সাইলেন্স-এ ফেল

সাইলেন্স-এ ফেল

বামন দৈত্য!

বামন-দৈত্যটা আমার সামনে, একেবারে মুখোমুখি এসে দাঁড়াল।

আমি আকস্মিক ব্যাপারটা বুঝে ওঠার আগেই বামন-দৈত্যটা মুখ খুলল–এই যে, আমি কি বলছি, ধৈর্য ধরে শোনো, তোমাকে আমি এখন যে অঞ্চলের কাহিনী শোনাব, তা নিরানন্দ, সে-ছোট্ট জায়গাটা লিবিয়ায় অবস্থিত। জেইরি নদীর তীরে সেটাকে দেখতে পাবে। সেখানে প্রশান্তি বিরাজ করছে না, আবার নৈঃশব্দও কিন্তু না।

ওই যে জেইরি নদীর কথা বললাম, তার রঙ গেরুয়া রঙের হলেও, কদর্য না বলে পারা যায় না। সমুদ্রের সঙ্গে মিলিত হবার জন্য ছুটে যায় না। লাল সূর্যের তলা দিয়ে কুলকুল রবে প্রতিনিয়ত বয়ে চলেছে তো চলেছেই। মুহূর্তের জন্যও তার এ চলার বিরতি নেই।

আর নদীটার গতিবেগ? তীব্র। হঠাৎ করে দেখলে মনে হবে, নদীটা যেন খিচুনি ব্যানোর শিকার হয়ে প্রতিটা মুহূর্তনিদারুণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছে।

নদীটার দুইকূল বরাবর মাইল দুই পর্যন্ত ধূসর মরুভূমির বুকে পাঁপড়ি মেলে দাঁড়িয়ে রয়েছে অতিকায় জলপদ্ম। জলপদ্মের দল তারা গভীর নৈঃশব্দে অনবরত দীর্ঘশ্বাস ফেলে একে অন্যের দিকে টুলটুল করে তাকিয়ে থাকে আর আকাশের দিকে অস্বাভাবিক লম্বা ঘাড় উঁচিয়ে বার বার মাথা দোলাতে থাকে।

ওই পদ্মবনের দিক থেকে অনবরত যে গুনগুন রব ভেসে আসে, তা শুনে মনে হয়, ওই খরস্রোতা নদীর বুক থেকেই বুঝি নির্গত হয়ে বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে এগিয়ে এসে কানে বাজছে। তবু তারা একে অন্যের দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাহাকার করে। প্রতিটা বুক বুঝি অব্যক্ত ব্যথা-বেদনায় ফেটে যাচ্ছে। আর এরই ফলে তারা অনাদি-অনন্তকাল ধরে এভাবে বাতাসে দীর্ঘশ্বাস ছড়িয়ে চলেছে।

এ অত্যাশ্চর্য অঞ্চলটার কিন্তু একটা সীমারেখা রয়েছে। যে সীমারেখা সৃষ্টি হয়েছে গভীর ছায়াছায়া আকাশচুম্বী বনাঞ্চল দিয়ে। যদিও সেখানকার স্বর্গ থেকে মর্ত্য অবধি কোথাও বাতাসের লেশমাত্রও নেই, তবু যেন আকাশচুম্বি গাছগুলোর তলার দিককার ডালপালা প্রতিনিয়ত বাতাসে দোল খাচ্ছে। যেন হাত-পা ছড়িয়ে নাচানাচি করছে।

অতিকায় গাছগাছালি উত্তর-পশ্চিম আর দক্ষিণ-পূর্ব দিক লক্ষ করে বার বার দুলে দুলে উঠছে। তাদের ডালে-ডালে, পাতায়-পাতায় ঘর্ষণের শব্দ যেন কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে।

প্রাগৈতিহাসিক বনাঞ্চল বলেই না এরা এরকম রোমহর্ষক শব্দ সৃষ্টি করতে সক্ষম।

আরও আছে, প্রতিটা গাছের মাথা থেকে টপটপ করে শিশিরবিন্দু প্রতি মুহূর্তে ঝরে পড়ছে। শিশির পড়ার বিরতি নেই, শেষ নেই আর শিশির জমার শেষ নেই।

অতিকায় গাছগুলোর শিকড় জুড়ে অদ্ভুত বিষাক্ত ফুলের গোছা যেন অত্যাশ্চর্যভাবে দোল খাচ্ছে, নাচানাচি, দাপাদাপি করছে। তারা চিরনিদ্রার কোলে ডুবে থাকলেও সর্বদা সঞ্চারমান, কারণ? কারণ তো অবশ্যই আছে। কারণ রাত-দিন তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে। সুখন্দ্রিা বলতে যা বোঝায় তা আদৌ তাদের অদৃষ্টে নেই।

তাদের মাথার ওপর দিয়ে টুকরো টুকরো কালো মেঘের দল বাতাসে দোল খেতে খেতে ছুটে চলেছে।

মেঘের দল অনবরত পশ্চিমে ছুটতে ছুটতে শেষমেশ একসময় চক্কর খেয়ে খেয়ে জলপ্রপাত সৃষ্টি করছে–দূর দিগন্তের ওপারে দুঃসপ্নময় এক অজানা-অচেনা রাজ্যে। অথচ আকাশের কোথাও এক তিল বাতাসের অস্তিত্বও নেই।

জেইরী নদীর দুকূলেও এতটুকু প্রশান্তি নেই, নেই নৈঃশব্দের নাম গন্ধও। এ যেন দুঃস্বপ্নময় এক অবিশ্বাস্য রাজ্য।

ও তের অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। যখন পড়ে তখন তো বৃষ্টি হয়েই পড়ে, কিন্তু পর মুহূর্তেই তা লালবর্ণ ধারণ করছে, রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

লম্বা ও লম্বা-পাতাবিশিষ্ট পদ্মবনে দাঁড়িয়ে আমি বৃষ্টিতে ভিজছিলাম, আমার সর্বাঙ্গে ঝরঝর করে পানি অনবরত ঝরছিল। আর জলপদ্মগুলো নির্জন-নিরালা। পরিবেশে একে অন্যের দিকে ফিরে দীর্ঘশ্বাসের পর দীর্ঘশ্বাস ফেলছিল।

অসহ্য জমাটবাধা কদাকার কুয়াশার চাদর ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে আকাশের চাঁদ উঁকি দিল। রূপালি নয়, রক্তের মতো টকটকে লাল চাঁদ। নদীর তীরে অবহেলিতভাবে পড়ে থাকা একটা অতিকায় পাথরের দিকে আমার চোখ পড়ল। ধূসর রঙের পাথরটার গায়ে চাঁদের আলো পড়ায় সেটা অদ্ভুত এক রঙ ধারণ করেছে।

কদর্য আর অতিকায় পাথরটার সামনের দিকে কি সব কথা উত্তীর্ণ করে রাখা হয়েছে।

পাথরটার দিকে চোখ পড়তেই আমার মধ্যে কৌতূহল দানা বাঁধল। সে কৌতূহল ক্রমে ঘনীভূত হয়ে ওঠায় আমি ভেতরে ভেতরে বড়ই অস্থির হয়ে পড়লাম।

নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আমি গুটিগুটি অতিকায় পাথরটার দিকে এগিয়ে গেলাম বৃষ্টি অনবরত ঝরেই চলেছে। জলপদ্মের ঝোঁপ ঠেলে-ধাকে এগোতে এগোতে আমি গিয়ে পাথরটার সামনে, একেবারে গা-ঘেঁষে দাঁড়ালাম।

পাথরটার গায়ে উত্তীর্ণ অক্ষরগুলো যাতে আমি ভালোভাবে দেখতে পাই, পড়তে পারি, সে জন্যই এত কাছে যাওয়া।

পাথরটার একেবারে কাছে এগিয়ে গিয়েও আমাকে হতাশ হতে হলো। ওগুলো যে আসলে আদৌ কোনো ভাষারই অক্ষর নয়–সাঙ্কেতিক চিহ্ন। ফলে আমার পক্ষে কিছুই পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হলো না। হতাশায় বুকটা ভরে গেল। ফুসফুস নিঙড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

অনন্যোপায় হয়ে জলপদ্মের ঝোঁপের দিকেই বিষণ্ণ মনে ফেরার উদ্যোগ নিচ্ছিলাম।

পিছন ফিরে একটা পা বাড়াতে না বাড়াতেই আচমকা চাঁদের আলো যেন খুব বেশি রকম বেড়ে গেল। ঝলমলে আলো আমার ঠিক মাথায় এসে ঝরে পড়ল।

ক্রমে চাঁদের আলো যেন আরও অনেক, অনেক বেশি রক্তিম হয়ে উঠল। আমি ঝট করে পিছন ফিরে আবার সুবিশাল পাথরটার দিকে তাকালাম। তার গায়ের উত্তীর্ণ লেখাটা এবার আরও স্পষ্ট হয়ে চোখের সামনে ফুটে উঠল। একটাই শব্দ।

হঠাৎ দৃষ্টি ফিরিয়ে পাথরটার ওপরের দিকে তাকালাম। দেখলাম, পাথরটার মাথায় একজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। দীর্ঘদেহী।

আমি ঝট করে পদ্মবনে গা-ঢাকা দিয়ে দিলাম। লোকটা যাতে আমাকে দেখতে পায়, সেজন্য সাধ্যমত নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে ঘাপটি মেরে রইলাম। দৃষ্টি কিন্তু সে লোকটার ছায়া ছায়া মূর্তিটার দিকেই নিবদ্ধ রাখলাম।

আগেই বলেছি, লোকটা দীর্ঘদেহী, রাজকীয় চেহারা আর রোমক পোশাক পরিচ্ছদে কাঁধ পর্যন্ত ঢেকে রেখেছে। অন্ধকারে তার মুখটা পুরোপুরি ঢাকা পড়ে যায়নি। কুয়াশা, ছিটে ছিটে শিশিরের মতো বৃষ্টিতেও তার মুখটাকে দেখা যাচ্ছে। তার কপালটা কুঞ্চিত আর কুটিল দুচোখে উদ্বেগের সুস্পষ্ট ছাপ বর্তমান আর গাল দুটোতে

অগণিত গভীর রেখা যাদের তলায় কবরস্থ রয়েছে যেন বহু চাপা দুঃখ-যন্ত্রণা।

লোকটা এবার পাথরটার শীর্ষে পা গুটিয়ে অদ্ভুত কায়দায় বসে পড়ল। তারপরই নিস্পলক চোখে রক্তিম জ্যোৎস্নালোকিত বিস্তীর্ণ জনহীন প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে প্রকট হয়ে উঠেছে মানবজাতির প্রতি প্রগাঢ় বিতৃষ্ণা। আর লক্ষিত হচ্ছে অসীম ক্লান্তি অবসাদ আর নির্জনতার সন্ধানের প্রয়াস।

সে হাঁটুর ওপর ভাজ করে রাখা হাতের ওপর চিবুক রেখে অশান্ত জলপদ্মের বনের ওপর অস্থির চোখের মণি দুটোকে বার কয়েক বুলিয়ে নিল। পরমুহূর্তেই দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকাল আকাশছোঁয়া গাছগুলোর মাথার দিকে, কালো মেঘের টুকরোগুলো কালো বুনো ঘোড়ার মতো হারা উদ্দেশ্যে ছুটে চলেছে। সবশেষে দৃষ্টি ফিরিয়ে সে তাকাল রক্তিম চাঁদটার দিকে।

হঠাৎ একেবারে হঠাৎ-ই লোকটার সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠল। আমি পদ্মবনে নিজেকে লুকিয়ে রেখেই তার আকস্মিক সৃষ্ট কাঁপুনি প্রত্যক্ষ করতে লাগলাম। আমি স্পষ্টই লক্ষ করলাম, অস্বাভাবিক কেঁপেই চলেছে তার আপাদমস্তক।

কেন এ কাঁপুনি? নিঃসীমনিস্তব্ধতাই তার কাঁপুনির মূল কারণ।

সে কিন্তু মুহূর্তের জন্যও বিচলিত হয়ে স্থানত্যাগ করে অন্যত্র চলে গেল না। বরং একইভাবেই, একই ভঙ্গিতে বিরামহীনভাবে সে বসেই রইল।

আকাশের গায়ে ঝুলে থাকা রক্তিম চাঁদটার গা থেকে চোখ দুটোকে ফিরিয়ে নিয়ে এসে সে এবার নিরানন্দ জেইরী নদীর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। চোখের সামনে ভেসে উঠল হলদেটে কুদর্শন জলস্রোত। গা ঘিন ঘিন করে, বার বার কাঁটা দিয়ে ওঠে। এবার তাকাল দুপাড়ের মড়ার মতো ফ্যাকাশে রঙে প্রান্তরের দিকে।

সে এবার উৎকর্ণ হয়ে শুনতে লাগল। হতাশায় জর্জরিত জলপদ্মগুলোর নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘশ্বাস–যার সঙ্গে নিরবচ্ছিন্ন গুনগুন মিলেমিশে একাকার হয়ে রয়েছে যাকে জেইরী নন্দীর খরস্রোত থেকেই উদ্ভুত বলেই মনে করা হচ্ছে।

আমি কাছ থেকে, খুবই কাছ থেকে তার নৈঃশব্দের নিরবচ্ছিন্ন অস্বাভাবিক কম্পন। চাক্ষুষ করলাম। রাত ক্রমে বেড়েই বেড়েই চলল। সে পাথর ওপরে একই ভঙ্গিতে ঠায় বসেই রইল। আর আমি? আমি নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে তার প্রতিটা মুহূর্তের গতিবিধির ওপর নজর রেখে চললাম। মুহূর্তের জন্যও আমি তার ওপর থেকে দৃষ্টি ফেরাইনি, ফেরাতেই পারিনি।

ঠিক সে মুহূর্তে আমার মধ্যে কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক ভাবান্তর ঘটে গেল। আমি ঠিক তখন অভিশাপ দিয়ে উঠলাম।

ভৌতবস্তুদের উদ্দেশ্যে দেওয়া আমার সে অভিশাপ দূর আকাশের গায়ে তুমুল ঝড় দেখা দিল। কী সে প্রলঙ্কর বিধ্বংসী সে ঝড়, তা আর বলার মতো নয়। আমার মনে হলো বুক-কাঁপানো সে-ঝড়ের তাণ্ডবে সৃষ্টি বুঝি ধ্বংস হয়ে যাবে।

সত্যি অবাক হবার মতো ব্যাপারই বটে। একটা আগেই যেখানে হাওয়া বাতাসের লেশমাত্রও ছিল না, সেখানে এমন তুমুল ঝড় যে বাস্তবিকই কল্পনাতীত ব্যাপার। এটা অবশ্যই আমার সে জ্বলন্ত অভিশাপেরই ফল।

মুহূর্তের মধ্যেই বৃষ্টির বেগ আগের তুলনায় যেন হাজারগুণ বেড়ে গেল। আর বৃষ্টির জলধারা পাথরটার ওপর বসে থাকা লোকটার মাথায় অনবরত ঝমঝম করে। পড়তে লাগল।

এদিকে নদীর পানি ফুলে-ফেঁপে বন্যার রূপ ধারণ করে তীব্র বেগে ধেয়ে আসতে লাগল। পানির উপরিভাগে এমন ফেণার আস্তরণ তৈরি হল, যা দেখে মনে হলো নদীর বুকে যেন পানি নয়, সফেন কোনো দৈত্য ছড়িয়ে দিয়েছে। আর মাটি কামড়ে ধরে জলপদ্মগুলো অনবরত আর্তনাদ করে চলেছে। একটু আগেও আর সদম্ভে মাথা উঁচিয়ে যেসব গাছ দাঁড়িয়ে ছিল, এখন ঝড়ের দাপটে সেগুলোই বার বার অসহায়ভাবে মাথা নোয়াচ্ছে।

আরও আছে, আকাশের একপ্রান্ত থেকে বুক চিড়তে চিড়তে দ্রুততম গতিতে অগ্রসর হয়ে বজ্র আকাশের অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত চলে যাচ্ছে। আর সে সঙ্গে মুহূর্তের জন্য হলেও আকাশের একটা বড় ভগ্নাংশকে উজ্জ্বল আলোকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে দিচ্ছে। বজ্রের প্রচণ্ড শব্দে পাহাড়ের মূল পর্যন্ত কেঁপে কেঁপে উঠছে।

আমি কাছ থেকে, গোপন অন্তরাল থেকে বিচিত্ৰদৰ্শন লোকটার কাণ্ডকারখানার ওপর সতর্ক দৃষ্টি রাখতে লাগলাম। আমি লক্ষ করলাম অখণ্ড অন্তহীন নৈঃশব্দ তার মধ্যে বার বার কম্পন সৃষ্টি করছে–সর্বাঙ্গ থরথর করে কেঁপে উঠছে। রাত অনবরত বেড়েই চলেছে।

আমি আর নিজেকে সামলে সুমলে রাখা সম্ভব হলো না। আমি ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে নদী, আকাশ, অতিকায় জলপদ্ম, অরণ্য, বাতাস আর বজ্রকে অভিশাপ দিলাম প্রাণভরে। আর অভিশাপে জর্জরিত করলাম জলপদ্মগুলোর দীর্ঘশ্বাসকে।

আমার অভিশাপকে সহ্য করতে না পেরে তারা সবাই নিশ্চল,নিথর আর অনড় হয়ে পড়ল।

আমার অভিশাপে বজ্রের অপমৃত্যু হল, চাঁদের গতিরুদ্ধ হওয়ায় স্তব্ধ হয়ে পড়ল, অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটার আধার বিদ্যুৎ আর চমকাল না। কয়েকমুহূর্ত আগেও যে ঘনকালো মেঘের টুকরোগুলো গতিশীল ছিল এখন সেগুলোই নিশ্চল অবস্থায় আকাশের গায়ে ঝুলছে, ফুলে-ফেঁপে ওঠা নদীর পানি ক্রমে নামতে নামতে তলদেশ স্পর্শ করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আর জলরাশি গতি হারিয়ে স্তব্ধ হয়ে রয়েছে, পদ্মবন থেকে বিচিত্র গুনগুনানি অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, আকাশ ছোঁয়া গাছগুলোর অস্থিরতা বন্ধ হয়ে গেছে, জলপদ্মগুলো দীর্ঘশ্বাস ছাড়া বন্ধ করে দিয়েছে, বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত মরুভূমির কোনো জায়গা থেকেই এতটুকুও শব্দ উত্থিত হচ্ছে না–একেবারেই শুনশান অবস্থা।

আমার চোখ দুটো চারদিকে চক্কর মারতে মারতে এক সময় বিশালায়তন পাথরটার গায়ে স্থির নিবদ্ধ হয়ে গেল। তার গায়ে উল্কীর্ণ করে রাখা লেখাটার গায়ে এবার নতুন করে চোখের মণি দুটোকে বার-বার বুলাতে লাগলাম। এখন দেখলাম, সেখানে নৈঃশব্দ শব্দটা লেখা রয়েছে। স্পষ্টাক্ষরে শব্দটা খোদাই করা।

পাথরটার গা থেকে দৃষ্টি তুলে নিয়ে আমি আবার বিচিত্র কায়দায় বসে-থাকা মানুষটার দিকে নিবদ্ধ করলাম।

তার মুখাবয়টার আকস্মিক পরিবর্তনটুকু আমার নজর এড়াল না। সে মুখটা এমন নিঃসীম আতঙ্কে ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গেছে।

সে মানুষটা যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। উল্কর্ণ হয়ে শব্দ শোনার চেষ্টা করল সত্যি। কিন্তু মরু অঞ্চলের কোনো প্রান্তেরই গা-বেয়ে উঠে এলো না কোনো শব্দ–কোনো কণ্ঠস্বর।

পাথরটার গায়ে যে নৈঃশব্দ কথাটা লেখা রয়েছে, সে স্থানটাকে আরও অনেক, অনেক বেশিনিস্তব্ধ বলে মনে হলো।

লোকটা অনবরত থর থর করে কাঁপতে কাঁপতে পাথরের শীর্ষদেশের আসনটা ছেড়ে নেমে এলো।

ব্যস, চোখের পলকে সে বেপাত্তা হয়ে গেল। তারপর মুহূর্তের জন্যও আমি আর তাকে দেখতে পাইনি।

বামন দৈত্যটা গল্পটা শেষ করে নীরব হলো।

সত্যি বলছি, আমি বহুদেশে, বহু লোকের মুখে অনেক উদ্ভট গল্প শুনেছি, দেশ বিদেশের বহু গল্প পড়েছিও বটে। কিন্তু এমন আর একটা কাহিনী কারো মুখেই শুনিনি, ভবিষ্যতেও শুনতে পাব বলে মনে হয় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *