১০. মসজিদে নামাজ শেষ হয়েছে

১০

মসজিদে নামাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু মুসল্লিরা কেউ মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন না। সকলেই এক ধরনের রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনা নিয়ে বসে আছেন। আশরাফ খাঁ এখনো কাউকে কিছু বলেননি। কিন্তু সকলেই যেন জানেন, তিনি কোনো কারণ ছাড়া এখানে আসেননি। কিন্তু কী সেই কারণ? এই নিয়েই সকলের মধ্যে চাপা উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, কৌতূহল। তবে বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন যিনি, তাঁর নাম জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আজ নামাজ শেষে এলাকার বিভিন্ন উন্নয়ন ও জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা নিয়ে তার বক্তৃতা দেয়ার কথা। তিনি মনে মনে ঠিকও করে রেখেছিলেন কী বলবেন, কীভাবে বলবেন। এই বক্তৃতার মধ্য দিয়ে মহিতোষ মাস্টারের জমি-জমাসংক্রান্ত বিষয়ে তার কিছু ভাবনা ও অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছেন তিনি। ওই জমি নিয়ে লোকজনের মধ্যে যে ফিসফাস, সন্দেহ তার অবসান ঘটাতে চান। সঙ্গে এই বার্তাও দিতে চান যে ওই জমি এখন তার ক্রয়কৃত ব্যক্তিগত সম্পত্তি হওয়া সত্ত্বেও তিনি একাই কেবল তা ভোগ করতে চান না। বরং এলাকার দরিদ্র জনসাধারণের কল্যাণেও কাজ করতে চান। ব্যবহার করতে চান ধর্মীয় ও সামাজিক কারণেও।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া জানেন, একবার যদি তিনি এই টোটকা জনগণকে গেলাতে পারেন, তাহলে আর চিন্তা নেই। এরপর চটজলদি নিজের পাকা বসতবাড়িখানা তুলে ফেলতে হবে। সঙ্গে নামকাওয়াস্তে হলেও তুলে ফেলতে হবে একখানা এতিমখানা, দু-একটি ধর্মীয়-সামাজিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। আর তাহলেই তাঁর উদ্দেশ্য সফল। তখন আর কারো পক্ষেই সহসা উড়ে এসে জুড়ে বসা সম্ভব হবে না এখানে। এমনকি কারো কাছে যদি এই জমির কাগজ-পত্রও থেকে থাকে, তবুও না। ততদিনে তিনি চারপাশ থেকে তার সকল ভিত শক্ত করে গেঁথেই আঁকিয়ে বসে যাবেন। ওই ভিত ওপড়ানো তখন আর কারো পক্ষেই সহজ কিছু হবে না।

বিষয়টি উপস্থিত জনগণের কাছে কীভাবে উপস্থাপন করবেন, সে বিষয়েও একটা প্রস্তুতি নিয়েই তিনি এসেছিলেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তার সেই পরিকল্পনা তিনি বাস্তবায়ন করতে পারবেন না। তার আগেই উল্টাপাল্টা কিছু ঘটে যাবে। সমস্যা হচ্ছে সেই উল্টাপাল্টাটা তিনি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারছেন না। তবে এটুকু বুঝতে পারছেন, আশরাফ খাঁ এখানে অকারণে আসেননি।

এমন নানা এলোমেলো ভাবনা ভাবতে ভাবতেই নামাজ শেষ হলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তিনি চিন্তিত মুখে বসেছিলেন। তার পেছনেই মতি, মধু, লোকমান। বাড়তি সতর্কতা হিসেবেই তারা ভূঁইয়ার পেছনে এসে বসেছে। আশরাফ খ এই মুহূর্তে ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন। তারপর সালাম দিয়ে বললেন, “কেমন আছো ভূঁইয়া, বহু বছর তোমার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ নাই।’

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া একটু অবাক হলেও ফিরে তাকালেন। তিনি ভাবেননি আশরাফ খাঁ নিজ থেকে এভাবে তার দিকে এগিয়ে আসবেন। তিনিও সালামের উত্তর দিলেন। তারপর বললেন, ‘আপনি হঠাৎ এইদিকে? খুব খুশি হইছি দেখে।

‘আসলাম। বহুদিন তো তোমাগো এইদিকে আসা হয় না। ভাবলাম এই গ্রাম, আর ওই গ্রাম, কিন্তু মানুষতো আমরা সব একই, আত্মীয়-স্বজন, এই গাঁয়ের লোক ওই গাঁয়ে বিয়া করছে। ওই গাঁয়ের লোক এই গাঁয়ে। নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি, খালাবাড়ি, ফুফুবাড়ি। সবাই সবার আত্মীয়। তারপরও এত দূরের মনে হয় কেন কে জানে! আইজ ঘুম থেইকা উইঠাই হঠাৎ মনে হইল, একবার যাই। সবাইর লগে দেখা-সাক্ষাৎ কইরা আসি।’

‘খুবই ভালো করছেন খাঁ সাব। খুব ভালো করছেন। দেখা-সাক্ষাৎ না থাকলে আপনও পর হইয়া যায়।’ বলেই বিগলিত হাসলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তা নামাজ তো শেষ, এখন কিন্তু আমার বাড়িতে চাইরটা ডাইল ভাত খাইয়া যাইতে হইব।

‘খুব খুশি হইছি ভূঁইয়া।’ বলে আশরাফ খাঁও হাসলেন। যাইতে পারলে আমারও খুব ভালো লাগত। তবে আমার যে একটা কাজও আছে এইখানে।’

‘কাজ? যেন খানিক অবাকই হলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া, এমন ভঙ্গিতে তাকালেন।

হুম।

কী কাজ?

আছে।’ বলে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলেন আশরাফ খাঁ। তার সেই হাসি দেখে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া একই সঙ্গে বিভ্রান্ত ও চিন্তিত বোধ করতে লাগলেন। তাহলে কি তার আশঙ্কাই ঠিক? মহিতোষ মাস্টারের জমি-জমাবিষয়ক কোনো কাজেই তিনি এখানে এসেছেন?

আশরাফ খাঁ বললেন, ‘জরুরি কাজই বলতে পারো। কাজটা শেষ না কইরা তো আর কোথাও যাওনের সুযোগ নাই। অন্য কোনোদিন তোমার বাড়িতে আমি যাব, বুঝলা ভূঁইয়া?

‘জি খাঁ সাব।’ কথাটা স্বাভাবিকভাবে বললেও ভেতরে ভেতরে উৎকণ্ঠিত বোধ করছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তবে সেটি তিনি বাইরে প্রকাশ করলেন না। যতটা সম্ভব নিজেকে স্বাভাবিক রেখেই বললেন, তা কী এমন জরুরি কাজ এইখানে খাঁ সাব?’

আশরাফ খাঁ সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। যেন খানিক চুপ থেকে পরিস্থিতিটা বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর স্মিত হেসে বললেন, আমার বড় ছেলে শফির জন্য মাইয়া দেখতে আসছি এই গাঁয়ে। তোমাগো ভুবনডাঙার সঙ্গে আরো একখান সম্বন্ধ হইব আমাগো, বুঝলা ভূঁইয়া? ঘরে ঘরে আত্মীয়।’ বলে হাসলেন তিনি। হাসল অন্যরাও।

তবে কথাটা শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বুক থেকে যেন পাষাণভার নেমে গেল। তিনি তাহলে অযথাই দুশ্চিন্তা করছিলেন? আশরাফ খাঁ বললেন, ‘নেয়ামত মুন্সীর মাইয়া দেখতে আসছি। ভাবলাম, দেখার আগে মসজিদে জুমার নামাজটাও পইড়া যাই। সবার সঙ্গে একটু দেখা-সাক্ষাৎও কইরা যাই। তা সবাই আপনারা ভালো আছেন তো?” বলে উপস্থিত মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে হাত নাড়লেন তিনি।

‘জি ভালো আছি। আলহামদুলিল্লাহ। সমস্বরে জবাব দিলেন মুসল্লিরাও।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, মাশাল্লাহ, খুবই ভালো খবর। তাইলে আর আপনারে এইখানে আটকাই রাখব না। আপনে আসছেন শুভ কাজে, সেইখানে বিলম্ব করা ঠিক হইব না। চলেন, আগাই দিই আপনেরে খাঁ সাব…।’

আশরাফ খাঁ ত্রস্ত কণ্ঠে বললেন, না না ভূঁইয়া, তোমার আসা লাগবে না। আমি-ই যাই। তুমি তোমার কাজ করো। পরে আবার কথা হইব।’ বলেই তিনি হাঁটতে শুরু করলেন। মসজিদের দুটি অংশ। মূল অংশের দরজা পেরোলেই বিশাল বারান্দা। জুমার দিন বলে দু জায়গাতেই মুসল্লিদের ভিড়। আশরাফ খাঁর এমন ঘটনাহীন প্রস্থানে যেন হতাশই হলেন তারা। আশরাফ খাঁ মূল কক্ষ থেকে বের হয়ে বারান্দার দিকে চলে গেলেন। সেখানেই বের হওয়ার দরজা। জাহাঙ্গীর ভূইয়া সামান্য অপেক্ষা করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। যেন বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ দুশ্চিন্তা থেকে মুক্তি ঘটেছে তার। এতক্ষণে আবার নিজেকে আত্মবিশ্বাসী মনে হচ্ছে। সবাই দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষা করছে। ফলে কথাগুলো এখন তাঁকে বলতেই হবে। তা ছাড়া মন্দির উচ্ছেদের বিষয়টা খুব রংচং মাখিয়েই বলতে চান তিনি। এতে চট করে একটা বড় জনসমর্থন তার দিকে চলে আসবে। সুযোগটা তিনি হেলায় হারাতে চান না।

তা হারালেনও না। যতটা সম্ভব সাজিয়ে-গুছিয়ে, মনের মাধুরী মিশিয়ে মহিতোষ মাস্টারের জমি নিয়ে তিনি তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বর্ণনা করলেন। এমনকি যে ফসলি জমি রয়েছে, সেখানেও বর্গাচাষিদের জন্য অন্যান্য জমির তুলনায় বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রদানের কথা ঘোষণা করলেন। সঙ্গে এতিমখানা, বিনামূল্যে ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা করাসহ নানা কর্মকাণ্ডেরও ঘোষণা দিলেন। খানিক আগেই যেসব মানুষ আশরাফ খাঁর অমন ক্লিশে প্রস্থানে হতাশ হয়েছিলেন, তারাই যেন মুহূর্তেই আবার উজীবিত হয়ে উঠলেন। শুধু যে উজীবিতই হলেন, তা-ই নয়। বরং মহিতোষ মাস্টারের জমির সত্যিকারের মালিকানা নিয়ে তাদের মধ্যে যে সন্দেহ দানা বেধে ছিল, সেই সন্দেহও যেন কর্পূরের মতো উড়ে গেল। বরং নিজেদের অজান্তেই যেন তারা ওই জমির একচ্ছত্র অধিপতি ও বৈধ মালিক হিসেবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার সর্বস্বত্ব ও কর্তৃত্ব মেনে নিলেন।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তার বক্তব্যের শেষে এসে বললেন, হয়তো বিভিন্ন সময়ে আমার বিভিন্ন কাজে আপনারা অনেকেই আমার ওপর অসন্তুষ্ট, বিরক্ত। কিন্তু মানুষ তো সবসময় একরকম থাকে না, থাকে?

না। সমস্বরে আওয়াজ উঠল।

ভূঁইয়া বললেন, আমি আমার এই সম্পত্তি যতটুক পারি আপনাদের জন্যই ব্যবহার করব। জীবনে তো নিজের জন্য কম করি নাই, এইবার আপনাদের জন্য করার পালা শুরু…।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তার কথা শেষ করতে পারলেন না। তার আগেই বারান্দা থেকে মূল কক্ষে ঢোকার দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার গলা শোনা গেল, কী করার পালা শুরু ভূঁইয়া?

মূল কক্ষে বসা মুসল্লিরা সামনের দিকে মুখ করে বসে থাকার কারণে তাদের পেছনে এসে দাঁড়ানো লোকটাকে চট করে দেখতে পেলেন না। কিন্তু তার ভরাট গলার স্বর শুনে পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলেন, আশরাফ খ সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। আবার ফিরে এসেছেন তিনি!

অবাক হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও। তবে তার এই অবাক হওয়ার সঙ্গে যুক্ত হলো শঙ্কাও। যেন মুহূর্তের মধ্যেই পরিস্থিতির আঁচ করতে পারলেন তিনি। আশরাফ খ তাহলে যাননি! তিনি তাহলে এতক্ষণ বারান্দায় আড়ালে বসে বসে তার কথা শুনছিলেন? কিন্তু এখন তার প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া? আর আশরাফ খাঁ-ই বা কোন উদ্দেশ্যে কী জানতে চাইছেন?

অন্যের জমি দখল কইরা নিজের নামে চালাই দেওয়ার পালা শুরু করতেছো নাকি ভূঁইয়া?

মসজিদভর্তি এত এত মানুষের সামনে আশরাফ খাঁ যে তার উদ্দেশে এমন ভয়ানক অপমানসূচক কথা বলতে পারেন, তাও তার গায়ে, এটি যেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কল্পনায়ও ছিল না। ঘটনার আকস্মিকতায় তিনি হতভম্ব হয়ে গেলেন। বললেন, আপনি এই সব কী বলতেছেন খ্ৰী সাব? আপনে বুঝতে পারতেছেন, আপনে কী বলতেছেন এই সব?’

‘আমি বলতেছি, এইটা কি তোমার নতুন ধান্ধা না কি ভূঁইয়া? অন্যের জমিতে নিজের নামের সাইনবোর্ড তো টানাইছোই, এখন আবার সেইখানে ঘর দুয়ারও করতেছো। শুধু তা-ই না, মসজিদভর্তি মানুষের সামনে নানা মিথ্যা কথা বলতেছো। তা তোমার একটু লজ্জাও করতেছে না? বিবেকে বাধতেছে না? তুমি কেমন মানুষ হে ভূঁইয়া?

আশরাফ খ থামলেও কেউ কোনো কথা বলল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও না। যেন নিজের দাঁড়িয়ে থাকা জায়গাটিতে স্থানুর মতো জড় হয়ে গেড়ে গেছেন তিনি। কথা বলার চেষ্টা করলেও জুতসই কোনো কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। আশরাফ খাঁ বললেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তুমি যা যা করছ, সেই সব না হয় এতদিনে মানুষরে ভুল-ভাল বুঝাইছো, গোপন করছ। নিজের ভোল পাল্টাইয়া অন্য বেশ ধরছ। মানুষও ভুইলা-টুইলা গেছে। কিন্তু তুমি নিজেরে তো পাল্টাইতে পারো নাই। লুকাইতেও পারো নাই। তোমার ভেতরের যে দুই নম্বর, ফ্রড মানুষটা আছে, সেইটারে তুমি লুকাইবা কেমনে? সে তো ঠিকই সময়ে-অসময়ে বাইর হইয়া আসতেছে। এই আসল তোমারে নকল তোমার মধ্যে তুমি কেমনে লুকাইবা?’

‘আপনে কিন্তু ভদ্রতার সব সীমা ছাড়াই যাইতেছেন খাঁ সাব। আপনে আমার বয়সে বড়, মুরব্বি। তাও আবার অতিথি-মেহমান মানুষ। এইজন্য এখনো আমি আপনারে কিছু বলতেছি না। কিন্তু তার মানে এই না যে…।’

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার গলা কাঁপছে। চুলের গোড়া বেয়ে তিরতির করে ঘাম নামছে। কথাও প্রায় জড়ানো। কিন্তু তার সেই কথাও শেষ করতে পারলেন না। তিনি। তার আগেই তাকে থামিয়ে দিলেন আশরাফ খাঁ। তারপর উপস্থিতির জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, আপনেরা আমারে মাফ করবেন। এইখানে আমার এই সব কথা বলা ঠিক না। তা-ও বলি। আপনাদের জানা দরকার আছে। তারে জিজ্ঞেস করে দেখেন তো, এই জমির কোনো কাগজ-পত্র, দলিল-পর্চা আছেনি তার কাছে? আমার শরীল-স্বাস্থ্য ভালো না। আমি আইজ এইখানে আসতামও না। আমার ছেলে শফির জন্য মেয়ে পরেও দেখতে পারতাম। কিন্তু আমি নিজ থেকেই আগ্রহ নিয়া আসছি এই কথা শুইনা যে সে নাকি মহিতোষ মাস্টারের জমিতে ঘর তুলতেছে…! কত বড় সাহস হইলে, যেই জমির মালিক আমি, সেই জমিতে সে ঘর তোলে!

এই কথায় কক্ষজুড়ে এক ধরনের বিস্ময় মিশ্রিত কোলাহল শুরু হলো। সকলেই একযোগে একে অন্যকে নানা কথা বলতে লাগল। মতামত দিতে লাগল। ফলে এক ধরনের তীব্র গুঞ্জন শুরু হলো। তবে সেই গুঞ্জন থেকে কিছুই আলাদা করা গেল না। আশরাফ খাঁ বললেন, মহিতোষ মাস্টার যাওয়ার আগে ন্যায্যমূল্যে ওই জমি আমার কাছে বিক্রি করে দিয়া গেছে, এই হইলো সেই জমির দলিলের কপি। নেন, দেখেন আপনেরা।’ বলেই তিনি ইমাম সাহেবের হাতে দলিলের একখানা কপি তুলে দিলেন। তারপর বললেন, আমার জমিতে থাকা পুরনো অনেক ঘরদোর, মন্দির, স্থাপনাও শুনেছি সে ভাঙাভাঙি শুরু করেছে। যুদ্ধের সময়ও এমন লুটপাটের কথা আমরা শুনছি। কিন্তু এইটা তো এখন স্বাধীন দেশ? নাকি মগের মুলুক? আপনাদের উদ্দেশ্যে আমি একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দিতেছি, আমার নগদ টাকায় কেনা জমিতে আমি যেন তারে আর এক মুহূর্তের জন্যও না দেখি। তার কোনো লোকও না। আর কোনোকিছু ভাঙতে হলে আমার জমির জিনিস আমি নিজে ভাঙব, সে না। আমার কথা কি পরিষ্কার?

সকলের কাছেই আশরাফ খাঁর কথা পরিষ্কার। উৎসুক জনতা যেন খানিক আগের মোহ কাটিয়ে উঠেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার প্রতি তীব্র এক ঘৃণা আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার নিজেরও মনে হচ্ছে, এই অপমানের চেয়ে যদি তিনি মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন, তবে তাও ভালো ছিল। এরপর তিনি এই গাঁয়ে আর মুখ দেখাবেন কী করে! তা ছাড়া, এখন এই মুহূর্তে যদি ওই জমি থেকে তার সরে আসতে হয়, তাহলে মন্দিরের নিচে থাকা গুপ্তধনের কী হবে?

তিনি প্রয়োজনে ওই জমির মায়া ছেড়ে দিতেও রাজি আছেন। কিন্তু যেকোনো মূল্যেই হোক, ওই গুপ্তধন তার চাই-ই চাই। সমস্যা হচ্ছে, আশরাফ খাঁর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তিনি আটঘাট বেঁধেই এসেছেন। হয়তো আজ থেকেই তিনি এই জমির রক্ষণাবেক্ষণ শুরু করবেন। সার্বক্ষণিক পাহারা বসাবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে ওই গুপ্তধন তিনি ওঠাবেন কী করে? এখন আর মহিতোষ মাস্টারের জমি নিয়ে চিন্তা করছেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার সকল চিন্তা ওই গুপ্তধন নিয়ে।

আর এই যে ভরা মজলিশে, গ্রামবাসীর সামনে তার এতদিনের সব মানসম্মান তিনি ধুলোয় মিশিয়ে দিলেন! তাকে একজন আপাদমস্তক অসৎ, ঠগ, প্রতারক হিসেবে পরিচিত করলেন, এর থেকে তার মুক্তি ঘটবে কী করে? মানুষকে তো আর মুখ দেখাতেই পারবেন না তিনি।

দরদর করে জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘামছেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার এই জীবনে এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি আর কখনো হননি তিনি। মনে হচ্ছে দাঁড়িয়ে থাকা পা জোড়া ক্রমশই অবশ হয়ে যাচ্ছে। যেকোনো মুহূর্তে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে মাটিতে। এই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন থেকে তার মুক্তি কীসে?

ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্রের এই অকূল পাথার থেকে যখন উত্তরণের কোনো আশা তিনি দেখছেন না। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই অভাবিত এক ঘটনা ঘটল। রুগ্ন এছাহাককে দেখা গেল মসজিদের দরজায়। তার হাতে একখানা কাগজের পোটলা। সে মসজিদের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে খনখনে গলায় বলল, “কী হইলো? এইখানে এত হৈ-হট্টগোল কীসের?

তার কথায় অনেকেই ফিরে তাকাল! জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও অবাক হলেন। এছাহাক তো অসুস্থ। সে এখানে এই সময়ে কী করছে?

এছাহাক অবশ্য কারো দিকে তাকাল না। সে আপনমনে বলতে লাগল, মানুষের অপমান দেখা আমাগো একটা নেশা। এরচেয়ে বড় আনন্দ আর কিছুতে নাই। আর সম্মানী মানুষের অসম্মান করতে পারলে তো কোনো কথাই নাই।

বলে থামল সে। এবার যেন সকলেই খানিক সচকিত হয়ে উঠল। কী বলতে চায় এছাহাক?

এছাহাক বলল, সুযোগ পাইলেই আমরা সবাই একযোগে কঁপাই পড়ি। চিলে কান নিছে শুনলে চিলের পিছেই দৌড়াই, কানে হাত দিয়া আর দেখি না, ঘটনা সত্য না মিথ্যা। আরে ভাই, আগে তো কানে হাত দিয়া দেখবেন!’

এছাহাকের এমন অভাবনীয় উপস্থিতিতে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া যতটা চমকে গিয়েছিলেন, এখন তার চেয়েও বেশি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন অন্যরাও। সে আসলে কী বলতে চাইছে, তার কিছুই এখনো স্পষ্ট নয়। তবে তার কথার ধাচ শুনে মনে হচ্ছে, সে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার পক্ষে কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু সেটা কীভাবে সম্ভব? আশরাফ খাঁ তো ভরা মজলিশের সামনে অকাট্য প্রমাণই হাজির করেছেন। তাহলে? এছাহাক তবে কীসের ভিত্তিতে এমন কথা বলছে?

নাকি সেও কোনো এক বুজরুকির আশ্রয় নিচ্ছে?

এছাহাক অবশ্য যা বলল, তা শুনে উপস্থিত জনতার মধ্যে আবার দ্বিধাবিভক্তি তৈরি হলো। যেন কার কথা তারা বিশ্বাস করবেন সে বিষয়ে পুরোপুরি সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এছাহাক তার হাতের কাগজে মোড়ানো পুটলিটা খুলে সেখান থেকে কিছু কাগজপত্র বের করল। তারপর জোরালো গলায় বলল, “দোষ যদি কেউ কইরাই থাকে, তাইলে সেইটা মহিতোষ মাস্টারই করছে। ভূঁইয়া সাবও না, খা সাবও না।

মানে?’ আশরাফ খাঁ, ইমাম সাহেবসহ অনেকেই অবাক চোখে এছাহাকের দিকে তাকালেন।

এছাহাক বলল, মানে হইল মহিতোষ মাস্টার তার জমি বেচার কথা বইলা বিভিন্ন সময় ভূঁইয়া সাবের কাছ থিকাও দফায় দফায় টাকা নিছিল। আর টাকা নেওনের সময় বলছিল, যাওনের আগে আগে জমির দলিল লেইখা দিয়া যাইব। কিন্তু আপনেরা তো জানেনই, সে কাউরে কিছু না জানাইয়া রাইতের আন্ধারে দেশ ছাড়ছে। এই যে দেখেন স্ট্যাম্প। এই স্ট্যাম্পে সব লেখা আছে, কখন কত টাকা সে নিছে। মহিতোষ মাস্টারের সইও আছে। এখন আপনেরাই কন, সে যদি এক জমি দুজনের কাছে বেইচা, টাকা নিয়া, দলিল দেয় একজনরে। তাইলে সেই দোষ কী যারে দলিল দেয় নাই, তার? ভূঁইয়া সাবে টাকাও দিল, জমির দলিলও পাইল না, আবার এখন দখলও পাইব না। তারপরও সব দোষ তার? আপনারাই বলেন মিয়ারা?

উপস্থিত জনতা এবার সত্যি সত্যিই বিভ্রান্ত হয়ে গেল। বিষয়টা এমন নয় যে তারা সকলেই এছাহাকের কথা বিশ্বাস করেছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সম্পর্কে অল্প বিস্তর ধারণা তাদের আছে। ফলে একটা অদ্ভুত দ্বিধার দোদুল্যমানতা তাদের ঘিরে ধরল। আর এতে করে খানিক আগের অমন ভয়ানক অপমানকর পরিস্থিতি থেকে যেন অনেকটাই মুক্তি পেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

আর এছাহাকের এমন আচানক আগমনে হতভম্ব আশরাফ খাঁ যেন কিছুতেই স্থির হতে পারছেন না। তবে তিনি এছাহাকের হাত থেকে কাগজপত্রগুলো নিলেন। জমি বিক্রি বাবদ প্রতিশ্রুতি সাপেক্ষে টাকা নেয়ার চুক্তিসংবলিত কতগুলো স্ট্যাম্প সেখানে। মহিতোষের সইও রয়েছে। কিন্তু কাগজগুলো সূক্ষ্মভাবে নিরিখ করে, উল্টেপাল্টে দেখে অভিজ্ঞ আশরাফ খাঁ অন্তত এটুকু বুঝতে পারলেন যে এসব কাগজপত্র নিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া গাঁয়ের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারলেও আইন আদালতকে পারবেন না। আশরাফ খাঁর কাছে থাকা দলিলপত্রের কাছে এগুলো এক মুহূর্তও টিকবে না।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কিংবা এছাহাকও হয়তো এ কথা জানে। কিন্তু এই মূল্যহীন নকল কাগজগুলো অন্তত কিছু সময়ের জন্য হলেও একটা কাজ ঠিকই করতে পেরেছে। আর তা হলো, খানিক আগেই ভরা মজলিশের সামনে জাহাঙ্গীর ভূইয়ার যে কদর্য রূপটা প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে খানিক আড়াল তৈরি করতে পেরেছে। তাকে তাৎক্ষণিক তীব্র অসম্মান, অপমান থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারছে।

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এখনো কথা বলতে পারছেন না। যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ছে তার। এই জীবনে এছাহাকের ঋণ তিনি কী দিয়ে শোধ করবেন? কীভাবে শোধ করবেন? এছাহাকের সঙ্গে শেষ কিছুদিন কী ভয়ানক দুর্ব্যবহারটাই না তিনি করেছিলেন! সে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে তার মন জয় করতে, কিন্তু তাতে বরং একের পর এক আরো ভুলই করেছে। ফলে তাকে একপ্রকার দূরেই সরিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি। কিন্তু আজ এ কী করল সে? এই কাগজগুলো মহিতোষ চলে যাওয়ার পর পরই বানানো হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো যে আজ এভাবে কাজে লেগে যাবে, এটা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া স্বপ্নেও ভাবেননি। তার এখন ইচ্ছে করছে, এছাহাককে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে। এই জীবনে তার এমন উপকার আর কেউ কখনো করেনি। এর প্রতিদান তিনি অবশ্যই দেবেন।

প্রয়োজনে মন্দিরের তলার ওই গুপ্তধন তিনি এছাহাকের সঙ্গে ভাগাভাগি করবেন। তা ছাড়া, এছাহাক ছাড়া অন্যদের ওপর খুব একটা ভরসাও পান না তিনি। সমস্যা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে বাকিদের কী করবেন? তিনি এত লোকের সঙ্গে ওই সম্পদ ভাগাভাগি করতে চান না। আর আশরাফ খাঁর সঙ্গে বোঝাপড়া? তিনি যদি। আজ থেকেই মহিতোষের জমিতে পাহারা বসান? খানিক আগে বললেন, এই জমিতে আর কিছুতেই হাত দিতে পারবেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। কোনো ভাঙাভাঙিও না। তাহলে? আশরাফ খাঁ পেয়ে যাবে ওই সম্পত্তি?

খানিক আগের বিধ্বস্ত, বিপর্যস্ত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মুহূর্তেই যেন আবার ফণা তুলতে লাগলেন। তাঁর বিষের থলেখানা ক্রমশই আবার পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে লাগল। আজকের এই অপমান, এত এত লোকের সামনে মহিতোষের জমি থেকে তাকে বহিষ্কার, এর কিছুই তিনি কোনোদিন ভুলবেন না। সময় এলে সাপের ছোবলের মতোই একে একে এর সব তিনি ফিরিয়ে দেবেন। কিন্তু তার আগে মন্দিরের তলায় থাকা ওই গুপ্তধন। ওটা তার চাই-ই চাই। তা যেকোনো মূল্যেই হোক।

১১

পারুর অদ্ভুত এক অভিনয়ের জীবন শুরু হলো। দিনের আলোয় সে যতটা সম্ভব রাজিয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করে। কিন্তু রাতের অন্ধকারে ভয়ে, কান্নায় জড়সড় হয়ে থাকে। রাজিয়াকে সে কিছুতেই বুঝতে দিতে চায় না যে তাদের গোপন নিষ্ঠুর অভিসন্ধি সে টের পেয়েছে। রাজিয়ার মা সাহেরা বানু অবশ্য পরদিন ভোরেই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে পারুকে ডেকে বললেন, মা, তুমি আমার কাছে আমার আরেকটা মাইয়াই। আলাদা কিছু না। দুই বইনে সুখে-দুঃখে এক লগে থাকবা। কোনো ঝগড়া-ঝাটি করবা না। বিপদ-আপদে একজন আরেকজনের সঙ্গে থাকবা। বুঝলা মা?

পারু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। সাহেরা বানু তাঁর পানের বাটা থেকে এক খিলি পান বের করে পারুকে দিলেন। বললেন, তোমার এহন খাওনে অরুচি হইব। বমি বমি ভাব হইব। কিন্তু তারপরও এই সময়ে না খাইয়া থাকলে চলব না। খাইতে হইব। বিশেষ কইরা যেই সব খাওনে মুখে রুচি হয়। বুঝলা?

‘জি। পারু অস্ফুটে বলে।

‘এই নেও পান। কাঁচা সুপারি দেওয়া আছে। পানের রস হজমের জন্যও ভালো। মুখে রাইখা আস্তে আস্তে চাবাইবা, দেখবা বমি বমি ভাবটা কাইটা যাইব। মুখটা একটু ভালো লাগব। নেও।

পারু পান হাতে নিল। কিন্তু মুখে দিল না। দেবেও না সে। এই পান লুকিয়ে নিয়ে গিয়ে বাইরে ফেলে দেবে। সে এখন জানে তাদের মা-মেয়ের হঠাৎ তার প্রতি এমন প্রসন্ন হয়ে ওঠার কারণ। তারা যেকোনো উপায়ে তার গর্ভের সন্তানটাকে নষ্ট করতে চায়। সাহেরা বানু বললেন, ‘কী হইল মা, খাও, খাও। মুখে নিয়া চাবাও, দেহো পানের রসটা কেমন ভাল্লাগে। একটু ঝাঁঝও আছে। মুখে রুচি বাড়ায় ওই ঝঝ।’

পারু তাও পান মুখে দিল না। সে বলল, আমি খাব। একটু পরে।

সাহেরা বানু বিরক্ত হলেও কিছু বললেন না। তিনি সেইদিনই চলে গেলেন। তবে যাওয়ার আগে বললেন, মাসখানেকের মধ্যেই আবার ফিরে আসবেন তিনি। এ থেকে অবশ্য একটা বিষয়ে কিছুটা হলেও নিশ্চিন্ত বোধ করছে পারু। তিনি ফের কবিরাজের কাছ থেকে গর্ভপাতের ওষুধ নিয়ে না আসা পর্যন্ত অন্তত কিছুটা হলেও নিরাপদ সে। কিন্তু তারপরও যতটা সম্ভব সতর্ক থাকার চেষ্টা করে পারু। রাজিয়া খাবার বেড়ে দিলে সে কৌশলে তার ভাতের থালার পরিবর্তে রাজিয়ার থালাটা টেনে নেয়। ঘরে থাকা পানির জগ থেকে পারতপক্ষে পানি পান করে না। পান করে সরাসরি বাড়ির নলকূপ থেকে। রাতে ঘুমানোর আগে তার ঘরের দরজা ভালো করে বন্ধ করে ঘুমায়। কিন্তু এভাবে এত হিসেব করে, সাবধানে কি কোথাও থাকা সম্ভব? এই যে এত সতর্কতা, এরপরও পারু জানে, সামান্য সুযোগেই রাজিয়া তাকে খুন করে ফেলতে পারে। বড় ধরনের কোনো ক্ষতি করে ফেলতে পারে। এরপর কী হবে, তা নিয়ে সে ভাবে না। নিজের মেয়ের এমন মাথা গরম স্বভাবের কথা চিন্তা করেই বোধহয় সাহেরা বানু তাকে সতর্ক করে দিয়েছেন। তিনি রাজিয়াকে বলেছেন, সে যেন উল্টাপাল্টা কিছু না করে বসে। যা করার, তা তিনি ফিরে এসেই করবেন।

ফরিদকে সেদিন স্বপ্ন দেখল পারু। ফরিদ বসে আছে বংশী নদীর তীরে। সেই বটগাছটার তলায়। তার সামনে আদিগন্ত জলের ঢেউ। সেই ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। পারু বলল, আপনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন কেন?

ফরিদ ঝট করে তাকাল। প্রথমে পেছনে। তারপর আশপাশে। পারু বলল, কী হলো, কী খুঁজছেন আপনি?

ফরিদ উঠে দাঁড়াল। সে বুঝতে পারছে না কথাগুলো কোথা থেকে আসছে। এ কী তার কল্পনা? নাকি বাস্তব। পারু তার সঙ্গে কথা বলছে, অথচ সে পারুকে দেখতে পাচ্ছে না। সে দু হাতে মাথা চেপে ধরল। পারু বলল, কী আশ্চর্য, আপনি কি আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না?

ফরিদ এবার কথা বলল, না। তুমি কি সত্যি আমার আশপাশে কোথাও আছো?

পারু ভারি অবাক হলো। সে বলল, এই যে আমি আপনার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি। এই যে আমি আপনার কাঁধে হাত রাখছি। আপনি টের পাচ্ছেন না।

ফরিদ আসলেই টের পাচ্ছে না। সে ঘুরে সামনে হাত বাড়িয়ে অদৃশ্য পারুকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। একটা বায়বীয় অনুভব ছাড়া আর কিছুই কোথাও নেই। ফরিদ পাগলের মতো বাতাসে হাত ছুঁড়তে লাগল। স্পর্শ করার চেষ্টা করতে লাগল পারুকে। কিন্তু পারু কই? সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হলো, পারু আচমকা আবিষ্কার করল, সে ফরিদকে ছুঁতে পারেনি। ফরিদ ক্রমশই একটা। অস্পর্শ অস্তিত্বে পরিণত হচ্ছে। তাকে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু ছোঁয়া যাচ্ছে না। পারু চিৎকার করে উঠল। ফরিদ বলল, তুমি কাঁদছ কেন?

‘আমি আপনাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু ছুঁতে পারছি না।’

আর আমি তো তোমাকে ছুঁতে এবং দেখতে কোনোটিই পাচ্ছি না। পারু, ও পারু। আমি তোমাকে একটু দেখতে চাই…।

‘দেখুন। এইতো আমি।

কই? আমি তো দেখতে পাচ্ছি না। আমি একবার শুধু তোমাকে দেখতে চাই পারু। ছুঁতে না পারলেও হবে। ও পারু, পারু, তুমি একবার শুধু আমাকে দেখা দাও।’

ফরিদ ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। পারুর এত খারাপ লাগছে! সে ফরিদকে কখনো এভাবে কাঁদতে দেখেনি। এমন ভেঙে পড়তেও দেখেনি কখনো। সে দু হাতে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। বরং আবিষ্কার করল, ফরিদের শরীরটা হুড়মুড় করে বালির বাঁধের মতো ভেঙে পড়ছে। যেন অসংখ্য বালু কণা ছড়িয়ে পড়ছে চারধারে। তারপর ভেসে যাচ্ছে জলে। কিংবা উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়। তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে শূন্যে। ফরিদকে আর কোথাও দেখতে পাচ্ছে না সে। এত কষ্ট হতে লাগল পারুর। এত তীব্র কষ্ট। গলার কাছে দলা পাকিয়ে আটকে রইল কিছু। অসহনীয় যন্ত্রণা। কান্না। ফরিদকে আর দেখতে পাচ্ছে না সে। ফরিদও না। কিন্তু তারা পরস্পরের কান্নার শব্দ শুনতে পাচ্ছে। আচ্ছা, তাদের বাকি জীবনটাও কি এমনই হবে? তারা কেউ আর কখনোই কাউকে দেখতে পাবে না! কেবল হাওয়ায় ভেসে বেড়াতে থাকবে তাদের এই অবর্ণনীয় যন্ত্রণার সুতীব্র চিৎকার?

মাঝরাতের দিকে ঘুম ভেঙে গেল পারুর। একটা অস্বস্তিকর খটখট শব্দ ক্রমাগত তার কানে বেজে যাচ্ছে। কিন্তু শব্দটা সে বাস্তবে না স্বপ্নে শুনতে পাচ্ছে, তা এখনো নিশ্চিত নয়। ফলে আরো খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে রইল। রাজিয়া কি তবে এই মাঝরাত্রিতে তার ঘরের দরজা খোলার চেষ্টা করছে? সে কি তাকে ঘুমের মধ্যেই খুন করতে চাইছে? পারুর ভয় করছে। আবার কেন যেন মনে হচ্ছে সে ভয়টাকে আর প্রশ্রয় দিতে চায় না। যতটা সম্ভব নিজে নিজেই বিপদের মুখোমুখি হতে চায়। বাঁচার চেষ্টা করতে চায়। সে ঝট করে উঠে বসল। তার চারপাশে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। সেই অন্ধকারে পা টিপে টিপে বিছানা থেকে নামল সে। তারপর দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই মনে হলো শব্দটা নেই। সে সম্ভবত ঘুমের মধ্যে কিছু একটা দেখেছে বা শুনেছে। সেখান থেকেই শব্দটা তার কানে গেঁথে ছিল। বাইরে তীব্র স্বরে নানা রকম পোকামাকড় ডেকে যাচ্ছে। তাদের ওই ডাক ভেদ করে অন্য কোনো মৃদু শব্দ শোনা একটু কঠিনই। তারপরও বাকি রাতটা ঘুমাতে পারল না সে।

পরদিন ভোরে রাজিয়া হঠাৎ বলল, রাইতে তো তোমারে ডাকছিলাম কয়েকবার, কিন্তু তুমি যে মরার ঘুম ঘুমাও। কোনো সাড়া শব্দ নাই।

‘কেন ডেকেছিলেন?’ পারু শান্ত গলায় বলল।

‘না, মানে তুমি তো রাইতে একবার হুঁশও করো না। মানুষের পায়খানা প্রসাবের জন্যও তো বাইরে যাওন লাগে! একলা ভয় পাও দেইখা যদি না বাইর হও, এইজন্য ডাকছিলাম।’

পারু কথা বলল না। তার শরীর খারাপ লাগছে। রাতের বিষয়টা কেন যেন মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না সে। গতরাতে সত্যিই কি কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছিল সে? নাকি মনের ভুল। এসব ভাবতে ভাবতেই দিন কেটে গেল তার। বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নামলেও চুপচাপ একা একা বসে রইল। মাথায় রাজ্যের এলোমেলো চিন্তা। একটার থেকে আরেকটা আলাদা করা যাচ্ছে না। রাতে তেমন কিছু খেল না সে। ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিল। আজ রাতে আর চট করে ঘুমিয়ে পড়তে চায় না সে। জেগে থাকতে চায়। তা থাকলোও গভীর রাত অবধি। কিন্তু নিঘুম এই পুরোটা সময়জুড়েই তার কেবল মনে হতে লাগল, এই বুঝি কোনো

উটকো শব্দ শুনতে পাচ্ছে সে। এই বুঝি কারো পায়ের শব্দ এসে থেমেছে তার দরজার সামনে। উৎকর্ণ পারুর শরীর খারাপ ছিল বলেই কি না কে জানে, নিজের অজান্তেই হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ল সে। তবে তার ঘুম ভাঙল তীব্র এক আতঙ্ক নিয়ে। সে স্বপ্ন দেখছিল। ফরিদ আর সে নৌকা করে কোথাও যাচ্ছিল। মাঝনদীতে হঠাৎ নৌকা ডুবে গেল। ফরিদ সঁতরে তীরে চলে গেলেও সে যেতে পারল না। ডুবে যেতে লাগল জলে। তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। হাত-পা অসাড় হয়ে আসতে লাগল। পারু সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে জলের ওপর ভেসে উঠতে, কিন্তু পারছে না। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে সে।

এই তীব্র রুদ্ধশ্বাস মুহূর্তে তার ঘুম ভেঙে গেল। কিন্তু অদ্ভুত বিষয় হচ্ছে, ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরও সে দম নিতে পারছে না। যেন এখনো স্বপ্নের ওই জলের নিচেই আটকে আছে। পারু মরিয়া হয়ে শ্বাস নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। মনে হলো যেকোনো মুহূর্তে হাওয়ার অভাবে তার ফুসফুস ফেটে যাবে। কী হচ্ছে? সে শ্বাস নিতে পারছে না কেন? পারু উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু তাও পারল না। যেন কেউ তাকে বিছানার সঙ্গে চেপে ধরে রেখেছে। এটা কি সত্যি? নাকি এখনো স্বপ্ন দেখছে সে?

পারু জানে না। জানতেও চায় না। সে কেবল এই মুহূর্তে একটু নিঃশ্বাস নিতে চায়। একটু বাতাসের জন্য তার বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, মারা যাচ্ছে সে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই সে আবিষ্কার করল, কেউ একজন তার মুখ চেপে ধরে আছে। সম্ভবত বালিশ বা কিছু একটা দিয়ে। লোকটা কি তাকে খুন করতে চাইছে! এই গভীর রাতের অন্ধকারে তাকে শ্বাসরোধ করে খুন করতে চাইছে কেউ!

পারুর শরীর বেয়ে ভয়ের শীতল স্রোত নেমে এলো। কিন্তু আজ কেন যেন আর গুটিয়ে গেল না সে। হালও ছেড়ে দিল না। বরং তার শিড়দারা টানটান হয়ে গেল। সাধারণত এমন সব মুহূর্তে সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যায়। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। কিন্তু আজ আর তেমন কিছুই হলো না। বরং মনে হলো, তার আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই জীবন তাকে যতটা ভয় দেখিয়েছে, বিপদে ফেলেছে, তাতে তার নতুন করে আর ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তারচেয়ে বরং খানিক সাহসীই হয়ে ওঠা যাক। নিয়তিতে যদি পরাজয় লেখা থাকে, তবে তাকে তো আর সে ভয় পেয়ে ঠেকাতে পারবে না!

ওই গভীর, শঙ্কাসংকুল অন্ধকারের ভেতর অদ্ভুত এক কাজ করে বসল সে। আচমকা পাঁক খেয়ে ঘুরে উবু হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। এমন পরিস্থিতিতে সাধারণত সর্বশক্তিতে বালিশটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে মানুষ। কিংবা উঠে বসতে চায়। পারু তার কিছুই করল না। সে যতটা সম্ভব তার মাথাটা চরকির মতো ঘুরিয়ে ফেলার চেষ্টা করল। পুরোপুরি না পারলেও মুহূর্তের জন্য খানিক ফাঁকা জায়গা পেল তার নাক। আর ঠিক ওইটুকু সময়েই বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল সে। তাকে চেপে ধরা মানুষটা ক্ষণিকের জন্য মনোযোগ হারাল। সুযোগটা নিল পারু। এক ঝটকায় তার হাতের নিচের থেকে সরে গেল সে। তারপর পায়ের কাছে রাখা কাঁথাটা টেনে নিয়ে জালের মতো করে ছুঁড়ে মারল জমাট অন্ধকারের ছায়ামূর্তিটার দিকে। মানুষটা আচমকা এমন কিছু আশা করেনি। কথাটা প্রায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলল তাকে। সঙ্গে একটা ভয়ও। পারু যদি এখন তাকে কোনোভাবে আঘাত করে বসে তবে তার কিছুই করার থাকবে না। কারণ, কিছুটা সময়ের জন্য হলেও পুরোপুরি অসহায় সে। সেই অসহয়াত্ব থেকে মুক্তি পেতেই দুই হাতে পাগলের মতো কথাটা মুখের ওপর থেকে সরিয়ে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল।

পারু অন্ধকারে যেটুকু দেখেছে, তাতে আন্দাজ করতে পারছে কী ঘটছে। কিন্তু এরপর কী করবে সে? লোকটা যদি এখন তাকে ধারালো কিছু দিয়ে আক্রমণ করে বসে? তাহলে? এই দুশ্চিন্তা অবশ্য খুব একটা ঘনীভূত হতে পারল না। তার আগেই জমাট অন্ধকারের ছায়ামূর্তিটাকে সরে যেতে দেখল পারু। মানুষটা কি তবে রণে ভঙ্গ দিল?

পারু বিছানা থেকে নামল না। সে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল দরজার দিকে। মানুষটা চলে গেলেও সে কোনো শব্দ করল না। নড়ল না। তবে তার ঠিক পেছনে, টিনের জানালায় সেই মুহূর্তে আবার ঠকঠক শব্দটা টের পেল সে। একবার, দুবার, তিনবার। পারু প্রমাদ গুনল। এতক্ষণ তার ধারণা ছিল অন্ধকারে ওই মানুষটা রাজিয়া। সে তাকে ঘুমের ঘোরে শ্বাসরোধ করে খুন করতে চেয়েছিল। তারপর হয়তো তার লাশ ফেলে দিত নদীতে। কেউ কিছু জানতেও পারত না। তার খোঁজেও কেউ আসত না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এখন ঘরের বাইরে থেকে জানালায় শব্দ করছে কে? রাজিয়াই?

কিন্তু সেটি যুক্তিসংগত নয়। সে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে কেন জানালায় শব্দ করবে? তা ছাড়া শব্দটা বাড়ছে। যেন কেউ তার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে। খানিক আগে ঘরের ভেতর যে মানুষটা তাকে দম আটকে খুন করতে চাইছিল, সে কোন যুক্তিতে বাইরে গিয়ে তার জানালায় নক করবে? তার কোনো কারণ নেই এখন জানালায় শব্দ করে তার ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করার। তাকে সজাগ-সতর্ক করার। তাহলে এই লোকটা কে? আর ভেতরের লোকটিই বা কে ছিল?

লোকটা আচমকা কথা বলে উঠল। একটা পুরুষ কণ্ঠ বলল, আপনে আছেন? আছেন আপনে?

পারু ভারি অবাক হলো। লোকটা তার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে? কিন্তু কে সে? রাজিয়া যে নয়, সেটিতে এবার স্পষ্টই হয়ে গেল। খুব আস্তে, প্রায় ফিসফিসিয়ে কথা বলছে সে। গলার স্বরটাও চিনতে পারছে না পারু। কী উত্তর দেবে সে? এত রাতে কে তাকে বাইরে থেকে ডাকবে? নাকি লোকটা রাজিয়াকে ভেবে জানালায় নক করছে? সে হয়তো ভেবেছে এই ঘরে রাজিয়া ঘুমিয়েছে। রাজিয়ার কোনো গোপন প্রেমিক নয় তো? নাকি এটা নতুন কোনো ফাঁদ?

পুরোপুরি বিভ্রান্ত লাগছে পারুর। তবে এত কিছুর মধ্যেও একটা ব্যাপার খুব অবাক করল তাকে। কেন যেন সেই তীব্র ভয়টা আর অনুভব করছে না সে। তার দুশ্চিন্তা হচ্ছে, কৌতূহল হচ্ছে, সামান্য ভয়ও। তবে তা সেই আগের মতো আগ্রাসী, সর্বগ্রাসী নয়। সেই এলোমেলো, অবশ করে দেয়া ভয়টা যেন আচমকা উধাও হয়ে গেছে। সেখানে জেগে উঠেছে খানিক সাহস, শক্তি, উত্তেজনাও। লোকটা আরো একবার ডাকল। কিংবা বলা চলে ডাকার চেষ্টা করল। কিন্তু তার আগেই ঘরের ভেতর ফস করে দিয়াশলাইয়ের আলো জ্বলে উঠল। আলো জ্বালাল বেরাজিয়া। তারপর উঁচু গলায় বলল, কেডা ওইখানে? বাইরে জানলার ধারে কেডা?

লোকটা চুপ হয়ে গেল। রাজিয়া বলল, কী কথা কয় না কেন? কোন গোলামের পুত গোলামে ওইখানে?

টিনের বেড়ায় ঢং ঢং করে কয়েকবার বাড়ি খাওয়ার শব্দ শোনা গেল। তারপর আছড়ে পাছড়ে কেউ ছুটে গেল দূরে। তার পলায়নপর পায়ের শব্দ শোনা গেল। রাজিয়া সম্ভবত এবার পারুকে উদ্দেশ্য করেই বলল, কী হইছে তোমার ওইহানে? কী সমস্যা?

পারু জবাব দিল না। চুপচাপ বসে রইল অন্ধকারে। ততক্ষণে অবশ্য ক্রমশই ভোরের আকাশে আলো ফুটতে শুরু করেছে। দূর থেকে ভেসে আসতে শুরু করেছে ফজরের আজান। কিন্তু পারুর মাথা থেকে অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর দূর হলো না। সেগুলো গিজগিজ করতে লাগল মগজভর্তি পোকার মতো।

১২

তরু বসে আছে মহিতোষের বিছানার পাশে। মহিতোষ বললেন, মা গো?

তরু জবাব দিল না। তার মুখ থমথমে। সে ভেজা তোয়ালেতে মহিতোষের গা মুছিয়ে দিতে লাগল। কদিন ধরে মহিতোষের শরীরটা একটু ভালো। তিনি নিজে উঠে বসতে পারছেন। খেতে পারছেন। তবে এখনো একা একা হাঁটার মতো পুরোপুরি সক্ষম নন। তার বাঁ পায়ে খানিক শিথিলতা দেখা দিয়েছে। পুরোপুরি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে না পড়লেও মস্তিষ্কে যে প্রচণ্ড আঘাত তিনি পেয়েছিলেন, সেই আঘাতে তার শরীরের কর্মক্ষমতা কিছু হ্রাস পেয়েছে। এই অবস্থাতেই আজ তিনি একা একা লুকিয়ে বাইরে বেরিয়েছিলেন।

মহিতোষ আবার ডাকলেন, মা।

আপনি আমার সঙ্গে কথা বলবেন না।

‘তোমার সঙ্গে কথা না বললে আমি কার সঙ্গে কথা বলব গো মা? আমার তুমি ছাড়া আর কে আছে?’

তরু এই প্রশ্নের জবাব দিল না। মহিতোষ বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে মা। এরপর থেকে আর এমন হবে না।’

তরু খানিক ধমকের স্বরে বলল, আমাকে কি আপনার ডাক্তার মনে হয় না?

হয় গো মা।

‘তাহলে? তাহলে আমি কিছু বললে আপনি শোনেন না কেন?

‘শুনি না? আমি তো তোমার সব কথা শুনি।

‘মিথ্যা কথা বলবেন না। আমার মিথ্যা কথা পছন্দ না।’ বলে হাতের তোয়ালেটা আবার পানিতে ভেজাল তরু। আপনি যদি আমার কথা শুনতেনই, তাহলে ঘুমের ওষুধগুলো না খেয়ে সব ফেলে দিতেন না। আপনার এখন ঘুম দরকার। ঘুম না হলে মাইল্ড ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছে, সেটা খাবেন। আপনি সেটাও খান না। ঠিকমতো খাবার খান না। আমার পক্ষে কি এখন চব্বিশ ঘণ্টা আপনার পাশে বসে থাকা সম্ভব?

মহিতোষ কথা বললেন না। তিনি চুপচাপ তরুর দিকে তাকিয়ে রইলেন। নিষ্পলক। তরু গজগজ করতে করতে বলল, আমি তো একটা কাজ করি, তাই না? আমাকে হাসপাতালে যেতে হয়। এসে নানা কাজ-কর্ম করতে হয়। আপনি যতক্ষণ বাসায় একা থাকেন, ততক্ষণ তো আমার কথা মতো চলবেন, নাকি? আপনি তো আর দুই বছরের বাচ্চা না যে আপনাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতে হবে। চোখের আড়াল হওয়া মাত্রই আপনি যা ইচ্ছে তাই করা শুরু করবেন। এটা তো কোনো কথা না। আপনাকে এত করে নিষেধ করার পরও আজ আপনি একা একা হেঁটে বাইরে গিয়েছেন। কেন গিয়েছেন? কেন?”

রাগে তরুর কপালের শিরা দপদপ করছে। মহিতোষ একদৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। মেয়েটার নাকের মাথায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। সারারাত হাসপাতালে ডিউটি করে সে ভোরে বাসায় ফিরেছে। মহিতোষ এখন এ বাসাতেই থাকেন। তরু তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছে। সমস্যা হচ্ছে, তরুকে রোজ ডিউটিতে যেতে হয়। মহিতোষ তখন থাকেন একা। তাকে দেখার কেউ থাকে না। ফলে তার হাতের কাছে প্রয়োজনীয় সবকিছু গুছিয়ে রেখে, এটা-সেটা নানা কিছু বুঝিয়ে দিয়ে তারপর যায় তরু। কিন্তু সে ফিরে এসে দেখে মহিতোষ তার একটা কথাও শোনেননি। খাবার, ওষুধ কিছুই খাননি। ঘুমাননি। ঘর ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছেন। পড়ে গিয়ে বিচ্ছিরি কাণ্ড ঘটিয়েছেন। তার পায়ের নখ উল্টে গেছে। হাত-পা-কনুই ছিলে গেছে। দেখে আর স্থির থাকতে পারেনি তরু। সেই থেকে সে রেগে আগুন হয়ে আছে।

মহিতোষ বললেন, “আর যাব না মা।

‘কেন যাবেন না, অবশ্যই যাবেন। রোজ যাবেন। আমি যা যা বলব, তার উল্টোটা করলেই তো আপনার শান্তি, তাই না?

তরুর গলাটা আচমকা ধরে এলো। কেন এলো কে জানে! এই মানুষটা তার কী হয়? কিছু না। অথচ তার জন্য কেন বুকের ভেতরটা এমন উথাল-পাথাল করবে? কেন মনে হবে, এই মানুষটা আপাদমস্তক একজন বাবা। সে কেবল পারু বা চারুর বাবা নয়। তারও বাবা। কিংবা জগতের সকল সন্তানেরই বাবা। কিছু মানুষ এমন হয়। দেখলেই কেমন মাটির মানুষ মনে হয়। যেন তাদের শরীরে, মনে, কথায় ওই মাটির মায়াময় সোঁদা গন্ধটুকুও লেগে থাকে। ওই গন্ধটা এত কোমল, এত পেলব যে তার স্পর্শ সারাক্ষণ ছুঁয়ে যায়। মনে লেগে থাকে। চারপাশের অজস্র মানুষ, অসংখ্য স্পর্শ, পাপ ও পঙ্কিলতা কিছুই আর ওই স্পর্শটুকু মুছে ফেলতে পারে না।

মহিতোষের হঠাৎ কী হলো কে জানে। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ‘কেন এমন করি জানো মা?

তরু জবাব দিল না। তাকালও না মহিতোষের দিকে। কারণ সে জানে, সে এখন তাকালেই মহিতোষ তার চোখের কোণে জমা অশ্রু বিন্দুটুকু দেখতে পাবে। কিন্তু সে চায় না, মহিতোষ তা দেখুক। মহিতোষ বললেন, “তোমার এই রাগ দেখার জন্য। তুমি যখন এভাবে রেগে যাও তখন আমার কী যে ভালো লাগে মা। মনে হয়, এই যে কষ্টে কষ্টে বুকের ভেতরটা দগদগে ঘা হয়ে গেছে, ওই ঘায়ে যেন একটু উপশমের মলম পড়ল।’ বলে থামলেন মহিতোষ। তার গলা ভার। চোখ ছলছল। তিনি বললেন, মনে হয়, ভগবান আমাকে যে দুঃখ দিল, তা বুঝি তোমাকে দিয়ে পুষিয়ে দিচ্ছেন। না হলে তোমার সঙ্গে আমার এমন করে দেখা হবে কেন? আর তুমিই বা এমন করে আমাকে একটা শিশুর মতো আগলে রাখবে কেন? তুমি যখন রেগে গিয়ে ধমক দাও, তখন অবিকল মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। মনে হয়, এই তো সেদিন, আমাদের ভুবনডাঙার বাড়ির উঠানে, মা আমাকে বকাবকি করছে। আমার আদুল গায়ে ধুলোবালি লেগে আছে। ছোট্ট সেই আমি মায়ের অমন বকা শুনে হেসে কুটিকুটি। মা তাতে আরো রেগে যেতেন। খেপে গিয়ে মারধরও করতেন। কিন্তু রাত্রিবেলা ঘুমের মধ্যে টের পেতাম, মা আমাকে কোলের মধ্যে নিয়ে পিঠে, গালে, বুকে আদর করে দিচ্ছেন। আহারে মা। মা গো…।’

একটা সুদীর্ঘ দীর্ঘশ্বাস যেন মহিতোষের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করে বেরিয়ে এলো। সেই দীর্ঘশ্বাসের ভেতর লুকিয়ে থাকা যন্ত্রণা, কষ্ট, আক্ষেপ বাতাস হয়ে ছুঁয়ে গেল তরুকেও। মহিতোষ বললেন, ‘আমি আমার ভাগ্য মেনে নিয়েছি মা। এই যে তুমি যখন এমন করে আমায় বকো, আবার আগলে রাখো, এত যত্ন করো, তখন আমার মনে হয়, এই তো আমার পারু। এই যে, পারুই তো…কিন্তু আমি জানি, এই জীবনে আমার আর কারো সঙ্গেই কখনো দেখা হবে না। আমার মায়ের সঙ্গে না, পারুর সঙ্গেও না। কিন্তু এই যে সব হারিয়ে নিঃস্ব, অসহায় এক বুড়ো মানুষ আমি…আমি যদি একটু খামখেয়ালি হই, একটু স্বেচ্ছাচারিতা করে লোভী, বেহায়া মানুষের মতো তোমার কাছ থেকে একটু বেশি আদর আদায় করে নিতে চাই, আরো একটু বেশি যত্ন চাই, সে কি খুব বেশি অপরাধ মা?”

তরু কথা বলল না। তবে তার চোখ থেকে দু ফোঁটা অশ্রু টুপটাপ ঝরে পড়ল মহিতোষের আদুল গায়ে। ওই অশ্রুটুকুর স্পর্শে কী ছিল কে জানে! মহিতোষ আচমকা হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। তার সেই কান্নার দমকে থরথর করে কাঁপতে লাগল তার ভঙ্গুর, জীর্ণ শরীর। তরু আলতো করে দু হাতে মহিতোষের গালে হাত রাখল। তারপর আঙুলের ডগায় মুছিয়ে দিতে লাগল চোখের জল। মহিতোষ আরো কী কী সব বলতে চাইলেন, কিন্তু পারলেন না। আজ বহুদিন পর আবার যেন তার বুকে বাঁধ দিয়ে রাখা অশ্রুর ঢল নেমেছে। এই ঢল তিনি রুখবেন কী করে!

.

সময় চলে যাচ্ছে ধীরে। মহিতোষ আজকাল যেন আর কারো মুখই মনে করতে পারেন না। না পারুর, না চারুর। এমনকি ছায়ারাণী কিংবা অঞ্জলিরও না। সবকিছুই যেন ক্রমশই ধূসর হয়ে যাচ্ছে। কেবল ওই যন্ত্রণাটা ছাড়া। সেটা থম মেরে থাকে জগদ্দল পাথরের মতো। কিন্তু খানিক এদিক-ওদিক হলেই সে মড়মড় করে ভাঙতে থাকে পাঁজরের হাড়। ওই যন্ত্রণা মানুষ ভুলবে কী করে? মহিতোষ মাস্টারও পারেন না। তরুর ভালোবাসা তাকে খানিক উপশম দেয়, এ কথা সত্যি। কিন্তু তা অনেকটা হাওয়ায় ভেসে যাওয়া অগণন মেঘের ফাঁকে হঠাৎ উন্মুক্ত হওয়া চাঁদের মতো। যে আবার নিমেষেই ঢেকে যায় ধেয়ে আসা আরো অজস্র গাঢ় মেঘের আড়ালে।

এই জীবনে আর কখনোই কারো সঙ্গে দেখা হবে না তার? এ কেমন নিয়তি? ভগবান কেন এমন জীবন দিলেন তাকে?

তিনি কি তবে অঞ্জলিদের কাছে ফিরে যাবেন? কিন্তু পারুকে ছাড়া তিনি একা কী করে যাবেন? কীভাবে গিয়ে অঞ্জলিদের সামনে দাঁড়াবেন? এই শরীর নিয়ে অবশ্য যেতেও পারবেন না। ফরিদ ছেলেটাও আর আসছে না। যেন তাকে এড়িয়েই চলতে চায়। তবে মহিতোষ জানেন, পারুর খবর সেও জানে না। ছেলেটা কেমন পাগল পাগল হয়ে গেছে। যে কয়েকবার সে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাতে দিন দিন তাকে কেমন অসংলগ্ন, অস্বাভাবিক মনে হয়েছে তার। সারাটাক্ষণ সে বংশী নদীর তীরে বালুর মাঠের পাশে বটগাছটার নিচে গিয়ে বসে, থাকে। খায় না, ঘুমায় না। আর কোথাও যায় না। রাতেও সেখানে গুটিশুটি মেরে শুয়ে থাকে। ছেলেটাকে মাসখানেক আগে শেষ যখন দেখেছিলেন তখন কেমন রোগা, এলোমেলো লাগছিল। মনে হচ্ছিল, চারদিকের কোনো কিছুর প্রতিই তার কোনো খেয়াল নেই। কেবল মহিতোষের দিকে অপলক তাকিয়ে ছিল সে। তারপর মুখ ফিরিয়ে নিয়ে তাকাল শূন্য দেয়ালের দিকে। অগত্যা মহিতোষই ডেকেছিলেন, ফরিদ? ফরিদ?’

ফরিদ কথা বলেনি। কেবল ফ্যালফ্যাল করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল ধবধবে সাদা দেয়ালে। তার চোখে উদভ্রান্ত দৃষ্টি। মুখভর্তি দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। রুক্ষ্ম ঠোঁট থেকে খসে পড়ছে মৃত চামড়া।

মহিতোষ বললেন, ফরিদ? বাবা…। ফরিদ?

ফরিদ এবার ফিরে তাকাল। না ঘুমানো টকটকে লাল চোখ। শার্টের ফাঁকে গলার কাছটাতে ময়লা জমে আছে। পরনের কাপড়গুলোও নোংরা। কতদিন চুলে তেল-জল পড়ে না কে জানে! মুখের এখানে-সেখানে গোট গোটা দাগ। পোকামাকড়ের কামড়ের চিহ্ন। কে বলবে, এই ছেলেই সেই ফরিদ? সেই ঝলমলে জলের ঢেউয়ের মতো প্রাণবন্ত ফরিদ? ওইটুকু এক ভুলের জন্য এত কেন মাশুল গুনতে হচ্ছে তাদের সবাইকে? ভগবান কেন এত রুষ্ট হয়ে গেলেন হঠাৎ? সামান্য এক অপরাধের জন্য কেন এতগুলো মানুষকে শাস্তি পোহাতে হচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর মহিতোষের কাছে নেই। তবে ফরিদের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই তার মায়া হতে লাগল। অথচ কত রাগ, অভিমানই না তিনি পুষে রেখেছিলেন ছেলেটার ওপর! মহিতোষ জানেন, তাঁর এই এক সমস্যা। কারো ওপর বেশিক্ষণ নিজের রাগ ধরে রাখতে পারেন না। কখনো কখনো নিজের অজান্তেই ওই মানুষটার জায়গা থেকে তার পক্ষেও যুক্তি খুঁজতে শুরু করেন তিনি। অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করেন। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, একটা সময় গিয়ে পেয়েও যান। অসংখ্য যুক্তি, কারণ একে একে এসে জড় হতে থাকে তার মাথায়। এখনো হচ্ছে। মনে হচ্ছে, কত ঝুঁকি, কত বিপদ মাথায় নিয়েই না পারুর জন্য ঘর ছেড়েছিল ফরিদ। শুধু ঘরই কেন, চিরদিনের জন্য নিজের পরিবার-পরিজন, সমাজ, পরিচয় সবই তাকে বিসর্জন দিতে হয়েছে। তারপর থেকে অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সে। বিপদের পর বিপদের মুখোমুখি হয়েছে। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তো পারুর হাত সে ছাড়েনি। অরক্ষিত হতে দেয়নি। তাহলে কোন যুক্তিতে ফরিদের ওপর রাগ করবেন তিনি? অপরাধী বলবেন?

এই যে এখন পারুকে হারিয়ে সর্বশান্ত, নিঃস্ব, অসহায় এক মানুষে পরিণত হয়েছে সে, এই কষ্ট কি আর কারো চেয়ে কম? আসলে জগতে ভালোবাসার মতো হএমন সার্বজনীন অথচ বহুমুখী অনুভূতি আর নেই। ঘৃণার রূপ যেখানে ওই একই, সেখানে ভালোবাসার রূপ অজস্র। সে সকলের জন্যই প্রবল অনুভূতি ধারণ করে। কিন্তু সেই অনুভূতির ধরন স্ত্রী, সন্তান, পিতা-মাতা ভেদে আলাদা। অথচ এর কোনোটিই অকিঞ্চিৎকর নয়।

‘পারু কোথায় ফরিদ? মহিতোষ জিজ্ঞেস করেছিলেন। ফরিদ উত্তর দেয়নি। সে কেবল তাকিয়ে ছিল। মইনুল বলেছিল, ‘ও স্বাভাবিক অবস্থায় নেই চাচা। কারো কোনো কথার উত্তর দেয় না। কিছু জিজ্ঞেস করলেই এভাবে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে।

তা তাকিয়েই রইল ফরিদ। যেন কারো কোনো কথা সে বুঝতে পারছে না। কেবল শুনছে। কিন্তু অর্থোদ্ধার করতে পারছে না। তবে যাওয়ার আগে সে কথা বলল। মহিতোষের খুব কাছে ঘনিষ্ঠ হয়ে সে প্রায় বিড়বিড় করে বলল, পারু আসবে স্যার। পারু আসবে। সে আমাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। আমাকে ছাড়া সে থাকতে পারবে না। কোনোদিন পারবে না।’

ফরিদকে দেখে মনে হচ্ছিল পাথর কেটে বানানো স্থির এক মানুষের মূর্তি। যার চোখজোড়াও পাথুরে। শূন্য। ভাবলেশহীন। কিন্তু সেই পাথুরে, ভাবলেশহীন চোখ জোড়াও ধীরে ধীরে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে উঠল। তারপর উপচে উঠতে লাগল টলমল জল। প্রথমে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল তার গাল বেয়ে। সেখানে একটা ভেজা প্রস্রবণের দাগ তৈরি হলো। সেই দাগ বেয়ে নেমে আসতে লাগল আরো আরো জলের ফোঁটা। তারা অবিরল ঝরে যেতে লাগল। ফরিদ কোনো কথা বলল না। শব্দ করল না। চোখের কোল মুছল না। অমন নিথর, নির্বাক চোখ মেলেই তাকিয়ে রইল। তারপর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর খুব সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে চলে গেল। আর এলো না।

.

লোকে বলে, পারুর মতো আরো অনেকেই সে রাতে নদীতে নিখোঁজ হয়েছে। তাদের বেশির ভাগই নারী। হয়তো সাঁতার কাটতে না পেরে নদীতে তলিয়ে গিয়েছিল তারা। তারপর তাদের লাশ পচে গলে খাবার হয়েছে মাছের। জেলেদের জালে কারো কারো লাশও উদ্ধার হয়েছে দীর্ঘ সময় পর। তবে সেসব লাশ দেখে আর বোঝার উপায় নেই কার কী পরিচয়। তাদের অজ্ঞাত, বেওয়ারিশ লাশ হিসেবেই মাটি দেওয়া হয়েছে। পারুরও কি এমন কিছু হয়েছে?

ফরিদ জানে না। জানতে চায়ও না। সে কেবল স্থানুর মতো বসে থাকে ওই বটগাছটার তলায়। সেখানে রোদ ওঠে, বৃষ্টি নামে, ঝড় হয়, কিন্তু ফরিদ নড়ে না। সে বসে থাকে দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। কিন্তু পারু আর আসে না। তাকে পাওয়া যায় না কোথাও। কে জানে, হয়তো এই জীবনে আর কখনোই তাকে পাওয়া হবে না। দেখা হবে না আর সেই স্মৃতিগন্ধা মেয়েটির সঙ্গে। যে তাকে ভালোবেসে ঘর ছেড়েছিল। অতল অন্ধকারে নেমে গিয়েছিল এক নিমেষের বুকভার যন্ত্রণায়। সেই যন্ত্রণা কি উপশম করতে পেরেছিল ফরিদ? ফরিদ তাও জানে না। সে কেবল জানে, তার বাকিটা জীবন সে এখানে বসে থাকবে। এখানে পারুর গায়ের গন্ধ লেগে আছে। স্মৃতির সুবাস লেগে আছে। এই ধুলোয় মিশে আছে তার পায়ের ছাপ। সেই ছাপ, সেই গন্ধ হয়তো মিলিয়ে গেছে আর সব মানুষের কাছে। কিন্তু তার কাছে, তার বুকের গভীরতম অলিন্দে যত্ন করে সঙ্গোপনে সাজিয়ে রাখা হয়েছে সেই অনুভব, সেই স্পর্শ, সেই অন্তহীন সুবাসের স্মৃতি। বেঁচে থাকার এই জীবনে বাকিটা সময় সে ওই স্মৃতির সুবাস নিয়েই না হয় বেঁচে থাকবে।

১৩

জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তুমি কি আমার ওপর গোস্বা?”

‘গোস্বা হবো কেন ভূঁইয়া সাব?

‘এই যে আমি তোমারে এত পরে কথাটা জানাইলাম।

‘আমি অসুস্থ আছিলাম। তা ছাড়া ওই দিন দুই জোড়া গোক্ষুর সাপ দেইখ্যা ভয়ও পাইছিলাম, এইজন্য আগে বলেন নাই। এতে গোস্বা হওনের কী আছে!’

‘এছাহাক!’ আর্দ্র গলায় এছাহাককে ডাকলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, তুমি আমার মায়ের পেটের আপন ভাই। আমি বিভিন্ন সময়ে তোমারে অনেক ভুল বুঝছি। গালমন্দ করছি। আশা করি, এই সব তুমি মনে রাখবা না।’

‘এই সব আপনে কী বলতেছেন ভূঁইয়া সাব?’ এছাহাক বিচলিত ভঙ্গিতে বলল, আপনে আমার গার্জেন। আমার বিপদে-আপদে সেই এইটুক বয়স থেইকা আপনে আমারে বটগাছের মতন ছায়া দিয়া আগলাই রাখছেন। আমি ভুল করলে আপনে আমারে গালমন্দ করবেন না তো ওই পাড়ার আশরাফ খাঁ করব? আদরও করবেন আপনে, শাসনও করবেন আপনে। এইজন্য আমি আপনের সঙ্গে রাগ করব? এইটা কোনো কথা? আপনে এতদিনে এছাহাকরে এই চিনলেন?

এছাহাকের কথা সত্য। তাকে চিনতে আসলেই ভুল হয়েছিল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। এতদিন ধরে মানুষটা তার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে আছে। তার এমন। কোনো কাজ নেই, যা এছাহাক বিনা দ্বিধায় করে দেয়নি। না পারলেও চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি সে। অথচ তারপরও এতদিনের এই বিশ্বস্ত, ছায়াসঙ্গী মানুষটাকে তিনি নানা সময়ে ভুল বুঝেছেন, অবিশ্বাস-অপদস্ত করেছেন!

শুক্রবারের মসজিদের ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনো গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। গ্রামসুদ্ধ লোকের সামনে কী অপমানটাই না তিনি হয়েছিলেন। ওই সময়ে এছাহাক যদি ওখানে ওভাবে হাজির না হতো তাহলে তিনি আর এ গাঁয়ে মুখ দেখাতে পারতেন না। তার মুখে একদম স্থায়ীভাবে চুনকালি ঘসে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন আশরাফ খাঁ। এজন্যই এতদিন সামনে আসেননি তিনি। তক্কে তক্কে অপেক্ষায় ছিলেন যে কবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ঘরবাড়ি তুলতে শুরু করেন এবং তারপরই হাটে হাঁড়ি ভাঙবেন। তা ভেঙেও ছিলেন। একদম জুতসই মুহূর্তটাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন তাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে। পুরনো সব যন্ত্রণার প্রতিশোধ নিতে। ওই ঘটনার পর এ গাঁয়ে আর মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারতেন না তিনি। মুখে রুমাল গুঁজে অথবা মহিলাদের মতো বোরকা পরে হাঁটতে হতো! ওই লজ্জা তিনি কই রাখতেন? এর চেয়ে নিজের জীবন দিয়ে দেয়াটাও শ্রেয়। ছিল। এছাহাক সেদিন তাঁকে যে কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছে, সেই ঋণ তিনি কোনোদিন শোধ করতে পারবেন না।

হয়তো এ কারণেই পরদিন রাতে এছাহাককে তিনি নিজের ঘরে ডাকলেন। তারপর মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের নিচে পাওয়া গুপ্তধনের কথা বললেন। সব শুনে বজ্রাহতের মতো দাঁড়িয়ে রইল এছাহাক। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না সত্যি সত্যিই ওই পুরনো ভাঙা মন্দিরের নিচে এমন কিছু থাকতে পারে! এসব কথা গাঁয়ের ময়মুরব্বিদের কাছে তারা অল্পবিস্তর শুনেছে। বাস্তুসাপ গুপ্তধন পাহারা দেয় বলেও প্রচলিত আছে। কিন্তু তাই বলে সত্যি সত্যি বাস্তবেও এমন কিছু থাকতে পারে, এ তার দূরতম কল্পনায়ও ছিল না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, এখন তুমি আমারে বলো, ওই জিনিস ওইখান থেইকা উঠাই আনব কেমনে?

এছাহাক খানিক চিন্তিত মুখে ভেবে বলল, বিষয়টাতো এখন একটু জটিলই হইয়া গেল ভূঁইয়া সাব। আশরাফ খাঁ তো দেখলাম আইজ থেইকা জমিতে পাহারা বসাইছে। রাইত দিন লোক থাকে ওইখানে। মন্দির ভাঙা তো বন্ধই। অন্য কোনো লোকও বিনা কারণে অন্তত মহিতোষ মাস্টারের বসতভিটায় যাইতে পারব না। তার বাড়িতে যা যেমন আছে, তেমনই থাকতে হইব।

হুম। গম্ভীর ভঙ্গিতে বললেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তাহলে উপায়?

‘এই কথা আর কে কে জানে?

মতি আর দেলু।

‘আর কেউ না তো?

না।’

আচ্ছা।’ বলে গম্ভীর হয়ে গেল এছাহাক। তারপর বলল, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়?

কী কাজ?

অমাবস্যা হইতে আর দিন দুই বাকি। ওদের চোখ ফাঁকি দিয়া যদি কাজ করতে হয়, তাইলে করতে হবে অমাবস্যার রাইতেই। তার আগের দুইদিন কড়া নজর রাখতে হইব যে ওই বাড়ির ভেতর থেইকা কেউ সন্দেহজনক কিছু নিয়া বাইর হয় নাকি?

সন্দেহজনক কী নিয়া বাইর হইব?’

‘ধরেন বলা তো যায় না, আমাগো আগেই যদি ওরা কেউ ওই জিনিসের খোঁজ-খবর পাইয়া যায়? নিজেরা নিজেরা তুইলা ফেলে?

‘উমম।’ বলে কী ভাবলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বললেন, আমার মনে হয় না এত অল্প সময়েই এমন কিছু হইব। ওইটার ওপরে মাটি চাপা দিয়া, তার ওপরে আগের মতোই ইট, ভাঙা লোহা-লক্কর, জিনিসপত্র রাইখা আসছি। এমনভাবে রাখছি যে কারো সাধ্য নাই কিছু বোঝার। যদি না আগে থেকে জানে।

হুম।’ বলে চুপ করে রইল এছাহাক। তারপর বলল, “তবুও সাবধানের মাইর নাই। একটু চোখ রাখতে তো সমস্যা নাই।

‘তা নাই।’

‘তাইলে মতি আর দেলুরে ডাকব?

‘ডাকো।

মতি মিয়া আর দেলু এলে তাদের সব বুঝিয়ে দেয়া হলো। তারা দুদিন যতটা সম্ভব দূর থেকেই চোখ রাখবে বাড়িটার ওপর। দেখবে কেউ সন্দেহজনক কিছু নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয় কি না! বা ভেতরে কার কী গতিবিধি, কতজন লোক আছে এসব। এতে অবশ্য সুবিধাও আছে। অমাবস্যার রাতে তাদের চোখ এড়িয়ে মন্দিরের কাছে পৌঁছাতে এসব তথ্যও কাজে লাগবে।

পরের দুটা দিন মতি আর দেলু বাড়ির চারপাশে আঠার মতো লেগে রইল। ভেতরে লোক বেশি নেই। অত বড় বাড়িতে মাত্র চার-পাঁচজন লোক হবে। আর পাহারা বলতে যা বোঝায়, তাও তেমন চোখে পড়ল না। বেশির ভাগ সময়ই পুকুর ধারে বসে তাস খেলে লোকগুলো। আড্ডা দেয়। গাছের ফল পেড়ে খায়। বিশেষ করে পুকুরপাড়ের ডাবগাছগুলোর দিকে তাদের খুব নজর। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবারই তারা ডাব পাড়ে। তারপর পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে আয়েশ করে খায়। পুকুরে সাঁতার কাটে। সবার মধ্যেই একটা উৎসব উৎসব ভাব। যেন এখানে বনভোজনে এসেছে।

ঘটনা শুনে অবশ্য জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া খুশিই হলেন। তার মানে বাড়ির পেছন দিকে যে গভীর জঙ্গল সেদিকে তাদের মনোযোগ নেই। তাদের মূল মনোযোগ বাড়ির সামনের দিকটাতে। এটা অবশ্য স্বাভাবিকই। পেছনের ওই ঘন অপরিচ্ছন্ন জঙ্গল পেরিয়ে ও বাড়িতে কে ঢুকবে? ঘটনা স্বস্তির। কিন্তু এছাহাক তবুও নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। সে ঘষ্টনার দিন দুপুরে বলল, একটা বুদ্ধি মাথায় আসছে ভূঁইয়া সাব।

‘কী বুদ্ধি?

মাঝেমধ্যে ওদের জইন্য খাওন আসে বাজারের ভাতের হোটেল থেইকা।

‘তো?”

রমজানের ভাতের হোটেল থেইকা যেই খাওন আসে, সেই খাওনে ঘুমের ওষুধ দেওনের ব্যবস্থা করতে পারলে একদম নিশ্চিন্ত।’

কী বলো তুমি এছাহাক? এইটা যদি জানাজানি হয়, বা ধরা পড়ে, কী হইব বুঝতেছো? তা ছাড়া এই কাজে কিন্তু ঝুঁকিও কম না!’

‘সেইটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনে একবার চিন্তা করেন ভূঁইয়া সাব। যদি কোনো কারণে কেউ টের পায়? তা ছাড়া কাজটা কিন্তু সহজ না। রাইতে ওইখানে যাইয়া, মাটি খুইড়া ওই জিনিস বাইর কইরা নিয়া আহন সহজ কথা না। সামান্য আলো, শব্দই রাইতে টের পাওন যায়। বুঝতে পারতেছেন?’

হুম। এবার চিন্তিত হলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া।

‘এইজন্য যতটা সম্ভব সতর্ক থাকন ভালো না?”

হুম। এইটা ঠিক বলছ। আর ওই জঞ্জালের ভেতর থেইকা মাটি খুঁইড়া কাজটা করতে সময়ও লাগব। কিন্তু সমস্যা হইছে, ওইটাও কিন্তু বিরাট বড় ঝুঁকির কাজ। আর ঘুমের ওষুধ মিশাইবা কেমনে? পাইবাই বা কই?

“কেন? ওহাব ডাক্তার আছে না? তার ফার্মেসির তন।

এই কথায় চুপ করে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। ওহাব ডাক্তারের কথা যেন তিনি ভুলেই গিয়েছিলেন। ফরিদের জন্য তাকে কম অপদস্ত করেননি তিনি। ভয়ভীতি পর্যন্ত দেখিয়েছেন। কিন্তু লোকটা চুপচাপ সব সয়ে গেছে। দীর্ঘদিন তার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাও নেই। সমস্যা হচ্ছে, তার দোকানে এতগুলো ঘুমের ওষুধ কিনতে গেলে সে আবার কিছু সন্দেহ করবে না তো?

এছাহাক অবশ্য সেই সমস্যারও সমাধান করে ফেলল। দেলুকে পাঠিয়ে মঠবাড়িয়া বাজার থেকে দুই পাতা ঘুমের ওষুধ নিয়ে এলো। এগুলো গুঁড়ো করে যেভাবেই হোক ওদের খাবারে মিশিয়ে দিতে হবে। দায়িত্বটা নিল এছাহাক নিজেই। সে সন্ধ্যার পরপর রমজানের ভাতের হোটেলে আড্ডা দিতে গেল। এই সময়ে সেখানে ভিড় ভাট্টা হয়। লোকে রাজ্যের আলাপ-আলোচনা করতে করতে চা-বিড়ি খায়। তা এছাহাকও খেলো। তার একমাত্র দুশ্চিন্তা যদি কোনো কারণে আজ তারা ও বাড়িতে খাবার না নেয়? এই দুশ্চিন্তা অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই কাটল অন্যভাবে। রমজানের দোকানে কাজ করা ছোঁকড়াটা হঠাৎ বলল, “ওস্তাদ, ওই বাড়ির খাওন দিয়াইতে হইব না?

হুম। হইব। আরেকটু অপেক্ষা কর। দেহস না আসমানে মেঘ করছে কী? আচুক্কা বিষ্টি বাদলা আইতে পারে।

বিষয়টা এতক্ষণ খেয়াল করেনি এছাহাক। অমাবস্যার রাত বলেই মেঘের বিষয়টা চোখে পড়েনি তার। তবে এতক্ষণে খেয়াল করল, বাইরে বেশ বাতাস বইতে শুরু করেছে। শুধু তা-ই নয়। সঙ্গে বিদ্যুৎ চমকাতেও শুরু করেছে। মনে মনে ভীষণ খুশি হয়ে উঠল সে। রাতে ঝড়-বৃষ্টি হলে এমনিতেই মানুষের ঘুম ভালো হয়। এই সময়ে লোকজনও ঘরের বাইরে থাকতে চায় না। তা ছাড়া তাদের গর্ত খোঁড়াতেও সুবিধা হবে। ঝড়-বৃষ্টির শব্দে অন্য সব শব্দ চাপা পড়ে যাবে।

এছাহাক তারপরও বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। কিন্তু খাবার নিয়ে আর দোকান থেকে কেউ বের হলো না। এরমধ্যে ঝিরিঝিরি বৃষ্টিও শুরু হয়েছে। এখানে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে সে? বেশিক্ষণ অবশ্য করতেও হলো না। তার আগেই দশাসই শরীরের একজনকে দেখা গেল হোটেলের সামনে। লোকটাকে আগেও দেখেছে এছাহাক। আশরাফ খাঁর খুব বিশ্বস্ত লোক। নাম রুস্তম। আগে কুস্তি টুস্তি লড়ত। কিন্তু বেশ কবছর আগে এক লড়াইয়ে তার বাঁ কাঁধের হাড় সরে গিয়েছিল। সঙ্গে বেড়ে গিয়েছিল হাঁপানির চোট। ফলে ডাক্তারের পরামর্শে তাকে কুস্তি লড়া ছেড়ে দিতে হয়েছে। তবে আগের সেই শরীর ধরে রাখতে তার চেষ্টার অন্ত নেই। এখনো সে নিয়মমাফিক খাওয়া-দাওয়া, শরীরচর্চা করে। আগের সেই বল আর দম ফিরে পেতে ডাক্তার-কবিরাজ থেকে শুরু করে যে যা বলে, তা-ই মেনে চলার চেষ্টা করে। ফলে লোকজন এখনো তাকে একটু সমীহই করে। রুস্তমের সঙ্গে আরো দুজন মানুষ রয়েছে। তাদের চেনে এছাহাক। পানু আর তৈয়ব। এরা দুজন আশরাফ খাঁর খুবই বিশ্বস্ত মানুষ। কিন্তু বাড়ি ফাঁকা রেখে হঠাৎ এখানে ওরা এত লোক কেন? এছাহাক একটু চিন্তিত হলো। তবে তার প্রশ্নের উত্তর মিলল রুস্তমের কথায়। সে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে গমগমে গলায় বলল, “ওই রমজান, আমার অভ্যাস জানোস না? সন্ধ্যার পরপরই আমি ভাত খাই। তা তুই ভাত পাঠাইতে এত দেরি করতেছস কেন?

রমজান ঝড়-বৃষ্টির অজুহাত দেখাল, ‘পোলাডাতো ছোটো রুস্তম ভাই। ঝড়বিষ্টিতে একলা যাইতে ডরায়। আর এত খাওন নিয়া যাওনও ওর জইন্য সমস্যা।

রুস্তম অবশ্য বেশি বাড়াবাড়ি করল না। সে বলল, হুম, বুঝছি। দে, খাওন। দে। আমরা তিনজন এইহানেই খাইয়া যাই। আর আইজ বাড়িতে মানুষও বেশি। এত মানুষের খাওন ওই পোলা নিতেও পারত না। দে, খাইয়া আমরাই সবাইরটা নিয়া যাই।’

আজ মানুষ বেশি? এছাহাক আবার চিন্তিত হয়ে পড়ল। একই সঙ্গে এটিও বুঝল যে তার ওষুধ মেশানোর উদ্দেশ্য সফল করা একটু কঠিনই হবে। তবে ঝড় বৃষ্টিটা যদি বেশি করে নামে, তাহলে সেটিই বরং অনেক বড় সুবিধা তাদের জন্য। সে মনে মনে সেই দোয়াই করতে লাগল। রমজান ততক্ষণে একটা বড় গামলায় ভাত বাড়তে শুরু করেছে। বড় বড় বাটিতে তরকারি। জগভর্তি ডাল। এসব সে টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখছে। রুস্তুমরা খাওয়া শেষে নিয়ে যাবে। এর মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। সঙ্গে বৃষ্টিও। লোকজন হঠাৎ হুড়মুড় করে দোকান থেকে বের হয়ে যেতে লাগল। কারণ রাত আরো বেড়ে গেলে বাড়ি ফেরাটা কঠিন হয়ে যাবে। আকাশের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে না বৃষ্টি আর সহসা থামবে।

একটা হুটোপুটি লেগে গেল দোকানের দরজায়। সুযোগটা নিল এছাহাক। সেও ভিড়ের সঙ্গে বেরিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু ঠিক দরজার কাছে, যেখানে খানিক নিচু হয়ে চৌকাঠ পেরোতে হয়, সেখানে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়াল সে। তারপর তার হাতে থাকা কাগজের ভেতরে গুড়ো করে রাখা ওষুধগুলো চোখের পলকে ডালের জগের ওপর ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল। কাজটা এমন ভাবে করল যাতে কারো চোখে না পড়ে। তা পড়লও না। তবে বাইরে থেকে আসা দমকা হাওয়া আর এত মানুষের তাড়াহুড়ার মধ্যে ঠিকমতো গুঁড়োগুলো জগের মধ্যে ফেলতে পেরেছে কি না নিশ্চিত হতে পারল না এছাহাক।

দোকান থেকে বেরিয়েই সে ছুটতে লাগল ভূঁইয়া বাড়ির উদ্দেশে। ততক্ষণে বৃষ্টির তোড় বেড়েছে। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আকাশে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বসেছিলেন বারান্দায় অন্ধকারে। তার পেছনে মতি আর দেলু দাঁড়ানো। এছাহাক সংক্ষেপে ঘটনা বর্ণনা করল। তারপর বলল, সমস্যা নেই ভূইয়া সাব। দোয়া করেন ঝড়বিষ্টিটা যাতে বাড়ে।

তা বাড়লোও। রাত যত বাড়তে থাকল তত বাড়তে থাকল ঝড়ের বেগও। সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। রাস্তাঘাট, খানাখন্দে পানি জমে যেতে লাগল। নরম গাছের ডাল মটমট শব্দে এখানে-সেখানে ভেঙে পড়তে লাগল। গাছের পাতায় একটানা শো শো শব্দ তুলে যেতে লাগল উন্মাতাল হাওয়া। এরচেয়ে ভালো সুযোগ আর হয় না। এছাহাক একবার ভেবেছিল জাহাঙ্গীর ভূইয়াকে সে বলবে যে এই বিপজ্জনক। আবহাওয়ার মধ্যে তার আর বের হওয়ার দরকার নেই। বরং মতি আর দেলুকে নিয়ে গিয়ে সে-ই জিনিসগুলো তুলে আনুক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলল না। এর কারণও অবশ্য রয়েছে। এমন একটি গুরুতর বিষয়ের দায়িত্ব তিনি অন্য কারো ওপর ছেড়ে দিতে নাও চাইতে পারেন।

তারা বের হলেন আরো খানিক রাত বাড়ার পর। মতি আগে গিয়ে বাড়ির সামনের অংশটা দেখে এলো। মহিতোষ মাস্টারের রেখে যাওয়া ঘরখানা আবার যতটা সম্ভব বসবাসযোগ্য করা হয়েছে। সেই ঘরে লোকজনের সমাগম আঁচ করা গেল। খানিক পর পরই তাদের উল্লাস কানে আসছে। সম্ভবত ঝড়-বৃষ্টির রাত উদ্যাপন করতে তারা কোনো খেলাধুলার আয়োজন করেছে। হতে পারে তাস বা পাশা। বিষয়টি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে চিন্তিত করে তুলল। এছাহাকের ওষুধ তো তাহলে কাজ করেনি। লোকগুলো কি তবে সারারাত জেগে থাকবে? যদি তা-ই হয়, তবে কাজ চালানো খুব কঠিন আর বিপজ্জনক হয়ে যাবে। এছাহাক অবশ্য ভিন্ন যুক্তি দিল। সে বলল, ভূঁইয়া সাব, এই ঘটনার সুবিধাও আছে।

কী সুবিধা?

তারা সবাই ব্যস্ত থাকবে এই খেলা নিয়া। সঙ্গে মদ-গাঁজা থাকাও বিচিত্র কিছু না। ফলে অন্য কোনোদিকে নজর দেওয়ার কথা তাদের মনেই থাকবে না। আর এইটাই আমাদের জইন্য বিরাট সুযোগ। বুঝলেন?

তার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া তবুও কেন যেন পুরোপুরি নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। খুব অস্বস্তি লাগছে তার। একটা কু ডাক ডেকে যাচ্ছে মনের ভেতর। বারবার মনে হচ্ছে, আজ রাতে কোনো ভয়ানক ঘটনা ঘটে যাবে। কিন্তু সেই ভয়ানক ঘটনাটা কী, তা তিনি জানেন না।

আরো ঘণ্টাখানেক অপেক্ষা করে তারা পুকুর পাড় দিয়ে মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির পেছন দিকের জঙ্গলে ঢুকলেন। তারপর অন্ধকারেই পানিতে ছপছপ শব্দ তুলে হাঁটতে শুরু করলেন মন্দিরের দিকে। ততক্ষণে অবশ্য বাড়ির সামনের দিকের হৈ-হল্লা অনেকটাই কমে এসেছে। টিনের চালের বৃষ্টির শব্দ, শীতল হাওয়া আর দিনব্যপী আড্ডাবাজি করে কি তারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে? নাকি শেষ পর্যন্ত এছাহাকের ঘুমের ওষুধ কাজ করতে শুরু করেছে? বিষয়টা কেউ নিশ্চিত নয়। তবে এই ফাঁকে এছাহাকরা পৌঁছে গেল জঙ্গলের আরো গভীরে। পায়ের তলায় জল জমে গেছে। সেই জলেই যতটা সম্ভব সাবধানে পা ফেলে এগিয়ে গেল তারা। মন্দিরের সামনে এসে তার হাতের তিন ব্যাটারির লাইটটা জ্বালাল এছাহাক। আর সঙ্গে সঙ্গেই আর্তনাদের মতো চিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। মন্দিরের ঠিক সামনেই এক জোড়া গোখরা সাপ। তবে সাপজোড়া জীবিত নয়, মৃত। পচে গন্ধও বের হচ্ছে। তার মানে দিন দুই আগেই মারা গেছে তারা। কিন্তু কীভাবে মারা গেল?

সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আর ফুরসত মিলল না কারোই। তারা সকলেই ত্রস্ত পায়ে মন্দিরের ভেতরে প্রবেশ করল। তারপর সাবধানে, রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় ভেতরের ছোট্ট কুঠুরিটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আর ঠিক তখুনি আবিষ্কার করল, তাদের সামনের জায়গাটা ফাঁকা। সেখানে সেই ভাঙা ইটের দেয়াল, লোহা লক্কড়ের টুকরো, এলোমেলো করে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা জঞ্জালের কিছুই নেই। নেই গর্তটাকে চাপা দিয়ে রাখা মাটিও। সবকিছু স্থপ করে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছে।

সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার হলো, গর্তটাও ফাঁকা। শূন্য। সেখানে কিছু নেই। না সেই স্বর্ণালংকারভর্তি কলসি। না একটুকরো সোনার বালা বা অন্যকিছু। কেবল বাইরে থেকে গড়িয়ে আসা বৃষ্টির পানি চারদিক থেকে ধীরে ধীরে গড়িয়ে এসে গর্তটাকে ভরে দিচ্ছে। সেখানে কোনো গুপ্তধন নেই। কখনো ছিল বলেও মনে হচ্ছে না। কেবল খাঁ খাঁ করছে আশ্চর্য ভয়ানক এক শূন্যতা! জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার আচমকা মনে হলো তিনি দমবন্ধ হয়ে মারা যাবেন। এই যে এখানে মাত্র দিনতিনেক আগে তিনি নিজে সব দেখেশুনে রেখে গেছেন। অথচ আজ এই মুহূর্তে জায়গাটা পুরোপুরি ফাঁকা। কোথাও কিছু নেই।

তার এত আরাধ্য সব স্বপ্ন মুহূর্তেই নেই হয়ে গেল? এ কেমন কথা? তিনি কোনো দুঃস্বপ্ন দেখছেন না তো? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। আচমকা বুক চেপে ধরে বসে পড়লেন তিনি। তারপর গড়িয়ে পড়লেন কাদা জলে ক্রমশই পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে থাকা ওই গর্তটার মধ্যে।

১৪

কাশেমের ফুপাতো ভাই ফয়জুল বিকেলে বাজার-সদাই নিয়ে এলো। এ বাড়ির পুরুষের কাজগুলো এখন সে-ই করে। আগেও তাকে দু-একবার দেখেছে পারু। কিন্তু কথাবার্তা তেমন হয়নি। কাশেমের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যপারটি তার আত্মীয়-স্বজন কেউ মেনে নিতে পারেনি। প্রথম প্রথম বিষয়টা অন্যদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিল কাশেম। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হয়নি। সকলেই জানে, প্রথম বউ রেখে গোপনে দ্বিতীয় বিয়ে করলে এ কথা সহজে কেউ স্বীকার করতে চায় না। নানা রকম মিথ্যে, ছলচাতুরির আশ্রয় নেয়। কাশেমও নিশ্চয়ই তা-ই করছে। সে অবশ্য পুরো বিষয়টা ভালোভাবে বোঝানোর সময়ও তেমন পায়নি। তার আগেই তাকে পুলিশের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। লোকে বলাবলি করছে, বাড়ির আশপাশে নাকি ছদ্মবেশে পুলিশ ঘোরাঘুরি করছে। সুযোগ পেলেই তারা তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুড়ে দেবে।

এসব কারণে কাশেমও আর এ মুখো হতে চায় না। আপাতত তাই ফয়জুলেরই দায়িত্ব পড়েছে বাড়ির বিভিন্ন কাজ-কর্ম সামলানোর। আজ বাজার নিয়ে এসে সে রাজিয়ার হাতে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করল, নতুন বউ কই?

রাজিয়া চোখের ইশারায় নদীর ধারের মাচাটা দেখিয়ে দিল। সেখানে একা একা বসেছিল পারু। ফয়জুলকে দেখে একটু অবাকই হলো সে। তবে কিছু বলল না। সরে গিয়ে বসার জায়গা করে দিল। ফয়জুল বলল, আমার নাম ফজু। কাশেম ভাইয়ের ফুপাতো ভাই।’

পারু কথা বলল না। তাকিয়ে সামান্য হাসির ভঙ্গি করল কেবল। ফয়জুল বলল, ভাই কাউরে কিছু না জানাইয়া বিয়া করল, এইজন্য সবাই তার ওপর রাগ। দেখেন না, এই বাড়িতেও কেউ আসে না?

পারু এবারও কথা বলল না। সে তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। ফয়জুল বলল, ‘শোনেন ভাবি সাব, আপনার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

পারু ফিরে তাকাল। তার সঙ্গে ফয়জুলের জরুরি কী কথা? ফয়জুল বলল, ‘আপনের যেকোনো প্রয়োজনে আমারে বলবেন। শত হোক, আপনের পেটে যে বাচ্চা, সেই বাচ্চাতো আমাগো বংশেরই। তাই না? তার প্রতি তো আমাগো একটা দায়িত্ব আছে। এখন থেইকা আপনের যখন যা লাগবে, আমারে বলবেন।

পারুর কিছুই ভালো লাগছে না। আজকাল তার মনে হচ্ছে, সে এখন সবচেয়ে বেশি যা চায়, তা হলো কাশেমের উপস্থিতি। মাত্র ওই কটাদিনই লোকটাকে দেখেছে সে। কথাবার্তা কম বললেও তাকে খারাপ লোক বলে মনে হয়নি। এমনকি পারুকে আবার বালুর মাঠে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতিও সে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর সবকিছুই হঠাৎ পাল্টে গেল। লোকটা যদি একবারের জন্যও আবার বাড়িতে আসত, তবে এতদিনে একটা না একটা ব্যবস্থা তার হয়েই যেত। কিন্তু এখন অপেক্ষা ছাড়া আর কিছু করার নেই।

ফয়জুল হঠাৎ বলল, “শুনলাম, কাশেম ভাই নাকি বলতেছে, আপনেরে বালুর মাঠের মেলায় পাইছে? আপনে অজ্ঞান হইয়া ট্রলারের ওপরে আইসা পড়ছেন। সে নাকি আপনেরে বিয়া করে নাই? হা হা হা। আরে ভাই, তুই ব্যাটা মানুষ, তোর এত ভয় থাকব কেন? তুইতো ধর্ম মতেই চাইর বউ এক লগে পালতে পারবি। তোর এত ভয় পাইলে চলবে? এক বউর ভয়ে আরেক বউরে অস্বীকার করবি, এইটা কেমন কথা?

‘আপনি বালুর মাঠ চেনেন? ঝট করে ফয়জুলের দিকে তাকাল পারু। তার কণ্ঠে স্পষ্ট উত্তেজনা।

যাই নাই কখনো। তয় নাম শুনছি। কাশেম ভাইর লগে অনেকবার যাইতে চাইছি যাত্রাপালা দেখনের জইন্য। কিন্তু সে নেয় নাই। তবে ভাবছি সামনে যদি মেলা হয়, তাইলে যাব। কিন্তু এই পরিস্থিতিতে হইব কি না, সেইটা একটা প্রশ্ন।

‘আপনি যাবেন?’ এতক্ষণে যেন ফয়জুলের ওপর আগ্রহী হয়ে উঠল পারু। সে কি তাহলে ফয়জুলকে বলবে, তাকে বালুর মাঠে পৌঁছে দিতে? কিন্তু সেখানে গিয়ে যদি ফরিদকে সে না পায়? তখন কী করবে? পারুকে অবশ্য কিছুই বলতে হলো না। তার আগেই এদিক সেদিক তাকিয়ে হঠাৎ গলা নিচু করে ফয়জুল বলল, ‘শোনেন ভাবি, আমারে আপনের কাছে পাঠাইছে কাশেম ভাই। আপনের লগে আমার জরুরি কথা আছে।

পারু এবার সোজা হয়ে বসল, ‘ সে আপানকে পাঠিয়েছে?

হুম।

কী জন্য? কী কথা? পারু রুদ্ধশ্বাস ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল।

ফয়জুল বলল, সে বলছে আপনারে কোনো এক রাইতে রামচরের লঞ্চঘাটে দিয়া আসতে। ওইখানে কাশেম ভাই আপনের জইন্য অপেক্ষা করব।’

কেন?

‘সে আপনেরে দিয়া আসব।’

‘কই দিয়া আসব?

বালুর মাঠ। সে আপনেরে বালুর মাঠ নিয়া গিয়া তার পরিচিত এক বাড়িতে রাইখা আসব। সেইখান থেইকা আপনের আত্মীয়-স্বজন আইসা আপনেরে নিয়া যাইব। আপনে তাদের কাছে খবর পাঠাইবেন।’

পারু জানে না সে কার কাছে কী খবর পাঠাবে। কিন্তু তার হঠাৎ মনে হলো সারা শরীরজুড়ে তীব্র এক তড়িৎ কম্পন শুরু হয়েছে। সে সত্যি সত্যিই আবার সেখানে ফিরে যেতে পারবে? ফরিদ কি তার জন্য এখনো অপেক্ষায় আছে? কত মাস হয়ে গেল সে হারিয়ে গেছে? ফরিদ কি এখনো তার জন্য ওখানে অপেক্ষা করছে? নিশ্চয়ই করছে।

‘আর ভাবিসাব। সাবধান কিন্তু। এই কথা যেন এই বাড়ির কেউ না জানে। রাজিয়া ভাবি কিন্তু কাশেম ভাইর ওপরে ভেতরে ভেতরে খুব ক্ষ্যাপা। সে যদি একবার বাড়িতে আসে, তাইলে আর তারে সে যাইতে দেব না। আটকাই রাখব। মাথা গরম মহিলা, বলা যায় না, পুলিশ দিয়াও ধরাই দিতে পারে। এই ডরেই কাশেম ভাই আর এই মুখো হয় না। আপনারও বড়সড় কোনো ক্ষতি কইরা ফেলতে পারে। খুব সাবধান।

সেই সারারাত আর ঘুমাতে পারল না পারু। গাঢ় অন্ধকারের ভেতর শূন্যে চোখ মেলে তাকিয়ে রইল সে। সেই চোখের ভেতর কত কত স্বপ্ন, কত কত কান্না। ওই সব কান্না আর স্বপ্নের যুগপৎ বন্দিশালায় আটকে রইল অজস্র দীর্ঘশ্বাস। আচ্ছা, বাবা কোথায়? মা, চারু, ঠাকুরমা? তারা কী করছে এখন? তাকে কি সবাই ভুলে গেছে? নাকি এখনো রোজ তার জন্য কাঁদে? এই জনমে আর কখনোই কি তাদের সঙ্গে দেখা হবে না তার?

পারু অবশ্য কোনো ভাবনারই খুব বেশি গভীরে প্রবেশ করতে পারে না আজকাল। একটা আশ্চর্য নির্লিপ্ততা যেন ক্রমশই তাকে গ্রাস করে নিচ্ছে। না হলে ওই রাতের ঘটনা নিয়েও তার মধ্যে কেন কোনো বিকার নেই। কে তাকে ওই রাতের অন্ধকারে ওভাবে শ্বাসরোধ করে খুন করে ফেলতে চেয়েছিল? কিংবা রাতদুপুরে তার জানালার বাইরে থেকে তাকে ডেকেছিলই বা কে?

আশ্চর্য ব্যাপার হচ্ছে সে রাতের পর রাজিয়া তার সঙ্গে আবার কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। আগের মতো গালমন্দ না করলেও গম্ভীর হয়ে গেছে সে। মাঝখানে যে আরোপিত হৃদ্যতা দেখিয়েছিল, তাও উধাও হয়ে গেছে।

সেদিন খেতে বসে হঠাই সে জিজ্ঞেস করল, তুমি নিজেরে খুব চালাক মনে করো, না?

পারু চোখ তুলে তাকাল। কিন্তু কথা বলল না। রাজিয়া বলল, তোমার কি ধারণা, আমি কিছুই বুঝি না? তুমি যে ভাতের প্লেট দিলে সরাইয়া দেও। তারপর আমারটা নিয়া নেও। পানির জগ থেইকা পানি খাও না। রাইতে ঘরের মইধ্যেও তোমার রুমে দরজায় খিল দিয়া ঘুমাও। এই সব কিছুই আমার চোখে পড়ে নাই?

পারু এবারও জবাব দিল না। রাজিয়া ঠাণ্ডা গলায় বলল, “তোমার কি মনে হয়, তোমারে ভাতের মইধ্যে বিষ খাওয়াইয়া মাইরা ফেলব আমি? তোমারে মারতে আমার বিষ লাগে? তোমারে আমি দিনে দুপুরে খুন না করতে পারি, রাইতে তো পারি। দিনে আশপাশে লোকজন থাকে। মানুষের চোখে পড়ার সম্ভাবনা আছে। আবার শুনছি তোমার আদরের সোয়ামির খোঁজে নাকি বাড়ির আশপাশে পুলিশও ছদ্মবেশে ঘুরঘুর করতেছে। কিন্তু তোমারে তো আমি রাইত-বিরাইতে ঘুমের মইধ্যেই খুন কইরা ফেলতে পারি। পারি না?

পারু এবার মাথা নাড়াল। রাজিয়া বলল, তাইলে কেন করি না? কারণ আমি ঝামেলা চাই না। আপসে সব চাই। কিন্তু তুমি তো তা করবা না। তোমারে আমি যা ভাবছি, তুমি তার চাইতেও সেয়ানা মাইয়া। মুখ দেইখা তো মনে হয় ভাজা মাছ উল্টাই খাইতে জানেন না। কিন্তু আরেক জনের জামাইর লগে লটরপটর কইরা পেট তো ঠিকই বাজাইছো। এখন আবার রাইত-বিরাইতে তোমার জানালায় কারা আসে? পেট বাজাইয়াও শখ মেটে নাই?

এই কথায় পারুর কান গরম হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে চাইত সে। কিন্তু আজ তেমন কিছুই করল না। বরং ভাতের নলাটা মুখে পুরে দিতে দিতে সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল, “সেইদিন রাতে তাহলে আপনিই আমার মুখ চেপে ধরছিলেন?

‘হ। ধরছিলাম।

বলে চুপ করে রইল রাজিয়া। তার মুখ থমথমে। চোখে শীতল দৃষ্টি। সে তাকিয়ে আছে পারুর দিকে। পারু তার সেই চোখের দিকে তাকাল না। তবে রাজিয়া হিসহিসে গলায় বলল, “ওই দিন রাইতে তোমার সোয়ামি কাশেম আসছিল আমার লগে দেখা করতে। আন্ধারে লুকাইয়া আইসা কত অনুনয় বিনয় করল, যেন আমি তোমার কোনো ক্ষতি না করি। তার পুলিশের ঝামেলা শেষ হইয়া গেলেই নাকি সে তোমারে তোমার আসল সোয়ামির কাছে দিয়া আসব।’ বলেই হা হা হা করে হাসতে লাগল রাজিয়া। তারপর টিপ্পনী কাটার ভঙ্গিতে বলল, তুমি তো মাইয়া যা তা জিনিস না। তোমার আসল সোয়ামিও আছে। আবার নকল সোয়ামিও আছে। এরা দুজনেই আবার তোমারে মেলা ভালোবাসে। আর আমি হইলাম গিয়া কপাল পোড়া রাজিয়া। এই কূলও নাই, ওই কূলও নাই।

রাজিয়া কথা শেষ করলেও পারু কিছু বলল না। সে এখন দুজন মানুষের স্ত্রী হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিত। অথচ তার স্ত্রী হিসেবে সত্যিকারের কোনো পরিচয় নেই। কী অদ্ভুত তার জীবন? এমন জীবন কি আর কারো আছে?

রাজিয়া বলল, কাশেম মিয়ার তোমার ওপর এত আহ্বাদ দেইখা আর নিজেরে সামলাইতে পারি নাই। সে যাওনের সঙ্গে সঙ্গে গিয়া তোমার মুখ চাইপা ধরছিলাম। মাথা ঠিক রাখতে পারি নাই। কিন্তু তোমার তো দেখি মাইয়া মাথাভর্তি চিকনা বুদ্ধি। ওই আন্ধারের মইধ্যেও কেমনে আমার হাত থেইকা ফসকাই গেলা!’

পারু এবারও কথা বলল না। সে গ্লাসে জল নিয়ে খেতে লাগল। তবে মনে মনে একটা ব্যাপারে সে নিজেও অবাক। তার কেন যেন ভয় করছে না। মনে হচ্ছে, রাজিয়াকে ভয় করার মতো কিছু নেই। গায়ে তুলনামূলক বলশালী হলেও তার মাথায় বুদ্ধি কম। পারু চাইলেই তার থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবে। এই আত্মবিশ্বাস কোথা থেকে এলো পারু জানে না। সে প্লেটখানা হাতে নিয়ে উঠতে লাগল। বাইরের নলকূপ থেকে জল খাবে সে। সঙ্গে প্লেটখানাও ধুতে হবে। কিন্তু তার আগেই রাজিয়া বলল, তোমারে বহুদিন শাহাজাদির মতো খাওয়াইছি। এখন থেইকা তুমি থাকবা চাকরানির মতো। আর আমি রাজরানি। যখন যা বলব, শুনবা। সব কাজ তুমি করবা। আর যদি না করো…।’

‘খুন করে ফেলবেন?’ মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল পারু।

রাজিয়া একটু অবাক হলেও গ্রাহ্য করল না। সে বলল, কী করব সেইটা সময় আসলেই বোঝন যাইব। তোমার মতো খানকি মাগিদের কেমনে শায়েস্তা করতে হয়, তা আমার জানা আছে। আমারে তো তুমি চেনো নাই। এখন থেইকা চিনবা, আমি রাজিয়া কেমন জিনিস।

কী জিনিস আপনি? লোহার, না তামার?’ বলেই পারু হঠাৎ হাসল। সেই হাসি দেখে হতভম্ব হয়ে গেল রাজিয়া। এই মেয়েকে সে এর আগে কখনো দেখেনি। এ যেন অন্য কোনো মানুষ। সঙ্গে অজানা এক আতঙ্কও ঘিরে ধরল তাকে। বুকের ভেতরটা কি খানিক কেঁপে উঠল?। প্রথম যখন পারু এ বাড়িতে এসেছিল, তখন তার চোখ-মুখ জুড়ে ছিল তীব্র ভয়। ঝড়ে বিধ্বস্ত ডানা ভাঙা পাখির মতো সারাক্ষণ একা একা বসে থাকত সে। কান্নাকাটি করত। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, ততই যেন একটু একটু করে অন্যরকম হয়ে উঠেছে সে।

এটি ভালো কোনো লক্ষণ নয়। বরং ভয়াবহ অশনিসংকেত। নরম স্বভাবের, ভীত-সন্ত্রস্ত কোনো মেয়েকে সতিন হিসেবে মেনে নেওয়া গেলেও এই মেয়েকে মেনে নেওয়া বিপজ্জনক। তার মা সাহেরা বানু তাহলে ঠিকই বলেছিলেন। সে পারুকে চিনতে ভুল করেছে। দুদিন বাদে এই মেয়ে তাকে তার সোনার সংসার থেকে লাথি মেরে বের করে দেবে।

পারু হাত-মুখ ধুয়ে এসে চুপচাপ বসে রইল। তার মাথায় এখন কেবল ফয়জুলের কথাই ঘুরছে। কবে তাকে নিয়ে রওনা দেবে ফয়জুল? বেশ কিছুদিন ধরে সে এ বাড়িতে আসছে না। তবে পারু জানে, সময় আর বেশি নেই। ফয়জুল এসে তাকে সংকেত দিলেই রওনার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়তে হবে তাকে। পারুর অবশ্য প্রস্তুতিরও কিছু নেই। সে যেকোনো সময়, যেকোনো মুহূর্তেই যেতে রাজি। এখন কেবল ফয়জুলের অপেক্ষা। আর এ কদিনের জন্য রাজিয়ার ভয়ে ভীত হয়ে থাকার কোনো মানেও হয় না।

তবে ফয়জুল না এলেও পরদিন সকালে সেই বৃদ্ধাকে দেখা গেল। সেদিন তার নাম না জানা হলেও আজ তার নাম জানল পারু। তাবারন বিবি। তিনি পারুকে দেখেই এক গাল হেসে বললেন, শইলডা খুব খারাপ হইয়া গেছিলো রে বু। এইজইন্য তোর আর কোনো খোঁজখবর নিতে পারি নাই। জ্বরে কাহিল হইয়া গেছিলাম।’

পারু জানে না কেন মানুষটাকে দেখেই তার মন ভালো হয়ে গেল। যেন মেঘলা দিনের গুমোট আকাশখানাকে হঠাৎ ফুরফুরে হাওয়া এসে পরিষ্কার করে দিল। চারপাশ ঝলমল করে উঠল। এই যে তিনি তাকে অবলীলায় তুই সম্বোধন করে বলতে লাগলেন, তাও পারুর কাছে খুব স্বাভাবিকই মনে হতে লাগল। যেন কত দিনের চেনা, আপন মানুষ তিনি। তাবারন বিবি বললেন, তুই সারাদিন এই বাড়িতে একলা একলা কী করস? এই নদীর পাড় ধইরা আধা মাইল হাঁইটা গেলেই আমার বাড়ি। দেখবি বাড়ির সামনে বড় বড় দুইটা জামগাছ। আর এই গাঁয়ে এক নামে সকলেই আমারে চেনে। তুই যাস না কেন আমারে দেখতে?

পারু হাসল। বলল, যাব এইবার।

হ… আইবি।’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তাবারন বিবি। বললেন, ‘বুড়া হইলে আর মাইনষের দাম থাহে না রে বু। না পোলা-মাইয়ার ধারে। না অন্য মানুষের ধারে। আমার পোলাডা, আইজ তিন মাস হয় বউ নিয়া গেছে শ্বশুরবাড়ি। বাড়িতে যে বুড়া মা একলা সেই খেয়াল নাই। এহন শুনতেছি, সে নাকি গোপনে শ্বশুরের দেশে জমিজমা কেনছে। সেইখানেই বাড়িঘর উঠাইয়া থাকব। আমারে না জানাইয়া নাকি আমার ভিটা বাড়িও বেচনের বন্দোবস্ত করছে। আগাম টাকাও নিছে মানুষের থোন। এখন তারা রোজ আসতেছে জমি দখল করতে।’

পারুর বুকটা আবার ধক করে উঠল। পৃথিবীজুড়েই যেন কেবল জমি দখলের গল্প। মানুষ মাটি ছাড়া টিকে থাকতে পারে না। গাছের মতোই মানুষেরও বোধহয় মাটিতেই শিকড় গাঁথা থাকে। সেও তাই নিজের মাটিতে গাঁথা শিকড় ছাড়া প্রাণ প্রাচুর্যে বাঁচতে পারে না। তবে ফারাকটা হলো, গাছ তার নিজের মাটিটুকু নিয়েই সন্তুষ্ট। এক গাছ অন্য গাছের শিকড় উপড়ে ফেলে দিয়ে তার মাটিটুকু দখল করতে চায় না। কিন্তু মানুষ চায়। সে কেবল নিজেরটুকুতেই সন্তুষ্ট নয়। তার আরো চাই, আরো।

ভুবনডাঙার জন্য আবার বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল পারুর। একটা তীব্র হাহাকার হুহু করে বয়ে যেতে লাগল বুকের এপাড়-ওপাড় জুড়ে।

‘এখন আমার বড় মাইয়াটা আইসা আমার লগে থাকে।’ বললেন তাবারন বিবি। কিন্তু সেও কি আর বেশিদিন থাকতে পারে? তার জামাই আছে। পোলাপান, সংসার আছে। এই নিয়া সেইখানেও ঝামেলা।’ বলেই হঠাৎ ডানে-বাঁয়ে সতর্ক দৃষ্টিতে চোখ বুলালেন তিনি। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, তুই এক কাম কর। এইখানে যদি কোনো অসুবিধা হয়, আমার বাড়িতে আইসা পড়িস। আমরা দুই বইনে এক লগে থাকব। আমার তো তোর বড় সতিন রাজিয়ারে ডরই লাগে। সে কিন্তু মারাত্মক মহিলা। কখন কী কইরা ফেলে কে জানে! সাবধানে থাকিস। কইলাম।

বলেই পারুর চুলে হাত বুলিয়ে দিলেন তিনি। পারুর এত ভালো লাগল। মুহূর্তের জন্য হলেও মন ভালো হয়ে গেল তার। এই মানুষটিকে যেন নিজের ঘরের মেঝের মাটির মতোই আপন আর শান্ত-শীতল আশ্রয় মনে হচ্ছে তার। তাবারন বললেন, ‘তোর শইলের অবস্থা তো দেহি বেশি ভালো না। খাওন-দাওন নাই, নাকি? কয় মাস হইল?”

এই কথায় পারু থমকে গেল। আসলেই তো, আজ কত মাস হলো? সে এখন প্রায়ই তার পেটের ভেতর নড়াচড়া টের পায়। মাঝে মাঝে তীব্র ব্যথাও অনুভূত হয়। কিন্তু এখানে কার কাছে কী বলবে সে? যা-ই ঘটুক না কেন, সব নিজের মধ্যেই লুকিয়ে রাখে সে। পাঁচ-ছ মাস তো হবেই। তার মানে আর বেশিদিন সময়ও নেই। কী ঘটবে তার ভাগ্যে? কিংবা তার পেটের ভেতর পৃথিবীর আলো হাওয়া দেখার অপেক্ষায় থাকা শিশুটির ভাগ্যে?

পারু জানে না। এ এক আশ্চর্য অনিশ্চিত জীবন। এই জীবন তাকে কোথায় নিয়ে যাবে কে জানে!

.

ফয়জুল এলো সপ্তাহখানেক পরে। সে এসেই বলল, ভাবিসাব, বড় ঝামেলায় পড়ছিলাম।’

কী ঝামেলা?

আমার বড় বইনের শ্বশুরবাড়ি যাইতে হইছিল। তার আবার বাচ্চা হইব। এর মধ্যে তার শ্বশুর হইল অসুস্থ। যমে-মানুষে টানাটানি। সাতটা দিন আমি দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না।’

‘এখন কেমন আছেন উনি?

‘এখন আল্লাহর ইচ্ছায় ভালো।

পারু বুঝতে পারছে না সে কাশেমের কথা কিছু জিজ্ঞেস করবে কি না? কিংবা তাদের বালুর মাঠ যাওয়ার পরিকল্পনারই কী খবর? ফয়জুলও তেমন কিছুই বলল না। রাজিয়া তাকে এটা-সেটা বাজার করতে পাঠাল। সেসব নিয়ে ফয়জুল বাড়ি ফিরল বিকেলে। সদাই-পাতি রেখে চলে যাওয়ার ঠিক আগে সে পারুকে বলল, ‘পরশু রাইতে আপনে রেডি থাইকেন। খবরদার বড় ভাবি যেন কিছু টের না পায়। সে তাইলে আবার ভাববে কাশেম ভাই মনে হয় অন্য কোথাও আপনের জন্য বাসাবাড়ি করছে। আমি আপনেরে সেইখানে নিয়া যাইতেছি। বুঝতেই পারতেছেন, জানলে কিন্তু লাগবে গোলমাল।

পারু বলল, আচ্ছা।

‘আমরা রাইত একটু বাড়লেই রওয়ানা করব। আমি ঘাটে ট্রলার নিয়াসবো। ঘণ্টা দুই ট্রলারে গেলেই রামচরের লঞ্চঘাট। ওইখান থেইকা কাশেম ভাই আপনেরে নিয়া যাইব। তার পরদিন পৌঁছাই যাইবেন বালুর মাঠ।

পারুর মনে হলো তার দমবন্ধ হয়ে আসছে। আর মাত্র দুটো দিন। তারপরই সে পৌঁছে যেতে পারবে বালুর মাঠে। সেখানে ফরিদ নিশ্চয়ই তার জন্য অপেক্ষায় আছে। আচ্ছা, ফরিদ যখন তাকে দেখবে, তখন কী করবে সে? পারুই বা কী করবে? সে কি কাঁদবে? দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরবে? না কি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকবে?

পারু আর ভাবতে পারছে না। এই দুটো দিন সে কী করে কাটাবে? একেকটা মুহূর্ত তো তার কাছে মনে হচ্ছে অনন্তকাল। এই শ্লথ সময়টা ফুরাবে কখন?

তা শেষ অবধি সময়টা ফুরাল। সেদিন সারাটাক্ষণ অস্থির হয়ে রইল পারু। সন্ধ্যার পর থেকে যেন আর তর সইছিল না তার। রাজিয়া বাতি নিভিয়ে ঘুমিয়ে যেতেই সে জানালার কাছে কান পেতে বসে রইল। ফয়জুল এসে সংকেত দেয়া মাত্রই সে বেরিয়ে যাবে। বাড়ির সামনের নদীর ঘাটে নৌকা বাধা থাকবে। ওই নৌকায় উঠতে পারলেই আর ভয় নেই তার। রাজিয়া কোনো ঝামেলাই করতে পারবে না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সময় বয়ে যাচ্ছে অথচ ফয়জুলের কোনো খবর নেই। একটা গাছের পাতা পড়লেই বুক কেঁপে উঠছে পারুর। ওই বুঝি ফয়জুল এলো। ওই বুঝি তার পায়ের শব্দ শোনা গেল। তা শেষ অবধি ফয়জুল এলোও। রাত তখন কত হবে পারু জানে না। এই সময়ে সে টের পেল খুব সতর্ক পদক্ষেপে কেউ এগিয়ে আসছে। সে উৎকর্ণ হয়ে আছে বলে তার পায়ের শব্দটা তার কান। এড়াল না। লোকটা ধীরে ধীরে তার জানালার কাছে এসে দাঁড়াল। তারপর নখের আঁচড়ে জানালায় শব্দ করতে লাগল। একবার, দু বার, তিন বার। পারু বুঝতে পারছে না, সে নিজ থেকেই আগে কথা বলবে? নাকি অপেক্ষা করবে?

শেষ অবধি অপেক্ষা করারই সিদ্ধান্ত নিল সে। খানিক নীরবতার পর ওপারের মানুষটা হঠাৎ কথা বলে উঠল। বলল, আপনে আছেন? জাইগা আছেন?

পারু মৃদু গলায় বলল, “জি আছি। কিন্তু কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হলো ওপারের মানুষটা ফয়জুল না। অন্য কেউ। তার ভুলও হতে পারে। তবে মুহূর্তের জন্য যেন বিভ্রান্ত হয়ে গেল সে। অন্য কেউ হলে কে? লোকটা বলল, ‘আপনের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।

কে এই লোক? তার সঙ্গে পারুর কী জরুরি কথা? সেই রাতের ঘটনার পর থেকে পারু বিছানার তলায় একখান ভাঙা কাস্তের ফলা এনে লুকিয়ে রেখেছে। সে সেখানা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে বলল, “কে আপনি?

‘আমি কাশেম।

কাশেম! পারুর বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে গেল। কাশেম কী করে এই রাতে এখানে আসবে? তার না এখন থাকার কথা রামচর নামের এক লঞ্চঘাটে? সে হড়বড় করে বলল, আপনি এখানে? আপনার তো অন্য জায়গায় থাকার কথা!

কাশেম অবাক গলায় বলল, “অন্য জায়গায় মানে?

‘আপনার না এখন রামচরের লঞ্চঘাট থাকার কথা? কাশেম অবাক চোখে অন্ধকারে তাকিয়ে রইল। পারুর কথা সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *