1 of 2

দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার

দ্য সিস্টেম অব ডক্টর টার অ্যান্ড প্রফেসর ফেদার

আঠারো মাস।

সে বছরের হেমন্তকালে ফরাসিদেশের একেবারে দক্ষিণ অঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় আমার সমুদ্র-যাত্রাপথের মাইল কয়েকের মধ্যেই একটা পাগলাগারদ পড়ে। বেসরকারি পাগলাগারদ।

আমি যখন প্যারিস শহরে বসবাস করছিলাম তখন ডাক্তার বন্ধুরা আমাকে ওই পাগলাগারদটা প্রসঙ্গে গল্পচ্ছলে অনেক কথাই বলেছিলেন।

সত্যি বলছি, এমন গঠনশৈলীসন্ন আর একটা বাড়ি ইতিপূর্বে কোথাও আমার চোখে পড়েনি। সে কারণেই আমি ভাবলাম, হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও এমন একটা সুযোগ হাতছাড়া করা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

এক ভদ্রলোক ছিলেন আমার সফরের সঙ্গী। তিনি আমার মাত্র দিন কয়েকের পরিচিত।

এক সকালে কথা প্রসঙ্গে তার কাছে প্রস্তাব করলাম–চলুন না, ঘণ্টাখানেকের জন্য একটু ঘুরে আসি।

ভদ্রলোক ভ্রূ কুঁচকে বললেন–ঘুরে আসতে চাইছেন? কিন্তু কবে, কোত্থেকে?

চলুন, পায়ে পায়ে গিয়ে পাগলাগারদটা দেখে আসি গে।

আমার প্রস্তাবটাকে তিনি সানন্দে গ্রহণ করতে পারলেন না। সময়ের অভাব আর একটা পাগলের সঙ্গে সাক্ষাতের স্বাভাবিক ভীতির অজুহাত খাড়া করে তিনি অসম্মতি জানালেন। তবে আমার আগ্রহ কৌতূহলকে দমন করার চেষ্টা না করে কোনোরকম বাধা না দিয়ে ভদ্রলোক আমার কাছে প্রস্তাব রাখলেন–ভালো কথা, আমি একা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাব, যাতে আজ বা আগামীকালই আপনি আমাকে ধরে ফেলতে পারেন, কী বলেন?

হুম!

এতে আমার কাজটাও মিটবে আর সে সঙ্গে আপনার কৌতূহলও নিবৃত্ত হবে, ভালো প্রস্তাব নয়?

তিনি যাত্রা করার পূর্ব মুহূর্তে আমি বললাম–সে বাড়িটায় প্রবেশাধিকার পাওয়ার ব্যাপারে কোনো সমস্যা দেখা দিতে পারে, অনুমান করে আমি একটু ভয়ই পাচ্ছি, যদি ঢুকতে না দেয়।

হ্যাঁ, প্রবেশাধিকার পাওয়ার ব্যাপারে ভয় তো একটু-আধটু আছেই। সেখানে যাকে তাকে যখন তখন ঢুকতে দেওয়া হয় না। দেখুন, ওই পাগলাগারদের সুপারিনটেন্ডেন্ট মি. মেলার্ডের সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয় না থাকলে, বা কোনো পরিচয়পত্র না থাকলে সেখানে প্রবেশাধিকার পাওয়ার সমস্যা তো আছেই।

কিন্তু–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই বন্ধুবর নিজেই আবার বলতে আরম্ভ করলেন–আপনি সরকারি হাসপাতালের কথা আপনি নিশ্চয়ই বলতে চাইছেন? দেখুন, সরকারি হাসপাতালের নিয়ম-কানুনের তুলনায় বেসরকারি পাগলাগারদের নিয়ম-কানুন অনেক, অনেক বেশি কঠোর। মুহূর্তের জন্য তিনি আবার মুখ খুললেন একটা কথা, সেখানকার সুপারিনটেন্ডেন্টের, মানে মি. –মেলার্ডের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়-খাতির রয়েছে।

তবে তো কোনো সমস্যাই নেই ভাই! আমি সোল্লাসে বলে উঠলাম। পাগলাগারদের সদর দরজা পর্যন্ত গিয়ে মি. মেলার্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারি।

আমি মুচকি হেসে বললাম–যদি সদর দরজা পর্যন্তই কষ্ট করে যাবেন তবে আর ভেতরে ঢুকে কিছু সময় ঘুরে ঘুরে সেখানকার ব্যাপার দেখে আসতে অসুবিধা কোথায়? বুঝতে পারছি না।

ভদ্রলোক আমতা আমতা করে বললেন–সত্যি কথা বলতে কি ওই উন্মাদ রোগটা মানে পাগলদের আমি খুবই ভয় করি। তাই আমি ভেতরে কিছুতেই ঢুকতে চাচ্ছি না।

আমরা সদর রাস্তা ধরে এগিয়ে এক সময় বাঁক ঘুরে সরু একটা রাস্তা ধরলাম। সে রাস্তাটা ধরে আমাদের গাড়িটা এগিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই পর্বতের পাদদেশের গভীর জঙ্গলে প্রবেশ করল।

জঙ্গলের ভেতরের এক পেশে পথ ধরে গাড়িটা প্রায় দুঘণ্টা এগিয়ে যাওয়ায় একটা বাড়ি আমাদের নজরে পড়ল।

আমার সঙ্গী ভদ্রলোকটি ওই বাড়িটার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে বললেন–ওই যে, ওইটাই মাই দ্য মতে পাগলাগারদ।

অদ্ভুতদর্শন একটা গ্রাম্যবাড়ি। বাড়িটা এতই জীর্ণ যে-ভাঙা না হলেও আধ-ভাঙা তো অবশ্যই বলা চলে। দীর্ঘদিন অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকার ফলে আজ নিতান্তই বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

দূর থেকে বাড়িটার হাল দেখেই আমার বুকের মধ্যে রীতিমত ঢিবঢিবানি শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম, খুব হয়েছে, আর এগিয়ে দরকার নেই। তার চেয়ে বরং ঘোড়ার লাগাম টেনে গাড়িটা দাঁড় করাই। আর মুহূর্তমাত্র দেরি না করে বাড়ির পথ ধরি।

তবে এও সত্য যে, পরমুহূর্তেই নিজের অবাঞ্ছিত ভীতি ও মানসিক দুর্বলতার জন্য লজ্জিত হলাম। আবার ঘোড়ার লাগাম ঢিলে দেওয়ায় গাড়িটা ওই বুকে কাঁপন ধরানো বাড়িটার দিকে এগিয়ে চলল। সদর দরজার কাছে পৌঁছে গাড়িটা দাঁড় করালাম। দরজাটা খোলা সামান্য ফাঁক। আর অদূরে বসে একটা ভদ্রলোক ভোলা দরজাটার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছেন।

গাড়িটাকে দাঁড়াতে দেখেই ভদ্রলোক তার আসন ছেড়ে উঠে ব্যস্তপায়ে এগিয়ে এলেন, গাড়ির খোলা-দরজা দিয়ে আমার সঙ্গি ভদ্রলোককে ভেতরে বসে থাকতে দেখেই অধিকতর ব্যস্ততার সঙ্গে এগিয়ে এসে তার সঙ্গে করমর্দন করলেন। তারপর তাকে গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে যাওয়ার জন্য অনুরোধ জানালেন। মি. মেলার্ডই আমাদের ভেতরে যাওয়ার জন্য সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। এক সুদর্শন মাঝ-বয়সী। ভদ্রলোক। পরনে সাবেকি আমালের পোশাক। মার্জিত আচার ব্যবহার। মুখে গম্ভীর ও কর্তৃত্বপরায়ণতার ছাপ সুস্পষ্ট। সব মিলিয়ে তিনি মর্যাদাসম্পন্ন এক ভদ্রলোক।

আমার সহযাত্রী বন্ধুটি সুপারিনটেন্ডেন্ট মি. মেলার্ডের সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর কোনোরকম ভূমিকার আশ্রয় না নিয়েই সরাসরি আমার অভিপ্রায়ের কথা তার কাছে ব্যক্ত করলেন।

মি. মেলার্ড আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন।

আমার সহযাত্রী বন্ধু-ভদ্রলোক মি. মেলার্ড আমার যাবতীয় দায়িত্বভার গ্রহণ এবং আমার থাকার ও ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখবার ব্যবস্থা করবেন প্রতিশ্রুতি আদায় করে তবেই সেখান থেকে ফিরে এলেন। ব্যস, সেটাই তার সঙ্গে আমার শেষবারের মতো দেখা। তারপর আর কোনোদিন কোনো পরিস্থিতিতেই তার সঙ্গে দেখা হয়নি।

আমার সহযাত্রী ভদ্রলোক বিদায় নিয়ে বাঁক ঘুরে দৃষ্টির বাইরে চলে গেলে সুপারিনটেন্ডেন্ট মেলার্ড আমাকে সাদর আমন্ত্রণসহ ভেতরে নিয়ে চললেন।

কয়েক পা এগিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন–যাকে বলে একেবারে ছিমছাম এক বসবার ঘরে ঢুকলেন। সেখানে চির পরিচায়ক যা-কিছু ছিল তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য, সুন্দর করে বাঁধানো বহু বই, শিল্পীর নিপুন তুলির টানে আঁকা মুল্যবান কিছু তৈলচিত্র, ফুল-সাজানো ফুলদানি আর কয়েকটা বাদ্যযন্ত্র।

ঘরের একধারে চুল্লিতে আগুন জ্বলছে। এক রূপসি তম্বী যুবতিকে পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইতে দেখা গেল। সে বেলিনির একটা গান তন্ময় হয়ে গেছে চলেছে।

আমি চৌকাঠ ডিঙিয়ে ঘরে পা দিতেই রূপসি যুবতিটা গান বন্ধ করে যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। ঠোঁটের কোণে ভালো-লাগা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে সে আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাল।

যুবতিটার কণ্ঠস্বর ক্ষীণ আর কথাবার্তা ও হাবভাবও একটু চাপা-ই বলা চলে।

আমি অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে তার মুখটাকে ভালোভাবে দেখে অনুমান করলাম, তার মুখজুড়ে বিষাদের কালোছায়া। বিরাজ করছে। তার গায়ে শোকের পোশাক। মুহূর্তের জন্য তার মুখটা দেখেই মনের কোণে শ্রদ্ধার উদ্রেক হলো, আগ্রহ উৎসাহের শিকার হয়ে পড়লাম, আর প্রশংসার আগ্রহ মনের গোপন কন্দর থেকে উঁকি দিতে লাগল। যুবতিটা তখনও করজোড়ে অভ্যর্থনার ভঙ্গিতে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল–আপনাকে আমাদের প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

মি. মেলার্ডের এ-প্রতিষ্ঠানটার কথা আমি বহুবার বহুলোকের মুখেই শুনছিলাম। এখানে সশরীরে এসে সবকিছু দেখার আগ্রহও আমার বহুদিনের। আজ তা পূর্ণ হতে চলেছে। আর এও শুনেছিলাম–এখানে প্রশমন পদ্ধতি চিকিৎসার মাধ্যমে রোগ নিরাময় করা হয়। এ-পদ্ধতিতে রোগীদের কোনোরকম শাস্তি ভোগ করতে হয় না। খুব কম সংখ্যক রোগীকেই ঘরে বন্ধ করে রাখা হয়, রোগীদের মর্জিমাফিক চলাফেরা করার সুযোগ দেওয়া হয়। তবে তাদের ওপর গোপনে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হয়। আরও আছে–রোগীদের বিশেষ পোশাক নয়, সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের খুশিমত পোশাক ব্যবহার করার বাধাও কিছু নেই।

এখানকার এসব ব্যবস্থাদির কথা মাথায় রেখেই আমি সতর্কতার সঙ্গেই বসার ঘরে অবস্থানতর মেয়েটার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে লাগলাম। কেন এরকম সতর্কতা অবলম্বন করেছি, তাই না? কারণ, যুবতিটা আদৌ সাধরণ কেউ, অর্থাৎ সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কিনা এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত হতে পারিনি।

সত্যি কথা বলতে কি, যুবতিটার চোখের তারা দুটো এমন অত্যুজ্জ্বল, রীতিমত জ্বলজ্বল করছে যার ফলে আমি প্রায় নিঃসন্দেহ হয়ে পড়েছি যে, তার মাথা সুস্থ স্বাভাবিক নয়। তাই আমি লাগাম টেনে রেখে, যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ধরতে গেলে সাধারণ ব্যাপার স্যাপার নিয়েই তার সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যেতে লাগলাম।

যুবতিটাও সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের মতোই আমার একের পর এক কথার জবাব দিতে লাগল।

কিন্তু উন্মাদ দশার তত্ত্বগত ব্যাপার-স্যাপারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের পরিচয় থাকার জন্য সুস্থ মস্তিষ্কের এসব প্রমাণ সম্বন্ধে আমার মনে তেমন আস্থা নেই। ফলে উপায়

দেখে আমি যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে বেছে বেছে আলাপ পরিচয় চালিয়ে যেতে লাগলাম। আমি তো ভালোই জানি, কোনোক্রমে ভুলচুক কিছু হয়ে গেলেই কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত হয়ে যাবে।

আমি যুবতিটার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় সারার সময় উর্দিপরা তকমা আঁটা এক কর্মী একটা ট্রে-তে কিছু ফল, অন্যান্য খাদ্যবস্তু আর মদ নিয়ে ঘরে ঢুকল। আমার সামনে, টেবিলের ওপর ট্রে-টাকে রাখল।

কথা বলার ফাঁকে আমি ট্রে-টা থেকে কিছু খাদ্যবস্তু তুলে নিলাম। আর কথার ফাঁকে ফাঁকে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে লাগলাম।

আরও দু-চারটি কথার পরই যুবতিটা আমার কাছ থেকে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যুবতিটা ঘরের চৌকাঠ ডিঙিয়ে সামনের বারান্দায় পা দিতে না দিতেই আমি গৃহকর্তা মি. মেলার্ডের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালাম।

আমার দৃষ্টির ইঙ্গিত বুঝতে পেরেই তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন–আরে, না মি., এ-আমার ভাইঝি। আমার পরিবারেরই একজন সদস্যা। আর বহুগুণে, গুণান্বিতাও বটে।

কিছু মনে করবেন না মি.। আমার অজ্ঞতাবশত সন্দেহ করার জন্য আমি যারপরনাই অনুতপ্ত, ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।

মি. মেলার্ড নীরবে মুচকি হাসলেন।

আমি এবার বললাম–আমি প্যারিস শহরে বসেই এ-সংস্থাটাকে পরিচালন ব্যবস্থার সুখ্যাতির কথা শুনেছি। আর এ-কারণেই হয়তো বা বুঝতে পারছেন নিশ্চয়ই–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই তিনি বলে উঠলেন–ঠিক আছে, ঠিক আছে–আর বলতে হবে না। বরং আমার দিক থেকেই আপনাকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করা দরকার। কারণ, আপনি যে এতক্ষণ ধরে প্রশংসনীয় জ্ঞান ও বিবেচনার পরিচয় দিয়ে চলেছেন তাতে আপনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

আমি সঙ্কোচে ঠোঁটের কোণে ছোট্ট করে হাসির রেখা ফুটিয়ে তুললাম।

মি. মেলার্ড পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলে চললেন–একটা কথা কি জানেন মি.? আজকালকার যুবকদের মধ্যে এমন বিবেচনাবোধ সচরাচর চোখেই পড়ে না।

দেখুন, সত্যি কথা বলতে কি, আমি পূর্বে অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতাম। তখন রোগিদের মেজাজ মর্জিমাফিক চলাফেরা করার অবাধ স্বাধীনতা দিতাম। তখন যে-সব উৎসাহি এ-আশ্রম দেখতে আসত তাদের মধ্যে জন কয়েকের সুযোগের অপব্যবহারের জন্য রোগীদের মধ্যে ভয়ানক অসন্তোষ, বলতে পারেন উত্তেজনার সঞ্চার ঘটত। তাই নিতান্ত অনন্যোপায় হয়েই আমাকে আশ্রমে প্রবেশাধিকারের ব্যাপারে কঠোরতা অবলম্বন করতেই হয়েছে। আমার মনের কথা বলছি, যে-সব। দর্শকের বিবেচনাবোধের ওপর আস্থা রাখতে পারি না, তাদের এখানে প্রবেশাধিকার। দেওয়া হয় না, কিছুতেই না।

আমি ভ্রূ কুঁচকে বললাম–মি. মেলার্ড, পূর্বে অন্য পদ্ধতি অবলম্বন করতেন, বলতে আপনি কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন? সম্প্রতি আপনি কী এখানকার পদ্ধতির পরিবর্তন করেছেন।

অবশ্যই।

তবে কি আপনি এটাই বোঝাতে চাইছেন যে, বর্তমানে আপনি প্রশমণ পদ্ধতিটা বাতিল করে দিয়েছেন?

হ্যাঁ।

কতদিন?

বেশ কয়েক সপ্তাহ যাবৎ আমরা প্রশমণ পদ্ধতিটা চিরদিনের জন্য বাতিল করে দিয়েছি। তা ছাড়া উপায়ও কিছু ছিল না, আপনাকে তো খোলাখুলিই বললাম।

আমি কপালের চামড়া পর পর কটা ভাঁজ এঁকে সবিস্ময়ে বললাম–সত্যি বলছেন, মি. মেলার্ড!

চাপা দীর্ঘশ্বাস ঘরময় ছড়িয়ে দিয়ে তিনি বললেন–আপনাকে আমার মনের কথাই বলছি মি., আগেকার পদ্ধতিটা আবার প্রয়োগ করা আমি আর প্রয়োজন বোধ করছি না। প্রশমন পদ্ধতির সমস্যাগুলো সর্বদাই ছির, আর তার সুযোগ, সুবিধার কথা ফলাও করে প্রচার করা হতো। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ-আশ্রমে সে পদ্ধতিটার পরীক্ষা নিরীক্ষার যথেষ্ট সুযোগ দেয়া হয়েছে, মিথ্যা নয়। বিবেকসম্মত যাবতীয় কাজই আমরা করেছি, খুবই সত্য।

মুহূর্তে সময় থেমে তিনি আবার সরব হলেন–মি., কিছুদিন আগে যদি আপনি এ আশ্রমে পদার্পণ করতেন, তবে আমাদের তখন প্রচলিত ব্যবস্থাদি নিজের চোখেই দেখতে পেতেন। সবকিছু দেখে শুনে বিচার-বিশ্লেষণও করতে পারতেন। আমার বিশ্বাস, প্রশমন পদ্ধতির যাবতীয় বিষয়ই আপনার ভালোই জানা আছে ঠিক বলিনি?

আমি আমতা আমতা করে বললাম কিছু কিছু জানি ঠিকই, কিন্তু সব অবশ্যই নয়। আসলে আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, পুরোটাই তৃতীয় বা চতুর্থ পক্ষের কাছ থেকে শোনার মাধ্যমে। মোদ্দা কথা, সবই পরোক্ষভাবে।

মি., প্রশমন পদ্ধতি সম্বন্ধে আপনাকে অল্প কথায় কিছু বলছি। আশা করি তাতে পদ্ধতিটা সম্বন্ধে মোটামুটি ধারণা নিতে পারবেন। তখন আমরা রোগীর পাগলামির প্রশ্রয় দিয়েই তার রোগ নিরাময়ের জন্য চিকিৎসা চালাতাম। উদাহরণস্বরূপ এখানে এমন অনেকেই আসতেন, নিজেদের যারা মুরগিশাবক জ্ঞান করতেন। তাকে পুরোপুরি মুরগি শাবক জ্ঞান করাই ছিল আমাদের চিকিৎসার ধরণ। যেমন মনে করুন, একটা সপ্তাহ রোজ তাকে স্রেফ মুরগির আধারই খেতে দেওয়া হতো। অন্য কিছুই নয়। এতে আমরা যে ফল পেয়েছি, তা বাস্তবিকই অবাক হবার মতোই বটে।

ব্যস, এটুকুই?

অবশ্যই না। হালকা ধরনের আনন্দ–যেমন ধরুন, নাচ-গান বাজনা, তাস খেলা, বিশেষ বিশেষ কিছু বই পড়া আর শারীরিক কসরৎ প্রভৃতির ওপর আমাদের খুবই আস্থা ছিল। আমাদের দৃষ্টিতে সবাই ছিল সাধারণ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি। ভুলেও কারো সম্বন্ধে পাগল বা উন্মাদ কথাটা অবশ্যই প্রয়োগ করতাম না।

আর কিছু?

হ্যাঁ, আরও আছে। আমাদের চিকিৎসাপদ্ধতির একটা বিশেষ দিক ছিল, এক পাগলকে অন্য আর এক পাগলের পাহারায় নিযুক্ত করতাম।

আমি চোখ দুটো কপালে তুলে বলে উঠলাম–সে কী অবিশ্বাস্য কথা শোনাচ্ছেন মি.! এক পাগল অন্য পাগলকে পাহারা দিত!

আরে, একটা পাগলের বিবেচনাবোধের ওপর আস্থা রাখার অর্থই তো হচ্ছে, তার দেহ-মনকে পুরোপুরি জয় করে নেওয়া, বুঝছেন না? আর এতে বহু প্রহরীর খরচও তো কমে যেত, তাই না?

আপনাদের চিকিৎসা-ব্যবস্থায় কোনোরকম শাস্তিদানের ব্যবস্থাই ছিল না?

না, মোটেই না।

রোগীদের খুপড়ির মধ্যে আটকে রাখা–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. মেলার্ড আবার বলতে আরম্ভ করলেন–হ্যাঁ, কখন সখন রাখতে হতো বৈকি কারো পাগলামি যদি সিমা ছাড়িয়ে যেত, রোগীর বিকার অত্যাধিক বেড়ে গেলে অন্য রোগীর মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে তাকে তখনই গোপন ঘরে চালান দেয়া হতো। আর প্রয়োজন মনে করলে তাকে সেখান থেকেই সরকারি হাসপাতালে বদলির ব্যবস্থা করা হতো।

সম্প্রতি আপনারা সে সব ব্যবস্থা সবই বদলে দিয়েছেন, এই তো? আপনারা কী বিশ্বাস করেন, মঙ্গলের জন্যই সে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?

অবশ্যই। অতীতের পদ্ধতিতে গলদ, অসুবিধা অনেকই ছিল, বিপদও ছিল কম নয়। আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, সম্প্রতি ফরাসি দেশের সব পাগলাগারদেই সে পদ্ধতি বন্ধ করে–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই আমি বলে উঠলাম–মি. মেলার্ড, আপনার বক্তব্য আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করেছে। আমার কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয় ছিল, সম্প্রতি দেশের কোনোঅংশেই পাগলদের চিকিৎসার অন্য কোনো চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে না।

মি. আপনি আজও যৌবনের চৌকাঠ পেরোতে পারেননি। এক সময় আপনার জীবনে এমন সময় আসবে যখন অন্যের চটকদার গল্পের ওপর আস্থা না রেখে পৃথিবীর কোথায় কী ঘটে চলছে, আপনার নিজের পক্ষেই উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।

হুম!

আমার এ-কথাটা মনে রাখবেন, অন্যের মুখ থেকে শোনা-কথার ওপর কিছুমাত্রও আস্থা রাখবেন না। আর যা নিজের চোখে দেখবেন, তার পুরোটা নয়, মাত্র অর্ধেকটা বিশ্বাস করে অবশিষ্টটুকু কেটে হেঁটে বাদ দিয়ে দেবেন, বুঝলেন? আপনার কথাবার্তা আমাকে এ-কথাই ভাবতে উৎসাহিত করছে যে, আমাদের আশ্রম সম্বন্ধে কিছু ভ্রান্ত ধারণা মাথায় নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছেন।

আমি, মানে–

এখন এসব প্রসঙ্গ ছাড়ান দিন। আপনি দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ক্লান্ত। আহারাদি সেরে বিশ্রাম করুন। তারপর আমি নিজে সঙ্গে করে আশ্রমের সবকিছু দেখাব। এমন একটা চিকিৎসা-পদ্ধতি আপনাকে দেখাতে পারব যা আমার বিশ্বা, আর অন্য যত মানুষ এ কর্মকাণ্ড দেখেছেন তাদেরও বিশ্বাস, আজ পর্যন্ত যত পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়েছে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। আমার মুখের কথা নয়। নিজের চোখে সবকিছু দেখে তবেই বিচার বিশ্লেষণ করবেন, কেমন?

আপনি যে পদ্ধতির কথা বলছেন তার আবিষ্কারক কী আপনি নিজেই?

হ্যাঁ, আমিই বটে। পুরোটা না হলেও একটা বড় অংশের আবিষ্কার তো অবশ্যই। আর এটাও স্বীকার করতে আমি মনে প্রাণে গর্বিত।

মি. মেলার্ডের সঙ্গে একনাগাড়ে এক বা দুঘণ্টা কথাবার্তা বললাম। আর এ অবসরে তিনি সেখানকার কাঁচের কক্ষ আর বাগান আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন।

তিনি এক সময় আমাকে নিয়ে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর বললেন–মি., এ-মুহূর্তে আমার পক্ষে রোগীদের দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। আগে আহারাদি করে একটু শক্ত হয়েনিন। তারপর আপনার বাঞ্ছা পূর্ণ করা যাবে, কী বলেন?

আমি ঘাড় কাৎ করে তার প্রস্তাবে সম্মতি জানালাম।

ছটার সময় নৈশভোজের জন্য গৃহকর্তা মি. মেলার্ড বড়সড় একটা ঘরে আমাকে নিয়ে হাজির হলেন। আমরা ছাড়া আরও পঁচিশ-ত্রিশজন আগেই সে ঘরে উপস্থিত হলেন।

চারদিকে চোখ বুলিয়ে বুঝলাম, অতিথিদের কম করেও দুই তৃতীয়াংশই মহিলা। তাদের পোশাক পরিচ্ছদ দেখে বর্তমান প্যারিস শহরবাসী কিছুতেই সেগুলোকে রুচিসম্মত বলে স্বীকার করবে না। যেমন বয়স সত্তরের কম নয়, এমন বহু মহিলাই গায়ে প্রচুর গয়নাপত্র–ব্রেসলেট, আংটি, মাকড়ি চাপিয়ে দিব্যি সেজেছেন। আর সবারই বুক আর বাহু দুটো অস্বাভাবিক রকম খোলামেলা। কারো গায়েই মাপ অনুযায়ী পোষাক তৈরি করা হয়নি। সংক্ষেপে বললে, সবার পোশাক আশাকই কিছু না কিছু বৈচিত্রে ভরপুর। খাবার কামরাটা কিন্তু সাজানো গোছানো নয়।

তবে খাবার টেবিলগুলো যত্ন করে সাজানো হয়েছে। প্রচুর খাদ্য সমগ্রিতে থালাগুলো সাজানো হয়েছে আর থালার সংখ্যাও যথেষ্টই। ভদ্রতা বহির্ভূত প্রাচুর্যের দিকে আমার নজর পড়ল। এর আগে এত অপচয় কোথাও কোনোদিনই আমার চোখে পড়েনি।

আরও আছে, ব্যবস্থাদিতেও কিছুমাত্র সুরুচির স্বাক্ষর লক্ষিত হয় না। আমার চোখ দুটো হালকা আলোতেই অভ্যস্থ, আর এ ঘরের ঝাড়বাতি আর অগণিত মোমবাতি অত্যুজ্জ্বল আলোকচ্ছটা আমার চোখ দুটোকে ঝলসে দিতে লাগল।

কামরাটার এক কোণে সাত-আটজন একটা টেবিল ঘিরে বসে হরেকরকম বাদ্যযন্ত্রে এমন সব উদ্ভট সুর বাজিয়ে চলেছে, যাতে আমি ছাড়া উপস্থিত সবার মনেই। দোলা দিচ্ছে।

আমি ধীরে সুস্থে এগিয়ে গিয়ে মি. মেলার্ডের ডানদিকের একটা চেয়ার টেনে বসলাম। উপযুক্ত পরিমাণ খাদ্যবস্তু দিয়ে উদরপূর্তি করলাম।

ইতিমধ্যে আশপাশের টেবিলগুলোতে গল্প বেশ জমে উঠেছে দেখলাম। বুঝতে পারলাম, সবাই উচ্চশিক্ষিত। গৃহকর্তাও মাঝে-মধ্যে টুকরো টুকরো রসের কথা ছুঁড়ে দিয়ে আসরকে আরও জমিয়ে তুলতে লাগলেন।

আমি সবচেয়ে বেশি বিস্মিত হলাম, সবার কথাই পাগলামির প্রসঙ্গ নিয়ে। রোগীদের হরেকরকম খেয়াল নিয়ে চটকদার গল্প হচ্ছে আসরের আলোচনার বিষয়বস্তু।

আমার ডানদিকের চেয়ারটা দখর করে বসে বেটেখাট পেটমোটা এক ভদ্রলোক। তিনি প্রসঙ্গক্রমে বলে উঠলেন–এক সময় এখানে এমন একজন ছিল যে নিজেকে একটা চায়ের পাত্র জ্ঞান করত। এ উদ্ভট ভাবনাটা কিভাবে সে সব পাগলের মাথায় জাগে, সেটা কি খুবই অবাক হবার মতো নয়? সারা ফরাসি দেশ ঘুরে এলে দেখা যাবে এমন একটাও পাগলাগারদ নেই এমন একটা মানব-চায়ের পাত্র না মিলবে। আমাদের এখানকার লোকটা এমন এক চায়ের পাত্র ছিল, যে রোজ সকালে নিজেকে সাদা রং দিয়ে মাজা ঘষা করত।

আর বিপরীত দিকের চেয়ারে বসা ইয়া লম্বা লোকটা বলতে আরম্ভ করল–মাত্র কদিন আগেই তো এখানে একজন লোক থাকত, যে নিজেকে গাধা মনে করত। তবে। এও সত্য যে, রূপক অর্থে বিচারে করলে আপনারাও মেনে নেবেন, সে যথার্থ কথাই বলত। তবে লোকটা খুবই জেদি ছিল। তাকে বশে রাখতে আমাদের নাকের পানি আর চোখের পানি এক হয়ে যেত। দীর্ঘদিন ধরে ঘাস ছাড়া অন্য কিছুই তার আহার্য ছিল না। আর আমরাও তাকে ঘাস ছাড়া অন্য কিছু খেতে না দেওয়ায় তার গাধা রোগটা সেরে যায়। তবে তখন সে সর্বদা এরকম–এরকমভাবে লাথি চালাত। সত্যি অবাক হবার মতো কাণ্ডকারখানাই বটে।

গল্পকথকের ঠিক পাশের চেয়ারে বসে-থাকা মহিলা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলেন– মি. সিক, অনুগ্রহ করে ভালো আচরণ করাটা শিখুন। আপনার পা-টাকে সামলে সুমলে রাখুন। পায়ের ময়লা লাগিয়ে আমার বোকেটাই যে বরবাদ করে দিলেন! একটা কথা, যাকে কথার মাধ্যমে প্রকাশ করছেন তাকে কি এরকমভাবে বাস্তবভঙ্গিতে দেখানোর কোনো প্রয়োজন আছে বলে আপনি মনে করেন কী? আপনার বক্তব্যে এসব ছাড়া এমনিতেই সবাই বুঝতে পারবে বলেই আমি অন্তত মনে করছি। আমার মনে হয় সে ভাগ্যাহত লোকটি নিজেকে যেমন গাধা ভাবত, আপনি তো দেখছি তার চেয়ে কম বড় গাধা নন। তবে স্বীকার করছি, আপনি খুবই স্বাভাবিক অভিনয় করেছেন।

তার কথার জবাবে মি. ডি কক বললেন–মাদমোয়াজেল! মিলে পারদো। হাজারবার মার্জনা ভিক্ষা করে নিচ্ছ। আপনার মনে ব্যথা দেবার মতো ইচ্ছা আমার আদৌ ছিল না। মাদামোয়াজেল পাপ্লাস, আপনার সঙ্গে বসে মি. ডি কক একটু মদ খেতে পারলে নিজেকে সম্মানিত ভাববেন।

এবার মাদামোয়াজেল পাপ্লাসের সঙ্গে মি. ডি কক খুশিমনে করমর্দন সারলেন। তারপর উভয়ে মদের গ্লাস হাতে তুলে নিলেন।

এবার মাইস দ্য আমার দিকে সঁতের সুপারিনটেন্ডেন্ট মি. মেলার্ড নজর দিলেন। আমাকে লক্ষ করে বললেন–মি., আপনি রাজি থাকলে এই বাছুরের মাংসের একটা টুকরো আপনাকে খেতে দিচ্ছি, ভালো লাগবে।

তার কথা চলাকালীনই তিনটি গাট্টাগোট্টা যুবক পরিবেশক গোটা একটা বাছুর সেদ্ধ একটা বড়সড় থালায় চাপিয়ে, হাঁটুর ওপর তোলা-অবস্থায় বয়ে এনে দুম্ করে টেবিলের ওপর রেখে দিল।

আমি বি বিনয়ের সঙ্গে বললাম–আপনার নিখাদ আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানাতেই হয়। বিশ্বাস করুন, মনের কথা বলছি, বাছুরের মাংসের ওপর আমার কোনোরকম লিপ্সা নেই।

স্লান হেসে তিনি বললেন–তাই বুঝি?

হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমি বরং বাছুরের মাংসের পরিবর্তে সামান্য খরগোশের মাংস তুলে নিচ্ছি।

মি. মেলার্ড এবার পিয়ের নামধারী এক পরিচারককে ডেকে আমার সামনের বাছুরের মাংসের থালাটা তুলে নিয়ে এক থালা খরগোশের মাংস দিয়ে যেতে বললেন।

আমি সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলামনা, না এ-নিয়ে আপনি এত ব্যস্ত হবেন না। আমি বরং নিজেই শুয়োরের মাংস থেকে কিছুটা তুলে নিচ্ছি।

ব্যাপার স্যাপার দেখে আমি ভাবতে লাগলাম– এখানকার মানুষদের সঙ্গে এক। টেবিলে বসে কী যে খায় কে জানে! আমি তো এসবের কিছুই খাওয়ার জন্য উৎসাহি নই।

কুৎসিত, একেবারেই কুদর্শন একটা লোক টেবিলের পায়ের কাছে বসে পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে বলতে লাগল–নিজেকে কার্ডোভা পনির জ্ঞান করত এরকমই একজন এক সময় এখানে থাকত। সে সর্বদা একটা ছুরি হাতে নিয়ে ঘুরত। কোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলেই অনুরোধ করে বসত–আপনার পা থেকে এক টুকরো মাংস কেটে নেব?

পাশ থেকে একজন মন্তব্য করে উঠলেন আরে, ওটা তো একটা নিরেট আহাম্মক, মুখের শিরোমণি ছিল। আমি এমন একজনের কথা বলছি, তার জুড়ি খুঁজে পাবেন না। সে নিজেকে এক বোতল শ্যাম্পেন মনে করত। আর পথ চলার সময় হরদম হু হুস্ ফুস্ ফুস্ আওয়াজ করত। কী বিশ্রি ব্যাপার বলুন দেখি।

কথা বলতে বলতে লোকটা তার বাঁ দিককার গালের ওপর ডান হাতের বুড়ো আঙুলটা রেখে মুখ দিয়ে বোতলের ছিপি খোলার মতো আওয়াজ করে আঙুলটাকে দুম্ করে তুলে নিলেন। এর পর মুহূর্তেই জিভটাকে দাঁতের ওপর ঘষতে ঘষতে এমন অদ্ভুত দক্ষতার সঙ্গে শ্যাম্পেনের বোতলের মুখ দিয়ে ফেণা বেরিয়ে আসার ভঙ্গি নকল করে, মিনিট কয়েক ধরে অনবরত হুস হুস ফুসফুস আওয়াজ করতে আরম্ভ করলেন।

আমার নিশ্চিত ধারণা, লোকটার এরকম ব্যবহারে মি. মেলার্ডের মোটেই মনপুত নয়। তবে তিনি মুখে কিছুই প্রকাশ করলেন না।

এবার মাথায় ইয়া লম্বা পরচুলা চাপানো একটা বেটেখাট শুকনো লোক মুখ খুললেন–আর এক আহাম্মক এখানে থাকত, যে লোকটা নিজেকে একটা ব্যাঙ মনে করত। তবে এও সত্য যে, সে অবিকল ব্যাঙের মতোই দেখতে ছিল। ইস্! মি. তাকে যদি একবারটি চোখে দেখতে পেতেন, তবে আপনি নির্ঘাৎ অবাক তো হতেনই চোখ দুটো রীতিমত ছানাবড়া হয়ে যেত।

আমার মুখের দিকে তাকিয়ে এবার বলল–মি., সে লোকটা যে প্রকৃতই ব্যাঙ সেটা বড়ই পরিতাপের ব্যাপার। সে থেকে থেকে ঘ্যাঙর-ঘ্যাঙর আওয়াজ করে ডাকাকাকি করত। আর বললে বিশ্বাস করবেন না ভাই, লোকটা যখন দু-এক বোতল মদ সামনে রেখে টেবিলের ওপর দু-কনুইয়ে ভর দিয়ে বসত, মুখটাকে বার বার এভাবে ফাঁক করত। চোখ দুটোকে এভাবে এদিক-ওদিক ঘোরাত, খুবই ব্যস্ততার সঙ্গে মিট মিট করে তাকাত। আমি রীতিমত দৃঢ়তার সঙ্গে বলছি–তার প্রতিভা আপনাকে তাজ্জব বা নিয়ে দিত! আপনার চোখ ট্যারা হতোই হতো।

আমি সঙ্গে জবাব দিলাম–এ ব্যাপারে আমার এতটুকুও দ্বিধা নেই।

এবার কোন টেবিল থেকে কে যেন বলল–আরও ছিল। পেতিত মেলার্ড নামে এক অদ্ভুত চরিত্রের লোক ছিল। সে নিজেকে এক টিপ্ নস্যি ভাবত। তার সবচেয়ে বড় আক্ষেপ কি ছিল, জানেন মঁসিয়ে?

আমি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি মেলে তার দিকে নীরবে তাকালাম। সে এবার বলল–একটা আক্ষেপই তাকে সবচেয়ে বেশি করে মর্মাহত করত, আঙুল দুটোর ফাঁকে সে নিজেকে ধরে রাখতে পারত না।

আরও ছিল। জ্বলেস দেসুলিয়েরেস নামে একজন ছিল। তার মতো প্রতিভাবান সচরাচর দেখা যায় না। সে নিজেকে একটা কুমড়া ভেবে সর্বক্ষণ গুম হয়ে বসে থাকত। সে সর্বদা পাচককে জ্বালিয়ে খেত। বলত–আমাকে টুকরো-টুকরো করে কেটে কড়াইয়ে চাপিয়ে পাকসাক করে ফেল। তার ঘ্যানঘ্যানানিতে বিরক্ত হয়ে পাচক বেচারা তাকে দেখলেই দশ হাত তফাতে চলে যেত।

আমি চোখ-মুখে বিস্ময়ের ছাপ এঁকে বললাম–আপনার কথা শুনে আমি তাজ্জব বনে গেলাম! এও কি কখন হয়, নাকি হতে পারে!

পরমুহূর্তেই ঘাড় ঘুরিয়ে গৃহকর্তার দিকে তাকিয়ে বললাম–মি. মেলার্ড–

আমার দিকে দৃষ্টি না ফিরিয়েই তিনি অট্টহাসিতে একেবারে ফেটে পড়ার জোগাড় হলেন। তারপর বলে উঠলেন–চমৎকার! চমৎকার।

এবার আমাকে লক্ষ্য করে তিনি বললেন–আপনি কিন্তু মোটেই অবাক হবেন না মি.। আমার এ বন্ধুবর একজন সত্যিকারের রসিক। রসে একদম টইটম্বুর। মনে করতে পারেন, একজন কৃতি ভড়। দয়া করে ওর কথাগুলোকে যেন সত্যি বলে ভেবে বসবেন না।

উপস্থিত ভদ্রলোকদের মধ্য থেকে অন্য আর একজন মুখ খুললেন–বুফে লি এঁদ নামে আর একজন ছিল। তাকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ মনে করা যেতে পারে। ভালোবাসায় মজে যাওয়াই তার একেবারে গড়বড় হয়ে গিয়েছিল। সে ভাবত, তার কাঁধে দুটো মাথা রয়েছে। তার মধ্যে একটা ডেমোস্থিনিস-এর আর দ্বিতীয়টা সিসেরোর মাথা। তার বিশ্বাসটা যে ভ্রান্ত এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু আজব ব্যাপার হচ্ছে, সে আপনার মধ্যে বিশ্বাস স্থাপন করে তবেই রেহাই দিত যে, তার ধারণাটাই অভ্রান্ত।

আমি সিবস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে বলে চলল–আরে ঠিক তা-ই। আসলে সে যে একজন জবরদস্ত বক্তা ছিল। ধরুন, ভাষণ দিতে দিচ্ছে সে, একসময় তড়াক করে লাফিয়ে একেবারে খাবার টেবিলের ওপর দাঁড়িয়ে পড়ত। আরও আছে–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়ে তার পাশের বন্ধুটা তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কি যেন বলল। তারপরই সে আর একটা কথাও না বলে দুম্ করে নিজের চেয়ারটায় বসে পড়ল।

সে বসার পর তার পাশের বন্ধুটা এবার যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত খাড়াভাবে দাঁড়িয়ে পড়ল। সে বেশ জোর গলায়ই বক্তব্য রাখতে লাগল–বুলার্ড নামে আর একজন জাদরেল লোক ছিল। তাকে একটা লাটু মনে করতে পারেন।

লাট্টু বলার যুক্তিটা জানার কৌতূহল দমন করতে না পেরে আমি সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকলাম।

আমার কৌতূহলের গভীরতাটুকু অনুমান করতে পেরে বক্তা এবার বলল–তার ঘোরার প্রক্রিয়াটা দেখলে হাসতে হাসতে আপনার পেটে খিল ধরে যেত। লোকটা একটা গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে অদ্ভুত কায়দায় এক ঘণ্টা অনবরত ঘুরতে পারত। কথাটা বলেই সে গোড়ালির ওপর ভর দিয়ে ঘোরার কায়দাটা দেখাতে চেষ্টা করল।

এবার এক বৃদ্ধা গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে উঠল–আরে মি., ওনার কথা আর বলবেন না। ওই মি. বুলার্ড নামে লোকটা তো পাগল–বদ্ধ পাগল ছিল। আমি জিজ্ঞেস করছি, লাটুর কথা কে, কবে শুনেছে, বলতে পারেন? এক্কেবারে অবাস্তব একটা কথা! মাদাম জুরেস যে একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ ছিলেন, তা কার না জানা আছে, বলুন তো?

ভদ্রলোক একেবারে চুপসে গেল। বৃদ্ধার ধমক ধামক খেয়ে আর টু-শব্দটাও করতে পারল না।

বৃদ্ধা পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন–তবে মাদাম জয়েয়ুস-এরও একটা বিদঘুঁটে ধারণা ছিল, সহজবোধ্য, ছিল সেটা। তার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, একটা দুর্ঘটনায় তিনি একটা মোরগ ছানায় পরিণত হয়ে গেছেন। কিন্তু তার আচার আচরণে সামঞ্জস্যের ঘাটতি ছিল না। এবার হাত দুটো শরীরের দুদিকে ডানার মতো সোজাভাবে ছড়িয়ে দিয়ে বললেন–তিনি এভাবে অনবরত ডানা ঝটপটানির মতো হাত দুটোকে অনবরত নাড়িয়েই যেতেন। তার মুখে বার বার কুকুরকু-কুকুরকু আওয়াজ করতেন।

আমি লক্ষ্য করছি, গৃহকর্তা যেন রাগে ফুঁসছেন। এবার দপ করে জ্বলে উঠে তিনি বললেন–মাদাম, আপনি নিজের আচরণ শুধরে নিলেই আমি আনন্দিত হব। আপনাকে একজন মহিলার মতো স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। তা যদি না করেন তবে আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে যেতে বাধ্য হব, বলে দিচ্ছি–এবার আপনি যা ভালো। বোঝেন করুন।

এমন বয়স্কা এক মহিলাকে মাদাম সম্বোধন করায় আমি খুবই বিস্মিত হলাম।

যা-ই হোক, গৃহকর্তা মঁসিয়ে মেলার্ডের বক্তব্যে তার মুখটা টকটকে লাল হয়ে। উঠল। শরীরের সবটুকু রক্ত যেন তার মুখে এসে ভর করেছে। বুঝতে দেরি হলো না, তিনি খুবই মর্মাহত হয়েছেন। তিনি মুখ গোমড়া করে মেঝের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বসে রইলেন।

আমাদের পূর্ব পরিচিতা সেই রূপসি তন্বী যুবতিটা এবার আলোচনার সূত্রটি ধরে বলে উঠলেন–উফ! মাদাম জয়েয়ুস একটা বোকার হদ্দ বোকা! আমি ইউজেনি সালসাফেওর কথা কিছু শোনাতে চাই। তার কথাবার্তার মধ্যে সারপদার্থ বলে কিছু থাকত। সে একজন যথার্থই রূপসি–রূপ-সৌন্দর্যের আকর ছিল। আর সে ছিল মাত্রাতিরিক্ত বিনয়ী এক তম্বী যুবতি। আমরা যে পোশাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করি তা খুবই অশোভন, ভদ্র সমাজে অচল। তাই সে সব সময় এমন পোশাক পরিচ্ছদ পড়তে উৎসাহি ছিল যাতে নিজেকে পোশাকের বাইরে রাখতে পারে। আরে, কাজটা তো অনায়াসেই করা যেতে পারে। ধরুন না কেন প্রথম এভাবে, তারপর এভাবে–এভাবে আর এভাবে ব্যস।

একডজন গলা একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল–হায় ভগবান! মাদামায়ে সালসাফেও! এ আপনি করছেন কী! করছেন কী! খুব হয়েছে আর নয়! এবার থামুন, থামুন! আপনার বক্তব্য আমরা সবাই বুঝতে পেরেছি। এবার থামুন! আর দরকার নেই।

কথাগুলো চলাকালীনই জনকয়েক লোক চেয়ার ছেড়ে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে। মদময় জেল সালসাফেও মেডিসি ভেনাম মূর্তির রূপ ধারণ করার আগেই তাকে মাঝ পথে থামিয়ে দিল।

অন্য দিকে বহুকণ্ঠের আর্তনাদে কামরাটা যেন রীতিমত নরকের দক্ষিণ দুয়ারে পরিণত হয়ে গেল।

চারদিকে এমন ভয়ঙ্কর হৈ-হট্টগোল, আমার স্নায়ুর ওপর এতই চাপ পড়ল, যা সহ্য করা আমার পক্ষে রীতিমত কষ্টকর হয়ে উঠল। আমি নিজের কথা না ভেবে অন্য সবার কথা ভাবতে গিয়ে করুণায় অস্থির হয়ে পড়লাম।

সত্যি কথা বলতে কি, এক সঙ্গে এতগুলো সুবিবেচক মানুষের এমন করে ভয়ে মুষড়ে পড়ার দৃশ্য ইতিপূর্বে কোনোদিনই আমার চোখে পড়েনি।

আমি কামরাটার চারদিকে মুহূর্তের জন্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে লক্ষ্য করলাম, সবার মুখই চকের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। আতঙ্কে সবাই এমন মিইয়ে গেছে যে অনবরত থর থর করে কেঁপেই চলেছে।

ক্রমে চিৎকার চাঁচামেচি বন্ধ হতে হতে এক সময় একেবারে থেমে গেল। সবার মুখে আবার আগেকার স্বাভাবিকতা ফিরে এলো।

এবার আমি মনে সাহস সঞ্চয় করে আকস্মিক হৈ-হট্টগোলের কারণ কি জানতে চাইলাম। আমার মনের অবস্থাও অল্প-বিস্তর প্রকাশ করতে বাদ দিলাম না।

আমার মানসিক অবস্থার কথা বিবেচনা করে মি. মেলার্ড বললেন–মনে করতে পারেন এটা একটা বাগাটেলি খেলা ছাড়া আর কিছুই নয় না। দেখুন মি., এসব ব্যাপার আমাদের গা-সহা হয়ে গেছে। এখন আর এসব নিয়ে মোটেই ভাবি না। এখানকার পাগলগুলো প্রায়ই একাট্টা হয়ে এ রকম হামলা-হুঁজ্জতি করে থাকে। রাতে রাস্তার কুকুরগুলোর ডাকের মতোই একজন আর একজন ক্ষেপা।

মুহূর্তের জন্য থেমে আমার মানসিক অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করে তিনি আবার মুখ খুললেন–দেখুন মি., তবে মাঝে-মধ্যে কনসার্টের মতো চিল্কারের পর সবার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা জেগে ওঠে। কিন্তু তখন যে কিছু কিছু বিপদের আশঙ্কা দেখা দেয় না তাও বলা যায় না।

আমি নিজেকে একটু সামলে সুমলে নিয়ে বললাম–মি. মেলার্ড, এখানে আপনার তত্ত্বাবধানে কজন আছে, অনুগ্রহ করে বলবেন কী?

এখন দশজনের বেশি নয়।

অধিকাংশই হয়তো মহিলা, তাই না?

আরে না। সবাই পুরুষ। আর শক্ত সাবুতও বটে।

হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। আমার ভালোই জানা ছিল যে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদেরই মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে।

হ্যাঁ, কথাটা আংশিক সত্য বটে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আপনার কথাই খাটে সত্য। কিন্তু সব সময় নয়। কিছুদিন আগে এখানে সাতাশটা রোগী ভর্তি ছিল। সাতাশটার মধ্যে আঠারো জনই মহিলা ছিল। কিন্তু সম্প্রতি যে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটেছে তা তো নিজের চোখেই দেখছেন, কী বলেন?

হ্যাঁ, তা অবশ্য দেখতে পাচ্ছি।

মাদামোয়াজেলকে যে ভদ্রলোক লাথি দিয়েছিলেন সে ভদ্রলোক হঠাৎ আগবাড়িয়ে বলে উঠলেন–ঠিকই তো, নিজের চোখেই তো দেখতে পাচ্ছেন মি.।

তার কথা শেষ হতে-না-হতেই উপস্থিত সবাই সমস্বরে বলে উঠল–শতকরা একশো ভাগই সত্যি। নিজের চোখেই তো দেখছেন।

গৃহকর্তা মি. মেলার্ড রেগে একেবারে অগ্নিশর্মা হয়ে উঠে বললেন–ওটা হচ্ছে কী শুনি? আপনারা সবাই নিজের নিজের জিভটা টেনে ধরুন।

ব্যস, মিনিটখানেক আর কারো মুখে টু-শব্দটিও নেই। এতবড় কামরাটায় একেবারে কবরখানার নীরবতা নেমে এলো।

একজন মহিলাই কেবল গৃহকর্তা মেলার্ডের হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। তিনি ইয়া লম্বা জিভটাকে বের করে হাতদিয়ে শক্ত করে চেপে ধরলেন।

আমি মি. মেলার্ডের কানের কাছে মুখ নিয়ে অনুচ্চকণ্ঠে, প্রায় ফিসফিসিয়ে বললাম আর আমাদের যিনি একটু আগেই ক-এ ডুডল্‌ শোনালেন, তিনি নিশ্চয়ই খুবই নিরীহ নম্র স্বভাব তাই না?

মি. মেলার্ড সবিস্ময়ে আমার কথার জবাব দিলেন নিরীহ, নম্র স্বভাব? কেন? এ-কথা কেন বলছেন মি.।

মানে, ব্যাপারটা হচ্ছে, আঘাতটা খুব অল্পই লেগেছে। মনে করা যেতে পারে তিনি তেমন কিছু আহত হননি।

হায়। এসব কী ভাবছেন আপনি। ধ্যুৎ! এসব চিন্তা-ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে মুছে ফেলে দিন। তিনি আমার দীর্ঘদিনের পরিচিতা। আর মাদাম জয়েসুস সম্পূর্ণ সুস্থ। তিনি আমার মতোই একজন সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষ। তবে তার বাতিক যে একটু আধটু আছে, অস্বীকার করা যাবে না। আর আপনার তো আর অজানা নয়। সব বৃদ্ধ মহিলারই কম-বেশি বাতিক থাকেই থাকে।

অবশ্যই অবশ্যই। আর এখানকার অন্যসব ভদ্রলোক ও ভদ্রমহিলা সম্বন্ধে আপনার–

আমাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে মি. মেলার্ড গর্বের সঙ্গে বলে উঠলেন–আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু আর সব বন্ধু, আর সহকারীও বটে।

কী? কী বললেন? সবাই? এখানকার মহিলারা আর সবাই কী–

আমাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই মি. মেলার্ড বলে উঠলেন অবশ্যই। মহিলাদের সাহায্য সহযোগিতা না থাকলে কি আর এ ধরনের কাজকর্ম চলে, আপনিই বলুন? আমি তার কথার কি উত্তর দেব মুহূর্তের মধ্যে গুছিয়ে উঠতে না পেরে মৌনই রইলাম।

মি. মেলার্ড পূর্ব প্রসঙ্গের জের টেনে এবার বললেন–আরে বলেন কী মি.। মহিলারই তো পৃথিবীর পাগলের নার্সদের মধ্যে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি, আর সেরাও বটে।

কিন্তু কেন?

মহিলাদের নিজস্ব যেসব সুবিধা আছে তার মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তাদের উজ্জ্বল চোখ দুটো আশ্চর্য কাজ করার ক্ষমতা রাখে, ঠিক যেন সাপের ওপরে কাজ করার ক্ষমতা রাখে, আপনাকে বোঝাতে পেরেছি কী?

অবশ্যই! অবশ্যই! কিন্তু তাদের ব্যাপার স্যাপার যেন একটু কেমন মানে অন্য ধরনের, ঠিক কি না? আমি অদ্ভুত কথাটা ব্যবহার করতে চাইছি আপনি কি স্বীকার করেন না?

কেমন ধরনের? অদ্ভুত? অদ্ভুত? কেন? আপনার এ-রকমটা মনে হওয়ার কারণ জানতে পারি কী? আমরা, মানে দক্ষিণের মানুষরা অন্য অঞ্চলের মতো মোটেই সাবধানী নই। আমরা সব সময় খেয়াল করি বুঝলেন মি.?

চমৎকার! মঁসিয়ে মেলার্ড, এবার বলুন তো, আপনারা যে এখানে প্রশমন পদ্ধতির পরিবর্তে যে পদ্ধতিটা আরোপ করেছেন সেটা কি খুবই কঠোর? মানে প্রশমন। পদ্ধতির চেয়ে–

না, অবশ্যই কঠিন না তবে খুবই সত্য যে, আমাদের আটকে রাখা ব্যাপারটাকে কঠোর বলে স্বীকার না করলে সত্য গোপনই করা হবে। তবে ডাক্তারি চিকিৎসা রোগীরা কিন্তু খুবই পছন্দ করে।

আর একটা কথা আপনার কাছে রাখতে চাচ্ছি, যদি অনুমতি করেন—

এ নতুন পদ্ধতিটার আবিষ্কারক কী আপনি নিজেই?

আংশিক বলতে পারেন, সম্পূর্ণটা অবশ্যই নয়।

অবশিষ্ট অংশ।

অবশিষ্টাংশের আবিষ্কারক অধ্যাপক টার্থার। আশা করি তার কথা আপনার অবশ্যই জানা আছে? আমাকে নীরব দেখে তিনিই এবার বললেন–এ ছাড়া আমার পরিকল্পনার অংশবিশেষ সংশোধন করে নেয়া হয়েছে। আমি আনন্দের সঙ্গে স্বীকার করছি, প্রখ্যাত ফেদার যেগুলো করেছেন আর তার সঙ্গে তো আপনার ঘনিষ্ট সম্পর্ক রয়েছে, ঠিক কি না?

দেখুন মি. মেলার্ড, খুবই লজ্জার সঙ্গে স্বীকার করে নিচ্ছি, আপনার উল্লেখিত ভদ্রলোক দুজনের মধ্যে কারো সঙ্গেই আমার পরিচয় তো নেই, এমন তাদের নামও কোনোদিন শুনিনি। অবাক হলেন?

গৃহকর্তা মি, মেলার্ড তড়াক করে লাফিয়ে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। দু বাহু উধ্বে তুলে প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন–হায় ভগবান! আমি নিশ্চয়ই এ কথাটা ঠিক ঠিকভাবে আমার কানে ঢোকেনি, শুনিনি। ভাই আপনি তো নিশ্চয় এ-কথা বলেননি, আপনি বিখ্যাত অধ্যাপক ফেদার আর ডাক্তারটার নামও কোনোদিন শোনেন, ঠিক কি না?

আমি তার কথার জবাব দিতে গিয়ে বললাম–দেখুন ভাই মেলার্ড, আমার অজ্ঞতাকে আমি স্বীকার না করে পারছি না। কিন্তু সত্য তো সবার শীর্ষে অবস্থান করছে তাই না? সত্যকে জিইয়ে রাখা অবশ্য কর্তব্য। তা সত্ত্বেও দুজন অনন্য ব্যক্তিত্বের কার্যকলাপের সঙ্গে আমার পরিচয় না থাকার জন্য লজ্জায় এতটুকু হয়ে যাচ্ছি। অন্তরে আগ্রহ পোষণ করছি, যত শীঘ্র সম্ভব তাদের লেখা অমূল্য গ্রন্থগুলো সংগ্রহ করে আমার অজ্ঞতাকে দূর করতে যে সাধ্যমত প্রয়াসী হব, এতে কিছুমাত্র দ্বিধা নেই।

হুম!

মি. মেলার্ড, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আপনার প্রশ্নে আমি যারপরনাই লজ্জিত হয়েছি। এবার আমরা পানীয়ের মাধ্যমে সতেজ হয়ে নেয়ার জন্য শ্যাম্পেনের গ্লাস হাতে তুলে নিলাম। আমাদের দেখাদেখি উপস্থিত অন্যানরাও মদের গ্লাসে চুমুক দেয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

ভাই মেলার্ড আর আমি দুজন দুবোতল মদ সামনে নিয়ে গলা ছেড়ে আলোচনা চালাতে লাগলাম। ঘরের অন্যান্যরা কিন্তু মদের গ্লাস হাতে নিয়ে এমন হৈ-হট্টগোল শুরু করে দিল যে, আমরা কেউ-ই কারো কথা শুনতে পাচ্ছি না।

মি. মেলার্ডের কানের কাছে মুখটাকে এগিয়ে নিয়ে আমি গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম–মি. মেলার্ড, একটু আগে আপনার মুখে প্রশমণ পদ্ধতির বিপদের কথা শুনছিলাম। সেটা কেমন অনুগ্রহ করে বলবেন কী?

হ্যাঁ, তা বলেছিলাম, সত্য। যাক, যে কথা বলছিলাম, প্রশমণ পদ্ধতিতে প্রায়ই বেশ বড় রকমের সমস্যা, মানে বিপদের সম্মুখীন হতে হত। দেখুন, পাগলের পাগলামি তো কোনো সীমারেখা মানে না আর তা কোথাও লিখে রাখাও হয় না। অতএব আমি বলব, বিখ্যাত অধ্যাপক ফেদার এবং ডাক্তার টার-এর মতেও কিন্তু বিকৃত মস্তিষ্ক ব্যক্তিদের বিনা পাহারায় স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেওয়া মোটেই নিরাপদ নয়। তখনকার মতো কোনো একটা পাগলকে সাময়িকভাবে প্রশমিত করা সম্ভব হলেও শেষপর্যন্ত কিন্তু সে ভীষণ গোলমেলে হয়ে দাঁড়ায়। তার চালাকি তো অন্তহীন। সে সাধারণত সুস্থতার ভান করতে থাকে। আসলে কিন্তু আদৌ তা নয়। অতএব কোন একজন বিকৃত মস্তিষ্ক লোককে যখন সম্পূর্ণ সুস্থ-স্বাভাবিক মনে হয়, তখনই কিন্তু তাকে ঘরে বন্দি করে ফেলা দরকার।

ভালো কথা, এবার অনুগ্রহ করে বলুন তো, এ-আশ্রমটা পরিচালনা করতে গিয়ে আপনার লব্ধ অভিজ্ঞতার ওপর নির্ভর করে বলুন, একটা পাগলকে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দিয়ে সমস্যায় পড়েছেন এমন কোন বাস্তব ঘটনা কি ঘটেছে বলে আপনার মনে পড়ছে?

এখানকার বাস্তব অভিজ্ঞতা? এ কী কথা বলছেন। আমি তো বলবই, সমস্যার, মানে বিপদের সম্মুখিন অবশ্যই হতে হয়েছিল। মনে করুন, খুব বেশি দিন আগের ব্যাপার নয়, বিশেষ একটা ঘটনা এ-আশ্রমেই ঘটেছিল যা অবশ্যই মনে গেঁথে থাকার মতো। আপনার তো ভালোই জানা আছে যে, এখানে যখন প্রশমন পদ্ধতি প্রয়োগ করা হত তখন এখানকার সব পাগলকেই ছেড়ে রাখা, মানে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে দেয়া হত। হঠাৎ এক সকালে অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটতে দেখা গেল।

অবিশ্বাস্য ঘটনা? ঘটনাটা কী, জানতে পারি কী?

ঘটনাটা হচ্ছে, এক সকালে দেখা গেল, আশ্রমের সব রক্ষীকেই পিঠমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় পাগলদের থাকার কামরাগুলোর মেঝেতে ফেলে রাখা হয়েছে। ব্যাপার এমন দাঁড়াল যে, রক্ষীরাই যেন পাগল। আর এমন অদ্ভুত কাণ্ডটা করে পাগলরাই রক্ষী বনে তাদের জায়গা দখল করেছে। কাণ্ডটা একবার মন দিয়ে ভেবে দেখুন তো মি.।

এ কী অদ্ভুত কথা শোনাচ্ছেন মি. মেলার্ড! এমনতর অদ্ভুত অবিশ্বাস্য কাণ্ডের কথা তো এর আগে কোনোদিন শুনিনি মি.! এমন কথা ভাবতেও যে আমি উৎসাহ পাচ্ছি নে!

আসলে কিন্তু পুরো ব্যাপারটা এক বুদ্ধিভ্রষ্ট পাগলের কাজ। যে করেই হোক তার মাথায় পোকা ঢুকল, সে এমন এক শাসন-ব্যবস্থার আবিষ্কারক যা ইতিপূর্বে কোথাও কোনোদিন কেউ-ই শোনেনি। হয়তো তার মাথায় মতলবটা ঢুকেছিল নিজের আবিষ্কৃত শাসন-ব্যবস্থাটাকে একবার পরীক্ষা করে দেখবে।

তাই নাকি?

ব্যবস্থাটাকে পরীক্ষা করে দেখার ইচ্ছাটাকে ফলপ্রসু করার আগেই সে বর্তমান শাসন-ব্যবস্থাকে বন্ধ করার ষড়যন্ত্রে যোগদানের জন্য সে আশ্রমের সব রোগীকে বলে কয়ে রাজি করায়। আর তার ষড়যন্ত্রের শিকার হলো আশ্রমের পাহারাদাররা।

তবে সে ষড়যন্ত্রটাকে পরিপূর্ণ সার্থক করে তোলে, এই তো?

অবশ্যই। এতে কিছুমাত্র সন্দেহের অবকাশ আছে কি, বলুন তো?

হুম! অচিরেই।

কার্যত, অচিরেই দেখা গেল, পাগল আর রক্ষী উভয় দলই স্থান পরিবর্তন করে নিল। তবে সম্পূর্ণরূপে বলা যাবে না।

কারণ কী?

কারণ হচ্ছে, পাগলগুলো ছাড়া পেয়ে গেল, আর তাদের ঘরে রক্ষীরা আটকা পড়ে রইল।

ফল কী হল?

রক্ষীদের অকারণে কঠোরভাবে চিকিৎসা করা আরম্ভ হয়ে গেল। কী অদ্ভুত কাণ্ড, বলুন তো?

আমার কিন্তু বিশ্বাস, অনতিবিলম্বে পাল্টা বিপ্লব আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। এরকম উদ্ভট ব্যবস্থা তো দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না। প্রতিবেশি অঞ্চলের মানুষ, যারা আশ্রম দেখতে আসে, তাদের মধ্যে ব্যাপারটা চাউর হয়ে গেলে তারা অবশ্যই তুলকালাম কাণ্ড বাঁধিয়ে দিয়েছিল, আর এটা খুবই স্বাভাবিক।

ঠিক এ-জায়গাটাতেই আপনি ভুল করে বসলেন। বিদ্রোহের সর্দারটা ছিল খুবই ধূর্ত। সে ও-পথই মাড়াল না। আশ্রম দেখার জন্য বাইরের লোকজনের ভেতরে ঢোকা সে পুরোপুরি বন্ধ করে দিল। একদিন এক বিপত্তি ঘটল। নিয়মটা ভাঙা হলো।

নিয়মটা ভাঙা হলো বলতে আপনি কীসের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, মি. মিলার্ড?

ব্যাপারটা তবে খোলসা করেই বলছি–একদিন ভদ্র চেহারারও সজ্জিত পোশাক পরিহিত এক বোকা হদ্দ যুবক আশ্রমের সদর দরজায় এলো। তার ভাবগতিক দেখে মনে হলো তার কাছ থেকে ভয়ের কোনো আশঙ্কাই নেই। এরকম ভেবে সে আগন্তুক যুবককে ভেতরে ঢোকার অনুমতি দিয়ে দিল। আসলে একঘেয়েমির হাত থেকে অব্যাহতি পাবার জন্যেই এ-কাজটা করা হয়। ভাবল যুবকটাকে নিয়ে একটু আধটু হাসি-মস্করা করে মনটাকে একটু চাঙা করে নেয়া যাবে। তারপর করলও তা-ই। তাকে নিয়ে চুটিয়ে মজা করে শেষমেশ তাকে আশ্রম থেকে ঘাড় ধরে তাড়িয়ে দেওয়া হলো।

আচ্ছা, বলুন তো, এখানে পাগলের জমানা কতদিন টিকেছিল?

অনেকদিন চলেছিল। এক মাস তো হবেই। তবে একেবারে সঠিক সময় বলা। মুশকিল।

তারপর?

তারপর পাগলরা বহাল তবিয়তে, মানে পরমানন্দে দিনাতিপাত করতে আরম্ভ করল। তারা সবচেয়ে লক্ষণীয় কাজ করল, নিজেদের ছেঁড়া ও নোংরা পোশাক রেখে দিয়ে আমাদের পরিবারের লোকজনদের পরিবারের পোশাক পরিচ্ছদ এবং অলঙ্কারাদি পড়ে মনের শখ মেটাতে লাগল।

তারপর? আর কী করল?

মাটির তলাকার গুদামে প্রচুর মদের পিপে মজুদ থাকত। হৈ হৈ করে সেগুলোকে বের করে এনে মৌজ করে পান করতে লেগে গেল। মোদ্দা কথা, তারা পরমানন্দে দিন গুজরান করতে লাগল। সত্যি কথা বলতে কি, এখানকার পাগলরা যেন রীতিমত উৎসবে মেতে গেল।

বুঝলাম। এবার চিকিৎসার ব্যাপারটা সম্বন্ধে কিছু বলুন তো। মানে বিদ্রোহীদের সর্দার এখানে কি রকম চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু করেছিল?

এতক্ষণ পরে আবার এ-কী প্রশ্ন করছেন মি.! আমি তো বলেছিই, পাগলমাত্রই বোকা হাঁদা এমন তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। আমার মনের ঠিক ঠিক কথা যদি শুনতে চান তবে আমি বলব, সত্যিকারের চিকিৎসা-পদ্ধতি পুরোপুরি উৎখাত করে দিয়েছিল। আর তার নিজের চিকিৎসা-পদ্ধতি অনেকাংশে ভালো ছিল। চমৎকার! সত্যি চমৎকার! চিকিৎসাপদ্ধতি সহজ সরল-ছিমছাম। কোনোরকম হাঙ্গামা-হুঁজ্জতি নেই। স্বাদুও বটে খুবই চমৎকার।

গৃহকর্তা মি. মিলার্ড আরও কিছু বলতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ আবার নতুন করে হৈ-হট্টগোল একে বারে আগেকার মতোই বহুকণ্ঠের চিল্লচিল্লি শুরু হয়ে যাওয়ায় তার পক্ষে বক্তব্যকে আর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না।

হৈ-হট্টগোলটা আগেকার মতো জোরদার হলেও মনে হল, তারা যেন অতি দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে।

আমি প্রায় আর্তনাদ করে উঠলাম–পাগল! পাগল! অবশ্যই পাগলারা একজোট হয়ে সব কটা অবরোধ ভেঙে ফেলেছে। তারা ক্ষেপে গিয়ে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

সবচেয়ে বেশি মিইয়ে যেতে দেখলাম, মি. মিলার্ডকে। তিনি চকের মতো। ফ্যাকাশে মুখে বললেন–মঁসিয়ে, সে আশঙ্কা আমার মধ্যেও ভর করেছে! পাগলারা দারুণভাবে ক্ষেপে না উঠলে তো এমনটা কিছুতেই ঘটতে পারে না।

তার কথা শেষ হবার আগেই একেবারে জানালার তলা থেকে ভয়ঙ্কর বুক কাঁপানো তর্জন গর্জন ভেসে এলো। ঠিক সে মুহূর্তেই বুঝতে পারলাম, বাইরের কিছু ক্রোধোন্মত্ত লোক ভেতরে ঢুকে আসার জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইয়া বড় হাতুড়ি দিয়ে দরজার গায়ে দমাদম আঘাত হানছে। আর জনা কয়েক শরীরের সবটুকু শক্তি নিঙড়ে জানালার শার্সি ধরে নাড়ানাড়ি–ঠেলা ধাক্কা দিয়ে চলেছে। সে যে কী উত্তেজনা, তা কাউকে বলে বোঝানো যাবে না।

ব্যস, মুহূর্তের মধ্যে হৈ-হট্টগোল তুঙ্গে উঠে গেল। বিক্ষুব্ধরা সবকিছু ধ্বংস করে দেবার জন্য যেন উঠে পড়ে লেগে গেছে।

আমি ঘাড় ঘুরিয়েই বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়লাম। আমাকে যাপরপরনাই অবাক করে দিয়ে মেলার্ড পাশের আলমারিটার পিছনে নিজেকে খুঁজে দিয়ে অনবরত ঠক্ঠক্‌ করে কেঁপে চলেছেন।

মি. এরকম আকস্মিক আচরণে আমি কেন অবাক হলাম, তাই না। কারণ, আমি তার কাছ থেকে অনেক, অনেক বেশি দৃঢ়তাই প্রত্যাশা করেছিলাম। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে বিপরীত আচরণ প্রত্যক্ষ করলে অবাক হবার কথাই তো বটে।

এদিকে আর একটা অত্যাশ্চর্য দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে আমি একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ব্যাপারটা হচ্ছে, বাদ্যকররা গত পনেরো মিনিট ধরে নেশায় বুঁদ হয়ে এলিয়ে পড়েছিল। বাহ্যিক জ্ঞান তিলমাত্রও তাদের ছিল না। আকস্মিকতার হৈ-হট্টগোল তাদের নেশা পুরোপুরি ছুটে যাওয়ায় তারা হুড়মুড় করে সোজাভাবে বসেই নিজের নিজের বাদ্যযন্ত্র হাতে নিয়ে একই সুরে ইয়াংকি ডুডুল বাজাতে শুরু করে দিল। তারা সুর-তাল মাফিক বাজনা না বাজালেও মাত্রাতিরিক্ত প্রচেষ্টা যে চালিয়ে যাচ্ছে, এতে কিছুমাত্রও দ্বিধা নেই।

এতক্ষণ যে ভদ্রলোককে অনেক কষ্টে লাফালাফি থেকে বিরত রাখা হয়েছিল, তিনি এখন তড়া করে এক লাপ দিয়ে মদের বোতল-গ্লাস আর খাবার দাবার সাজানো টেবিলের ওপর উঠে পড়ল। তিনি কিন্তু কোনোরকম উত্তেজনা প্রকাশ না করে ধীর-স্থিরভাবেই লম্বা একটা ভাষণ দিয়ে ফেললেন, যা কারোই কান অবধি পৌঁছল না।

ভাষণরত লোকটা শান্ত হতে না হতেই যে লোকটার লাটুর মতো চক্কর মারা স্বভাব তিনি চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘরময় অনবরত চক্কর মেরে চলেছে। শুধুই কি চক্কর মারা? হাত দুটো মাথার ওপর তুলে এমন অদ্ভুত অঙ্গভঙ্গিও করতে লাগল যা হাসির উদ্রেকই কেবল করল না, তার ধারে কাছে যারা ছিল তারা প্রচণ্ড ধাক্কার চোট সামলাতে না পেরে দুম দুম করে যে যেদিকে পারল ছিটকে পড়ে কাতরাতে শুরু করল।

পর মুহূর্তেই ওদিকে শ্যাম্পেনের হু-হুঁস্ ফুসফুস শব্দ শুনে অতর্কিতে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম। অনুসন্ধিৎসু নজরে লক্ষ্য করে প্রকৃত ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। কিছুক্ষণ আগে যে লোকটা খাবার শুরু হবার পরপরই মদের বোতলের ছিপি খোলার ব্যাপারটার অনুকরণ করে অনবরত তার মুখ না। দিয়ে উপরোক্ত শব্দ সৃষ্টি করে চলেছে।

এবার অধিকতর বিস্ময়ের সঙ্গে আমি কামরাটার চারদিকে অনুসন্ধিৎসু চোখের মণি দুটোকে ঘোরাতে লাগলাম। এক অবাঞ্ছিত কণ্ঠস্বর–গাধার ডাক, ঘরের বাজনা আর চিৎকার চাচামেচিকে ছাপিয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াতে লাগল। অনবরত গাধার ডাক চলতেই লাগল।

আবার আমার বেচারি বৃদ্ধা বন্ধু মাদাম জয়েয়ুসের পরিস্থিতি? সত্যি তার দুঃখে আমার বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে লাগল। বাস্তবিক তিনি খুবই মুষড়ে পড়েছেন। চকের মতো ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে তিনি ঘরের কোণের জ্বলন্ত চুল্লিটার গায়ে দাঁড়িয়ে গলা ছেড়ে অনবরত কএ ডু… গানটা গেয়েই চলেছেন। এ-যেন বাস্তবিকই এক বিষণ্ণতার প্রতিমূর্তি।

ঘটনাটা এবার চরম পরিণতির দিকে দ্রুত এগিয়ে চলতে লাগল।

সত্যি কথা বলতে কি, যেহেতু বাইরের বিক্ষোভকারী দলটাকে প্রতিরোধ করার জন্য বাজনা-বাদ্যি, হরেকরকম আওয়াজ উদগীরণ আর ককে-ডুল….গান গাওয়া ছাড়া অন্য কোনো ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হলো না, তাই অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা ক্রোধে ফুঁসতে ফুঁসতে জানালাটা ভেঙে ফেলল। ব্যস, সবাই মুহূর্তের মধ্যেই হুড়মুড় করে আশ্রমের ভেতরে ঢুকতে আরম্ভ করল। এবারের দৃশ্যটা কোনোদিন একটা মুহূর্তের জন্যও আমার অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মুছে যাবে না। কিছুতেই না।

ব্যাপার দেখে তো আমি একদম থ বনে গেলাম। আমি বিস্ময়ভরা চোখে হা করে পুরো ব্যাপারটা দেখতে লাগলাম। অভাবনীয় আতঙ্ক আমার বুকের ভেতরে, কলিজাটা যেন আচমকা দরকচরা মেরে গেল। সৈন্য? কেমন সৈন্য তারা? ওরাংওটাং, শিম্পাঞ্জি অথবা উত্তমাসা অন্তরীপের বিশালদেহী ক্রোধোন্মত্ত বেবুন ছাড়া আর কিছু নয়। তারা লাফিয়ে লাফিয়ে ভেতরে ঢোকার সময় ভয়ঙ্কর হুঙ্কার দিচ্ছে, যা অতীতে কোথাও শোনা তো দূরের ব্যাপার, কল্পনাও করতে পারিনি।

তারা ভেতরে ঢুকে হম্বিতম্বি করতে করতে আমাকেও অন্যান্যদের মতো অনবরত কিল-চড়-লাথি মারতে লাগল। বেদম প্রহার খেয়ে আমি যন্ত্রচালিতের মতো দ্রুত একটা সোফার তলায় নিজেকে চালান দিয়ে দিলাম। ব্যস, আর কথা নয় মড়ার মতো নিশ্চল-নিথরভাবে পড়ে রইলাম।

সোফার তলায় শুয়ে আমি ফাঁক-ফোকর দিয়ে দেখতে লাগলাম, অসভ্য জানোয়ারগুলো প্রচণ্ড হুঙ্কার দিতে দিতে রীতিমত দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, আর যাকেই হাতের কাছে পাচ্ছে দমাদম্ ঘা কতক বসিয়ে দিচ্ছে। সে যে কীরকম দক্ষযজ্ঞ বেঁধে গেল, তা বর্ণনা করার মতো ভাষা আমার রপ্ত নেই।

এ যেন নাটকের তাণ্ডব-দৃশ্য অভিনীত হচ্ছে। তাণ্ডব-নাচটা মিনিট পনেরো ধরে চলার পরই প্রত্যক্ষ করলাম বিয়োগান্ত নাটকের এক প্রীতিকর পরিণতি।

এ-বিদ্রোহের সর্দারের যে কেরামতির কথা মি. মেলার্ড আমাকে শোনালেন, আমি কিন্তু ধরেই নিলাম সেগুলো তার নিজের দ্বারাই সম্পন্ন হয়েছে।

মি. মেলার্ড নামধারী এ-ভদ্রলোক বছর দু-তিন আগে সত্যি সত্যি এ পাগলাগারদের সুপারিনটেন্ডেন্টের পদে বহাল ছিলেন।

ব্যস, তারপরই একটু-একটু তার মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটতে থাকে। অচিরেই তিনি বদ্ধ পাগল বনে যান। এবার তিনি চাকরিটা খুইয়ে এখন রোজই কুঠুরিতে ঢোকেন।

আমার যে সহযাত্রী-বন্ধু পাগলাগারদটার সদর-দরজা পর্যন্ত এসে আমার সঙ্গে তার, মানে মি. মেলার্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বিদায় নিয়ে ছিলেন, তিনি তার ব্যাপার-স্যাপার সম্বন্ধে জানতেন না।

দশজন রক্ষীকে কোনোরকমে বাগে এনে প্রথমেই তাদের গায়ে মগে করে নরম আলকাতরা ঢেলে দেওয়া হলো। তারপর চটচটে আলকাতরার ওপর পাখির পালক ছড়িয়ে দিয়ে তাদের জানোয়ারের মতো টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে মাটির তলায় গোপনে বন্দি করে রাখা হলো।

সেখানে তাদের কম করেও এক মাস কয়েদ করে রাখা হয়েছিল। তবে এটাও সত্যি যে, মি. মেলার্ড এ-সময় তাদের প্রচুর পরিমাণে পালক সরবরাহ করেছিল। আর করবেন না-ই বা কেন। কারণ, এটাই তো তার চিকিৎসা পদ্ধতির বিশেষত্ব। আর তদের কিছু কিছু রুচি আর প্রচুর পরিমাণে পানিও সরবরাহ করা হত। আর পানি দেওয়ার উপায়টা? নর্দমা দিয়ে প্রচুর পরিমানে-পানি ঘরের মধ্যে নিয়মিত ঢুকিয়ে দেয়া হত এ-ব্যবস্থাটাকেই তারা মওকা হিসেবে গ্রহণ করে। পানির স্রোতের সঙ্গে ভেসে কয়েদিদের একজন নর্দমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। ব্যস, কাজ হাসিল করার উপযুক্ত পথ তৈরি হয়ে গেল। নর্দমা দিয়ে পালিয়ে আসা কয়েদিটা এবার অন্যন্যদের অনায়াসেই মুক্ত করে দিল।

এবার নতুন করে পূর্বের প্রচলিত প্রশমণ পদ্ধতিটা আবার আশ্রমে চালু করা হয়। পদ্ধতিটার কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন করেই এ-রোগীদের ওপর আরোপ করা হলো।

আশ্রমটাকে ঘুরে ঘুরে দেখে ও সবকিছু শুনে আমি মি. মেলার্ডকে সমর্থন না করে পারলাম না যে, তার আরোপিত নিজস্ব পদ্ধতিটাই ছিল পুরোদস্ত তোফা পদ্ধতি।

প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তে পদ্ধতিটা সম্বন্ধে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি নিজেই বলেছিলেন–পদ্ধতিটা খুবই সহজ-সরল। ঝামেলা-হাঙ্গামা নেই বলতে কিছুই নেই। যাকে বলে একেবারেই ছিমছাম।

মি. মেলার্ডের বক্তব্যের সঙ্গে আমি মাত্র একটা কথাই জুড়ে দিতে চাচ্ছি। অধ্যাপক ফেদার আর ডাক্তার টারের লেখা বইগুলো সংগ্রহ করার জন্য আমি ইউরোপের সবগুলো লাইব্রেরিতেই ঢু মেরেছি। কিন্তু পরিতাপের বিষয় একটা বইও আজ অবধি আমার পক্ষে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তবে এও সত্য যে, আমি কিন্তু হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দেইনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *