1 of 2

দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার

দ্য ফ্যাকটস ইন দ্য কেস অব মি. ভালডিমার

মি. ভালডিমারের কেস।

মি. ভালডিমারের অস্বাভাবিক কেসটা কেন অভাবনীয় উত্তেজনার সৃষ্টি করেছিল সেটা সম্বন্ধে বিস্মিত হবার মতো বাহানা করার আর কোনো দরকার আছে বলে আমি অন্তত প্রয়োজন বোধ করছি না। সত্যি কথা বলতে কি, ভালডিমারের কেসটাকে পর্যালোচনা করে বলতে গেলে না বলে পারা যায় না যে, এটা একটা অলৌকিক ব্যাপার ছাড়া কিছুই নয়।

আরও কিছু গবেষণা করার চিন্তা করে আমি তখনকার মতো সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম, তখনকার মতো ব্যাপারটাকে সবার গোচরে আনা চলবে না। আনবও না। আমার এরকম চিন্তা ভাবনার পিছনে যুক্তি হচ্ছে, আশ্চর্য ঘটনা সম্বন্ধে কিছু ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়, অদ্ভুত রহস্যটাকে ভেদ করতে পারি।

আমি ব্যাপারটাকে চেপে রাখতে চেষ্টা করলে পরিচিত মহল এমন গোপন ফিসফিসা নিতে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। প্রকৃত ব্যাপারটা সবাই জানতে না পেরে তার শাখা-প্রশাখা বিস্তার করা ফুলানো-ফাঁপানো এক বিবরণ, অর্থাৎ আসলের সঙ্গে মাত্রাতিরিক্ত খাদ মিশে গিয়ে ব্যাপারটা সবার মধ্যে প্রচার হয়ে যায়।

ব্যাপারটা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন মহলে জোর সমালোচনা শুরু হয়ে যায়, চারদিকে হৈ হৈ রৈ রৈ কাণ্ড বেঁধে যায়। আর এরই ফলে স্বাভাবিকভাবেই পথে-ঘাটে, হাটে-বাজারে সবার মধ্যে বিদ্রূপ আর অবিশ্বাসের জোয়ার বয়ে যেতে শুরু করে। শেষপর্যন্ত পরিস্থিতি এমন সঙ্গীন হয়ে পড়ে যে, আসলকে দূরে রেখে নকলকে নিয়েই সবাই মাতামাতি শুরু করে দেয়।

এ জন্যই প্রকৃত ঘটনাটা সবার সামনে তুলে ধরা উচিত মনে করছি। ঘটনাটাকে সংক্ষেপে মোটামুটি এরকম–

আমি গত তিন বছর ধরে মেসমেরিজম বিদ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ি, যাকে বলে আমার মধ্যে প্রবণতা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। গত নয়মাস আগেকার কথা, হঠাৎ আমার মাথায় খেয়াল চেপে বসে একের পর এক এত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও একটা ব্যাপার সর্বদাই বাদ পড়ে গেছে। তবে সে খেয়ালটা একেবারে হঠাৎই- আমার মাথায় আসে। ব্যাপারটা খুবই আশ্চর্যজনক তো অবশ্যই, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে তার মিমাংসাও সম্ভব নয়। তবে ব্যাপারটা যে একেবারে অত্যাশ্চর্য, রীতিমত অবিশ্বাস্য এ বিষয়ে এতটুকু সন্দেহ নেই।

অনেকেই জানেন, চোখের সামনে ঘটতে দেখেছেন অনেকেই জীবন্ত মানুষকে বহুবার বহু স্থানে সম্মোহন করা হয়েছে। কিন্তু মরা মানুষকে সম্মোহন করার চেষ্টা করা কেউ করেছে কি? না, এমন কোনো ঘটনার কথা কস্মিনকালেও কেউ করেছে বলে শোনা যায়নি। তবে অন্য কেউ, কোথাও শুনে থাকলেও আমি অন্তত শুনিনি।

একটা কথা কি, যে লোকটা মৃত্যু পথযাত্রী, অর্থাৎ মর-মর হয়েছে তাকে সম্মোহন করা সম্ভব। কিন্তু মৃত্যুর পর পরিস্থিতি কেমন হয় তারও তো পরীক্ষা করে দেখা চাই। শেষপর্যন্ত ব্যাপারটা তো এমনও দাঁড়াতে পারে যে, মেসমেরিজমের মাধ্যমে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে? শেষপর্যন্ত যদি মৃত্যুটা রদ করা সম্ভব না-ই হয় তবুও চেষ্টা করে দেখতে দোষটা কোথায়?

এরকম একটা অত্যাশ্চর্য পরীক্ষা-নিরীক্ষায় হাত দেওয়ার আগে এর অনেকগুলো দিক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা অবশ্যই দরকার। ব্যাপারগুলো নিয়ে আগেই গভীরভাবে চিন্তা-ভাবনা, বিচার-বিবেচনা করে নিয়ে তবে কাজে হাত দেওয়া উচিত।

অবশ্যই বিবেচনা করার মতো দিকগুলোর মধ্যে আসল দিক হচ্ছে তিনটি–সবার আগে আমাদের দেখা দরকার, মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মুমূর্ষ মানুষটার ওপর চৌম্বক শক্তির প্রভাব কার্যকর হয় কি না। আর যদি হয়ই তবে তা কতখানি কার্যকর হয়। তারপর, অর্থাৎ দ্বিতীয়ত-চৌম্বক প্রভাব যদি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে কারো মধ্যে, কার্যকর হয়েই থাকে তবে আসন্ন মৃত্যু মেসমেরিজম প্রভাবকে বৃদ্ধি করে, নাকি হ্রাস করে দেয়? তার পরবর্তী পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়, অর্থাৎ তৃতীয়ত কতদিন অথবা কি পরিমাণে আসন্ন মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখা যেতে পারে।

এর শেষের ব্যাপারটাই কিন্তু আমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি আগ্রহের সঞ্চার করল। সত্যি কথা বলতে কি, ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমি কৌতূহলাপন্নও কম হলাম না। আর এরকম আগ্রহ কৌতূহলের শিকার হয়েই আমি এরকম একটা উদ্ভট কাজে হাত দেবার সিদ্ধান্ত না নিয়ে পারিনি।

কিন্তু একটা সমস্যার মুখোমুখি আমাকে হতে হলো। সমস্যাটা হচ্ছে, কাকে নিয়ে আমি এ অভিনব আর অত্যাশ্চর্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজটা করব? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার অভিন্নহৃদয় বন্ধু মি. আরনেস্ট ভালডিমারের নামটা আমার মনে পড়ে গেল।

মি, আরনেস্ট ভালডিমার নামে আর যে বন্ধুবর বিবলিথিকা ফরেনসিকা বইটা লিখে খুব নাম করেছে, তার কথা বলছি। আর ছন্দনামেও সে ইস্সাচার মাকস নামে আরও একটা বই লিখেছে। তার লেখা ওয়ালন্সটাইন আর গর্গনচুয়া বই দুটোও পাঠক-পাঠিকাদের কাছে কম সমাদৃত হয়নি।

নিউ ইয়র্ক শহরের হারলেম নামক অঞ্চলে আমার বন্ধুবর মি. ভালডিমার ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। সেই তখন থেকে তার চেহারার তেমন লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তনই হয়নি। অর্থাৎ তখন তাকে আমি যেমনটি দেখেছিলাম আজও তাকে ঠিক একই রকম চোখে লাগে।

আমার বন্ধুবরের দেহেরনিম্নাংশের সঙ্গে জন র‍্যানডলফের দেহের নিচের দিকটার হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়। তার মাথায় একরাশ ঝাঁকড়া চুল, কুচকুচে কালো। হঠাৎ করে দেখলে মনে হয়, মাথা থেকে বুঝি তেল চুঁইয়ে পড়ছে। তবে কানের কাছে নেমে আসা জুলফি সাদা, দুধের মতো ধবধবে সাদা। তাই স্বাভাবিকভাবেই অনেকের বিশ্বাস, তার মাথার চুলগুলো আসল নয়, নকল চুলের গোছা মাথায় পড়েছে। অর্থাৎ পুরচুলা ছাড়া তো এমনটা হবার কথা নয়।

আমার বন্ধুর স্বভাব প্রকৃতির কথা বলতে গেলে সবার আগেই বলা দরকার, যে মানুষ হিসেবে বড়ই নার্ভাস প্রকৃতির। অল্পতেই কেমন ঘাবরে যায়। মেসমেরিজম-এর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজে তার মতো একজন মানুষ হলেই ভালো হয়। একবার নয়, দু তিনবার তাকে খুব সহজেই ও অল্প সময়ে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। কোনো সমস্যাই হয়নি। সহজেই ঘুম পাড়ানো সম্ভব ঠিক এরকমই একজন মানুষ আমার পরীক্ষা নিরীক্ষার কাজে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস।

তবে এও সত্য যে, আমার বন্ধুবরকে সহজে ঘুম পাড়ানো সম্ভব হলেও বেশ বার কয়েক আমাকে রীতিমত নাকানি-চুবানি খাইয়ে ছেড়েছিলেন। যাকে বলে একেবারে নাস্তানাবুদ হওয়া। আরও আছে, তার স্বভাব প্রকৃতি, মানে তার ধাতটা এমনই অদ্ভুত যে, কি ঘটতে পারে আগে থেকে কিছুই অনুমান করা যায় না।

আরও আছে, আমার বন্ধুবর এমনই এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ যে, তার ইচ্ছাশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে আমার বশে আনা সম্ভব হয়নি, কোনোদিনই না। অর্থাৎ আমি এটাই বোঝাতে চাচ্ছি–আমরা যাকে ক্লোয়ারভয়্যান্স বলি, আরও সহজভাবে বলতে গেলে যাকে অতীন্দ্রিয় দৃষ্টি। এ ব্যাপারটায় তার ওপর কিন্তু কোনোদিনই ভরসা করা যায়নি। পুরো ব্যাপারটাকেই সে ভেস্তে দিয়েছে। পরবর্তীকালে ভাবতে বসে ব্যর্থতার কারণ হিসেবে সবার আগেই আমার মাথায় এসেছে তার ক্ষীণ শরীরের কথা।

আমি আগাগোড়াই তাকে একজন নড়বড়ে মানুষ দেখে আসছি। স্বাস্থ্য সর্বদাই টালমাটাল। সে যে কখন ভালো আছে আর কখন যে রীতিমত দুর্বল হয়ে পড়েছে তা তাকে দেখে কিছুই বোঝার উপায় নেই।

বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। বন্ধুবর ভালডিমারের সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ পরিচয় হওয়ার মাস কয়েক আগে ডাক্তাররা তাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রায় দিয়েছিলেন, ব্যাধিটার নাম দুরারোগ্য যক্ষা। আর জোর দিয়ে তারা বলেছিলেন, এ রোগের কবল থেকে অব্যাহতি পাওয়ার কোনো উপায় তো নেই-ই, মৃত্যু যে অবশ্যম্ভাবী এতে কোনো সন্দেহই নেই।

ডাক্তারের ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর রোগী-ভদ্রলোক কিন্তু মনের দিক থেকে মোটেই ভেঙে পড়েননি, বরং মৃত্যুকে হাসিমুখে বরণ করে নেবার জন্য নিজের মনকে শক্ত করে বেঁধে তৈরি হয়েই রইলেন।

অত্যুদ্ভুত ধারণাটা আমার মাথায় চেপে বসার পরই বন্ধুবর মি. ভালডিমার-এর নামটাই সবচেয়ে আগে আমার মনের কোণে উঁকি দিল।

আমি মোটামুটি নিশ্চিন্তই ছিলাম, আমার উদ্দেশ্যের কথা শুনে সে আপত্তি করবে না। কারণ, তার মনটা তো আমার আর অজানা নয়।

ব্যাপারটা সম্বন্ধে আমার নিঃসন্দেহ হবার পিছনে অন্য কারণও ছিল যথেষ্টই। আমি ভালোই জানতাম, আমেরিকাতে তার কোনো আত্মীয়-পরিজন নেই যে তাকে বাধা দিয়ে আমার উদ্দেশ্যটাকে বানচাল করে দিতে পারে। এরকম ভাবনা চিন্তার মাধ্যমে আমি উৎসাহিত হয়ে বন্ধু ভালডিমারের সঙ্গে আমার উদ্ভট পরিকল্পনাটা সম্বন্ধে খোলাখুলি বিস্তারিত আলোচনা করলাম। তার উৎসাহ, আগ্রহ আর মানসিক উত্তেজনা আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করল। বিস্মিত হবার কারণও অবশ্যই রয়েছে। আমার মেসমেরিজমের পাল্লায় বার বারনিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিয়েছিল ভালডিমার। কিন্তু অবাক কাণ্ড! সে কিন্তু কোনোদিন, মুহূর্তের জন্যও মেসমেরিজমের ব্যাপারে তেমন মাতামাতি করেনি।

রোগটা এমনই একটা বিশেষ প্রকৃতির যে, মৃত্যু কবে, কখন আর কিভাবে হবে বলা সম্ভব নয়, শুনে বন্ধুবর বলল–আমিই তোমাকে সময়মত সবকিছু বলে দেব।

আমি তার কথা শুনে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে আমার জিজ্ঞাসা দূর করার জন্য এবার খেলাসা করেই বলল–শোন বন্ধু, ডাক্তাররা পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে আমার মৃত্যুর দিন আর সময় সম্বন্ধে আমাকে রায় দিয়ে যাবেন, তখনই আমি উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণে কিছুমাত্র উদাসিন থাকব না।

ব্যবস্থা গ্রহণ বলতে তুমি কি বুঝাতে চাচ্ছ?

ডাক্তাররা যখনই আমার মৃত্যুর দিনক্ষণ বলে যাবে তার চব্বিশ ঘণ্টা আগেই আমি তোমাকে তলব করব।

ভালডিমার মাস সাতেক আগে আমাকে একটা চিঠি লিখেছিল। যথাসময়েই আমি সেটা হাতে পেয়েছিলাম। চিঠিটার বক্তব্য এরকম–

সুপ্রিয় পি
এখন অনায়াসেই চলে আসতে পার। গতকাল মাঝরাতে দুজন চিকিৎসক আমাকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আমার পরমায়ু সম্বন্ধে রায় দিয়ে গেলেন। সময় আগত। দেরি না করে এসে পড়।

ইতি
তোমার বন্ধু ভালডিমার

বন্ধুবর ভালডিমার চিঠিটা লেখার আধঘণ্টা পরেই সেটা আমি হাতে পেয়ে গেলাম। চিঠিটা পাওয়ার ঠিক পনেরো মিনিট পরেই আমি মুমূর্ষ বন্ধুর রোগশয্যার পাশে পৌঁছে গেলাম। দিন দশেক তাকে দেখা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু এই দশাটা দিনের মধ্যেই তার শরীরের অবস্থা যা হয়েছে, তা দেখামাত্রই চমকে ওঠার মতো। সর্বাঙ্গে রীতিমত কাঁপুনি লেগে যায়।

প্রথম দর্শনেই দেখলাম, তার মুখটা চকের মতো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। চোখ। দুটোনিস্তেজ, এতই ক্ষীণ হয়ে পড়েছে যে, চোয়ালের হাড় যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। গালের চামড়া পর্যন্ত ঢিলে হয়ে ঝুলে পড়েছে। আর নাক ও মুখ দিয়ে অনবরত শ্লেষ্ম বেরোচ্ছে।

আমি তার শিয়রে বসে হাতটা টেনে নিলাম। নাড়ি দেখলাম। নাড়ির গতি খুবই ক্ষীণ, নেই বললেই চলে। এতকিছু সত্ত্বেও আমার বন্ধুবর ভালডিমার অস্বাভাবিক দৃঢ় মনোবল আর সর্বশেষ দৈহিক শক্তির জোরেই তার ধড়ে এখনও প্রাণের অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে। নিজেকে একটু সতেজ করে নেওয়ার জন্য সে নিজের হাতেই শিশি থেকে ওষুধ ঢেলে নিয়ে খেল।

আমি দরজা ঠেলে যখন ঘরে ঢুকলাম তখন দেখলাম, দুর্বল হাতে সে একটা নোটবইতে কি যেন লিখছে।

আমাকে দেখেই সে ঠোঁটের কোণে ম্লান হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে নীরবে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। তারপর খুবই স্পষ্টস্বরে কথা বলল।

তার বিছানার দুদিকে দুজন চিকিৎসককে বসে থাকতে দেখলাম। আর মুমূর্ষ বন্ধুবর ভালডিমার বালিশে হেলান দিয়ে বসে। বালিশের গায়ে নিজের ভার সঁপে দিয়ে সে কোনোরকমে নিজেকে সোজা রেখেছে।

আমি ইশারায় ডাক্তার দুজনকে বাইরে, বন্ধুর আড়ালে ডেকে নিয়ে এলাম। তার শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলাম।

আমার প্রশ্নের উত্তরে উভয়ে একই কথা বললেন।

গত আঠার মাস যাবৎ আপনার বন্ধুর বাঁ দিকের ফুসফুস ক্রমে শক্ত হতে হতে এখন চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। মোদ্দা কথা, বর্তমানে তা একেবারেই কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে প্রায় অকেজো হয়ে পড়েছে। আর ডানদিকের ফুসফুস? সেটার ওপরের অংশও একই দশায় পৌঁছাতে চলেছে। আরও আগে নিচের দিকের বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে দগদগে ঘা হয়ে গেছে। ফুসফুসের কয়েকটা জায়গায় ছোট-বড় ছিদ্রও হয়েছে আর পাঁজরের গায়ে লটকে রয়েছে। সম্প্রতি ডানদিকে এ-হাল হয়েছে। ফুসফুস এত শক্ত হয়ে পড়েছে যা ভাবাই যায় না। সে সঙ্গে গতিবেগ অভাবনীয়ভাবে বেড়ে গেছে।

এক মাস আগেও রোগীর উপরোক্ত লক্ষণগুলো ধরা পড়েনি। মাত্র তিন মাস আগে ধরা পড়েছে, ফুসফুস পাঁজরের সঙ্গে লটকে রয়েছে।

তবে এখন আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা সম্ভব নয় সত্য, তবু মনে হচ্ছে মূল ধমণীটাও অবশ্যই অকেজো হয়ে পড়েছে, কেন সম্ভব নয়? কারণ, আমার বন্ধুবরের মারা যাবার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে রবিবার রাত বারোটা নাগাদ। আর আমি এ ব্যাপারটা নিয়ে এসব ভাবনা-চিন্তা করছি শনিবার সন্ধ্যা সাতটা নাগাদ। এটুকু সময়ের মধ্যে তার শেষ অবস্থায় আর কী-ই বা করার কথা ভাবা যেতে পারে?

ডাক্তারদের মতামত শোনার পর তাদের অনুরোধ করলাম–আগামীকাল রাত দশটা নাগাদ আপনারা উভয়েই যেন আমার মৃত্যুপথযাত্রী রোগী বন্ধুর কাছে উপস্থিত থাকবেন।

আমার কথায় সম্মতি জানিয়ে ডাক্তার দুজন বিদায় নিলেন। আমি তাদের বিদায় জানিয়ে ঘরে ঢুকে বন্ধুবর ভালডিমারের রোগশয্যার পাশে বসলাম। সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে ম্লান হাসল। তার বর্তমান শারীরিক পরিস্থিতি আর আসন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপারটা নিয়ে আমার খোলাখুলি আলোচনা হলো।

তার সঙ্গে কথা বলে আমি বুঝতে পারলাম, এ রকম মর্মান্তিক শোচনীয় পরিস্থিতিতেও তার আগ্রহ আগের মতোই আছে, সামান্যতমও হ্রাস পায়নি। আমি এতে যারপরনাই অবাক হলাম।

পরীক্ষার কাজ শুরু করতে দেরি দেখে সে আমাকে জোর তাগাদা দিতে লাগল– কেন মিছে দেরি করছ বন্ধু, কাজ শুরু করে দিলেই তো পার। তাছাড়া হাতে সময়ও তো বেশি নেই। নাও, কাজে লেগে যাও।

ঘরে দুজন নার্স উপস্থিত। তারা আমার হুকুম তামিল করার জন্য তৈরি হয়েই রয়েছে। সমস্যা দেখা দিল কাজ শুরু করার প্রস্তুতির ব্যাপারটা নিয়ে। সবার আগে দরকার আমার কাজের দুজন সাক্ষী। এরকম দুজন লোকের উপস্থিতি ছাড়া কাজ শুরু করতে কিছুতেই আমি মনের দিক থেকে সাড়া পেলাম না। আসলে দুর্ঘটনাটা তো যে কোনো মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে।

আমার বন্ধুবরের তাড়া দেখে আমি বললাম–এত ব্যস্ততার কিছু নেই। এখনও হাতে প্রচুর সময় আছে। আগামীকাল সকাল আটটা নাগাদ পরীক্ষা শুরু করব, ভেবে রেখেছি।

কাল! কাল সকালে! আজ, এখনই নয় কেন, বুঝছি না তো?

কাল সকালে একজন ডাক্তারি পাঠরত ছাত্রকে সামনে হাজির রাখব।

ডাক্তারি পড়ছে?

হ্যাঁ। তার নাম থিওডোর এলো—

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সে বলল–ঠিক আছে, তবে তা-ই কর।

সকাল হলো। ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলছে তার নির্দিষ্ট পথে আর নির্দিষ্ট গতিতে। ডাক্তার দুজন তখনও এসে পৌঁছায়নি। তাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেই ভালো হত। আমার এরকমই ইচ্ছা ছিল।

না, ডাক্তারদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা আর সম্ভব হয়ে উঠল না। বন্ধুবর ভালডিমারই বাগড়া দিল। সে এমন ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে, তা আর বলার নয়। তবে তার শারীরিক অবস্থা দেখে আমিও শেষপর্যন্ত আর দেরি করতে উৎসাহি হলাম না।

আমি কাগজ-কলম নিয়ে ডাক্তারি পড়ুয়া মি. এলের সামনে বসলাম। তিনি যা কিছু দেখেছেন, যা-কিছু বললেন সবই লিখে নিলাম। একটা অক্ষরও বাদ দিলাম না। আর মুখ থেকে শোনা আমার লিখে-নেওয়া সে বক্তব্য নিচে উল্লেখ করলাম–

পরদিন রাত আটটার সময় আমি বন্ধুবর ভালডিমারের হাত দুটো জড়িয়ে ধরলাম। আমার হাতে তার হাত দুটোকে ধরে রেখেই আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম– দেখ বন্ধু মি. এল–আমাদের কাছে উপস্থিত রয়েছেন। আমাদের কথোপকথনের সাক্ষী হিসেবে তাকে এখানে আনা হয়েছে। অতএব তার সামনে তোমার যা-কিছু বক্তব্য কিছুমাত্রও গোপন না করে স্পষ্টভাবে সবকিছু বলবে, খেয়াল থাকে যেন।

বন্ধুবর ভালডিমার সামান্য ঘাড় কাৎ করে আমার কথার সম্মতি জানাল।

আমি এবার তাকে বললাম–কোনোরকম দ্বিধা সঙ্কোচ না করে, খোলামনে বল, পরীক্ষঅর ব্যাপারে তোমার সম্মতি আছে তো?

সে এবার ক্ষীণ অথচ স্পষ্ট স্বরে নিজের মতো ব্যক্ত করতে গিয়ে বলল–আমার সম্মতি তো অবশ্যই আছে। আমি যদি মেসমেরিজমে সম্মত না-ই হতাম তবে আর তোমার কথামতো কাজ করতে গেলাম কেন। তাছাড়া তোমাকে তড়িঘড়ি খবর দিয়ে এখানে নিয়ে আসতেই বা উৎসাহি হতে যাব কেন, বল তো?

হুম।

আমি মেসমেরিজমে সম্মত। আর তা এখনই শুরু কর, এটাই আমার ইচ্ছা।

হ্যাঁ, তা-ই করছি।

এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছ। নাও, ঝটপট কাজে লেগে যাও।

ব্যস আর মুহূর্তমাত্রও সময় নষ্ট না করে আমি তার ওপর মেসমেরিজম বিদ্যা প্রয়োগ করতে মেতে গেলাম। গোড়াতেই হস্তচালনা শুরু করে দিলাম, ইতিপূর্বে বহুবারই সে পদ্ধতিতে তাকে ঘুম পাড়িয়েছিলাম, ঠিক একই পদ্ধতিতে।

তার কপালের ওপর দু-একবার টোকা দেওয়ামাত্র সম্মোহনের প্রভাব ফলতে শুরু করে দিল।

কিন্তু না, ফল তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দশটার কাছাকাছি ডাক্তার দুজন হাজির হলেন। এর আগে পর্যন্ত ফল না পাওয়ায় কিছুটা হতাশা আমার মধ্যে জেঁকে বসেছিল, সত্য বটে।

ডাক্তার দুজন ঘরে পা দিতেই আমি কোনোরকম ভূমিকার অবতারণা না করেই সরাসরি প্রশ্ন করলাম–বন্ধুবর ভালডিমারের ওপর মেসমেরিজমবিদ্যা প্রয়োগ করতে চলেছি, আপনাদের কোনো আপত্তি আছে কী?

তাঁরা সমস্বরে বললেন-দেখুন, রোগীর মৃত্যুযন্ত্রণা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। অতএব এখন মেসমেরিজমের ঝুঁকি নেওয়া যেতে পারে?

ডাক্তার দুজনের সম্মতি পেয়েই আমি নিচের দিকে হাত চালালাম। এবার ভালডিমারের খুলে-রাখা ডান চোখের দিকে আমার দৃষ্টি নিবন্ধ রাখলাম।

একজন ডাক্তার তার নাড়ি ধরে সর্বক্ষণ বসেই রইলেন। দেখলেন নাড়ির গতি খুবই ক্ষীণ। অতিকষ্টে শ্বাসকার্য চালাচ্ছে। প্রতি আধ মিনিট অন্তর নিশ্বাস ফেলছে।

তার এই একই অবস্থা পনেরো মিনিট ধরে চলল। পনেরো মিনিট পরে সে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আমি লক্ষ্য করলাম, এবার তার শ্বাসক্রিয়া চালাবার আর কোনো কষ্টই রইল না। তবে এও লক্ষ্য করলাম, আধ মিনিট পর শ্বাস ফেলার ব্যাপারটা রয়েই গেল।

আমি এবার তাড়াতাড়ি তার হাত-পা পরীক্ষা করে দেখলাম, বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। উত্তাপ বলতে কিছুই নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম, এগারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। এবার তীক্ষ্ণ অনুসন্ধিৎসু নজরে বন্ধুর দিকে তাকিয়ে রইলাম। লক্ষ্য করলাম, তার মধ্যে প্রকৃত মেসমেরিজমের আসল লক্ষণগুলো এক এক করে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। আর সেগুলো খুবই স্পষ্ট।

আমি তার চোখের ক্রমপরিবর্তনটুকু স্পষ্ট দেখতে পেলাম। আর লক্ষ্য করলাম, ঘুমের ঘোরে যারা হাঁটাচলা করে তাদের চোখের সাদা অংশটুকুতে যেমন অন্তর্মুখিত প্রকাশ পায় ঠিক সেরকমই ভাব তার চোখে প্রকট হয়ে উঠল।

এবার দ্রুত হস্তচালনা করতে শুরু করলাম। করলামও বার কয়েক।

ব্যস, তার চোখের পাতা তির তির করে কেপে উঠল। দু-তিনবার কাঁপা কাঁপির পরই চোখের পাতা বন্ধ হয়ে গেল। দুটো চোখই এবার বন্ধ রইল।

আমি এতেও সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। ফলে আবারও হস্তাচালনা শুরু করলাম। বার কয়েক হস্তচালনা করে আর ইচ্ছাশক্তিকে সম্পূর্ণরূপে খাঁটিয়ে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ শক্ত আর সহজ-সরল করে আনলাম। এতে অবশ্য আমাকে কিছুটা বেগ পেতে হয়েছে।

ভালডিমার এবার দুহাত আর পরা দুটো টান টান করে বিছানার ওপর ছড়িয়ে দিল। আর মাথাটাকে সামান্য উঁচু করে সে স্থির হয়ে রইল।

তখন মাঝরাত। ঘরে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের অনুরোধ করলাম। আপনারা বন্ধু ভালডিমারের শরীরিক অবস্থা ভালোভাবে লক্ষ্য করুন, দেখে নিন, এখন এ। সম্পূর্ণরূপে সম্মোহিত।

রোগীর ক্রমপরিবর্তন লক্ষ্য করে ডাক্তার ডি-র মধ্যে প্রবল উত্তেজনা দেখ দিল না। তিনি ব্যাপারটাতে খুবই আগ্রহান্বিত হয়ে পড়লেন। তিনি এবার মুখ খুললেন–আমি ব্যাপারটায় খুবই উৎসাহ বোধ করছি।

আমি নীরবে মুচকি হেসে বললাম খুবই আনন্দের কথা! এতে আপত্তির কোনো কারণই থাকতে পারে না।

ডক্টর এফ বললেন–আমার ইচ্ছা থাকলেও থাকা সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি কাজ থাকলে অবশ্যই বাকি রাতটুকু এখানেই কাটিয়ে যেতাম। তবে কথা দিচ্ছি, ভোর হলেই চলে আসব।

ডক্টর এফ বিদায় নিয়ে বাড়ি গেলেন।

ডক্টর ডি আর নার্স দুজন ঘরে রয়ে গেলেন।

বন্ধুবর ভালডিমারকে একই রকমভাবে রাত তিনটি পর্যন্ত রেখে দিলাম। অর্থাৎ ডক্টর এফ বিদায় নিয়ে ঘর ছেড়ে যাবার সময় তার যে রকম অবস্থা দেখে গিয়েছিলেন ঠিক সেরকমই তাকে রেখে দিলাম।

এবার তার অবস্থা এমন হয়ে এলো যে, তার নাকের ডগায় আয়না ধরে কেবলমাত্র এটুকুই বোঝা গেল, তার শ্বাসক্রিয়া চলছে।

এমনও দেখা গেল, তার হাত-পা আড়ষ্টপাথরের মতো শক্ত আর আগের মতো বরফের মতো ঠাণ্ডা। তবে তার শরীরের কোথাও মৃত্যুর সামান্যতম লক্ষণও চোখে পড়ল না।

একটা ব্যাপার কিন্তু খুবই সত্য যে, বন্ধু ভালডিমারের আগে মেসমেরিজম অবস্থায় রেখে কখনই সম্পূর্ণরূপে সাফল্য লাভ করিনি। ডান বাহুর ওপর হাত চালনা করে ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে আমার হাত নাড়ায় তার হাত নাড়াতে আমি পারিনি!

মৃত্যুপথযাত্রী মুমুর্ষ বন্ধু ভালডিমারের ওপর ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে ডান বাহুর ওপর হাত চালনা করে আমার নাড়ার অনুকরণে তার হাত নাড়ানোর চেষ্টা আবারও করলাম, ব্যর্থ হব–সাফল্য লাভ করব না জেনেই তা করলাম।

আরে বাবা! এ যে রীতিমত অবিশ্বাস্য কাণ্ড! অত্যাশ্চর্যভাবে সাফল্য লাভ করায় আমি যারপরনাই অবাক হয়ে পড়লাম। আমার হাতটা যে যে দিকে গেল, তার হাতটাও ঠিক সে সে দিকে নড়তে লাগল। খুশিতে আমর বুকের ভেতরে যেন রীতিমত আন্দোলন শুরু হয়ে গেল।

আমি তার মুখের ওপর সামান্য ঝুঁকে বললাম–বন্ধু ভালডিমার, তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছ?

সে ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল–না।

তার ঠোঁট দুটো তির তির করে কাঁপতে আরম্ভ করল।

আমি একই প্রশ্ন পর পর তিনবার পুনরাবৃত্তি করলাম।

প্রথম দুবার তার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল না।

কিন্তু তৃতীয়বার তার মধ্যে প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না সত্য। কিন্তু তার চোখের পাতা ধীরে ধীরে খুলে গেল। ঠোঁট দুটো বার কয়েক নড়ে উঠল। পর মুহূর্তেই ঠোঁট দুটোর ফাঁক দিয়ে খুবই অস্পষ্ট কথা কটা বেরিয়ে এলো–হ্যাঁ, ঘুমোচ্ছি। জাগিয়ে দিও না। এভাবেই আমাকে মরতে দাও!

আমি হাত বাড়িয়ে তার হাত-পা পরীক্ষা করলাম। বুঝলাম আগের মতোই শক্ত। তবে আমি নড়ানোমাত্র সে ডান হাতটাকে একই রকমভাবে নড়াচ্ছে।

আমি আবারও তার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করলাম–একটা কথা খোলাখুলিভাবে বল তো, তুমি কী এখনও বুকে ব্যথা বোধ করছ?

সে আগের চেয়ে আরও স্পষ্ট স্বরে জবাব দিল–না, ব্যথা নেই–আমি মরতে চলেছি!

সকালে ডক্টর এফ না আসা অবধি বন্ধু ভালডিমারকে আর বিরক্ত করলাম না।

ভোর হবার পর পরই ডাক্তার এফ হাজির হলেন। তিনি ঘরে ঢুকেই দেখলেন, রোগী এখনও বেঁচে আছে। ব্যাপারটা তাকে যারপরনাই বিস্মিত করল। তিনি চোখের তারায় বিস্ময়ের ছাপ এঁকে আমার বন্ধুর দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলেন।

তিনি এগিয়ে গিয়ে রোগীর বিছানার পাশের চেয়ারটায় বসলেন। এবার হাত বাড়িয়ে তার নাড়ি পরীক্ষা করলেন। তারপর ঠোঁটের সামনে আয়না ধরলেন। তারপর সেটাকে এদিক-ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিলেন। এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। তারপর বললেন–থামবেন না, চালিয়ে যান–চালিয়ে যান।

ভালডিমার আগের মতোই মিনিট কয়েক নিশ্চল-নিথরভাবে কাটিয়ে দিল। আমি টুকরো-টুকরো কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। তার কাছ থেকে কোনো জবাবই পেলাম না।

তাকে নীরব দেখে ভাবলাম, একটু-আধটু শক্তি সঞ্চয় করে নিচ্ছে।

পর পর চারবার আমি তাকে একই প্রশ্ন করলাম। প্রথম তিনবার তার দিক থেকে। কোনো জবাব পেলাম না। চতুর্থবার খুবই ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দিল–হ্যাঁ এখনও ঘুমিয়ে রয়েছি।

ডাক্তার দুজন তার মুখের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে রইলেন। এক সময় উভয়ে প্রায় সমস্বরেই বললেন–মৃত্যু পর্যন্ত মি. ভালডিমারের এ প্রশান্ত অবস্থানে অব্যাহত রাখা হোক। ঠিক এমনই প্রশান্ত অবস্থার মধ্যে থাকুন।

আমি প্রায় অস্ফুট উচ্চারণ করলাম–হুম!

তারা এবার বললেন–মৃত্যুক্ষণ আসতে নাকি আর তেমন দেরি নেই। আমাদেরও মনে হচ্ছে খুব বেশি হলেও তিনি আর মিনিট কয়েক টিকে থাকবেন।

আমি আগের সে প্রশ্নটাই বন্ধুকে আবার জিজ্ঞাসা করলাম।

আমি প্রশ্নটা শেষ করতে-না-করতেই তার মুখমণ্ডলে অভূতপূর্ব, একেবারেই অত্যাশ্চর্য পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম।

আমি অনুসন্ধিসু দৃষ্টিতে তার চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে থেকে আকষ্মিক পরিবর্তনটুকুর দিকে নজর রাখতে লাগলাম। দেখলাম, তার চক্ষুগোলক ধীরে ধীরে ওপরের দিকে উঠে গেল। এ জন্যই চোখের মণি আমার দৃষ্টির বাইরে চলে গেল। গায়ের চামড়া যেন সাদা চকের মতো বিবর্ণ হয়ে গেল। হঠাৎই জ্বরভাবযুক্ত উত্তপ্ত গোলাকার দাগ দুটো নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। নিভে গেল।

নিভে গেল কথাটা বিশেষ কারণবশত ব্যবহার করতেই হলো। মনে হলো, জ্বলন্ত মোমবাতির মতোই কোনো অদৃশ্য শক্তি ফুঁ দিয়ে হঠাৎ নিভিয়ে দিয়েছে।

একটু আগেও ওপরের ঠোঁটটা নিচের দিকে ঝুলে থাকার জন্য দাঁতগুলো চাপা পড়েছিল। দেখা যাচ্ছিল না। তারপর হঠাৎ অস্বাভাবিক কাঁপতে কাঁপতে ঠোঁটটা ওপরের দিকে উঠে গেল। ব্যস, মুহূর্তের মধ্যেই দাঁতের পাটি আমাদের চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল, আরও প্রকট হয়ে দেখা দিল কালচে হয়ে ওঠা জিভটা। তখন ঘরে যারা উপস্থিত ছিলেন সবাই মৃত্যুর দৃশ্য ইতিপূর্বে বহুবারই প্রত্যক্ষ করেছেন, তবু আমার বন্ধুবর ভালডিমারের তখনকার পরিস্থিতি তার অস্বাভাবিক মুখমণ্ডলটা দেখামাত্র চমকে উঠলেন। ফ্যাকাশে বিবর্ণ মুখে সবাই তার বিছানা থেকে হঠাৎ পিছিয়ে না গিয়ে পারলেন না।

আমার বিশ্বাস, আমার বক্তব্যে পাঠক-পাঠিকার মনে অবিশ্বাস জন্মাচ্ছে। এ রকম কথায় অবিশ্বাস জন্মানোর কথাই বটে। তবু সেদিন যা-কিছু ঘটেছিল আমি একটা কথা বাদ না দিয়ে হুবহু তা-ই বলব।

আমরা, বিশেষ করে উপস্থিত ডাক্তার দুজন আমার বন্ধু ভালডিমারের মধ্যে প্রাণের আর সামান্যতম লক্ষণও দেখতে না পেয়ে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নিতেই হলো সে মারাই গেছেন।

তার মৃত্যু হয়েছে এরকম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আমরা সবাই আলোচনার মাধ্যমে একমত হয়ে তার দেখভালের দায়িত্ব নার্স দুজনের ওপরই ছেড়ে দিলাম। ঠিক সে মুহূর্তেই তার জিভটা অস্বাভাবিক রকম কেঁপে উঠল। পুরো একটা মিনিট ধরে একইভাবে কাটল।

এবার তার মুখবিবরটা পুরোপুরি খুলে একেবারে হাঁ হয়ে গেল। হাঁ হয়ে থাকা চোয়ালের ফাঁক দিয়ে এমন এক বুক-কাঁপানো কণ্ঠস্বর বেরিয়ে এলো যাকে ভাষায় প্রকাশ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। স্বরটা অভাবনীয় কর্কশ, ভাঙা-ভাঙা এবং রীতিমত শূন্যগর্ভ। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বীভৎস ছাড়া সে স্বরটাকে বীভৎস বা অবর্ণনীয় ছাড়া অন্য কোনোভাবে প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সত্যি, কোনো মানুষ কোনোদিনই এমন ভয়ঙ্কর শব্দ অবশ্যই শোনেনি।

আর ভয়ঙ্কর সে শব্দটা যে অপার্থিব, এতে কোনোরকম সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। অপার্থিব বলছি এ কারণেই যে, অন্তত আমার যা মনে হয়েছিল তা-ই ব্যক্ত করলাম। প্রথমত শব্দটা যেন বহু, বহু দূরবর্তী উৎস থেকে বেরিয়ে এসেছে। আর দ্বিতীয়ত তা আঠালো বস্তুর মতোই রীতিমত চটচটে।

এতক্ষণ কণ্ঠস্বর আর শব্দর ভয়ঙ্করতার কথাই বললাম। এবার সে পরিস্থিতিটার কথা আরও একটু খোলসা করে বলছি–যাকে শব্দ বলছি তাকে শব্দাংশ বলাই উচিত। কারণ শব্দটা শুরু হবার পর হঠাৎ যেন মাঝপথে থেমে গিয়েছিল।

মাত্র কয়েক মিনিট আগে আমি বন্ধু ভালডিমারকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, সে ঘুমোচ্ছে কি না।

আমার প্রশ্নটার উত্তর সে যা দিয়েছিল, তা এরকম- হ্যাঁ, হ্যাঁ, না, ঘুমোচ্ছিলাম বটে। এখন মরতে চলেছি।

সে আমার প্রশ্নটার উত্তর যেরকম ভয়ঙ্কর স্বরে দিয়েছিল, তা কানে যাওয়া মাত্র আমার বুকের ভেতরে কেবলমাত্র ধড়াস করেই উঠেছিল তা নয়, গায়ের সবগুলো নোম একই সঙ্গে খাড়া হয়ে উঠেছিল। সত্যি কোনো শব্দ যে এরকম ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক হতে পারে, বার বার কেটে কেটে বেরোতে পারে খুব বেশি রকম দুঃস্বপ্নেও কেউ তা কল্পনাও করতে পারবে না। অতএব গায়ে যে কাঁটা দিয়েছিল তা কারো পক্ষে অস্বীকার করার কথা নয়।

ভয়ঙ্কর শব্দটা কানে যাওয়ামাত্র ডাক্তারি পড়ুয়া ছাত্র মি. এল মুহূর্তে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে নার্স দুজন কাঁপতে কাঁপতে ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

ঘর ছেড়ে যাবার পর তাদের ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য বহুভাবে চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কিছুতেই আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।

সে মুহূর্তে আমার অবস্থা যে কেমন খারাপ হয়ে পড়েছিল তা চেপে রেখে পাঠক পাঠিকাকে ধন্ধের মধ্যে রাখা আদৌ আমার ইচ্ছে নয়।

সত্যি বলছি, তখন আমার জ্ঞান-বুদ্ধি যেন একেবারেই ভোতা হয়ে গিয়েছিল। যাকে বলে পুরোপুরি লোপ পেয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টাখানেক কারো মুখে টু-শব্দটিও ছিল না। আসলে কথা বলার ক্ষমতাই যেন ছিল না।

নিরবচ্ছিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে মি. এল-এর সংজ্ঞা ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়েছি। দীর্ঘ চেষ্টার পর তার মধ্যে সংজ্ঞা ফিরে এলো। সে চোখ মেলে তাকাল। একটু পরেই ধীরে ধীরে উঠে বসল।

এবার মি. এলের সঙ্গে বন্ধু ডালডিমারের অবস্থা নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করলাম।

বন্ধুর অবস্থা সম্বন্ধে যা-কিছু বলেছি, দেখা গেল এখন তার কিছুমাত্রও হেরফের হয়নি। সে একই রকম অবস্থায় বিছানা আঁকড়ে পড়ে রয়েছে। তবে বর্তমানে যেটুকু পরিবর্তন হয়েছে, মুখের সামনে আয়না ধরলে আগের মতো নিশ্বাসের লক্ষণ চোখে পড়ছে না।

বন্ধুর বাহু থেকে টেনে রক্ত বের করার চেষ্টা করা হলো। একবার নয়, বেশ কয়েকবারই চেষ্টা করা হলো। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হতে হলো।

এবার আমার ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে তার বাহুকে আগের মতো নাড়াবার চেষ্টা করলাম। এ-কাজেও দারুণভাবেই ব্যর্থ হতে হলো। কিছুতেই তার বাহুটাকে নাড়াতে পারলাম না। মেসমেরিজমের লক্ষণ প্রকট হয়ে উঠেছিল কেবলমাত্র আমার বন্ধুর জিভে।

আমি যতবারই তাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করেছি, ততবারই তার জিভটা তিরতির করে কাঁপতে আরম্ভ করেছে। ব্যাপারটা দেখে মনে হলো কিছু বলার জন্য, মানে আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু প্রতিবারই সে অসহায়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। জিভটা নড়েছে, কিন্তু কোনো স্বরই বেরোয়নি।

কেবলমাত্র আমি নই, অন্যান্য সবাইও এক এক করে প্রশ্ন করেছে। তারাও ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি বন্ধু ভালডিমারকে যুগ্ম সন্মোহনের প্রভাবে ও অন্যকে নিয়ে প্রশ্ন করাতেও বাদ দেইনি। এক্ষেত্রেও প্রায় সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। তার জিভ অনড়ই থেকে গেছে।

এবার নার্স পরিবর্তন করার দরকার বোধ করলাম। কারণ, যে দুজন নার্স বিন্দ্ৰি রাত কাটিয়েছে তাদের পক্ষে আর কর্তব্য পালন করা সম্ভব নয়। তারাও তো মানুষ। শরীরের ক্লান্তি আসাটাই তো স্বাভাবিক। ফলে অন্য দুজন নার্স জোগাড় করে তাদের। ওপর বন্ধুবর ভালডিমারের দেখভালের দায়িত্ব দিয়ে ডাক্তার দুজন আমার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন। মি. এল আর আমিও তাদের পিছন পিছনই বেরিয়ে এলাম।

বিকেল হলো। আমরা আবার এক-এক করে রোগীর অবস্থা দেখার জন্য তার ঘরে হাজির হলাম।

দরজায় দাঁড়িয়েই আমি শয্যাশায়ী বন্ধুর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলাম। তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। কিন্তু তার অবস্থার কোনো পরিবর্তনই আমার চোখে পড়ল না। আগের মতো একই অবস্থায় সে বিচানা আঁকড়ে নিশ্চল-নিথর পাথরের মূর্তির মতো এলিয়ে পড়ে রয়েছে।

আমরা আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিলাম, বন্ধুকে আর জাগানোর চেষ্টা করে ফায়দা কিছু হবার নয়। তার শারীরিক অবস্থা দেখে পরিষ্কার দেখা গেল, মৃত্যু বলতে যা বোঝায় তা হয়ে গেছে, একমাত্র মেসমেরিজমের মাধ্যমে তাকে এখনও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। অতএব তাকে আবার জাগাবার চেষ্টা করলে মৃত্যু দ্রুত ঘটে যাওয়া ছাড়া কিছুই হওয়া সম্ভব নয়।

সেদিন, সে মুহূর্তের পর থেকে পুরো একটা সপ্তাহ পর্যন্ত পুরো সাত সাতটা দিন বন্ধু ভালডিমার একইভাবে বিছানা আঁকড়ে এলিয়ে পড়ে থেকেছে।

আমি, ডাক্তার আর অন্যান্যদের সঙ্গে করে মাঝে মাঝে গিয়ে বন্ধুর অবস্থা দেখে এসেছি। নার্সরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো তার দেখাশোনায় লিপ্ত থেকেছে। তাদের কর্তব্যে এতটুকুও ত্রুটি ছিল না।

গত শুক্রবারের কথা। সেদিন সকালেই মনস্থ করলাম, বন্ধু ভালডিমারকে আর একবার জাগাবার চেষ্টা করে দেখি। করলামও তা-ই। কিন্তু সর্বশেষ এ পরীক্ষার ফল ভালো হয়নি। আর এ ঘটনাটা নিয়েই আড়ালে যত কিছু গুনগুনানি, যত কিছু ফিসফিসানির সূত্রপাত হয়েছিল।

মেসমেরিজম পদ্ধতি অনুযায়ী বেশ কিছুক্ষণ ধরে হস্তচালনার কাজে লিপ্ত রইলাম। কিন্তু নিদারুণভাবে ব্যর্থ হতে হলো।

এবার তার চোখের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে দেখতে পেলাম, তার চোখের করোনিয়া নিচের দিকে ধীরে ধীরে কিছুটা নেমে গেল। প্রথমে চোখের ভুল মনে করলাম। কিন্তু না, ঠিকই দেখেছি বটে!

তার পর মুহূর্তে নজরে পড়ল, নিচের দিকে নেমে-আসা চোখের তারার গা থেকে খুবই দুর্গন্ধযুক্ত হলুদ রস চুঁইয়ে-চুঁইয়ে পড়তে লাগল। আমি কয়েক মুহূর্ত সেখান থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারলাম না।

.

আমার পক্ষে হাত গুটিয়ে নিশ্চেষ্টভাবে বসে থাকা সম্ভব হলো না। আবার সক্রিয় হয়ে উঠলাম। চেষ্টা চালাতে লাগলাম, ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে বন্ধু ভালডিমারের বাহুকে আবার চালনা করা সম্ভব হয় কিনা। নিষ্ঠার সঙ্গে চেষ্টা চালালাম। কিন্তু তাশ হতে হলো। আমার চেষ্টা পুরোপুরি ব্যর্থ হলো।

এবার ডক্টর এফের ইচ্ছায় তাকে একটা প্রশ্ন করলাম–বন্ধু ভালডিমার, একটা প্রশ্ন করতে চাচ্ছি, উত্তর দেবে কি?

সে আগের মতোই নির্বাক নিশ্চল নিথরভাবেই এলিয়ে পড়ে রইল।

আমি এবার বললাম–বন্ধু, বল তো, এ মুহূর্তে তোমার অনুভূতি কেমন, বলতে পারবে কি?

এবারও তার দিক থেকে কোনো জবাবই পেলাম না। তবে মুহূর্তের মধ্যে তার চোখ দুটোর ওপর চক্রাকার লালচে আভা প্রকাশ পেল। তারপরই তার জিভটা তিরতির করে কেঁপে উঠল। ব্যাপারটা দেখে আমার যেন স্পষ্টই মনে হল, ব্যথিত অস্বস্তিকর মুখবিবরের ভেতরে জিভটা অস্বাভাবিকভাবে ঘুরপাক খেতে আরম্ভ করেছে। মুখটা দীর্ঘ সময় হাঁ করা অবস্থায় ছিল। কারণ, চোয়াল আর ঠোঁট দুটো আগের মতোই একই রকম আড়ষ্ট ছিল। এ সাতটা মাস একই অবস্থায় ছিল, কোনো পরিবর্তনই লক্ষিত হয়নি।

তারপর জিভ দিয়ে কদাকার সে স্বর মুখবিবর দিয়ে ঠেলে বেরিয়ে এলো। পরম পিতার দোহাই! আর দেরি কোরো না, দ্রুত কর! দ্রুত! হয় আমাকে জাগিয়ে দাও, তা যদি নাই হয় তবে একটা কিছু কর। এখনই, এক মুহূর্তেই! দ্রুত কর। আমি মরে যাচ্ছি। সত্যি আমি মরে গেছি।

ব্যাপারটা আমাকে রীতিমত হকচকিয়ে দিল। আমি ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে কি করব, কি-ই বা করা উচিত হঠাৎ করে ঠিক করে উঠতে পারলাম না।

বেশ কিছুক্ষণ অথর্বের মতো চুপচাপ বসে থাকার পর বন্ধুকে স্বাভাবিক করে তোলার জন্য চেষ্টা চালাতে আরম্ভ করলাম। পুরোপুরি ব্যর্থ হতে হলো।

এবার তাকে জাগিয়ে তোলার জন্য চেষ্টা করলাম। এতেও দারুণভাবে ব্যর্থ হলাম। ইচ্ছাশক্তি প্রয়োগ করে যা করলাম, তাকে দাপাদাপি ছাড়া অন্য কোনো নামে অভিহিত করা সম্ভব নয়।

উফ! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম, কাজ হতে শুরু হয়েছে।

বুঝতে অসুবিধা হলো না। বন্ধু ভালডিমারের মেসমেরিজমের প্রভাব শীঘ্রই কেটে যাবে।

ব্যাপারটা কি হয়, কিভাবে বন্ধুর মেসমেরিজমের প্রভাব কাটে তা দেখার জন্য অত্যুগ্র আগ্রহের সঙ্গে লক্ষ্য করতে লাগলাম।

আসলে কার্যত যা ঘটল তা এমনই অদ্ভুত, এমনই অসম্ভব ব্যাপার যা চাক্ষুষ করার জন্য কোনো মানুষের পক্ষেই মানসিক দিক থেকে প্রস্তুত থাকা সম্ভব নয়।

আমি ব্যস্ততার সঙ্গে হস্তচালনা শুরু করে দিলাম আর বার বার আমার ভেতরে রোমাঞ্চ জাগতে শুরু করল। আমি বন্ধুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম মারা গেছি! আমি মারা গেছি!

তার গলা দিয়ে কথাগুলো বেরোচ্ছে বটে, কিন্তু মুখবিবরে বার বার জিভটা নড়াচড়া করছে। আর কথাগুলো বেরোচ্ছে জিভ থেকে, ঠোঁট থেকে নয়।

পরমুহূর্তেই হঠাৎই আমার বাহুর নিচেই বন্ধুর সম্পূর্ণ দেহটা মিনিট খানেকের মধ্যেই দুমড়ে, মুচড়ে কুঁকড়ে, গুটিয়ে ছোট্ট হয়ে গিয়ে পুরোপুরি পচে গেল।

ব্যস, সবশেষ। বিছানায় ছড়িয়ে পড়ে রইল সামান্য পরিমাণে খুবই দুর্গন্ধময় তরল পদার্থ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *