সে? তাবারন বিবি তাকে যে ভালোবাসা দেখিয়েছেন, তা কল্পনাতীত। পারুর ধারণা, ভগবানের প্রতি তার এই যে এত অভিযোগ, অনুযোগ–এ যেন তারই প্রতি উত্তর। তিনি যেন ভ্রুকুটি হেনে বলছেন, তুমি কেবল আমার রুঢ় হওয়াটাই দেখছো, কিন্তু এমন ঝড়-ঝঞ্ঝায়ও তোমার জন্য যে সুশীতল মমতার অভাবিত আশ্রয় আমি রেখেছি, তা তুমি দেখোনি!

প্রশ্ন হচ্ছে, এরপর সে কোথায় যাবে? তাবারন বিবির সামর্থ্য সীমিত। তিনি আর কতদিন তাকে আশ্রয় দিতে পারবেন? তা ছাড়া ঠিক কী পরিচয়ে, আর কতদিন সে তার কাছে থাকবে? এই প্রশ্নের উত্তরও পারুর কাছে নেই। নেই তাবারন বিবির কাছেও। ঝিম ধরে যাওয়া পা জোড়া খানিক নাড়িয়ে নিতে তিনি উঠে দাঁড়ালেন। এই সময়ে নদীর পাড়ে ঘন জঙ্গলের মতো জায়গাটা চোখে পড়ল তার। তিনি রবিউলকে ডেকে বললেন, রবিউল, আর তো পারতেছি না ভাই। পা– তো ঝিঁঝি ধইরা গেল। একটু থামা। বুড়া মানুষ, আগানে-বাগানেও তো একটু যাওন দরকার। এত সময় কি আর চাইপা রাখন যায়?

এতক্ষণে যেন আসল কথাটা বললেন তাবারন বিবি। পারুর নিজেরও কেমন অস্বস্তি লাগছিল শরীরজুড়ে। তা ছাড়া দীর্ঘ সময় তারা একইভাবে বসে আছে। নিজেদের হালকা করে নেয়ার কোনো সুযোগও ট্রলারে নেই। ফলে বাধ্য হয়েই থামতে হলো রবিউলকে। বড় একটা বালতিতে করে পানি তুলে নদীর পাড়ে রেখে এলো সে। তারপর এক এক করে তিনজনকেই নামতে সাহায্য করল। ট্রলারের ভেতরে কাঁথায় মোড়ানো ছোট্ট শিশুটি বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে বেশ কিছুটা সময় চুপচাপ বসে রইল রবিউল। কেন যেন একটা তীব্র অস্বস্তি টের পাচ্ছে সে। এ কারণেই বার দুই গলা উঁচু করে মা আর নানিকে তাড়া দিল সে, ও মা, ও নানি, তাড়াতাড়ি আসো। বিপদের হাত-পাও নাই। আন্ধার হইয়া আসতেছে।

তা সবার আগে ধীর পায়ে নেমে আসতে দেখা গেল তাবারন বিবিকে। যদিও পারু আর সালমার তখনো খবর নেই। কিন্তু একটা বিষয় দেখে থমকে দাঁড়িয়েছেন তিনি। শ পাঁচেক ফুট দূরে আরো একখানা ট্রলার দেখা যাচ্ছে। আকারে ছোট বলে ট্রলারখানার গতি তীব্র ও বেপরোয়া। তাবারন বিবি জানেন না কেন, তার মনে আচমকা প্রচণ্ড ভয়ের সঞ্চার হলো। তিনি রবিউলকে ডেকে বললেন, “ও রবিউল, পিছে ওইডা কিসের ট্রলার দেখতো? আমি তো এতদূর থেকে ঠিকঠাক ঠাওর করতে পারতেছি না!

রবিউল ফিরে তাকাল। ট্রলারখানা ততক্ষণে আরো বেশ খানিকটা সামনে চলে এসেছে। এই সময়ে ভয়ানক মুখখানা দেখতে পেল সে। গলুইয়ের ওপর টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে লোকটা। তার পেছনে আরো একজন। সঙ্গে ট্রলারচালকও আছে। পারু আর ফজুর মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে কিছুই জানে না রবিউল। তা ছাড়া এতদূর থেকে ফজুকে চিনতেও পারল না সে। তারপরও কেন যেন দৃশ্যটা দেখে আঁতকে উঠল। সে বলল, মায়রে ডাক দাও নানি। তাড়াতাড়ি ডাক দাও। লোকগুলারে ভালো লাগতেছে না।’

তাবারন বিবি যতটা সম্ভব তাড়াহুড়া করলেন। কিন্তু সদ্য প্রসূতি পারুর নিজেকে গোছগাছ করে নিতে একটু সময় লাগছে। তাকে সাহায্য করছিল সালমা। তাবারন বিবির তাড়া খেয়ে সে তড়িঘড়ি বেরিয়ে এলো। কিন্তু পারু তখনো আসেনি। রবিউল বলল, “সে কই? সে আসে না কেন?

আসতেছে। এত অস্থির হইছস কেন?’ সালমা ভ্রুকুটি করল।

মা, জায়গাটা ভালো না। ওইদিকে দেখো, কারা না কারা আসতেছে!’

সালমা তাকাল পেছনে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনে হলো ভয়ংকর কিছু দেখেছে সে। ট্রলারের সামনে দাঁড়ানো ওই মুখখানা কার? কে সে? এমন বিভৎস মুখ কি কোনো মানুষের হতে পারে!

রবিউলের তাড়া খেয়ে এস্ত ভঙ্গিতে ট্রলারে উঠে গেলেন তাবারন বিবি ও সালমা। কিন্তু পারুকে দেখা গেল না। এই নিয়ে সকলেই উৎকণ্ঠিত হয়ে রইল। পারুর আসতে অবশ্য সময় লাগল আরো কিছুটা। পেছনের ট্রলারখানা ততক্ষণে সামনে চলে এসেছে। ট্রলারের গতি দেখে রবিউল ভেবেছিল লোকগুলো বুঝি তাদের পাশ কাটিয়ে সামনে চলে যাচ্ছে। তা গেলও অনেকটা। ফলে কিছুটা নিশ্চিন্তও বোধ করছিল সে। কিন্তু তার ভাবনা সত্যি হলো না। আচমকা গোত্তা খেয়ে আবার তাদের সামনে চলে এলো ট্রলারখানা। তারপর ঠিক আড়াআড়ি পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে গেল। সন্ত্রস্ত রবিউল কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসা পারুকে দেখতে পেল সে। তার হাতে লোহার খালি বালতিখানা। সে নিশ্চিন্ত মনে উঁচু ঢাল বেয়ে ট্রলারের দিকে নেমে আসছিল। আর ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের পরিবর্তিত দৃশ্যটা চোখে পড়ল তার। সঙ্গে সঙ্গে থমকে দাঁড়াল সে। কারা ওখানে?

পারু অবশ্য খুব বেশি কিছু ভাবার সময় পেল না। তার আগেই ট্রলার থেকে লাফ দিয়ে নেমে এলো ফজু। সে চিৎকার করে ডাকতে লাগল, ‘ভাবিজান, ও ভাবিজান। আছেন কেমন? ভালা?

পারু কী বলবে ভেবে পেল না। সেই ভয়াল রাতের পর ফজুকে আর দেখেনি সে। কিন্তু আজ সন্ধ্যার এই ম্লান আলোয় ফজুর মুখখানা দেখে তার অন্তরাত্মা অবধি কেঁপে উঠল। ফজু ঢাল বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল। তার পেছনে থাকা লোকটা এগিয়ে গেল রবিউলের দিকে। তারপর তাকে পাশ কাটিয়ে ট্রলারের ভেতরটা উঁকি দিয়ে দেখল। সেখানে জড়সড় ভঙ্গিতে বসে আছেন তাবারন বিবি ও সালমা। তাদের আড়ালে থাকায় ঘুমন্ত শিশুটিকে দেখতে পেল না সে। তবে তার হাতে থাকা কাস্তের মতো ধারালো অস্ত্রখানা চোখের সামনে দোলাতে দোলাতে বলল, ‘কেউ কোনো ঝামেলা করবেন না। আপনাগো কারো সঙ্গেই আমাগো কোনো শত্রুতা নাই। শত্রুতা যার সঙ্গে আছে, তার সঙ্গেই বোঝাপড়া হবে। বোঝাপড়া শেষ হইলে আমরা চইলা যাব। সুতরাং কেউ উটকো ঝামেলা করবেন না। তাইলেই বিপদ।

কেউ অবশ্য কোনো ঝামেলা করলোও না। ভীত সন্ত্রন্ত পাখির মতো আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল। লোকটা হঠাৎ রবিউলকে ধাক্কা মেরে ট্রলারের পাটাতনে ফেলে দিল। তারপর এক গাছি দড়ি বের করল বেঁধে ফেলল তাকে। বলল, “কোনো চালাকি করবা না, বুঝলা বাবা? চুপচাপ এইখানে শুইয়া থাকবা। ট্রলার ছাড়নের চেষ্টা যাতে না করতে পারো, এই জন্য এই ব্যবস্থা।

রবিউল অবশ্য তেমন কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার আগেই লোকটা ফজুকে অনুসরণ করতে ওপরের দিকে চলে গেল। পরিস্থিতি বুঝতে খানিক সময় লেগেছিল পারুর। কিন্তু বিমূঢ় পারু তাৎক্ষণিক তার করণীয় ঠিক করতে পারছিল না। সন্ধ্যার আকাশ ততক্ষণে ম্লান হয়েছে। নেমে আসতে শুরু করেছে গাঢ় অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পারুর হঠাৎ মনে হলো, তাকে পালাতে হবে। যে করেই হোক এখান থেকে পালিয়ে যেতে হবে তাকে। না হলে ভয়ানক বিপদ। কিন্তু কোথায় যাবে সে? পারু চট করে একটা ঝোঁপের আড়ালে সরে গেল। কিন্তু নিজেকে লুকিয়ে ফেললেও দূরে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতে পারল না সে। কারণ তার মন পড়ে আছে নদীতে ভাসমান ট্রলারে। ওখানে তার সবটুকু অস্তিত্ব রয়ে গেছে। ওই অস্তিত্ব ছেড়ে সে কোথায় যাবে!

এই মুহূর্তে ফজুর গা শিউরে ওঠা হাসির শব্দ শুনতে পেল সে। তার খুব কাছে চলে এসেছে ফজু। পারু নিশ্চিন্ত না সে তাকে দেখতে পেয়েছে কি না? কিন্তু সে এটুকু জানে, কোনোভাবেই ফজুর কাছে নিজেকে ধরা দেয়া যাবে না। সে এখন আহত হিংস্র পশু। তাকে নাগালের মধ্যে পেলেই ছিঁড়েখুড়ে ফেলবে সে। ফজু বলল, ভাবিছাব, আপনের বুদ্ধি ভালো। কিন্তু সমস্যা হইছে, এই বুদ্ধি দিয়াতো বারবার জেতা যাইত না। আগেরবার তো বুঝি নাই যে আপনে এমন সেয়ানা জিনিস। বুঝলে অত সহজে আপনে আমার এত বড় ক্ষতি করতে পারতেন না। বলে আরো দু পা এগোলো সে। তার চোখে সতর্ক দৃষ্টি। পেছনের লোকটা ততক্ষণে ফজুর কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ফজু বলল, কীরে মন্টু, ট্রলারের ভেতরে কী দেখলি?

‘অসুবিধা নাই ভাই। চিন্তা করনের মতো কিছু দেখি নাই। পোলাডারে বাইন্ধা রাইখা আসছি।’ বলল মন্টু নামের লোকটা। সব ঠিকঠাক।’

‘কোনো ঝামেলা নাই তো?

না। কেউ কোনো ঝামেলা করব না। আর করলে এক কোপে কল্লা নামাই দিয়া গাঙ্গের পানিতে ভাসাই দেব। কেউ কোনোদিন খুঁইজাও পাইব না।

ফজু আবারও হাসল। তারপর বলল, কিন্তু আমার ভাবিছাব তো আমার লগে ইটু পলান্তিস খেলতেছে। এই আন্ধারে তারে খুঁইজা বাইর করব কেমনে?

আপনে খাড়ান। আমি দেখতেছি।’ বলতে বলতেই দুপদাপ পা ফেলে সামনে এগিয়ে গেল মন্টু। ফজু অবশ্য তাকে সতর্ক করল। সে বলল, সাবধান। সে কিন্তু ডেনজারাস জিনিস। কখন কোনদিক দিয়া কী কইরা ফেলব চিন্তাও করতে পারবি না।

পারু প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে জানে সামান্য অসতর্ক হলেই ধরা পড়ে যাবে সে। তারপর যা ঘটবে তা দুঃস্বপ্নেও ভাবা অসম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এর থেকে তার পরিত্রাণ কীভাবে? কতক্ষণ এভাবে লুকিয়ে থাকতে পারবে সে?

পারু অবশ্য বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকতে পারল না। মন্টু বেশ খানিকটা খুঁজেও যখন তাকে পেল না, তখন সে বিচলিত গলায় বলল, “এই আন্ধার আর জঙ্গলে তারে কেমনে খুঁজব ভাই?

ফজু আচমকা বলল, তুই তো দেখি আমার মতোই বলদ রে মন্টু।

‘কেন ভাই?

তারে তো আমাগো কষ্ট কইরা খোঁজনের দরকার নাই। বরং সে-ই আমাগো খুঁইজা বাইর করব। নিজে আইসা ধরা দেবো। সেই ব্যবস্থাই তো আছে।’

কী ব্যবস্থা?

তার পোলা। তার পোলা কই? ট্রলারে না? কান টানলে যেমন সুরসুর করে মাথা চইলা আসে। তেমনি তার পোলারে ধরলেই সেও চইলা আসবে।’

‘কিন্তু ট্রলারে তো ওইরকম কাউরে দেখলাম না। কোনো ছোট্ট বাচ্চা-কাচ্চাতো চোখে পড়ল না।’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে বলল মন্টু।

কী কস? আসলেই?’ যেন হতাশ হলো ফজু।

এই প্রশ্নে মন্টু খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল। বলল, আমি তো ভেতরে ঢুকি নাই। বাইরে থিকা উঁকি দিয়া দেখছিলাম। কিন্তু ছোটো বাচ্চা-কাচ্চা কিছু দেখছি। বইলাতো মনে পড়ে নাই।’

এবার বিরক্ত হলো ফজু। বলল, একটা কাজ যদি তুই ঠিকঠাক করতে পারস।’ বলেই পেছন ফিরে তাকাল সে। তারপর বলল, ‘এক কাজ কর, তুই এইখানে থাক। সাবধান। আমি গিয়া পোলা খুঁইজা আনি।’ বলে সামান্য থামল সে। তারপর অন্ধকারে পারুকে উদ্দেশ্য করে বলল, কী ভাবিছাব? আর কত টুক। পলান্তিস খেলবেন? বাইর হন, বাইর হন। নাইলে কিন্তু পোলারে গাঙ্গের পানিতে হাডুডু খেলতে নামাই দিমু। তখন কিন্তু আর ডুবুরি সাইজ্যাও লাভ হইব না। তার আগে ভালোয় ভালোয় বাইর হইয়া আসেন। শেষের কথাগুলো পারুকে উদ্দেশ্য করে বললেও তার অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত নয় ফজু। কোথাও কোনো অনভিপ্রেত শব্দও শুনতে পাচ্ছে না সে। ঝুপ করে অন্ধকারও নেমে পড়েছে। এই অন্ধকারে এমন ঝোঁপঝাড়ের মধ্যে কাউকে চট করে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। তবে ফজুর সুবিধা হলো পারুর বাচ্চাটা রয়ে গেছে ট্রলারে। সে চাইলেই তাকে টোপ হিসেবে। ব্যবহার করতে পারবে।

ফজু ধীরে ধীরে আবার ঢাল বেয়ে নামতে লাগল। পারুর কোনো হদিস না পেয়ে বিরক্ত, বেপরোয়া মন্টু কেঁপের আরো সামনের দিকে এগোতে থাকল। যেন ফজুর কাছে নিজের বুদ্ধি ও সাহসের প্রমাণের এইটাই একমাত্র সুযোগ। এই সুযোগ সে কোনোভাবেই হারাতে চায় না।

ফজু ঢাল বেয়ে নামতে নামতে গলা চড়িয়ে বলল, ভাবিছাব, এখনো সময় আছে ভালোয় ভালোয় নাইমা আসেন। আপনের দুই দিনের পোলারে পানিতে ডুবাইয়া মারতে আমার দুই মিনিটও লাগব না। হাতও কাপব না। ও ভাবি, ভাবিজান। কই আপনে? আসেন আসেন? দেরি কইরেন না।

পারু কী করবে জানে না। ফজু অনেকটা নিচে নেমে গেছে। আর খানিক বাদেই চাতালের মতো জায়গাটা। তারপর ট্রলারে ওঠার ছোট্ট কাঠের সিঁড়ি। ওই সিঁড়ি বেয়েই খানিক আগে পারুরা নেমে এসেছিল। কিন্তু এখন ফজু উঠে যাবে সেই একই সিঁড়ি বেয়ে। তারপর তার সন্তানকে কোলে তুলে নিয়ে ফিরে আসবে। তারপর কী হবে?

পারু আর ভাবতে পারছে না। তবে সে জানে, ফজু এখন সাক্ষাৎ পশু হয়ে গেছে। সে ছাড়া পৃথিবীর আর কোনোকিছুই তাকে নিরস্ত করতে পারবে না। কিন্তু সে ধরা দিলেই কি তার সন্তান রক্ষা পাবে?

পারু এই প্রশ্নের উত্তরও জানে না। ফজু গিয়ে চাতালের মতো জায়গাটাতে দাঁড়াল। তারপর ভেতরে উঁকি দিয়ে তাবারন বিবিকে বলল, “ও নানিজান, আমারে চেনা যায়? হারিকেনটা জ্বালান। আমি ফজু। আমার মুখটা একটু চাইয়া দেহেন নানিজান। আমারে চেনা যায়? আপনে যারে আদর-যত্ন কইরা পালতেছেন, সে আমার এই দশা করছে। একটু চাইয়া দেহেন নানিজান। ও নানিজান।

পারু অবাক হয়ে আবিষ্কার করল ফজু কাঁদছে। তার গলা প্রায় বুজে আসছে। কিন্তু সেই কান্নার ভেতরও ভয়াবহ এক জিঘাংসা। ওই জিঘাংসা থেকে তাকে আর তার সদ্যোজাত সন্তানকে কে রক্ষা করবে? ফজু খনখনে গলায় বলল, নানিজান, আমার জেল হোক, ফাঁস হোক, ওই মাগিরে আমি এমন শাস্তি দেব যা কেউ কোনোদিন ভাবতেও পারব না। ও নানিজান, নানিজান…।’ ফজু কাঁদছে। তবে তার সেই কান্না যেন গা শিউরে ওঠা জান্তব কোনো গোঙানি। সেই গোঙানি মৃত্যুর। হিম শীতল আতঙ্ক হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে নির্জন অন্ধকার এই নদী তীরে। সে ভাঙা গলায় বলল, নানিজান, আপনে আমারে তার মেয়ে দেন। ওই যে কথায়। পেচানো মেয়েডা, ওইডা দেন। আমি তার সামনে বইসা ওই মেয়েরে খুন করব। কেমনে খুন করব জানেন?

পারু আর শুনতে পারছে না। ভাবতে পারছে না কিছু। তার পায়ের নখ থেকে মাথার তালু অবধি তীব্র আতঙ্কে হিম হয়ে আসছে। হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে আসছে। ফজু বলল, আমি তারে নিজ হাতে পিষে খুন করব। ও ভাবিছাব, ভাবিছাব। আমার কথা শুনতেছেন? সে চিৎকার করে কথাগুলো বলল। তারপর পা বাড়াল ট্রলারের সিঁড়ির উদ্দেশ্যে। পারুর মনে হলো সে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ছে। যেকোনো সময় সে সংজ্ঞাহীন হয়ে লুটিয়ে পড়বে মাটিতে। এই তীব্র যন্ত্রণা আর নিতে পারছে না সে। এরচেয়ে মৃত্যু অনেক শ্রেয়। সে ঝোঁপের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। ফজু যা ইচ্ছা করুক তাকে। যত ইচ্ছা যন্ত্রণা দিক। মারুক, কাটুক কিংবা পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য নোংরা কাজটাই করুক। তারপরও নিজের চোখের সামনে ওই ভয়াল দৃশ্য সে দেখতে পারবে না। তার আগেই মৃত্যু হোক নিজের।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *