1 of 2

ইম্প অফ দ্য পারভাস

ইম্প অফ দ্য পারভাস

মানুষের বিবেগটা মাঝে মধ্যে নরবড়ে হয়ে যায়–যার ফলে তারা কুকর্মে লিপ্ত হয়। তার কাজকর্ম দেখে আমরা তখন বলাবলি করি, লোকটা মানসিক বিকৃতির শিকার হয়ে পড়েছে।

আসল ব্যাপারটা হচ্ছে, শয়তান তার মধ্যে ভর করে তাকে কুকর্মে লিপ্ত করে। কোন কোন সময় এমনও দেখা যায়, অত্যাশ্চর্য ঘটনাটা ঘটে যাওয়ার ফলে তার ভালোই হয়েছে। কাণ্ডটা না ঘটানো পর্যন্ত তার ছোঁকছোঁকানি ভাবটা তাকে যে প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াত এখন তার কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ায় স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছে।

এবার আমার প্রসঙ্গে আসা যাক।

বহুদিন ধরেই খুন করার পরিকল্পনাটা আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু ইচ্ছা থাকলে সাহসে ভর করে মতলবটাকে বাস্তবে পরিণত করতে পারছিলাম না। একটা আতঙ্ক বুকের ভেতরে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতেই ধুকপুকানি শুরু হয়ে যেত গোয়েন্দারা যদি পাকড়াও করে ফেলে? বুকের ভেতরে জাঁকিয়ে বসে-থাকা এ আতঙ্কটার জন্যই আমি খুনটা করতে পারছিলাম না, গড়িমসি করছিলাম।

তারপর একদিন একটা ফরাসি বই হাতে পেলাম। সেটাকে গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। তাতে লেখা হয়েছে, অদ্ভুত কৌশল অবলম্বন করে এক মহিলাকে খুন করা হয়েছে। কৌশলটা আমার খুবই মনে ধরে গেল। অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বইটার আগাগোড়া আবারও পড়ে ফেললাম।

পরিকল্পনা যে শুধুমাত্র অত্যুড়ুত তা-ই নয়। রীতিমত মৌলিকও বটে।

বইটায় উল্লেখিত পরিকল্পনা হচ্ছে–মোমবাতির সঙ্গে বিষ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মোমবাতিটা জ্বলার সময় তা থেকে বিষাক্ত গ্যাস ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সে বিষাক্ত গ্যাস নাকের মাধ্যমে তার ফুসফুসে ঢোকে। মহিলাটি মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। তারপর তিনি পুঁকতে ধুঁকতে এক সময় পটল তোলেন। ব্যস, কাজ হাসিল। চমৎকার! অত্যাধুনিক এক মৌলিক পরিকল্পনার মাধ্যমে খুন।

ব্যস, আর মুহূর্তমাত্রও দেরি না করে আমি পাকা সিদ্ধান্ত নিয়ে এ-বেড়ে মতলবটাকে কাজে লাগিয়ে উদ্দেশ্য সিদ্ধ করব না।

যে লোকটাকে খুন করার জন্য আমি মানসিক অস্থিরতা বোধ করেছিলাম, রীতিমত ছোঁকছোঁক করে বেড়াচ্ছিলাম, তার অনেকগুলো বাতিক ছিল, বদঅভ্যাসও বলা চলে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে, বিছানায় শুয়ে অনেক রাত অবধি বই পড়ায় মেতে থাকা। তখন ভেতর থেকে জানালা-দরজা বন্ধ করে ঘরটাকে সে একটা পায়রার খোপে পরিণত কওে নিত। আমার মতলবটাকে বাস্তবরূপ দেওয়ার মতো মোক্ষম পরিবেশই বটে।

ব্যস, আমি কোমর বেঁধে কাজে লেগে গেলাম।

বিষ মিশিয়ে একটা জব্বর মোমবাতি তৈরি করে ফেললাম। এবার নিজেহাতে তৈরি মোমবাতিগুলোর একটা তার ঘরে দিলাম জ্বালিয়ে।

পরদিন সকালে দেখলাম, নচ্ছাড়টা বিছানায় মরে শক্ত হয়ে এলিয়ে পড়ে রয়েছে।

ডাক্তার ডেকে আনা হলো। তিনি লিখলেন–ঈশ্বর সন্দর্শনে তার মৃত্যু হয়েছে।

আমার বাঞ্ছা পূরণ হলো। পথের কাঁটা নির্বিবাদেই দূর হয়ে গেছে। ব্যস, আমি তার বিষয় আশয়ের মালিক বনে গেলাম।

অগাধ অর্থ বাগিয়ে নিয়ে মৌজ করে সেগুলোর সদ্বব্যবহার করে কয়েকদিন আনন্দে কাটিয়ে দিলাম।

গোয়েন্দারা যতই আশপাশ দিয়ে ছোঁকছোঁক করে বেড়াক না কেন, আমার একটা চুলও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি নিঃসন্দেহ, আর এসব বাজে ব্যাপার-স্যাপার নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করে সময় কাটানোর দরকারও মনে করি না।

নচ্ছার বুড়োর ঘরের মোমবাতির শেষাংশটুকু আমি গায়েব করে দিয়েছিলাম। সন্দেহ করার মতো তিলমাত্র চিহ্নও কোথাও রাখিনি।

অপরাধ? হ্যাঁ অপরাধ তো আমি অবশ্যই করেছি। কিন্তু অনেক ভেবে চিন্তে চারদিক বজায় রেখে তবেই কাজটা করেছি। ফেঁসে যাওয়ার মতো সামান্যতম সূত্রও কোথাও রাখিনি। অতএব আমার গায়ে হাত দেওয়ার হিম্ম কার আছে? কে আমাকে পাকড়াও করবে? তাই আমি রীতিমত পুলকানন্দেই মেতে ছিলাম।

আমি নিজের নিশ্চিদ্র ও নিশ্চিত নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে প্রতিটা দিন-রাত চব্বিশ ঘণ্টা মুহূর্ত নিরাপত্তার ভাবনায় ডুবে থাকতাম।

হ্যাঁ, খুন আমি করেছি। আমি খুনি। কিন্তু খুন করেও আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমি সর্বদা এসব ভাবনায় ডুবে থাকতাম আর অভাবনীয় এক পুলকানন্দে ফেটে পড়ার যোগাড় হতাম। খুন করেও আনন্দ উল্লাসের জোয়ারে নিশ্চিন্তে গা ভাসিয়ে চলা–কম কথা!

একদিন রাস্তা দিয়ে একা একা হাঁটার সময় আপন মনে সে ঘটনাটার কথা ভাবছিলাম। আমি স্বগতোক্তি করলাম–আমি সম্পূর্ণ নিরাপদ। আমি গোয়েন্দাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। আমার ওপর কারো তিলমাত্র সন্দেহও নেই, থাকার কথাও নয়।

মুহূর্তের জন্য নীরব থেকে আবারও স্বগতোক্তি করতে লাগলাম–আরে ধ্যুৎ! কে আমার গায়ে হাত দেবে। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ার সাধ্যও কারো নেই। আমিনিজে থেকে যদি স্বীকার না করি তবে আমার গায়ে হাত দেয় কার সাধ্য!

আমার অন্তঃস্থলে সর্বক্ষণ যে নিরাপত্তাবোধ চক্কর মেরে বেড়াচ্ছে তা কখন যে আমার মুখ দিয়েও আচমকা বেরিয়ে এলো তা আমি খেয়াল করিনি।

পথ চলতে চলতে হঠাৎই বুঝতে পারলাম, আমি নিজের মনেই পাগলের মতো বক বক করে চলেছি–ধরবে? আমাকে ধরবে? কে আমার গায়ে হাত দেবে? কিছুমাত্রও প্রমাণ নেই, কোনো সূত্রও নেই, আর সন্দেহ করার মতো কারণও কিছু নেই। কে আমাকে ধরবে? কে ধরবে? আমিনিজে থেকে স্বীকার না করে নিলেই তো হলো! আমার গায়ে কাঁটার আঁচড় দেওয়ারও কারো সাধ্য নেই।

যখন বুঝতে পারলাম, ঠিক সে মুহূর্তেই আমার বুকের ভেতরে অস্বাভাবিক ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেল। তবে সে আর কতক্ষণ? খুবই অল্পক্ষণের জন্য। তা যদি

হতো তবে অনেক আগেই আমার ভবলীলা সাঙ্গ হয়ে যেত। ব্যস, কেল্লা ফতে হয়ে যেত। এ কী কেলেঙ্কারি ব্যাপার! তবে কি শয়তান আমার কাঁধে ভর করেছে? হ্যাঁ, সে রকমই তো মনে হচ্ছে। তা নইলে আমার এমন আকস্মিক অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটতে যাবেই বা কেন? মৃগী রোগের শিকার হলে মানুষ এমন করে আপন মনে প্রলাপ বকতে থাকে। হায়! এ কী সর্বনাশা কাণ্ড!

আমি অনবরত বকেই চললাম–হ্যাঁ, আমি খুন করেছি। খুন করেছি, বেশ করেছি। হাজার বার বলব, বেশ করেছি। এতদিন তো অন্তরের অন্তঃস্থলে গোপন। করেই চেপে রেখে দিয়েছি। কিন্তু এখন কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটতে শুরু করেছে রে বাবা! তবে কি…তবে কি নিহত বুড়োটার প্রেতাত্মাই আমাকে দিয়ে এসব কথা বলাচ্ছে! তবে কি এটা প্রেতাত্মারই কারসাজি।

আমার বুকের ভেতরের ধুকপুকানি মুহূর্তে যেন হাজার গুণ বেড়ে গেল। আমি কাণ্ডজ্ঞান রহিত অবস্থায় লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা জুড়ে দিলাম। না, হাঁটা বললে ঠিক বলা হবে না, বরং উর্ধশ্বাসে দৌড়ানোই বলা উচিত। আমি সদর রাস্তা ছেড়ে দিয়ে গলিপথ ধরলাম। একের পর এক বাঁক ঘুরে, গলি পাল্টাতে পাল্টাতে রীতিমত উৰ্দ্ধশ্বাসে পথ পাড়ি দিতে লাগলাম। ছুটতে ছুটতে আপন মনেই ভাবতে লাগলাম, পাগলের মতো চেঁচিয়ে বলাই বরং উচিত। গলা ছেড়ে চেঁচিয়ে সবাইকে বলে দেওয়াই তো উচিত। বরং চেঁচিয়ে বলেই ফেলি–শোন, তোমরা সবাই শোন, আমি খুনি, খুন করেছি। আমি নিজেহাতে খুন করেও বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমার গায়ে কাঁটার আঁচড়ও কেউ দিতে পারেনি। পারবেও না কোনোদিন!

আমার অন্তরের অন্তঃস্থলে প্রায়োন্মাদের মতো ইচ্ছাটা যতবার তীব্রতর হয়ে উঠছে ততবারই আমি আতঙ্কে একেবারে কুঁকড়ে গিয়েনিজেকে কোনোরকমে সামলেসুমলে দমিয়ে রেখেছি।

আমি আতঙ্ক-জ্বরের শিকার হয়ে হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে রীতিমত দৌড়াতে শুরু করলাম। দৌড়াতে দৌড়াতে নির্জন-নিরালা অঞ্চল ছেড়ে মানুষের ভিড়ের মধ্যে চলে এলাম। জোরে তখনও জোরে দৌড়াতে আরম্ভ করলাম। কাউকে ঠেলে, কাউকে গোত্তা মেরে আমি নিরবচ্ছিন্নভাবে দৌড়েই চললাম।

দৌড় লাগানো আমার পক্ষে সম্ভব হলো না। আমি বুঝতে পারছি, এভাবে উন্মাদের মতো দৌড়ালে আমার আতঙ্কটা অনেকাংশে বেড়েই যাবে। আর সে সঙ্গে আমার প্রতি পথচারীদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি হবে। আর কৌতূহল থেকে মনে দানা বাঁধবে সন্দেহ। ব্যস, সর্বনাশের চূড়ান্ত ঘটে যাবে। কিন্তু হায়! আমি যে কিছুতেই দৌড় থামিয়ে স্বাভাবিক হতে পারছি না।

হায়! যা স্বাভাবিক, যা ঘটা উচিত ছিল তা-ই ঘটে গেল। উন্মত্ত ষাঁড়ের মতো আমাকে অনবরত দৌড়াতে দেখে পথচারীদের একটা অংশ ধর! ধর রবে চিল্লাচিল্লি করতে করতে আমার পিছু নিল।

আমার বুঝতে দেরি হলো না অদৃষ্ট আমাকে শেষপর্যন্ত কোন দিকে নিয়ে চলেছে।

হায় ঈশ্বর! এ কী সর্বনাশ ঘটতে চলেছে! তখনও যদি আমার অবাধ জিভটাকে টেনে ছিঁড়ে ফেঁড়ে ফেলতে পারতাম,নির্ঘাৎ অব্যাহতি পেয়ে যেতাম। কিন্তু আমার মনের কোণে সদ্য জেগে-ওঠা জিভ ছেঁড়ার ইচ্ছাটা উঁকি মারতে না মারতেই আমার একেবারে কানের কাছে হেড়ে গলায় কড়া স্বরে কে যেন পিছন থেকে ধমক দিয়ে উঠল–হুঁশিয়ার! দাঁড়া! ব্যস আচমকা শক্ত একটা হাত আমার কাঁধটাকে সাড়াশির মতো চেপে ধরল।

ব্যস, আমার শরীরের সবটুকু শক্তি যেন মুহূর্তের মধ্যেই নিঃশেষে উবে গেল। আমার পথে বাধা দেওয়া তো দূরের কথা, সামান্য নড়তে চড়তেও পারলাম না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে কালা মাছের মতো হাঁ করে অনবরত জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলাম। দম বন্ধ হয়ে যাবার যোগাড় হয়ে আসছিল। চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসতে লাগল। দৃষ্টিশক্তি যেন লোপ পেতে বসেছে। কানেও কিছু শোনা যাচ্ছে না। হায়! চোখ আর কান দুটোই একই সঙ্গে চলে গেল, অকেজো হয়ে পড়ল!

আমি কর্তব্য ভাববার আগেই অদৃশ্য শয়তানের মতো কার যেন বজ্রমুষ্ঠি আমার পিঠের ওপর দুম্ করে আছড়ে পড়ল না।

ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই অঘটনটা ঘটে গেল। অন্তরের অন্তরতম গোপন কোণে এতদিন যে কথাটাকে জোর করে চেপে রেখেছিলাম, সেটা অতর্কিতে আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো।

পরে জানতে পারলাম, আমি নাকি খুবই স্পষ্টস্বরে আর খুবই ব্যস্ততার সঙ্গে আমার দোষ কবুল করেছিলাম–খোলাখুলি সবকিছু বলে ফেলেছিলাম। কথা বলতে গিয়ে যদি কিছু বাদ পড়ে, ছাড় ঘটে তাই মুহূর্তের জন্যও থামিনি।

আমার বুকের ভেতরে জোর করে চেপে রাখা কথাগুলোকে এক নিশ্বাসে বলেই আমি সংজ্ঞা হারিয়ে রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তারপর যা-কিছু ঘটনা সবই আমার অজান্তে।

গারদের ভেতরে আমি এখন ভাবছি, আমার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে একদিন না একদিন আমার হাত পায়ের বেড়ি হয়তো খুলে যাবে। কিন্তু তারপর! তারপ আমার কি গতি হবে? আজ আমি জেলখানায় বসে আফসোস করছি কাল কোথায় আমার স্থান হবে?

শয়তানটার ভালোই জানা আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *