৪. গভীর সুন্দরবন

চার

গভীর সুন্দরবন।

নদীর পাড় থেকেই হেঁতাল, গেঙো আর সুন্দরী গাছের ঘন জঙ্গল আরম্ভ হয়েছে। দু-তিন তলার সমান উঁচু উঁচু গাছ। গাছগুলোর নীচে কাটা-ঝোঁপ, তার মাঝ দিয়ে হাতখানেক চওড়া জঙ্গল-কাটা পথ। দেখে মনে হয়, এ বনে কাঠ কাটতে বা মৌচাক ভেঙ্গে মধু সংগ্রহ করতে যারা আসে, তার ঝোঁপ কেটে সাফ করে এ পথ তৈরী করেছে।

আক্রমণের ভয় এখনো ওদের আছে। তাই বুলেট মানা করেছে টর্চ জ্বলতে। অন্ধকারে বহু কষ্টে কাটা-ঝোঁপ ঠেলে সেই সরু পথ ধরে তিনজনে ঢুকলে আরো গভীর জঙ্গলে। রাত পোহাতে তখনো অনেক দেরী।

নদীর ধারে পথ একটু চওড়া হলেও জঙ্গলের মধ্যে খানিক গিয়েই এত সরু যে, একজন মাত্র লোক সে-পথে কাটা আর বিছুটির চোট বাঁচিয়ে সহজে যেতে পারে কোনোমতে!

কিছুদূর এসে বুলেট বললে–এবারে টর্চ জ্বালো। আর ভীম, তুমি তো এ অঞ্চলের লোক, ভালো করেই বুঝবে, এ জঙ্গলে বাঘ থাকতে পারে কিনা।

ভীম টর্চ্চের আলোয় ভালো করে সবদিক দেখে বললে– কতকগুলো ভাঙ্গা-ভাঙ্গা বাড়ী আর একটা ঐ বড় ঝাউ গাছ। মনে হচ্ছে, এর নাম ‘নীলের-জঙ্গল’। তার মানে, কোম্পানির আমলে এ-সব জায়গায় নীলের চাষ হতো শুনেছি। হ্যাঁ, এ জঙ্গলে বাঘ থাকা সম্ভব।

বুলেট বললে–আমারও তাই মনে হয়।

ভীমের অনুমান ঠিক। সুন্দরবনের মধ্যে যে জায়গাটাকে ‘নীলের-জঙ্গল’ বলে এ সেই জায়গা। ইংরাজ রাজত্বের গোড়ার দিকে এই সব অঞ্চলের জঙ্গল কাটিয়ে দিনকতক নীল চাষের চেষ্টা হয়েছিল, তারপর নীলের চাষ তেমন চললো না বলে এ জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়। সুন্দরবন তখন আবার ঘন জঙ্গল হয়ে ওঠে।

ভীম বললে,–শুনেছি, ঐ নীলের জঙ্গলে আসল যে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, তারাই করছে রাজত্ব।

বুলেট সবার সামনে, তার পিছনে ভীম, বজ্ৰ সকলের শেষে চলেছে। ভীম বললে–কোনো বড় গাছে উঠে রাতটা কাটালে ভালো হয়।

টর্চ্চের আলো নীচু করে ফেলতে-ফেলতে বুলেট বললে–দ্যাখো তো ভীম, একটা বাড়ীর মত কি দেখা যাচ্ছে না? মানুষের ঘর হতে পারে।

কিছুক্ষণ সেইদিকে চেয়ে ভীম বললে–এতক্ষণে জায়গাটা বেশ ভালো চিনতে পেরেছি। এ জঙ্গলে আমি দুবার এসেছি বাবার সঙ্গে মৌচাক ভাঙ্গতে। যে বাড়ীটা দেখা যাচ্ছে, ওটা হলো ‘রাজা দক্ষিণ রায়ের থানা।

বজ্ৰ জিজ্ঞাসা করলে–রাজার থানা। লোকজন আছে এ থানায়?

ভীম বললে–লোক নেই। দক্ষিণ রায় হলেন বাঘের রাজা। ওখানে তার মূর্ত্তি আছে।

পথের উপর কতকগুলো কাঁটা-গাছ এসে পড়েছে। দু-হাতে সেগুলো সরিয়ে পথ করে চলতে-চলতে বুলেট বললে–চলো, ঐখানেই রাত্রিবাস করা যাক্।

ইটের তৈরী ছোট একটা ঘর। সামনের দিকটা একেবারে ফাঁকা। তার মধ্যে কতকগুলো বিরাট আকারের মূর্ত্তি বা বিগ্রহ। সেদিকে আলো ফেলে ভীম সকলকে বুঝিয়ে দিলে, লম্বা গোঁফওয়ালা ঐ বীরের মূর্ত্তিটা হলো স্বয়ং দক্ষিণ রায়ের! ভার পাশের দেবীমূর্ত্তি নারায়ণী বা বনবিবি। ওপাশের মূর্ত্তিদুটো হচ্ছে গাজীসাহেব আর তার ভাই কালুর।

সুন্দরবনের অদ্ভুত দেবতা। এদের কথা বুলেট কি বজ্র আগে কখনো শোনেনি বা কোনো বইয়েও পড়েনি।

ভীম বললে–গাছে না উঠে আজ রাতের মত এই দক্ষিণ রায়ের থানে বসে রাত কাটালে হয়! বাঘের সাধ্য নেই এখানে ঘেঁষে…এটা তাদের রাজার কাছারি।

ভীমের বিশ্বাস, দক্ষিণ রায়ের সামনে বাঘ শিকার পেলেও তাকে খায় না। ভীমের সরল বিশ্বাসে আঘাত না দিয়ে বুলেট বললে–আমরা এইখানেই থাকবে। কিন্তু নীচেয় নয়, ঘরটার উপরে–ছাদে!

বজ্র বললে–ছদে ওঠা যাবে কি করে?

রাজা দক্ষিণ রায়ের থানা বা মন্দিরের হাত-দশেক দুরে বহু প্রাচীন এক বিরাট বট গাছ অনেক ডাল-পালা আর ঝুরি নামিয়ে বিঘে-তিনেক জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেই গাছটার দিকে চেয়ে বুলেট বলে উঠলো,-ছাদে ওঠবার চমৎকার ব্যবস্থা দেখছি…ঐ গাছ! তোমরা রেডি হও।

বুলেট লাফ দিয়ে বট গাছের একটা ঝুরি ধরে দুলতে-দুলতে ছাদের উপর উঠে ঝুরিটা ছেড়ে দিল টুপ করে ঝুরি নেমে পড়লো।

বজ্র বললে–সাবাস বুলেট! এসে ভীম, আমরাও ঐরকম করে ছাদে উঠি।

বুলেট বললে–তোমাদের ওরকম করে ওঠবার দরকার কি! আমার সঙ্গে সেই ডিঙ্গি-বাঁধা দড়িটা আছে, সেটা ঝুলিয়ে দি। ধরো–আমি টেনে ছাদে তুলে নেবে।

বুলেট দেওয়ালের গা বেয়ে দড়িটা ঝুলিয়ে দিলে। ভীমের কি মনে হলো, ভীম বললে– বঙ্গকে–এটা কি ভালো হবে?

বিস্মিত হয়ে বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–কেন? এ-কথার মানে?

ভীম বললে–দেবতার মন্দিরের মাথায় ওঠা।

বজ্র বললে–তাহলে গঙ্গার বুকে সাঁতার-কাটা কি নৌকো করে যাওয়াও ভালো নয়, মা-গঙ্গা হলেন দেবী!

বজ্রের যুক্তি অকাট্য। ভীমকে হার মানতে হলো!

উপর থেকে বুলেট হাঁকলো–উঠে পড়ে তোমরা, একটু গড়িয়ে নিতে হবে।

ভীমের আর আপত্তি নেই। বুলেট তাকে আর বজ্রকে পর-পর দড়ি দিয়ে টেনে ছাদে তুললো। জিনিষপত্রও উঠলো এই রকমে। বজ্র আর ভীম ওঠবার আগে জিনিষপত্র দড়িতে বেঁধে দিলে, দড়ি টেনে বুলেট সেগুলো তুললো উপরে।

ছাদের উপর রাজ্যের শুকনো পাতা আর আগাছা। সে-সব পরিষ্কার করে দুখানা সতরঞ্চি পাশাপাশি বিছিয়ে বজ্র বুলেটকে বললে–আজ আমাদের সকলের মধ্যে বেশী পরিশ্রম হয়েছে তোমার। তুমি রাগ মুড়ি দিয়ে ঘুমোও, আমি আর ভীম পালা করে জেগে থাকবো।

বুলেট দেশলাই জ্বেলে তার আলোয় ঘড়ি দেখে বললে– রাত আর বেশী নেই। তিনটে বেজে চল্লিশ মিনিট। তবু ঘুমোনো দরকার–নাহলে শরীর ভয়ানক বেজুৎ থাকবে।

দূরে ফেউয়ের ডাক! ভীম বললে–ফেউ! বাঘমশায় তাহলে কাছাকাছি কোথাও আছেন।

বুলেট বললে–থাকুক! আমার ভারী ঘুম পাচ্ছে, একটু ঘুমিয়ে নিই। তোমরা তো জেগে চৌকি দেবে বলছো! বেশ এক ঘণ্টা পরে আমাকে তুলে দিয়ে!

তিনজনেরই জামা-কাপড় হাফপ্যাণ্ট ভিজে গিয়েছিল, সেগুলো ছেড়ে শুকনো জামা-কাপড় পরলো। ছাদের এককোণে শুকনো পাতা জ্বালিয়ে আগুন করে ভীম বললে–শরীরগুলো একটু তাতিয়ে নেওয়া দরকার।

মিনিট দুয়ের মধ্যে বুলেট ঘুমিয়ে পড়লো। বজ্র বললে ভীমকে–তুমি ইচ্ছা করলে ঘুমোতে পারো! আমি জেগে আছি।

ভীমের খুব ঘুম পেয়েছিল, তবু সে বললে–আমি দুপুরবেলায় ঘুমিয়েছি, তুমি বরং ঘুমোও।

বজ্র বললে–বেশ।

র‍্যাগ মুড়ি দিয়ে বজ্র শুয়ে পড়লো।

ঘুম আসাটা আশ্চর্য্য নয়–সারাদিন যা হয়েছে। বজ্রর নাক ভাকতে লাগলো।

বোধহয় দশ মিনিটও হয়নি, ভীমের ঠেলায় আর ডাকাডাকিতে বজ্র আর বুলেট জেগে উঠলো। উঠে বসে সড়কিটা হাতে করে বুলেট জিজ্ঞাসা করলে–ব্যাপার কি?

ভীম চাপা গলায় বললে–শুনতে পাচ্ছে না?

বজ্র বললে–সেই শয়তানগুলো?

ভীম বললে–না, তারা নয়। মশাই!

বুলেট দারুণ বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করলে–মশাই! তার মানে? কে?

ভীম উত্তর দিলে–মশাই আমরা বলি বাঘকে।

–বাঘ! বজ্র বললে।

বুলেট কিছুক্ষণ কাণ পেতে থেকে বললে–হুঁ, বাঘ ডাকছে। তবে তিন চার মাইল তফাতে, মনে হচ্ছে। যাক্, সেজন্য ভাবনার কারণ নেই তেমন। এদিকে না আসতেও পারে। একান্তই যদি আসে তো তার আসতে এক ঘণ্টা সময় লাগবে। ততক্ষণ ঘুমিয়ে নেওয়া যাক।

বুলেট আবার শুয়ে পড়লো। হাতে যখন একটা সড়কি আছে, ভাবনা কি!

ঘুম তার চিরদিনই খুব অনুগত। শুয়েই বুলেট ঘুমিয়ে পড়লো। মিনিট-দুইয়ের মধ্যে বুলেটের নাক ডাকতে লাগলো।

ভীম কিন্তু ভয় পেয়ে ঠায় বসে আছে। ভীমের ব্যাপার দেখে বজ্র বললে–ভয় কি, ঘুমোও না! আমি তো জেগে আছি।

ভীম বললে–না, আমি ঘুমোবো না, তুমি ঘুমোও। কিন্তু খুব হুঁশিয়ার!

.

সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল। যেমন ভীষণ অন্ধকার, তেমনি নিঝুম নিস্তব্ধ! তার উপর মহা-দুর্যোগের রাত, এ যেন আর শেষ হতে চায় না। মাঝে-মাঝে জন্তু জানোয়ারদের যাওয়া-আসার খড়-খড় শব্দ-ভীম সে শব্দ শুনে চমকে চমকে উঠছে? ঘুমে এক একবার চোখ জুড়ে আসছে, চুলে-চুলে পড়েও নিজেকে সামলে নিয়ে তখনি সজাগ হয়।

বোধহয় ঘণ্টাখানেক কেটে গেছে, ভীম শুনলো, হঠাৎ খড়-খড় ধপ-ধপ শব্দ। সতর্ক হয়ে নীচের দিকে লক্ষ্য করতেই চমকে উঠলো–দেহের রক্ত এক মুহূর্তে হিম হয়ে এলো!

দেখলো, ঝোঁপের জমাট অন্ধকারের মধ্যে ঠিক যেন দুটো আগুনের গোলা জ্বলছে দপদপ করে…ভীষণ তীব্র ভাবে!

আগুনের ও গোল দুটো যে বাঘের চোখ, তা বুঝতে ভীমের দেরী হলো না। সে এই অঞ্চলের ছেলে। কিন্তু এমনি ভাবে বাঘের সামনা-সামনি অস্ত্র-শস্ত্রহীন অবস্থায় সে কখনও পড়েনি। জোরে সে বজ্রকে ঠেলে দিলে।

আচমকা ঠেলা খেয়ে বজ্রর ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে জিজ্ঞাসা করলে–কি?

ভীম চাপা গলায় উত্তর দিলে–বাঘ এসেছে!

বজ্র বললে–বাঘ? না, বাঘের ডাক?

ভীম বললে–না, না, সাক্ষাৎ বাঘ। সামনে এসে গিয়েছে। বুলেটকে জাগাও।

বুলেট উঠলে ভীম তাকে আঙুল দিয়ে বাঘের দিকে দেখিয়ে বললে–ঐ দ্যাখো।

বুলেট আর বজ্র দু’জনেই দেখলো, সত্যই একজোড়া জ্বলজ্বলে চোখ! এরকম চোখ বাঘ ছাড়া অন্য কোনো জীব-জন্তুর হতে পারে না। আর বাঘের গায়ের উৎকট দুর্গন্ধে বন ভরে গিয়েছে!

বজ্র বললে–আমাদের দেখতে পেয়েছে?

বুলেট বললে–না পেলেও এখনি পাবে। ওর গায়ের গন্ধে বুঝতে পারে, মানুষ কোথায় আছে।

বাঘটা ঘোঁস্‌-ঘোঁস্ করে গন্ধ শুঁকতে শুঁকতে এগিয়ে আসছে। একটু এগোয় আর ভালো করে চারি দিকে চেয়ে-চেয়ে দেখে।

বাঘটার দিকে চেয়ে বজ্র নাচতে-নাচতে বললে–দ্যাখ বুলেট, বাটা বোধহয় উপর দিকে চাইতে পারে না! ও শুধু নীচের দিক লক্ষ্য করে এগুচ্ছে।

বুলেট সে কথার কোনো উত্তর না দিয়ে ব্যাগ থেকে একখানা কাপড় বার করে বললে–বাঘটা আর একটু এগুলেই কাপড়টা জেলে ওর গায়ে তুমি ফেলে দেবে, আমি সড়কি হাতে তৈরী থাকি। ও যে-কোনো মুহূর্তে আমাদের উপর লাফ দিয়ে পড়তে পারে।

রাজা দক্ষিণরায়ের থানা হলেও ঘরটা দশ-বারো ফুটের বেশী উঁচু নয়। ঘরটার উপরে কার্ণিশ বা প্যারাপেট নেই যে তার আড়ালে লুকোনো যেতে পারে!

বাঘটা হেলতে-দুলতে থানার সামনে এসে আক্রোশে গোঁয়াতে লাগলো আর জোরে জোরে মাটি আঁচড়াতে লাগলো থাবা দিয়ে। মানুষের গন্ধ পাচ্ছে অথচ মানুষ সে দেখতে পাচ্ছে না, তাই তার রাগ হচ্ছিল বেজায়।

চাপা গলায় বুলেট বললে–বাঘটা এখনো আমাদের দেখতে পায়নি, কিন্তু এখনি দেখে ফেলবে–কি রকম চন্মন্ করে চারিদিকে চাইছে!

যা বলা, তাই ঘটলো! বাঘটা মাটিতে বসতেই বুলেটদের দেখে ফেলল।

ভীম বললে–এবার আর আমাদের রক্ষা নেই।

বুলেট কাপড়টায় আগুন ধরিয়ে বাঘের গায়ে জোরে ছুঁড়ে মারলো।

আগুন দেখে বাঘ প্রথমে একটু ভয় পেয়ে সরে গেল, কিন্তু পরক্ষণেই দাঁড়িয়ে আবার বুলেটদের দিকে চেয়ে গজরাতে লাগলো।

ভীম ছাদের এক কোণে শুকনো পাতা জ্বেলে দিয়েছিল।

বজ্রও দেখলো। বাঘটা আগুন দেখে পালালো না–আরও গজরাচ্ছে!

বাঘ একটু পিছু হঠে গেল–গিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসবার উপক্রম যেন।

ভীম বলে উঠলো–বুলেট বুলেট, সর্ব্বনাশ! বাব এখনি আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।

সড়কিটাকে শক্ত করে ধরে বুলেট বললে–তোমরা আমার পিছনে বসো। তুমি বাঘটার চোখে টর্চ্চের আলো ফ্যালো–যত জোরে পারে।

টর্চ্চের আলোয় দেখে বাঘটা লাফ মারবার জন্য দেহটাকে সঙ্কুচিত করছে। বুলেট দাঁড়িয়ে উঠে সড়কিটাকে বাগিয়ে ধরলে। তিনজনের জীবন নির্ভর করছে ওই একটিমাত্র সড়কির উপর।

সুন্দরবনের বাঘ–যাকে বলে ব্যাঘ্র-রাজ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। যেমন বড়–সাহস আর শক্তি তেমনি। থাবার ঘায়ে বড় বড় বুনো মোষকে মেরে টুটি ধরে অনায়াসে পিঠে তুলে নিয়ে যায়। মানুষ দেখলে এদের বিক্রম আর লোভ বেড়ে যায় খুব বেশী। আগুন বা টর্চ্চের আলোকে বড় তোয়াক্কা করে না।

ভীম হঠাৎ আর্তনাদ করে উঠলো বুলেট, বুলেট, লাফ মারছে!

ঝপাং-আঁক–আঁক–আঁ-ক!

বাঘটা লাফ মারার সঙ্গে-সঙ্গে বুলেট তার মাথা তাগ করে সজোরে সড়কি ছুঁড়েছে। অব্যর্থ এবং মোক্ষ তাগ! সড়কিটা যেমন ভারী, তেমনি ধারালো। সড়কিটা বাঘের চোয়াল ভেদ করে মাথা পর্যন্ত্য ঢুকেছে–ঢুকে মাথার খুলি ফেটে সড়কির মুখ বেরিয়ে পড়েছে!

ভীষণ খাতনায় কাতরাতে-কাতরাতে বাঘটা দিক-বিদিক জ্ঞানার হয়ে কাঁটা-পলোর জঙ্গল ভেঙ্গে নদীতে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো। সড়কিটা তার মাথায় বিধে আছে।

ভীম বললে– আঃ!

বুলেটকে বজ্র বুকে জড়িয়ে ধরলো।

খিল-খিল করে হেসে বুলেট বললে–শুনছো, বাঘটা নদীতে পড়ে কেমন সাঁৎরাচ্ছে।

নদীর দিক থেকে ঝপাঝপ শব্দ আসছিল।

টর্চ্চের আলো নদীর দিকে ফেলে চারিদিক দেখে বুলেট বললে—সাঁৎরাচ্ছে? না, ওকে কুমীরে ধরেছে।

ভীম বললে–তাইতো! দেখছি–বেলেমাছের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছেন!

তিনজনে হাসতে লাগলো।

বুলেট বললে–একেই বলে ‘যা শত্রু পরে’। আমরা আজ কুমীরদের কলা দেখিয়ে চলে এসেছি, যাহোক ওদের একটা বড় রকমের ব্যবস্থা করে দিলুম তো! দে শুত বী গ্রেটফুল।

বজ্র বললে–নির্ভয় কওয়া গেল! জলে পড়লে যদি এবার ধরে–মনে করিয়ে দেবো ব্যাঘ্র-ভোজ পাঠানোর কথা–তাহলে তখনি নমস্কার করে আমাদের ছেড়ে দেবে–এ্যাঁ।

হাসতে-হাসতে ভীম বললে–যা বলছো, বজ্র।

সকলেরই মনে এখন বেশ সাহস আর আনন্দ। তারা নদীর দিকে চেয়ে আছে তিনজনে।

বিরাট এক কুমীর বাধটার পিছনের পা-দুটো কামড়ে ধরে ওকে টেনে নদীর মাঝখানে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, কুমীরের গ্রাস থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য বাঘটারও প্রাণপণ চেষ্টা।

কি ধস্তাধস্তি! বজ্র বললে–গজ-কচ্ছপের যুদ্ধ কোথায় লাগে।

ব্যাটারির আয়ু এদিকে নিঃশেষ হলো। ব্যাটারির অপরাধ কি! কত কাজ তারা দেছে আজ জলে-স্থলে।

বাঘ আর কুমীরের যুদ্ধের শেষ-অংশ দেখার ভাগ্য বিলুপ্ত হলো।

… … …

অন্ধকার ফিকে হয়ে এসেছে, রাত আর বেশী নেই।

বুলেট বললে–দ্বিতীর যুদ্ধেও আমরা জয়ী হলুম।

বজ্র বললে–শুধু তোমার মিলিটারী করতে।

নিজের প্রশংসা ভালো লাগে না। বুলেট বললে–বাঘটা যদি ওখানে মরতো, তাহলে ছালখানা নিয়ে যেতে পারতুম–ট্রফি!

সকাল হয়ে আসছে-পূব-আকাশে তার ইঙ্গিত। কিন্তু জঙ্গলের নীচে অন্ধকার একেবারে কাটলো না। সড়-সড় শব্দ এখনও সেখানে–দু-চারটে হরিণ আর বন-বরা ছুটে যাচ্ছে।

ভীম ঘুমোচ্ছে। বজ্র বললে–বুলেট, এবার কি করা যাবে? বোম্বেটেদের হাতে পড়ে আমাদের প্ল্যান একদম্ ভেস্তে গেল! এই গভীর অরণ্য-আবার সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নেই।

বুলেট বললে–যাক, উলটে-পালটে সব ব্যবস্থা! তাতে দমবো না। এ-পথে বিপদ, বাধা, বিপর্যয় ঘটবে পদে-পদে! হিংস্র জন্তু জানোয়ার এবং তার চেয়েও সাংঘাতিক হিংস্র এখানকার মানুষ। এদের কবলে কতবার পড়তে হবে, ঠিক কি! কিছুতে দমা হবে না! মনে হয়-শুভ-যাত্রা-জয়-যাত্রা! নাহলে যে-বিপদে পড়েছিলুম– ভাগ্যে ভীম ছিল হাত-পা বাঁধা নৌকোর খেলে পড়ে। ওকে না পেলে আমরা দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে নৌকোয় ঘুমোতম–আর ব্যাটার কি না করতে পারতো, বলো দিকিনি।

বুলেট বললে–হুঁ! কিন্তু এখন গোটা-দুই সড়কি আর ছোঁয়া জোগাড় করতে হবে, আর ভীমকেও সঙ্গে নিতে হবে। ও এদিককার ছেলে, সাহস আছে–অনেক জানে-শোনে, সঙ্গে থাকলে অনেকখানি সুবিধা হবে।

বজ্র বললে–হুঁ। কিন্তু ও কি রাজী হবে?

বুলেট বললে–খুব হবে! বুঝচো না–এ্যাডভেঞ্চারে ভয় নেই। তার উপর এমন সব বিপদে রক্ষা পেলে মানুষের এ্যাডভেঞ্চারের নেশা কতখানি বেড়ে ওঠে! তার উপর আমরা কোথায় যাচ্ছি, কি আমাদের উদ্দেশ্য-সে-সব বললে– ও নিশ্চয় মেতে উঠবে!

… … …

মহাদুর্যোগের রাত–তাও শেষ হয়। অল্প-অল্প করে সুন্দরবনের ঘন গাছপালার আবরণের ফাঁক দিয়ে বাঁকা রেখায় সূর্যের রশ্মি এসে ঝোপে-ঝোপে পড়ছে। নানা পাখীর কল-কাকলীতে বন মুখর।

বজ্র বলে উঠলো–দেখ বুলেট দেখ–কি চমৎকার দৃশ্য! এ-সব অঞ্চলের সৌন্দর্য দেখলে নেহাৎ নিরেট গদ্য অকবি ব্যক্তিও বোধ হয় কবিতা লিখতে পারে। মোষ্ট মার্ভেলাশ!

দিকদিগন্ত ঘন-শ্যামল অরণ্য, এর না আছে আদি, না আছে অন্ত! মাঝখান দিয়ে শুভ্র-স্বচ্ছ নদী চলেছে বয়ে কলস্বরে কোথায় কতদূরে এ-নদীর শেষ–কে জানে! যতদূর দেখা যায়, লীলামন্ত রূপই নজরে পড়ে! দূরে বহু দূরে কটা বালিয়াড়ী দেখা যাচ্ছে–অতি অস্পষ্ট হলেও পাহাড়ের মত বিরাট গাম্ভীর্য্যভরা রূপ! শীতের ভোরে মনোরম।

বুলেটও সে-দৃশ্যে মুগ্ধ হলো। সে বললে–সত্যই সুন্দরবন–সুন্দর-বন! ভারতের অনেক জায়গা ঘুরেছি, কিন্তু এমন সৌন্দর্য্য কোথাও দেখেছি বলে মনে হয় না!

দেখতে দেখতে বেলা হলো। ভীমকে বজ্র বললে–তুমি আমাদের গাইড, এ-নদীর নাম বলতে পারে?

ভীম বললে–এর নাম হরিণা! এ-নদী গিয়ে মিশেছে জামিরা নদীতে, তারপরই সাগর। আর সামনেই গভীর বন-ওটা হলো কোম্পানির খাশ জঙ্গল-ওখানে কাঠ কাটা বা শিকার করা একেবারে বারণ।

বিস্মিত হয়ে বজ্র বললে–এ-জঙ্গলে কোনো কোম্পানি আছে নাকি?

বুলেট বললে–কোম্পানি মানে, গভর্ণমেণ্ট। পাড়া-গাঁয়ের লোকজন এখনও ইষ্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কথা ভুলতে পারেনি। তাই গভর্ণমেন্টের জায়গাকে কোম্পানির জায়গা বলে। দেখলে, ডিষ্ট্রিক্ট বোর্ডের রাস্তাকে সকলে কোম্পানির রাস্তা বলছিল।

বজ্র হাসতে লাগলো।

বুলেট পকেট থেকে ম্যাপ বার করে তার উপর দৃষ্টি রেখে বললে–ভীম ঠিক বলেছে। এনদীর নাম হরিণা–ওপারে গভর্ণমেন্টের রিজার্ভ ফরেষ্ট-জগবন্ধুর চক এখান থেকে মাইল বারের বেশী নয়। তার পাশেই রাজপোতা–ওখান থেকে বড় জোর দু-মাইল দক্ষিণ-পূর্বে।

বজ্র বললে–কিন্তু ওই ছোট ডিঙি নিয়ে সেখানে যাওয়া যাবে?

বুলেট বললে–ভাড়ার নৌকো আর চড়ছি না-যে-কোনো রকমে ওতে করেই যাবো।

ভীম বললে–ডিঙি বাইব কিসে? সে-লগিটাও নেই।

বুলেট বললে–জঙ্গলে এত গাছ, সুন্দরী গাছের ডাল কেটে লগি-দাঁড়–সব বানিয়ে নেবে।

ভীম বললে–আমার কাছে চাকু-ছুরি আছে, আমি এখনি গোটা দুই গাছের ডাল কেটে নিয়ে আসি-এনে দাঁড়-লগি তৈরী করছি।

বুলেট বললে–বনের ধার থেকে গাছের ডাল কেটো, ভিতরে টুকো না। বাঘ থাকতে পারে।

ভীম গাছের ডাল কাটতে গেল।

নদীর চরে ডিঙিটার দিকে লক্ষ্য করে বজ্র বললে–আমাদের বরাত ভালো–তাই ডিঙিটা নদীর স্রোতে ভেসে যায়নি বা ওর মালিক এসে নিয়ে যায়নি।

বুলেট বললে–ডিঙিটা মাঝরাত্রে জোয়ারের জলে চড়ায় উঠে গিয়েছিল, তারপর ভাঁটার সময় জল সরে গেছে, তাই এখনও ওখানে আটকে আছে। ভালোই হয়েছে। এখন আমরা ডিঙিটাকে নিয়ে চালাই তো-তারপর ফেরবার পথে মালিককে ডেকে তার ডিঙি তাকে দিয়ে যাবো, ভাড়া বলেও কিছু দেবো।

বজ্র বললে– বেশ, তাই করা যাবে। কিন্তু এদিকে পেটের মধ্যে নাড়ীগুলো চুইচুই করছে খিদেয়–তেষ্টাও তেমনি। নদীর জল এমন নোনা যে, খেলে বমি হয়ে অন্নপ্রাশনের অন্ন পৰ্য্যন্ত উঠে যাবে। জলের উপায়?

বুলেট বললে–কাল রাত্রে দক্ষিণ রায়ের থানায় একটা নারকোল গাছ দেখেছি–গোটাকতক ঝুনো নারকোলও আছে দেখেছি। চলো, ঐ নারকোল খেয়ে খিদে মেটাই–আর ঐ নারকোলেয় জলে তেষ্টা দূর হবে।

***

হরিণা নদীতে ভাঁটার টান শেষ হয়েছে, এবার জোয়ার আসৰে…..একটু দেরি আছে জোয়ার আসতে। নদীর জল চঞ্চল হয়ে উঠেছে, হাওয়া লেগে ঢেউগুলো তীরের উপর ছলাৎ ছলাৎ করে আছাড় খেয়ে পড়ছে। বেলা দুপুর। গভর্ণমেন্টের রিজার্ভ ফরেষ্টের সীমা পার হয়ে বুলেটদের ডিঙি মৌগাছার হাটে এসে পেছিলো।

মৌগাছা হাট বেশ বড়। এ-অঞ্চলে এত বড় হাট আর নেই। এখানে শীতকালে ধান-চালের কেনা-বেচা হয় খুব বেশী, পেঁয় হেতাল গাছের খুটি আর মধু বিক্ৰী হয় বারোমাস।

ভীম এর আগে একবার মৌগাছার হাটে এসেছিল–এদিককার পথ-ঘাট সে কিছু-কিছু চেনে।

হাটের পার-ঘাটায় সাহেবী পোষাক-পরা দুজন সহুরে ছেলের উপর দৃষ্টি পড়তে বহু লোক এসে তাদের ঘিরে কৌতূহলী দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো এবং নানারকম মতামত প্রকাশ করতে লাগলো।

বজ্র বললে– বুলেটকে–ভীমকে হাটে পাঠানো যাক, খাবার আর অস্ত্র-শস্ত্র যদি কিছু পাওয়া যায়, আনবে।

বুলেট বললে–অস্ত্র-শস্ত্র প্রকাশ্যভাবে বিক্রীর জন্য থাকে না। নিশ্চয়। থাকলেও কেনা ঠিক নয়। একে এ-সব অঞ্চলের লোকের সন্দিগ্ধ মন, তার উপর যদি ছেঁড়া কি সড়কি কেনা হয়–তাহলে পিছু নেবে।

বজ্র বললে–আমাদের দেখে এই হাটের লোকেরা কি কম আশ্চর্য হয়েছে। করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে তো আছেই।

বুলেট বললে–দেখো একটা কথা মনে হচ্ছে।

বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–কি?

বুলেট উত্তর দিলে–এ-পোষাকে আমাদের সেখায়ে যাওয়া চলবে। ভোল ফেরাতে হবে। তা না করলে ও-অঞ্চলের লোকদের সন্দেহ আর কৌতূহলের সীমা এমন হবে যে, আমাদের সঙ্গ ছাড়বে না। তা যদি হয় তো আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না।

বজ্র জিজ্ঞাসা করলে কি করতে বলে?

বুলেট বললে–কতকগুলি জামা-কাপড় আর জিনিষ কিনতে হবে। এক টুকরো কাগজ দাও, একটা ফর্দ করে ভীমকে দিই। ও হাটে গিয়ে খাবার আর সে-সব জিনিষ কিনে আনবে।

কাগজ ছিল না, বজ্র তার ডায়েরির একখানা পাতা ছিঁড়ে বুলেটকে দিলে। বুলেট পেনসিল দিয়ে ফদ তৈরী করে সে-ফদ আর একখানা দশটাকার নোট দিলে ভীমকে।

ভীম হাটে গেল।

সুন্দরবনের ম্যাপটাতে লক্ষ্য রেখে বজ্রকে বুলেট বললে–আমরা গন্তব্য স্থানের কাছাকাছি এসে পড়েছি, যদি ঝড়-তুফান না পাই, তাহলে সন্ধ্যের আগেই আমরা জগবন্ধুর চকে গিয়ে পৌঁছুবো। রাতটা ঐখানে কাটিয়ে ভোরবেলায় রাজপোতায় গিয়ে উঠবে। ওখানে অতিথির বা সাধু সন্ন্যাসীদের থাকবার জায়গা আছে, শুনেছি।

চারিদিকে ভালো করে চেয়ে চাপা-গলায় বজ্র জিজ্ঞাসা করলে–বাজপোঁতাতেই গুপ্তধন আছে, মনে হয়?

বুলেট বললে–আমার তো ধারণা সেই রকম। ওখানে কতকগুলো পুরোণো বাড়ীর ধ্বংস-স্তূপ পড়ে আছে। তবে নিশ্চিত বলা যায় না। ঐধর মাইতির বাড়ী থেকে যে ম্যাপখানা জোগাড় করেছি, সেটা ভয়ানক অস্পষ্ট সঙ্কেতে লেখা। ওখানে না গেলে সাঙ্কেতিক চিহ্নগুলির মানে আর গুপ্তধন কোথায় আছে বোঝা যাবে না।

বজ্র বললে–কিন্তু বুলেট, এই আকাট জঙ্গলে বাঘ, কুমীর আর ফেরারী আসামী ছাড়া কবে কোনো কালে কোনো রাজ-রাজড়া থাকতো, এমন মনে হয় না।

বুলেট বললে–গোড়ায় আমার তাই মনে হয়েছিল, তারপর এক ঐতিহাসিকের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা করতে তিনি বলেন, আগে অর্থাৎ সেন রাজাদের আমলে এসব অঞ্চলে জঙ্গল ছিল না, বড় বড় সহর ছিল, এখানে বহু লোকের বাস ছিল। রাজা সামন্ত ছিল, রাজ্যও ছিল। তারপর এ অঞ্চলে একবার ভীষণ ভূমিকম্প হয়, সেই ভূমিকম্পে এদিককার সব প্রায় ধ্বংস নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এদিক কার নদীগুলোর স্রোত নষ্ট হয়, মগ-ফিরিঙ্গি বোম্বেটেদের ভাষণ অত্যাচারও এ অঞ্চলের লোকালয় নষ্ট হবার কারণ। লোকালয় নষ্ট হলে এদিকটা জঙ্গলে ভরে ওঠে। এই জঙ্গলই হলো সুন্দরবন।

বজ্র বললে–সত্যি?

বুলেট বললে–যেখানে বড়-বড় লোকালয়, রাজারাজড়াদের গড়-বন্দী গ্রামের ধ্বংস, পাথরের মূর্ত্তি, বৌদ্ধ মঠের তূপ আজও দেখা যায়, সেখানে গুপ্তধন থাকা অসম্ভব হবে কেন?

বজ্র একটু চিন্তা করে উত্তর দিলে–সেকথা ঠিক।

বুলেট বললে–আর এই শ্রীধর মাইতির ব্যাপার থেকে আমার ধারণা, কলকাতার বাড়ীতে যাব দশ-বিশটা চাকর-দরোয়ান্… মহা ধনী লোক-কাকেও সঙ্গে না নিয়ে, কাকেও কিছু না বলে, একলা। কি জন্য এই গভীর জঙ্গলে তিনি এসেছিলেন? কিসের সন্ধানে? লোকটার এখানে কোন জমি বা জলা নেই। লোকটা তেমন লেখাপড়া জানে না…..মকুটেপানা মানুষ! ঐতিহাসিক নয়, কবি নয়–ওরকমের কিছুই নয় যে ভাবের প্রেরণায় বা কিছু আবিষ্কারের উদ্দেশে এসেছিল। তাই মনে হচ্ছে, শ্রীধর মাইতির এখানে আসার কারণ, ঐ মোহর বা গুপ্তধন নেওয়া। একটা মোহর তার লাশের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। আর ঐ ত্রিশূল-আঁকা ছোট সাইজের মোহর হিন্দু রাজাদের আমলের সহজেই তা বোঝ যায়। তাই থেকে মনে হয়, হিন্দু আমলের কোনো রাজা বা সামশুর বাড়ী ছিল এ অঞ্চলে এই সব গুপ্তধন তারই পরিত্যক্ত সম্পত্তি। শ্রীধর মাইতি সে গুপ্তধনের সন্ধান কি করে পেয়ে এদিকে এসেছিল তা নিতে…নিয়েও ছিল, কিন্তু কে বা কারা তাকে খুন করলো, তা বোঝা যায় না।

বজ্র বললে–আমার মনে হয়, শ্রীধর মাইতি ছাড়া অন্য লোকও এ গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে এসেছিল–আর সেই লোকই শ্রীধরকে খুন করেছে।

একটু ভেবে বুলেট বললে–সম্ভব!

ফর্দ্দমত জিনিষ নিয়ে এসে ভীম বললে–সব জিনিষ পাওয়া গেছে, তবে মুড়ি-মুড়কী আর বাতাসা ছাড়া অন্য খাবার পাওয়া গেল না।

বুলেট বলল-ওতেই হবে। তাড়াতাড়ি খেয়ে নিই, ভাঁটার টান হলেই আমরা যাত্রা শুরু করবো। শীতের উত্তরে-হাওয়া আর সাগরের দিকে জলের টান আমাদের সহায় হবে।

.

চব্বিশ পরগণা জেলার একেবারে শেষপ্রান্তে বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি সুন্দরবনের মাঝে রাজপোতা গ্রাম। এদিককার তুলনায় নেহাৎ খেলো নয়। গ্রামে পঁচিশ ত্রিশ ঘর কাওরা, তিয়র, হাড়ীর বাস; একটা মুদির দোকান আছে, গুরুমশাইয়ের পাঠশালা আছে, হরিসভা আছে, পুতুলনাচের দল আছে। শীতকালে নদীর ধারে ধান চালের হাট বসে হপ্তায় একবার করে।

গ্রামটা সেজন্য বিখ্যাত। এ গ্রামের নাম-ডাক আর প্রতিপত্তি কারণ হলো চামুণ্ডা দেবীর বিগ্রহ। এদিককার লোকেদের ধারণা, চামুণ্ডা দেবী জাগ্রত।

চামুণ্ডা-মূৰ্ত্তি আর তার মন্দির–দুইই পাথরের তৈরী। দেখলে বহু প্রাচীন কালো বলে মনে হয়। গ্রাম এখন জঙ্গলে ভরা হলেও সুদূর-অতীতে যে এখানে কোনো বিখ্যাত ধনী বা রাজা রাজড়া বাস করতো, কতকগুলো বিরাট-বিরাট ইটের স্তূপ দেখলে তো মনে হয়।

এখন এ গ্রামের মোড়ল বা মালিক কণ্ঠিভূষণ তলাপাত্র। বিগ্রহের পূজা করে এক তান্ত্রিক সন্ন্যাসী-ভৈরব। এ-অঞ্চলে বিশ মাইলের মধ্যে এই ভৈরবই একমাত্র ব্রাহ্মণ!

পৌষ মাসের শেষের দিকে গঙ্গাসাগর মেলার সময় বহু তীর্থযাত্রী, পথচারী আর সাধু-সন্ন্যাসী চামুণ্ডা দেবীর নাটমন্দিরে এসে দু-একদিন থেকে যায়। নাটমন্দির বেশ বড়, তার সঙ্গে দুখানা ঘরও আছে। ঘর দুটি আধুনিক কেতায় তৈরী!

সাগরের মেলার সময় এদিকে এবার খুব কলেরা হচ্ছিল, তাই চামুণ্ডা মন্দিরে তীর্থযাত্রীর সমাগম ঘটেনি।

হঠাৎ একদিন ভোরে তিনজন সন্ন্যাসী এসে সেই নাট-মন্দিরে উঠলো।

সন্ন্যাসীদের পরণে গেরুয়া আলখাল্লা, মাথায় বড় পাগড়ী। কপালে সিদূরের ফোঁটা-তিলক–সর্ব্বদেহে ছাই-মাখা।

শোনা গেল এঁরা কেও-কেটা বাজে সন্ন্যাসী নন–বিখ্যাত তান্ত্রিক শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ মহারাজ–সঙ্গে তার দুই শিষ্য।

শ্রী শ্রীকিলানন-মহারাজ দেখতে কমবয়সী হলেও তাঁর বয়স নাকি পাক্কা একশো তিন বছর ছমাস! মহারাজ থাকেন হিমালয়ের চূড়ায় এক বিখ্যাত তান্ত্রিক-পীঠে। গঙ্গা-সাগরে যাবার পথে চামুণ্ডা দেবীর সঙ্গে তিনি সাক্ষাৎ করতে এসেছেন। সিদ্ধপুরুষ, দেবদেবীর সঙ্গে হরদম কথাবার্তা হয় তার। মহারাজ প্রায় সব সময় মৌনী থাকেন–ক্কচিৎ কখনো দু-একটা কথা কন-তাও হিন্দীতে। সন্ধ্যার পর ছাড়া ঘর থেকে বার হন্ না–সব-সময়ে চিতাভস্ম মেখে থাকেন।

সশিষ্য শ্রীশ্রীকিলানন্দ মহারাজের আগমনে বাজপোঁতা এবং আশপাশের গ্রামের লোকজনের মধ্যে প্রচণ্ড সাড়া পড়ে গেল।

একে সাধু, তায় খাশ হিন্দুস্থানী। এমন সাধু এদেশে খুব কম আসেন। দেখতে বহু লোক আসা-যাওয়া আরম্ভ করলো। তাদের ভক্তিও বেশ গভীর, শুধু-হাতে কেউ বড় একটা আসে না দুধ, ঘি, ফলমূল অন্য কিছু-না-কিছু নিয়ে আসে।

মহারাজ এবং তার শিষ্য দুটি অতি নির্লোভ-তারা কারো কাছে কিছু প্রার্থনা করেন না–সারাদিন মন্দিরের মধ্যে পূজা, ধান আর ভজন গান করেন–দিনের আলোতে বার হন না, সারা দিন-রাতের মধ্যে মাত্র একবার সন্ধ্যার পর সাধারণকে দর্শন দেন কিছুক্ষণের জন্য। একটু রাত হলে আবার ঘরের মধ্যে গিয়ে গভীর সাধনা আরম্ভ করেন। মাঝের রাতেও তাদের ঘর থেকে ওঁ, হ্রিং, ফটফটায়ঃ ইত্যাদি শব্দ বার হয়।

শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ মহারাজ আর তার শিষ্য দু-জনকে গ্রামের মোড়ল কণ্ঠিভূষণ তলাপাত্র নিজের চণ্ডীমণ্ডপে এসে থাকবার জন্য বহু অনুনয়-বিনয় করলেন, মহারাজ কিছুতে রাজি হলেন না।

তার প্রধান শিষ্য বললে–তা হয় না মোড়ল মশাই। গুরুজী হলেন পরিব্রাজক–গৃহীর আশ্রয়ে প্রবেশ করবেন না। তাছাড়া উনি এখানে এসেছেন স্বয়ং মা-চামুণ্ডা দেবীর নিমন্ত্রণে। এখন যদি মন্দিরে না থেকে অন্যত্র গিয়ে ওঠেন, তাহলে চামুণ্ডা দেবী গোশসা করবেন। কাল রাত্রে চামুণ্ডা দেবীর সঙ্গে গুরুজীর অনেক কথা হয়েছে।

কণ্ঠিভূষণ নিরাশ হয়ে ফিরে গেল। এত-বড় সাধুকে বাড়ী নিয়ে গিয়ে তোয়াজ করতে পারলে সোনা-তৈরী-বিদ্যাটা শিখে নিতে পারতে! কণ্ঠিভূষণের ধারণা, বড়-বড় সাধু-সন্ন্যাসীদের মধ্যে কেউ-কেউ সোনা তৈরী করতে জানেন এবং তাদের তুষ্টি করতে পারলে তারা দয়া করে ভক্তদের সোনা-তৈরীর বিদ্যা শিখিয়ে দেন।

কণ্ঠিভূষণ সেজন্য সাধু-সন্ন্যাসী পেলে খুব তোয়াজ করে!

সন্ধ্যার পর ভক্তদের দর্শন আর ধর্মোপদেশ দান- তাদের আনা দুধ, ঘি, ফলমূল ইত্যাদি ভক্তি-উপহার গ্রহণ-পর্ব শেষ করে শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ মহারাজ আর তার শিষ্য দুজন মন্দিরের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালা হলো। শ্ৰীশ্ৰীকিলানন্দ মহারাজ পাগড়ী আলখাল্লা ছেড়ে ‘বুলেট’ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে–বজ্র আর ভীমও সাধুজীর ভোল পালটে নিজেদের আদিম কাপড় চোপড় পরেছে।

বুলেট চাপা গলায় বললে–কি আরামেই না আছি! দিব্বি ঘি, দুধ, মাছ, মাংস বিনা-পয়সায় মিলছে! আর কিছুদিন এই রকম ভোগে থাকলে দেহ ফুলে বেলুন হয়ে উঠবে!

র‍্যাগ মুড়ি দিতে-দিতে বজ্ৰ হেসে বললে–এ-অঞ্চলের লোকদের ভক্তি-শ্রদ্ধা আছে।

ভীম বললে–ভক্তি মোটে নেই, তবে সাধু-সন্ন্যাসী পেলে তাদের তুষ্ট করে নিজেদের কাজ বাগাবার জন্য। এ-অঞ্চলের প্রায় অর্দ্ধেক লোক ফেরার আসামী। চুরি-ডাকাতি বা খুন-রাহাজানী করে পালিয়ে এসে নাম ভাঁড়িয়ে আছে এই সুন্দরবনের অরাজক জায়গায়।

বজ্র বললে–লোকগুলোর চেহারা দেখলে তাই মনে হয়, বটে!

বুলেট বললে–চামুণ্ডাদেবীর পূজারী ভৈরব-লোকটা কি লম্বা চওড়া আর জোয়ান। চেহারায় সুপুরুষ হলেও মুখে-চোখে বাঘের হিংস্র ভাব-সাংঘাতিক লোক বলে মনে হয়

বজ্র বললে–আমারও তাই মনে হয়, বুলেট-থুড়ি, স্বামী। কিলানন্দজী।

হেসে ভীম বললে–আচ্ছা, বুলেটের নাম কিলানন্দ হলো কেন?

বজ্র বললে–বুলেটের মতো বক্সার কলকাতার স্কুল-কলেজে আর নেই। ঘুষোঘুষিতে নানা জাতের বহু ছাত্রের মধ্যে তিনবার ও ফার্ষ্ট হয়েছে, তাই আমি ওর নাম দিয়েছি ‘কিলানন্দ’।

বজ্রের কথায় সকলে হাসতে লাগলো।

ভীমকে বুলেট বললে–বজ্রও কম যায় না, জিউজুৎসুতে মোক্ষম প্যাঁচের অমন ওস্তাদ আর দুজন পাবে না।

ভীম বললে–সেদিন যখন শড়কী নিয়ে অসুরের মতো সর্দ্দার টাকে এক প্যাঁচে তিন হাত তফাতে ছিটকে ফেলে দিলে, তখনি বুঝেছি–বজ্র সাংঘাতিক ছেলে।

.

রাত অনেক হয়েছে। দরজার ফাঁক দিয়ে বস্ত্র বাইরের দিকে একবার ভালো করে দেখে ফিরে এসে চাপা-গলায় বুলেটকে বলে কি বুঝলে, ঠিক জায়গায় এসেছি তো?

ব্যাগ থেকে হাতে-আঁকা ছোট ম্যাপ বার করে বুলেট বললে–আমার মনে হয় ঠিক জায়গায় এসেছি। তুমিও ম্যাপটা ভালো করে দেখ।

প্রদীপের পলতে উস্কে দিয়ে আলোটা জোরালো করে বজ্র আর বুলেট দুজনে বেশ ভালো করে দেখতে লাগলো।

একটু পরে বুলেট বললে–এ-ম্যাপটা বহু কষ্টে শ্ৰধর মাইতির বাড়ী থেকে জোগাড় করেছি। এর সাঙ্কেতিক অক্ষরগুলির মানে আগে বুঝতে পারিনি, এখানে এসে বুঝেছি। সাঙ্কেতিক অক্ষর থেকে যা-যা বুঝতে পেরেছি–তাতে আশা হচ্ছে। গ্রামটা আজ প্রদক্ষিণ করতে বেরিয়েছিলুম এই উদ্দেশ্যে।

–এই দেখ, ম্যাপের নীচে লেখা ‘জে-আর’–এ-থেকে আমি মানে করেছি জামিরা রিভার। জামিরা নদী। নদীটা এই গ্রামের ঠিক দক্ষিণে। ম্যাপটার দু-পাশে লেখা রয়েছে—’এস-ভি’ আর ‘এন-ভি’। আমার মনে হয় ‘এস-ভি’ হলো, সাধুর-চক ভিলেজ, আর ‘এন-ভি’ নলখালি ভিলেজ। এ-গ্রামের পূবে সাধুর চক, পশ্চিমে নলখালি আর ম্যাপের ঠিক মাঝখানে এই তারার চিহ্ন দেখে মনে হয়, এজায়গায় গুপ্তধন আছে।

ম্যাপটার দিকে তাকিয়ে বজ্র বললে–আমার মনে হয়, তোমার ধারণা ঠিক। কিন্তু এ-তারার চিহ্নটাই বা কি? যেখানে গুপ্তধন আছে–সে-জায়গা বোঝাচ্ছে?

বুলেট বললে–আমার তাই মনে হয়। আরও মনে হয়, গুপ্তধন আছে এইখানেই অর্থাৎ এমন্দিরের আশপাশে খুব কাছে।

বজ্র বললে–তা হতে পারে।

ম্যাপখানা জামার পকেটে রেখে বুলেট বললে–চটপট খুঁজে বার করতে হবে। আর রাত থেকে কাজ আরম্ভ করবে। শেষ রাত্রে ক-জনে বেরিয়ে প্রথমে এ-মন্দিরের আশপাশগুলো ভালো। করে দেখতে হবে। এসো, এখন ঘুমোই–রাত চারটেয় উঠবে।

ভীম বললে–ভাঙ্গা ইটের বোঝা–এর মধ্যে এখন শীতকালে সাপ-খোপ নেই হয়তো–শীতের সময় ওরা গর্ত ছাড়া আর কোথাও থাকে না। তবে বাঘ থাকা সম্ভব।

বুলেট বললে–মন্দির থেকে খাঁড়াটা নিয়ে বেরুতে হবে। সুন্দরবনে এসে বাঘের ভয় করলে চলবে না।

***

সুন্দরবনের প্রায় জনহীন এ জায়গা-রাত্রে কিরকম নিঝুম নিস্তব্ধ-না দেখলে বোঝা যাবে না। চলতে ফিরতে গা ছমছম করে। কেবলি মনে হয়, বিপদ যেন চারিদিকে নানা মূর্ত্তিতে ওৎ পেতে আছে! কুয়াশায় আকাশ ভরে গেছে–এমন অন্ধকার যে, গাছপালা-নদী-জলা গায়ে মিশে একাকার…..কোটা কোথায় সুরু হয়েছে আর কোথায় বা তার শেষ–কিছুই ঠাহর হয় না।

চামুণ্ডা দেবীর নাটমন্দিরের বড় একটা ঘরে বজ্র আর ভীম ঘুমিয়ে আছে। বুলেটের চোখে ঘুম নেই। এমন কখনও হয় না। খানিক আগে তার ঘুম ভেঙ্গে গেছে–শত সাধনাতেও ঘুম আর আসছে না। হঠাৎ কোথায় একটু যেন শব্দ হলো–খুব মৃদু শব্দ। কানে সে স্পষ্ট শুনলে! কেমন সন্দেহ হলো! কান পেতে রইলো সে–শব্দ সমানে চলেছে! কিসের শব্দ। মনে হলো, কে যেন তাদের ঘরের পাশ দিয়ে খুব সাবধানে পা টিপে-টিপে চলছে।

বজ্রকে বুলেট আস্তে-আস্তে জাগিয়ে তুললো–খুব চাপ-গলায় বললে–কান পেতে শোনো, কে যেন ঘরের বাইরে চলা-ফেরা করছে।

কিছুক্ষণ কান পেতে থেকে বজ্র বললে–এত রাত্রে মানুষ কে আসবে? বোধ হয়, বাঘ!

বুলেট বললে–উঁহু! বাঘের চলার কায়দা আলাদা। ওদের চলায় থপথপ শব্দ হয়। বাঘ বা আর কোনো জানোয়ার নয় মানুষ নিশ্চয়।

সোয়েটার পরতে-পরতে বুলেট বললে–ভীম ঘুমোচ্ছে–ঘুমোক। তুমি এসো, দেখা যাক–কিসের শব্দ!

চকিতে দুজনে নাটমন্দিরের ভারী দরজাটা আস্তে আস্তে খুলে শব্দ লক্ষ্য করে পা টিপেটিপে জমাট অন্ধকারে বেরুলো।

***

বোধহয় মাঝ-রাত্রি! আস্‌শেওড়া, বোঁচ, উলির ঝুপি জঙ্গল আর শ্যাতলাধরা ইটের বোঝা–তার মাঝখান দিয়ে পায়ে-চলা আঁকা-বাঁকা সরু পথ–নিকষ-কালো অন্ধকারে ঢাকা।

একটা লোক সে-পথে চলেছে আস্তে আস্তে অতি সাবধানে–সঙ্গে আলো নেই। সারা দেহ কালো কম্বলে ঢাকা, হাতে বাধ-মারা কাটা-মুগুর। খানিকটা যাবার পর একটা ভাঙ্গা ঘরের সামনে বাড়িয়ে বেশ করে চারিদিকে কি দেখতে লাগলো।

ছোট ছোট লাল ইটের তৈরী অতি জীর্ণ ঘর–দেখলে মনে হয়, কত শতাব্দীর ঝড়-জল-রৌদ্র তার উপর দিয়ে বয়ে গেছে–ছাদের এতটুকু মাত্র আছে, বাকি কবে ধ্বসে পড়ে গেছে! খিলান দেওয়াল ফেটে গেছে দু-তিন জায়গায়। সে-সব ফাটলে বড় বড় বট অশথ ডালপালা-ঝুরি মেলে ঘরটাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ঘরের প্রায় কার্নিশের কাছে ছোট একটা জানলা, আর তার ঠিক নীচে দরজা। দরজাট। ছোট, কিন্তু শক্ত। কপাটের গায়ে আঁটা বড়-বড় লোহার গুল। গুলগুলো মজবুত আছে এখনো।

আর একবার সবদিক ভালো করে দেখে লোকটা দেশলাইয়ের কাঠি জ্বাললো। অস্পষ্ট আলোয় দেখা গেল দরজার পর ছোট ছোট ধাপ, ধাপগুলো নীচে নেমে গেছে…একটা সুড়ঙ্গ! সুড়ঙ্গটা বেশ চওড়া আর লম্বা। শেষ প্রান্ত থেকে আলোর ক্ষীণ রশি আসছে। লোকটা সে-আলো লক্ষ্য করে সুড়ঙ্গের মধ্যে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলে–খিল দিলে না। বোধ হয় খিল নেই কিন্থা খিল আটকাবার দরকার নেই, বোলে।

আলো নিভিয়ে লোকটা ঘরে ঢোকবার পরই বুলেট এবং বজ্র দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো।

চাপা গলায় বজ্রকে বুলেট বললে–ওকে চিনতে পেরেছো? বজ্র উত্তর দিলেই, গায়ের মোড়ল কন্ঠিভূষণ তলাপাত্র!

কপাট বন্ধ করলেও কপাট দুটোর মধ্যে ইঞ্চিখানেক ফাঁক–বুলেট সেক দিয়ে সুড়ঙ্গের মধ্যে নজর চালিয়ে বললে–সুড়ঙ্গের ভিতর দু-তিনজন মানুষ–কিসের আলোচনা চলেছে। আমি ওদের দেখি, তুমি নজর রাখে–এদিকে কেউ আসে কিনা!

ঘন অন্ধকার। সুড়ঙ্গের এক কোণে একটা মোমবাতি জ্বলছে–ক্ষীণ আলো–সে-আলো ঘিরে তিনজন লোক কিসের আলোচনা করছে। আলোচনাটা বেশ গরম গরম–মাকে বলে, বচসা!

কণ্ঠিভূষণ আসামাত্র একজন বেশ কড়া গলায় বললে–এই যে মোড়লমশা, আমার কি বেবস্থা করলেন? আমি সবুর করবে না।

লোকটা বাংলা কথা বললে–ও বাঙ্গালী নয়, ছাপরা বা দ্বারভাঙ্গ। অঞ্চলের লোক–হিন্দুস্থানী। যেমনি লম্বা চওড়া তেমনি কদাকার-–দু-চোখের একটা ছানিপড়া, অন্যটা জবাফুলের মতো লাল টকটক করছে, মুখে বসন্তর দাগ–তাছাড়া কটা চোট-জখমের চিহ্ন–গলার আওয়াজ অতি কর্কশ। কথাটা বলে সে কণ্ঠিভূষণের দিকে চেয়ে রইলো।

পাথরের দেওয়ালে ঠেশ দিয়ে বসে কণ্ঠিভূষণ বললে–মা চামুণ্ডার দিব্বি, মাল-বেচার একটি পয়সা এখনও হাতে আসেনি–এলে তোমাকে কিছু দেবো, তুমি ভেবো না খড়্গধারী, তোমাকে আমি বঞ্চিত করবো না।

বিরক্ত হয়ে খড়্গধারী বললে—মাল-বেচার টাকা যদি না এসে থাকে, তোমার ঘরের তবিল থেকে আমার বখরা দিয়ে দাও। আমি আজ রূপেয়া না নিয়ে যাবো না!

রাগ হবার সঙ্গে-সঙ্গে খড়্গধারীর মুখে মাতৃভাষা বেরুতে লাগলো।

কণ্ঠিভূষণ বললে–এখন আমার বিলে কিছু নেই।

অত্যন্ত রেগে খড়্গধারী বললে–জুয়াচোর! চোট্টা কাঁহেকা! তুঁহার তহবিলমে কুছ নেই? তুর হাজার হাজার রূপেয়া চোটা খাটছে! দু’শো মণ ধান, ত্রিশ কাহন খড় উদিম বিকিয়েসে, আর বোলতা, হামারা তবিল নেই। জুম্নচোর বাঙ্গালী! হামি যান্তি বাত কহনে নেই মাংতা, তুম সাফ বাতাও–দেগা? কি, নেহি দেগা?

কণ্ঠিভূষণ দৃঢ় স্বরে বললে–তুমি চাও কত?

খড়্গধারী বললে–দে। হাজার।

বিস্মিত কণ্ঠে কণ্ঠিভূষণ বললে–দু-হাজার টাকা। ইস! এত টাকা পাবার মতো কি কাজ করেছো তুমি, শুনি?

খড়্গধারী বললে–হাম কি করিছে, তুম জানতা নেহি, বেইমান? হাম তোমার মাল আচ্ছা ভাওসে বিকিয়েসে। মালুম নেই, তুম পান-রূপেয়া ভরি সোনা ছেড়েছে, হামি বারা রূপেয়া করকে তোমার একশ বিশ ভরি সোনা কিনিয়ে, শ্ৰীধরকে কলকাত্তামে হাম আনিয়েসিল, উনকে খুন করিয়ে টাকা ছিনিয়ে নিবার মতলব হাম দিয়েছিল, যো-যো চিজ বিক্রী হলো তা মিলল, রূপেয়া বি মিলল–সব হামসে–আর আজ তুম বোলতা–কি করিয়েসে!

খড়্গধারী রাগে গরগর করতে লাগলো।

কণ্ঠিভূষণ দৃঢ়স্বরে বললে–শ্রীধরকে যে-টাকার মাল বিক্রী করা হয়েছিল, তার বখরা তুমি পেতে পারো। কিন্তু আমি নিজের হাতে তাকে খুন করে যে-টাকা আর বিক্রী-করা মাল ফিরে পেয়েছি, সে-সব আমার–তা থেকে তুমি ভাগ চাও কি বলে?

খড়্গধারী রাগে খাপ্পা হয়ে উঠলো। সে বললে–চাই কি করে? এইসা চাহি–আলবৎ চাহি!

কণ্ঠিভূষণ দৃঢ় কণ্ঠে বললে–না! ও-টাকার একটা কাণা কড়িও আমি তোমায় দেবো না।

খড়্গধারীর চোখ দুটো বাঘের চোখের মতো জ্বলে উঠলো। খুনোখুনি লাগে আর কি!

ঘরের কোণে একজন এতক্ষণ চুপ করে বসেছিল। দুজনের সামনে হাত জোড় করে সে বলে উঠলো–দোহাই বাবা, মা চামুণ্ডার দোহাই, থামো! এ-সময়ে নিজেদের মধ্যে ঝগড়াঝাটি করলে লোকসান ছাড়া লাভ নেই! মা চামুণ্ডা ভৈরবীর কৃপায় অফুরন্ত গুপ্তধনের সন্ধান পেয়েছি। যদি উদ্ধার করতে পারি, আমরা লাখো-লাখো টাকার মালিক হয়ে যাবে। এ আমরা সকলেই পাবে–কেউ কাকেও ঠকাবে না। ব্যবসা করতে বসে ঠকানো চলে কখনো? সকলে মিলে-মিশে কাজ চালাতে হবে তো। সকলেই এ-ব্যাপারে কিছু-না-কিছু করেছি। প্রথম এ-ধনের সন্ধান পায় ভৈরব, আমি আর দুজন তখন ওর সঙ্গে ছিলুম। আমাদের চারজনের দ্বীপান্তরের হুকুম হয়েছিল, আন্দামানে নিয়ে যাবার আগের দিন ভৈরবের পরামর্শে আর সাহায্যে আলিপুর জেল থেকে পালিয়ে সোজ। সুন্দরবনে এসে এই সুড়ঙ্গের মধ্যে লুকোই। ভৈরব আগে থেকেই জায়গাটার কথা জানতো। সে কি করে এখানকার গুপ্তধনের সন্ধান পায়– আমাদের চারজনকে সে তা বলে। আর দুজন বেইমানী করেছিল বলে ভৈরব দুটোকেই সাবাড় করে এখানে পুতে ফেলে। তারপর ভৈরব এখানে চামুণ্ডা দেবীর পুরুত সেজে রয়ে গেল। কণ্ঠিভূষণকে ভৈরব দেয় গুপ্তধনের সন্ধান–তাকে বখরাদারও করে নেয়। কণ্ঠিভূষণের এখানে ভয়ানক প্রতিপত্তি! ওকে না হলে চলবে না। তাই ওকে দলে নেওয়া হয়। আর মাল বিক্রী করার জন্য খড়্গধারীকেও দলে নেওয়া হয়। ভৈরব ওকে আগে থেকে চিনতো। তাহলে বোকো–আমাদের সকলেরই দায়িত্ব কতখানি। ভাগ পাবো ন্যায্য মতো আর মিলে-মিশে। কাজও করতে হবে। ফেরার আসামী, খুব সাবধানে আমাদের চলতে হবে। একটু বেসামাল হলেই পুলিশ জানতে পারবে। তাহলে কি হবে, সে-কথা আর বলতে হবে না। তাই বলি বাবা, ঝগড়াঝাটি নয়–অন্যায় বোঝো–ভৈরবকে বলো–সে করুক বিচার। সর্দ্দার বলে ওকে মেনে নিয়েছি–ওর কথা শুনতে আমরা বাধ্য।

ফেরার আসামী আর ডাকাত হলেও লোকটার বিবেচনা আছে। লোকটার নাম হারাণ, একটা হাত কাটা, বুড়ো হয়েছে। দিনের বেলায় পাগল সেজে থাকে।

টাকার একটা থলি হাতে নিয়ে ভৈরব আলোর সামনে বললো।

ভৈরবকে হারাণ বললে–একটা বিচার করতে হবে, সর্দ্দার।

তার কথার উত্তর না দিয়ে গম্ভীরভাবে বসে ভৈরব থলি থেকে মোহর নিয়ে গুণে ভাগ করে থাক্‌ দিয়ে রাখতে লাগলো।

কথার জবাব না পেলেও হারাণ সংক্ষেপে কক্টিভূষণ আর খড়্গধারীর ঝগড়ার ব্যাপার ভৈরবকে বললে–।

মোহর গোণা আর ভাগ করা শেষ হলে কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারীর দিকে চেয়ে গম্ভীরভাবে ভৈরব বললে– তোমরা যা বলতে চাও, এক-এক করে বলল।

কণ্ঠিভূষণ প্রথমে বললে–গুপ্তধনের সম্বন্ধে যে-ব্যবস্থা তুমি করেছিলে, তা মানতে রাজী আছি। যে যেখান থেকে যা-কিছু পাবে, সকলকে তার ভাগ দেবে। কিন্তু শ্ৰীধরের খুনের ব্যাপার সম্পূর্ণ আলাদা-তার সঙ্গে আমাদের এ-কাজের কোনো সম্পর্ক নেই, খড়্গধারীকে তাই আমি এক পয়সা দিতে চাই না।

কণ্ঠিভূষণের কথা শুনে খড়্গধারীকে ভৈরব বললে–তোমার কি বলবার আছে?

খড়্গধারী তখনও রাগে ফোঁস-ফোঁস করছে। সে বললে– হামারা দোসরা বাতচিৎ নেহি হ্যায়, হামকো দো-হাজার রূপেয়া দেনে হোগা, বাস!

কণ্ঠিভূষণ বললে–তাহলে একটি আধলাও দেবো না।

রেগে খড়্গধারী বললে–কেয়া নেহি দেগা? বলেই ভোজালি নিয়ে কণ্ঠিভূষণের দিকে এগিয়ে গেল, কণ্ঠিভূষণও তার ধারালো টাঙ্গি নিয়ে খড়্গধারীর মাথা লক্ষ্য করে কোপ মারবার উদ্যোগ করতে দুজনের মধ্যে দাঁড়িয়ে ভৈরব ভীষণ ধমক দিয়ে উঠলো–খবর্দার! চুপ–একদম চুপ।

ভৈরবের ধমক নয়, গর্জ্জন! সুড়ঙ্গের মধ্যে হঠাৎ যেন বাজ পড়লো।

খড়্গধারী আর কণ্ঠিভূষণকে চুপ করতে হলো। ভৈরবের গর্জনে সুড়ঙ্গের মধ্যে কতকগুলো চামচিকে ভয় পেয়ে ঝটপট করতে করতে খানিকটা দূরে গেল সরে।

খড়্গধারী আর কণ্ঠিভূষণের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাত দিয়ে ভৈরব দুজনকে বিপরীত দিকে সরিয়ে দিলে। ভৈরবের হাতে অস্ত্র শস্ত্র নেই, শীতের রাত হলেও গায়ে জামা নেই, শুধু একটা আলোয়ান ছিল, তাড়াতাড়িতে সেটা মাদুরের উপর ফেলে এসেছে।

ভৈরব লোকটার চেহারা দৈত্যের মত! লম্বা চওড়া জোয়ান–গায়ে বেশী মাংস নেই–প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ লোহার মত শক্ত পেশীতে ভরা। লোকটা যে ভীষণ, দেখলেই বোঝা যায়। মাথার চুলগুলো বড় বড় কোকড়ানো-রং এককালে বেশ ফর্শা ছিল, এখন এ-বয়সে নানা কারণে তামাটে হয়ে গেছে-মুখ-চোখ দেখলে তাকে শুধু ভীষণ বলে মনে হয় না–এককালে বহু দুর্ধর্ষ ডাকাত আর বদমায়েসের উপর হুকুমদারী করেছে তাও বেশ বোঝা যায়! প্রৌঢ়-বয়সে এখনও শক্তি আর সাহস অসাধারণ। নাহলে খালি হাতে খুনোখুনির মাঝে বুক ফুলিয়ে কেউ দাঁড়াতে পারে?

খড়্গধারী আর কণ্ঠিভূষণকে লক্ষ্য করে ভৈরব বললে– গম্ভীর কণ্ঠে–আমি সর্দ্দার, আমার কথা তোমাদের মানতে হবেই! দলের কেউ আমার কথা না শুনলে তাকে বাঁচিয়ে রাখা চলে না। এই সেদিন আমার কথা মানেনি বলে দুটো গুণ্ডাকে মেরে এইখানে পুঁতেছি–এখনও তাদের হাড় বোধহয় মাটিতে মিশে যায়নি! আমার বিচার ন্যায্য হবেই। কাকেও খাতির বা ভয় করি না, আমি। শোনো কণ্ঠিভূষণ, তুমি গ্রামের মোড়ল, জমিদার, হাতে দু’শো বাদী ডাকাত আছে, টাকাও আছে, তা বলে আমি তোমাকে গ্রাহ্য করি, ভেবো না। আর খড়্গধারী, তুমি ওস্তাদ পালোয়ান হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তোমাকে ভয় করি না। তোমাদের মত দুটোকে এই শুধু হাতেই গুঁড়িয়ে ধূলো করে দিতে পারি, এখনো আমার সে তাকৎ আছে। দরকার হলে অর্থাৎ আমার কথা না মানলে বাধ্য হয়ে তোমাদের সম্বন্ধেও আমাকে তাই করতে হবে। আজ পুলিশের চোখ এড়িয়ে আমি চামুণ্ডাদেবীর পুরুত সেজে আছি, কলকাতার হাঁদু-গুণ্ডার নাম শুনেছো? যার ভয়ে পুলিশ-কমিশনারের পর্যন্ত্য বুক কাঁপতে-বড় বড় পাঠানী পালোয়ানরাও যাকে বাঘের মত ভয় করতে–আমি সেই হাঁদুগুণ্ডা!

ভৈরবের কথায় সেখানকার সকলে শিউরে উঠলো! ভৈরব বললে–জেলে কখনও আমাকে দু’চার দিনের বেশী কেউ আটক রাখতে পারেনি। আমার উপর দু’দুবার দ্বীপান্তরের হুকুম হয়েছিল। প্রথমবার টাকার জোরে পালিয়ে আসি। দ্বিতীয়বারে জেলের ওয়ার্ডারকে গলা টিপে মেরে পাঁচিল টপকে সরে পড়ি। আমি হাঁদু-গুণ্ডা!

কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারী একেবারে ঠাণ্ডা! রাজপোতা গ্রামের দুর্দান্ত জমিদার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা বহু ডাকাত আর বাদী লেঠেলের সর্দ্দার কণ্ঠিভূষণ বললে–কি করতে হবে?

ভৈরব বললে–তুমি খড়্গধারীকে এক হাজার টাকা এখনি দেবে, আর খড়্গধারী তুমি ভয়ানক হামবড়া,-তুমি ভাবো, হিন্দুস্থানী, তাই মস্ত পালোয়ান! আমার একটা রদ্দা খেলে জীবনে আর উঠতে পারবে না। যাক, তুমি যদি ওই এক হাজার টাকা নিয়ে তোমার দাবী না মিটিয়ে ফেল–আর কণ্ঠিভূষণ এখনি এক হাজার টাকা যদি না দেয় তো এই মুহূর্তে তোমাদের একজনের নিশ্চিত মৃত্যু।

সুড়ঙ্গের আবহাওয়া গমগম করছে, দু’চারটে চামচিকে, বাদুড় এদিক-ওদিক ফরফর করে উড়তে লাগলো।

কোঁচার কাপড় থেকে কণ্ঠিভূষণ একশো টাকার দশখানা নোট…বার করে ভৈরবের হাতে নোটের তাড়া দিলে ভৈরব খড়্গধারীর দিকে চাইলো।

খড়্গধারী লোকটা অত্যন্ত বদ-গায়ে খুব জোর–আর তার মুখে চোখে হিংস্র ভাব! ভৈরবের পানিতে সে কেঁচো। ভৈরবের হাত থেকে টাকা নিয়ে না গুণেই বেনিয়নের পকেটে পুরতে পুরতে সে বললে–তুমহার মর্জ্জি।

কথাটা বলে গভীর একটা নিশ্বাস ফেললো।

মোম বাতিটার পরমায়ু শেষ হয়ে এসেছে, ভৈরবের অনুচর হারা। আর একটা বাতি জ্বেলে একখানা ইটের উপর বসিয়ে দিলে! ভৈরব আগের জায়গায় এসে বসলো,–কণ্ঠিভূষণ ঠিক তার পাশে বসলো,–খড়্গধারী আর হারাণ একটু তফাতে গিয়ে তামাক খেতে লাগলো।

একটা কাগজে পেনসিল দিয়ে কি লিখতে লিখতে ভৈরব খড়্গধারীকে উদ্দেশ করে বললে—গেল চালানের মোহর কতয় কাটালে?

খড়্গধারী কোমর থেকে লম্বা থলি বার করে ভৈরবের হাতে দিয়ে বললে– তিন হাজার পঁচপন।

ভৈরব থলির টাকা মাদুরের উপর ঢাললো। সব টাকা,–একখানাও নোট নেই,–সেদিকে চাইতেই সকলের চোখে-মুখে খুশীর আভাস দেখা গেল।

ভৈরব বলে–এবার তাহলে ভালো দামেই কেটেছে!

গর্ব্বিত ভাবে খড়্গধারী বললে–আরে মুশয়, হামি দশ রকম কাম করছি। এক বড়বাজার বাঁশতলাতেই চোরাই মাল গন্ত করনেও পচাশ ঘরে আমার স্বাতে যাতে হোয়।

খড়্গধারী ঘোঁৎ-ঘোৎ করে হাসতে লাগলো। খড়্গধারীর হাসিও

মোহর বিক্রির টাকা ভৈরব ভাগ করে যার যা বখরা দিয়ে দিলে–কোনো গোলযোগ নেই! মনে হলো সকলেই খুশী।

রাত অনেক হয়েছিল–বোধ হয়, একটা। শীতের রাত। বহুদিনের পুরোনো সুড়ঙ্গের স্যাঁতসেঁতে ঠাণ্ডায় সকলে কেঁপে উঠছিল। কণ্ঠিভূষণ আগুনের মাল নিয়ে নিজেকে গরম করছে। ভৈরব সবশেষে নিজের ভাগের টাকাগুলি মাদুর থেকে নিয়ে কাপড়ের খুটে বেঁধে তারপর বললে–এবার আমি নতুন গুপ্তধনের সন্ধান দেবো তোমাদের। মনে হয়, উদ্ধার করে ভালো দামে বিক্রি করতে পারলে প্রত্যেকে লক্ষলক্ষ হাজার টাকা পাবো।

দলের সকলে উৎসুক হয়ে ভৈরবের দিকে তাকিয়ে। সুড়ঙ্গের প্রায় শেষে একটা বড় পাথর পড়ে আছে। সেই দিকে দেখিয়ে ভৈরব বললে–ওই পাথরটার নীচে আর একখানা সিন্দুকের সন্ধান পেয়েছি। সিন্দুকটার দু-এক জায়গায় অল্প-অল্প ফেটে গেছে–সেই ফাটা দিয়ে লক্ষ্য করে আমি দেখেছি, ওর মধ্যে শুধু মোহর নয়; হীরা-পান্নাও আছে। এই সিন্দুকটা কাল রাত্রে ভাঙ্গা যাক– তোমরা সবাই হাজির থাকবে।

কণ্ঠিভূষণ একটু অধীর প্রকৃতির মানুষ। সে বললে–আজই হোক না। আমরা সবাই আছি।

ভৈরব বললে–আজ যন্ত্রপাতি নেই, সিন্দুক খুব সাবধানে ভাঙ্গতে হবে। সেজন্য দু-তিনটে ছোট-ঘোট শাবল দরকার–সাবধানে না ভাঙ্গলে দামী-দামী পাথর নষ্ট হয়ে যাবে। তাই বলছি, কাল দিনমানে শাবল তৈরী করিয়ে রাত্রে কাজ করতে হবে।

খড়্গধারী বললে–ঠিক, ঠিক, ভৈরবজি, আচ্ছা বাত বলিয়েছে, যাতে চীজ, সব বরবা না-হোয়,জরুর দেখতে হবে।

কণ্ঠিভূষণ বললে–সকাল বেলায় দুটো শাবল করিয়ে নেবে, ঘরে লোহা আছে, দেশে কামারেরও অভাব নেই।

কণ্ঠিভূষণের কথায় বাধা দিয়ে ভৈরব বললে–এই বুদ্ধি নিয়ে মোড়লমশাই এ-পথে এসেছে। মোল আনার জায়গায় বত্রিশ আনা হুঁশিয়ার হয়ে এ-পথে চলতে হয়। হঠাৎ দু’-তিনটে শাৰণ একদিনের তাগিদে বানাতে দিলে কামারের মনে সন্দ হবে না? ভিন জায়গা থেকে বানাতে হবে। আমরা বাগবাজারে ডাকাতি করবার সময় চন্দননগর থেকে ছোরা আর ব্যারাকপুর থেকে টর্চ কিনেছিলুম। তারপর গড়ের মাঠে সব জমা হয়ে কালীঘাট ঘুরে বাগবাজারে গিয়েছিলুম। বুঝলে মোড়লমশায়, এসব ভারি হুঁশিয়ারীর কাজ। পুলিশকে ভয় তত নয়, যত ভয় এমনি লোককে। পুলিশ পাছু নিলে বোঝা যায়–কিন্তু এমনি লোক লক্ষ্য করছে কিনা, ধরা যায় না।

কণ্ঠিভূষণ বললে–সে কথা ঠিক।

স্থির হলো, তিন মাইল দূরে একটা হাট আছে, ভোরে সেখানে মোড়লের লোক গিয়ে শাবল কিনে নিয়ে আসবে। আসবার সময় সোজা পথে সে আসবে না, একটু ঘুরে আসবে, রাতের অন্ধকার হলে–তবে।

ভৈরব উঠে দাঁড়ালে–দাঁড়িয়ে বললে–বেশ, এই কথা কইলো, কাল রাত দুপুরে আমরা সবাই এখানে জমা হবে, তারপর কাজ।

খড়্গধারী বললে–হামিও কাল সঁঝের মধ্যে গঙ্গাসাগর তীরথ, সেরে আসি। গঙ্গাসাগর বড়া ভারী তীরথ,!

খড়্গধারীর তীরথ্‌ প্রীতি দেখে সকলে না হেসে থাকতে পারলো না।

সভা ভঙ্গ হলো।

***

ওঁ-হ্রী-ফট্‌ফটায় … বোধহয়, মাঝ রাত্রি। চামুণ্ডা ভৈরবীর নাট মন্দিরের ধরে ঐকিলানন্দ মহারাজ ধুনি জ্বালিয়ে সশিষ্য গভীর তন্ত্র সাধনা করছেন। পা টিপে টিপে সেই ঘরের পাশ দিয়ে যেতে-যেতে কণ্ঠিভূষণ তার দলের লোকদের বললে–এরা বেশ উঁচু-অঙ্গের সাধক, দেখেচো, সারা দিন-রাত সাধন করে।

খড়্গধারী বললে–এরা সোনা বানাতে জানে?

কণ্ঠিভূষণ বললে–এদের ঐ মহারাজটা জানে। তার বড় চেলার কাছে শুনেছি। ও কিন্তু কিছুতেই স্বীকার করতে চায় না। তোয়াজ করেছি কম!

ভৈরব বললে–সোনা বানাতে জানা বাজে কথা। আমি সাধু-সন্ত ঢের দেখেছি, পর-পর তিনখানা ওয়ারেণ্ট বার হবার পর, আমিও সাধু সেজে কত সাধু-সন্ন্যাসীর আড্ডায় ঘুরেছি। দেখেছি অনেক। ওদের বেশীর ভাগ আমাদের মত ফেরারী আসামী-দু একজন ভিখ না পেয়ে ভেক নিয়েছে। এমনি দশাটা লোকের মাঝে একটা ভালো পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু সাধুদের হাজারটার মধ্যে ভালো লোক একটা মেলে কিনা সন্দেহ।

খড়্গধারী বললে—ঠিক—ঠিক–বাংলা মুল্লুকে সাঁধু হোয় না।

****

রাত প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

ভৈরবের দল অনেকক্ষণ চলে গেছে।

বজ্র বললে–এত সহজে গুপ্তধনের সন্ধান পাবো, কল্পনা করতে পারিনি।

বুলেট বললে–সেকথা একশো বার! কিন্তু মনে রেখো, এখনই ওদের কবল থেকে এই গুপ্তধন সব সরাতে হবে। সময় খুব কম। এখন থেকে কাল সন্ধ্যা পর্যন্ত্য সময়–যা করবার, এর মধ্যে করতে হবে।

ভীম বললে–সিন্দুকটা ভাঙ্গা যাবে কি করে? শাবল নেই–অন্য কোনো যন্ত্রপাতিও নেই।

শড়কীটা দেখিয়ে বুলেট বললে–এটা দিয়ে নিশ্চয় সিন্দুক ভাঙ্গা যাবে।

বোধ হয়-হতে পারে-হয়তো–এ-সব কথা বুলেট বলে না। সবসময় নিজের ক্ষমতায় তার গভীর বিশ্বাস।

বজ্র বললে–বেশ, তাই করা যাবে।

বুলেট বললে–করা যাবে নয়! বলো, এখনই করব। ভীম তুমি ঘরে থাকে, বজ্র তুমি রেডি হও, এখনি বেরুতে হবে।

সোয়েটার গায়ে দিয়ে বজ্র বললে–রেডি।

শড়কীটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে হঠাৎ থেমে বুলেট বললে– রাত শেষ হয়ে গেছে–সকাল হতে দেরী নেই।

বজ্র বললে–সকাল হলেই মন্দিরে ভৈরব আসবে, তখন যদি সিন্দুক ভাঙ্গা হয়, তাহলে মন্দির থেকে সে শব্দ শোনা যাবে।

বুলেট ফিরে এলো। এসে একটু ভেবে বললে–একটা কাজ কয়ে …আমি একা যাই–তোমরা দুজনে থাকো, খুব ভোর থেকে মন্দিরের সামনে বসে খোল-কাল বাজিয়ে ভজন-গান শুরু করে দাও। মন্দিরে যারা আসে, তাদেরও সঙ্গে নাও, আমি তোমাদের ঢোল পেটার তালে তালে সিন্দুক ভাঙ্গতে থাকবে, আর সন্ধ্যার পর আসবো। তোমরা সকলকে বলবে, আজ মহা পুণ্যতিথি-মহারাজ সারাদিন কঠোর সাধনা করবেন। …বলবে, সূৰ্য্য হলেন শুদ্র–তিনি সূর্যের মুখ দেখবেন না–তাই দোরে খিল লাগিয়ে অন্ধকারে আছেন, সন্ধ্যার পর বেরুবেন। তিনি সারাদিন সাধন করবেন, আর আমরা সারাদিন ভজন গাইবো।

বুলেটের কথা শেষ হলে বজ্র বললে–তোমার মাথায় এত বুদ্ধিও খেলে।

****

শুকতারা আকাশের গায় দপদপ করছে, নদীর ধারে পাখী কুজন সুরু করছে, ভোরের আকাশ-বাতাস কাঁপয়ে শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ মহারাজের দুই শিষ্য খোল-কত্তাল সহযোগে ভজন গান আরম্ভ করলে।

পৌষ মাসের শেষ। এই সময় সুন্দরবনের দক্ষিণ অঞ্চলের লোকদের তেমন কাজ থাকে না। চাষ অনেকদিন হয়ে গেছে। ধান কাটা, এমন-কি তা বিক্রি হতেও বাকী নেই। শীতের সকাল। দেখতে দেখতে গ্রামের বহু লোক এসে ভজন গানে যোগ দিলে। পুণ্যকামীরা অনেকে এসে গেল। তারা শুনলো আজ মহাপুণ্যদিন শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ মহারাজ ঘরের মধ্যে মহাসাধনায় বসেছেন, তার দুই চেলা আজ উদয়-অস্ত ভজন গান করবেন।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা কালী-কীৰ্ত্তন চলেছে–সাধন-সঙ্গীত চলেছে। বজ্র বেশ ভালো গাইতেও পারে। বহু লোক এসে জমেছে। তাদের মধ্যে আট-দশ জন গানে দোয়ারকি দিচ্ছে। গান জমে উঠলো। ভীম সঙ্গত করছে ঢোল নিয়ে।

বেলা বেশ বাড়বার সঙ্গে-সঙ্গে বজ্রর গলার জোরও বেড়ে চলেছে–উদারা-মুদারা ছাড়িয়ে চলেছে। বেতালা সঙ্গত করলেও ভীমের দম আর কসরতি দেখে সকলে অবাক! তার বাজনার শব্দে সিন্দুক ভাঙ্গা কি, বাঘের গর্জনও চাপা পড়ে!

মোড়ল কণ্ঠিভূষণ এসে খানিকক্ষণ গান শুনে পুণ্য সঞ্চয় করে চলে গেল।

বেলা এক প্রহর–দুপুরের শেষ–ক্রমে সন্ধ্যা হলো। চামুণ্ড দেবীর পূজা সেরে তারা সেদিনের মত চলে গেল। মোড়লের বাড়ী থেকে সিধা এলো শ্ৰীশ্ৰকিলানন্দ আর তার দুই শিষেয়। সাধন-সঙ্গীতে আশ-পাশের যে-সব লোক যোগ দিয়েছিল, তারাও চলে যাচ্ছে। পাড়াগাঁ, সন্ধ্যার পর কেউ একটা ঘরের বাইরে থাকে না–বাইরে নানা রকমের ভয়। ভূত, প্রেত, চোর, ডাকাত, ঠ্যাঙ্গাড়ে–তার উপর বাঘ আর বুনো বরা?

****

কিছুক্ষণ হলো, সন্ধ্যা নেমেছে–গ্রামে যে শাঁখ ঘন্টার আওয়াজ হচ্ছিল, তাও থেমে গেছে–চারিদিক প্রায় নিস্তব্ধ-জমাট নিস্তব্ধ!

নাট-মন্দিরের দরজা আস্তে-আস্তে ঠেলে বুলেট ঘরে ঢুকলো।

বজ্র বলে উঠলো–হাসিল।

বুলেট সগর্বে বললে–নিশ্চয়, বেয়ণ্ড অল এক্সপেকটেশন্স!

আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বজ্র বললে–থি, চিয়াস ফর বুলেট, থুড়ি শ্রীশ্রীকিলানন্দজী!

বুলেট পিঠ থেকে হীরা-পান্না-ভরা ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বললে–আর কথা নয়–এখনি পাড়ি দিতে হবে।

ভীম বললে–একটু জিরিয়ে নাও, সারাদিন ভয়ানক খাটুনি গেছে।

বুলেট উত্তর দিলে–সারাদিন খাটুনি হয়েছে সত্যি, কিন্তু তাতে ক্লান্ত হইনি।

ভীম বললে–ভালো কথা। বেশ…না জিরোও, কিছু খেয়ে নাও। তোমার ভক্তরা নতুন গুড়ের সন্দেশ, রসকরা, চাটিম-কলা দিয়ে গেছে।

কলসী থেকে খানিকটা জল খেয়ে বুলেট বললে–এখন খেতে বসলে চলবে না। নৌকোয় উঠে তবে খাবো।

বুলেট যখন কাজে লাগে, তখন কোনো কিছুতে তার নজর থাকে না। জিরানো-খাওয়া তো দূরের কথা।

জিনিষপত্র গুছিয়ে তৈরী হতে পাঁচ-ছ মিনিটের বেশী সময় লাগলো না।

বজ্র জিজ্ঞাসা করলে ভীমকে-ডিঙিটা ঠিক জায়গায় আছে তো ভীম?

ভীমের উপর ডিঙি লুকিয়ে রাখবার ভার ছিল। সে বললে– আছে। পার-ঘাটার পাশে একটা হেঁতাল ঝোপে লুকিয়ে রেখেছি। সেখানে কারো চোখ পড়বে না।

বুলেট বললে–তাহলে আর দেরী নয়, চলো, রেডি।

বুলেট তার ব্যাগটা ঘাড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। বজ্র এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খোলবার চেষ্টা করেই বলে উঠলো–সর্ব্বনাশ!

সবিস্ময়ে বুলেট বললে–কেন? কি হয়েছে?

বজ্র উত্তর দিলে–ঘরের দরজা দেখছি, বাইরে থেকে কে বন্ধ করে দেছে।

বুলেট বললে–বলো কি! বন্ধ! ঐ একটিমাত্র দরজা যে! ভেঙে বেরুতে পারবো?

পিঠ থেকে জিনিষপত্র নামিয়ে এক হাতে শড়কী অপর হাতে টর্চ নিয়ে এগিয়ে এসে বুলেট দরজার একটা কড়া ধরে সজোরে টান দিলে। খটখট শব্দ হলো কিন্তু দরজা খুললো না। বুলেট বললে–ঠিক! বাইরে থেকে কে তালা বন্ধ করেছে।

সভয়ে ভীম বললে–এরা কেউ টের পেলে নাকি?

সে-কথায় কান না দিয়ে বুলেট শড়কী দিয়ে দরজা ফাঁক করবার চেষ্টা করতে লাগলো। বহু দিনের দরজা–যেমন ভারী, তেমনি পুরু। কপাট দুটোর মধ্যে শড়কীর সরু মাথাটা চেষ্টা করেও কিছুতে ঢোকানো গেল না।

ভীম বললে– কি হবে?

ভীমের কথার উত্তর দিতে যাচ্ছিল বুলেট–ঘরের বাইরে থেকে কে অট্টহাস্য করে উঠলো…অট্টহাস্য করে বললে–কি আর হবে? হবে মৃত্যু!–বাঘের গর্তে সেঁধুলে যা-হয়, তাই হবে! ভেবেছিলে, ভারী চালাক তোমরা! এখন ভোগো সে চালাকির ফল। গুপ্তধনের সন্ধানে যে-যে এসেছে, কেউ প্রাণ নিয়ে ফেরেনি। পনেরো দিনও হয়নি শ্রীধর মাইতি খুন হয়েছে এইখানে, তোমাদের বরাতেও তাই হবে। আমাদের উপর টেক্কা দিতে চাও, ধন! ঘুঘু দেখেছো, ফাঁদ দ্যাখোনি।

বাইরে থেকে এ-কথা বললে ভৈরব

কথা শুনে তিনজনে একেবারে চুপ। ভৈরবের হাতে তাহলে বন্দী! কিছুক্ষণ পরে ভৈরবকে উদ্দেশ করে বুলেট বললে– শোনো ভৈরব, তোমরা এই সামান্য কটা মোহর আর ঝুটো পাথর নিয়ে ভেবেছো, না জানি কি পেয়েছি! কিন্তু আমাদের যদি ছেড়ে দাও, তাহলে তোমাকে এমন জায়গার সন্ধান দিতে পারি, যেখানে এর চেয়ে অনেকগুণ বেশী টাকা পাবে। সেখান থেকে যদি একমাস দিন-রাত ঝোড়ায় করে টাকা কুড়িয়ে নিয়ে এসো, তাহলেও সে-টাকা ফুরোবে না! আমি তোমাকে সেই টাকার সন্ধান দেবে–তুমি কিন্তু আমাকে তার ভাগ দেবে–যা তোমার খুশী।

বুলেটের কথার জবাব নেই–ভৈরব কি ভাবছে।

বুলেট বললে–কি? বিশ্বাস হচ্ছে না? আমাদের তো আটকেছো–আমরা এখন তোমার হাতে, তুমি কত বড় ওস্তাদ জানি তো…জেল ভেঙ্গে পালিয়ে এসে এখানে নেছো আস্তানা। তোমার অসাধ্য কাজ নেই, জানি। মিথ্যা কথা বলে তোমার কাছে রেহাই পাবো না…সে জ্ঞান আমার আছে। এখন বলো, কি চাও? আমাদের প্রাণ? না, রাজার ঐশ্বৰ্য্য?

ভৈরব বললে–কোথায় আছে?

বুলেট বললে–বললে– তার সন্ধান পাবে কি? সেখানে যেতে হবে। তাছাড়া শোনো–টাকার সন্ধানে তোমরাও যেমন ঘুরছে, আমরাও তেমনি! সম-ব্যবসায়ী! তোমার হাতে যখন পড়েছি তোমাকে দলে নিয়ে ভাগ দিতে চাই। তার কারণ, এত টাকা… ভাগেও বা মিলবে, তাতে একটা রাজ্য কেনা যায়! এখন দ্যাখো ভেবে…যা তোমার ভালো মনে হয় করতে পারো।

বাহির থেকে ভৈরব দরজা খুললো। ভৈরব দরজা খুলতেই বুলেট বেরুলো।

সাধুর পোষাক ছেড়ে ইতিমধ্যে তারা হাফ-সার্ট-প্যাণ্ট পরেছে। কাছে কোনো অস্ত্র নেই। ভৈরব ভালো করে দেখে নিলে; তারপর বুলেটের সামনে এসে জিজ্ঞাসা করলে–বলো, কোথায় আছে?

বুলেট ভৈরবের নাকের উপর প্রচণ্ড এক ঘুষি বসিয়ে দিলে। আচমকা ঘুষি খেয়ে, ওঃ বলে ভৈরব একটু সরে গেল, কিন্তু সেও রীতিমত জোয়ান মানুষ–ঘুষি খেয়ে পড়ে গেল নাতনি পাল্টা জবাব দেবার জন্য এগিয়ে এলো। যেমন এগুনো, বুলেট তার নাক তেগে পর-পর দুটি ঘুষি ঝাড়লো। সে ঘুষিতে ভৈরবের নাকের ভগা গেল ভেঙ্গে। ভীম আর বজ্র সেই ফাঁকে বেরিয়ে পড়লো। ভৈরব একটু কাহিল হয়েছে। বুঝলো, এরা শুধু চতুর নয়, বেশ জোয়ান। তাছাড়া ওরা তিনজন–হাতে অস্ত্র আছে। সে চট, করে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে জোরে শাঁখ বাজাতে লাগলো।

বজ্র আর ভীমকে বুলেট বললে–তোমরা দৌড়ে নদীর ঘাটে যাও–টর্চ জ্বেলো না, অন্ধকারেই ছোটো, ভৈরব শখ বাজিয়েছে, ওর দলের সকলে নিশ্চয় আসবে। ব্যাগটা আমার হাতে দিয়ে জোরে ছোটো। আর সুযোগ হলে ভৈরবকে বন্দী করেই আমি যাচ্ছি।

ভীম আর বজ্র চকিতে সেই অন্ধকারে মিলিয়ে গেল।

ভৈরব দেখল, ওরা তিনজনেই বেরিয়েছে, তখন সে মন্দিরে অস্ত্র খুঁজতে লাগলো, কিন্তু বুলেটের দল ইতিমধ্যে সেগুলি সরিয়েছে। কিছুই সে পেলো না। মনে পড়লো, কোণে একখানা খাঁড়া ছিল হুকে ঝোলানো। দরজার দিকে পিছন করে ভৈরব দেশলাই জ্বাললো…আলোয় খাঁড়াটা দেখে নেবে, সেই সুযোগে বুলেট মন্দিরের দরজা বন্ধ করে শিকল তুলে দিলে। ভৈরব মন্দিরের মধ্যে আটক রইলো।

.

চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। কিছু দেখা যায় না। অজানা জায়গা, ঝোঁপ, ঝড়, ইটের স্তূপ, খানা, ডোবা, তার পাশ দিয়ে সরু পথ। এ-সব পথে দিনের আলোতেই ঠাহর করে চলা শক্ত।

ভারী ব্যাগ ঘাড়ে পথে বার-বার হোঁচট খেতে-খেতে খানিকদূর এসে বুলেট দেখে, একটা ফাঁকা জায়গায় দু’-তিনজন লোক মশাল জ্বেলে কি করছে। কি দুশমনের মত তাদের চেহারা!

বুলেট বুঝলল, এরা ভৈরবের লোক। সে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে চাইতেই চোখে পড়লো–ওদের মাঝখানে বজ্র আর ভীম শুয়ে আছে। তাদের সারা দেহে দড়ির বাঁধন।

বুলেট আর এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারলো না, নক্ষত্র-গতিতে ছুটে গিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে দমাদম্ ঘুষি চালাতে লাগলো।

আচমকা অন্ধকার থেকে বেরিয়ে ঘুষির পর ঘুষি চালায় কে … ডাকাতরা বেশ হকচকিয়ে গেল। সে ভাব চকিতে কাটলো।

তখন তারা বুলেটকেও ঘিরে ফেললো।

এরা ঘুমোচ্ছিল–শাঁখের শব্দে জেগে যে যেমন ছিল ছুটে বেরিয়েছে…হাতে অস্ত্র নেবার ফুরশৎ পায়নি। তা না পাক, এরা সকলেই বেশ জোয়ান।

এরাও ছিল তিনজন–বুলেটকে ঘিরে কিছুতে ঘায়েল করতে পারছে না। মেসিন-গান থেকে যেমন অনবরত গুলি ছোটে, বুলেট তেমনি ঘুষির পর ঘুষি চালাচ্ছে। দেখতে দেখতে বুলেটের ঘুষি খেয়ে একজন বাপ’ বলে পড়ে গেল। বাকী এখনোও দু’জন।

বুলেট কাহিল না হলেও তার সারা অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ছুটছে, কিন্তু সে-দিকে গ্রাহ্য নেই। ডাকাতদের মধ্যে একজনের খুব জোর-ঘুষিও সে চালায় ভালো, লোকটার চেহারা বুনো মোষের মত। বুলেট তাকে কিছুতেই কাহিল করতে পারছে না। তার উপরই বুলেটের ঘুষি পড়ছে অনর্গল–অবিরাম।

ভীমের দাতে জোর খুব। কামড়ে-কামড়ে বর বাঁধন সে ছিঁড়ে দিলে। বাঁধন ছিঁড়তেই বজ্র লাফ দিয়ে উঠে সেই বুনো মোষের মত লোকটাকে জুজুৎসুর এক প্যাঁচ মেরে দিলে–লোকটা ছিটকে এক ইটের স্তূপে পড়ে হাঁফাতে লাগলো। তার আর নড়বার সামর্থ্য রইলো না।

বুলেটদের জয় হচ্ছে, সঙ্গে-সঙ্গে মনে আশার সঞ্চার। অবস্থা বুঝে একজন ছুটে গেল ভৈরবকে ডাকতে। আর দু’জন বুলেটের সঙ্গে পেরে উঠছে না। বজ্র ভীমের বাঁধন খুলে দেবার চেষ্টা করছে, হঠাৎ বুলেট মাটিতে ধপ করে শুয়ে পড়লো। বজ্র দেখলে, বুলেটের মাথা ফেটে রক্ত গড়াচ্ছে, আর তার পেছনে মস্ত লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে ভৈরব!

বুলেটের অবস্থা দেখে বজ্র তেড়ে গিয়ে ভৈরবের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো…..অমনি তার সঙ্গী দুটো তাকে ধরে ফেললে। বন্ধ তাদের একজনের গলা টিপে দম্ বন্ধ করে দিতে সে পড়ে গেল। ভৈরব তখন বজ্রের মাথা তাগ করে লাঠি মারবার উপক্রম করতেই বজ্র সাঁ করে তার হাত থেকে লাঠিটা ছিনিয়ে নিলে। কিন্তু ডাকাতদের একজন ছিল তার পিছনে, সেদিকে সে লক্ষ্য করেনি! সে ডাকাতটা বজ্রর পিঠে একটা ইট মারতেই বজ্র পড়ে গেল! সেই সুযোগে ভৈরব তার ঘাড়ে চেপে বসলো। বুলেট আর বজ্রকে ওরা বেঁধে ফেললে। ভীম আগে থেকেই বাঁধা ছিল।

****

ভৈরবের দল আনন্দে, গর্বে উৎফুল্ল। এরা জাতে বাগদী, এ অঞ্চলের আদি বাসিন্দা, রঙ সাঁওতালদের মত কালো–আকার, স্বভাব অতি বদ। খুন, জখম চুরি ডাকাতি–এদের নেশা। এই-সব জঘন্য কাজ না করে এরা থাকতে পারে না। ভৈরব তার দলের লোককে হুকুম দিলে– নিয়ে চল্ এদের তিনজনকে ঘাড়ে করে…মা চামুণ্ডার সামনে আজ রাত্রে এদের বলি দিতে হবে। আর একজন যা, গিয়ে মোড়লকে আর খড়্গধারীকে ডেকে আন।

বুলেট, বজ্র আর ভীম–তিনজনকে বেঁধে চামুণ্ডা বিগ্রহের সামনে শুইয়ে রেখে ভৈরবের দল তাদের ঘিরে বসেছে।

ভৈরব বললে–খুব হুঁশিয়ার, এরা ভয়ানক শয়তান, কেউ যদি ওঠবার চেষ্টা করে, ডাণ্ডা মেরে মাথা চুর করে দিবি। আমি খাঁড়াটাতে শাণ দিয়ে নিই। বহুদিন মাকে নর-রক্ত খাওয়ানো হয়নি, আজ খাওয়াবো। মোড়ল আর খড়্গধারী এলেই হয়!

চামুণ্ডা বিগ্রহের সামনে হাত-পাঁচেক দূরে মাটির উপরে বিরাট এক হাড়-কাঠ, তাতে মোষ বলিও হয়। ভৈরবের দল বুলেটদের সেই হাড়-কাঠের পাশে শুইয়ে রেখেছে।

মন্দিরের বারান্দায় একটা মশাল জ্বলছে–ভৈরব মহানন্দে খাঁড়া শাণাচ্ছে।

ভৈরবকে একজন জিজ্ঞাসা করলে–ওনাদের কাছে যা জিনিষ পত্তর আছে, সেগুলো কেড়ে নিলে হয় না?

ভৈরব ওদের সঙ্গে কাজ করে কিন্তু গুপ্তধনের কথা কাকেও বলেনি। এখন ব্যাগটা কেড়ে নিতে গেলে হীরে-পান্না বেরিয়ে পড়ে যদি, তাহলে জানাজানি হওয়া সম্ভব! বলি দেবার পর ব্যাগটা নিলে চলবে, এই ভেবে ভৈরব বললে– ওসব আর যাচ্ছে কোথায়? থাক, বলি দেবার পর নিলেই হবে।

****

নিশ্চিত মৃত্যু!

নিস্তার পাবার কোনো উপায় নেই–আশাও নেই। গভীর রাত। নির্জন অরাজক সুন্দরবনের বুকে তিনজন কেন, তিন শ’ লোককে খুন করে ভৈরবের দল নদীর জলে ভাসিয়ে দেয় যদি তাহলেও পুলিশ বিন্দু-বাষ্প জানতে পারবে না!

ভীম রীতিমত ভয় পেয়েছে, কারো উপর তার আর আস্থা নেই। বুলেটের উপরও নয়। সে নির্জীব অসহায়ের মত চামুণ্ডা বিগ্রহের দিকে মলিন দৃষ্টি মেলে চেয়ে আছে।

চামুণ্ডা মুর্ত্তির সামনে ভৈরব খুব ঘটা করে জোরালো আলো জ্বেলে দিয়েছে। চামুণ্ডা দেবীকে অতি ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে…রুক্ষ, শীর্ণ, কঙ্কালসার দেহ, লাল লাল চোখ দুটো কোটর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়েছে! চামুণ্ডার বড় বড় দাঁত, লকলকে জিভ যেন নররক্ত পানের লোভে অধীর হয়েছে। মাথার চুলগুলো কি ভীষণ! যেন এক একটা বিষাক্ত সাপ! দেবীর পরণে বাঘের চামড়া আর মড়ার হাড়, মাথার খুলি। চামুণ্ডার মুর্ত্তি কি ভয়ানক, বীভৎস!

বজ্রও মলিন–বুলেট কিন্তু এদিকে-ওদিকে মাঝে-মাঝে চাইছে। তাকে দেখলে মনে হয়, এখনও সে আশা রাখে।

****

ভয়ানক রাত! যেমন ভীষণ কালো, তেমনি ভীষণ নিঝুম নিস্তব্ধ।

বুলেট, বজ্র আর ভীম চুপচাপ মাটিতে শুয়ে আছে, তাদের গা ঘেঁষে যারা পাহারা দিচ্ছে, তারাও নীরব। ভৈরবের খাঁড়া শাণানো হয়ে গেছে। এক-একবার সে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে, তার ইচ্ছা, মাঝ রাত্রে বলি দেয়।

কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারী এলো। ওর সব কথা শুনেছে।

বুলেটদের দিকে চেয়ে খড়্গধারী কর্কশ কণ্ঠে বললে–,–হামি জানতো ই-সব ঠগ, জুয়াচোর! তুম্ লোক খালি বলিয়েসে ‘সাঁধু’ ‘সাঁধু’। আরে, বাঙ্গাল মুলুকে কি সাঁধু হোয়! সব ঝট… বদ্‌মাস।

বালাপোষখানা ভালো করে মুড়ি দিতে দিতে কণ্ঠিভূষণ বললে– এক-ফোঁটা একরত্তি ছেঁড়াগুলো, গলা টিপলে দুধ বেরোয়, বলিহারী বুকের পাটা! বাঘের গর্তে মাথা গলাতে সাহস করে! আমাদের উপর টেক্কা। সাক্ষাৎ কলি কি না!

ভৈরব অধীর ভাবে বললে–মোড়ল মশাই, এবার কাজ শুরু করি।

উৎফুল্ল হয়ে খড়্গধারী বললে–আবি–আবি, আবি তিনকো গর্দ্দানা লেও!

কণ্ঠিভূষণ মহা-ভক্তিভরে চামুণ্ডা বিগ্রহকে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে বললে–মাকে আজ পেট ভরে নর-রক্ত খাওয়াবো। মাগো, দয়াময়ী জননী!

খড়্গধারী বললে–মা-জী সন্তোষ হোবে, দুশমন বি থতম্ হোবে! হাঃ হাঃ হাঃ!

মানুষের হাসি যে কত ভয়ঙ্কর হতে পারে, বুলেট তা অন্তরে অন্তরে বুঝলো।

ভীম আতঙ্কে চীৎকার করে উঠলো!

দলের একজনকে ভৈরব বললে– এদের বাঁধন খুলে দাও। তারপর এদের স্নান করাতে হবে। বাঁধা অবস্থায় বলি দিতে নেই।

একজন উঠে বুলেটদের বাঁধন খুলে দিলে–তারপর তাদের মাথায় জল ঢেলে স্নান করালো।

খড়্গধারী আর কণ্ঠিভূষণ হাড়-কাঠের খুব কাছে এসে বসলো। বলিটা স্পষ্ট দেখার ইচ্ছা দু’জনের খুব প্রবল।

স্নান করানো হলে ভৈরব তাদের কপালে সিঁদুরের ফোঁটা পরিয়ে দিয়ে, এক-মুঠা জবাফুল হাতে নিয়ে বিড়বিড় করে কি মন্ত্র পড়তে পড়তে তাদের প্রদক্ষিণ করতে লাগলো।

কণ্ঠিভূষণ আরও দুটো মশাল জ্বেলে দিলে। তার ইঙ্গিতে একজন বড় ঢাকটা কাঠি দিয়ে পিটতে লাগলো–দু-দু-দুম্ দু-দু-দুম…দ্যাম্ বাজতে লাগলো।

হাড়-কাঠের কাছে বুলেটদের দাঁড় করিয়ে ভৈরব মন্ত্র শেষ করলো। কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারী তাদের পাশে এসে দাঁড়ালো… দলের সকলে দাঁড়ালে তাদের ঘিরে। হাড়-কাঠ পরিষ্কার করে ভৈরব খাঁড়া আনতে গেল।

***

আর ক-মিনিট বা! তারপর ইহলোকের সঙ্গে সব সম্পর্ক চুকে যাবে!

কাছে মন্দির। মন্দির থেকে খাঁড়া আনতে কত সময় লাগে।

ভীম নিস্পন্দ–যেন পুতুল! বজ্রও মুষড়ে পড়েছে। বুলেট নিঃশব্দে ভিজে জামা থেকে জল নিংড়ে-নিংড়ে ফেলছে আর বারবার বজ্রর দিকে চাইছে। তার চাউনির মানে বজ্র ঠিক বুঝতে পারছে না!

নিঝুম নিস্তব্ধ রাত–জয়-টাকের শব্দ হচ্ছে দু-দু-দুম দুম দুম দুম দ্যাম!

ভৈরব খাঁড়া নিয়ে বুলেটদের সামনে এসে দাঁড়ালো, তার বড় বড় চুল গুলো ঝুঁটি বাঁধা–গয়ে জামা নেই, কাপড় খুব আঁট করে পরা, কপালে সিঁদুরের চওডা ফোঁটা, খালি বুকের উপর তিন চারটে রুদ্রাক্ষের মালা। ভৈরব নিজেই তিনজনকে বলি দেবে!

কারো মুখে এতটুকু শব্দ নেই। শুধু কণ্ঠিভূষণ মাঝে-মাঝে জয়-মা চামুণ্ডা-মা ব্ৰহ্মময়ী মা কালী ভৈরবী-দয়াময়ী জননী গো! বলে চীৎকার করে উঠছে।

খাঁড়া হাতে ভৈরব এলো প্রথমে বুলেটের কাছে। বুলেটের উপর তার রাগ বেশী।

ভীম কেঁপে উঠলো! বজ্রর দিকে চেয়ে চাপা গলায় বুলেট বললে–বী রেডি।

–ওঃ হোঃ গেলুম! গেলুম! চোখ জ্বলে গেল! পুড়ে গেল! ভৈরব আৰ্ত্ত চীৎকার তুললো! তার হাতের খাঁড়া মাটিতে পড়ে গেল। সঙ্গে-সঙ্গে কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারীও আর্তনাদ করে উঠলো–বাপরে গেলুম রে! ছোঁড়াটা চোখে কি দিলে রে বাবা!

–চোট্টা আদমী আঁখ বরবাদ কর দিয়া! বলে যাতনায় কাৎরাতে কাৎরাতে খড়্গধারী মাটিতে শুয়ে পড়লো। কণ্ঠিভূষণও তার দেহের উপর পড়ে গেল।

ভৈরব চোখ মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে বুলেটকে ধরবার চেষ্টা করতেই নাইট্রিক এসিডের শিশিটা তার মুখের উপর ঢেলে বজ্র আর ভীমকে বুলেট বললে–ফিনিশ! নাউ মার্চ অন।

মুহূর্তে দৃশ্য বদলে গেল।

ভৈরব, কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারী কাৎরাচ্ছে। দলের সকলে ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যেদিকে পারে, পালাচ্ছে। একজন সাহস করে দাঁড়িয়ে ছিল–ভৈরবের খাঁড়াখানা নিয়ে বজ্র তাকে তাড়া করতেই কোথায় সে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। খাঁড়াখানা বজ্ৰ সঙ্গে রাখলো।

সর্দ্দার ভৈরব, চতুর কণ্ঠিভূষণ, অতিলোভী পালোয়ান্ খড়্গধারী কারো আর দাঁড়াবার সামর্থ্য নেই।

তাদের সামনে দিয়ে জোরে পা ফেলে বীরের মত বুলেট, বজ্র আর ভীম হীরা-পান্না আর মোহর ভরা ব্যাগ নিয়ে সদর্পে চলে গেল।

ভৈরব, কণ্ঠিভূষণ আর খড়্গধারী নিষ্ফল আক্রোশে গর্জ্জাতে লাগলো–যেন সদ্য-খাঁচায়-পোরা বনের হিংস্র তিনটে বাঘ।

–শেষ–

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *