1 of 2

দ্য স্পেকট্যাকল

দ্য স্পেকট্যাকল

প্রেম:

প্রথম দর্শনেই চোখে লেগে গেল?

ব্যস, আর দেরি নয়–প্রেমে মজে গেল! প্রথম চোখে দেখামাত্রই প্রেম?

বেশ কিছু বছর আগে যদি এমন কথা কেউ বলত তবে সঙ্গে সঙ্গে ঠাট্টা রঙ্গ রসিকতার হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে যেত। হাসতে হাসতে কারো দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হত, আবার কেউ বা মাটিতে গড়াগড়ি খেতে আরম্ভ করত।

অনেকেই কিন্তু ব্যাপারটা সম্বন্ধে বিপরীত কথাই বলেন। আসলে ব্যাপারটাকে যারা একটু তলিয়ে দেখার চেষ্টা করে, মাথা খাটায় তারা সত্যি বলে।

প্রথম দর্শনেই প্রেমের ব্যাপারটা কিন্তু আদৌ টিটকারির বা হাসাহাসি করে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেবার মতো নয়।

প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়া, প্রেমে হাবুডুব খাওয়ার ব্যাপারটা আজ যেমন অবাস্তব নয়, তেমনি অতীতেও ছিল না, ভবিষ্যতেও থাকবে না–মোদ্দা কথা, চিরকালই থাকবে।

এক ঝলক দেখেই মন-প্রাণ উতলা হয়ে পড়াটা কিন্তু যে-সে ব্যাপার নয়, হেসে উড়িয়ে দেওয়ার ব্যাপার তো অবশ্যই নয়। অত্যাধুনিক আবিষ্ককারগুলোর দিকে দৃষ্টিপাত করলে বহু অদ্ভুত ঘটনার কথা জানা সম্ভব হচ্ছে।

আপনারা প্রেমের ব্যাপারটাকে যে দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করুন না কেন, নৈতিক চৌম্বক ধর্ম বা চৌম্বক-সৌন্দর্য বিজ্ঞান যা-ই বলুন না কেন, প্রকৃত বক্তব্যটা কিন্তু বাস্তবিকই যারপরনাই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী।

এক পলকে, মুহূর্তের দর্শনে দু-দুটো অন্তরের গভীরে যে অভাবনীয়নিবিড় নৈকট্যবোধ মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তাকে লোহা গলিয়ে, লোহার সঙ্গে সেঁটে দেওয়ার মতোই চিরস্থায়ী মনে করতে তিলমাত্র দ্বিধাও কারো মধ্যে থাকা উচিত নয়।

সত্যি বলছি, হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলে আপনিও অবশ্যই আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করবেন যে, প্রথম দর্শনেই দুটো অন্তরের গোপন বন্দরে অতর্কিতে ঠিক যেন ইলেকট্রিক সহানুভূতি ঝিলিক মেরে ওঠে। বুকের ভেতরে তীব্র আলোক আলোড়ন সৃষ্টি করে।

প্রেম বা ভালোবাসা যে শব্দই ব্যবহার করুন না কেন, তা কিন্তু প্রথম দর্শনের মুহূর্তেই খুবই তীব্র, পুরোপুরি নিখাদভাবে বিকিরিত হয়ে থাকে।

ভেবে দেখুন, প্রথম দর্শনে অন্তরে যে প্রেমের সঞ্চার ঘটে তার চেয়ে নিখাদ, তার চেয়ে অকৃত্রিম আর কিছু হতে পারে কি? আমি তো জোর গলায়ই বলব–না, অবশ্যই না। দু টুকরো গলানো লোহার মতোই একটা হৃদয় অন্য আর একটা হৃদয়ের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে জোড়া লেগে যায়।

যে কাহিনীটা এখনই আপনার দরবারে পেশ করব তা পড়লেই নিঃসন্দেহ হবেন আমার কথাটা কতখানি বাস্তবতায় পরিপূর্ণ, কতখানি নিখাদ। আর এও বলছি, এ ব্যাপারে হাজারো দৃষ্টান্ত তুলে ধরা যেতে পারে। তবুও আমি বলব, বর্তমান কাহিনীটাই আমার এ বক্তব্যের প্রমাণ দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট।

একটা কথা গোড়াতেই বলে রাখছি–গল্পটাকে রসসিক্ত ও মনোমুগ্ধকর করে তোলার জন্য আমাকে একটু বিশদভাবেই বর্ণনা দিতে হবে। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি, আমাকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আপনাদের দরবারে পেশ করতে হবে, আশা করি আমার বক্তব্যটা আপনাদের বোঝাতে পেরেছি।

যাক গে, যে কথা বলছিলাম, বর্তমানে আমি বয়সের দিক থেকে নিতান্তই এক যুবক–সবে যৌবনের প্রথম ধাপে পা রেখেছি। এখন আমার বয়স বাইশ চলছে। আর আমার বর্তমান নামটাও মোপটেই জবরজং নয়, নিতান্তই সাদামাটা–সিম্পসন।

স্বাভাবিকভাবেই মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, বর্তমান শব্দটা কেন ব্যবহার করলাম, তাই না? হ্যাঁ, কারণ তো একটা অবশ্যই আছে। কারণটা হচ্ছে, অতি সম্প্রতি আইনানুগভাবে আমার পদবীটা বদল করার দরকার হয়ে পড়ে। ফলে করলামও তা-ই।

কেন পদবীটা বদল করতে আমি উৎসাহি হয়েছি তা-ও খোলসা করেই বলছি। বহু দূর সম্পর্কের আমার এক আত্মীয়, পুরুষ আত্মীয়ের উত্তরাধিকারী আমাকে হতে হয়েছে। সে জন্যই পদবী বদলের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছি। আর ঘটনাটা বেশিদিন আগে ঘটেনি, গত বছরের ব্যাপার।

আমার ভাগ্য কিছুটা বদলে দেওয়া সে পরম আত্মীয়ের নামটাও আপনাদের সামনে পেশ করা যাক, কি বলেন?

অ্যাডলফাস সিম্পসন তার নাম।

আমি যথাসময়ে জানতে পারলাম, সম্পত্তির উত্তরাধিকার অর্জন করতে হলে যার সম্পত্তি তার পদবী আমাকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তবে এটা খুবই সত্য যে, আমি কেবলমাত্র প্রথম নামটা গ্রহণ করলেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ করে দিতে পারতাম। কিন্তু উইলের শর্ত যে আমাকে মানতেই হবে!

সম্পত্তি বাগাবার তাগিদে আমি আমার পারিবারিক পদবীই কেবল নয়, খোল নলচে সবই বদলে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আর ধ্যুৎ! যদি হাতছাড়া হয়ে যায় তবে পারিবারিক নাম পদবী ধুয়ে কি পানি খাব?

আমার পারিবারিক প্রথম আসল নাম, যাকে বলে আমার জন্মসূত্রে পাওয়া নাম ছিল নেপোলিয়ান বোনাপার্ট। আরও খোলসা করেই বলছি-আমার আগেকার নামের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশ ঠিক এরকমই ছিল। কিন্তু সেটাকে তো আর আঁকড়ে রাখতে পারলাম না। এখন আর তা নিয়ে মিছে আক্ষেপ করে ফায়দা তো কিছু নেই।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, নিতান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে পারিবারিক নামটাকে কবরস্থ করে সিম্পসন নামটাকে বেছে নিয়েছিলাম।

আমার পৈত্রিক নামটা এবার বলেই ফেলি–ফ্যয়সার্ট। এ-নামটা বলতে গিয়ে আমি ভেতরে ভেতরে যে কী গর্ববোধ করতাম, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না, শত চেষ্টা করেও না।

তবে এটাও ঠিক যে, আমি সিম্পসন নামটার মাধ্যমেও মনে গর্ব জাগিয়ে তুলতে কম প্রয়াস চালাইনি। ভেতরে ভেতরে সাব্যস্ত করেও ফেলেছিলাম–কোষ্ঠী ঠিকুজী ঘাটাঘাটি করে পূর্বপুরুষের কৌলিন্য কোনোরকমে বের করে ফেলতে পারলেই বাজিমাৎ করে দিতে পারব, ঐতিহ্যের গর্বে বুকটা একেবারে কাণায় কানায় ভরে উঠবে, অহঙ্কারে তখন আর আমার মাটিতে পা ই পড়বে না।

দেখুন কথায় কথায় নামের প্রসঙ্গ যখন উঠেই গেল তখন আর কিছু বলে, কিছু বাদ দিয়ে ফায়দাই বা কি?

সত্যি কথা বলতে কি, আমার পূর্বসূরীদের নামগুলোতে অদ্ভুত রকমের একটা কাকতালীয় ব্যাপার এসে গেছে। সে কী? ব্যাপারটা হচ্ছে, প্যারিস নগরের মি. ফ্রয়সার্ট ছিলেন আমার বাবা। আমার মা যখন পনেরো বছরের কিশোরী তখন আমার বাবা তাকে বিয়ে করে ঘরে নিয়ে আসেন।

বিয়ের আগে আমার মায়ের নাম ছিল ক্রয় সার্ট–কুমারী ক্রয় সার্ট। ব্যাঙ্কার ক্ৰয়সার্ট ছিলেন তাঁর বাবা। তিনি ছিলেন তার বড় মেয়ে।

ব্যাংকার ক্রয়সার্ট ষোলো বছরের এক রূপসি কুমারীকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর বাবার নাম ছিল ভিক্টর ভয়সার্ট। তিনিও ছিলেন তার বাবার বড় মেয়ে।

কী অভাবনীয় একেবারেই অত্যাশ্চর্য ব্যাপার ভেবে দেখুন তো ভাই, মর্সিয়ে ভয় সার্ট যাকে বিয়ে করে ঘর বেঁধে ছিলেন তার নাম ছিল কুমারী ময়সার্ট। এক্ষেত্রে মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে বয়ষ খুব কমই ছিল। নাবালিকা তো অবশ্যই, খুকিও বলা চলে, তাই না?

আর তার মা? তিনিও মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছিলেন। ম্যাডাম ময়সার্ট ছিল তার নাম।

ফরাসি দেশে এরকম কম বয়সে বিয়ের প্রচলন রয়েছে। অন্য সব ঘটনার কথা আলোচনা না-ই বা করলাম। এ ঘঠনাটার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ময়সার্ট, ভয়সার্ট, ক্ৰয়সার্ট আর ফ্ৰয়সার্টরা বংশগতির ধারা বহন করছেন।

আইন, আইনের কচকচানির ফলে আমি সিম্পসন নামটা আমি নিজের সঙ্গে জড়িয়ে নিতে বাধ্য হয়েছি। নিজের পৈত্রিক নাম পদবী পাল্টে এ নামটা গ্রহণ করতে আমি মোটেই ভেতর থেকে উৎসাহ পাইনি। বরং বলা চলে নতুন নামটা গ্রহণের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমার দিক থেকে প্রবল আপত্তিই ছিল।

আমার আপত্তিটা যে একেবারে অমূলক ছিল এমন কথা বলা যায় না। কারণ ঝুটমুট একটা নামধারণ করে উত্তরাধিকারী বনে বিষয় সম্পত্তির মালিকানা লাভ করতে হবে? পিতৃদত্ত নামটা জলাঞ্জলি দিয়ে ধনকুবের বনে যাওয়া? অসম্ভব। এমন সম্পত্তির মুখে হাজার বার ঝাটা মারি।

মনস্থির করেই ফেললাম কিছুতেই নাম বদলাব না। দরকার এমন সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে। সত্যি বলছি, মনের সঙ্গে এমন লড়াইও আমাকে দিনের পর দিন করতে হয়েছে। আমি হাঁপিয়ে উঠেছি, দম বন্ধ হয়ে আসার যোগাড়।

ধ্যুৎ! আমার ভাগ্য গুণে, ঈশ্বরের করুণা আমি সে বিষয় সম্পত্তি লাভ করেছি তার পরিমাণও তো নিতান্ত কম নয়। সত্যি কথা বলতে কি, তার পরিমাণ খুবই বেশি।

আমার শারীরিক শক্তি সামর্থ্যও নেহাৎ কম নয় শক্ত সমর্থ। পৃথিবীর অন্তত শতকরা নব্বই জন লোক অবশ্যই এক বাক্যে স্বীকার করে নেবে, আমি দেখতে শুনতে রীতিমত সুন্দর। আর মুখশ্রীর তো তুলনাই য় না। উচ্চতাও কম নয়–পাঁচফুট এগারো ইঞ্চি।

আমার মাথার চুল কালো, কোঁকড়ানোও বটে। নাকের গড়ন তাকিয়ে দেখার মতোই বটে। চোখ দুটো ধূসর, আড় ডাগর ডাগর, তবে দুর্বল। দৃষ্টি শক্তির এমন দুর্বলতা আমাকে সর্বদাই বিব্রত করেছে, স্বীকার না করে উপায় নেই। প্রতিকার করার জন্য হরেক রকম ব্যবস্থাও যে করিনি তাও নয়। কিন্তু তেমন কিছু ফয়দা হয়নি। শেষমেশ চশমা পরতেও বাদ দেইনি। তবে এওতো সত্য যে, দেহ-মনে যখন আমার যৌবনের জোয়ার বয়ে চলছিল তখন এসব জিনিস অন্য পাঁচটা যুবকের মতো আমিও বরদাস্ত করতে পারিনি। যৌবনে এসব জিনিস মুখশ্রীকে একেবারেই নষ্ট করে দেয়। মুখটাকে কিম্ভুতকিমারকা করে দেয়। তাই আমি কোনোদিনই এসব বাহ্যিক ব্যবহার্য দ্রব্যাদির ব্যবহার বরদাস্ত করিনি। তাই দুর্বলতা কাটাবার সহায়ক বস্তুগুলো আমাকে বর্জন করতেই হলো।

তা ছাড়া, বকধার্মিকের মতো নাকের ডগায় চশমা চাপালে আসল যে বয়স তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি বলেই মনে হয়। তাই আমার মতে চশমার মতো বাজে জিনিস আর হয় না।

আর আর গ্লাস? এটা প্রকৃতপক্ষে ফুটেয়ে তোলে যাকে এক কথায় বিতিকিচ্ছিরি ছাড়া আর কোন শব্দে ব্যাখ্যা করা যায় না। তাই অবধি এ বস্তু দুটোকে আমি সতর্কতার সঙ্গে বর্জন করে চলেছি।

নিজের চেহারা ছবি আর পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে এত করে ঘ্যানর ঘ্যানর করা বাড়াবাড়িই হয়ে যাচ্ছে, স্বীকার করছি। নিজেকে গুরুত্ব একটু বেশিই দিয়ে দিয়েছি, তাই না?

যাক কে, নিজের কথার ইতি করার আগে শুধুমাত্র এটুকই বলব যে, আমি স্বাভাবের দিক দিয়ে একটু দৃঢ়চেতা, বে-পরোয়া, একনিষ্ঠ আর অত্যুৎসাহীও বটে। আর জীবনভর খুবই নিষ্ঠার সঙ্গে পঞ্চমুখে মেয়েদের গুণকীর্তন করে এসেছি।

জন্মের মধ্যে কর্ম করেছিলাম, এক সন্ধ্যায় পিউ থিয়েটারে একটা বক্স ভাড়া করে নাটকটাটক দেখেছিলাম। মি. ট্যালবট নামে আমার এক দোস্ত সঙ্গে ছিল। একটা নামকরা গীতিনাট্য মঞ্চে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। নামজাদা অভিনেতা-অভিনেত্রীরা অভিনয়ে অংশগ্রহণ করেছিল। প্রেক্ষাগৃহে ভিড়ও হয়েছিল গাদাগাদি।

আমার এ বন্ধুবর পাক্কা দুটো ঘণ্টা অপলক দৃষ্টিতে মঞ্চের দিকে তাকিয়ে রইল। গান বাজনা তার প্রাণ বললেও অত্যুক্তি হয় না। আর গীতিনাট্য হলে তো কথাই নেই। একটা টিকিটের বিনিময়ে গায়ের জামা খুলে দিতেও দ্বিধা করবে না

আমিও তার পাশে বসে দর্শকদের চেহারা আর পোশাক পরিচ্ছদ দেখেই পুরো দুটো ঘণ্টা কাটিয়ে দিলাম। মজা না পাওয়ার তো কথাই নয়। কারণ, সবাই তো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের রূপসি মহিলা। তাদের রূপ সৌন্দর্যে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করে এক সময় দৃষ্টি ফিরিয়ে মঞ্চের নৃত্যনাট্য দেখতে লাগলাম।

আচমকা মঞ্চে নাটকের নায়িকার দিকে যেই দৃষ্টি ফেরাতে যাচ্ছি, ঠিক সে মুহূর্তেই একটা মূর্তি আমার দৃষ্টিকে চুম্বকের মতো আটকে ফেলল।

বেশ কয়েকটা প্রাইভেট বক্সে সে মূর্তিটাকে অদ্ভুত মনোলোভা ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখলাম। আশ্চর্য ব্যাপার! এতক্ষণ এমন একটা রূপের আকর আমার নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। আমার তো অন্তত এমনটা হবার কথা নয়!

বলতে লজ্জা নেই, যদি হাজার বছরও পৃথিবীতে টিকে থাকি, অপরূপা দৃষ্টিনন্দন মূর্তিটাকে এক মুহূর্তের জন্যও মন থেকে মুছে ফেলতে পারব না। যার দিকে তীব্র আবেগ-উচ্ছ্বাসে আমি অপলক চোখে তাকিয়ে ছিলাম।

রূপের আভায় চোখ ঝলসে দেয়ার ক্ষমতা রাখে এমন এক অনন্যা নারী-মূর্তি জীবনে আর কোনোদিনই দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি।

সে মুহূর্তে আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়েছিল, স্বর্গের অপ্সরাদের তৈরির রূপ অবশিষ্ট সৌন্দর্যটুকু নিয়ে এসে স্টুঝি নারী-মূর্তিটার গায়ে লেপে দেওয়া হয়েছিল। নইলে একটামাত্র দেহে এত রূপ-সৌন্দর্য এসে ভিড় করল কোথা থেকে?

চমৎকার! অপূর্ব! অনন্যা! মনোলোভা সে নারী-মূর্তির মুখটা তখন মঞ্চের দিকে ফেরানো ছিল। তাই মুখটা পুরোপুরি দেখা সম্ভব হলো না।

রূপসি তন্বী যুবতির অনন্য দেহসৌষ্ঠবের মধ্যে একটা যাদু ছিল, সন্দেহ নেই। নারীর সৌন্দর্যের এ-যাদুশক্তি চিরদিনই আমাকে এক অভাবনীয় শক্তিতে আকর্ষণ করেছে। এ ক্ষমতা যেন ডাইনীদের ক্ষমতা। একে প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বা। মানসিকতা কোনোটাই আমার নেই।

কিন্তু সে সন্ধ্যায়, নাট্যশালার ভিড়ে মধ্যে যা দেখলাম, তাকে আমার স্বপ্নের, আমার কল্পনার মোহিনী মূর্তি যেন সাক্ষাৎ মূর্তিমতি হয়ে আমার চোখ, আমার মন প্রাণ জুড়ে বসে রয়েছে।

কিন্তু হায়! সে যে বক্সের মধ্যে বসে। তাই তো তার সম্পূর্ণ অবয়ব আমার দৃষ্টিগোচর হলো না, হবার কথাও নয়। কিন্তু এমন অত্যাশ্চর্য-অদ্ভুত কৌশলে বক্সটা তৈরি করা হয়েছে যে, তার পায়ের নখ থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত কোনোকিছুই আমার দৃষ্টিগোচর না হওয়ার মতো ছিল না।

আমার সে অপরূপার উচ্চতা ছিল মাঝারি। অনবদ্য তার দেহসৌষ্ঠব। সুস্পষ্ট দেহরেখা। উন্নত বক্ষদ্বয় সমুন্নত মনোলোভা, মাথার পিছনের দিকটাই কেবলমাত্র নজরে আসছিল, তা-ও একটা বড় ভগ্নাংশই ছিল টুপির আড়ালে। হায়! গ্রীক পুরাণে বর্ণিত সাইকিং, যার মাথার গড়ন, টুপি দিয়ে তার সৌন্দর্য আর কতটুকুই বা ঢেকে ঢুকে রাখা সম্ভব? বরং মাথার শোভাকে আরও অনেকাংশেই বাড়িয়ে দিয়েছে।

রূপসির ডানবাহুটা চমৎকারভাবে বক্সের রেলিংয়ের ওপর দিয়ে পাতার মতো ঝুলছে। আমার শরীরের সব কয়টা স্নায়ু একই সঙ্গে ঝনঝা নিয়ে উঠল। শিরা উপশিরায় রক্তের গতি গেল বেড়ে। আমার সর্বাঙ্গ বারবার শিউরে শিউরে উঠতে লাগল।

আর তার বাহুর ওপরের দিকটা সম্প্রতিকালের ফ্যাশন অনুযায়ী, ঢিলেঢালা বস্ত্রে আচ্ছাদিত। হাতার বস্ত্রখণ্ডটা কনুইয়ের সামান্যনিচু অবধি নেমে এসেছে। মিহি বস্ত্রখণ্ডে তৈরি অন্তর্বাসটা উঁকি-ঝুঁকি মেরে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। মহামূল্য হীরার আঙটি টা আঙুলে আবদ্ধ থেকে ঝকমক করছে। আর তার গহনার বিবরণ না ই বা দিলাম। আর তার রুচিবোধ? সাধারণ মানুষের ধরা-ছোঁয়ার সম্পূর্ণ বাইরে।

পুরো আঘঘণ্টা! আধঘণ্টার জন্য আমি যেন পুরোপুরি পাথরের মূর্তির মত নিশ্চল-নিথর হয়ে পড়েছিলাম। পাথরের মতো নিশ্চল অবস্থায় বসে অপলক চোখে সে অপরূপা মূর্তির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আধঘণ্টা। হ্যাঁ, সে আধঘণ্টার মধ্যেই আমি মর্মে মর্মে অনুভব করলাম, শরীরের প্রতিটা স্নায়ুর দ্বারা অনুভব করলাম। প্রথম ভালোবাসা কাকে বলে আর তার আকর্ষণ কতই না তীব্র!

বিশ্বাস করুন, জীবনে বহু অপরূপার সান্নিধ্য লাভ করতে আমি সক্ষম হয়েছি– তাদের মুল্লুকের সেরা সুন্দরী আখ্যা দেওয়া যেতে পারে। তা সত্ত্বেও তাদের কেউ কারো রূপের জৌলুসে, লেলিহান আগুনের শিখায় পতঙ্গের মতো জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাওয়ার মতো আমার সমস্ত সত্তাকে উদভ্রান্ত করে তোলেনি।

আকর্ষণ! নিদারুণ আকর্ষণ! চুম্বক যেমন লোহাকে তীব্রবেগে আকর্ষণ করে, নিজের বুকে টেনে নিতে চায় ঠিক তেমনই তার মায়া-কাজল মাখানো স্বপ্নালু ডাগর ডাগর চোখ দুটো যেন দুর্নিবার আকর্ষণে আমাকে কাছে টানার জন্য বদ্ধপরিকর।

দুটো আত্মাকে যেন অদৃশ্য এক যাদু-ডোরে বেঁধে নিয়েছে। মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে যাচ্ছে, সে রূপসির আর আমার পবিত্র আত্মা।

তার আর রূপের অভাবনীয় অত্যাশ্চর্য শক্তির কাছে আমার দৃষ্টিশক্তি যেন মুহূর্তে নিজস্বতা হারিয়ে ফেলেছে। আমার পক্ষে চোখ ফেরানোই দায় হয়ে পড়েছে; অন্য কথা–অন্য কোনোকিছু ভাববার ক্ষমতা, অন্য যাবতীয় অনুভূতি অনেক আগেই আমার মধ্য থেকে নিঃশেষে লোপ পেয়ে গেছে।

মানবীরূপে স্বর্গের দেবীতুল্য সে মূর্তি আমার মনের মন্দির জুড়ে অবস্থান করছে।

আমি যেন জেগে নেই, স্বপ্নের ঘোরে অচেতন অবস্থায় কেবলমাত্র এটুকুই। উপলব্ধি করতে লাগলাম, আমি বদ্ধউন্মাদের মতো প্রেম-সাগরের গভীরে ডুবে যাচ্ছি। সেখান থেকে আর কোনোদিনই ফিওে আসা সম্ভব হবে না। তার অবর্ণনীয় মোহ আমার আমার সত্তাকে তো অনেক, অনেক আগেই কেড়ে নিয়েছে। আমি নিঃস্ব-রিক্ত হয়ে পড়েছি।

আমার কিন্তু তখনও সে অপরূপার মুখবয়ব দেখার সৌভাগ্য হয়নি। না দেখেই আমি এমন অবিশ্বাস্য রকম বেহাল হয়ে পড়েছি। মর্মান্তিক অবস্থায় পড়ে হাবুডুবু খেয়ে চলেছি, বলাই ভালো।

আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে এরকম ভাবনার উদয় যে হয়নি, তাও নয়। সে মুখে চমৎকৃত হওয়ার মতো সৌন্দর্য যদি না চাক্ষুষ করি। তবুও আমি প্রথম দর্শনে মনের গভীরে জেগে ওঠা প্রেমে আমি যে হাবুডুবু খাচ্ছি তাতে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

প্রেম! প্রেমের যাদুকরি শক্তি অভাবনীয়। সে যে কোনো প্রতিকূল শক্তি অগ্রাহ্য করে উদ্ভ্রান্তের মতো ভালো-লাগা পাত্রীর কাছে ছুটে যায়। লোক বলে বটে, মহাশক্তি দিয়ে ইচ্ছা অনিচ্ছাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। কিন্তু সে মুহূর্তে আমি এ-সত্যতা কিছুমাত্র উপলব্ধি করতে পারলাম না। কি করেই বা পারব? আমি যে নিজস্ব যাবতীয় সত্তাকে নিঃশেষে হারিয়ে ফেলেছি। এ পরিস্থিতিতে কী করে যে লাগাম টেনে ধরে মন-প্রাণকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব তা আমার জানা নেই। আমি যে নিজেকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে শক্তিহীন হয়ে পড়েছি।

রূপসি ললনা। রূপ-সৌন্দর্যের আঁকর, উদ্ভিন্ন যৌবনা, মন-প্রেয়সী অনন্যা সৌন্দর্য-সুধা আমি যেন নিজের অজান্তেই পান করে চললাম।

আমি যখন প্রেমের মদিরা আকণ্ঠ পান করে নেশায় বিভোর হয়ে রয়েছি ঠিক তখনই রঙ্গালয়ে হঠাৎ-ই হে-হট্টগোল শুরু হয়ে গেল। চারদিক থেকেচিল্লচিল্লি শুরু হয়ে গেল।

হৈ-হট্টগোল কানে যেতেই আমি যেন আচমকা আত্মস্থসম্বিৎ ফিরে পেলাম।

প্রেমের দেবতা যেন মুহূর্তে আমার প্রতি সদয় হলেন। আমার ভালো-লাগা সে রূপসি লালনা হৈ-হট্টগোল শুনে ব্যাপারটা সম্বন্ধে ধারণা নেওয়ার জন্য আচমকা মুখ ফেরাল।

ব্যস, আমি তৃষ্ণার্ত চোখ দুটো মেলে তার দিকে তাকালাম। দেখতে পেলাম, তার সম্পূর্ণ মুখাবয়ব বহু আখাঙ্ক্ষিত মুখাবয়ব।

উফ! ই! কী যে রূপের আঁকরের আগল মুহূর্তে আমার চোখের সামনে হাট হয়ে খুলে গেল; কোন্ শব্দের ব্যবহারে তার বর্ণনা দেব, ভেবে পাচ্ছি না। আর তা কি করেই বা দেব? আমার সবকিছু যে কেমন গোলমাল–অত্যাশ্চর্যভাবে এলোমেলো। হয়ে গেল।

আমি এতক্ষণ সে রূপ-সৌন্দর্যের আঁকরের ভাবনায় আত্মমগ্ন ছিলাম। এ-মুখ যে তার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি সুন্দও, বর্ণনার অতীত।

তবু সে মুখাবয়বে এমনকিছু একটার উপস্থিতি আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল যা আমাকে হতাশ, হ্যাঁ, হতাশই করে দিল। কোন অদৃশ্য হাত যেন আচমকা আমার বুকের ভেতরে দুম্ করে হাতুড়ির আঘাত হেনে বসল। কিন্তু সেটা যে কী? আমার মন-প্রাণ মুহূর্তে কেন এমন বিষিয়ে উঠল তা আমি বলতে পারব না। আমার পক্ষে বর্ননা করা সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।

বিষিয়ে আর হতাশ শব্দ দুটো ব্যবহার করলাম সত্য। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে এ-শব্দ দুটো আদৌ যথার্থ নয়।

আমার ভেতরের উথলে ওঠা ভাবাবেগ চোখের পলকে থিতিয়ে কোন গভীরে চলে গেল। বলতে পারব না। মুহূর্তেই এক অবর্ণনীয় প্রশান্তিতে আমার অন্তরের অন্তঃস্থল কানায় কানায় ভরে উঠল। আমার যাবতীয় সত্তাকে মোহমুগ্ধ, আবিষ্ট করে রেখে দিল। মনে হলো আমি যেন এখানে নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোনো লোকে অবস্থান করছি।

তার মুখাবয়বের সঙ্গে একমাত্র ম্যাডোনার মুখের সঙ্গেই তুলনা চলতে পারে। সে মুখ ঘিরে গিন্নিসূলভ গাম্ভীর্যই আমার অন্তরের আলোড়নকে যেন মুহূর্তের মধ্যেই উচ্ছ্বাসহীন করে তুলল। তা সত্ত্বেও আমি বলব, একমাত্র এজন্যই আমার মনের প্রশান্তি ঘটতে পারেনি।

আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করলাম, কোনো-না-কোনো রহস্য এর পিছনে কাজ করে চলেছে।

সে রূপসির মুখাবয়বে আমি এমনকিছু একটা প্রত্যক্ষ করেছিলাম, যা আমাকে সামান্য বিচলিত করল বটে, কিন্তু আমার আগ্রহ-উৎসাহকে চরমে পৌঁছে দিয়েছিল। এরকম পরিস্থিতিতে চরম কিছু করে ফেলার প্রবণতা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। আমার মধ্যেও প্রবণতা তুঙ্গে উঠে গিয়েছিল, অস্বীকার করব না।

আমার মনময়ূরী রূপসি তম্বী যুবতি যদি বক্সে একা থাকত, তবে আমি এক লাফে তার কাছে হাজির হতাম। হাজার বাধা-বিপত্তি অগ্রাহ্য করে তার রূপ-লাবণ্য, তার সঙ্গ-সুখ প্রাণভরে উপভোগ করতাম।

না, তার সঙ্গলাভ সম্ভব হয়নি। কারণ, তাকে সঙ্গদান করছিল এক ভদ্রলোক আর রূপসি মহিলা। তার মুখের দিকে তাকিয়ে উপলব্ধি করলাম, আমার ভালো-লাগা রূপসি তম্বীর চেয়ে তার বয়স একটু বেশিই হবে। আর রূপ-লাবণ্যের দিক থেকেও কিছু না কিছু পিছিয়েই রয়েছে।

অস্থিরচিত্ত আমি মুহূর্তের মধ্যেই মাথায় হাজার খানেক মতলব এঁটে ফেললাম। আমার প্রথম কাজ হবে, একটু বেশি বয়স্কা মেয়েটার সঙ্গে আলাপ পরিচয় করা। কিন্তু কিভাবে আমার মতলবটাকে বাস্তববায়িত করা সম্ভব? তা যদি না-ও হয়, তবে কিভাবে আমার স্বর্গের অপ্সরাকে আরও কাছে, আরও স্পষ্টভাবে দেখে মন আর চোখ দুটোকে এর চেয়ে কিঞ্চিৎ বেশি হলেও তৃপ্ত করতে পারব?

হঠাৎ মাথায় এলো, নিজের বক্সটা ছেড়ে রূপসির বক্সের কাছাকাছি একটা বক্সে চলে গেলেও কিছুটা অন্তত সুবিধা হত। কিন্তু সে উপায় ছিল না। কারণ, প্রেক্ষাগৃহে তিল ধারণের জায়গাটুকুও যে খালি ছিল না।

তারপরই যে চিন্তা মাথায় এলো, সামাজিক রীতিনীতি, সে গুড়েও বালি দিয়েছে রেখেছে। দূরবীণের কথা বলতে চাচ্ছি। যন্ত্রটা চোখে লাগানো মাত্র আইনের পৃষ্ঠপোষকরা অতর্কিতে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পিঠের চামড়া গুটিয়ে ফেলবে, সন্দেহ নেই। তাই যন্ত্রটা সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও সেটা আমার পকেটে ছিলও না তাই মুষড়ে পড়ে বারবার দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না।

বেশ কিছুটা সময় বিষণ্ণ মনে, মুখ গোমড়া করে কাটাবার পর মনস্থির করলাম, বন্ধুকে আমার সমস্যা,নিদারুণ অস্থিরতা বলে কোনো মতলব পাওয়া যায় কি না দেখা যাক। গোড়ার দিকে আমার অসহায় অবস্থার কথা তার কাছে ব্যক্ত করতে পারলাম না। বরং চেষ্টা করে নিজেকে সামলে-সুমলে রেখে, স্বাভাবিক কণ্ঠেই তাকে বললাম–

বন্ধু ট্যালবট, একটা অনুরোধ করব, রাখবে?

সে মঞ্চের হুর,পরী, নর্তকীদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বলল–কী! কীসের কথা বলছ?

তোমার অপেরা গ্লাসটা আমাকে মিনিট কয়েকের জন্য ধার দেবে? সে সচকিত হয়ে আমার দিকে মুখ ফেরাল। কপালের চামড়ায় পর পর কয়েকটা ভাজ এঁকে বলল–অপেরা গ্লাস!

হ্যাঁ, তোমার অপেরা গ্লাসটা আমাকে ধার দাও।

কিন্তু ও বস্তু আমি কোথায় পাব যে, তোমাকে দেব? আরে ধ্যুৎ! ওসব আমার কাছে নেই। কথাটা বিরক্তিভরে আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়েই আবার চটপট মঞ্চের দিকে তাকাল।

আমি কিন্তু এত সহজে হাল ছাড়ার পাত্র নই। মানসিক অস্থিরতার শিকার হয়ে টিকতে না পেরে আমি তার কাঁধে মৃদু চাপ দিতেই ঘাড় ঝাঁকুনি দিয়ে সে অধিকতর অসহিষ্ণুতা প্রকাশ করল।

আমি তবু দমলাম না। হাতটা তার কাঁধের ওপর রেখেই কাতর মিনতি জানালাম–বন্ধু, আমার কথাটা আগে ধৈর্য ধরে শোন, তারপর আমার অসহায়তার কথা বুঝে শুনে যা ভালো মনে কর, করবে।

সে আগের মতোই অধৈর্য ও বিতৃষ্ণার সঙ্গে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রায় খেঁকিয়ে উঠল– কী? কী বলতে চাচ্ছ, ঝটপট বলে ফেল।

অসহিষ্ণু হয়ো না। শোন, মাথা ঠাণ্ডা করে আমার কথাটা শোন–স্টেজ বক্সটা কী চোখে পড়ছে?

সে ঘাড় ঘুরিয়ে সামনের দিকে তাকাল।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–আরে, না-না, ওটা নয়, ওটা নয়, ওই যে পাশেরটা। ধ্যুৎ! দেখছ না, ওর চেয়ে রূপসি তষী যুবতিটা কেমন বক্সটা আলো করে বসে রয়েছে!

রূপসি তো অবশ্যই! খুবই সুন্দরী। বাস্তবিকই তার রূপের আভা রীতিমত চোখ দুটোকে ঝলসে দেওয়ার মতো ক্ষমতা রাখে।

রূপসি পরিচয়, মানে সে কে, জানো?

তা-ও বলা দরকার?

প্লিজ বন্ধু, তার সম্বন্ধে যদি কিছু জেনেই থাক, আমাকে বল।

ক্যাডাম ল্যানাডে ল্যানাডে। বাস্তবিকই স্বনামধন্যা এক নারী। সম্প্রতিকালে ম্যাডাম ল্যানাডের মতো রূপসি তন্বী যুবতিয় ধারে-কাছে দ্বিতীয় কেউ নেই।

আমি চোখে-মুখে অত্যুগ্র আগ্রহের ছাপ এঁকে তার মুখের কথাগুলো গোগ্রাসে গিলতে লাগলাম।

বন্ধুবর ট্যালবট পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনে আবার বলতে আরম্ভ করল–আরও আছে সবাই স্বনামধন্যা এ রূপসির রূপ-লাবণ্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। অগাধ ধন সম্পত্তির মালিক। তার ওপর বিধবা। মনের মতো বর পাকড়াও করার উদ্দেশ্যে প্যারিস নগরী থেকে সবে এসে এখানে ঘাঁটি গেড়েছে।

তোমার কথা তো দেখা যাচ্ছে, রূপসির সঙ্গে পরিচয় আছে, তাই না?

অবশ্যই! পরিচয় খাতির তো অবশ্যই আছে,

তার হাতটা চেপে ধরে অনুরোধ করে বললাম–ভাই, তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবে? প্রথম দর্শনেই আমি কুপোকাৎ–

সে ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল–তুমি তার সঙ্গে পরিচয় করতে আগ্রহি?

অবশ্যই! বলো তুমি পরিচয় করিয়ে দেবে কি না?

ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই সে বেশ একটু তাচ্ছিল্যের সঙ্গেই বলল– এ আর বেশি কথা কী–।

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি সোল্লাসে বলে উঠলাম–তবে তুমি অবশ্যই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিচ্ছ, কী বলে?

অবশ্যই, অবশ্যই! বললামই তো, আমার কাছে এটা কোনো ব্যাপারই না বন্ধু।

নিশ্চন্ত হলাম!

কবে, কখন পরিচয় করতে চাচ্ছ, বলো?

কাল–কালই!

ভালো কথা, তাই হবে। কাল কখন?

দুপুরে! দুপুর একটায় অসুবিধা হবে?

কিছুমাত্রও না। এবার বলো কাল দুপুরে তোমার সঙ্গে কোথায় আমার দেখা হবে?

কোথায়? আমি ঠিক একটায় বি-তে তোমার সঙ্গে দেখা করব।

সে আমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বলল–ঠিক আছে, তা-ই হবে।

তবে পাকা-কথা হয়ে গেল, কী বলে?

হ্যাঁ, একেবারে পাকা-কথা। এবার আর একটা কথাও না বলে লক্ষী ছেলের মতো মুখে কলুপ এঁটে বসে থাক।

আমি আশ্বস্ত হয়ে বললাম ঠিক আছে। এই আমি মুখে কলুপ এঁটে দিলাম। আর তোমাকে বিরক্ত করব না। তুমি নিশ্চিন্তে নাটক দেখ।

আমি বন্ধু ট্যালবটকে কথা দিলাম বটে, আর টু-শব্দটিও করব না। কিন্তু আমি যে নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে পড়েছি। রূপসি তন্বী যুবতিটা আমার মন-প্রাণ জুড়ে নিয়েছে। তার রূপের পোকা যে আমার মাথার ভেতরে নিবচ্ছিন্নভাবে কিলবিল করেই চলেছে। আমাকে মুখ বন্ধ করে স্বস্তিতে থাকতে দেবে কেন? অস্থিরতার শিকার হয়ে আর বার-কয়েক তাকে এটা-ওটা জিজ্ঞাসা না করে পারলাম না।

কিন্তু তার দিক থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নিজেকে সামলে-সুমলে নিতেই হলো। সে আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিল না। কেবলমাত্র হা-হুঁ অস্ফুট শব্দ উচ্চারণ করে বিরক্তি প্রকাশ করল।

বন্ধুবর অনুষ্ঠান শেষ না হওয়া পর্যন্ত মঞ্চের দিকে মন-প্রাণ সঁপে তন্ময় হয়ে বসে রইল। আর আমি? নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে অনবরত ছটফট করতে লাগলাম। আমার নাটক দেখা অনেক আগেই শিকেয় উঠে গেছে।

যখন বন্ধু ট্যালবটের দিক থেকে আমার অসংখ্য প্রশ্নের একটারও জবাব পেলাম

তখন অনন্যোপায় হয়েই তার দিক থেকে চোখ ও মন তুলে নিয়ে সে রূপসি ললনা ম্যাডাম ল্যানাডের ওপর স্থাপন করলাম। দীর্ঘসময় নিষ্পলক চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকার পর, এক সময় আমার ভাগ্য খুলে গেল। তার মুখের সামনের দিকটাও স্পষ্টভাবে দেখার সুযোগ পেলাম। সত্যিকারের রূপসি। অসাধারণ লাবণ্যময়ী।

সমস্ত মন-প্রাণ, আগেও অবশ্য আমি উপলব্ধি করেছিলাম আমার প্রাণ-প্রেয়সী রূপের বিচারে বাস্তবিকই অনন্যা। এখন নিমেষহীন নয়নে তার সম্পূর্ণ মুখটা চাক্ষুষ করে সে সত্যতার প্রমাণ পেলাম।

বন্ধুবর ট্যালবটের মুখ থেকে শোনার আগেই মনে-প্রাণে জেনে গিয়েছিলাম, তার মতো রূপ-সৌন্দর্যের আঁকর এ-তল্লাটের শুধু নয়, সারা শহরে দ্বিতীয় আর একজন নেই, পৃথিবীতেও মিলবে কি না সন্দেহ যথেষ্টই রয়েছে।

তবুও অন্তরের গোপন বন্দরে কী যেন একটা অব্যাখ্যাত ব্যাপার বারবার ঘুরপাক খেতে লাগল।

দীর্ঘসময় ধরে রূপসির মুখাবয়টা অনুসন্ধিৎসু নয়নে নিরীক্ষণ করে, আপন মনে চিন্তা-ভাবনা করে দেখলাম, মুখের বিষণ্ণতার ছাপটুকু, অভাবনীয় গাম্ভীর্যটুকু, আর ক্লান্তির চিহ্নটুকু হয়তো বা মুখমণ্ডলের উদ্ভিন্ন যৌবনোচিত লাবণ্যকে কম-বেশি ম্লান করে দিয়েছে। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, তার অনস্বীকার্য সত্যটা আমার মনকে

অনবরত কাঁটার মতো বিদ্ধ করতে লাগল। অসহ্য!

পরমুহূর্তেই তার স্মিতহাস্য, কোমলতা নমনীয়তা, সম্রাজ্ঞাসুলভ গাম্ভীর্য আর আবরণ আমাকে উদ্দীপিত করতে লাগল। আমার মন-প্রাণকে বিমুগ্ধ আর রোমাঞ্চে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলতে লাগল। আর আমার আগ্রহ-উদ্দীপনা যে উত্তরোত্তর কী পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে লাগল, ভাষায় ব্যক্ত করা সাধ্যাতীত।

আমি সে অফুরন্ত উৎসাহ নিয়ে রূপ সৌন্দর্য-সুধা পান করে চলেছি, তা আমার মন-ময়ূরী আমার নিষ্পলক চোখ দুটোর দিকে বার কয়েক তাকিয়ে নিঃসন্দেহ হয়ে পড়ল। ব্যাপারটা বুঝতে পারায় তার মধ্যে মুহূর্তের জন্য কম্পনের সৃষ্টিও হলো।

সে কেবলমাত্র একবারই নয়, আড়চোখে বারবার আমার দিকে তাকিয়ে আমার কাণ্ডকারখানার দিকে নজর রাখতেও ভুলল না।

আমার পিপাসা, আমার আগ্রহ আর উদ্দীপনা তখন চরমে উঠে গেছে। অতএব সে কি ভাবছে, আমার সম্বন্ধে তার মনে কোন ভাবনায় উদয় হয়েছে আর ব্রাপারটা আমার অনুকূল, নাকি প্রতিকূলতার দিকে ধেয়ে চলেছে, সে সব নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় বা মানসিকতা কোনোটাই আমার ছিল না।

আচমকা, একেবারে, হঠাৎ-ই মুখটা পাশের দিকে ফিরিয়ে নিল আমার ভালো লাগার রূপসি তম্বী যুবতিটা।

আমার কপাল ফেটে গেল। এমন রূপের সৌন্দর্য দেখে চোখ ও মনকে তৃপ্ত করার সুযোগ থেকে আমি নির্মমভাবে বঞ্চিত হলাম। ফলে তার মাথার পিছন দিককার খোদাই করা অংশটুকুই আবার আমি দেখতে লাগলাম।

কয়েক মুহূর্ত পরেই রূপসি মেয়েটা আবার ধীরে ধীরে ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল। বোধহয় পরীক্ষা করে দেখে নিল, আমি আগের মতোই তার দিকে অপলক চোখে, লালসা-মাখানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি কি না।

আমি একটু বিচলিত হলেও দুচোখের তারায় গভীর উৎসাহ নিয়ে তখনও তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

আমার নির্লজ্জ ভাবটুকু চাক্ষুষ করা মাত্র সে এক ঝটকায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। চকিতে তার শুভ্র সুন্দর গাল দুটো যে রক্তাভ হয়ে উঠল। মনে হলো মুহূর্তে তার শরীরের সবটুকু রক্ত গাল দুটোতে আশ্রয় নিয়েছে। ডাগর ডাগর চোখ দুটো চাঞ্চল্যের ছাপটুকুও আমার নজর এড়াল না। সব মিলিয়ে মনে পুলকের সঞ্চারই ঘটল।

কিন্তু পরবর্তী অভাবনীয় কাণ্ডটা দেখে আমি বিস্মিত না হয়ে পারলাম না। মনে করতে পারেন হঠাৎ, একেবারে হঠাৎ-ই আমার বিস্ময় তুঙ্গে উঠে গেল।

সত্যি বলছি, সে যখন ধীরে ধীরে মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল তখনও আমি এতটা অবাক হইনি।

আমার এ-আকস্মিক বিস্ময়ের কারণ কি, তাই না? হ্যাঁ, কারণ তো অবশ্যই আছে। কারণ না থাকলে তো কার্য সম্ভব নয়। কারণটা তবে বলেই ফেলি–আমি তখনই বিস্ময়ের ঘোরে ডুবে গেলাম যখন দেখলাম, আমার ভালো-লাগা মেয়েটা হেঁচকা টানে কোটের পকেট থেকে একটা দূরবীণ বের করে হঠাৎ সেটাকে চোখে ধরে আমার দিকে তার মুখটা তুলে ধরল।

চাকা ঘুরিয়ে ফোকাস ঠিক করে নিল। তারপর সেটাকে আমার মুখের ওপর স্থির নিবদ্ধ রেখেনিবিড়ভাবে তাকিয়ে রইল। দু-এক মুহূর্ত মাত্র নয়, বেশ কয়েক মিনিট ধরেই দূরবীণের মুখটাকে আমার মুখের ওপর একই রকমভাবে স্থির রাখল।

এবার কিন্তু আর লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা নয়। আমার মন-ময়ূরী ডাবল আই-গ্লাসের মাধ্যমে খোলাখুলিভাবে আমাকে দেখে চলেছে। ইস! সে মুহূর্তে আমার বুকের ভেতরে যে কী অব্যক্ত খুশির জোয়ার বয়ে যেতে লাগল, তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

আমার বুকের ভেতর উথাল-পাথাল হতে থাকলেও অবাকও হয়েছিলাম যথেষ্টই। আমার পায়ের কাছে, একেবারে হাতের নাগালের মধ্যে বজ্রপাত হলেও আমি এমন বিস্ময়ের সমুদ্রে পড়ে অসহায়ভাবে হাবুডুবু খেতাম না।

কি ভাবছেন, আমি নিতান্ত প্রত্যাশিত ব্যাপারটায় ক্ষুব্ধ হয়েছি? রাগে আমার শরীর জ্বলে যাচ্ছিল? মোটেই না। বরং ভাবতে পারেন, আমার মধ্যে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রতিক্রিয়াই ঘটে চলছিল। আরে না-না, ক্ষোভ বা বিরক্তির তো প্রশ্নই উঠতে পারে না।

সত্যি বলছি, আমার একেবারে মনের কথা–অন্য কোনো মেয়ে যদি এভাবে দূরবীণের ভিতর দিয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকত, অবশ্যই ক্ষোভে ফেটে পড়ার যোগাড় হতাম। হয়তো চোখ কটমট করে বলেই ফেলতাম–এটা হচ্ছে কি, শুনি? এটা কোন দেশি ভদ্রতা। কিন্তু তা আর আমার পক্ষে বলা হয়ে উঠল না। কারণ, এমন এক অনন্যাকে এ-কথা বলা কি করে সম্ভব? আমার পক্ষে তো নয়ই। কিন্তু তার কাণ্ডটা যে বুক-কাঁপানো, এতে কোনো সন্দেহই নেই।

তবে এও সত্য যে, সমাজের রীতিনীতি ভাঙার ঔদ্ধত্য সে পেল কি করে?

সমাজের একেবারে ওপর তলার মানুষের মধ্যে এরকম কোনোকিছুর পরিচয় যদি থেকে থাকে তবে অন্য কথা–আমার অন্তত জানা নেই।

ব্যাপারটা আমার নজর এড়ালো না, দূরবীণের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো আমার দেহ দেখে নিয়ে তৃপ্ত হয়ে, সে চোখ থেকে যন্ত্রটা নামিয়ে নিল।

কিন্তু সে আর কতক্ষণের জন্যই বা? কয়েক মুহূর্ত পরেই সে আবার কি ভেবে দূরবীণটা চোখে লাগিয়ে আমার দেহ সৌষ্ঠব দেখতে লাগল। এবার আর দু-এক মিনিট নয়–দীর্ঘসময় ধরেই সে রূপসি ললনা দূরবীণটা চোখে লাগিয়েই রাখল।

আমেরিকার রঙ্গালয়ে কোনো রূপসি তন্বী যুবতি যদি কোনো সুন্দরকান্তি পুরুষের দিকে দূরবীণের মাধ্যমে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়েই থাকে তবে সাধারণ মানুষের মধ্যে চঞ্চল্য জাগবে, কোনো সন্দেহই নেই।

আমেরিকায় এসব ব্যাপার-স্যাপার নিতান্তই অস্বাভাবিক জ্ঞান করা হয়। তাই আমার মন-ময়ূরীর কাণ্ডটা দেখে দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য লক্ষিত হলো। আর সে সঙ্গে গুণাগুণানিও অবশ্য শুরু হলো।

আমি রূপসির দিকে তাকালাম। তাকে এতটুকুও বিলিত মনে হলো না। কোনোরকম অপ্রতিভ-অপ্রস্তুত হয়েছে বলেও ভাবতে পারলাম না। আগের মতোই শান্ত-সুন্দর-স্বাভাবিক দেখলাম তাকে।

ম্যাডামের ভাব দেখে মনে হল, তার অন্তরের অন্তঃস্থলে জমে ওঠা কৌতূহল ইতিমধ্যেই নিবৃত্ত হয়ে গেছে। হয়তো বা এজন্য সে চোখের সামনে থেকে দূরবীণটা নামিয়ে আবার জায়গামত চালান করে দিল। এবার আবার রঙ্গমঞ্চের নাট্যানুষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি ফেরাল।

আমিও নিতান্ত অসভ্যের মতোই তার মাথার পিছন দিকটার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলাম। সত্যি আমি যেন কাণ্ডজ্ঞান হারিয়ে বসেছি। কিন্তু হায়! আমার আকাক্ষিত দেবীর মুখটাকে আর দেখতে পাচ্ছি না। মন-প্রাণ আবারও বিষিয়ে উঠল।

আর আমি এও লক্ষ্য করলাম, আমার দেবী–সৌন্দর্যের আধার মেয়েটা মঞ্চের দিকে ফিরে রয়েছে বটে, কিন্তু আড়চোখে আমার অসভ্যতার দিকে সর্বক্ষণ নজর রেখে চলেছে। আমি কি করছি, চোখের কোণ দিয়ে সে সাধ্যমত দেখছে।

স্বর্গের অপ্সরাতুল্য সুন্দরী কোনো মেয়ে যদি কোনো পুরুষের দিকে আড়চোখে নিরবচ্ছিন্নভাবে তাকায় তবে অন্য পাঁচটা লোক যেমন বেহাল হয়ে পড়ে, আমারও ঠিক তেমনই হয়ে গিয়েছিল।

স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, ওই মিনিট কয়েকের মধ্যেই আমি এমন বিহ্বল হয়ে পড়লাম যে নিজেকেই হারিয়ে বসলাম।

আমি একেই উদ্বেগ উৎকণ্ঠার আগুনে জ্বলে-পুড়ে খাক হচ্ছিলাম, তারপর এমন ডাগর-ডাগর চোখে লুকিয়ে-চুরিয়ে তাকানো–অসহ্য যন্ত্রণাদায়ক ব্যাপার।

এ সময়টুকুর মধ্যে আমার অবস্থা খারাপ হয়ে পড়ল। সত্যি আমি আর আমার মধ্যে রইলাম না।

আমার একান্ত আকক্ষিত ম্যাডাম ন্যালাডের পাশে এক ভদ্রলোক মঞ্চের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রয়েছেন ম্যাডাম তার কাঁধে ছোট্ট করে একটা টোকা দিয়ে নিজের দিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করল। প্রায় তার কানের কাছে মুখ নিয়ে কি যেন বলল। উভয়ের মধ্যে কথাবার্তা হলো অনেকক্ষণ ধরে। তারা কি বলাবলি করছে, দূর থেকে। শুনতে না পেলেও প্রসঙ্গ যে আমি বুঝতে অসুবিধা হলো না।

আমার দেবীমূর্তি কথা শেষ করে আবার মঞ্চের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে রইল। আমার ফুসফুস নিঙড়ে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তার ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হলো বেশ কয়েক মিনিট ধরে তার চোখ ও মনকে মঞ্চের দৃশ্যই পুরো আকৃষ্ট করে রাখল।

একটু পরেই আবার একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্ত ঘটল।

আমার আকাঙ্ক্ষিতা ম্যাডাম আবার আমার দিকে প্রথমে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, পরমুহূর্তেই সরাসরি আমার দিকে ফিরে বসল।

আর পকেট থেকে দূরবীণটা বের করে আগের মতোই সেটার মুখ আমার দিকে ফিরিয়ে চোখের সামনে ধরল। আমার আপাদমস্তক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। সে কিন্তু প্রেক্ষাগৃহের দর্শকদের গুণগুণা নিতে মোটে এতটুকুও দ্বিধাগ্রস্ত হলো না।

আমি সে মুখে লক্ষ্য করলাম, গভীর প্রশান্তি আর অভাবনীয় সংযমটুকু দিব্যি ধরে রেখেছে।

সত্যি বলছি, তার মুখের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে ভাবভঙ্গি দেখে আমি যারপরনাই অবাকই হলাম–একটু আগে ঠিক যেমনটা হয়েছিলাম।

আমার মধ্যে একটু-একটু করে উত্তেজনার সঞ্চার হতে হতে যেন এক সময় প্রবল উত্তেজনায় জরাচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম। এমনটা না হলেই বরং অবাক হতে হত। কারন, স্বর্গের দেবীর মতো রূপ-লাবণ্য যার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, তার কাছ থেকে এমন অভাবনীয় সাড়া পেয়ে আমি বাস্তবিকই দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়লাম। সত্যি তো আমি যা প্রত্যাশা করতে পারিনি তা না চাইতেই পেয়ে যাওয়ায় দিশেহারা হবার মতো ব্যাপারই তো বটে।

রূপসি তন্বী ম্যাডাম ল্যাসাড়ে বারবার আমার দিকে তাকানোর ফলে বিস্ময়কর সাড়া পাওয়ায় আমি দমে তো গেলামই না বরং বুকের আগুন যেন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আমার বুকে প্রেমের জোয়ার বয়ে যেতে লাগল।

বিকারগ্রস্ত হয়ে পড়লাম।

হায়! এ কী বেহাল অবস্থা হলো আমার! অদূরে অবস্থানরত রূপসি ম্যাডাম ছাড়া আর সবকিছু যেন আমার চোখের সামনে থেকে নিঃশেষে মিলিয়ে গেল।

আমি তক্কে তক্কে ছিলাম। প্রেক্ষাগৃহের সবাই যখন মঞ্চের জমাট অভিনয় দেখতে মন-প্রাণ সঁপে দিয়েছে তখন সুযোগটার সদ্ব্যবহার করতে আমার এতটুকুও ভুল-চুক হলো না। আমি টান হয়ে বসে পড়লাম। রূপসির চোখে চোখ রাখলাম। মুচকি হেসে, আলতো করে ঘাড় কাৎ করে দুম করে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বসলাম। কিন্তু কিভাবে আমি উদ্দেশ্যটা সিদ্ধ করলাম, তা অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য না করলে, উপলব্ধি করাই সম্ভব নয়। আর কোনোক্রমে একবার লক্ষ্য করলে তার অর্থ বুঝতে পারবে না, এমন লোকের সংখ্যা খুব বেশি আছে বলে মনে হয় না।

রূপসি লাবণ্যময়ী অকস্মাৎ রক্তিম হয়ে উঠল। তার কান অবধি রক্তাভ হয়ে পড়ল। গাল দুটোর রক্তিম ছোপ আরও অনেক, অনেক বেশি স্পষ্ট হয়ে উঠল।

আমি অপলক চোখে তাকিয়েই রইলাম। লক্ষ্য করলাম, খুবই সতর্কতার সঙ্গে চোখ ফিরিয়ে চারদিক ভালোভাবে দেখে নিল।

আমি তার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই বসে রইলাম। তাকে পুলকিতই মনে হলো। আমার দুঃসাহসিক কাজটা যে কারোই নজরে পড়েনি, সম্পূর্ণরূপে নিঃসন্দেহ হয়ে সে পাশের ভদ্রলোকের গায়ে প্রায় হেলান দিয়ে বসল–স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

আমার ভেতরে তখন যে কী অসহনীয় পরিস্থিতির উদ্ভব হলো তা আর কহতব্য নয়। একটু আগে যে অবর্ণনীয় অশোভন আচরণই কেবল নয়, অসঙ্গত আচরণ করেছি সে অপরাধ-জ্বালায় দগ্ধ হতে লাগলাম। ধরেই নিলাম, এবারই কেলেঙ্কারি চূড়ান্ত হয়ে যাবে। ব্যাপারটা চাউর হলো বলে। আর মুহূর্তের মধ্যেই হল-ভর্তি লোকের সামনে আমাকে মান-সম্মান খোয়াতে হবে। মান-ইজ্জত কিছুই আর থাকবে না।

ব্যস, কাল সকাল হলেই পিস্তল হাতে দ্বন্দ্বযুদ্ধে নামতে হবে। কী কেলেঙ্কারীই করে বসেছি।

পিস্তল আর দ্বন্দ্বযুদ্ধের আতঙ্কটা আমার মগজে অনবরত চক্কর মারতে লাগল।

আমি যেন হাঁট ছেড়ে বাঁচলাম। সত্যি কথা বলতে কি, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ালেও বুঝি মানুষ এতটা স্বস্তি পায় না। যখন দেখলাম, ম্যাডাম ল্যানাডে তার পাশে বসে থাকা লোকটার হাতে গীতিনাট্যটার অনুষ্ঠানসূচিটা গুঁজে দিল, তখন আমার বুকের জমাট-বাঁধা আতঙ্কটা কেটে গেল–খুবই আশ্বস্ত হলাম।

আর? সে আর একটা কথাও ভদ্রলোকটাকে বলল না। যাক, এ যাত্রায় তবে অব্যাহতি পেয়ে গেলাম।

কিন্তু এর পরের ঘটনা শুনলে আপনারা অন্তত কিছুটা হলেও বুঝে নিতে পারবেন, আমার সে মুহূর্তের গায়ের রক্ত হিম হয়ে যাওয়া বিষয়বোধ, আমার যারপরনাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া হাল আর আমার মনের প্রলাপ বকার মতো উৎকণ্ঠা, কি পরিমাণে আমাকে কাহিল করে দিয়েছিল।

রূপসি তন্বী ম্যাডাম ল্যানাড পাশের ভদ্রলোকের হাতে গীতিনাট্যের অনুষ্ঠান সূচীটা গুঁজে দিয়ে ঝট করে চারদিকে চোখের মণি দুটোকে বুলিয়ে নিল। নিশ্চিন্ত হল, স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। না, তার ধারে-কাছে কেউ নেই, তার দিকে কেউ গোপনে নজরও রাখছে না।

ব্যস, এবার সে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হয়ে অত্যুজ্জ্বল চোখের মণি দুটোকে ফিরিয়ে আমার মুখের ওপর স্থির নিবদ্ধ করল। তারপর ছোট্ট করে হেসে, দু-দুবার খুবই

স্পষ্টভাবে ঘাড় নেড়ে আমার সে দুঃসাহসিক কাজে সম্মতি দিয়ে দিল।

আমার বুকের ভেতরে উল্লাসের জোয়ার বয়ে চলল। বল্গাহীন আনন্দে আমি যে আত্মহারা হয়ে পড়িনি, দুহাত দুলে ধেই-ধেই করে নাচানাচিতে মেতে যাইনি সেটা আমার কাছেই অদ্ভুত কাণ্ড বোধ হচ্ছিল।

আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমার মনটা সে মুহূর্তে ময়ূরের মতো নাচন-কোদন শুরু করেছিল। মাত্রাতিরিক্ত আনন্দে মানুষ নাকি উন্মাদ দশাপ্রাপ্ত হয়ে পড়ে। সে মুহূর্তে আমার হালও ঠিক তাই হলো। আমি প্রেমে পড়ে গেছি–পাগল বনে গেছি।

আমার তো এরকমই মনে হল–এটাই আমার জীবনের প্রথম প্রেম। একেই তো স্বর্গীয় প্রেম আখ্যা দেওয়া হয়–সত্যি অভাবনীয় আর বর্ণনাতীতও বটে।

প্রথম দর্শনে প্রেম কথাটা অনেকের মুখেই শুনেছিলাম বটে। এখন নিজেকে দিয়ে তা মর্মে-মর্মে উপলব্ধি করছি! কথায় বলে, প্রেম জীবনে দুবার আসে না।

তার দিক থেকে সে সম্মতি পেয়েছি, এতে আর সন্দেহের তিলমাত্রও অবকাশও নেই–থাকার কথাও নয়। প্রেমের বদলে প্রেম-ভালোবাসার বদলে ভালোবাসা জানাবার এটাই তো রীতি।

হ্যাঁ, কাজ হয়েছে, আমার দেবী ম্যাডাম ল্যানাডেও আমারই মতো প্রেম-সাগরে খাবি খাচ্ছে। আমার প্রেমে সে মাতোয়ারা হয়ে পড়েছে, সন্দেহ নেই। সে যদি আমার প্রেমে আকণ্ঠ নিমজ্জিত না-ই হয় তবে হলভর্তি লোকের সামনে এমন বে পরোয়াভাবে আমার ইঙ্গিতে সাড়া দিত? অবশ্যই না। সে কিছুতেই আমার মতো লোক-নিন্দার ভয়কে অগ্রাহ্য করে মাথা হেলিয়ে সায় দিতে উৎসাহি হত না।

হাজারো টুকরো-টুকরো আজেবাজে চিন্তা আমার মাথায় ভিড় জমাল। নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আমি যেন খাবি খেয়ে চলেছি। ঠিক তখনই রঙ্গমঞ্চের পর্দা পড়ে গেল। যবনিকা পতন হলো।

দর্শকদের মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। সবাইনিজনিজ আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কে, কার আগে প্রেক্ষাগৃহ ছেড়ে বাইরে বেরোবে, তা নিয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়ে গেল আর সে সঙ্গে এমন হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল। যেন প্রেক্ষাগৃহের দেওয়ালগুলো ভেঙে যাওয়ার যোগাড় হলো।

আমি মুহূর্তের জন্য বন্ধুদের ট্যালবটের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে নিলাম। নিঃসন্দেহ হলাম, আমার দিকে তার নজর নেই। ব্যস, চুপিচুপি তার সান্নিধ্য থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে আমার আকাঙ্ক্ষিতা মনময়ূরী ম্যাডাম ল্যানাডের দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা চালাতে লাগলাম।

সে মুহূর্তে তার যতটা কাছাকাছি এগিয়ে যাওয়া যায়। আর কিছু না হোক একটিবার কাছ থেকে তার স্বর্গীয় রূপ সৌন্দর্য চাক্ষুষ করে চোখ আর মনকে তৃপ্ত করা।

কিন্তু হায়! এ কী কঠিন গেরো বাঁধল রে বাবা! দলে দলে কাতারে কাতারে মানুষ সঙ্কীর্ণ স্থানটুকুতে এমন গুঁতোগুতি জুড়ে দিয়েছে, যার ফলে জনস্রোতের বিপরীত দিকে দু-চার পা এগিয়ে যাওয়াও আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। ম্যাডাম ল্যানাডের স্পর্শসুখ লাভ করা তো দূরের ব্যাপার, তার পোশাকের একটা কোণাও স্পর্শ করতে পারলাম না।

শেষপর্যন্ত আমাকে হতাশই হতে হলো। ফুসফুস নিঙড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। অনন্যোপায় হয়ে বাড়ির পথই আমাকে ধরতে হলো।

পথ চলতে চলতে বিষণ্ণ মনে নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্যে পরবর্তী কর্তব্য সম্বন্ধে ভাবতে ভাবতে মনস্থ করে ফেললাম, আগামীকালই ট্যালবটের সাহায্যে রূপসি তন্বী ম্যাডাম ল্যানাডের সঙ্গে আলাপ পরিচয় করব। ব্যস, তারপরই তার সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করব। না, নিদারুণ অস্থিরতার শিকার হয়ে আর কিছু ভাবতে পারলাম না। ধীর পায়ে এগিয়ে চললাম বাড়ির পথে।

নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতার মধ্যে আমার বিদ্রি রাত কাটল।

সকালটাওনিদারুণ অস্বস্তির মধ্যেই কাটাতে হলো। সে যে কী ছটফটানি, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না। আমার কাছে সময় যেন বোঝা হয়ে দাঁড়াল। একটা মিনিট যেন এক-একটা ঘণ্টা মনে হতে লাগল। সে দিনই জীবনে প্রথম অনুভব করলাম, অসহিষ্ণুতা কী ভয়ঙ্কর সমস্যা।

নিদারুণ অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দুপুর পর্যন্ত কোনোরকমে কাটিয়ে দিলাম। শেষপর্যন্ত দুপুর একটায় সে বাঞ্ছিত মুহূর্তটা এগিয়ে এলো। শামুকের মতোই ধীর গতিতে সময় কেটে তবেই বাঞ্ছিত মুহূর্তটায় পৌঁছতে পারলাম। জীবন থাকলে যন্ত্রণাও কম-বেশি থাকবেই। আবার সব যন্ত্রণারই এক সময় না এক সময় শেষ হয়ই। আমার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হয়নি। আমার যন্ত্রণা বলতে প্রতীক্ষা-যন্ত্রণা নিদারুণ অস্থিরতার যন্ত্রণা। আমার যন্ত্রণারও এক সময় অবসান ঘটল। দেওয়াল ঘড়িটার ওপর চোখ বুলিয়ে দেখলাম, একটা বাজে।

মুহূর্তের মধ্যেই ঢং করে একটা ধ্বনি হলো। ঘণ্টা-ধ্বনিটা ঘরময় প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। প্রতিধ্বনিটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই আমি ভিরের মধ্যে ঢুকে গেলাম।

হাতের কাছেই ট্যালবটের এক ভৃত্যকে পেয়ে গেলাম। তার কাছে আমার অভিন্ন হৃদয় বন্ধু ট্যালবটের খোঁজ করলাম।

সে বলল সাহেব তো একটু আগেই বেরিয়ে গেছেন। আমি বিষণ্ণ মুখে বললাম–বেরিয়ে গেছে! হঠাৎ বেরিয়ে যাওয়ার কারণ?

তা তো বলতে পারব না। কর্তার ব্যাপার স্যাপার আমরা, ভৃত্যরা জানব কী করে, বলুন?

সে কখন ফিরবে, বলে গেছে কিছু?

না, তেমন কিছুই বলে যাননি।

ব্যাপারটা আমার কাছে বিশেষ সুবিধার মনে হলো না। মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে ভেবে নিয়ে বেশ একটু গম্ভীর স্বরেই বললাম–অসম্ভব! এটা হতেই পারে না। ট্যালবট কিছুতেই বেরিয়ে যেতে পারে না–বেরিয়ে সে যায়নি। কিন্তু ব্যাপারটা কি, আমি জানতে চাই।

হঠাৎ ঘাবড়ে গিয়ে মুখ কাচুমাচু করে ভৃত্যটা জবাব দিল কর্তা, এর মধ্যে আবার ব্যাপার স্যাপারের প্রশ্ন ওঠে কি করে, মাথায় যাচ্ছে না তো! বিশ্বাস করুন, ব্যাপার কিছুই নয়।

কিন্তু–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই সে বলে উঠল–সকালে কোনরকমে জলখাবার খেয়েই তিনি ঘোড়ায় চেপে চলে গেছেন। সত্যি কথা বলছি, আমাকে ডেকে বলে গেলেন, এস এস-এর কাছে যাচ্ছি। কেন যে যাচ্ছেন তা কি আমাকে বলে যাবেন, নাকি আমার জিজ্ঞেস করা উচিত, আপনিই বলুন?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবার শুকনো গলায় বললাম–কবে ফিরবে, কিছু বলে গেছে। কী?

হ্যাঁ, তা অবশ্য বলে গেছেন!

কবে?

বলে গেছেন, দিন সাতেক শহরের বাইরে কাটিয়ে তবে ফিরবেন।

রাগে-দুঃখে আমার পা থেকে মাথা পর্যন্ত কাঁপতে লাগল। সাতদিন অপেক্ষা করতে হবে। আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার মতো ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ পরিচয়ের এমন অপূর্ব সুযোগ হাতের মুঠোয় পেয়েও মুহূর্তে এমন করে ভেস্তে গেল! হতচ্ছাড়া ট্যলবটটা আর বেড়াতে যাওয়ার সময় পেল না! শেষপর্যন্ত বেছে বেছে এ সময়টাকেই উপযুক্ত জ্ঞান করল! আমার আশা-আকাঙ্ক্ষায় ছাই পড়ায় রাগে আমার মাথায় যেন রক্ত উঠে গেল।

মোক্ষম একটা জবাব দেওয়ার জন্য তৈরি হলাম। কিন্তু পারলাম না। অবাধ্য জিভটা বেইমানী করল।

কোনোরকমে মনের ক্ষোভ মনেই চেপে রেখে ট্যালবটের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

পথ চলতে চলতে একটা কথাই আমার মাথায় বার বার চক্কর মারতে লাগল, কিভাবে ট্যালবটের চৌদ্দ-পুরুষকে নরকের দক্ষিণ দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া যায়। হতচ্ছাড়াটা এমন করে আমার এমন একটা মোক্ষম সুযোগ, এমন জবরদূস একটা পরিকল্পনা, হেলায় ভাসিয়ে দিল যার ফলে আমার মন থেকে জমাটবাধা ক্ষোভটুকুকে কিছুতেই ঝেড়ে মুছে ফেলতে পারছিলাম না। রূপসি তন্বী যুবতির মুখটার কথা মনে পড়তেই আমি যেন আরও তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলাম।

দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তার পর একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারলাম। আমার গীতিনাট্যের পোকা বন্ধু ট্যালবট রঙ্গমঞ্চের মন-মাতানো দৃশ্য দেখতে দেখতেই আমার সঙ্গে কথা বলেছিল, আমাকে কথা দিয়েছিল, আমার প্রাণ-প্রতিমা রূপসি ম্যাডামের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করিয়ে দেবে। কথা দেওয়ার সময় তার মন-প্রাণ রঙ্গমঞ্চের মন মাতানো দৃশ্যের মধ্যেই ডুবেছিল। পরমুহূর্তেই রঙ্গমঞ্চের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে মেরে দেয়। ব্যস, সে অন্যজগতের বাসিন্দা হয়ে পড়ল। তারপর বাড়ি ফিরেও হয়তো গীতিনাট্যটার সাফল্য ও ব্যর্থতার কথা ভাবতে বসেছে। অতএব আমাকে দেওয়া সামান্য প্রতিশ্রুতিটার কথা মন থেকে মুছে যাওয়াই স্বাভাবিক।

তবে এটাও মিথ্যে নয়, কথা দিয়ে ট্যালবট অনায়াসেই কথার খেলাপ করতে বড়ই ওস্তাদ। আসলে কাউকে কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর মুহূর্তেই সেটা ভুলে যাওয়া তার বহুদিনেরই অভ্যাস–স্বভাবে দাঁড়িয়ে গেছে। তাই আমাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা স্বাভাবিক কারণেই তার মন থেকে মুছে গেছে।

কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এ মুহূর্তে ব্যাপারটা সম্বন্ধে তো কিছু করারও দেখছি না।

বিষিয়ে ওটা মনটাকে কোনোরকমে সামলে সুমলে নিয়ে গম্ভীরমুখে পথ চলতে লাগলাম।

বন্ধুবর ট্যালবট বেইমানি করলেও আমার পক্ষে কিন্তু স্বর্গের অপ্সরা ম্যাডাম লানাডকে এত সহজে মন থেকে মুছে দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়। বরং ফল দাঁড়াল অদ্ভুত চেনা অচেনা কাউ দেখলেই ম্যাডাম-এর ঠিকানা জিজ্ঞেস করতে লাগলাম।

জানতে পারলাম, তার নামটা অনেকেই শুনেছে বটে, কিন্তু খুব কম লোকেরই তাকে চোখের সামনে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। কারণ, মাত্র কসপ্তাহ আগে সে শহরে এসে বসবাস করছে। এরই মধ্যে তার রূপের প্রশংসা লোকের, বিশেষ করে যুবকদের মুখে-মুখে ঘুওে বেড়াতে শুরু করেছে। ইদানিং ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছে, চার-পাঁচটা যুবক একত্রিত হলেই ম্যাডাম ল্যানাডেই তাদের একমাত্র আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কিন্তু মাত্র জনা কয়েকই তার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার, আলাপ পরিচয় করতে পেরেছেন। আর এ জনা কয়েক আমার পরিচিত তো নয়ই তাদের নামও কোনোদিন শুনেছি বলে মনে হচ্ছে না। অতএব তাদের খুঁজে বের করে আমার প্রাণপ্রতিমার খোঁজ পাওয়া সম্ভব নয়, কিছুতেই নয়।

শেষপর্যন্ত হতাশায় জর্জরিত হয়ে বিকেলে তিনজন প্রাণের দোস্তের সঙ্গে কথা বলে বিভিন্নভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করছি, এমন সময় উপায়টা হাতের মুঠোর মধ্যে চলে এলো।

বন্ধুদের মধ্যে থেকে একজন হঠাৎ বলে উঠল–ওই, ওই যে, তোর দেবী ম্যাডাম ল্যানাড যাচ্ছে। ওই যে, ওই দেখ।

পাশ থেকে আর একজন সবিস্ময়ে বলে উঠল–আরে বাবা! আশ্চর্য রূপের জৌরুস! সত্যি স্বর্গের অপ্সরা যেন মর্ত্যভূমিতে নেমে এসেছে! আর হা করে তার দিকে তাকিয়ে থেকেই অধিকতর বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল–অপ্সরা-টপ্সরা কিনা বলতে পারব না। অপ্সরা না হলেওনির্ঘাৎ আকাশ থেকে এক পরী নেমে এসেছে।

আর তৃতীয়জন চোখ দুটো কপালে তুলে নিৰ্ণিমেষ চোখে তার দিকে তাকিয়েই রইল। হাসিহাসি মুখ করা ছাড়া একটা শব্দও সে মুখ দিয়ে বের করতে পারল না

আমি এক ঝটকায় ঘাড় ঘুরিয়ে সে দিকে তাকালাম। দেখলাম, খোলা একটা গাড়ি আমাদের দিকে আসছে। খুবই ধীরগতিতে হলেও সেটা প্রায় আমাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। আমি অপলক চোখে গাড়িটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দেখলাম, চমৎকার ভঙ্গিতে খোলা গাড়িটা আমার দেবী, আমার প্রাণপ্রতিমা ম্যাডাম ল্যানাড বসে। আপন মনে বলে উঠলাম, গত সন্ধ্যায় এ-চোখ ধাঁধানো রূপরাশিই তো আমার চোখে চমক লাগিয়ে দিয়েছিল। আর এরই দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে, এরই সৌন্দর্য সুধা আকণ্ঠ পান করেই পুলকানন্দে ডুবেছিলাম।

আরও দেখলাম, আমার দেবী মূর্তির পাশে বসে রয়েছে অল্পবয়সী সে মেয়েটো, যে বক্সে তার পাশে বসেই গীতিনাট্য দেখায় মেতে ছিল।

আমি পাশে বসে থাকা মেয়েটার মুখের ওপর চোখ দুটো বুলিয়ে নিয়ে নিঃসন্দেহ বন্ধু তিনজনের মধ্য থেকে একজন শেষমেশ বলল, এও কম সুন্দরী নয়। এরা এত রূপ পেল কোত্থেকে! এসে দেখছি, মেয়ে দুজনের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে, কে কাকে টেক্কা দেবে। যার দিকেই তাকাই, চোখ রীতিমত ট্যারা হয়ে যায়!

কোনো উপায়ই হাতের কাছে পেলাম না। ট্যালবট ফিরে আসা অবধি অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো উপায়ই দেখছি না। সে ফিরে এলে তার দৌলতে যদি ভাগ্য খোলে, এটুকুই এখন আমার একমাত্র আশা ভরসা।

পথের হদিস না পেলেও আমি কিন্তু হতাশ হয়ে নিশ্চন্তভাবে বসে থাকলাম না। বরং বলা চলে ক্ষুধার্ত নেকড়ের মতো তাকে হাতের নাগারে মধ্যে পাওয়ার মওকা খুঁজতে লাগলাম।

আমি কর্তব্য সম্পাদনে সামান্যতম ত্রুটি রাখলাম না। আনন্দ ফুর্তির যতগুলো সম্ভাব্য জায়গা শহরময় ছড়িয়ে রয়েছে, এক এক করে সবগুলোতে ঢু মারতে লেগে গেলাম। আমি নিজে অন্তত নিঃসন্দেহ, আমার নিষ্ঠার এতটুকু অভাব নেই।

হন্যে হয়ে তার খোঁজে ছুটোছুটি করার ফল একদিন সত্যি সত্যি পেয়ে গেলাম। আমি হাতে-নাতে প্রমাণ পেয়ে গেলাম, কোনো কাজে নিষ্ঠা ও পরিশ্রম সহাবস্থান কররে তার ফল একদিন-না-একদিন পাওয়া যাবেই। আমার ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হলো না। আমি সত্যি সত্যি একদিন আমার দেবীর দেখা পেয়ে গেলাম। তবে দিন পনেরো নিরবচ্ছিন্ন ও নিরলস চেষ্টা চালাবার পর।

আমার দীর্ঘ প্রতীক্ষার অবসান ঘটল। রূপসি তন্বী ম্যাডাম ল্যানাডের দেখা পেয়ে গেলাম। মুখোমুখিই দেখা হলো আমাদের।

দৃষ্টি বিনিময়ের ফলে আমার মধ্যে এমন এক অব্যক্ত রোমাঞ্চভাব হঠাৎ জেগে উঠল যে, আমি যেন সম্বিৎ হারিয়ে ফেললাম। আর এও খুবই সত্য, সে মুহূর্তে আমি কেন যে মূৰ্ছা যাইনি, নিজেকে কোনোরকমে সামাল নিতে পেরেছিলাম, তা আমার নিজের কাছেই যারপরনাই বিস্ময়ের ব্যাপার।

আর এও সত্য যে, এই দীর্ঘ পনেরটা দিন আমি ট্যালবটের খোঁজ-খবর নিতেও এতটুকু ত্রুটি রাখিনি।

আমি বন্ধুবর ট্যালবটের বাড়ি গিয়ে তার পরিচারকটার কাছে তার খোঁজ নিয়েছি। তাকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছি, বন্ধুর নতুন কোনো খবর এসেছে কিনা। বলা তো যায়, হঠাৎ কোনো-না-কোনো বিশেষ জরুরি কাজের তাগিদে সে পূর্বনির্ধারিত সময়েই বাড়ি ফিরে আসতেও পারে। এরকম প্রত্যাশা বুকে নিয়ে আমি প্রতিদিন অন্তত একবার করে তার বাড়িতে হানা দিয়েছি। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়েই ফিরে আসতে হয়েছে।

বন্ধুবর ট্যালবটের প্রসঙ্গটা এখনকার মতো ধামাচাপা দিয়ে বরং আমার আকস্মিক অসম সাহসিকতার দুঃসাহসিকতা প্রসঙ্গটা নিয়ে আলোচনা করা যাক।

একদিন আমার দীর্ঘ প্রচেষ্টা আর হন্যে হয়ে রূপসি ম্যাডাম ল্যানাডের সঙ্গে আমার মুখোমুখি দেখা তো হলো। মানে এক প্রমোদকক্ষে তার দেখা পেলাম। পরস্পরের মধ্যে চাওয়াচাওয়ী–দৃষ্টি বিনিময়ও হলো। ব্যস, আর যাবে কোথায়! সে মুহূর্ত থেকেই ভয়ঙ্কর এক দুশ্চিন্তা আমার মাথায় আশ্রয় নিল।

আমার আকস্মিক দুশ্চিন্তার কারণ কি, জানতে খুবই ইচ্ছা করছে, তাই না? তবে বলেই ফেলছি, শুনুন–

আমার আকাঙ্ক্ষিতা মনময়ূরী রূপসি ম্যাডাম ল্যানাডে প্যারিস শহরের বাসিন্দা। যেখানেই সে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। অচিরেই সেখানে ফিরে যাবার চিন্তাও নাকি করে ফেলেছে। সে তার স্থায়ী বাসস্থলে ফিরে যাবে, এতে আর অবাক হবারই বা কি থাকতে পারে।

কিন্তু আমার সমস্যা যে অন্য জায়গায়। আমি ভাবচি বন্ধু ট্যালবটের কথা। সে ফিরবে পনের দিন পরে, এরই মধ্যে যদি আমি প্যারিসের উদ্দেশ্য পাড়ি জমাই, তবে? তবে তো আমার আশায়, আমার বাড়া-ভাতে ছাই পড়বে! আর কোনোদিনই হয়তো আমার স্বপ্নের রানির সঙ্গে আলাপ পরিচয় করার সুযোগ পাব না।

যাক, হাত গুটিয়েনিশ্চেষ্ট হয়ে বসে থাকলে তো আর আমার চলবে না। ম্যাডাম ল্যানাডের সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের করার উদ্যোগ আয়োজন আমাকেই করতে হবে। তাই অনন্যোপায় হয়ে গভীর ভাবনা-চিন্তার পর পরিকল্পনার একটা জুতসই খসড়া তৈরি করে ফেললাম।

আমি প্রমোদ-ভবনটা থেকে ম্যাডামকে সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করে তার বাড়ি পর্যন্ত গেলাম। দূরত্ব বজায় রেখে এবং সাধ্যমত গোপন অন্তরাল দিয়ে যে পথ পাড়ি দিয়েছি, তা বলাই বাহুল্য। যা-ই হোক, তার বসত-বাড়িটা আমি কৌশলে চিনে নিলাম।

সে রাতটা বিশ্রাম করেই কাটালাম। পরদিন কাকডাকা ভোরেই বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লাম। কাগজ-কলম নিয়ে খস্ খস্ করে ইয়া লম্বা একটা চিঠি লিখে ফেললাম। প্রেমপত্রে সচরাচর ব্যবহার করা এরকম বাছাবাছা শব্দ ব্যবহার করে জ্বালাময়ী একটা প্রেমপত্র লিখে ফেললাম। চিঠিটার মূল্য বক্তব্য, আমার মানসিক পরিস্থিতি প্রাঞ্জল ভাষায় ব্যক্ত করে তাকে প্রেম নিবেদন করা।

সকালেই প্রেমপত্রটাকে জায়গামত পাঠিয়ে দিলাম। সত্যি বলছি, বুকে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে খোলাখুলিই চিঠিটা লিখেছিলাম। আর একই রকম সাহসকিতার সঙ্গে এর শব্দগুলোও বেছেছিলাম। তার আবেগ-উচ্ছ্বাসের জোয়ারে ভাসতে ভাসতে প্রেমপত্রটা লিখেছিলাম।

আর এও বলে রাখছি, প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে আমার কথা কিছুই লুকাইনি। আমার দোষ-ত্রুটি, প্রচণ্ড চারিত্রিক দুর্বলতার কথাও লুকাছাপা করিনি।

আর এও লিখেছি, প্রথম দর্শনের মুহূর্তে তার চারদিকে যে অবর্ণনীয় রোমাঞ্চ ভিড় করেছিল, তার বিবরণও সাধ্যমত প্রাঞ্জল ও প্রাণস্পর্শী ভাষাতেই ব্যক্ত করেছি।

শুধু কি এ-ই? কবির মনপছন্দ বাছাবাছা শব্দ পাশাপাশি বসিয়ে ব্যক্ত করেছি। তাকে প্রথম দর্শনের মুহূর্তে এক ঝলক চাহনির মাধ্যমে যে চার চোখের মধুর মিলন ঘটেছিল, তার মাধুর্যতাও যেন বাদ না পড়ে, সেদিক সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে লেখনির মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে কসুর করিনি এতটুকুও।

আরও আছে, বুকে সাহস সঞ্চয় করে, ভাগ্য ঠুকে খোলাখুলিভাবেই বলেছি আমার প্রথম দর্শনেই প্রেমসাগরে হাবুডাবু খাওয়ার কথা।

সবশেষে লিখতে ভুললাম না, আমার ধৃষ্টতা দেখে ম্যাডামের অন্তরে যেন ক্রোধের সঞ্চার না ঘটে আর তিনি যেননিজগুণে আমাকে মার্জনা করে দেন।

আর? লিখেছি প্রেমের আগুনে প্রতিনিয়ত এমনই খাক হচ্ছি, যার ফলে আমি চিঠি না লিখি পারলাম না।

আর এও আমাকে লিখতেই হয়েছে শুনেছি, ম্যাডাম নাকি এ-শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। তার আগে কি তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়ের মাধ্যমে আমার অশান্ত মনকে শান্ত করার সুযোগ পাবই না?

চিঠিটার একদম শেষের দিকে আমার হঠাৎ-ই যেন মাথায় এসে গেল। আমার আর্থিক সঙ্গতির কথাও তাকে জানিয়ে দিতে ছাড়লাম না। আমি কোনো দিক থেকেই কারো হাতের ফাঁক দিয়ে পড়ে যাওয়ার মতো পাত্র নই। আর অগাধ ধন-সম্পত্তির মালিকও বটে।

মন-প্রাণ তো ম্যাডাম ল্যানাডেকে সঁপে দিয়ে দেউলিয়া হয়ে গেছি। এখন শুধু প্রতীক্ষায় আছি, তিনি যদি আমাকে হাতে ধরে কাছে টেনে নেন। আমার বুকের জ্বলন্ত আগুনে শান্তি-বারি সিঞ্চন করে শীতল করেন।

চিঠিটা তো যথাস্থানে পাঠিয়ে দিয়ে নিজের অশান্ত মনকে যৎকিঞ্চিৎ হলেও শান্ত করা সম্ভব হলো বটে।

এবার শুরু হলো কেবলই প্রতীক্ষা–প্রতীক্ষার দুর্বিষহ যন্ত্রণায় দগ্ধে মরা।

আমার চিঠি লেখা বৃথা গেল না। উত্তর এলো। যেন দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে অধীর প্রতীক্ষার পর আমার চিঠিটার উত্তর পেলাম।

হ্যাঁ, আমার চিঠির জবাব সত্যি এল। ব্যাপারটা রীতিমত রোমান্টিকতায় ভরপুর, আশা করি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এরকম উক্তি কেন করছি? রূপ সৌন্দর্যের আঁকর, স্বর্গের অপ্সরা আর আমার অন্তরতমা ধনবতী ম্যাডাম ল্যানাডের কাছ থেকে আমার ধৃষ্টতাপূর্ণ চিঠির জবাব পাওয়ায় আমার মন-প্রাণ এক অনাবিল আনন্দের জোয়ারে ভেসে উথাল-পাথাল করতে লাগল।

সত্যি স্বীকার না করলে সে রূপসি তন্বীর প্রতি ইচ্ছাকৃতভাবে অবিচার করা হবে বলেই আমার বিশ্বাস। তার রূপ যেমন মনোলোভা তেমনি তার মনটাও ফুলের মতোই পবিত্র–স্বচ্ছ। কেউ যদি তার পবিত্র-সুন্দর মনটাকে মরিচিকা বলে বর্ননা করে, আর কেউ না হোক, আমি অন্তত তীব্র প্রতিবাদ করবই করব।

আমার মন্মোহিনী নির্ভেজাল ফরাসি মহিলার মতোই অন্তরের অন্তরতম কোণের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে, মুক্তির তাড়নায় স্বতস্ফূর্তভাবেই চালিত হয়েছে, বিচলিত হয়েছে প্রকৃতির বেগে। পৃথিবীর প্রচলিত রীতিনীতি তোয়াক্কা করেনি।

আর আমি এও ভালোভাবেই লক্ষ্য করলাম, আমার প্রস্তাবে সে ক্ষুণ্ণ তো হয় ইনি, প্রতিবাদের নামে হুলুস্থুলও বাঁধায়নি। আবার এমন অন্ধকার গহ্বরেও আত্মগোপন করেনি। মোদ্দাকথা, আমি যা আশঙ্কা করেছিলাম, তার আবরণে সে সবকিছুই তার মধ্যে প্রকাশ না পাওয়ায় আমি তাতে সামান্য হলেও অবাকই হয়েছি। এমনকি, আমার চিঠিটাকে প্রত্যাখ্যান–ফিরিয়েও দেয়নি।

আমি অবাক হলাম যখন দেখলাম, সে ক্ষুব্ধ না হয়ে বরং উলটো একটা উত্তর লিখে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দিয়েছে। আর তা লিখেছে নিজেরই সুন্দর আর তুলতুলে নরম আঙুলগুলো দিয়েই।

আমার আকাক্ষিত, দেবীমূর্তির লেখা চিঠিটার বক্তব্য এরকম–

মি. সিম্পসন, আপনার দেশের ভাষা আমার ভালো রপ্ত নেই, আর এ অপূর্ব ভাষা আমি লিখতে না পারার জন্য আশা করি মার্জনা করবেন। এই তো সবে, সেদিনই এদেশের মাটিতে প্রথম পা দিলাম। সাহিত্যচর্চা করার সময় সুযোগ যে পাইনি, আশা করি বুঝতেই পারছেন।

মি. সিম্পসন, অশিষ্টতার কারণে প্রথমেই মার্জনা চেয়ে নিয়ে আপনাকে জানাচ্ছি, যা সত্যি তা বুঝে ফেলেছেন। এর বেশি আর কী-ই বলার থাকতে পারে, বলুন? আমি কি আপনার সঙ্গে বাক্যালাপ করার জন্য অস্থিরতা বোধ করছি না?

ইতি

ইউজিনি ল্যানাড

চিঠিটার প্রতিটা ছত্রেই আমি তার সহৃদয়তার পরিচয় পেলাম। সেটা প্রথমবার পাঠ করেই আমি যে কী মুগ্ধ হয়েছি, তা ভাষার মাধ্যমে কারো মধ্যে ধারণা-সঞ্চার করা সম্ভব নয়, আবার বলেও কাউকে বুঝানো যাবে না।

চিঠিটা একবার মাত্র পাঠকের মনের আকস্মিক আবেগ-উচ্ছ্বাসটুকু সামলাতে না পেরে অন্তত হাজারবার সেটাকে চুম্বন করলাম। কেবলমাত্র এটুকুতেই আমি থামলাম না। তারপরও লাগামছাড়া বাড়াবাড়ি করে ফেললাম। কিন্তু সেটা যে কি ধরনের, এখন আর তা স্মৃতিতে আনতে পারছি না।

ইতিমধ্যে এতকিছু কাণ্ড ঘটে গেল তবু বন্ধু ট্যালবট এখনও বেপাত্তা।

আমি যে অভিন্নহৃদয় ট্যলবটের জন্য কী নিরবচ্ছিন্ন অস্থিরতা বোধ করছি, যন্ত্রণায় ছটফট করছি তার একটা ভগ্নাংশও যদি সে উপলব্ধি করত তবে সে উভ্রান্তের মতো ছুটে না এসে কিছুতেই দূরে থাকতে পারত না। আমার এ প্রত্যয়টুকু অবশ্যই আছে যে, সমবেদনা প্রকাশ করার জন্য তাকে আমার কাছে ছুটে আসতেই হত।

সবচেয়ে বড় কথা, আমার বন্ধুর স্বভাব-চরিত্র তো আর আমার অজানা নয়। কেউ যদি কোনোরকম সমস্যায় পড়ে তবে সে ব্যস্ত হয়ে ছুটে যায়, যে কোন মূল্য দিয়ে তাকে রক্ষা করে।

অথচ আজ অবধি বন্ধু ট্যালবটের ফেরার নামগন্ধও নেই।

আমিনিদারুণ অস্থিরতার মধ্যে অপেক্ষা করে করে শেষপর্যন্ত নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই তাকে একটা চিঠি লিখলাম।

আমি চিঠিটা পাঠাবার পর বেশিদিন অপেক্ষা করতে হলো না। তার জবাবও পেয়ে গেলাম। সে লিখেছে, খুবই জরুরি একটা কাজের ঝামেলায় জড়িয়ে যাওয়ায় ফিরতে দেরি হচ্ছে। সব শেষে এও লিখেছে, আর তেমন দেরি হবে না, শিগগিরই ফিরতে পারবে বলে বিশ্বাস করে।

চিঠিটা শেষ করার ঠিক আগে সে লিখেছে, আমি যেন দ্রুত গাড়ি না চালাই, স্নায়ুবিক উত্তেজনার শিকার না হয়ে পড়ি আর স্নায়ু-শীতল রাখার উপযুক্ত যেসব বই টই বাজারে পাওয়া যায়, সেসব যেন মন দিয়ে পড়ি এবং উপদেশ-টুপদেশ মন দিয়ে পড়ে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করি।

আর মদ্যপানের ব্যাপারে তার উপদেশ হচ্ছে, আমি যেন হগ মদের চেয়ে কড়া মদ স্পর্শও না করি।

আরও আছে, আমি যেন সর্বদা নিজেকে প্রশমিত রাখি। এর জন্য উগ্রদর্শনের সাক্কণা-বাণীই আমার ক্ষেত্রে বিশেষ উপযোগি।

অপদার্থ! আহাম্মক কোথাকার! নিজের ফিরে আসার সমস্যা তো থাকতেই পারে। মানুষ কখন, কোন ঝামেলায় জড়িয়ে পড়বে, তা সব সময় আগেভাগে জানতে পারেন। বন্ধু ট্যালবটের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। ভালো কথা, সে যদি কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে গিয়ে ফিরে আসতে না-ই পারে তবে অন্তত একটা পরিচয়পত্র লিখেও তো পাঠিয়ে দিতে পারত। নিরেট আহাম্মকই যদি সে না হয়ে থাকে তবে সে নিজেই তো বুদ্ধি খরচ করে অবশ্যই কাজটা করত।

অস্থিরতার কারনে আমি এবার বন্ধুর বাড়ির ঠিকানায় একটা চিঠি লিখলাম। চিঠির মূল বক্তব্য, সে যেন বেশ সুন্দর করে একটা পরিচয়পত্র লিখে আমার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেয়।

কিন্তু আমার লেখা চিঠিটা ফিরে আবার আমার হাতেই এসে পড়ল। চিঠিটা যেভাবে পাঠিয়েছিলাম ঠিক সেভাবেই আবার সেটা আমার হাতেই ফিরে এলো।

আমার চিঠিটার সঙ্গে তার ভৃত্যের একটা চিঠিও এলো। সে অশুদ্ধ ভাষায় চিঠিটা লিখেছে। আর বানান ভুলও অজস্র। চিঠির বক্তব্য, আমার বন্ধুবর ট্যালবট এখন কোথায় আছে, সে সম্বন্ধে কিছুই সে জানে না। যাবার সময় ঠিকানাটা রেখে যায়নি; এমনকি পরেও ঠিকানাসহ চিঠি পাঠায়নি।

ট্যালবাটের ভৃত্য খামের গায়ে লেখা ঠিকানাটা দেখেই বুঝতে পেরেছে, আমি এটা পাঠিয়েছি। তাই খামটার মুখ ছিঁড়ে চিঠি পড়ার দরকার নেই মনে করেই সেটাকে সরাসরি ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। পাঠক-পাঠিকা, আশা করি সহজেই অনুমান করতে পারছেন, এ ঘটনার পর বন্ধুবর ট্যালবট যাতে তার প্রিয় ভৃত্যটাকে সঙ্গে করে দ্রুত নরকে গমন করে, সে চিন্তাই মনে মনে দারুণভাবে করেছিলাম।

না, মিথ্যা রাগ করে ফায়দাও তো কিছু নেই। তার বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগ করলেই বা কে আমাকে প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা দিতে আসবে?

কিন্তু আমি যে খুব বদমেজাজি আর একরোখা চরিত্রের মানুষ। বলতে গেলে এসব গুণ আমার বহুদিনের, রক্তের সঙ্গে মিশে রয়েছে। এসব তো আর কোনোদিনই যাবার নয়।

আমি একবার যা-কিছু করব বলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেই, তা শেষ করে তবেই আমার স্বস্তি। আর এতকাল তো এর ফল হাতেনাতেই পেয়ে গেছি। এবারও দেখতে চাই পরিণামে কি দাঁড়ায়।

আমি শেষপর্যন্ত সাহসে ভর করে ঝুলেই পড়লাম। এ রকমভাবে আমাদের, মানে ম্যাডাম আর আমার মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়ে গেল।

এবার ভবিষ্যত কর্তব্য স্থির করতে গিয়ে ভাবলাম, এরপর যদি আর পা-বাড়াই, যদি আরও এক ধাপ এগোই, আশা করা যাচ্ছে সহৃদয়া ম্যাডাম ল্যানাড অবশ্যই সেটাকে অশিষ্ট আর অশোভন জ্ঞান করবে না। আমি অন্তত এটাই বিশ্বাস করছি।

আর ম্যাডামের বাড়ির ঠিকানাটা জেনে যাওয়ার পর থেকে আমি গোপন স্থান থেকে খুবই সন্তর্পণে তার গতিবিধির ওপর নজর রাখতে আরম্ভ করলাম।

আমি দেখতে পেলাম, আমার স্বপ্নের রানি প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির সামনের পার্কটায় বেড়াতে যায়। দীর্ঘসময় ধরে পার্কের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত মনের আনন্দে হাঁটাচলা করে। অবশ্য একজননিগ্রো পরিচারক সর্বদা সঙ্গে সঙ্গে থাকে।

আমি মনে মনে পরিকল্পনা করে ফেললাম, গাছপালার ফাঁকে, সন্ধ্যার হালকা আলোর মনোরম পরিবেশে তার সানিধ্য লাভের মাধ্যমে মন-প্রাণ পুলকানন্দে কানায় কানায় ভরিয়ে তুলব।

আর আমি একরম পরিকল্পনাও করে ফেললাম, এমন হাবভাব করে তার সঙ্গে বাক্যালাপ শুরু করব, যাতে মনে হয় আমাদের আলাপ-পরিচয়–ঘনিষ্ঠতা দীর্ঘদিনের।

শেষপর্যন্ত পরিকল্পনা মাফিকই কাজ করলাম। ম্যাডাম ল্যানাড কিন্তু সত্যিকারের প্যারিসবাদীদের মতোই চমৎকার উপস্থিত বুদ্ধির পরিচয় দিল।

সে উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে ঝট করে আমার ধান্ধাটা বুঝে ফেলল। ঠোঁটের কোণ দুটোতে মুচকি হাসি ফুটিয়ে তুলে ছোট্ট-নিটোল দুটো হাত করমর্দনের জন্য আমার দিকে বাড়িয়ে দিল।

ব্যাপারটা নজরে পড়তেই নিগ্রো ভৃত্যটা না-দেখি, না-দেখি করে অন্যদিকে সড়ে পড়ল। ব্যস, আর কোনো সমস্যাই আমাদের রইল না। আর কে ঠেকায় আমাদের। আমাদের উভয়ের বুক-ভরা প্রেমের জোয়ার মুখের ভাষার মধ্যে বেরিয়ে আসতে লাগল। আমরা প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে পড়লাম। এমন ভাবাপ্লুত হয়ে পড়লাম যে, কি। বলব আর কি করব হঠাৎ করে গুছিয়ে ওঠাই উভয়ের ক্ষেত্রেই সমস্যা হয়ে দাঁড়াল।

একটা ব্যাপার আমার নজরে পড়ল, আমার মনময়ূরী ম্যাডাম ল্যানাডে ইংরেজিতে কথা বলতে খুবই অ-পটু। চিঠিটা লেখার সময় ভাষায় যে-গতিটুকুও ছিল, কথা বলার ক্ষেত্রে তা-ও দেখা গেল না।

অনন্যোপায় হয়েই আমাদের বাক্যলাপকে ইংরেজি থেকে ফরাসি ভাষায় নিয়ে যেতেই হলো। অতএব ফরাসি ভাষায়ই কথাবার্তা চলতে লাগল।

সত্যি কথা বলতে কি, আমার মুখ দিয়ে অনবরত খই ফুটতে থাকলেও মিষ্টি মধুর বাছা-বাছা প্রেমের শব্দগুলো ঘাটতি পড়েনি। আবার অভাবনীয় আবেগে-উচ্ছ্বাসে অভিভূত হয়ে পড়লেও বাপটুতায় এতটুকু শৈথিল্য আসতে দেইনি। মোদ্দা কথা, আমার বুকে আগ্রহ-উৎসাহের জোয়ার বয়ে চললেও লাগাম টেনে রেখে, সতর্কতার সঙ্গে দেবী ল্যানাডের সঙ্গে বাক্যালাপ চালিয়ে যেতে লাগলাম। তাই তো বিয়ের প্রসঙ্গটা পাড়তে আমার জিভটা অবাধ্যতা করেনি, আড়ষ্ট হয়ে পড়েনি এতটুকুও।

তবে এও কিন্তু মিথ্যা নয়। আমার কথাবার্তায় অস্বাভাবিক অস্থিরতাটুকু কিন্তু মাডামের নজর এড়ায়নি। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসতে লাগল।

ম্যাডাম ল্যানাডে কথা প্রসঙ্গে আদিকালের সামাজিক লৌকিকতার প্রসঙ্গ উত্থাপন করল। সে অন্তরের অন্তঃস্থলে বহু সংখ্যক সুখকে জোর করে দাবিয়ে রেখেছে আর সময় অতিক্রান্ত হয়ে যাবার পর সেই সুখ যখন আর সুখ থাকে নাই। মিলনের পথ ছেড়ে সে লৌকিকতায় এসে দাঁড়িয়েছে, এই সেই চিরাচরিত সামাজিক রীতিনীতি।

আর এও শুনলাম, আমি নাকি খুবই বোকা-হাঁদার মতো ম্যাডাম ল্যানাডের কথা ইয়ারদোস্তদের কাছে ফলাও করে বলে বেরিয়েছি।

শুধু কি বলা-ই? তার সঙ্গে পরিচিত হতে, সঙ্গ-সুখ লাভ করার জন্য আমি যে প্রায় পাগলের মতো হয়ে গেছি, তা-ও নাকি আর এ-তল্লাটের কারোই অজানা নেই– জানতে পেরে গেছে।

আর এই যে পার্কে আমাদের দেখা হল, কথাবার্তা হলো এটাও কি আর কারো কাছে গোপন থাকবে? অবশ্যই না, সকাল হতে না হতেই কথাটা এ-তল্লাটের সবার মধ্যে চাউর হয়ে যাবে, কানাকানি, ফিসফিসানি শুরু হয়ে যাবে।

ম্যাডাম এ পর্যন্ত বলেই বিশেষ একটা ভঙ্গিতে লাল হয়ে ওঠা মুখটাকে ঘুরিয়ে প্রসঙ্গটাকে সম্পূর্ণ অন্য একটা প্রসঙ্গে নিয়ে চলে গেল। যে প্রসঙ্গে সব মেয়ের মুখই স্বাভাবিকভাবেই রক্তিম হয়ে ওঠে। ম্যাডাম ল্যানাডে একটু বেশ দৃঢ়তার সঙ্গেই আমার উদ্দেশ্যে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিল–কাজটা কি ঠিক হবে বলে আপনি মনে করছেন?

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলাম–কোন কাজ? আপনি কোন কাজের ইঙ্গিত দিচ্ছেন?

বিয়ের কথা, আপনি যে বিয়ের প্রসঙ্গ পাড়তে চাচ্ছেন, তা আমি ধরেই নিয়েছি। সে কথা।

কেন? আমি তো আপত্তিকর কোনো কথা বলছি না।

তবে?

বলছি এমন সাততাড়াতাড়ি বিয়ে হয়ে যাওয়াটা কি সঙ্গত হবে, আপনি বলুন?

অসঙ্গত? কেন? এতে অসঙ্গতের কী-ই বা থাকতে পারে?

আমি বলতে চাচ্ছি, ব্যাপারটা কেবলমাত্র অসঙ্গতই নয়, নিতান্তই অন্যায় করা হবে বলেই তো আমি মনে করছি। একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভেবে দেখলেই আপনিও হয়তো আমার কথায় সায় না দিয়ে পারবেন না।

ম্যাডাম ল্যানাডে মিষ্টিস্বরেই বুকে কাঁটা বেঁধানো কথাগুলো হাসিমুখে বলে গেল।

আমার বুকটা ভেঙে টুকরো-টুকরো হয়ে গেলেও তার যুক্তির কাছে হার না মেনে পারলামই না।

আরও আছে, আমি যে নিতান্তই একজন অবিবেচক এবং মাথায় বুদ্ধি তেমন কিছু নেই, ম্যাডাম তা-ও আমাকে না শুনিয়ে ছাড়ল না।

কিন্তু আমারই বা দোষ-ত্রুটি কোথায়, বুঝবই বা কী করে? আসলে ম্যাডাম ল্যানাডে-র প্রকৃত পরিচয় কি, তার ভবিষ্যতই বা কি, তার আত্মীয় পরিজনরাই বা কেমন আর তার সামাজিক খ্যাতি-অখ্যাতিই বা কতটুকু–এসবের বিন্দুবিসর্গও কি আমার জানা আছে ছাই?

শেষপর্যন্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে ম্যাডাম বললেন–তাই বলছিলাম কি, বিয়ের ব্যাপারটা একটু গভীরভাবে ভেবে দেখবেন। এ মুহূর্তে যাকে ভালোবাসা বলে আমরা মাতোয়ারা হয়ে পড়েছি, তা হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আলেয়ার আলোতে পরিণত হয়েও যেতে পারে।

প্রকৃতির বুকে যখন সন্ধ্যার আলো-আঁধারীর খেলা শুরু হয়েছে, ঠিক তখনই আমার স্বর্গের অন্সেরা, আমার মন্মোহিনী দেবী ম্যাডাম কথাগুলো বলে নিজেকে ধীরে ধীরে শামুকের মতোই গুটিয়ে নিল। যেন নিজের মধ্যেই নিজে আত্মগোপন করল।

আর আমি? আমি লাগাম টেনে রেখে নিজেকে সাধ্যমত সামলে রেখে সত্যিকারের একজন প্রেমিকের মতোই তার প্রতিটা প্রশ্নের এক এক করে উত্তর দিয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ ধরেই আমাদের মধ্যে কথাবার্তা হলো।

আমি যা-কিছু তাকে বলেছিলাম, তাতে বারবার বুঝাতে চেষ্টা করেছি, আমার প্রেমের গভীরতা অপরিসীম, অনন্য সাধারণ নিষ্ঠা, সতোর অভাব লেশমাত্র নেই আর আবেগও অপরিমেয়।

আমার মন-ময়ূরী রূপসি তন্বী যুবতি ইউজিনি কিন্তু স্বর্গের দেবীর মতো ঝকঝকে চকচকে দাঁতগুলো আধো বের করে আর আধো ঢেকে রেখে হাসতে হাসতে ছবিটা আমার হাতে ফিরিয়ে দিল।

ছবিটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে মধুঝরা কন্ঠে বলল–এটা আপনার কাছেই রেখে দিন। তারপর ঠোঁটের কোণে মনে দোলা-লাগানো হাসির ঝিলিক ফুটিয়ে তুলে বলল–আপনি যা জানতে অত্যুৎসাহী. তার উত্তর ছবিটার পিছন দিকে স্পষ্টভাষায় লেখা রয়েছে।

আমি নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার হাত থেকে ফটো নিলাম। কিন্তু অতুগ্র আগ্রহের সঙ্গে ফটোটাকে ঘুরিয়ে তার পিছন দিককার লেখাটা পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম।

আমার অবস্থা দেখে ম্যাডাম বললেন–বৃথা চেষ্টা। অন্ধকারে পড়তে পারবেন না। বাড়িতে গিয়ে আলোর সামনে ভালো করে পড়ে নেবেন।

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার মুখের দিকে তাকালাম। আমার আগ্রহ ও কৌতূহলের আধিক্য লক্ষ্য করে ম্যাডামই উদ্ভুত কৌতূহল নিবৃত্ত করতে গিয়ে বললেন–এখানে কি লেখা আছে জানার জন্য খুবই উকণ্ঠাবোধ করছেন, তাই না?

আমি গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলাম–হুম।

ম্যাডাম পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনে, মুখে দুষ্টুমিভরা হাসির ছোপ ফুটিয়ে তুলে এবার বললেন–কি লেখা আছে ভেবে বড়ই উতলা হয়ে পড়েছেন, তাই না?

আমি ম্লানমুখে জবাব দিলাম–আপনার কথাটা যে মিথ্যে নয়, তা আর অস্বীকার করবই বা কি করে?

লেখা আছে, আজ রাতে আমার বাড়িতে এক সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছি।

আমি জোর করে মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলে বললাম–তাই বুঝি?

হ্যাঁ।

বহু জ্ঞানী-গুণী–সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির আগমন ঘটবে, এই তো?

আপনাকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। ছবিটার পিছনে এ-কথাই লিখে দিয়েছি।

এবার আমার গোমড়ামুখে সত্যি সত্যি এক অবর্ণনীয় হাসির ঝিলিক খেলে গেল।

পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনেই ম্যাডাম বলে চললেন–আমার বন্ধু সেখানে উপস্থিত থাকবে।

আমি হঠাৎ মিইয়ে গিয়ে বলে উঠলাম–তাদের মাঝখানে আমি… আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ম্যাডাম বলে উঠলেন–আরে ভাই, এমন বিমর্ষ হয়ে পড়ার কি আছে। আপনি যাতে সবার মাঝে অপ্রস্তুত হয়ে না যান, সে চিন্তাও আমি করে রেখেছি।

আমি তার কথার তাৎপর্যটুকু ধরতে না পেরে চোখে-মুখে জিজ্ঞাসার ছাপ এঁকে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে এবার বলল–সবার সঙ্গে আপনার পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে আমার একজন পুরনো বন্ধু হিসেবে পরিচয় দেব। আলাপ-পরিচয় জমে গেলে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন না, সময় কি করে কেটে যাচ্ছে। সব শেষে আমার কাছে থেকে যথাসময়ে সংগীতানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার প্রতিশ্রুতি পেয়ে তবেই থামলেন।

আমার ভালোলাগা ম্যাডাম ইউজিনি, হাতে হাত ধরে নিজের বাসস্থলে নিয়ে গেলেন। বাড়িটা সত্যি প্রাসাদোপম। সুবিশাল হলঘরটা অতিথি অভ্যাগতদের সমাগমে গমগম্ করছে। যথাসময়ে সংগীতানুষ্ঠান শুরু হলো। মধুর সংগীত, আনন্দ উচ্ছ্বাস আর হৈ-হুঁল্লোড়ের মধ্যে দিয়ে সন্ধ্যাটা কাটতে লাগল।

এক সময় আমার মধুমিতা ইউজিনি পিয়ানোর আসনটা ছেড়ে আমার পাশে, একেবারে গা ঘেঁষে বসল। আমি পুলকিত হয়েছিলাম খুবই। কিন্তু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছি, যখনই কোনো কথা বলি তখনই কাঁপা কাঁপা স্বর আমার কণ্ঠ দিয়ে বেরিয়ে আসে। আমার তখনকার উদ্দেশ্য আর পরিস্থিতিই যে এর কারণ, বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হয়নি।

কেবল আমার কথাই বা বলি কেন? ইউজিনির অবস্থাও আমারই মতো। তার কথাগুলোও যেন গলা দিয়ে কেঁপে কেঁপে বেরিয়ে আসছে। কিন্তু পরমুহূর্তেই লক্ষ্য করলাম, তিনি গান ধরতেই যেন কণ্ঠস্বরের স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়ে গেলেন। আমি রীতিমত স্তম্ভিত হয়ে, নিতান্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো তন্ময় হয়ে তার মধুঝরা কণ্ঠের গান শুনতে লাগলাম। এমন মধুর কণ্ঠস্বর যে স্বর্গের দেবী ছাড়া মর্ত্যের কোনো মানবীর হতে পারে, তা আমার কল্পনায়ই ছিল না।

আমরা দুজনে কাছাকাছি পাশাপাশি বসে দীর্ঘসময় ধরে কথাবার্তা বলছিলাম। কোনো দিক থেকেই বাধা আসেনি, আপত্তিও করেনি কেউ-ই। যাকে বলে একেবারে মনভরে অনর্গল নিজের কথা বলে গিয়েছিলাম।

আমার প্রাণাধিকা ইউজিনি কিন্তু আমার মতো ধৈর্য ধরে শুনেছিল। আমি আগেই মনস্থির করেছিলাম, আমার নিজের সম্বন্ধে যা-কিছু বলব তার একটা কথাও গোপন করব না, বাদও দেব না কিছুই। কলেজ জীবনে যত নষ্টামি করেছি, ছোটখাট টুকরো টুকরো যত গর্হিত কাজ করেছি, শরীরের ওপর যতভাবে অত্যাচার করেছি, বিবেকে কতরকমের কু-মতলব জমা আছে আর কাকে-কাকে ভালোবেসেছি আর প্রেমের নামে কতভাবে খেলায় মেতেছি–এসব কথার কিছুই বাদ দিইনি।

একবার অস্বাভাবিক ঠাণ্ডায় ঘোরাফেরা করার জন্য বুকে কফ বসে যাওয়ায় ক্রনিক ব্যাধিতে ভুগতে হয়েছিল, বাতের ব্যথা বেদনায় বেশ কিছুদিন ভোগান্তিতে পড়েছিলাম। এসবে মূলে আমার বংশগতির প্রভাব রয়েছে, তা-ও বলেছি। সব শেষে আমার চোখের দুর্বলতার কথা বলতেও বাদ দেইনি।

আমি চোখের দুর্বলতার কথাটা পাড়তেই, ইউজিনি সশব্দে হেসে উঠল।

আমি তার আকস্মিক হাসি, কারণ কিছুই ধরতে না পেরে, ঢ্যাবাচ্যাবা চোখে তার মুখের দিকে হা করে তাকিয়ে রইলাম।

হাসি থামিয়ে এক সময় সে বলল–এটা মুখ ফুটে না বললেও আপনার দুর্বলতাগুলো আজ না হোক কাল তো জানাজানি হবেই হবে। অতএব আগেভাগেই স্বীকার করে নিয়ে ভালোই করেছেন।

কথাটা বলার সময় তার গাল দুটো এমন রক্তিম হয়ে উঠল যে, সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারেও আমি যেন স্পষ্টই দেখতে পেলাম।

ইউজিনি এবার একটা দূরবীন আঙুলে নাচাতে লাগল। আমার চিনতে অসুবিধা হলো না, রঙ্গমঞ্চে নৃত্যনাট্য দেখার সময় সে এটা ব্যবহার করেছিল।

তার প্রশ্নের উত্তরে আমি বললাম–হ্যাঁ, এ-যন্ত্রটার সঙ্গে আমার পরিচয় আছে অবশ্যই। আগেই আপনার চোখে দেখেছিলাম। এবার হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে ভালো করে দেখা যাক। কথা বলতে বলতে দূরবীনটা তার হাত থেকে নিলাম। আবছা অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম, যন্ত্রটা খুবই দামি, সন্দেহ নেই।

আমার মধুমিতা মুচকি হেসে বলল তোমার প্রেমে আমি যারপরনাই মুগ্ধ। আমি শপথ করছি কাল, হ্যাঁ, কালই বিয়ের মালা গলায় পড়ব। কিন্তু এর বদলে আমি কিন্তু ছোট্ট একটা অনুরোধ রাখতে যাচ্ছি।

অনুরোধ! অনুরোধ না বলে তার চেয়ে বরং বলুন আদেশ।

ঠিক আছে, আপনার কথাই হবে, আদেশ–

হাজার বার। এমন গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে আমি কথাটা ছুঁড়ে দিয়েছিলাম যে, ধারেকাছে যারা ছিল সবাই রীতিমত চমকে উঠে। আমার দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকাল।

সবার দৃষ্টি আমার দিকে ছিল বলে আমি নিজেকে সামলে নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। নইলে আমি অবশ্যই দুম করে তার পায়ে পড়ে যেতাম।

আমি ভাবাপুত কণ্ঠে বলে উঠলাম–প্রিয়তমা, আমার প্রিয়তমা ইউজিনি তোমার আদেশটা কি, বলো? কেবলমাত্র একটা বার তোমার অনুরোধের কথা আমাকে বলো?

শুধুমাত্র এ দূরবীন–তাই-গ্লাসটা চোখে লাগাতে হবে।

আই-গ্লাস!

আসলে ডাবল আই-গ্লাস তো। একটু চেষ্টা করে অ্যাডজাস্ট করে নিলেই দিব্যি একটা লেখায় পরিণত হয়ে যাবে। আমি অবাক বিস্ময়ে ঢ্যাব-ঢ্যাব চোখ মেলে তার দিকে তাকালাম। পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনে সে এবার বলল–এটা চোখে লাগালে তোমার মহত্ব আরও অনেকাংশে বেড়ে যাবে। আর দৃষ্টিশক্তি প্রকটতর হবে। বহু মূল্যবান বস্তু। যত্ন করে কোটের পকেটে রেখে দিও। একবার মুখ ফুটে বল, তুমি রাজি? যদি রাজি হয়ে যাও তবে আমি বলব, তুমি সত্যি সত্যি আমাকে অন্তর থেকে ভালোবাস।

ব্যাপারটা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তার অনুরোধটা শুনে আমি কেমন বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলাম। মাথার মধ্যে সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। কিন্তু তখন আমার যা হাল হয়েছে, তাতে ওজর-আপত্তির কথা তো আমার পক্ষে ভাবাই সম্ভব নয়।

আমি শুকনো, কাঁপাকাপা গলায় উচ্চারণ করলাম–রাজি। আমি রাজি। আমার ভেতরটা মুহূর্তে মিইয়ে গেলেও জোর করেই বলে উঠলাম–আমি রাজি! রাজি! রাজি!

ইউজিনি সোল্লাসে বলে উঠল–রাজি! তুমি রাজি!

হ্যাঁ, আমি রাজি। আমি রাজি হয়েছি কেবলমাত্র তোমার প্রেমের খাতিরে। তোমার অন্তরের ভালোবাসা পাবার জন্য, অন্তরে চশমা বিস্তৃত থাকা সত্ত্বেও আমি রাজি না হয়ে পারছি না।

ইউজিনি সোল্লাসে বলে উঠল-সাবাস! এই তো চাই।

নিছক একটা আই-গ্লাস হিসেবেই আজ রাতে আমি এটাকে গলায়, আমার বুকের ওপর ঝুলিয়ে রাখব। কাল ভোরে যখন তোমাকে স্ত্রী বলে সম্বোধন করার সৌভাগ্য হবে তখন থেকে আমৃত্যু এ আই-গ্লাসটা আমার নাকের ওপরে অবস্থান করবে। ব্যস, পর মুহূর্তেই আলোচনার মোড় ঘুরে গেল। আগামীকালের আলোচনায় আমরা ডুবে গেলাম।

জানতে পারলাম, ট্যালবট নাকি আগামীকালই শহরে ফিরে আসছে। অনুমান করা যাচ্ছে, রাত দুটো নাগাদ গানের মজলিস ভাঙবে। তারপরেই গাড়ি নিয়ে আমরা বন্ধুবরের খোঁজে যাব।

অনুষ্ঠানের শেষে সবাই যখন এক-এক করে বেরোত আরম্ভ করবে তখন হৈ হট্টগোলের মধ্যে ম্যাডাম গিয়ে দরজায় অপেক্ষমান গাড়িতে ঝটপট বসবে। সেখান থেকে সোজা আগে থাকতে বন্দোবস্ত করে রাখা এক পাদরির বাড়ি হাজির হব। সেখানেই আমাদের বিয়েটা চুকিয়ে নেব।

পাদরির বাড়ি থেকে বেরিয়ে বন্ধুবর ট্যালবটকে তার বাড়ির দরজায় বসিয়ে দেব। ব্যস, এভাবে কাজ মিটিয়ে আমরা সোজা পূর্বাঞ্চলের দিকে যাত্রা করব। প্রাচ্যের কোনো একনিরিবিলি অঞ্চলে গিয়ে আমরা ঘর বাঁধব। আমাদের দেখে সম্ভ্রান্ত ও সৌখিন সমাজ যখন কৌতূহলাপন্ন হয়ে পড়বে, গোপনে সমালোচনায় লিপ্ত হবে তখনই আমরা সেখান থেকে চম্পট দেব।

পরিকল্পনার খসড়াটা পাকাপাকি করে ফেলতে পেরেছি তখনই, আর মুহূর্তমাত্র সময় নষ্ট না করে গাইয়েদের আখড়া থেকে আমি কেটে পড়লাম।

বন্ধু ট্যালবটের খোঁজে রওনা হওয়ার পূর্বমুহূর্তে আমি পথের ধারের ছোট্ট একটা হোটেলে ঢুকে পড়লাম। উদ্দেশ্য, আই-গ্লাসের ভেতর দিয়ে ছোট্ট ছবিটাকে ভালোভাবে দেখে চোখ-আর মনকে একটু তৃপ্ত করে নেওয়া। করলামও ঠিক তাই।

ছবিটাকে বার বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার পর সেটাকে উলটে দিতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল কয়েকটা অক্ষর। দেখলাম লেখা রয়েছে–ইউজিনি ল্যানাড বয়স সাতাশ বছর সাত মাস ব্যস, এর বেশি আর একটা শব্দও লেখা ছিল না।

গাড়িটা বার কয়েক বাঁক ঘুরে বন্ধু ট্যালবটের বাড়ির সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল। বন্ধুকে বাড়িতেই পেয়ে গেলাম।

কুশল সংবাদাদি আদান-প্রদান ছাড়া অতিরিক্ত আর একটা শব্দও উচ্চারণ না করেই আমি আমার সৌভাগ্যের কথা ঝটপট তাকে অত্যুত্র আগ্রহের সঙ্গে ব্যক্ত করলাম।

আমার ভাগ্য খোলার কাহিনী শুনে ট্যালবট খুবই অবাক হলেও আমাকে অভিনন্দন জানাতে কিন্তু সে ভুল করল না। আর সে সঙ্গে প্রতিশ্রুতি দিল, আমাকে সে এ-ব্যাপারে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা করবে।

রাত দুটোয় ইউজিনি আর আমি একটা ঢাকা-গাড়িতে চেপে সোজা উত্তর-পশ্চিম দিকে ধেয়ে চললাম।

পাদরি সাহেবের বাড়িতে, তারই পৌরহিত্যে রাত দুটোর সময় আমাদের বিয়ের পাট ভালোভাবেই সেরে নিলাম।

বন্ধুবর ট্যালবটই শহর থেকে সাতাশ মাইল দূরবর্তী এক গ্রাম্য পরিবেশের অখ্যাত অজ্ঞাত এক সরাইখানায় আমাদের মধুচন্দ্রিমা যাপনের ব্যবস্থা করে রেখেছিল। কারণ, আমাদের অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে।

সরাইখানা থেকে ভোরে জল-খাবারের পাট চুকিয়ে আমাদের আবার গাড়িতে উঠতে হবে। এবারই আমাদের আসল যাত্রা শুরু হবে। ( কাঁটায়-কাঁটায় চারটার সময় আমাদের গাড়িটা সরাইখানার সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল।

আমি সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর হাত ধরে গাড়ি থেকে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনলাম।

এখন সবে পূর্ব-আকাশে রক্তিম ছোপ দেখা দিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জল খাবারের ব্যবস্থা করতে বলে আমরা দুজন সরাইখানার বারান্দায় একটা খাঁটিয়ার ওপর বসলাম।

আমি নিস্পলক চোখে আমার পাশে বসে থাকা চোখ ধাঁধানো রূপের ডালি গায়ে মাখা দেবী-মূর্তির দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আমার মনে হল–যাকে সহধর্মিনীরূপে পাওয়ার জন্য আমি এতদিন উন্মাদপ্রায় হয়ে গিয়েছিলাম আজ সে সত্যি সত্যি আমার সহধর্মিনী হয়ে আমার পাশে, একেবারে গা-ঘেঁষে অবস্থান করছে।

তাই একেবারে কাছ থেকে তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমি বড়ই মানসিক চাঞ্চল্য বোধ করলাম। আমার এ ইচ্ছাটার কারণও তো রয়েছে যথেষ্ট। সত্যি কথা বলতে কি, দিনের আলোয় তাকে দেখার এমন অপূর্ব সুযোগ তো এর আগে মুহূর্তের জন্যও বরাতে জোটেনি।

আমার মনের কথা আমার সদ্য বিয়ে করা বউ ইউজিনি মুখে হাসির ছোপ ফুটিয়ে তুলে বলে উঠল–আশাকরি কাল রাতের দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা ভুলে যাও নি কী বলো?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম। সে মুখের হাসিটুকু অক্ষুণ্ণ রেখেই এবার বলল–কাল রাতে কথা দিয়েছিলে, দিনের আলো ফুটে উঠলেই চশমা চোখে লাগাবে আর সারা জীবনে সেটা চোখ থেকে খুলবে না, মনে নেই?

আমি থতমত খেয়ে বললাম–আছে, অবশ্যই মনে আছে। তবে কি প্রতিশ্রুতি দিয়ে–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম–প্রতিশ্রুতি যখন দিয়েছি তখন রক্ষাও করব অবশ্যই।

আমি চশমাটা নাকে লাগানো মাত্র ইউজিনি নড়েচড়ে অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে বসল। আমার কাছে কিন্তু তার বসার এ ভঙ্গিকে তেমন সুন্দর কিছু মনে হলো না।

চশমাটা নাকে বসাতে না বসাতেই আমি গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠলাম–একী! চশমাটার হলো কী?

সঙ্গে সঙ্গে আই-গ্লাসটাকে নাক থেকে নামিয়ে এনে রুমাল দিয়ে জোরে ঘষে ঘষে মুছতে আরম্ভ করলাম। তারপর আবার নাকে লাগিয়ে দিলাম।

চশমাটা নাকে লাগিয়ে প্রথমবার আমি অবাক হয়েছিলাম। আর দ্বিতীয়বার? দ্বিতীয়বার স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। কেবলমাত্র স্তম্ভিত বললে ঠিকঠিক বলা হবে না। মানুষ যখন অত্যধিক স্তম্ভিত হয় তখন তা আতঙ্কে পরিণত হয়।

আমি আই-গ্লাসের ভেতর দিয়ে যাকে প্রত্যক্ষ করলাম, তাকে মূর্তিময়ী বিভীষিকা ছাড়া আর কিছুই ভাবা সম্ভব নয়। এর চেয়ে কদারকার কোনো মূর্তি হতে পারে বলে আমার অন্তত জানা নেই। তার মুখের দিকে চোখ পড়ামাত্র আমার সর্বাঙ্গ রীতিমত থরথরিয়ে কাঁপতে লাগল। আর শরীরের সবকয়টা স্নায়ু যেন একই সঙ্গে ঝনঝ নিয়ে উঠল। হায়! আমি কি তবে নিজের চোখ দুটোর ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছি? আমি সংশয়ের দোলায় দুলতে লাগলাম। ওটা কি? ওটাই বা কি দেখছি? তবে কি বলিরেখা? আমার স্বপ্নের রানির এমন সুন্দর মুখায়বে আমি এসব কি দেখছি!

হায় ঈশ্বর! এ কী দেখালে আমাকে! ওগুলো কি দাঁত নাকি? তার দাঁতের এ-হাল হলো কি করে? হায় ঈশ্বর এ কী দেখালে!

আমি মুহূর্তমাত্র দেরি না করে এক ঝটকায় নাকের ডগা থেকে আই-গ্লাসটাকে নামিয়ে আনলাম। চরম বিতৃষ্ণায় মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম।

আমি যন্ত্রচালিতের মতো এক লাফে খাঁটিয়া ছেড়ে উঠে পড়লাম। আমি ক্রোধোন্মত্ত বাঘের মতো অনবরত ফুঁসতে লাগলাম। মুহূর্তে যেন বাশক্তি হারিয়ে ফেললাম।

দেখলাম, মিসেস সিম্পসন গগামড়ামুখে অদূরে বসে রয়েছে।

আতঙ্কের সঙ্গে অপরিমিত ক্রোধ গাটছড়া বাঁধায় আমার জিভটাও যেন আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে। হায় ঈশ্বর! এ কী অত্যাদ্ভুত দশা হলো আমার!

মিসেস সিম্পসন হঠাৎ বলে উঠল–এ কী কাণ্ড করছ! এভাবে দাপিয়ে বেড়াচ্ছ কেন? ব্যাপারটা কি বুঝছি না তো! আমাকে কি তোমার এখন আর পছন্দ হচ্ছে না? ভালো লাগছে না?

আমি ক্রোধ সম্বরণ করতে না পেরে উন্মাদের মতো গর্জে উঠলাম– হরামজাদি! ডাইনি কোথাকার! নচ্ছার মেয়ে মানুষ! বুড়ি ঘাটের মড়া শকুনি কোথাকার!

সে-ও বাজখাই গলায় চেঁচিয়ে উঠল–কী বললে, আমি বুড়ি? বিরাশি বছরের মেয়েকে তুমি বুড়ি বলে গালমন্দ করছ অপমান করছ!

কী বললে, বিরাশি বছর! কথাটা সোনামাত্র আমার মাথাটা আচমকা চক্কর মেরে উঠল। কোনোরকমে দেওয়ালের গায়ে শরীরের ভার সঁপে দিতে না পারলে, মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়েই যেতাম। দেওয়ালে হেলান দিয়ে বাজ-পড়া রোগীর মতো অনবরত কাতড়াতে লাগলাম।

আমি অতি কষ্টে স্মৃতিশক্তিকে চাঙা করে তুলে আপন মনে বিড়বিড় করে বলতে লাগলাম–ছবিটার পিছনে তো সাতাশ বছর সাত মাস বয়স লেখা ছিল।

সে কণ্ঠস্বরে স্বাভাবিকতা বজায় রেখেই এবার বলল–কিছুমাত্রও ভুল দেখনি। আসলে ছবিটা তো আঁকা হয়েছিল পঞ্চান্ন বছর আগে। দ্বিতীয়বার জনাব ল্যানাডেকে বিয়ে করার সময় এটাকে এক অভিজ্ঞ শিল্পী এঁকেছিল।

পঞ্চান্ন বছর আগে! দ্বিতীয় বার বিয়ে!

হ্যাঁ, ঠিক তা-ই। আমর প্রথম স্বামী ময়সার্টের মেয়ের জন্য এটা আঁকিয়ে ছিলাম।

ময়সার্ট! মি. ময়সাট!

আরে হ্যাঁ-হ্যা! মি. ময়সার্ট। আমার প্রথম স্বামী ময়সার্টের কথা বলছি। ব্যাপার কী? ময়সার্টকে চেনো না তুমি?

না, কোনোদিনই না। ময়সার্ট আমার এক পূর্ব পুরুষের নাম ছিল। ব্যস, এর বেশি কিছুই জানা নেই। কিন্তু তুই ডাইনি, শকুনি, বুড়ি। ঘাটের মড়া ছাড়া তোকে আমি অন্য কিছু ভাবতেই পারছি না।

নামটা ভারি সুন্দর, তাই না? ভয়সার্ট নামটাও কিন্তু মনে দোলা দেয়, ঠিক বলিনি?

হুম! আমি গুলি খাওয়া বাঘের মতো অনবরত ফুঁসতে লাগলাম।

সে পূর্বপ্রসঙ্গের জের টেনে বলে যেতে লাগল–শোনো, মি, ভয়সার্টকে আমার রূপসি কুমারি মেয়ে বিয়ে করে ঘর রাঁধতে চেয়েছিল।

বুড়ি শকুনি! ময়সার্ট! কী সব আজেবাজে কথা তখন থেকে সমানে বলে যাচ্ছিস!

কি বলতে চাচ্ছি ধৈর্য ধরে শোনো–আমার মেয়ের মেয়ে কুমারী ভয়সার্ট মি. ভয়সার্ট-এর গলায় বরমাল্য দিয়ে তার ঘর করতে গিয়েছিল। আমার মেয়ের নাতনি মি. ফ্ৰয়সার্টকে স্বামীত্বে বরণ করে নিয়েছিল। কী চমঙ্কার সব নাম, ঠিক কি না?

কি বললি বুড়ি শকুনি, ফ্ৰয়সার্ট! মনে হচ্ছে, আমি বুঝি এবার সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়েই পড়ব। আরে বাবা! ময়সার্ট, ভয়সার্ট, ক্ৰয়সার্ট আর ফ্ৰয়সাট–কী ঝকমারিতেই না পড়া গেল! সব কিছু আমার কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে!

আরে ভাই ফয়সার্ট তো একটা নিরেট আহাম্মক। আমেরিকায় মরতে গিয়েছিল হতচ্ছাড়াটা। সেখানে সে একটা ছেলেও পয়দা করেছিল। সেটা ছিল একটা আস্ত উল্লুক।

হুম্! আমি ক্রোধে স্বগতোক্তি করলাম।

সত্যি বলছি, এমন আহাম্মক আমি আগে কোনোদিনই দেখিনি। কেবল আমার কথাই বা বলি কেন? আমার বান্ধবী ম্যাডাম স্টিফানি ল্যানাডেরও সে দুর্ভাগ্য কোনোদিন হয়নি। হতচ্ছাড়াটার নাম কী জানো? আমি তার কথার জবাব না দিয়ে ভেতরে ভেতরে গজরাতে লাগলাম।

সে বলেই চলল–হতচ্ছাড়া ছোঁড়াটার নাম ছিল, নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ফ্রয়সাট। বেশ নাম বটে, তুমি কী বল?

কথা বলতে বলতে ইউজিনি যেন মৃগী রোগীর মতো দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়ে যাওয়ার যোগাড় হলো। যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত একটা লাফ দিয়ে ঘরে একেবারে মাঝামাঝি জায়গায় এসে পড়ল। মনে হলো যেন ডাইনিতে নতুবা কাঁধে পেত্নী ভর করেছে। তিড়িং বিড়িং করে নাচতে নাচতে মাথা থেকে টুপিটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেই হঠাৎ তার পরচুলা খুলে দুম্ করে মেঝেতে পড়ে গেল। এবার বিকট আর্তনাদ করে আমার দিকে ঘুষি বাগিয়ে আমার নাকের সামনে অনবরত নাচাতে লাগল। আর পেত্নীর মতো তিড়িং বিড়িং করে লাফানো আর গলা-ফাটানো চিৎকার সমান তালেই চালাতে লাগল। সে যে কী উদ্দাম নাচ! তা আর কহতব্য নয়।

তার বুক-কাঁপানো চিৎকারে আমার কানের পর্দা ফেটে যাবার যোগাড় হলো।

নাচতে নাচতে এসে আমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বার-কয়েক মুখ খিচুনি দিই মুখ থেকে নকল দাঁতের পাটি দুটো খুলে ছিটকে গিয়ে মেঝেতে আছাড় খেয়ে পড়ল।

আর দাঁড়িয়ে থাকার মতো অবস্থা আমার মধ্য থেকে লোপ পাওয়ায় আমি দুপা পিছিয়ে গিয়ে দুম্ করে একটা চেয়ারে বসে পড়লাম। আর বিমর্ষমুখে মন্ত্রের মতো অনুচ্চকণ্ঠে ময়সার্ট আর ভয়সার্ট! ভয়সার্ট আর ময়সার্ট–অনবরত উচ্চারণ করতে লাগলাম।

আমি যখন অসহায়ভাবে বসে প্রায় কাতড়ে চলেছি ঠিক তখনই ইউজিনি এক লাফে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়াল। তার পর মুহূর্তেই আচমকা এক হেঁচকা টানে তার নকল একটা দিক আলগা করে দিল।

এবার সে প্রায় উন্মাদিনির মতো বিকট স্বরে চেঁচিয়ে উঠল–আরে, এত ভাবছ কী পাগলের মতো! আমি নিজেই তো নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফয়সাট, বুঝলি এবার? আমি হ্যাঁ, আমিই সেই ফ্ৰয়সার্ট–নেপোলিয়ান বোনাপার্ট ফ্ৰয়সার্ট, এবার বুঝলি তো আহাম্মক?

এবার কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে ইউজিনি বলতে লাগল–আমি আজ কাকে বিয়ে করেছি! ম্যাডাম ইউজিনি ল্যানাড ওরফে সিম্পসন, ভূতপূর্ব ময়সার্ট হচ্ছেন আমার ঠাকুরমার মায়ের মা, বুঝলে? বয়সকালে সে ছিল যথার্থই এক রূপসি রূপের আঁকর যাকে বলে।

বিরাশি বছর বয়স চলছে। কিন্তু আজও সম্রাজ্ঞীর মতো শরীরটাকে বজায় রেখেছে। শরীরের কোনো জায়গা এতটুকু দুমড়ে মুচড়ে তো যাইনি, এমনকি টোল খায়নি এতটুকুও। এতটুকু কুঁজো পর্যন্ত হয়নি। মাথার গড়ন পর্যন্ত স্বাভাবিক রয়েছে। আর চোখ দুটো? আজও দৃষ্টিশক্তি অক্ষুণ্ণ রয়েছে। কুমারী বয়সে নাকের সে সৌন্দর্য পর্যন্ত আজও দিব্যি বজায় রাখতে পেরেছে। তবে মাথায় পরচুলা ব্যবহার করতে হয়েছে, ব্যস। আর সে সৌন্দর্যকে ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে নকল বুক আর দাঁতের পাটি জোড়া।

প্যারিসের সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞদের হাতের যাদু বলে তার বয়স কমিয়ে বার্ধক্য থেকে একেবারে যৌবনে নিয়ে এসেছে–অবিশ্বাস্য কাণ্ড। ব্যস, এবার দিব্যি যুবতি সেজে হাসিমুখে দিব্যি শহরময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। যাদু, যাদুবিদ্যা রপ্ত না থাকলে কারো পক্ষে কী করে যে এমন একটা অদ্ভুত কাণ্ডকে বাস্তবায়িত করা সম্ভব ভাবাই যায় না।

টাকা! টাকা! আর টাকা! ইউজিনি আজ টাকার পাহাড় তৈরি করে সম্রাজ্ঞীর মতো দিব্যি বসে আছে।

প্রথম বিয়ের পর নিঃসন্তান অবস্থায় তার দ্বিতীয়বার বিয়ে হয়। তাই তো মনস্থ করেছিল, আমেরিকার অধিবাসী এ-উলুকটাকে টাকার পাহাড়ের উত্তরাধিকারী করে দেবে। তার দ্বিতীয় স্বামীর দূর-সম্পর্কের এক আত্মীয়া অতুলনীয়া রূপসি ম্যাডাম স্টিফানি ল্যানাডেকে সঙ্গে করে এ-ধান্ধাতেই আমেরিকায় হাজির হয়েছে।

রঙ্গমঞ্চের আসরে গীতিনাট্য চলার সময় আমার আগ্রহ ও কৌতূহলাপন্ন নিস্পলক। চাহনি আমার পিতামহীকে সচকিত করে ও মনে কৌতূহলের জোয়ার বইয়ে দেয়।

কৌতূহলের শিকার হয়ে চোখে আই-গ্লাস লাগায়। তার ভেতর দিয়ে আমার মুখে তার পারিবারিক ছাপ লক্ষ্য করে বিস্মিত কৌতূহলাপন্ন আর আগ্রহান্বিত হয়ে পড়ে।

আগ্রহের শিকার হয়ে খোঁজ-খবর নিতে থাকে, আমি এ শহরের কোন অঞ্চলে বসবাস করি। তার সঙ্গের ভদ্রলোকটা আমার পরিচয় ও ঠিকানা জানত। সে-ই আমার যাবতীয় তথ্য তাকে বলে দেয়।

যাবতীয় তথ্য পাওয়ার পর আমার ঠাকুমার মায়ের মার মনে আগ্রহ আরও হাজার গুণ বেড়ে যায়। আবার চোখে আই-গ্লাস লাগিয়ে আমার পা থেকে মাথা অবধি ভালো কওে নিরীক্ষণ করে নেয়। এ দেখাটাই আমার সর্বনাশটা ডেকে আনে।

আমি তখন আনন্দের জোয়ারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে কি কি করেছি, সবই তো। খালাখুলিভাবেই বলেছি। ঠাকুমার মায়ের মা ঘাড় কাত করে তখন আমার অভিনন্দন কেন ফিরিয়ে দিয়েছিল, তাই না? বুড়িটা নির্ঘাৎ ধরে নিয়েছিল, আমিও তাকে কোনো না-কোনোভাবে চিনতে পেরে গেছি।

এবার স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কেন এভাবে প্রবঞ্চিত হলাম? এখন আমি বলব, আমার দুর্বল চোখ দুটো আর বুড়িটার অসাধারণ প্রসাধনের কেরামতি।

আমি যখন ট্যালবটের কাছে মেয়েটার পরিচয় জানতে আগ্রহ প্রকাশ করেছি, সে কিন্তু নিঃসন্দেহই হয়েছিল, আমি বুড়ির সঙ্গিনী অল্পবয়সা মেয়েটার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করছি। আর তার পক্ষে এটাই তো স্বাভাবিক। তাই সে সেবারেই আমার কথার জবাব দিয়েছে স্বনামধন্যা ম্যাডাম ল্যানাডে। বিধবা। উপযুক্ত বরসংগ্রহের ধান্ধায় প্যারিস ছেড়ে লন্ডন শহরে এসে ঘাঁটি গেড়েছে।

পরদিনই পথ চলতে গিয়ে বুড়িটার সঙ্গে হঠাৎ ট্যালবটের দেখা হয়ে যায়। বলাবাহুল্য তার সঙ্গে বুড়ির আগেই পরিচয় হয়েছিল। পথের মাঝেই উভয়ের মধ্যে আমার প্রসঙ্গে আলোচনা হয়। আমার চোখের দুর্বলতার জন্য রঙ্গশালায় যা-কিছু ঘটেছে তার ব্যাখাও মিলে গেছে। বুড়ি ধরেই নিয়েছে, আমি হয়তো তাকে চিনতে পেরে আনন্দে উথলে উঠেছি। তাই তো আমার ইশারায় সাড়া দিতে দেরি করেনি। আর এরই ফলে আমি নিতান্ত বোকা হাঁদার মতো খোলাখুলিভাবেই প্রেমের ইঙ্গিত একের পর এক দিয়ে গেছি।

আমি অকপটে স্বীকার করছি, রূপসি যুবতিদের প্রতি আমার মনে অস্বাভাবিক দুর্বলতা রয়েছে। আর এর জন্য আমার অবশ্যই শাস্তি হওয়া দরকার।

বুড়িটা আমার বন্ধু ট্যালবটের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে মতলব এঁটেছে। গভীর ষড়যন্ত্রও বলা চলে। বুড়ির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার ভয়েই ট্যালবট ইচ্ছে করেই শহর থেকে কেটে পড়েছে।

পথের মাঝে দাঁড়িয়ে যে তিন বন্ধু পঞ্চমুখে রূপসি বিধবা ম্যাডাম ল্যানাডের রূপ সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছিল–এ ক্ষেত্রেও তারা অল্পবয়সী মেয়েটার কথাই বুঝেছিল।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, দিনের আলোয় কোনোদিনই বুড়িকে কাছ থেকে দেখা সম্ভব হয়নি। আরও বড় কারণ হচ্ছে আমি চোখে চশমা কোনোদিনই ব্যবহার করিনি। এ বস্তুটার প্রতি বরাবরই আমার অনীহা, কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারি না। তাই তো পাশাপাশি বসেও বুড়ির বয়স সম্বন্ধে কোনোদিনই কোনোরকম ধারণা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

এবার গানের আসরের কথা বলছি। গানের আসরে ম্যাডাম ল্যানাডের নাম যখন ঘোষণা করা হল, তখন অল্পবয়সী মেয়েটাই পিয়ানোর সামনে বসে দিব্যি সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে সবাইকে মোহিত করে দিল। আসলে তো গানটা বুড়ি গায়নি, গেয়েছিল ম্যাডাম স্টিফনি ল্যানাড।

আই-গ্লাসটা কেন আমাকে উপহার দেওয়া হল, তাই না? এটা প্রবঞ্চনা আর একটা কারসাজি ছাড়া কিছুই নয়। বুড়ি সেটার কাঁচ বদল করে আমার চোখের উপযুক্ত করে রেখেছিল যাতে সেটা চোখে লাগানো মাত্র ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। আমি যে একটা পয়লা নম্বরের আহাম্মক, এবার আমি নিজেই সেটা আবিষ্কার করে ফেললাম।

এবার বিয়ের নামে ছেলেখেলার ব্যাপারটা সম্বন্ধে দু-চার কথা বলা যাক। যে পাদরী বাড়ির পোশাকের সঙ্গে আমার পোশাকের যে নিছক একটা গিট মেরে রসিকতা করেছিল। সে তো আসলে ট্যালবটের প্রাণের বন্ধু। হতচ্ছাড়াটা অবশ্যই পাদরি নয়। গাড়ি চালায়।

বিয়ের নামে বিটলেমিটা শেষ করেই ইয়া লম্বা একটা আলখাল্লা গায়ে চাপিয়ে নিজেই গিয়ে গাড়ির কোচবাক্সে বসে। গাড়ি হাঁকিয়ে আমাদের নিয়ে যায় শহর থেকে দূরে, বহু দূরের এ-সরাইখানায় নিয়ে হাজির করে নতুন বর-বউকে।

হতচ্ছাড়া ট্যালবট কোচবাক্সে, চালকের পাশেই ঘাপটি মেরে বসেছিল। সে নাকি পিছন দিককার ছোট্ট জানালাটা দিয়ে আমাদের সব কাণ্ডকারখানার ওপর নজর রেখেছে আর হেসে অনবরত গড়াগড়ি খেয়েছে।

যাক গে, আমি তো আর আমার ঠাকুমার মায়ের মাকে বিয়ে করিনি। এ-মুহূর্তে এটুকুই আমার সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা। আমি বিয়ে তো করেছি, ম্যাডাম স্টিফেনি ল্যানাডেকে। যদিও হাবভাব দেখে মনে হয় না, বুড়ি কোনোদিন কেঁসে যেতে পারে। আর যদি নেহাৎ দুনিয়া থেকে কোনোদিন বিদায় নেয়-ই তবে তার পর্বত প্রমাণ টাকা পয়সার মালিক তো অবশ্যই আমি হব। কারণ, সেগুলো তো আমার হকের পাওনা।

তবে একটা কথা বলে রাখছি, প্রেমপত্র লেখার পোকাগুলোকে মাথা থেকে ঝেটিয়ে বিদায় করেছি। আর চশমাকেও কোনোদিন প্রশ্রয় দিয়ে নাকে তুলব না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *