রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো

রিভিউ অব স্টিফেন্স অ্যারেবিয়া ট্রো

বাইবেল!

পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাইবেল!

বাইবেল সম্বন্ধে ধারণা দান করার ইচ্ছা নিয়ে দুখণ্ডে প্রকাশিত এ-বইটা সত্যি অতুলনীয়। ঠিক এমন প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা দ্বিতীয় আর একটি বই আমার অন্তত নজরে পড়েনি।

আসলে এমন সহজ-সরল ভাষায় মনের ভাব সুন্দরভাবে ব্যক্ত করার ফলে বইটার গুণ অনেকাংশে বেড়ে গেছে। আর এরই ফলে বইটা একবার পড়তে আরম্ভ করলে চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরানো সম্ভব হয় না। শেষপাতা পর্যন্ত পড়ে তবেই স্বস্তি।

সম্পতিকালে প্রাচ্য দেশে বাইবেলের ঘটনাবলির নানারকম ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। পুস্তিকারে ছেপে প্রকাশও করা হচ্ছে। আর এরই জন্য বাইবেলের পাতায় যেমন ভৌগোলিক বিবরণের উল্লেখ রয়েছে, বর্তমানেও তার মিল লক্ষিত হচ্ছে।

এ সম্বন্ধেই দু-একটা বিষয় নিয়ে দু-চার কথা বলা যাক। বর্তমানকালের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের কথা আলোচনা করা যাক। গতবছর সে শহরে প্লেগ মহামারীরূপে দেখা দিয়েছিল। ভয়ানক এ ছোঁয়াচে রোগের কবলে পড়ে শহরটাকে একেবারে শ্মশানে পরিণত হয়েছিল। দলে-দলে কাতারে কাতারেমানুষ যারা নিষ্ঠুর মৃত্যুর হাত থেকে অব্যাহতি পেয়ে গিয়েছিল, তারা পিতৃদত্ত প্রাণটাকে নিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বেঁচেছে।

এতকিছুর পরও বর্তমানে পঞ্চাশজন অধিবাসী আজও শহরটার বুকে বসবাস করছে। আর ক্রমান্বয়ে শহরটার উন্নতিও ঘটে চলেছে। আলেকজান্দ্রিয়া শহরটা লিণিয়া মরুভূমির কেন্দ্রস্থলে, ভেন্টা খালের বাইরে অবস্থিত।

জলপাবনের সময় কেবলমাত্র ভেন্টা খালই নীলনদের পানি নিজ বক্ষে ধারণ করে, বয়ে নিয়ে গিয়ে ফেলেছিল। আর আলেকজান্দ্রিয়া সে মিশরের সঙ্গে যোগসাজোস রক্ষা করে চলেছে। এ-কথা তখনকার মানুষ ভেবে নিয়েছিল।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরের পত্তন করেছিল আলেকজান্ডার। তাই তারই নামানুসারে শহরটার এরকম নামকরণ হয়।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরটার প্রতিষ্ঠার পিছনে দ্বিগ্বীজয়ী বীরের উদ্দেশ্য ছিল প্রাচ্য বিজয় নির্বিঘ্ন রাখা।

বর্তমানে আফ্রিকা বা সিরিয়ার উপকূল বরাবর একমাত্র নিরাপদ বন্দর হিসেবে, একমাত্র এ শহরটাকেই মনে করা যায়–আসলেও তাই। এক সময় এখানে অদ্ভুত বহু বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা ছিল। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই আলেকজান্দ্রিয়া বেশ বড়সড় একটা শহরে পরিণত হয়ে গেল।

শহরটার পরিধি পনেরো মাইল জুড়ে। নাগরিকের সংখ্যা তিনলক্ষ। প্রায় একই সংখ্যক পরিচালক-পরিচালিকা। সুদৃশ্য-মনোলোভা একটা রাজপথ, যা দু হাজার ফুট লম্বা। এটা শহরের একপ্রান্ত থেকে শুরু হয়ে অন্যপ্রান্তে গিয়ে শেষ হয়েছে।

শহরটার একপ্রান্তে অবস্থিত ভূমধ্যসাগরীয় বন্দর আর অন্যপ্রান্তে অবস্থিত ম্যারিওটিক হ্রদের বন্দর।

সমুদ্র উপকূল বরাবর আর একটা রাস্তা রয়েছে। এটা প্রধান রাজপথকে সমকোণে খণ্ডিত করেছে। শহরে আর যা-কিছু দেখা যায়, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুদীর্ঘ একটা রথ দৌড়ের ময়দান আর বিশাল সাকার্স। আর দেখা যাবে, দু শশা ফুটেরও বেশি দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট একটা ব্যায়ামাগার। আরও রয়েছে, আমোদপ্রমোদপ্রিয় অধিবাসীদের জন্য প্রচুর সংখ্যক থিয়েটার আর রয়েছে সুবিশাল হামাম–যাকে বিলাসবহুল স্নানাগার আখ্যা দেওয়া হয়।

অতীতে এক সময় সারা দেন সৈন্য আলেজান্দ্রিয়া শহরটাকে দখল করে নেওয়ার পর তাদের সেনাপতি ওমর খন্দিকাকে জানিয়েছিল, এখানকার ধনদৌলত আর সৌন্দর্যের হিসাব-নিকাশ করা সম্ভব নয়। কিছুতেই নয়।

যখনকার কথা বলছি, শোনা যায় তখন নাকি সেখানে ছিল চার হাজার প্রাসাদ, চার হাজার স্নানাগার, চার হাজার নাট্যশালা অথবা গণমিলন ভবন, বারো হাজার হরেক রকম দোকান আর ইহুদি ছিল।

আলেকজান্দ্রিয়া শহরটা মুসলমানদের হাতে পড়ার সময় থেকেই নাকি সবকিছুই দ্রুত ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। ইন্ডিয়ায় যাওয়ার ঘুর পথের সন্ধান লাভ করার

পর আলেকজান্দ্রিয়ার ব্যবসা-বাণিজ্যের গৌরব ক্ষুণ্ণ হতে থাকে।

বর্তমানে আলেকজান্দ্রিয়া শহর তুর্কি অধিকারে যাওয়ার পর আবার ব্যবসা বাণিজ্যের উন্নতি নয়, শাসনব্যবস্থাও সুদৃঢ় করে তোলা হয়। সব মিলিয়ে দেশটার হৃত গৌরব অনেকাংশে পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হয়।

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের কথা।

সে বছর মি. স্টিফেল আলেকজান্দ্রিয়া যান। সেখানে কিছুদিন থেকে সেখানকার রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক ও সামাজিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে আন্তরিকতার সঙ্গে খোঁজ-খবর নেন। তারপর উপরে উল্লিখিত বিবরণগুলো লিপিবদ্ধ করেন।

সে বছর তিনি নীল নদের তীর পর্যন্ত অগ্রসর হয়েছিলেন। উক্ত বিবরণাদি ছাড়া তিনি আর যা-কিছু লিপিবদ্ধ করেছিলেন, তা পড়ে মিশর সম্বন্ধে বহু তথ্য জানা যায়। সবচেয়ে বেশি উপকৃত হওয়া মিশরের ভবিষ্যৎ জানা সম্ভব হওয়ার জন্য। মিশরের ভবিষ্যৎ কি হবে, এ প্রসঙ্গে বহু নির্ভরযোগ্য মূল্যবান তথ্য তিনি প্রাঞ্জল ভাষায় লিপিবদ্ধ করেছেন।

তারা বাইবেল সম্বন্ধে উৎসাহি পাঠকরা তার লিখিত বিবরণী পাঠ করে শুধুমাত্র বিশেষ উপকৃত হবেন তা নয়, বিশেষ গুরুত্বও উপলব্ধি করবেন।

তার বিবরণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, এ অঞ্চলের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তিনি যা কিছু লিপিবদ্ধ করে গেছেন, তার সে বক্তব্য খুবই পরিষ্কার, কোনোকিছুতেই ঝাপসা ভাব নেই। বক্তব্য এতটুকুও অস্পষ্ট নয়।

প্রাচীনকালে রাজারাজরাদের আমল যখন রীতিমত রমরমা ছিল, উন্নতির চরম শিখরে উঠেছিল, তখনই ভবিষ্যৎ দ্রষ্টারা সুস্পষ্ট ভাষায় মন্তব্য করেছেন, সিংহাসনে আসীন থাকতে থাকতেই রাজবংশ একেবারেনিমূর্ল হয়ে যাবে। তাদের বংশে বাতি দেওয়ার মতো কেউ-ই জীবিত থাকবে না।

এমন স্পষ্টভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করা কি করে যে সম্ভব, ভেবে পাওয়া যায় না। তাই একে নিতান্তই অসম্ভব বলে মনে হয়। অতএব তা বিস্ময় উৎপাদন করার মতো কথাই বটে।

মোজেস যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং মানুষের প্রতি অসীম মমত্ববোধ ও সহানুভূতির পরিচয় দিয়েছিলেন, তার আগেই কি মিশর প্রকৃতই একটা রাজ্য ছিল, সেখানকার সিংহাসনে তখন পর্যন্ত কতজন বসেছিলেন, আর কে কত বছর রাজত্ব করে গেছেন, সবই সহজ-সরল ভাষায় ব্যক্ত করে গেছেন। আর সে সব তথ্য এমন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে লেখা হয়েছে, যার ফলে কোনো উলেখযোগ্য তথ্যই বাদ পড়তে পারেনি।

মিশরে রাজার কোনো অস্তিত্বই আর থাকবে না। এ ভবিষ্যদ্বাণী করার আগে মিশরের সিংহাসন কোনোদিন প্রায় দু হাজার বছরের মধ্যে একটা দিনের জন্যও খালি যায়নি। তবুও রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গেই ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, মিশরে দেশবাসীর কেউ অর্থাৎ নিজেদের কেউ কোনোদিই সিংহাসনে বসতে পারবে না।

বহিরাগতরা মিশর দখল করবে। দেশটাকে একেবারে ছারখার করে ছাড়বে। মিশরকে ধূলিস্যাৎ করে দেবে।

শুধু কি এই? রাজ্য হিসেবে মিশরের অবনিত ঘটতে ঘটতে একেবারে নিচে নেমে যাবে আর জাতি হিসেবে তারা আর কোনোদিনই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

আর প্রকৃতিও মিশরের বিরোধিতায় লিপ্ত হবে। প্রকৃতির নিমর্ম-নিষ্ঠুর খেয়ালের শিকার হয়ে মিশরের একটা বিশাল অংশ মরুভূমিতে পরিণত হয়ে যাবে। আর মরুভূমির বালির তলায় তলিয়ে যাবে মিশরের একটা বিশাল জনপদ।

দু-এক শতক নয়, দু হাজার বছর ক্রমান্বয়ে ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা যাচাই হয়ে আসছে। প্রমাণীতও হয়েছে।

দেখা গেছে, কেবলমাত্র পিরামিডের পর পিরামিড সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে নিজেদের অস্তিত্ব ঘোষণা করে চলেছে। যাদের এতটুকু ক্ষয় নেই, ধ্বংস তো নেই-ই।

আর এখানে-ওখানে শহরে পড়ে কাদামাটির তৈরি দুর্বল কিছু সংখ্যক বাসগৃহ।

অতীতেরই কেবল নয়, বর্তমানের মিশরের সঙ্গেও সুদৃঢ় অতীতের রাজশক্তির দাপট আর গৌরবময় কৃতিত্বের কোনো সাদৃশ্যই খুঁজে পাওয়া যাবে না। দেশটা ঘুরে এলে মনে হবে, এ যেন মিশর নয়, অন্য কোনো দেশ, অন্য কোনো রাজ্য।

আবার এ-কথাও ভুললে চলবে না, মিশর দেশটা সম্বন্ধেই এমন ভবিষ্যদ্বাণী আছে যার সত্যতা আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি, বাস্তবরূপ পায়নি।

কি সে ভবিষ্যদ্বাণী, যা আজ পর্যন্ত বাস্তবরূপ পায়নি? সেটা হচ্ছে, সারা পৃথিবীটা খুশিতে ডগমগ হয়ে পড়বে, আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ার যোগাড় হবে, মিশর চিরদিন সবার তলায় পড়ে থাকবে না। পরমপিতা তার নির্মম নিষ্ঠুর প্রহারে মিশরকে জর্জরিত করবেন। তারপর আবার নিজেই প্রহারের পর প্রহার করে তাকে শান্ত করবে, বিপদের সূর্য অস্তমিত যাবে, পূর্ব আকাশে দেখা দেবে সুদিনের রক্তিম সূর্য।

মিশরের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির দিকে দৃষ্টিপাত করলে বিশ্বাস করা যেতে পারে, ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবরূপ পেতে শুরু করেছে। ফ্যারগুদের রাজত্বকালেও যে মিশরের আদলে নতুন মিশরনির্মিত হতে শুরু হয়েছে।

আমি দীর্ঘদিন ধরে মিশরের প্রেক্ষাপটে লেখা বিভিন্ন পুঁথিপত্র পাঠ করে যে চিত্র দেখতে পেয়েছি তার উল্লেখ নিচে করলাম–

মিশরে দাসপ্রথা আজও বহাল তবিয়তে চলছে। দাস-ব্যবসায়ীদের কারবারও খুবই রমরমা। ক্রীতদাসদের দুটো বেশ বড়সড় নৌকায় বোঝাই করে নদীপথে নিয়ে যেতেও দেখা গেছে।

যে ক্রীতদাস তুর্কী-পরিবারে আশ্রয় লাভ করে তার ভাগ্য খুলে যায়। সে অন্যান্য দাস-দাসিদের চেয়ে বেশি আদরযত্ব পায়। আর সম্মান ও বিশ্বাসও সে বেশিই পেয়ে থাকে। কিছুদিন থেকে মনিবের আস্থাভাজন হতে পারলে এখন যেমন ক্রীতদাস স্বাধীনতা পেয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমনই স্বাধীন হয়ে যাওয়াও কিছুমাত্র বিচিত্র ব্যাপার ছিল না। মনিবের মেজাজ-মর্জির ওপরই নির্ভর করত, সে ক্রীতদাসই থেকে যাবে, নাকি স্বাধীনতা লাভের মাধ্যমে মুক্ত জীবনের স্বাদলাভে ধন্য হবে? আবার এমন ব্যাপারও ঘটতে দেখা গেছে, ক্রীতদাস মনিবের বিশ্বাসভাজন ও প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়ে তার কন্যাকে বিয়ে করে স্ত্রীরূপে লাভ করেছে। ক্রীতদাস হয়েছে জামাতা।

আর প্রাচ্যের মানুষের চাল-চলন আচার-আচরণের কোনো পরিবর্তনই হয়নি, পুরোপুরি আগের মতোই রয়ে গেছে। কিছু সংখ্যক জিনিস–পোশাক-পরিচ্ছদ, বাগধারা আর অনুষ্ঠানাদি পর্যটকদের চোখের সামনে একই ছবি ফুটে ওঠে। তখন তাদের অন্তরের অন্তঃস্থলে বাইবেলের ভাষা আর ইতিহাসের ঘটনাবলি একে একে জেগে ওঠে।

ইউরোপের মানুষের মধ্যে বাড়ি-ঘর, বাগ-বাগিচা নির্মাণকৌশল আর আচার আচরণের পরিবর্তন প্রায়ই কম-বেশি হচ্ছে। কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলোতে এসব অপরিবর্তিতই থেকে যাচ্ছে। দু হাজার বছর আগে পরিস্থিতি যেমন ছিল আজও ঠিক তেমনই আছে।

প্রাচ্যের দেশগুলোতে অগ্রগতি রুখে দেওয়ার জন্য প্রয়াস প্রতিনিয়ত অব্যাহত রয়েছে। কিছুতেই যেন উন্নতি করতে দেওয়া হবে না, সে চেষ্টাই পুরোদমে চলছে। তা কিন্তু অবিশ্বাস্য রকম সীমিত রয়েছে, বাইবেল ইতিহাসের অঞ্চল এবং সমাদৃত অঞ্চলগুলোতে।

পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে, প্রায় সর্বত্র সভ্যতার বন্যা বয়ে চলেছে। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সভ্যতার অগ্রগতি সমান চলেছে। কিন্তু এখানে? এখানে সে সভ্যতার জোয়ার অন্যদিকে, অন্যপথে প্রবাহিত হয়ে চলেছে। মূল স্রোত থেকে কিছুতেই যেন বিচ্ছিন্ন হতে চাইছে না। যাকে সভ্যতা সংস্কৃতি বলে সে যে তিমিরে ছিল ঠিক সে তিমিরেই রয়ে গেছে।

আমরা এবার পাতা উলটে মি. স্টিফেন্সের লিখিত বিবরণীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং কৌতূহলোদ্দীপক স্থানটার দিকে দৃষ্টি করি, দেখাই যাক না তিনি সেখানে কোন মূল্যবান তথ্যের উল্লেখ করেছেন?

হ্যাঁ, এই তো একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ পাওয়া গেছে। তিনি বলেছেন, মাউন্ট সিনাই-এ যাবার তীব্র বাসনা তার মনে ছিল। সেখানে থেকে পবিত্র ভূমি দর্শনের বাসনা ছিল। সেখানকার পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে সে মহাপুরুষকে প্রণাম জানাবেন।

মি. স্টিফেন লিখেছেন, মিশরে জলভ্রমণ ব্যয়বহুল তো নয়ই বরং খুবই সস্তা। যথেষ্ট আরাম ও আনন্দদায়কও বটে। সেখানে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চল। আরামে-আয়েসে সবকিছু ঘুরে ঘুরে দেখা যায়। আর ভ্রমণ খুবই আনন্দদায়ক বটে। সবচেয়ে বড় কথা, বিপদের কোনো সম্ভাবনাই নেই। আর দশজন মাঝিমাল্ল নিয়ে নিজের দেশের পতাকা মাস্তুলের মাথায় উড়িয়ে নিশ্চিন্তে ভ্রমণ সারা যায়। কোনোরকম বিপদের ঝুঁকি এতে নেই। আর ভাড়া? মাত্র ত্রিশ থেকে চল্লিশ ডলারের বিনিময়ে এক মাসের জন্য বেশ বড়সড় একটা নৌকা ভাড়া মেলে।

একটু আগে মি. স্টিফেন্সের আলোচ্য গ্রন্থের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ আর কৌতূহলপূর্ণ যে জায়গার কথা বলেছি, আবার সে প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া যাক। তার একান্ত ইচ্ছা ছিল, একবার মাউন্ট সিনাই দর্শনে যাবেন। সেখানকার দ্রষ্টব্যগুলো দেখে, যাবেন পবিত্রভূমি দর্শনে।

তিনি এ ভ্রমণ সারতে গিয়ে সোজা পথে না গিয়ে মরুভূমির বিপদসঙ্কুল পথেই অগ্রসর হবেন। এরকম ইচ্ছার পিছনে কারণও রয়েছে যথেষ্ট। কারণ, দৈববাসীর অভিসম্পাত আজও সেখানে কার্য করা হয়ে চলেছে আর স্থানটা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃতও হয়নি। জায়গাটার নাম ইডুমিয়া–ইডুমিয়া দেশ।

ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে মি. স্টিফেন্সকে তখনই চিন্তা-ভাবনা করতে হয়েছিল।

এমন বহু ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে যা হুবহু বাস্তবে পরিণত হয়ে যায়। একটা কথা মনের গোপন করে উঁকি দেয়, সমগ্র খ্রিস্টান জগতকে একত্রিত করা, আর যাতে একই নীতি অনুসরণ করে চলে তারই জন্য যেন ভবিষ্যৎ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এটা যখন হৃদয়ঙ্গম করা সম্ভব হয়, ব্যাপারটা কুয়াশার আড়ালে চাপা পড়ে রয়েছে বুঝতে পেরেও অবিশ্বাসকে কেউ বাড়তে তো দেয়ই না, সাধ্যমত চাপা দিয়ে রাখতেই সচেষ্ট হয়। আর অধীর প্রতীক্ষায় থাকে, ভবিষ্যদ্বাণী যদি ফলে যায় ফলুক। কারো পক্ষে এমন প্রগাঢ় ভবিষ্যৎ-জ্ঞান থাকতে যে পারে না, তা কি আর বুঝতে পারা যায় না।

এবার ইমুডিয়া দেশ সম্পর্কে সে ভবিষ্যদ্বাণী রয়েছে সে প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা করা যাক।

বংশ পরম্পরায় এ অঞ্চল দুর্ভেদ্য থাকবে। একেবারে এমন দুর্গম অঞ্চল হয়ে থাকবে, যার ফলে কোনোদিনই এর ওপর দিয়ে মানুষের পক্ষে যাতায়াত করা সম্ভব হবে না।

এ দেশটা বকজাতীয় লম্বা গলাওয়ালা বারখোর্যান্ট পাখিদের দখলে থাকবে বছরের পর বছর ধরে। আর দাঁড় কাক আর পেঁচার দলও সেখানে পরমানন্দে দাপাদাপি করে বেড়াবে। আর এ বিস্তীর্ণ প্রান্ত জুড়ে শুধু পাথর আর পাথর বিরাজ করবে আর পদে পদে থাকবে অফুরন্ত বিভ্রান্তি।

এ উষার ভূমি বাইরের কোনো সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিকে শত ডাকাডাকি করলেও সে এ পথ মাড়াবে না। শুধু কি এই? এখানে রাজকুমার বলেও কারো অস্তিত্ব থাকবে না।

যত সব প্রাসাদ সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেগুলোতে ক্রমে কাটা জাতীয় গাছ গজাবে, আর এক সময়ে সেগুলো ক্রমে পুরো প্রাসাদই ঢেকে ফেলবে। আর দুর্গে বিচুটি ঝোঁপ গজাবে এবং তা পুরো দুৰ্গটাকেই এক সময় ছেয়ে ফেলবে।

ড্রাগন আর পেঁচার দল এখানে আধিপত্য বিস্তার করবে। আর এক সময় পুরো অঞ্চালটাই তাদের শাসনাধীন হয়ে পড়বে।

উষার ভূমির হিংস্র পশুর সঙ্গে নিকটবর্তী অঞ্চলের বন্যপশু প্রায়ই বিবাদে লিপ্ত হবে। তাদের তীব্র হুঙ্কারে আকাশ-বাতাস কেঁপে কেঁপে উঠবে।

মজা লুটবে শকুন-শকুনি। তারা মৃত পশুর মাংসে মজা করে ভোজ সারবে।

আমার অভিশাপে মাউন্ট সিনাই পর্বত জর্জরিত হবে। আর এরই ফলে বিস্তীর্ণ অঞ্চল বছরের পর বছর ধরে জনমানবশূন্য হয়ে শ্মশানের মতো হয়ে থাকবে।

সেখানে যাওয়া কারো পক্ষেই সম্ভব হবে না। কেউ যদি নেহাৎ সেখানে যাওয়র জন্য জেদ ধরে তবুও তার পক্ষে কিছুতেই লক্ষ্যে পৌঁছনো সম্ভব হবে না, পথ ভুল করে অন্যদিকে ধাওয়া করবে। যাদের মরুভূমিতেই জন্ম, আর মরুভূমির বালির ওপরেই বেড়ে উঠেছে, দুর্ধর্ষ সে আরববাসীরাও এ অঞ্চলে আসার নামে শিউরে উঠবে। কোনোকিছুর বিনিময়েও তাদের সেখানে যাওয়ার জন্য রাজি করাতে পারবে না।

এ বিস্তীর্ণ অঞ্চলটা এমন ভয়ঙ্কর অভিশাপগ্রস্ত হওয়ার আগে এর উপর দিয়ে রোমান রাস্তা প্রবাহিত ছিল। এখান দিয়েই দলে দলে কাতারে কাতারে মানুষ দূরদেশে পাড়ি জমাত। এ পথে বিপদের সামান্যতম আশঙ্কাও থাকত না।

তখন কিন্তু কারো মনেই সামান্যতম আশঙ্কাও উঁকি দেয়নি যে, অদূর ভবিষ্যতে কেউ আর এ রাস্তা দিয়ে গন্তব্য স্থানের উদ্দেশ্যে পা বাড়াবে না। এ রকম একটা বিশ্বাস্য কথা মনে স্থান দেওয়া তো দূরের ব্যাপার, কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি।

অভিশাপ উচ্চারিত হওয়ার সাতশো বছর পরের বিবরণীয় মারফত জানতে পারা। গেছে, তখনও রাস্তার ব্যবহার চালু ছিল।

তীর্থযাত্রীর দল অভিশপ্ত অঞ্চল ছুঁয়ে, পাশে অঞ্চলের ওপর দিয়ে গন্তব্যস্থলের দিকে চলে গেছে। কিন্তু ভুলেও কেউ অঞ্চলটার ভেতরে যেতে উৎসাহি হয়নি।

কিন্তু সম্প্রতিকালের পর্যটকদের অভিশাপকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অভিশপ্ত অঞ্চলটার ওপর দিয়ে নির্দিধায় পাড়ি দিয়ে তারা মৃত্যুর শিকার হয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মৃত্যুর কারণ অভিশাপ নয়, অন্য কিছু।

অতএব এ-কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা চলে, সেখানে যেতে এবং সেখানে আসতে হলে কেউ-ই গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে পারব না। এ অভিশাপ পুরোপুরি কার্যকরী হয়নি। বরং বলা চলে, অভিশাপের ব্যাপারটা অসত্যই প্রমাণীত হয়েছে।

মি. স্টিফেন্স অভিশাপকে কেন্দ্র করে অন্য অর্থনির্ণয় করেছেন।

ইডুমিয়া পথের ব্যবহার বাণিজ্যপথ হিসেবে আর থাকবে না। এর সঙ্গে অভিশাপের কোনো সম্পর্ক নেই। আসলে পথের গুরুত্ব কমে গেলে যা হয় এক্ষেত্রেও তা-ই হবে। বণিকদের কাছে পথের গুরুত্ব যেমন বাড়তে পারে, ঠিক একইরকমভাবে কমে যাওয়া তো বিচিত্র নয়।

অতএব অভিশাপের ব্যাপারটা নিয়ে, সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করে, মিছে তর্কে লিপ্ত হয়ে মি. স্টিফেন্সের একটা দ্বন্দ্ব সম্বন্ধে মতামত ব্যক্ত করে আমরা বরং আলোচনার ইতি টানি।

বাইবেলের পাতায় খোঁজ করলে পাওয়া যাবে, মোজেস সদলবলে ঠিক কোন অঞ্চল থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়েছিলেন, মি. স্টিফেন্স সে স্থানটার হদিস পেয়েও সামনের দিকে আরও এগিয়ে যান। শেষপর্যন্ত দুটো পর্বতশ্রেণির মধ্যবর্তী একটা পথের সন্ধান পান। অনেক ভেবে-চিন্তে সে গিরিপথকেই মোজেসের সাগর পাড়ি দেবার পথ ধরে নিয়েছেন।

কিন্তু ফ্যারাওের সশস্ত্র সৈন্যদল নিয়ে দু লক্ষ অনুগামীসহ ওই স্থান দিয়ে এক রাতের মধ্যে বিশাল সমুদ্র অতিক্রম করা কি সম্ভব হতে পারে? তিনি কেন যে একবারও ভাবলেন না, এতগুলো বছরের মধ্যে সাগর সরে যাওয়া অসম্ভব নয়, আবার পানি ও তিন ফুট নেমে যাওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নয়?

দু লক্ষ অনুগামীসহ মোজেস এক রাতের মধ্যেই উপসাগরের অল্প পানি অতিক্রম করতে পারার পিছনে যে কারণ ছিল তা হচ্ছে–সে রাতে ভাটার ফলে পানি আরও অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল। আর এরই ফলে তিনি এমন একটা অসম্ভবকে সম্ভব করতে পেরেছিলেন। আবার সর্বশেষ বক্তব্য মি. স্টিফেন্সের দুখণ্ডের এ বই বড়ই সুখপাঠ্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *