০. ভূমিকার পরিবর্তে – সলিমুল্লাহ খান

পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ – আহমদ ছফা
প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৬

ভূমিকার পরিবর্তে* – সলিমুল্লাহ খান

… আমাদের সঙ্গীসাথীরা যদি আমার খবর জানবার চায়
কইও না আমার বুকের ফুটোয় গুলি, দোহাই দিও না কপালের
কইও আমার বিয়া হইছে
দরিয়াপারে ঐ দুঃখের দেশে…
শাশুড়ি মা আমার চওড়া পাথররাণী
নবীন নুড়ি শালাশালি আর পাথরকালো মাটি বঁধুয়া আমার।

ডাকাতসেনার গান (এয়ুদ ১৯৭২)**

আহমদ ছফার ‘ পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ (১৯৯৬) পড়ে আমার গ্রিকদেশের একদা ডাকাত ও এককালীন মুক্তিযোদ্ধা সেনাদের এই গানের টুকরা মনে পড়েছে। কেন পড়েছে সে ব্যাখ্যা লেখার তাগিদে এই নিবন্ধ।

আমাদের বাংলাভাষায় আঙ্গুলে গোণা যায় এমন কয়েকজন মাত্র মহান লেখক আছেন। আহমদ ছফা তাঁদের একজন। আর বর্তমান লেখকের বিচারে ‘ পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ আহমদ ছফার মহত্তম রচনার একটি। বইটি এখনো যারা পড়েন নাই, তাদের আমন্ত্রণ জানাই আগে পড়ে এই দীন নিবন্ধ পরে পড়ার। পাছে এমন মহৎ সাহিত্যের অমর্যাদা হয় এই ভয়ে বহুদিন এ বই আলোচনার সাহস পাই নাই।

——

[* লেখাটি প্রথম আহমদ ছফা স্মৃতি বক্তৃতা আকারে পঠিত হয় ২৬ জুলাই, ২০০২ তারিখে। একই তারিখে ছাপা হয় দৈনিক যুগান্তরে এবং রাষ্ট্রসভা পত্রমালা নামক পত্রিকায় প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায়। এ লেখাটির আদি শিরোনাম ছিল : “ফাঁকানো কি জিনিস? অথবা আহমদ ছফার সুশীল সমাজ’ বিচার।”

**. … If our comrades ask you any questions about me, Don’t say I stopped a bullet, don’t say I was unlucky, Just tell them I’ve got married In the sad lands overseas… With a big flat stone for a mother-in-law New pebble brothers and the black erath for my bride.]

‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ পড়ার কিছুদিন আগেই আমার কানে আসে এর নাম। পাঠকসমাজের গোচরার্থে জানানো হয়তো বাহুল্য নয়, এই লেখকের সাথে মহাত্মা আহমদ ছফার একটা অধীনতামূলক মিত্রতার সম্বন্ধ ছিল। অর্থাৎ তার উপদেশ আমার অমৃত হলেও আমার দেশ তিনি ইচ্ছা হয় গ্রাহ্য, বেশির ভাগ সময় অগ্রাহ্য, করতে পারতেন।

আমি তখন পৃথিবীর অন্য এক প্রদেশে। বইয়ের নাম শুনে সংশয় হল, কোন (বিদেশি) দাতা কিংবা (দেশি) মদতদাতার টাকায় লেখা কি না। এদিকে আহমদ ছফা-আপদেরই কথা– তখন দাতা জার্মানি হাইফেন মদতদাতা বাংলার ‘সম্প্রীতি’ [ওরফে বাংলা-জার্মান সম্প্রীতি] নামক এক প্রতিষ্ঠানে কর্তব্যরত ছিলেন। অনেকদিন পরে বইটি পড়ে আমার এই প্রথম সংশয় কাটে। টের পাই, নামটি প্রতারণা করেছে আমার সঙ্গে।

ফুল, গাছ বা পাখি এ বইয়ের খোসা বা জাহিরি চেহারা মাত্র, এর বাতেনি বা সারবিষয় খোদ মানুষেরই সমাজ। বিশেষ অর্থে সমাজের পদে পদে যে স্বার্থ ও শ্ৰেণীসংঘাত– যার কথা সকলেই জানেন অথচ কেউই বলেন না এখন– আহমদ ছফা তারই সরল বয়ান পেশ করেছেন পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গের ছদ্মনামে। একটি ইশারাই কারো কারো জন্যে কাফি। বইয়ের শেষ পাতায় পড়ি :

মাটির মানুষের জগতে হিংস্রতা এবং হানাহানি দেখে আকাশের পাখির জগতে আমি আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেও হিংস্রতা এবং জাতিবৈরিতার প্রকোপ দেখতে পাচ্ছি। সুতরাং মানুষের মত কর্তব্য পালন করার জন্য আমার মানুষের কাছে ফিরে না গিয়ে উপায় কী? আমি বৃক্ষ নই, আমি পাখি নই, মানুষ। ভাল হোক, মন্দ হোক, আনন্দের। হোক, বেদনার হোক আমাকে মানুষের মত মানুষের সমাজে মনুষ্যজীবনই যাপন করতে হবে। মনুষ্যলীলার করুণ রঙ্গভূমিতে আমাকে নেমে আসতে হবে। তথাপি আমার জীবন আমি একেবারে অর্থহীন মনে করিনে। (ছফা ১৯৯৬ : ৮০)

পাখির জগতের হিংস্রতা ও জাতিবৈরিতা কোন পদার্থ? একদিন আহমদ ছফা (কাহিনী বয়ানকারের এই নামই লেখক জারি রেখেছেন) রুটি হাতে বেরিয়ে এসেছেন এবং কাকমণ্ডলী শব্দটি উচ্চারণ করে ফেলেছেন। কাকেরা দলে দলে খেতে এল। বাকিটার বয়ান তাঁর মুখেই শোনা যাক :

আমি ছাদের ওপর তাকিয়ে দেখি, একটি দাঁড়কাক বসে আছে। আহা, বড় ভাল লাগল। শহরে কখনো দাঁড়কাক দেখেছি মনে পড়ে না। গ্রামের মানুষ শহরে এলে যেমন আড়ষ্ট হয়ে থাকে, কাকটিও তেমনি এক কোণায় জবুথবু হয়ে বসে আছে। আমি তার দিকে রুটির টুকরো ছুঁড়ে দিলাম। শহরের কাকেরা সে টুকরোগুলো তার মুখের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে খেয়ে ফেলল। আমার মনে বড় লাগল। এভাবেই শহরের মানুষেরা গ্রামের মানুষের মুখের গ্রাস কেড়ে নিয়ে থাকে। তার পরদিন একটার জায়গায় দুটো দাঁড়কাক এল। তারপর থেকে এখানে সেখানে নানা জায়গায় দাঁড়কাক দেখতে লাগলাম। আমার মনে একটা প্রশ্ন জাগল। গ্রামে কি ভীষণ খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে, নইলে শহরে দলে দলে দাঁড়কাক এমনভাবে ছুটে আসবে কেন? নদীভাঙা মানুষ যেমন আসে, দুর্ভিক্ষের থাবা থেকে জান বাঁচানোর জন্য হাভাতে মানুষ যেমন আসে, তেমনি শহরে দলে দলে দাঁড়কাক আসছে, তার কারণ কী? (ছফা ১৯৯৬ : ৭৮-৭৯)।

একদিন আহমদ ছফা খেয়াল করলেন কাকেরা আর রুটি খাচ্ছে না। তিনি দেখলেন, সব কাক একযোগে কা কা করে তাঁর ছাদের সীমা পেরিয়ে আকাশে উড়ে উড়ে কোলাহল করতে লাগল। এত কাক নানা জায়গা থেকে এসে জুটেছে যে আমার সামনের আকাশটা যেন একটা কাকের সমুদ্র হয়ে গিয়েছে। কাহিনীকারের দোহার সুশীলের মতে কাক আসছে না কাকে কাকে জাতিসংগ্রামের কারণে। ছফার মতে আসে না অন্য কারণে, মানুষের মানে অপর দোহার ইদ্রিসের–বদকামনার দোষে। সুশীল প্রতিবাদ করে : আপনি সামনের দিকে চেয়ে দেখুন। দাঁড়কাকেরা পাতিকাকদের কিভাবে মেরে মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে।

আমি তাকিয়ে দেখলাম, আট দশটা দাঁড়কাক একজোট হয়ে যেখানেই পাতিকাক দেখছে খেদিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার পরদিন থেকে দেখতে থাকলাম দাঁড়কাকেরা দল বেঁধে জঙ্গি বিমানের মত বেগে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেখানেই পাতিকাক দেখছে হামলা করছে। কাকের জগতেও হিংস্রতা এবং মস্তানি প্রবেশ করেছে। একসময় হয়তো এমনও হতে পারে দাঁড়কাকেরা এই শহর থেকে পাতিকাকদের তাড়িয়ে দেবে। (ছফা ১৯৯৬ : ৭৯-৮০)

আহমদ ছফার আবার পশ্চিমী বিনয়ও কম নয়। সাথে সাথেই তিনি তফ সীরকারের সংশয় নিয়ে বলছেনও : ব্যাপারটা কি সত্যি তাই? এখন কথা হল কাকের রাজ্যে বিপর্যয়ের যে লক্ষণগুলো আমি দেখতে পাচ্ছি, অন্যেরা কি সেভাবে দেখছে?

সকলেই দেখছে না, কিন্তু কেউ কেউ নিশ্চয়ই। আহমদ ছফার কিছু কম পাঁচ শত বছর আগে ইতালিদেশের এক কবিও এর কাছাকাছি দৃশ্য বয়ান করেছিলেন। পণ্ডিত হিসেবেই এই কবির অধিক প্রসিদ্ধি। জগদ্বিখ্যাত ‘রাজা’ গ্রন্থে নিক্কোলো মাকিয়াভেলি (১৪৬৯-১৫২৭) বয়ান করেন, প্রত্যেক দেশেই মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত : একদিকে সাধারণ মানুষ, অন্যদিকে অভিজাত সম্প্রদায়।’

আজকাল বাংলাদেশে এই দোসরা পক্ষেরই নাম দাঁড়াচ্ছে সুশীল সমাজ। এদের মধ্যে যারা চতুরতর তারা হয়তো বলবেন, জাতীয় সমাজ’। দুটোরই ইংরেজি বুলি সিভিল সোসাইটি’। মাকিয়াভেল্লির মতে, সাধারণ মানুষ চায় অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে মার না খেতে আর তাদের কথায় উঠবস করার কবল থেকে রেহাই পেতে, ওদিকে অভিজাতরা চায় সাধারণ মানুষকে মার দিতে, আর কথায় কথায় উঠবস করাতে, এই পথেই (সুশীল ওরফে) জাতীয় রাজের উদ্ভব। কারণ সাধারণ মানুষ ও অভিজাত সম্প্রদায়ের মুখোমুখি পরস্পরবিরোধী বাসনা থেকেই নৈরাজ্য। মাকিয়াভেল্লি লিখেছেন :

রাজার শাসন কায়েম করতে পারে সাধারণ মানুষ বা অভিজাত সম্প্রদায়, যে-কোন দলই। কে করবে তা নির্ভর করে তাদের নিয়তের ওপর। অভিজাতরা যখন দেখে যে সাধারণ মানুষকে ঠেকাতে পারা যাচ্ছে না, তখন তাঁরা নিজেদেরই একজনকে সমর্থন দেয়, তাকে রাজার আসনে বসায় যেন তার ছায়ায় নিজেদের বাসনা পূরণ করতে পারে। সাধারণ মানুষও যখন দেখে অভিজাতদের সাথে পারা যাচ্ছে না, তখন তারাও কোন একটা লোকের পেছনে কাতার বাঁধে, তাঁকে রাজা বানায়, যেন তার ক্ষমতার আশ্রয়ে নিজেরা বাঁচতে পারে। (মাকিয়াভেল্লি ১৯৮৯ : ৩৯)।

আহমদ ছফা আর এক জায়গায় শুধাচ্ছেন : ‘মানুষের নিয়ম কি পাখিদের সমাজে চালু করা যায়?’ উত্তরে তাঁকে পুরাণ লিখতে হল। ছফা সাহেব কোন এক সময় একটি টিয়া পাখি পুষেছিলেন, সে পাখি বিড়ালের থাবায় একদিন মারা পড়ে। এরপর তিনি বহুদিন কোন পাখি পোষেন নাই। অনেকদিন পর তাঁর নতুন সাকরিদ সুশীলবাবু নীলক্ষেতের চিড়িয়াওয়ালার কাছ থেকে একটা ঝুঁটিশালিকের বাচ্চা কিনে নিয়ে আসে। তাদের ঘরে একটি প্লাস্টিকের খোপ খোপ ঝুড়ি ছিল। দেখতে বেশ খাঁচার মতন। ছফার বয়ানে :

পাখিটা এই ঝুড়ির স্বল্প আয়তনের মধ্যে হাঁটাচলা করতে গিয়ে বেশ কষ্ট পাচ্ছে। আধারাতে পাখিটার দিকে তাকিয়ে দেখি, পাখার মধ্যে মুখ গুঁজে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। মনে হল পাখিটি কাঁদছে। (ছফা ১৯৯৬ : ৬৩)। একটু পরের বর্ণনায় দেখি পাখির খাঁচা পরিবর্তন ঘটেছে :

পাখিটিকে যখন বড় খাঁচায় চালান করা হল, সমস্ত পাখি ব্যক্তিত্ব নিয়ে সে লাফালাফি করতে থাকল। কখনো দাঁড়ের ওপর ওঠে, কখনো নিচে নামে। খাঁচার ফাঁক দিয়ে বিশাল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আসলে অন্য পাখিদের ওড়াওড়ি দেখলে খাঁচার ভেতর তার ছটফটানি বাড়তে থাকে। খাঁচার এপাশ-ওপাশে পাখায় ভর করে উড়তে গিয়ে ধাক্কা খায়। আশাভঙ্গের বেদনা এবং শারীরিক ক্লান্তি যখন তাকে কাবু করে ফেলে, সে দাঁড়ের ওপর বসে চিন্তা করে, কোথায় এসেছি। দাঁড়ের ওপর বেশিক্ষণ বসে থাকা তার পোষায় না। সে ছাতুর বাটিটাতে নিচু হয়ে ঠোকর বসাতে থাকে। দু তিনটা ঠোকর দিয়ে পানির বাটির দিকে সরে যায়। …(ছফা ১৯৯৬ : ৬৩-৬৪)

একদিন পাখিটি পালিয়ে যায়। ছফা সাহেবের ভাষায়, “আমি ভেতরে ভেতরে জানতাম, পাখি একদিন দাগা দিয়ে পালিয়ে যাবে। কারণ তার আগেই আমাদের শখের পাখিওয়ালা জানতেন :

আমাদের শালিকটি খাঁচায় অবিরাম ছুটোছুটি করে, কখনো ওপরে ওঠে, কখনো নিচে নামে, কখনো দাঁড়ে বসে ক্ষেপা চিৎকার করে, কখনো দুঃখের গান গায়, কখনো পাখা ঝাড়া দিয়ে পালকগুলো প্রসারিত করে, পাখার ভেতর ঠোঁট বুজে থাকে, হলুদ ঠোঁট খাঁচার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে আকাশের স্বাদ গ্রহণ করতে চেষ্টা করে। পাখিটির দুঃখের এই অভিব্যক্তিগুলো আমার চোখে অত্যন্ত সুন্দর মনে হয়। তাই পাখিটিকে কিনে এনে খাঁচায় বন্দি করেছি। পাখিটির সঙ্গে জোর করে প্রণয় সম্পর্ক স্থাপন করতে গিয়ে আমার ভেতরেও একটা নাম না-জানা পাখি অবিরাম পাখা ঝাঁপটাচ্ছে। (ছফা ১৯৯৬ : ৬৫-৬৬)

একদিন ছফা দেখলেন তার শালিকটি ফিরে এসেছে, সামনের পাঁচতলা দালানের শিকের ওপর ম্লান মুখে বসে আছে :

আমার কেমন জানি বিশ্বাস হল, পাখিটি আমাকে একেবারে ভুলে যায়নি। আমি ডাকলাম, বাবু, বাবু। আমার ডাক যেই শুনেছে তক্ষুনি লম্বা উড়াল দিয়ে পাঁচতলা দালান ছাড়িয়ে, অ্যাক্যালিপ্টাসগাছের ওপর দিয়ে, ইস্কাটনের দিকে কোথায় উড়ে গেল ঠাহর করতে পারলাম না। তার পরদিন থেকে পাখিটিকে নানা জায়গায় দেখতে থাকলাম। কখনো পাঁচতলা দালানের লোহার শিকে, কখনো নোনাগাছটির মাথায়, কখনো নারকোলগাছে। একবার তো আমার জানালার পাশের আমগাছের আগডালে এসে বসেছিল। সকাল-দুপুর-বিকেল সবসময়ে দেখি পাখিটি বাড়ি পালানো ছেলের মত এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কেবল আমার গলার আওয়াজটি শুনলেই দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যায়। (ছফা ১৯৯৬ : ৬৭)

পাখি যায়, আবার আসেও। আবার ভয়ে পালায়। ভয়ের টানা ও প্রয়োজনের পোড়েন মিলে ছফার সাথে শালিকের এক নতুন সম্পর্ক বয়নের ইতিহাস আমরা সবিস্তার পড়ি। এরই মধ্যে বিপদ হয়ে নেমে আসে আর জাতের পাখি, একটি গেরোবাজ কবুতর, দুটি রাজঘুঘু, আরও কত। ছফা তাঁর এই পলাতক পাখিকে পুত্রস্বরূপ দত্তক নিয়েছেন। আর বেটা গিয়েছে পালিয়ে। কিন্তু হাজার হলেও পিতার হৃদয়ে বাবরের প্রার্থনা। তিনি পাখিটাকে যখনই ধারে কাছে কোথাও দেখেন, তার দৃষ্টিতে পড়ে মত ছোট ছোট দলা পাকিয়ে ছাদের নানা জায়গায় ছাতু ছড়িয়ে দিতে থাকলেন। ভাতও ছুঁড়ে দিলেন। সে যদি ইচ্ছে করে ছাতু খেতে পারে। আবার পছন্দ করলে ভাতও খেতে পারে। পাখি কাছে আসে, কিন্তু তার ভয় যায় নাই। ছফা বলছেন :

একদিন নটার সময় দেখলাম পাখিটি একেবারে ছাদের দেয়ালে এসে বসেছে। ইচ্ছে হলে দু’গজ নিচে নেমে খাবারে মুখ বসাতে পারে। তখন ঘরে কেউ ছিল না। আমি ভ্যান্টিলেটারের ফাঁক দিয়ে দেখলাম, পাখিটি এদিক-ওদিক ভাল করে তাকাচ্ছে, বিপদের কোন আশঙ্কা আছে কি না। এক সময়ে মুখ হাঁ করা খাঁচাটির দিকে যখন তার চোখ গেল অমনি উড়াল দিয়ে চলে গেল। (ছফা ১৯৯৬ : ৬৮)।

শেষতক এক স্মরণীয় প্রাতঃকালে ঝুঁটিশালিকের বেটা সত্যি সত্যি খেতে এলেও সাবেক প্রভু ও সাম্প্রতিক বাবার লঙ্গরখানায়, তুলসী গাছের ফাঁকটিতে। খুব ভোরে মানুষবাবা খাবার ছড়িয়ে রাখেন, পাখিপুত্র এক ফাঁকে এসে খেয়ে চলে যায়। ছেলের চেহারা কোনদিন বাবা দেখেন, কোনদিন দেখতে পান না। মানুষের সঙ্গে শালিকের এই প্রণয়– ছফার বুলিতে ‘গোপন বন্দোবস্ত’–চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। কাকেরা সে খবর পেয়ে যাওয়ায় বন্দোবস্তের আয়ু আরো কমে আসে। ছফা সাহেবের খাঁচায় কিছুদিন কারাবাস করেছিল বলেই শালিকের বাচ্চা শালিক পেনশনস্বরূপ সব খাবার একা একা খেয়ে যাবে, কাকেরা তা মোটেই মানতে রাজি নয়। ছফা সাহেব খাবার দেয়ার পরেই তিন চারটি কাক শূন্য থেকে তাঁর ছাদে তশরীফ আনে এবং লাজ শরমের মাথার মত শালিকের বরাদ্দ খাবারটা খেয়ে ফেলে। শালিকটি কাছাকাছি এলে তাড়িয়ে বুড়িগঙ্গা পার করে দিয়ে আসে। মাকিয়াভেল্লি দুই জাতের মানুষের কথা বলেছিলেন। তাদের কোন জাতের সাথে কাকজাতির মিল? অভিজাত বা সুশীল সম্প্রদায়ের। সুশীল সমাজকে অনেকে নোংরা কাকের মত বলে গাল দিয়ে থাকেন। ছফা একমত নন :

কেন যে পাখিটিকে নোংরা পাখি বলে আমি তো তার কোন কারণ খুঁজে পাইনি। ভদ্রলোকদের অনেক গুণই কাকের আছে, খেয়েই ঠোঁট মুছে ফেলবে। যখনই পানি পাওয়া যায়, চট করে গা ধুয়ে ফেলবে। গা ধোওয়ার ব্যাপারে তার শীত-গ্রীষ্ম বাছ বিছার নেই। পুরুষকাক নিজের মুখের খাবারটা যেভাবে খেয়ে বান্ধবীর ঠোঁটে ঢুকিয়ে দেয় সেটা শুধু দেখবার নয়, অনুভব করারও ব্যাপার। (ছফা ১৯৯৬ : ৭১)

ভদ্রলোক সমাজের আরো এক চরিত্রগুণ কাকেরা পেয়েছে। এর নাম সামাজিক ঐক্য। ছফা লিখেছেন :

আরেকজনকে ঠকিয়ে খেতে যেমন কাকের জুড়ি নেই, তেমনি তাদের সামাজিক ঐক্যের বন্ধনটিও অত্যন্ত জীবন্ত। একটি কাক যখন ফাঁদে ধরা পড়ে কিংবা বিদ্যুতের তারে আটকে যায়, তামাম দুনিয়ার যত কাক আছে, চিৎকার করে বন্দির প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করতে থাকে। (ছফা ১৯৯৬: ৭০)।

পাখিদের সমাজে মানুষের নিয়ম চালু করার আরো এক বিপদ। এর নামই হযরত ইবনে খলদুন (১৩৩২-১৪০৬) রেখেছেন আসাবিয়াহ। লোকে বলে এর বাংলা গোত্রপ্রীতি। আমার পছন্দ জাতীয়তাবাদ। (খলদুন ১৯৮১) ছফা সাহেব চান। শুধু তাঁর পাখিপুত্র তাঁর কাছে আসুক, আর কাকেরা না আসুক। কাকেঁদের তাড়ানোও তেমন আহামরি ব্যাপার নয়। কিন্তু এখানেই দ্বন্দ্ব বা মাকিয়াভেল্লির বিষয়বস্তু দেখা দেয়।

আজকাল গলিতে গলিতে কাটা রাইফেল, পাইপ গান এসব পাওয়া যাচ্ছে। কিছু টাকা ফেললেই তার একটা ভাড়া হিসেবে পাওয়া যায়। লাশ ফেলতে হবে না, দুয়েকটা আওয়াজ করলেই কাকেরা আর এ বছর এমুখো হবে না। কিন্তু গণ্ডগোল ঠেকেছে গিয়ে এক জায়গায়। রাইফেলের আওয়াজ করে যদি কাকদের আসা বারণ করি, অন্য পাখিদের আসাও বন্ধ হয়ে যায়। আমি যদি চাই রোজ সকালে আমার শালিকটি আসবে, তাহলে আকাশের সব পাখি যারা এখানে আসতে চায় তাদের সকলকে আতিথেয়তা দেয়ার জন্য আমাকে রাজি থাকতে হবে। সব প্রজাতির পাখির মধ্যে যত প্রজাতিগত বিরোধ থাকুক না কেন, সকলে একটা বিষয়ে একমত। এক প্রজাতির পাখি যেখানে নিরাপদ নয়, কোন প্রজাতির পাখির জন্য সেটা আদর্শ বিচরণস্থল হতে পারে না। (ছফা ১৯৯৬ : ৭০-৭১)

এই প্রকার নানান কিসিমের কারণে পিতাপুত্র সম্পর্কের টানাপোড়েন। বিহঙ্গ পুরাণের পুরা আখ্যানভাগ দখল করেছে। পাখিপুত্র এখন স্বাধীন। স্বাধীনতার নগদলাভের মধ্যে সে একটা বান্ধবী জুটিয়ে নিতে পেরেছে। ছফা বলছেন : আমার পাখিপুত্রটি একটি বউ জুটিয়ে নিতে পেরেছে দেখে আমার মনে খুব আনন্দ হল। মেয়েটি নেহায়েত পাখি বলেই আমি খায়-খরচের দায় থেকে রেহাই পেয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে শালিকটি একেবারে একা একা ছফার ছাদে আসে। সঙ্গে বউটিও থাকে না। দেয়ালে বসে ডাকাডাকি করে।

আমার মন আনন্দে আটখানা হয়ে যেতে চায়। আমি ধরে নিয়েছিলাম, আমার পাখিপুত্র আমার সঙ্গে ব্যক্তিগত কুশল বিনিময় করার জন্যই এমনিভাবে একাকী আসে। পাখিপুত্রটি আমার কথা স্মরণ রেখেছে। এর বেশি আমি কী চাইতে পারি! (ছফা ১৯৯৬ : ৭২)

পাখিপুত্রের কাছে ছফার ঋণের শেষ এখানেই নয়। ছফার ভাষায়, ‘সে আমার দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, অনুভূতিকে তীক্ষ্ণতর করেছে। পাখির কণ্ঠের বৈচিত্র্য শুনে অনুভব করতে পারি, এখনো মানুষের ভাষা কতদূর সীমিত। কত কিছুই আমি জানতাম না। আমার জানালার পাশের আমগাছটিতে যে দশ বারোটি বুলবুলি স্থায়ীভাবে বাসা করে থাকে, তার কিছুই আমি জানতাম না। এখন সকালবেলা দরজা খুললেই দেখি আমার ডাইনে বাঁয়ের বাড়িগুলোর দেয়ালে, গাছে গাছে ঝাঁকে ঝাকে বুলবুলি ছুটোছুটি করছে।’ উড়ে আসে একটা দোয়েল। গাঙশালিকেরা ঝাঁক বেঁধে তাঁর বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। কোথা থেকে আসে একটা হলুদ পাখি, আসে কয়েকটা চড়াই। বয়ানকারের খেয়াল হয় এই চড়াই জাতটা তবে বিশেষ সুবিধার বস্তু নয়। অনেকটা সুশীল সমাজের মত তাদেরও আচরণ। ছফা ক্ষুব্ধ তাদের ওপর : ‘অপোগণ্ড রবীন্দ্রপোষ্যরা কুকর্ম করে যেভাবে পার পেয়ে যায়, এই চড়াই দুটোও সেভাবে আমাকে বোকা বানাবে।’

আহমদ ছফা একটি চরিত্রের নাম রেখেছেন সুশীল। সে হয়তো ধর্মে খ্রিস্টান, জাতে নমশুদ্র, কিন্তু নিশ্চিত ছফার পালিতপুত্র পাখির মত প্রায়। সে এবং ইদ্রিসটা মিলে চড়াইয়ের পক্ষ নিয়েছে। চড়াই মেয়েরা ইয়াহুদি মেয়েদের মতন পুরুষের পর পুরুষ নির্ভেজাল রক্তের ধারা পার করে দিচ্ছে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির আড়ালে। বাবু ছফার বাসায় রবি ঠাকুরের একটা ছবি। (আহমদ ছফাও যে খানিক বাবু তার তার ক্রিয়ার ব্যবহারে খানিক টের পাওয়া যায়।) ঝড়ে সেই ছবি পড়ে গেছে। কিন্তু এই ছবি ফেলে দেওয়া যায় না। ছফা নামক চরিত্রের কথায়, “রবি ঠাকুর এমন মাল এড়াতে চাইলেও কি এড়ানো যায়?’

মজার ব্যাপার, রবি ঠাকুর কেন, চড়াই পাখিদেরও এড়ানো যায় না। ইদ্রিস পাখির বাসা ফেলে দেবে না। তার কথা : ‘হে আমি পারতাম না। আমার ঘরে বউয়ের পেডেত বাচ্চা।’ সুশীল বলল, এইবার পাখির বাচ্চাগুলো বড় হয়ে উড়ে যাক, তারপর বাসাটি আমি নিজেই ভেঙ্গে দেব। তারপরে কত জোড়া জোড়া আণ্ডা দিল, কত জোড়া চড়াই উড়ল। বাসাটি রবি ঠাকুরের ছবির পেছনে পড়ে রইল। শেষ পর্যন্ত ছফাও পাখির বাসা ভাঙ্গতে পারলেন না। তার যুক্তিও কম সুশীল নয় :

এই চড়াই হারামিরাও পাখি সমাজের পর্যায়ভুক্ত। পাখিদের একটি প্রজাতির ওপর যদি নির্যাতন করি, বৃহত্তর পাখিসমাজ সেটা মেনে নেবে না। পাখিসমাজে আমার দুর্নাম রটে যাবে এবং আমার পাখিপুত্রটি সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না। তাকে আমার এখানে আসা বাদ দিতে হবে। (ছফা ১৯৯৬:৭৭)।

কি অপরাধ এই পাখিদের? সূর্য ওঠার পর থেকে সূর্য ডোবা পর্যন্ত নিরন্তর যৌনসঙ্গম করে যাওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই। তবু তাদের এহেন ইচ্ছারতি সইতে হয় কুমার আহমদ ছফার। পুত্রের মায়া বড় মায়া। সুশীল সমাজে পরিবারের ভূমিকা রাষ্ট্রের অধিক–আহমদ ছফার মতন এমন টের কাকপক্ষীও পায় না। মুক্ত ও বন্দীজীবনের এমনই এক শান্ত মহাকাব্য আহমদ ছফার ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’।

‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণে’র সংহার অনুচ্ছেদ এই আবেগের চূড়ান্ত প্রকাশ। এখানেই আহমদ ছফা রায় দিয়েছেন : ‘একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’ এই শিক্ষা তিনি কোথায় পেলেন? পেয়েছেন তাঁর পাখিপুত্রের কাছে :

আমি পুত্রটির কাছে বিশেষভাবে ঋণী। আমার পাখিপুত্রটি আমাকে যা শিখিয়েছে কোন মহৎ গ্রন্থ, কোন তত্ত্বকথা, কোন গুরুবাণী আমাকে সে শিক্ষা দিতে পারেনি। একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে। আমার পাখিপুত্র মুক্ত, আমি মুক্ত, আমাদের সম্পর্ক থেকে প্রত্যহ অমৃত উৎপন্ন হয়। এই আকাশের জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের যে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে, সেটা কি অমৃত সমুদ্রে অবগাহন নয়? (ছফা ১৯৯৬ : ৭৭)

মানুষের মুক্তি কি বস্তু এবং তা কোন পথে পাওয়া যায়? এই চিন্তার ইতিহাস খোদ পৃথিবীর ছায়ার মতই দীর্ঘ। একেবারে আমাদের যুগের গোড়ায় এসে যদি থামি দেখি, সপ্তদশ ইংরেজি শতাব্দীর ওলন্দাজ দার্শনিক একদা ইয়াহুদি স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) বলেছেন, একমাত্র অনাদি এবং অনন্ত খোদ বা স্বভাবের সাথে এককাট্টা হওয়ার মত জ্ঞান উপায় করেই মানুষ মুক্ত হতে পারে। খণ্ডের মরিচীকায় নয়, অখণ্ডের স্থিরতাই মুক্তি। এই নিখিল স্বয়ং-ভাব বা স্বভাবই স্পিনোজার খোদা। স্পিনোজার খোদা বা স্বভাব সময়ের সীমায় দেশের চৌহদ্দিতে সুলভ নন। খোদার মাত্র দুই গুণ-বিস্তার ও চিন্তা-সসীম মানুষের কাছে ধরা দেয়। যারা মনে দেখতে পান সবকিছুই স্বভাবের বা খোদার প্রকাশ তারাই মুক্ত। এই দেখতে পাওয়ার বা বুদ্ধির প্রণয়ই মুক্তির পথ জানিয়েছেন স্পিনোজা। ইয়োরোপ বহুদিন স্পিনোজাকে নাস্তিক’ জ্ঞানে নাকচ করেছিল। কিন্তু আঠারো ইংরেজি শতকের শেষে আবার তাঁর কদর ফিরে আসে। জার্মান মহাত্মা গ্যেটে, ইংরেজি কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ প্রমুখ মনীষী স্পিনোজার কদর করেছেন। আমাদের আহমদ ছফাও গ্যেটের অনুরাগী। অনুমান করি তিনিও স্পিনোজার মত একটা চিন্তাজগতে উঠে গিয়েছেন। আমার কখনো কখনো মতি হয়, বলি, স্পিনোজার চাইতেও আহমদ ছফার সিদ্ধি অধিক। মানুষের মুক্তির প্রস্তাব উত্থাপনের জন্যে স্পিনোজা খোদ বা প্রকৃত ভাব বা খোদা থেকে শুরু করেন। অগুণতি অ-খোদ বা খণ্ড মানুষের সাথে খোদ বা অখণ্ডের সম্পর্ক তাঁকে দেখাতে হয় অনেক গভীর অপদার্থ বিদ্যার বরাত দিয়ে। আহমদ ছফাঁকে তা করতে হয় নাই। অথচ তিনিও স্পিনোজার মত একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন : যে মানুষ নিজেকে ‘আশরাফুল মখলুকাত’ মনে করে সে মানুষ মুক্তি লাভ করে না। মুক্তির পথ নিজেকে দেশের একজন মনে করার মধ্যেই। (স্পিনোজা ১৯৯৬: ২৫-৩১) একমাত্র অন্যকে মুক্ত করার মধ্যেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’

স্পিনোজার নীতিকথা শুরু হয় খোদা বা স্বভাব থেকে। আহমদ ছফা শুরু করেন ঢাকা শহরের একটি নিম্ন-মধ্যবিত্ত পাড়ায় বাড়িভাড়ার গল্প দিয়ে। সপ্তদশ থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ইয়োরোপখণ্ডে সিভিল সোসাইটি’ বলতে যা বোঝাতো তার গোড়ার কথাও এই ভাড়া এবং চুক্তি। ইংরেজ দার্শনিক হবস এবং লক প্রভৃতির যুগ থেকে জার্মান দার্শনিক হেগেল এবং মার্কস পর্যন্ত সিভিল সোসাইটির সারকথাও চুক্তি, যেমন ব্যবসায়ে তেমনি সমাজেও চুক্তিই হয়ে উঠেছিল নতুন বুর্জোয়া সমাজের প্রধান রূপকথা। স্পিনোজাও এরই প্রবক্তা। স্পিনোজার দর্শনে খোদা বা স্বভাবের যে জায়গা আহমদ ছফার এই রূপকথায় বাড়িভাড়ার চুক্তিও সেই জমিতেই অবস্থান করে। ছফার মনীষা এখানেই আমাকে রুদ্ধবাক করে রাখে। পাছে বেয়াদবি হয় এই ভয়ে লেখা পিছিয়ে দিয়েছি–একথা গোড়াতেই কবুল করতে হয়েছে আমাকে।

টের পাই, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’ অভিজাত শ্রেণী, দাতাগোষ্ঠী বা ওদের দালাল সমাজের পেটে হজম হওয়ার জিনিস নয়। কারণ আধুনিক ধনতন্ত্রের যে হয়রানির কবলে পৃথিবী আজ ধ্বংসপ্রায়, আহমদ ছফা তার আদি ও আসল ছহি বড় জঙ্গনামা লিখে বসে আছেন।

আমাদের অপরভাষায় (অপর ভাষায়, পরিভাষায় নয়) সুশীল সমাজ’ মানে এই ভাড়ার সমাজ। এ সমাজ খাঁচার সমাজও বৈকি। বঁটিশালিকের আদলে আহমদ ছফা সেখানে আমাদের সবাইকে বন্দি করেছেন। এক জায়গায় তিনি বলেন :

মানুষের আত্মাকে তো বারবার পাখির সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। এই পাখিটির অবিরাম ছুটোছুটির মধ্যে আমি আমার গহনচারী আত্মার অভিসারের ছায়া প্রত্যক্ষ করে স্তব্ধ বিস্ময়ে বসে থাকি। (ছফা ১৯৯৬ : ৬৬)।

ছফার মত মাল বুর্জোয়া সমাজ ফেলেও দিতে পারবে না। আবার রাখবেও-বা কী করে? তার সুশীল চেহারার নিচে তো বীভৎস বস্তি, ভাড়া ও ফাকানো।

এই সুশীল সমাজের আর এক খাম্বা বিবাহ ও পরিবার প্রথা। ছফা সাহেব বাড়ি ভাড়া করতে গেছেন। ঢাকা শহরের অতি পরিচিত এক নিত্য প্রশ্ন তাঁকেও করা হল : আপনার বেগম কোথায়?’ সাহেবের বেগম থাকবে এটাই সুশীল নিয়ম। ছফা বললেন, ‘আমার তো কোন বেগম নেই। এখানে ‘তো’ শব্দটা সারকথা বলে দিয়েছে। সুশীল সমাজে বউ বা বেগম থাকতে হয়। তাঁর নেই। তাই তো এর প্রয়োগ। বাড়িওয়ালার তবুও বিশ্বাস হয় না। সে কি করে হয়? মারা গেছে না? কতদিন হয়? যখন তিনি জানলেন, তার হবু ভাড়াটিয়া একেবারে বিয়ের মুখই দেখেন নাই তখন আমাদের পরহেজগার সাহেব সুশীল’ কর্মচারী মহোদয় আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, ব্যাচেলর মানুষের কাছে বাড়িভাড়া দেয়ার তো কোন নিয়ম নেই। সুশীল সমাজে এ কথা উঠবেই, তা তো জানা কথা। ছফাও বললেন, তা জানতাম।

তবু আশ্চর্যের বিষয় সিভিল সোসাইটিতে অর্ধেকেরও বেশি প্রাপ্তবয়স্কের সাহেব কিংবা বেগম নাই। তারা আকাশের নিচে কোথায় কোন মোকামে থাকেন? বাড়িওয়ালা সাহেবের বাড়িটাও তো ভাড়াটেস্থ করার প্রয়োজন। পরিবার বলতে শুধু বেগমযুক্তি বা বেগমচুক্তি বোঝায় না। বাড়িওয়ালার মুখে ইংরেজি, পানদোক্তা এবং আপশোস তিনটাই চুকচুক করে। তিনি মিনিস্ট্রি অব এডুকেশন থেকে সেকশন অফিসার হিসেবে রিটায়ার করেছেন আজ পাঁচ বছর। (ছফা ১৯৯৬ : ৯)

আহমদ ছফার সুশীল সমাজে পুষ্পও ফোটে। ছফার সাকরিদ পালিতপুত্র সুশীল ছাদের এক কোণায়–এই নতুন বাসায়–শুরু করল তুলসি ও নয়নতারার চাষ। সুশীল সমাজের এলাকায় প্রতিদিন যে শ্রেণীসংগ্রাম–সে সংগ্রাম মাথাচাড়া দেয় অপাপবিদ্ধ ফুলের পুরাণেও। ছফা লিখেছেন :

প্রতিদিন কত ফুলই তো দেখি। তুলসি এবং নয়নতারার ফুল দেখে প্রাণে যে হিলোল জাগে, অন্য ফুলে তেমন হয় না কেন? বোধহয় প্রাণের সঙ্গে সংযোগটি স্থাপিত হয়নি বলে। এই তুলসি এবং নয়নতারার শিশুগুলোকে একদম মৃতদশা থেকে বেঁচে উঠতে দেখেছি। আমার পালক ছেলে সুশীলের হাতের অনেক যত্নের পরশ পেয়ে তারাও বাড়ির ছেলের মত বেড়ে উঠেছে। আমি যখন তুলসি এবং নয়নতারার ফোঁটা ফুলগুলো দেখি সেগুলোকে জীবনের দীর্ঘ সগ্রাম-লব্ধ বিজয়-মুকুটের মত মনে হয়। তুলসি এবং নয়নতারার ফুল দেখে আমার জীবনের প্রতি আস্থা এবং বিশ্বাস নতুন করে জন্মায়। (ছফা ১৯৯৬ : ১৪)।

ছফা শুনলেন, তাঁর ভক্তরা কয়েকটা গোলাপের টব নিয়ে আসবেন। সুশীল সমাজের গোড়ার সমস্যা–পদ ও শ্রেণীর জঞ্জাল-ভেসে উঠল। সারারাত ধরে ছফার কেমন জানি মনে হতে লাগল তার নয়নতারারা কাঁদছে। কারণ সন্ধ্যাবেলা ভাইপো আনোয়ার চারটা বড় বড় গোলাপের টব আমদানি করেছে। সেই শ্রেণীহীন ফুলের ছাদেও শ্রেণী সংগ্রামের সূচনা হয়েছে। কিন্তু স্পিনোজার পথ ষোল আনা ভুলে যাওয়ার সুযোগ আহমদ ছফার মত মনীষীকেও দেয়া হয় নাই। তিনিও বলতে বাধ্য : ‘গোলাপ যখন বর্ণে গন্ধে পুরো বিকশিত হয়ে ওঠে, তাকিয়ে দেখলে মনে হয় তার ভেতর থেকে ঈশ্বরীয় বিভূতি প্রকাশ পাচ্ছে। কমবেশি সব পুষ্পের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন। গোলাপগুলো যখন ফুটতে থাকল–ছফা লিখেছেন তিনি তাদের সঙ্গে নয়নতারাদের কোন বিবাদ আছে তার আভাসটিও খুঁজে পেলেন না। বেশ তো আছে নয়নতারা এবং গোলাপ সৎ প্রতিবেশীর মত। তাহলে তিনি কেন ভাবলেন, গোলাপের আগমনে নয়নতারারা বেজায় বেজার? ছফার উত্তর :

এখন বুঝতে পারছি এটা নয়নতারাদের মনের কথা ছিল না। আমার মনের কথাটিই তাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছি। মানুষ সুবিধের জীব নয়, তারা নিজেদের মনের ময়লা কাদা এগুলো ফুলের শরীরে মাখিয়ে দিয়ে ভীষণ আনন্দ পায়। (ছফা ১৯৯৬: ১৬)।

মানুষের বিরুদ্ধে ছফার এই অভিযোগ সুশীল সমাজের আরেক খাম্বায় গিয়া পড়ে। এই বস্তুর নাম সাম্প্রদায়িকতা বা আরো বানান করলে বলা যায় ধর্ম সাম্প্রদায়িকতা। ভারতবর্ষে আর্যদের অভিযানের সময় আর্যরা হোম করতেন, পূজা করতেন ভারতের পুরাণাতর জাতিরা। পুষ্প আর পূজা কথা দুটি এক জায়গার সন্তান। আর্যরা আপোসে পূজাবিধি বা পুষ্পচার গ্রহণ করেন। অনেকদিন পর পারস্যাগত মুসলমান জাতিগুলো ভারতবর্ষে গোলাপ নিয়ে আসেন। আর্য পূজাবিধিতে এই নবাগত ম্লেচ্ছ বা যবনদের আমদানি কল্কে পায় নাই। ছফা লিখেছেন :

গোলাপকে নিয়ে একটু গোলে পড়ে গেলাম। এই সুষমাসম্পন্ন পুষ্পটি দেবতার সেবায় লাগে না। দেবতার দুর্ভাগ্য না পুরোতের ঈর্ষা আমি কেমন করে বলব। পুজোয় কেন। পুষ্পের প্রয়োজন হয়, এখন মনে হচ্ছে তার মাহাত্ম অল্প অল্প বুঝতে পারি। গাছের সঙ্গে ফলের সংযোগসূত্রটির যে মিলনবিন্দু, সেটাই তো পুষ্প। পুষ্পের মধ্যে গাছ এবং ফল দুই-ই বর্তমান রয়েছে। যেমন, গোধূলির মধ্যে দিন এবং রাত যুগপৎ অবস্থান করে, তেমনি ফুলের মধ্যে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এ-ওর হাত ধরে সুখনিদ্রায় শয়ান রয়েছে। অনেক ভেবে দেখেছি, পুজোর চাইতে ফুলের কোন উৎকৃষ্ট ব্যবহারের কথা আমি চিন্তাও করতে পারিনে। (ছফা ১৯৯৬ : ১৬)

ধর্মের সাথে ফুলের, পূজার সাথে পুষ্পের এই দ্বন্দ্বের আগেই ছফা পুষ্পের ধর্মে, ফুলের দ্বীনে ঈমান আনেন : ‘যে দেবতাকে ধরতে পারিনে, ছুঁতে পারিনে, তাঁর উদ্দেশে যদি পুম্পাঞ্জলি নিবেদন করি, তিনি হয়তো মুখ তুলে চাইবেন’–লিখেছেন। এক জায়গায়। আর জায়গায় পড়ি :

কমবেশি সব পুষ্পের মধ্যে ঈশ্বর বিরাজ করেন। কিভাবে বিরাজ করেন, আমি বলতে পারব না। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোথাও কোনখানে যদি ঈশ্বর নাও থাকেন, শুধু পুস্পাঞ্জলি নিবেদন করার জন্য আমাকে একটা ঈশ্বর মনে মনে বানিয়ে নিতে হবে। (ছফা ১৯৯৬:১৬)।

সবশেষে বৃক্ষ পুরাণ। ছফাঁকে এখানে স্পিনোজার সাকরিদ মনে হয়। তাঁর মতে : আল্লাহতালা তার গোপন (বাতেন) শক্তির একটা অংশ বৃক্ষজীবনের মধ্য দিয়ে ক্রিয়াশীল করেছেন। এই কারণেই একদিন না একদিন মানুষকে বৃক্ষের কাছে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। একটু পরেই তিনি জানান :

বৃক্ষের ভেতরে যে সরল জীবনপ্রবাহ স্পন্দিত হয়, তার সঙ্গে মানুষের হৃদস্পন্দনের অবশ্যই একটা মিল আছে। প্রকৃতিগতভাবে উভয়ে একই বস্তু। কিন্তু তারতম্য হচ্ছে শক্তি এবং গতিশীলতার। গ্রিক পণ্ডিত আরিস্ততল তো মানুষকে চলমান উদ্ভিদ বলে অভিহিত করেছিলেন। (ছফা ১৯৬৬:১৭)।

আহমদ ছফা মনে করেন, অন্য যে-কোন প্রাণীর মত গাছেরও একটি জীবন্ত সত্ত্বা বা ভাব আছে। তাঁর গল্পটা–তিনিসহ অনেকেই বলবেন–অর্ধেক গাছ থেকে আর অর্ধেক প্রাণ থেকে হয়ে ওঠা। একটা উদাহরণ নেয়া যাক। ছফা সাহেব এক সন্ধ্যাবেলা একজন নিকটাত্মীয়ের এন্তেকাল সংবাদ পান। মনটা খারাপ। ঘুম আসছে না। বিছানা ছেড়ে উঠে সদ্য রোপণ করা একটি চারার কাছে বসেছেন মোড়া নিয়ে। ছফা উবাচ :

এই সময়ে একটি অভাবিত কাণ্ড ঘটে। আপেলচারাটি সারা শরীর আন্দোলিত করে শাখা পল্লব দুলিয়ে হঠাৎ আমার শরীর স্পর্শ করল। আমার খালি গা, মনে হল, আপেলশিশু আমার বেদনায় সমবেদনা প্রকাশ করছে। সচেতনভাবে চিন্তা করে দেখলাম, তা কেমন করে হয়। বাতাসের ঝাঁপটায় হঠাৎ তরুশিশুটি একপাশে হেলেছে। আমার পরখ করে দেখার একটা ইচ্ছে জাগল। উত্তরদিকটিতে বসেছিলাম। দিক পরিবর্তন করে দক্ষিণে এসে বসলাম। আবার দেখি, আপেলশিশুর মাথাটি ধীরে ধীরে অল্প অল্প হেলতে হেলতে নত হয়ে আমার বুক স্পর্শ করল। পুবদিকে, পশ্চিমদিকে গিয়ে বসলাম। প্রতিবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটল। এবার আরেকটু দূরে সরে গিয়ে একটি হাত একটুখানি সামনের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সত্যি সত্যি তরুর একটি শাখা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে আলতোভাবে আমার হাত ছুঁয়ে গেল। (ছফা ১৯৯৬: ১৯)।

আহমদ ছফার বেগুনক্ষেত উপাখ্যানটি আমি এখানে বাদ দিয়ে যাব। গাছ জীবন সম্পর্কে তাঁর অনেক মজার কথা সেখানেও পাওয়া যেত। এখন সুশীল সমাজের সমাপ্তিকথায় বা রোজ কেয়ামতে আসি। আগেই বলার চেষ্টা করেছিলাম এ বইয়ের আসল কাহিনী মানুষের। বস্তির মানুষ বা বাস্তুহারা সমাজের শিশুদের নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আহমদ ছফা সহকর্মী নাজিমুদ্দিন মোস্তানযোগে একটি শিশু-কিশোর পাঠশালা বসান। এই অভিজ্ঞতার পূর্ণাঙ্গ বিচার করার জায়গা এখানে হবে না। শুধু একটি ঘটনার দিকে আমরা তাকাবো।

সুশীল সমাজের তলায় কি পদার্থ থাকে? সম্পত্তি ও চুক্তির সমাজে সম্পত্তিহীন মানুষের জায়গাটা কোনখানে? তার জায়গা শ্রমিক বা কামলার। কিন্তু যে সমাজে মানুষ শুধু সম্পত্তি থেকেই চ্যুত নয়, কাজের, কর্মসংস্থানের সুযোগ থেকেও বঞ্চিত সেখানেই গড়ে ওঠে গ্রাম-খারিজ মানুষের, বাস্তুহারার বস্তি। বস্তির মানুষ শ্রমিকেরও অধম। সেই অভিজ্ঞতা ছাড়া সুশীল সমাজের বিচার পূর্ণ হয় না। লুম্পেন প্রলেতারিয়েত সুশীল বুর্জোয়ারই পাল্টা প্রতিচ্ছবি।

এই বস্তিরই এক অনাথ শিশু। নাম দুনিয়ার প্রভু অর্থাৎ আলমগীর। ধনতান্ত্রিক সুশীল সমাজে মানবিক সম্পর্কের অবনতি মানুষকে কতখানি নিচে নিয়ে যেতে পারে তা আহমদ ছফা তুলে ধরেছেন আলমগীর উপাখ্যানে। আলমগীরকে বাড়ি কোথায় জানতে চাইলে বলত হাসপাতালে। মা-বাবা জাতীয় সবকিছুর পরিচয় দিত। হাসপাতাল।

তার জন্ম হাসপাতালে। জন্মের সময় মা মারা যায়। বাবাকে সে কোনদিন চোখে। দেখেনি। কিভাবে সে মানুষ হয়েছে, কে লালন-পালন করে এত ডাগর করেছে সে সংবাদ কারো কাছে প্রকাশ করেনি। ছেলেটি নীলক্ষেত বস্তিতে থাকে। দুপুরবেলা পুলিশ ক্যান্টিন থেকে পুলিশদের খাবার নিয়ে যায়। নিজের দুপুরের খাবারটাও সেখানে খায়। বিকেলের নাস্তা এবং রাতের খাবারটা জোটাবার জন্য নিউ মার্কেটে মিন্তির কাজ করে কিংবা হলের ছেলেদের ফাইফরমাশ খাটে। এই বাচ্চাটাই সব চাইতে বেপরোয়া। তার ঘর-বাড়ি, মা-বাবা সম্পর্কে কোনও ধারণা নেই। এসব কেন থাকতে হবে, সে বোঝে না। তাকে অক্ষরজ্ঞান শেখাতে গিয়ে আমাদেরও যে অভিজ্ঞতা হল, মোষের শিং থেকে দুধ বের করা তার চাইতে অনেক সহজ। অন্য বাচ্চারা যখন ঘরে মা-বাবা, ভাই বোনদের কাছে ফিরে যেত, আলমগীর উদাস নয়নে সে দৃশ্য দেখত। সমস্ত পৃথিবীর সঙ্গে এমন নিঃসম্পর্কিত কোন মনুষ্যশিশু ইতোপূর্বে আমি দেখিনি। (ছফা ১৯৯৬: ৪২)

ছফা সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন, আলমগীরকে নিজের ঘরে রাখবেন। আলমগীর নির্বিকার। ওর এতে ইচ্ছাও নাই, অনিচ্ছাও নাই। ছফা জানালেন :

আমি আলমগীরের জন্য ছোট্ট একটা তোষক কিনলাম। তাকে জামা-কাপড় বানিয়ে দিলাম, স্যান্ডেল কিনে দিলাম। আলমগীর থাকছে, খাচ্ছে ঘুমোচ্ছে কিন্তু তার মধ্যে কোন ভাবান্তর দেখতে পাচ্ছিনে। সে আমার কোন কথা শোনে না। যখন তখন রাস্তায় ছুটে যায়। তার এই অনিকেত স্বভাবটি ভুলিয়ে দিয়ে তার ভেতর কতিপয় নতুন অভ্যেস তৈরি করার জন্য পণ করে বসলাম। বারবার চেষ্টা করেও তার মধ্যে কোন পরিবর্তন আনা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। অথচ ভেতরে ভেতরে আমি ক্লান্ত হয়ে পড়ছিলাম। (ছফা ১৯৯৬ : ৪৩)

‘যাতে সঙ্গ দোষে ছেলেটি আর নষ্ট না হয়’ তার উদ্দেশ্যে ছফা সাহেব তাকে সবসময় চোখে চোখে রাখতেন। তিনি যেখানেই যেতেন সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ছফা লিখেছেন :

আমাকে যখন আলমগীরের সঙ্গে দেখত অন্য বাচ্চারা হাততালি দিয়ে হেসে উঠত। তাদের সঙ্গে আলমগীরও হেসে উঠত। কেন হাসছে, কারণ জিগগেস করলে সকলে চুপ করে আমার দিকে তাকাত। এক সময় আমার ধারণা হল, বাচ্চারা নিশ্চয়ই আমার কোন খুঁত ধরতে পেরেছে। সেজন্যই আমাকে দেখলে খল খল করে হাসে। অথচ জিগগেস। করলে কেউ কিছু বলে না। (ছফা ১৯৯৬ : ৪৩)

একদিন বস্তির আরেক শিশু বাবুলকে রাস্তায় একা পেলেন ছফা সাহেব। এই বাবুল শিশুটি বড় নকলপটু। বিশ টাকা দিলে সে শেখ মুজিবের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেয়া ভাতে মারব, পানিতে মারব বক্তৃতাটি দিত। পনেরো টাকা দিলে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর নকল করে বক্তৃতা দিত। তাকে কমলা এবং বেলুন কিনে দিয়ে ছফা বললেন :

আচ্ছা বাবুল, বল তো বাচ্চারা আমার সঙ্গে আলমগীরকে দেখলে হাসে কেন? বাবুল বলল, বড় ভাই আপনে জানেন না? আমি বললাম, তুমি না বললে জানব কেমন করে। সে বলল, আপনে মায়ের পেডে আছেন, কিছু জানেন না? আলমগীর বলেছে আপনে তারে ফাঁকাইবেন। হের লাইগ্যা সব দিতাছেন। এই ফাঁকাইবার অর্থ কী আমি জানিনে। আমি বললাম, বাবুল ফাকানো কী জিনিস। বাবুল বলল, বড় ভাই আপনে কিছু বোঝেন না, আলমগীর বলে এক সময় আপনে তার লগে খারাপ কাম শুরু করবেন। (ছফা ১৯৯৬ : ৪৩)

এই বাক্যটি পড়ার পর আমার প্রথম সংশয়টা পুরোপুরি কাটল। দাতা ও মদতদাতাদের টাকায় তো এই বই লেখা সম্ভব নয়। লেখা হলেও ওরা টাকা ফেরত নিয়ে যাবেন। ওদের সে ফ্রিডম আছে।

আহমদ ছফা ১৯৭২ সনে লিখেছিলেন, বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না, আর এখন যা বলছেন শুনলে দেশের সমাজ-কাঠামোর আমূল পরিবর্তন হবে না।’ ছফা যাঁদের বুদ্ধিজীবী নামের আড়ালে লুকিয়েছিলেন এখন তাঁরা নিজেদের সুশীল সমাজের অংশীদার করে নিয়েছেন। (ব্লেয়ার ২০০০, কোচানেক ২০০০)

বোঝা যায়, দেশের লোক আহমদ ছফার পরামর্শে কান দেয় নাই। (সমাজ কাঠামোর) পরিবর্তনের মধ্যে এই হয়েছে বুদ্ধিজীবীরা সুশীল সমাজ হয়েছেন। এখন সুশীল সমাজ যা বলছেন তা শুনলে আমাদের দেশের শিশুরাও হাসে। আমাদের সাধারণ মানুষ জানে, সুশীল সমাজই (যারা বাচ্চাদের স্কুলের জন্যে অনেক টাকা খরচ করে, তোষক কেনে, জামা-কাপড় স্যান্ডেল কিনে দেয়, মাঝে মাঝে অল্প-স্বল্প মারধোরও করে) এক সময় তাদের ফাঁকাইবেন। কিন্তু এই ফাঁকানো কি জিনিস আহমদ ছফার মত, পাঠক, আপনেও বোঝেন না! আমিও বুঝি নাই। শুনেন, আপনারা নাটক বোঝেন, কিন্তু ফাটক বোঝেন না।

শোনা যায়, ১৯৪৩ সালে আহমদ ছফার জন্ম। তার এক বছর আগে নাৎসি জার্মানির বাহিনী গ্রিস দখল করে। সেই দখলের বিরুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধে গ্রিসের সাধারণ ডাকাতরাও অংশ নেন। এঁদের অনেকেই তখন কমিউনিস্ট পার্টির পতাকা হাতে নেন। কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে গ্রিসে আমেরিকান ও ব্রিটিশ বাহিনী হাজির হয়। ১৯৪৫ সালে মস্কোস্থ কমিউনিস্ট পার্টি ইয়াল্টা চুক্তিমাফিক গ্রিসে ইঙ্গ-মার্কিন আধিপত্য মেনে নেয়। স্থানীয় কমিউনিস্ট মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ অস্ত্র সমর্পণ করেন, কেউ করেন না। ১৯৪৬ সনের পর সেখানে কমিউনিস্ট নিপীড়ন প্রকাশ্য যুদ্ধের রূপ নেয়। ১৯৪৯ নাগাদ কমিউনিস্টরা পরাস্ত হন। তখনকার বন্দী কমিউনিস্টদের উদ্দেশ্যে ইঙ্গ-মার্কিন তরফদার গ্রিক ডানপন্থীরা যে নীতি গ্রহণ করে তার সাথে আমাদের বর্তমান সুশীল সমাজের নীতির এক দূরাগত মিল আছে।

গ্রিসের লোকসংখ্যা তখন ৭০ লাখ। বলা হয়, ১৯৪৩-১৯৪৯ এর এক গৃহযুদ্ধেই সে দেশে ৬ লাখ লোকের প্রাণহানি হয়। ইউরোপের ঠাণ্ডাযুদ্ধের সেই সূচনাকাল আর আমাদের দেশে ঠাণ্ডাযুদ্ধের এই পরকালে অনেক ব্যবধান। তবুও আমার মনে হয় কোথায় জানি কী এক মিল আছে। ‘পুষ্প বৃক্ষ ও বিহঙ্গ পুরাণে’ শুনি ডাকাতসেনার গান। পাথারকালো মাটি বধুয়া আমার।

বন্দী কমিউনিস্ট সেনাদের উদ্দেশে ডানপন্থী সেনাপতি জিকাকিস একদিন বললেন :

আমরা এখন তোমাদের বিনা ওজরে হত্যা করতে পারি। সে হত্যার অধিকার আমরা রাখি। আমরা যদি তোমাদের প্রাণে বাঁচিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি, তো নিয়েছি এক কারণে আমরা চাই তোমরা আমাদের জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দেবে। আমাদের বাধা দেবার শক্তি কারো নাই। আমরা এ যুদ্ধে জয়ী হয়েছি, তোমরা পরাজয় মেনে নিয়েছ। যুদ্ধে যারা হারে, ভাগ্য তাদের যা দেয় তাই গ্রহণ করতে হয়।…এখন যাও, ওপাশে গিয়ে তোমাদের পুরানা কমরেডদের সাথে একটু খোশ-গল্প করে আস। ওরা এরই মধ্যে আমাদের জাতীয়তাবাদী দলে যোগ দিয়েছে। হয় দলে যোগ দেয়ার মুচলেকায় দস্তখত দিয়ে আস, নয় মৃত্যুর জন্যে তৈরি হও। যদি ভাবতে চাও এ আমাদের দয়া, তো ধরে নাও দয়াই করছি। যদি ভাবতে চাও তোমাদের অপমান করতে চাইছি, তবে জেনে রেখ এর নাম অপমান। যদি মনে কর এর নাম নীতিমত ধর্ষণ, তো ঠিকই আছে, এর নাম নীতিমত ধর্ষণই। (এমুদ ১৯৭২:৩৫৭-৮)

সকলেই যখন বলে নীতিমত ধর্ষণ মানে অনুগ্রহ, তখনও আলমগীররূপী আহমদ ছফা জানেন অনুগ্রহ মানে ‘আপনে তারে ফাঁকাইবেন।’ মজা কি জানেন? এখানে এসেই ফেরেশতারূপী ছফাবাবু বা সুশীল সমাজ বিলকুল ভুলে বসেছেন : একমাত্র অন্যকে মুক্ত করেই মানুষ নিজের মুক্তি অর্জন করতে পারে।’ আহমদ ছফাও ভুলে আছেন তিনি আলমগীরকে বন্দি করেছেন তোষক ও স্যান্ডেলের খাঁচায়। এখানে তাঁর পাখিপুত্র শালিকটিকেও তিনি তুলেছেন। এহেন চরিত্রের ভুলকেই মহাত্মা ফ্রয়েড শনাক্ত করেন ‘অচেতন বা অজ্ঞান নামে। সুশীল ফেরেশতার সাক্ষ্য শোনার মত :

একটা অপরাধবোধ পাথরের মত মনের ভেতর চেপে রইল। আমি এই শিশুদের প্রতি আমার কর্তব্য পালন করিনি। আমার মনুষ্যজন্ম বিফল হয়ে যাচ্ছে। এই শিশুদের জন্য কি করতে পারি, এই চিন্তার মধ্যে এতদূর মগ্ন হয়ে গিয়েছিলাম যে আমি ক্ষেতের চারাগাছগুলোর প্রতি যত্ন করার কথাও ভুলে গিয়েছিলাম। (ছফা ১৯৯৬ : ৪০)

আলহামদুলিল্লাহ!

দোহাই

১. ছফা আহমদ, ‘পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গ পুরাণ’, (ঢাকা : সন্দেশ, ১৯৯৬)।

২. H.W. Blair, ‘Civil Society, Democratic Development and International Donors’, in R. Jahan, ed., Bangladesh : Promise and Performance (Dhaka : University Press Limited, 2000).

৩. Dominique Eudes, The Kapetanios : Partisans and Civil War in Greece 1943-1949, J. Howe tr., (London : New Left Books, 1972).

8. Khaldun, Ibn The Muqaddimah : An Introduction to History, F. Rosenthal, tr. and N.J. Dawood, ed., 5th Printing, (Princeton : Princeton University Press, 1981).

৫. S.A. Kochanek, ‘The Growing Commercialization of Power’, in R. Jahan, ed., Bangladesh : Promise and Performance (Dhaka : University Press Limited, 2000).

৬. N. Machiavelli, The Chief Works and Others, Vol. I, A. Gilbert, tr., (Durham : Duke University Press Limited, 1989).

৭. Benedict de. Spinoza, Ethics, E. Curley, ed. and tr., (London : Penguin, 1996).

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *