1 of 2

দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান

দ্য কনভারসেসন অব ইরোজ অ্যান্ড চারমিয়ান

ইরোজ বলল–আমাকে কেন ইরোজ নামে সম্বোধন করছ?

চারমিয়ান বলল–হ্যাঁ, এখন থেকে তোমাকে এ নামেই সম্বোধন করা হবে। মনে কর, তোমার ফেলে-আসা পৃথিবীর নামটা হারিয়ে গেছে। আমি নিজের যেমন পৃথিবীর নামটাকে ভুলে যেতে আগ্রহি, তোমাকেও তাই করতে হবে। শোন, এখন থেকে আমার নাম হবে, চারমিয়ান। এ নামেই আমাকে সম্বোধন করবে, বুঝলে।

ইরোজ বার কয়েক এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল–কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে না যে, আমি স্বপ্নে বিভোর হয়ে রয়েছি।

না, এখন আর স্বপ্ন বলে কোনোকিছুর অস্তিত্ব নেই। এখন শুধুই রহস্য আর রহস্য। তোমার মধ্যে প্রাণের অস্তিত্ব বর্তমান, যুক্তির উপস্থিতি দেখে আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে, তা আর বলার নয়! তোমার চোখের ওপরের ছায়ার আস্তরণ অপসারিত হয়ে গেছে। মনকে শক্ত কর, জোর আন আর মন থেকে ভয়-ডরকে দূরে সরিয়ে দাও ইরোজ। এতদিন তুমি গভীর ঘোরের মধ্যে ছিলে, তোমার ভাগে যে দিন কয়টা ভাগে পড়েছিল, এখন আর সে অবস্থা নেই। তোমাকে কাল দীক্ষা দিয়ে তৈরি করে নেব।

দীক্ষা!

হ্যাঁ, দীক্ষা। তোমার মধ্যে যে আশ্চর্য অস্তিত্ব বর্তমান–কেবলই আনন্দ আর বিস্ময়।

দেখ, যাকে তুমি ঘোর বলছ, তা আমার মধ্য থেকে কেটে গেছে। আগেকার সে জমাটবাধা ভয়ঙ্কর অন্ধকারও বিদায় নিয়েছে। দুর্বলতাও আর নেই। ভয়ঙ্কর আওয়াজটাও আর শুনতে পাচ্ছি না। তবুও যেন সবকিছু কেমন ওলট পালট হয়ে যাচ্ছে, ঘুলিয়ে যাচ্ছে। আমার এ-নতুন অস্তিত্বের ক্ষীণ উপলব্ধি আমার ভেতরে যেন প্রতিনিয়ত সূঁচ ফুটিয়ে চলেছে।

চারমিয়ান ক্ষীন হেসে বলল–শোন, মাত্র দিন কয়েকের মামলা। কয়েকদিন এরকম হবার পর সবকিছু কেটে গিয়ে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। তুমি এখন কী মর্মান্তিক পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছ, তা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছি। ওই একই অবস্থায় আমিও ছিলাম। কবে? কতদিন আগে? পৃথিবীর হিসাব অনুযায়ী দশ বছর আগেকার কথা। আজও কিন্তু আমার সবকিছু স্পষ্ট মনে আছে। তবে একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, দুঃখ-যন্ত্রণা সহ্য করতে পেরেছ বলেই তোমার পক্ষে এখানে আসা সম্ভব হয়েছে।

ইরোজ সবিস্ময়ে বলল, এখানে! এখানে বলতে তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চারমিয়ান বলে উঠল–এ জায়গাটার নাম আইদেন।

কি বললে, আইদেন!

হ্যাঁ, এটা তো আইদেন নামেই পরিচিত।

আইদেন! আমার সবকিছু কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, চারমিয়ান। সবকিছু কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে। জানার জগতে অজানা আধিপত্য বিস্তার করছে। রহস্যময় ভবিষ্যৎ এসে মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে আনন্দঘন নিশ্চিত বর্তমানে। অসহ্য! রীতিমত অসহনীয় ব্যাপার।

কেন? এ কথা বলছ কেন? অসহ্য কেন?

এত বোঝা সইতে পারা আমার পক্ষে নিতান্তই অসহনীয় হয়ে পড়েছে চারমিয়ান।

আমার কথা শোন ইরোজ–

তাকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই ইরোজ বলে উঠল–কী? কোন কথা?

তুমি এসব অবান্তর ভাবনা-চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দাও। এপ্রসঙ্গে তোমার সঙ্গে কাল কথা বলব–আজ নয়।

কেন? কাল কেন? আজ নয় কেন?

কারণ, আজ তোমার মন বড়ই চঞ্চল। আজ কেবলমাত্র স্মৃতিমন্থন করে যাও, তবেই মনে স্বস্তি আসবে, শান্তি পাবে। আর দেখবে উত্তেজনা প্রশমিত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। আর একটা কথা–।

কী? কীসের কথা বলতে চাইছ?

ভুলেও যেন এদিক-ওদিক তাকাতে চেষ্টা কোরো না। এমনকি সামনেও তাকাবে না। কেবলমাত্র পিছনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখ। আমি কিন্তু তোমার মুখ থেকেই মহাপ্রলয়ের ভয়ঙ্কর ঘটনাটার খুঁটিনাটি বিবরণ শুনতে চাই। যার ফলে তোমাকে এখানে আসতে হয়েছে। হাজির হয়েছ আমাদের সবার মাঝখানে। ইরোজ, কোনো দ্বিধা না করে আমার কাছে সবকিছু খোলসা করে বলো। পিছনে ফেলে-আসা পৃথিবীর চেনা-জানা ভাষা আর ভঙ্গিতে কথা বল, যে পৃথিবী ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক ঘটনা-দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে চিরদিনের মতোই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সে পৃথিবীর কথা শোনাও যা আর না শোনাও তাই। ইরোজ, যে পৃথিবীর ভাষার মাধ্যমে তুমি আমার কাছে সব বৃত্তান্ত খুলে বলো।

প্রলয়,মহাপ্রলয়ই বটে। আর লোমহর্ষক ব্যাপার-স্যাপারই বটে। গায়ের হিম হয়ে যাওয়ার মতো মহাপ্রলয়ঙ্কর কাণ্ড! সে কী স্বপ্ন, না কী সত্যি।

সত্যি হলেও তা কিন্তু পুরোপুরি স্বপ্নেরই মতো। তবে এখন কিন্তু সে-স্বপ্ন টুটে গেছে ইরোজ। একটা কথা ভালো করে ভেবে বল তো।

কী? কোন কথা

আমাকে দেখে তোমার কি মনে হয় আমি দুঃখ-যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি? ভালো করে ভেবে বল তো, তাই মনে হয় কী?

এখন তা মনে হচ্ছে না সত্য। কিন্তু শেষের সেদিনের কথা খুব বেশি করে আর ভীষণভাবে মনে পড়ছে চারমিয়ান।

কোন ব্যাপারটার ইঙ্গিত দিচ্ছ বলতো ইরোজ?

শোক তাপের জমাটবাধা ঘন কালো মেঘের আস্তরণ তোমার বাড়ির মাথায় তখন ভেসে বেড়াচ্ছিল!

কেবলমাত্র শেষের সে দিনটার কথাই বা বলছ কেন ইরোজ? সব শেষের যে ভয়ঙ্কর মুহূর্তটার কথা খুলে বলে নিজের মনকে হালকা কর। পৃথিবী জুড়ে রীতিমত প্রলয়ঙ্কর কাণ্ড, মহাপ্রলয়ের মহা বিপর্যয় উলঙ্গনাচ পৃথিবী জুড়ে শুরু হয়ে গিয়েছিল। ব্যস, একুটুই কেবলমাত্র এটুকই আজ মনে আছে। তারপর কি কি ঘটনা ঘটেছিল, কিছুই স্মৃতির পটে আনতে পারছি না।

তবু বলছি, চেষ্টা কর, চেষ্টা করে দেখ কিছু স্মৃতিতে আনতে পার, কি না।

খুবই অস্পষ্টভাবে হলেও মনে পড়ছে, পৃথিবীর মানুষ জাতটা থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে কবরের অন্ধকার অতলগহ্বরে। তখন যে কী দুর্ভোগ, কী অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করেছিলাম যা তোমাকেও দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করতে হয়েছে, তার জন্য মোটেই মনের দিক থেকে তিলমাত্রও তৈরি ছিলাম না। যে সব দুর্ভোগকে কোনোরকম পূর্বজ্ঞান দিয়ে কল্পনাতেও আনা সম্ভব নয়। অথচ ভবিষ্যতের কথা বলার সামান্যতম জ্ঞানও আমার ছিল না।

ইরোজ সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল–ঠিকই বলেছ তুমি। প্রতিটা মানুষের ব্যক্তিগত দুর্ভোগের কথা আগে থেকে বিন্দু-বিসর্গও জানা সম্ভব হয়নি। তবে একটা কথা কিন্তু খুবই সত্য যে, মানুষের চরম দুর্গতি কিভাবে আসবে তা নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা বহুদিন আগেই যথেষ্ট হিসাব-নিকাশে মেতে ছিলেন, বহু তথ্যই দিয়ে গেছেন।

সত্য। শতকরা একশো ভাগ সত্য কথাই বলেছ।

তবে একটা কথা, চারমিয়ান, তুমি যখন আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে দূরে সরে এলে তখন থেকেই কিন্তু পণ্ডিতরা মতামত ব্যক্ত করতে শুরু করেছিলেন না।

কোন মতামতের কথা বলছ চারমিয়ান?

জ্ঞানীরা বলতে শুরু করেছিলেন, ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে পবিত্র গ্রন্থে যা-কিছু বলা আছে তা দেখছি এখন থেকে ফলতে শুরু হয়ে গেছে? ধ্বংসের আগুনে সৃষ্টি কি ধ্বংস হয়ে যাবে? সবকিছু কি সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়েই যাবে? সে ভয়ঙ্কর আগুনটা লাগবে কিভাবে অর্থাৎ কোন উপায়ে যে পৃথিবীটা ধ্বংস হবে এ প্রসঙ্গে বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-বুদ্ধি আর বিচার-বিশ্লেষণ ক্ষমতার মধ্যেও প্রথমাবস্থা থেকেই ফাঁক থেকে গিয়েছিল।

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের বিশ্বাস ছিল, ধূমকেতুতে আগুনের ভয়-ভীতি নেই। সেগুলোর অর্থাৎ মহাকাশে অবস্থানরত সে সব বিভীষিকার মোটামুটি একটা ঘনত্ব হিসাব নিকাশের মাধ্যমে জানা সম্ভব হয়েছিল।

ধূমকেতুগুলো মহাকাশে বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহদের আশপাশ দিয়ে ধেয়ে যায় খুবই সত্য কিন্তু তারা অবশ্যই গ্রহ বা উপগ্রহগুলোর কারো চেহারায় কোনোই পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়ে যায় না। শুধু কি এ-ই? এমনকি তাদের কক্ষপথেরও পরিবর্তন ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব হয় না।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ধূমকেতুগুলো কি দিয়ে গঠিত, তাই না? তারা অবশ্যই বায়বীয় পদার্থের সম্বন্বয়ে গঠিত। তারা যদি আচমকা পৃথিবীকে ধাক্কা মারে, অর্থাৎ পৃথিবীর ওপর আছড়ে পড়ে তবে পৃথিবীর সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না–এ বিশ্বাসই আমরা করেছিলাম।

তবে ধূমকেতু আর পৃথিবীর মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধতে পারে বা ধূমকেতু পৃথিবীর ওপর কোনোদিন হুমড়ি খেয়ে পড়তে পারে এরকম আশঙ্কা কোনোদিনই আমাদের মনে দানা বাঁধেনি।

কেন আমরা এরকম আশঙ্কার শিকার হইনি? এর কারণও রয়েছে অনেকই। কেন? কারণ, আমাদের তো জানাই ছিল, মহাকাশের ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলে পর্যটকদের শরীরটা কোন্ কোন্ মালমশলা দিয়ে তৈরি। তাদের পেটে যে আগুন তৈরির মাল মশলা থাকা সম্ভব এমন কোনো কথা আমাদের মনে কোনোদিনই জাগেনি। আর জাগবেই বা কি করে? আমরা এমন কোনো ব্যাপার যে নিতান্তই অসম্ভব ও অবাস্তব বলেই আমাদের ধারণা ছিল।

কিন্তু একটা ব্যাপার ভেবে দেখ। মানুষ বিস্মিত হতে, বিস্ময়ের ঘোরে ডুবে থাকতে পছন্দ করে। তারা অসম্ভব কিছুর কল্পনায় মজে থাকতেই সবচেয়ে বেশি আগ্রহি। তখন কী যে তুলকালাম কাণ্ড বেঁধে গিয়েছিল তা আর বলার নয়। ধূমকেতু ধেয়ে আসছে খবরটা চাউর হয়ে যাওয়ামাত্র কিছুসংখ্যক মানুষ ভয়ে রীতিমত জড়সড় হয়ে গিয়েছিল খুবই সত্য। আর অধিকাংশ মানুষ অস্বাভাবিক উত্তেজনার শিকার হয়ে বুকভরা অবিশ্বাস নিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণে মেতে গিয়েছিল।

কাগজ-কলম নিয়ে জোর হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে গিয়েছিল। ফলাফলও তখনই নির্ণয় হয়ে গিয়েছিল। হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো হয়েছিল, ধূমকেতুর আঁচ পৃথিবীর গায়ে কমবেশি লাগবেই লাগবে। দু-তিনজন দ্বিতীয় শ্রেণির জ্যোতির্বিজ্ঞানী মন্তব্য করেছিলেন, ওই ছন্নছাড়া বাউণ্ডুলেটা অভাগা পৃথিবীটাকে গোত্তা মারার জন্যই ধেয়ে আসছে।

কিন্তু সাধারণ মানুষের মনে সংশয়ের অন্ত ছিল না। এর কারণও ছিল যথেষ্টই। কোন জ্যোতির্বিজ্ঞানী সে হিসাব-নিকাশের মাধ্যমে কতটুকু জানতে পেরেছেন–এটাই ছিল তাদের মনের দানা-বাঁধা সংশয়ের কারণ।

আর এ রকম সংশয় আর আতঙ্কের জন্যই সাধারণ মানুষ তেমন সন্ত্রস্ত হতে পারেনি। কেবলমাত্র অনুসন্ধিৎসু নজর মেলে আকাশের দিকে চেয়ে চেয়ে তারা দিন রাতের একটা বড় ভগ্নাংশই কাটিয়ে দিত।

পর পর সাত-আটটা দিন একই রকমভাবে আকাশ-পর্যবেক্ষণ পর্ব দারুণভাবে চলল। কিন্তু আতঙ্কের আঁধার সে ধূমকেতুটা আবছা ঘোলাটে ভাব নিয়ে দেখা দিয়ে আবার নজরের আড়ালে চলে গেছে। তার নিজের অংশটাও আবছা, ছায়া-ছায়া ভাবে দেখা গেছে। মাঝে-মধ্যে খুব সামান্যই রঙ পাল্টেছে।

ব্যাপারটা ওই রকমভাবে ঘটে যাওয়ার পর পণ্ডিতরা নড়ে চড়ে বসলেন। তারা আসল ব্যাপারটা ফাঁস করলেন। এবারই সাধারণ মানুষ জানতে ও বুঝতে পারল প্রকৃত ঘটনাটা কি ঘটতে চলেছে।

প্রকৃত ঘটনাটা সম্বন্ধে কিছু আঁচ পাওয়ার পরও কিন্তু প্রায় সবাই দো-মনা অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে লাগল, অর্থাৎ পণ্ডিতদের বক্তব্য বাস্তবরূপ পেতে পারে, আবার না-ও পেতে পারে।

দ্বিতীয় শ্রেণির পণ্ডিতরা হিসাব-নিকাশের ফলে গৃহীত যে সিদ্ধান্তের কথা ব্যক্ত করেছেন–ধুমকেতু আচমকা সংঘর্ষের ফলে পৃথিবীতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে তছনছ করে দিতে পারে। সাধারণ মানুষ কিন্তু এ-ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর আদৌ তেমন আস্থা রাখতে পারেনি।

দ্বিতীয় শ্রেণির পণ্ডিতদের ভবিষ্যদ্বাণীর ওপর আস্থা রাতে না পারার কারণ ছিল, প্রথম সারি পণ্ডিতরা যুক্তির মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, এমন একটা অসম্ভব ব্যাপার ঘটা সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।

বহুদিন ধরেই ধুমকেতুগুলো গ্রহরাজ বৃহস্পতির আশপাশ দিয়ে আসা-যাওয়া করছে। প্রত্যেক ধূমকেতুর মাথা অর্থাৎ অগ্রভাগ আমাদের জানা সবচেয়ে বিরল গ্যাসের চেয়েও অনেক হালকা। একটা কথা আমার মাথায় কিছুতেই আসছে না

ইরোজকে কথাটা শেষ করতে না দিয়েই চারমিয়ান বলে উঠল–কী কোন্ কথা?

ইরোজ কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ এঁকে বলে উঠল–কথাটা হচ্ছে, এতদিন বৃহস্পতি উপগ্রহদের কোনো ক্ষতিই যখন হয়নি তখন আমাদের এ পৃথিবীর ক্ষতি কীভাবে হতে পারে? আমার তো মনে হয় এরকম আশঙ্কার কোনো কারণই থাকতে পারে না।

জনগণের মন থেকে আতঙ্কের মেঘ কেটে গেল। তারা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।

গির্জার মহামান্য ধর্মগুরুরা বাইবেল খুলে বসলেন। তারা সাধারণ মানুষকে বাইবেলের বাণী শোনাতে লাগলেন। ফায়দা কিন্তু কিছুই হলো না। জনসাধারণের মনে তারা ভীতি সঞ্চার করতে পারলেন না। তারা জোর প্রচার চালালেন–আগুনে পৃথিবী জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবে। ধ্বংসের সাক্ষাদূত আগুনকে বয়ে নিয়ে আসবে।

চমৎকার! চমৎকার কথাই বটে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, একটা কথা তো আবালবৃদ্ধবণিতারই জানা আছে।

চারমিয়ান অত্যন্ত আগ্রহ প্রকাশ করে বলে উঠল–কী? কীসের ইঙ্গিত দিতে চাইছ?

বলছি কি, ধুমকেতুর জঠরে যে আগুনের লেশমাত্রও নেই, এ-কথা তো একটা শিশুরও জানা আছে।

এবার কী বলছি শোন, ধূমকেতুর আবির্ভাব অশুভ লক্ষণ। তার আবির্ভাবে পৃথিবীর বুকে যে মড়ক লাগে তাতে কিছুমাত্রও সন্দেহের অবকাশ নেই। কেবলমাত্র মড়ক বা ঠিক হবে না, ঘোরতর যুদ্ধও বাঁধে পৃথিবীর বুকে। যা বলে বলুক গে না। যত্তসব কুসংস্কার। ওসব কুসংস্কারে কে-ই বা কান দিচ্ছে।

তবে কথা হচ্ছে, এমন অতিকায় একটা আকাশ-দৈত্য পৃথিবীর মাথার ওপর দিয়ে বহাল তবিয়তে পুচ্ছ নাচাতে নাচাতে দিব্যি চলে গেলে পৃথিবীর গায়ে কিছুটা অন্তত আঁচ তো লাগতেই পারে। আর এটাই তো স্বাভাবিক। পৃথিবীর বুকে যে পরিবর্তনটুকু দেখা যাবে তা হচ্ছে, যৎকিঞ্চিৎ ভৌগোলিক পরিবর্তন তো ঘটাই স্বাভাবিক, আবহাওয়ার পরিবর্তন কিছু না কিছু হতেই পারে আর একই কারণে গাছগাছালির লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়াটাও কিছুমাত্র অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু এতকিছু সত্ত্বেও একটা কথা জোর দিয়েই বলা চলে, পৃথিবীর বুকে যা-ই ঘটুক না কেন, বড় রকমের কোনো পরিবর্তনের সম্ভাবনা কিন্তু নেই। একটু-আধটু পরিবর্তনের সম্ভাবনার কথা তো বলামই।

এরকম বহু যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়েই ধূমকেতুর চেহারার পরিবর্তন ঘটে গেল। সবাই তার চেহারা সম্বন্ধে যা-কিছু ভেবেছিল, জল্পনা-কল্পনা করেছিল, বাস্তবে দেখা গেল সবই ভুল। সবাই নিজনিজ জ্ঞান-বুদ্ধি অনুযায়ী তার দৈহিক গড়নের যে বিবরণ এতদিন দিয়েছে, কার্যত দেখা গেল, তার চেহারার সঙ্গে সে সবের কিছুই মিলছে না। ধূমকেতুটা ক্রমেই এগিয়ে আসতে লাগল। সেটা যতই পীথবীর কাছাকাছি আসতে লাগল ঝাপসা ভাবটা কেটে গিয়ে ততই স্পষ্টতর হয়ে উঠতে লাগল। তার চেহারাটা সবার চোখের সামনে আরও বড় হয়ে উঠল। তার অতিকায় দেহটা চকচকে ঝকঝকে হয়ে উঠতে লাগল। ব্যাপারটা চাক্ষুষ করেই পৃথিবীর যত মানুষ, সবাই যেন কেমন মিইয়ে গেল। এমনটা হওয়া তো বিচিত্র কিছু নয়। এতদিনের ভাবনা চিন্তা জল্পনা কল্পনা যদি হঠাৎ করে এমন নস্যাৎ হয়ে যায় তবে তো স্বাভাবিকভাবেই তাদের মুখ ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে উঠতে বাধ্য।

ইতিপূর্বে পৃথিবীবাসী তো আরও বার কয়েক ধূমকেতুর আবির্ভাব চাক্ষুষ করেছে। কিন্তু আজকের ধুমকেতুটার সঙ্গে সেগুলোর সাদৃশ্য তো খুঁজে পাওয়া যাবে না, সম্ভবও নয়। কারণ, এর আগে তো কোনো ধূমকেতু এমন বিশাল দেহ নিয়ে আমাদের চোখের সামনে আত্মপ্রকাশ করেনি।

এতদিন পৃথিবীর বড় বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যত্তসব আজেবাজে মন্তব্য করে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করে দিয়েছে। যারা এরকম মন্তব্য করেছিলেন, তারা বর্তমানে ধূমকেতুটাকে চাক্ষুষ করে রীতিমত শিউরে উঠলেন।

ধ্বংসের সাক্ষাৎ অবতার বিচিত্র দেহধারী অতিকায় ও ভয়ঙ্কর ধূমকেতুটাকে চোখের সামনে দেখামাত্র তাদের হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া দ্রুততর হয়ে গেল। মস্তিষ্কের কন্দরে কন্দরে ঘোরতর কালো ছায়া দেখা দিল, ছেয়ে ফেলল।

উফ্! কী সর্বনাশা চেহারা রে বাবা! সবার মনই যারপরনাই বিষিয়ে উঠল। বড় রকমের একটা অঘটন যে ঘটতে চলেছে তাতে আর কারো মনে এতটুকু সন্দেহ রইল না। পৃথিবী তোলপাড় না হয়ে যাচ্ছে না। কারণ, অতি দ্রুত আগুনের অতিকায় গোলার রূপ নিয়েছে মহাকাশের বিভীষিকা। তার সুবিশাল দেহটা দিগন্ত জুড়ে লেলিহান অগ্নিশিখা ছড়িয়ে দিয়ে অনবরত দাপিয়ে চলেছে। কী ভয়ঙ্কর দৃশ্য!

এ জীবনটা রক্ষা পাবে নাকি, শেষ হয়ে যাবে, এরকম দোটানা মনোভাবটা একদিন কেটে যাওয়ায় মানসিক স্বস্তি ফিরে পেলাম।

একদিন নিঃসন্দেহ হলাম, আমরা ধূমকেতুর আওতায় এসে গেছি। মানসিক অস্থিরতা কেটে গিয়ে স্থিরতা ফিরে এলো। দেহ-মনে বল ফিরে পেলাম। মন থেকে জমাটবাধা আতঙ্ক কেটে যাওয়ায়, স্বস্তি ফিরে পাওয়ায় এবার সহজভাবেই লক্ষ্য করলাম গাছগাছালির মধ্যেও পরিবর্তন আসছে। গাছে গাছে সবুজপাতার এমন বিচিত্র সমারোহ এর আগে তো কোনোদিন নজরে পড়েনি। আর রঙ-বেরঙের ফুল, এতসব কুঁড়ির মেলা তো কোনোদিনই এর আগে দেখতে পারেনি। নিঃসন্দেহ হতে পারলাম, আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটতে আরম্ভ করেছে।

পণ্ডিতদের কথা মনের কোণে বার বার উঁকি দিতে লাগল।

তারা তো ঠিকই বলেছিলেন। এরকমটা যে ঘটবে তার পূর্বাভাস তো তারা আগেই দিয়ে রেখেছিলেন।

তারপর বুঝতে পারলাম, ধূমকেতু কিভাবে পৃথিবীকে গোত্তা মারবে–মাথায় হাঁড়ি চাপিয়ে, সেটা একদিন না একদিন পৃথিবীর সঙ্গে ঠোকাঠুকি লাগিয়ে দেবে।

ব্যস, আর যাবে কোথায়, কথাটা চাউর হতেই পৃথিবীর মানুষ আতঙ্কে পৌণে মরা হয়ে যাবার জোগাড় হলো। আতঙ্কের যন্ত্রণায় তাদের মুখের রক্ত নিমষে নিঃশেষে কোথায় উবে গেল। মুখে আশ্রয় করল পাত্রতার ছাপ।

অব্যক্ত যন্ত্রণা নিরবচ্ছিন্নভাবে জনসাধারণের মধ্যে দুটো কারণে স্থায়ীভাবে আশ্রয় নিল। প্রথমত বুক, বিশেষ করে ফুসফুস ও তার ধারে কাছে খিচুনি শুরু হয়ে গেছে; আর দ্বিতীয়ত অসহনীয় উপায়ে চামড়া শুকিয়ে কুঁকড়ে যেতে শুরু করেছে। আসলে এর পরিণামের কথা কল্পনা করেই মানুষের মনে আতঙ্ক ক্রমেই গভীর থেকে গভীরতর হতে শুরু করেছে।

আমাদের তো ভালোই জানা আছে, যে সব উপাদানের সমন্বয়ে বাতাসের সৃষ্টি তাদের মধ্যে অক্সিজেনের উপস্থিতি শতকরা একশোভাগ আর নাইট্রোজেন ঊনআশি ভাগ। অক্সিজেন ছাড়া প্রাণের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না আর আগুনও জ্বলতে পারে না। অর্থাৎ নাইট্রোজেনের পক্ষে প্রাণকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

আবার যদি অক্সিজেনের পরিমাণ অস্বাভাবিক রকম বেড়ে যায় তবে অতিরিক্ত জীবনীশক্তি মানুষকে উত্তাল-উদ্দাম আর মাতালে পরিণত করে ছাড়বে। তারপর আমরা ঠিক এমনটাই ঘটতে দেখেছি।

আর নাইট্রোজেন যদি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, তবে? দুম করে প্রলয়কাণ্ড ঘটে যাবে, দাউ দাউ করে লেলিহান জিহ্বা বিস্তার করে চোখের পলকে পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে।

আমাদের অন্তিম মুহূর্তটাকে আমাদের চরমতম আতঙ্কের আধার মূর্তিমান ধূমকেতুর টকটকে লাল অগ্রসরমান আকৃতির প্রত্যক্ষ করলাম।

ঠিক একদিন পরই দুর্ভাগ্য চরমতম রূপ নিয়ে হাজির হলো। বায়ুর নির্দিষ্ট উপাদানগুলোর অতি দ্রুত পরিবর্তন ঘটতেই পৃথিবীর সর্বত্র, প্রতিটা আনাচে কানাচে অবস্থিত মানুষগুলোর রীতিমত নাভিশ্বাস শুরু হয়ে গেল। ধমনী ধমনীতে লাল রক্তের স্রোত দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে পড়ল।

মানুষের স্বভাবের আকস্মিক পরিবর্তন ঘটতে শুরু করল। প্রত্যেকে ভয়াবহ প্রলাপে আচ্ছন্ন হয়ে প্রতিটা মুহূর্ত আচ্ছন্ন হয়ে পড়ল।

হাত দুটো কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আড়ষ্ট হয়ে পড়ল। শক্তি যেন একেবারে কর্পূরের মতো উবে গেল। আড়ষ্ট হাত দুটোকে ওপরে, আকাশের লাল গোলকটার দিকে তুলে ধরলাম সত্য। কিন্তু নিষ্কৃতি পেলাম না কিছুতেই।

বেশিক্ষণ নয়, মুহূর্তের জন্য ফ্যাকাশে, খুবই ম্লান বিষণ্ণ আলো চরাচর ছেয়ে ফেলল। আর সে স্লান আলো সবকিছুকে বিদীর্ণ করে দিয়ে গেল।

তারপর–হ্যাঁ তারপর মুহূর্তেই স্বয়ং ঈশ্বরই যেন তারস্বরে চিৎকার করে উঠলেন–সে রকম তীব্র আওয়াজ কেউ এর আগে কোনোদিন শুনতে পায়নি। ব্যস, তার পরমুহূর্তেই ইথারে সে আগুন ফেটে পড়ল, যে ইথারের মধ্যে আমাদের অস্তিত্ব বর্তমান। লেলিহান সে আগুনের শিখা বাস্তবিকই বর্ণনার অতীত। আর সেই শেষ, সব শেষ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *