১৫. মহিতোষ শুয়েছিলেন

১৫

মহিতোষ শুয়েছিলেন। এই মুহূর্তে ঘরে ঢুকল তরু। তার মুখে একই সঙ্গে আনন্দ ও বিষাদের ছায়া। মহিতোষ উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বললেন, কী হয়েছে মা? তোমার মন খারাপ কেন?

তরু বিষণ্ণ হাসল, আমার শুধু মন খারাপই না, মন ভালোও।

‘অনেক ভালোর মধ্যে যদি সামান্য এতটুকু খারাপও থাকে, তবে সে ভালো। আর ভালো থাকে না মা। খারাপই হয়ে যায়।’

তরু হাসল, তা অবশ্য ঠিক।

‘তোমার মন খারাপ কেন, সেইটা আগে বলো?

তরু জবাব দিল না। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তার চোখের আনন্দটা ধীরে বিষাদে রূপান্তরিত হচ্ছে। মহিতোষ বললেন, আমি কিন্তু আজ কিচ্ছু করি নাই। ঘর থেকে এক পা-ও বের হই নাই। তুমি যা যা বলে গেছো, তার সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।’

‘আমি কী কী বলে গিয়েছিলাম?’ বলে হাসল তরু।

মহিতোষ একে একে বলতে শুরু করলেন। ঘুম থেকে ওঠা থেকে শুরু করে সারাদিনের খাওয়া, ঘুম, ওষুধ, বারান্দায় খানিক হাঁটা পর্যন্ত সবই। তরু অপলক চোখে মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল। শিশুর মতো সহজ একজন মানুষ। এমন মানুষে যদি পৃথিবী পরিপূর্ণ থাকত, তাহলে আর চারদিকে এত দুঃখ, কষ্ট, হিংসা, বিদ্বেষ থাকত না। মহিতোষ বললেন, ‘কী? হয়েছে?

হুম। হয়েছে। আমার ওপর আপনার অনেক রাগ, তাই না?

মহিতোষ খানিক ভেবে বললেন, “তাতো একটু আছেই।

‘কদিন পর থেকে আর থাকবে না।

‘কেন?

‘এই যে আপনাকে যন্ত্রণা দেওয়ার আর কেউ থাকবে না।

মানে?’ যেন আঁতকে উঠলেন মহিতোষ। তুমি কোথাও যাবে মা? হুম।

‘কোথায়?

তরু সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। সে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তারপর সোজা জানালাটার কাছে গিয়ে গ্রিল ধরে তাকিয়ে রইল বাইরে। সেখানে কতগুলো হাসনাহেনা ফুলের গাছ। গাছ থেকে তীব্র গন্ধ ভেসে আসছে। এই গন্ধটা আর পাওয়া হবে না তার। হাসনাহেনা ঝরে যাবে। সুবাস মিলিয়ে যাবে। অথচ তাকে পড়ে থাকতে হবে দূরের কোনো গাঁয়ে। সেখানে হয়তো স্যাঁতসেঁতে কোনো ঘরে রাত কাটাতে হবে। পাঁচপেঁচে কাদার মধ্যে ছুটে বেড়াতে হবে। মহিতোষ ফ্যাকাশে গলায় বললেন, তুমি আমাকে যন্ত্রণা দাও, এইজন্য আমি রাগ না। আসলে কী মা…।’

বলে একটু থামলেন মহিতোষ। তারপর কেমন ভারী গলায় বললেন, “তোমার কাছে থাকতে থাকতে আমি লোভী হয়ে গেছি মা। সারাক্ষণ কেবল মনে হয়, এই বুঝি তুমি এসেছো। কিন্তু তোমার তো অনেক কাজ, ব্যস্ততা, পরীক্ষা। এই কারণে মাঝে মাঝে একটু মন খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু আমি জানি, এ আমার বড় অন্যায় মা।’

তরু কথা বলল না। চুপ করে জানালার গ্রিলে গাল চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ। তারপর আচমকা মহিতোষের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমার চাকরি হয়ে গেছে।

‘কী!’ যেন ঝলমল করে উঠল মহিতোষের গলা। কী বলছো তুমি মা? এত বড় খবর? এতক্ষণ বলোনি কেন? কেন বলোনি? আহা, কী যে আনন্দ হচ্ছে। আমার। কী যে আনন্দ! ভগবান…।’ মহিতোষের গলা বুজে এলো আনন্দে।

তরু বলল, ‘কিন্তু একটা সমস্যাও আছে।

কী সমস্যা?

‘বেশ কিছুদিনের জন্য আমাকে গ্রামে গিয়ে থাকতে হবে। কোনো থানা লেভেলের জায়গায়। বেশ অনেকদিন।

তাতে কী! এত বড় ডাক্তার তুমি এখন, আর তুমি গাঁয়ে যাবে না? শহরের মানুষ তো সবসময়ই ভালো হাসপাতাল পায়। ভালো ডাক্তার, চিকিৎসা সবই পায়। কিন্তু গাঁয়ের লোকেদের কথা একবার ভাববা? ওই দুর্ভাগা লোকগুলো পোকামাকড়ের কামড়ে অবধি মারা যায়। কিন্তু ডাক্তার দেখানোর উপায় নেই। এ যে কত বড় সৌভাগ্য মা।

মহিতোষের চোখ ছলছল করছে। পারু একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এই মানুষটি তার আত্মীয়-পরিজন কেউ নন। অথচ তার প্রাপ্তিতে যতটা আনন্দিত তিনি হয়েছেন, ততটা আনন্দ ধারণ করার ক্ষমতা কি তার আছে? এমন মানুষকে ভালো না বেসে পারা যায়?

মহিতোষ প্রায় ভেঙে পড়া গলায় বললেন, ইশ! তুমি যদি আমার ভুবনডাঙায় যেতা, মা রে…। ভুবনডাঙার মানুষ তোমারে মাথার মুকুট বানাই রাখত। এত ভালো মানুষ তুমি এই জগতে আর কোথাও পাবা না। এরা একেকটা খাঁটি সোনা। না না, ভুল বললাম। এরা খাঁটি সোনার চাইতেও খুঁটি। আমি একবার যদি তোমারে আমার ভুবনডাঙায় নিয়া যাইতে পারতাম গো মা…!

তরু এখন মহিতোষের সব ঘটনাই জানে। ভুবনডাঙা থেকে তিনি কীভাবে রাতের অন্ধকারে প্রাণ হাতে নিয়ে সপরিবারে পালিয়ে এসেছিলেন তাও। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, এছাহাকের গল্পও। অথচ তারপরও সেই ভুবনডাঙাই তার কাছে এখনো স্বপ্নের গ্রাম। ভুবনডাঙার মানুষগুলোই তার কাছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম মানুষ। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা-ই থাকবে। কিছু কিছু মানুষ এমন হয় কেন? এমন ফুলের মতো সুবাসিত, রোদের মতো উজ্জ্বল, শিশুর মতো কোমল, মায়াময়, সহজ!

.

তরুর হাতে মাসখানেক সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে তাকে অনেক কিছু গুছিয়ে নিতে হবে। বাসায় যেতে হবে সবার সঙ্গে দেখা করতে। তা সে গেলও। ঢাকায় ফিরে এসে দেখে মহিতোষ কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে গেছেন। সে বলল, ‘কী হয়েছে আপনার?

মহিতোষ বললেন, আমি পারুরে স্বপ্ন দেখছি।’

কী স্বপ্ন দেখেছেন?

আমি স্বপ্ন দেখেছি সে একটা নৌকায় কোথাও যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ ঝড়ে সেই নৌকা গেল ডুবে। সে ভাসতে ভাসতে এক চরে গিয়ে উঠল। সমস্যা হচ্ছে সেই চরে কোনো মানুষজন নাই। সে একা একা সেইখানে ঘুরতেছে। আর বাবা বাবা বলে কাঁদতেছে। কিন্তু তার কান্না শোনার কেউ নেই।

তরু কথা বলল না। এসব মুহূর্তে সে বলার মতো কিছু খুঁজে পায় না। মহিতোষ বলল, কিন্তু পারুরে দেখতে লাগছে ছোটো। যেন সাত আট বছর বয়স তার। পরনে লাল ফ্রক। এই ফ্রক তারে অঞ্জলি হাতে সেলাই করে বানাই দিছিল। তার মাথার চুলে লাল ফিতা বাঁধা। জলে ভিজে সেই ফিতার রং উঠে গেছে। তার দুই গাল বেয়ে রং নামতেছে। দেখে মনে হচ্ছে তার মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে।

‘এসব আপনার দুশ্চিন্তার কারণে হচ্ছে। আপনি দেখবেন পারু ফিরে আসবে। আমার মন বলছে, সে ফিরে আসবে।’

‘তুমি সত্য বলছ মা?

তরু ওপর-নিচ মাথা নাড়ল। বলল, আমি আর কারো সঙ্গে মিথ্যা বললেও আপনার সঙ্গে বলব না, এটা আপনি বিশ্বাস করেন না?’

‘করি।’

তাহলে আমার কথায় বিশ্বাস রাখেন। পারুর সঙ্গে আপনার দেখা হবে। অবশ্যই দেখা হবে। আপনি এখন ঘুমান।

মহিতোষ কোনো কথা বললেন না। তিনি শিশুর মতো বিছানায় শুয়ে পড়লেন। তরু তাঁকে একটা কড়া ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিল। মহিতোষের অবস্থা দেখে কেন যেন তার ভালো লাগছে না। ভেতরে ভেতরে মানুষটা পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গেছেন। বাইরে কেবল একটা শূন্য খাঁচা বেঁচে আছে। মহিতোষ নিজেও চেষ্টা করেন ওই খাঁচাটাতে জোর করে হলেও খানিক প্রাণের সঞ্চার করতে। কিন্তু পারেন না। কিংবা পারলেও সেটা খুব সামান্য সময়ের জন্য। খানিক বাদেই আবার তার মাথার মধ্যে, মনের মধ্যে ঝড়ের বেগে ছুটে আসতে থাকে পারু। তারপর প্রলয়ঙ্করি কালবৈশাখির মতো লন্ডভন্ড করে দেয় সব। এই মুহূর্তটা খুব ভয়ানক। মহিতোষ বিছানায় মাথা রেখে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু হঠাৎ সেই ঘুম থেকে জেগে উঠলেন তিনি। তারপর পাগলের মতো বলতে লাগলেন, ‘পারু, আমার পারু। আমার পারু আমাকে ডাকছে। আমি ছাড়া তার আর কেউ নাই। তার অনেক বিপদ। অনেক বিপদ। আমি আমার পারুর কাছে যাব। পারু, ও পারু। পারু, মা, ও মা।’

মহিতোষ চিৎকার করে পারুকে ডাকতে লাগলেন। তরু শান্ত গলায় বলল, ‘পারুর বিপদ মানে, সে এখনো বেঁচে আছে, তাই না?

মহিতোষ কিছু বুঝলেন কি না বোঝা গেল না। তবে তিনি এলোমেলো পাগলাটে ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন। তরু বলল, তাকে ওই বিপদ থেকে রক্ষা করতে হলে আপনাকে সুস্থ হতে হবে, তাই না?

মহিতোষ আবারও মাথা নাড়লেন। তরু বলল, আমি বলেছি না, পারুর সঙ্গে আপনার আবার দেখা হবে?”

হুম। মহিতোষ বাধ্য ছেলের মতো ওপর-নিচ মাথা নাড়লেন।

তাহলে সেই পর্যন্ত আপনাকে সুস্থ, স্বাভাবিক থাকতে হবে না?

মহিতোষ আবারও মাথা কঁকালেন। তার এই একান্ত অনুগত হয়ে যাওয়া লক্ষণও সুবিধার মনে হচ্ছে না তরুর। তারপরও সে বলল, তাহলে আপনাকে এখন কী করতে হবে?

ঘুমাতে হবে। মহিতোষ নিরীহ ভঙ্গিতে জবাব দিলেন।

তরু বলল, তাহলে এখন লক্ষ্মী ছেলের মতো ঘুমিয়ে পড়ুন।

মহিতোষ ঘুমিয়ে পড়লেন।

.

তরুর বেশ কিছু কেনাকাটা ছিল। তার পরের কয়েকদিনে সে সেই কেনাকাটাগুলো সারল। মহিতোষের জন্যও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করে রাখল। একদিন মইনুলকে ডেকে বলল, যতটা সম্ভব মহিতোষের দিকে খেয়াল রাখতে। তার রান্নাবান্নার জন্যও একজন কাজের লোকের ব্যবস্থা করল। তরুর অবর্তমানে যেন। কোনো অসুবিধা না হয় তার। এর মধ্যে ফরিদের সঙ্গেও একদিন কথা বলতে চাইল সে।

কিন্তু ফরিদ এলো না। তাকে অনেক করে বোঝানোর পরও সে মইনুলের কথা শুনল না। অগত্যা তরুই গেল ফরিদের কাছে। সে বসে আছে সেই বটগাছের তলায়। তাকে দেখে রীতিমতো আঁতকে উঠল তরু। যেন মাটির সঙ্গে মিশে গেছে ছেলেটা। গায়ের জামাটাও এখানে সেখানে ছেঁড়া, নোংরা। শুকিয়ে এতটুকু হয়ে গেছে সে। চোখে কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি। তরু বলল, আপনি এখানে কী করছেন?

ফরিদ বলল, আপনি কী করছেন?

আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।

‘আমিও এখানে একজনের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।’

কার সঙ্গে?

‘পারুর সঙ্গে।

‘পারু কই?

‘পারু কই সেটা আমি আপনাকে বলতে চাচ্ছি না।’

‘কেন বলতে চাচ্ছেন না?

কারণ আমার ইচ্ছে করছে না।

ইচ্ছা না করলেও মানুষকে অনেক কিছু করতে হয়। হয় না ফরিদ সাহেব?’

হলে আপনি গিয়ে করুন। আমাকে জ্ঞান দেবেন না। আমার জ্ঞান পছন্দ না।’

এভাবে কথা বললে কারো সঙ্গে কথা চালানো সম্ভব নয়। তরু ভেবেছিল, ফরিদকে সে মহিতোষ মাস্টারের সঙ্গে তার বাসায় রেখে যাবে। ফরিদ অসুস্থ মহিতোষ মাস্টারের দেখাশোনা করবে। এই মুহূর্তে সে কাছে থাকলে অন্তত নিজের একজন মানুষ তার সঙ্গে আছে, এই অনুভূতি কাজ করতে পারত। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেই চিন্তা পুরোপুরি অর্থহীন। এই ফরিদ যুক্তিহীন, খামখেয়ালি। এর সঙ্গে কোনো কিছু বলেই এখন লাভ নেই। তারপরও তরু শেষ চেষ্টাটা করল, আপনি কি একটু স্যারকে দেখতে যাবেন?

‘কোন স্যার?

মহিতোষ স্যার।

‘তার কাছে আমি কেন যাব?

‘কারণ তিনি অসুস্থ।’

‘আমিও অসুস্থ। তিনি যে কারণে অসুস্থ, আমিও সেই একই কারণে অসুস্থ। তিনি কি আমাকে দেখতে এসেছেন?

তরু আর কথা বাড়াল। মহিতোষ অসংখ্যবার চেয়েছিলেন এখানে আসতে, কিন্তু তার শরীরের যা অবস্থা, তাতে তাকে এখানে নিয়ে আসাটা সমীচীন ছিল না। এখনো ডান পায়ে পুরোপুরি শক্তি পান না মহিতোষ। ডান হাতও সম্পূর্ণ কর্মক্ষম নয়। এই অবস্থায় আর কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি তরু। সে ফরিদকে শেষ কথাটা বলল, তার মানে আপনি স্যারকে দেখতে যাবেন না? আপনি গেলে উনার একটু ভালো লাগত।’

না লাগত না। আমাকে দেখলে ওনার রাগ লাগত।

‘কেন?’

কারণ আমার জন্যই ওনার মেয়ের আজ এই অবস্থা। শুধু ওনার মেয়ে না, আমি ওনার পুরো সংসারটা ধ্বংস করে দিয়েছি। আমি একটা খুনি। জঘন্য মানুষ। ওনার উচিত আমাকে দেখলেই খুন করে ফেলা। সেটা না পারলে অন্তত মুখভর্তি করে থুতু দেওয়া। কিন্তু উনি অতিরিক্ত ভদ্র মানুষ বলে তা পারেন না। কিন্তু আমি জানি, মনে মনে উনি সারাক্ষণ আমাকে থুতু দিতে থাকেন।

‘আপনি তাহলে ওনাকে চেনেন না ফরিদ সাহেব। উনি অন্য ধাতের মানুষ।

‘আপনিও আমাকে চেনেন না। আমিও অন্য ধাতের মানুষ।

মানে?

মানে আমি ওনাকে কথা দিয়েছি। পারুকে না নিয়ে আর আমি ওনার সামনে যাব না।’

‘আপনি নিশ্চিত যে আপনি পারুকে পাবেনই?

‘কেন, আপনার কী মনে হয়?

আমার কিছু মনে হয় না।’

কিছু মনে না হলে এখানে কেন এসেছেন? আপনার ধারণা, আমি আর কখনো পারুর খোঁজ পাব না?’

তরু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। এর সঙ্গে কথা চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব। বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হলো। ফিরে দেখে মহিতোষ অনেকটাই শান্ত। কিছুটা সুস্থিরও লাগছে তাকে। তরু ঘরে ঢুকতেই তিনি বললেন, আমি যশোর যাব।’

যশোর? খানিক অবাকই হলো তরু। এতদিনে তিনি অসংখ্যবার এই কথা বলেছেন। কিন্তু মহিতোষ রাজি হননি। তিনি পারুর খোঁজ না পেয়ে কোথাও যাবেন না। তবে এর মধ্যে কয়খানা চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন অরবিন্দু মেসোর ঠিকানায়। কিন্তু সেই চিঠির উত্তর এখনো আসেনি। হতে পারে কোনো কারণে তা অরবিন্দু মেসোর হাত অবধি পৌঁছায়নি। কিংবা তিনি নিজেই ঠিকানা ভুল করেছেন। তবে এই সময়ে যে দু-একবার যাওয়ার কথা যে ভাবেননি, তাও নয়। তবে কি এই পাঁচ ছ মাসের বেশির ভাগ সময়ই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন বিছানায়। নিজের পক্ষে একা একা নড়ার শক্তিটুকু অবধি ছিল না। ফলে চাইলেও আসলে তার পক্ষে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। আজ হঠাৎ চলে যেতে চাইছেন কেন তিনি?

মহিতোষ বললেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি পারু একা একা যশোর চলে গিয়েছে। সে এখন আছে তার মা আর চারুর সঙ্গে। তারা সেখানে খুব আনন্দ করছে। কিন্তু আমার কারণে তাদের আনন্দ পরিপূর্ণ হচ্ছে না। বাইরে বাইরে তারা ভান করছে যে সব ঠিক আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা আমার জন্য চিন্তিত। আমার মা খুব কান্নাকাটি করছেন। আমি স্পষ্ট আমার মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পেয়েছি, আবার সেই একই সময়ে একই সঙ্গে পারু আর চারুর হাসির শব্দ শুনতে পেয়েছি। এটা খুব আশ্চর্য বিষয় না?

তরু কথা বলল না। তাকিয়ে রইল। মহিতোষ বললেন, ‘একই সঙ্গে হাসি কান্না মিলে মিশে গেছে, এই স্বপ্নের অর্থ কী?

‘এর তো বিশেষ কোনো অর্থ থাকার কথা না। সবার জীবনেই হাসি– কান্না থাকে। এটাই স্বাভাবিক ঘটনা।

‘না, এইটা স্বাভাবিক ঘটনা না। আমি দেখলাম আমার মা একটা চিতার ওপর শুয়ে আছেন। সেই চিতায় আগুন দিচ্ছে পারু আর চারু। আমার মা সেখান থেকে কাঁদছেন। আর তা দেখে চারু আর পারু হাসছে। এই স্বপ্ন কি স্বাভাবিক? মেয়েরা তো চিতায় আগুন দিতে পারে না। আর তারা আগুন দিতে দিতে হাসবেই বা কেন?

তরু কথা বলল না। মহিতোষ উঠে দাঁড়াতে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে বিছানায় পড়ে গেলেন। তরু তাঁর গায়ে হাত দিয়ে দেখে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। সে দৌড়ে বাথরুমে গেল। সেই সারা রাত মহিতোষের মাথায় পানি দিতে হলো তাকে। পরদিন অবস্থা কিছুটা ভালো হলেও বিছানা থেকে উঠতে পারলেন না তিনি। তরুর চলে যাওয়ার প্রায় সময় হয়ে এসেছে। সে যেদিন চলে যাবে, তার আগের দিন রাতে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। তরু হাসপাতাল থেকে কিছু কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরছিল। এই সময়ে তার সামনে এসে দাঁড়াল ফরিদ। তাকে দেখে চট করে চিনতে পারল না তরু। ফরিদ চুল-দাড়ি কেটেছে। বহুদিন পরে সম্ভবত গোসলও করেছে। তার গায়ে বোয়া জামা। সে বলল, আমি পারুকে আনতে যাচ্ছি।’

‘পারুকে আনতে যাচ্ছেন মানে? আপনি জানেন, পারু কই?

হুম, জানি।

‘পারু কই?

“সে ভুবনডাঙা।’

চট করে ভুবনডাঙার কথা মনে করতে পারল না তরু। সে বলল, ভুবনডাঙা কোথায়?

‘এইটা আমাদের গ্রাম।

‘পারু সেখানে গেল কী করে?

‘তা জানি না।’

তাহলে সে যে গ্রামে গেছে, এটা কী করে জানলেন?

‘স্বপ্নে দেখেছি। একদম দিনের আলোর মতো স্বপ্ন। পারু আমার মামার ফার্মেসির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে মামাকে জিজ্ঞেস করছে, জেঠু, ফরিদ কই? মামা বললেন, সে তো এখনো আসে নাই। পারু বলল, কেন আসে নাই? আমি আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব? মামা বললেন, আরেকটু অপেক্ষা করো। সে এখুনি এসে পড়বে।

তরু মনে মনে বিরক্ত হলেও কিছু বলল না। ফরিদ আর মহিতোষ দীর্ঘসময়। ধরে ভয়ানক দুশ্চিন্তায় ডুবে আছে। তাদের এই দুশ্চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হলো পারু। ফলে প্রায় সারাক্ষণই তারা পারুকে নিয়ে কিছু না কিছু স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্ন। এতটাই তীব্র যে তারা এর প্রভাবও কাটিয়ে উঠতে পারেন না। বাস করতে থাকে। একটা ঘোরের জগতে।

তরু বলল, এইজন্য আপনি এখন গ্রামে যাচ্ছেন?

‘হ্যাঁ।

‘আপনার ধারণা পারু সেখানে আছে?

হুম।

“আচ্ছা।’ বলে আর কথা বাড়াল না তরু। সে ঘুরে হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু ছুটে এসে তাকে থামাল ফরিদ। তারপর বলল, আপনার কি ধারণা, পারু সেখানে নেই?

তরু তার এই প্রশ্নের জবাব দিল না।

.

ফরিদ সেই রাতেই ভুবনডাঙার বাসে উঠল। তরু তার ঠিক তিনদিন পর রওয়ানা হয়ে গেল তার নতুন কর্মস্থলে। জায়গার নাম রূপগঞ্জ। প্রত্যন্ত এক মফস্বল। অবশ্য একে মফস্বল না বলে গ্রাম বলাই ভালো। সে যতটা আশঙ্কা করেছিল, এখানকার পরিবেশ পরিস্থিতি তার চেয়েও খারাপ। কিন্তু কিছু করার নেই। তাকে কম করে হলেও বছরখানেক এখানে থাকতে হবে। এতকিছুর মধ্যেও মহিতোষের জন্য তার বুকটা খাঁখাঁ করতে লাগল। মনে হতে লাগল, একবারের জন্যও যদি মানুষটাকে সে দেখতে পেত। একটু কথা বলতে পারত। তবে তার আর কিছুই দরকার হতো না। কিন্তু সেটি আর সহসা সম্ভব না।

মহিতোষ তখন তার থেকে অনেক অনেক দূরে। একা অন্ধকার কবরের মতো এক ঘরের কোণে চুপচাপ মৃত লাশের মতো শুয়ে আছেন। তিনি বুঁদ হয়ে আছেন। নিজের ঘোরের জগতে। তার সেই জগতের সঙ্গে বাইরের আর কোনো জগতের কোনো সম্পর্ক নেই, সংস্রব নেই।

১৬

পারুর কথা শুনে দীর্ঘসময় কথা বলল না কাশেম। পারুও চুপ করে রইল। অন্ধকারে টিনের বেড়ার দু পাশে দুজন মানুষই যেন হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা কেউ কারো কথা বুঝতে পারছে না। আর যেটুকুও বুঝতে পারছে, তাও এলোমেলো, ভজঘট লাগছে। নীরবতা ভাঙল কাশেম। সে বলল, এই সব আপনেরে ফজু কইছে? এই রাইতে সে আপনেরে রামচরের লঞ্চঘাট দিয়াসবো? আর তারপর আমি আপনেরে সেইখান থেইকা বালুর মাঠ নিয়া যাব?

‘জি। আজ রাতেই তার আমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা। আমি তার অপেক্ষায়ই এখন বসে আছি।

‘আপনার কি বুদ্ধিসুদ্ধি কম?’ চেষ্টা করেও রাগটা চেপে রাখতে পারল না কাশেম। তারপর বলল, ‘পুলিশ আমারে দিকবিদিক পাগল হইয়া খুঁজতেছে। এই কথা আপনে জানেন না?

‘জি।

‘তাইলে? এই অবস্থায় আমি আপনেরে ওইখানে কেমনে নিয়া যাব? এই কথাটা একবারও আপনের মাথায় এলো না?

পারু কী বলবে! নিজেকে এখন সত্যি সত্যিই বোকা মনে হচ্ছে তার। এই অসহনীয় নির্বাসনের জীবন থেকে মুক্তি পেতে অস্থির হয়ে গিয়েছিল সে। ফলে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই এক অলীক মুক্তির অন্ধকার পথেই পা বাড়াতে চাইছিল। কিন্তু কাশেমের কথা শুনে এখন বুঝতে পারছে, কী ভয়ংকর বিপদেই না পড়তে যাচ্ছিল।

কাশেম বলল, এই জইন্যই সেইদিন রাইতে আমি আপনেরে ফজুর ব্যাপারে সাবধান করতে চাইছিলাম। কিন্তু আপনেরে বার দুই ডাকনের পরেও আপনে ওঠেন নাই।’

‘কোন দিন? পারু অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল।

প্রশ্নটা করলেও চকিতে সেই ভয়ানক রাতের কথা মনে পড়ল পারুর। রাজিয়া যখন অন্ধকারে তার ঘর থেকে বের হয়ে গেল, তার কিছুক্ষণ বাদেই একটি পুরুষ কণ্ঠ জানালার ওপার থেকে তাকে দুইবার ডেকেছিল। কিন্তু ভয় ও দ্বিধায় তখন সাড়া দেয়নি পারু। ওই মানুষটি তবে কাশেম ছিল?

কাশেম বলল, আমি আপনেরে কয়েকবার ডাকনের পরও আপনে শোনেন নাই। পরে রাজিয়া চিৎকার-চেঁচামেচি করতে শুরু করলে আমি ভয় পাইয়া চইলা গেছিলাম।’

পারুর মনে পড়ল, রাজিয়াও তাকে বলেছিল যে সেই রাতে কাশেম এসেছিল। রাতের অন্ধকারে পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে এসে রাজিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল সে। বলেছিল, পরিস্থিতি একটু শান্ত হলেই পারুকে তার স্বামীর কাছে পৌঁছে দেবে। কিন্তু রাজিয়াতো তা শোনেইনি, বরং কাশেম চলে যেতেই পারুর ঘরে গিয়ে তার মুখ চেপে ধরেছিল বালিশ দিয়ে। কাশেম অবশ্য বেশ কিছুদূর গিয়ে আবার ফিরেও এসেছিল। তার হঠাৎ মনে হয়েছিল পারুকে একটু সতর্ক করা। দরকার। কিন্তু পারেনি সে। তার আগেই টের পেয়ে গিয়েছিল রাজিয়া।

কাশেম বলল, বইন, আপনেরে একখান কথা কই।’ বলে খানিক সময় নিল সে। তারপর নরম গলায় বলল, রাজিয়া আগে এমন আছিল না। কিন্তু বছরের পর বছর বাচ্চা-কাচ্চা হয় না। লোকে আ-কথা, কু-কথা শোনায়। বন্ধ্যা, বাজা মাইয়া মানুষ বইলা খোটা দেয়। অপয়া, কুলক্ষণা বইলা ডাকে। এই সব শুনতে শুনতে ও জানি কেমন হইয়া গেছে।

পারু কথা বলল না। তবে ওই অন্ধকারে বেড়ার ওপাশে থাকা মানুষটার গলায় কিছু একটা ছিল, যা তাকে রাজিয়ার কষ্টটাও খানিক অনুভব করাল।

কাশেম বলল, আপনেরে দেখনের পর থেইকা তার মাথায় আগুন ধইরা গেছে। সে আপনেরে আর আমারে নিয়া কি ভাবতেছে, সেইটা তো বুঝতেই পারতেছেন। মাইয়া মানুষের কাছে এর চাইতে অপমানের, কষ্টের আর কিছু নাই। এইগুলা তারে অমানুষ বানাই ফেলছে। সে এখন করতে পারে না, এমন কোনো কাজ নাই। এইজন্যই আমি আপনেরে সাবধান করতে চাইছিলাম।’

বলে আবার থামল কাশেম। তারপর বলল, ফজু আমার ফুপাতো ভাই। তার মায় আমার বাপের আপন বইন। আমাগো লগে তার মায়ের সম্পত্তির ভাগের হিসাব আছে। কিছু দেওয়াও হইছে। কিন্তু সে তা নেবে না। সে নেবে এই বাড়ি। এই নিয়া তার লগে আমার দ্বন্দ্ব। তো আমার লগে সুবিধা করতে না পাইরা সে এখন ধরছে রাজিয়ারে। রাজিয়ার বুদ্ধিসুদ্ধি কম। তারে দিয়া উল্টাপাল্টা কিছু করাই ফেলতে পারলেই তার উদ্দেশ্য হাসিল…। এমনিতেই আমারে পুলিশে খুঁজতেছে। আমি থাকি বাড়ির বাইরে বাইরে। এর মইধ্যে রাজিয়ারেও যদি ফাসাই দেওন যায়, তাইলে আর তারে পায় কে?

কাশেম যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, জায়গাটা সংকীর্ণ, খাড়া। নিচে বর্ষার জল থই থই জমি। এ কারণে তাকে বেশ কসরত করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে। সে খানিক উঁচু হয়ে পায়ের ভর বদলাল। তারপর বলল, আমি নতুন আর কোনো বিপদ চাই না বইন। এই জইন্যই চাইছিলাম, সবকিছু একটু ঠাণ্ডা হইলেই আপনেরে আমি দিয়াসবো। কিন্তু রাজিয়ারে কিছুতেই কিছু বোঝাইতে পারি না। যা-ই বলি, তা-ই তার কাছে দোষ। ফজুই তারে নানা কুবুদ্ধি দেয়। আর তক্কে তক্কে থাকে যে কখন কোন সুযোগে সে আমারে ধরাই দিতে পারব। সামান্য চান্স পাইলেও মিস করব না। সে। ফজু যদি ঘুণাক্ষরেও কোনোভাবে টের পায় যে, আমি এইখানে, তাইলেই কী হইব জানেন? সে আমারে সঙ্গে সঙ্গে শ্যাষ কইরা দেব। পুলিশে ধরাই দেব। এলাকার যে পুলিশের চকিদার, তার লগেও তার রেগুলার যোগাযোগ।

কিন্তু আমি এখন কী করব?’ ভীত কণ্ঠে কথাটা বলল পারু।

কাশেম খানিক কী ভেবে বলল, ‘সেইটাই তো এখন চিন্তার বিষয়। আপনেরে নিয়া আমি ভালো বিপদে পড়ছি বইন। জানি, আপনের বিপদও কম না। কিন্তু আমি কী করব বলেন?

পারুর কাছে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। সে জানে, কাশেমের কথা মিথ্যে নয়। সেও ভীষণ বিপদেই পড়েছে। তারমধ্যে পারু এসেছে তার মরার ওপর খাড়ার ঘা হয়ে। কাশেম কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু সেই সুযোগটা আর সে পেল না। তার আগেই নদীর ঘাটে একটা ট্রলার ভেড়ার শব্দ হলো। পারু কম্পিত গলায় বলল, সে মনে হয় আসছে, আমি কী করব?

কী জবাব দেবে কাশেম? সে কোনোভাবেই এই মুহূর্তে ফজুর মুখোমুখি হতে চায় না। বা হলেও লাভ নেই। বরং নিজের ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে সে। কিন্তু পারুর কী হবে? অনেক ভেবেও মাথায় কিছু এলো না কাশেমের। ফজু ততক্ষণে ট্রলার থেকে নেমে পড়েছে। কাশেমকে এখুনি পালাতে হবে। কিন্তু পারু? পারু কী করবে? সে প্রায় অসহায় গলায় বলল, আমাকে একটা বুদ্ধি দেন ভাই। আমি এখন কী করব? ওই লোকের হাত থেকে আমি পালাব কী করে?

‘এক কাজ করেন, আপনে ঘর থেইকা বাইর হন।

ঘর থেকে বের হবো? অবাক গলায় বলল পারু।

‘এক্ষণি। এক মুহূর্তও দেরি করন যাইব না।’ চাপা গলায় বলল কাশেম। ‘আন্ধারে উত্তর দিকে নদীর পাড় যান। আমি ওইখানে আসতেছি। আপনেরে আপাতত তাবারন বুর বাড়িতে রাইখা যাব। সে মানুষ ভালো। আমারে খুব আদর করে। আর শোনেন…’

কাশেম আরো কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই উঠানে ফজুর জুতার শব্দ পাওয়া গেল। সে রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘ওইহানে কেডারে? কেডা ওইহানে? কোন হুমুন্দির পুতে রাইত-বিরাতে এই বাড়িতে চুরি করতে আসছে? ওই… কেডা?’

কাশেম লাফ দিয়ে অন্ধকারে ধান ক্ষেতের মধ্যে পড়ল। তারপর ছুটতে লাগল রুদ্ধশ্বাসে। ফজু দৌড়ে এসে জানালার কাছে দাঁড়াল। কিন্তু এত রাতে আর ওই অন্ধকার জলা ধানক্ষেতে তাড়া করল না। তবে পারুকে উদ্দেশ্য করে কেমন। ব্যাঙ্গাত্মক স্বরে বলল, দরজা খোলেন ভাবিসাব। রাইত-বিরাইতে কোন নাগরের লগে পিরিত করতেছেন? আমরা থাকতে আবার নাগর লাগে নাকি?

ফজুর কথা শুনে পারুর গা ঘিনঘিন করতে লাগল। ততক্ষণে রাজিয়া উঠে গেছে। সে ঘরের দরজা খুলে দিয়েছে। ফজুর হাতে তিন ব্যাটারির টর্চ লাইট। সে সেই লাইটের আলো ফেলতে ফেলতে ঘরে ঢুকল। তারপর বলল, তোমার জামাই তো রাইত বিরাইতে আইসা তার ছোট বউর লগে গোপনে পিরিত করে। তোমার লগে করে না?

রাজিয়া কথা বলল না। তবে তার চোখ জোড়া যেন ইটের ভাটার মতো গনগন করে জ্বলছে। ফজু বলল, কই, আমার ছোট ভাবিসাব কই?

রাজিয়া সরে তাকে জায়গা করে দিল। ফজু পারুর ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল। তারপর বলল, কী হইলো ভাবিসাব, আপনে এখনো রেডি হন নাই? রওয়ানা দিতে হইব না?’

পারু কথা বলল না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফজুর দিকে। এর মধ্যেই ঘরে এসে ঢুকল রাজিয়া। সে সাপের মতো হিসহিস শব্দ তুলে বলল, “নে ফজু, মাগিরে নিয়া যা। ওর বিয়া বহনের সাধ জন্মের মতো মিটাইয়া দে। বাইস্যা কালের গাঙ্গের পানিতে ভাসাই দিলে কোনো সাধও আর থাকব না। কেউ আর খুঁইজ্যাও পাইব না। নে।’

পারুর কাছে এখন সবকিছুই দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। ঘটনার সঙ্গে রাজিয়া সরাসরি জড়িত হওয়া সত্ত্বেও ফজু তাকে বলেছিল, বিষয়টা যেন রাজিয়া না জানে! সে আসলে বিষয়টা তার কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতেই এটা বলেছিল। কিন্তু এখন সে কী করবে?

ফজু বলল, ভাবছিলাম ভাবিসাবরে আপসেই নিয়া যাব। কিন্তু এখনতো আর মনে হয় না সে আপসে যাইব। ঘটনা তো এখন সব জাইনাই গেছে। কী ভাবিসাব, জোর করতে হইব?

পারু ভীত, অসহায় গলায় বলল, আপনি যা বলবেন, আমি তা-ই করব ভাই। কিন্তু আমি তো কোনো অপরাধ করিনি। বিশ্বাস করেন…।’ বলেই ভীত চোখে রাজিয়ার দিকে তাকাল। তারপর বলল, “ও দিদি আপনি বিশ্বাস করেন, কাশেম ভাইর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। আমার সন্তানের বাবাও সে না। আমি মেলার মাঠ থেকে…’।

পারু তার কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই রাজিয়া তাকে চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে ঘরের বাইরে নিয়ে এলো। তারপর বলল, ‘বেশ্যা মাগি আবার ঢং মারায়। আইজ আমি তোর ঢং সব শেষ করব। ওই ফজু, ধরস না মাগিরে।

ফজু এসে পারুকে ধরল। কিন্তু পারুর ততক্ষণে মনে হলো তার শরীরে আর এক ফোঁটা শক্তিও অবশিষ্ট নেই। এত শারীরিক-মানসিক ধকল আর সে নিতে পারছে না। রাজিয়া ছুটে এসে সপাটে দুটো চড় বসাল তার গালে। তারপর বলল, ‘আমার তো তারে নিজের হাতে খুন করতে ইচ্ছা করতেছে রে ফজু।

ফজু বলল, নদীর পাড় লও। ট্রলারে উইঠা যা ইচ্ছা তা-ই কইরো।

রাজিয়া আবারো তেড়ে-ফুড়ে আসছিল। নিজেকে কিছুতেই সংযত করতে পারছিল না সে। কিন্তু পারুকে আঘাত করার আগেই তার শরীরটা কেমন শিথিল হয়ে গেল। ফজুর দু হাতের মাঝেই প্রায় এলিয়ে পড়ল পারু। যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে। হতভম্ব ফজু বলল, ‘এ কী? কী হইল এর? এখন কী করব?”

বেরাজিয়া বলল, আগে ট্রলারে উঠা। তারপর দেখা যাইব।

ফজু আর রাজিয়া দুজন দুপাশ থেকে ধরে পারুকে হটিয়ে নিয়ে এলো নদীর পাড়ে। পারুও চেষ্টা করছে হাঁটতে, তবে তার শরীর ভীষণ দুর্বল। দেখে মনে হচ্ছে অনেক চেষ্টা করেও নিজের পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না সে।

নদীর ঘাটে ছোট্ট ট্রলারটা বাঁধা। তবে দড়ি লম্বা হওয়াতে জলের স্রোতে খানিক দূরে সরে গেছে। ফজু পারুকে রাজিয়ার হাতে ছেড়ে দিতে দিতে বলল, ‘তুমি একটু ধরো ভাবি। আমি ট্রলারখান টাইনা ঘাটে আনি।’ বলেই হাতের টর্চখানা বগলের মাঝখানে চাপ দিয়ে রেখে দুই হাতে ট্রলারের দড়ি ধরে টানতে লাগল সে।

রাজিয়া বলল, কতদূর যাব আমরা?

যদুর গিয়া ফালাইলে লাশ আর পাওন যাইব না।

‘কোনো সমস্যা হইব না তো?

“আরে ভাবি, তুমি খালি খালি চিন্তা করো। এই ফজু থাকতে এত চিন্তা কীয়ের? ফজুর প্ল্যানে কোনো ফাঁক নাই। সকাল হইতেই তুমি কাইন্দা কাইট্টা পাড়া মাথায় তুলবা যে রাইতের আন্ধারে সে তোমার সোনা-দানা নিয়া ভাগছে।’

রাজিয়া কথা বলল না। চুপ করে রইল। ফজু বলল, তোমার কি ভয় করতেছে?

রাজিয়া মিনমিনে কণ্ঠে বলল, একটু কেমন জানি লাগতেছে।

‘কেমন লাগনের কিছু নাই। ঘরে সতিন পালন কোনো ভালো বুদ্ধি না, বুঝলা? আর দুই দিন পর যখন পোলার মা হইব, তখন তোমার কী অবস্থা হইব, ভাবছ?

কথাটা শুনে রাজিয়া যেন আবার ফোঁস করে উঠল। সে চাপা গলায় বলল, ‘নে, ধর মাগিরে। যা হওনের হইব। এরে ট্রলারে উঠা।

ফজু ট্রলারখানা ঘাটের সঙ্গে শক্ত করে ভেড়াল। তারপর ঘুরে দুই হাতে পারুকে ধরে পাঁজাকোলা করে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। ঘটনাটা ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটল। পারুর ডান হাতখানা অকস্মাৎ সাপের ছোবলের মতো তীব্র গতিতে নড়ে উঠল। খানিক আগের সেই নেতিয়ে পড়া মেয়েটিই যেন মুহূর্তের মধ্যে এক ফণা তোলা সাপের মতো তেজস্বী হয়ে উঠল। সে তার কোমরে গোজা ভাঙা কাস্তের ফলাখানা টেনে বের করল। তারপর চোখের পলকে বিঁধিয়ে দিল ফজুর মুখ বরাবর। একদম শেষ মুহূর্তে ঘটনা বুঝতে পারল ফজু। কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। মুখ সরিয়ে নিতে গিয়েও শেষ রক্ষা হলো না তার। বাঁ চোখের ঠিক নিচ থেকে চিবুক অবধি গাল চিরে দু ভাগ হয়ে গেল। গলগল করে রক্ত ছুটতে শুরু করল মুখ বেয়ে। সে কলিজা কাঁপানো তীব্র চিৎকারে ছিটকে পড়ল নদীতে। তার বগলের টর্চখানাও নদীর পাড়ের মাটিতে দুয়েকবার ধাক্কা খেয়ে জলের গভীরে তলিয়ে গেল। দু হাতে মুখ চেপে ধরে গোঙাচ্ছে ফজু। সঙ্গে অশ্রাব্য ভাষায় গালির তুবড়ি ছোটাচ্ছে মুখে। কিন্তু ওই অন্ধকারে নদীর খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে আসতে পারছে না সে।

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব রাজিয়া কী করবে ভেবে পেল না। খানিক আগে যে পারু শিকড় কাটা লতার মতো নেতিয়ে ছিল, সেই পারুই হঠাৎ এমন ভয়ংকর, এমন হিংস্র হয়ে উঠতে পারে–এ সে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। দিশেহারা রাজিয়া বিবশ, বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে। সে ভেবেছিল, পারু বুঝি এবার তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। যদি তা-ই হয়, তাহলে এই অন্ধকারে কিছুই করার থাকবে না তার। ফলে সীমাহীন আতঙ্ক নিয়েই অসহায় আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে পিছিয়ে যেতে থাকল সে। পারু অবশ্য তেমন কিছুই করল না। সে বরং উল্টোদিকে ঘুরে নদীর পাড় ধরে ছুটতে লাগল। তার মাথায় তখন ঘুরছে, এই নদীর পার ধরে ছুটতে থাকলেই সে পেয়ে যাবে তাবারন বিবির বাড়ি। বাড়ির সামনে বড় বড় দু খানা জামগাছ। কাশেমও বলেছে, তাবারন বিবি ভালো মানুষ। তার কাছে পৌঁছাতে পারলেই আর চিন্তা নেই তার। কিন্তু এত রাতে তাকে দেখে কী বলবেন তাবারন বিবি?

পারু ছুটছে। নদীর পারের এবড়োখেবড়ো পথ ধরে উন্মাদের মতো ছুটছে সে। কয়েকবার অন্ধকারে হোঁচট খেয়ে পড়েও গেল। কিন্তু ছোটা বন্ধ করল না। কে জানে, ফজু হয়তো ছুটে আসছে তাকে ধরতে। মরা শামুক, ধারালো ঘাসে তার পা। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে। বুক ধুকপুক করছে। সহসা শ্বাস টেনে নিতে পারছে না বুক ভরে। তারপরও ওই বিভীষিকাময় কালরাত্রির অন্ধকার পেরিয়ে সে পৌঁছে গেল তাবারন বিবির বাড়ির সামনে। পুরো পৃথিবী তখন গভীর ঘুমে মগ্ন।

পারু তার দরজার সামনে গিয়ে ডাকল, ঠাকুমা, ঠাকুমা।’

তাবারন বিবি প্রথম ডাকেই সাড়া দিলেন। সম্ভবত রাতে তার ঘুম হয় না। তিনি বললেন, ‘কেডা ওইখানে, কেডা?’

পারু অনেক চেষ্টা করেও তার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়ে জ্ঞান হারাল সে।

১৭

বিকেলের আলো পড়ে এসেছে।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া শুয়ে আছেন বিছানায়। পাশে চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তার স্ত্রী ও দুই ছেলে। বড় ছেলে লিয়াকত বিয়ে করেছে সখীপুর। সে থাকে সেখানেই। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নিজে বহু হিসেব নিকেশ করে তাকে বিয়ে দিয়েছেন। পুত্রবধু রূপে-গুণে আহামরি কিছু না হলেও সম্পদশালী পিতার একমাত্র সন্তান। ফলে শ্বশুরের বিশাল সম্পত্তির উত্তরাধিকার হিসেবে লিয়াকতের ভবিষ্যৎ বলতে গেলে নিশ্চিন্তই। অসুস্থ শ্বশুরের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভারও এরই মধ্যে তার কাঁধে উঠেছে। এ কারণে খুব প্রয়োজন না হলে বাড়িতেও আসা হয় না তার। তা এ নিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যে অসন্তুষ্ট, তা নয়। বরং তিনি খুশিই। লিয়াকত তো একভাবে তার সাম্রাজ্যই বিস্তৃত করছে।

ছোট ছেলে শওকত চুপচাপ, শান্ত। তার বড় খালার কোনো পুত্র সন্তান নেই বলে সেই ছোটবেলা থেকেই তিনি কারণে অকারণে তাকে নিজের কাছে নিয়ে রেখেছেন। এতে খালার প্রতি একটা আলাদা টান তার তৈরি হয়েছে। পড়াশোনা যেটুকু করেছে, তাও ও বাড়িতে থেকেই। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ধারণা, তার স্ত্রী চাইছেন বড় বোনের ছোটো মেয়ের সঙ্গে শওকতের বিয়ে দিতে। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো কেউ তাকে সরাসরি কিছু জানায়নি। কারণ সকলেই তাকে চেনে! যথাযথ লাভ-লোকসানের হিসেব ছাড়া এক চুলও নড়বেন না তিনি।

সকালে বাবার অসুস্থতার খবর শুনে দিনে দিনেই দুই ছেলে চলে এসেছে। তারা দাঁড়িয়ে আছে বাবার বিছানার পাশে। সঙ্গে এছাহাক, মতি মিয়া, দেলু। সকলের মুখেই উদ্বিগ্নতার ছাপ। এছাহাক বলল, “এখন কেমন ঠেকতেছেন ভূঁইয়া সাব?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এছাহাকের কথা শুনলেন কি না বোঝা গেল না। তিনি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছেন ঘরের ছাদের দিকে। যেন ওখানে ছাদ নেই। আছে একটা কাদা থকথকে বিশাল গর্ত। সেই গর্তের ভেতর কোনো কলস নেই। নেই তিনি সেদিন আর যা যা দেখে এসেছিলেন, তার কিছুই। গর্তটা ক্রমশই পানিতে ভরে যাচ্ছে।

অন্যরা দাঁড়িয়ে থাকলেও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বিছানার পাশের চেয়ারে একজন লোক বসে আছেন। তিনি ওহাব ডাক্তার। সারাদিন পরিবারের বাইরে কাউকে কিছু না জানালেও বিকেলের দিকে গিয়ে তাকে নিয়ে এসেছে এছাহাক। সে জানিয়েছে, রাতে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। সম্ভবত জ্ঞানও হারিয়েছিলেন। দুপুরের দিকে তার ঘুম ভেঙেছে। কিন্তু সেই থেকে কারো সঙ্গেই কথা বলছেন না তিনি।

ওহাব ডাক্তার যতটা সম্ভব মনোযোগ দিয়েই রোগী দেখলেন। হার্টবিট, পালস বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর বললেন, ভূঁইয়া সাবের প্রেসার তো অনেক হাই। খাওয়া-দাওয়া ঘুমের মনে হয় ঠিক-ঠিকানা নাই। আর অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা। এই সময়ে এগুলা যত কন্ট্রোল করা যায়, তত ভালো। সবচাইতে ভালো একটা রুটিনের মধ্যে চইলা আসতে পারলে। ঘুমাতে হবে ঠিক মতো। খেয়াল রাখতে হবে, যেন কোনো কারণেই তিনি রেগে না যান। আর কোনো কিছু নিয়া দুশ্চিন্তাও না করেন।

এছাহাক বলল, কোনো ওষুধ দেবেন না?

আমার সঙ্গেতো কোনো ওষুধ নাই। ফার্মেসিও অনেকদিন ধইরা বন্ধ। এক কাজ করো, আমার বাড়িতে ঘুমের ওষুধ আছে, ওইটা আইনা খাওয়াও।

এছাহাকের চট করে মনে পড়ল, গতকালের আনা কিছু ঘুমের ওষুধ তার কাছে এখনো রয়ে গেছে। সে বলল, সমস্যা নাই। আমি ব্যবস্থা করব। কিন্তু আপনে তারে ভালো কইরা দেখছেন তো? নাকি আবার আগের কথা মনে রাইখা। ভুলভাল কইতেছেন।

ওহাব ডাক্তার মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন, দুনিয়ার সব মানুষ যদি এক হইত, তাইলে কি আর দুনিয়া চলত এছাহাক?

ডাক্তারের এই কথায় এছাহাক চুপ করে গেল। পুরো ঘরে পীনপতন নীরবতা। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার পুত্ররা কিছুই বুঝতে পারছে না। হঠাৎ কী এমন হলো তাদের বাবার?

গতকাল শেষ রাতের দিকে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে এছাহাকরা বাড়িতে এসে হাজির। তাদের কাঁধে কাদাজলে মাখামাখি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি কিছুতেই ঘরে ঢুকবেন না। ফিরে যাবেন মন্দিরের জায়গাটিতে। এই নিয়ে ক্রমাগত চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। একে ওকে হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। পরক্ষণেই আবার বুক চাপড়ে বিলাপ করছেন। তার স্ত্রী মরিয়ম বেগম ঘটনার কিছুই বুঝতে পারলেন না। তিনি ভয় পেয়ে তখুনি ছেলেদের খবর পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন। তারা আসতে আসতে প্রায় বিকেল। এই পুরোটা সময় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হয় প্রলাপ বকেছেন, নাহয় চুপচাপ তাকিয়ে থেকেছেন ছাদের দিকে।

এছাহাক যতটা সম্ভব আসল ঘটনা চেপে গিয়েছে। সে চায় না, গতরাতের ঘটনা এখুনি কেউ জানুক। এমনকি তার পরিবারের সদস্যরাও না। এর অবশ্য কারণও আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তাঁর নিজস্ব বৈসয়িক বিষয়াদি সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়া পারতপক্ষে কারো সঙ্গেই শেয়ার করেন না।

ফলে তিনি আগে খানিক সুস্থ, সুস্থির হোন। তখন তার পরামর্শ নিয়েই না হয় যা বলার বলা যাবে। তবে আপাতত এছাহাক পরিস্থিতি সামাল দিয়েছে। বলেছে, রাতে একটা জরুরি কাজে তারা বাইরে বেরিয়েছিল। কিন্তু ঝড়-বৃষ্টির কারণে আটকে যেতে হয়েছিল সেখানেই। ফেরার পথে কাদার মধ্যে আছাড় খেয়ে পড়ে আঘাত পেয়েছেন ভূঁইয়া।

ওহাব ডাক্তার চলে যেতেই এছাহাক সকলের উদ্দেশ্যে বলল, তাইলে ভূঁইয়া সাবে একটু ঘুমাক। কী বলো লিয়াকত?

লিয়াকত-শওকত কথা বলল না। তবে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। পরের দুটো দিন আর কিছুই ঘটল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও চুপচাপ শুয়েই থাকলেন। কারো সঙ্গে কথা বললেন না। ঘটনার তৃতীয় দিন তিনি এছাহাককে ডাকলেন। তারপর সরাসরিই জিজ্ঞেস করলেন কথাটা, আমার এই সর্বনাশটা কে করল এছাহাক? কার এত বড় কলিজা যে আমার মুখের সামনে থেকে আমার গ্রাস কেড়ে নিল?

এছাহাক কথা বলল না। কারণ তার কাছেও দেয়ার মতো কোনো সদুত্তর নেই। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নরম কণ্ঠে বললেন, তোমার কী মনে হয়? কে করতে পারে এই কাজ? আমি তো এখন আর কাউরেই বিশ্বাস করতে পারতেছি না। এই দেওয়ালের ইটরেও না। মনে হয়, এই ইটেরও প্রাণ আছে। আমি না থাকলে সেও আমার অগোচরে হাঁইটা হাইটা আইসা আমার লুকানো জিনিস উধাও কইরা দেবে।

এছাহাক কী বলবে বুঝতে পারল না। সে মিনমিন করে বলল, আমি কিছুই বুঝতে পারতেছি না ভূঁইয়া সাব। আমার মাথা এখনো ঝিমঝিম করতেছে।’

‘আমার কি মনে হয় জানো?

কী?

‘আমার শনির দশা লাগছে। যেইখানেই হাত দিই, সেইখানেই বিপদ।

কিন্তু ঘটনাটা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না ভূঁইয়া সাব। কেউ কিছু না জানলে ওই জঙ্গলে কে যাইব?’ বলে একটু আমতা আমতা করে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আসলেই কি ওইখানে কিছু ছিল? আপনে নিজ চোখে দেখছেন? না কি ওই মতি আর দেলু আইসা আপনেরে বলছিল?

এই কথায় আবার উত্তেজিত হয়ে উঠলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, নিজ চোখে দেখছি মানে? ওই যে ওইখানে আমার ট্রাংক আছে। ট্রাংকটা খোলো। এই যে বিছানার নিচে চাবি আছে।’

এছাহাক চাবি নিয়ে গিয়ে ট্রাংকটা খুলল। সেখানে এক জোড়া সোনার মোটা বালা। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, ‘ওইটা এইদিকে নিয়া আসো।

এছাহাক নিয়ে এলো। তবে আনতে আনতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ভালো ভাবে দেখলও সে। ভূঁইয়া বললেন, এই বালা জোড়া আমি ওইখান থেকে আনছিলাম। দেখো, আসল খাঁটি সোনার বালা। এইরকম বালা, বাজু, বিছা, হারে ভর্তি ছিল ওই কলস।

এছাহাক এবার আর বলার মতো কোনো কথা খুঁজে পেল না। জাহাঙ্গীর ভূইয়া বললেন, আমি তো একলা না। মতি আর দেলুও তো ছিল, তাই না? ওরাও তো দেখছে।

তাইলে?

মতি আমার কাছে এই বালা জোড়া আইনা দিছে। তারপর আমি নিজে গিয়া দেখছি। তোমারে বললাম না ওইদিন?

এছাহাক যেন কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছে না। তার কপালের দুশ্চিন্তার রেখা। সে বলল, এই কথা কি আপনারা তিনজন ছাড়া আর কেউ জানত? মানে ধরেন, ওই সময় তো ওই খানে আরো অনেকেই কাজ করতেছিল?

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চট করে উত্তর দিলেন না। একটু সময় নিয়ে ভাবলেন। তারপর বলেন, “একদম নিশ্চিত কইরা বলতে পারব না। বাইরে তো অনেকেই ছিল, কাজ করতেছিল। এখন কেউ যদি কোনো ফাঁকে-ফুঁকে দেইখা ফেলে…। সেইটা তো আর বলতে পারব না। তবে আমরা খুব তাড়াহুড়া কইরা সব ঢাইকা। ঢুইকা বের হইয়া আসছিলাম।’

হুম।’ বলে গম্ভীর হয়ে গেল এছাহাক।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অনিশ্চিত ভঙ্গিতে বললেন, মতি আর দেলু ছাড়া আর কেউ দেখছে বইলা আমার মনে হয় না। তোমার কী মনে হয়, ওরা দুজনে কি কিছু করছে…?’ কথাটা বলতে গিয়েও আবার নিজেকে সামলে নিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। যেন কথাটা তাঁর নিজের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হচ্ছে না।

এছাহাক বলল, বুঝতেছি না। কিন্তু এত বড় সাহস কি ওদের হইব? ওরা তো। জানেই যে ওই জিনিস না পাওয়া গেলে সবার আগে ওদের ওপরেই সন্দেহ। পড়বে।

হুম। গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আর ওদের তো আমি ভাগও দিতে চাইছি।’

‘সেইটাই।’ বলে চুপ করে গেল এছাহাক। তারপর হঠাৎ বলল, ওই সময়ে মন্দিরের কাছাকাছি আর কেউ ছিল? যে আপনেগো কথাবার্তা শুনতে পারে? বা কিছু দেখতে বা আন্দাজ করতে পারে?

‘উমমমম।’ বলে একটু ভাবলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, ‘হুম। আছিল।

‘কেডা?’

‘পরান।

‘কোন পরান?

‘ওই যে মাটি কাটার কাম করে। সে তখন একদম কাছেই ছিল। মন্দিরের দেয়ালের ঠিক বাইরেই মাটি খুঁড়তেছিল সে। আমরা যখন এই সব নিয়া কথা বলতেছিলাম, তখন সে মতি মিয়ারে কয়েকবার ডাকও দিছিল।

হুম।’ বলে আবারও গম্ভীর হয়ে গেল এছাহাক। তাকে খুব চিন্তিত লাগছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হঠাৎ কাতর গলায় বললেন, ‘আমি এইবার মইরাই যাব এছাহাক। ওই জিনিস যদি আমি না পাই, আমার আর এই কূল–ওই কূল কিছুই রইল না। তুমি একটা ব্যবস্থা করো। তুমি আমার ভাই। মসজিদের সেদিনের ঘটনার পর থেকে এছাহাকের ওপর খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। যেন অকূল সমুদ্রে এছাহাকই তাঁর ভরসার খড়কুটো। যেমনেই পারো, তুমি ওই জিনিস বাইর করনের ব্যবস্থা করো। তোমারে আমি অর্ধেক জিনিসই দিয়া দেবো।’

ভূঁইয়া সাব…।’ আচমকা গম্ভীর হয়ে গেল এছাহাক। তার গলা ভারী। যেন ভেজাও খানিকটা। তারপর খুব নরম গলায় বলল, “আমারে আপনের জিনিসের লোভ দেখাইতে হইব? এই যে এতবছর আপনের সঙ্গে কাজ করতেছি, কোনোদিন দেখছেন, আপনের কোনো জিনিসের প্রতি আমি লোভ করছি? আপনে যখন যা দিছেন, তার বাইরে একটা কানা আধলি কোনোদিন চাইছি?

‘আরে আমি সেইটা বলি নাই ভাই। তুমি আমারে ভুল বুঝতেছো। থতমত খাওয়া ভঙ্গিতে কথাটা বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তুমি আমার জইন্য যা করছ, তার প্রতিদান আমি জীবন দিয়া দিলেও শোধ হইব না। ওই দিন মসজিদের ঘটনায় এই জীবনে আর কোনোদিন মানুষরে আমি মুখ দেখাইতে পারতাম?

জাহাঙ্গীর ভূইয়া থামলেও এছাহাক কথা বলল না। তার মুখ ভার। যেন মানুষটার প্রতি তার নিবেদন সে এতবছরেও পুরোপুরি প্রমাণ করতে পারেনি। অথচ চেষ্টার ত্রুটিও কখনো করেনি সে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তুমি যে আমার কাছে কী, এইটা তুমি জানো না এছাহাক। এতদিন তুমি আমার জইন্য করছ। এইবার আমার করার পালা। তুমি এখন থেইকা আমার মায়ের পেটের আপনা ভাই। এই কথা একবার এই মুখ দিয়া বলছি মানে এইটাই দলিল। এর কোনো অন্যথা নেই।’

এছাহাক বলল, আপনের কাছেই আমি ছোট থেইকা বড় হইছি। বাপ-মা মরা আমারে যদি আপনে আশ্রয়-প্রশ্রয় না দিতেন, আপনের কাজে-কর্মে না রাখতেন, তাইলে মানুষের লাথি-গুতা খাইয়াই আমার বাঁচতে হইত। আর এখন দশ গ্রামের মানুষ জানে, আমি ভূঁইয়া বাড়ির লোক। ভূঁইয়া সাবের ডাইন হাত। আমারে তারা সম্মান, ভক্তি করে। এই পরিচয়টাইতো আমার পরিচয়। আর কী আছে আমার? আর কী লাগব আমার?

এছাহাকের চোখ জোড়া হঠাৎ ছলছল করে উঠল। সে বলল, আমি আমার জীবন দিয়া চেষ্টা করছি আপনের মন জোগাইতে। কখনো পারছি, কখনো পারি নাই। যখন পারি নাই, আপনে গালমন্দ করছেন। মনে কষ্টও পাইছি। কিন্তু ভাবছি, নিজের বাপ হইলেও তো মারত, বকাঝকা করত। আপনে তো আমার কাছে তার চাইতে কম কিছু না।

জাহাঙ্গীর ভূইয়া জানেন না, কত দিন পর, কত সপ্তাহ, মাস, বছর বাদে কারো কথা শুনে তার চোখে হঠাৎ পানি চলে এলো। তিনি এছাহাকের হাতখানা শক্ত করে ধরলেন। কিন্তু কিছু বলতে পারলেন না। এমন পরিস্থিতির সঙ্গে তার পরিচয় নেই। তবে এছাহাক বলল, “যেমনেই পারি, ওই জিনিস আমি বাইর করবই। আর ওই জিনিস যে সরাইছে, তারে আমি নিজ হাতে খুন করব।’

এছাহাকের চোখ মুখ শক্ত। ভয়ানক ক্রোধে যেন ফেটে পড়ছে সে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশ্য শান্ত গলায় বললেন, ‘খুন করলে কি মাল উদ্ধার হইব এছাহাক? মাল বেউদ্ধার করতে হইলে যে নিছে তারে চাই রাখতে হইব।’

মাল উদ্ধারের পর খুন করব।’ এছাহাক শীতল গলায় বলল। আরেকটা কথা, ওইখানে খাঁ সাবের লোক যারা পাহারায়, তাদেরও সন্দেহের বাইরে রাখন যাইব না। আমি তাগো একটা লিস্ট করতেছি। আপনি চিন্তা কইরেন না, চোর যত সাবধানেই চুরি করুক না কেন, একটা না একটা আলামত সে রাইখাই যায়। চোখ-কান খোলা রাখলে সেইটা ধরা পড়বই।

হুম। আমার মাথা আসলে কাজ করতেছে না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অস্ফুটে বললেন।

করব। একটু সময় দেন। এত দুশ্চিন্তা কইরেন না।’ বলে সামান্য থামল এছাহাক। তারপর বলল, আরেকটা কথা।

কী?

‘আশপাশে যত স্বর্ণকারের দোকান আছে, সব জায়গায় এক দিন এক দিন কইরা যাইতে হইব।

‘কেন?

‘গিয়া সব সেঁকরাগো বলতে হইব, এই বালার মতো এইরকম বা বহু বছরের পুরানো আমলের ডিজাইনের কোনো সোনার গয়না যদি কেউ বেচতে আনে, তাইলে যেন আমাগো জানায়।

‘তারা কেমনে জানব? তাগো কাছে কি…।’ কথা শেষ করার আগেই যেন নিজেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

এছাহাক তারপরও ব্যাখ্যা করল, কারণ যে সোনা চুরি করছে, সে তো আর সোনা খাইয়া বাঁচতে পারব না! তারে আগে সোনাগুলান বেইচা টাকা বানাইতে হইব। আর সোনা বেচতে হইলে বেশি দূরেও যাইতে পারব না। গুপ্তধন হইল সরকারি জিনিস। ধরা পড়লেই জেল-জরিমানা। তো দূরে নিতে গেলেও রাস্তাঘাটে রিস্ক আছে। পুলিশের চোখে পড়নের ভয় আছে। তো সে যদি আশপাশের সোনার দোকানে বেচতে চায়, তাইলে যেন খবরটা আমরা সঙ্গে সঙ্গে জানতে পারি।’

পুরো বিষয়টা চিন্তা করেই জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার চোখ জোড়া আবার চকচক করে উঠল। এছাহাকের প্রতি সত্যি সত্যিই তিনি এতদিন অবিচার করেছেন। অবমূল্যায়ন করেছেন। মাঝে মাঝে এমন বড় বড় নির্বুদ্ধিতা সে করেছে যে সেসবের কারণে তার ভেতরের এই তুখোড় বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষটা আড়ালেই ঢাকা পড়েছিল। আজ এছাহাকের কথা শুনে আবার যেন নব উদ্যমে কাজ করতে লাগলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

কিন্তু দিন কয় পেরিয়ে গেলেও জিনিসের কোনো হদিস মিলল না। প্রথমে পরানকে ডেকে আনা হলো। তাকে নানা উপায়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো। ভয় ভীতি অবধি দেখানো হলো। কিন্তু লাভ হলো না। ঘটনার পর থেকে মতি মিয়া আর দেলু ভেতরে ভেতরে বেশ আড়ষ্ট হয়ে আছে। এর অবশ্য কারণও আছে। তারা দুজনই জানে, এই ঘটনায় প্রথম সন্দেহের তীরটা আসবে তাদের দিকেই।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নিজে তাদের নিয়ে বসলেন। বললেন, দেখ, ওই জিনিস যদি তোরা নিয়াও থাকস, লাভ নাই। কারণ, ওই জিনিস তোরা কোনোখানে বেচতে পারবি না। গিলতেও পারবি না। মাঝখান দিয়া পুলিশের হাতে ধরা খাবি। তার চাইতে আমি যদি তোদের একটা ভাগ দিতাম। তখন সব ব্যবস্থা কিন্তু আমিই কইরা দিতাম। নিজে সেইফ থাকনের জইন্য হইলেও তোদের কোনো বিপদ হইতে দিতাম না আমি। দিতাম?

মতি মিয়া আর দেলু ডানে বাঁয়ে মাথা নাড়াল।

তাইলে? তাতে তো তোদেরই লাভ হইত। না?”

‘জে।’ বলে সামান্য চুপ করে রইল মতি মিয়া। তারপর ঢোক গিলে বলল, ‘কিন্তু ভূঁইয়া সাব আপনেই বলেন ওই মাল যদি আমরা সরানোর চিন্তা করতাম, তাইলে ওই দিন ওমনে আইসা আপনেরে জানাইতাম? আমরা দুজনেই তো কাউরে কিছু না জানাইয়া রাইতের অন্ধকারে আইসা সবাইর অগোচরে মাল উধাও কইরা দিতে পারতাম। পারতাম না? আপনে কিছু জানতেও পারতেন না।

মতি মিয়া থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। আসলে বলার নেইও। তার কথায় যুক্তি আছে। বিষয়টা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ভাবলেন। ভাবল এছাহাকও। সমস্যা হচ্ছে, তাহলে গুপ্তধন সরাল কে!

.

সেই রাতে অদ্ভুত এক ঘটনা ঘটল। মতি আর দেলু পাহারায় ছিল মহিতোষের বাড়ির বাইরে। তখন প্রায় মাঝরাত। আচমকা মৃদু আলো জ্বলে উঠল মহিতোষের বাড়ির পেছন দিকের জঙ্গলে। খানিক বিরতি দিয়ে আবার। তারপর আবার। আলো জ্বালানোর ধরন দেখে মনে হচ্ছে কেউ একজন খুব সন্তর্পণে অন্য সবার চোখ এড়িয়ে মূল রাস্তার দিকে আসতে চাইছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই বর্ষার চুপচুপে কাদা-পানির মধ্যে এত রাতে ওই জঙ্গলে কী? কোনো গোপন ব্যাপার নয় তো?

উত্তেজনায় মতি আর দেলুর শিরদাঁড়া টানটান হয়ে গেল। তারা দমবন্ধ করে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল। লোকটা যতটা সম্ভব নিজেকে আড়াল করে বাড়ি থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। সে আরো একবার টর্চ জ্বালতেই মুহূর্তের জন্য তার হহাতে থাকা চটের থলেটা চোখে পড়ল মতি মিয়ার। সঙ্গে সঙ্গেই জায়গায় জমে গেল সে। এত রাতে ওই জঙ্গল থেকে লুকিয়ে থলেতে করে কী বের করছে সে? আর যেন ভাবতে পারল না মতি মিয়া। তার বুকের ভেতর যেন রক্ত ছলকে উঠছে। সে কী করবে এখন? এছাহাককে খবর দেবে? নাকি দেলু আর সে মিলে লোকটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? ফিসফিস করে কথাটা দেলুকে বলল সে। দেলু বলল, কিন্তু মানুষটা কেডা?

“যে-ই হোক, কাক কইরা চাইপা ধরতে হইব দুজন মিললা।

‘তোর কি মাথা খারাপ হইয়া গেছে?’ বলল দেলু।

‘কেন?’

‘এইহানে বইসা ধরলে আওয়াজ শুইনা ভেতর থেইকা লোক বাইর হইয়া আসব। তখন কী হইব? আমাগো দুজনরে খুন কইরা রাখলেও কেউ টের পাইব না। এমনেই আশরাফ খাঁর জমিনে আমাগো আসন নিষেধ।

‘তাইলে?”

‘ও কই যায়, কী করে, সেইটা আগে দেখতে হইব।’

মতি মিয়া কথা বলল না। তবে লোকটা রাস্তায় উঠে আসতেই সে বলল, সাইজ দেইখাতো মনে হয় রুস্তমে। ওই যে আগে কুস্তি লড়ত।

‘হ। রুস্তমেই। একমত হলো দেলু।

আমরা দুজনে ওর লগে পারব? পারব না। আর ওর আরেক হাতে ওইটা কি দেখছস?”

‘কী?

‘র্টেটা! এক কোপ দিলেই শেষ।

‘এত রাইতে সে তেঁটা হাতে কই গেছিল? তার লগে আবার চটের ব্যাগ। আবার এখন ওই জঙ্গল থেইকা বের হইয়া সে কই যায়? চিন্তিত মুখে কথাগুলো বলল দেলু।

মতি মিয়া সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল না। খানিক চুপ করে কী ভাবল সে। তারপর বলল, আমরা দুজন কিছুই করতে পারব না। আর কী না কী কইরা বসব, তারপর আবার ভূঁইয়ার কাছে দোষে পড়ব। তার চাইতে একটা কাজ কর।

কী কাজ?

‘তুই গিয়া এছাহাকরে খবরডা দে। আমি এইখানে থাকি। দেখি সে কী করে কই যায়।

বুদ্ধিটা মনে ধরল দেলুর। সে এছাহাককে খবর দিতে গেল। সবশুনে এছাহাক হতভম্ব হয়ে গেল। সে ঘুম রেখে এক কাপড়ে ছুটে চলে এলো। কিন্তু এসে দেখে মতি মিয়া বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে আছে একা। এছাহাক বলল, কীরে মতি, রুস্তম কই?

‘সে তো বাজারের পাশের রাস্তা দিয়া নাইমা গেল।’

‘কই নাইমা গেল?

বটগাছটার নিচে ঝোঁপের দিকে। আমি একটু সামনে গিয়া উঁকি দিয়া দেখছিলাম। কিন্তু সে আর নাই। কই গেছে কে জানে! এখন একলা একলা গিয়া যদি তার চোখে পইড়া যাই? এই রাইতে আমারে একলা পাইয়া খুন কইরা রাইখা গেলেও তো কেউ টের পাইব না। এই ডরে আর নিচে নামি নাই।’

এছাহাক সামান্য ভর্ৎসনা করলেও তারা তিনজনই দ্রুত নিচে নামল। সেখানে রমজানের ভাতের হোটেলের পেছন দিকটা ঘেঁষে সরু একটা পথ চলে গেছে উত্তরপাড়ার দিকে। রুস্তম কি তবে ওই পথেই চলে গেছে? কোথায়?

দেলু অস্ফুটে বলল, “সে কি উত্তরপাড়ায় আশরাফ খাঁর বাড়ির দিকে গেছে?

‘এখন তো সেইটাই মনে হইতেছে।’ বলল মতি মিয়া। তার হাতের ওই ব্যাগে কি তাইলে আমাগো ওই জিনিস? সে কোনোভাবে খোঁজ পাইয়া গেছিল? তারপর আমরা সেই দিন রাইতে যাওনের আগেই সে অন্য কোথাও সরাই রাখছিল। আর এখন রাইতের আন্ধারে সেইগুলা নিয়া যাইতেছে উত্তরপাড়ায় আশরাফ খাঁর কাছে?

মতি মিয়ার কথা শেষ হলেও কেউ কোনো জবাব দিল না। যেন তাদের তিনজনের মনের অবস্থাও এই একই। কিন্তু এই আন্ধকারে তারা কেউই রুস্তমকে খুঁজে তার পথ রোধ করে সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহস পেল না।

.

পরদিন রাতে ঘটল আরো এক অদ্ভুত ঘটনা। এছাহাক আর মতি মিয়ার কাছে গতরাতের ঘটনা শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া হতভম্ব হয়ে গেলেন। যদি সত্যি সত্যিই ওই গুপ্তধন আশরাফ খাঁর হাতে গিয়েই পৌঁছে থাকে, তবে তার পরাজয়ের মোলকলা পূর্ণ হবার আর কিছুই বাকি রইল না। আশরাফ খাঁর কাছ থেকে ওই জিনিস উদ্ধারের ক্ষমতা তার নেই। নেই কোনো আইনগত ভিত্তিও। এখন তাহলে কী করবেন তিনি? অনেক ভেবেও এর কোনো উত্তর খুঁজে পেলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বরং একটা প্রবল অক্ষম আক্রোশ যেন তাকে ক্রমশই বুনো উন্মাদে পরিণত করতে লাগল। আজকাল প্রায়ই সবকিছু ভেঙেচুড়ে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে হয়। মনে হয়, দলবল নিয়ে রাতের অন্ধকারে আশরাফ খাঁর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন। তারপর বইয়ে দেবেন রক্তগঙ্গা। পরিণতিতে যা হবার হবে। অন্তত এই চাপা দুশ্চিন্তা, নিষ্ঠুম রাতের যন্ত্রণা, আর প্রতি মুহূর্তে পরাজয়ের দুঃস্বপ্ন থেকে তো মুক্তি মিলবে!

একবার পুলিশকে খবর দেওয়ার কথা ভাবলেন। কিন্তু প্রায় ছ-সাত মাস হলো কামালের কোনো খবর নেই। এছাহাক বলেছিল সে গ্রেপ্তার হয়েছে। যদি তা ই হয়ে থাকে, তাহলে সেটি একদিক থেকে যেমন খারাপ, তেমনি অন্যদিক থেকে খানিক ভালোও। অন্তত এখন তিনি এটুকু নিশ্চিন্ত যে কামাল পুলিশের কাছে তার ব্যাপারে কিছু বলেনি। বললে এতদিনে হয়তো এই ভুবনডাঙাতেই পুলিশ চলে আসতে পারত তার খোঁজে। এই ভয়েই ঢাকা থেকে ফিরে প্রায় দু-তিন মাস জড়সড় হয়েছিলেন তিনি। সমস্যা হচ্ছে, এখন যদি আশরাফ খাঁর বিষয়ে পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ করতে যান, আর সেটি যদি তার নিজের জন্যই বুমেরাং হয়ে যায়? যদি নিজেই ফেঁসে যান কোনো বিপদে? তখন কী হবে?

পুলিশকে বিশ্বাস নেই। কোনদিক থেকে যে কী খবর তারা বের করে ফেলবে কে জানে! তখন দেখা গেল নতুন কোনো ঝামেলা। এই মুহূর্তে আর কোনো ঝামেলায় জড়ানোর শক্তি বা সাহস কোনোটিই তার নেই। চতুর্মুখী বিপদ আর দুর্ভাগ্যের আঘাতে তিনি পর্যদস্ত। এই ঘনঘোর দুর্যোগ থেকে মুক্তির আশু কোনো উপায়ও জানেন না তিনি। বরং পুরোপুরি নির্ভর করে বসে আছেন এছাহাকের ওপর। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এটিও উপলব্ধি করেন, এছাহাক যত বুদ্ধিমানই হোক না কেন, তার চেষ্টা ও আন্তরিকতা যতই শতভাগ হোক না কেন, তারপরও এই এত এত সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা তার একার নেই। নিজের ছেলে দুটোকেও কীভাবে কীভাবে যেন দূরে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। ফলে চাইলেও এখন আর তাদের অবলম্বন হিসেবে কাছে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তা ছাড়া, এই বিপদ আপদের কথাও কিছু জানে না তারা।

আচমকাই কামালের কথা খুব মনে পড়তে লাগল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। এই কূল-কিনারাহীন বিপদ থেকে তাকে যদি কেউ উদ্ধার করতে পারত, তবে তা একমাত্র কামালই। সে ছাড়া আর কারো ক্ষমতা নেই তাকে এই সব বিপদ থেকে উদ্ধার করে। তা ছাড়া, বাইরে থেকে বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে যে আশরাফ খাঁ কত বড় ধুরন্ধর মানুষ, তা এখন তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। এই এতটা বছর চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকার পর অবশেষে সুযোগ বুঝে তিনি ঠিকই জেগে উঠেছেন। যেন এই সময়ের অপেক্ষাতেই ছিলেন। সমস্যা হচ্ছে, কামাল নেই। সে পুলিশের হাতে বন্দি। নিজেকে কোনো ভয়াল বিচ্ছিন্ন দ্বীপের একা নিঃসঙ্গ এক অসহায় বাসিন্দা মনে হতে লাগল তার। যার চারপাশে কেউ নেই, কিছু নেই। কেবল আছে ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাক্ষুসে এক অকূল সমুদ্র।

সেই রাতে আর ঘুমাতে পারলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। শরীরটা প্রচণ্ড খারাপ লাগতে লাগল তার। মনে হলো ওহাব ডাক্তার যে স্বাস্থ্যগত ভয়টা তাকে দেখিয়েছিলেন, অধিক দুশ্চিন্তা আর নিদ্রাহীনতায় সেই ভয়টাই যেন ত্বরান্বিত হয়ে উঠছে। কিন্তু এসব কিছু থেকে উত্তরণের উপায় কী?

ভোর রাতের দিকে খানিক তন্দ্রা মতো লেগে এলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তিনি সেই তন্দ্রার মধ্যেই দেখলেন কেউ একজন এসে তার ঘরের দরজা ধাক্কাচ্ছে। কিন্তু সেই দরজা কেউ খুলছে না। তিনি চিৎকার করে ডাকছেন। কিন্তু তার ডাকেও কেউ সাড়া দিচ্ছে না। যেন বাড়িতে তিনি ছাড়া আর কেই নেই। মরিয়া জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া নিজেই অবশেষে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলতে গেলেন। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই তার ঘুম ভেঙে গেল। তিনি ঘুম ভেঙে হঠাৎ আবিষ্কার করলেন, সত্যি সত্যিই তার ঘরের মূল দরজা কেউ ধাক্কাচ্ছে। অথচ কেউ খুলছে না। এই ভোর রাতের দিকে আবার কে এলো? বিস্মিত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। আর তারপর হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

দরজার বাইরে তার ঠিক সামনেই হাত ছোঁয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে কামাল।

১৮

পারুর শরীর খারাপ করেছে। তাবারন বিবি যতটা সম্ভব চেষ্টা করছেন তার সেবা যত্ন করার। এই বাড়িতে এখন তিনি আর তার বড় মেয়ে সালমা থাকেন। সালমার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। তার বিয়ে হয়েছে পাশের গায়ে। ছেলে-মেয়েরাও বড় হয়ে গেছে। তারপরও সে ঘন ঘন মাকে দেখতে বাপের বাড়ি আসে। এই নিয়ে জামাইয়ের সঙ্গে তার খটোমটো লেগেই থাকে। তবে ছেলে-মেয়েরা নানিকে খুব পছন্দ করে বলে তাদের বাবা বেশি কিছু বলতে পারেন না। বরং তার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই তারা হুটহাট নানি বাড়ি চলে আসে। আর তারা যে কদিন এখানে এসে থাকে, সে কদিন তাবারন বিবির আনন্দ যেন আর ধরে না। তখন এই বাড়ি পরিণত হয় তুমুল কোলাহলের আনন্দনগরে। কিন্তু তারা চলে যেতেই যেন আবার নিশব্দ এক যমপুরী। তখন একটা গাছের পাতা পড়লেও তার শব্দ শোনা যায়। রাতের বেলা মনে হয় কোনো এক অচিনপুরের নিঃসঙ্গ নির্বাসিত পরিত্যক্ত পোড়ো বাড়ি। এখানে তখন কেবলই কেউ নেই কেউ নেই হাহাকার। সেই হাহাকার কাটাতেই বুঝি তাবারন বিবি গাঁয়ের এপাশ থেকে ওপাশ ঘুরে বেড়ান। মানুষের আনন্দ-দুঃখ দেখেন। সঙ্গ-সান্নিধ্য লাভ করেন। ওটুকুতেই তার আনন্দ।

তিনি একা। শরীরী সামর্থ্যের দিক থেকেও প্রায় অসহায়। তারপরও ফজু বা রাজিয়ার সাহস হয়নি এ বাড়িতে এসে পারুকে নিয়ে যাওয়ার। কিংবা তার খোঁজ করার। এর অনেকগুলো কারণ থাকতে পারে। ফজু খুব বাজেভাবে আহত হয়েছে। তারপক্ষে আর ওই অবস্থায় এখানে আসা সম্ভব হয়নি। এমনকি সে লোকের কাছেও তার মুখের ওই বিভৎস অবস্থার সঠিক কারণ বলতে পারবে না। তারওপর এখন তাকে ছুটতে হবে ডাক্তারের কাছে। এই এলাকায় আশপাশে ভালো হাসপাতাল নেই। ডাক্তার দেখাতে হলে তাকে যেতে হবে থানা শহরে। সেখান থেকে প্রতিদিন আসা-যাওয়া করাটাও কঠিন। হয়তো এ কারণে স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই থেকে যেতে হতে পারে তাকে। আর সেদিন রাতে পারুর যে রূপ রাজিয়া দেখেছে, তারপর সে একা আর কখনো পারুর মুখোমুখি হতে চাইবে বলে মনে হয় না। তা ছাড়া তাবারন বিবি বয়সের ভারে ন্যুজ হলেও গ্রামে তার আলাদা একটা সম্মান আছে। লোকে তাকে সমীহ করে। ফলে তার বাড়ি থেকে কাউকে জোর করে নিয়ে যাওয়াটা ভালো কিছু হবে না। এমনিতেই ফজু আর রাজিয়া জানে, তারা যা করেছে তা ভয়াবহ অন্যায়। এই ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে তাদের আর নিস্তার নেই। হয়তো এসব কারণেও তারা গুটিয়ে আছে।

গত এক সপ্তাহ আর তেমন কিছুই ঘটেনি। কেবল দিন যত গড়িয়েছে, পারুর শরীর তত খারাপ হয়েছে। এই সময়ে তার পর্যাপ্ত মানসিক ও শারীরিক বিশ্রাম দরকার। যত্ন দরকার। কিন্তু সেসবের কিছুই সে পায়নি। বরং একের পর এক অবিশ্বাস্য শারীরিক-মানসিক ধকল গেছে তার। আজকাল পারুর নিজের কাছেই সবকিছু অবাস্তব মনে হয়। মনে হয় তার জীবনের এই যে গল্প, এসবই তার কল্পনা। কিংবা কোনো দুঃস্বপ্ন। হঠাৎ তার ঘুম ভেঙে যাবে, সে অবাক হয়ে দেখবে ভুবনডাঙার সেই ছায়া ঘেরা, মায়াময় টিনের চালের ঘরখানাতে সে শুয়ে আছে। দেয়ালের ঘুলঘুলি দিয়ে ভোরের ত্যারচা আলো এসে পড়ছে তার মুখে। সে চিৎকার করে চারুকে ডাকবে, চারু, চারু।

চারু আড়মোড়া ভাঙতে ভাঙতে বলবে, আমি এখন ওটা বন্ধ করতে পারব।

‘বন্ধ করতে না পারলে আমি ঘুমাব কী করে? তুই জানিস না মুখে আলো পড়লে আমি ঘুমাতে পারি না।’

তুমি চোখে কাপড় বেঁধে ঘুমাও।’

‘পারব না। তাতেও আমার ঘুম হবে না। তুই ওঠ। উঠে গিয়ে আলোটা বন্ধ করার ব্যবস্থা কর।

চারু উঠবে না। সে গুটিশুটি মেরে শুয়েই থাকবে। পারু এরপর নানা ফন্দি আটতে থাকবে। বোঝাতে থাকবে, আমি তোর বড় না চারু?

না।

তাহলে?

‘ছোটো। চারু ইচ্ছে করেই কথাটা বলবে। কারণ সে জানে, বড় বললেই পারু বলবে বড় বোনের কথা শুনতে হয়। যা আলোটা বন্ধ করে আয়। পারু তখন চারুকে ঠেলতে থাকবে। চারু আচমকা তারস্বরে বাবাকে ডাকবে। শেষ অবধি বাবা এসে ঘুলঘুলির মুখে কাপড় সেঁটে দিয়ে আলো বন্ধ করে দেবেন। তারপর দুই মেয়ের বিছানার পাশে বসে দুই হাতে তাদের দুজনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকবেন। পারু তখন ঘুম ঘুম গলায় বলবে, বাবা, তুমি কিন্তু চারুর মাথায় বেশি বিলি কেটে দিচ্ছো। আমি বড়, আমার ভাগ বেশি।

মহিতোষ হাসবেন। সেই হাসি পারু কিংবা চারু কেউ দেখবে না। কিন্তু তারা জানে, বাবা তখন এমন মায়া জড়ানো আভা ছড়িয়ে হাসেন, যে মনে হয় ওই হাসির উৎস এই জগতে না। অন্য কোথাও। তারা দুজনই তখন বাবার আরো কাছে সরে আসবে। মহিতোষ তখন বলবে, এখন কিন্তু মা এসে বকবে। বেলা অনেক হলো।’

চারু বলবে, মাকে বলো, এখন না বকতে। মা যদি আদর কম করে, তাহলে বাবার তো একটু বেশি আদর করে সেটা পুষিয়ে দিতেই হয়। তাই না?

‘তোদের মা তোদের কম আদর করে? মহিতোষ জিজ্ঞেস করবেন।

করেই তো!’

কী বলছিস এসব? মা শুনলে কষ্ট পাবে না?

মা যখন বকে, তখন আমরাও তো কষ্ট পাই। তাই না দিদি?

পারু কথা বলে না। সে এই সব মুহূর্তের একটুও অকারণে হারাতে চায় না। সবটুকু শুষে নিতে চায়। তা নেয়ও। কিন্তু তাদের আশঙ্কাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই অঞ্জলি এসে হাজির হন। তারপর শুরু করেন চিৎকার চেঁচামেচি। তার বেশির ভাগই যতটা না মেয়েদের উদ্দেশ্য করে, তার চেয়ে ঢের বেশি মহিতোষকে লক্ষ্য করে। এত বড় ধাড়ি ধাড়ি মেয়েদের তিনি আদর-আহ্লাদ দিয়ে নষ্ট করছেন। কদিন পর মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দিলে তিনি কি তখন তাদের সঙ্গে শ্বশুরবাড়ি গিয়ে থাকবেন? কাজ-কর্ম সব করে দিয়ে আসবেন? এমন কত কী! মহিতোষ কোনো কথারই জবাব দেন না। তিনি যেমন ছিলেন, তেমন বসেই থাকেন। আর তার দুই হাত দুই মেয়ের চুলের ভেতর বিলি কাটতে থাকে। সেই হাতের স্পর্শ এই জগতের আর কোনো স্পর্শের সঙ্গে তুল্য নয়। অমন মমতা, অমন স্নেহমাখা স্পর্শ বুঝি এই ত্রিভুবনে আর কোথাও নেই।

.

পারু আচমকা আবিষ্কার করে তার বালিশ ভিজে যাচ্ছে। সে আর কাঁদবে না বলে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই প্রতিজ্ঞা সে রাখতে পারে না। কারো বুকের ভেতর লুকিয়ে থাকা এমন অপার্থিব অনুভব, এমন মায়াময় স্মৃতি যদি এভাবে। কারণে-অকারণে সুবাস ছড়িয়ে সবকিছু এলোমেলো করে দিতে থাকে, তবে তার চোখের আর কী দোষ?

.

সেদিনের সেই ভয়াবহ রাতে দরজা খুলে পারুকে ওভাবে দুয়ারের বাইরে পরে থাকতে দেখেও কোনো হইচই করেননি তাবারন বিবি। যেন তিনি জানতেন এমন কিছু হবে। কিংবা হতে পারে। সালমাকে ডেকে পারুকে ঘরে নেয়ার ব্যবস্থা করলেন তিনি। তারপর মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলেন। তা পারু চোখ মেলে তাকালোও। কিন্তু কোনো কথা বলল না। তার চোখে মুখে তীব্র ভয়। প্রথম বেশ খানিকটা সময় যেন সে বুঝতেই পারল না এ সে কোথায় এসেছে! তার মুখের ওপর যে মুখ দুটি ঝুঁকে আছে, তারাই বা কারা? তাবারন বিবি প্রথম কথা বললেন। তিনি বললেন, ‘এহন কেমন লাগতেছে?

পারু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তার হঠাৎ মনে হলো তার মুখের ওপর কোঁচকানো চামড়ার, ফোকলা দাঁতের ওই মুখখানা বুঝি ছায়ারাণীর। কিন্তু এই বিভ্রান্তিটুকু কেটে যেতেও সময় লাগেনি। তাবারন বিবি বিড়বিড় করে কী যেন দোয়া পড়ে কয়েকবার ফুঁ দিয়ে দিলেন তার চোখে, মুখে, মাথায়। তারপর বললেন, আর কোনো ভয় নাই। এই রাইত-বিরাইতে আ-জায়গা, কু-জায়গার ভেতর দিয়া আসছস, তাও আবার চুল খোলা। পোয়াতি মাইয়াগো অনেক কিছু মাইনা চলতে হয়। খারাপ কিছুতে আসর করলে তহন?

পারু তাবারন বিবির বেশির ভাগ কথাই বুঝতে পারল না। তবে সে এটুকু নিশ্চিত যে এই মানুষটার কাছ থেকে তার ক্ষতির কোনো আশঙ্কা নেই। বরং এখানে সে নিরাপদ। যদিও নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা প্রকাশ করা নিয়ে দ্বিধান্বিত সে। সেটি প্রকাশ করলে যদি আবার কোনো বিড়ম্বনা হয়? তিনি যদি আর আগের মতো স্নেহ না করেন! কাশেমকে পছন্দ করেন বলেই হয়তো তাবারন বিবি তাকে এত যত্ন-আত্মী করছেন। এবং এখন এই যত্নটুকু তার ভীষণ প্রয়োজন। সে কোনোভাবেই এটুকু হারাতে চায় না।

তাবারন বিবি বললেন, কী হইছে এহন বলন লাগব না। কাইল সব শোনন যাইব। তুই রাইতে কিছু খাইছস?’

পারু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তাবারন বিবি বললেন, ‘এহন তো আর কিছু খাবি না?

না।’

তাইলে এহন আমার লগে ঘুমা। যা শোননের বেয়ানে উইঠা শুনব। রাজিয়ারে তো আমি চিনি। আস্ত একখান দজ্জাল মাইয়া। যহন মাথায় বাই ওঠে তহন আর দিন দুনিয়ার কিছু খেয়াল থাহে না, কিছু মানে না। এইজন্যই আমি তোরে আগেভাগেই সাবধান করছিলাম। যাই হোক, এহন আর অত চিন্তা দিয়া কাম নাই। ঘুমা।

পারু আর কথা বলেনি। সে জানে না কেন, আচমকা প্রবল ঘুমে তার চোখ জড়িয়ে এলো। মনে হলো সে তুলোর মতো হালকা হয়ে হাওয়ায় ভাসছে। তার। চারপাশে অসংখ্য শুভ্র মেঘ। সে সেই মেঘের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। বহুদিন পর তার খুব ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল পরদিন বেলা করে। অবাক ব্যাপার হলো তাবারন বিবি তাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। বরং খুব যত্ন করে খাওয়ালেন। তারপর বললেন, যা হইছে, যদি বলতে না মন চায়, বলার দরকার নাই। তুই এইহানেই থাক কাশেম না আসা পর্যন্ত। বাকিটা আমি দেখতেছি।’

পারু অবশ্য পরে নিজ থেকেই খানিক বলেছিল। তবে তাতে ফজু কিংবা। রাজিয়ার এত বড় পরিকল্পনা কিংবা পুরো ঘটনার হুবহু বর্ণনা ছিল না। সে তার মতো করে ঘটনাকে যতটা সম্ভব লঘু করেই বলার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু এর পরপরই তার শরীর খারাপ হতে লাগল। গর্ভাবস্থায় মেয়েদের যেসব জটিলতা দেখা দেয়, তারও অনেক কিছুই দেখা যেতে লাগল। তবে একটা বিষয়ে ভাগ্য তাকে সহায়তা করেছে। তাহলো তাবারন বিবি এসব বিষয়ে অভিজ্ঞ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান সম্পর্কে তার তেমন কোনো ধারণা না থাকলেও গাঁয়ের মেয়েদের বাচ্চা প্রসবে তিনি বিভিন্ন সময়ে নানাভাবে যুক্ত ছিলেন। এমনকি কখনো কখনো দাইয়ের ভূমিকাও পালন করেছেন। ফলে এসব থেকে সঞ্চিত প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাকে অনেকটাই দক্ষ করে তুলেছে। যদিও তাতে কুসংস্কারের অস্তিত্বও কম নয়। তারপরও পরিস্থিতি বিবেচনায় পারুর জন্য এরচেয়ে ভালো আর কিছু হতে পারত না।

সেই ভালোও অবশ্য আর ভালো রইল না। দিন দশেকের মাথায় এক রাতে পারুর প্রচণ্ড চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল তাবারন বিবির। তিনি আলো জ্বালিয়ে দেখেন পারু কাটা মাছের মতো ছটফট করছে। তার নিম্নাংশের কাপড় ভিজে জবজব করছে। তাতে খানিক রক্তের আভাসও। দৃশ্যটা দেখে ভয় পেয়ে গেলেন তাবারন বিবি। কিন্তু নিজের সীমিত জ্ঞানে এর কোনো আশু প্রতিকার তিনি খুঁজে পেলেন না।

সালমা বলল, মা, লক্ষণ তো ভালো ঠেকতেছে না।

‘আল্লাহ আল্লাহ কর। আল্লাহ খোদার নাম নেওন ছাড়া তো এহন আর কিছু করার নাই।

সালমা জোরে জোরে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগল। তাবারন বিবি বললেন, কাশেম ছ্যামড়াডা এই সময়ে বউয়ের পাশে নাই। তার উচিত আছিল, নিজে না। থাকতে পারলেও একটা ট্রলার অন্তত আমার বাড়ির ঘাটে রাইখা যাওন। কহন কী হইয়া যায়, কওন যায়? এহন এত রাইতে এই মাইয়া লইয়া আমি কই যাই?

সালমা ফিসফিস করে বলল, ‘দেহি আমি কাইল কোনো ব্যবস্থা করতে পারি কি না! কিন্তু মা, এহনও কিন্ত রক্ত কম যায় নাই। বাচ্চার কোনো ক্ষতি হইব না তো?’

তাবারন বিবি জবাব দিলেন না। তিনি পারুর মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে তার মাথায় তেল-পানি ঘষতে লাগলেন। সালমার সঙ্গে সুর মিলিয়ে দোয়া পড়তে লাগলেন।

পরদিন সকাল নাগাদ পারুর শরীর খানিক সুস্থ হলো। কিন্তু গতরাতের ভয়াল যন্ত্রণা তার মাথা থেকে কিছুতেই গেল না। তার কেবল মনে হতে লাগল, এই জীবন তার সকল সঞ্চয় একে একে তার কাছ থেকে কেড়ে নিতে চাইছে। কিছুই অবশিষ্ট রাখতে চায় না তার জন্য। সে যেখানেই যাকে জড়ায়ে ধরে বাঁচতে চেয়েছে, তাকেই ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে তাকে নিঃস্ব, অসহায় করে দিতে চেয়েছে। কিন্তু তারপরও এই জীবনের কাছে কিছুতেই সে হার মানবে না। তা তাকে আরো নিঃসঙ্গ, আরো যন্ত্রণাক্লিষ্ট কিংবা সহায়-সম্বলহীন করে ফেললেও না।

সমস্যা হচ্ছে, এরপর আরো কটা দিন কেটে গেল। পারু হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করল, সে তার শরীরের ভেতর ক্রমশই বেড়ে উঠতে থাকা, সরব হয়ে উঠতে থাকা অস্তিত্বটার আর কোনো সাড়া পাচ্ছে না। সে যেন নিষ্প্রাণ, নিঃসাঢ়, মৃত এক অস্তিত্ব। সে কি তবে চিরদিনের জন্য থমকে গেছে? আর কখনো নড়ে উঠবে না সে? এই পৃথিবীর আলো-হাওয়া দেখবে না?

পারু আর ভাবতে পারে না। এই যদি হয় তার জীবন, এমন অন্তহীন দুঃস্বপ্নের চোরাগলিতে পরিপূর্ণ, তবে সেই জীবন সে কেন বয়ে বেড়াবে? সব হারিয়েও ওই একখানা মুখের জন্যই তো বেঁচে ছিল সে! স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু শেষ অবধি সেই মুখখানাও তার কাছে এমন দুঃস্বপ্নই রয়ে যাবে?

পারু আচমকা তার সকল প্রতিজ্ঞা, সকল প্রতীরোধকে কর্পূরের মতো হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। অভিশপ্ত এই জীবনে বেঁচে থাকার এত লোভ কেন তার? একে নিঃশেষ করে দিলেই তো তার চির শান্তি! তাহলে এবার থেমে যাক এই যুদ্ধ, হেরে যাক সে, জিতে যাক মৃত্যু।

১৯

আছমা ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছে। রাতে বৃষ্টি হয়েছে বলে উঠানের এখানে সেখানে পানি জমে পিচ্ছিল হয়ে আছে। কিন্তু তাকে ওজু করতে হলে ঘর থেকে বেরোতেই হবে। যেতে হবে ঘরের দক্ষিণ দিকের কলপাড়ে। সে খুব সাবধানে পা ফেলে হাঁটছিল। এই সময়ে খানিক থমকে দাঁড়াল। বাড়ির প্রবেশ পথের সঙ্গেই একটা হাসনাহেনা ফুলের গাছ। সেই ফুল থেকে মাতাল করা ঘ্রাণ আসছে। আছমা ঠিক জানে না, সেই সুবাসের কারণেই কি না, সে খানিক অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কিংবা তার মনে হলো পলকের জন্য হলেও কেউ একজন ওখানে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই শেষ রাতে ওই অন্ধকারে কে দাঁড়িয়ে থাকবে? সদ্য ঘুম ভাঙা আছমা চোখের ভুল ভেবে আবার এগোতে লাগল কলপাড়ের দিকে। এই মুহূর্তে ঘরের ভেতর থেকে তার মা নুরুন্নাহার তাকে ডাকলেন। বললেন, ‘উঠানে কি পানি জইমা আছেনি আছমা? পিছলা?”

‘হ মা। আছমা জবাব দিল।

তাইলে আমার জন্য বালতিতে কইরা একটু পানি আন। আমি দুয়ারে বইসাই ওজু কইরা নেই।’

“আর আব্বায়? সে কি মসজিদে যাইব?’

‘এই বৃষ্টি কাদার মধ্যে এহন আর যাওন লাগব না। পরে দেখা গেল আছাড় খাইয়া হাত-পা ভাঙছে।

তাইলে আব্বার জন্যও ওজুর পানি আনি?”

আন।

আছমা ধীরে সুস্থে ওজু করল। তারপর কল চাপিয়ে বালতিতে পানি ভরল। কিন্তু অত বড় বালতি হাতে ঘরের দিকে যেতে ভারি কষ্ট হতে লাগল তার। সে কেবল দু কদম এগিয়েছে। এই মুহূর্তে ছায়ামূর্তিটাকে দেখল। স্পষ্ট। একটা লম্বা, ছিপছিপে লোক আতা গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে আসছে। আছমা তার মাকে কিছু বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু পারল না। তার আগেই তীব্র চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। সে হাতের বালতিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাগলের মতো ছুটতে লাগল ঘরের দিকে। নুরুন্নাহার ও ওহাব ডাক্তার হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন। আছমার চোখ সন্ত্রস্ত। সে থরথর করে কাঁপছে। ওহাব ডাক্তার বললেন, কী হইছে মা? কী দেইখা ভয় পাইছস?

আছমা কথা বলল না। নুরুন্নাহার আলো হাতে বাইরে বের হয়ে এলেন। কিন্তু আশপাশে কাউকে কোথাও দেখতে পেলেন না। ওহাব ডাক্তার বললেন, কী হইছে বল? কোনো কিছু দেইখা ভয় পাইছস?”

আছমা এবার ওপর নিচ মাথা নাড়ল। নুরুন্নাহার বললেন, ‘কী দেখছস? এই আন্ধারে কুত্তা-বিলাই দেইখাও অনেকে ভয় পায়।’ বলেই স্বামীর দিকে ফিরলেন তিনি। এই জইন্যই বলি, মাইয়াটারে একলা বাইর হইতে দিয়েন না। আপনেও তো বাইর হইতে পারতেন।

ওহাব ডাক্তার স্ত্রীর কথার জবাব দিলেন না। তিনি মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী হইছে, আমারে বল। কী দেইখা এমন ভয় পাইছস?

‘ওইখানে ওই আতাফল গাছটার নিচে কে জানি দাঁড়াই আছে।

আতাফল গাছের নিচে? ওহাব ডাক্তার খুবই অবাক হলেন। এই সময়ে ওইখানে কে দাঁড়াই থাকবে?

‘আমি এই মাত্র হারিকেন দিয়া দেখলাম, কই কেউ তো নাই।’ বললেন নুরুন্নাহার।

‘আছে মা। আমি স্পষ্ট দেখছি।’

কী দেখছস?’

সাদা শার্ট পরা মানুষটা। ফরিদ ভাইয়ের মতো লম্বা, রোগা।

এই কথায় নুরুন্নাহার চুপ করে রইলেন। তবে আড়চোখে একবার স্বামীর দিকে তাকালেন তিনি। তার সেই দৃষ্টিতে রাজ্যের রাগ, অভিযোগ, ভর্ৎসনা। যেন তার কারণেই আজ আছমার এই দশা। ফরিদ আর পারুর ঘটনায় সে যে খুব প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তা নয়। তবে তারপরও নুরুন্নাহার মাঝে মাঝে টের পেতেন, মাঝরাতে ঘুম থেকে উঠে একা একা কাঁদত আছমা। সময়ে অসময়ে ফরিদের কথা ভেবে অস্থির হয়ে থাকত। ঘুমের মধ্যেও যে কতবার তাকে স্বপ্ন দেখে কথা বলেছে সে, কান্নাকাটি করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে সেসবের বেশির ভাগই নিজের ভেতর লুকিয়ে রাখতে চাইত আছমা। বলতে চাইতো না কাউকেই। এমনকি মাকেও না। মেয়েটা এত চাপা। এত সংবেদনশীল। ফরিদকে সে নিজের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়েই ভালোবেসেছিল। কিন্তু বিনিময়ে তার জীবনটা এলোমেলো করে দিয়ে গেল ফরিদ। আর এসব কিছুর পেছনে কোথাও না কোথাও যেন স্বামীরও দায় দেখেন নুরুন্নাহার। যেন তার কারণেই ফরিদ আর পারুর সম্পর্কটা হয়েছে। ওভাবে সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যাওয়ার সাহস পেয়েছে ফরিদ। আর সেসবের ফলশ্রুতিতে এখন আমার মানসিক অবস্থাও এমন ভয়াবহ পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। যে সে এই সাতসকালের অন্ধকারেও ফরিদের ছায়া দেখে!

ওহাব ডাক্তার মিনমিন করে বললেন, ‘তুই যা মা, নামাজ পড় গিয়া। আমি দেখতেছি ঘটনা কী!’

আছমা অবশ্য গেল না। সে দাঁড়িয়েই রইল। নুরুন্নাহার বললেন, আমি ওর সঙ্গে যাইতেছি। আপনে একটু বাইরেরটা দেখেন।’ বলে চোখের ইশারায় উঠোনের দিকে যেতে বললেন ডাক্তারকে। আপাতত কিছু একটা প্রবোধ দিতে হবে আছমাকে। সে ভালোই ভয় পেয়েছে। কিংবা নিজের মনে মনে অবচেতনেই হয়তো সে সারাক্ষণ ফরিদের আকস্মিক উপস্থিতি কামনা করে। এমনও হতে পারে যে সে কারণেই আচমকা অন্ধকারে কিছু একটা দেখেই সে ভেবেছিল ফরিদ। কিন্তু এটা নিয়মিত হতে থাকলে সমস্যা। ফলে এখুনি বিষয়টার সমাধান করে ফেলতে হবে।

ওহাব ডাক্তার উঠানে নেমে এলেন। তারপর সাবধানে পা ফেলে এসে দাঁড়ালেন আতাগাছটার নিচে। ততক্ষণে আলো ফুটতে শুরু করছে। চারপাশটা ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে চোখের সামনে। কিন্তু গাছের নিচে কিংবা আশপাশে কোথাও কেউ নেই। কী দেখেছে আছমা? কিছু একটা তো দেখেছেই। একদম কিছু না হলে সে তো আর বানিয়ে বানিয়ে কথাটা বলেনি!

মামা, পারু কি বাড়ি আসছে? ঘরে সে?

কণ্ঠটা শুনে ঝট করে পেছন ফিরে তাকালেন ওহাব ডাক্তার। ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছেন তিনি। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফরিদ। ফরিদের পরনে সাদা শার্ট, কালো প্যান্ট। সে গম্ভীর মুখে কথাটা বলল। ওহাব ডাক্তার কী জবাব দেবেন, বা কী বলবেন, তা কিছুতেই খুঁজে পেলেন না। ফরিদ খুব শান্ত, সহজ গলায় বলল, আমি বাজারেও গেছিলাম মামা। ফার্মেসির ওইখানে। আমি স্বপ্নে দেখছিলাম যে পারু ওইখানে থাকবে। কিন্তু গিয়ে দেখি ফার্মেসি বন্ধ। পারুও নাই। তখন মনে হইল আমার আসতে দেরি দেখে সে বোধহয় আপনার সঙ্গে বাড়ি চলে আসছে। সে কি আসলেই বাড়ি আসছে মামা?’

ওহাব ডাক্তার ফরিদের কথাবার্তা কিছুই বুঝলেন না। তিনি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। ফরিদের চোখ কোটরে ঢুকে গেছে। তার গাল ভাঙা। চিমসানো মুখ। শার্টের কলারের ফাঁক দিয়ে জেগে ওঠা কণ্ঠার হাড় দেখা যাচ্ছে। এ কী অবস্থা তার? এসব কী আবোতাবোল বকছে সে?

ফরিদ বলল, পারু আসে নাই মামা? পারু?

‘পারু? এতক্ষণে কথা বললেন ওহাব ডাক্তার।

হুম। পারু। ও তো হারাই গেছে মামা। অনেকদিন হয়ে গেছে, ওরে আর পাওয়া যায় নাই। অনেক খুঁজছি। কিন্তু সে কোথাও নাই। অনেকেই বলে সে নাকি পানিতে ডুবে মারা গেছে। তারপর ভেসে চলে গেছে কোথাও। তার লাশ পচে গলে গেছে। মাছের খাবার হয়ে গেছে। এগুলা কি সত্য মামা? আপনার কী মনে হয়?

ওহাব ডাক্তার এবার শঙ্কিত হয়ে পড়লেন। ফরিদকে তার সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে অপ্রকৃতস্থ। শারীরিকভাবেও সুস্থ নয় সে। তিনি ফরিদের হাত ধরে বললেন, ‘তোর কী হইছে?

‘আমার কিছু হয় নাই মামা। হয়েছে পারুর। সে নাই।

‘আমি সব শুনব। তার আগে তুই ঘরে আয়।

‘ঘরে? ঘরে পারু আছে?

ওহাব ডাক্তার ফরিদের এই কথার কোনো উত্তর দিলেন না। তিনি তার হাত ধরে ঘরে নিয়ে এলেন। এবং আবিষ্কার করলেন ফরিদের সারা শরীর ভেজা। সম্ভবত বৃষ্টিতে ভিজেছিল সে। তার গা গরম। যেকোনো সময় জ্বর চলে আসতে পারে। চোখের দৃষ্টিও কেমন ঘোলাটে। তিনি নুরুন্নাহারকে ডাকলেন। আছমাকে ডাকলেন। তারা দুজনেই ছুটে এলো। তারপর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। যে। আছমা কোনোদিন তার বাবার সামনে দাঁড়িয়ে খানিক উঁচু স্বরে কথা বলেনি। তার বুকের ভেতর পুষে রাখা সীমাহীন যন্ত্রণার এতটুকুও কখনো তাকে বুঝতে দেয়নি। লজ্জা কিংবা আড়ষ্টতায় ফরিদের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালোবাসার একবিন্দুও কখনো বাবার সামনে প্রকাশ করেনি। সেই আছমা অকস্মাৎ স্থান, কাল, পাত্র সব ভুলে গিয়ে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের মতো ছুটে এলো। তারপর শিকড় উপড়ে পড়া গাছের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল ফরিদের বুকে। তারপর এতদিন ধরে বুকে জমে থাকা কষ্টের বরফ গলা শীতল নদীটাকে উপচে উঠতে দিল তার দু চোখ বেয়ে। ফরিদ নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। তাকে দেখে মনে হচ্ছে না আছমার এই কান্না, এই আকুতি বা আক্ষেপ তাকে এতটুকু স্পর্শ করছে। সে বরং কয়েকবার মুখ ফুটে নুরুন্নাহারকে বলল, পারু কই মামি? পারু?

.

ফরিদের এই প্রত্যাবর্তনের কথা কাউকে জানালেন না ওহাব ডাক্তার। বরং যতটা সম্ভব তাকে আটকে রাখলেন ঘরে। তিনি চান না আপাতত তার এই ফিরে আসার কথা কেউ জানুক। আগে তিনি ঘটনা বুঝতে চান। পারুর কী হয়েছে? কেনই বা সে এভাবে ফিরে এসেছে? তবে দিন কয়েক যেতে ফরিদ খানিক সুস্থির হয়ে উঠল। প্রথম দিন যেই অস্বাভাবিকতা তার মধ্যে লক্ষ্য করা গিয়েছিল, তা যেন ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করেছে। যেন একটা ঘোরের মধ্যে সেদিন রাতে কথাগুলো বলেছিল সে। এখনো যে মাঝে মাঝে অসংলগ্ন আচরণ করে না, বা এলোমেলো কথা বলে না, তা নয়। বরং হঠাৎ হঠাৎ অদ্ভুত সব কথা বলে ওঠে সে। অস্বাভাবিক আচরণ করে ফেলে। তবে তা আগের চেয়ে অনেকটাই কম।

এ ছাড়া বাকিটা সময় উঠানের এক কোণে চুপচাপ বসে থাকে। নুরুন্নাহার বেগম ফরিদের এই ফিরে আসাতে যে অখুশি হয়েছেন তা নয়। তবে পারু যে চিরতরে নিখোঁজ হয়েছে, এমনকি সে মারা গিয়েও থাকতে পারে, এমন আশঙ্কার কথা শুনে তিনি যেন খানিক স্বস্তিই বোধ করছেন। তার মতে, ফরিদের এই বেপথু হয়ে যাওয়ার পেছনে সকল দায় পারু ও তার পরিবারের। তারাই ফরিদকে দিয়ে কাজটা করিয়েছে। ফরিদ যুবক বয়সের ছেলে। চেহারা-ছবি ভালো, এমন কোনো মেয়ে যদি এই বয়সের কোনো ছেলেকে সুযোগ দেয়, মেয়ের পরিবারও প্রলুব্ধ করে, তবে তার ভুল করা স্বাভাবিক। ফরিদ হয়তো সেই ভুলটিই করেছিল। তা ছাড়া, এখানে তাদের নিজেদের ভুলও কম নয়। তাদের উচিত ছিল ফরিদকে চোখে চোখে রাখা। তার চারপাশে একটা কঠিন বিধি-নিষেদের দেয়াল তৈরি করে দেয়া। আর আছমাও সেভাবে তার ভালোবাসা দিয়ে ফরিদকে আগলে রাখতে পারেনি। যদি সে তা পারত, তবে ফরিদ এভাবে অন্যেও পাতা ফাঁদে পা দিত না। ফলে দিনশেষে ফরিদের এই অপরাধকে নিজেদের অক্ষমতা বলেও স্বীকার করছেন নুরুন্নাহার বেগম। এ তাদের সকলেরই ব্যর্থতা।

.

আছমা সারাক্ষণ ফরিদের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকে। মাঝে মাঝে ফরিদের সঙ্গে তার কথাও হয়। ফরিদ সেদিন বলল, তোর কি ধারণা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি?

‘পাগল কেন হবে?’

“এই যে সবাই বলে।

সবাই তোমাকে পাগল কেন বলবে?

কারণ আমি এখনো বিশ্বাস করি পারু বেঁচে আছে। এইটা নাকি পাগল না হলে বিশ্বাস করার কথা না।

‘এই কথা তোমারে কে বলল? মা?

হুম।

কী বলল?

বলল ওই ঘটনার পর নাকি পারু কিছুতেই বেঁচে থাকতে পারে না। বেঁচে থাকলে সে এতদিন কোনো না কোনো ভাবে ফিরে আসততাই।

এটা আছমারও মনে হয়। তবে তা ফরিদকে বলতে সাহস পায় না সে। তা ছাড়া পারুর অমন পরিণতির কথা ভাবলে তার খারাপও লাগে। সে মানুষটাই যেন কেমন! সবার জন্যই কেবল মায়া হয় তার। না হলে পারুদির প্রতি খুব স্বাভাবিকভাবেই ক্ষুব্ধ কিংবা ক্রোধান্মত্ত হওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু কই, তা তো সে পারল না। বরং ফরিদের কাছে সব শোনার পর থেকে ভেতরে ভেতরে কী যে কষ্ট হতে লাগল তার। যেন নিজের বোন বা প্রিয় কোনো বান্ধবী হারিয়ে গেছে। এমনকি মার সঙ্গে এই নিয়ে খানিক ঝগড়াও হয়ে গেল। সেদিন মা বললেন, আল্লাহর বিচার আল্লাহয় করছে। কারো হক যদি কেউ জোর কইরা কাইড়া নেয়, তাইলে সে কোনোদিন সুখী হইতে পারে না। আর যার হক, আল্লাহ তার কাছে তা কোনো না কোনোদিন ফিরাইয়া দেয়ই। এইজন্যই আল্লাহ তোর হক তোর কাছেই। ফিরাইয়া দিছে।

এই নিয়ে মায়ের সঙ্গে খানিক বাগবিতণ্ডা হলেও ওই শেষ কথাটা যেন কানে গেঁথে রইল আছমার। আসলেই কি ফরিদকে আল্লাহ তার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন? কে জানে, হতেও তো পারে! না হলে এতকিছুর পর, এত ঝড়-ঝঞ্ঝা, যুদ্ধের পর ফরিদ আবার এভাবে তাদের কাছে ফিরেই বা আসবে কেন? আর পারুদির ই বা ওই পরিণতি কেন হবে? কিন্তু এই ভাবনা ভাবতে গিয়েও ঠিক যেন স্বস্তি পায় না আছমা। সে বরং চায় ফরিদ খানিক ভালো থাকুক। শান্ত, নিশ্চিন্ত থাকুক। পুরোপুরি। সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে উঠুক। এই জন্য সাধ্যমতো চেষ্টাও করে সে। সমস্যা হচ্ছে, তার এই চেষ্টা তার মা নুরুন্নাহার বেগমের পছন্দ হয় না। তিনি প্রায়ই বলেন, ফরিদরে পুরাপুরি সুস্থ-স্বাভাবিক করনের আসল উপায় কি জানস?

‘কী উপায়?

তার মাথা থেইকা ওই পারুর ভূত নামাইতে হইব। যদি তা না নামাইতে পারস, তাইলে এই জীবনে আর কখনো তারেও পাবি না। এইটা মনে রাখিস। আগেও তো মায়ের কথা শোনস নাই, গুরুত্ব দেস নাই। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি, কাঙাল আর মা, এদের কথা বাসী হইলেও ফলে।

কিন্তু পারুর কথা সে কীভাবে ফরিদের মাথা থেকে তাড়াবে? এই চিন্তায় ভেতরে ভেতরে কুঁকড়ে থাকে আছমা। প্রথমত, নিজেকে কেমন স্বার্থপর, লোভী আর ধুরন্ধর মনে হতে থাকে। দ্বিতীয়ত, সে তো জোর করে কাউকে দখল করতে চায় না। ফরিদ যদি তাকে ভালো না বেসে পারুকে ভালোবাসে, তাহলে কী-ই বা করার আছে তার? এ কারণেই ফরিদ যখন তাকে পারুর কথা বলে, তখন চুপচাপ শোনে সে। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়। ফরিদ বলল, “তুই সত্যি সত্যিই বিশ্বাস করিস যে পারু বেঁচে নাই?’

‘এইটা তো কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।’

‘কিন্তু আমি পারি। আমার বিশ্বাস সে বেঁচে আছেই।’

‘কিন্তু এই যে এত এত দিন হয়ে গেল। কতগুলা মাস, এর মধ্যে তাইলে সে ফিরা আসল না কেন?

আছমার এই প্রশ্নের জবাব খুঁজে পায় না ফরিদ। আজকাল এটাও সে ভাবে। পারু নেই পাঁচ ছ মাসেরও বেশি। এটা কম সময় নয়। সে যদি বেঁচেই থাকে, তবে এতটা সময়েও কেন ফিরে আসেনি সে। তার অপেক্ষায় দিনের পর দিন, রাতের পর রাত সে পড়েছিল বালুর মাঠের পাশে। কিন্তু কই, পারু তো এলো না। তবে কি আর সবার কথাই সত্যি?

এই প্রশ্নটা যখন মাথায় আসে, তখনই কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে সে। নানা এলোমেলো কথা বলতে থাকে। রাতভর জেগে থাকে। ঘুমাতে গেলেই দুঃস্বপ্ন দেখে জেগে ওঠে। এই সময়টা খুব ভয় পায় আছমাও। তখন ফরিদকে কেমন পাগল পাগল লাগে। কেবল এই ফরিদকে দেখলেই তার মায়ের কথাটা সত্যি মনে হয়। মনে হয়, ফরিদকে সুস্থ করে তুলতে হলে সত্যি সত্যিই তার মাথা থেকে পারুর ব্যাপারটা যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে দিতে হবে। এ জন্য মাঝে মাঝে সে তার সেই চিরন্তন, সহজাত লাজ-লজ্জাও যেন বিসর্জন দেয়।

এই সেদিন যেমন আকাশে চাঁদ উঠেছে, ফরিদ হঠাৎ বলল, ‘চাঁদ নিয়ে আমার একটা কবিতা শুনবি?’

কী কবিতা?

‘এনে দাও যদি কিছু জোছনার রং,
আমিও লুকাই ব্যথা হাসিতে বরং।

আছমা এই কথার কিছুই বুঝতে পারল না। সে বলল, তারপর?

তারপর আবার কী?’ বিরক্ত গলায় বলল ফরিদ।

মাত্র এই দুই লাইনই? দুই লাইনে আবার কবিতা হয়?

তুই তো দেখি অবিকল পারুর মতো কথা বলা শিখেছিস… হা হা হা।’ বলে শরীর দুলিয়ে হাসতে লাগল ফরিদ। কতদিন পর এভাবে হাসল সে? ফরিদ, জানে। জানে না আছমাও। তবে সে মুগ্ধ হয়ে ফরিদের দিকে তাকিয়ে রইল। এই এতদিনে তার শরীরটা আবার আগের মতো ফিরতে শুরু করেছে। মুখের রংও ফিরেছে। সে হাসি থামিয়ে বলল, পারুকে প্রথম আমি একটা চিঠি লিখেছিলাম, এমন দুই লাইনের এক কবিতা দিয়ে বুঝলি? সে সেই চিঠি পেয়ে কী করল জানিস?

কী?

‘কিছুই করল না। বলে আবারও হাসল ফরিদ। তারপর বলল, সে যে সেই চিঠি পেয়েছে, সেটাই আমাকে জানাল না। পরে একদিন আমি জিজ্ঞেস করতে অবিকল তোর মতো করে বলল, দুই লাইনের কবিতা আবার চিঠি হয় কী করে? হা হা হা। কী গাধা বল তো? ঠিক তোর মতো।

আছমা জানে না কেন, তার হঠাৎ কেমন মন ভালো হয়ে যেতে লাগল। এই যে অবচেতনে হলেও ফরিদ তার সঙ্গে পারুর তুলনা করছে, এটা তার ভালো লাগছে। অন্য কারো হলে হয়তো খারাপ লাগত। ব্যাপারটা পছন্দ হতো না। কিন্তু তার লাগল। বরং নিজেকে কিছুটা হলেও যেন শ্রেয়তর মানুষ মনে হচ্ছে তার। সেও কি তাহলে পারুর মতোই ফরিদের মনে খানিক জায়গা করে নিতে পারবে?

ফরিদ বলল, ‘সে-ও প্রথম প্রথম আমার লেখা কিছুই বুঝত না। বুঝিয়ে দিতে হতো। তুই বুঝেছিস?

আছমা ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, বোঝেনি। ফরিদ আবারও হাসল। তারপর হাসতে হাসতেই বলল, তুই তো দেখি অবিকল পারুর মতো। তোরা দুজন কি আগের জন্মে টুইন ছিলি না কি?

‘টুইন কী?

যমজ। ছিলি নাকি যমজ বোন?’ ফরিদ হাসছে।

আছমা জবাব দিল না। কিন্তু সে আবিষ্কার করল, ফরিদ আজ যেন আবার সেই আগের ফরিদের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে হারিয়ে যাওয়া সেই আলো ঝলমলে মানুষটাকে সে আবার ধীরে ধীরে ফিরে পাচ্ছে। ফরিদ হাসি থামিয়ে বলল, ‘শোন, চাঁদের কি নিজের কোনো আলো আছে?

আছমা ডানে-বাঁয়ে মাথা নাড়ল, না।’

বাহ, গুড। তোকে যতটা গাধা ভাবি, তুই তো দেখি ততটা গাধা না। চাঁদ তাইলে যে আলোটা দেয়, যাকে আমরা জোছনা বলি, সেটা তাইলে সে কই পায়?

সূর্যের কাছ থেকে।

‘একদম ঠিক। সে সূর্যের আলোকে তার শরীরে ধারণ করে সেটা প্রতিফলিত করে। সেই প্রতিফলিত আলোকে আমরা জোছনা বলি। সেটা নিয়ে কত কত গল্প কবিতা করি। ওটাকে চাঁদের হাসিও বলি। বলি না?

হুম।

আসলে ঘটনা কী?

‘কী?

‘ওইটা কিন্তু চাঁদের কান্নাও হতে পারে। কারণ সূর্যের যে গনগনে তাপ, যে আগুনের মতো আলো, সেই আলোতে পুড়ে পুড়ে সে জোছনা বিলায়, তাই না?

‘হুম।’ বললেও আছমা আসলে এখন আর কিছুই শুনছে না। সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে আছে ফরিদের দিকে। ফরিদ বলল, আমরা মানুষেরাও ওইরকম বুঝলি? আমরাও বুকের মধ্যে অনেক কষ্ট, যন্ত্রণা পুষে রেখে মুখে হাসি ধরে রাখি। এইজন্যই আমি লিখেছি–এনে দাও যদি কিছু জোছনার রং, আমিও লুকাই ব্যথা হাসিতে বরং। চাঁদের যেমন সূর্যের তাপের দহন লুকানো জোছনা, মানুষের তেমন দুঃখ লুকানো হাসি। একই। বুঝলি?

হুম।

আরেকটা কবিতা শোনাই?

‘শোনাও।’

‘চল, তার আগে উঠানে গিয়ে বসি। চাঁদের কবিতা শুনতে হয় জোছনায় বসে। ঘরে বসে না। বুঝলি?

হুম।

‘চল তাইলে।

চলো।

ফরিদ আর আছমা উঠানে এসে বসল। তাদের মাথার ওপর চাঁদ। এক অদ্ভুত মায়াবী কোমল আলোয় চারপাশটা কেমন বিবশ হয়ে আছে। স্বপ্নালু হয়ে আছে আকাশ, মেঘ, চাঁদ, জোছনা সব। সে সেই আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘লুকিয়ে একা কাঁদছে যে জন দহন সয়ে
কে দেখেছে যন্ত্রণা তার কখন কবে?
বুকের ভেতর কান্না থাকে মেঘ শেখাল
চাঁদ শেখাল পুড়তে জানা অসম্ভবে!’

ফরিদ থামলেও আছমা কথা বলল না। সে চুপ করে তাকিয়ে রইল ফরিদের দিকে। তারপর হঠাৎই আবিষ্কার করল, ফরিদের চোখের কোল গড়িয়ে চকচক করে কী যেন নেমে আসছে। ফরিদ কি কাঁদছে? আছমার আচমকা কী যে হলো! সে উঠল। তারপর ফরিদের খুব কাছে গিয়ে তার গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর দু হাতে তার মুখ তুলে ধরে তাকিয়ে রইল নিষ্পলক। ফরিদের চোখ বন্ধ। তবে সেই বন্ধ চোখের পাতার ফাঁক দিয়েও জোছনার আলো মেখে নেমে আসছে চকচকে জলের ধারা। আছমা সেই জলের ধারা আঙুলের ডগায় মুছিয়ে দিতে দিতে মনে মনে বলল, তোমারে আমি আর কোনোদিন কাঁদতে দেব না ফরিদ ভাই। আর কোনোদিন না। এই যে তোমার চোখের পানি, এই পানি ভূঁইয়া বলতেছি।’

.

দূরে কোথাও তখন শিয়াল ডাকছে। একটা রাতজাগা পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে গেল কোথাও। আর খানিক দূরে ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে ওই দৃশ্য দেখছে একজোড়া ঝলমলে আনন্দময় চোখ। সেই চোখজোড়া নুরুন্নাহার বেগমের। শেষ পর্যন্ত আছমা তার কথা শুনেছে। সে ফরিদকে তার ভালোবাসার আঁচলে বাঁধতে পেরেছে! ওই ভরা জোছনায় পরস্পরের নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে পাওয়া দূরত্বে দাঁড়িয়ে থাকা মানব-মানবী দুজনকে কী সুন্দরই না লাগছে। দেখে মনে হচ্ছে এ যেন অপার্থিব কোনো দৃশ্য। তিনি কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন, এই দৃশ্য অন্তহীন হোক।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *