1 of 2

ডাইরির পাতা থেকে

ডাইরির পাতা থেকে

৬ এপ্রিল!

শনিবার!

সারা রাত ধরে নিরবচ্ছিন্নভাবে নিরলস কর্মযজ্ঞে মেতে থেকে ভোরের আলো ফোঁটার আগেই আমি বেলুনটাকে বাতাস ভরে ফোলাবার কাজে লেগে গেলাম। কুয়াশা খুবই প্রতিবন্ধকতা করল। কুয়াশায় রেশমের কাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গিয়েছিল। তাই বাতাসের চাপে কাপড়ের ভাঁজগুলো খুলতে চাই ছিল না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই বাতাস ভরে বেলুনটাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে ব্যবহারের উপযোগি করে তুলতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল।

কাজ পুরোপুরি মোনোর পর দিলাম বাঁধন কেটে। ব্যস, বাতাসের চাপে সেটা তর তর করে ওপরে উঠে আমাদের নিয়ে ইংলিশ চ্যানেলের দিকে এগিয়ে চলল।

বাতাসের গতি আশাতীতভাবে বেড়ে যাওয়ায় অতিকায় বেলুন আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক, অনেক বেশি দ্রুত গতিতে ওপরে উঠতে আরম্ভ করল। সত্যিকথা বলতে কি, বেলুনটা আমাদের নিয়ে উল্কার বেগে ছুটে চলল।

দ্রুত গতিতে ওপরে উঠতে উঠতে আমরা পাহাড়ের মাথাগুলো ডিঙিয়ে বেশি করে রোদেও দিকে যেতে আরম্ভ করলাম। আমাদের গতিও দ্রুত থেকে দ্রুততর হতে লাগল।

আমরা ব্যারোমিটারের গায়ে দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখলাম। মিনিট দশেকের মধ্যেই ব্যারোমিটার যন্ত্রে পনেরো হাজার ফুট উচ্চতায় পারদ স্থির হলো।

তখন আবহাওয়া ছিল মনোরম। কুয়াশার লেশমাত্রও ছিল না। আর দিনটাও ছিল রৌদ্র কিরণোজ্জ্বল। তাই স্বাভাবিকভাবেই এত ওপর থেকে হলেও পায়ের নিচের স্তর ভূ-ভাগকে মনোলোভা দেখাতে লাগল। চোখ ও মন বড়ই তৃপ্ত হলো।

আমাদের গতি অব্যাহতই রইল। আমরা দক্ষিণ অঞ্চলের পর্বতমালার দিকে উল্কার বেগে ধেয়ে চললাম। মুহূর্তের জন্যও আমাদের গতি মন্থর হয়নি। আমরা চলছি তো চলছি। তবে তখন আমরা এতই উচ্চতা বজায় রেখে চলেছি যার ফলে আমাদের সামান্যতম বিপদের সম্ভাবনাও ছিল না।

ঘড়ির মিনিটের কাটাটা এগোতে এগোতে ছয়টার ঘরে পৌঁছল। বেলা সাড়ে এগারোটা বাজল। ঠিক তখনই আমার অনুসন্ধিৎসু নজরে ইংলিশ চ্যানেল ধরা পড়ে গেল। আকস্মিক পুলকানন্দে মন-প্রাণ নেচে উঠল।

আমাদের গতি অব্যাহতই রইল। আরও পনের মিনিট এগিয়ে যাওয়ার পর উপকূলের গায়ে আছড়ে পড়া ঢেউগুলোকে আমাদের ঠিক পায়ের তলায় দেখতে পেলাম।

বুঝতে পারলাম, আমরা এবার সমুদ্রের ওপরে পৌঁছে গিয়েছি। উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রকে দারুণ আক্রাশে আমাদের পায়ের তলায় অবস্থান করে অনবরত ফোঁস ফোঁস করতে দেখলাম।

এবার আমরা ভেবেচিন্তে মনস্থ করলাম, বেলুনটার গ্যাস কিছু পরিমাণে ছেড়ে দেব। এর ফলে আমাদের ধীরে ধীরে কিছুটা নিচে নামা সম্ভব হবে। কার্যত করলাম তাই। বেলুনটা থেকে কিছু পরিমাণ গ্যাস বের করে দেওয়ার ফলে আমরা ধীরে ধীরে নিচের দিকে নামতে আরম্ভ করলাম।

প্রায় বিশ মিনিট ধরে আমরা ক্রমেই নিচে নেমে যেতে লাগলাম।

মিনিট বিশের মধ্যেই আমাদের বেলুনের সঙ্গে সংযুক্ত প্রথম বয়টা সমুদ্র স্পর্শ করল। আমরা প্রায় আগের গতিতেই এগোতে লাগলাম।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই বেলুনটার দ্বিতীয় বয়াটা সমুদ্র স্পর্শ করল। এবার বেলুনটার গতিবেগ অপেক্ষাকৃত ধীর মন্থর হয়ে এলো। আমরা সমুদ্রের ছন্দবদ্ধ ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলতে লাগলাম। এখন আমাদের গতি মোটামুটি স্থির হয়ে এলো।

এবার বেলুনটার ভ্রু এবং হালের কার্যকারিতা পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন দেখা দিল। কারণ, যে কোনো সময় এদের ব্যবহার করতে হতে পারে। সে দুটোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য উভয়কে একই সঙ্গে সক্রিয় করে দেওয়া হলো।

এখন আমাদের সবার আগে লক্ষ্য বেলুনটাকে ঘুরিয়ে পূর্বদিকে, প্যারিসের দিকে নিয়ে যাওয়া।

সামান্য চেষ্টার মাধ্যমে আমরা বেলুনটাকে আমাদের বাঞ্ছিত দিকে ঘুরিয়ে নিতে পারলাম। কাজ হাসিল হবার পর আমাদের মধ্যে এক অনাস্বাদিত আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল। অনাবিল আনন্দে আমাদের সবার মুখে হাসির ছোপ ফুটে উঠল। বাঞ্ছিত কাজে সাফল্য লাভ করামাত্র আমরা সমবেত কণ্ঠে পর-পর নয় বার জয়ধ্বনি করে উঠলাম।

এবার আমাদের আবিষ্কারের মূলনীতি একটা কাগজে বিস্তারিতভাবে লিখে ফেললাম। তারপর বিবরণ সম্বলিত কাগজটাকে একটা বোতলের মধ্যে ভরে ভালোভাবে ছিপি এঁটে দিলাম। এবার সেটাকে সফেন সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে দিলাম।

ব্যস, আনন্দ-উৎসাহ আর কতক্ষণ? বোতলটাকে সমুদ্রের বুকে ছুঁড়ে দিতে না দিতেই হঠাৎ এমন একটা অভূতপূর্ব, একেবারেই অভাবনীয় একটা ঘটনার মুখোমুখি আমাদের হতে হলো যাতে মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। আমাদের উৎসাহেও কম ভাটা পড়ল না।

বেলুনের স্পিংটাকে প্রপেলারের সঙ্গে সে ইস্পাতের দণ্ডটা যুক্ত করে রেখেছিল সেটা আচমকা খুলে ছিটকে বেরিয়ে গিয়ে অদ্ভুতভাবে ঝুলতে আরম্ভ করল। একেবারেই এমন একটা অভাবনীয় কাণ্ড দেখে আমাদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার যোগাড় হলো।

কিন্তু ক্রমশ চরম একটা বিপদের কপাল চাপড়ে হা পিত্যেশ করার অর্থ চূড়ান্ত সর্বনাশকে ত্বরান্বিত করা, আমার ভালোই জানা আছে। অতএব মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্য তৎপর হলাম। সেটাকে টানাটানি করে আবার জায়গামত বসিয়ে দেবার জন্য আমরা প্রায় সবাই মিলে জোর চেষ্টা চালাতে লাগলাম।

আমরা যখন সে লোহার দণ্ডটার সাহায্যে আবার বেলুনের স্প্রিং আর প্রপেলারের সংযোগ সাধনের কাজে ব্যস্ত ছিলাম ঠিক তখনই পূর্বদিক থেকে প্রবল বেগে বাতাস ধেয়ে এলো। আর তারই প্রচণ্ড ধাক্কায় বেলুনটা উল্কার বেগে আটলান্টিক মহাসাগরের দিকে ছুটতে লাগল।

মুহূর্তের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছি।

আমি সামনের উত্তাল-উদ্দাম সমুদ্রের ওপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই স্বগতোক্তি করলাম–হায় ঈশ্বর! আমরা ঘণ্টায় পঞ্চাশ-ষাট মাইল বেগে ছুটে চলেছি।

কিন্তু যে মুহূর্তে পরিস্থিতি এমনই খারাপ যে, প্রকৃত অবস্থাটা নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করার মতো অবকাশ আমাদের নেই। কারণ তখন আমাদের প্রথম ও প্রধান কাজ ম্প্রিং আর প্রপেলারের মধ্যে সংযোগ সাধন করে সমূহ ধ্বংসের কবল থেকে বেলুনটাকে রক্ষা করা, আমাদের নিজেদের জীবনও বটে।

প্রাণান্ত প্রয়াস চালিয়ে শেষপর্যন্ত এক সময় অবশ্য কর্তব্যটা সম্পাদন করা সম্ভব হলো। স্প্রিং আর প্রপেলারের ব্যবস্থা করার পর আমরা এবার প্রকৃত ঘটনাটা সম্বন্ধে আলোচনা করতে বসলাম। আলোচনার ফাঁকে, ঠিক সে মুহূর্তেই মি. আইন্সওয়ার্থ আচমকা একটা অসাধারণ প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। তার মুখ দিয়ে কথাটা বেরোতেই মি. হল্যান্ড তাকে সমর্থন করলেন। সমর্থনটা তিনি বেশ দৃঢ়স্বরেই করলেন।

মি. আইন্সওয়ার্থের প্রস্তাবটা হচ্ছে–প্যারিসের দিকে আবার ফিরে যাবার উদ্যোগ না নিয়ে এ প্রবল বাতাসটার সুযোগ আমাদের অবশ্যই নেওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রবল বাতাসের বেগ সম্বল করে আমাদের উচিত হবে আমেরিকার উপকূলে পৌঁছে। যাবার ধান্ধা করা।

তার প্রস্তাবটা দুঃসাহসি, সন্দেহ নেই।

আমি কয়েকমুহূর্ত গুম্ হয়ে বসে তার প্রস্তাবটা নিয়ে চিন্তা ভাবনায় লিপ্ত হলাম। শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিলাম, তার মাথা দিয়ে পরিকল্পনাটা মন্দ বেরোয়নি। সাহসে ভর করে ঝুলে পড়লে পরিণতি ভালো ছাড়া মন্দ হবার তো কথা নয়। অতএব পরিকল্পনাটা দুঃসাহসি হলেও বাস্তবে পরিণত করলে আখেরে ফল ভালোই পাওয়া যাবে। শেষপর্যন্ত আমিও তার প্রস্তাবে সম্মতি না জানিয়ে পারলাম না।

কিন্তু হায়! এ কী অবাক কাণ্ড! আমরা সবাই একমত হলেও নাবিক দুজন কিন্তু মুখ ফিরিয়ে বসে থাকল। তারা কিছুতেই আমাদের আকস্মিক পরিকল্পনাটাকে মেনে নিতে রাজি হলো না।

কিন্তু নাবিক দুজন কেন যে আমাদের প্রস্তাবে কিছুতেই সময় দিল না, তার সুস্পষ্ট কারণ কিছুই বুঝতে পারলাম না, তারাও মুখ ফুটে কিছু বলল না ফলে ব্যাপারটা রহস্যের আড়ালেই রয়ে গেল। আমরাও তাদের বেশি ঘাটালাম না।

যা-ই হোক আমাদের দিকে পাল্লা ভারী হওয়ায় নাবিক দুজনের আপত্তি শেষপর্যন্ত গুরুত্ব পেল না–নস্যাৎ হয়ে গেল।

এবার আমরা সোজা পশ্চিমদিকে অগ্রসর হতে লাগলাম। বাতাসের বেগ প্রবল থাকায় বেলুনটা সমুদ্রের বুক চিড়ে তর তর করে এগিয়ে চলল।

একটু পরেই বাতাসের গতিবেগ প্রবল থেকে প্রবলতর হতে শুরু করল। আর বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে বেলুনটাও আমাদের নিয়ে রীতিমত উল্কার বেগে সোজা পশ্চিমদিকে এগিয়ে চলতে লাগল।

এবার নতুন করে ঝড়ো বাতাস বইতে শুরু হলো। বাতাসের সে কী বেগ! আমরা যেন বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো অস্বাভাবিক দ্রুত গতিতে উড়ে চলতে লাগলাম।

আশা করি আর খোলসা করে বলার দরকার নেই। কল্পনাতীত অল্পক্ষণের মধ্যেই আমাদের চোখের সামনে থেকে সমুদ্রতটরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

ইতিমধ্যেই আমরা বিভিন্ন আকৃতির জাহাজকে আমরা পিছনে ফেলে এসেছি। আরও কয়েকটার সঙ্গে জোর পাল্লা দিয়ে চলেছি। তাদের মধ্যে কয়েকটা আমাদের সঙ্গে এমন তীব্র প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হলো মনে হলো যেন আমাদের হারিয়ে দেবার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। কিন্তু একটু পরেই তাদের অধিকাংশই রণেভঙ্গ দিতে বাধ্য হলো।

বাজপাখির তো আমাদের উড়ে যেতে দেখে সব জাহাজের কর্মীদের মধ্যেই দারুণ উত্তেজনা দেখা দিল। ব্যাপারটা আমাদের মধ্যে খুবই আনন্দের সঞ্চার করল।

আমাদের নাবিকরা আনন্দে এমনই মাতোয়ারা হয়ে উঠল যে, তারা ঠোঁট থেকে জেনেভার নামাতেই চায় না। আর তারা সে মুহূর্তে এমনই বেপরোয়া হয়ে উঠল যেন কাণ্ডজ্ঞানই হারিয়ে বসেছে।

ব্যাপারটার শেষপর্যন্ত তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করল। চারদিকের জাহাজগুলো থেকে ঘন ঘন বন্দুকের গুলির আওয়াজ করে আমাদের উৎসাহ দিতে লাগল। আর চিৎকার চ্যাঁচামেচি আর হৈ হুল্লুড়ের মাধ্যমে জাহাজের কর্মীরা আমাদের উৎসাহ দিতে মেতে গেল। আবার কেউ কেউ টুপি খুলে বার বার নাড়িয়ে আমাদের অভিবাদন জানাতেও বাদ দিল না। রুমালও নাড়াল কেউ কেউ।

আমাদের চিন্তা কিন্তু অন্যদিকে। আমরা ইতিমধ্যে কতটা পথ পাড়ি দিয়ে এসেছি তার মোটামুটি একটা হিসাব করে ফেললাম।

হিসাব নিকাশের মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারলাম আমরা পঁচিশ মাইলের কম পথ তো অবশ্যই নয়, বরং কিছু বেশি হওয়াও অস্বাভাবিক নয়।

প্রপেলারটাকে মেরামতের পর সর্বদাই কাজে লাগানো হলো। সেটা সক্রিয় থাকার ফলে আমাদের অগ্রগতিতে ছেদ তো পড়লই না বরং তীব্র গতিতেই আমরা প্রতিনিয়ত এগিয়ে যেতে লাগলাম।

সূর্য পটে বসল। সমুদ্রের বুকে আলো-আঁধারির খেলা শুরু হয়ে গেল।

ইতিমধ্যে ঝড়ের উন্মাদনা অনেকাংশে স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার বাড়তে বাড়তে তা ঘূর্ণিঝড়ের রূপ নিল। ঝড়ের কী যে উন্মাদনা শুরু হয়ে গেল–তা আর বলার নয়। বুক শুকিয়ে ওঠার মতো প্রলয়ঙ্কর ঝড় আমাদের ওপর যেন দারুণ আক্রোশে বার বার ঝাঁপিয়ে পড়তে লাগল।

আর সমুদ্র। রাতভর পূবের হাওয়া বয়ে চলল। সমুদ্রও কম উত্তাল উদ্দাম হয়ে উঠল না। তার ওপর ফসফরাসের দ্যুতি সমুদ্রের সর্বত্র জোনাকি পোকার মতো পর্যায়ক্রমে জ্বলতে আর নিভতে লাগল। স্পষ্টই মনে হলো লক্ষ-কোটি জোনাকি পোকা যেন সমুদ্রের বুকে দাপাদাপি শুরু করে দিয়েছে।

রাতভর পূর্বদিক থেকে বাতাস বয়ে আসায় আমাদের যাত্রার যথেষ্ট সুবিধাই করে দিল। দমকা বাতাস পেয়ে আমাদের বেলুনটার গতি অনেকাংশে বেড়ে যাওয়ায় আমরা দ্রুত এগিয়ে চললাম।

ঠাণ্ডা কনকনে ঠাণ্ডা! ঠাণ্ডায় গায়ে রক্ত হিম হয়ে আসার উপক্রম হলো। আর বরফ-শীতল বাতাস যেন হাড়ে গিয়ে আঘাত হানতে লাগল। তার ওপর আবহাওয়া আর্দ্র থাকায় আমাদের হাল যেন বেহাল হয়ে পড়ল।

ভাগ্য ভালো যে, বেলুনের ভেতরে জায়গার অভাব নেই। ফলে আমাদের কম্বল মুড়ি দিয়ে গুটিসুটি মেরে পড়ে থাকতে কোনো অসুবিধাই পড়তে হলো না। আমরা করলামও তাই। কম্বল আর জোব্বা জড়িয়ে পাশাপাশি গাদাগাদি হয়ে শুয়ে পড়লাম।

পুনশ্চঃ (এ প্রতিবেদনটা মি. আইন্সওয়ার্থ লিখেছেন।) আমার জীবনের সবচেয়ে উত্তেজনাপূর্ণ ও মনে গেঁথে রাখার মতো সময় নয়টা ঘণ্টা। অজ্ঞাত বিপদ আর রোমাঞ্চকর অভিযানের নতুনত্ব আমার চোখে এক কল্পনাতীত মহত্বরূপে দেখা দিল। সত্যি বলছি, এমন একটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার কথা মন থেকে মুছে যাবে না, কিছুতেই না।

পরম পিতার কাছে একটাই প্রার্থনা, আমাদের যাত্রা যেন শুভ হয়, সাফল্যে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এ সাফল্য প্রার্থনার পিছনে কোন অন্তনিহিত কারণ রয়েছে? আমার জীবন রক্ষার জন্যই কি পরমেশ্বরের কাছে এমন সনির্বন্ধ প্রার্থনা করছি? না, অবশ্যই না। আমার মতো অতি নগণ্য একটা জীবন রক্ষার জন্য অবশ্যই না। তবে? আমি প্রার্থনা করছি, মানুষের জ্ঞান-ভাণ্ডার যেন পরিপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে, আর এ জয় যেন বিরাটত্ব লাভ করতে পারে।

আমি অবাক হচ্ছি, অতীতের মানুষের অনাগ্রহ আর অক্ষমতার কথা ভেবে। কই, কাজটা তো এমনকিছু কঠিন ও সমস্যা সৃষ্টিকারী তো নয়, বরং সহজসাধ্যই বটে। অথচ অকারণ ভীতির জন্যই এর প্রতি মানুষের মধ্যে অনিহা জেগেছে। এটা সত্যি আমার কাছে বিস্ময়েরই উদ্রেক করছে।

যে তুফানটা আমাদের সমুদ্রযাত্রার সহায়তা করেছে, অত্যল্প সময়ের মধ্যে আশাতীত পথ পাড়ি দেবার সুযোগ করে দিয়েছে, ঠিক সেরকমই আর একটা দমকা ঝড় উঠল। বেলুনটার গায়ে বাতাসের তীব্র চাপ লেগে ক্রমাগত চার পাঁচদিন আমাদের উল্কার বেগে ছুটিয়ে নিয়ে চলুক। আর সে সময়ের মধ্যেই যাত্রীরা এক উপকূল থেকে অন্য আর এক উপকূলে অনায়াসে পৌঁছে যাক। তবে এও সত্য যে, এরকম ঝড় কেবল চার-পাঁচ দিনই নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশিদিন স্থায়ীত্ব লাভ করে। এরকমই একটা ঝড়ের কল্যাণে যাত্রীরা সুবিস্তীর্ণ আটলান্টিক মহাসাগর হয়ে একটামাত্র হৃদে হাজির হয়ে যায়।

সমুদ্র এখন উত্তাল উদ্দাম। আকাশ-ছোঁয়া এক-একটা ঢেউ তীব্র আক্রোশে যেন অন্যটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ছে। আর সে সঙ্গে সমুদ্র জুড়ে ফেণার ছড়াছড়ি তো রয়েছেই। কিন্তু বড়ই আশ্চর্যের ব্যাপার, সমুদ্র মোটামুটিনিস্তব্ধ। বুক-কাঁপানো তর্জন গর্জন এখানে অনুপস্থিত দেখে আমি একেবারে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়ার যোগাড় হলাম। পানি থেকে কোনো শব্দ উত্থিত হয়ে আকাশের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে না। সুদীর্ঘ অঞ্চল জুড়ে সমুদ্র অবস্থান করায় উত্তাল সমুদ্রের যন্ত্রণা যেন মুচড়ে মুচড়ে উঠলেও যাবতীয় যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করছে। আকাশছোঁয়া ঢেউগুলো দেখে মনে হচ্ছে যেন, অগণিত বিশালদেহি মূক দৈত্য বুঝি অসহ্য ও প্রতিকারহীন যন্ত্রণায় প্রতিনিয়ত ছটফট করছে। তীব্র আক্রোশে বার বার আছড়ে পড়ছে।

উফ্! কী বিচিত্র অভিজ্ঞতা! এরকম একটা ভয়ঙ্কর রাতের অভিজ্ঞতা যে লাভ করেছে সে-ই সত্যিকারে বেঁচে থাকে। আর এ জীবনটা রাতটা তো একটা শতাব্দীব্যাপী জীবনের সমতুল্য।

আজকের এরকম একটা রোমাঞ্চকর রাতের বিনিময়ে অনাস্বাদিত আনন্দের বিনিময়ে আমাকে যদি একশো বছর পরমায়ু দান করতে উৎসাহি হয় তবু আমি সম্মত হব না।

এবার মি. ম্যাসনের পাণ্ডুলিপি থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া যাক। তাতে দেখা গেল, লেখা রয়েছে–রবিবার, সাতই। আজ ভোরের দিকে ঝড়ের তাণ্ডব অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছিল। একটু আগেও যে ঝড় আমাদের বেলুনটাকে উথাল-পাথাল করেছিল এমন তা-ই ক্রমে স্তিমিত হতে হতে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে পড়েছে।

আমরা তখন ক্রামগত উত্তরদিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। আর আমরা হয়তো ঘণ্টায় ত্রিশ মাইল গতিতে উত্তর দিক বরাবরই এগোচ্ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে? আমাদের গতি পশ্চিমদিকে। হানস্ আর প্রধান স্কুর দৌলতেই আমরা অনবরত পশ্চিমদিক বরাবর ছুটে চলেছি। অন্যথায় আমাদের হয়তো বা এমন উত্তর দিকেই ধেয়ে যেতে হতো। আমার বিশ্বাস, আমার দ্ধমূল ধারণা আমাদের এ অভিযান শতকরা একশো ভাগই সফল হয়েছে, আমরা যে চিন্তা করে পা বাড়িয়েছিলাম সেদিক থেকে পূর্ব সিদ্ধান্তের বাইরে কোনো ঘটনাই ঘটেনি। ব্যর্থতা বা হতাশার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সাফল্য এটাই প্রমাণ করেছে যে, আকাশ-পথে সমুদ্র পাড়ি দেওয়া কিছুমাত্রও সমস্যার ব্যাপার নয়।

গতকালের প্রবল বাতাসের বিরুদ্ধে আমাদের কিছুই করার ছিল না,নিজেদের ইচ্ছামত যে কোন দিকে বেলুনটাকে চালিত করতে পারতাম না। তবে হয়তো বা বহু

পরিশ্রম ও বুদ্ধি খরচ করে সে বাতাসের দাপটকে এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল।

আমার দৃঢ় বিশ্বাস সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ একটা প্রপেলারকে ব্যবহারের মাধ্যমে মোটামুটি তেজি বাতাসকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইচ্ছামত দিকে বেলুনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া চলে।

আজ দুপুরে…ভার হ্রাস করে, বেলুনটার ওপন অনেকাংশে লাঘব করে আমরা তর তর করে আকাশের দিকে অনেকখানি ওপরে উঠে যেতে পেরেছিলাম। আমরা তখন ভূমি থেকে পঁচিশ হাজার ফুট ওপরে উঠে গিয়েছিলাম। তখন আমাদের গতি ছিল অবিশ্বাস্য রকমের দ্রুত।

আমি মনে মনে হিসাব করে মোটামুটি সিদ্ধান্তে পৌঁছিলাম, আমার যাত্রা যদি এভাবে আরও তিন সপ্তাহও অনবরত চলে তবুও এ পুকুরের মতো ছোট্ট এ জলাশয়টাকে পাড়ি দেবার জন্য যে পরিমাণ গ্যাস আমাদের দরকার সে তুলনায় প্রচুর গ্যাসই আমাদের ট্যাঙ্কে মজুদ আছে।

এখন বুঝছি, অহেতুক ভুলগুলোকে আমরা খুব বেশি করে গুরুত্ব দিয়ে ফেলেছি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি প্রয়োজনে নিজের ইচ্ছামত স্রোত বেছে নিয়ে যাত্রা অব্যাহত রাখতে পারি। আর যত স্রোত আছে সবগুলোও যদি আমার বিরুদ্ধাচরণ করে তবুও আমি প্রপেলারের সাহায্যে নির্বিপরেই অগ্রগতি অব্যাহত রাখতে পারব।

না, উল্লেখযোগ্য কোনো ঘটনাই ঘটেনি। পুরোপুরি নিরাপদেই আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম।

দিনটা তো নির্বিঘ্নেই কাটল। এখন চিন্তা হচ্ছে রাতটা নিয়ে। রাতটা যে কিভাবে কাটবে সেটাই ভাববার বিষয়। তবু আমার ধারণা, দিনের মতো রাতটাও ভালোভাবেই কাটিয়ে দেওয়া যাবে।

পুনশ্চঃ মি. আইন্সস্যান্ডের ডায়রির পাতায় উল্লেখযোগ্য তেমন কিছু নেই বটে। তবে একটা ঘটনার মুখোমুখি হয়ে আমি যারপরনাই স্তম্ভিত হয়েছি। ব্যাপারটা আমার কাছে অবাক হবার মতোই মনে হয়েছে। অবাক হবার মতো ব্যাপারটা ছিল, তাই না? কটোপাবিসর মতো সমান উচ্চতায় উঠে যাওয়ার পরও আমার মোটেই ঠাণ্ডা লাগেনি, কষ্ট হয়নি, মাথাও ধরেনি–মোদ্দাকথা, কোনোরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়াই আমার মধ্যে প্রকাশ পায়নি। আর কষ্টবোধও করিনি এতটুকুও।

কেবলমাত্র আমার নিজের কথাই বা বলি কেন? মি. হল্যান্ড, মি. ম্যাসন বা স্যার এভারার্ড কেউ এতটুকুও শারীরিক কষ্টবোধ করেন নি।

তবে এটা কিন্তু আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, মি. অসবোর্ণ মাঝে মধ্যে বুকের সংকোচনের কথা বলে ছিলেন। কিন্তু সে আর কতক্ষণ। অচিরেই তা নিরাময় হয়ে গিয়েছিল–স্বাভাবিকতা ফিরে পেয়েছিলেন।

আমরা দিনভর তীব্রগতিতে উড়ে চলেছি। অতএব নিঃসন্দেহ হওয়া যেতে পারে, আটলান্টিক অতিক্রম করার মোট পথের একটা বড় অংশই আমরা পিছনে ফেলে এসেছি।

আটলান্টিকের জলরাশির ওপর দিয়ে উল্কার বেগে ধেয়ে চলার সময় আমাদের বেলুনটা বিভিন্ন রকমের একটা-একটা করে বেশ কয়েকটা বিশ-ত্রিশটা জাহাজকে পিছনে ফেরে দুর্বার গতিতে অগ্রসর হয়েছে। আর আমাদের কাণ্ডকারখানা দেখে অন্যান্য জাহাজের কর্মীও যাত্রীরা বিস্মিত হয়েছে বলেই আমার মনে হয়েছে।

যা-ই হোক, মোদ্দা কথা, বেলুনে চেপে মহাসাগর পাড়ি তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। কথায় বলে যা-কিছু অজানা-অচেনা তাকেই আমরা অনেক বড় কিছু বলে। মনে করে থাকি।

আমরা ভূমি থেকে পঁচিশ হাজার ফুট ওপরে উঠার পর মনে হলো আকাশটা নীল নয় প্রায় কালো। সমুদ্রকে কচ্ছপের পিঠের মতো নয় সম্পূর্ণ অবতল দেখায়। আর? তারাগুলো অনেক, বেশি পরিষ্কার দেখায়। সব মিলিয়ে আমাদের এ পৃথিবীটাকে অত্যাশ্চর্য বোধ হয়।

মি. ম্যাসনের পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত বক্তব্য সোমবার সকাল হতেই প্রপেলারের দণ্ডটা বিগড়ে গেছে। ফলে কিছু সমস্যা পার হতে হলো। দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই চালাবার পর হতাশ সিদ্ধান্ত নিতেই হলো। ওটাকে বাতিল করে নতুন একটা দণ্ড ব্যবহার না করে উপায় নেই। আর ওটাকে একেবারে নতুন করেই গড়তে হবে।

উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দিনভর এক নাগাড়ে দমকা বাতাস বয়ে চলল। বাতাসের বেগ খুবই বেশি। ফলে বাতাস আমাদের অগ্রগতিতে যথেষ্ট সহায়তাই করতে লাগল।

ভোরের আগে, পরিবেশ পুরোপুরি পরিষ্কার হবার পূর্ব মুহূর্তে বেলুন থেকে একটা অভাবনীয় ঠুঠা আওয়াজ হতে থাকায় আমরা খুবই ঘাবড়ে গেলাম। অস্বীকার করব না, অজানা আতঙ্কে বুকের ভেতরে ঝুকপুকানি শুরু হয়ে গেল।

ব্যাপারটা নিয়ে একটু ভাবনা চিন্তা করতেই অবাঞ্ছিত আওয়াজটার কারণ বের করা সম্ভব হলো। আবহাওয়ার তাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে গ্যাসের আয়তন বেড়ে যাওয়ায় হঠাৎ এমন একটা আওয়াজের সৃষ্টি হয়েছে।

অবাঞ্ছিত ও বিরক্তিকর আওয়াজটা বন্ধ করা দরকার। উপায় বের করতেও। আমাদের বেশি মাথা ঘামাতে হলো না।

কয়েকটা খালি বোতল জড়ো করে ফেললাম। এবার সেগুলোকে একটা-একটা করে নিচের একটা জাহাজে ছুঁড়ে ফেলতে লাগলাম। হ্যাঁ, উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে বটে। বোতলগুলো অক্ষত অবস্থাতেই পানিতে পড়েছে।

এবার বেলুন থেকে তলার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বুঝতে পারলাম, সেটা নিউইয়র্ক অঞ্চলের কোনো একটা জাহাজ। দেখলাম, জাহাজের নাবিকরা কায়দা কৌশল করে পানি থেকে বোতলগুলো তুলতে আরম্ভ করল। মিনিট কয়েকের মধ্যেই তারা সব কয়টা বোতল তুলে নিতে পারল।

আমি বারবার এদিক-ওদিক কাৎ হয়ে জাহাজটার নাম দেখার চেষ্টা করলাম। লেখাটা দেখতে পেলাম বটে, কিন্তু নামটা পড়া সম্ভব হলো না। কারণ, হরফগুলো এতই ছোট যে, এত উঁচু থেকে ঠিকঠাক নজরে পড়ল না–যাতে পাঠোদ্ধার করা যেতে পারে। উপায়ান্তর না দেখে মি. অসবোর্ণের থলেটা হাতিয়ে দূরবীণটা বের করে চোখের সামনে ধরলাম। এবার লেখাটাকে আটলান্টা বলেই মনে হলো।

এখন রাত বারোটা। আমাদের পক্ষীরাজ বেলুনটা দুর্বার গতিতে প্রায় পশ্চিম দিকে ধেয়ে চলল। আমার চোখের মণি দুটো প্রায় অন্ধকার সমুদ্রের বুকে অনবরত চক্কর মারতে লাগল। অন্ধকার সমুদ্রের বুকে অনবরত ফসফরাসের ঝকমকি চলতে লাগল। সে যে কী মনোরম চোখে চমকলাগানো দৃশ্য তা চাক্ষুষ না করলে, কারো মুখ। থেকে শুনে বা লিখিত বিবরণীয় পড়ে সম্যক ধারণা করা সম্ভব নয়–কিছুতেই নয়।

পুনশ্চঃ এবার মি. আইন্সওয়ার্থের লিখিত বিবরণী উল্লেখ করছি–এখন রাত দুটো।

বেলুনের পরিস্থিতি এবং বেলুনের বাইরে অবস্থা দেখে বুঝতে পারলাম–চারদিক মোটামুটি শান্তই। কিন্তু এবারটা সম্বন্ধে নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, আমরা সম্পূর্ণ বাতাসের অনুকূলে অগ্রসর হচ্ছি।

একটা কথা খুবই সত্য যে, হুইল ডের ছাড়বার পর থেকে আমি নির্ঘুম অবস্থাতেই কাটিয়ে দিয়েছি। এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমাইনি। ঘুমানো তো দূরের কথা, দুচোখের পাতা এক করাই আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। অতন্দ্র প্রহরীর মতো চারদিক সতর্ক দৃষ্টি রেখে চলতে লাগলাম।

কিন্তু আর নয়, চোখের পাতা খোলা রাখাই সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ঘুমে চোখ বুজে আসতে লাগল। কিছুক্ষণ অন্তত ঘুমিয়ে নিতে না পারলে আর চলতে পারব না।

অনুমানে বোঝালাম, আমেরিকার উপকূলে পৌঁছতে আর বেশি দেরি নেই। সবচেয়ে বড় কথা, আমরা যেমন উল্কার বেগে ধেয়ে চলেছি তাতে এরকম ধারণাই আমার মধ্যে বদ্ধমূল হলো।

মি. আইন্সওয়ার্থের পাণ্ডুলিপির পাতা থেকে গৃহীত–মঙ্গরবার নয়, তখন রাত একটা। বেলুন থেকে দক্ষিণ আমেরিকার তটরেখা স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে উঠল। মনটা আনন্দে নেচে উঠল।

বড় একটা সমস্যা আমাদের সামনে থেকে সরে গেল।

আমি আপন মনে বলে উঠলাম–ঈশ্বরের অপার করুণা না থাকলে এমন একটা অভাবনীয় সাফল্য কিছুতেই সম্ভব নয়। আমরা আতলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে ফেলেছি। অনায়াসে আর একেবারে নির্বিবাদেই আটলান্টিক পাড়ি দেওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে। ঈশ্বর সহায়! ঈশ্বরের জয় হোক!এরপর কে বলতে পারবে, পৃথিবীতে কোন কাজ অসম্ভব? আমরা যে অসম্ভবকে সম্ভব করেছি তা দেখে কেউ-ই এ-কথা বলতে উৎসাহি হবে না।

ডায়েরির বক্তব্য এখানেই শেষ করা হলো। তবে ডাইরির বক্তব্য ছাড়াও মি. আইন্সওয়ার্থ কিছু কথা মি. ফরসাইথকে বলে দিলেন।

বেলুনের অভিযাত্রীরা প্রথম সমুদ্রের তটরেখা দেখতে পেয়েছিলেন। তখন চারদিকে মৃত্যুর–কবরখানার স্তব্ধতা বিরাজ করছিল।

অনুসন্ধিৎসু চোখে দীর্ঘসময় ধরে তাকিয়ে থাকার পর দুজন নাবিক আর মি. অসওয়ার্থ প্রথম তটরেখাটা দেখতে পেয়েছিলেন।

মি. অসওয়ার্থের ফোর্থ মুলট্রিতে কিছু পরিচিত লোকজন ছিল। তাই তারা সবাই আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধঅন্ত নিয়েছিলেন। সে জায়গাটার কাছাকাছি কোনো একটা জায়গায় তারা নামার চেষ্টা করবেন।

শেষপর্যন্ত তারা করলেনও তাই। ফোর্ট মুলট্রির অদূরবর্তী এক জায়গায় বেলুনটাকে সমুদ্রের তীরের কাছাকাছি নিয়ে চলে এলেন। এতে তাদের কোনো সমস্যার মুখোমুখিও হতে হলো না। কারণ, তখন ভাটা চলছিল। আর ভাটাও শেষ হয়ে এসেছিল। ফলে বালি ছিল শক্ত আর মসৃণ। বেলুন অবতরণের পক্ষে অনুকূল ছিল সমুদ্রসৈকতটা।

বেলুনটাকে উপকূলের কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে সজোরে নোঙরটাকে ছুঁড়ে মারতেই সেটা উড়ে গিয়ে শক্ত বালির স্তূপে গেঁথে গেল। ব্যস, নিশ্চিন্ত।

সমুদ্র উপকূলে বেলুন অবতরণের খবরটা বাতাসের কাঁধে ভর দিয়ে দ্বীপের সর্বত্র একেবারে আনাচে কানাচে পর্যন্ত পৌঁছে গেল। খবরটা চাউর হতে না হতেই অসভ্য দ্বীপবাসী আর দূর্গের অবস্থানরত লোকজন ছুটাছুটি করে সমুদ্রসৈকতে ছুটে এলো। কৌতূহলবশত সবাই বেলুনটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে পড়ল।

তারা বেলুনটাকে ঘিড়ে দাঁড়িয়ে অতুগ্র আগ্রহের সঙ্গে বেলুনটাকে দেখতে লাগল। তারা যত দেখছে ততই যেন বেলুনটার প্রতি কৌতূহল চড়চড় করে বেড়ে যেতে লাগল।

কিন্তু একটা সমস্যা দেখা দিল বেলুনটার কার্যকরী ক্ষমতার কথা দ্বীপবাসীদের বোঝাতে গিয়ে। ব্যাপারটা হচ্ছে, আটলান্টিক মহাসাগরে বেলুনটায় চেপে পাড়ি দেবার মতো এত বড় অভিযানের কথা, বাস্তব অভিজ্ঞতার ব্যাপার-স্যাপার তাদের বোঝাতে গিয়ে অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হলো, আর মাথার ঘাম পায়ে নামার যোগাড় হলো।

আমাদের বেলুনের নোঙরটা সমুদ্রসৈকতের শক্ত বালি স্পর্শ করেছিল ঠিক দুইটায়।

হিসাব করে দেখা গেল নোঙর তুলে বেলুনটা যাত্রা করার উপায় করে দেওয়ার পর থেকে যাত্রা শেষ করতে সময় লেগেছিল মোট পঁচাত্তর ঘণ্টা বা তার কিছু কম।

পথে খুঁটিনাটি সমস্যা কিছু দেখা দিলেও তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো দুর্ঘটনারই মুখোমুখি আমাদের হতে হয়নি। এমনকি পথ পাড়ি দেবার সময় আমাদের মনে সামান্যতম বিপদের আশঙ্কাও দেখা দেয়নি।

মোদ্দাকথা, বেলুনটা নির্বিঘ্নেই সমুদ্র সৈকতে অবতরণ করেছিল। ভাটার সময় থাকায় সৈকতভূমি এমন শক্ত ছিল, যাতে নোঙর ফেলতেও কিছুমাত্র সমস্যা হয়নি। আমাদের অভিযানের বিবরণটাকে যে পাণ্ডুলিপি থেকে সংগৃহীত হয়েছে সেটাকে যখন চার্লস্টন থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হলো দলটা তখন ফোর্ট মুলট্রিতেই অবস্থান করছিল।

ফোর্ট মুলট্রিতে অবস্থানকালে বেলুনচারীদের মনে আর কোনো বাসনা ছিল কি না, থাকলে তা যে কি কিছুই জানা সম্ভব হয়নি।

তবে পাঠক-পাঠিকাদের হতাশ হবার মতো কোনো কারণই দেখছি না। একটা কথা বেশ জোর দিয়েই বলতে পারি যে, আগামী সোমবার বা বড়জোর তার পরের দিন আরও কিছু খবর তাদের দরবারে শে করতে পারব।

একটা কথা কিন্তু অস্বীকার করার উপায় নেই, আজঅবধি যেখানে, যত অভিযান সম্পূর্ণ করা সম্ভব হয়েছে। তাদের মধ্যে বর্তমান অভিযানটা যে সবচেয়ে দীর্ঘ, সবচেয়ে আকর্ষণীয় আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সে-বিষয়ে তিলমাত্র সন্দেহের অবকাশও নেই। তাই আরও কিছু বিচিত্র ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকতে পারে এরকম আশঙ্কা করা নিতান্তই যুক্তিহীন। অতএব ধৈর্য ধরে ভবিষ্যতের পথ চেয়ে বসে থাকা ছাড়া কোনো উপায়ই তো দেখছি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *