বিজনেসম্যান

বিজনেসম্যান

আমি একজন ব্যবসায়ী। কারবারের মাধ্যমেই আমি জীবিকা নির্বাহ করি। আমি ঊ্যবসায়ী বটে, কিন্তু পদ্ধতি নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করে থাকি। পদ্ধতিই আমার কাছে পরম ধর্ম বিবেচিত হয়। পদ্ধতির পরম ভক্ত আমি। পদ্ধতিকেই আমি সবচেয়ে বড় কর্ম জ্ঞান করি। পদ্ধতির বাইরে আমি একটা কুটোও এদিক থেকে ওদিকে নেই না। পদ্ধতিই আমার কাছে পাথেয় বিবেচিত হয়।

পদ্ধতিই আমার ধ্যান-জ্ঞান-সাধনা। পদ্ধতি ছাড়া আমি নিজে একটা শূন্য ছাড়া কিছুই নই। পদ্ধতিকে আমি পরম গুরু জ্ঞান করে জীবনে চলার পথে প্রতিটা পদক্ষেপ ফেলি।

সত্যি কথা কি জানেন, আসল ব্যাপার তো পদ্ধতিটাই, আর যা-কিছু সবই শূন্য।

কারবারের আত্মাই তো পদ্ধতি। কিন্তু পৃথিবীতে এমন বহু ব্যক্তি রয়েছে যাদের আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি। কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারি না।

আপনারা, যারা একেবারে একটি মূর্খ আর একটু-আধটু বাতিকগ্রস্ত তারা এ শ্রেণির মানুষদের দুচোখে দেখতে পারেন না, ঘৃণায় তাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিন সত্য, কিন্তু আমি তাদের চেয়ে অনেক, অনেক বেশি ঘৃণার চোখে দেখি, ভুলেও তাদের দিকে চোখ তুলে তাকাই না।

আমি কেন তাদের অন্তর থেকে ঘৃণা করি বলতে পারেন? এ হতচ্ছাড়াগুলো পদ্ধতি অবলম্বন করে চলা তো দুরের ব্যাপার, যথাযোগ্য সমাদর কি করে করতে হয়, তাও তাদের জানা নেই। তারা নিজেদের জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী পদ্ধতি অবলম্বন করে কাজকর্ম সম্পন্ন করে বটে, কিন্তু পদ্ধতির প্রকৃত অর্থ কি, সেটা সম্বন্ধে উপযুক্ত জ্ঞানগম্য তাদের ঘটে না। তারা অক্ষরে অক্ষরে পদ্ধতি মেনে কাজকর্ম করে, কিন্তু ভাবগতভাবে মানে জানে না।

আরও পরিষ্কারভাবে বললে–পদ্ধতির অক্ষরবোধ তাদের আছে সত্য, কিন্তু পদ্ধতির উদ্দেশ্য সম্বন্ধে কিছুমাত্র ধ্যান-ধারণা তাদের ঘটে নেই।

ইতর প্রাণি,নিচু শ্রেণির প্রাণিরা খুবই অগতানুগতিক কাজ করে থাকে বলেও কিনা পদ্ধতিটা নিতান্তই গতানুগতিক, পুরোপুরি ধরাবাধা ছকের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

এসব আহাম্মকদের সঙ্গে আমার তফাৎ তো এ ব্যাপারেই। ধরাবাঁধা ছক। ছক বলে পদ্ধতির অভিধানে কোনোকিছুর অস্তিত্ব আছে নাকি?

সত্যি কথা বলতে কি, মুনাফা লুটতে হলে যে পথ অবলম্বন করা দরকার, সেটাই তো সে মুনাফা লাভের পদ্ধতি বিবেচিত হয়।

আমার মনের কথা কে বুঝবে, কাকেই বা বোঝাব? আরে, আলেয়া ভূত কি কোনোদিন বাঁধাঁধারা পদ্ধতি মেনে কি জ্বলে আর নেভে? এ-কি কখনও সম্ভব? আহাম্মকের দল!

বর্তমানে আমি যে পুরো ব্যাপারটা সম্বন্ধে পরিষ্কার একটা ধারণা করতে পেরেছি, তা কিন্তু কিছুতেই এতটা পরিষ্কার হতো না, যদি খুব ছোটবেলায় একটা উদ্ভট দুর্ঘটনার শিকার আমি না হতাম।

এক দয়াশীলা আইরিশ নার্স, শেষ ইচ্ছাপত্রে আমি তার নাম লিখে রেখে যাব এরকম দৃঢ় সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে রেখেছি–একদিন আমার গোড়ালিটা ধরে শূন্যে তুলে নিয়েছিল, দু-তিনবার শূন্যে দুলিয়ে চোখ দুটোতে দুটো থাপ্পর কষিয়ে দিয়ে ঘাটের বাজুতে ঝোলানো একটা খড়ের লম্বা টুপির ভেতরে মাথাটাকে চেপে ঢুকিয়ে দিয়েছিল। যতখানি চিৎকার চ্যাঁচামেচি করলে কাজ চলে যেতে পারে আমি তখন তার চেয়ে অনেক, অনেক জোরে চেঁচিয়েছিলাম।

ব্যস, এটুকুই–এ একটা ঘটনার মধ্য দিয়েই আমার ভাগ্যের লিখন খতম হয়ে গেল। আমার ভাগ্য নির্দিষ্ট হয়ে গেল।

ভাগ্য সুপ্রসন্ন হওয়ার লক্ষণস্বরূপ এ দুর্ঘটনার ফলেই সে মুহূর্তেই একটা প্রকাশ পেয়ে গেল। ইয়া বড় একটা আব আর সেটা আমার কপাল আর চাদির মধ্যবর্তী অঞ্চল জুড়ে বিরাজ করতে লাগল। একেবারে স্পষ্ট, জ্বলজ্বল করতে লাগল সে বস্তুটা।

সত্যি কথা বলতে কি, এমন সুগঠিত, এমন সুচারু পদ্ধতি অনুযায়ী দেহযন্ত্র কোনোদিন কারোই এর আগে চোখে পড়েনি। কারো সৌভাগ্যও এভাবে রচিত হয়নি। আরনিটোল জ্বলজ্বলে আর…।

সে সময় থেকেই পদ্ধতি যেন আমার জীবনের রক্তের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। পদ্ধতি ছাড়া আমি যেন এক পা-ও এগোতে পারি না। পদ্ধতি ছাড়া আমার জীবন–আমার সর্বস্ব অচল।

পদ্ধতির আকাঙ্খায় আমি স্থির হয়ে পড়তে লাগলাম। পদ্ধতি ছাড়া আমি যেন দুর্বিষহ যন্ত্রণায় কাতড়ে মরি।

আমি রীতিমত পদ্ধতি পাগল হয়ে পড়লাম। পছন্দমাফিক কোনো পদ্ধতি পেলেই আমি তাকে খপ করে আঁকড়ে ধরি। সব কারবারের যা মূলমন্ত্র –সে সঠিক পদ্ধতির কথাই বলতে চাচ্ছি।

উপযুক্ত পদ্ধতি বৃদ্ধি খরচ করে বেছে নেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে বলেই না। আমার পক্ষে ব্যবসায় সাফল্য লাভ করা সম্ভব হয়েছে। আর এরই ফলে আমি ব্যবসায়ী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করকে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু যদি পদ্ধতি সঠিক না হত তবে কি আর আমার পক্ষে নিজেকে সমাজের বুকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হত? আমি বলব অবশ্যই নয়।

আমি কিন্তু একটা জিনিসকে অন্তর থেকে ঘৃণা করি। কোনোদিন, কোনো পরিস্থিতিতেই তাকে বরখাস্ত করতে পারি না। সেটা কি, তাই না? সেটা হচ্ছে ধীশক্তি, যাকে সবাই প্রতিভা আখ্যা দিয়ে থাকে তার কথা বলতে চাচ্ছি। যাকে প্রতিভাধর আখ্যা দেওয়া হয় তারা কিন্তু প্রত্যেকেই এক-একটা সাত জন্মেও নির্ভেজাল আহাম্মক–নিরেট গাধা ছাড়া কিছু নয়। সে যত বড় প্রতিভাধর, সে তত বড় গাধা। এ-নিয়মের এতটুকু হেরফের হবার উপায় নেই–মোটেই না। যত্তসব আহাম্মকের দল! আহাম্মক ছাড়া তো আর কারো পক্ষে প্রতিভার অধিকারী হওয়া সম্ভব নয়। প্রতিভার প্রকাশ যত ঘটবে, আহাম্মকিও ততই প্রকট হয়ে পড়বে।

একটা মোদ্দাকথা কখনই ভুললে চলবে না, প্রতিভাধরকে যতই রগড়ারগড়ি করা যাক না কেন, তার ভেতর থেকে কিছুতেই ব্যবসায়ী বুদ্ধি বেরোবে না, সে ঝানু। ব্যবসায়ী কিছুতেই হতে পারবে না।

আশা করি এ-কথা খোলসা করে বলার দরকার হবে না, কোনো ইহুদিকে রগড়ারগড়ি করা যাক না কেন তার কাছ থেকে একটা ঘেঁদা পয়সাও যেমন বেরোবে না, ঠিক সেরকমই প্রতিভা ধরের মত নিংড়ালেও তার ভেতর থেকে ব্যবসায়ী মতলব তিলমাত্রও বেরোবে না।

একটা কথা মনে রাখবেন, প্রতিবাদকারীরা খুবই সম্ভাবনাময় সুযোগ হাতের নাগালের মধ্যে পেলেও সে কিন্তু সে সবের কাছেও ঘেঁষবে না, বরং প্রায় গা ঘেঁষে সুরুৎ করে চলে যাবে। আর তা যদি না করে, এমন হাস্যকর কাজ করে বসবে যাতে হাসতে হাসতে দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হবে। তা যদি নাও করে তবে এমন কাজ করে বসবে যা একেবারেই অসঙ্গত অর্থাৎ যা করা উচিত ছিল। তার ঠিক বিপরীত কাজ করে ফেলে যাতে হাতে পাওয়া অপূর্ব সুযোগটা একেবারে মাঠে মারা যায়। কারবার বলতে যা-কিছু বোঝায় তার তিলমাত্রও অবশিষ্ট থাকে না। অতএব আশা করি কোনো প্রতিভাবধর হঠাৎ করে কারবার ফেঁদে বসলে পরিণামে কি ঘটতে পারে তার আর কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার দরকার নেই।

এত কথার মধ্য দিয়ে আমি যে কথা বলতে চাচ্ছি তা হল–কোনো প্রতিভাধর হঠাৎ কারবারে নামলে পরিণতি কি হতে পারে। আর এরকম ব্যক্তিদের চোখের সামনে দেখলেই অনায়াসে তাকে চিনতে পারা যাবেই যাবে। সে প্রতিভার কেরামতি দেখাতে গিয়ে যে সব অপকর্ম করে বসছে, একেবারে নাজেহালের চূড়ান্ত হচ্ছে–সে কাজের গতি প্রকৃতি অনুযায়ী তার একটা জুতসই নামও দিয়ে ফেলতে পারেন।

তার কাজকর্মের প্রকৃতি, ধরন-ধারণ দেখলেই আপনি অনায়াসেই বুঝে নিতে পারবেন।

মনে করুন, একজন কোনোকিছু কেনাবেচা করে হঠাৎ সাধারণ অবস্থা থেকে একেবারে একজন ধনকুবের বনে গেছে। তা নইলে বিরাট কারখানা গড়ে সারাদিন বিভিন্নরকম দ্রব্য সামগ্রী বানাচ্ছে, অথবা তামাক বা তুলা কারবার কেঁদে কেনাবেচায় মেতেছে, তা নইলে এরকমই অন্য কোনো কারবারে মেতেছে, নতুন চিকিৎসাবিদ্যা; আইন ব্যবসা বা কর্মকার হবার জন্য ঘুর ঘুর করছে; আর তা যদি নাও করে তবে সাবান তৈরি বা এরকমই কিছু একটা তৈরি করে চলেছে–অর্থাৎ স্বাভাবিক কাজকর্ম বহির্ভূত যা-ই হোক, কিছু একটা করতে দেখলেই তাকে প্রতিভাধর আখ্যা দিয়ে দেবেন। ব্যস, আর দেরি না করে তৃতীয় সূত্র অনুসারে তাকে মানুষ বলে গণ্য করলেও আহাম্মক ছাড়া আর কিছু বলা যাবে না। তা না করে গাধা নামকরণ করলেই কিন্তু উপযুক্ত কাজ করা হবে, যাকে বলে একেবারে জুতসই কাজ।

যাক গে, আর ওসব কথা না-ইবা বাড়ালাম। তার চেয়ে বরং আমার প্রসঙ্গেই কিছু বলছি, কেমন?

বিশ্বাস করুন, আমি কোনোদিনই প্রতিভাধর ছিলাম না। সত্যি কথা বলতে কি, আমার মধ্যে প্রতিভার নাম-গন্ধও কোনোদিন ছিল না, আজও নেই। একজন সত্যিকারেরনিখাদ ব্যবসায়ী বলতে যা বোঝায় আমি অবিকল তাই।

হ্যাঁ, আমি একজন খাঁটি ব্যবসায়ী।

আমি যে একজন মনে-প্রাণে খাঁটি ব্যবসায়ী তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেয়ে যাবেন আমার প্রাত্যহিক হিসাব-নিকাষের খাতাপত্র যাকে আয়-ব্যয়ের খাতা বলা হয়, আর আমার দিনলিপির পাতায় চোখ বুলালে। আমার কাজ একেবারে ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আমার নিজের ঢাক নিজেই পিটাচ্ছি। এছাড়া অন্য কোনো পথও তো দেখছি না।

আমার নিয়মানুবর্তিতা সম্বন্ধে জ্ঞান প্রখর, যাকে বলে একেবারে টনটনে। আর কাজের সময় জ্ঞানের তো তুলনাই হয় না। কোনো কাজ করতে নামলে একটা সেকেন্ডেরও হেরফের কখনও হয় না। আমার কাজের গতি দেখে ঘড়ির কাটারও বুঝি লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। অতএব সময় জ্ঞান যে আমার খুবই টনটনে, এ ব্যাপারে আর কোনো যুক্তির অবতারণা করার দরকার আছে বলে মনে করছি না।

কারবার চালানো তো আর যে-সে কর্ম নয়, দশজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতেই হয়। অর্থাৎ একাধিক ব্যক্তির পারস্পারিক সাহায্য সহযোগিতায়ই কারবারকে রমরমা করে তোলে। আবার আশপাশের মানুষগুলোর অভ্যাসও তো ভিন্নতর। ফলে আমাকে তাদের অভ্যাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হয় বলে নিজের মানসিকতাকেও ঠিক সেভাবেই তৈরি করে নিতে হয়েছে। এ ব্যাপারে আমি আমার গর্ভধারিণী আর জন্মদাতা পিতার কাছে শতকরা একশো ভাগই ঋণী, অকপটে স্বীকার করে নিচ্ছি। আমার অন্তহীন দুর্বলমনা মা ও বাবার কথা যদি এখানে উল্লেখ না করতাম তবে চরমতম অকৃতজ্ঞতার দায়ে নিজেকে বড়ই অপরাধী জ্ঞান করতে হত। কারণ নিয়তি আর তাদের উদার মানসিকতা সহায় না থাকলে আমার পরিণতি যে কি হত তা ভাবলে আমার মাথা আজও রীতিমত ঝিমঝিম করে। একটিবার গভীরভাবে ভাবুন তো, তারা আমাকে একজন প্রতিভাবান না বা নিয়ে ছাড়তেন কি? ব্যস, আমার দফা একেবারে রফা হয়ে যেত।

আমার ভাগ্য-দেবতা যেন একেবারে ঘড়ি ধরে কাটায় কাটায় এসে হাজির হয়েছিলেন। তিনি কৃপাবলে আমাকে মহাসঙ্কট থেকে উদ্ধার করে দিয়েছিলেন বলেই আমি বেশি হয়ে পড়িনি।

জীবনী নাম দিয়ে অদ্ভুত বইয়ের পাতায় পাতায় যা-কিছু লেখা হয়, সবাই সে সব কথাকেই সত্য বলে ধরে নিয়ে বিচার করতে বসে।

তবুও আমার বাবার প্রকৃত বাসনাটার কথা মনে পড়লেই আমার মনটা দারুণ বিষিয়ে ওঠে। তবে সে ঘটনাটা খোলসা করেই বলছি–আমি তখন মাত্র বছর পনেরোর কিশোর। দিনের একটা বড় অংশ খেলাধুলা আনন্দ-ফুর্তি নিয়েই মেতে থাকতাম।

আমার বাবা হঠাৎ আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে বড়ই ভাবিত হয়ে পড়লেন। এ বয়সেই কোনো একটা কাজকর্মে লাগিয়ে দিতে পারলে আমি ধীরে ধীরে অভিজ্ঞ হয়ে উঠতে পারব, এ চিন্তাটাই তার মাথায় চেপে বসল।

একদিন তিনি আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে একটা কাজে লাগিয়ে দিতে চাইলেন–সম্মানজনক পেশা। লোহা কেনাবেচার পেশা। এক জায়গা থেকে পাইকারি দরে লোহা-লক্কর খরিদ করে খুচরা বিক্রি করা। এতে কশিমন ভালোই পাওয়া যাবে।

ব্যাপারটা মোটামুটি এরকম–আমার বাবা আমাকে একদিকে লোহার ব্যবসায়ী আর অন্যদিকে কমিশন এজেন্ট দু-দুটো পেশায় নিযুক্ত করবেন–তার ইচ্ছা ছিল। তার বিশ্বাস এটাই নাকি সম্মানজনক উঁচু জাতের কারবার।

আরে ধ্যুৎ! উঁচু জাতের কারবার না ঘোড়ার ডিম! এ ভুলের মাশুল তাকে তিন দিনের মধ্যেই দিতে হলো।

কারবার চলাতে গিয়ে তৃতীয় দিনে আমি প্রবল জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। বাবা আমার গায়ে হাত দিয়েই রীতিমত আঁতকে উঠে বললেন–আরে সর্বনাশ! গা দিয়ে যে আগুন বেরোচ্ছে।

আমার পদ্ধতি দেহযন্ত্রটা এমন একটা অত্যাচার বরদাস্ত করতে পারেনি। মারাত্মক বিপজ্জনক পরিস্থিতি আর ব্যথা-বেদনার চোখে আমার কাতড়ানি দেখে আমার বাবা তো দারুণ ঘাবড়ে গেলেন। আর আমার গর্ভধারিণীও কম মুষড়ে পড়লেন না।

আমি বিছানায় আশ্রয় নিলাম। চৌকি থেকে নামার ক্ষমতাও এক সময় আমার শরীরে থাকল না। পুরো দেড় মাস ধরে আমাকে যমরাজের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হলো। সরু একটা সুতোয় আমার প্রাণটা কোনোরকমে ঝুলে রইল।

চিকিৎসক গোড়া থেকেই তার অধীতবিদ্যা আর অভিজ্ঞতা নিঃশেষে উজার করে যমরাজের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে আমাকে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রাণবন্ত প্রয়াস চালাতে লাগলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হবার নয় ভেবে শেষমেশ হাল ছেড়ে চলে গেলেন।

এবার বিনা চিকিৎসাই আমাকে নিতান্ত সাহসের ভর করে মরিয়া হয়ে যমরাজের চেলাচামুণ্ডাদের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকার জন্য চেষ্টা চালাতেই হলো।

হ্যাঁ, কাজ হলো। আমারই জয় হলো। রোগে ভূগে ভুগে কাঠির মতো হয়ে গেলেও আমি শেষমেশ যমরাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রোগ-শয্যা ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমার ব্যাধি নিরাময় হয়ে গেল।

তবে সর্বনাশ যা হল–আমার মাথায় বলের মতো গোল আব বা গোল শিং অপেক্ষাকৃত চকচকে হয়ে উঠেছিল। ভাগ্য দেবতার নির্দেশ তাঁর মধ্যে প্রোজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছিল।

যা-ই হোক, স্বাস্থ্য গেলেও ভাগ্যগুণে সম্মানজনক লোহার ব্যবসায়ী হওয়ার অপূর্ব ফাঁদ থেকে কোনোরকমে পিছলে গিয়ে অব্যাহতি পেয়ে গিয়েছিলাম।

রোগ নিরাময়ের মাঝপথেই আমি কৃতজ্ঞতাবশত দয়াবতী যে নার্সের কথা বারবার অন্তরের অন্তঃস্থলে ভেসে উঠছিল, যার অপরিসীম করুণায় আমার মাথায় বলের মতো ভাবটা দেখা দিয়েছে–আজও বহাল তবিয়তে যথাস্থানে জ্বলজ্বল করছে। আর তারই দূরদর্শিতায়ই তো শেষপর্যন্ত লোহার ব্যবসায়ী আর মোটা টাকাকড়ি কমিশন খাওয়ার ব্যাপারটা আমার ঘাড় থেকে নেমে গেল। নইলে আমার বরাতে যে কি ছিল, তা তো আমি বুঝতেই পারছি।

দেশের অধিকাংশ ছেলে দশ কি বারো বছরে পড়লেই বাপের আশ্রয় ছেড়ে টুক করে কেটে পড়ে। ব্যস, তারপর নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করে নেয়। বাবার খবরদারির আর ধার ধারে না।

আর আমি? আমি কিন্তু লক্ষ্মী ছেলের মতো, বাবা-মায়ের একান্ত অনুগত সন্তান সেজে ষোল বছর বয়স পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিলাম, জন্মভিটার মাটি কামড়ে পড়েছিলাম।

কেবলমাত্র ষোলটা বছরই নয়, আর কয়েকটা বছর হয়তো বাবার ছাতার ছায়াই রয়ে যেতাম। কিন্তু আমার গর্ভধারিণীর আচরণ আমার চোখ-কান খুলে দিয়েছিল। তার পৈশাচিক পরিকল্পনার কথা আমি দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে আড়ি পেতে শুনেছিলাম–আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা-কল্পনা করছেন।

আমার মা খোলাখুলিভাবেই বাবাকে যা বললেন, তাতে করে আমি এটুকুই বুঝলাম, আমাকে আমার মনের মতো কাজে লাগিয়েই বাড়ি থেকেনির্বাসিত করতে উঠেপড়ে লেগেছেন। তার পরিকল্পনাটা হচ্ছে, আমি একটা মুদিখানা খুলে টাকাকড়ি রোজকারের ধান্ধা করি। এতে নাকি দুহাতে মুনাফা পাওয়া যায়।

মুদিখানা! আমি মুদির দোকান খুলে বসব। এটাই আমার পছন্দমাফিক পেশা! শেষপর্যন্ত এমন একটা পেশার মধ্য দিয়ে আমাকে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে হবে।

ধ্যুৎ! মুদিখানার নিকুচি করেছি। মনে মনে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, বাপের অন্ন অনেক খেয়েছি, আর নয়। এবার মানে মানে কেটে না পড়লে কেলেঙ্কারীর চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

বাতিকগ্রস্ত বুড়ো বাবা-মায়ের কাছ থেকে দূরে সরে যাই। তারা তাদের চিন্তা ভাবনা নিয়ে নিজেদের খেয়াল-খুশিমাফিক জীবন কাটাক, আর আমি নিজের পথ দেখে নিচ্ছি। বাবা-মা আমাকে প্রতিভাধর করে তোলার যে স্বপ্ন দেখেছেন, এখানেই তার ইতি হোক।

এত বড় পৃথিবীটাতে আমি আমাকে একেবারে নিজের মতো করেই গড়ে তুলতে চাই, করবও ঠিক তাই। কলুর বলদের মতো চোখে ঠুলি পড়িয়ে আমাকে কেউ ঘোরাতে পারবে না। সে বান্দা এ-শর্মা নয়। আমি কি বাজিকরের হাতের পুতুল নাকি যে, যেমন খুশি আমাকে নাচিয়ে নিয়ে বেড়াবে? আমি স্বাধীন, মুক্ত! নিজের মর্জিমাফিক কাজে লিপ্ত থেকে ভবিষ্যৎ গড়ে তুলব। মাথার ওপরে কারো ছড়ি ঘোরাক, তোয়াক্কা করি না।

বাড়ি থেকে সটকে গিয়ে আমার মর্জিমাফিক হরেকরকম কারবার চালাতে গেলাম। তবে খুবই সত্য যে, পদ্ধতি অবলম্বন করেই কারবার চালাতে লাগলাম। আর সে পদ্ধতি একেবারেনিত্যনতুন।

আমার বলের মতো গোলাকার দেহযন্ত্র থেকে অনবরত একের পর এক সাফাই আনতে লাগল।

আমি আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত রমরমা কারবার চালিয়ে গেলাম। তারপর! দরজির হটিয়ে-বিজ্ঞাপন লাইনে ভিড়ে গেলাম। কারবার জমাতে সময় লাগল না। এর বাজার বিস্তৃত-অঞ্চল জুড়ে, মালকড়িও ভালোই আমদানি হয়। অতএব কারবারে আমার উৎসাহ-উদ্দীপনা যে তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল, আশা করি তা খোলসা করে না বললেও চলবে।

একটা কথা খুবই সত্য যে, আমার এ পেশাটার সঙ্গে কঠিন কর্তব্য জড়িয়ে রয়েছে। তা হোক তো, আমার কাছে এটা কোনো সমস্যাই নয়। কেবলমাত্র আমার পদ্ধতি প্রীতির জন্যই ব্যাপারটা আমার কাছে নিছকই মামুলী।

এ পেশায় টাকাকড়িকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। সর্বাধিক প্রাধান্য দেওয়া দরকার ঘড়ির কাটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কর্তব্য সম্পাদন করে যাওয়া। কেবলমাত্র সময় সম্বন্ধে সচেতনতাই নয়, নিষ্ঠার দিকেও যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে হবে। আমি এসব দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলেছি। আর সে সঙ্গে প্রতিটা কানাকড়ির হিসাবও রেখেছি। কোনো প্রতিভাধরকে যদি এসব দিকে কড়া নজর রেখে কারবার চালাতে হতো তবে নির্ঘাৎ ফেসে যেত ভায়া।

আমি যে দরজির কাজ হাতে নিয়েছিলাম, ব্যবসার মাধ্যমে সে দুহাতে পয়সা কামাতে পারে সত্য। কিন্তু পদ্ধতি যে কি জিনিস, তা সে কিছুমাত্রও বুঝতে পারেনি। আর আমি যে তা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছিলাম, এতে কারো মনে এতটুকুও সন্দেহ থাকার কথা নয়। আর যদি তা না পারতাম তবে কি আর এত সহজে নিজেকে কাজের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে পারতাম? অবশ্যই না।

কাটায় কাটায় নটায় দর্জির দোকানে হাজির হতাম। দু-চার কথার মাধ্যমে দর্জির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় সেরেই সেদিনের সেলাই করার মতো জামা-কাপড় বুঝেনিতাম।

সেদিন কোন কোন পোশাক বিজ্ঞাপিত হবে তা দর্জি বার বার বলে আমার মগজে ভালোভাবে ঢুকিয়ে দিত। আর তার সঙ্গে সঙ্গতি রখে আমার উপ-মস্তিষ্ক নতুন-নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবনে মেতে যেত। আমার উপ-মস্তিষ্ক বলতে বলের মতো গোলাকার। দেহযন্ত্রটা।

আমার মগজ মুহূর্তের জন্যও সুস্থির থাকত না। আরে ভাই, নতুন নতুন পদ্ধতি আমার মস্তিষ্কে পোকার মতো সর্বক্ষণ কিলবিল করত। আর সেই তো বিজ্ঞাপনের পদ্ধতি–এক-একটা পোশাক এক-একরকম রুচিশীল লোকের সামনে তুলে ধরার কৌশল, বুঝলে তো?

ফ্যাশানের রকমফের যে কতই না হতে পারে, তা নিয়ে সে মুহূর্তে আসার উপ মস্তিষ্কে যেন বিশাল এক কারখানা বসে যেত–আমার অর্থাৎ বলের মতো গোলাকার দেহযন্ত্রটাতে।

আমার উপ-মস্তিষ্ক–আর অর্থাৎ যাকে বলের মতো গোলাকার দেহযন্ত্র বলা হচ্ছে, সেখানে পুরো একটা ঘণ্টা ধরে পোশাকে নিত্য-নতুন ফ্যাশান উদ্ভাবনের চিন্তা ভাবনা চলত।

শহরের বিশে বিশেষ জায়গায় সৌখিন মানুষরা ঘুর ঘুর করে বেড়ায়। তারা নতুন নতুন ফ্যাশানের খোঁজে হন্যে হয়ে ছোঁক ছোঁক করে। বেলা দশটা বাজতে না বাজতেই আমি সে-সব জায়গায় হাজির হয়ে যেতাম। তা নইলে এমন কোনো জায়গায় চলে যেতাম যেখানে আমোদপ্রিয় মানুষদের জন্য হরেকরকম আমোদ প্রমোদের ব্যবস্থা রয়েছে।

আমি পথচারীদের গায়ে গা ঠেকিয়ে পথ চলতাম। তাদের নজরের বাইরে যেতাম না মুহূর্তের জন্যও কিছুতেই না।

তারা যেদিকেই নজর ফেরাক না কেন, চোখে পড়ত আমার মন ভোলানো রূপ, আমার পিঠে ঝুলিয়ে রাখা নজরকাড়া পোশাক পরিচ্ছদ।

একবার ভেবে দেখুন তো, আমার এ-কৌশল আর সৌখিন পথচারীদের চোখে চোখে থাকার জন্য অনন্য নিষ্ঠার কথাটা। আর বিবেচনা করুন, এ কারবারে যারা নিজেদের লিপ্ত করেছে, তাদের বুক হিংসায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খাক করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট নয় কি? আবারও বলছি, এক্ষেত্রে আমি নিষ্ঠার কদরই সবচেয়ে বেশি দিয়েছি।

পোশাক-পরিচ্ছদ পিঠে ঝুলিয়ে সৌখিন লোকদের ভিড়ে বা আমোদ-প্রমোদের অঞ্চলে ঘোরাফেরা করতে করতে দুপুর পার হতো না। আমি দক্ষ শিকারির মতো একজন-না-একজন খদ্দের বাবাজীকে ছিপে গেঁথে দরজীর কারখানায় হাজির হয়ে যেতাম। মুহূর্তমাত্র দেরি না করে শিকারটাকে দর্জি বাবাজীর হাতে উৎসর্গ করে দিতাম।

ব্যস, চোখের পলকে সে জবাই হয়ে যেত। দাঁত বের করে হেসে আমার মুনিব বলত-দরকার-টরকার হলে আবার আসবেন ভাই। প্রতিষ্ঠানের কারখানার দরজা আপনার জন্য সর্বক্ষণ খোলাই থাকবে–সালাম!

আমি রীতিমত গর্তের সঙ্গে, বুকে টোকা খেয়ে দিনের পর দিন এ-কাজে লেগে রয়েছি। এমন নিঃসীম আনন্দ ছাড়া কাজ করা কখনও পোষায়, নাকি করা সম্ভব?

আমি গর্বের সঙ্গেই বলছি, এভাবে কত খদ্দের-লক্ষ্মীকে জবাই করেছি, তা আর গণাগাথা নেই। না, কথাটা ঠিক বলিনি। কবে, কতজন খদ্দেরের গলায় যে ছুরি চালিয়েছি, তা আমার নোট বইয়ের পাতায় প্রত্যেকের বিবরণাদি টুকে রেখেছি।

রীতিমত উৎসাহ-আনন্দের মধ্য দিয়েই আমি কাজে মেতে ছিলাম। কিন্তু সেদিনই আমার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছিল, যেদিন জবাই করা প্রতিষ্ঠানের মালিক আমার প্রাপ্য মিটিয়ে না দিয়েই আমাকে জবাই করে ছেড়ে দিল।

আমি তো মোটেই বেহিসেবি নই, বরং অতিমাত্রায় হিসেবিই বলা চলে। প্রতিটা কানাকড়ির হিসাব নোট বইয়ের পাতায় টুকে রেখেছি। লোকে বলে হিসেবের কড়ি বাঘেও ছুঁতে পারে না, কিন্তু জবাই-করা মালিক বাবাজী আমার প্রাপ্য বেমালুম হজম করে বসল।

হতচ্ছাড়া দর্জি আমার চোখে পানির ধারা নামিয়ে ছাড়ল। মাত্র দুটো পেনি আত্মসাৎ করে দেওয়ায় তার সঙ্গে তুমুল ঝগড়া করে কাজটা ছেড়ে দিতে গিয়ে আমার পাঁজরের একটা হাড় যেন খসে যাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্বাস করুন, পেনি দুটো আমি মোটেই নিজের ভোগে লাগাইনি। পেনি দুটো যদি নিজের ভোগে না-ই লাগিয়ে থাকি, তবে গেল কোথায়, তাই নয়? তবে খুলেই বলছি–কাগজের একটা ধবধবে সাদা কলার কিনে ময়লা কলারটা পাল্টে সেখানে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। এর দরকার কি ছিল? প্রশ্ন উঠতে পারে। জবাই করা প্রতিষ্ঠানের ইজ্জত বাড়ানোর জন্য আমি এ কাজটা নিজের বিবেচনা মতোই করেছিলাম।

যারা সত্যিকারের ব্যবসায়ী তারাই এ বিশেষ পদ্ধতির গুরুত্বটাকে অবশ্যই মেনে নেবেন। কিন্তু কেবলমাত্র জবাই-করা প্রতিষ্ঠানের মালিক মেনে নেয়নি।

আমাকে জব্দ করার জন্য হতচ্ছাড়াটা এক পেনি দিয়ে এক পাতা ফুলস্কেপ কাগজ কিনে দেখানোর জন্য জেদ ধরেছিল। আর দেখতে চেয়েছিল যে, কাগজ দিয়ে কেমন চমৎকার জামার কলার তৈরি করা যায়।

ধাপ্পা, সে ধাপ্পা নয় কি? স্রেফ ধাপ্পা ছাড়া আর কি-ই বা একে বলা চলে, বলুন তো? ধাপ্পা ছাড়া আর যে জুতসই শব্দ এখানে ব্যবহার করা চলে তা হচ্ছে ধান্ধাবাজী। ব্যাপারটা তো একটা পেনি বাঁচানোর ব্যাপার। এক পেনি বাঁচানোর অর্থই তো আমার প্রাপ্য। একটা পেনি কেঁপে দেওয়ার ধান্ধা। আর শতকরা পঞ্চাশ পেনি ঠকানোর ধান্ধা করা। নচ্ছাড়টা করল তাই। একেই কি বলে কারবার? পদ্ধতির গোড়ায় কুড়াল চালানো নয় কি?

আমি পরিষ্কার বুঝে নিলাম, এমন একজন ধান্ধাবাজের সঙ্গে আমার মতের আর। মনের মিল নির্ঘাত হবে না। আমি সততা রক্ষা করে চললে কি হবে, তার মাথায় তো। সব সময় ঠকানোর মলতব চক্কর মারছে।

আমি তার মতলবটা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়ে তার চাকরির বদলে পদাঘাত করে কারখানা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম।

চাকরি করতে এসে তো আর নাকে খত দেইনি–নিজের পদ্ধতি জলাঞ্জলি দেওয়া তো সম্ভব নয়। দর্জির কাছ থেকে সরে এসে অশোভন কারবার শুরু করলাম। এবার আর কারো অধীনে থেকে কারবারে মাতা নয়, সম্পূর্ণনিজস্ব কারবার।

সদ্য গড়ে তোলা কারবারের মালিক আমি নিজেই, কর্মচারীও আমিই। তবে কারবারটা সত্যি খুবই লাভজনক, আবার অবশ্যই সম্মানজনকও বটে। আর বিস্তর স্বাধীনতাও আছে।

যেহেতু আমি নিজেই কারবারের মালিক তাই সর্বক্ষণ কানের কাছে ফাটা রেকর্ডের মতো ঘ্যানর ঘ্যানর করারও কেউ নেই। নিজের মর্জিমাফিক কাজ করো, দোষ ত্রুটি ধরার বলতে কেউ-ই নেই!

আমার একেবারেই নতুন ধরনের কারবারটায় আমার নির্ভেজাল মিতব্যয়িতা, সময়ানুবর্তিতা, ব্যবসায়িক কৌশল ও অভ্যাস আর সততা–গুণগুলোর সবকয়টাই কাজে লাগাতে পারলাম, কম কথা?

আমার অভিনব কারবারটার পসার জমতে দু-চারদিনের বেশি সময় লাগল না। আর দাগী হতেও সময় লাগল না।

আমার অভিনব অশোভন কারবারটার কথা সংক্ষেপে বলে দেওয়া যাক, কি বলেন?

এ দুনিয়ার বেশ কিছু সংখ্যক হঠাৎ ধনকুবের বনে যাওয়া, নইলে ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে ওয়ারিস বা ডকে-ওঠা প্রতিষ্ঠান আছে যারা ইয়া বড় প্রাসাদ তৈরি করতেই থাকে।

প্রাসাদ তো বানাতে আরম্ভ করল–যখন তৈরির কাজ অর্ধেক হয় তখন কাছেই বা ঠিক ঢোকার মুখে কাদামাটি দিয়ে জঘন্য কিছু তৈরি করে রাখতে হয়।

কাদা দিয়ে তৈরি বলতে কি বলতে চাইছি, তাই না? সেটা এস্কিমোদের বাসস্থল ইগলু হতে পারে প্যাগোডা হতে পারে, তা যদি না-ই হয় তবে হটেনটটদের অদ্ভুত ধরনের দোচালা হওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র নয়। তবে আর যাই হোক, এমনকিছু একটা হওয়া দরকার, যে-দিকে চোখ পড়লেই চোখের ভেতরে কড়কড়ানি শুরু হয়ে যায়, মেজাজ তুঙ্গে উঠে যাবে–তখনই ইচ্ছা হবে সেটাকে ধূলিসাৎ করে দেওয়া হোক।

এমনতর ইচ্ছাটা যখন মনের কোণে দানা বাঁধে ঠিক তখনই আমাকে একেবারে নিরীহ গোবেচারা ভালো মানুষের মতো, সাদাসিদে পোশাক-পরিচ্ছদ গায়ে চাপিয়ে অপদেবতার মতো আবির্ভূত হতে হয়।

ঠিক সে মুহূর্তেই কদাকার–একেবারে জঘন্য জিনিসটাকে দৃষ্টিপথের বাইরে চালান দেওয়ার মতো বিচ্ছিরি কাজটার দায়িত্ব নিজের কাঁধেই তুলে নেই। মতলবটা কি খারাপ, বলুন?

কাজটা হাসিল করার বিনিময়ে সামান্য কিছু প্রাপ্য আদায় করে নেওয়া। খুবই সামান্য অর্থ, তবে হাতে-হাতে আদায়। আর পাইও অবশ্যই। বলুন তো, এর মধ্যে অন্যায় কিছু আছে?

আপনি আর আমি এতে দোষ কিছু না পেলে কি হবে, কসাইয়ের মতো মানসিকতাসম্পন্ন এক হতচ্ছাড়া কিন্তু কাজটাকেনিষ্কলুষ বলে মনে করল না। আমার প্রাপ্য অর্থ মিটিয়ে তো দিলই না উপরন্তু আমাকে জোর করে ফটকে আটক করার ব্যবস্থা করতেও দ্বিধা করল না।

বেশ কিছুদিন আমাকে জেলে ঘানি টানতে হলো। হতচ্ছড়াটার কৃপায় এই প্রথম আমি জেলে ঢুকলাম।

জেলখানা থেকে ছাড়া পেয়ে আবার অশোভন কারবারটা চালু করলাম বটে, কিন্তু আগের মতো রমরমা করে তুলতে পারলাম না।

কারবার কী করেই বা জমবে? ব্যাপারটা যে দ্রুত চারদিকে চাউর হয়ে গিয়েছিল।

কারবার উঠলই তো লাঠে। আমার আরোপিত পদ্ধতিটার প্রশংসা করছেন তো? এমন অভিনব আর চমৎকার একটা পদ্ধতির সুখ্যাতি না করে কি পারা যায়, বলুন?

যাক গে, মিছে কপাল চাপড়ে ফায়দা তো কিছু হবার নয়। এবার ভেবে-চিন্তে আর একটা নতুনতর মতলব বের করলাম। এটাও একেবারে অভিনব এক ব্যবসা। নামটা জানার জন্য মনটা উসখুস করছে, তাই না? ঠিক আছে, জিজ্ঞাসা দূঢ় করার জন্য ব্যবসার নামটা বলতেই হচ্ছে–ল্যাঙ্গ-মেরে পিটুনি-খাওয়া কারবার নাম কেমন অভিনব কি না?

কি ব্যাপার বলুন তো, কারবারের নামটা কানে যেতেই চোখ দুটো যে কপালে উঠে গেল?

আরে ধ্যুৎ! লেট লতিফ নাকি? সামান্য একটা ব্যাপার মাথায় ঢুকতে এত সময় লাগে? ঠিক আছে, খোলসা করেই বলছি–মনে করুন, ইচ্ছে করেই কোনো এক বেচারার মাড়িয়ে দিলাম।

ব্যস, মুহূর্তমাত্র দেরি না করে লোকটা দুম করে আমার নাকের ওপার সজোরে একটা ঘুষি মেরে বসলেন। আমার নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়তে আরম্ভ করল। এ অবস্থাতেই সোজা উকিলের দরজায় হাজির হলাম। আমার রক্তাপুত থেলানো নাকটা দেখে উকিল সাহেব নানাভাবে আক্ষেপ করতে লাগলেন। সান্ত্বনাও দিলেন বহুভাবে।

আমি এক হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করলাম। আমি তো ভালোই জানি, মধ্যস্থতা করা পাঁচশ ডলার হাতে মিলবে।

হোক না পাঁচশো ডলার। উকিলের প্রাপ্য মিটিয়ে দেওয়ার পরও যা হাতে থেকে যাবে, তা-ই বা কম কি?

নতুন এক দাঙ্গাবাজ ছেলেকে আগে থেকে বেছে রাখলাম। পকেট বইয়ের পাতায় তার নাম ঠিকানা টুকে রাখলাম–এটাই যে আমার পদ্ধতি জনাব। তারপর তাকে অনুসরণ করতে করতে রঙ্গালয়ে গেলাম। তাকে দেখলাম, দুপাশের দুই তন্বী যুবতিকে নিয়ে ওপরের বক্সে বসে মজা করে নাটক দেখাচ্ছে।

যুবতি দুজনের মধ্যে একজন মোটাসোটা থলথলে চেহারা যাকে বলে, আর দ্বিতীয়জন তালপাতার সেপাই–লিকলিকে চেহারা।

আমি বক্সে বসে চোখে অপেরা গ্লাস লাগালাম। তার মুখটা মোটাসোটা যুবতিটার দিকে ঘুরিয়ে দিলাম।

আমার ব্যাপার-স্যাপার যে যুবতিটার নজরে পড়ামাত্র তার মুখটা জবা ফুলের মতো লাল হয়ে গেল। বার কয়েক চোখ কটমট করে আমার দিকে তাকাল। তা সত্ত্বেও আমি নিজেকে সংযত করছি না দেখে সে বাধ্য হয়ে দাঙ্গাবাজ ছেঁড়াটার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলতে লাগল। বুঝতে অসুবিধা হয় না? আমার বিরুদ্ধে তার কাছে জোর নালিশ করছে।

চকিতে আমার বুকে খুশির জোয়ার বইতে শুরু করল। বুঝলাম, আমার মতলবটা বাস্তব রূপ পেতে চলেছে।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি নিজের বক্স ছেড়ে গুটিগুটি পায়ে দাঙ্গাবাজ ছোঁড়াটার বক্সটার একেবারে সামনে গা-ঘেঁষে গিয়ে দাঁড়ালাম। আর সঙ্গে সঙ্গে নাকটাকে তার দিকে এগিয়ে দিলাম।

আশ্চর্য ব্যাপার! ছোঁড়াটা কিন্তু মুহূর্তের জন্য আমার দিকে তাকাল না। ব্যাপারটা যেন তার মধ্যে অনীহার সৃষ্টি করল। আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালও না। এমন একটা ভাব চোখ-মুখে ফুটিয়ে তুলল যে, আমি যেন নিতান্তই তুচ্ছাতিতুচ্ছ একটা প্রাণি। আমার গায়ে হাত তোলার অর্থই যেন, আচমকা কুড়ানো।

আমি এবার ছোঁড়াটার একেবারে মুখের কাছে আমার ইয়া লম্বা নাকটাকে নিয়ে গেলাম। বেশ জোরে জোরে বার কয়েক নাক ঝাড়লাম। তবুও তাকে আমার প্রতি উদাসীনই দেখলাম। এবার দুম করে তার হাতের সঙ্গে আমার নাকটা ঘষে দিলাম।

কিন্তু হায়! এ কী তাজ্জব ব্যাপার! সে যেন ঠাণ্ডা মাথায়ই ব্যাপারটার নিষ্পত্তি করে ফেলল–হাত দিয়ে আলতোভাবে আমার নাকটাকে সরিয়ে দিল।

হতাশ হয়ে হাল ছাড়ার পাত্র আমি নই। এত সহজে তো আমি হাল ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে বসে রইলাম না। এবার রোগা পটকা মেয়েটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। মওকা বুঝে তাকে দম করে চোখ মেরে বসলাম। এ মোক্ষম দাওয়াইটা ছেড়ে না দিয়ে পারলাম না। ব্যস, দাঙ্গাবাজ ছোঁড়াটা যন্ত্রচালিতের মতো লাফিয়ে উঠে আমাকে জাপ্টে ধরল। আমি ব্যাপারটা বোঝার আগেই সে আমাকে শূন্যে তুলে জানালা দিয়ে ছুঁড়ে একেবারে বাইরে ফেলে দিল। আমি গিয়ে রাস্তায় আছাড় খেয়ে পড়লাম।

আমার অবস্থা একেবারে খারাপ হয়ে পড়ল। ডান পায়ের হাড় ভেঙে একেবারে দু টুকরো হয়ে গেল। শুধু কি এই ঘাড়ের একটা হাড়ও গেল খুলে।

মনের মতো কাজ হয়েছে ভেবে কোনোরকমে খোঁড়াতে খোঁড়াতে বাসায় ফিরে এলাম।

পরদিন সকাল হতে না হতেই উকিলের বাড়ি হাজির হলাম। তার সাহায্যে পাঁচ হাজার ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করে বসলাম।

আমার নোট বইয়ের পাতায় প্রতিটা ঘটনার কথা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লিখে রাখলাম। কোনো ঘটনার জন্য কত খরচাপাতি হয়েছে, লাভ হয়েছে কত টাকা–কিছুই লিখতে বাকি রাখলাম না। আমার পদ্ধতি যে মোক্ষম। এতটুকু ভুল হতেই পারে না।

এ নোট বইয়ের পাতায় লেখা রয়েছে ক্ষতিপূরণ কত টাকা আশা করেছিলাম অবশ্য প্রতিটা ঘটনায় প্রত্যাশার তুলনায় অনেক কম টাকাই পেয়েছি।

সে ঘটনায় ওই জানোয়ারটা আমার নাক ভেঙেছিল, সে মোট পঞ্চাশ সেন্ট দিয়েছে। যে হতচ্ছাড়াটা আমার কাঁধ ভেঙে একসার করে দিয়েছে, আর পা-টাও টুকরো করে দিয়েছে, সে পাঁচ ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়েছে। নতুন একটা প্যান্ট খরিদ করতে খরচ করেছি পঁচিশ সেন্ট। সব মিলিয়ে পঁচাত্তর সেন্ট মুনাফা পেয়েছি। খারাপ পেলাম কি করে?

কিছুদিন কারবারটা চালাবার পর একদিন একটু বে-কায়দায় পড়ে গিয়েছিলাম। আমার দেহের জিয়োগ্রাফিই পুরো পালটে যাচ্ছিল–এমন আড়ং ধোলাই খেয়েছিলাম। আমার বাইরেটা যেন অন্য মানুষের দেহ হয়ে যাচ্ছিল। কিছু পালটে গেলও বটে। লোকে আমাকে চিনতেই পারছিল না।

তাই কয়দিন ধরে ভেবে, আমার উপ-মস্তিষ্কটাকে খাঁটিয়ে কারবারের নতুন একটা মতলব বের করে ফেললাম। একেবারেই অত্যাধুনিক মতলব বেরিয়ে এল।

এ সুযোগে সে দয়াবতী মহিলার নামটা মনে মনে স্মরণ করে নিচ্ছি, সে আমার কচি বয়সে–কারবারের গোড়াতেই আমাকে পদ্ধতি শিরোমণি তৈরি করে দিয়ে গেছে। আমি অকপটে অঙ্গীকার করছি, সে দয়াবতী মহিলার নাম মৃত্যুকালে কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।

আরও ভেবে রেখেছি, দুনিয়া ছেড়ে যাবার আগে তার নামে কিছু না কিছু অর্থ উইল করে যাবই যাব।

যাক গে, এরপর আমার নতুনতর কারবারটার কথা অল্প কথায় বলার চেষ্টা করছি।

অত্যাধুনিক কারবারটার নামকরণ করেছি–কাদা ছিটানো কারবার। টাইপ মেশিন সামনে নিয়ে বসে-থাকা ফুলবাবুদের গায়ে একটু-আধটু কাদা মাখিয়ে দিয়ে ভড়কিয়ে দেওয়া। ব্যস, নগদ ছয় পেনি আদায় করা।

এ কারবারটা ছ্যাচড়ামি ছাড়া কিছু নয়। কিন্তু উপায় উপার্জন কম হচ্ছিল না। আমার কর্মস্থল ছিল ব্যাঙ্ক আর বড় বড় বাণিজ্যিক অফিস।

কাদা কিন্তু আমি নিজে মাখতাম না। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটা কুকুর সর্বক্ষণ আমার ধারে কাছেই থাকত।

ব্যাংক, বাণিজ্যিক অফিস বা দোকান থেকে কেতাদুরস্ত বাবু বেরোলেই কুকুরটাকে গোপনে ইশারা করে বসতাম।

ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই সে নিকটবর্তী ডোবা বা নালা থেকে গায়ে পানি-কাদা মেখে কেতাদুরস্ত বাবুটার সামনে হাজির হয়ে যেত। কাছে এসেই গা-ঝাড়া দিয়ে তার সারা গায়ে কাদা ছিটিয়ে একেবারে ভূত বা নিয়ে দিত।

কেতাদুরস্ত বাবু রেগেমেগে লাঠির খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করে দিত। ঠিক সে মুহূর্তে আমি গুটি গুটি সেখানে হাজির হয়ে যেতাম। আমার এক হাতে থাকত ইয়া মোটা একটি লাঠি আর অন্য হাতে একটা ব্রাশ।

কেতাদুরস্ত লোকটার অনুরোধে আমি কুকুরটাকে তাড়িয়ে দিতাম। তারপরই লেগে যেতাম ব্রাশ চালিয়ে তাকে সাফ সুতরা করার কাজে। বিনিময়ে আদায় করতাম আমার মজুরি। নোংরা কাজের মজুরি তো একটু বেশিই দিতে হতো।

কারবারটা ভালোই চলছিল। ছয় পেনি আদায় করে তার অর্ধেক আমার কারবারের অংশীদার কুকুরটাকে খাবার কিনে দিতাম। পদ্ধতিটা আমার। অতএব অর্ধেক তো আমার পকেটে উঠবেই।

না, বেশিদিন এ কারবারে ধৈর্য রাখতে পারলাম না। বিরক্ত হয়ে মাথা থেকে এটাকে মুছে ফেললাম।

ঠিক এরকমই আর একটা কারবার নিয়ে কিছুদিন মেতেছিলাম। কর্মস্থল শহরের চৌমাথা। কেতাদুরস্ত কোনো বাবু দেখলেই রাস্তা ঝাটা দিতে লেগে যেতাম। তার পোশাকে ধুলো ময়লা জড়িয়ে যেত। তারপর ব্যস্ততা দেখিয়ে নিজেই পাশের ডোবা থেকে পানি এনে ধুয়ে মুছে দিতাম। দক্ষিণানিতাম এক পেনি।

কারবারটা ভালোই চলছিল। আমার অর্থাগমের লক্ষ্য ছিল ব্যাঙ্কের ফুলবাবুরা। কিন্তু ব্যাংকগুলো একে একে লাটে উঠে গেল। আমার কারবারও উঠল সিকেয়।

তারপর মেতেছিলাম দমাদম বাজনা নামক এক কারবার নিয়ে। রীতিমত মৌলিক পদ্ধতির কারবার। নামমাত্র দাম দিয়ে একটা ভাঙা বাজনা খরিদ করে নিয়েছিলাম, যা থেকে বেসুর বেরায়।

তারপর সে বাজনাটা কাঁধে ঝুলিয়ে শহরের নিরিবিলি জায়গায় চলে যেতাম, যেখানে অখণ্ড শান্তি বিরাজ করত।

ব্যস, রাস্তার ধারে বসে দমাদম পেটাতে আরম্ভ করতাম ভাঙা বাজনাটকে। লোকে বিরক্ত হয়ে জানালা-দরজা বন্ধ করে দিত। গলা খেঁকিয়ে বলত, এখান থেকে কেটে পর বাছাধন। সে সঙ্গে সামান্য কিছু হাতে ধরিয়েও দিত। সারাদিনে এভাবে পকেট প্রায় বোঝাই হয়ে যেত।

তারপর আমি সপ্তম ব্যবসার দিকে ঝুঁকে পড়লাম। এতে চমৎকার পদ্ধতি প্রয়োগ করেছিলাম। তাই শহরের সর্বত্র আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। আমার এবারের ব্যবসাটা হচ্ছে, হরেক নাম খামের গায়ে লিখে লোকের সঙ্গে প্রতারণা করা। আমি কমন ববি টমকিন, আবার কখনও বা টম জবসন নাম উল্লেখ করে চিঠি লিখতাম। চিঠি বলতে আজে-বাজে কথায় পাতা ভরা যাকে বলে। চিঠিটা, পড়ামাত্র যেন পায়ের। নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত উত্তেজনায় ফেটে পড়ার জোগাড় হতো। তা নইলে আতঙ্কে যেন গা ছমছম করত।

চিঠিগুলো লেখা শেষ করে খুব যত্নের সঙ্গে একটা একটা করে খামে ভরতাম। তাদের নাম-ঠিকানা যোগাড় করার পদ্ধতি ছিল বাড়ির সামনের নেমপ্লেট দেখে।

খামের গায়ের ঠিকানাগুলো লিখে এক এক করে বাড়িতে হাজির হয়ে, ঠিকানা অনুযায়ী চিঠিগুলো বিলি করতাম।

খামের গায়ে কোনো ডাকটিকিট লাগানো নেই, বা উপযুক্ত ডাকটিকিট লাগানো নেই বলে, ডাক বিভাগের নামে উপযুক্ত ডাকটিকিটের মূল্যের দ্বিগুণ পয়সা আদায় করতাম।

চিঠির প্রাপক নিতান্ত অপরাধীর মতো আমার চাহিদা অনুযায়ী পয়সা দিতে আপত্তি করত না।

আমি বিদায় নিলে খামের মুখ ছিঁড়ে, চিঠি পড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ত। আতঙ্কে কুঁকড়ে যেত, মুচ্ছা যেত অথবা রাগে ফুঁসতে থাকত।

আর চিঠি পড়ে তাদের কেউ কেউ এমন প্রতিজ্ঞাও করে বসত, ববি টমকিন বা টস ডবসনকে হাতের কাছে পেলে গাল টিপে ধরবে।

আমি পরিস্থিতির চাপে পড়ে এ-ব্যবসা থেকেও সরে দাঁড়াবার চিন্তা করলাম। আওে ধ্যুৎ! কথায় কথায় নতুন এ ব্যবসাটার নাম বলতেই ভুলে গেছি। যাক্ গে, এ ব্যবসটার নাম দিয়েছি–নকল ডাকঘর।

নকল ডাকঘর ব্যবসাটা বন্ধ করে এবার হাত দিলাম নতুন আর একটা ব্যবসায়। এর নাম দিলাম–সেকুর আইন। সেকুর কথার অর্থ যে বিড়াল, আশা করি তা আর কাউকে বলে দিতে হবে না।

ব্যাপারটা হচ্ছে, শহরের বিড়াল এত বেড়ে গেছে যে, একেবারে গিজগিজ করছে। লোকে অতিষ্ট হয়ে পড়েছে। অতএব শহরের একটা কর্তাব্যক্তি বা আইন করলেন। একটা করে বিড়াল ধরে দিলেই নগদ চার পেনি মিলবে।

গোড়ার দিকে আইন ছিল, এক একটা বিড়ালের জন্য নগদ চার পেনি পাওয়া যাবে। তারপর বলা হলো গোটা বিড়াল না দিলেও চলবে, বিড়ালের মাথা জমা দিলেই চার পেনি পাওয়া যাবে।

কয়দিন পরে আইন একটু বদলে নিয়ে বলা হল–বিড়াল বা বিড়ালের মাথা নয়, শুধুমাত্র বিড়ালের লেজটা জমা দিলে চলবে। আর লেজের বদলেও চার পেনিই মিলবে।

বিড়ালের প্রতিটা লেজের জন্য নগদ চারটি পেনি কম কথা!

ব্যস, আর দেরি নয়, আমি বিড়াল জড়ো করে আস্তানা ভরে ফেললাম। ইঁদুর খাইয়ে খাইয়ে তাদের তাগড়া করে তুলে বছরে তিন-চারবার তাদের লেজ কেটে প্রতিটার জন্য চারটি করে পেনি আদায় করতে লাগলাম। তবে তাড়াতাড়ি লেজ বাড়াবার জন্য ম্যাকাসার নামক কেশ তেল দিনে একবার করে তাদের লেজে মাখাতে হচ্ছে।

আজও আমি এ-ব্যবসাটাই আঁকড়ে ধরে রেখেছি। মোটা টাকা মুনাফা অর্জন করছি। সম্প্রতি আমি হাডসন নদীর তীরে একটা জায়গা কেনার জন্য দালাল নিযুক্ত করেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *